Sunday, 17 October 2021

ব্যাসদেব/LIFE OF HRISHI BYASDEV

 


ঋষিবর ব্যাসদেবের  জীবনচরিত
 
ওম নারায়নাং নমস্কৃত্য নরঞ্চৈব নরোত্তমম
দেবী সরস্বতীঞ্চৈব তত জয় মুদিরয়েৎ। 
ব্যাসায় বিষ্ণুরূপায় ব্যাসরূপায় বিষ্ণবে
   নমো বৈ ব্রহ্মবিষয়ে বাশিষ্ঠায় নমো নমঃ।    

হিন্দুদের প্রচলিত স্বীকৃত সমস্ত ধর্ম্মশাস্ত্রের মধ্যেই আমরা ঋষি ব্যাসদেবের ছবি  দেখতে পাই। প্রাচীনকালে,  বেদ অর্থাৎ জ্ঞানভান্ডার  প্রথমে ঋষি পরম্পরায় মুখে মুখে, কানে কানে  প্রচারিত হতো।কালের সঙ্গে সঙ্গে,  এই বিশাল জ্ঞানের ভান্ডার এক সময় বর্ধিত হতে হতে এমন আকার নিলো, যা একজন শিষ্যের পক্ষে বহন করা, অর্থাৎ একজনের  স্মৃতিতে ধরে রাখা  অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। ফলত সামগ্রিক জ্ঞানের প্রচারে বাধা সৃষ্টি হতে লাগলো । এমনকি বিশেষ বিশেষ ঋষি-আচার্য্যের  দেহত্যাগের ফলে এই জ্ঞান হারিয়ে যেতে লাগলো। এইসময়,  ঋষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন এই জ্ঞানের ভান্ডারকে সংগ্রহ করতে শুরু করলেন। তিনি   বিভিন্ন ঋষির দ্বারে দ্বারে  ঘুরে এই জ্ঞানকে একজায়গায় লিপিবদ্ধ করতে শুরু করলেন। লিপিবদ্ধ করবার সময় খেয়াল করলেন, এই জ্ঞানের বিষয় ভিন্ন ভিন্ন। তো এই বিষয়ভেদে জ্ঞানের বিশাল ভান্ডারকে খন্ডিত করে তিনি চার ভাগে ভাগ করলেন। এতে সুবিধে হলো, আচার্য্য এখন চারজন কে আলাদা আলাদা বিষয়-জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে তুলতে সমর্থ হলেন । আর লিপিবদ্ধ হবার ফলে, জ্ঞান সংরক্ষিত করবার এবং আচার্য্যের মৃত্যুর পরেও, পরবর্তী জ্ঞানপিপাসুগন এই অমূল্য জ্ঞানের স্বাদ পেতে লাগলেন। এই দুরূহ কাজ করবার জন্য, ঋষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন সমস্ত ঋষি কুলের কাছে সশরীরে উপস্থিত হয়েছিলেন। ফলত ঋষি কৃষ্ণ  একজন পরিচিত নাম হয়ে উঠলো, সমস্ত ঋষি-মুনিদের কাছে । তার নাম হয়ে উঠলো বেদব্যাস, অর্থাৎ বেদের বিভাজক। ব্যাসদেবের যেমন একজন আত্মজ পুত্র শুকদেব ছিলো, যাঁকে  তিনি তার সমস্ত অর্জিত বিদ্যা দান  করেছিলেন, তেমনি বেদ বিভাজন করে তার চার শিষ্যদেরকে আলাদাভাবে এক-এক বেদের জ্ঞানে বিশেষজ্ঞ করে তুলেছিলেন, চারজনকে । এঁরা  ছিলেন ঋকবেদ - পৈলা, সামবেদ - জৈমিনি,  যজুর্বেদ -বৈশম্পায়ন,  অথর্ববেদ- সুমন্তু।  

এই ব্যাসদেবই  মহাভারতের মতো বিশাল গ্রন্থের স্রষ্টা, এমনকি ১৮টি পূরানের  লেখক। বিষ্ণু, পদ্ম, নারদ, গরুড় , বরাহ, ভাগবত,  মৎস, কূর্ম্ম, লিঙ্গ, শিব, শঙ্খ, অগ্নি, ব্রহ্মান্ড, ব্রহ্মবৈবর্ত, মার্কেন্ডেয় , ভবিষ্য়, বামন, ব্রহ্মপুরান।   এই আঠারোটি পুরাণের মধ্যে ১০টি পুরাণেই  (বিষ্ণুপুরাণ  ব্রহ্মপুরাণ, পদ্মপুরাণ বায়ুপুরাণ গরুড়পুরাণ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ স্কন্দপুরাণ বামন পুরাণ কূর্মপুরাণ ও দেবী ভাগবতম ) কৃষ্ণকথা আছে -

  আমার মনে প্রশ্ন জাগে, এই যে বিশাল জ্ঞানের যিনি বিতরণ করেছেন, তিনি না জানি কতই অসাধারন পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। মাঝে মধ্যে মনে হয়,  তিনি কি একই ব্যক্তি ? নাকি অনেক ব্যক্তি, ব্যাসদেবের নাম ব্যবহার করে, এইসব ধর্ম্মগ্রন্থ রচনা করেছেন। এর কোনো সঠিক  উত্তর আজো পাওয়া যায় না। 

তবে যিনি বেদের জ্ঞান সংগ্রহ করেছিলেন, এবং এই বিশাল জ্ঞানের ভান্ডারকে বিভাজন করে যুগ যুগ  ধরে, নিজের নামকে স্বর্ণাক্ষরে উজ্বল করেছেন, সেই  ব্যাসদেব তাঁর  আসল নাম কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। আমাদের খুব জানতে ইচ্ছে করে,  তার জীবন কেমন ছিল, তিনি কত বছর বেঁচে ছিলেন ? তাঁর  বংশ পরিচয়ই বা কি ? কে তার পিতা-মাতা, কেমন ছিল তার শৈশব। আজ থেকে  আমরা সেই কথাগুলো উত্তর  খুঁজে বের করবার চেষ্টা করবো। ব্যাসদেবের কোনো জীবনীগ্রন্থ আছে কি না তা আমি জানি না। তবে তার রচিত  গ্রন্থগুলো পড়লে তার জীবনের খণ্ডিত  কিছু সময়ের কথা আমাদের কাছে ধরা পড়ে। 

ব্যাসদেবের মা ছিলেন সত্যবতী। পিতা ছিলেন ঋষি পরাশর। মা-সত্যবতীর  পালক পিতা ছিলেন নিষাদরাজ্ । নিষাদরাজ্ ছিলেন, মৎসজীবি।  এই কাজের ফাঁকে নৌকা নিয়ে যমুনা নদীতে যাত্রী পারাপার করতেন।  এঁরা তখনকার সমাজে ছিল ভূমিপুত্র অনার্য শুদ্র। সত্যবতী আসলে মৎসকন্যা। সত্যবতীর জন্ম হয়েছিল মাছের পেটে। নিষাদরাজ মাছের পেট  থেকে এই মৎসকন্যাকে খুঁজে পেয়েছিলেন । এই মাছটি পাওয়া যায় শুক্তিমতী নদীতে। এই মাছটি নাকি আসলে আদ্রিকা নামে  এক অপ্সরা। ব্রহ্মশাপে মৎস জন্ম লাভ করেন। আর সত্যবতীর আসল পিতা  ছিলেন চেদিরাজ। যাঁর শুক্র ভক্ষনের ফলে এক  কন্যা ও এক পুত্র আসে মৎসরূপী অপ্সরার আদ্রিকার  গর্ভে। চেদিরাজ ও আদ্রিকার  এই কন্যার নাম মৎসগন্ধা  বা সত্যবতী বা য়োজনগন্ধা  হয়েছিল।  

ব্যাসদেবের পিতা ছিলেন পরাশর  মুনি।  ব্রহ্মা পুত্র বশিষ্ট, বশিষ্ট  মুনির পুত্র শক্তিমুনি, শক্তিমুনির  পুত্র ঋষি পরাশর । অর্থাৎ প্রথমে ব্রহ্মা - বশিষ্ঠ - শক্তি- পরাশর - ব্যাসদেব । তো মোটামুটি ব্যাসদেবের একটা বংশ পরিচয় পাওয়া  গেলো। 

ব্যাসদেবের জন্ম-প্রক্রিয়া একটা অদ্ভুত প্রক্রিয়ার সাহায্যে হয়েছিলো। ঋষি পরাশর  যমুনা পার  করে অপর তীরে যাবেন। যমুনার তীরে এসে দেখেন  পারাপারের নৌকা আছে একটি, কিন্তু মাঝি নেই সেখানে বসে আছে  একটি মেয়ে। নদী পার করবার জন্য, মেয়েটি রাজি হয়ে গেলো।  কিন্তু নৌকায় বসে ঋষি পরাশরের মনে সুন্দরী মৎসজীবীর কন্যাকে  সন্তান দানের ইচ্ছে বলবতী হলো। এই অভিলাষ পূরণের জন্য, মৎসগন্ধার দেহে সুগন্ধের আবির্ভাব ঘটে। এবং তিনি গন্ধবতী বা যোজনগন্ধা নামে  পরিচিত হন। 

এদিকে সত্যবতী যমুনা  নদীর  তীরে এক পুত্র প্রসব করলেন।  জন্ম থেকেই ব্যাসদেবের গায়ের রঙ ছিল কালো। তাই তাকে বলা হতো কৃষ্ণ।  আর দ্বীপ যার আশ্রয় বা অয়ন তাকে বলা হয় দ্বৈপায়ন। তো যমুনা নদীর একটা দ্বীপে এই কৃষ্ণের জন্ম - তাই কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। প্রভূত তেজ-সম্পন্ন এই পুত্র জন্মের পর থেকেই, তপস্যায় রত থাকতেন। একদিন মাকে  বললেন, মানুষের আয়ু অতি অল্প। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের শক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে থাকে।  মহান ঋষিদের তেজাত্মক জ্ঞানের বাণী আমার অন্তরে প্রষ্ফুটিত হয়েছে। সেই জ্ঞানের বাণী   আমাকে রক্ষা করতে হবে। ভবিষ্যৎ মনুষ্যের কল্যাণার্থে  জগতে প্রচার করতে হবে। আপনার অনুমতি সাপেক্ষে এই কাজের জন্য, আমাকে পৃথিবীর সমস্ত মুনিঋষিদের কাছে গমন  করতে হবে। আমাকে এই জ্ঞানের সংগ্রহ করতে হবে, ভবিষ্যৎ মানুষের কল্যাণের জন্য।  আপনি অনুমতি করুন, আমি ঋষি-অভিমুখে গমন করি। মাতা সত্যবতী পুত্রকে বাধা দিলেন না, বললেন, তাই হোক, কিন্তু মনে রেখো মায়ের কথা। কৃষ্ণ বললেন, হে মাতঃ, কার্যকাল উপস্থিত হলে, আমাকে স্মরণ করলেই আমি আসবো। (অন্য এক কাহিনীতে আছে, কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ট হয়েই পিতার সাথে চলে যান।  সেক্ষেত্রে আমরা ধরে নিতে পারি, কৃষ্ণ দ্বৈপায়ণ তার পিতা ঋষি পরাশরের কাছেই বিদ্যাশিক্ষা লাভ করেছিলেন) 

এর পরের কাহিনী আমাদের জানা নেই।  তবে তার লেখা থেকে আমরা বুঝতে পারি, ঋষি যাজ্ঞবল্ক, ও তার গুরুদেব বৈশম্পায়ণ, ঋষি বিশ্বামিত্র, আঙ্গিরস, কান্ব, গৌতম, কাশ্যপ, জমদগ্নি ,মৈত্রা বারুনী, অত্রি    .....................ইত্যাদি বহু মনিষীর পর্ণকুটিরে তিনি ঘুরে ঘুরে জ্ঞানের কথা শ্রবণ করেছিলেন, এবং তা লিপিবদ্ধ আকারে সংগ্রহ করেছিলেন। যা আসলে বেদ বা ব্রহ্মজ্ঞান নামধেয়।

এখন কথা হচ্ছে, এই কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন কবে জন্মে ছিলেন, তার কোনো প্রামাণ্য তথ্য আমাদের জানা নেই। তবে  কথা হচ্ছে, বেদের বিভাজনের বা লিপিবদ্ধের সময়/তারিখ   যদি আমরা জানতে পারতাম তবে হয়তো একটা অনুমান করতে পারতাম, ব্যাসদেবের জন্ম কবে হয়েছিল। কেউ বলেন, বেদবিদ্যা  যদিও বহু পুরানো,  কিন্তু এগুলো সংকলিত হয়েছিল, খ্রিস্ট জন্মের ১৫১৬ বছর  আগে। আবার কেউ বলেন, খ্রিষ্ট জন্মের ৮০০০ বছর আগেও অথর্ব বেদের বিদ্যমানতা প্রতিপন্ন হয়। এখন কথা হচ্ছে বেদজ্ঞানের স্থিতিকাল হিসেবে ব্যাসদেবের আবির্ভাবের তিথি অনুমান করা যাবে না। আর এছাড়া এমন অনেক মুনি ঋষি ছিলেন, যাদের স্থিতিকাল নির্দিষ্ট করা খুবই মুশকিল। বিশ্বামিত্র মুনি রামায়ণের যুগে অর্থাৎ সত্যযুগেও ছিলেন, আবার দ্বাপর  যুগেও ছিলেন। এমনকি বলা হয়ে থাকে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন স্বয়ং বিষ্ণুর অবতার।  তিনি নাকি এখনো পৃথিবীতে বিচরণ করছেন। আসলে এইসব মহাপুরুষদের কীর্তি তাদেরকে চিরজীবী করেছে। তাঁদেরকে অমর  করে রেখেছে।    তো এদের জন্ম মৃত্যু সম্পর্কে কিছু বলা মানে  কল্পনা বিলাস মাত্র।   

যাই হোক, এর পরে, আমরা এই কৃষ্ণ দ্বৈপায়ণের  সাক্ষাৎ পাই, মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্র-পান্ডু ও বিদুরের  জন্মের সূচনায় । ততক্ষনে সত্যবতীর বিয়ে হয়েছে, রাজা শান্তনুর সঙ্গে। তাদের  দুই পুত্র জন্মেছে - চিত্রাঙ্গদ ও  বিচিত্রবীর্য। চিত্রাঙ্গদ অকালে শরীর ছেড়ে দেয়। রাজা শান্তনুর মৃত্যুর পরে,  বিচিত্রবীর্য রাজা হন। বিচিত্রবীর্য সন্তানহীন অবস্থায়, দুই জন স্ত্রীকে রেখে দেহত্যাগ করেন। তো তখন রাজা শান্তনুর সিংহাসন  শূন্য হয়ে গেলো। 

 যদিও  গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম বা দেবব্রত  রাজা শান্তনুর প্রথম পু/ত্র।  তৎসত্ত্বেও দেবব্রত প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তিনি রাজ্ সিংহাসনে বসবেন না, আর কাউকে বিয়েও করবেন না, সংসার করবেন না। আর এই ভীষণ প্রতিজ্ঞা করবার জন্য, দেবব্রত পরিচিত হলেন, ভীষ্ম নামে। ইনি থেকে গেলেন ব্রহ্মচারী হয়ে । 

রাজা শান্তনুর বংশ রক্ষার জন্য, বংশধরের আবশ্যক হয়ে  পড়লো। মাতা সত্যবতী, বিচিত্রবীর্যের স্ত্রীরদের  গর্ভে সন্তান আনয়নের জন্য, আয়োজন করতে লাগলেন। তখনকার সমাজে স্ত্রীর গর্ভের সন্তান, তা সে যিনিই গর্ভদান করুন না কেন, বা যার সংসর্গে এই সন্তান আসুক না কেন, তার বিবাহিত স্বামীর পরিচয়ে পরিচিত হতেন। অতয়েব রাজা শান্তনুর স্ত্রীর গর্ভে যদি সন্তান আসে, তবে সেই সন্তান রাজা শান্তনুর বংশধর হিসেবে স্বীকৃতি পাবে সমাজে । তো মাতা সত্যবতী, এই কাজে প্রথমে শান্তনুর প্রথম সন্তান, দেবব্রতকে নিয়োগ করতে চাইলেন। কিন্তু দেবব্রত এই প্রস্তাবে রাজী হলেন না।      

তো  মহামতি আবাল্য ব্রহ্মচারী ভীষ্ম যখন সৎ-মা সত্যবতীর  নির্দেশ সত্ত্বেও পুত্রার্থে ভ্রাতৃবধূদের সঙ্গে মিলনে অস্বীকার করলেন, তখন সত্যবতীর কৃষ্ণদ্বৈপায়নকে অর্থাৎ তার প্রথমপুত্রকে  স্মরণ করলেন। ততক্ষনে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদের বিভাজনের মতো দুরূহ কাজ সম্পাদন করে ফেলেছেন, এবং ব্যাসদেব নামে খ্যাত হয়েছেন। মহান তপস্বী হয়ে সন্ন্যাস জীবন যাপন করছেন। ব্যাসদেবের কথায় জানা যায়, এই সময় তিনি একটা ঘোর-তামসিক-তপস্যায় রত ছিলেন। কিন্তু মায়ের আদেশ অগ্রাহ্য  করতে পারলেন না। উপস্থিত হলেন, মায়ের রাজ্ প্রাসাদে।  

---------------

( এই প্রসঙ্গে একটা কথা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না, যে ব্যাসদেবের এক পুত্র ছিল। যদিও এই শুকদেবের জন্ম হয়েছিল, এই ঘটনার অনেক পরে। 

শুকদেবের জন্ম বৃত্তান্ত :  ব্যাসদেবের যখন প্রায় ১০০ বছর বয়স, তখন তার মনের মধ্যে একজন উত্তরাধিকারীর প্রয়োজন অনুভব করেন। আর তাই যজ্ঞের আগুনে লাঠি দিয়ে উস্কে শুকদেবের জাগরণ ঘটিয়েছিলেন। অন্যমতে শুকদেবের মাতা ছিলেন, জাবালি ঋষির কন্যা পিঞ্জালী।  এই শুকদেব ছিলেন শ্রুতিধর। যা কিছু শুনতেন, তা হুবহু পুনরাবৃত্তি করতে পারতেন। অন্য একটা কাহিনী আছে।  আর তা হলো ঘৃতাচী নামে  এক অপ্সরা তোতাপাখির মতো সুন্দর রূপ নিয়ে ঋষি ব্যাসদেবের সামনে দিয়ে চলে যায়।  এতে করে, ব্যাসদেব কামার্ত হয়ে পড়েন। তাঁর বীর্যস্খলন ঘটে। এই বীর্য  কিছু যজ্ঞকাষ্ঠের (লাঠির) উপরে পড়ে । সেখান থেকে জন্ম হয় শুকদেবের। )

----------------

মায়ের স্মরণ মাত্রই ঋষি ব্যাসদেব মায়ের রাজপ্রাসাদে এসে উপস্থিত হয়েছেন। সত্যবতী বহুদিন পরে, পুত্ৰমুখ দর্শন করে, তৃপ্ত হলেন।  তাকে স্নেহপাশে আলিঙ্গন করলেন। মাতাপুত্রের মিলনে, আনন্দাশ্রু বিসর্জন  করতে লাগলেন উভয়ে। ব্যাসদেব তখন বিখ্যাত ঋষি-তাপস। রাজপুরহিত এসে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে মন্ত্র উচ্চারণের তার বরণ  করে নিলেন। ঋষিবর পূজা গ্রহণ করলেন। আসনে স্থির হয়ে বসে, মায়ের কুশলবার্ত্তা জিজ্ঞাসা করলেন। মাতা সত্যবতী বললেন, তুমি তো যেন, পুত্র শুধু পিতার নয়, পিতামাতা উভয়ের ধন। পুত্রের প্রতি পিতার যেমন প্রভুত্ব করবার অধিকার আছে, তেমনি মায়ের অধিকারও কম নয়। তুমি আমার জ্যেষ্ঠপুত্র।  বিচিত্রবীর্য তোমার ছোট ভাই। দেবব্রত যেমন পিতৃ সন্মন্ধে বিচিত্রবীর্যের বড়ো ভাই, তুমিও মাতৃ সন্মন্ধে বিচিত্রবীর্যের বড়ো ভাই। দেবব্রত ভীষণ প্রতিজ্ঞা করেছে, সে সে দরপরিগ্রহ করবে না এমনকি কোনোদিন রাজসিংহাসনেও বসবে না। অতয়েব হে পুত্র, ভীষ্ম ও আমি তোমাকে নিয়োগ করছি, যদি তুমি তোমার স্বর্গত ভাইয়ের প্রতি ও পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীদের প্রতি দয়াবান হয়ে, আমাদের বংশরক্ষার্থে, ভ্রাতৃজায়াদের প্রতি প্রীত হয়ে, এই নিয়োগবাক্য রক্ষা করো। তোমার ভ্রাতৃজায়ারা সবাই রূপ-যৌবনা-সম্পন্ন, সাতিশয় পুত্রার্থিনী। তুমি তাঁদের গর্ভে অনুরূপ পুত্র  উৎপাদন করে, তাদের মনোরথ সিদ্ধ করো। ব্যাসদেব বললেন, মাতা তুমি ধর্ম্ম জানো, ধর্ম্মের প্রতি তোমার ভক্তি আছে। একান্ত অনুরাগ আছে, এইজন্যে তোমার অভিলষিত কাজ ধর্ম্মমূলক বিবেচনা করে, আমি এই কাজ করতে সম্মত হোলাম।  কিন্তু ভ্রাতৃবধূদেরকে বলুন, মিত্র-বরুন সদৃশ পুত্র উৎপাদনের জন্য, একবছর কাল আমার নির্দিষ্ট ব্রত-উপাসনা করুক। এই ব্রত উপাসনা তাদেরকে পবিত্র করবে।  নতুবা ব্রতবর্জিতা অপবিত্র রমণী আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। মাতা সত্যবতী বললেন, হে পুত্র, যাতে যথাশীঘ্র সম্ভব এঁরা  যাতে গর্ভবতী হয়, তার অনুষ্ঠান করো।  কারন রাজা বিহীন প্রজা বা  রাজ্য, পিতাবিহীন সন্তান উৎসন্নে যায়। ভীষ্ম এই সন্তানদের লালন-পালন করবে, তুমি অবিলম্বে এই অনুষ্ঠান করো।   

 মায়ের আদেশ শুনে তাকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে  বললেন। ঋষি ব্যাসদেব বললেন, মাতা আমি এখন পরমব্রত অনুষ্ঠান করছি।  যদি আপনার পুত্রবধূঅম্বিকা  আমার এই পরমব্রত-স্বরূপ আমার  যে বিরূপতা দেখা যাচ্ছে, তা সহ্য করতে পারে, তবে আমি অকালেই পুত্র প্রদান করতে পারি। যদি আমার বিকটমূর্তি, ভয়ানক বেশভূষা, আমার শরীরের অসহ্যগন্ধ সহ্য করতে পারে, তাহলে আজই গর্ভবতী হতে পারে। তাহলে  অম্বিকাকে বলুন, শুচিবস্ত্র পরিধান করে, শয়নকক্ষে আমার জন্য প্রতীক্ষা করুক। এই কথা  বলে তিনি অন্তর্ধান করলেন। 

এবার সত্যবতী অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন। অম্বিকাকে বুঝিয়ে বললেন, উত্তরাধিকারের জন্য, এই কাজ আবশ্যিক।  অন্য কোনো উপায় নেই।  তুমি শয়নকক্ষে অপেক্ষা করো, তোমার দেবর আজ রাতে তোমার কাছে আসবে।  তুমি তাকে গ্রহণ করো। এখন অম্বিকা সজ্জিত সজ্জ্যায় শুয়ে শুয়ে ভাবছেন, কে সেই দেবর, যিনি আজ আমার সজ্জ্যাকে আলোকিত করবেন। মনে মনে ভাবছেন, নিশ্চয় ভীষ্ম বা অন্য কোনো কৌরবভ্রাতা আসবেন। তাই এদের আগমনের জন্য উৎফুল্ল চিত্তে অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু একসময় তার ঘরে প্রবেশ করলেন, এক পিঙ্গলবর্ন জটাধারী, মুখে বিশাল শ্মশ্রু, চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে, এক ভয়ঙ্কর মূর্তি।  অম্বিকা এঁকে  দেখেই ভয়ে, বিস্ময়ে চোখ বুজে ফেললেন। ব্যাসদেব মায়ের আদেশ রক্ষার্থে অম্বিকার সঙ্গে সহবাস করলেন। 

সত্যবতী অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলেন।  ব্যাসদেবকে  দেখেই বললেন, কেমন অম্বিকা গুণবান পুত্রের জন্ম দেবে তো ? ব্যাসদেব অতীন্দ্রিয় জ্ঞানসম্পন্ন, মায়ের কথা শুনে বললেন, অম্বিকা এক অলৌকিক ধীশক্তি সম্পন্ন অতিশয় বলবান, মহাবীর্যশালী, মহা বিদ্যান পুত্রের জন্ম দেবে।  কিন্তু এই পুত্র মায়ের দোষে জন্মান্ধ হবে। পুত্রের কাছে, এই কথা শুনে সত্যবতী বললেন, অন্ধ-নৃপতি কখনো কুরুবংশের উপযুক্ত নয়। অতয়েব এমন একটি পুত্র প্রদান করো, যার দ্বারা কুরুবংশ রক্ষা পায়, ও রাজ্যের মঙ্গল হয়। ব্যাসদেব  "তথাস্তু"  বলে স্বস্থানে গমন করলেন। 

এর পরে যথা সময়ে অম্বিকা এক অন্ধ পুত্র প্রসব করলেন। যার নাম রাখা হলো, ধৃতরাষ্ট্র। সত্যবতী আবার পুত্র ব্যাসদেবকে স্মরণ করলেন। ব্যাসদেব পুনরায়, সেই ভয়ঙ্কর মূর্তিতে আগমন করলেন, এবং মায়ের এদেশে অম্বালিকার শয়নকক্ষে প্রবেশ করলেন। রাজমহিষী অম্বালিকা, এই ঋষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের এই ভয়ঙ্কর মূর্তি দর্শনে, ভিতা ও বিবর্ণা হয়ে গেলেন। অম্বালিকার শরীরের এই অবস্থা দেখে, ব্যাসদেব বললেন, আমাকে দর্শন করে, তুমি যে পাণ্ডুরবর্ন প্রাপ্ত হয়েছো, তোমার গর্ভজাত সন্তানও পাণ্ডুবর্ণ প্রাপ্ত হবে। পাণ্ডুবর্ণ অর্থাৎ রক্তহীন  অবস্থা। আসলে গর্ভদান কালে মাতা-পিতার  শরীর ও মনের একটা প্রতিকৃতি পুত্রের শরীরে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়। আর এই বিজ্ঞান মহর্ষি ব্যাসদেবের অজ্ঞাত ছিল না।  তাই তিনি সত্য প্রকাশ করে, অম্বালিকাকে সাবধান করে দিলেন। যাতে তিনি সন্তানের এই দুর্বলতাকে সরিয়ে তুলতে পারেন। এই কথা বলে, কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন স্বস্থানে ফিরে গেলেন। 

যাইহোক, যথাকালে অম্বালিকার এক পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করলো, যার নাম রাখা হলো পান্ডু, যিনি জন্ম থেকেই পান্ডু রোগগ্রস্থ। সত্যবতী আবার সেই কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের স্মরণ করলেন। এবং অম্বিকা পুনরায় ঋতুমতী হলে, কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন পুনরায়, মায়ের আদেশ পালন করবার জন্য উপস্থিত হলেন। এই খবর পেয়ে, অম্বিকা পূর্বের সেই ভয়ঙ্কর মূর্তির কথা স্মরণ করে, ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন, এবং সশ্রুমাতার আজ্ঞায় সম্মত হলেন না। এবং তাঁর এক সুন্দরী দাসীকে নিজের অলংকার দিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে, ঋষির কাছে পাঠিয়ে দিলেন। দাসী যথারীতি মালকিনের আদেশ পালন করতে ঋষির কাছে উপস্থিত হলেন।  তার যথাযোগ্য সেবাযত্ন করলেন। ব্যাসদেব কিন্তু এই চাতুরতা বুঝেও না বোঝার ভান করলেন। মহর্ষি এই দাসীর সাথে মিলনে পরমপ্রীত হলেন। এবং বিছানা থেকে নেমে , দাসীকে বললেন, তুমি দাসত্ব শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হবে। তোমার গর্ভজাত পুত্র অসাধারন জ্ঞানী ও পরম ধর্ম্মিক হবে। কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে, মাতা সত্যবতীকে এই প্রতারনার কথা জানিয়ে, ধর্ম্মের নিকট অঋণী হয়ে, তক্ষুনি অন্তর্দ্ধান করলেন। এই দাসীপুত্রই বিদুর নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। তো ঋষি দ্বৈপায়নের ঔরসে, বিচিত্রবীর্যের স্ত্রীদের ও দাসীর গর্ভে ধৃতরাষ্ট্র ও পান্ডু ও বিদুরের  জন্ম বৃত্তান্ত। অম্বিকার পুত্র ধৃতরাষ্ট্র, অম্বালিকার পুত্র পান্ডু। উভয়ের  পিতা কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন।  

কুরু-পান্ডবের বংশ বলতে আমরা যাদেরকে বুঝি আসলে এঁরা  সবাই  এই ভূমিপুত্র ঋষিব্যাসদেবেরই,  বংশধর।........... ঋষি ব্যাসদেব কি তাহলে নিজের বংশধরদের উপাখ্যান লিখে রেখেছিলেন ?

এর পরে আমরা মহাভারতে ব্যাসদেবের দেখা পাই, ধৃতরাষ্টের ১০০ পুত্রের জন্মের সূচনায়। মহর্ষি দ্বৈপায়ন একদিন ক্ষুধা তৃষ্ণায় ক্লান্ত হয়ে, ধৃতরাষ্টের রাজভবনে এসে উপস্থিত হন। তখন ধৃতরাষ্টের স্ত্রী গান্ধারী তাঁকে যত্নসহকারে সেবা শুশ্রুষা করলেন। আর এতে প্রীত হলে, ঋষি দ্বৈপায়ন তাকে বরদান করতে চাইলেন।  তখন গান্ধারী তাঁকে বললেন, আপনি যদি সন্তুষ্ট হয়ে থাকেন, তবে আমাকে এই বরদান করুন, যেন আমার গর্ভে যেন আমার স্বামীর সমান গুণশালী শতপুত্র জন্মে।  ঋষি দ্বৈপায়ন "তথাস্তু" বলে প্রস্থান করলেন। কিছুদিন পরে, ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসে গান্ধারী গর্ভবতী হলেন। কিন্তু দুবছর অতিবাহিত হলো, কোনো সন্তান প্রসব হলো না। এদিকে খাবার পেলেন, কুন্তীর এক সূর্য্যসম পুত্র জন্ম গ্রহণ করেছে। একথা শুনে, তিনি আশঙ্কিত হলেন। কেননা রাজবংশে সবসময় জ্যেষ্ঠপুত্র সিংহাসনের অধিকারী হয় - এটাই বংশের প্রচলিত রীতি। ঈর্শ্বান্বিত হয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে না জানিয়ে, দাসীদের দ্বারা তিনি গর্ভপাত করিয়ে ফেললেন। আর গর্ভ থেকে বেরিয়ে এলো, লোহার মতো শক্ত একটা মাংসপিন্ড, যা দুই বছর ধরে তাকে পেটে  বর্ধিত হয়েছে। এই খবর পেয়ে,  ব্যাসদেব সেখানে এসে উপস্থিত হলেন।  এসে বললেন, এ-কি করেছো ? গান্ধারী তার মনের কথা খুলে হৃষীকে বললেন।  বললেন, আমার পুত্রের জন্মের আগে, কুন্তীর পুত্র জন্মেছে, শুনে, আমি ভীষণ দুঃখ পেয়েছি। আর সেই দুঃখে আমি এই গর্ভপাত ঘটিয়েছি। এখন আপনি যা ভালো বোঝেন তাই করুন।  আপনি আমাকে বরদান করেছিলেন, আমি সাতপুত্রের জননী  হবো। এখন এই মাংসখন্ড থেকে শতপুত্র উৎপন্ন করুন। ব্যাসদেব বললেন, আমার মুখের কথা কখনো মিথ্যা হতে পরে না। মাংসখন্ড নষ্ট কোনো না। এই মাংসখন্ড থেকেই তোমার শতপুত্রের জন্ম হবে। তুমি একটা গোপন স্থানে, একশত ঘৃতপূর্ন কলসির ব্যবস্থা করো। আর মাংস খন্ডের উপরে  জলের ছিটে দিতে  থাকো। .গান্ধারী তাই করলেন। মাংসখন্ডের উপরে জল সিঞ্চন করতে লাগলেন। ব্যাসদেব মাংসখন্ড ভাগ করছেন, আর গান্ধারী মনে মনে ভাবছেন, ছেলে তো ১০০ টি হবে, একটা কন্যা হলে আরো ভালো হতো। ঋষি ব্যাসদেব গান্ধারীর মনের কথা জানতে পারলেন।তিনি মাংস খন্ডকে ভাগ করছেন, আর একেকটি খন্ডকে ঘৃতপূর্ন কলসির মধ্যে রেখে আসছে দাসীগণ যারা আসলে নার্স।  এর কিছুক্ষনের মধ্যেই মাংসখন্ড ১০১ খন্ডে বিভক্ত হয়ে গেলো। গান্ধারী দাসীগণের সাহায্যে এইসব মাংস খন্ডকে, ঘৃতপূর্ন কলসির মধ্যে রেখে, সযত্নে প্রহরা দিতে লাগলেন। ব্যাসদেব বললেন, দুই বছর  পরে, এই কলসির মুখ খুলবে।  তার আগে নয়। এই কথা বলে মহর্ষি তপস্যার জন্য হিমাচলপ্রদেশে প্রস্থান করলেন। 

ব্যাসদেব একজন উচ্চকোটির যোগী ছিলেন। তার মধ্যে যে অনেক যোগ-ঐশ্বর্যের সমাগম হয়েছিল, তা এই ঘটনার থেকে প্রকাশ পায়।  যদিও যা কিছু ঘটেছে, তার মধ্যে অলৌকিকতা নেই। আছে একটা প্রস্তুতি।  আছে একটা আয়োজন, যার ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঢাকা। এ যেন জাদুকরের জাদু দেখাবার প্রস্তুতি। 

যাইহোক, দুই বছর অতিক্রান্ত হলো।  এরমধ্যে নিশ্চই গান্ধারী আর কৌতূহল বশে, বা অধৈর্য্য হয়ে কুম্ভের ঢাকনা খুলে, মহর্ষির কথার খেলাপি করেননি। এর মধ্যে আবার ভীমসেনের জন্ম হয়েছে। যথাসময়ে  কলসি থেকে প্রথম শিশুর দেখা মিললো, যার নাম রাখা হলো দুর্যোধন। দুরাত্মা এই দুর্যোধন জন্মাবার সঙ্গে অঙ্গে গাধার মতো কর্কশ স্বরে চিৎকার করতে আরম্ভ করলো। একটা কুকুরে ডাক শুরু করলে যেমন অন্য কুকুরগুলো ডাকা শুরু করে দেয়, একটা শিয়াল ডাকলে যেমন অন্য শিয়ালগুলো হোক্কা হুয়া করে ডাকা শুরু করে দে, তেমনি দুর্যোধনের গলার আওয়াজে গাধা, শকুন, শেয়ালগুলো ডাক ছাড়তে লাগলো। যাই হোক, ব্যাসদেবের অলৌকিক ক্ষমতার সাহায্যে জন্ম নিলো, গান্ধারীর ১০০ পুত্র ও একটি কন্যা।

-----------------------

অদ্ভুত জন্মপ্রক্রিয়ার কথা : কে কার পিতা ? কেই বা মাতা ?

মহাভারতে এমন অনেক চরিত্র আছে, যাদের জন্ম মাতৃগর্ভের জরায়ুর সাহায্য ছাড়াই।  যেমন

ধৃষ্টদ্যুম্ন ও দ্রৌপদী : রাজা দ্রুপদ একসময় পুত্র কামনায়, পুত্রেষ্টি যজ্ঞ  করেছিলেন। এই যজ্ঞের যাজক ছিলেন যাজ নাম এক মহর্ষি। এই যজ্ঞাগ্নি  থেকে জন্ম নিলেন, ধৃষ্টদ্যুম্ন। যিনি পরবর্তীকালে, দ্রোণাচার্য্যকে বাধ করেছিলেন। এই যজ্ঞ থেকেই ক্ষাণিক্ষণ পরে, জন্ম নিয়েছিল, কুমারী পাঞ্চালী যাঁকে  আমরা মহাভারতের নায়িকা দ্রৌপদী বলে জানি। অর্থাৎ এদের জন্মের জন্য কোনো শুক্রকীট বা ডিম্বাণুর দরকার হয়নি। 

 দ্রোণ : ঋষি ভরদ্বাজ তখন গঙ্গোত্রীতে। একদিন ঘৃতাচি নামক এক সুন্দরী অপ্সরাকে স্নানরত  অবস্থায় দেখে তার রেতঃস্খলন ঘটে। ঋষি এই শুক্রকে একটা কলসির মধ্যে অর্থাৎ দ্রোণীর মধ্যে রেখে সযত্নে রক্ষা করলেন। এই দ্রোণীর মধ্যে জন্ম নিলো, দ্রোণ।  

কৃপ-কৃপা : ঋষি গৌতমের শিষ্য ছিল শরদ্বান। শরদ্বান তপস্যায় রত।  স্বর্গের রাজা ইন্দ্র ভীত হলেন, তার রাজ্য পাচ্ছে, কেড়ে নেয়। তিনি অপ্সরা জানপদীকে পাঠালেন, শরদ্বানের ধ্যান  করবার জন্য। জানপদীকে দেখে, শরদ্বানের শুক্র স্খলন হলো, আর হাতের তীর ছুটে গিয়ে, সেই শুক্রকীটকে দুই ভাগে ভাগ করে দিলো।  জন্ম হলো জমজ সন্তানের।  যাদের নাম কৃপা ও কৃপ। 

 সগর রাজার ষাট হাজার পুত্র  এরা  লাউ-এর আকারে জন্মেছিলেন আর এই অলাবু  ঘৃতকুম্ভের মধ্যে রেখে তাদের মনুষ্য দেহ লাভ হয়েছিল। 

ভগীরথের জন্মবৃত্তান্ত  অর্থাৎ সগরের প্রপৌত্র, পিতার নাম রাজা দিলীপ-এর পুত্র আরো অদ্ভুত। রাজা দিলীপের দুই স্ত্রী কামতাড়িত হয়ে সমকামিতায় রত হয়, এর ফলে এক স্ত্রী গর্ভবতী  হয়। এবং কালক্রমে এক মাংসপিন্ড প্রসব করে। মাংসপিন্ড দেখে, তাকে ফেলে দেওয়া হয়।   আর ঋষি অষ্টাবক্রকে দেখে এই মাংসপিন্ড নড়ে ওঠে। ঋষি অষ্টাবক্র মুনি এই ঘটনা দেখে, বলে উঠলেন, তুমি উত্তম-অঙ্গ হবে। এই মাংসপিন্ড যাকে  ফেলে দেওয়া হয়েছিল, যার কোনো জৈবিক পিতৃপরিচয় নেই, তার নাম ভগীরথ।

দুর্যোধন দুঃশাসন দুঃশলা : ইত্যাদি ১০০ ভাই, ও এক বোনের জন্ম হয়েছিল, একটি মাংস খন্ড থেকে। যার পরিচার্য্য করেছিলেন, স্বয়ং ব্যাসদেব। 

যুধিষ্ঠির ভীম, অর্জুন  এবং কর্ন  সবাই কুন্তীর গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন।  কিন্তু এদের কারুর শরীরধারী পিতা  নেই।  কর্ন নাকি সূর্যপুত্র। যুধিষ্ঠির ধর্ম্মের অংশ, ভীমসেন বায়ুর অংশ, অর্জুন ইন্দ্রের অংশ আর নকুল-সহদেব অশ্বিনী-কুমারদ্বয়ের পুত্র। 

তো এই দ্রৌপদী, ধৃষ্টদ্যুম্ন,  জন্মেছেন মাতা-পিতা  ছাড়াই, অগ্নি থেকে । আবার দ্রোণ, কৃপা-কৃপ জন্মেছেন পিতার শুক্র  থেকে এখানে মায়ের কোনো ভূমিকা নেই। আবার কেউ জন্মেছেন একটা মাংসপিন্ড আকারে, এর মধ্যে যেমন দুর্যোধন ও তার ভাই-বোন আছে, তেমনি আছে ভগীরথ। 

আমরা জানি, একজন পুরুষ ও স্ত্রীর জননক্রিয়ার ফলে সন্তানের জন্ম সম্ভব। একটা পূর্ণাঙ্গ ভ্রূণ তখনই তৈরি হতে পারে, যখন স্ত্রী ও পুরুষের জননকোষের জিনের সম্মেলন হয়। স্ত্রীর জননকোষ ও পুরুষের জননকোষের মধ্যে যে নিউক্লিয়াস আছে, তার সম্মিলন একটি পূর্ণাঙ্গ ভ্রূণ - ( যার পরিণতি হচ্ছে মাতা-পিতার অনুরূপ দেহ প্রাপ্তি, ) তৈরী হতে পারে। এছাড়া কোনো শিশুর জন্ম হতে পারে না। 

কিন্তু কথা হচ্ছে, বিজ্ঞানীগন বলছেন, স্ত্রীর ও পুরুষের জননকোষ জীন মূলত একই পদার্থে তৈরী। এই দুইয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য আজও  বিজ্ঞান আবিষ্কার করতে পারে নি। কিন্তু  কোনটা স্ত্রীর  জননকোষের নিউক্লিয়াস আর কোনটা পুরুষ জনন কোষের  নিউক্লিয়াস এটা কিন্তু ওরা অর্থাৎ জননকোষ জীন  ধরতে পারে। তাই স্ত্রী নিউক্লিয়াস পুরুষ নিউক্লিয়াসকে  আঁকড়ে ধরে, আর পুরুষ নিউক্লিয়াস স্ত্রী নিউক্লিয়াসকে  আঁকড়ে ধরে। এর সঠিক কারন আজও  জানা যায় নি। 

এখন আমরা জানি পুরুষের আছে একটা X একটা Y  ক্রোমোজম কিন্তু স্ত্রীর থাকে দুটো X   ক্রোমোজম।  বিজ্ঞান বলছে, পুরুষের X ক্রোমোজম যদি স্ত্রীর X ক্রোমোজমকে আঁকড়ে ধরে তবে ভবিষ্যতে কন্যা  সন্তানের জন্ম হবে।  আবার পুরুষের Y  ক্রোমোজম যদি স্ত্রীর X  ক্রোমোজমকে আঁকড়ে ধরে তবে জন্ম নেবে পুত্র  সন্তান।  এই অবধি বিজ্ঞান জানতে পেরেছে। অর্থাৎ একটা জিনিস আমাদের মনে হয়, স্ত্রীর শরীরে আছে কেবলমাত্র দুটো এক্স  ক্রোমোজম। অর্থাৎ পুরুষের শুক্রই (XY)  নির্ধারক শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে, মেয়ে হবে না ছেলে হবে।  

Men determine the sex of a baby depending on whether their sperm is carrying an X or Y chromosome. An X chromosome combines with the mother’s X chromosome to make a baby girl (XX) and a Y chromosome will combine with the mother’s to make a boy (XY).- source  - SCIENCE DAILY - 08-12-2008.

তাহলে এগুলো কি সব কল্প কাহিনী ? নাকি  এই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানের মধ্যে কোনো প্রাকৃতিক পরিবর্তন মানুষের শরীরের গঠনশৈলীতে  ঘটে গেছে, যার জন্য আগে যে ভাবে জন্ম-ক্রিয়া সংগঠিত হতো, এখন তার পরিবর্তন/বিবর্তন  ঘটে গেছে  আমাদের শরীরের অভ্যন্তরে । কেননা পরিবর্তনই তো জীবনের নিয়ম।বিবর্তনবাদীগণ বলে থাকেন, ধারাবাহিকভাবে জৈব পরিবর্তনের/বিবর্তনের  মধ্যে দিয়ে, একপ্রকার জীব থেকে অন্যপ্রকার জীবের সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীতে প্রথমেই মনুষ্য আকৃতির জীব ছিল না। প্রাণের প্রথম সৃষ্টি জলজ উদ্ভিদ হিসেবে, ধীরে জলের পোকা, মাছ, সরীসৃপ, ব্যাঙ, কচ্ছপ - এইভাবে ধীরে  ধীরে জীবের শারীরিক ও গুনগত পরিবর্তন হতে হতে আজ মনুষ্যরূপী জ্ঞানী জীবের জন্ম হয়েছে।  

শ্রী প্রশান্ত প্রামানিক তার ভারতীয় দর্শনে আধুনিক বিজ্ঞান গ্রন্থে লিখছেন, "কিছুদিন আগে, ফরাসী দূরদর্শনে একটা অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছিল, অনুষ্ঠানের শিরোনাম "যখন পুরুষরা থাকবে না"  . তারা এই প্রতিবেদনে দেখিয়েছিলেন, কোনো শুক্রকীট ছাড়াই কোনও মহিলা সন্তান ধারণ করতে পারেন। বিশেষ অবস্থায়,  ডিম্বাণু কোনো শুক্রকীটের নিষিক্তকরন ছাড়াই ভ্রূণ সৃষ্টি করতে সমর্থ। কোনো পুরুষ সংসর্গ ছাড়াই বা কোনো শুক্রকীটের সাহায্য ছাড়াই দু'জন মহিলা একটা ভ্রূণ সৃষ্টি করতে পারে।" এদের এই প্রতিবেদন যদি সত্য হয়, তবে ভবিষ্যতে একমাত্র পুরুষ-নারীর মিলনে যে সৃষ্টতত্ত্ব, সেই ধরনের আমূল পরিবর্তন করে দিতে পারে। আর এইভাবেই ভগীরথের জন্ম হয়েছিল কিনা কে বলতে পারে ?       

জীবনের ইতিহাস  সম্পর্কে আমরা সবাই জানতে উৎসুক। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জীবন সম্পর্কে মানুষের ধারণা ও অভিজ্ঞতা দিন দিন বেড়েছে। আসলে যার জন্মের সময় কেউ ছিল না, এমনকি মাতা-পিতা বলে কেউ ছিল না, তার জন্ম পরিচয় কে দেবে ? ফলস্বরূপ ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমে কোষবিদ্যার প্রসার ঘটেছে। এবং বলা হচ্ছে, প্রত্যেকটি জীব হয় একটিমাত্র কোষ অথবা একাধিক কোষ দ্বারা গঠিত। মানুষ একাধিক কোষের সমষ্টিমাত্র। এই কোষকে ভেঙে পাওয়া গেলো, নিউক্লিয়াস, গলগি কমপ্লেক্স, মাইটোকন্ড্রিয়া, এন্ডোপ্লাজমীয় জালিকা ইত্যাদি ইত্যাদি।  কোষের মধ্যে প্রজননের ফলে তৈরি হয় প্রোটোপ্লাজম। এই প্রোটোপ্লাজমই জীবের আদি পুরুষ। কতকগুলো একই-ধরনের কোষের সমষ্টি  নিয়ে তৈরী হলো, কলা বা টিসু (TISSUE). বিভিন্ন কলা মিলিত হয়ে তৈরী করলো অঙ্গ বা ORGAN. অনেকগুলো অঙ্গ নিয়ে তৈরি হলো তন্ত্র বা SYSTEM আবার বিভিন্ন তন্ত্রের দ্বারা গঠিত হলো দেহ বা BODY. আর বিভিন্ন কোষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য শুরু হল হরমন নিঃসরণ। একটা স্নায়বিক তন্ত্র আর একটা অন্তঃক্ষরা তন্ত্র। প্রাণী দেহের কোনো কোনো কাজে এই হরমন সহযোগিতা করে, আবার কোনো কোনো হরমন বাধা সৃষ্টি করে। এই হরমোনের একটা প্রকারভেদ হচ্ছে, আমাদের রজঃ ও শুক্র ? আমাদের যৌনত্ব প্রকাশ, আমাদের শারীরিক বৃদ্ধি ইত্যাদির ক্ষেত্রে এই হরমন সহযোগিতা করে থাকে। হরমোনের কাজ খুবই জটিল। হরমোন শুধু আমাদের ভৌত পরিবর্তন নয়, আমাদের DNA ও RNA কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। 

চার ধরনের জন্মপ্রক্রিয়া আছে। বা বলা যেতে পারে, যার ধরনের জন্ম স্থান আছে। প্রথম হচ্ছে জরায়ু  বা মায়ের গর্ভ থেকে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে অন্ডজ বা ডিম্ থেকে, তৃতীয়ত বীজ থেকে।  আরো একধরনের জন্ম আছে, যা শূন্য থেকে। এই শূন্য থেকে জন্মের কথা আমরা জানতে  পারি না, বুঝতেও পারি না। আসলে সবকিছুর মধ্যে ভবিষ্যতের বীজ লুক্কায়িত আছে। রূপান্তরই জন্ম। ঘরের মধ্যে টিনের পাত্রে চাল রেখে দিয়েছিলাম।  একদিন দেখি, চালের মধ্যে পোকা। টিন খুলতেই উড়তে লাগলো। কোথা থেকে এলো ? আবার কোথায়ই বা চলে গেলো ? বাসি সবজির মধ্যে পোকার জন্ম হয়। জলের মধ্যে মাছির জন্ম হয়। মৃত শরীরে কিলবিল করে পোকা। সৃষ্টি এক গুড় রহস্যঃ। শূন্য থেকে কি করে এক পূর্ন  জীবনের সৃষ্টি হয়, তা আমাদের আজও অজানা। তবে এটা বুঝতে বোঝা যায়, যখন বস্তুর মধ্যে প্রাণকে আকর্ষণ করবার শক্তি জন্মায় তখন তা জীবে  পরিণত হয়। উল্টো দিকথেকে বলা যায়, প্রাণশক্তি যখন যে বস্তুর মধ্যে প্রবেশ করে, তখন তা জীবন্ত হয়ে ওঠে। রহস্যে ঘেরা এই সৃস্টিতত্ব।  

 যাইহোক, মহাভারতের গল্পে বা কাহিনীতে যে জন্ম প্রক্রিয়ার বর্ণনা আছে, তা নিতান্ত কল্প কাহিনী না এর মধ্যে সত্যতা নিহিত আছে, তা আমরা জানি না।  তবে আমার একটা জিনিস মনে হয়, মানুষ যাকিছু কল্পনা করতে পারে, তার সমস্তকিছুই   ব্যক্ত বা অব্যক্ত ভাবে জগতে বিরাজ করছে। তাই মহাত্মাদের কল্পনা আমাদের মতো সাধারনের কাছে অবাস্তব বলে মনে হলেও, হয়তো কোনো একদিন এই সত্য তারা প্রতক্ষ্য করছিলেন। আজ সেই বিদ্যা আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেছে।  অথবা প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই পদ্ধতির পরিবর্তন হয়ে গেছে। তবে আজ স্ত্রী-জাতির মধ্যে গর্ভ-ধারণের একটা অনিচ্ছা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। আর মানুষের এই চাহিদা, হয়তো বিজ্ঞান পূরণ করে দেবে। বিজ্ঞান এখন টেস্ট-টিউব বেবির জন্ম দিচ্ছে, যা একদিন ভাবাই যেত  না। এখনো পিতার শুক্রাণু ও মাতার ডিম্বাণু নিয়ে ভ্রূণের সৃষ্টি করা হয়ে থাকে।  এমন একদিন ছিল, যখন সন্তান জন্মের জন্য শুধু পিতাই যথেষ্ট, অথবা  একমাত্র মাতাই যথেষ্ট ছিলো । এই অভূতপূর্ব বিজ্ঞান আজ আমরা বিস্মৃত হয়েছি। হয়তো একদিন এই বিশেষ বিদ্যা আমাদের আয়ত্ত্বে আসতে  পারে।  

---------- 

 যাইহোক, এর পরে আমরা ব্যাসদেবের কথা মহাভারতে পাই, যখন পান্ডু মারা যায়। পান্ডু মারা যাবার পরে, শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে হয়তো ব্যাসদেব হাজির ছিলেন, আবার এমনও হতে পারে, ব্যাসদেব মাঝে মধ্যে নিজের মাতাকে এবং নিজের  পুত্র অর্থাৎ ধৃতরাষ্ট্র, পান্ডু, ও  বিদুর এর কাছে আসতেন।  বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমস্যায় নিজের মতামত বা উপদেশ দিয়ে সাহায্য করতেন। ঠিক এইরকমই, পান্ডু মারা গেলে, তার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে এসে, ঋষি ব্যাসদেব তা মা  সত্যবতীকে পরামর্শ দিলেন, এখানে না থাকবার জন্য।  কেননা দূরদর্শী ব্যাসদেব বুঝতে পারলেন, এখানে থাকলে, তার মায়ের দুঃখ-কষ্ট বাড়বে বৈ কমবে না। এখানে এখন পাপাচার শুরু হবে। এই কথা শুনে, সত্যবতী পুত্রবধূ অম্বিকা ও অম্বাকে সঙ্গে নিয়ে বনে, হয়তো ব্যাসদেবের আশ্রমে  গমন করলেন। অর্থাৎ ব্যাসদেবের সাথেই বনে চললেন, সেখানে কঠোর তপস্যা করতে করতে একদিন কলেবর পরিত্যাগ করলেন। 

এখন কথা হচ্ছে, ব্যাসদেবের আশ্রম কোথায় ছিল ? ব্যাসদেবের আশ্রম ছিল, হিমাচলে। অর্থাৎ বর্তমান হিমাচল প্রদেশের কোনো এক পাহাড়ি জঙ্গলে। মহাভারতে এর পরে আমরা ব্যাসদেবের দর্শন পাই, যখন পাণ্ডবগন জতুগৃহ থেকে পলায়ন করে, সন্ন্যাস বেশে জঙ্গলের  মধ্যে বাস করছেন। হতে পারে, পাণ্ডবগন তাদের  মা কুন্তীদেবীকে নিয়ে, হয়তো ঘুরতে ঘুরতে ব্যাসদেবের আশ্রমের কাছাকাছি হয়তো এসে পড়েছিলেন। এখানে বসেই পাণ্ডবগন বিভিন্ন ধর্ম্মশাস্ত্র অধ্যয়ন  করতেন। পিতামহকে  দেখে, তারা মায়ের কাছে, তাকে নিয়ে গেলেন। রাজ্-পৌত্রদের এই  অবস্থা দেখে ব্যাসদেবের মনে করুনার উদ্রেগ হলো।  বললেন, যদিও ধৃতরাষ্ট্রের সন্তানগণ ও পান্ডুর  পুত্রগণ সবাই আমার কাছে সমান, তথাপি ধৃতরাষ্ট্র পুত্র যা করেছে, তা অধর্ম্ম। আমর কাছে তোমাদের এই দুর্দশার কথা অজানা নয়।  তোমরা বিষণ্ণ হয়ো না। ধৈর্য্য ধরো।  ধর্ম্মের কাল বাতাসে নড়ে। আমি তোমাদের হিতসাধনে উদ্যত হয়েছি। এখন তোমরা সামনের  নগরে গিয়ে বাস করো আর আমার অপেক্ষা করো। এই বলে, এঁদেরকে সঙ্গে নিয়ে নগরের মধ্যে এক ব্রাহ্মণের গৃহে ওদের থাকবার ব্যবস্থা করলেন। কুন্তীকে বললেন, তোমার জ্যেষ্ঠপুত্র যুধিষ্ঠির ধর্ম্মপরায়ণ। তোমার ছেলে অর্জুন-ভীম বাহুবলে একদিন সমস্ত নৃপতিগণকে শাসন করবে। একদিন তোমার ছেলেরাই রাজসূয় যজ্ঞ করবে। তোমার ছেলেরাই একদিন অশ্বমেধ যজ্ঞ করবে। তোমার ছেলেরাই একদিন পিতা-পিতামহের রাজ্য ভোগ করবে। এর অন্যথা হবে না। যুধিষ্ঠিরকে সম্মোধন করে বললেন, তোমরা এখানে এই ব্রাহ্মণের বাড়িতে একমাস বাস করো। আমি একমাস পরে, আবার আসবো। এই কথা বলে, ঋষি ব্যাসদেব নিজের কুটিরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। 

এর ঠিক একমাস পরে, ব্যাসদেব আবার এই ব্রাহ্মণের গৃহে উপস্থিত হলেন, এবং বললেন, তোমরা শাস্ত্রমতে জীবিকা নির্বাহ করছো তো ? ইত্যাদি ইত্যাদি কুশল বার্তা, ও  উপদেশ বিনিময়ের পরে, একটা গল্প বললেন। আসলে এই গল্প একটা ভবিষ্যৎ বার্তা।  বা বলা যেতে পারে, পান্ডবদের প্রতি ভবিষ্যৎ কর্ম্ম নির্দেশ।  তিনি বললেন, 

কোনো এক তপোবনে, এক ঋষি কন্যা ছিল।  সে যেমন সর্বাঙ্গ সুন্দরী, তেমনি সর্বগুনসম্পন্না। কিন্তু ভাগ্যদোষে সে কোনো পতিলাভ করতে পারছিলো না। তাই পতিলাভের কামনায় মহাদেবের তপস্যায় রত হলেন।  আর মহাদেবকে প্রীত ও প্রসন্ন করে, তার কাছে বর  চাইলেন।  বললেন, আমি যাতে সর্বগুণ সম্পন্ন পতি লাভ করতে পারি, এই বর দান করুন। এখন মহাদেব চুপ করে আছেন দেখে, ঋষিকন্যা বার বার একই প্রার্থনা করতে লাগলেন।  এইভাবে পাঁচবার একই প্রার্থনা উচ্চারণের পরে, মহাদেব মুখ খুললেন, বললেন, তুমি যেহেতু পাঁচবার পতিলাভের প্রার্থনা করেছো, অতয়েব তোমার প্রার্থনা মতো পরজন্মে তোমার পাঁচটি পতি লাভ হবে। 

সেই ঋষিকন্যা, এখন দ্রুপদকন্যা রূপে জন্ম গ্রহণ করছে। এই দ্রুপদকন্যাই তোমাদের সহধর্মিনী হবে।  তোমার পাঞ্চালপ্রদেশে (পাঞ্জাবে) গমন করো। এই কন্যাকে লাভ করে, তোমরা সুখী হবে। এই কথা বলে, ঋষিব্যসদেব স্ব-স্থানে গমন করলেন। আর পঞ্চপান্ডবগন ঋষি ব্যাসদেবের আশীর্বাদ নিয়ে, পাঞ্চালদেশের উদ্দেশ্যে রওনা করলেন। 

 পরাশরের  জন্ম - পৃষ্ঠা -২১৪ 

এর পরে, অর্জুন সহ পাঁচ পান্ডব পাঞ্চালে গিয়ে, সমস্ত রাজাকে পরাজিত করে,  দ্রৌপদীকে নিয়ে এলেন। এইবার বিয়ের আনুষ্ঠানিক পর্ব সমাপ্ত হবে। এখানে একটা দ্বন্দ উপস্থিত হলো। রাজা যখন অর্জুনের বড়ভাইকে অর্থাৎ যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে অর্জুনকে কন্যা দ্রৌপদীকে সমর্পন করতে চাইলেন, তখন যুধিষ্ঠির আপত্তি করলেন।  বললেন, আমরা এর মধ্যেই মায়ের নির্দেশক্রমে, পাঁচভাই দ্রৌপদীকে ভার্য্যরূপে গ্রহণ করেছি। অতয়েব কৃষ্ণা ধর্ম্মত আমাদের পাঁচভাইয়ের মহিষী। একথা শুনে, রাজা দ্রুপদ আকাশ থেকে পড়লেন।  বললেন, এক পুরুষের বহু পত্নী হতে পরে, কিন্তু এক নারীর বহু পতি একথা জীবনে শুনিনি। এমন কথা তোমার মতো ধর্ম্মিক ব্যক্তির উচ্চারণ করা অনুচিত। যুধিষ্ঠির বললেন, ধর্ম্মের গতি অতিসূক্ষ্ম, আমরা মায়ের আদেশ উপেক্ষা করতে পারি না। যখন এইসব বাত বিতান্ডা চলছে, সেই সময় ঋষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন এসে উপস্থিত হলেন। ঋষি ব্যাসদেবকে পেয়ে, রাজা দ্রুপদ প্রশ্ন করলেন, হে দ্বিজোত্তম, এক স্ত্রী বহু পুরুষের পত্নী, এমন দৃষ্টান্ত দেখতে পাই না, আপনি এই বিষয়ে আমার কর্তব্য নির্ধারণ করুন। 

ব্যাসদেব হে নরেন্দ্র আমি তোমাকে অতি আশ্চার্য্য দিব্যচক্ষু প্রদান করছি, এতে করে তুমি দেখতে পারবে, কুন্তী-তনয়গন দিব্য দেহ ধারণ করে ধরাতলে পর্যটন করছে। এদের মাথায় হেমকিরীট, সর্বাঙ্গে বিবিধ অলংকার। ইন্দ্রিযাত্মজ পঞ্চপান্ডব  ও  দ্রৌপদীকে সোম ও বহ্নির  ন্যায় দীপ্তিময় দেখে তৃপ্ত হলেন দ্রুপদরাজ  । ব্যাসদেব বললেন, এই বিবাহ পূর্ব-নির্দিষ্ট । এসব মহাদেবের বরে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। এবার আপনার যেমন অভিরুচি হয়, করুন। এই ঘটনা থেকে অনুমান করা যায়, ঋষি ব্যাসদেবর যোগশক্তি, যোগবিভূতি কতটা প্রবল ছিল। এইসময় থেকেই তিনি দিব্যদৃষ্টির শুধু অধিকারী ছিলেন না, তিনি অন্যদেরকে দিব্যদৃষ্টি দান  করবার ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। 

ব্যাসদেব বললেন, আজ শুভদিন, আজ চন্দ্রমাঃ পুষ্যা নক্ষত্রে গমন করবে। অতয়েব আজই এই শুভ কাজ সম্পন্ন করুন। এইভাবে ঋষি ব্যাসদেবের মধ্যস্থতায় পঞ্চপান্ডব বিধিমতে দ্রৌপদীর পানি গ্রহণরূপ আনুষ্ঠানিক ক্রিয়া সম্পন্ন হলো।   

এই ঘটনা থেকে  আরো  অনুমান করা যায়, ঋষি শুধু তার শাস্ত্রগ্রন্থ রচনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তা নয়, এমনকি তিনি শুধু ধর্ম্মাচারন বা যাগ-যজ্ঞ নিয়ে, বা তপস্যায় মগ্ন থাকতেন না, তিনি সমস্ত সামাজিক সমস্যার সমাধানের জন্য অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতেন। সময়মতো উপস্থিত থেকে সমস্যা সমাধানের জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন। এই হচ্ছে ঋষি যিনি সমাজের সমস্ত বিধি-নিষেধের উর্দ্ধে আবার সমাজের সমস্ত বিধির নিয়ামক ও রক্ষক। 

------------

এরপরে, আমরা ঋষি ব্যাসদেবের দেখা পাই, ইন্দ্রপ্রস্থের রাজা যুধিষ্ঠির যখন রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করছেন। আসলে ঋষি নারদের কথায়, যুধিষ্ঠিরের মনে রাজসূয় যজ্ঞের মাথায় আসে। রাজসূয় যজ্ঞ আসলে রাজার ও রাজ্যের কল্যাণের  কথা চিন্তা করে অনুষ্ঠিত হয়। রাজা হন, সর্বজয়ী। ব্যাসদেব একদিন কুন্তীকে বলেছিলেন, তোমার সন্তান একদিন রাজসুখ ভোগ করবে, রাজসূয় যজ্ঞ করবে। সেই কথা আজ কার্যকরী হতে চলেছে। যুধিষ্ঠির এইসময় ঋষি ব্যাসদেবের কাছে এই কার্য্যের অনুমতি প্রার্থনা করেছিলেন। ঋষি এই সময় কি উপদেশ দিয়েছিলেন, তা মহাভারতের পাতায় লিপিবদ্ধ নেই।  তবে ধরে নেওয়া যেতে পারে, তিনি নিশ্চই রাজসূয় যজ্ঞের অনুমতি প্রদান করেছিলেন। 

রাজসূয় মহাযজ্ঞ সমাপ্ত হয়ে গেলে, একদিন মহামুনি ব্যাসদেব সশিষ্য পাণ্ডবদের কাছে এলেন। এসে বললেন, আমার সময় কম, আমি এক্ষুনি চলে যাবো, যাবার আগে বলি, তোমরা যা করেছো, তাতে কুরুদেশের উন্নতি সাধন হয়েছে ঠিকই   কিন্তু সামনের দিন বড্ড উৎপাতের দিন। এখন পার্থিব, অন্তরীক্ষ ও দিব্য এই তিন প্রকারের উৎপাত শুরু হবে।  আর এই উৎপাত আগামী তের বছর যাবৎ ঘটতে থাকবে। আর এতে করে, সমস্ত ক্ষত্রিয়কূল বিনাশপ্রাপ্ত হবে। দুর্যোধনের অপরাধে, আর ভীম-অর্জুনের বাহুবলকে উপলক্ষ করে, সমস্ত ক্ষত্রিয় রাজেন্দ্রবর্গ ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। আজ শেষরাতে তুমি একটা স্বপ্ন দেখবে, দেবাদিদেব মহাদেব, ষাঁড়ের পিঠে চেপে, শূল ও পিনাক ধারণ করে, শমনের অধিষ্ঠান ক্ষেত্র  দক্ষিনদিক  নিরীক্ষণ করছেন। এই স্বপ্ন দেখে তুমি দুশ্চিন্তা করো না।  কারন কালকে কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। আমি এবার কৈলাশ পর্বতে যাত্রা করবো। তোমরা ধৈর্য্যশীল হও। স্থিতিমান  হও। অধিক শক্তিশালী হয়ে পৃথিবী পরিপালন করো। এই কথা বলে, ক্ষনিকের মধ্যেই ঋষি ব্যাসদেব তার শিষ্যদেরকে নিয়ে কৈলাশ পর্বতের দিকে গমন করলেন। অর্থাৎ  দেবাদিদেবের বিচরণ ক্ষেত্র , তপস্যার জন্য  সর্বোচ্চ জ্ঞানের বিকাশস্থল,  কৈলাশ পৃথিবীর বিরলতম স্থান। যেখানে সর্বোচ্চ যোগী ভিন্ন কেউ প্রবেশ করতে পারে না। যে স্থান তপস্যার জন্য শ্রেষ্ঠ।  

ঋষি ব্যাসদেব বলে গেলেন বটে, যে দুশ্চিন্তা করো না। কিন্তু দুশ্চিন্তা পরিহার করা, সাহজসাধ্য নয়। যুধিষ্ঠিরের শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি বেড়ে গেলো। আর বারবার পিতামহ ব্যাসদেবের কথাই মনের মধ্যে আঁচড় কাটতে লাগলো। মহর্ষি যা বলেছেন, তাতো ঘটবেই, পুরুষকার দ্বারা দৈবকে অতিক্রম করা যায় না। একবার ভাবছেন, এর চেয়ে মৃত্যু বরণ  করা ভালো।  কেননা, আমার নিমিত্ত আমারই সামনে সমস্ত ক্ষত্রিয় ধংশপ্রাপ্ত  হবে। আর সেই ঘটনা আমি সামনে থেকে দেখবো ? এর চেয়ে, আমার কেন মরন হয় না। আমি এখন রাজ্যপাট ছেড়ে দিয়ে, যোগসাধনায় রত হবো। মনে মনে বলতে লাগলেন, আমি আর কাউকে আমি কষ্ট  দেব না।  নিজের পৌরুষ প্রদর্শন করবো না। 

আমাদের আলোচ্য বিষয় ঋষি ব্যাসদেব। তিনি এখন কৈলাশের পথে। হয়তো মঙ্গল-অধিপতি দেবাদিদেব মহাদেবের সাথে সাক্ষাৎ করতে চলেছেন। নয়তো সেখানে নির্জনে সাধনার জন্য সশিষ্য গমন করলেন।  

এর পরে আমরা ব্যাসদেবের দেখা পাই, দ্বৈতবনের মধ্যে। ততক্ষনে ব্যাসদেবের ভবিষ্যৎবাণী ফেলতে শুরু করেছে।  পান্ডবগন পাশা খেলায় হেরে বারো বৎসরের জন্য বনবাসে চলে গিয়েছেন। সেখানে  গিয়ে সবে   ১৩ মাস বনবাসকাল অতিক্রম করেছেন। যেখানে প্রতিজ্ঞা অনুসারে, তাদের ১২ বৎসর বনবাস, ও ১ বছর অজ্ঞাতবাস করতে হবে। সেখানে মাত্র ১৩ মাস অতিক্রম হতে না হতেই, পান্ডব ভ্রাতাগন অতিষ্ট হয়ে উঠেছে। আর মন্ত্রণা করছে, কিভাবে এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। বিশেষ করে ভীম, যিনি ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শারীরিক শক্তিধর, তিনি আর সহ্য করতে পারছেন না। মাঝে মধ্যে ফুসে ফুসে উঠছেন। কিন্তু ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির, ভীমের এই অধৈর্য্যের কথায় সম্মতি দিতে পারছেন না।  ভীম চাচ্ছে দুর্যোধনাদিকে পরাজিত করে, এই দুর্বিসহ  জীবনকালের সমাপ্তি ঘটাতে। কিন্তু যুধিষ্ঠির বলছেন, দেখো আমরা যেসব রাজাদের উৎখাত করেছি,  তারা সবাই এখন দুর্যোধনের হিতসাধনে তৎপর।  এছাড়া,  ভূরিশ্রবা, শল্য, ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ন, দুর্যোধন, এরা  সবাই অস্ত্র বিশারদ। যদিও ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য্য এনারা  সবাই আমাদের স্নেহ করেন, তথাপি তাঁরা এখন, রাজপ্রদত্ত গ্রাস-আচ্ছাদনের ঋণ পরিশোধের নিমিত্ত দুর্যোধনের পক্ষেই যুদ্ধ করবেন। দেখো, গায়ের জোরে সব কিছু করা যায় না। গায়ের জোরের সঙ্গে বুদ্ধির সহযোগে কাজ করতে হয়। তবেই  সাফল্য আসতে  পারে। আমাদের এখন নীরব থাকায় ভালো। এইমতো যখন পান্ডব ভ্রাতাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে,সেইসময় আবার আবির্ভাব হলেন, ঋষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। সবাই পিতামহকে দেখে আস্বস্ত হলেন। যথাযোগ্য সন্মান প্রদর্শন পরে, তাকে আসন পেতে দিলেন।  

ব্যাসদেব বলছেন : দেখো, যুধিষ্ঠির, আমি জানি তোমার মধ্যে যে ভয়ের আশঙ্কা হয়েছে। আর  আমি তা দূর করবার জন্য, এখানে এসেছি।  তুমি যে, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কর্ন, অশ্বত্থামা, দুর্যোধন, দুঃশাসন - এদের দ্বারা ভয়ের আশঙ্কা  করছো, তা দূর হয়ে যাবে, যদি আমার কথা মতো কাজ করো। কোনো চিন্তা করবার দরকার নেই।  শোনো আমি তোমাকে মূর্তিমতী সিদ্ধিস্বরূপ প্রতিস্মৃতি নাম্নী বিদ্যা দান  করছি। প্রতিস্মৃতি কথাটার অর্থ হচ্ছে স্মরণবিদ্যা। এই বিদ্যা প্রভাবে, সমস্ত বিশ্ব-রহস্যঃ দৃষ্টি সম্মুখে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ব্যাসদেব বললেন, এরপরে মহাবাহু অর্জুন, এই বিদ্যা লাভ করলে, এবং অস্ত্রের জন্য সাধনা করলে দেবাদিদেব মহাদেবের, এবং দেবরাজ ইন্দ্রের অনুগ্রহ লাভ করতে পারবে। অর্জুন তপস্যা ও বিক্রম প্রভাবে বরুণ, কুবের ও ধর্ম্মরাজের অর্থাৎ যমরাজের সাক্ষাৎ লাভ করতে পারবে। একটা কথা জেনো, অর্জুন সামান্য মানুষ নয়, সে একজন জন্ম-জন্মান্তরের তপস্বী, একজন মহাতেজসম্পন্ন ঋষি। স্বয়ং  ভগবান নারায়ণ ওর সহায়।  অর্জুনকে জয় করে আর সাধ্য। এই অর্জুন একদিন, ইন্দ্রদেব, রুদ্রদেব,  ও বিভিন্ন লোকপালগনের কাছ থেকে অস্ত্র প্রাপ্ত হবে এবং মহৎ কার্য্যে নিযুক্ত হবে। তবে একটা কথা বলি, এক জঙ্গলে কখনো এক  জায়গায় বেশিদিন থাকা উচিত নয়। এতেকরে সেখানকার বাসিন্দাদের উদ্বেগ জন্মে। তার নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারে না।  এছাড়া, তুমি অনেক ব্রাহ্মণদের ভরনপোষন করছো। তারা তোমার কাছে প্রতিনিয়ত যাতায়াত করছে।  এতে করে, বনের জীবজন্তুদের স্বভাবিক জীবনযাত্রায় বাধা সৃষ্টি হয়। বনের লতাপাতা-গাছ ইত্যাদি বিনষ্ট হচ্ছে। এমনকি লোকসমাগমে তপোবনের তাপস্বীদের ধ্যানের  জন্য প্রয়োজনীয় নীরবতা বিঘ্নিত হয়। এই বলে, যুধিষ্ঠিরকে সেই অনুত্তম বিদ্যা অর্থাৎ প্রতিস্মৃতি বিদ্যা দান  করে, অন্তর্হিত হলেন। যুধিষ্ঠির ঋষি ব্যাসদেবের  কথা মতো মন্ত্রবিদ্যার  চর্চা করতে লাগলেন, আর সবাইকে নিয়ে দ্বৈতবন পরিত্যাগ করে, সরস্বতী নদীর উপকূলে, কাম্যক-বনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। \

---------------

এর পরে আমরা ঋষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের সাক্ষাৎ পাই, যখন যুধিষ্ঠির তার ভাইদের   দ্রৌপদীকে সঙ্গে নিয়ে  তীর্থভ্রমণে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন।  এইসময় ঋষি ব্যাসদেব কাম্যক বনে প্রবেশ করলেন।

মহাভারত পড়তে বসলে, মনেই হয় না যে এর কোনো লেখক আছেন, যার নাম কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। এই কৃষ্ণ দ্বৈপায়নকে মনে হয়, যেন মহাভারতের হাজার হাজার চরিত্রের মধ্যে একজন পার্শ্ব চরিত্র। আর মহাভারত হচ্ছে, একটা ঐতিহাসিক দলিল।  যেন মহাকাশ থেকে কেউ একটা নির্দিষ্ট সময়ের পৃথিবীর তথ্যচিত্র তুলে রাখছেন।  যা আমরা আজ লিপিবদ্ধ আকারে দেখতে পাচ্ছি। মহাভারত শুধুই অধ্যয়ন  করবার বিষয় নয়, মহাভারত যেন কথা বলে। মহাভারত যেন শোনার বিষয়। ইতিহাস কথা বলে, আমরা বর্তমান শুনি । মহাভারতের  কথা সত্য, না মিথ্যে, না নিতান্তই কল্পনা তা জানি না।  এখানে কোনো ছবি  স্পষ্ট, কোনো ছবি  অস্পষ্ট-আবছা। কোনোটা  বোঝা যায়, কোনটা বোঝা যায় না। অনুমান করা যায় মাত্র।

যাইহোক, কাম্যক বনে, আবার ঋষি ব্যাসদেবের সাথে পঞ্চপান্ডবদের সাথে সাক্ষ্যাৎ হলো। ঋষি বললেন, মন পরিশুদ্ধ করে তীর্থযাত্রা করতে হয়। নিজের অন্তঃকরণকে সহজ-সরল করো। দেখো শারীরিক শুদ্ধতা বজায় রাখবার জন্য, যে নিয়মাদি পালন করতে হয়, তা মনুষ্যব্রত, আর মনের শুচিতা বজার রাখবার জন্য দৈবব্রত পালন করতে হয়। শরীর ও মন পরিশুদ্ধ না করতে পারলে, তীর্থদর্শনের ফল অনুভব হয় না। যুধিষ্ঠিরকে তীর্থপথে যাত্রা করিয়ে দিয়ে, ঋষি  ব্যাসদেব নিজ কুটিরে  ফিরে এলেন। 

পৃষ্ঠা - ৬৫৬  ২৫.১০.২০২১

এর পরে আমরা  ঋষি ব্যাসদেবের দেখা পাই প্রায় ১০ বছর  পরে। অর্থাৎ তখন পান্ডবদের বনবাস ১১ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। অরণ্যে অনায়াসলভ্য ফলমূল খেয়ে খেয়ে, দিনে দিনে ক্লান্ত-অবসন্ন বোধ করতে লাগলো। সার শরীর কৃশকায় হয়েছে। রুক্ষতা ফুটে উঠেছে চেহারার মধ্যে। যুধিষ্ঠির,  ভাইদের ও দ্রৌপদীকে, "আর বেশি দেরি নেই" বলে শান্তনা  বাক্য  শুনিয়ে, স্থির করে রাখবার চেষ্টা করতে লাগলো। এইসময়, সত্যবতী পুত্র, স্বীয় পৌত্র পাণ্ডবদের সাথে দেখা করতে এলেন। এইসময় ঋষি ব্যাসদেব মহর্ষি মুদ্গলের উদাহরণ উদাহরণ দিয়ে যে শান্তনাবাক্যঃ শুনিয়েছিলেন, তা আমাদের দুঃখের দিনের সম্পদ হতে পারে। 

এঁরা  সবাই রাজপুত্র। আজ দীর্ঘ এগারো বৎসর রাজসুখে বঞ্চিত। বলা যেতে পারে, সন্যাস জীবন-যাপন করছেন। জঙ্গলের ফলমূল খেয়ে জীবন ধারণ করছেন।  যত্রতত্র সাইন করছেন।  সঙ্গে আছে আবার দ্রৌপদীর মতো সুন্দরী গৃহবধূ। নিজের জন্য তো বটেই, এঁরা  কেউ কারুর দুঃখই সহ্য করতে পারছেন না। কিন্তু এঁরা  কেউ সন্যাসীর মানসিকতার নয়।  এদের সবার মধ্যে রাজসুখ থেকে বঞ্চনার আগুন তাদের মনে ধিকি ধিকি করে জ্বলছে। অথচ এদের মধ্যে বল বীর্যের অভাব ছিল না। আজ এঁরা  জীবন সংগ্রামে ক্লান্ত - অবসন্ন হয়ে, নিভে যাওয়া আগুনের অগ্নি-স্ফুলিঙ্গের  মতো ধিকিধিকি জ্বলছে। এইসময় সামনে এসে দাঁড়ালেন, স্বয়ং ভগবানের দূতরূপী পিতামহ ব্যাসদেব। আমরাও যখন জীবন-সংগ্রাম করতে করতে তিলে তিলে  ক্ষয় হয়ে, শেষ-নিঃশ্বাসের অপেক্ষায় থাকি তখন আবির্ভাব হন, স্বয়ং ভগবানের দূত। 

এখানেও এইসময় সত্যবতী-পুত্র কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন, স্বীয় পুত্র পান্ডবদের সাথে দেখা করতে এলেন।  যেন শান্তনা-বারিধারা সিঞ্চন করবার জন্য, স্বয়ং ভগবানের দুটি হিসেবে পাণ্ডবদের জীবনে উদয় হলেন মহর্ষি ব্যাসদেব।  এইসময় ঋষি ব্যাসদেব মহর্ষি মুদ্গলের উদাহরণ দিয়ে যে শান্তবাক্যঃ শুনিয়েছিলেন, টি আমাদের সকালের দুঃখের দিনের সম্পদ হতে পারে। 

ঋষি ব্যাসদেব বলছেন, হে ধর্ম্মরাজ তপোনুষ্ঠান না করলে, কখনোই সুখ লাভ হতে পারে না। মানুষ পৰ্য্যায়ক্রমে  সুখ-সুখ ভোগ করে থাকে। কারুর জীবনেই অনন্ত সুখ বা অনন্ত দুঃখ নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে থাকে না। কেউই অনন্ত সুখভোগে সমর্থ হয় না। বিশুদ্ধ বুদ্ধি সম্পন্ন প্রাজ্ঞ লোক জীবনের উন্নতি লাভে হৃষ্ট বা হীনদশায় কোনোক্রমেই বিষণ্ণ হন না। অতয়েব পাণ্ডুপুত্রগন জীবনে লাবদ্ধ সুখ-দুঃখ সমানভাবে গ্রহণ করবে, সুখ-দুঃখ সমভাবে বোধ করবে। কৃষক যেমন শস্যের প্রতিপালন করে, তেমনি সুখ-দুঃখের অবসরকে প্রতিপালন করবে।  একটা কথা যেন তপস্যা অপেক্ষা সার কথা আর কিছু নেই।  তপস্যা থেকেই পরমসুখ লাভ করে থাকে। তাপ  সহ্য করবার ক্ষমতায় তপস্যা। সুখে-দুঃখে, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায়  সমভাবে অবস্থান করো। অনুভব করো একটা সাম্য অবস্থা।  সত্য, সরলতা, অক্রোধ, দম, শম, অনুসূয়া অহিংসা, শৌচ ও ইন্দ্রিয়-সংযম, এই কয়টি  গুন মানুষকে পবিত্র করে তোলে। সৎ পথের যারা বিরোধী, ধর্ম্মাচরনে যাদের রুচি নেই, তারা কখনোই সুখ লাভ করতে পারে না। একটা জিনিস জানবে, আজ যে কাজের অনুষ্ঠান করা যায়, ভবিষ্যতে তার ফল ভোগ হয়ে থাকে।  অতয়েব, মানুষের উচিত সবসময় তপস্যা ও নিয়মে নিরেট থাকা। তবেই ভবিষৎ জীবন উজ্জ্বল হয়।  জীবন শুধু নেবার জন্য নয়, জীব দেবার জন্য বটে।  জীবনে অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়।  যখন সেই ত্যাগের সময় উপস্থিত হয়, যখন দেবার সময় উপস্থিত হয়, তখন প্রফুল মনে আর্থিক পূজা ও প্রণামপূর্বক শক্তি অনুসারে দান  করবে। 

একটা কথা শোনো, সত্যবাদী পুরুষ যিনি সত্যকে আঁকড়ে থাকেন, তার জীবন নিরুদ্বিগ্ন থাকে,সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয় তারা। আর দুশ্চিন্তাহীন মানুষের জীবন হয় দীর্ঘায়ু।  দানশীল ও শান্তিপ্ৰি জীবনে নিরন্তর সুখ-স্বচ্ছন্দতা লাভ হয়ে থাকে। ইন্দ্রিয়-দমনশীল ব্যক্তি কখনো অন্যের সম্পত্তি দেখে সন্তপ্ত হন না। যিনি সানবিভাগ করতে অর্থাৎ সবাইকে দুয়ে থুয়ে সন্তুষ্ট থাকেন, যিনি দাতা, যিনি অহিংসক, যিনি মানসিক দিক থেকে তৃপ্ত বা সুখী থাকেন, তিনি শারীরিক দিক থেকেও আরোগ্যলাভ করে থাকেন। যিনি সন্মানীয় অথচ সবাইকে সন্মান করে থাকেন, ভবিষ্যতে তার মহাতকুলে জন্ম হয়ে থাকে।  যিনি ইন্দ্রিয়কে জয় করতে পেরেছেন, তিনি বাসনা-রোহিত পুরুষ হন। যিনি সদা শুভবিষ্যের চিন্তা করেন, তিনি মানুষের দুঃখের সময়, কল্যাণকামী হয়ে দুঃখীর নিকট আবির্ভূত হন। 

হে যুধিষ্ঠির পৃথিবীতে দান অপেক্ষা দুস্কর কিছু নেই।  মানুষের অর্থতৃষ্ণা  অতি বলবতী ।  অর্থও অতি কষ্টে  অর্জিত হয়ে থাকে।  দেখো,  মানুষ ধনের লোভে, এমনকি নিজের প্রাণের মায়া পরিত্যাগ করে, সাগর-পাড়ি দেয় , মধুর লোভে ঘন জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করে।  কেউ বা কৃষিকাজ করে, কেউ বা গো-পালন করে, কেউ বা অর্থের জন্য অন্যের দাসত্ত্ব স্বীকার করে।  সুতরাং কষ্টে  উপার্জিত অর্থ বা ধন, দুঃখ-উপার্জিত ধন পরিত্যাগ করা নিতান্ত কঠিনতর। বিশেষভাবে ন্যায়ভাবে উপার্জিত ধন দান  করবার জন্য বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজন। দেশ-কাল-পাত্র বুঝে দান  করতে হয়। আর এই দেশ-কাল-পাত্র বিবেচনা করা, সাতিশয় সুকঠিন। দেখো অন্যায় পথে অর্জিত ধন দান  করলেও তার কোনো সুফল হয় না। এমনকি সে তার পাপ-কর্ম্মের ভয় থেকেও পরিত্রান পায় না। কিন্তু বিশুদ্ধ অন্তঃকরণে ন্যায় পথে উপার্জিত অর্থ দান  করলে, অনন্ত পুণ্যফল লাভ হয়ে থাকে। 

এই উপদেশের কথা বলতে বলতে ঋষি ব্যাসদেব মুদ্গলের উপাক্ষাণ শোনালেন।   

প্রাচীনকালে কুরুক্ষেত্রে মহাত্মা মুদগল নামে  এক সত্যবাদী, জিতেন্দ্রিয় পুরুষ ছিলেন। তিনি কপর্দক শূন্য অবস্থায় ভিক্ষে করে, কুড়িয়ে বাড়িয়ে যা পেতেন, তা একটি কলসিতে  রাখে দিতেন। আর এর থেকে তিনি অতিথি সৎকার করতেন,.ধর্ম্ম  কর্ম্মে ব্যয় করতেন। প্রতি সপ্তাহে তার এক কলসি চাল সংগ্রহ হতো।  আর সেই অন্ন দিয়ে তিনি দেবতাদের ভোগ দিতেন, অতিথি সৎকার করতেন এবং সব শেষে যা থাকতো, তাই দিয়ে তিনি জীবন ধারণ করতেন।  আর এইসব তিনি করতেন অতি প্রফুল্ল   চিত্তে। আশ্চর্য্যের ব্যাপার হচ্ছে, তার এই শুদ্ধ মনে অতিথি সৎকার  কার্য্যে কখনো অন্নের  অভাব হতো না।  যখনই অতিথি সমাগম হতো, তখনই তার কলসি অন্নে ভোরে উঠতো। 

তো একদিন দুর্বাসা মুনি এই মহাত্মাকে পরীক্ষা করতে এলেন।  এসে বললেন, আমি খুবই ক্ষুধার্থ আমি অনার্থী, তোমার নিকট এসেছি। মহাত্মা মুদগল হৃষ্ট চিত্তে তাকে অন্ন ভোজন করলেন।  এর পর থেকে ঋষি দুর্বাসা প্রতিদিন মুদ্গলের কাছে আসতেন, আর এখানে অন্ন গ্রহণ করে পরিতৃপ্ত হয়ে আনন্দে বাকি অন্ন নিজের অঙ্গে লেপন করে, অন্তর্ধান করতেন। আর এই অন্ন অপচয়ের ফলে, মুদ্গলের জন্য, কোনো অন্ন অবশিষ্ট থাকতো না। কিন্তু মহাত্মা মুদগল এতে কখনো বিরক্ত হতে না।  কিছু বলতেনও না। আর নিজে দিনের পর দিন অভুক্ত থেকে ধ্যান সাধনায় রত থাকতেন। এইভাবে কিছুদিন চলার পরে, ঋষি দুর্বাসা সন্তুষ্ট হয়ে তাকে স্বর্গপ্রাপ্তির আশীর্বাদ করলেন। 

এরপরে যথা সময়ে,  স্বর্গ থেকে স্বর্গের দূতগণ মুদগল ঋষিকে নিয়ে যেতে আসলো।  এখন মুদ্গলের  স্বর্গ সম্পর্কে কোনো ধারণা  ছিল না।  তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, স্বর্গ ব্যাপারটা কি ? কোথায় এই স্বর্গ। তো দেবদূতগণ বললেন, তুমি কেমন অবোধের ন্যায় কথা বলছো ! স্বর্গলোক এই পৃথিবীর উপরিভাগে অবস্থিত। সেখানে দেবতাদের বাস।  দেবতাগণ নিরন্তর দেবযানে  যাতায়াত করে থাকেন। সেখানে কেবল ধর্ম্মিক, জিতাত্মা, শান্ত, দান্ত, ধ্যানশীল ব্যক্তি প্রবেশ করতে পারেন। সেখানে আছে অপ্সরাগন, আছে গন্ধর্বগন, মহর্ষি, ও দেবতাগণ। সেখানে অতি সুন্দর দেবোদ্যান আছে।  এই স্বর্গলোকই সমস্ত পুণ্যবানের বিচরণভূমি। এখানে না আছে, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, না আছে ভয়-গ্লানি। না আছে কোনো অশুভ। সেখানে সুগন্ধিতে ভরপুর।  মধুর সংগীতে ভরপুর এই স্থান। এখানে শোক-তাপ-জরা-ব্যাধি বিরাজ করতে পারে না। এখানে কোনো স্থূল শরীর  ধারণ করতে হয় না।  এখানে সবাই শুদ্ধ ও পবিত্র সুক্ষ দেহের অধিকারী।  এখানে ফুল কখনো সুগন্ধি দানে অপারগ হয় না।  এখানে চির অমলিন ফুলের গন্ধে ও সৌন্দর্যে  ভরপুর থাকে। 

এই স্বর্গলোকের পূর্বদিকে আছে ব্রহ্মলোক। সেখানে আছে ঋতু নামক দেবতাগণ।  মানুষ যেমন দেবতাগনের উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করে থাকে, তেমনি দেবতাগণ এই ঋতু নামক ব্রহ্মলোকবাসী দেবতাজ্ঞানের উদেশ্যে যজ্ঞ করে থাকেন।  এদের দিব্য শরীর। অনির্বচনীয় তার শোভা। এঁরা  কল্প থেকে কল্পান্তরেও একইভাবে অবস্থান করছেন। 

মুদগল বললেন, সব তো বুঝলাম, কিন্তু আমি শুনেছি, এখান থেকেও দেবতাগণ মনুষ্য শরীর ধারণ করবার জন্য মর্তলোকে প্রবেশ করে থাকেন । তো স্বর্গে তাহলে অসুবিধা কি ? কেন তাঁরা আবার মৃত্যুপুরীতে প্রত্যাগমন করে থাকেন ? তখন দেবদূতগণ বললেন, দেখুন, স্বর্গে কোনো কাজ করতে হয় না. তাই সেখানে কোনো কর্ম্মফল সঞ্চিত হয় না। তাই মানুষ মর্তে থাকাকালীন যে পুন্য-কর্ম্ম-ফল সঞ্চয় করেছিল, তার ভোগ শেষ হয়ে গেলে, তাঁরা আবার মর্তলোকে অধঃপতিত  হয়।  মুদগল বললেন, তাহলে তো মহা বিপদ। কিছুদিন সুখ ভোগের পরে, আবার যদি আমাকে এই মৃত্যুলোকে প্রবেশ করতে হয়, তবে তো তখন দুর্গতির শেষ থাকবে না। একবার সুখ ভোগের পরে, আবার এই ক্লেশপূর্ন জীবন অত্যন্ত দুর্বিসহ। মালা ধারণ করতে ভালো লাগে, কিন্তু যদি মালা শুকিয়ে যায়, বা মালা দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে যায়, তবে তো ভীষণ উদ্বেগের বিষয়। আমি এমন জায়গায় সন্ধান চাই, যেখানে গেলে, আমাকে আর এই মৃত্যুপুরীতে ফিরে আসতে  হবে না। একথা বলে, মহাত্মা মুদগল আবার তার ভিক্ষাবৃত্তি দ্বারা ধর্ম্মিক জীবন অতিবাহিত করতে লাগলেন। আবার সেই উঞ্ছবৃত্তি অবলম্বন  করে, অতিথি সেবা করে, দিনযাপন করতে লাগলেন। শেষে একদিন মুদ্গল  বিশুদ্ধ জ্ঞানযোগের সাধনায় ধ্যনস্থ হলেন। ধ্যানযোগবলে পরম পুরুষার্থঃ শ্বাশত মুক্তিপদ লাভ করলেন। 

এই গল্প কাহিনী বলে, মহর্ষি ব্যাসদেব যুধিষ্ঠিরকে বললেন, হে কৌন্তেয়, রাজ্যচ্যুত  হয়েছো বলে, তোমার শোক করা উচিত নয়।  তুমি তোমার তপঃবলে আবার রাজ্য-প্রাপ্ত হবে। এর জন্য তুমি চিন্তা করো না। দেখো, সুখ-দুঃখ চক্রের ন্যায় নিরন্তর পরিবর্তিত হচ্ছে।  সুখের অবসানে দুঃখ, আবার দুঃখের অবসানে সুখ।  দিনের অবসানে রাত্রি, আবার রাত্রির অবসানে দিন।  এগারো বৎসর অতিক্রান্ত হয়েছে, এখানে তোমরা পণ্ডিত মহাজনদের কাছ থেকে বেদবিদ্যা আয়ত্ত্ব করেছো, মুনি  ঋষিদের সাহচর্য পেয়েছো।  তোমাদের জীবনের এই তপঃকাল কখনো বৃথা যাবে না। কঠোর জীবন  আমাদের সবাইকে সত্যিকারের জীবন-শিক্ষা দিয়ে থাকে। তোমার এর মধ্যে তীর্থ-ভ্রমণের পুন্য অৰ্জন করেছো।  এই দুর্লভ জীবন-শিক্ষা তোমরা রাজপ্রাসাদে থেকে অর্জন করতে পারতে  না। আর তো  মাত্র কয়েকটা দিন, দেখতে দেখতে কেটে যাবে।  তেরো বৎসর অতিক্রান্ত হলেই তোমরা তোমাদের পৈতৃক রাজ্য নিশ্চয় পুনরায় ফিরে পাবে। অতয়েব, মন থেকে দুঃখ শোক দূর করে দাও। আর ধৈর্য্যের সঙ্গে তাপিত জীবন থেকে জীবনের পাঠ গ্রহণ করো। সময় তোমাদের যথার্থ সুখী ও বাঞ্চিত জীবনে প্রবেশ করিয়ে দেবে। জানবে দুঃখ মানুষকে খাঁটি করতে পারে। তোমরা সমস্ত জীবকুলের আদর্শ হয়ে থাকবে। 

এইকথা বলে ব্যাসদেব তার আশ্রম অভিমুখে যাত্রা করলেন। আমরাও আবার ব্যাসদেবের সন্ধানে বেরিয়ে পড়বো। 

-------------------------------------              

     



 

 

               

      

 

   

 

            

 















        

  

No comments:

Post a Comment