যথার্থ গুরু দুর্লভ কেন ?
দেখুন, সমস্ত শিক্ষার জন্য যেমন শিক্ষক প্রয়োজন, তেমনি আধ্যাত্মিক জীবনে উন্নতি করতে গেলে আচার্য্য প্রয়োজন। কিন্তু আচার্য্য ও গুরুদেব এক নয়। দেহধারী আচার্য্য আবশ্যক। কিন্তু দেহধারী গুরু আবশ্যক নয়। ভাগ্যক্রমে যদি কেউ পেয়ে যান দেহধারী গুরু, তো ভালো, কিন্তু পেতেই হবে এমনটি নয় । জীব ও শিব অভিন্ন। ভগবান স্বয়ং জীব সেজে মায়ার জগতে আত্মপ্রকাশ করেছেন। কিন্তু জীবের বিড়াম্বনা হচ্ছে, জীব স্বভাবতঃ বহির্মুখী। জীবের নিত্যস্বরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে জ্ঞানগুরু, বা যোগগুরু, যিনি প্রতক্ষ্য জ্ঞানের অধিকারী। এই নির্মল জ্ঞানের প্রাপ্তিতে সাধকের কর্ম্ম-বাসনার বিনাশ হয়। আর বাসনার বিলুপ্তিতে কর্ম্মফল সঞ্চয় হয় না। কিন্তু এতেকরে পরমাত্মার সাথে আত্মার যোগসাধন হয় না। পরমাত্মার সাক্ষাৎ পেতে গেলে প্রকৃত দীক্ষার প্রয়োজন। এই দীক্ষা দিতে পারেন, একমাত্র শিবস্বরূপ সৎগুরু। যিনি নিজে জীবন্মুক্তির রস আস্বাদন করেন। বাসনার ত্যাগে ও প্রারব্ধ কর্ম্মফল ভোগের শেষে মানুষের পৌরুষজ্ঞানের উদয় হয়। তখন তিনি বাস্তবিক শিবস্বরূপে স্থিতি লাভ করেন। এই পৌরুষজ্ঞানের উদয় হতে পারে, একমাত্র ষট্চক্র ভেদের ফলে। এইজন্য যোগক্রিয়া আবশ্যক। যোগক্রিয়া ব্যাতিত শরীর শুদ্ধ হতে পারে না। আর শরীর শুদ্ধ না হলে কোনো গুরুর সাধ্য নেই আপনার মধ্যে দীক্ষার মাধ্যমে চৈতন্যশক্তি সঞ্চালন করে দেবে। যে কোনো শিক্ষক তার অর্জিত জ্ঞানের সামান্যই ছাত্রের মধ্যে বিতরণ করতে পারেন। কেননা ছাত্রের গ্রহণ ক্ষমতা শিক্ষকের মতো নয়, আবার শিক্ষকের মধ্যেও সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু ছাত্র একসময় শিক্ষক হতে পারে, নিজের চেষ্টায়। তাই নিচেষ্ট হয়ে আধাত্মিক জগতের সুফল শুধু গুরুকৃপাতে হয়ে যাবে এমন ভাবার কোনো কারন নেই।
দীক্ষা দুই প্রকার। বাহ্যদীক্ষা ও অন্তর দীক্ষা। যোগের বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেখানোকে বাহ্যদীক্ষা বলা হয়। আবার অন্তরে জ্ঞানের উন্মেষ ঘাঁটানোকে অন্তরদীক্ষা বলা হয়। এই অন্তরদীক্ষা আবার বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। দৃষ্টিদিক্ষা, স্পর্শদীক্ষা, শব্দদীক্ষা, ধ্যান দীক্ষা ইত্যাদি ইত্যাদি। দৃষ্টিদ্বারা তেজের সঞ্চার, স্পর্শদ্বারা তেজের সঞ্চার, মন্ত্রদ্বারা তেজের সঞ্চার, মৌনথেকে তেজের সঞ্চার। এই দীক্ষা তাদেরই দেবার ক্ষমতা আছে, যারা সিদ্ধিলাভ করেছেন, এবং নিজের শক্তিকে সঞ্চালিত করবার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। তাই শুধু সিদ্ধিলাভ করলেই দীক্ষা দেবার ক্ষমতা অর্জিত হয় না। শক্তি সঞ্চালন করবার ক্ষমতা অর্জন করতে হয়। আপনি হয়তো ৬০ কেজি মাল মাথায় নিতে পারেন, কিন্তু আপনি ইচ্ছে করলেই আপনার শক্তি ৫ বছরের সন্তানের মধ্যে সঞ্চালন করে, তাকে ৬০ কেজি বহন ক্ষমতা রাতারাতি বাড়িয়ে দিতে পারেন না। তেমনি যিনিই সিদ্ধি লাভ করেছেন, তিনিই এই অন্তর দীক্ষা দেবার অধিকারী নাও হতে পারেন। যিনি গুরুপদে আসীন হবেন, তিনি অবশ্য়ই জগৎগুরুর সঙ্গে নিজের অভিন্নতা অনুভব করবেন। এবং একমাত্র এই অবস্থায়, স্বয়ং শিব দেহধারী গুরুর মধ্য দিয়ে জগৎগুরু ক্রিয়া করে থাকেন। কিন্তু যার মধ্যে এই তদাত্মবোধ জাগ্রত হয়নি, তার পক্ষে গুরু হবার প্রয়োজন নেই। মানুষের কি সাধ্য আছে পরমাত্মাকে শিষ্যের মধ্যে সঞ্চালিত করবার, যদি না তিনি স্বয়ং নিজেকে প্রকাশ করেন। তো এই ধরনের তথাকথিত গুরুর খপ্পরে পড়ে নিজের অগ্রগতির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। কেননা, গুরু কাজ হচ্ছে শিষ্যের হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তো গুরু না এগুতে পারলে, শিষ্যের এগোনো হয় না। এছাড়া তথাকথিত গুরু শিষ্যের দল ভারী করে, নিজেই আর এগুতে পারেন না। ফল হয়, গুরু শিষ্যের উভয়ের অধঃপতন ।
দিব্যজ্ঞান পরমশিবে নিত্য বিরাজ করছে। এর কণামাত্র সিদ্ধপুরুষগন পেয়ে থাকেন। এই সিদ্ধগুরু স্থূল দেহে অবস্থান করেন না। এর পরে দেহধারী মনুষ্যগুরু। পরমেশ্বর থেকে যে জ্ঞান দিব্যপুরুষের মধ্যে সঞ্চার হয়, তারই একটা অংশ মনুষ্যগুরুর মধ্যেও সঞ্চারিত হয়ে থাকে। গুরুশক্তি যদিও এক কিন্তু মাত্রাভেদ আছে। কিন্তু গুরু আলাদা হলেও জানবেন, জ্ঞান কিন্তু একই। মৎস্যেন্দ্রনাথের গুরু গোরক্ষনাথ। আচার্য্য শংকরের গুরু গোবিন্দপাদ, গোবিন্দপাদের গুরু গৌড়পাদ, গৌড়পাদের গুরু স্বয়ং শুকদেব। এই শুকদেব ছিলেন, সিদ্ধগুরু। শুকদেবের গুরু রাজা জনক, রাজা জনকের গুরু ঋষি অষ্টাবক্র। অষ্টাবক্রের গুরু ছিলেন, ঋষি উদ্দালক। তো এটা একটা পরম্পরা। আর ভগবত ইচ্ছাতেই আসে এই পরম্পরাক্রম।
আসলে, শ্রীভগবানই গুরু। তিনিই জীবের উদ্ধারকর্তা। তিনিই জীবকে মায়াপাশ থেকে উদ্ধার করে, পরম্পদে স্থাপিত করতে সমর্থ। এই সামর্থ আর কারো নেই। পাতঞ্জল যোগসূত্রেও ঈশ্বরকে পূর্বগুরুবর্গেরও গুরু বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনিই অনাদি গুরুতত্ত্ব। এই কথাগুলো শুনে ভদ্রলোক নিষ্প্রভ হয়ে গেলেন। কথাগুলো না বললেই হয়তো ভালো হতো। কিন্তু বিশ্বাস করুন, কথাগুলো বেরিয়ে গেলো, আমি বলতে চাইনি।
------------------
মহাত্মা রামঠাকুরের সাধনপ্রক্রিয়া : গুরুধ্যান
আমার সেই পরিচিত ভদ্রলোক, যিনি রামঠাকুরের কাছ থেকে মন্ত্র দীক্ষা নিয়েছিলেন, তিনি মাঝে মধ্যে আমার কাছে আসেন, বসেন। কিছু প্রশ্ন করেন না। তার এই নীরবতা আমাকে একদিন মুখ খোলালো। তো তাকে একদিন সাধন সম্পর্কে কিছু বলতেই হলো।
প্রথমেই বলি, আমি রামঠাকুরের সাধন পথের পথিক নোই। আসলে শ্রীশ্রী রামঠাকুরের আশ্রিত একজন মহাপুরুষ ছিলেন, তাঁকে সবাই জানতো মাধব পাগলা নামে । এই মাধব পাগলাকে শ্রীশ্রী রামঠাকুর যেভাবে সাধনার ক্রমের কথা বুঝিয়ে বলেছিলেন, সেই ক্রম অনুসারে, এই সাধন পদ্ধতি। এগুলো তার বিভিন্ন বাংলা চিঠিতে প্রকাশিত হয়েছিল। এই মাধব পাগলা ঠাকুর একসময় কাশীর পথে পথে ঘুরে বেড়াতেন। তো তার কাছ থেকে সংগ্রহ করে, ড. গুপীনাথ কবিরাজ এই সাধন প্রক্রিয়ার কথা লিখে গেছেন।
ভদ্রলোককে বললাম দেখুন, যেকোনো সাধন পথে দৃঢ়বিশ্বাস, গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা, আর ভগবানের প্রতি ভক্তি থাকা চাই। এই তিনটি সাধন জীবনের পাথেয়। যেকোনো সাধন পথেই আপনি যান, সেই সাধন পথের যিনি প্রবর্তক তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা থাকা আবশ্যিক। আপনি নিশ্চই শ্রীশ্রী রামঠাকুর প্রতি শ্রদ্ধাবান। তা যদি না হতো তবে আপনি নিশ্চই রামঠাকুরের আশ্রমে যেতেন না। যাই হোক তার প্রবর্তিত সাধন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আপনার মন্ত্রদাতা গুরুদেব কিছু বলেছেন কিনা জানি না। তবে আমি আপনাকে সেই প্রক্রিয়া সম্পর্কে আপনাকে কিছু কথা বলি। আপনার যদি ভালো লাগে, তবে এই পথে আপনি গুরুদেবকে যথাযথ সন্মান করতে পারবেন।
মহাত্মা রামঠাকুরের সাধনপ্রক্রিয়া : গুরুধ্যান
প্রথম প্রক্রিয়া : শ্রীশ্রী রামঠাকুরের মূর্তি, বা গুরুমূর্তি একটা উত্তম স্থানে স্থাপন করুন। প্রতিদিন নিয়ম করে, গন্ধ-পুষ্পাদি দ্বারা নানা উপাচার্যের মাধ্যমে সাধ্য অনুসারে পূজা পাঠ করুন। কিছু স্তোত্র পাঠ করুন। প্রথম দিকে এসব কাজে আপনার শরীর সাধ নাও দিতে পারে। দৈহিক ক্লেশ অনুভব করতে পারেন । এমনকি আপনার মধ্যে যে মানসিক চাঞ্চল্য আছে, বা বিষয়চিন্তা আছে সেগুলো নিশ্চই আপনার ভিতর থেকে সহজে যাবে না, মাঝে মধ্যেই এগুলো আপনার মনে জেগে উঠবে। কিন্তু তার জন্য বিচলিত হবার কিছু নেই। আপনি শুধু প্রথম দিকে, যন্ত্রের মতো নিয়ম রক্ষা করে যান। অর্থাৎ নিয়ম করে, গুরুপূজো শুরু করুন। গুরুপূজো হয়ে যাবার পরে, গুরুমূর্তির প্রতি একদৃষ্টিতে কিছুক্ষন দর্শন করুন। আর মনে মনে আপনি যে মন্ত্র পেয়েছেন, তার জপ্ করতে থাকুন।
সাংসারিক সমস্ত কাজ কর্ম্মের মধ্যেই গুরুদেবকে স্মরণ করতে থাকুন। শ্রীগুরুর আশ্রিতরূপে নিজেকে ভাবতে থাকুন। মনে মনে ভাবুন সমস্ত কাজই গুরুদেবের নির্দেশে সম্পাদিত হচ্ছে। আপনি নিমিত্ত মাত্র। এইভাবে সংসারের প্রতিটি কাজের মধ্যে গুরুদেবকে অর্থাৎ রামঠাকুরকে দেখতে থাকুন।তার চরণ বন্দনা করুন। তার অবয়বের ধ্যান করুন। গুরুদেবের চরণকমল থেকে শুরু করে, গুরুদেবের মুখমন্ডলের ধ্যান করতে থাকুন। এইভাবে ধ্যানের একটা অভ্যাস গড়ে তুলুন। হোক না তা ৫-১০ মিনিট। সকাল-সন্ধ্যা একটা নির্জন স্থানে গুরুদেবের মূর্তির সামনে বসে মেরুদন্ড সোজা করে এই ধ্যানের অভ্যাস করতে থাকুন। কিছুদিনের মধ্যেই দেখবেন, এই ধ্যান অভ্যাস আপনার নেশায় পরিণত হয়ে গেছে। তখন ধ্যান না করে আপনি থাকতে পারবেন না। একদিন ধ্যানে ব্যাঘাত হলে, আপনার মনে কীযেন হয়নি - কীযেন হয়নি বলে মনটা আনচান করতে থাকবে। এইভাবে ধ্যান যখন পরিপক্কতা লাভ করবে, তখন আপনি দ্বিতীয় পদক্ষেপ নিন।
দ্বিতীয় পর্যায় : এই পর্যায় গুরুদেবের পূর্ণস্বরূপের চিন্তন ও জপ-ধ্যান করা আবশ্যক। এই ধ্যানের অভ্যাস করতে করতে একদিন দেখবেন, একটা শব্দ তা সে শো-শো শব্দ হতেপারে, শঙ্খধ্বনি হতেপারে, মধুর বাঁশির ধ্বনি হতেপারে, ঘন্টার ধ্বনি হতেপারে। এই ধ্বনি শুনতে শুনতে আপনার ভিতরে কান্না পেতে পারে। আপনার চোখ দিয়ে আনন্দ-অশ্রু নিঃসরণ হতে পারে। শরীরের মধ্যে একটা কম্পন হতে পারে, এইসময় একটা পুলক অনুভব হতে পারে। এগুলোকে অস্বাভাবিক ভাববার কোনো কারন নেই। এগুলো শারীরিক কোনো রোগও নয়। বরং এইসব লক্ষণ আপনার আধ্যাত্মিক উন্নতির লক্ষণ। এইসময় শ্রীগুরু মূর্তি মানসপটে স্থায়ীরূপে রাখবার চেষ্টা করুন। এইভাবে শ্রীগুরুমূর্তিতে মন স্থির হলে, তৃতীয় স্তরে যেতে পারবেন।
তৃতীয় পর্যায় : এইবার শরীরকে শ্রীগুরুর ইচ্ছেতে চলতে দিন। শরীরের বাইরে ভিতরে শ্রীগুরুকে দর্শন করতে থাকুন। এতে আপনার বিষয়াশক্তি ক্রমশ লোপ পেতে থাকবে। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, হিংসা, দ্বেষ, ভীতি, ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকবে। মন হবে শান্ত। মনের মধ্যে একটা প্রসন্নতার ভাব জেগে উঠবে। সাংসারিক ভাবগুলোর প্রাধান্য কমতে থাকবে। আর শ্রীগুরুর উপরে বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা স্থায়ী ও দৃঢ় হবে। গুরুকৃপার সফলতা স্বরূপ, চিত্তের মধ্যে, অন্তরের অন্তঃস্থলে চিন্ময়সত্তার আবির্ভাব অনুভব হতে থাকবে। সমস্ত পঞ্চতত্ত্ব, সমস্ত জ্ঞান ইন্দ্রিয়, সমস্ত কর্ম্মেন্দ্রিয় গুরুশক্তির প্রভাবে চলতে থাকবে। নিজের মধ্যে কোনো কর্তৃত্ববোধ থাকবে না। চিত্ত তখন নাদবোধে স্থিতি লাভ করবে। গুরু ও শিষ্যের মধ্যে একটা অভেদভাবের উদয় হবে। এর পরে এই অভেদতত্ত্ব বা গুরুদেবের সঙ্গে একাত্মবোধের ফলে গুরুর মধ্যে নিজেকে অভেদ বলে প্রত্যক্ষ করবেন। এইসময় যে কোনো সাংসারিক দায়িত্ব, আনন্দের সঙ্গে সুসম্পন্ন হবে। নিজেকে মুক্ত পুরুষ, নির্ভিক পুরুষ, বলে মনে হবে। পৃথিবীর বুকে তখন আপনি নির্ভিক নিঃসংশয় হয়ে বিচরণ করতে পারবেন। তখন ধর্ম্ম-অধর্ম্ম, পান-পুন্য, সুখ-দুঃখ এমনকি আপনার যে পূর্বার্জিত সংস্কারও আপনাকে বিচলিত করতে পারবে না। তখন আপনি অর্থাৎ সাধক সমস্ত কর্তব্য, সমস্ত দায়িত্ব গুরু চরণে সমর্পন করে, জীবন ধারণ করতে থাকবেন।
এই অবস্থা প্রাপ্তির পর, শাম্ভবী মুদ্রার অভ্যাস শুরু করুন। শাম্ভবী মুদ্রা সম্পর্কে পরে একদিন বলবো। নামজপ যেমন চলছিল, তেমনি চলতে থাকুক। এতে করে আপনার দেহাভিমান দূর হয়ে যাবে। অর্থাৎ আপনি যে গুণাতীত সেই সৎ- পুরুষ, আপনার ভিতরে সেই জ্ঞানের উদয় হবে।
এই অবস্থায় স্বয়ং গুরুদেব আপনার ভিতরে প্রবেশ করবেন। এবং নানান প্রকার অলৌকিক কার্য্য আপনার দ্বারা সংগঠিত হতে থাকবে। যার কোনো ব্যাখ্যা আপনি জানেন না, এমনকি এটি যে কিভাবে আপনার দ্বারা হচ্ছে, তাও আপনি বুঝতে পারবেন না। কিন্তু হয়তো দেখবেন, আপনার মুখ দিয়ে যা কিছু বেরুচ্ছে,, তা বাস্তবে ঘটে যাচ্ছে, এমনকি আপনার কথায়, অসুস্থ মানুষ সুস্থ হয়ে উঠছে, আপনার করুণাদৃষ্টি যার উপরে পড়ছে, তিনি অভিভূত হচ্ছেন। এই অবস্থায়, আপনার মধ্যে একটা অহংকারের উৎপত্তি হবে। আর অহংকার আপনার আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। সুতরং এই বিষয়ে বিশেষ সাবধানতা ও সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক। এই অহংকার কাটিয়ে উঠতে পারলেই, আপনি পরবর্তী পর্যায়ে উন্নীত হতে পড়বেন।
চতুর্থ পর্যায় : এই অহংকারকে অতিক্রম করতে গেলে, আপনাকে গুরুভজন করতে হবে। আর জানবেন, এই ভজন আপনার গুরুশক্তি দ্বারাই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এইসময় সাধকের জীবসত্ত্বার নিজস্ব সংস্কার লোপ পায় না। তাই সংস্কার বা সাধকের ভাব অনুযায়ী তা প্রকাশ হতে থাকে। এই ভাবরস চিত্তকে আনন্দ দান করে। আবার এই আনন্দ গুরুতেই বা ইষ্টেই অর্পিত হয়ে যায়। অর্থাৎ সাধক এইসময় ইষ্টদেব, বা গুরুদেবের দর্শন অনুভব করেন। এইসময় নিজস্ব কোনো সত্ত্বা থাকে না। তখন শুধু ইষ্টসত্ত্বাতে সাধক স্ফূরিত হতে থাকে। আর ইষ্টপ্রীতির জন্য তখন সমস্ত ইন্দ্রিয় উদ্দীপ্ত হয়। সমস্ত ক্রিয়া তখন ইষ্টপ্রীতির জন্যই সম্পাদিত হয়ে থাকে। মন, বুদ্ধি, জ্ঞান, অহংকার ইত্যাদি আমাদের পূর্বপূর্ব সংস্কার ছেড়ে ইষ্টের অনুসন্ধানে লীন হয়ে যায়। যতক্ষন শরীর থাকে, ততক্ষন পর্য্যন্ত স্মরণ মনন থাকে। একেই পরাভক্তি বা ঈশ্বর ভক্তি বলা হয়ে থাকে। এই তীব্র ঈশ্বরপ্রেম তখন বাইরে স্বপ্নবৎ, আর ভিতরে অখণ্ড দিব্যজ্যোতি রূপে প্রকটিত থাকে। তখন সাধক চিন্ময় রস-বিগ্রহ বা সচ্চিদানন্দ স্বরূপ হয়ে যান।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
(মূলসূত্র : সাধুদর্শন ও সৎপ্রসঙ্গ - ৩ খন্ড - ডঃ গোপীনাথ কবিরাজ। পৃষ্ঠা ৮১)
শাম্ভবী মুদ্রা
শাম্ভবী মুদ্রা একদিকে যেমন গুহ্যবিদ্যা অন্য দিকে এই বিদ্যা গুরুবিদ্যা। আমরা যে স্বামী বিবেকানন্দের যোগমূর্তি দেখি, বা ঠাকুর রামকৃষ্ণের যে সমাধি মূর্তি দেখি, বা বাবা লোকনাথের যে ধ্যানস্থ মূর্তি দেখি, তা আসলে এই শাম্ভবী মুদ্রা করা ছাড়া আর কিছু নয়। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, যে অবস্থায় যোগীর মন অন্তরের দিকে লক্ষ্য রাখে এবং বহির্জগতের দিকে যোগী উদাসীন থাকে, তাকেই শাম্ভবী মুদ্রা বলে । এই সময় অপলক দৃষ্টিতে যোগী তাকিয়ে থাকে, কিন্তু বাহ্য জগতের থেকে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে তিনি অন্তর্মুখী হয়ে থাকেন। যোগীর বাহ্যদৃষ্টি তখন নিম্ন মুখী, চোখের তারা নিশ্চল। এইসময় মন ও প্রাণবায়ু সুষুম্নাতে লীন করে দেন। এই মুদ্রা গুরুকৃপাধন। এই অবস্থায় যোগী বহির্জগৎ সন্মন্ধে সর্বভাবনা শূন্য এবং অন্তর্জগৎ ব্রহ্মভাবনায় পরিপূর্ন থাকে। চোখের দৃষ্টি নাসিকার অগ্রভাগে, স্থাপন করতে হবে। মনকে জ্যোতিযুক্ত করে, ভ্রূযুগলকে কিঞ্চিৎ উর্দ্ধে তুলে, শিবনেত্রের অবস্থায়, নাকের ডগায় দৃষ্টি স্থাপন করতে হবে।
যারা সাধনার মধ্যে লিপ্ত আছেন, তারা চোখ বুজলেই জ্যোতি দর্শন করে থাকেন। এই জ্যোতি প্রথম দিকে ক্ষণস্থায়ী, আবার অস্থির থাকে। নাকের ডগায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, জ্যোতিকে স্থির করতে হয়। কিছুক্ষনের মধ্যে মনের গতি রুদ্ধ হয়ে যায়। মন তখন উন্মনা অবস্থায় হৃত হয়।
শাস্ত্র বলছে, যে যোগী অর্থ-উন্মিলিত লোচনে, স্থির মনে, নাসিকার অগ্রভাগে দৃষ্ট স্থির রেখে ইড়া ও পিঙ্গলা দ্বারা প্রবাহিত বায়ুকে লীন করে নিঃশব্দে অবস্থান করেন, তিনি অনন্ত-বিশ্ব-বীজ স্বরূপ শ্রেষ্ট জ্যোতির্ময় তত্ত্বকে প্রাপ্ত হন। সেই বস্তুই শ্রেষ্ঠ ব্রহ্ম। ইড়া ও পিঙ্গলায় যতক্ষন বায়ু প্রবাহিত হয়, ততক্ষন এই জ্যোতির্ময় ব্রহ্মের ধ্যান নিষিদ্ধ। সর্বাগ্রে ইড়া-পিঙ্গলার বায়ু প্রবাহকে রুদ্ধ করে, সুষুম্না নাড়ীতে প্রবাহিত করতে হবে তারপরেই এই শাম্ভবী মুদ্রা বা এই জ্যোতির্ময় ব্রহ্মের ধ্যান হতে পারে।
শাম্ভবী মুদ্রার কথা যোগগুরুগন সযত্নে কুলবধূর ন্যায় রক্ষিত করে থাকেন।
আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলোর অর্থাৎ চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহ্বা,ত্বক - এই ইন্দ্রিয়গনের রাজা হচ্ছেন আমাদের মন। মনের নির্দেশ ব্যাতিত আমরা কোনোকিছুই দেখতে শুনতে পাই না। আবার মনের প্রভু হচ্ছেন প্রাণবায়ু। তাই প্রাণবায়ু স্থির হলে, আমাদের মন স্থির হয়ে যায়। এই প্রাণের প্রভু হচ্ছে লয় অর্থাৎ কালের নিবিচ্ছিন্ন গতি, বা নিবৃত্তি। এই লয়ের স্থানকে বলা হয়, ব্রহ্মস্থান। আর এই লয়ের প্রভু হচ্ছে, নাদ। এই কারনে লয় নাদব্রহ্মকে অবলম্বন করেই অবস্থান করে থাকে। মন-প্রাণে লয় হলে, একপ্রকার আনন্দের উৎপন্ন হয়। লয় শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিক ক্রিয়াকে দূর করে। বিষয়বুদ্ধিকে নষ্ট করে। এমনকি বৈষয়িক উন্নতির ব্যাপারে, কোনো প্রকার কায়িক চেষ্টা থাকে না। মন বিষয়ের ব্যাপারে নির্বিকার হয়ে যায়। যোগীগণ এই লয়ের সাধনা করে থাকেন। এই লয় অবস্থা একমাত্র যোগীপুরুষই উপভোগ করে থাকেন। এই অবস্থার কথা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। সংকল্পের উচ্ছেদ হলে, কায়িক ও বাচনিক সমস্ত চেষ্টার নিঃশেষে হলে, তবেই এই ধরনের লয়-অবস্থা দৃষ্ট হয়। প্রাণ ও মনের লয় না হলে, সাধনায় সিদ্ধিলাভ হতে পারে না। প্রাণের লয় হলে মনের লয়সিদ্ধি আপনা-আপানি এসে যায়।
এখন কথা হচ্ছে, কিভাবে প্রাণের লয় হতে পারে ? দেখুন, প্রথমেই দরকার আমাদের একটা ধর্ম্মিক পরিবেশ। তারপরে দরকার উপযুক্ত সাধুসঙ্গ। এর পরে দরকার উপযুক্ত গুরু। উপযুক্ত গুরুর সন্ধান পেলে, তারই অনুগ্রহে তারই আদেশে আমাদের এই ইড়া-পিঙ্গলায় প্রবাহিত বায়ু, সুষুম্নার মধ্যগত ব্রহ্মরন্ধ্র পথে নিরুদ্ধ হবে। এইভাবে প্রাণবায়ুকে নিরুদ্ধ করতে পারলেই, প্রাণের লয় সম্ভব হয়। আর প্রাণের লয় হলেই মনেরও লয় হয়ে থাকে। যোগগুরুগন বলে থাকেন, যোগ-অভ্যাস দ্বারা প্রাণবায়ু সুষুম্না নাড়ী দ্বারা সঞ্চরণ করে ব্রহ্মরন্ধ্রে স্থিত হলে মন প্রশান্ত হয়ে যায়। একেই যোগ গুরুগন নির্বাণ বলে থাকেন।
বলা হয়ে থাকে, যিনি প্রাণকে লয় করতে পেরেছেন, তিনি কালকেও পরাজিত করতে পেরেছেন। বাহ্যিক জগতে যেমন চন্দ্র সূর্য কাল ধারণ করছে, তেমনি আমাদের শরীরের মধ্যে সূর্য নাড়ী ও চন্দ্র নাড়ী কালকে ধারণ করছে। আর সুষুম্না নাড়ীরুপা সরস্বতী নদী সেই চন্দ্র-সূর্য-কৃত দিবারাত্রি স্বরূপ কালকে গ্রাস করে থাকেন। যখন সূর্য নাড়ীর মধ্যে প্রাণবায়ু প্রবাহিত হয়, তখন দিন, আর যখন চন্দ্র নাড়ী দ্বারা স্বাসবায়ু প্রবাহিত হয়, তখন রাত্রি। লৌকিক দিবারাত্রির অর্থাৎ ২৪ ঘন্টার মধ্যে যোগের দৃষ্টিতে ১২টি দিবারাত্র হয়ে থাকে। এইভাবে কাল অনুসারে, জীবের আয়ু পরিমাপ করা হয়।
যখন সুষুম্না নাড়ীমার্গে প্রাণবায়ু ব্রহ্মরন্ধ্রে বিলীন হয়, তখন দিবারাত্রি স্বরূপ কালের অভাব বশতঃ সুষুম্নাকে কালভোক্ত্রী বলা হয়ে থাকে। সুতরাং যতক্ষন ব্রহ্মরন্ধ্রে প্রাণবায়ু লিন থাকে, ততক্ষন জীবের জীবনকাল বা আয়ু বৃদ্ধি পায়। দীর্ঘকাল সমাধির অভ্যাস করলে, যোগীপুরুষ আগে থেকে আয়ুষ্কাল নির্নয় করতে সক্ষম হন। এবং ব্রহ্মরন্ধ্রে প্রাণবায়ুকে স্থাপন করে কালকে রুখে দিতে সক্ষম হন। তখন আপন ইচ্ছে অনুযায়ী দেহত্যাগ করতে পারেন।
পাখির বাসার মতো এই শরীরে, আত্মা বাস করে থাকেন। এখানে অসংখ্য, বা বলা হয়, ২২ হাজার নাড়ীর সমাবেশ। এর মধ্যে সুষুম্না নাম্নী নাড়ীর মধ্যে শাম্ভবী শক্তি অর্থাৎ শিব-শিবা অর্থাৎ শম্ভূ শক্তি নিহিত আছে। এই শক্তি ভক্তদের সুখ প্রদান করে থাকেন । কেউ বলেন, চিৎস্বরূপ আত্মার অভিব্যক্তির স্থান, এই সুষুম্না নাড়ী । অর্থাৎ এখানেই ধ্যানের মাধ্যমে আত্মসাক্ষাৎকার হয়ে থাকে। আমাদের ইড়া-পিঙ্গলা নাড়ী এই সুষুম্না নাড়ীর সঙ্গে সংযোগ করতে পারে, যদি আমরা এই শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করতে পারি। আর এটি কেবলমাত্র নিরন্তর অভ্যাসের দ্বারাই সম্পন্ন হতে পারে। প্রাণ বায়ু যখনই সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে প্রবাহিত হতে শুরু করে, তখনই সাধকের মধ্যে উন্মনা ভাবের উদয় হয়। এইসব গুহ্যতত্ত্ব গুরুমুখে শুনে, নিজের নিরন্তর অভ্যাসের মাধ্যমে উপলব্ধ হতে পারে। নতুবা এসব কথা শোনা কথা হয়েই থাকবে।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
-------------------
No comments:
Post a Comment