এই পৃথিবীর পান্থশালায় কেহ আসে কেহ যায়। কেই বা আসে, কেই বা যায়। কোথা থেকে আসে কোথায় যায়। কথায় বলে জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে তিন বিধাতা নিয়ে। অর্থাৎ এইসব ঘটনা বিধি-নির্দিষ্ট। এতে আমাদের কোনো হাত নেই। আমি কারুর মৃত্যু হলে বলি, কর্ম শেষ তাই চলে গেলেন। কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন জাগে কর্ম কখন শুরু হলো ? কবেই বা শেষ হলো ? সত্যই কি কর্ম শেষ হলো ? আমি অনেক মানুষকে মরতে দেখেছি, কতকিছু করবে বলে ভেবেছিলো। সব ভাবনা রেখে দিয়ে চলে গেল। অসময়ে চলে গেলো। পরিণত বয়সে অর্থাৎ বৃদ্ধ বয়সে মারা গেলে ঠিক ছিলো, কিন্তু এতো আগে আগে চলে গেলো। কাল পূর্ন হলে মানুষের মৃত্যু হয়। নিয়তি যখন প্রবল হয় তখন মানুষের বুদ্ধিভ্ৰষ্ট হয়।
আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি, সুতিকা গৃহে দোয়াত কলম রাখা হতো। বিধাতা শিশুর ভাগ্যলিপি লিখে রেখে যাবেন । জন্মের পরে, তুমি যতই ভালো কাজ করো আর খারাপ কাজ করো, যতই তুমি জ্ঞান অর্জন করো, আর অজ্ঞানী হও, যতই তুমি ধর্মকার্য্য কারো, আর অধার্মিক হও, বিধির লেখা একটা অক্ষরও কাটা যাবে না। কাল পূর্ন হলে তোমাকে চলে যেতে হবে। নিয়তি যখন প্রবল হয় তখন মানুষের বুদ্ধিভ্ৰষ্ট হয়। বিচারশক্তি ক্ষীণ হয়। আত্মরক্ষার ক্ষমতা থাকে না। কত মানুষ অসময়ে সামান্য কারণে মারা যায়। আবার কত মানুষ মরতে মরতে বেঁচে যায়। কোন শক্তি তাকে বাঁচায়, আর কেনই বা বাঁচায়। আবার কোন শক্তি তাকে মেরেফেলে। বোঝা দায়। এই না বোঝাকেই আমরা বলি অদৃষ্ট । অদৃষ্ট মানে না এমন কোনো মানুষ নেই। সব যুক্তির উর্দ্ধে এই অদৃষ্ট বা ভাগ্য ।
দার্শনিকরা বলেন, মানুষ যে কাজ করে, চিত্তে তার ছাপ পড়ে । একে বলে সংস্কার। জন্ম-জন্মান্তর ধরে, মানুষ এই সংস্কার অর্জন করছে, আবার ক্ষয় করছে। ফলপ্রদান উন্মুখ এই সংস্কারপুঞ্জ জীব দেহকে আশ্রয় করে, ফল প্রদান করে। এটাই জীবের জন্মের কারন। আমাদের ভোগ ও আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করে,এই সংস্কারপুঞ্জ।
শ্রূতিশাস্ত্র আবার অন্য কথা বলে। তারা বলেন, পরম-ঈশ্বরের নির্দেশেই সব কার্য্য হচ্ছে। তাঁর ভয়ে চন্দ্র, সূর্য, নিজ নিজ কক্ষপথে ঘুরছে। বায়ু, অগ্নি নিজের কাজ করছে। জগতের সমস্ত কার্য্য তার নির্দেশেই হচ্ছে। একটা পাতাও পড়তে পারে না, তার নির্দেশ ছাড়া। এমনকি মৃত্যুও তার নির্দেশেই সংগঠিত হচ্ছে। ভগবানের সর্বোৎকৃষ্ট সৃষ্টিই হচ্ছে এই জীব জগৎ। তো তার থাকা না থাকা, অবশ্যি তারই নির্দেশেই চলছে। উৎপত্তির কারণও তিনি আবার লেয়ার কারণও তিনি। তিনিই সর্বময়। তিনি সৃষ্টিকালে সৃষ্টি করেন, সংহারকালে সব আত্মস্যাৎ করেন। ঈশ্বরই জগৎ কারন।
উপনিষদ বলছে : জীব জন্ম গ্রহণ কোরে যতক্ষন দেহে অবস্থানযোগ্য কর্ম থাকে সেই পর্যন্ত জীবিত থাকে। কর্মক্ষয় হলে সে মারা যায়। কর্মরাশি যতদিন ভোগের দ্বারা ক্ষয়িত না হচ্ছে ততদিন তার জীবন থাকে। কর্মের ভোগ শেষ হয়ে গেলে তার মৃত্যু হয়। অতএব মানুষের জীবন হচ্ছে, প্রারব্ধ বা ফল-উন্মূখ কর্মের সমষ্টি মাত্র। তাই আমাদের কাজ ফুরুলেই চলে যেতে হবে। এমনকি আত্মজ্ঞান সম্পন্ন মানুষও তার প্রারব্ধ কর্ম অর্থাৎ যে কর্মভোগ হেতু জন্ম গ্রহণ করেছেন, বা দেহ উৎপন্ন হয়েছে, সেই সকল কর্ম উপভোগের দ্বারা যতক্ষন ক্ষয়প্রাপ্ত না হচ্ছে, ততক্ষন তার মোক্ষলাভ হয় না। জ্ঞান দ্বারা তিনি সঞ্চিত কর্ম বা ক্রিয়মান কর্ম ক্ষয় করতে পারেন, কিন্তু প্রারব্ধ কর্ম ভোগ তাকে করতেই হবে।
অতয়েব আমরা বুঝতে পারছি, প্রারব্ধ কর্মের ফল ভোগ করার জন্য আমাদের জন্ম নিতে হয়। তাই জন্মকালেই আমাদের জীবিত-কাল বা আয়ুষ্কাল নির্দিষ্ট হয়ে যায়।
No comments:
Post a Comment