Wednesday 30 January 2019

পাতঞ্জল যোগসূত্র- সমাধিপাদ (1)

পাতঞ্জল যোগসূত্র


মহর্ষি পতঞ্জলির জীবন সম্পর্কে প্রামাণ্য কোনো পরিচয় বিশেষ জানা যায় না। কারুর মতে. পতঞ্জলি মুনি ছিলেন গোনর্দপুর বাসী প্রাচীন-যোগের পুত্র। মাতার নাম গণিকাদেবী। 

আবার কারুর মতে গোনর্দ দেশে কোনো এক মহান ঋষির সান্ধ্য-উপাসনাকালে ঋষির অঞ্জলি হতে নির্গত হন পতঞ্জলি ।  অর্থাৎ ঋষির অঞ্জলি হতে নির্গত (পতন ) হয়েছিলেন, তাই তার নাম পতঞ্জলি।

একটি প্রচলিত কাহিনী আছে যে পতঞ্জলি ছিলেন অত্রিমুনি  ও অনুসূয়ার পুত্র। 

আবার কোনো কোনো পন্ডিতের মতে, পতঞ্জলি হচ্ছেন ভগবান বিষ্ণুর শয্যা অনন্তনাগের অবতার। কি ভাবে তিনি পৃথিবীতে এলেন তার সম্পর্কে একটা কাহিনী আছে। ভগবান বিষ্ণু যোগনিদ্রায় শায়িত ছিলেন। এবং মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্য দেখছিলেন। অনন্তনাগ বিষ্ণুর ভার আর সইতে পারছিলেন না। ভগবান বিষ্ণুকে জিজ্ঞেস করলেন, ভগবান আপনার ভার আমার কাছে অতিরিক্ত লাগছে কেন ? বিষ্ণু বললেন, আমি এতক্ষন মহাদেবের নৃত্য দেখছিলাম। আর তা দেখে, শিবশক্তি আমার উপরে ভর করেছে। তাই আমার ভার বেড়ে গেছে। অনন্তনাগ এই কথা শুনে, এই অদ্ভুত নৃত্য সম্পর্কে জ্ঞান যাঞা করেন। বিষ্ণু বললেন, ঠিক আছে মহাদেবের  এই কলা সম্পর্কে তোমাকে জ্ঞান দান করবো। কিন্তু তার জন্য তোমাকে মানুষ হিসেবে জন্ম গ্রহণ করতে হবে। ওই সময়ে গণিকা নাম্নী এক যোগবিদুষী, সন্তানের কামনা করছিলেন। তার হাতে একটি সাপ ছিল। ভগবানের  ইচ্ছেয় সেই সাপ হঠাৎ মানুষ্য সন্তানে পরিণত হয়ে যায়। এ সবই রূপক কাহিনী, এর অন্তর্নিহিত অর্থ  আছে, যা আমরা  অর্থ জানিনা। 

যাই হোক, মহামুনি পতঞ্জলি কে ছিলেন, সেই সত্য আমরা না জানলেও তার কার্য্য সম্পর্কে আমাদের কাছে অনেক তথ্য আছে। 

মহর্ষি পতঞ্জলি এক না একাধিক ব্যক্তি ছিলেন, সে নিয়েও পন্ডিতদের মধ্যে মতান্তর আছে। কিন্তু সত্য হচ্ছে : তার নামে যেমন আমরা "যোগসূত্র" বইখানি পাই, তেমনি পাণিনির "অষ্টাধ্যায়ী"  এর মহাভাষ্য তাঁর নামেই পাই।  এ ছাড়া "চড়কপ্রতিসমস্ক্র্তাঃ" অর্থাৎ চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রথম প্রামাণ্য গ্রন্থ তার নামেতেই পাই।  

যাইহোক, আমাদের আলোচ্য "পাতঞ্জল যোগদর্শন" । পতঞ্জলি সম্পর্কে আমরা শুনলাম। কিন্তু যোগ -ই বা কি আর দর্শন-ই বা কী ? সে সম্পর্কে, আমরা শুনবো। 

যোগ কথাটার অর্থ মিলন। এখানে পরম-আত্মার সঙ্গে জীব-আত্মার মিলন। সমস্ত সাধনার উদ্দেশ্য এই মিলনের অনুভূতি লাভ। দর্শন কথাটার মানে ব্যবহারিক জ্ঞান। 
তাহলে যোগদর্শন কথাটার অর্থ হচ্ছে, পরম-আত্মার সঙ্গে জীবাত্মার মিলনের ব্যবহারিক জ্ঞান। 
সাংখ্য দর্শন আত্মতত্ত্বের জ্ঞান। আর  সাংখ্যদর্শনের পরিশিষ্ট হচ্ছে যোগদর্শন, যা এই আত্মতত্ব জ্ঞানের, আমাদের ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ বিধি শেখায় ।

পাতঞ্জল যোগদর্শনে চারটি অধ্যায়। 

১) সমাধিপাদ ; ২) সাধনপাদ ; ৩) বিভূতিপাদ ; এবং ৪) কৈবল্যপাদ ।     

   
সমাধিপাদ 

০১ - অথ যোগ অনুশাসনম। 

এখন যোগ সম্পর্কে অনুশাসন বা বিধি-উপদেশ দেওয়া হচ্ছে।
অথ অর্থাৎ এখন। আসলে এইসব উপদেশ চিরকালীন। তাই অথ। না ভূত না ভবিষ্যৎ সবসময়ই বর্তমান। কারুর কারুর মতে, অথ শব্দের অর্থ অধিকার। অর্থাৎ একমাত্র অধিকারীই এই উপদেশ শ্রবণ যোগ্য।
যোগ অর্থাৎ মিলন, একের সঙ্গে অন্যের মিলন বা যোগ । যিনি এই যোগের প্রক্রিয়ায় বা চেষ্টায় রত তিনিই যোগী।
অনুশাসনম অর্থাৎ সুক্ষ নিয়ন্ত্রণ।  অনু কথাটার মানে সুক্ষ, শাসন অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ।
তাহলে আমরা বুঝতে পারলাম - যোগ্যব্যক্তিকে বর্তমানে (চিরকালীন) মিলনের বা যোগের সুক্ষ নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে উপদেশ প্রদান করা হচ্ছে।

০২ - যোগ চিত্তবৃত্তি নিরোধঃ। 

যোগ হচ্ছে চিত্তবৃত্তির নিরোধ। 
যোগ প্রক্রিয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে চিত্তবৃত্তিকে নিরোধ  করা অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ করা । এখন চিত্ত কী আর তার বৃত্তিই বা কী ? আমরা পঞ্চ ইন্দ্রিয়দ্বারা (চক্ষু, নাসিকা, জিহ্ববা ত্বক) যখনি বহির্জগতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হই, তখন আমাদের গ্রাহক  গ্রন্থির সাহায্যে গ্রন্থিচক্রে স্পন্দন তোলে। এবং গ্রন্থিচক্রের প্রধান কর্মকেন্দ্র মস্তিষ্কে আলোড়ন তোলে।  সেখানে সঞ্চিত স্মৃতি-অভিজ্ঞতা দ্বারা বহির্জগতের ক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করা হয়। এবং তত্ক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে, এবং বাহক গ্রন্থির সাহায্যে কর্মকেন্ত্রগুলিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ পাঠায়। সেইমত ক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়। এই গ্রন্থিচক্রগুলোই চিত্ত।  আর এই চিত্তে যখন আলোড়ন হয় অর্থাৎ বহির্জগতের ক্রিয়া, দৃশ্য, শব্দ, গন্ধ, আস্বাদ, ইত্যাদি যখন গ্রাহক যন্ত্রের সাহায্যে প্রতিফলিত হয়, তখন চিত্ত বা গ্রন্থিচক্রের রসে আন্দোলন তোলে।  এবং আমরা বিচলিত হয়ে উঠি। অর্থাৎ গ্রন্থিরসে আন্দোলন না হলে আমাদের চিত্ত বিক্ষিপ্ত হবে না।  তাই পতঞ্জলি বলছেন চিত্তবৃত্তিকে নিরোধ করতে পারলেই যোগ সম্পাদিত হবে। অর্থাৎ  চিত্তবৃত্তিকে নিরোধ করো।

এখন কথা হচ্ছে চোখ থাকলে আমরা দেখবো, কান থাকলে শুনবো, ত্বকে আমাদের অনুভূতি হবে, নাক থাকলে আমরা গন্ধ পাবো, জিহ্বা আস্বাদন করবে।  এগুলোকে কি ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে ? দেখুন চোখ দেখে না। এই প্রক্রিয়া কি করে সম্পাদিত হয় সেটা আমরা একবার দেখে নেই। মাথার মধ্যে যে উচ্চ, মধ্যে, ও নিম্ন মস্তিস্ক আছে, এগুলো তারই ক্রিয়া। মস্তিস্ক থেকে  এই গ্রন্থি সরিয়ে নিন। চোখকে চোখের  জায়গায় থাকতে দিন। তখন চোখ কি দেখতে পাবে ? পাবে না। মস্তিষ্কের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলেও চোখ ঠিক থাকে।  তাই মানুষের মৃত্যুর পরে মানুষের চোখ অন্যের শরীরে প্ৰতিস্থাপন করে চোখের ক্রিয়া বজায় রাখা যায়। তখন সে আবার দেখতে পায়। আমাদের এই মস্তিষ্কের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের যোগ নিষ্ক্রিয় করতে হবে। বিচ্ছিন্ন নয়, নিষ্ক্রিয় করতে হবে। এটাই যোগ। বহির্জগতের সঙ্গে নিজেকে বিচ্ছিন্ন  করা, যোগাযোগের মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা । আর এটা করা যেতে পারে যোগের মাধ্যমে। অর্থাৎ যিনি সত্যিকারে দ্রষ্টা তাকে আত্মস্থ করা। অর্থাৎ তাকে নিজের মধ্যে ডুবিয়ে দেওয়া। নিজেকে নিজের মধ্যে ডুবিয়ে দেওয়া। এই প্রক্রিয়ার নামই যোগ।

শ্রীমতি রাধারানী একাকিনী গিয়েছেন যমুনায়। কলসিতে জল ভরে আনবেন, নদী থেকে। কবির ভাষায়, "একা  কুম্ভ কাঁখে করি /  যমুনাতে জল ভরি " . আমরাও নিজ নিজ জীবন ঘট্ পূর্ন করবার জন্য মন যমুনার তটে যাই। এই মন-যমুনাতেই বংশীধারীর ছায়া পড়ে। রশিক আমি, প্রেমিক আমি তাকে ধরতে চাই। শ্রীরাধাও অনিন্দ্যসুন্দর সেই মুরলীধরকে  যমুনার জলে দেখে আকুল হয়ে ওঠে। তাকে পেতে চায়।  ধরতে চায়। কিন্তু কানু একবার দেখা দিয়েই আবার জলের মধ্যে লুকায়। শ্রী রাধার মনে হলো, কানু জলেই আছে। শ্রীরাধার ব্যাকুলতা বাড়ে। তাই তখন শ্রীরাধা, "অনেক প্রবন্ধ করি, ধরিবারে যায় হরি, ধীরে ধীরে কর বাঢ়াইনু" । শ্রীরাধার ব্যাকুলতা তীব্র হয়। যতই রাধা জলের মধ্যে হাত বাড়ায়, কানুকে ধরবার জন্য, কানু ততই জলেতেই মিলিয়ে যায়, যেন জলেতে লুকায়। শ্রীমতি    ধীরে  হাত বাড়ায় জলের মধ্যে।  কিন্তু ফল হয় উল্টো। "কর বাড়াইয়া যাই আর না দেখিতে পাই". শেষে "আকুল হইয়া জলেতে ডুবিনু " . শ্রীমতি যত হাত বাড়ায়, জল  তাতো আন্দোলিত হয়। শ্রীমতি যত যমুনার ভিতরে এগিয়ে যায়, মুরলীধর তাতো অদৃশ্য হয়। আকুল-ব্যাকুল শ্রীরাধা তখন যমুনার জলে ডুব দেয়। ভাবে ডুব দিলে নিশ্চয়ই কানুকে পাবে। কিন্তু হায়, ডুব দেবার ফলে জল হলো তোলপাড়, কানু হলো অগোচার। ডুব দেবার ফলে, জলে আন্দোলন উঠলো, তরঙ্গ সংকুল যমুনায়  কানুকে আর পাওয়া গেলো না। কোথায় তাঁর সেই প্রাণেশ্বর ? খেদ করে, শ্রীরাধিকা বলে উঠলো "ঢেউ মোর হলো কাল, না পাইনু নন্দলাল, উঠিলাম যমুনার তীরে। শ্রীমতি বুঝলেন, তরঙ্গ, যা আমি মন যমুনায়  নিজেই তুলেছি, সেই তরঙ্গই ছিন্ন-ভিন্ন করে দিলো আনন্দ-মুরতি। হায় হায়, এ কি করলাম আমি। কাঁদতে কাঁদতে শ্রীরাধিকা ঘরে ফিরলেন , শুন্য   কলসি নয়ন জলে পুরে। কবি বলছেন, "না হেরি বঁধুর মুখ, হইলো বিষম দুঃখ, কাঁদিতে কাঁদিতে এলাম ঘরে " . আমাদের সবার সেই এক দশা। মন যমুনার শান্ত জলে, হঠাৎ করে ক্ষণিক তরে ভেসে ওঠে সেই পরমেশ্বরের ছায়া।  চঞ্চল মন তাকে পেয়েও পায়  না। দেখেও দেখে না। "ক্ষণিক আলোকে আখির পলকে " একবার দেখা দিয়েই তিনি মিলিয়ে যান।

তাই মহর্ষি পতঞ্জলি বলছেন, আগে চিত্ত-তরঙ্গ শান্ত করো। উপাসনা যদি করতে চাও, তবে মনকে আগে শান্ত করো। অথবা উপাসনা দ্বারা মনকে শান্ত করো। একমাত্র তাহলেই তোমার শান্ত চিত্তে তিনি সমাহিত হবেন। তাকে সম্যক  রূপে জানতে পারবে।

এর পরের ধাপ তার মধ্যে লয়  হওয়া, আর সেটা করতে গেলে আরো এগুতে হবে। মনভূমিতে যা দেখছো তাতো তিনি নন। তার ছায়া মাত্র। তিনি তো ওপরে। চিত্তে ছায়া পড়েছে মাত্র। পরমপিতার প্রতিবিম্ব পরে চিত্তে। যার প্রতিবিম্ব আমার চিত্তে, যার ছায়া যমুনার জলে, তিনি তো আসলে কদম্ব ডালে। তাই কবি বলছেন, "মিছে কেন ডুবেছিলে জলে ? বুঝিতে নারিলে মায়া, জলে ছিল অঙ্গ-ছায়া, (তোমার) শ্যাম ছিল কদম্বেরি ডালে।"

আমরা আমাদের মনের দিকে তাকাই না। আমাদের আমাদের হৃদয়ের মধ্যেও তাকে অনুসন্ধান করি না। আমরা আমাদের বুদ্ধি দিয়ে, জ্ঞান দিয়ে, পরম-পিতাকে জানতে চাই , ধরতে চাই, আর তাই তো আমরা বঞ্চিত হই, বিড়ম্বিত হয়, বিলম্বিত হই। তাই মহর্ষি পতঞ্জলি, তার যোগদর্শনে বলছেন, যোগ চিত্তবৃত্তি নিরোধঃ - অর্থাৎ চিত্তবৃত্তিকে নিরোধ করাই যোগ। পরম-পিতার সঙ্গে মিলনের প্রথম সোপান।       
     

০৩ - তদা দ্রষ্টূ স্বরূপে অবস্থানম। 

সেই অবস্থায় দ্রষ্টা  স্ব-রূপে অবস্থান করে।
পতঞ্জলি বলছেন এই যোগে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে, দ্রষ্টা অর্থাৎ সত্যিকারের আমি স্বরূপে অবস্থান করবে। সে তখন ইন্দ্রিয় প্রদত্ত্ব তথ্য দ্বারা আবেশিত হবে না। এখন এই দ্রষ্টাই বা কে ? আর স্বরূপ-ই বা কি ? দ্রষ্টা হচ্ছেন আত্মা, আর স্ব-রূপ হচ্ছে সৎ-চিৎ-আনন্দম।  অর্থাৎ সত্য, চিন্ময়স্বরূপ, আনন্দ স্বরূপ। মহর্ষি পতঞ্জলি এর আগের শ্লোকে বলেছিলেন, চিত্তবৃত্তি নিরোধ করতে হবে। এখন বলছেন, এই অবস্থায় অর্থাৎ নিরোধ কালে, যোগী স্বরূপে অবস্থান করবেন। অর্থাৎ  পরমপুরুষ পরম-ঈশ্বর বা দ্রষ্টা স্বরূপে অবস্থান করবেন। তাহলে বলা যেতে পারে, দ্রষ্টার স্বরূপে অবস্থিতির জন্য, চিত্ত বৃত্তির নিরোধ আবশ্যিক, এবং চিত্তবৃত্তি নিরোধ হলে, পরমপুরুষ চিত্তে সঠিক ভাবে প্রতিফলিত হতে পারে।

আমাদের বাড়িতে একটা ডায়মন্ড শেপের কাঁচের  টুকরো আছে। সেই কাঁচের টুকরোতে বিরাট সূর্য প্রতিফলিত হয়। এবং সূর্য্যরশ্মি ঔ কাঁচে প্রতিফলিত হয়ে আবার ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ঘর আলোকিত হয়।
যোগী যখন নিরোধের অবস্থায় থাকে, তখন তার চিত্তে পরমপুরুষ  প্রতিফলিত হয়। যোগের ভাষায় এই অবস্থাকে বলে, অসম্প্রজ্ঞা। এই অসম্প্রজ্ঞাতে যোগী পূর্বাপূর্ব সংস্কারহীন হয়ে যান । এবং এই অবস্থায় যোগী নৈষ্কর্ম্যক হয়ে যায়। এই অবস্থায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তূ সম্পর্কে তিনি নির্লিপ্ত হয়ে যান। ফলতঃ, কান থাকতেও তিনি শোনেন না। চোখ থাকতেও তিনি দেখেন না। ত্বক থেকেও তিনি স্পর্শবোধ করেন না।জিব্বায় স্বাদবোধ থাকে না।  নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের গতি ধীর হতে হতে .... নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, অচেতন বা শ্বাসরুদ্ধ  অবস্থা বলা যেতে পারে। ভুলক্রমে এঁকে মৃত বলা যেতে পারে। কিন্তু দেহের অগ্নি, বায়ুর খেলা বন্ধ হয় না। এটাকে কেউ কেউ বিক্ষেপ অবস্থা বলে। এখন কথা হচ্ছে পরমপুরুষ সঙ্গে এই বিক্ষেপ অবস্থায় চিত্তবৃত্তির সম্বন্ধটা কি হয় ?

এর পরের  শ্লোকে মহর্ষি পতঞ্জলি বলছেন :           

০৪ -  বৃত্তি সারূপ্যম ইতর অত্র। 

এই সময় বৃত্তি স্বরূপে অবস্থান  করে, অন্য সময় বৃত্তি অন্যত্র অবস্থান করে।
এই যোগে অবস্থিত করতে পারলে, বৃত্তি অর্থাৎ গ্রন্থিরস স্থির, আন্দোলনহীন অবস্থায় অবস্থান করবে এবং এই আন্দোলনহীন অবস্থায় পরম-আত্মা চিত্তে প্রতিফলিত হবে। কিন্তু অন্য্ সময় চিত্ত যখন ইন্দ্রিয় লব্ধ অনুভূতিতে স্পৃষ্ট থাকবে, তখন বৃত্তি প্রতিনিয়ত চঞ্চল ও বাহ্যিক ক্রিয়াশীল থাকবে।

বৃত্তি সারূপ্যম, অর্থাৎ এই সময় বৃত্তি স্ব-রূপে অবস্থান করে। চিত্ত আসলে যেন একটা চুম্বক, পরম-পুরুষের কাছে আসা মাত্র, চিত্ত পরম-পুরুষের নিজস্ব স্ব-রূপ হয়। সেই জন্য, চিত্তবৃত্তি জ্ঞানের সঙ্গে পরম-পুরুষের একাত্মতা অনুভব হয়। এবং এই সম্বন্ধন আদি অনাদি। এই পুরুষ হলো ভোক্তা।  আর চিত্ত হলো ভোগ্য দৃশ্য। এবং বৃত্তি হলো বিষয়। চিত্তই বিষয় আকারে পরিমিত হয়ে আমিত্ত্বযুক্ত জ্ঞানবান পুরুষের সামনে তুলে ধরে। এবং আমিত্ত্বযুক্ত জ্ঞানবান পুরুষ তখন দ্রষ্টা। আর দ্রোষ্টা-ই সাক্ষী-চৈতন্য। আমাদের শরীরে চেতন-পুরুষের অবস্থান হওয়ায় ইন্দ্রিয় ও করণগুলি চেতনের মতো কাজ করে। তাই চিত্তবৃত্তি তার দর্শিত বিষয় চেতনপুরুষকে ভোগ করায়। তাই পরম-পুরুষ নিজে ভোগাতীত হয়েও যেন ভোগাধীন হয়ে যান। নিজেকে বৃত্তির অধীনে রেখে বৃত্তির সঙ্গে অভেদ প্রতিপন্ন হন। অনন্ত কালের এই অজ্ঞানতা আমাদের সংস্কার রূপে দৃঢ় হয়ে গেছে। তাই সংস্কারবসত আমাদের চিত্তের সঙ্গে পরম-পুরুষের একতানতা অনুভব হয়। দ্রষ্টা ও দৃশ্য আমরা এক করে ফেলি। দ্রষ্টা স্বয়ং-প্রকাশ, আর দৃশ্য প্রকাশ সাপেক্ষ। ভোগ্য, ভোক্তা, দ্রষ্টা। ভোগ্য হচ্ছে দৃশ্য। ভোক্তা হচ্ছে আমিত্ত্বযুক্ত পুরুষ, দ্রষ্টা হচ্ছেন পরম-পুরুষ। একটা সুন্দর উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝানো হয়েছে। একটা গাছে দুটো পাখি। গাছের সুমিষ্ট  পার্থিব ফল একটা পাখি খাচ্ছে, তিনি আমিত্বযুক্ত পুরুষ, আর একটা পাখি দেখছে, যিনি দ্রষ্টা অর্থাৎ পরম পুরুষ ।

যুক্ত করে রাখাকেই বলে যোগ। এককে অগ্রাধিকার দিয়ে মনকে স্থির করতে পারলেই যোগ সম্ভব। চিত্ত সদা চঞ্চল। বহু বিষয়ে ধাবিত। চিত্তকে বহুমুখী অবস্থান থেকে সরিয়ে একমুখী করে যোগ। আমাদের চিত্তে পরস্পর বিচ্ছিন্ন চিন্তাধারার স্রোত বইছে। বিরামহীন, নিয়ন্ত্রণহীন এই চিন্তাস্রোত। এবং এসবই বিষয়মুখী। প্রকৃতি  থেকে উৎপন্ন। এ যেন এক বহমান নদী। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের মন থাকবে আর তার চঞ্চলতা থাকবে না সেটা তো হতে পারে না। এইখানেই যোগের কারিকুরি। যোগ আমাদের শেখায়, বহমান চঞ্চল ধারাকে অবিচ্ছিন্ন ধারায় প্রবাহিত করা যায় কি না। নদী বয়ে চলবে। কিন্তু তার ঢেউকে প্রশমিত করবার জন্য, আমাদের বুঝতে হবে ঢেউ কেন হয়। নদীর ভেতরের ভূমিকে যদি সমতল করা যায়, তবে বহমান নদী তার চঞ্চলটাকে স্তিমিত করে দেবে। আর আমরা এই চিত্তনদীতে পরম-পুরুষের স্থির প্রতিফলন অনুভব করতে পারবো। এই জন্য প্রথমে  দুটো ঢেউয়ের মাঝের সময়কে আমাদের ধরতে হবে।  এবং তখনি আমরা ধরতে পারবো ভূমির অচঞ্চল অবস্থা। আর আমাদের চিন্তা যেহেতু বিষয় ভিত্তিক, এবং বিষয় যেহেতু প্রকৃতির অঙ্গ মাত্র তাই প্রকৃতির পরিবর্তনের ক্ষণটিকে ধরতে হবে। অর্থাৎ বৃত্তির বিষয়ান্তরে যাবার ক্ষণটিকে ধরতে হবে। প্রকৃতির যেমন পাঁচটি সন্ধিক্ষণ আছে অর্থাৎ সকাল, সন্ধ্যা, দুপুর গভীর রাত ও ব্রাহ্মমুহূর্ত।  এই সময়গুলোকে কাজে লাগাতে হবে। যোগ দর্শন এক যুক্তিভিত্তিক, পৃকৃতিবন্ধু চিত্ত দিয়েই চিত্তকে উদ্ধারের প্রক্রিয়া। ধীরে ধীরে আমরা সে সব জানবো।       


০৫ -বৃত্তয়ঃ পঞ্চতয্য ক্লিষ্টা অক্লিষ্টাঃ।

বৃত্তি পাঁচ প্রকার - ক্লেশ সহ ও ক্লেশ বিহীন।
মহর্ষি পতঞ্জলি বলছেন বৃত্তি পাঁচ প্রকার, অর্থাৎ বৃত্তির ক্রিয়াফল পাঁচ রকম।  এর মধ্যে কিছু আছে ক্লেশকর আর কিছু আছে ক্লেশবিহীন। সেগুলি কী ? পরের  শ্লোকে বলছেন :

০৬ - প্রমান-বিপর্যয়-বিকল্প-নিদ্রা-স্মৃতয়ঃ। 

প্রমান অর্থাৎ প্রত্যক্ষ জ্ঞান ,বিপর্যয় অর্থাৎ  বিপরীত জ্ঞান বা  ভ্ৰম , বিকল্প অর্থাৎ প্রায় একই রকম,  এর পর আছে নিদ্রা, ও  স্মৃতি ইত্যাদি। 

প্রমান বা প্রতক্ষ্য জ্ঞান তিন রকম।
এক ) ইন্দ্রিয় উপলব্ধি : আমরা ইন্দ্রিয় দিয়ে যা  উপলব্ধি করি। যদিও ইন্দ্রিয় আমাদের মাঝে মধ্যে  বিভ্রম ঘটায়। এই বিভ্রম বাদ  দিলে, যা কিছু আমরা অনুভব করছি বা দেখতে পারছি সেটাই আমাদের কাছে প্রত্যক্ষ জ্ঞান বা প্রমান। আমার চারিপাশে যা কিছু দেখছি, এটাই যথেষ্ট প্রমান যে এইসব দৃশ্যমান বস্তু আছে।

দুই) চিহ্ন : কোনো চিহ্ন দেখে আমরা চিহ্ন-সূচিত কোনো জিনিস আমরা বুঝতে পারি। অর্থাৎ ধোঁয়া দেখে আগুন, বাঘের পদচিন্হ দেখে বাঘের উপস্থিতি অনুমান করা যেতে পারে।

তিন) আপ্তবাক্য : সত্যদ্রষ্টা  যোগীদের অনুভবলবদ্ধ আপ্ত বাক্য। আপ্ত কথাটার মানে হচ্ছে সিদ্ধ। অর্থাৎ সিদ্ধ পুরুষ দ্বারা দেখা বা অনুমান করা যে বিষয়টি অপরকে শোনানো হয়েছে,  সেটাই
আগম- প্রমান। এখন যার কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়, যিনি অশ্রদ্ধেও সেই আগম-জ্ঞান মিথ্যা। মূল বক্তা যদি বিষয়কে প্রতক্ষ্য করে থাকেন, বা অনুমান দ্বারা স্থির সিদ্ধান্তে আসতে  পারেন,  বক্তব্যকে আগম প্রমান বলা হবে। এইবার সিদ্ধ পুরুষ থেকে বাক্য শোনার পর, সে কথা অনুযায়ী পদার্থের জ্ঞান হলে, বা সেই আকারের বৃত্তি জন্মালে তবেই তা আগম।

বিপর্যয় : বিপর্যয় কথাটার মানে বিভ্রান্তিকর।  আমরা কোনো জিনিষ বা বস্তু প্রতক্ষ্য করছি সত্য, কিন্তু অনুভবে সত্য প্রতিফলিত হচ্ছে না। আপাতত মনে হচ্ছে ওটা সাপ। কিন্তু আলো  জ্বালার পরে বুঝতে পারলাম ওটা আসলে দড়ি। এই বিপর্যয় জ্ঞান আমাদের হয় তখনই যখন আমরা বস্তুতে প্রয়জনীয় জ্ঞানের আলো বিকিরণ করতে না পারি।

এই প্রসঙ্গে একটা গল্প শুনেছিলাম : এক মাতাল রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করছিলো। সবাই তার দিকে তাকাতেই সে প্রচণ্ড বেগে, ল্যাম্পপোস্টে উঠে গেল। এক্ষেত্রে পুলিশ যা করে, তাই করলো।  তাকে ল্যাম্প পোস্ট থেকে জোর করে নাবিয়ে, কোর্টে  চালান করে দিলো।  বিচারক জিজ্ঞেস করলো, কি ব্যাপার তোমার ? মহাশয়, আমার কোনো দোষ  নেই, আমাকে বাঘের মতো দেখতে, তিনটে কুমির আমাকে তাড়া করলো যে, তাই ভয়ে, আর নিজেকে বাঁচাতে, আমি ল্যাম্প পোস্টে উঠে গিয়েছিলাম। শহরের রাস্তায়, কুমির বা বাঘ ?  আর বাঘের মতো দেখতে কুমির ? অথচ মাতাল কিন্তু দেখেছিলো, এবং সেই জন্যই লাফিয়ে ল্যাম্প-পোস্টে উঠেছিলো ।  আমরাও বিপর্যয় জ্ঞানে এইরূপ দেখছি।

বিকল্প :  চিত্ত যখন বিক্ষিপ্ত থাকে, আমরা তখন সত্য অনুভব করতে পারি না। এই বিক্ষিপ্ত চিত্তে আমরা যে জ্ঞান সঞ্চয় করি তা অসত্য হতে পারে, অসম্পূর্ন হতে পারে। তাই আমাদের জ্ঞান সংগ্রহের সময় সংযত হতে হবে, ধৈর্য্যশীল হতে হবে। নতুবা সংগৃহিত জ্ঞান অসম্পূর্ন বা অসত্য হতে পারে। এটাই বিকল্প জ্ঞান।

নিদ্রা : নিদ্রা অর্থাৎ ঘুম। আমরা ঘুমের মধ্যে  স্বপ্ন দেখি। এবং স্বপ্নে দেখা সবকিছুই আমাদের মধ্যে সাময়িক সত্য অনুভূতি দেয়। এবং আমাদের মধ্যে আলোড়ন তোলে, আমরা ভয় পাই, আনন্দ পাই। তাই নিদ্রা কালীন আমাদের জ্ঞান সাময়িক ও অসত্য জ্ঞান।  যা আমরা ঘুম থেকে জেগে উঠলে বুঝতে পারি।

স্মৃতি : আমাদের পূর্ব সংগৃহিত অভিজ্ঞতার নাম স্মৃতি। স্মৃতি আমাদেরকে বর্তমানেও বিব্রত করে। সুখ দুঃখের অনুভূতি তোলে। অথচ এই মুহূর্তে যার কোনো অস্তিত্ব নেই।আধ্যাত্মিক জগতে স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলাই কাজ। অর্থাৎ স্বরূপের স্মৃতি জাগ্রত করা। আমি কে সেই স্মৃতি জাগিয়ে তোলাই উদ্দেশ্য।    

০৭ - প্রত্যক্ষ অনুমান আগমঃ প্রমাণানি 

প্রমান হচ্ছে তিন প্রকার - প্রত্যক্ষ, অনুমান, ও আগম অর্থাৎ আপ্তবাক্য।

প্রত্যক্ষ জ্ঞান : আমাদের প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভের উপায় বা মাধ্যম হচ্ছে ইন্দ্রিয়বর্গ । আমরা চোখ দিয়ে দেখি, কান দিয়ে শুনি, নাক দিয়ে ঘ্রান নেই, জিভ দিয়ে আস্বাদ নেই, ত্বক বা চামড়া দিয়ে স্পর্শ করি। এগুলোর সাহায্যেই আমরা অকাট্য প্রমান পাই। এই ইন্দ্রিয় লব্ধ জ্ঞানই আমাদের সাক্ষাৎ জ্ঞান।

অনুমান : প্রতক্ষ্য পূর্ব-অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞানকে আশ্রয় করে মানুষ অনুমানের সাহায্যে নতুন জ্ঞান আহরণ করতে পারে। বাঘের পদ-চিহ্ন দেখে জঙ্গলে বাঘের বাস অনুমান করতে পারি ।

আগম বা আপ্তবাক্য : অর্থাৎ বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির কাছ থেকে, আমরা জ্ঞান সংগ্রহ করতে পারি।       

০৮ - বিপর্যয়ো মিথ্যা জ্ঞানম তদ্রুপ প্রতিষ্ঠম। 

বিপর্যয় হলো মিথ্যা জ্ঞান  অর্থাৎ আপাততঃ মনে হয় সত্য এবং সেইমতো জ্ঞান প্রতিষ্ঠা হয়।

বিপর্যয় বা মিথ্যা জ্ঞান অর্থাৎ আমরা যে প্রতক্ষ্য করছি এটা  সত্য, কিন্তু যা প্রতক্ষ্য করছি সেটাই  সত্য এমন নয়। অথবা এমন অনেক কিছু আছে, যা আমাদের প্রত্যক্ষের বাইরে, কিন্তু সত্য। আসলে আমাদের ইন্দ্রিয়বর্গের একটা নিজস্ব সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা অতিরিক্ত কাছের বস্তু দেখতে পাই না।  আমরা অতিরিক্ত দূরের কিছু দেখতে পাই না। আলো  কম হলে  আমরা দেখতে পাই না।  আলো  বেশি হলে আমরা দেখতে পাই না। এই সীমাবদ্ধতা চোখের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি আমাদের কানের ক্ষেত্রেও  সত্য। খুব উঁচুগ্রাম বা খুব নিচুগ্রামের শব্দ আমরা শুনতে পাই না। আমাদের চোখের দৃষ্টিগ্রাহ্যতার যেমন একটা সীমা  আছে। আমাদের কানেরও তেমনি শ্রূতিগ্রাহ্যতার একটা সীমা আছে। তাই ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে লব্ধ প্রতক্ষ্য জ্ঞান আমাদের সম্পূর্ণ জ্ঞান দান করতে পারে না।      

০৯ - শব্দ-জ্ঞানানুপাতী বস্তূ শূন্য বিকল্পঃ। 

শব্দ জ্ঞানের অনুধাবনকারী বস্তূ বিহীন বিকল্প।

শব্দজ্ঞান  আসলে বস্তু নিরপেক্ষ জ্ঞান।  কোনো শব্দই আমাদের বস্তুর জ্ঞান দিতে পারে না।
"বাঘ" বলতে আমাদের মনে একটা বাঘের ছবি  ভেসে ওঠে মাত্র। বাঘের গর্জন আমাদের কাছাকাছি বাঘ আছে এই জ্ঞান দিতে পারে মাত্র।  তার বেশি কিছু নয়।   

১০ - অভাব প্রত্যয়ালম্বনা বৃত্তিঃ নিদ্রা। 

(জ্ঞানের) অভাবকে আশ্রয় করে যে প্রত্যয় বৃত্তি-তে হয় তাকে নিদ্রা বলে।

নিদ্রা তিনটি স্তরে বিভক্ত।  আচ্ছন্ন, স্বপ্ন, সুষুপ্তি। আচ্ছন্ন অবস্থায় আমরা বিশ্রাম করি মাত্র। স্বপ্নে আমরা ক্রিয়াশীল হয়ে যাই। সুষুপ্তিতে  আমরা সাম্যাবস্থায় থাকি। স্বপ্নে আমাদের কর্ম-ইন্দ্রিয়গুলো ও জ্ঞান ইন্দ্রিয় গুলো জড়বৎ থাকে, কিন্তু মন, বুদ্ধি,চিত্ত অহংকার ইত্যাদি এবং মস্তিষ্কের পরিচালন অংশ অর্থাৎ মধ্যে-মস্তিস্ক সচেষ্ট থাকে।     

১১ - অনুভূত  বিষয় অসম্প্রমোষঃ স্মৃতিঃ। 

শুধুমাত্র অনুভূত হয়েছে, অন্যগুলো নয় , হচ্ছে স্মৃতি।

যা অনুভব হয়েছে, তাই স্মৃতি। আসলে সমগ্র আধ্যাত্মিক জগতে সবথেকে গুরুত্ত্বপূর্ন হচ্ছে স্মৃতি। এই স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলাই সাধনা। আমি কে, তা এই স্মৃতিতে আছে। সমস্ত জ্ঞান ভান্ডার এই স্মৃতি। আমরা নতুন করে কিছু জানি না। স্মৃতিতে যা আছে, তাকে উন্মোচন করাই জ্ঞানের সাধনা, আধ্যাত্মিক সাধনা।    

১২ - অভ্যাস বৈরাগ্যাভ্যাং তন্ নিরোধঃ। 

অভ্যাস ও বৈরাগ্যের সাহায্যে এদের নিরোধ করতে হবে। 

১৩ - তত্র  স্থিতৌ যত্ন  অভ্যাসঃ। 

এই অবস্থায় থেকে অর্থাৎ অভ্যাস ও বৈরাগ্যের সাহায্যে বৃত্তি নিরোধ ক্রিয়া  অবিরাম অভ্যাস করে যেতে হবে। 

১৪ - স তু  দীর্ঘকাল নৈরন্তর্য সৎকার আসেবিতো দৃঢ়ভূমিঃ। 

সেই অভ্যাস কিন্তু দীর্ঘকাল আদরের সঙ্গে পালন  করলে, তা দৃঢ় স্থান করে নেয়। 

১৫ - দৃষ্ট  আনুশ্রবিক বিষয় বিতৃষ্ণস্য বশীকার  সংজ্ঞা বৈরাগ্যম।

দেখা বা শোনা সমস্ত বিষয়ে বিতৃষ্ণাকারীর বাশিকার নামক বৈরাগ্য উৎপন্ন হয়। 

১৬ - তৎ পরং পুরুষখ্যাতেঃ গুনবৈতৃষ্ণ্যম্। 

তারপর পুরুষখ্যাতি সিদ্ধ হলে গুণে  বিতৃষ্ণার উদয় হয়।  

১৭ - বিতর্ক বিচার আনন্দ অস্মিতা রূপানুগমাৎ সম্প্রজ্ঞাতঃ। 

বিতর্ক, বিচার, আনন্দ ও অস্মিতা রূপে অনুগমনের পরে যে অবস্থা বা  সমাধি তাকে সম্প্রজ্ঞাত বলে।

১৮ - বিরাম প্রত্যয় অভ্যাস-পূর্বঃ সংস্কার-শেষঃ অন্যঃ

বিরামের প্রত্যয় অভ্যাস পূর্বক সংস্কারের যে শেষ অবস্থা তাকে অন্য অর্থাৎ সম্প্রজ্ঞাত  থেকে অন্য অর্থাৎ অসম্প্রজ্ঞাত বলে। 

১৯ -  ভব প্রত্যয়ো বিদেহ প্রকৃতিলয়ানাম্

বিদেহ ও প্রকৃতিলয় পুরুষদের ভব-প্রত্যয়  হয়।

২০ - শ্রদ্ধা বীর্য স্মৃতি সমাধি প্রজ্ঞা পূর্বক ইতরেষাম্। 

শ্রদ্ধা, বীর্য, স্মৃতি, প্রজ্ঞা সমাধি  দ্বারাই অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি লাভ হয়, অন্যথা নয়। 

২১ - তীব্র সংবেগানাম আসন্নঃ। 

তীব্র বেগশালীদের  সমাধি আসন্ন। 

২২ - মৃদু মধ্য অধিক মাত্র ত্বাৎ ততো অপি বিশেষঃ। 

বেগের মাত্রার তারতম্যে অর্থাৎ মৃদু, মধ্যে, বা অধিক বেগের জন্য  আসন্ন সমাধির তারতম্য  রয়েছে। 

২৩ - ঈশ্বর প্রণিধানৎ বা 

অথবা ঈশ্বরেতে প্রণিধান থেকেও সমাধি লাভ হয়। 

২৪ - ক্লেশ কর্ম বিপাকশৈঃ অপরামৃষ্টঃ পুরুষ বিশেষ ঈশ্বরঃ

অবিদ্যা জনিত যে ক্লেশ, ক্লেশ জনিত যে কর্মের  উদ্ভব , আবার কর্ম জনিত যে ফল তার সঙ্গে যিনি অপরামৃষ্ট অর্থাৎ সম্মন্ধ বিহীন সেই পুরুষই ঈশ্বর। 

২৫ - তত্র নিরতিশয়ং সর্বজ্ঞ বীজম। 

সেখানে সর্বজ্ঞ বীজ সদা সর্বদা বিরাজমান। 

২৬ - পূর্বেষামপি  গুরুঃ কালেন অনবচ্ছেদাৎ। 

তিনি পূর্ব  পূর্ব গুরুদেরও  গুরু, কারন কাল দিয়ে তাকে ছেদন করা যায় না। 

২৭ - তস্য বাচকঃ প্রণবঃ। 

সেই বাচক অর্থাৎ শব্দই প্রণব বা ওঁ-কার। 

২৮ - তৎ জপ তদ্ অর্থ ভাবনম্। 

তৎ অর্থাৎ প্রণব বা ওঁ জপ করো, এবং তার অন্তর্নিহিত অর্থ ভাবো।  তারই জপ্ তারই অর্থ ভাবনা।

২৯ - তৎ প্রত্যেক চেতন অধিগমঃ অপি অন্তরায় অভাবশ্চ।

তৎ অর্থাৎ এই ভাবে জপ্ করলে প্রত্যেক চেতনে অধিগমন হয় অর্থাৎ সমস্ত চেতনার  জ্ঞান হয়, এবং সমস্ত অন্তরায় দূর হয় বা অন্তরায়ের অভাব হয়। 

৩০ - ব্যাধি স্তান্যং সংশয়ঃ প্রমাদঃ আলস্যাৎ অবিরতি ভ্রান্তি দর্শন অলব্ধ
         ভুমিকত্বং অনবস্থিত ত্বানি চিত্ত বিক্ষেপাঃ তে অন্তরায়াঃ। 

ব্যাধি, চিত্তের অলসতা, সংশয়, প্রমাদ, আলস্য, অবিরাম ভ্রান্তি দর্শন, অলব্ধ  ভূমিকত্ব অর্থাৎ সমাধি লাভ করতে দেয় না। চিত্ত বিক্ষেপের  কারন তাই এগুলি  সমাধির অন্তরায়।  

৩১ - দুঃখম  দৌর্মনস্য অঙ্গমেজয়ত্বং শ্বাস-প্রশ্বাসঃ বিক্ষেপসহ ভুবঃ। 

দুঃখ, দূর্দমনস্য অর্থাৎ ইচ্ছায় বাঁধা সৃষ্টি হলে চিত্তে যে বিক্ষেপ জন্মায়, অঙ্গমেজয়ত্ব মানে শরীরের কম্পন, শ্বাস-প্রশ্বাস অর্থাৎ বায়ু গ্রহণ ও ত্যাগ, বিক্ষেপসহ ভুবঃ অর্থাৎ এই চিত্ত বিক্ষেপের সঙ্গে জন্ম। 
 অদমনীয় এবং অপূরণীয়  ইচ্ছার ফলে যে চিত্ত বিক্ষেপ হয় তাই দুঃখ। 

৩২ - তৎ প্রতিষেধার্থম একতত্ব  অভ্যাসঃ। 

তৎ অর্থাৎ এই দুঃখ উপশমের জন্য এক তত্বের অভ্যাস করা উচিত। 

৩৩ - মৈত্রী করুনা মুদিতা উপেক্ষানাম সুখ দুঃখ পুন্যা-
          পুন্য বিষয়াণাং ভাবনাতঃ চিত্ত প্রসাদনম্।

সুখী, দুঃখী, পুণ্যবান, অপূণ্যবান সবার প্রতি মৈত্রী, করুণা, মুদিতা অর্থাৎ হর্ষ বা উৎফুল্ল, উপেক্ষা - এইরূপ ভাবনা থেকেই চিত্ত  প্রসন্ন হয়। 

৩৪ - প্রচ্ছর্দন-বিধারণাভ্যাং বা প্রাণস্য। 

প্রাণবায়ু ছেড়ে দিয়ে সেই অবস্থাকে ধারণ করা অর্থাৎ কুম্ভক করলে চিত্ত স্থির করা যায়। 

৩৫ - বিষয়বতী বা প্রবৃত্তিঃ উৎপন্না মনসঃ স্থিতি নিবন্ধিনী। 

বিষয়বতী অর্থাৎ কোনো বিষয়ের প্রতি নিবিষ্ট চিত্ত হলে বা মনে উৎপন্ন প্রবৃত্তির প্রতি স্থিত হলে চিত্ত স্থির হতে পারে। 

৩৬ - বিশোকা  বা জ্যোতিষ্মতি। 

শোক রোহিত অথবা  জ্যোতিতে স্থির হলে চিত্ত শান্ত হয়। 

৩৭ - বীতরাগ বিষয়ং বা চিত্তম। 

বিষয়ে যার বীতরাগ অর্থাৎ বিতৃষ্ণা হয়েছে - সেই চিত্ত শান্ত। 

৩৮ - স্বপ্ন নিদ্রা জ্ঞান আলম্বনং বা। 

স্বপ্নজ্ঞান বা নিদ্রাজ্ঞান ভাবনাতেও চিত্ত স্থির হয়। 

৩৯ - যথাভি মত ধ্যানাৎ বা। 

যেমন যেমন নিজের অভিমত সেই বস্তুতে ধ্যান করলে চিত্ত স্থিত হয়। 

৪০ - পরমাণু-পরম-মহত্ত্বন্তঃ অস্য বশীকারঃ

পরমাণু অর্থাৎ সুক্ষ থেকে পরম মহৎ তত্ত্ব অর্থাৎ স্থুল যা কিছুতেই আপনি ধ্যানের মাধ্যমে পৌঁছান তাতেই চিত্ত বশিকার অর্থাৎ পরম বৈরাগ্য লাভ হয়। 

৪১ - ক্ষীণবৃত্তেঃ অভিজাতস্য এব মণেঃ গ্রহীতৃ- গ্রহণ -
         গ্রাহ্যেষু তৎস্থ তদঞ্জনতা সমাপত্তিঃ। 

ক্ষীনবৃত্তে অর্থাৎ বৃত্তি যার ক্ষীণ হয়েছে এমন চিত্ত মনি সম স্বচ্ছ। গ্রহীতা, গ্রহণ, ও গ্রাহ্য অর্থাৎ ধ্যেয় বিষয়ের  মধ্যে তদঞ্জনতা অর্থাৎ তন্ময়তা বা  স্থিতি এসেছে সেটাই সমাপত্তি অর্থাৎ জ্ঞানের সমাধি। 

৪২ - তত্র শব্দার্থজ্ঞান বিকল্পৈঃ সংকীর্ণা সবিতর্কা সমাপত্তিঃ। 

সেখানে শব্দের যে জ্ঞান, শব্দের বিষয়ের যে জ্ঞান, আর উভয়ের মিশ্রিত যে  একত্ত্ব  তাকেই সবিতর্কা বলে।  

৪৩ - স্মৃতি পরিশুদ্ধৌ স্বরূপ শূন্যে এব  অর্থ মাত্র নির্ভাসা নির্বিতর্কা। 

স্মৃতি যখন পরিশুদ্ধ হয়ে যায়, স্ব-রূপ অর্থাৎ অহং  যখন শুন্য হয়  বা বিস্মৃত হয় তখন লক্ষিত বিষয়েই স্থিত হয় - এবং এটাকেই বিতর্করহিত সমাপত্তি বলে। 

৪৪ - এতয়া এব সবিচারা নির্বিচারা চ সূক্ষ্ম বিষয়া ব্যাখ্যাতা। 

অতয়েব এই ভাবে বিচার দ্বারা নির্বিচারে পৌঁছে সূক্ষ্ম বিষয়ের ব্যাখ্যা করা হল। 

৪৫ - সূক্ষ্ম বিষয় ত্বং চ অলিঙ্গ পর্যবসানম। 

সূক্ষ্ম বিষয়কে আবার শেষ পর্যন্ত পর্যবেক্ষন করতে হবে। 

৪৬ - তা এব সবীজঃ সমাধিঃ। 

সেগুলিই সবীজ সমাধি। 

৪৭ - নির্বিচার বৈশারদ্যে অধ্যাত্ম প্রসাদঃ। 

নির্বিচার-বিশেষ অবস্থায় অধ্যাত্ম প্রসাদ লাভ হয়। 

৪৮ - ঋতম্ভরা তত্র প্রজ্ঞা। 

যেখানে সত্য প্রতিষ্ঠিত সেখানেই প্রজ্ঞা। 

৪৯ - শ্র্ুত অনুমান প্রজ্ঞাভ্যম অন্য বিষয়া  বিশেষ অর্থ ত্বাৎ। 

শোনা কথা, অনুমান এই দুটি জ্ঞান থেকে পৃথক, কারন তার বিশেষ অর্থ রয়েছে। 

৫০ -  তজ্জঃ সংস্কারঃ অন্য সংস্কার প্রতিবন্ধী। 

সেই সংস্কার অন্য সংস্কারের প্রতিবন্ধী। 

৫১ - তস্যাপি নিরোধে সর্ব নিরোধাৎ নির্বীজঃ সমাধিঃ। 

তারও নিরোধে, সবকিছুর নিরোধে নির্বীজ সমাধি। 

ইতি শ্রীপাতঞ্জলে সাংখ্য প্রবচনে বৈয়াসিকে সমাধিপাদঃ। 

                   

                     


                       


    
  
    

No comments:

Post a Comment