আমরা সবাই শুনেছি, গীতায় অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে বলছেন, হে মধুসূদন তুমি যে যোগের কথা বললে, মনের চঞ্চলতা বশতঃ এই যোগে স্থায়ী হওয়া সম্ভব নয়। হে কৃষ্ণ মন তো চঞ্চল, বলবান, ও লোহার মতো কঠোর। বায়ুকে নিরুদ্ধ করা যেমন দুঃসাধ্য, মনকে আটকে রাখা তেমনি সাধ্যের অতীত। ( ৬/৩৩-৩৪) তো ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাকে বলেছিলেন, অভ্যাস ও বৈরাগ্য দ্বারা মনকে বশে আনা যায়।
এক রাজা একটা বলশালী অশ্ব খরিদ করেছেন। গায়ে হাত পড়লেই চিড়বিড় করে লাফিয়ে ওঠে ঘোড়াটি। বহু বলবান তাকে লাগাম পড়ানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু সবাই ব্যর্থ হলেন। তো এক যুবক এসে বললেন, ঘোড়াকে আগে বশে আনুন, তারপরে লাগাম পড়ান । সবাই বললো, তাই হয় নাকি ? লাগাম না পড়াতে পারলে ঘোড়াকে বশে আনবো কি করে ? তো প্রশ্নটা হচ্ছে, আগে লাগাম পড়ানো, না আগে বশে আনা। তো যুবক ঘোড়াটিকে এক বছর যাবৎ নিজের কাছে নিয়ে নিলেন। তাকে পছন্দমত খাওয়ানো, স্নান করানো, আদর করা, এমনকি তার সাথে যুবক খেলা করতে লাগলো। এখন ঘোড়া ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু মনিব ডাক দিলেই চলে আসে। এইবার যুবক যা বলে, ঘোড়া তাই শোনে। এবার তাকে লাগাম পড়ানো, বা ইচ্ছেমতো পরিচালনা করা, তার পক্ষে সহজ হয়ে গেলো।
আমরা আমাদের মনকে লাগাম পড়াতে চাই। কিন্তু যে আমার বশে নেই, তাকে লাগাম পড়াবো কি করে ? তো আমার মন কি চায়, কি সে ভালোবাসে, তাই আমরা জানি না। তো তাকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করবো কি করে ?
ধরুন আপনি ধ্যান করতে চান। কিন্তু ধ্যান-তো মনের সাহায্যেই করতে হবে। মনতো আপনাকে জিজ্ঞেস করবেই, কেন ধ্যান করবো। আপনি বললেন, ভগবান লাভ করবার জন্য। এখন এই ভগবান সম্পর্কে কিন্তু মনের কোনো ধারণা নেই। কারন সে আগে কখনো ভগবানের কথা শোনেই নি। ভগবানকে দেখেও নি। অর্থাৎ ইন্দ্রিয় লব্ধ যে জ্ঞান আমাদের মনের মধ্যে বাসা বেঁধে আছে, তার মধ্যে ভগবানের কোনো দেখা নেই। তাই এ এব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাবে না। তার জন্য আপনাকে কি করতে হবে ? আপনাকে ভগবান সম্পর্কে শুনতে হবে, এসম্পর্কে পড়াশুনা করতে হবে। তো এতে করে, আপনার মনে ভগবান সম্পর্কে একটা ধারণা গড়ে উঠবে। এবং এটি তখন আপনার কল্পনার স্তরে থাকবে। কারন এতো তার প্রতক্ষ্য জ্ঞান নয়, এটি একটি একপেশে ধারণা মাত্র। এমনকি এই ধারণাও এক এক জনের ক্ষেত্রে এক এক রকম হবে। কারন, আপনার পড়াশুনা বেশি, বুদ্ধি বেশি আপনার ধারণা হবে উচ্চস্তরের। আর আমার পড়াশুনা কম আমার বুদ্ধিও কম, আমার ধারণা হবে নিম্ন মানের। কিন্তু সত্য হচ্ছে, ভগবানের একটাই মান। এর কোনো উচ্চমান বা নিম্নমান হয় না। আর এগুলো কোনো কল্পনা প্রসূত জ্ঞান নয়, এটি বাস্তব সত্য। আপনার শিক্ষা আপনার সংস্কৃতি, আপনি যে পরিবারে জন্মেছেন, সেই পরিবারের ঐতিহ্য, আপনার ব্যক্তিগত রুচি, ইত্যাদির উপর নির্ভর করে, আপনার মনে একটা ভগবান সম্পর্কে প্রতিচ্ছবি তৈরি হবে। আর এই প্রতিচ্ছবিটা সত্য নাও হতে পারে। আপনার বোঝাটা ভুলও হতে পারে। এইখানে একটা কথা খেয়াল করুন, আমি যখন শিশু ছিলাম, তখন ঈশ্বর সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা মনে ছিল না। ধীরে ধীরে, আমার মধ্যে আমার পরিবেশের ছোঁয়ায়, আমার জ্ঞানের ছোঁয়ায়, আমার মধ্যে একটা ধারণা জন্মেছে। আর এই ধারণা নিয়ে যদি আপনি ভগবানকে খুঁজতে যান, তবে রজ্জুতে সর্প ভ্রম হবে। এইজন্য আগে আমাদের সঞ্চিত জ্ঞান অর্থাৎ আমাদের সংস্কার সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করতে হবে। ভগবান সম্পর্কে আমাদের ধারণা, আর ভগবানের প্রকৃত সত্ত্বা এক নাও হতে পারে। তারকেশ্বরের স্বয়ম্ভূ শিবলিঙ্গের কাছে গেছেন কখনো ? ওখানে গেলে দেখবেন, খালি গায় যেতে হয়। আসলে ইটা একটা প্রতীক। সত্য হচ্ছে, ভগবানের কাছে যেতে হলে আমার সঞ্চিত জ্ঞান ব্যাড দিয়ে যেতে হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন, সবধর্ম পরিত্যাগ করে, আমার স্বরনে এসো। অর্থাৎ এতদিন, ধর্ম বলতে যা তুমি বুঝেছো, অর্থাৎ কুলধর্ম, আচার বিচার সব ত্যাগ করে তবে তুমি আমার কাছে আসতে পারবে।
আমার চেতন মন বুদ্ধির সাহায্যে যে ভগবানকে চাইছে, সেটা আমাদের ধারণা মাত্র। আর অবচেতন মন সত্যকে খুঁজছে, সেটা তার সংস্কার মাত্র । মনের এইযে দুটো ঢেউ, এই দুটোকেই শান্ত করতে হবে।
এই দুটো মনকে শান্ত করতে পাড়লে আমরা মনের তৃতীয় স্তরে পৌঁছতে পারবো। আর সেটা হচ্ছে অতিচেতন মন। এটি আমাদের সজ্ঞার স্থান। এখানেই সত্য দৃষ্ট হয়।
এখন কথা হচ্ছে, চেতন ও অবচেতন মনকে শান্ত কি ভাবে করতে পারবো। আমরা আগেই জেনেছি, মন হচ্ছে আমাদের চেতনকেন্দ্রের স্ফূরণ মাত্র। জ্ঞান আমরা দুই ভাবে গ্রহণ করতে পারি, এক - ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে জ্ঞাত অনুভবের সাহায্যে, আর একটা হচ্ছে, ইন্দ্রিয়াতীত অনুভূতি। যেটা আমাদের সজ্ঞা কেন্দ্রের কাজ। মাস্টারের কথা ছাত্র বুঝতে পারছে না - এটা মাস্টার মহাশয় বুঝতে পারে। আমি আপনার কথা ভাবলে, আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, আপনার মধ্যে আমার ভাবনা ফুটে উঠবে।
এটা আমাদের ইন্দ্রিয়াতীত সম্পর্ক স্থাপন। এই অভিজ্ঞতা আমাদের সবার কম বেশি হয়ে থাকবে।
এখন কথা হচ্ছে, মনকে শান্ত করবার উপায় কি ? মনকে শান্ত করবার উপায় সম্পর্কে অনেক মহাত্মা অনেক প্রক্রিয়ার কথা বলেছেন, সবগুলোর মধ্যে একটা জিনিস দেখতে পাবেন, আর তা হচ্ছে - শরীরকে স্থির করা, নিশ্বাস-প্রশ্বাস কে ধীর করা।
কিন্তু আমরা বলি, সবকিছু করুন, কিন্তু শুধু ভাবুন, আমি কিছুই করছি না। যার কাজ সেই করছেন। আমার শরীর সেই কাজে সাথ দিচ্ছে মাত্র। আমি কিছুই করছি না। আর প্রত্যক্ষ করুন, আপনার শরীর মন শান্তই আছে। কেননা আপনি তো কিছুই করছেন না।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি ওম।
মনকে বুঝুন :
মাথাটাকে বাদ না দিলে মনটাকে ধরা যাবে না। মাথাটাই যত নষ্টের গোড়া। আমি একবার এক আশ্রমে গিয়ে দেখি, সমস্ত সাধক মাথাকে কাপড়ের টুপি দিয়ে ঢেকে বসে আছে, এমনকি চোখ কান ঢাকা । আচার্য্যের কেবলমাত্র চোখ-কান খোলা।মাথাটা ঢাকা। তো আমি আচার্য্যকে জিজ্ঞেস করলাম। মাথায় টুপি পড়া অনেক সাধু মহাত্মাদের দেখি। কিন্তু আপনি তো দেখছি মুণ্ডুটাকেই ঢেকে দিয়েছেন,এর অর্থ কি ? তো তিনি একটা সত্য উদ্ভাসিত করলেন, আমার সামনে। বললেন, দেখুন মাথাটাই আসলে ঈশ্বর থেকে আমাদেরকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। মানুষে মানুষে বিভেদের সৃষ্টি করেছে। মাথা দিয়ে বৈজ্ঞনিক তৈরি হয়। মাথা দিয়ে পণ্ডিত হয়। মাথা দিয়ে ঈশ্বরের ভক্ত হওয়া যায় না। মাথা দিয়ে অখন্ডকে বোঝা যায় না। মাথা বিভেদের সৃষ্টি করে। বৈজ্ঞানিক, পদার্থকে টুকরো টুকরো করে, পরীক্ষা করে, সে,উৎসে যেতে চায়। পন্ডিতেরা বিচারের মাধ্যমে ঈশ্বরের খোঁজ করে। বিচারের মাধ্যমে ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে না। ঈশ্বর অখন্ড তাকে খণ্ডিত করা যায় না। ঈশ্বর বিচারের উর্দ্ধে। আমরা বুদ্ধির মাধ্যমে যুক্তির মাধ্যমে ঈশ্বরের খোঁজ করি। অর্থাৎ ঈশ্বরকে খন্ড খন্ড করে বুঝতে চাই। যা একেবারেই সম্ভব নয়। ঈশ্বরকে পেতে গেলে আমাদের মনকে বুঝতে হবে, মনকে মাথা থেকে হৃদয়ে নাবিয়ে নিয়ে আসতে হবে। অশান্ত মনকে শান্ত করতে হবে। ভালোবাসা দিয়ে মনকে বুঝতে হবে। মন যতক্ষন মাথাতে থাকবে, ততক্ষন মন যুক্তির সাহায্য, বুদ্ধির সাহায্যে চলতে চাইবে। সেখান থেকে মনকে হৃদয়ের অনুভূতিতে নাবিয়ে আনতে হবে।
আমরা শারীরিক অস্বস্তি বা অসুখ বোধ করি কখন ? আমাদের শরীরের কোনো অঙ্গ বা তন্ত্র যখন ঠিক ঠিক মতো কাজ করে না। অর্থাৎ শরীরের তন্ত্রগুলোর মধ্যে সঙ্গতির অভাব। তেমনি মন চারটি স্তরে কাজ করে। চেতন - বা জাগ্রত অবস্থা, অবচেতন বা স্বপ্নাবস্থা, অতিচেতন বা তুরীয় অবস্থা, আর স্থির অবস্থা বা সুসুপ্তির অবস্থা। তবে আমাদের মত সাধারণ মানুষের মন দুটো স্তরে কাজ করে। একটা চেতন আর একটা অবচেতন। আগে এই দুটো মনকে আমরা একটু ভালোভাবে বুঝবার চেষ্টা করি আজ।
আমি তখন দুর্গাপুরে অফিস করি। সপ্তাহান্তে বাড়িতে আসি। সোমবার ভোরে, ৪-৩৫-এর ট্রেন ধরি। তো সকালে সময়মতো উঠবার জন্য, ফোনে অ্যালার্ম দিয়ে রাখতাম। ফোনের রিং বেজে উঠলেই, আমার মনের মধ্যে একটা আতঙ্ক হতো। ভাবতাম আবার অফিস যেতে হবে ? একটু পরে উঠি, বা ভাবতাম আজ আর অফিস যেয়ে কাজ নেই। আমার এই যে ভাবনা এটি আসলে অবচেতন মনের ভাবনা। তখন চেতন মন বলতো, না আজ সোমবার, অফিসে ভিড় হবে। আমি না গেলে, অন্যদের কষ্ট হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি। .. . তো দেখুন এক মন বলছে, শুয়ে থাকো, আর এক মন বলছে, উঠে পরতে । এর পরে যখন চেতন মনের তাগিদে, ঘুম থেকে উঠলাম, তখন একটা বিরক্তির ভাব। এবার দেখুন, ছুটির দিনে, সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে প্রাণায়াম-ধ্যান করতে ঠাকুর ঘরে চলে গেলাম। সেদিনও ভোর চারটেতে উঠলাম। কিন্তু কোনো বিরক্তি নেই। আজ ছুটির দিন। ছুটির দিনে আমাদের চেতন মনে ও অবচেতন মনে একই ধরনের বৃত্তি জেগে ওঠে, তাই চেতন মন আর অবচেতন মন এক সঙ্গে কাজ করে, কিন্তু অফিসের দিন, আমাদের চেতন মন যা বলে অবচেতন মন সে কথা শুনতে চায় না। দুটো মনে, বা বলা যেতে পারে মনের দুটো স্তরে দুই রকম চিন্তা চলছে। বা দুই রকম চাহিদা।
ধ্যান-জপের প্রথম দিকে মন কিছুতেই শান্ত হতে চায় না। আর আমরা দুটো মনের লড়াইয়ে ক্লান্ত হয়ে যাই। চেতন মন যখন ধ্যান-জপ করতে চায়, অবচেতন মন তখন তার সুপ্ত সংস্কার নিয়ে বেরিয়ে আসে। আর আমাদের ধ্যান-জপ থেকে বিরত রাখতে চায়। এইভাবে চেতন মন আর অবচেতন মন দ্বন্দে লিপ্ত হলে আমাদের মধ্যে চঞ্চলতা সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ মনের ভারসাম্য নষ্ট হয়।
এই জন্য উপনিষদ বলছে, ভিদ্যতে হৃদয় গ্রন্থিঃ ছিদ্যন্তে সর্ব সংশয়াঃ। হৃদয় গ্রন্থি ছিন্ন হলে সমস্ত সংশয় দূর হয়। মুণ্ডক উপনিষদ বলছে, ঋষিরা অর্থাৎ যারা আত্মাকে জেনেছেন, তাঁরা আসক্তিশূন্য হন, তাদের মন তখন ধীর, স্থির, শান্ত হয়ে যায়। তাঁর মনে না আছে, কোনো উদ্বেগ, না আছে বিরোধ। তাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়, সংযত। বালসুলভ প্রফুল্লতা ও আনন্দে ভরপুর থাকেন। এদেরকে বুদ্ধি দিয়ে বিচার করা যায় না।
আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তারা সব সময় বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হতে পারি না। অনেক সময় আমরা আবেগ দ্বারা পরিচালিত হই। অর্থাৎ আমাদের সচেতন মনের চেয়ে অবচেতন মন আমাদের তখন শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আর অবচেতন মন পরিচালিত হয় আমাদের সংস্কার দ্বারা। এইজন্য আমাদের দরকার আমাদের অবচেতন মনে কি আছে, অর্থাৎ আমাদের সংস্কারগুলো কে, ও কেমন সেটা বোঝা ও জানা। এবং এই অবচেতন মনের সংস্কারগুলোকে যদি আমরা ধরতে পারি, তবে, চেতন মন বার বার অভ্যাসের দ্বারা নতুন বোধ পাঠাতে পারে অবচেতন মনে। অর্থাৎ আমাদের যদি কিছু খারাপ সংস্কার থেকে থাকে, তবে তাকে প্রথমে চাপা, তারপরে, উৎপাটন করে দিতে পারি। এইজন্য আমাদের ধ্যান যত গভীর হবে, আমরা আমাদের অবচেতন মনকে তত বেশিকরে বুঝতে পারবো, এবং অবচেতন মনের বৃত্তিগুলোকে সংশোধন করতে পারবো।
প্রত্যেক মানুষের মনের একটা জগৎ আছে। সাধারণের মানুষের জগতের কেন্দ্র হচ্ছে, তার বিষয়াশয়, পরিবার-পরিজন আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব, কর্মক্ষেত্র ইত্যাদি। এগুলো নিয়েই সে অবিরত চিন্তা করছে। আর এই অনিত্য বস্তূতে যে পরিবর্তন হচ্ছে, সেই পরিবর্তনগুলো তাকে ভাবাচ্ছে। অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রের অবস্থা, ছেলেমেয়ের চিন্তা, বাড়িঘরের চিন্তা, টাকাপয়সার চিন্তা এগুলোকে নিয়েই সে ঘুরপাক খাচ্ছে। এবং একটা থেকে আর একটায় তার চিন্তা সরে সরে যাচ্ছে। এখানেই সে সুখ-দুঃখ অনুভব করছে, কখনো সে অসহায় হচ্ছে, কখন তার রাগ হচ্ছে, কখনো তার হিংসা হচ্ছে। এগুলোর উপরে তার মোহ জন্মাচ্ছে। এবং এইভাবেই সে তার মনের সমতা নষ্ট করছে।
খেয়াল করে দেখবেন, ধ্যানের সময় যতক্ষন আমাদের মন শান্ত না হচ্ছে, অর্থাৎ চেতন ও অবচেতন মন একই দিকে ধাবিত না হচ্ছে, ততক্ষন আমাদের মনে নানান চিন্তা ভেসে উঠছে। তাই এই দুটো মনকে একজায়গায় আনবার জন্য, ধ্যানীরা একাধিক কাজ এক সময় করে থাকেন। অর্থাৎ জপ করবেন, আবার জপের সংখ্যা গুনে রাখবেন । এতে করে দুটো মন ক্রিয়াশীল থাকায়, মনের দ্বন্দ্ব দূর হয়ে যাবে। অর্থাৎ মন এবার মাথা থেকে হৃদয়ে চলে আসবে। বুদ্ধি থেকে পরিশীলিত সংস্কারে নেবে আসবে।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি ওম।
ধ্যানের উদ্দেশ্য - সত্যকে ধরা।
ধ্যান আমাদের বন্ধন মুক্তির পথ। আর এই বন্ধন আবার আমাদের স্বকীয়। কম্বলের লোভে আমি নদীতে ঝাঁপ দেই। আসলে যে ওটা ভাল্লুক তাতো আমি জানিও না, ভাবিওনি, এখন আমাদের যখন বন্ধন ছাড়ানোর ইচ্ছে জাগ্রত হয়, তখন দেখি আমি ছাড়লেও কম্বল আমাকে ছাড়ছে না। কম্বল কল্পনা হলেও, বন্ধন আমাদের বাস্তব হয়ে যায়। তাই অবচেতন মনের সংস্কারগুলোকে যতক্ষন আমি না ধরতে পারবো, ততক্ষন আমি সত্যের কাছাকাছি যেতে পারবো না। মিথ্যাকে মিথ্যা বলেই বুঝতে হবে। ভাল্লুককে যেন আমরা কম্বল না ভাবি। ভাল্লুককে আমাদের ভাল্লুক বলেই চিনতে হবে। অর্থাৎ অবচেতন মনের সংস্কারগুলোকে ঠিক ঠিক ভাবে বুঝতে হবে। তার সংস্কার করতে হবে, সংশোধন করতে হবে, তবেই আমরা আমাদের চেতন মনের উদ্দেশ্য অনুযায়ী অবচেতন মনকে পরিচালিত করতে পারবো।
আমাদের মন অশান্ত বলেই আমরা কষ্ট পাই। আবার আমরা কষ্ট পাই বলেই আমাদের মন অশান্ত হয়। দেখুন, আমাদের ইচ্ছে অনুযায়ী জগৎ চলবে না। জগতের ইচ্ছে অনুযায়ী আমাদের চলতে হবে। কিন্তু আমরা করি উল্টো। অর্থাৎ আমি যা চাই তাই জগতের কাছ থেকে পেতে চাই। আর এটা হয় না বলেই, আমাদের দুশ্চিন্তা হয়। আর দুশ্চিন্তা থেকে আমাদের ভয়, আর ভয় থেকে দুঃখ পাই আমরা। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে আমাদের অতৃপ্তি আমাদের কষ্টের কারন। আর এই অতৃপ্তি আমাদের চিরকাল খেপা কুত্তার মতো তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে। অথবা বলা যেতে পারে, আমরা মরীচিকার পিছনে ছুটছি। কিন্তু কেন এই অতৃপ্তি ?
সন্তোষ যখন কর্মসূত্রে বাড়ির বাইরে আসে , তখন সে মেসে থাকতো । একটা ঘরে ৪/৬ জন থাকতো । বছর কয়েক পরে, একটাঘর ভাড়া নিলো, টালির ছাউনি। বর্ষাকালে চাল দিয়ে জল পড়তো। কিন্তু একটা ঘরে একাই থাকতো । বছর খানেক পরে একটা প্লাস্টারবিহীন পাকা বাড়ি ভাড়া নিলো । এর পরে একসময় নিজেই বাড়ি কিনলো। কিন্তু এসবেস্টস-এর ছাদ। দুটো ঘর। কিন্তু তখন সে দুজন হয়ে গেছে । এর পরে বাড়ির ছাদ হলো, ঘর দুটো থেকে তিনটে হলো। ওরাও দুজন থেকে তিন জন হলো । এর পরে, বাড়ি দোতলা হয়েছে। ছটা ঘর হয়েছে। নিউটাউনে একটা আলাদা দু-কামরার ফ্লাট কিনেছে। মানুষ কিন্তু তিন থেকে, দুই হয়ে গেছে, কারন ছেলে কর্মসূত্রে বাড়ির বাইরে চলে গেছে। সন্তোষ এখন চাইছে,বোম্বেতে একটা ফ্লাট কিনতে, কারন ছেলে সেখানে ভাড়া বাড়িতে থাকে।
মানুষ সাফল্য চাইছে, সন্মান চাইছে, টাকা চাইছে, বাড়ি-গাড়ি চাইছে। বড় হতে চাইছে। কিন্তু কখনো কি ভেবেছেন, মানুষ এগুলো কেন চাইছে ? না আমি বলছিনা যে এই চাওয়াটা খারাপ, উচ্চাকাঙ্খা না থাকলে মানুষ বড়ো হতে পারে না। আসলে মানুষ পূর্ন হতে চায়। এবং সেটাই তার স্বভাব। কিন্তু এই পূর্নতা কিসে হবে, তা সে জানে না। তাই সবকিছুর মধ্যে আমিত্ত্বের প্রবেশ করাচ্ছে। আমার বাড়ি, আমার গাড়ি, আমার স্ত্রী, আমার ছেলে, আমার মেয়ে। আমাকে নিয়ে একটা জগৎ তৈরি করতে চাইছে। অপূর্ন থেকে সে পূর্ন হতে চায়। কিন্তু যার মধ্যে সে আমিত্ত্বের প্রবেশ করাচ্ছে, সেটাকে সে কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে যাচ্ছে। তাই আবার হাহা-কার উঠছে তার মনে। হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোনো খানে। তাই আবার সে পূর্ণতার খোঁজে বেরিয়ে পড়ছে। তাই সর্ব্বক্ষন সে অতৃপ্ত। আমার কল্পনার বস্তুতে আমি তৃপ্তি খুঁজছি। আমি ভাবছি, আমি এম.এ পাশ করলে সুখী হবো। চাকরি পেলে আমি সুখী হবো। একটা বাড়ি হলে আমি সুখী হবো। একটা গাড়ি পেলে আমি সুখী হবো। একটা ছেলে হলে আমি সুখী হবো। ধর্মশাস্ত্র মুখস্ত করলে আমি সুখী হবো। এগুলো সবই আমার কল্পনা। বর্তমানে দাঁড়িয়ে আমি ভবিষ্যতের জন্য সুখী মনকে অভিক্ষেপন করছি। অর্থাৎ বর্তমানে আমি সুখী নোই। কল্পনাকে আশ্রয় করে, আমার মনকে ভবিষ্যতের পথে যাত্রা করিয়ে দিচ্ছি, সুখী-গৃহ খুঁজবার পথে এগিয়ে দিচ্ছি। আসলে ভবিষ্যতের মধ্যে নিজেকে প্রস্থাপন করে, সুখের স্বপ্ন দেখছি।
ধ্যানে, আমরা মনের এইযে প্রজেকশন বা অভিক্ষেপন সেটা আমরা ধরতে পারি। এইজন্যই ধ্যানের প্রয়োজন। অর্থাৎ আমার অবচেতন মনের যে সংস্কার তাকে আমরা ভালোভাবে ধরতে পারি। এবং সেই অনুযায়ী চেতন মনের সাহায্যে সেই সংস্কার গুলোকে সংশোধন করতে পারি। অতীত জ্ঞান বা স্মৃতি আমাদের ধারণা তৈরি করে। ধারণা আবার কল্পনা সৃষ্টি করে, নতুন জ্ঞানের আহরণের জন্য।
তাই বলে ভাববেন না যে আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভাবা উচিত নয়। নিশ্চই আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভাবা উচিত। যে কোনো কাজ করতে গেলে আপনার যেমন পূর্বস্মৃতি সহায়ক হয়ে কাজ করে, তেমনি, আজকের অভিজ্ঞতা আপনার ভবিষ্যতের রূপরেখা তৈরি করতে পারে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা যেন আমাদের বাসনায় পরিণত না হয়। অর্থাৎ ভবিষ্যতের পরিকল্পনা আর ভবিষ্যতের সুখপ্রাপ্তির কল্পনা এক নয়। তাই ভবিষ্যতের সুখপ্রাপ্তির কল্পনা আমাদের ত্যাগ করতে হবে। স্মৃতিকে বা আমাদের পূর্ব-অভিজ্ঞতাকে আমাদের প্রয়োজন অনুসারে কাজে লাগাতে হবে। আমরা কখনোই কল্পনার স্রোতে ভেসে যাবো না। জ্ঞানীরা তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান, আর ভবিষ্যৎকে নিজের মতো চলতে সাহায্য করেন, এবং তার যথাযথতা সঠিক ভাবে ধরবার চেষ্টা করেন। আসলে আপনাকে সত্যকে ধরতে হবে। আপনার প্রজেক্টেড সত্য নয়। প্রতিষ্টিত সত্য। তাহলে আপনার অতৃপ্ততা বলে কিছু থাকবে না। আপনি যখন আপনার চিন্তার স্রোতকে বুদ্ধির সাহায্যে পরিচালিত করতে পারবেন, যখন আপনি ঘটনাকে যুক্তি দিয়ে উপস্থাপন করতে পারবেন, তখন যেকোনো অবাঞ্চিত ঘটনা আপনাকে বিচলিত করতে পারবে না। আপনি যখন আবেগ দ্বারা পরিচালিত হবেন , তখন আপনি অশান্ত হয়ে উঠবেন। আপনার মন বিশৃঙ্খল হবে। আর আপনি যখন বুদ্ধি দ্বারা যুক্তি দ্বারা পরিচালিত হবেন , তখন আপনি সুশৃঙ্খল থাকবেন, শান্ত থাকবেন।
শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি ওম।।
No comments:
Post a Comment