কাশী-গয়া-বৃন্দাবনে মারা গেলে কি মুক্তি হয় ?
কথায় বলে নিয়তি বধ্য়তে। নিয়তিকে কেউ রোধ করতে পারে না। আমার এক প্রতিবেশী ভদ্রলোক ছিলেন। বয়স কত হবে, বড়োজোর ৬৫/৭০ বছর। কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসে কাজ করতেন। অবসর নিয়ে আমাদের বাড়ির পাশে এসে বাড়ি করেন। সুখের সংসার ছিলো । একটি ছেলে। ছেলেটি একটি পত্রিকা অফিসে কাজ করতো। ছেলেকে বিয়ে দিয়েছেন। একটি নাতনি হয়েছে। হঠাৎ একদিন শুনলাম, ভদ্রলোক পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে, ছেলে, বৌমা ও নাতিটিকে হারিয়েছেন। নিজের স্ত্রীকে আগেই হারিয়েছিলেন, এখন উনি পুরোপুরি একা হয়ে গেলেন।
এখন ওর বাড়িতে একা একা থাকতে ভয় করে। ভদ্রলোকের টাকা পয়সার অভাব ছিল না। তো সে ঠিক করলো, সে কাশীতে গিয়ে বাস করবে। ও শুনেছিলো, কাশী গিয়ে বাস করলে, ও সেখানে মৃত্যু হলে নাকি মুক্তি হয়। তো সেই উদ্দেশ্যে সে একদিন বেনারসের টিকিট কেটে গাড়িতে উঠে পড়লো। ট্রেনে যাবার পথে ধানবাদ থেকে এক ভদ্রলোক উঠলো। তিনি সাসারামে যাবেন। সেখানেই তার ব্যবসা। স্টেশনের কাছেই তার দোকান। তো ভদ্রলোকের সাথে তার আলাপ জমে উঠলো। তিনি তাকে তার বাড়িতে বেড়াতে যাবার জন্য নিমন্ত্রণ করলেন। যাইহোক, ভদ্রলোক কাশীতে গিয়ে একটা ঘর ভাড়া করলেন । সেখানে একটা ছেলেকে সে সারাক্ষন কাজের জন্য রাখলো। মাঝে মধ্যে সে আমাদের এখানেও আসতেন। কারন এখানকার বাড়িটিকে বেচে তিনি কাশীতে পাকাপাকি ভাবে থাকতে চান। কিন্তু বাড়িটির খদ্দের হচ্ছিলো না। ওই সাসারামের ভদ্রলোকও দুই একবার ওনার সঙ্গে এসেছেন। সেই সূত্রে সাসারামের ভদ্রলোকের সঙ্গেও আমার আলাপ হয়।
তো বছর দুই আগে, সাসারামের সেই ভদ্রলোক, আমার সাথে দেখা করতে এলেন। তার কাছে শুনলাম, ভদ্রলোক সাসারামে তার বাড়িতে আসবার সময়, রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ির ধাক্কায় মারাত্মক ভাবে জখম হন। হাসপাতালে তিনিই দেখাশুনা করতেন। সেখানে অনেক টাকা পয়সা খরচ হলেও, ভদ্রলোককে আর বাঁচানো যায় নি। আর মৃত্যুর আগে, বাড়ির দলিল ইত্যাদি তার কাছে রেখে গেছেন। এখন ওই বাড়িটি তিনি বিক্রি করে, টাকা সংগ্রহ করতে চান।
সাসারামের ভদ্রলোক যখন আমাকে এইসব কথা বলছিলেন, তখন আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। ভদ্রলোক কাশীতে গিয়েছিলো, মুক্তির আশায়। সেখানে দেহ রেখে তিনি চিরমুক্তি চেয়েছিলেন। কিন্তু কি থেকে কি হলো ? কাশীতে গিয়েও তিনি মারা গেলেন সাসারামের হাসপাতালে। ঈশ্বর ওনার আত্মার শান্তি করুন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কাশীতে মৃত্যু হলেই কি আমাদের মুক্তি হতে পারে ? আপনি হয়তো বলবেন, এটা আমাদের একটা সংস্কার, এই কথার মধ্যে কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু এই কথা আমাদের হিন্দুশাস্ত্রেও বলা হয়েছে। তাহলে কি, বেনারাসকে বা কাশীর মাহাত্ম বৃদ্ধি করবার জন্য, মানুষকে আকর্ষণ করবার জন্য, এইসব কথা পণ্ডিত ব্রাহ্মণগণ লিখে রেখেছেন ? কাশীতে মৃত্যু হলেই যদি মুক্তি হয়, তবে তো আমাদের কর্ম্মের কোনো গুরুত্ত্বই থাকে না। সারাজীবন যাকিছু করি না কেন, মৃত্যুর আগে, কাশীতে গিয়ে দেহ ছাড়তে পারলেই, আমাদের মুক্তি অবশ্যাম্ভাবী। এর জন্য আলাদা ভাবে যোগ-সাধনার বা জ্ঞান সাধনার বা ভক্তি সাধনার কোনো দরকার নেই। আর আমাদের কৃত কর্ম্মের বা আমাদের দুষ্কর্ন্মের ফলও ভোগ করতে হবে না। তাহলে পাপ-আত্মা আর পুন্য-আত্মার মধ্যে কোনো ফারাকও থাকবে না। তো একদিকে ঋষিগণ বলছেন, সাধনবিনা মুক্তি নেই, আবার শাস্ত্র বলছে কাশীতে দেহ রাখলেই সাত-খুন মাপ। তো সত্য কি ? আজ আমরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো।
প্রথমে বলি, স্থান-মাহাত্ম-এর কথা আমরা সবাই বিচারবুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারবো, এমনটা নয়। আমাদের কাছে, বাহ্য দিক দিয়ে, কাশী-গয়া-বৃন্দাবন আর দিল্লী-মুম্বাই-কোলকাতাতে কোনো লৌকিক পার্থক্য নেই। কিন্তু যদি একটু গভীরভাবে নিজেকে প্রশ্ন করেন, তবে দেখতে পারবেন, আপনার বাড়ির সমস্ত ঘর থেকে আপনার ঠাকুর ঘরের মধ্যে যেন আলাদা একটা প্রশান্তির ভাব আছে। শহর কলকাতা আর দক্ষিণেশ্বরের মধ্যে, শ্যামবাজার আর কালীঘাটের মধ্যে কোথায় যেন একটা পার্থক্য অনুভব হয়। গঙ্গা নদীর তীরে, আর কাটাখালের পাড়ে কোথায় যেন একটা পার্থক্য আছে। এই অনুভূতি আমাদের ইন্দ্রিয়াতীত অনুভূতি। এই অনুভূতি কাউকে বোঝানো যায় না, কিন্তু মোটামুটি আমরা সবাই এই পরিবেশের পার্থক্য ধরতে পারি।
আমরা জানি, মৃত্যুকালীন অবস্থায়, আমাদের স্থুল শরীর ও সূক্ষ্ম শরীর আলাদা হয়ে যায়। এবং আমাদের সংস্কার অনুযায়ী গতিপ্রাপ্ত হয়। যতক্ষন পর্য্যন্ত স্থুল শরীর ও সূক্ষ্ম শরীর আলাদা না হচ্ছে, ততক্ষন এই গতি দেখা যায় না। একমাত্র তথাকথিত মৃত্যুর পরেই এই গতির শুরু হয়। এই গতি সবার ক্ষেত্রে একই রকম হয় না। আমাদের কর্ম্ম সংস্কার অনুযায়ী এই গতি লক্ষিত হয়। উর্দ্ধগতি, অধোগতি, বা তির্য্কগতি - ইত্যাদি অনন্তপ্রকার জটিল গতি পরিলক্ষিত হয়। আর এই গতির পরিচালকশক্তি হচ্ছে আমাদের কর্ম্ম-সংস্কার।
এখন কথা হচ্ছে, কাশী-গয়া-বৃন্দাবনে যখন স্থুল শরীর ও সূক্ষ্ম শরীর আলাদা হয়, তখন দেখা গেছে,সূক্ষ্ম শরীর বা লিঙ্গ শরীর আমাদের অন্নময় কোষ থেকে আলাদা হতেই এক তীব্র উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হয়। এই স্থানে প্রাকৃতিক ভাবেই হোক, বা এখানে বিভিন্ন রকম যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠানের কারণেই হোক, বা এখানকার বাতাসে মন্ত্রশক্তির প্রভাবে হোক, একটা তীব্র উর্দ্ধগামী আকর্ষণ শক্তি বিরাজ করছে। এখন এই তিন স্থান ব্যাতিত অন্য কোথাও এই তীব্র উর্দ্ধগামী আকর্ষণ শক্তির প্রবাহ নেই। বা হয়তো আছে, যেখানকার সম্পর্কে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। তাই বলা হয়ে থাকে কাশী-গয়া-বৃন্দাবনে জীব যখন স্থুল অন্নময় শরীর ছেড়ে সূক্ষ্ম শরীরসহ ভ্রাম্যমান হয়, তখন সূক্ষ্ম শরীর উর্দ্ধগতিসম্পন্ন হয়। অর্থাৎ সূর্যমুখী হয়ে যায়।
এখন কথা হচ্ছে, কথা হচ্ছে, এইসব কথার কোনো যুক্তি আছে কি না। জ্ঞানী-অজ্ঞানী, পাপাত্মা-পুণ্যাত্মা, ভালো মানুষ খারাপ মানুষ, সবার কি একই গতি হয়, যদি যে কাশীবাসী হয় ? সাধারণ মানুষ, অর্থাৎ আমাদের দৃষ্টিতে যারা অজ্ঞানী তাদের গতি আর একজন জ্ঞানী বা যোগীপুরুষের গতি কি একই রকম হয় ? দেখুন এই সব কথা যুক্তি দিয়ে কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়। এটি অনুভবলব্ধ জ্ঞান। মৃত্যুর পরে কেউ এসে বলেনি যে আমার মৃত্যু কাশীতে হবার ফলে আমার লাভ হয়েছে। দেখুন, গাছে ফল পাকলে, সাধারণত মাটিতে ঝরে পড়ে। অর্থাৎ পাঁকা ফলের গতি নিম্নমুখী। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু বাগানের মালিক যদি গাছ থেকে ফল নিজের হাতে পারেন, তবে, ফলের গতি মালির ইচ্ছেমতো হতে পারে। ঠিক তেমনি আমাদের প্রারব্ধ কর্ম্মের ভোগ সম্পন্ন হলেই আমাদের সূক্ষ্ম শরীর স্থুল শরীর থেকে আলাদা হয়ে যায়। আবার যোগীপুরুষগন যোগবলে স্থুল শরীর থেকে সূক্ষ্ম বা লিঙ্গ শরীরকে আলাদা করতে পারেন, নিজের ইচ্ছে অনুসারে, এই জীবিত অবস্থাতেই, জীবনকালেই । এবং দেখা গেছে, যোগীগণ যখন এই যোগক্রিয়া অনুষ্ঠান করেন, তখন স্থানে ভেদে এই কাজ সহজ অথবা কষ্টসাধ্য হয়ে থাকে। পাহাড়ে, নির্জনে, বা তীর্থক্ষেত্রে এই কাজ যত সহজে সম্পন্ন হয়, অন্যত্র এই কাজ সহজে আয়ত্ত্বে আসে না। যোগীগণ যখন এই কাজের অভ্যাস করেন, তখন তাঁরা দেখেছেন, লিঙ্গ বা সুক্ষ শরীরকে স্থুল শরীর থেকে মুক্ত করে, যখন বাইরে আসেন, তখন বাহ্য জগতের বিচিত্র আকর্ষণ অনুভব করেন। আর এই যে আকর্ষণশক্তি এবং লিঙ্গশরীরে যে কর্ম্মসংস্কার এই দুয়ের মধ্যে প্রাধান্য হেতু, লিঙ্গশরীরের গতি নির্ধারিত হয়। যোগীপুরুষগন অনুভব করেছেন, স্থানবিশেষে এই যোগাভ্যাস কালে, লিঙ্গ শরীর অন্নময় শরীর থেকে পৃথক হবার সঙ্গে সঙ্গে অচিন্ত শক্তির আকর্ষনে উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হয়। তখন যোগীর কর্ম্ম-সংস্কারও কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। এই অবস্থা হলে বুঝতে হবে, এখানে বা এই স্থানের কিছু বিশেষ মাহাত্ম আছে। বিশেষভাবে অনুভূতিসম্পন্ন যোগীপুরুষগন এই অচিন্ত্যশক্তির অনুভব এই কাশী-গয়া-বৃন্দাবনে বিশেষ ভাবে উপলব্ধি করেছেন।
এইজন্য স্বীকার করতেই হয়, এইসব জায়গায় যখন আমাদের স্থুল শরীর ত্যাগের ক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়, অর্থাৎ আমরা যখন তথাকথিত মৃত্যু বরণ করি, তখন আমাদের সূক্ষ্ম শরীর স্বাভাবিক থেকে বেশী উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হয়। আর চৈতন্যশক্তির অধিক সান্নিধ্য অনুভব করে থাকি।
তবে একটা জিনিস জানবেন, কর্ম্মসংস্কার ভিন্ন অর্থাৎ যথাযথ জ্ঞানযোগ ভিন্ন উর্দ্ধগতি লাভ করা সম্ভব নয়। তাই যথার্থ জ্ঞানযোগী যেখানেই স্থুল শরীর ত্যাগ করুন না কেন, তিনি অবশ্য়ই উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হবে। আবার যাদের কৰ্ম্মসংস্কার যেমন তাদের তেমনই উর্দ্ধগতি বা তির্য্কগতি লাভ হবে। অজ্ঞান আমাদেরকে নিম্নগতির দিকে ধাবিত করে, আবার জ্ঞান আমাদের উর্দ্ধের দিকে আকর্ষণ করে। কাশীতে আসলে এই জ্ঞানের চর্চা যুগ-যুগ ধরে চলে আসছে। বলা হয়ে থাকে কাশী জ্ঞানপীঠ। তাই কাশীতে শুধু শরীর নিয়ে বসবাস করলেই হবে না। কাশীতে যে জ্ঞানের চর্চা আবহমান কাল ধরে হয়ে আসছে, তার সঙ্গে নিজেকে সংযোগ করতে হবে। তবেই কাশীর এই বিশেষ মাহাত্ম আমরা অনুভব করতে পারবো। আর এর উপযোগিতা উপলব্ধি করতে পারবো। শাস্ত্রকারেরা কি বলেছেন, সেটি বড়ো কথা নয়, শাস্ত্রকারীদের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে, নিতান্ত সেখানে একটা বাড়ি করে বাস করলেই হবে না। তাই যদি হতো, তবে শিবলিঙ্গের পুজো না করে পাহাড়ের পুজো আরো ভালো ফল দিতে পারতো। পাহাড়ে গেলেই যদি সাধন হতো, তবে সমস্ত পাহাড়বাসীই উচ্চকোটির সাধক হতে পারতেন। তা কিন্তু নয়। আবার স্থান মাহাত্মের কথা আমাদের স্বীকার করতেই হয়। বিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ থাকে, খেলার মাঠে খেলার পরিবেশ থাকে। সিনেমা হলে বিনোদনের ব্যবস্থা থাকে। এটা যেমন অস্বীকার করবার উপায় নেই, তেমনি বিশেষ বিশেষ স্থানে যোগের পরিবেশ আছে, বিশেষ বিশেষ স্থানে অধ্যাত্ম পরিবেশ আছে। আমাদের সেই পরিবেশেই বাঞ্চিত শিক্ষা সহজে উপলব্ধ হতে পারে। তো কাশীতে যে জ্ঞানের প্রবাহ চলছে, সেই জ্ঞানের প্রবাহে নিজেকে অবগাহন করতে হবে। বৃন্দাবনে যে ভক্তির প্রবাহ চলছে, গয়াতে যে যোগের ঐশ্বর্যের প্রবাহ চলছে তার সান্নিধ্য আসতে হবে। তবেই আমার স্থান-মাহাত্ম হিসেবে কাশীর এই বিশেষত্ত্ব গ্রহণে সক্ষম হবো।
সবশেষে বলি, আমাদের যে প্রারব্ধ কর্ম্ম তার ফল, তা সে সুখ হোক বা দুঃখ যাই হোক না কেন, আমরা যদি উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হই, তাহলেও সেসব আমাদের ভুগতে হবে। তবে জ্ঞানের উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন কর্ম্মের জন্ম হয় না, নতুন কর্ম্মফল সঞ্চিত হয় না । পুরাতন কর্ম্মের ফল ভোগও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যায়। আর যখন জ্ঞানের পূর্নতা আসে, তখন মানুষ মুক্তির অধিকারী হয়। এখানে কোনো বৈষম্য নেই। ঈশ্বরের কানুন সর্বত্র একই থাকে। মুক্তি একমাত্র ভগৎকৃপাতেই ঘটে থাকে। মানুষের কি সাধ্য আছে, মুক্তি লাভ করে ?
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
No comments:
Post a Comment