Friday, 25 October 2019

নিত্য ও অনিত্য।




নিত্য অনিত্য 

গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, এমন কোনো সময় ছিল না যখন আমি ছিলাম না। বা তুমি ছিলে  না, বা এই সমস্ত জনলোক ছিল না।  আবার এমন কোনো সময় হবে না যখন আমি থাকবো না, বা তুমি থাকবে না, বা এই সমস্ত রাজা-মহারাজারা, সমস্ত জনলোক  থাকবে না।

জগতে দুটো জিনিস সবসময় আছে, আর সে দুটো হচ্ছে, সৎ ও অসৎ। অর্থাৎ নিত্য ও অনিত্য। একটা শরীর যেটা পার্থিব বা  স্থুল  আর একটা শরীরী যেটা অপার্থিব। এই দুটোই সবসময় বর্তমান। শরীর কখনো স্থায়ী হয় না। কিন্তু  শরীরী কখনো অস্থায়ী হয় না।  দুটোই আছে। শরীরীর কখনো অভাব নেই। আর শরীরের অভাব যায় না কখনো।

আমাদের দৃষ্টিতে আমরা যারা রূপ পরিগ্রহ করে আছি, তারা একদিন ছিলাম না, আবার একদিন থাকবো না। আমাদের এই যে ধারণা বা জ্ঞান তা অসত্য। আর যারা অসাধারণ-মহাত্মা-জ্ঞানী তারা জানেন,  আমরা সবাই ছিলাম, আছি, থাকবো। এমনকি যাকে  আমরা অনিত্য বলছি, তারও কখনো বিনাশ নেই।

আমার আপনার সবার বহুবার জন্ম হয়েছে, সেগুলো আমরা জানি না। আবার আমাদের বহুবার জন্ম হবে, সেসবও আমরা জানি না। কিন্তু কৃষ্ণের মতো মহাপুরুষেরা জানেন। তাইতো ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, আমি সেসব জানি, কিন্তু তুমি অর্জুন, অর্থাৎ অজ্ঞান  তুমি সেসব জান  না।

অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ যে কোনো কালে, যে কোনো দেশে, যে কোনো পরিস্থিতিতে, যে কোনো অবস্থায়, এমনকি যেকোনো বস্তুতে নিত্য ও অনিত্য দুটোই বর্তমান।  ভবিষ্যতে আমাদের এই শরীর বা যেকোনো বস্তু আগের অবস্থায় থাকবে না। আবার এখন যে অবয়ব আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা ঠিক এই অবস্থায় আমাদের দৃষ্টিগোচর হবে না। কিন্তু আমরা অবশ্য়ই থাকবো। নিত্য - অনিত্য সবই থাকবে। এর কোনো অভাব হবে না। আর সত্যি কথা বলতে কি বর্তমান বলে কিছু হয় না। হয় অতীত নয় ভবিষ্যৎ কেবলমাত্র টিকে থাকে।  একটু গভীর ভাবে ভাবলে বুঝতে পারবেন, আমরা যে ভাবি আমরা বর্তমানকালে আছি, তা আসলে তিলেক ধারণা। তিল মাত্র সময় আমাদের এই শরীর বর্তমানে আছে। প্রতিমুহূর্তে এই শরীর বা যা কিছু আমরা দেখছি, সবই পরিবর্তন হয়ে চলছে। এইজন্য শরীরের বাইরে আমার যে পৃথক সত্ত্বা তাকেই আমাদের বর্তমানে অনুভব করা উচিত। অর্থাৎ অতীতে আমি সত্ত্বার (অহং হীন আমি) যেমন অভাব ছিল না, ভবিষ্যতেও আমার নিজ সত্ত্বার কোনো অভাব হবে না, এখনো তার অভাব নেই। এটা আমাদের গভীর ভাবে অনুভব করতে হবে।

জাগ্রত অবস্থায় আমি যেমন আছি, নিদ্রাকালীন স্বপ্ন অবস্থাতেও আমি ছিলাম। আবার নিদ্রা ভাঙার পরেও আমি থাকবো। আসলে আমাদের জ্ঞানের অভাব আমাদের এই ত্রিবিধ অবস্থার মধ্যে পার্থক্য দেখে। আসলে আমি একই থাকি। আমাদের সবার শরীর একটা সময় ছিল না, আবার একটা সময় থাকবে না, এমনকি এই মুহূর্তেও আমাদের শরীর নাশ হবার লক্ষে ধাবিত হচ্ছে। কিন্তু আমি থাকবো।

আসলে খটকা লেগেছে, এইখানে যে বর্তমানে আমি দৃশ্যমান। অর্থাৎ দৃশ্যটি আমাদের মন, বুদ্ধি, এবং ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু একটা কথা শুনুন, আমাদের মন বুদ্ধি, ও ইন্দ্রিয় এগুলোও নিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। দৃশ্য যেমন পরিবর্তন হচ্ছে, মন, বুদ্ধি, ইন্দ্রিয়সকলও পরিবর্তন হচ্ছে। তা আমরা ধরতে পারি না। দ্রষ্টা ও দৃশ্য কোনোটাই স্থায়ী নয়। যতক্ষন দ্রষ্টা ও দৃশ্যের মাঝখানে আধেয় অর্থাৎ প্রকাশক বা আলো না থাকলে দৃশ্যের কোনো অস্তিত্ত্ব থাকবে না। আর দৃশ্যের অস্তিত্ত্ব না থাকলে দ্রষ্টার কোনো অস্তিত্ত্ব থাকে না। শরীর হচ্ছে দৃশ্য আর শরীরী হচ্ছে দ্রষ্টা। মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার এগুলো মাধ্যম মাত্র ।  এরা দৃশ্যের প্রকাশ ঘটায়। তাই দ্রষ্টা দেখে। দৃশ্যের পরিবর্তন হচ্ছে, তার কারন মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকারের পরিবর্তন হচ্ছে অর্থাৎ দৃশ্যের যে প্রকাশ ঘটে তার পরিবর্তন ঘটছে। স্বল্প আলোতে আমরা ভালো দেখতে পাই না। অন্ধকারে আমরা দেখতে পাই না। আবার অতিরিক্ত আলোতেও  আমরা দেখতে পাই না। মধ্যাবস্থায় আমরা দেখতে পাই।

আমাদের শরীর একটা গতিশীল কম্পন মাত্র। এই গতিশীলতা বা পরিবর্তনই আমাদের শিশু থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন, যৌবন থেকে প্রৌঢ়, প্রৌঢ় থেকে বৃদ্ধাবস্থা লাভ করে থাকি। এই স্থূল শরীরের যেমন পরিবর্তন আছে, তেমনি স্থুলদেহ  থেকে আমরা সূক্ষ্মদেহে  প্রবেশ করি। আর এটাকে আমরা বলি দেহান্তর প্রাপ্তি বা মৃত্যু। কিন্তু এটা শুধু একটা পরিবর্তন মাত্র। স্থূল শরীরের যেমন পরিবর্তন আছে, তেমনি আমাদের সূক্ষ্ম শরীরেরও  পরিবর্তন আছে। স্থূল শরীর সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বা ধারণা আছে, কিন্তু সূক্ষ্ম শরীর সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বা ধারণা নেই, তাই এই পরিবর্তন সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতে পারি না। স্থূল শরীরকে আমরা জাগ্রত অবস্থায় ধরতে পারি। সূক্ষ্ম শরীর আমরা স্বপ্নাবস্থায় ধরতে পারি। কারন শরীর আমরা সুষুপ্তির অবস্থায় ধরতে পারি। এই শরীরগুলো থেকে আমরা যখন বেড়িয়ে পড়তে পারি, তখন আমরা তুরীয় অবস্থায় পৌঁছাতে পারি।

আসলে শরীরগুলো পরিবর্তিত হচ্ছে, সরে সরে যাচ্ছে, । আমি কিন্তু স্থির আছি। শরীরকে আশ্রয় করে আমার প্রকাশ হয়েছিল। আবার শরীরের পরিবর্তন বা বিলয়ের  সঙ্গে সঙ্গে আমি অপ্রকাশিত হয়ে যাচ্ছি।  কিন্তু আমি সর্বদা আছি।

এই শরীর সম্পর্কে একটা ধারণা করে নেই। অন্নদ্বারা পরিপুষ্ট শরীর হচ্ছে - অন্নময় শরীর, বায়ু বা প্রাণ দ্বারা পরিপুষ্ট শরীর হচ্ছে প্রাণময় শরীর, আমাদের মানসিক জগৎ হচ্ছে মনোময় শরীর। বিশেষ ধরনের জ্ঞান দ্বারা পরিপুষ্ট হচ্ছে আমাদের বিজ্ঞানময় শরীর। আর যে শরীরে আমাদের আনন্দ অনুভূত হয়, সেটি হচ্ছে আনন্দময় শরীর। এইসব শরীরের বাইরে আছি আমি।

এখন কথা হচ্ছে, এই পূর্বশরীর জ্ঞান আমাদের কেন থাকে না। আমাদের পূর্ব শরীরের বা পূর্বজন্মের জ্ঞান কেন আমাদের থাকে না। দেখুন, আমরা স্থূল শরীরে থাকাকালীন অবস্থাতেও আমাদের সমস্ত স্মৃতি থাকে না। আমরা ৭দিন আগে কি খেয়েছিলাম, সেটাই আমরা মনে রাখতে পারি না। কারন এগুলোকে আমরা গুরুত্ত্ব দিয়ে দেখি নি। অর্থাৎ ধ্যান দেই  নি। আসলে যে জিনিসের প্রতি আমরা ধ্যান না দেই সেটা আমারা  সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যাই। কিন্তু যে ঘটনার প্রতি আমারা  বেশি বেশি ধ্যান দিয়েছিলাম, সেটি আমাদের বেশ মনে আছে। আমার সন্তানের জন্ম, আমার পিতা-মাতার মৃত্যু, এই সব দিনের কথা আমাদের বেশ মনে আছে। এছাড়া আর একটা দিক আছে, প্রাকৃতিক কারণে অর্থাৎ আমাদের শরীরের পঞ্চভূতের অসামঞ্জস্য যখন দেখা দেয়, তখনও আমাদের পূর্বস্মৃতি মনে করতে পারি না। মৃত্যুকালে, আমাদের আত্মীয়স্বজনকে চিনতে পারি না। অত্যধিক কষ্টের সময় আমরা পূর্বস্মৃতি হারিয়ে ফেলি। সংজ্ঞা হারালে  আমাদের কিছুই মনে থাকে না। সাধারণ মানুষের জন্ম মৃত্যু একটা অসহ্য কষ্টের সময়। এই সময় সে সংজ্ঞাহীন হয়ে যায়। এমনকি এক দেহ থেকে যখন আমরা অন্য দেহে স্থানান্তরিত হই তখনও আমরা সংজ্ঞাহীন হয়ে যাই।  তাই আমাদের পূর্বস্মৃতি থাকে না। কিন্তু মহাত্মারা এই অবস্থান্তরের অবস্থাতেও চেতন থাকেন। তাই তাঁরা পূর্ব স্মৃতি মনে রাখতে পারেন। এমনকি সাধারণ মানুষও যদি মৃত্যুতে কষ্ট  না পায়, অথচ অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে মারা যেতে হয়  তবে, তার পূর্বস্মৃতি থাকা সম্ভব। মহাভারতে (অ.প - ১৪৫) মহামুনি ব্যাসদেব বলছেন, যে ব্যক্তি সহসা মারা গিয়ে আবার সহসা কোথাও জন্ম গ্রহণ করেন, তার পুরাতন অভ্যাস বা সংস্কার কিছুকাল বজায় থাকে। তাই সে পূর্বজন্মের জ্ঞান নিয়েই ইহলোকে জন্মান, এবং এঁকেই জাতিস্মর বলে। কিন্তু সে যতো বয়োঃপ্রাপ্ত  হয়, ততই তার স্বপ্নের মতো পুরোনো স্মৃতি নষ্ট হতে থাকে।
তো সবশেষে বলি আমাদের কিছুই হারায় না, কিছুই বিনাশ প্রাপ্ত হয় না, অনিত্যের অবস্থান্তর ঘটে মাত্র।  আর  নিত্য অবিকার থাকে।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম। । 


No comments:

Post a Comment