ভ্রূযুগলের মধ্যে জ্যোতির ধ্যান কেন করবো ?
এই ভ্রূযুগলের মধ্যে আছে আজ্ঞাচক্র। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের চিত্ত চঞ্চল। চিত্তের এই চঞ্চলতা বিক্ষেপ জনিত । সত্যি কথা বলতে কি লয় ও বিক্ষেপ যোগ পথের অন্তরায়। যিনি যে ধরনের সাধনাই করুন না কেন, যদি আপনি দুর্বল মনের মানুষ না হন, তবে সাধনকালে আপনি আপনার ভ্রূযুগলের মধ্যে অথবা ভ্রুদ্বয়ের একটু উর্দ্ধে জ্যোতির চিন্তা করতে পারেন। কিন্তু যদি দুর্বল মনের মানুষ হন তবে আপনার হৃদয়-কেন্দ্রে ধ্যান করাই শ্রেয়। যোগাচার্য্য বলছেন, এই জ্যোতি অবশ্য়ই শুদ্ধ হওয়া আবশ্যক। এইজন্য যোগীগণ প্রভাত সূর্য্যের অখন্ড রূপ চিন্তার বিষয়ভূত করে থাকেন। কেউ কেউ এই ভ্রূমধ্যে বিন্দুর চিন্তন করতে বলে থাকেন। এই বিন্দু চিন্তন আপনি দিন-রাত্রির যেকোনো সময়, এমনকি নিত্য কর্ম্মরত অবস্থায়,, জাগ্রত অথবা শয়নকালে করতে পারেন। এই যে জ্যোতির ধ্যান যোগীগণ করে থাকেন, এই জ্যোতি প্রথম দিকে কল্পনা মাত্র। কিন্তু সাধনার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এই জ্যোতি বাস্তবে পরিণত হয়। একেই বলে সবিতার জ্যোতি অর্থাৎ সূর্য্যের জ্যোতি। গায়েত্রী মন্ত্রের উপাসনার মধ্যে এই সাধনার কথা বলা আছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে সাধনার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বা আমাদের একাগ্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সত্যিকারের জ্যোতির প্রকাশ ঘটে থাকে এটা কিভাবে ঘটে থাকে। বলা হচ্ছে একাগ্রতার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতির প্রকাশ আমরা দেখতে পাই। এটি চক্ষু মুদ্রিত অবস্থাতেই দেখতে পারি, আবার চক্ষু উন্মীলন করেও আমরা এই জ্যোতির দর্শন করতে পারি। দেখুন বস্তুর যত বিস্তার ঘটে তত আমাদের চক্ষু থেকে তা অগোচর হয়ে যায়। একবস্তা সর্ষে যদি ৫ বিঘা জমিতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তবে তা আমাদের চোখে পড়ে না। কিন্তু সেই সর্ষের দানা যখন বস্তার মধ্যে ছিলো, তখন তা আমাদের দৃষ্টির মধ্যে ছিলো। কিন্তু যখন তা ছড়িয়ে দেওয়া হলো, তখন তাকে দেখবার জন্য আমাদের আরো মনোযোগ দিতে হয়। তো বিস্তার যার যত বেশি, তার দর্শন পেতে গেলে, তত বেশি মনোযোগ দিতে হয়।
তো আমাদের চিত্তে একাগ্র অবস্থার উদয় না হলে জ্যোতির উদয় হতে পারে না। ছড়ানো সত্তাকে গুটিয়ে আনতে পারলে, জ্যোতির উদয় হয়। আর এই জ্যোতির উদয় হলে অব্যক্ত-অপ্রকাশিত সত্তা প্রকাশিত হয়। প্রথম প্রথম এই জ্যোতি দেখা দিয়ে মিলিয়ে যায়। কিন্তু যখন জ্যোতিটি স্থায়ীভাবে প্রকাশ পায় , তখন যে সত্য আমার কাছে অপ্রকাশিত ছিল, তা তখন প্রকাশিত হতে আরম্ভ করে। এই যে মনের একাগ্রতা যে ভূমিতে নিবিষ্ট হয়, তাকে বলা হয় চিত্ত নিরোধের পূর্বাবস্থা, বা একাগ্রভূমি । এর পরে আমাদের চিত্ত নিরোধভূমিতে প্রবেশ করে। এই যে জ্যোতির উদয় হয়, একেই বলে জ্ঞানজ্যোতি বা প্রজ্ঞা। এই জ্ঞানজ্যোতির উদ্দেশ্য বা পরিণতি হচ্ছে জ্ঞেয়কে প্রকাশ করা। আবার জ্ঞেয়বস্তু প্রকাশিত হলে আমাদের অজ্ঞানের উপশম হয়। আমাদের আকাঙ্খ্যার নিবৃত্তি হয়। অর্থাৎ অজ্ঞান ক্রিয়াহীন হয়ে যায়। এরপর নিরোধের অবস্থা আপনা আপনি ফুটে ওঠে। কিন্তু একাগ্রভূমি অতিক্রম না করতে পারলে নিরোধভূমিতে প্রবেশ করা যায় না। যাওয়াও উচিত নয়।
আসলে আধার বা শরীর যতক্ষন অষ্টাঙ্গ যোগের মাধ্যমে ধীরে ধীরে শুদ্ধ না হয়, ততক্ষন একাগ্রভূমিতেই অবস্থান নিরাপদ। কিন্তু এই অবস্থায়, চিত্তকে নিরোধের চেষ্টা করলে চিত্ত প্রকৃতিতে লিন হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে । এই প্রকৃতিলীন অবস্থার যোগ্য শরীর না হলে, শরীরপাত হয়ে যেতে পারে। শুদ্ধ জ্যোতির চিন্তা করতে করতে অর্থাৎ মনে মনে নিরন্তর এই দর্শন চিন্তা করতে করতে একসময় একাগ্রভূমিতে স্থিতি লাভ করা যায়। চিত্তের বিক্ষেপ হচ্ছে বিকল্পের খেলা। এই বিকল্প আবার দুই প্রকার শুদ্ধ ও অশুদ্ধ । সাধকযোগীর কাজ হচ্ছে অশুদ্ধ বিকল্পকে ছেড়ে শুদ্ধ বিকল্পতে স্থিতি লাভ করা। এই অবস্থাই একসময় শুদ্ধ বিকল্প থেকে নির্বিকল্প পরম পদে লীন হয়ে যায় । এখন কথা হচ্ছে বিকল্প আর নির্বিকল্প ব্যাপারটা কি ? বিকল্প কথাটার অর্থ হচ্ছে বিপরীত। এখানে বিপরীত চিন্তা বা বিপরীত কল্পনা। এই বিপরীত কল্পনার বা চিন্তার মধ্যেও থাকে কিছু শুদ্ধ বা সদর্থক চিন্তা আর কিছু নঞৰ্থক চিন্তা। সাধন জগতে এই নঞৰ্থক চিন্তা পরিহার করে চলতে হয়। পঞ্চজ্ঞান ইন্দ্রিয়ের অতীত এই পরিবর্ত কল্পনা। প্রথমে আমাদের অশুদ্ধ বিকল্প চিন্তাকে পরিহার করে শুদ্ধ বিকল্প চিন্তায় স্থিতি লাভ করতে হয়। পরে, শুদ্ধ বিকল্প থেকে নির্বিকল্প অর্থাৎ যার কোনো বিপরীত অবস্থান নেই, সেই নির্বিকল্প সত্যে চিত্তকে স্থির করতে হয়।
আমরা যে ধর্ম্ম কর্ম্ম করি, জ্ঞানের সাধনা করি, ভক্তি লাভের চেষ্টা করি, এগুলো সবই ওই শুদ্ধ বিকল্প অবস্থা প্রাপ্তির জন্য করে থাকি। মাত্রিকা বা মাত্রিক থেকে ভাষার উৎপত্তি। মাত্রিকা কথাটার অর্থ হচ্ছে তন্মাত্র বা অমিশ্র পঞ্চভূত। যা সমস্ত জগতের মূল উপকরণ। এই মাত্রিকা শক্তি থেকেই ভাষার উৎপত্তি। আবার আমাদের সকলপ্রকার চিন্তা প্রবাহ গতিশীল হয়, এই ভাষার মাধ্যমে। আবার এই মাত্রিকা হচ্ছে বর্ণের সমষ্টি। সমস্ত বর্ণই ভাষার অন্তর্গত। তো এই বর্ণ বা মাত্রিকা যতক্ষন না বিগলিত হয় ততক্ষন তার স্বভাব অনুযায়ী সে বিকল্প উৎপাদন করে থাকে। অর্থাৎ বিক্ষেপ বা বিকল্প উৎপাদন করে থাকে। এই মাত্রিকা অর্থাৎ অমিশ্র ভূতপঞ্চ ক্রিয়াশীল থাকে ততদিন আমাদের চিত্ত থাকে বিক্ষিপ্ত । আর বিক্ষিপ্ত চিত্ত কখনো একাগ্রভূমিতে প্রবেশ করতে পারে না। অর্থাৎ আমরা একাগ্র হতে পারি না। এইজন্য প্রাচীন যোগগুরুগন এই মাত্রিকাকে বিগলিত করে বিন্দুতে পরিণত করেন। মাত্রিকা গলে গেলে নির্বিকল্প অবস্থার উদয় হয়। আমরা যে বিভিন্ন চক্রের সাধনা করে থাকি, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই মাত্রিকাকে বিন্দুতে পরিণত করে, একাগ্রভূমিতে প্রতিষ্ঠা করা। আর মাত্রিকা যখন বিন্দুতে পরিণত হয়, তখন সে উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হয়। আর এই গলন ক্রিয়ায় সাহায্য করে থাকে নাদ। মাত্রিকা থেকে বিন্দুতে যেতে হলে, নাদের মধ্যে দিয়েই যেতে হয়। আবার এই মাত্রিকা বিগলিত হলেই নাদের উদয় হয়। নাদ হচ্ছে উর্দ্ধমুখী প্রবাহ, যা অন্তর্মুখী। সাধকের অনুভবে একটা জিনিস আসবে, সেটি হচ্ছে পৃথিবীর সর্বত্র মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কার্যকরী। অর্থাৎ নিম্নমুখী গতি কাজ করে। কিন্তু সুষুম্না নাড়ীতে সর্বদা উর্দ্ধমুখী আকর্ষণ অনুভব হয়। তাই বিন্দু উর্দ্ধগতিসম্পন্ন হয়ে আজ্ঞাচক্রে স্থিতি লাভ করে। এই হচ্ছে ভ্রূমধ্যে জ্যোতি চিন্তার পরিণতি।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
এক বন্ধু প্রশ্ন করেছেন, : অশুদ্ধ বিকল্প যদি ভালোভাবে বুঝিয়ে বলেন।
দেখুন শুদ্ধ ও অশুদ্ধ বলতে আমরা কি বুঝি ? শুদ্ধ হচ্ছে অমিশ্রিত অবস্থা। অর্থাৎ কোনো খাদ নেই। আবার যেখানে খাদ আছে বা যখন মূল বস্তুর সঙ্গে কিছু মেশানো হয়, তাকে বলে অশুদ্ধ । আর বিকল্প বলতে আমরা বুঝি সমগুণ সম্পন্ন, সমদর্শী বস্তু। অর্থাৎ প্রায় একই রকম কিন্তু একই বস্তু নয়। বলা হয়েছে অশুদ্ধ বিকল্পকে ত্যাগ করে শুদ্ধ বিকল্পে স্থিতি গ্রহণ করতে হয়। এই ব্যাপারটা বুঝতে গেলে একটু আমাদের দর্শনশাস্ত্রের একটু গভীরে প্রবেশ করতে হবে।
দেখুন আমরা পরমাত্মা থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। কতদূর চলে এসেছি, তা আমাদের ধারণার বাইরে। আমি আগে বলেছি, শব্দই ব্রহ্ম। আর এই শব্দব্রহ্ম থেকে আমাদের উৎপত্তি। তো একটা সময় ছিল, যখন শব্দেরও সৃষ্টি হয়নি। তারও আগে একটা ক্ষণ ছিল, যখন সময় বা কালের সৃষ্টি হয়নি। সাধনা না করলে, এই বিষয়গুলো স্পষ্ট হয় না। সে যাই হোক, পরমসত্তা থেকে মহাকালের আবির্ভাব ঘটে থাকে। মহাকালের মধ্যে ভূত, বর্তমান ভবিষ্যৎ ও সুক্ষ, স্থুল ও কারন বস্তু নিহিত থাকে। এই মহাকালের মধ্যে পূর্ণ অহং প্রকাশ পায়। এঁকে বলে মহাসত্তা। এর পর বিভাগ শুরু হয়। যার পরিণতি হচ্ছে শব্দব্রহ্ম। প্রথমে পশ্যন্তি, এই অবস্থা হচ্ছে জগতের অতীত অবস্থা কিন্তু পরাবস্থা নয়, পরাবস্থা থেকে হীন অবস্থা। পরাবস্থায় ইদং ভাবের সমাবেশ নেই। কিন্তু এখানে এই পশ্যন্তি অবস্থায় ইদং-ভাব আছে। সাধকের বিশুদ্ধ চৈতন্যে এই অবস্থা ধরা পড়ে। এই অবস্থায় মন বা চিত্তের উদয় হয়। চিত্ত যখন শুদ্ধ থাকে তখন এগুলো আলাদা আলাদা ভাবে প্রকাশমান হয়। একেই বিশুদ্ধ সংকল্পময় রাজ্য বলা হয়ে থাকে। এখানে অনন্ত রূপ আছে, এবং প্রত্যেকের স্থিতি বিশুদ্ধ। এই অবস্থাকে বলে মধ্যমা। এর পরে বায়ুর স্তর আসে। শুরু হলো অশুদ্ধ অবস্থা। অর্থাৎ শব্দব্রহ্মের সাথে বায়ুর মিশ্রণ ঘটলো। এই বায়ু সূক্ষ্ম। কিন্তু যখন বায়ুর মধ্যে গতির সঞ্চার হলো, তখন শব্দ বৈখরীর অবস্থায় এলো। শুরু হলো নাদ। যাকে আমরা নাদব্রহ্ম বলে থাকি। এটি অশুদ্ধ অবস্থা।
আমাদের চিত্তের দুটো ভাগ, এক হচ্ছে শুদ্ধ যেখানে মাত্রিকারূপ (পঞ্চভূত মিশ্রিত অবস্থা) শব্দ বা বর্নমালা নেই। আর একটি হচ্ছে অশুদ্ধ অর্থাৎ যেখানে বায়ুর প্রাধান্য বা বর্ণমালার উদয়-অস্ত আছে। মন্ত্র বর্নমালা দিয়ে গাঁথা। সাধনার অগ্রগতিতে এই বর্ণ একসময় বিগলিত হয়ে যায়। তখন থাকে কেবল বিন্দু। এই বিন্দু একসময় আজ্ঞাচক্রে স্থিত লাভ করে।
অজপা জপ :
জীবন শ্বাসের খেলা। শিশুর প্রথম শ্বাসে জন্ম, আর শ্বাসের শেষ ত্যাগ জীবের মৃত্যু। শিশু যখন মাতৃগর্ভে অবস্থান করে, তখন তার নিজস্ব শ্বাস প্রশ্বাস থাকে না। মায়ের শ্বাস-প্রশ্বাসই শিশুকে বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু শিশু ভূমিষ্ট হলে, তার নাড়িচ্ছেদ করা হয়। আর এই নাড়িচ্ছেদন ক্রিয়াই শিশুকে পৃথক ভাবে শ্বাস গ্রহণ-বর্জন করতে বাধ্য নয়। শ্বাস গ্রহণ থেকে জীবন শুরু আবার শ্বাসের ত্যাগই জীবের মরন। জীবের সমগ্র জীবনটাই শ্বাস-প্রশ্বাসের খেলা। আসলে মানুষ যতদিন আত্মবিস্মৃত থাকে, ততদিন সে শ্বাস-প্রশ্বাসের অধীন থাকে। শ্বাস-প্রশ্বাস হচ্ছে কালের খেলা। কালই জীবের জীবন-মৃত্যু ঘটিয়ে থাকে। আমরা যে আত্মস্থ হতে পারি না তার কারন হচ্ছে, আমাদের শারীরিক ব্যাধি, মদের আলস্য, আমাদের চিত্তের চঞ্চলতা, অকর্মণ্যতা, বিষয় তৃষ্ণা, ভ্রমজ্ঞান ইত্যাদি আমাদেরকে প্রতিনিয়ত বিক্ষিপ্ত করছে। আর এই বিক্ষেপ না থাকলে, বিক্ষেপরূপ শ্বাস-প্রশ্বাসও থাকতো না।
আমরা জানি, দিনরাত্রি মিলিয়ে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের সংখ্যা ২১৬০০। এই সংখ্যার ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, তবে এই ব্যতিক্রম বাদ দিলে, প্রত্যেকটি মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের সংখ্যা কম-বেশি ২১৬০০ বার।
সংসার জীবনে ঈশ্বরের স্থান :
একটা শিশু যত বৃদ্ধি প্রাপ্ত হতে থাকে, ততই তার মধ্যে অভাববোধ জাগতে থাকে, আর সে সেই অভাব পূরণের জন্য, চাইতে শেখে। আর চাওয়া তার কাছেই চলতে থাকে যার থেকে সে কিছু পায়। যার কাছ থেকে সে কিছুই পায় না, তার কাছে আর কোনো চাওয়াই থাকে না. এমনকি তার জীবন থেকে সে হারিয়ে যায়। ছোটবেলা থেকেই আমাদের এই চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে নিজেকে গন্ডিবদ্ধ করতে শিখে চাই, মা-বাবার কাছে চাওয়া, পরিবারের কাছে চাওয়া, প্রতিবেশীর কাছে চাওয়া, সমাজের কাছে চাওয়া, রাষ্ট্রের কাছে চাওয়া। সবশেষে ঈশ্বরের কাছে চাওয়া। এই চাওয়া যদি না থাকতো, তবে আমাদের আর সব কিছুর অস্তিত্ত্ব থাকলেও, আমাদের কাছে ঈশ্বরের অস্তিত্ত্ব থাকতো না। আমরা সবাই ঈশ্বরকে ডাকি কিছু পাওয়ার জন্য। আমরা ঈশ্বরের প্রসংশা করি, স্তুতি করি, প্রার্থনা করবার জন্য বা আমাদের প্রত্যাশা নিবেদনের জন্য। আমরা সবাই চাই আমাদের প্রার্থনা সফল হোক।
আমরা প্রার্থনা করি, ভয়ে, উদ্বেগে। আমরা প্রার্থনা করি কিছু পাবার আশায়। এই প্রার্থনার প্রক্রিয়া মানুষ সৃষ্টির আদিম যুগ থেকেই শুরু হয়েছে। তখন প্রার্থনা করতো, প্রকৃতির শক্তির কাছে।
মুক্ত পুরুষ
মুক্তানন্দ বলছেন, ছোটবেলায় আমি পিতা-মাতার মুখাপেক্ষী ছিলাম। কৌশোরে আমি শিক্ষকের মুখাপেক্ষী হলাম। যৌবনে আমি নিজের মুখাপেক্ষী হলাম। প্রৌঢ় অবস্থায় আমি সংশয়াতীত হলাম। ষাট বছর বয়সে এসে, আমি যেন ঈশ্বরের আজ্ঞা শুনতে পেলাম । বৃদ্ধ বয়সে এসে আমি ঈশ্বরের আজ্ঞাবহ হলাম। যারা টাইপ জানে, বা হারমোনিয়াম জানে, তাদের আঙ্গুল ঠিক সুরে, বা অক্ষরে গিয়ে পড়ে। আমার আদত আমাকে সঠিক কর্ম্মে লিপ্ত করে থাকে।
আমার অহংগ্রন্থি ছিন্ন হয়ে গেছে। আমার মন আর দুর্বোধ্য জীবনের হিসেবে কষতে গিয়ে কষ্ট পায় না। আমার জীবনের উদ্দেশ্য আমি বুঝতে পেরেছি। আমার সব দ্বন্দ্ব দূর হয়ে গেছে। আমি এখন সর্বত্র ঈশ্বরীয় সাম্য দেখতে পাই। আমার মনের মধ্যে থেকে ঘৃণা দূর হয়ে গেছে। আমি যেমন আত্মা বৈ কিছু নোই, সমগ্র জগতেও আত্মা বৈ কিছু নেই। প্রেম-করুনায় আমার মন পূর্ন হয়ে আছে। আমার আশীর্বাদ ছাড়া দেবার মতো কিছু নেই। আমি নিজেই নিজেকে ভালোবাসি তাই আমি ভালোবাসায় পূর্ন। আমার পাবার কিছু নেই। তাই আমার হারাবারও কিছু নেই। আমার জাতি নেই, আমার ধর্ম্ম নেই, আমার দেশ নেই, আমার গোষ্ঠী নেই। জগতের কল্যাণ চিন্তা ছাড়া আমার কোনো চিন্তা নেই। আমি মুক্ত, মুক্তির চিন্তাও আমার নেই।
আমার কোনো ভয় নেই। আমার হারাবার কিছু নেই। আমি এখন দুহাত তুলে নাচি, কেননা, আমার বগলে কিছু লুকোনো নেই। আমার কোনো আশঙ্কা নেই, আমার কোনো বিপদ নেই। তাই আমার সাহসের দরকারও নেই। আমি অসুস্থ নোই, তাই আমার সুস্থ হবার দরকার নেই। আমি সমর্পিত তাই সমর্পন করবার মতো কিছু নেই। আমার কোনো লাভ নেই, তাই আমার লোকসান নেই। আমার কোনো বিপদ নেই, তাই বিপদ থেকে উদ্ধ্বারের চিন্তা নেই। আমি বিচারক নোই, তাই আমার বিচার বুদ্ধির দরকার নেই। আমি চৈতন্যস্বরূপ, আমিই আনন্দ, আমিই অনাসক্ত। সূর্য্যকে দেখবার জন্য প্রদীপের আলোর দরকার নেই। আমাকে দেখবার জন্য, আমার আয়নার দরকার নেই। অন্ধকার আমার কাছে আসে না, তাই আমি অন্ধকার দূর করবার চেষ্টা করি না। আমি স্বয়ং আত্মারাম, তাই আমি আত্মার খোঁজও করি না।
No comments:
Post a Comment