Wednesday, 13 October 2021

হঠযোগ

 


ঋষিকথা -  হঠযোগ - ভূমিকা

যোগ প্রধানত তিন প্রকার : কর্ম্ম-যোগ , জ্ঞান-যোগ, ও ভক্তি-যোগ। অর্থাৎ ঈশ্বর-আদিষ্ট কর্ম্মের সাহায্যে, ঈশ্বরের সম্পর্কে জ্ঞানের সাহায্যে, এবং ঈশ্বরের প্রতি অহৈতুকী ভক্তির সাহায্যে স্বয়ং পরমেশ্বরের  সঙ্গে মিলনের আনন্দ গ্রহণকেই বলে যোগ । আসলে কর্ম্ম-জ্ঞান-ভক্তি একে অন্যের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। কর্ম্ম না করলে, আপনার মধ্যে প্রত্যক্ষ জ্ঞানের অনুভব হবে না। আবার জ্ঞানহীন ভক্তি অসার। এই জ্ঞানহীন ভক্তি আসমানে অট্টালিকার মতো।  যার কোনো ভীত নেই। এই ভক্তি যেকোনো মুহূর্তে  উবে যেতে পারে। যাই হোক, আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে হঠযোগ।  

তো,  আরো একটা যোগের কথা আমরা শুনতে পাই সেটি হচ্ছে রাজযোগ। বলা হয়ে থাকে ব্রহ্মানুভূতি লাভের সবথেকে উৎকৃষ্ট উপায় বা পথ হচ্ছে রাজযোগ। ঋষি পতঞ্জলি এই রাজযোগকে  আটটি  সোপানের উপরে দাড়  করিয়েছেন। যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি। 

হঠযোগ এই রাজযোগের একটি শাখা। "হ" বর্ণে বা শব্দে সূর্যকে বোঝানো হয়।  আর "ঠ" বর্ণে  বা শব্দে চন্দ্রকে বোঝানো হয়। তাই হঠযোগ অর্থে সূর্য ও চন্দ্রের শক্তিকে বোঝানো  হয়। জীবন হচ্ছে, চন্দ্র-সূর্য-পৃথিবীর মিশ্রণ। এই তিনের মিলনে জীবন। এই তিনের বিলুপ্তিতে জীবনের বিলুপ্তি। এর যেকোনো একটির বিলুপ্তিতেও  জীবনের সমাপ্তি ঘটবে। তো আমাদের শরীরকে বলা হচ্ছে পৃথিবী।  কথায় বলে মাটির  দেহ, মাটিতেই  মিশে যাবে। এখন এই মাটির দেহতে দুটো শক্তি ক্রিয়া করছে। এক হচ্ছে, চন্দ্রশক্তি  দুই হচ্ছে   সূর্যশক্তি । যা আমাদের প্রশ্বাস ও নিঃশ্বাস। হঠযোগ আমাদেরকে এই শ্বাস-প্রশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখায়। অর্থাৎ প্রাণায়ামের সাহায্যে চন্দ্র সূর্য্যের শক্তি রশ্মির মাধ্যমে শরীরকে সুস্থ রাখার বিদ্যা শেখায়।  যদিও প্রাণায়ামের সাহায্যে শরীরকে সুস্থ রাখতে পারি,  কিন্তু হঠযোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে, ঈশ্বরানুভূতি শরীরের মধ্যে জাগিয়ে তোলা। বিশ্বশক্তির সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করা। 

যোগী ভর্তৃহরি, জালন্ধরনাথ, গোরক্ষনাথ, মৎস্যেন্দ্রনাথ, স্বাত্মারাম, ঋষি ঘেরন্ড, এমনিতর বহু ঋষি-মুনি  এই বিদ্যার চর্চা করেছেন। আসলে এই গুহ্যবিদ্যার প্রবর্তকগুরু হচ্ছে, স্বয়ং শিব। আর এই কথা বলেছিলেন, মাতা  পার্বতীকে।

 দেখুন, শরীর  ভিন্ন আমরা কোনোকিছুই উপলব্ধি করতে পারি না। তা সে বাহ্যিক জগৎ বলুন, বা অন্তর্জগৎ বলুন। যে কোনো জগতের স্বাদ নিতে গেলে,আমাকে শরীরধারী হতে হবে। দেহাতীত হয়ে, আমরা কোনো কর্ম্ম করতে পারি না।  শরীরেই মানুষ অসুর  হতে পরে, আবার এই শরীরেই মানুষ দেবতা বা সুর হতে পারে। পার্থিব জগৎ-এর আনন্দ নিতে গেলে, আমাদের শরীরের সাহায্যেই তা হতে পারে। সুস্থ শরীরেই আনন্দ উপলব্ধ হয়, তা সে পার্থিব বলুন বা অপার্থিব বলুন। অসুস্থ শরীর কোনো আনন্দের আধার হতে পারে না। তাই বলা হয়ে থাকে দেবতারাও এই মনুষ্য শরীরের কামনা করে থাকেন।    

বলা হয়ে থাকে ত্রিলোকে, যা কিছু আছে, তা আমাদের শরীরে অবস্থান করছে। শিব সংহিতায় দ্বিতীয় পটলে শ্লোক ৬-১১) বলা হচ্ছে, আমাদের মেরুদণ্ডের  চূড়ায় চন্দ্ররশ্মি ষোড়শকলা পূর্ন  হয়ে, দিবারাত্র বর্তমান আছেন। সেই চন্দ্র নিরন্তর নিম্নমুখী হয়ে সুধা বর্ষণ করছেন। সেই অমৃতধারা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে সূক্ষ্মরূপে দেহের দুই নাড়ীর (ইড়া ও সুষুম্না) মধ্যে প্রবেশ করছে। দেহের বাম  দিকে ইড়া নাড়ীর অবস্থান।  চন্দ্ররশ্মি আমাদের শরীরের বাম  দিকে থাকে।  চন্দ্রের এই কিরণ, সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মেরুদণ্ডের মধ্যপথ অর্থাৎ সুষুম্নার পথ ধরে নিম্নগামী হয়ে থাকে। 

আবার মেরুদণ্ডের উর্দ্ধদেশে  দ্বাদশকলা যুক্ত সূর্য অবস্থান করছেন। এই সূর্য তার  উর্দ্ধমুখী রশ্মির  দ্বারা মানুষের শরীরে দক্ষিণ মার্গ অর্থাৎ পিঙ্গলা নাড়ীতে সঞ্চারণ করে থাকেন। এবং চন্দ্রমণ্ডল থেকে নির্গত যে স্নিগ্দ্ধ কিরণরাশি তাকে গ্রাস করেন।  অর্থাৎ আমাদের ধাতুকে গ্রাস করে থাকেন। আর বায়ুর দ্বারা প্রবাহিত হয়ে. আমাদের সমস্ত দেহে বিচরণ করে থাকেন।

 এই সূর্য্যের একটা রূপ আমাদের পিঙ্গলা  নাড়ীতে বা আমাদের দক্ষিণ পথে সঞ্চালিত হয়ে আমাদের মুক্তিপ্রদ হন আবার এই এই সূর্য্যশক্তিই  বিশেষ লগ্নে, সৃষ্টিকে সংহার করে থাকেন। 

এবারে একটু অন্য কথা বলি। দেখুন আমাদের বেঁচে থাকতে গেলে, গ্রহণ বর্জন উভয়ই দরকার। এই ক্রিয়া, একে  অন্যের পরিপূরক। আমরা জানি, খাদ্য গ্রহণ বিনা আমরা বেঁচে থাকে পারি না। তো আমাদের পরিমাণমতো, সময়মতো খাবার গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু দেখুন, এই খাবারের একটা অংশ  আবার আমাদের পরিমান ও সময়মতো ত্যাগ করতে হবে। এই দেওয়া নেওয়ার মাধ্যমেই মানুষ এমনকি জীবকুল বেঁচে আছে। এই দেওয়া নেওয়া কম-বেশি হলেই বিপদ। আবার অতিরিরিক্ত ভোজন, বা অখাদ্য-কুখাদ্য গ্রহণ যেমন ক্ষতিকারক, তেমনি আমাদের শরীরের পক্ষে যা অপ্রয়োজনীয় অংশ তা আমাদেরকে অবশ্যই  বের করে দিতে হবে।  আমাদের যদি কোনো কারনে, মল-মূত্র-ঘাম ইত্যাদি ত্যাগের যে স্বাভাবিক ক্রিয়া আছে, তা যদি বন্ধ হয়ে যায়, তবে প্রাণ নাশের সম্ভাবনা। একটু কল্পনা করুন তো, শরীরের জন্য খাদ্যের প্রয়োজন।  তো এমনটা তো হতে পারতো, আমরা শুধু খাবো।  আমাদের মল-মূত্র ত্যাগের কোনো প্রয়োজন হবে না।  যা গ্রহণ করবো, তাই আমাদের শরীরের কাজে লেগে যাবে। গ্রহণের জন্য আমাদের সক্রিয় হতে হয়।  কিন্তু ত্যাগের জন্য আমাদের কিছুই করবার প্রয়োজন পরে না। অর্থাৎ মৃত্যু আমাদের স্বাভাবিক গতিতে আসে, কিন্তু জীবনের জন্য লড়াই করতে হয়। হঠযোগ আমাদের জীবন-মৃত্যুর মধ্যে একটা সাম্যতা এনে দেয়। ফলে আমরা ইচ্ছেমৃত্যু বরণ করতে পারি। এর পরেও একটা কথা থাকে, তবে যোগীগণ কেন চিরকাল বেঁচে থাকেন না। তার  কারন হচ্ছে, যোগীদের  ইচ্ছে করে না বেঁচে থাকতে, অর্থাৎ শরীরের মধ্যে আবদ্ধ থাকতে তাঁদের  ইচ্ছে করে না। কর্ম্মহীন জীবন, উদ্দেশ্যহীন জীবন, সঙ্কল্পহীন জীবন বিস্বাদ। তাই কর্ম্মের এই আধারকে ছেড়ে যোগীগণ নিরাধারে বিচরণ করে থাকেন। ................এবং আবার ইচ্ছে অনুযায়ী দেহ ও পরিবার নির্বাচন করেন, যেখানে যোগচর্চার সুবিধা ও পরিবেশ পেতে পারেন। 

যোগে, নারী পুরুষ ভেদ  নেই।  এই যোগকথা দেবাদিদেব মহাদেব মাতা পার্বতীকে প্রথম শুনিয়েছিলেন। যোগে কোনো ধর্ম্মের ভেদ নেই। শিব কথাটার অর্থ মঙ্গলময়।আর পর্বত পুত্রী পার্বতী।যোগেসূত্র  বিশ্বাসের উপরে নয়, এমনকি অনুমানের উপরে নির্ভর করে এগুতে হয় না। যোগ  বিজ্ঞানের উপরে নির্ভরশীল। যোগসিদ্ধি  কোনো নির্দিষ্ট সময় মেনে চলে না। যোগ চলে নিষ্ঠার উপরে। যোগশাস্ত্র স্বয়ং ভগবানের দান।  যোগ মানুষের মঙ্গলদায়ক ক্রিয়া, যা বিশ্বশক্তির সঙ্গে মানুষকে জুড়ে দিতে পারে। আর মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে সহজ সরল আনন্দময় করে যোগসিদ্ধি লাভ করে থাকেন। তো কবে হবে আমাদের যোগসিদ্ধি ?    

নারদ চলেছেন, ভগবানের দর্শনে। পথে দেখা এক গুহাবাসী যোগসাধকের সঙ্গে। সাধক বললেন, হে মহর্ষি আমার কবে মুক্তি হবে ? নারদ বললেন, এর উত্তর তো আমার কাছে নেই, ভগবানের যবে  ইচ্ছে হবে, তখন তোমার মুক্তি হবে। সবই ভগবানের ইচ্ছে। তো যোগসাধক আবার জিজ্ঞেস করলেন, তো আপনি তো ভগবানের সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছেন, তাঁকে একবার দয়াকরে জিজ্ঞেস করবেন, আমার কবে মুক্তি হবে।  বহু জন্ম আমি সাধনায় লিপ্ত আছি। আমি আর পারছি না। 
কিছু দূর যাবার পরে, আরো এক যোগসাধকের সাথে দেখা। ইনি একটা  বটগাছের নিচে বসে যোগ সাধনা করছেন। নারদকে পেয়ে, তার যথাযোগ্য সন্মান দিয়ে আসন পেতে  দিলেন। বিশ্রামের জন্য অনুরোধ করলেন। নারদ বললেন, আমার বসবার সময় নেই। আমি ভগবৎ দর্শনে যাচ্ছি। যা বলার তাড়াতাড়ি বলো। যোগসাধক মিনতি করলেন, হে মহর্ষি আমার কবে মুক্তি হবে। নারদ বললেন, ভগবানের যবে ইচ্ছে  হবে, তবে তোমার মুক্তি হবে। সবই ভগবানের ইচ্ছে।  তো সাধক আবার বললেন, ভগবানের ইচ্ছেটা কবে হবে, যদি বলেন।  তো নারদ বললেন, ঠিক আছে, আমি ভগবানের কাছে জিজ্ঞেস করে এসে বলবো।
নারদ এবার ভগবৎ দর্শন করে মর্তের  দিকে আসছেন। প্রথমে  নারদ গুহাবাসী যোগীর কাছে এলেন।  তাকে বললেন, যে তপস্বী তোমার্  মুক্তি আসন্ন।  মাত্র এক হাজার  পরেই তোমার মুক্তি হবে। একথা শুনে সাধক ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললেন।  বললেন, ভগবান কতো নিষ্ঠূর। আমি হাজার বছর  ধরে সাধনা করছি, আরো হাজার বছর আমাকে অপেক্ষা করতে হবে।  হা ভগবান।  
    
এবার  বটগাছের নিচে যোগস্থ সাধকের সাথে দেখা। নারদ বললেন, হে যোগী, তোমার মুক্তি এখনো দেরী আছে।  বটগাছের যত  পাতা আছে, তত বছর পরে তোমার মুক্তি হবে। তো একথা শুনে যোগী নাচতে লাগলেন। নারদ বললেন, নাচছো যে বড়ো ? বটগাছে কত পাতা আছে জানো ? গুনেছো কখনো ? লক্ষকোটি পাতা আছে।  তো একথা শুনে তোমার এক্ষুনি আনন্দের  কি হলো ? যোগী বললেন,  আমার সাধনার কথা ভগবানের কানে পৌঁছেছে, এতেই আমার আনন্দ,  আমার মুক্তি আসন্ন। আপনি আমার প্রণাম নেবেন।  ভগবানকে আমার মুক্তির আনন্দের খবর দেবেন। হে ঋষি  আমার ভগবানের অসীম দয়া। 

আমাদের সর্বোচ্চ জ্ঞানের বিষয় হচ্ছে ঈশ্বর। আর এই ঈশ্বর আপনার থেকে দূরে নয়। এই ঈশ্বর স্বয়ং আপনি। আপনার ভিতরেই আছেন সেই ঈশ্বর। ঈশ্বর বলে কিছু নেই বললে যেমন আপনি ঈশ্বরকে খুঁজে পাবেন না, তেমনি ঈশ্বর আছেন আছেন বলে চিৎকার করলেও আপনি ঈশ্বরের সন্ধান পাবেন না। এই দুই ধরনের মানুষই অজ্ঞান। আমি বলে কিছু নেই, এই কথা বললে, যেমন আমার অস্তিত্ত্বকে অস্বীকার করা হয়, তেমনি ঈশ্বর নেই বললে বোঝা যায়, আমাদের আত্মজ্ঞান হয়নি। আবার আমি ছাড়া কিছু নেই, এই কথাও আমাদের অহংকারকে জাগিয়ে তোলে। আমি যা বুঝি, সেটাই সত্য। আমি যা বুঝি তাই করি। আমি যা বুঝি তাই বলি, এই অধমের সংখ্যাও কম নয় । ঋষি ঘেরন্ড বলছেন, "অহঙ্কারাৎ পরো রিপুঃ। " -অহংকারের চেয়ে বড়  শত্রু নেই। জ্ঞানাৎ পরো বন্ধু। জ্ঞানের সমান বন্ধু নেই। তবে একটা কথা বলি, কাঁচা মাটির কলসিতে  জল রাখলে, যেমন কলসিটাই  ভেঙে যায়। তেমনি কাঁচা দেহে জ্ঞান সঞ্চয় সম্ভব নয়। তাই আমাদের মতো সমস্ত সাধারণ  মানুষ এই জ্ঞানের কথায় আস্বস্ত্ব হবেন, এমনটি ভাবার কোনো কারন নেই। তবে হ্যাঁ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সূর্য্যের তাপে  যেমন মাটির কলসি ধীরে ধীরে শক্ত হতে থাকে, তেমনি আগুনের কাছে এলেও মাটির কলসি শক্ত হয়ে যায়। আর জল ধারনের ক্ষমতা এসে যায়।
 কেউ ত্যাগের মধ্যে, বৈরাগ্যের মধ্যে ঈশ্বরকে খুঁজছেন। কেউ মন্ত্রজপের সাহায্যে ঈশ্বরের কাছে যেতে চাইছেন। কেউ আবার তীর্থে তীর্থে ঈশ্বরকে খুঁজছেন।  কেউ আবার পরহিত কর্ম্ম করে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করতে চাইছেন। কেউ আবার মন্দির মসজিদে ধনদান করে, ঈশ্বরের কাছে যেতে চাইছেন। কেউ যজ্ঞাদি কর্ম্ম করে ঈশ্বরের কাছে যেতে চাইছেন। আসলে এঁরা সবাই মোহজালে আবদ্ধ।  শিব সংহিতায়  স্বয়ং মহাদেব  বলছেন, এরা  যা কিছুই করুন না কেন, এরা  সবাই আসলে জন্ম-মৃত্যু চক্রে আবদ্ধ হয়ে নিতান্ত অবশ হয়ে বারবার সংসারে যাতায়াত করছেন।

 যোগ সম্পর্কে বুঝতে গেলে, আমাদের দুটো জিনিস বোঝার দরকার।  একটা হচ্ছে বিশ্বশক্তি, অর্থাৎ যাঁকে  আমরা আত্মা বলে থাকি।  আর একটি হচ্ছে এই বিশ্বশক্তি বা আত্মা  আমাদের শরীরে কিভাবে কাজ করে থাকে। আত্মা সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে,  আত্মা বহু। কারন প্রত্যেক জীবের একটি করে আত্মা আছেন। আবার কেউ বলেন, আত্মা এক অভিন্ন। সবেতেই সেই এক আত্মা।  কেউ বলেন, শূন্য থেকে জগৎ সৃষ্টি হয়েছে, কেউ বলেন, শূন্য থেকে কিছু সৃষ্টি হতে পারে না। আসলে এইসব কথা  আমাদের অনুমান বা শোনা কথা বা শাস্ত্রপড়া বিদ্যা মাত্র। আসলে সমস্ত ব্যক্তির এমনকি  সমস্ত মহাত্মাগণের ভিন্ন ভিন্ন মত।  কারন হচ্ছে, তাদের দর্শন ও উদ্দেশ্য ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু সত্য কখনো ভিন্নভিন্ন হতে পরে না ।  দর্শন যদি ভিন্ন হয়, তবে বুঝতে হবে, আমাদের সার্বিক দর্শনজ্ঞানের পরিবর্তে আংশিক দর্শনজ্ঞান লাভ হয়েছে। আসলে  জীবন সম্পর্কে আংশিক জ্ঞানের দ্বারা এঁরা  মানুষকে বাক্যজালে বিমুগ্ধ করে মহাপথে নিপাতিত করেছেন। গঙ্গা দক্ষিণ বাহিনী, নর্মদা পশ্চিম বাহিনী, আবার ব্রহ্মপুত্র পূর্ব-দক্ষিণ  বাহিনী। উদ্দেশ্য এক, পরিণতি এক সেই  সমুদ্র। এখন যিনি যেমন দেখছেন, তিনি তেমনি নদীর গতিপথের ধারণা  করছেন।  এমনকি বলা যেতে পারে, এঁরা সবাই সত্যকেই প্রত্যক্ষ করছেন। কিন্তু সত্য হচ্ছে, নদী সমুদ্র অভিমুখী।  এর কোনো অন্যথা নেই। এঁরা  যা দেখছেন, বা প্রত্যক্ষ করছেন, তা আংশিক সত্য মাত্র।   

শিব সংহিতায় বলা হয়েছে, আত্মা এক, অদ্বিতীয়, এবং পূর্ন। তিনি দ্বৈতভাব বিবর্জিত হয়েও অর্থাৎ সগুন হয়েও ঈশ্বর থেকে আরম্ভ করে, জগতের সমস্ত বস্তুর মধ্যে সর্বোতভাবে ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন। ((১/৫৪) অর্থাৎ নিজে  খণ্ডিত না হয়েও প্রতিটি খন্ডের  মধ্যে তিনিই বিরাজ করছেন। 

আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে হঠযোগ। হঠ (সূর্য=হ, চন্দ্র=ঠ ইড়া=চন্দ্র পিঙ্গলা = সূর্য ) কথার অর্থ আমরা আগে শুনেছি চন্দ্র -সূর্য। এই চন্দ্র ও সূর্য রশ্মি আমাদের ইড়া ও পিঙ্গলা নামক নাড়ীর মাধ্যমে আমাদের শরীরে যাতায়াত করছে। এবং আমাদের শরীরের সাড়ে তিনলক্ষ নাড়ীর মধ্যে বিচরণ করছে। এই সাড়ে তিন লক্ষ নাড়ীর মধ্যে, চোদ্দটি নাড়ী প্রধান আর তা হচ্ছে - সুষুম্না, ইড়া, পিঙ্গলা, গান্ধারী, হস্তিজিহ্বিকা, কুহু, সরস্বতী, পুষা, শঙ্খিনী, পয়স্বিনী, বারণী, অলম্বুষা, বিশ্বোদরী,  এবং যশস্বিনী। এর মধ্যে সবথেকে গুরুত্ত্বপূর্ন হচ্ছে ইড়া পিঙ্গলা ও সুষুম্না। এই তিন নাড়ীর  মধ্যে আবার সুষুম্না নাড়ী প্রধান।  এই সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে আছে বজ্রাক্ষা।  বজ্রাক্ষার মধ্যে আছে  চিত্রাণি। এই চিত্রাণি নাড়ীর মধ্যে আছে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ছিদ্রনালী ।  যাকে যোগশাস্ত্র বলছে, ব্রহ্মরন্ধ্র। এই ছিদ্রপথ দিয়ে কুল-কুণ্ডলিনী শক্তি মূলাধার থেকে সহস্রারে গমন করে থাকেন। এবং পরমব্রহ্ম-এর সাথে মিলিত হন। বিজ্ঞান এই সুষুম্নাকে নির্দিষ্ট করতে পেরেছে।  কিন্তু সুষুম্নার  মধ্যেই আছে আরো দুটি নাড়ী যা আজও চিকিৎসা শাস্ত্রে অজ্ঞাত।  এমনকি মূলাধার সম্পর্কেও বিজ্ঞান কিছু বলতে পারে নি।  কিন্তু যোগী পুরুষের কাছে এগুলো অনুভূতিলব্ধ  জ্ঞান।  এই জ্ঞান কাউকে ভাষার দ্বারা বোঝানো যায় না।  কিন্তু পাকা শরীরে  বিশেষ বিশেষ তপঃক্রিয়া অনুষ্ঠানের দ্বারা এর উপলব্ধি হতে পারে। ব্রহ্মের সঙ্গে শক্তির মিলিত হবার এটাই পথ। এঁকে  কেউ বলেন, ব্রহ্মবিবর, কেউ বলেন ব্রহ্মরন্ধ্র, কেউ বলেন ব্রহ্মপথ। শিবসংহিতা বলছেন, এই চিত্রা বা চিত্রাণি নাড়ী পাঁচবর্ণের দ্বারা উজ্বল এবং বিশুদ্ধ।  সুষুম্না নাড়ীর  মাধ্যভাগকেই চিত্রা বা চিত্রাণি বলা হয়ে থাকে। এই চিত্রাণি নাড়ীই দেহের আধারস্বরূপ। এই পথই দিব্য পথ। এই দিব্য পথের  সন্ধান যিনি পেয়েছেন, তিনিই  যোগীশ্রেষ্ঠ। 

গুহ্যদ্বার ও লিঙ্গদ্বার এর মাঝখানে চার-আঙ্গুল বিস্তৃত স্থানে আছেন মূলাধার পদ্ম। এই পদ্মের পঞ্চকোষের মধ্যে ত্রিকোণ স্থানকে বলে যোনি। এই যোনিমন্ডলে তন্ত্রশাস্ত্রে গুহ্যপ্রদেশ। কুণ্ডলিনী শক্তি এই যোনিমন্ডলের মধ্যে সাড়েতিন পাক দ্বারা বক্র অবস্থায় সুষুম্না নাড়ীর মার্গে অবস্থান করছেন। এই শক্তিই জগতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্তা হয়ে  সৃষ্টিকর্ম্মে প্রবৃত্তা। যিনি বাক্যের অতীত বাগ্দেবী। 

সুষুম্নার বাম  দিকে আছে ইড়া  নাড়ী।  এই ইড়ানাড়ী সুষুম্নাকে জড়িয়ে ধরে, আমাদের ডান  নাকের ছিদ্রপথ ধরে আজ্ঞাচক্রে মিলিত হয়েছে। আবার সুষুম্না নাড়ীর ডান দিকে ধীরে পিঙ্গলা নাড়ী নাকের বাম  দিকের ছিদ্র দিয়ে আজ্ঞাচক্রে মিলিত হয়েছে। 

তো ইড়া  ও পিঙ্গলা এই দুই নাড়ীর মধ্যবর্তীতে আছে সুষুম্না নাড়ী।  এই সুষুম্না নাড়ীর ছয়টি স্থানে অর্থাৎ মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মনিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ, ও আজ্ঞা এই ছয়টি স্থানে আছে বিভিন্ন নাড়ীর সন্ধিস্থল। যেখান থেকে গ্রাহক ও প্রেরক নাড়ী বেরিয়ে আমাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছাড়িয়ে পড়েছে।  যার সাহায্যে আমাদের সমস্ত ক্রিয়া-কর্ম্মের  নির্দেশাদি বাহিত হচ্ছে।  এই স্থানগুলোকে শক্তির কেন্দ্রও বলা হয়ে থাকে। উৎসাহী ব্যক্তি রুদ্রযামল তন্ত্র শাস্ত্রে এর বিশদ বিবরণ পেতে পারেন। .......... 

যোগের প্রথম শর্ত হচ্ছে, পরিমিত আহার। অতিহারি, বা নিরাহারিকে , যোগের সাফল্য এনে দিতে পারবে না। আমাদের  কেন খাদ্য গ্রহণ করতে হয় ? উপোষ থেকে কেউ দীর্ঘজীবন লাভ করতে পারেনা। আমরা কি খাই, কেন খাই ? আপনি হয়তো বলবেন, আমাদের ক্ষিদে পায়  তাই আমরা খাই। আমাদের যা ভালো লাগে তাই আমরা খাই।  কিন্তু সত্য হচ্ছে, আমাদের শরীরে সর্বক্ষণ অগ্নি প্রজ্বলিত হয়ে আছে।  আর অগ্নিতে আপনি যদি আহুতি দিতে না পারেন, তবে অগ্নি যেখানে স্থিত অর্থাৎ শরীর, সেই শরীরকে সে ভস্মিভূত করে, উৎসে ফিরিয়ে দেবে। তখন আমরা শরীর ছেড়ে দেবো, বা দিতে বাধ্য হবো। আমাদের আরো একটা ক্ষিধে আছে, আর তা হচ্ছে, ঈশ্বরের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম অনুভব করা।  আর সেই ক্ষিদেই আমাদের কঠিন অধ্যাত্মজীবনে টেনে নিয়ে যায়। যোগ সেই ক্ষিদে মেটাবার জন্য, পাকের অর্থাৎ রান্নার  ব্যবস্থা করে। সেখানে আমরা আরো একটা জিনিস  আহুতি দিতে হয়, সেই আলোচনা আমরা পরে শুনবো।  

আমাদের স্থুল শরীরের জন্য দুই ধরনের পদার্থ, খাদ্য হিসেবে  গ্রহণ করতে হয়।  এক) যার দ্বারা আমাদের শরীরের পুষ্টি সাধন করে. বৃদ্ধি করে, শক্তি উৎপাদনে সহায়তা করে।, যেমন প্রোটিন, ফ্যাট, শর্করা।  দুই) যার দ্বারা আমাদের শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে, দেহের স্বাভাবিকতা বজায় রাখে । যেমন  ভিটামিন খনিজ লবন ও জল। খাদ্য গ্রহণের সময়ে এই কথাটা আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। আপনি যদি যোগী পুরুষ হতে চান, তবে আপনাকে এই দ্বিতীয় প্রকারের খাদ্যের গ্রহণ করতে হবে। এতেকরে দেহের স্বাভাবিক ভারসাম্য বজায় থাকবে। মনের চঞ্চলতা দূর হবে।

 স্থুল শরীরের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই শরীরের মধ্যে খাদ্যের চাহিদার জন্ম হয়। প্রথমে সে মায়ের শরীর  থেকে এই খাদ্য সংগ্রহ করে থাকে। পরবর্তীতে, অর্থাৎ মায়ের শরীর  থেকে সে যখন আলাদা হয়ে যায়, তখন সে নিজের থেকে খাবার সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু করে। আর অভ্যাস বসে, সে মায়ের শরীরের মধ্যেই সে খাবার সন্ধান করে। আর এই সন্ধানক্রিয়াই  তাকে মায়ের বুকে দুধের সন্ধান এনে দেয়। তাই আমরা দেখি, স্বাভাবিক শিশুকে  মায়ের বুক থেকে দুধ সংগ্রহের জন্য যে বিশেষ প্রক্রিয়া, তা তাকে শেখাতে  হয় না। ওই  ছোট্ট মুখ চুক-চুক করে দুধের ভান্ডার থেকে খাবার সংগ্রহ করে।

যোগ আমাদের শরীরের এই স্বাভাবিক ক্রিয়াগুলো, যা আমাদের শরীরকে বাঁচিয়ে রাখে, বর্ধিত করতে সাহায্য করে, এমনকি নীরোগ করে, সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়োগ করে।  সবশেষে  আমাদের স্ব-স্বরূপের উপলব্ধি এনে দেয়। দেখুন। যেকোনো ঘটনার সঙ্গে অনেকগুলো সম্ভাব্য ঘটনার জন্ম দেয়। পরিবেশ অনুযায়ী, সেই সম্ভাব্য ঘটনাগুলো আকৃতি নেয়, বা রূপ ধারণ করে। দুধের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে, দই, ছানা, ঘি, মাখন, সন্দেশ  ইত্যাদি হবার সম্ভাবনার জন্ম হয়। ক্রিয়া ও পরিবেশের গুনে ধীরে ধীরে এইসব রূপের প্রকাশ ঘটে। তেমনি আমাদের জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গেও, আমাদের  অনেক সম্ভাব্য ভবিষ্যতের জন্ম হয়। এর মধ্যে কোনটি রূপ ধারণ করবে, তা নির্ভর করে, আমাদের ক্রিয়া ও পরিবেশের উপরে। এই পরিবেশের উপরে আপনার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, কিন্তু ক্রিয়ার উপরে আপনার অধিকার আছে। এই অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে আপনি  আপনার ভবিষ্যতের রূপ দিতে পারেন। 

কর্ম্মের নিমিত্ত এই দেহে স্থিত হয়েছি  আমরা সবাই। কর্ম্ম হীন জীবন বলে কিছু হয় না। আবার এই কর্ম্মের ফলেই আমাদের ভবিষ্যৎ দেহপ্রাপ্তি হবে। দেহ থেকেই কর্ম্মের উৎপন্ন হয়।  আবার এই কর্ম্মফল অনুযায়ী উন্নত বা অনুন্নত দেহ প্রাপ্তি হয়। যোগ হচ্ছে, কর্ম্মের কৌশল। 

মূলাধার পদ্ম থেকে  যে সমস্ত নাড়ী উত্থিতা হয়েছে, সেই নাড়ীগুলো জিহবা মেঢ্র অর্থাৎ উপস্থ, বৃষণ অর্থাৎ অণ্ডকোষ, পায়ের আঙ্গুল, কক্ষ, চোখ, হাতের আঙ্গুল, পান, পায়ু অর্থাৎ সমস্ত অঙ্গ  প্রত্যঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হয়ে, নিত্যকার্য সমাপ্ত করে আবার নিজ নিজ উৎপত্তিস্থানে ফিরে আসে। এই নাড়ীগুলোকে বলা হয়ে থাকে ভোগবহা  নাড়ী। এই নারীগুলো থেকে শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে সংখ্যায় সাড়ে তিন লক্ষ নাড়ী হয়েছে। এদের সবার আলাদা আলাদা কর্ম্মবিভাগ আছে, আবার এই কর্ম্ম বিভাগ অনুসারে দেহে অবস্থানকেন্দ্র আছে।  এই নাড়ীসকল, সর্বশরীরে বায়ু সঞ্চালন  করে শরীরের রক্ষক হিসেবে কাজ করে থাকে। অর্থাৎ এইসব নাড়ী আমাদের সমস্ত দেহজুড়ে ওতপ্রোতভাবে অবস্থান করছে। 

শিব সংহিতরার দ্বিতীয় পটলের ৩৩ নং শ্লোকে বলা হয়েছে,  সূর্যমন্ডল মধ্যে  যে দ্বাদশকলা রশ্মি আছে, তা আমাদের শরীরের বস্তিদেশে অর্থাৎ নাভির নিম্নদেশে অগ্নি প্রজ্বলিত করছে।  এই অগ্নিকে বলা হয়, বৈশ্বানর। প্রাণীদেহে এই অগ্নি পাচকরূপে খাদ্যকে জীর্ন করে।  এই অগ্নি আমাদের শরীরকে আয়ু প্রদান করে থাকে। এই অগ্নি দেহের পটুতা, বল, পুষ্টি এমনকি ব্যাধির বিনাশ করে থাকে। এই কারনে হঠযোগীগণ বলছেন, গুরুর নির্দেশ অনুসারে, এই অগ্নি প্রজ্বলিত রেখে এখানে অন্ন আহুতি দিতে হয়। এই কারণেই অর্থাৎ বৈশ্বানর বা সূর্য্যের তেজ থেকে উৎপন্ন বহ্নি যা আমাদের শরীরের মধ্যে প্রতিক্ষণ প্রজ্বলিত আছে, তাকে শান্ত করবার জন্য, অগ্নিতে অন্ন আহুতি দিতে হয়। নতুবা এই অগ্নি আমাদের দেহকে ভস্মীভূত করে দেবে। 

আবার এই অগ্নির সাহায্যেই আমরা, আমাদের আত্মশক্তিকে  উর্দ্ধমুখী করতে পারি। ........... 

হঠযোগ আমাদের জ্ঞানের স্তরকে উন্নীত করে। হঠযোগ আমাদের অনুভূতিকে সূক্ষাতিসূক্ষ্ম করে। ব্রহ্ম আছেন, এই কথাগুলো আমাদের শোনা কথা বা বইপড়া বিদ্যা। আমাদের অনুভূতির স্তরে এই ব্রহ্মানুভূতি ধরা দেয়  না। হঠযোগ এই কাজটাই করে থাকে। অর্থাৎ ব্রহ্মানুভূতির স্তরে আমাদের শরীরকে স্থাপন করে। 

যোগাবশিষ্ট জ্ঞানের স্তরকে ৭টি ভাগে ভাগ করেছেন। ১. শুভেচ্ছা ২. বিচারণা ৩. তনুমানসা ৪.সত্বাপত্তি ৫. অসংশক্তিকা ৬. পরার্থাভাবিনী  এবং ৭. তুর্য্যগা। 

১. শুভেচ্ছা : প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ইচ্ছেশক্তি কাজ করে থাকে। এই ইচ্ছেশক্তি বিপরীতমুখী দুটি ধারায় প্রবাহিত হয়। শুভ ও অশুভ। আসলে শুভ অশুভ বলা হচ্ছে সত্য, যাকে আমরা খারাপ অথবা ভালো বলে থেকেই। কিন্তু সত্য হচ্ছে আমাদের এখানে  দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক সম্পর্কে বলা হচ্ছে।  অর্থাৎ আমাদের বেশিরভাগের দৃষ্টি বহির্মুখী।  দৃশ্যমান জগতের দিকে আমাদের দৃষ্টি, নিবদ্ধ।  এই বহির্মুখী দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে যখন আমরা অন্তর্মুখী করতে পারি, যখন আমাদের চিন্তার মধ্যে জাগতিক বস্তুর বদলে, ব্রহ্ম বিষয়ক চিন্তার বিস্তার ঘটতে থাকে তখন তাকে বলা হয়, শুভেচ্ছা।   

২. বিচারণা : আমাদের শ্রবণ, মনন ইত্যাদি দ্বারা বিচারশক্তির উদয় হয়। সমস্ত বিষয়ে যার বিচারশক্তি কাজ করে, সেই অবস্থাকে বলে বিচারণা।  

৩. তনুমানসা : আমাদের মন সবসময় দেহের প্রতি আসক্ত থাকে। আবার দেহ নানান বিষয়ে আসক্ত থাকে। এই দেহ ও মন যখন বাহ্যিক বিষয়কে পরিত্যাগ করে, সৎস্বরূপে অনুরক্ত হয়, তখন আমরা তৃতীয় জ্ঞানের স্তরে অবস্থান করি। 

এই তিনটি জ্ঞানের স্তর আসলে আমাদের সাধনভূমি স্বরূপ। যাঁরা এই তিনজ্ঞানের স্তরে ঘোরাফেরা করেন, তারাই সত্যিকারের সাধক।  এদের মধ্যে বিবেক বৈরাগ্য উপস্থিত হয়।  মনের মধ্যে একটা মুক্তির কামনা জাগ্রত হয়। আর সৎস্বরূপে অনুরক্ত হবার ফলে, এদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ বেশি থাকে।  এরাই ধ্যান-আসনাদির দিকে ঝোকে। আর ধ্যান আসনের সাহায্যে অন্তর শুদ্ধি হলে.জ্ঞানের পরবর্তী স্তরে উন্নীত হয়। 

৪.সত্বাপত্তি : নিদিধ্যানাসান ইত্যাদির দ্বারা অন্তঃকরণ  যখন শুদ্ধ হয়, তখন "আমিই ব্রহ্ম" এই অপরোক্ষ বৃত্তিমূলক জ্ঞান উপস্থিত হয়। একেই সত্বাপত্তি জ্ঞানভূমি  বলা হয়ে থাকে। এই অবস্থায় সাধককে ব্রহ্মবিদ বলা হয়।   

 ৫. অসংশক্তিকা : সত্ত্বাপত্তি জ্ঞানভূমিতে সিদ্ধি হলে, তিনি সর্ব বিষয় নিঃসংশয় হন এবং অনাসক্ত হন। একেই বলে জ্ঞানের পঞ্চম ভূমি। 

৬. পরার্থাভাবিনী : এই অবস্থায় যোগী স্বয়ং উত্থিত হন। এই স্তরে, যোগীর পরব্রহ্ম ব্যতীত ভাবনা জন্মে না। এই অবস্থায় যোগীর পরব্রহ্ম বোধ উপস্থিত হয়। এরাই শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মজ্ঞানী। 

৭. তুর্য্যগা : এই জ্ঞানভূমিতে যোগীর অবস্থান কালে চিত্ত চঞ্চলতা দূর হয়ে যায়। এই অবস্থাযা যোগীকে  বলা হয়, স্বাত্মারাম। জ্ঞানের সর্বোচ্চ  ভূমি। 

ঋষি যাজ্ঞবল্ক বলছেন, হিরণ্যগর্ভ এই যোগের বক্তা। যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণরূপী ভগবান বিষ্ণু বলছেন, তিনি এই বিদ্যা সূর্যদেবকে দান করেছিলেন।  আবার বলা হচ্ছে দেবাদিদেব শিব হচ্ছেন পরমযোগী।  সুতরাং বলা যেতে পারে, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব তিনজনই যোগের অধীশ্বর।  তিনজনই যোগগুরু। মনুষ্য মধ্যে এমন কোনো মহাপুরুষ নেই, যিনি যোগসিদ্ধ নন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণঅর্জুনকেকে বলেছিলেন, তুমি যোগী হও। যোগভিন্ন ইহলোক, পরলোক সবই  অসার। আর যোগরূঢ় ব্যক্তির না আছে কোনো অভাববোধ, না আছে কোনো হারানোর ভয়। যোগী জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্থান লাভ করেন। যোগীই ঈশ্বরের পরম ভক্ত। যোগীই কর্ম্মবীর। তাই যোগসাধনার ফল বাক্যের অতীত। যোগীর সমস্ত কর্ম্মই যোগ। তবে যোগ গুপ্ত সাধনা। যোগবিদ্যা গুপ্ত বিদ্যা।  শিবসংহিতায় স্বয়ং শিব বলছেন, এই বিদ্যা অবশ্য়ই গোপনে সংরক্ষণ করবে। এই জগতে যিনি অতি ভক্তি-পরায়ণ, একমাত্র তাকেই এই যোগশাস্ত্রজ্ঞান দেন করা উচিত। যোগ কোনো আড়ম্বরের অপেক্ষা রাখে না। ভগবানের সান্নিধ্য ভিন্ন যোগ সম্পূর্ণ হয় না। আমরা সেই গুপ্ত যোগ সাধনার কথা ধীরে ধীরে শুনবো। যা শুনলেও আমাদের জ্ঞানের স্তরের উন্নতি হবে। ........

শিব সংহিতায় বলা হচ্ছে, (২/৩৯) জীবের স্থুল শরীরেই সর্বত্রগামী আদি অন্তহীন কামনা-বাসনার মালায় নিজেকে সুশোভিত ক'রে, এবং কর্ম্ম-শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে বাস করেন। জীব যেমন তার পূর্বার্জিত প্রারব্ধ কর্ম্মফল ভোগ করে, তেমনি জীব তার স্বভাবগুন্ বশতঃ নানাবিধ কর্ম্ম করে থাকে। জগতের এই যে সমৃদ্ধি এসবই কর্ম্মপ্রসূত। আর কর্ম্ম অনুসারেই সমস্ত জীব ফল ভোগ করে থাকে। জীবের কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ ইত্যাদি দোষ জীবকে দুঃখের সাগরে টেনে নিয়ে যায়।  আর এই কর্ম্মজনিত দুঃখ ভোগ, জন্ম-জন্মান্তর ধরে চলতে থাকে। এমনকি এই ভোগের নিমিত্তই তদুপযুক্ত দেহ ধারণ করে থাকে। আবার আমাদের শুভ কর্ম্ম আমাদের শুভ ফল প্রদান করে থাকে।  এসব কথা আমরা জানি। কিন্তু যে কথা আমরা কখনো ভাবিনা, তা হচ্ছে এই ভোগের নিমিত্তই বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে আমাদের ভ্রমজ্ঞান উৎপন্ন হয়ে থাকে। ভোগ্যবস্তু প্রাণসমূহকে তৃপ্ত করে। কিন্তু চৈতন্য কখনো ভোগে আসক্ত হন না। আবার এই প্রাণের সঙ্গেই মিশে আছে চৈতন্য। যোগীদের কাজ হচ্ছে, প্রাণ থেকে চৈতন্যকে  আলাদা করা। আবার এই চৈতন্যকে আলাদা করতে গেলে, আমাদের প্রাণের ক্রিয়া, স্বভাব, গতিবিধি সম্পর্কে সম্যকরূপে জ্ঞাত হতে হবে। তাই হঠযোগ আসলে, ক্রিয়ার সাহায্যে কর্ম্মফলকে নিয়ন্ত্রণ করে ও চৈতন্যকে যথাযথ রূপে প্রতিষ্ঠিত করে। 

যুক্তিবুদ্ধি  দিয়ে বস্তুকে বুঝতে চাইলে, আমাদের ভ্রমে পতিত হবার সম্ভাবনা। কিন্তু পর্যবেক্ষন দ্বারা বস্তুর স্বরূপ আমাদের  উপলব্ধিতে  আসতে পারে। এই উপলব্ধ জাত জ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞান। আসলে কোনো কিছুকেই যুক্তি-তর্ক  দ্বারা বোঝা যায় না। রসোগোল্লা কখনো যুক্তি-তর্ক দ্বারা আস্বাদন  করা যায় না। দর্শন ও গ্রহণ রসোগোল্লার  উপলব্ধি দিতে পারে। তাই শিবসংহিতায় বলা হচ্ছে, প্রতক্ষ্য জ্ঞান হলে আমাদের সমস্ত ভ্রমাত্মক জ্ঞানের নাশ হতে পারে। জগৎ সংসার মিথ্যা জগৎ সংসার  মিথ্যা বলে যতই আমরা নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করি না কেন, এতে করে আমাদের মতো অজ্ঞানীদের কাছে কখনোই জগৎ মিথ্যা হতে পারে না। কিন্তু জগতের মধ্যেই নিহিত মূলসত্য-স্বরূপকে  যখন আমরা উপলব্ধি করবো, তখন আমাদের কাছে জগৎ-ব্রহ্ম-এর সাক্ষাৎ হবে। আর তখন আমি বুঝতে পারবো, যে ঝোপের আড়ালে লুকোনো জীবটি আসলে শ্রীকান্ত, বাঘের ছাল পরিহিত শ্রীকান্ত, বাঘ নয়। নাটকের শ্রীকৃষ্ণ আসলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নয়, ও আমাদের পাড়ার মদন, শ্রীকৃষ্ণ সেজেছে।  তাই আমরা ভ্রম বশত শ্রীকৃষ্ণ ভেবে  তাকে প্রণাম করেছি। রাক্ষসকে দেখে ভয় পেয়েছি। নারদকে দেখে আনন্দ পেয়েছি। আসলে যাকে  দেখে ভয় বা আনন্দ পেয়ে থাকি, তা আসলে আমার ভাবনা প্রসূত মূর্তি মাত্র। ভেতরের সত্তাটি আলাদা। যাকে  আমি চিনতাম, কিন্তু এখন আর চিনতে পারছি না। 

তাই বলছিলাম, জগৎ কর্ম্মের নিমিত্ত। জগতে যা কিছু আমরা দেখছি, সবই কর্ম্মজাত। আর আমরা এই দেহ ধারণ করেছি, কর্ম্মের কারনে।  আবার এই কর্ম্মের মাধ্যমেই আমরা স্ব-স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হবো। হঠযোগ আমাদের কর্ম্মকুশলতা শেখায়। কর্ম্মফলের দ্বারা অর্জিত এই জীবদেহ, কর্ম্মফলের দ্বারাই মোক্ষসাধনের যোগ্য হয়। আর তখনই আমাদের এই শরীরে অবস্থান করা, বা শরীর ধারণ করা সার্থক হয়। তা না হলে ইতর  জীব ও উন্নত জীবের মধ্যে পার্থক্য কোথায় ? মানুষ আর পশু দেহের মধ্যে পার্থক্য কোথায় ? ইতর  জীব, ভালো মন্দ বোঝে না, কর্তব্য অকর্তব্য বোঝে না। কিন্তু উন্নত জীব, তথা মানুষের মধ্যে এই জ্ঞান ধারণ করবার ক্ষমতা আছে। কিন্তু আমাদের শরীরে জ্ঞানের গতিপথ কফ, পিত্ত, শ্লেষা দ্বারা বদ্ধ হয়ে আছে। এই মল দূরীভূত করতে পারলেই, আমাদের এই মনুষ্য শরীরেই ব্রহ্মজ্ঞানের ধারা প্রবাহিত হতে শুরু করবে। আমাদের মনুষ্যদেহ সার্থক হবে, মনুষ্যজীবন সার্থক হবে। 

 তো এই জ্ঞান আহরণের জন্য, ব্যস্ত হবার দরকার নেই, কারুর কাছেই যাবার দরকার নেই। দরকার শুধু জ্ঞানকে প্রবাহিত করবার দ্বার উন্মোচন  করে দেওয়া। সুষুম্নার দ্বার খুলে দিন।  জ্ঞান সর্বত্র।  আত্মা সর্বগতা।  তাকে আপনার এই স্থুল  শরীরে  প্রবাহিত হতে দিন। আর এই উন্মোচনের কথাই বলে থাকে হঠযোগ। আমরা ধীরে ধীরে এইসব অমৃতকথার দুয়ার খুলে দেবো। এই জ্ঞানের উদয় হলেই, আমাদের মধ্যে থেকে কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ প্রভৃতি প্রবৃত্তি নষ্ট হয়ে যাবে। আর এই সব তত্ত্বের যখন অভাব হয়, তখনই স্বয়ং-প্রকাশ আত্মতত্ত্ব উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।   আসুন আস্বাদন করি, ব্রহ্ম-অনুভূতি। ........          

কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করবার প্রথম ও নিরাপদ উপায়। 

আমার এক বন্ধুর বাবা ছিলেন, সাপের ওঝা। সাপে  কাটা রুগীর চিকিৎসা করতেন। তো আমাদের বন্ধুকে দেখেছি, হেলে সাপ (আমরা বলতাম চ্যালা স্যাপ) সিগারেটের পকেটে করে স্কুলে নিয়ে আসতো আমাদেরকে তার সাহসের নমুনা দেখাতে। আমরা সাপ দেখে ভয় পেতাম।  নিতাই খিল-খিল করে হাসতো। নিতাইয়ের ভাইয়ের নাম ছিল, বিষ্ণু। বিষ্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, যার বাবা সাপে  কাটা রুগীর প্রাণদাতা, সেই ওঝা-বাবার ছেলে বিষ্ণু একদিন সাপের কামড়ে মারা গেলো। জানিনা, সাপে কাটা রুগীর চিকিৎসা গাছ-গাছড়া, বা মন্ত্র পড়ে, কাঁসার থালা পড়া দিয়ে ভালো করা যায় কি না। তবে সেদিন বুঝছিলাম, বিষ্ণু নিজের ক্ষমতার বাইরে, অজ্ঞানতা  বশতঃ সাপ নিয়ে বাহাদুরি করতে গিয়ে অকালে প্রাণ দিয়েছিলো। 

আমরা হঠযোগ সম্পর্কে শুনছি।  একটা গুপ্ত বিদ্যা সম্পর্কে শুনছি। একটা গুরুমুখী বিদ্যা সম্পর্কে শুনছি। এই বিদ্যা প্রয়োগ করবার আগে, আমরা যেন নিজেকে প্রস্তুত করে তবে এই পথে পা বাড়াই। অনুসন্ধিৎসু সাধকের একটা কথা মনে রাখা উচিত, যারা দেহ-মনে পবিত্রতা অর্জন করতে পারেন নি, অথচ কৌতহল বশতঃ হঠযোগের অনুশীলনীতে তৎপর হয়েছেন, তারা শুধু নিজের সময় ও শক্তির অপচয় করছেন তাই নয়, তারা নিজেদের বিপদও ডেকে আনতে  পারেন। কেননা শক্তিকে ধরে রাখার আধার প্রস্তুত না করে, কাঁচা মাটির  কলসিতে গরম জল ঢালতে যাচ্ছেন না তো ? এতে করে আপনার নরম কলসি ভেঙে, গরমজল শুধু আপনার ক্ষতি করবে না, আপনার সঙ্গে যারা সম্পর্কযুক্ত তাদেরও আপনি ক্ষতি করতে পারেন। আধ্যাত্মিক শক্তি যা উর্দ্ধমুখী হবার কথা, সেই শক্তি বন্ধ নাড়ীতে বাধা পেয়ে, শত -কোটিগুন শক্তি বৃদ্ধি  হয়ে, নিম্নমুখী হবে। মা গঙ্গা যখন মর্তগামী হন, তখন গঙ্গার বেগ ধারণ করবার জন্য, স্বয়ং শিব তার জটাকে উন্মুক্ত করেছিলেন। আপনার জন্য সেই শিবশক্তি আছে তো ? 

আমি এক তথাকথিত পণ্ডিত সাধুকে  দেখেছি, কুণ্ডলিনী শক্তিকে বোঝাবার জন্য, ব্ল্যাকবোর্ডে একটা সাপের মূর্তি এঁকে, বক্তৃতা দিচ্ছেন। মাত্র ৫০০ টাকার বিনিময়ে কুণ্ডলিনী বোঝাচ্ছেন। একটা প্লাস্টিকের নর-মেরুদন্ড দেওয়ালে ঝুলিয়ে লেকচার দিচ্ছেন। লোকে হা করে সেইসব কথা শুনছেও।  এর মধ্যে কিছু বিদেশিও আছে। জানিনা এদের ভবিষ্যৎ কি হয়েছে। তবে আমি ভীত এইসব অর্বাচীন পন্ডিতদের কথা শুনে। সামনে যারা বসে আছেন, এমনকি যিনি আচার্য্যের পদে বসে আছেন, তিনিও যে শুদ্ধ আত্মা নন, সেটি বোঝার জন্য, বিশেষ কোনো গুনের প্রয়োজন হয় না। সন্ধের দিকে  দেখলাম, সবাইকে নিয়ে গাজার কাল্কেতে দীর্ঘ-টান  দিচ্ছেন। আর বোম-ভোলানাথ  বলে তারস্বরে চিৎকার করছেন।  কিছুক্ষন পরে, সব বেহুশ হয়ে গেলেন। স্বয়ং শিবঠাকুর এদের রক্ষা করুন। 

অনেকে বলে থাকেন, এযুগে এইসব যোগ সাধন অসম্ভব শুধু নয়, নিষিদ্ধ। এসব গুহ্য সাধনা সত্যযুগে চলতো, কলিযুগে এসব করা উচিত নয়। আর তা ছাড়া গুরু পাওয়া যায় না। তাই এসব কথা জেনে লাভ নেই।

দেখুন, সাধনা চিরকাল সঙ্গীসাথীহীন। সাধন জগতে কোনো সাথী হয় না। এখানে সবাইকেই একলা চলতে হয়।  যুধিষ্ঠির স্বর্গারোহন কালে  তার চার ভাইকে এমনকি দ্রৌপদীকে পিছলে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন,  কুকুরবেশী ধর্ম্মাবতার। সমস্ত যোগীপুরুষ অন্তরঙ্গ সাধনাই করে থাকেন। পাহাড়ে, জঙ্গলে, গুহায় এইসব সাধকদের দেখা মেলে।  মন থেকে সংসার অসার হলে, সাধনা শুরু হয়। একলব্য একাই সাধনা করেছিল। 

আসলে এই সাধনবিদ্যা এককালে কিছু স্বার্থপর জাতবিদ্বেষী আচার্য্যের কাছে গোপন ছিল। সাধারনের জন্য এই বিদ্যা আয়াত্বের অধিকার ছিল না।  এতো  একটা সামাজিক ব্যাধি। সত্যযুগেও ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় ব্যতীত এই বিদ্যা দান  করা হতো না। আর এখন যেসব আশ্রম হয়েছে, তার বেশিরভাগই  আসলে বিনোদনের ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।  এখানে গেলে একটা সাময়িক আনন্দের উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়।  তার বেশিকিছু নয়। 

দেখুন, কুণ্ডলিনী শক্তিকে উর্দ্ধমুখী করা, মুখে যতটা বলা সহজ প্রকৃতপক্ষে এই বিদ্যা আয়ত্ত্ব  করা তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি কঠিন। কিন্তু অসম্ভব নয়। গীতায় বলা হয়েছে, হাজার হাজার যত্নশীল সাধকের মধ্যে হয়তো একজনের এই আত্মবিদ্যা আয়ত্ত্ব হতে পারে।  (গীতা ৭/৩)  

কিন্তু তাই বলে কি আমরা চুপচাপ বসে থাকবো। নিরুৎসাহিত হয়ে, কেবল কীর্তন করে সময় কাটাবো, পুরোহিত ডেকে পুজোপাঠ করবো  ? কীর্তন ভালো, পুজোপাঠ ভালো, এব্যাপারে সন্দেহ নেই, কিন্তু এগুলো সাধনার প্রাথমিক দিকের কাজ হতে পারে। সাধনায় চরম উন্নতি লাভ করতে গেলে এই কীর্তন বা পুজোপাঠে তা হতে পারে না। পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন, এঁরা স্থূল দেহ ত্যাগের পরেও, পুজো-পাঠ  নিয়েই থাকে।  আর জন্ম-মৃত্যুর চক্রে পড়ে সুখ-দুঃখ ভোগ করে। 

দেখুন, কর্ম্ম,জ্ঞান ও ভক্তির একত্র সমাবেশ না হলে, জীবাত্মার উন্নতির দুয়ার কিছুতেই খুলতে পারে  না। জ্ঞানহীন কর্ম্ম, আবার কর্ম্মহীন জ্ঞান, কোনো কাজে আসে না। ভক্তির সঙ্গে জ্ঞান ও কর্ম্ম মিশ্রিত হলে, তবেই আমাদের মন শুদ্ধ হবে।  আর শুদ্ধ মনে আমরা অসীম শক্তির সঙ্গে  নিজেকে একাত্ম বোধ করবার   অধিকারী হবো। সব সময় নিজেকে বিশ্লেষণ করবার একটা আদত বা অভ্যাস গড়ে তুলুন। নিজেকে শান্ত রাখুন, শরীর -মন শান্ত রাখুন। আপনার কুণ্ডলিনী শক্তি জাগলো কি জাগলো না সেটা বড়ো  কথা নয়। সেদিকে প্রথম দিকে নজর না দেওয়াই ভালো। নিজেকে জপ-ধ্যানে-প্রাণায়ামে নিযুক্ত রাখুন। এতে করে আপনার শরীর  মন ভালো থাকবে। আর জপ ধ্যান ঠিক ঠিক মতো করতে পারলেই আপনার অন্তরে একটা সাম্যভাব  বজায় থাকবে। এই সাম্যাবস্থায় থাকতে পারলে, সুষুম্নার মুখ ধীরে ধীরে খুলে যাবে, শুদ্ধ বায়ু প্রবাহিত হয়ে, সুষুম্না নাড়ীকে ক্রিয়াশীল করে তুলবে। এতে করে হয়তো একটু বেশি সময় লাগবে, তবে নিরাপদ থাকবেন আপনি, আপনার শরীর, মন। ................   

হঠযোগবিদ্যার কথা উঠলেই, সঙ্গে সঙ্গে সতর্কবাণীর ধ্বনি শুনতে পাই আমরা। তা সে গুরুবাক্যেই হোক বা গুরুলিপিতেই হোক।  সতর্ক বাণী আমাদেরকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে। একটা দুরহটো দুরহটো গর্জন আমাদেরকে এই বিদ্যা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, গান আমি গাইতে পারিনা বলে, গান আমি শুনতেও পারবো না, এই কথায় কোনো যুক্তি নেই। গান আমি গাইতে পারিনা বলে, গানের বই আমি পড়তেও পারবো না, এইসব কথায় আমি অহংকারের ধ্বনি শুনতে পাই। তাই এঁদেরকে আমি পাশ কাটিয়ে চলি। তবে এটা ঠিক, আমি স্বরলিপির বই পড়ে  কিছু বুঝি না। এক্ষেত্রে একজন শিক্ষাগুরু থাকলে ভালো হয়। একটু খতিয়ে দেখলে আমরা দেখতে পাই, পৌরাণিক বচনে, হঠযোগ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, নারী, পুরুষ সবার অধিকার। এমনকি প্রাণী মাত্রেই হঠযোগে অধিকার আছে। তবে, সংসারে যার বিরক্তি আসেনি, মোক্ষের জন্য যার মধ্যে আকুতি জাগেনি,  তা সে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় যাই হোক না কেন, জ্ঞানী-অজ্ঞানী যাই হোক না কেন, তার পক্ষে হঠযোগ অনুশীলনী সময়ের অপচয় মাত্র। বায়ু সংহিতায় বলছেন, যার মন বিষয়ে বিরক্ত, তারই হঠযোগে অধিকার আছে। যার ইহকালের বা পরকালের অভিলাষ লোপ পেয়েছে, ব্রহ্মবিজ্ঞানে যার ইচ্ছে জেগেছে, তিনিই যোগের যোগ্য পাত্র। 

যাই হোক, আমার সংসারে বিরক্তি আসেনি, কিন্তু আসতে  কতক্ষন ? আমার ব্রহ্মবিদ্যায় আগ্রহ জাগেনি, কিন্তু জাগতে কতক্ষন ? কার কোন্ কথায় মুহূর্তের মধ্যে বৈরাগ্য জাগ্রত হয়, তা কে  বলতে পারে  ? তাই যেকোনো বিদ্যা, যেকোনো জ্ঞানের কথা আগ্রহ নিয়ে শোনা বা আয়ত্ত্ব করবার জন্য প্রয়াস করা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যেমন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে, তেমনি জীবাত্মার উন্নতি সাধনে এই যোগক্রিয়াকর্ম্মের  কোনো তুলনা নেই। তীর্থে না পৌঁছাতে পারলেও, আমাদের  যাত্রাপথের দৃশ্য আমাদেরকে আনন্দ প্রদান করতে পরে। তাই আমরা বলি মা-ভৈ, চরৈবতি-চরৈবতি।  এগিয়ে চলাই জীবন সার্থক করতে পারে।  

মনে মনে ভাবুন, আমি আমার বিষয়াসক্ত চিত্তকে নিরুদ্ধ করবো - এই উদ্যম, এই সাহস নিয়ে নিজের সাধ্য-অসাধ্য বিবেচনা না করেই আমাদের কার্য্যে উদ্দীপ্ত হওয়া উচিত। আমাদের ধৈর্য্য ধরতে হবে। রাতারাতি কার্যসিদ্ধি হলো না বলে, কার্য্য বিরতি দেওয়া বা কাজ থেকে নিজে সরিয়ে নেওয়া কোনো কাজের কথা নয়। সারা জীবনের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোন। নিজের অধ্যাবসায় বজায় রাখুন।  তত্ত্বজ্ঞান অর্থাৎ নিত্য-অনিত্য জ্ঞান অর্জন করবার চেষ্টা করুন। শাস্ত্র বাক্যে, বা গুরুবাক্যে শ্রদ্ধা রাখুন। প্রতিকূল পরিস্থিতিকে এড়িয়ে চলুন। যাদের নেতিবাচক কথায় আপনার মন বিগড়ে যেতে পারে, তাদের সঙ্গ  ত্যাগ করুন। যথা-সম্ভব মৌন থাকুন।  কেবল ঈশ্বর চিন্তন করতে থাকুন। শুধু এই কথাগুলো সঠিকভাবে পালন করতে পারলেই, আপনি যোগের উপযুক্ত হয়ে উঠবেন। 

যোগের শুরু হয়, যম-নিয়ম দিয়ে। যম  বলতে অহিংসা, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য্য, ক্ষমা, দয়া, সরলতা, পরিমিত ভোজন ও শৌচ।  এই দশটি আপ্তবাক্য সবসময় মেনে চলুন। 

নিয়ম বলতে বোঝায় - তপস্যা, সন্তোষ, ঈশ্বরে অস্তিত্ত্ববোধ, দান, ঈশ্বরজ্ঞানে জীবসেবা, ঈশ্বর বাক্য অর্থাৎ সিদ্ধান্ত শ্রবণ, লজ্বা, বুদ্ধি, তাপ সহন, ও হোম, এই দশবিধ কার্য্যকে বলা হয়, নিয়ম। এগুলো নিয়ে আমরা আগে আলোচনা করেছি। দরকার হলে আবার আলোচনা করবো। এগুলো আসলে হঠযোগের যোগ্যতা অর্জনের বিষয়। 

কিন্তু হঠযোগের শুরু হচ্ছে আসন-প্রাণায়াম দিয়ে। আসন-কুম্ভক-মুদ্রা-নাদানুসন্ধান এই চারটি হচ্ছে হঠযোগের অঙ্গবিশেষ। আসনে  অভ্যস্ত হলে, আমাদের দেহ ও মন অচঞ্চল অবস্থায় স্থিত হয়। 

দেখুন, হঠযোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই স্থুল শরীরের সাহায্যেই ব্রহ্মানুভূতি লাভ করা। তো স্থুল শরীর যদি রোগগ্রস্থ থাকে, তবে, সেই শরীরে ব্রহ্মানুভূতি হতে পারে না। এমনকি আমরা জানি রোগগ্রস্থ শরীরে আমাদের কোনো আনন্দই  অনুভূত হয় না, তা সে বিষয় আনন্দ বলুন, বা বিষয় বহির্ভূত আনন্দ বলুন । তাই শরীরকে আমাদের শুধু নীরোগ নয়, শরীরকে আমাদের শক্তিশালী, করতে হবে। শক্তিশালী মানে এই নয়, যে আমাদের মাংশপেশী শক্ত করতে হবে। শক্তিশালী মানে আমাদের সহ্য শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। শরীরের মধ্যে যে অনুভূতি শক্তি আছে, তার  বৃদ্ধি করতে হবে। চিত্ত বিক্ষেপের জন্য, আমাদের অনেক শারীরিক ব্যাধির উৎপত্তি হয়।  সেগুলোর নাশ করতে হবে। আমাদের শারীরিক অঙ্গের গুরুতা থাকলে, শরীরে রোগের উদ্রেগ করে। চিত্ত বিক্ষেপের জন্য, যেমন রোগের  উৎপত্তি হয়, তেমনি রোগের উৎপত্তিতে আমাদের চিত্ত বিক্ষেপ হয়ে থাকে। তাই এই দুটোকেই আমাদের নির্মূল করতে হবে। 

স্বয়ং শিব বলছেন, জগতে দুই ধরনের দেহি আছে।  পক্কদেহী ও অপক্কদেহী। যোগহীনের অপক্ক দেহ। আর যোগীর পক্ক দেহ। জল-মাটির তৈরী কলসি যতক্ষন অগ্নি দগ্ধ  না হয়, ততক্ষন সেই কলসি পাকা হয় না।  তেমনি পঞ্চভূতের তৈরী এই দেহ যতক্ষন  যোগাগ্নি দ্বারা দাহ না হচ্ছে, ততক্ষন এই দেহ জড়-শোকাবহ দেহ।  যোগাগ্নি দ্বারা যোগী শোকবর্জিত অজড়,  দেহ লাভ করেন। যোগহীন দেহ দুঃখবহ অপক্ক। অপক্ক দেহী ধ্যানমগ্ন হলেও ইন্দ্রিয়ের বশীভূত থাকেন। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, সুখ-দুঃখ, নানানরকম ব্যাধি, মানসিক অশান্তি, জীব-জন্তু, শস্ত্র, অগ্নি জল, বায়ু ইত্যাদি দ্বারা অপক্ক দেহীর শরীর পীড়িত হয়।  আর এর ফলে তার চিত্ত বিক্ষিপ্ত হয়। প্রাণ ইত্যাদি বায়ুর বিপত্তি হেতু, চিত্তে ক্ষোভ জন্মায়। দেহে সামান্য পিঁপড়ে কামড়ালেই, বা মশায় কামড়ালেই, তার ধ্যান ভঙ্গ  হয়। 

অহঙ্কার নষ্ট না হলে, সত্যজ্ঞান জন্মায় না। পক্কদেহীর অহংকার বলে কিছু থাকে না। আর যার অহংকার নেই, তার  না আছে শারীরিক ব্যাধি, না আছে মানসিক অশান্তি। কারন বিনা কার্য্য নেই, অহংবিনা সুখ-দুঃখ নেই। যোগী প্রথমে পঞ্চমহাভূতকে যোগাগ্নিতে আহুতি দিয়েছেন, ধীরে ধীরে সপ্তধাতুকে যোগাগ্নিতে অগ্নি দগ্ধ করেছেন।  ইনি এখন শুধুই শক্তি। ইনি নির্মল আকাশের মতো বিশাল। যিনি সূক্ষ্ম  থেকেও  সূক্ষ্মতর। স্থুল থেকেও স্থুলতর।  জড় হতেও জড়। ইনি অজর অমর ইচ্ছাশক্তি রূপ।  ইনি  ত্রিলোকে ক্রীড়া করেন, লীলা করেন, স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেন। আবার ইনিই মৃত্যুঞ্জয়ী। শিব বলছেন, হঠযোগের দ্বারা যোগীর পূর্বেই মরন হয়েছে।  মৃতের আবার মরন কি ? তাই সাধারণ লোক যাকে জন্ম-মৃত্যু বলে, কর্তব্য-অকর্তব্য বলে যোগীর সেসব কিছুই নেই। তথাপি তিনি কর্ম্ম করে থাকেন, কিন্তু ফলের ভাগী হন না। .............

ঈশ্বর সাধনার জন্য আমাদের দুটো শক্তির প্রয়োজন।  এক হচ্ছে শারীরিক শক্তি অন্যটি হচ্ছে মানসিক শক্তি। সাধন জগতে দুর্বলের কোনো স্থান নেই।  রম্তা সাধুদের দেখছি, এক জায়গায় স্থির থাকেন না। আজ এখানে তো কাল সেখানে। পাহাড়ি রাস্তায় মাইলের পর মাইল হেটে যেতে এদের যেন কোনো ক্লান্তি নেই। যাঁরা নর্মদা পরিক্রমণ করেন, তাদের দেখেছি, সারা দিনে একবার খেয়ে, বা কোনোকোনোদিন কিছুই না খেয়ে, শুধুমাত্র জল পান করে, মাইলের পর মাইল জঙ্গল-পাহাড় পেরিয়ে হেটে চলেছেন। তো আধ্যাত্মিক আনন্দ পেতে গেলে, আমাদের শারীরিক দিক থেকে সক্ষম হতে হবে। না আপনাকে পালোয়ান হতে হবে না। কারুর সঙ্গে কুস্তি লড়তে হবে না। কিন্তু আধ্যাত্মিক সাধনায়, যে মানসিক চাপ ও সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে এগুতে হয়, তাতে  শরীর সাধ না দিলে পথেই সাধনার সমাপ্তি ঘটবে। জানবেন, শরীর হচ্ছে, ভগবানের মন্দির। সুস্থ শরীর ভিন্ন সাধনা শুধু নয়, কোনো কর্ম্মই করা সম্ভব নয়। আবার এই শরীরেই  আমরা ভগবানের সাক্ষাৎ পেতে পারি। তাই শরীরকে অবহেলা করে, অধ্যাত্ম সাধন পথে এগুনো যায় না। 

শরীর ও মনকে সুস্থ রাখবার জন্য আমাদের কিছু যৌগিক ক্রিয়া করতে হবে। এতে করে, আমাদের শরীর যেমন সুস্থ  সবল থাকবে, তেমনি বেশিক্ষন ধ্যানে বসবার জন্য উপযুক্ত হয়ে গড়ে উঠবে আমাদের মন। শরীরের সঙ্গে মনে একটা ওতপ্রোত সম্পর্ক আছে। শরীর যেমন স্থুল, মন তেমনি আমাদের একটা সুক্ষ শরীর। কিন্তু দুটোই পার্থিব।  এই দুই পার্থিব  শরীরকেই আমাদের সুস্থ রাখতে হবে। শরীর ভালো রাখতে গেলে, আমাদের যেমন যৌগিক ব্যায়াম করতে হবে, তেমনি প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য পরিমিত পরিমানে গ্রহণ করতে হবে। অতিঅল্প আহার, বা অতিরিক্ত আহার সম্পর্কে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। মনের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে গেলে, আমাদের যেমন শুভ চিন্তন করতে হবে, তেমনি সংযমের অভ্যাস করতে হবে। আমি যদি সংযমের অভ্যাস না করি, তবে আমাদের মস্তিস্ক সহজেই উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। বহুক্ষণ ঈশ্বর চিন্তন করতে গেলে, বা ধ্যানের সময় বাড়াতে গেলে, আমাদের শান্ত শক্তিশালী শরীর দরকার, তেমনি দরকার দৃঢ়চেতা মন। 

যোগব্যায়াম  : পেশীর সঞ্চালন হচ্ছে ব্যায়াম।  ব্যায়াম-এর সাহায্যে আমাদের মাংশপেশীর গঠন পুষ্ট  হয়। কিন্তু যৌগিক ব্যায়াম  বা যোগব্যায়াম  আমাদের দেহের ভিতরে স্নায়ুমণ্ডলীর, গ্রন্থিগুলোর এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে সবল রাখে।  যোগব্যায়াম আমাদের রক্তকে শুদ্ধ করতে পারে। রক্ত সঞ্চালন ক্রিয়াকে গতিসম্পন্ন করে। আমরা জানি আমাদের দেহ পরিচালিত হয়, স্নায়ুমণ্ডলীর সাহায্যে। আর এই সমস্ত স্নায়ুমণ্ডলীর কেন্দ্রস্থল হচ্ছে মস্তিস্ক। এই মস্তিস্ক থেকেই বিভিন্ন স্নায়ুর সাহায্যে বিভিন্ন নির্দেশ আসে। আর সেই নির্দেশ অনুযায়ী, আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ সঞ্চালিত হয়ে, কর্ম্ম করে থাকে। যোগব্যায়াম এমন একটা কৌশল যাতে, আমাদের মস্তিষ্কে প্রয়োজন মতো রক্ত প্রবাহিত করে দিতে পারে। আর মস্তিষ্কে ঠিক ঠিক মতো রক্ত প্রবাহিত হলেই, মস্তিষ্কের ক্রিয়া সঠিক ভাবে সংগঠিত হতে পারে। 

যোগব্যায়াম বা যোগাসন  তিন প্রকার।  ১. ধ্যানাসন, ২. স্বাস্থ্যাসন ৩. বিশ্রাম-আসন। প্রথম দিকে এই তিন ধরনের আসনেই আমাদের অভ্যস্থ হতে হবে ।       

 ১. ধ্যানাসন : ধ্যান-জপ ইত্যাদির জন্য যে আসনে আমরা স্থির হয়ে মেরুদন্ড সোজা করে বেশিক্ষন বসতে পারি, তাকেই ধ্যানাসন বলে ।  আসলে ধ্যানাদির জন্য এইসব আসন উপযুক্ত। যেমন পদ্মাসন, বজ্রাসন, গোমুখাসন ইত্যাদি । এগুলো যেমন আমাদের শরীরকে স্থির রাখে, মনকে অচঞ্চল রাখতে সাহায্য করে থাকে।  

২. স্বাস্থ্যাসন : আমাদের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য, শরীরকে  নীরোগ করবার জন্য, যে আসলে ব্যবহার করা হয়, তাকে স্বাস্থ্যাসন বলা হয়।  যেমন সর্বাঙ্গ আসন, মৎস্-আসন, চক্রাসন, ভুজঙ্গ-আসন ইত্যাদি। 

৩. বিশ্রাম-আসন। শবাসন বিশ্রামের শ্রেষ্ঠ আসন। 

সুস্থদেহে বেঁচে থাকবার আনন্দই আলাদা। এর পরে আমরা যদি ইন্দ্রিয়-সংযম-এর  অভ্যাস করতে পারি, তবে একটা পবিত্র দেহের অধিকারী হতে পারি । আত্মসংযমী পবিত্র দেহীর আনন্দ ইন্দ্রিয়-পরায়ণ  মানুষের ধারণার বাইরে। আর এই আত্মসংযম ও  পবিত্রতা অর্জন করতে গেলে, প্রথম দিকে আমাদের  নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে আনতে  হয় নিজেকে।  এইসময় একটা অস্বস্তি একটা কষ্ট আমাদেরকে বিব্রত করতে পারে। কিন্তু এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারলেই, এটি একটা আদতে পরিণত হয়ে যায়।  নিজের মধ্যে একটা শক্তিশালী ব্যাক্তিত্ত্বের জন্ম হয়। আর এই ব্যাক্তিত্ত্বের রক্ষার জন্য, আমরা তখন সব সময় সতর্ক পদক্ষেপ করি। আর এটাই তখন আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। আধ্যাত্মিক পথে চলতে গেলে আমাদের শরীর  মনকে শক্ত করতে হবে। নতুবা এই পথে চলা অসম্ভব হয়ে যাবে। 

মনকে নিয়ন্ত্রণে আনতে  হবে। নিজের মধ্যে একটা দৃঢ় বিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে হবে, মনে করতে হবে, আমি অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র।  আমি অধ্যাত্ম জগতের সম্পদ সংগ্রহের জন্য জন্ম গ্রহণ করেছি। আমার ভাবনা, আমার লক্ষ সব সময় স্থির থাকবে।  আমার ভাবনার মধ্যে কোনো বিশৃঙ্খলা আসতে  দেব না। আমাদের বিচারশক্তি কাজে লাগাতে হবে। দেখুন জীবন একটা সংগ্রাম। জীবনের প্রতি পদক্ষেপে আমাদের সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে চলতে হয়।  সতর্ক পদক্ষেপ ফেলতে হয়।  অধ্যাত্ম জীবন আরো বেশি সংগ্রামের জীবন জানবেন। অধ্যাত্ম জীবনের গতি কখনোই সহজ সরল নয়।  আমাদের অসাফল্য আমাদের শিক্ষা গ্রহণের সময়। এইসময় মানসিক শক্তি সংগ্রহের সময়। এই সময় আমাদের বিচারশক্তিকে বেশি করে গুরুত্ত্ব দিতে হবে। এইসময় স্থির চিত্তে, শান্ত মনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।  তবেই আমরা অধ্যাত্ম জীবনের সাফল্যের শিখরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবো। আমরা ঈশ্বরের সান্নিধ্যে আসতে  পারবো।    

 আসন সবসময় সুখকর হওয়া উচিত। সমস্ত আসনে সবাই স্বস্তি বোধ করেন না। দীর্ঘক্ষণ একই আসনে বসে স্বস্তিবোধ করতে পারলে, জানবেন সেই আসনই আপনার জন্য উপযুক্ত। যোগমুদ্রায় অভিজ্ঞ ব্যাক্তিগন চুরাশিটি আসনের কথা  উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে আমরা কয়েকটি আসনের উপরে গুরুত্ত্ব সহকারে   উল্লেখকরেছেন, যোগ-আচার্য্য স্বাত্মারাম । 

স্বস্তিকাসন : গোমুখাসন : বীরাসন  : কূর্মাসন : কুক্কুটাসন :  ধনুরাসন। ...........

------------ 

হঠযোগ : (১০) 

স্বস্তিকাসন : জানু ও উরুর মাধ্যস্থলে দুই পায়ের তলদেশ স্থাপন করে দেহকে  সোজা রেখে উপবেশন করলে সেই অবস্থাকে বা আসনকে বলা হয় স্বস্তিকাসন। 

গোমুখাসন : বা দিকের পাছার নিচে  ডান  পায়ের গোড়ালি রাখতে হবে। এবার বাম  পায়ের গোড়ালিকে  ডান পাছায় পার্শে স্থাপন করতে হবে। একে  গোমুখাসন বলে। যে আসনে বাবা লোকনাথ বসতেন।  

বীরাসন : এক (ডান)পা অন্য (বাম) পায়ের  উরুর উপরে  অন্য পা অন্য উরুর উপরে  স্থাপন করাকে বীরাসন বলা হয়। 

কূর্মাসন : দুই গোড়ালিকে গুহ্যদেশে চেপে ধরে সোজা অবস্থায় উপবেশন করলে কূর্মাসন হয়।

পদ্মাসন : বাম উরুর উপরে ডান  পা এবং ডান  উরুর উপরে বাম পা রেখে অবস্থান করাকেই বিরাসন  বলে। আবার এই অবস্থায় ডান  হাত পিঠের পিছন থেকে ঘুরিয়ে ডান   পায়ের বুড়ো আঙ্গুল ও বাম  হাত পিঠের পিছন থেকে ঘুরিয়ে বাম   পায়ের বুড়ো আঙ্গুল ধরে, হৃদয়স্থানে চিবুক স্থাপন করে নাসাগ্রে দৃষ্টি স্থাপন করাকে যোগীগণ  পদ্মাসন বলে থাকেন। কেউ কেউ একে বদ্ধ পদ্মাসন বলে থাকেন।      

সিদ্ধাসন : গুহ্যদ্বার ও লিঙ্গের মধ্যস্থলে বাম গোড়ালিকে স্থাপন করুন, এবার লিঙ্গ-অন্ডকোষ   উপরে তুলে  এর উপরে ডান  গোড়ালিকে স্থাপন করুন।  একেই সিদ্ধাসন বলে। এই সময় বুকের উপরে চিবুককে স্থিরভাবে স্থাপন করবেন ।  

কুক্কুটাসন : পদ্মাসন অবস্থায় দুই হাত জানু ও উরুর মধ্যে ঢুকিয়ে হাতের উপরে ভার দিয়ে দেহকে শূন্য অবস্থান করলে, কুক্কুটাসন হয়। 

ধনুরাসন : পায়ের দুই বুড়ো আঙ্গুল দুই হাতের দ্বারা ধরে কান পর্যন্ত টানলে ধনুরাসন হয়।

বজ্রাসন : পাদুটো এক এক করে, পিছনদিকে মুড়ে গুড়ালির উপরে বসুন। মেরুদন্ড সোজা করে বসুন। দৃষ্টি থাকবে সোজা। অথবা চোখ বন্ধ করে বসুন।   একেই বজ্রাসন বলে।  

যাইহোক, আমরা আগেই বলেছি, যোগীগণ ৮৪ প্রকার আসনের কথা বলেছেন। যারা আসন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান, তারা যেকোনো যোগব্যায়ামের বইতে বা হঠযোগের বইতে পেয়ে যাবেন । শ্রী নীলমনি  দাসের বা স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী মহাশয়ের বইতে এগুলো পেয়ে যাবেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, অতি প্রাচুর্য্য শিশুর খেলা মাটি করে দেয়। আমরাও যদি হঠযোগের খুঁটিনাটি  বিস্তারিতভাবে এবং হঠযোগের   সূক্ষ্মতত্ত্ব সম্পর্কে জানতে চাই তবে হঠযোগের অনুশীলনীর জন্য আমাদের সময়ের অভাব হবে।  কেননা আমাদের সবার জীবনের একটা নির্দিষ্ট সীমা  আছে। সময় আর ফিরে আসে না।  তাই   আমরা শুধু পদ্মাসন, সিদ্ধাসন, বিরাসন(সুখাসন), এবং বজ্রাসন সম্পর্কে জানবার চেষ্টা করবো ।  আসলে বজ্রাসন অভ্যাস করতে চাইছি, আমাদের খাদ্য সহজে হজম করবার জন্য। অন্য আসনের যেকোনো একটি আসনে অভ্যস্থ হতে পারলে, আমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে।  অর্থাৎ আমরা শরীরকে  স্থির করে, মনকে অচঞ্চল অবস্থায় স্থিত হতে চাই। স্নায়ুর চঞ্চলাকে দূর করতে চাই। অর্থাৎ এই চারটির মধ্যে কেবল দুটো আসনের অনুশীলনী করবো। 

সুখাসন : আপনি যে আসনে মাটিতে বা পিঁড়িতে বসে খাবার খান, তাকেই সুখাসন বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ পা হাটু থেকে ভাঁজ  করে, একটি পা অন্য পায়ের উপরে স্থাপন।  এটি সহজ-সরল, এবং আমরা এতে অভ্যস্ত। এই আসনে বসেও আমরা ধ্যানের  অভ্যাস করতে পারি।  

পদ্মাসন : পদ্মাসনকে যোগগুরুগন দুই ভাগে ভাগ করেছেন।  মুক্ত পদ্মাসন ও বদ্ধ পদ্মাসন।  স্বামী শিবানন্দ  সরস্বতী বলছেন, বাম  উরুর উপরে ডান পা, এবং ডান উরুর  উপরে বাম পা রাখতে হবে। এবার জিহ্বাকে রাজদন্তমূলে অর্থাৎ সামনের চারটি দাঁতে স্থাপন করবে। এইসময় আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে নাকের ডগায়। মেরুদন্ড থাকবে সোজা। বাম  হাত বাম  উরুর উপরে  ও ডান হাত ডান উরুর উপরে স্থাপন করতে হবে।  হাতের চেটো থাকবে উপরের দিকে। এই হলো মুক্ত পদ্মাসন। এই মুক্ত পদ্মাসনই আসলে ধ্যানের  উপযুক্ত আসন।  

এবার এই মুক্তপদ্মাসনে বসে যদি আমরা হাত দুটোকে উরুর উপরে না রেখে, ডান হাত  পিঠের পিছন দিক থেকে ঘুরিয়ে এনে বাম  উরুর উপরে অবস্থিত ডান  পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের অগ্রভাগ ধরুন। ঠিক তেমনি বিপরীত ভাবে, বাম হাতকেও পিঠের পিছন দিয়ে ঘুরিয়ে এনে ডান  উরুর উপরে বাম  পায়ের আঙ্গুল ধরুন।  চিবুক কণ্ঠকূপে নিবদ্ধ রাখুন। দৃষ্টি রাখুন নাসাগ্রে।  একেই বলে বদ্ধ পদ্মাসন। 

স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী বলছেন, এই পদ্মাসনে পায়ের বাতব্যাধি দূর করতে সাহায্য করবে।  মেরুদণ্ডের বিভিন্ন ব্যাধি, বিশেষ করে বক্র  মেরুদণ্ডের চিকিৎসায়, পদ্মাসন বিশেষ ফলপ্রদ।  এই পদ্মাসনে বসে আমাদের বিভিন্ন মুদ্রার ও প্রাণায়ামের অভ্যাস করতে হয়। ধ্যান ধারণার পক্ষেও এই আসন বিশেষ ফলপ্রদ। বহু সাধক এই পদ্মাসনে সাধন করে সিদ্ধি লাভ করেছেন। পদ্মাসনেই অষ্টসিদ্ধি স্বল্প সময়ের মধ্যে আয়ত্ত্বে এসে যায়। যদিও অষ্টসিদ্ধি সাধনপথের অন্তরায়। 

শ্রী বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী, একবার তার গুরুদেবকে (ব্রহ্মানন্দ পরমহংস) জিজ্ঞেস করলেন, অনিমাদি সিদ্ধির কথা যে শাস্ত্রে আছে, তা কি সত্য ?" তো গুরুদেব তাকে একটা নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে, অষ্টসিদ্ধির অবস্থাগুলো একেএকে দেখাতে লাগলেন।  অর্থাৎ শুন্যে ভাসা, সূক্ষ্ম হয়ে এক পর্বত থেকে আর এক পর্বতে চলে যাওয়া, নিজ দেহ থেকে আত্মাকে বের করে, অন্য মৃত দেহে প্রবেশ করানো, এবং সেই মৃত দেহের সাহায্যে কথা বলা ইত্যাদি ইত্যাদি।  এর পর জিজ্ঞেস করলেন, এবার বিশ্বাস হয়েছে ?  সাধন করতে থাকো, এই সব ক্ষমতা তোমারও  জন্মাবে।  কিন্তু জেনে  রেখো এগুলো কিছুই নয়, সাধন জগতের বিভূতি মাত্র। এর পর গোস্বামিজী, বিন্ধ্যাচলে গিয়ে কঠোর সাধনা করতে থাকেন। এতে করে তার মধ্যে একটা অদ্ভুত ভাব প্রকাশ পেতে থাকে। এতে তিনি ভয় পেয়ে যান এবং ভাবতে থাকেন, এটা আমার মানষিক নয় তো ? পরে গুরু সাক্ষাৎকালে গুরুদেবকে এই কথা বললে, গুরুদেব তাকে হঠযোগ প্রদীপিকা, ও বিচার সাগর নাম দুটো বই পড়তে  বলেন। বই-দুটো পড়ার পড়ে, তিনি বুঝতে পারেন,  এগুলো যোগেরই অবস্থা মাত্র।  কোনো রোগ নয়।

সিদ্ধাসন :  সিদ্ধাসন সম্পর্কে আমরা আগেও  বলেছি। দুটো পা ছড়িয়ে বসুন। এবার বা হাটুর কাছে ভেঙে বা পায়ের গোড়ালি সীবনী অর্থাৎ আমাদের লিঙ্গমূল থেকে গুহ্যদ্বার পর্য্যন্ত যে সেলাই আছে, সেখানে স্থাপন করুন। এবার অন্ডকোষ ও জনিন্দ্রিয় বাম হাতে তুলে ধরে, বাঁ পায়ের গোড়ালির উপরে রাখুন। এবার ডান পা হাটু থেকে ভাজ করে, ডান পায়ের গোড়ালি লিঙ্গমূলের মেরুদেশে স্থাপন করুন। ডান পায়ের আঙ্গুল বা পায়ের উরুর উপরে রাখুন। বুকের উপর চিবুক স্থিরভাবে স্থাপন করতে হবে। বুক ও চিবুকের মধ্যে চার আঙ্গুল ফাঁকা থাকবে। এরপর ইন্দ্রিয় সংযম করে, ভ্রূমধ্যে অচলদৃষ্টিতে দেখতে হবে। মেরুদন্ড থাকবে সোজা। হাত দুটো ভাজ করে, হাঁটুর উপরে স্থাপন করুন। হাতদুটো সোজা নয়, ভাজ করে। কেউ কেউ হাতদুটো সোজা রাখতে বলে থাকেন, কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এতে মনের অহংভাব বিড়ম্বনায় ফেলে। অর্থাৎ আমি যোগ করছি, এই ভাব সহজে যায় না। আসলে যোগ তো আমি করছি না। যোগ হচ্ছে। আমি কোলে উঠতে চাইলে কোলে ওঠা হলো না। মা যখন কোলে নেবেন, তখনই একমাত্র কোলের শান্তি পাওয়া যায়। ঈশ্বর যতক্ষন আমাকে নিজের মধ্যে দ্রবীভূত না করছেন, আমি ততক্ষন আমিই থেকে যাবো। যাই হোক, হাত দুটো ভাজ করে নেবেন। হাতের পাতা আঙ্গুল থাকবে জ্ঞানমুদ্রায়, অর্থাৎ তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ- এর অগ্রভাগ চেপে ধরতে হবে। এই অবস্থায় স্থির হয়ে অবস্থান করতে হবে। একেই বলে সিদ্ধাসন। আমাদের মতে, চুরাশি আসনের মধ্যে যে কোনো আসন যাতে আপনি স্বস্তি অনুভব করেন, এবং দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে পারেন, সেই আসনই আপনার উপযুক্ত। তবে আমরা এই সিদ্ধাসনেই অভ্যস্ত হতে চাই। এই সিদ্ধাসন অলৌকিক ফলপ্রদ বলে আমাদের অনুভব।

দেখুন, আমরা দেহ-সর্বস্য জীব। দেহ ভিন্ন আমি বলে কিছুর অস্তিত্ত্ব নেই  আমাদের কাছে । দেহের বাইরে আমি বলে কিছু নেই। এই দেহের মধ্যে আছে, মন।  মন-যমুনাতে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে সেই পরমপুরুষ। মন যমুনার জলে তরঙ্গ থাকলে, আমরা পরম-পুরুষকে (প্রতিবিম্ব) দেখতে পারবো না। তাই আমরা আগে দেহকে শান্ত করবার চেষ্টা করছি, আসনে স্থির হয়ে বসে। দেহকে শিথিল করছি। দেহ স্থির হলে, মনের দিকে দৃষ্টি দেব। আর যখন মনের দিকে দৃষ্টি দেবো, তখন দেখবেন, মনও ধীরে ধীরে শান্ত  হবে। ................... 

যাকিছু বলা হলো, তাতে কিছুই বোঝা গেলো না। কথার মধ্যে সত্য-মিথ্যা কিছুই ধরা  গেলো না। আসলে যোগ সম্পর্কে যা কিছুই বা যতকিছুই বলা হোক না কেন, তাতে যোগের যথার্থ স্বরূপ বোঝা যায় না। হ্যাঁ কথাগুলো মুখস্ত করে রাখা যায়, এই মাত্র। 

বিজ্ঞ পণ্ডিত প্রবর এর মধ্যে তিরস্কার শুরু করে দিয়েছেন। যা বোঝা যায় না, যা বোঝা যাবে না, তারজন্য এতো প্রয়াস কেন ? আমরা অবশ্য এইসব বিজ্ঞের কথায় কর্নপাত করতে চাই না।  যদিও কানে  সেই আওয়াজ ভেসে আসে। আজকাল এই সব বিজ্ঞের কথা শোনে কে ? এঁরা হয়তো কখনো সূর্যকে বলে বসবেন, তুমি মশায় সবার কাছে, নির্বিবাদে  আলোর রশ্মি পৌঁছে দাও কেন ? কখনো হয়তো বলে বসবেন, নদী তুমি সমুদ্রের দিকে যাও  কেন ? ঝর্ণা  তুমি নিম্নগামী হও কেন ? আগুন তুমি উর্দ্ধগামী হও কেন ? বাতাস তুমি অজ্ঞানের ঘরে প্রবেশ করে, তাদের বাঁচিয়ে রাখো কেন ? এইসব অনাচার যাতে না হয়, তার জন্য একসময় মনুস্মৃতি নামকরে, আইন জারি করেছিল। কিন্তু কালের প্রবাহে, সেই আইন-এর কথা কেউ আর শোনে না। চানক্য পন্ডিতের শ্লোক স্ত্রীষু রাজকুলেষু চ' এরা  মুখস্ত করে রেখেছে। তথাপি এদের কণ্ঠলগ্ন হয়ে আছে স্ত্রী। এরা আজও মাতৃগর্ভে জন্ম নেয়, মায়ের স্নেহে লালিত পালিত হয়। আবার  এরাই স্ত্রীকে নরকের দ্বার বলে থাকে। কিন্তু দুঃখের কথা হচ্ছে, এরা  আজও এমন পুরুষের জন্ম দিতে পারেনি, যে সন্তান ধারণ করবে। এরা যার খায়, যার পরে, তাকেই কুড়ুল মারে।  গাছে যখন কুড়ুল মারা হয়, জানিনা, গাছ তখন বাঁচার জন্য  মিনতি করে কি না, নাকি ভাবে কুড়ুল আমাকে আলিঙ্গন করছে।

-----------------------  

হঠযোগ - ১১ 

ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, "স্থিরসুখম আসনম্" । যে আসনে আপনি স্থির ভাবে সুখে বসে থাকতে পারবেন, সেই আসন-ই আপনার পক্ষে উপযুক্ত। আমরা এর আগে  বীরাসন, পদ্মাসন, স্বস্তিকাসন, সিদ্ধাসন, ইত্যাদি সম্পর্কে শুনেছি। মোদ্দা কথা হচ্ছে, আপনি যে আসনেই বসুন না কেন, আপনাকে সবসময় খেয়াল রাখতে হবে, আপনার মাথা, গ্রীবা, অর্থাৎ ঘাড় এবং বুক সমানভাবে উন্নত রাখতে হবে। শরীরকে সমান্তরাল রাখতে হবে। শরীরকে শিথিল করতে হবে।  এইসময় ইন্দ্রিয়গুলোকে মনের সাহায্যে হৃদয়ে স্থাপন করতে হবে। ঋষিবর  আরো বলছেন,  আপনি যদি ঠিক ঠিক মতো আসনে সিদ্ধ হতে পারেন, তবে আপনার শান্ত শিথিল শরীর আপনার মনকে চিন্তাশূন্য করতে সাহায্য করবে।  মনের একাগ্রতা বৃদ্ধি  পাবে। কথাটা যদি উল্টো করে বলি তবে বলতে হয়, আপনার শরীর যদি স্থির  হয়, শিথিল হয়, মন যদি চিন্তাশূন্য হয়, আপনার মনে যদি একাগ্রতা আসে, তবে জানবেন আপনার আসনে বসা সার্থক হয়েছে।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, (গীতা-৬/১১) "শুচৌ দেশে প্রতিষ্ঠাপ্য স্থিরম আসনম আত্মনঃ"  শুদ্ধ স্থানে আসন করবেন। স্থিরমনে আসনে বসবেন। আসনে বসবেন, যেন মাটির পুতুল। এখন কথা হচ্ছে, মনকে স্থির করবার জন্য, মনকে একাগ্র করবার জন্য, মনকে শান্ত করবার জন্য আমরা আসনে বসবো। কিন্তু শরীরকে না হয়, জোর করে, আসনে বসিয়ে দিলাম।  কিন্তু মনতো  আমাদের নিয়ন্ত্রণে নয়। সেতো সদা চঞ্চল। তাকে তো আর নির্দেশ দিয়ে বসিয়ে রাখতে পারবো না। সেতো তার ইচ্ছে মতো চিন্তা করবে। ইতস্তত ঘোরাফেরা করবে। এখাান থেকে আমরা বেরুবো কি করে।  দেখুন, যোগে অভ্যস্ত হতে গেলে, আপনাকে হতে হবে  স্বল্পাহারী। স্বল্পাহারী  মানে এই নয়, যে আপনাকে প্রয়োজনের তুলনায় কম খেতে হবে।  আপনি শরীর  বুঝে খাবেন । খেয়াল করবেন, খাবারের  দোষে আপনার পেটে  গ্যাসের উৎপত্তি না হয়।    সহজ পাচ্য খাবার খাবেন। যোগ অনুশীলনকারীর অতিভোজন যেমন ঠিক নয়, ঠিক তেমনি প্রয়োজনের তুলনায় কম খাওয়াও ঠিক নয়। খাবার অন্ততঃ ৪/৫ ঘন্টা পরে আসনে বসুন। খাবার  পরে একমাত্র বজ্রাসনে বসা উচিত।  

আর একটা কথা হচ্ছে, আপনাকে কথা কম বলতে হবে। মৌনব্রত পালন করতে বলছি না. কিন্তু কথা কম বলুন।  প্রয়োজন অতিরিক্ত কথা না বলাই ভালো।  আমাদের অনেকের অভ্যাস আছে, অন্যকে জ্ঞান দেওয়া। অন্যের ব্যাপারে নাক গলানো। এই অভ্যাস ত্যাগ করুন।  আগে নিজেকে জ্ঞানসমৃদ্ধ  করুন। তারপরে অন্যদের কথা ভাববেন। 

আরো একটা বড়ো ব্যাপার হচ্ছে আপনাকে আরামপ্রিয় হলে চলবে না। আপনাকে আলস্য  ত্যাগ করতে হবে। একটা কথা জানবেন, অলস ব্যক্তির কোনো কাজেই সাফল্য আসে না।  তা সে জাগতিক ব্যাপারেই বলুন আর আধ্যাত্মিক ব্যাপারেই বলুন। তাই আমাদের সমস্ত রকম আরাম থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে হবে।

কেবলমাত্র এই তিনটে নিয়ম মেনে দেখুন, আপনার মন শান্ত হতে চলেছে। একসময় আপনি আপনার মনের রাজা হয়ে যাবেন। শুধু ধৈর্য্যধরে, আসনের অভ্যাস করতে থাকুন। সময় ও স্থান নির্দিষ্ট করে, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন - এই সময় এই স্থানে আমাকে আসনে বসতেই হবে। নিজের লক্ষে স্থির হোন।  

 আসনের জন্য এমন জায়গা বাছুন, যেটি পরিষ্কার পরিছন্ন, (পোকামাকড় বর্জিত, দুর্গন্ধমুক্ত, কোলাহল বর্জিত। এই কোলাহলবর্জিত অবস্থা আপনি গভীররাতে নিজের বাড়িতেই  পেতে পারেন। নিজের বাড়ির মধ্যেই একটা ঘরের কোন্, সম্ভব হলে একটা আলাদা ঘরে, বা ঠাকুরঘরে, আসন নির্দিষ্ট করুন। মাটিতে বসবেন না , সামান্য উঁচু কোনো জায়গা বেছে  নিন। অর্থাৎ আপনি স্বচ্ছন্দে অনেকক্ষন সময় অতিবাহিত করতে পারেন, এমন জায়গায় আপনাকে আসনে বসতে হবে। একটা কম্বলের আসনে বসবার অভ্যাস করলে ভালো হয়।  

এবার মনটাকে বিস্তার করতে শুরু করুন।  অর্থাৎ ভাবুন, আপনার চিত্ত যেন অনন্ত আকাশে একাকী ভ্রমন করছে। যদি অনন্তে আপনি নিজেকে নিয়ে যেতে পারেন, অথবা নিজেকে হৃদয়স্থানে, বা আজ্ঞাচক্রে (আজ্ঞা থেকে হৃদয় অনেক ভালো) মনটাকে নিবিষ্ট করতে পারেন, তাহলে আপনার চিত্ত চঞ্চলতা দূর হয়ে যাবে। এরপরে ধীরে ধীরে আপনি আসনের প্রক্রিয়ার মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারবেন। 

আসনে যদি আপনি সিদ্ধ  হন, তবে, আপনার শরীরে কোনো দ্বন্দ্ব, কোনো বাধাই  আসতেই   পারবে না। শীত-উষ্ম সহ্য করবার চেষ্টা করুন। আসনে সিদ্ধ হলে  কয়েকদিনের মধ্যেই এই শক্তি আপনা থেকেই আপনার মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই এসে যাবে। শরীরে ঘাম এলে যেমন শীত চলে যায়, আবার ঘাম নিজের শরীরে  ঘষে মিলিয়ে দিলে গরম চলে যাবে। একটা নাতিশীতোষ্ণ ভাব সবসময় আপনাকে ঘিরে রাখবে। এসব কোনো কল্পনা নয়।  আপনি আসনে সিদ্ধ হলেই, এই উপলব্ধি আপনার মধ্যে আপনা-আপনি এসে যাবে।  

আসনে আপনি স্থির হয়ে বসবার অভ্যাসে রপ্ত হতে পারলে, এর পর আপনাকে প্রাণায়ামের দিকে নজর দিতে হবে। অর্থাৎ শ্বাস গ্রহণ, শ্বাস ত্যাগ, ও শ্বাসের গতিকে রোধ করা। শ্বাস গ্রহণের গতি, শ্বাস ত্যাগের গতি, এবং শ্বাসকে শরীরের ভিতরে বা বাইরে রুদ্ধকরে রাখাকে এবার আমাদের অভ্যাস করতে হবে। একেই বলে প্রাণায়াম। প্রাণের আয়াম - প্রাণায়াম। একটা কথা জানবেন, প্রাণকে যিনি আয়ত্ত্ব করতে পেরেছেন, তিনি শরীরের রোগব্যাধিকেও সময়মতো ধরতে পারবেন, এবং শরীরকে নীরোগ রাখার স্বাভাবিক শক্তি বৃদ্ধি  পাবে। আপনি যখন প্রাণায়ামে সিদ্ধ হবেন, তখন আপনার প্রাণবায়ু দীর্ঘ ও সূক্ষ্ম হয়ে যাবে । আর জানবেন, যেকোনো সূক্ষ্ম বস্তুর শক্তি অধিক। ধীরগতি সম্পন্ন বায়ু আপনাকে শান্ত করবে, সূক্ষ্ম বায়ু আপনাকে শক্তি যোগাবে।  ............. 

৬-১০-২০২১

আমরা আসনের কথা শুনছিলাম। আসলে আসনে রপ্ত হতে পারলে, যোগীর যোগসাধনায় পরিশ্রম লাঘব হয়। এর পরে আমাদের নাড়ীশুদ্ধি, মুদ্রা ও প্রাণায়াম অভ্যাস করতে হবে। 

হঠযোগে আসন, কুম্ভক, ও নানান রকম মুদ্রা অভ্যাসের জন্য জোর দিয়ে থাকে। আসন, কুম্ভক ও মুদ্রা সাধনে সিদ্ধ হলে, নাদের অনুসন্ধান করতে হয়, অর্থাৎ অনাহত নাদের অনুসন্ধান ক্রিয়ায় অভ্যস্ত হতে হয়। যোগসাধনায়  আমাদের মিতাহারী হতে হবে।  অন্তত এক বছর শারীরিক মানসিক ব্রহ্মচর্য্য অর্থাৎ কথায়, কাজে,  ও চিন্তায় সংযম পালন করতে হবে। তবেই আমরা যোগসাধনের উপযুক্ত হয়ে উঠবো। একটা কথা জানবেন , আপনার শরীরের বয়স কত, আপনার শরীর ব্যাধিগ্রস্থ কি না, আপনি সবল না দুর্বল, আপনি শিশু, যুবক না বৃদ্ধ, আপনি নারী না পুরুষ, ইত্যাদি চিন্তা মাথা থেকে দূর করে দিন। যেকেউ  হঠযোগ অভ্যাস করলে, সিদ্ধি লাভ করতে পারে। তবে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে যোগাঙ্গের সাধন ও যোগের অভ্যাস করতে হবে। যারা যোগাঙ্গ সাধন না করে, যোগসাধনে রত হতে চান, তারা জানবেন, গাড়িতে না চেপে, গাড়িকে ঘাড়ে  নিয়ে যাবার চেষ্টা করছেন। 

আর একটা কথা জানবেন, যোগশাস্ত্র অধ্যয়ন করে, বা কারুর মুখে শুনে যোগসিদ্ধি হতে পারে না। কাজ না করে, শুধু কার্যপ্রণালী মুখস্ত করে, আপনার কোনো লাভ হবে না। আপনি পণ্ডিত হন, বা অজ্ঞানী হন, আপনি কপালে চন্দন লাগিয়েছেন কি চন্দন লাগাননি, আপনি গেরুয়া বস্ত্র পরিধান করেছেন, কি শ্বেত বস্ত্র পরিধান করেছেন, তাতে কিছুই এসে-যায় না। যোগ হাজার কথার দ্বারা সিদ্ধ হয় না, ক্রিয়ার দ্বারাই যোগ  সিদ্ধ হয়। এইজন্য আসন, সূর্যভেদ  (শ্বাসের নিয়ন্ত্রন) কুম্ভক, এবং মুদ্রা, এঁরাই  যোগের অঙ্গ। অতয়েব,  এই যোগাঙ্গগুলিকে  সাধন করতে হবে। তবেই আপনি যোগসিদ্ধ-পুরুষ হতে পারবেন। 

এখন কথা হচ্ছে, যোগে সিদ্ধ হয়ে আমাদের লাভ কি ? এমনকি আপনি যদি স্বয়ং ভগবানের সাক্ষাৎ পেয়ে যান, তাতেই বা আপনার লাভ কি ? দেখুন, ক্ষুধার্থ অন্ন খোঁজে, তৃষ্ণার্থ জলের সন্ধান করে।  ক্ষুধার্তকে  বা তৃষ্ণার্থকে আপনি অন্নের বা জলের উপরে বক্তৃতা দিলে, বা রচনা পড়তে দিলে, তার অভাব মিটবে না।  আর সে আগ্রহও দেখাবে না।  মাহাজনগন  বলে থাকেন, প্রয়োজন না থাকলে আমরা কেউ  কোনো কাজ করতে চাই না। প্রয়োজনই আমাদের কাজের অনুপ্রেরণা যোগায়। তো যোগের প্রয়োজন-বোধ না জন্মালে আমরা কেউ যোগের দিকে আকৃষ্ট হবো না।

তাই মৎস্যেন্দ্রনাথ বলছেন,  এই হাড্ডি-মাস-রক্তের শরীরে যতক্ষন প্রাণবায়ু বিদ্যমান থাকে, ততক্ষনই আমরা জীবিত থাকি। দেহ ও প্রাণ এই দুইয়ের সংযোগে জীবন। দেহ থেকে প্রাণবায়ু নিষ্ক্রান্ত হলে, জীবনের এমনকি দেহের বিলোপ সাধন হয়ে থাকে। অতয়েব, একটা জিনিস জানবেন, আমাদের দেহে  অবশ্য়ই বায়ুর ধারণ করতে হবে, তবেই আমরা জীবন্ত থাকবো।  নতুবা, আমাদের মরন হবে।  এমনকি এই যে দৃশ্যমান বিশ্বজগৎ তখন আমাদের চোখের সামনে থেকে মুছে যাবে। তাই দেহের বায়ু (প্রাণ) ধারনের ক্ষমতাকে নিশ্চিত করতে হবে, এমনকি বায়ুধারন ক্ষমতাকে  বাড়াতে হবে। তবেই আমরা সজীব থাকতে পারবো। 

আরো একটা কথা হচ্ছে, শুধু বায়ু ধারণ করলেই হবে না, বায়ুকে সঞ্চালন করতে হবে।  অর্থাৎ শরীরের সর্বত্র এই বায়ুকে চালিত করতে হবে। দেহের কোনো অঙ্গে যদি প্রাণবায়ুর উপস্থিত না থাকে তবে জানবেন , আপনার সেই অঙ্গ ধীরে ধীরে অকেজো হয়ে যাবে। আর এই দেহের মধ্যে বায়ুর ভ্রমন পথ হচ্ছে দেহের নাড়ীসকল। তো প্রাণবায়ুর যাতায়তের রাস্তা যদি আবর্জনা দ্বারা আবদ্ধ থাকে, তবে বায়ু গতিশীল হতে পারবে না। অর্থাৎ আমাদের দেহমধ্যেগত মলশোধনই হঠযোগের প্রাথমিক কাজ। 

দেহস্থিত নাড়ীসকল যদি মল দ্বারা পরিব্যাপ্ত থাকে, তবে তার মধ্যে বায়ুর গমন হতে পারে না। অর্থাৎ সুষুম্নামার্গে প্রাণবায়ুর ক্রিয়া স্তব্ধ থাকে। কিন্তু নাড়ীসকল যদি, বিশুদ্ধ বা মলবিহীন থাকে তার মধ্যে বায়ুর সঞ্চরণ ঘটতে পারে। তাই যোগীরাজ মৎস্যেন্দ্রনাথ বলছেন, মলশোধন ব্যতিরেকে কোনো ভাবেই উন্মনীভাব, অর্থাৎ চিত্ত একাগ্র হতে পারে না। আবার চিত্তের একাগ্রতা না থাকলে, আমাদের কোনো কাজেই সাফল্য আসতে  পারে না। আর এই একাগ্রতা বা উন্মনীভাব সাধকের মধ্যে না জাগলে, সাধকের কার্যসিদ্ধি হতে পারে না। অতয়েব প্রাণায়ামে অভ্যস্ত হতে হলে আমাদের আগে মলশোধনক্রিয়া করতে হবে। তাই যোগগুরু বলছেন, আলস্য ত্যাগ করে, অর্থাৎ আমাদের তামস বৃত্তিকে পরিত্যাগ করে, চিত্তের বিক্ষেপকে পরিহার করে,  সাত্ত্বিক বুদ্ধি দ্বারা, ঈশ্বর প্রণিধানের জন্য, প্রাণায়াম করতে হবে। কিন্তু কিভাবে আমাদের এই মলশুদ্ধি হবে ? ................

হঠযোগ - ১৩

যোগীগণ প্রথমে পদ্মাসনে, সিদ্ধাসনে বা কোনো সুখাসনে মেরুদন্ড সোজা রেখে, ঘাড়-মাথা সোজা রেখে দীর্ঘক্ষণ (১-২ ঘন্টা) বসে থাকবার অভ্যাস করবেন।  এবার চন্দ্র বা ইড়া নাড়ী দ্বারা বায়ুর পূরক করবেন। এরপরে, জালন্ধর বন্ধ করে, যথাশক্তি সেই প্রাণবায়ুকে ধারণ করে, কুম্ভক করবেন। এর পরে, পিঙ্গলা বা সূর্য নাড়ী  দ্বারা ধীরে ধীরে রেচন করবেন। এর পর উল্টো করে, অর্থাৎ সূর্য্য নাড়ী বা পিঙ্গলা নাড়ী দ্বারা পূরক করবেন, যথাবিধি কুম্ভক করবেন এবং চন্দ্রনাড়ী দ্বারা রেচক করবেন। পিঙ্গলা বা চন্দ্র  নাড়ী আমাদের বাম  নাসিকা। আর ইড়া বা সূর্য  নাড়ী আমাদের ডান নাসিকা। 

মৎস্যেন্দ্রনাথ বলছেন, বাম নাসিকা বা ডান নাসিকা যখন যে নাসিকা দ্বারা বায়ু রেচন করবেন, সেই নাসিকা দ্বারাই পূরক করবেন, এবং কুম্ভক করবেন। অর্থাৎ যে নাসিকা দ্বারা বায়ু গ্রহণ করবেন, অপর নাসিকা দ্বারা রেচন করবেন।  আবার যে নাসিকা দ্বারা রেচন করবেন, সেই নাসিকা দ্বারাই আবার পূরক করবেন। এখন কথা হচ্ছে, কতক্ষন ধরে আমরা কুম্ভক করবো ? মৎস্যেন্দ্রানাথ বলছেন, যতক্ষন না আমাদের কাঁপুনি বা ঘাম না হয়, ততক্ষন আমাদের এই কুম্ভক করতে হবে। 

 আমরা বলি, সাধ্য অনুযায়ী কুম্ভক করবেন।  প্রথম  দিকে তো অবশ্য়ই দীর্ঘক্ষণ কুম্ভক করতে যাবেন না।  তাতে  হিতে বিপরীত হতে পারে। আরো একটা কথা হচ্ছে, বায়ু গ্রহণের সময় যদি আপনি চার সেকেন্ড সময় নিয়ে থাকেন, তবে বায়ু ছাড়বার  সময় আপনি আট সেকেন্ড সময় ধরে রেচন করবেন। আর যদি সম্ভব হয়, তবে ১৬ সেকেন্ড অন্তর-কুম্ভক  করবেন। 

 শরীরের  ভিতরে, ছেলেদের ক্ষেত্রে বুকের ভিতরে, আর মেয়েদের ক্ষেত্রে পেটের মধ্যে বায়ুকে রুদ্ধ করে রাখাকে অন্তরকুম্ভক বলে।  আরো একটা গুরুত্ত্বপূরণ নির্দেশ হচ্ছে, বাহ্যকুম্ভক অর্থাৎ শরীর থেকে সমস্ত বায়ু বের করে দিয়ে কুম্ভক করতে যাবেন না। এই ক্রিয়া, যোগে যারা ধাতস্ত হতে পেরেছেন, তারাই এই প্রক্রিয়ার যোগ্য।  নতুবা আপনার শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে যেতে পারে। একটা কথা সব সময় মনে রাখবেন, আমরা দেহ-সর্বস্য জীব।  দেহের্ একটা সাম্য অবস্থায় আমরা স্বাভাবিক থাকি। দেহের ভারসাম্য হারিয়ে গেলে, আমরা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাবো। এইরূপ সম্ভাবনা থেকেই  হঠযোগকে গুপ্ত বিদ্যা বলা হয়ে থাকে। যাকে-তাকে এই বিদ্যা দান  করতে নিষেধ করা হয়েছে।  এমনকি বলা হয়ে থাকে গুরুবিনা এই সাধনে রপ্ত হওয়া যায় না। তাই যা কিছু করবেন, নিজের সাধ্যের মধ্যে করবেন।  আমরা কথায় বা কোনো হঠযোগবিদ্যার বইয়ের জ্ঞান নিয়ে এই কার্য্যে নিজেকে নিয়োগ করবেন না। এখন কথা হচ্ছে, তাহলে আমরা কি নিষ্ক্রিয় হয়ে, শুধু পুঁথিপড়া বিদ্যা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবো ? কাজের কাজ কিছু করতেই পারবো না ? 

সেক্ষেত্রে আমরা  বলি, প্রথমদিকে আপনি নিতান্ত অনুলোম বিলোম করুন। অর্থাৎ এক নাক  বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে বন্ধ রেখে ধীরে ধীরে শ্বাস গ্রহণ করুন।  এবার  কুম্ভক না করে  অপর নাক দিয়ে ধীরে ধীরে  শ্বাস ছাড়ুন।  আবার যে নাক দিয়ে শ্বাস ছাড়লেন, সেই নাক দিয়েই ধীরে ধীরে শ্বাস গ্রহণ করুন, এবং অপর নাক দিয়ে শ্বাস ছাড়ুন। এই শ্বাস ছাড়া বা গ্রহণ করার সময়কে  ধীরে ধীরে বাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করুন। কুম্ভক করতে যাবেন না। যদি করেন, তবে সামান্য সময় অর্থাৎ১০ সেকেন্ড থেকে শুরু করে বড়োজোর  ২০-৩০ সেকেন্ড করুন, এবং খেয়াল করুন নিজের মধ্যে এর ফলে কোনো অস্বস্তি হচ্ছে কি না। যদি অস্বস্তি হয়,  তবে কিছুদিন এই কুম্ভক ক্রিয়া  বন্ধ  রেখে, আবার ধীরে ধীরে অভ্যাস শুরু করুন।আশাকরি এতে করে, আপনার স্বাভাবিক জীবনে কোনো বাধা আসবে না। বরং আপনি শারীরিক দিকে থেকে নীরোগ, ও মানসিক দিক থেকে  বলবান হয়ে উঠবেন। আপনি যদি মাস তিনেক এই ক্রিয়া করেন, তবে আপনি অবশ্যই ২০-৩০ সেকেন্ড কুম্ভক করবার যোগ্য হয়ে উঠবেন, আর পরবর্তী  ক্রিয়া করবার যোগ্য হয়ে উঠবেন।

 তবে একটা কথা বলি, নিজেকে পবিত্র রাখুন, নিজেকে পবিত্র ভাবুন । সবসময়   মনে রাখবেন, এই শরীরেই স্বয়ং  ভগবান অবস্থান করছেন। এটি  ভগবানের মন্দির। এই শরীরেই ভগবানের উপলব্ধি সম্ভব। তাই অমূল্য এই শরীরকে  সবসময় পরিষ্কার-পরিছন্ন রাখতে হবে। খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারেও মৎস্যেন্দ্রনাথ একটা তালিকা প্রস্তুত করে দিয়েছেন। আমরা সেই আলোচনা হয়তো কখনো প্রয়োজন হলে করবো।  তবে একটা কথা বলতে পারি, দুধ-ঘি (দই  নয়) পঞ্চশাক খাবারের তালিকায় রাখুন।  আমিষ খাবার পরিহার করুন।  বিশেষ করে যেকোনো  মাংস অবশ্য়ই খাবার তালিকা থেকে বাইরে রাখুন। মোদ্দা কথা খাবার হোক আমাদের পুষ্টিবর্ধক।  খাবার যেন আমাদের শারীরিক  রোগের কারন না হতে পারে। আমিষ খাবার শুধু শরীরকে উদ্দীপ্ত করে তাই নয়, মনকেও চঞ্চল করে তোলে।      

যাই হোক, আমাদের এই  আলোচনায়, একটা কথা শুনেছি সেটি হচ্ছে, অন্তর কুম্ভক করবার সময় আমাদের জালন্ধর বন্ধ করতে হবে।  এই জালন্ধর বন্ধ বলতে আমরা কি বুঝি ? ..........           

হঠযোগ - ১৪  

এমনিতে মুদ্রা অনেক প্রকারের হয়ে থাকে। তবে দশ রকম মুদ্রা আছে, মহামুদ্রা, মহাবন্ধ, মহাবেধ, খেচরী, জালন্ধর, মূলবন্ধ, বিপরীত করণী,  উড্ডান, বজ্রোলী এবং শাক্তিচালন -   শিবসংহিতায় এই দশটিকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে।  আমরা এর মধ্যে মাত্র দুটি (মূলবন্ধ, জালন্ধর বন্ধ,)  নিয়ে আলোচনা করবো, যা আমাদের যোগের জন্য আবশ্যিক।

১.মহাবেধ মুদ্রা : প্রাণ ও অপান বায়ুদ্বারা উদর পূর্ন  করে, এবার উদরের দুই দিকে চাপ দেবেন।  একেই মহাবেধ মুদ্রা বলে। 

২. মহামুদ্রা :গুহ্যদেশ ও উপস্থের মধ্যবর্তী যোনীমন্ডলকে বাম পায়ের গোড়ালি দিয়ে সযত্নে চেপে ধরে, দেন পা প্রসারিত করে, দুই হাত দিয়ে দেন পায়ের আঙ্গুলগুলো ধরবে, এবং দেহের নবদ্বার অর্থাৎ দুই চোখ, দুই কান, নাকের দুই ছিদ্র, মুখ, মুত্রদ্বার, ও মলদ্বার এই নয়টি দ্বারকে সংযত করে, রিদয়ের উপরে চিবুক স্থাপন করবে।  মনকে ব্রহ্মভাবনায়, যুক্ত করে, বায়ু সাধন আরম্ভ  করতে হয়।  

 শিবসংহিতায় বলা হয়েছে, এই মহামুদ্রা  অভ্যাস করে স্বয়ং কপিল মুনি সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। এটি অতি গোপন বিদ্যা।  গুরুর আদেশ অনুসারে, গুরুর সান্নিধ্যে  এই ক্রিয়ার অভ্যস্ত হতে পারলে, প্রকৃত সিদ্ধিলাভ করা যায়। 

৩. মহাবন্ধ : মহামুদ্রার পরে, যোগী প্রসারিত পা উরুর উপরে রেখে মূলাধারকে আকুঞ্চিত করে অপানবায়ুকে উর্দ্ধগামী করে নাভিস্থনে সমান বায়ুর সঙ্গে যুক্ত করবেন এবং প্রাণবায়ুকে নিম্নগামী করে প্রাণ ও অপান বায়ুকে সমান বায়ুর সঙ্গে রুদ্ধ  করবেন।  একেই বলে মহাবন্ধ মুদ্রা। 

শিবসংহিতায় বলা হয়েছে, এই তিনটি মুদ্রা (মহাবেধ -মহামুদ্রা -মহাবন্ধ) ক্রমানুসারে  প্রতিদিন চারবার সাধন করতে হয়।   

৪.  খেচরী : বজ্রাসনে বসে ভুরুর মধ্যবর্তী স্থানে স্থিরভাবে দৃষ্টি স্থাপন করবেন। তারপর আলজিভের উপরের দিকে যে গর্ত আছে, তার মধ্যে জিভকে উল্টো করে সযত্নে প্রবেশ করাতে হবে। এই আলজিব যদি ভ্রূমধ্যস্থ অমৃতকুম্ভ থেকে যে অমৃতবিন্দু নিঃসরণ হচ্ছে, তার স্বাদ গ্রহণ করতে পারে, তবে জানবেন, খেচরী মুদ্রা সম্পন্ন হয়েছে। 

 ৫. জলন্ধর বা জালন্ধর মুদ্রা : এই মুদ্রাকে কেউ বলছেন, জালন্ধর আবার কেউ বলছেন, জলন্ধর।  । জলন্ধর কথাটার অর্থ হচ্ছে, যিনি জলকে ধারণ করেন। প্রত্যেক প্রাণীর নাভিদেশে থাকে অগ্নি প্রজ্বলিত থাকে ।  এই অগ্নি প্রাণীর সহস্রদল পদ্ম থেকে যে অমৃতধারা ক্ষরিত হচ্ছে, তাকে এই অগ্নি শোষণ করছে। যোগীর কাজ হচ্ছে, এই অমৃতরসকে যাতে অগ্নি শোষণ না করতে পারে, তার জন্য, এই জালন্ধর মুদ্রা দ্বারা একটা বাঁধ দেওয়া। এখন কথা হচ্ছে, তাহলে এই অমৃতরসের পরিণতি কি হবে ? এই অমৃতরসকে সাধক নিজেই পান করবেন। এই হচ্ছে জলন্ধর বন্ধ মুদ্রার উদ্দেশ্য। কিভাবে এটি করবেন ? 

গলার শিরাজালকে রুদ্ধ করে, হৃদয়দেশে চিবুক স্থাপন করতে হবে। ব্যাস এই কাজ, একেই বলে জালন্ধর বা জলন্ধর মুদ্রা।      

৬. মূলবন্ধ : পায়ের গোড়ালি দিয়ে গুহ্যদেশ চেপে ধরুন, অপান বায়ুকে বলপ্রয়োগের দ্বারা ক্রমান্বয়ে উর্দ্ধে নিয়ে গিয়ে সেখানেই তাকে আটকে দিন।  প্রাণ ও অপান বায়ুর সমতা হলে মুলবন্ধ  মুদ্রা সম্পন্ন হলো। 

৭. বিপরীতকরণী মুদ্রা : মাটিতে মাথা রেখে, দুটো পা উপরের দিকে ওঠাতে হয় / একেই বিপরীতকরনী মুদ্রা বলে।

৮. উড্ডান বন্ধ : নাভির উপরিভাগ ও নিম্নভাগ পশ্চিমতান করাকেই  উড্ডান বন্ধ বলে। পশ্চিম্তান অর্থাৎ পশ্চিমোত্তাসন।  পশ্চিমোত্তাসনকে আবার কেউ কেউ উগ্রাসন বলে থাকেন। 

(উগ্রাসন : মাটিতে বসে, দুই পা ছড়িয়ে দিতে হবে, যাতে পাদুটো জোড়া না লাগে। তারপরে দুই হাতের দ্বারা দুই পায়ের আঙ্গুল ধরে, হাঁটুর উপরে মাথা রাখতে হবে।  এই অবস্থায় শিরদাঁড়া বাঁকানো চলবে না।)

৯. বজ্রোলী মুদ্রা : এটি তন্ত্রশাস্ত্রের গুহ্য মুদ্রা। আমাদের জানার দরকার নেই।

১০.  শক্তিচালনা : মূলাধারে আছেন কুণ্ডলিনী শক্তি। সাধক অপান  বায়ুর সাহায্যে কুণ্ডলিনী শক্তিকে আকর্ষণ করে উর্দ্ধমুখী করে, সুষুম্নাপথে পরিচালিত করাকে বলে শক্তিচালনা মুদ্রা।   

দশটা মুদ্রা সম্পর্কে আমরা একটা সাধারণ ধারণা  পেলাম। কিন্তু আমরা কেবলমাত্র দুটো মুদ্রা অর্থাৎ জালন্ধর ও মূলবন্ধ  সম্পর্কে বিশদভাবে জেনে নেবো। কারন এই দুটো মুদ্রা আমাদের মতো সাধারনের  সাধন পথের জন্য কাজে লাগবে। বাকিগুলো আমাদের একমাত্র গুরুসান্নিধ্যে অভ্যাস করতে হবে। এইসব মুদ্রার যেমন অলৌকিক অসীম ক্ষমতা আছে, তেমনি  এইসব মুদ্রার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। তাই এই মুদ্রার অভ্যাসের মধ্যে যাবো না। ...........   


হঠযোগ - ১৫ 

হঠযোগের এই লেখা নিতান্ত সাধনজ্ঞানের বিষয়, তার বেশিকিছু নয়। গুরুসান্নিধ্যে, অথবা হঠযোগের গ্রন্থ ঠিকমতো অধ্যায়ন   না করে, এই যোগের পথে পা বাড়ানো বিপদজনক । তবে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ এই হঠযোগের কতদূর পর্যন্ত এগুতে পারেন, তার একটা অভ্যাস, একটা পথনির্দেশ এই লেখনীর মধ্যে অবশ্যই মিলতে পারে। ভবিষ্যতে এই গুহ্যবিদ্যা কেবলমাত্র সদস্যদের জন্যই শুধু  প্রকাশ করা হবে, সাধারনের জন্য নয়। 

 কুম্ভক : 

কুম্ভ কথাটার অর্থ হচ্ছে, কলসি। তো জল পূর্ন কুম্ভের ন্যায় উদরে বায়ু ধারণ করাকে বলে কুম্ভক। বারোটি রাশির মধ্যে একাদশ রাশির নাম কুম্ভ। এই রাশির অধিপতি হচ্ছেন স্বয়ং শনিগ্রহ, বা শনিদেব। কথায় বলে শনিদেব কুপিত হলে, বা রুষ্ট  হলে, জীবের দুর্গতির শেষ থাকে না। জীবন অতিষ্ট হয়ে ওঠে।ঠিক তেমনি, বায়ু কুপিত হলে আমাদের শরীরে নানান রোগের সৃষ্টি হয়ে থাকে। আবার শনি বা বায়ু যদি শান্ত থাকে, তবে জীবন মসৃন হতে পারে। আমাদের প্রাচীন ঋষিগণ এই চরম সত্য উপলব্ধি করেছিলেন। ঋষিগণ বলছেন, যোগাভ্যাস দ্বারা যে ফলপ্রাপ্তি হতে তা এমনকি তপস্যা দ্বারাও হতে পারে না। 

শাস্ত্রে, আটপ্রকার কুম্ভকের কথা বলা হয়েছে। 

 সূর্য্য-ভেদন, উজ্জায়ী, সীৎকারী, শীতলী, ভস্ত্রিকা, ভ্রামরী, মূর্ছা ও প্লাবনী, এই আট প্রকার কুম্ভকের কথা যোগশাস্ত্রে নির্দেশ করেছেন।  

আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমরা সবাই এক-একটা কুম্ভ,  ফাঁকা কলসি। ন'টি ছিদ্রওয়ালা একটা কলসি। কেউ একজন আনমনা হয়ে,  যার নাম মায়া, হ্লাদিনী শক্তি, তিনি পরমপুরুষের  দর্শনের আশায়,  চৈতন্য-সমৃদ্ধ এই বায়ু সমুদ্রে দাঁড়িয়ে কলসি ভরাট করবার চেষ্টা করছেন । কিন্তু এই কলসির নটি ছিদ্র দিয়ে সেই বায়ু বেরিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও এই কলসিতে আছে, অসংখ্য ছোটোছোটো লোমকূপ-ছিদ্র।  ফলত চৈতন্যরূপ বায়ু এই দেহরূপ  কলসিকে কখনোই ভরাট  করতে পারছে না। আর বারবার দেহরূপ কলসিকে  চৈতন্য সমদ্রে ডোবাবার জন্য, সুমুদ্রে ঢেউ উঠছে। পরমপুরুষের প্রতিচ্ছবিও স্থির থাকতে পারছে না।  একসময় মায়ারূপ হ্লাদিনী শক্তি  বিরক্ত হয়ে, কলসি ভেঙে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘরের দিকে পা বাড়াচ্ছেন, নতুন কলসির জন্য।

যোগঋষি মৎস্যেন্দ্র নাথ বলছেন, শ্বাসবায়ু পূরক করে, জালন্ধর বন্ধ করবে। যাতে প্রাণবায়ুর বাঁধন হয়, তাকেই বলে বন্ধ  .আমরা আগেই শুনেছি, কন্ঠ আকুঞ্চিত করে হৃদয়ের উপরে স্থাপন করাকেই জালন্ধর আবার পুরকের  পরে, রেচকের ঠিক আগে উড্ডীয়ান বন্ধ  করতে হবে। কুশলতা অবলম্বন করে পিঠের নাড়ীকে আকর্ষণ করাই উড্ডীয়ান বন্ধ। এই তিনটি বন্ধ অর্থাৎ জালন্ধর, মূলবন্ধ ও উড্ডীয়ান বন্ধ আয়ত্ত্বে এলে, প্রাণবায়ু ধীরে ধীরে সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে যে ব্রহ্মরন্ধ্র আছে, তার মধ্যে প্রাণবায়ুর প্রবেশ করতে পারে । 

সূর্য ভেদন কুম্ভক :  সিদ্ধাসনে বা স্বস্তিকাসনে, বা পদ্মাসনে, বা যে আসনে আপনি স্বস্তিবোধ করেন, তেমন কোনো আসনে \  বসুন। এবার ডান  হাতের অনামিকা  আঙ্গুল দ্বারা বাম  নাসিকাকে বন্ধ  করুন।এবার পিঙ্গলা (সূর্য  নাড়ী বা ডান নাসিকা) নাড়ী দ্বারা ধীরে ধীরে বায়ু আকর্ষণ করতে থাকুন। এবার কুম্ভক করুন। এইভাবে প্রাণবায়ুকে রুদ্ধ করতে পারলে, আমাদের লোমকূপ দ্বারা বায়ু নিঃসৃত হবার চেষ্টা করবে। এতে করে শরীরে ঘামের প্রকোপ দেখা দেবে।  যদি ঘাম বেরুতে না পারে, শরীরে একটা কম্পনের সৃষ্টি হবে। এর পরে বাম-নাকে স্থিত ইড়ানাড়ী দ্বারা ক্রমে ক্রমে রেচক করতে হবে। একেই সূর্যভেদন কুম্ভক বলে। সূর্যনাড়ী দ্বারা বায়ু গ্রহণ, ও চন্দ্র নাড়ী দ্বারা বায়ুর রেচন করা হয় হয় বলে,এই ক্রিয়াকে সূর্যভেদন কুম্ভক বলা হয়ে থাকে।    

সাবধানবাণী : যোগগুরু বলছেন, এই প্রক্রিয়াতে শরীরে কুষ্ঠ রোগের সৃষ্টি হতে পারে। তাই  শরীর বুঝে, কুম্ভকের  সময় নির্দিষ্ট করতে হয়। আমরা সবাই জানি, ঔষধে রোগের  প্রকোপ কমে, কিন্তু  overdose অর্থাৎ ঔষধের পরিমান বেশি খেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। অর্থাৎ রোগ বেড়ে যেতে পারে। এই ক্রিয়াতেই আবার কুষ্ঠ রোগের  নিবারণ হতে পারে, যদি কুম্ভকের ক্রিয়া সময়-মেনে করা হয়। তাই শাস্ত্র নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসারে, বা গুরুবাক্য অনুসারে প্রণায়ামের অনুষ্ঠান করা কর্তব্য।

ফল :  সূর্যভেদন কুম্ভক করলে, সাধকের মস্তক শুদ্ধ হয়, সমস্ত প্রকার বায়ুদোষ বিনাশ প্রাপ্ত হয়। পেটের  সমস্ত কৃমিজনিত বিকার নষ্ট হয়ে থাকে। ........

-------------- 

হঠযোগ : ১৬           

হঠযোগের এই লেখা নিতান্ত সাধনজ্ঞানের বিষয়, তার বেশিকিছু নয়। গুরুসান্নিধ্যে, অথবা হঠযোগের গ্রন্থ ঠিকমতো অধ্যায়ন   না করে, এই যোগের পথে পা বাড়ানো বিপদজনক । তবে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ এই হঠযোগের কতদূর পর্যন্ত এগুতে পারেন, তার একটা অভ্যাস, একটা পথনির্দেশ এই লেখনীর মধ্যে অবশ্যই মিলতে পারে।     

উজ্জায়ী : সাধক মুখ বন্ধ করবেন। এইবার উভয় নাসিকা দ্বারা অর্থাৎ ইড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী দ্বারা  সশব্দে বায়ুকে  আকর্ষণ করবেন। এইসময় গলায় বায়ুর ঘর্ষনে একটা উম/ওম ধ্বনি নির্গত হবে।  বায়ু আকর্ষণ করবার পরে সূর্যভেদন ক্রিয়ায় কুম্ভক করবেন। কুম্ভক করবেন, নিজের সাধ্য অনুযায়ী।  শেষে ইড়া নাড়ী অর্থাৎ বাম  নাসিকা দ্বারা রেচন করবেন। এই প্রাণায়ামে শ্বাস নেবার সময় অর্থাৎ পূরক করবার সময়, আমাদের গলার শিরার ভিতর দিয়ে শ্বাস ভিতরে নেওয়া হয়। আর এই শ্বাস ভিতরে নেবার সময় একটা আওয়াজ হয়। খেয়াল করুন,  এই আওয়াজটা যেন গলার ভিতর  থেকে আসে, নাকের আওয়াজ না হয়। গলাকে একটু সংকুচিত করলেই বায়ুর স্পর্শে গলায় একটা কম্পন অনুভব  হয়। বায়ুর  ঘর্ষণ যেন নাকে না হয়, কন্ঠে ঘর্ষণ হবে, এবং ধ্বনির সৃষ্টি হবে। প্রথম দিকে শ্বাস নেবার পরে, কুম্ভক না করে, শব্দ  করতে করতে শ্বাস নিন, আবার ডান নাক বন্ধ করে, বাম নাসিকা নিয়ে, শ্বাস ধীরে ধীরে ছাড়ুন। একটা কথা সব সময় মনে রাখবেন, যখনই ডান  নাক বন্ধ করবেন, অবশ্য়ই ডান  হাতের বুড়ো আঙ্গুল ব্যবহার করুন।  আবার যখন বাম  নাক বন্ধ করতে বলা হবে, তখন আপনার ডান  হাতের অনামিকা ব্যবহার করবেন। কেন করবেন, এই ব্যাপারে, পরে একসময় আলোচনা করবো। জানবেন, হঠযোগের প্রত্যেকটি ক্রিয়াই  বিজ্ঞানসম্মত। তো যা বলা হচ্ছে, সেই মতো করুন। নিজের ইচ্ছেমতো করতে যাবেন না।  তো কন্ঠের শিরায় সামান্য চাপ দিয়ে ওম ধ্বনি করতে করতে উভয় নাসিকা দিয়ে, শ্বাস নিন। এবার সাধ্য মতো কুম্ভক করুন। প্রথম দিকে কুম্ভক না করেই বাম নাক দিয়ে শ্বাস ছাড়ুন। পূরক করবেন ধীরে ধীরে, রেচকও করবেন ধীরে ধীরে।  কখনোই তাড়াহুড়া করতে যাবেন না। কুম্ভক প্রথম দিকে ১০ সেকেন্ড থেকে শুরু করুন। কাছেই টেবিল-ঘড়ি রাখুন, টিক টিক আওয়াজ থেকে আপনার সময় বুঝে নিতে পারবেন। কুম্ভক যদি ১০ সেকেন্ডের বেশী করবার মতো অবস্থায় পৌঁছান তবে, জালন্ধর বন্ধ ও মূলাধার বন্ধ অবশ্য়ই করবেন।  

ফল : উজ্জায়ী প্রাণায়াম সাধন করলে, শরীরের শ্লেষ্মা-দোষের নিবৃত্তি হয়। গলা পরিষ্কার থাকে। গলার যাবতীয় রোগের  নিরাময়ের রাম-বান হিসেবে কাজ  করে থাকে।  কাশি ইত্যাদি রোগ জন্মাতে পারে না। যেকোনো বাহ্যিক ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রেহাই পাবেন। নাকের হাড়ের অহেতুক বৃদ্ধি রোধ করতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এতে জঠরাগ্নি বৃদ্ধি পায়। এই কুম্ভক ধাতুদোষ হরণ  করে থাকে। এরজন্যে আলাদা ভাবে কোনো বন্ধ-ক্রিয়া করবার দরকার নেই। অতিরিক্ত সময় (১০/১৫ সেকেন্ড-এর বেশী ) কুম্ভকে না থাকলে, এতে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।  সমস্ত জীবকুল এই ক্রিয়ার অধিকারী।

সীৎকারী : যেকোনো ধ্যানাসনে বসুন। জীব উপরের তালুকে স্পর্শ করুন। দাঁত মাড়িতে লাগিয়ে লাগিয়ে চাপ দিন। অর্থাৎ দাঁতে দাঁত চেপে ধরুন। ঠোঁট খুলে রাখুন। এবার ধীরে ধীরে সি-সি আওয়াজ করতে করতে মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে থাকুন। ফুসফুস পূরণ করুন। এবার জালন্ধার বন্ধন করুন। কিছুক্ষন এই অবস্থায় অবস্থান করুন। এবার ধীরে ধীরে রেচন করতে থাকুন। অন্তত পাঁচ বার এই অভ্যাস করুন। 

ফল : দাঁতের যেকোনো রোগ, বিশেষ করে পাইরিয়া, রোগে বিশেষ কাজ করে থাকে।  এছাড়া, মুখ, নাক, জীবের রোগেও এই অভ্যাস ফলদায়ী। যাদের রক্তচাপ আছে, তাদের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া ১০-২০ বার করলে, বিশেষ উপকার পাবেন। শরীর ঠান্ডা থাকবে। ক্লান্তি দূর হবে। মৎস্যেন্দ্রনাথ বলছেন, এতে করে, যোগীর ক্ষুধা-তৃষ্ণা, নিদ্রা, আলস্য  দূর হয়ে যাবে। দেহে সত্ত্বগুণের প্রভাব বাড়বে। এই ক্রিয়ায় কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বলে কিছু নেই। 

শীতলী : ধ্যানযোগে, বসে, হাঁটুতে হাত ভাজকরে রাখুন।  জিভকে ভাজকরে, চঞ্চুর মতো করুন। এবার  সীৎকারী প্রক্রিয়ায় মতো করে,  বায়ু আকর্ষণ করে, কুম্ভক সাধন করতে হবে।  এরপরে ধীরে ধীরে নাসারন্ধ্র দ্বারা বায়ুকে রেচন করতে হবে। অর্থাৎ জিহ্বাকে কাকের ঠোঁটের মতো ভাজ করে বায়ু সেবন করতে হবে, কিছুক্ষন কুম্ভক করার পরে নাক দিয়ে রেচন করতে হবে। এইভাবে ৫-১০ বার করুন। এই কুম্ভকের ক্রিয়া শীতকালে না করা, বা কম করা  ভালো। কারন এতে আপনার গলায়/বুকে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। এই ক্রিয়া শরীরের মধ্যে শীতলতা সৃষ্টি করে থাকে তাই একে শীতলী বলা হয়।  

ফল : যোগাচার্য্য মৎস্যেন্দ্রনাথ বলছেন, এই প্রক্রিয়াতে ক্ষুধা, তৃষ্ণা পিত্তরোগ, জ্বর, প্লীহা ইত্যাদি রোগের  বিনাশ হয়ে থাকে। ...........  

ভস্ত্রিকা, 

ভ্রামরী, 

মূর্ছা

 প্লাবনী :

 

     



 : 

     

 


   

      

    

                                                                                                                                                                                                                                                                                                                            

       


  

    

 


                     

     









 

1 comment:

  1. This comment has been removed by a blog administrator.

    ReplyDelete