প্রশ্নের উত্তর কেন দেয় না ? জানেনা তাই, দেয় না। গল্প ১. একবার এক পাগলা সাধুর কাছে, জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সাধু জীবনের উদ্দেশ্য কি। কিসে জীবন সার্থক হবে ? তো পাগলা সাধু একটি আশ্চার্য্য জবাব দিয়েছিলো। সেটা হচ্ছে ধরো-মারো-কাটো-খাও। সাধু যে সত্যি পাগোল, সেটা বুঝে নিয়ে তারা সবাই চলে গেল। পাগলের কাছ থেকে কিই বা আশা করা যেতে পারে ? সাধুকে পাগোল-ছাগল ইত্যাদি বলে গালাগাল দিতে দিতে তারা চলে গেল। সাধু হাসতে লাগলো। একজন মূর্খ, সাধুর কাছে বসে রইলো। তো সাধু জিজ্ঞেস করলো। তুই বসে আছিস কেন ? তো সে বললো আমি কিছু বুঝি নি তাই বসে আছি। আমি বোকা তো তাই কিছু বুঝিনি। আমাকে একটু বুঝিয়ে বলুন। তো সাধু বললো, কে বললো তুই বোকা, তুই ব্যাটা আসলে চালাক। তাই এখনো বসে আছিস। যা ভাগ। তো মূর্খ বসেই থাকলো। সাধুকে তামাক সেজে দিলো। কল থেকে জল এনে দিলো। বাড়ি থেকে খাবার এনে দিলো।
সাধু খুশি হয়ে বললো - শোন ধরো-মারো-কাটো-খাও এর মানে হচ্ছে। যথার্থ গুরুকে ধরো। গুরুর কাছে মরার মতো পড়ে থাকো। কামনা বাসনাগুলোকে মারো। মায়ার বাঁধন কাটো। তার পরে পরমানন্দ ভোগ করো। মূর্খ সেই হয়, যে ঈশ্বর ছাড়া কিছু বোঝে না। পাগল সেই হয়, যে ঈশ্বরের প্রেম পেয়েছে। প্রেমেই তো মানুষ পাগল হয়।
গল্প ২ : মূর্খ ডাকাতের হাতে ধরা পড়েছে সর্বজ্ঞ নারদ। নারদ ব্রহ্ম-জ্ঞানী। পাপ পুণ্যের পার্থক্য বোঝেন। নারদ ডাকাতকে তার মধুর বাণী দিয়ে, বোঝাতে চেষ্টা করলো ডাকাতি করা মহাপাপ। আর সেই পাপের ভাগ একমাত্র ডাকাতকেই নিতে হবে। যাদের জন্য সে এই ডাকাতি করছে, এই পাপের ভাগ তারা কেউ নেবে না। এইসব ছেঁদো কথায় ভুলবার পাত্র নয়, ডাকাত। বরং উল্টে চিৎকার করে নারদমুনিকে গালাগাল দিতে লাগলো। কথায় কাজ হচ্ছে না দেখে নারদ ডাকাতকে পিতা মাতা স্ত্রী-সন্তানদের কাছে পাঠালো। সেখান থেকে ফিরে ডাকাত অন্য মানুষ হয়ে গেলো। শুধু কথায় কাজ হয় না, অভিজ্ঞতার মধ্যেই প্রকৃত শিক্ষা হয়।
গল্প তিন : এক সাধু মহারাজ মানুষের সমাবেশে কাছে প্রতিদিন ঈশ্বরের কথা বলতেন। আর তার ড্রাইভার সাথী প্রতিদিন একই কথা বিভিন্ন সমাবেশে শুনতেন। তো একদিন ড্রাইভার বললো, আপনি তো প্রতিদিন একই কথা বলেন, আর সবাই কেমন মুগ্ধ হয়ে শোনে। আমিও এসব বলতে পারি। তো ঠিক হলো, এর পরদিন ড্রাইভার বক্তৃতা করবে, আর সাধু মহারাজ ড্রাইভার সেজে গাড়িতে বসে থাকবে। ড্রাইভার কিন্তু খুবই সুন্দর ভাবে বক্তৃতা করলেন। সবাই হাত তালি দিয়ে প্রশংসা করলো। শেষে প্রশ্ন- উত্তর পর্বে এসে, ড্রাইবার ঘাবড়ে গেলেন। সমস্ত কঠিন প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই। কিন্তু সাধুসঙ্গে উন্নত ড্রাইভার, বুদ্ধি করে বললেন, এসব সহজ সহজ প্রশ্নের উত্তর আমার ড্রাইভার বলে দেবে। বলে সে ড্রাইভাররুপি সাধুমহারাজকে ডেকে দিলেন। তো শুধু শুনলে কাজ হয় না।
গল্প চার : আমি এক (স্বঘোষিত)ভগবানকে জানতাম, নাম বললে, আপনারাও তাকে চিনতে পারবেন। তিনি ভীষণ জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু তাকে দেখতাম, সবসময় বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করতেন । কেউ হয়তো কৃষ্ণভক্ত, এসেছেন তার সাথে কৃষ্ণের আশ্চার্য্য ঐশ্বরিক গুণাবলী নিয়ে আলোচনা করতে। স্বঘোষিত ভগবান, শ্রীকৃষ্ণের বদনাম করা শুরু করে দিতেন। আর এতে করে ভক্ত রেগে মেগে গালাগাল করতে করতে চলে যেতেন। তাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে, তিনি বলতেন, ও ব্যাটা কৃষ্ণের সমর্থনে লোক খুঁজছে। কৃষ্ণকে খুঁজছে না। আমাকে ওর দলের লোক ভেবেছে। তো লক্ষ স্থির করুন, আর লক্ষে পৌঁছাবার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন।
গল্প পাঁচ : অর্জুনের মতো মহামানবের মনে প্রশ্ন জেগেছিলো, উত্তর দিয়েছিলেন, স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। এতে অর্জুনের লাভ হয়েছিল কিনা জানি না, তবে সমস্ত মানবজাতির লাভ হয়েছে। মহাভারতের যুদ্ধের পরে,অর্জুন একসময় সখা শ্রীকৃষ্ণকে বলেছিলেন, আমি তোমার সেই মূল্যবান কথা বিস্মৃত হয়েছি, আমার কিছুই মনে নেই। তুমি যদি আরো একবার এই প্রসঙ্গে উপদেশ দাও । আর এই প্রশ্নের জবাব আছে মহাভারতের অনুগীতা পর্ব্বে।
সত্য হচ্ছে : আমরা বাইরে প্রশ্নের উত্তর খুঁজি। সমস্ত প্রশ্নের উত্তর আছে নিজের মধ্যে। প্রশ্ন তাকেই করা যায়, যার প্রতি আমার শ্রদ্ধা জাগ্রত হয়েছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, গুরুসেবা করবে, গুরুকে প্রশ্ন করবে। গুরুসেবা অর্থাৎ গুরুকে তৃপ্ত করা। আর গুরু তখনই তৃপ্ত হন, যখন শিষ্য গুরুর বাক্য অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। গুরু বলেছেন, জমিতে বৃষ্টির জল ধরে রাখতে। তো শিষ্য মাটি দিয়ে আলকে বেঁধে রাখতে পারছে না দেখে, সারারাত আলের উপরে শুয়ে জল আটকাবার চেষ্টা করতে লাগলো।
গুরু বলেছেন, অগ্নিকে প্রজ্জ্বলিত করে, শীতের রাতে বাইরে সারারাত ধ্যানে বসে থাকতে। তো, শিষ্য ধ্যানে বসে ঘুমিয়ে পড়েছে, আর কখন অগ্নি নিভে গেছে। শীতের রাতে শিষ্য বাধ্য হয়ে গুরুদেবের কাছে দেশলাই চাইলেন, আগুন জ্বালাবার জন্য । গুরুদেব রেগে জ্বলন্ত অগ্নিকাষ্ঠ দিয়ে শিষ্যকে আঘাত করলেন।
তাহলে শশাঙ্ক শেখরের কাজটা কি ? শশাঙ্ক শেখরের কাজ হচ্ছে প্রশ্ন জাগিয়ে তোলা। আর যার মধ্যে প্রশ্নের উদ্গিরণ হয়েছে, সে ব্যাটা প্রশ্নের উত্তর ঠিক খুঁজে পাবে। যার মধ্যে প্রশ্নরূপ বীজ আছে, তার মধ্যেই উত্তররূপ বৃক্ষ আছে। এর জন্য তাকে শশাঙ্ক শেখরের কাছে আসতে হবে না। সমস্ত প্রশ্নের উত্তর যেমন প্রশ্নকর্তার নিজের ভিতরে আছে, উত্তর আছে প্রকৃতির মধ্যে। শশাঙ্ক শেখর সামান্য সাধারণ মানুষ মাত্র। সামান্য সাধক মাত্র। যার নিজের মধ্যেই ব্রহ্মজ্ঞান-এর অভাব, সে কি করে ব্রহ্মজ্ঞান দান করবে ? বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, শিক্ষক হবার যোগ্যতা তার নাই। যা কিছু লেখা, বলা, এর উৎস অন্য কোথাও হয়তো স্বয়ং শশাঙ্ক-শেখরের (শিব) কাছেই আছে।
মানুষ কোথা থেকে আসে, আবার কোথায় চলে যায় ?
জিজ্ঞাসু শিষ্য : মানুষ মরলে কোথায় যায় ?
গুরুদেব : যেখান থেকে এসেছিলো সেখানেই চলে যায়।
শিষ্য : কোথা থেকে এসেছিলো, আর কোথায়ই বা চলে যায় ?
গুরুদেব : ভাষা দিয়ে একথা বোঝানো যায় না।
শিষ্য : তাহলে কিভাবে বুঝবো ?
গুরুদেব : দুটো শুকনো কাষ্ঠখন্ড নিয়ে এসো।
শিষ্য দুই টুকরো শুকনো কাঠের টুকরো নিয়ে এলো।
গুরুদেব :এবার দুটো কাঠ ঘষতে থাকো।
শিষ্য দুটো কাঠে ঘর্ষণ শুরু করলো।
গুরুদেব : আরো জোরে, আরো জোরে।
ঘষতে ঘষতে একসময় আগুন জ্বলে উঠলো। দাউদাউ করে করে অগ্নিশিখা উর্দ্ধমুখী হয়ে উঠলো।
গুরুদেব : এবার দেখতে থাকো। যতক্ষন না আগুন নিভে যায়।
একসময় আগুনশিখা অদৃশ্য হয়ে গেলো।
গুরুদেব : এবার নিজেকে প্রশ্ন করো, আগুন কোথা থেকে এলো ? কোথায়ই বা চলে গেলো ?
শিষ্য ভাবতে লাগলো, আগুন কোথা থেকে এলো, আবার কোথায়ই বা চলে গেলো ? এই ভাবনাই চলছে, যুগযুগ ধরে। কোথা থেকেই বা আসে, আর কোথায়ই বা চলে যায় ?
----------------
পিতার মৃত্যুর পরে, লোটা আর লাঠি সম্বল করে ৮/৯ বছরের এক জন্মসিদ্ধ মহাপুরুষ ভাই-মাতা কে ছেড়ে, গৃহত্যাগী হলেন। সন্ন্যাসরূপী এই ছোট্ট ছেলেটিকে সবাই ভালোবাসে। যেখানে সে যায়, সবাই তাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। শিশুসন্যাসীকে সবাই তাদের সঙ্গে রাখতে চায়। কিন্তু শিশুর সংস্কার তাকে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায়, তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। আর সে নিঃসঙ্গ হয়ে যায় । পাহাড়ে পাহাড়ে, জঙ্গল থেকে জঙ্গলে, এক গুহা থেকে আর এক গুহায়, বরফের রাজত্বে সে ঘুরে ফেরে। কখনো তার খাবার জোটে, কখনো আবার জোটে না। তো এক মহাজন পণ্ডিত ব্যক্তি, যিনি ভাষণ, ভজন আর ভোজন সম্বল করে, ঈশ্বরের গুনকীর্তন করে বেড়ান, তাঁর নজর পড়লো এই দিব্য শিশুটির উপরে। আহা-রে কি দিব্যকান্তি শিশু। কিন্তু অনাহারে, তার চেহারায় দুর্বলতার ছাপ। করুনায় তার মন ভোরে উঠলো। শিশুটিকে সে খাবারের জোগান দিতে লাগলো। শিশু যেখানে যায়, মহাজন তার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। একটা সময়, হলো কি, শিশুটি তার খাবারের জন্য আর এক জায়গায় বসে থাকতে চাইলো না। আর মহাজনকে উপদেশ দিলেন, খাবার সংগ্রহে, বা খাবার পাঁকানোর জন্য, সময় নষ্ট করা ঠিক নয়। মহাজনের মধ্যেও যেন এই অনুভূতি হতে লাগলো। কিন্তু খাবার ভিন্ন শরীর বাঁচে না, এই কথাটা সে ভুলে যেতেও পারলো না। আবার সে শিশুটিকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারলো না। শিশুটি পথের রুক্ষতায় ক্লান্ত হয়ে পড়লো। মহাজন তার কাছ থেকে তার লোটাটা হাতে নিলো, শিশুটির কষ্ট লাঘব হবে বলে। কিন্তু লোটাটা হাতে নিতেই, লোটার সৌন্দর্য্যের দিকে তার আকর্ষণ হলো। মনে মনে ভাবলো, এই লোটাটা তার নিজের হলে কেমন হয় ? কি সুন্দর কারুকার্য্য করা, এই লোটা । এটি আর কোথাও পাওয়া যাবে না। সে এখন আর লোটাটিকে হাতছাড়া করতে চায় না। শিশু সন্যাসী, মহাজনের মনের কথা টের পেলেন। মহাজনের কাছ থেকে লোটাটি নিয়ে, পাহাড়ের গায়ে ছুড়ে ফেললেন , আর লোটাটি ভেঙে শত-টুকরো হয়ে গেলো। মহাজন আহত বাঘের মতো হয়ে গেলো। শিশু সন্যাসী বললেন - আপনি এখান থেকে পশ্চিম দিকে চলে যান, আমি পুবের দিকে যাবো। আমার সঙ্গে আপনি অনেকদূর এসেছেন, কিন্তু এখন থেকে আমাদের রাস্তা আলাদা। আবার কখনো নিশ্চয় দেখা হবে।
কপাল বা ভাগ্য লিখন - মনে হয়, মানুষের এতো কষ্ট কেন ?
ভগবানের সৃষ্টিতে এতো দুঃখ কেন ? এর উত্তরে কেউ কর্ম্মের কথা বলেছেন। ভগবান বিশ্বাসী মানুষ বলছেন, সবই ঈশ্বরের ইচ্ছে। লক্ষ করেছি, ভাগ্য সম্পর্কে সব সময় আমাদের মধ্যে একটা বিপরীতমুখী ধারণা প্রবাহিত হয়ে থাকে। কেউ বলেন, ভাগ্যবিধাতা হচ্ছেন, ঈশ্বর। আর ঈশ্বরের নির্দেশ ছাড়া একটা গাছের পাতাও নড়ে না। আবার কেউ বলেন, যেমন কর্ম্ম তেমন ফল। আমরা যেমন কর্ম্ম করবো, আমরা সেই মতো ফল পাবো। আমরা যখন কোনো বিপদে পড়ি, তখন আমরা আবার ঈশ্বরমুখী হয়ে থাকি। ঈশ্বরের কাছে বিপদ থেকে মুক্ত হবার জন্য প্রার্থনা করে থাকি। যদি সমস্ত কিছু আমাদের কর্ম্ম দ্বারা নির্ধারিত হয়, তবে আমরা কেন ঈশ্বরমুখী হয়ে বিপদ থেকে নিষ্কৃতির আশা করি ? আবার আমরা যে কর্ম্ম করি, তার ফলও সবসময় আমাদের ইচ্ছে অনুযায়ী হয় না। আমরা চাই এক, আর হয় আর-এক। তো মাঝে মধ্যে মনে হয়, আমাদের ভাগ্য কি পূর্ব-নির্দিষ্ট ? কে এই ভাগ্য বিধাতা ? বা আমাদের কর্ম্মও কি পূর্বনির্ধারিত ? আমরা কি কারুর হাতের পুতুল হয়ে, রোবটের মতো কর্ম্ম করে থাকি ?
যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেই, যে আমাদের ভাগ্য বিধাতা হচ্ছেন, সর্ব্বশক্তিমান ঈশ্বর। তবে মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন জাগে, আমরা সবাই একই ভগবানের সন্তান। তাহলে মানুষের এত কষ্ট কেন ? তাহলে মানুষে মানুষে এত প্রভেদ কেন ? নাকি অনেক ভগবান আছেন ? যারা আমাদের ভাগ্য লিখছেন। অনেক পরীক্ষক আছেন, যারা আমাদের কর্ম্মের খাতা দেখে, নিজের খেয়াল-খুশী মতো আমাদের ভাগ্য লিখে রাখছেন। কেন কেউ কোটিপতির ঘরে জন্ম নিচ্ছেন, আর কেউ গৃহহীন-অন্নহীন গরিবের ঘরে জন্ম নিচ্ছেন ? আমরা সবাই ঈশ্বরের সন্তান - একথা যদি সত্য হয়, তবে পিতা কি কখনো তার সন্তানদের মধ্যে প্রভেদ করতে পারেন ? ঈশ্বর দূরে থাকুক, একজন সাধারণ পিতা বা মাতা যদি তার সন্তানের জন্য, ভাগ্য লিখতে বসেন, তবে কি তিনি এক-এক সন্তানদের জন্য, আলাদা আলাদা ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারেন ? বিশেষ করে, পিতা-মাতা কি কখনো তার সন্তানদের দুঃখের মধ্যে ফেলে দিতে পারেন ? আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে পিতা-মাতার দ্বারা এই বৈষম্য কখনোই সম্ভব নয়। পিতা-মাতা যদি তার সন্তানের ভাগ্য লিখতেন, তবে কোনো সন্তানের কপালে দুঃখের কথা লিখে রাখতে পারতেন না। তাহলে ঈশ্বর, যাঁকে আমরা পরম পিতা বলে মনে করি, এবং সত্যিই যদি তিনি আমাদের পরমপিতা, হন, এবং তিনি যদি ভাগ্যের লেখক হন, তবে আমাদের জীবনে বৈষম্য আসবার কথা নয়।
এমনকি আমাদের কর্ম্মের পরিচালক যদি স্বয়ং ঈশ্বর হতেন, তবে নিশ্চয় তিনি আমাদের কু -কর্ম্মের মধ্যে লিপ্ত করতেন না। কেননা খারাপ কর্ম্মে কখনো পিতা মাতা উৎসাহ দিতে পারেন না, বরং খারাপ কর্ম্ম থেকে আমাদের বিরত অবশ্য়ই করতেন। তো কে এই কর্ম্মের নির্ধারক ? ঈশ্বর না আমি না অন্য কোনো শক্তি ?
আর যদি ধরেই নেই, আমরাই আমাদের কর্ম্মের পরিচালক, আমাদের নিজস্ব কর্ম্ম-ই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে থাকে, তবে আমরা তো - এও দেখি, বহু মানুষ প্রাণপাত পরিশ্রম করেও, দুমুঠো অন্যের জন্য হা-পিত্তেস করছে। আবার বড়োলোকের ঘরের ছেলে, কোনো কাজ না করে ফেলে ছড়িয়ে খাবার কাছে। কেউ সারাদিন রিক্সা টেনে, রাস্তার ফুটপাতে, পুলিশের লাঠির গুতো খেয়ে, ঘুমোনোর জায়গা খুঁজছে। আবার নিস্কর্মা বড়লোক পিতার সন্তান কেউ ৯ ইঞ্চি মোটা গদিতে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছে। কেন এই বৈষম্য ? কেউ সুযোগের অভাবে, আর্থিক দৈন্যতার কারনে স্কুল কলেজের শিক্ষা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, আবার কেউ বড়োলোকের ছেলে হবার সুবাদে, বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। একই কাজ ক'রে যদি একই ফল হয়, তবে আমরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্ম্মরত কেরানিদের মধ্যে মাইনের হেরফের কেন দেখি ? রেলে একরকম মাইনে তো ব্যাঙ্কে আর একরকম মাইনে । কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরীতে একরকম মাইনে , আবার রাজ্যসরকারের চাকরিতে এক রকম মাইনে । তো একই কাজ করে, একই যোগ্যতার অধিকারী হয়েও, একই ফল আমরা পেতে পারি, তা নয়। তবে এর মধ্যে রহস্যঃ কোথায় ? হে সৃষ্টিকর্তা তোমার লীলা আমাদের বোঝার শক্তি দাও।
আজ আমরা এইসব জটিল ও রহস্যে ঘেরা প্রশ্নের জবাব খুঁজবো।
দেখুন ঈশ্বরের ইচ্ছেয় আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ হয়, এই কথার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য প্রমান পাওয়া যায় না। তাহলে ধরে নিতে হয়, কর্ম্মই আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকে। এখন কথা হচ্ছে, কি সেই কর্ম্ম যা আমাদের ভবিষ্যৎ এমনকি পরবর্তী জীবনের ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকে ?
কর্ম্ম বলতে সাধারণত আমরা দৈহিক কর্ম্ম বুঝে থাকি। কিন্তু কর্ম্ম হচ্ছে আমাদের ভাবনা-প্রসূত ক্রিয়া । আমাদের লক্ষ্য, আমাদের উদ্দেশ্য, আমাদেরকে কর্ম্মে প্রবৃত্ত করে থাকে। আমরা শুনেছি, জীবাত্মা বা আত্মা হচ্ছে একটা শক্তি যা আমাদের মন ও শরীরকে পরিচালনা করে থাকে। তো এই শক্তি আমাদের মনের সাহায্যে ভাবনার মাধ্যমে শরীরের সাহায্যে কর্ম করে থাকে। অর্থাৎ কর্ম্ম আসলে আমাদের মনের ভাবনার প্রতিফলন। আর জীবাত্মা তার ভোগ সাধনের জন্য, মনের মধ্যে এই ভাবনার উদ্রেগ করে থাকে। ভাবনা শরীরের সাহায্যে কর্ম্মে পরিণত হয়। আর কর্ম্ম তার নির্দিষ্ট ফল প্রদান করে থাকে।
মহাত্মাগণ বলছেন, কর্ম্ম তিন প্রকার প্রারব্ধ, ক্রিয়মান, ও সঞ্চিত কর্ম্ম। আর এই কর্ম্ম হচ্ছে, ১. কামনা প্রসূত, অর্থাৎ আমাদের কামনাকে পূরণ করবার জন্য, যেসব কর্ম্ম করে থাকি, ২. বাসনা বা সংকল্প প্রসূত, অর্থাৎ সংকল্প পূরণের জন্য আমরা যে সব কর্ম্ম করে থাকি। আর ৩. হচ্ছে মানস প্রসূত বা মনের চিন্তা বিশেষ ।
যাই হোক, আমরা কর্ম্মের সূক্ষ্ম তত্ত্ব বুঝবার চেষ্টা করবো।
কামনা প্রসূত : আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা - প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ-শব্দ-স্পর্শ উপভোগ করবার যে প্রবৃত্তি সবসময় আমাদের মনের মধ্যে বর্তমান থাকে, যার দ্বারা ভোগ্য বিষয়ে আমাদের আসক্তি জন্মে তা কামনা প্রসূত কর্ম্ম । এই যে কামপ্রবৃত্তি, এর সঙ্গে ধর্ম্মের কোনো বিরোধ নেই। এটি জীবের ধর্ম্ম। কিন্তু মানুষের মধ্যে অন্যায্য অধিকার পাইবার জন্য একটা প্রবৃত্তি কাজ করে থাকে। আর এই অবস্থায় আমাদের মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। সাধ ও সাধ্যের মধ্যে একটা পার্থক্য থাকায়, আমাদের মধ্যে অতৃপ্তির জন্ম নেয়। যা দুঃখের কারন।
বাসনা প্রসূত : মানুষের মধ্যে দুটো বৃত্তি কাজ করে, এক হচ্ছে, বিষয়ের সংস্পর্শে এসে, কাঁচা আমিকে তুষ্ট রাখা। আর একটা হচ্ছে, পাঁকা আমিকে তুষ্ট করা। সত্য, সংযম, পবিত্রতা, নিঃস্বার্থপরতা, জ্ঞান অর্জন, লোকহিতকর কার্য্য করা, ইত্যাদি বৃত্তির অনুশীলনীতে মানুষ একধরনের তৃপ্তি পায়, যা আসলে পাঁকা আমির তৃপ্তি সাধন করে থাকে। এখানে যদি সাধ ও সাধ্যের মধ্যে পার্থক্য হয়, তবেও মানুষ দুঃখী হয়ে থাকে।
মানস প্রসূত : মনের মধ্যে যখন এই কামনা ও বাসনার উৎপত্তি হয়, তখন তা আমাদেরকে কর্ম্মে উদ্দীপ্ত করে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, মনের চিন্তাকে কার্য্যে সম্পাদন করা, বা না করা দুটোই ফলদায়ী কর্ম্ম। এই ব্যাপারটা আমাদের একটু ভালোভাবে বুঝতে হবে।
আমাদের মনের মধ্যে যখনই কোনো চিন্তার উদ্রেগ হলো, জানবেন, তখনই তা ফল প্রদানে উন্মুখ হবে - তা সে কার্যে রূপান্তরিত হোক বা না হোক। অর্থাৎ শুধুমাত্র চিন্তা ফলপ্রদানে সক্ষম। ধরুন আপনি মনে মনে ভাবছেন, পরীক্ষায় পাশ করলে ভালো হয়, মেয়েটিকে বা ছেলেটিকে স্ত্রী বা স্বামী হিসেবে পেলে ভালো হয়। একটা চাকরি পেলে ভালো হয়, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এব্যাপারে আপনি কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করলেন না, অথচ নিজের মনের মধ্যে চিন্তা আকারে রয়ে গেলো। তো এর জন্যও আপনার মধ্যে একদিন দুঃখের উদ্রেগ হবে। আবার ঈশ্বর অন্বেষণ করার মতো কাজ হচ্ছে, আমাদের মানসিক- শরীরের কাজ। ঈশ্বর চিন্তন আমাদের একটা তৃপ্তি এনে দিতে পারে।
এইখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, আমাদের যেমন স্থুল, সূক্ষ্ম, ও কারন দেহ আছে, তেমনি আমাদের পাঁচকোষের দ্বারা নির্মিত পাঁচটি শরীর আছে। আর আমাদের যে কর্ম্ম তাও বিভিন্ন শরীর করে থাকি। আমাদের এই যে ঈশ্বরের অনুসন্ধান রূপ কর্ম্ম তা হয়ে থাকে আমাদের মানস শরীরে। আমরা সাধারণত কর্ম্ম বলতে বুঝি স্থুল দেহের কর্ম্ম। কিন্তু আমাদের অন্য শরীরগুলোরও কর্ম্ম করবার শক্তি আছে। যদিও পৃথিবীই আমাদের কর্ম্ম ভূমি। আর পার্থিব জীবনে আমরা সূক্ষ্ম, স্থুল বা মানস দেহের যে কোনো কর্ম্ম করি না কেন, পরলোকে অর্থাৎ স্থুল দেহের নাশের পরে, আমরা সেই কর্ম্মের ফল ভোগ করবো না। আবার পৃথিবীতে এসে, সেই কর্ম্মের ফল ভোগ করতে হবে।
প্রারব্ধ কর্ম্ম : আমরা জানি, যে সব কর্ম্মের ফল ভোগ করবার জন্য, আমরা জীবদেহ নিয়ে পৃথিবীতে এসে থাকি, তাকেই বলে প্রারব্ধ কর্ম্ম। অর্থাৎ পূর্ব-পূর্ব জীবনের কর্ম্ম। আর এই প্রারব্ধ কর্ম্ম যখন ফলদানে উন্মুখ হয়, তখন সেই কর্ম্মফল আমরা কোনোভাবেই রোধ করতে পারি না।
ক্রিয়মান কর্ম্ম : আমরা এই পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করে, বা দেহধারন করে যে সমস্ত কর্ম্ম করে থাকি, তাকে বলে ক্রিয়মান কর্ম্ম। এই ক্রিয়মান কর্ম্মের ফল যেমন আমরা এই জীবনে ভোগ করতে পারি, আবার ভবিষ্যৎ জন্মেও ভোগ করতে পারি। এটি আমাদের ইচ্ছেধীন নয়, এটি স্থান-কালের গতির উপরে নির্ভর করছে। কোনো কর্ম্ম আশু ফল প্রদান করে থাকে, আবার কোনো কোনো কর্ম্ম দীর্ঘকাল পরে ফল প্রদান করে থাকে। মহাত্মাগন বলে থাকেন, আমাদের যখন আত্মজ্ঞান উৎপন্ন হবে, তখন এই সব কর্ম্মের প্রভাব থেকে আমরা নিষ্কৃতি পাবো। অর্থাৎ ক্রিয়মান কর্ম্মফল থেকে নিষ্কৃতি পাবো। কিন্তু প্রারব্ধ কর্ম্মফল আমাদের ভোগ করতেই হবে।
চিন্তাপ্রসূত কর্ম্ম : চিন্তা-প্রসূত কর্ম্ম নিয়ে আমাদের একটু ভালোভাবে বোঝার প্রয়োজন। আমাদের পাঁচটি কর্ম্ম-ইন্দ্রিয় (বাক-পাণি-পাদ-পায়ু-উপস্থ অর্থাৎ মুখ, হাত, পা, মলদ্বার ও লিঙ্গ ) দ্বারা যে সমস্ত কর্ম্ম সম্পাদন করে থাকি, তার ভালো মন্দ বোঝা আমাদের সাধারনের জ্ঞানের বিষয়। অনেক সময়, আমরা না বুঝে, বা বিচার বিশ্লেষণ না করে, অনেক কাজ করে আমরা অনুতপ্ত হই। আবার অনেক সময় আমরা বুঝেশুনেও বিবেকের নির্দেশকে অগ্রাহ্য করে প্রবৃত্তির বশে অন্যায় কাজ করে বসি । এসব আমরা বুঝি, আবার সংশোধন করেও নিতে পারি। কিন্তু আমাদের চিন্তা যে কর্ম্ম করছে, তা আমাদের জ্ঞানের বিষয় নয়। আর চিন্তাপ্রসূত কর্ম্ম আদালতের বিচার্য বিষয়ও নয়। চিন্তা শারীরিক উদ্দম ছাড়া যে ফলপ্রসূ হতে পারে, তা আমাদের বোধগম্য নয়। আমরা জানি, চিন্তা হচ্ছে মনের অবস্থা বিশেষ মাত্র। কিন্তু সত্য হচ্ছে, চিন্তার বাস্তব রূপ আছে, আর এই চিন্তার মধ্যে বস্তুর ধর্ম্ম বিরাজ করছে। শুধু চিন্তা দ্বারাই আমরা নিজের বা অপরের উপকার বা অপকার করতে পারি।
আমরা জানি ঐকান্তিকভাবে চিন্তাই হচ্ছে তপস্যা, যা মুনি ঋষিগণ করে থাকেন। আর তপস্যার ফল আমাদের বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থে বর্ণিত আছে। শাস্ত্র বলছেন, তপঃপ্রভাবসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে কিছুই দুর্লভ নয়। তপস্যার সাহায্যে সমস্ত ঐশর্য্য লাভ করা যেতে পারে। শুধু মুনি ঋষিগণের তপঃরূপ চিন্তা নয়, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের যে চিন্তা তাও কখনো নিষ্ফলাহতে পারে না। সাধারণ চিন্তাও ফল প্রদান করে থাকে। একটা কথা জানবেন, সমস্ত লোক, (অর্থাৎ ভূঃ ভূূবঃ-স্বঃ মহঃ জনঃ তপঃ সত্যম ) ওতপ্রোত ভাবে পৃথিবীতেই অবস্থান করছে। এমনকি আমাদের শরীরেই সমস্ত লোক অবস্থান করছে। আমাদের দেহ স্থুল -সূক্ষ্ম-সূক্ষ্মতর- সূক্ষ্মতম-কারন ভেদে পাঁচ রকম। সূক্ষ্ম দেহের জ্যোতির্বিম্ব আমাদের স্থুলদেহকে বেষ্টন করে আছে। এই সুক্ষদেহ বা আলোক দেহ, আমাদের গভীর ধ্যানে উপলব্ধ হয়। বিজ্ঞান এখন এই সত্যকে স্বীকার করছে। আমাদের শরীর থেকে প্রায় দেড়ফুট পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। এই সূক্ষ্ম দেহই আসলে আমাদের কামনার আধার। এরজন্য একে বলা হয়, কামদেহ। আমাদের মনের আবেগ বা কামের প্রভাবে এই বর্ণচ্ছটায় বর্ণের পার্থক্য হয়। আমাদের মনে যেমন প্রবৃত্তি জেগে ওঠে, সেই অনুসারে বর্ন পরিবর্তনের দ্বারা জ্যোতির্বিম্ব সূক্ষ্ম জগৎ থেকে সূক্ষ্ম পরমাণু আকর্ষণ করে থাকে। আর এই পরমাণু হাজার হাজার আজ্ঞাবহ চিন্তামূর্তিতে সৃষ্ট হয়। এই চিন্তা মূর্তিকেই আমরা শ্রীকৃষ্ণের সেনাবাহিনী হিসেবে জানি।
এখন কথা হচ্ছে এই চিন্তামূর্তি কিভাবে কাজ করে ? দেখুন এই চিন্তা মূর্তি অর্থাৎ সূক্ষ্ম-পদার্থে নির্মিত মূর্তি আমাদের মানসিক জগতের নিম্ন স্তরের হওয়ার ফলে এদের মধ্যে সামান্যতম চৈতন্য অবস্থান করে থাকে। অর্থাৎ কিঞ্চিৎ চৈতন্যের সঞ্চার এদের মধ্যেও হয়ে থাকে। তো প্রবৃত্তির লক্ষবস্তু নিকটে থাকলে, এই চিন্তামূর্তি সেই লক্ষ বস্তুর কাছে গিয়ে, তার সূক্ষ্মদেহে একই প্রকার প্রবৃত্তির উন্মেষ ঘটাতে চেষ্টা করে। অর্থাৎ প্রেরকের চিন্তা যত গাঢ় হবে, এবং যতক্ষন বেশিক্ষন স্থায়ী হবে, এইসব চিন্তাপ্রসূত জীবের অস্তিত্ত্ব তত দীর্ঘস্থায়ী ও ফলপ্রদ হবে। এইজন্য বলা হয়ে থাকে, আমাদের কারুর সম্পর্কে কুচিন্তা পোষণ করা গর্হিত কর্ম্ম। কেননা এতে যার সম্পর্কে চিন্তা করা হয়, তার ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে। আবার যদি প্রেরক সু-চিন্তা করে, তবে গ্রাহকের অর্থাৎ যার সম্পর্কে আপনি চিন্তা করছেন, তার ভালো হবার সম্ভাবনা থাকে।
পরাবিদ্যাবিদ ক্ষিতিনাথ ঘোষ "জীবন মরণ" বলছেন, চিন্তা বস্তু ও বিষয় দুইই। চিন্তার গভীরতা অনুযায়ী চিন্তা-প্রসূত বস্তু সবল বা দুর্বল হয়ে থাকে। সারা বিশ্বে চিন্তার স্রোত অবিরাম গতিতে চলছে। এরা কৃত্তিম হলেও, এদের ভৌতিক সত্তা আছে। এদের কাজ করবার শক্তি আছে, জীবনীশক্তি আছে। এমনকি বুদ্ধিও আছে। আমাদের চন্ডি পূরাণে, প্রবল শক্তিসম্পন্ন এইসব ভৌতিক সত্তা ভয়ানক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলো। এগুলো আমাদের কাছে গল্পকথা মনে হয়। কিন্তু সূক্ষ্ম জগৎ সম্পর্কে যাদের ধারণা তাদের কাছে, এই দৃশ্যপট স্পষ্ট। সুতরাং আমাদের কাছে, এই চিন্তাপ্রসূত মূর্তির কোনো বাস্তব সত্যতা নেই। আবার আমাদের কপালে যখন কোনো দুর্ভোগ বা সৌভাগ্যের উদয় হলো, তখন আমাদের বিষ্ময় জাগে, কেন হলো, কিভাবে হলো ? আসলে আমাদের চিন্তাশক্তি দুর্বল, তাই তাই আমাদের চিন্তাপ্রসূত সত্তা স্বল্পায়ু ও দুর্বল। আমরা যদি একই বিষয়ের উপরে, দীর্ঘকাল চিন্তা করতে থাকি, তবে নতুন নতুন সাত্তার জন্ম হবে এমনি পূর্ব প্রসূত সত্তার জীবনীশক্তি বর্দ্ধিত হবে। আমার চিন্তার উদ্দেশ্য ভালো বা মন্দ যাই হোক না কেন, চিন্তাপ্রসূত মূর্তিগুলোর প্রকৃতিও সেই মতো হবে। আর এদের প্ররোচনায়, আমাদের মনে আবার সুচিন্তা বা কুচিন্তা উদয় হতে থাকবে। তাই দেখবেন, কুচিন্তাকারীর মনে কুচিন্তার উদয় হয়, আর শুভ চিন্তার অধিকারীর মধ্যে সর্বদা শুভ চিন্তার উদ্রেগ হয়। তাই বলা হয়ে থাকে, যদি আমরা আমাদের বা অন্যকারুর ভালো বা মঙ্গল চাই, তবে আমাদের মঙ্গল চিন্তার প্রবাহিত বইয়ে দিতে হবে। গভীর চিন্তাই প্রাথমিক ভাবে ধ্যান। চিন্তা যখন এক বিষয়ে স্থিত হয়, তখন তাকে বলে ধ্যান। ধ্যান যত গভীর হবে, ধ্যানমূর্তি গুলোও তত সতেজ-সবল হবে। আর এই ধ্যানেই যোগীগণ অষ্টসিদ্ধি লাভ করে থাকেন। এদের কাছে, কোনো কিছুই অধরা থাকে না। ধ্যানযোগীগণ, পরম শান্তিতে বাস করেন।
মানুষের শারীরিক শক্তির একটা সীমা আছে, কিন্তু মানুষের মানসিক চিন্তার ক্ষমতা অসীম। আমাদের শারীরিক কর্ম্ম তা সে খারাপ ভালো যাই হোক না কেন, তার একটা সীমা আছে, কিন্তু আমাদের মানসিক চিন্তা প্রসূত কর্ম্মের ক্ষমতা অসীম। তাই চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। দেহকে আপনি একটু চেষ্টা করলেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন। কিন্তু চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা দুরূহ কাজ। অথচ এই চিন্তাই একটা মানুষকে মহামানব করে তুলতে পারে, অধিক শক্তিশালী করতে পারে, আবার এই চিন্তাই মানুষকে নরকের দ্বারে পৌঁছে দিতে পারে। অসহনীয় কষ্টের মধ্যে ফেলে দিতে পারে। আমাদের বিভিন্ন ধর্ম্ম অনুষ্ঠানে, বা আমাদের বিভিন্ন সামাজিক কাজে, যে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে, শুভ-ইচ্ছা শক্তিকে শব্দব্রহ্ম-এর দ্বারা সূক্ষ্ম জগতে আজ্ঞাবহ সচেতন চিন্তামূর্তি সৃষ্টি করা। এইসব মূর্তি আমাদের মতো স্থুল দেহধারীর তো বটেই এমনকি কামলোকবাসী মৃত্য ব্যক্তিদেরও প্রভূত উপকার করতে পারে। আমাদের বিবাহ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন মন্ত্রের সাহায্যে এই শক্তিধর চিন্তামূর্তি সৃষ্টি ক'রে, স্বামী-স্ত্রী উভয়কে রক্ষা করা হয়ে থাকে। যাইহোক, আমাদের মঙ্গল চিন্তা, শুভ চিন্তা যেমন আমাদের নিজেদের রক্ষা করতে পারে, তেমনি যার সম্পর্কে এই চিন্তা প্রবাহিত করা হয়, তারও এতে ভালো হতে পারে। তাই কর্ম্মের কথা আলোচনা করতে গিয়ে আমরা অবশ্য়ই এই চিন্তার দিকে খেয়াল রাখবো। চলবে। ..........
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
কপাল বা ভাগ্য লিখন - মানুষের এতো কষ্ট কেন ? (২)
মহাত্মাগণ বলছেন, মানুষের চিন্তাই মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকে। অর্থাৎ মানুষ তার নিজের ভাগ্য নিজেই লিখে থাকে। আর এই ভাগ্য লিখনের তিনটি সূত্র ১. সংকল্প পূরণের চিন্তা, ২. বাসনা পূরণের চিন্তা ৩. তৎজনিত কার্য্য। এখন কথা হচ্ছে, কোন শক্তিবলে আমরা এই চিন্তায় লিপ্ত হই ?
জীবাত্মার শক্তিই আমাদের মনের মধ্যে ভাবনার উদ্রেগ করে থাকে। জীবাত্মা তার অস্তিত্ত্ব শরীরের মধ্যে বজায় রাখবার জন্য, জীবাত্মা তার ভোগের নিমিত্য, এই ভাবনার উদ্রেগ করে থাকে। এই ভাবনার তিনটে দিক।
১. যা আমি নিজের থেকে ভাবছি। অর্থাৎ নিজের জন্য ভাবছি। তার একটা প্রভাব আমার মধ্যে পড়ছে। আমরা আমাদের অস্তিত্ত্ব রক্ষার জন্য, স্বাভাবিক ভাবেই চিন্তা করে থাকি। এই যে নিজের থেকে ভাবনা, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমার সংকল্প বা বাসনা পূরণের ভাবনা। এই ভাবনা আমাদের বাহ্যিক দৃশ্যমান জগৎ থেকে আসতে পারে, আবার আমাদের মনের মধ্যে যে সংকল্প আছে, তার পূরণের উদ্দেশ্যে হতে পারে, আবার অস্তিত্ত্ব রক্ষার কারনে হতে পারে। আর এই চিন্তা বা ভাবনা আমাদের জন্ম-জন্মান্তর ধরে চলছে।
বাহ্যিক দৃশ্য এবং আমাদের পূর্ব জীবনের সংস্কার আপনাকে কিভাবে ভাবনাকে প্রভাবিত করে দেখুন। ধরুন আপনি একটা ফুল দেখছেন, তো আমার মধ্যে একটা ভাবনার উদয় হচ্ছে। আপনি যদি শিল্পী হন, অর্থাৎ আপনার মধ্যে যদি শিল্প সংস্কার থাকে, তবে আপনার মধ্যে ফুলের গঠনগত সৌন্দর্যের দিকে আপনি আকৃষ্ট হবেন। আপনি ফুলের উপরে আলতো করে, হাত বোলাতে পারেন। গন্ধ উপভোগ করতে পারেন। কিন্তু যদি আপনি মালি হন, ফুলের ব্যবসায়ী হন, তবে আপনি অতকিছু চিন্তা না করে, ফুল বিক্রি করবার কথা ভাবেন, আর ফুলটিকে ছিঁড়ে ঝুড়ির মধ্যে রাখবেন। আপনি যদি জাগতিক প্রেমিক হন, তবে ফুলটিকে ছিঁড়ে আপনি আপনার প্রেয়সীর মাথায় গুঁজে দেবেন। আবার যদি আপনি ঈশ্বর প্রেমী হন, তবে আপনি ফুলটিকে ছিঁড়ে ঈশ্বরের পায়ে নিবেদন করবেন। তো কি করবেন, সেটা নির্ভর করছে, আপনার সংস্কারের উপরে। আর আমরা জানি সংস্কার আর কিছুই নয়, আমাদের পূর্ব-পূর্ব জীবনের চিন্তা মাত্র।
অস্তিত্ত্ব রক্ষার জন্য চিন্তা - আবার ধরুন, আপনি আপনার সামনে একটা সাপ /বা বাঘ দেখলেন, .আপনার যদি এই বাঘ বা সাপ সম্পর্কে কোনো পুরোনো অভিজ্ঞতা থাকে, যা আপনি শুনে বা দেখে সংগ্রহ করেছিলেন, তবে মুহূর্তের মধ্যে এদের থেকে নিজেকে সতর্ক করে লাভিয়ে পগারপার হয়ে যাবেন। কিন্তু একটা শিশু, যার মধ্যে বাঘ বা সাপ কোনো পুরোনো অভিজ্ঞতা নেই, সে কিন্তু স্থির হয়ে বসে থাকবে, তাতে তার যাই পরিণতি হোক না কেন। এতে করে তার মধ্যে কোনো চিন্তার উদ্রেগ হবে না।
২. তো অন্যের আচরণ, অর্থাৎ যাদের সঙ্গে আমি সম্পর্কযুক্ত তাদের আচরণ বা প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে একটা ভাবনা আমার মধ্যে আসছে। কোনো একটা দৃশ্য দেখলাম, পাখির গান শুনলাম, তারও একটা প্রভাব আমার মধ্যে পড়ছে। আবার অন্যে আমার সম্পর্কে কি ভাবছে, তার একটা প্রভাব আমাদের মধ্যে আসছে। অর্থাৎ অন্যের ভাবনা প্রসূত কর্ম্ম আমাকে প্রভাবিত করছে। ধরুন, আমাকে কেউ বকাবকি করলো, বা আমার প্রসংশা করলো। এর দ্বারা আমার মন প্রভাবিত হলো। এর ফলে আপনার মধ্যে নতুন ভাবনার সৃষ্ট হতে পারে, অর্থাৎ কর্ম্মের সৃষ্টি হতে পারে।
৩. আবার পরিবেশ পরিস্থিতির ভাবনার পাল্টা একটা ভাবনা আমাদের মধ্যে তৈরী হচ্ছে । অর্থাৎ অন্য কেউ আমার আচরণে কষ্ট পেলো, দুঃখ পেলো, বা আনন্দ পেলো, এর ফলে প্রতিদানে সেও আমার সম্পর্কে নিজের মধ্যে একটা ভাবনা তৈরী করলো। এই যে অন্যের ভাবনা সেটিও আমাকে প্রভাবিত করতে পারে। অর্থাৎ কেউ আমার আচরণে কষ্ট পেয়ে, পাল্টা একটা কিছু করলো, বা বললো, তো তার কথা বা কর্ম্ম আমাকে বিব্রত করতে পারে। আবার আমার আচরণে আনন্দ পেয়ে, সেও আমাকে একটা আনন্দপূর্ণ বাক্য বা আচরণ করলো। এসবই আমাকে প্রভাবিত করবে। আসলে আমি যা কিছু ভাবছি, তা যেমন আমার প্রবৃত্তির লক্ষবস্তুকে প্রভাবিত করছে, তেমনি অন্য কেউ কিছু ভাবলে, তাদের প্রবৃত্তির লক্ষবস্তুকে প্রভাবিত করছে। চিন্তার খেলা এইভাবে নিরন্তর চলছে।
তো ভাবনা আমার - কিন্তু তার প্রভাব তিন রকম। আমি নিজের সম্পর্কে কি ভাবছি, অন্যরা আমার সম্পর্কে কি ভাবছে, আর আমি অন্যের সম্পর্কে কি ভাবছি। একটা হচ্ছে বর্তমান, অর্থাৎ এখন আমার মধ্যে যে ভাবনার উদ্রেগ হচ্ছে, একটা হচ্ছে অতীত যা আমি আগে ভেবেছিলাম, আর একটা হচ্ছে ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান যা আমি অন্যের সম্পর্কে ভেবেছিলাম, এবং তার প্রতিদানে তাদের কাছ থেকে এক বিপরীত ভাবনা, যে ভাবনা আমাকে প্রভাবিত করছে বা করবে ।
এখন ভাবনা হচ্ছে একটা শক্তি যা আমাদের মূল সত্তা অর্থাৎ আত্মা থেকে থেকে উৎসারিত হচ্ছে। এই শক্তি মনকে প্রভাবিত করছে। এখন এই শক্তি মনের থেকে চিন্তা আকারে উৎপন্ন হয়ে, বিস্তার লাভ করছে। চিন্তার বা ভাবনার স্তরে থাকে সংকল্প ও বাসনা। আর এর প্রকাশরূপকে বলে কার্য্য। এই তিনটিই আমাদের ভাগ্য সৃজন করে থাকে।
এই চিন্তার ক্ষমতা অসীম। আমাদের যে মনের শক্তি বা মানসিক শক্তি তা আমরা এই চিন্তা থেকে পেয়ে থাকি। পূর্ব পূর্ব জীবনে আমি যে চিন্তার অনুশীলন করেছিলাম, বর্তমান জীবনে আমি সেইমতো মানসিক শক্তি অর্জন করেছি। এইজন্য আমরা বারবার বলেছি, ধ্যান করতে। তার কারন হচ্ছে, ধ্যানে আমরা গাঢ় চিন্তায় মগ্ন থাকি। আর এই ধ্যান অবস্থায়, আমাদের চিত্তবৃত্তি এক বিষয়েই নিবদ্ধ থাকে। জ্ঞানবৃত্তির একতানতাকে ধ্যান বলে। প্রতিদিন নিয়ম করে ধ্যান করলে, আমাদের চিত্ত বৃত্তি শান্ত হয়, এবং ক্রমশঃ মানসিক শক্তি বৃদ্ধি হতে থাকে। আর মানসিক শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমরা চিন্তার একটা উচ্চস্তরে মনকে স্থাপন করতে পারি। মনের এই উচ্চস্তরে আমাদের যে চিন্তার উদ্ভব হয়, তার সংযাগে আমাদের কামনা বাসনার কোনো সম্পর্ক থাকে না। আপন স্বার্থসিদ্ধির কোনো কল্পনা তখন আর অবশিষ্ট থাকে না। এই উচ্চ শ্রেণীর চিন্তাই আমাদের আধ্যাত্মিক সম্পদ। মানুষ সংকল্প প্রধান জীব। আর ইহজগত থেকে প্রয়াণের পরে, আমরা আবার সংকল্প সাধনের উপযুক্ত দেহ জন্মান্তরে ধারণ করে থাকি। মনের নিম্ন স্তরে যে চিন্তার উদ্রেগ হয়, তার মধ্যে কামনা-বাসনার মিশ্রণ থাকে। আর ফলেই, আমরা পার্থিব বন্ধন সৃষ্টি করে থাকি। এই জগতে এসে আমি যাদের সঙ্গে সন্মন্ধে আবদ্ধ হয়েছি, তা আমার পূর্ব জীবনের চিন্তার ফল। আমি নিশ্চয়ই আগের জন্মে এদের উদ্দেশ্যে আমার চিন্তারাশিকে প্রবাহিত করেছিলাম।
ক্ষিতিনাথ ঘোষ মহাশয় বলছেন, আমাদের কামনার সাথে আমাদের মনের গভীর সংযোগ আছে। আর এই কামনা থেকেই কামদেহ সৃষ্টি হয়ে থাকে। আমাদের কামনার শুচিতার উপরে, আমাদের পরবর্তী জীবনের কামদেহ পুষ্টিলাভ করে থাকে। ক্ষিতিবাবু, আরো বলছেন, মনের মধ্যে পাশবিক প্রবৃত্তি পোষণ করলে, জীব বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম গ্রহণ করে থাকে। কিংবা কুৎসিত বংশানুক্রমিক রোগের বীজ শরীরে ধারণ করে থাকে। জানিনা এর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে কি না। তবে এটা ঠিক পিতামাতা যদি উশৃঙ্খল কাম-জীবনযাপন করে, তবে তারা বিকলাঙ্গ সন্তানের জন্মদাতা হতে পারে । আসলে মানুষ যেমন চায়, সেইমতো দেহ ধারণ করে থাকে। এমনকি পিতা-মাতা পছন্দ করে থাকে কামনা পূরণের উদ্দেশ্য নিয়ে। আমাদের কর্ম্ম, আচার-আচরণ, আমাকে সেইমতো পরিবেশে এমনকি দেশ নির্বাচন করিয়ে দেয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যোগভ্রষ্ট পুরুষ পরবর্তী জন্মে সেই পরিবেশে, সেই মাতা-পিতার ঘরে জন্ম গ্রহণ করে, যেখানে সে যোগের সমস্ত সুযোগ সুবিধা পাবে। কামনার অনুরূপ হয় সংকল্প, আর সংকল্প অনুযায়ী জীব কর্ম্ম করে থাকে । আবার কর্ম্ম অনুযায়ী ফল লাভ করে থাকে।
আমরা এই কামনা দ্বারাই আমাদের ঐহিক সম্পর্ক স্থাপন হয়ে থাকি । পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন, যে যাকে চায়, স্বর্গবাস কালীন, সে তাকেই পায়। আবার সেই ভাব-বন্ধনের আকর্ষনে পরজন্মে আবার তাদের সাথেই মিলিত হয়। তো বুঝতে পারছেন, আমাদের কর্ম্ম আমাদের শুধু এই জীবনের বিষয় নয়, ইহকালের বিষয় নয়, এই কর্ম্মফল আমরা পরবর্তী জীবনেও ভোগ করতে থাকবো।
মহাত্মাগণ বলছেন, সাধারণ মানুষের চিন্তা থেকে কামনা প্রবলতর। আর এই কারণেই সে কামনা দ্বারা ঐহিক সম্পর্ক সৃষ্ট করতে চায়। আমরা ভাবি, আমাদের সম্পর্কের জন, ভালোবাসার জন, যেন আমাদের মৃত্যুর পরেও আমাদেরই সাথে থাকে। আর তাই সাধারন মানুষের স্থুল দেহ নাসের পরে, এমনকি সে যখন স্বর্গে বাস করে, সেখানে সে তাকেই পায়। আবার এই ভাববন্ধনের আকর্ষনে, পরবর্তী জীবনে আবার তাদের সাথেই সন্মন্ধে আবদ্ধ হয়। আর এই কামনার প্রকৃতির উপরে অর্থাৎ শুভ কামনা ও অশুভ কামনা আমাদের শত্রু ও মিত্রের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরী করে। আমরা আমাদের বাহ্যিক দৈহিক কর্ম্মের বিচার বিশ্লেষণ করতে পারে। তার ভালো মন্দ বিচার করতে পারি। কিন্তু আমাদের মনের মধ্যে যে চিন্তা অহরহ আসছে, তার বিচার করতে পারি না। এমনকি তাকে সহজে বন্ধও করতেও পারি না।
আমরা ধারণাও করতে পারি না যে আমাদের চিন্তাই আমাদের ভবিষ্যৎ গড়ে দিচ্ছে। আমাদের ভাগ্য লিখে দিচ্ছে।
বৃহদারণ্যক উপনিষদ বলছেন, জীব কামময়। তিনি যেমন যেমন কামনা করেন, সেইমতো তিনি কৃতসংকল্প হন। আর যেমন কৃতসংকল্প হন, সেইমতো কর্ম্মে লিপ্ত হন, আবার যেমন যেমন কর্ম্ম করেন সেইরূপ ফল সম্পাদন করেন। (৪/৪/৫) "অথো খল্বাহু কামময় এবায়ং পুরুষ ইতি স যথাকামো ভবতি তৎ ক্রতুর-ভবতি, যৎ ক্রতুর-ভবতি, তৎ কর্ম্ম কুরুতে, যৎ কর্ম্ম কুরুতে তৎ অভিসম্পদ্যতে।"
এখন কথা হচ্ছে, আমরা যা কিছু করি তা সবই কামনা থেকে জাত। আর যেহেতু আমাদের কর্ম্ম কামনা জাত কর্ম্মফল কামনা অনুযায়ী হয়ে থাকে। আমরা যদি কামনা রোহিত হয়ে কর্ম্ম করতে পারি, তবে আমাদের কর্ম্মফল ভোগ করতে হবেনা। অর্থাৎ কামনাবিহীন কর্ম্ম কোনো কর্ম্ম ফল প্রদান করে না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণও বলছেন, আসক্তিবিহীন কর্ম্ম করতে। কামনাবিহীন কর্ম্ম করতে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, কামনাবিহীন কর্ম্ম কোনো জীব করতে পারে কিনা সন্দেহ। এইজন্য আমাদের দুটো ১. আমাদের কর্ম্মের উদ্দেশ্য যেন সৎ ও শুভ হয়। ২. আর একটি হচ্ছে, পরমাত্মাকে সাক্ষী রেখে কাজ করুন। অর্থাৎ আপনি জানবেন, আপনার সমস্ত কাজের একজন দ্রষ্টা আছেন, আর তিনি হচ্ছেন ঈশ্বর। তখন দেখবেন, আপনি বিরুদ্ধে কাজ করতে পারবেন না। আপনি কি করছেন সেটা বারো কথা নয়, আপনি কি উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছেন, সেটাই বড়ো কথা। অস্ত্র হাতে দুই ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে, একজনের উদ্দেশ্য হচ্ছে রুগীর শরীরে অস্ত্রপচার করে রুগীকে সুস্থ জীবন দান করা, অরে একজনের উদ্দেশ্য হচ্ছে অস্ত্রের আঘাতে কারুর প্রাণনাশ করা। তো উদ্দেশ্য বড়ো কথা, কর্ম্ম নয়।
উপনিষদ বলছেন, আসক্ত হয়ে জীব, সেই ফলই পান, যাতে ওই জীবের পরিচায়ক মনটি অর্থাৎ শুদ্ধ বা অশুদ্ধ মনের মধ্যে উদ্ভূত অভিলাষ হয়েছে। জীব ইহলোকে যা কিছু করেন, পরলোকে সেই কর্ম্মের ভোগ শেষ করে, পুনর্বার কর্ম্ম করবার জন্য, পরলোক থেকে ইহলোকে আসেন। ফলাকাঙ্খী জীবের এই রকমটাই হয়ে থাকে। আর যারা অকাম, নিষ্কাম, আপ্তকাম, ও আত্মকাম, তাঁর গমনাগমন নেই, দেহান্তরপ্রাপ্তিও নেই। ( শ্লোক - ৪/৪/৭) বৃহদারণ্যক উপনিষদের এই জায়গাটা আমাদের মধ্যে প্রশ্নের জাগরণ করতে পারে। অর্থাৎ পরলোকেও আমাদের তাহলে ভোগ সম্পন্ন হয় ? যদি হয়, তবে প্রারব্ধ কর্ম্ম কেন থাকবে ? আর মৃত্যুর পরে তো আমাদের এই স্থুল দেহ থাকবে না, তবে কিভাবে সেখানে আমাদের ভোগ সম্পন্ন হবে ? এই ধরনের কথা আমরা গীতাতেও পাই। তো এই সব কথার যথার্থ অর্থ আমরা পরবর্তীতে শুনবো।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
জীবাত্মার কাকে বলে ?
উপনিষদ বলছেন, অহম ব্রহ্মাস্মিন, আমিই ব্রহ্ম। আমিই যদি ব্রহ্ম হই, তবে জীবাত্মা বা আমি, বা আমার আলাদা একটা সত্তা যা আমরা উপলব্ধি করি, যা আমাদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে, সেই জীবাত্মার উৎপত্তি কিভাবে হলো। সবাইকেই, যদি ব্রহ্ম বলা হয়, ব্রহ্মই যদি সব, কখনো তিনি ব্যক্ত, কখনো তিনি অব্যক্ত - ও যদি সত্য হয়, তবে জীবাত্মা বলে আলাদা কিছু থাকে কি ?
দেখুন, সন্ধিনী, সম্বিৎ ও হ্লাদিনী এই যে তিনটি শক্তি তা ভগবানে পূর্ণভাবে প্রকটিত। কিন্তু জীবের মধ্যে তা বীজভাবে প্রসুপ্ত।
সন্ধিনী কথাটার অর্থ হচ্ছে, যার মধ্যে মিলন ইচ্ছে জাগ্রত হয়েছে। বৃষ দ্বারা আক্ৰান্ত ঋতুমতী গাভীর সঙ্গে এই সন্ধিনী কথাটার উপমা দেওয়া হয়েছে। তো ভগবানের মধ্যে এই সন্ধিনী শক্তি পূর্ন ভাবে প্রকটিত। সম্বিৎ অর্থাৎ জ্ঞান বা চৈতন্য। আর হ্লাদিনী কথাটার অর্থ হচ্ছে আহ্লাদযুক্ত, হৃষ্টা। ভগবানের সেই স্বরূপ শক্তি যার দ্বারা স্বয়ং তিনিই আনন্দলাভ করে থাকেন । তো এই তিনটি শক্তি ভগবানে পূরণ ভাবে প্রকটিত আর জীবের মধ্যে সুপ্ত।
আমরা জানি জীবদেহ প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন হয়েছে। কিন্তু আমরা যাকে জীবাত্মা বলি তা আসলে তপলোকের বাসিন্দা, ভগবানের অংশ মাত্র । এই তপলোক, অর্থাৎ অপার্থিব আলোক লোক থেকে ভগবানের অংশ রশ্মির সাহায্যে জনলোকে নেমে আসে। এবং সেখানে হিরন্ময় কোষ গ্রহণ করে। এর পর ক্রমশ মহর্লোকে নেমে আনন্দময় কোষের দ্বারা আবৃত হয়। এর পর স্বর্গলোকে বিজ্ঞানময় কোষের দ্বারা আবৃত হয়। এ তিনটি কোষের দ্বারা আবৃত অর্থাৎ হিরণ্ময়, আনন্দময় ও বিজ্ঞানময় কোষের দ্বারা আবৃত চৈতন্যকে বলা হয়, আত্মা-বুদ্ধি-মনস। এই আত্মা-বুদ্ধি-মনস ধীরে ধীরে পুষ্টি লাভ করতে থাকে, সুসংহত হতে থাকে। এই পুষ্টিকৃত সুসংহত সত্তা পরবর্তীতে জীবাত্মা হবে।
এবার, এই আত্মা-বুদ্ধি-মনস-এর অংশ রূপস্বর্গে নেমে ভাবনাময়, ভুবর্লোকে নেমে বাসনাময়, এবং সবশেষে ভুলোকে নেমে ইথার-নির্মিত কোষ ও স্থূলজড় নির্মিত কোষ অর্থাৎ ভাইরাস-দেহ (বস্তু থেকে জীবসৃষ্টির মধ্যাবস্থা) গ্রহণ করে ও স্থাবর রূপে প্রকাশিত হয়। ইথার ও কঠিন-তরল-বায়বীয় ভেদে জীবের শরীরকে ছয়টি কোষের সমন্নয় বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ জীবের শরীরের সংখ্যা ছয়টি। এগুলোকেই আবার পিন্ডদেহ, লিঙ্গদেহ, কারন দেহ বা স্থূল, সুক্ষ ও কারন প্রভৃতি আখ্যা দেওয়া হয়েছে। উপনিষদ বলছেন, কঠিন-তরল ও বায়বীয় পদার্থে নির্মিত শরীরকে বলা হয়, অনন্ময় শরীর। পার্থিব আকাশ তত্ত্বে অর্থাৎ ইথারে নির্মিত শরীরকে বলা হয়, প্রাণময় শরীর। বাসনাময় ও ভাবণাময় কোষদুটোকে মিলিয়ে, জীবের মনোময় শরীর। আর সূক্ষ্মতর তিনটি শরীর যা অপার্থিব তা হচ্ছে, বিজ্ঞানময়, আনন্দময়, ও হিরণ্ময় .
ভগবানের অংশ, যখন, তপলোক থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসে, এবং হিরণ্ময়, আনন্দময়, বিজ্ঞানময় কোষে আবৃত হবার ফলে চৈতন্যের যে জীব ভাব প্রকাশ পায়, তাকেই বলে জীবাত্মা। আবার জীবাত্মার যে অংশ স্থুল ও সূক্ষ্ম পদার্থের অর্থাৎ জড়দেহ, মানস (ভাবনা ও বাসনা) দেহের আশ্রয়ে যে প্রকাশ তাকে বলে, ভূতাত্মা।
--------------------------
.
No comments:
Post a Comment