১৯.১২.২০২১
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - দ্বিতীয় অধ্যায় - সাংখ্যযোগ
শ্লোক নং ২/১১ থেকে ২/১২
শ্রীভগবান উবাচ :
অশোচ্যান অম্বশোচস্ত্বম প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভাষসে
গতাসুন্ অগতাসুন্ চ ন অনুশোচন্তি পন্ডিতাঃ। (২/১১)
এর আগে আমরা ভগবানের কথা শুনেছি শ্লোক নং ২/২ ও ২/৩ নং শ্লোকে। এবার দ্বিতীয়বার মুখ খুললেন। বলছেন :
যাদের জন্য শোক করার প্রয়োজন নেই, তাদের জন্য তুমি শোক করছো, আবার পন্ডিতের মতো কথা বলছো ? পন্ডিতগণ জীবিত বা মৃত কারো জন্য শোক করেন না।
আমরা ভগবানের কথা শুনছি। কে এই ভগবান ? ভগ+বৎ। ভগ কথাটার অর্থ ঐশ্বর্য্য, বৎ অর্থাৎ স্থিত। তো যার মধ্যে ঐশর্য্য স্থিত আছে, তাঁকে বলা হয় ভগবান। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, যার মধ্যে ভগবৎ জ্ঞানের উন্মেষ হয়েছে, তাকে বলা হয় ভগবান। এখানে ভগবান অর্থে পরমেশ্বর। পরমাত্মা পরব্রহ্ম নির্গুনং প্রকৃতেঃ পরঃ, কারণাং, কারনানাঞ্চ, শ্রীকৃষ্ণ ভগবান স্বয়ং।
যা গত হয়েছে, যা অবশ্যম্ভাবী তার জন্য কখনোই জ্ঞানীব্যক্তিগন শোক করেন না। আসলে গতবিষয় শোচনার যোগ্য নয়। কারন গতবিষয় কখনো সংশোধন যোগ্য নয়। পন্ডিতের মতো, বা পন্ডিতকে নকল করে কথা বললেই পণ্ডিত হওয়া যায় না। পণ্ডিত হন সমদর্শী। সমদর্শী না হলে পণ্ডিত হওয়া যায় না। এখন সমদর্শী কে ? সমদর্শী হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি নিজের বিবেক জাগ্রত করতে পেরেছেন। স্থুল শরীরে যতক্ষন ইড়া-পিঙ্গলায় শ্বাস-প্রবাহ চলবে, ততক্ষন মানুষ বিমোহিত থাকে। বাহ্যিক বিষয়ে উন্মুখ থাকে। যা নয়, তাই দেখে, যা নয়, তাই শোনে। অনিত্য সংসারকে সে নিত্য বলে মনে করে। যখন সাধনার দ্বারা শ্বাস-প্রবাহ সুষুম্নামুখী হয়, তখন সাধকের শুদ্ধ সত্ত্ব ভাবের উদয় হয়। সত্যিকারের জ্ঞান হয়। এঁকেই বলে প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি। সাধারন মানুষও মাঝে মধ্যে জ্ঞানের কথা বলে বসে, কিন্তু তা তার অপ্রত্যক্ষ জ্ঞান। আবার মাঝে মধ্যে সাময়িক ভাবে আমাদের মধ্যে সত্ত্ব গুনের আভাসেও আমাদের মধ্যে জ্ঞানের স্ফূরণ হয়। কিন্তু তা কিছু সময় পরেই মিলিয়ে যায়। যারজন্য আমাদের সেই জ্ঞানের কথা আমাদের ব্যবহারে প্রকাশ পায় না। শুধু মনে মনে ভাবলেই হবে না - যে আমি আত্মা, যা কিছু দেখছি সবই এক, তোমার আমার মাধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি বড়ো বড়ো কথা বলে নিজেকে পণ্ডিত ঠাওরালে, নিজেকে পণ্ডিত সাজালে, পণ্ডিত হওয়া যায় না।জ্ঞানদৃষ্টি সম্পূর্ণ ভিন্ন বস্তু। সমাধি সাগরে ডুবে, যখন যোগীপুরুষ একমাত্র ব্রহ্মসত্ত্বা অনুভব করেন, যখন সাধকের সহস্রারের ভেদ সম্পূর্ণ হয়, তখনই সমস্ত দ্বৈতভাব দূরীভূত হয়। যখন সমস্ত দ্বৈতভাব চলে যায়, এ'কে স্থির হয় মন, তখন আর শোকের বিষয় থাকে না। তখন এই জগৎ যথার্থই ব্রহ্মময় বলে বোধ হয়। তার আগে থাকে কেবল বুদ্ধির খেলা। আর আমাদের স্থুলবুদ্ধি জীবিত বা মৃত দেখে, শোকাচ্ছন্ন হয়। যখন মানুষ সৎ-চিৎ-আনন্দের মধ্যে স্থির হয়, তখন হয় সত্যিকারের জ্ঞান। এই অবস্থায় সে জীবিত-মৃত-আত্মীয়-অনাত্মীয় দেখে। জ্ঞান হলে, এই যে কার্য্য-কারন স্বরূপ জগৎ সেই মহাশূন্যে যোগী স্থির হয়ে যান ।
প্রাজ্ঞব্যক্তিগন সংসারী ব্যক্তির কানে শুভ সংবাদ প্রদান করেন। তাঁরা বলেন, হে জীবকুল, তোমরা অজর, অমর, চিরন্তন। তোমাদের শোকের কোনো কারন নেই। কে ছিল, কে ছিলোনা, কে থাকবে কে থাকবেনা এই প্রশ্ন অবান্তর। কোথা থেকেই বা এলো, আর কোথায় বা গেলো এই প্রশ্নও অবান্তর। যা ছিলো, তাই আছে। যা ছিলোনা তা নেই। বুদ্বুদ জলেই ছিল, জলের মধ্যে বিলীন হলো। সমুদ্রে ঢেউ উঠেছিল, আবার মিলিয়ে গেলো। কোথায় গেলো ? যেখানকার জিনিস সেখানেই আছে। শুধু তোমার স্থুল দৃষ্টির বাইরে অবস্থান করছে। তো শোকের কোনো কারন নেই। তুমি যেমন নিত্য বর্তমান, তেমনি সবাই নিত্য। তুমি, আমি, ও, সে, বলে কিছু হয় না। এগুলো উপাধি মাত্র। জল বাষ্প হলেও জল, আবার বরফ হলেও জল। তোমার আমার রূপ আসলে সেই মূল সত্ত্বার উপরে আবরণ মাত্র। আবরণ ঘুঁচে গেলেও সত্ত্বার নাশ নয় না। অতএব বিবেকের নির্দেশে কাজ করো। ক্রিয়াশীল হও। যোগক্রিয়া করো। যোগক্রিয়া করে, প্রাণকে স্থির করো। তখন দেখবে সমস্ত ধোঁয়াশা কেটে যাবে। আর ভ্রান্তধারনা কেটে গেলে এইসব অসংখ্য মুখোশ খসে পড়বে। তুমি সত্যে প্রতিষ্ঠিত হবে। তোমার শোক-তাপের কারনের অবলুপ্তি ঘটবে। অতএব যোগক্রিয়াতে নিজেকে স্থিত করো।
ন ত্বেবাহং জাতু নাসং ন ত্বং নেমে জনাধিপাঃ
ন চৈব ন ভবিষ্যামঃ সর্ব্বে বয়ম অতঃপরম্। (২/১২)
এর আগে আমি ছিলাম না, বা তুমি ছিলে না তাও নয়, আবার এই রাজন্যবর্গ ছিলেন না, তাও নয়। আবার এর পরে যে আমরা থাকবো না তাও নয়।
না আমার জন্ম-মৃত্যু আছে, না তোমার জন্ম-মৃত্যু আছে। অর্থাৎ যিনি কূটস্থ তিনি যেমন ছিলেন, তেমনি আছেন। তিনি নিত্য-বর্তমান। তো যিনি নিত্যবর্তমান তা সে ইন্দ্রিয়াদি বলো, বা প্রবৃত্তি-নিবৃত্তি বলো, ভালো-মন্দ বলো, শুভ অশুভ বলো. সবই ব্রহ্ম, অতএব জন্ম মৃত্যু রোহিত। এগুলো সবই অতীতেও ছিল, বর্তমানেও আছে, আবার ভবিষ্যতেও থাকবে। এগুলো সবই ব্রহ্মের প্রকাশ স্বরূপ। কখনো প্রকাশিত কখনো অপ্রকাশিত। তো প্রকাশিত হলে আছে, আর অপ্রকাশিত হলে নেই তা তো নয়। রাতে চোখ দেখতে পায় না, আবার দিনে দেখতে পায়, তাহলে জগৎ কি রাতে নেই, আবার দিনে আছে ? আসলে আছে, কিন্তু কখনো আমাদের দৃষ্টির গোচর, আবার কখনো দৃষ্টির অগোচর। সমস্ত মনুষ্যকুল এমনকি সমস্ত জীবকুল ব্রহ্মময়, নিত্য-সত্য। অতএব এদের নাশ কিভাবে হতে পারে ?
বস্তুর নাম ও রূপ বাদ দিলে, যা অবশিষ্ট থাকে তা অবিনশ্বর। এই অনিশ্বর সত্ত্বার সঙ্গে এক হতে পারলেই আমরা জন্ম-মৃত্যু রোহিত হতে পারি। দেহ আবাসস্থল মাত্র, আবাসিক নয়। তো আবাসস্থলের নাশ হলেও আবাসিকের অস্তিত্ত্ব নষ্ট নয় না। খোলস বদলালেও সর্প সর্পই থাকে।আসলে যা মূল অর্থাৎ আত্মা এই বর্তমান দেহ ধারনের পূর্বে কূটস্থরূপে অন্যদেহে বর্তমান ছিলেন, এখনো একদেহে কূটস্থ আছেন, পরেও অন্যদেহে কূটস্থরূপে বিরাজ করবেন। সুতরাং ত্রিকালে অর্থাৎ ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান-এ যিনি বিদ্যমান আছেন, তার আবার মরা-বাঁচার চিন্তা কিসের ? অন্যদিকে থেকে দেখলেও, এই স্থুল শরীর নাসের পরে, আত্মা সূক্ষ্ম দেহে অবস্থান করেন। আবার এই স্থুল দেহে প্রবেশের আগে অন্য কোনো স্থূল দেহে অবস্থান করছিলেন। আসলে প্রিয় এই দৃশ্যমান শরীরের প্রতি আমাদের একটা মায়া-মোহ তৈরী হয়েছে। আর তাই দেহনাশের ভয়ে মন শোকাভিভূত হয়েছে।
কিন্তু একটু বিচার করলে দেখা যাবে, এই দেহের জন্যও আমাদের শোক অনাবশ্যক। কেননা এই দেহ প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। একসময় এই দেহ ছিলো শিশু, তারপরে যুবক, তারপরে বৃদ্ধ। তো আমরা কি বৃদ্ধ বয়সে এসে শিশুর দেহের জন্য শোকাভিভূত হই ? তা তো হয় না। তবে এই শোক কেন ? যাকে আমরা মৃত্যু বলে থাকি তা আসলে এই দেহের পরিবর্তন মাত্র। সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে তুমি তো দেহ নও, তুমি আত্মা। তো আত্মার দেহান্তর তো প্রকৃতির নিয়ম। একসময় বৃদ্ধ বয়সে, প্রকৃতির নিয়মে যখন দেহ অকেজো হয়ে যায়, তখন এই আত্মাই ভগ্নদেহকে বাসের অযোগ্য মনে করে, নতুন দেহের প্রাপ্তির জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। একথা ঠিক খোলস পাল্টানোর সময়, বা দেহান্তরের সময় একটা কষ্ট আছে। আর সেই কষ্টের একটা কারণও আছে। সেই কথা আমরা ভগবানের মুখ দিয়েই শুনবো।
---------------------------
২০.১২.২০২১
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - দ্বিতীয় অধ্যায় - সাংখ্যযোগ
শ্লোক নং ২/১৩ থেকে ২/১৪
দেহিনঃ অস্মিন যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা
তথা দেহান্তরপ্রাপ্তি-ধীরঃতত্র ন মুহ্যতি। (২/১৩)
যেমন দেহীর এই দেহেই কৌমার, যৌবন ও জরা প্রাপ্ত হয়ে থাকে, তেমনি দেহান্তর প্রাপ্তিও তদ্রুপ। ধীর পুরুষগন তাতে মোহগ্রস্থ হন না।
গীতা পড়তে গিয়ে আমার বারবার মনে হয়েছে, গীতার কথা বোঝানো যায় না, গীতা বুঝে নিতে হয়। আর যার যেমন বিচার বুদ্ধি, সে তেমন করে গীতার মর্মার্থ উপলব্ধি করে। এমনিতে গীতার বাহ্যিক দিক অর্থাৎ গীতার শ্লোকের অর্থ সহজেই বোধগম্য। কিন্তু মর্মার্থ এক এক জনের হৃদয়ে একরকম ভাবে প্রস্ফুটিত হয়।
একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারি, শরীর পরিবর্তন হচ্ছে, মনের পরিবর্তন হচ্ছে, এমনকি আমাদের নামেরও পরিবর্তন হচ্ছে, আর সেটি আমরা ধরতে পারি আমাদের স্মৃতির সাহায্যে। ছোটবেলার গোপাল, পরে হয়েছে শ্রীকৃষ্ণ, তারপরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ,এই যে নামের পরিবর্তন, এর সঙ্গে ঘটছে শরীরের পরিবর্তন। মাথায় একসময় একরাশ ঝাঁকড়া কালো চুল ছিলো। এখন নেই। ধীরে ধীরে চুল কালো থেকে সাদা হয়েছে। কিন্তু অদ্ভুত কথা হচ্ছে এই অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমার একটা নিত্যত্ব বোধ রয়ে গেছে। এই আমি যেন আমিই আছি। সেই আমি আর এই আমি যেন একই। অর্থাৎ দেহের পরিবর্তন হচ্ছে, নামের পরিবর্তন হচ্ছে, এমনকি মনের পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু কোনো একটা নিত্যসত্ত্বা অপরিবর্তনীয় আছে। এঁকেই বলে আত্মা।
আত্মার দেহ আছে বলে তাকে বলা হয় দেহী। এই দেহের তিন অবস্থা শিশু, যৌবন, জরা। তেমনি প্রত্যেকটি বস্তুর তিন অবস্থা, অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। এই অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে আত্মার পরিবর্তন হয়, এমটা নয়। শৈশব অবস্থার নাশ হয়েছে, যৌবন অবস্থারও নাশ হয়, শুরু হয় বৃদ্ধাবস্থা । একদিন এই বৃদ্ধাবস্থার নাশ অবশ্যই ঘটবে, যাকে আমরা বলি মৃত্যু । কিন্তু আমি বা আত্মা থাকবো। অর্থাৎ আত্মার নাশ হয় না। তো যার নাশ হয় না, তার উৎপত্তিও হয় না। আবার উল্টো দিক থেকে বলা যায়, যার উৎপত্তি আছে তার নাশ আছে।
এইজন্য বলা হয়ে থাকে ধীর ব্যক্তি, ধীমান ব্যক্তি, যার মন বুদ্ধিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে তিনি এই অবশ্যম্ভাবী পরিণতির কথা জানেন ব'লে, আত্মাকে বলেন অশোচ্য। যার নিত্যঅনিত্য জ্ঞান হয়েছে, যিনি ঋতুসকলের পরিণতি জানেন, তিনি প্রত্যেক বস্তুর পরিণতি জানেন বলে, তাই তিনি কখনো শোকাচ্ছন্ন হন না।
মাত্রাস্পর্শাঃ তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণ-সুখ-দুঃখদাঃ
আগম-অপায়িনঃ-অনিত্যাঃ-তান তিতিক্ষস্ব ভারত। (২/১৪)
হে কৌন্তেয়, ভোগ্য বিষয়ের সাথে, ইন্দ্রিয়ের সংযোগ, আসলে শীত উষ্ণ বা সুখ-দুঃখ অস্থায়ী অনিত্য। অতয়েব হে ভারত, এসব সহ্য করো।
মাত্রাস্পর্শাঃ অর্থাৎ তন্মাত্রের সংযোগে, শীত-গ্রীষ্ম, সুখ-দুঃখ অনুভব হয়। এই পঞ্চতন্মাত্র হচ্ছে ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। আর এর গুন্ হচ্ছে, ব্যোম-শব্দ, মরুৎ-স্পর্শ, তেজ-রূপ, অপ-রস, ক্ষিতি -গন্ধ। তো বাতাসের সাহায্যে আমাদের অনুভব শক্তি আসে। আবার এই বায়ু যখন গতিহীন হয়, তখন শব্দ ইত্যাদি গুনও গতিহীন হয়ে পড়ে। সুতরাং তন্মাত্রের গুন্ গতিরহিত হলে, অর্থাৎ স্পর্শবর্জিত হলে, সুখ-দুঃখ রোহিত অবস্থার উদ্ভব ঘটে। তন্মাত্রের সাথে স্পর্শ বা বায়ু থাকলে তবেই সুখের সাথে দুঃখ, অনুভব হয়ে থাকে। এইজন্য বলা হয়ে এই পঞ্চ তন্মাত্রের অতীত হয়ে কূটস্থে অর্থাৎ আজ্ঞাচক্রে বায়ুকে স্থির করতে পারলে, আমরা বাহ্যিক সুখ-দুঃখের অতীতে পৌঁছাতে পারবো। আর মন যখন আজ্ঞাচক্রে স্থির হবে, তখন আর মনের মধ্যে সংকল্প-বিকল্প উঠবে না। মন তখন নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে একে বলা হয়, মনের "অমন" অবস্থা। আমাদের কামনা, সংকল্প, সংশয়, ভয়-ভালোবাসা, শ্রদ্ধা-অশ্রদ্ধা, ধৈর্য্য-অধৈর্য্য লজ্বা ঘৃণা, জ্ঞান-অজ্ঞান সবই মনের ক্রিয়া সঞ্জাত। আবার মন এইসব বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে সংযোগ স্থাপন করে থাকে। মন যখন ক্রিয়াহীন হয়ে যায়, তখন মনের মধ্যে আর এ-সমস্ত থাকে না। মনের এই পরাভাবকে বলা হয় আত্মভাব। এই আত্মভাবে থেকে বিচ্যুত হয়ে আমরা সংসারে আকৃষ্ট হই। কিন্তু আত্মভাবে বাহ্যিক সংসারী ভাব থাকে না। এই আত্মভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে আমাদের আজ্ঞাচক্রে স্থিতি লাভ করতে হবে। তখন ইন্দ্রিয়লব্ধ সুখ-দুঃখের উর্দ্ধে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সাধক। আজ্ঞাচক্রে বায়ুকে স্থির করাই সাধন-সংগ্রাম। মূলাধার থেকে স্বাধিষ্ঠান, স্বাধিষ্ঠান থেকে মনিপুর, মনিপুর থেকে অনাহত, অনাহত থেকে বিশুদ্ধ, বিশুদ্ধ থেকে অকার-উকার-মকার, নাদ, নাদ থেকে বিন্দু। এই হচ্ছে গতিপথ। ধীরে ধীরে বায়ুকে এই পথে সঞ্চালন করে আজ্ঞাচক্রে বিন্দুতে স্থিত করাই সাধনা।
যাদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়ে আমরা বিষয়ভোগ করে থাকি, সেই সন্মন্ধ উৎপত্তি-বিনাশশীল। একসময় এই সম্পর্কের উৎপত্তি হয়, একসময় এই সম্পর্কের নাশ হয়। অতয়েব এই সম্পর্ক সাময়িক। একদিন অবশ্যই এই সম্পর্কের সমাপ্তি হবে। এই সম্পর্কের জন্য যে শোক তাও সাময়িক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই শোকের সমাপ্তি হবে। শুধু অপেক্ষা, সহ্য করা। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা জনিত কষ্ট, ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চলে যাবে। শুধু সহ্য করো।
আবার বলি, পঞ্চ তন্মাত্রের প্রভাবে, এই শরীরের জন্ম-স্থিতি-মৃত্যুর অনুভব হয়ে থাকে। সাধন দ্বারা আজ্ঞাচক্রে স্থিতি লাভ করলে, অর্থাৎ আজ্ঞাচক্রে বায়ুকে স্থির করতে পারলে সাধক পরমানন্দস্বরূপ হয়ে ওঠেন। তখন ইদ্রিয়লব্ধ কোনো সুখ-দুঃখের অনুভূতি তাকে স্পর্শ করতে পারে না।
----------------------------
২১.১২.২০২১
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - দ্বিতীয় অধ্যায় - সাংখ্যযোগ
শ্লোক নং ২/১৫
য হি ন ব্যথয়ন্তি এতে পুরুষং পুরুষর্ষভ
সম-দুঃখ-সুখং ধীরং স অমৃতত্বায় কল্পতে। (২/১৫)
হে পুরুষর্ষভ, অর্থাৎ পুরুষশ্রেষ্ট, এই সুখ-দুঃখ যে ধীর ব্যক্তিকে ব্যথিত করে না, সেই ব্যক্তিই অমৃতত্ব লাভ করে।
এখানে একটা অমৃতবাণীর কথা আমাদের শ্রুতিগোচর হচ্ছে, আর সেটি হচ্ছে অমৃতত্ব। বলছেন, ধীর ব্যক্তি সুখ দুঃখের অতীত। যে সাধকের বায়ু স্থির হয়েছে, তিনি মৃতবৎ আর মৃতবৎ শরীরে কোনো ব্যাথা-কষ্ট অনুভাব হয় না। কূটস্থে যিনি স্থির, তাঁর সুখ-দুঃখ নেই , ব্যাথা কষ্ট নেই, অথচ অমর, অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যু রহিত। সাম্যাবস্থায় বিরাজ করছেন। শরীর যতক্ষন আত্মবোধ সম্পন্ন ততক্ষন সুখ-দুঃখের অনুভব। কিন্তু দেহাতীত চৈতন্য উত্তম পুরুষ, তিনি দেহের অতিরিক্ত কিছু। আমরা আগেই শুনেছি, কূটস্থে বায়ু স্থির হলে সব অনুভবের উর্দ্ধে চলে যাই আমরা। সাধনের দ্বারা এই স্থিরত্বপদ লাভ করতে হয়। এখন কথা হচ্ছে, স্থির মানে তো জড় মাটি পাথর। তো সেখানে সুখ-দুঃখ নাও থাকতে পরে, কিন্তু আনন্দের অনুভূতি কিভাবে আসবে ? অর্থাৎ পাহাড়-পর্ব্বতের কি আনন্দ অনুভূতি থাকতে পারে ? দেখুন, পাহাড়ে বা পাথরে চৈতন্যের স্থিতি চৈতন্যের ভাগ সামান্যই আছে। কিন্তু জড়বৎ এইযে দেহটির অবস্থা এটি পূর্ণভাবে চৈতন্যে স্থিতি। আর চৈতন্য স্থিতি থাকার জন্য, চৈতন্যের সে মূল স্বরূপ সেই আনন্দ এখানে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে প্রবাহমান। এই চেতন ভাবের মধ্যে কখনোই সুখ বা দুঃখের উদয়-অস্ত হয় না। এই পরমানন্দ স্বরূপকেই বলা হয় অমৃতত্ব। দেখুন সাধারণ মানুষ সর্বদা দেহে স্থিত। আমরা কেউ আত্মাতে স্থিত নোই। আর আমরা আত্মাতে থাকতে পারি না, বা থাকি না বলে, আমাদের চঞ্চল মনের বিক্ষিপ্ত জ্ঞান আমাদের ঘিরে ধরে। আমরা কেউ নিজেকে দেখতে পাইনা। আমার এই "আমি" যখন আত্মাতে রমন করতে সক্ষম হবে তখন চোখের সামনের ভ্রমাত্মক জগতের বিলোপ ঘটবে। সেই সঙ্গে জাগতিক সুখ-দঃখের বোধ চলে যাবে। পঞ্চ-তন্মাত্রের স্পর্শবোধ রোহিত হয়ে তখন সুখ দুঃখের অতীতে চলে যাবো। আর এরজন্যই আমাদের সাধনায় লিপ্ত হতে হবে। সাধনের দ্বারা এই উপলব্ধি আমাদের ভিতরে ধীরে ধীরে জেগে উঠবে। আসলে বাহ্যিক জগতে কি ঘটছে, সেটি বড়ো কথা নয়। এই ঘটনা আমাকে কতটা স্পর্শ করতে পারছে, সেটাই বড়ো কথা। আর এই অবস্থা প্রাপ্তি ঘটাতে গেলে, আমাদের বায়ুর সাধনা করতে হবে, তেজের সাধনা করতে হবে।
এই প্রসঙ্গে আরো দুটো কথা : আমাদের মতো সাধারনের দৃষ্টিতে অমরত্ত্ব, অমৃতত্ব, মৃত্যুঞ্জয় সম্পর্কে একই ধারণা পোষণ করে থাকি। বস্তুত অমরত্ব ও মৃত্যুঞ্জয় একই বিষয় হলেও, মৃত্যুঞ্জয় অনেক উচ্চ অবস্থা। দেখুন পুরান কাহিনীতে পাই, সমুদ্র মন্থন করে, যে অমৃত পাওয়া গিয়েছিলো, তা পান করে দেবতাগণ অমরত্ব লাভ করেছিলেন। অন্যদিকে এই অমৃতের গরল অংশ পান করে দেবাদিদেব মহাদেব মৃত্যুঞ্জয়ী হয়েছিলেন। কালরূপী মৃত্যুকে জয় করতে না পারলে, মৃত্যুঞ্জয়ী হওয়া যায় না। এই কালকেই বলা কালকূট। দেবতাগণ এই কালকূট হজম করতে পারেন না। এই যে মহাদেবের মৃত্যুঞ্জয়ী হবার ক্ষমতা, একে বলা হয় স্বরূপের রূপান্তর সম্পাদন।
আমরা জানি ভৌত ও অভৌত মিলিয়ে আমাদের পাঁচটি শরীর। অনন্ময়, প্রাণময়, মনোময়, বিজ্ঞানময়, আনন্দময়। সাধনক্রোম এইরকম - প্রাণময় থেকে প্রাণশক্তি নিয়ে অনন্ময় শরীরে প্রবেশ করতে হয়। প্রতিনিয়ত এই অভ্যাসে অনন্ময় শরীরকে প্রাণময়রূপে পরিণত করা যায়। তখন প্রাণময় যেমন অনন্ময় সত্তায় সত্তবান হয়, তেমনি অনন্ময় প্রাণময় সত্তায় সত্তবান হয়। এই হচ্ছে প্রথম অবস্থা। এর পরে প্রথম অবস্থা থেকে উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হতে হবে। এখন প্রথম অবস্থা থেকে মনোময় শরীরে প্রবেশ করতে হবে। এবং প্রথম অবস্থায় মনোময় করে তুলতে হবে। ধীরে ধীরে যখন এই তিনটি সত্তা এক হয়ে যাবে তখন জানবেন আপনি দ্বিতীয় অবস্থায় উন্নীত হয়েছেন। এর পরে আরো উর্দ্ধে উত্থিত হয়ে, বিজ্ঞানময় কোষে প্রবেশ করতে হবে। এবং অনন্ময়-প্রাণময়-মনোময় কোষকে বিজ্ঞানময় কোষের সঙ্গে একাত্ম করতে হবে। এই অবস্থাটি তৃতীয় অবস্থা। এরপরে এই তৃতীয় অবস্থাটির উত্তরণ ঘটাতে হবে। অর্থাৎ এবার আনন্দময় সত্তার সঙ্গে একাত্ম করতে হবে। একে বলা হয় চতুর্থ অবস্থা। এই অবস্থাই শেষ নয়, এর পরে আমাদের এই চতুর্থ অবস্থা থেকে আরো উর্দ্ধমুখী হতে হবে, আর তা হচ্ছে এই চতুর্থ অবস্থার সঙ্গে চিৎঘনরূপের অর্থাৎ চিৎস্বরূপ আত্মার মধ্যে প্রবেশ করতে হবে। এবং এই আত্মার সঙ্গে একাত্ব হতে হবে। তখন আত্মা আর শরীরের সঙ্গে কোনো প্রভেদ থাকবে না। তখন সমস্ত কোষের ভিন্নতা লোপ পেয়ে যাবে। এই অবস্থাই মৃত্যুঞ্জয় অবস্থা। দেবতাগণ অমৃতপানে অমরত্ব লাভ করেছিলেন, কিন্তু ,আপনারা জানেন, পুণ্যকর্ম্মফল ভোগের শেষে দেবতাদের আবার মৃত্যুপুরীতে ফিরে আসতে হয়। অর্থাৎ দেবতাগণ দীর্ঘজীবী কিন্তু মৃত্যুর অধীন। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় অবস্থা কালের অধীন নয়। কালের অতীত এই মৃত্যুঞ্জয় অবস্থাতে পৌঁছলে, সিদ্ধপুরুষগন স্বেচ্ছা-জন্ম-মৃত্যু গঠনের যোগ্য হয়ে যান। শ্রীগীতাতে এই সম্পর্কে আমরা ভগবানের মুখে আরো শুনবো।
----------------------
২২.১২.২০২১
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - দ্বিতীয় অধ্যায় - সাংখ্যযোগ
শ্লোক নং ২/১৬
নাসতো বিদ্যতে ভাবো, নাভাবো বিদ্যতে সতঃ
উভয়ঃ অপি দৃষ্টঃঅন্তঃ তু অনয়োঃ তত্ত্ব দর্শিভঃ। (২/১৬)
যে বস্তু অনিত্য, তার অস্তিত্ত্ব থাকে না। যে বস্তু নিত্য, তার নাশ হয় না। তত্ত্বদর্শিগণ এইভাবে উভয়ের পরিনাম দর্শন করেছেন। (২/১৬)
এই কথাগুলো আমরা বহুবার শুনেছি - অনিত্য বস্তুর বিনাশ নেই, আর নিত্যবস্তু অবিনাশী। আর এই অনিত্য বস্তুর বিনাশ হতে আমরা প্রতি মুহূর্তেই দেখছি। কিন্তু সত্য হচ্ছে, অনিত্য বস্তুই আমাদের চোখের সামনে ভাসছে, যা জন্মাচ্ছে আবার মারা যাচ্ছে । আর যাঁকে নিত্যবস্তু বলা হচ্ছে, তা আমাদের সামনে প্রকাশিত হয় কৈ ? আমরা যারা সাধন জগতের মানুষ নোই, তারা কখনো নিত্য বস্তুর সম্মুখীন হই না কেন ? শাশ্বত বস্তু যদি কিছু থাকে তা আমাদের কাছে দৃষ্টির অগোচর কেন ? আমরা উপনিষদে পড়েছি "তত্ত্বমসি"। এগুলো আমাদের পড়া জ্ঞান - যার সারতত্ত্ব আমাদের কাছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, এমনকি উপল্বদ্ধিতেও নেই। আরো একটা কথা হচ্ছে, এই যে দৃশ্যমান প্রপঞ্চ জগৎ, এইসব নাকি উৎপত্তির আগে সেই সৎস্বরূপেই অবস্থান করছিলো। আর সেই সৎবস্তুই এক এবং একমাত্র। যদি সৎ বস্তু এক এবং অদ্বিতীয়, তবে জগতের এই ভিন্নতা আসে কোথেকে। বস্তুর এতো প্রকারভেদ এলো কোথেকে ? এমনকি অজ্ঞানী শিষ্য আর জ্ঞানী গুরুর মধ্যে এই পার্থক্য কেন, যদি আমরা সবাই এক হই।
এইসব প্রশ্নের জবাব পেতে গেলে, নিজের মধ্যে প্রশ্ন জাগাতে হবে। এইসব প্রশ্নের জবাব পেতে গেলে, নিজের মধ্যে যে জ্ঞানের ভান্ডার তালামারা অবস্থায় পড়ে আছে, তার উন্মোচন করতে হবে। দেখুন এই সৎবস্তুকে জানতে গেলে, আমাদের এই অস্ৎবস্তুর উপরে যে আবরণ আছে, তাকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করতে হবে। অর্থাৎ নিজের এই দেহের বাইরে-ভিতরে যে মলিনতা যুগ-যুগ ধরে জমা হয়ে আছে, তাকে পরিষ্কার করতে হবে। আর এই কাজটি করতে পারে, যোগসাধনা। দেখুন, আমরা যে সৎবস্তুকে জ্ঞাত হতে পারি না, তার কারন হচ্ছে, এই সৎবস্তু দেশ-কাল-বস্তুর পরিচ্ছেদ পরিধান করে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমার শ্রদ্ধেয় মাস্টার মহাশয়, আজ যাত্রামঞ্চে ভিখারির অভিনয় করছেন, সেইমতো ছেঁড়া-ময়লা জামা কাপড় পড়েছেন, তাই আমরা তাকে শ্রদ্ধেয় মাস্টার-মহাশয় বলে চিনতে পারছি না।
এইজন্য যোগক্রিয়ার উচ্চ-অবস্থাতে যখন আমাদের প্রাণ-মন-ইন্দ্রিয়-বুদ্ধি সমস্ত বিলুপ্ত হয়ে যাবে, তখনই আমাদের নির্মল চিত্তে শুদ্ধবুদ্ধির উদয় হবে, আর তখনই আত্মার স্বরূপ জ্ঞান আমাদের শুদ্ধবুদ্ধিতে ভাসতে থাকে। সুতরাং যোগক্রিয়া না করলে, আত্মভাবে সমাহিত হওয়া যায় না। ঋষি পতঞ্জলি বলেছেন, চিত্তবৃত্তি নিরোধেই যোগ সম্পন্ন হতে পারে। আর সহজ প্রাণায়ামের অভ্যাসের দ্বারাই এই চিত্ত-বৃত্তি নিরোধের অবস্থা প্রাপ্ত হওয়া যায়। শ্বাসের নিয়ন্ত্রণ, শ্বাসের রেচক-পূরক-কুম্ভক অভ্যাস করলেই প্রাণের স্থিরতা আপনা-আপনি আসতে পারে। আর শ্বাসের এই স্থিরপদ প্রাপ্ত হলেই, জীবতত্ত্ব পরমতত্ত্বের উপলব্ধি করতে পারে। আর এই যোগীপুরুষই তখন ব্রহ্মজ্ঞ হতে পারেন। তখন তার কাছে নিত্য-অনিত্য জ্ঞান পরিষ্কার হয়ে যায়।
২৩.১২.২০২১
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - দ্বিতীয় অধ্যায় - সাংখ্যযোগ
শ্লোক নং ২/১৭
অবিনাশী তু তদ্বিদ্ধি যেন সর্ব্বম ইদং ততম
বিনাশম অবয়স্য অস্য ন কশ্চিৎ কর্ত্তুম অর্হতি। (২/১৭)
জেনে রাখো, যার দ্বারা এইসব (জগৎ) পরিব্যাপ্ত তা কিন্তু বিনাশরহিত। এই অব্যয় বস্তুর অর্থাৎ উৎপত্তি-নাশহীন সদ্বস্তুর বিনাশ কেউ করতে পারে না।
অবিনাশী তু তদ্বিদ্ধি। কথাটার অর্থ দুই ভাবে করা যায়। সেই অবিনাশী তত্ত্বকে তুমি জানো। আবার তুমি যে অবিনাশী এই তত্ত্বকে তুমি জানো। তু বলতে সৎতত্ত্বকে বোঝানো যেতে পারে, আবার তু বলতে তুমি বা অর্জুনকে বোঝানো যেতে পরে। যাই বোঝানো হোক না কেন, সৎবস্তু আর তুমির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, এই কথাটা আমাদের বোঝার চেষ্টা করতে হবে ।
আবার "যেন সর্বমিদং ততম" - এই কথা কয়টি, শ্রীগীতার মধ্যে আমরা আরো কয়েকবার শুনবো প্রাসঙ্গিক-ক্রমে। বলা হচ্ছে, সমস্ত তত্ত্বই এই নিত্যতত্ত্ব দ্বারা পরিব্যাপ্ত।আবার
"বিনাশম অবয়স্য অস্য ন কশ্চিৎ কর্ত্তুম অর্হতি"। শরীরের মধ্যে আছেন শরীরী। আর এই শরীরীর কেউ বিনাশ করতে পারে না। কিন্তু শরীর প্রতিনিয়ত বিনাশশীল। শরীরের এই ধংসক্রম কেউ রোধ করতে পারে না।
আমরা জানি আত্মা সর্বব্যাপী। আবার চোখের সামনে আমরা যেসব খন্ড বস্তু দেখছি, তাও আত্মা। এই সতবস্তুই নাকি ভিন্ন ভিন্ন রূপে আমাদের নিকট দৃশ্যমান হচ্ছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই জগৎ যাকে মহাত্মাগণ অনিত্য বলছেন, আবার বলছেন, এই জগতের মধ্যেই সতের স্ফূরণ হচ্ছে, তো জগৎ যদি বিনাশশীল হয়, তবে জগতের মধ্যে যিনি সৎ তারও তো তাহলে নাশ হচ্ছে। এই প্রশ্নের উত্তর আছে, "অবিনাশী তু তদ্বিদ্ধি" এই কথাটার মধ্যে।
উপনিষদ বলছে, ব্রহ্মার চার অবস্থা। জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি ও তুরীয়। এই চার-এর মধ্যে তিন অবস্থাতেই আমি আছি। জাগ্রত অবস্থাতে আমি থাকে। স্বপ্নাবস্থাতেও আমি থাকে, আবার সুষুপ্তি অবস্থাতেও আমি থাকে। তুরীয় অবস্থাতে আমির বিলোপ সাধন হয়, থাকে সেই সৎ স্বরূপ চৈতন্য। তো যখন আমার স্ফূরণ ঘটে অর্থাৎ জাগ্রত ও স্বপ্ন অবস্থা তখন আমি। সুষুপ্তি অবস্থায়, আবার এই আমির সাময়িক নিষ্ক্রিয় অবস্থাতেই আমিই থাকি। তো ক্রিয়াশীল অবস্থাতেও আমি আবার নিষ্ক্রিয় অবস্থাতেও আমি। ঠাকুর রামকৃষ্ণ এই অবস্থাকে সুন্দর উদাহরনের সাহায্যে বলেছেন, বলছেন, সাপ, কুণ্ডলী পাকিয়ে গর্তের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকলেও সাপ আবার জেগে উঠলেও সাপ। তো সুসুপ্তির অবস্থার আগেও যে "আমি" ছিলো, জাগ্রত অবস্থাতেও সেই আমিই আছে। এমনকি আমাদের স্থুলশরীরের মৃত্যু হলেও, আমরা সূক্ষ্ম শরীরে অবস্থান করি, অর্থাৎ মনোময় শরীরে অবস্থান করে থাকি। তখনও আমিই থাকি। স্বামী বিবেকানন্দকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল, মৃত্যুর পরে, মানুষ কি অবস্থায় থাকে, তখন তিনি বলেছিলেন, আমরা স্বপ্নাবস্থায় যেমন থাকি, স্থুল শরীরের মৃত্যুর পরে আমরা এই স্বপ্নবৎ অবস্থায় থাকি। তাই আমি অর্থাৎ আত্মা, যাঁকে উপনিষদ বলছেন, সৎবস্তু, তিনি নিত্য তিনি অবিনাশী। এই যে তত্ত্বকথা এগুলো যোগগুরুর কাছে, দৃশ্যত সত্য। ধীরে ধীরে আমরা যত শ্রী গীতার মধ্যে প্রবেশ করবো, তত এই সত্য আমাদের কাছে প্রস্ফুটিত হতে থাকবে।
২৪.১২.২০২১
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - দ্বিতীয় অধ্যায় - সাংখ্যযোগ
শ্লোক নং ২/১৮
অন্তবন্ত ইমে দেহা নিত্য আসক্তাঃ শরীরিণঃ
অনাশিনো অপ্রমেয়স্য তস্মাদ যুধ্যস্ব ভারত। (২/১৮)
অবিনাশী অপ্রমেয় এবং নিত্যস্থিত শরীরীর অর্থাৎ জীবাত্মার এই দেহকে নশ্বর বলা হয়েছে। অতয়েব হে ভারত তুমি যুদ্ধ করো।
যাঁকে কোনো ভাবেই নাশ করা যায় না, অর্থাৎ অবিনাশী , আবার অপ্রমেয় যা প্রমানের বিষয় নয়। শরীরীর যার প্রতি আসক্ত সেই শরীরের বিনাশ আছে। এ এক অদ্ভুত কথা, শরীরের বিনাশ আছে কিন্তু শরীরীর বিনাশ নেই। আমাদের যে স্বরূপ, তা যখন যে বস্তুতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন, অর্থাৎ যাতে তিনি আসক্ত হন, সেই বস্তুতেই আমিত্ব ভাব জেগে ওঠে। যেমন শরীরে আসক্ত বা প্রবেশ করলে, তিনি শরীরী, বলে মনে হয়। নিজেকে ধনের মধ্যে প্রবেশ করলে, তিনি ধনী। বিদ্যার মধ্যে প্রবেশ করলে, আমি বিদ্বান। বুদ্ধির মধ্যে প্রতিষ্ঠা করলে, বুদ্ধিমান। সিদ্ধির মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলে আমি সিদ্ধ, এইভাব জেগে ওঠে।
সমুদ্রের মধ্যে বুদ্বুদের নাশ আছে, যতক্ষন বাতাস আছে, ততক্ষন বুদ্বুদের স্থিতি। বাতাস নেই তো বুদ্বুদ নেই। আবার শরীরের মধ্যে যতক্ষন শ্বাসের ক্রিয়া চলতে থাকে ততক্ষন শরীর আছে, বাতাস নেই তো শরীর নেই। কিন্তু এই যে জল, এর নাশ নেই। এই শরীর যার ভিতরে উৎপন্ন হয়েছে, যার দ্বারা উৎপন্ন হয়েছে, সেই সৎ সত্তার বিনাশ নেই। এইজন্য তোমার কর্তব্য হচ্ছে ক্রিয়া করা, করে যাও। শরীরের নাশ হবে, এই ভেবে তুমি ক্রিয়া বন্ধ করো না। শরীর ধারনের উদ্দেশ্য হচ্ছে কর্ম্ম করা। শরীরের একদিন নাশ হবেই। বাতাস চলে গেলে বুদ্বুদের নাশ হবে। আবার শরীরের মধ্যে থেকে বাতাস বেরিয়ে গেলে শরীরের নাশ হবে।
এখন কথা হচ্ছে, আমি তো এই শরীরের মধ্যেই বদ্ধ অবস্থায় আছি। তো এই শরীরের নাশ হলে, তো আমি অবশ্য়ই মুক্ত হয়ে যাবো। তবে আর এই সাধন ভজনের দরকার কি ? এই ক্রিয়াকর্ম্মের দরকার কি ? শরীরে আশ্রয় নেবার আগে আমি মুক্ত ছিলাম, আবার শরীরের নাশের মুহূর্ত থেকে আমি মুক্ত হয়ে যাবো। বরং ক্রিয়াহীন হয়ে অপেক্ষা করাই শ্রেয়।
একদিক দিয়ে বলতে গেলে, কথাটা সত্য যে শরীরের নাশেই জীবাত্মার মুক্তি। কিন্তু এই শরীর তো একটা নয়, অসংখ্য। বোঝার সুবিধার জন্য, শরীরকে পাঁচ ভাগে (অনন্ময়, প্রাণময়, মনোময়, বিজ্ঞানময়, আনন্দময়) ভাগ করা হয়েছে। আবার সূক্ষ্ম ও কারন ভেদে এঁকে তিন ভাগে (স্থুল-সূক্ষ্ম-কারণ) ভাগ করা হয়েছে। আবার পার্থিব-অপার্থিব ভেদে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তো এই সমস্ত শরীরের নাশের জন্যই এই সাধনক্রিয়া।
দেখুন, স্থুল মতে শরীর ধারনের জন্য, শরীর রক্ষার জন্য, আমরা নানানরকম ক্রিয়া-কর্ম্ম করে থাকি। কেউ কখনোই শরীরের নাশের উদ্দেশ্য নিয়ে ক্রিয়া করি না। এইখানে সাধারন ক্রিয়া ও আধ্যাত্মিক ক্রিয়া বা যোগক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য। আমরা স্বাভাবিক ভাবে যা কিছু করি, তার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমাদের শরীরের রক্ষা, শরীরের শক্তি বৃদ্ধি, এবং শরীরের বিনাশক্রিয়াকে রোধ করবার চেষ্টা। কালের নিয়মে স্থুল শরীরের একদিন অবশ্য়ই নাশ হবে। এমনকি সূক্ষ্ম শরীরেরও নাশ হবে। কিন্তু কারন শরীরের নাশ সহজে হয় না। এই কারন শরীর থেকেই আবার নতুন শরীরের উদ্ভব হবে। এ যেন গাছের ডাল ছেঁটে গাছকে নির্মূল করবার চেষ্টা।
প্রবৃত্তি রূপ আবরনের দ্বারা আমাদের সূক্ষ্মদেহ আবৃত রয়েছে। সূক্ষ্ম থেকেই স্থূলের আবির্ভাব হয়েছে। আবার স্থুলদেহ সূক্ষ্মদেহকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে থাকে। সূক্ষ্ম দেহ হচ্ছে জ্ঞানস্বরূপ। এই সূক্ষ্মদেহ ছাড়া আমাদের স্থুল দেহ কোনো কাজ করতে পারে না। আবার সূক্ষ্মদেহ স্থুলদেহ ভিন্ন কোনো কাজ করতে পরে না। তাই স্থুল দেহ সুক্ষ্ম দেহের প্রদর্শিত পথে অর্থাৎ জ্ঞানের পথে কাজ করে সর্বজ্ঞানময় ও সর্বতেজময় হয়ে উঠতে পারে। আবার কামনা ও প্রকৃতি দ্বারা পরিচালিত হয়ে সে অধোগামী হতে পারে। মনোময় নাম্নী সুক্ষ দেহ কামনা দ্বারা আবৃত থাকে। বিজ্ঞানময় দেহ জ্ঞানের দ্বারা আবৃত্ত থাকে।
মৃত্যুর পরে, যে সূক্ষ্ম দেহ স্থুল দেহ থেকে বের হয়ে যায়, তাও স্থূলের মতোই ভৌতিকদেহ। যখন সুক্ষ দেহ স্থূলদেহ দ্বারা কিছু করতে পারে না, তখন সে বাধ্য হয়ে স্থূলদেহকে ত্যাগ করে থাকে। কিন্তু স্থুলদেহের পতন হলেই, সূক্ষ্ম দেহের প্রবৃত্তি নষ্ট হয় না। তথাকথিত মৃত্যুর পরেও, সূক্ষ্ম দেহ কর্ম্ম করতে ইচ্ছে করে। তাই আবার স্থুলদেহে প্রবেশের জন্য উন্মুখ হয়। এমনকি সে যা কিছু ত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে, অর্থ বিষয়-সম্পত্তি, স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়স্বজন, এদের প্রতি সে একটা মায়িক আকর্ষণ অনুভব করে, এবং অসম্পূর্ন কর্ম্ম সম্পাদন করবার জন্য, আবার স্থুলে আসতে বাধ্য হয়। সূক্ষ্ম দেহকে সাধনা দ্বারা স্থির করা যায়, কিন্তু কারন দেহ সূক্ষ্ম দেহের প্রদর্শিত পথের দর্শক মাত্র। আবার যোগের পথে যখন পরাভক্তি জাগ্রত হয়, তখন সাম্যভাবের সৃষ্টি হয়। কারনদেহ তখন সাম্যাবস্থায় বিরাজ করে। আত্মস্বরূপজ্ঞান জাগ্রত হলে, কারন শরীরের বিলোপ সাধন হয়। তখন জন্ম-মৃত্যুর চক্র বন্ধ হয়ে যায়।
ধীরে ধীরে এক-একটা শরীরের নাশক্রিয়া করতে হবে। প্রথমে স্থূল দেহ - যা আসলে কর্ম্মময় শরীর - এটি কালের নিয়মে, প্রাকৃতিক কারণেই নাশ হবে। কিন্তু এই দেহেই আমরা সমস্ত কর্ম্ম সম্পাদন করতে পারি। তাই স্থূল দেহনাশের আগেই, আমাদের সমস্ত সাধনক্রিয়া করতে হবে। সূক্ষ্ণ অর্থাৎ প্রাণময় ও মনোময় শরীরের নাশ তখনই সম্ভব যখন আমাদের কামনা-বাসনার বিলুপ্তি ঘটবে। এর পরে কারন শরীর অর্থাৎ বিজ্ঞানময় ও আনন্দময় শরীর - এই শরীরের নাশ আত্মজ্ঞান লাভ হলে তবেই হতেপারবে। আর এগুলো সবই সাধন-সংগ্রামের ফলে সম্পাদিত হতে পারে। এই শরীরে থাকতেই কামনা ত্যাগ করতে হবে, এই শরীরে থাকতেই জ্ঞান সংগ্রহ করতে হবে, এই শরীরে থাকতেই, সমস্ত প্রারব্ধ কর্ম্মফলের ভোগ শেষ করতে হবে। এই শরীরে থাকতেই সমস্ত অশুভ সংস্কারের নাশ করতে হবে। তবেই শরীর নাশের সার্থকতা উপলব্ধি করতে পারবো।
সুতরাং স্থুলদেহ নাশে মুক্তি হবে, এই অপেক্ষায় বসে থাকা উচিত হয়. স্থুলদেহে থাকা কালীনই কর্ম্মসাধনা করতে হবে। জ্ঞানীগন জানেন, দেহ ক্লেশ ভোগের জন্য, কাম-উপভোগ করবার জন্য নয়। প্রাণায়াম ইত্যাদির সাধনাই তপস্যা, একে সম্যক রূপে অনুষ্ঠান করো।
ইন্দ্রিয়াদির বিভিন্ন বিক্ষেপ জনিত কারনে তোমার মধ্যে সাধনার বিঘ্নরূপ রিপু তোমাকে আক্রমনে উদ্দত। তাদের প্রতিহত করতে হবে। "আমি পারবো না", "এর চেয়ে মরে যাওয়া ভালো", "এর চেয়ে ভিক্ষে করা ভালো" ইত্যাদি উক্তি তোমার চিত্ত দুর্বলতার লক্ষণ। তোমাকে আত্মস্থ হতে হবে। চিত্তবিক্ষেপ-হেতু তুমি ভালো-মন্দ বুঝতে পারছো না। তুমি তোমাকে, তোমার অমৃতস্বরূপ আত্মাকে জানতে পারো নাই। আর এই সব কারণেই তোমার মধ্যে নানান রকম দ্বন্দের সৃষ্টি হয়েছে। চিত্ত বৃত্তি যখন নিরোধ হবে তখন কে থাকলো, আর কে থাকলো না, তা নিয়ে তুমি হাহুতাশ করবে না। চিত্ত নিরোধে আত্মার প্রকাশ হবে। আর আত্মার স্বরূপ আনন্দ, অবিনাশী, নিত্য বিরাজমান, এই জ্ঞান তোমার মধ্যে প্রস্ফুটিত হবে। অতএব সাধন-সমরে উদ্দম নিয়ে এগিয়ে যাও। যুদ্ধ করো।
---------------
২৫.১২.২০২১
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - দ্বিতীয় অধ্যায় - সাংখ্যযোগ
শ্লোক নং ২/১৯-২০
য এনংবেত্তি হন্তারং যশ্চৈনং মন্যতে হতম
উভৌ তৌ ন বিজানীতো নায়ং হন্তি ন হন্যতে। (২/১৯)
যিনি এঁকে হন্তা অর্থাৎ হত্যার যোগ্য মনে করেন, আর যিনি এঁকে হত মনে করেন, উভয়েই জানেননা যে ইনি হত্যাও করেন না, আবার হতও হন না।
যাঁকে তুমি মনে করছো, হননকর্তা তিনি আসলে কূটস্থ ব্রহ্ম। আবার যাঁকে তুমি মনে করছো হত হতে চলেছে, তিনিও সেই কূটস্থ ব্রহ্ম। এই কূটস্থ ব্রহ্মকে তুমি জানতে পারোনি, তাই ভাবছো, কেউ হনন করছে, আবার কেউ হত হচ্ছে। আসলে এই কূটস্থ ব্রহ্মই তোমার স্বরূপ। তুমি এই শরীর নয়, আর এই শরীরের নাশ হলেও, তোমার নাশ হবে না। তোমার সামনে যারা যুদ্ধে উদ্দত হয়েছে, তারা সবাই এই কূটস্থ ব্রহ্ম ছাড়া কেউ নয়। সমস্ত প্রাণী মাত্রেই সেই কূটস্থ ব্রহ্ম। এদের দেহরূপ আবাসস্থল আজ আছে, কাল নেই। সমস্ত প্রাণীর কূটস্থ ব্রহ্ম আর তোমার মধ্যে কূটস্থ ব্রহ্মের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সমস্ত ঘটে সেই একই আকাশ। ঘাটের নাশে আকাশের নাশ হয় না। হননকর্তা তুমি বা আত্মা, এই কথা যারা ভাবেন, তারা আত্মা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আবার যারা ভাবেন, তুমি বা আত্মা মারা যাচ্ছো, তারাও আত্মা সম্পর্কে অজ্ঞান। এদের কূটস্থ ব্রহ্ম সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই। সাধন-সমরই একমাত্র পথ। প্রাণবায়ুর চঞ্চলতা মনকে চঞ্চল করছে, আবার মনের চঞ্চলতা বুদ্ধিকে চঞ্চল করছে। তাই বুদ্ধিরূপ আয়নায় প্রতিবিম্বিত আত্মার প্রকৃত প্রতিচ্ছবি তোমার কাছে ধরা পড়ছে না। তাই প্রথমে বায়ুকে স্থির করতে হবে, বায়ু স্থির হলে, তোমার মন স্থির হবে, আবার মন স্থির হলে বুদ্ধি স্থির হবে। তখন শুদ্ধ বুদ্ধিতে তোমার মধ্যে শুদ্ধ জ্ঞানের উদয় হবে। তখন জন্ম-মরন সন্মন্ধে তোমার যে অজ্ঞান তা দূরীভূত হবে। এই অজ্ঞানের ফলে তোমার মধ্যে শোক-মোহের উৎপত্তি হয়েছে, তার বিনাশ হবে। তখন সাক্ষীস্বরূপ কূটস্থ ব্রহ্ম যা আসলে তুমি, যা আসলে সাক্ষী, যা আসলে অবিনাশী, নিত্য, ব্যাপ্ত এই শুদ্ধ জ্ঞান প্রাপ্ত হবে। তখন তোমার কাছে চিরসত্য প্রতিভাত হবে।
অস্বছ জলরূপ আয়নায়, নিজেকে স্পষ্ট দেখা যায় না। তরঙ্গসংকুল জলে নিজেকে বহু বলে মনে হয়। কিন্তু বায়ু যখন স্থির থাকে, তরঙ্গ তখন উধাও হয়ে যায়, জল যখন শুদ্ধ নির্মল, স্থির থাকে তখন প্রতিফলন যথাযথ হয়। আগে দেহের বায়ুকে স্থির করো, দেহকে নির্মল করো, তখন কূটস্থের ব্রহ্ম স্ব-মহিমায় তোমার সম্মুখে প্রকাশিত হবে। এমনকি ভেদবুদ্ধি চলে যাবে। এক-এ স্থির হবে। তখন কেই বা মারে, আর কেই বা মরে, এই ভ্রম তোমার থেকে চলে যাবে।
ন জায়তে ম্রীয়তে বা কদাচিৎ
নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতো অয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে। (২/২০)
ইনি কখনো জন্মান না, কখনো মারাও যান না। ইনি না জন্মেছেন, না জন্মাবেন। তিনি অজ, নিত্য, শাশ্বত, পুরাণ। শরীর বিনষ্ট হলেও এনার বিনাশ নেই।
দেখুন, এই শরীরকে আলাদা ভাবে কেউই হত্যা করতে পারে না, শরীর সদা নাশশীল। শরীরের সঙ্গে জন্মের সংযাগের কারণেই নাশক্রিয়া অবিরত চলছে। কারন জন্মই একমাত্র কারন, যার ফলে নাশ বা মৃত্যু হতে পারে। যিনি কখনো জন্মান না, তিনি কখনো মারা যেতেও পারেন না। প্রতিটি শ্বাস গ্রহণের সঙ্গে সংযাগে শরীরের জন্ম হচ্ছে, আবার প্রতিটি শ্বাস ত্যাগের মাধ্যমে শরীরের মৃত্যু হচ্ছে। তো জন্ম-মৃত্যু একটা প্রক্রিয়া মাত্র। প্রকৃতির মধ্যে এই প্রক্রিয়া অবিরত চলছে। প্রকৃতির বাইরে, যে মূল সত্তা তার না আছে জন্ম, না আছে মৃত্যু। কেননা এই সত্তা চিরকালীন, ছিল-আছে-থাকবে। প্রকৃতির রাজ্যে জন্ম-মৃত্যুর খেলা চলছে । তাই যিনি আত্মা, প্রকৃতির উর্দ্ধে, তাঁর জন্মও মৃত্যুও নাই।
তো এখানে একটা প্রশ্ন জাগে মনে, আর তা হচ্ছে, "আমি" যাকে বলা হচ্ছে, অজ, অমর, নিত্য, শ্বাশ্বত, পুরাণ, তার মৃত্যু বা জন্ম নেই। অর্থাৎ এখানে "আমি" মানে "আত্মা"। সত্যি কথা বলতে গেলে, এই "আমি" বা "আত্মা" সম্পর্কে আমাদের কোনো বোধ নেই। আমি বলতে আমরা অহংবোধকেই বুঝি। আর মহাত্মাগণ যাকে আমার বলছেন, অর্থাৎ শরীর, মন ইত্যাদি, এগুলো আমাদের বোধের মধ্যে বিদ্যমান । তো আমার কোনোকিছু হারিয়ে গেলে, বা নষ্ট হয়ে গেলে, আমার একটা কষ্টবোধ, বা বেদনা তো হয়। আমার মা, আমার বাবা, আমার স্ত্রী, আমার সন্তান, এমনকি আমার শরীর ইত্যাদির হারানোর একটা কষ্ট তো আমার বা জীবাত্মার হয়। কথায় বলে ভোগ তো আমার নয়, ভোগ জীবাত্মার। এমনকি জীবাত্মা এই শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে, প্রারব্ধ ভোগ করবার জন্য। কর্ম করবার জন্য। ধরুন আপনি একটা গাড়ি কিনলেন, যার সাহায্যে আপনি ইতস্তত ঘোরা ফেরা করবেন। বা আপনি একটা বাড়ি বানালেন, প্রকৃতির দুর্বিপাক থেকে বাঁচবার জন্য। তো গাড়ি-বাড়ি বিনষ্ট হলে আমি কষ্ট পাবো। তেমনি শরীর বিনষ্ট হলে, আত্মা আশ্রয়হীন হয়ে পড়বে। এই নিরাশ্রয়, নিরালম্ব, নিঃসঙ্গ আত্মার মধ্যে তখন শোকের উৎপত্তি হওয়া স্বাভাবিক। এখান থেকে রেহাই পাবার উপায় কি ?
দেখুন, আমি আমার ভাব থেকেই আসে সুখ-দুঃখ, শোক, আশঙ্কা, ভয়, ইত্যাদি । আবার আমি আমার ভাবের যখন অভাব হয়, তখন আসে শান্তি বা স্থিরতা, সাম্যাবস্থা। তাই এইসব জাগতিক শোক-দুঃখ থেকে নিষ্কৃতি এতে গেলে, প্রাণের উপাসনা করতে হবে। প্রাণ যখন উপাসিত হবে, তখন প্রাণ শুদ্ধ ও স্থির হবে। এই শুদ্ধ ও স্থির প্রাণের মধ্যেই আত্মা উদ্ভাসিত হবে। তখন আমাদের অহং-এর বিলোপ হবে। আর আমরা আমাদের নিজ স্বরূপ যে আত্মা তাঁকে জানতে পারবো এবং শোক দুঃখের অতীতে যেতে পারবো।
-------------------------
২৬.১২.২০২১
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - দ্বিতীয় অধ্যায় - সাংখ্যযোগ
শ্লোক নং ২/২১-২২
বেদ অবিনাশিনং নিত্যং এনম অজম অব্যয়ম
কথং স পুরুষঃ পার্থং কং ঘাতয়তি হন্তি কম। (২/২১)
হে পার্থ, যিনি আত্মাকে অবিনাশী, নিত্য, জন্মরহিত, অব্যয় বলে জানেন, সেই পুরুষ কাকে কিভাবে বধ করান বা করেন।
বেদ অর্থাৎ জ্ঞান, তো যিনি বা যে পুরুষের মধ্যে এই জ্ঞানের উদয় হয়েছে যে আত্মা (১) অবিনাশী, অর্থাৎ নাশ করা যায় না, (২)আত্মা নিত্য অর্থাৎ চিরকালীন সৎবস্তু, ৩)অজ - জন্ম-মৃত্যুর উর্দ্ধে, ৪) অব্য়য় অর্থাৎ ক্ষয়রোহিত। অর্থাৎ পাঁচ বিকার রোহিত এই আত্মা। যিনি কোনো কাজকে যদি অসম্ভব বলে নিশ্চিত হন, তবে তিনি সেই কাজে কখনোই প্রবৃত্ত হবেন না। তো পাঁচ বিকারের উর্দ্ধে এই আত্মা, তাঁকে মারবেই বা কে, আর কাকেই বা মারবেন ? আবার যিনি নিজেকে আত্মা বলে জানেন, আবার জগতের সমস্তকিছুকেই সেই এক আত্মা বলে জানেন, তিনি কোনো কামনার বসেই নিজের হন্তাকারী হবেন না, একথা নিশ্চিত করে বলা যায় ।
আসলে এইসব কথা আমাদের কাছে জ্ঞানীর কথা, জ্ঞানের কথা, এর মধ্যে কোনো সত্য আমাদের মতো সাধারণ মানুষ খুঁজে পাই না। আমাদের মধ্যে দ্বৈতভাবের প্রভাব। দেহাতিরিক্ত আত্মাকে আমরা অনুভব করতে পারি না, এগুলো আমাদের কাছে কথার কথা। এখান থেকে বেরুতে গেলে, সত্যকে আমাদের উপল্বদ্ধিতে আনতে গেলে, সেই বিশ্বশক্তির সাথে ক্রিয়া করতে হবে। অলস ভাবে শুধু জ্ঞানের কথায় আমাদের মধ্যে পরিবর্তন হবার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই ঋষিমুনের দেওয়া যোগক্রিয়াতে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। যোগক্রিয়া করতে করতে একদিন আমাদের মধ্যে পরাবস্থার ভাবের সমাবেশ ঘটবে। আর এই পরাবস্থায় আনন্দস্বরূপ ব্রহ্মকে জানতে পারবো। আর এই আনন্দস্বরূপে সন্ধান পেলে, বিষয় ত্যাগের দুঃখ, শোক, ক্লেশ বোধ হবে না। সত্যি বলতে গেলে কি, বিষয়ে তো আনন্দ নেই, বিষয়ের মধ্যে আত্মা আছে বলেই, বিষয় সবাইকে আনন্দ দিতে সক্ষম। যোগক্রিয়া দ্বারা আমরা যখন পরাবস্থাতে স্থিত হতে পারবো, পরাবস্থায় যখন আত্মস্থ হতে পারবো, তখন আপনাতে আপনি তুষ্ট হয়ে আনন্দসাগরে ডুব দেবো। তখন কর্তাভাবও থাকবে না, দ্বৈতভাবও উধাও হয়ে যাবে। পাপ-পুন্য বলে কিছু থাকবে না। যতদিন এই অবস্থা না হচ্ছে, ততদিন শ্রীগুরুর নির্দেশে যন্ত্রের ন্যায় যোগক্রিয়াতে নিজেকে নিয়োজিত করো। সাধন-সমরে লেগে পড়ো।
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়
নবানি গৃহ্ণাতি নরঃ অপরাণি।
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণা-
ন্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহী। (২/২২)
মানুষ যেমন জীর্ণবস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে, ঠিক তেমনি দেহী (আত্মা) জীর্ন দেহ পরিত্যাগ করে নতুন দেহ ধারণ করে থাকেন।
আমরা যারা অজ্ঞান, আমাদের কাছে শরীরের কষ্ট মানেই আমার কষ্ট। শরীরের নাশে তো কথাই নেই। শরীরের নাশ মানে আমরা শেষ হয়ে গেলাম। এর থেকে দুঃখের আর কিছু থাকতে পারে না। মৃত্যু আমাদের কাছে একটা বিভীষিকা। অথচ মহাত্মাগণ বলে থাকেন, আমার এই দেহ চলে গেলেও, আত্মারূপ আমির কখনো শেষ হয় না অর্থাৎ দেহের নাশেও আমি বেঁচে থাকি। অতয়েব স্থুল দেহের মৃত্যুকে ভয় করো না।
আমরা কেউ এই মহাত্মাগণের এই কথায় গভীর আস্থা বা বিশ্বাস করতে পারি না। এমনকি কি অর্জুনও এই কথায় বিশ্বাস করতো না। মহাত্মাগণ বলছেন, এঁরা সবাই মুক্তপুরুষ, যাঁরা এই উপলব্ধি করেছেন, যে দেহের নাশে আমাদের আত্মার মৃত্যু হয় না। এই মুক্তপুরুষগন বলছেন, দেহ বন্ধনে জড়িয়েই আমাদের এতো শোক-তাপ হয়ে থাকে। তাই এখানে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ, নতুন ও পুরাতন পোশাকের কথা তুলে অর্জুনকে বোঝাতে চাইলেন, নতুন জিনিস সবার প্রিয়, আর এই সবাই আসলে বালক-অজ্ঞানী। তো একটা বালকের কাছেও যা ভালো, একটা বালকও যা বোঝে তা তুমি কেন বুঝতে চাইছো না ? কাপড় পুরানো হয়ে গেলে, কাপড় ছিঁড়ে -ফেটে গেলে, তা ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যায়। তেমনি তোমার এই দেহ কালের নিয়মে পুরাতন হয়ে গেলে, কাজের যোগ্য না থাকলে, সেই দেহ বদল করে যদি নতুন দেহ পাও, তবে তো তোমার আনন্দ করা উচিত, দুঃখ পাওয়া উচিত নয়। বরং তোমার মধ্যে নতুন উদ্দম আসা উচিত। কারন নতুন দেহের কার্যশক্তি আরো বেশি থাকবে। তাই একটু বিচার করে দেখো, এই দেহত্যাগে আসলে তোমারই লাভ। অপদার্থ অজ্ঞানীগন এই কথা বোঝে না বলে, তারা মৃত্যুর কথা শুনলেই শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ।
এখন দেখে নেই, স্থুল নাশের পরে, আমাদের কি গতি হয়। ছান্দোগ্য উপনিষদে সংক্ষেপে অথচ সুন্দর ভাবে এই মৃত্যু থেকে জন্মের মধ্যে আমাদের গতিপথ সম্পর্কে একটা বর্ণনা আছে। শ্লোক নং. ৫-১০.০১ থেকে ৫.১০.১০
"সন্তান জন্ম গ্রহণ করে যতদিন তার আয়ু থাকে ততদিন জীবিত থাকে। তারপর যথা নির্দিষ্টরূপে অর্থাৎ কর্ম্মফল অনুযায়ী বিভিন্ন লোক প্রাপ্ত হবার জন্য, দেহ ত্যাগ করে। এরপর তার পুত্র-শিষ্যগণ অন্তেষ্টির জন্য তাকে ঘর থেকে বের করে, সেই অগ্নিতে নিয়ে যায়, যে অগ্নি থেকে এসেছে, যে অগ্নি থেকে সে উৎপন্ন হয়েছে।
"যারা পঞ্চাগ্নি বিদ্যা জানেন, এবং যারা অরণ্যে বাস করেন, শ্রদ্ধা যুক্ত হয়ে তপস্যা ইত্যাদি করেন, তারা মৃত্যুর পর অর্চিলোকে যাত্রা করেন। এরপর অর্চি থেকে দিনে, দিন থেকে শুক্ল পক্ষে, শুক্লপক্ষ থেকে উত্তরায়ণে ছয়মাসে, সেখান থেকে সংবৎসরে, সংবৎসর থেকে আদিত্যে, আদিত্য থেকে চন্দ্রে এবং চন্দ্র থেকে বিদ্যুৎলোক প্রাপ্ত হন। এখানে ব্রহ্মলোক থেকে এক অমানব পুরুষ এসে তাদের ব্রহ্মলোকে নিয়ে যান। এই পথকেই বলা হয়, দেবযান বা দেবলোকের পথ।
"আর যারা গৃহস্থ যজ্ঞ করেন, সমাজসেবামূলক কাজ করেন, দানাদি করেন, মৃত্যুর পরে তারা ধূমকে প্রাপ্ত হন। তারপর তারা ধুম থেকে রাত্রি, রাত্রি থেকে কৃষ্ণপক্ষ, কৃষ্ণপক্ষ থেকে দক্ষিণায়নের ছয়মাসে গমন করেন। এঁরা দেবযানপথের যাত্রীদের মতো, সংবৎসরকে প্রাপ্ত হন না। দক্ষিণায়নে ছয়মাস থেকে পিতৃলোকে, পিতৃলোক থেকে আকাশে, আকাশ থেকে চন্দ্রলোকে গমন করেন। এখানে ভোগ শরীর নির্মাণ হয়, যা দেবতাদের ভোগ্য।
"কর্ম্মফল ক্ষয় না হাওয়া পর্যন্ত এঁরা চন্দ্রলোকে বাস করেন। তারপর যে পথে তারা গিয়েছিলেন সেই পাথেই পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসেন। তারা প্রথমে আকাশ, তারপরে বায়ু প্রাপ্ত হন। বায়ু হয়ে ধুম, ধুম হয়ে কুয়াশা হন। কুয়াশা হয়ে মেঘ হন, মেঘ হয়ে বর্ষণ করেন। তারপর জীবগন এই পৃথিবীটিতে বৃহি, যব, ঔষধি, বনস্পতি, তিল ও মাষ ইত্যাদি রূপে জাত হন। এই শস্যাদি বা অন্ন যে প্রাণী আহার করে, এবং সন্তান উৎপাদন করে, সেই সেই প্রাণীরূপে জীবগন পুনরায় জন্ম গ্রহণ করে।
"যারা অর্থাৎ যে জীবসকল উপাসনা বা ইষ্টের আরাধনা করেন না এরা আগের দুই পথের কোনো পথ দিয়েই যান না, তারা বারবার জন্ম-মৃত্যু চক্রে আবর্তনশীল ক্ষুদ্র প্রাণীরূপে জন্ম গ্রহণ করেন। তাদের সম্পর্কে বলা হয়, এরা জন্মায় আর মরে। অর্থাৎ এরা এত ক্ষণস্থায়ী যে জন্ম গ্রহণ করেই মারা যায়। জন্ম-মৃত্যু ছাড়া এদের জীবনে অন্য কোনো ঘটনা নেই। এই হলো তৃতীয় স্থান। এইজন্যই ওই চন্দ্রলোক কখনো পূরণ হয় না।
"তাই উপনিষ বলছে, পঞ্চাগ্নি বিদ্যা আয়ত্ত্ব করো। পঞ্চাগ্নি হচ্ছে, বায়ু, মেঘ,বিদ্যুৎ,বজ্র, স্ফুলিঙ্গ। অগ্নির এই পাঁচ তত্ত্ব। যিনি পঞ্চাগ্নি বিদ্যা জানেন, তিনি এদের সংসর্গ করেও পাপ দ্বারা লিপ্ত হন না। যিনি এভাবে জ্ঞাত হন, তিনি শুদ্ধ ও পবিত্র। মৃত্যুর পরে তিনি পুণ্যলোকে যান। "
এই পঞ্চবিদ্যাই যোগবিদ্যা। যদিও আমরা বিশ্বাস করি না যে মানুষ কখনো কুয়াশা, মেঘ, অন্ন ইত্যাদি হয়ে যায়। আসলে সাধারণ মানুষ এইসময় তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে। সঙ্গাহীন অবস্থায় থাকে। কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তি উর্দ্ধলোকে যাবার সময়, পূর্ণমাত্রায় সচেতন থাকেন । কিন্তু পৃথিবীতে ফিরে আসার সময় তার চেতনার সম্পূর্ণ লোপ পায়। এইসময় সে কারন দেহে তার সমস্ত স্মৃতি ফেলে আসতে বাধ্য হয়।তাই প্রত্যেকটি মানুষ অজ্ঞ হয়েই জন্মায়। ধীরে ধীরে মানুষ নতুন শরীরে আবার জ্ঞানের সঞ্চার করে। কিন্তু মারা যাবার সময় সে যে সংস্কার নিয়ে গিয়েছিলো, সেই সংস্কার অনুযায়ী সে স্বভাব প্রাপ্ত হয়। আসলে এই যে প্রক্রিয়ার কথা বলা উপনিষদে হয়েছে, তা মানুষের স্থুল দেহ থেকে সূক্ষ্ম দেহের পরিণামের বা সূক্ষ্ম থেকে স্থলে পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে। এখানে আত্মার সংযোগের বিষয়টি নেই।
----------------------
২৭.১২.২০২১
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - দ্বিতীয় অধ্যায় - সাংখ্যযোগ
শ্লোক নং ২/২৩-২৫
নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ
ন চৈনং ক্লেদয়ন্তি আপঃ ন শোষয়তি মারুতঃ। (২/২৩)
অস্ত্র দ্বারা এঁকে ছেদন করা যায় না, অগ্নি এঁকে দগ্ধ করতে পারে না। জল এঁকে আর্দ্র করতে পারে না। বায়ু এঁকে শুষ্ক করতে পারে না।
আত্মা বা জীবাত্মা প্রকৃতির উর্দ্ধে। প্রকৃত জাত এই শরীর। প্রকৃতি জাত অর্থাৎ পৃত্থিতত্ত্ব দ্বারা উৎপন্ন যাকিছু সবকিছুর ক্রিয়া, বৃদ্ধি, নাশ এই প্রকৃতির মধ্যেই হতে পারে। এর বাইরে এর কোনো ক্রিয়া তো দূরে থাকুক, এর কোনো অস্তিত্ত্বই থাকে না। পৃথিবী তত্ত্ব, অগ্নি তত্ত্ব, জলতত্ত্ব, বায়ুতত্ত্ব - এঁরা কখনোই জীবাত্মার কোনো বিকার করতে সক্ষম নয়। কারন আত্মা এইসব তত্ত্বের উর্দ্ধে অবস্থান করে থাকেন । এখানে অগ্নি, বায়ু, পৃথিবী, বা জল পৌঁছাতেই পারে না।
এখানে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ সুকৌশলে আকাশতত্ত্বের কথা উহ্য রেখেছেন। আসলে সাধনার উদ্দেশ্য হচ্ছে গুণাতীত হয়ে যাওয়া। গুণাতীত অবস্থাকেই বলা হয়, ব্যোম। যদিও এটি অবস্থা মাত্র, স্থিতি নয়। আর সব কিছু বিনা সাধনেই বোঝা সম্ভব। কারন এর আকার বা রূপ আছে। পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, - এদের সবার আকার আছে, রূপ আছে। কিন্তু আকাশের কোনো আকার নেই। আকাশের গুন্ হচ্ছে শব্দ - যার দ্বারা সমস্ত জগতের সৃষ্টি হয়েছে। আকাশ অসীম, আকাশের রূপান্তর ঘটে না। অগ্নি একসময় নিভে যায়, জল একসময় শুকিয়ে যায়, কিন্তু আকাশ আকাশই থাকে এর কোনো বিবর্তন নেই। সাধন জগতেও, একটু অগ্রসর হলেই নিজেকে আকাশবৎ মনে হয়। প্রাণবায়ু সাধনার সাহায্যে স্থির করতে পারলে, নিজেকেও আকাশবৎ মনে হয়। আত্মা যখন কোনো গুনের মধ্যে প্রবেশ করে, অর্থাৎ গুন্ দ্বারা আবধ্য হয়, তখন জীব বা জীবাত্মা হয়। আর গুণশূন্য হলে জীব শিব হয়ে যায়। এই শিবের এক নাম হচ্ছে ব্যোম। আমাদের নানান সংকল্প এই সংসার বন্ধনের দড়ি। সংকল্প যত ক্ষীণ হতে থাকে, তত সংসার বন্ধন কেটে যায়। আমাদের গুন্-উপাধি আশ্রয়হীন হলে যা পড়ে থাকে তাকেই মুক্ত আত্মা বলা হয়ে থাকে।
আসলে আত্মা অস্তিত্ত্ব অনস্তিত্ত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে ভগবান আমাদেরকে নানান ভাবে পুনঃ পুনঃ বোঝাবার চেষ্টা করছেন। এই একই কথা বারবার বলবার একটা উদ্দেশ্য আছে, আর সেটি হচ্ছে, আমরা যখন সাধন জগতে প্রবেশ করবো, তখন দেখবো, সাধন ক্রিয়া অর্থাৎ শ্রবণ মনন ও নিদিধ্যাসন, বারবার পুনরাবৃত্তি না করলে, আত্মদর্শন হয় না। এই একই জিনিস অর্থাৎ পুনরাবৃত্তি আমরা লক্ষ করেছি, অষ্টাবক্র গীতা পড়তে গিয়ে। একই কথা বারবার বলা হচ্ছে, বিভিন্ন ভাবে, ভাষার পরিবর্তনের সাহায্যে, বিভিন্ন উদাহরনের সাহায্যে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সাধন কালেও আমাদের আসন-প্রাণায়াম-ধ্যান -প্রত্যাহার ইত্যাদি বারবার করতে হয়, যতক্ষন না আত্মদর্শন হয়।
অচ্ছেদ্যঃ অয়ম অদাহ্যঃ অয়ম অক্লেদ্যঃ, অশোষ্যঃ এব চ
নিত্যঃ সর্ব্বগতঃ স্নায়ুঃ অচলঃ অয়ং সনাতনঃ। (২/২৪)
ইনি অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য এবং অশোষ্য। ইনি নিত্য সর্ব্বব্যাপী, স্থির, অচল ও অনাদি।
দেখুন আত্মা ভৌতিক পদার্থ নয়। ভৌতিক পদার্থ হলে অস্ত্র দ্বারা ছেদন করা যেত, অগ্নি দ্বারা দাহ করা যেত, জল দ্বারা ক্লিন্ন বা ধৌত করা যেত, বায়ু দ্বারা শুষ্ক করা যেত। এই আত্মার কোনো পরিবর্তন নেই, তাই তিনি নিত্য একইভাবে বিরাজ করছেন, সর্বত্র তার গতি, আবার তিনি অচল, তিনি সনাতন অর্থাৎ চিরকালীন। জগৎ সৃষ্টির আগেও তিনি ছিলেন, আবার মহাপ্রলয়ের পরেও তিনি যথাপূর্ব অবস্থাতেই থাকবেন।
যিনি এই পৃথিবীতে থেকেও পৃথিবী থেকে ভিন্ন, যিনি জলের মধ্যে থেকেও জল থেকে আলাদা, যিনি অগ্নির মধ্যে থেকেই অগ্নি থেকে পৃথক, বায়ুর মধ্যে থেকেও বায়ু থেকে স্বতন্ত্র। আবার তার কোনো রূপ না থাকা সত্ত্বেও তিনি লক্ষ-কোটি রুপের মধ্যে অনু-রূপে বিরাজ করছেন, তিনিই আত্মা। সর্বত্র অনুরূপে বিরাজ করছেন। সর্বত্র বীজ রূপে বিরাজ করছেন। সর্বজগতের বীজরূপে অণুমাত্র হয়ে বিরাজ করছেন।
সমগ্র জগতের মধ্যে এমনকি নিজের মধ্যে এই একমাত্র সত্ত্বা যা সবার অজ্ঞাত অথচ খুই কাছের। এঁকে বোঝা যেমন সহজ, তেমনি এরমত দুর্বোদ্ধ জ্ঞান আর কিছু নেই। তাই যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বার বার উদাহরণ দিয়ে, অর্জুনরূপ তেজঃশক্তিকে তার নিজেরই স্বরূপ সম্পর্কে বার বার বোঝাবার চেষ্টা করছেন। উদ্দীপ্ত করবার চেষ্টা করছেন। আসলে আত্মবস্তু অত্যন্ত দুর্বোধ্য। চোখ নিজেকে দেখতে পায় না। তাই ভাষা এখানে সহযোগিতা করে না। তবু যতক্ষন ভাবের বিনিময় মৌনতা দ্বারা সমন্বিত না হচ্ছে, ততক্ষন ভাষাই সহায়। যাঁকে জানলে সংসারে জীব, সংসার ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন, যাঁকে জানলে জন্ম-মৃত্যু স্তব্ধ হয়ে যায়, তা সহজবোদ্ধ নয়। তাই ভগবান বারবার একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলছেন। আমাদের সাধন জগতেও নিরন্তর এই ক্রিয়া চলছে। এখানেও একবারে না পারিলে দেখো শতবার - এই নীতির প্রয়োগ দেখতে পাই।
অব্যক্তঃ অয়ম অচিন্তঃ অয়ম অবিকার্য্যঃ অয়ম উচ্চতে
তস্মাৎ এবং বিদিত্বা এনং ন অনুশোচিতুং অর্হসি। (২/২৫)
ইনি অব্যক্ত, অচিন্ত, ও অবিকারী বলে বলা হয়ে থাকে। অতএব তুমি এই কথা বিদিত হয়ে, বা স্বরূপ জেনে আর শোক করতে পারো না।
যা মুখে বলা যায় না, অর্থাৎ ইন্দ্রিয়লব্ধ নয়, আবার যাকে মনের চিন্তার মধ্যেও আনা যায় না। অর্থাৎ সমস্ত ইন্দ্রিয়ের যিনি রাজা তিনিও যাঁকে ধরতে পারেন না। যাঁকে শুধু নিজের বোধের মধ্যে আনতে হয়, যার মধ্যে কোনো বিকার নেই - তার জন্য শোক অনাবশ্যক। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলতেন, সমস্ত কিছুই উছিষ্ট হতে পারে, কিন্তু ব্রহ্ম কখনো হন না।
এইখানে একটাই সমাধান, এঁকে ক্রিয়া দ্বারা ধরতে হয়। ক্রিয়ার পরাবস্থাতে নিজস্বরূপের জ্ঞান হতে পারে। তাই ভগবান বলছেন, হে অর্জুন তুমি অহেতুক শোক করছো, যার অবস্থান্তর নেই, তার জন্য আবার শোক কিসের ? তো শোক ছেড়ে ক্রিয়ার মধ্যে অর্থাৎ সাধনসমরে ক্রিয়াশীল হও। শোক তোমাকে নিশ্চেষ্ট করে দেবে। এখন থেকে বেরিয়ে এস।
------------------------------------
২৮.১২.২০২১
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - দ্বিতীয় অধ্যায় - সাংখ্যযোগ
শ্লোক নং ২/২৬-২৭
অথ চৈনং নিত্যজাতং নিত্যং বা মন্যসে মৃতম
তথাপি ত্বং মহাবাহো নৈনং শোচিতুমর্হসি। (২/২৬)
আর যদি ধরেই নেওয়া যায় যে আত্মা নিত্য জন্মান, আর নিত্য মারা যান, তথাপি হে মহাবাহো, তোমার শোক করা উচিত নয়।
এখানে অর্জুনকে বলা হচ্ছে মহাবাহো অর্থাৎ দীর্ঘবাহু যুক্ত পুরুষ। সাতিশয় বাহুবল সম্পন্ন পুরুষ। অর্থাৎ নিজের বাহুবলে যিনি বিশ্বাস করেন। আসলে মানুষের যতদিন দেহশক্তি সম্পর্কে অতিসচেতন থাকে, ততক্ষন বিশ্বের সবকিছুকেই সে অগ্রাহ্য করে থাকে। এমনকি ভালো কথা, মঙ্গলের কথা, মহাত্মাদের সূক্ষদৃষ্টির কথা তার কাছে ভালো লাগে না। জগতের সূক্ষ্ম পরিণতি সম্পর্কেও সে অবিশ্বাস করে থাকে। আমাদেরও যতদিন বয়স কম থাকে, যতদিন আমাদের দেহে শক্তি থাকে, ততদিন আমাদের আত্মা বা ঈশ্বর সন্মন্ধে কোনো কথা শুনতে আগ্রহ দেখা যায় না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, দেহের শক্তিক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মধ্যে ঈশ্বর সম্পর্কে আগ্রহ দেখা যায়। তো অর্জুন এখন বাহুবলে বিশ্বাসী। তাকে আত্মার কথা বিশ্বাস করানো, এই মুহূর্তে অসম্ভব। আত্মার কথা বুঝতে গেলে শুদ্ধচিত্ত চাই। অর্জুনের চিত্ত এখন মলিনতায় পূর্ন। কারন যে বাহুবলে বিশ্বাসী, সে সম্মুখে যা কিছু সে দেখতে পায়, তাকেই সে সত্য বলে মনে করে। এর বাইরে সে যেতে চায় না।
ঋষি চার্বাক বলছেন, প্রকৃতির নিয়মেই জন্ম মৃত্যুর খেলা চলছে, এখানে মৃত্যু মানে কর্ম্মের সমাপ্তি। আবার জন্ম মানে কর্ম্মের শুরু। জন্ম একটা রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফল। আবার মৃত্যুও রাসায়নিক বিক্রিয়া মাত্র। চার ভূতের ( ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ) সংযোগ ও বিচ্ছিন্নতাই জন্ম মৃত্যু। জন্মের সঙ্গে সংযাগে আমি-বোধের উৎপত্তি, আবার মৃত্যুর সঙ্গে আমি বোধের নিস্পত্তি। জন্মের আগে আমি বলে কিছু ছিল না, আবার মৃত্যুর পরে আমি বলে কিছু থাকবেও না। অতএব নিত্যবস্তু বা আত্মা বলে কিছু নেই। এঁরা কর্ম্মবাদে বিশ্বাস করে, পুরুষাকারে বিশ্বাস করে। এদের কাছে সবই অনিত্য। এঁরা অদৃষ্টবাদে বা ভাগ্যে বিশ্বাস করে না। এদের কাছে, জন্ম গ্রহণ মানে কর্ম্ম করা ও ভোগ করাই আদর্শ। এরা মৃত্যুর পরে মানুষের বা আত্মার কোনো রকম অস্তিত্ত্বে বিশ্বাস করে না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, তুমি যদি এই চার্বাক মতে বিশ্বাস করো, তাহলেও তোমার শোক করা উচিত নয়।
দেখুন, পৃথিবীতে একবার যে জন্মায়, একবার যে বীজ রোপন করা হয়, একবার যে বস্তুর উদ্ভব হয়, তা কখনোই এক অবস্থায় থাকে না। একসময় বীজ কঠিন থেকে খোলস পাল্টে কোমলে অংকুরিত হয়। বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়ে বৃক্ষে পরিণত হয়। বস্তু থেকে ভাইরাস, ভাইরাস থেকে এককোষী প্রাণী। এককোষী থেকে বহুকোষী প্রাণী। আয়ু ফুরিয়ে গেলে, শুকিয়ে যায় - যাকে আমরা মরন বলে থাকি। আসলে মরন তো নয়, রূপান্তর মাত্র। বীজের মরন অঙ্কুরে, অংকুরের মরন গাছে। প্রতিমুহূর্তে এই নবজন্ম হয়ে চলেছে। এই শরীর সূক্ষ্ম রূপে বীর্য-রজের মিলিত সত্তা। এই সত্তাই বৃদ্ধি পেয়ে, শিশু হয়ে জন্ম নেয়। জন্মের পরেও কোষের জন্ম-মৃত্যুর মধ্যেই সে বাড়তে থাকে, একসময় এই কোষের জন্ম-মৃত্যুর মধ্যদিয়ে সে নিঃশেষিত হতে থাকে। তো জীবের জন্ম মৃত্যু একটা প্রক্রিয়া মাত্র। আর এই প্রক্রিয়া ধারাবাহিক ভাবেই জগৎ সৃষ্টির প্রথম থেকেই চলছে। এর কোনো ব্যতিক্রম নেই। তো এই শ্বাশত কালের নিয়মের মধ্যে কোথাও শোকের বিষয় নেই। তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যদি একথা মেনে নেওয়াও যায়, যে জীবাত্মা নিত্য জন্মায় ও বিনষ্ট হয়, তথাপি এই চিরন্তন নিয়ম কখনো শোকের কারন হতে পারে না।
জাতস্য হি ধ্রুব মৃত্যু ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ
তস্মাদ অপরিহার্য্যে অর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি। (২/২৭)
যেহেতু জাত ব্যক্তির মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, আবার মৃত ব্যক্তির পুর্নজন্ম নিশ্চিত। অতয়েব যা অবশ্যম্ভাবী, যা অপরিহার্য্য সেই বিষয়ে তোমার শোক করা উচিত নয়।
বিষয়গত দিক থেকে দেখতে গেলে, আগের শ্লোকের সঙ্গে এই শ্লোকের কোনো পার্থক্য নেই। অর্থাৎ যার জন্ম হয়েছে, তার মৃত্যু নিশ্চিত। আবার যার মৃত্যু হয়েছে, তার জন্ম নিশ্চিত। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই যে চক্র চলছে, এর ভিত্তিটা কি ? মানুষ কেনই বা জন্মায়, আবার কেনই বা মৃত্যু বরন করে ? কে এই জন্ম মৃত্যুর নিয়ন্ত্রক ?
বলা হয়ে থাকে কালই মৃত্যু-রাজ্যের রাজা। মহাত্মাগণ বলে থাকেন, মানুষ তার প্রারব্ধ কর্ম্মফল ভোগ করবার জন্য জন্ম গ্রহণ করে। আবার জন্ম গ্রহণ করবার পরে, সে যে কর্ম্মফল সঞ্চয় করে, তা নিয়ে সে অমৃতলোকে যাত্রা করে। সেখান থেকে সে আবার বাসনা ও সংকল্প পূরণের জন্য, প্রারব্ধ কর্ম্মফল ভোগ করবার জন্য, জন্ম গ্রহন করে থাকে। কর্ম্ম বন্ধনে আবদ্ধ জীবের জন্ম-মরন অপরিহার্য্য।
কিন্তু আমরা এখানে যে মৃত্যুর সামনে এসে দাঁড়িয়েছি, তা কিন্তু স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। বলা যেতে পারে অকাল মৃত্যু। সামনে যুদ্ধের মহড়া চলছে। আর যুদ্ধ মানেই একাধিক প্রাণের অকাল নাশ। এখানে মহাত্মাদের কথা অর্থাৎ প্রারব্ধ ভোগের শেষে মৃত্যু, ব্যাপারটা মেলানো যায় না । এমনকি, প্রকৃতি বা কালের প্রকোপে যে মৃত্যু হয়, তা এখানে প্রযোজ্য নয়। এখানে মানুষ মানুষকে মারবে বলে একত্র হয়েছে। অকালমৃত্যু। এই ব্যাপারটা বুঝতে গেলে, আমাদের মৃত্যুর গভীরে প্রবেশ করতে হবে।
দেখুন, মৃত্যু ও দেহত্যাগ ঠিক এক কথা নয়। মর্ত-লোকে মৃত্যু সকলের হয়ে থাকে। কিন্তু দেহত্যাগ সকলের হয় না। যে দেহ গ্রহণ করতে পারে না, সে দেহ ত্যাগও করতে পারে না। তেমনি মৃত্যু আমাদের মতো অজ্ঞানীর ইচ্ছেমতো হতে পারে না। মৃত্যুর আগেও জীব যেমন স্বাধীন নয়, তেমনি মৃত্যুর পরেও জীব স্বাধীন নয়। আমাদের জন্ম মৃত্যু কর্ম্ম সাপেক্ষ শক্তির অধীন। আমরা কেউ এর বাইরে নোই।
এখন কথা হচ্ছে কাল-মৃত্যু ও অকাল-মৃত্যুর মধ্যে একটা ভেদ আছে। একদৃষ্টিতে দেখতে গেলে অকালমৃত্যু বলতে কিছু হয় না। সময় না হলে কারুর মৃত্যু হওয়া সম্ভব নয়। এখন কথা হচ্ছে, যুদ্ধে যে একসঙ্গে এতগুলোর লোকের মৃত্যু হয়, বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে যে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়, বা দাঙ্গায় যে হাজার হাজার লোকের মৃত্যু হয়, তার কারন কি ?
আমরা আগেই শুনেছি, মানুষের জন্ম-মৃত্যু কর্ম্মবন্ধনের কারনে হয়ে থাকে। ব্যক্তির কর্ম্ম তার জন্ম মৃত্যুকে প্রভাবিত করে। আবার সমষ্টি কর্ম্মফল সমষ্টির মৃত্যুকে ডেকে আনে। আমরা যেমন আমাদের নিজেদের কর্ম্মফল ভোগ করে থাকি, তেমনি আমাদের পরিবারের কর্ম্ম, আমার আত্মীয়স্বজনের কর্ম্ম, আমার জাতির কর্ম্ম, আমার দেশনায়কদের কর্ম্ম, আমাদের পৃথিবীর সমস্ত মানুষের কর্ম্ম, এমনকি চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদির যে কর্ম্ম, সমস্ত কর্ম্মই আমাদেরকে প্রভাবিত করে থাকে। এখানেও সেই সমষ্টির কর্ম্মফলের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। সূর্য্যে যদি কোনো বিস্ফোরণ হয়, তবে তার ফল আমাদের সকলকে প্রভাবিত করবে।
এখন কথা হচ্ছে, তাহলে তো বলা যেতে পারে, এই যে যুদ্ধক্ষেত্রে সাধারণ সৈনিক থেকে শুরু করে, বীর-যোদ্ধাগন, রাজ্-রাজন্যবর্গ, এমনকি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যেন তাদের মৃত্যুকে আহবান করছেন, স্বঘোষিত কর্ম্মের দ্বারা। এতো আত্মাহুতির নামান্তর। এযেন পিপিলিকার পাখা ওঠে মরিবার তরে। এ যেন সেই পতঙ্গ যে অগ্নির দিকে দিক-বিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে ছুটছে, নিজের অজ্ঞাতসারে আত্মাহুতি দেবার জন্য। এই ব্যাপরটা একটু বুঝবার চেষ্টা করবো।
কর্ম্মবন্ধনের কারনে, জীবের জন্ম-মৃত্যু হয়ে থাকে। কর্ম্মক্ষয় না হলে, জীবের পুনরায় জন্ম নিতে হয়। আবার প্রারব্ধ কর্ম্মক্ষয়ে মৃত্যু নিশ্চিত। এই জন্ম-মৃত্যুকে কেউ এড়াতে পারে না। মহাত্মাগণ বলছেন, জীবের জ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত, তাকে এই জন্ম মৃত্যুর চক্রে পাক খেতে হয়। কিন্তু আত্মা সর্বদা আত্মাই থাকেন। আত্মার সঙ্গে কর্ম্মবশত ইন্দ্রিয়যোগের ফলে জন্ম, আবার আত্মা থেকে ইন্দ্রিয়-বিয়োগে মৃত্যু। এই জন্ম মৃত্যুর হাত থেকে বেরুতে গেলে, কর্ম্মকে কর্তৃত্বাভিমান-শূন্য করতে হবে। এখন কথা হচ্ছে, কর্তৃত্বাভিমানশূন্য কিভাবে হবে ? এখানে মহাত্মাগণ বলছেন, সেই সর্বেশ্বরের কাছে মনে মনে কর্ম্মফল অর্পণ করতে হবে। মনে মনে ভাবতে হবে, আমি কিছু করছি না তা নয়, আমি নিজে থেকে কিছু করছি না, আমি যেন চাকুরী করছি। আমি সেই সর্ব্বেশ্বরের কাজে ভৃত্যবৎ, তাঁরই আদেশে কর্ম্মে লিপ্ত হয়েছি। এই ধ্যান-ধারণায় নিজেকে অভ্যস্ত করতে হবে।
দেখুন, আমাদের সমস্ত কর্ম্ম ইন্দ্রিয়, জ্ঞান ইন্দ্রিয় যে কাজ করে, তার সঙ্গে যেমন বিষয়যুক্ত থাকে, তেমনি ফলের আকাংখ্যা থাকে । কিন্তু আমাদের মধ্যে যে প্রাণের ক্রিয়া চলছে, দিন-রাত, ২৪ ঘন্টা, এমনকি সারা জীবন ধরে যে প্রাণের ক্রিয়া চলছে, তা কিন্তু ফলাকাঙ্খ্যা রোহিত। আমাদের যে চোখের পাতা পড়ে, আমাদের যে হজম ক্রিয়া হয়, এমনকি আমাদের যে বাহ্যক্রিয়া হয়, এইসব ক্রিয়ার সঙ্গে কোনো ফলাকাঙ্খ্যা নেই। আর এগুলো সবই প্রানেরই ক্রিয়া। এই জন্য আমাদের উচিত প্রাণের সঙ্গে মনের একটা নিত্য সংযোগ স্থাপন করা। মন যখন প্রাণের সঙ্গে মিলিত হয়ে যাবে, তখন মন আপনা-আপনি ব্রহ্মে স্থিত হবে। আমাদের যতদিন দেহজ্ঞান থাকবে, ততক্ষন আমরা জন্ম-মৃত্যুকে ভুলতে পারবো না। আমরা যদি দেহকে ভুলে কূটস্থ ব্রহ্মে স্থিত হতে পারি, তখন ভেদাভেদ দূর হয়ে যাবে। তখন জন্ম মৃত্যু বলে কিছু থাকবে না। তখন আমি-তুমি-দেহ-মন-বুদ্ধি সব একাকার হয়ে যাবে। এটাই যোগের উদ্দেশ্য। সাধন-সমর জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। তার জন্য হারানোর ভয়, বা আশঙ্কা করে, সাধন সমর থেকে দূরে গেলে জন্ম-মৃত্যু আমাদের চেপে ধরে থাকবে। এখানেই যোগের বিশেষত্ব।
-------------------------
২৯.১২.২০২১
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - দ্বিতীয় অধ্যায় - সাংখ্যযোগ
শ্লোক নং ২/২৮-৩০
অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত
অব্যক্ত-নিধনানি-এব তত্র কা পরিবেদনা। (২/২৮)
হে ভারত, ভূত্সকল আদিতে অব্যক্ত, মধ্যাবস্থায় ব্যক্ত, আবার বিনাশে অব্যক্ত। অতএব এদের জন্য শোক কিসের ?
ঘন্টা তিনেকের সিনেমা। প্রজেক্টরের আলো নিভে গেলে সিনেমা শেষ। হলের আলো জ্বলে উঠলো। সিনেমার চরিত্ররা কোথায় হারিয়ে গেলো। আমরা বাস্তবে ফিরে এলাম। জীবন তো ভোজবাজি। এই আছে এই নাই। নিজে চোখ বুজলে, কোথায় থাকে এই আত্মীয়-স্বজন ? আমরা অজ্ঞান, আমরা জানিনা, জন্মের আগে কোথায় ছিয়াম, আবার মৃত্যুর পরে কোথায় চলে যাবো। ভগবান বলছেন, সবই অব্যক্ত অবস্থায় ছিল, আবার অব্যক্ত হয়ে যাবে। মাঝে কেবল দুদিনের খেলা। কথাগুলো শুনলে, উদাস উদাস লাগে নিজেকে, এই আমি, এই আমার এসব কিছুই একদিন ছিল না, আবার একদিন থাকবে না। ভগবান বলছেন, না ছিল না তা নয়, থাকবেও না তা নয়, সবই থাকবে তবে এই দৃশ্যমান অবস্থায় থাকবে না, যেমন একদিন দৃশ্যমান অবস্থায় ছিল না। তাই মানুষের সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্ক অর্থাৎ এই দেহ-বিষয় ইত্যাদির সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক, এই সম্পর্ক সাময়িক। এগুলো অজ্ঞানের কারনে হয়ে থাকে, জ্ঞান হলে সব একাকার হয়ে যাবে।
এখন কথা হচ্ছে, এই যে সতবস্তু আত্মা এর না হয় বিনাশ নেই, তাই আত্মার জন্য আমাদের কোনো শোকের কারন নেই। কিন্তু শরীর যা আমাকে সুখ দুঃখের অনুভূতি এনে দেয়, তার জন্য তো দুঃখ হতেই পারে। হ্যাঁ শরীর আছে যার, শরীর বোধ আছে যার, তার মধ্যে তো শারীরিক অনুভূতি অবশ্য়ই হবে। এইজন্য আমাদের শরীরের উর্দ্ধে উঠতে হবে। শরীরের উপরে ভর করেই শরীরকে ছাড়তে হবে। শরীর কর্ম্ম নিমিত্ত তৈরী হয়েছে। কর্ম্ম শেষ হয়ে গেলে, বা কর্ম্মের অযোগ্য হয়ে গেলে, প্রকৃতির নিয়মেই আমাদের এই শরীর একদিন মৃত্যুমুখে পতিত হবে। জাগতিক সুখ-দুঃখের অনুভূতিকে গ্রহণ করা যেমন শরীরের স্বাভাবিক ধর্ম্ম তেমনি শরীরের আরো একটা কাজ আছে তা হচ্ছে কূটস্থ ব্রহ্মের অনুভূতি গ্রহণ করা। এই কূটস্থ ব্রহ্মের সন্ধান যখন আমরা পাবো, তখন জাগতিক সুখ-দুঃখ আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। আসুন, আমরা সেই সাধন ভজনের দ্বারা, যোগক্রিয়া দ্বারা, দিব্যজ্ঞান ও মনোবল সংগ্রহ করি। অসার এই সংসার থেকে আমরা পরমতত্ত্বের আহরণে ব্রতী হই আর জ্ঞান ও শান্তির অধিকারী হই। আমাদের সমস্ত ক্রিয়াকে যোগে পরিণত করি। আমাদের যে সাময়িক আত্মবিস্মৃতি হয়েছে, সেটাকে মেনে নিয়ে, আত্মস্মৃতি জাগিয়ে তোলার জন্য ঋষি মুনিদের দেওয়া মহামন্ত্র উচ্চারণ করি। আমরা গুরু নির্দেশে যোগক্রিয়াতে আত্মসমর্পন করি। এই গুরুবাক্যই আমরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীমুখ দিয়ে ধীরে ধীরে শুনবো।
আশ্চর্যবৎ পশ্যতি কশ্চিদেন-
মাশ্চর্যবদ্ বদতি তথৈব চান্যঃ।
আশ্চর্য্যবচ্চৈনমন্যঃ শৃণোতি
শ্রুত্বাপ্যেনং বেদ ন চৈব কশ্চিৎ।। (২/২৯)
কেউ এঁকে (আত্মাকে) আশ্চর্য্যবৎ দেখেন, আবার কেউ এঁকে আশ্চর্য্যবৎ বর্ণনা করেন, কেউ এঁকে আশ্চর্য্য ভাবে শ্রবণ করেন, আবার কেউ শ্রবণ করেও আত্মাকে জ্ঞাত হতে পারেন না।
উপনিষদে আত্মাকে বলা হয়েছে অবাঙ্ মনসগোচরম। অর্থাৎ যেখান থেকে বাক ও মন ব্যর্থ-মনোরথ হয়ে ফিরে আসে। এখানে বলা হচ্ছে, আত্মাকে কেউ জ্ঞাত হতে পারেন না। কেউ এঁকে আশ্চর্য্যের ন্যায় দেখে, বলে, শোনে, কিন্তু তাকে জানতে ইচ্ছে করে না কেউ।
এই প্রসঙ্গে "কেন" উপনিষদে একটা সুন্দর গল্প আছে। দেবাসুরের যুদ্ধে দেবতাগণ জয়ী হয়েছেন। এখন দেবতাগণ বিজয়উৎসব শুরু করলেন। সেখানে, বায়ু,অগ্নি, বরুন, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, দেবরাজ ইন্দ্র সকলে উপস্থিত। হঠাৎ তারা দেখলেন, একটা জ্যোতিঃপুঞ্জ । কি তেজ তার ! এমন রূপ তো তারা কখনো দেখেনি। তাই তারা আশ্চর্য্য হয়ে গেলেন । অনির্বচনীয় অদ্ভুত এই জ্যোতিঃ। সকলে সমস্বরে বলে উঠলেন, আশ্চার্য্-আশ্চার্য্ ! এখন দেবতাদের একটা ধারণা ছিল, তারা সব জানেন। তাদের অজানা কিছু নেই। কিন্তু এই জ্যোতিরূপ তাদের কাছে অজানা, অচেনা, তাই কার এই জ্যোতিঃ সেটা জানবার জন্য, তারা উদগ্রীব হলেন। তো অগ্নি আগে জ্যোতির কাছে গিয়ে, জিজ্ঞেস করতে যাবে, যে তুমি কে, তার আগেই আকাশমার্গে জ্যোতির ধ্বনি শ্রুত হলো। তুমি কে ? অগ্নি নিজেকে ঔদ্ধত্ত্বের সঙ্গে জাতবেদা বলে পরিচয় দিলেন। সেই পুরুষপ্রবর তাকে একগাছি তৃণ পোড়াবার জন্য বললেন, কিন্তু অগ্নি তার সমস্ত তেজঃশক্তি প্রয়োগ করেও তৃণ পোড়াতে ব্যর্থ হলো। অগ্নি দুঃখে অপমানে, পুরুষের পরিচয় চাইতে ভুলে গেলেন। এবার বায়ু এলেন, পুরুষের পরিচয় জানতে। বায়ু নিজেকে মাতরিশ্বা বলে গর্বের সঙ্গে পরিচয় দিলেন। সেই আশ্চার্য্য পুরুষ আবার তৃণ তুলে ধরে বললেন "এই তৃণগাছি উড়াও তো দেখি।" কিন্তু বায়ু তৃণকে একচুল নড়াতে পারলেন না। এই ঘটনা দেখে দেবতাদের মধ্যে আলোড়ন উঠলো, তারা বিস্মিত হলো, অজানার ভয় তাদেরকে চেপে ধরলো। দেবতাগণ এই আশ্চর্য্য পুরুষের দর্শন করছেন, কিন্তু বুঝতে পারছেন না ইনি কে ? দেবতাদের দেববুদ্ধি আজ নিষ্প্রভ, নিস্তেজ। এবার দেবরাজ স্বয়ং ইন্দ্র সেই আশ্চর্য পুরুষের কাছে উপস্থিত হলেন। কিন্তু তাঁকে আর দেখতে পেলেন না। মনে মনে ভাবলেন, এই আশ্চর্য্য পুরুষকে আমি দেখতেও পেলাম না। মৌন হয়ে ভাবতে লাগলেন, কিভাবে এই আশ্চর্য্য পুরুষকে জানা যায় ?
সাধারণত আমরা দেহ থেকে আত্মাকে আলাদা ভাবে দেখতে পাই না। দেখবার জন্য, যদি মন অতি ব্যাকুল হয়, বিচার বুদ্ধি প্রয়োগ করে আমরা বড়োজোর বলতে পারি, যিনি আমাদের চৈতন্য শক্তি। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, কেনই বা এই চৈতন্যশক্তি দেহের মধ্যে প্রবেশ করে ? দেহ ওনাকে টানে, নাকি, উনি দেহকে টানেন। কেউ তো তাকে বাইরের থেকে জোর করে টেনে এনে শরীরের মধ্যে পুড়ে রাখেনি। এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। এই দেহ বিনাশশীল, তাই মিথ্যা, সাময়িক। এই মিথ্যা দেহের মধ্যে নিত্যসত্ত্বার সংযোগ, দেহের মধ্যে আত্মার এই যে বন্ধন এ বড়ো জাদু। এই আত্মার সংযোগে দেহ কর্ম্মক্ষম হয়, আবার এই আত্মার বিচ্ছেদে দেহ কর্ম্মের অযোগ্য হয়ে যায়। জিজ্ঞাসু সাধক, মুমুক্ষ সাধক এই ব্যাপারটা জানতে গিয়ে আশ্চার্য্যান্বিত হন। মনকে নিয়ে বাক্ যাত্রা করে, সেই আশ্চর্য্য সত্তার সন্ধানে। কিন্তু মন-বাক তাঁকে না পেয়ে ফিরে আসে। বৈখরী ফিরে আসে, যা আমাদের জাগ্রত অবস্থার ধ্বনি। কিন্তু পশ্যন্তি ফিরে আসে না, যা আমাদের সমাধি অবস্থার নির্বাক অবস্থা। মৌন অবস্থাতেই যেন তাঁকে জানতে পারা যায়।
দেহী নিত্যম অবধ্য়ঃ অয়ং দেহে সর্ব্বস্য ভারত
তস্মাৎ সর্ব্বাণি ভূতানি ন ত্বং শোচিতুমহর্সি। (২/৩০)
হে ভারত, সকল দেহেই এই দেহী নিত্য অবধ্য। অতএব কোনো প্রাণীর জন্যই তোমার শোক করা উচিত নয়।
সবার দেহে এই আত্মা নিত্য ও অবধ্য। অর্থাৎ এই অবিনাশী আত্মা বধযোগ্য নয়। সেইজন্য সমস্ত প্রাণীর জন্যই শোকের কোনো কারন নেই। মানুষ বলুন, পশুপক্ষী বলুন, দেবতা বলুন বা কিন্নর বলুন, এমনকি কিট পতঙ্গ বলুন সবার দেহের মধ্যেই সেই একই দেহী অবস্থান করেছন । দেহীর যেহেতু বিনাশ কখনো সম্ভব নয়, তাই বিনাশের কথা ভেবে তোমার শোক করা উচিত নয়। অন্যদিকে শরীর প্রতিনিয়ত মৃত্যু মুখে পতিত হচ্ছে। শরীরের এই যে মৃত্যুমুখী গতি একেও কেউ কখনো রোধ করতে পারে না। তো দেহের নাশ অবশ্যম্ভাবী। তো যা অবশ্যম্ভাবী, অর্থাৎ আত্মার মৃত্যু বলে কিছু হয় না, আবার শরীরের মৃত্যু ছাড়া গতি নেই, তাই এইদুই অবশ্যম্ভাবী বিষয়ে শোক নিরর্থক।
আত্মা আমাদের জ্ঞান স্বরূপ, আত্মাই আমাদের আনন্দস্বরূপ। তো জ্ঞান ও আনন্দ স্বরূপ যে সত্তা তা তো জড় পদার্থ নয়, যে ধংশ হয়ে যাবে, বা ধংশ করা যাবে। তো তোমার মূল সত্তা এই আত্মা আকাশের মতো বিশাল, সর্ব্বব্যাপী। সাধারণ বুদ্ধিতেই আমরা বুঝতে পারি, শরীর বিনাশশীল। কিন্তু এই অবিনাশী আত্মাকে আমরা সহজে বুঝতে পারি না। কারন আমাদের আত্মজ্ঞান নেই। এই আত্মজ্ঞান লাভ করতে পারলেই তোমার সমস্ত শোক-তাপ দূরীভূত হয়ে যাবে। এই দেহ যেমন ব্রম্মান্ডের অংশ, আবার এই দেহেই আছে ব্রহ্মান্ড। তো এই ক্ষুদ্র ভান্ডের মধ্যে অবস্থান করছেন, সেই আত্মা। আমাদের সাধারনের দৃষ্টিতে দেহ একটা জড় পদার্থ, যা দৃশ্যমান। কিন্তু সত্য হচ্ছে এই দেহ আসলে একটা চলমান জ্যোতি। যা ভিন্নভিন্ন বর্ণের মিশ্রণ। বাহ্যিক দৃষ্টিতে আমরা জানি, দেহ অসংখ্য কোষের সমষ্টি। এই কোষ প্রতিনিয়ত জন্মাচ্ছে, আবার প্রতিনিয়ত মৃত্যু বরণ করছে। তো প্রতিনিয়ত এই শরীরের জন্ম হচ্ছে, আবার প্রতিনিয়ত মৃত্যু মুখে পতিত হচ্ছে। প্রতিদিন, আমরা নতুন নতুন শরীরে অবস্থান করছি। ৭ বছরের মধ্যে আমরা সম্পূর্ণ নতুন দেহ পাচ্ছি। তো কিসের শোক ? কার জন্য শোক ? বরং আত্মজ্ঞানের জন্য, যোগের অনুষ্ঠান করো। আত্মজ্ঞান লাভ হলে স্ব-স্বরূপে স্থিত হতে পারলে, তোমার সমস্ত দুঃখ-কষ্ট-শোক-তাপ ভ্রান্তি দূর হয়ে যাবে। আর একবার আত্মাতে স্থির হতে পারলে, তখন জ্ঞান ও আনন্দ সমুদ্রে অবগাহন করতে পারবে।
বি.দ্রঃ - আমারা গত কয়েক দিন থেকে অর্থাৎ দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১১ নাম্বার শ্লোক থেকে ৩০ নং শ্লোক পর্যন্ত শরীর ও শরীরী সম্পর্কে শুনছি। শরীর অনিত্য, শরীরী নিত্য। একটি সৎ আর একটি অসৎ। একটি অবিনাশী আর একটি বিনাশশীল। এই পার্থক্যবোধ যতক্ষন আমাদের জাগ্রত না হয়, ততক্ষন আমরা কেউই যোগক্রিয়ার পথে পা বাড়াতে চাইবো না। এইজন্যই যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুনের মাধ্যমে আমাদের এইসব গুহ্য পৃথিবীবাসীদেরকে শোনালেন।
--------------------
৩০.১২.২০২১
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - দ্বিতীয় অধ্যায় - সাংখ্যযোগ
শ্লোক নং ২/৩১-৩৩
স্বধর্ম্মম অপি চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমর্হসি
ধর্ন্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাৎ শ্রেয়ঃ অন্যৎ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে। (২/৩১)
স্বধর্ম্মের দিক থেকে দেখতে গেলেও, তোমার কম্পিত হওয়া উচিত নয়। কেননা ধর্ম্মযুদ্ধ ছাড়া ক্ষত্রিয়ের কাছে অধিক শ্রেয় আর কিছু হতে পারে না।
খেয়াল করুন, অর্জুনকে এখানে পার্থ বলে সম্মোধন করা হয়েছে, অর্থাৎ পৃত্থির পুত্র পার্থ। পৃথা রাজার কন্যা পৃত্থি। এই মুহূর্তে অর্জুনের মধ্যে প্রকৃতির গুন্ বা নারীর গুণগুলো অর্থাৎ মায়া, মমতা, ভালোবাসা, সহনশীলতা, সহ্যশক্তির ইত্যাদির প্রকাশ দেখা যাচ্ছে। অর্জুনকে বলা হচ্ছে, ক্ষত্রিয় অর্থাৎ যে ক্ষয় থেকে রোধ করে, সেই ক্ষত্রিয়। এই ক্ষাত্রশক্তি আমাদের সবার মধ্যেই আছে, আর এই কারণেই সমস্ত জীবকুল এই শক্তিবলে নিজেকে রক্ষা করে থাকে। তো অর্জুনের মধ্যে এই ক্ষাত্রশক্তির প্রাবল্য দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এখন পার্থ এই যুদ্ধে যে ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে, তার সম্ভাবনাকে সামনে রেখে সে বিচারশীল হয়েছে। ভগবান তাকে এখানে থেকে বের করে সমরে যাবার জন্য উপদেশ দিচ্ছেন।
প্রত্যেকটি জীব পরমাত্মার অঙ্গস্বরূপ। এখন এই সদ্বস্তু যখন শরীরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়, তখন সে নিজেকে শরীর ভাবে। আর পরমাত্মা নিজেকে বিভিন্ন শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে নিজের সঙ্গে ক্রিয়া করে থাকেন। এখন প্রত্যেকটি শরীরের মধ্যে কিছু গুনের সমাবেশ ঘটে থাকে। এটি তন্মাত্রের মিশ্রতার তারতম্য অনুসারে হয়ে থাকে। দেখুন ক্ষুদ্র কীটপতঙ্গের শরীর ধারণ করে হাতির মতো বলবান হতে পারবেন না। আবার আপনি মনুষ্য শরীর ধারণ করে পাখির মতো আকাশে উড়ে বেড়াতে পারবেন না। মাছ হয়ে জন্ম গ্রহণ করে, আপনি ডাঙায় ঘুরে বেড়াতে গেলে আপনার মৃত্যু অবধারিত। তো যদিও আমরা সবাই সেই পরমাত্মার অংশ, তথাপি শরীরের কিছু নিজস্বতা আছে, যাকে আপনি অবজ্ঞা করতে পারেন না। তো পরমাত্মা যখন মনুষ্য শরীর ধারণ করেন, তার একটা উদ্দেশ্য থাকে। এই মানব দেহ হচ্ছে ঈশ্বর সৃষ্ট সর্বোৎকৃষ্ট শরীর যার মধ্যে অনুভূতি শক্তি সবচেয়ে বেশী। এবং একমাত্র এই শরীরের মাধ্যমেই ব্রহ্ম উপলব্ধি হয়ে পারে। মনুষ্য শরীর ভিন্ন অন্য কোনো শরীরে এই উপলব্ধি সম্ভব নয়। আচার্য্য শংকর তার বিবেকচূড়ামনি গ্রন্থে মনুষ্য শরীরের ভূয়সী প্রসংশা করেছেন। বিশেষ করে ব্রাহ্মণ পুরুষ-দেহের উচ্চ প্রসংশা করেছেন। ব্রাহ্মণ-শরীর, অর্থাৎ যে শরীরে ব্রহ্মজ্ঞানের অবাধ গতি।আর পুরুষ অর্থাৎ যার মধ্যে পুরুষকারের প্রাবল্য আছে। তো মনুষ্য দেহ দুর্লভ, দেবতারাও নাকি এই মনুষ্য দেহের কামনা করে থাকেন।
এখন এই মনুষ্য দেহের যে উদ্দেশ্য, অর্থাৎ ব্রহ্ম-উপলব্ধি তা যদি না করতে পারি, তবে এই দুর্লভ দেহ ধারনের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যায়। তাই যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, হে অর্জুন তোমার্ শরীরের যা ধর্ম্ম, সেই ধর্ম্ম পালন করা তোমার কর্তব্য।
আমরা জানি পিতৃ-মাতৃ প্রদত্ত পঞ্চভূতের এই শরীর। এই শরীরের মধ্যে আছে, পিতৃশক্তি-মাতৃশক্তি। আমাদের সবার শরীর এই জন্মসূত্রে পিতার-মাতার শরীরের অনুরূপ, একটা শরীর প্রাপ্ত হয়ে থাকে। এর অন্যথা হতে পারে না। মানুষের পেট থেকে মানুষের অনুরূপ একটা দেহ আসে। তেমনি ছাগলের পেট থেকে ছাগলই হয়। আবার এই শরীরের যেমন একটা সীমাবদ্ধতা আছে, তেমনি এর মধ্যে আছে বিশেষ কিছু গুনের সমাবেশ। যে গুনগুলোকে উন্মোচন করাই, জীবনের প্রধান কর্তব্য। সুপ্ত গুনের প্রকাশের জন্য উদ্যোগী হওয়াই আমাদের কর্তব্য। অর্জুনের পিতা ছিলেন রাজা। তো অর্জুনের মধ্যে আছে রাজশক্তি। আবার মাতা কুন্তীদেবী সূর্য দেবতার আশীর্বাদ ধন্যা। তো একদিকে রাজশক্তি অন্য দিকে তেজঃশক্তি উভয়ের মিলিত সত্তা হচ্ছে অর্জুনের দেহ। এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাই অর্জুনকে সাধন সমরে তেজশক্তি প্রয়োগের জন্য উদ্যোগী হবার কথা বলছেন। খেয়াল করুন, অর্জুনকে এখানে পার্থ বলে সম্মোধন করা হয়েছে, অর্থাৎ পৃত্থির পুত্র পার্থ। পৃথা রাজার কন্যা পৃত্থি। এই মুহূর্তে অর্জুনের মধ্যে প্রকৃতির গুন্ বা নারীর গুণগুলো অর্থাৎ মায়া, মমতা, ভালোবাসা, সহনশীলতা, সহ্যশক্তির ইত্যাদির প্রকাশ দেখা যাচ্ছে।
এখন কথা হচ্ছে ধর্ম্মযুদ্ধ কি ? ধর্ম্ম রক্ষার নাম জীবের সংহার নয়। বরং হিংসা পরিহার করাই ধর্ম্ম। হিংসা আসলে আমাদের আত্মদর্শনের অভাব সূচিত করে। আমরা হিংসা করি কারন আমরা নিজের মতো করে সবাইকে দেখতে পারি না। ক্ষত হতে যে পরিত্রান করে, সেই ক্ষত্রিয়। এই ক্ষত রয়েছে নিজের মধ্যেই। জন্ম-মরন, সংসারের অভাব অভিযোগ, দুঃখ-কষ্ট সবই এই ক্ষতের কারনে হয়ে থাকে। সাধনার পথ অত্যন্ত নিরস, বিপদসংকুল, তাই ক্ষত্রিয় ভাবাপন্ন পুরুষ, পুরুষকারের প্রয়োগে সাধন-অভ্যাসে কখনও পরান্মুখ হবেন না। কতকগুলো সাময়িক সুখের অভাব হবে বলে, সাধনক্ষেত্র থেকে পশ্চাৎ অপসারণ করা কোনো সাধকেরই উচিত নয়।
যদৃচ্ছয়া চ উপপন্নং স্বর্গদ্বারম অপাবৃতম
সুখিনঃ ক্ষত্রিয়াঃ পার্থ লভন্তে যুদ্ধম ঈদৃশম। (২/৩২)
হে পার্থ, অযাচিতভাবে উন্মুক্ত স্বর্গদ্বার-স্বরূপ এই যুদ্ধ ভাগ্যবান ক্ষত্রিয়গণই পেয়ে থাকেন।
আবার সেই পার্থকে উদ্দেশ্য করে ভগবানের উক্তি। যে কাজ করে ভগবান তাকেই সাহায্য করে থাকে। উদ্যমহীন, অলস ব্যক্তির কাছ থেকে ভগবান সাহায্যের হাত গুটিয়ে রাখেন। সুযোগের যারা সদ্ব্যবহার করতে জানে, সেই সৌভাগ্যবান। নদীতে জোয়ারের সময় যে জাল ফেলতে পারে, সেই মাছ ধরতে পারে। বর্ষার প্রারম্ভে যারা বীজ বপন করে থাকে তারাই ফসল তুলতে পরে। তাই সঠিক সময় নির্ধারণ, এবং সময়মতো কাজে লেগে পড়া, মানুষকে অধিক ফল প্রদায়ী করে থাকে। প্রত্যেক মানুষের জীবনেই সুযোগ আসে, সৌভাগ্য অর্জনের। কেউ সেই সময় হেলায় কাটায়, কেউ তার উপযুক্ত ব্যবহার করে। তো সুযোগ সব সময় আসে না, আবার সুযোগের অপেক্ষায় বসে থাকাও ঠিক নয়। উদ্যোগী পুরুষ পরিবেশকে নিজের মতো করে তৈরী করে নিতে পারে, আর সাধারণ মানুষ পরিবেশের দাস হয়ে বেঁচে থাকে। যারা পুণ্যকর্ম করে, তারা স্বর্গসুখ অনুভব করে, আর যারা সঠিক সময়ে, সঠিক কর্ম্মের মধ্যে নিজেকে নিযুক্ত করতে না পারে, তা পরবর্তীতে আফসোস করে থাকে।
ভাগ্যক্রমে যদি গুরুসন্নিধানে এসে পড়ো তবে সেই সুযোগ অবহেলায় নষ্ট করো না। এইসময় গুরুদেবও সহজে তাকে ছেড়ে দিতে চায় না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আজ অর্জুন সম্মুখে গুরুরূপে উপস্থিত হয়েছেন। অর্জুনও আজ দ্বন্দ্বের নিরসনের জন্য গুরুমুখী হয়েছেন। অর্জুনের মধ্যে জিজ্ঞাসা জেগেছে, ভগবান তার দ্বন্দ্বের নিরসন করছেন, অসীম ধৈর্য্যের সঙ্গে ।
সাধনার দ্বারাই স্বর্গের দ্বার খুলে যেতে পারে। আর এই স্বর্গের দ্বার হচ্ছে সুষুম্না নাড়ীর মুখ। এই সুষুম্না নাড়ীর মুখ বন্ধ বলেই, জীবের এতো দুর্গতি। সাধন দ্বারা এই সুষুম্নার দ্বার উন্মোচন করতে হবে। গুরুদত্ত বিধিবৎ প্রাণের সংযমের দ্বারা নাড়ী শুদ্ধ হলে, সুষুম্নার দ্বার খুলে যায়। তখন সুষুম্নার মধ্যে সহজে প্রাণবায়ু চলাচল করতে পারে। আর সুষুম্নার মধ্যে প্রাণবায়ুর সঞ্চালন শুরু হলেই, মনের স্থিরতা আসে। মন তখন নিরালম্ব হয়ে শূন্যে প্রবেশ করে। তখন যোগীপুরুষের কর্ম্মফল নির্মূল হয়। একেই জীবনমুক্তি বলা হয়ে থাকে।
অথ চেৎ ত্বম ইমং ধর্ম্মাং সংগ্রামং ন করিষ্যসি
ততঃ স্বধর্ম্মং কীর্ত্তিং চ হিত্বা পাপম অবান্স্যসি। (২/৩৩)
কিন্তু যদি তুমি ধর্ম্মযুদ্ধ না করো, তাহলে তুমি স্বধর্ম্ম ও কীর্ত্তি পরিহারের জন্য পাপের ভাগী হবে।
প্রত্যেক ব্যাক্তির জন্য নির্দিষ্ট কিছু কর্ম্ম আছে। আপনি যদি সাধু হতে চান, তবে আপনাকে কিছু আদর্শ পালন করতে হবে। আপনি যদি শিক্ষক হতে চান, তাহলেও, আপনাকে কিছু নৈতিক আদর্শ পালন করতে হবে। এই আদর্শ থেকে বিচ্যুতি মানে আপনার পদস্খলন। আমরা কোনো সাধুকে চুপি-চুপি মাছ-মাংস খেতে দেখতে অভ্যস্ত নোই। আবার আমরা একজন গেরুয়াধারীকে অযাচিত সন্মান প্রদর্শন করে থাকি , কোনো চিন্তা না করেই, তার সন্মন্ধে কিছু না জেনেই । আমরা ধরে নেই সাধুবেশী পুরুষ অবশ্য়ই একজন সৎব্যক্তি। পরোপকারী না হোন, অন্তত কারুর ক্ষতি চিন্তা করেন না। আমরা মন্দির দেখলে মাথা নত করি, অট্টালিকা দেখে করি না।
তো মানুষ হয়ে যখন তুমি জন্মেছ, তখন তোমার একটা ধর্ম্ম বা কর্তব্য আছে। আর তা হচ্ছে পশুসুলভ প্রবৃত্তির বিনাশ সাধন, আর মনুষ্যত্ত্বের পালন পোষণ। আর এই কাজে যদি তোমার উদ্দম না দেখা যায়, তবে মানুষ হিসেবে তোমার জন্ম গ্রহণ করা বৃথা। তো মানুষ হিসেবে জন্ম গ্রহণ করে, যদি কূটস্থ পুরুষের সন্ধান না করো, তবে তোমার জন্ম বৃথা শুধু তাই নয়, তোমাকে এই অসম্পূর্ন কাজ শেষ করবার জন্য, বা পাপের প্রায়ঃশ্চিত্ত করবার জন্য বারবার এই জন্ম-মৃত্যুর কষ্টের ভাগিদার হতে হবে। একটা জিনিস জানবে, সাধন-সমরে তোমাকে লিপ্ত হতেই হবে, হয় এই জীবনের দুর্লভ দেহে, নতুবা জন্মান্তরে পাওয়া অন্য দেহে। এর থেকে কারুর রেহাই নেই। তাই ভগবান বলছেন, স্বধর্ম্ম পালন করো, মানুষ হয়ে মনুষ্যধর্ম্ম অর্থাৎ সেই সৎ-বস্তুর সন্ধানে লিপ্ত হও। প্রবৃত্তিকে পরিহার করে নিবৃত্তির পথে এগিয়ে যাও। স্বধর্ম্ম হচ্ছে আত্মভাবে অবস্থান করা। ক্রিয়া না করলে, কূটস্থে থাকা হবে না। আর কূটস্থে না থাকলে, মন বিষয় ভোগের দিকে ছুটবেই। মনের এই যে বিষয়াশক্তি, একেই বলা হয়ে থাকে পাপ। এই পাপ থেকে পরিত্রানের উপায় হয়ে আত্মস্থ হওয়া। আর ক্রিয়ার পরাবস্থাই কূটস্থে স্থিত হবার একমাত্র পথ। নান্য পন্থা।
----------------------
৩১.১২.২০২১
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - দ্বিতীয় অধ্যায় - সাংখ্যযোগ
শ্লোক নং ২/৩৪-৩৭
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা : যাঁরা ধৈর্য্য সহকারে পড়ছেন, তাঁদের ভগবৎ সত্ত্বায় আমার সশ্রদ্ধেয় প্রণাম। এতো ভগবানের শ্রীমুখ-নিঃসৃত অমৃত কথা। এই অমৃত যাঁরা পান করছেন, তাঁরা সবাই আমার শ্রদ্ধেয়।
অকীর্ত্তিং চ অপি ভূতানি কথয়িষ্যন্তি তে অব্যয়াম
সম্ভাবিতস্য চ অকীর্ত্তিঃ মরণাৎ অতিরিচ্যতে। (২/৩৪)
সকলেই তোমার অকীর্তি চিরকাল ঘোষণা করবে। বহুমান্য ব্যক্তির অপযশ অপেক্ষা মরণ শ্রেয়।
দেখুন, এই শরীরের একদিন বিনাশ হবেই, এই সত্য আমরা এর মধ্যে অনুধাবন করেছি। আর এই শরীর আমরা কত জন্মের পরে ধারণ করেছি, তাও আমরা বিস্মৃত হয়েছি। আগের জন্মে কোন্ শরীর ধারণ করেছিলাম, তাও আমাদের স্মৃতিতে নেই। আগের জন্মে আমরা কি কাজ করেছিলাম, সে সব আমরা ভুলে বসে আছি। কিন্তু সেই কাজের সুকৃতি বা অপকীর্তির ফল আমাদের মধ্যে সংস্কার রূপে বহন করে নিয়ে চলেছি। আর একথা সত্য যে আগের জন্মের সু-কর্ম্মফলেই আজ আমরা এই উন্নত মনুষ্যদেহ ধারণ করতে সমর্থ হয়েছি। আর এই মনুষ্য দেহের যা ধর্ম্ম অর্থাৎ কূটস্থে স্থিত হওয়া, বা আত্মজ্ঞান লাভ করা, সেই কর্ম্মে যদি আমরা ব্রতী না হই, তবে মনুষ্য জীবন শুধু বৃথা নয়, এই কৃতকর্ন্ম না করবার জন্য, আমার মধ্যে যে সংস্কারের জন্ম হবে, তা আমাকে বহন করে নিয়ে যেতে হবে, দেহ থেকে দেহান্তরে । বিশেষ করে গুরুসান্নিদ্ধে এসেও যদি গুরুবাক্যের প্রতি বিশ্বাস না করি, গুরুর আদেশ অনুসারে যদি যোগকর্ম্মে লিপ্ত না হই, তবে এই যোগকর্ম্ম ত্যাগের ফলে আমাদের যে অধঃপতন হবে, সেই সংস্কার আমাদেরকে মনুষ্যেতর দেহ ধারণ করতে বাধ্য করবে। উন্নত মনুষ্যদেহ ত্যাগের যে যন্ত্রনা, তার চাইতে অধিকতর যন্ত্রনা হচ্ছে মনুষ্যেতর দেহ ধারন, ও সংস্কারের অধোগতি। আসলে, অর্জুনের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের বহু জন্মের সম্পর্ক। একসময় অর্জুন নর, ও শ্রীকৃষ্ণ নারায়ণ নামে ধরাধামে এসে যোগক্রিয়া সম্পন্ন করেছিলেন। যার ফলে উভয়ের আবার মিলন সম্ভব হয়েছে। এই অর্জুন আর কেউ নয়, আমি আপনি সবাই। আমরা সবাই পূর্ব-পূর্ব জীবনে সাধন সিদ্ধি লাভের চেষ্টা করেছি। যার ফলে উন্নত দেহ প্রাপ্ত হয়েছি, অর্থাৎ মনুষ্য দেহ প্রাপ্ত হয়েছি। আবার সেই সংস্কারের বশে আমরা জ্ঞান সঞ্চয়ে ব্রতী হয়েছি। এখন বিষয়উন্মুখ মন যদি বিষয় থেকে নিবৃত্ত না হতে পারে, তবে জন্ম-জন্মান্তরের সাধনার ফল এক লহমায় শেষ হয়ে যেতে পারে। এই অকীর্তিকর অবস্থায় আমরা যেন পতিত না হই।
ভয়াৎ-রণাৎ-উপরতং মংস্যন্তে ত্বাং মহারথাঃ
যেষাঞ্চ ত্বং বহুমতো ভূত্বা যাস্যসি লাঘবম্। (২/৩৫)
মহারথগণ তোমাকে ভয়ে যুদ্ধ হতে পরান্মুখ বলে মনে করবেন। যাদের কাছে তুমি সম্মানিত - তারা তোমাকে লঘুজ্ঞান করবে।
এখন কথা হচ্ছে লড়াইটা হচ্ছে, প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির মধ্যে। আমাদের মতো সাধারনের মধ্যে নিবৃত্তির প্রভাবের থেকে প্রবৃত্তির প্রভাব বেশি। মন ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বিষয়সুখ উপভোগ করছে। মন-ই ইন্দ্রিয় সকলের রাজা। তো মনের কাজ হচ্ছে, ইন্দ্রিয়সকলকে পরিচালনা করা। কিন্তু আমরা মাঝে মধ্যে ইন্দ্রিয়শক্তি দ্বারা মনকে পরিচালিত হতে দেখি। আসলে এই সময়টা আমাদের মতিভ্রমের ক্ষণ। এই সময়টা আমাদের অধঃপতনের সময়। ইন্দ্রিয়দ্বারা মন প্রলুব্ধ হয়ে গেলে, সে অন্তরে স্থিত পরমপুরুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এখন ইন্দ্রিয়গুলোর স্বাভাবিক স্বভাব হচ্ছে মনকে বিষয়মুখী করে তোলা। আর দৃঢ়চেতা সাধকের মন বিষয়ে ধাবিত না হয়ে ইন্দ্রিয়সকলকে নিয়ে কূটস্থে স্থিত হতে চায় । তো সাধকের ইন্দ্রিয়সকল যদি অধিক শক্তিশালী হয়, অর্থাৎ সে যদি আমাদের শুদ্ধমনকে, বিষয় দ্বারা প্রভাবিত করতে পারে, তবে সে সার্থক। ঘোড়ার ইচ্ছে মতো সারথি চলবে, না সারথীর ইচ্ছে মতো ঘোড়া চলবে ? সারথী বিভ্রান্ত হলে ঘোড়া উন্মাত্তবৎ ছোটাছুটি করে, আখেরে সবাইকে বিপদে ফেলবে। ঘোড়ার শক্তি দেখে সারথী যেন বিভ্রান্ত না হন। সারথী যেন ভীত না হন। তাহলে ঘোড়া মধ্যে সারথীকে অগ্রাহ্য করবার প্রবৃত্তি দেখা দেবে। সাধন পথ থেকে সামান্য বিচ্যুত হলেই, ষড়রিপু মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। এমনকি নিজেই নিজের কাছে তুচ্ছ হয়ে যাবে। যথার্থ সাধকের কাছে অসহনীয় এই অবস্থা।
অবাচ্যবাদাংশ্চ বহুন বদিষ্যন্তি তবাহিতাঃ
নিন্দন্ত চ তব সামর্থ্যং ততো দুঃখতরং নু কিম্। (২/৩৬)
তোমার শত্রুরাও তোমার নিন্দা করে, অনেক অকথ্য কথা বলবে। এরচেয়ে অধিকতর দুঃখকর আর কি আছে ?
তুমি যদি সাধন ক্রিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে আনো, তবে তোমার যে ইন্দ্রিয়সকল উল্লাস শুরু করে দেবে। আসলে, ইন্দ্রিয়সকলকে তুমি শত্রু মনে না করলেও, এই ইন্দ্রিয়সকল তোমাকে কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। কারন সাধন পথে পা দিলে, ইন্দ্রিয় সকলকে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকতে হবে। তাই তুমি যদি সাধন পথ থেকে দূরে সরে আসো, তবে ইন্দ্রিয়সকল হাততুলে নৃত্য শুরু করে দেবে। আর তাদের এই উল্লাস তোমাকে ব্যথিত করে তুলবে। ইন্দ্রিয়সকল সমস্বরে বলে উঠবে, কেমন, আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলে, এবারে নিজ ক্ষমতা কত তা বুঝতে পারলে তো ?
হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং জিত্বা বা ভোক্ষসে মহীম্
তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃত নিশ্চয়ঃ। (২/৩৭)
হে কৌন্তেয়, এই যুদ্ধে যদি হত হও, তবে স্বর্গে যাবে, আর যদি বিজয়ী হও তবে পৃথিবী ভোগ করবে। অতএব ওঠো, যুদ্ধের জন্য দৃঢ়-নিশ্চয় হও।
অর্জুন একসময় বলেছিলো (২/৬) "যদিবা আমরা জয়ী হই , অথবা যদি আমরা পরাজিত হই, এর মধ্যে আমার পক্ষে কোনটা ভালো তা আমি বুঝতে পারছি না। যাদের হত্যা করে আমরা বাঁচতে চাই না, সেই ধৃতরাষ্ট্র পুত্রগণ আমার সম্মুখে উপস্থিত। জয় ও পরাজয়ের মধ্যে কোনটা শ্রেয় তা আমি বুঝতে পারছি না।" ভগবান সেই দ্বন্দ্বের নিরসন করলেন, এই শ্লোকে এসে। ধৃতরাষ্ট্র পুত্রগণ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সকল। ভগবান, বলছেন, সাধন করে সিদ্ধি লাভ করলে ভালো। আর যদি ধরেই নেওয়া হয়, যে সাধনায় সিদ্ধি নিশ্চিত নয়, তথাপি জানবে, সাধনার ফল কখনো নিঃশেষিত হয় না। সাধন সমরে দেহের নাশ হলেও, নিশ্চিত জেনো পুনরায় এই মনুষ্য দেহেরই প্রাপ্তি হবে, এবং সেই দেহ আরো বেশী ধীশক্তি নিয়ে জন্মাবে। সিদ্ধিলাভের জন্য, আরো বেশী যোগ্য- শরীর তোমার প্রাপ্ত হবে। সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, দেহাতীত অবস্থায় তোমার মধ্যে কোনো অনুশোচনা থাকবে না। ফলতঃ স্বর্গসুখে মনোময় শরীরে বিশ্রাম করবে। আবার যদি সাধন করতে করতে সৌভাগ্যক্রমে জয়লাভ অর্থাৎ সিদ্ধি লাভ করো, তবে পৃথিবী ভোগ অর্থাৎ সমস্ত গ্রন্থি ছিন্ন করে, তুমি ইছারহিত অবস্থায় কূটস্থে স্থিতি লাভ করবে। আর যদি সিদ্ধি লাভ নাও হয়, তাহলেও তুমি স্বর্গ অর্থাৎ ক্ষনিকের জন্য হলেও আজ্ঞা চক্রে পরমাস্থিতি লাভ করবে। শরীর ত্যাগের পরেও সাধকের গতি হবে উর্দ্ধমুখী।
-----------------
০১.০১.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - দ্বিতীয় অধ্যায় - সাংখ্যযোগ
শ্লোক নং ২/৩৮-৪০
সুখদুঃখে সময়ে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ
ততো যুদ্ধায় যুজ্যস্ব নৈবং পাপমবাপ্স্যসি। (২/৩৮)
সুখ-দুঃখ, লাভ-অলাভ, জয়-পরাজয় সমান মনে করে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। তাহলে তুমি পাপের ভাগীদার হবে না।
সুখ-দুঃখ, লাভ-লোকসান, জয় অথবা পরাজয় ইত্যাদির কথা চিন্তা না করে ক্রিয়ানুষ্ঠানে লেগে পড়তে হবে। চিত্তের সমতা আনতে হবে। যোগক্রিয়ার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে চিত্তের সমতা আসতে পারে। এই অবস্থা যোগক্রিয়া না করলে পাওয়া যাবে না। প্রথমেই যদি ভাব, বা ভাবতে থাকো, যোগক্রিয়া করলে কি কি শক্তি হবে, কি কি অলৌকিক শক্তি অর্জন করা যাবে, বা কি কি যোগৈশ্বর্জ্য অর্জিত হবে, তাহলে যোগের মধ্যে একাগ্র হওয়া যাবে না। আর যোগে একাগ্র না হতে পারলে, যোগের কোনো ফল কোনোদিনই মিলবে না। বীজ মাটিতে পুতে পরিচর্য্যা করতে হয়। এখন প্রতিদিন যদি একবার করে মাটি থেকে বীজ তুলে দেখতে যাও যে বীজে থেকে অঙ্কুর হলো কি না, তাহলে বীজ থেকে অংকুর হওয়া তো দূরে থাকুক, বীজটাই নষ্ট হয়ে যাবে। যোগক্রিয়া করা মনুষ্যমাত্রেই কর্তব্য, অন্যদিকে থেকে বলতে গেলে, এই ক্রিয়াই আমাদের স্বধর্ম্ম। নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখো, গুরুদেবের প্রতি শ্রদ্ধা রাখো, গুরুদেবের নির্দেশে ক্রিয়াকর্ম্ম করে যাও। কি হবে বা কি হবে না , কবে হবে বা কবে হবে না, এই চিন্তা মাথা থেকে দূরে সরিয়ে দাও। ভগবৎস্মরণ যেমন আমাদের কর্তব্য, তেমনি ভগবানের নির্দেশ পালন আমাদের ধর্ম্ম।
ভগবৎ স্মরণে আমাদের সমস্ত জাগতিক দুঃখ দূর হয়ে যাবে, আমাদের সমস্ত কুপ্রবৃত্তির নাশ হয়ে যাবে, লোভ, লালসা, ক্রোধ, ভয় দূর হয়ে যাবে এই ভেবে যদি সাধন-ভজন করতে যান, তবে আপনার পাওনা হবে শুধুই হতাশা। কামনা করে বিক্ষিপ্ত চিত্তকে স্থির করা যায় না। শান্তির জন্য সাধন-ভজন নয়, সাধন-ভজনের ফলে শান্তি। যখনই সাধনার মধ্যে কামনা আসবে, তখনই চিত্তের ব্যাকুলতা তৈরী হবে। আর তা হবে শান্তির জন্য, ঈশ্বরের জন্য নয়। ঈশ্বর আমাকে কি দেবে সেটি বড়ো কথা নয়, আমি ঈশ্বরের জন্য কি করতে পারি, সেই দিকে কর্ম্মকে ধাবিত করতে হবে। একথা ঠিক তিনি কারুর ইচ্ছে অপূর্ন রাখেন না। কিন্তু ইচ্ছে নিয়ে তার কাছে গেলে, তিনি দূরে সরে যান।
এষা তে অভিহিতা সাংখ্যে বুদ্ধির্যোগে ত্বিমাং শৃণু
বুদ্ধা যুক্তো যয়া পার্থ কর্ম্মবন্ধং প্রহাস্য়সি। (২/৩৯)
এতক্ষন তত্ত্বজ্ঞানের বিষয় তোমাকে বলা হলো। এবার বুদ্ধিযোগের রহস্য অবগত হও।
এই বুদ্ধিযোগ ব্যাপারটা কি ? বুদ্ধি বলতে আমরা বুঝি জ্ঞানের সমাহার। আর এই জ্ঞান হচ্ছে আমাদের অভিজ্ঞতা লব্ধ বিদ্যা। আমরা যখন কোনো বিষয়ের প্রতি আসক্ত হই বা সংস্পর্শে আসি, সেই মুহূর্তে সেই বিষয় সম্পর্কে আমাদের পূর্ব অর্জিত জ্ঞানের দ্বারা তার বিচার করে থাকি। এমনকি আমরা যখন কোনো কাজের মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত করতে চাই, তার আগে সেই কাজের ভবিষ্যৎ পরিণতি সম্পর্কে একটা ধারণা করে নেই। এই ধারণা আমাদের পূর্বার্জিত জ্ঞানের সাহায্যে হয়ে থাকে। ধরুন আপনি একটা পাতকুয়ো খুঁড়তে চান। আপনার উদ্দেশ্য হচ্ছে, পাতকুয়ো থেকে জলের সংস্থান করবেন। এবং আপনার মধ্যে যে জ্ঞান আছে, তাতে আপনি মনে করছেন, ১০-১২ ফুট মাটি খুঁড়লেই জল আসতে পারে। কারন আপনি দেখেছেন, পাশের বাড়িতে ১০-১২ ফুট মাটি খোঁড়ার পরে জল এসেছে। আমাদের প্রত্যেকটি কাজই এই অহংবুদ্ধি যোগে ও ফলাকাঙ্খ্যার ফলে সম্পাদিত হয়ে থাকে। এখন গর্ত খুঁড়তে গিয়ে দেখলেন, জল তো উঠছেই না বরং নিচে একটা বিশাল পাথরের চাঁই। তো আপনার সারাদিনের পরিশ্রম বৃথা গেলো। আর এতে আপনার মানসিক উদ্বেগ ও অশান্তি বৃদ্ধি হলো। এখন এই কাজটাই আপনি কাউকে কন্ট্রাক্ট দিয়ে দিলেন। তাহলে আর আপনার মধ্যে দুশ্চিন্তা রইলো না। অর্থাৎ যে কাজে আপনার কর্তৃত্ত্ব থাকবে, সেই কাজের পরিণতি সম্পর্কে আপনার মধ্যে নানান রকম অশান্তির বাতাবরণ তৈরী হবে। কিন্তু যদি আপনি অহংবুদ্ধিকে ত্যাগ করে, অর্থাৎ নিজের কাছে কর্তৃত্ত্ব না রেখে, পিতার কাছে কর্তৃত্ত্ব ছেড়ে দিতে পারেন, তবে আপনার সমস্ত কাজের দায়িত্ত্ব তিনিই নিয়ে নেবেন। তখন আপনার মধ্যে ফলাফলের জন্য উদ্বিগ্নতা বা আতঙ্ক থাকবে না। এই হচ্ছে যথার্থ বুদ্ধিযোগ। দেখুন আপনি ছোট থেকে বড়ো হয়েছেন, এই পিতার সাহায্যেই। আর ছোটবেলায় আপনার নিজের কোনো কর্তৃত্ত্ববোধ ছিল না - দুশ্চিন্তাও ছিল না। যেদিন থেকে আপনি সমস্ত কাজের দায়িত্ত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন, সেইদিন থেকেই আপনার মধ্যে চঞ্চলতা, আশঙ্কা, উদ্বেগ, ভয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এখন সাধারণ ভাবে পিতা কারুর চিরকাল থাকেনা। একদিন না একদিন আমাদের স্ব-নির্ভর হতেই হয়। তখন আমাদের উপায় কি ? তখন আমাদের উপায় হচ্ছে বিশ্বপিতার সাথে সংযোগ স্থাপন করা। আসলে সংযোগতো আছেই, কিন্তু অহংবুদ্ধির বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বপিতার সঙ্গে আমাদের দূরত্ত্ব তৈরী হয়েছে। এই দূরত্ত্ব ঘোচানোই আসলে যোগের কাজ। এখন কথা হচ্ছে আমি দেহ আর তিনি দেহাতীত। আমরা সম্পর্ক গড়তে পারি, কোনো না কোনো দেহের সঙ্গে, তা সে মানুষ হোক বা পশু হোক, এমকি গাছগাছালির সঙ্গেও সম্পর্ক গড়তে পারি। কিন্তু যার কোনো অবয়ব নেই, যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, যাঁকে দেখা যায় না, যার কথা শোনা যায় না, যাঁকে স্পর্শ করা যায় না, তার সঙ্গে আমরা সম্পর্ক গড়ে তুলবো কি করে ? এইখানেই যোগের মাহাত্ম। আমরা ধীরে ধীরে এইসব কথাই যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে শুনবো। যিনি দেহের মধ্যেও আছেন, আবার দেহাতীত অবস্থাতেও আছেন।
মন-প্রাণকে স্থির করে, ব্রহ্মতে আটকে থেকে ফালাকাঙ্খ্যা রোহিত হতে পারলেই, আমরা কর্ম্মপাশ হতে মুক্ত হতে পারবো। আমাদের সাম্যবস্থাতে যেতে হবে, আর এই সাম্যাবস্থা হচ্ছে ত্রিগুণের অতীত অবস্থা। ইড়া পিঙ্গলা এমনকি সুষুম্না নাড়ীতেও যতক্ষন প্রাণ বায়ু প্রবাহমান থাকবে, ততক্ষন আমাদের সাম্যভাব আসবে না। এই সাম্যভাবের অভাবের কারণেই আমরা সংসারের মধ্যেও অভাব দেখতে পাই। মনের চঞ্চলতা ও বিক্ষেপ আমাদের সমস্ত দুঃখের কারন। এই মন যখন স্থির হয়ে যায়, এই মন তখন ব্রহ্মে স্থিত হয়। এই স্থিরতাতে মন যখন আটকে যায়, তখন আর মন বাইরে আসবার পথ খুঁজে পায় না। একেই বলে সম্যক জ্ঞান বা সাংখ্য। এই সাংখ্যবিদ্যা জীবন্মুক্তির অবস্থা। এই সাংখ্য বিদ্যার কথা বলার পরে, এখন এই অবস্থায় স্থির হয়ে কিভাবে থাকা যায়, সেই সম্পর্কে বলছেন, ভগবান ।
এই অবস্থায় থাকার উপায় হচ্ছে বুদ্ধি সহযোগে কর্ম্মযোগ বা ক্রিয়া। এই বুদ্ধিযোগে চিত্তশুদ্ধি হয়। অর্থাৎ চিত্তে যে বিষয়-মল আছে, তা দূর হয়ে যায়। আর বিষয়-মল দূর হয়ে গেলে, চিত্ত শূন্য হয়ে যায়। তখন আত্মজ্ঞানের উপলব্ধি হয়। এমনি এমনি এই জ্ঞানে স্থিত হওয়া যায় না। এর জন্য দরকার প্রাণায়াম। এই প্রাণায়ামের দ্বারা প্রাণবায়ু শুদ্ধ হলেই মন-বুদ্ধি সব শুষ্ক হয়ে যায়। তখন চিত্তে একাগ্রতা বা ধ্যাননিষ্ঠা জন্ম নেয়। এইসময় রজঃগুনের খেলা বন্ধ হয়ে যায়। মন প্রসন্ন ও তদ্গত হয়ে থাকে। একেই বলে আত্মসাক্ষাৎকার।
ন ইহ অভিক্রমনাশঃ অস্তি প্রত্যবায়ো ন বিদ্যতে
স্বল্পমপ্যস্য ধর্ম্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ। (২/৪০)
ইহা অর্থাৎ এই বুদ্ধিযোগে অভিক্রম নাশ নেই। এতে কোনো প্রত্যবায় বা অনিষ্টের কারন নেই। বরং এই বিদ্যার স্বল্প প্রয়োগও সাধককে মহাভয় থেকে পরিত্রান করে।
অভিক্রম কথাটার অর্থ শত্রুনিধনের জন্য অভিযান। তো এই অভিনব অভিযানের সুবিধে হচ্ছে, এতে কিছু হারানোর ভয় নেই। এমনকি এই নিষ্কামকর্ম্ম যোগে বিফলতা বলে কিছু নেই। এমনকি যদি ধরেও নেওয়া যায়, যে ক্রিয়া সমাপ্তির আগেই শরীরের নাশ হলো, তথাপি জানবেন, এই ক্রিয়ার ফল বৃথা যাবে না। নিয়মাদি রক্ষা করে নিয়মিত সাধন করতে পাড়লে তো ভালোই, যদি নিয়ম করে ক্রিয়া অনুষ্ঠান করতে নাও পারেন, আপনি যতটুকু করবেন, এমনকি আপনি যদি ভগবানের এই অমৃতকথা গুলো শুধু মনোযোগ দিয়ে শোনেন, এবং সেইমতো কর্ম্মে প্রবৃত্ত হন, বা সেইমতো শুধু কথাগুলো মনন করেন, তাহলেও জানবেন, আপনি একটা ধাপ এগিয়ে গেলেন। প্রতিদিন একটু একটু করে, এই কথাগুলো শুনলে, আপনার মধ্যে একটা সংস্কার তৈরী হবে, আর সেই সংস্কার আপনাকে একদিন সাধনপথে টেনে নিয়ে আসবে। এমনকি মৃত্যুর পরেও আপনার এই সংস্কারের নাশ হবে না। আপনার মধ্যে থেকে জন্ম-মৃত্যুর ভয় কেটে যাবে। আর যদি সৌভাগ্যবশতঃ গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সামান্যতম সাধন ক্রিয়াও শুরু করেন, এবং ধীরে ধীরে এর মাত্রা বাড়াতে থাকেন, তাহলে অবশ্য়ই এই জীবনেই মুক্তির পথ খুঁজে পাবেন। আপনি কূটস্থে স্থিত হয়ে যাবেন। কেননা আপনি তো কূটস্থের কথাই মনোযোগ দিয়ে শুনছেন।
------------
০২.০১.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - দ্বিতীয় অধ্যায় - সাংখ্যযোগ
শ্লোক নং ২/৪১-৪৪
ব্যবসায়ত্মিকা বুদ্ধিঃ-একা-ইহ কুরুনন্দন
বহুশাখা হ্যনন্তাশ্চ বুদ্ধ্য়য়ঃ-অব্যবসায়িনাং। (২/৪১)
হে কুরুনন্দন এই বুদ্ধিযোগের নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি একই। কিন্তু ফলকামী অস্থির চিত্তদিগের বুদ্ধি বহুশাখা ও অনন্ত অর্থাৎ ওদিকে যে ধাবিত হয়ে থাকে, তার অন্ত নেই ।
এখানে অর্জুনকে কুরুনন্দন নামে ডাকা হয়েছে।"কুর" কথাটার অর্থ ছেদন করা। তো যিনি সমস্ত রাজমন্ডলের গর্ব্ব ছেদন করেছেন, তিনি কুরু। তো আমরা জানি আমাদের শরীরের মধ্যে প্রতিনিয়ত শ্বাসপ্রশ্বাসের ক্রিয়া চলছে। এই ক্রিয়া অবিরত চলছে। এই ক্রিয়াকে কুম্ভকের সাহায্যে ছেদন করা হয়। কর্ম্মযোগী সাধকের লক্ষ হচ্ছে সমতা প্রাপ্তি। সমতা প্রাপ্তির জন্য অন্তঃকরনের অনুরাগ দূর করতে হয়। আর এই অনুরাগ দূর করবার জন্য, যে দৃঢ় নিশ্চয়াত্মক বুদ্ধি একেই বলে ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি। এই ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি জাগ্রত হলে, জাগতিক সমস্ত পদার্থের কামনা ত্যাগ হয়। শ্বাস-প্রশ্বাসের যে নিরন্তর ক্রিয়া, আমাদের মধ্যে চলছে, এর মধ্যে কোনো ফলের আকাঙ্খ্যা নেই। অর্থাৎ স্বাস গ্রহণ ও বর্জন করবার সময় আমরা কোনো ফলের আকাংখ্যা করি না। যদিও এর ফলেই আমরা প্রাণবন্ত থাকি। আর এই নিষ্কাম কর্ম্মের যিনি কর্তা অর্থাৎ প্রাণশক্তি, সেই প্রাণশক্তির দিকে আমরা যদি লক্ষ রাখি, তবে আমাদের মন এই প্রাণের ন্যায় নিষ্কাম কর্ম্মে প্রবৃত্ত হতে পারে। প্রাণ স্থির হলে, মন স্থির হয়ে যাবে। মনের স্থিরতা বা একাগ্রভাবই আমাদের নিষ্কাম অবস্থা। মন যতক্ষন চঞ্চল থাকবে ততক্ষন আমাদের কামনা শূন্য হবার কোনো উপায় নেই। এইসময় আমাদের মন চঞ্চলতা হেতু শতমুখী হয়ে ছুটে বেড়াবে। ঋষি পতঞ্জলি বলেছেন, চিত্তবৃত্তির নিরোধ হলেই, যোগ সম্পন্ন হয়ে থাকে। মহাত্মাগণ বলে থাকে নির্মল জ্ঞান সংগ্রহ ও যোগে প্রবৃত্ত হলে, চিত্ত একমুখী অর্থাৎ ঈশ্বরমুখী হয়ে যাবে। জীবের আর যত কর্ম্ম আছে,তার কোনোটাই এমনকি ঈশ্বর আরাধনা বা উপাসনাও নিষ্কাম নয়। কারন এখানেই ঈশ্বরকে পাবার আকাংখ্যা আছে। কিন্তু আপনি যখন প্রাণের ক্রিয়ার দ্রষ্টা হবে, তখন আপনার মধ্যে কোনো কামনার লেশ মাত্র থাকবে না। একেই পরাভক্তিযোগ বলা হয়ে থাকে।
যামিমাং পুস্পিতাং বাচং প্রবদন্ত্য-অবিপশ্চিতঃ
বেদবাদরতাঃ পার্থ নান্যদ-অস্তি-ইতি-বাদিনঃ (২/৪২)
কামাত্মনঃ স্বর্গপরা জন্ম কর্ম্ম ফল প্রদাম্
ক্রিয়া-বিশেষ-বহুলাং ভোগৈশ্বর্য্য়-গতিং প্রতি। (২/৪৩)
হে পার্থ যে কামনাতে মগ্ন আছে, স্বর্গকেই সে শ্রেষ্ট বলে মনে করে, বেদোক্ত সকাম কর্ম্মে যে প্রীতি রাখে। ভোগৈশ্বর্য্যে যার রুচি, এইরূপ অবিবেকী ব্যক্তি পুষ্পিত বাক্য বলে থাকে, যা আসলে জন্ম-মৃত্যুরূপ কর্ম্মফল প্রদানকারী এবং ভোগ-ঐশ্বর্য্য প্রাপ্তির নানান ক্রিয়া অনুষ্ঠান মাত্র, যা বেদে কথিত আছে ।
আপনি যদি বেদ পড়েন, তবে সাধারণ দৃষ্টিতে দেখতে পারবেন, সেখানে বিভিন্ন দেবতাদের স্তুতি আর প্রার্থনা। অর্থাৎ এটা দাও, সেটা দাও। একে মেরে ফেলো, তাকে বাঁচিয়ে রাখো, ভালো রাখো ইত্যাদি ইত্যাদি। বেদের মধ্যে অনেক ক্রিয়া কর্ম্মের কথা আছে, যার প্রয়োগবিধি সম্পর্কে আমাদের কিছুই জানা নেই। কঠ-উপনিষদে যমরাজ কর্তৃক স্বর্গলাভের উপায় বলা আছে। যা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কোনো কাজে লাগবে না। এমনকি বেদের মধ্যে অনেক চিকিৎসা পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে, যার যথার্থ মর্মার্থ আমাদের জানা নেই। আমরা মহাভারতের গল্প পড়ি, কিন্তু এই গল্পের মধ্যে যে নীতিবাক্যের কথা আছে, বা যে গুহ্যকথা আছে, তার দিকে আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় না। দেখুন স্বর্গলাভ বা জাগতিক ঐশ্বর্য্য লাভ জীবনের পুরুষার্থঃ নহে। কেবল মধুর ভাগবত পাঠ শুনলাম, তাতে কোনো কাজ হবে না। আসলে আমরা তো ভগবানের কথা শুনি না, আমরা গল্পকথা শুনি। তো গল্পে পেট ভরবে না। যারা সত্যিকারের পরম পুরুষার্থঃ লাভ করতে চান, তাদের শাস্ত্রের খুঁটিনাটি বাদ দিয়ে, অর্থাৎ কামনার কঠিন শৃঙ্খল ভেদ করে, কঠোর সাধনার অভ্যাসের মধ্যে নিজেকে নিয়োগ করতে হবে। আমরা অনেক কথা বলতে পারি। আমরা শান্তির কথা অন্যকে শোনাতে পারি, কিন্তু নিজে শান্তি পাই কই ? আমরা অন্যকে অনেক কাজের কথা বলতে পারি, কিন্তু নিজে কাজ করি না। সব ছেড়ে যদি আমরা সাধনার অভ্যাসে উঠে পড়ে লাগি, তবে আমরা ব্রহ্মসাগরে অবগাহন করতে পারি। বাসনার তাড়নায় অস্থির চিত্ত কখনো স্থির হতে পারে না। মন্ত্র পড়ে, ব্রাহ্মণদেরকে দান ধ্যান করলে আপনার পিতা স্বর্গবাসী হবেন,গরুর লেজ ধরে বৈতরণী নদী পার হয়ে যাবেন, আর ব্রাহ্মণকে তার চাহিদা পূরণ না করলে পিতার নরকবাস কেউ ঠেকাতে পারবে না, এই ধরনের মিশ্র বাক্য মানুষকে বিভ্রান্ত করে। দেখুন, বাসনার বিনাশ না করতে পারলে, কিছুতেই সেই মহাস্থিরতার মধ্যে প্রবেশ করা যায় না। বাহ্য অনুষ্ঠানাদির দ্বারা পারলৌকিক সুখভোগের কথা শুনতে ভালো লাগে, কিন্তু এতে কাজের কাজ কিছুই হয় না। এইসব ভ্রান্ত ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। বাহ্য ক্রিয়ার চাইতে অন্তরের ক্রিয়া অধিক শক্তিশালী।
কঠোপনিষদে,যমরাজ নচিকেতাকে বলছেন,
এষ সর্বেষু ভূতেষু গূঢ়ো আত্মা ন প্রকাশতে
দৃশ্যতে ত্বগ্রয়া বুদ্ধ্যা সূক্ষ্ময়া সূক্ষ্ম দর্শিভিঃ।(১/৩/১২)
পরমাত্মা সকল বস্তুর মধ্যে প্রচ্ছন্ন ভাবে রয়েছেন। তিনি সকলের অগোচরে আছেন। যারা সূক্ষ্ম বুদ্ধি সম্পন্ন তারাই কেবল তিক্ষ্ণ ও একাগ্র বুদ্ধির সাহায্যে পরমাত্মাকে উপলব্ধি করতে পারেন।
উপনিষদের আরো বাণী - "উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্নিবোধত" ওঠো জাগো। শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের সঙ্গ লাভ করো এবং তাদের কাছ থেকে আত্মজ্ঞানের শিক্ষা নাও। আমরাও যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে সেই কথাই শুনছি। এখন আমাদের উচিত, নিজের মধ্যে সাহস জাগ্রত করে, নির্ভিক হয়ে, সর্বভূতের অন্তরে প্রবিষ্ট ও দেহরূপের গহ্বরে এবং বুদ্ধির অভ্যন্তরে নিত্য বিদ্যমান সেই পরমাত্মাকে জ্ঞাত হওয়া।
ভোগৈশ্বর্য্য-প্রসক্তানাং তয়া অপহৃত-চেতসাম
ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি সমাধৌ ন বিধীয়তে। (২/৪৪)
এইসমস্ত আপাত প্রীতিকর ব্যবসায়ী বাক্যে যাদের চিত্ত মোহিত হয়েছে, সেইসব ব্যক্তিদের কখনো বিধিমতে সমাধি লাভ হতে পারে না।
বাসনাই মনের ময়লা। আর মনের এই ময়লা যতক্ষন দূর না হবে, ততক্ষন চিত্ত অস্থির থাকবেই। কামনা দ্বারা তাড়িত চিত্ত সব সময় বিষয়ের দিকে ধাবিত হবে। এই কামনাপ্রসূত মনে কখনো মুক্তির কথা উদয় হয় না। আমাদের পুরুষকারও বিষয়ভোগের দিকে ধাবিত হয়। বিষয়ভোগ করতে করতে একসময় হয়তো বৈরাগ্য আসে, অথবা শরীর যখন বিষয়ভোগে অপারগ হয়, তখন একটা শ্মশান বৈরাগ্য হয়তো আসে, কিন্তুএই বৈরাগ্যের অবস্থায় মন বেশিদিন স্থিত থাকে না। কেননা, হয় শরীর পাত হয়ে যায়, নতুবা বৈরাগ্যের বৈরাগ্য এসে উপস্থিত হয়। আর যতদিন আমাদের এই ভোগের ইচ্ছে থাকবে, ততদিন, ব্রহ্মে স্থিতাবস্থা অধরাই থাকবে।
যোগীরাজ্ বলে থাকেন, রেচক-পূরক-কুম্ভক (বাহ্য ও অন্তর) এটা যদি আপনি মনোযোগ দিয়ে কেবলমাত্র বারো-বার (১২) করেন, এবং সঙ্গে প্রত্যাহার করেন, তাহলে ধীরে ধীরে মন স্থির হতে থাকে। আপনি যদি ১৪৪ বার করতে পারেন, তখন ধারণা অর্থাৎ চিত্ত ইষ্টমূখী হয়। ১৭২৮ বার করতে পারলে, ধ্যানের উত্তম অবস্থায় পৌঁছতে পারবেন । এবং ২০৩৬ বার করতে পারলে, প্রাণের সমস্ত কার্য্য নিরুদ্ধ হয়ে সমাধি লাভ করতে পারবেন। যতদিন কাজে না লাগবেন, ততদিন, এর সম্যক উপলব্ধি সম্ভব নয়। এইসময় মনের অশান্তি, মনের অজ্ঞানতা দূর হয়ে যাবে। তবে বিষয়ের দিকে মন রেখে শারীরিক কসরৎ করা মানে বৃথা পরিশ্রম। তথাপি বলবো, প্রাণায়ামের অভ্যাস ধীরে ধীরে মন থেকে বিষয় থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করে।
------------------------------------
০৩.০১.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - দ্বিতীয় অধ্যায় - সাংখ্যযোগ
শ্লোক নং ২/৪৫
ত্রৈগুণ্য-বিষয়া বেদা নিস্ত্রৈগুণ্যো ভবার্জ্জুন
নির্দ্বন্দ্বো নিত্যসত্ত্বস্থো নির্যোগক্ষেম আত্মবান। (২/৪৫)
হে অর্জ্জুন, বেদসকল ত্রৈগুন্যঃ-বিষয়ক। তুমি ত্রিগুণের রোহিত হও, দ্বন্দ্বের অতীতে যাও, নির্যোগক্ষম ও আত্মবান হও।
আসলে বেদ এমন একটা জ্ঞানের সম্ভার, যেখানে সমস্ত গুনের কথা বলা আছে। এই বেদজ্ঞান সাধারনের জন্য নয়। স্বয়ং ব্যাসদেব এই গুহ্যকথা অনুভব করেছিলেন। তাই বেদ বিভাজনের মতো মহৎ ক্রিয়া করে, তার মনে হয়েছিল - এই বেদের জ্ঞান সাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করবে। রচনা করলেন মহাভারত - সহজ সরল রূপক গল্পের মধ্যে বেদের গুহ্য তত্ত্ব প্রকাশ করলেন। আর গল্প বলতে বলতে মনে হলো, সরাসরি ভক্ত-ভগবানের কথা হোক সহজ সরল ও সংক্ষিপ্ত ভাষায়। তাই সংযোজন করলেন, শ্রীগীতা। এই মহাভারতের সারগ্রন্থ হচ্ছে শ্রীমৎ ভগবৎগীতা। এখানে এসে ব্যাসদেব ভগবানের শ্রীমুখ দিয়ে গুহ্য জ্ঞানের কথা সহজ সরল ভাষায় প্রকাশ করলেন।
ভগবান বলছেন, ত্রিগুণের অতীতে যেতে হবে। সত্ত্বঃ রজঃ তমঃ - এই তিন গুনের উর্দ্ধে উঠতে হবে। এখন কথা হচ্ছে, আমরা তো জানি তমঃগুণ-এর প্রসার না হয় আমাদের অজ্ঞানতা বশতঃ হয়ে থাকে। আর এই তমগুন, আমাদের আলস্য এনে দেয় , কিন্তু রজঃগুন তো আমাদের কর্ম্মে নিযুক্ত করে। আর সত্ত্বগুণ আমাদের সৎগুণের অধিকারী করে দেয়, তাহলে এই তিনটিগুনের উর্দ্ধে উঠতে কেন বলছেন ? আসলে এই ত্রিগুণের প্রভাবেই এই জগৎ চলছে। আপনার ভালো কাজ মন্দ কাজ সবই বাসনাতাড়িত হয়ে সম্পন্ন হয়ে থাকে। আর বাসনাতাড়িত কর্ম্ম আপনাকে কর্ম্মফল ভোগ করাবে। হতে পারে তা ভালো কর্ম্ম। আর এই ভালো কর্ম্ম আপনাকে হয়তো স্বর্গবাসের অধিকারী করে দেবে। আপনি সেখানে স্বর্গ ভোগ করবেন। কিন্তু পুণ্যকর্ম্মের ভোগ শেষ হয়ে গেলে, আপনাকে আবার এই কারন্মভূমিতে দেহ ধারণ করতে হবে। এর থেকে নিষ্কৃতি নেই। তাই ভগবান শ্রীকৃষ বলছেন, সংসারের বাসনা ত্যাগ করে অসংসারী হও। সংসারের উর্দ্ধে অবস্থান করো।
আবার সংসারের উর্দ্ধে উঠতে গেলে আমাদের দ্বন্দ্ব রোহিত হতে হবে। রাগ-দ্বেষ-ঘৃণা-ভয়ের উর্দ্ধে উঠতে হবে। এগুলো সাধন জগতের শত্রু। এগুলোই সংসারের বন্ধনের কারন। র দ্বন্দ্বাতীত হতে গেলে, আমাদের নিত্যসত্যে স্থিত হতে হবে। অর্থাৎ অস্ৎবস্তু বস্তু ত্যাগ করে সতবস্তুতে অর্থাৎ পরমাত্মাতে নিরন্তর স্থিতিলাভ করতে হবে। যত্মবান হতে হবে অর্থাৎ একমাত্র পরমাত্মার প্রতি লক্ষ স্থির করে অবস্থান করতে হবে।
নির্যোগক্ষেম কথাটার অর্থ একটু বোঝার চেষ্টা করি। যোগ কথাটার অর্থ অপ্রাপ্ত বস্তুকে পাওয়া। প্রাপ্তবস্তুকে রক্ষা করার অর্থ ক্ষেম। তো নির্যোগক্ষেম কথাটার অর্থ হচ্ছে, কোনো বস্তু পাওয়ার জন্য আকাংখ্যা করো না, তাকে রক্ষা করবার চেষ্টাও করো না। আসলে যোগক্রিয়াতে যিনি স্থিত তার সমস্ত দায়িত্ত্ব কাঁধে তুলে নেন, স্বয়ং ভগবান। তো ভক্তের আবার কিছু চাইতে হবে কেন। তাই বলছেন, হে অর্জ্জুন তুমি নির্যোগক্ষেম হও। তুমি নিষ্কাম হও।
এবার যোগক্রিয়ার কথায় আসি। আমাদের সাধারণ মানুষের শ্বাসবায়ু ইড়া ও পিঙ্গলা দিয়ে প্রবাহিত হয়। যারা সাধন জগতের মধ্যাবস্থায় স্থিত হয়েছেন, তাদের শ্বাসবায়ু সুষুম্নার মুখে চলে আসে। আমাদের শ্বাস যখন স্থির হয়, তখন মন স্থির হয়। শ্বাস যখন সুষুম্নাতে প্রবাহিত হয়, তখন মন বহির্মুখী না হয়ে অন্তর্মুখী হয়ে ওঠে। শ্বাস তখন স্থির অথচ মৃদুভাবে বইতে থাকে। এইসময় চিত্তের স্পন্দন বৃদ্ধি পায়।অর্থাৎ রজোগুণের আবির্ভাব হয়। আবার এই বায়ু আঘাতে আঘাতে যখন একসময় ক্লান্ত হয়ে যায় তখন আসে তমোভাব। এইসময় বহু বাসনা চিত্তের মধ্যে উদ্বেলিত হতে থাকে। এই সময় শুধু দেহে স্থিত থেকে সুখেচ্ছা, এমনকি দেহাতীত হয়ে পরলোকের সুখের অভিলাষ বৃদ্ধি পায়। এবং সাধনকর্মে আগ্রহ বৃদ্ধি হতে থাকে। এইসময় যে আত্মস্থ জ্ঞানের উদয় হয়, তাকেই বলে বেদের জ্ঞান। ঋষিদের হৃদয়ে মধ্যে এই অবস্থায় বেদের জ্ঞানের উন্মেষ হয়েছিল - যা আমরা বেদ-গ্রন্থ রূপে প্রকাশিত দেখতে পাচ্ছি। বেদকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ঋক, সাম, যজু, অথর্ব। আসলে জ্ঞান একই, কিন্তু বিষয়ভেদে একে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে । প্রথম অবস্থায় দেহঽহং, দ্বিতীয় অবস্থায় শূন্যোঽহং, তৃতীয় অবস্থায় সর্ব্বোঽহং, এবং শেষে সর্ব্বাতীতোঽহং।
আমাদের ইড়া পিঙ্গলা দিয়ে শ্বাসবায়ু প্রবাহিত হয়। যখন আমাদের পিঙ্গলা দিয়ে শ্বাস প্রবাহিত হয়, তখন তমোগুণের প্রভাব থাকে। তখন আমাদের মধ্যে দেহ-সর্বস্য ভাবের প্রকাশ হয়ে থাকে। আমি ভাবের প্রাধান্য থাকে। তখন দেহের সুখ, দেহকে রক্ষা করা, আমি বড়ো, আমি জ্ঞানী, আমি ধনী ইত্যাদি দেহভিত্তিক ভাবের প্রকাশ ঘটে থাকে। অর্থাৎ তখন সমস্ত ভাবই দেহ ভিত্তিক ঘটে থাকে।
আবার যখন ইড়া নাড়ী দিয়ে স্বাস বায়ু প্রবাহিত হয়, তখন আমাদের মধ্যে রজোগুণের প্রভাব দেখা যায়। এইসময় আমাদের মধ্যে একটা "আমার-আমার" ভাবের জন্ম হয়। অর্থাৎ আমার বাড়ি, আমার গাড়ি, আমার ছেলে, আমার মেয়ে, আমার দেহ। অর্থাৎ এইসময় "সব আমার চাই" এই ভাবের প্রকাশ ঘটে থাকে।
এরপরে সাধন ক্রিয়ার ফলে যদি ভাগ্যক্রমে, আমার শ্বাসবায়ু সুষুম্না নাড়ীদিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করে, তখন সত্ত্বগুণের প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। তখন আমি-আমার এই বোধের লোপ হয়ে একটা শূন্যতা উপলব্ধি হয়। তখন কে আমি কে আমার ? সবই শূন্য বোধ হয়। তখন একমাত্র আত্মাকেই জগৎব্যাপী বলে মনে হয়। তখন জাগতিক সমস্ত বস্তু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে হয়। সংসারের সমস্ত বস্তু থেকে সংযোগহীন বলে মনে হয়। জাগতিক বস্তু-বোধ তখন ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকে। তখন যে জ্ঞানের উদয় হয়, তার সংযাগে আমি-আমার সম্মন্ধ থাকে না। এই অবস্থাই আসলে গভীর ধ্যানের অবস্থা।
এর পরে ইড়া-পিঙ্গলা-সুষুম্না নাড়ীর অতীতে চলে যায় মন। এইসময় কোনো ভাবের উদয় হয় না। একেই বলে দ্বন্দ্বাতীত অবস্থা। উপনিষদে এই চার অবস্থাগুলোকে বলা হয়েছে, জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি ও তুরীয় অবস্থা। এই শেষ অবস্থা অর্থাৎ তুরীয় অবস্থায় মনের লয় হয়ে যায়। সুসুপ্তির অবস্থায় মন নিষ্ক্রিয় থাকে। কিন্তু তুরীয় অবস্থায় মনের বিলোপ সাধন হয়ে থাকে। এই অবস্থায় জ্ঞান, জ্ঞাতা, জ্ঞেয় বলে কিছু থাকে না। এটাই সর্বোচ্চ অবস্থা। তাই যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, ত্রিগুণাতীত হয়ে দ্বন্দ্বাতীত হয়ে, নির্যোগক্ষম ও আত্মবান হও। অর্থাৎ যোগের সাহায্যে আত্মবান হও।
প্রাণায়ামের নিরন্তর অভ্যাসে প্রাণবায়ু যখন আজ্ঞাচক্র ভেদ করে সহস্রারে স্থিত হয়, তখন সুষুম্নাও ভেদ হয়ে যায়, আর এই অবস্থাকে বলে ত্রিগুণাতীত অবস্থা। একেই জীবনের পুরুষার্থ লাভ বলা হয়ে থাকে। এই অবস্থা বাক্যের অতীত। ত্রিগুন বর্জিত অবস্থা। তখন না আছে সৃষ্টি না আছে প্রলয়। সব একাকার - একটা সাম্যাবস্থা। সমস্ত দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে তখন। আত্মা থেকে যে সুখের উদয় হয়, তাকে বলে সাত্ত্বিক। বিষয় থেকে সুখের উদয় হয়, তাকে বলে রাজসিক, আর মোহ থেকে যে সুখের বোধ হয়, তাকে বলে তামসিক। এসবের উর্দ্ধে ভাগবত সত্ত্বায় স্থিত হতে পারলে, হয় নির্গুণ, বা গুণাতীত অবস্থা।
---------------------
০৪.০১.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - দ্বিতীয় অধ্যায় - সাংখ্যযোগ
শ্লোক নং ২/৪৬-৪৮
যাবানর্থ উদ্পানে সর্বতঃ সংপ্লুতোদকে
তাবান সর্বেষু বেদেষু ব্রাহ্মণস্য বিজানতঃ। (২/৪৬)
সমস্ত স্থান জলে প্লবিত হয়ে গেলে, ক্ষুদ্র জলাশয়ের আর প্রয়োজন থাকে না। তেমনি বেদজ্ঞ এবং শাস্ত্রজ্ঞ পুরুষের মধ্যে বেদের আর প্রয়োজন থাকে না।
সমুদ্রের মৎসের তৃষ্ণা জাগে না। ব্রহ্ম সর্বত্র। ব্রহ্মানন্দের কণামাত্র পেয়ে আমরা সবাই জীবনের আনন্দ ভোগ করছি। যিনি ব্রহ্মসাগরে বাস করছেন, ডুবে আছেন, তার ব্রহ্মানন্দের অভাব বোধই নেই। জীবন হচ্ছে আমিত্বে ভরপুর। আর আমি আনন্দস্বরূপ। এই আমিই সর্বত্র। আমিত্ব অজ্ঞান। "আমি"র জ্ঞান হলে "আমিত্বে"র নাশ হয়ে যায়। বিষয়ের মধ্যে আনন্দের আভাস পেলে, আমরা সেই বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হই। তো আনন্দের আভাস যদি সাময়িক আনন্দ দিতে পারে, তবে স্বয়ং আনন্দ না জানি কত আনন্দ দিতে পারে। আনন্দ ও আত্মা সমার্থক, অভিন্ন। অতয়েব ভগবান বলছেন, আত্মার অনুসন্ধান করে আত্মবান হও। আর আত্মস্থ হলেই আমাদের সমস্ত ক্লান্তির অবসান, আমাদের সমস্ত দ্বন্দ্বের অবসান। প্রাণের চঞ্চলতার কারনে জগৎ বহুরূপে প্রতিভাত হচ্ছে। এই চঞ্চলতা দূর হয়ে গেলে, জগৎ স্ব-স্বরূপে প্রতিভাত হবে। তখন আনন্দ ভিন্ন আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। প্রাণ স্থির হলে আর বহুত্ত্বের বিকাশ থাকে না। সমস্ত জগৎ ব্যাপী এই এক আমির ভিন্ন ভিন্ন রূপ। কখনও শিব, কখনও শিবা। কখনো কৃষ্ণ কখনও কালী। কখনও আলো, কখনও অন্ধকার। কখনও প্রকাশ, কখনও অপ্রকাশ, কখনও ব্যক্ত, কখনও অব্যক্ত। অতয়েব প্রাণকে স্থির করবার প্রক্রিয়াই সমস্ত সাধনার মূল। এক-এর সাধনে সবার সাধনা সম্পন্ন হয়, নতুবা সব সাধনাই বিফল।
কর্ম্মেন্যবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন
মা কর্ম্মফল-হেতু-ভুর্মা তে সঙ্গো-ঽস্ত্ব-কর্ম্মণি। (২/৪৭)
কর্ম্মফলে তোমার অধিকার, ফলে কখনও নয়।কর্ম্মফল যেন তোমার কর্ম্মে প্রবৃত্তির হেতু না হয়। কর্ম্ম ত্যাগেও যেন তোমার প্রবৃত্তি না জন্মে।
শ্রীগীতার শ্রেষ্ট উক্তির মধ্যে এই শ্লোকটি অন্যতম। বলছেন, কর্ম্মে তোমার অধিকার, ফলে নয়। তাই কর্ম্ম তুমি অবশ্যই করবে, কিন্তু ফলের আশা করে কর্ম্মে প্রবৃত্ত হয়ো না। আসলে কাল্পনিক একটা ফলের আশায় আমরা সবাই বর্তমান-কর্ম্মে লিপ্ত হই। কিন্তু কল্পনা তো কল্পনাই হয়ে থাকে, এর সঙ্গে বাস্তবের মিল নাও থাকতে পারে। আর আমাদের সেই ভবিষ্যৎ কর্ম্মফল, তার সঙ্গে যদি কল্পনার সামঞ্জস্য না থাকে, অর্থাৎ ফল যদি আমাদের প্রত্যাশা মতো না হয়, তবে আমাদের মধ্যে হতাশার জন্ম দেয়। আর হতাশা আমাদের পীড়িত করে, হতাশা আমাদের ক্রোধের উদ্রেগ করে, যার পরিণতি হচ্ছে সর্বনাশ ।
সকাম কর্ম্ম আমাদের চিত্তে মলের মিশ্রণ ঘটায়। চিত্ত উদ্বিগ্ন হয়। দেখুন, আপনি ক্রিয়া করবেন, বা করছেন, আর ভাবতে থাকছেন, যোগ করলে, আমার এই হবে, ওই হবে. অর্থাৎ আপনার চিত্তের মধ্যে যদি চিন্তার প্রভাব চলতে থাকে, তবে চিত্ত কিছুতেই স্থির হতে পারবে না। যোগের প্রাথমিক উদ্দেশ্যই হচ্ছে চিত্তকে স্থির করা। আর এই চিত্তকে স্থির করবার উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা বায়ুকে স্থির করে থাকি। যোগের উদেশ্য বায়ুকে স্থির করা নয়, যোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে মন কে স্থির করা। আর মনকে স্থির করবার উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা বায়ুকে স্থির করে থাকি। কারু কারুর এটা মনে হতে পারে, ভগবান বলছেন, নিষ্কাম বা কামনাহীন কর্ম্ম করতে। আসলে নিষ্কাম কর্ম্ম মানে এই নয়, যে আমাদের উদ্দেশ্যহীন বা লক্ষহীন কর্ম্মে প্রবৃত্ত হতে হবে। চিত্তকে স্থির করবার একটা উদ্দেশ্য আছে - এর ফলে আমাদের চিত্ত শুদ্ধি হবে। যদিও মুখ্য উদ্দেশ্য এটা নয়, এই চিত্তশুদ্ধি হলে শুদ্ধ চিত্তে আত্মার বোধ হবে। এটাই আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। অর্থাৎ আত্মদর্শন আমাদের মূল উদ্দেশ্য। আর গৌণ উদ্দেশ্য হচ্ছে চিত্ত শুদ্ধি। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে, যদি আমরা ভাবতে থাকি, চিত্ত কেন স্থির হচ্ছে না, বায়ু কেন স্থির হচ্ছে না, আর কুম্ভকের মাত্রা সাধ্যাতীত ভাবে বাড়াতে থাকি, তাতে লাভের পরিবর্তে আমাদের ক্ষতি হতে পারে। অর্থাৎ আমরা ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছি। আমাদের বিচারবুদ্ধি আমাদের ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন নয়। একটা জিনিষ জানবেন, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে অসীম ক্ষমতা দিয়েছেন, ভগবান। তো আমাদের নিজস্ব বিচারবুদ্ধি দিয়ে আমাদের ক্ষমতাকে বুঝতে হবে। সেই মতো আমাদের যোগক্রিয়ার মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে। এই বিচারের কাজটা অনেকসময় করে দেন, আমাদের যোগগুরুগন। তিনি শিষ্যের মধ্যে আগ্রহ ও শারীরিক শক্তি সম্পর্কে সচেতন থাকেন, আর সেইমতো নির্দেশ দিয়ে থাকেন। সুতরাং গুরুর নির্দেশে ক্রিয়া করে যাওয়াই সাধকের কর্তব্য। ক্রিয়া করলে কতদিনে, কি কি ঐশ্বর্য আয়ত্ত্বে আসবে, বা কি কি ক্ষমতা আমার লাভ হবে, এই চিন্তার মধ্যে থাকলে, আপনি আখেরে হতাশার স্বীকার হবেন। গুরুর নির্দেশে কাজ করে যাও, এতে কি হবে না হবে, সেসব নিয়ে আমাদের চিন্তার দরকার নেই। আর যখনই গুরু-নির্ভর ভাবের মধ্যে, আপনি ক্রিয়ার অভ্যাস করবেন তখন দেখবেন , অল্প-সময়ে অধিক ফলের অধিকারী হবেন। কারন, গুরু নির্ভর মনে চিন্তার স্ফূরণ কমতে থাকবে। তাই "এসব করে কিছু হবেনা", এমন ভাবনা যেমন অগ্রগতির অন্তরায়, ঠিক কখন কি হবে, সেই ভাবনাও সাধকের সাধনার বাধা স্বরূপ। তাই যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, "কর্ম্মফল যেন তোমার কর্ম্মে প্রবৃত্তির হেতু না হয়। আবার কর্ম্ম ত্যাগেও যেন তোমার প্রবৃত্তি না জন্মে।"
যোগস্থ কুরু কর্ম্মাণি সঙ্গং ত্যকত্ত্বা ধনঞ্জয়
সিদ্ধ্য-অসিদ্ধোঃ সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে। (২/৪৮)
হে ধনঞ্জয়, যোগযুক্ত হয়ে ফলাসক্তি ত্যাগ করে ও সিদ্ধি-অসিদ্ধি সমজ্ঞান করে তুমি কর্ম্ম করো। এইযে সমত্ব বুদ্ধি একেই প্রকৃত যোগ বলে।
এইবার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সরাসরি "যোগ" কথাটার প্রয়োগ করলেন। অর্জ্জুনকে এখানে সম্মোধন করা হয়েছে ধনঞ্জয় বলে। আমরা আগেই শুনেছি, ধনঞ্জয় কথাটার অর্থ যিনি ধনকে জয় করেছেন। আমাদের মতো সাধারনের কাছে ধনকে জয় করা মানে ধনকুবের হওয়া। আধ্যাত্মিক জগতে ধনকে জয় করা মানে যোগবিভূতি বা যোগৈশ্বর্য্যকে জয় করা। এই ধনে যিনি ধনী তিনি জন্মমৃত্যু, সুখদুঃখ, ক্ষুধা-তৃষ্ণা প্রভৃতিকে তিনি জয় করতে পেরেছেন। যিনি জাগতিক সমস্ত ধনকে অগ্রাহ্য করতে পেরেছেন তিনিই ধনঞ্জয়। সাধকের এই তেজঃশক্তি না থাকলে সাধনক্রিয়ায় সাফল্য আসে না। এই তেজঃশক্তি আমাদের মনিপুর চক্রে অবস্থান করে। ইনিই উপনিষদের বৈশ্বানর, জীবকুলের জীবনীশক্তি। এঁকে জাগ্রত করবার নামই সাধনা, যোগ।
সমস্ত অনুকূল-প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে সাম্যাবস্থা বজায় রেখে ক্রিয়া করার নামই "যোগ" . এমনিতে যোগ কথার অর্থ আমরা জানি মিলন। জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনকে যোগ বলা হয়। বলছেন, সমস্ত সঙ্গ ত্যাগ করতে। অর্থাৎ লাভ ক্ষতি, দেশ-কাল পরিস্থিতি,সমস্ত কিছু থেকে নিজেকে নির্লিপ্ত রাখতে হবে। চিত্তকে সমস্ত কিছু থেকে নির্বিকার রাখতে হবে। আসলে আমরা যারা সাংসারিক জীব, তারা কোনো কর্ম্মের আগে, তার ফল সম্পর্কে চিন্তা করে থাকি। কিন্তু আমাদের কর্ম্মের কুশলতার দিকে মনোযোগে অনাগ্রহী থাকি। কর্ম্মে ফলাশক্তি থাকলে, অনিশ্চিত ফলের দিকে আমাদের অন্তঃকরণ প্রবাহিত হবে। আর কর্ম্মে ফলাসক্তি না থাকলে, আমাদের অন্তঃকরণ সমস্ত শক্তি কর্ম্মের কুশলতার মধ্যে নিবদ্ধ হবে। এতে করে আমাদের কর্ম্মের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পাবে। এবং ফল হবে উৎকৃষ্ট।
এখন ব্রহ্মে মন স্থির করতে হলে, প্রাণকে স্থির করতে হবে। প্রাণের স্থিরতা দ্বারাই আমাদের ঈশ্বর-প্রণিধান রূপ যোগের সিদ্ধি আসবে। তখন কর্ম্ম হবে, আমাদের আসক্তিহীন। তখন মনে একটা স্থির ভাব আসবে, যাতে কর্ম্মের সঙ্গে মনের যে বন্ধন তা ছিন্ন হয়ে যাবে। কারন মন তো ব্রহ্মে স্থিত। শ্বাসের স্থিরতার সঙ্গে সঙ্গে ব্রহ্মাকাশে চিত্ত লয় হয়ে যাবে। তখন আপনি যা-কিছু করুন না কেন, হোক না তা শরীর রক্ষার কর্ম্ম বা সংসারের কর্তব্য - তখন সবই হবে আসক্তিহীন, "কার কাজ কেই বা করে, আর তার ফলই বা কি", এই নিয়ে মন অনুসন্ধানে বিরত থাকবে। এই হচ্ছে, প্রকৃত যোগ, আর যথাযথ যোগের ফল।
-------------------------------
০৫.০১.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - দ্বিতীয় অধ্যায় - সাংখ্যযোগ
শ্লোক নং ২/৪৯-৫০
দূরেণ হ্যবরং কর্ম্ম বুদ্ধিযোগাৎ-ধনঞ্জয়
বুদ্ধৌ শরণম-অম্বিচ্ছ কৃপণাঃ ফলহেতবঃ (২/৪৯)
হে ধনঞ্জয়, বুদ্ধিযোগের তুলনায় কাম্যকর্ম্ম অতি নিকৃষ্ট। অতএব তুমি বুদ্ধিযোগের আশ্রয় নাও। কারন, যারা ফলের উদ্দেশ্যে কর্ম্ম করে তারা অতি দীন ও কৃপার পাত্র।
বুদ্ধিযোগ কথাটার অর্থ সমত্ত্ববোধ। এই বুদ্ধিযোগহীন যে কর্ম্ম তা সকাম কর্ম্ম। বুদ্ধিযোগে কর্ম্ম অর্থাৎ ভগবত সত্ত্বায় মনকে স্থির রেখে কর্ম্ম করা। আর সকাম কর্ম্ম হচ্ছে অহং-এর তৃপ্তির জন্য কর্ম্ম করা। যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, সকাম কর্ম্ম অপেক্ষা সমত্ত্ববোধে মনকে স্থির রেখে যে যোগকর্ম্ম, তা উৎকৃষ্ট। দূরেণ কথার অর্থ হচ্ছে - আলো ও অন্ধকার, দিন ও রাত্রি, জ্ঞান ও অজ্ঞান যেমন একত্রে স্থিত হতে পারে না, সবসময় বিপরীত মুখী হয়ে থাকে - তেমনি বুদ্ধিযোগে যে কর্ম্ম ও আর কামনার বশবর্তী হয়ে যে কর্ম্ম, তা কখনো একমুখী হতে পারে না। একটি উৎকৃষ্ট আর একটি নিকৃষ্ট।
চিত্তবৃত্তির নিবৃত্তিই চিত্তশুদ্ধি। চিত্তের বিক্ষেপ ভাবের নিস্পত্তি না হলে চিত্তের জ্ঞানের স্ফূরণ হতে পারবে না। সাধন করতে এসে লাভালাভের কথা চিন্তা করলে, যোগক্রিয়ায় উন্নতি সম্ভব নয়। সংসারে যাদের আসক্তি, তারা সবসময় ফলাফলের কথা চিন্তা করেই কর্ম্মে উদ্দীপ্ত হয়। আর এই ফলাফলের নেশা যতদিন না যাবে, ততদিন বুদ্ধিযোগের নেশা আসবে না। ফলাসক্তি ত্যাগ না করতে পারলে, মনের স্থিরতা আসবে না। এমনকি কর্ম্মেও একাগ্রতা আসবে না। আবার কর্ম্মহীন জীবন বলে কিছু হয় না। কর্ম্ম আমাদের করতেই হবে। তা সে শরীর রক্ষার জন্য হোক বা সংকল্প পূরণের জন্য হোক - কর্ম্মহীন হয়ে আমরা কেউ বাঁচতে পারি না। এখন এই কর্ম্ম করলে একটা ফল অবশ্যম্ভাবী - তা সে ভালো মন্দ যাই হোক না কেন। আর কর্ম্মফল মানেই, সেই কর্ম্মফল আমাকেই ভোগ করতে হবে। এখন যদি কেউ কর্ম্ম-ফলের প্রতি অনাসক্ত হয়ে কর্ম্ম করে, তাহলেও কর্ম্মফলের উৎপত্তি হবে। কিন্তু সেই কর্ম্মফলজনিত ভোগ তখন জীবের উদ্বেগের কারন হবে না। একবার প্রাণকে স্থির করতে পারলে, মন ব্রহ্মে স্থিত হবে। তখন যাকিছু কর্ম্ম করা হোক না কেন, তাতে মনের কোনো আসক্তি থাকবে না। কারন মন তখন কর্ম্মে নয়, ব্রহ্মে স্থিত হয়ে রয়েছে। তখন কর্ম্ম বন্ধন থেকে মন বিচ্ছিন্ন থাকে।
শ্বাস-প্রশ্বাসের স্থিরতা যত আসবে, ততই ব্রহ্মাকাশে চিত্ত বিলীন হয়ে যাবে। তখন কে কর্ম্ম করছে, কি কর্ম্ম হচ্ছে, তার ফলাফলই বা কি এই বিষয়ে মন উদাসীন হয়ে থাকবে। কর্ম্মই কর্ম্মফলের কারন, আবার নিত্যতত্ত্ব এর থেকে আলাদা। তো তুমি নিত্যতত্ত্বে স্থির হলে, কর্ম্ম বা কর্ম্মফল তোমাকে আকৃষ্ট করতে পারবে না।
বুদ্ধিযুক্তো জহাতীহ উভে সুকৃত-দুস্কৃতে
তস্মাদ যোগায় যুজ্য়স্ব যোগঃ কর্ম্মসু কৌশলম। (২/৫০)
যার মধ্যে বুদ্ধিযুক্ত হয়েছে, তিনি ইহলোকেই সুকৃত ও দুষ্কৃত - এই উভয়ই পরিত্যাগ করেন। অতএব যোগে যুক্ত হও। কর্ম্মের কৌশলই যোগ।
কর্ম্ম আমরা সবাই করে থাকি। শুধু করে থাকি না, আমাদের কর্ম্ম করতেই হয়। কিন্তু বুদ্ধিযুক্ত হয়ে করি না। অর্থাৎ একাগ্রতার সঙ্গে করি না। কর্ম্মে একাগ্রতাই কর্ম্মে সাফল্য এনে দিতে পারে। এটা আমরা সবাই বুঝি।
আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া, অর্থাৎ প্রাণের ক্রিয়া, যে প্রাণের সাথে মিশ্রিত আছে আমাদের চেতন শক্তি, সেই প্রাণশক্তির ক্রিয়া আমাদের আপনা-আপনি হচ্ছে। এর জন্য আমাদের আলাদা করে কোনো প্রয়াস করতে হয় না। এই প্রাণক্রিয়া না থাকলে, আমাদের মনের বা ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া সম্পন্ন হতে পারে না। এই প্রাণের শক্তি আমরা বৃথা কাজে ব্যয় করে, মনকে চঞ্চল করে তুলছি। তাই মন বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে নিরন্তর ঘুরে মরছে। কিন্তু ক্রিয়াযোগে যদি আমরা প্রাণকে স্থির করতে পারি, তবে আমাদের মন স্থির হতে পরে, আবার মন স্থির হলে মনের একাগ্রশক্তি বৃদ্ধি পাবে। আর মন যখন একাগ্র হবে, তখন আত্মমুখী হবে। আর আত্মমুখী মন সুকৃতি বা দুষ্কৃতি কোনোকিছুর মধ্যেই থাকতে চায় না। আমাদের যে ভালো-মন্দ কর্ম্ম সবই মনের চিন্তার ফল। সেই মন যখন একমুখী অর্থাৎ আত্মমুখী হয়, তখন তখন দেহ থেকে পৃথক হয়ে পড়ে। তখন ভালো-মন্দ বা পাপ-পুন্য তাকে স্পর্শ করতে পারে না। মন তখন আত্মাতেই লেগে থাকে। মনকে এই আত্মাতে সম্পৃক্ত করে যোগ। শ্বাস তখন আমাদের বক্ষস্থলে স্থির হয়ে যায়, আর মন তখন আজ্ঞাচক্রে নিবদ্ধ হয়। এই অবস্থায় কর্ম্মবন্ধন থেকে সাধক নিষ্কৃতি পায়। এর বাইরে এমন কোনো কৌশল অবলম্বন করা সম্ভব নয়, যাতে চিত্তকে নিরুদ্ধ করতে পারে। অবিচ্ছিন্ন ভাবে এই শ্বাসক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে, চিত্ত নিরালম্বে স্থির হতে পারে। মনে মধ্যে একটা ঐশীশক্তি সঞ্চিত হয়। এইসময় বাহ্যিক কর্ম্মের মধ্যে শরীর নিযুক্ত থাকলেও, চিত্ত আত্মাতেই স্থিত থাকে। অর্থাৎ চিত্তের একটা অটল অবস্থা আসে। তখন সুখ-দুঃখের মধ্যে সমতার ফলে মন উদ্বিগ বা চঞ্চল হতে পারে না।
ঋষি পতঞ্জলি তার যোগদর্শন গ্রন্থে বলছেন, যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান, সমাধি - এগুলো অভ্যাসের দ্বারা আয়ত্ত্বে এলে, মনের দৃঢ়তা আসে। বাহ্যিক কর্ম্মেও একাগ্রতা আসে। কিন্তু এই যোগের নিরন্তর অভ্যাস, একাগ্রতা গভীর থেকে গভীরতর করে থাকে। একাগ্রতা যখন গভীর থেকে গভীরতা প্রাপ্ত হয়, তখন ঈশ্বর-প্রণিধান হয়ে থাকে। একাগ্রতার গভীরতা যত বাড়তে থাকে তখন মনের মধ্যে বৈরাগ্যের সৃষ্টি হয়। আবার চিত্ত- বৈরাগ্য যত বাড়তে থাকে, অর্থাৎ বাহ্যিক বিষয় থেকে মন যত ঈশ্বরমুখী হতে থাকে, তখন মন ব্রহ্মে স্থিত হয়। যোগীর স্বভাবের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ করা যায় । এমনকি যোগীর দেহের মধ্যেও একটা পরিবর্তন হয়ে থাকে। সাময়িক কালের জন্য ধ্যান ভঙ্গ হলেও, চিত্ত যোগযুক্ত অবস্থা থেকে বিচ্যুত হয় না। চিত্ত আত্মভাবে সমাহিত থাকে। তাই যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, "কর্ম্মের কৌশলই যোগ"। অর্থাৎ আত্মভাবে শরীর কর্ম্মে নিযুক্ত থাকলে, তার দ্বারা কৃত কর্ম্ম অবশ্য়ই উৎকৃষ্ট হবে।
-------------------
৭/০১/২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - দ্বিতীয় অধ্যায় - সাংখ্যযোগ
শ্লোক নং ২/৫১-৫৪
কর্ম্মজং বুদ্ধিযুক্তা হি ফলং ত্যকত্ত্বা মনীষিণঃ
জন্মবন্ধন-বিনির্ম্মুক্তাঃ পদং গচ্ছন্তি-অনাময়ম্। (২/৫১)
সমত্ত্ব-বুদ্ধিযুক্ত ব্যাক্তিগন কর্ম্মফল ত্যাগ করে জন্ম-বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে দুঃখ-শূন্য পদ লাভ করেন।
যিনি বুদ্ধিযুক্ত হয়ে কর্ম্ম করেন, তাকে মনীষী বলা হয়। ইনি জন্ম-মৃত্যু হতে মুক্ত হয়ে যান। মনীষী = মনীষা + ইন। জ্ঞানী, বুদ্ধিমান, স্থিরবুদ্ধিবিশিষ্ট। যিনি আত্মমনন শীল তিনিই জ্ঞানী বা মনীষী। আত্মাতে মন স্থির করবার অভ্যাস যখন আদতে পরিণত হয়, তখন সাধক আত্মারাম হয়ে যান। বিক্ষিপ্ত মনই বাহ্যিক বিষয়ে চিন্তা করে থাকে। এই বিক্ষিপ্ত মনকে প্রত্যাহারের দ্বারা আত্মাতে স্থিত করা যায়, তখন মন আর অনর্থক বিষয়ে চিন্তা করতে পারে না। মন স্থির হলেই, একটা অহেতুক প্রসন্নতায় চিত্ত ভরপুর হয়ে যায়। তখন জাগতিক সমস্ত ক্লেশ থেকে মন আত্মাতে সমাহিত থাকে। দেখুন যার কোনো খবর আপনি রাখেন না তার ভালো মন্দ কোনো কিছুতেই আপনার মনে দুঃখে-কষ্ট হবে না। তাই ব্রহ্মে স্থিত মন জাগতিক সমস্ত দুঃখ-কষ্টের উর্দ্ধে উঠে যায়। একেই বিষ্ণুর পরম পদ বলা হয়ে থাকে, যাকে আপনি মোক্ষ নামে অভিহিত করতে পারেন। আর এই কাজটি করতে পারে, কেবল ফলাকাঙ্খ্যা রহিত কর্ম্ম। এই ফলাকাঙ্খ্যা রোহিত কর্ম্মই হচ্ছে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া। এই শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়ার সঙ্গে নিজের মনকে একাগ্র করতে পারলেই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে পারে। শ্বাসের সঙ্গে নিজের মনকে শুধু যুক্ত করে দিন। এই ক্রিয়া করতে করতে একদিন দেখবেন, শ্বাসের যে চরিত্রগত বৈশিষ্ট অর্থাৎ ফলাকাঙ্খ্যা রোহিত কর্ম্ম, তার মধ্যে নিজেকে সম্পৃক্ত করে ফেলেছেন। একেই উপদ্রপ হীন অনাময় পদ বা বিষ্ণুর পদ বলা হয়ে থাকে।
যদা তে মোহকলিলং বুদ্ধিঃ-ব্যতিতরিষ্যতি
তদা গন্তাসি নির্ব্বেদং শ্রোতব্যস্য শ্রুতস্য চ। (২/৫২)
যখন তোমার বুদ্ধি মোহময় গহন দুর্গ পরিত্যাগ করবে, তখন তুমি শ্রোতব্য ও শ্রুত বিষয়ের প্রতি বৈরাগ্য আসবে।
শুদ্ধ জ্ঞান প্রাপ্ত না হাওয়া পর্যন্ত মানুষ যে যা বলে, হয় তা বিশ্বাস করে নয় তা অবিশ্বাস করে থাকে। কিন্তু বারবার একটা জিনিস শুনতে শুনতে অথবা পণ্ডিত ব্যক্তির বিধি বিধান শুনতে শুনতে তা মনের মধ্যে সেটি গেঁথে যায়। জন্ম সূত্রে মানুষ অজ্ঞান। এইসময় মানুষের মন থাকে স্বচ্ছ, কিন্তু বহির্মুখী। আর মন বহির্মুখী হবার ফলে, বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ঘুরে বেড়ায়। অর্থাৎ মানসিক স্থিরতা থাকে না। এই অবস্থায় সত্যিকারের জ্ঞান বা ধর্ম্ম কি তা সে সম্যকরূপে উপলব্ধি করতে পারে না। এইভাবে লৌকিক বা বেদের কর্ম্মকান্ডের দিকে দৃষ্টি থাকলে, বুদ্ধি কখনো ধীর-স্থির-শান্ত-সমাহিত হতে পারে না। একেই বলে মোহাচ্ছন্ন অবস্থা। এই মোহ-দুর্গ যখন তুমি পরিত্যাগ করবে, তখন তুমি যাকিছু শোনা উচিত, আর যাকিছু তুমি শুনেছো, অর্থাৎ সমস্ত শ্রুত ও শ্রোতব্য সমস্ত বিষয়ে বৈরাগ্য আসবে।
যখন আত্মদেবকে ভজন করতে করতে দেহাত্মবোধ কেটে যাবে, তখন পরম পদের প্রাপ্তি হবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই দেহাত্মবোধ-এর লয় হওয়া কি এতই সহজ ? দেখুন যোগক্রিয়া করতে করতে এক-এক সময় সাধক বাহ্যজ্ঞান শূন্য হয়ে যায়। কিন্তু প্রাণ ইত্যাদি পঞ্চকোষে নানান দৃশ্য, নানান শব্দের খেলা চলতে থাকে। আর এগুলো আসালে সাধনক্রিয়ায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ তখনও আমরা সব কিছু ভুলি না। আর এই দৃশ্য ও শব্দ সূক্ষ্ম ও সুন্দর হওয়ায় মন তাকে ছেড়ে যেতেও চায় না। একেই বলে মোহ। এখান থেকে আমাদের বেরুতে হবে। দেখা ও শোনার প্রবৃত্তি যতক্ষন কার্যকরী থাকবে, ততক্ষন শুদ্ধ বুদ্ধির উদয় হবে না। এখান থেকে বেরুতে গেলে, সাধককে দীর্ঘ দিন অপেক্ষা করতে হয়ে, কারুর দু মাস তো কারুর ক্ষেত্রে দু বছরও লাগতে পারে। এইসময় নিরন্তর ব্রহ্মচিন্তা ওঠাতে হয় মনে। অর্থাৎ নিরন্তর তাঁকেই স্মরণ-মনন করতে হয়। ঔষধের দ্বারা যেমন রোগের নাশ হয়, তেমনি অবিদ্যার বিক্ষেপ-কে সমূলে উৎপাটিত করতে পারলে, সেই আত্মারামের কাছে পৌঁছানো যাবে। বুদ্ধি থেকে যখন মোহ প্রখর আত্মজ্যোতির দ্বারা বিগলিত হয়ে বুদ্ধি থেকে বেরিয়ে যাবে, তখন বুদ্ধি শুদ্ধ হবে। তখন শব্দের শ্রুতি, বা দৃশ্যের দর্শন আমাদের কোনো ব্যাঘাত করতে পারবে না। তখন দেহ ও দেহের গুনগুলোকে তুচ্ছ বলে মনে হয়। প্রাণের মধ্যে লক্ষবস্তুর আর আত্মার জন্য ব্যাকুলতা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না।
শ্রুতি-বিপ্রতিপন্না তে যদা স্থাস্যতি নিশ্চলা
সমাধাবচলা বুদ্ধিস্তদা যোগম-অবাপ্স্যসি। (২/৫৩)
শ্রুতি অর্থাৎ বেদ-বিক্ষিপ্ত তোমার বুদ্ধি সমাধিতে যখন নিশ্চল অচল হয়ে থাকবে তখন তুমি যোগ-প্রাপ্ত হবে।
নানান লৌকিক ও বৈদিক কর্ম্মকান্ড শুনে তোমার মধ্যে যে বুদ্ধির বিক্ষিপ্ত অবস্থা হয়েছে, তা যখন বিষয়ান্তরে অনাকৃষ্ট হয়ে যোগের অভ্যাস বশতঃ পরমেশ্বরে অচল হয়ে থাকবে, তখন তত্ত্বজ্ঞান লাভ করবে।
ক্রিয়া অনুষ্ঠানের শুরুর কয়েকদিনের মধ্যেই একটা ধ্বনি শ্রুতিগোচর হতে থাকে। এই শব্দ কোনো বাহ্যিক আহত শব্দ নয়। এই ধ্বনি কোথা থেকে আসছে, অর্থাৎ এর উৎসের দিকে মনোযোগ দিলে, মন স্পন্দনশূন্য হয়ে যায়, বুদ্ধির দ্বারা এর উৎস খুঁজে পাওয়া যায় না। ক্রিয়ার ক্রমোন্নতির সাথে সাথে এই শব্দ একসময় লয় প্রাপ্ত হয়। তখন উজ্জ্বল জ্ঞানজ্যোতির সাক্ষাৎ মেলে। এই জ্যোতির মধ্যে মন অচঞ্চল অবস্থায় স্থিত হয়। তখন বাহ্যিকবোধ রোহিত হয়ে বিষ্ণুর পরম পদ প্রাপ্তি হয়ে থাকে।
অর্জ্জুন উবাচ :
স্থীতপ্রজ্ঞস্য কা ভাষা সমাধিস্থস্য কেশব
স্থিতধীঃ কিং প্রভাষেত কিমাসীত ব্রজেত কিম্। (২/৫৪)
অর্জ্জুন বলছেন, হে কেশব, যিনি পরমাত্মায় স্থিত এবং স্থিতপ্রজ্ঞ তার লক্ষণ কি ? সেই স্থিতধী ব্যক্তি কিভাবে কথা বলেন, কিভাবে অবস্থান করেন, কিভাবে চলাচল করেন ?
এখানে শ্রীকৃষ্ণকে বলা হচ্ছে কেশব। "ক" অর্থাৎ ব্রহ্মা "ও" অর্থাৎ বিষ্ণু, "ইশ" অর্থাৎ শিব। আবার "কে" অর্থাৎ জলে, "শব" অর্থাৎ মৃতবৎ বা শবতুল্য, .তো, প্রলয়-জলধি-জলে যিনি অনন্ত শয়নে শবাকারে ভাসমান ছিলেন, তিন কেশব । এই কেশব আর কেউ নয়, জগতের বীজ স্বরূপ এই "কেশব"। অর্জ্জুন হচ্ছে, শরীরের তেজঃশক্তি। জীবাত্মা যখন স্থূল দেহ করে অনন্তের পথে যাত্রা করে, তখন তার আবরণ থাকে সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম জলকনা - যাকে উপনিষদ বলে থেকে শ্রদ্ধা। আবার তেজঃশক্তি এই জলকনাকে আকর্ষণ করে থাকে।
তো এই অর্জ্জুন জানতে চাইছেন স্থিতপ্রজ্ঞ কি ? সমাধি কি ? স্থিতধী কি ? মনের মধ্যে যে অন্যায্য যুক্তিতর্ক, বিচার বিশ্লেষণ, তাকে ত্যাগ করে ঈশ্বরভাবাপন্ন হয়ে, ক্রিয়ায় স্থির হওয়ার নামই স্থিতপ্রজ্ঞ। সাধক যখন নিজেকে ভুলে যায়, জগৎকে ভুলে যায়, সেই অবস্থাকে বলে সমাধি। যা ক্ষনিকের জন্যও হতে পারে, আবার দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। এই অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে তাকে বলে স্থিতধী। এসব কথা আমরা পরবর্তীতে বিস্তারিত পরবর্তীতে শুনবো, ভগবানের শ্রীমুখ থেকে।
আসলে সাধন করতে করতে প্রাণবায়ু কূটস্থে আটকে যায়। তখন যোগীর শরীর স্পন্দনহীন হয়ে যায়, যদিও এই অবস্থা স্থায়ী হয় না। একসময় এই অবস্থা থেকে প্রাণ বায়ু আবার নেমে আসে। ক্রিয়ার পরা বা উচ্চ অবস্থায় মন নিষ্ক্রিয় থাকে। কিন্তু ক্রিয়ার উচ্চতর অবস্থায়, সাধক জাগ্রত থাকেন না। ঘোর তন্দ্রাচ্ছন বা সঙ্গাহীন, যেন একটা নেশার টানে থাকেন। এই অবস্থায় চলতে চলতে একসময় যোগী, এই তন্দ্রা-আছন্ন অবস্থাতেই অভ্যস্থ হয়ে যান। তখন তার স্বাভাবিক শারীরিক ক্রিয়া কর্ম্ম অর্থাৎ খাদ্যগ্রহণ, চলাচল কথাবার্তা, ইত্যাদি চলতে থাকে। কিন্তু জগতের কোনো বিষয়েই তিনি স্থিত থাকেন না। এই অবস্থায় মন এতটাই একাগ্র থাকে যে জগতের শব্দ-স্পর্শ-রুপ -রস-গন্ধ আর তেমন ভাবে যোগীকে স্পর্শ করতে পারে না। ঘুমন্ত শিশু যেমন তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থাতেই বোতল থেকে মায়ের বুক থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে থাকে, আবার ঘুম থেকেও জাগে না, তেমনি যোগীর এই অবস্থায় স্বভাববশে ক্রিয়াশীল হলেও, বা প্রাকৃতিক কাজ গুলো করে গেলেও, এঁদের বুদ্ধি আত্মভাবে ভাবিত থাকার দারুন, কি করছেন, তা তাঁর স্মৃতি থাকে না। এর পরে যদি তাকে কেউ জিজ্ঞেস করে, আপনি খেয়েছেন কি ? তখন তিনি সঠিক জবাব দিতে পারেন না। এই ঘোরের অবস্থা দীর্ঘক্ষণ বা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে, তাকে জড়বৎ মনে হয়। তখন সাধারণ লোকের মতোই কাজ করতে পারেন, কিন্তু তাঁর ধী শক্তির পার্থক্য থাকে। যোগীর এই অবস্থা অত্যন্ত নিগুড়। এই অবস্থা সাধারনের দুর্জ্ঞেয় অবস্থা।
যোগীরাজ বলছেন, যোগের যে সাতটি অবস্থা আছে, তার মধ্যে দুটো বাইরের - শুভেচ্ছা ও বিচারণা। তৃতীয় হচ্ছে তনু-মানস -এই অবস্থায় মন আত্মভাবে ডুবে থাকে। চতুর্থ হচ্ছে, সত্ত্বাপত্তি - এই অবস্থায় জগতের বিস্মৃতি ঘটে। এমনকি সে নিজেকেও ভুলে যায়, অর্থাৎ স্মৃতি ঠিক মতো কাজ করে না। এই অবস্থাই সাধকের শ্রেষ্ট অবস্থা। এটি ঠিক সমাধির অবস্থা নয়, এটি সমাধির প্রারম্ভ মাত্র। পঞ্চম অবস্থা হচ্ছে অসংসক্তি। এই অবস্থায় কখনো তিনি সমাধিস্থ থাকেন, কখনো আবার বুত্থিত থাকেন। কিন্তু সর্বদা ব্রহ্মভাব চলতেই থাকে। একেই যোগারূঢ় অবস্থা বলা হয়ে থাকে। সাধারণত অবতার পুরুষগন এই অবস্থায় থাকেন। এই অবস্থায়, সবকিছুই করা যায়, আবার না করলেও চলে যায়। এরপরে আসে ষষ্ঠ অবস্থা যাকে বলা হচ্ছে পদার্থ-অভাবনী। এই অবস্থায় একবার প্রবেশ করলে যোগীর আর বুত্থানের সম্ভাবনা থাকে না। তখন তার কাছে, থাকা না থাকায় কোনো পার্থক্য থাকে না। তখন তার যেমন কর্ম্মের নিস্পত্তি হয়, তেমনি আর কিছু হবার সম্ভাবনাও থাকে না। সুখ-দুঃখ-জীবন-মৃত্যু সব ধরনের ভ্রমজ্ঞানের উর্দ্ধে তিনি অবস্থান করেন। এই অবস্থাই দ্বন্দ্বাতীত পরম প্রজ্ঞার অবস্থা।
প্রথম তিনটি অবস্থা ভূমি-মুমুক্ষদের। চতুর্থ ভূমিতে যোগীকে বলা হয় ব্রহ্মবিদ। পঞ্চম অবস্থায় যোগীর যখন কর্ম্মে আসক্তি থাকে না, তখন তাকে বলা হয় ব্রহ্মবিদ-বর । ষষ্ঠ অবস্থায় ব্রহ্মবিদ-বিবিধান, অর্থাৎ এই সময় সব একাত্ম হয়ে যায়, আমি-তুমি জ্ঞানহারা হয়ে যায়। সপ্তম অবস্থা হচ্ছে তূর্য্য-অবস্থা অর্থাৎ জীব-লীলার অবসান। এঁকে সমাধির শেষ অবস্থায় বলা হয়ে থাকে। এই অবস্থা ভাষার অগম্য। সাক্ষাৎ শিবরূপ, ব্রহ্মরূপ, অত্যুচ্চ জ্ঞানরূপ। চতুর্থ অবস্থায়, মুক্তির লক্ষণ প্রকাশ পায়। অর্থাৎ অপরোক্ষ জ্ঞানের উদয় হয়। ধীরে ধীরে এক-এক ধাপ অতিক্রমণের ফলে জীবন্মুক্ত অবস্থা। এই হচ্ছে ব্রহ্মবিদের লক্ষণ যা জানতে চেয়েছেন অর্জুন ।
--------------------------------------
৮/০১/২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - দ্বিতীয় অধ্যায় - সাংখ্যযোগ
শ্লোক নং ২/৫৫
শ্রী ভগবান উবাচ :
প্রজহাতি যদা কামান সর্ব্বান পার্থ মনোগতান্
আত্মন্যেব-আত্মনা তুষ্টঃ স্থিতপ্রজ্ঞঃ-তদা-উচ্চতে। (২/৫৫)
শ্রী ভগবান বলছেন :
আপনাতে আপনি তুষ্ট এমন ব্যক্তি যখন মনের সমস্ত কামনা পরিত্যাগ করেন, তখন তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ নামে অবিহিত হন।
নিজের মধ্যে নিজেই তুষ্ট এমন স্থির ব্যক্তিই স্থিতপ্রজ্ঞ। আমাদের মন ইন্দ্রিয়লব্ধ বিষয় থেকেই তুষ্টি লাভ করে থাকে। এখন মনের মধ্যে যদি কামনার লেশ মাত্র না থাকে, সে তো জড়বৎ। আমাদের সাধারনের কাছে তিনি পাগল বই কিছু নয়। পাগলই নিজের হাতে তালি দিয়ে, নিজের মধ্যে আনন্দ অনুভব করে থাকে। আসলে সংসারী মানুষের কাছে, এই কথা সত্য হলেও, সমাধির মধ্যে যিনি মধ্যে প্রবেশ করতে পেরেছেন, সেখানে বাহ্যিক সুখ-অনুভূতির উর্দ্ধে আনন্দময় আত্মার, অর্থাৎ যেখান থেকে সমস্ত আনন্দ উৎসারিত হচ্ছে, সেই উৎসের সন্ধান যিনি পেয়েছেন, তার কাছে বিষয়ানন্দের প্রয়োজন শেষ হয়েছে। আসলে বিষয়ের মধ্যে আনন্দ নেই। আনন্দ আছে, আপনার আমার নিজের মধ্যে। আসলে আমরা সবাই সেই আনন্দেরই খোঁজ করছি। আর বিষয়ের মধ্যে যে সামান্যতম আত্মার স্ফূরণ ঘটছে, সেই আনন্দ আমাদেরকে আনন্দ দিচ্ছে। আনন্দের জন্য সে বিষয়ের দিকে ছুটছে। কস্তুরীনাভি মৃগ যেমন কস্তুরীর সুগন্ধে পাগলপ্রায় হয়ে চারিদিকে ঘুরে বেড়ায়, তেমনি বিষয়ের মধ্যে মন ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আনন্দের সন্ধান করে ফিরছে। মন যখন বিষয়ের দিকে ছোটে তখন সে নিজের খোঁজ রাখে না। পরমানন্দ যে তার নিজের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় বিরাজ করছেন তা সে জানতে পারে না। ভাগ্যবান সাধক যখন গুরুকৃপায়, রহস্যের সন্ধান পায়, তখন সে আর সুখের আশায় বিষয়ের দিকে ছোটে না। তখন বিষয় থেকে নিজেকে টেনে এনে সাধনায় লিপ্ত হয়। আবার এই সাধন ক্রিয়া তাকে মনের সংকল্প বিকল্প থেকে দূরে টেনে নিয়ে যায়। সে তখন বুঝতে পরে, এই যে বিষয় চিন্তা, এতে তার চিরস্থায়ী সুখলাভ হতে পারে না। বরং সাধন ক্রিয়া করতে করতে একসময় আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে মন । এতদিন ছিল ছুঁটে বেড়ানোতে ক্ষনিকের আনন্দ, আর এখন স্থিরতায় স্থায়ী আনন্দ। সাধনার সঙ্গে সঙ্গে স্থিরতা যখন আদতে পরিণত হয়ে, তখন জগতের প্রতি আকর্ষণ কমতে থাকে। এমনকি জগতের স্থিতি ভুলেও যেতে পারেন। এই অবস্থাতেই যোগী পুরুষকে স্থিতপ্রজ্ঞ বলা হয়ে থাকে। এই অবস্থায়, যদি মন কোনো কারনে বিষয়ে ধাবিত হলেই, তাহলে আবার যোগীর আত্মস্থিতি বিচ্যুত হয়ে যায়। তখন আবার দুঃখের অনুভব হয়। মন আত্মভাবে থাকলে, পরমানন্দ সতত স্ফূরিত হতে পারে।
এখন কথা হচ্ছে, আত্মা যখন সকলের মধ্যেই বিদ্যমান, আবার আত্মা সর্ব্বত্র বিরাজ করছেন, তথাপি আমরা এই অনুভূতির স্বাদ পাই না কেন ? পাই না তার কারন হচ্ছে, আমাদের মন বিক্ষিপ্ত। আর মনের বিক্ষিপ্ত অবস্থায় আমাদের আত্মানুভূতি হতে পারে না। আর সাধনার ফলে যখন মন অচঞ্চল হয়ে যায়, তখন আত্মারামের অনুভূতি হয়। তখন আর বাহ্যবস্তুতে আমরা আনন্দ খুঁজে পাই না। এমনকি বাহ্য বস্তুতে আমরা দুঃখও খুঁজে পাই না। আসলে সুখ দুঃখ বিষয়ের মধ্যে নিহিত নয়, সুখ দুঃখ আছে আমাদের মনের ভিতরে। তাই মন স্থির হলে আমরা আত্মস্থ হয়ে পরমানন্দ লাভ করে থাকি। নিজের মধ্যে নিজেই মগ্ন হয়ে যাই। তো দুঃখ ত্যাগ করতে চাই, কামনা ত্যাগ করতে চাই, রাগ-দ্বেষ ত্যাগ করতে চাই, ইত্যাদি ইত্যাদি চাই তো অনেক কিছু, কিন্তু পাই না কেন ? পাই না তার কারন আমাদের চঞ্চল মন, আমাদের বিক্ষিপ্ত মন ছুটছে। যখন প্রাণায়ামের সাহায্যে বাতাসের গতিকে স্থির করতে পারবো, তখন মনের ছোটাছুটি বন্ধ হয়ে যাবে। বাতাসের চঞ্চলতায় মধুমক্ষী ফুলের উপর বসতে পারে না, মধুও পান করতে পারে না। কিন্তু এই বাতাস যখন স্থির হয়, তখন মনমক্ষী আত্মারূপ ফুলের মধু সংগ্রহে শান্তি পায়। এইসময় মর্তবাসী জীব, অমৃতত্ব প্রাপ্ত হয়। এবং এই জন্মেই ব্রহ্মস্বরূপতা প্রাপ্ত হয়।
স্বামী মুক্তানন্দ গিরিমহারাজ : আমার এক পরিচিত সাধুমহারাজ আছেন, তার নাম মুক্তানন্দ। ইনি পাইলট-বাবার শিষ্য। না কোনো গল্পের সাধু নয়, ইনি এখন হরিদ্বারে সশরীরে অবস্থান করছেন। এই সাধু পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ান। কোনো আশ্রমেও স্থায়ী ভাবে থাকেন না। আমি তাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিসের আনন্দে আপনি সংসার ছেড়ে, অনাশ্রমী হয়ে, পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ান ?
তো তিনি বললেন, ছোটবেলায় আমি পিতা-মাতার মুখাপেক্ষী ছিলাম। কৌশোরে আমি শিক্ষকের মুখাপেক্ষী হলাম। যৌবনে আমি নিজের মুখাপেক্ষী হলাম। প্রৌঢ় অবস্থায় আমি সংশয়াতীত হলাম। ষাট বছর বয়সে এসে, আমি যেন ঈশ্বরের আজ্ঞা শুনতে পেলাম । বৃদ্ধ বয়সে এসে আমি ঈশ্বরের আজ্ঞাবহ হলাম। আমার এখন শরীর চলে ঈশ্বরের আদেশে।
আমি বললাম, এই যে আপনি ঘুরে ঘুরে বেড়ান, এতে করে আপনার সাধনক্রিয়ার ব্যাঘাত হয় না ? তো তখন তিনি বললেন, যারা টাইপ জানে, বা হারমোনিয়াম জানে, তাদের আঙ্গুল ঠিক সুরে, বা অক্ষরে গিয়ে পড়ে। আমার আদত আমাকে সঠিক কর্ম্মে লিপ্ত করে থাকে। আমার অহংগ্রন্থি ছিন্ন হয়ে গেছে। আমার মন এখন আর দুর্বোধ্য জীবনের হিসেবে কষতে গিয়ে কষ্ট পায় না। আমার জীবনের উদ্দেশ্য আমি বুঝতে পেরেছি। আমার সব দ্বন্দ্ব দূর হয়ে গেছে। আমি এখন সর্বত্র ঈশ্বরীয় সাম্য দেখতে পাই। আমার মনের মধ্যে থেকে ঘৃণা দূর হয়ে গেছে। আমি যেমন আত্মা বৈ কিছু নোই, সমগ্র জগতেও আত্মা বৈ কিছু নেই। প্রেম-করুনায় আমার মন পূর্ন হয়ে আছে। আমি সর্বদা আনন্দে থাকি।
আমি তাকে আবার বললাম, আপনার এই সাধনক্রিয়া-পদ্ধতি তো আপনি সাধারণ মানুষকে দিতে পারেন । তিনি বললেন, আমার আশীর্বাদ ছাড়া দেবার মতো কিছু নেই। আমি নিজেই নিজেকে ভালোবাসি তাই আমি ভালোবাসায় পূর্ন। আমার পাবার কিছু নেই। আবার দেবারও কিছু নেই। তাই আমার হারাবারও কিছু নেই। আমার জাতি নেই, আমার ধর্ম্ম নেই, আমার দেশ নেই, আমার গোষ্ঠী নেই। জগতের কল্যাণ চিন্তা ছাড়া আমার কোনো চিন্তা নেই। আমি মুক্ত, তাই মুক্তির চিন্তাও আমার নেই। আমার কোনো ভয় নেই। আমার হারাবার কিছু নেই। আমি এখন দুহাত তুলে নাচি, কেননা, আমার বগলের মধ্যে কিছু লুকোনো নেই। আমার কোনো আশঙ্কা নেই, আমার কোনো বিপদ নেই। তাই আমার সাহসের দরকারও নেই। আমি অসুস্থ নোই, তাই আমার সুস্থ হবার দরকার নেই। আমি সমর্পিত তাই সমর্পন করবার মতো কিছু নেই। আমার কোনো লাভ নেই, তাই আমার লোকসানও নেই। আমার কোনো বিপদ নেই, তাই বিপদ থেকে উদ্ধ্বারের চিন্তা নেই। আমি বিচারক নোই, তাই আমার বিচার বুদ্ধির দরকার নেই। আমি চৈতন্যস্বরূপ, আমিই আনন্দ, আমিই অনাসক্ত, আমি নিঃসঙ্গ । দেবার কথা যদি বলেন তো বলি, সূর্য্যকে দেখবার জন্য প্রদীপের আলোর দরকার নেই। স্বয়ংকে দেখবার জন্য, কোনো আয়নার দরকার নেই। অন্ধকার আমার কাছে আসে না, তাই আমি অন্ধকার দূর করবার চেষ্টাও করি না। আমি স্বয়ং আত্মারাম, তাই আমি আত্মার খোঁজও করি না।
--------------------------
৯/০১/২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - দ্বিতীয় অধ্যায় - সাংখ্যযোগ
শ্লোক নং ২/৫৬-৫৮
দুঃখেষু অনুদ্বিগ্নমনা সুখেষু বিগতস্পৃহঃ
বিতরাগ-ভয়-ক্রোধঃ স্থিতধীঃ মুনিঃ উচ্যতে। (২/৫৬)
দুঃখে নিরুদ্বিগ্ন মন, সুখেও বিগতস্পৃহ, কাম-ক্রোধ-ভয় শূন্য স্থির জ্ঞানী পুরুষকে মুনিগন স্থিতধী বলা হয়ে থাকেন ।
সাধনক্রিয়ার উচ্চ অবস্থায় সুখ বা দুঃখের রোহিত হয়। তার মানে এই নয়, যে তার কোনো সুখ-দুঃখের অনুভূতি নেই, তা নয়, এই অবস্থায় তার মন এমন একটা উচ্চ অবস্থায় থাকে যে সুখ-দুঃখ তাকে স্পর্শ করতে পারে না। ফলত সুখের ইচ্ছে বা দুঃখের জন্য মনের উদ্বিগ্নতা - এইসব বিকার তার মধ্যে লক্ষ করা যায় না। ইচ্ছা রোহিত, ক্রোধ-রোহিত অবস্থার নাম স্থিতধী। অন্যদিকে স্থীতপ্রজ্ঞর লক্ষণ হচ্ছে, ক্রিয়ার ঘনীভূত অবস্থা, যেখানে না আছে কর্তৃত্ত্ববোধ, না আছে ভোগের ইচ্ছে, না আছে জ্ঞানের ইচ্ছে, অর্থাৎ সমস্ত চেষ্টা রোহিত হয়ে ধ্যানে অটল ভাবে অবস্থান করা। তখন তার শরীর জীবিত না মৃত সেটা বোঝাও মুশকিল হয়ে পড়ে। দেহে বায়ুর সঞ্চরণ এতটাই মৃদু, যে অনেক সময় আধুনিক যন্ত্রেও তা ধরা পড়ে না। এই অবস্থা হচ্ছে স্থীতপ্রজ্ঞের লক্ষণ।
এখন কথা হচ্ছে, একজন যোগীপুরুষ সারাক্ষণই সমাধিস্থ থাকেন না। সমাধি একসময় ভঙ্গ হয়। তখন কিন্তু তিনি আবার সাধারণ মানুষের মতোই কাজ কর্ম্ম করতে পারেন, পান-ভোজনাদি গ্রহণ করে থাকেন, এমনকি তার রোগ-ভোগও হয়ে থাকে। তারও শারীরিক কষ্টও হয়। তো সমাধিলাভের পরেও বা সাধনার উচ্চতর অবস্থা প্রাপ্ত হবার পরেও যদি আমাদের সেই জীবন যন্ত্রনা ভোগ করতে হয়, তবে আমাদের এই সাময়িক সমাধিতে লাভ কি ?
দেখুন, আমরা জন্ম গ্রহণ করি প্র্রাবদ্ধ ভোগ করবার জন্য। এখন এই জন্মে সাধনার উচ্চ অবস্থাতে অবস্থান করলেও, আপনি কিন্তু প্রারব্ধকে ক্ষয় করতে পারেন নি। প্রারব্ধ একমাত্র ভোগেই ক্ষয় হতে পরে। এর কোনো অন্যথা হবে না। তা আপনি মহাপুরুষই হোন আর নিকৃষ্ট জীবই হন। প্রারব্ধ থেকে আপনাকে কেউ, বা কোনো ক্রিয়াই রেহাই দিতে পারবে না। তবে সাধারণ পুরুষের প্রারব্ধ ভোগ আর যোগীপুরুষের প্রারব্ধ ভোগের মধ্যে একটা সুক্ষ পার্থক্য লক্ষিত হয়। সাধারণ মানুষ কষ্টের দিনে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। সে জানে না কবে এই দুঃখের লাঘব হবে। কিন্তু সমাধি থেকে বুত্থিত পুরুষ জানেন, তার প্রারব্ধ কর্ম্মফল কতদিনে শেষ হবে। তিনি তাই এই ভোগজনিত সুখ বা দুঃখে কখনোই তিনি উদ্বিগ হন না। কারণ দেহাত্মবোধ অজ্ঞানীর যত প্রবল থাকে, জ্ঞানী পুরুষের দেহাত্মবোধ ততটাই ক্ষীণ। দেহে আছেন, এটা যেমন বাস্তব সত্য, তেমনি তার দেহের প্রতি কোনো মোহ-মায়া থাকে না, এটাও সত্য । তাই দেহের সুখ-দুঃখের প্রতি তিনি উদাসীন থাকেন। এইসব প্রারব্ধ ভোগে তিনি বিচলিত বোধ করেন না। একসময় যিনি সমাধিস্থ অবস্থায় জগৎ ভুলে ছিলেন, সেই রেশ বা সমাধিস্মৃতি তার যথেষ্টই থাকে। তাই দুঃখে তিনি ক্ষুব্দ হন না, বা সুখে তাঁর কোনো স্পৃহা থাকে না। এই অবস্থাকেই বলা হয় স্থিতধী। যিনি জ্ঞানে স্থির।
য সর্বত্র-অনভিস্নেহ-তৎ-তৎ প্রাপ্য শুভাশুভম
নাভিনন্দতি ন দ্বেষ্টি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা। (২/৫৭)
যিনি সর্ব্ব ভূতে স্নেহ শূন্য, প্রিয় বা অপ্রিয় বস্তুতে যিনি আনন্দ বা দ্বেষ করেন না, তাঁরই প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত অর্থাৎতিনি প্রজ্ঞাবান।
যার মধ্যে প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তিনি ভালো মন্দের উর্দ্ধে উঠে যান। স্থিতপ্রজ্ঞ যোগী সমাধি ভাঙার পরেও তাঁর শত্রু মিত্র বোধ থাকে না। কারুর প্রতি বিশেষ স্নেহ বা ভালোবাসা, বা কারুর প্রতি বিশেষ বিরাগভাবাপন্ন থাকেন না। আমাদের মতো সাধারনের মধ্যে যে আমি-আমার ভাব আছে, স্থিতপ্রজ্ঞ পুরুষ এর উর্দ্ধে প্ৰস্থান করেন। শত্রু-মিত্র, উপকারী-অপকারীর মধ্যে তার ব্যবহারিক কোনো পার্থক্য থাকে না। মনের মধ্যে লাভালাভের ভাবের উধাও হয়ে যায়। এইসময় জগতের মূল বস্তুর সঙ্গে তিনি একাত্মতা অনুভব করেন। তার মধ্যে ভ্রান্ত জ্ঞান বা অজ্ঞানের, স্নেহের ইত্যাদি তামসীক গুন তার বৃত্তি থেকে লোপ পায়।
যদা সংহরতে চায়ং কুর্মঃ-অঙ্গানি-ইব সর্ব্বশঃ
ইন্দ্রিয়াণি-ইন্দ্রিয়ার্থেভ্যঃ-তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা। (২/৫৮)
কচ্ছপ যেমন বিপদের সম্মুখীন হলে নিজের হাত-পা-মুখ (পঞ্চইন্দ্রিয়) ইত্যাদি দেহমধ্যে গুটিয়ে নিয়ে অবস্থান করে, অর্থাৎ ইন্দ্রিগ্রাহ্য় বস্তুকে পরিহার করে অবস্থান করে, তেমনি স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলোকে বিষয় থেকে গুটিয়ে অবস্থান করেন।
দেখুন, চক্ষু-কর্ন-নাসিকা-জিহ্বা-ত্বক ইত্যাদি ইন্দ্রিয় যেমন আমাদের মতো সাধারন মানুষের আছে, তেমনি একজন যোগীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গও দেখতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মতোই। কিন্তু আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয় বহির্মুখী। আমাদের চোখ বাইরে দেখছে, কান বাইরের শব্দ শুনছে, অর্থাৎ বিষয়মুখী হয়ে জ্ঞান ও আনন্দ সংগ্রহ করছে। জগতের আস্বাদন করছে। কিন্তু একজন যোগী আমাদের মতোই সমস্ত ইন্দ্রিয়সকল নিয়ে একটা দৃশ্যত সাধারণ দেহেই অবস্থান করছেন। কিন্তু যোগীর ইন্দ্রিয়ের গতি বহির্মুখী না হয়ে অন্তর্মুখী হয়ে থাকে। অর্থাৎ তার চোখ বাইরের দৃশ্যে উদাসীন। বাইরের শব্দে উদাসীন, বাইরের আস্বাদে উদাসীন। এমনকি বাহ্যিক জ্ঞানেও উদাসীন।
শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ এগুলো সবই মায়ার খেলা। ইড়া পিঙ্গলায় শ্বাসের প্রবাহের জন্য, প্রাণের কম্পন শুরু হয়। আর প্রাণের কম্পনের ফলে আমাদের বিষয়বোধ অনুভূত হয়। এই শ্বাস যখন সুষুম্না নাড়ী দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করে, তখন জগৎব্যাপী আত্মার অনুভব হয়। তখন এই পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব-এর অস্তিত্ত্ববোধ থাকে না। আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয় যেমন বহির্মুখী তেমনি পদার্থদর্শী। আর এইজন্যই আমরা আমাদের অন্তরাত্মাকে ইন্দ্রিয়দ্বারা জানাতে পারি না। কিন্তু যোগীপুরুষ এই ইন্দ্রিয়সকলের ক্রিয়াকে অবজ্ঞা করেন, অথবা ইন্দ্রিয়সকল রোধ করে, জীবদেহে প্রতীয়মান আত্মাকে দর্শন করেন। এইজন্য এই "প্রত্যগাত্মা"-কে দেখতে গেলে, কচ্ছপের মতো সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলোকে গুটিয়ে আনতে হয়। শুধু গুটিয়ে রাখলে হবে না, সবকিছুর গতিমুখ ঘুরিয়ে দিতে হয়। চোখের পাতা বাইরে না খুলে, ভিতরে খুলতে হয়, জিভকে উল্টে কন্ঠ নালিতে স্থাপন করতে হয়, শ্বাসের গতি বহির্মুখী-অন্তর্মুখী না করে, কুম্ভক করতে হয়। প্রাণের গতি হবে এই উল্টোদিকে, আর গতি হবে আজ্ঞাচক্র মুখী, বা বিন্দুমুখী। আর তখন জগতের বীজ স্বরূপ জ্যোতি, শব্দব্রহ্ম হৃদয়ে অনাহত ধ্বনির উৎপন্ন করে। আবার এই সমাধি যখন ভেঙে যায়, তখন যোগী না ঘরকা না ঘাটকা হয়ে যান । অনুকূল পরিস্থিতে আবার তিনি সমাধিস্থ হয়ে যান। সমাধি ভাঙার পরেও, অর্থাৎ বুত্থিত পুরুষের ইন্দ্রিয়সকল বহির্মুখী হতে পারে না। একেই বলে ইন্দ্রিয় প্রত্যাহার। আর এই পুরুষেরই প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জানবে।
---------------------------
১০/০১/২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - দ্বিতীয় অধ্যায় - সাংখ্যযোগ
শ্লোক নং ২/৫৯-৬৩
বিষয়া বিনিবর্ত্তন্তে নিরাহারস্য দেহিনঃ
রসবৰ্জ্জং রসঃ-অপি-অস্য পরং দৃস্ট্বা নিবর্ত্ততে। (২/৫৯)
ইন্দ্রিয়দ্বারা বিষয়ভোগে যিনি প্রবৃত্ত নন, তাঁর বিষয়ভোগ সাময়িক ভাবে নিবৃত্ত হয়েছে ঠিকই কিন্তু এর দ্বারা চিরতরে ভোগ-তৃষ্ণার নিবৃত্তি হয় না। একমাত্র সেই পরমপুরুষের দর্শনের ফলেই বিষয় বাসনা সম্পূর্ণরূপে নিবৃত্তি হয়।
আমার সাধারণত আহার বলতে বুঝি মুখ দিয়ে খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করা। আসলে আহার আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয় গ্রহণ করে থাকে। অর্থাৎ ইন্দ্রিয় দিয়ে তা সে দর্শনীয় বস্তু হতে পারে, ধ্বনি হতে পারে, স্বাদ হতে পারে। যাকিছু আমরা পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে গ্রহণ করছি, তাকে আহার বলা হয়ে থাকে। দেখুন, যোগীপুরুষ মুখ দিয়ে খান না, নাক দিয়ে নিঃস্বাস নেন না, কান দিয়ে শোনেন না, বা ত্বক দিয়ে স্পর্শ করেন না, এমনটা নয়। অর্থাৎ তিনি কোনো বাহ্যিক কর্ম্ম করেন না তা কিস্তু নয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ স্বাদের সঙ্গে খাবার গ্রহণ করেন, আর যোগীপুরুষ শরীরের জন্য রসবর্জিত আহার গ্রহণ করেন। তিনি সমস্ত কর্ম্ম করেন, কিন্তু সেগুলো সকাম কর্ম্ম নয়, ফলাকাঙ্খ্যা রোহিত কর্ম্ম। যিনি ক্রিয়ার উচ্চ অবস্থায় অবস্থান করছেন, তার কর্ম্ম স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই সম্পন্ন হয়ে থাকে। তার কোনো কর্ম্মেই তিনি আত্মস্থ অবস্থা থেকে বিচ্যুত হন না। তিনি কোনো কর্ম্মে-ই বাঁধা পড়েন না। এমনকি কর্ম্মফল তাকে স্পর্শ করতে পারে না। তার চিত্তের আকাশে বিষয়রসের কোনো সংযোগ ঘটে না।এই অবস্থায় সুখের-অভিলাষের শিকড় উৎপাটন হয়ে যায়। সুখ-দুঃখের অনুভূতির যে মূল, তা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। একেই বাউলের ভাষায় সহজ-অবস্থা বলা হয়ে থাকে। দেহের সাথে ইন্দ্রিয়সকলের যোগাযোগ যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
যততো হ্যপি কৌন্তেয় পুরুষস্য বিপশ্চিতঃ
ইন্দ্রিয়াণি প্রমাথিনী হরন্তি প্রসভং মন। (২/৬০)
হে কৌন্তেয়, প্রমাথীনি (চিত্তের বিক্ষেপকারক) ইন্দ্রিয়গণ যত্নশীল বিদ্বান মানুষেরও মনকে বলপূর্বক হরন করে থাকে।
আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো এতটাই শক্তিশালী, যে এঁকে সহজে নিষ্ক্রিয় করা যায় না। সাধক বারবার চেষ্টা করে, ইন্দ্রিয়বিষয় থেকে মনকে সরিয়ে আনতে। বার বার বিবেক বিচার দ্বারা বিদ্বানপুরুষগন ইন্দ্রিয় থেকে মনকে বিচ্ছিন্ন করবার চেষ্টা করে থাকেন । কিন্তু এই ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে আমাদের জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক। আমাদের পূর্ব-পূর্ব সংস্কার এই ইন্দ্রিয়দ্বারা বশীভূত হয়েই কাজ করে এসেছে। তাই আমাদের স্বভাবের মধ্যেই ইন্দ্রিয়জনিত কর্ম্মের সংস্কার রয়েছে। তাই মনকে মাঝে মধ্যে ইন্দ্রিয় থেকে বিচ্ছিন্ন করা গেলেও, ঘুরেফিরে মন পুনরায় ইন্দ্রিয়মুখী হয়ে যায়। তাই সৎ-বিবেকযুক্ত পুরুষও ইন্দ্রিয়ের টানে বিষয়মুখী হয়ে ওঠেন । আমাদের সাধনার ভীত যত দৃঢ় হবে, সাধনায় মন যত স্থির হতে থাকবে, বিষয়ের টান ততো হালকা হতে শুরু করবে। কিন্তু শুধু বিষয় থেকে মনকে টেনে সাধনায় ধরে রাখা সহজে সম্ভব নয়। কিন্তু সাধনায় যখন রস-আস্বাদন শুরু হবে, তখন মন আপনা থেকেই বিষয় থেকে অধ্যাত্মরসে, এসে বসবে। আর এই রসে একবার আটকে গেলে, মন আর বিষয়ের দিকে ঝুকতে চাইবে না। তাই নিরন্তর সৎসঙ্গ, ভগবত স্মরণ ও ক্রিয়ার মধ্যে স্থিত হওয়াই এই ইন্দ্রিয়গুলোকে মন থেকে আলাদা রাখতে পারে।
তানি সর্ব্বাণি সংযম্য যুক্ত আসীত মৎপরঃ
বশে হয় যস্য-ইন্দ্রিয়াণি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা। (২/৬১)
যিনি সমস্ত ইন্দ্রিয়সকলকে সংযত করে আমাতে চিত্ত সমাহিত ক'রে অবস্থান করেন, তেমন ব্যক্তির ইন্দ্রিয়গণ চিরতরে বশীভূত হয়, তাঁর মধ্যেই প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ইন্দ্রিয়গুলোকে সংযম মানেই হচ্ছে ব্রহ্মে মনকে স্থির করা। ব্রহ্মতে স্থিত না হলে ইন্দিয়সংযম থাকে না। অর্থাৎ যখনই মন ব্রহ্ম থেকে নেবে আসে, তখন আর ইন্দ্রিয়-সংযম থাকে না। আবার ইন্দ্রিয়সকল মনকে নিয়ে নিজ-নিজ বিষয়ের দিকে ধাবিত হতে থাকে। আর এটাই ইন্দ্রিয়ের স্বভাব। কিন্তু সাধনায় লেগে থাকলে, অর্থাৎ ক্রিয়ার পরাবস্থার রেশ যতক্ষন থাকে ততক্ষন আমাদের সমস্ত বৃত্তি, নিরোধের অবস্থায় থাকে। এই অবস্থাকেই বলে "মৎপর" অবস্থা। এই মৎপর অবস্থায় ইন্দ্রিয়সকল মনের উপরে আর জোর করতে পারে না। সুতরাং জোর করে বিষয়ভোগ করাতেও পারে না। এই মৎপরায়ণ অবস্থাই ঈশ্বরের শরণাগত অবস্থা। ঈশ্বরের শরণাগত না হলে ইন্দ্রিয়কে বিষয়বিমুখ করা যায় না। আর ইন্দ্রিয়জয় না হলে, সাধকের আত্মানুভব হয় না। তাই ক্রিয়া করবার সময় আমাদের ঈশ্বরে শরণাগতি রাখতে হবে। মন যখন ঈশ্বরের দিকে ধাবিত হবে, তখন সে ইন্দ্রিয় থেকে মন মুক্ত থাকবে।
ধ্যায়তো বিষয়ান পুংসঃ সঙ্গঃ-তেষু-উপজায়তে।
সাক্ষাৎ সংজায়তে কামঃ কামাৎ ক্রোধঃ-অভিজায়তে। (২/৬২)
বিষয়ের ধ্যান করতে করতে আসক্তি জন্মায়। আসক্তি হতে জন্মায় কামনা, অর্থাৎ উপভোগের আকাঙ্খ্যা । এই ভোগাকাঙ্খ্যাকে চরিতার্থ করবার পথে যদি অন্তরায় উপস্থিত হয়, তবে জন্মায় ক্রোধ।
যার যেমন ভাব, তার তেমন লাভ। যে যেমন ভাবে, তার সেইমতো প্রাপ্তি হয়ে থাকে। বিষয় চিন্তা থেকে বিষয়ভোগের স্পৃহার জন্ম হয়ে থাকে। আর এই বিষয়ভোগেচ্ছা মানুষকে পাগলপ্রায় করে দেয়। তখন নিজের স্বরূপের কথা সে ভুলে যায়। খাবারের থালা দেখলে, খেতে ইচ্ছে করে, এমনকি খাবারের ছবি দেখলেও আমাদের মনের মধ্যে খাদ্যচিন্তার উদয় হয়। আর বাঞ্চিত বস্তু পাবার জন্য মন উদগ্রীব হলে, বিষয়ের দিকে ধাবিত হবে। আর সেই বাঞ্চিত বস্তু না পেলে, মনের মধ্যে রাগের উৎপত্তি হবে। অর্থাৎ কামনাই আমাদের ক্রধের উৎপত্তির কারন। এইজন্য মনকে বিষয়বিমুখ রাখতে গেলে, বিষয় থেকে দূরে অবস্থান করতে হবে। আবার মনকে বিষয়বহির্ভূত করতে গেলে, আমাদের মনকে বিষয়ের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতে হবে।অর্থাৎ খাবারের থালার দিকে তো তাকাবেনই না এমনকি খাবারের ছবির উপরেও দৃষ্টি দেবেন না। আর এটি করতে গেলে, আমাদের মনকে সবসময় ঈশ্বরচিন্তায় মগ্ন রাখতে হবে। তবেই মনের মধ্যে নতুন বৃত্তির জন্ম হবে, তা হচ্ছে অনাসক্তি। যাকেই আপনি স্মরণ করবেন তার প্রতি আপনার লোভাতুর মন আকৃষ্ট হবে। আর লোভকে আটকাতে গেলেই, নিজের মধ্যে একটা রাগের উৎপত্তি হবে। যে এই লোভ-সম্বরন করবার কথা বলবে, সে বন্ধু হলেও, তাকে শত্রু বলে মনে হবে।
আসলে আমরা সবাই আত্মা। আর এই আত্মা ইন্দ্রিয়সংযোগে, প্রাণের থেকে আলাদা হয়ে গেছে। অর্থাৎ যে ছিল প্রাণের সাথে, সে এখন ইন্দ্রিয়ের সাথী হয়ে গেছে। তাই চতুর সাধক প্রাণের মন্থন করে, অর্থাৎ প্রাণায়ামের ক্রিয়া করে, মনকে ইন্দ্রিয় থেকে আলাদা করে ফেলে। তখন জল আর দুধ আলাদা হয়ে যায়। ইন্দ্রিয় থেকে মনকে আলাদা করে ফেলে। এবার দুধের মন্থন করতে করতে যেমন মাখনের দেখা মেলে, তেমনি প্রাণের মন্থন থেকে আসে আত্মানুভূতি। তাই বলা হয়ে থাকে কামনার শেষ হলে, ক্রোধের সমাপ্তি। আর ইন্দ্রিয়বিষয় থেকে মনকে সরিয়ে ব্রহ্মে স্থিত করতে হবে। যদিও এই কাজ এতো সহজ নয়, তা সে যতই পণ্ডিত হও না কেন। অর্থাৎ আমরা বুঝি সবই কিন্তু কাজে না লাগলে, এই পান্ডিত্যের কোনো মূল্য নেই। অকর্মন্য পণ্ডিত ভাবের ঘরে চুরি করেন। আর চতুর যোগীপুরুষ প্রাণের ক্রিয়া করতে শুরু করে দেন। এইসময় সাধক চিদাকাশের বিচিত্র দৃশ্যে মনকে আটকে রাখেন। যোগী পুরুষ হয়ে যান মৌনী পুরুষ। অর্থাৎ স্থির চিত্ত। এর কারন হচ্ছে যোগীর প্রাণবায়ু স্থির। আর মন লিন হয়ে গেছে। তাই আত্মভাবে ভাবিত মনভ্রমর বিষয় বিমুখ হয়ে নীলপদ্মের মধু আস্বাদনে রত হয়ে গেছে ।
ক্রোধাৎ ভবতি সন্মোহঃ সন্মোহাৎ স্মৃতিবিভ্রমঃ
স্মৃতিভ্রংশাদ বুদ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশাৎ প্রনশ্য়তি (২/৬৩)
ক্রোধ থেকে মোহ, মোহ থেকে স্মৃতিভ্রম, স্মৃতিভ্রম থেকে বুদ্ধিনাশ, এবং বুদ্ধিনাশের ফলে প্রাণের নাশ ঘটে থাকে।
যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, ক্রোধ থেকে মোহ, মোহ থেকে স্মৃতিভ্ৰংশ, স্মৃতিভ্ৰংশ থেকে বুদ্ধিনাশ, আর আর যার বুদ্ধিনাশ হয়েছে, সে-তো মৃতবৎ। যার বুদ্ধিনাশ হয়েছে, তার বেঁচে থাকা আর মারা যাওয়া - এর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এখন ভগবান এখানে ক্রোধ থেকে মোহের উৎপত্তির কথা বলছেন। দেখুন সন্মোহ বলতে আমরা সাধারণত বিচারহীন হয়ে কোনো বিষয়ে আকৃষ্ট হওয়াকে বুঝি । হতে পারে তা অন্ধ ভালোবাসা, মায়া-মমতা, এমনকি ধর্ম্ম-অধর্ম্ম জ্ঞানরহিত আচরণ, বা পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ। কিন্তু রাগ থেকে যে মোহের জন্ম নেয়, তা আমাদের অনিষ্ট করবার প্রবৃত্তি জাগরিত করে থাকে। তখন বুদ্ধি অন্যায় কাজের সমর্থন দেয়। অর্থাৎ বিবেকবর্জিত কাজ করে থাকে। আর এর ফল স্বরূপ প্রাণনাশের মতো ভয়ঙ্কর ক্রিয়া সংগঠিত করতে পারে।
যোগের দৃষ্টিতে বুদ্ধিনাশের অর্থ হচ্ছে, বুদ্ধি ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে থাকা। বুদ্ধি ব্রহ্মে স্থির না হলে, জানবেন, বুদ্ধি মনকে ইন্দ্রিয় সংযোগ করে দেবে। এখন কথা হচ্ছে, বুদ্ধি ব্রহ্মে কখন থাকে ? প্রাণের গতির সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিও ঘোরাফেরা করে থাকে। যখন মন প্রাণের অনুগত হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, তখন প্রাণের সঙ্গে সংগে বুদ্ধিও সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হতে থাকে, আর বুদ্ধি তখন একমুখী হয়ে ব্রহ্ম-অভিলাষী হয়। স্থির বুদ্ধি আত্মহারা হওয়ায়, বুদ্ধির মধ্যে ব্রহ্ম আত্মপ্রকাশ করেন। যার বায়ু স্থির, চিত্ত নির্মল, তার বুদ্ধিও সূক্ষ্ম হয়ে আত্মবোধে সমাহিত থাকে। চঞ্চল চিত্তে আমাদের বিবেকবর্জিত মোটাবুদ্ধি অবস্থান করে, ও সমস্ত বিষয়ানুভব হতে থাকে। বিষয়-অনুভব-বীনা অশান্তির দেখা যায় না। আবার অজ্ঞান থেকেও চিত্ত চাঞ্চল্য দেখা যায়। আর এই অজ্ঞান হচ্ছে, দেহাত্মবোধ। দেহত্ববোধ থাকলে, সত্যিকারের প্রসন্নতা অনুভব হয় না। জ্ঞানের সংযোগে আমাদের চিত্তে আনন্দের স্ফূরণ হতে থাকে। দেহবোধে যতক্ষন চিত্ত প্রতিষ্ঠিত থাকে, ততক্ষন আমাদের দেহবোধের বিলুপ্তি ঘটে না। চঞ্চল চিত্তে কেবল মায়ার খেলা। অর্থাৎ মায়ার স্থিতি চঞ্চল চিত্তে। আর স্থির চিত্ত হচ্ছে পরম ব্যোম - যেখানে শিবের স্থিতি।
-------------------------
১০/০১/২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - দ্বিতীয় অধ্যায় - সাংখ্যযোগ
শ্লোক নং ২/৬৪-৬৭
রাগ-দ্বেষ-বিমুক্তৈঃ-তু বিষয়-ইন্দ্রিয়ৈঃ-চরণ্
আত্মবশ্যৈঃ-বিধেআত্মা প্রসাদম-অধিগচ্ছতি।(২/৬৪)
যিনি বিধেয়াত্মা অর্থাৎ জিতেন্দ্রিয় এবং রাগ-দ্বেষ থেকে মুক্ত, তিনি বশীভূত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বিষয়ভোগ করে শান্তি লাভ করে থাকেন।
ইন্দ্রিয়ই বিষয়সুখের মূল। মন এই ইন্দ্রিয় দ্বারাই বিষয় গ্রহণ করে থাকে। চঞ্চল মন ইন্দ্রিয়যুক্ত হয়ে বিষয়ের অনুসন্ধান করছে। মন যতক্ষন বিষয়-উন্মুখ ততক্ষন ইন্দ্রিসকলকে নিরোধ করা অসম্ভব। কেননা ইন্দ্রিয়ের রাজা হচ্ছে মন। তাই মনের সন্তুষ্টির জন্যই ইন্দ্রিয়সকল বিষয়কে গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু সাধক যখন ক্রিয়া শুরু করেন, অর্থাৎ প্রাণের ক্রিয়া শুরু করেন, তখন প্রাণ শান্ত হয় , আর প্রাণ শান্ত হলে মনও সন্তুষ্ট থাকে। আর মন সন্তুষ্ট হলে, সে আর ইন্দ্রিয়সকলকে নিয়ে বিষয়ের অন্বেষনে যেতে চায় না। তথাপি ইন্দ্রিয়ের যে স্বাভাবিক বিষয়ভুক্তি তাতো শেষ হয়ে যায় না, তাই এই অবস্থায় বিষয়ভোগ হলেও মন অশান্ত থাকে না, মনের শান্তির ব্যাঘাতও হয় না। অর্থাৎ ইন্দ্রিয় তখন জৈবিক ক্রিয়া করছে, আর মন তখন বিক্ষেপশূন্য হয়ে বিষয় স্মরণ করছে। তবে বিষয়চিন্তা রোহিত হয়ে যখন মন শুদ্ধ হয়, তখন যথার্থ সংযম পালন হয়ে থাকে। শরীর যতক্ষন আছে, ততক্ষন আমাদের বিষয়গ্রহন আবশ্যিক, তা না হলে শরীররক্ষা সম্ভব নয়। আমি খাবো না, আমি জল পান করবো না, আমি শ্বাস প্রশ্বাস ক্রিয়া করবো না, আমি দেখবো না, শুনবো না, তাতো হতে পারে না, তাহলে শরীরের বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু বিষয়ে অনাসক্ত মনই ভগবানের আসন হতে পারে। মন যখন সাধনক্রিয়া করতে করতে আত্মানন্দে মগ্ন হয়ে যায়, তখন ক্ষুধা-তৃষ্ণার জন্য যে ব্যাকুলতা তা তাঁর থাকে না। আসলে আমাদের বিষয়ের প্রতি আসক্তি বা বিষয়তৃষ্ণাই সমস্ত অনর্থের মূল। বিষয়ের সঙ্গে আমাদের আমি-আমার ভাব বা আমাদের অহংকার লেগেই থাকে। আর অহংকার-এর বিলোপ না হলে আত্মানন্দ লাভ হয় না। তাই সবসময় ব্রহ্মবিষয়ক জ্ঞানাগ্নি প্রজ্বলিত রেখে বিষয়কে ভোগ করতে হয়।
প্রসাদে সর্ব্ব-দুঃখানাং হানিরস্যোপজায়তে
প্রসন্নচেতসো হ্যাশু বৃদ্ধিঃপৰ্য্যবতিষ্ঠতে। (২/৬৫)
এইভাবে চিত্তপ্রসাদ লাভ হলে সমস্ত দুঃখের নিবৃত্তি ঘটে, কেননা, প্রসন্নচিত্তে ব্যক্তির বুদ্ধি চিরপ্রতিষ্ঠিত।
মানুষ যখন তৃপ্ত থাকে, সন্তুষ্ট থাকে, তখন তার বুদ্ধিও স্থির হয়, আর দুঃখের নাশ হয়। অর্থাৎ তখন আর তার দুঃখবোধ থাকে না। এখন কথা হচ্ছে, মনের তুষ্টি কিভাবে সম্ভব ? আমাদের মন এক বিষয় থেকে আর এক বিষয়ের দিকে ছুটছে । আসলে সে বিষয়ের মধ্যে তুষ্টি খুঁজছে, কিন্তু একই বিষয়ে সময়ান্তরে তার তুষ্টির নাশ হচ্ছে। তাই সে নতুন বিষয়ের খোঁজ করছে।
সাধনক্রিয়ার ফলে মন যখন আত্মাতে স্থিত হয়, তখন মনের মধ্যে আর কোনো তরঙ্গ উঠতে পারে না। মনের এই নিস্তরঙ্গ অবস্থাই প্রকৃত পক্ষে মনের সন্তুোষজনক অবস্থা । আর এই অবস্থায় বুদ্ধিও বিপথগামী হতে পারে না। সুতরাং আত্মমুখী মন স্বচ্ছ বুদ্ধির অধিকারী। প্রসন্ন চিত্তে মানুষ উদার হয়ে যায়। অর্থাৎ বুদ্ধি আত্মস্বরূপে নিশ্চল অবস্থায় অবস্থান করে থাকে। যে চিত্ত নির্মল আত্মবোধ সম্পন্ন, সেই চিত্তে বিষয়স্বাদ অরুচিকর মনে হয়। চঞ্চল চিত্তে বিষয়-অনুভব, আর বিষয় স্পর্শে অশান্তি, দুঃখ-কষ্ট অনুভব হতে থাকে। আসলে অজ্ঞান থেকে চিত্ত-চাঞ্চল্য। কিন্তু সাধন প্রভাবে চিত্ত যখন নির্মল হয়, বুদ্ধি স্বচ্ছ হয়, তখন জ্ঞানের অংকুর স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জ্ঞানের ফলে চিত্তে প্রসন্নতা, আবার চিত্তের প্রসন্নতা মানে জ্ঞানের প্রতিষ্ঠা। আমরা বই পড়ে, বা কারুর কাছ থেকে শুনে, অনেক জ্ঞানের কথা মুখে বলতে পারি, কিন্তু তাতে আমাদের দেহ-বোধের নাশ হয় না। মুখে আমি বলতে পারি, আমি আত্মা, আমি এই দেহ নোই, দেহ আমার বাসস্থল, ইত্যাদি ইত্যাদি । কিন্তু দেহে একটা পিঁপঁড়ে কামড়ালেই চিৎকার করে উঠি। চঞ্চল চিত্তে শক্তির খেলা, আর স্থির চিত্ত ব্যাপ্তির লক্ষণ।
নাস্তি বুদ্ধির-যুক্তস্য ন চ অযুক্তস্য ভাবনা
ন চ অভাবয়তঃ শান্তিরশান্তস্য় কুতঃ সুখম। (২/৬৬)
অ-যোগীর বুদ্ধি নাই, অ-যোগীর ধ্যান নাই, ধ্যানহীনের শান্তি নাই, অশান্ত ব্যক্তির সুখ কোথায় ?
যার সাধন চর্চা নেই, যিনি সাধনক্রিয়া করেন না, তার মধ্যে স্থিরতা আসে নি এমনকি ধ্যান অর্থাৎ মনের একাগ্রতা আসেনি। এমন ধ্যানহীন ব্যক্তির শান্তি অধরা। সাধন ক্রিয়ার উচ্চ অবস্থায় না পৌঁছতে পারলে, মনের মধ্যে বৈরাগ্যের উদয় হয় না। তার মধ্যে বিষয়-পিপাসাই থাকে। নানান শাস্ত্র গ্রন্থ পড়ে বিষয়-পিপাসা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের সবাইকে তাই যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যোগী হতে, ধ্যানী হতে। প্রাণায়াম করলে, ধ্যান করলে, ইন্দ্রিয়গুলো শান্ত হয়। আবার ইন্দ্রিয় অশান্ত থাকলে, আমাদের প্রাণায়াম-ধ্যান ইত্যাদিতে মন বসবে না। সাধন ক্রিয়া না করলে, আমাদের চিত্ত শান্ত হতে পারে না। চিত্ত শান্ত না হলে, চিত্তের একাগ্রতা আসে না। চিত্তের একাগ্রতা না আসলে, সাধন ক্রিয়ায় সাফল্য আসে না। ক্রিয়ায় সাফল্য না আসলে, আত্মসাক্ষাৎকার সম্ভব্ হয় না। আত্মসাক্ষাৎকার না হলে চিত্তে শান্তি আসতে পারে না। সুতরাং সে সুখের সন্ধান কি করে পাবে ? সুতরাং নিশ্চেষ্ট না থেকে, ধ্যান সাধনায় নিযুক্ত হতে হবে। তবে একদিন শান্তির সন্ধান পাওয়া যাবে।
ইন্দ্রিয়াণাং হি চরতাং যন্মনো-অনুবিধিয়তে
তদস্য হরতি প্রজ্ঞাং বায়ুঃ-নাবম-ইব-অম্ভসি। (২/৬৭)
বায়ু যেমন জলের উপর নৌকাকে চালিত করে, তেমনি নিজ নিজ বিষয়ে বিচরণশীল ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে কোনো একটি ইন্দ্রিয় যখন মনকে বশীভূত করে, তখন তার প্রজ্ঞা হরণ হয় ।
বায়ুর দ্বারা যদি নৌকা পরিচালিত হয়, তখন বায়ুর গতিমুখেই নৌকা উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ধাবিত হয়। আমাদের যদি অহংভাবের পরিবর্তন না হয়, অর্থাৎ আমি যোগী, যোগ-ই আমার কর্তব্য এই বোধ যতদিন না হবে, ততদিন আমরা ইন্দ্রিয় দ্বারা পরিচালিত হবো। প্রত্যেকটি ইন্দ্রিয়ের নিজস্ব বিষয় আছে। মনকে প্রত্যেকটি ইন্দ্রিয় তার নিজস্ব বিষয়ে চালিত করে। মন তখন বোধবুদ্ধি হারিয়ে সেই বিষয়ের রস আস্বাদন করতে থাকে।
আমরা জানি মন হচ্ছে ইন্দ্রীগণের রাজা। এখন রাজা যদি দুর্বল হয়, তবে রাজকর্ম্মচারীগণ সবাই মিলে নিজ-নিজ বিষয়ে রাজাকে বুদ্ধি দিতে থাকে। রাজার বিচারবুদ্ধি হচ্ছে রাজার নিজস্ব সম্পদ। হাওয়া যেমন নৌকাকে উড়িয়ে নিজস্ব গতিপথে স্থাপন করে, তেমনি ইন্দ্রিয়শক্তি আমাদের প্রজ্ঞাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। ইন্দ্রিয়াসক্ত মন বিচারহীন হয়ে যায়। এই অস্থির মনকে সুস্থির করতে হলে আগে, আমাদের প্রাণের সংযম করতে হবে। কেননা প্রাণ হচ্ছে মনের রাজা। তো আমরা যদি প্রাণকে সাধনক্রিয়ার দ্বারা স্থির করতে পারি, তবে মন-ইন্দ্রিয় দুইই স্থির ও বশীভূত হবে। যতক্ষন এই যোগক্রিয়ার মধ্যে আমরা না প্রবেশ করবো, ততক্ষন এই যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখের কথা আমাদের কাছে কোনো কাজেই লাগবে না।
------------------------
১১/০১/২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - দ্বিতীয় অধ্যায় - সাংখ্যযোগ
শ্লোক নং ২/৬৮-৬৯
তস্মাদ যস্য মহাবাহো নিগৃহীতানি সর্ব্বশঃ
ইন্দ্রিয়াণী ইন্দ্রিয়ার্থেভ্যঃ তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা। (২/৬৮)
হে মহাবাহো, যাদের মন ও ইন্দ্রিয়গণ বশীভূত, তারাই প্রকৃত প্রজ্ঞাবান ।
ইন্দ্রিয় তার স্বভাব অনুযায়ী কাজ করবে। কিন্তু সাধককে ইন্দ্রিয়ের বশীভূত হলে চলবে না। এই অবস্থাকেই প্রজ্ঞার অবস্থা বলা হয়ে থাকে। প্রজ্ঞার অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হলে, আমাদের ইন্দ্রিসকল অর্থাৎ চক্ষু, কর্ন, নাসিকা জিহ্বা, ত্বক, তার নিজস্ব অভ্যাস ছেড়ে দেবে, বা অকেজো হয়ে যাবে এমন ভাববার কোনো কারন নেই। কিন্তু ইন্দ্রিয়ের বাহ্যিক বিষয়ভূত কর্ম্মে যদি বুদ্ধি যুক্ত হয়ে যায়, তবে বুদ্ধি আর ব্রহ্মের তালাসে যেতে পারবে না। তখন ইন্দ্রিয় সোল্লাসে তার বিষয়-কর্ম্ম করতে থাকবে। কিন্তু বুদ্ধি যখন ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করবে, অর্থাৎ বুদ্ধি যখন ব্রহ্মে স্থির হয়ে অবস্থান করবে, এই অবস্থাকে বলে প্রজ্ঞা। অর্থাৎ আমাদের বুদ্ধি তখন আত্মস্থ হয়েছে।
এখন কথা হচ্ছে, এই অবস্থা আমাদের কিভাবে হতে পারে ? নিরন্তর প্রাণায়ামের অভ্যাস অর্থাৎ রেচক-পূরক-কুম্ভকের সাহায্যে বায়ুকে স্থির করা, আর বায়ু স্থির হলে, মন স্থির হবে, তখন মন সদা সজাগ থাকবে, যাতে সে ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত না হয়ে যায়। ইন্দ্রিয় যেন তাকে প্রভাবিত করতে না পারে। এই সংযমের সাধন কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। প্রাণ-সংযম হলেই ইন্দ্রিয়সংযম অনায়াসলদ্ধ হয়। তো প্রাণায়ামের অভ্যাস করে, প্রাণকে-সংযমে অভ্যস্ত হতে হবে। এই অভ্যাসের ফলে মন একটা স্থানে (ইষ্টে) আটকে থাকবে। তখন ইন্দ্রিয়ের যে বিষয়াদি বোধ হচ্ছে, এটা সে যদিও বুঝতে পারবে, কিন্তু ব্রহ্মে স্থিত মন সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে না। তখন মন আর ইন্দ্রিয়ের কাজে কোনো আগ্রহ প্রকাশ করবে না। শান্তি লাভের এটাই উৎকৃষ্ট পন্থা। অর্থাৎ মনকে ইন্দ্রিয় থেকে বিচ্ছিন্ন করে কূটস্থে স্থিত করা।
যা নিশা সর্ব্ব ভূতানাং তস্যাং জাগর্ত্তি সংযমী
যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা পশ্যতো মুনেঃ। (২/৬৯)
সমস্ত ভূতের অর্থাৎ জীবকুলের পক্ষে যা রাত্রি, সংযমী পুরুষ তাতে জাগ্রত থাকেন। যাতে অজ্ঞ প্রাণীগণ জাগ্রত থাকেন, মুনিগণের পক্ষে তাই রাত্রি স্বরূপ।
সাধন ক্রিয়ার উচ্চ অবস্থাতে সাধক ধ্যানাবিষ্ট হয়ে যান। সেই অবস্থা সমস্ত ভূতের পক্ষে নিদ্রাবস্থা বা রাত্রিকাল। মানুষের ইন্দ্রিয়সকল যখন সজাগ থাকে, তাকে সে জাগ্রত বা দিন বলে মনে করে। আর ইন্দ্রিয়সকল যখন নিষ্ক্রিয় থাকে তখন মানুষের নিদ্রাবস্থা বা রাত্রিকাল। সাধক যখন মৌন অবস্থায় আছেন, আমাদের মনে হয়, তিনি নিদ্রিত রয়েছে, অর্থাৎ রাত্রিকালে অবস্থান করছেন।
আসলে সাধন ক্রিয়ার উচ্চ অবস্থায় যোগীগণ সজাগ থাকেন, আপনাতে আপনি মগ্ন থাকেন, মন বাহ্যিক-ব্যাপারশূন্য হলেও, একদম ব্যাপারশূন্য নন। তখন তার সামনে যা কিছু ঘটছে, তা তার মনকে অস্থির করে না। এমনকি নিজের চারিপার্শে বিপদের সম্ভাবনা দেখেও তিনি নিলিপ্ত থাকেন। মনের মধ্যে তার কোনো বিক্ষেপ উৎপন্ন হয় না, নিস্কম্প থাকেন তিনি । যোগীদের এই অবস্থা সাধারনের কাছে নিদ্রিত বা রাত্রির অবস্থা। অর্থাৎ বাইরের লোকসকল এই রহস্যঃ ধরতে পারেন না। সাধারণ লোক এইসময় সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকে সুখ-দুঃখ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু যোগীপুরুষ সংসারীদের এই অবস্থাতে উদাসীন থাকেন। আবার সমাধি যখন গভীর হয়, তখন তার চারিপার্শ্বে যা কিছু ঘটছে, তার সম্পর্কে তার কোনো বাহ্যিক জ্ঞানও থাকে না। তিনি এইসময় আত্মকায়ভাবে অবস্থান করে থাকেন। সুতরাং বাহ্যিক বহুত্ত্বতার মধ্যেও তিনি স্বতন্ত্রভাবে একাত্ম থাকেন।
সাধন ক্রিয়া করতে করতে মন যখন নিশ্চল অবস্থায় উপনীত হয়, তখন মনের মননক্রিয়ার অবসান ঘটে। আত্মদর্শনের সমস্ত বাধা তখন কেটে যায়। তখন একমাত্র আত্মস্থ অবস্থা ছাড়া আর কোনো ভাবের উদয় হয় না। ক্রিয়ার প্রথম বা প্রাথমিক অবস্থা হচ্ছে যেন আমাদের স্বপ্নাবস্থা, অর্থাৎ এইসময় মনের ক্রিয়া থাকে কিন্তু জড়দৃশ্য থাকে না। এর পরে অবস্থা হচ্ছে সুসুপ্তির অবস্থা সেখানে মনের ক্রিয়া অর্থাৎ মননক্রিয়া সাময়িকভাবে বন্ধ থাকে। মন তখন নিষ্ক্রিয় অবস্থায় অবস্থান করে। এর পরের অবস্থা আরো গভীর। এখানে দৃশ্য থাকে না, কেবল আত্মার অনুভব থাকে। এই অবস্থাকে বলা হয়, সকল্প সমাধি। এর পরে, যখন সাধক আরো উচ্চস্তরে অবস্থায় উন্নীত হন, তখন দৃশ্য থাকে না দ্রষ্টা থাকে না, অর্থাৎ আত্মার অনুভব বলেও কিছুই থাকে না। একেই বলে নির্বিকল্প সমাধি। অর্থাৎ দ্রষ্টা ও দৃশ্য এক হয়ে যায়।
তো আমাদের চার অবস্থা , জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি ও তুরীয় অবস্থা। জাগ্রত অবস্থায় আমরা জগৎকে সম্যকরূপে ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করে থাকি। এখানে মন ও শরীর দুইই কাজ করে থাকে। স্বপ্নাবস্থায়, আমাদের স্থুল শরীর নিষ্ক্রিয় থাকে, কিন্তু আমাদের সূক্ষ্ম দেহ অর্থাৎ মনোময় দেহ কাজ করে। স্বপ্নে আমরা কত কিছু দেখি, শুনি, কিন্তু স্বপ্ন থেকে জেগে উঠলে, তখন সেই দৃশ্যপট আর কিঁছুই আমাদের সামনে থাকে না। ঠিক তেমনি জাগ্রত অবস্থায় আমরা যা দেখছি, বিষয়াদি ভোগে যে আনন্দ পাচ্ছি, যোগীপুরুষ যখন যোগনিদ্রায় থাকেন, তখন আমাদের জাগ্রত অবস্থার মতো সমস্ত বিষয়কে স্বপ্নদৃষ্ট বস্তুর মতো দেখে থাকেন। এর পরে অর্থাৎ স্বপ্নাবস্থার পরে, আমরা যেমন স্বপ্নের কথা ভুলে যাই, তেমনি সাধক যখন সাধনার উচ্চতর অবস্থার মধ্যে প্রবেশ করেন, তখন জগৎব্যাপারকে যোগী ভুলে যান। আমাদের সংসারের লাভ-অলাভ, দেনা-পাওনা, সুখ-দুঃখ, প্রিয়-অপ্রিয় শত্রু-মিত্র সবই স্থিতপ্রজ্ঞ পুরুষের কাছে স্বপ্নের অলিকের মতো মনে হয়। আমরা যেমন জাগ্রত অবস্থায় স্বপ্নের কথা মানি না, তেমনি সাধক-প্রবর প্রজ্ঞার অবস্থায় সমস্ত কিছুতে উদাসীন থাকেন। সাধারণ মানুষ সমাধিস্থ পুরুষকে জড়বৎ মনে করেন, কিন্তু সামাধিবান পুরুষ আত্মস্বরূপে মগ্ন থেকে পরম-আনন্দ ভোগ করতে থাকেন।
-------------
১২.০১.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - দ্বিতীয় অধ্যায় - সাংখ্যযোগ
শ্লোক নং ২/৭০-৭২
আপূর্যমাণম -অচলপ্রতিষ্ঠং সমুদ্রমাপঃ প্রবিশন্তি যদবৎ।
তদবৎ কামা যং প্রবিশন্তি সর্ব্বে।
স শান্তিম-আপ্নোতি ন কামকামী।। ( ২/৭০)
চতুর্দিক থেকে যেমন নদনদীর জলরাশি প্রশান্ত সমুদ্রে প্রবেশ করে সমুদ্রের সাথে বিলীন হয়ে যায়, ঠিক তেমনি যে মহাপুরুষ বিষয় সকলে প্রবিষ্ট হয়েও মনের বিক্ষেপ অনুভব করেন না, তিনিই প্রকৃত শান্তিলাভ করতে পারেন। ভোগকামী ব্যাক্তিগন (শান্তি লাভ করতে) পারেন না।
যার ইচ্ছা নিবৃত্ত হয়েছে, যার মধ্যে "আমি-আমার" এই ভাবের রোহিত হয়েছে, তিনিই শান্তিতে আছেন। ছোট ছেলে বাবার হাত ধরে মেলায় এলে, যাকিছু দেখে, তার দিকে সে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে, ভাবে আমার যদি হতো এটা। এই ভাবনা থেকে সে সবকিছুর দিকে হাত বাড়ায়। কিন্তু সতর্ক দোকানদার হাত সরিয়ে দেয়। শিশুর মনে কষ্ট হয়। সে দুঃখ পেয়ে কেঁদে ফেলে। আমরাও ওই শিশুটির মতো ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়কে ভোগ করতে চাই, আমার করে নিতে চাই। আর যখন সে চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে বাধা আসে তখন দুঃখ-কষ্ট ভোগ করি। এখান থেকে আমাদের বেরুতে হবে। যার মধ্যে জ্ঞান হয়েছে, একটু যার বাস্তব বুদ্ধি হয়েছে, তিনি দোকানের সামগ্রীর দিকে তাকান বটে, কিন্তু তিনি জানেন, এই বস্তু তার জন্য নয়। তাই তার এটি পেলেও ভালো, আবার না পেলেও ভালো। তার দুঃখ হয় না। তেমনি যার মধ্যে প্রজ্ঞা অর্থাৎ সত্যিকারের জ্ঞান হয়েছে, তিনি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর প্রতি নির্ণিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন বটে, কিন্তু তার মধ্যে একটা নিস্পৃহ ভাব থাকে। কোনোকিছুতেই তিনি ব্যাকুল হন না। দেখুন, অসীম সমুদ্র, এই সমুদ্রে কোন নদীর জল এলো, আর কোন নাদির জল এলো না, তা নিয়ে সমুদ্রের মাথাব্যথা হয় না। এমনকি সমুদ্রের জলের পরিমাপের মধ্যেও বিশেষ কোনো তারতম্য দেখা যায় না। ঠিক তেমনি স্থিতপ্রজ্ঞ পুরুষের কাছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর আগমন বা নির্গমনে কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। সমুদ্র জেনম সমুদ্রের মধ্যেই থাকে, তেমনি স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি আত্মস্থ হয়ে অবস্থান করেন। সমুদ্র নদিকে আসতে বাধা দেয় না, আবার আগমনের সম্ভাষণও করে না। ভাবখানা এমন যেন, এসেছো বাবা থাকো, চলে যেতে হয় চলে যাও। আবাহন নেই আবার বিসর্জনও নেই।
বাসনাই আমাদেরকে ভোগে প্রবৃত্ত করে থাকে, যখন কোনো বাসনার লেশ মাত্র থাকে না, তখন আমি-আমার বলেও কিছু থাকে না। তখন শান্তি-শান্তি-শান্তি। সব শান্ত - প্রারব্ধ তো ভোগ করতেই হয়, কিন্তু প্রারব্ধ ভোগের জন্য কোনো উতলা থাকে না - আবার প্রারব্ধে ভোগের কারনে মনের মধ্যে কোনো বিচলিত ভাবও থাকে না। সমুদ্রে শতশত নদীর মিলনে সমুদ্র কখনো বিক্ষুব্ধ হয় না। স্থিতপ্রাজ্ঞ ব্যক্তির প্রারব্ধ ভোগে মনের মধ্যে কোনো চঞ্চলতা দেখা যায় না।
বিহায় কামান্ যঃ সর্ব্বান্ পুমাংশ্চরতি নিঃস্পৃহঃ
নির্ম্মমো নিরহঙ্কারঃ স শান্তিম-অধিগচ্ছতি (২/৭১)
যিনি সবরকম কামনা পরিত্যাগ করে নিস্পৃহ, নিরহঙ্কারী ও মমতা শূন্য হয়ে সংসারে বিহার করেন, তিনি শান্তি লাভ করেন।
কামনাই সমস্ত শোক-দুঃখের কারন। আসক্তি থেকে কামের উৎপত্তি। চিত্তের মধ্যে আসক্তির দাগ লেগে থাকে। চিত্ত থেকে এই আসক্তির দাগ যতক্ষন না যায়, ততক্ষন মন নির্মল আনন্দ ভোগ করতে পারে না।
এখন কথা হচ্ছে, স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি সমস্ত কামনা ত্যাগ করেন, কিন্তু যতদিন শরীর রক্ষার প্রয়োজন হয়, ততদিন তার জাগতিক বস্তুর প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। এই যে প্রয়োজনীয় বস্তুর আবশ্যিক ব্যবহারিক দিক, একেই বলে স্পৃহা। যোগীপুরুষ এই প্রয়োজনীয় বস্তুর ব্যবহার করেন না, তা নয়, তিনি এই বস্তু গ্রহণের জন্য তার মধ্যে কোনো আকুলতা বা আগ্রহ দেখা যায় না। একেই বলে নিস্পৃহ ভাব।
মানুষের মধ্যে যখন আমি-আমার ভাব থাকে, তখন "আমার" এই ভাব থেকে মমতার জন্ম হয়। স্থিতপ্রজ্ঞ মহাপুরুষের মধ্যে "আমার" এই বোধ নেই,তাই তাঁর মধ্যে মমতার জন্ম হতে পারে না।
মানুষের মধ্যে যতক্ষন দেহাত্মবোধ থাকে, ততক্ষন তার মধ্যে "আমি" ভাব দেখা যায়। একেই বলে অহংভাব। স্থীতপ্রজ্ঞ মহান ব্যক্তি নিজেকে শরীর-ইন্দ্রিয়-মন-বুদ্ধি এসব থেকে উর্দ্ধে অবস্থান করে থাকেন। (এই আমি দুই প্রকার - ঠাকুর রামকৃষ্ণের ভাষায় একটা কাঁচা আমি আর একটা পাঁকা আমি। দেহাত্মবোধ হচ্ছে কাঁচা আমি, আর আত্মস্থ হলে অর্থাৎ আমি আত্মা এই বোধ যার মধ্যে জাগ্রত হয়, সেই হচ্ছে পাঁকা আমি) । সাধক যখন নিজেকে আত্মাভাবে স্ফূরিত করতে পারে তখন তার মধ্যে আর অহংকার-এর জন্ম হতে পারে না।
এখন যোগের কথায় আসি, সাধন ক্রিয়ার দ্বারা অর্থাৎ অষ্টাঙ্গ যোগের দ্বারা (যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, ধারণা প্রত্যাহার,ধ্যান সমাধি) ধীরে ধীরে চিত্ত আকাশ স্বরূপ হয়ে যায়। আর নির্মল চিদাকাশে কোনো মলিনতা স্থান পেতে পারে না। তখন অনাসক্ত চিত্তে কাম-প্রবৃত্তির বিনাশ ঘটে। তখন আমি-আমার ভাব থাকে না। আর যার আমি-আমার ভাব নেই, সেই যোগীর মধ্যে না থাকে কোনো অহংকার, না থাকে কোনো মায়া-মমতা, সব সম্পর্কেই তিনি নিস্পৃহ থাকেন। ফলত শোক-দুঃখ-ভয়-অশান্তি তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না।
এষা ব্রাহ্মী স্থিতিঃ পার্থ নৈনাং প্রাপ্য বিমুহ্যতি
স্থিত্বা-অস্যাং-অন্তকালে-অপি ব্রহ্মনির্বাণম ঋচ্ছতি (২/৭২)
হে পার্থ, এইভাবে ব্রহ্মনিষ্ঠা প্রাপ্ত হলে, আর তিনি বিমুগ্ধ হন না। মৃত্যুকালেও এই অবস্থায় অবস্থানপূর্বক সাধক ব্রহ্মনির্বাণ প্রাপ্ত হন।
ব্রহ্মতে স্থিত থাকবার ক্রিয়া না পেয়ে আমরা ব্রহ্ম-ব্যতিরেকে জাগতিক রূপে মুগ্ধ হয়ে রয়েছি। যদিও জগৎ ব্রহ্মব্যতিরেকে নয়। কিন্তু জগতের মধ্যে যে ব্রহ্ম বিরাজ করছেন তাঁকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি না। এই জ্ঞান ও ক্রিয়া প্রাপ্ত হয়ে আমরা অনন্তকাল ব্রহ্মতে স্থিত হতে পারি। ব্রহ্মতে স্থিত হতে গেলে আমাদের সাধন ক্রিয়ার সাহায্য নিতে হবে। এই স্থিতি লাভ হলে, আমাদের আর অজ্ঞানে দিন কাটাতে হবে না। শোক-দুঃখ-এর আশঙ্কাও আমাদের থাকবে না। মহাযোগী পুরুষগন অনন্তকাল এই ব্রহ্মে স্থিত থেকে অসীম আনন্দসাগরে নিমজ্জিত হয়ে থাকেন। তাঁর দ্বৈতভাব বলে কিছু থাকে না। শারীরত্যাগের সময়, সাধারণ লোকের মতো জ্ঞানীর প্রাণের নিঃসরণ হয় না। সমুদ্রবক্ষের বুদ্বুদ সমুদ্রেই মিলিয়ে যায়। একেই বলে স্ব-স্বরূপে স্থিতি। অর্থাৎ যেখান থেকে এসেছিলো, সেখানেই ফিরে গেলো।
প্রণবের ক্রিয়া ও প্রাণের স্থিতি সাধককে নিরঞ্জন ব্রহ্ম লাভ করায়। সাধারণ লোকের মৃত্যু হয়, আর সাধকের ব্রহ্মে স্থিতি হয়। মৃত্যুকে আমাদের ভয়, কিন্তু ব্রহ্মে স্থিত হলে মৃত্যুভয় বলে কিছু থাকে না। কেননা ব্রহ্মে মৃত্যু বলে কিছু নেই। এই যে ব্রহ্মস্থিতি এটি সাধকের জীবিত কালেই হয়ে থাকে। একেই জীবনমুক্ত অবস্থা বা অভয় পরম পদ বলা হয়ে থাকে। প্রাণায়াম বা প্রাণের সাধনা করতে করতে একসময় ওঙ্কারের ধ্বনি শ্রুত হয়, বাইরের জট শব্দ তখন শূন্য মিলিয়ে যায়। প্রাণ স্থির হয়ে যায়। বাইরের সমস্ত কিছু অগ্রাহ্য হয়ে যায়। একেই বলে ব্রাহ্মীস্থিতি। এই অবস্থা প্রাপ্তির জন্য ছেলেবেলা থেকেই আমাদের সচেষ্ট হাওয়া উচিত, তবে জীবনের শেষে বৃদ্ধ বয়সে এমনকি মৃত্যুর আগেও যদি মনকে ব্রহ্মেস্থিত করা যায়, তবে নির্ব্বাণ পদ লাভ হতে পারে।
শেষ হলো - শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা নামক যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণ-অর্জুন সংবাদে সাংখ্যযোগ নামক দ্বিতীয় অধ্যায়।
পুনশ্চ : শ্রীগীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে মোট ৭২টি শ্লোক আছে। এর মধ্যে ভগবানের উক্তি শুরু হয়েছে, ১১ নং শ্লোক থেকে। ভগবানের কথাগুলো আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায় প্রথমত সংখ্যা প্রকরণ, (১১-৩০) দ্বিতীয়ত স্ব-ধর্ম্ম প্রকরণ (৩১-৩৮) তৃতীয়ত যোগপ্রকরন। (৩৯-৫৩) এর পরে আছে অর্জুনের প্রশ্ন - অর্থাৎ স্থিতপ্রজ্ঞ পুরুষের লক্ষণ কি (৫৪) .এর পর (৫৫- ৭২ অর্জ্জুনের প্রশ্নের জবাব। ২ -৩ নং শ্লোকে ভগবানের উক্তি আছে, তবে সেটি প্রশ্নের আকারে বিস্ময়সূচক। এটিই ভগবানের প্রথম উক্তি।
আমরা আনন্দ লাভের জন্য সকলেই ব্যস্ত, সকলেই অনুসন্ধান করছি। আমাদের যতক্ষণ না ব্রহ্মজ্ঞান না হবে, আমাদের যতক্ষন না পরমাত্মার উপলব্ধি হবে, ততক্ষন আমাদের চিরস্থায়ী আনন্দ পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই পরমাত্মার উপলব্ধি কিভাবে সম্ভব ? যোগীপুরুষগন বলছেন, পরমাত্মার উপলব্ধি কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। আর তার জন্য আমাদের যোগসাধনায় লিপ্ত হতে হবে। সাধনকর্ম্মে লিপ্ত হতে হবে। দেখুন আলো বিশ্বব্যাপী আছে, কিন্তু আমাদের দৃষ্টিশক্তির স্বল্পতার জন্য আমাদের দৃষ্টি বিশ্বব্যাপী হতে পারে না। ঠিক তেমনি আকাশ-বাতাস ভরা আছে শব্দব্রহ্ম দ্বারা। কিন্তু আমাদের কর্নের শ্রুতিক্ষমতার স্বল্পতার জন্য, আমাদের সেই শব্দব্রহ্মের মধুরতা অনুভব করতে পারি না। তো আলো-কে জানবার জন্য যেমন আমাদের চক্ষু, শব্দকে উপলব্ধি করবার জন্য যেমন আমাদের কান, তেমনি আমাদের মধ্যে আছ্ প্রাণবায়ু, চেতনশক্তি ও আত্মা। এগুলোর দিকে ধ্যান দিলেই আমরা ধীরে ধীরে সেই পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হতে পারি। আর এই ধ্যান দেবার নামই যোগসাধনা। এই যোগসাধনার প্রকারভেদ থাকতে পারে, কিন্তু যোগ-ই একমাত্র উপায় যার কথা শ্রী গীতার ছত্রে ছত্রে, যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের কাছে বলেছেন। আমরা ধীরে ধীরে এইসব কথা যেমন শুনবো, তেমনি, সেই কথা অনুযায়ী নিষ্কাম-কর্ম্মে লিপ্ত হবো। আর সেই ব্রহ্ম-অনুভূতির লক্ষে পৌঁছে যাবো।
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা : যাঁরা ধৈর্য্য সহকারে পড়ছেন, তাঁদের ভগবৎ সত্ত্বায় আমার সশ্রদ্ধেয় প্রণাম। এ-তো ভগবানের শ্রীমুখ-নিঃসৃত অমৃত কথা। এই অমৃত যাঁরা পান করছেন, তাঁরা সবাই আমার শ্রদ্ধেয়।
---------------------------
No comments:
Post a Comment