প্রার্থনা কিভাবে কাজ করে ?
দক্ষিণেশ্বরে রসিকলাল নামে একজন ঝাড়ুদার ছিল। ঠাকুর রামকৃষ্ণের কাছে বহুলোক তাঁর কথা শুনতে আসেন । কিন্তু রসিকলাল কিন্তু যেতে পারে না। ছোটজাত বলে। তো একদিন, ঠাকুর পঞ্চবটি থেকে একা একা ফিরছেন, সেই সুযোগে সে ঠাকুরের পায়ে পড়ে কাঁদতে লাগলো। ঠাকুর তাঁকে স্নেহের সুরে বললেন, বাছা রসিক, ওঠ্ উঠে দাঁড়া। চিন্তা করিস না, রসিক তোর দায়িত্ত্ব সব আমি নিলাম। তুই শুধু তোর কাজ করে যাস। এক মনে ভক্তি করে,সকল সন্ধ্যা প্রার্থনা জানাস। ঠাকুর এই কথা অর্থাৎ প্রার্থনা, সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। মৃত্যুর আগে রসিক দেখলো, এক দিব্য পুরুষ তার সামনে দাঁড়িয়ে, রসিক বলে উঠলো - "ও আপনি আপনার কথা রেখে আমাকে দেখা দিয়েছেন!" এই বলে সে প্রাণত্যাগ করলো। তো প্রশ্ন হচ্ছে, প্রার্থনার কি এই ফল ?
সমস্ত সাধু মহাত্মাগণ বলে থাকেন প্রার্থনা করা ভালো। আমরা যখনই বিপদে পড়ি, তখন আমরা প্রার্থনা করে থাকি। সমস্ত ধর্ম্মগুরু এই প্রার্থনার কথা বলে থাকেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, কার কাছে প্রার্থনা করবো ? আর কিই-বা প্রার্থনা করবো ? আমরা তো সর্বদা অভাবের যন্ত্রনায় ভুগছি, তাহলে কী বিষয়ের জন্যই প্রার্থনা করবো ? মহাত্মাগণ বলে থাকেন, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করো। আমাদের মতো সাধারণের মানুষের কাছে, ঈশ্বর আছেন কি নেই তার কোনো প্রত্যক্ষ প্রমান নেই। আর যদি গুরুদেবের কথায় বিশ্বাস করে ধরেও নেই যে ঈশ্বর আছেন, তাহলেও, একথা বিশ্বাস করার কি কোনো কারন আছে, যে ঈশ্বর আমার প্রার্থনা শোনেন, বা আমার প্রার্থনার ভাষা বোঝেন। কেননা পৃথিবীতে অসংখ্য ভাষাভাষীর লোক আছে, তারা সবাই যে যার ভাষায় প্রার্থনা করছে, তো সব ভাষায় কি তিনি বোঝেন ? আর যদি ধরেই নেই তিনি সব ভাষাই বোঝেন, তাহলেও কি এই সমস্ত প্রাণীর যে চাহিদা, অর্থাৎ প্রার্থনা তা তার পক্ষে পূরণ করা সম্ভব ? একদল মানুষ আছেন, যারা বলে থাকেন, বিশ্বাসের সঙ্গে আকুল হয়ে প্রার্থনা করলে, ঈশ্বর অবশ্য়ই সারা দেন।
আর একদল মানুষ আছেন, যারা বলে থাকেন, ঈশ্বর বলে কিছু আছেন, তার কোনো প্রমান নেই। আর যদি থেকেও থাকেন, তিনি যে প্রার্থনায় সারা দেন তার কোনো প্রতক্ষ্য প্রমান নেই। যদি ঈশ্বর সত্যি সত্যি থাকতো, এবং তিনি যদি আমাদের প্রার্থনায় সারা দিতেন, তবে মানুষের সারা জীবভোর যে দুঃখ ভোগ করতে হয়, এই দুঃখই থাকতো না। মা কখনো সন্তান হারা হতেন না। মানুষও কখনো অনাহারে থাকতেন না। আর সত্যি কথা বলতে কি, মানুষ তাহলে মারাই যেতো না.কারন, মানুষ তো যুগ যুগ ধরে কেবল সুখে শান্তিতে বেঁচে থাকতে চেয়েছে।
এইসব প্রশ্নের মীমাংসা তর্কের দ্বারা হওয়া সম্ভব নয়। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বার বার বহু ভক্তকে বলেছেন, প্রার্থনা করো। বিশ্বাস রাখো। আবার স্বামী বিবেকানন্দ, যিনি রামকৃষ্ণের মানস সন্তান, তিনি বলছেন কর্ম্ম করো। রাজযোগের আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে না। যা বলছি, তা অনুসরণ করে দেখো, প্রতক্ষ্য ফল পাবে। তো কেউ বলছেন, বিশ্বাসে মিলে বস্তু, কেউ বলছেন অন্ধের মতো বিশ্বাস করো না, কাজ করো ফল পাবে। আমরা কোন পথে যাবো ?
আধ্যাত্মিক জগতের ক্রিয়াকর্ম্মের একটা মস্তবড় পরিণতি হচ্ছে, এর ফল ভীষণভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। আধ্যাত্মিক ক্রিয়াকর্ম্মের ফল, অনুভূতি, কেবলমাত্র ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ধরা পড়ে। এই অভিজ্ঞতা অন্যকে দেখানো যায় না। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার ফল, বা অলৌকিক কান্ড সাধকের অন্তর্লোকে ঘটে থাকে। কথায় বলে, ঈশ্বরের কৃপায়, অন্ধ দৃষ্টি ফিরে পায়, মুক কথা বলে, বধির শ্রবণশক্তি ফিরে পায়। পাহাড় টলে যায়। এগুলো আসলে কথার কথা। তাই যদি হতো, তবে অধ্যাত্ববিদ্যা চিকিৎসা বিদ্যার মতো মানুষের ব্যবহারিক জীবনে কাজ করতে পারতো। তা কিন্তু হয়নি। আর এই ভরসাও কখনো অধ্যাত্মবিদগন দিয়ে থাকেন না। ঠাকুর রামকৃষ্ণকে তার অসুস্থতার সময়, ডাক্তার ডাকতে হয়েছিল। এখনো, স্বামীজিরা অসুস্থ হলে, ডাক্তার ডাকেন বা হাসপাতালেই যান। তাহলে কি প্রার্থনার কোনো মূল্য নেই ? ঈশ্বর বলে কি কিছু নেই? ঈশ্বর কি সর্ব্বশক্তিমান নন ? এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো আমরা।
আসলে প্রার্থনার তাৎপর্য্য অন্যত্র লুকিয়ে আছে। প্রার্থনা একজন মানুষকে দিতে পারে আত্মবিশ্বাস। বাড়িয়ে দিতে পারে মনের শক্তি। আর এর ফলে মানুষ জীবনের অনেক অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়ে যেতে পারে। এইখানেই প্রার্থনার মূল্য। প্রার্থনা মানুষকে তার ইচ্ছাশক্তিকে বাড়িয়ে দিতে পারে। আর এই ইচ্ছাশক্তির জোরেই মানুষ সব অসাধ্য সাধন করতে পারে। বিশ্বশক্তির একটা ক্ষুদ্র অংশ আছে, প্রত্যেক জীবের মধ্যে। বিশেষ করে, মানুষের মধ্যে এই শক্তি সীমাহীন। এই শক্তি সম্পর্কে মানুষ সচেতন নয়। প্রার্থনা মানুষকে এই শক্তি সম্পর্কে সচেতন করে তুলে পারে, অবশ্যই পারে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, কেউ প্রার্থনা করছে, কোনো মাটির প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে, বা একটা শিলাখণ্ডের সামনে দাঁড়িয়ে। কিন্তু প্রকৃতভাবে সে প্রার্থনা করছে, নিজের কাছেই। বৃহৎ সত্বার যে ক্ষুদ্র সংস্করণ আছেন, প্রত্যেক জীবের মধ্যে, সেই অখন্ড সত্ত্বার কাছেই সে প্রার্থনা করছে। যে শক্তি তার নিজের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও অপ্রকাশিত হয়ে আছে, নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে, সেই ঘুমন্ত সত্ত্বাকে সে জাগিয়ে তোলে প্রার্থনার মাধ্যমে। তাই সে যা পায় এই প্রার্থনার মাধ্যমে, তা সে নিজের কাছ থেকেই পেয়ে থাকে। প্রার্থনা একটা চাবি, এই চাবির মাধ্যমে খুলে যেতে পারে, বিশ্বশক্তি দ্বার । এর ব্যবহার আমরা জানি না। আমাদের অন্তরে যে বিশ্বভাণ্ডার মজুত আছে, তার দ্বার খুলে যেতে পারে, প্রার্থনার মাধ্যমে।
প্রার্থনা আর কিছু নয়, খোঁজে বেরিয়ে পড়া। আর এই বেরিয়ে পড়বার জন্য আমাদের দরকার কিছু যোগ্যতা। আর তা হলো, আমাদের বুঝতে হবে, প্রকৃতি প্রদত্ত, বা মাতা-পিতার প্রদত্ব এই পঞ্চভূতের শরীর। এই শরীর প্রকৃতির নিয়মে বাঁধা। এর অন্যথা হবার কোনো উপায় নেই। কিন্তু এই শরীরের মধ্যে যে পুরুষ-শক্তি আছে, সে কোনো নিয়মে বাধা নয়। এই পুরুষ কোনো বাঁধা মানে না। সে তার ইচ্ছাশক্তির দ্বারা পরিচালিত হয়। সে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে, সে যা ইচ্ছে তাই হতে পারে। তার অসাধ্য কিছু নেই। আমাদের চিত্তের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হবে শুভ শক্তি। শুভ চিন্তাই , আমাদেরকে শুভকর্মে প্রবৃত্ত করবে। আর শুভ চিন্তা, শুভ কর্ম্ম আমাদের শুভ ফল প্রদান করবেই। এর কোনো অন্যথা হবে না। কথায় বলে, ঈশ্বর তাকেই সহযোগিতা করে, যে চেষ্টা করে। অলস-নিচেষ্ট মানুষকে ঈশ্বর কখনো প্রতিশ্রুতি দেন না। মানুষ এক পা বাড়ালে, ঈশ্বর দশ-পা এগিয়ে আসেন। বিশ্বশক্তি কোনো কল্পনার বিষয় নয়, এমনকি অজানা বিষয় নয়। এই বিশ্বব্রহ্মান্ড যে শৃঙ্খলার মধ্যে আবধ্য, সেটা বুঝতে আমাদের কোনো পন্ডিতের কাছে যেতে হয় না। আর এই নিয়ম শৃঙ্খলার একজন প্রবর্তক অবশ্যই আছেন, তিনিই এই শৃঙ্খলার রক্ষক। প্রকৃতি-প্রদত্ত্ব শরীর যেমন হাজার বছর বাঁচতে পারে না। সূর্য যেমন আলো দেওয়া বন্ধ করতে পারে না। বাতাস যেমন স্থির হয়ে থাকতে পারে না। তেমনি, শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যতিরেকে জীব কখনো জীবন ধারণ করতে পারে না। আর এই পঞ্চভূতের মধ্যেই লুকিয়ে আছে, ঈশ্বরের অদম্য শক্তি। এই শক্তি পঞ্চভূতের থেকে আলাদা, কিন্তু দ্রবীভূত হয়ে আছে, আমাদের এই পঞ্চভূতের শরীরের মধ্যে। সেই শক্তিকে প্রকাশিত করবার নামই প্রার্থনা। সেই ঘুমন্ত শক্তিকে জাগিয়ে তোলার নামই প্রার্থনা। প্রার্থনার শক্তির কোনো সীমা -পরিসীমা নেই। অফুরন্ত এই শক্তি। এর প্রভাবে হয়না, এমন কিছু আমরা কল্পনাও করতে পারি না। সব হয়, সব হয়। প্রার্থনার জন্য আমাদের দরকার একাগ্রতা। মনের সমস্ত শক্তি চিত্তের উপরে নিক্ষেপ করা। এতে করে আমাদের মানসিক শক্তির তীব্রতা বৃদ্ধি পায় এবং নির্দিষ্ট লক্ষে কেন্দ্রিত হওয়ায় প্রচন্ড শক্তির স্ফূরণ হয়। আর প্রার্থনাকারীকে লক্ষ পূরণের জন্য, ধাবিত করে। সে তখন, হাজার বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও সমস্ত বাধা অতিক্রম করে, দুর্বার গতিতে লক্ষপূরণের জন্য ধাবিত হয়। আর লক্ষ পূরণ না করে সে থামতে পারে না । যা আগে সে করবার সাহস সঞ্চয় করতে পারে নি, আজ সেই কাজ অনায়াসে নিজের ক্ষমতাবলেই সম্পাদন করে ফেলে। এখানেই প্রার্থনার সাফল্য।
ধর্ম্ম মানুষকে বাঁচার অনুপ্রেরণা জোগায়। ধর্ম্ম মানুষের মধ্যে একটা আদর্শের স্থাপন করে থাকে। আর ধার্মিক মানুষ এই আদর্শকে নিয়ে বাঁচার জন্য অন্তরের ভিতরে একটা তীব্র ইচ্ছে অনুভব করে থাকেন । প্রার্থনা এই আদর্শকে নিয়ে বাঁচার উপায় বাতলে দেয়। প্রার্থনা যত গভীর হয়, যত দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে ততই আমরা নতুন মানুষ হয়ে উঠি। আমাদের জীবনে পরিবর্তন আসে, আমাদের চরিত্রের মধ্যে, আমাদের আচরণের মধ্যে সেগুলো ফুটে ওঠে। এই পরিবর্তন এতটাই স্পষ্ট যে এটি যেমন নিজের মধ্যে একটা নির্ভয়-শান্ত অথচ একটা স্ফূর্তি, একটা শক্তি, একটা আত্মনির্ভরতা জেগে ওঠে । প্রার্থনার এটাই লাভ। প্রার্থনায় মরা মানুষ বেঁচে ওঠে না। কিন্তু ম্রিয়মান মানুষ, ভীতু মানুষ, হয়ে উঠতে পারে সতেজ, হয়ে উঠতে পারে সাহসী। এইখানেই প্রার্থনার কারিকুরি।
সবশেষে একটা প্রচলিত অথচ অসীম শক্তিশালী মন্ত্র পাঠ করে আমাদের বাক্যের সমাপ্তি করবো।
ওঁং ভূর্ভুবঃ স্বঃ। ওঁং তৎসবিতুর্বরেন্যং।
ভর্গো দেবস্য ধীমহি।
ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ ওঁং।
ওঁং শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ
হে (ভূঃ-ভূবঃ-স্বঃ) ত্রিলোকেশ্বর ! সবিতাদেবের পরব্রহ্মাত্মক সেই বরণীয় তেজকে আমরা ধ্যান করি। সেই সবিতা আমাদের বুদ্ধি-বৃত্তিকে প্রেরিত করুন।ওঁং আমাদের ত্রিবিধ শান্তি হোক।
No comments:
Post a Comment