Sunday, 28 March 2021

পরের জন্মে কোন দেহপ্রাপ্তি হবে ?

 


পরের জন্মে কোন দেহপ্রাপ্তি হবে ?
পর্ব -১
এক ব্রহ্মচারী সাধুর সাথে আমাকে মাঝে মধ্যে কথা বলতে হয়। তিনি একসময় সংসার করেছেন।  তাঁর একটা মেয়ে আছে। এখন তিনি ব্রহ্মচারী। তার আশ্রমে প্রচুর দান আসে। সরকারি সাহায্যও নাকি পেয়ে থাকেন।  তিনি অনেক সমাজসেবামূলক  কাজও  করে থাকেন। ইনি দান-ধর্ম্মকে সর্বশ্রেষ্ট ধর্ম্ম বলে মনে করেন। ইনি তার শিষ্যদেরকে দান দেবার জন্য উৎসাহিত করে থাকেন।  বলেন : কি নিয়ে এসেছিলে ? যা কিছু পেয়েছো, তা এখন থেকেই পেয়েছো। খালি হাতে এসেছো, খালি হাতেই চলে যেতে হবে। অতএব দানধ্যান করে কিছু পুন্য সঞ্চয় করে যাও। 

এখন  প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কেউ খালি হাতে এসেছিলাম কিনা, বা আমাদের খালি হাতে যেতে হবে কি না। আসলে বিষয় সম্পত্তি আমরা কেউ নিয়ে আসিনি, এটা সত্যি, আবার এই বিষয়সম্পত্তি  আমরা সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবো না,  এটাও সত্যি। কিন্তু আমি তো জন্মের পর থেকেই দেখছি, আমার বাপের অঢেল সম্পত্তি। আমার পূর্ব জন্ম যদি থেকে থাকে তবে আমি তো মনে করতেই পারি  যে এই অঢেল সম্পত্তি আমার পূর্ব  জন্মে অর্জিত হয়েছিল। আবার  যদি মনে করি, যে আজ  এই যে বিষয়সম্পত্তি আপনি আজ সংগ্রহ করছেন, এর কিছুই বিফলে যাবে না, এই বিষয়সম্পত্তি ভোগ করবার জন্যই আপনাকে আবার সেই পরিবারে জন্ম গ্রহণ করবেন, যেখানে আপনি বিষয়সম্পত্তি গচ্ছিত রেখে যাচ্ছেন। মানুষ যে গরিব বা ধনীর ঘরে জন্ম গ্রহণ করে থাকে এর মূল কারন এই বিষয়-সম্পদ সংগ্রহের প্রবৃত্তি। এই সিদ্ধান্ত  যদি আমরা মেনে নিতে পারি, তবে গরিব-বড়োলোক ঘরে জন্ম গ্রহণের একটা যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে।   আপনি জানবেন, পাপ হোক বা পুন্য হোক, ভালো হোক বা খারাপ হোক,  কর্ম্ম যদি আমার হয়, তবে তার ফলও আমার। আর বলা হয়ে থাকে কর্ম্মফল ভোগবিনা নিস্পত্তি হয় না।   

 আসলে কিন্তু  কেউ আমরা খালি হাতে আসিনি, আবার কেউই খালি হাতে যেতেও  পারবো না। আমরা আমাদের পূর্বপূর্ব জীবনের সংস্কার নিয়ে এসেছি, আবার আমরা নতুন সংস্কার নিয়ে দেহ ত্যাগ করবো।এখন কথা হচ্ছে, এ জন্ম তো গেলো, পরের  জন্মটা আমার কেমন হবে। আবার কি আমি লেখক, শিল্পী, ডাক্তার, শিক্ষক হবো ? মহাত্মাগণ বলছেন, এটা নির্ভর করছে, আপনার নতুন সংস্কার ও সময়-পরিবেশ-পরিস্থিতির উপরে। 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যোগভ্রষ্ট ব্যক্তির ইহলোকে বা পরলোকে কোথাও বিনাশ নেই। কল্যাণকামী ব্যক্তি কখনো দুর্গতিপ্রাপ্ত হন না। এঁরা পুন্যকর্ম্ম হেতু, স্বর্গলোক প্রাপ্ত হন, এবং সেখানে দীর্ঘকাল বাস করবার পরে, ধনীর গৃহে অথবা জ্ঞানবান যোগীর কূলে জন্ম গ্রহণ করে থাকেন। (গীতা-৬/৪১-৪২)

আমরা লক্ষ করেছি,  ভগবান বুদ্ধ, মহাবীর, মীরাবাঈ এরা  সবাই রাজকুলে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। হ্যাঁ সব মহাপুরুষ যে রাজপরিবারে বা ধনীর গৃহে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন, তা নয়, ধনীর গৃহে তারাই জন্মান, যারা পূর্বজীবনে ধনসংগ্রহ করেছিলেন, আর যারা পূর্বজীবনে জ্ঞান সংগ্রহে ব্যস্ত ছিলেন, তারা  সেই পরিবেশেই জন্ম গ্রহণ করে থাকেন, যেখানে জ্ঞানের চর্চা করতে পারেন। আর যারা যোগ অনুশীলন করতে করতে দেহ ত্যাগ করেছিলেন, তারা সবাই যোগের পরিবেশেই বা সেই ধরনের পরিবারেই জন্মলাভ করে থাকেন। 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবার বলছেন, মানুষ মৃত্যুকালে যে-ভাব স্মরণ করতে করতে দেহত্যাগ করে, সে সেই ভাবে তন্ময়চিত্ত  থাকায় সেই ভাবই প্রাপ্ত হয়ে থাকেন । অর্থাৎ  যেমন চিন্তা নিয়ে দেহ ত্যাগ করেন, পরবর্তীতে সেইমতো দেহপ্রাপ্ত হন। (গীতা -৮/৬) 

এখন কথা হচ্ছে, আমি যে কি চিন্তা করবো, তার নিয়ন্ত্রক কে ? আপনি বলতেই পারেন, কেন আমিই তো চিন্তা করছি, তাই আমিই আমার চিন্তার প্রবর্তক, নির্ধারক, পরিচালক। কিন্তু এই "আমি"  যে কে তা কি আমরা জানি ? যাইহোক, প্রসঙ্গ পাল্টাবো না। ভবিষ্যতে আমার কোন ধরনের দেহ হবে, কোথায়,  কোন বংশে, কোন জাতিতে আমার জন্ম হবে সেই আলোচনাতেই থাকবো।   

এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলি, কেউ কেউ  মনে করেন, চুরাশি লক্ষ যোনী পরিভ্রমের পরে, জীব মনুষ্যদেহ পরিগ্রহ করেছে। এখন মনুষ্যদেহ লাভ করবার পর, যদি সে পশুবৎ আচরণ করেন, বা পশুর প্রতি আসক্ত বা মোহ -সম্পন্ন হন, তবে তিনি  আবার পশুযোনিতে জন্মগ্রহণ করবেন । এই প্রসঙ্গে রাজা  ভরত-এর দৃষ্টান্ত  দেওয়া হয়।   কেউ বলেন,  একবার মনুষ্যদেহ লাভ করবার পর, আর তাকে পশুযোনিতে ফিরে যাবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। মনুষ্যদেহ ছেড়ে জীবাত্মা আবার মনুষ্য দেহেই অনুপ্রবিষ্ট হয়ে থাকে। তবে সংস্কার যদি পশুবৎ হয়, তবে তার আচরণের মধ্যে পাশবিক প্রবৃত্তির প্রকাশ ঘটবে। আমরা মনে করি, মানুষ কখনো পশুযোনিতে প্রবিষ্ট হতে পারে না। মানুষ আবার মানুষ হয়েই জন্ম গ্রহণ করবে।  তবে হ্যাঁ তার আচরণ, স্বভাব যেমন মনুষ্যচিত  হতে পারে, আবার পশুবৎ হতে পারে। আমরা তো চোখের সামনে দেখতেই পাই কতো মানুষ ঘৃণ্য জীবন বহন করছে।   

যাই হোক, এখন কথা হচ্ছে, আমাদের পরবর্তী জন্ম কেমন হবে। শ্রী প্রনাবন্দ বলতেন, প্রতিদিন মৃত্যুচিন্তা করবে। এই কথাটার একটা তাৎপর্য্য আছে। আসলে আমরা কেউ জানিনা, কখন আমরা মারা যাবো। আজ বেঁচে আছি, কালকের প্রভাতসূর্য্য আমরা দেখতে পারবো কি না তা আমরা জানি না। তাই দেহে যতক্ষন প্রাণ আছে, তার প্রতিটি মুহূর্তই খুব গুরুত্ত্বপূর্ন। মৃত্যুমুহূর্তের চিন্তা-ভাবনা আমাদের পরবর্তী শরীর প্রাপ্ত হতে সাহায্য করবে, পরবর্তী জীবনকে প্রভাবিত করবে । তাই আমাদের মধ্যে যদি মৃত্যু চিন্তা থাকে, তবে আমরা অবশ্য়ই শুভ চিন্তায়, হিত  চিন্তায় সময় অতিবাহিত করবো।  তাতে করে, আমাদের ভবিষ্যৎ জীবন  অবশ্য়ই  উচ্চ তরঙ্গে প্রবাহিত হবে।  

স্বামীজী বলছেন, আমাদের পরিণত বয়সের ভাবধারা আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনের ইঙ্গিত বহন করে থাকে। পরিণত বয়সে যারা মৃত্যুর সম্মুখীন হন, তাদের ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ দেহপ্রাপ্তির সম্ভাবনা সম্পর্কে কিছু ধারণা দেওয়া যেতে পারে, । কিভাবে আপনি শেষ জীবন কাটাচ্ছেন, তার উপরে নির্ভর করছে আপনার ভবিষ্যৎ জীবনের দেহপ্রাপ্তির। আমরা যাকিছু করি, তা সে ভালো মন্দ যাই হোক না কেন, আমাদের সমস্ত কাজেরই একটা প্রভাব আমাদের অবচেতন মনের উপরে একটা ছাপ  ফেলে। আমরা দেখেছি, শেষ জীবনে বা বলা  যেতে পারে অবসর জীবনে বেরিয়ে আসে আমাদের মূল-ইচ্ছে, যা আমি সারা জীবনে পূরণ করতে পারিনি।  অর্থাৎ আমরা পড়াশুনা করেছি, চাকরি করেছি, এমনকি সংসার করেছি, অন্যের প্রভুত্ব  মেনে। সমাজের নিয়ম  মানতে গিয়ে আমাদের ভিতরের সুপ্ত ইচ্ছেগুলোকে কোনো গুরুত্ত্ব দিতে পারিনি।  কিন্তু অবসর জীবনে এসে, বা শেষ বয়সে এসে, আমাদের সেই মূল ইচ্ছে বা আমাদের ভিতরের প্রবণতাকে কার্যকরী করবার দিকে আমরা ঝুঁকতে পারি। এই সময়েই আমাদের মধ্যে ধর্ম্ম-জিজ্ঞাসা জেগে ওঠে, এই সময় আমাদের ঈশ্বর-পিপাসা জেগে ওঠে। তাই এই বয়সের অর্থাৎ ৬০ বা তার উর্দ্ধের বয়সের মানুষকে দেখে  তার আচরণের বিচার করলে একটা আভাস মিলতে পারে, তার পরজন্ম কেমন হবে। 

এই প্রসঙ্গে স্বামীজী  বলছেন, আমাদের সংস্কারগুলো থাকে আমাদের অবচেতন মনে। আর মানুষের চেতনার স্থিতি কোথায় অবস্থান করছে, সেই দিকে খেয়াল করলেই, অর্থাৎ আমাদের যে ছয়টি গ্রন্থিচক্র  আছে তার কোন চক্রে  তার মন ঘোরাফেরা করছে, সেটা খেয়াল করলেই, তার ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে একটা ধারণা আমরা পেতে পারি। 

এর আগে আমরা গ্রন্থিচক্র  সম্পর্কে যখন আলোচনা করেছিলাম, তখন আমরা জেনেছিলাম যে মন বলে আসলে কোনো বস্তু বা অঙ্গ  আমাদের শরীরে নেই। এই যে চিন্তা-ভাবনা আমাদের মধ্যে প্রতিনিয়ত উদয় হচ্ছে, যাকে আমরা মনে কাজ বলে আখ্যা দিয়েছি,  এসব আসলে গ্রন্থিচক্রের মধ্যে যে রস অর্থাৎ হরমোন নিঃসৃত হচ্ছে তার  তরঙ্গ, বিদ্যুৎ তরঙ্গ। তাই যে গ্রন্থিচক্রের রসে  যখন তরঙ্গ আন্দোলিত  হয়, সেইমতো আমাদের চিন্তার ধারা প্রবাহিত হয়। 

আর এই গ্রন্থি চক্রগুলোর মধ্যে যেগুলো আমাদের শরীরের উপরের দিকে অবস্থান করে, তার  বেশিরভাগ গ্রন্থি চক্র  আমাদের মতো সাধারণ মানুষের নিষ্ক্রিয় থাকে। কিন্তু নিচেরদিকের গ্রন্থিচক্রগুলো রস নিঃসরণ ক্ষমতা  বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে অধিক ক্রিয়াশীল হয়  আবার বয়সের শেষে স্বাভাবিক ভাবেই স্তিমিত হতে থাকে।  আর উপরের দিকের গ্রন্থিচক্র গুলোর মধ্যে রস নিঃসরণক্রিয়া  আমাদের আমাদের কিছু অভ্যাসের দ্বারা জাগ্রত করতে হয়, অর্থাৎ এইসব চক্রের হরমোন রসে স্পন্দন তুলতে হয় । আর আপনি উপরের দিকের চক্রগুলোকে যত  ক্রিয়াশীল করতে পারবেন, তত আপনার চিন্তার মধ্যে একটা উচ্চভাব ফুটে উঠবে। 

এই গ্রন্থি চক্রগুলো ক্রিয়াশীল হয় আমাদের জ্ঞানীন্দ্রিয়গুলোর সাহায্যে। অর্থাৎ চক্ষু-কর্ন-নাসিকা-জিহ্বা-ত্বক এর সাহায্যে। 
 
মূলাধার চক্র বা বরুন গ্রন্থি : আপনারা যারা ধ্যানের  অভ্যাস করেন, তারা জানেন, মূলাধারে আমাদের মনকে বেশিক্ষন রাখতে নেই। তার কারন হচ্ছে, এখানে আছে, মূত্রগ্রন্থি,(KIDNEY)  প্রজাপতি গ্রন্থি, - TESTIS কন্দর্পগ্রন্থি PROSTATE  GLAND,   মদন গ্রন্থি, COWPERS GLAND মাতৃগ্রন্থি বা OVARY রতি গ্রন্থি, মিথুন  গ্রন্থি।  আবার এই মিথুন গ্রন্থিতেই আছে,  এমনসব উপগ্রন্থি যা আমাদের শরীরের রক্ষাকারী জীবাণু উৎপাদন করে থাকে। তো আমাদের বরুন গ্রন্থি যদি সক্রিয় থাকে তবে মানুষ বৈষয়িক জগতে জগতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে থাকেন। এবং তাদের চিন্তাধারার মধ্যেও দৈহিক ও বৈষয়িক বিষয় ঘোরাফেরা করে। 
  
মনিপুর চক্র বা অগ্নিগ্রন্থি :  এখানে থাকে আমাদের প্লীহা, যকৃৎ, অগ্ন্যাশয়। সূর্য যেমন আমাদের পৃথিবীর সমস্ত জীব, জন্তু উদ্ভিদকূলকে বাঁচিয়ে রেখেছে, তেমনি আমাদের এই মনিপুরের অগ্নিতত্ত্ব আমাদেরকে সজীব করে রেখেছে।  এই অগ্নি প্রধান লোকেরা হন, তেজস্বী, উদ্দমী। এবং এদের চিন্তাধারার মধ্যেও দেহ ও বৈষয়িক বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। 

অনাহত চক্র  বা বায়ু গ্রন্থি :  বুকের মধ্যে আছে আমাদের ফুসফুস, হৃদযন্ত্র, এবং প্রাণকোষ নির্মাণকারী গ্রন্থি। আমরা জানি বায়ু আমাদের দেহের প্রধান রক্ষক ও পরিচালক। বায়ু গ্রন্থি  যাদের সক্রিয় থাকে তারা আত্মজয়ী বিশুদ্ধ স্বভাবের হয়ে থাকেন। এরা  সংসারে থাকলেও ঈশ্বরমুখী হন। 

আজ্ঞা চক্র বা অহং গ্রন্থি   অহং তত্ত্বের স্থান আমাদের ললাট প্রদেশ। আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের পরিচালন শক্তি নিহিত আছে, এই ললাট দেশে। মানুষের মধ্যে যখন জীবন-জিজ্ঞাসা জাগে, জানবেন তখন মানুষ আজ্ঞাচক্রে অবস্থান করছেন। এইসময় সাধনপথ, ধর্ম্ম পথ এদের সহায় হয়।  এরা  পরবর্তী জীবনেও এই সাধনজীবনে আগ্রহী হয়ে থাকে। এবং সেইমতো দেহ-পরিবার পিতা-মাতা  পেয়ে থাকেন।

এখন এই যে চেতনার স্থিতি অর্থাৎ আমি কোন ধরনের মানুষ, আমার ভাবধারা কি, আমার জীবনের উদ্দেশ্য কি, এই সম্পর্কে আমার ভাবনাগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়,  গ্রন্থির ক্রিয়ার উপরে। আর এই গ্রন্থিগুলো ক্রিয়াশীল হয় তখনই যখন আমরা গ্রন্থি সম্পর্কে মনোযোগী হই।   

এই যে ভবিষ্যৎ জীবনের ধারণা, এই ধারণার ব্যতিক্রম নেই তা নয়। তবে, সবার ক্ষেত্রেই পরিবেশ, পরিস্থিতি, সৎসঙ্গ প্রত্যেক মানুষকেই যে কোনো মুহূর্তে পরিবর্তন করতে পারে।  তাই জীবনের সর্বোচ্চ পর্যায় নির্ভর করে, বর্তমান জীবনের চিন্তা-ভাবনা থেকে। এবং বর্তমান জীবনের চিন্তা ভাবনায় পরিবর্তন এলে ভবিষ্যৎ জীবনেরও পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। 

তাই আমাদের যাদের বয়স হয়েছে, বিশেষ করে যারা ষাট বছর অতিক্রম করেছেন, তাদের চিন্তাধারায় ধীরে ধীরে পরিবর্তন আনবার চেষ্টা করুন। মনে রাখবেন, আপনার শেষ বয়সের চিন্তাই আপনার ভবিষ্যৎ জীবন গড়ে দেবে। ভবিষ্যতে আপনি কেমন পিতা-মাতা পাবেন, কেমন ঘরে জন্ম গ্রহণ করবেন, কেমন দেহ পাবেন, সবই নির্ভর করছে, আপনার আজকের মানসিক স্থিতির উপরে। ভুলে যান আগে আপনি কি চিন্তা করেছেন, কি কাজ করেছেন, আজ থেকে আপনি শুভ চিন্তায়, ঈশ্বর চিন্তায় অতিবাহিত করুন। আপনি কি করছেন, সেটা বড়ো  কথা নয়, আপনার মধ্যে কি ধরনের চিন্তার প্রবাহ চলছে সেটাই আপনার ভবিষ্যৎ  জীবন, ভবিষ্যৎ দেহপ্রাপ্তির কারন হবে।   

যেমন ধরুন, কারুর মন ঘোরাফেরা করছে, মূলাধারে - তো তিনি বলা যেতে পারে, নিতান্তই একজন সাধারণ মানুষ। অর্থাৎ তার চিন্তার মধ্যে জৈবিকশক্তি বেশি ক্রিয়াশীল। দৈহিক চিন্তা, দৈহিক অস্তিত্ত্বই তার কাছে গুরুত্ত্বপূর্ন। এদের সাথে যদি আপনি কথা বলেন, তবে শুনবেন, তারা এই বয়সে এসে দৈহিক ভালো-মন্দের কথা বেশি ভাবছেন। আর বলবেন না দাদা, কালকে একটু বেশি খাওয়া হয়েছিল, আজ বোধহয়, প্রেসার-সুগার বেড়েছে। হাঠুতে ব্যথা, রাতে ঘুম হয় না। ইত্যাদি ইত্যাদি।  আর সত্যি কথা বলতে কি, এই বয়সে এসে সবারই শরীর একটা রোগের বাসা হিসেবে কাজ করে থাকে। এরা শরীর  সচেতন, শরীর নিয়ে সারাক্ষন চিন্তা করছেন,  ডাক্তার এদের নিত্যসঙ্গী। আত্মীয়-স্বজন, টাকা-পয়সা, বিষয়সম্পত্তি এইসব নিয়েই এরা সারাক্ষন চিন্তা করছেন। তার এই যে চিন্তা-ভাবনা, এই চিন্তা ভাবনা নিয়েই একসময় সে দেহ ত্যাগ করবেন ।  এবং পরবর্তী জীবনেও একটা গতানুগতিক জীবনেই তারা ফিরে আসবেন। এই ধরনের মানুষকে তামসিক চরিত্রের মানুষ বলা যেতে পারে। 

স্বাধিষ্ঠান চক্র : আমরা দেখেছি, কিছু মানুষ বৃদ্ধ বয়সেও প্রাণ শক্তি উচ্ছল।  এই বয়সেও তারা হৈচৈ করতে ভালোবাসেন। এমনকি এইবয়সে নতুন করে তারা সংসার পাততে পারেন। এদের মন স্বাধিষ্ঠান চক্রে  অবস্থান করে থাকে। এদের শরীর খারাপ থাকলেও, এরা প্রাণবন্ত। স্বামীজী বলছেন, এরা  ভবিষ্যৎ জীবনে প্লেয়ার, নেতা, এমনকি ভালো ব্যবসায়ী হতে পারেন। তবে এদের মধ্যে প্রাণশক্তির অর্থাৎ পঞ্চবায়ুর মধ্যে যদি অসাম্য থাকে, তবে এরা  পাড়ার মাস্তান, নীতিহীন কিন্তু শক্তিশালী পুরুষ হতে পারেন, পরবর্তী জীবনে। অর্থাৎ এরা যাকিছুই করুক না কেন, তার মধ্যে অদম্য প্রাণশক্তি কাজ করবে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে, পরবর্তী জীবনের পরিবেশ-পরিস্থিতির উপরে।

এখানে মন থাকলে মানুষ হয় রাগী, খিটখিটে, সব সময় অন্যের দোষ ধরতে ওস্তাদ, সবসময় একটা দাদাগিরি ভাব। সংসারকে এরা নিজের জমিদারি ভাবেন । কিন্তু সাহসী, ঝুঁকি নিয়েও কাজে উৎসাহী।  এরা অন্যদের জোরকরে  নিজের বশীভূত থাকতে বাধ্য করে থাকেন । স্বামীজী বলছেন, এরা  পরবর্তী জীবনে মিলিটারি, পুলিশ, হতে পারেন । পর্বত আরোহী, সমুদ্র যাত্রা করতে পারেন।  শিকারী অর্থাৎ সাহসী হবার সম্ভাবনা।

অনাহত চক্রে যাদের মন স্থিত, তারা হন কোমল স্বভাবের। এরা  সৃজনশীল শিল্পী।  এরা  অন্যায়কে সমর্থন করেন না, কিন্তু প্রতিবাদও করতে পারেন না, তারা ভিতরে ভিতরে কষ্ট  অনুভব করেন। এরা ভবিষ্যৎ জীবনে শিল্পী, সাহিত্যিক, সমাজসেবী হয়ে  করে থাকেন। শরীরে বায়ুর ভারসাম্যের অভাবে এরা হন, ছিঁচ কাঁদুনে, ভীতু। 

বিশুদ্ধ চক্র বা  : এরা হন বাকপটু, এদের মধ্যে পান্ডিত্য ও স্মৃতিশক্তি বেশি থাকে। পরজন্মে ইনি হতে পারেন, শিক্ষক, দার্শনিক, সাংবাদিক, বিজ্ঞানী। কিন্তু বায়ুশক্তির ভারসাম্যের অভাবে এরাই হন, সবজান্তা নির্বোধ, অহংকারী বাক্যবাগীশ। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

অকালমৃত্যু রোধের উপায় : তথ্যসূত্রঃ  খাদ্যনীতি এবং শিশুপালন-বিধি - শ্রীমৎ স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী 

অকালমৃত্যু রোধের উপায় - 
ঠাকুর থাকবে কতক্ষন, ঠাকুর যাবে বিসর্জন। (১)  পুনঃ প্রচার। 

অকালমৃত্যু প্রতিরোধের উপায় জানতে গেলে আমাদের আগে জানার দরকার, আমরা কতদিন বাঁচতে পারি। অর্থাৎ আমরা যে মনুষ্যদেহ পেয়েছি তা প্রাকৃতিক ভাবে কতদিন বেঁচে থাকতে পারে । জীবের যখন সুস্থ সবল সন্তানের জন্ম দেবার ক্ষমতা জন্মে জানবেন, তখনই স্বাভাবিক দৈহিক বৃদ্ধি সমাপ্ত হয়েছে। অর্থাৎ তার দেহের বৃদ্ধিকাল সমাপ্ত হয়েছে। আর এই সময়কালকে ধরে একটা জীবের মৃত্যুকাল  বা আয়ু পরিমাপ করা হয়ে থাকে। তা সে জীবজন্তু বলুন, উদ্ভিদ বলুন, সবারই জীবনসীমা এই হিসেবে  পরিমাপ করা হয়ে থাকে। (ব্যতিক্রম হচ্ছে  ঔষধী উদ্ভিদ যা একবার মাত্র সন্তান অর্থাৎ ফুল-ফল-বীজের জন্ম দিয়ে মারা যায়।) সাধারনতঃ দেখা যায়, আমাদের যখন দেহবৃদ্ধি সমাপ্ত হয়, এর পরেও ৩-৫ বছর পরে আমরা পরিণত মনের অধিকারী হয়ে থাকি। আর দেহ বৃদ্ধির সময়কাল  থেকে ৫/৬গুন্ সময় এই দেহ জীবিত থাকতে পারে।
 ধরুন, একটা গরু ৪ বছর বয়সে সন্তান ধারনের ক্ষমতা লাভ করে, তো সেক্ষেত্রে গাভীর আয়ু হতে পারে ৪*৫/৬ অর্থাৎ ২০-২৪ বছর। আবার একটা বিড়াল ধরুন ১.৫ বা ২ বছরে সন্তান ধারনের ক্ষমতা অর্জন করে, তো সেক্ষেত্রে বিড়ালের আয়ু হতে পারে ১০-১২ বছর। একজন পুরুষের দেহ সম্পূর্ণ বৃদ্ধি পেতে অন্তত ২৪-২৫ বছর সময় লাগে অর্থাৎ পুরুষ  সুস্থসবল  সন্তানধারন করবার ক্ষমতা অর্জন করে থাকে ২৫ বছর বয়সে। আর পরিণত মনের অধিকারী হতে আরো তিন-চার বছর সময় লাগে।  তো সেই হিসেবে, একজন পুরুষের আয়ু হতে পারে, ১০০ থেকে ১২৫ বছর।  আবার একজন মহিলার মা হবার ক্ষমতা, দেহের সম্পূর্ণ বৃদ্ধি হতে অন্তত ১৮-২০ বছর লাগে, আর পরিণত মনের অধিকারী হতে ২১-২২ বছর সময় লাগে । সেইজন্য একজন মহিলার আয়ু হতে পারে ৯০-১১০ বছর। এই হিসেবে মানুষের গড় আয়ু ধরা হয়েছে ১০০ বছর। আমাদের বেদ-উপনিষদে আমরা দেখতে পাই, সুস্থদেহে জীবিতকাল ১০০ বছর থাকার জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। 

ওঁং তৎ-চক্ষুর-দেব-হিতং পুরস্তাচ্ছুক্রমুচ্চরৎ।
পশ্যম শরদঃ শতং জীবেম শরদঃ শতং। 
শৃনুয়াম শরদঃ শতং প্রব্রবাম শরদঃ শতমদীনাঃ। 
স্যাম শরদঃ শতং ভূয়শ্চ শরদঃ সতাৎ।। 

হে দেবতাদের হিতকারী চক্ষুস্বরূপ আদিত্য,  তুমি শুদ্ধ-আলোক নিয়ে পূর্বদিকে উদিত হোচ্ছ।  তোমার প্রসাদে তোমারি মহিমাকে যেন  শতবছর  দেখি, আমরা যেন শত বছর বেঁচে থাকি। শত বছর তোমার কথা শুনবো, তোমার আজ্ঞা পালন করবো। শত বছর তোমার গুন্-কীর্তন করবো। শত বছর অ-দীন অর্থাৎ স্বাধীন হয়ে বাঁচবো। শত বছরের অধিক যেন এইভাবে বেঁচে থাকি।

এই যে বৈদিক প্রার্থনা এর থেকে বোঝা যায়, মানুষের আয়ু কম বেশি একশত বছর । আর এই বয়সের অর্থাৎ ১০০-১২৫ বছরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আমাদের দেশে বা বিদেশে যথেষ্ট সংখ্যক আছেন। যাইহোক, আমাদের এই স্থুল দেহ ১০০ থেকে ১২৫ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকবার কথা থাকলেও, আজ অধিকাংশ মানুষ তার আগেই দেহ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। যদিও আমাদের এই স্থুল দেহের লয় হলেও, আমাদের মানস  দেহের্ সমাপ্তি ঘটে না। মানসিক উন্নতির  ধারা আর স্থূল দেহের  পরিণতির ধারা সমবেগে ধাবিত হয় না। মানস শরীরের গতি তুলনামূলক ভাবে শ্লথ। ব্যক্তি ভেদে বা কর্ম্ম ভেদে বা ভাবনা চিন্তা ভেদে, এই মানসিক উন্নতির গতি ভিন্নতর। 

একটা কথা মনে রাখতে হবে, যে আমরা দেহ ধারণ করি, কর্ম্ম করবার জন্য। আর এই কর্ম্মের উৎপত্তি হচ্ছে আমাদের চিন্তা-ভাবনা। আর এই চিন্তা ভাবনার উৎপত্তি হচ্ছে আমাদের বাসনা-সংকল্প। আর এই বাসনা-সংকল্পের উৎপত্তি হচ্ছে ইচ্ছেশক্তি। আর এই ইচ্ছে শক্তি হচ্ছে বিশ্বশক্তির অংশ মাত্র। আমরা ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, যে মলিনতা প্রাপ্ত হয়েছি, অর্থাৎ খেলতে এসে যে ধূলি-কালি মেখেছি, তাকে ধৌত না করা পর্যন্ত,  আমরা  জন্ম মৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হতে থাকবো।  একটা অজ্ঞান আচ্ছন্ন মুঢ় মন, একটা ইন্দ্রিয়াসক্ত মন, একটি পার্থিব বিষয়ে আসক্ত মন, যতক্ষন না পর্যন্ত প্রতিভাদীপ্ত হচ্ছে, মনে যতক্ষন না শুদ্ধতা আসছে, মনে যতক্ষন না পর্যন্ত দিব্য অনুভূতির স্ফূরণ ঘটছে, ততক্ষন আমাদের এই জন্ম-জন্মান্তরের ঘূর্ণিপাকে ঘুরে বেড়াতে হবে। স্বামীজী বলছেন, মনের  এই যে শম্বুকগতি তা দেখে আমরা অনুমান করতে পারি, এই সময়টা হাজার বছর বা তার বেশি হতে পারে। আর মানবমনের এই পরিণতি লাভের  জন্য ২/১ জীবন,  বা দুই একবার স্থূল শরীরে প্রবেশ করলেই ঈশ্বরের উদ্দেশ্য সফল হবে না। স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী বলছেন, আমাদের গড় আয়ু অর্থাৎ আমাদের এই পৃথিবীবাসের আনুমানিক সময় একহাজার বছর। তো এই ১০০০ বছর আমরা কেউ এক জীবনে সমাপ্ত করতে পারি না। এক স্থুল দেহে অবস্থানকালে যদি আমাদের ১০০ বছর হয়, তবে আমাদের অন্তত ১০টি স্থুলদেহ ধারণ করতে হবে। কারুর কারুর ক্ষেত্রে এটি ১৫-২০ বারও হতে পারে। আবার  যোগী পুরুষগন যোগের সাহায্যে স্থূল শরীরে অবস্থানকাল দীর্ঘায়ীত করে, জন্ম-মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনতে  পারেন। আবার নিজের মনকে বসে এনে জ্ঞান বৃদ্ধি করে, শুদ্ধ করে, সংযত চিত্তে নিজেকে উন্নততর করে সত্বর  পরিণতির দিকে ধাবিত হতে পারেন। যদিও একবার স্থুল দেহের মধ্যে প্রবেশ করলে, দেহের নাশ অবশ্যম্ভাবী জেনেও, দেহের আয়ুর হ্রাস-বৃদ্ধি সম্ভব। স্বামীজী বলছেন, এই স্বাধীনতাটুকু আমাদের আছে। অকালমৃত্যু কিন্তু অবশ্যম্ভাবী নয়।  যেকোনো কারণেই হোক, আমাদের শরীর যদি স্বল্পায়ু হয়ে যায়, তবে আমাদের বারবার ফিরে ফিরে আসতে  হবে। আর আমরা যদি দীর্ঘায়ু হয়ে, যথাযথ কর্তব্য করতে পারি, তবে সংসারে যাতায়াতের সংখ্যা কমে যাবে। তখন  আমরা সাংসারিক সুখ-দুঃখ-যন্ত্রনা, এমনকি জন্ম-মৃত্যু কালীন যে যন্ত্রণা তার  হাত থেকেও  রেহাই পাবো।

আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ধারণা  হচ্ছে, মানুষের মৃত্যুর উপরে আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।  কবে আমাদের মৃত্যু আসবে তা আমরা জানি না। কিন্তু স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী বলছেন, এই ধারণা  সত্য নয়, অকালমৃত্যু রোধ করবার ক্ষমতা আমাদের সবার আছে। এমনকি শিশুর অকালমৃত্যু রোধ করবার ক্ষমতাও আমাদের আছে। হ্যাঁ যেটা নেই, সেটা হচ্ছে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর উপরে আমাদের কোনো হাত নেই। হিন্দু শাস্ত্রের মতে অকালমৃত্যু মুলে আছে আমাদের অশুভ কর্ম্মফল। আমরা বহু নির্দোষ প্রাণীকে কারনে  অকারনে হত্যা করে থাকি। এছাড়া আমার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত জীব-জন্তু-সমাজ-জাতি-পরিবেশ-রাষ্ট্র ইত্যাদির কর্ম্মফল আমাদের উপরে বর্তায়। এইসব কর্ম্মের যে প্রতিক্রিয়া, তাকে আমরা প্রতিহত করতে পারি না। তবে এটা  ঠিক, কথায় বলে, সাবধানের মার্ নেই।  তাই আমরা যদি সতর্ক থাকি, সাবধান থাকি, সময়মতো নিজের কর্তব্য কর্ম্ম সমাপ্ত করে থাকি, তবে অনেক দুর্ঘটনা থেকে আমরা রেহাই পেতে পারি। 

ঠাকুর থাকবে কতক্ষন, ঠাকুর যাবে বিসর্জন। (২) পুনঃ প্রচার। 

ভারতীয় যোগী-ঋষিগণ আমাদের আয়ু বৃদ্ধির প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের অনেক আগেই বলেছেন। মুনিঋষিগন বলছেন, আমরা প্রতি মিনিটে ১৫-বার শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া করে থাকি। এই হিসেবে ঘন্টায় ৯০০ বার, দিনে ২১৬০০ বার আমরা শ্বাস গ্রহণ  ও বর্জন করে থাকি । আর একটা কথা হচ্ছে, শ্বাস-প্রশ্বাসের দীর্ঘতা বা স্বল্পতা। অর্থাৎ স্বাভাবিক অবস্থায়, আমাদের শ্বাস যখন ভিতরে প্রবেশ করে, তখন তার দীর্ঘ হয় ১০ আঙ্গুল পরিমান। আর যখন আমরা স্বাস ছাড়ি তখন সেই প্রশ্বাসের দীর্ঘ হয় ১২ আঙ্গুল পরিমান। অন্যদিকে আমরা যখন উত্তেজিত হi, বা শারীরিক পরিশ্রম করি, তখন এই গতি অনেক দীর্ঘায়িত হয়। আমরা যখন গভীর নিদ্রাতে থাকি, তখন প্রশ্বাসের গতি হয় ৮০ আঙ্গুল পরিমান। এই হচ্ছে স্বাভাবিক গতি। এই হিসেবে আমাদের শরীরের ১০০ বছর  আয়ু নির্ধারিত হয়ে থাকে। এখন আমরা যদি অতিরিক্ত পরিশ্রম করি, আমরা যদি কারনে অকারনে উত্তেজিত হই, এমনকি আমরা যদি অতিরিক্ত ঘুমাই, বা অসংযমী হই, তাহলে আমাদের শ্বাসের যে দীর্ঘতা বা যত  আঙ্গুল শ্বাস-প্রশ্বাস, আমাদের ১০০ বাছরের জীবনে নেবার ও ছাড়ার কথা ছিল, তা আমরা হয়তো ১০০ বছরের অনেক আগেই নিঃশেষিত করে ফেলবো। ফলত আমরা তখন স্বল্পায়ু হয়ে যাবো। জানিনা ব্যাপারটা আমি আপনাদের বোঝাতে পারলাম কি না। 

প্রসঙ্গত একটা ঘটনার কথা বলি, ডাঃ ইন্দ্রনীল আইচ, একবার কৌতূহল বশত তার গুরুদেবকে ধ্যানস্থ অবস্থায় শারীরিক পরীক্ষা করেছিলেন। ডঃ আইচ তার  "ব্রহ্মতত্ত্ব ও বিজ্ঞান" গ্রন্থে লিখছেন, 
 
"হঠাৎ খেয়াল করলাম, গুরুজীর বুক ও পিঠের  কোনো নাড়াচাড়া নেই। আপনি জানেন, যে আমরা যখন শ্বাস নিই তখন আমাদের বুক কিঞ্চিৎ চওড়া হয়, শ্বাস ছেড়ে দেওয়া মাত্রই বুক আগের আকৃতি ধারণ করে. কিন্তু গুরুজীর বুকে সেই ধরনের নাড়াচাড়া আমার চোখে পড়লো না। ব্যাগ থেকে স্টেথোস্কোপ বার করে গুরুজীর বুকে বসালাম। প্রায় ১০ মিনিট স্টেথোস্কোপ দিয়ে বুকের শব্দ পরীক্ষা করবার পরে, নিশ্চিত হলাম যে উনি শ্বাস নিচ্ছেন, কিন্তু তা অত্যন্ত ঢিমে গতিতে। আমার হিসেবে মতো উনি এক একটা প্রশ্বাস নিচ্ছেন প্রায় তিন মিনিট সময় ধরে।  এর পরের তিন মিনিট শ্বাস বন্ধ  থাকছে, পরের তিন মিনিট ধরে তিনি অত্যন্ত ধীর গতিতে শ্বাস ছাড়ছেন।  অর্থাৎ ওনার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া সম্পন্ন হতে সময় লাগছে প্রায় ৯ মিনিট। ................ প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, যেকোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ এক-একটা breath cycle ৪ সেকেন্ডে সম্পন্ন করে।

এই ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম, যোগীপুরুষগন তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়াকে এতটাই ধীর গতিতে চালনা করেন, যে  দীর্ঘ সময় এতে তিনি ব্যায়  করেন। একটু ঘুরিয়ে বলতে বলা যায়, ডাক্তারবাবুর কথা অনুযায়ী, আমরা একবার শ্বাসক্রিয়া সম্পন্ন করি চার  সেকেন্ডে আর উনি সেই চার  সেকেন্ডের ক্রিয়াকে করছেন, ৯ মিনিট ধরে। দীর্ঘ জীবন লাভের এটাই ঋষিকথিত পথ।   
   
যাই হোক, আরো একটা ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের পরিমিত আহার, সহজ পাচ্য খাবার । বলা হয়ে থাকে যে আমরা সাধারণত যে পরিমান খাবার খাই তার এক-চতুর্থাংশ খাবারেই আমাদের শরীর সুস্থ রাখতে পারি।  আমাদের পেটে  যত  জায়গা আছে, তার মধ্যে কেবলমাত্র অর্ধেক জায়গা আমরা খাদ্য সামগ্রী দিয়ে পূরণ করবো, একচতুর্থাংশ জায়গা জল দিয়ে পূরণ করবো, বাকি একচতুর্থাংশ জায়গায় বাতাস থাকবে। কিন্তু আমরা অনেকেই এই নিয়ম মেনে চলি না। এর জন্য আমরা অনেক কারন দেখাই । না খেলে পরিশ্রম করবো কি করে ? ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার বেশিক্ষন যেমন আমাদের পেট খালি রাখা উচিত নয়, তেমনি, খাবার দেখলেই, বা যখন পেলাম তখনই খেয়ে নিলাম, এই ধরনের অভ্যাস ঠিক নয়। আবার সকালের দিকে আমাদের খাবারের পরিমান বেশি হওয়া উচিত। আবার বেলা পড়ে গেলে, বা রাতের দিকে হালকা খাবার, অল্প পরিমানে খাওয়া উচিত।  

আর একটা কথা হচ্ছে ঘুম।  ঘুমও আমাদের পরিমিত হওয়া উচিত। সুস্থ মানুষের ৬ ঘন্টা ঘুম যথেষ্ট।  যোগী পুরুষের ৪ ঘন্টা ঘুম যথেষ্ট। দিনে ৮ ঘন্টার  বেশি  ঘুম শরীরকে অকেজো, অলস করে দেয়। জীবনী শক্তি যেমন আমরা ঘুম থেকে সংগ্রহ করে থাকি, তেমনি ঘুম আমাদের জড়তা ডেকে আনতে  পারে। এই ব্যাপারটার দিকে আমাদের সদা সতর্ক থাকতে হবে। তবেই আমরা ১০০ বছরের আয়ু উপভোগ করতে পারবো। 

তাহলে আমরা বুঝতে পারলাম, আমরা যদি ১০০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে চাই, তবে আমাদের পরিমিত আহার নিতে হবে, পরিমিত শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে, স্বাস্থ্যকর  সহজ  পাচ্য খাবার নিতে হবে, পরিমিত নিদ্রা উপভোগ করতে হবে, কাম-ক্রোধকে নিজের আয়ত্ত্বে রাখতে হবে, শ্বাসপ্রশ্বাসের অনুপাতের পরিমান ঠিক রাখতে হবে।  আর এর ব্যতিক্রম হলে আমাদের শরীর  ব্যাধিগ্রস্থ হয়ে পড়বে । আর এই অসংযমী - ব্যাধিগ্রস্থ শরীর শ্বাসের গতিকে অস্বাভাবিক ভাবে বাড়িয়ে দেবে, এবং আমাদের আয়ু হ্রাস পেতে থাকবে। একেই আমরা অকালমৃত্যু বলে থাকি। 

স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী একটা উদাহরনের দ্বারা আয়ু হ্রাসের রহস্যঃ বুঝিয়েছেন। বলছেন, ৩০ মিনিটে আমরা নিঃশ্বাস ত্যাগ করি ( ৩০*১৫*১২) ৫৪০০ অঙ্গুলি। আবার নিদ্রাকালীন সময়ে সেই আধাঘন্টায় নিশ্বাস ত্যাগ করি (৩০*১৫*৮০) ৩৬০০০ অঙ্গুলি। আমরা যদি অলসতা বশত অতিরিক্ত আধাঘন্টা ঘুমাই, তবে এই আধাঘন্টার জন্য (৩৬০০০-৫৪০০) /(১৫*১২) = দুই ঘন্টা পঞ্চাশ মিনিট। অর্থাৎ আধাঘন্টা বেশি ঘুমিয়ে আমি  প্রায় তিন ঘন্টার আয়ুক্ষয় হলো। এইজন্য বলা হয়ে থাকে যারা ভোর বেলা আলস্যের বসে ঘুমিয়ে থাকে তারা কখনো দীর্ঘায়ু হয় না। 

আমাদের যখন কঠিন অসুখ হয়, তখন আমাদের নিঃশ্বাসের দৈর্ঘ ৮০ অঙ্গুলি থেকেও বেশি হয়। যা বলা হয়ে থাকে নাভিশ্বাসের চেয়েও বেশি দীর্ঘ। শোকগ্রস্থ অবস্থায়, দীর্ঘশ্বাস আমাদের আয়ুক্ষয় করে থাকে।এই দীর্ঘতম নাভিশ্বাসেই একসময় আমাদের প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায়। 

আমরা আগেই শুনেছি, আত্মহত্যা, দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু, বা যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু বা যেকোনো অস্বাভাবিক মৃত্যু এই নিয়মের অন্তর্ভুক্ত নয়।  এসবই অকালমৃত্যু আর এইসব অকালমৃত্যুর জন্য ব্যাষ্টিসমাজ ও সমষ্টি  সমাজ, রাষ্ট্রনায়ক  ইত্যাদির  অশুভ কর্ম্ম  দায়ী।  একে আপনি অদৃষ্ট বা নিয়তি বলতে পারেন। 

অতএব শুনলাম, আমাদের অসংযম, ও বাহ্যিক সংক্রমণ আমাদের শ্বাসের গতিকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করতে পারে। তেমনি আমরা  মুনি ঋষিদের দেওয়া যোগক্রিয়া অবলম্বনে আমরা আমাদের শ্বাসের গতিকে হ্রাস করতে পারি। আর যদি শ্বাসের গতি হ্রাস করতে পারি, তবে আমাদের জীবনের বা স্থূলদেহের আয়ু বৃদ্ধি হতে পারে। যোগীগণ শ্বাসপ্রশ্বাসের গতিকে ১২ থেকে নাবিয়ে ৮/৯ আঙ্গুল সহজেই করতে পারেন। আর সেই অনুপাতে, আমাদের আয়ু দুই তিন শতাব্দী বৃদ্ধি পেতে পারে। এইজন্য আমাদের ত্রৈলঙ্গ স্বামী, বাবা লোকনাথ, বাবাজি, গোবিন্দপাদ এমনিতর  ভারতের অনেক সাধু যোগী ২০০-৩০০ বছর বেঁচে থেকে নিজেদের স্থূল দেহের কর্তব্য সম্পাদন করে গেছেন ।  এমনকি তারা জন্ম-মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে সত্ত্বর ইশ্বরের সঙ্গে একাত্ত্ব বোধ করতে   পেরেছেন । এযুগেও এমন সাধু-যোগী দুর্লভ নয়। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি  ওম।  

তথ্যসূত্রঃ : উমাচল গ্রন্থাবলী - ৮ - খাদ্য-নীতি এবং শিশুপালন-বিধি - শ্রীমৎ স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী - অধ্যায় অকালমৃত্যু প্রতিরোধের উপায়,  পৃষ্ঠা - ৫৯ - আপনি ভাগ্যবান। "আমি" ভালো আছি সত্য কিন্তু "আমরা" কি ভালো আছি ? "আমি" - যাকে শশাঙ্ক শেখর বলা হয়, সে  যোগীও নয়,, মহারাজও নয়,, গুরুও নয়,, আচার্য্যও  নয় ।  পাঠক মাত্র,  বক্তা মাত্র।  মহাপুরুষদের  অমৃতকথা শুনতে ভালো লাগে তাই নিজেকেই শোনাই। ঈশ্বর সবাইকে ভালো রাখুন, এই কামনা করি ।

আত্মা চলে গেলে দেহের নাশ হয়, না দেহের নাশ হলে আত্মা দেহত্যাগ করে ?

        
















                          


No comments:

Post a Comment