তারিখ : ৩.১০-২০২১
অন্যের অমঙ্গল কামনা করা, বা অন্যের অনিষ্ট প্রার্থনা করাই অভিশাপ। ঠিক তেমনি অন্যের মঙ্গল কামনা করা, অন্যের সমৃদ্ধি জন্য প্রার্থনা করাই আশীর্বাদ।
রাজা জনমেজয়ের দীর্ঘদিন ধরে ভাইদেরকে (শ্রুতসেন, উগ্রসেন, ভীমসেন) সঙ্গে নিয়ে একটা যজ্ঞ করছেন। তো সেখানে একটা কুকুর এসে উপস্থিত হলো। এখন জনমেজয়ের ভাইয়েরা যজ্ঞানুষ্ঠানে কুকুর দেখে, তাকে পেটাতে পেটাতে যজ্ঞস্থল থেকে বের করে দিলো। কুকুরটি কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে গিয়ে নালিশ করলো। সরমা অর্থাৎ কুকুরটি মা, বললো, তুমি নিশ্চয় তাদের কোনো অপকার করেছো। কুকুরটি বললো, না আমি তাদের কোনো অপকার করিনি, এমনকি তাদের হবির দিকেও নজর দেই নি। তো কুকুরের মা সরমা যজ্ঞস্থলে এসে, জনমেজয়ের ভাইদের জিজ্ঞেস করলো, তোমরা আমার সাবককে কেন মেরেছো ? এখন কুকুরের কথায় কে আর জবাব দেয় ? জনমেজয়ের ভাইয়েরাও কুকুরের কথা অগ্রাহ্য করলো। এতে করে,সরমা নামে মা-কুকুরটি অভিশাপ দিলো, - তোমরা একজন নিরপরাধকে প্রহার করেছো, অতয়েব অদৃশ্য ভয় তোমাদেরকে তাড়া করবে। জনমেজয় একথা শুনে বিষণ্ণ ও ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো। মহাভারত শুরু হয়েছে, এই অভিশাপের কাহিনী দিয়ে।
আমাদের প্রাচীন মুনিঋষিগন কথায় কথায় আশীর্বার বা অভিশাপ দিতেন। এই দুটোই নাকি ফলিত বিদ্যা। অর্থাৎ এই দুটোই ফল প্রদান করে থাকে। আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, তাহলে আর এতো কষ্ট করে, কাজকর্ম্ম করা কেন ? আশীর্বাদের জন্য প্রার্থনা করলেই তো হয়। আর এতো যুদ্ধ বিগ্রহ কেন, অভিশাপ দিয়েই তো সমস্ত সমস্যার সমাধান করে নেওয়া যায়। মহাভারতের এতবড়ো যুদ্ধ, যেখানে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উপস্থিত আছেন, তিনি কৌরবদের অভিশাপ দিতেন "তোরা সব গোল্লায় যায়", আর এতে দুর্যোধন ও তার দলবল শেষ হয়ে যেতো আর পান্ডবদের আশীর্বাদ দিতেন, ইন্দ্রপ্রস্থের রাজা হবার জন্য। তো সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু তা হয়নি।
বর্তমান যুগেও আশীর্বাদ দেবার একটা প্রথা প্রচলিত আছে। কেউ আমাদেরকে প্রণাম করলে আমরা তাকে আশীর্বাদের নাম শুভবার্তা প্রদান করে থাকি। এমনকি রেগে গিয়ে, বা আমাদের শত্রু নাশের উদ্দেশ্যে অভিশাপ দেবার কথাও আমরা শুনতে পাই। কিন্তু সমস্যা সমাধান হয় কি ? বরং বলা হয়ে থাকে শকুনের অভিশাপে কখনো গরু মারা যায় না। অর্থাৎ আমাদের মতো সাধারণ মানুষের আশীর্বাদ বা অভিশাপে আদৌ কোনো কাজ হয় না। আদৌ কি আশীর্বাদ বা অভিশাপে কোনো কাজ হয় ? যদি হয়, তবে তা কিভাবে সম্পন্ন হয়ে থাকে ? আর একটা কথা হচ্ছে, যুগযুগ ধরে, এই প্রথা চলে আসছে, এর যদি কোনো বাস্তব ভিত্তি না থাকে, তবে কিভাবে এটি টিকে আছে ? আজ আমরা এই আশীর্বাদ ও অভিশাপের কার্যপ্রণালী সম্পর্কে শুনবো।
তার আগে এই অভিশাপের কাহিনীর পরবর্তী অংশ একবার শুনে নেই।
জনমেজয় যথারীতি তার ক্ষত্রিয় ধর্ম্ম অনুসারে প্রজা পালন করছেন। একদিন ঋষি উতঙ্ক তার রাজ্ সভায় এলেন। এসে রাজা জনমেজয়কে মন্ত্রণা দিলেন, হে মহারাজ দুরাত্মা তক্ষক আপনার পিতাকে দংশন করেছিল। আর এতে করে, আপনার পিতার অকালে পঞ্চত্ব প্রাপ্তি হয়। এমনকি, কাশ্যপ বিষ- চিকিৎসক দ্বারা মহারাজ পরীক্ষিতের প্রাণ রক্ষা করতে এসেছিলেন। কিন্তু তক্ষক তাকে নিবৃত্ত করে। আপনার উচিত এই পাপাত্মা তক্ষককে প্রদীপ্ত হুতাশনে আহুতি দেওয়া। রাজা জনমেজয় এতদিন পিতার মৃত্যুর কারন জানতেন না। তার মধ্যেও পিতার মৃত্যুর কারন জানবার আগ্রহ ছিল। আর এখন উতঙ্কমুনির কাছ থেকে রাজা জনমেজয় এইসব শোক-উদ্দীপ্ত কথা শুনে, শোকে-দুঃখে বিষন্ন হয়ে, নিজের মধ্যে ক্রোধাগ্নির উৎপত্তির কারন হলেন।
শুরু হলো মহাভারত, শুরুহলো প্রতিশোধের পালা। শুরু হলো ধর্ম্ম অধর্ম্মের কাহিনী। শুরু হলো নিয়তির কার্য্য-কারন ব্যাখ্যার প্রতি-কাহিনী।
তো অভিশাপ আছে, অভিশাপের থেকে নিষ্কৃতি পাবার চেষ্টাও আছে। যিনি অভিশাপ দেন, তিনিই আবার এই অভিশাপ থেকে নিষ্কৃতি পাবার রাস্তা বলে দেন। তো অভিশাপ ব্যাপারটা কি ? অভিশাপের দ্বারা একটা মানুষের জীবনকে কি বদলে দেওয়া যায় ? আমরা এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো।
বাসুদেবের দেবালয়ে একবার দেবর্ষি নারদ এসেছেন। সবাই তাকে অভ্যর্থনা করলেন, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণপুত্র শাম্ব তখন সহচরীদের নিয়ে সূরাপানে ও হাস্যরসে মশগুল। নারদের উপস্থিতি তিনি খেয়াল করলেন না। কিন্তু মহর্ষি নারদ এতে ক্ষুব্ধ হলেন। শাম্ব নিজের অজ্ঞাতসারেই, নারদের কোপে পড়ে গেলেন। নারদ কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। হিন্দু শাস্ত্রে নারদ একটা অদ্ভুত চরিত্র। যার কুমন্ত্রণায় আমরা অজ্ঞানের অন্ধকারে নিজেদেরকে নিমজ্জিত করে, নির্মম ভবিতব্যের নির্মাণ করি। কংশকে ধংসের রাস্তায় নিয়ে যাবার জন্য, এই নারদেরই মন্ত্রণা ছিল।
যাইহোক, তো শ্রীকৃষ্ণ একবার রমনীদের নিয়ে জলকেলিতে মগ্ন। এমনসময় নারদ শাম্বকে গিয়ে বললেন, বাসুদেব তোমাকে রৈবতকের প্রমোদকাননে ডেকে পাঠিয়েছেন। মহর্ষির কথায়, শাম্ব তড়িঘড়ি প্রমোদকাননে উপস্থিত হলেন। সাধারণত এইসময় প্রমোদকাননে শ্রীকৃষ্ণের অনুমতি ভিন্ন প্রবেশ নিষেধ। তো এখানে শাম্বকে আসতে দেখে, শ্রীকৃষ্ণ ক্ষুব্দ হলেন। অন্যদিকে রমণীগণ শাম্বকে নিয়ে জলকেলী করতে শুরু করে দিলেন। নারদ শ্রীকৃষ্ণের দৃষ্টিপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন। বাসুদেব, রেগেমেগে জ্বলন্ত চোখে রমনীদের দিকে তাকালেন। নারদ এই ঘটনার পরিণতি দেখবার জন্য, অর্থাৎ শাম্বকে তার পিতাকে দিয়েই শায়েস্তা করবার জন্য, অপেক্ষা করছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ রমনীদের উদেশ্যে অভিশাপ বাণী উচ্চারণ করলেন, আমার মৃত্যুর পরে, তস্করদের দ্বারা লাঞ্চিত ও নিপীড়িত হবে। শাম্বর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার এই রমণীমোহন রূপ কুষ্ঠ রোগের কুশ্রীতা গ্রাস করুক।
আমরা জানি ভবিষ্যতে এমনটাই ঘটেছিলো। শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর পরে, যখন অর্জুন শ্রীকৃষ্ণ আশ্রিতদের নিয়ে হস্তিনাপুরে যাচ্ছিলেন, পথে চোর-ডাকাতদের দ্বারা তাঁরা লাঞ্চিত হয়ে ছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ পুত্র শাম্বর কুষ্ঠ রোগ হয়েছিলো। রমনিগন, অভিসম্পাত শুনে কৃষ্ণের কাছে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। এতে করে, শ্রীকৃষ্ণ তাদের তিনি বলেছিলেন, দালভ্য ঋষির নাম জপ করতে। শাম্ব ছিল, এই ঘটনার শিখন্ডি মাত্র। আসলে নারদের কথা শুনেই সে এখানে এসেছিলো। তার কোনো দোষ নেই। একথা সর্বজ্ঞ শ্রীকৃষ্ণ জ্ঞাত ছিলেন না এমনটা বলা যায় না। । কিন্তু তাৎক্ষণিক ঘটনায়, তিনি অভিসম্পাত দিয়ে দিয়েছিলেন। এখন আর কিছু করবার নেই। কিন্তু শাম্ব বাবার কাছে কান্নাকাটি করতে লাগলো। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সত্যের পূজারী। শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাণী সত্যে পরিণত হবে। এব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ নিজে বুঝতে পারছিলেন, এটা কাম্য নয়। তাহলে কেন শ্রীকৃষ্ণ কেন এমনটা করলেন ? বা কেন এমনটা হলো ? এইখানে শ্রীকৃষ্ণ শাম্বকে যা বলেছিলেন, সেই কথার মধ্যে লুকিয়ে আছে, অভিসম্পাদের বিষ্ময়কর নেপথ্য কাহিনী।
শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, হে প্রাণাধিক পুত্র শাম্ব, দেখো, অভিশাপ দিয়ে সঙ্কট থেকে মুক্তি লাভ করা যায় না। আর তাই যদি হতো, তবে আমাকে গদা আর চক্র ধারণ করে, শত্রু নিধন করবার করবার দরকার পড়তো না। এমনকি আমাকে এই মনুষ্য দেহ ধারণ করে, পৃথ্বি মাতার ভার লাঘব করতে হতো না। যদিও সাধারণ লোকে অভিশাপ দিয়ে থাকে মনস্তাপ থেকে। অর্থাৎ তারা অন্যের ক্ষতি সাধন ইচ্ছায় অভিশাপ দিয়ে থাকে। নিজের মনের বিকৃত তুষ্টির জন্য অভিশাপ দিয়ে থাকে। আসলে এরা সবাই, আখেরে নিজেদের ক্ষতি সাধন করছে। কেননা চিন্তা প্রসূত কর্ম্ম সদা ফল প্রদান করে থাকে। যে চিন্তা তুমি বিশ্বভুবনকে ছাড়িয়ে দিছো, সেই চিন্তাই তোমাকে আচ্ছাদিত করছে। এবং সেইমতো ফল প্রদান করছে।
কিন্তু আমার অভিশাপবাণী সেইমতো অকারনে শুধুই মনস্তাপের কারনে নিঃসৃত হয় না। আসলে যা অবশ্যম্ভাবী, যে ভবিষ্যৎ ঘটনার কারনের জন্ম হয়েছে, যা ভবিতব্য তাই আমার মুখে অভিশাপ রূপে উচ্চারিত হয়। তোমার জন্ম লগ্নেই এই কুৎসিত ব্যাধি তোমার ভাগ্যে লেখা আছে। আমার মুখ দিয়ে তা উচ্চারিত হয়েছে মাত্র। মানুষ যখন ক্রোধান্বিত হয়, মানুষ যখন গভীর শোকাচ্ছন্ন হয়, তখন মানুষের চিন্তার গভীরতা বেড়ে যায়। আর আর চিন্তা প্রসূত মূর্তিগুলো তখন অধিক শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আর ওই চিন্তার প্রভাব বাক্যের আকারে মুখ থেকে অকস্মাৎ বেরিয়ে আসে। এই বাক্যের সাহায্যে আমরা ভূত ভবিষ্যৎকে নির্দিষ্ট করতে পারি। তুমি হয়তো খেয়াল করোনি, তোমার শরীরের মধ্যে এর মধ্যেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গের স্ফিতি এসেছে। তোমার দেহে রক্তাভ বর্ণ প্রকট হচ্ছে। তোমার্ শরীর এখন আর স্বাভাবিক নেই। তুমি শীঘ্র এই রোগে আক্রান্ত হবে। তার লক্ষণ আমি দেখতে পাচ্ছি। ঋষি নারদের রোষানলে তুমি বিদ্ধ। তিনি অভিজ্ঞ, তিনি সর্বত্র ভ্রমন করে থাকেন। তার কাছেই তুমি তোমার শরীর ঠিক করবার উপদেশ প্রাপ্ত হবে। দেখো, যা প্রারব্ধ, যা অমোঘ, তাই-ই অনিবার্য হয়ে মানুষের জীবনে নেমে আসে। একে কেউ বলেন, নিয়তি, কেউ বলেন ভাগ্য, বা অদৃষ্ট। অভিশাপ পূর্বঘোষিত ভবিষ্যৎ মাত্র। যাকে লঙ্ঘন করা দুঃসাধ্য । কিন্তু অলংঘনীয় নয়। কেননা সমস্ত সমস্যার যেমন উৎপত্তি আছে, তেমনি সমস্ত সমস্যার নাশ আছে। মানুষের চিন্তা প্রসূত মূর্তির অসীম ক্ষমতা। তোমাকে এই চিন্তা শক্তির মনন করতে হবে। নির্দিষ্ট পরিবেশে, নির্দিষ্ট স্থানে, উপযুক্ত প্রাকৃতিক জল হাওয়ায়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তোমাকে শুধু কর্তব্য করে যেতে হবে আর প্রতীক্ষা করতে হবে, ধৈর্য্য ধরতে হবে, সুসময়ের জন্য । অভিশাপকে ক্রোধের অভিব্যক্তি ভেবো না। অভিশাপ ভবিষ্যতের আগাম বার্তা, ভবিতব্য। আশীর্বাদ করি এই অভিশাপ থেকে তুমি মুক্ত হও। শ্রীকৃষ্ণের এই আশীর্বাদও ভবিষ্যতে ফলপ্রসূ হয়েছিল। এর পরের দিন আমরা আশীর্বাদের কথা শুনবো।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ , হরি ওম।
আশীর্বাদ /অভিশাপ : (2)
আমরা শুনছিলাম অভিশাপের কথা। তো আশীর্বাদ বা অভিশাপ যাই হোক না কেন, এটি আসলে একধরনের চিন্তাশক্তি, যা চিন্তাপ্রসূত বিষয়কে গতিশীল করে, ও বিষয়ের লক্ষবস্তুর দিকে ধাবিত হয়। অর্থাৎ একটা চিন্তাকে সৃষ্টি করা, ও তাকে গতিশীল করা। কোনো ঘটনার বীজ অন্যকোনো ঘটনা থেকেই উৎপন্ন হয়ে থাকে। আশীর্বাদ বা অভিশাপ এই বীজরূপ ঘটনাকে উদ্গমনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দেয়। ফলত যে ঘটনা বীজ আকারে সুপ্ত ছিল, তা আশীর্বাদ বা অভিশাপের ফলে সত্ত্বর ফল প্রদানে উন্মুখ হয়ে ওঠে।
কর্ম্ম আমাদের চিন্তা প্রসূত। আমাদের মনে হতে পারে, কর্ম্ম যদি আমার তবে চিন্তাও আমার। ব্যাপারটা কিন্তু তেমন নয়। দেখুন আপনি যখন চাকরি করতে যান, তখন যে কর্ম্ম আপনাকে করতে হয়, তা কি আপনার নিজস্ব চিন্তা প্রসূত ? আমরা অনেক সময়ই অন্যের নির্দেশে অর্থাৎ অন্যের চিন্তাকে ফলপ্রসূ করবার জন্য, কর্ম্ম করে থাকি। এইভাবে আমরা আমাদের অভিভাবকের কথায়, বন্ধুবান্ধবের কথায়, মনিবের কথায়, প্রতিবেশীদের কথায়, দেশনায়কের কথায়, আমরা কাজ করে থাকি। তাহলে আমার যে কর্ম্ম তা শুধু আমার চিন্তা প্রসূত নয়। বহুজনের চিন্তা প্রসূত কার্য্য আমার দ্বারা সম্পাদন হয়ে থাকে। তো আমরা এক সময় সম্মিলিত যে ইচ্ছেশক্তি, অর্থাৎ বিশ্বশক্তির ইচ্ছেকেও কার্য্যে রূপান্তরিত করে থাকি। একেই বলে ঈশ্বরের নির্দেশে কার্য্য করা। এখন যার ইচ্ছেতে আমরা কাজ করি, সেই কর্ম্মের ফল কিন্তু তারই পাওনা। অর্থাৎ আমরা যখন মনিবের ইচ্ছেতে কার্য করি, তখন সেই কাজের ভালো-মন্দ আমাদের মনিব ভোগ করে থাকেন। কিন্তু এই কাজের বিনিময়ে যদি আমি কিছু গ্রহণ করি, হতে পারে তা অর্থ, বা অন্য কোনো কিছু, অর্থাৎ প্রত্যাশা জনিত কর্ম্ম, সেটি কিন্তু আমারই ভোগে লাগবে। তাই প্রত্যাশা নিয়ে কাজ করলে, সেই কর্ম্মের ফল আমাকেই ভোগ করতে হবে।
এবার আবার মহাভারতের গল্পের দিকে নজর দেই। মহাভারতের যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। আপনারা জানেন, মহাভারতের যুদ্ধে গান্ধারী তার সমস্ত সন্তানদের হারিয়েছিলেন । সেই শোকহেতু, ক্রোধান্বিত হয়ে, বাসুদেবকে দোষারোপ করে, বলেছিলেন, হে জনার্দ্দন তুমি যেমন কৌরব ও পান্ডবদের জ্ঞাতি বিনাশ কালে, নিরুদ্বিগ্ন ও উপেক্ষা প্রদর্শন করেছো, আজ থেকে ঠিক ৩৬ বছর পরে, তোমার আপন জ্ঞাতিবর্গ তোমারই হাতে বিনষ্ট হবে। এমনকি তোমার কুল-রমণিগণ পুত্রহীন, আত্মীয়স্বজন বিহীন হয়ে, বিলাপ ও পরিতাপ করবে। ভাবুন স্বয়ং ভগবানকে এক মানবী অভিশাপ দিচ্ছেন। তো তখন ভগবান যা বলেছিলেন, সেই কথাগুলো খুবই গুরুত্ত্বপূর্ন ও প্রণিধান যোগ্য। গান্ধারীদেবীর কথাশুনে শ্রীকৃষ্ণ হেসে ফেললেন। তিনি ভূত ভবিষ্যৎ জানেন। তিনি বললেন, হে দেবী, আমি ছাড়া যদুবংশীয়দের বিনাশ করে, এমন কেউ নেই। আর মৃত্যুহীন জগৎ বিষময়, মৃত্যুহীন জীবন কলহে পরিপূর্ন। মৃত্যু আছে তাই জীবন এতো সুন্দর। যাদব বংশ কখনোই মনুষ্য বা দানবগনের বধ্য নয়। তাই আমার কর্তব্য আমাকেই করতে হবে। আপনি ঠিকই বলেছেন, ওঁরা সবাই আমার দ্বারাই নিহত হবে।
তো যা বলছিলাম, ভগবান আমাদের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে কর্ম্মও নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। সামান্য কিছু ক্ষমতা পেয়ে মানুষ নিজেকে কর্তা ভেবে বসে আছে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, ভবিতব্যই মানুষকে কর্ম্মে প্রেরণা দিয়ে থাকে। আর সেইমতো কর্ম্ম মানুষকে ফল প্রদান করে থাকে। ভগবান স্বয়ং যখন মনুষ্য দেহ ধারণ করেন, তিনিও এই নিময়ের দ্বারা আবদ্ধ হয়ে যান । এর অন্যথা নেই। পার্থক্য হচ্ছে, ভগবানের কোনো পূর্বকর্ম্ম বা প্রারব্ধ কর্ম্ম বলে কিছু থাকে না। আর ক্রিয়মান কর্ম্মফল বলেও কিছু থাকে না। সঞ্চিত কর্ম্ম বলেও কিছু থাকে না। ভগবানের অংশ বা মহাবতারগন আমাদের মতো, কোনো প্রারব্ধ কর্ম্ম ফল নিয়ে আসেন না, আবার কোনো কর্ম্মফল নিয়েও যান না। ক্রিয়মান কর্ম্মের ফল তাঁদের এখানেই নিঃশেষিত হয়ে যায়।
মহাভারতের সেই ভীষণ যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে। যুদ্ধের আগে শ্রীকৃষ্ণ উক্ত গীতার বাণী আমরা শুনেছি। এখন অর্জুন গান্ডীব হাতে তুলে নিয়েছেন। এবার আর যুদ্ধ আরম্ভ করতে আর কোনো অসুবিধা নেই। হঠাৎ , যুধিষ্ঠির রথ থেকে নেমে বিপরীত পক্ষের সেনাপতি রথারোহী মহামতি ভীষ্মের কাছে, চললেন। এখন বিপক্ষীয় সেনাদের কাছে যুধিষ্ঠির একাকী চলেছেন, দেখে পান্ডব পক্ষের সবাই আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে উঠলো। কিন্তু যুধিষ্ঠির নির্বিগ্নে, পিতামহ ভীষ্মের পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন। বললেন, হে দুর্দ্ধর্ষ যোদ্ধা, আমি আপনার কাছে, আপনারই বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য অনুমতি নিতে এসেছি। আপনার অনুমতি ও আশীর্বাদ পেলে, আমরা যুদ্ধ শুরু করতে পারবো। মহাত্মা ভীষ্ম বললেন, যুদ্ধ করে জয় লাভ করো, এই আশীর্বাদ করি । যুধিষ্ঠির আবার বললেন হে মহাত্মণ , আপনি অপরাজেয়। আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, আমরা কিভাবে জয় লাভ করবো ? যুদ্ধে আপনার আশীর্বাদ যদি ফলপ্রসূ হয়, তবে আমরা জিতবো। আর আমরা জয়ী হলে, আপনার অপরাজেয় খ্যাতি নাশ হবে। যা একদমই কাম্য নয়। এমনকি এটি অসম্ভব ব্যাপার। গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম বললেন, আমার মৃত্যুকাল এখনো উপস্থিত হয় নি। তথাপি তোমাদেরই জয় হোক।
এখানে, দুটো ভবিষ্যৎ বাণী আছে। এক - যুদ্ধে যুধিষ্ঠিরের পক্ষ জয় লাভের আশীর্বাদ। দুই - আবার ভীষ্মের বেঁচে থাকা। আমরা পরবর্তীতে দেখেছি, যুদ্ধে ভীষ্ম শরশয্যায় আছেন, কিন্তু প্রাণ ত্যাগ করেন নি। এই অবস্থায় যুদ্ধে পাণ্ডবেরা বিজয়ী হয়েছে। তো দেখুন মহাত্মাদের কথা, মহাত্মাদের আশীর্বাদ কেমন ভবিষ্যতের ঘটনাকে প্রভাবিত করে।
এর পরে এক এক করে, যুধিষ্ঠির অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য, কুলগুরু কৃপাচার্য্য, মামা শল্য সবার কাছে যুদ্ধের অনুমতি চাইলেন, এবং আশীর্বাদ ভিক্ষা করলেন। আর সবাই যুধিষ্ঠিরকে জয়লাভের আশীর্বাদ প্রদান করেছেন ।
এইখানে একটা কথা আশীর্বাদ সম্পর্কে খুবই গুরুত্ত্বপূর্ন। সেটিহচ্ছে, যুধিষ্ঠিরের আগমন, প্রপিতামহ ভীষ্ম, কুলগুরু কৃপাচার্য্য, অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য্য ইত্যাদি মহাত্মাদের, যাঁরা পান্ডবদের বিরুদ্ধে, কৌরবদের পক্ষে অস্ত্রধারণ করে যুদ্ধ ক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েছেন, তাদের কাছে পাণ্ডব পক্ষীয় যুধিষ্ঠির আশীর্বাদ চাইছেন। আর তাঁরা সবাই যুদ্ধে জয়লাভের আশীর্বাদ করছেন। এই ঘটনা প্রতক্ষ্য ক'রে, দুর্যোধন মনে মনে ভাবছেন, আমি যখন যুদ্ধেক্ষেত্রে আগমনের প্রাক্কালে, মাতা গান্ধারীর কাছে, আশীর্বাদ চাইতে গিয়েছিলাম, তখন মাতা গান্ধারী বলেছিলেন, "ধর্ম্মের জয় হোক"। তখনও তিনি আমাকে জয়ের জন্য আশির্বাণী উচ্চারণ করেন নি। আর আজ আমারই সামনে আমারই জন্য আমারই পক্ষে সমরাঙ্গনে উপস্থিত থেকে এঁরা সবাই যুধিষ্ঠিরকে যুদ্ধজয়ের আশীর্বাদ করে চলেছেন। মন তার বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো। মহামতি ভীষ্ম, দুর্যোধনের এই মনের কথা জানতে পেরে, দুর্যোধনকে বললেন, দেখো, কেউ যদি চরণে মাথা ছোঁয়ায়, তখন আশীর্বাদ হস্ত নিজের অজ্ঞাতসারেই তার মস্তক স্পর্শ করে, এবং একটা শুভ বার্তা হৃদয় থেকেই নিঃসৃত হয়। এই হৃদয়নিঃসৃত আশীর্বানী রোখে কার সাধ্য ? যুধিষ্ঠির যদি, মামা শকুনিকেও চরণ ধরে মিনতি করতো, শকুনির মনে যাই থাকুক না কেন, তার সাধ্য ছিলো না, এই আশীর্বানী উচ্চারণ না করে মৌন থাকা। এমনকি তুমি যদি, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যুধিষ্ঠিরের পায়ে ধরে, আশীর্বাদ প্রার্থী হতে, তবে যুধিষ্ঠিরেরও সাধ্য ছিল না, তোমাকে উপেক্ষা করা। আশীর্বাদ ক্রিয়া এমনই নিয়মে বাঁধা। কারুর মস্তক যখন ঝুকে পড়ে চরণ ছুঁয়ে যায়, তখন আশীর্বাদ হস্ত আপনা-আপনি আশীর্বাদ-প্রার্থীর মস্তক স্পর্শ করে। এই আশীর্বাদ-হস্ত স্বয়ং ঈশ্বরও রুখতে পারেন না।
আমরা শুনেছি আশীর্বাদ বা অভিশাপ আর কিছুই নয়, যারা ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা, তাঁদের মুখ নিঃসৃত বাণী এগুলো। আর আমাদের মতো অর্বাচীন, ভূত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যাদের কোনো জ্ঞান নেই, তাদের আশীর্বাদবাণী বা অভিশাপ আখেরে নিজের কাছেই ফিরে আসে। অর্থাৎ আমরা যদি কারুর সম্পর্কে শুভ চিন্তন করি, অর্থাৎ অন্যের মঙ্গল চিন্তা করি, তবে সেই চিন্তাই ফল আকারে ফিরে আসে আমাদের দিকে, আমাদের মঙ্গল সাধন করে থাকে । আবার আমি যদি কারুর অমঙ্গল চিন্তা করি, তবে সেই অমঙ্গল চিন্তার ফলও আখেরে আমাকেই ভোগ করতে হয়।
এবার আমরা শুনে নেই, বাস্তবে এটি কিভাবে কাজ করে ? অভিশাপ হচ্ছে, স্বর্গীয় গরল। আর আশীর্বাদ হচ্ছে স্বর্গীয় সুধা। এই দুটোই আমাদের চিন্তার উপাদানে সৃষ্ট হয়। আমরা জেনে বা না জেনে এই গরল সৃষ্টি করে থাকি। এমনকি তথাকথিত জ্ঞানী পুরুষও অনেক সময় মূর্খতা প্রকাশ করে থাকেন। যদি আমরা মনের স্বরূপ জানতে পারতাম, তবে আমরা এই মনের সাহায্যে অনেক অমৃত সৃষ্টি করতে পারতাম। মন কি ? মন হচ্ছে এমন একটা শক্তি, যা অসংখ্য চিন্তা, অনুভূতি, কল্পনা, এবং প্রত্যয়কে ধরে রাখে। মন হচ্ছে ইচ্ছে, কর্ম্ম শক্তি, ও জ্ঞানের নিয়ামক। মন হচ্ছে একটা সূক্ষ্ম পদার্থ যা আমাদের নৈতিক শক্তি বা ব্যাক্তিত্ত্বকে ধরে রাখে। এই শক্তিই আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকে। আমাদের সমস্ত কাজকর্ম্ম এবং অর্জিত গুণরাজি হচ্ছে আমাদের মনে আবেগ, চিন্তা ও কল্পনার ফলশ্রুতি।
দেখুন কারন ভিন্ন কার্য্য হয় না। আবার এই কারন কিন্তু একটা নিয়মের শৃঙ্খল দ্বারা আবদ্ধ। এইযে বিশ্ববিধি একে উপনিষদ বলছে, ঋত। এই ঋতই বিশ্বভুবনকে শাসন করছে। ফলত এই গ্রহ, তারা, নক্ষত্র, যার যার নির্দিষ্ট পথেই বিচরণ করতে বাধ্য হচ্ছে । দিন রাত্রি হচ্ছে। এমনকি আমাদের অন্তর্জগৎ, এবং স্থুল শরীরও এই ঋত দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। আমাদের যে সুখ-দুঃখ, নিদ্রা জাগরণ, সবই নিয়ন্ত্রণ করছে এই অলিখিত বিধিলিপি বা ঋত । জীবন একটা ধারাবাহিক গল্পের বই। আর বর্তমান জীবন এই গল্পের বইয়ের একটা অধ্যায়। পরবর্তী অধ্যায় যখন শুরু হবে, তখন আগের অধ্যায়-এর সঙ্গে তা কোনো না কোনো ভাবে সম্পর্ক যুক্ত । আমাদের কারুর জীবন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আর এখানেই এর পরিসমাপ্তিও নয়। এই চক্র তখনই সমাপ্ত হবে, যখন আমরা উৎসে ফিরে যাবো ।
আশীর্বাদ বা অভিশাপ তিনটি উৎস থেকে উৎসারিত হয়।
প্রথম হচ্ছে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের দেওয়া আশীর্বাদ বা অভিশাপ। অর্থাৎ শুভ প্রার্থনা বা অশুভ প্রার্থনা। এই প্রার্থনা আখেরে প্রার্থনাকারীর দিকেই ভবিষ্যতে ফিরে আসে অধিক শক্তি নিয়ে । তাই আমাদের মতো সাধারণ মানুষের সব সময় শুভ প্রার্থনার রচনা করা উচিত।
দ্বিতীয় হচ্ছে, মহাপুরুষদের দেওয়া আশীর্বাদ বা অভিশাপ। এটি আসলে কেবল ভবিষ্যৎবাণী মাত্র। এর মধ্যে কোনো শুভ বা অশুভ যোগ নেই। এটি আমরা কর্ম্মের দ্বারা পরিবর্তন করে নিতে পারি।
আর সব শেষে হচ্ছে ভগবানের আশীর্বাদ/অভিশাপ বলে আমরা যাকে ভাবি, যাকে ভাগ্য বলে ভাবি, যাকে আমরা দৈব বলে ভাবি, তা আসলে আমাদের পূর্ব-পূর্ব জীবনের প্রারব্ধ কর্ম্মফল। যার পরিবর্তন সম্ভব নয়। যার কোনো কার্য্য-কারন আমরা খুঁজে আপাত দৃষ্টিতে খুঁজে পাওয়া যায় না । তো আশীর্বাদ/বা অভিশাপ আসলে আমাদেরই পূর্বকর্ম্ম জাত ভবিষ্যতের ঘটনা, যা অবশ্যম্ভাবী। যার কারণবীজ এরমধ্যেই জন্ম নিয়েছে তারই পূর্বাভাষ।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
No comments:
Post a Comment