শ্রাদ্ধ কর্মে উপাসনা বা প্রার্থনা করার উপকারিতা
সমস্ত ধর্মীয় ভাই-বোনদের মৃত্যুর পরে , শ্রাদ্ধ-কর্মাদির সঙ্গে আমরা উপাসনা বা প্রার্থনা করতে দেখি। এর দ্বারা কি উপকার হয় ? যদি হয় কার উপকার হয়?
একটা কথা মনে রাখা দরকার আমাদের এই পার্থিব জগতে বা দৃশ্যমান জগৎ যেমন নিয়মে বাঁধা অর্থাৎ প্রত্যেক কাজের একটা কারন আছে, তেমনি পরলোকেও একটা নিয়ম শৃঙ্খলা আছে। নিতান্ত খেয়ালের উপরে কোনো কিছু হয় না। জগতের সমস্ত ঘটনাই নিয়মের অধীন। এবং মনে রাখবেন, ঈশ্বর আমাদের মঙ্গলের জন্যই সমস্ত ঘটনা ঘটাচ্ছেন। আমাদের উচিত অদৃশ্য শাসন-কর্তাকে সাহায্য করা। আমরা অজ্ঞতা বশতঃ অনেক সময় বিপরীত কাজ করে থাকি। এইসব ভুল পদক্ষেপ যেমন আমাদের নিজেদের পক্ষে ক্ষতিকারক, তেমনি আমাদের নিকটজনের জন্যও ক্ষতিকারক।
আমাদের সবারই অভিজ্ঞতা বলে, কেউ মারা গেলে আমরা শোক করি, কান্নাকাটি করি। কিন্তু এটা আমাদের করা উচিত নয়। এতে আমাদের যিনি মারা গেছেন, তাঁর অর্থাৎ দেহ-মুক্ত জীবাত্মার ক্ষতি করি। এতে করে, সেই জীবাত্মার কামলোকে অবস্থানের মেয়াদ বেড়ে যায়। তাই আমাদের শোক ত্যাগ করে, আমাদের ভাবা উচিত, কি ভাবে আমাদের সেই স্নেহের পাত্র বা শ্রদ্ধার পাত্র যিনি দেহ থেকে মুক্ত হয়ে গেছেন, তিনি পরলোকে কিভাবে সুখে শান্তিতে থাকতে পারেন। এবং সেই উদ্দেশ্যেই আমাদের উচিত তার আত্মার শান্তির জন্য পরমেশ্বর-এর কাছে প্রার্থনা করা বা উপাসনা করা , এমনকি তার উদ্দেশে যদি আমরা ধ্যান করি, তাহলেও পরলোকগত আত্মার শান্তি হয়।
"উপাসনা" সর্বদাই মঙ্গলময় বাসনা বা মঙ্গলমায়ের কাছে আবেদন ছাড়া আর কিছু নয়। এর মধ্যে স্বার্থের লেশ মাত্র থাকা উচিত নয়। কিছু প্রত্যাশা করা উচিত নয়। নিঃস্বার্থ শুভইচ্ছা প্রদান, গভীর ভাবে তার শুভ চিন্তায় মগ্ন থাকলে তার উপকার হয়। এবং এই শুভকর্ম করলে, তা কখনোই নিষ্ফল হয় না।
আমরা জানি, চিন্তার একটা আকার আছে, চিন্তা মাত্রেই বস্তূ, তা সে সুচিন্তাই হোক বা কুচিন্তাই হোক। আমাদের স্বার্থহীন কল্যাণ চিন্তা অব্যর্থ ভাবে সেই অদৃশ্য সেই বিদেহী আত্মার কাছে বা বস্তূর কাছে, আমাদের চিন্তার প্রবাহ বা স্রোত অবশ্য়ই পৌঁছাবে । এবং তার কল্যাণ হবে। আমরা শুধু শ্রাদ্ধ শান্তি করে, নিয়ম রক্ষা করতে পারি। নিজেরা তৃপ্ত হতে পারি। কিন্তু তাতে তার কোনো মঙ্গল হয় না। বরং আমরা যদি পরম-ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, হে প্রভু তোমার এই পুত্রকে " চির শান্তি দাও তারে, রেখো তারে আনন্দ পাথারে" - এই চিন্তা করে, দৈনিক কয়েকবার স্থির চিত্তে পরম-ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে পারি, তবে পরলোকগত আত্মার কল্যাণ সাধিত হয়। আমাদের যে সব নিকট আত্মীয়, পরলোকে বাস করছে, তারা সবাই তখন এসে নবাগতকে অভ্যর্থনা করে। নতুন জগতের সব কিছু তাকে বোঝায়, এবং সাহায্য করে। তা না করে যদি আমরা শোকাচ্ছন্ন হয়ে থাকি, কান্নাকাটি করি, তবে মৃত ব্যক্তির আত্মা একটা দোটানায় পরে যায়, এবং অকুল পাথারে দুলতে থাকে। এবং এর ফলে, যে মৃত্যু তাকে এক আনন্দময় উজ্বল জীবনের সন্ধান দিতে পারতো, তাঁকে সে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করতে পারে না। ফলে আমাদের কান্নাকাটি, শোক, এগুলো মৃত আত্মার উন্নতির অন্তরায় হয়ে যায়। এবং নতুন জীবনে অভ্যস্ত হতে তার দেরি হয়। মৃত আত্মার প্রকৃত মঙ্গল সাধন করতে হলে তন্ময় চিত্তে প্রতিদিন, মৃত আত্মার জন্য প্রার্থনা করা কর্তব্য। একটা সুন্দর প্রার্থনার কথা আমি অনেক দিন আগে এক ব্রাহ্মণ পন্ডিতের কাছে শুনেছিলাম, জানিনা কার লেখা, সেটা বলি :
ঈশো দিশতু কল্যানং সর্ব্ব অশুভ নিবর্তকম।
নির্মল আনন্দ সন্দোহং শাশ্বতং তে প্রযচ্ছতু। ।
হে ঈশ্বর, সমস্ত অশুভকে দূর করে, কল্যাণ করুন। শাশ্বত নির্মল আনন্দ যথেষ্ট পরিমানে প্রদান করুন।
শান্তি নির্বাণ-পরমা ব্রহ্ম সংস্থা সদা অস্তু তে।
ভূয়াৎ চিরন্তনী তৃপ্তিঃ প্রীতির ঐকান্তিকী পরা। ।
পরম-নির্বাণ শান্তি স্বরূপ ব্রহ্মে স্থিতি যেন বিধেয় হয়। তৃপ্তি ও প্রীতি যেন চিরস্থায়ী হয় ও ঐকান্তিক হয় ।
সৎ কৃপাবারি বর্ষৈস্তে ত্রিতাপানল সঞ্চয়াঃ।
চিরায় প্রশমং যান্তু-মাঙ্গল্যম ঈদম অর্থয়ে। ।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি ওঁং
ত্রিতাপ জ্বালা নিবারণের জন্য তোমার সৎ কৃপাবারি সদাই বর্ষাতে থাকুক। অমঙ্গল প্রশমিত হোক চিরতরে। এই আমাদের প্রার্থনা।
আমাদের মধ্যে কারুর কারুর ধারণা, উপাসনাতে, বা প্রার্থনাতে, পরলোকগত আত্মার কি আসে যায় ? বরং বলা যেতে পারে, যারা এই উপাসনা, বা প্রার্থনা করে, তাদের এতে লাভ হয়। মনের শান্তি আসে। মৃত ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠা আমাদের পক্ষে আরো বেশি জরুরী। কিন্তু তারা যেটা জানে না, সেটা হচ্ছে, জীবের মৃত্যু কিংবা জীবিত থাকা প্রকৃত পক্ষে অর্থহীন বাক্য। জীব যখন, আনন্দলোক থেকে বেরিয়ে আসে, তার পর থেকে সে ঘুরতে থাকে, কখনো স্থুল শরীর ধারণ করে, যাকে আমরা জীবিত বলি, আবার কখনো সূক্ষ্ম শরীর ধারণ করে, তখন তাকে আমরা মৃত বলি। আসলে আমরা যেমন, তেমনই আছি। যখন আমরা মনুষ্য শরীরের মধ্যে প্রবেশ করি তখন মানুষ হয়ে যাই। আসলে আমি যার মধ্যে যখন প্রবেশ করি, তখন আমাকে তাই মনে হয়। আমি মানুষের মধ্যে প্রবেশ করলে আমি মানুষ হই , আবার যদি কোনো জীব অর্থাৎ গরু গাধা, বাঘ, হাতি যার মধ্যেই প্রবেশ করি, তখন আমি তাই হয়ে যাই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, আমাদের বাসনার তৃপ্তি সাধনের সমাপ্তিতে, আবার সেখান থেকে বেরিয়ে নিজ ধামে ফিরে আসি। এটাই মোক্ষ। এটাই মুক্তি। আসলে আমি যা তাইই থাকি। আমি যার মধ্যে প্রবেশ করি, সেটার লয় মানে আমার লয় নয়। এই সত্য আমাদের বুঝতে হবে।
তথাকথিত মৃত্যু আর কিছুই নয়, শরীরের পরিবর্তন, অর্থাৎ স্থূল থেকে সূক্ষ্ম শরীরে গমন। জীবিত মানুষের ক্ষেত্রে যেমন ভালো কথা, ভালোবাসার কথা আমাদের আনন্দ দেয়, ঠিক তেমনি বিদেহীর পক্ষে, তার সম্পর্কে প্রেমাত্মিকা চিন্তা, তার কাছে উপাদেয়, বা উপভোগ্য। আমাদের শুভ চিন্তা যত ঐকান্তিক হবে যত গভীর হবে, ততই অধিক ফলবতী হবে। আর একই জিনিস যদি সমবেত ভাবে করা যায়, অর্থাৎ উপাসনা যদি সমবেত ভাবে করা যায়, তবে সেটা আরো বেশি ফলপ্রসূ, আরো বেশি আনন্দ দায়ক হবে। আর বিদেহীর আত্মউন্নতির পথে সহায়ক হবে। আত্মীয়স্বজন যদি একসঙ্গে, একই সময়ে একত্রে মিলিত হয়ে প্রতিদিন শুভচিন্তা প্রেরণ করে তার চেয়ে ভালো কিছু আর হয় না। যদি সবাই একই সময় এক জায়গায় মিলিত হতে নাও পারেন, তথাপি, একটা নির্দিষ্ট সময়ে এই শুভ চিন্তার অনুষ্ঠান করতে পারেন, তবে সেটাও খুব ফলপ্রসূ হবে। সুতরং আমাদের চিন্তাশক্তির এই শুভ দিকটি যদি আমরা সম্মিলিত ভাবে কাজে লাগাতে পারি, তবে শুধু পারলৌকিক আত্মাদেরই শান্তি হবে তাই নয়, আমাদেরও সর্বাঙ্গীন শান্তি লাভ হবে।
শোক আসলে স্বর্থের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আমরা মনে করি, যে এত স্নেহ, মমতা, প্রেম, ভালোবাসা, সবই জীবনের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায়। আমি তো জানিনা যে আমার শেষ নেই। নতুন ভাবে আমি পরলোকে বিকশিত হই। পরলোকে তো জন্ম মৃত্যু নেই সেখানে আমরা আবির্ভূত হই, আবার সময় শেষ হয়ে গেলে আমরা সেখান থেকে প্রস্থান করি। অর্থাৎ হয় উচ্চতর স্তরে অথবা আবার মৃত্যুপুরীতে চলে আসি। কারুর সঙ্গেই আমার বিচ্ছেদ হয় না। পরলোকে বসে আমরা সব দেখতে শুনতে পাই শুধু আদান প্রদান পার্থিব ভাবে করতে পারি না। কিন্তু ভাবনা-চিন্তা আমাদের মিলনের সেতু হতে পারে। পুত্র যখন দূর দেশে চাকরি করতে যায়, তখন আমরা কান্নাকাটি করি, এগুলো ঠিক নয়। এতে দুরদেশবাসী আমার আত্মীয়ের বা পুত্রের মানসিক যন্ত্রনা হয়।এতে তারা সেখানকার স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারে না। আমরা সেটা বুঝতে পারি না। তেমনি পরলোকবাসীর জন্য আমরা যদি শোক করি, তাতে তাদের কষ্ট হয়। এবং তাদের স্বাভাবিক উন্নতিতে বাধা হয়। কামনার লোকে তাদের বাসের সময় দীর্ঘায়িত হয়। সেটা আমাদের একদম অনুচিত। আমাদের নিকটজন বাড়ির বাইরে গেলে এক অশুভ আশঙ্কা আমাদের ঘিরে থাকে, এই বুঝি তার কোন খারাপ কিছু হলো। আসলে স্নেহ ভালোবাসা, আমাদের অনিষ্টের আশঙ্কা বাড়িয়ে তোলে। তাই শোক করা, বা অনিষ্টের আশঙ্কা থেকে আমাদের চিন্তাকে দূরে রাখতে হবে। শুভ চিন্তা-ভাবনা নিয়ে উপাসনা করুন, শুধুই উপাসনা করুন। আমাদের শুভভাবনার এক অলৌকিক ক্ষমতা আছে, সেটা প্রতক্ষ্য করুন।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ
No comments:
Post a Comment