Friday, 21 January 2022

বিহঙ্গম যোগ / কায়াসিদ্ধি / ভালো থাকবো/মন্ত্র কেন প্রণব-পুটিত

 বিহঙ্গম যোগ - সহজ যোগ / কায়াসিদ্ধি 

বিহঙ্গম কথাটার অর্থ আকাশচারী। তো আকাশচারী বলতে আমরা বুঝি পাখিকে। এখানে  এই আকাশচারী বলতে বলা হচ্ছে শব্দকে। শব্দব্রহ্ম-এর সহজ যোগক্রিয়াকে বলা হয় বিহঙ্গমযোগ। আমরা যোগ বলতে সাধারণত হঠযোগকে বুঝে থাকি। এই হঠযোগ হচ্ছে দেহকে কেন্দ্র করে। কথায় বলে মাটির দেহ, মাটিতে মিশে যাবে। সেই শরীরকে অর্থাৎ পৃথ্বিকে কেন্দ্র করে, যে যোগ অনুষ্ঠিত হয় তাকে বলে হঠযোগ। আর শব্দকে বা আকাশকে কেন্দ্র করে যোগ অনুষ্ঠিত করা হয়, তাকে বলে বিহঙ্গম যোগ। 

আমরা জানি পঞ্চতত্ত্ব  দ্বারা তৈরী নবদ্বার সম্পন্ন এই শরীর। এগুলো হচ্ছে - চক্ষু-২ কর্ন-২, নাসিকা-২, মুখ, লিঙ্গদ্বার, ও মলদ্বার। পঞ্চতত্ত্ব বা পঞ্চতন্মাত্র হচ্ছে, ক্ষিতি, অপ, তেজ মরুৎ, ব্যোম। (আবার পঞ্চতন্ত্র - তাঁর কথাটার অর্থ হচ্ছে নীতি - তো পঞ্চতন্ত্র  হচ্ছে, মিত্রভেদ, মিত্রপ্রাপ্তি,কাকোলুক্য, লব্দনষ্ট, অসমপ্রেক্ষকারিতা। এগুলো আসলে নীতিশাস্ত্রের বই, যা একসময় পণ্ডিত বিষ্ণুশর্ম্মা কর্তৃক রচিত হয়েছিল।) এই সাধন প্রণালীর প্রথমেই বলা হয়েছে সুরতি ও নিরতি এই দুটির সমন্বয় সাধন করতে পারলে, এই বিহঙ্গম সাধনায় সিদ্ধি লাভ করা যেতে পারে। "সুরতি" বলতে বোঝায় অসাধারন বা বিশেষ দৃষ্টিশক্তি ।  এই অসাধারন দৃষ্টি শক্তির উন্মীলন হলে, নানান প্রকার দৃশ্য ও শব্দের অনুভব ঘটে থাকে। আর "নিরতি" কথাটার অর্থ হচ্ছে নির্বিকল্প ধ্যান। এই নির্বিকল্প ধ্যানে দৃশ্যের ভান থাকে না। 

আসলে এটি একটি মন্থনক্রিয়া। আমরা জানি মন্থন ক্রিয়ার সাহায্যে বস্তু থেকে তার নির্যাস বের করা সম্ভব। দই থেকে মাখন বের করতে গেলে যেমন ছড়ির সাহায্যে দধিকে মন্থন করতে হয়, তেমনি, এই যোগক্রিয়াতে দুটো জিনিসের সাহায্যে নিতে হয়, আর তা হচ্ছে সুরতি ও নিরতি। 

কায়াসিদ্ধি (২৪১ পাতা- সাধন ও সিদ্ধি)

দুই সিদ্ধ যোগীর মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে, একজন বলছেন, তোমার কাযা সিদ্ধি ঠিক ঠিক মতো হয়নি।  আর একজন বলছেন, পরীক্ষা করে দেখো। তো প্রথম জন হাতে তরবারি নিয়ে দ্বিতীয়  ব্যক্তিকে আঘাত করতে লাগলেন। দমাদম আঘাতের শব্দ শোনা যেতে লাগলো, কিন্তু শরীরে  আঘাতের কোনো চিহ্ন দেখা গেলো না। তো দ্বিতীয় ব্যক্তি বললেন, দেখেছো, আমার শরীরের কোনো ক্ষতি তুমি করতে পারলে ? প্রথম জন বললেন, আঘাতের কোনো চিহ্ন অবশ্য নেই কিন্তু আঘাতের শব্দ আমরা সবাই শুনতে পেয়েছি। কায়াসিদ্ধ পুরুষের দেহে আঘাত করলে কোনো আঘাতের শব্দ হতে পারে না।  তার মানে কোথাও একটা বাধা পাচ্ছে, তাই আঘাতের ফলে শব্দের উৎপত্তি হচ্ছে। তুমি এবার আমার শরীরে আঘাত করে দেখো কোনো শব্দ হয় কি না। তো দ্বিতীয় ব্যক্তি প্রথম জনের শরীরে তরবারির আঘাত করতে লাগলেন। কিন্তু কোনো আঘাতের ধ্বনি উৎপত্তি হলো না। 

দ্বিতীয় জন ভাবতে লাগলেন, তাহলে কি আমার কায়াসিদ্ধি ঠিক ঠিক মতো হয়নি ? ছুটলেন গুরুর কাছে, গুরু বললেন, তোমার অহঙ্কার এখনও নিঃশেষিত হয়নি। এই প্রথম পুরুষ হচ্ছে অললাম প্রভু, আর দ্বিতীয় জনের নাম যোগীরাজ্ গোরক্ষনাথ। আর গুরুদেব হচ্ছেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ।  

আপনারা সবাই  যোগীরাজ গোরক্ষনাথের কথা শুনেছেন। এই যোগী সাধকের তপস্যার কথা বা তার ঋদ্ধিসিদ্ধির কথা ভারত সহ  ভারতের বাইরেও ব্যাপ্ত হয়েছে। ইনি  ছিলেন যোগসিদ্ধ মৎস্যেন্দ্রনাথ মহাশয়ের যোগ্য শিষ্য। গোরক্ষনাথ ছিলেন কায়াসিদ্ধ পুরুষ। রসেশ্বর সাধনা কায়াসিদ্ধির একটা প্রাচীন পন্থা। শোনা যায়, জরা-মরনহীন সূক্ষ্ম দিব্যদেহ আশ্রয় করে, এই পন্থার সিদ্ধ যোগীগণ ত্রিলোকে বিচরণ করে থাকেন।  

আমরা সবাই বেঁচে থাকতে চাই।  অর্থাৎ আমরা সবাই এই স্থুল দেহের বিনাশ চাই না।  কিন্তু সত্য হচ্ছে, যার জন্ম আছে, তার মৃত্যু আছে। এই ধ্রুবসত্যকে আমরা স্বীকার করেও, এর থেকে আমরা সবসময় দূরে থাকবে চাই। দেহ বলতে আমরা বুঝি একটা হাড়-মাংস-রক্ত দিয়ে গড়া একটা অবয়ব বা মূর্তি। যা আমাদের মাতা-পিতা বা সৃষ্টিকর্তা তৈরি করে রেখেছেন। মহাত্মাগণ বলছেন, কর্ম্মফল ভোগের জন্য জীবাত্মা এই দেহ ধারণ করে থাকে। এই দেহ আমাদের কর্ম্মক্ষেত্ৰ, আবার ইন্দ্রিয়-লব্ধ বিষয় ভোগের আশ্রয় এই দেহ। বেদান্তে দেহকে তিন ভাগে  ভাগ করা হয়েছে, ভৌতিক দেহ, লিঙ্গ দেহ ও কারন দেহ। আবার কার্য্য-কারন ভেদে দেহকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে, একটা স্থুল আরেকটি সূক্ষ্ম। ভৌতিক দেহ প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল।  তথাপি যোগাচার্য্যগন বলছেন,  আমরা মন্ত্র, ঔষধ এবং তপঃ সাধনার দ্বারা এমনকি উপাসনা যোগক্রিয়া ও জ্ঞানপ্রভাবে অথবা অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় দ্বারা  যদি শরীরকে বিমল করতে পারি, তাহলে নাকি নশ্বর এই দেহ অবিনাশী হতে পারে। এইসব কথা আমাদের কাছে কল্পনা বিলাস মাত্র, যোগীপুরুষের কাছে এগুলো অনুভবসিদ্ধ বলা হচ্ছে। অনুসন্ধ্যিৎসু পাঠক  কালদহন তন্ত্রে ও মৃত্যুঞ্জয় তন্ত্রে এর বিবরণ দেখতে পারেন। 

পাতঞ্জল দর্শনের বিভূতিপদে শ্লোক নং ৪৫ এ বলা হয়েছে "ততো-অনিমাদি-প্রাদুর্ভাবঃ কায়সম্পদৎ তৎ-ধর্ম্ম-অনিভিঘাতঃ-চ" . অর্থাৎ ভূতকে জয় করতে পারলে, অনিমাদি অর্থাৎ অষ্টসিদ্ধির উৎপন্ন হয়। কায় বা শরীর ধর্ম্মের বাধাশূন্যতা সিদ্ধ হয়। 

অষ্টসিদ্ধি হচ্ছে, অনিমা - শরীরকে অনু করা যায়, ২) লঘিমা - শরীরকে লঘু করা যায়, ৩) মহিমা- অর্থাৎ মহান বা বিরাট হওয়া যায়, ৪) প্রকাম্য - অর্থাৎ ইচ্ছার বাধা অপসারণ করা যায়, যেমন আমি যদি জলে ডুবে থাকতে চাই, এমনকি ভূমিতে ডুবে থাকতে চাই, তবে তাই সম্ভব ৫) বশিত্ব অর্থাৎ ভৌতিক ও অভৌতিক সমস্ত দ্রব্য নিজের বশে নিয়ে আসা। ৬) ইশিতৃত্ব হলো ভূত বা ভৌতিক দ্রব্যগুলোর দ্রব্যগুলোর উৎপন্ন ও বিনাশ ও স্থিতি নিজের ইচ্ছেমতো করা। ৭) সত্যসঙ্কল্পতা - অর্থাৎ সংকল্প অনুযায়ী ভূত ও প্রকৃতির অবস্থান এবং ৮) যত্র -কামাবসায়ী - অর্থাৎ      

ঋষি পতঞ্জলি বলছেন,  রূপ, কমনীয়তা, বল, বজ্রহননত্ব (হীরেকে ছেঁদা করবার মতো দৃঢ়তা) এগুলো হচ্ছে, আমাদের শরীরের সম্পদ। "রূপ-লাবণ্য-বল-বজ্রহননত্বানি কায়সম্পদ" - বিভূতিপাদ -শ্লোক-৪৬। 

আমরা পাতঞ্জল যোগদর্শনে দেখছি, ভূত্সকল পঞ্চস্বভাব যুক্ত। "গ্রহণ-স্বরূপ-অস্মিতা-অন্বয়-অর্থবত্ব-সংযমাদি-ইন্দ্রিয়-জয়ঃ" বিভূতিপাদ শ্লোক নং - ৪৭ অর্থাৎ গ্রহণ, স্বরূপ, অস্মিতা, অন্বয়, ও অর্থবত্ত্ব এগুলো হচ্ছে ইন্দ্রিয়ের স্বরূপ।  এই স্বরূপের উপরে সংযম করলে ইন্দ্রিয় জয় করা যায়। 

গ্রহণ: শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ে যে বৃত্তি তাকে বলা হয় গ্রহণ। অর্থাৎ দৃশ্যমান পৃথিবী, দৃশ্যমান জল, দৃশ্যমান তেজ, দৃশ্যমান বায়ু, দৃশ্যমান আকাশ এগুলো সবই স্থূল অবস্থা বা রূপ। 

স্বরূপ : ইন্দ্রিয় উৎপন্ন হয়ে সাত্ত্বিক-অহংকার থেকে।  আর সাত্ত্বিক অহংকার উৎপত্তি হয়ে প্রকাশাত্মক বুদ্ধি থেকে। এই প্রকাশ ধর্ম্মকে বলা হচ্ছে স্বরূপ-অবস্থা। পৃথিবীর কঠিনতত্ব, জলের স্নিগদ্ধতা, শীতলতা  বা আদ্রতা, অগ্নির দহন-শক্তি, বায়ুর স্পর্শশক্তি, আকাশের ব্যাপকত্ত্ব - এগুলো হচ্ছে ভূতের স্বরূপ।   

অস্মিতা : অস্মিতা বা অহংকার।  প্রকাশ ধর্ম্মের সঙ্গে সাত্ত্বিক অহংকার হচ্ছে অস্মিতা। এটি পঞ্চভূতে সূক্ষ্ম অবস্থায় টানমাত্রা বা পরমাণু। 

 অন্বয় :  প্রত্যেকটি ভূত ত্রিগুণাত্মক হওয়ায়, প্রকাশত্ব, প্রবৃত্তত্ব ও স্থিতিত্ত্ব হওয়ায় এটি অন্বয়িত্ব।  

অর্থবত্ত্ব - গতিশীল, অন্বয় - যাকে বিভাজন করা যায় না, সূক্ষ্ম - ক্ষুদ্র  যা দৃষ্টিগোচর নয়, স্বরূপ - যার নিজস্বতা অপরিবর্তনীয়, স্থুল - প্রাকৃত। 

এখন এই পঞ্চভূতের এই পঞ্চভূত স্বরূপে সংযমের দ্বারা যোগী অনিমা-লাঘিমা ইত্যাদি আট  প্রকার সিদ্ধি লাভ করতে পারেন। ভূত জয় হলে, একদিকে যেমন যোগীর রূপ-লাবণ্য বৃদ্ধি পায় , তেমনি শরীর  বজ্রবৎ দৃঢ় হয়। দেহ সিদ্ধ হলে নাকি, জরা ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকা যায়, এমনকি অজর অমর হওয়া যায়।

এখন কথা হচ্ছে, এটি কিভাবে সম্ভব ? এই পঞ্চভূতের একত্রীকরণের ফলে এই স্থুল জগৎ দৃশ্যমান হয়েছে। কিন্তু এই ভূতাত্মক অবয়ব-এর মধ্যে থেকে আমির অর্থাৎ আত্মার বিয়োগ হলেই, পঞ্চভূত স্বরূপে ফিরে যায়। এই আত্মজ্যোতি যেন এই পঞ্চভূতকে একত্র করে রাখবার জন্য আঠা-র কাজ করছে। এই আঠা-র নিষ্ক্রান্ত হলেই, পঞ্চভূতে সুক্ষ অবস্থায় ফিরে যায়। আবার প্রত্যেকটি বস্তুর তিন অবস্থা অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ।  

আমরা ভালো থাকবো কি করে ? মানস ক্রিয়া। 

সারা পৃথিবী জুড়ে একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটে চলেছে । যার কোনো ব্যাখ্যা আজ পর্যন্ত কোনো বৈজ্ঞানিক সঠিক ভাবে দিতে পারেন নি। আবার  এর মধ্যে একটা মনস্তাত্মিক পীড়ন আমরা বছর দুই ধরে লক্ষ করছি। আমাদের ভালো রাখার জন্য, আমাদের ভালো করবার জন্য, সরকার থেকে শুরু করে  চিকিৎসকদের একাংশ উঠে পড়ে  লেগেছেন । আপনি চান আর না চান, আপনাদের ভালো না করে ছাড়বেন না। বলছেন, তোমরা কেউ ভালো নেই, তোমরা কেউ সুরক্ষিত নয়, এসো তোমাকে সুরক্ষা কবচ দিয়ে দেই। আর এই কারণেই এর মধ্যেই  কোটি কোটি টাকার ভ্যাকসিন সরকারি খরচে আমাদের শরীরের মধ্যে একাধিকবার প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরো হচ্ছে। এক ভদ্রলোক শুনলাম, ১১-বার ভ্যাকসিন নিয়েছেন।  ঈশ্বর এদের মঙ্গল করুন। টেলিফোন খুললেই, সতর্কবাণী শুনতে পাচ্ছি - যা আসলে  সতর্কীকরণের বদলে আমাদের কাছে বিরক্তির কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা কাজ হারিয়ে উদ্ভ্রান্ত হয়ে গেছি। আমরা দুঃখী, আমরা উদ্বিগ্ন, আমরা আশঙ্কিত, আমরা ভয়ার্ত হয়ে কোনো রকমে নাকেমুখে কাপড় গুঁজে বেঁচে থাকবার চেষ্টা করছি। আর এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মধ্যে একদল শুধু টাকার হিসেবে কষছেন । 

ভাবছিলাম, লক্ষকোটি মানুষ দুঃখী, আর কয়েকশ মানুষ সুখী। লক্ষকোটি মানুষ দরিদ্র, দুর্দশাগ্রস্থ ভীত, সন্ত্রস্ত, উদ্বিগ্ন, আর গুটিকয় মানুষ নিজের প্রতি  আস্থাবান, দৃঢ় বিশ্বাসী। কেন হাজার-কোটি মানুষের শরীরে রোগ-ব্যাধি, আর কয়েকজন মাত্র স্বাস্থবান। কেন হাজারকোটি মানুষ ধর্ম্মিক হয়েও অসুখী, আবার কিছু মানুষ অধার্ম্মিক হয়েও বিলাসিতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। আমরা এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো। সমাধানের রাস্তাও  খুঁজবো। 

দেখুন আমাদের সবার শরীরে আছে সেই শক্তি যা আমাদের শরীরকে ভালো রাখতে পারে। আমাদের মনের মধ্যে আছে সেই শক্তি যা আমাদের সবাইকে জীবনের সাফল্যের দ্বার পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে। এই শক্তি সম্পর্কে আমরা হয়তো জানি, বা হয়তো জানি না।  কিছু এই শক্তি ক্রিয়া করে চলেছে অবিরত। আপনার মধ্যে যেমন শ্বাস প্রশ্বাস তার নিজস্ব গতিতে শরীরের মধ্যে যাতায়াত করছে, তেমনি আমরা জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে মনের মধ্যে চিন্তার জাল বিস্তার করে চলেছি। 

শ্বাস-প্রশ্বাসের গতির সঙ্গে ঘোরা  ফেরা করছে, আমাদের বাঁচার দাওয়াই, আবার এই শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে ঘোরা  ফেরা করছে, জীবন নাশের ভয়ঙ্কর ভাইরাস। অন্যদিকে আমাদের মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে সদর্থক চিন্তা, আবার এই মনের মধ্যেই ঘোরাফেরা করছে নঞৰ্থক চিন্তা। সদর্থক চিন্তা আমাদের সাফল্যের চাবিকাঠি।  আবার নঞৰ্থক চিন্তা আমাদের উদ্বেগের কারন।  জীবনের বিফলতার কারন। 

তো আপনি আগে ঠিক করে নিন - আপনি কি চান ? সুস্থ শরীর না ব্যাধিগ্রস্থ শরীর। উদ্বেগহীন জীবন না দুশ্চিন্তাগ্রস্থ জীবন। আপনি হয়তো বলবেন, আমরা কেউ ব্যাধিগ্রস্থ শরীর  চাই না। আমরা কেউ দুশ্চিন্তাপুর্ন জীবন চাই না। আমরা কেউ দরিদ্র হতে চাই না। আমরা কেউ দুঃখের ভিতরে জীবন কাটাতে চাই না।  আমরা কেউ উদ্বিগ্ন হতে চাই না।  আমরা কেউ ভয়ার্ত জীবন চাই না। খুব  সত্যিকথা, আমরা কেউ খারাপ  কিছুই চাইনা কিন্তু সত্য হচ্ছে, আমাদের জীবনে খারাপটাই  ঘটে চলেছে।

আসলে দুঃখের ফেরিওয়ালারা, করোনার ফেরিওয়ালারা, অমিক্রমের পসার  নিয়ে, ডেল্টার ঝুড়ি নিয়ে,  রাস্তা দিয়ে হাঁক ছেড়ে  দিয়ে যাবে। এটাই এই সংসারের নিয়ম। কিন্তু আপনি তাকে ডেকে বাড়ির মধ্যে নিয়ে আসবেন কি না, সেটা আপনার ব্যাপার। মানুষের মধ্যে একটা অদ্ভুত প্রবৃত্তি হচ্ছে, আমরা কেউ একদিকে যেমন নিজে ঠকতে  চাই না, আবার অন্য দিক দিয়ে আমরা সুযোগ পেলেই অন্যকে ঠকাতে চাই। আমাদের এইযে অন্যকে ঠকানোর দুস্টু প্রবৃত্তি, আখেরে এই প্রবৃত্তি আমাদের সবাইকেই ঠকাচ্ছে।  আর আমরা সবাই ঠকছি। কিন্তু আমরা এই সত্যকে ধরতে পারি না। 

তো যে কথা বলছিলাম, আপনি কি চান সেটা আগে ঠিক করুন। আর সেই মতো ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করুন। প্রার্থনার কথা শুনলেই, আপনি হয়তো বলবেন, প্রার্থনা তো করি, কিন্তু শুধু প্রার্থনায় কি কিছু পাওয়া যায় ? শুধু প্রার্থনায় কি মানুষের শরীর ভালো থাকতে পারে।  শুধু প্রার্থনায় কি রোগ ভালো হতে পারে ? শুধু প্রার্থনায় কি জীবনে সাফল্য আসতে  পারে ? আমি বলছি, হ্যাঁ পারে, যদি আপনি ঠিক ঠিক ভাবে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রার্থনা করতে পারেন, তবে অবশ্য়ই সাফল্য আসবে। । আপনার সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, যদি আপনি মন-প্রাণ দিয়ে প্রার্থনা করতে পারেন। আপনি বেদ পড়েছেন ? সেখানে দেখবেন, শুধুই প্রার্থনা আর প্রার্থনা।  ঈশ্বরের স্তুতি আর প্রার্থনা। আমি কখনোই মনে করি না যে প্রার্থনা করলে, ভগবান কারুর বাসনা অপূর্ন রাখেন।  সমস্ত বাসনা তার পূরণ হয়ে যাবে যদি সঠিক উপায়ে প্রার্থনা করতে পারেন। আর এই সত্য আমাদের প্রাচীন মুনিঋষিগন সম্যক উপলব্ধি করেছিলেন। তাই আমাদের প্রাচীন জ্ঞান-গ্রন্থ বেদের মধ্যে প্রার্থনা আর প্রার্থনা।  প্রার্থনা কিভাবে কার্যকরী হয়, সে সম্পর্কে আগে একদিন আমি প্রার্থনার বৌজ্ঞানিক ব্যাখ্যার কথা বলেছিলাম। আজ আর সেই বিষয়ের দিকে যাবো না। 

ব্যক্তিগতভাবে আমি এমন অনেকের  সঙ্গে পরিচিত, যারা  তাদের  শারীরিক অসুস্থতা  নিজের ভিতরের ঐশ্বরিক শক্তি দিয়েই ঠিক করে নেন ।  ফলতঃ  তাঁরা  ডাক্তারের উপরে মোটেই নির্ভরশীল নয় । একটা কথা জানবেন, ডাক্তার ঔষধ দেয়, ব্যান্ডেজ করে সত্য কিন্তু রোগ নিরাময় করে স্বয়ং রোগী।   ডাক্তারের কাছে  সেইদিন যান, যেদিন আমার মৃত্যুর শংসাপত্রের দরকার পড়বে । কারন এটা শ্মশান ঘাটে কাজে লাগবে। আমার এই বন্ধুরা   শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করেই শরীরকে সুস্থ রাখতে পারেন । তো এঁরা  যদি পারেন, তবে আপনিও অবশ্য়ই পারবেন। সকাল সন্ধ্যে আধাঘন্টা করে আপনি প্রাণের সঙ্গে সময় কাটান। প্রাণের কাছে প্রার্থনা করুন, তবেই দেখবেন, অলৌকিক ভাবে আপনিও অবশ্যই শারীরিক দিক থেকে ভালো থাকবেন। (ভস্ত্রিকা, কপালভাতি, উজ্জায়ী, অগ্নিসার, অনুলোম-বিলোম, ভ্রামরী, উদ্গীথ ও ব্রাহ্ম-প্রাণায়াম ) এর মধ্যে কাপালভাতি ও অনুলোম বিলোম ১০ মিনিট করে করুন, বাকি গুলো ২ মিনিট করে করতে থাকুন। সঙ্গে  সঙ্গে প্রাণায়ামের পিতা দেবাদিদেবকে শিবরুপি বিশ্বশক্তিকে  স্মরণ করুন, তাঁর কাছে ভালো থাকবার জন্য প্রার্থনা করুন। দিনে দুবার, ২৪ ঘন্টার মধ্যে মাত্র ১ ঘন্টা শরীরের জন্য দিন, আর বাকি ২৩ ঘন্টা আনন্দে কাটান। আপনি অবশ্য়ই  ভালো থাকবেন, একথা হলফ করে বলা যায়। 

দ্বিতীয় প্রক্রিয়া : প্রথমে আপনাকে বুঝে নিতে হবে, কীভাবে আপনার শরীরের সমস্ত কাজ অবচেতন মন নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এটি প্রথমে কল্পনা করতে হয়। বিশ্বাস করতে হয়। দেখুন আপনি যখন জেগে থাকেন, বা শুয়ে থাকেন, তখন আপনার অবচেতন মন আপনার শরীরের সমস্ত অত্যাবশ্যক  কাজ করে থাকে।  আপনার হৃদয় ছন্দবদ্ধ ভাবে টিক-টিক করছে। আপনার ফুসফুস নিয়মিত বায়ু গ্রহণ করছে, শোধন করছে, আবার ছেড়ে দিচ্ছে। বাতাস থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করছে।  সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে দিচ্ছে।  খাদ্য থেকে রক্ত তৈরী করছে। অপ্রয়োজনীয় মলাদি শরীর থেকে বের করে দিচ্ছে। আপনার শরীরের মধ্যে গ্রন্থিসকল রস ক্ষরণ করছে। এগুলো সবই আপনার প্রয়াস ছাড়াই সংগঠিত হচ্ছে। এমনকি হাঁচি দিয়ে ভাইরাসকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।  তা সে আপনি বিশ্রামে থাকুন, শুয়ে থাকুন বা শারীরিক কোনো ক্রিয়ার মধ্যে থাকুন, এমনকি আপনি ঘুমিয়ে থাকুন - অর্থাৎ সারাক্ষন এইসব আবশ্যিক ক্রিয়া আপনাকে আপনার শরীরকে প্রাণবন্ত করে রেখেছে। আপনি জোর করে এই কাজগুলো করতে পারতেন না।  আপনাকে কিছু খাবার দিয়ে, যদি  বলা হতো, এবার এর থেকে আপনি রক্ত বার করুন, বা হজম করুন, তাহলে অসহায় হয়ে যেতেন।  কারন এসম্পর্কে আপনি কোনোদিন কিছুই করেন নি, বা আপনাকে কিছুই করতেও  হয়নি। এগুলো সব ঐশ্বরিক শক্তি থেকেই সম্পন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু যদি আপনি এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে যান, তবে আপনার শরীর ভারসাম্য হারাবে। ধরুন, আপনি কোনোদিন ট্রাক চালাননি।  এখন হঠাৎ যদি আপনি চলন্ত  গাড়িতে ড্রাইভারের সিটে জোর করে  বসতে চান, তবে ড্রাইভার ব্যালান্স হারিয়ে ফেলবে। এবং ট্রাকটি বিপথে চালিত হবে। তো আপনি গাড়ি চালাতে পারেন না, কিন্তু গাড়িকে বিপথে চালাতে পারেন। ড্রাইভারকে বিব্রত করতে পাবেন। ঠিক তেমনি আপনার যে দুশ্চিন্তা, আপনার যে ভয়, আপনার যে উদ্বেগ, আপনার যে বিষণ্ণতা - এগুলো আপনার শরীরের স্বাভাবিক ক্রিয়া করতে সাহায্য করতে পারে না, কিন্তু আপনার শরীরকে বিপদে ফেলতে পারে, অর্থাৎ বিপথে চালিত করতে পারে। তো আমাদের শরীরের রোগ হচ্ছে, আমাদের  চেতন মনের চিন্তা।   আমাদের চেতন মন,  অবচেতন মনের কাজ তো করতে পারে না, কিন্তু চেতন মনের চিন্তা অবচেতন মনের কাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যারা আমাদের ভালো কাজগুলো করে দিতে পারেন না, কিন্তু ভালো কাজের বাধা স্বরূপ হয়ে উঠতে ওস্তাদ। আর এদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে,  আমরা যখন দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হই, আমরা যখন ভীত-সন্ত্রস্ত  হই, আমরা যখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি,  আমরা যখন বিষণ্ণ হই   তখন আমাদের হৃদয়, ফুসফুস, পাকস্থলী, অন্ত্রের যে স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপ তা ব্যাহত হয়। আর আমাদের শরীর রোগগ্রস্থ হয়ে পড়ে । এই কাজটাই করছেন, আমাদের রাষ্ট্রনেতাগণ, আমাদের একশ্রেণীর চিকিৎসকগন।  আমাদেরকে এরা  বিভিন্ন রকম তথ্য দিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত করছেন, আশঙ্কাগ্রস্থ করছেন, তা সে জ্ঞাতসারেই  হোক বা অজ্ঞাতসারেই হোক । ফলত  বিশ্বস্বাস্থ্য আজ বিপর্যয়ের মুখে। সমস্ত বিশ্বের স্বাস্থ্যব্যবস্থা আজ ভেঙে পড়েছে। 

তো যা বলছিলাম, আমাদের অবচেতন মন সারাক্ষন তার নিজস্বভঙ্গিতে কাজ করে চলেছে। আর এই অবচেতন মনই আপনার শরীরের নির্মাতা, আপনার অবচেতন মনই আপনার শরীরের রক্ষাকর্তা। আপনার যে বাহ্যিক কর্ম্ম তা আপনার চেতন মনের কাজ। এই চেতন মনের কাজ প্রভাবিত করে অবচেতন মনকে। আমরা যদি আমাদের চেতন মনের চিন্তাধারাকে বদলে দিতে পারি, আর সেগুলো যদি হয় সত্যসন্ধানী, সেগুলো যদি হয় ঈশ্বর প্রত্যাশী, সেগুলো যদি হয় সুন্দরের পিয়াসী, তবে আমাদের শরীরের মধ্যে একটা সমন্বয় সাধন হতে পারে। 

এখনই শুরু করুন আপনার অবচেতন মনকে যত্ন নেওয়া। একটা জিনিস জানবেন, আপনার অবচেতন মন আপনার চেতন মনের চিন্তার অভিব্যক্তি করে থাকে। অর্থাৎ আপনার চেতন মন যা কিছু চিন্তা করছে, তা একসময় অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে। তো এই অভ্যাসগুলোকে আপনি আপনার ভিতরের বিবেকগুরুর কাছে থেকে বিচার বিশ্লেষণ করে, আত্মার চাহিদা অনুযায়ী চিন্তাকে প্রসারিত করুন। বিশ্বাস করুন, আপনার শরীরের আরোগ্যের চাবিকাঠি ওই অবচেতন মনের কাছে আছে। এবং এই চিন্তা প্রবাহিত হতে দিন। 

প্রতিদিন তা সে যে কাজের মধ্যেই থাকুন না কেন, এমনকি ঘুমুতে যাবার আগে, ভাবতে থাকুন, শারীরিক ভাবে খুব ভালো আছি। আমার পায়ের পাতা ভালো আছে, আমার গোড়ালি ভালো আছে, এইভাবে ধীরে ধীরে পায়ের পাতা থেকে মাথার চুলের অগ্রভাগ পর্যন্ত মনকে ছুঁতে  নিন। ভিতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যার সম্পর্কে আপনার সামান্য ধারণা  আছে, যেমন,মাথার তালু, উর্দ্ধ মস্তিস্ক, মধ্যে মস্তিস্ক, নিম্ন মস্তিস্ক, মেরুদন্ড,  চোখ,কান, নাক,  মুখ, জিহ্বা, কন্ঠনালী, হাত, হাতের কনুই, হাতের পাতা, হাতের আঙ্গুল, বুক, ফুসফুস, হৃদয়, পাচনযন্ত্র, নাভি, লিভার, অন্ডকোষ, কোমড়, থাই, হাটু, পা, পায়ের পাতা, পায়ের আঙ্গুল - ইত্যাদি সমগ্র শরীর-যন্ত্রটাকে একবার করে মনের সঙ্গে মিলিয়ে নিন। আর খুব-ভালো আছি এই চিন্তা করতে থাকুন।  শ্বাস গ্রহণের সঙ্গে  সঙ্গে ভাবুন,  বিশ্বশক্তি আমার ভিতরে প্রবেশ করছে, আবার শ্বাস বেরুবার  সঙ্গে সঙ্গে চিন্তা করুন,আমার ভিতরে যে বিষদ্রব্য ছিলো  তা বেরিয়ে যাচ্ছে। শুভ শক্তি ঢুকছে, অশুভ শক্তি বেরিয়ে যাচ্ছে। শ্বাস নিচ্ছি, মানে আত্মশক্তি ভিতরে প্রবেশ করছে, আবার শ্বাসের বেরিয়ে যাবার সময় চিন্তা করুন আত্মশক্তি বেরিয়ে যাচ্ছে।  শ্বাসের সঙ্গে আমার জন্ম হচ্ছে, প্রশ্বাসের সঙ্গে আমার মৃত্যু হচ্ছে। আমি জন্ম মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছি। প্রতিদিন দুমিনিট মৃত্যু চিন্তা করুন। এই প্রক্রিয়ায় আপনার শরীর  ভালো থাকবে। মন ভালো থাকবে, এমনকি আপনার মধ্যে যে অভাববোধ, উদ্বিগ্নতা, ভয়, আশঙ্কা ছিলো তা ধীরে ধীরে দূর হয়ে যাবে। একটা জিনিস জানবেন, হয় না, বললে কোনো কিছুই হয় না, হয় বললে একদিন অবশ্য়ই হবে। পারি না বললেন, কোনোদিনই পারবেন না, কিন্তু যদি বলেন পারি, তবে অবশ্যই  একদিন না একদিন আপনি পারবেন। তবে রাতারাতি হবে, এমনটা আমি বলবো না, অপেক্ষা নিশ্চয় করতে হবে। তবে এটা জানবেন, এই প্রক্রিয়ার সফলতা দ্রুত সংগঠিত হবে।  এমনকি এক্ষুনিও হতে পারে। 

 আপনার শরীরের বিশেষ অঙ্গে যদি কোনো যন্ত্রনা, অনুভব করেন, বা আপনার কোনো অঙ্গ  যদি অসুস্থ থাকে তবে সেখানে আপনার মনটাকে নিয়ে যান, আর মনে মনে বলুন, হে পরমাত্মা পরমেশ্বর আমার এই অঙ্গ অসুস্থ বোধ করছে, তুমি একে  তোমার শক্তি দিয়ে সুস্থ করে তোলো। মনে মনে প্রার্থনা করুন বিশ্বশক্তির কাছে, দেখবেন, তিনি অবশ্য়ই আপনাকে ভালো করে দেবে। আপনি চোখের  সমস্যা অনুভব করছেন, প্রতিদিন, খাবার পরে ঠান্ডাজলের ছিঁটে দিন, আর মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করুন, আপনার চোখের সমস্যা দূরকরবার জন্য। আপনি যে অঙ্গে অসুবিধা মনে করছেন, সেই অঙ্গে হাত দিয়ে স্পর্শ করুন, মনে মনে বলতে থাকুন, হে ঠাকুর তোমারই দেওয়া এই অঙ্গ অসুস্থ বোধ করছে,  তুমি সুস্থ -সবল-ক্রিয়াশীল করে দাও। আপনি প্রতিদিন খাবার খাচ্ছেন - খাবার মুখে তোলার আগে, ঈশ্বরকে বলুন, খাবার আমি খাচ্ছি  না, তুমি আমার মাধ্যমে খাবার খাছ।  এই শরীর  তোমার বাসস্থান। তুমি খাবার গ্রহণ করছো।   

এই যে কথাগুলো বললাম, এটি কোনো কাল্পনিক কাব্যগ্রন্থের রচনা নয়। এটি আমার জীবনে বাস্তব সত্য। এর জন্য আপনাকে কোনো টাকা-পয়সা খরচ করতে হবে না। আপনাকে কোনো গুরুদেবের কাছে যেতে হবে না।  আপনার দৈনন্দিন কাজের মধ্যে সামান্য সময় বের করে, এই প্রক্রিয়া করতে পারেন। যেখানে যে অবস্থায় থাকুন না, আপনি এই মানস-ক্রিয়া  থেকে যদি সরে না যান, তবে জানবেন, ঈশ্বর আপনার সহায় হবেন। এই উপলব্ধি আপনি উপভোগ করতে পারবেন। অবশ্য়ই পারবেন।  শুধু শুরু করে দেখুন। 

------------------

সংকল্প, প্রার্থনা ও সিদ্ধি 

শ্রী শ্রী পরমহংস যোগানন্দের একটা বই পড়ছিলাম - সেখানে সংকল্পের মাধ্যমে রোগ নিরাময়ের কথা বলা হয়েছে। এই সংকল্প বা প্রার্থনা কি মানুষের জীবনে সত্যিই কি কোনো উপকারে করতে পরে ?   বিশেষ করে বাস্তব জীবনে এর কি কোনো ভূমিকা আছে  ? দেঝুন সংকল্প ও প্রার্থনার মধ্যে আমরা  কোনো পার্থক্য দেখি না। সংকল্প করতে হয়, নিজের কাছে, আর প্রার্থনা করতে হয় ঈশ্বরের কাছে।  এখন কথা হচ্ছে,  ঈশ্বর যে আছেন, তার কোনো প্রমান আমাদের  কাছে নেই। আর যদি থেকেও থাকেন, তিনি আমার  প্রার্থনার কথা শোনেন, কি না - তা আমি বুঝবো কি করে ? আর এই দুটোর অর্থাৎ ঈশ্বরের অস্তিত্ত্ব ও  আর ঈশ্বর আমাদের প্রার্থনা শোনেন কি না, এর কোনো প্রতক্ষ্য প্রমান আমাদের কাছে নেই। এখন এইসব তর্কের কোনো মীমাংসাও  কোনোদিনই হবার নয়। ঈশ্বর বিশ্বাসীগন  বলবেন, প্রার্থনায় কাজ হয়, আর যুক্তিবাদীগণ বলবেন, শুধুই মুখের কথায় কোনো কাজ হয় না। প্রার্থনায় কি হয়, আর কি না হয়, এগুলো কেবলমাত্র ব্যক্তিগত অনুভূতির মধ্যে ধরা দেয়। একটা কথা বলা যেতে পারে যে, প্রার্থনা বা সংকল্প একজন মানুষকে এতটাই আত্মবিশ্বাস এনে দিতে পারে, বা একটা মানসিক শক্তি এনে দিতে পারে, যা অনেক অসাধ্য সাধন করতে পারে। এই কথা যুক্তিবাদীদের কাছে অস্বীকারের কোনো জায়গা নেই। এক্ষেত্রে যুক্তিবাদীদের বক্তব্য হচ্ছে, মানুষের অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে মানুষ যা চাইবে তাই  করতে পারে। মানুষের অসাধ্য কিছু নেই। ঈশ্বর-ফিশ্বর কিছু নয়, মানুষের মধ্যেই আছে অসীম শক্তির ভান্ডার, সেই শক্তি সম্পর্কে সে সচেতন নয়, কিন্তু প্রার্থনা তাকে সচেতন করে তুলতে পারে। কথায় বলে যে খোঁজে সে পায়। এই খোঁজার কাজ শুরু হতে পারে সংকল্প বা প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে। প্রার্থনার জন্য চাই মনকে একাগ্র করা। আমাদের যে কর্ম্ম-ক্ষমতা  আছে, তাকে কাজে লাগানো। 

প্রার্থনা আর কিছুই নয়, কিছু শব্দের সমষ্টি। কিছু অর্থবহ শব্দের সমষ্টি। মুখের ভাষার বা শব্দের একটা বিশেষ গুরুত্ত্ব আছে। এই ভাষা আমাদের কাছে টানতে পারে, এই ভাষাই  আমাদেরকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে। ভাষাই বহু সমস্যার জন্মদাতা, আবার ভাষাই  বহু সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে।   

দূরে কোথাও গোঙানির আওয়াজ হচ্ছে, আওয়াজ শুনে ধীরেনবাবু এগিয়ে গেলেন।  গিয়ে দেখলেন, ক্ষত-বিক্ষত একটা মেয়ে মাটিতে শুয়ে কাতরাচ্ছে। ধীরেনবাবু তাকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন । তো একটা আওয়াজ বা শব্দ, দেখুন একটা মানুষকে প্রকান্তরে ভালো করে দিলো।  জঙ্গলের মধ্যে দূরে কোথাও বাঘের আওয়াজ শোনা গেলো, আওয়াজ শুনে, মধুসংগ্রহকারীগন পাততাড়ি গুটিতে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটলো। তো শব্দ মানুষকে বাঁচানোর পথ দেখাতে পারে, শব্দ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যেতে  পারে।  এখন কথা হচ্ছে এই প্রার্থনা কি আমাদের শারীরিক রোগ নিরাময়ে সাহায্য করতে পারে ? বা আমাদের কোনো বঞ্চিত ফল এনে দিতে পারে ?   

আমরা শুনছি শব্দই ব্রহ্ম।  শব্দ নাকি আমাদের আত্মা। আমাদের সমস্ত চিন্তা একধরনের কম্পনের  সৃষ্টি করে। আর কম্পন থেকে শব্দ ধ্বনিত হয়। তো চিন্তা হচ্ছে কম্পন, যা আত্মা থেকে উদ্গত হয়। ভাষার মধ্যে একটা ঐশ্বরিক শক্তি নিহিত আছে, একথা স্বীকার করতেই হয় । তাই আমাদের চিন্তা বা শব্দ আত্মিক বা ঐশ্বরিক শক্তি দ্বারা শক্তিশালী হয়ে থাকে। আবার এই শব্দ  যখন বাচালতায় পরিণত হয়, এই শব্দের মধ্যে ঐশ্বরিক শক্তির প্রকাশ দেখা যায় না। 

ভাষার মধ্যে যখন  বিশ্বাস, প্রত্যয় ও ঐকান্তিকতা থাকে, তখন যে কম্পন সৃষ্টি হয়, তা সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে ছাড়িয়ে  অভিলষিত পরিবর্তন আনতে  পারে। তাই কথা বলার সময় আমাদের সতর্ক থাকা উচিত। অসত্য বাক্যকে সবসময় এড়িয়ে চলুন।  এমনকি অপ্রিয় সত্য বাক্যকেও এড়িয়ে চলা ভালো । আপনি যখন আপনার মনের কথা বা সংকল্প  যথাযথ ভাবে হৃদয়ের অনুভূতি দিয়ে বারবার উচ্চারণ  করতে পারবেন, তখন বাক্যের স্পন্দনশীল শক্তি সক্রিয় হয়ে উঠবে। যে বিষয়ে আপনার বিশ্বাস নেই, যাতে আপনার সন্দেহ আছে, সেইসব কথা উচ্চারণ না করাই ভালো।   এমনকি সেই সব ভাব মনের মধ্যে আসতে না দেওয়াই উচিত। সন্দেহকে পরিত্যাগ করে অটল বিশ্বাসের সঙ্গে বিশ্বশক্তির কাছে নিরন্তর প্রার্থনা করে দেখুনতো, কোনো ফল হয় কি না ?  সময়ের দিকে তাকাবেন না। কবে আপনার সংকল্প কার্যকরী হবে, তা নিয়ে সন্দেহ, মনে দানা বাঁধতে দেবেন না। শুধু প্রার্থনা আর  অপেক্ষা করতে থাকুন  আপনার সমস্ত সংকল্প বাস্তবে রূপায়িত হবে, একথা সমস্ত দেবমানুষগন বলে গেছেন । বিশ্বশক্তি একসময় চৈতন্যরূপ মাটিতে আপনার প্রার্থনা-রুপী  বীজটিকে গ্রথিত করে দেবেন । আর যেকোনো বীজের অংকুরে পরিণত হবার জন্য, একটা নির্দিষ্ট  সময় আছে, সেই সময়ের পরে  অবশ্য়ই বীজ থেকে গাছের জন্ম হবে। মহাত্মাগণ বলছেন, প্রার্থনার কখনো  বিরতি টানবেন না। ঐশ্বরিক শক্তিকে অবিচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করবার সুযোগ করে দিন। 

ঐশ্বরিক শক্তির থেকে মহান আর কিছু নেই। শুধু তাঁরই কৃপাপ্রার্থী হয়ে, ঈশ্বরমুখী হয়ে অপেক্ষা করুন। অবশ্য এর মানে এই নয় যে, আপনি ঈশ্বরমুখী হয়ে নিস্কর্মা হয়ে যাবেন। বা কেবলমাত্র সরল বিশ্বাসে ঈশ্বরমুখী হয়ে অপেক্ষা করবেন। ঈশ্বর আপনার ভিতর থেকেই কাজ করবে। তাই নিজেকে বিবেকের নির্দেশে কর্ম্মে নিযুক্ত করুন। একটা কথা মনে রাখবে, ঈশ্বর তাকেই সাহায্য করে, যে চেষ্টা করে। ঈশ্বর কখনো অনাধিকারীকে কিছু দেন  না, ঈশ্বর অধিকারীর খোঁজ করেন। আপনার দৈহিক ও মানসিক ক্লেশ দূর করবার জন্য, আপনার মধ্যে ঈশ্বর ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন।  সেই ঈশ্বরপ্রদত্ত  ইচ্ছেশক্তি যুক্তি-বিচার  দিয়ে বিশ্বাস ও একাগ্রতার সাথে কাজে লাগান। ঈশ্বরের কাছে যেমন প্রার্থনা করতে হবে, তেমনি ভগবান আমাদের যে শারীরিক শক্তি, মানসিক শক্তি দিয়েছেন, তার সদ্ব্যবহার করতেও  হবে। 

যেকোনো সমস্যা সমাধানের জন্য তা সে শারীরিক রোগ নিরাময় হোক, বা অন্য কোনো জাগতিক বস্তুর পাবার জন্য হোক, আপনি ঈশ্বরের শক্তিকেই ব্যবহার করছেন, এই কথাটা  সর্বদা মনের মধ্যে জাগরুক রাখবেন। তাঁর কাছেই সাহায্য চান, যিনি সর্ব্বশক্তিমান। তাঁর কাছেই চান, যিনি সমস্ত ঐশ্বর্যের মালিক। আপনি তাঁরই প্রিয় সন্ত্রান রূপে যাবতীয় সমস্যা থেকে মুক্তি লাভের জন্য শুধুমাত্র ঈশ্বরপ্রদত্ত ইচ্ছেশক্তি, আবেগ, ও বিচারের  ক্ষমতাকেই ব্যবহার করছেন, এই কথাটা  সব সময় ভাবতে থাকুন । মনে রাখবেন, ঈশ্বর ও আপনি এক না হলেও আপনি ঈশ্বরেরই  সন্তান। 

ছোট ছোট সংকল্প পূরণের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ধ্যান ধারণার পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। তাই বলবো, প্রথমে ছোটো ছোটো সংকল্প দিয়ে কাজটা শুরু করুন। আপনি আগে নিজে বিশ্বাস করুন যে এগুলো পাবার আপনি যোগ্য। যদিও  ঈশ্বর যোগ্যতা দেখেন না , তিনি আকুলতা দেখেন। তথাপি বলবো,   আপনার ইচ্ছেগুলোর সঙ্গে আপনার ক্ষমতার বিচার-বিশ্লেষণ করুন, বিশ্বাস করতে শিখুন, আপনি আপনার সংকল্প পূরণের যোগ্য পাত্র। আপনার অনুভূতি ও আপনার যুক্তি বিচার যেন সুস্পষ্ট বোধের উপরে প্রতিষ্ঠিত হয়। যেকোনো সংকল্প পূরণের জন্য দরকার হয় প্রগাঢ় ঐকান্তিকতা। আপনার এই ঐকান্তিকতা দেখেই, ঈশ্বর আপনাকে ফল প্রদান করবেন।  ফলের দিকে না তাকিয়ে সংকল্পের সঙ্গে ঈশ্বরভক্তি, বিশ্বশক্তির ইচ্ছে, ও আপনার বিশ্বাসকে মেলাতে হবে। একমনে বার বার আপনার সঙ্কল্পগুলোকে উচ্চারণ করতে থাকুন। তবেই আপনার যাবতীয় পরিশ্রমের সুফল মিলতে শুরু করবে। 

দৈহিক ব্যাধির নিরামায়নের জন্য ব্যাধির দিকে দৃষ্টি না দিয়ে মনের অসীম শক্তির দিকে মনোযোগ দিন।  বিশ্বাস যেন কখনো দুর্বল হয়ে না পড়ে । মন থেকে ভয়, ক্রোধ, বদভ্যাস এগুলোকে বিপরীত গুন্ দিয়ে ঢেকে দেবার চেষ্টা করুন। ভয়ের কথা চিন্তা করতে যাবেন না, সাহসের কথা চিন্তা করুন, ক্রোধের কথা চিন্তা করতে যাবেন না, শান্তির কথা চিন্তা করুন, দুর্বলতা দূর করবার কথা চিন্তা না করে শক্তির কথা চিন্তা করুন। তেমনি অসুস্থতার কথা চিন্তা না করে সুস্থতার কথা চিন্তা করুন। অর্থাৎ সব সময় সদর্থক চিন্তা দিয়ে নিজেকে ভরিয়ে রাখুন।  

কতদিন ধরে আপনি এই শারীরিক ব্যাধিতে ভুগছেন, সে কথা ভাবতে যাবেন না এতে আপনার মধ্যে রোগ ও শরীর একাত্ম হয়ে যায়। বিশেষ করে স্নায়ুরোগের ক্ষেত্রে এই কথা খুবই কার্যকরী।  আপনি যত  দুশ্চিন্তা করবেন, আপনার স্নায়ু তত দুর্বল হতে থাকবে। আপনি দীর্ঘদিনের রুগী এই ভাব তখন আপনার শরীরের মধ্যে গেথে যাবে । আর  আপনি রুগী হয়েই  থাকেন । এখানে থেকে বেরুতে হবে। আপনি সুস্থ, সবল, সুখী, স্বচ্ছন্দ - একথা চিন্তার মধ্যে নিজেকে  ভাসিয়ে তুলুন। আমাদের অবচেতন মনের গভীরে যে ব্যাধির  শেকড় ছড়িয়ে আছে, তাকে উৎপাটন করতে হবে।  চেতন মনে সুস্থতার চিন্তাই একদিন অবচেতন মনের গভীরে প্রবেশ করবে, আর সেই দিন থেকেই আপনি সুস্থ  বোধ করতে শুরু করবেন।  

আমাদের অবচেতন মনে সংকল্পের বা প্রার্থনার  ধ্বনি পৌঁছে দিতে গেলে, আমাদের চেতন মন থেকে যাবতীয় সন্দেহ দূর করে দিতে হবে। আপনার মনোবল ও বিশ্বাস, হচ্ছে আপনার সুস্থ  দেহের পথের  দিশারী। তাই এই দুটি ধরে রাখতে হবে। বিশ্বাস ও সন্দেহ দূর করতে পারলে, আপনার মনের দৃঢ়তা স্থাপন হবে। আর এই দৃঢ়তাকে মনের মধ্যে গেথে ফেলার জন্য, প্রথমে প্রার্থনার শব্দ গুলো বার-বার উচ্চারণ করতে হবে। ধীরে ধীরে প্রার্থনার বাণী  অনুচ্চারিত শব্দে পরিণত হবে। আরো পরে এটি আমাদের মানস -ক্রিয়াতে পরিণত হবে। আর এই ভাবে আপনার প্রার্থনার শক্তিও বৃদ্ধি পেতে থাকবে।   আমরা জানি স্থুলের চেয়ে সূক্ষ্মের শক্তি বেশী।  তো আপনার প্রার্থনা যখন স্থুলধ্বনি থেকে সূক্ষ্মধ্বনিতে পরিণত  হবে তখন  আপনার প্রার্থনার শক্তি একটা  আলোকউজ্জ্বল রশ্মিতে পরিণত হবে, অসীম আকার ধারণ করবে। আপনার এই প্রার্থনা যত এগুতে থাকবে, তত আপনার মধ্যে বীজ থেকে অংকুরের জন্ম হবে। ভুলক্রমেও প্রার্থনা থামিয়ে শরীরের নিরাময়ের দিকে দৃষ্টি ফেরাবেন না। মাটি থেকে বীজ তুলে দেখতে যাবেন না, যে বীজ অঙ্কুর উদ্গমন হলো কি না। একটা জিনিস জানবেন, শরীর প্রকৃতির নিয়মেই প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে, তো  রোগগ্রস্থ শরীরের মধ্যেও প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে।  আর আমাদের প্রার্থনা অসুস্থ শরীরকে সুস্থ শরীরে রূপান্তর করবে। প্রত্যেকের শরীর  এক-সময় সুস্থ ছিলো,  এখন অসুস্থ হয়েছে, আবার সুস্থ হয়ে যাবে এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আমাদের কাজ হচ্ছে অপেক্ষা করা। এই নিয়মকে ত্বরান্বিত করতে পারে, বা অপেক্ষার সময়কে কমিয়ে আনতে  পারে  আমাদের প্রার্থনা।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।   

-------------------- 

মূল সূত্র : তত্ত্ব ও সাধনা - গোপীনাথ কবিরাজ 

ওঙ্কার তত্ত্ব : উপনিষদ বলছে, শব্দই ব্রহ্ম। একথাগুলো আমরা বার বার শুনেছি। ঈশ্বর যদি বাচ্য হয় তবে ওঙ্কার হচ্ছে বাচক। ওঙ্কার বা প্রণব হচ্ছে ঈশ্বরের একটা নাম।  প্রণব কথাটার অর্থ হচ্ছে প্রতিনিয়ত নতুন। তো বাচ্য ও বাচকের মধ্যে একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক আছে।  যারজন্য একজনকে অবলম্বন করলে আরেকজনকে আকর্ষণ করা যায়।  এযেন সেই কান টানলে মাথা আসে। নাম ধরে ডাকতে ডাকতে যেমন নামীকে  পাওয়া যায়। 

ওম এর স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে আমরা তিনটে মাত্রা আর একটা পূর্নমাত্রা  দেখতে পাই। অকার, উকার, মকর হচ্ছে জীবের জাগ্রত-স্বপ্ন- সুষুপ্তি, সৃষ্টি-স্থিতি-সংহার, সূক্ষ্ম-স্থূল-কারন, সত্ত্ব,-রজ-তম, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ, পিছনে-মধ্যে-সামনে অর্থাৎ তিনটি ভাগের প্রতিনিধিত্ত্ব করতে এই ওঙ্কার। এই তিন মাত্রায় অভিব্যক্তি হয়ে থাকে।  আর পূর্ন  মাত্রায় আছে বিন্দু - যা বলা হয় তুরীয় অবস্থা, তিনের  অবান্তর অবস্থায় বিন্দু বা অ-উ-ম একত্রে বিন্দু । এই পূর্ণমাত্রায়   বা তুরীয় অবস্থায় পৌঁছতে পারলে বিশ্বসত্ত্বার ভেদ হয়ে যায়। এই অবস্থা কারন সত্তারও  অতীত। এই তুরীয় অবস্থায় বড়  রহস্যময়। একমাত্র শ্রেষ্ঠ যোগীপুরুষ এই অবস্থায় প্রবেশ করতে পারেন। 

এই অবস্থায় বিন্দুর দর্শন মেলে।  এই বিন্দু জ্যোতি স্বরূপ। এই জ্যোতি থেকে সকল রূপ প্রকটিত  হতে পারে। এই জ্যোতিই স্থুল , সূক্ষ্ম ও কারন-রূপে বিশ্বকে ঘিরে রেখেছে। এই জ্যোতির কোনো সীমানা নেই। অকার, উকার, মকর ভেদ করতে পারলে এই সাক্ষাৎ দর্শন মেলে। প্রথম দিকে বিদ্যুৎ চমকের মতো এই জ্যোতি সাধকের চিদাকাশে ভেসে ওঠে। এঁকে যোগশাস্ত্রে নাম দেওয়া হয়েছে নিরোধিকা। এই জ্যোতির্বিন্দুতে কোনো রূপ নেই, আবার  সাধকের সংস্কার অনুযায়ী যেকোনো  রূপের প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়, এই জ্যোতিস্বরূপে ।

এই নিরোধের  পরে নাদের অবস্থান। জগতের সমস্ত রূপ যেমন জ্যোতিরূপে প্রকাশ পায় , তেমনি জগতের সমস্ত শব্দ এই নাদ  রূপে শ্রুত হয়। জ্যোতির মধ্যে সাধকের সংস্কার অনুযায়ী যেমন ইষ্টদেবের প্রকাশ ঘটে, তেমনি নাদের মধ্যে থেকে ইষ্টধ্বনি  বের হয়ে আসে। বলা হয়ে থাকে, জগৎব্যাপী এই নাদধ্বনি ধ্বনিত হচ্ছে।  বিন্দুর রাজ্যে যেমন তিনের প্রকাশ নাদের তেমনি দুইয়ের প্রকাশ।  একটা আদি আর একটা অন্ত। আমাদের শরীরের সুষুম্নানাড়ীতে যে ব্রহ্মরন্ধ্র আছে, সেখানে এই নাদের অন্তভাগ। সাধক এই নাদান্ত বা নাদের অন্তভাগ ধরেই বিরাট সত্তাতে প্রবেশ করে থাকেন । এখন থেকে শাক্তিরাজ্যের শুরু, যাকে  বলা হয় কলা। যোগীগণ উৎক্রমণকালে এই ব্রহ্মরন্ধ্রের পথ ধরে, সূর্য্যরশ্মি অবলম্বন করে, দেবযানী পথে আদিত্য অর্থাৎ সূর্য পর্যন্ত যে গতিপথ সেই শক্তির রাজ্য মহাশূন্যে প্রবেশ করেন। এই মহাশূন্যে সমগ্র সৃষ্টি  ভাসছে। এই রাজ্য তার  নিজস্ব আলোতেই  আলোকিত।  এখানে চন্দ্র-সূর্য্যের প্রবেশ নিষেধ। এখানে জন্ম-মৃত্যু নাই এখানে কোনো সংঘাত নাই। এই মহাশূন্যে অনন্তকোটি সিদ্ধভূমিতে বিস্তৃত। এই সিদ্ধভূমির দুটি ক্রিয়া এক-আকুঞ্চন, দুই-প্রসারণ। একেই উন্মেষ ও নিমেষ বলা হয়ে থাকে। একবার আত্মসংকোচনের ফলে নিগ্রহ ক্রিয়া সংগঠিত হয়, আবার আত্মপ্রসারণের ফলে অনুগ্রহশক্তির ক্রিয়া সংগঠিত হয়। একেই বলা হয় কালের খেলা। 

এই বিশাল মহাশূন্যে জ্যোতির্ময় শাক্তরাজ্যের একপ্রান্তে অবস্থান করছে এক ক্ষীণ কৃষ্ণবর্ণের রেখারূপে মায়ারাজ্য। মায়ারাজ্য অন্ধকারময়। শক্তিরাজ্যের মধ্যে আছে অসংখ্য প্রকৃতি রাজ্য।  আর প্রত্যেক প্রকৃতিরাজ্যে আছে অসংখ্য ব্রহ্মান্ড।  এইসবই মায়ারাজ্যের অন্তর্গত। 

মায়ারাজ্য থেকে পার করার কাজ করেন, যে শক্তি তাকে বলা হয় সদাশিব। তাই গুরুদেবকে বলা হয় শিবসম। আর মায়াতে নিক্ষিপ্ত করে কালরূপী ঈশ্বর। এইযে ঈশ্বর ও সদাশিব, আসলে একই পরমেশ্বরের দুজন প্রতিনিধি মাত্র। তিনি   নিগ্রহ করেন আত্মসংকোচন দ্বারা, আবার অনুগ্রহ করেন আত্মবিকাশের দ্বারা। এই যে  ঈশ্বর বা সদাশিব কথা বললাম, এটি একটি উপাধিমাত্র এঁকে  আপনি যেকোনো  নামেই ডাকতে পারেন, বা চিহ্নিত করতে পারেন। এর পর মায়ারাজ্যের মধ্যে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-রুদ্র - যাদের কাজ হচ্ছে সৃষ্টি-স্থিতি-সংহার। 

এইযে মহাশূন্যের কথা বললাম, এর কোনো আদি অন্ত  নেই। মহাশূন্যের মধ্যে স্থিত শাক্তরাজ্য। আবার শাক্তরাজ্য  ছাড়িয়েও অবস্থান করছে সেই মহাশূন্য। এই মহাশূন্য সমগ্র বিশ্বব্যাপী অবস্থান করছে বলে একে  বলা হয় ব্যাপিনী।  এই মহাশূন্যকেও ভেদ করতে হবে, তবেই মুলচক্রের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। এইজন্য ব্যাপিনীর পরে সমনা-ভূমির প্রাপ্ত হওয়া আবশ্যক। ধীরে ধীরে সাধক ব্যাপিনীরূপ অভাব ও সমষ্টিরূপ  ভাবের পরম সত্তাতে প্রতিষ্ঠিত হন। এই পরম সত্তাই যোগীর নিজ আত্মা। এই সমনা শক্তিকে আশ্রয় করেই পরমপিতা-পরমেশ্বর সমস্ত কার্য্যনির্বাহ করে থাকেন। সাধককে এই সমনাকে অতিক্রম করে, উন্মনাতে প্রবেশ করতে হয়।  তবেই পরম-পিতার  ধামে উপস্থিত হওয়া যায়। 

বিন্দু থেকে উন্মনা অবধি মোট নয়টি ধাপ। এতক্ষন যে ব্রহ্মাণ্ডের কথা বলা হলো এরই একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ আছে, যা আমাদের এই স্থূল শরীরেই অবস্থান করছে।  

এখন আমরা কালের লঙ্ঘণ  কিভাবে করা যেতে পারে, সে সম্পর্কে শুনবো। 

মন্ত্রের উচ্চারণ-কালকেই বলা হয়ে থাকে কাল। একেই সূক্ষ্মকাল বলে।  এই সূক্ষ্মকাল আমাদের সাংসারিক কাজের মধ্যে, সংসারী জীবনে প্রত্যেক অবস্থাতে এই  ক্রিয়া  নিহিত আছে। আমাদের জপ বা চিন্তার একটা মাত্রা আছে। লৌকিক দিক থেকে দেখতে গেলে, এই মাত্রা  হচ্ছে হ্রস্ব, দীর্ঘ, ও প্লুত। হ্রস্ব এক মাত্রার, দীর্ঘ দুই মাত্রার আর প্লুত অধিক মাত্রার। আমাদের চিত্ত যখন একাগ্র হয়, তখন এই হৃস্ব বা একমাত্রা ভেঙে অর্ধমাত্রাতে পর্যবশিত হয়।  অর্থাৎ বহির্বিশ্বে চিত্ত একাগ্র হলে কালের মাত্রা এক থাকে, এরপর যখন জ্যোতির আবির্ভাব হয়, তখন এই একমাত্র অর্ধমাত্রাতে পরিণত  হয়। জগৎ ব্যবহারের জন্য একমাত্রার প্রয়োজন। কিন্তু পরমার্থ লাভ করতে হলে আমাদের এই একাগ্রভুমিকে  ভেদ করে নিরোধের দিকে ধাবিত হতে হয়, তখন একমাত্রা ভেঙে অর্ধমাত্রার উদয় হয়। এই অর্ধমাত্রা আবার একসময় ভাঙতে ভাঙতে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর  হতে থাকে। 

জ্যোতি হচ্ছে বিন্দু। এই বিন্দু থেকেই যোগীপুরুষের সুক্ষ মাত্রার আরম্ভ হয়ে থাকে। এই মাত্রার তাৎপর্য হচ্ছে, এই যে কালের মাত্রা এটি ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকে। যোগীর বোধশক্তির শেষ সীমা পর্যন্ত কালের মাত্রা ক্ষীণ হতে থাকে। যদিও ক্ষীনক্রিয়ার কোনো শেষ সীমা নেই, তথাপি, সাধকের সামর্থ অনুযায়ী একটা স্থানে এসে স্থির হয়। একেই সাধকের উন্মনা ভাব বলা হয়ে থাকে। একেই কেউ কেউ সমনার ভূমি বলে থাকেন। এই সমনার পর থেকেই কালের ক্রোম লক্ষিত হয়।  উন্মনা অবস্থায় বা সমনকালে কালের অস্তিত্ত্ব নেই. এটি কালাতীত অবস্থা। 

সমনা অবস্থা হতে একটা অতিক্ষুদ্র কালাংশ নিয়ে যোগীপুরুষ আত্মবলে সমর্পন করে থাকেন। এরই নাম মনের সাহায্যে মনের বাইরে যাওয়া। অধিকশক্তিশালী যোগী এই স্তরকেও  ভেদ  করে বেরিয়ে যেতে পারেন।  তথাপি কালের মধ্যেই তাকে  থাকতে হয়। এখানে, এই স্তরে কালের মাত্রা অতি ক্ষুদ্র। যতক্ষন সাধক আত্মসমর্পনে এতটুকু ফাঁকি থাকে, তবে কালের পারে যাওয়া যায় না। এখানে, এই স্তরে  সাধকের নিজের প্রয়াস বলে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এখন থেকে অতিক্রমন করতে গেলে, পরমেশ্বরের অনুগ্রহ একমাত্র সহায়। উন্মনা অবস্থায় দেশ-কাল-পাত্র বলে কিছুই থাকে না।  এমনি জ্ঞান-অজ্ঞান বলে কিছুই থাকে না। আছে একখন্ড মহাকাশ সেখানে হয় স্বাতন্ত্রের বিলাস। 

এবার আবার ওঙ্কারের কথায় আসি, ও-কার থেকে উন্মনা পর্যন্ত ওঙ্কারের বিকাশ। এর মধ্যে মন, কাল, আর  উন্মনা ভূমি। অর্থাৎ মনরাজ্য, কালের রাজ্য, এবং এসবের অতীত  উন্মনা  ভূমি। এই মনোরাজ্যের মধ্যে আবার দুটো মনোরাজ্য একটা হচ্ছে স্থূল মনোরাজ্য, আর একটা সূক্ষ্ম মনোরাজ্য।  এই স্থূল মনোরাজ্যের মধ্যেই প্রকাশ ঘায়ে "অ- উ-ম" এর। আবার সূক্ষ্ম মনোরাজ্যের মধ্যে আছে মহাশূন্য, যেখানে বিরাজ করছে শক্তি-মায়া-প্রকৃতি-অনন্ত ব্রহ্মান্ড। সহজ কথায় ওঙ্কারই প্রকাশিত বিশ্ব, আবার অপ্রকাশিত বিশ্ব। 

ওঙ্কার লেখার সময় আমরা ওম, ওঁ, ওং, ওঁং - এই চার ভাবে লিখে থাকি।  এই ওম হচ্ছে স্থুল ওঙ্কার, ওঁ হচ্ছে সূক্ষ্ম, ওং সূক্ষ্মতর, আর ওঁং হচ্ছে সূক্ষ্মতম ওঙ্কার।  সূক্ষ্ম ওঙ্কারের (ওঁ) মধ্যে যে অর্দ্ধ চন্দ্র ও বিন্দু আছে - এর গুহ্য অর্থ আছে। আবার একটি শূন্য ও অর্দ্ধ-উত্তিত রেখা আছে, এর পিছনেও বিশেষ অর্থ নিহিত আছে। এইসব আলোচনা আমরা সময় বিশেষে করবো। 

প্রাচীন মুনি ঋষিদের মতে ভূলোক, দ্যুলোক ও অন্তরীক্ষ লোক মন্থন করে এই রূপের প্রকাশ হয়ে থাকে। এর উদ্দেশ্য যজ্ঞের সিদ্ধি।  অর্থাৎ বিশ্বচক্রের আবর্তনজনিত যে যজ্ঞ চলছে, অর্থাৎ আকর্ষণ ও বিকর্ষণ তাকে সাময়িক রূপে উপলব্ধি করা। অগ্নিতে ইন্ধন দিলে, অগ্নিই  শিখা রূপে প্রকাশ পায়। সূর্য-অগ্নি-ইন্ধন এই তিন তেজের সমাহারে সমস্ত জগৎক্রিয়া চলছে। বস্তুত প্রণবের মধ্যে এই তিন শক্তির খেলা চলছে। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ।  "অ-উ-ম" সৃষ্টি-স্থিতি-ধংশ।                  


সমস্ত মন্ত্রকে কেন প্রণব-পুটিত করতে হয় ? 

আমরা দেখেছি, প্রত্যেক মন্ত্রের  আদি অন্তে প্রণব পুটিত করা হয়। অর্থাৎ ওং এই ধ্বনি দিয়ে শুরু করতে হয়, আবার এই ওং এই ধ্বনি দিয়ে মন্ত্রের সমাপ্তি টানতে হয়। সমস্ত বেদ  মন্ত্রের ক্ষেত্রেই এই নিয়ম পালন করা হয়। তাই প্রণব দিয়ে মন্ত্র শুরু হয়, আবার প্রণব দিয়েই মন্ত্রের শেষ করতে হয়। তন্ত্র  শাস্ত্রেও এই বিধি পালন করা হয়।   এর কারন কি ? ওঙ্কার হচ্ছে মন্ত্রের বাঁধন।  প্রণব পুটিত মন্ত্র অধিক শক্তিশালী।  কিন্তু কেন ? সমস্ত শব্দের উৎপত্তি এমনকি মায়  সমস্ত জগতের উৎপত্তির কারন হচ্ছে এই প্রণব ধ্বনি।  এখান থেকে সমস্ত জগতের সৃষ্টি হয়েছে। আবার প্রলয়কালে এই ওঙ্কারের মধ্যে সমস্ত জগৎ লয় প্রাপ্ত হবে। কিন্তু এর সঙ্গে মন্ত্রের সম্পর্ক কি ?  মন্ত্রের আগে ও পরে প্রণবের উচ্চারণ করতে হয় কেন ?

আমরা জানি শব্দ আকাশ থেকে উৎপন্ন হয়।  আকাশ থেকে উৎপন্ন হয়ে শব্দ আকাশেই   প্রকাশ পায়।  আবার আকাশেই মিলিয়ে যায়। তেমনি  মন্ত্র আমাদের চিদাকাশে উদ্ভাসিত হয়, আবার এই মন্ত্রকে চিদাকাশেই মিশিয়ে  দিতে হয়। আসলে মন্ত্র জাগ্রত হলে, এই মন্ত্রশক্তিকে  আশ্রয় করে, সাধক তার অভীষ্ট লক্ষ-প্রাপ্ত হন । মন্ত্র লক্ষ নয়, মন্ত্র হচ্ছে লক্ষে পৌঁছাবার বাহক মাত্র।  তো লক্ষপ্রাপ্ত হবার পরে, যদি মন্ত্রকে সেখানে রেখেই আপনি আপনার লক্ষের দিকে ধাবিত হন, তখন মন্ত্রশক্তি প্রথমে উদাসীন, পরে মন্ত্রের উদ্গাতাকে লক্ষ করে ধাবিত হয়।  এতে করে, সাধকের লক্ষে পৌঁছানো হয় না। আপনি গাড়ি করে কোথাও গেলেন, এখন লক্ষে পৌঁছানোর পরে, গাড়ির  স্টার্ট বন্ধ করে, আবার ড্রাইভারের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। তা না হলে,  ড্রাইভার বিহীন চলন্ত ইঞ্জিন যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে। 

মন্ত্র স্থুল থেকে সূক্ষ্মে, সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর, সূক্ষ্মতম অবস্থায় গিয়ে অধিক শক্তিশালী হয়ে কার্যকরী ভূমিকা  পালন করে থাকে।অথাৎ বৈখরী থেকে মধ্যমা, মধ্যমা থেকে পশ্যন্তি, পশ্যন্তি থেকে পরা ভূমিতে গিয়ে মন্ত্র কার্যকরী ভূমিকা নেয়। তখন বাচক ও বাচ্যের মধ্যে একটা সম্পর্ক  গড়ে ওঠে।  বাচ্য ও বাচক তখন এক হয়ে যায়। তখন সাধক এই মন্ত্রশক্তির মধ্যে নিজ লক্ষ পূরণ করে থাকেন।    

সমস্ত বস্তুর মধ্যে সৃষ্টি-স্থিতি ও লয়ের  ক্রিয়া চলতে থাকে।  তাই একসময় যেমন বস্তুর উদ্ভাবন হয় , তেমনি তার স্থিতিকাল শেষ হয়ে গেলে, আবার সে উৎসে ফিরে যায়। ঠিক তেমনি সমস্ত মন্ত্রের ক্রিয়ার মধ্যেও  সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের ক্রিয়া বর্তমান। সত্য হচ্ছে, ওঙ্কার  থেকেই সমস্ত ধ্বনি বা শব্দ সৃষ্টি হয়েছে। তো সৃষ্টি-স্থিতি ও সংহারের মধ্যেই মন্ত্রের স্ব-রূপের  স্থিতি। অর্থাৎ মন্ত্রের শক্তির মধ্যে নিহিত আছে, সৃষ্টি-স্থিতি-সংহারের শক্তি। বা মন্ত্র এই তিন শক্তির   দ্বারাই  বেষ্টিত হয়ে থাকে । এখন ধরুন কোনো কাজ করবার সময় আপনি যে সব সামগ্রীর (দা-কোদাল) সাহায্য নিচ্ছেন, কাজ হয়ে যাবার পরে, যদি আপনি সেই সামগ্রী সেখানেই ফেলে রাখেন, তবে সেগুলো দ্বারা যেকোনো অনিষ্ট সাধন হতে পারে। তাই এগুলো যেখান থেকে আপনি এনেছিলেন, কাজের শেষে সেখানেই আবার গচ্ছিত করে রাখা উচিত। তেমনি মন্ত্র হচ্ছে একটা শক্তি যা ওঙ্কারের সাহায্যেই সৃষ্টি হয়েছিল, মন্ত্রের স্থিতি অর্থাৎ  মূল-মন্ত্র উচ্চারণের ফলে শক্তির জাগরণ হয়।   পরে যদি সেই শক্তিকে  আপনি আবার সেই  ওঙ্কারের মধ্যে লয় করে না দেন, তবে মন্ত্রশক্তি দিশেহারা হয়ে বিনাশমূলক কাজে লিপ্ত হতে পারে। বোতল থেকে দৈত্য বের করে, কার্য্য সম্পাদনের পরে, আবার দৈত্যকে  বোতলের  মধ্যে ভরে রাখতে হয়, নতুবা দৈত্যশক্তি বিভ্রান্ত হয়ে, নানান অনিষ্টকর কাজে লিপ্ত হতে পারে। 

মন্ত্রের মধ্যে থাকে কাল ও বায়ুর প্রভাব। উভয় দিকে প্রণব থাকলে  কাল ও বায়ুর দ্বারা মন্ত্র কলঙ্কিত  হতে পায়ে না। মন্ত্রের একজন দেবতা থাকেন ।  নাদের মধ্যে যে বর্ণাত্মক তরঙ্গ  উৎপাদন হয়, তার সময়চিত ব্যবহার করে, আবার যথাপূর্ব অবস্থায় মন্ত্রকে মিলিয়ে দিতে হয়। তাই সমস্ত মন্ত্রের আদি ও অন্তে প্রণব-পুটিত করে নিতে হয়। 

-----------


ওঙ্কার  ও গায়ত্রীমন্ত্র 

ওঙ্কার  ও ব্যাহৃতিতত্ত্ব।                   

কালের গতিমুখ : মানুষ কেন শিশু থেকে বুড়ো হয় ? 

জীবকুল শিশু থেকে বৃদ্ধ হয়, কিন্তু বৃদ্ধ থেকে কেউ শিশু হয় না। মানুষ ছোট থেকে বড় হয়, কিন্তু বড় থেকে কেউ ছোট হয় না কেন ? কি একটা সিনেমা দেখেছিলাম, সেখানে পুকুরে ডুব দিয়ে নাকি বৃদ্ধ যুবক হয়ে যেত। একটা গল্পে পড়েছিলাম, একটা ছোট্ট ছেলে, রাতারাতি  বাবা হতে চেয়েছিলো, আর একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখে, সে বাবার মতো হয়ে গেছে।  তার জামা -প্যান্ট সব আঁটোসাঁটো হয়ে গেছে। এগুলো সব মানুষের কাল্পনিক গল্প কথা।  কিন্তু মহাভারতের কাহিনীতে, আদিপর্ব্বে,  আছে রাজা যযাতির গল্প। তিনি নাকি শুক্রের শাপে জরাগ্রস্থ হয়েছিলেন।  আর রাজা যযাতি তার কনিষ্ঠ পুত্র পুরুর  কাছ থেকে হাজার বছরের জন্য যৌবন ধার করে নিয়েছিলেন। আর রাজা যযাতি  শুক্রকে স্মরণপূর্বক  তার সমস্ত পাপ ও জরা পুরুর শরীরে স্বকীয় জরা সঞ্চারিত করেছিলেন। অর্থাৎ এক শরীরের জরা অন্যের শরীরে, আবার একজনের যৌবন অন্যের শরীরে প্রবেশ করানো কি সম্ভব ?

আমর হিরু নামে  এক  বন্ধু ছিল, সে নাকি  একসময় অন্যের হয়ে জেল খাটতো। আবার এমন বন্ধুও ছিল, যে কিনা অকারনেই  শুধু টাকার বিনিময়ে নাকি মানুষ ক্ষতম করতো।  অর্থাৎ অন্যকে স্বস্তি দেবার জন্য, বা অন্যের ইচ্ছেপূরণের জন্য নিজের কাঁধে পাপের  বোঝা নিয়ে নিতো।   

তো মানুষের বানানো গল্পের কথা না হয় ছেড়ে দিলাম, আবার অন্যের হয়ে জেল খাটার কথা সত্য হলেও, এটি একটা ব্যতিক্রম বলে না হয় ছেড়ে দিলাম।  কিন্তু মহাভারতের কাহিনীর মধ্যে এমন একটা অবৈজ্ঞানিক কাহিনীর সংযোজন করার কারন কি  ? নাকি এর মধ্যে অন্য কোনো গুহ্যসত্য নিহিত আছে ? আজ আমরা এই প্রশ্নের যাবেন খুঁজবো। মানুষ কেন শিশু থেকে বুড়ো হয়।

আপনি হয়তো বলবেন, অরে বাবা, শিশু থেকেই তো মানুষ বুড়ো হয়। বুড়ো থেকে আবার কেউ শিশু হয় নাকি ? কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন হয় ? আর কেনই বা মানুষ ইচ্ছে করলে উল্টো পথে যেতে পারবে না। যে পথ দিয়ে সে এসেছে, সেই পথে কেন সে ফিরে যেতে পারবে  না। কেনই বা মানুষ বৃদ্ধ থেকে আবার শিশু হতে শুরু করবে না। বাধাটা কোথায়। কেন ঘি থেকে দুধ হয় না, দই থেকে দুধ হয় না, ভাত থেকে ধান হয় না ? অসুবিধাটা  কোথায় ? 

---------------      

কি করে সুখী হবো ? সুখের সন্ধানে - ছান্দোগ্য উপনিষদ - সপ্তম অধ্যায় (১-২২) খন্ড । 

শাস্ত্রবিদ্যা - শব্দ অর্থপূর্ণ শব্দ - নাম বাক -মন -সংকল্প - চিত্ত - ধ্যান - বিজ্ঞান - বল- অন্ন- জল-তেজ-আকাশ-স্মৃতি-আশা-প্রাণবায়ু-সত্য-ব্রহ্ম - সবিশেষ জ্ঞান - মনন - শ্রদ্ধা- গুরুসেবা- একাগ্রতা- আত্মসংযম -সুখ- ভূমা - যা পেলে মনে হয় আর নতুন করে আর কিছু পাবার নেই 

আমরা সবাই সুখী হতে চাই।  কিন্তু আমরা জানিনা কিভাবে আমরা সুখী হবো। আমরা খাবার খাই, সুখী হবার জন্য,  কিন্তু কিছুক্ষন পরেই, আবার আমাদের ক্ষুধা পায় আর আমরা দুঃখী হয়ে উঠি। আবার বেশি সুখের জন্য আমরা বেশি করে খেয়ে ফেলি, আর আমরা অসুস্থ হয়ে উঠি।  তখন আমাদের আনন্দ তো দূরে থাকে, বরং এই অতিরিক্ত ভোজন আমাদের দুঃখী করে তোলে। সমস্ত জাগতিক সুখই  তাই।  জাগতিক সুখ ক্ষণস্থায়ী এমনকি পরিণামে দুঃখকর। তাহলে প্রকৃত সুখ কোথায় ? উপনিষদ বলছে ভূমাতেই সুখ। যা অনন্ত, যা শাশ্বত যা চিরন্তন সেখানেই সুখ।  সনৎকুমার বলছেন, "নাল্পে  সুখম  অস্তি" - যা ক্ষণিক, যা ক্ষুদ্র, যা অনিত্য তাতে সুখ নেই। সসীম বস্তু বাসনাকে কখনো তৃপ্ত করতে পারে না।  একটা বাসনা পূর্ন হতে না হতেই আর একটা এসে জোটে। এমনকি কেউ যদি সমস্য পৃথিবীর অধীশ্বর হয়, তথাপি সে সুখী নয়।  যা সসীম তার মধ্যে লুকিয়ে আছে দুঃখের বীজ। 

যতক্ষন আমরা ইন্দ্রিয়-সুখের পেছনে ছুটে  বেড়াবো, ততক্ষন পর্যন্ত আমরা কখনো সুখী হতে পারবো  না।  আমাদেরকে  এই ইন্দ্রিয়সুখের পারে যেতে হবে। ছান্দোগ্য উপনিষদ বলছে "যো বৈ ভূমা তৎ সুখম" যা ভূমা তাই সুখ। এই ভূমা হচ্ছে ব্রহ্ম।  যা দেশ কালের উর্দ্ধে। আমাদের জীবন সীমিত, আমরা কোনো একটা নির্দিষ্ট সময়ে, একটা নির্দিষ্ট দেশে, একটা পরিবারে জন্ম গ্রহণ করি. তার পর কিছুদিন বেঁচে থাকি।  তার পর একদিন তা সে ১০০ বছর পরে হলেও আমাদের মৃত্যু ঘটে। তখন তো আমরা সুখ-দুঃখের পারে চলে যাই।  তাহলে আমাদের ভগবানের কথা ভেবে কি লাভ ? তথাপি আমরা ভগবানের কথা ভাবি, কারন আমাদের মূলসত্ত্বা বারবার ডেকে ওঠে, বলে ভগবান লাভই সুখের একমাত্র উপায়।

ঋষি সনৎকুমারের কাছে ঋষি নারদ এসেছেন, বলছেন, আমি সমস্ত শাস্ত্র পাঠ  করেছি, কিন্তু আমি শোকগ্রস্ত, আপনি আমাকে শোকের পরপারে নিয়ে যান। এই শোকগ্রস্ত হয়েছিল, অর্জ্জুন, বলেছিলেন, হে কেশব, আমি স্থির হতে পারছি না, আমি রাজ্য সুখ চাইনা, আমি হৃদয়দৌর্বল্যে আক্রান্ত, আমি ধর্ম্মাধর্ম্ম জ্ঞানহারা মি বিমূঢ়চিত্ত, আমার পক্ষে যা কল্যাণকর তাই তুমি বলো।  আমি তোমার শিষ্য শরণাগত, আমাকে উপদেশ দাও। শ্রীগীতায়, যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ এখন এইসময় যাকিছু উপদেশের কথা শুনিয়েছিলেন, সেই কথাগুলোই আমাদের শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা। কিন্তু এই গীতার আগেই রচনা হয়েছে উপনিষদ - যা আসলে বেদের অংশ।  আমরা সেই উপনিষদ থেকেই এই প্রশ্নের উত্তর শুনবো। 

সনৎকুমার বলছেন, নারদ, তুমি অনেক কিছু পড়েছো, কিন্তু তা কেবল শব্দমাত্র। প্রত্যেক শব্দের একটা অর্থ আছে. আমাদের সেই অর্থটাকে বুঝতে হবে। আচার্য্য শঙ্কর একটা উদাহরনের সাহায্যে বুঝিয়েছেন। ধরো শোভাযাত্রা সহকারে রাজা আসছেন। তো রাজাকে দেখবার জন্য, হাজার হাজার লোক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।  কিন্তু রাজা তো আর এক আসছে, তার সঙ্গে আসছে, হাজার হাজার লোক, মন্ত্রী পরিষদ, সৈন্য সামান্য, বাদ্যযন্ত্র ঘোড়া হাতি ইত্যাদি - এসব নিয়ে মহা ধুমধাম করে রাজা আসছেন। প্রশ্ন হচ্ছে রাজা কোথায় ? আচার্য্য শংকর বলছেন, এই শোভাযাত্রার মধ্যেই রাজা আছেন, তিনি এই জাঁকজমক আড়ম্বর আড়ালে নিজেকে আমাদের থেকে আড়াল করে আছেন। আমরা দেখছি সবকিছুই কিন্তু রাজাকে দেখতে পাচ্ছি না। ও ঠিক তেমনি জগতে আমরা যা কিছু দেখি তা আসলে রূপের তারাং মাত্র।  এর পিছনে যে সত্য লুকিয়ে আছে, তা আমরা জানি না।  কেবলমাত্র ব্রহ্ম শব্দটা জানলে ব্রহ্মকে জানা হলো না।  শাস্ত্র পড়লেই ব্রহ্মকে জানা যায় না।  ব্রহ্মজ্ঞান হয় না।  ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে গেলে, নিজেকে ব্রহ্ম হতে হবে। শাস্ত্রগ্রন্থ শব্দের কচকচানি ছাড়া কিছু নয়। তাহলে কি শাস্ত্র-অধ্যয়নের কোনো প্রয়োজন নেই ? তা নয়, আসলে অক্ষরজ্ঞান হলে শাস্ত্রপাঠ করা যায়। অভিধান থাকলে হয়তো শব্দের অর্থ জানা যেতে পারে। কিন্তু শাস্ত্রের মধ্যে যে গুহ্যতত্ত্ব কথা আছে, তা জানতে গেলে শাস্ত্রের বিষয়ের  উপরে সংযম করতে হবে।  শাস্ত্রের প্রতিটি শব্দের ধ্যান করতে হবে। দেখুন আমরা সবাই আত্মাকে সঙ্গে নিয়েই চলেছি। সর্ব্বক্ষন আমরা এই আত্মার সঙ্গেই আছি, এমনকি এই আত্মাই আমাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু আত্মজ্ঞান কি আমাদের হয়েছে ? তেমনি শাস্ত্রের মধ্যেই আছে শব্দব্রহ্ম যা ইন্দ্রিয়ের অতীত, যা বুদ্ধিগম্য নয়।  কেবলমাত্র শাস্ত্রপাঠে এই শব্দব্রহ্মের জ্ঞান হবার নয়। 

ঋষি সনৎকুমার বললেন, তুমি নামের উপাসনা করো। দেখো বেদ-পুরান, এমনকি সমস্ত বেদের বেদ সেই ব্যাকরণ, অর্থশাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র নীতিশাস্ত্র ইত্যাদি একেকটা নাম মাত্র।  তুমি নামের উপাসনা করো। নামকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করো। নাম আমাদের একটা নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ  করে ফেলে। যেমন ধরো জবাফুল, জবা বললেই আমরা ফুলের একটা নির্দিষ্ট জাতিকে বুঝি।  তা সে যেকোনো রঙের হোক। এখন জবাকে যদি আমরা ব্রহ্মরূপে দেখি তখন জবার উপরে আমরা জবার রূপ-গুন্ আরোপ করি। কিন্তু ব্রহ্ম হচ্ছেন, নাম-রূপের উর্দ্ধে, ব্রহ্ম নির্গুণ, অনন্ত। তাই ব্রহ্মকে নাম ও রূপের মধ্যে আমরা সীমাবদ্ধ করতে পারি না। 

এই নামের এসেছে শব্দ থেকে। নাম একটা শব্দ ছাড়া কিছু নয়। শব্দ আমাদের বাগেন্দ্রিয়র ক্রিয়া। বাগেন্দ্রিয় আছে বলেই আমরা কথা বা শব্দ করতে পারি। বেদের প্রতি শব্দের একটা অর্থ আছে। প্রতিটি শব্দের একটা গভীর অর্থ আছে। এই শব্দকে যদি আমরা ব্রহ্মের প্রতীক হিসেবে ধরতে পারি, তবে আমাদের শব্দের উপাসনা করা উচিত। 

এই বাক বা শব্দ অপেক্ষা মন শ্রেষ্ট।  কেননা মন এই বাক ও মনকে ধরে রেখেছে। মন চাইলে,তবেই  মুখ শব্দের সাহায্যে নাম বা শাস্ত্রগ্রন্থের পাঠ করতে পারে। তাই মনই আত্মা - মনই ব্রহ্ম - কিভাবে চিন্তা করে, মনের উপাসনা করো। 

এই মনের মধ্যে আছে সংকল্প। মন আগে সংকল্প করে, তারপরে চিন্তা করে। তারপরে সে বাকশক্তি দ্বারা নামের উচ্চারনে প্রবৃত্ত হয়।  তখন সমস্ত মন্ত্র নামে, এবং সমস্ত কর্ম্ম মন্ত্রে  একীভূত হয়। মনের গুরুত্ত্ব অপরিসীম, কিন্তু মন চঞ্চল, সব সময় মন কিছু না কিছু চিন্তা করতে চায়। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সিদ্ধান্ত নেয় বুদ্ধি - বিচারশক্তি। যাইহোক, মনের থেকে সংকল্প শেষ্ঠ। (৩১০ পাতা)  তাই সংকল্পের উপাসনা করো। 

সংকল্পের চেয়ে চিত্ত শ্রেষ্ঠ। মানুষ প্রথমে অনুভব করে, তারপর সংকল্প করে। তারপর বারবার চিন্তা করে। চিন্তা বাক্যের দ্বারা  প্রকাশিত হয়। বাক্য  নাম উচ্চারণ করে। মন্ত্র নামে, ও কর্ম্ম মন্ত্রে একীভূত হয়। যিনি ছিটকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, তিনি বুদ্ধিযুক্ত হয়ে বাঞ্চিত লোকসমূহ প্রাপ্ত হন। 

চিত্ত থেকে ধ্যান শ্রেষ্ট। ভূলোক, দ্যুলোক, অন্তরীক্ষ লোক যেন ধ্যানরত। দেবতা মনুষ্য সবাই যে যার ধ্যান করছেন। সুতরাং ধরনের উপাসনা করো। যিনি ধ্যানকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, তিনি ধরনের যতদূর গতি ততদূর যেতে পারেন। 

ধ্যানের চেয়ে বিজ্ঞান শ্রেষ্ঠ। সমস্ত জগৎকে এই জ্ঞানের দ্বারা জ্ঞাত হওয়া যায়। বিজ্ঞান কথাটার অর্থ হলো উপলব্ধি জাত  জ্ঞান। এই কারনে বিজ্ঞান ধরনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তো যিনি বিজ্ঞানকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, তিনি বিজ্ঞানের যতদূর গতি ততদূর যেতে পারেন। 

বিজ্ঞানের চেয়ে বল শ্রেষ্ঠ। বলহীনের জ্ঞান কোনো কাজে লাগে না। বলবান মানুষ উদ্যমশীল হতে পারে। যার মনে বল নেই, শরীরে বল নেই, বুদ্ধির বল নেই, তার কর্ম্মে উদ্দীপনা নেই। 

আবার বল অপেক্ষা অন্ন শ্রেষ্ট। দুদিন না খেলেই মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে। এইসময় তার দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণ শক্তি, এমনকি প্রাণশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।  আর তার দ্বারা কোনো কাজই হতে পায়ে না। অতএব তুমি  অন্নের  উপাসনা করো। অন্নকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করো। 

অন্ন থেকে জল শ্রেষ্ঠ। অন্ন না খেয়ে মানুষ হয়তো ১০/১৫ দিন বাঁচতে পারে, কিন্তু জল পান নাকরে মানুষ তিনদিনও বাঁচতে পারে না। তাই তুমি জলকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করো। ভালো বৃষ্টি না হলে অন্ন উৎপন্ন হতে পারে না।  তাই অন্ন  থেকে জল শ্রেষ্ঠ। 

জল থেকে তেজ শ্রেষ্ঠ। তেজ আমাদের শরীরকে শীতলতার হাত থেকে রক্ষা করে। সূর্য্যের তেজশক্তি থেকে এই প্রাণীকুলের পুষ্টি সাধন হচ্ছে।  ক্রিয়াশীল হচ্ছে। তাই তুমি তেজের উপাসনা করো। তেজশক্তিকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করো। তেজই যজ্ঞের অগ্নি স্বরূপ।  সমস্ত যজ্ঞ এই তেজের সাহায্যে সম্পন্ন হয়ে থাকে। 

আবার আকাশ অগ্নি থেকে শ্রেষ্ট। কেননা এই তেজ আকাশকেই আশ্রয় করে আছে। যিনি আকাশকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, তিনি আকাশের যতদূর গতি ততদূর পর্যন্ত যেতে পারেন। 

আকাশ থেকে স্মৃতি শ্রেষ্ট। স্মৃতির সাহায্যেই মানুষ নিজেকে স্মরণ করতে পারে। ছোটবেলার আমি আর বৃদ্ধ বয়সের আমির সঙ্গে সম্পর্ক জুড়ে দেয়  এই স্মৃতি। সমস্ত জ্ঞান আমাদের স্মৃতিতেই সংরক্ষিত থাকে।  তাই স্মৃতিকেই ব্রহ্মরূপে উপাসনা করো। 

এরপরে আশা মানুষের স্মৃতির থেকে শ্রেষ্ট। কেননা আশাই মানুষের স্মৃতিকে  উদ্দীপিত করে। যিনি আশাকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করে, তিনি আসার যতদূর গতি ততদূর যেতে পারেন। 

আশা অপেক্ষা প্রাণবায়ু শ্রেষ্ঠ। প্রাণবায়ুর সমস্ত উদ্দেশ্যকে সিদ্ধ করে। প্রাণই সবকিছুর আশ্রয়। তাই তুমি প্রাণকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করো। 

ঋষি নারদ ঋষি সনৎকুমার কথা শুনে চুপ হয়ে গেলেন। কিন্তু সনৎকুমার বার বললেন, প্রাণই সর্বোচ্চ নয়, প্রাণ ব্রহ্মের প্রকাশ স্বরূপ। ব্রহ্ম হচ্ছে সত্যস্বরূপ।  সবকিছুর পিছনে, বা কেন্দ্রে যে সত্য লুক্কায়িত আছে, যাঁকে  ঘিরে সমস্ত জগৎ ঘুরছে, তাঁকেই  ব্রহ্ম নাম অভিহিত করা হয়।  চরম সত্যই ব্রহ্ম। পরোক্ষ জ্ঞান নয় অপরোক্ষ জ্ঞান যা নিজের মধ্যে  উপলব্ধি হয়, তাই ব্রহ্ম।      


         

 

  









                  


     

No comments:

Post a Comment