Friday, 14 December 2018

ভক্তিযোগ ও শ্রীকৃষ্ণ-গীতা




ভক্তিযোগ  ও   শ্রীকৃষ্ণ-গীতা 


শুধুমাত্র অনন্যা ভক্তি থাকলেই আমাকে জানা যায়, বোঝা যায়। আমার জন্য যে ব্যক্তি কর্ম  করেন, যিনি আমার শরণাপন্ন ও আসক্তিশুন্য,সর্বভূতে শত্রূ শুন্য, ইনিই আমাকে প্রাপ্ত হন।  ১১/৫৫.........

মৎ কর্ম কৃৎ মৎ পরমঃ মৎ ভক্তঃ সঙ্গবর্জিতঃ। 
নির্বৈরঃ সর্বভূতেষু যঃ স মাম এতি পাণ্ডব। ।  


ভগবান কথা : ১৪/০৬/২০১৭ (ভক্তিযোগ)

পরম শ্রদ্ধা সহকারে যাদের মন আমাতে নিবিষ্ট করে আমাকে উপাসনা করেন, তারাই শ্রেষ্ট যোগী।

যাঁরা  সর্বদা সমবুদ্ধি যুক্ত, সর্ব ভূতে হিতে রত, সর্বত্র গমনকারী, অব্যক্ত, কূটস্থ, অচল, অচিন্তনীয়, ধ্রূব, ক্ষয়োদয় রোহিত, ব্রহ্মের উপাসনা করে তারাও আমাকে প্রাপ্ত হয়। অব্যক্ত বা নিরাকার নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসকদের মুক্তিলাভ কষ্টকর  হয়। কারণ, দেহধারীর নির্গুণ ব্রহ্মলাভ খুবই কষ্টসাধ্য। 
কিনতু যাঁরা আমাপরায়ণ হয়ে, সর্ব কর্ম আমাতেই  সমর্পন করে, স্থির চিত্তে, আমাকেই চিন্তা করতে করতে আমার উপাসনা করে, সেই সকল সাধককে আমি মৃত্যুপূর্ণ সংসার সমুদ্র হতে অচিরেই রক্ষা করি। আমাতেই মন নিবিষ্ট কর।  আমাতেই বুদ্ধিযুক্ত হও, তাহলে দেহান্তে আমাকেই প্রাপ্ত হবে। স্থির ভাবে আমাতে চিত্ত স্থির করতে যদি সমর্থ না হও, তা হলে অভ্যাসের সাহায্যে আমাকে পেতে চেষ্টা করো। যদি অভ্যাসেও সামর্থ না হও, তাহলে আমার কাজে চিত্ত স্থির করো। আমার প্রীতির জন্য কর্ম করলেও তুমি সিদ্ধি লাভ করবে। তাও যদি সম্ভব না হয়, তবে আমার শরণাপন্ন হয়ে, সংযত চিত্ত হয়ে, সমস্ত কর্মফল ত্যাগ করো। অভ্যাস থেকে জ্ঞান শ্রেষ্ট - জ্ঞান হতে ধ্যান শ্রেষ্ট - কর্মফল ত্যাগ ধ্যান হতেও শ্রেষ্ট।  ত্যাগেই পরম শান্তি। 
যে ব্যক্তি সর্বভূতে হিংসা শূন্য, মৈত্রী ভাব সম্পন্ন, সবাকার প্রতি করুণা, মমতা শূন্য, অহংকার শূন্য, সুখ-দুঃখ সমান জ্ঞান করেন, ক্ষমাশীল, সর্বদা তুষ্ট,দৃঢ় বিশ্বাসী, মন বুদ্ধি যার আমাতে অর্পিত - সেই যোগী আমার ভক্ত ও প্রিয়। 
যার দ্বারা উদ্বেগ প্রাপ্ত হয় না, নিজেও কারো ব্যবহারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন না, অপরের আনন্দ লাভে যিনি অসহিষ্ণু নহেন, ভয় ও উদ্বেগ শূন্য - সে-ই  আমার প্রিয়। ১২/১৬.....

যে  ব্যক্তির আনন্দের প্রকাশ নেই, চিত্ত ক্লেশ শূন্য, কামনা হীন, শুভ অশুভ ফল ত্যাগী সে ভক্তই আমার প্রিয়। যিনি শত্রূ-মিত্র, মান-অপমানে, শীত-গ্রীষ্মে, সুখে-দুঃখে অবিচলিত, সর্ব বিষয়ে আসক্তিহীন, নিন্দা প্রসংশায় সম জ্ঞানকারী, স্থির চিত্ত, নির্দিষ্ট বাসস্থান শুন্য, সেই ভক্তই আমার প্রিয়। যারা ভক্তি পূর্বক মৎপরায়ণ হয়ে, এই ধর্ম-অমৃত পান করেন, তারাই আমার অত্যন্ত প্রিয়। 

১২/২০.........

আমি এই ভক্তি যোগটা একটু ভালো করে বোঝার চেষ্টা করবো :

এই ভক্তিযোগ অর্থাৎ দ্বাদশ অধ্যায়ে মাত্র কুড়িটা শ্লোক আছে। 

এখানে প্রথমেই অর্জুন প্রশ্ন করছে :

এবং সততযুক্তা যে ভক্তাঃ ত্বাং পর্যা-উপাসতে
যে চ অপি অক্ষরম-অব্যক্তং তেষাং কে যোগবিত্তমা।

অর্থাৎ  যে ভক্ত তোমাতে সততযুক্ত হয়ে তোমার (রূপের) উপাসনা করে আর যারা তোমার অব্যক্ত অক্ষর রূপের সাধনা করে, তাদের মধ্যে শ্রেষ্ট যোগবিদ কে ?


ভগবান তার উত্তরে বলছেন :

ময়ি-আবেশ্যমান যে মাং নীতিযুক্ত উপাসতে 
শ্রদ্ধয়া পরয়া-উপেতা-অস্তে মে যুক্ততমা মতাঃ।

যারা আমাতে মন নিবিষ্ট করে, আমাতে নীতিযুক্ত হয়ে আমার উপাসনা করে, আমার মতে  তারাই শ্রেষ্ট।


শুনলে মনে হয়, এতো  অহংকারের কথা। এ কথা হয় বুদ্ধু  বলতে পারেন নতুবা বুদ্ধ বলতে পারেন। ভগবান আগেই বলেছেন ঈশ্বর  অব্যক্ত। এই অব্যক্ত ঈশ্বরের কথা পুরাতন ব্রহ্মবিদগণ, বেদবিদগণ বলে গেছেন।  তো যারা অব্যক্ত পরম-ঈশ্বরের সাধনা করছে, তাদের থেকে তোমার এই মনুষ্যরূপী শ্রীকৃষ্ণের সাধনা করা, কি করে শ্রেষ্ট হয়। তাছাড়া এই শ্রীকৃষ্ণের জন্মের আগেও  ঈশ্বর ছিলেন, এবং তার উপাসক-ও  ছিলেন , তবে তারা সবাই নিকৃষ্ট সাধনা করে ছিল ? আর শ্রীকৃষ্ণের আমলেও তো শ্রীকৃষ্ণের পূজা হতো না। কেউ কেউ হয়তো তাকে ভগবানের অবতার বলে স্বীকার করতো। কিনতু তখনও  শ্রীকৃষ্ণকে  ঘিরে সাধন পদ্ধতির উদ্ভব হয় নি। তাহলে শ্রীকৃষ্ণ এসব কি বলছেন ?

এইখানেই গীতার সংযোজন। এর আগে বেদ-নির্দিষ্ট পথে সাধন হতো।  বেদে কর্মকাণ্ড অর্থাৎ জাগযজ্ঞ করবার পদ্ধতি ছিল।  আর ছিল জ্ঞান কাণ্ড, অর্থাৎ নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা। চিত্ত-নিরোধের পদ্ধতি যা পতঞ্জলি প্রবর্তন করেছেন -  আশ্রমীদের এই চিত্তনিরোধের পদ্ধতি বা অষ্টাঙ্গ যোগ করতে দেখা গেছে। 

শ্রীকৃষ্ণ এসে জ্ঞানযোগের সঙ্গে যোগ করলেন নিষ্কাম কর্মযোগ। 

অর্থাৎ বাসনাহীন বা আসক্তিহীন  কর্ম। আর একটা নতুন পদ্ধতি তা হলো ভক্তিযোগ। আশ্রমীদের মধ্যে গুরুভক্তি আগেও ছিল, কিনতু  ভগবানে ভক্তি কথাটার প্রচলন ছিল না, নির্ভরতা ছিল।  আর দেবতা বলতে ছিল প্রকৃতি।  বিশেষ করে আর্যদের মধ্যে নিরাকার সাধনাই প্রচলিত ছিল। শ্রীকৃষ্ণ এসে এই ভক্তিযোগ চালু করলেন। এবং এটা ভারতবর্ষের আবিষ্কার। শ্রীকৃষের আবিষ্কার। ব্যাসদেবের আবিষ্কার।  অন্য কোনো ধর্মে এই ভক্তিবাদ আজও আসেনি। এবং এই ভক্তিবাদের আকর্ষণেই লক্ষ লক্ষ্য বিদেশী হিন্দু-ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। আশ্চার্য্য ব্যাপার হচ্ছে এই ভক্তি আমাদের অন্তরে জন্ম থেকেই আছে।  এটা জাগ্রত করার জন্য শুধু বলছেন শ্রীকৃষ্ণ। নতুন কিছু সংগ্রহ নয়।  

এখন সাধন পদ্ধতি দুই প্রকার - দ্বৈতবাদ আর অদ্বৈতবাদ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই দ্বৈতবাদের আবিস্কারক। শ্রীকৃষ্ণ একদিকে বলছেন ঈশ্বর অব্যক্ত, আবার বলছেন : যারা আমাতে মন নিবিষ্ট করে,আমাতে নিত্যযুক্ত হয়ে ঐকান্তিক ভক্তি সহকারে আমার উপাসনা করে, তারাই শ্রেষ্ট। এখন কেন  শ্রেষ্ট ? প্রশ্ন এখানেই। আর একটা প্রশ্ন শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে ভগবান বলছেন, এটা কি তার অহমিকা নয় ? নিজেকে জাহির করা নয় ?  তিনি যদি ভগবান হন তবে তার কর্মেই আমরা তার ভগবানত্ব বুঝবো বা দর্শন করবো। নিজেকে কেন বলতে হবে আমি ভগবান, আমার পূজা করো। এর থেকে আমরা কি শিখবো ? আমরা কি নিজের ঢাক নিজে পেটাতে শিখবো না ? 

এই প্রসঙ্গে আমি দুটো উদাহরণ দেই।  এক : স্বামী প্রণবানন্দ মহারাজ, ভারত সেবাশ্রম এর প্রতিষ্ঠাতা। ইনি একটা সময়ে, তার শিষ্যদের কাছ থেকে আক্ষরিক অর্থে পূজা গ্রহণ করতেন। স্বামীজী আসনে বসতেন, ভক্তরা তাকে মালা পড়াতেন, ভোগ দিতেন, ফুল, বেলপাতা , ধুপ, প্রদীপ দিয়ে তার পূজা করতেন, আরতি  করতেন। প্রণবানন্দজি নিজেকে শিব ভাবতেন। আর শিষ্যদের বলতেন পূজা করতে।  এখন, তার সমবয়সী যে সব সন্যাসী, যারা তার মানবসেবা কর্মের সহযোগী ছিলেন, তাদের কাছে এটা অশোভন লাগতে লাগলো। তারা একদিন, একথা স্বামী প্রনাবনান্দকে বললেন। প্রণবানন্দ তাদের বলে ছিলেন : দেখো, মা বাবাকে যদি পূজা করা যায়, তবে আমার পূজায় দোষ  কোথায় ? আমি যেটা বলতে চাইছি - মহাপুরুষরা নিজের পূজার প্রচলন নিজেরাই করেছেন। পূজা পাবার জন্য অনেক দেবতা, নানান ভাবে ভক্তদের বিড়ম্বনায় ফেলতো, এমন গল্পতো বহু আছে। 

আর ঠাকুর রামকৃষ্ণ নিজেকে অবতার বলে প্রচারের ভাগিদার ছিলেন। ভৈরবী যজ্ঞেশ্বরী  যখন তাকে অবতার বলে প্রচার করতে চেয়েছিলো, এবং পান্ডিত্সভা ডাকবার জন্য বলছিলেন।  তখন ঠাকুর  রামকৃষ্ণই মাথুরবাবুকে এই পান্ডিত্সভা ডাকবার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা। তাহলে এও তো এক প্রকার নিজেকে ভগবানের অবতার বলে প্রচার করা , এবং সেটা  নিজে থেকেই করা। আসলে ভগবানকে আমরা তো চিনি না। তাই ভগবানরাও নিজেকে ভগবান বলে প্রচার করে।  আবার ভন্ডরাও নিজেকে ভগবান বলে প্রচার করে। কালের গতিতে ভগবান বেঁচে থাকে, ভন্ডরা হারিয়ে যায়। শ্রীকৃষ্ণের আমলেও দ্বিতীয় বাসুদেব ছিল পৌন্ড্র।  ইনি আসামের দিকে কোনো রাজ্যের রাজা ছিলেন, তার কাকার পুত্রের নাম ছিল বলরাম।  তার সুদর্শন চক্র ছিল।  নিজেকে বাসুদেব বলে প্রচার করতেন। অতএব  শ্রীকৃষ্ণ একা নিজেকে ভগবান বললেন, বা নিজের প্রচার নিজেই করেছেন এমন নয়। এইরকম প্রচার আকছার এখনো হচ্ছে।  আগেও হয়েছে। যাই হোক এখন আমরা অদ্বৈত বাদ সম্পর্কে আলোচনা করবো।  

যারা অদ্বৈতবাদের সাধনা করেন, তারা নিজেরা জানেন এটি একটি সময়সাপেক্ষ, এমনকি জন্ম জন্মান্তর লেগে যেতে পারে, এই উপলব্ধিবোধের চূড়ান্তে পৌঁছাতে। এছাড়া ব্রহ্মজ্ঞানী পুরুষ আর তথাকথিত পাগলের মধ্যে প্রায়শই কোনো পার্থক্য থাকে না। একজন চৈতন্যবান পুরুষ আর একজন চৈতন্যহীন। যার জন্য ঠাকুর রামকৃষ্ণের মতো ব্রহ্মজ্ঞানীকে তখনকার অনেক পণ্ডিত পাগল বলতো।  যার যেমন জ্ঞানের বহর আর কি ? তবুতো রামকৃষ্ণ দ্বৈত - অদ্বৈত দুরকম সাধনা করেছিলেন। 
অষ্টাবক্র তার সংহিতায় ব্রহ্মজ্ঞানী সম্পর্কে এক জায়গায় বলছেন :

নির্বাসন নিরালম্বঃ স্বচ্ছন্দো মুক্তবন্ধনঃ। 
ক্ষিপ্তঃ সংস্কারবাতেন চেষ্টতে শুস্কপর্নবৎ।

অর্থাৎ বাসনারাহীত, কর্তব্যবুদ্ধিবিহীন, রাগদ্বেষের অনধীন বন্ধনহেতু অজ্ঞানশূন্য জ্ঞানী প্রারবদ্ধকর্মরুপ বায়ুদ্বারা প্রেরিত হয়ে পবন-সঞ্চালিত শুস্কপত্রের ন্যায় কর্ম প্রচেষ্টা করে থাকেন। 

তাহলে ভাবুন তো এই ব্রহ্মজ্ঞানী কেমন আছেন। ব্রহ্মবিদ তো জড়বৎ। না আছে দুঃখ না আছে আনন্দ।  না আছে কর্তব্যকর্ম। না আছে দ্বেষ, না আছে রাগ, না আছে মমতা, না আছে স্নেহ।  উনি কাঁদেন না, হাসেন না।  অথবা ওনার হাঁসা-কাঁদার সাধারণ মানুষ কি বোঝে ? ওনার থাকা না থাকা সমান। উনি স্ব -স্বরূপে স্থিত। 

তাহলে ব্রহ্মজ্ঞানী হতে সময় লাগে, আর তার পরে যা হয় তা আর  কোনো কম্মে লাগে না। তাহলে অদ্বৈতপথে এই ব্রহ্মজ্ঞানী হয়ে কি লাভ ? যার দেহ জ্ঞান থাকে না। 

আর ভক্তিযোগের সাধনার ফল আলোচনার আগে আমরা সাকার সাধনা আর নিরাকার সাধনার পার্থক্যটা একবার আমরা বুঝে নেই। 

ঈশ্বর নিরাকার, নির্গুণ, অব্যক্ত, অব্যয়, সর্বত্র। কয়েকজন লোক নির্বাক হয়ে আকাশ দেখছে। কেউ আকাশে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কেউ আকাশের নীল বর্ণ দেখছে।  কেউ আকাশের ক্ষনে ক্ষনে পরিবর্তিত মেঘ দেখছে। কেউ সে মেঘের মধ্যে শিবের মূর্তি দেখছে, কেউ শিব লিঙ্গ দেখছে,  কেউ ইস্ট মূর্তি দেখছে, কেউ হাতি  দেখছে। আবার কেউ  কিছুই দেখছে না, শুধুই মেঘ দেখছে, আর  সে বিরক্ত হচ্ছে। যে মেঘ দেখছে, সে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছে। যে ইষ্টমূর্তি দেখছে সে আনন্দে আত্মহারা হচ্ছে। আপনি কি বিরক্ত হতে চান ? ধৈর্য্য হারাতে চান ? নাকি আনন্দ পেতে চান ? আনন্দ আকারেই দিতে পারে।  নিরাকারে আনন্দ সুদুর্লভ। 

ঈশ্বরকে কি দেখা যায় ? কিভাবে দেখা যায় ? ঈশ্বর কি আকার নেয় ?

ঈশ্বরকে অবশ্যিই দেখা যায়। কিভাবে ঈশ্বরকে দেখা যায় না,  সেটা আগে ভাবুন।  তবেই ঈশ্বরকে দেখতে পারবেন। ঈশ্বরকে না দেখার কোনো উপায় নেই। বরং ঈশ্বরকে দেখতে না পারাটাই আশ্চর্য্য। ঈশ্বর অবশ্যই  আকার নেন।  আপনি যেমন তাকে দেখতে চান, তেমন ভাবেই তিনি আপনাকে দেখা দেবেন। আপনি দেখছেন কিনতু সনাক্ত করতে পারছেন না।  তাই ভাবছেন আমি দেখতে পারছি না। আসলে ঈশ্বর আপনি, আপনার ভিতর, বাহির, সর্বত্র যা কিছু দেখছেন সবই ঈশ্বর। তবে আমি দেখছি না, এটা কত বড়ো ভুল, বুঝতে পারছেন ? ঈশ্বর-সমুদ্রের মধ্যে বুদ্-বুদ্ আমি।  এখানেই জন্ম, এখানেই লয়। মানুষের শরীরের  মধ্যে যেমন অসংখ্য কোষ, আমিও তেমনি ঈশ্বরের বিরাট শরীরের কোষ মাত্র।  শরীরেই জন্ম, শরীরেই মৃত্যু। যতদিন বাঁচি, ঈশ্বর থেকেই খাদ্য সংগ্রহ করি, বা ঈশ্বরই  খাদ্য যোগায়। এক সময় ঈশ্বরেই লয়  প্রাপ্ত হই। আমি বা অহং বলে কিছু নেই।  এগুলো  মন-বুদ্ধির খেলা। মন বুদ্ধির ওপারে আমি বলে কিছু থাকে না।

নিরাকারই সাকার হয়।  আবার সাকার থেকে নিরাকার। জলের তিন রকম অবস্থা। বায়বীয়, তরল, কঠিন।তাপমাত্রার তারতম্যে এই প্রকারভেদ।  বায়বীয় জল সর্বত্র। তরল জল নদী, নালা, পুকুরে যেমন পাওয়া যায়, তেমনি পৃথিবীর মধ্যেও পাওয়া যায়। কঠিন জল আমরা বরফের আকারে দেখতে পাই। বায়বীয় জল আমাদের ভোগ্য বস্তু নয়। কঠিন জলের আইচক্রীম খাই, তরল জলে তৃষ্ণা মেটাই। বায়বীয়  জলে আমাদের তৃষ্ণা মেটায় না।  বাহ্যিক কোনো কাজ বায়বীয় জলে আমাদের হয় না। অর্থাৎ নিরাকারে আমরা আনন্দ পাই না। কোনো কাজে লাগে না। তৃষ্ণা পেলে, হা করে থাকলে বায়বীয় জল, আপনার তৃষ্ণা মেটাবে ? তাহলে বায়বীয় জল সত্য কিনতু আনন্দ দেয় না। তাই ঈশ্বর সাধনায় যদি আনন্দ পেতে চান তবে সাকারের সাধনা করুন। 

নিরাকারের শক্তি সাকারের মধ্যেই প্রকাশ পায়। আকাশের একটা গুন্ - শব্দ, বাতাসের দুটো গুন্  - শব্দ, স্পর্শ। আগুনের তিনটি গুন্ শব্দ, স্পর্শ, রূপ। জলের চারটি  গুন্ -শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস।  মাটির পাঁচটা  গুন্ - শব্দ, স্পর্শ, রূপ,রস, গন্ধ।  তাহলে দেখতে পাচ্ছেন, নিরাকার থেকে সাকারের দিকে যত  যাচ্ছে তত তার গুন্ বেড়ে যাচ্ছে। এবং আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো এই গুন্ গুলো থেকেই জ্ঞান সংগ্রহ করছে। কান দিয়ে আমরা শব্দ  শুনছি। চোখ দিয়ে আমরা রূপ দেখছি। নাক দিয়ে আমরা গন্ধ শুঁকছি। মুখ দিয়ে আমরা রসের আস্বাদন করছি। ত্বক দিয়ে আমরা স্পর্শ করছি। এ সবই  আমাদের সুখ ও দুঃখের আস্বাদন করাচ্ছে। এ থেকেই আমরা সুখ দুঃখের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছি আমাদের অজ্ঞাতসারে। দৈহিক সুখ দুঃখের কারন এই ইন্দ্রিয়গুলো। তাই মহাপুরুষগন  বলছেন, ইন্দ্রিয়গুলোকে সংযমী করো, যদি সুখী  হতে চাও। যাক অন্য্ কথায়  চলে যাচ্ছি। আমাদের মূল আলোচনা ভক্তিবাদ, এবং সে প্রসঙ্গে সাকার, নিরাকার ঈশ্বর। 

আপনি আগুন চান। আগুন পেতে গেলে আপনাকে একটা মাধ্যম করতে হবে। আগুন সবত্র আছে। কিনতু  কাঠি/কাঠ  চাই। আর চাই বারুদ।  এই বারুদ দেন গুরুদেব।  মাধ্যম ছাড়া আগুনের প্রকাশ হয় না। তেমনি  ঈশ্বরের  প্রকাশ যদি দেখতে চান তবে মাধ্যমকে আশ্রয় করুন। আর নিজেকে তৈরি করুন। অপেক্ষা করুন আকুলতা নিয়ে।


আজও  নাকি শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি শোনা যায়, বৃন্দাবনে। আপনি কি বলবেন সত্যিই শোনা যায় ? আপনি বলবেন - পাগল ? আজও রাশলীলা দেখা যায়।  আপনি কি বলবেন - পাগল ? আপনার এক্সপোজারে যদি ব্যাটারি বা ইলেকট্রিসিটি থাকে, অর্থাৎ আপনার মধ্যে যদি ভক্তি থাকে, অনুরাগের সুইচ দিয়ে দিন।  ঠিক দেখতে পাবেন রাসলীলা , শুনতে পাবেন বাঁশি । আপনার আগে পিছনে সর্বত্র, গান ভেসে বেড়াচ্ছে। নাচের ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে। আপনি দেখতে পাচ্ছেন না। কিনতু আপনার যদি এক্সপোজার অর্থাৎ টিভি থাকে তাতে যদি ইলেকট্রিসিটি থাকে, সুইচটা অন করে দিন আপনি সব দেখতে পাবেন। এক্সপোজারের মধ্যে কিনতু  কিছু নেই। ওটা ভেঙে ফেললেও ভিতরে ছবি পাবেন না. গান পাবেন না। গান আছে সর্বত্র,ছবি আছে সর্বত্র। আপনার এন্টেনা ঠিক করুন, নিজেকে যোগ্য করুন, ব্যাকুল হন, নিরন্তর তৎগতপ্রাণ হন , তবেই তাকে দেখতে পারবেন তার বাঁশি  শুনতে পাবেন। 

আপনি  ফল খেতে চান ?  ফলের স্বাদ আপনি কান্ডে  পাবেন না। বীজ তো বিস্বাদ। ভক্তিবাদীরা ফল খায়। নিরাকারবাদীরা মাটির মধ্যে উৎস খোঁজে,মাটির মধ্যে  স্বাদ খোঁজে। আপনি কোনটা  চান ?

একটা ঘটনা বলি।  শিরডির সাঁইবাবা - নাম শুনেছেন নিশ্চই।  তো  তাকে এক ভদ্রলোক দুপুরে খাবার জন্য নিমন্ত্রণ করেছেন।  খাবারের সমস্ত  আয়োজন সম্পূর্ণ।  ভদ্রলোক অপেক্ষা করছেন। এই বুঝি বাবা আসে। বাবা আর আসছেন না।   দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। বাবা আর আসেন না। সন্ধ্যে হয়ে গেল।  বাবা আর আসেন না। একটা কুকুর ঘুর ঘুর করছে। ভদ্রলোক  খাবার রেখে উঠতে পারছেন না। কুকুরটাকে যতই তাড়ানো হচ্ছে,  কুকুরটা একটু দূরে গিয়ে অপেক্ষা করছে।    ভদ্রলোক, লোক পাঠালেন, বাবার কাছে। বাবা বললেন - আমিতো গেছিলাম রে। কিন্তু তোর  মনিব তো লাঠি দিয়ে তারা করলো। লোকটি বললো - সে কি বাবা কখন গেছিলেন ? আমার বাবু তো সারাক্ষন আপনার অপেক্ষায় বসে আছেন।  বাবা বললেন - তোর  বাবুতো  লাঠি নিয়ে বসে আছে।  আমি যাই কি করে ? খাই-ই  বা কি করে ? 


ভগবানকে না চিনলে এই হয় দশা। ভগবান এসে বসে থাকে।  আর আমি লাঠি নিয়ে বসে থাকি। ভগবান আসতে  চায়, আমরা তাকে তাড়াতে চাই।


অতএব  শ্রীকৃষ্ণ বলছেন : আমার মতে  তারাই শ্রেষ্ট যারা ভক্তি সহকারে আমার উপাসনা করে। ভক্তিবাদেই আনন্দ, জ্ঞানী নিরস।



দুধের মধ্যে মাখন আছে, দই আছে। আপনি যদি ফেলে রাখেন , দুধ দই হয়ে যাবে। আর যদি ঝাঁকান তবে মাখন পেতে পারেন। তখন জলে ভাসতে পারবেন। না হলে জলে মিশে যাবেন। নিজেকে ঝাঁকান-ঝাঁকান, আরো জোরে, আরো জোরে নিজেকে ঝাঁকান, তবে আপনি নিজেকে মাখন করতে পারবেন।  নতুবা একদিন জলে মিশে যাবেন। তাই ভগবান বলছেন ভক্তিবাদ-ই শ্রেষ্ট।
এবার একটু অন্য্ কথা বলি। ধ্যানে সাধকেরা তার ইষ্ট  বা গুরুদেবের প্রতিচ্ছবি কল্পনা করে ধ্যান করেন। তখন গুরুদেবকে বা তার ইষ্টকে জ্যান্ত বলে  মনে হয়। তখন সেই ইষ্টদেবতার সঙ্গে বা গুরুদেবের সঙ্গে কথা বলা যায়। এবং কথা বলেন সাধক।  সেই প্রতিচ্ছবিও কথা বলে। আপনারা নিশ্চয় শুনেছেন আমাদের আজ্ঞা চক্র বা তৃতীয় নয়ন বলে একটা কথা আছে। এটি একটি শক্তিশালী বার্তা প্রেরণ কেন্ত্র। বিশ্বাস করতে হবে না, এই বার্তা প্রেরণ কেন্দ্রে নিজের মনকে স্থির করে  আপনি যদি কাউকে আদেশ বা নির্দেশ দেন, তবে সে তা পালন করতে বাধ্য হবে। এটা আপনি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। এটি একটি অসাধারন গতিশীল শক্তি। কোনো ব্যক্তির ছবি, বা প্রতিমাকে মনের মধ্যে রেখে, তার ক্ষুদ্র প্রতিমাকে ধ্যানে নিয়ে আজ্ঞা চক্র থেকে যদি ভিজা মাটির মূর্তির উপরে, বা ছবির  উপরে নিবিষ্ট করা যায় তবে সেই মাটির মূর্তি আর সাধারণ থাকে না। সেটা আপনার আজ্ঞা দ্বারা সঞ্চারিত চলমান শক্তিতে পরিণত হয়ে যায়। তখন আপনি যা স্নরন করবেন, সেটা গতিশীল হয়ে যাবে। মূর্তিপূজা এই প্রক্রিয়ার গভীর প্রয়োগ ।  আমি মনে করি, ঈশ্বর তো বিরাট। আর এই সর্বত্র বিরাজমান  বিরাটের কাছে  পৌঁছেতে আমরা মূর্তির মাধ্যমে যেতে পারি। একটা কথা আছে, যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তাই আছে এই ভান্ডে অর্থাৎ মানব শরীরে।  এবং শুধু তাই আছে না, সেই  প্রপোরশনে অর্থাৎ সেই  ভাগে আছে। অর্থাৎ জল ৭৫%, আকাশ ____, বায়ু _____ অগ্নি _____ মৃত্তিকা  _____ । আপনার মস্তিস্ক আর পরমাত্মার মস্তিষ্কের সঙ্গে একটা সম্পর্ক আছে। এই দুই সন্মন্ধকে যুক্ত করার জন্য একটা সেতু চাই। এই সেতু নির্মিত হতে পারে মূর্তি দিয়ে। কেননা আপনি নিরাকার কিছুর সঙ্গে সোজা সুজি সম্পর্ক স্থাপিত করতে পারবেন না। আপনি আকারে বর্তমান।  নিরাকার সম্পর্কে তো আপনার কিছু জানা  নেই। তাই যে যাই বলুক না কেন পরমাত্মা নিরাকার, অপ্রকাশিত।  সেটা শুধু শুধু কথার কথা হয়ে যাবে আপনার কাছে। আপনার অনুভবের মধ্যে কিন্তু আসবে না। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের মস্তিষ্কের  মধ্যে যত  অনুভব আছে, সেগুলোর সবই  আকৃতির অনুভব। রূপের অনুভব। আমাদের কারুর মধ্যে নিরাকারের একটাও অনুভব নেই। কারুর কথা ভাবা মানে তার রূপের কথা। অবয়বের কথা। তার সূক্ষ্ম গুনের কথাতেও আমরা রূপ কল্পনা করি। আর যার সন্মন্ধে কোনো ধারণা নেই তার সম্পর্কে কোনো শব্দ আপনাকে তার স্মরণ করাতে পারবে না। তাই আপনি নিরাকারের কথা বলতে থাকবেন আর সাকারের মধ্যে বাস করবেন। যদি সত্যি সত্যি আপনি নিরাকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে চান তবে আপনাকে এমন একটি মূর্তি নির্মাণ করতে হবে যার একদিকে সাকার আর এক দিকে নিরাকার। এটা একটা অসম্ভব রহস্যময় মূর্তি হবে। একটু ভাবুন, আমরা যেখানে রয়েছি, সেখানে তার সীমা  প্রকাশিত। আর অন্যদিকে পরমাত্মা যেখানে আছেন সেটা সীমাহীন অপ্রকাশিত। তাই মূর্তিকে দুটো কাজ করতে হবে আমরা যেখানে সেখানে সে প্রকাশিত হবে, আর পরমাত্মা যেখানে আছেন সেখানে নিরাকারের মধ্যে হারিয়ে যাবে। এই ধরনের  কথা হয়তো কখনো শোনেননি।

একটা কথা শুনুন যে ব্যক্তি পূজা করে, সে ওই মাটির মূর্তিকে পূজা  করে না। সে ওই ছবিকে পূজা করে না। সে পূজা করে ওই ছবির  মধ্যে তার পিতাকে, মাতাকে, গুরুকে  ।  দেবতাকে।  ইষ্টকে। পরমাত্মাকে।  মূর্তির কখনো পূজা হয় না। মূর্তির মধ্যে আমি যাকে  দেখতে চাই তার পূজা করা হয়। আর যার কাছে মূর্তি দৃশ্যমান, সে কখনো পূজা শেখেনি, সে পূজা করে না। তার পূজা সম্পর্কে  কোনো ধারণাই  নেই। পূজা আর মূর্তি দুটো আলাদা কথা। পূজা মূর্তির হয় না, পূজা হয় ভাবনার। যে পূজা করে, সে কখনো মূর্তি দেখতে পায়  না। যে মূর্তি দেখতে পায়, সে কখনো পূজা  করে না। পূজা মূর্তিকে মুছে ফেলার কৌশল। আমরা তো আকৃতি সম্পন্ন, সেই আকৃতিকে মুছে ফেলার কৌশলই পূজা।দেহাতীত হয়ে যাওয়াই পূজা।  পূজায় দৃশ্যমান আকৃতি, আকৃতিবিহীন হয়ে যায়। তবেই পূজা সম্পন্ন হয়। প্রকাশিত অংশে পূজা আরম্ভ হয়, অপ্রকাশিতে পূজা সম্পন্ন হয়। পূজা সাধককে গ্রাস করে নেয়। যারা পূজা করেনি তারা ভাবে পাথর রেখে কি হবে ? আর যারা পূজা করেছে তাদের পাথর হারিয়ে যায়, সীমা হারিয়ে যায়, অসীমে প্রবেশ করে আর তখন পরমাত্মা  প্রকট হয়ে যায়।
ভগবান শ্রীচৈতন্য যখন দুহাত তুলে কৃষ্ণনাম করে, মিরা যখন পূজার ছলে  নাচ করে, মতুয়ারা যখন হরিবোল হরিবোল করে তখন তারা নিজেরা পূজার মধ্যে বিলীন হয়ে যায়।  এদের জন্য সেখানে কোনো মূর্তির অস্তিত্ব থাকে না। পূজা শুরু হলে মূর্তি বিলীন হয়ে যায়।  মূর্তি তো প্রারম্ভ মাত্র।  আমরা যারা পূজার কিছু বুঝি না, তারা মূর্তি দেখতে পাই। তাই আমার মনে হয় - সত্যিকারের পূজা যত কমতে থাকবে, মূর্তি তত  বাড়তে থাকে, পূজা শুরু হলে মূর্তি অন্তর্হিত হবে।

মূর্তি তো পরমাত্মাকে দেখবার জানলা মাত্র। আমি দেহের মধ্যে থেকে পরমাত্মাকে দেখতে চাই।  আমার তো দেহ আছে।  অর্থাৎ আমি আকৃতি সম্পন্ন। তো জালনা ও তো আকৃতি সম্পন্ন হবে , কিন্তু জানলা খুলে যখন আকাশের দিকে তাকাবো তখন নিরাকারের মধ্যে প্রবেশ করবো। এই দেহের মধ্যে জানলা আছে, সেটাকে খুলতে হবে। আকাশকে দেখতে হবে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে জানলা ছোট্ট।  কিন্তু আকাশ তো বড়ো। কিন্তু ছোট্ট জানলা দিয়েইতো বড়ো আকাশকে দেখা যায়। এটা বোঝানো কঠিন কিন্তু সত্যি। যে জানলা কখনো খোলেনি, যুক্তি দিয়ে তাকে বোঝানো কঠিন হবে যে বৃহৎ আকাশকে, আয়তনে ছোট্ট জানলা দিয়েও দেখা যায়। মূর্তি পূজা এই জানলা খোলার প্রক্রিয়া। আপনি মন্দিরের কাছে যেতে পারেন। মূর্তির কাছে যেতে পারেন।  কিন্তু পূজার কাছে যেতে পারেন না।  কতকগুলো বিষয় আছে যার অভিব্যক্তি সম্ভব নয়। এগুলো অন্তরের ব্যাপার। আন্তরিক বস্তু প্রদর্শন সম্ভব নয়।

সাকার নিরাকার দুটি পৃথক নয়। একটি অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। যাকে  আমরা সাকার বলি সেটা নিরাকারের অংশ।  আবার যাকে  আমরা নিরাকার বলি সেটিও সাকারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আমরা সাকারে আছি। আমার দেহ সাকার। আমরা সম্পর্ক গড়ি সাকারের সঙ্গে। এই সত্য তো অস্বীকার করলে চলবে না যে আমরা সাকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। আর আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি আমাদের সেখান থেকেই যাত্রা  শুরু করতে হবে। যেখানে আমাদের যাওয়া  উচিত, সেখান থেকে যাত্রা শুরু করা যায় না। যেখানে আছি সেখান থেকেই যাত্রা শুরু করতে হয়। যেখানে আমরা নেই সেখান থেকে যাত্রা শুরু করা যায় না। আমরা যা কিছু জেনেছি আকারের মধ্যেই জেনেছি। আমরা প্রেম করেছি - আকারে। আমরা রাগ করেছি আকারে।  আমরা ঘৃণা করেছি আকারে। আসক্ত হয়েছি তাও আকারে। বন্ধুত্ব করেছি আকারে।  শত্রূতা করেছি তাও আকারে। ঈশ্বরের নিরাকারত্ব যেমন সত্য। আমাদের আকারত্ব তেমনি সত্য। আমাদের মন যখন কিছু ধরে রাখে সেটা আকারেই ধরে রাখে।

তাই শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ বা কথা  যখন আমরা স্মরণ করি, তার গুনের কথা যখন আমরা স্মরণ করি, তখন তার আকারের কথাই আমাদের চোখে ভাসে। আর এই জন্য নিরাকারের দিকে যদি যাত্রার জন্য  আমাদের বেরোতে হয়, তবে আমাদের নিরাকারের জন্য আকার সৃষ্টি করতে হবে।এই আকারটা যদি শ্রীকৃষ্ণের হয়, বা অন্য্ কারুর হয় তবে আমাদের সাধনপথ সহজ হবে।                      

No comments:

Post a Comment