আবার আত্মার খোঁজে - এবার মহাভারতের পাতায়
জীবদেহে পরমাত্মার উপলব্ধি। পৃ ৮২২.
মহাত্মা ভীষ্ম মৃত্যু শয্যায় বা বলা যেতে পারে, শরশয্যায়। ধর্মাবতার যুধিষ্ঠির এসেছেন, তাঁর কাছে, জীবনের শেষ কথা কটি শুনতে। মহাত্মা ভীষ্মের ইচ্ছামৃত্যু। উত্তরায়নের অপেক্ষায় আছেন। তাই কিছুটা সময় পাওয়া গেলো, গঙ্গাপুত্র মৃত্যুঞ্জয়ী মহাপুরুষের কাছ থেকে মূল্যবান উপদেশ গ্রহণের।
বেদ সাধারণের বুদ্ধিগ্রাহ্য় নয়। এই ব্রহ্মবিদ্যা ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের জন্য। মহাভারত কিন্তু সর্ব্ব সাধারণের জন্য। তাই বেদের তত্ত্বকথা মহাভারতের মধ্যে গল্পের আকারে, সাধারণের বোধগম্য করে পরিবেশন করা হয়েছে। তো ভীষ্মদেব বলছেন, দেবতাদের কুলগুরু হচ্ছেন,মহর্ষি বৃহস্পতি। আর মহর্ষি বৃহস্পতির গুরুদেব হচ্ছেন প্রজাপতি মনু। তো দেবগুরু বৃহস্পতি একদিন প্রজাপতি মনুর কাছে বলছেন, আমি বেদাদি অধ্যায়ন করেছি, সব ব্যাকরণ পড়েছি। কিন্তু আকাশাদি মহাভূতের কারন কি, তা জানি না। জীব যে কিভাবে এক দেহ থেকে বেরিয়ে আর একটা দেহে আশ্রয় নেয়, তা আমার জানা নেই। হে মহাত্মন, যদি কৃপাবশতঃ এই সম্পর্কে বিস্তারিত কীর্তন করেন।
তো প্রজাপতি মনু বললেন, হে মহর্ষি সেই অবিনাশী পুরুষ থেকেই আকাশের সৃষ্টি হয়েছে। আবার আকাশ থেকে বায়ু, বায়ু থেকে অগ্নি, অগ্নি থেকে জল, জল থেকে এই জগৎ, আর জগৎ থেকে জগতের সমস্ত পদার্থ মায় জীবজগৎ সৃষ্টি হয়েছে। আবার অন্তিম কালে, যাবতীয় শরীরীর যে পার্থিব শরীর আছে, তা প্রথমে জলে, তার পরে জল থেকে তেজে, তেজ থেকে বায়ুতে, তারপর বায়ু থেকে অন্তরীক্ষে গমন করে থাকে। কিছু শরীরী আছেন, যাঁরা অন্তরীক্ষ অতিক্রম করে, পরমপুরুষে লিন হয়ে যান। একেই বলে মোক্ষলাভ। পরমপুরুষে যাঁরা লীন হয়ে যান, তারা আর ফিরে আসেন না। অর্থাৎ তাঁরা আর কোনো দেহে স্থিত হন না।
এখন কথা হচ্ছে, এই পরমপুরুষ কে ? এই পরমপুরুষকে ভাষার দ্বারা আবদ্ধ করা যায় না। তিনি বাক্যের অতীত। তিনি কি নন, সেটা বড়জোর বলা যেতে পারে। তিনি সমস্ত গুনের উর্দ্ধে। তিনি না শীত না উষ্ম, না কোমল না তীক্ষ্ণ, না অম্ল না কষা, না তেতো না মধুর, অর্থাৎ সমস্ত গুন্ রোহিত। আবার তিনি শব্দ-গন্ধ বা রূপ-সম্পন্ন নন। তিনি পরাৎপর স্বভাবশূন্য। অর্থাৎ তিনি ইন্দ্রিয়াদির স্বভাবের উর্দ্ধে। ইন্দ্রিয় দ্বারা যে সব কর্ম্ম তা তিনি করেন না। তাই তার স্বভাব বলে কিছু নেই। আমরা বিভিন্ন ইন্দ্রিয় দ্বারা বিষয়ের বিভিন্ন অনুভব করে থাকি, যেমন ত্বক দ্বারা স্পর্শফল, জিহ্বা দ্বারা আস্বাদন বা রস অনুভব করে থাকি। কর্ন দ্বারা, শব্দ, ঘ্রাণশক্তির সাহায্যে গন্ধ, চক্ষু দ্বারা রূপ অনুভব করে থাকি। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ এর বাইরে কিছু অনুভব করতে পারি না। কিন্তু যিনি বা যে ব্যক্তি রস থেকে রসনাকে, দুর্গন্ধ থেকে নাককে, শব্দ থেকে কানকে, স্পর্শ থেকে ত্বককে, এবং রূপ থেকে চোখকে নিবৃত্ত করতে পারেন, তিনিই নিজের স্বভাবকে বুদ্ধি প্রভৃতি হতে শ্রেষ্ঠ বলে বুঝতে সমর্থ হন।
আমাদের মধ্যে যে কর্তাভাব, আমাদের মধ্যে যে কর্ম্মের প্রবৃত্তি, আমাদের মধ্যে যে শোকের (করণের) অনুভূতি, আমাদের মধ্যে যে দেশ ও কালের অনুভূতি, আমাদের মধ্যে যে সুখ-দুঃখের অনুভূতি, আমাদের যে প্রবৃত্তি আমাদের যে অনুরাগ, এই সবকিছু যে কারণে হয়ে থাকে তাকেই বলে স্বভাব। সমষ্টিগতভাবে এই স্বভাবকে বলে পরমাত্মা, আর ব্যষ্টিগত ভাবে, বলে জীবাত্মা। আসলে এই স্বভাবই সমস্ত কাজ করছে। অর্থাৎ স্বভাব বা তিনিই কারন, আর স্বভাবজাত যা কিছু তা হচ্ছে কার্য্য।
পাপ-পুন্য যেমন পরস্পর বিরুদ্ধ কিন্তু একই মানুষ্য শরীরে বাস করে থাকে, ঠিক তেমনি জ্ঞান জড়বস্তু না হয়েও জড়দেহে নিবদ্ধ হয়ে আছে। প্রদীপ যেমন প্রজ্বলিত হয়ে, অন্যের বিষয়বোধ করিয়ে দেয়, ঠিক তেমনি জ্ঞান জীবআত্মাকে বা মানুষের ইন্দ্রিয়গনের বিষয়বোধ সম্পাদন করছে। মন্ত্রী-পরিষদ যেমন রাজ্যের বিভিন্ন বিষয়, রাজার গোচরে আনেন, তেমনি আমাদের ইন্দ্রিয়গণ বাহ্য-জগতের সমস্ত বিষয়-বোধ সম্পাদন করছে। মন্ত্রীদের থেকে রাজা যেমন শ্রেষ্ঠ, তেমনি শরীরের ইন্দ্রিয়গণ থেকে জীবাত্মা শ্রেষ্ঠ। অগ্নির শিখা, বাতাসের বেগ, সূর্য্যের রশ্মি, নদীর জল, যেমন বারবার গমনাগমন করছে, ঠিক তেমনি, আমাদের এই দেহ, একবার নষ্ট আবার একবার উদ্ভূত হচ্ছে। যতক্ষন ইন্ধন থাকে ততক্ষন অগ্নিশিখা দৃষ্টিগোচর থাকে। ইন্ধন শেষ হয়ে গেলে, অগ্নিশিখা দৃষ্টিগোচর থাকে না। তাই বলে কি অগ্নি নেই, তা নয়। কাঠের মধ্যে আগুন, ধোঁয়া আছে। কিন্তু কাঠকে কুড়ুলের দ্বারা টুকরো করেও, আগুনের বা ধোঁয়ার দেখা মিলবে না। ঠিক তেমনি, মানুষের শরীরকে টুকরো টুকরো করে ফেললেও, আত্মা বা জীবাত্মার সন্ধান মিলবে না। কিন্তু এই কাঠকে যদি আমরা সঠিক উপায়ে ঘর্ষন করতে পারি, তবে এই কাঠের মধ্যেই ধোয়া ও অগ্নি দেখতে পাবো। ঠিক তেমনি, আমরা যদি বুদ্ধিকে যদি শান দিতে পারি, অর্থাৎ সঠিক জ্ঞান অর্জনের সাহায্যে আমরা জীবাত্মা ও পরমাত্মাকে দর্শন করতে পারি। মানুষ যেমন স্বপ্নে, নিজের পার্থিব দেহকে বিছানায় রেখে, পৃথকভাবে চৈতন্য প্রভাবে ভূমন্ডল ঘুরে বেড়াতে পারে, আবার জাগ্রত অবস্থায়, পার্থিব দেহকে অভিন্নভাবে দর্শন করে, ঠিক তেমনি, মন ও বুদ্ধি সম্পন্ন দশ ইন্দ্রিয় (জ্ঞান -ইন্দ্রিয় ৫টি, চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক। কর্ম্ম ইন্দ্রিয় -৫টি বাক, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ ) এছাড়া অন্তর-ইন্দ্রিয় ৪টি - মন, বুদ্ধি, অহংকার ও চিত্ত ও বায়ুযুক্ত জীবাত্মা (দশ বায়ু, প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান, সমান এবং নাগ, কূর্ম্ম, কৃকর, দেবদত্ত ও ধনঞ্জয়) জীবনান্তে দেহকে একবার আপনা হতে পৃথকভাবে দর্শন করেও পুনরায় এঁকে অভিন্ন বিবেচনা পূর্বক দেহান্তরে গমন করে থাকে।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
( দেহের মধ্যে বায়ুর যে ক্রিয়াস্থান, এই ক্রিয়া-স্থান ভেদে বায়ুকে ৫ ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যেমন ১. বুকের মধ্যের বায়ুকে বলে প্রাণ। ২. নাভি থেকে নিম্নাঙ্গের বায়ুকে বলে অপান। ৩. নাভি থেকে বুকের নিচ পর্যন্ত যে স্থান সেখানকার বায়ুকে বলে সমান। ৪. কন্ঠের বায়ু উদান। ৫. এছাড়া সর্ব্ব শরীরে যে বায়ু ছড়িয়ে আছে তাকে বলে ব্যান বায়ু।এগুলোর ক্রিয়া সম্পর্কে আমরা আগে শুনেছি। এছাড়া আমাদের শরীরে যে সাড়ে তিন লক্ষ বা অসংখ্য নাড়ী আছে তার মধ্যে ছড়িয়ে আছে যে বায়ু, সেগুলো হচ্ছে, নাগ, কূর্ম্ম, কৃকর, দেবদত্ত ও ধনঞ্জয়। আর এগুলোর কর্ম্মক্ষেত্ৰ বা চলাচলের ক্ষেত্র হচ্ছে ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, বজ্রাক্ষ্যা ও চিত্রাণি। নাগ বায়ু আমাদের উদ্গার তুলতে সাহায্য করে। কূর্ম্ম বায়ু আমাদের উন্মীলন অর্থাৎ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের সংকোচন-প্রসারণের সাহায্য করে থাকে। কৃকর বায়ু আমাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা জাগিয়ে তোলে। দেবদত্ত বায়ু আমাদের হাই তুলতে সাহায্য করে। এবং ধনঞ্জয় বায়ু আমাদের হিক্কা তুলতে সাহায্য করে। এইভাবে বায়ু ও তার ক্রিয়া-পদ্ধতি সম্পর্কে যিনি উপলব্ধি করেছেন, তিনি সেই বিরাট-পুরুষ ব্রহ্মান্ডকে জ্ঞাত হতে পেরেছেন, আবার এই ক্ষুদ্র ভান্ডকে জ্ঞাত হতে পেরেছেন। তিনি নিশ্চিত-রূপে মুক্ত পুরুষ এবং অবশ্যই উত্তম অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছেন।)
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পরমাত্মা কখনোই এই যে সুখ-দুঃখ কর্ম্ম প্রভাবে উৎপত্তি, বৃদ্ধি, ক্ষয় ও মৃত্যু এগুলো কখনোই প্রাপ্ত হন না। তিনি অদৃশ্য দেহ পরিগ্রহ করে দেহ থেকে দেহান্তরে গমন করে থাকেন। চোখের দ্বারা এই রূপ প্রত্যক্ষ করা যায় না। এঁর স্পর্শ কেউ অনুভব করতে পারেন না। তিনি ইন্দ্রিয় দ্বারা কোনো কার্য্য সাধন করেন না। আবার চক্ষু ইত্যাদি ইন্দ্রিয়গণ তাকে নিরীক্ষণ করতে সমর্থ হয় না। কিন্তু তিনি এদেরকে সবসময় নিরীক্ষণ করছেন। যেমন আগুনের মধ্যে লৌহখন্ডে আগুনের সন্তাপের কারনে আগুনের রূপ লৌহখন্ডের মধ্যে নিরীক্ষিত হয়। ঠিক তেমনি, জীবদেহে, পরমাত্মার চৈতন্যস্বরূপই নিরীক্ষিত হয়ে থাকে।
জীবাত্মা এক দেহ ত্যাগ করে, অদৃশ্যভাবে অন্য দেহে প্রবেশ পূর্বক, সেই দেহের গুনে গুণবান জ্ঞান করে। দেহী যখন দেহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়, তখন সেই দেহ তার উদ্ভূত বস্তুতে অর্থাৎ পঞ্চভূতে প্রবেশ করে থাকে। এবং ইন্দ্রিগুলোও নিজ নিজ উপাদানকে আশ্রয় করে। অর্থাৎ শ্রবণশক্তি আকাশের মধ্যে বিলীন হয়, ঘ্রাণশক্তি পৃথিবীকে আশ্রয় করে, দৃষ্টিশক্তি তেজের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়, আস্বাদন শক্তি সলিলে আশ্রয় নেয়, এবং স্পর্শগুন বায়ুতে আশ্রয় নেয়। এইভাবে আমাদের পাঁচ-ইন্দ্রীয় শক্তি পঞ্চভূতকে আশ্রয় করে রয়েছে। আবার এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়-গুন্ মনের অনুগত হয়ে আছে । মন আবার বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত, বুদ্ধি আবার স্বভাবের অনুগত। জীব তার স্ব-স্ব কর্ম্ম অনুযায়ী অর্জিত নতুন দেহে পূর্ব জন্মের পাপ-পুন্য বহন করে থাকে। জলের পোকা যেমন স্রোতের অনুকূলে গমন করে, তেমনি মন বুদ্ধিকে অনুসরন করে থাকে। আমরা যখন দ্রুতগামী ট্রেনে ভ্রমন করে থাকি, তখন বাইরের দৃশ্যকে চঞ্চল বলে মনে হয়। কিন্তু ট্রেন যখন স্টেশানে স্থির হয়ে থাকে, তখন আমাদের এই ভ্রম দূর হয়। ঠিক তেমনি জ্ঞানবান ব্যক্তির বুদ্ধি যখন স্থির হয়, তিনি তখন অনায়াসে ঈশ্বরের যথার্থতা নির্নয় করতে সমর্থ হন। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ বস্তু যেমন আমরা অণুবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা দেখতে পারি, দূরের বস্তু যেমন আমরা দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে দেখতে পারি, নিজের মুখ দেবার জন্য যেমন আমরা আয়নার ব্যবহার করে থাকি, পরমাত্মা নিতান্ত সূক্ষ্ম ও অদৃশ্য হলেও, বিরাট এবং দূরস্থ হলেও বুদ্ধির প্রভাবে আমরা সেই মহান অর্থাৎ বিরাট বা অতিশয় ক্ষুদ্র বলে যাঁকে আমরা দেখতে পারছিলাম না, তাঁকে তখন আমরা বুদ্ধির প্রভাবে দর্শন করতে পারি। এর পরের দিন আমরা শুনবো আত্মাকে দর্শনলাভের উপায়।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।
আত্মাকে দর্শন লাভের উপায়। আত্মাকে দর্শন স্থূল -মনুষ্য দেহ ভিন্ন সম্ভব নয়। তথ্যসূত্রঃ মহাভারত - শান্তিপর্ব্ব।
আজ অক্ষয়-তৃতীয়া । এইদিন মহাভারত লেখা শুরু হয়েছিলো। আমরাও আজ শুনছিলাম মহাভারত কথা। দুর্লভ এই মনুষ্য শরীর। কেন জানেন ? একমাত্র এই মনুষ্য শরীরেই আত্ম উপলব্ধি সম্ভব। এই স্থুল মনুষ্য দেহেই একমাত্র দর্শন করা যায় আত্মাকে। এই মনুষ্য শরীরেই একমাত্র অনুভব করা যায় পরমাত্মাকে। হ্যাঁ এই স্থূল মনুষ্য শরীরেই ঈশ্বরের কৃপায় তাঁর দর্শনলাভ সম্ভব হয়। তাইতো দেবতারাও মনুষ্য শরীর পাবার জন্য লালায়িত। কিন্তু কি ভাবে ? আজ আমরা সেই কথাই শুনবো।
আর একটা কথা, মানুষ, কেবলমাত্র মানুষই ঈশ্বরের খোঁজ করে থাকে । স্থূল মনুষ্য দেহধারীই অর্থাৎ মানুষ যখন কেবলমাত্র স্থুলদেহে অবস্থান করে থেকে, তখনই সে ঈশ্বরের খোঁজ করে থাকে। মানুষ যখন , স্থুল দেহ ত্যাগের পরে, হাজার বছর ভুবর্লোকে অবস্থান করে, মানসদেহে অবস্থান করে, যা আমরা মহাত্মাদের কাছ থেকে শুনে থাকি, তো সেখানে বসেই তো সে পরমাত্মার খোঁজ করতে পারে। ঈশ্বরকে খোঁজা তো মনের কাজ, যতদূর আমরা বুঝেছি । তো মানসদেহে সেই কাজটি করা যেতেই পারে। কিন্তু তা কেন হয় না ? আসলে স্থুল মনুষ্য দেহ ভিন্ন অন্য কোনো রূপে বা অবস্থায়, ঈশ্বরের সাধনা সম্ভব নয়। তাই মহাত্মাগন প্রাণপাত করার আগে পর্যন্ত ঈশ্বরের সাধনায় লিপ্ত থাকতে চান। এই সম্পর্কেই আজ এবার আমরা মহাভারতের কথা শুনবো।
প্রজাপতি মনু ও দেবগুরু বৃহস্পতির কথোপকথন হচ্ছিলো । প্রজাপতি মনু দেবর্ষি বৃহস্পতিকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, হে ব্রহ্মন, ইন্দ্রিয়সহকৃত অর্থাৎ বিভিন্ন ইন্দ্রিয় দ্বারা আমরা যে জ্ঞান লাভ করে থাকি, বা কর্ম্ম করে থাকি, জীবচৈতন্য, সেই ইন্দ্রিয় দ্বারা অর্জিত পূর্ব-পূর্ব অনুভূত সেই বিষয় সমূহ কালান্তরে স্মরণ করে থাকে । এবং ইন্দ্রিয়সমূহ বিলীন হলে স্বপ্নযোগে পরম-স্বভাবই বিষয় অনুভব করেন। সেই স্বভাব অনেক সময় এককালে অর্থাৎ ইহজন্ম বা পরজন্মে দৃষ্ট শব্দ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়-বিষয়-সমুদয় সন্নিহিতের ন্যায় অর্থাৎ যেন নিকটেই আছেন, এইভাবে প্রকাশ করে দেন। এবং এই একমাত্র সর্বোৎকৃষ্ট স্বভাবই পরস্পর বিভিন্ন অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ প্রভৃতি তিন অবস্থাতে সাক্ষীরূপে সঞ্চরণ করে থাকেন।
এই বিষয়টা একটু ভালো করে বুঝে নেবো। বাংলায় একটা প্রচলিত প্রবচন আছে, "স্বভাব যায় না ম'লে আর ইল্লৎ যায় না ধু'লে" । অর্থাৎ আমাদের তথাকথিত মৃত্যুর পরেও আমাদের স্বভাবের কোনো পরিবর্তন হয় না, যেমন মানুষের মনের মধ্যে যে নোংরামি আছে, তা কখনো ধুয়ে পরিষ্কার করা যায় না। প্রজাপতি মনু বলছেন, আমাদের মৃত্যুর পরে, আমাদের ইন্দ্রিয়শক্তি পঞ্চভূতের সঙ্গে মিশে থাকে। কিন্তু ইন্দ্রিয়লব্ধ যে জ্ঞান তা আমাদের স্বভাবের মধ্যে থাকে। আর এই স্বভাবএর স্মৃতিতে আমাদের জন্ম-জন্মান্তরের ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের সাহায্যে তিনি তখন তা প্রত্যক্ষ করতে থাকেন। এগুলো তখন তার কাছে প্রকাশিত সত্য। এবং এই অবস্থা ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান সর্ব্ব কালের জন্য চলতে থাকে, এবং আমাদের ব্যষ্টি স্বভাব এটাকে উপলব্ধি করতে থাকেন, আর সমষ্টি স্বভাব সাক্ষী হিসেবে নির্লিপ্ত থাকেন। অর্থাৎ জীবাত্মা এটাকে মনোময় শরীরে উপভোগ করেন। একটা কথা মনে রাখতে হবে, আত্মার কোনো ভোগ নেই, আত্মা কেবল পরস্পর বিরুদ্ধ সত্ব রজঃ ও তম গুন্ জনিত সুখ-দুঃখাদি অবগত হয় থাকেন মাত্র, তাঁকে এসব ভোগ করতে হয় না। বায়ু যেমন কাঠ দ্বারা জ্বলতে থাকা অগ্নিতে প্রবেশ করে, ঠিক তেমনি আত্মা ইন্দ্রিয়সমুদায়ে প্রবিষ্ট হন। কিন্তু পরমাত্মা যেহেতু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, তাই জ্ঞান, ঋষিবাক্য, বিচার এবং সবশেষে সজ্ঞা দ্বারা তার দর্শনলাভের চেষ্টা করাই সঙ্গত।
মানুষ ইন্দ্রিয়দ্বারা আত্মাকে বুঝতে পারে না। কিন্তু সর্বজ্ঞ সর্ব্বদর্শী পরমাত্মা সবসময় আত্মাকে দেখছেন। হিমালয়ের অনেক দুর্গম জায়গা আছে, যেখানে এখনো মানুষ যেতে পারে নি। চাঁদের পৃষ্ঠদেশে কি আছে, বা শুক্রগ্রহে কি আছে, তা আমাদের কাছে এখনো অজানা । কিন্তু চাঁদকে আমরা দেখতে পাই। হিমালয় সম্পর্কে একটা ধারণা থাকলেও, সমগ্র হিমালয় সম্পর্কে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। ঠিক তেমনি মানুষের মধ্যে আত্মজ্ঞান থাকলেও তাকে আমরা সম্পূর্ণ রূপে জানতে পারি না। আত্মজ্ঞান ভিতর থেকে উদয় হয়। আপনা থেকেই আত্মজ্ঞান হয়ে থাকে। এর জন্য কোনো বিষয়ের আশ্রয় নিতে হয় না। পন্ডিতগণ আজকে যে সুন্দর বৃক্ষটি দেখছেন, তারা জানেন, এই বৃক্ষের কোনো রূপ আগে ছিল না, আবার পরেও থাকবে না। তবু গাছটি অপরূপ সুন্দর । পন্ডিতগণ জানেন, সূর্যের চারিদিকে পৃথিবী ঘুরছে, এমনকি সূর্য্যও গতিশীল, এগুলো প্রতক্ষ্যভাবে জ্ঞাত হওয়া সম্ভব নয়, তথাপি এই অপ্রতক্ষ্য জ্ঞান বিচারের দ্বারা অবগত হওয়া যায়। ঠিক তেমনি, সুদুর্লভ হলেও, বুদ্ধিরূপ প্রদীপের দ্বারা আত্মাকে নিরীক্ষণ করা সম্ভব। জ্ঞানের স্বরূপ এবং জ্ঞেয় পরমাত্মাতে বিলীন করতে অভিলাষ করে থাকেন। অর্থাৎ নিজেকে পরমাত্মার সঙ্গে একাত্মীভূত করার প্রয়াস করে থাকেন। মনের মধ্যে আকুলতা ব্যাকুলতা যত বাড়তে থাকে, বিলীন হবার উপায় তত স্পষ্ট হতে থাকে। জেলেরা বড়শিতে মাছ গেঁথে, মাছ ধরে থাকে। শিকারীরা পোষা হরিণ দিয়ে, বনের হরিণকে খাঁচায় ঢোকায়। পোষা পাখি দ্বারা আকাশের পাখি, কুনকো হাতি দ্বারা জঙ্গলের হাতি ধরা যায়। ঠিক তেমনি জ্ঞান দ্বারা জ্ঞেয়পদার্থ ধরতে হবে। কথায় বলে, সাপ কুন্ডলি পাকিয়ে তার লেজ বা চরণ নিরীক্ষণ করে থাকে। ঠিক তেমনি জড়দেহ মধ্যে যে জ্ঞান, যা আসলে জড় নয়, কিন্তু জড় দেহের মধ্যেই থাকে। সেই জ্ঞানই পারে, দেহমধ্যে সূক্ষ্ম যে জ্ঞেয় বস্তু আছে তাই প্রত্যক্ষ করতে। দেখুন, চোখ চোখকে দেখতে না। কানের কোনো কেন নেই। ইন্দ্রিয় কখনো ইন্দ্রিয়কে জানতে পারে না। ঠিক তেমনি বুদ্ধি দ্বারা পরম-বোধ্যকে জানা সম্ভব নয়।
চাঁদ সবসময় আকাশে আছে, তথাপি অমাবস্যার সময় দেখা যায় না। আত্মা মানুষের শরীরে বর্তমান থাকলেও, কেউ তাকে প্রত্যক্ষ করতে পারে না। আবার আত্মা শরীর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেও তাঁকে কেউ প্রত্যক্ষ করতে পারে না। চাঁদ যেমন অমাবস্যান্তে আবার রূপ পরিগ্রহ করেন। ঠিক তেমনি আত্মা দেহান্তর প্রাপ্ত হয়ে পুনরায় প্রকাশিত হন। চাঁদ যেমন ধীরে ধীরে প্রত্যক্ষ হন, বৃদ্ধি প্রাপ্ত হন, আবার ক্ষয় প্রাপ্ত হন, এটি চাঁদের স্থূল দেহের গুন্। ঠিক তেমনি জীবের স্থূল দেহের জন্ম, বৃদ্ধি, ক্ষয়প্রাপ্ত বা মৃত্যু হয়ে থাকে। এগুলো স্থুলদেহের গুন্ বা পরিনাম। আত্মাতে এই গুন্ বা এই যে ক্ষয়-বৃদ্ধি জনিত পরিনাম, কখনোই আরোপ করা যায় না। চাঁদের দ্বিতীয়া, পঞ্চমী, একাদশী আছে। এবং একেক সময় তার আকার বা রূপের পরিবর্তন হয়, কিন্তু আমরা জানি চাঁদ একই আছে। ঠিক আমাদের বাল্য অবস্থা, কৈশোর অবস্থা, যৌবন অবস্থা, প্রৌঢ় অবস্থা বা বার্ধক্য অবস্থা আছে কিন্তু আমরা জানি মানুষটি সেই একই আছে। রাহু যেমন চাঁদকে বা সূর্যকে গ্রাস করলে, আমরা রাহুর (ছায়া) অস্তিত্ত্ব টের পাই, আবার পরিত্যাগ ৰলে আর দেখতে পাই না, ঠিক তেমনি আত্মা যখন জীবদেহে প্রবেশ করেন, তখনই তাকে অনুমান করা সম্ভব হয়। আবার দেহ পরিত্যাগ করলে আর তাকে অনুমান করা সম্ভব নয়। চাঁদ যেমন অমাবস্যাতে অদৃশ্য থাকলেও, নক্ষত্রমন্ডলী তাকে পরিত্যাগ করে না ঠিক তেমনি আত্মা শরীর থেকে মুক্ত হলেও কর্ম্মফল থেকে মুক্ত হতে পারেন না। কর্ম্মফল নিয়ে আত্মা ভূমন্ডলে ভ্রমন করে থাকেন । কিন্তু তখন তিনি উপনিষদের ভাষায় শ্রদ্ধা (অর্থাৎ আত্মবীজ ) । বীজে সব আছে, কিন্তু প্রকাশ নেই। বীজ পূর্নতা পায় না, যতক্ষন না সে প্রকৃতির সহযোগিতা পায়। তাই আত্মা যখন স্থুল প্রাকৃতিক পঞ্চভূতের দেহর মধ্যে প্রবেশ করে তক্ষুনি তাকে ধরতে হয়। বড়শির আঁধারে মাছ যখন ঠোকর মারে, ঠিক তক্ষুনি তাঁকে ডাঙায় তোলে জেলে।
আত্মা সর্বত্র আছে।আবার দেহের মধ্যেও আছে। জেলে যেমন মাছ ধরতে গেলে জালের সাহায্য নেয় । মাছকে গন্ডিবদ্ধ করবার জন্য। ঠিক তেমনি আমাদের এই দেহ জালের সাহায্য নিতে হবে। আত্মাকে ধরতে গেলে আমাদের দেহ-জালকে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের এই স্থুল দেহ এই জাল। এখানে প্রতিনিয়ত আত্মা অর্থাৎ চেতনশক্তি প্রবেশ করছেন আবার বেরিয়ে যাচ্ছেন। অর্থাৎ এই মনুষ্য দেহে আত্মার প্রতিনিয়ত যাতায়াত। তাই জাল দিয়ে যেমন জেলে মাছ ধরে, আমাদের দেহ-জাল দিয়ে আমাদের আত্মাকে ধরতে হবে।
যোগীরা বলছেন, আমাদের শ্বাসের সঙ্গে তিনি প্রতিনিয়ত যাতায়ত করছেন, আমরা যদি নিবিষ্ট চিত্তে এই শ্বাস-প্রশ্বাসের গতির দিকে দৃষ্টি রেখে স্থির হয়ে বসে থাকতে পারি, তবে আমরা চেতনশক্তি বা আত্মাকে আমরা ধরতে পারবো। দর্শন করতে পারবো।
হঠযোগীগণ বলছেন, আমাদের শরীরের নাড়ীশুদ্ধি করে, অর্থাৎ আমাদের সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে যে শ্লেষ্যা ও মলাদি আছে তা পরিষ্কার করে, বায়ুকেকে দেহাগ্নি দ্বারা প্রজ্জ্বলিত করে, উর্দ্ধগতিসম্পন্ন করে, সুষুম্না নাড়ীর ভিতর দিয়ে ব্রহ্মদেশে নিয়ে যেতে পারি, তবে সেখানে আমাদের ব্রহ্ম সাক্ষাৎকার হয়।
ঈশ্বরভক্ত গন বলছেন, আমরা যদি প্রার্থনা ধ্যান-জপ করি তবে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করতে পারি। এমনি নানান পথের সন্ধান দিয়েছেন আমাদের মুনি ঋষিগণ। আমরা যেকোনো পথেই ঈশ্বরের সন্ধান করতে পারি। তবে যে ভূমির উপরে দাঁড়িয়ে, এই সাধন সাধনা করতে হবে, তা এই মনুষ্য শরীর। এই স্থুল শরীর। এর অন্যথা নেই। তাই প্রজাপতি মনু বলছেন, আত্মদর্শনের একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে এই মনুষ্য শরীর যার কোনো বিকল্প নেই।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
আর একটা কথা, মানুষ, কেবলমাত্র মানুষই ঈশ্বরের খোঁজ করে থাকে । স্থূল মনুষ্য দেহধারীই অর্থাৎ মানুষ যখন কেবলমাত্র স্থুলদেহে অবস্থান করে থেকে, তখনই সে ঈশ্বরের খোঁজ করে থাকে। মানুষ যখন , স্থুল দেহ ত্যাগের পরে, হাজার বছর ভুবর্লোকে অবস্থান করে, মানসদেহে অবস্থান করে, যা আমরা মহাত্মাদের কাছ থেকে শুনে থাকি, তো সেখানে বসেই তো সে পরমাত্মার খোঁজ করতে পারে। ঈশ্বরকে খোঁজা তো মনের কাজ, যতদূর আমরা বুঝেছি । তো মানসদেহে সেই কাজটি করা যেতেই পারে। কিন্তু তা কেন হয় না ? আসলে স্থুল মনুষ্য দেহ ভিন্ন অন্য কোনো রূপে বা অবস্থায়, ঈশ্বরের সাধনা সম্ভব নয়। তাই মহাত্মাগন প্রাণপাত করার আগে পর্যন্ত ঈশ্বরের সাধনায় লিপ্ত থাকতে চান। এই সম্পর্কেই আজ এবার আমরা মহাভারতের কথা শুনবো।
প্রজাপতি মনু ও দেবগুরু বৃহস্পতির কথোপকথন হচ্ছিলো । প্রজাপতি মনু দেবর্ষি বৃহস্পতিকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, হে ব্রহ্মন, ইন্দ্রিয়সহকৃত অর্থাৎ বিভিন্ন ইন্দ্রিয় দ্বারা আমরা যে জ্ঞান লাভ করে থাকি, বা কর্ম্ম করে থাকি, জীবচৈতন্য, সেই ইন্দ্রিয় দ্বারা অর্জিত পূর্ব-পূর্ব অনুভূত সেই বিষয় সমূহ কালান্তরে স্মরণ করে থাকে । এবং ইন্দ্রিয়সমূহ বিলীন হলে স্বপ্নযোগে পরম-স্বভাবই বিষয় অনুভব করেন। সেই স্বভাব অনেক সময় এককালে অর্থাৎ ইহজন্ম বা পরজন্মে দৃষ্ট শব্দ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়-বিষয়-সমুদয় সন্নিহিতের ন্যায় অর্থাৎ যেন নিকটেই আছেন, এইভাবে প্রকাশ করে দেন। এবং এই একমাত্র সর্বোৎকৃষ্ট স্বভাবই পরস্পর বিভিন্ন অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ প্রভৃতি তিন অবস্থাতে সাক্ষীরূপে সঞ্চরণ করে থাকেন।
এই বিষয়টা একটু ভালো করে বুঝে নেবো। বাংলায় একটা প্রচলিত প্রবচন আছে, "স্বভাব যায় না ম'লে আর ইল্লৎ যায় না ধু'লে" । অর্থাৎ আমাদের তথাকথিত মৃত্যুর পরেও আমাদের স্বভাবের কোনো পরিবর্তন হয় না, যেমন মানুষের মনের মধ্যে যে নোংরামি আছে, তা কখনো ধুয়ে পরিষ্কার করা যায় না। প্রজাপতি মনু বলছেন, আমাদের মৃত্যুর পরে, আমাদের ইন্দ্রিয়শক্তি পঞ্চভূতের সঙ্গে মিশে থাকে। কিন্তু ইন্দ্রিয়লব্ধ যে জ্ঞান তা আমাদের স্বভাবের মধ্যে থাকে। আর এই স্বভাবএর স্মৃতিতে আমাদের জন্ম-জন্মান্তরের ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের সাহায্যে তিনি তখন তা প্রত্যক্ষ করতে থাকেন। এগুলো তখন তার কাছে প্রকাশিত সত্য। এবং এই অবস্থা ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান সর্ব্ব কালের জন্য চলতে থাকে, এবং আমাদের ব্যষ্টি স্বভাব এটাকে উপলব্ধি করতে থাকেন, আর সমষ্টি স্বভাব সাক্ষী হিসেবে নির্লিপ্ত থাকেন। অর্থাৎ জীবাত্মা এটাকে মনোময় শরীরে উপভোগ করেন। একটা কথা মনে রাখতে হবে, আত্মার কোনো ভোগ নেই, আত্মা কেবল পরস্পর বিরুদ্ধ সত্ব রজঃ ও তম গুন্ জনিত সুখ-দুঃখাদি অবগত হয় থাকেন মাত্র, তাঁকে এসব ভোগ করতে হয় না। বায়ু যেমন কাঠ দ্বারা জ্বলতে থাকা অগ্নিতে প্রবেশ করে, ঠিক তেমনি আত্মা ইন্দ্রিয়সমুদায়ে প্রবিষ্ট হন। কিন্তু পরমাত্মা যেহেতু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, তাই জ্ঞান, ঋষিবাক্য, বিচার এবং সবশেষে সজ্ঞা দ্বারা তার দর্শনলাভের চেষ্টা করাই সঙ্গত।
মানুষ ইন্দ্রিয়দ্বারা আত্মাকে বুঝতে পারে না। কিন্তু সর্বজ্ঞ সর্ব্বদর্শী পরমাত্মা সবসময় আত্মাকে দেখছেন। হিমালয়ের অনেক দুর্গম জায়গা আছে, যেখানে এখনো মানুষ যেতে পারে নি। চাঁদের পৃষ্ঠদেশে কি আছে, বা শুক্রগ্রহে কি আছে, তা আমাদের কাছে এখনো অজানা । কিন্তু চাঁদকে আমরা দেখতে পাই। হিমালয় সম্পর্কে একটা ধারণা থাকলেও, সমগ্র হিমালয় সম্পর্কে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। ঠিক তেমনি মানুষের মধ্যে আত্মজ্ঞান থাকলেও তাকে আমরা সম্পূর্ণ রূপে জানতে পারি না। আত্মজ্ঞান ভিতর থেকে উদয় হয়। আপনা থেকেই আত্মজ্ঞান হয়ে থাকে। এর জন্য কোনো বিষয়ের আশ্রয় নিতে হয় না। পন্ডিতগণ আজকে যে সুন্দর বৃক্ষটি দেখছেন, তারা জানেন, এই বৃক্ষের কোনো রূপ আগে ছিল না, আবার পরেও থাকবে না। তবু গাছটি অপরূপ সুন্দর । পন্ডিতগণ জানেন, সূর্যের চারিদিকে পৃথিবী ঘুরছে, এমনকি সূর্য্যও গতিশীল, এগুলো প্রতক্ষ্যভাবে জ্ঞাত হওয়া সম্ভব নয়, তথাপি এই অপ্রতক্ষ্য জ্ঞান বিচারের দ্বারা অবগত হওয়া যায়। ঠিক তেমনি, সুদুর্লভ হলেও, বুদ্ধিরূপ প্রদীপের দ্বারা আত্মাকে নিরীক্ষণ করা সম্ভব। জ্ঞানের স্বরূপ এবং জ্ঞেয় পরমাত্মাতে বিলীন করতে অভিলাষ করে থাকেন। অর্থাৎ নিজেকে পরমাত্মার সঙ্গে একাত্মীভূত করার প্রয়াস করে থাকেন। মনের মধ্যে আকুলতা ব্যাকুলতা যত বাড়তে থাকে, বিলীন হবার উপায় তত স্পষ্ট হতে থাকে। জেলেরা বড়শিতে মাছ গেঁথে, মাছ ধরে থাকে। শিকারীরা পোষা হরিণ দিয়ে, বনের হরিণকে খাঁচায় ঢোকায়। পোষা পাখি দ্বারা আকাশের পাখি, কুনকো হাতি দ্বারা জঙ্গলের হাতি ধরা যায়। ঠিক তেমনি জ্ঞান দ্বারা জ্ঞেয়পদার্থ ধরতে হবে। কথায় বলে, সাপ কুন্ডলি পাকিয়ে তার লেজ বা চরণ নিরীক্ষণ করে থাকে। ঠিক তেমনি জড়দেহ মধ্যে যে জ্ঞান, যা আসলে জড় নয়, কিন্তু জড় দেহের মধ্যেই থাকে। সেই জ্ঞানই পারে, দেহমধ্যে সূক্ষ্ম যে জ্ঞেয় বস্তু আছে তাই প্রত্যক্ষ করতে। দেখুন, চোখ চোখকে দেখতে না। কানের কোনো কেন নেই। ইন্দ্রিয় কখনো ইন্দ্রিয়কে জানতে পারে না। ঠিক তেমনি বুদ্ধি দ্বারা পরম-বোধ্যকে জানা সম্ভব নয়।
চাঁদ সবসময় আকাশে আছে, তথাপি অমাবস্যার সময় দেখা যায় না। আত্মা মানুষের শরীরে বর্তমান থাকলেও, কেউ তাকে প্রত্যক্ষ করতে পারে না। আবার আত্মা শরীর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেও তাঁকে কেউ প্রত্যক্ষ করতে পারে না। চাঁদ যেমন অমাবস্যান্তে আবার রূপ পরিগ্রহ করেন। ঠিক তেমনি আত্মা দেহান্তর প্রাপ্ত হয়ে পুনরায় প্রকাশিত হন। চাঁদ যেমন ধীরে ধীরে প্রত্যক্ষ হন, বৃদ্ধি প্রাপ্ত হন, আবার ক্ষয় প্রাপ্ত হন, এটি চাঁদের স্থূল দেহের গুন্। ঠিক তেমনি জীবের স্থূল দেহের জন্ম, বৃদ্ধি, ক্ষয়প্রাপ্ত বা মৃত্যু হয়ে থাকে। এগুলো স্থুলদেহের গুন্ বা পরিনাম। আত্মাতে এই গুন্ বা এই যে ক্ষয়-বৃদ্ধি জনিত পরিনাম, কখনোই আরোপ করা যায় না। চাঁদের দ্বিতীয়া, পঞ্চমী, একাদশী আছে। এবং একেক সময় তার আকার বা রূপের পরিবর্তন হয়, কিন্তু আমরা জানি চাঁদ একই আছে। ঠিক আমাদের বাল্য অবস্থা, কৈশোর অবস্থা, যৌবন অবস্থা, প্রৌঢ় অবস্থা বা বার্ধক্য অবস্থা আছে কিন্তু আমরা জানি মানুষটি সেই একই আছে। রাহু যেমন চাঁদকে বা সূর্যকে গ্রাস করলে, আমরা রাহুর (ছায়া) অস্তিত্ত্ব টের পাই, আবার পরিত্যাগ ৰলে আর দেখতে পাই না, ঠিক তেমনি আত্মা যখন জীবদেহে প্রবেশ করেন, তখনই তাকে অনুমান করা সম্ভব হয়। আবার দেহ পরিত্যাগ করলে আর তাকে অনুমান করা সম্ভব নয়। চাঁদ যেমন অমাবস্যাতে অদৃশ্য থাকলেও, নক্ষত্রমন্ডলী তাকে পরিত্যাগ করে না ঠিক তেমনি আত্মা শরীর থেকে মুক্ত হলেও কর্ম্মফল থেকে মুক্ত হতে পারেন না। কর্ম্মফল নিয়ে আত্মা ভূমন্ডলে ভ্রমন করে থাকেন । কিন্তু তখন তিনি উপনিষদের ভাষায় শ্রদ্ধা (অর্থাৎ আত্মবীজ ) । বীজে সব আছে, কিন্তু প্রকাশ নেই। বীজ পূর্নতা পায় না, যতক্ষন না সে প্রকৃতির সহযোগিতা পায়। তাই আত্মা যখন স্থুল প্রাকৃতিক পঞ্চভূতের দেহর মধ্যে প্রবেশ করে তক্ষুনি তাকে ধরতে হয়। বড়শির আঁধারে মাছ যখন ঠোকর মারে, ঠিক তক্ষুনি তাঁকে ডাঙায় তোলে জেলে।
আত্মা সর্বত্র আছে।আবার দেহের মধ্যেও আছে। জেলে যেমন মাছ ধরতে গেলে জালের সাহায্য নেয় । মাছকে গন্ডিবদ্ধ করবার জন্য। ঠিক তেমনি আমাদের এই দেহ জালের সাহায্য নিতে হবে। আত্মাকে ধরতে গেলে আমাদের দেহ-জালকে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের এই স্থুল দেহ এই জাল। এখানে প্রতিনিয়ত আত্মা অর্থাৎ চেতনশক্তি প্রবেশ করছেন আবার বেরিয়ে যাচ্ছেন। অর্থাৎ এই মনুষ্য দেহে আত্মার প্রতিনিয়ত যাতায়াত। তাই জাল দিয়ে যেমন জেলে মাছ ধরে, আমাদের দেহ-জাল দিয়ে আমাদের আত্মাকে ধরতে হবে।
যোগীরা বলছেন, আমাদের শ্বাসের সঙ্গে তিনি প্রতিনিয়ত যাতায়ত করছেন, আমরা যদি নিবিষ্ট চিত্তে এই শ্বাস-প্রশ্বাসের গতির দিকে দৃষ্টি রেখে স্থির হয়ে বসে থাকতে পারি, তবে আমরা চেতনশক্তি বা আত্মাকে আমরা ধরতে পারবো। দর্শন করতে পারবো।
হঠযোগীগণ বলছেন, আমাদের শরীরের নাড়ীশুদ্ধি করে, অর্থাৎ আমাদের সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে যে শ্লেষ্যা ও মলাদি আছে তা পরিষ্কার করে, বায়ুকেকে দেহাগ্নি দ্বারা প্রজ্জ্বলিত করে, উর্দ্ধগতিসম্পন্ন করে, সুষুম্না নাড়ীর ভিতর দিয়ে ব্রহ্মদেশে নিয়ে যেতে পারি, তবে সেখানে আমাদের ব্রহ্ম সাক্ষাৎকার হয়।
ঈশ্বরভক্ত গন বলছেন, আমরা যদি প্রার্থনা ধ্যান-জপ করি তবে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করতে পারি। এমনি নানান পথের সন্ধান দিয়েছেন আমাদের মুনি ঋষিগণ। আমরা যেকোনো পথেই ঈশ্বরের সন্ধান করতে পারি। তবে যে ভূমির উপরে দাঁড়িয়ে, এই সাধন সাধনা করতে হবে, তা এই মনুষ্য শরীর। এই স্থুল শরীর। এর অন্যথা নেই। তাই প্রজাপতি মনু বলছেন, আত্মদর্শনের একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে এই মনুষ্য শরীর যার কোনো বিকল্প নেই।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
No comments:
Post a Comment