জপ সাধনার পরিণতি
তথ্যসূত্রঃ - তত্ত্বজ্ঞান সাধনা - মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্ত
আমাদের ছোটবেলায়, ভূতের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য, রাম নাম জপ্ করতাম । সেই রাম নাম জপ করে, আমরা ভূতের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতাম কি না জানিনা, তবে ভূতের ভয় থেকে নিষ্কৃতি পেতাম।
আজও আমাদের কেউ গালাগালি দিলে আমাদের রাগ হয়। কেউ প্রসংশা করলে, আমাদের ভালো লাগে। ভিড়ের মধ্যে আমার নাম ধরে কেউ ডাকলে, আমার দৃষ্টি আকর্ষণ হয়। এমনকি আমি যখন ঘুমিয়ে থাকি, তখন কেউ আমার নাম ধরে ডাকলে, আমি সজাগ হয়ে উঠি। অর্থাৎ নামের সঙ্গে আমাদের স্বরূপের অনুভূতির একটা সম্পর্ক আছে। যা আমি নিজেকে মনে করি, সেটাই আমার নাম। অর্থাৎ নাম একটা প্রতীক, যা আমাকে জাগিয়ে তোলে, বা আমার অনুভূতিকে জাগিয়ে তোলে।
সমস্ত ধর্ম্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই এই নাম-জপের একটা গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়েছে।
হিন্দুদের মধ্যে তা সে শৈব বলুন, বৈষ্ণব বলুন শাক্ত বলুন সবাই কোনো না কোনো ভাবে জপের গুরুত্ত স্বীকার করেছেন। এমনকি এখনকার রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম, বা অন্যান্য ধর্মীয় সংগঠন সবারই জপের প্রতি নিষ্ঠা আছে।
ঈশ্বরের গুন্ বর্ণনা ক'রে, বা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা ক'রে কিছু সংক্ষিপ্ত শব্দ বা বাক্য আমাদের ঋষি-মুনিরা রচনা করে গেছেন। এগুলোকে বলা হয় মন্ত্র। যেমন গায়েত্রী মন্ত্র, মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র, গনেশ মন্ত্র, বিষ্ণুমন্ত্র, শিব মন্ত্র, সূর্য মন্ত্র ইত্যাদি ইত্যাদি। ইসলামে আল্লাহ বা আলি মন্ত্র জপের নির্দেশ আছে। খ্ৰীষ্ট ধর্ম্মে যীশুর পুন্য নাম নিরন্তর জপের কথা বলা হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্ম্মে "নমু অমিদা বুৎসু" (জাপানী)
জপের নির্দেশ আছে। অর্থাৎ জপকে সবাই গুরুত্ত্ব দিয়েছে।
জপের নির্দেশ আছে। অর্থাৎ জপকে সবাই গুরুত্ত্ব দিয়েছে।
উপনিষদে ঈশ্বর-এর নাম রাখা হয়েছে "ওঁ"। পতঞ্জলি যোগসূত্রে ওঁ-কে ঈশ্বরের প্রতীক বলা হয়েছে। আসলে ওঁ হচ্ছে এমন একটা ধ্বনি যা আমাদের কন্ঠ থেকে শুরু করে, জিহ্বামূল হয়ে, শেষে ওষ্ঠে এসে সমাপ্ত হয়। অর্থাৎ শব্দ উচ্চারণের যে প্রক্রিয়া ও প্রবাহ তা সম্পূর্ণ করতে পারে এই ওঁ। অন্য কোনো শব্দ বা ধ্বনির এই মাহাত্ম নেই। তাই জপ হিসেবে যে কোনো মন্ত্র উচ্চারণ করুন না কেন, হিন্দু ধর্ম্ম মতে সেই মন্ত্রকে অবশ্যই প্রণবপুত করে নিতে হয়। অর্থাৎ মন্ত্রের আদি ও অন্তে ওঁ উচ্চারণ করতে হয়। অথবা একমাত্র ওঁ ধ্বনিও জপমন্ত্র হতে পারে।
শব্দ বা ধ্বনি আমাদেরকে কিভাবে প্রভাবিত করে ? এটি বুঝতে গেলে আমাদের শব্দের উৎপত্তির দিকে খেয়াল করতে হবে। আমরা যখন কথা বলি, তা আসলে ধ্বনির স্থুল রূপ। কন্ঠনালী, জিহ্ববামুল, তালু, ওষ্ঠ ইত্যাদির আলোড়নের ফলে এই শব্দের উৎপত্তি হয়। শব্দের এই অবস্থাকে বলে বৈখরী। আর এই শব্দ সৃষ্টির উৎস হিসেবে কাজ করে আমাদের চিন্তা। অর্থাৎ আমরা যা চিন্তা করি, তারই বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে শব্দ। এই অবস্থায় শব্দকে বলা হয়ে থাকে মধ্যমা। এবার, দেখুন এই যে চিন্তা এগুলো আসলে আমাদের আবেগের ফল। এই স্তরে শব্দকে বলে পশ্যন্তি। আর এই যে আবেগ এটি আসলে উপনিষদের ভাষায় ব্রহ্ম অর্থাৎ অব্যক্ত শব্দব্রহ্ম থেকেআবেগ আসে । শব্দের এই স্তরকে বলা হয়ে থাকে পরা অর্থাৎ উচ্চ। সুতরাং শব্দের উৎপত্তি হচ্ছে যথাক্রমে পরা-পশ্যন্তি-মাধ্যমা-বৈখরী যা মানুষের চিন্তা জীবন। যা আমাদের অন্তর্জগতের ক্রিয়া। এইবার একটু উল্টো করে ভাবুন, চিন্তা আমাদের ভাষায় প্রকাশ হচ্ছে, কিন্তু জপে আমরা চিন্তাকে ভাষা দ্বারা প্রভাবিত করছি। অর্থাৎ ভাষা যা ঈশ্বরের গুন্ কীর্তন তার দ্বারা আমরা আমাদের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করছি। এইখানেই জপের সার্থকতা।
জপ ধাতুর অর্থ হৃদয়ে স্মরণ। আর হৃদয়ে কাকে স্মরণ করা হয় ? না ঈশ্বরকে বা ঈশ্বরের গুন্গুলোকে। অনেক সময় ঈশ্বরের স্তুতি বা প্রার্থনাও করা হয়ে থাকে এই জপের মাধ্যমে। আমরা জানি, এই জপ তিনভাবে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। বাচিক, মৃদু, ও মানস জপ। অর্থাৎ যে জপ শ্রবণযোগ্য তাকে বাচিক জপ, যে জপ মনে মনে উচ্চারণ করা হয়ে কিন্তু কেবলমাত্র ওষ্ঠ কম্পিত হতে থাকে, তাকে মৃদু বা উপাংশু জপ বলা হয়ে থাকে। সবশেষে মানস-জপ যা কেবলমাত্র মনে মনে উচ্চারিত হয়ে থাকে। বাইরে থেকে কিছুই বুঝবার উপায় থাকে না। জপ আবার কেউ সংখ্যা গুনে রাখেন। আবার কেউ সংখ্যা গোনেন না। কেউ আবার মালার সাহায্যে গুনে রাখেন, কেউ আবার হাতের আঙুলে গুনে রাখেন। সব ধরনের জপই ভালো, তবে প্রথমদিকে বাচিক, তারপরে মৃদু বা উপাংশু , এবং সব শেষে মানস জপ সাধনের নির্দেশ দিয়ে থাকে মহাত্মাগণ। কিন্তু আমরা লক্ষ করেছি, আপনি যদি বাচিক জপ দিয়ে শুরু করে, এবং শরীর ক্লান্ত হয়ে গেলে মৃদু বা উপাংশু, এবং জপের গভীরতা বৃদ্ধি পেলে মানস জপ করতে পারলে ভালো ফল প্রদান করে থাকে। এমনকি আমাদের মানস জপ তখন স্বতঃস্ফূর্ততা প্রাপ্তি পায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে জপ সাধনা করলে তার ফল কী হয় ?
মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন, জপ এক প্রকার গুনকীর্তন। অতএব গুণকীর্তনের যাবতীয় ফল এই জপের সাহায্যে হতে পারে। আপনি যদি অন্ধকার ঘরে বসে চোখ বুজে জপের মধ্যে নিবিষ্ট চিত্ত হতে পারেন, তবে আপনি আপনার চিদাকাশ-চত্ত্বরে অন্ধকার দেখতে পাবেন। খেয়াল করুন, অন্ধকার ঘরে, অর্থাৎ বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পর্কহীন হয়ে, আবার চোখ বুজে, অর্থাৎ বাইরের দৃশ্য যাতে আপনার মনকে বিব্রত না করতে পারে। আসলে ইন্দ্রিয়জাত জ্ঞান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে হবে। জপ আমাদের শ্রবণক্রিয়াকে ব্যস্ত রাখতে সাহায্য করে। ফলতঃ বাইরের শব্দ, আমাদের সুতিগোচর হয় না। এর পর চোখ যখন বন্ধ রাখা হয়, তখন আমাদের সামনে চিদাকাশ উন্মুক্ত হতে থাকে। এই চিদাকাশেই প্রথমে আমরা অন্ধকার দেখতে থাকি। ধীরে ধীরে ধ্যানের বা জপের গভীরতা অনুযায়ী মূর্তি দর্শন হতে থাকে। এই মূর্তি দর্শন সাধারণত স্বল্পকালের জন্য দেখা দিয়ে আবার হারিয়ে যায়। কখনো কখনো এই মূর্তি একটু বেশিক্ষন স্থায়ী হয়। এর পরে আসে জ্যোতিঃ। এই জ্যোতি আর কিছু নয়, পরলোকগত মহাত্মাদের দেহ জ্যোতিঃ মাত্র। এর পর এইসব মহাত্মাদের জ্যোতি ধীরে ধীরে ঘনীভূত আকার নেয়, এবং সাধক তখন মূর্তি দর্শন করতে থাকেন। এই মূর্তি কখনো ভেসে উঠেই আবার মিলিয়ে যায়। কখনো দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়। এর পর কিছুদিনের মধ্যেই এই মূর্তির সাথে কখোপকথন শুরু হতে পারে।
মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন, এইসব দর্শন আমাদের নিজেদের দেহের শুদ্ধতা, পবিত্রতা ও প্রেম-ভক্তি-একাগ্রতা প্রভৃতি গুনের উন্নতি সাপেক্ষে হয়ে থাকে। এছাড়া সঠিক বীজমন্ত্র, তার সঠিক অর্থ সম্পর্কে জ্ঞান, এবং বীজমন্ত্রের সঠিক উচ্চারণের সামর্থতার উপরেও জপের ফল নির্ভর করে থাকে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, আপনার গুন্ অনুসারে, আপনার অভাব অনুসারে, আপনাকে বীজমন্ত্র নির্ধারণ করতে হবে। আর বীজমন্ত্র সবসময় প্রণবপুট হাওয়া চাই। যেমন ধরুন হ্রিং, ঐং, ক্লিং, সুং ইত্যাদি হচ্ছে বীজমন্ত্র। প্রত্যেক মন্ত্রের অগ্রে ওং অন্তে ওং দিয়ে উচ্চারণ করতে হবে। গুরুদেব যখন আপনাকে বীজমন্ত্র দান করছেন, দেখবেন, আপনাকে সেটি কানে কানে বলছেন, আসলে এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই মন্ত্রের সঠিক উচ্চারণ বা ধ্বনি আপনার কর্ন কুহরে স্থায়ী ভাবে স্থাপন করা। এবং এরপরে আপনি যখন এই মন্ত্রের উচ্চারণ করবেন, তখন গুরুদেবের মুখ থেকে শোনা ধ্বনির সাথে সেটি আপনি মিলিয়ে নিতে পারবেন।
যাইহোক, দেবমূর্তি বা জ্যোতিদর্শনের সময় থেকেই সাধকের মধ্যে একটা অহেতুক আনন্দ স্ফূরিত হতে থাকবে। দেবমূর্তির সাথে কথোপকথন নিজের মধ্যে একটা আত্মপ্রত্যয়ের ভাব দৃঢ় হয়। যারা এই অবস্থায় পরিতৃপ্ত থাকেন, তাদের উন্নতি স্তব্ধ হয়ে যায়। এইসময় সাধকের সাধনের মাত্রা দীর্ঘায়িত করা উচিত। এতে করে প্রেম, ভক্তি, একাগ্রতা, অভেদজ্ঞান ইত্যাদির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ব্রহ্মতেজ দর্শন হয়। এবং জীবভাবের লয় হয়। সাধক তখন পরমাত্মত্ব প্রাপ্ত হন। কিন্তু তখন অংশের পূর্নতা হয় না। অর্থাৎ আমি বোধ জেগে থাকে। সাধনার যত উন্নতি হতে থাকবে, তত সাধকের পাশ মুক্তি হতে থাকবে। এবং পরমাত্মার গুনবিশেষ একত্ব-প্রাপ্তি ঘটবে। মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন,এর পরে নিত্য ব্রহ্মদর্শন হতে থাকবে। কিন্তু তখন সাধকের পূর্ণত্ব হয় না। আসলে সাধক যে কালে যে গুন্ প্রভাবে ব্রহ্ম দর্শন লাভ করেন, সেই গুনেই তিনি একত্বপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন। পরমেশ্বরের গুনের সীমা-সংখ্যা নেই, গুন্ অনন্ত। আবার পরব্রহ্ম অনন্ত একত্বের একাত্বস্বরূপ। সুতরাং সাধক যতই সাধনায় যত্নবান হন না কেন, অনন্ত একত্বের যে পূর্ণত্ব তা সে কখনোই লাভ করতে পারেন না। তাই বলা হয়ে থাকে সাধনার শেষ করতে নেই। মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন, সাধকগণ সেই পরব্রহ্মের অংশ। সুতরাং অংশসাধনা ধীরে ধীরে পূর্ণত্বের দিকে ধাবিত হয়।
ঠিকঠিক জপের মাধ্যমে আপাত স্তব্ধ ধ্বনি জীবন্ত হয়ে প্রচুর শক্তির অধিকারী হতে পারে। প্রত্যেকটি মন্ত্রের মধ্যে একটা অন্তর্নিহিত শক্তি বা চৈতন্য শক্তি নিহিত রয়েছে। যখন কোনো উন্নত সাধক, অর্থাৎ যিনি সংযম নিয়ম ইত্যাদি পালন ক'রে, পবিত্র জীবনের অধিকারী হয়েছেন, তিনি যখন মন্ত্র জপ করেন, তখন মন্ত্র তার নিজ শক্তিতে শক্তিমান হয়ে জীবন্ত হয়ে ওঠেন। আর এই উন্নত-আত্মা যখন অন্যকে মন্ত্র-দীক্ষা দেন, তখন সেই শক্তিও শিষ্যের মধ্যে সঞ্চালিত হয়ে ওঠে। স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলছেন, কুণ্ডলিনী জাগরণের শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে জপ-ধ্যান। বলছেন, জপের থেকে সহজ অধ্যাত্মিক অনুশীলন আর নেই।
যাইহোক, আমরা এর আগের দিন অভেদজ্ঞান সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম। সেখানে আমরা বলেছিলাম, অভেদজ্ঞান তিন প্রকার। পরম-ঈশ্বরের সঙ্গে অভেদজ্ঞান হচ্ছে উত্তমর্ণ। তো প্রথমদিকে অধমর্ণ অভেদজ্ঞান সাধনায় উন্নতি হলে, ওই গুন্ প্রভাবে সচ্চিদানন্দ পরব্রহ্মের অন্তর্গত থেকে প্রেমানন্দ সুধা পান করতে হয়। অর্থাৎ মায়ের কোলে আশ্রয় নিতে হয়। ধীরে ধীরে এই বোধ জন্মায় যে মায়ের শরীর থেকেই সন্তানের দেহের জন্ম-পুষ্টি-বর্ধন সম্ভব হচ্ছে। যাই হোক, এই অবস্থায় উপনীত হলে যে পরমানন্দ যে পরমসুখ অনুভূত হয়, তার বর্ণনা করা মানুষের সাধ্য নেই।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
বায়ু শুদ্ধিতে দেহ শুদ্ধি। শিব সংহিতা - ১
আমরা জানি প্রাণের ছোঁয়ায় জীব সঞ্জীবনী শক্তি প্রাপ্ত হয়ে থাকে। আবার প্রাণের অভাবে জীব নির্জীব বস্তুতে পরিণত হয়।
বায়ু প্রবাহ দ্বারা যেমন সমুদ্রে ঢেউ-বুদ্বুদ-ফেনা সৃষ্টি হয়, ঠিক তেমনি এই বায়ু প্রবাহ দ্বারাই আত্মাতে ক্ষণভঙ্গুর এই সংসারের উৎপন্ন হয়েছে।
ব্যবহারিক জগতে আমরা লক্ষ করেছি, তিন ভাবের জীব। শত্রূ-মিত্র-উদাসীন। যে আমাদের দুঃখ দেয়, ক্ষতি করে, সে আমাদের শত্রূ। আবার যার সঙ্গে মিলিত হলে আমাদের সুখ হয়, সে আমাদের মিত্র। আবার এমন কিছু উদাসীন মানুষ বা জীব আছে, যে আমাদের ক্ষতি বা সুখ সাধন করে না। এরা নির্লিপ্ত। এরা সুখ দুঃখের কারন হয় না। এই শত্রূ, মিত্র, উদাসীন মানুষ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান হলে, এবং সেইমতো সতর্ক থাকলে, আমরা ভালো থাকতে পারি।
আবার কর্ম্মের জন্য এই বিশ্বের উৎপত্তি। শাস্ত্রবিহিত কর্ম্মসমূহ সম্পাদনে, আমরা বাঞ্চিত ফল পেয়ে থাকি। শাস্ত্র-নিষিদ্ধ কর্মে, বা কর্ম্ম সম্পর্কে আমরা উদাসীন হয়ে নিস্কর্মা হয়ে বসে থাকলে, আমরা প্রকৃতির নিয়মে ফল প্রাপ্ত হয়ে থাকি।
মায়া-বরন-কারিণী শক্তি দ্বারা আচ্ছাদিত কর্ম্ম-রূপিণী সেই মহামায়া তার বিক্ষেপশক্তি ( যা আসলে আমাদের কাছে কর্ম্মে প্রেরণাশক্তি) এই জগৎ সংসারকে পরিচালনা করে থাকেন। সেই মহামায়াতে যখন তমঃগুণের আধিক্য হয়, তখন তাকে আমরা স্বয়ং দূর্গা নামে অভিহিত করে থাকি। এই তমোগুণকে উপলক্ষ্য করে যে চৈতন্য উদয় হয়, তাকে বলা হয়, রুদ্রদেব। আবার এই মায়াতে সত্ত্বগুণের আধিক্য হলে, তা লক্ষী নামে অভিহিতা হন । সেই লক্ষীকে উপলক্ষ্য করে যে চৈতন্যের উদয় হয়, তাকে বলা হয় বিষ্ণু। রজোগুণের আধিক্যযুক্ত বিদ্যার নাম সরস্বতী। আবার সরস্বতী উপলক্ষিত চৈতন্যের নাম ব্রহ্ম। এই সমস্ত দেবতাই পরমাত্মাতেই দৃশ্যমান।
শরীর আসলে জড়বস্তু। আর সেই জড় বস্তুতেই প্রকাশিত হয়, সত্ত্ব, রজঃ, তম বিদ্যা। জগতের সমস্ত বস্তুই জ্ঞানের সহায়তায় প্রতিভাত হচ্ছে, কখনো জ্ঞাতা, কখনো জ্ঞেয়, কখনো জ্ঞান। সত্যি কথা বলতে কি কোনো বস্তুরই কোনো নিজস্ব সত্তা নেই। কেবলমাত্র চৈতন্যরূপে আত্মা নিত্য ভাসমান। সেই চৈতন্য সত্তা সৃষ্টি বা ব্রহ্মস্বরূপের দ্বারা প্রকাশমান বিশেষ উপাদান। বিশেষ অর্থাৎ বিশেষ নামের দ্বারা বস্তুর মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বস্তুর মধ্যে কোনো ভেদ নেই। আমাদের যথার্থ জ্ঞানের অভাবে এই পার্থক্য লক্ষিত হচ্ছে।
আমরা পূর্ব-পূর্ব জন্মের কর্ম্মফলবশতঃ পিতার অনন্ময় কোষ থেকে সন্তানরূপে এই শরীর প্রাপ্ত হয়েছি। এই দেহ প্রথম দিকে সুন্দর-কর্মঠ হলেও, ধীরে ধীরে তা অসুন্দর কর্ম্মের অযোগ্য হয়ে যায়। এই যে অস্থি, মজ্জা, রক্ত, মাংস, স্নায়ু, শিরা-উপশিরা দ্বারা গঠিত শরীর, এটি আসলে ক্লেশময় কর্ম্মফল ভোগের মন্দির মাত্র। এই দেহ সুখ-দুঃখ ভোগের জন্যই নির্মিত হয়েছে।
শিবস্বরূপ বিন্দু আর শক্তিস্বরূপ রজঃ - এই উভয়ের মিলনে আত্মা স্বয়ং জড়রূপিণী নিজশক্তি দ্বারা বহুরূপে জন্ম গ্রহণ করে থাকেন। সেই পঞ্চভূতের নানা প্রক্রিয়ায় মিলিত হয়ে পঞ্চি-করণের ফলে যে অসংখ্য স্থুল বস্তু এই ব্রহ্মাণ্ডে উৎপন্ন হয়, সেই বস্তুসমূহে জীবগন নিজ নিজ কর্ম্ম অনুসারে অবস্থান করে থাকে। অর্থাৎ পঞ্চভূত থেকে ভোগদহ বা জীবদেহ। আর জীবের পূর্ব জীবনের কর্ম্ম অনুসারে ব্রহ্মশক্তি এই ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন।
আত্মা জড় পদার্থ নয়, আত্মাই ভোক্তা, আত্মাই জড়পদার্থের ভিতরে থেকে কর্ম্মফল ভোগ করে থাকেন। জড়পদার্থ হ'তে নিজ নিজ কর্ম্মে আবদ্ধ হয়ে, জীব নানা নাম, নানা রূপে নানা প্রকার হয়েথাকে। কর্ম্মফল ভোগের দ্বারা কর্ম্মফলের অবসান হয় ঠিকই, কিন্তু কর্ম্ম হীন হয়ে কেউ একমুহূর্ত থাকতে পারে না। তাই পুনঃপুনঃ চক্রবৃদ্ধি হারে কর্ম্মফলের বৃদ্ধি হতে থাকে। তাই ভোগ-বাসনায় নয়, নিরাসক্ত হয়ে কর্ম্ম করাই কর্ম্মফলের অবসান ঘটায়।
মানুষের শরীরে প্রায় সাড়েতিনলক্ষ নাড়ী আছে। এর মধ্যে চোদ্দটি নাড়ী প্রধান। সুষুম্না, ইড়া, পিঙ্গলা, গান্ধারী, হস্তিজীহ্বিকা, কুহু, সরস্বতী, পুশ, শঙ্খিনী, পয়স্বিনী, বারনী, অলম্বুষা, বিশ্বোদরী, যশস্বিনী। এর মধ্যে আবার তিনটি নাড়ী শ্রেষ্ট। ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না।
এই সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে আছে চিত্রাণি নাড়ী। এই চিত্রাণি নাড়ীর মধ্যে আছে ব্রহ্মরন্ধ্র। এই ব্রহ্মরন্ধ্র পথই পরব্রহ্মের সঙ্গে মিলিত হবার রাস্তা। আবার এই চিত্রাণি নাড়িই এই দেহের আধার স্বরূপ। এই ব্রহ্মরন্ধ্রের পথই দিব্য পথ। এই পথে বায়ু প্রবাহিত হয়, তখন দিব্য আনন্দের অনুভব হয়ে থাকে।
আমরা মূলাধার সম্পর্কে শুনেছি। গুহ্যদ্বার থেকে দু-আঙ্গুল উঁচুতে আবার পুরুষাঙ্গ থেকে দুই আঙ্গুল নিচে অর্থাৎ পুরুষাঙ্গ ও গুহ্যদ্বার এর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান করে মূলাধার। মূলাধার অর্থাৎ জীবের মূল আধার। মূলাধার থেকে যে সমস্ত নাড়ী উত্থিতা হয়েছে, সেই নাড়ীগুলো আমাদের জিহ্বা থেকে পায়ু পর্যন্ত (জিহবা, মেঢ্র, বৃষণ, পাদাঙ্গুষ্ঠ, নাসিকা, কক্ষ, নেত্র, অঙ্গুষ্ঠ, কর্ন প্রভৃতি সর্ব অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজ নিজ কার্য্য সম্পাদন ক'রে, উৎপত্তি স্থানে ফিরে আসে। এই নাড়ীগুলোই আমাদের সমস্ত দেহে বায়ুর সঞ্চালন ক'রে দেহকে সংবেদশীল করে রেখেছে। এদের ভোগবহা নাড়ী বলে।
তো এর থেকে আমরা বুঝলাম, আমাদের দেহে বায়ুর একটা বিশেষ ভূমিকা আছে। আর বায়ুর চলাচলের রাস্তা হচ্ছে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে থাকা নাড়ী সকল। এই নাড়ীর মধ্যে যে ছিদ্র বা রন্ধ্র আছে, তা অনেক সময় পিত্ত, কফ, রস দ্বারা রুদ্ধ থাকে, তাই বায়ুর চলাচল স্বাভাবিক হতে পারে না। এই বায়ু-পিত্ত-কফ ইত্যাদিকে অপসারণের জন্য বায়ুকে অত্যাধিক বেগ সম্পন্ন করা হয়, এই নাড়ীশুদ্ধি ক্রিয়ার সাহায্যে।
নাড়ীশুদ্ধি ক্রিয়া সম্পর্কে বুঝতে গেলে আমাদের বায়ুর ক্রিয়ার দিকে আমাদের দৃষ্টিপাত করতে হবে। বায়ু সম্পর্কে আমাদের একটু গভীর ভাবে বুঝতে হবে। আবার বায়ুর ক্রিয়ার ফলে যে তেজের সৃষ্টি হয়, সেই সম্পর্কেও একটা ধারণা রাখতে হবে। তবেই আমরা জীবদেহের পরিণতির দিকে গতাগতি বুঝতে পারবো।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
মোক্ষসাধন ও স্থুলদেহ প্রাপ্তির কারন : শিব-সংহিতা - ২
বায়ু এবং তেজঃ শক্তি :
আমরা জানি, জীবের প্রান-ধারনের জন্য প্রয়োজন শক্তি। আর এই শক্তির উৎস হচ্ছে সূর্য বা সৌরশক্তি। আবার জীব এই সৌরশক্তিকে খাদ্যে পরিণত করতে পারে না। এক্ষেত্রে উদ্ভিদ এই কাজে সাহায্য করে থাকে। জীবকুল উদ্ভিদের তৈরী খাদ্যকে গ্রহণ করে অক্সিজেনের সাহায্যে স্থির শক্তিকে গতিশীল শক্তিতে পরিণত ক'রে, আবার এই শক্তিকে ব্যয় করেই জীব তার দেহের যাবতীয় ক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকে।
তো দুটো শক্তি একটা সৌরশক্তি বা তেজ আর একটা অক্সিজেন বা বাতাস। জীবকূলকে সজীব থাকতে এই দুটো শক্তি সাহায্য করে থাকে। এখন আগুন বা তেজঃশক্তি কখনো ইন্ধন ছাড়া প্রজ্বলিত হতে পারে না। সূর্য্যের তেজ যেমন হিলিয়াম গ্যাসের জোগানে নিয়মিত প্রজ্বলিত হচ্ছে, বাহ্য জগতে তেমনি এই আগুন বিভিন্ন ইন্ধন বা কাঠকুঠি ইত্যাদি থেকে পেয়ে থাকে, তেমনি মানুষের মধ্যে এই অগ্নি খাদ্য নামক ইন্ধনের সাহায্যে প্রাপ্ত হয়ে থাকে। তাই শিবসংহিতায় বলা হয়েছে, সুধী যোগী নিয়ম মেনে, জঠরাগ্নিকে পৃজ্বলিত রেখে, এই অগ্নিতে নিয়ম মেনে অন্ন আহুতি দেবেন। তা সে সুস্বাদু হোক বা বিস্বাদ যাই হোক, পুষ্টিবর্ধক খাদ্যই নিয়মিত গ্রহণ করতে হবে।
এখন কথা হচ্ছে, আমাদের এই যে স্থুল দেহ, যা আসলে খাদ্যের সাহায্যে পুষ্টি লাভ করে বেঁচে বর্তে থাকে, বর্ধিত হয়, আবার বাতাস থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করে, প্রাণময় থাকে, আমাদের এই দেহপ্রাপ্তির কারন কি ? আমরা তো এই দেহকে রক্ষার জন্য, সারাজীবন প্রাণপাত করে থাকি। তো যে দেহ রক্ষার জন্য প্রাণপাত করে থাকি, সেই দেহের দরকারটা কি আমাদের ? মহাত্মাগণ বলে থাকেন, আমরা সবাই সেই পরমাত্মার অংশ, জীবাত্মা। তো আমরা যদি আত্মা হই, আর পরমাত্মার অংশ হই, তবে আমরা কেন সেইমতো থাকতে পারিনি, বা থাকতে পারি না। আমরা কেন এই দেহের মধ্যে এসে বাস করছি। আমি তো সেই সৎ-চিৎ-আনন্দময়ের অংশ। তবে সেখানেই তো আমরা আনন্দে থাকতে পারতাম, দেহের মধ্যে অবাধ্য হয়ে, আমরা কেন বিড়াম্বনা ভোগ করছি ? প্রশ্ন অনেক কিন্তু উত্তর অধরা।
স্থুলদেহ প্রাপ্তির কারন : দেখুন ব্রহ্মান্ড সম্পর্কে যেমন জানার শেষ নেই, তেমনি আমাদের এই দেহরূপ ব্রহ্মান্ডের সম্পর্কে জানারও শেষ নেই। তবে একটা কথা আমরা জানি, এই দেহ আমাদের সংকল্প-বাসনার ফল। নানান প্রকার গুন্ বিশিষ্ট এই জীবদেহ। আর বিভিন্ন দেহ বিভিন্ন কর্ম্ম সম্পাদনের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। তো যাই হোক, একটা উত্তর পাওয়া গেলো, এই দেহ আমাদের কর্ম্ম-সম্পাদনের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।
আবার দেখুন, আমাদের চারিদিকে, যে অসংখ্য প্রকার দেহ দেখতে পাই, সেগুলো একই রকম আকৃতির নয়, একই গুন্ সম্পন্ন নয়। যে কোনো দেহে যেকোনো কর্ম্ম করা সম্ভব নয়। এসব আমরা সবাই বুঝি। আমরা বানরের মতো গাছে গাছে লাফিয়ে বেড়াতে পারবো না। গরু কখনো গাছে উঠতে পারবে না। আমরা পাখির মতো উড়ে বেড়াতে পারবো না। আমরা হাঁসের মতো জন্মের সঙ্গে সঙ্গে জলে ভেসে বেড়াতে পারবো না। বাছুর যত -তাড়াতাড়ি চার পায়ে দাঁড়াতে শিখে যায়, আমরা তা পারি না। তো বিভিন্ন দেহের কর্ম্মক্ষমতা বিভিন্ন রকম।
তাই এটা মনে করা যেতে পারে যে আমরা যে মনুষ্যদেহে আশ্রয়লাভ করেছি, সেই মনুষ্য-দেহের একটা বিশেষ কর্ম্ম ও ধর্ম্মযোগ আছে। মহাত্মাগণ বলে থাকেন, আমাদের জাতি-ধর্ম্ম সম্পর্কে সচেতন থেকে আমাদের কর্ম্মের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। জাতি-ধর্ম্ম বলতে আমরা হিন্দু-ইসলাম-খ্রিষ্ট-বুদ্ধ-শিখ বুঝবো না, আমরা বুঝবো, মানুষ একটা জাতি, গরু একটা জাতি, পাখি একটা জাতি, মাছ একটা জাতি, ইত্যাদি বুঝবো। অর্থাৎ আমি যে জাতির অন্তর্ভুক্ত সেই জাতির একটা কর্ম্ম পদ্ধতি আছে, আছে কর্ম্ম ক্ষমতা, আছে ধর্ম্ম, আছে জন্মগত অভ্যাসের পরম্পরা। এই পরম্পরাকে মেনে আমাদের চলতে হবে।
মহাত্মাগণ বলছেন, দেহ সৃষ্টি কামনা থেকে আর জগৎ সৃষ্টি কর্ম্ম থেকে। এই জগতে যা কিছু দেখা যায়, সবই কর্ম্ম থেকে উৎপন্ন হয়েছে। আমাদের যে দুঃখ ভোগ করতে হয়, তার কারন হচ্ছে আমাদের কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ। এই কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ থেকেই দুঃখের উৎপত্তি। কিন্তু কিভাবে ? দেখুন, এই কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ থেকে আমাদের ভিতরে চিন্তার উদ্রেগ হচ্ছে, চিন্তা একসময় কার্য্য করবার উদ্দীপনা সৃষ্টি করছে, আর সেইমতো আমরা অর্থাৎ মনুষ্যজাতি বা জীবকুল স্ব-স্ব কার্য্যে অগ্রসর হচ্ছে। আবার সেই কর্ম্মজাত ফল আমরা ভোগ করছি। কিন্তু কথা হচ্ছে, একটা সময় তো ছিলো, যখন আমাদের কারুর কোনো কর্ম্ম ছিল না। অর্থাৎ এই কর্ম্মজাত শরীরের উৎপত্তি হয় নি। আমরা যখন অব্যক্ত। তো তাহলে আমরা এই অবস্থায় এলাম কি করে ?
শিব সংহিতায় বলা হয়েছে,
পুন্যোপরক্ত-চৈতন্যৈঃ প্রাণান প্রীতাতি কেবলম।
বাহ্যে পুণ্যময়ং প্রাপ্য ভোজ্যবস্তু স্বয়ম্ভবেৎ। ।
অর্থাৎ পুণ্যের অনুরক্ত চৈতন্য নিজেই বাহ্যজগতে পুণ্যময় ভোগ্যবস্তু প্রাপ্ত হয়ে, কেবল প্রাণসমহ্কে প্রীত করে থাকে। প্রাণ বা বাতাসের সূক্ষ্ম অংশ যখন বস্তুর সংস্পর্শে আসে তখন সেই বস্তু আলোড়িত হয়। প্রাণ ও চৈতন্য ওতপ্রোতভাবে অবস্থান করে থাকে। তো প্রাণ যখন বস্তুতে অনুরক্ত হয়, তখন চৈতন্য বস্তুভোগে লিপ্ত হয়।
অর্থাৎ আমরা যখন অব্যক্ত ছিলাম, যখন আমরা কোনো দেহের বা বস্তুর মধ্যে প্রবেশ করিনি, তখনও আমাদের মধ্যে একটা শক্তি ছিল, যাকে বলা হয়ে থাকে ইচ্ছাশক্তি। এই ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগে প্রাণের সাহায্যে বস্তুভোগে উদ্দীপ্ত হয়ে, আমরা বস্তুর মধ্যে প্রবেশ করে থাকি।
আমরা পুরানে পড়েছি, একজন মুনি, মহান মনিষী হওয়া সত্ত্বেও এই মোহবশতঃ হরিণ হয়ে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। অর্থাৎ আজ আপনি যে অবস্থায় নিজেকে দেখছেন, যে দেহে আপনি আছেন, তা আপনার পূর্ব-পূর্ব জীবনের চিন্তা ও চিন্তাজনিত কর্ম্মের ফলে হয়েছে। আবার ভবিষ্যতে আপনি কোন্ দেহে প্রবেশ করবেন, বা কোন্ ধরনের দেহপ্রাপ্ত হবেন, তা আপনার চিন্তা-ভাবনার উপরে নির্ভর করছে।
আপনি ছোটবেলা থেকে পুলিশ বাবাকে দেখেছেন আর ভেবেছেন, আপনি বড়ো হয়ে পুলিশ অফিসার হবেন। সেইমতো আপনি শরীর চর্চা করেছেন, পড়াশুনা করেছেন, তাই আজ আপনি পুলিশের বড়কর্তা হয়েছেন। তো আজ আপনি যা হয়েছেন, একটু ভেবে দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন, তা আপনার পূর্বচিন্তা ও কর্ম্মের সম্মিলিত ফল। হ্যাঁ কতকগুলো, চিন্তা বাসনা কামনা, আমাদের এক জীবনে সফলতার মুখ দেখতে পায় না। কিন্তু আপনার কর্ম্মফল সঞ্চিত থাকে। ভবিষ্যতে উপযুক্ত সময়ে সেই কর্ম্ম আপনাকে ফল প্রদান করবে। আর একটা কথা বলি, আমাদের চিন্তা ধারার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দৈহিক গঠনেরও পরিবর্তন হয়েছে।
এখন কথা হচ্ছে, আমরা মনুষ্যদেহধারী হলাম কি করে ? আমরা আগেই শুনেছি, সব দেহে সব কাজ সম্পন্ন হয় না। মনুষ্যদেহ ভিন্ন ঈশ্বরের সন্ধান করা সম্ভব নয়। ঈশ্বর অনুভূতির জন্য, আমাদের দেহে যেসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দরকার তা একমাত্র মনুষ্যদেহেই আছে। অর্থাৎ ঈশ্বর এমনভাবে আমাদের এই দেহকে তৈরী করেছেন, যাতে করে আমরা ঈশ্বর অনুভূতিসম্পন্ন হতে পারি। আমরা কোনো না কোনো এক সময়ে, এই ঈশ্বর অনুভূতি পেতে চেয়েছিলাম। তাই আমরা মনুষ্যদেহে প্রবেশ করেছি। বা বলা যেতে পারে, মনুষ্যদেহ প্রাপ্ত হয়েছি, কারন আমি পূর্বে কোনো না কোনো সময়ে ঈশ্বরের সাযুজ্যলাভ করবার জন্য, কামনা করেছিলাম । তাই শঙ্করাচার্য তার বিবেকচূড়ামনি গ্রন্থের প্রথমেই এই মনুষ্যদেহের প্রসংসা করেছেন।
কিন্তু আমাদের বিড়ম্বনা হচ্ছে, মনুষ্যদেহ প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পূর্ব-পূর্ব দেহের সংস্কার এমনকি পুরুষকার রয়ে গেছে। তো এই পুরুষকারের প্রয়োগে যেমন জগৎভোগের দিকে আমরা দৃষ্টি দিতে পারি, আবার এই পুরুস্কারের প্রয়োগেই, একমাত্র এই মনুষ্যদেহেই আমরা ঈশ্বরের সাযুজ্য লাভ করতে পারি। দেখুন দেহভিন্ন ঈশ্বরের সন্ধান-কর্ম্ম, বা ঈশ্বর চিন্তন করা সম্ভব নয়। তো আমাদের উচিত, আমরা যখন এই দুর্লভ মনুষ্য জীবন পেয়েছি, তখন এই দেহপ্রাপ্তির যে উদ্দেশ্য, সেই লক্ষে নিজেকে নিয়োজিত করা। ইচ্ছাশক্তি যাকিছু হবার কথা, ইচ্ছা করতে পারে। কিন্তু সেই ইচ্ছাশক্তিকে কার্য্যে পরিণত করতে গেলে, দরকার পরিকাঠামোর। আর এই পরিকাঠামোই আমাদের এই মনুষ্যদেহে স্থিত।
মোক্ষ লাভের উপায় :
মোক্ষ লাভের উপায় : শিবসংহিতা বলছে, আমাদের ভ্রমজ্ঞান বা অজ্ঞান, বস্তু সম্পর্কে ভিন্ন ধারণার জন্ম দিয়ে থাকে। আর এই অজ্ঞান আমাদের বাসনাজাত। তো বস্তু সম্পর্কে যখন আমাদের প্রত্যক্ষ জ্ঞান জন্মাবে, তখন বস্তু সম্পর্কে আমাদের যে ভ্রমাত্মক জ্ঞান তা প্রত্যক্ষজ্ঞানের প্রভাবে, দূরীভূত হবে। দেখুন, যতই আপনি যুক্তি দেখান, বা বুদ্ধির প্রয়োগ করুন না কেন, যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে আপনার কখনো ঈশ্বর জ্ঞান হতে পারে না। দেখুন, লঙ্কার স্বাদ, বা তেতুলের স্বাদ, বা রসগোল্লার স্বাদ কেমন, তা যুক্তি তর্ক, বা উদাহরণ দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। কিন্তু, যখন আপনি লঙ্কা, তেতুল, বা রসগোল্লা মুখে পুড়বেন, তখন আপনার মধ্যে যে জ্ঞান হবে, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ঠিক তেমনি, আপনার সঙ্গে যখন ঈশ্বরের সাথে প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ হবে, তখনই ঈশ্বর সম্পর্কে আপনার জ্ঞান যথযথ হতে পারে। এবং আপনার আগের কল্পনা, বুদ্ধি, যুক্তি তখন অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে।
শিবসংহিতায় বলা হয়েছে, জগৎ সত্য, অর্থাৎ চর্মচোক্ষে যা কিছু আমি দেখছি, সেটাই সত্য, এই ভ্রমাত্মক জ্ঞান যতক্ষন আমাদের দূরীভূত না হবে ততক্ষন আমরা সত্যকে দেখতে-জানতে পারবো না। আবার উল্টোদিকে থেকে বলতে বলা যেতে পারে, যতক্ষন ঈশ্বর সম্পর্কে প্রত্যক্ষজ্ঞান না হবে, ততক্ষন আমাদের ভ্রমজ্ঞান দূর হতে পারে না। এই এক অদ্ভুত অবস্থান আমাদের। সংহিতা বলছে, কেবল বিশেষ দৃষ্টি দ্বারাই মিথ্যা জ্ঞানের নিবৃত্তি হতে পারে। আত্ম-সাক্ষাৎকার দ্বারাই একমাত্র প্রতাক্ষজ্ঞান হতে পারে। আর এটি হতে পারে, আমাদের বিশেষ দৃষ্টি দ্বারা। অর্থাৎ ঝিনুকে রুপো দর্শনজাত ভ্রম, তখনই দূর হতে পারে, যখন আমরা ঝিনুকটিকে ভালো করে পর্যবেক্ষন করবো। সাপকে দড়ি ভাবা বা দড়িকে সাপ ভাবা - দুটোই ভ্রম। আর এই ভ্রমজ্ঞান তখনই দূর হতে পারে, যখন আমরা বিষয়ের গভীরে পর্যবেক্ষন করতে পারবো। আমাদের এই মনুষ্য শরীর একটা ক্ষুদ্র ব্রহ্মান্ড, এই জ্ঞান আমাদের তখনই যথাযথ হতে পারে, যখন আমরা এই শরীর সম্পর্কে খুঁটিনাটি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারবো। তাই বলা হচ্ছে, আত্মসাক্ষাৎকার আমাদের প্রতক্ষ্য জ্ঞান দিতে পারে। আর এই জ্ঞান পেতে গেলে, আমাদের নিজ নিজ জাতিগত ধর্ম্ম পালন করতে হবে। অর্থাৎ মনুষ্য জাতির যে স্ব-ধর্ম্ম তা আমাদের পালন করতে হবে। দ্বিতীয়ত কর্ম্মফলের ইচ্ছে ত্যাগ করে, সংসারে বিচরণ করতে হবে। সাধক যখন নিজেই নিজেকে দেখেন, অর্থাৎ আত্মাকে নিজের মধ্যে দর্শন করেন, তখন না থাকে কোনো কর্ম্ম না থাকে কোনো কর্ম্মফল। আর এই জ্ঞানের যখন উদয় হয়, বা আত্মদর্শন লাভ হয়, তখন তার মধ্যে কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ নামক প্রবৃত্তির নাশ হয়। সকল তত্ত্বের যখন অভাব হয়, তখনই স্বয়ং-প্রকাশ আত্মতত্ত্ব উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। অভাবে সর্ব্ব-তত্ত্বানাং সমং তত্ত্বং প্রকাশতে।
যাইহোক, আমরা এর পরের দিন, প্রাণ ইত্যাদি দশ বায়ুর সম্পর্কে শুনবো। আজ ব্রহ্মবাক্যের বিরাম দিলাম।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
শিবসংহিতা - ৩ - প্রাণ-বায়ুর দশকর্ম্ম।
আমরা আগের দিন শুনেছি, প্রধানতঃ দুটো শক্তি আমাদেরকে ক্রিয়াশীল করে রাখে। বায়ুশক্তি ও তেজ শক্তি। এই বায়ু শক্তির মধ্যে আছে সত্ত্ব ও রজঃশক্তির প্রকাশ। বায়ুর নিজস্ব গুন্ হচ্ছে স্পর্শ এবং উত্তরাধিকার সূত্রে অর্থাৎ আকাশ থেকে পেয়েছে, শব্দ। অর্থাৎ বায়ুর মধ্যে দুটো গুন্। এই বায়ুই যেমন আমাদের শরীরে স্পর্শেন্দ্রিয়ে অর্থাৎ ত্বকে সুখ দুঃখের অনুভব জাগায়। আবার এই বায়ুই আমাদের দেহে প্রাণশক্তি, প্রাণবীজ ও প্রাণকোষ নির্মাণ করে থাকে। আবার এই বায়ু আমাদের শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে রস-রক্ত সরবরাহ করে থাকে।
আর তেজশক্তি রজঃশক্তির প্রকাশ। এই তেজশক্তির নিজস্ব গুন্ হচ্ছে রূপ বা আকার। এছাড়া এই তেজশক্তি তার পূর্বপুরুষের কাছ থেকে পেয়েছে শব্দ ও স্পর্শ গুন্। আমরা যে বাইরে এতো রূপের প্রকাশ দেখি, তা এই অগ্নিতত্ত্বের দ্বারাই ঘটে থাকে। এই তেজঃশক্তি আমাদের দেহের শক্তি বা বল প্রদান করে থাকে। এই অগ্নিই আমাদের পেটের মধ্যে জঠরাগ্নিরূপে খাদ্যসামগ্রী জীর্ন বা হজম করে রস-রক্ত উৎপাদন করে। আমাদের দেহে তাপের্ উৎস এই তেজশক্তি।
যাই হোক, আমাদের আলোচ্য বিষয় প্রাণ বা বায়ু।
প্রাণের বাস মানুষের হৃদয়ে। শিবসংহিতা বলছে, মানুষের হৃদয় কোঠায় একটি মনোহর দিব্য পদ্ম বিরাজ করছে। এই পদ্মের বারোটি পাপড়ি। এই পাপড়িগুলোতে দ্বাদশ অক্ষর শোভা পাচ্ছে। পদ্মমধ্যে বিরাজ করছে শিবলিঙ্গ চিহ্ন। এই দ্বাদশদল পদ্মমধ্যে বাস করেন প্রাণ। আর এই প্রাণ আমাদের আদি-অন্তহীন কৃতকর্ম্মের সঙ্গে যুক্ত থেকে, কর্ম্মফল লাভ করে অহংকার যুক্ত অবস্থায় আমাদের বাসনার দ্বারা অলংকৃত হয়ে প্রত্যেকের হৃদিপদ্মে বাস করেন।
প্রাণস্য বৃত্তিভেদন নামানি বিবিধানি চ। বায়ুকে (প্রাণ) বৃত্তি বা কর্ম্মভেদে বিভিন্ন নামে অভিহিত হয়ে থাকে। প্রানোঽপ্রাণঃসমানশ্চোদানো ব্যানশ্চ পঞ্চমঃ। প্রাণ, অপান,সমান,উদ্যান, ও ব্যান - এই পাঁচটি প্রধান। নাগঃ কুর্মশ্চ কৃকর দেবদত্ত ধনঞ্জয়ঃ। এছাড়া আছে, বহুপ্রকার বায়ু আছে, এরমধ্যে উল্লেখ্য হচ্ছে নাগ, কুর্ম, কৃকর, দেবদত্ত, ধনঞ্জয়ঃ।
প্রাণ আসলে বায়ুর সূক্ষাতিসূক্ষ রূপমাত্র। প্রাণবায়ুর ক্রিয়াই মানুষকে বা সমস্ত জীবকে বাঁচিয়ে রেখেছে, চলত্শক্তিসম্পন্ন করে রেখেছে। তো বায়ুস্বরূপ এই প্রাণ। বায়ু আবার বিভিন্ন গুন্ প্রকাশহেতু বিভিন্ন নামে অবহিত হয়ে থাকেন। বায়ুর গুনের সংখ্যা নির্নয় মানুষের সাধ্য নয়। তবে, এই গুনগুলোর মধ্যে দশটি বায়ুর কথা আমাদের শাস্ত্রগ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো, প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান, নাগ , কুর্ম, কৃকর , দেবদত্ত, ধনঞ্জয়। বায়ুর এই দশ প্রকারভেদ করা হয়েছে, তার কর্ম্ম ও গুন্ অনুসারে। আবার এই দশ প্রকার বায়ুর মধ্যে একদিকে প্রাণবায়ু যেমন শ্রেষ্ঠ, তেমনি সমস্ত বায়ুর মধ্যেই প্রাণদায়িনী শক্তি থাকায়, এই সমস্ত বায়ুকেই প্রাণবায়ু বলা হয়ে থাকে।
আমাদের আয়ু, অর্থাৎ শরীরের জীবিতকাল মিশে আছে এই বায়ুর সঙ্গে। বায়ু আমাদের ফুসফুসের সম্প্রসারণ ও সংকোচনের মাধ্যমে, বহির্জগৎ থেকে আমাদের শরীরে নাসিকার রন্ধ্রপথ ধরে প্রবেশ করে থাকে। এবার শরীরে প্রবেশ করেই, বায়ু বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে, আমাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে প্রহরীর মতো অবস্থান করে থাকে। এই দশ প্রকার বায়ু, আমাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করে থাকে। শরীরের বিভিন্ন কর্ম্মের উৎস বা শরীরের বিভিন্ন কর্ম্মের উদ্গাতা। হৃদয়মধ্যে থাকে প্রাণ, গুহ্যদেশে থাকে অপান। নাভিমন্ডলে থাকে সমান, কণ্ঠদেশে থাকে উদান, এবং সর্বশরীর জুড়ে অবস্থান করে ব্যানবায়ু । তো প্রধান পাঁচটি বায়ুর অবস্থান আমরা শুনলাম।
প্রাণ বায়ু : বায়ুর মধ্যে মুখ্য হচ্ছে প্রাণবায়ু। এই প্রাণবায়ু আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়াকে পরিচালনা করে থাকে। হৃদযন্ত্রকে পরিচালনা করে এই প্রাণবায়ু। তাই বলা হয়ে থাকে বায়ুই আমাদের আয়ু। আমরা যাকিছু খাবার মুখে নেই, তা এই প্রাণবায়ুর সাহায্যে আমাদের পেটে বা উদরে প্রেরিত হয়। আমাদের ধমনীর মধ্যে শিরা-উপশিরার মধ্যে যে রক্ত পরিচালনা কর্ম্ম তা এই প্রাণবায়ুর কাজ। এমনকি আমাদের স্নায়ুর কাজকেও পরিচালনা করে থাকে এই প্রাণ বায়ু।
অপান বায়ু : আমরা শুনলাম প্রাণ বায়ুর প্রধান কাজ হচ্ছে, শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়াকে পরিচালনা করা। প্রাণবায়ুর এই কাজকে সহায়তা করে থাকে অপান বায়ু। এছাড়া আমাদের শরীরের যে অপ্রোজনীয় বস্তু অর্থাৎ খাদ্যের নির্যাস মল, মূত্র তাকে নিম্নগামী করে বাইরে বের করে দেওয়ার কাজ করে থাকে এই অপান বায়ু। এছাড়া পুরুষের শুক্রকে নিম্নগামী করা, নারীর রজঃনিঃসরন করা, এমনকি সন্তানকে ভূমিষ্ট করা, এগুলো এই অপান বায়ুর কাজ।
সমান বায়ু : আমরা শুনলাম, খাদ্যের নির্যাসকে বাইরে বের করে দেওয়া অপান বায়ুর কাজ। সমান বায়ু আমাদের জঠরাগ্নিকে প্রজ্বলিত করে পিত্তকে সক্রিয় রাখে। পিত্ত এই খাদ্যকে পরিপাক করে। খাদ্যের মধ্যে কিছু জীর্ন হয়, আবার কিছু অজীর্ণ থেকে যায়। এই জীর্ন খাদ্যের সারভাগ ও অসারভাগ পৃথক করে অসারভাগকে বৃহদন্ত্রের ভিতর দিয়ে আমাদের মলনাড়ীতে প্রেরণ করা, ও সারবস্তুকে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে প্রেরণ করা, এই সমান বায়ুর কাজ। এছাড়া আমাদের প্রাণবায়ু ও অপান বায়ুর ক্রিয়ার মধ্যে একটা সমতা বজায় রাখার দায়িত্ব পালন করে থাকে এই সমান বায়ু।
উদান বায়ু : আধ্যাত্মিক জগতে এই উদান বায়ুর গুরুত্ত্ব অপরিসীম। উদান বায়ু আমাদের মনের ভাবকে ধ্বনি, শব্দ বা ভাষার আকারে প্রকাশ করে থাকে। এই উদান বায়ুই আমাদের মন-বুদ্ধি-স্মৃতিকে পুষ্ট করে থাকে। আসলে উদান বায়ু আমাদের মনের ক্রিয়াকে সংগঠিত করে থাকে। এই উদান বায়ু আমাদের মূলাধারে যে কুণ্ডলিনী শক্তি আছে, তাকে উর্দ্ধমুখী করতে পারে। এই উদান বায়ু, সাধককে অতীন্দ্রিয় অনুভূতি এনে দিতে পারে। সাধক মনের উর্ধে উঠে যে ঈশ্বর অনুভূতি লাভ করে থাকে, তা এই উদান বায়ুর সাহায্যেই করে থাকে। তাই সাধনার জগতে এই উদান বায়ু খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যান বায়ু : আমরা শুনলাম, আমরা যে খাবার খাই, তাকে হজম করতে সাহায্য করে থাকে সমান বায়ু। সমান বায়ু, খাদ্যকে দুটো ভাগে ভাগ করে থাকে। সার ও অসার। এই সার বস্তু অর্থাৎ রস-রক্ত আমাদের সমস্ত শরীরে প্রয়জন মতো পরিবেশ করা এই ব্যান বায়ুর কাজ। এছাড়া, আমাদের শরীরের যে সংকোচন-প্রসারণ, মস্তিষ্কে রক্ত প্রেরণ ক্রিয়া সম্পাদন করে থাকে এই ব্যান বায়ু। এছাড়া আমাদের যে ঘাম নিঃসরণ হতে দেখি, এটি ব্যান বায়ুর কাজ।
এই পাঁচ ধরনের বায়ুই আমাদের শরীরের সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তাই আমাদের শারীরিক সুস্থ থাকা, এমনকি মানসিক দিক থেকে সুস্থ থাকা নির্ভর করছে, এই বায়ুর সঠিক ক্রিয়ার উপরে। এই পঞ্চ বায়ুর মধ্যে যদি অসামঞ্জস্য দেখা দেয়, তবে আমরা শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা বোধ করে থাকি। এই পাঁচটি বায়ু সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। কিন্তু বায়ুর আরো পাঁচটি প্রকার বা গুনক্রিয়া আছে, যা আমরা খেয়াল করি না। সেগুলো আমি আগেই বলেছি, নাগ , কুর্ম, কৃকর , দেবদত্ত, ধনঞ্জয়। এখন কথা হচ্ছে এগুলো আমাদের শরীরে কি কাজ করে থাকে ? আমরা যে উদ্গার বা ঢেকুর তুলি, এটি নাগবায়ুর কাজ। আমাদের শরীরের যে প্রসারণ-সংকোচন-উন্মীলন হয়, এটি কুর্ম বায়ু করে থাকে। আমাদের যে ক্ষিদে পায়, তৃষ্ণা পায় এসব কৃকর বায়ুর কাজ। আমরা যে হাই তুলি, এটি দেবদত্ত বায়ু করে থাকে। এবং সবশেষে আমরা যে হিক্কা তুলি, এটি আমাদের ধনঞ্জয় বায়ু করে থাকে।
তাই শিবসংহিতায় বলা হয়েছে,
প্রাণস্য বৃত্তিভেদন নামানি বিবিধানি চ। বায়ুকে (প্রাণ) বৃত্তি বা কর্ম্মভেদে বিভিন্ন নামে অভিহিত হয়ে থাকে। প্রানোঽপ্রাণঃসমানশ্চোদানো ব্যানশ্চ পঞ্চমঃ। প্রাণ, অপান,সমান,উদ্যান, ও ব্যান - এই পাঁচটি প্রধান। নাগঃ কুর্মশ্চ কৃকর দেবদত্ত ধনঞ্জয়ঃ। এছাড়া আছে, বহুপ্রকার বায়ু আছে, এরমধ্যে উল্লেখ্য হচ্ছে নাগ, কুর্ম, কৃকর, দেবদত্ত, ধনঞ্জয়ঃ।
এখন কথা হচ্ছে, আমাদের আলোচ্য বিষয় যোগ। আর যোগে প্রবেশ করতে গেলে, আমাদের বায়ুর সাহায্যেই যেতে হবে। বায়ু পথই যোগের পথ। তাই বায়ু ও আমাদের শরীরে বায়ুর ক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের একটা সাধারণ ধারণা অবশ্যই গড়ে তুলতে হবে।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
শিবসংহিতা - ৪ দিব্যদৃষ্টি ও সমান্তরাল বা বিকল্প জগৎ
বেদান্তে বলা হচ্ছে, শ্রবণ-মনন-নিদিধ্যাসনে ঈশ্বরলাভ হতে পারে। আবার ভক্তিশাস্ত্র বলছে, শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ ও পাদসেবনে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছনো যেতে পারে। শ্রীমদ্ভগবৎ গীতাতে আমরা দেখেছি, কর্ম্মযোগ ধ্যানযোগ, জ্ঞানযোগ তারপরে ভক্তিযোগের আলোচনা। আসলে শোনা-মানা-জানা এই হচ্ছে রাস্তা।
যদিও আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে যোগ, তথাপি এই প্রসঙ্গে আজ আমরা শ্রীমদ্ভগবৎ গ্রন্থে বা বলা যেতে পারে, আমরা মহাভারতের নির্দিষ্ট কিছু অংশে প্রবেশ করবো। মহাভারতে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ যখন, অর্জুনকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করবার জন্য, নানান ভাবে বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন, আর অর্জুন নানান রকম প্রশ্নবানে শ্রীকৃষ্ণকে বিদ্ধ করছিলেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ এক অলৌকিক কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। যোগের কথা বলতে শুরু করলেন, অর্থাৎ কর্ম্ম যোগ, জ্ঞানযোগ, ধ্যানযোগ, ভক্তিযোগ। বলছেন, এই অবিনাশী যোগের কথা আমি সূর্যকে বলেছিলাম, সূর্য তার পুত্র মনুকে বলেছিলো, আবার মনু তার পুত্র ইক্ষাকুকে বলেছিলো। এখন এই ত্রেতাযুগে যোগ লুপ্তপ্রায় হয়েছে। অর্জুন বলছে, আপনার জন্ম হয়েছে এখন, আর সূর্য্যের জন্ম হয়েছে সৃষ্টির আদিতে, মনু বা ইক্ষাকু জন্ম গ্রহণ করেছিলেন, মনুষ্য সৃষ্টির প্রথম পর্য্যায়ে, অনেক আগে। তো আপনি সেই সময় সূর্যকে এই বিদ্যা দান করেছিলেন, এ কিকরে সম্ভব ? তো ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, হে অর্জুন, আমার ও তোমার বহু জন্ম অতীত হয়েছে, যেসব আমি জানি, কিন্তু তুমি জানো না। এখান থেকে আমরা দুটো সূত্র পাই। এক) শ্রীকৃষ্ণকে অর্জুন এতক্ষন একজন সাধারণ মানুষ, তার সখা, সারথী, জ্ঞানী, বড়জোর একজন বীর যোদ্ধা হিসেবে ভাবছিলো। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ এবার নিজেকে অর্জুনের ধারণার বাইরে নিয়ে যেতে চাইলেন। তাই নিজেকে একজন জাতিস্বর হিসেবে দেখালেন। সাধারণের থেকে নিজেকে উর্দ্ধে তুলে ধরলেন। দুই) এই জন্মের আগেও আমরা ছিলাম। আর এই জন্মের পরেও আমরা থাকবো। কিন্তু কোথায় থাকবো, কিভাবে থাকবো, কোন দেহে অবস্থান করবো, এখন যাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তৈরী হয়েছে, তাদের সঙ্গে আবার আমাদের কি ধরনের সম্পর্ক হতে পারে, তা আমরা জানি না।
এর পর অর্জুনকে অনেকভাবে বোঝাতে লাগলেন, অনেক তাত্ত্বিক জ্ঞান দান করলেন। কিন্তু অর্জুন বুঝেও বুঝতে চাইছিলো না যে শ্রীকৃষ্ণ একজন অতিমানব, মহামানব। তিনি অনেক বিভূতি বা অলৌকিক ক্ষমতা ধারণ করে থাকেন।তাই অর্জুনকে যোগীর বিভূতির কথা বোঝাতে লাগলেন। তো যোগবিভূতির কথা শুনতে শুনতে অর্জুন ভাবলেন, শ্রীকৃষ্ণের সত্যিই কি কোনো যোগ বিভূতির কার্যকরী প্রয়োগ সম্পর্কে ক্ষমতা আছে, নাকি এসব কথা কেবল কথার কথা। তাই একসময় বলে বসলেন, হে পুরুষোত্তম আপনি যে আত্মতত্ত্ব-র কথা বলছেন, তা না হয় মেনে নিচ্ছি, কিন্তু আপনি যদি সত্যি সত্যি ঈশ্বর হন, তবে, আপনার সেই ঐশ্বরিক রূপ আমি দেখতে চাই।
এখন কথা হচ্ছে, সবাইকে সবকিছু যেমন বোঝানো যায় না, তেমনি সবাইকে সবকিছু দেখানোও যায় না। আমরা সবাই একটা পরিবেশ, পরিস্থিতি, অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে বেড়ে উঠি। আর সবকিছু, তা সে নতুন হোক বা পুরাতন হোক, আমরা আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে বুঝতে চাই। বিষয়ের গভীরে বুঝবার জন্য যেমন বিষয়ের উপরে একটা সাধারণ জ্ঞান চাই, তেমনি কিছু দেখতে গেলেও আমাদের চোখ চাই। অর্জুন ভাগ্যবান ছিলেন, ঈশ্বরের কৃপা তার উপরে বর্ষিত হয়েছিল। কিন্তু অর্জুন জিজ্ঞাসু ছিলেন। অর্জুনের মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন ছিল। কিন্তু সেই প্রশ্নের জবাব, শোনার সৌভাগ্য হয়তো হয়েছিল, কিন্তু এইসব গূঢ় তত্ত্ব ধারণ করবার শক্তি তার ছিল না। এই কথার মান্যতা পাই আমরা অনুগীতা পর্বে। সেখানে অর্জুন বলছেন, হে অচ্যুত, তুমি যুদ্ধক্ষেত্রে যা বলেছিলে, তা আমার এখন আর মনে পড়ে না, দয়াকরে যদি আরো একবার সেই অমৃতকথাগুলো যদি একবার বলো।
যাই হোক, দেখতে গেলে চোখ চাই। চোখ আমাদের কাছে জগৎকে উদ্ভাসিত করে, উপল্বদ্ধির স্তরে নিয়ে যায়। আবার আমাদের এই চর্ম্ম-চক্ষুর একটা সীমাবদ্ধতা আছে। আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলোরই তা সে কান, নাক, ত্বক প্রত্যেকেরই একটা সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা কিভাবে চোখ দিয়ে দেখি ? আপনি বলবেন, কোনো বস্তু থেকে প্রতিফলিত আলোক তরঙ্গ আমাদের চোখের রেটিনাতে প্রতিফলিত হওয়ার ফলে, সেই রেটিনাতে একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ উৎপন্ন হয়। সেই বিদ্যুৎ তরঙ্গ অপ্টিক নার্ভের মাধ্যমে আমাদের মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়। এবং মস্তিষ্কের একটা বিশেষ স্থানকে উদ্দীপ্ত করার ফলে আমরা সেই বস্তুটিকে দেখতে পাই। আমাদের চর্ম্ম-চক্ষুর কাজ এখানেই সমাপ্ত। তো ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, তুমি তো ভাই তোমার এই চর্ম্মচক্ষু দিয়ে আমার সেই পরম-ঈশ্বর রূপ দেখতে পাবে না। তোমাকে তাহলে দিব্যচক্ষু দান করতে হবে।
এখন কথা হচ্ছে এই দিব্যচক্ষু ব্যাপারটা কি ? দেখুন, আমাদের চোখের রেটিনাতে যত আলোর তরঙ্গ প্রতিফলিত হয়, তার সবই কি আমাদের চোখে ধরা দেয় ? দেয় না। আমরা সেই আলোক তরঙ্গদের দেখতে পাই, যা ৪০০ থেকে ৭০০ ন্যানোমিটারের মধ্যে থাকে। অর্থাৎ খুব কাছের জিনিস আমরা দেখতে পাই না, আবার খুব দূরের জিনিসও আমরা দেখতে পাই না। তাহলে কি সেই কাছের বা দূরের জিনিসের কোনো অস্তিত্ত্ব নেই ? তা নয়। আসলে আমাদের মস্তিষ্কের একটা সীমাবদ্ধতা আছে। আমাদের মস্তিস্ক-যন্ত্র যেমন আমাদের পিতা-মাতার কাছ থেকে পেয়েছি। তেমনি আমরা পেয়েছি একটা অদ্ভুত জিনিস যার নাম স্নায়ুতন্ত্র। সুষুম্না কান্ড বলে একটা জিনিস আছে। যা আমাদের মস্তিষ্কেরই অঙ্গ। মস্তিষ্কের থেকে বের হয়ে, মূলাধারে গিয়ে ঠেকেছে এই সুষুম্না কান্ড । এই সুষুম্না কাণ্ডের মধ্যে আছে বিভিন্ন গ্রন্থি চক্র, যেখানে স্নায়ুর ক্রিয়া চলছে। এই স্নায়ুর ক্রিয়াই আমাদের বহির্জগতের অনুভূতি জাগায়। এখন এই মূলাধারে একটা বিশেষ শক্তি আছে, যাকে উজ্বীবিত করতে পারলে, আমরা সামনে যে জগৎ দৃশ্যমান, সেই জগৎ ছাড়াও, অনেক জগৎ আমাদের সামনে ভেসে উঠতে পারে। এবং সেইসব জগৎও হুবহু দৃশ্যমান জগতেরই মতো। সেই জগৎগুলোকে বলা হয়, paralal universe বা সমান্তরাল জগৎ। এই জগতে সমস্ত সম্ভাবনাময় ঘটনার চিত্র আছে। অর্থাৎ যা ঘটেনি কিন্তু ঘটতে পারতো। বা যা ঘটেনি কিন্তু ভবিষ্যতে ঘটবে।
একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হতে পারে। ধরুন আপনি হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষায় পাশ করেছেন। তো এর পরে আপনি, জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসতে পারেন, বা নাও বসতে পারেন। এখন জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসলে, মেডিকেল কলেজে - ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হতে পারেন। সেখানে ঠিকঠাক মতো পড়াশুনা করলে, আপনার রেজাল্ট ভালো হতে পারে, আবার পড়াশুনা না করলে উল্টোটা হতে পারে। এখন কথা হচ্ছে, প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে এমনিতর হাজার হাজার সম্ভাবনাময় জগতের সৃষ্টি হচ্ছে। এর যেকোনো একটি আপনার সামনে ভবিষ্যতে দৃশ্যমান হয়ে ফুটে উঠবে। এই যে হাজার হাজার জগৎ এর যে কোনো জগতেই আপনি ফুটে উঠতে পারেন। এখন কথা হচ্ছে কোন জগৎটি আপনার সামনে ভবিষ্যতে ফুটে উঠবে তা নির্ভর করছে আপনার প্রকৃতির উপরে। ধরুন আশ্রমের গুরুমহারাজ হঠাৎ অসুস্থ হয়েছেন। তো আশ্রমের সবাই মিলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে পারেন, আবার নাও করতে পারেন। এখন দেখা গেলো, আশ্রমের সবাই তার সুস্থতা কামনা করছেন। যার যেমন দৃষ্টিভঙ্গি সে তেমনি ভাবে করছেন। কেউ মন্দিরে গিয়ে পুজো দিচ্ছেন। কেউ ডাক্তার ডাকতে ছুটছেন। সম্মিলিত ভাবে এই যে চেষ্টা, এর ফলে গুরুমহারাজ সুস্থ হয়ে যাবেন, যদি না তার প্রারব্ধ বাধা হিসেবে দেখা দেয়। না এটা কোনো অলৌকিক ভাবে ঘটবে তা নয়, কিন্তু আপনি যদি গভীরভাবে কিছু চান দেখবেন, সেই জিনিস পাবার জন্য, আপনার কাছে উপায় এসে যাবে। মৃত্যু যদি ভবিতব্য হয়, অর্থাৎ প্রারব্ধ হয়, তবে আপনি হাসপাতালে গেলেও, ডাক্তার পাবেন না, ডাক্তার পেলেও ঔষধ পাবেন না। আর যদি প্রকৃতি আপনার সহায় হয়, তবে আশ্রমে বসেই ডাক্তার পেতে পারেন, ঔষধ পেতে পারেন, ভালো হয়ে যেতে পারেন। এইযে সম্ভাব্য সমস্ত ঘটনা যা ঘটেনি, কিন্তু ঘটতে পারে, সে সমস্তকিছুই আমাদের কাছে দৃশ্য আকারে, দৃষ্টিগোচর হতে পারে। অনুভূতিতে আসতে পারে। একেই বলে দিব্যদৃষ্টি।
যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে দিব্যদৃষ্টি দান করেছিলেন। আর এই দৃষ্টি-শক্তির জোরে, অর্জুন ঈশ্বরের স্বরূপ দেখতে পেয়েছিলেন। এটি আসলে আমাদের সুষুম্না কাণ্ডের স্নায়ুতন্ত্রের ক্রিয়া। যাকে উপলব্ধি করা যায় যোগের সাহায্যে।
যাইহোক, আজ এইপর্যন্ত। কিন্তু এটা আমি বেশ বুঝতে পারছি, দিব্যদৃষ্টির ব্যাপারটা এখনো আমরা বুঝতে পারিনি। কিন্তু ধীরে ধীরে এই দিকে আমরা অগ্রসর হবো। স্নায়ুতন্ত্রের ক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের আরো গভীরভাবে জানতে হবে। তবে একটা কথা বলি, যোগে প্রবিষ্ট না হলে, যোগের ফলাফল অনুধাবন করা সহজ নয়, বলা যেতে পারে হয়তো সম্ভব নয়। তাই শিব-সংহিতায় বলা হচ্ছে,
ন ভবেৎ সঙ্গযুক্তানাং তথা বিশ্বাসিনামপি।
গুরুপূজা বিহিনানাং তথা চ বহু সঙ্গিনাম।
অর্থাৎ যারা বিষয়াসক্ত, যারা অবিশ্বাসী, যারা গুরুর উপাসনা করে না, এবং বহুজনের সঙ্গে নানান ধরনের আলাপচারিতায় রত, তাদের সিদ্ধিলাভ হয় না।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
--------------------------
খাবার একঘন্টা আগে অথবা খাবার তিন-চার ঘন্টা পরে করুন। শিবসংহিতা বইটি কাছে রাখেতে পারেন।
নিজের শরীর বুঝে করবেন, কোনো অসুবিধা মনে হলে বিশেষ করে, মাথা ঘোরা বা মাথা ব্যথা হলে, কিছুদিন বন্ধ রাখার পরে আবার শুরু করতে পারেন। কুম্ভকের সময় নির্ধারণ, নিজের শরীর বুঝে করতে হয়। শিরদাঁড়ায় ব্যথা অনুভব করলে, কাউকে বলুন, হাত দিয়ে আলতো করে পাশাপাশি মালিশ করতে। উপর-নিচ মালিশ করবেন না। ঠিক হয়ে যাবে। সম্ভব হলে কয়েকজন মিলে করুন। তাহলে সুবিধা-অসুবিধা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে পারবেন। শিবসংহিতা বইটি কাছে রাখুন। নিজেকে পবিত্র রাখুন, আহার ও চিন্তায় পবিত্রতা রক্ষা করুন।
------------------------------------
শিবসংহিতায় বলা হয়েছে, সন্ধিকালে অর্থাৎ সূর্য উদয়ের সময়, সূর্য অস্ত যাবার সময়, দুপুরে, ও মধ্যরাত্রে, এই চারবার প্রাণায়াম করলে অবিলম্বে (তিনমাসের মধ্যে) আমাদের নাড়ীশুদ্ধি হবে। আর নারী শুদ্ধি হলে, আমাদের জঠরাগ্নি উদ্দীপ্ত হবে। আমদের শারীরিক বল, মানসিক বল, উৎসাহ-উদ্দীপনা, বৃদ্ধি পাবে, আমরা সুভোগী ও সুখী হতে পারবো।
প্রক্রিয়া :
১) পরিষ্কার পরিছন্ন খোলামেলা স্থানে সুখাসনে বসুন।
২) অঞ্জলিবদ্ধ হয়ে গুরুদেবকে প্রণাম করুন, বিঘ্ননাশক শ্রীগণেশ ও রুদ্রদেবকে প্রণাম করুন। সবশেষে মা-দুর্গাকে প্রণাম করুন।
৩) এরপর ডান হাতের বৃন্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে ডান নাসিকা (পিঙ্গলা নাড়ী) রুদ্ধ করে, বাম নাসিকা দিয়ে (ইড়া নাড়ী) বায়ুকে যথাশক্তি ভিতরে টেনে নিন।
৪)এবার যথাশক্তি কুম্ভক করুন।
৫)এবার ধীরে ধীরে অর্থাৎ বেগের সঙ্গে নয়, বাম নাসিকা অর্থাৎ ইড়া নাড়ীকে অনামিকা দ্বারা বন্ধ করে, পিঙ্গলা দ্বারা অর্থাৎ ডান নাক দ্বারা বায়ু ত্যাগ করবেন।
এবার ঠিক উল্টোটা করুন, অর্থাৎ ডান হাতের অনামিকা দ্বারা বাম নাক বন্ধ করে, ডান নাক দিয়ে শ্বাস নিন, কুম্ভক করুন, আবার ডান নাক বন্ধ করে, বাম নাসিকা দিয়ে শ্বাস ছেড়ে দিন।
এইভাবে বিশবার কুম্ভক করবেন। খেয়াল করবেন, বাম নাসিকা দ্বারা শ্বাস নিতে হবে, আর ডান নাসিকা দ্বারা শ্বাস ছাড়তে হবে। আবার ডান নাসিকা দ্বারা শ্বাস নিতে হবে, এবং বাম নাসিকা দ্বারা ছাড়তে হবে। মাঝে কুম্ভক করতে হবে। শ্বাস নেবার জন্য যে সময় ব্যায় করবেন, শ্বাস ছাড়ার সময় তার দ্বিগুন এবং কুম্ভক তার দ্বিগুন সময় যাবৎ করবেন। (১:৪:২)
শিব সংহিতায় বলা হয়েছে, প্রতিদিন, দিনে চার বার। আর প্রতিসন্ধিক্ষনে বিশবার করে, এই প্রাণায়ামের অভ্যাস করলে, অবিলম্বে সাধকের নাড়ী শুদ্ধি হবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
কি করে বুঝবেন, যে আপনার নাড়ীশুদ্ধি হয়েছে ? শিব সংহিতা বলছে, নাড়ী শুদ্ধি হলে, যোগীর শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য বজায় থাকবে। দেহ হবে সুগন্ধময়। দেহ সুন্দর ও কান্তিযুক্ত হবে। কন্ঠস্বর হবে সুমধুর ও সংগীত সাধনার যোগ্য । জঠরাগ্নি উদ্দীপ্ত হওয়ায়, যাকিছু আহার করবেন, তা সহজে হজম হয়ে যাবে। ফলত স্বল্প বা পরিমিত আহারেই শরীর সুস্থ সবল থাকবে। আর সর্বাঙ্গ সুস্থ-সুন্দর শরীরে আত্মা হবে সুভোগী ও সুখী।
No comments:
Post a Comment