Friday, 25 October 2019

মহাভারতের কথা অমৃত সমান।



মহাভারতের কথা অমৃত সমান। 
যে শোনেনি তার কথা, সে অতি ভাগ্যবান।।

মহাভারতের অনুশাসনিক পর্বের দশম অধ্যায় থেকে একটা গুরুত্ত্বপূর্ন উপদেশ শুনবো । 
ধর্মরাজপুত্র যুধিষ্ঠির গঙ্গাপুত্র ভীষ্মকে জিজ্ঞেস করছেন, হে পিতামহ, হীনজাতিকে সহৃদয় ভাবে, উপদেশ দান করলে শুনেছি দোষের ভাগীদার হয়, এ সম্পর্কে আপনি কিছু বলেন। 

গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম বললেন, হ্যাঁ ঠিকই শুনেছো। শাস্ত্র অনুসারে, হীনজাতিকে উপদেশ প্রদান করলে অপরাধী হতে হয়। এ সম্পর্কে তোমাকে একটা কাহিনী বলি। 

বহুকাল আগে, ব্রহ্মার আশ্রমের কাছে, একটা সুন্দর আশ্রম ছিলো। সেখানে মহা ঋষিগণ নিরন্তর বেদ পাঠ করতেন। একদিন এক পরম দয়াবান শুদ্র সেই আশ্রমে এসে উপস্থিত হলেন। তো সেখানকার মুনিদের অসাধারন তেজঃসম্পন্ন দেখে, তার তপস্যা করতে ইচ্ছে হলো। তো সেই আশ্রমবাসী কুলপতির চরণ ধরে, নিবেদন করলেন - হে ভগবন আমি শুদ্রবংশ সম্ভূত। ধর্মশিক্ষার মানসে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। আপনি যদি প্রসন্ন হয়ে আমাকে সন্যাস ধর্ম দেন, তবে আমি চরিতার্থ হই। আমি সারাজীবন আপনার সেবায় নিয়োজিত থাকবো। 

তখন সেই আশ্রমের কুলপতি বললেন, বৎস শূদ্রজাতির সন্ন্যাস ধর্মে অধিকার নেই। তবু যদি তোমার ধর্ম্মবুদ্ধি জেগে থাকে, তবে এক কাজ করতে পারো - তুমি এখানে আমাদের সেবাযত্নের কাজে লেগে পড়ো, এতেই তোমার উন্নতি হবে। 

তো শূদ্র ভাবলো, এখন কি করা উচিত ? কিছুক্ষন সে ভাবলো। ভেবে ঠিক করলো, স্থানটি বড় মনোরম। সাধন ক্ষেত্র হিসেবে এটি উত্তম বটে। অতএব, সে ওই আশ্রম থেকে একটু দূরে, একটা ছোট্ট পাতার কুটির তৈরি করলো। সেখানে একটা শোবার  জায়গা, একটা বেদি অর্থাৎ ধ্যান আসন পাতার জায়গা, আর একটা দেবস্থান তৈরি করলো।  সেখানে সে নিজেকে কিছু নিয়মের মধ্যে  আবদ্ধ করলো। নিজেকে সংযমী করলো, ফলমূল আহার করতে লাগলো, প্রতিদিন দেবতাদের অর্চ্চনা করতে লাগলো। ফলমূল দ্বারা অতিথিদের সৎকার করতে লাগলো। এইভাবে বহুদিন কেটে গেলো। এখন সে ঋষিসম তেজষ্মী। 

এমনি সময় এক মহর্ষি এলেন তার আশ্রমে। শুদ্রঋষি তাকে সৎকার করলেন। এতে করে ব্রাহ্মণ মহর্ষির খুব ভালো লাগলো। এবং মাঝে মধ্যে তার আশ্রমে আসতে  লাগলো। তার সঙ্গে একটা বন্ধুত্ব হলো। ধর্ম বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা চলতে লাগলো।

তো একসময় শূদ্রঋষি তার পিতার পারলৌকিক কাজ করবার বাসনা হলো । তিনি এই কাজের দায়িত্ব দিতে চাইলেন, ব্রাহ্মণহঋষীকে। কারন ব্রাহ্মণ ছাড়াতো পারলৌকিক কাজ করা যাবে না। ব্রাহ্মনঋষি সেই দায়িত্ব গ্রহণ করলেন,  এবং তার নির্দেশ অনুযায়ী সবকিছু সম্পাদন করা হলো।

এখন কালের নিয়মে, দুইজনই এক সময় স্থুলদেহ ত্যাগ করলেন। এখন, ব্রাহ্মনঋষি পরবর্তী জন্মে পুরাহিতকুলে জন্ম গ্রহণ করলেন। আর শুদ্রঋষি রাজবংশে জন্ম গ্রহণ করলেন। দুজনেরই বয়স বাড়তে লাগলো। দুজনই বিদ্যাশিক্ষা লাভ করতে লাগলেন। ব্রাহ্মণঋষি বেদ, বেদাঙ্গ, জ্যোতিষশাস্ত্র ইত্যাদিতে বিশেষ জ্ঞান লাভ করলেন। আর সেই শুদ্রঋষি যিনি এখন রাজপুত্র তিনি যুদ্ধবিদ্যাতে পারদর্শী হয়ে উঠলেন। কিছুদিন পরে, রাজার মৃত্যু হলে, রাজপুত্র রাজা হলেন।  পুরোহিতকে রাজপুরোহিত নিযুক্ত করলেন। এবং পরমসুখে রাজ্যশাসন করতে লাগলেন। পুরোহিতের পরামর্শকেও যথেষ্ট গুরুত্ত্ব দিতেন। কিন্তু, একটা  বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, পুরোহিতকে দেখলেই রাজা উঁচুস্বরে হাসতেন। এতে পুরোহিত অপমানিত বোধ করতেন। এমনকি তার  রাগ হতে লাগলো।

তো একদিন, রাজাকে নির্জনে পেয়ে, তাকে জিজ্ঞেস করলেন। আপনি একটা সত্য কথা বলবেন, আপনি আমাকে দেখে অহেতুক হাসেন কেন ? আমি এতে অপমানিত বোধ করি। এর কারন কি জানতে পারি ?

নরপতি বললেন, শুনুন, আমি জাতিস্মর। আগের জীবনে যা কিছু ঘটেছিলো, আমি সে সব জানি। আপনি তা জানেন না। আমি আগের জন্মে শূদ্র তপস্বী ছিলাম।  আর তখন আপনি ছিলেন, ব্রাহ্মণ তপস্বী। আমার পিতৃদেবের পারলৌকিক কাজের দায়িত্ব নিয়েছিলেন আপনি। আর সে সময় ভুল বসতঃ ব্রাহ্মণের আসন দক্ষিণ দিকে পশ্চিম শীর্ষ করে স্থাপন করে ছিলাম আমি ।  আপনি তখন সেটিকে সংশোধন  করার জন্য আমাকে আপনি উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, তুমি পূর্বশীর্ষ করে ব্রাহ্মণের আসন পাতো , আর উত্তরাস্য করে তোমার আসন স্থাপন করো।

আপনার সেই কর্মের জন্য আপনি আজ পুরোহিত হয়ে জন্ম গ্রহণ করেছেন, আর আমি রাজা।  কালের কি আশ্চৰ্য্য মহিমা দেখুন।আপনি আমাকে শ্রাদ্ধ কার্য্যে  উপদেশ দিয়েছিলেন বলে, আজ আপনি পুরোহিত। হে দ্বিজবর, আপনি আমার গুরু, শ্রদ্ধার পাত্র।  আপনাকে অবজ্ঞা করে আমি হাসি না।  আমি শুদ্র থেকে  জাতিস্মর, আপনি মুনি হয়েও পুরোহিত হলেন। এতে আমার দুঃখ হয়। আপনি দয়াকরে, এই ধনরাশি গ্রহণ করে, পুন্কাযর্য্যের অনুষ্ঠান করেন। আর উত্তম যোনিতে জন্ম গ্রহণ করবার জন্য যত্নবান  হোন।

এই গল্পটি বলে, গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম বললেন, শোনো, নীচজাতিকে উপদেশ দেওয়া কখনো ব্রাহ্মণের কাজ নয়। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এই তিন বর্নকে ব্রাহ্মণ উপদেশ দিলে কোনো দোষ নেই। কিন্তু শূদ্রকে উপদেশ দেওয়া নিতান্ত অকর্তব্য। ধর্মের গতি নিতান্ত সূক্ষ্ম। এটি অনুধাবন করা শক্ত। অতএব নীচ জাতিকে উপদেশ প্রদান করা কোনোক্রমেই বিধেয় নয়।

ভাগ্যিস শশাঙ্ক শেখর মহাভারতটা পড়ে নি। তাহলে তাকে মৌন থাকতে হতো।

ওম শান্তি, শান্তি, শান্তিঃ।  হরি ওম।   


No comments:

Post a Comment