Friday, 26 November 2021

শুদ্রদম্পতির বেদ-ব্যাখ্যা।


 শুদ্রদম্পতির  বেদ-ব্যাখ্যা। 

ভূমিকা : সর্ব সাধারণের জন্য বেদ-বেদাঙ্গ পাঠ এমনকি শ্রবণ করাও নিষিদ্ধ। কারন ব্রহ্মজ্ঞান যার হয়নি তিনি এইসব শাস্ত্রের মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারবেন না। শুধু মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারবেন না তাই নয়,  শাস্ত্রের অপব্যাখ্যা, এমনকি এর অপব্যবহার করবার সম্ভাবনা। দেহমন যার শুদ্ধ হয় নি, তার মধ্যে রাগ, দ্বেষ, ঘৃণা, লোভ, মোহ থাকা স্বাভাবিক। এমনকি যার মধ্যে ধীশক্তি স্তিমিত, যার মধ্যে স্মৃতিশক্তি পর্যাপ্ত নেই, তাকে এই বিদ্যা দান শুধু অপাত্রে দান নয়, পাত্রের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা। ঠান্ডা জিনিস প্রায় সব পাত্রে রাখা যায়, কিন্তু অতিরিক্ত গরম বস্তু যেখানে সেখানে রাখা, মানে নিরীহ মানুষের ক্ষতির সম্ভাবনা। বিদ্যুৎবাহীত তার মোড়কে ঢেকে পরিবেশন করতে হয়, নতুবা সাধকের  সমূহ বিপদ হতে পারে। 

কিন্তু এই বেদের জ্ঞান যখন লিপিবদ্ধ  আকারে প্রকাশ পেলো, তখন আর এঁকে গোপন রাখা গেলো না। আর এই কাজটি করেছিলেন, শ্রী কৃষদ্বৈপায়ণ, যার পিতা পরাশর  মুনি, মাতা এক মৎসকন্যা। জেলে নিষাদ পালিত  মেয়ে, সত্যবতী।  একসময় এই জ্ঞান ছিল, ঋষি পরম্পরায় তাঁদের স্মৃতিতে। মানুষ আবিষ্কার করলো, লিপি।  এখন এসে গেলো, ভূর্জপত্রে। কালে কালে বইয়ের পাতায়। তো জ্ঞান একসময় ছিল, অপরোক্ষ অনুভূতিতে, স্মৃতির ভাণ্ডারে, আজ তা গ্রন্থের ভাণ্ডারে। সত্যকামকে পরীক্ষা দিতে হয়েছিলো, তার বংশ পরিচয় দিতে হয়েছিল, গুরুকরণের জন্য। এখন আর বংশ পরিচয় দিতে হয় না।  এখন বাজারে গেলেই বই কিনতে পাওয়া যায়। সবাই এখন টাকায় বশ। কিন্তু বিষয়টি অন্য জায়গায়। 

জ্ঞান দুই প্রকার - বাহ্যজ্ঞান ও আন্তরজ্ঞান। বাহ্যজ্ঞানের অধিকার সবার  কিন্তু এই অধ্যাত্ম বা আত্মবিষয়ক জ্ঞান সবাই অধিগ্রহণে সমর্থ নয়। প্রজাপতি ব্রহ্মা বলেছিলেন, "দ" . তো কেউ ভাবলো দমন করো, কেউ ভাবলো দান করো। কেউ হা করলেই হাওড়া বুঝে যায়। কেউ আবার হা-হা কার বোঝে, হালিশহর বোঝে । আসলে প্রত্যেক ঘটনার পিছনে আরো একটা ঘটনা আছে, আবার প্রত্যেক বর্তমানের সামনে একটা ভবিষ্যৎ পরিণতি আছে। এটি বুঝতে গেলে বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে হয়। তো বিষয়ের গভীরে যারা প্রবেশ করতে পারেন না, তাদের বর্তমান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা ভালো। আমরা কান দিয়ে শুনি, চোখ দিয়ে দেখি, মুখ দিয়ে কথা বলি, ত্বক দিয়ে অনুভব করি। কিন্তু সত্য হচ্ছে, কান শোনে না।  চোখ দেখে না।  মুখ কথাও বলতে পারে না। এই কানের পিছনে আছে আরো একটা শক্তি যা কানকে মাধ্যম করে শোনে।  চোখ দেখে না, চোখকে মাধ্যম করে অন্য কেউ দেখে। এই বোধ যার হয়নি, তার মধ্যে জ্ঞানের প্রবেশ ঘটলেও, কোনো কাজে আসবে না।  এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যাবে। তাই বলা হয়েছে বাহ্যজ্ঞান তো সবাই সংগ্রহ করতে পারে, কিন্তু আত্মজ্ঞানে সবার অধিকার নেই। নচিকেতাকে যমরাজ নানান ভাবে প্রলোভিত করে, পরীক্ষা নিয়ে ছিলেন। জিজ্ঞাসু নচিকেতাকে যমরাজ সহজে গোপনীয় জ্ঞান দান করতে সম্মত হননি। সমস্ত শাস্ত্রগ্রন্থের প্রতিটি শব্দের একটা নিগুড় অর্থ আছে। যার অন্তর স্বচ্ছ নয়, তার মধ্যে এই সত্য প্রকাশিত হয় না। এমনকি দেখবেন, অসময়ে কাউকে কিছু বললে, সে তা বুঝতে সক্ষম হয় না। একসময় মা-বাবা তার সন্তানের ভালোর জন্য সাবধানবানী উচ্চারণ করতেন,  উপদেশ দিতেন। তো সন্তানদের মধ্যে  কেউ শোনে কেউ শোনে না। কান দিয়ে তো সবাই শোনে, কিন্তু কাজের মধ্যে তা প্রকাশ পায় না। কিন্তু একটা সময় আসে, যখন মা-বাবার সেই কথার অর্থ সে হাড়ে হাড়ে টের পায় । শ্রুতি শাস্ত্রের গুরুগম্ভীর মর্মবাণী আমাদের প্রাচীন মুনি-ঋষিগণ  ব্যক্তির কল্যাণের জন্য,  সমাজের কল্যাণের জন্য, রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য পুরাণাদিতে প্রণয়ন করেছিলেন। এখনকার যুগে, এইসব শাস্ত্র গ্রন্থ সম্পর্কে পাঠকের কৌতূহল নেই তা নয়, কিন্তু কৌতূহল নিবৃত্ত করবার যথাযথ শিক্ষকের অভাব। আর জীবন এখন এতটাই দ্রুততার সঙ্গে ধাবিত হচ্ছে, যে মানুষের একজায়গায় বেশিক্ষন স্থির হয়ে বসে থাকবার সময় নেই। তাই তার সবকিছুর জন্য হাতে সময়ের স্বল্পতা। গাছে আর আম  পাঁকে না, আম  এখন পাকঁছে গুদাম-ঘরে, কার্বাইটের প্রভাবে । এখন এককালের দোফসলি জমি চার রকম ফসল দিতে বাধ্য হচ্ছে। প্রকৃতির নিয়মে যে গাছে ফল আসতে ৫/৬ বছর লাগার কথা, তা এখন ২ বছরে ফল দিতে বাধ্য হচ্ছে। এতে করে মানুষ খাবার তো পাচ্ছে, কিন্তু খাবারের মান নিম্নগামী হয়েছে। আর খাদ্যের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে খাদকের সংখ্যা। যাদের জন্ম খাবারের জন্য, আবার মারা যায় সেই অখাদ্য কুখাদ্য খেয়েই। আজ দেহ-সর্বস্য জীবের সংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ চলছে। প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির যুদ্ধ আজও চলছে। পরমাত্মা আজও বিশ্বভুবন ব্যাপ্ত করে রেখেছে। আবার জীবের হৃদয়ে স্থিত হয়ে আছেন। অথচ দেখুন, অন্য সব বিষয় আমাদের ইন্দ্রিয়গোচর কিন্তু আত্মাকে জানবার জন্য, আমাদের কোনো বাহ্যিক ইন্দ্রিয় নেই। আবার সর্বকারনের কারন এই আশ্রয়-বস্তুটি আছে বলে, সমস্ত বস্তুর অস্তিত্ত্ব আমাদের  বোধগম্য হচ্ছে। সেই আত্মাকে অনুসরণ করেই সমস্ত প্রকাশ হচ্ছে। শাস্ত্র বলছে, বুদ্ধিতে প্রতিবিম্বিত সেই আত্মাকে যে ধীর ব্যক্তি সাক্ষাৎ করেন, তিনিই শান্তিতে থাকেন, বিষয়াসক্ত ব্যক্তি শান্তি লাভে অসমর্থ। 

মহাভারতের শান্তনু হচ্ছেন আত্মা।  আমরা জানি, শান্তনু মহারাজ প্রতীপের পুত্র, মহামতি ভীষ্মের পিতা।  শান্তনু শান্ত+অনু শান্তনু। অনু কথাটার অর্থ সেই বিন্দু যাকে আর বিভাগ করা যায় না। শান্ত অর্থাৎ স্থির,  শমতাপ্রাপ্ত যা শমগুনযুক্ত ।  তো স্থির অনু হচ্ছেন শান্তনু অর্থাৎ আত্মা। শান্তনু হচ্ছেন প্রতীপ-এর পুত্র।  প্রতীপ কথাটার অর্থ হচ্ছে বিপরীত মুখী কোনো গতি। তো পরমাত্মা থেকে বিচ্যুত হয়ে বিপরীতমুখী গতিতে যিনি জন্ম গ্রহণ করেছেন, তিনি রাজা প্রতীপ ।  ভীষ্ম হচ্ছে শান্তনুর পুত্র। ভীষ্ম হচ্ছে ভ্রম। জীবাত্মার ভ্রমাত্মক বোধ এই ভ্রমের সহজে নাশ হয় না। রাজা শান্তনুর দুই স্ত্রী, গঙ্গা ও সত্যবতী। গঙ্গা হচ্ছে আমাদের সুষুম্না নাড়ী - যা আসলে শক্তির আধার।  এই চেতন প্রকৃতি জগতের মূল উপাদান বা কারন স্বরূপ। সুষুম্নার অষ্টশক্তি, গঙ্গার আটটি পুত্র ।  সোম,ভব, ধ্রুব, বিষ্ণু, অনিল, অনল, প্রভুশ, প্রভব,  (সোম - চন্দ্র, ভব-পৃথিবী, ধ্রুব- গতিহীন,  , প্রভুশ- আকাশ, প্রত্যুষ বা প্রভব - সূর্য,  অপ বা বিষ্ণু - জল, অনিল-বাতাস, অনল- অগ্নি) এর মধ্যে প্রভব প্রত্যুষ বা সূর্য বা সূর্য হচ্ছে প্রকাশ স্থান। এঁকে অবলম্বন করেই জগৎ-লীলা চলছে। এরই নাম ভীষ্ম বা সত্যব্রত। এই সত্যব্রত-ই কুরুবংশকে বাঁচিয়ে রাখেন। অর্থাৎ সূর্য-ই কুরুবংশকে বাঁচিয়ে রাখেন।  কুরুবংশ অর্থাৎ কার্য্যশক্তি।  আভাস চৈতন্য ব্যাতিত এই কার্য্যশক্তি টিকে থাকতে পারে না। কিন্তু এনার কোনো পুত্র নেই। অর্থাৎ আভাস চৈতন্য যদিও  জগতের অবলম্বন কিন্তু নিজে অসৎ বা অনিত্য  বলে এনার স্থায়ী বংশ থাকতে পারে না। এই আভাস চৈতন্যের অন্তরালে যার প্রতিবিম্ব তিনি নিত্য বিরাজমান। আমরা বেদের কথায় যাবো।  আমরা বেদের নাম  সবাই শুনেছি, কিন্তু বেদ অর্থাৎ সত্যজ্ঞান আমরা কোথায় পাবো ?....... হে ঈশ্বর আমাদের সহায় হোন। 

শুদ্রদম্পতির  বেদ-ব্যাখ্যা।(২) ২৫.১১.২০২১

বেদ গ্রন্থ বাজার থেকে কিনে আপনি তা পড়তে পারেন। আবার বেদ-পাঠের ভিডিও বাজারে কিনতে পাওয়া যায়, বা ইউটুবে বেদ পাঠ যা ব্রাহ্মণ যুবকগণ করেছেন, তা আপনি শুনতে পারেন। এতে করে আপনার মধ্যে বেদ  সম্পর্কে আপনার একটা ধারণা অবশ্য়ই হতে পারে। কিন্তু বেদের সুফল পেতে গেলে, বেদ-আদিষ্ট  ক্রিয়া অনুষ্ঠান করতে হয়।

বেদ কথাটার সঙ্গে হিন্দু কথাটা, ব্রাহ্মণ কথাটা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। আসলে বেদ  যাঁরা রচনা করেছিলেন, তাঁরা কিন্তু নিজেদেরকে হিন্দু বলে পরিচয় দিতেন না।  তাঁরা নিজেদেরকে বলতেন হয় আর্য নয় ব্রাহ্মণ। আবার ব্রহ্ম সন্মন্ধে আলোচনা যেখানে আছে, তাকে বলে বেদের ব্রাহ্মণ।  বেদের মধ্যে সাধন তত্ত্বের যে ব্যঞ্জনা আছে, তাকে প্রকাশ করা হয়েছে এই ব্রাহ্মনে। ব্রাহ্মণ শব্দ এসেছে ব্রহ্মন্ থেকে। ব্রহ্মবিদকে বলা হয় ব্রাহ্মণ। 

নিজেকে বিকাশ করবার প্রবৃত্তি মানুষের সহজাত। কিন্তু আমাদের চিত্ত বিক্ষিপ্ত। আমাদের সবার রুচি ও প্রকৃতিও  ভিন্ন ভিন্ন। তাই সমুদ্র মন্থনে অমৃত নিতে আমরা সবাই আগ্রহী, কিন্তু এর বিষ একমাত্র দেবাদিদেব  মহাদেব সহ্য করতে পারেন। আসলে বেদাঙ্গ-তত্ত্ব অনুশীলনের মাধ্যমে আমরা বেদ  পাঠের যোগ্য হতে পারি। এই বেদাঙ্গের মধ্যে আছে ছটি বিভাগ - শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ, ও জ্যোতিষ। এগুলো বুঝতে গেলে, শুধু বইয়ের সাহায্যে সম্ভব নয়। এরজন্য উপযুক্ত শিক্ষক অবশ্য়ই প্রয়োজন। দেখুন, গানের বই থেকে বা গানের স্বরলিপির বই দেখে আপনি গান শিখে যাবেন, এমনটা সম্ভব নয়। এই শিক্ষা যেমন সময়সাপেক্ষ তেমনি উপযুক্ত গুরু প্রয়োজন। আমাদের সেই সঙ্গতি নেই। তথাপি বেদের কথা শুনতে চাই। তাই বেদের মধ্যে যে শব্দ-সংগ্রহ  আছে, তার শব্দার্থ অর্থাৎ আভিধানিক অর্থ ও ভাবার্থ নিয়ে আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে। এই শব্দার্থও  প্রয়োগ ভেদে আলাদা আলাদা। আবার বেদের ভাষা হচ্ছে বৈদিক। যা প্রাণিজগতের ভাষার (বৈজিক)  দ্বিতীয় পুরুষ। তাই এর জটিলতা ভেদ করে এগুনো দুরূহ ব্যাপার। তাই বেদমাতা গায়ত্রী দেবীকে প্রণাম করে, আমাদের বিচার বুদ্ধির উপরে নির্ভর করে, আমরা সরাসরি বেদের অসীম জ্ঞানের গহ্বরে প্রবেশ করবো।  হে বেদমাতা আমাদের মধ্যে জ্ঞানের আলোকশিখা প্রজ্জ্বলিত করুন। 

বেদের বিভাগ করেছিলেন, মহামতি ব্যাসদেব। আমরা তাঁকে আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই। ইনি বেদকে চার ভাগে ভাগ করে চার শিষ্যকে এই বেদবিদ্যা সংরক্ষণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এইযে চারটি বিভাগ, এর নামকরণ হয়তো ব্যাসদেব-ই করেছিলেন। ঋক্বেদ-সংহিতা দিয়েছিলেন শিষ্য পৈল-কে, সামবেদ দিয়েছিলেন শিষ্য জেমিনিকে, যজুর্বেদ-সংহিতা দিয়েছিলেন বৈশম্পায়ন-কে, এবং অথর্ব সংহিতা দিয়েছিলেন শিষ্য সুমন্ত্রকে। আমরা এই চারজনকে আমাদের অবনতশীরে প্রণাম জানাই। 

এরপরে, এই বিদ্যা সহস্র মুনিঋষির হাত ঘুরে, আজ আমাদের কাছে এসেছেন। আমরা এই বিদ্যাকে আমাদের অন্তরে প্রবেশের পথ করে দিতে চাই। হে বেদমাতা আমাদের অন্তরে আপনি অবস্থান করুন। 

ঋক্বেদ : ঋক কথাটির অর্থ হচ্ছে স্তুতি - দেবতাদের স্তুতি। আর সুক্ত কথাটা অর্থ হচ্ছে প্রশস্তি।ঋকবেদে ১০ টি মন্ডল, ১০২৮ টি সুক্ত, আর ঋক আছে, ১০৫৫২-টি । কতকগুলো মন্ত্র (ঋক) সমষ্টিবদ্ধ ভাবে অবস্থিত এই সূক্তে। এক এক দেবতার মন্ত্রগুলোকে একত্রিত করে এক-একটি সুক্ত করা হয়েছে। কোনো কোনো সূক্তে অবশ্য একাধিক দেবতার স্তুতি পাওয়া যায়। এই সূক্তগুলো এক-এক ঋষির নামে প্রচারিত। অর্থাৎ এঁরা এই সুক্তের প্রবর্তক। এই ঋষি-মহর্ষিগণের সংখ্যা অগণ্য। অগস্ত্য, অদিতি, কশ্যপ, আঙ্গিরস, বিশ্বামিত্র, ভরদ্বাজ, নারদ, কন্ব, যযাতি, মান্ধাতা, প্রস্কন্ন, হিরণ্যগর্ভ ইত্যাদি বহু নামে হৃদের পরিচয় পাওয়া যায়। আবার নানান দেবতাদের নাম পাওয়া যায়। অগ্নি, অদিতি, ইন্দ্র, বায়ু, মরুৎ, বরুণ, দেব্যা, পৃথিবী, গঙ্গা, বিশ্বকর্ম্মা, প্রজাপতি, সবিতা, বিষ্ণু, প্রভৃতি হাজার হাজার দেবতাদের নাম পাওয়া যায়। এবার আমরা সরাসরি ঋক্বেদের শব্দভাণ্ডারে প্রবেশ করবো। 

আসলে বাকের উচ্চশক্তির  প্রকাশ দেখতে পাই আমরা এই বেদে। আর এই বাকের প্রেরণায় প্রাচীন ঋষিগণ তাদের হৃদয়-মন  হতে যা কিছু উৎসারিত করেছেন, তাকেই বলা হয় মন্ত্র। আর এই মন্ত্রগুলোকে আশ্রয় করে, জ্ঞানের বাহন বেদ আমাদের কাছে মধুময় হয়ে  উঠেছে। 

 প্রথম মন্ডল - প্রথম অষ্টক 

সুক্ত - ১ 

অগ্নিম ঈলে  পুরোহিতং। ...........

এই অগ্নি যজ্ঞের পুরোহিত, অগ্নি দীপ্তিমান, অগ্নি দেবতাগনের আহ্বাহক ঋত্বিক এবং প্রভূত রত্নধারী। আমি অগ্নির স্তুতি করি।  (১)

অগ্নি পুরাতন ঋষিদের স্তুতিভাজন ছিলেন, নতুন ঋষিদেরও স্তুতিভাজন।  তিনি দেবতাগনকে সঙ্গে করে এই যজ্ঞে আনুন। (২)

অগ্নিদ্বারা যজমান ধন লাভ করেন।  সেই ধন দিনদিন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, যশযুক্ত হয় এবং তা দিয়ে অনেক বীরপুরুষ নিযুক্ত করা যায়। (৩)

হে অগ্নি, তুমি যে যজ্ঞের চারিদিকে বেষ্টন করে থাকো, সেই  যজ্ঞ কেউ হিংসা করতে পরে না  এবং সেই  যজ্ঞ কেউ হিংসা করতে পারে না। এবং সেই যজ্ঞ নিশ্চিত দেবগনের নিকট গমন করে থাকে। (৪)

অগ্নি দেবগনের আহ্বানকারী।  সিদ্ধ-কর্ম্মা, সত্যপরায়ণ, ও প্রভূত ও বিবিধ কীর্তিযুক্ত। হে অগ্নিদেব, দেবগণকে সঙ্গে করে এই যজ্ঞে আগমন করুন। (৫)

হে অগ্নি, তুমি হব্যদাতা যজমানের যে কল্যাণ সাধন করবে, তা আসলে তোমারই কল্যাণ, হে অঙ্গিরা। (৬) 

আমরা তোমাকে দিনরাত নমস্কার করে তোমার কাছে এসেছি। (৭)

তুমি দীপ্যমান হও।  তুমিই যজ্ঞের রক্ষক, তুমিই যজ্ঞের দীপ্তি প্রদানকারী, তুমিই যজ্ঞস্থলে বর্ধমান। (৮)

সন্তানের কাছে, পিত যেমন অনায়াসে আস্তে পারে, হে অগ্নি তুমি আমাদের নিকট সেইমতো মঙ্গলার্থে আমাদের কাছে বাস করো। 

ঋক্বেদের প্রথম সুক্ত এটি। ঋক্বেদের এই সুক্তের দেবতা হচ্ছেন, অগ্নিদেব। আর এর রচয়িতা হচ্ছেন, মধুছন্দা ঋষি। গায়ত্রী ছন্দ, অর্থাৎ ২৪ অহ্মর বিশিষ্ট) এখানে অগ্নিদেবকে যজ্ঞের স্থলে আসবার জন্য স্তুতি করে আহবান করা হচ্ছে।  

বেদকে আমরা ধর্ম্মগ্রন্থ হিসেবে জানি। আর আমরা সবাই জানি, ধর্ম্মের প্রথম ও প্রধান কাজ হলো, বিশ্বশক্তিকে শ্রদ্ধা, ভক্তিরূপ অর্ঘ প্রদান করা।  কিন্তু সত্য হচ্ছে, আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারা ব্যবহারিক প্রয়োজনকে অগ্রাহ্যধিকার দেই। অর্থাৎ আর্ত বা অর্থার্থীর মনোভাব নিয়েই সেই দেবতাদের বা বিশ্বশক্তির পুজো-অর্চ্চনা করে থাকি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, আর্ত, অর্থার্থী, ভক্ত, ও জিজ্ঞাসু এই চার ধরনের মানুষ ভগবানের স্মরণ নিয়ে থাকে। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে, আমরা হয়, আর্ত নয় অর্থার্থী। তাই বেদের মধ্যেও সাধারনের মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য, নানান রকম স্তুতির সংকলন আমরা দেখতে পাই।

এখন কথা হচ্ছে, এই মন্ত্রটি শুনে আমাদের মনে হয়ে পারে, এটি যজ্ঞের অগ্নিকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে। অগ্নির উৎস হচ্ছেন সূর্যদেব। এই সূর্যদেবের মধ্যে যে দাহিকা শক্তি তার দাতা  হচ্ছেন, ব্রহ্ম। যিনি অগ্নিরূপে প্রকাশিত তার উপাসনা করার অর্থ সেই ব্রহ্মশক্তির  উপাসনা করা। এখানে অগ্নি নিমিত্ত মাত্র। --------------------- 

26.11.2021

আমরা যখন গান শিখতে চাই, তখন আমরা প্রথমে সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি, সা - এই সাতটি সুরের চর্চা দিয়ে শুরু করে থাকি। তেমনি স্বরবিদ্যা আয়ত্ত্বে আনতে  গেলে  আমাদের সাতটি স্বরের চর্চা দিয়ে শুরু করতে হয়। এই সাতটি  স্বর হচ্ছে - স, ঋ, গ, ম,প, ধ, নি। ষড়জ, ঋষভ,গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম,  ধৈবত, নিষাদ। বৈদিক আমলে এগুলো ছিল উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিৎ। যারা যথাযথ মন্ত্রের বই পড়েছেন, তারা দেখেছেন, কোনো কোনো বর্ণের নিচে একটা চিহ্ন (-) ,আবার উপরে একটা চিহ্ন (।), দেওয়া থাকে। এই চিন্হগুলো স্বরের  নির্দিষ্টকরণ  করে থাকে। বর্ণের নিচে (-) শায়িত চিহ্ন অনুদাত্ত স্বর।  আবার উপরে যে চিহ্ন (।) এটি উদ্বাত্ত স্বর।  যেখানে কোনো চিহ্ন নেই সেটি স্বরিৎ। আবার আমরা জানি হ্রস্ব, দীর্ঘ, ও প্লুত স্বর আছে।  যেমন বি, বী, বি-ই-ই, এগুলো আমরা জানি। এগুলো অবশ্য আমাদের শুধু বেদ পাঠ করতে গেলে শিখতে হবে, তা নয়, আমারা যখন কবিতা পাঠ করি, গান করি, এমনকি যেকোনো বই উচ্চস্বরে পাঠ  করতে গেলে, এই স্বরবিদ্যা আমাদের আয়ত্ত করে নেওয়া উচিত। আর এগুলো যেকোনো অভিজ্ঞ আচার্য্যের কাছ থেকে শিখে নিতে হয়। 

ছন্দ :  গায়ত্রী, উষ্ণিক,অনুষ্টুপ, বৃহতী, পংক্তি, ত্রিষ্টুপ, জগতি। চব্বিশ অক্ষরে বা স্বরবর্ণ তিন চরণে নিবদ্ধ হলে হয় গায়েত্রী ছন্দ। আঠাশটি অক্ষরে হয় উষ্ণিক, ৩২- অক্ষরে  অণুষ্টুপ, - ছত্রিশটি অক্ষরে  বৃহতী -  পংক্তি হচ্ছে চল্লিশটি অক্ষরে,  ত্রিষ্টুপ হচ্ছে চুয়াল্লিশটিতে  জগতি হচ্ছে আটচল্লিশটি অক্ষরে। এই ছন্দগুলোকে  আবার  দৈবিক চাঁদ বলা হয়ে থাকে। 

যাই হোক, আমরা পরবর্তী কথায় আসি। আমরা ঋক্বেদের প্রথম সুক্ত শুনেছি। এগুলো আসলে যজ্ঞের মন্ত্র। যজ্ঞে সাধারণত তিনটি জিনিস দরকার। প্রথম : যজমান, অর্থাৎ যিনি ঈশ্বরের কাছে কিছু নিবেদন করবেন, এবং ফলের ভাগিদার হবেন । দ্বিতীয় হচ্ছে একজন দেৱতা - যার কাছে নিবেদিত হবে এবং ফলদান করবেন । তৃতীয়তঃ পুরোহিত অর্থাৎ যিনি পুরবাসীর হিত কামনা করেন, এমন একজন ব্যক্তি, যিনি এই কাজে যজমান-কে সহযোগিতা করবেন। 

এখন দেখুন আপনি ভগবানকে কিছু দিতে চান। কিন্তু ভগবান-তো কোনো শরীর নয়। স্থুল বস্তু আমরা তাঁর কাছে  কিছুতেই দিতে পারি না। তো বৈদিক ঋষিগণ একটা বাস্তব-সম্মত পদ্ধতির মাধ্যমে এই স্থুলবস্তুকে ভগবানের কাছে পৌঁছে দেবার একটা ব্যবস্থা করলেন। মাধ্যম করলেন, অগ্নিকে। অগ্নি সমস্ত বস্তুকে তার উৎসে  ফিরিয়ে দেয়। সমস্ত বস্তু পঞ্চভূতের সমষ্টি।  এই ভূতগুলোকে আলাদা করতে পারে একমাত্র  অগ্নিদেব। তাই ঋষিগণ স্তুতি করে, প্রশস্তির গাঁথা দিয়ে অগ্নিদেবকে আহ্বান করছেন, ঋক বেদের প্রথম সূক্তে। 

ঋক সুক্ত-২ (১/১/২)

বায়বা যাহি। .......

এই সুক্তের দেবতা হচ্ছেন বায়ুদেব। ঋষি : মধুছন্দা।  ছন্দ : গায়ত্রী শ্লোক সংখ্যা - ৯

হে প্রিয়দর্শন বায়ুদেব, আপনি এই যজ্ঞে আগমন করুন।  এখানে বিশুদ্ধ সোমরস সংগ্রহ করা হয়েছে। এই সোমসুধা আপনি পান করুন।   

  

     

  



   

      

           




















No comments:

Post a Comment