Monday, 15 November 2021

গায়ত্রীতত্ত্ব



 

গায়ত্রী মন্ত্রের গুহ্যতত্ত্ব

 ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ তৎ সবিতুর্বরেণ্যং  ভর্গো দেবস্য ধীমহি। ধিয়ো যো নঃ প্রচদয়াৎ। ওং প্রচলিত গায়ত্রী মন্ত্র বলতে আমরা এই শব্দসমষ্টিকেই  জানি। 

কিন্তু এই মন্ত্রের যিনি দ্রষ্টা ঋষি বিশ্বামিত্র তিনি এই ঋকের   সঙ্গে আরো দুটো ঋক  উচ্চারণ করতেন, এবং ওং ভূর্ভুবঃ স্বঃ - এই শব্দ  সেখানে নেই  । মন্ত্রের প্রথম অংশ অর্থাৎ " ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ" আমরা পাই শুক্লযজুর্বেদের তৃতীয় অধ্যায়-এর ৫ নং শ্লোকে।  এটি ৫ নং শ্লোকের প্রারম্ভ মাত্র। যা আসলে আদিমন্ত্র। 

 আর মূল মন্ত্র বেদের বিভিন্ন জায়গায় আমরা দেখতে পাই।    

এক - ঋগ্বেদ সংহিতা-র তৃতীয় মণ্ডলের ৬২ সূক্ত ১০-তম ঋক। এই ঋক বা স্তূতি লিখেছেন বিশ্বামিত্র ঋষি, ত্রিষ্টূপ ছন্দে । এই ঋক, সবিতা দেবের উদেশ্যে গীত হয়েছে। বলছেন :   "তৎসবিতুর্বরেন্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি। ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ ।" 
 ঋক-বেদের  সমস্ত শ্লোককেই ঋক বলা হয়।  ঋক  কথাটার মানে - দেবতাদের স্তূতি।  
 ঋগ্বেদ সংহিতা-র তৃতীয় মণ্ডলের ৬২ সূক্ত ১০-১২তম ঋকের দেবতা হচ্ছেন সবিতা। মন্ত্রগুলো এই রকম। 
 তৎসবিতুর্বরেন্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ ।-৩/৬২/১০ 
-যিনি আমাদের ধীশক্তি প্রেরণ করেন ,আমরা সেই সবিতাদেবের সেই বরণীয় তেজ ধ্যান করি।  
দেবস্য  সবিভুর্বয়ং বাজয়ন্তঃপুরন্ধ্যা। ভগস্য রাতিমিমহে। -৩/৬২/১১
-আমরা অন্নাভিলাষী হয়ে স্তূতি করে সবিতাদেবের  ও ভগদেবের ধন দান যাচ্ঞা করছি।
দেবং নরঃ সবিতারং বিপ্রা যজ্ঞৈসুবৃক্তিভিঃ। নমস্যন্তি ধিয়েষিতাঃ।  -৩/৬২/১২  কর্মরতা মেধাবী অধ্বর্যুগন বুধিদ্বারা প্রেরিত হয়ে যজ্ঞ ও সুন্দর স্তোত্রদ্বারা সবিতা দেবতাকে  পূজা করেন। 

দুই  : শুক্লযজুর্বেদ-সংহিতার ৩য় অধ্যায় ৩৫ নম্বরে  এবং ৩০তম  অধ্যায় শ্লোক নম্বর ২- এ  আমরা প্রথম  শ্লোকটি  দেখতে  পাই।
আপনারা জানেন, আমরা যে গায়ত্রী মন্ত্রের উপাসনা করি, তা আসলে ঋষি বিশ্বামিত্র আরাধিতা গায়ত্রী। অর্থাৎ বিশ্বামিত্র ছিলেন, এই মন্ত্রের দ্রষ্টা।  ঋষি বিশ্বমিত্র জন্মসূত্রে ছিলেন, ক্ষত্রিয়। এবং তিনি এই গায়ত্রী দেবীর  সাধনা করে, ব্রাহ্মণত্বে উত্তীর্ন হয়েছিলেন। তো বলা হয়ে থাকে যিনি ব্রাহ্মণ হতে চান, অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী হতে চান, তার অবশ্য়ই গায়ত্রী মন্ত্র জপ করা উচিত।

এখন এই গায়ত্রী মন্ত্রের উৎস কোথায় ? এই গায়ত্রী মন্ত্রের আদি দ্রষ্টা হচ্ছেন ব্রহ্মা। ব্রহ্মার নাভিদেশ থেকে স্ফূরিত হয়েছিল, এই মন্ত্র । আর নাভি দেশ থেকে স্ফূরিত হয়ে ব্রহ্মার হৃদয়ে স্থিত হয়েছিলেন । এর পরে, ব্রহ্মার পরমপ্রিয়  শিষ্য বশিষ্ট মুনিকে ব্রহ্মা  এই গায়ত্রীদেবীকে দান   করেছিলেন। এই বশিষ্ট মুনির কাছে, ইনি ছিলেন, কামধেনু রূপে। এর পরে,  রাজা বিশ্বামিত্র একে প্রথমে জোর করে অপহরণ করতে চেয়েছিলেন।  পরে, এই গায়ত্রী দেবীর উপাসনা করে, এঁকে  আয়ত্ত্বে এনেছিলেন। আমরা কিন্তু  এই বিশ্বামিত্রের কাছ থেকেই  এই গায়েত্রী মন্ত্রের কথা জানতে পারি - যা মহাত্মা ব্যাসদেব বেদের মধ্যে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। 

এখন কথা হচ্ছে, এই মন্ত্র যখন ব্রহ্মার নাভিদেশ থেকে স্ফূরিত হয়, তখন এটি ছিল, উন্মুক্ত আবরণহীন।  ব্রহ্মা একে মোড়কে আবদ্ধ করে, তার হৃদয়স্থলে লুকিয়ে রেখেছিলেন। আমরা যেমন কোনো মূল্যবান সামগ্রীর সুরক্ষার জন্য, একটা মোড়কে রেখে লোহার  আলমারিতে গচ্ছিত রাখি, তেমনি ব্রহ্মা এই অদৃষ্টপূর্ব অসীম শক্তিকে একটা মোড়কে ঢেকে, তার হৃদয়স্থলে লুকিয়ে রেখেছিলেন। এর পর এই মন্ত্র তিনি দান করেন, তার পরমপ্রিয় শিষ্য বশিষ্টমুনিকে। বশিষ্টমুনির কাছে, ইনি  ছিলেন কামধেনু রূপে। এখন রাজা বিশ্বামিত্র, বশিষ্টমুনির অসীম শক্তির উৎস হিসেবে এই কামধেনুকে জানতে পারেন আর  তাঁকে জোর করে, ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু অপহরণে অপারগ হয়ে, শেষে  তিনি এই গায়ত্রীদেবীর আরাধনা শুরু করেন। তো যে মন্ত্রে তিনি আরাধনা শুরু করেন, তা আমরা ব্যাসদেবের অনুগ্রহে,  বেদের মধ্যে লিপিবদ্ধ আকারে পাই। 

তো আমরা যেটা বলতে চাইছি, ঋষি বিশ্বামিত্র প্রদত্ত এই পবিত্র গায়ত্রী মন্ত্র তিনটি আবরণে ঢাকা। প্রথম আবরণ যা স্বয়ং ব্রহ্মা দিয়েছিলেন, দ্বিতীয় আবরণ বশিষ্ট মুনি দিয়েছিলেন, আর  তৃতীয় আবরণ বিশ্বামিত্র ঋষির দেওয়া। এই আবরণগুলোকে  উন্মোচন না করতে পারলে, আমরা গায়ত্রীদেবীর সান্নিধ্য লাভ করতে পারবো না। অর্থাৎ মন্ত্রের শাপমোচন করতে হবে। এই শাপমোচনের প্রক্রিয়া বা আবরণের উন্মোচনের প্রক্রিয়া হচ্ছে, নিরন্তর এই মন্ত্রের জপ। শব্দের মোড়কে ঢাকা এই দেবীশক্তি।  শব্দ যখন বারবার উচ্চারিত হয়, তখন এই শব্দের উপরে আঘাতের  ফলে শব্দ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, এবং একসময় আমাদের আরাধ্য দেবী গায়ত্রী আবরণ হীন  হয়ে পড়েন। তিনি তখন স্বরূপে প্রকাশিত হন। এবং আমাদের নিকট প্রকট হয়ে ওঠেন। 

এই গায়ত্রী দেবীর উপরে যেমন তিনটি আবরণ তেমনি জীবসত্ত্বার উপরে তিনটি আবরণ।  সেগুলো হচ্ছে, আণব, মায়া ও কর্ম্ম। আণব অর্থাৎ অতিসূক্ষ্ম কণা। অর্থাৎ একটা শক্তি যা এই কণাগুলোকে আকর্ষণ করে থাকে। মায়া - অর্থাৎ ব্রহ্মের  ঐশীশক্তি যার দ্বারা বিশ্ব পরিমিত হয়েছে, অবিদ্যা - ভ্রমাত্মক  শক্তি বা প্রকৃতি। সবশেষে কর্ম্ম - যা আমাদেরকে ফল প্রদান করে থাকে। এই তিনটি আবরণ উন্মোচন করতে পারলে, জীব শিবরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। এবারে মন্ত্রের কথায় আসি। 
           
ওং ভূর্ভুবঃ স্বঃ।  এরপরে ত্রিপদা গায়ত্রী যা ২৪ অক্ষর বিশিষ্ট। তারপরে  গায়ত্রীর শির।  
ওং - ওঙ্কার  হচ্ছে, শব্দব্রহ্মের স্বরূপ, যা আসলে বিশ্বসৃষ্টির মূল ধ্বনি। এর পরে তিনিটি ব্যাহৃতি বা আদিমন্ত্র যা আসলে  বিস্তারভূমি।  ভূঃ, ভুবঃ ও স্বঃ। মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে এই ভূমিতে বিস্তার করতে হয়। 

ভূর্ভুবঃ স্বঃ। অর্থাৎ এখানে  তিনিটি লোকের কথা বলা হচ্ছে। ভূ অর্থাৎ পৃথিবী, ভুবঃ অর্থাৎ অন্তরীক্ষ বা  পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশ  থেকে যে লোকের শুরু যেখানে গ্রহ নক্ষত্র অবস্থান করছে, অর্থাৎ স্বর্গের নিম্নভাগ পর্যন্ত ভুব- লোকের বিস্তার। এর পরে বলা হচ্ছে, স্বর্গ লোকের কথা। যেটির অবস্থান এই  নক্ষত্রলোকেরও  উপরে ।   কিন্তু আমরা শুনেছি  লোক আছে ৭টি। ভূঃ ভুবঃ স্বঃ মহঃ জনঃ তপঃ ও সত্যম। কিন্তু এখানে কেবল মাত্র তিনটি লোকের কথা বলা হচ্ছে।  আসলে স্বর্গলোকের মধ্যেই  আছে বাকি চারটি লোক মহঃ জনঃ তপঃ সত্যম ।  তাই স্বঃ কথাটা দিয়ে মোট পাঁচটি  লোকের  কথাই  বলা হচ্ছে। 

এই ৭টি লোকের যিনি প্রসবকর্ত্রী তাকে বলা হয় সবিতা। সবিতা কথাটার অর্থ হচ্ছে, যিনি প্রসব করেন। সেই সূর্যদেবকে এখানে সবিতা বলা হচ্ছে। এখানে সূর্য হচ্ছেন পরমাত্মা পরব্রহ্ম-এর জ্যোতি স্বরূপ। এই জ্যোতি এসেছে শব্দ বা নাদব্রহ্ম থেকে। এই নাদব্রহ্ম সরাসরি ব্রহ্ম থেকে উৎসারিত। এই শব্দ অনাহত ধ্বনি। এখন এই অনাহত ধ্বনির ধ্যান আমাদের মতো সাধারনের পক্ষে হয়তো করা সম্ভব নয়। কিন্তু এই অনাহত  ধ্বনি থেকে যে জ্যোতির উৎপত্তি হয়েছে, তার প্রতীক হচ্ছেন সূর্যদেব যা আমাদের সাধনা ব্যতিরেকেই দৃষ্টিগোচর হয়। এমনকি সূর্য্যের থেকে কিরণরাশি বিচ্ছুরিত হচ্ছে, তাও আমাদের উপল্বদ্ধিতে আসে। তাই ঋষিগণ এই সবিতাদেবকে আমাদের আরাধ্য করতে বলছেন।  
 
তৎ সবিতুর বরেণ্যম - সেই সবিতাকে আমরা বরণ  করছি। 

ভর্গো দেবস্য ধীমহি  এই সবিতার যে তেজ-স্বরূপ দেবতা  তাঁকে বরণ  করতে বলা হচ্ছে। ভর্গো কথাটার অর্থ হচ্ছে তেজঃশক্তি। তো সবিতাদেব থেকে বিচ্ছুরিত যে তেজ তার মধ্যে আছে শক্তি। অগ্নির  মধ্যে  আছে দাহিকা শক্তি।  তো প্রথমে আমরা চাক্ষুস সূর্যদেবের ধ্যান করছি, তার পরে আমরা সূর্য্যের তেজের ধ্যান করছি।  তার পরে আমরা তেজের মধ্যে যে শক্তি নিহিত আছে তাঁর ধ্যান করছি। অসংখ্য তেজরশ্মি, অসংখ্য গুনের অধিকারী। একেই আমরা দেবতা বলে থাকি। অসংখ্য রশ্মি তাই অসংখ্য আমাদের দেবতা। জ্যোতি আমাদের ভয় দূর করে, জ্যোতিঃর সাহায্যেই   ব্রহ্মদেব  জগৎকে  শুদ্ধিকরণ করে থাকেন। এই জ্যোতি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিকে জাগ্রত করতে পারে। তাই মন্ত্রে বলা হচ্ছে,    
ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ - আমাদেরকে ধীশক্তি প্রেরণ  করুন। 
 
সাধারণ ভাবে প্রচলিত গায়ত্রী এই তিনটি পাদ-এ বিভক্ত। এবং চব্বিশটি অক্ষর। গায়ত্রীর চতুর্থপাদ অত্যন্ত গুহ্য।  বলা হয়ে থাকে, প্রকৃত সন্ন্যাসী ভিন্ন অন্যের পক্ষে এই পাদ  শোনাই নিষেধ। সন্যাসী অর্থাৎ যার সমস্ত পাশের নাশ হয়েছে, তিনিই এই চতুর্থপাদের ধ্যান করতে সক্ষম।  কিন্তু আমাদের কাছে সমস্ত বিদ্যাই সমস্ত মানুষের অধিকার। কিন্তু আপনাকে যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। অধিকারী হতে হবে। অধিকারী না হয়ে, এই বিদ্যার অনুশীলনী আপনাকে কোনো ফল প্রদান করে না। এতে আপনার মধ্যে অবিশ্বাস দানা বাধবে। আর আপনি অপপ্রচারের চেষ্টা করবেন।  যাইহোক,  এরমধ্যে আগেই এই চতুর্থপদের কথা বলে গেছি।  যারা বোঝার তারা বুঝে নেবেন। 

গায়ত্রী উপাসনায় কর্ম্ম-জ্ঞান-ভক্তি ও যোগের সমন্বয় ঘটে থাকে। গায়ত্রী উপাসনা আসলে সূর্য বা সূর্য্যের শক্তির উপাসনা। উপাসনা কথার অর্থ আমরা জানি কাছে আসন পাতা।  যেন উপাস্যের নিকট আমি আসন পেতে বসে আছি। 

গায়ত্রীকে বলা হচ্ছে, প্রসবকারী সূর্য বা সবিতা। ইনিই পরমাত্মা স্বরূপ। এই সূর্যদেবের অনন্ত শক্তি যেগুলোকে  বলা হচ্ছে ভর্গ অর্থাৎ জ্যোতিঃ।  এই জ্যোতির মধ্যে অনন্ত শক্তি বিরাজ করছে। এই শক্তি আমাদের কর্ম্মরাশিকে ভর্জন বা দগ্ধ করে। সাধক এই বরেণ্য শক্তিকে বা মহাশক্তিকে উপাসনা করে থাকেন। এই সবিতা দেবের উপাসনার ফলে সাধকের মধ্যে সবিতাদেবের স্বরূপকে হৃদয়ে স্থাপন করা সম্ভব হয়ে থাকে। আর এই ধ্যান যখন প্রসারিত হয়, তখন সাধকের হৃদয়ে একটা তেজোময়ী শক্তির প্রকাশ ঘটে থাকে। সাধকের জ্ঞান ও কর্ম্ম ক্ষেত্রে প্রেরণা দায়ক হয়ে থাকে। তখন আমাদের যে জ্ঞান ইন্দ্রিয় চক্ষু, কর্ন, নাসিকা জিহ্বা, ত্বক, সত্যিকারের জ্ঞানের পথে প্রেরিত হয়।  আবার আমাদের কর্ম্ম-ইন্দ্রিয় শুভ কর্ম্মের পথে ধাবিত হন।  ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ - নঃ অর্থাৎ আমিত্ব বিহীন আমাকে ধীশক্তি প্রেরণ করুন। এই ধীশক্তি যখন বৃদ্ধি পায়, তখন আমাদের মধ্যে অদ্বৈত জ্ঞান প্রাপ্ত হয়। আর এই অদ্বৈত জ্ঞান প্রাপ্ত হলে, সাধক পরাভক্তি লাভ করতে  সমর্থ হন।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

--------------------------     




       

No comments:

Post a Comment