"ওম্" ও ছান্দোগ্য উপনিষদ
"ওম্" ও ছান্দোগ্য উপনিষদ CHANDOGYA UPANISHAD & OM
ওঁ আপ্যায়ন্তু মম অঙ্গানি বাক্ প্রাণ চক্ষু শ্রোত্রম অথঃ
বলম ইন্দ্রিয়ানি চ সর্বানি। সর্বং ব্রহ্ম উপনিষদম। মা অহং
ব্রহ্ম নিরাকুর্যাং, মা মা ব্রহ্ম নিরাকরোৎ ;
অনিরাকরম অস্তু, অনিরাকরনং মে অস্তু। তদ্ আত্মনি নিরতে
য উপনিষদসু ধর্মাস্তে ময়ি সন্তু, তে ময়ি সন্তু। ।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ।।
আপ্যায়ন্তু - পুষ্টি লাভ করুক
মম অঙ্গানি - আমার অঙ্গ সমূহ
বাক্ প্রাণ চক্ষু শ্রোত্রম অথঃ বলম - বাকশক্তি, প্রাণবায়ু, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি এবং বলশক্তি
ইন্দ্রিয়ানি চ সর্বানি। - এবং সব ইন্দ্রিয়
সর্বং ব্রহ্ম উপনিষদম। উপনিষদ বলছে সবই ব্রহ্ম,
মা অহং ব্রহ্ম নিরাকুর্যাং, - আমি যেন না উদাসীন হই ব্রহ্ম কথা শুনতে
মা মা ব্রহ্ম নিরাকরোৎ ; - ব্রহ্ম যেন আমাকে কখনো সরিয়ে না নেন।
অনিরাকরম অস্তু, - আমি যেন তার কাছ থেকে সরে না আসি।
অনিরাকরনং মে অস্তু। - তিনিও যেন তার কাছ থেকে আমাকে সরিয়ে না দেন।
তদ্ আত্মনি নিরতে য উপনিষদসু ধর্মাস্তে ময়ি সন্তু, : উপনিষদে যে সব ধর্ম আছে তার অর্থাৎ আত্মজ্ঞান লাভের সাধনায় রত আমি
তে ময়ি সন্তু। । - সেগুলো যেন আমার আয়ত্ত্বে আসে।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ।। - আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক শান্তি হোক।
অর্থাৎ - আমার সমস্ত অঙ্গ যেন পুষ্ট হয়। আমার প্রাণবায়ু, বাকশক্তি, দৃষ্টি শক্তি,শ্রবণশক্তি ও অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলো যেন শক্তিশালী হয়। সব উপনিষদ ব্রহ্ম কথা বলে। আমি যেন কখনো ব্রহ্ম কথা শুনতে উদাসীন না হই। ব্রহ্মও যেন কখনো আমাকে সরিয়ে না দেন। আমি তার কাছ থেকে সরে আসবো না।
তিনিও যেন আমাকে সরিয়ে না দেন। আমি যেন সরে না আসি। উপনিষদের যে সব ধর্মকথা আছে, সেই শিক্ষা লাভে আমি রত আছি। আমার যেন সেগুলো আয়ত্ত্বে আসে।
-আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক শান্তি হোক।
ছান্দোগ্য : ছান্দোগ্য উপনিষদ আসলে সাম-বেদের অংশ। সামবেদ আবার বিভিন্ন বেদের ছন্দোবদ্ধ গান। এই বইয়ের প্রথমে সাকার উপাসনা সম্পর্কে বলা হয়েছে। যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় তার সম্পর্কে ধারণা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বাক্য-মনের অতীত যে ব্রহ্ম তাকে আমাদের পক্ষে ধারণা করা সম্ভব নয় । ঈশ্বর নিরাকার, এগুলো আমাদের শোনা কথা। উপল্বদ্ধির বিষয় নয়। এছাড়া, নানারকম বাসনা আমাদেরকে তারা করে নিয়ে বেড়ায়। এই সমস্ত বাসনা পূরণ হলে আমরা খুশি হই। এইসব যারা অস্বীকার করেন, তারা আত্মপ্রবঞ্চনা করছেন। আমরা সকাম উপাসনার মাধ্যমে আমাদের অপূর্ন বাসনা পূরণের সুযোগ পাই। সেই জন্য উপনিষদ বলছে, শাস্ত্রবিহিত, সকাম উপাসনা করলে আমরা আমাদের মন, শরীর ভালো রাখতে পারি। ধন দৌলত লাভ করতে পারি, মান সন্মান প্রতিপত্তি ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারি। এমনকি আমরা স্বর্গলাভও করতে পারি। কিন্তু এগুলো সব অনিত্য। কেউ যদি শাশ্বত শান্তি বা আনন্দ পেতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই মুক্তি লাভ করতে হবে। মুক্তি পেতে গেলে আত্মজ্ঞান লাভ করতে হবে। এই আত্মজ্ঞানই ব্রহ্মজ্ঞান। স্থায়ী শান্তি বা আনন্দ পেতে গেলে আমাদের আত্মজ্ঞান বা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে হবে।
আত্মজ্ঞান লাভের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে উদ্গীথ অর্থাৎ ওম-কে আবৃত্তি করতে বলা হয়েছে। মনকে বসে আনার এটি একটি উপায়। ছান্দোগ্য উপনিষদের প্রথম পাঁচটি অধ্যায়ে এই উদ্গীথ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। আমরা সেই কথা শুনবো।
১.১.১ ওম ইতি এতৎ অক্ষরম উদ্গীথম উপাসীত ওম ইতি হি উদ্গায়তি তস্য উপ ব্যাখ্যানম। ।
ওম ইতি - এই ওম
এতৎ অক্ষরম - এই অক্ষরকে
উদ্গীথম উপাসীত -উদ্গীথ রূপে উপাসনা করবে।
ওম ইতি - এই ওম
হি উদ্গায়তি -কিভাবে গাইবে
তস্য উপ ব্যাখ্যানম। । - তার ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।
উদ্গীথ কথাটার আভিধানিক অর্থ সামবেদের ধ্বনি, সামগান বা প্রণব। কেউ কেউ বলেন, যা থেকে সমস্ত উদ্গত হয়েছে, সেই কারণের কারণ হচ্ছেন উদ্গীথ। সেই পরম ব্রহ্ম। যার তরঙ্গধ্বনিকে অক্ষরে প্রকাশ করা হয়েছে "ওম" এই শব্দ। তাই ওম-ই ব্রহ্ম। যখন কেউ ওম এই শব্দটি উচ্চারণ করেন, তখন তিনি আসলে ব্রহ্মের উপাসনা করছেন বুঝতে হবে। এই আবৃত্তিই উদ্গীথ। এই আবৃত্তি সাধারণতঃ উচ্চস্বরে করা হয়ে থাকে। ওম-এর উপাসনা দ্বারাই ধীরে ধীরে, আমাদের মনের মলিনতা দূর হয়। আমাদের চিত্তশুদ্ধি হয়। আর একটা কথা উদ্গীত মানে উচ্চকন্ঠে গীত। তাই উদ্গীথ সবসময়েই উদাত্তস্বরে গীত হয়।
১.১.২. এষাং ভূতানাং পৃথিবী রসঃ। অপাম ঔষধয়ঃ রস, ঔষধীনাং পুরুষ রসঃ, পুরুষস্য বাগ্ রসো, বাচ ঋগ রস, ঋ চ স্যাম রসঃ, সাম্ন উদ্গীথো রসঃ।
এষাং ভূতানাং পৃথিবী রসঃ। - এই ভূত সকলের রস অর্থাৎ সার বা আশ্রয়স্থল হচ্ছে প্রথিবী।
অপাম ঔষধয়ঃ রস, - অপাম, অপ অর্থাৎ জলের সার উদ্ভিদ।
ঔষধীনাং পুরুষ রসঃ, - ঔষধীনাং অর্থাৎ উদ্ভিতের সার হচ্ছে পুরুষ বা মানুষ।
পুরুষস্য বাগ্ রসো, - পুরুষস্য অর্থাৎ পুরুষের বা মানুষের বাক বা বাকশক্তি।
বাচ ঋগ রস, - - অর্থাৎ বাকের সার ঋক্বেদ।
ঋ চ স্যাম রসঃ, - আবার ঋক্বেদের সার হচ্ছে সামবেদ।
সাম্ন উদ্গীথো রসঃ। সামবেদের সার হচ্ছে উদ্গীথ।
তাহলে আমরা বুঝলাম, পৃথিবী হলো চরাচর সমস্ত ভূতের সার। আর জল হচ্ছে পৃথিবীর সার। উদ্ভিদ হচ্ছে জলের সার। মানুষ উদ্ভিদের সার। মানুষের সার হচ্ছে বাক। বাকের সার হচ্ছে ঋক্বেদ। আবার ঋক্বেদের সার হচ্ছে সামবেদ। সামবেদের সার হচ্ছে উদ্গীথ বা প্রণব মন্ত্র অর্থাৎ "ওম"।
পৃথিবীতে আমরা দুই ধরনের পদার্থ দেখতে পাই। চেতন ও অচেতন। এদের আশ্রয় কি ? বা কাদের আশ্রয়ে এরা আছে ? এরা সবাই পৃথিবীকে আশ্রয় করে আছে। পৃথিবী কার আশ্রয়ে আছে ? পৃথিবী জলের আশ্রয়ে আছে। জলের উপরেই পৃথিবী ভাসছে। এই জল থেকেই উদ্ভিদের জন্ম। তাহলে জল হচ্ছে উদ্ভিদের আশ্রয়। আবার মানুষ হচ্ছে উদ্ভিদের সার। কারন মানুষ উদ্ভিদজাত খাবার খেয়ে বেঁচে থাকে। আবার মানব দেহের শ্রেষ্ট অংশ হচ্ছে বাগ-ইন্দ্রিয়। তাই বাগ হচ্ছে মানবদেহের সার। এবার বাকের মধ্যে শ্রেষ্ট হচ্ছে ঋকবেদ। আর ঋক্বেদের সার হচ্ছে সামবেদ। সাম-বেদের সার হচ্ছে ওঙ্কার।
১.১.৩. স এষ রসানাং রসতমঃ পরমঃ পরার্ধ্যো অষ্টমো যৎ উদ্গীথঃ
স এষ রসানাং রসতমঃ - সেই এই রসের মধ্যে শ্রেষ্ট রস অর্থাৎ সার।
পরমঃ পরার্ধ্যো অষ্টমো - সর্বশ্রেষ্ঠ পরম স্থান অষ্টম। অষ্টম (অর্থাৎ ১. পৃথিবী, ২. জল, ৩. উদ্ভিদ, ৪.মানুষ, ৫.বাক্, ৬. ঋক্বেদ, ৭. সামবেদ, ৮. উদ্গীথ ) .
যৎ উদ্গীথঃ -যা উদ্গীথ বা ওম।
সমস্ত অষ্ট রসের মধ্যে উদ্গীথ বা ওম হলো পরম রস। অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ রস। এই শ্রেষ্ঠ রস ব্রহ্মের এক ও অভিন্ন।
১.১.৪. কতমা কতমর্ক্ কতমৎ সাম কতমঃ কতম উদ্গীথ ইতি বিমুষ্টং ভবতি।
কতমা কতমর্ক্ - কোনটা কোনটা ঋক ?
কতমৎ সাম কতমঃ - কোনটা কোনটা সাম ?
কতম উদ্গীথ ইতি বিমুষ্টং ভবতি। - কোনটা উদ্গীথ ? এই হলো প্রশ্ন।
কোনটা ঋক ? কোনটাই বা সাম, আর উদ্গীথই বা কি ?
আমরা জানি, ঋক কথাটার মানে হচ্ছে স্তূতি। ভগবানের স্তূতি। ঋকবেদের সমস্ত শ্লোককেই বলা হয় ঋক। এই ঋক বেদ থেকে কিছু স্তোত্র যেগুলো সুর করে গাওয়া হয়, সেগুলো আলাদা করে সাম বেদের মধ্যে ঢোকানো হয়েছে। এই সামবেদে যত গান আছে, তার মূল সুর হচ্ছে উদ্গীথ। উদ্গীথ হচ্ছে - উচ্চস্বরে যা গাওয়া হয়।
১.১.৫. বাগেব ঋক্ প্রাণঃ সাম-ওম-ইতি-এতৎ-অক্ষরম-উদ্গীথঃ।
তদ্বা এতৎ-মিথুনং যদ্-বাক চ প্রানশ্চ ঋক চ সাম চ। ।
বাগেব ঋক্ - বাক এব ঋক অর্থাৎ বাক্যই ঋক
প্রাণঃ সাম- প্রাণই সাম অর্থাৎ প্রাণ শক্তি হলো সাম। কারন প্রাণশক্তির সাহায্যে (অর্থাৎ বাতাসের সাহায্যে ) সামগান করা হয়।
ওম-ইতি-এতৎ-অক্ষরম-উদ্গীথঃ। - ওম এই শব্দটি উদ্গীথ।
তদ্বা - তৎ বৈ অর্থাৎ তা-ই
এতৎ-মিথুনং - এই যুগল বস্তূ - মিথুন কথাটার মানে হচ্ছে মিলনজনিত সংঘর্ষ। এই বাতাস বা প্রাণের সাথে বাকের সংঘর্ষে ওম এর উৎপত্তি।
যদ্-বাক চ প্রানশ্চ - যা বাক ও প্রাণের মিলন
ঋক চ সাম চ। । - যা ঋক ও সামের মিলন।
আগের শ্লোকে প্রশ্ন ছিল ঋক কি, সাম কি, এবং উদ্গীথ কি ? এর উত্তরে এখন বলছেন - বাক্যই হলো ঋক, প্রাণ হলো সাম, এবং উদ্গীথ হলো ওম। বাক ও প্রাণের মিলনে আবার ঋক ও সামের মিলনে এই ওম এবং ইনি ব্রহ্ম। অর্থাৎ স্থূল জগতের ক্রমবিকাশের সর্বোচ্চ হল ওম। সবকিছুর শেষ কথা হল ওম। সবকিছুর অন্তরাত্মা হল ওম। "ওম"-ই হলো পরম-আত্মা।
১.১.৬. তৎ এতৎ মিথুনম ওম ইতি এতস্মিন অক্ষরে সংসৃজ্যতে যদা বৈ মিথুনৌ
সমাগচ্ছত আপয়তো বৈ তাবন্যোন্যস্য কামম্ ।।
তৎ এতৎ মিথুনম - সেই এই মিলন অর্থাৎ বাক ও প্রাণের মিলন
ওম ইতি এতস্মিন অক্ষরে সংসৃজ্যতে - ওম্ এই অক্ষরের সৃষ্টি করে
যদা বৈ - অর্থাৎ যখনই
মিথুনৌ সমাগচ্ছত - পরস্পর মিলিত হয়
আপয়তো বৈ তাবন্যোন্যস্য (তৌ+অন্যোন্যস্য) কামম্ - তারা একে অন্যের কামনা পূর্ন করে।
অর্থাৎ বাক ও প্রাণের মিলনেই ওম্ এই শব্দ ব্রহ্মের সৃষ্টি হয়। এবং পরস্পরের অর্থাৎ বাক ও প্রাণ তাঁদের পরস্পরের কামনা পূর্ন করে। বাক ও প্রাণ মিলিত হয়ে পরস্পরের ওম সৃষ্টির যে আকাঙ্খা তা পূরণ করে।
১.১.৭.আপয়িতা হ বৈ কামানাং ভবতি য এতদেবং বিদ্বান অক্ষরম উদ্গীথম উপান্তে।
আপয়িতা : অর্থাৎ প্রাপক অর্থাৎ জিনিলাভ করেন।
হ বৈ কামানাং : যা কামনা করেন।
ভবতি য : হন যিনি।
এতদেবং : এতৎ এবম - এঁকে এইভাবে
বিদ্বান : জেনে
অক্ষরম : ওম এই অক্ষরকে
উদ্গীথম : উদ্গীথ রূপে অর্থাৎ ব্রহ্ম রূপে।
উপান্তে : উপাসনা করেন।
ওম-ই সব কিছুর আশ্রয়। এইভাবে যিনি ওমকে ব্রহ্ম বা উদ্গীথরূপে উপাসনা করেন, তিনি যা পেতে চান, তিনি তাই পান। অর্থাৎ ওমকে আপনি যেভাবে উপাসনা করবেন, অর্থাৎ ওম-এর মধ্যে সব কিছু আছে, তাই আপনি ওমকে যা ভেবে উপাসনা করবেন, আপনি তাই পাবেন। ওম-ই সব কিছুর আশ্রয়স্থল। আপনার ভাবনা ওম-এর উপাসনার মাধ্যমে প্রকাশিত হবে। আপনি তাই হয়ে যাবেন। আপনি যদি ওম-কে ব্রহ্ম ভেবে উপাসনা করেন, তবে আপনি স্বয়ং ব্রহ্ম সেই জ্ঞান আপনার হবে।
অর্থাৎ - আমার সমস্ত অঙ্গ যেন পুষ্ট হয়। আমার প্রাণবায়ু, বাকশক্তি, দৃষ্টি শক্তি,শ্রবণশক্তি ও অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলো যেন শক্তিশালী হয়। সব উপনিষদ ব্রহ্ম কথা বলে। আমি যেন কখনো ব্রহ্ম কথা শুনতে উদাসীন না হই। ব্রহ্মও যেন কখনো আমাকে সরিয়ে না দেন। আমি তার কাছ থেকে সরে আসবো না।
তিনিও যেন আমাকে সরিয়ে না দেন। আমি যেন সরে না আসি। উপনিষদের যে সব ধর্মকথা আছে, সেই শিক্ষা লাভে আমি রত আছি। আমার যেন সেগুলো আয়ত্ত্বে আসে।
-আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক শান্তি হোক।
ছান্দোগ্য : ছান্দোগ্য উপনিষদ আসলে সাম-বেদের অংশ। সামবেদ আবার বিভিন্ন বেদের ছন্দোবদ্ধ গান। এই বইয়ের প্রথমে সাকার উপাসনা সম্পর্কে বলা হয়েছে। যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় তার সম্পর্কে ধারণা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বাক্য-মনের অতীত যে ব্রহ্ম তাকে আমাদের পক্ষে ধারণা করা সম্ভব নয় । ঈশ্বর নিরাকার, এগুলো আমাদের শোনা কথা। উপল্বদ্ধির বিষয় নয়। এছাড়া, নানারকম বাসনা আমাদেরকে তারা করে নিয়ে বেড়ায়। এই সমস্ত বাসনা পূরণ হলে আমরা খুশি হই। এইসব যারা অস্বীকার করেন, তারা আত্মপ্রবঞ্চনা করছেন। আমরা সকাম উপাসনার মাধ্যমে আমাদের অপূর্ন বাসনা পূরণের সুযোগ পাই। সেই জন্য উপনিষদ বলছে, শাস্ত্রবিহিত, সকাম উপাসনা করলে আমরা আমাদের মন, শরীর ভালো রাখতে পারি। ধন দৌলত লাভ করতে পারি, মান সন্মান প্রতিপত্তি ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারি। এমনকি আমরা স্বর্গলাভও করতে পারি। কিন্তু এগুলো সব অনিত্য। কেউ যদি শাশ্বত শান্তি বা আনন্দ পেতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই মুক্তি লাভ করতে হবে। মুক্তি পেতে গেলে আত্মজ্ঞান লাভ করতে হবে। এই আত্মজ্ঞানই ব্রহ্মজ্ঞান। স্থায়ী শান্তি বা আনন্দ পেতে গেলে আমাদের আত্মজ্ঞান বা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে হবে।
আত্মজ্ঞান লাভের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে উদ্গীথ অর্থাৎ ওম-কে আবৃত্তি করতে বলা হয়েছে। মনকে বসে আনার এটি একটি উপায়। ছান্দোগ্য উপনিষদের প্রথম পাঁচটি অধ্যায়ে এই উদ্গীথ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। আমরা সেই কথা শুনবো।
১.১.১ ওম ইতি এতৎ অক্ষরম উদ্গীথম উপাসীত ওম ইতি হি উদ্গায়তি তস্য উপ ব্যাখ্যানম। ।
ওম ইতি - এই ওম
এতৎ অক্ষরম - এই অক্ষরকে
উদ্গীথম উপাসীত -উদ্গীথ রূপে উপাসনা করবে।
ওম ইতি - এই ওম
হি উদ্গায়তি -কিভাবে গাইবে
তস্য উপ ব্যাখ্যানম। । - তার ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।
উদ্গীথ কথাটার আভিধানিক অর্থ সামবেদের ধ্বনি, সামগান বা প্রণব। কেউ কেউ বলেন, যা থেকে সমস্ত উদ্গত হয়েছে, সেই কারণের কারণ হচ্ছেন উদ্গীথ। সেই পরম ব্রহ্ম। যার তরঙ্গধ্বনিকে অক্ষরে প্রকাশ করা হয়েছে "ওম" এই শব্দ। তাই ওম-ই ব্রহ্ম। যখন কেউ ওম এই শব্দটি উচ্চারণ করেন, তখন তিনি আসলে ব্রহ্মের উপাসনা করছেন বুঝতে হবে। এই আবৃত্তিই উদ্গীথ। এই আবৃত্তি সাধারণতঃ উচ্চস্বরে করা হয়ে থাকে। ওম-এর উপাসনা দ্বারাই ধীরে ধীরে, আমাদের মনের মলিনতা দূর হয়। আমাদের চিত্তশুদ্ধি হয়। আর একটা কথা উদ্গীত মানে উচ্চকন্ঠে গীত। তাই উদ্গীথ সবসময়েই উদাত্তস্বরে গীত হয়।
১.১.২. এষাং ভূতানাং পৃথিবী রসঃ। অপাম ঔষধয়ঃ রস, ঔষধীনাং পুরুষ রসঃ, পুরুষস্য বাগ্ রসো, বাচ ঋগ রস, ঋ চ স্যাম রসঃ, সাম্ন উদ্গীথো রসঃ।
এষাং ভূতানাং পৃথিবী রসঃ। - এই ভূত সকলের রস অর্থাৎ সার বা আশ্রয়স্থল হচ্ছে প্রথিবী।
অপাম ঔষধয়ঃ রস, - অপাম, অপ অর্থাৎ জলের সার উদ্ভিদ।
ঔষধীনাং পুরুষ রসঃ, - ঔষধীনাং অর্থাৎ উদ্ভিতের সার হচ্ছে পুরুষ বা মানুষ।
পুরুষস্য বাগ্ রসো, - পুরুষস্য অর্থাৎ পুরুষের বা মানুষের বাক বা বাকশক্তি।
বাচ ঋগ রস, - - অর্থাৎ বাকের সার ঋক্বেদ।
ঋ চ স্যাম রসঃ, - আবার ঋক্বেদের সার হচ্ছে সামবেদ।
সাম্ন উদ্গীথো রসঃ। সামবেদের সার হচ্ছে উদ্গীথ।
তাহলে আমরা বুঝলাম, পৃথিবী হলো চরাচর সমস্ত ভূতের সার। আর জল হচ্ছে পৃথিবীর সার। উদ্ভিদ হচ্ছে জলের সার। মানুষ উদ্ভিদের সার। মানুষের সার হচ্ছে বাক। বাকের সার হচ্ছে ঋক্বেদ। আবার ঋক্বেদের সার হচ্ছে সামবেদ। সামবেদের সার হচ্ছে উদ্গীথ বা প্রণব মন্ত্র অর্থাৎ "ওম"।
পৃথিবীতে আমরা দুই ধরনের পদার্থ দেখতে পাই। চেতন ও অচেতন। এদের আশ্রয় কি ? বা কাদের আশ্রয়ে এরা আছে ? এরা সবাই পৃথিবীকে আশ্রয় করে আছে। পৃথিবী কার আশ্রয়ে আছে ? পৃথিবী জলের আশ্রয়ে আছে। জলের উপরেই পৃথিবী ভাসছে। এই জল থেকেই উদ্ভিদের জন্ম। তাহলে জল হচ্ছে উদ্ভিদের আশ্রয়। আবার মানুষ হচ্ছে উদ্ভিদের সার। কারন মানুষ উদ্ভিদজাত খাবার খেয়ে বেঁচে থাকে। আবার মানব দেহের শ্রেষ্ট অংশ হচ্ছে বাগ-ইন্দ্রিয়। তাই বাগ হচ্ছে মানবদেহের সার। এবার বাকের মধ্যে শ্রেষ্ট হচ্ছে ঋকবেদ। আর ঋক্বেদের সার হচ্ছে সামবেদ। সাম-বেদের সার হচ্ছে ওঙ্কার।
১.১.৩. স এষ রসানাং রসতমঃ পরমঃ পরার্ধ্যো অষ্টমো যৎ উদ্গীথঃ
স এষ রসানাং রসতমঃ - সেই এই রসের মধ্যে শ্রেষ্ট রস অর্থাৎ সার।
পরমঃ পরার্ধ্যো অষ্টমো - সর্বশ্রেষ্ঠ পরম স্থান অষ্টম। অষ্টম (অর্থাৎ ১. পৃথিবী, ২. জল, ৩. উদ্ভিদ, ৪.মানুষ, ৫.বাক্, ৬. ঋক্বেদ, ৭. সামবেদ, ৮. উদ্গীথ ) .
যৎ উদ্গীথঃ -যা উদ্গীথ বা ওম।
সমস্ত অষ্ট রসের মধ্যে উদ্গীথ বা ওম হলো পরম রস। অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ রস। এই শ্রেষ্ঠ রস ব্রহ্মের এক ও অভিন্ন।
১.১.৪. কতমা কতমর্ক্ কতমৎ সাম কতমঃ কতম উদ্গীথ ইতি বিমুষ্টং ভবতি।
কতমা কতমর্ক্ - কোনটা কোনটা ঋক ?
কতমৎ সাম কতমঃ - কোনটা কোনটা সাম ?
কতম উদ্গীথ ইতি বিমুষ্টং ভবতি। - কোনটা উদ্গীথ ? এই হলো প্রশ্ন।
কোনটা ঋক ? কোনটাই বা সাম, আর উদ্গীথই বা কি ?
আমরা জানি, ঋক কথাটার মানে হচ্ছে স্তূতি। ভগবানের স্তূতি। ঋকবেদের সমস্ত শ্লোককেই বলা হয় ঋক। এই ঋক বেদ থেকে কিছু স্তোত্র যেগুলো সুর করে গাওয়া হয়, সেগুলো আলাদা করে সাম বেদের মধ্যে ঢোকানো হয়েছে। এই সামবেদে যত গান আছে, তার মূল সুর হচ্ছে উদ্গীথ। উদ্গীথ হচ্ছে - উচ্চস্বরে যা গাওয়া হয়।
১.১.৫. বাগেব ঋক্ প্রাণঃ সাম-ওম-ইতি-এতৎ-অক্ষরম-উদ্গীথঃ।
তদ্বা এতৎ-মিথুনং যদ্-বাক চ প্রানশ্চ ঋক চ সাম চ। ।
বাগেব ঋক্ - বাক এব ঋক অর্থাৎ বাক্যই ঋক
প্রাণঃ সাম- প্রাণই সাম অর্থাৎ প্রাণ শক্তি হলো সাম। কারন প্রাণশক্তির সাহায্যে (অর্থাৎ বাতাসের সাহায্যে ) সামগান করা হয়।
ওম-ইতি-এতৎ-অক্ষরম-উদ্গীথঃ। - ওম এই শব্দটি উদ্গীথ।
তদ্বা - তৎ বৈ অর্থাৎ তা-ই
এতৎ-মিথুনং - এই যুগল বস্তূ - মিথুন কথাটার মানে হচ্ছে মিলনজনিত সংঘর্ষ। এই বাতাস বা প্রাণের সাথে বাকের সংঘর্ষে ওম এর উৎপত্তি।
যদ্-বাক চ প্রানশ্চ - যা বাক ও প্রাণের মিলন
ঋক চ সাম চ। । - যা ঋক ও সামের মিলন।
আগের শ্লোকে প্রশ্ন ছিল ঋক কি, সাম কি, এবং উদ্গীথ কি ? এর উত্তরে এখন বলছেন - বাক্যই হলো ঋক, প্রাণ হলো সাম, এবং উদ্গীথ হলো ওম। বাক ও প্রাণের মিলনে আবার ঋক ও সামের মিলনে এই ওম এবং ইনি ব্রহ্ম। অর্থাৎ স্থূল জগতের ক্রমবিকাশের সর্বোচ্চ হল ওম। সবকিছুর শেষ কথা হল ওম। সবকিছুর অন্তরাত্মা হল ওম। "ওম"-ই হলো পরম-আত্মা।
১.১.৬. তৎ এতৎ মিথুনম ওম ইতি এতস্মিন অক্ষরে সংসৃজ্যতে যদা বৈ মিথুনৌ
সমাগচ্ছত আপয়তো বৈ তাবন্যোন্যস্য কামম্ ।।
তৎ এতৎ মিথুনম - সেই এই মিলন অর্থাৎ বাক ও প্রাণের মিলন
ওম ইতি এতস্মিন অক্ষরে সংসৃজ্যতে - ওম্ এই অক্ষরের সৃষ্টি করে
যদা বৈ - অর্থাৎ যখনই
মিথুনৌ সমাগচ্ছত - পরস্পর মিলিত হয়
আপয়তো বৈ তাবন্যোন্যস্য (তৌ+অন্যোন্যস্য) কামম্ - তারা একে অন্যের কামনা পূর্ন করে।
অর্থাৎ বাক ও প্রাণের মিলনেই ওম্ এই শব্দ ব্রহ্মের সৃষ্টি হয়। এবং পরস্পরের অর্থাৎ বাক ও প্রাণ তাঁদের পরস্পরের কামনা পূর্ন করে। বাক ও প্রাণ মিলিত হয়ে পরস্পরের ওম সৃষ্টির যে আকাঙ্খা তা পূরণ করে।
১.১.৭.আপয়িতা হ বৈ কামানাং ভবতি য এতদেবং বিদ্বান অক্ষরম উদ্গীথম উপান্তে।
আপয়িতা : অর্থাৎ প্রাপক অর্থাৎ জিনিলাভ করেন।
হ বৈ কামানাং : যা কামনা করেন।
ভবতি য : হন যিনি।
এতদেবং : এতৎ এবম - এঁকে এইভাবে
বিদ্বান : জেনে
অক্ষরম : ওম এই অক্ষরকে
উদ্গীথম : উদ্গীথ রূপে অর্থাৎ ব্রহ্ম রূপে।
উপান্তে : উপাসনা করেন।
ওম-ই সব কিছুর আশ্রয়। এইভাবে যিনি ওমকে ব্রহ্ম বা উদ্গীথরূপে উপাসনা করেন, তিনি যা পেতে চান, তিনি তাই পান। অর্থাৎ ওমকে আপনি যেভাবে উপাসনা করবেন, অর্থাৎ ওম-এর মধ্যে সব কিছু আছে, তাই আপনি ওমকে যা ভেবে উপাসনা করবেন, আপনি তাই পাবেন। ওম-ই সব কিছুর আশ্রয়স্থল। আপনার ভাবনা ওম-এর উপাসনার মাধ্যমে প্রকাশিত হবে। আপনি তাই হয়ে যাবেন। আপনি যদি ওম-কে ব্রহ্ম ভেবে উপাসনা করেন, তবে আপনি স্বয়ং ব্রহ্ম সেই জ্ঞান আপনার হবে।
শ্লোক নং - ১.১.৮
এই ওং অক্ষরটি সম্মতি সূচক। আমরা যখন কারুর কথায়, বা কোনো বিষয়ে সায় দিতে চাই, তবে এই ওং ধ্বনি উচ্চারণ করে থাকি। "ওম আমাদের উন্নতির কারন, ওম আমাদের সকল ইচ্ছে পূরণ করেন " এই বিশ্বাস যার আছেন, ওম-কে যিনি এইভাবেই উপাস্য করেন, ওমকে যিনি এইভাবেই জানেন, তাঁর সমস্ত ইচ্ছেই ওম-এর উপাসনার দ্বারা পূরণ হয়। আসলে ওমকে যিনি আশ্রয় করেন, ওম তাকেই আশ্রয় দেয়।
শ্লোক : ১.১.৯
হিন্দুদের মধ্যে যারা শাস্ত্র বিহিত কর্ম্ম অর্থাৎ যাগ-যজ্ঞ করেন, তারা ওম উচ্চারণ করেই শুরু করেন, আবার ওম উচ্চারণ করেই শেষ করেন। যখন যজ্ঞের মন্ত্র পাঠ করা হয়, বা কোনো প্রার্থরনা মন্ত্র বা শান্তি মন্ত্র পাঠ করা হয়, তখন আমরা ওম এই ধ্বনি দিয়েই শুরু করে থাকি। ওম সমস্ত উৎপত্তির কারন। তাই আমরা যে অন্ন খেয়ে বেঁচে থাকি, তার উৎপত্তির কারণও ওম। অর্থাৎ সমস্ত রসের কারন এই ওম। সমুদ্র যখন বাতাসের সাহায্যে ঢেউ তুলছে, তখন এই ওম ধ্বনি শুনতে পাই। আমরা জানি বায়ু ও অগ্নির মিথুনে এই ধ্বনির উৎপত্তি। তাই সূর্য যখন উদয় হচ্ছে, সূর্য যখন অসৎ যাচ্ছে, চাঁদ যখন উদয় হচ্ছে, নক্ষত্রের যখন জন্ম হচ্ছে, তখন এই ওঙ্কারের গুনগান করতে করতে জন্ম নিচ্ছে, আবার এই ওঙ্কারের গুনগান করতে করতেই অস্তগামী হচ্ছে। তাই আমাদের জন্ম কর্ম্ম মৃত্যু সবই ওঙ্কার জাত।
শ্লোক ১.১.১০
ওঙ্কারের মহিমা কেউ জানুক না জানুক, আমাদের সবার কর্ম্মক্ষমতা এই ওঙ্কার থেকেই আসে। যে জানে তার কর্ম্ম ক্ষমতা যেমন ওঙ্কার থেকে আসে, তেমনি যে জানেনা তার কর্ম্মক্ষমতাও এই ওঙ্কার থেকেই আসে। এখন কথা হচ্ছে, এই জানা বা না জানার মধ্যে পার্থক্য কি ? দেখুন ওঙ্কারকে জেনে, অর্থাৎ গুরুবাক্যে শ্রদ্ধাবান হয়ে, শাস্ত্রবিধি মেনে যখন আপনি কর্ম্ম করবেন, তখন আপনার সমস্ত কর্ম্ম-ই যোগে পরিণত হবে। আর এই যোগকর্ম্ম অধিকতর ফলপ্রসূ হয়। এই হলো ওঙ্কারের যথার্থ ব্যাখ্যা।
এবার আমরা সংক্ষেপে আলোচ্য বিষয়টিকে আরো একবার শুনে নেবো।
-----------
ছান্দোগ্য উপনিষদ - প্রথম অধ্যায়, প্রথম খন্ড : ওঙ্কারের মাহাত্ম্য - GLORY OF ONGKAR
ছান্দোগ্য উপনিষদ আসলে সাম-বেদের অংশ। সামবেদ আবার বিভিন্ন বেদের ছন্দোবদ্ধ গান। এই বইয়ের প্রথমে সাকার উপাসনা সম্পর্কে বলা হয়েছে। আসলে যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় তার সম্পর্কে ধারণা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বাক্য-মনের অতীত যে ব্রহ্ম তাকে আমাদের পক্ষে ধারণা করা সম্ভব নয় । ঈশ্বর নিরাকার, এগুলো আমাদের শোনা কথা। উপল্বদ্ধির বিষয় নয়। এছাড়া, নানারকম বাসনা আমাদেরকে তারা করে নিয়ে বেড়ায়। এই সমস্ত বাসনা পূরণ হলে আমরা খুশি হই। এইসব যারা অস্বীকার করেন, তারা আত্মপ্রবঞ্চনা করছেন। আমরা সকাম উপাসনার মাধ্যমে আমাদের অপূর্ন বাসনা পূরণের সুযোগ পাই। সেই জন্য উপনিষদ বলছে, শাস্ত্রবিহিত, সকাম উপাসনা করলে আমরা আমাদের মন, শরীর ভালো রাখতে পারি। ধন দৌলত লাভ করতে পারি, মান সন্মান প্রতিপত্তি ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারি। এমনকি আমরা স্বর্গলাভও করতে পারি। কিন্তু এগুলো সব অনিত্য। কেউ যদি শাশ্বত শান্তি বা আনন্দ পেতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই মুক্তি লাভ করতে হবে। মুক্তি পেতে গেলে আত্মজ্ঞান লাভ করতে হবে। এই আত্মজ্ঞানই ব্রহ্মজ্ঞান। স্থায়ী শান্তি বা আনন্দ পেতে গেলে আমাদের আত্মজ্ঞান বা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে হবে।
আত্মজ্ঞান লাভের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে উদ্গীথ অর্থাৎ ওম-কে আবৃত্তি করতে বলা হয়েছে। এই উদ্গীথ, প্রণব, ওঙ্কার বা ওম, ওং, ওঁ, ওঁং ইত্যাদি বলতে সেই পরব্রহ্মকেই বোঝানো হয়েছে। সাম বেদে উদ্গীথ বলা হয়েছে। আর যেহেতু ছান্দোগ্য উপনিষদ হচ্ছে, সামবেদের অংশ, তাই এখানে এই ব্রহ্মধ্বনিকে বলা হয়েছে, উদ্গীথ। মনকে বসে আনার এটি একটি উপায়। ছান্দোগ্য উপনিষদের প্রথম পাঁচটি অধ্যায়ে এই উদ্গীথ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। আমরা সেই কথা শুনবো।
১.১.১ উদ্গীথ কথাটার আভিধানিক অর্থ সামবেদের ধ্বনি, সামগান বা প্রণব। কেউ কেউ বলেন, যা থেকে সমস্ত উদ্গত হয়েছে, সেই কারণের কারণ হচ্ছেন উদ্গীথ। সেই পরম ব্রহ্ম। যার তরঙ্গধ্বনিকে অক্ষরে প্রকাশ করা হয়েছে "ওম" এই শব্দ। তাই ওম-ই ব্রহ্ম। যখন কেউ ওম এই শব্দটি উচ্চারণ করেন, তখন তিনি আসলে ব্রহ্মের উপাসনা করছেন বুঝতে হবে। এই আবৃত্তিই উদ্গীথ। এই আবৃত্তি সাধারণতঃ উচ্চস্বরে করা হয়ে থাকে। ওম-এর উপাসনা দ্বারাই ধীরে ধীরে, আমাদের মনের মলিনতা দূর হয়। আমাদের চিত্তশুদ্ধি হয়। আর একটা কথা উদ্গীত মানে উচ্চকন্ঠে গীত। তাই উদ্গীথ সবসময়েই উদাত্তস্বরে গীত হয়।
১.১.২. তাহলে আমরা বুঝলাম, পৃথিবী হলো চরাচর সমস্ত ভূতের সার। আর জল হচ্ছে পৃথিবীর সার। উদ্ভিদ হচ্ছে জলের সার। মানুষ উদ্ভিদের সার। মানুষের সার হচ্ছে বাক। বাকের সার হচ্ছে ঋক্বেদ। আবার ঋক্বেদের সার হচ্ছে সামবেদ। সামবেদের সার হচ্ছে উদ্গীথ বা প্রণব মন্ত্র অর্থাৎ "ওম"।
পৃথিবীতে আমরা দুই ধরনের পদার্থ দেখতে পাই। চেতন ও অচেতন। এদের আশ্রয় কি ? বা কাদের আশ্রয়ে এরা আছে ? এরা সবাই পৃথিবীকে আশ্রয় করে আছে। পৃথিবী কার আশ্রয়ে আছে ? পৃথিবী জলের আশ্রয়ে আছে। জলের উপরেই পৃথিবী ভাসছে। এই জল থেকেই উদ্ভিদের জন্ম। তাহলে জল হচ্ছে উদ্ভিদের আশ্রয়। আবার মানুষ হচ্ছে উদ্ভিদের সার। কারন মানুষ উদ্ভিদজাত খাবার খেয়ে বেঁচে থাকে। আবার মানব দেহের শ্রেষ্ট অংশ হচ্ছে বাগ-ইন্দ্রিয়। তাই বাগ হচ্ছে মানবদেহের সার। এবার বাকের মধ্যে শ্রেষ্ট হচ্ছে ঋকবেদ। আর ঋক্বেদের সার হচ্ছে সামবেদ। সাম-বেদের সার হচ্ছে ওঙ্কার।
১.১.৩. সমস্ত অষ্ট রসের মধ্যে উদ্গীথ বা ওম হলো পরম রস। অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ রস। এই শ্রেষ্ঠ রস ব্রহ্মের এক ও অভিন্ন।
১.১.৪. এখন কথা হচ্ছে, কোনটা ঋক ? কোনটাই বা সাম, আর উদ্গীথই বা কি ?
আমরা জানি, ঋক কথাটার মানে হচ্ছে স্তূতি। ভগবানের স্তূতি। ঋকবেদের সমস্ত শ্লোককেই বলা হয় ঋক। এই ঋক বেদ থেকে কিছু স্তোত্র যেগুলো সুর করে গাওয়া হয়, সেগুলো আলাদা করে সাম বেদের মধ্যে ঢোকানো হয়েছে। এই সামবেদে যত গান আছে, তার মূল সুর হচ্ছে উদ্গীথ। উদ্গীথ হচ্ছে - উচ্চস্বরে যা গাওয়া হয়।
১.১.৫. আগের শ্লোকে প্রশ্ন ছিল ঋক কি, সাম কি, এবং উদ্গীথ কি ? এর উত্তরে এখন বলছেন - বাক্যই হলো ঋক, প্রাণ হলো সাম, এবং উদ্গীথ হলো ওম। বাক ও প্রাণের মিলনে আবার ঋক ও সামের মিলনে এই ওম এবং ইনি ব্রহ্ম। অর্থাৎ স্থূল জগতের ক্রমবিকাশের সর্বোচ্চ হল ওম। সবকিছুর শেষ কথা হল ওম। সবকিছুর অন্তরাত্মা হল ওম। "ওম"-ই হলো পরম-আত্মা।
১.১.৬. বাক ও প্রাণের মিলনেই ওম্ এই শব্দ ব্রহ্মের সৃষ্টি হয়। এবং পরস্পরের অর্থাৎ বাক ও প্রাণ তাঁদের পরস্পরের কামনা পূর্ন করে। বাক ও প্রাণ মিলিত হয়ে পরস্পরের ওম সৃষ্টির যে আকাঙ্খা তা পূরণ করে।
১.১.৭. ওম-ই সব কিছুর আশ্রয়। এইভাবে যিনি ওমকে ব্রহ্ম বা উদ্গীথরূপে উপাসনা করেন, তিনি যা পেতে চান, তিনি তাই পান। অর্থাৎ ওমকে আপনি যেভাবে উপাসনা করবেন, অর্থাৎ ওম-এর মধ্যে সব কিছু আছে, তাই আপনি ওমকে যা ভেবে উপাসনা করবেন, আপনি তাই পাবেন। ওম-ই সব কিছুর আশ্রয়স্থল। আপনার ভাবনা ওম-এর উপাসনার মাধ্যমে প্রকাশিত হবে। আপনি তাই হয়ে যাবেন। আপনি যদি ওম-কে ব্রহ্ম ভেবে উপাসনা করেন, তবে আপনি স্বয়ং ব্রহ্ম সেই জ্ঞান আপনার হবে।
আত্মজ্ঞান লাভের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে উদ্গীথ অর্থাৎ ওম-কে আবৃত্তি করতে বলা হয়েছে। এই উদ্গীথ, প্রণব, ওঙ্কার বা ওম, ওং, ওঁ, ওঁং ইত্যাদি বলতে সেই পরব্রহ্মকেই বোঝানো হয়েছে। সাম বেদে উদ্গীথ বলা হয়েছে। আর যেহেতু ছান্দোগ্য উপনিষদ হচ্ছে, সামবেদের অংশ, তাই এখানে এই ব্রহ্মধ্বনিকে বলা হয়েছে, উদ্গীথ। মনকে বসে আনার এটি একটি উপায়। ছান্দোগ্য উপনিষদের প্রথম পাঁচটি অধ্যায়ে এই উদ্গীথ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। আমরা সেই কথা শুনবো।
১.১.১ উদ্গীথ কথাটার আভিধানিক অর্থ সামবেদের ধ্বনি, সামগান বা প্রণব। কেউ কেউ বলেন, যা থেকে সমস্ত উদ্গত হয়েছে, সেই কারণের কারণ হচ্ছেন উদ্গীথ। সেই পরম ব্রহ্ম। যার তরঙ্গধ্বনিকে অক্ষরে প্রকাশ করা হয়েছে "ওম" এই শব্দ। তাই ওম-ই ব্রহ্ম। যখন কেউ ওম এই শব্দটি উচ্চারণ করেন, তখন তিনি আসলে ব্রহ্মের উপাসনা করছেন বুঝতে হবে। এই আবৃত্তিই উদ্গীথ। এই আবৃত্তি সাধারণতঃ উচ্চস্বরে করা হয়ে থাকে। ওম-এর উপাসনা দ্বারাই ধীরে ধীরে, আমাদের মনের মলিনতা দূর হয়। আমাদের চিত্তশুদ্ধি হয়। আর একটা কথা উদ্গীত মানে উচ্চকন্ঠে গীত। তাই উদ্গীথ সবসময়েই উদাত্তস্বরে গীত হয়।
১.১.২. তাহলে আমরা বুঝলাম, পৃথিবী হলো চরাচর সমস্ত ভূতের সার। আর জল হচ্ছে পৃথিবীর সার। উদ্ভিদ হচ্ছে জলের সার। মানুষ উদ্ভিদের সার। মানুষের সার হচ্ছে বাক। বাকের সার হচ্ছে ঋক্বেদ। আবার ঋক্বেদের সার হচ্ছে সামবেদ। সামবেদের সার হচ্ছে উদ্গীথ বা প্রণব মন্ত্র অর্থাৎ "ওম"।
পৃথিবীতে আমরা দুই ধরনের পদার্থ দেখতে পাই। চেতন ও অচেতন। এদের আশ্রয় কি ? বা কাদের আশ্রয়ে এরা আছে ? এরা সবাই পৃথিবীকে আশ্রয় করে আছে। পৃথিবী কার আশ্রয়ে আছে ? পৃথিবী জলের আশ্রয়ে আছে। জলের উপরেই পৃথিবী ভাসছে। এই জল থেকেই উদ্ভিদের জন্ম। তাহলে জল হচ্ছে উদ্ভিদের আশ্রয়। আবার মানুষ হচ্ছে উদ্ভিদের সার। কারন মানুষ উদ্ভিদজাত খাবার খেয়ে বেঁচে থাকে। আবার মানব দেহের শ্রেষ্ট অংশ হচ্ছে বাগ-ইন্দ্রিয়। তাই বাগ হচ্ছে মানবদেহের সার। এবার বাকের মধ্যে শ্রেষ্ট হচ্ছে ঋকবেদ। আর ঋক্বেদের সার হচ্ছে সামবেদ। সাম-বেদের সার হচ্ছে ওঙ্কার।
১.১.৩. সমস্ত অষ্ট রসের মধ্যে উদ্গীথ বা ওম হলো পরম রস। অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ রস। এই শ্রেষ্ঠ রস ব্রহ্মের এক ও অভিন্ন।
১.১.৪. এখন কথা হচ্ছে, কোনটা ঋক ? কোনটাই বা সাম, আর উদ্গীথই বা কি ?
আমরা জানি, ঋক কথাটার মানে হচ্ছে স্তূতি। ভগবানের স্তূতি। ঋকবেদের সমস্ত শ্লোককেই বলা হয় ঋক। এই ঋক বেদ থেকে কিছু স্তোত্র যেগুলো সুর করে গাওয়া হয়, সেগুলো আলাদা করে সাম বেদের মধ্যে ঢোকানো হয়েছে। এই সামবেদে যত গান আছে, তার মূল সুর হচ্ছে উদ্গীথ। উদ্গীথ হচ্ছে - উচ্চস্বরে যা গাওয়া হয়।
১.১.৫. আগের শ্লোকে প্রশ্ন ছিল ঋক কি, সাম কি, এবং উদ্গীথ কি ? এর উত্তরে এখন বলছেন - বাক্যই হলো ঋক, প্রাণ হলো সাম, এবং উদ্গীথ হলো ওম। বাক ও প্রাণের মিলনে আবার ঋক ও সামের মিলনে এই ওম এবং ইনি ব্রহ্ম। অর্থাৎ স্থূল জগতের ক্রমবিকাশের সর্বোচ্চ হল ওম। সবকিছুর শেষ কথা হল ওম। সবকিছুর অন্তরাত্মা হল ওম। "ওম"-ই হলো পরম-আত্মা।
১.১.৬. বাক ও প্রাণের মিলনেই ওম্ এই শব্দ ব্রহ্মের সৃষ্টি হয়। এবং পরস্পরের অর্থাৎ বাক ও প্রাণ তাঁদের পরস্পরের কামনা পূর্ন করে। বাক ও প্রাণ মিলিত হয়ে পরস্পরের ওম সৃষ্টির যে আকাঙ্খা তা পূরণ করে।
১.১.৭. ওম-ই সব কিছুর আশ্রয়। এইভাবে যিনি ওমকে ব্রহ্ম বা উদ্গীথরূপে উপাসনা করেন, তিনি যা পেতে চান, তিনি তাই পান। অর্থাৎ ওমকে আপনি যেভাবে উপাসনা করবেন, অর্থাৎ ওম-এর মধ্যে সব কিছু আছে, তাই আপনি ওমকে যা ভেবে উপাসনা করবেন, আপনি তাই পাবেন। ওম-ই সব কিছুর আশ্রয়স্থল। আপনার ভাবনা ওম-এর উপাসনার মাধ্যমে প্রকাশিত হবে। আপনি তাই হয়ে যাবেন। আপনি যদি ওম-কে ব্রহ্ম ভেবে উপাসনা করেন, তবে আপনি স্বয়ং ব্রহ্ম সেই জ্ঞান আপনার হবে।
শ্লোক নং - ১.১.৮ এই ওং অক্ষরটি সম্মতি সূচক। আমরা যখন কারুর কথায়, বা কোনো বিষয়ে সায় দিতে চাই, তবে এই ওং ধ্বনি উচ্চারণ করে থাকি। "ওম আমাদের উন্নতির কারন, ওম আমাদের সকল ইচ্ছে পূরণ করেন " এই বিশ্বাস যার আছেন, ওম-কে যিনি এইভাবেই উপাস্য করেন, ওমকে যিনি এইভাবেই জানেন, তাঁর সমস্ত ইচ্ছেই ওম-এর উপাসনার দ্বারা পূরণ হয়। আসলে ওমকে যিনি আশ্রয় করেন, ওম তাকেই আশ্রয় দেয়।
শ্লোক : ১.১.৯ হিন্দুদের মধ্যে যারা শাস্ত্র বিহিত কর্ম্ম অর্থাৎ যাগ-যজ্ঞ করেন, তারা ওম উচ্চারণ করেই শুরু করেন, আবার ওম উচ্চারণ করেই শেষ করেন। যখন যজ্ঞের মন্ত্র পাঠ করা হয়, বা কোনো প্রার্থরনা মন্ত্র বা শান্তি মন্ত্র পাঠ করা হয়, তখন আমরা ওম এই ধ্বনি দিয়েই শুরু করে থাকি। ওম সমস্ত উৎপত্তির কারন। তাই আমরা যে অন্ন খেয়ে বেঁচে থাকি, তার উৎপত্তির কারণও ওম। অর্থাৎ সমস্ত রসের কারন এই ওম। সমুদ্র যখন বাতাসের সাহায্যে ঢেউ তুলছে, তখন এই ওম ধ্বনি শুনতে পাই। আমরা জানি বায়ু ও অগ্নির মিথুনে এই ধ্বনির উৎপত্তি। তাই সূর্য যখন উদয় হচ্ছে, সূর্য যখন অসৎ যাচ্ছে, চাঁদ যখন উদয় হচ্ছে, নক্ষত্রের যখন জন্ম হচ্ছে, তখন এই ওঙ্কারের গুনগান করতে করতে জন্ম নিচ্ছে, আবার এই ওঙ্কারের গুনগান করতে করতেই অস্তগামী হচ্ছে। তাই আমাদের জন্ম কর্ম্ম মৃত্যু সবই ওঙ্কার জাত।
শ্লোক ১.১.১০ ওঙ্কারের মহিমা কেউ জানুক না জানুক, আমাদের সবার কর্ম্মক্ষমতা এই ওঙ্কার থেকেই আসে। যে জানে তার কর্ম্ম ক্ষমতা যেমন ওঙ্কার থেকে আসে, তেমনি যে জানেনা তার কর্ম্মক্ষমতাও এই ওঙ্কার থেকেই আসে। এখন কথা হচ্ছে, এই জানা বা না জানার মধ্যে পার্থক্য কি ? দেখুন ওঙ্কারকে জেনে, অর্থাৎ গুরুবাক্যে শ্রদ্ধাবান হয়ে, শাস্ত্রবিধি মেনে যখন আপনি কর্ম্ম করবেন, তখন আপনার সমস্ত কর্ম্ম-ই যোগে পরিণত হবে। আর এই যোগকর্ম্ম অধিকতর ফলপ্রসূ হয়। এই হলো ওঙ্কারের যথার্থ ব্যাখ্যা।
পরের দিন আমরা ছান্দোগ্য উপনিষদের প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় খন্ড থেকে আলোচনা শুনবো।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
ছান্দোগ্য উপনিষদ - প্রথম অধ্যায় - দ্বিতীয় খন্ড - ওঙ্কারের মাহাত্ম্য - GLORY OF ONGKAR
শ্লোক ১.২.১ হিন্দুদের পুরান কাহিনীতে যুদ্ধ যুদ্ধ আর যুদ্ধ। দেবতাদের সাথে অসুরদের যুদ্ধ, মা-দুর্গার সাথে মহিষাসুরের যুদ্ধ। রাম-রাবনের যুদ্ধ, কুরু-পান্ডবের যুদ্ধ। বলা হয়ে থাকে, দেবতা ও অসুর দুজনেই প্রজাপতির সন্তান। একই পিতার সন্তান হয়েও, তারা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। যুদ্ধকালীন সময়ে, দেবতাগণ জয়ের আশায়, উদ্গীথ গ্রহণ করেছিলেন। অর্থাৎ সমস্ত কর্ম্ম তারা ওঙ্কার ধ্বনি দিয়ে শুরু করতেন, আবার কর্ম্মশেষে ওঙ্কারের ধ্বনি দিতেন। এর ফলে দেবতাদের সমস্ত কর্ম্ম যোগে পরিণত হয়েছিল। আর আমরা আগেই শুনেছি, কর্ম্ম যখন যোগে পরিণত হয়, তখন আমাদরে সমস্ত কর্ম্ম অধিক ও শুভ ফলদায়ক হয়ে থাকে। আসলে এই দেবতা ও অসুর আর কেউ নয়, আমাদের অন্তরের শুভ বুদ্ধি ও অশুভ বুদ্ধি। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই এই শুভ শক্তি ও অশুভ শক্তি ওতপ্রোত ভাবে বিরাজ করছে। আমরা যখন এই ওঙ্কারের ধ্বনির সাহায্য নেই, তখন আমাদের শুভ শক্তি উদ্দীপিত হয়, আর আমাদের অশুভ শক্তি দিশেহারা হয়ে যায়।
আমাদের ইন্দ্রিয়সকল বাইরের জগতের শুভ ও অশুভ, ভালো মন্দ, সবই প্রতক্ষ্য করছে। নাক কখনো দুর্গন্ধকে পরিহার করতে পারে না. কান কখনো খারাপ কথা শুনবো না তা বলতে পারে না। চোখ কখনো খারাপ কিছু দেখবো না তা বলতে পারে না। কিন্তু যখন আমরা এই আমাদের মন, যিনি ইন্দ্রিয়গুলোকে পরিচালনা করছেন, তিনি যখন ইন্দ্রিয়গুলোকে এই অশুভ বিষয় থেকে মুক্ত করে, শুভদৃষ্টি সম্পন্ন হতে পারবেন, তখন আমাদের মধ্যে দেবত্ব শক্তির বিকাশ ঘটবে। তাই উপনিষদ বলছে, দেবতাগণ উদ্গীথ-এর উপাসনার সাহায্যে অসুরদের পরাজিত করেছিলেন।
এখন কথা হচ্ছে, উপাসনা বলতে আমরা কি বুঝি ?
সগুন ব্রহ্মের মানস চিন্তন হচ্ছে উপাসনা। অর্থাৎ উপাসনা হচ্ছে মানসিক ক্রিয়া। আমরা জানি জ্ঞানও মানসিক ক্রিয়া। কিন্তু জ্ঞান অর্জন ও উপাসনা করার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, জ্ঞান বস্তুতন্ত্র, কিন্তু উপাসনা কর্তৃতন্ত্র। অর্থাৎ উপাসনা করা না করা কর্তার ইচ্ছাধীন। জ্ঞানের উন্মেষ হয় বিজ্ঞানময় শরীরে। আর উপাসনা হচ্ছে মানসিক শরীরের ক্রিয়া। উপাসনায় গুরুর কাছথেকে প্রাপ্ত উপাস্য-তত্ব-টিকে বিশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করতে হয়। এবং সেই তত্ত্বটিকে চিত্তবৃত্তির সহযোগে চিন্তন করতে হয়। নিরন্তর উপাস্যের চিন্তন করতে থাকলে, স্বপ্নের মধ্যেও এই ভাবনা চলতে থাকে। তো উপাসনায় তিনটি বিষয় প্রয়োজন ১. উপাস্যবিষয়, ২. উপাসক, ৩. প্রত্যায়বৃত্তি বা নিরন্তর ভাবনা। একটা বিষয় জানবেন, ১) উপাস্য ও উপাসকের ভেদজ্ঞান থাকলে উপাসনা হয় না। ২) উপাসনার মুলে রয়েছে বিশ্বাস, এখানে বিচারের কোনো স্থান নেই। ৩) আর এই উপাস্যতত্ত্ব শাস্ত্রাদি থেকে বা গুরুমুখে প্রাপ্ত হতে হয়। নিজের কল্পিত উপাস্যের চিন্তাকে উপাসনা বলে না। সগুন ব্রহ্মের গুনের চিন্তনই উপাসনা। যাই হোক,
১.২.২ আমাদের শুভবুদ্ধি, বা আমাদের দেবত্ব শক্তি জাগ্রত হয়ে, বাকের মধ্যে উদ্গীতের উদ্গিরণ করলেন, অর্থাৎ সত্যভাষন রপ্ত করতে থাকলেন। যা অসুরগন পারলো না। বাকশক্তি যখন নিরপেক্ষ থাকে তখন সে সত্য-অসত্য দুইই বলে থাকে। কিন্তু যখন দেবতাদের পক্ষে থাকে, তখন সে সত্য বৈ মিথ্যা বলতে পারে না। আর যখন অসুরদের পক্ষে থাকে সে অনবরত মিথ্যা ভাষণে রপ্ত থাকে।
১.২.৩ - এইভাবে দেবতাগণ কানকে উদ্গীথ রূপে উপাসনা করলেন। অর্থাৎ কান যাতে খারাপ কথা না শুনতে পারে, সেইমতো তাকে ব্যবহার করতে লাগলেন। যা অসুরদের পক্ষে সম্ভব হলো না। অর্থাৎ আমরা যখন মিথ্যাচারী হই , তখন আমরা আসুরিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত হই। আমরা যখন সত্যভাষী হই তখন আমাদের মধ্যে দেবত্ব শক্তি কাজ করে থাকে। এইভাবে, সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলোকে যদি আমরা দেবত্ব শক্তি দ্বারা উদ্দীপ্ত করতে পারি, তবে জগতের মিশ্র শক্তি অর্থাৎ ভালো -মন্দ থেকে আমরা ভালোকে গ্রহণ করতে পারি। ভালোকে আলাদা করবার শক্তি আমাদের মধ্যে জাগ্রত হবে।
১.২.৪ - ৬ আমরা জানি, ইন্দ্রিয়গুলোর পরিচালক হচ্ছে মন। দেবতাগণ এই মনকে উদ্গীথ রূপে উপাসনা করলেন। আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়শক্তি, অর্থাৎ বাকশক্তি, শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, স্পর্শশক্তি, ঘ্রাণশক্তি ইত্যাদির যিনি পরিচালক, যিনি রাজা, তাকে উদ্গীথ রূপে উপাসনা করলেন। এর ফলে হলো কি, আমাদের মন কলুষিত হতে পারলো না। অন্যদিকে অসুরগন ইন্দ্রিয়গুলোকে অসৎ অর্থাৎ অনিত্য বস্তুতে আবদ্ধ করে নিলো। অর্থাৎ ভালো-মন্দ দুটোকে গ্রহণ করতে থাকলো। আর ভালোর থেকে মন্দের প্রভাব যেহেতু বেশি, তাই অসুরগন মন্দের দিকে ধাবিত হলো।
১.২.৭ - এরপরে দেবতাগণ প্রাণকে উদ্গীথরূপে উপাসনা করতে লাগলেন। আর অসুরগন প্রাণকে আঘাতের সাহায্যে আয়ত্ত্বে আন্তে চাইলেন। উপনিষদে বলা হয়েছে, মাটির খন্ড দিয়ে যেমন পাথরে আঘাত করলে, মাটির খন্ড চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে যায়, কিন্তু পাথর নির্বিকার থাকে, তেমনি প্রাণকে আঘাতের ফলে অসুরগন ছুড়বিচুর্ণ হয়ে গেলো। কিন্তু দেবতা প্রাণকে উদ্গীথ রূপে উপাসনা কারাতে, প্রাণের স্পর্শে দেবতাগণ আরো বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠলো।
১.২.৮ - প্রাণ সম্পর্কে যিনি সচেতন, প্রাণ সম্পর্কে যিনি জানেন, প্রাণের ক্ষমতা সম্পর্কে যিনি অবহিত আছেন, তিনি প্রাণেরই উপাসনা করছেন। আর যিনি প্রাণের আশ্রয়ে আছেন, তাকে কেউ আঘাত করলে, যিনি আঘাত করেন তিনি নিজেই ধংস হয়ে যান। এখানে প্রাণ অর্থাৎ ব্রহ্ম। প্রাণবায়ু যা আমরা নাকের সাহায্যে গ্রহণ করে থাকি, তা আসলে এই ঘ্রান-ইন্দ্রিয়ের উপরে নির্ভরশীল। অতএব প্রাণবায়ু কখনোই স্বাধীন নয়। আমাদের নাক বা মুখ যদি বন্ধ থাকে তবে প্রাণবায়ু আমাদের শরীরে কোনো ক্রিয়া করতে পারে না। প্রাণবায়ু তাই সসীম। কিন্তু মুখ্যপ্রাণ নীতিশুদ্ধ, অপরিবর্তনীয়, সর্বত্র বিরাজমান, অক্ষয়। তাই উপনিষদ বলছে, এই মুখ্যপ্রাণকে যিনি জানেন, যিনি মুখ্যপ্রাণের উপাসনা করেন, যিনি মুখ্যপ্রাণের আশ্রয়ে আছেন, তিনি পাষাণবৎ। এই ব্যক্তিকে আঘাত করলে, যিনি আঘাত করেন, তিনিই আঘাত প্রাপ্ত হন।
১.২.৯ - দেখুন আমরা শ্বাসবায়ুর যাঁকে আমরা প্রাণবায়ু বলে থাকি, তার দ্বারা সুগন্ধ ও দুর্গন্ধ উভয়ই গ্রহণ করে থাকি। কুন্তু একটা কথা জানবেন, মুখ্য প্রাণ শুদ্ধ-নিত্য-অপাপবিদ্ধ। এই মুখ্যপ্রাণ যদি কিছু পান করেন, বা আহার করেন, তবে জানবেন, তিনি এর দ্বারা ইন্দ্রিয়গুলোকেই পালন করছেন। স্থূল শরীরের মৃত্যু হলে, এই মুখ্যপ্রাণ কোনো কিছু আহার করেন না - এরফলে ইন্দ্রিয়গুলোর বিলোপ হয়। আমাদের মনে হয়, যেন ইন্দ্রিয়গুলো দেহ ছেড়ে চলে গেছে। উপনিষদ বলছে, বাঁচার আশায় এই ইন্দ্রিয়গুলো তখনও আহার করতে চায়। আর সেইজন্য, আমরা দেখি মৃতদেহের মুখ খোলা। মৃত্যুকালে মানুষ হা করে থাকে।
১.২.১০ -১২ - ঋষি আঙ্গিরস মুখ্যপ্রাণকে উদ্গীথ রূপে উপাসনা করেছিলেন। ঋষি আয়াস মুখ্যপ্রাণকে উদ্গীথ রূপে উপাসনা করেছিলেন। মুখ্যপ্রাণ মুখথেকে বেরিয়ে আসে, তাই মুখ্যপ্রাণকে বলা হয় আয়াস। আঙ্গিরস হচ্ছে অঙ্গের অর্থাৎ ইন্দ্রিয়াদির রস। যা ইন্দ্রিয়কে ধারণ করে, তাকে বলে আঙ্গিরস অর্থাৎ মুখ্যপ্রাণ।
বৃহস্পতি অর্থাৎ বৃহতী বা বাকের পতি, তাই বৃহস্পতি। বৃহস্পতি এই মুখ্যপ্রাণকে উদ্গীথরূপে উপাসনা করেছিলেন। প্রানকেই বলা হয়ে থাকে বৃহস্পতি কারন বাকই বৃহতী অর্থাৎ শক্তিশালী। এবং এই প্রাণ তার পতি অর্থাৎ প্রভু।
১.২.১৩ - দলভের পুত্র ছিলেন বক ঋষি। এই বক-ঋষি প্রাণ ও তার শক্তিকে জেনেছিলেন। সেই জন্য নৈমেষ অরণ্যবাসী ঋষিগণ বক-ঋষিকে উদ্গাতারূপে মনোনীত করেছিলেন। এবং বক-ঋষি প্রাণের প্রশস্তিতে উদ্গীথ গেয়ে ঋষিদের সন্তুষ্ট করেছিনেন।
যিনি মুখ্যপ্রাণের প্রকৃত স্বরূপ জানেন, যিনি মুখ্যপ্রাণকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন, যিনি অক্ষর রূপে ব্রহ্মকে জেনেছেন, তা সে এক অক্ষর বলুন আর পাঁচ অক্ষর বলুন, যিনি অক্ষররূপে ব্রহ্মের উপাসনা করেন, তিনি নিজেই অক্ষর-ব্রহ্ম হয়ে যান। প্রণবের স্তুতি মানেই সর্ব-দেবতার স্তুতি। তাই উদ্গীথ হচ্ছে, যিনি যা পেতে চান, তাই লাভ করেন। এই হলো উদ্গীথ-এর শরীর বা স্থুলদেহ সংক্রান্ত ব্যাখ্যা। উদ্গীথ-এর সূক্ষ্ম ফল হলো, অক্ষর ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া।
উদ্গীথ থেকে তিন রকম ফল পাওয়া যেতে পারে - অধ্যাত্ম, অধিভূত, ও অধিদৈব। অধ্যাত্ম অর্থাৎ শরীর সংক্রান্ত, অধিভূত অর্থাৎ প্রাণ সংক্রান্ত, আর অধিদৈব অর্থাৎ প্রকৃতি সংক্রান্ত।
প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় খণ্ডের এখানেই সমাপ্তি।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
ছান্দোগ্য উপনিষদ - প্রথম অধ্যায় - তৃতীয় খন্ড - ওঙ্কারের মাহাত্ম্য - GLORY OF ONGKAR
বলা হয়ে থাকে বেদের সার গায়ত্রী, আর গায়েত্রীর সার হচ্ছে ওঙ্কার। উপনিষদে এই ওঙ্কারকে বলা হয়েছে উদ্গীথ। উদ্গীথ-এর উপাসনাই সগুন ব্রহ্মের উপাসনা। এর আগে আমরা উদ্গীথকে কিভাবে উপাসনা করতে হবে, তার একটি উপায় সম্পর্কে আমরা শুনেছি। আর সেটি হলো, অধ্যাত্ম বা শরীর সম্পর্কিত, সেখানে আমরা মুখ্যপ্রাণকে উদ্গীথ হিসেবে উপাসনার কথা শুনেছি। এবার আমরা শুনবো, প্রকৃতি বিষয়ক উদ্গীথ উপাসনা। অর্থাৎ উদ্গীথ-এর উপাসনা এবার আধিদৈবিক অর্থাৎ প্রাকৃতিক শক্তিকে আশ্রয় করে করতে হবে।
স্বামী বিবেকানন্দ বারবার উপনিষদের কথা বলেছেন, উপনিষদকে সাধারণের কাছে, তাদের উপযুক্ত করে তুলে ধরবার কথা বলেছেন। আসলে উপনিষদ এমন একটি ভান্ডার যেখানে জীবনমুখী শক্তির সন্তরন দেখতে পাওয়া যায়। দেখুন মানুষের জীবনে দুটো জিনিসের খুব প্রয়োজন (basic needs). তার মধ্যে প্রথম হচ্ছে প্রাণে বেঁচে থাকা, অর্থাৎ প্রকৃতির কাছ থেকে প্রাণের পুষ্টি সংগ্রহ করা ও শরীরের পুষ্টি সংগ্রহ করা, অর্থাৎ বুক ভোরে শ্বাস নেওয়া, আর পেট ভোরে দুটো ভাত খাওয়া। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে নিজের ইচ্ছেপূরণ করা। ছান্দোগ্য উপনিষদের এই অংশে সেই দুটো স্বাভাবিক চাহিদার কথা ভেবে উপাসনার দিক নির্ণয় করা হয়েছে। উপাসনার উপাস্য নির্ণয় করা হয়েছে। এর আগে আমরা প্রাণের কথা শুনেছি, অর্থাৎ সূক্ষ্ম বায়ুর কথা শুনেছি, যা আমাদের জীবনে বেঁচে থাকবার জন্য, আবশ্যিক। এবার আমরা সূর্য্যের কথা শুনবো। এই দুটোই জীবনের জন্য অপরিহার্য।
১.৩.১ - সূর্য এই পৃথিবীর সমস্ত প্রাণকে জাগ্রত করে, লালন-পালন করে। এই সূর্য আমাদের উত্তাপ দিচ্ছে। উপনিষদ এবার সূর্যকে উদ্গীথ রূপে উপাসনার কথা বলছে। সূর্য উদিত হলে, আমাদের জগৎ থেকে অন্ধকার দূরীভূত হয়, আমাদের মন থেকে ভয় দূরীভূত হয়। সূর্য বা অগ্নি সমস্ত কিছুকে ব্রহ্মের নিকটে উপস্থিত করবার বাহন। অগ্নি সমস্ত কিছুকে দাহ করে, তার উৎসে ফিরিয়ে দেয়। এই সূর্য্যই প্রাণের উৎস। সূর্য্যের আলোর স্পর্শ না পেলে, কোনো প্রাণ প্রস্ফুটিত হতে পারে না। আসলে সমস্ত জীব-জন্তু-উদ্ভিদ-প্রাণী সূর্যমুখী। সূর্য্যের মুখাপেক্ষী হয়ে আমরা বেঁচে-বর্তে আছি। এই সূর্যকে ঘিরেই আমাদের বিকাশ। সূর্য ছাড়া গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ত্ব সম্ভব নয়। আবার এই সূর্যই আমাদের লালনপালন করবার জন্য উদ্গান করছেন। সূর্য এই পৃথিবীর জন্মদাতা, সূর্যই এই পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর জন্ম দাতা। উপনিষদ প্রণেতা ঋষি বলছেন, এই চরম-সত্য যিনি সম্যক রূপে উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তিনি অমর হন।
১.৩.২ আবার প্রাণ ও সূর্য উভয়ই সমান। প্রাণ যেমন আমাদের মধ্যে উষ্ণতার সৃষ্টি করে, তেমনি সূর্য সারা সৌরলোকে উষ্ণতার সৃষ্টি করছেন। প্রাণকে প্রাচীন ঋষিগণ বলে থাকেন স্বর। অর্থাৎ যা সরে সরে যায়, অর্থাৎ নির্গত হয়। সূর্য ও প্রাণের মধ্যে তফাৎ হচ্ছে, সূর্য সন্ধ্যাকালে অস্তগেলে প্রভাতে আবার উদয় হয়। কিছু প্রাণ একবার শরীর থেকে বেরিয়ে গেলে, আর ফিরে আসে না। তাই জীবনের জন্য, প্রাণের থেকেও সূর্য্যের কদর বেশি। কারন সূর্য থাকলে, প্রাণ নতুন শরীরে প্রবেশ করতে পারবে। সূর্য থাকলে, উষ্ণতা থাকবে, মেঘ হবে, বৃষ্টি হবে, নতুন নতুন উদ্ভিদের জন্ম হবে, প্রাণের জন্ম হবে ।
১.৩.৩ উপনিষদ প্রণেতা ঋষি বলছেন, ব্যানকে উদ্গীথরূপে উপাসনা করবে। শ্বাস গ্রহণ হচ্ছে প্রাণ, আবার শ্বাস ত্যাগ হচ্ছে অপান। প্রাণ ও অপান অর্থাৎ শ্বাস গ্রহণ ও শ্বাস ত্যাগের মাঝে থাকে ব্যান বায়ু। অর্থাৎ মধ্যবর্তী বায়ুকে বলে ব্যান। .তাই প্রাণ ও অপানের সাঁকো হচ্ছে ব্যান। এই ব্যানবায়ুকেই বলা হয়ে থাকে বাক্। আমরা যখন কথা বলি, তখন আমাদের শ্বাসবায়ুকে রুদ্ধ করতে হয়। অর্থাৎ ব্যানের সাহায্যেই আমাদের মধ্যে বাক্যের স্ফূরণ হয়ে থাকে।
১.৩.৪ আমরা যখন ঋকবেদ থেকে ঋকমন্ত্র উচ্চারণ করি, অর্থাৎ ভগবানের স্তুতি করি, তা এই ব্যানের সাহায্যেই করে থাকি। এইসময় প্রাণ ও অপান-এর কার্য্য স্থগিত রাখি। আবার যা ঋক তা-ই সাম। কেননা ঋকের শ্লোকগুলোই সামবেদে সংযোজিত করা হয়েছে। অর্থাৎ এই ঋকের সাহায্যে সামবেদ তৈরী। তাই ঋক বা সামগান করবার সময় আমাদের শ্বাসগ্রহন ও শ্বাসত্যাগ ক্রিয়া বন্ধ থাকে। তাই আমাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস রুদ্ধ করেই উদ্গান করতে হয়। অর্থাৎ ব্যানবায়ু ভিতরে রেখে আমরা ঋক বা সামগান অর্থাৎ ঈশ্বরের স্তুতি করে থাকি।
১.৩.৫ যেসব কাজে শারীরিকশক্তি অধিক প্রয়োজন, সেই সব কাজ করবার জন্যও, আমাদের শ্বাসবায়ুকে রুদ্ধ করতে হয়। অর্থাৎ আমাদের ভিতরে অগ্নিকে প্রজ্বলিত করতে হয়। কাঠে কাঠে ঘর্ষনের ফলে যেমন অগ্নির স্ফূরণ হয়, তেমনি প্রাণ ও অপানের মিথুনে ব্যানের মধ্যে অগ্নি প্রজ্বলিত হয়। দৌড়োনোর সময়, যুদ্ধ করবার সময়, ধনুকের ছিলা বাঁকানোর সময়, আমরা বায়ুকে রুদ্ধ করে থাকি। এমনকি আমরা যখন কথা বলি, তখনও আমাদের বায়ুকে রুদ্ধ করতে হয়। তাই ব্যানবায়ুর গুরুত্ত্ব অপরিসীম। ব্যানবায়ু আমাদেরকে শক্তিশালী করে তোলে। এই কারণেই ব্যানকে বিশেষভাবে উপাসনা করতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ ব্যান বায়ুকে উদ্গীথরূপে উপাসনা করতে বলা হয়েছে।
১.৩.৬ ঋষি বলছেন, উদ্গীথ-এর অক্ষরগুলোকে আলাদা ভাবে উপাসনা করতে হবে। অর্থাৎ উৎ, গী , থ, এই অক্ষর গুলোকে পৃথকভাবে উপাসনা করতে হবে। উৎ - হচ্ছে প্রাণের প্রতীক। প্রাণ-ই সবকিছুকে বাড়তে সাহায্য করে থাকে। গী অক্ষরটি হলো, বাক্। বাকসমূহকে বলা হয়ে থাকে গির। থ অর্থাৎ অন্ন। অন্ন -ই এই সমস্ত প্রাণকে ধারণ করে আছে। আমরা ধ্যানের উদ্গীথ-এর প্রতিটি অক্ষরের তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করবো।
১.৩.৭ - উৎ হলো স্বর্গ, এবং পৃথিবী হলো থ। পৃথিবী ও স্বর্গের মাঝখানে যে স্থান তাকে গী বা অন্তরীক্ষ বলা হয় । ঋষি আবার বলছেন, উৎ হচ্ছে সামবেদ, গী হচ্ছে যজুর্বেদ, আর থ হচ্ছে ঋকবেদ। যিনি এইভাবে উদ্গীথকে জানেন, তার কাছে শাস্ত্রের মর্মার্থ প্রকাশিত হয়। যিনি উদ্গীথ-এর উপাসনা করেন, তিনি অন্নভোক্তা হন, তিনি প্রভূত অন্নের অধিকারী হন। শাস্ত্রের মর্মার্থ উপলব্ধি করবার ফলে তার মধ্যে জ্ঞান-অগ্নি প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে। তিন হন জ্ঞান-জ্যোতিতে ভাস্বর।
১.৩.৮ সামবেদে বহু মন্ত্র আছে, যা আমাদের কাম্য বিষয়কে পাবার জন্য গীত হয়ে থাকে। অর্থাৎ কাম্য বস্তু কিভাবে পাওয়া যায়, তার নির্দেশ আছে এই সামবেদে। তো সাধক যখন কোনো কাম্য বস্তু পেতে চান, তখন তিনি সেই বিষয়ক সাম-মন্ত্র-এর যথার্থ মর্মার্থ বুঝে সামগান গেয়ে মনের ইচ্ছে পূরণ করতে পারেন। অর্থাৎ সামগান আমাদের অভীষ্ট পূরণ করে দিতে পারে।
১.৩.৯ - আমরা জানি সামবেদে যেসব ঋক-মন্ত্রের উল্লেখ আছে, কোনো না কোনো ঋষি সেগুলো সেই মন্ত্রের উদ্গাতা বা দ্রষ্টা। তো আপনি যখন সাম মন্ত্রের গীত গাইবেন, তখন সেই মন্ত্রের অর্থের সঙ্গে সঙ্গে সেই মন্ত্রের দ্রোষ্টাঋষির এবং ঋকটি যে দেবতার বা দেবতাদের উদ্দেশ্যে গাওয়া হয়েছে, সেদিকেও ধ্যান দিতে হবে। অর্থাৎ মন্ত্রের দ্রষ্টা-ঋষি ও দেবতাদের উদ্দেশ্য করে, শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা অবশ্য কর্তব্য।
১.৩.১০ - সামবেদের সমস্ত মন্ত্র-ই এক-একটি উচ্চাঙ্গের প্রার্থনা সংগীত। তো যখন এই প্রার্থনা সংগীত আপনি উচ্চারণ করবেন, বা সুর করে গাইবেন, তখন তার নির্দিষ্ট ছন্দের দিকে খেয়াল করবেন। প্রতিটি সাম মন্ত্রের জন্য নির্দিষ্ট ছন্দ, মন্ত্রের প্রথমেই উল্লেখ করা আছে। নির্ভুল ছন্দ, সঠিক উচ্চারণ, মন্ত্রের সঠিক অর্থের মনন এবং যে দেবতার উদ্দেশে এটি গীত হয়েছে, এমনকি যিনি এই মন্ত্রের দ্রষ্টা তাকেও ধ্যান করতে হবে, শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে হবে । তবেই সাম-মন্ত্র যথাযথ শুভ ফল প্রদান করবে। প্রসঙ্গত বলি, বেদের মন্ত্রের ঋষিগনকে কিন্তু লেখক বা লেখিকা বলা হয় না, কারন এই মন্ত্রের তিনি দ্রষ্টা অর্থাৎ এই মন্ত্রকে তিনি মানশ্চক্ষুতে দর্শন করেছিলেন।
১.৩.১১ - সামবেদ পাঠ করবার সময়, আরো একটা জিনিসের দিকে খেয়াল করতে হবে। আপনার বসবার আসন যেমন অবস্থানে থাকবে, অর্থাৎ আপনি যদি পুব দিকে মুখ করে বসেন, তবে পুবদিকের অধিষ্ঠাত্রী দেব-দেবীর ধ্যান করতে হবে। অর্থাৎ আপনি যেকোনো দিকেই মুখ করে এই সাম-মন্ত্র উচ্চারণের সুফল পেতে পারেন। কিন্তু যেদিকে মুখ করে আপনি বসবেন, সেই দিকের অধিষ্ঠাত্রী দেবতার স্তুতি বা গুনগান দিয়ে শুরু করবেন। আসলে সমস্ত দিকেই ব্রহ্মার স্থিতি। তো যেদিকে ব্রহ্মার যে গুনের স্ফূরণ, তাকেই বলে সেই দিকের দেবতা বলা হয়ে থাকে।
১.৩.১২ সাম-মন্ত্র ধ্যানের শেষে অর্থাৎ সাম মন্ত্রের সাহায্যে প্রার্থনার শেষে উদ্গাতা আত্মবিষয়ক পরিচয় দেবেন। নির্ভুল উচ্চারন, নির্দিষ্ট কাম্য বস্তুর ধ্যান অবশ্যই করবেন। আর এর ফলে উদ্গাতার কামনাগুলো অবশ্যই শীঘ্র পূরণ হবে, এমনটি উপনিষদ-বাক্য, ঋষি-বাক্য ।
জানিনা আজকাল এইসব ক্রিয়া-অনুষ্ঠানের চর্চা আছে কি না। তবে গভীর ভাবে আপনি যদি সাম -মন্ত্রের অর্থ বুঝতে পারেন, ঋকের তাৎপর্য্য বুঝতে সক্ষম হন, তবে জানবেন,আপনার মধ্যে সেই ধরনের চিন্তার উদ্রেগ হবে, একটা প্রার্থনাচিত্র ফুটে উঠবে। আর আপনি যা কিছু চিন্তা করছেন, আপনার কর্ম্ম সেইমতো হবে, আর আমরা জানি কর্ম্ম-ই ফলপ্রাপ্তির সাময়িক উপায়। অর্থাৎ আপনার কামনা, আপনাকে ভাবাবে, এবং আপনাকে কর্ম্মের দিকে ঠেলে দেবে। আর আপনি সেই মতো বস্তুর প্রাপ্তিলাভ করতে পারবেন, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। আপাতত বিষয়টিকে হালকা মনে হলেও, আপনি প্রার্থনা মন্ত্রের যথার্থ অর্থ-উচ্চারণ, দেবতা ও ঋষিদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, কাময়বস্তু প্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা করুন - দেখবেন আপনি যা চান, তাই হবে, আপনি যা চান তাই পাবেন । এই সত্য উপলব্ধি করতে গেলে, শাস্ত্র বাক্য মেনে, তার নির্দেশ অনুযায়ী ক্রিয়া করতে হবে।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম ।
ছান্দোগ্য উপনিষদ - (৪) প্রথম অধ্যায় - চতুর্থ ও পঞ্চম খন্ড - ওঙ্কারের মাহাত্ম্য - GLORY OF ONGKAR
উপনিষদ হচ্ছে বেদের সেইভাগ, যেভাগে ঈশ্বরের নিরুপন আছে, অর্থাৎ জ্ঞানকাণ্ড। উপনিষদকে বলা হয়, ব্রহ্মবিদ্যা। যে গ্রন্থে বিদ্যা, ধর্ম্ম, সত্য, তত্ত্ব ইত্যাদি রহস্যবিদ্যা আলোচিত হয়েছে, তাকেই বলে উপনিষদ। উপনিষদ কথাটার অর্থ গমন করা, জ্ঞান হওয়া। তো যার দ্বারা আমাদের সৃষ্টিকর্তা-পালনকর্তা-লয়কর্তার জ্ঞান হয়, তাকেই বলে উপনিষদ।
ওম উচ্চারণ করে, সামগান করা হয়। এই সামগান সূর্যকে ঘিরে হয়। সাম সা+অম। সা অর্থাৎ প্রকৃতি বা অদিনা অক্ষয়া ঐশীশক্তি। অম্ অর্থাৎ আত্মা, যা সূর্যমন্ডলের মধ্যে আসীন। অতএব সূর্যরূপে জগতের আত্মার সঙ্গে যা ওতপ্রোত তা-ই হচ্ছে "সাম" ।
১.৪.১ - ওঙ্কার হচ্ছে ব্রহ্মের নিকটতম প্রতীক। অর্থাৎ ব্রহ্মের প্রতীক হিসেবে এই ব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুকেই আপনি ভাবতে পারেন। আসলে ব্রহ্মান্ডের সবকিছু ব্রহ্ম বই কিছু নয়। তথাপি মায়ের কাছে শিশু যেমন সবথেকে কাছের, তেমনি ওঙ্কার হচ্ছে ব্রহ্মের সবথেকে কাছের। ব্রহ্মের ছায়া ওঙ্কার। ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন। ওঙ্কারকে এইভাবে জেনে, ওম আবৃত্তি করতে হবে। অর্থাৎ প্রতীক ব্রহ্ম ওম, এই তত্ত্বকে জেনে ওঙ্কারের ধ্যান করতে হবে। এবার কিভাবে ওম উচ্চারণ করতে হবে সেই ব্যাখ্যা বর্ণনা করা হচ্ছে।
১.৪.২ দেবতাগণ মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে বৈদিক ক্রিয়া-কর্ম্মের অনুষ্ঠান করেছিলেন। অর্থাৎ আমরা মৃত্যুভয়ে যখন কোনো কাজ করি, তখন সমস্ত মন প্রাণ ঢেলে, অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে সেই কাজে সম্পূর্ণ প্রয়াস করে থাকি। মৃত্যুভয় মনে জাগলে আমরা ঈশ্বরের আশ্রয় প্রার্থনা করি। বিপদে পড়লে আমরা "হে ঈশ্বর আমাকে বাঁচাও" বলে কান্নাকাটি করি। ওঙ্কারের উচ্চারণও সেই আন্তরিকতার সঙ্গে করতে হবে। মনে করতে হবে, এই বৈদিক মন্ত্র যেন আমাদেরকে আবৃত করে রাখে। এইভাবে বেদের সার ওঙ্কার মন্ত্রের দ্বারা নিজেকে আচ্ছাদিত করে ফেলতে হবে। বৈদিক মন্ত্র আমাদেরকে আচ্ছাদিত করে রাখতে পারে, তাই সমস্ত বৈদিক বা সাম-মন্ত্রকে বলা হয়ে থাকে "ছন্দ" .
১.৪.৩ - বলা হচ্ছে, আচ্ছাদন যদি হালকা হয়, অগভীর হয়, তবে বাইরে থেকে আচ্ছাদিত সামগ্রী দেখতে পাওয়া যায়। অগভীর জলের মাছ, জলের উপর থেকে দেখতে পাওয়া যায়। অগভীর জলের মাছকে ধরা জেলেদের পক্ষে সহজ হয়ে যায়। দেবতাগণ প্রথমে তিন বেদে উল্লিখিত সকাম কর্ম্ম করেও, মৃত্যুর নজরের মধ্যে ছিলেন। তাঁরা মৃত্যুকে অতিক্রম করতে পারেন নি। দেবতাগণ এই অবস্থা অর্থাৎ অসুরক্ষিত অবস্থার কথা বুঝতে পেরে, সমস্ত বৈদিক ক্রিয়া-কর্ম্ম বন্ধ করে, তিন বেদের অর্থাৎ ঋক, যজু, অথর্ব বেদের উর্দ্ধে যে ওঙ্কার তার আবৃত্তি করতে লাগলেন। তেমনি আমাদের সকাম কর্ম্ম অর্থাৎ সমস্ত বৈদিক কর্ম্মকান্ড আমাদের মৃত্যুর অধীনে রাখে। একটা সময় মানুষ বুঝতে পারে, সকাম কর্ম্মে আমাদের বারবার জন্ম মৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হতে হবে। এই বোধ যখন জাগ্রত হয়, তখন মানুষ ওঁকারের ধ্যান করতে শুরু করে। আর এই ওঁকারের ধ্যানের অবস্থায়, মানুষ বুঝতে পারে, মানুষ অজর, অমর ও অভয়।
১.৪.৪ - ঋক মন্ত্রের আদি অন্তে ওম উচ্চারণ করা উচিত। সাম-মন্ত্রের উচ্চারণের সময়ও মন্ত্রের আদি ও অন্তে ওম উচ্চারণ করা উচিত।
১.৪.৫ - যিনি ওংকারকে সঠিকরূপে জেনে তার উপাসনা করেন, তিনি এই অমৃতস্বরূপ অভয়রূপ ওম-স্বরে প্রবেশ করেন। অর্থাৎ অক্ষরের সঙ্গে অর্থাৎ যার ক্ষয় নেই, তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। দেবতাগণ ওঁকারের ধ্যান করে যেমন অমৃত লাভ করেছিলাম তেমনি সমস্ত মানুষ্য জাতি এই ওঙ্কারের ধ্যানে অমরত্ব বা অমৃতত্ব লাভ করতে পারেন।
--------
১.৫.১ - আমরা যাকে প্রণব বলে জানি, তা-ই উদ্গীথ, অনুরূপ ভাবে যা উদ্গীথ তাই প্রণব। সূর্যকে একাধারে প্রণব বা উদ্গীথ বলা হয়ে থাকে। সূর্য উদয়কালে ওম ধ্বনিতে মুখরিত করে, সমস্ত জগতের প্রকাশ করে থাকেন। সূর্য ওম উচ্চারণ করতে করতে আকাশমার্গে ভ্রমন করে থাকেন। আসলে ওম-এর উচ্চারণ করতে করতে মানুষ প্রতিনিয়ত নতুন থেকে নতুন প্রতিপন্ন হন, যা প্রণবের অর্থ। আবার উদ্গীথ যা নিজেকে প্রকাশিত করে বা উদ্গিরণ করে, তাকেই বলা হয় উদ্গীথ। তো আপনি যদি প্রতিনিয়ত উদ্গীথ-এর উচ্চারণ করেন, বা ধ্যান করেন, তবে, আপনার মধ্যে যত সুপ্ত শক্তি আছে, তা ধীরে ধীরে প্রকাশিত হবে। সূর্য্যের আবর্তন অনুযায়ী জীবকুল কর্ম্মে প্রবৃত্ত হয়। অতএব সূর্যদেবের আবর্তনকালে সূর্যদেব ওম উচ্চারণ করতে করতে জীবকূলকে স্ব-স্ব কার্যে অনুমতি ও অনুমোদন প্রকাশ করে থাকেন।
১.৫.২ ঋষি কৌষীতকি তার পুত্রকে বলেছিলেন, "আমি সুর ও তার রশ্মিকসমূহকে এক ও অভিন্ন ভেবে উপাসনা করেছিলাম। সেজন্য তুমিই আমার একমাত্র পুত্র। তুমি যদি সূর্য ও তার রশ্মিকে পৃথক ভেবে উপাসনা করো, তোমার বহু পুত্র হবে। একে অধিদৈবত উপাসনা বলে।
১.৫.৩ মুখ্যপ্রাণকে উদ্গীথরূপে উপাসনা করতে হবে। কারন, মুখ্যপ্রাণ ওম উচ্চারণ করে ইন্দ্রিয়সমূহকে অর্থাৎ কর্ম্ম ইন্দ্রিয় ও জ্ঞান ইন্দ্রিয়গুলোকে কার্য্যে নিযুক্ত করে।
১.৫.৪ - ঋষি কৌষীতকি আবার তার পুত্রকে বলেছিলেন, আমি প্রাণকে এম ও অভিন্ন সত্তারূপে উপাসনা করেছিলাম। সেজন্য তুমিই আমার একমাত্র পুত্র। "আমার বহুপুত্র হোক" তুমি যদি এই মনে করে প্রাণকে বহুগুণসম্পন্ন রূপে উপাসনা করো।
১.৫.৫ - যা উদ্গীথ তাই প্রণব। আবার যা প্রণব তাই উদ্গীথ। এই জ্ঞান যে উদ্গাতার হয়েছে, তিনি যদি যজ্ঞ অনুষ্ঠানের সময় মন্ত্রের উচ্চারণের সময় ভুলও করেন, তবে তা সহজেই সংশোধন করা যায়।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
ছান্দোগ্য উপনিষদ - (৫) প্রথম অধ্যায় - ষষ্ঠ খন্ড - ওঙ্কারের মাহাত্ম্য - GLORY OF ONGKAR
উপাসনা দূর রকম। ১. সরাসরি ব্রহ্ম উপাসনা ও ২. ব্রহ্মের প্রতীকের উপাসনা। ব্রহ্মকে যখন আমরা গুনবিশিষ্ট রূপে চিন্তন করতে পারি, তখন তা ব্রহ্ম উপাসনা। কিন্তু আমাদের চিত্ত পদার্থের সঙ্গে সংস্কারযুক্ত। পদার্থবিহীন গুনের চিন্তন আমাদের মধ্যে আসে না। আমরা যখন কোনো বস্তুর গুনের চিন্তন করি তখন আমাদের মনশ্চক্ষুতে সেই পদার্থের রূপ ভেসে ওঠে। আমরা যখন গুরুদেবের গুনের চিন্তন করি, তখন আমাদের মনে গুরুদেবের স্থুল দেহের ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমরা যখন এমনকি সৃষ্টি ও ধংসের -এর চিন্তন করি তখন আমাদের মনে সেই কাল্পনিক চিত্র চতুর্মুখ বিশিষ্ট শশ্রুধারী ব্রহ্মা, শ্মশানচারী অর্ধচন্দ্র শোভিত, নাগমালা পরিহিত , নীলকণ্ঠ শিব-এর মূর্তি ভেসে ওঠে। আবার আমরা যখন আমাদের পালনকর্তার কথা চিন্তা করি, তখন আমাদের চোখের সামনে এক সৌম্য মূর্তি ক্ষিরোদসাগরে শায়িত বিষ্ণুর চিত্র আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। এগুলো আসলে আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে শুনে কল্পনায় এঁকে নিয়েছি। এই মূর্তিগুলোর কোনো সত্যতা আছে কি না, সে প্রশ্ন আমাদের মনে কখনো আসেনি। আমাদের শাস্ত্রকারেরা এই মূর্তিগুলোর মধ্যে বিশেষ বিশেষ গুনের সমাহারের কথা শুনিয়েছেন। আমরাও বিশ্বাস করেছি। আসলে গুনের কোনো রূপ হয় না। আমাদের মতো স্বল্পবুদ্ধির মানুষকে গুনের কথা বোঝাতে এই রূপের কল্পনা করা হয়েছে। আর এগুলো লৌকিক পদার্থের চিত্র ছাড়া কিছু নয়। তাই আমাদের চিত্ত লৌকিক পদার্থের সংস্কারযুক্ত হবার জন্য, এই লৌকিক পদার্থকে পরিত্যাগ করে, আমরা রূপহীন ব্রহ্মে প্রবেশ করতে পারি না। আর এই কারণেই মহাত্মাগণ বলছেন, লৌকিক বস্তুর মধ্যে ব্রহ্ম চিন্তন করো। এইযে ব্রহ্মদৃষ্টিতে লৌকিক বস্তুর চিন্তন একেই বলে প্রতীক উপাসনা, বা লৌকিক বস্তুতে ব্রহ্ম চিন্তন, একেই বলে প্রতীক উপাসনা ।
এই প্রতীক আবার দুই প্রকার। একটা হচ্ছে যজ্ঞ বহির্ভূত আর একটি হচ্ছে যজ্ঞের অঙ্গ। যজ্ঞে মন্ত্রের উচ্চারণ করা হয়, আবার যজ্ঞে দ্রব্যের আহুতি দেওয়া হয়। প্রতীক আসলে দ্বারীভূত অবলম্বন। যেমন নাম, মন্ত্র, প্রার্থনাবাক্য, স্তুতিবাক্য বা বিশেষ আকৃতি বা অবয়ব। অর্থাৎ ব্রহ্ম থেকে অতিরিক্ত কিছু মায়িক পদার্থ হচ্ছে প্রতীক । যেমন বিষ্ণুর প্রতীক হিসেবে, আমরা শালগ্রামশীলাকে, বা শিবের প্রতীক হিসেবে আমরা বান-লিঙ্গকে আশ্রয় করি। সংক্ষেপে বলতে গেলে, অনাত্ম বস্তুটিকে আমরা যখন দেবতাজ্ঞানে বা ব্রহ্ম বুদ্ধিতে উপাসনা করি তখন তা হয়ে ওঠে প্রতীক উপাসনা। প্রতীকে কখনো আমাদের ব্রহ্ম সাক্ষাৎ, বা ব্রহ্মজ্ঞান বা ব্রহ্ম উপলব্ধি হতে পারে না। কারন তখনও আমরা প্রতীকের মধ্যেই ঘোরাফেরা করি। প্রতীকের ধ্যানে আমাদের প্রতীকের প্রাধান্য থাকে। এই জন্য স্থুল পদার্থ থেকে সুক্ষ পদার্থের ধ্যান যেমন ধ্বনি, আলোক, স্বাস অর্থাৎ বায়ু, ইত্যাদির ধ্যান উত্তম।
আমরা যে উদ্গীথ-এর ধ্যানের কথা আলোচনা করছিলাম, এটিও আসলে প্রতীক উপাসনা। এই ওঙ্কারের ধ্যান যজ্ঞের অঙ্গ। ছান্দোগ্য উপনিষদ আমাদের প্রথমে এই প্রতীকের উপাসনার কথাই বলেছেন, এবং ধীরে ধীরে আলোচনার শেষে আমরা প্রতীকের ধ্যান থেকে গুনের ধ্যানের মধ্যে প্রবেশ করবো। কিন্তু তার জন্য আমাদের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হবে। আমরা জানিনা আমরা কত জন্মের সাধনার পরে, আজ এই শরীর লাভ করেছি। তবে ছান্দোগ্য উপনিষদ কিন্তু পার্থিব পদার্থের অর্থাৎ বিনাশশীল পদার্থের সাধনা যা আমাদের প্রাথমিক জীবনের জন্য প্রযোজ্য, সেখান থেকে শুরু করেন নি। ছান্দোগ্য উপনিষদ প্রথমেই অক্ষরের অর্থাৎ যার ক্ষয় নেই, সেই ওম এর সাধনা থেকে শুরু করেছেন। অতএব, যারা সাধন জগতে খানিকটা অগ্রসর ব্যক্তি, তাঁদের পক্ষেই এই ওঙ্কারের ধ্যান উপযুক্ত। অগ্রসর ব্যক্তি নিরাকার ব্রহ্মের সাধনা করবেন, আর যারা একটু প্রাথমিক পর্যায়ে আছেন, তাঁরা স্থুল পদার্থের প্রতীকের সাধনা দিয়েই শুরু করবেন। মাধ্যবস্থায় ওঙ্কারের সাধনা ফলপ্রসূ হতে পারে।
যাই হোক, আমরা আবার ছান্দোগ্য উপনিষদের মধ্যে প্রবেশ করবো।
১.৬.১ - ঋক কথাটার অর্থ হচ্ছে স্তুতি। বেদ কথাটার অর্থ জ্ঞান। উপনিষদ-এর দ্রষ্টা ঋষি বলছেন, এই পৃথিবী হচ্ছে ঋকবেদ, আর অগ্নি হচ্ছে সামবেদ। আমরা জানি সাম বেদের মন্ত্র ঋক্বেদ থেকে গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ সামবেদ ঋকবেদে অধিষ্ঠিত । আবার সাম কথাটার অর্থ হচ্ছে অগ্নি, আর ঋক কথার অর্থ হচ্ছে পৃথিবী। পৃথিবী হচ্ছে "সা" আর অগ্নি হচ্ছে "অম" । সা ও অম-এর মিলনে সাম। অগ্নি ও পৃথিবীর মিলনে ওঁকার। একে অন্যের উপরে নির্ভরশীল।
১.৬.২ ঋষি আবার বলছেন, অন্তরীক্ষ হচ্ছে ঋক, আর বায়ু হচ্ছে সাম। সাম যেমন ঋক-এ অধিষ্টিত তেমনি বায়ু অন্তরীক্ষে অধিষ্ঠিত । সা অর্থে অন্তরীক্ষ, আর অম অর্থে বায়ু। অর্থাৎ অন্তরীক্ষ ও বায়ুর মিলনে সাম।
১.৬.৩ - মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি পুনরায় বলছেন, আকাশকে ঋক রূপে জানবে। আর সূর্য্যকে সাম বলে জানবে। সূর্য যেমন আকাশে প্রতিষ্ঠিত, সাম তেমনি ঋকে প্রতিষ্ঠিত। আর এই দুয়ের মিলনে সাম। অর্থাৎ আকাশ ও সূর্য্যের মিলনেই সাম।
১.৬.৪ - ছান্দোগ্য উপনিষদ বলছেন, নক্ষত্র সমূহ হচ্ছে ঋক, আর চাঁদ হচ্ছে সাম। তো এই সাম বা চন্দ্র ঋকে অর্থাৎ নক্ষত্রসমুহের উপরে অধিষ্ঠিত। সা অর্থে নক্ষত্ররাজি, আর চাঁদ হচ্ছে অম। এই দুইয়ের মিলনেই সাম।
১.৬.৫ - সূর্য্যের এইযে শুভ্র দীপ্তি একেই বলে ঋক। সূর্য্যের দুটি আভা। একটি কৃষ্ণবর্ণ আর একটি নীলবর্ণ। সূর্য্যের এই যে কৃষ্ণবর্ণের আভা একেই বলা হয় সাম। সূর্য্যের এই কৃষ্ণবর্ণ হচ্ছে সাম, আর সূর্য্যের জ্যোতি হচ্ছে ঋক। উপনিষদের ব্যাখ্যাকারগন বলছেন, সূর্য্যের এই কৃষ্ণবর্ণ আভা সাধারণ মানুষে দেখতে পান না। কিন্তু যারা শুদ্ধমনের অধিকারী কেবলমাত্র তারাই সূর্য্যের এই কৃষ্ণ-আভা দেখতে পান।
১.৬.৬ - ঋষি বলছেন, সূর্য্যের শুভ্র জ্যোতিই সাম। "সা" অর্থাৎ অক্ষর, আর গভীর কৃষ্ণআভা হচ্ছে "অম"। এই দুইয়ের মিলনে সাম। জ্যোতি অর্থাৎ আলো, আর কৃষ্ণ অর্থাৎ অন্ধকার। সূর্য্যের মধ্যে আলো-অন্ধকার দুইই আছে। আর এই সূর্য্যের মধ্যেই আছেন, অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। অর্থাৎ গুনের সমাহার। এই গুন্গুলোকে অর্থাৎ অধিষ্ঠাত্রী দেবতাকে বলা হচ্ছে হিরণ্ময় অর্থাৎ স্বর্নবর্ণের। অর্থাৎ উৎকর্ষতার প্রতীক এই স্বর্ণবর্ন। উপনিষদ বলছেন, সূর্য্যের এই অধিষ্ঠাত্রী দেবতাকে জিতেন্দ্রিয় যোগীপুরুষগন দেখতে পান।
১.৬.৭ - সূর্যকে বলা হচ্ছে কপ্যাসম। কপিকলের কথা আমরা শুনেছি বা অনেকে দেখেছি। কপিকল হচ্ছে কুয়ো থেকে জল তুলবার যন্ত্র। সূর্য হচ্ছে সৌরলোক থেকে জল তোলার যন্ত্র। সূর্য তার বিকিরিত তাপের সাহায্যে পৃথিবীর সমস্ত জলকে উর্দ্ধগতি সম্পন্ন করতে পারে। শুধু জল নয়, পার্থিব সমস্ত কিছুকে অগ্নি উর্দ্ধমুখী করে দেয়। সমস্ত মালিনতাকে মুছে দেয় এই সূর্য। তো সূর্য আমাদেরকে পবিত্র করে। তাই সূর্য আমাদের পবিত্রতার প্রতীক। এইভাবে যিনি সূর্যকে জেনেছেন, তিনি সমস্ত পাপ রূপ মলিনতা থেকে মুক্ত থাকতে পারেন।
১.৬.৮ - ঋক ও সামবেদে এই সূর্য দেবতার স্তুতি উদ্গীথ রূপে গীত হয়েছে। উদ্গীথ-এর গায়ক হচ্ছেন উদ্গাতা। স্বয়ং সূর্যদেব এই উদ্গীথ গায়ক। অতয়েব তিনি উদ্গাতা। সূর্যলোকের উর্দ্ধে যেসব লোক আছে আদিত্যমন্ডলের এই দেবতা, সেইসব লোকেরও ঈশ্বর। তিনি দেবতাদের কাম্যবস্তু সমুহেরও বিধাতা অর্থাৎ দেবতাদের কামনা পূরণ করে থাকেন, এই সূর্যদেব।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
ছান্দোগ্য উপনিষদ - (৬) ওঙ্কারের মাহাত্ম্য - GLORY OF ONGKAR/CHANDOGYA UPANISHAD -
প্রথম অধ্যায় - সপ্তম ও অষ্টম খন্ড - IST CHAPTER SEVENTH & EIGHTH PART
১.৭.১ - ঋকবেদের শ্লোকগুলোকে বলে ঋক অর্থাৎ ঈশ্বরের স্তুতি হচ্ছে কিছু বাক্য মাত্র। আমরা জানি, বাক্য উচ্চারিত হয় প্রাণের সাহায্যে। আবার সামবেদের মন্ত্র গুলো ঋকবেদ থেকে গৃহীত হয়েছে । তাহলে এটা বলা যায়, সাম ঋকে প্রতিষ্ঠিত। সা বলতে বাক আর অম বলতে প্রাণ। তো বাক ও প্রাণের মিলনে হলো সাম।
১.৭.২ : আমরা জানি সমস্ত মন্ত্র যা লিখিত তা আমাদের চোখে ধরা পরে। তো চোখকে বলা হচ্ছে ঋকবেদ। আর সাম হচ্ছে আত্মা কারন আত্মাই প্রতিবিম্বিত হয়। সামবেদে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে ঋকবেদ। তাই চোখ হলো সা আর আর চোখে প্রতিবিম্বিত যে দেহ বা রূপ হলো অম। এই দুইয়ের মিলনে হলো সাম।
১.৭.৩ - কান হচ্ছে ঋক, আর মন হচ্ছে সাম। কেননা কর্ণেন্দ্রিয়ই মন্ত্রের শ্রোতা। আর আমরা জানি কর্ন-সহ সমস্ত ইন্দ্রিয়ের রাজা হচ্ছেন মন। এই মনই ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে সমস্ত বিষয়কে গ্রহণ করে থাকে। তাই মন হচ্ছে সাম। কর্ন হচ্ছে ঋক। তাই কর্ন হচ্ছে সা মন হচ্ছে অম। দুয়ে মিলে সাম।
১.৭.৪. চোখের যে শুক্ল আভা অর্থাৎ মনি তাকে বলা হচ্ছে ঋকবেদ। আর এই মনির যে গাঢ় নীল আভা তাকে বলা হচ্ছে সাম। আবার সা বলতে শুক্ল আভা, আর অম বলতে গাঢ় নীল আভা। এই দুইয়ে মাইল সাম।
১.৭.৫ - চোখের অভ্যন্তরে এক পুরুষ অবস্থান করছেন, তিনি তিন-বেদ অর্থাৎ ঋক, সাম, যজুঃ। সূর্য্যের অভ্যন্তরে যে পুরুষ আছেন, আমাদের চোখের অভ্যন্তরেও সেই একই পুরুষ আছেন। ঋক ও সাম মন্ত্রে এই উভয় পুরুষেরই স্তুতিগান করা হয়েছে।
সৌরজগতের অধিপতি পুরুষ এই জগৎকে প্রকাশ করছেন। সেই একই পুরুষ আমাদের চোখের, কর্নের, বাকের ইত্যাদি ইন্দ্রিয়সমূহের মধ্যে দিয়ে জগৎকে প্রকাশ করছেন। এই পুরুষই আমাদের সকল ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্তা।
১.৭.৬ - তো চোখের যিনি পুরুষ তিনিই লোকসমূহের প্রকাশকর্তা। তাঁর অধীনেই লোক সমূহ এবং মানুষের মন। চক্ষু মধ্যস্থ সেই পুরুষ তার শরীরে অধিষ্ঠিত আত্মা থেকে অধঃস্থন যেসব লোক আছে, তাদের তিনি শাসন করেন। মানুষের কামনা বাসনারও অধিপতি ইনি। সেইজন্য এই যারা বীনা যন্ত্রে গান করেন, তারা প্রকৃতপক্ষে এই পুরুষের সম্মানার্থে গান করে থাকেন। তো কামনা-বাসনার অধিপতির উদ্দেশ্যে যিনি উদ্গীথ উচ্চারণ করেন, উপনিষদ বলছেন, এই গায়করা ধনী হন।
১.৭.৭ - উপনিষ উক্ত এই চক্ষু মধ্যস্থ পুরুষ ও আদিত্য পুরুষ এই দুইই এক এবং উদ্গীথ এই পুরুষের উদ্দেশ্যেই গীত হচ্ছে, এইভাবের মধ্যে থেকে যিনি সাম গান করেন, অর্থাৎ উদ্গীথ উচ্চারণ করেন তিনি আদিত্য থেকে উর্দ্ধলোকে যেসব দেবতা আছেন, তাদের কাম্যবস্তুও প্রাপ্ত হন। বস্তুতঃ এই উদ্গাতাই দেবতা হয়ে যান।
১.৭.৮ আবার চাক্ষুস পুরুষের চেয়ে নিচে যেসব অধঃস্থন লোক আছে, চাক্ষুস পুরুষের কৃপায় সেই সব লোক অর্থাৎ মানুষের যা কাম্য, তাও লাভ করেন। এই কারণেই বলা হয়ে থাকে,
১.৭.৯. চোখের অভ্যন্তরে যে পুরুষ অবস্থান করছেন, তিনিই পৃথিবী ও তৎ সংশ্লিষ্ট লোকের নিয়ন্তা। তো সেখানে অর্থাৎ পৃথিবীতে যারা বাস করছেন, অর্থাৎমানুষ বা প্রাণিকুল - এদের যা কিছু বাসনা, তা এই চক্ষু পুরুষের কৃপায়, উদ্গীতা লাভ করে থাকেন।
এবার আমরা উদ্গীথে যেসব কুশীলব আছেন, তাদের কাছ থেকে উদ্গীথ সম্পর্কে শুনবো।
১.৮.১ প্রাচীন কালে শলাবত-পুত্র শিলক, চিকিতানের পুত্র চৈকিতান, এবং জিবল-পুত্র প্রবাহন, এই তিনজন উদ্গীথ বিদ্যায় পারঙ্গম ছিলেন। এর মধ্যে প্রবাহন ছিলেন, ক্ষত্রিয়। আর শিলক ও চিকিতান ছিলেন ব্রাহ্মণ।
১.৮.২ তো সেকালে ব্রাহ্মণদের জ্ঞান-বিদ্যার প্রথম অধিকার ছিল। যদিও জনক ইত্যাদি রাজন্য-বর্গ ব্রহ্মবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন, তথাপি ব্রাহ্মণদের এই বিদ্যায় অধিকার স্বীকৃত ছিল। তাই প্রথমে প্রবাহন দুই ব্রাহ্মণদের বিচার শুনতে চাইলেন।
১.৮.৩-৪-৫ শিলক অনুমতি সাপেক্ষে প্রথম প্রশ্ন করলেন দাল্ভ্য চৈকিতানকে
শিলক : সামের আশ্রয় কি ?
দাল্ভ্য - স্বর
শিিলক - স্বরের আশ্রয় কি ?
দালভ্য - প্রাণ।
প্রাণের আশ্রয় কি ?
প্রাণের আশ্রয় অন্ন।
অন্নের আশ্রয় কি ?
অন্নের আশ্রয় জল।
জলের আশ্রয় কি ?
জলের আশ্রয় ওই স্বর্গলোক।
ওই স্বর্গ কোথায় প্রতিষ্ঠিত ?
ওই স্বর্গলোককে অতিক্রম করা যায় না। আমরা সামকে স্বর্গলোকে প্রতিষ্ঠিত বলে জানি, তাই সামকে স্বর্গরূপে স্তুতি করা হয়।
১.৮.৬ - দালভ্য - তাহলে আপনার সাম আশ্রয়বিহীন।
শিলক - এবার নিজের উক্তির সমর্থনে শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বললেন, এ বিষয়ে যেন কোনো সন্দেহ প্রকাশ না করেন।
১.৮.৭ - দালভ্য আবার প্রশ্ন করলেন। ওই স্বর্গলোকের প্রতিষ্ঠা কি ?
শিলক - এই পৃথিবী।
পৃথিবীর আশ্রয় কি ?
এই পৃথিবী লোককে অতিক্রম করে, সামকে অন্যত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এই পৃথিবীই সামের প্রতিষ্ঠা। আর সামকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত রূপেই স্তুতি করা হয়।
১.৮.৮ - প্রবাহন জৈবলি বললেন, তাহলে আপনার সাম অনন্ত নয়। তখন শিলক শালাবাত্য বললেন, তাহলে সাম বিষয়ে প্রকৃত সত্য কি তা আপনার কাছে জানতে চাই। জৈবলি বললেন শুনুন তাহলে। জৈবলির জবাব আমরা পরের দিন শুনবো।
আসলে, ছান্দোগ্য উপনিষদ ধীরে ধীরে মানুষকে বহির্জগৎ জগৎ থেকে অন্তর্জগতে অধিষ্ঠিত করে দেয়। বিশ্বব্রহ্মান্ড থেকে ধীরে দেহভান্ডে, এর পর অন্তরের অন্তঃস্থলে মনকে নিয়ে আসন পেতে দেয়। আমরা যদি শুধু কান পেতে মন দিয়ে উপনিষদের কথাগুলো শুনি, তবে এই সত্য ধরতে পারবো ।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
------------
ছান্দোগ্য উপনিষদ - ৭ CHANDOGYA UPANISHAD - PART -7
১.৯.১ - শিলক - এই পৃথিবীর আশ্রয় কি ?
প্রবাহন - আকাশ। এই সমস্ত ভূতবর্গ (বায়ু, অগ্নি, জল, পৃথিবী) আকাশ থেকেই উৎপন্ন হয়, আকাশেই অবস্থান করে, আবার আকাশেই লয় প্রাপ্ত হয়। অতয়েব আকাশ সব কিছু থেকে শ্রেষ্ঠ। সুতরাং আকাশ সবকিছুর পরমাগতি।
১.৯.২ - আগে আমরা শুনেছি, উদ্গীথ শ্রেষ্ট ও অনন্ত। তো এই অনন্ত আকাশকে যিনি উদ্গীথ জেনে উপাসনা করেন, তিনি ধীরে ধীরে উছ্ত্র লোকসমূহ লাভ করে থাকেন। এবং মানুষ হিসেবে উন্নততর হয়ে ওঠেন।
১.৯.৩ - পুরাকালে অতিধন্বা নাম এক ঋষি ছিলেন। অতিধন্বার পিতা ছিলেন শুনক। অতিধন্বা, শৌনক ঋষির শিষ্য উদরশান্ডিল্যকে বলেছিলেন, যতদিন তুমি ও তোমার বংশের লোকেরা, এই উৎগীত বিদ্যা জানবে, ততদিন তাদের জীবন সাধারণ লোকের জীবন অপেক্ষা উন্নত হবে।
১.৯.৪ - উদ্গীথ-এর উপাসনা শুধু ইহলোক নয়, পরলোকেও উৎকৃষ্ট জীবন লাভের উপায়।
--------
১.১০.১ - একবার শিলাবৃষ্টিতে কুরুদেশের সমস্ত ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়। এতে করে ঋষি চক্রের পুত্র ঊষস্তি নিদারুন অন্নকষ্টে পড়েন। তো ঊষস্তি ঘরবাড়ি ছেড়ে, তার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ইভ্য গ্রামে চলে যান। ইভ্য কথাটার অর্থ হাতি। তো সমৃদ্ধ গ্রামের কথা বলতে গিয়ে এই ইভ্য সমৃদ্ধ গ্রামের কথা বলা হয়েছে। যেখানে লোকে হাতি পুষবার মতো আর্থিক ক্ষমতা ভোগ করে থাকেন।
১.১০.২ - ছান্দোগ্য উপনিষদের প্রথমেই, উদ্গীথকে শ্রেষ্ট এবং অনন্ত বলা হয়েছে। যিনি উদ্গীথকে এই শ্রেষ্ঠ ও অনন্ত পরমাত্মা জেনে উপাসনা করেন, তিনি উত্তরোত্তর উচ্চতর লোকসমূহ প্রাপ্ত হন। এই উপাসকের জীবন উত্তরোত্তর উন্নততর হয়।
.
,
No comments:
Post a Comment