শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা ভাবনা
নারায়নং নমস্কৃত্য নরঞ্চৈব নরোত্তমম্
দেবীং সরস্বতীং ব্যাসং ততো জয়মুদিরয়েত।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।
সর্ব্ব উপনিষদো গাবো দোগ্ধা গোপালনন্দনঃ
পার্থ বৎসঃ সুধীর্ভোক্তা দুগ্ধং গীতামৃতং মহৎ।
সূচনা : শ্রীমৎ ভগবৎ গীতা হচ্ছে, একটা দেহতত্ত্বের গানের বই। গীতা মহাভারতের একটা গুরুত্ত্বপূর্ন অংশ মাত্র। মহাভারতের ভীষ্মপর্ব্বের ২৫ থেকে ৪২ অধ্যায় পর্যন্ত এই গীতার কথা বিধৃত আছে। গীতাকে বুঝতে গেলে আমাদের দেহের সঙ্গে এই মহাভারতের প্রধান চরিত্রগুলোর সঙ্গে আমাদের কি সম্পর্ক সেটা বুঝতে হবে। তবেই আমরা গীতার যথার্থ মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারবো। গীতায় মোট ১৮টি অধ্যায় আছে আর সমস্ত অধ্যায়ের নাম দেওয়া হয়েছে "যোগ" । যোগ কথাটার অর্থ হচ্ছে মিলন। অর্থাৎ সমস্ত অধ্যায় অধ্যয়নের সাথে সাথে, সাধারণ মানুষ যাতে ঈশ্বরের সাথে মিলনের কথা অনুভব করতে পারেন তারই আলোচনা করা হয়েছে এখানে। অর্থাৎ যতক্ষন আমরা এই আলোচনায় থাকবো, ততক্ষন আমরা ঈশ্বরের সাথেই যুক্ত হয়ে থাকবো। আসলে গীতা শুধু অধ্যয়নের বিষয় নয় এটি চিন্তন মনন ও আচরণে গীতার উপদেশগুলোকে ফুটিয়ে তুলতে পারলে, আমরা এক নতুন জীবন- শৈলীর সন্ধান পেতে পারি ।
আসলে আমি যখন খন্ড-বিখন্ড হয়ে যায়, তখন বহু আমিত্বের সৃষ্টি হয়। আর বহু আমিত্ত্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব ও অস্তিত্ত্বের লড়াই অবশ্যাম্ভাবী। আমাদের এই দেহ বহু অঙ্গের সমষ্টি মাত্র। কোনটা একটু কম গুরুত্ত্বপূর্ন কোনটা আবার বেশি গুরুত্ত্বপূর্ন। কিন্তু সবাইকে নিয়েই আমি।আমাদের প্রাণশক্তি, ঘ্রাণশক্তি, বাকশক্তি, শ্রবণশক্তি, স্পর্শশক্তি, এইসব শক্তির মিলিত সত্ত্বাই আমি। আবার এই দেহের বিনাশ ঘটলেও পাঁচটি জ্ঞানীন্দ্রিয় শক্তি ভ্রূণাকারে বেঁচে থাকে। এরাই পান্ডব। কিন্তু মারা যায় আমাদের কর্মশক্তি অর্থাৎ কুরু। তাই গীতা শুনতে গেলে আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের নিজেদের ভিতরে যে অশুভ শক্তি আছে, আর যে শুভ শক্তি আছে, এই দুই শক্তির লড়াইয়ের কাহিনী এটি। এ কোনো সাধারন যুদ্ধের কাহিনী নয়। রূপকের মাধ্যমে আমাদেরকে শোনানো হয়েছে। এবং স্বয়ং মহাযোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই কাহিনীর নায়ক। অর্থাৎ যিনি অবিনাশী অকর্তা তাঁর মুখনিঃসৃত বাণী বা শাশ্বত জ্ঞান এই গীতায় নিহিত আছে। এটি কোনো বিশেষ ধর্মের ব্যাপার নয়, এটি সত্যকে উদ্ঘাটন করা মাত্র।
এই কাহিনীর রূপক চরিত্রগুলোর দিকে আমরা একটু চোখ বুলিয়ে নেই, তাহলে গীতার মর্মার্থ বুঝতে আমাদের সুবিধে হবে। পঞ্চ পান্ডব, দ্রৌপদী ও কুন্তী সব সময় এক জায়গায় থাকেন । এর কারন কি ?
একজন মানুষের মৃত্যু প্রক্রিয়ার সঙ্গে দ্রৌপদী ও পঞ্চপাণ্ডবের মৃত্যু প্রক্রিয়ার সম্পর্ক কী । আর এঁদের জন্মের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কোথায় ? এসব আমাদের ভালো করে বুঝতে হবে, তবেই গীতাকে ধরতে পারবো।
একএক করে পঞ্চপান্ডব সিদ্ধান্ত নিলো তারা রাজ্যপাট দেখাশুনা করবে না। তারা অর্জুন ও সুভদ্রার পুত্র অভিমন্যুর ছেলে পরীক্ষিৎকে হস্তিনাপুরের রাজ্যভার দিলেন। এবং নিজেরা মহাপ্রস্থানের পথে পা বাড়ালেন। পাঁচ পান্ডব ও দ্রৌপদীর মধ্যে, দ্রৌপদীর মৃত্যু হয় সবার আগে।
এই পাঁচ পান্ডব বা দ্রৌপদী, এমনকি দ্রোণাচার্য্য, ভীষ্ম, এঁদের কারুরই জন্ম স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয় নি।
আমরা জানি দ্রৌপদী অগ্নি থেকে উদ্ভূত। অর্থাৎ আমাদের মৃত্যুকালে দেহের এই অগ্নিতেজ আমাদের সবার আগে ছেড়ে যায়। পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কন্যা দ্রৌপদী। এঁর আর এক নাম কৃষ্ণা। গায়ের রঙ কালো বা শ্যামলা। ইনি জন্মেছিলেন, যজ্ঞাগ্নি থেকে। অগ্নিতেজঃ সম্পন্ন আমাদের এই দেহ। মৃত্যুকালে তাই এই অগ্নি আমাদের দেহ ছেড়ে দেয় সবার আগে। পাঁচ পান্ডব ও দ্রৌপদীর মধ্যেও , দ্রৌপদীর মৃত্যু হয় সবার আগে। আমাদের দেহের অগ্নি হচ্ছেন এই মহাভারতের দ্রৌপদী।
আমরা জানি অগ্নি চলে যাবার পরে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ দেহ ছেড়ে চলে যায়। এরা হচ্ছেন নকুল-সহদেব। এঁরা অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের পুত্র। এই অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের মাতা হচ্ছে সংজ্ঞা। ইনি চন্দ্রভার্য্যা। কুমারদ্বয়ের নাম হচ্ছে, আশ্বিন ও রেবন্তঃ। এঁরা জমজপুত্র। এদের দেখতে একই রকম। থাকে একই সাথে। এরা চিকিৎসা বিদ্যায় পারদর্শী। এই কথাগুলোর মাধ্যমে বুঝতে পারবেন, আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস হচ্ছে এই নকুল ও সহদেব। এঁরাই আমাদের সংজ্ঞা দান করে থাকেন। আর এই শ্বাস-প্রশ্বাস আমাদের শরীরের সমস্ত রোগ নিরাময়ে সাহায্য করে থাকে।
অর্জুন : দেবরাজ ইন্দ্রের পুত্র হচ্ছে অর্জুন। ইন্দ্র হচ্ছেন দেবতাদের রাজা। অর্থাৎ সমস্ত শুভশক্তির রাজা। আমাদের মধ্যে যে রাজসিক শক্তি আছে, অর্জুন তার প্রতিভূ। এই রাজসিক শক্তির দ্বারাই আমরা কর্মে লিপ্ত হই। এবং এই শক্তি সুকর্ম দুস্কর্ম দুটোই করতে সক্ষম। তাই অর্জুন হচ্ছে আমাদের পুরুষকার-এর প্রতীক এক শুভশক্তি । ইচ্ছে করলে বা মনে করলে আমরা যুদ্ধ করতেও পারি, আবার নাও পারি। অপ্রতিরোধ্য শক্তি আছে আমাদের মধ্যে। যাকে আমরা শুভ বা অশুভ দুটো কাজেই কাজে ব্যবহার করতে পারি, আবার নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারি । কিন্তু নকুল-সহদেব অর্থাৎ আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস চলে গেলে এই পুরুষকার কোনো কাজে লাগতে পারে না। তাই অর্জুন মারা যান।
ভীম : ভীম হচ্ছে বায়ুপুত্ৰ। বায়ুর অসীম শক্তি। ভীম এই বায়ুর প্রতীক। আমাদের উর্জ্বা শক্তি। বায়ু আমাদের সমস্ত শরীরে পরিব্যাপ্ত। আমরা জানি, বায়ু দশ রকম বা বায়ুর দশটি গুন্ - প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান। এছাড়া আছে, নাগ, কূর্ম, কৃকর (অর্থাৎ কয়ার পাখি) দেবদত্ত্ব ও ধনঞ্জয় । এই মোট দশটি বায়ুর গুন্। প্রাণবায়ু আমাদের হৃদয়ে অবস্থিত। অপান আমাদের গুহ্যদেশে। নাভিদেশে আছে সমান, কন্ঠে উদানবায়ু, এবং সর্বশরীরে ছড়িয়ে আছে ব্যানবায়ু। এই পাঁচটি বায়ু প্রধান। নাগ, কূর্ম, কৃকর, দেবদত্ত্ব ও ধনঞ্জয় - এগুলো আমাদের নাড়ীতে অবস্থান করে। অর্থাৎ আমাদের শরীরে যে হাজার হাজার নাড়ী আছে, তার মধ্যে অবস্থান করে। তবে প্রধানত পাঁচটি নাড়ী অর্থাৎ ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, বজ্রাক্ষ্যা ও চিত্রাণি এই পাঁচটি নাড়ীতে অবস্থান করে। মৃত্যুকালে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলেও, এই বায়ুর ধারাবাহিকতা শেষ হতে সময় নেয়। তাই দেখবেন, ডাক্তাররা, অন্তত ৪ ঘন্টা সময় নেয়, দেহকে প্রাণহীন বলতে। ভীম আমাদের উর্জ্বা দেহ।
যুধিষ্ঠির : ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে একজন যুধিষ্ঠির আছেন। অর্থাৎ ধর্মবুদ্ধি আমাদের সবার আছে। এই ধর্মবুদ্ধি যদি আমাদের সক্রিয় থাকে তবে আমরা ভীম অর্থাৎ শারীরিক বল ও অর্জুন অর্থাৎ অর্থ-ধনুর্বিদ্যা দিয়ে এই ধর্মবুদ্ধিকে কাজে লাগাতে পারি। আর তা না হলে এই ধর্মবুদ্ধি নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে। আর ধর্ম্মবুদ্ধি আমাদের মৃত্যুর পরেও অর্থাৎ স্থুল দেহ ত্যাগের পরেও বেঁচে থাকে। তাই বলা হয়ে থাকে যুধিষ্ঠির সশরীরে স্বর্গে যান।
দুর্যোধন : আমাদের যেমন ধর্মবুদ্ধি আছে, তেমনি আছে আমাদের দুর্বুদ্ধি। এই দুর্বুদ্ধি আমাদের সদা সক্রিয়। এঁকে দমন করা সহজ নয়। সমস্ত শক্তি লাগে এই দুর্বুদ্ধিকে দমন করতে। তাই যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে সঙ্গেই জন্ম নেয় দুর্যোধনও । বলা হয়ে থাকে দুর্যোধন হচ্ছে কলির অংশে জাত । ইনি দুই বছরের উপরে মায়ের গর্ভে ছিলেন। আসলে ধর্ম না এলে অধর্মের আভির্ভাব হতে পারে না। তাই অধর্ম আসে দেরি করে, কিন্তু ধর্মযুদ্ধে অধর্ম-ই আগে চলে যায়।
কুন্তী : কুন্তীর আসল নাম পৃত্থি অর্থাৎ পৃথিবী। কুন্তীর পিতা সুরসেন ভাইয়ের নাম বসুদেব। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের পিতা। শ্রীকৃষ্ণের সম্পর্কে পিসিমা। তো পৃথিবীতেই আমাদের সবার জন্ম। আর আমরা যেখানেই যাই না কেন, পৃথিবী আমাদের সর্বদা আশ্রয় দান করে। পালনকর্ত্রী পৃথিবীকে ছেড়ে আমরা কখনো কোথাও যেতে পারি না। এই পৃথিবীই আমাদের অগ্নি, জল, বায়ুকে ধরে রেখেছে।
আমরা এক এক করে গভীরে যাবো। একটা কথা মনে রাখতে হবে, যা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন - ক্ষেত্র হচ্ছে এই শরীর আর ক্ষেত্রজ্ঞ হচ্ছে শরীরী।
অর্জুন বিষাদ যোগ - প্রথম অধ্যায়
শ্রীমদ্ভগবৎ গীতার প্রথম অধ্যায়ের নাম অর্জুন বিষাদ যোগ। যদিও প্রত্যেক অধ্যায় এক একটা যোগ। তো বিষাদ কথার মানে আমরা জানি শোক। এই অধ্যায়ে মোট ৪৬টি শ্লোক আছে। আসলে সাধারণ মানুষের আধ্যাত্মিক জীবন শুরুই হয়, এই শোক দুঃখ থেকে। যতদিন আমাদের জীবন সুখময় থাকে, ততদিন আমরা আধ্যাত্মিক জীবনের কথা ভাবতে পারি না। এটাই স্বাভাবিক। যখন আমাদের জীবনে দন্দ্ব উপস্থিত হয়, সংঘাত উপস্থিত হয়, যখন আমাদের জীবন দুঃখ বেদনায় ভরপুর হয়ে ওঠে, তখন আমরা এই দুঃখের জীবনকে কাটিয়ে উঠবার জন্য, উপায় খুঁজি। আর এই উপায় যখন আমরা জাগতিক বা পার্থিব বস্তুতে না পাই, তখন আমরা অপার্থিব বস্তুর খোঁজ করি। জীবনের এই যাত্রায়, আমরা যখন হাপিয়ে উঠি, সুখ সম্পদ আহরণ করতে গিয়ে যখন আমরা বিপদের সম্মুখীন হই, তখন আমাদের ঈশ্বরের কথা মনে পড়ে। বিরল কিছু মহাত্মা আছেন, যারা এর ব্যতিক্রম। তো এই অধ্যায়ে আমরা লক্ষ করবো, কিভাবে একটা মানুষের মনে আশঙ্কার নিবৃত্তির জন্য ঈশ্বরের আশ্রয় নিচ্ছেন।
গীতা আসলে একটা গীতি আলেখ্য। এখানে এই প্রথম অধ্যায়ে, তিনটি চরিত্র, ধৃতরাষ্ট্র, সঞ্জয় ও অর্জুন।
প্রথম বক্তা ধৃতরাষ্ট্র : বলছেন, হে সঞ্জয়, ধর্ম্মক্ষেত্ৰ কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের জন্য সমবেত হয়ে আমার ও পাণ্ডবের পুত্রগণ কি করলো ?(১/১)
ভগবৎ গীতার প্রথম বক্তা ধৃতরাষ্ট্র। শ্রোতা সঞ্জয়। ধৃতরাষ্ট্র শারীরিক দিক থেকে জন্মান্ধ। আবার অন্য দিকে পুত্র স্নেহেও অন্ধ। এনার ন্যায়-অন্যায় টনটনে জ্ঞান আছে। কিনতু স্বার্থ বিঘ্নিত হলে, অন্যায়কে সমর্থন করে বসেন। ইনি পরামর্শ দাতাদের কথা শোনেন,বোঝেন কিনতু সেই অনুযায়ী চলেন না। কারণ সত্য পথে চলার অক্ষমতা। আমরা যারা গীতার শ্রোতা বা পাঠক তারাও ভালো মন্দ সব বুঝি কিনতু করি না। আমাদের সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্রের খুব মিল। আসলে শরীর-বোধে যে আমি সেটাই গীতার রূপক চরিত্র ধৃতরাষ্ট্র । আমাদের মতো জ্ঞানান্ধ যতদিন থাকবে তত দিন এই গীতার শ্রোতা বা পাঠক থাকবে। তাইতো গীতার এতো কদর।
এবার আমরা এই ধৃতরাষ্ট্রের জন্ম বৃত্তান্তটা একবার শুনে নেই। আসলে যেহেতু মহাভারত রূপক কাহিনীর মাধ্যমে আমাদের বেদ বেদান্তের মর্মবাণী সাধারণের স্তরে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন, তাই এই সব চরিত্রের জন্মবৃত্তান্ত অদ্ভুত, অস্বাভাবিক, ও দ্বিঅর্থ-বোধক । সত্যবতীর বিয়ের আগে, তাঁর গর্ভে মুনি পরাশরের এক পুত্র জন্ম গ্রহণ করে, তার নাম ঋষি দ্বৈপায়ন বা ব্যাসদেব, যিনি এই মহাভারতের মতো অমূল্য গ্রন্থের স্রষ্টা । এর পর সত্যবতীর বিয়ে হয় রাজা শান্তনুর সাথে। রাজা শান্তনুর তিন পুত্র। এক হচ্ছে গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম। বাকি দুইজন হচ্ছেন, সত্যবতী পুত্র চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য্য। চিত্রাঙ্গদ আর এক চিত্রাঙ্গদের সাথে যুদ্ধে মারা যান। সত্যবতীর অন্য পুত্র বিচিত্রবীর্য্য দুই স্ত্রীকে রেখে সন্তানহীন অবস্থায় মারা যান। আর ভীষ্ম প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তিনি ব্রহ্মচারী থাকবেন । তো বংশরক্ষার্থে সত্যবতী ব্যাসদেবকে অনুরোধ করলেন, বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রে অর্থাৎ বিচিত্রবীর্যের স্ত্রীর গর্ভে সন্তান উৎপাদন করবার জন্য । মহর্ষি ব্যাসদেব অম্বিকার গর্ভে যখন সন্তান উৎপাদনে উদ্যত হয়েছেন, সেই সময় ঋষি ব্যাসদেবের উজ্জল চক্ষু, মাথায় বাদামি জটা, আর তার মুখে বিশাল শ্মশ্রু দেখে অম্বিকা চক্ষু মুদ্রিত করে ফেলেন । ফলতঃ অম্বিকার পুত্র হয় অন্ধ। এই পুত্রের নামই ধৃতরাষ্ট্র। এই অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের অলৌকিক ধীশক্তি, অতিশয় বলবান, কিন্তু মাতৃদোষে অন্ধ।
আসলে আমাদের দুটি সত্ত্বা। একটা ভালো আমি, আর একটা খারাপ আমি। একটা ভিতরের আমি আর একটা বাইরের আমি। এই ধৃতরাষ্ট্র হচ্ছে আমাদের বাইরের আমি। অর্থাৎ এই দেহরূপ আমি। প্রথম প্রশ্নটা আমাদের এই বাইরের আমি করছে। করছে কাকে ? করছে সঞ্জয়কে। সঞ্জয় কে ? সঞ্জয় হচ্ছে ধৃতরাষ্ট্রের সারথি। আমরা জ্ঞানান্ধ এই সব কথা শুনি। কিন্তু বুঝি না। সঞ্জয় হচ্ছে আমাদের স্মৃতি। আসলে যুদ্ধ তো দশ দিন হয়ে গেছে । এখন সেই ঘটনার স্মৃতি চারণ চলছে।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ দশ দিন হয়ে গেছে। সঞ্জয় এতদিন যুদ্ধক্ষেত্রে ছিল।এদিকে ধৃতরাষ্ট্র যুদ্ধের কোনো সংবাদ পাচ্ছে না। উদ্বিগ্ন চিত্তে অপেক্ষা করছেন। মন চাইছে কৌরবরা জিতুক। কিনতু তার জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক বলছে - পাণ্ডবরাই জিতবে। এই দ্বন্দ নিয়েই অপেক্ষমান ধৃতরাষ্ট্র খবর পেয়ে গেছেন - ভীষ্ম ভীষণ ভাবে আহত হয়েছেন। উদ্বিগ্নতা আরও বেড়েছে। তাই পুরো ঘটনা কি হয়েছে প্রথম থেকে জানতে চাইছেন। এতদিন ভেবে ছিলেন যুদ্ধ হবে না। কারণ কুরুক্ষেত্রের একটা স্থান মাহাত্য আছে। এটা ধর্মক্ষেত্র। এখানে গেলে মানুষের মনের পরিবর্তন হয়। তাই এমন হতে পারে, কুরুক্ষেত্রে গিয়ে তার ছেলেদের বা পাণ্ডবদের মনের পরিবর্তন হয়েছে। তার ছেলেরা - দুর্যোধন - দুঃশাসন হয়তো ৫-টা গ্রাম দেবার জন্য রাজি হয়ে গেল। অথবা এমনও হতে পারে ধর্মাত্মা পাণ্ডবরা ভাবলো - শুধু শুধু রাজ্য লাভের ইচ্ছায় ভাই-ভাইয়ে যুদ্ধ করা ঠিক হবে না। পাণ্ডবদের বহু গুরুজন তাদের বিপক্ষে। তাদের বধ করে রাজ্য লাভের আশা তারা ছেড়ে দিতে পারে। এই জন্য সঞ্জয় এসে যখন ভীষ্মের আহত হবার সংবাদ দিলেন তখন তার দুরাশায় জল পড়লো। তাই বিস্তারিত জানতে চেয়ে সঞ্জয়কে প্রশ্ন করলেন । প্রথম থেকে বলতো ব্যাপারটা কি হলো ? যেন রহস্যটা বুঝতে চাইছেন।
ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে - এই কুরুক্ষেত্রে একসময় দেবতারা যুদ্ধ করেছিলেন। এটা একটা তপভূমি। রাজা কুরু, এইখানেই একসময় তপস্যা করেছিলেন, এবং এখানেই যজ্ঞাদি কর্ম্ম করতেন। । যেহেতু যজ্ঞাদি কর্ম হচ্ছে বেদমতে ধর্মকর্ম, তাই এই স্থানকে বলা হয় ধর্মক্ষেত্র। এখন কথা হচ্ছে, রাজা ধৃতরাষ্ট্র যুদ্ধের স্থানটিকে ধর্মক্ষেত্র ও কুরুক্ষেত্র বললেন কেন ? আসলে ধৃতরাষ্ট্র কুরুবংশের রাজা। যদিও সন্দেহাতীত রাজা তিনি নন - পাণ্ডর প্রতিনিধি মাত্র। অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চাইছেন, আমাদেরই জায়গায় এই যুদ্ধ হচ্ছে। আর আমার পূর্বপুরুষ এই স্থানটিকে ধর্মক্ষেত্র বানিয়েছিলেন। অর্থাৎ আজ যা হচ্ছে, তাও ধর্মকর্মের অঙ্গ মাত্র।
আবার ধর্মক্ষেত্র বলা হচ্ছে এই জন্য যে ধর্মক্ষেত্র অর্থাৎ যজ্ঞক্ষেত্রে কি হয় ? আহুতি প্রদান করা হয়। আর এই আহুতি দ্রব্য হচ্ছে দেবভোগ্য। তাই এই যুদ্ধে যিনি বা যারা নিজেদের আহুতি প্রদান করবেন, তিনি দেবভোগ্য হবেন। অর্থাৎ স্বর্গলাভ করবেন।
এতো গেলো বাহ্যিক দিক। আসলে এই যুদ্ধক্ষেত্রটা হচ্ছে আমাদের দেহ। এই দে'হর মধ্যে দিয়েই আমরা যেমন দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে পারি। অর্থাৎ গ্রাস-আচ্ছাদনের জন্য নিত্যনৈমিত্তিক কর্ম সম্পাদন করতে পারি, তেমনি পারি এই দেহ দিয়েই ধর্ম্ম কর্ম্ম করতে। এই দেহ যেমন আমাদের কুকর্মের জন্য কাজে লাগতে পারে। আবার দেহের সাহায্যেই আমরা আধ্যাত্মিক জগতের কাজকর্ম্ম করতে পারি। ভগবানের সেবা করতে পারি। অর্থাৎ এই দেহই আসলে আমাদের কুরুক্ষেত্র অর্থাৎ কর্ম্ম-স্থল। এই দেহ ভিন্ন আমরা কোনো কর্মই করতে পারবো না। আর এই দেহেই অবস্থান করে আমাদের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন বৃত্তি সমূহ এবং অশুভ বৃত্তিগুলো।
সমবেত যুযুৎসবঃ - এই যুদ্ধের আগে বার বার সন্ধির চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং সন্ধি প্রস্তাব নিয়ে দুর্যোধনের দরবারে উপস্থিত হয়েছিলেন। আবার সন্ধির প্রস্তাব দিয়ে, পাণ্ডবদের কাছে দূত পাঠিয়ে ছিলেন, ধৃতরাষ্ট্র । কিন্তু সবই ব্যর্থ হয়। দুর্যোধনের ছিল, রাজ্য হারাবার ভয়। আর পাণ্ডবদের ছিল, নারীর মর্য্যাদা রক্ষা ও রাজ্যের পুনঃউদ্ধার। তাই যুদ্ধে কেউই পরান্মুখ ছিলেন না।
মামকাঃ পান্ডবাশচৈব : আমার এবং পান্ডবের। ধৃতরাষ্ট্রকে পান্ডবরা জেষ্ঠপিতা হিসেবে সন্মোধন করতেন। ধৃতরাষ্ট্র তার সন্তানদের ও পাণ্ডর সন্তানদের উপর সম মনোভাব পোষন করতেন না। এই মোহ ও ভেদবুদ্ধিই মানুষকে দন্দ্বে লিপ্ত করে। আর বিনাশের পথে নিয়ে যায়। আর একটা কথা এই শব্দচয়ন দ্বারা বোঝানো হয়, পান্ডবাশচৈব, অর্থাৎ পান্ডবরাও। তার মানে পান্ডবরা তো ধার্মিক, দেখো তারাও যুদ্ধে উদ্দত। অর্থাৎ যা ভেবেছিলাম, তা নয়। অর্থাৎ ধার্মিকরা আবার যুদ্ধে যাবে কেন। তারাতো সব ছেড়ে বনে চলে যাবে, তা কিন্তু তারা করে নি। দেখো যুদ্ধ ক্ষেত্রে এসে পৌঁছেছে। তার মানে এরা অধার্মিক।
এবার আমরা আবার সঞ্জয়ের কথায় ফিরে যাই। সঞ্জয় আসলে আমাদের স্মৃতি।
তো সঞ্জয় বলছেন : রাজা দুর্যোধন পান্ডবসেনাদেরকে ব্যুহ আকারে সজ্জিত দেখে আচার্য্য দ্রোণের কাছে গিয়ে বললেন, হে আচার্য্য আপনার বুদ্ধিমান শিষ্য দ্রুপদপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন কর্তৃক ব্যুহ আকারে সজ্জিত পাণ্ডবদের এই বিরাট সৈন্যদল দেখুন। এই সেনাদলে আছেন ভীম ও অর্জুনের সমকক্ষ মহাধনুর্ধরেরা। আছেন সাত্যকি, বিরাট, মহারথ দ্রুপদ, ধৃষ্টকেতু, চেতিকান, পরাক্রান্ত কাশীরাজ, পুরুজিৎ, কুন্তিভোজ, নরশ্রেষ্ট শৈব্য, পরাক্রমশালী যুধামন্নু, আছেন উত্তমৌজা, সুভদ্রা নন্দন অভিমন্যু এবং দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র। এরা সবাই মহারথ। (১/২-৬)
এই যে নামগুলো বলা হ'ল এগুলো আসলে সবই আমাদের শুভ বৃত্তি সমূহ। অর্থাৎ যেসকল বৃত্তি আমাদের আধ্যাত্মিক পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে থাকে।
দুর্যোধন আবার বলছেন, হে দ্বিজত্তম, আমাদের পক্ষে যেসকল বিশিষ্ট সেনাপতি আছেন, তাদের কথা শুনুন, আপনার অবগতির জন্য,তাদের নাম বলছি। আমাদের মধ্যে আছেন, আপনি নিজে, আছেন ভীষ্ম, কর্ন,(কর্ন কথাটার অর্থ আমরা জানি কান, কর্ণের আর একটা অর্থ হচ্ছে, যে নৌকা সোজা করে রাখে, কুন্তীর কন্যাকালের পুত্র এই কর্ন, আসলে শ্রবণশক্তি আমাদের যেমন জ্ঞান বৃদ্ধির সহায়ক, তেমনি এই কানই, সৎ ব্যবহারের অভাবে, আমাদের মনে বিষ ঢেলে দিতে পারে। আসলে কর্ন তার নিজ পরিচয়ের অভাবে, সমাজের কাছ থেকে তাচ্ছিল্যের স্বীকার হয়েছিল। তাই কান আমাদের আধ্যাত্মিক সাধনার সময় যেমন সাহায্য করতে পারে, তেমনি কান কুকথা শোনাতেও সাহায্য করতে পারে। তাই কানের যথাযথ ব্যবহার প্রয়োজন, না হলে সে ধর্ম্মের পথে বাধা স্বরূপ হতে পারে। ) রণজয়ী কৃপাচার্য্য,( কৃপা কথাটার মানে আমরা জানি করুনা, আসলে কৃপ ও কৃপি, শান্তনু রাজার দয়ায় পালিত। দ্রোণাচার্যকে বিয়ে করেন, এই কৃপি। তো আপনি যখন করুন কাছ থেকে কৃপা নেবেন, তখন আপনার আর ধর্ম্ম পথে চালবার ক্ষমতা থাকবে না ) অশ্বত্থামা বিকর্ন, সোমদত্তপুত্র ভূরিশ্রবা ও জয়দ্রথ। এছাড়া আমার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত - এমন আরো বহু বীর আছেন যারা অস্ত্র-শস্ত্রে সুদক্ষ ও যুদ্ধবিশারদ।
এই যে নামগুলো বলা হ'ল এগুলো আসলে সবই আমাদের অশুভ বৃত্তি সমূহ। যারা আমাদের ধর্মের পথের বাঁধা। লড়াইটা এদের সঙ্গেই।
দুর্যোধন দ্রোণাচার্য্যকে আবার বলছেন,আমাদের সেনানায়ক ভীষ্ম কর্তৃক রক্ষিত আমাদের সেনা অপর্যাপ্ত। আর ভীম কর্তৃক রক্ষিত ওদের সেনা পৰ্য্যাপ্ত। আপনারা সবাই সৈন্যব্যুহগুলোর প্রবেশদ্বারে নিজ নিজ স্থানে অবস্থিত থেকে, পিতামহ ভীষ্মকেই সমস্ত ভাবে রক্ষা করতে থাকুন।
এই পর্যাপ্ত আর অপর্যাপ্ত কথাটা দিয়ে, আমরা মনে হয়, সৈন্যদলের শক্তি সম্পর্কে একটা বার্তা দেওয়া হলো। পর্যাপ্ত কথাটার মানে হচ্ছে, যথেষ্ট অর্থাৎ যতটা দরকার। আর অপর্যাপ্ত কথাটার অর্থ হচ্ছে, পরিমিত নয়। তো দুর্যোধনের দলের সৈন্য অপর্যাপ্ত কথাটা দিয়ে কি লেখক তাদের দুর্বলতার কথা বোঝাতে চাইছেন ?
কিন্তু কথা হচ্ছে, এই পিতামহ ভীষ্ম কে ? ভীষ্ম হচ্ছে, গঙ্গাপুত্র। ইনি একদিকে যেমন ব্রহ্মচর্য্য রক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ঠিক অন্যদিকে হস্তিনাপুর রাজার হয়ে দেশরক্ষার নামেও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ইনি আসলে আমাদের ভ্রম। এই ভ্রম আমাদের শেষ অবধি বেঁচে থাকে। আর এই এই ভ্রমকে, আমরা বুঝে উঠতে পারি না। এই ভ্রম আমাদের দ্বন্দ সৃষ্টি করে দেয়। যিনি ভালো না মন্দ বিচার করা আমাদের পক্ষে মুশকিল হয়ে ওঠে। ভীষ্মের চরিত্রের মধ্যেও এই দিকটা ফুটে উঠেছে।
এবার আমরা সঞ্জয়ের মুখ দিয়ে নতুন দুটো চরিত্রের কথা শুনলাম। এক - রাজা দুর্যোধন, দুই আচার্য্য দ্রোণ। রাজা দুর্যোধন : দূর + যোধন = দুর্য্যোধন। দূর কথাটার অর্থ দুঃখজনক বা নিন্দিত হয়েছেন, যিনি যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন, আবার অন্য মানে হচ্ছে, যার সঙ্গে যুদ্ধে বহু ক্লেশ পেতে হয়। আসলে এই যুদ্ধের যিনি হোতা বা রাজা তিনি হচ্ছেন দুর্যোধন। হস্তিনাপুরের রাজা কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র তথাপি সঞ্জয় দুর্যোধনকেই রাজা বলে সম্মোধন করলেন। এতে ধৃতরাষ্ট্র খুশি হলেন, তা যদি না হতেন, তবে তিনি এর প্রতিবাদ করতেন। আসলে আমরা যা হতে পারিনি, আমার যে স্বপ্ন পূরণ হয় নি, আমার সন্তান তাই হয়েছে, এটা শুনে ধৃতরাষ্ট্র খুশিই হলেন। আবার এই শব্দের মাধ্যমে নাটের গুরুকে বা নষ্টের গোড়াকে চিহ্নিত করা হয়ে গেল।
এই দুর্যোধনের জন্ম বৃত্তান্ত একবার শুনে নেই। ব্যাসদেবের কাছে, গান্ধারী ১০০ পুত্র ও এক কন্যার কামনা করলেন। গান্ধারী যথাকালে গর্ভবতী হলেন। কিন্তু দুবছর ধরে সন্তান হচ্ছে না দেখে, এবং ধৃতরাষ্ট্রের জন্ম সংবাদ শুনে, তিনি কাউকে কিছু না বলে গর্ভপাত ঘটালেন। বেরুলো একটা মাংসপিন্ড। ব্যাসদেব গান্ধারীকে একটু বকাবকি করলেন, তারপর এই মাংশপিন্ডকে ১০১টি মাটির পাত্রে ঘি ও জল সিঞ্চন করে ১০০টি পুত্র ও ১ কন্যার জন্ম দিলেন। দুর্য্যোধন জন্মেই গাধার মতো কর্কশ ধ্বনি করতে লাগলো। এরমধ্যে অবশ্য ধৃতরাষ্ট্রে এক বৈশ্যার গর্ভে একটি সন্তান উৎপাদন করলেন, যার নাম যুযুৎসু । এছাড়া আরো একটি সন্তান উৎপন্ন করলেন, যার নাম করণ।
এবার আমরা দ্রোণাচার্য্যের কথা শুনবো। দ্রোণাচার্য্য : আচার্য্য কথার মানে হচ্ছে শিক্ষক বা গুরু। আচার্য্য দ্রোণ ছিলেন সবার অস্ত্র শিক্ষক । অর্থাৎ কৌরব পক্ষীয় দুর্যোধন দুঃশাসন সহ একশত ভাইয়ের আবার পান্ডব পক্ষীয় পাঁচভাইয়েরই অস্ত্র শিক্ষক । যিনি ভরদ্বাজ মুনির পুত্র। অশ্বত্থামার পিতা। দ্রোণীর মধ্যে অর্থাৎ কলসির মধ্যে জন্ম বলে এনার নাম দ্রোণ। পিতা ভরদ্বাজ এক সময় কামতাড়িত হয়ে বীর্য স্খলন করে ফেলেছিলেন। আর তা গিয়ে পড়েছিল একটা কলসির মধ্যে। এবং সেখান থেকেই জন্ম হয় দ্রোণের। অর্থাৎ পিতার কামতাড়িত আকস্মিক সন্তান।
সবশেষে একটা কথা বলি, মাতা-পিতার কামতাড়িত সন্তান, আকস্মিক সন্তান, এরা কখনো ভালো মানুষ হতে পারে না। আর ভালো মাতা পিতা না পেলে মহাত্মাদের জন্মও হয় না।
দুর্যোধন এগিয়ে গিয়ে দ্রোণাচার্যকে সৈন্য সমাবেশ দেখাতে লাগলেন । ভীষ্ম যখন বান বিদ্ধ হয়ে ভূমিতে লুটিয়ে পড়েছেন, দুর্যোধন তখন এই যুদ্ধের সেনাপতি করেছিলেন ব্রাহ্মণ অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যকে ।
দ্রোণাচার্য ব্রাহ্মণ। সেযুগের রীতি অনুযায়ী ব্রাহ্মণদের কাজ হলো জ্ঞান দান করা, যুদ্ধ করা নয়। আর প্রথমেই যাদের দেখালেন তারা সবাই বিপক্ষের অর্থাৎ পাণ্ডব পক্ষের। আশ্চর্য ব্যাপার হলো দ্রোণাচার্য শুধু বিপক্ষের শক্তি দেখছেন। কারন তারা সামনে আছে। নিজের শক্তি দেখতে পারছেন না। কারন ওরা সবাই আছে দুর্যোধনের পিছনে। আর দ্রোণাচার্যের পিছনে আছে বদরাগী দুর্যোধন। যে তার নিজের শক্তি সম্পর্কে সচেতন নয়, যার নিজ ধর্মও যুদ্ধ করা নয়। যার পিছনে একজন দুরাচারী দাঁড়িয়ে আছে। কি মনে হয়, এর দ্বারা যুদ্ধে জেতা সম্ভব ? প্রত্যেক মানুষকে জীবন যুদ্ধে জিততে গেলে নিজের শক্তিকে জানতে হবে - সামনে আসতে হবে।
এর পর আবার আমরা সঞ্জয়ের কথায় ফিরে যাই। সঞ্জয় বলছেন, দুর্যোধনের আনন্দ উৎপন্ন করে কুরুকুলের প্রতাপশালী বৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম উচ্চ সিংহনাদপূর্বক শঙ্খধ্বনি করলেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে অন্যরা শঙ্খ, ভেরী, প্রণব, গোমুখ প্রভৃতি বাদ্য বাজাতে লাগলো । আর সেই শব্দ থেকে তুমুল রোল উঠলো।
এর পর শ্বেতশুভ্র বিশাল রথে অবস্থিত শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন দুটো দিব্য শঙ্খ থেকে দিব্য ধ্বনি তুললেন। শ্রীকৃষ্ণ বাজালেন পাঞ্চজন্য শঙ্খ, অর্জুন বাজালেন দেবদত্ত শঙ্খ, আর ভীম বাজালেন পৌন্ড্র নামক মহাশঙ্খ। কুন্তীপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির বাজালেন অনন্তবিজয় নামক শঙ্খ এবং নকুল বাজালেন সুঘোষ শঙ্খ আর সহদেব বাজালেন মণিপুষ্প নামক শঙ্খ।
সঞ্জয় ধৃতরাষ্টকে সম্মোধন আবার বললেন - হে মহারাজ, মহাধনুর্দ্ধর কাশীরাজ, মহারথ শিখন্ডি, দৃষ্টদুম্ন, রাজা বিরাট, অপরাজিত সাত্যকি, রাজা দ্রুপদ, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র এবং মহাবীর অভিমন্যু নিজ নিজ শঙ্খ বাজালেন। সেই তুলুল শব্দ আকাশ ও পৃথিবীতে প্রতিধ্বনিত হয়ে ধৃতরাষ্ট্র পুত্রগণ ও তৎ-পক্ষীয়দিগের হৃদয় বিদীর্ন করলো।
আমরা জানি শঙ্খধ্বনি বাতাসের মধ্যে একটা বিশেষ তরঙ্গ সৃষ্টি করবার ক্ষমতা রাখে । আমরা যে কোনো শুভ কাজের আগে এই শঙ্খধ্বনি তুলে থাকি। এই শঙ্খ ধ্বনির সঙ্গে ওম এর নাদ ব্রহ্মের একটা সম্পর্ক আছে। এমনকি প্রত্যেকটি মন্ত্রের বাঁধন হচ্ছে ওম। আমরা যখন যোগের মধ্যে প্রবেশ করতে চাই, তখন এই শঙ্খধ্বনি ও ওম ধ্বনি প্রয়োগ করে থাকি।
সঞ্জয় আবার বলছেন, হে মহারাজ, আপনার পক্ষের বীরদিগকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত দেখে শস্ত্র নিক্ষেপ আরম্ভ হবার সময় কপিধ্বজ (কপি অর্থাৎ হনূমান রয়েছে যার ধ্বজে ) অর্জুন ধনুক তুলে শ্রীকৃষ্ণকে বললেন : হে অচ্যুত, (অর্থাৎ যিনি চ্যুত হন না ) যুদ্ধের জন্য যারা এখানে এসেছেন, তাদের যতক্ষন না ভালো ক'রে দেখে নেই ততক্ষন তুমি উভয় সেনার মধ্যে আমার রথ স্থাপন করো । আমাকে কাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে, তাদের আমি দেখতে চাই। যে যুদ্ধে দুর্বুদ্ধি ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রের হিতকামী যে সব নৃপতি সমাগত হয়েছেন, সংগ্রাম-ইচ্ছুক সেই সব ব্যক্তিকে আমি পর্যবেক্ষন করি।
এখানে একটা কথা খেয়াল করুন, অর্জুনকে বিশেষিত করা হচ্ছে, কপিধ্বজ ব'লে, কপি কথাটার অর্থ হচ্ছে বানর। আর বানরের স্বভাব হচ্ছে চঞ্চলতা। তো অর্জুনের মন এখন চঞ্চল। অন্যদিকে শ্রীকৃষ্ণকে বলা হচ্ছে অচ্যুত অর্থাৎ যিনি লক্ষ্য থেকে যিনি কখনোই চ্যুত হন না। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ স্থির চিত্তের মানুষ। আর অর্জুন চঞ্চল চিত্তের মানুষ, এটা বোঝাবার জন্য লেখক এই শব্দ চয়ন করেছেন।
সঞ্জয় আবার বলছেন : হে ভারত (ধৃতরাষ্ট্র) গুরাকেশকে অর্জুন এইকথা বললে, শ্রীকৃষ্ণ উভয় সেনাদলের মধ্যস্থলে উত্তম রথ স্থাপন করে ভীষ্ম-দ্রোণ ইত্যাদিদের দেখিয়ে বললেন, হে পার্থ এই সমবেত কৌরবদল নিরীক্ষণ করো। অর্জুন তখন সেখানে উভয় সেনাদলের মধ্যে অবস্থিত পিতৃব্য, পিতামহ, আচার্য্য, মাতুল, পুত্র, শ্বশুর ও সুহৃদগণকে দেখতে লাগলেন ।
সঞ্জয় বলছেন : সেই কুন্তীপুত্র অর্জুন, যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত সেই সমস্ত বন্ধু-বান্ধবগনকে দেখে পরম কৃপাবশ ও বিষন্ন হয়ে পড়লেন। এবং
অর্জুন বললেন : অর্থাৎ অর্জুনের প্রথম বাক্য, হে কৃষ্ণ, যুদ্ধাভিলাষী এইসব স্বজনকে সমুপস্থিত দেখে আমার অঙ্গ সকল অবসন্ন ও মুখ বিশুষ্ক হয়ে আসছে। আমার শরীরে কম্পন ও রোমাঞ্চ হচ্ছে, হাত থেকে গান্ডীব খসে পড়ছে এবং সমুদয় ত্বক যেন বিদগ্ধ হচ্ছে। হে কেশব, আমি স্থির হয়ে থাকতে পারছি না। আমার মন অস্থির হচ্ছে, ও নানান অশুভলক্ষ্মণ দেখতে পারছি। হে কৃষ্ণ যুদ্ধে আত্মীয়গনকে নিহত করার মধ্যে, আমি কোনো মঙ্গল দেখছি না। আমি বিজয় আকাঙ্ক্ষা করি না, রাজ্যসুখ ভোগের আকাঙ্খাও করি না। হে গোবিন্দ ! আমাদের রাজ্যে কি প্রয়োজন ? ভোগ বা জীবনে বা কি প্রয়োজন ? যাদের জন্য রাজ্য-ভোগ বা সুখের কামনা করা , সেই আচার্য্য, পিতৃব্য, পিতামহ, পুত্র, ধন ও প্রাণের মায়া পরিত্যাগ করে আমরা যুদ্ধে উদ্দত হয়েছি। হে মধুসূদন, এখানে আমার মাতুল, শ্বশুর, পৌত্র, শ্যালক, ও বৈবাহিকগন উপস্থিত, আমি মারা গেলেও আমি এদের নিহত করতে ইচ্ছা করি না। হে জনার্দ্দন, পৃথিবীর জন্য কি কথা, ত্রিলোকের সমস্ত রাজ্যের জন্য আমি কাউকে বধ করতে ইচ্ছা করি না। ধৃতরাষ্ট্র পুত্রদের বধ করে আমাদের কি সুখ হবে ? এই সব আততায়ীদের হত্যা করলে, আমাদের পাপই হবে। এজন্য আমাদের বন্ধুবান্ধব সহ ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের হত্যা করা আমাদের উচিত নয়। হে মাধব, স্বজনদের হত্যা করে কিভাবে আমরা সুখী হবো ? লোভে অভিভূত চিত্ত হওয়ায় দুর্যোধনের পক্ষের লোকেরা এই কুলক্ষয় ও মিত্রদ্রোহ জনিত পাপরাশি দেখতে পাচ্ছে না। হে জনার্দ্দন, কুলক্ষয় জনিত পাপ লক্ষ্য করেও কেন আমাদের এই পাপ কাজ থেকে নিবৃত্তি হবার জ্ঞান হবে না ? কুলক্ষয় হলে সনাতন কুলধর্ম্মসমূহ বিনষ্ট হয় ও ধর্ম্ম নষ্ট হলে অধর্ম্ম সমস্ত কুলকে অভিভূত করে ফেলে। হে কৃষ্ণ, কুল যখন অধর্ম্মে অভিভূত হয়, কুলনারীগণ ব্যভিচারিণী হয়। হে বৃষ্ণি বংশধর, কুলনারীগণ পতিতা হলেই বর্ণশংকর উৎপন্ন হয়। আবার ব্যভিচার জনিত এই বর্ণশংকর কুলের ও তার নরকের কারন হয়। শ্রাদ্ধ-তর্পন বর্জিত হওয়ায় তাদের পিতৃপুরুষগন নরকে পতিত হন। আর এই কুলনাশকারীদের কর্ম্মফলে উৎপন্ন এইসব বর্ণশঙ্কর দশ দ্বারা শাশ্বত জাতি-ধর্ম্ম ও কুল-ধর্ম্ম বিনষ্ট হয়। হে জনার্দ্দন, যাদের কুল-ধর্ম্মাদি বিনষ্ট হয়েছে, সেই মানুষগণের চিরদিন নরকবাস হয়ে থাকে - এটাই আমরা শুনেছি। হায় ! আমরা রাজয়সুখ লোভে স্বজনদেরকে বিনাশ করতে চেয়ে মহাপাপে উদ্যত হয়েছি। যদি প্রতিকারে উদ্দমরহিত এই আমাকে নিরস্ত্র অবস্থায় ওই শস্ত্রধারী ধৃতরাষ্ট্র পুত্রগন হত্যাও করে, তাতে আমার অধিকতর মঙ্গল-ই হবে।
অর্জুনের এই উক্তিগুলো সঞ্জয় বলার পরে, সঞ্জয় বললেন শোকাকুলচিত্ত অর্জুন এই কথা বলে ধনুর্ব্বান পরিহার করে, রথের উপরে বসে পড়লেন।
এখানে প্রথম মধ্যে সমাপ্তি যার নাম অর্জুন-বিষাদযোগ।।
আমরা জানি শ্রীগীতাতে মোট চারটি চরিত্র। ধৃতরাষ্ট্র, সঞ্জয়, অর্জুন, ও শ্রীকৃষ্ণ। কিন্তু এই প্রথম অধ্যায়ে সরাসরি শ্রীকৃষ্ণের মুখ দিয়ে কোনো কথা আমরা শুনতে পাই না। শ্রীকৃঞ্চের কথা একবার আমরা শুনেছি বটে, কিন্তু তা সঞ্জয়-এর মুখ দিয়ে। অর্থাৎ অর্জুনের নির্দেশে রথকে যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝে অবস্থান করে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, হে পার্থ, যুদ্ধক্ষেত্রে সমবেত কৌরবদলকে তুমি নিরীক্ষণ করো।
এখন কথা হচ্ছে, এই চারটি চরিত্র কারা ? আমাদের মধ্যে দুটো বৃত্তি সবসময় কাজ করে, একটা ভালো বৃত্তি, আর একটা খারাপ বৃত্তি। এই ভালো আমিটা হচ্ছে অর্জুন। আর খারাপ আমিটা হচ্ছে, ধৃতরাষ্ট্র। অর্থাৎ শরীরবোধে আমি ধৃতরাষ্ট্র। আর আত্মবোধে আমি অর্জুন।পরমাত্মা যখন জীবের মধ্যে প্রতিফলিত হন , তখন তাকে বলে জীবাত্মা। এই পরমাত্মার প্রতিফলিত জ্যোতিই হচ্ছেন অর্জুন। আর আমাদের স্মৃতি হচ্ছে, সঞ্জয়। স্মৃতি এমনি জিনিস যে এ সত্য বই মিথ্যে জানে না। আর শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান। বা আমার বিবেক গুরু।
আমরা যখন ধ্যানে প্রবৃত্ত হই, তখন আমাদের এই চার শক্তি ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। আর প্রথম কথাটাই বলে ওঠে আমাদের এই ধৃতরাষ্ট্র। অর্থাৎ যে রাষ্ট্রকে ধরে রেখেছে। বা আমাদের শরীর বোধ, বা শরীরী আমি । মহাভারতের যুদ্ধ তো আসলে আমাদের ভিতরের বৃত্তিগুলোর মধ্যে যুদ্ধ। আমাদের শুভ ও অশুভ বৃত্তি গুলোর মধ্যে লড়াই। আর তখন আমাদের স্মৃতিতে যা সংরক্ষিত আছে, অর্থাৎ সংস্কার ভেসে ওঠে।
গীতা আসলে স্মৃতিচারণ। মহাভারতের যুদ্ধে ১০ দিন হয়ে গেছে। ভীষ্ম শরবিদ্ধ হয়ে রথচ্যূত হয়েছেন। এই দশদিন সঞ্জয় রণাঙ্গনে ছিলেন। এর পরে, সঞ্জয় হস্তিনাপুরে ফিরে আসেন। এবং ধৃতরাষ্ট্রকে এই সংবাদ দিলেন। এতেকরে ধৃতরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন হলেন, এবং যুদ্ধের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ শুনতে চাইলেন। এখান থেকেই গীতার শুরু।
আমরা সাধারণ মানুষেরা শোক-দুঃখে যখন অভিভূত হয়ে পড়ি, যখন শোকদুঃখে আমরা মুষড়ে পড়ি, তখন সেই দুঃখের নিবৃত্তির জন্য, নানান রকম উপায়ের অবলম্বন করে থাকি। তার মধ্যে একটা হচ্ছে, দুঃখের কথা অন্যকে শোনানো। এবং প্রত্যাশা করি, অন্যের কাছ থেকে আশ্বাসের বাণী। অনেক সময় বিষয়ান্তরে প্রবেশ করতে চাই। কিন্তু সত্য হচ্ছে, সব করেও আমরা দুঃখের কথা কিছুতেই ভুলতে পারি না। বরং বেড়ে যায় ।
যাই হোক আমরা এখন একটু দেখে নেবো, অর্জুন কিভাবে, এই বিষাদচক্রের মধ্যে ঢুকে গেলো। এই যুদ্ধের সুচনাতো অনেক আগে হয়েছিল। এবং অর্জুনও মন-প্রাণ দিয়ে এই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল। যুদ্ধের জন্য তার উৎসাহ উদ্দীপনা কম ছিল না। আর তার বীরত্ব, তেজস্বিতায় সে নিজেও সন্দেহাতীত ছিল। এখন যে সব বীর যোদ্ধার সঙ্গে, বা বলা যেতে পারে, যে সব আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সে যুদ্ধ করতে চলেছে, তাদের সঙ্গেও সে আগে যুদ্ধ করেছে, এমনকি তাদের পরাজিত করেছে । বিরাট রাজার গোধন রক্ষার জন্য, সে যুদ্ধ করেছে। তখন তার মনে এতটুকু মানসিক দুর্বলতা প্রশ্রয় পায় নি। তবে আজ তার মধ্যে কেন এই দুর্বলতা দেখা দিয়েছে ? আসলে তখন তার কাছে, শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন না। আজ তার কাছে, শ্রীকৃষ্ণ আছেন। আজ এই যুদ্ধের সারথি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। আর তখন যুদ্ধের সারথি ছিল সে নিজে বা বলা যেতে পারে ধৃষ্টদ্যুম্ন।
আসলে আমরা সবাই ক্রীড়নক। যেমন চালায়, তেমনি চলি। মানুষকে যখন ভগবান সত্যের পথে পরিচালিত করতে চান, তখন তার মধ্যে বিবেক জাগ্রত হয়। আর বুদ্ধি দিয়ে অর্থাৎ শুভবুদ্ধি দিয়ে বিবেক আমাদের ভবিষ্যৎ কর্ম্মের সূচনা করতে বলেন। দস্যু রত্নাকর, সারা জীবন ডাকাতি করেছে, কোনোদিন তার এতটুকু অনুশোচনা হয় নি। কিন্তু একদিন নারদের কথায় তার মনে হলো কার জন্য ডাকাতি করছি ? কার জন্য এই পাপ কর্ম্ম করছি ? যখন সে বুঝতে পারলো, এই পাপের ভাগিদার কেউ নয়। তার মধ্যে একটা চেতনা জাগ্রত হলো। তো প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ভগবান, এই চেতনাকে জাগ্রত করে দেন। আর তখন মানুষ বিহ্বল হয়ে পড়ে। সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, কি করা উচিত আর কি করা উচিত নয়। এই যে মনের দ্বন্দ এটাও তৈরি করে দেন ভগবান স্বয়ং। আমরাও সারাজীবন দৈনন্দিন কাজের মধ্যে লিপ্ত থাকি, ভালো মন্দ কাজ আমাদের করতেই হয়। কিন্তু কখনো এর পরিণতি নিয়ে ভাবি না। বরং সাময়িক সাফল্য আমাদের পরিতৃপ্তি দেয়।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকেও প্রথমে সখা হিসেবে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। অর্জুন যখন যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝখানে যেতে চাইলেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ তাকে নিষেধ করতে পারতেন, কেননা এটা যুদ্ধনীতির বিরুদ্ধ। স্বয়ং ভীষ্ম, যুদ্ধ ঘোষণার আগেই, অর্জুনের এই সমরাঙ্গনের ভিতরে চলে আসা অবাঞ্চিত কাজের জন্য, অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। কিন্তু যেখানে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ আছেন, সেখানে কোনো অনর্থ ঘটতেই পারে না, এসব ভেবেও অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। আর স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ এসব জেনেও তাকে রণক্ষেত্রের মাঝখানে নিয়ে গেলেন। ভগবান স্বয়ং ভক্তের আদেশ পালন করলেন, আসলে এই শিক্ষা দেবার জন্য। আর তাকে সম্মোধন করলেন পার্থ নামে - কারন অর্জুনের মাতা হচ্ছেন কুন্তী যার আর একনামে হচ্ছে পৃত্থি। পৃত্থির পুত্র, অর্থাৎ সম্পর্ককে জাগিয়ে তুললেন। আসলে আমরা যতক্ষন যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝখানে না আসছি, ততক্ষন আমরা আমাদের বৃত্তিগুলোকে দেখতে পারবো না। নিজেকে দেখতে গেলে, আমাদের মধ্যে ভালো মন্দ দুটোকে দেখতে গেলে, নিজেকে আগে নিরপেক্ষ রাখতে হয়। আর ঠিক এই সময় মানুষ অসহায় আর বিপন্ন বোধ করে। একপেশে মনোবৃত্তি যতক্ষন আমাদের থাকে, ততক্ষন আমি আমাদে বুঝতেপারি না। আমি সত্যকে বুঝতে পারি না। আমাদের মধ্যে যে বিদ্যার গর্ব , যে বুদ্ধির গর্ব,, যে আত্মগরিমা, এগুলোকে নিঃশেষ না করতে পারলে, আমরা সত্যের পথে পরিচালিত হতে পারবো না। তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে এক বিচিত্র অবস্থার মধ্যে নিক্ষেপ করলেন, যাতে সমস্ত অভিমান চূর্ন হয়ে যায়। আর আমাদের যখন, অভিমান চূর্ন হয়ে যায়, আমারা তখন অসহায় হয়ে যাই, আমরা বিপন্ন বোধ করি। আর তখনি আমরা স্মরণাগতির আশ্রয় গ্রহণ করি। আমাদের জৈব-জীবনধারায় একটা রূপান্তর ঘটে।
অধ্যাত্ম জীবনেও আমাদের এই পর্যবেক্ষন ভীষণ দরকার। আমার পক্ষে কে আছে, আর বিপক্ষে কে আছে। অর্থাৎ আমার মধ্যে ভালো কি আছে, আর খারাপ কি আছে ? এই পর্যবেক্ষন ঠিক ঠিক মতো না করতে পারলে, অধ্যাত্ম জীবনে অগ্রসর হওয়া যায় না। অর্থাৎ নিজেকে জানা। কে আপন কে পর এটা ভালো করে বোঝা। আর যখন এটা আমরা প্রথম-প্রথম পর্যবেক্ষন করবো, তখন আমাদের নজরে পড়বে, আমাদের ভ্রমাত্মক দৃষ্টি। অর্থাৎ প্রথমে বুঝতেই পারবো না, কে ভালো আর কে মন্দ। আর ভ্রমের প্রতীক হচ্ছেন, ভীষ্ম। যার প্রতি আমাদের সব থেকে বেশি মোহ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা মিশ্ৰিত হয়ে আছে। আর অর্জুনেরও প্রথম নজরে আসে পিতামহ ভীষ্মকে। এই সময় আমরা আমাদের মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ আত্মীয় স্বজন্দের দেখি। মানুষ হিসেবে দেখি না, ভালো মন্দ দেখি না, আমরা দেখি আমাদের সম্পর্কের দিক থেকে। অর্থাৎ কে আমার বাবা, কে আমার মা, কে আমার ভাই ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্জুনও তাই দেখছিলো। ও ভ্রমের মধ্যে পড়ে পিতৃব্যকে দেখছিলো। এটাই মায়া। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে এই মায়ার মধ্যে ফেলে দিয়ে শিক্ষা দিতে চাইলেন। দ্বন্দ্বের মধ্যে ফেলে দিয়ে তাকে বিভ্রান্ত করলেন।
অর্জুন উভয়পক্ষের সেনাদলের মধ্যে নিজের এই জন্মের আত্মীয়-স্বজনদের দেখে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বিবশ হয়ে পড়লেন। হাত থেকে তার ধনুক খসে পড়লো। আর এটাই হয়, যে কোনো ভালো কাজে বেরোতে গেলে পুরাতন অনেক কিছুকে ছেড়ে যেতে হয়। আমরা যখন উচ্চশিক্ষার জন্য বাড়ির বাইরে যেতে উদ্যোগ নেই, তখন আমাদের মধ্যে এই ভাবনার উদয় হয়, এই মা-বাবা-দাদা-ভাই-বোন-বন্ধু-বান্ধব এদের ছেড়ে আমি থাকবো কি করে ? এদের ঘিরেই তো আমার সুখদুঃখ। এদের জন্যই আমার সুখের সন্ধান। তো এই সময় আমাদের মায়া মমতা করুনা, ভালোবাসা, পূর্ব্বস্মৃতি, জেগে ওঠে।আর এখন অর্জুন যে অবস্থায় পড়েছে, সেটা তো আরো বেশি মারাত্মক। কেননা এই যুদ্ধে তাকে অনেক আত্মীয়-স্বজন হারাতে হবে। সুখভোগ তো একা করা যায় না, সবাইকে নিয়ে ভাগ করে সুখ ভোগেই সব থেকে বেশি আনন্দ। এর থেকেও বড়ো কথা হচ্ছে, অর্জুন এমন একটা কাজে লিপ্ত হতে যাচ্ছে, যাতে তার নিজের জীবনও বিপন্ন। বিপক্ষে তার নিজের গুরুদেব দ্রোণাচার্য আছেন, যিনি তাকে অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছেন। আছেন, মহাবীর কর্ন, আছেন, পিতামহ ভীষ্ম, যার সঙ্গে অর্জুন স্নেহবন্ধনে আবধ্য । এদের যুদ্ধে পরাজিত করা আর এদের কাছে পরাজিত হওয়া, দুটোই ভবিষ্যতের পক্ষে ক্ষতিকারক। হয়, এদের মধ্যে কেউ না কেউ মারা যাবে, নতুবা অর্জুন নিজেই মারা যাবে। এটাতো একটা উভয় সঙ্কট। এই সংকট থেকে বেরুতে গেলে, যুদ্ধ নামক ভীষণ-ভয়ঙ্কর কাজ থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়।
আসলে আমাদের জীবন একটা যুদ্ধ। আমরা যেখানে আছি সেটা একটা মৃত্যুপুরী। ইহজগতের রঙ্গ-তামাশা দেখে মানুষ ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে, আকুতি মিনতি করে, এই দেহ ধারনের জন্য। তো ভগবান যখন তাঁকে জীবদেহ ধারণের জন্য, মাতৃগর্ভে প্রবেশ করায়, তখন মাতৃগর্ভের অসহ্য যন্ত্রনা, পুঁজ-রক্তের মধ্যে বাস করতে হয়, তখন সে আবার ভগবানকে ডাকতে থাকে, এর থেকে পরিত্রান পাবার জন্য। কিন্তু তখন তো আর কিছু করার থাকে না। অনেক দেরি হয়ে গেছে। দশমাস দশ দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। গর্ভ-যন্ত্রনা শুরু হয়ে গেছে। শঙ্খধ্বনি বেজে উঠেছে। যুদ্ধের দামামা বেজে গেছে। এখনতো আর এর থেকে পরিত্রানের উপায় নেই। ভগবান তখন তাকে শান্তনা দেয়, উৎসাহ যোগায়, জীবনে সুকীর্তি রেখে যাবার কথা বলে, এগিয়ে যেতে বলে। চরৈবতি চরৈবতি। এটাই গীতা। ভগবানের বাণী। ভগবানের গান। এই গান আমরা আগেও শুনেছি, পরেও শুনবো।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি ওম ।
নারায়নং নমস্কৃত্য নরঞ্চৈব নরোত্তমম্
দেবীং সরস্বতীং ব্যাসং ততো জয়মুদিরয়েত।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।
দ্বিতীয় অধ্যায় : সাংখ্যযোগঃ
এর আগে আমরা শ্রীগীতার প্রথম অধ্যায় অর্থাৎ অর্জুন বিষাদ যোগ-এর কথা শুনেছি। এবারে আমরা দ্বিতীয় অধ্যায় অর্থাৎ সাংখ্যযোগ -এ প্রবেশ করবো। এই সাংখ্য যোগ বুঝতে গেলে আগে যেটা দরকার তা হচ্ছে, কার সাথে কার কথা হচ্ছে, কোথায় বসে কথা হচ্ছে। একটা কথা বলি অধ্যাত্ম জগতে যার প্রবেশের ইচ্ছে হয়েছে, তিনিই এই পড়বার এবং বুঝবার যোগ্য। এতো নিছক কবিতার বই নয়। এটি একটি রূপক গল্পের মাধ্যমে ঋষি ব্যাসদেব আমাদের অধ্যাত্মিক জ্ঞান দান করছেন। এবং স্বয়ং ভগবানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দিচ্ছেন। তো যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝখানে একটা রথ। তো আমরা যখন গীতার ভাবনার মধ্যে প্রবেশ করবো, তখন এই যুদ্ধক্ষেত্রের চিত্র যেমন আমাদের চোখের সামনে ভাসতে থাকবে, তেমনি ভাসবে, রথ আর রথে উপবিষ্ট জীবাত্মা-অর্জুন, বিবেকরূপী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। ইন্দ্রিয়রূপী ঘোড়া, যার লাগাম হচ্ছে মন স্বয়ং আর এই লাগাম ধরে আছেন, বিবেকেকরূপী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের । শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, এই শরীর হচ্ছে রথ, আর শরীরী হচ্ছেন রথী। তো ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, অর্থাৎ বিবেকরূপী ভগবান আমাদের রথী। রথ হচ্ছে আমাদের শরীর। মুন্ডক উপনিষদ(২/২/৬) বলছে, রথচক্রে বহু শলাকা থাকে, আমাদের হৃদযন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ধমনীগুলোই চক্রের শলাকা ।
কঠ উপনিষদ (১/৩/৩) বলছেন, শরীরটা হচ্ছে একটা রথ। জীবাত্মাকে বলছেন রথের রথী, বুদ্ধিকে সারথি, আর মন হচ্ছে বল্গা। ইন্দ্রিয়সকল আমাদের রথের ঘোড়া। ইন্দ্রিয়গুলো যেমন চঞ্চল, রথের ঘোড়াগুলোও চঞ্চল। এই দুজনকেই নিয়ন্ত্রণ করা বড় কঠিন।
গীতা এমন কোনো পরশপাথর নয় যে আমি মারা যাবার পরে, আমার মৃতদেহের উপরে পুস্তকটি রেখে দিলে আমার বিষ্ণুলোক প্রাপ্তি হবে । বা দুবেলা চন্দন-তুলসীপাতা দিয়ে পুজো করলে , আমার কোনো উপকার হবে। কিন্তু গীতা এমন একটা পবিত্র গ্রন্থ যা মনন করলে আমরা ঈশ্বরের সান্নিধ্য অনুভব করতে পারি। যে কোনো উপন্যাস বা গল্পের বই পড়লে যেমন আমাদের সামনে উপন্যাসের চরিত্রগুলো বা গল্পের চরিত্র গুলো আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে , তেমনি গীতা যখনই আমরা অধ্যায়ন করবো , তখন আমাদের মানসপটে একটা চিত্র ফুটে উঠবে, যা অর্জুন অর্থাৎ জীবাত্মার সাথে শ্রীকৃষ্ণের অর্থাৎ পুরুষোত্তমের সঙ্গে কথোপকথন। গীতার এইখানেই বৈশিষ্ঠ।
এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি। গল্পটা আপনাদের সবার জানা। কোনো এক মন্দিরের সিঁড়িতে বসে এক স্বল্প-শিক্ষিত ভক্ত প্রতিদিন, গীতা পাঠ করতেন । পণ্ডিত তীর্থযাত্রীরা, বা পুরোহিত ব্রাহ্মণরা এটা দেখে, এবং তার ভুল উচ্চারণ শুনে হাসি-তামাশা করতো। তো একদিন, এক মহাত্মা সেই মন্দিরে আসেন। আর সেই স্বল্প শিক্ষিত ভক্ত মহাত্মাকে অনুরোধ করলো, গীতা পড়ে শোনাবার জন্য। মহাত্মা তাঁকে গীতা পরে শোনালেন , এবং তাকে জিজ্ঞেস করলো, সে প্রতিদিন গীতা পড়ে কেন ? তো তার উত্তরে, সে একটা গভীর অনুভবের কথা বললো আর তা হচ্ছে, "আমি যখন গীতা পড়ি, আমার সামনে তখন রথে অরূহ স্বয়ং ভগবান ও অৰ্জুন - এর দৃশ্য ভাসতে থাকে। আর আমার অন্তরে ব্যথা অনুভব করি, আমার চোখে আনন্দ অশ্রু ভ'রে আসে। আসলে গীতা প্রতিদিন অধ্যয়ন করতে হয়, ঠিক এই দৃশ্যটি দেখবার জন্য।
যাইহোক, দ্বিতীয় অধ্যায়ের নাম সাংখ্যযোগ। সাংখ্য কথাটার অর্থ হচ্ছে জ্ঞান। কিন্তু সাংখ্য-দর্শন বলতে আমরা বুঝি মহামুনি কপিলদেবের রচনা "সাংখ্যদর্শন"। আর এই সাংখ্যদর্শনে আমরা পাই সর্বোচ্চ জ্ঞান। অর্থাৎ পরম-পুরুষ ও প্রকৃতির স্বরূপ কি. আর এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্যই বা কি ?অন্যদিকে এই গীতার সাংখ্যযোগে আমরা পাই আত্মা ও অনাত্মার স্বরূপ। ভক্ত ও ভগবানের সঙ্গে সম্পর্ক।
এই দ্বিতীয় অধ্যায়ে ৭২-টি শ্লোক আছে। আসলে গীতার যে সর্বোচ্চ জ্ঞান তা আমরা দেখতে পাই, এই অধ্যায়েই। এর পরে যা আছে, সেগুলো হচ্ছে, বিচার বিশ্লেষণ ও উপদেশ। প্রথম অধ্যায়ে আমরা ধৃতরাষ্ট্র, সঞ্জয়, দুর্যোধন ও অর্জুনের কথা শুনেছি। এবং সেখানে যুদ্ধের যে ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে, সে সম্পর্কে আমরা অর্জুনের মুখে শুনেছি। এবং এই পরিণতির কথা ভেবে, অর্জুন বিহ্বল হয়ে পড়েছে, । কিন্তু যাঁকে সে এসব কথা বলছে, তিনি কিছু জবাব দিচ্ছেন না দেখে, ধনুর্বান রেখে রথের উপরে বসে পড়েছে। আর দ্বিতীয় অধ্যায়ে অর্জুনসখা শ্রীকৃষ্ণ কথা বলা শুরু করেছেন।
সঞ্জয় বলছেন, মধুসূদন, অর্থাৎ যিনি মধু নামক রাক্ষসকে বধ করেছিলেন, স্বীয় সখা পার্থকে কাতর হয়ে পড়তে দেখে, শোকাকুল দেখে ও কৃপার যোগ্য মনে করে, তিনি (মধুসূদন) বললেন। আসলে আমরা জানি,মধু শব্দের একটা অর্থ হচ্ছে ইন্দ্রিয় তৃপ্তি। তো এই ইন্দ্রিয়তৃপ্তি-কে যিনি নাশ করেন, তিনিই মধুসূদন।
এর পরেই আমরা দেখতে পাই, ভগবান উবাচ। হঠাৎ মহামুনি ব্যাসদেব "ভগবান বলছেন", একথাটা কেন বলতে গেলেন। আসলে ব্যাসদেব বেদ বিভাজন করতে গিয়ে, যে অতিউচ্চ জ্ঞানের সন্ধান পেয়েছিলেন, সেসব জ্ঞান সাধারণের মধ্যে বিলি করবার জন্য, প্রয়াস শুরু করেছেন। অর্থাৎ আমাদের সবাইকে অর্থাৎ মানব সমাজকে ডেকে বলতে চাইছেন, দেখো ভগবান কথা বলছেন, অর্থাৎ যা তুমি কোনোদিন শোনো নি, যাকে তুমি কোনোদিন দেখোনি, তিনি স্বয়ং কথা বলছেন। এইখানেই ব্যাসদেবের বৈশিষ্ঠ, বা বলা যেতে পারে, সার্থক কৌশল । কারন যে উচ্চ জ্ঞান এখন পরিবেশন হতে চলেছে, তা সাধারণ কাউকে দিয়ে বলালে, সেসব গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। এটা পরিবেশনার কারুকার্য। দেখুন ভগবত সত্ত্বা কখনো প্রমান সাপেক্ষ হতে পারে না। ভগবত সত্ত্বা কেবল মুনি-ঋষিদের অনুভূতিতে ধরা দিয়েছে। বাক্য-মনের অতীত যে জ্ঞান, তাকে মানুষ কি ভাবে প্রকাশ করবে, তাই ব্যাসদেব যথাযথ ভাবে ভগবানকে ডেকে নিয়ে এসেছেন এখানে। আর এই কারণেই গীতার এত পাঠক। কেননা এই জ্ঞান আমরা বেদবেদান্তে পেয়েছি, কিন্তু তা সাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় নি। তাই সাধারণের মনের মানুষকে দিয়েই কথাগুলো বলাতে চাইছেন। সার্থক বিজ্ঞাপন।
ভগবান বলছেন, হে অর্জুন ! এই বিষম (সংকট) কালে কোত্থেকে তোমার এই আর্য্যগনের অযোগ্য, স্বর্গের বাধা স্বরূপ, অকীর্তিকর মোহ উপস্থিত হলো তোমার মধ্যে ? (২/২)
হে পার্থ, কাতর হয়ো না, এমন দুর্বলতা তোমার শোভা পায় না। তুমি তোমার এই তুচ্ছ হৃদয়দুর্বল্য পরিহার করে, শীঘ্র উঠে পড়ো। (২/৩)
ভগবানের প্রথম অমৃতবাণী শুনলাম আমরা। সত্যি কথা বলতে কি, উচ্চতর আধ্যাত্মিক জীবন আমাদের চিরন্তন কুরুক্ষেত্র। আর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের যে ভালো-মন্দ কর্ম্ম প্রচেষ্টা সেটা তার জীবন সংগ্রাম। নবজাতকের অসহায় ক্রন্দন থেকে শুরু হয় এই জীবন, আর মনুষ্য থেকে দেবত্বে উন্নীত হওয়াই আমাদের জীবনের লক্ষ। আর এই লক্ষ পূরণের কাজে নানান ঘাত প্রতিঘাত আসে। আমরা আশংকাগ্রস্থ হই। আমাদের সঠিক কর্তব্য সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে আমরা অপারগ হই । আমরা কিংকর্তব্যঃ-বিমূঢ় হয়ে পড়ি। আর ঠিক তখনি আমাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে অন্তর্ভেদী কাতর আকুতি উঠে আসে। আর এই আকুতি যথন গভীর হয়, তখন ভগবান এগিয়ে আসেন। তিনি আমাদের অভয় দেন। আমাদের ভেতরের যে ক্ষত্রিয়শক্তি অর্থাৎ পুরুষাকার তাকে জাগিয়ে তোলেন। আমরা যে নিত্য-শুদ্ধ-মুক্ত সেই স্মৃতি আমাদের মধ্যে জাগিয়ে তোলেন। আমরা যে স্বর্গের অর্থাৎ অমৃতলোকের অধিবাসী, সেই স্মৃতি জাগিয়ে তোলেন। এটাই ভগবানের বাণী, যা আমরা স্বয়ং ভগবানের মুখ থেকে শুনলাম। মায়ার প্রভাবে আমরা দয়াশীল হয়ে উঠি। অর্জুনের কথা শুনলে আমরা বুঝতে পারবো, অর্জুন সত্যকে দেখতে পাচ্ছে না। অর্জুন দেখছে মায়াবেশিত সম্পর্ক। অর্জুন দেখছে,তথাকথিত কুলধর্ম্ম, জাতিধৰ্ম্ম, অর্জুন দেখছে, আমি-আমার সম্পর্ককে, অর্জুন দেখছে, আত্মীয়-স্বজন বন্ধু বন্ধুবান্ধবকে, যারা এই যুদ্ধে নিহত হবে, বা হতে পারে। এমনকি যারা বেঁচে থাকবে, তাদের ভবিষতের করুন অবস্থার কথা চিন্তা করছে। অর্থাৎ তার মধ্যে একটা আশঙ্কা জাগ্রত হয়ে উঠেছে। এই যুদ্ধের একটা কাল্পনিক ভবিষ্যৎ ভেবে সে শিহরিত হয়ে উঠছে। আসলে অর্জুন একটা ক্ষুদ্র আমি ও আমারকে দেখছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই জায়গা থেকে অর্জুনকে কি ভাবে ধীরে ধীরে তুলে নিয়ে আসেন। সেটা আমরা পরবর্তীতে শুনবো। আমি ব্রহ্মান্ডবাসী, আমি পৃথিবীবাসী, আমি ভারতবাসী, আমি পশ্চিমবঙ্গবাসী, আমি কলকাতাবাসী, আমি অমুকগ্রামবাসী, আমি অমুক পরিবারের, আমি অমুক বাবার ছেলে, অমুকের আমি ভাই, অমুকের আমি স্বামী/স্ত্রী । এই আমি কিন্তু একটাই। আমার ভাবনার সীমাবদ্ধতার জন্য, আমরা আমাদেরকে ব্রহ্মান্ডবাসী ভাবতে পারি না। কিন্তু সত্য হচ্ছে, আমরা অবশ্য়ই ব্রহ্মান্ডবাসী। এই সত্যকেই উদ্ঘাটন করবার গ্রন্থ হচ্ছে শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা। আমরা ধীরে ধীরে গভীরে প্রবেশ করবো।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি ওম।
নারায়নং নমস্কৃত্য নরঞ্চৈব নরোত্তমম্
দেবীং সরস্বতীং ব্যাসং ততো জয়মুদিরয়েত।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।
আজ আমরা শ্রীমদ্ভগবতের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৪ থেকে ৯ নং শ্লোকের কথা শুনবো। এর মধ্যে ৪ থেকে ৮নং শ্লোক-এর বক্তা জীবাত্মা অর্জুন, এবং ৯ নং শ্লোকের বক্তা হচ্ছেন আমাদের স্মৃতি-রুপি সঞ্জয়।
অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে সম্মোধন করে বলছে, হে মধুসূদন ! রনভূমিতে পূজনীয় ভীষ্ম ও দ্রোণের সাথে বানের দ্বারা আমি কিভাবে যুদ্ধ করবো অরিসূদন ? (২/৪)
এখানে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে সম্মোধন করছেন, একবার মধুসূদন আর একবার অরিসূদন নামে। মধুসূদন নামের অর্থ আমরা আগে শুনেছি অর্থাৎ আমাদের ইন্দ্রিয়-তৃপ্তিকে যিনি নাশ করেন, তাকেই বলা হয়, মধুসূদন। আর অরিসূদন কথাটার অর্থ হচ্ছে, অরি কথাটার মানে হচ্ছে শত্রূ। তো আধ্যাত্মিক পথের যাত্রীদের যারা শত্রূ, অর্থাৎ আমাদের যে সব খারাপ স্বভাব আছে, অর্থাৎ হিংসা, দ্বেষ ইত্যাদি দোষ আছে, সেই সব শত্রুদের যিনি নাশ করে থাকেন, তিনিই হচ্ছেন অরিসূদন।
এখন সামনে যাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন, তার মধ্যে প্রধান হচ্ছেন, ভীষ্ম ও দ্রোণ। এই ভীষ্ম হচ্ছেন আমাদের ভ্রম উদ্রেককারী, আর দ্রোণ হচ্ছেন আমাদের প্রতিরোধ শক্তি। অর্থাৎ আমাদের যে ভ্রমাত্মক বুদ্ধি, বা অজ্ঞান এবং যে স্বচ্ছ বুদ্ধি অর্থাৎ জ্ঞান এই দুইয়েরই রক্ষাবিদ্যার নাম দ্রোণ। আমাদের দ্বৈত ভাবনা। ইনি অবশ্য়ই ব্রাহ্মণ, তার কারন হচ্ছে, ইনি জ্ঞানের ভান্ডার বা জ্ঞান কলসি। এই ভ্রম অর্থাৎ ভীষ্ম আর ভ্রমাত্মক জ্ঞানকলসি অর্থাৎ দ্রোণ আমাদের সব থেকে বড় শত্রূ। কারন এঁরা আমাদের সবথেকে কাছের মানুষ। এঁরা আমাদের জাগতিক বিষয়ের প্রতি যে টান, অর্থাৎ ভ্রমের বশীভূত হয়ে যে জ্ঞান আমরা সংগ্রহ করে থাকি, তাকে সর্বদা সত্য বলে প্রতীত হয়। এদের সঙ্গে আমরা, সাধারণ মানুষরা হৃদয়ের টান অনুভব করি। তাই এদের সাথে যুদ্ধ করতে গেলে আমাদের শরীর অবশ হয়ে যায়, হাত থেকে ধনুর্বান খসে পড়ে।
এই সংসার জীবনে আমাদের মধ্যে দুটো গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে একটা হচ্ছে রক্তের সম্পর্ক যা আমরা জন্ম সূত্রে পাই, আর একটা শিক্ষার-দীক্ষার সম্পর্ক। জন্ম সূত্রে আমরা পিতা, পিতামহ, মাতা মাতামহ, এমনি অনেক সম্পর্কের সঙ্গে জড়িয়ে থাকি। এরাই আমাদের ছোটবেলা থেকে আমাদের কোলে পিঠে করে মানুষ করেন। আমরাও তাদের স্নেহ-ভালোবাসার কাঙাল হয়ে যাই। আর এগুলো থেকে বেরিয়ে আসা শুধু কঠিন নয়, মাঝে মধ্যে মনে হয়, অসম্ভব। আবার অন্যদিকে জ্ঞানদাতা আচার্য্য আমাদের অবশ্য়ই শ্রদ্ধেও। আর শ্রদ্ধা বিনা আমাদের জ্ঞান লাভ সম্ভব নয়। তাই জ্ঞানী কখনো শ্রদ্ধাহীন হতে পারেন না। এই দুই সম্পর্কই আমাদের পূজ্য সম্পর্ক। তাই এদের শরীরের উপরে আঘাত তো দুরস্ত, মনের উপরে আঘাত করতেও আমাদের মন সায় দিতে পারে না। এমনকি ভুল করে আঘাত দিয়ে ফেললে, আমরা অনুতপ্ত হই। তাই অর্জুন সংশয় প্রকাশ করছেন, কি করে আমি এদের সঙ্গে প্রতিযুদ্ধ করবো।
অর্জুন আবার বলছে : (২/৫) মহানুভব গুরুজনদের বধ না করে ইহলোকে ভিক্ষান্ন ভোজন করা কল্যাণকর। কিন্তু গুরুজনদের হত্যা করে যে ধনসম্পদ ও রাজ্য ভোগ করতে হবে, সেতো রুধিরলিপ্ত।
শ্রীকৃষ্ণের বকুনিতে অর্থাৎ হে অর্জুন, তোমার এই কাপুরুষতা কোত্থেকে এলো ? এই কথা শুনে অর্জুনের মধ্যে একটা প্রশ্ন জেগেছে। একটু বোঝার ভুল হলো কিনা - এমন সন্দেহ দেখা দিয়েছে । যার জন্য সবাইকে অর্থাৎ অন্যান্য সমস্ত আত্মীয়স্বজনকে বাদ দিয়ে সবচেয়ে কাছের ও শ্রদ্ধেয় বা পূজনীয়জনকে অর্জুন আশ্রয় করতে চাইলো। অর্থাৎ অন্যদের কথা থাক , এই দুইজনের দান অর্জুনের জীবনে অপরিসীম। আর এঁরা শ্রীকৃষ্ণের কাছেও শ্রদ্ধার পাত্র। অতএব উভয়ের শ্রদ্ধার পাত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা নিশ্চই শ্রীকৃষ্ণ সমর্থন করতে পারেন না।
দেখুন আমাদের জীবনে শত্রূ যখন শত্রূ হিসেবে উপস্থিত হয়, তখন তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা, বা তার বিরোধিতা করা, আমাদের পক্ষে সহজ হয়। কিন্তু শত্রূ যখন মিত্রভাবে আসে, তখন তার সঙ্গে যুদ্ধ করা কঠিন হয়ে ওঠে। চোর যখন সাধু বেশে আসে, তখন তাকে আমরা চিনতে পারি না। আমাদের ভুল হয়ে যায়। আর আমরা নিঃস্ব হয়ে যাই। এই সময় বিবেকরূপী ভগবান আমাদেরকে সতর্ক করেন। তখন যদি আমরা কান না দেই, তবে আমাদের ভুল পথে পা বারাবার সম্ভবনা। রাবন সাধুবেশে এসেছিলো। তাই সীতা তাকে চিনতে পারেন নি। বিষ্ণু তুলসীর (বৃন্দা) কাছে এসেছিলো তুলসীর স্বামী সঙ্খচূড়ের বেশে। তাই তুলসী তাকে চিনতে পারেন নি। চাটুকারের বেশে আসে আমাদের শত্রূর প্রতিনিধি। সুখের বেশে আসে আমাদের দুঃখ। আমরা তাদের চিনতে অপারগ হই । কিন্তু আমাদের যদি বিবেক সজাগ থাকে, শ্রীকৃষ্ণ যদি আমাদের কাছে থাকে, তিনি আমাদের সতর্ক করে দেন। এখানেও অর্জুন যেটাকে ভালো বলে মনে করছেন, সেই ভ্রম রূপ ভীষ্ম আর আমাদের দ্বিধা রূপ দ্রোণ অর্জুনের সামনে দাঁড়িয়ে, অর্জুনকে কর্তব্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছে। কিন্তু বিবেকরূপ শ্রীকৃষ্ণের ধমকে অর্জুন কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পড়েছে।
এর পরে অর্জুন বলছে : ( ২/৬) : আমরা বুঝতে পারছিনা, আমাদের এই যুদ্ধে জয়ী হওয়া ভালো না পরাজিত হওয়া ভালো। এই দুটোর মধ্যে কোনটা আমাদের পক্ষে শ্রেষ্ট তা আমি বুঝতে পারছি না। যে আত্মীয়স্বজন অর্থাৎ ধৃতরাষ্ট্রের তনয়গনকে হত্যা করে আমরা বাঁচতে চাই না, তারাই আজ আমাদের সামনে উপস্থিত যুদ্ধ করবার জন্য।
অর্জুনের এই সব কথায় বোঝা যায়, যে অর্জুন তার এই জীবনের সম্পর্কিত আত্মীয়স্বজনদের চিন্তায় নিমজ্জিত। অর্থাৎ তার চিন্তার মধ্যে জড়িয়ে আছে তার কুল-স্বার্থ। অর্থাৎ অর্জুন এখনো সংকীর্ণ মায়া-মোহ -এর মধ্যে আবদ্ধ। অর্থাৎ তার মধ্যে স্বার্থকেন্দ্রিক মনোভাব রয়ে গেছে।
মানুষ যখন অধ্যাত্ম সাধনায় ব্রতী হয়, তখন আমাদের মধ্যে চিত্তের যে ভালো-মন্দ সংস্কার আছে, সেগুলো ভীষণ উগ্রভাবে জাগ্রত হয়ে ওঠে। এসময় আমাদের মানসিকতা অত্যন্ত ভয়ানক কষ্টকর হয় । এইসময় নানান রকম অপ্রত্যাশিত চিন্তা, অবাঞ্চিত কামনা বাসনা, আমাদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, আমাদেরকে অভিভূত করে, .দিশেহারা করে। ভবিষ্যতের কাল্পনিক ভয় আমাদেরকে আশংকাগ্রস্থ করে তোলে। আর এসবই আমাদের অজ্ঞান। সৎ-অসৎ সম্পর্কে আমাদের তথাকথিত জ্ঞান বা বলা যেতে পারে অজ্ঞান। আর এই অজ্ঞানকে কাটাতে পারে আমাদের বিবেকরূপী গুরু। তখন এই বিবেকরূপী গুরুর স্মরনাম্পন্ন হতে হয়। দ্বিধা তো থাকেই, গুরুকে গুরুরূপে চিনতেই পারি না। তখন গুরু আমাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করেন। শ্রীকৃষ্ণ তাই এখনো অর্জুনের সখা ।
আসলে গীতা ভাবনা শুরু করলে, এখান থেকে বেরিয়ে আসা খুব মুস্কিল। অর্জুনের মনের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব সেতো আমাদের সবার। অর্জুনের প্রশ্ন সেতো আমাদের সবার প্রশ্ন। আর গীতার ভাবনা আমাদের বিবেকগুরুকে জাগ্রত করে দেয়। আমরা তখন ঈশ্বরের সান্নিধ্য অনুভব করি। আর এই ঈশ্বরের চিত্র যার মানসপটে একবার অঙ্কিত হয়ে গেছে, সেতো জলের মধ্যে লবনের মতো গলিত হয়ে গেছে। তখন আর নিজেকে ঈশ্বর থেকে আলাদা করা দুঃসাধ্য হয়ে যায়। আলাদা করার সাধ ও সাধ্য তখন হারিয়ে যায়।
অর্জুন বলছেন : (২/৭) - আমি কাপুরুষতা দোষে আক্রান্ত, ধর্ম্ম অধর্ম্ম জ্ঞান হারা, বিমূঢ়চিত্ত এই অবস্থায় আমি তোমাকে (অর্থাৎ সখাকে) জিজ্ঞেস করছি - আমার পক্ষে যা কল্যাণকর তা তুমি আমাকে নিশ্চিত করে বলো। আমি তোমার শিষ্য, শরণাগত আমাকে উপদেশ দাও।
(২/৮) পৃথিবীতে প্রতিদ্বন্দ্বীহীন সমৃদ্ধ রাজ্য, এমনকি দেবতাদের উপরে আধিপত্য লাভ করেও, আমাদের ইন্দ্রিয়গনের সন্তাপদায়ী যে শোক কিভাবে দূর হবে, তা আমি বুঝতে পারছি না।
সঞ্জয় বলছেন : (২/৯) - এই কথা বলে, পারিতাপে দগ্দ্ধ নিদ্রাজয়ী অর্জুন হৃষিকেশ গোবিন্দকে "আমি যুদ্ধ করবো না" এই কথা বলে চুপ করে গেলেন।
এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে, অর্জুন কিন্তু যুদ্ধ বিমুখ নয়। কিন্তু তার যে পূর্ব-অর্জিত জ্ঞান সঞ্চয় হয়ে রয়েছে, যে তথাকথিত বুদ্ধি তার মধ্যে কাজ করছে, সেটা হচ্ছে, যুদ্ধে স্বজনদের বধ করলে পাপ হবে। আর এই যে পাপবোধ তার মধ্যে উদয় হয়েছে, তার পিছনে আছেন, সেই বিবেকগুরু। এই বিবেকগুরুই তাকে এই দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ধার করবার জন্য, অর্জুনকে দ্বন্দ্বের মধ্যে নিক্ষেপ করেছেন। ভীরুতা তার স্বভাব বিরুদ্ধ। কাপুরুষতা তার মধ্যে থাকার কথা নয়, কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ হবার কারনে সে এই কাপুরুষতা, স্বীকার করে নিলো। আর এই স্বীকার করার মধ্যে দিয়েই অর্জুন ভগবানের দিকে এক পা এগিয়ে গেলেন ।
আমাদের আধ্যাত্মিক জগতের প্রবেশ পথে এই বাধার সন্মুখীন হতে হয়, আমাদের সকলের। আমরা যখন সেই বাধা অতিক্রম করতে মানসিক দ্বন্দ্বের মধ্যে পরে যাই,তখন মনে হয়, যা করে ভগবান করুক । আমি আর ভাবতে পারছি না। ভগবান যা চায় তাই হোক। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, আমরা মাঝে মধ্যে বলি বটে যে ভাগবান যা চায় চাই হোক। কিন্তু আমাদের তথাকথিত বুদ্ধি, আমাকে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে চায়। অর্থাৎ কর্তব্য কর্ম্ম থেকে আমরা তখন সরে আসি। আর ভগবানের দোহাই দেই। আসলে ভগবানের দোহাই দেই বটে কিন্তু কর্ম্মটা করি নিজের ইচ্ছে মতো। অর্জুনও ঠিক তাই করলো, মুখে বললো, আমি তোমার শিষ্য, আমি তোমার শরণাগত, আমাকে উপদেশ দাও। কিন্তু উপদেশ পাবার আগেই নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো, "আমি যুদ্ধ করবো না"। অর্থাৎ তোমার বিচার আমি মানছি, কিন্তু আমার আল সোজাই থাকবে। অর্থাৎ যুদ্ধ না করলে যে ভালো হবে, এটা আমি নিশ্চিত, এবার তোমার দায়িত্ত্ব হচ্ছে, আমার এই যুক্তির সমর্থনে আমাকে সাহায্য করা। এইখানেই অর্জুনের সঙ্গে আমাদের খুব মিল।
কিন্তু ভগবান কখনো, আমাদের বিপথে পরিচালিত করতে পারেন না। তাই আমরা যাই করি না কেন, ভগবান আমাদের হাত ধরে নিয়ে যাবেন, সেই ধর্ম্মযুদ্ধ ক্ষেত্রে। যাতে আমাদের মঙ্গল হবে, সেই অশুভবৃত্তির নাশ আমাকেই করতে হবে। ভগবান এসে এই কাজ করে দিয়ে যাবেন না। কিন্তু ভগবান আমাদের অলক্ষে থেকে আমাকে সঠিক দিশা দিয়ে যাবেন। আমাকে তো ধর্ম্ম পথে যেতেই হবে, ভগবানই আমাদের সেখানে টেনে নিয়ে যাবেন। আমরা যত বেগরবাই করবো, তত আমাদের জীবন থেকে জীবন, যোনি থেকে যোনি পরিভ্রমন করে যেতে হবে। কিন্তু সবার জীবনে একটা দিন আসবে, যখন আমরা অসহায় হয়ে যাবো, আর ভগবান আমাদেরকে নির্দেশ দিয়ে, সঠিক পথে পরিচালনা করবেন। এর পরের দিন আমরা ভগবানের কথা শুনবো।
ওম নমঃ শ্রী ভগবতে বাসুদেবায়। ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি ওম।
নারায়নং নমস্কৃত্য নরঞ্চৈব নরোত্তমম্
দেবীং সরস্বতীং ব্যাসং ততো জয়মুদিরয়েত।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।
আজ আমরা শ্রীমৎ ভগবতের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১০ নং শ্লোক থেকে শুনবো। সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে উদ্দেশ্য করে বলছেন : হে ভারত,অর্থাৎ ভরত বংশোদ্ভব, তখন হৃষীকেশ হাসতে হাসতে উভয়-সেনাদল মধ্যবর্ত্তী বিষাদগ্রস্থ অর্জুনকে বললেন :
আমরা জানি অর্জ্জ+উন = যিনি কুবেরের ধান উপার্জন করেছিলেন। অর্জ্জ কথাটার মানে উপার্জন, তো যিনি অর্জন করেন, তিনি অর্জুন। যিনি সঞ্চয় করেন, তিনি সঞ্জয়। অর্জুন জীবাত্মা, সঞ্জয় আমাদের স্মৃতি। মহর্ষি ব্যাসদেব আমাদের রূপকের মাধ্যমে আমাদের জীবন রহস্যের কথা শোনাচ্ছেন।
ভগবানের বাণী শোনার আগে আমরা একবার এই শ্রীকৃষ্ণের কথা শুনে নেই। কে এই শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণ কথাটার সত্যিকারের অর্থ অর্থাৎ যথার্থ শব্দার্থ কি সেটা একবার একটু দেখেনেই ।
কৃষ্ণ :
কৃষ্ণ আমাদের মহাভারতের দেবকী নন্দন। বসুদেবর পুত্র। কংশ যার মামা। দেবকীর পিতা উগ্রসেন। বসুদেবের পিতা সুরসেন। অর্থাৎ মাতৃ বংশ অসুর। উগ্রসেনের বংশধর। আবার পিতৃবংশ সুর। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে দুটো শক্তি সব সময় ক্রিয়াশীল শুভ-অশুভ, সুর-অসুর, দেব-দানব, ভালো-মন্দ। আর এই দুই শক্তির মিলনে যার জন্ম তিনিই কৃষ্ণ।
কৃষ্ণ কথাটা কৃষ ধাতু থেকে উৎপত্তি।(কৃষ + ন ) কৃষ মানে আকর্ষণ করা। যিনি সকলের হৃদয় আকর্ষণ করেন, তিনিই কৃষ্ণ । ভক্তজন-পাপাদি-দোষাকর্ষণাৎ কৃষ্ণঃ। ভক্তজনের পাপ-ইত্যাদি যিনি আকর্ষণ করেন তিনি কৃষ্ণ।
কৃষ কথাটার আর একটা মানে হচ্ছে, জীব, ন কথাটার মানে আত্মা - তো জীবেবৃন্দের আত্মা স্বরূপ।
কৃষ্ণ শব্দের আরো একটা অর্থ আছে। ক কথার মানে ব্রহ্ম, ঋ (ৃ) অর্থাৎ অনন্ত শিব আর নিবৃত্তিবাচক ন - অর্থাৎ যিনি ব্রহ্ম-রূপে সৃষ্টি করেন যিনি অনন্ত, যিনি শিব রূপে সংহার করে থাকেন।
কৃষ্ণ কথাটার আর একটি অর্থ হচ্ছে আকর্ষক বা মাধ্যাকর্ষন শক্তি । অর্থাৎ যা আমাদের সকলকে আকর্ষণ করছে। জগৎ, এই প্রেম বা আকর্ষণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। আকর্ষণই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডকে সঠিকভাবে শৃঙ্খলিত করে রেখেছে। তাই কৃষ্ণকে বলা হয় প্রেমপুরুষ।
আবার কৃষ্ণকে ভাগ করলে দাঁড়ায় কৃৎস্ন + ন। কৃষ কথাটার মানে সর্ব্ব। অন্য মানে, স্তূপ, জল। ন কথাটার মানে আত্মা। অর্থাৎ জলে স্থিত বা স্তূপাকৃতি আত্মা তাকেই বলে কৃষ্ণ। এই জন্য কৃষ্ণ বা বিষ্ণুকে আমরা দেখি সমুদ্রের মধ্যে শায়িত। ক্ষিরোদসাগরে শায়িত, পাশে শ্রীলক্ষ্মী বসা।
কৃষ্ণ কথাটার আর একটি অর্থ হচ্ছে "কালো" । অর্থাৎ অন্ধকার। অর্থাৎ শুন্য বা অজানা । শুন্য থেকেই জগতের সৃষ্টি। অর্থাৎ কৃষ্ণ কথাটা দিয়ে সেই সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করা হচ্ছে যিনি গোচরীভূত নন।
ভগবান হাসছেন, অর্থাৎ অর্জুন তো এই যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করতেই এসেছিলো। এখন সেই ভাব পরিবর্তন হয়েছে, বিষাদে। আবার এটা শুনে, ভগবানের হাসি পাচ্ছে, যে সখা এখন এখন তার শরণাগত হয়েছে। এতো বড় কৌতুকের বিষয়। একবার বলছে, যুদ্ধ করবো না. আবার বলছে, যুদ্ধ করা ঠিক হবে কি না, কোনটা ঠিক সেই শিক্ষা আমাকে দেও। ভগবানের কথা শোনার আগেই অর্জুন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, সে যুদ্ধ করবে না। একদিকে শরণাগত অন্য দিকে নিজেই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিচ্ছে। এতো বড়ো হাস্যকর কথা। তাই ভগবান মিটিমিটি হাসছেন। সাধারণ উপদেষ্টা হলে, তিনি বলে দিতেন, তোমার যা ইচ্ছে তাই করো। আমাকে জিজ্ঞেস করছো কেন ? ভগবান তা করলেন না. কারন তিনি জানেন, মানুষ যখন অজানাকে ভয় পায়, মানুষ যখন আশংকায় দোলে, মানুষ যখন শোকগ্রস্ত হয়, তখন মানুষ অস্থির হয়, আর উল্টোপাল্টা বকে। ভগবান কখনো আমাদের মুখের কথায়, বিশ্বাস করেন না। আমাদের মনের কথায় বিশ্বাস করেন। আমাদের আসল ভাবকে গুরুত্ত্ব দেন। এবং সেইমতো তিনি আমাদের কাছে ধরা দেন। এর পরে আমরা ভগবানের মুখনিঃসৃত বাণী শুনবো।
যাই হোক : (২/১১) এখানে শ্রীকৃষ্ণকে হৃষীকেশ বলে সম্মোধন করা হয়েছে।হৃষীক+ ইশ = হৃষীকেশ। হৃষীক অর্থ ইন্দ্রিয়ের, ইশ অর্থাৎ ঈশ্বর। বা পরমাত্মা, স্বয়ং বিষ্ণু।
হৃষীকেশ বলছেন, অর্থাৎ স্বয়ং ভগবান বলছেন - হে অর্জুন, যাদের জন্য শোক করার প্রয়োজন নেই, তাদের জন্য তুমি শোক করছো ? আবার পন্ডিতের মতো কথা বলছো ? পন্ডিতগণ জীবিত বা মৃত কারোর জন্য শোক করেন না।
এইখানে একটা কথা বলি, অর্জুনের আদৌ কোনো শোক হয় নি। তিনি আশঙ্কাগ্রস্থ, একটা কাল্পনিক ভবিষ্যতের কথা, ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা ভেবে তার ভয় উৎপত্তি হয়েছে। যদি যুদ্ধ হয়, তবে কি হবে, সেই আশঙ্কায় অর্জুন বিহ্বল। কিন্তু ভগবান এই যদি কিন্তুর মধ্যে গেলেন না। কেননা তিনি ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। অর্জুনের আশঙ্কা অমূলক নয়। আর যদি কিন্তু কোনো জবাব হয় না। তাই তিনি যদি কিন্তু মধ্যে না গিয়ে, সরাসরি ভবিষ্যতের সত্যের জবাব শুরু করলেন।
আমরা জানি, জন্ম-মৃত্যু একটা স্বাভাবিক ও অলংঘনীয়। প্রতিদিন জীব জন্মাচ্ছে, আবার মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। এই চির সত্যকে মানুষ মেনে নিতে পারে না। তাই স্বজন-বিয়োগের চিন্তায় সে আতঙ্কিত হয়। ব্যথিত হয়। আর এর কারন হচ্ছে, আমাদের মোহ বা অজ্ঞান। যারা জন্ম-মৃত্যুর রহস্যঃ জানে না , অর্থাৎ অজ্ঞান তাদের মধ্যে মধ্যে এই মৃত্যুভয় উদ্রেগ করে। আর যারা জ্ঞানী, যারা জন্ম মৃত্যুর রহস্যঃ জেনে গেছেন, তারা কারুর মৃত্যুতে শোকগ্রস্থ হন না। তারা সদা আনন্দে থাকেন।
অর্জুন আমাদের বা লৌকিক দৃষ্টিতে বুদ্ধিমান পণ্ডিত। রাজ্যলোভে গুরুজনকে বধ করা অন্যায়। এমনকি যে কোনো জীবকে মারা বা শারীরিক নির্যাতন করা আমাদের দৃষ্টিতে অন্যায়। রাষ্ট্রের আইনও সেই কথাই বলে থাকে। আর শোক আমরা তাদের জন্যি করে থাকি, যাদের প্রতি আমরা নির্ভরশীল। অর্থাৎকারুর মৃত্যুতে আমাদের স্বার্থ বিঘ্নিত হলে, বা হবার হবার আশঙ্কা থাকলে, আমরা শোকগ্রস্থ হয়ে উঠি। পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ লোক প্রতিদিন মারা যাচ্ছে, কতজনের জন্য আমরা শোক করে থাকি। শোক করি না, কারন তাদের মৃত্যু আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কোনো ব্যাঘাত করে না। আসলে আমারা মোহগ্রস্থ। এই মোহ আমাদেরকে যেমন কষ্ট দেয়, তেমনি মোহ আমাদের স্বরূপকে ভুলিয়ে রাখে। আমাদের এই মোহ কেটে গেলে, আমাদের স্বরূপ সম্পর্কে জ্ঞান হয়। তখন আমরা শোক রোহিত হতে পারি। আর এই মোহ আমাদের তখনই কেটে যাবে, যেদিন আমরা সৎগুরুর সান্নিধ্য পাই। তখন আমরা জীবিত বা মৃত - এই ধারণাটাই পাল্টে যাবে। আমরা আসলে না জীবিত না মৃত। আমরা আদৌ জন্মাই না, আমরা আদৌ মারাও যাই না। জন্ম মৃত্যু তো দেহের আমি তো দেহ নোই, আমি দেহি। আমার স্বরূপ শাশ্বত। জন্ম মৃত্যু আমাদের চোখের ভ্রম। মনের খেলা। এর কোনো সত্যতা নেই।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি ওম।
2/2/2020
নারায়নং নমস্কৃত্য নরঞ্চৈব নরোত্তমম্
দেবীং সরস্বতীং ব্যাসং ততো জয়মুদিরয়েত।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।
হৃষীকেশ বলছেন - (২/১১) - হে অর্জুন, যাদের জন্য শোক করার প্রয়োজন নেই, তাদের জন্য তুমি শোক করছো ? আবার পন্ডিতের মতো কথা বলছো ? পন্ডিতগণ জীবিত বা মৃত কারোর জন্য শোক করেন না।
আমাদের সারা জীবন দুঃখভারাক্রান্ত। সারা জীবনটা আমাদের চলে যায়, এই দুঃখ দূর করবার লড়াই করে। আমরা যা চাই, তা পাই না। আমরা যা চাই তা ভুল করে চাই। আমরা যা পাই তা চাই না। আর যা পাই না তাই চাই। আকাঙ্খিত বস্তু পেতে আমাদের আকাঙ্ক্ষিত ধনসামগ্রী হারাতে হয়। রাষ্ট্র ক্ষমতা পেতে আমাদের আত্মীয়-স্বজনদের হারাতে হয়। এ বড় বিড়াম্বনা। ধন পেতে আমাদের শরীর চলে যায়। আবার শরীর রাখতে গেলে ধন চলে যায়। এ বড় নির্ম্মম দুঃখময় জীবন। এখান থেকে বেরুতে গেলে আমাদের হয় পাথরে পরিণত হতে হবে, নিস্প্রান হতে হবে, অথবা জীবন-মৃত্যুর উর্দ্ধে ব্রম্হময় হতে হবে। এই সংঘাত -ই আমরা দেখতে পাই অর্জুনের জীবনে। আর তাই অর্জুন বিষাদগ্রস্থ। প্রিয়জনদের রক্তে হাত রাঙাতে চাচ্ছে না অর্জুন, আবার এদের সাথে যুদ্ধ না করলে, তাঁর পৈতৃক জমির উদ্ধার হবেনা, আবার দৌপদীর সন্মান রক্ষাও করা যাবে না। এই দ্বন্দ্ব নিয়েই আমরা জীবন কেটে যায়। আমাদের জীবন কাটাই, আদর্শের রক্ষার জন্য। আর এই আদর্শের জন্য সংঘাত, আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে দুঃখময় করে তোলে।
এখন থেকে মানুষ কি করে উপরে উঠতে পারে, সেই সিঁড়ির সন্ধান দিয়েছেন, মহর্ষি বেদব্যাস। এই সিঁড়ির সংখ্যা আঠেরো। প্রথম সিঁড়িটা তাই বিষাদের। এই বিষাদ থেকে ভগবান কিভাবে আমাদের হাতে ধরে মোক্ষের পথে নিয়ে যান, সেই ক্রমোন্নতির সোপান শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা। আমাদের জ্ঞানী হতে হবে। তবে আমরা শোক দুঃখের উর্দ্ধে উঠতে পারবো।
অর্জুন কথা বলছে, তথাকথিত জ্ঞানী পুরুষের মতো, যেমন আমরা ভেবে থাকি আরকি । অর্থাৎ হত্যা তো পাপ। আর সেই পাপ কর্ম্ম করে আমরা শান্তি খুঁজছি। আমরা বিজয় খুঁজছি। সেটা কি করে সম্ভব ? এই দ্বন্দ্বের উত্তর দিচ্ছেন, হৃষিকেশ অর্থাৎ আমাদের ইন্দ্রিয়ের ঈশ্বর। অর্থাৎ এই যে আমাদের জ্ঞান বা বোধবুদ্ধি, এগুলো আমাদের ইন্দ্রিয় সঞ্জাত। অর্থাৎ এই জ্ঞান আমরা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যেই পেয়েছি । তো ইন্দ্রিয়ের যিনি অধিপতি, সেই হৃষিকেশ আমাদের ইন্দ্রিয়জাত জ্ঞানকে পরিশুদ্ধ করবার জন্য, ব্যাসদেব হৃষিকেশকে ডেকে আনলেন। হৃষিকেশ বলছেন, পন্ডিতগণ জীবিত বা মৃত কারোর জন্য শোক করেন না। এখন এই পণ্ডিত করা ? পণ্ডিত হচ্ছেন, স্থিতপ্রজ্ঞ পুরুষ। আমরা এই স্থিতপ্রজ্ঞ পুরুষ সম্পর্কে শুনব। অর্থাৎ প্রথমে শ্রীকৃষ্ণ আঘাত করলেন, আমাদের তথাকথিত জ্ঞানকে, যা আমাদের ভ্রম থেকে উৎপন্ন। অর্থাৎ ভীষ্ম ও দ্রোণকে দেখে যে বিষাদ উৎপন্ন হয়েছে। ভগবানের উত্তরটা অদ্ভুত - বলছেন, জ্ঞানীরা জীবিত বা মৃত কারুর জন্যই শোক করেন না। তার মানে জ্ঞানীরা শোক রোহিত। নাকি কারুর বাঁচা বা মরা কোনটা শোকের বিষয় হতে পারে না। এতো অদ্ভুত। বাঁচা বা মরা কোনটা ভালো ? বাঁচানো না মেরে ফেলা কোনটা ভালো ? ভগবান বলছেন, দুটোই মিথ্যে। বাঁচা বা মরা এই দ্বন্দ্বের আড়ালে একটা সত্য আছে, সেই সত্যের সন্ধান যে জেনেছে, তার কাছে মরা বা বাঁচা - এর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এই মরা বা বাঁচা বলে আমরা যা বুঝি, তা আসলে অর্থহীন। এর মধ্যে কোনো সত্য নেই। সত্যকে জানলে তখন এই মরা বা বাঁচার মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখতে পারবো না। আর এই দ্বন্দ্ব যখন আমাদের জ্ঞানের দ্বারা দূর হয়ে হবে, তখন আমরা এই তথাকথিত দুঃখ, শোক, তাপ , জ্বালা ইত্যাদি থেকে মুক্তি পাবো। আমাদের চাওয়া - পাওয়ার যে দ্বন্দ্ব সেখান থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারবো। আমাদের তখন যাবতীয় বস্তু প্রাপ্তিতে যে সুখ আর অপ্রাপ্তিতে যে দুঃখ, বা সম্পর্ক স্থাপনে যে সুখ, আর সম্পর্কের বিয়োগে যে শোক সেখান থেকে আমরা একটা সাম্যাবস্থায় স্থিতি পাবো। ভগবান সেই জ্ঞানের কথাই বলবেন, পরবর্তীতে। আমরা ধীরে ধীরে সেই সব স্বাস্বত সত্য শুনবো। আসলে যুদ্ধ করা বা না করা, এই সিদ্ধান্ত নেবার আগে ভগবানের কথা শোনো। অর্থাৎ ভগবানে সমর্পিত হও। তোমার ওই হিসেবের খাতা ছিড়ে ফেলে দাও। তাহলে তোমার শোক হবার কোনো কারন থাকবে না।
ভগবান বলছেন, (২/১২) উপস্থিত রাজন্যবর্গ, তুমি, আমি যে আগে ছিলাম না তা নয়, আবার পরেও যে থাকবো না তাও নয়। (২/১৩) সবার জীবনে যেমন, বাল্য -যৌবন-বার্দ্ধক্য এই তিনটি অবস্থা আসে, তেমনি মৃত্যুও একটা অবস্থা মাত্র। এতে জ্ঞানীগণ বিচলিত হন না।
এখানে ভগবান দুটো জিনিসের স্বীকৃতি দিলেন, এক হচ্ছে পুনর্জন্মবাদ। দেহের অবস্থান্তর, অর্থাৎ এক দেহ থেকে অন্য দেহে আমাদের স্থানান্তর । আর সবশেষে বললেন, তোমার এই সম্পর্কে জ্ঞান হলে, তোমার বিচলিত হবার কোনো কারন থাকবে না।
এইখানে ব্যাসদেব হৃষিকেশের মুখ দিয়ে সহজ সরল ভাষায়, উদাহরণ দিয়ে গুড় আত্মতত্ত্বকে উপস্থাপন করলেন। হে পার্থ, আমি-তুমি এমনকি এই নৃপতিগণ পূর্বে ছিলাম না, তা নয়, আবার পরে থাকবো না, তাও নয়। আগের জীবনে আমরা সবাই হয়তো অন্য জায়গায় ছিলাম, অন্য রূপে ছিলাম। এখন এই জন্মে আমরা এই রূপে এইখানে আছি। আবার পরবর্তী জীবনে অবশ্য়ই অন্য কোনো রূপে, অন্য কোনো জায়গায় থাকবো। আমরা জানি, আজকের অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণ আগের জীবনে, নর ও নারায়ণ ছিলেন। এবং কঠোর তপস্যা মধ্যে দিয়ে দিন যাপন করেছিলেন। সেই নর-নারায়ণের দেহ এখন আর নেই, কিন্তু তাঁদের আত্মা আছেন। শ্রীকৃষ্ণের সেসব কথা স্মৃতিতে আছে, কিন্তু অর্জুনের সেসব কথা মনে নেই। আসলে শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন একজন মহাযোগী, অষ্টাঙ্গ যোগ ও তাঁর বিভূতি সমস্তই তাঁর আয়ত্ত্বে। তাই তো তিনি বলতে পারলেন। এই যে দেহ, এই দেহের নাশ অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু এই দেহীর নাশ নেই। অর্থাৎ আমি আত্মা রূপে চিরকাল ছিলাম, আছি, থাকবো। এই সত্য একটা বাস্তব, আমাদের বোঝার সুবিধের জন্য একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছেন , বলছেন প্রত্যেক জীবের দেহের শৈশব আছে, যৌবন আছে, প্রৌঢ়ত্ত্ব,বার্ধক্য আছে। এইসব অবস্থায় আমরা নিজেকে মানিয়ে নেই। এর জন্য আমরা কোনো শোক-তাপ অনুভব করি না। এটাই স্বাভাবিক বলেই আমরা মনে করি। ঠিক তেমনি বার্ধক্যে পরেই আসে দেহ নাশের সময়, বা দেহ ত্যাগের সময়। যাকে আমরা মৃত্যু মনে করি। তো দেহের পরিবর্তনের জন্য যেমন জ্ঞানী-অজ্ঞানী কেউই শোক করেন না, কেননা এই অভিজ্ঞতা তাদের কাছে ইন্দ্রিয়লব্ধ। তেমনি দেহ নাশের কারনে জ্ঞানীরা শোক করেন না, এই বিষয় তাদের অনুভূতিলবদ্ধ। কেননা তাঁরা জানেন, লক্ষ পূরণের জন্য, তাঁরা অবশ্যই উপযুক্ত শরীর পাবেন। আর এই অলংঘনীয় পরিণতি কখনো শোকের কারন হতে পারে না। আর সত্যি কথা বলতে কি আমাদের কোনো কিছু হারানোর ভয় নেই। কেননা পুরোনো জ্বরা-জীর্ন দেহ ত্যাগ করে আমরা যেমন আবার একটা নতুন দেহ পাবো, ঠিক তেমনি আমাদের এই জীবনে সংগৃহিত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা আমাদের সংস্কার আকারে আমাদের নতুন দেহে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে থাকবে। আর এই পৃথিবী তো পৃথিবীর মতো করেই থাকবে, রাজ্য রাজ্যের মতোই থাকবে। হয়তো রূপের পরিবর্তন হবে। কিন্তু থাকবে। আর ধন-সম্পত্তি, আত্মীয়-স্বজন আমরা যেমন নিয়ে আসিনি, আবার নিয়েও যাবো না। আমি যখন আবার নতুন দেহে আসবো , আবার আমার হয়তো এদের সঙ্গেই সম্পর্ক স্থাপন হবে, নতুবা অন্য কারুর সঙ্গে হবে। কিন্তু সম্পর্ক নিশ্চিত হবেই। আর বিষয় সম্পত্তি, এতো আমি নিয়েও আসতে পারিনি, আবার নিয়েও যেতে পারবো না। তবে একথা ঠিক, যার যেমন বাসনা বা সংকল্প সেই অনুযায়ী আমাদের যেমন দেহ প্রাপ্তি হবে, ঠিক আমাদের সংকল্প পূরণের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ, পরিস্থিতির সঙ্গে বিষয় সম্পত্তিও আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে এসে যাবে। এর জন্য না আছে আমাদের কোনো চিন্তা, না আছে কোনো শোকের কারন। তাই মাভৈ। হারানোর কিছু নেই। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, ধৈর্য্য ধরতে হবে। আর সঠিক সময়ে নিজ নিজ কার্য্য সম্পাদন করতে হবে। আর এই কাজগুলো করতে হবে বিবেকের নির্দেশে। আর বিবেকগুরুই হচ্ছেন, গীতার শ্রীকৃষ্ণ।
ওম নমঃ শ্রী ভগবতে বাসুদেবায়। ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি ওম।
নারায়নং নমস্কৃত্য নরঞ্চৈব নরোত্তমম্
দেবীং সরস্বতীং ব্যাসং ততো জয়মুদিরয়েত।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।
ভগবান বলছেন (২/১৪) হে কৌন্তেয় ইন্দ্রিয় সমূহের সঙ্গে ভোগ্য বিষয়-সংযোগে সুখ-দুঃখ শীত-উষ্মা ইত্যাদি বোধ জন্মে। হে ভারত, সেজন্য এইসব অনিত্য বিষয়কে অনিত্য জেনে সহ্য করা ভালো।
আমরা এর আগে শুনেছি, আত্মতত্ত্বের একটা সরল উদাহরণ। এবার আরেকটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছেন। বলছেন, হে কৌন্তেয়, অর্থাৎ কুন্তীপুত্র - অর্জুন যে সম্পর্কের জালে এখনো জড়িয়ে আছেন। অর্জুন নিজেকে এখনো একজন দেহধারী, সে কুন্তী নামক মায়ের পুত্র। কুন্তী হচ্ছেন, ভোজ রাজের কন্যা। সুরসেনের পালিত কন্যা। তার পুত্র হচ্ছেন অর্জুন। আবার বলছেন, হে ভারত অর্থাৎ ভরতবংশ-উদ্ভূত। অর্জুন তার বংশ-কুল নাশের কথা চিন্তা করে ব্যথিত। সেই অর্জুনকে বোঝাতে হচ্ছে। অতয়েব সে যে ভাষা বুঝবে, সেই ভাবেই তাকে বোঝাচ্ছেন।
আর সেইজন্য শ্রীকৃষ্ণ আমাদের দেহের সঙ্গে ইন্দ্রিয়গুলোর সম্পর্ককে এবং তার পরিনাম দিয়ে বোঝাতে চাইছেন, আত্মতত্ত্বের গভীর গুহ্য কথা ।বলছেন দেখো আমাদের দেহে যেসকল পঞ্চ ইন্দ্রিয় আছে, অর্থাৎ চক্ষু, কর্ন , নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক ইত্যাদির সঙ্গে যখন বাহ্যিক রূপ-রস ইত্যাদি বিষয়ের সংযোগ ঘটে তখন ভালো বা মন্দ, সুখ বা দুঃখ, শীত বা উষ্মতা অনুভব করি। এই অনুভব আমাদের সাময়িক। সূর্য উঠলে শীত বিদায় নেয়। সুতরাং শীতের যে দুঃখ তা আমাদের সাময়িক। ঠিক তেমনি গ্রীষ্ম কালের দুপুরে আমরা যে গরমে কষ্ট পাই, সেই অনুভূতিও আমাদের সাময়িক। প্রকৃতির ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেহ শীত বা উষ্মতা অনুভব করে। শীতের পরে প্রাকৃতিক নিয়মে বসন্ত আসবে, আবার গরমের পরে বর্ষা আসবে, এই জ্ঞান যাদের হয়েছে, তারা না শীতের জন্য উতলা হন। না গরমের জন্য উতলা হন। বরং এই প্রকৃতির নিয়মকে মেনে নিয়েই আমরা এগুলোকে সহ্য করি, উপেক্ষা করি । অপেক্ষা করি পরবর্তী সময়ের জন্য। ঠিক তেমনি, স্বজনদের মৃত্যু আমরা না চাইলেও প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসারে একদিন না একদিন আসবেই । আর এর জন্য শোক করা বৃথা। আর ধৈর্য্য ধরে এই শোক-দুঃখ সহ্য করলে, আর সহ্য আমাদের করতেই হবে, না হলে আমরা উতলা হবো। আমাদের কষ্টের অনুভূতি বাড়বে, আর যদি সহ্য করি তবে আমরা উতলা হবো না আর কালের নিয়মেই আমাদের শোক-দুঃখ প্রশমিত হয়ে আসবে। অতএব ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করাই শ্রেয়। কথায় বলে যে সয় সেই রয়।
ভগবান বলছেন (২/১৪) হে কৌন্তেয় ইন্দ্রিয় সমূহের সঙ্গে ভোগ্য বিষয়-সংযোগে সুখ-দুঃখ শীত-উষ্মা ইত্যাদি বোধ জন্মে। হে ভারত, সেজন্য এইসব অনিত্য বিষয়কে অনিত্য জেনে সহ্য করা ভালো।
আমরা এর আগে শুনেছি, আত্মতত্ত্বের একটা সরল উদাহরণ। এবার আরেকটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছেন। বলছেন, হে কৌন্তেয়, অর্থাৎ কুন্তীপুত্র - অর্জুন যে সম্পর্কের জালে এখনো জড়িয়ে আছেন। অর্জুন নিজেকে এখনো একজন দেহধারী, সে কুন্তী নামক মায়ের পুত্র। কুন্তী হচ্ছেন, ভোজ রাজের কন্যা। সুরসেনের পালিত কন্যা। তার পুত্র হচ্ছেন অর্জুন। আবার বলছেন, হে ভারত অর্থাৎ ভরতবংশ-উদ্ভূত। অর্জুন তার বংশ-কুল নাশের কথা চিন্তা করে ব্যথিত। সেই অর্জুনকে বোঝাতে হচ্ছে। অতয়েব সে যে ভাষা বুঝবে, সেই ভাবেই তাকে বোঝাচ্ছেন।
আর সেইজন্য শ্রীকৃষ্ণ আমাদের দেহের সঙ্গে ইন্দ্রিয়গুলোর সম্পর্ককে এবং তার পরিনাম দিয়ে বোঝাতে চাইছেন, আত্মতত্ত্বের গভীর গুহ্য কথা ।বলছেন দেখো আমাদের দেহে যেসকল পঞ্চ ইন্দ্রিয় আছে, অর্থাৎ চক্ষু, কর্ন , নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক ইত্যাদির সঙ্গে যখন বাহ্যিক রূপ-রস ইত্যাদি বিষয়ের সংযোগ ঘটে তখন ভালো বা মন্দ, সুখ বা দুঃখ, শীত বা উষ্মতা অনুভব করি। এই অনুভব আমাদের সাময়িক। সূর্য উঠলে শীত বিদায় নেয়। সুতরাং শীতের যে দুঃখ তা আমাদের সাময়িক। ঠিক তেমনি গ্রীষ্ম কালের দুপুরে আমরা যে গরমে কষ্ট পাই, সেই অনুভূতিও আমাদের সাময়িক। প্রকৃতির ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেহ শীত বা উষ্মতা অনুভব করে। শীতের পরে প্রাকৃতিক নিয়মে বসন্ত আসবে, আবার গরমের পরে বর্ষা আসবে, এই জ্ঞান যাদের হয়েছে, তারা না শীতের জন্য উতলা হন। না গরমের জন্য উতলা হন। বরং এই প্রকৃতির নিয়মকে মেনে নিয়েই আমরা এগুলোকে সহ্য করি, উপেক্ষা করি । অপেক্ষা করি পরবর্তী সময়ের জন্য। ঠিক তেমনি, স্বজনদের মৃত্যু আমরা না চাইলেও প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসারে একদিন না একদিন আসবেই । আর এর জন্য শোক করা বৃথা। আর ধৈর্য্য ধরে এই শোক-দুঃখ সহ্য করলে, আর সহ্য আমাদের করতেই হবে, না হলে আমরা উতলা হবো। আমাদের কষ্টের অনুভূতি বাড়বে, আর যদি সহ্য করি তবে আমরা উতলা হবো না আর কালের নিয়মেই আমাদের শোক-দুঃখ প্রশমিত হয়ে আসবে। অতএব ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করাই শ্রেয়। কথায় বলে যে সয় সেই রয়।
ভগবান আবার বলছেন : (২/১৫) হে পুরুষর্ষভ ! এই সুখ দুঃখ যে ধীর ব্যক্তিকে ব্যথিত করে না সেই ব্যক্তিই অমৃতত্ত্ব লাভ করে থাকেন।
এই শ্লোকটি খুবই মহত্ত্বপূর্ন। এই শ্লোকের মধ্যে অমৃতত্ত্ব বা অমরত্বে সন্ধান আছে। অমৃতত্ব লাভের উপায় বলা আছে। অমৃতত্বের অর্থ কি ? অমৃতত্বের মানে হচ্ছে পরম শান্তি লাভ। ভগবান বলছেন, সুখ-দুঃখে সমভাবে স্থিত যে ধীর ব্যক্তিকে এই বিষয় স্পর্শজনিত সুখ-দুঃখ বিচলিত করে না, তিনি অমৃতত্ব লাভ সামর্থ হন বা তিনি অমর হন।
এই অমরত্বের জন্য, যুগ যুগ ধরে মানুষ কত কিছুনা করছে। কেউ এক পায়ে দাঁড়িয়ে ভগবানের নাম করছেন । কেউ প্রচন্ড শীতের মধ্যে এমনকি বরফের মধ্যে ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে আছেন। কিন্তু ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব কারুর কাছ থেকেই নাকি এই অমরত্ব নামক বরটি আদায় করতে পারছেন না। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এখানে সেই অমরত্বের সঠিক সন্ধান দিলেন।
আমাদের মধ্যে তিন শ্রেণীর মানুষ আছেন।
এক - যারা নিজেরা সাধন-ভাজন করতে চান না। কেবল সৎগুরুর খোঁজ করেন। যিনি তাকে, হয় সাধন ভজনের সোজা-সরল রাস্তা বলে দেবেন। নতুবা, গায়ে ফুঁ দিয়ে, বা কানে মন্ত্র দিয়ে উদ্ধার করে দেবেন। এরা প্রচন্ড অধৈর্য্য। এরা সংসার সমুদ্রের মাছ ধরে খাবেন, আবার বৈতরণী পার হবার জন্য, গুরুর নৌকায় উঠে বসবেন। এরা ভুলে যান, কেউ কাউকে উদ্ধার করতে পারে না। জন্ম-জন্মান্তরের কামনা বাসনার বেগ ও ইন্দ্রিয়ের চঞ্চলতা যতক্ষন না বিনষ্ট হয়, ততক্ষন আমাদের নিজেদেরকেই সাধনায় নিমগ্ন হয়ে থাকতে হবে।
দুই : আর এক ধরনের মানুষ আছেন, যারা মনে করেন, বিষয়ের সংস্পর্শে এলেই আমাদের মন চঞ্চল হয়। আর মন যখন চঞ্চল হয়, তখন আমাদের মনে অশান্তির সৃষ্টি হয়। অতএব বিষয় থেকে দূরে থাকাই ভালো। এঁরা তাই জীবন নির্বাহের জন্য, অন্যের উপরে নির্ভরশীল হন, এরা তখন মাধুকরীতে বেরিয়ে পড়েন। এরা এটা বোঝেন না, যে সবাই যদি মাধুকরীতে বেরিয়ে পরে, সবাই যদি সংসার ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন, তবে ভিক্ষা কে দেবেন ? এরা কর্ম্ম-চঞ্চল সংসার থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের গুহার মধ্যে আশ্রয় নেন । কিন্তু সবাই যদি পাহাড়ের গুহায় আশ্রয়ের জন্য বেরিয়ে পড়েন, তবে গুহা আর নির্জন থাকবে না। ভিক্ষা দেবার লোকও থাকবে না। আসলে সংসার আমাদের মনের মধ্যে বাসা বেঁধেছে। মনে যতদিন ভোগেচ্ছা আছে, মনে যতদিন কামনা বাসনা আছে, ততদিন, আমি গিরিগুহাতেই যাই, আর গহন অরণ্যে যাই, আমার নতুন কিছু পাবার উপায় নেই। আর এই যন্ত্রনা থেকে, দ্বিধা দ্বন্দ্ব থেকে রেহাইও নেই।
তিন : আর এক ধরনের মানুষ আছেন, যাঁরা এই দুয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলেন। তারা মনে করেন, আমাদের এই দুয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য আনতে হবে। যতদিন দেহ আছে, ততদিন দেহ রক্ষার প্রয়োজনও আছে। আর এই দেহ ভিন্ন আমাদের সাধন কর্ম্ম করারর উপায় নেই। মানব দেহ একটা অমূল্য সম্পদ। মানব দেহ দুর্লভ বস্তু। আমাদের সাধারণের দেহেকে বলা হয়ে থাকে কাঁচা দেহ। আর যোগীর দেহকে বলা হয়ে থাকে পাকা দেহ। কিন্তু দুটো দেহেরই খাদ্যের প্রয়োজন। জ্ঞানী যোগী সূক্ষ্ম দেহের খাদ্য সংগ্রহে বেশি গুরুত্ত্ব দেন। আর আমরা সাধারণ মানুষরা স্থুল দেহের খাদ্যের জন্য বেশি গুরুত্ত্ব দেই। যিনি যে দেহের পুষ্টি সাধন করেন, তার সেই দেহ বলশালী হয়।
গীতার মর্ম্মবাণী যাঁরা ধরতে পেরেছেন, তারা বুঝেছেন, এই সংসার হচ্ছে কর্ম্মক্ষেত্ৰ। যার যা অবশ্য করণীয় কর্ম্ম তা তাকে ধৈর্য্য-ধরে, অনাসক্ত হয়ে পালন করতে হবে। আর কর্তব্য কর্ম্মে অনীহা মানে অন্যায় - অধর্ম্ম। কর্ম্মের দ্বারাই ব্যক্তির উন্নতি সম্ভব, কর্ম্মের দ্বারাই দেশের উন্নতি সম্ভব, কর্ম্মের দ্বারাই সমাজের উন্নতি সম্ভব। হ্যাঁ কর্ম্ম করতে গেলে যেমন সফলতা-বিফলতা আসবে, কর্ম্ম করলে তার ফল অবশ্যই ভোগ করতে হবে, কর্ম্ম আমাদের সুখ-দুঃখের অনুভূতি দেবে। এই সত্যকে অস্বীকার করলে চলবে না। এই কর্ম্ম করতে গেলে আমাদের মন অস্থির হবে। আমাদের মধ্যে ভালো-মন্দের দ্বন্দ্বের উৎপত্তি হবে। কিন্তু এই বিপর্যয়ের মধ্যে আমাদের বিবেকগুরুর আশ্রয়ে থাকতে হবে। তার নির্দেশ মতো কাজ করতে হবে। কর্ম্ম ফলের কাল্পনিক ভবিষতের উপরে আমরা যেন আগে থেকে ভালো বা মন্দের আরোপ না করে বসি। আমরা যেন ভবিষ্য়্ত্কে ভবিষ্যের মতো করেই আসতে দেই। আমাদের এই আরোপিত সুখ বা আরোপিত দুঃখের কারণেই আমাদের মনে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। তখন আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ হয়। আর ভবিষ্যৎ যখন আমাদের ইচ্ছেমতো আসে না, তখন আমরা দুঃখ পাই। এই জায়গা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। বাস্তবকে মেনে নিতে হবে। বর্তমানকে আরো সঠিক পথে চালিত করতে হবে। আর এই জন্যই আমরা যেন বিবেকগুরুর উপরে নির্ভর করি। আর বিবেকগুরুর উপরে নির্ভর করতে পারলেই আমরা দ্বন্দ্বের উর্দ্ধে উঠতে পারবো। এবং পরম শান্তি লাভ করতে পারবো। অমৃতত্ব লাভ করতে পারবো। আমাদের মন তখন হবে, বাসনা রোহিত। আমাদের মন হবে শান্ত। আমাদের মন হবে অচঞ্চল। সংসারের সমস্ত কর্ম্ম কোলাহল থেকে আমি হবো মুক্ত। ভগবান এই শ্লোকে এই কথাই জোর দিয়ে বলেছেন। সমদুঃখসুখং ধীরং সো-অমৃতত্বায় কলপ্তে। ধীর ব্যক্তিকে সুখ দুঃখ ব্যথিত করে না। ধীর ব্যক্তি অমৃতত্ব লাভ করে থাকেন।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি ওম।
No comments:
Post a Comment