মৃত্যুকে মানুষ কেন ভয় পায় ? আপনি কিভাবে মৃত্যুভয় থেকে দূরে থাকবেন?
মৃত্যুকে মানুষ কেন এত ভয় পায় ? শুধু মানুষ কেন সমস্ত জীব মৃত্যুকে ভয় পায়। যারা পরলোকে বিশ্বাস করে, তাদের ব্যাপারটা তবু কিছুটা হলেও অনুমান করা যায়। কারন তারা ভাবে, মৃত্যুর পরে সে স্বর্গে না নরকে যাবে, তা সে জানে না। এই আস্তিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার মনে করে, তাকে নরক অবশ্য়ই ভোগ করতে হবে। যুধিষ্ঠিরের মতো সাক্ষাৎ ধর্মপুত্রের যদি নরক দর্শন অবশ্যম্ভাবী হয়, তবে আমাদের তো কথাই নেই।এতো গেলো এসিডের কথা। কিন্তু নাস্তিকেরা তো বিশ্বাস করে, মৃত্যুর পরে আর কিছু থাকে না। তবে তাদের এত মৃত্যুভয় হয় কেন ? তাই আস্তিক-নাস্তিক সবারই মৃত্যু ভয় আছে । কিন্তু কেন ?
আসলে মৃত্যুর পরে আমাদের কি হবে, তা আমরা কেউ জানি না। আমরা সবাই অনিশ্চয়তাকে ভয় পাই। জীবনে যে নিশ্চিত নিরাপত্তা আমরা বহুকষ্টে গড়ে নিয়েছি, সেটা হারাতে আমরা ভয় পাই। দীর্ঘকাল ধরে আমরা একটা নির্ভরতার ভীত গড়ে তুলেছি। সেখানে আমরা নিরাপত্তা পাই, বা নিরাপত্তা দেই। আমরা একে অপরের উপরে নির্ভরশীল হয়ে আছি । এই নির্ভরতার অভ্যাস আমাদের জীবনে একটা ছন্দ এনেছে। পাছে মরন আমাদের এই জীবনের ছন্দকে ছিনিয়ে নেয়, এটা ভেবেই আমাদের ভয় হয়।
সত্যি কথা বলতে কি এই নির্ভরতা আমাদের আসক্তির জন্ম দিয়েছে। আমরা আমাদের স্ত্রী ছেলে-মেয়েদের প্রতি, আত্মীয়স্বজনদের প্রতি আসক্ত। এমনকি আমার বাড়ি, গাড়ি, বিষয় সম্পত্তির প্রতি আমরা সবাই আসক্ত। একটা ছন্দময় জীবনে আমরা আবদ্ধ। আর বিশেষ ছন্দের এই জীবন, আমাদের মৃত্যু এসে কেড়ে নেবে, এই আশঙ্কায় আমাদের মনে ভয়ের উদ্রেগ হয় । আমরা সবাই নিরাপদে থাকতে চাই। আর এই প্রত্যাশা থেকে আমাদের আমাদের চারিদিকে একটা কাল্পনিক নিরাপত্তার বলয় তৈরি করে নিয়েছি আমরা । আর সত্য যেটা তা হচ্ছে,, স্থায়ী নিরাপত্তা বলে কিছু হয় না।
ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কারনে আমাদের ভয়ের উদ্রেগ হয়। আর ভয় থেকে হয় আমাদের দুশ্চিন্তা। আমরা কেন ভয় পাই ? ভয় আসলে আমাদের বিশেষ মানসিক অবস্থা বা অনুভূতি। আমরা সবাই সব সময় ভয়ে ভয়ে আছি। আমাদের মরে ভয়, আমাদের লোকলজ্জ্বার ভয়, শরীর খারাপের ভয়, রাজরোষের ভয়, সম্মানহানির ভয় - সারাক্ষণই আমাদের কোনো না কোনো ভয় তাড়া করে নিয়ে বেড়াচ্ছে। আর এই ভয় থেকে বাঁচার জন্য আমরা একটা কৃত্তিম নিরাপত্তার কাল্পনিক বেড়া দিয়ে রেখেছি। রোগের ভয় থেকে বাঁচার জন্য আমরা মেডিক্লাইম করে রেখেছি। ঔষধ খাচ্ছি, ব্যায়াম করছি। অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য আমি ব্যাংকে টাকা জমাচ্ছি, জীবনবীমায় টাকা জমাচ্ছি। কিন্তু এগুলোর কোনোটিই চিরস্থায়ী নিরাপত্তা দিতে পারে না। যতই মেডিক্লেম করুন, এমনকি প্রতিনিয়ত ডাক্তারকে দিয়ে শরীরকে চেক-আপ করুন, প্রকৃতির নিয়মেই আপনার শরীর খারাপ হবে, আপনি বৃদ্ধ হবেন। এমনকি একদিন আপনি মারা যাবেন। ব্যাঙ্কের টাকা আপনাকে বস্তূ বা মানুষের সেবা এনে দিতে পারে, কিন্তু আপনাকে কখনোই নিরাপত্তা দিতে পারে না।
ভয় আমাদের বর্তমান কালের ঘটনা। আর অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এর কারন লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের গর্ভে। আমরা ভবিষ্যতের জন্য বর্তমানকে বিসর্জন দিচ্ছি। ভবিষ্যতে কি হবে এটা যদি আমরা আগে থেকে জানতে পারি, তবে আমি তার জন্য নিজেকে সঠিক ভাবে প্রস্তুত করতে পারি। কিন্তু আমরা যা করে থাকি সেটা হচ্ছে আমরা আমাদের কাল্পনিক ভবিষ্যতের বিপদের আশঙ্কায়, বর্তমানের সুখকে বিসর্জন দিচ্ছি।
যদি আমি একটু স্থির হয়ে চিন্তা করি, কেন আমি নিরাপত্তার জন্য বিশেষ বিশেষ ব্যবস্থার কথা ভাবছি। কেন আমি বিশেষ বিশেষ মানুষের উপরে নির্ভর করছি, কেন আমি বিশেষ বস্তু বা ব্যবস্থার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছি, তাহলে আমরা বুঝতে পারবো, আমরা কতকগুলো কাল্পনিক ব্যাপারকে বাস্তব বলে ভাবছি। এমনকি কিঁছু অপরিবর্তিনীয় সত্যকে আমি মেনে নেবার পরিবর্তে আমরা তাকে পরিবর্তন করতে চাইছি। তাকে থামিয়ে দিতে চাইছি।
ভয় আমাদের মনের অনুভূতি। আর এটি আসে অজানা থেকে। আপনি যখনি ভয় পাচ্ছেন, তখনি আপনি ভয়ের করণগুলোর দিকে নজর দিন। যে চিন্তাস্রোত আপনাকে ভয় পাওয়াচ্ছে, আপনি তক্ষুনি সেই চিন্তাস্রোতকে দাবিয়ে রাখবার জন্য, আপনার ভিতরে অন্য চিন্তা স্রোত তুলুন। তখন দেখবেন, আপনি ভয় থেকে মুক্ত হয়ে গেছেন। নিজের কর্তব্য করুন। কিন্তু ভবিষ্যকে অন্ধকারময় বা আলোকময়, সুখের বা দুঃখের কোনোটাই কল্পনা করতে যাবেন না। ভবিষ্যৎকে তার মতো করেই আসতে দিন। আপনার কল্পনার মোড়কে তাকে বাঁধবেন না। তাহলেই আপনার মোহভঙ্গ হবে।
মৃত্যু আমাদের সবার আসবে। তা সেই মৃত্যু ভালো হলেও আসবে, খারাপ হলেও আসবে। যা আপনি স্থগিত করতে পারবেনা না, তাকে তার নিজস্ব সময়, নিজস্ব রূপে আসতে দিন। আর আপনার কাজ হচ্ছে তাকে স্বাগত জানানো। আর আপনি যখন নিশ্চিত যে মৃত্যু একদিন আপনার ঘরে আসবেই, তখন সম্ভব হলে মৃত্যুর রূপ সম্পর্কে আগে থেকে জানবার চেষ্টা করুন।
বহু মহাপুরুষ মৃত্যুকে স্বাগত জানিয়ে থাকেন। কারন তিনি জানেন, তার লক্ষ পূরণের জন্য, বা সংকল্প পূরণের জন্য, এই দেহ আর কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারবে না। বা তার এই জীবনে যে লক্ষ ছিল, সেটা লক্ষ পূরণ হয়ে গেছে, এখন আর এই লক্ষপূরণের যন্ত্রকে অর্থাৎ শরীরকে আর দরকার নেই, তখন তাকে ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন, অনন্ত যাত্রায়। জীবন তো একটা যাত্রা। মৃত্যু সেই যাত্রাপথের একটা বাঁক মাত্র। আমাদের এই অনন্ত যাত্রায় শরীর একটা অতিথি শালা। এখানে আমরা কিছুক্ষনের জন্য, কয়েক মুহূর্তের জন্য অবস্থান করেছিলাম। এখন সকাল হয়েছে, সূর্য উঠেছে, আবার পথে পা বাড়াতে হবে।
ধর্মকথা আসলে ব্যথা নিবারক । ডাক্তারবাবু, আমাকে ঘুমের ঔষধ দেন। এগুলো সবই সাময়িক। এর অ্যাকশন চলে গেলে আবার আমাদের কষ্ট শুরু হয়। সমস্যার মুখোমুখি হওয়া, মায়াকে চিনতে পারা - সেটাই আসল। আর এগুলোকে যখনি আপনি চিনতে পারবেন, তখন দেখবেন আপনার সব ভয় দূর হয়ে গেছে। অর্থাৎ আপনার সত্যিকারের জ্ঞান আপনাকে নির্ভয় করবে।
এখন কথা হচ্ছে মৃত্যুকে কারা ভয় পায় না ? বা আপনি কিভাবে মৃত্যুভয় থেকে দূরে থাকবেন। প্রথমতঃ এখন যেখানে আছেন, সেখান থেকে যদি লক্ষপূরণের জন্য, অন্যত্র যেতে হয়, তখন আপনি কি করেন ? অর্থাৎ আপনি ধরুন উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বা চাকরি করবার জন্য বিদেশে যাবেন। তখন আপনি কি করেন, যেখানে যাবেন, সেখানকার সম্পর্কে আপনি একটা জ্ঞান লাভ করার চেষ্টা করেন। সেখানকার সম্পর্কে যিনি জানেন তার কাছ থেকে শুনে নেবেন, সেখানকার জলবায়ূ, সেখানকার থাকবার ব্যবস্থা, যাতায়াত ব্যবস্থা ইত্যাদি ইত্যাদি । তো তাহলে আপনার ভয় থাকবে না। আবার একটা মেয়ে য্খন তার শ্বশুর বাড়ি যায়, তখন কি তার ভয় হয় ? না, তার কারন সে ছোটবেলা থেকে শুনে আসছে, তাকে একসময় শ্বশুরবাড়ী যেতেই হবে। ভালোমন্দ যাই হোক না কেন, সেটাই তার আসল বাসা।
আসলে আপনাকে মানসিক দিক থেকে প্রস্তুত হতে হবে, যেমন বিয়ের আগে মেয়েরা করে থাকে এবং মহৎ আদর্শকে বা লক্ষ্যকে সামনে রাখতে হবে, এগুতে হবে এবং সেই উদ্দেশ্যে আগে থেকে অজানাকে জানতে হবে। তবে আমাদের ভয় দূর হবে। আমাদের মনের গভীরে যেকোনো অলীক কল্পনাই আমাদের ভয়ের কারন। আর নিজের মনকে বিশ্লেষণ করলে, সেই অলীক কল্পনা দূর হবে, আর আমাদের ভয় দূর হবে।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি ওম।
হরে🙏কৃষ্ণ শুভ সকাল সকল ভক্ত বৃন্দ পিতা-মাতা সাধু সজন বন্ধুরা শ্রীচরণে
ReplyDeleteআমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।সকল ভক্তদের অশ্বিনী কুমার ব্রতের শুভেচ্ছা জানাই।