Sunday, 9 December 2018

সত্যধর্মের আলোতে গুরুতত্ত্ব - ৬

সত্যধর্মের আলোতে গুরুতত্ত্ব - ৬ 
(মহাত্মা গুরুনাথের (সেনগুপ্ত) গুরু কে ছিলেন ? )


আসলে আমার মধ্যে প্রশ্ন অনেক। জবাবের জন্য হন্যে হয়ে খুঁজছি। কিন্তু কে বলে দেবে ? মহাত্মা গুরুনাথ গুরু করণের ব্যাপারে সদর্থক বক্তব্য লিখেছেন। অর্থাৎ গুরুকরন আবশ্যিক বলেছেন। যদিও উপযুক্ত গুরু না পেলে, সারা জীবন গুরুহীন থাকা ভালো এ কথাও বলেছেন।  কিন্তু আমি জানতে চাই, তাঁর কি কোনো দেহধারী গুরু ছিলো ? যদি থেকে থাকে তিনি কে ? যদি না থেকে থাকে, তবে তো ধরে নিতে পারি, দেহধারী গুরু না থাকলেও সাধন সিদ্ধ হওয়া যায়। যার জ্বলন্ত উদাহরণ তিনি নিজে।

মহাত্মা গুরুনাথের সাধন জীবন সম্পর্কে জানতে গিয়ে, শ্রী ভুবন মোহন গঙ্গোপাধ্যায় লেখা "সত্যধর্ম্ম প্রচারক দেব-মানব মহাত্মা গুরুনাথ" বই থেকে জানতে পারি, পারলৌকিক মহা-মহোন্নত কোন মহাত্মাকে গুরুরূপে প্রাপ্ত হয়ে, প্রেম সাধনা করতে করতে, তিনি ঈশ্বর প্রেমের অঙ্কুর "প্রকৃত প্রেম" লাভ করেন  এবং "অভেদ জ্ঞান" সাধনা সহযোগে, সিদ্ধ মনোরথ হয়ে, নিজেকে জগদীশ্বরের সাক্ষাৎ অংশে পরিণত করেছিলেন। 

এখন কথা হচ্ছে, এখানে কোনো দেহধারী গুরুদেবের কথা লেখা নেই। পরলোকগত মহাত্মার কথা লেখা আছে। জানিনা এইসব কথা গুরুদেব নিজে বলেছিলেন কি না।  অথবা এসব কথা লেখকের কষ্ট  কল্পনা কি না। কষ্ট-কল্পনা কথাটা বলার কারন হচ্ছে, এই বই পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে, লেখক গুরুদেবকে যথাযথ পরিবেশনের চেয়ে, নিজের আবেগের কথা পরিবেশন করেছেন
বেশীকরে । গুরুদেবকে  উঁচুতে তুলে ধরার একটা প্রবণতা, সবসময়  সবশিষ্যের মধ্যে থাকে। ভুবনবাবুর  এই লেখার মধ্যেও  আছে, এটা  আমার মনে হয়েছে। কিন্তু আমাদের সত্য খুঁজতে হবে। 

এবার তার সাধনজীবন  সম্পর্কে অর্থাৎ তিনি কবে,  কিভাবে, কার সাধনা করেছেন তা আমরা একটু দেখে নেবো। 

বালক গুরুনাথ, তার বাবাকে দেখতেন, ধ্যান ধারণা, জপ্ তপঃ ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে । এই সময়, বালক গুরুনাথ পূজা-উপার্জন-এর দিকে, আকৃষ্ট হন ।সেই দিক দিয়ে দেখতে গেলে পিতা রামনাথ তার প্রথম গুরু।  যখন তাঁর ১১/১২ বছর বয়স। সেই সময় তিনি কারুর কাছ থেকে শুনেছিলেন, যে অগ্নি প্রজ্বলিত করে, মা কালির মূর্তির সামনে, কালী মন্ত্র  জপ্ করতে হয়। তো অগ্নি কুন্ডের  অভাবে, আগুনের তাওয়া কোলে বসিয়ে, একমনে মা কালীর নাম জপ্ করতেন।

মাত্র ষোলো বছর বয়সেই সূক্ষ্ম জগৎ দর্শন, দেবদেবীদের সাথে কথোপথন ইত্যাদি আধ্যাত্মিক ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। আমার মনে হয়, এই ক্ষমতা নিশ্চই ধ্যানের মাধ্যমেই অর্জন করেছিলেন। গভীর ধ্যানে নিমগ্ন থাকলে, এই দর্শন সম্ভব।

এর পরে তিনি আকৃষ্ট হন রাজা রামমোহনের রায়-এর ব্রাহ্মসমাজ, অর্থাৎ যারা নিরাকার পরম-ঈশ্বরের উপাসনা করতো, কিন্তু গুরুবাদে বিশ্বাস করতো না। এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করতো  । সেখানেও তিনি অনেক দিন যাতায়াত করেছেন। এইভাবে মহাত্মা গুরুনাথ নিরাকার পরব্রহ্মের  উপাসনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। এইসময় থেকেই মহাত্মা মহিম চন্দ্র দাসগুপ্ত  ইত্যাদি চার-পাঁচজনকে  নিয়ে গভীর রাতে, পরব্রহ্মের উপাসনা করতে লাগলেন।

অধ্যাত্ম পিপাসু মন এবং অলৌকিক ক্ষমতার  অন্বেষনে মহাত্মা গুরুনাথ সাধনায় লিপ্ত থাকেন। এই সময় তিনি স্পিরিচুয়ালিস্ট অর্থাৎ যারা পরলোকগত আত্মাদের আকৃষ্ট করে তাদের সাথে কথোপথন চালাতো, তাদের ক্রিয়াকলাপ আয়ত্ব করেন। এবং স্পিরিচুয়ালিস্টদের মতো তিনিও বন্ধুদের নিয়ে আত্মা আকর্ষণ কার্যে নিজেদের নিয়োজিত করেন।

এই আত্মা আকর্ষণের দ্বারাই, নাকি তিনি এই সত্যধর্মের  সন্ধান পেয়েছিলেন। এই আত্মারা আসতো  মহাত্মা মহিম চন্দ্রের  (দাসগুপ্ত) দেহে। ওই সময় মহিমচন্দ্র যা বলতো, সেটা লিখে রাখা হতো। এই সময় মহিমচন্দ্রের বয়স মাত্র বারো, আর মহাত্মা গুরুনাথের বয়স আঠারো। এটা ১৮৬৫/৬৬ সালের কথা।
এর প্রায় কুড়ি বছর  বাদে অর্থাৎ ১৮৮৫ সালের ২০শে অক্টোবর পারলৌকিক মহাত্মারা এই সত্যধর্মের প্রচারের অনুমতি দেন। অর্থাৎ মহাত্মা গুরুনাথের বয়স যখন ৩৮ বছর, ও মহাত্মা মহিমচন্দ্রের বয়স যখন ৩২,  সেই সময় তিনি বা তারা,  এই ধর্ম প্রচার করার জন্য আদেশ প্রাপ্ত হন।

এরও তিন বছর বাদে, ১৮৮৮ সালে, বাংলা ১২৯৫ বঙ্গাব্দে দীর্ঘ ১৭দিন  অনাহারে, স্বল্পাহারে থেকে উপাসনায় লিপ্ত থেকে  তিনি ব্রহ্ম দর্শন পান। অর্থাৎ মহাত্মা গুরুনাথ প্রায় ৪১ বছর  বয়সে তিনি সাধনার চূড়ান্ত ফল প্রাপ্তিহন। অর্থাৎ প্রায় ত্রিশ বছরের সাধনায় তিনি সাফল্য লাভ করেন। এই সময়েও তার কোনো গুরু ছিলেন কি না তার কথা পাই নি।

আমি যদিও  এই স্পিরিচুয়ালিস্টদের এই আত্মা আকর্ষণের বিষয়ে আকৃষ্ট নোই। সেই আলোচনায় আমি যাবো না। আমাদের মূল আলোচনার বিষয় মহাত্মা গুরুদেবের দেহধারী গুরু কে ছিলেন। মহাত্মার দীর্ঘ জীবনের আলোচনায় কোথাও তার গুরুদেবের সন্ধান পাই না। দীর্ঘ সাধনায় তিনি নাকি  ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মহাপুরুষ মহম্মদকে দেখতে পেয়েছিলেন। এগুলো বিতর্কিত বিষয়। জানিনা এসব কথা গুরুদেব বলেছিলেন কি না। যাইহোক : আমরা সাধারণ মানুষ স্রষ্টাকে চিনিনা জানিও না, কিন্তু তার সৃষ্টিকে আমরা দেখতে পাই। তার সৃষ্টি  দেখেই তার মহত্ত্ব অনুমান করি। আমরা মহাত্মা গুরুনাথের বই পড়ে, তিনি যে হাজার হাজার লোককে সাধন পথের  সন্ধান দিয়েছেন, শান্তি লাভের উপায় দান করেছেন, সেটা যারা তাঁর নির্দেশিত পথে উপাসনায় লিপ্ত আছেন বা ছিলেন , বা উপাসনার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন, তারাই উপলব্ধি করেছেন ।
 
 মহাত্মা গুরুনাথ, ২৭/০৩/...১২ তারিখে, জনৈক বিধূ ভূষণ-কে লিখছেন, মহাদেব বললেন যে, ধর্ম্ম এক এবং তার নাম সত্যধর্ম্ম ; বিশেষতঃ কলিকালে সত্যধর্ম্ম ভিন্ন অন্য কোনো ধর্ম্মই  বলবান (ফলপ্রসূ) থাকবে না। যারা সত্যব্রত, সত্যনিষ্ঠ ও সত্যধর্ম্ম পরায়ন এবং যারা কুল সাধনাকেও সত্যধর্ম্ম বলে বোধ করেন, কলি তাদেরকে, পীড়া দিতে পারবে না।

গুরুদেব লিখছেন, মহাদেব ভগবতীকে বলছেন, হে দেবী ! কলি প্রকট হলে, সকল ধর্ম্মই দুর্ব্বল হবে, কেবল সত্যধর্ম্ম থাকবে। অতএব, সত্যময়, অর্থাৎ সম্পূর্ণভাবে সত্যধর্ম্ম-আশ্রিত হওয়া সকলেরই কর্তব্য। 

মহাদেব আবার বলছেন হে দেবী (সুব্রতে) ! মনুষ্য সত্যধর্ম্ম অবলম্বন করে যে কার্য্য করবে, সেই কার্য্যই সফল হবে, ইহা সত্য বলে জানবে। 

এর পরে, মহাদেব  বলেছেন  "না হয় সত্যাৎ পরো ধর্ম্মঃ" অর্থাৎ সত্যধর্ম্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ধর্ম্ম আর নাই। ইত্যাদি ইত্যাদি। .......

উপরুক্ত কথাগুলি, "মহানির্ব্বান" তন্ত্রে শিবের উক্তি। সেটাকেই মহাত্মা গুরুনাথ প্রবর্তিত, সত্যধর্ম্ম-এর গুরুত্ত্ব বোঝাতে ব্যবহার করছেন।

উপরুক্ত চিঠি বা লেখা থেকে আমার মনে হয়, দেবাদিদেব মহাদেব যে সত্যধর্মের কথা বলেছেন, মহাত্মা গুরুনাথ সেই একই সত্যধর্ম  কথা বলতে বলেছেন । আমার শ্বশ্রূমাতা বলতেন, মহাদেবই গুরুদেবের গুরু। জানিনা সত্য কি, সত্য কোথায়। 

সমাপ্ত


    




      
   

No comments:

Post a Comment