সূর্য-বিজ্ঞান - শূন্য থেকে কি সৃষ্টি করা যেতে পারে ? -
মূলসূত্র : সূর্য্য বিজ্ঞান - গোপীনাথ কবিরাজ, পাতঞ্জল দর্শন, হঠযোগ প্রদীপিকা, ঘেরন্ড সংহিতা ও শিব-সংহিতা।
যুঞ্জান প্রথমং মনস্তত্বায় সবিতা ধিয়ঃ
অগ্নের্জ্যোতি নির্চায্য পৃথিব্যা অধ্যাভরৎ।
যারা শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ পড়েছেন, তারা জানেন, এই শ্লোকটি দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম শ্লোক। এখানে বলা হচ্ছে, সবিতা বা সূর্য যেন কৃপা করে, আমাদের মন ও অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলোকে পরমাত্মার দিকে চালিত করেন। অগ্নেঃ জ্যোতিঃ নিচায্য অর্থাৎ অগ্নির আলোকপ্রদ শক্তি সংগ্রহ করে, পৃথিব্যা অর্থাৎ পৃথিবীর সমস্ত কিছু থেকে আমাদের মন অন্তর্মুখী হোক।
এখন কথা হচ্ছে, সবিতাদেবে র কাছে আমাদের কেন এই প্রার্থনা। আসলে সূর্য আমাদের কাছে সমস্ত দৃশ্যমান বস্তুর মধ্যে বিশাল। আর এই সূর্য্যশক্তির সাহায্যেই পৃথিবীর সমস্ত জীবজগৎ জীবনধারণ করছে। এই দৃশ্যমান জগৎ আমাদের মনকে আকর্ষণ করছে। যাতে এই জগৎ থেকে মনটা তুলে নিতে পারি, তার জন্য আমাদের সূর্যদেবের কাছে প্রার্থনা। পৃথিবীর তাবৎ মনুষ্যজাতি এই সূর্যদেবের কাছে ঋণী। জাত-ধর্ম্ম নির্বিশেষে আমরা তাই সূর্য্যের উপাসক।
বলা হয়ে থাকে এই সূর্যবিজ্ঞানের চর্চা হচ্ছে জ্ঞানগঞ্জে। বলা হয়ে থাকে এই জ্ঞানগঞ্জ কোনো ভৌতিক স্থান নয়, আবার এই স্থুল জগতের সীমার মধ্যেও এই জ্ঞানগঞ্জের অবস্থান নয়। বলা হয়, সময়-কাল ও স্থানের উর্দ্ধে এর অবস্থান। এখানে সিদ্ধপুরুষগন অবস্থান করছেন। এই সিদ্ধাশ্রমের অবস্থান স্থুল দৃষ্টিতে স্থুল আবার সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে সূক্ষ্ম। একজন সিদ্ধ সাধক যেমন আমাদের দৃষ্টিতে একজন রক্ত-মাংসের মানুষ, তেমনি আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে তিনি মহামানব, মহানাত্মা। এঁদের অবস্থান, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে অসাধারন কিছু নয়, এঁরা সবাই আমাদের মতো মুড়ি খায়, ঘুমায়, বাহ্য-ক্রিয়া করে। আবার কিছু মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে এঁরা অন্য জগতের মানুষ। অর্থাৎ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী আমরা এঁদের দর্শন করে থাকি । আমরা যেমন আমরা তেমনই দেখি।
প্রথমেই বলি, পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছু হয় না। আপনি যা কিছু দেখছেন, শুনছেন, সব সত্য আবার সত্য নয়। এমনকি আমরা যাকিছু প্রতিদিন প্রতক্ষ্য করছি, তার কার্য্য-কারন সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নাও থাকতে পারে। তাই যাকিছু আমরা দেখছি, তা সাময়িক ভাবে আমাদের কাছে সত্য বলে প্রতিভাত হলেও, আসলে সেই ঘটনা সেই সময়ের জন্যই মাত্র সত্য। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে, ঘটনার ধারাবাহিকতার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেখা সত্য অদৃশ্য হয়ে যাবে।
আমরা জানি, দুধ থেকে দই হয়, কিন্তু দই থেকে কখনো দুধ হতে দেখি না। আমরা জানি মানুষের পেটে মানুষ হয়, মানুষের পেটে কখনো ছাগল হয় না। আবার ছাগলের পেতে ছাগল হয়, ছাগলের পেটে কখনো মানুষ হয় না। কিন্তু এর যে অন্যথা হতে পারে, তার একটা গল্প মহাভারতে আছে : মাছের পেটে নাকি ব্যাসদেবের মাতা সত্যবতীর জন্ম হয়েছিল। আমরা জানি, মানুষের মৃত্যুর পরে, মানুষকে পুড়িয়ে বা মাটিতে কবর দেওয়া হয়। কিন্তু আগুন থেকে বা মাটি ফুড়ে মানুষের আবির্ভাব হতে দেখিনি।
কিন্তু মহাভারতের লেখক ঋষি ব্যাসদেব বলছেন, আগুন থেকেও মানুষের জন্ম হতে পারে। দ্রৌপদী, ধৃষ্টদ্যুম্ন অগ্নি থেকে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন । আমরা শুনেছি, বিষ্ণুর ব্রহ্মকমল থেকে ব্রহ্মার জন্ম হয়। ব্রহ্মকমল অর্থাৎ নাভি থেকে পদ্মের জন্ম এযুগে কেউ কখনো দেখেনি এমনকি শোনেও নি। কিন্তু গোপীনাথ কবিরাজ বলছেন (সূর্যবিজ্ঞান - পৃ : ৫৭) এযুগেও নাকি তিনি ব্রহ্মকমল দর্শন করেছিলেন। বলছেন, বাবা তখন কাশিতে, হনূমান ঘাটে অবস্থান করছেন। গুরুদেব তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে আছেন, আমরা ৪/৫জন সেখানে উপস্থিত। তাকিয়ায় হেলান দিয়ে নিজের নাভি প্রদেশ খুলে দিলেন, নাভির উপরে হাত বুলাতে লাগলেন, প্রথমে নাভি প্রদেশে একটা গভীর খাদের সৃষ্টি হলো, তারপর নাভিমূল রক্তবর্ণের হয়ে গেলো। কিছুক্ষন পরেই এক-দেড় ফুট লম্বা একটা সুগন্ধ যুক্ত পদ্ম, নাভি থেকে বের হয়ে এলো। সুগন্ধিতে সারা ঘর ময়ময় করতে লাগলো। বাবা বললেন, এখন সূর্য্যের তেজ কম, তাই এটি আর বড়ো হবে না, নতুবা ছাদ পর্যুন্ত বড়ো হওয়া সম্ভব ছিল। গোপীনাথ কবিরাজ বলছেন, আমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে এই অভূতপূর্ব দৃশ্যের সাক্ষী রইলাম।
মহাত্মাগণ বলছেন, এমনকি শূন্য থেকেও প্রাণের সৃষ্টি হতে পারে। এইসব অভিজ্ঞতা আমাদের জীবনে ঘটেনি, তাই আমাদের কাছে এগুলো অবিশ্বাস্য। কিন্তু কিসে যে কি হয়, কে বলতে পারে ? ঘরের মধ্যে একটা টিনের পাত্রে চাল রাখা হয়েছিল। কিছুদিন পরে দেখা গেলো, চালের মধ্যে পোকার জন্ম হয়েছে। বলা হয়ে থাকে প্রথমে খাদ্যের জন্ম তার পরে খাদকের জন্ম। খাদ্যের জন্ম হলেই জানবেন, খাদকের আবির্ভাব আসন্ন। মৃত শরীরে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই পোকার জন্ম হতে আমরা সবাই দেখেছি। তাই বলছিলাম, কিসে যে কি হয়, কে বলতে পারে ? গাছে ফুলের আবির্ভাব হলে, কোথা থেকে মধুমক্ষী আসে, আবার কোথায় বা চলে যায়, তা আমরা জানিনা। তো আমরা জানিনা অনেক কিছু। গুরুদেব বলছেন, যা আমাদের বুদ্ধির অগোচর, যা আমাদের জ্ঞানের বাইরে, তাকে অস্বীকার করা সহজ, কিন্তু তার কারন অনুসন্ধান করা কঠিন। আমাদের দর্শনের বাইরে বা আমাদের জ্ঞানের বাইরে বুদ্ধির অগোচর অনেক কিছু ঘটছে, বা আমাদের দৃষ্টির বাইরে অনেক বস্তু আছে যাকে আমরা দেখতে পাইনা বটে, তার মানে এগুলো নেই তা নয়। মানুষ যাকিছু কল্পনা করতে পারে, এমনকি মানুষের কল্পনার অতীত অনেক কিছুই এই পৃথিবীতেই অবস্থান করছে, যা আমরা জানি না। সমুদ্রের মধ্যে যে অসংখ্য জীব সংসার করছে, তার কতটুকুই বা জানি আমরা । পৃথিবীর মাটির গর্ভে অর্থাৎ পাতালপ্রদেশে অসংখ্য প্রাণের অস্তিত্ত্ব আছে, তার খবর কি আমরা রাখি ? আমার চোখের সামনে অসংখ্য ভাইরাস জাতীয় সূক্ষ্ম পদার্থ ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদেরকে কি আমরা খালি চোখে দেখতে পাই ? পাই না। তো আমরা দেখতে পাই না বলে তাদের অস্তিত্ত্ব বিলোপ হয়ে যায় না। তারা আছে, আমাদের অগোচরেই আছে। এই সত্য মেনে এদের অনুসন্ধান করলে, আমরা এদের সন্ধান পেতে পারি।
পতঞ্জলির যোগশাস্ত্রে, এইসব অনেক বিভূতির কথা বলা আছে। এমনকি এইসব যোগবিভূতি লাভের উপায় আছে এই গ্রন্থে । এখন আর এইসব বিদ্যা, গোপন বিদ্যা নয়। আপনি নিজে ইচ্ছে করলে, এইসব যোগশাস্ত্রে বই বাজার থেকে কিনে, যোগ পদ্ধতির অনুশীলন করে, এইসব যোগবিভূতির অধিকারী হতে পারেন। কিন্তু আবার এও মনে রাখতে হবে, ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, এইসব ক্রিয়া আসলে ঈশ্বর-অনুভূতি লাভের পথিকের যাত্রাপথের দৃশ্যমাত্র। এই দৃশ্য দেখে যারা ভুলে যায়, তারা কখনো মূল তীর্থে পৌঁছাতে পারে না। এগুলো ঈশ্বরলাভের পথের বাধাস্বরূপ। আমরা জানি মন-মন ঘিও কেউ ঢালবে না, আর রাধাও নাচবে না। কিন্তু তাই বলে ঋষিবাক্য তাচ্ছিল্ল্য করা আসলে নিজের বুদ্ধির অসম্পূর্ণতা। এইখান থেকে আসুন, আমরা বেরুতে চেষ্টা করি।
ঠাকুর রামকৃষ্ণকে সবাই পরমহংস বলতেন। দুধ ও জল মিশ্রিত থাকলেও হাঁস যেমন জল থেকে দুধকে আলাদা করে গ্রহণ করতে পারে, তেমনি যিনি বা যাঁকে পরমহংস বলা হয়, তিনি জগতের মধ্যে মিশ্রিত আত্মা ও অনাত্মা, নিত্য ও অনিত্যকে আলাদা করতে পারেন। এই অবস্থায় সাধকের জাগতিক সমস্ত দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে থাকে। আমাদের মধ্যে শুদ্ধবোধ ও অশুদ্ধ বোধ আছে, আমাদের মধ্যে ভালো-মন্দ বিচার আছে, পরমহংস এই বিচারের উর্দ্ধে উঠে জগৎকে উপলব্ধি করে থাকেন।
সূর্যবিজ্ঞান আসলে বাহ্যিক ভাবে সূর্য্যের সাধন নয়। আমাদের শরীরে আছে ইড়া-পিঙ্গলা নাড়ী। এই নাড়ী দুটোর মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করে থাকে, সূর্য্যশক্তি ও চন্দ্রশক্তি। আমাদের মধ্যে যে জ্ঞানের প্রকাশ, বিজ্ঞানের প্রকাশ, জীবনের প্রকাশ তা আসলে সূর্য-চন্দ্রকে আশ্রয় করেই ঘটে থাকে। এই জ্ঞানের প্রচারক বা সংকলক ডাক্তার গোপীনাথ কবিরাজ। আর এই বিজ্ঞানের যিনি শিক্ষা দেন তিনি হচ্ছেন, যোগীরাজ বিশুদ্ধানন্দ। আসলে এই বিশেষ যোগপদ্ধতি ঋষি পতঞ্জলির যোগদর্শনে আমরা দেখতে পাই। আমরা ধীরে ধীরে এইসব কথা শুনবো। আর শুনতে শুনতে দেখুন না, এই বিদ্যার অল্পবিস্তর আয়ত্ত্ব করে, নিজের জীবনে কোনো সুফল আনতে পারেন কি না। এই বিদ্যার অনুশীলনীতে আমাদের মন ও শরীর অবশ্য়ই সুস্থ থাকতে পারে - একথা হলফ করে বলা যায়। আমরা বলছি না যে আপনি রাতারাতি এই বিদ্যার দ্বারা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যাবেন। সেই আশাকরাও আমাদের পক্ষে অনুচিত। কেননা আমরা কেউ পুরোপুরি শুদ্ধ শরীর বা মনের অধিকারী নোই। তবে এই প্রক্রিয়ার অনুশীলনী আপনাকে একটা সুস্থ-সবল-নির্ভিক জীবনের অধিকারী করে দিতে পারে।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
সূর্য-বিজ্ঞান - (২) - শূন্য থেকে কি সৃষ্টি করা যেতে পারে ?
গুরুদেব বলছেন, পাতঞ্জলির সব সিদ্ধান্ত সত্য, অভ্রান্ত এবং পূর্ন। দেখো সব কিছুর মধ্যেই আছে পঞ্চভূত বা তার গুন্ । কিন্তু পরিমানের তারতম্যের জন্য তাদের মধ্যে বিভিন্নতা দেখা যায়। সব কিছুর মধ্যে সব কিছু আছে. কিন্তু এক-এক জিনিসের মধ্যে এক-একটি মূল ভূতের গুনের পরিমানের তারতম্যের জন্য, আকার প্রকার ও নামের ভেদ হয়ে থাকে। সমস্ত উদ্ভিদ মাটি থেকে রস বা জল সংগ্রহ করছে, সূর্য্য থেকে তাপ বা সূর্য্যরশ্মি সংগ্রহ করছে, এবং এইভাবেই তারা বেঁচে বেড়ে উঠছে, তথাপি দেখো, এক-এক গাছ এক-এক আকৃতির, ভিন্ন ভিন্ন রঙের ফুল ফুটছে। ভিন্ন ভিন্ন তার গুন্। ভিন্ন ভিন্ন ফল দান করছে।
ঋষি পতঞ্জলি বলছেন,
পরিনাম একত্বাৎ বস্তুতত্ত্বম। (কৈবল্যপাদ শ্লোক - ১৪)
পরিণামের একত্ব হেতু তত্ত্বগত ভাবে সমস্ত বস্তুই এক। অর্থাৎ পরিণামে সবাই একই বস্তুতে পরিণত হবে। বর্তমানে ভিন্ন ভিন্ন, অন্তিমে সব এক। সমস্ত বস্তুই ত্রিগুণাত্বক। তা সে জড় বা চেতন যাই হোক না কেন। ত্রিগুণের চঞ্চলতা হেতু বস্তুর সত্ত্বাকে আলাদা বলে মনে হয়। আর এই ত্রিগুণের মধ্যে হিল্লোলের ফলে তৈরী হয়েছে, পঞ্চভূত। পঞ্চভূতের পাঁচ রকম গুন্। আবার করুর একটা গুন্ তো কারুর পাঁচটি গুন্। আকাশের একটা গুন্ শব্দ, আর পৃথিবীর পাঁচটি গুন্ - শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ।
শিষ্য বলছেন, এগুলো তো তত্ত্ব কথা, কিন্তু কিভাবে এর প্রতক্ষ্য অনুভব হতে পারে ? আমরা তো চোখের সামনে সবাইকে আলাদা আলাদাই দেখছি। আমারদের দেখা কি তাহলে সত্য নয় ?
এই কথা শুনে , গুরুদেব হাতে একটা গ্যান্ধা ফুল নিলেন। বললেন, দেখো এটা একটা গ্যান্ধা ফুল। এই ফুলের মধ্যেই সমস্ত ফুল আছে। দেখো, একে আমি গোপাল ফুল বানিয়ে দিচ্ছি। বলে, গ্যান্ধা ফুলটিকে হাতের মধ্যে নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে, হাতটি খুললেন,, এবং দেখা গেলো, গ্যান্ধা ফুলটি গোলাপ ফুলে রূপান্তরিত হয়ে গেলো। এর পরে আবার গোপাল ফুলটিকে হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে আবার নাড়াচাড়া করে, এটিকে জবা ফুলে পরিণত করে দিলেন। এর পর বললেন, সমস্ত বস্তুর ভিতরই সমস্ত বস্তু অল্পবিস্তর আছে। এবং এইসকল পরমাণুর আবির্ভাব এবং ত্যাগই সৃষ্টি-প্রকরণের প্রধান সহায়ক, যাতে একবস্তু থেকে অন্য বস্তুতে রূপান্তরিত হতে পারে। । সব কিছুর মধ্যে সমস্ত সত্ত্বা থাকলেও যে বস্তুর অংশ অধিক থাকে তার গুন্ ও ক্রিয়া তদ্রুপ অভিব্যক্ত হয়। এবং একটা বিশেষ রূপে প্রকাশ প্রাপ্ত হয়।
দেখো একজন সাধুকে অসাধুতে পরিণত করা যায়, আবার একজন অসাধুকে সাধুতে পরিণত করা যায়। কেবল তার মধ্যে গুনের তারতম্য ঘটিয়ে এই কাজ করা যেতে পারে। আর একেই বলে সূর্যবিজ্ঞান।
শিষ্য মনে মনে ভাবছেন, দেখলাম তো চোখের সামনে, গ্যান্ধা ফুল থেকে গোলাপ হলো, আবার গোলাপ থেকে জবাফুল হলো, কিন্তু হলো কিভাবে ? মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগ্রত হলো। ভাবলেন, সূর্য্যরশ্মির প্রভাবে ফুলের রঙ হয়। এটা আমরা শুনেছি। এই সূর্য্যরশ্মির প্রভাবেই কি তাহলে ফুলের আকৃতি ও গন্ধ উৎপাদন হয়ে থেকে ? তাহলে সূর্য্যরশ্মির বিশিষ্ট প্রক্রিয়ামূলক সংঘটন অর্থাৎ মিলন-বিচ্ছেদ প্রক্রিয়ার সাহায্যে এই বস্তু উৎপন্ন, বা পরিবর্তিত রূপ পরিগ্রহ করতে পারে ! কিন্তু এই রশ্মিগুলোকে কিভাবেই বা আলাদা করা যায় ? সূর্য্যরশ্মি গুলোর আলাদা রঙ আছে এর মধ্যে শ্বেতবর্ণ প্রধান। তাহলেই এই সাদা রংটাই কি বিশুদ্ধ সত্ত্ব। এই সাদা রঙের উপরে প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন রঙের রশ্মির উদ্ভাবন এবং সংযোজন করার পরেই এইসব বস্তুর আবির্ভাব হয়ে থাকে ?
কিন্তু এই রশ্মিগুলোকে কিভাবে পৃথক করা যায়, সেই বিদ্যা আমার জানা নেই। প্রত্যেক বস্তুর ভিতরে প্রত্যেক বস্তুর আবির্ভাব হয়, এটা না হয় মেনে নেওয়া গেলো, কিন্তু এর মধ্যে যে অনু পরমাণু আছে, তার গতি প্রকৃতি কোন নিয়মের দ্বারা পরিচালিত হয় ?
শিষ্য গুরুদেবকে জিজ্ঞেস করলেন, প্রত্যেক জিনিসের মধ্যে কিছু ভূত প্রবল আবার কিছু ভূত দুর্ব্বল থাকে, অর্থাৎ কোনো গুনের আধিক্য, কোনো গুনের স্বল্পতা বর্তমান । কিন্তু যদি মূল ভূত কম-বেশি না থাকে, অর্থাৎ সমস্ত গুন্ বা বস্তু যদি সমান ভাবে থাকে তবে কি হয় ?
গুরুদেব বললেন, সমস্ত মূলবস্তুর বা গুনের সমাহার যদি সমপরিমাণ হয়, তবে সেই বস্তু লয় প্রাপ্ত হয়। সৃষ্টি এবং সংহার পরম-সূক্ষ্ম অণুগুলোর খেলা বা বিচ্ছুরণ। তাই সূর্য্যরশ্মির দ্বারা এইসব অণুগুলোর পরিচয় পাওয়া যায়। রশ্মি হচ্ছে ব্যঞ্জক অর্থাৎ যা রাঙিয়ে তোলে, আর অনু হচ্ছে ব্যঞ্জ অর্থাৎ যাকে রাঙিয়ে তোলে। এই রশ্মি বা ব্যাঞ্জকের আকর্ষনেই ব্যঞ্জ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে বা আবির্ভাব ঘটে। এই যে ব্যঞ্জকবর্ণের মিশ্রণ ক্রিয়া এর আলাদা আলাদা সূত্র আছে।
জ্ঞানের উন্মেষ দ্বারা বিশেষ ক্রিয়ার মাধ্যমে এইসব উপাদানকে আকর্ষণ করতে হয়। বিজ্ঞান প্রত্যেক বস্তুকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে, তাকে টুকরো টুকরো করে থাকে। আবার আকর্ষণ বিদ্যা দ্বারা একত্রীকরণ করতে হয়। এর মধ্যে একটা রহস্যঃ হচ্ছে, যতই আকর্ষণ করা হোক না কেন, মূল রশ্মি কিন্তু আকর্ষিত হয় না, যতক্ষণ না সেই বস্তু বাহ্য দৃষ্টিতে সেই বস্তুর অভ্যাস পাওয়া যায়। মূলরশ্মি বা অন্তিম রশ্মির আবির্ভাবের সাথে সাথে রশ্মির ব্যঞ্জ উপাদানের আবির্ভাব হয়ে যায় এবং সেই বস্তু তখন সবার দৃষ্টিগোচর হয়। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার। অন্তিম রশ্মিকে ছেড়ে শেষ রশ্মির স্থিতি দীর্ঘকাল রাখতে পারা যায়। অন্যদিকে প্রয়োজন অনুসারে এক রশ্মির প্রভাবেই সেই বস্তুর আবির্ভাব বা দৃষ্টিগোচর হয়। এই বস্তু কল্পিত নয় বরং এই বস্তু শুদ্ধ। তাই এই বস্তু জাগতিক বস্তুর চেয়েও অধিক নির্মল ও স্থায়ী রূপে বিদ্যমান থাকে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রশ্মির সংযোগ কিভাবে সম্ভব হতে পারে ? কারন প্রত্যেকটি রশ্মি ক্ষনিকের জন্য প্রকট হয়ে, আবার লীন হয়ে যাচ্ছে। তো রশ্মির স্থায়িত্ত্ব নিতান্ত ক্ষনিকের জন্য হয়ে থাকে। তো এই স্বল্প সময়ের জন্য রশ্মিকে অনুর সঙ্গে যুক্ত করা কিভাবে সম্ভব ? এই ব্যাপারটা রহস্যে ভরা। গুরুদেব বলছেন, দেখো, সমস্ত রশ্মির মধ্যেই এক বিশুদ্ধ শুভ্র কিরণমালা থাকে। আর এই কিরনের মধ্যে আছে তীব্র আকর্ষণশক্তি। আগেই বলেছি, সৃষ্টিতে রশ্মিতে শুভ্র শক্তির স্ফূরণ থাকে না। সমস্ত সৃষ্টির পৃষ্ঠভূমিতে থাকে এই শুভ্র শক্তি। যেন একটা সাদা কাগজ, যাতে সমস্ত ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এখানে এই সাদা বা শুভ্র কাগজ ছবি নয়, কিন্তু ওই সাদা কাগজ ভিন্ন ছবি দৃশ্যমান থাকে না। তেমনি সৃষ্টিতে শুভ্র শক্তির স্ফূরণ থাকে না অথচ সৃষ্টির পৃষ্ঠভূমি হচ্ছে এই শুভ্রশক্তি। কিন্তু বিজ্ঞানবিদ খণ্ডরূপে তা প্রকটিত করতে পারেন। এবং এর স্থিতিকালকেও বজায় রাখতে পারেন। এই রশ্মির সাথে কোনো কিছুর বিরোধ নেই, তার কারন হচ্ছে রশ্মি হচ্ছে স্নিগ্ধ ও স্বচ্ছ। সুতরাং শুভ্র রশ্মির উপরে যে কোনো রশ্মির প্রতিফলন সম্ভব, এবং অন্যান্য রশ্মিও আকৃষ্ট হয়ে এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায় অর্থাৎ এর তিরোধান ঘটে না ।
এইভাবে, ক্রমানুসারে, দ্বিতীয় রশ্মি এর সাথে আকর্ষণ শক্তির সাহায্যে মিলন ঘটে থাকে। এইরূপে রশ্মির মহামিলন ঘটে। একই ভাবে, তৃতীয় রশ্মি, চতুর্থ রশ্মি বা পঞ্চম রশ্মি-গুলোও একই ভাবে সংযোগ সাধন করে থাকে। সংযোগ সাধন অর্থাৎ ব্যঞ্জনের উপাদান সংযোগ সাধিত হয়। যখন অন্তিম উপাদান সংযোগ সাধন হয়, তখনই দ্রব্যের আবির্ভাব ঘটে। এই হচ্ছে সৃষ্টির রহস্যঃ। শেষে গুরুদেব বলছেন, অনুলোম ও বিলোম এই দুই প্রকার রশ্মি অর্থাৎ সূর্য ও চন্দ্র নাড়ীর ক্রিয়া সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। দেখো, সূর্য্যবিজ্ঞানই সৃষ্টি তত্ত্বের মূল। সূর্য্যের নাম সবিতা অর্থাৎ প্রসবকারী রাখা হয়েছে। এইভাবে চন্দ্র বিজ্ঞান, বায়ুবিজ্ঞান, নক্ষত্র বিজ্ঞান, ক্ষণ বিজ্ঞান প্রভৃতি বিশেষ জ্ঞানের বিষয় পরিলক্ষিত হয়।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
সূর্যবিজ্ঞান - (৩) - কিরাত ধৌতি - দেহকে শূন্যে চালনা করা।
অনিমা সিদ্ধি সম্পর্কে : ঋষি পতঞ্জলি বলছেন,
কায়াকাশয়োঃ সম্মন্ধ -সংযমাৎ লঘু-তুল সমাপত্তেঃ চ আকাশ গমনম। (শ্লোক-৪২)
শরীর ও আকাশ এই দুটোর সন্মন্ধে সংযম করলে, শরীর তুলোর মতো হালকা অবস্থা প্রাপ্তি হয় আর আকাশ গমন সিদ্ধ হয়।
আবার অন্যদিকে গোপীনাথ কবিরাজ বলছেন, কিরাত ধৌতিতে ধাতস্থ হলে, আকাশগমন সিদ্ধি লাভ করা যায়। -সূর্যবিজ্ঞান পৃষ্ঠা -৪৭)
যোগবিভূতির কথা উঠতেই অনেকে বলে থাকেন, এগুলো বুজরুকি, বড়োজোর একে ম্যাজিক বলা যেতে পারে। এতে মানুষের কোনো উপকার হয় না। কথাগুলো সম্পূর্ণ সত্য না হলেও, আংশিক সত্য তো বটেই। তবে দেখুন, একে আপনি জাদুবিদ্যা বলুন, বা যোগবিদ্যা বলুন, একথা মানতেই হবে, এটাও এক ধরনের বিদ্যা, যা অনেক দিনের অনুশীলনের ফলে আয়ত্ত্ব করা সম্ভব। এখন এই বিদ্যা আপনি কিভাবে ব্যবহার করবেন, সেটা আপনার উপরে নির্ভর করছে। দেখুন, বুজরুকি মানুষকে ধোঁকা দেয়, ঠকায়। কিন্তু ম্যাজিক মানুষকে বিনোদন এনে দেয়। আপনি যদি এই বিদ্যা প্রয়োগে কাউকে ঠকান সেটি অন্যায়। কিন্তু এর দ্বারা যদি আপনি কারুর উপকার করতে পারেন, এমনকি বিনোদন দিতে পারেন, তবে সেটি মানুষের পক্ষে অবশ্য়ই ভালো বলতে হবে।
দেখুন, পতঞ্জলির যোগসূত্রে যে যোগবিভূতির কথা বলা আছে, তা কিন্তু মানুষকে বিভ্রান্ত করবার জন্য নয়, বা কাউকে ঠকানোর জন্য নয়, এমনকি এর ব্যবহার সম্পর্কে ঋষি পতঞ্জলি নিজেই নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছেন। এখন কথা হচ্ছে, যদি এগুলো নিষিদ্ধ বিদ্যা, তবে এর দরকার কি , বা এইসব বিদ্যার প্রচারের দরকার কি ? দেখুন পাহাড় খুব উঁচু জায়গা। তো এখানে বা পাহাড়ের উচ্চ শিখরে আপনি যদি পৌঁছতে চান, তবে পাহাড়ি রাস্তায় আপনাকে একবার উঁচুতে একবার নিচুতে যেতে হবে। পাহাড়ী রাস্তার এটাই ধরন। আপনাকে উঁচুতে উঠতে গেলে, সময়ে সময়ে আপনাকে নিচুতেও নামতে হবে। আপনি যদি বলেন, আমি নিচুতে যাবো না, তবে আপনার পাহাড়ের শিখরে ওঠা হবে না। ঠিক তেমনি, আধ্যাত্মিক জগতের উচ্চ শিখরে উঠতে গেলে, চড়াই-উৎরাই আছে। এই চড়াই -উৎরাই পথ ধরেই, আপনাকে এগুতে হবে। ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, সাধন জগৎ বড্ড কঠিন যাত্রা। এখানে নানান রকম, বাধা বিপত্তি পেরিয়ে, কঠিন অনুশীলনীর মাধ্যমে ধীরে ধীরে একটার পর স্তর পেরুতে হয়। এই কঠিন পথেই একসময়, সাধকের অজ্ঞাতসারেই তার মধ্যে বিভিন্ন বিভূতির প্রকাশ ঘটে থাকে। কিন্তু ঋষি পতঞ্জলি, সতর্ক করে বলছেন, এগুলো থেকে সাধককে মুখ ঘুরিয়ে রাখতে হবে। তবেই লক্ষে পৌঁছনো যাবে। কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ মানুষ, এই বিভূতি প্রদর্শনকে মহাত্মাদের মাপকাঠি হিসেবে গণ্য করে থাকি। তাই এইসব নিয়ে আমাদের মধ্যে এতো আলোচনা। আসলে, সত্যিকারের সাধকের মধ্যে এই নিয়ে কোনো মাথা-ব্যাথা নেই। তারা এইসব বিভূতির প্রয়োগ সাধারণত করেন না। আর কেউ যদি এই বিভূতিকে প্রয়োগ করে, কিছু জাগতিক লাভ কুড়ুতে চান, তবে তার জন্য সাধন জগতের দ্বার বন্ধ হয়ে যায়। তাই বিভূতি প্রদর্শন সাধকের কাজ নয়, কিন্তু অনেকসময় এই তারমধ্যে এই বিভূতির প্রকাশ স্বতস্ফূর্ত ভাবেই ঘটে থাকে। কিন্তু তিনি এসবকে অগ্রাহ্য করে সাধন পথে এগিয়ে যান।
আসলে আত্মজ্ঞানের উন্মেষ না হলে, কখনোই যোগবিভূতির প্রকাশ হয় না। সুরেশ্বরাচার্য্য বলছেন, পুরুষ ধাবমান হলে যেমন তার ছায়া তাকে অনুসরণ করে, ঠিক তেমনি আত্মা বা ঈশ্বরের স্বরূপ উপলব্ধি হলে যোগ-ঐশর্য্য তার স্বাভাবিক ভাবেই প্রকটিত হয়। এর জন্য তাকে আলাদা করে কোনো প্রয়াস করতে হয় না। আসলে যোগৈশ্বর্য্যের আত্মা ভিন্ন কোনো অস্তিত্ত্ব নেই। যোগৈশ্বর্য্যকে বলা হয় আত্মার ছায়া। আমরা জানি ব্রহ্মচর্য্যের সাহায্যে আমাদের বিন্দু শোধন ও স্থির হয়ে থাকে। এই বিন্দুই জীবদেহের সত্ত্ব। এই বিন্দু শুদ্ধ ও স্থির হলে, অর্থাৎ সাধনবলে দেহ যখন শুদ্ধ হয়, তখন সাধকের চিত্তশুদ্ধি ও ভূতসিদ্ধি আপনা থেকেই আয়ত্ত্ব হয়ে যায়।
আমরা আবার পুরানো কথায় ফিরে যাই, সাধক কি করে আকাশপথে গমন করতে পারেন। ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, শরীর ও আকাশ এই দুইয়ের সংযম থেকে শরীরের তুলোর মতো হালকা অবস্থা প্রাপ্তি হয়। আর এতে করে আকাশ গমন সিদ্ধ হয়। এখন কথা হচ্ছে, সংযম বলতে ঋষি পতঞ্জলি কি বলতে চেয়েছেন ? ঋষি বিভূতিপদে ৪ নং শ্লোকে বলছেন, "ত্রয়মেকত্র সংযমঃ" . তিনটিকে একত্র করলে সংযম হয়। এই তিনটি হচ্ছে ধারণা, ধ্যান ও সমাধি - এই তিনটিকে একটি মাত্র বিষয়ে যুক্ত করতে পাড়লে সংযম হতে পারে। এই তিনটি বিষয় নিয়ে আমরা আগে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। চিত্তকে নিরালম্ব করবার জন্য, যে সব অভ্যাস ও চেষ্টা তার দ্বারা সাধক সম্প্রজ্ঞাত অবস্থা লাভ করে থাকেন। এই অবস্থায় সাধকের চিত্ত সংযমী হয়ে ওঠে। আর চিত্ত সংযমী হয়ে উঠলে, সাধকের মধ্যে কতকগুলো সিদ্ধি বা ঐশ্বর্যের উন্মেষ হতে দেখা যায়। তো প্রথমে আমাদের সংযমী হতে হবে, তবেই আমরা এইসব ঐশ্বর্যের অধিকারী হতে পারবো।
এবার আমরা গোপীনাথ কবিরাজের কথায় আসবো। তবে তার আগে দুটো কথা শুনে নেই।
আপনারা নাসাপান কথা হয়তো অনেকেই শুনেছেন। নাসাপান হচ্ছে, নাক দিয়ে জল পান করা। আবার মুখ দিয়ে সেই জল বের করে দেওয়া। আমাদের নাসামুলে যে ইড়া পিঙ্গলা ও সুষুম্নার মিলন স্থান আছে, সেখানে শ্লেষা সঞ্চিত হলে, এই তিন নাড়ীর ক্রিয়ার ব্যাঘাত উপস্থিত হয়। এতে করে অনেক সময় আমাদের নাক বন্ধ হয়ে আসে, এবং তখন আমরা মুখ দিয়ে স্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া করে থাকি। মুখ দ্বারা শ্বাস গ্রহণ করলে আমাদের ফুসফুসে ঠান্ডা লেগে, বিবিধ রোগের সৃষ্টি হতে পারে। এইসব রোগ থেকে বাঁচার জন্য, নাসাপান আমাদের উপকার করতে পারে। এছাড়া আছে নেতিযোগ বা নেতিধৌতি। বারো আঙ্গুল পরিমান লম্বা একটা সরু সুতোকে নাকের ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করিয়ে তাকে মুখ দিয়ে বার করতে হয়। ঋষি ঘেড়োন্ড বলছেন, এই ক্রিয়ার ফলে একদিকে যেমন কাফদোষ দূর হয়, তেমনি দুব্যদৃষ্টি জন্মায় (শ্লোক-৫১) হঠযোগে একপ্রকার ধৌতি-কর্ম্মের কথা বলা হয়েছে। বলছেন, দৈর্ঘে পনেরো হাত, চওড়া ৪ আঙ্গুল, একটা পাতলা কাপড় নিন. তাকে জলে ভিজিয়ে ধীরে ধীরে গিলে ফেলবেন, আবার ধীরে ধীরে সেটিকে পেট থেকে টেনে বার করুন। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ নাভি-ধৌতির কথা শুনেছি। এই নাভি ধৌতি দীর্ঘকাল অভ্যাসের ফলে রপ্ত হতে পারে।
কিন্তু গোপীনাথ কবিরাজ বলছেন, কিরাত ধৌতির কথা। বলছেন, কিরাত ধৌতি আসলে নাভি ধৌতির উন্নত অবস্থা বিশেষ। কিরাত ধৌতি বছরের পর বছর কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমেই কেবলমাত্র রপ্ত হতে পারে।
কিরাত ধৌতি কিভাবে করবেন ? একটা মখমল বা অন্যপ্রকার শুদ্ধ বস্ত্রের ২৫/৩০ হাত দীর্ঘ খন্ড গলাদ্ধকরণ করে নাভি থেকে মুখ পর্যন্ত যথাবিধি অনুলোম বিলোম প্রণালীতে পুনঃ পুনঃ চালনা করতে হয়। এই ধৌতিক্রিয়ায় সাফল্য অর্জন করতে গেলে দীর্ঘকাল গুরুসান্নিধ্যে থেকে অভ্যাস করতে হয়।
ফলাফল : এই কিরাত ধৌতি ক্রিয়ায় যিনি অভ্যস্ত হন, তিনি আকাশ গমনের ক্ষমতা অর্জন করেন। গোপীনাথ কবিরাজ বলছেন, কুম্ভকের দ্বারাও শূন্যে ওঠা যায় বটে, তবে এতে সাধক অনেক সময় বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, এমনকি এইসময় তিনি কথাবার্তা বলতে পারেন না। এছাড়া, উর্দ্ধ বায়ু মন্ডলে চলার কালে, অনেক সময় প্রতিকূল বায়ুর প্রভাব সহ্য করতে পারেন না। ফলতঃ এই অবস্থায় পতনের ভয় থাকে। বলা হয়ে থাকে নাভি-ধৌতিতে পরিপক্কতা লাভ করলে দেহ শূন্যময় হয়ে যায়। তখন সমগ্র দেহ সংকুচিত ও প্রসারিত করবার ক্ষমতার জন্ম হয়। এমনকি লোমকূপের মতো অতিসূক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে বৃহৎ পদার্থ প্রবেশ করাতে পারা যায়। শরীরের যে কোনো অংশকে তখন নিজে মর্জি-মাফিক ক্ষুদ্র বা বৃহৎ করতে পারা যায়।
কিরাত ধৌতি দ্বারা দেহকে শুদ্ধ করে, দেহের কোনো অঙ্গে বায়ু পূর্ন করে রাখাকে বলে কিরাত-কুম্ভক। এই কিরাত-কুম্ভক দ্বারা শূন্যে উঠলে, তখন কথা বলতে কোনো বাধা থাকে না। এমনকি কথা বলতে বলতে শূন্যে ভ্রমন করা যায়। সাবাথেকে বিশেষ কথা হচ্ছে, এই সময় নিজের বাহ্যজ্ঞান থাকে কিন্তু বাহ্য বিষয়ে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ততা জন্মায়। অন্যের শরীরে প্রবেশ বা অন্য-শরীর ধারণ করবার পক্ষেও এই কিরাত-কুম্ভক অধিকতর উপযোগী। একবার কিরাত-কুম্ভক দ্বারা দেহকে শুদ্ধ করতে পারলে, এবং কিরাত কুম্ভকের দ্বারা দেহে বিশুদ্ধ বায়ু ভোরে নেওয়া যায়। আর তখন কোনো কিছুই তাকে অভিভূত করতে পারে না। এই সময় অতি শক্তিশালী তেজোরাশির দর্শন ও তার সংস্পর্শে এলেও সাধকের জ্ঞানের বিলোপ হয় না।
এই বিশেষ ক্রিয়া, নাভি-ধৌতি এবং কিরাত-কুম্ভক স্বয়ং ভৃগুরাম পরমহংসদেবের কাছ থেকে শিখেছিলেন। এবং দীর্ঘকাল অভ্যাসের ফলে এই ক্রিয়াতে তিনি রপ্ত হন। গোপীনাথ কবিরাজ এই বিদ্যা নাকি তার কৈশোরেই দাদাগুরুর কৃপায়, অর্থাৎ শ্রীযুক্ত ভৃগুরাম স্বামীর অযাচিত কৃপায় নাভি-ধৌতি ক্রিয়া আয়ত্ত্ব করতে পেরেছিলেন। তিনি আরো বলছেন, দেহকে ইচ্ছেমতো সংকুচিত ও প্রসারিত করতে পারলে, অনিমা মহিমা সিদ্ধি স্বাভাবিক হয়ে পরে। বাবাজি অর্থাৎ পরমহংস ভৃগুরাম আকাশমার্গেই যাতায়াত করতেন। তিনি কখনো ভূমি স্পর্শ করেন না। স্থূল দেহ নিয়ে সূর্যলোকে গমন করবার ক্ষমতা তার ছিল। তার ছিল সিদ্ধ দেহ। গোপীনাথ কবিরাজের গুরুদেব, বিশুদ্ধানন্দ পরমহংস এই কিরাত-যোগের অভ্যাস দ্বারা শরীরের লোমকূপের মধ্যে স্ফটিকের খন্ড রেখে দিতেন। তাঁর মাথার মধ্যে বাণলিঙ্গ শালগ্রামশীলা বৃহৎ স্ফাটিকের মালা সাজানো থাকতো। এসব কবিরাজ মহাশয় নিজর চোখে দেখেছেন। এইসব অলৌকিক কান্ড-কারখানার কথা আমরা গোপীনাথ কবিরাজের কাছে আরো শুনবো। শুধু ঘটনার বিবরণ নয়, এই সব অদ্ভুত কার্যকলাপের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও আমরা তাঁর কাছ থেকে শুনবো। তবে শেষ করবার আগে, আমরা আবার বলি, অলৌকিক বলে কিছু হয় না। সমস্ত ঘটনার আগে, তার কারন-ঘটনার জন্ম হয়েছে। আমরা সেই সাবকারন ঘটনার কথাও শুনবো। অর্থাৎ এই সব অবিশ্বাস্য ঘটনার কার্য্য-কারন ব্যাখ্যা শুনবো। তবে একটা কথা বলি, এই গুহ্যবিদ্যা হাজার হাজার বই পড়ে কিন্তু আয়ত্ত্ব করা জয় না। এসব আয়ত্ত্ব করতে গেলে, নিজেকে এই ক্রিয়ার অনুশীলনীর মধ্যে নিয়োগ করতে হবে। আর তা করতে হবে, একজন যোগ্য গুরুর সান্নিধ্যে। তবেই এইসব বিদ্যার সুফল পাওয়া যেতে পারে।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
সূর্য বিজ্ঞান : ৪ : যোগবিভূতির প্রসঙ্গে
যোগ বিভূতি সম্পর্কে আমাদের অনেকে রকম শুনে থাকি। ভাগ্যক্রমে কেউ কেউ হয়তো দেখেও থাকতে পারি। কিন্তু অবস্থায় যে কিভাবে পৌঁছানো যায়, সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। এমনকি এই বিদ্যার যারা সমালোচক, তারাও এই বিদ্যা সম্পর্কে কিচুই জানেন না, একথা হলফ করে বলা যায়। আবার আমাদের অনেকে, এই সব বিদ্যা যে থাকতে পারে, সেই সম্পর্কেও সন্দেহ প্রকাশ করে থাকেন। কিন্তু আমাদের মতো সাধারণের যাদের যোগবিভূতি সম্পর্কে কোনো প্রতক্ষ্য অভিজ্ঞতা নেই, তাদের মধ্যে যোগবিভূতির প্রসঙ্গে আলোচনা কালে, দুটো প্রশ্ন মনের মধ্যে জেগে ওঠে।
১. যোগবিভূতি দ্বারা যদি সমস্ত জাগতিক বস্তুর সৃষ্টি করা যেতে পারে, তবে মানুষের অভাব মোচনের জন্য, এই যোগবিভূতির ব্যবহার কেন করা হয় না ? মানুষের তো এতো অভাব, যোগের দ্বারা যদি, এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব, তবে মানুষ কেন যোগবিদ্যালয় স্থাপন করে যোগের শিক্ষা চালু করা যেতে পারে। তা কেন করা হচ্ছে না।
তপোভূমি নর্মদা গ্রন্থে পড়েছি, লেখক যখন নর্মদা পরিক্রমা করতে করতে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় ক্লান্ত, তখন মা নর্মদার পুণ্যতোয়া জলে তৃষ্ণা নিবারণ করতেন। আর মহাত্মার কৃপায়, নর্মদার জলে ভেসে আসতো লুচি, মিষ্টি। অথবা নির্জন অরণ্যের মধ্যে মন্দিরে বাসকালীন এসে স্থানীয় কেউ না কেউ তাঁদের খাবারের যোগান দিতেন। আর তা খেয়ে তিনি শারীরিক ক্ষুধা মেটাতেন। অনেক সাধু মহাত্মাদের ভান্ডারায় খাদ্যসামগ্রী কখনো শেষ হতো না, যতক্ষন অতিথি সমাগম হতো। শিরডির সাঁইবাবার এই অপূর্ব লীলা আমরা বইতে পড়েছি। এমনকি এমন অনেক গল্প-কাহিনী লোকের মুখে মুখে ফেরে। এইসব সাধু-মহাত্মাগণ বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন সামগ্রী, এমনকি সোনাদানা দান করতেন, তাঁদের পছন্দমত শিষ্যদেরকে এই অলৌকিক ক্ষমতাবলে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যাঁরা এইসব অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হতেন, বা ছিলেন, তাঁরাও কিন্তু দানসামগ্রী গ্রহণ করতেন, এমনকি আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করতে ভুলে যেতেন না। আবার অকাতরে সবাইকে এই বিভূতিলদ্ধ সামগ্রী দানও করতেন না। তাহলে রহস্যটা কি ?
ঠাকুর রামকৃষ্ণের কাছে, কেউ একজন এসে বলছিলো, অমুক সাধু জলের উপরে দিয়ে হেটে গঙ্গা পার হয়ে যেতে পারে। তো ঠাকুর তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এই বিদ্যা আয়ত্ত্ব করতে কতদিন লেগেছে ? তো তিনি বললেন, সারা জীবন ধরেই তিনি এই বিদ্যার চর্চা করছেন। ঠাকুর আবার বললেন, দেখো, যেখানে দু পয়সায় গঙ্গা পার হওয়া যায়, সেখানে সারা জীবন লেগেছে, তার এই বিদ্যালাভ করতে। আমি তো দু পয়সায় গঙ্গা পার হয়ে যাই।
আরো একটা গল্প, মহাত্মা বিশুদ্ধানন্দজী এই ধরনের অনেক অলৌকিক ঘটনা তার শিষ্যদের কাছে, উপস্থিত করতেন। তিনি যেন একটা ল্যাব, যেখানে সমস্ত যোগবিদ্যার প্রতক্ষ্য প্রয়োগ দেখা যেতো। তো মা আনন্দময়ী এইসব দেখে তাকে বলেছিলেন, তুমি এইসব কি ছেলেমানুষি করছো ? আমি কিন্তু সব বুঝতে পারছি। এসব করে কি লাভ, তার চেয়ে, তোমার মধ্যে যে আসল বস্তুটি আছে, তা তুমি এদেরকে দাও। একথা শুনে বিশুদ্ধানন্দজী শুনে চুপ হয়ে গেছিলেন, আর অস্ফুট স্বরে বলেছিলেন, কেই বা
নেয় ?
২. শুনেছি, এই যোগৈশ্বর্য্য অকারনে এমনকি পার্থিব বস্তু লাভের জন্য, ব্যবহার করা উচিত নয়। তো এইসব মহাত্মাগণ তাহলে, নিতান্ত মানুষকে চমকে দেবার জন্য, অথবা নিজের ক্ষমতা জাহির করবার জন্য, কেন এই সব যোগবিভূতির ক্ষমতা প্রদর্শন করে থাকেন ? এতে তাঁদের সাধনার কোনো বিঘ্ন ঘটে কি না। আরো একটা কথা হচ্ছে, যোগবিভূতি স্বতঃস্ফূর্ত হওয়ার কথা, এখানেও কি তাহলে ইচ্ছেশক্তি কাজ করে থাকে ? কারন ইচ্ছেশক্তির সাহায্যে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করা যায় - এটা আমাদের অনেকের প্রতক্ষ্য অভিজ্ঞতা।
আমরা এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো পরবর্তীতে।
গোপীনাথ কবিরাজ একবার এই দ্বিতীয় ধরনের একটা প্রশ্ন করেছিলেন, তার গুরুদেবকে। বলেছিলেন, "যোগীদের নিজের নিজের শক্তি বা যোগবিভূতি বাইরে প্রকাশ করা উচিত কি না। " তাতে করে গুরুদেব যে জবাব দিয়েছিলেন, তা আমরা আমাদের মতো করে বোঝার চেষ্টা করবো।
দেখো, যারা শিক্ষার্থী এবং যোগরাজ্যে সবেমাত্র নতুন প্রবেশ করেছে, তাদের পক্ষে যোগশক্তি বা যোগবিভূতি প্রদর্শন করা হানিকর। কারন এতে আসক্তি এবং অহংকার বৃদ্ধি পেতে পারে, এমনকি অতি নিকটতম ব্যক্তিকেও এইসব কথা বলতে নেই। তাদের এমন ভাবে থাকা উচিত, যাতে অন্যকেউ তার যোগবিভূতির কথা বুঝতে না পারে। সুতরাং যথাসম্ভব যোগবিভূতি বা যোগ সম্পত্তি গুপ্ত রাখাই ভালো।
তবে যিনি সিদ্ধ যোগী, যিনি অধিকারী, যিনি সামর্থবান, যিনি ঈশ্বরের মহাকৃপা লাভ করেছেন, তার জন্য কোনো নিয়ম নেই। কারন, তাঁর অহংকার লোপ পেয়েছে, তাঁর অহংকার হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। তিনি নিজের জন্য এই শক্তি ব্যবহার করেন না, করার প্রয়োজনও নেই। কেননা তিনি পরমপিতার মহা করুনা প্রাপ্ত হয়ে সমস্ত ভূতকে জয়লাভ করেছেনতাঁর অতৃপ্তি বলে কিছু অবশিষ্ট নেই।
তোমরা যাকে বলছো, জাহির করা, অর্থাৎ নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন, এই উদ্দেশ্যে এই ধরনের যোগবিভূতি প্রকাশ করা হয় না। তাহলে কেন এই যোগবিভূতি, যাকে ঋষি পতঞ্জলি নিষিদ্ধ করেছেন, তা সর্বসমক্ষে প্রকাশ করা হচ্ছে ?। ঋষি পতঞ্জলি বলেছেন, এই ক্ষমতা স্বাভাবিক ভাবে যোগীর মধ্যে আসবে, কিন্তু এই ক্ষমতা প্রয়োগে, যোগীর ঈশ্বরপ্রাপ্তির বাধা সৃষ্টি হবে। তাই এইসব ক্ষমতাকে উপেক্ষা করতে হবে।
তথাপি, কোনো কোনো যোগীপুরুষ এই ক্ষমতার প্রদর্শন করে থাকেন। এর কারন হচ্ছে, সত্যিকারের জিজ্ঞাসুর মধ্যে বিশ্বাস জাগিয়ে তোলা। দেখো, তোমার মধ্যে যদি বিশ্বাস না জাগে, তবে তুমি অনুসন্ধান কর্ম্মে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে পারবে না। ঈশ্বর আছেন, এই বিশ্বাস যার মধ্যে জাগ্রত হয়েছে, সে-ই ঈশ্বরের সন্ধানে সংসার ছেড়ে পাহাড়ে, জঙ্গলে, নির্জনে ঈশ্বরের সন্ধানে ঘুরে ফিরে মরে। যার মধ্যে ঈশ্বরে বিশ্বাস জাগ্রত হয়নি, সে কখনো সংসারের সুখ-স্বচ্ছন্দ ছেড়ে মরীচিকার পিছনে ধাবিত হতে পারে না। ঈশ্বর যে তোমার মধ্যে আছেন, সমস্ত ঐশ্বরিক ক্ষমতা যে তোমার মধ্যেই আছে, একমাত্র যোগীপুরুষের মধ্যে আছে, মানুষের মধ্যে আছে, মানুষ যোগের অনুশীলনীতে নিজেকে যোগ্য করে নিতে পারে, এই বিশ্বাস দৃঢ় করবার জন্য, যোগ্য জিজ্ঞাসুকেই কেবলমাত্র এই যোগবিদ্যার প্রয়োগ প্রদর্শন করা হয়ে থাকে। এই রহস্যঃ কখনো বাক্যের সাহায্যে যথাযথভাবে বোঝানো যায় না। বস্তুর রহস্যঃ, বস্তুর তত্ত্ব বুঝতে গেলে, সংযম পালন করতে হয়। অর্থাৎ ধারণা-ধ্যান-সমাধিতে সিদ্ধ হতে হয়। দেহকে শুদ্ধ করতে হয়, মনকে পবিত্র করতে হয়। তাই বলছি, প্রথম প্রবেশার্থী, এবং যাকে যোগ্য অধিকারী বলে মনে হয়, একমাত্র তাকেই এই যোগবিভূতি প্রদর্শন করা হয়ে থাকে। দেখো, তুমি যাকে বা যে কাজকে অসম্ভব বলে বিবেচিত করবে, তা কখনোই তোমার কাছে সম্ভব হতে পারে না। তুমি যদি মনে করো, স্রোতস্বীনি গঙ্গা তুমি সাঁতার দিয়ে পার হতে পারবে না, তবে তুমি কখনোই এই কাজ করতে যাবে না। কিন্তু যদি তোমার মধ্যে যদি বিশ্বাস থাকে যে আমি ভালো সাঁতার কাটতে পারি, আমি অবশ্য়ই গঙ্গা পেরুতে পারবো, তবে তুমি আজ না হলেও কাল অবশ্য়ই গঙ্গা পার হতে পারবে। আবার তোমার মধ্যে যখন বিদ্যাসাগরের মতো মায়ের ডাক শুনতে পাবে, তখন উত্তাল দামোদর পার হবার প্রবল ইচ্ছেশক্তি তোমাকে উন্মত্তবৎ করে দেবে। আর তুমি হয়তো পার হয়েও যাবে।
দেখো সিদ্ধ যোগীর কাছে, অসম্ভব বলে কিছু হয় না। শক্তির অধীনে সবকিছু। তাই শক্তি আয়ত্তে থাকলে সব কিছু হতে পারে। যা অন্যের কাছে অঘটন, অলৌকিক, অবাস্তব, তা যোগীপুরুষের কাছে বাস্তব সত্য। আর এই যোগমার্গে উন্নতিলাভ করতে গেলে, দরকার শ্রদ্ধা, ভক্তি, বিশ্বাস, সরলতা। এরপরে নিরন্তর অভ্যাস, ধৈর্য্য। গুরুর প্রতি যখন তোমার শ্রদ্ধা - বিশ্বাস জাগবে, তখন তার কথায় তুমি অবশ্য়ই প্রানপন শক্তি প্রয়োগে কর্ম্মে লিপ্ত হবে। আর যদি শ্রদ্ধা, ভক্তি বিশ্বাস না থাকে তবে দ্বন্দ্বের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলবে। আর হতাশ হয়ে তুমি একদিন কর্ম্মে বিরতি টানবে। কিন্তু অটল বিশ্বাস যখন তোমার মনের মধ্যে জাগ্রত থাকবে তখন তোমাকে কেউ কিছুতেই কর্ম্ম থেকে সরিয়ে রাখতে পারবে না।
দেখো গাছ লাগালে ফল হয়, এটা তুমি শুনেছ, বা দেখেছো। যদি তুমি শুধু কথাটা শুনে থাকো, তাহলেও তোমার মধ্যে সামান্যতম হলেও অবিশ্বাস থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু যদি তুমি দেখে থাকো, তবে তোমার মধ্যে কখনো সন্দেহ দানা বাঁধতে পারবে না।
তাই আমরা যোগ্য অধিকারী, পেলে যোগ্য পাত্র পেলে, তাকে একটু আধটু যোগবিভূতি দেখিয়ে তাকে আকৃষ্ট করতে চাই। বিদ্যা দানের পরম্পরা না থাকলে যে বিদ্যা হারিয়ে যায়। বিদ্যা-দানের মধ্য দিয়েই, বিদ্যাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়।
--------------------------
৭.১১.২০২১
আমাদের প্রথম প্রশ্ন ছিলো, যোগবিভূতির দ্বারা যদি সমস্ত দ্রব্য বা বস্তু তৈরি করা যায়, তবে মানুষের বৈষয়িক চাহিদা মেটানোর জন্য, এই প্রক্রিয়ার সাহায্য কেন নেওয়া হচ্ছে না ? যোগবিভূতি দ্বারা যদি সমস্ত জাগতিক বস্তুর সৃষ্টি করা যেতে পারে, তবে মানুষের অভাব মোচনের জন্য, এই যোগবিভূতি-বিদ্যার ব্যবহার কেন করা হয় না ?
দেখুন এই ব্যাপারটা বুঝতে গেলে, আমাদের আগে বুঝতে হবে, যোগীর বা সাধকের মধ্যে কখন যোগ বিভূতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ হয়ে থাকে। অর্থাৎ কখন যোগী এ যোগৈশ্বর্য্যের অধিকারী হন ? এর উত্তর শুনবার আগে, আরো দুটি প্রাক-কথা আমরা একটু ধৈৰ্য্যধরে শুনে নেই। দেখুন যোগবিভূতির জন্য, আলাদা করে করে সাধন পদ্ধতির নির্দেশ বা পথ নেই। যোগবিভূতির প্রকাশ তখনই সাধকের মধ্যে হয়, যখন তিনি সমাধিতে সিদ্ধি লাভ করেন। আবার এই সাধক যখন কৈবল্য লাভের উপযুক্ত হয়ে ওঠেন, তখন তার মধ্যে এই যোগৈশ্বর্য্যের বিলোপ সাধন হয়ে থাকে। তখন তার মধ্যে আর এই যোগ ঐশ্বর্যের প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় না। আর তার মধ্যে এমন কোনো ইচ্ছেরও উৎপত্তি হতে পারে না।
পাতঞ্জল-যোগদর্শনে যেসব যোগবিভূতির কথা বলা আছে, জানবেন তা সবই বিজ্ঞান সম্মত। এখন বিজ্ঞান বলছে, সমস্ত ঘটনার কারন আছে। কারন ভিন্ন কিছুই হয় না। আবার কারনেও কারন আছে। কিন্তু যোগীর কার্যের ভিতরে কারণের সন্ধান পাওয়া যায় না। আসলে যে কারনের জন্য, বা যে মূল সত্তার জন্য সমস্ত ঘটনা ঘটে থাকে বা বস্তুর প্রাদুর্ভাব ঘটে থাকে, তা যোগীর আয়ত্তাধীন। যে শক্তির বলে সমস্ত কার্য্য-উৎপাদন করতে পারা যায়, তা যোগীর আত্ম-ভাবের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত। যোগে পূর্ন-আত্মাতে স্বাত্মভাব প্রতিষ্ঠিত থাকে বলে, ইচ্ছামাত্রই কার্য্যের উৎপাদন হয়ে থাকে, এখানে উপাদানের অপেক্ষা থাকে না। যোগীর কাছে অপ্রাপ্ত বস্তু বলে কিছু নেই। আবার উপাদেয়ও কিছু নেই।
দেখুন, মানুষের দেহের মধ্যে যা কিছু আছে, তার সৃষ্টি কর্তা সে নিজেই। আমরাই আমাদের দেহের সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু কিভাবে সৃষ্টি করছি ? শূন্য থেকে কিছুই সৃষ্টি হচ্ছে না। উপাদান থেকে উৎপাদন করছি। খাদ্য, পানীয়, বাতাস, সূর্যালোক থেকে আমরা জীবাণুশক্তি সংগ্রহ করছি। এই পরিবেশ থেকেই আমাদের শরীরে রক্ত, কোষ, স্নায়ুশক্তি তৈরী হচ্ছে। আমরা নিজেরাই এই কাজ করছি। এই কাজ অন্য কেউ এসে করে দিয়ে যাচ্ছে না। আবার আমরা সবাই আমাদের প্রবণতা অনুযায়ী জ্ঞান সংগ্রহ করছি। একটি শিশুও এই কাজটি করছে। যোগীগণ বলছেন, আমরা আমাদের যে সূক্ষ্ম দেহ আছে, তার যে অনু-পরমাণু আছে, তা বদলে ফেলে, আমরা নতুন আমি হয়ে যেতে পারি। যোগীগণ এইকাজটি জ্ঞাতসারে করছেন। আর আমাদের মতো সাধন মানুষও এই কাজ করছি, তা আমাদের জ্ঞাতসারে করি না। আমরা প্রতিদিন আমাদের শরীরে নতুন নতুন বস্তুকণা সৃষ্টি করছি। কিন্তু তা আমাদের জ্ঞাতসারে করি না বলে, আমরা এই পরিবর্তন আঁচ করতে পারি না। যদি আমরা এই কাজটি জ্ঞাতসারে করতে পারি, তবে আমরা আমাদের বিপুল ক্ষমতার কথা জানতে পারবো। আর এই পরিবর্তন তখন আমাদের ইচ্ছে অনুযায়ী করতে পারবো। যোগীদের ক্ষেত্রে তারা এই কাজটি জ্ঞাতসারে করেন বলে, তারা জীবনকে এমনকি শরীরকে ইচ্ছেমতো পরিচালনা করতে পারেন। যতদিন ইচ্ছে ততদিন বেঁচে থাকতে পারেন। আবার সজ্ঞানে শরীরে ছেড়ে চলে যেতে পারেন। আমরা আমাদের চারপাশ থেকে বস্তু কনা সংগ্রহ করে, যা চাই তাই তৈরী করে নিতে পারি। একটা জিনিস জানবেন, চিন্তার দ্বারা সব অবস্থার রূপান্তর ঘটানো সম্ভব। চিন্তাগুলিও বস্তু, তাদের বাস্তব সত্তা আছে।
ঋষি পাতঞ্জল বলছেন, (বিভূতিপাদ- শ্লোক-৪৪)
"স্থুল-স্বরূপ-সূক্ষ্ম-অন্বয়-অর্থবত্ত্ব-সংযমাৎ-ভূত-জয়।"
পৃথিবী আদির স্থুলতা, স্বরূপতা, সূক্ষ্মতা, অন্বয়িতা ও অর্থবত্ত্বা এই পাঁচরূপ বিশিষ্ট স্থূল ভূতগুলোতে সংযম থেকে যোগীর ভূত-জয় হয়ে যায়।
স্থুল অর্থাৎ দৃশ্যমান রূপ, স্বরূপ অর্থাৎ স্বাভাবিক গুন্, সূক্ষ্ম অর্থাৎ পরমাণু ও তন্মাত্র, অন্বয় অর্থাৎ সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ, এই তিন গুনের সাথে বস্তুর অন্বয় ; অর্থবত্ত্ব অর্থাৎ ভোগ প্রদান-সামর্থ।
ঋষি আবার পারে শ্লোকে বলছেন : (বিভূতিপাদ শ্লোক - ৪৫)
"ততঃ-অনিমাদি-প্রাদুর্ভাবঃ কায়সম্পৎ তদ্-ধর্ম-অনিভিঘাতঃ চ।"
ভূতজয়ে অনিমা ইত্যাদি অষ্টসিদ্ধি উৎপন্ন হয়। কায় সম্পদ ও কায়ধর্মের বাধাশূন্যতা সিদ্ধ হয়।
যোগের অভ্যাস করে সিদ্ধি লাভ করলে, বিভূতি আপনা থেকেই প্রকাশিত হয়ে থাকে। আগুন জ্বলে উঠলে যেমন তাপ বিকিরণ হতে থাকে। তেমনি সাধন পথে অগ্রসর হলে, সিদ্ধি আপনা থেকেই আসে।
এই সিদ্ধি কার না এসেছে ? ঠাকুর রামকৃষ্ণ থেকে শুরু করে, যীশুখ্রিষ্ট, গুরুনানক থেকে চৈতন্যদেব, গোরক্ষনাথ থেকে শঙ্করাচার্য্য সমস্ত মহাত্মার মধ্যেই এই অলৌকিক শক্তির স্ফূরণ দেখতে পাওয়া যায়।
একটা জিনিস জানবেন, আত্মসমর্পন না করতে পারলে, কোনো পদার্থেই স্থিতি লাভ করা যায় না। আমার, আপনার, সমস্ত জগতের যে উপাদান আছে, তা যেমন স্থুল আকারে আছে, তেমনি সূক্ষ্ম আকারে সমগ্র জগতে ছড়িয়ে আছে। আর তা যদি না থাকতো, তা হলে আমাদের কোনো স্থিতি বা অস্তিত্ত্বই থাকতো না। আমরা এই উপাদানগুলোকে আকর্ষণের মাধ্যমে ঘনীভূত আকারে আকৃতি ধারণ করেছি। আবার এই উপাদানের একসময় বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অর্থাৎ সাম্যাবস্থায় অবসান করবে। তখন আর আমাদের দৃষ্টিগোচর থাকবে না। এই আকারের অবলুপ্তি ঘটবে। এখন এই উপাদানগুলোর উপরে একাগ্রতা বা সমগ্রতা উৎপাদনের ক্ষমতা অর্জনই সিদ্ধি। অর্থাৎ পরমার্থ বা চৈতন্যের উপরে পূর্নতা লাভ। তাই বলা হয়ে থাকে বিক্ষিপ্ত চিত্ত আত্মসমর্পনে অধিকারী হতে পারে না। কিন্তু চিত্ত যখন স্থির হয়, তখন আত্মসমর্পনের অধিকারী হওয়া যায়। আত্মসমর্পনের অধিকারী ব্যক্তি চৈতন্যের মধ্যে পূর্নতা লাভ করে। এই অবস্থা লাভ হলে তার কোনো কিছুরই অভাব থাকে না। তার ইচ্ছামাত্রই সমস্ত বস্তুর আবির্ভাব হয়। আর কে না জানে ঈশ্বরের ইচ্ছেতেই সমগ্র জগতের সৃষ্টি। আর সেই ঈশ্বরের এক ক্ষুদ্র সংস্করণ হচ্ছে এই মানবজাতি, মানব শরীর । আবার মানব জাতির মধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশ হচ্ছেন আপনি। তাই বিশ্ব -ইচ্ছেশক্তির অংশ রয়েছে আমাদের সবার মধ্যে। তবে একটা কথা বলি, ইচ্ছে আর ইচ্ছেশক্তি এক নয়। ইচ্ছের সঙ্গে যখন ঈশ্বরের শক্তির সংযোগ ঘটে তখন তা ইচ্ছেশক্তি। নতুবা ইচ্ছে কেবল ইচ্ছেই থাকে।
..........................
১০.১১.২০২১
এখন কথা হচ্ছে, এই বিভূতির দ্বারা যে সব বস্তুর লাভ হয়, তা কি বাস্তবে সত্য, না আমাদের ভ্রম ? আসলে জগতে সব বস্তুই অনিত্য। সতত পরিবর্তনশীল বস্তুকে আমরা বাস্তবে নিত্য বস্তু বলে মনে করি। আর আমাদের চোখে যা জড়বস্তু জ্ঞানীর চোখে তা চৈতন্যস্বরূপ। শক্তি যখন খণ্ডিত তখন জড়-অনিত্য। আবার এই শক্তি যখন অখন্ড তখন তা নিত্য।
বিশ্বের সমস্ত বস্তু, দেহ বা শরীর, এই তন্মাত্রের সমষ্টি। আর এই বস্তুর মধ্যে ভেদের কারন হচ্ছে তন্মাত্রের বিন্যাসের তারতম্য। তন্মাত্র অর্থাৎ সূক্ষ্মতম কনা বা পরমাণু।
তন্মাত্র কথাটার অর্থ হচ্ছে, কেবলমাত্র সেই। সাঙ্খ্য দর্শনে বলাহচ্ছে সূক্ষ্ম অমিশ্র পঞ্চভূত। অর্থাৎ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম - এই পাঁচ ভূতের স্বাধীন স্থিতি স্থান হচ্ছে তন্মাত্র ।
ব্যাসভাষ্যে বলা হয়েছে,
"তন্মাত্রং ভূত কারনং, তস্যৈকোঽবয়বঃ পরমাণুঃ সামান্য বিশেষ আত্মাঽযুত
সিদ্ধ-অন্বয়ব-ভেদ অনুগতঃ সমুদয় ইতি, এবং সর্ব-তন্মাত্রাণি। "
তন্মাত্রা হচ্ছে পঞ্চভূতের কারন, এই তন্মাত্রা অবিভাজ্য বা একাবয়ব, এর সময়দয় অতি সামান্য, বিশেষ অর্থাৎ একমাত্র বস্তু যা নানা স্থানে স্থিত আবার শূন্য বলে বিবেচিত হয়। এবং অযুতসিদ্ধভেদের অনুগত। অযুত সিদ্ধ অর্থাৎ যা যুত সিদ্ধ নয়। যুত কথাটির অর্থ হচ্ছে, যাকে বিভাজন করা যায়। ভাগ করা যায়। তো অযুতসিদ্ধ অর্থাৎ যাকে বিভাজন বা বিলি-বন্দোবস্ত করা যায় না। সব তন্মাত্রাই এইরকম।
তন্মাত্রং ভূত কারনং, - তন্মাত্রই পঞ্চভূতের কারন।
তস্যৈকোঽবয়বঃ - তা অবিভাজ্য অর্থাৎ একাবয়ব।
পরমাণুঃ - এর সমুদয় হচ্ছে পরমাণু
সামান্য বিশেষ আত্মাঽযুতসিদ্ধ- - অর্থাৎ অতি সামান্য। আত্মাঽযুতসিদ্ধ- অর্থাৎ সেই মূল বস্তু যা অযুত অর্থাৎ বিভাজনের অযোগ্য।
অন্বয়ব-ভেদ অনুগতঃ - অর্থাৎ অভেদ সত্তার অনুগত।
সমুদয় ইতি, এবং সর্ব-তন্মাত্রাণি। - এই সমস্তই তন্মাত্রা।
আমার যদি আরো একটু গভীরে প্রবেশ করি তাহলে দেখতে পারবো, সমস্ত বস্তুর অবিভাজ্য কনা বা পরমাণু নয়, এটি একটি তড়িৎ প্রবাহ। আমাদের এই স্থূল শরীরও এই তড়িৎশক্তির বা ইলেক্ট্রনের সমষ্টি। আমাদের যে চিন্তাশক্তি তাও আসলে একটা বিদ্যুৎ প্রবাহ। আর এই বিদ্যুৎ প্রবাহের দ্বারা বা চিন্তাশক্তির আমরা আমাদের শরীরের বিভিন্ন তন্ত্রে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারি। চিন্তাকে একাগ্র করে, যদি দেহের সমস্ত অনু-পরমাণুকে বিদ্যুৎ-বাহিত করতে পারি, তবে সেই বিদ্যুৎ প্রবাহ দ্বারা আমরা আমাদের বাঞ্চিত বা অবাঞ্চিত পরিবর্তনক্রিয়া উৎপন্ন করা সম্ভব।
যোগক্রিয়া হচ্ছে এই বিন্যাসের কর্তা বা কারন উৎপাদক-শক্তি। আমরা এই চিন্তা বা বিন্যাসকর্তার দ্বারা আমাদের দেহের বিন্যাস করে নিতে পারি। এখানে আমি বা আমরা হচ্ছে আত্মশক্তি বা আত্মা। আমরা জানি আমাদের শরীরের প্রভু হচ্ছে মন, আর মনের প্রভু হচ্ছে আত্মা। আমরা আমাদের বিভিন্ন কোষ ও স্নায়ুর নির্মাণকর্তা। আমরা আমাদের রক্তে, মস্তিষ্কে কোষ তৈরী করছি। এমনকি স্নায়ুর সৃষ্টিকর্তা আমি নিজেই। কিন্তু এগুলো আমাদের নজরে আসে না। আমরা যে কে, তা আমরা বিস্মৃত হয়েছি। আমাদের স্বরূপকে আমরা ভুলে গেছি। আমরা ভাবি, আমার এই স্থুল দেহের নির্মাতা আমাদের মাতা-পিতা। কিন্তু আমরা যখন মাতৃদেহ থেকে নির্গত হয়েছি, তখন কে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে ? আমরা ভাবি, হয়তো ঈশ্বর বা প্রকৃতি বা অন্যকোনো অদৃশ্য শক্তি একে নিয়ন্ত্রণ করছে। আসলে এইসবই নিয়ন্ত্রণ করছে আমাদের মধ্যে যে চিৎশক্তি আছে, বা যে পুরুষশক্তি আছেন, তিনিই এর নিয়ন্ত্রক। তিনিই আমাদের শরীরের সমস্ত কিছু, তা সে স্নায়ুর ক্রিয়া বলুন, তন্ত্রের ক্রিয়া বলুন, বা কলার ক্রিয়া বলুন, সবই পরিচালনা করছেন, এই পুরুষ যিনি আমাদের মধ্যে সদা বিরাজমান। তিনিই সবকিছুর সঙ্গে সবকিছুর সমন্বয় সাধন করছেন।
জগতে দুই বলে কিছু নেই। জগৎ এক। শক্তিও দুই নয়, অশুভ বা শুভ বলে আলাদা শক্তি নেই। একই শক্তি সূক্ষ্মতম অবস্থা থেকে স্থুলতম প্রকাশের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আর স্থলতম প্রকাশের ফলে দৃশ্যমান এই দেহ বা বস্তু প্রতীয়মান হচ্ছে। সূক্ষ্মতম স্পন্দনের প্রকাশ হচ্ছে মন-বুদ্ধি। নিজেকে জানলে, জগতের আর কিছু জানার প্রয়োজন নেই। কিন্তু কথা হচ্ছে কি করেই বা জানবো ? এই জানার পদ্ধতিই হচ্ছে যোগক্রিয়া। ........................... এই যোগক্রিয়ার ফলেই স্বাভাবিক ভাবেই আসে বিভূতি, যা আমাদের আলোচ্য বিষয় । কিন্তু সাধকযোগী কখন এই ঐশ্বর্যের অধিকারী হন, সেই আলোচনায় আমরা ধীরে ধীরে আসবো। ...............
---------
১০.১১.২০২১
আমরা বাইরের অনেককিছু দেখছি। এমনকি গুরুদেব কি করে, শূন্য থেকে বাঞ্চিত বস্তু এনে দিচ্ছেন, তাও অবাক হয়ে দেখছি।
গুরুদেব বলছেন, হাত মুঠো করো, এবার নিজের ইচ্ছে মতো কোনো জিনিষ চাও। দেখো হাতের মধ্যে সেই জিনিস এসেছে কি না। মুঠো খুলে দেখা গেলো, কিছুই আসেনি। গুরুদেব বললেন, আবার মুঠো বন্ধ করো। চোখ বুজে থাকো। এবার হাতের মুঠো খুলে দেখো, তোমার চাওয়া বস্তু তোমার হাতের মধ্যে এসে গেছে। অবাক কান্ড আমি যখন চেয়েছিলেন, তখন কিছুই আসেনি। কিন্তু গুরুদেব যখন চাইলেন, তখন সেই বস্তু আমার হাতের মুঠোয়। এই বিদ্যা আমরা আয়ত্ত্বে আনতে চাই। গুরুদেব যদি পারে, তবে আমরা কেন পারবো না ? গুরুদেব বলছেন, আমরাই স্রষ্টা, আমরাই এই সৃষ্টির নিয়ন্ত্রক। আর যখন আমরা আমাদের ইচ্ছেমতো সৃষ্টি করতে পারবো, তখন এমনকি আমরা আমাদের জন্ম-মৃত্যু, সুখ-দুঃখ, নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো।
কিন্তু যে নিজের সৃষ্টির রহস্যঃ অবগত নয়, সে অন্যকে সৃষ্টি করবে কি করে ? যে নিজেকে চেনে না, যে নিজের ভবিষ্যৎ জানে না, যে নিজের অতীত জানে না, সে তার বর্তমানকেও জানে না। তো আগে নিজেকে জানতে হবে, নিজেকে পরিবর্তন করতে শিখতে হবে, নিজের ভবিষ্যৎ গড়তে জানতে হবে, তবেই বহিঃবিশ্বও তার নিয়ন্ত্রণে আসবে।
আমাদের অবচেতন মন বা অন্তর্জ্ঞান, চেতন মনের বা সজ্ঞান মনের চাইতে অধিক শক্তিশালী। যদিও অবচেতন মনের এই অভিজ্ঞতা একসময় চেতন মনেই ছিলো। আজ তা কালের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এই কালের নিয়ন্ত্রণে থাকা অন্তর্জ্ঞানকে আমাদের চেতন মনের স্তরে নিয়ে আসতে হবে। আমাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আস্তে হবে। আর এর জন্য আমাদের অন্তরমনের গভীরে প্রবেশ করতে হবে। সেখান থেকে সত্যকে তুলে আনতে হবে। আর এই কাজে সমস্ত বাধাবিঘ্ন আমাদেরকে জয় করতে হবে। আমরাই স্রষ্টা। আমাদের এই সৃষ্টি আজ অন্যের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। আমরা নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারিয়েছি। এখন এই সৃষ্টিকে অর্থাৎ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তবেই আমরা পারবো নিজেদের ইচ্ছেমতো সবকিছু তৈরী করতে। তখন আমাদের না থাকবে জন্ম না থাকবে মৃত্যু বলে কোনো বিভীষিকা। আমরা এই অবস্থাই লাভ করতে চাই। আর এইজন্য চাই, ধারণা, ধ্যান, সমাধি এবং সব শেষে কৈবল্য লাভের পথে নিজেকে নিয়োজিত করা।
আর এইপথে এগুতে গেলে, আগে জানত হবে, এই পথের ক্লেশ বা বাধা কি আছে। আমাদের উচিত প্রকৃতির নিয়ম বুঝে নিয়ে পথ চলা শুরু করা। আমাদের জানতে হবে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর জ্ঞান। যা আসলে কারন অবস্থায় আছে, তার সন্মন্ধে জ্ঞান অর্জন করা। এইভাবেই আমরা আমাদের লক্ষবস্তু লাভ করতে পারি।
মহাত্মাগণ বলে থাকেন, ঈশ্বর যেমন পূর্ণ আমরাও তেমনি পূর্ন। সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যেমন স্রষ্টা , সর্বোচ্চ, আমরাও যখন পূর্নতা লাভ করবো তখন তেমনই হয়ে যাবো। তখন আমরা ঈশ্বরের সঙ্গে অভিন্নতা প্রাপ্ত হবো। আসলে আমরা সবাই ঈশ্বর। কিন্তু আমরা আমাদের সেই স্বরূপকে বিস্মৃত হয়ে অধঃপতিত হয়ে নিজেকে দুর্বল ভাবছি, হীনমন্যতায় ভুগছি। দেখো, এখনো আমরা কেউ ঈশ্বরের থেকে ভিন্ন নয়। কেবল আমরা দূরে সরে এসেছি, পরমপিতা থেকে দূরে সরে এসেছি। আর সেই দূরত্ত্ব যে কতটা তা আমরা কেউ জানি না। কারন, মানুষ যখন হারিয়ে যায়, মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যখন সে পথের হদিস পায় না, তখন সে এটাও বুঝতে পারে না, যে মা-বাবা থেকে সে কতদূর চলে এসেছে। ঈশ্বর বৃহৎ আমরা ক্ষুদ্র। তবু আমাদের মধ্যেই আছে সেই ঈশ্বরের স্ফুলিঙ্গ, যা ক্ষুদ্র হলেও মূলত এক। কেবল মাত্রাগত পার্থক্য, প্রকারগত নয়।
দেখুন কাঠ পেলে একজন কাঠমিস্ত্রি টেবিল তৈরী করতে পারে, মাটি পেলে একজন কুমোর হাড়ি-কলসি তৈরী করতে পারে, সোনা পেলে একজন স্বর্ণকার অলংকার তৈরী করতে পারে, পাথর পেলে একজন শিল্পী শিব গড়তে পারে। এইযে টেবিল, হাড়ি, অলংকার, শিবমূর্তি - এগুলো সবই একসময় নির্মাতার কল্পনার মধ্যে ছিলো। মূল-উপাদান ও শিল্পীর কুশলতা সহযোগে ক্রিয়া, একে বাস্তব রূপ দিয়েছে। ঠিক তেমনি যোগীপুরুষগন পরমাণুর সাহায্যে সমস্ত বস্তুর সৃষ্টি করতে পারেন, যা তিনি কল্পনা বা স্বপ্ন দেখতে পারেন। আমাদের তাই স্বপ্ন দেখতে হবে, একটা সুন্দর জীবনের জন্য। আমাদের স্বপ্ন দেখতে হবে, যোগীপুরুষ হবার জন্য। আমাদের স্বপ্ন দেখতে হবে সুখ-দুঃখের অতীতে যাবার জন্য। আর এই স্বপ্ন যখন যোগের সাহায্যে ক্রিয়াশীল হয়ে উঠবে তখন আমাদের স্বপ্নের বস্তু আমাদের সামনে এসে যাবে।
ঈশ্বর বৃহৎ আমরা ক্ষুদ্রতম। তবু আমাদের মধ্যেই আছে সেই চৈতন্যশক্তি, যা ঈশ্বরের মধ্যেও আছে। যদি বিশ্বকর্তা, বিশ্বস্রষ্টা সমস্ত উপাদান সংগ্রহ করে, এই চন্দ্র, সূর্য, পৃথিবী, গ্রহ, নক্ষত্র, উদ্ভিদকুল ও জীবকুল সৃষ্টি করতে পারেন, তবে আমরাও পরিবেশ থেকে উপাদান সংগ্রহ করে, যেকোনো পদার্থে রূপান্তর করতে পারি। ............
১১.১১.২০২১
শ্রীমৎ ভগবতগীতার দশম অধ্যায়ের নাম হচ্ছে বিভূতিযোগঃ। আপনারা যাঁরা গীতার এই অধ্যায় পড়েছেন, তারা জানেন, যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ এখানে নিজের পরিচয় দিচ্ছেন। অর্থাৎ তিনি যে স্বয়ং ঈশ্বর, সেই পরিচয় দিচ্ছেন। বলছেন, আমার জন্ম বৃত্তান্ত কেউ জানে না। যদি কেউ জানেন, তবে তিনি মোহশূন্য হন। প্রাণীদের যে ভিন্ন ভিন্ন ভাব তার সবই আমা হতে উৎপন্ন। আমি ছাড়া কোনো স্রষ্টা নেই। আমি ছাড়া কোনো নিয়ন্ত্রকও নেই। এঁরা সবাই আমারই মানসজাত। যিনি আমার এই বিভূতি ও যোগৈশ্বর্য্য সম্পর্কে জানেন, তিনি আমাতে নিবিষ্ট চিত্ত হন। এদের আমি বুদ্ধিযোগ দান করি, অন্তরে উজ্জ্বল জ্ঞান প্রদীপ দ্বারা এদের অজ্ঞান অন্ধকার দূর করি।
অর্জুন বলছেন, হে পুরুষোত্তম, তুমি স্বয়ং আপন জ্ঞানে আপন স্বরূপ জানো। আমরা তোমাকে কিভাবে কোন পদার্থে চিন্তা করবো ?
ভগবান বলছেন, সর্বভূতের হৃদয়স্থিত আত্মা আমি, (১০/২৫) আমিই সর্ব্ব ভূতের উৎপত্তি, স্থিতি ও সংহার স্বরূপ। আমিই চন্দ্র, আমিই সূর্য, আমিই মরুৎ - ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কথা বলেছেন। যাতে করে আমাদের মনে হয়, তিনি সর্বোৎকৃষ্ট, তিনি বিরাট, তিনিই মহান, তিনি অনন্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষে এক জায়গায় এসে বলছেন আমিই প্রহ্লাদ (১০/৩০), আমিই অর্জুন, ব্যাসদেব, শুক্রাচার্য্য আবার আমিই বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ (১০/৩৭)
এখানে একদিকে বলছেন, আমিই শ্রীকৃষ্ণ আবার আমিই অর্জুন, অন্যদিকে বলছেন, আমি সর্বভূতের হৃদয়স্থিত আত্মা। আর আমরা সবাই জানি, আমাদের সবার ভিতরেই আছেন সেই পরমপুরুষ যার নাম আত্মা।
আমরা যখন অষ্টাবক্র গীতা পড়ছিলাম, তখন দেখেছি, ঋষি অষ্টাবক্র তার শিষ্য রাজা জনককে বলছেন, হে শিষ্য ! তুমি পৃথিবী নয়, জল নয়, অগ্নি নয়, বায়ু নয়, আকাশ নয়, তুমি সকলের সাক্ষী সরূপ আত্মা। অর্থাৎ দেহাত্মবোধে অধিষ্টিত আমরা নিজেকে দেহ বলেই ভেবে থাকি। বড়োজোর দেহের যে উপাদান অর্থাৎ পঞ্চভূত - এই অবধি আমাদের চিন্তা প্রসারিত হতে পারে। এই পঞ্চভূতের অতীত যে আত্মা আমাদের স্বরূপ, তা আমাদের সাধারনের চিন্তার মধ্যে আনতে পারি না।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, আমিই সৃষ্টিকর্তা, আমিই নিয়ন্ত্রক। আমি সর্বভূতের যা বীজ স্বরূপ তাই আমি। অর্থাৎ আমা-ব্যাতিত উৎপন্ন হতে পারে, বিশ্বচরাচরে এমন কিছুই নেই। (১০/৩৯)
এখন কথা হচ্ছে আমি আত্মা এই কথা আমাদের কাছে কথার কথা। এটা আমাদের উপল্বদ্ধিতে আসে না। কিন্তু কিভাবেই বা আমরা এই উপলব্ধি আমাদের অনুভূতির স্তরে নিয়ে আসতে পারবো ? এর জন্য একটা প্রক্রিয়া আছে, যেটি প্রথমে শুনুন তারপরে অনুশীলন করুন। তবে দেখবেই অচিরেই আপনার মধ্যে এই অনুভূতি জাগ্রত হবে। সঙ্গে লিংক দিলাম। https://www.youtube.com/watch?v=IjPU_yN4Iq8
https://www.youtube.com/watch?v=NrlBPC0XDjs
-----------------------------
যোগৈশ্বর্য্য সম্পর্কে আলোচনা শুনতে শুনতে আমাদের মধ্যে কিছু লোকের ধারণা হয়েছে, যেন শশাঙ্ক শেখর কোনো মন্ত্র জানেন, যা দিয়ে পরশ পাথরের কাজ হতে পারে। লোহাকে সোনা বানানো যেতে পারে।
হংস বা সোঽহং - স-কার হচ্ছে প্রাণের সঞ্চার আর হ কার হচ্ছে অপান সঞ্চার।
মুক্তানন্দজী একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার জপের মন্ত্র কী ? আমি তো জপ করি না। জপের মন্ত্র গুরু-প্রদত্ব হয়ে থাকে বলে শুনেছি। তবে মাঝে মধ্যে আমি ওং নমঃ শিবায়ঃ, বা ওং শ্রী ভগবতে বাসুদেবায় নমঃ, বলে
No comments:
Post a Comment