পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে মনকে শান্ত করবার প্রাথমিক উপায়।
ধ্যানে প্রবৃত্ত হবার প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে শান্ত মনের অধিকারী হতে হবে। এই মনকে শান্ত করবার জন্য ধ্যানের আগে আমরা ধারণা দিয়ে শুরু করি। ধারণা দুরকম। স্থুল ধারণা ও সূক্ষ্ম ধারণা। স্থূল বস্তুর উপর মনকে একাগ্র করাকে বলে স্থূল ধারণা। আর সূক্ষ্ম বস্তুর উপরে মনকে স্থির করাকে বলে সূক্ষ্ম ধারণা। আজ আমরা স্থূল ধারণার পাঁচটি উপায় নিয়ে আলোচনা করবো। এই পাঁচটি আসলে আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয়। চক্ষু, কর্ন, নাসিকা,জিহ্বা, ত্বক।
১. চক্ষু : চোখের সাহায্যে মনকে শান্ত করবার যে উপায় তাকে বলাহয় ত্রাটক। ত্রি কথাটার অর্থ হচ্ছে, কাঁছা। অর্থাৎ কাঁছা আটকে বসে থাকা। অর্থাৎ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হওয়া। এটি বিভিন্ন ভাবে করা যেতে পারে।
যে কোনো মূর্তি, বা ছবি, কাগজে একটা বৃত্ত এঁকে বা অক্ষর অর্থাৎ "ওং" এঁকে সামনে রাখুন। ছবিটিকে এমন ভাবে রাখবেন, যাকে সোজাসুজি দেখতে পারেন। আপনি স্থির হয়ে সুখাসনে বসুন। মেরুদন্ড সোজা করুন। এইবার স্থির দৃষ্টিতে আপনি আপনার লক্ষবস্তুর দিকে তাকিয়ে থাকুন। চোখের পলক ফেলবেন না। প্রথমে সমগ্র ছবিটির দিকে তাকান, তারপরে, ছবিটির বিভিন্ন অংশ দেখতে থাকুন। চোখে জল আসলে, একটু বিশ্রাম করুন, আবার শুরু করুন। ক্রমে ক্রমে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার সময় বাড়ান। তবে যদি দেখেন, যে দৃশ্য ধীরে ধীরে বড়ো হচ্ছে বা ছোট হচ্ছে, বা একাধিক দৃশ্য চোখের সামনে ভাসছে, তাহলে খানিকটা বিশ্রাম নিন। ৫-৭ মিনিট এরকম করতে পারেন।
অন্ধকার ঘরে একটি প্রদীপ জ্বেলে (সরিষার তেল বা ঘিয়ের) দ্বীপশিখার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকুন। তবে যাদের চোখের সমস্যা আছে তারা এটি করবেন না। চোখে জল পড়লে, বার বার পলক পড়লে, প্রক্রিয়া ক্ষাণিক ক্ষনের জন্য বন্ধ রাখুন। এটিও ৫-৭ মিনিট করতে পারেন।
একটা কথা মনে রাখবেন, যেকোনো একটি বস্তুকে সামনে রেখে প্রতিদিন এটির অভ্যাস করুন। আজ এটা, কাল ওটা করবেন না। এতে করে মনের স্থিরতা নষ্ট হয়।
এই ত্রাটক প্রক্রিয়ার একটা শক্তিশালী মাধ্যম হচ্ছে, বুড়ো আঙুলের নখ, কোন উজ্জ্বল স্বচ্ছ ধাতুকে সামনে রেখেও এটি করা যেতে পারে। তবে দুর্বল মানুষের পক্ষে এইসব মাধ্যমের সাহায্যে ত্রাটক করা উচিত নয়। এটি করার সময় যে সব দৃশ্য দেখা যায়, তা আমাদের সবার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নাও হতে পারে। তাতে সাধকের ক্ষতি হতে পারে। তাই নতুন সাধকদের এই অভ্যাস না করে ভালো।
একটা কথা সব সময় মনে রাখবেন, আমাদের মূল উদ্দেশ্য ধ্যান। মনকে ধ্যানের জন্য প্রস্তূত করবার উদ্দেশ্যে, এইসব প্রাথমিক ধারণা আমাদের শিক্ষা করতে হয়।
২. কর্ন বা কানের সাহায্যে - আমরা আমাদের শ্রবণশক্তিকে ব্যবহার করেও মনকে স্থির করতে পারি। প্রতিনিয়ত হয়ে যাওয়া শব্দগুলোকে শোনার চেষ্টা করুন। ঘড়ির টিক-টিক শব্দ, ফ্যানের শো-শো শব্দ, আপনার পালসবিট , বা কোনো মৃদু সঙ্গীত, বা বাজনা। কান বন্ধ করলে একটা শব্দ শুনতে পাবেন, সেটিও শুনতে পারেন। এটা উৎকৃষ্ট পদ্ধতি। এর চেয়ে আরো ভালো হচ্ছে, অনাহত ধ্বনি শোনা। তবে আগে নিজের নাড়ীশুদ্ধি করে নিন। তাহলে আপনার পক্ষে অনাহত ধ্বনি শোনা সম্ভব হবে। এই অনাহত ধ্বনি শোনা সবচেয়ে উৎকৃষ্ট।
নাড়ীশুদ্ধি প্রক্রিয়া : যেকোনো সুখাসনে মেরুদন্ড সোজা রেখে বসুন। বা নাক বন্ধ করে,ডান নাক দিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস নিন, আবার ডান নাক বন্ধ করে বা নাক দিয়ে শ্বাস ছাড়ুন। এবার বা নাক দিয়ে শ্বাস নিন ডান নাক দিয়ে শ্বাস ছাড়ুন। শ্বাস কখনো ভিতরে বা বাইরে রুখে দেবেন না। এটি আসলে অনুলোম-বিলোম। পার্থক্য হচ্ছে, এটি করবার সময়, ১০-১২ সেকেন্ড ধরে শ্বাস নিন আবার ১০-১২ সেকেন্ড সময় নিয়ে শ্বাস ছাড়ুন। ভুলেও অন্তরকুম্ভক বা বাহ্যকুম্ভক করবেন না। এটাই নাড়ীশুদ্ধি প্রক্রিয়া। এটি মাত্র ৫-৭ বার করুন। তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যেই আপনি ডানকানে একটা ভ্রমরের শব্দ শুনতে পাবেন। বা কানে যদি আসে, তার দিকে নজর দেবেন না। ডান কানের দিকে খেয়াল করুন। যদি ডান কানে এটি শুনতে পান তবেই সেটা শুনতে থাকুন। কানের সাহায্যে মনকে শান্ত করবার এটা একটা শক্তিশালী প্রক্রিয়া। খেয়াল করার চেষ্টা করুন, এই ধ্বনি কোথা থেকে আসছে। প্রথমে আপনার মনে হবে, এটি মাথা থেকে আসছে, তারপর মনে হবে হৃদয় থেকে আসছে, তারপরে মনে হবে নাভি থেকে আসছে। এটি করবার সময় যদি মাথা ঘোরে, তবে প্রক্রিয়াটি বন্ধ রাখুন। মাথাঘোরা চলে যাবে। কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু করুন।
৩. নাকের সাহায্যে : যেকোনো একটা সুগন্ধি ফুল বা ধূপের গন্ধ নিতে থাকুন। সবথেকে ভালো হয়, যদি শ্বাস-প্রশ্বাসের দিকে খেয়াল করে বসে থাকেন। চুপচাপ বসে শুধু শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিকে অনুভব করার চেষ্টা করুন। খেয়াল করার চেষ্টা করুন, বাতাস আপনার নাক দিয়ে প্রবেশ করছে, ভ্রূদ্বয়ের মাঝে আঘাত খেয়ে, বাতাস বুকের মধ্যে ঢুকছে, ফুসফুসের মধ্যে ঢুকছে, কিছুটা বাতাস পেটের মধ্যে চলে যাচ্ছে। আবার একই পথে বেরিয়ে আসছে। এটি অভ্যাস করলে, আপনার শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি ধীর হয়ে যাবে। এমনকি, এটি আর তখন পেট পর্যন্ত যাবে না। ফুসফুস পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসবে। আপনার মনোযোগের গভীরতা যত বাড়বে, বাতাসের গতি তত ধীর ও সংকুচিত হবে। একটা সময় মনে হবে, এটি শুধু নাকের ডগায় ঘোরাফেরা করছে। এই প্রক্রিয়া, আপনাকে ধারণা থেকে ধ্যানে নিয়ে যাবে, আপনার অজ্ঞাতসারে।
৪. জিভের সাহায্যে : মুখ বন্ধ করুন, জিভের আগা দিয়ে মূর্ধা স্পর্শ করুন। অর্থাৎ আপনি যখন ট, ঠ, ড, ঢ,ণ উচ্চারণ করেন, জিভ এই সময় আমাদের মূর্ধা স্পর্শ করে। এইভাবে মূর্ধা স্পর্শ করে মনটাকে সেখানে রাখুন। এই স্পর্শ সুখ অনুভব করতে থাকুন। কিছুদিন পরে দেখবেন, আপনার জিভে একটা মিষ্টি স্বাদ অনুভব করছেন। একেই যোগের ভাষায় বলে, দিব্যস্বাদ।
৫. ত্বকের সাহায্যে : আপনার শরীরের যে কোনো অংশ দিয়ে যে কোনো বস্তূ স্পৰ্শ করুন, তা সে নরম বিছানা হতে পারে, বা একটা শক্ত গাছের গুড়ি হতে পারে, এবার আপনি সেটাকে অনুভব করতে থাকুন।
আসলে মন কোনো বস্তু নয়। আমাদের স্নায়ু কেন্দ্রের ক্রিয়াকে বলে মনের ক্রিয়া।
সাধকের ভাষায় বলে চক্রের ক্রিয়া। আমাদের দর্শন-শক্তি, আমাদের শ্রবণ-শক্তি, স্পর্শশক্তি, ঘ্রাণশক্তি, ও বাকশক্তি ইত্যাদি আমাদের শরীরের বিভিন্ন স্নায়ুকেন্দ্রে আঘাত করে, এবং সেখানে স্পন্দন তোলে, তাকে চঞ্চল করে তোলে, এবং ক্রিয়াশীল করে তোলে। আমাদের বিশেষ বিশেষ জায়গায় বা স্নায়ু গ্রন্থিতে আলোড়ন তোলার সক্রিয় ভূমিকা নেয়, আমাদের পঞ্চইন্দ্রিয়। । আর ওই গ্রন্থি যখন ক্রিয়াশীল হয়ে যায়, তখনি আজব ব্যাপার সংগঠিত হয়। মানুষ তখন চিন্তাকরতে শুরু করে, ভাবনা করতে শুরু করে। এবং এই স্পন্দনধারায় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তা ধারার পরিবর্তন হয়। বিচারাধারার পরিবর্তন হয়। কর্মধারার পরিবর্তন হয়। মানুষ পাশবিক প্রবৃত্তি ত্যাগ করে, দেবমানব হয়ে যায়।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি ওম।
No comments:
Post a Comment