মানুষের আসা যাওয়া - মৃত্যু রহস্য - (দুই ও তিন)
মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ন ঘটনা হচ্ছে তার জন্ম ও মৃত্যু। জন্মের আগে সে ভাবা শেখেনি, তাই জন্মের কারন নিয়ে সে ভাবে নি। কিন্তু মৃত্যুর আগে ভাবতে শিখেছে। তাই মৃত্যুর কারন নিয়ে সে ভাবে। এক জিজ্ঞাসু একদিন আচার্য্যের কাছে গিয়ে এই জন্ম - মৃত্যুর রহস্য নিয়ে প্রশ্ন করে বসলো।
জিজ্ঞাসু : হে পিত জন্ম -মৃত্যুর রহস্যঃ আমার কাছে অজানা। আপনি দয়া করে এ ব্যাপারে আমাকে জ্ঞান দান করুন।
আচার্য্য : দেখো মানুষের জন্ম-মৃত্যু এক গভীর রহস্য । এই রহস্য উন্মোচন করতে গেলে আমাদের মুনি ঋষিদের কথার উপর নির্ভর করতে হবে। অর্থাৎ আপ্ত বাক্যের উপর নির্ভর করতে হবে। আমি যা বলবো তার সত্যতা যাচাই করা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আমার কথা শোনো ও অন্তরের গভীরে অনুসন্ধান করো। পরা-বিদ্যাজ্ঞানীরা এই রহস্যের উন্মোচন করেছেন এই ভাবে। পরাবিদ্যা জ্ঞানীরা বলছেন :
মানুষের যে দেহটা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়, তা আসলে অন্ন দ্বারা গঠিত, অন্ন দ্বারাই পরিপুষ্ট। একেই আমরা স্থুল দেহ বলি। এই দেহই আমাদের সকল দোষ-গুনের আধার, এই ধারণা কিন্তু ঠিক নয়।মৃত্যুর পরে, আমাদের দোষ-গুন্ শেষ হয়ে গেলো, এমনটা নয়। মৃত্যুর পরেও আমাদের কর্মফল, আমাদের জ্ঞান, আমাদের স্মৃতি অর্থাৎ আমাদের সঞ্চিত দোষগুণ বা অর্জিত সংস্কার, প্রারব্ধ রূপে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। এসব বুঝতে গেলে আগে আমাদের দেহকে আগে বুঝতে হবে।
আমরা সবাই জানি, পঞ্চভূতের তৈরী এই দেহ। এই দেহ বিনষ্ট হয়ে গেলে, পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাবে। আমাদের আর একটা দেহ আছে, সেটা হচ্ছে সূক্ষ্মদেহ বা লিঙ্গদেহ। এই দেহে স্থুল কোনো উপকরণ নেই। আমাদের আবেগ, কামনা, বাসনা, প্রভৃতি সূক্ষ্ম উপকরণে এই দেহ গঠিত।
এই সূক্ষ্ম দেহের ভেতরে আছে একটি দেহ তার নাম মানস দেহ।
এই মানস দেহের অভ্যন্তরে অতি সূক্ষ্ম উপকরণে তৈরী,আর একটি দেহ আছে তার নাম কারণদেহ। এটাই আমাদের মন, বুদ্ধির আধার।
জিজ্ঞাসু : তাহলে কি আমাদের দেহ একটা ফলের মতো। প্রথমে খোসা, তারপরে মাংস, তার পরে আঁটি ?
আচার্য্য : না পুত্র, ব্যাপারটা এমন নয়। আমাদের দেহ আসলে পঞ্চকোষের সমষ্টি। এগুলো হচ্ছে, অন্নময় , প্রাণময়, মনোময়, বিজ্ঞানময়, এবং আনন্দময়।
ধরো জলের মধ্যে একটা স্পঞ্জের বল - স্পঞ্জের বল হচ্ছে আমাদের এই স্থুলদেহ, আর স্পঞ্জের মধ্যে যে জল সেটা হচ্ছে সূক্ষ্ম দেহ, আর জলের মধ্যে যে বাতাস সেটা হচ্ছে মনোময় দেহ। বাতাসের মধ্যে যে ইথার আছে সেটা হচ্ছে বিজ্ঞানময় দেহ, আর ইথারের মধ্যে আরো সূক্ষ্ম পদার্থ আছে তাকে বলা হয় আনন্দময় কোষ। অর্থাৎ আমাদের শরীরের সর্বত্র পরস্পরের মধ্যে ওতপ্রোত ভাবে সব দেহ একত্রে অবস্থান করছে।
অন্নময় কোষ : অন্ন অর্থাৎ খাবার, অন্নময় কোষ মানে খাবার দিয়ে তৈরি যে কোষ রয়েছে আমাদের শরীরে।
প্রাণময় কোষ : অর্থাৎ উর্জা শরীর। এই শরীর বায়ুর শক্তিতে তৈরী।
মনময় কোষ : অর্থাৎ মানসিক শরীর, মনের চিন্তার জগৎ ।
এই তিন শরীরকে ভৌতিক শরীর বলে। অন্নময় শরীর স্থূল। প্রাণময় শরীর সূক্ষ্ম ও মনময় শরীর অতি সূক্ষ্ম। কিন্তু এই তিন শরীর-ই ভৌতিক। এই তিন শরীরের উপরেই আমাদের কর্মের প্রভাব পড়বে। স্থূল শরীর অর্থাৎ অন্নময় কোষ দ্বারা গঠিত শরীরের উপরে কর্মের ছাপ পড়বে। তেমনি প্রাণময় ও মনময় শরীরের উপরেও কর্মের প্রভাব আছে। কর্ম-বন্ধন এই তিন শরীরকে জুড়ে রেখেছে। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, সিমেন্ট বা আঠার মতো কর্ম এই তিন শরীরকে জুড়ে রাখতে সাহায্য করে। কর্ম বন্ধন এই তিন শরীরকে জুড়ে রাখে। অর্থাৎ আমাদের কামনা বাসনা থেকে উদ্ভুত কর্ম এই শরীরকে সজীব রেখেছে।
এর পরে আছে :
বিজ্ঞানময় কোষ : এটি ভৌতিক নয় কিন্তু ভৌতিক শরীরের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে।
আনন্দময় কোষ : পুরোপুরি অভৌতিক।
বিজ্ঞানময় শরীর যা আসলে অভৌতিক, এই আনন্দময় শরীরের অর্থাৎ অভৌতিক শরীর ও ভৌতিক শরীরের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। তার মানে বিজ্ঞানময় কোষ নিজে অভৌতিক, কিন্তু তিনি ভৌতিক ও অভৌতিক শরীরের মধ্যে সম্পর্ক জুড়ে রাখে।
ভৌতিক শরীরের রূপ বা আকার আছে। অন্নময় শরীর অতি স্থূল, তাই আমরা দেখতে পাই। প্রাণময় ও মনময় সূক্ষ্ম কিন্তু আমাদের অনুভূতির বাইরে নয়। এদুটো আসলে আউড়া বা জ্যোতি। দেখতে না পেলেও আমরা এর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি।
যদি ভৌতিক শরীর নষ্ট হয়ে যায়, তবে এই বিজ্ঞানময় শরীর আনন্দময় শরীরের সঙ্গে মিশে যায় ,এবং তৎপর আনন্দময় শরীর বিশ্বব্রমান্ডের সাথে বিলীন হয়ে যায় বা একাত্বিভূত হয়ে যায়।
ভৌতিক শরীর পঞ্চভূতের মিশ্রণ। মৃত্যুর পরে, আমাদের ভৌতিক শরীর পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের কর্মবন্ধন, আমাদের আবার দেহধারণের জন্য উদগ্রীব হয়। ও আমরা আবার শরীরের মধ্যে প্রবেশ করি। যখন আমরা কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারি তখন আমরা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সাথে এক হয়ে যাই। জন্মমৃত্যুর চক্রের থেকে মুক্ত হয়ে যাই। একে বলে, মুক্তি। কেউ বলে সমাধি।
আর একটা গূঢ় কথা শোনো, আমাদের এই দেহ যা তোমার চোখে পড়ছে, এটি কিন্তু তুমি যা দেখছো, তার থেকে আকারে অনেক বড়। অর্থাৎ তোমার এই স্থূল দেহের চতুর্দিকে ১৫/১৬ ইঞ্চি পর্যন্ত এর বিস্তৃত, একটা আউড়া দেহ আছে । যেটা তুমি বুঝতে পারো না। কিছুদিন, ধ্যান অভ্যাস করলে, তোমার এই আউড়া উপলব্ধি করতে পারবে। ধ্যানের সময় এই আউড়া ঘনীভূত হয়। এবং আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। এঁকে কেউ কেউ বলেন, আতিবাহিক দেহ। এই আতিবাহিক দেহ বা আউড়া সূক্ষ্ম ও স্থুল দেহের সংযোগ সাধন করে। আমাদের কোনো চিন্তা, আমাদের মনের আবেগ, আমাদের বুদ্ধি, ভাবনা প্রভৃতি স্থুল দেহে প্রকাশিত হবার জন্য, এই ইথারিক দেহ, বা আউড়া বা এর মধ্যে যে অনুকৃতি থাকে, তার সাহায্য নেয়। এটাই আমাদের অনুভূতির কারন, জীবনী শক্তির কারন, চেতনার কারন। এই ইথারিক শরীর না থাকলে, মন, চিন্তা,বুদ্ধি, বিবেক আমাদের স্থূল দেহে প্রকাশিত হতে পারতো না। প্রত্যেক মানুষের চারদিকে, এই বলয় বা জ্যোতির্ময় মন্ডল দেখা যায়। এবং এটা দেখলে মনে হয় একটা ডিম্বাকৃতি বলয়ের মধ্যে একটা স্থুল দেহ ভাসছে। তুমি যখন বসে আছো. তখনও এই আউড়া তোমাকে ঘিরে থাকে।
মানুষ যখন শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে সুস্থ সবল, থাকে তখন এই বলয় ডিম্বাকৃতি থাকে। যদি তার অন্যথা হয়, অর্থাৎ শরীর সুস্থ না থাকে, মন ঠিক না থাকে, বা মনে কোনো ভয়, বা দুশ্চিন্তা থাকে, এমনকি মনে কোনো অশুভ ভাব থাকে, তবে এই ইথারিক শরীর কিঞ্চিৎ বক্র দেখতে লাগে। অর্থাৎ আঁকাবাঁকা লাগে। এই জ্যোতির্মণ্ডল বা ইথারিক দেহ সুক্ষ, এবং কারন, মনময়, ও প্রাণময় দেহের উদ্ভাসিত কিরণ। এই জ্যোতির মধ্যে আবার সূক্ষ্ম দেহের জ্যোতি কিঞ্চিৎ চঞ্চল। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, মনের ভাব পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতির বর্ণের পরিবর্তন হয়। যেমন, তোমার মনে যদি
কাম ভাব বা তুমি যদি ইন্দ্রিয় পরায়ন হও তবে তোমার জ্যোতি গাঢ় লাল রঙের হবে। তুমি যদি স্বার্থপর হও তবে তোমার জ্যোতি বাদামি বর্ণের হবে। আবার তুমি যদি মানসিক অবসাদে ভোগো তবে তোমার জ্যোতির রং হবে ধূসর বর্ণ। তেমনি তুমি যদি উৎকৃষ্ট মানসিকতার হও তবে তোমার জ্যোতি হবে হলুদ রঙের। তুমি যদি ঈশ্বর ভক্ত হও তবে তোমার জ্যোতির বর্ণ হবে বেগুনি। আর তুমি যদি আধ্যাত্মিক দিক থেকে উন্নত ব্যক্তি হও তবে তামার জ্যোতির বর্ণ হবে গাঢ় নীলবর্ণ। তুমি যখন, সাধনা করতে করতে, দিব্য দৃষ্টি সম্পন্ন হবে, তবে তুমি এসব দেখতে পাবে। এগুলো কোনো কাল্পনিক ব্যাপার নয়। সাধনায় উপলব্ধ জ্ঞান। অতএব তুমি নিশ্চই বুঝতে পারছো, স্থূল দেহের সূক্ষ্ম অংশের নামই ইথারিক দেহ বা আউড়া দেহ।
জিজ্ঞাসু : এতো গেল দেহের কথা। কিন্তু এই স্থুল দেহের মৃত্যুর পরে কি হয় সেটা আমাকে একটু বলুন দয়া করে।
আচার্য্য : দেখো পুত্র, আমাদের শাস্ত্রে, সাতটি লোকের উল্লেখ আছে। তুমি সেসব শুনেছো । যা তুমি সকালবেলা প্রতিদিন, উচ্চারণ করে থাকো। আর সে গুলো হচ্ছে, ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ, মহঃ, জনঃ, তপঃ, সত্যম। এই লোককে সপ্ত-ব্যাহৃতি বলা হয়ে থাকে। মানুষ তার স্থুল দেহ নিয়ে, এই পৃথিবী বা ভূ-লোকে বিচরণ করে থাকে। যখন তার এই স্থুল-শরীর নষ্ট হয়ে যায়, তখন সে সূক্ষ্ম দেহে ভুবঃ-লোকে বাস করে। স্থুল দেহের মৃত্যুর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই অর্থাৎ বেশি হলে ৪ থেকে ৫ ঘন্টার মধ্যেই ইথারিক দেহ ত্যাগ করে সূক্ষ্ম দেহ ধারণ করে। এর পরে সাধারণত ২০/২৫ বছর পরে সূক্ষ্ম দেহ ত্যাগ করে স্বর্লোকে অবস্থান করে। স্বর্লোকে সাধারণত এক হাজার বছরের কাছাকাছি অবস্থান করে। এই স্বর্লোক-ই মানুষের প্রকৃত বাসভূমি। এখান থেকেই মানুষ আবার পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করে। এটাই স্বর্গলোক। অতিশয় উন্নত না হলে, মানুষ এই স্বর্গলোক থেকে উপরে অর্থাৎ মহঃ-জনঃ-তপঃ লোকে যেতে পারে না। আমরা যেহেতু মানুষের আসা যাওয়া নিয়ে আলোচনা করবো, তাই এই সব লোক অর্থাৎ মহঃ-জনঃ-তপঃ এই লোকগুলো নিয়ে আপাতত আলোচনা করবো না।
জিজ্ঞাসু : হে পিত ! মানুষ কি ভাবে মারা যায় ? অর্থাৎ এক শরীর থেকে আর এক শরীরে যাত্রা সম্পর্কে যদি কিছু বলেন, দয়া করে।
আচার্য্য : দেখো তুমি যদি দিব্যদৃষ্টি সম্পন্ন হও তবে তুমি মানুষ কি ভাবে মারা যায়, তা তুমি দেখতে পাবে। অর্থাৎ মানুষের মৃত্যুকালে, এই ইথারিক অনুকৃতি কিভাবে দেহ ত্যাগ করে, তা তুমি দেখতে পাবে। মৃত্যুমুখে পতিত মানুষের দেহ থেকে একটা অতি বেগুনি রঙের কুয়াশা-কুন্ড ধীরে ধীরে ঘনীভূত হয়ে, ওই ব্যক্তির দেহের ন্যায় আকৃতি বিশিষ্ট হয়। এই অতি বেগুনি রঙের দেহের সঙ্গে একটা উজ্বল সুতোর মতো সংযোগকারী রেখা থাকে, যা শরীরের সঙ্গে যুক্ত থাকে। কিছুক্ষনের মধ্যেই এই সংযোগকারী সুতো দেহ থেকে ছিন্ন হয়ে যায়। মানুষের মৃত্যু হয়। এর পরে, এই বেগুনি দেহ কিছুক্ষন স্থুল মৃতদেহের কাছেই থাকে। ঘোরাফেরা করে। হয়তো কাছে কোথাও প্রিয়জনের কাছে যায়। কোনো কোনো সময়, যে প্রিয়জন দূরে থাকে, তার কাছেও যায়। যতক্ষন দেহ থাকে, ততক্ষন এই বেগুনি দেহ স্থুলদেহকে ছেড়ে যায় না। এমনকি, সে নানা রকম নির্দেশ দিতে থাকে। কিন্তু নিস্প্রান স্থুল দেহ কোনো নির্দেশ পালন করে না , কোনো ডাকে সারা দেয় না। এতে সে অসহায় বোধ করে। শরীরের সৎকার না হওয়া পর্যন্ত এই অবস্থা চলতে থাকে। এর পরে সে সজ্ঞানে ভুর্বলোকে প্রবেশ করে। মৃত্যুর মুহূর্তে অজ্ঞান থাকে , কিন্তু মৃত্যুর পরে তার জ্ঞান হয়। শারীরিক লঘুতা অনুভব করে। মৃত্যুর আগে প্রতিদিন যেমন ঘর বাড়ি, আত্মীয়স্বজন সব দেখতে পারতেন, এখনো সবই তিনি দেখতে, শুনতে পারেন। কিন্তু কোথায় যেন ফারাক অনুভব করেন। সবই তো ঠিক আছে। তবে সবাই শোকার্ত কেন ? কেউ আমার কথার জবাব দিচ্ছে না কেন ? আমার নিজেকে এত হালকা লাগছে কেন ? দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে আমি যাতায়াত করতে পারছি কিভাবে । তাহলে কি স্বপ্ন দেখছি, নাকি মারা গেছি ? এইসব অসম্ভব সত্য তাকে উদ্বিগ্ন করে দেয়। চঞ্চল করে দেয়। আর এই সময় তাকে সত্য বোঝাতে, এগিয়ে আসে, সূক্ষ্মলোকবাসী। তা সে তার মৃত আত্মীয়রা হতে পারে, অথবা অন্য কোনো সত্বা যাঁরা এই সূক্ষ্ম লোকে বাস করেন তারাও হতে পারে।এঁরা সবাই নতুন অথিতিকে স্বাগত জানায়। উপদেশ দিতে থাকে। যাতে নতুন জগতে সে স্বাছন্দ বোধ করে।
জিজ্ঞাসু : হে পিত ! এই ভুবর্লোক কোথায় ?
আচার্য্য : হে পুত্র ! সমস্ত লোকই, এই পৃথিবী ঘিরেই অবস্থান করছে। ভূলোক বলতে আমরা বুঝি, পৃথিবী থেকে একশত মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত বায়ুমণ্ডল-সমন্বিত স্থান। আমাদের সূক্ষ্ম দেহ যেমন স্থুল দেহের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, তেমনি ভিন্ন ভিন্ন লোক এই ভূ-লোকের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। সমস্ত লোকই অর্থাৎ সমস্ত সূক্ষ্ম লোকই পৃথিবীর অভ্যন্তরের কিছুদূর হতে আরম্ভ করে, চন্দ্রের ভ্রমনপথ অর্থাৎ চন্দ্র যে অক্ষপথে ভ্রমন করে, সেই পর্যন্ত বিস্তৃত। চাঁদ যখন ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর কাছাকাছি এসে পরে তখন সূক্ষ্মলোক চন্দ্রকে স্পর্শ করতে পারে। অতিশয় সূক্ষ্ম পদার্থে এই জগৎ নির্মিত। আমাদের যেমন সূক্ষ্ম দেহ আছে, বহির্জগতের সমস্ত পদার্থের সূক্ষ্ম রূপ আছে। সুতারাং এই সূক্ষ্ম জগৎ স্থুলের মতোই একই রকম। তাই মানুষ মৃত্যুর পরে যখন এই জগতে প্রবেশ করে, তখন সে প্রথমে বুঝতেই পারে না যে সে অন্য কোথাও এসেছে।
জিজ্ঞাসু : হে আচার্য্যদেব ! সূক্ষ্মলোকবাসী মানুষের কি কোনো আকৃতি থাকে ?
আচার্য্য : হ্যাঁ পুত্র, জীব যখন মৃত্যুর পরে, সূক্ষ্ম দেহপ্রাপ্ত হয়, তখন তার আকৃতি তার মৃত্যুর আগে যেমন ছিল তেমনই হয়। এজন্য, মানুষ মৃত্যুর পরে পরলোকে গিয়ে যখন সে তার বন্ধু, বান্ধব, মা বাবা,ভাই বোন ইত্যাদির সাক্ষাৎ পায়, তখন সে তাকে চিনতে পারে। তুমি যখন দিব্যদৃষ্টি সম্পন্ন হবে,তখন যদি তুমি সূক্ষ্ম জগৎ পর্যবেক্ষন করো তখন তুমি এই সব ব্যক্তিদের চিনতে পারবে।
কিন্তু সূক্ষ্ম জগতের লোকেরা কখনো আমাদের এই স্থুল জগৎ দেখতে পায় না। এই স্থূল জগতের অনুরূপ আর এক সূক্ষ্ম জগৎ তার দেখতে পান মাত্র। এবং এর দ্বারা তারা আমাদেরকে দেখতে পান। কিন্তু, আমাদের সাথে কথাও বলতে চান। কিন্তু তারা অসহায় হয়ে যান যখন দেখেন যে, তাদের কথায় আমরা সারা দেই না। কেন সারা দেয় না সেটা তারা বুঝতে পারে না। আসলে জীবিত অবস্থায় আমরা যে আউড়া দ্বারা আবিষ্ট থাকি, সেই আউড়া তারা দেখতে পায়। এবং আউড়ার রং দেখেই তারা বুঝতে পারেন, আমরা সুখে আছি না দুঃখে আছি। রাত্রে আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি, তখন, আমাদের সূক্ষ্ম দেহ স্থুল দেহ থেকে বেরিয়ে মৃত আত্মীয়দের সূক্ষ্ম দেহের সাথে কথা বলতে পারি। ভাবের আদান প্রদান করতে পারি। কিন্তু আমরা সব সময় সে সব মনে রাখতে পারি না। আবার কখনো কখনো সেসব কথা আমাদের মনে থাকে, আমরা তখন বলি, স্বপ্নে আমি বাবাকে দেখেছি। জাগ্রত অবস্থায় এটা হয় না। অর্থাৎ ঘুমের মধ্যে আমরা কখনো কখনো সূক্ষ্ম দেহে ভ্রমন করি, এই সূক্ষ্ম জগতে। আমরা যদিও জাগ্রত অবস্থায় মৃত ব্যক্তিদের দেখতে পাই না, কিন্তু মৃত ব্যক্তিরা সব সময়ই আমাদের আউড়া-দেহ দেখতে পান। এই দৃষ্টিতে দেখলে, আমরা বলতে পারি, যারা এই স্থূল দেহ ছেড়ে চলে গেছেন, তারা সব সময় আমাদের দেখছেন, আমাদের সঙ্গে আছেন। তুমি যাকে ভাবছো, মারা গেছে, সে কিন্তু তোমার সঙ্গেই আছে সব সময়। অন্তত প্রিয়জনরা সব সময় তোমার দিকে খেয়াল করছে। শুধু তাই নয়, তারাও আমাদের মতো সুখ দুঃখের অধীন। তারা যখন স্থুল দেহে ছিলেন, ঠিক সেই মতো জ্ঞান, বুদ্ধি, স্মৃতি, এমনকি স্নেহ, ভালোবাসা, সংস্কার সবই অক্ষুন্ন আছে। মৃত্যু আসলে, মানুষের একটা ক্রমন্নতির সোপান মাত্র। বা বলা যেতে পারে, মৃত্যু মানে একটা উন্নতির স্তর পেরোনো। আর একটা কথা শোনো। তুমি যখন কোনো কিছু চিন্তা করো, তার কোনো অস্তিত্ব মনের বাইরে থাকে না। কিন্তু সূক্ষ্ম জগতে এই ভাব,একটা মূর্তি গ্রহণ করে। আমরা যখন কোনো গভীর চিন্তা বা ভাবাবেশে থাকি তার দ্বারা সূক্ষ্ম জগতে একটা স্পন্দন শুরু হয়, এবং এর দ্বারা সূক্ষ্ম জগতের পরমাণু সকল ঘনীভূত হতে শুরু করে, এবং মূর্তি ধারণ করে। চিন্তার গভীরতা অনুসারে, এই সব মূর্তি স্বল্প স্থায়ী বা দীর্ঘ স্থায়ী হয় - সবল অথবা দুর্বল হয়। যাদের চিন্তাশক্তি ভীষণ গভীর, তারা চিন্তা প্রসূত ফল প্রতক্ষ্য দেখতে পান। আর একটা কথা বলি, সূক্ষ্ম জগতেও চিন্তাশীল জীব আছেন।
এতো গেল দেহ ত্যাগের কথা। কিন্তু আবার দেহ ধারণ করে কি করে ও কেন এসব নিয়ে আমরা আবার আলোচনা করবো। কিন্তু আজ নয়।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি ওঁং ।।
বিবেকানন্দ বলছেন, "সত্য তাদের কাছেই প্রকাশিত হয়, যারা শুধু সত্যের জন্য ভয় ত্যাগ করে, লাভালাভের চিন্তা ত্যাগ করে, সত্যের মন্দিরে উপাসনা করেন। মানুষের বুদ্ধির সচেতন প্রচেষ্টার দ্বারাই এই ব্যাপারে আলোকপ্রাপ্ত হওয়া যায়।"
আমাদের বাড়িতে আমার স্ত্রীর হেফাজতে একটা কৌটার মধ্যে কতকগুলো দানা আছে। তো আমি একদিন স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, এগুলো কি ? তো আমার স্ত্রী বললেন এগুলো ফুলের বীজ। তো আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোনটা কিসের বীজ তুমি চেনো কি করে ? আর এগুলো লাগিয়ে দিচ্ছো না কেন ? তো তিনি বললেন, প্রত্যেকটি বীজ লাগাবার একটা সময় আছে। সময়মতো না লাগালে এর থেকে গাছ হবে না। আর তা ছাড়া, এর মধ্যে কোনো কোনো বীজ অপুষ্ট যা থেকে কোনো গাছ হবে না। সেগুলো আমাকে বেছে বার করতে হবে। আর আমি এগুলো চিনি কি করে ? এটা আমার অভিজ্ঞতার ফল। যখন এগুলো সংগ্রহ করেছি, তখন এগুলো আমি ভালো করে দেখে রেখেছি, কোন গাছে কেমন বীজ হয়। তাই কোন বীজে কি ফুল বা ফল হবে তা আমি বুঝতে পারি। আর কবে হবে তাও আমি জানি।
আমাদের চিন্তা হচ্ছে কর্মের বীজ। আসলে সমস্ত জিনিস আমাদের মনের মধ্যে আছে। অতীতে যা ঘটেছে, এমনকী বর্তমানে যা ঘটছে সবই আমাদের অবচেতন মনে সংস্কার আকারে সঞ্চিত হয়ে থাকছে। আমরা যদি আমাদের অবচেতন মনের সংস্কারকে ধরতে পারি তবে সব ঘটনার আগাম খবর বলে দেওয়া যায়। আমাদের অবচেতন মনের সংস্কারকে চেতন স্তরে নিয়ে আসতে গেলে একটা কম্পন তুলতে হয়।এই কম্পন হচ্ছে মাধ্যম। চেতন ও অবচেতন মনের সংযোগের মাধ্যম। এই কম্পনের ফলে অবচেতন মনের সংস্কার চেতন স্তরে উদ্ভাসিত হয়। তখন আমরা ভূত ভবিষ্যৎ জানতে পারি। এমনকি আমরা অন্যের অবচেতন মনের সংস্কারকে এই কম্পনের মাধ্যমে আমাদের চেতন স্তরে টেনে আনতে পারি। তখন আমরা অন্যের ভূত ভবিষ্যৎও জানতে পারি। আর এটি তারাই পারেন, যারা মানসিক উচ্চ শক্তি সম্পন্ন, অর্থাৎ মহাত্মারা, যাদের মনের শক্তি বিশেষ ভাবে বিকাশ লাভ করেছে ।
আমরা যখন দেহ ছেড়ে অনন্তের যাত্রায় বেরিয়ে পড়ি, তখন আমরা মানস দেহে অবস্থান করি। মানস দেহ অর্থাৎ আমাদের চিন্তা-ভাবনার যে মূর্তি তাকে বলে মানস দেহ। আমরা এখন জগতের তৃতীয় স্তরে আছি। অর্থাৎ স্থুল দেহে আছি। স্থুল দেহের বিনাশ হলে আমরা মানস দেহে অবস্থান করি। অর্থাৎএই মানস দেহ আমাদের চতুর্থ স্তরের বাসিন্দা। আমরা জানি অসংখ বিন্দুর সমষ্টি দিয়ে তৈরি হয় একটা ছবি। এখন এই বিন্দুর-সমষ্টি যখন অসীমে ছাড়িয়ে পড়ে বা কমতে থাকে তখন ছবি অস্পষ্ট হয়ে যায়। তৃতীয় স্তরে আসতে গেলে আমাদের আবার ঘনীভূত হতে হয়। আমাদের মৃত্যুর পরে আমরা আমাদের স্পন্দন বা কম্পন নিজের সঙ্গে নিয়ে যাই। আর এই কম্পনের গতি অনুযায়ী আমরা নির্দিষ্ট স্তরে প্রবেশ করি। এগুলো স্বয়ংক্রিয়। তাই আমাদের চিন্তা ভাবনা জ্ঞান অনুযায়ী আমাদের মৃত্যু পরবর্তী স্থান নির্দিষ্ট হয়। এই সময় প্রথম দিকে আমরা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় থাকি। যারা পৃথিবীতে থাকাকালীন, উকন্ঠা, না পাবার দুঃখ-যন্ত্রনা নিয়ে ছিলেন, অপূর্ন বাসনা রেখে যেতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের তন্দ্রাঘোর কাটতেই, চঞ্চলতা অনুভব করেন। পৃথিবীর মায়া-মোহ-আসক্তি তাকে তাকে অস্থির করে তোলে। আর যখন সে দেখে তার কোনো নির্দেশ শরীর, বা অন্য কেউ পালন করছে না তখন সে অসহায়, অস্থির ও শোকাচ্ছন্ন হয়ে যায় । আর যারা জ্ঞানত দেহ ত্যাগ করে, তারা মৃত্যুকালীন তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব কাটিয়ে চির নিদ্রায় শায়িত থাকে। এই অবস্থাটা আমাদের খানিকটা স্বপ্নের মতো। স্বপ্নে যেমন আমরা একটা জাগতিক পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াই। সুখ-দুঃখ ভোগ করি, এই অবস্থাতেও আমরা একই রকম অনুভব করি। বাসনা যাদের বেশি থাকে তারা ভোগ ভূমিতে নেবে আসে। আত্মীয়স্বজনদের পাশে পাশে ঘুরে বেড়ায়। আমরা যেমন আমাদের ঘুমের মধ্যে ঘুরে বেড়াই, এরা তখন তাদের আত্মীয়স্বজনদের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। তাদের সাহায্য করতে চায়। তারা তখন বুঝতেই পারে না, যে তারা মারা গেছে। এই বিশৃঙ্খল অবস্থায় তাদের বেশ কিছু সময় কেটে যায়। আর একদল আছেন, যারা মৃত্যুর পরে বুঝতে পারেন। তারা দেহাতীত হয়ে গেছেন। এরা তখন শান্তিতে নিদ্রা যান। অর্থাৎ সুসুপ্তির স্তরে অবস্থান করেন। এই সময় তাদের কোনো জ্ঞান থাকে না। এমনকি সময়জ্ঞানও থাকে না। এইজন্য বলা হয়ে থাকে মানুষের বাসনা অনুযায়ী, জ্ঞান অনুযায়ী মানুষ মৃত্যুর পরে, স্বর্গ-নরকে অবস্থান করেন, ভালো বা মন্দ থাকেন । এই জন্য বিভিন্ন আত্মার জন্য বিভিন্ন স্তর নির্দিষ্ট হয়ে যায়। এবং এগুলো সবই আমাদের চিন্তা-ভাবনার ফল। তাই আমাদের চিন্তা -ভাবনা যেমন সবার আলাদা আলাদা, আমাদের সবার চিন্তা-ভাবনার কম্পনও তেমনি আলাদা আলাদা। আর এই কম্পনের মাত্রা অনুযায়ী আমাদের বসবাসের স্তর নির্দিষ্ট হয়ে যায়। এখানে ঈশ্বরেরও কিছু করার নেই। একটা কথা আমাদের বোঝা দরকার যে, আমাদের এই যে মনময় শরীর, এটি সুক্ষ কিন্তু অপার্থিব নয়। স্থূল শরীর যেমন পার্থিব এই সূক্ষ্ম শরীরও পার্থিব। অর্থাৎ অন্নময়, প্রাণময় শরীর যেমন পার্থিব, মনময় শরীরও পার্থিব। এবং এই মনময় শরীর চিরস্থায়ী নয়। এটিরও পরিবর্তন আছে, নাশ আছে। অন্ন না পেলে যেমন অন্নময় শরীরের ধংশ হয়ে যায়, বায়ু না পেলে যেমন প্রাণময় শরীর নাশ হয়ে যায়, আমাদের কামনা বাসনা সংকল্প শেষ হয়ে গেলে এই মনময় শরীরেরও নাশ হয়ে যায়। এইজন্য স্বাভাবিক মৃত্যুতে দেখবেন, মানুষ প্রথমে খাওয়া ছেড়ে দেয়।অর্থাৎ খাবার থেকে যে শক্তি সে সংগ্রহ করছিলো, তা বন্ধ হয়ে যায়। এর পরে হৃদযন্ত্র কাজ করা বন্ধ করে দেয়, অর্থাৎ বায়ু থেকে যে উর্জাশক্তি সে সংগ্রহ করছিলো, সেটা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু মনময় শরীর থেকে যায়। অর্থাৎ কামনা বাসনা আমাদের সহজে ছেড়ে যায় না। এইজন্য, ঋষি-মহাপুরুষরা আমাদের কামনো বাসনা পরিত্যাগ বা নিয়ন্ত্রণ করতে বলেছেন। অর্থাৎ অন্নময় এবং প্রাণময় শরীর একসময় প্রাকৃতিক নিয়মে শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু মনময় শরীর, তখনি নাশ হবে, যখন আমরা কামনা-বাসনা পরিত্যাগ করতে পারবো। আর এই তিনটে শরীর নাশ হয়ে গেলে বিজ্ঞানময় শরীর আনন্দময় শরীরের সঙ্গে মিশে যায়। এবং আনন্দময় শরীর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে বিলীন হয়ে যায়।
মনময় সূক্ষ্ম দেহকে সহজে নাশ করা যায় না। এটি তার কামনা বাসনা পূরণের জন্য আবার দেহ ধারনের জন্য উদগ্রীব হয়। কারন সে জানে দেহ ভিন্ন কামনা বাসনা পূরণের কোনো উপায় নেই। এই জন্য বলা হয়ে থাকে, মানুষ তার কামনা বাসনা অনুযায়ী দেহ প্রাপ্ত হয়। এবং এই চক্রের মধ্যেই আমরা অর্থাৎ বেশির ভাগ প্রাণী ঘুরপাক খাচ্ছি।
মানুষ মৃত্যুর পরে অজ্ঞানের ঘুমে সে আচ্ছন্ন হয়ে পরে, এবং ধীরে ধীরে ঘন্টা চারেকের মধ্যেই তার আচ্ছন্নতা কেটে যায়। তখন থেকে বায়বীয় দেহ নিয়ে সে জীবনের চতুর্থ স্তরে ধাতস্ত হবার চেষ্টা করে। এই চতুর্থ স্তরের মধ্যেই স্বর্গ-নরক বলতে আমরা যা বুঝি, তা এইখানেই। এই চতুর্থ জগতের সঙ্গে আমাদের বুঝবার জন্য আমাদের স্বপ্নাবস্থার সাথে তুলনা করতে পারি। আমাদের স্বপ্নের জগতে যেমন এই পৃথিবীর জগতের মতো একটা জগৎ উপলব্ধি করি, এখানেও আমাদের দৃশ্যমান জগতের অনুরূপ একটা জগৎ বিদ্যমান। পার্থক্য হচ্ছে আমাদের স্বপ্ন ৬ বা ৮ ঘন্টার পরে ভেঙে যায়। আমরা বুঝতে পারি যে আমরা স্বপ্ন দেখছিলাম। আর এই জগতের স্থিতিকাল দীর্ঘ। এবং এক একজনের ক্ষেত্রে এক এক রকম। তবে অনন্তকাল নয়। এখানেও আমরা ইহজগতে থাকা কালীন যেমন কাজ কর্ম করতাম। এখানেও সেইরূপই করে থাকি। কেউ যদি ইহজগতে পুজো-অর্চনা করতে ভালো বাসতেন, তবে এখানেও তিনি সেটাই করেন। এখানে চিন্তামাত্র তার কাছে সবকিছু উপস্থিত হয়ে যায়। এমনকি তারা ইহজগতের সবাইকে যাদের তিনি স্মরণ করেন, তাদেরই সাথে মিলিত হতে পারেন। এগুলো তাদের কল্পনা প্রসূত। এমনকি এখানে তারা আহার-পানীয় গ্রহণ করেন। অর্থাৎ এটাকে বলা যেতে পারে চিন্তা বা কল্পনার রাজ্য। আসলে আমরা যখন স্বপ্ন দেখি, সেই মূহুর্তের জন্য স্বপ্নকে আমাদের সত্য বলে মনে হয়। আমরা জানি স্বপ্ন আমাদের চিন্তার আকার বা পরিণতি বিশেষ। স্বপ্নে আমরা যেমন স্পর্শসুখ পাই, শ্রবণসুখ এবং দৃশ্যসুখ পাই বা বিপরীত ভাবে বলা যেতে পারে, স্বপ্নে আমরা যেমন দুঃখ বা ভয় পাই, আতঙ্কগ্রস্থ হই, তেমনি এখানেও আমরা মানসিক দেহ নিয়ে আমরা সমস্ত সুখ-দুঃখ ভোগ করি। এই ভোগেচ্ছা একটা সময় সমাপ্ত হয়। তখন আবার আমরা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি।
এই অবস্থায় এক একজনের ক্ষেত্রে এক একরকম সময়-কাল ধরে চলে। কেউ কেউ বলেন, ২৫/৩০ বছর থাকার পরে, তার আবার ধরণীতে দেহ ধারণের ইচ্ছা প্রবল হয়। কেউ বলেন, হাজার বছর। আসলে বাসনার প্রবলতা অনুসারে এই স্তরে স্থায়ীকাল নির্দিষ্ট হয়। এই দেহ ধরনের ইচ্ছা যখন প্রবল হয়, সে সময় আবার সে অজ্ঞান-আচ্ছন্ন হয়ে পরে। এবং এই অবস্থাতেই সে তার ইচ্ছে পূরণের জন্য বা বাসনা পূরণের জন্য উপযুক্ত শরীরের ভ্রূণের মধ্যে প্রবেশ করে। এটাকেই বলি আমরা গর্ভধারণ। পার্থিব শরীর ভিন্ন আমাদের আমাদের ইচ্ছে পূরণের কোনো সুযোগ নেই। তা সে ভালো ইচ্ছেই বলুন আর ভোগের ইচ্ছেই বলুন। শরীর যন্ত্র ছাড়া আমাদের কোনো আদর্শ বা লক্ষ্য পূরণের কোনো উপায় নেই। তাই অনন্ত কাল কেউ স্বর্গে অর্থাৎ আনন্দে থাকে না বা অনন্ত কাল কেউ নরকে বা নিরানন্দে থাকে না। এখানেই ফিরে ফিরে আসে। ভীষ্মের ইচ্ছামৃত্যুর বড় ছিল, ভীষ্ম কথাটা এসেছে ভ্রম থেকে, এই ভ্রম মানুষের সহজে যায় না।ভীষ্মেরও সহজে মৃত্যু ঘটে না। তীরের ঊপরে বিদ্ধ হয়ে, শ্বর-শয্যায় তাকে বেঁচে থাকতে হয়। আমাদের ভোগেই সুখ, এই ভ্রম যতদিন না যাবে ততদিন আমাদের বার বার ফিরে আসতে হবে।
এখানথেকে আদর্শবান পুরুষ, বা প্রাজ্ঞপুরুষ যাকে স্থিতপ্রজ্ঞ বলে থাকি, তারা আর এই জগতে সাধারণত ফিরে আসেন না। তারা আরো উর্দ্ধে অর্থাৎ পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম অর্থাৎ মহঃ, জনঃ তপঃ এবং সব শেষে সত্যম বা ব্রহ্মলোকে যাত্রা করেন।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি ওম।
পূর্বজীবন :
আমাদের সবার খুব জানতে ইচ্ছে করে, এই জন্মের আগে আমি কি ছিলাম ? না, আমি জাতিস্মরের কথা বলছি না। জাতিস্মর তার নিজের পূর্বজীবনের কথা বলতে পারে। আমাদের অনুসন্ধানের উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমরা কিভাবে জন্মেছি মানুষ হয়ে, কোথায় ছিলাম, কিভাবে এলাম। আর কিভাবে সমস্ত মানুষের যাত্রা প্রক্রিয়া সংগঠিত হয় । মহাত্মারা বলে থাকেন, জীব তার বাসনা পূরণের জন্য দেহ ধারণ করে। জীব যদি সত্যিই বাসনা পূরণের জন্যই দেহ ধারণ করে থাকে, তবে বাসনা পূরণের আগেই কেন মানুষের চলে যেতে হয় এই দেহ ছেড়ে। বিশেষ করে শিশুমৃত্যু তো আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, যে, কোনো বাসনা পূরণের আগেই তার দেহপাত হয়ে গেল। আর বয়স হয়ে গেলে অর্থাৎ আমি যদি ৮০ বা ১০০ বছর বাঁচি, তাহলেও কি, আমাদের বাসনা পূরণ হয় ? আর যদি বাসনা পূরণ না হয় তবে আমাদের কেন চলে যেতে হয় ? আমাদের দেহ ধারণ ও দেহ ত্যাগ কি পূর্ব নির্ধারিত ? কেউ কেউ বলেন, আমাদের কর্মও নাকি পূর্বনির্ধারিত। ঈশ্বর মানুষকে মারতে পারে কি না জানি না, তবে মানুষ মানুষকে মারতে পারে, এটা তো আমরা চাক্ষুস দেখতে পারছি। তাহলে আমাদের জন্ম মৃত্যুতে কার ভূমিকা বেশি ? ভগবানের, নাকি মানুষের, নাকি প্রকৃতির। আমরা এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো।
জড়বাদীরা আত্মায় বিশ্বাস করে না। ঈশ্বরেও বিশ্বাস করে না। তারা মনে করে, জীবসত্ত্বা কতক গুলো রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফল। প্রকৃতির সমুদ্রে বুদ্বুদের মতো জীব ভেসে উঠছে, আবার প্রকৃতির সঙ্গেই মিশে যাচ্ছে। এ সবই প্রকৃতির খেলা। অসংখ্য কারণে জীবের যেমন সৃষ্টি হয়, আবার অসংখ্য কারণেই জীব প্রকৃতির মধ্যে লয় প্রাপ্ত হয়। জীবের কোনো ব্যক্তি সত্ত্বা নেই। জীব প্রকৃতির অঙ্গ। এতে জীবের কোনো ভূমিকা নেই। জীবের মরণের সাথে সাথে জীব গঠনের উপাদানসমূহের বিভাজন ও বিনাশ ঘটে থাকে। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবনগঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। জীব ইচ্ছে করলেই জন্ম গ্রহণ করতে পারে না। আবার মরতেও পারে না। আসলে জীবের ইচ্ছা, অর্থাৎ জীবন-মৃত্যু, প্রাণের অর্থাৎ বায়ুর সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত। বায়ু নিষ্কাশনের সঙ্গে সঙ্গে জীবসত্ত্বার বিলোপ ঘটে। অর্থাৎ প্রাকৃতিক কারণেই জীবনের বিলোপ ঘটে।
আমাদের সবার মন এই সমাধানে তৃপ্ত হয় না। পদার্থ কখনো চেতন সত্ত্বার সৃষ্টিকারী হতে পারে না। আমাদের ধীশক্তি পদার্থ দিয়ে উৎপত্তি হয়েছে, এমন কথা বিজ্ঞান প্রমান করতে পারে নি । জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় অবশ্য়ই আলাদা। আর যদি আলাদা না হয়, তবে ধরে নিতে হয় দুজনই চেতন সত্ত্বার অংশ, জড় নয়। মস্তিস্ক কখনো মনকে সৃষ্টি করতে পারে না। মস্তিস্ক বা জড় পদার্থ একটা বাদ্যযন্ত্র বিশেষ। এরমধ্যে সুর আছে, সেটা সত্য। কিন্তু এই সেই সুর তুলতে গেলে একটা চেতন সত্ত্বার দরকার। আর চেতন সত্ত্বা হচ্ছে শিল্পী। শিল্পী বাদ্যযন্ত্রে সুর তোলেন । জড় আর চেতন সত্ত্বার সঙ্গে এটাই পার্থক্য। তো চেতন সত্ত্বা একটা আছে। তা কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক। ঈশ্বরকে আপনি ছাড়তে পারেন , কিন্তু ঈশ্বর আপনাকে ছাড়বে না। তা আপনি যে অবস্থায়ই থাকুন না কেন ।
জগতে কোনোকিছু অকারণে হয় না। এই কথাটা বিজ্ঞান স্বীকার করে। তাহলে জীবন মরনেরও একটা কারন আছে নিশ্চয়। আর এই কথাটা যখন মনে হয়, তখন ইচ্ছে জাগে কারণের অনুসন্ধান করি। আর আমরা এও জানি, কারন কখনো বাইরে থাকতে পারে না। গাছের বীজ গাছের মধ্যেই থাকে। অনু আকারে যে বীজ গাছের মধ্যে থাকে, কালে কালে পরিবেশের দোলায়, সেই বীজ গাছে রূপান্তরিত হয়ে থাকে। শুধু পরিবেশে গাছ হতে পারে না। তাহলে জীব সৃষ্টির বীজ জীবের মধ্যেই নিহিত আছে। সুপ্ত সেই বীজ আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। আর খুঁজে বের করতে গেলে আমাদের জীবনচক্রকে পেছনের দিকে ঘোরাতে হবে। আমরা যেখান থেকে এসেছি সেখানে যেতে হবে। আমাদের মায়ের গর্ভে যেতে হবে। আমাদের শুক্রে যেতে হবে। শুক্রের উৎসে যেতে হবে। "জীবনচক্র" সিনেমাটাকে আমাদের রেউইন্ডিং করতে হবে, অর্থাৎ পিছন দিকে চলা হবে । মায়ের গর্ভ বা পৃথিবী, বীজকে অংকুরিত করবার পরিবেশ দেয়। বেড়ে ওঠার খাদ্য দেয়। কিন্তু বীজ আসে বাবার কাছ থেকে। আর এই বীজ স্থানান্তরিত হয়েছিল কামনার উদ্ভবে। কামনা আমাদের পিতাকে চঞ্চল করে তুলেছিলো অবয়ব তৈরির জন্য। দেহ ধারনের জন্য। এই কামনা কি পিতার ইচ্ছে ? নাকি আমাদের সূক্ষ্ম শরীরের ইচ্ছে। ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে। এই অন্তরকে আমাদের বুঝতে হবে। উপনিষদ প্রাণ সৃষ্টির উৎসকে বলছেন শ্রদ্ধা। অর্থাৎ জলের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অংশকে বলে শ্রদ্ধা। এটিই জীব সৃষ্টির প্রাথমিক ও আবশ্যিক উপাদান। তাই বলা হয়ে থাকে যে গ্রহে জল নেই সেখানে প্রাণ থাকবে না। কিন্তু জল আমাদের আবরণ বা দেহসৃষ্টির কারন। আমি নই। আমি কিন্তু সবত্র সমস্ত গ্যালাক্সিতে আমি। ঈশ্বরকণা।
আবার,বিজ্ঞান প্রথম প্রাণকে বলছেন, protozoa প্রটোজোয়া বা প্রথম প্রাণ। প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে সূক্ষ্ম নির্দিষ্ট আকারবিহীন এককোষী প্রাণী হচ্ছে amoeba এমিবা। একে কেবলমাত্র অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখা যায়। ক্ষনে ক্ষনে এরা রূপ পরিবর্তন করতে পারে। একটা মাত্র কোষ দিয়েই এদের সমস্ত জৈবিক ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এরা কখনো গোল, কখনো ডিম্বাকৃতি, কখনো লম্বা, ইত্যাদি যেকোনো আকার ধারণ করতে পারে। একেই বলে protozoa প্রটোজোয়া বা প্রথম প্রাণী। এমনও তো হতে পারে, এই প্রটোজোয়া কালের সঙ্গে সঙ্গে মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে। আর এর মধ্যেই মানুষের সমস্ত শক্তি অদৃশ্য ভাবে লুক্কায়িত ছিল। বেদান্ত দর্শন একেই বলছে সুক্ষ শরীর বা প্রাণবীজ । আর এর মধ্যেই আছে, আমাদের মন, বুদ্ধি, চিন্তা, ইচ্ছাশক্তি, এবং সমস্ত ইন্দ্রিয়সকল। আবার এর মধ্যেই আছে আমাদের প্রারব্ধ। এর মধ্যেই আছে এক ইথারীয় শক্তি, বা তরঙ্গ শক্তি যাকে আমরা বলি প্রাণশক্তি। সমস্ত দ্রব্যের আদিমতম সূক্ষ্ম সংস্করণ। এবং এই শক্তি আমাদের সবার মধ্যে বর্তমান। তাই প্রাণ থেকে প্রাণের সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ থেকে মানুষের সৃষ্টি হচ্ছে।
সূক্ষ্ম শরীর আমাদের প্রকৃত মানব সত্ত্বা। এই সূক্ষ্ম শরীরই মনুষ্য দেহের আকার ধারণ করে। ভোগের জন্য অবয়বের সৃষ্টি করে। এর জন্য আমাদের বাইরের থেকে কোনো কিছু নেবার প্রয়োজন পড়ে না।
চেতনশক্তিই শরীর তৈরি করে, শরীর কখনো চেতন শক্তি তৈরি করে না। এই সুক্ষ শরীরের মধ্যে অনন্ত সম্ভাবনা থাকে। জীবের যখন মৃত্যু হয়, তখন সে তার সমস্ত শক্তি অর্থাৎ মন, বুদ্ধি, স্মৃতি, চিত্ত, অহংকার, চিন্তা, ইচ্ছা এমনকি ইন্দ্রিয় শক্তি অর্থাৎ শ্রবণশক্তি, ঘ্রান শক্তি, দর্শনশক্তি, স্পর্শশক্তি, বাকশক্তি, অর্থাৎ সমস্ত সম্ভাবনা নিয়ে এমনকি আমাদের সংস্কার ও প্রারব্ধ নিয়ে একটা বিদ্যুৎতরঙ্গ আকারে ঘুরতে থাকে। অর্থাৎ সমস্ত পদার্থের অতি সূক্ষ্মকণা সন্নিবদ্ধ হয়ে ঘুরতে থাকে। এটি অব্যক্ত অবস্থা নয়। ব্যক্ত, এবং ভৌতিক। প্রথম দিকে এরা চতুর্থ স্তরে থাকে। কালে কালে যারা জ্ঞানলোকের আলো ধরতে পারে, তারা পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম স্তরে প্রবেশ করে। এই রকম স্তর আছে ৫১টি। যে যত উপরের স্তরে চলে যায়, তাদের ফিরে আসতে তত দেরি হয়। আমরা বলি এদের পুনরাবৃত্তি হয় না। কেবল মাত্র চতুর্থ স্তর থেকেই আমরা আমাদের এই তৃতীয় স্তরে নেবে আসি। এটাই পুনর্জন্ম। অর্থাৎ চতুর্থ স্তর থেকে তৃতীয় স্তরে নেবে আসা জন্ম। আর তৃতীয় স্তর থেকে চতুর্থ স্তরে চলে যাওয়ায় মৃত্যু।
আমরা আগেই শুনেছি , মৃত্যুকালে,আমাদের চেতন সত্ত্বা বা আত্মা ব্যক্তিবিশেষের সমস্ত শক্তিকে সংকুচিত ক'রে, নিউক্লিয়াসে, প্রাণবিন্দুতে, বা শ্রদ্ধাতে পরিণত হয়। কালে কালে অনুকূল পরিবেশ পেলে এই শ্রদ্ধা বা প্রাণবিন্দু আবার দেহ ধারণ করে। এখানে মা-বাবা এই দেহ গঠনে সহায়ক হয় মাত্র। দেহগঠনকারী নয়। দেহ হচ্ছে আত্মার আবরণ মাত্র । এবং এই দেহ আত্মাই সৃষ্টি করে থাকে । রেশম কিট যেমন নিজের লালা নিঃসরণ ক'রে, নিজেকে আচ্ছাদিত করে তেমনি রেশমকীটের মতো, জীবাত্মা নিজেকে আচ্ছাদিত করে, নিজেরই লালার বা রসের সাহায্যে। এই রসকে উপনিষদ বলছে শ্রদ্ধা । অর্থাৎ জীবের সূক্ষ্মতম সংস্করণ। মা বাবা কখনোই তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী শিশুর জন্ম দিতে পারে না। যতক্ষন না পর্যন্ত পিতার মধ্যে শুক্রের আবির্ভাব না হয়, যতক্ষন না পর্যন্ত মাতার মধ্যে রজের আবির্ভাব না হয় ততক্ষন মা-বাবা কোনো দেহের বা শিশুর জন্মে কারন হতে পারে না। আর এই শুক্র বা রজ প্রক্রিয়া, মানুষের মধ্যে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এমনি এমনি হয়। এর জন্য মানুষের আলাদা করে কিছু করতে হয় না। সূক্ষ্ম শরীর জল কনার মতো। জল যখন বাষ্পাকারে থাকে তখন সে মেঘ, যখন সে তরল আকারে থাকে তখন সে সমুদ্র। এটি কখনো ধংশপ্রাপ্ত হয় না। অবস্থার পরিবর্তন হয় মাত্র।
আমাদের এই মূলসত্ত্বা সত্ত্বা যেমন এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হতে পারে, তেমনি অন্য যে কোনো গ্রহে, অন্য যে কোনো মন্ডলে আবির্ভূত হতে পারে। এই সত্ত্বা আলো ও শব্দ তরঙ্গের সাহায্যে মহাবিশ্বের যে কোনো স্থানে বিচরণ করতে পারে। এটি তখন অভৌতিক অবস্থায় থাকে। পরিবেশ পেলে, প্রাণবিন্দুর মধ্যে নিজেকে অবাধ করে। ভৌত রূপ নেয়। আর একটা কথা, যে শক্তি আমাদের এই স্তর পরিবর্তন করায়, তাকেই আমরা বলি পরম-আত্মা। তাকে প্রতিরোধ করবার শক্তি কারুর নেই।
দেখুন মাধ্যাকর্ষন শক্তি যেমন আমাদের এই দেহকে ধরে রেখেছে, আমাদের আত্মাও আকার নেয়, এই মাধ্যাকর্ষণ শক্তির জন্য। আর এই জগৎটাও মাধ্যাকর্ষণ শক্তির নিয়মে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই ধ্রুব সত্য আপনি মানুন আর না মানুন, তাতে কিছুই এসে যায় না।
আমাদের মূল সত্ত্বা এই প্রাণবিন্দু অর্থাৎ শ্রদ্ধা সৃষ্টির অতীত। এটি পরমাত্মার প্রতিফলিত জ্যোতি সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর একে সংরক্ষণ করে, প্রাণবায়ু, মন, ইন্দ্রিয়শক্তি,সংস্কার। এই প্রাণবিন্দু দেহ ধারণ ক'রে, আবার নতুন অভিজ্ঞতার সন্মুখীন হয়, সংস্কারের জন্ম দেয়, আবার ভোগের দ্বারা সংস্কারের বিলোপ সাধন করে। এই প্রক্রিয়াই চলছে যুগের পর যুগ, কাল থেকে কালান্তরে।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি ওম
পূর্ব জীবন (২)
একটা কথা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি যে ৮৪ লক্ষ যোনি পরিভ্রমন করে আমরা এই মনুষ্য দেহ পেয়েছি। এই ৮৪ লক্ষ যোনি ব্যাপারটা কি ?
জীবের বেঁচে থাকার জন্য দুটো জিনিসের প্রয়োজন। এক - প্রাণক্রিয়া অর্থাৎ ফুসফুসের ক্রিয়া। আর একটা হচ্ছে চেতন শক্তি। মায়ের পেটে যখন থাকি, তখন আমাদের প্রাণক্রিয়া মায়ের প্রাণক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকে। পরে, আমাদের নিজস্ব ফুসফুস ক্রিয়াশীল হয়। এই প্রাণক্রিয়ার শুরু কি এখানেই না, না এর কোনো ইতিহাস আছে ? দুই - চেতন শক্তি আমাদের শরীরে কখন শুরু হয় ? অর্থাৎ আত্মা আমাদের শরীরে কখন প্রবেশ করে ? আচ্ছা, মানুষের মৃত্যুর পরে কি আবার সেই ৮৪ লক্ষ যোনি ঘুরে তবে আবার আমি মানুষ হতে পারবো ? এমনি অনেক প্রশ্ন আমাদের মধ্যে জাগে।
এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে আমাদের প্রাণের উৎসে যেতে হবে। আত্মার গমন নির্গমন ব্যাপারটা বুঝতে হবে। প্রাণ সৃষ্টির একটা প্রক্রিয়া আছে। কিন্তু আত্মা অজন্মা। আত্মার না আছে শুরু না আছে শেষ। ফুসফুস সম্প্রসারণ ও সংকোচনের মাধ্যমে আমরা প্রাণকে গতিশীল করতে পারি। কিন্তু চেতন শক্তি আসা যাওয়া করে কি করে ? এমনি অনেক প্রশ্ন আমাদের মধ্যে জাগে, আমরা আজ তার জবাব শুনবো।
আমরা সবাই জানি, আমাদের দেহ পঞ্চকোষের সমষ্টি। আর তা হচ্ছে, অন্নময়, প্রাণময়, মনময়, বিজ্ঞানময়, ও আনন্দময়। এখন কথা হচ্ছে, কোষ বলতে আমরা কি বুঝি ? বিজ্ঞান বলছে, প্রোটোপ্লাজম সমন্বিত জীবদেহের ক্ষুদ্র একককে বলে কোষ। জীবদেহ এক বা একাধিক কোষ দ্বারা গঠিত। আমাদের দেহে আছে পাঁচ ধরনের কোষ। কিন্তু সমস্ত জীবের দেহে এই পাঁচ ধরনের কোষ নেই। এখন কথা হচ্ছে, প্রোটোপ্লাজম কি ? প্রোটোপ্লাজম হচ্ছে, একধরনের অর্দ্ধ তরল জেলির মতো সজীব পদার্থ। এই প্রোটোপ্লাজম-ই আসলে জীবের প্রাণ পদার্থ। এই প্রোটোপ্লাজম তৈরি হয় কতকগুলো মৌল পদার্থ দিয়ে। আর তা হচ্ছে - কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, সালফার, ফসফরাস ইত্যাদি মৌল পদার্থ দিয়ে তৈরি। জীবের সমস্ত জৈবিক বা বায়োলজিক্যাল ক্রিয়াগুলো এই প্রোটোপ্লাজমের মধ্যেই ঘটে থাকে । আর কোষের বৈচিত্র দেখা যায়, তার গঠনপ্রক্রিয়ার মধ্যেই। অর্থাৎ মৌল পদার্থের পরিমান ভেদের জন্য তাদের মধ্যে তারতম্য দেখা যায়।
আমরা বা মনুষ্যদেহ যেমন পাঁচ ধরনের কোষ দ্বারা গঠিত, তেমনি এক ধরনের জীব আছে যারা একটি মাত্র কোষ দ্বারা গঠিত। যেমন, ব্যাক্টেরিয়া, অ্যামিবা ইত্যাদি।
কতকগুলো কোষ একত্র হয়ে গঠিত হয় টিসু বা কলা। অর্থাৎ কতকগুলি কোষের সমষ্টিকে বলে কলা। আবার কতকগুলো কলার সমষ্টিকে বলে অরগ্যান বা অঙ্গ। আবার কতকগুলো অঙ্গের সমষ্টিকে বলে তন্ত্র, আর কতকগুলো তন্ত্রের সমষ্টিকে বলে জীব। এই জীব আবার অনেক রকম হয়। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পোকা একটা জীব, আবার কুকুর-ছাগল জীব, আবার উদ্ভিদ-এরও প্রাণ আছে। এদের সবার আকৃতি যেমন আলাদা আলাদা তেমনি গঠনশৈলী ও বেঁচে থাকার কাল বা সময় আলাদা আলাদা। উদ্ভিদের শাখা, প্রশাখা, পাতা, ফুল, ফল ইত্যাদি তাদের অংগ। তেমনি জীবের চোখ, মুখ, কান, ফুসফুস, পাকস্থলী, হৃৎপিন্ড এক-একটা আলাদা অঙ্গ। এই অঙ্গগুলোকে একত্রিত করে তৈরি হয় একটা তন্ত্র যাকে আমরা বলি সিস্টেম। স্নায়ুতন্ত্র, পরিপাকতন্ত্র, পেশিতন্ত্র ইত্যাদি।
পৃথিবীতে জীব সৃষ্টির আদিতে ছিল, এককোষী, যা কেবলমাত্র অণুবীক্ষণ দ্বারাই দেখা যেতে পারে। কোটি কোটি বছর ধরে নানান পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আজকের জীব তৈরি হয়েছে। এই পরিবর্তন এখনো চলছে, এবং আজ থেকে কোটি বছর পরে, জীবের আকার, গঠন ও ক্ষমাতাগত পরিবর্তন হবে। এবং উন্নততর জীব সৃষ্টি হবে। আর একটা কথা, জীবের যেমন জন্ম আছে, তেমনি জীবের মৃত্যু অবধারিত। তবে কোনো জীব, স্বল্পক্ষন বাঁচে, আবার কোনো জীব বহুদিন যাবৎ বেঁচে থাকে। প্রাণীদের মধ্যে যেমন কচ্ছপ অনেকদিন বাঁচে, তেমনি উদ্ভিদের মধ্যে বটগাছ অনেক দিন বাঁচে। জন্মের পর জীব ক্রমশঃ বৃদ্ধি পায়, বংশ বিস্তার করে, আবার বিপাকীয় ক্রিয়াগুলো যখন হ্রাস পেতে থাকে, তখন জীবের বার্ধক্য আসে. এবং একদিন মৃত্যু হয়। এটাকেই জীবনচক্র বলে। অর্থাৎ নতুন কোষ জন্মানো ও পুরাতন কোষের অপসারণ বা মৃত্যু - এটাই আমাদের জীবন বা শারীরিক যাত্রাবৃত্ত ।কোষের মৃত্যুর থেকে যখন কোষের জন্মের হার বেশি থাকে তখন আমরা শিশু থেকে যৌবনে পৌঁছাই। আবার কোষের জন্মের থেকে মৃত্যুর হার যখন বেশি হয়, তখন আমরা বৃদ্ধাবস্থায় চলে যাই। এর পরে আমাদের প্রাণপাত হয়।
পৃথিবীতে দুই ধরনের বস্তু আছে। যে বস্তুর প্রাণ আছে অর্থাৎ প্রোটোপ্লাজম আছে, তাকে বলা হয় প্রাণী। আর যাদের এই প্রোটোপ্লাজম নেই বা শুকিয়ে গেছে, তাদের বলা হয় প্রাণহীন বা জড় বস্তু। প্রাণহীন বস্তুর আকৃতির বৃদ্ধি নেই , বংশ বিস্তার করতে পারে না, চলন বা গমন নেই, উত্তেজনাতেও সাড়া দেয় না। আর যাদের প্রাণ আছে, তাদের আকৃতির বৃদ্ধি আছে, বংশ বিস্তার করতে পারে, চলন বা গমন আছে, এবং উত্তেজনায় সাড়া দেয়।
এখন কথা হচ্ছে, মানুষের বা সমস্ত জীবের প্রাণ আছে, উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। এমনকি এমন উদ্ভিদ আছে যারা উত্তেজনায় সাড়া দেয়, যেমন লজ্জাবতী গাছ। এরা বাতাসের বা মানুষের স্পর্শে নিজেকে সংকুচিত করে নেয়। আবার এমন উদ্ভিদ আছে, যারা গমনে সক্ষম। এমনকি মাংসাশী উদ্ভিদ আছে। যারা পোকা মাকড় খেয়ে থাকে। সব থেকে গুরুত্ত্বপূর্ন কথা হচ্ছে, এমন কিছু এককোষী জীব আছে, যাদের মধ্যে উদ্ভিদ ও প্রাণীর উভয় লক্ষণ আছে। যেমন ক্রাইস এমিবা ইত্যাদি। এইজন্য বিজ্ঞানীরা মনে করে থাকেন, আজকের যে উন্নততর জীব, তা এই সব এককোষী জীব থেকেই হয়েছে।
এত গেলো দেহের কথা, এবং প্রাণের কথা। পৃথিবীতে যখন প্রাণ সৃষ্টির প্রক্রিয়া চলছে, তখন আত্মা কোথায় ছিল ? এই দেহে আছে আমাদের আত্মা বা চেতন শক্তি। আমরা আগেই শুনেছি যে, জীবের যখন মৃত্যু হয়, তখন সে তার সমস্ত শক্তি অর্থাৎ মন, বুদ্ধি, স্মৃতি, চিত্ত, অহংকার, চিন্তা, ইচ্ছা এমনকি ইন্দ্রিয় শক্তি অর্থাৎ শ্রবণশক্তি, ঘ্রান শক্তি, দর্শনশক্তি, স্পর্শশক্তি, বাকশক্তি, অর্থাৎ সমস্ত সম্ভাবনা নিয়ে এমনকি আমাদের সংস্কার ও প্রারব্ধ নিয়ে একটা বিদ্যুৎতরঙ্গ আকারে ঘুরতে থাকে। অর্থাৎ সমস্ত পদার্থের অতি সূক্ষ্মকণা সন্নিবদ্ধ হয়ে ঘুরতে থাকে। এটি অব্যক্ত নয় ব্যক্ত। জীব সৃষ্টির প্রক্রিয়া যখন পৃথিবীতে চলছিল, তখন আত্মা এই প্রক্রিয়ার অব্যক্ত অকর্তা ছিলেন। জীবন যে এই পৃথিবীতে প্রথম শুরু হয়েছে, তা তো নয়। এর আগে জীবনের খেলা চলছিল চন্দ্রে। তখন চন্দ্র ছিল, গ্রহ। এসব কথা আমরা সৃষ্টিতত্ত্বে শুনেছি। জীবন সৃষ্টির প্রাথমিক প্রক্রিয়া এখন শুরু হয়েছে বুধে। এমনকি এই মুহূর্তে আমাদের থেকে উন্নত জীব আছে শুক্রে। এবং এর পরে পৃথিবীতে যখন প্রাণের কাজ শেষ হয়ে যাবে, তখন বুধে প্রাণ স্থানান্তরিত হবে। পৃথিবী আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যাবে। এসব কথা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু পরাবিদ্যাবিদদের কাছে এসব সত্য।
এখন কথা হচ্ছে, আমাদের মৃত্যুর পরে আমাদের কি আবার প্রোটোপ্লাজম থেকে শুরু করতে হবে, মানুষ হবার জন্য ? অর্থাৎ যদি প্রাণ বা প্রোটোপ্লাজম থেকে জীবের শুরু হয়, তবে কি আমাদের আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে ? পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন না, তবে ব্যতিক্রমও আছে। মানুষ যদি নিকৃষ্ট জীব হয়ে জন্মাতে চায়, তবে সে তা হতে পারে। কিন্তু সাধারণত তা কেউ চায় না, তাই সে আবার মানুষ হয়েই জন্মাবে।
আত্মা সম্পর্কে আমরা বিভিন্ন রকম মত শুনতে পাই। চার্বাক বলছেন, চৈতন্য শক্তি হচ্ছে মিশ্র বস্তুর অতিরিক্ত গুন্। অর্থাৎ যে গুন্ মৌল পদার্থের মধ্যে ছিল না। সেই একাধিক মৌল বস্তু যখন একত্রিত হয়ে যৌগবস্তুতে পরিণত হয়, তখন তার মধ্যে একটা বিশেষ বা অতিরিক্ত গুনের সমাহার লক্ষ করা যায়। আমাদের চৈতন্য শক্তি হচ্ছে এই যৌগবস্তুর অতিরিক্ত গুন্, যা মৌল বস্তুর মধ্যে লক্ষ করা যায় নি। দুটো রঙ মেশালে একটা নতুন রঙের সৃষ্টি হয়। যা ওই মূল রঙ গুলোর মধ্যে ছিল না, বা দেখা যায় নি। আপনি চুন সুপুরি খয়ের দিয়ে পান খেয়েছেন, এর মধ্যে কোনোটাই লাল ছিল না। কিন্তু যখন চুন-সুপুরি-খয়ের-পান চিবোলেন, অর্থাৎ মেশালেন, তখন একটা নতুন রঙের দেখা মিললো, আর তা হলো লাল। ঠিক তেমনি - কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, সালফার, ফসফরাস ইত্যাদি মৌল পদার্থ দিয়ে তৈরি প্রোটোপ্লাজম । এইসব মৌল পদার্থ একত্রিত হয়ে যা তৈরি হলো তা প্রাণ বা প্রোটোপ্লাজম। আবার বিভিন্ন মিশ্রনের কোষগুলো যখন একত্রিত হলো, তখন আর একটা শক্তি সৃষ্টি হলো আর তা হচ্ছে চেতন শক্তি। যাকে আমরা আত্মা বলে থাকি।
বৈদিক যুগে এই মত প্রত্যাহার করা হয়। কারন যোগঋষিগন উপলব্ধি করেছিলেন, প্রকৃতির উপরে আর একটা সত্ত্বা আছে , যাকে তারা বলছেন পুরুষ। এই বিরাট পুরুষ অর্থাৎ ব্রহ্মান্ডের অব্যক্ত শক্তি, যা পরবর্তীতে পুরুষের মধ্যেই ব্যক্ত হয়েছে। যাকে আমরা বলছি, প্রকৃতি। প্রকৃতি যে সনাতন শক্তির সাহায্যে শৃঙ্খলার মধ্যে আবদ্ধ থাকছে, তা ওই নিত্যশক্তির খেলা। প্রকৃতি নিয়মে আবদ্ধ। আর পুরুষ নিয়মের স্রষ্টা। প্রকৃতি পরিবর্তনশীল, আর পুরুষ অপরিবর্তনীয়। একেই বেদ বলছে ব্রহ্ম। এই বিরাটপুরুষের প্রতিফলিত শক্তি নিয়ে জীব চেতনাসম্পন্ন হয়েছে। প্রাণ ও চেতনা আলাদা, কিন্তু একের সঙ্গে অন্যের একটা সংযোগ আছে। জীবের দেহ থেকে যখন প্রাণের উৎক্রমন ঘটে, তখন আত্মাও দেহকে ছেড়ে দেয়। অর্থাৎ পুরুষ সত্ত্বা দেহের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়, প্রাণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আর স্থুল দেহকে বাঁচিয়ে রাখে প্রাণশক্তি। আর প্রাণহীন আমাদের মনময় দেহ বা বিজ্ঞানময় দেহ, ও আনন্দময় দেহ - এদের সাথেও থাকে সেই পুরুষের প্রতিফলিত শক্তি। তাই আমরা যখন দেহের মধ্যে আসি, তখন আমাদের যেখান থেকে পুনরাবৃত্তি হয়, সেখানেই আমরা বীজ আকারে আত্মার প্রতিফলিত শক্তিকে আশ্রয় করে ছিলাম। তাই প্রাণ যখন শরীরে আসে, অর্থাৎ মাতৃগর্ভে ৪৫-৫০ দিনের মধ্যেই মায়ের প্রাণের সঙ্গে আমাদের সংযোগ তৈরি হয়। আবার মায়ের প্রাণের সঙ্গে যখন আমাদের প্রাণের বিচ্ছিন্নতা ঘটে, অর্থাৎ মায়ের গর্ভের বাইরে আসি তখন আমাদের নিজস্ব প্রাণের ক্রিয়া শুরু হয়। চৈতন্য শক্তির আবির্ভাব ঠিক একই সময় হয়ে থাকে। তাই মায়ের পেটে আমরা মায়ের প্রাণ ও চৈতন্য শক্তির আশ্রয়ে থাকি। তখন আমাদের শরীর মায়ের শরীরের একটা অঙ্গবিশেষ মাত্র। আর মায়ের শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে আমরা আমাদের নিজস্ব প্রানক্রিয়ার সাথে আমাদের চৈতন্যশক্তিকে আশ্রয় করি।
একটা কথা শোনা যায়, যে আমরা নাকি ৮৪ লক্ষ যোনী পরিভ্রমন করে মনুষ্য দেহ লাভ করেছি। সত্য হচ্ছে চুরাশি লক্ষ একটা কথার কথা, আসলে অসংখ্য যোনী ভ্রমণের পর আমরা মনুষ্য দেহ লাভ করেছি। কিন্তু আমাদের আবার মনুষ্য দেহ ধারনের জন্য, প্রথম থেকে শুরু করতে হবে, তা নয়। যারা একবার মানুষ হয়ে জন্মেছেন , তারা মৃত্যুর পরে, যে দেহে অবস্থান করবেন , অর্থাৎ মনময়, বা বিজ্ঞানময় দেহে বা আনন্দময় দেহে সেখান থেকেই নিজেদের প্রারব্ধকে সঙ্গে নিয়ে আবার মানুষ হিসেবেই জন্ম গ্রহণ করবেন , তাদের সংকল্প বা বাসনা পূরণের জন্য। তবে একটা কথা বলি, যারা মনময় দেহে অবস্থান করবেন, তারা তাড়াতাড়ি আবার আসতে পারবেন, বা বলা যেতে পারে, আসতে হবে। আর যারা বিজ্ঞানময় দেহে অবস্থান করবেন, তারা আসতে অনেক দেরি করবেন। আর আনন্দময় দেহে যারা অবস্থান করবেন, তারা শুধু সৃষ্টির কাজে সাহায্য করবার জন্যই এসে থাকেন। আমরা যে উন্নত বা উন্নততর মহাত্মাদের দেখতে পাই, এই পৃথিবীতে তাদের আগমন হয় বিজ্ঞানময় বা আনন্দময় দেহ থেকে। গীতায় ভগবান যে বলেছেন, আমি ধর্মের পালনের জন্য, অধর্মের নাশের জন্য, এই পৃথিবীতে এসে থাকি। অর্থাৎ এঁরা আনন্দময় দেহে অবস্থান করছিলেন। এদের ভোগ বা বাসনা বা সংকল্প বলে কিছু নেই। কেবলমাত্র সৃষ্টিকে সহায়তা করবার জন্য, এঁরা এসে থাকেন। এদের নিজেদের জন্য এঁরা কিছু করেন না। জগতের হিত , জগৎবাসীদের শিক্ষা দেবার জন্য এসে থাকেন।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি ওম।
পূর্ব জীবন (২)
একটা কথা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি যে ৮৪ লক্ষ যোনি পরিভ্রমন করে আমরা এই মনুষ্য দেহ পেয়েছি। এই ৮৪ লক্ষ যোনি ব্যাপারটা কি ?
জীবের বেঁচে থাকার জন্য দুটো জিনিসের প্রয়োজন। এক - প্রাণক্রিয়া অর্থাৎ ফুসফুসের ক্রিয়া। আর একটা হচ্ছে চেতন শক্তি। মায়ের পেটে যখন থাকি, তখন আমাদের প্রাণক্রিয়া মায়ের প্রাণক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকে। পরে, আমাদের নিজস্ব ফুসফুস ক্রিয়াশীল হয়। এই প্রাণক্রিয়ার শুরু কি এখানেই না, না এর কোনো ইতিহাস আছে ? দুই - চেতন শক্তি আমাদের শরীরে কখন শুরু হয় ? অর্থাৎ আত্মা আমাদের শরীরে কখন প্রবেশ করে ? আচ্ছা, মানুষের মৃত্যুর পরে কি আবার সেই ৮৪ লক্ষ যোনি ঘুরে তবে আবার আমি মানুষ হতে পারবো ? এমনি অনেক প্রশ্ন আমাদের মধ্যে জাগে।
এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে আমাদের প্রাণের উৎসে যেতে হবে। আত্মার গমন নির্গমন ব্যাপারটা বুঝতে হবে। প্রাণ সৃষ্টির একটা প্রক্রিয়া আছে। কিন্তু আত্মা অজন্মা। আত্মার না আছে শুরু না আছে শেষ। ফুসফুস সম্প্রসারণ ও সংকোচনের মাধ্যমে আমরা প্রাণকে গতিশীল করতে পারি। কিন্তু চেতন শক্তি আসা যাওয়া করে কি করে ? এমনি অনেক প্রশ্ন আমাদের মধ্যে জাগে, আমরা আজ তার জবাব শুনবো।
আমরা সবাই জানি, আমাদের দেহ পঞ্চকোষের সমষ্টি। আর তা হচ্ছে, অন্নময়, প্রাণময়, মনময়, বিজ্ঞানময়, ও আনন্দময়। এখন কথা হচ্ছে, কোষ বলতে আমরা কি বুঝি ? বিজ্ঞান বলছে, প্রোটোপ্লাজম সমন্বিত জীবদেহের ক্ষুদ্র একককে বলে কোষ। জীবদেহ এক বা একাধিক কোষ দ্বারা গঠিত। আমাদের দেহে আছে পাঁচ ধরনের কোষ। কিন্তু সমস্ত জীবের দেহে এই পাঁচ ধরনের কোষ নেই। এখন কথা হচ্ছে, প্রোটোপ্লাজম কি ? প্রোটোপ্লাজম হচ্ছে, একধরনের অর্দ্ধ তরল জেলির মতো সজীব পদার্থ। এই প্রোটোপ্লাজম-ই আসলে জীবের প্রাণ পদার্থ। এই প্রোটোপ্লাজম তৈরি হয় কতকগুলো মৌল পদার্থ দিয়ে। আর তা হচ্ছে - কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, সালফার, ফসফরাস ইত্যাদি মৌল পদার্থ দিয়ে তৈরি। জীবের সমস্ত জৈবিক বা বায়োলজিক্যাল ক্রিয়াগুলো এই প্রোটোপ্লাজমের মধ্যেই ঘটে থাকে । আর কোষের বৈচিত্র দেখা যায়, তার গঠনপ্রক্রিয়ার মধ্যেই। অর্থাৎ মৌল পদার্থের পরিমান ভেদের জন্য তাদের মধ্যে তারতম্য দেখা যায়।
আমরা বা মনুষ্যদেহ যেমন পাঁচ ধরনের কোষ দ্বারা গঠিত, তেমনি এক ধরনের জীব আছে যারা একটি মাত্র কোষ দ্বারা গঠিত। যেমন, ব্যাক্টেরিয়া, অ্যামিবা ইত্যাদি।
কতকগুলো কোষ একত্র হয়ে গঠিত হয় টিসু বা কলা। অর্থাৎ কতকগুলি কোষের সমষ্টিকে বলে কলা। আবার কতকগুলো কলার সমষ্টিকে বলে অরগ্যান বা অঙ্গ। আবার কতকগুলো অঙ্গের সমষ্টিকে বলে তন্ত্র, আর কতকগুলো তন্ত্রের সমষ্টিকে বলে জীব। এই জীব আবার অনেক রকম হয়। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পোকা একটা জীব, আবার কুকুর-ছাগল জীব, আবার উদ্ভিদ-এরও প্রাণ আছে। এদের সবার আকৃতি যেমন আলাদা আলাদা তেমনি গঠনশৈলী ও বেঁচে থাকার কাল বা সময় আলাদা আলাদা। উদ্ভিদের শাখা, প্রশাখা, পাতা, ফুল, ফল ইত্যাদি তাদের অংগ। তেমনি জীবের চোখ, মুখ, কান, ফুসফুস, পাকস্থলী, হৃৎপিন্ড এক-একটা আলাদা অঙ্গ। এই অঙ্গগুলোকে একত্রিত করে তৈরি হয় একটা তন্ত্র যাকে আমরা বলি সিস্টেম। স্নায়ুতন্ত্র, পরিপাকতন্ত্র, পেশিতন্ত্র ইত্যাদি।
পৃথিবীতে জীব সৃষ্টির আদিতে ছিল, এককোষী, যা কেবলমাত্র অণুবীক্ষণ দ্বারাই দেখা যেতে পারে। কোটি কোটি বছর ধরে নানান পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আজকের জীব তৈরি হয়েছে। এই পরিবর্তন এখনো চলছে, এবং আজ থেকে কোটি বছর পরে, জীবের আকার, গঠন ও ক্ষমাতাগত পরিবর্তন হবে। এবং উন্নততর জীব সৃষ্টি হবে। আর একটা কথা, জীবের যেমন জন্ম আছে, তেমনি জীবের মৃত্যু অবধারিত। তবে কোনো জীব, স্বল্পক্ষন বাঁচে, আবার কোনো জীব বহুদিন যাবৎ বেঁচে থাকে। প্রাণীদের মধ্যে যেমন কচ্ছপ অনেকদিন বাঁচে, তেমনি উদ্ভিদের মধ্যে বটগাছ অনেক দিন বাঁচে। জন্মের পর জীব ক্রমশঃ বৃদ্ধি পায়, বংশ বিস্তার করে, আবার বিপাকীয় ক্রিয়াগুলো যখন হ্রাস পেতে থাকে, তখন জীবের বার্ধক্য আসে. এবং একদিন মৃত্যু হয়। এটাকেই জীবনচক্র বলে। অর্থাৎ নতুন কোষ জন্মানো ও পুরাতন কোষের অপসারণ বা মৃত্যু - এটাই আমাদের জীবন বা শারীরিক যাত্রাবৃত্ত ।কোষের মৃত্যুর থেকে যখন কোষের জন্মের হার বেশি থাকে তখন আমরা শিশু থেকে যৌবনে পৌঁছাই। আবার কোষের জন্মের থেকে মৃত্যুর হার যখন বেশি হয়, তখন আমরা বৃদ্ধাবস্থায় চলে যাই। এর পরে আমাদের প্রাণপাত হয়।
পৃথিবীতে দুই ধরনের বস্তু আছে। যে বস্তুর প্রাণ আছে অর্থাৎ প্রোটোপ্লাজম আছে, তাকে বলা হয় প্রাণী। আর যাদের এই প্রোটোপ্লাজম নেই বা শুকিয়ে গেছে, তাদের বলা হয় প্রাণহীন বা জড় বস্তু। প্রাণহীন বস্তুর আকৃতির বৃদ্ধি নেই , বংশ বিস্তার করতে পারে না, চলন বা গমন নেই, উত্তেজনাতেও সাড়া দেয় না। আর যাদের প্রাণ আছে, তাদের আকৃতির বৃদ্ধি আছে, বংশ বিস্তার করতে পারে, চলন বা গমন আছে, এবং উত্তেজনায় সাড়া দেয়।
এখন কথা হচ্ছে, মানুষের বা সমস্ত জীবের প্রাণ আছে, উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। এমনকি এমন উদ্ভিদ আছে যারা উত্তেজনায় সাড়া দেয়, যেমন লজ্জাবতী গাছ। এরা বাতাসের বা মানুষের স্পর্শে নিজেকে সংকুচিত করে নেয়। আবার এমন উদ্ভিদ আছে, যারা গমনে সক্ষম। এমনকি মাংসাশী উদ্ভিদ আছে। যারা পোকা মাকড় খেয়ে থাকে। সব থেকে গুরুত্ত্বপূর্ন কথা হচ্ছে, এমন কিছু এককোষী জীব আছে, যাদের মধ্যে উদ্ভিদ ও প্রাণীর উভয় লক্ষণ আছে। যেমন ক্রাইস এমিবা ইত্যাদি। এইজন্য বিজ্ঞানীরা মনে করে থাকেন, আজকের যে উন্নততর জীব, তা এই সব এককোষী জীব থেকেই হয়েছে।
এত গেলো দেহের কথা, এবং প্রাণের কথা। পৃথিবীতে যখন প্রাণ সৃষ্টির প্রক্রিয়া চলছে, তখন আত্মা কোথায় ছিল ? এই দেহে আছে আমাদের আত্মা বা চেতন শক্তি। আমরা আগেই শুনেছি যে, জীবের যখন মৃত্যু হয়, তখন সে তার সমস্ত শক্তি অর্থাৎ মন, বুদ্ধি, স্মৃতি, চিত্ত, অহংকার, চিন্তা, ইচ্ছা এমনকি ইন্দ্রিয় শক্তি অর্থাৎ শ্রবণশক্তি, ঘ্রান শক্তি, দর্শনশক্তি, স্পর্শশক্তি, বাকশক্তি, অর্থাৎ সমস্ত সম্ভাবনা নিয়ে এমনকি আমাদের সংস্কার ও প্রারব্ধ নিয়ে একটা বিদ্যুৎতরঙ্গ আকারে ঘুরতে থাকে। অর্থাৎ সমস্ত পদার্থের অতি সূক্ষ্মকণা সন্নিবদ্ধ হয়ে ঘুরতে থাকে। এটি অব্যক্ত নয় ব্যক্ত। জীব সৃষ্টির প্রক্রিয়া যখন পৃথিবীতে চলছিল, তখন আত্মা এই প্রক্রিয়ার অব্যক্ত অকর্তা ছিলেন। জীবন যে এই পৃথিবীতে প্রথম শুরু হয়েছে, তা তো নয়। এর আগে জীবনের খেলা চলছিল চন্দ্রে। তখন চন্দ্র ছিল, গ্রহ। এসব কথা আমরা সৃষ্টিতত্ত্বে শুনেছি। জীবন সৃষ্টির প্রাথমিক প্রক্রিয়া এখন শুরু হয়েছে বুধে। এমনকি এই মুহূর্তে আমাদের থেকে উন্নত জীব আছে শুক্রে। এবং এর পরে পৃথিবীতে যখন প্রাণের কাজ শেষ হয়ে যাবে, তখন বুধে প্রাণ স্থানান্তরিত হবে। পৃথিবী আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যাবে। এসব কথা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু পরাবিদ্যাবিদদের কাছে এসব সত্য।
এখন কথা হচ্ছে, আমাদের মৃত্যুর পরে আমাদের কি আবার প্রোটোপ্লাজম থেকে শুরু করতে হবে, মানুষ হবার জন্য ? অর্থাৎ যদি প্রাণ বা প্রোটোপ্লাজম থেকে জীবের শুরু হয়, তবে কি আমাদের আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে ? পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন না, তবে ব্যতিক্রমও আছে। মানুষ যদি নিকৃষ্ট জীব হয়ে জন্মাতে চায়, তবে সে তা হতে পারে। কিন্তু সাধারণত তা কেউ চায় না, তাই সে আবার মানুষ হয়েই জন্মাবে।
আত্মা সম্পর্কে আমরা বিভিন্ন রকম মত শুনতে পাই। চার্বাক বলছেন, চৈতন্য শক্তি হচ্ছে মিশ্র বস্তুর অতিরিক্ত গুন্। অর্থাৎ যে গুন্ মৌল পদার্থের মধ্যে ছিল না। সেই একাধিক মৌল বস্তু যখন একত্রিত হয়ে যৌগবস্তুতে পরিণত হয়, তখন তার মধ্যে একটা বিশেষ বা অতিরিক্ত গুনের সমাহার লক্ষ করা যায়। আমাদের চৈতন্য শক্তি হচ্ছে এই যৌগবস্তুর অতিরিক্ত গুন্, যা মৌল বস্তুর মধ্যে লক্ষ করা যায় নি। দুটো রঙ মেশালে একটা নতুন রঙের সৃষ্টি হয়। যা ওই মূল রঙ গুলোর মধ্যে ছিল না, বা দেখা যায় নি। আপনি চুন সুপুরি খয়ের দিয়ে পান খেয়েছেন, এর মধ্যে কোনোটাই লাল ছিল না। কিন্তু যখন চুন-সুপুরি-খয়ের-পান চিবোলেন, অর্থাৎ মেশালেন, তখন একটা নতুন রঙের দেখা মিললো, আর তা হলো লাল। ঠিক তেমনি - কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, সালফার, ফসফরাস ইত্যাদি মৌল পদার্থ দিয়ে তৈরি প্রোটোপ্লাজম । এইসব মৌল পদার্থ একত্রিত হয়ে যা তৈরি হলো তা প্রাণ বা প্রোটোপ্লাজম। আবার বিভিন্ন মিশ্রনের কোষগুলো যখন একত্রিত হলো, তখন আর একটা শক্তি সৃষ্টি হলো আর তা হচ্ছে চেতন শক্তি। যাকে আমরা আত্মা বলে থাকি।
বৈদিক যুগে এই মত প্রত্যাহার করা হয়। কারন যোগঋষিগন উপলব্ধি করেছিলেন, প্রকৃতির উপরে আর একটা সত্ত্বা আছে , যাকে তারা বলছেন পুরুষ। এই বিরাট পুরুষ অর্থাৎ ব্রহ্মান্ডের অব্যক্ত শক্তি, যা পরবর্তীতে পুরুষের মধ্যেই ব্যক্ত হয়েছে। যাকে আমরা বলছি, প্রকৃতি। প্রকৃতি যে সনাতন শক্তির সাহায্যে শৃঙ্খলার মধ্যে আবদ্ধ থাকছে, তা ওই নিত্যশক্তির খেলা। প্রকৃতি নিয়মে আবদ্ধ। আর পুরুষ নিয়মের স্রষ্টা। প্রকৃতি পরিবর্তনশীল, আর পুরুষ অপরিবর্তনীয়। একেই বেদ বলছে ব্রহ্ম। এই বিরাটপুরুষের প্রতিফলিত শক্তি নিয়ে জীব চেতনাসম্পন্ন হয়েছে। প্রাণ ও চেতনা আলাদা, কিন্তু একের সঙ্গে অন্যের একটা সংযোগ আছে। জীবের দেহ থেকে যখন প্রাণের উৎক্রমন ঘটে, তখন আত্মাও দেহকে ছেড়ে দেয়। অর্থাৎ পুরুষ সত্ত্বা দেহের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়, প্রাণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আর স্থুল দেহকে বাঁচিয়ে রাখে প্রাণশক্তি। আর প্রাণহীন আমাদের মনময় দেহ বা বিজ্ঞানময় দেহ, ও আনন্দময় দেহ - এদের সাথেও থাকে সেই পুরুষের প্রতিফলিত শক্তি। তাই আমরা যখন দেহের মধ্যে আসি, তখন আমাদের যেখান থেকে পুনরাবৃত্তি হয়, সেখানেই আমরা বীজ আকারে আত্মার প্রতিফলিত শক্তিকে আশ্রয় করে ছিলাম। তাই প্রাণ যখন শরীরে আসে, অর্থাৎ মাতৃগর্ভে ৪৫-৫০ দিনের মধ্যেই মায়ের প্রাণের সঙ্গে আমাদের সংযোগ তৈরি হয়। আবার মায়ের প্রাণের সঙ্গে যখন আমাদের প্রাণের বিচ্ছিন্নতা ঘটে, অর্থাৎ মায়ের গর্ভের বাইরে আসি তখন আমাদের নিজস্ব প্রাণের ক্রিয়া শুরু হয়। চৈতন্য শক্তির আবির্ভাব ঠিক একই সময় হয়ে থাকে। তাই মায়ের পেটে আমরা মায়ের প্রাণ ও চৈতন্য শক্তির আশ্রয়ে থাকি। তখন আমাদের শরীর মায়ের শরীরের একটা অঙ্গবিশেষ মাত্র। আর মায়ের শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে আমরা আমাদের নিজস্ব প্রানক্রিয়ার সাথে আমাদের চৈতন্যশক্তিকে আশ্রয় করি।
একটা কথা শোনা যায়, যে আমরা নাকি ৮৪ লক্ষ যোনী পরিভ্রমন করে মনুষ্য দেহ লাভ করেছি। সত্য হচ্ছে চুরাশি লক্ষ একটা কথার কথা, আসলে অসংখ্য যোনী ভ্রমণের পর আমরা মনুষ্য দেহ লাভ করেছি। কিন্তু আমাদের আবার মনুষ্য দেহ ধারনের জন্য, প্রথম থেকে শুরু করতে হবে, তা নয়। যারা একবার মানুষ হয়ে জন্মেছেন , তারা মৃত্যুর পরে, যে দেহে অবস্থান করবেন , অর্থাৎ মনময়, বা বিজ্ঞানময় দেহে বা আনন্দময় দেহে সেখান থেকেই নিজেদের প্রারব্ধকে সঙ্গে নিয়ে আবার মানুষ হিসেবেই জন্ম গ্রহণ করবেন , তাদের সংকল্প বা বাসনা পূরণের জন্য। তবে একটা কথা বলি, যারা মনময় দেহে অবস্থান করবেন, তারা তাড়াতাড়ি আবার আসতে পারবেন, বা বলা যেতে পারে, আসতে হবে। আর যারা বিজ্ঞানময় দেহে অবস্থান করবেন, তারা আসতে অনেক দেরি করবেন। আর আনন্দময় দেহে যারা অবস্থান করবেন, তারা শুধু সৃষ্টির কাজে সাহায্য করবার জন্যই এসে থাকেন। আমরা যে উন্নত বা উন্নততর মহাত্মাদের দেখতে পাই, এই পৃথিবীতে তাদের আগমন হয় বিজ্ঞানময় বা আনন্দময় দেহ থেকে। গীতায় ভগবান যে বলেছেন, আমি ধর্মের পালনের জন্য, অধর্মের নাশের জন্য, এই পৃথিবীতে এসে থাকি। অর্থাৎ এঁরা আনন্দময় দেহে অবস্থান করছিলেন। এদের ভোগ বা বাসনা বা সংকল্প বলে কিছু নেই। কেবলমাত্র সৃষ্টিকে সহায়তা করবার জন্য, এঁরা এসে থাকেন। এদের নিজেদের জন্য এঁরা কিছু করেন না। জগতের হিত , জগৎবাসীদের শিক্ষা দেবার জন্য এসে থাকেন।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি ওম।
অকাল মৃত্যু কেন হয় ? আমরা কেন মারা যাই ?
কথা হচ্ছিলো বাসনা পূরণের আগে কেন মানুষ মারা যায়। শিশুরা অকালে কেন চলে যায়। দুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষের প্রাণ এক মুহূর্তে চলে যায় কেন ? যুদ্ধে অসংখ্য নিরাপরাধ মানুষের প্রাণ যায় কেন ? আমাদের যখন দেশ ভাগ হয়েছিল, তখন অসংখ মানুষ দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছিল। কেন এমন হয়।
আয়ুষ্কাল সম্পর্কে জানতে গেলে, আমাদের আগে বুঝতে হবে, আমরা কেন জন্ম নেই। আর কখন আমাদের মৃত্যুর ডাক আসে। দেখুন আয়ুষ্কাল আমাদের পূর্ব নির্দিষ্ট। আবার এর অন্যথাও আছে।আপনি যে দেহ ধারন করেছেন, সেই দেহ প্রাকৃতিক কিছু বস্তুর সমাহার মাত্র। আর এই সমাহার একটা গতিশীল প্রক্রিয়া। এটি স্থির নয়। প্রতিনিয়ত যাচ্ছে আসছে। এই আসা যাওয়ার গতি আমরা ধরতে পারি না তাই আমাদের মনে হয়, আমরা বা আমাদের দেহ স্থির আছে । এবং একটা অবয়ব আমাদের চোখের সামনে ভাসছে। একটা কথা আছে, স্রোতের জলে কখনো দুবার ডুব দেওয়া যায় না। অর্থাৎ এখন যে জলে আপনি ডুব দিলেন, পরের ডুব আপনি অন্য জলে দিচ্ছেন। আমাদের শরীর একটা স্রোতস্বীনি নদী। একটা কম্পন মাত্র। আর কম্পনের প্রবাহ গতিশীল। আপনারা জানেন, আমাদের শরীরের কোষ প্রতিনিয়ত মরছে, আবার প্রতিনিয়ত জন্মাচ্ছে। এবং ৭ বছর পরে, আমরা সম্পূর্ণ নতুন দেহ পাই। অর্থাৎ ৭ বছর যে কোষ আমার শরীরকে আশ্রয় করেছিল, তা আর নেই।এবং এই কারণেই আমরা শিশু থেকে ধীরে ধীরে বার্ধক্যে পৌঁছে যাই। এই প্রক্রিয়া আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। প্রতিটি জীবের এই দেহ গঠন ও বিনাশ প্রক্রিয়া মোটামুটি একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অন্তিম সীমায় পৌঁছে যায়। তাই বিভিন্ন জীবের বেঁচে থাকা বা আয়ু মোটামুটি একটা নির্দিষ্ট কালের মধ্যেই সম্পন্ন হয়। মানুষ যেমন ৮০-১২০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। কিন্তু একটা কুকুরের শরীর, ৮-১০ বছর বা একটা পোকার শরীর আরো কম দিন বাঁচে। তো সীমা অতিক্রম করা কারুর পক্ষেই সম্ভব নয়। এই দিক থেকে দেখতে গেলে মানুষের আয়ুর একটা উর্দ্ধ সীমা আছে। এই জন্য বলা হয় মানুষের আয়ু পূর্ব নির্ধারিত।
এতো গেলো দেহের কথা, কিন্তু আমরা কেন জন্মাই, অর্থাৎ আমরা কেন দেহ ধারণ করি ?আমি তো দেহ নোই, আমি আত্মা, তো আমার দেহ ধারনের দরকার কি ? আমরা দেহ ধারণ করি, বাসনা পূরণের জন্য, সংকল্প সাধনের জন্য । এই বাসনা বা সংকল্প পূরণ হয়ে গেলে আমরা দেহ ছেড়ে দেই। আবার প্রাকৃতিক নিয়মে দেহ অকেজ হয়ে গেলে আমরা দেহত্যাগ করি। অতএব আমাদের দেহ ত্যাগের দুটো কারন (এক) বাসনা বা সংকল্প পূরণের অযোগ্য হয়ে যায় যখন আমাদের দেহ, আর (দুই) বাসনার শেষ হয়ে গেলে। আমাদের এই দেহ ভোগায়তন দেহ। পরমাত্মার প্রতিফলন যে জীবাত্মা, সেই জীবাত্মার ভোগ সাধনের জন্য এই দেহ সৃষ্টি করা হয়ে থাকে, আবার এই দেহ ভোগের অযোগ্য বা বাসনার পূরণের শেষে আমরা দেহ ত্যাগ করে থাকি। ফুলে ততক্ষনই মৌমাছি থাকে, যতক্ষন ফুলে মধু থাকে। ফুল প্রকৃতির নিয়মে শুকিয়ে যায়। মৌমাছি অন্য ফুলে মধু খেতে চলে যায়।
শিশুমৃত্যু প্রসঙ্গে একটা প্রচলিত গল্প বলি। শ্রীবাস অঙ্গনে মহাপ্রভু দলবল নিয়ে নাম-সংকীর্তন করছেন। কীর্তন চলাকালীন শ্রীবাস পন্ডিতের এক শিশুপুত্র দেহরক্ষা করে। বাড়িতে কান্নার রোল ওঠে। শ্রীবাস পণ্ডিত বাড়ির সবাইকে কান্না করতে নিষেধ করলো, পাছে কান্নার শব্দে মহাপ্রভুর কীর্তনের ব্যাঘাত ঘটে। কিন্তু মহাপ্রভু তো সর্বজ্ঞাতা। তিনি বললেন, "দেখো, আজ যেন কীর্তনের আনন্দ তেমন জমে উঠতে পারছে না। কারন কি বলতো ? সবাই চুপ । প্রভু আবার বললেন, আমার হৃদয় আজ যেন বড় উদ্ভ্রান্ত। আমার মনে আনন্দের কোনো সাড়া জাগছে না। নিশ্চয় শ্রীবাসের বাড়িতে কোনো শোকের ছায়া পড়েছে। তখন কয়েকজন তাকে বললেন : হ্যাঁ প্রভু শ্রীবাসের শিশুপুত্র আড়াই ঘন্টা আগে মারা গেছে . পাচ্ছে আপনার কীর্তনের ব্যাঘাত হয়, তাই এই সংবাদ কাউকে বলা হয় নি। শ্রীবাসের এই অপূর্ব ভক্তি নিষ্ঠা দেখে, প্রভুর চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে বললেন : আমার জন্য,কীর্তনের জন্য,কেউ পুত্রশোক ভুলে যায়, এমন ভক্ত আমি কোথায় পাবো ? তো তিনি সেখানে এক আশ্চর্য্য ঘটনা সংগঠিত করলেন।
মৃত শিশুটিকে শ্মশানে নিয়ে যাবার উদ্যোগ চলছে। সবাই শিশুটিকে ঘিরে রেখেছে। প্রভু তখন, মৃত শিশুটিকে ডেকে বললেন - বৎস, শ্রীবাসের গৃহ ছেড়ে কেন যাচ্ছো তা একবার বলতো ? তো প্রাণহীন দেহে তখন প্রাণের সঞ্চার হলো। ঠোঁট কেঁপে উঠলো - স্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো, প্রভু, এ দেহে বাস করে, শ্রীবাস পন্ডিতের ঘরে যে স্নেহ ও আদার আপ্যায়ন পাবার কথা নির্দিষ্ট ছিল তা পেয়েছি। এবার বিধির নিবন্ধ অনুযায়ী নতুন আবাসে আমি চলে যাচ্ছি। প্রণাম। অপরাধ মার্জনা করবেন। কথা কয়টি বলে শিশুটি আবার নিস্প্রান হয়ে গেলো। সবাই নির্বাক। আসলে জীবন-মৃত্যুর ভেদ রেখা তেমন কিছু নয়। সময় অথবা কাজ শেষ হয়ে গেলে, আবার নতুন আবাসে আমাদের যেতে হবে। জীবের এই পরিক্রমা কাল থেকে কালান্তর ধরে চলছে।
আসলে ভোগ আমার নয় ভোগ আমার উপাধির।আমি আত্মা। এই দেহ তো আমি নোই, এই দেহ আমার উপাধি মাত্র। বিখ্যাত সেই উপমা আপনারা সবাই জানেন। একটা গাছে সুমিষ্ট ফল। গাছের ডালে বসে আছে দুটো পাখী। তার একটিতে সুমিষ্ট ফল খায়, আর একটা দেখে। পরম আত্মার কোনো ভোগ নেই। তিনি দ্রষ্টা। তার কোনো কর্ম নেই, তিনি অকর্তা। তিনি নিঃসঙ্গ তার কোনো সঙ্গী নেই। আর জীবাত্মা বাসনা ভোগের জন্য দেহ ধারণ করে, সঙ্কল্প পূরণের জন্য দেহ ধারণ করে। অফিসের বড়বাবু, অফিস থেকে ফ্লাট পেয়েছেন, গাড়ি পেয়েছেন। প্রচুর অর্থ মাইনে পান। বড়বাবুর পদ চলে গেলে ফুটুস। বাড়ি, গাড়ি, মাইনে সব বন্ধ হয়ে যায়। আর এই পদ পাবার জন্য আমাদের সারা জীবনের প্রয়াস। বড়বাবু হবার জন্য আমরা দিন-রাত পরিশ্রম করে ডিগ্রি নিচ্ছি। কিন্তু ষাট বছর বয়স হয়ে গেলে পদ ক্ষতম। তখন কেই বা চাপরাশী আর কেই বা বড়বাবু। চাকরির যেমন একটা নির্দিষ্ট নিয়মকানুন আছে, প্রকৃতির জগতেও পদ পাবার জন্য অর্থাৎ দেহ ধারণ করবার জন্য নিয়ম আছে। নিয়ম না মানলে, যেমন ষাট বছর না হতেও আপনার চাকরি যেতে পারে। ঠিক তেমনি দেহরক্ষার জন্য আমাদের কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। দেহরক্ষার নিয়ম অর্থাৎ প্রকৃতির নিয়ম যদি আমরা না মেনে চলি তবে আমাদের অকাল মৃত্যু হতে পারে। আবার অনেক সময়, নিজে ভুল না করলেও, যাকে আমরা বলি কপাল দোষে আমাদের চাকরি চলে যেতে পারে। আসলে কিছু জিনিস আমার নিয়ন্ত্রণে, আবার কিছু জিনিস আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেলে আমার চাকরি চলে যেতে পারে।আবার কোম্পানির নিয়মবহির্ভূত কর্মের জন্য আমার চাকরি যেতে পারে।ঠিক তেমনি, এই জীবদ্দশায় আমার কর্ম, আমার পরিবারের কর্ম, আমার আত্মীয়স্বজনের কর্ম, আমার প্রতিবেশীর কর্ম, আমাদের জাতির কর্ম্ম, আমি যে দেশে বাস করি, সেই দেশনায়কদের কর্ম, এ সবই আমার ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করবে। আমাকে সুখ দুঃখের ভাগিদার করবে। আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বা বিপর্যয়ও আমাকে প্রভাবিত করবে।
এই প্রোসঙ্গে গুরু নানকের একটা গল্প বলি। দিল্লিতে তখন লোদী বংশের রাজত্ত্ব চলছিল। মোগল সম্রাট বাবর সেইসময় তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে ভারতের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মোগল সৈন্যরা তখন অকথ্য অত্যাচার করেছিল, সাধারণ মানুষের উপরে। এই সময় পরিব্রাজক গুরুনানক ও তার সঙ্গী মর্দানাকেও জেলে যেতে হয়েছিল । আজকের গুজরানওয়ালা জেলার আমিনাবাদ, সেসময় সঈয়দপুর নামে পরিচিত ছিল। মোঘল সৈন্যদের হাতে পড়ে এই সঈদপুরবাসীদের বাড়িঘর অগ্নিদগ্দ্ধ হয়েছিল। অবাধে চলেছিল লুণ্ঠন। এখানেই গুরুনানক সৈন্যদের হাতে ধরা পড়েছিলেন । সাধুর বেশ দেখে, সৈন্যরা তাদের প্রাণে মারে নি বটে, কিন্তু বন্দি জীবন কাটাতে হয়েছিল তাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, গুরুনানকের অলৌকিক কার্যকলাপ দেখে, পরে বাবর তাকে ছেড়ে দিয়েছিলো।
তো বন্দি অবস্থা কেটে গেলে, নানক আবার পরিব্রাজন শুরু করে দিলেন। সেদিনকার সঈয়দপুরের এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে মর্দানা গুরুনানককে প্রশ্ন করলেন, ঈশ্বরের রাজত্ত্বে এই মর্মান্তিক ঘটনা কেন ঘটে ? মুষ্টিমেয় পাঠান হয়তো অপরাধী থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু হাজার হাজার নিরপরাধ নিরীহ মানুষ কেন এই নির্মম দণ্ডের সম্মুখীন হয় ? ঈশ্বরের এ কেমন ধারা বিচার।?
তো, সেদিন যে বাড়িতে মর্দানা ও গুরুনানক আশ্রয় নিয়ে ছিলেন, সেই বাড়ির সামনে ছিল একটা সুস্বাদু ফলের গাছ। নানক বললেন, তুমি এই গাছের নিচে আজ শুয়ে থাকো। কাল এর উত্তর পেয়ে যাবে।
গুরুভক্ত মর্দানা সেই রাতে ওই গাছের নিচে একটা কম্বল পেতে শুয়ে পড়ে। এখন হয়েছে কি, ভোর রাতে দিকে পাখির ঠোঁটের আঘাতে পাকা ফল থেকে রস চুইয়ে চুইয়ে মর্দানার দেহের উপরে ঝরে পড়ে। এখন মিষ্টি রসের গন্ধে, পিঁপড়ে চলে আসে। দুচারটে পিঁপড়ে, মর্দানাকে কামড়ে দেয়। আর মর্দানা ঘুমের ঘোরে, হাত চালিয়ে প্রায় সমস্ত পিঁপড়েকে মেরে ফেলে।
সকালবেলা গুরুদেব বললেন, মর্দানা চেয়ে দেখো, কম্বলের উপরে তোমার কালকের প্রশ্নের জবাব। ঠিক এই ভাবেই, সঈয়দপুরের হাজার হাজার নিরীহ মানুষ সেদিন মারা গেছিলো। তোমাকে কামড়েছে মাত্র দুচারটি পিঁপড়ে, কিন্তু দেখো তুমি কয়েক'শ পিঁপড়ে মেরে ফেলেছো। জন্ম-মৃত্যুর এই অমোঘ লীলা চলছে নিরন্তর। অখন্ড সত্ত্বায় সবকিছু বিধৃত। কর্তা নিজেই যেখানে সর্বত্র ওতপ্রোত ভাবে বিরাজ করছে, সেখানে বিচার - অবিচারের প্রশ্ন ওঠে না। দন্ড আর পুরস্কার সেখানে এক হয়ে যায়। জীবন একটা যাত্রা। মৃত্যু মানে জীবন পথে বাঁক নেওয়া। মৃত্যুর পর মৃত্যু অতিক্রম করে, জীব এগিয়ে চলেছে, অনন্তের সাথে নিজেকে বিলিয়ে দেবার জন্য এগিয়ে চলছে । মেঘ থেকে জল পাহাড় বেয়ে, গ্রাম গঞ্জ পার হয়ে সমুদ্রে মিলবে। এটাই পরিণতি। চলার পথে সুখ দুঃখের অনুভূতি মাত্র। অনন্তে শান্তি।
আমরা যাকে ভালো বা মন্দ বলি, সেটা আমাদের ভাবনাপ্রসূত। প্রকৃতির কাছে ভালো বা মন্দ বলে কিছু নেই। সে একটা শৃঙ্খলে আবদ্ধ। তার বাইরে যাবার তার উপায় নেই। সূর্য্য ইচ্ছে করলে তাপ প্রদান বন্ধ করতে পারে না। বায়ু রুদ্ধ হতে পারে না। প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরন করলে শাস্তি পেতে হবে এটা চিরসত্য। এর অন্যথা হবার উপায় নেই। তাই আমাদের শরীর যা কিনা প্রকৃতির অঙ্গ বিশেষ, তা প্রকৃতির নিয়মেই নিঃশেষিত হবে। আপনি তথাকথিত ভালো কাজ করলে আপনি বেশি দিন বাঁচতে পারবেন, আর খারাপ কাজ করলে, বা কিছুই না করলে আপনি তাড়াতাড়ি মারা যাবেন, এর কোনো মানে নেই। আপনি জ্ঞানী হলে আপনি বেশি দিন বাঁচতে পারবেন, আর অজ্ঞানীরা তাড়াতাড়ি মারা যাবেন, এমন অঙ্গীকার প্রকৃতি করে না।
তাই আমাদের আয়ু, দুটো কারণের উপরে নির্ভরশীল। এক আমি কি জন্য এই দেহ ধারণ করেছি। অর্থাৎ আমার বাসনা বা সংকল্প । আর যা দিয়ে দেহ ধারণ করেছি, অর্থাৎ প্রকৃতি, আর তার স্থিতিকাল বিষয়ে প্রকৃতির কি নিয়ম। আসলে এই মর্তলোক একদিকে যেমন কর্ম্মক্ষেত্ৰ, অর্থাৎ যার দ্বারা আমরা উন্নত স্তরে থাকতে পারি, ঠিক তেমনি এই মর্তলোক একটা মৃত্যুপুরি, যার দ্বারা আমরা অমৃতের পথে যাত্রা করতে পারি।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি ওম
No comments:
Post a Comment