নমো বৈ ব্রহ্মবিষয়ে বাশিষ্ঠায় নমো নমঃ।
জন্মান্তর (গীতা শ্লোক ২/২৬-২৭)
মহামুনি কৃষ্ণদৈপায়ণ ব্যাস বা ঋষি ব্যাসদেবের অমূল্য কালজয়ী গ্রন্থ মহাভারতের গীতা পর্বে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, (শ্লোক - ২/২৭) "জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যু, ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ। তস্মাৎ অপরিহার্য্যে অর্থে ত্বং শোচিতুং ন অর্হসি।"
আমরা জানি, এই শ্লোকটি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শোকাতুর অর্জুনকে শান্তনা দেবার জন্য বলেছিলেন। বলছেন, যেহেতু জাত ব্যক্তির মৃত্যু নিশ্চিত, আবার মৃতব্যাক্তির জন্ম অবশ্যম্ভাবী, তাই এই অপরিহার্য্য বিষয়ে তোমার শোক করা উচিত নয়। এখন এই কথার ফাঁকে লুকিয়ে আছে, একটা গুহ্য সত্য, যা আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়, বা আমাদের সাধারণ জ্ঞানের বাইরে। অর্থাৎ জন্মালে মরতে হবে, এটি আমরা জন্মাবার পর থেকেই চোখের সামনে দেখছি। এই ধ্রুব সত্যে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই। যে জন্মাচ্ছে সে আমাদের সামনেই একদিন না একদিন মারা যাচ্ছে। কিন্তু যিনি দেহ ত্যাগ করছেন, অর্থাৎ এই মরদেহ ত্যাগ করে চলে যাচ্ছেন, তিনি আবার এই দেহে ফিরে আসেন। "ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ" মৃত ব্যক্তির জন্মও ধ্রুবসত্য। এই ধ্রুবসত্য আমাদের কাছে সন্দেহের সৃষ্টি করে। কারন যে মারা যায়, সে আবার এই পৃথিবীতে দেহ ধারণ করে ফিরে আসে, এই সত্য আমাদের উপলবদ্ধিতে ধরা পরে না। আর এই কথা কেউ তার মৃত্যুর পরে, এসে আমাদেরকে বলেও না যে, আগের জন্মে আমি সম্পর্কে তোমার মামা ছিলাম, অমুক জায়গায় আমরা বাস করতাম, এই আমার নাম ছিলো, এইভাবে অমুক দিন আমি দেহ ত্যাগ করেছিলাম ইত্যাদি ইত্যাদি কোনো কথা কেউ কোনোদিন আমাদেরকে এসে বলে না। আর পিতৃমাতৃ প্রদত্ব পরিবর্তনশীল এই দেহ দেখেও আমরা বুঝতে পারি না, যে আমার মামা আবার ফিরে এসেছে, আমার সংসারে বা অমুকের সংসারে।
আবার ২/২৬ নং শ্লোকে বলছেন : "অথ চৈনং নিত্যজাতং নিত্যং বা মন্যসে মৃতম। তথাপি ত্বং মহাবাহো নৈবং শোচিতুং ন অর্হসি।" অর্থাৎ আর তুমি যদি মনে করো, এই জীবাত্মা নিত্য জন্ম গ্রহণ করেন, আর নিত্য মারা যান, তাহলেও তোমার শোক করা উচিত নয়। এই শ্লোকটি পড়ে আবার মনে হয়, ভগবান যেন উদাহরণ দিচ্ছেন মাত্র, সত্য বলছেন না। কোনো স্থির সিদ্ধান্তের কথা বলছেন না।
দেখুন, মাটিতে বীজ-বোনা হলে, তবে তা ধীরে ধীরে অঙ্কুরে পরিণত হয়। এই অংকুর আবার ধীরে ধীরে গাছে পরিণত হয়।এই বিষয়ে একটু ধ্যান দিলেই, আমরা অনুধাবন করতে পারবো, বীজটি কিন্তু এক মুহূর্তও একই আকার বা একই অবস্থার মধ্যে ছিল না। বীজ তার কঠিন খোলস ত্যাগ করে, কোমল রূপ ধারণ করেছিল, তারপরে সেই কোমল রূপ ত্যাগ করে, অংকুরে পরিণত হয়, এবার অংকুররূপ ত্যাগ করে, একটা পরিণত গাছে রূপান্তরিত হয়। এই গাছ একসময় ফুলে-ফলে ভোরে ওঠে। কালে কালে, এই গাছ বৃদ্ধ হয়। একসময় শুকিয়ে মারা যায়। শুধু গাছ নয়, আমরা সবাই একসময় মাতৃ গর্ভে ভ্রূণ আঁকড়ে ছিলাম, ধীরে ধীরে মাতৃগর্ভে মাংসপিন্ডে পরিণত হই. এরপরে মা-বাবার রূপের আকার পাই। কিন্তু তখনও এই মাংস পিন্ডে প্রাণের সঞ্চার হয়নি। একসময় দেহের মধ্যে মায়ের প্রাণের গমনাগমন শুরু হয়, একসময় মাতৃগর্ভের থেকে বেরিয়ে নিজস্ব প্রাণের স্পন্দন শুরু হয়। অর্থাৎ যেটা আমরা বলতে চাইছি, প্রতিটি জিনিস প্রতিমুহূর্তে পরিবর্তনের নিয়মের মধ্য দিয়ে রূপান্তরিত হয়ে চলেছে। আর এই প্রতিটি রুপই তার নবজন্ম। আমরা যদি আমাদের মাতৃগর্ভের আগের অবস্থার কথা চিন্তা করি, তাহলে বুঝতে পারবো, আমরা অন্নের ভিতরে সুপ্ত আকারে ছিলাম। যার গ্রহণকালে বা সেবনকালে আমরা পিতৃদেহে স্থানান্তরিত হয়েছি। তারও আগে নিশ্চই আমরা জলের মধ্যে, বাতাসের মধ্যে, অগ্নির মধ্যে, আকাশের মধ্যে অবস্থান করছিলাম। অর্থাৎ যার দ্বারা এই অন্নের উৎপত্তি হয়েছে।
আবার আমরা যদি অন্য দিকে থেকে ভাবি, অসংখ্য কোষের সমষ্টি হচ্ছে, আমাদের এই দেহরূপ আমি। এই দেহের মধ্যে প্রতিনিয়ত অসংখ্য কোষের জন্ম হচ্ছে, আবার বহু কোষের মৃত্যু হচ্ছে, এই জন্ম-মৃত্যুর হারের উপরেই আমাদের দেহ বর্ধিত হচ্ছে, বা হ্রাস পাচ্ছে। অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যে যদি এটা তুমি বিশ্বাস বা উপলব্ধি করো যে, তোমার নিত্য জন্ম হচ্ছে, তুমি নিত্য বিনষ্ট হোচ্ছ, তাহলেও তোমার শরীরের জন্য, শোক করা উচিত নয়। কেননা, এটি (দেহ) তো প্রতিনিয়ত মরণশীল। তো এখান থেকে একটা কথা আমার মনে হয়, আমরা এগুচ্ছি সামনের দিকে ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে সত্য কি। জন্মালে মৃত্যু হবে, নিশ্চিত। কিন্তু মৃত্যুর পরে, আবার জন্মাবে, সেটি তাহলে সত্য নাও হতে পারে ? এই জায়গাটা আমাদের ভালোকরে বুঝতে হবে। যদি আমরা সত্যে উপস্থিত হতে চাই। দেখুন, এই জায়গাটা আমাদের জ্ঞানের বাইরে। এখানে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে গেলে, আমাদের আপ্তবাক্যের উপরে অর্থাৎ ঋষি বাক্যের উপরে নির্ভর করতে হবে। বিচার দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে এইখানে পৌঁছানো যাবে না। এই প্রসঙ্গে জন্মান্তরবাদীদের সপেক্ষে একটা গল্প দিয়ে আমরা বুঝবার চেষ্টা করবো।
গল্পটা পড়েছিলাম, বাবা রামশরন দাস-এর লেখা "পরলোক ও পুনর্জন্মের সত্য ঘটনা" বইতে।
বলছেন, সুভাষচন্দ্র নামে একটা ছেলে, পিতা ব্রজবিহারীলাল, জাতিতে আগরওয়াল বৈশ্য, মিরাটের বাসিন্দা। ছেলেটি হঠাৎ একদিন বড় ভাইয়ের সঙ্গে ক্যারমবোর্ড খেলতে খেলতে রেগে গিয়ে, ক্যারামবোর্ড ফেলে দিয়ে বলে উঠলো :
"এই নে তোর ক্যারামবোর্ড, আমাকে খুব গরিব মনে করেছিস, তাই না ? আমি লক্ষ্নৌ-এর বিরাট ধনী লোক ছিলাম। সেখানে আমাদের বাড়িতে নব্বুই হাজার টাকা মাটিতে পোতা আছে। একটা নয়, ওই টাকায় আমি হাজারটা বোর্ড কিনতে পারি।
এরপরে তাকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে, সে বলেছিলো, পূর্বজন্মে আমার নাম ছিল, জানমঽম্মদ খাঁ। আমার শ্বশুরের নাম ছিল, দিলদার খাঁ। স্ত্রীর নাম ছিল, সোফিয়া খাতুন। আমার দুই মেয়ে। আমার একটা গাড়ি ছিল, নম্বর ছিলো USJ - ৩৮৯। গত জন্মে আমি ছাদে দাঁড়িয়েছিলাম, হঠাৎ একটা বাঁদর এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। বাঁদরের ভয়ে পালতে গিয়ে আমি ছাদ থেকে পড়ে মারা যাই। ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কথা নাকি সে বলেছি। এবং ছোটো বেলা থেকেই সে নাকি নামাজ পড়বার জন্য, কাপড় বিছিয়ে বসে পড়তো। তার মধ্যে অনেক মুসলমানি সংস্কার চোখে পড়েছে। স্বামী রামশরন দাস, ঘটনাটা বলবার পরে লিখছেন, এই ঘটনা আমি নিজে লক্ষ্নৌ গিয়ে আর সমস্ত বিষয় অনুসন্ধান করে, তুলে ধরলাম।
এই ঘটনার দ্বারা তিনি বলতে চাইছেন, হিন্দু শাস্ত্রের পুনর্জন্ম সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত তা সত্য ?
এখন কথা হচ্ছে, মহাত্মাদের এইসব কথা অস্বীকার করবার সাধ্য আমার নেই। কিন্তু আমি এই ধরনের কোনো ঘটনার সাক্ষী নোই। শাস্ত্রে পড়েছি, আমাদের স্মৃতি ধরা থাকে আমাদের কারন দেহে । কোন কোনো সময়, কোনো আঘাতে বা আকস্মিক ভাবে, এই স্মৃতি জেগে উঠতে পারে। এছাড়া কারুর কারুর ক্ষেত্রে ছোটবেলায়, এই স্মৃতি থাকে যা ধীরে ধীরে লোপ পেয়ে যায়। বড়োজোর ৭ বছর পর্যন্ত এই স্মৃতি থাকতে পারে।
কিন্তু আমার প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। দুধ থেকে ঘি হয়, দই হয়, ঘোল হয়, এমনকি রসোগোল্লা তৈরী হতে পারে। কিন্তু ঘি থেকে, দই-ঘোল থেকে কি কখনো দুধ হতে পারে ? শিশু থেকে আমরা কোনো চেষ্টা না করেই আমরা বৃদ্ধ হতে পারি। কিন্তু বৃদ্ধ থেকে সাত চেষ্টা করেও কি আমরা শিশু হতে পারি ? আসলে জীবাত্মা বলে কিছু নেই, জীবাত্মা হচ্ছে আত্মার প্রতিবিম্ব মাত্র । তো আত্মাই সত্য এবং একমাত্র। আর যা কিছু দেখছেন, সে সবই ক্ষণিক ও অস্থায়ী, তাই একে বলা হচ্ছে মায়া বা অসৎ।
ঋষি চার্বাক বলছেন, ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুত এই চারটি ভূত তত্ত্বরূপে বা মূল বস্তু রূপে স্বীকৃত। এই চার তত্ত্ব একত্রিত হয়ে দেহরূপে পরিণত হয়। আর এই চারতত্ত্বের মিলিত স্বভাবের ফলে, চৈতন্যের উদয় হয়। বিশেষ বিশেষ গাছের নির্যাসে (রস) সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মাদকশক্তির আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু এই রস যখন স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে, তখন কিন্তু মাদকশক্তির লক্ষণ প্রকাশ পায় না।
আচার্য্য শঙ্করকে অনুসরণ করে বলা যায়, আবার বৃহদারণ্যক উপনিষদের ২/৪/১১ শ্লোকে বলা হচ্ছে বিজ্ঞানঘন অর্থাৎ চৈতন্য এই চারভূত থেকে উত্থিত হয়। এবং এই চার ভূত নির্মিত দেহ বিনাশ প্রাপ্ত হলে, চৈতন্য সঙ্গে সঙ্গে বিনাশপ্রাপ্ত হয়। মৃত্যুর পর এই দেহের কোনো অস্তিত্ত্ব যেমন থাকে না, তেমনি মৃত্যুর পর চৈতন্যেরও কোনো আলাদা অস্তিত্ত্ব থাকে না। আসলে এই চৈতন্য বিশিষ্ট দেহকেই জীবাত্মা বলে স্বীকার করে নেওয়া ভালো। (শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা - স্বামী বাসুদেবানন্দ -পৃষ্ঠা - ১৫৯)
আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, আমরা সবাই যেমন এই জীবনে বেঁচে থাকতে চাই। তেমনি আমরা মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকতে চাই। তাই আমরা মৃত্যুর পরের অবস্থা সম্পর্কে এক কল্প কাহিনী তৈরী করে, নিজেকে শান্তনা দিয়ে থাকি। সবশেষে বলি, আজকের আলোচনায় আমরা তৃপ্ত হতে পাড়লাম না। কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারলাম না। ভবিষ্যতে এই নিয়ে আমরা আবার আসবো।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
ওম নারায়নাং নমস্কৃত্য নরঞ্চৈব নরোত্তমম
দেবী সরস্বতীঞ্চৈব তত জয় মুদিরয়েৎ।
ব্যাসায় বিষ্ণুরূপায় ব্যাসরূপায় বিষ্ণবে
নমো বৈ ব্রহ্মবিষয়ে বাশিষ্ঠায় নমো নমঃ।
গীতা শ্লোক - ৭/১৬-১৮ ভগবানের শ্রীকৃষ্ণের কাছে কে সবথেকে প্রিয় ?
শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা অধ্যায়ন করতে বসলেই আমার মধ্যে নানান রকম দ্বন্দ্ব এসে উপস্থিত হয়। আসলে প্রত্যেকটি শ্লোকে নিহিত আছে, দুটো সুর একটা বাহ্যিক আর একটা অন্তরের। আমরা সবাই ভগবানের ভক্ত হতে চাই। অর্থাৎ সর্বশক্তিমান, সর্ব্ব-ঐশর্য্যদাতা ঈশ্বরের ভক্ত হতে চাই। আমরা শুনেছি, ভক্তের বিনাশ নেই। ভক্তকে ভগবানই রক্ষা করেন। এমনকি ভক্তের সমস্ত প্রয়োজন, ভগবান স্বয়ং মিটিয়ে থাকেন। তাই আমরা যদি একবার ভক্ত হতে পারি, তাহলে আমরা অবিনাশী হতে পারবো। আমাদের সমস্ত দুঃখ-কষ্টের ভার স্বয়ং ভগবান বহন করবেন। এর থেকে স্বস্তিদায়ক আর কি হতে পারে। তো একবার ভক্ত হতে পারলে, আমরা মাথা উঁচু করে, নিশ্চিন্তে পৃথিবীর মাটিতে বিচরণ করতে পারবো। কিন্তু কথা হচ্ছে, মুখে বললেই তো আর ভক্ত হওয়া যায় না। তো কিভাবে আমরা এই ভক্তের নামাবলী গায়ে চড়াবো ? আজ সেই গুহ্য কথা শুনবো আমরা। শ্রীমদ্ভগবৎ গীতায় ভগবান সখা অর্জুনকে বলছেন, ভক্ত চার রকমের হয়ে থাকে।
চতুর্ব্বিধা ভজন্তে মাং জনাঃ সুকৃতিনঃ অর্জুন
আর্ত্তো জিজ্ঞাসু অর্থার্থী জ্ঞানী চ ভরতর্ষভ। (৭/১৬)
হে ভরতর্ষভ অর্জুন যেসমস্ত সুকীর্তিশালী ব্যক্তি আমাকে ভজনা করেন, তারা চার প্রকার - আর্ত্ত, জিজ্ঞাসু, অর্থার্থী এবং জ্ঞানী।
দেখুন ভগবান তারই ভক্তদের মধ্যে কেমন একটা বিভাজন করে দিলেন। এর আগে আমরা শুনেছি, ভগবান মানুষকে গুন্ ও কর্ম্ম অনুসারে মানুষকে চার ভাগে ভাগ করেছেন, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র। আসলে এইসব কথার গুড় অর্থ আমরা বুঝতে পারি না। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র আসলে জীবন কালের মধ্যে অথবা আমাদের শরীরের মধ্যেই এই তত্ত্ব নিহিত আছে। আমরা সবাই শুদ্র অর্থাৎ অজ্ঞান হয়ে জন্মাই, ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে জ্ঞানের উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মনত্ম প্রকাশ পায়। আবার আমাদের শরীরের মস্তিস্ক হচ্ছে ব্রাহ্মণ, পেট বৈশ্য, হাত-দুটি ক্ষত্রিয়, পাদুটো শুদ্র। তাই এই বিভাজনের কথা শুনলে, আমাদের মতো অজ্ঞানীর খারাপ লাগে, আমরা এইসব কথা শুনতে চাইনা, কিন্তু সত্যকে লুকোবো কি করে ? আমরা এতদিন জানতাম ভগবানের কাছে সবাই সমান। তাঁর কাছে আবার ভেদরেখা আছে নাকি ? কিন্তু ভগবানের মুখে ভক্তবিভাজনের এই কথা শুনে আমরা যারা অজ্ঞানী তাদের একটু অভিমান তো হয়ই। তাহলে আমি যে নিঃশর্ত ভাবে ভগবানে সমর্পিত হয়েছি, সেটাই যথেষ্ট নয়। নাকি এই কথার অন্য কোনো তাৎপর্য আছে ?
আজ আমরা এই সন্মন্ধে তিনটি শ্লোকের গভীরে প্রবেশ করবো। শুনবো, জ্ঞানীগণ কেন ভগবানের কাছে প্রিয়। আমার কাছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রিয়, এটা সত্য হলেই, আমি যেহেতু অজ্ঞান, অন্ধের মতো ভগবানকে ভালোবাসি, তাই ভগবানের কাছে আমি প্রিয়তম নই । এমন কথা শুনতে কার ভালো লাগে বলুন ?
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, চার প্রকার ভক্ত। আর্ত্ত, জিজ্ঞাসু, অর্থার্থী ও জ্ঞানী।
আর্ত্ত : আর্ত্ত কথাটার অর্থ হচ্ছে, যিনি পীড়িত, অসুস্থ, বিপন্ন, উৎপীড়িত আর এই সব অবস্থার মধ্যে যিনি উত্তেজিত। সারা জীবন যে ন্যায়-অন্যায়-এর ধারে ধারেননি। ধর্ম্ম-কর্ম্মে যার অনীহা। কিন্তু যখনই সংকট উপস্থিত হয়, তখন তিনি ত্রাহি মাম - ত্রাহি-মাম বলে চিৎকার শুরু করে দেন। এই আর্ত্তদের মধ্যে আবার দুটো শ্রেণী আছেন। একজন কৃতজ্ঞ আর একদল অকৃতজ্ঞ। অর্থাৎ যিনি বিপন্ন অবস্থায় ভগবানের স্মরণ করেন, আবার বিপদ মুক্ত হয়ে গেলে, ভগবানকে ভুলে যান। আর তখন তিনি অদৃষ্টের বা পুরুষকারের প্রসংশা করেন। ভগবানের দয়ার/করুনার কথা তিনি ভুলে যান। অকৃতজ্ঞ আর্ত্তভক্ত। আবার একদল আছেন, যা মনে করেন, হে ভগবান, তোমার অসীম দয়া, আমার কাজের ভুলের মাশুল তুমি নিজের মাথায় নিয়ে আমাকে মুক্ত করেছো। আমি জীবনে এই কথা কখনো ভুলে যাবো না। এই কৃতজ্ঞ ভক্ত একসময় সত্যিকারের ভক্তে রূপান্তরিত হয়।
জিজ্ঞাসু : যাদের ঈশ্বর সম্পর্কে নিজের মনের মধ্যে প্রশ্ন জেগেছে, তারাই জিজ্ঞাসু ভক্ত। এই জিজ্ঞাসু ভক্ত আবার দুই প্রকার। একদল তার্কিক, আর একদল শ্রদ্ধালু । এদের দুইজনের মধ্যেই প্রশ্ন করবার প্রবৃত্তি আছে। একদল ভগবানের অস্তিত্ত্বে বিশ্বাস করবার জন্য, প্রশ্ন করে থাকে। আর এক দল ভগবানের অনস্তিত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত কোরবার জন্য প্রশ্ন করে থাকে। একদল জানবার জন্য প্রশ্ন করে থাকে, আর একদল অন্যকে বিচার কোরবার জন্য প্রশ্ন করে থাকে। একদল অন্যের জ্ঞানের বহর কতদূর জেনে তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করবার জন্য, প্রশ্ন করে থাকে। একদল শ্রদ্ধা নিয়ে প্রশ্ন করে থাকে, আরেক দল অবজ্ঞাভরে প্রশ্ন করে থাকে। ভগবান বলছেন, "তদবৃদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া" ।
রাজা জনকের মনে প্রশ্ন জেগেছে, স্বপ্ন সত্য না জগৎ সত্য ? ঋষি অষ্টাবক্র বলছেন, তুমি রাজা, সিংহাসনে বসে আছো। আমি উত্তরদাতা তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তুমি যদি প্রশ্নের জবাব জানতে চাও, তবে নেমে এসো নিচে, চলো নির্জনে, করো গুরুত্ত্বে বরণ, প্রতিজ্ঞা করো গুরুদক্ষিণার, যা বলি সেইমতো কার্যনিবাহ করো, তবেই সমস্ত প্রশ্নের জবাব মিলবে। এই হচ্ছে প্রকৃত প্রশ্নকর্তা ও উত্তরদাতার সঙ্গে সম্পর্ক। যার প্রতি আপনার শ্রদ্ধা জাগেনি, তার কাছে প্রশ্ন করতে যাবেন না, কেননা সে আপনাকে তৃপ্ত করতে পারবে না। .
অর্থার্থী : জ্ঞানের ভান্ডার বেদ পড়তে গিয়ে মনে প্রশ্ন জেগেছে, ঋষিরা কি খুব অভাবে ছিল ? ঋষিরা কি অসুরক্ষা রোগে ভুগতেন ? কেননা বেদে বারবার দেবতাদের গুনগান কীর্তন করা হয়েছে, প্রসংসা করা হয়েছে, আর আর্ত্তি জানানো হয়ে সমস্ত দুঃখ দূর করবার, শত্রুদের মেরে ফেলবার। ধন ও গাভীর জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে দেবতাদের কাছে। আমরা যখন, মন্ত্র উচ্চারণ করে দেবদেবীর পূজা অর্চনা করি, তখনও সেই ধ্বনি শুনতে পাই, ধনং দেহি, জনং দেহি, জ্ঞানং দেহি, বিদ্যাং দেহি, বুদ্ধিং, দেহি, যশং দেহি, বলং দেহি, ইত্যাদি ইত্যাদি। খালি দাও দাও। কেন রে বাবা, ভগবান কি না চাইতেই আমাদেরকে অনেক কিছু দেন নি ? এতো দাও দাও কেন ? যা দিয়েছেন, তার জন্য তাঁকে কি দিয়েছো তোমরা ? যাইহোক, এই ধনার্থী ভক্তের খালি দাও-দাও রব। এদের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চাওয়া আর অভাব চলতেই থাকে।
এই চাওয়া-পাওয়ার দলেই আরো একদল মানুষ আছেন, যারা আবার এইসব তুচ্ছ জাগতিক বস্তু চান না। তারা আরো চালাক। তারা বলেন, আমাকে স্বস্তি দাও, মুক্তি দাও, শান্তি দাও, ভক্তি দাও, ভালোবাসা দাও। এমনকি এরা ভগবানের চতুর্ভূজ মূর্তি দেখবার জন্য, তাঁর সাক্ষাৎলাভের জন্য, তারই চরণে কাতর প্রার্থনা করে থাকে। যদিও প্রথম শ্রেণীর থেকে এই দ্বিতীয় দলের মানুষ অনেক ভালো, কিন্তু এদেরও চাওয়া-পাওয়ার শেষ হয়নি। এঁরাও ভগবানের একশ্রেণীর ভক্ত বলা যেতে পারে উচ্চশ্রেণীর ভক্ত। এদের কাছে, হয়তো একদিন ভগবান আসেন, দেখাও দেন। কিন্তু ওই পর্যন্ত। এরা ভগবানকে দেখলেই, ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন, কান্নাকাটি জুড়ে দেন। আর বলতে থাকেন, হে ভগবান তোমার এই ভীষণ-দীপ্তিময় ভয়ঙ্কর মূর্তি আমি আর সহ্য করতে পারছি না। তুমি স্বাভাবিক হও, অর্থাৎ আমার মতো মনুষ্যদেহে আমার পাশেপাশে থাকো। অর্থাৎ আমার সব চাওয়া শেষ হয়ে গেলেও পাওয়ার শেষ নেই।হায় ভগবান!
জ্ঞানী: চতুর্থ প্রকার ভক্ত হচ্ছেন জ্ঞানী। যাঁকে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, সবথেকে কাছের ভক্ত। অর্থাৎ যিনি বুদ্ধিমান, যার জ্ঞান আছে, যিনি আমার যথার্থ স্বরূপ জেনেবুঝে আমার ভক্ত হয়েছেন। এখন কথা হচ্ছে জ্ঞানী ভক্ত বলতে আমরা কি বুঝি ? কাকেই বা জ্ঞানীভক্ত বলছেন ভগবান। আসলে জ্ঞানী ভক্ত তিনি, যিনি যথার্থ যোগী। ভগবান গীতার অন্যত্র বলেছেন, কৰ্ম্মী থেকে জ্ঞানী শ্রেষ্ঠ, জ্ঞানী থেকে ধ্যানী শ্রেষ্ঠ, আবার ধ্যানী থেকে যোগী শ্রেষ্ঠ, আর যথার্থ যোগীই আমার প্রকৃত ভক্ত। যিনি জন্ম থেকেই আত্মজ্ঞান পাবার জন্য ব্যাকুল, যিনি জন্ম থেকেই ভগবতপ্রাপ্তির জন্য উৎকন্ঠিত। তিনি প্রথমে নিষ্কাম কর্ম্ম, তারপরে আত্মজ্ঞান অর্জন, ও শেষে যোগের দ্বারা ভগবৎ উপলব্ধি করতে পারেন, তিনিই যথার্থ জ্ঞানী । এঁকেই বলা হয়, জ্ঞানীভক্ত। এঁরা মোক্ষের জন্য ব্যাকুল নয়, কিন্তু মোক্ষ এঁদের স্বাভাবিক পরিণতি।
এর পরের শ্লোকে বলছেন :
তেষাং জ্ঞানী নীতিযুক্ত একভক্তিঃ বিশিষ্যতে।
প্রিয় হি জ্ঞানীনঃ অত্যর্থং অহং স চ মম প্রিয়ঃ। (৭/১৭)
তাদের মধ্যে অর্থাৎ সমস্ত ভক্তের মধ্যে জ্ঞানি-ভক্তটি হচ্ছে শ্রেষ্ঠ। এই জ্ঞানী ভক্ত নিরন্তর আমাতেই যুক্ত এবং আমাতেই ভক্তিনিষ্ঠ থাকেন। ভগবান বলছেন, আমি জ্ঞানিভক্তের কাছে অত্যন্ত প্রিয়, আবার আমার কাছে জ্ঞানী ভক্ত অত্যন্ত প্রিয়। অর্থাৎ ভগবান ও জ্ঞানীভক্ত দুইজন দুজনের খুব কাছাকাছি অবস্থান করে থাকেন। তিনি নিরন্তর আমাতেই যুক্ত, আমাতেই ভক্তিনিষ্ঠ।
এর পরের শ্লোকে বলছেন :
উদারাঃ সর্ব্ব এবৈত জ্ঞানী ত্বাত্মৈব মে মতম্।
আস্থিতঃ স হি যুক্তাত্মা মাম এব অনুত্তমাং গতিম। (৭/১৮)
এঁরা সবাই অর্থাৎ সমস্ত ভক্তই মহান, কিন্তু জ্ঞানী আমার আত্মস্বরূপ। এটাই আমার অভিমত। কেননা, মদ্গতচিত্ত সেই জ্ঞানী ভক্ত জীবের সর্বোৎকৃষ্ট গতি যে আমি, এই কথা জেনেবুঝেই সে আমাকেই আশ্রয় করে থাকে।
দেখুন, আমি যাঁকে চিনি না, জানি না, যার সাক্ষাৎ করিনি কোনোদিন। তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্কই গড়ে উঠতে পারে না। খারাপ-ভালো কোনো সম্পর্কই হতে পারে না। কাল্পনিক ভগবানের সঙ্গেও আমাদের কোনো সম্পর্ক হতে পারে না। যারা এসব বলছেন, তারা ভাবের ঘরে চুরি করছেন।
তো জ্ঞান দুই প্রকার। এক) তাত্ত্বিক জ্ঞান, যা আমরা ধর্ম্ম শাস্ত্র অধ্যান করে বা গুরুবাক্য শ্রবণ করে অর্জন করতে পারি।
দুই) উপলব্ধি জাত প্রতক্ষ্য জ্ঞান, যা আমরা যোগক্রিয়ার দ্বারা প্রতক্ষ্যভাবে অনুভব করতে পারি।
তো ভগবানের সাক্ষাৎ হতে পারে, একমাত্র যোগক্রিয়ার দ্বারা। আর এই যোগক্রিয়ার সাহায্যে যারা ভগবৎ জ্ঞান অর্জন করেছেন, যারা ভগবৎ উপলব্ধি করেছেন, তারাই প্রকৃত ভগবানের সান্নিধ্যে আছেন। অর্থাৎ ভগবান তার কাছেই আছেন, আবার তিনিও ভগবানের কাছেই আছেনা। এইজন্য ভগবান বলছেন, প্রিয় হি জ্ঞানীনঃ অত্যর্থং অহং স চ মম প্রিয়ঃ। অর্থাৎ জ্ঞানীর কাছেও আমি প্রিয়, আবার আমার কাছেও জ্ঞানী প্রিয়।
এবার আমরা আমাদের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে এই বিষয়টি বুঝবার চেষ্টা করি।
আমরা এটা সবাই প্রতক্ষ্য করেছি যে, যে ছেলেটি পড়াশুনায় ভালো, তাকে তার মা-বাবা এমকি সমস্ত শিক্ষক, তাকে আলাদা করে ভালোবসেন । মা-বাবা বা শিক্ষকের কাছে সমস্ত সন্তান বা ছাত্র সমান হলেও, পড়াশুনায় ভালো ওই ছেলেটি কিন্তু ,মাস্টারদের কাছ থেকে, বা নিজের মা-বাবার কাছ থেকে একটা আলাদা ভালোবাসার জায়গা তৈরী করেছে এটি স্রেফ পড়াশুনায় ভালো হবার জন্য নয়, পড়াশুনায় মনোযোগী হবার জন্য, পড়াশুনায় ধ্যান দেবার জন্য ।
আমরা এও লক্ষ করেছি, নিজের সন্তানের প্রতি মা-বাবার একটা অন্ধ ভালোবাসা থাকে। যা অন্যকারুর প্রতি থাকে না। এইযে অন্ধ ভালোবাসা, বা প্রশ্রয়, আখেরে কিন্তু তাতে ছেলেমেদের সবসময় ভালো হয় না। বরং এতে করে আমরা অনেকসময় ছেলেমেদের খারাপ দিকটাকে উপেক্ষা করে, তাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছি। আর শেষে সন্তানের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ইচ্ছে পূরণ না হওয়ার জন্য, নিজেই কষ্ট পাচ্ছি। তো অন্ধ-ভালোবাসা তা সে ঈশ্বরের প্রতি হোক, বা ছেলেমেয়েদের প্রতি হোক, এটি নিছক অন্ধ মোহ ছাড়া আর কিছু নয়। যা আমাদেরকে সত্যে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। বরং বিপদের দিনে, ভগবানকে সর্বশক্তিমান ভেবে, সর্ব-সমস্যার সমাধানকর্তা ভেবে, যখন আমরা ভগবানের কাছে অমূলক প্রার্থনা করি, আর সেই প্রার্থনায় যখন কোনো সুফল পাই না , তখন আমরা বিমর্ষ হয়ে যাই, হতাশ হয়ে পড়ি, ভগবানে বিশ্বাস হারাই। ভগবানের প্রতি যারা অন্ধ ভক্ত, তারা আসলে এই মোহজালে জড়িয়ে আছেন। সত্য এদের কাছে অধরা।
সবশেষে বলি, কথায় বলে টাকা নিও গুনে, আর বন্ধু নিও চিনে। কাউকে ভালোভাবে না জেনে তাকে নিঃশর্তভাবে ভালোবাসলে, আখেরে সেই ভালোবাসা টেকেনা। আপনি যদি ভগবানকে না জেনে, তাকে ভালোবাসতে যান, তাহলেও আমাদের সেই দশা হবে। আমাদের মধ্যে অনেকের ধারণা হচ্ছে, ভগবান সর্বশক্তিমান, ভগবান সমস্ত ঐশ্বর্যের মালিক। তো আমি বিপদে পড়ে, যখন ভগবানকে ডেকে, আমার সমস্যার সমাধান করতে না পারি, তখন আমাদের ভগবানের প্রতি ভালোবাসায়, ভগবানের প্রতি বিশ্বাসে এমনকি ভগবানের অস্তিত্ত্বে আমরা সন্দিহান হয়ে উঠি। তাই আমাদের উচিত আগে ভগবানের সম্পর্কে জানা, অর্থাৎ ভগবান সম্পর্কে জ্ঞানের উন্মেষ ঘটানো, তার পরে ভগবানকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। আর এর জন্য যোগই সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। এই যোগের পদ্ধতি সম্পর্কেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবৎ গ্রন্থেই আমাদের নির্দেশ পাঠিয়েছেন। আর এই যোগসাধনের ফলে, যোগী জানতে পারেন, সমস্ত জীবের সর্বোৎকৃষ্ট গতি স্বয়ং ঈশ্বর । আর এই কথা জেনেবুঝেই সে আমাকেই অর্থাৎ ঈশ্বরকেই আশ্রয় করে থাকে।
ভগবান বলছেন, এঁরা সবাই অর্থাৎ সমস্ত ভক্তই মহান, কিন্তু জ্ঞানী আমার আত্মস্বরূপ। এটাই আমার অভিমত। কেননা, মদ্গতচিত্ত সেই জ্ঞানী ভক্ত, জীবের গতি যে আমি, সেই কথা জেনে বুঝেই সে আমাকে আশ্রয় করে থাকে। না জেনে নয়। অজ্ঞান অবস্থাতেও নয়, মোহের বশেও নয়। সত্যিকারের যোগীর কাছে, ভগবান কোনো কল্পনা নয়, কোনো বিশ্বাসের বস্তু নয়, জ্ঞানীযোগীর কাছে, ভগবান অনুভবের বিষয়, উপল্বদ্ধির বিষয়। তাই জ্ঞানযোগীই ভগবানের সবথেকে প্রিয়ভক্ত ও কাছের মানুষ । তো আমাদেরকে প্রথমে ভগবানের স্বরূপ সম্পর্কে জ্ঞাত হতে হবে। ভগবানের স্বরূপ জ্ঞান হলে, তাঁর প্রতিভালোবাসা, ভক্তি, শ্রদ্ধা এমনি এমনি এসে যাবে। আজ ব্রহ্ম বাক্যের বিরাম দিলাম।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
--------------------------
আমি তখন সবে চাকুরী পেয়েছি। অর্থাৎ প্রায় ৪০/৪৫ বছর আগের কথা। আমার অন্য অনেক বন্ধু যাদের সাথে আমি একই ক্লাসে লেখাপড়া করেছি, এবং যাদের আমি খুবই ভালো বাসি তাদের অনেকের তখনও চাকুরী হয়নি। তো খুবই কাছের এক বন্ধু, আমাকে বললো, ৫০০০ টাকা ঘুষ জোগাড় করতে পারলে, তার রেলে চাকুরী হতে পারে। তো আমি তখন মাইনে পাই ৫০০ টাকার কাছাকাছি। আর সব টাকাটাই তখন আমি বাবার হাতে ধরে দেই। তো তাকে বললাম, তোর বাবার কাছে, বা দাদার (ওর দাদা তখন ব্যাঙ্কে চাকরি করে) কাছে চেয়ে নে। তো ও বললো, বাবার কাছে চেয়েছিলাম। বাবা না করে দিয়েছে। আর দাদা বিশ্বাসই করতে পারছে না, ঘুষ দিলে চাকরি পাওয়া যায়। তো আমি ওকে আমাদের কে-অপারেটিভ থেকে ধার করে, ৪০০০ টাকা এনে দিলাম। আর ১০০০ টাকা ও ওর দাদার কাছে পেয়ে গেলো। তখন চার হাজার টাকা মানে আমার ১০ মাসের মাইনে। ভাগ্যক্রমে চাকরিটাও হয়ে গেলো। আজ আমরা সবাই চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেছি। কিন্তু আজো সেই টাকা আমাকে ও ফেরত দেয়নি। আর ওর সঙ্গে আমার যে আন্তরিক বন্ধুত্ত্ব ছিলো, তা ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে। যে ভালোবাসা ছিল, তা ওই টাকা ফেরত না পাবার জন্য, আমাদের মধ্যে থেকে উবে গেছে।
আরো একটা ঘটনা বলি, আমরা অফিসের কয়েকজন বন্ধু মিলে একটা হাউসিং কে-অপারেটিভ করবার সিদ্ধান্ত নেই। বন্ধুটির নাম বলবো না, সে আমাদের সঙ্গে যোগদেবার জন্য, প্রথম থেকেই উৎসাহী ছিল। তো নিউটউন-এ জমির জন্য আমরা দুই বন্ধু দুটো কোপেরাটিভ তৈরী করে দরখাস্ত করলাম। আমার নামের কে-অপেরাটিভের জন্য জমি পাওয়া গেলো। কিন্তু বন্ধুর নামের কোপারেটিভের জন্য জমি পাওয়া গেলো না। বন্ধুর মন ভেঙে গেলো। আমি তাকে আমাদের কে-অপেরাটিভে জায়গা করে দেবার জন্য, সচেষ্ট হলাম। কিন্তু সে তার নিজের নাম না রেখে তার স্ত্রীর নামে আমাদের সাথে যোগদান করলো। ভালোই চলছিল। কিছুদিন পরে সে বললো, এই সদস্যপদ, তার স্ত্রীর কাছে না রেখে সে তার নিজের নাম করতে চায়। আমরা তাতেই সম্মতি দিলাম। এখন প্রোমোটারদের কাজ যেমন হয়, প্রথম দিকে কাজের গতি ঠিক থাকলেও, শেষের দিকে প্রোমোটার আমাদের অতিরিক্ত টাকার জন্য, চাপ দিতে লাগলো। আর বিল্ডিঙের কাজ বন্ধ করে দিলো। এইবার ওই বন্ধু আমাদের চাপ দিতে লাগলো, তাড়াতাড়ি বিল্ডিঙের কাজ শেষ করবার জন্য। বিল্ডিঙের কাজ শেষ হতে না হতেই, আমাদের অজ্ঞাতসারে, সে ওর ফ্ল্যাটটি বিক্রি করবার ব্যবস্থা পাকা করে ফেললো। এবং যেখানে ১৭/১৮ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে, সেখান থেকে ৪২০০০ টাকা সংগ্রহ করে নিলো। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, সবাই মিলে আমরা একসাথে থাকবো। সেখান থেকে সে বেরিয়ে গেলো। আমাদের বন্ধুত্ত্বের শেষ হলো।
----------------------------------------
প্রাণ বিহীন কোষ বস্তু মাত্র। প্রাণের সংস্পর্শে এসে কোষ প্রানবন্ত হয়। বস্তু থেকে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে কোষের জন্ম হয়। কোষকে বস্তু ও প্রাণের রূপান্তরের মধ্যবস্থা বলা হয়ে থাকে ।
মায়ের শরীরে যখন পিতার শুক্রের স্থানান্তর হয়, তখন শুক্র বস্তুগুন্ সম্পন্ন হয়ে থাকে। ধীরে ধীরে একসময়,৪৪-৫০ দিনের মধ্যে সে মায়ের প্রাণের সংস্পর্শে আসে। কিছু ক্ষেত্রে এই সময় ৮৪-৯০ দিন হয়ে থাকে। আর প্রাণ ও চেতনা একসঙ্গেই প্রবাহিত হয়ে থাকে। এইসময় শিশুর নাড়াচাড়া টের পাওয়া যায়। কিন্তু যখন সে মাতৃগর্ভ থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে, তখন সে নিজে থেকে প্রাণ সংগ্রহ প্রক্রিয়া শুরু করে। ফুসফুস ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে, আর কেঁদে ওঠে।
----------------------------
No comments:
Post a Comment