Friday, 2 April 2021

জ্ঞানগঞ্জের রহস্যঃ

 


জ্ঞানগঞ্জের রহস্যঃ  

জ্ঞানগঞ্জ নিয়ে আমাদের কৌতূহলের শেষ নেই। অনেক কল্প কাহিনী শোনা যায়, এই জ্ঞানগঞ্জ নিয়ে। কিন্তু আসলে এই জ্ঞানগঞ্জ কোথায়, কিভাবে সেখানে যাওয়া যায়, আর সেখানে গেলে কিই বা পাওয়া যায়, - এই সম্পর্কে আজ আমরা শুনবো।  

জ্ঞানগঞ্জ কোথায় ? 

বলা হয়ে থাকে, বিন্ধাচল থেকে ১৬ মাইল দূরে তিব্বত সীমান্তে  অবস্থিত একটি আশ্রম। এ এক অদ্ভুত সাধন রাজ্য। বহু শক্তিধর দন্ডি সন্যাসী, পরমহংস-দের এ এক মিলনক্ষেত্র। এই স্থানটির ভৌগলিক অবস্থান সম্পর্কে কেউ নির্দিষ্ট করে কিছু বলেন নি। রহস্যে ঢাকা এই স্থান। যারা এখানে অলৌকিক ভাবে গিয়েছিলেন , এবং আবার আমাদের কাছে ফিরে এসেছিলেন, তারাও কেউ এই রহস্যঃ উন্মোচন করেন নি। তারা বলছেন, এখানে সাধারণ ভাবে আসার কোনো উপায় নেই। কোনো উচ্চ কোটির সাধক কৃপা করে নিয়ে না গেলে, সেখানে কেউ যেতে পারেন না। ত্রৈলঙ্গস্বামী, লোকনাথ ব্রহ্মচারী, রামদাস কাঠিয়াবাবা, রামঠাকুর, বাবাজি মহারাজ,  শ্যামাচরণ লাহিড়ী ইত্যাদি ব্যতিক্রমী কিছু মহাত্মা এই সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন বলে শোনা যায়।

 কেউ কেউ বলে থাকেন, জ্ঞানগঞ্জ আসলে একটা সাধন ক্ষেত্র, একটা বিশ্ববিদ্যালয় ।  বা বলা যেতে পারে, যোগীমহারাজদের বিচরণ ক্ষেত্র। এই জ্ঞানগঞ্জ মঠের দুটো প্রধান বিভাগ, একটা হচ্ছে বিশুদ্ধ জ্ঞানযোগ সম্মন্ধীয়, আর একটা হচ্ছে যোগ বিজ্ঞান। এই যোগবিজ্ঞনের ষোলোটি বিভাগ আছে, তার মধ্যে সৌরবিজ্ঞান, সূর্যবিজ্ঞান, নক্ষত্রবিজ্ঞান, কাল বা সময়বিজ্ঞান, ক্ষনবিজ্ঞান, বায়ুবিজ্ঞান, চন্দ্রবিজ্ঞান ইত্যাদি ইত্যাদি।  প্রত্যেক বিজ্ঞানের শিক্ষা আলাদা আলাদা ভাবে দেওয়া হয়।  সংসারে যার যে বিজ্ঞান শিক্ষার যোগ্যতা আছে, তাদেরকে খুঁজে নিয়ে এই বিষয়েই শিক্ষা দেওয়া হয়।  এছাড়া আছে কয়েকটি তান্ত্রিক মঠ।  এখানে উচ্চকোটির শক্ত সাধকগণ বাস করে থাকেন। এঁরা অলৌকিক শক্তিধর, এঁরা কালজয়ী, এঁরা আকাশপথে গমন করে থাকেন। এঁরাই যোগ্য ছাত্রের সন্ধানে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমন করেন।  এবং নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে ভৌতিক জগতে বিচরণ করে থাকেন।   

 এখানে বহু সাধক আছেন, যারা বছরের পর বছর সাধনা করছেন।  এখানকার প্রাকৃতিক জল-হাওয়া এমনিই যে   এখানে  মানুষের শরীরের পরিবর্তন হয় না।  এখানে কেউ কিছু না খেয়েও বেঁচে থাকতে পারেন ।  অর্থাৎ এখানে বাতাস ও সূর্য থেকে  থেকে শরীরের জন্য আহার সংগ্রহ করা যেতে পারে। তাই এখানে বসবাসকারীর  বয়সের কোনো গাছ পাথর নেই।

 বলা হয়ে থাকে, এই অবস্থা আপনি প্রতক্ষ্য করতে পারবেন, যদি আপনি কৈলাশ পর্বতের কাছাকাছি কিছুদিন বাস করেন। এখানে শোনা যায়, নখ ও চুলের বৃদ্ধি পায়  অতি দ্রুত। কৈলাশ পর্বতেও আজ অবধি কেউ পৌঁছুতে পারে নি। তার কারন হচ্ছে, সেখানকার আবহাওয়া মানুষের বেঁচে থাকবার উপযুক্ত নয়।  আর এ জ্ঞানগঞ্জ কৈলাশ থেকেও আরো উত্তর-পূর্ব কোনে এক দুর্গম স্থান।  এখানে এমনকি উড়োজাহাজে করেও পৌঁছনো যায় না। 

আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, এটি আসলে যোগের একটা উচ্চ অবস্থা মাত্র। এই স্তরে সাধক  উন্নীত হলে, সাধকের মধ্যে জ্ঞানের উন্মেষ আপনা-আপনি হয়। এই সময় সাধকের মধ্যে নানান রকম বিভূতির প্রকাশ হতে থাকে। আর এই বিভূতি নিয়ে যারা মেতে থাকেন, তাদের সাধন-জীবন এখানেই সমাপ্ত হয়ে যায়। এই বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনার শেষে দুচার কথা শুনবো।  

যাইহোক, বলা হয়ে থাকে জ্ঞানগঞ্জ একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো। জ্ঞানগঞ্জের প্রধান জায়গাটি হচ্ছে মনোহর তীর্থ। অতি রমণীয় কিন্তু দুর্গম স্থান। ব্রহ্মর্ষি মহাতপার আসন এখানে। এখানে যোগাযোগের রাস্তা হচ্ছে আকাশপথে, যোগ-বিভূতিমার্গে।  

সাংগ্রীলা  ঘাঁটি : এই জ্ঞানগঞ্জের সঙ্গে আরো একটা জায়গার কথা শোনা যায়।  আর তা হচ্ছে সাংগ্রীলা। সাংগ্রীলা ঘাঁটি সম্পর্কে জানতে গেলে, আগে জ্ঞানগঞ্জ সম্পর্কে একটা প্রতক্ষ্য জ্ঞান থাকা দরকার। তিব্বত ও অরুনাচল সীমা থেকে শুরু হয়েছে এই সাংগ্রীলা ঘাঁটি। এই সাংগ্রীলা ঘাঁটি অগম্য স্থান। ব্যাপক ভূমিহীনতা এবং চতুর্থ আয়াম বা forth dimension দ্বারা প্রভাবিত।  তাই সাংগ্রিলা ঘাঁটি শুধু অগম্য নয়, এটি রহস্যময়। অন্তঃরীক্ষের অন্যকোনো লোকের সঙ্গে এই সাংগ্রীলা  মঠের প্রতক্ষ্য সম্মন্ধ রয়েছে। এখন কথা হচ্ছে এই ভূমিহীনতা ব্যাপারটা কি ? লামা যুৎসুং বলছেন, বায়ু মন্ডলের মধ্যে এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে বায়ুশূণ্যতা বিরাজ করছে। তেমনি এই বিশ্বে এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে ভূমিহীন।  এই বায়ুশূন্য স্থান ও ভুশুন্য স্থানগুলো ফোর্থ ডাইমেনশন বা চতুর্থ আয়ম দ্বারা প্রভাবিত। আর এই জায়গাগুলো দেশ কাল নিমিত্তের উর্দ্ধে। তাই কোনো বস্তু বা প্রাণী যদি নিজের অজ্ঞাতসারে এই চতুর্থ আয়ামে প্রবেশ করে, তবে তৃতীয়আয়াম  জগতের দৃষ্টিতে তার সত্তা অদৃশ্য অথবা লুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু তার অস্তিত্ত্ব যেমন ছিল, তেমনই  থাকবে। তবে ভবিষ্যতে কবে তার অস্তিত্ত্ব আবার তৃতীয় আয়ামে বা আমাদের এই জগতে প্রকট হবে, বা আদৌ প্রকট হবে কি না, তা বলা যায় না। একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের এই জগৎ যা আমাদের কাছে দৃশ্যমান, তা তৃতীয় আয়ামে বাঁধা। আমাদের বিশ্বের যে ভূমি, তা বাঁকা। যদি কোনো বস্তু শূন্যতা বা ভূমিহীন জায়গায় চলে যায়, তবে তার এই বক্রতার  পরিসমাপ্তি ঘটবে। এমনকি তার স্মৃতিতে আগের জগৎ সম্পর্কে সমস্ত জ্ঞান লোপ পেয়ে যাবে। সে বুঝতেই পারবে না যে সে একটা নতুন জগতে প্রবেশ করেছে এবং এই জগতে কালের প্রভাব অতি নগন্য। এই নতুন জগতে তার বুদ্ধি ও মনের শক্তি, বিচার শক্তি, শারীরিক ক্ষমতা, জীবনীশক্তি, এমনকি মানসিক চেতনা আশাতীত ভাবে বেড়ে যাবে। এই জায়গায় সে নিজেকে প্রফুল্ল, তরতাজা অনুভব করতে থাকে। এখানে শরীরের উপরে কালের কোনো প্রভাব পড়তে পারে না। এখানে যদি কুড়ি  বছরের এক যুবক-দেহ প্রবেশ করে, তবে বহু বছর  ধরে, ওই কুড়ি বছরের যুবকই আছে। আবার সংযোগ বশতঃ যদি কোনো কারনে ওই যুবকের দেহ ফোর্থ ডাইমেনশন প্রভাবিত এলাকা ছেড়ে থার্ড ডাইমেনশন স্তরে প্রবেশ করে, তাহলে সেই বৃদ্ধি হওয়া আয়ুর প্রভাব তৎক্ষণাৎ তার শরীরের উপরে পড়তে শুরু করবে। তখন  তার জীবনীশক্তি ক্ষীণ হয়ে যাবে। এমনকি সে মারাও যেতে পারে।  এই হচ্ছে সাংগ্রিলা ঘাঁটির বাতাবরণ যা আমাদের কাছে অবৈজ্ঞনিক না হলেও অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। সাংগ্রীলা ঘাঁটি একটা স্বর্গীয় বাতাবরণে ডুবে থাকে। এক অদ্ভুত আলোর আভায় পরিপূর্ন এই অবিশাস্য স্থান। এখানেই অদৃশ্যরূপে অবস্থান করছে বহু যোগাশ্রম, সিদ্ধাশ্রম ও তন্ত্র সাধনার মঠ। এখানেই উচ্চকোটির ক্ষমতাসম্পন্ন কালজয়ী সাধকগণ অবস্থান করে থাকেন। এরা  সূক্ষ্ম দেহে আকাশপথে বিচরণ করে থাকেন। এরাই ইচ্ছেমতো শিষ্যদের দর্শন দিয়ে থাকেন। সাধন নির্দেশ দিয়ে থাকেন। অনেকের ধারণা মহাভারত বা তার আগের যুগের অনেক সাধক এখনো এখান থেকেই সাধকদের বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করে থাকেন। বলা হয়ে থাকে সত্যিকারের যোগীদের কাছে অসম্ভব বলে কোনো কথা নেই। এইসব যোগী-মহাপুরুষ দেবলোকে সরাসরি আসা যাওয়া করে থাকেন।  এদের দেহ আলোকময়-অবিনশ্বর।

জ্ঞানগঞ্জের স্থিতি - সময় ও স্থানের উর্দ্ধে এখানে একটা কথা বলা যেতে পারে, এই বিশাল পৃথিবীর মধ্যে এমন  কিছু রহস্যময় স্থান আছে, যা সময়সীমার বাইরে। এখন কথা হচ্ছে সময় কাকে বলে ? আসলে ব্রহ্মান্ডের সমস্ত কিছুই চলমান। স্থির হচ্ছে একমাত্র সময়। সময়ের পরিমাপ করা যায় না।  কিন্তু আমাদের ধারণা  হচ্ছে, সময় বয়ে চলেছে, স্রোতস্বীনি নদির মতো। আসলে আমাদের সামনে যা কিছু দেখছি, সবই ক্ষয়িষ্ণু পদার্থ। যেমন ধরুন, আমার এই দেহ, এটি একসময় শিশু ছিলো, তো সেটা আমার শিশুকালীন সময়, আবার আমি কৈশোরে যখন পা দিলাম, তাকে বলা হচ্ছে আমার কৈশোরকালীন সময়। আবার আমার যৌবন কালীন সময়, আমার বৃদ্ধকালীন সময়, এমনকি আমার মৃত্যুকালীন সময় ইত্যাদিকে আমরা একটা সাল তারিখ দিয়ে চিহ্নিত করে রেখেছি ।  আবার আমার একসময় মৃত্যু হলো, তো ক্যালেন্ডারের পাতা দেখিয়ে বলা যেতে পারে, আমি খ্রিস্টপূর্ব এতো সাল  থেকে এতো খ্রিস্টাব্দ   পর্যন্ত আমি বেঁচেছিলাম।  আসলে আমার জীবনকালকে চিহ্নিত করবার জন্য, বা কোনো ঘটনাকে নির্দিষ্ট করবার জন্য, আমরা সময়কে মেপে থাকি, বা চিহ্নিত করে থাকি। এখন কথা হচ্ছে সময় কিন্তু আমার জন্মের আগেও ছিল, আবার সময় আমার মৃত্যুর পরেও থাকবে, এমনকি এই পৃথিবীর জন্মের আগেও সময় ছিল, আবার এই পৃথিবী বা ব্রহ্মান্ডের ধংশ হয়ে গেলেও সময় থাকবে। আসলে সময় হচ্ছে সাক্ষী। ব্রহ্মান্ডের যাবতীয় ঘটনার এমন কি  ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির আগে থেকেই এই সময়ের উপস্থিতি ছিল।  আবার ভবিষ্যতেও থাকবে।  তো সময় হচ্ছে সাক্ষী। এখন কথা হচ্ছে সব কিছুর সাক্ষী হচ্ছে সময় কিন্তু এমন কোনো ঘটনা বা জায়গা আছে কি যা সময়ের সাক্ষী হতে পারে ? এর সহজ উত্তর হচ্ছে না। 

এখন বলা হচ্ছে বিন্ধগিরির ১৬ মাইল দূরে এই জ্ঞানগঞ্জ।  আর এই জ্ঞানগঞ্জ হচ্ছে, সময়ের বাইরের এলাকা। তো সময়ের বাইরে কে আছেন, ব্রহ্ম। বিন্ধ কথাটার অর্থ হচ্ছে, ছিদ্র। অর্থাৎ শূন্য স্থান। আর বিন্ধ্য কথার অর্থ হচ্ছে বিরুদ্ধ চিন্তন। সূর্য্যের গতিকে রুদ্ধ করবার জন্য, যিনি বিপরীত বা উন্নত হতে কামনা করেছিলেন, বিন্ধ্যপর্বত বা বিন্ধ্যগিরিমালা। এটি পুরাতন ভারতবর্ষের আর্য্যাবর্ত ও দক্ষিণাবর্তকে বিভক্ত করেছে। পূরাণ মতে অগস্ত মুনি হচ্ছেন এই বিন্ধ্যগিরির গুরু। আবার বান রাজার মাতা হচ্ছেন, এই বিন্ধ্যগিরিমালা। 

আবার দেখুন আমাদের শরীরের মেরুদণ্ডের মধ্যে আছে সুষুম্না নাড়ী। এই সুষুম্না নাড়ীর  মধ্যে আছে ব্রহ্মরন্ধ্র। এই ব্রহ্মরন্ধ্র ধরে আমরা যখন উপরের দিকে উঠে যাই, তখন আমরা ব্রহ্মলোকে উপস্থিত হই। এই ব্রহ্মলোকের উপরে আছে বিন্দু। এই বিন্দুর সাহায্যেই আমরা বাহ্যিক জগতের সঙ্গে অন্তর্জগতের যোগাযোগ করতে পারি।  বা করে থাকি। এইসময় আমাদের যে জ্ঞানালোকের উৎপত্তি হয়, তাকে বলা  হচ্ছে জ্ঞানগঞ্জ। এই হচ্ছে জ্ঞানগঞ্জের আসল স্থিতি।  এটিকে আমরা রূপকের সাহায্যে ব্যক্ত করে থাকি। 

জ্ঞানগঞ্জে কিভাবে বিশুদ্ধানন্দ পরমহংস গিয়েছিলেন  ?

জ্ঞানগঞ্জে গিয়েছিলেন, বেশকিছু যোগী মহাপুরুষ। এরমধ্যে ত্রৈলঙ্গ স্বামী, বাবাজি মাহারাজ, বাবা লোকনাথ, শ্রীশ্রী রামঠাকুর, বিশুদ্ধানন্দ পরমহংস ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য। 

এই বিশুদ্ধানন্দ পরমহংস পূর্বাশ্রমে ছিলেন ভোলানাথ নামে পরিচিত ছিলেন। ইনি কৈশোরেই এই জ্ঞানগঞ্জে যাবার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন।  এবং পরবর্তীতে আবার সংসারে ফিরে এসেছিলেন। তো তিনি কিভাবে সেখানে গিয়েছিলেন, সেটা আমরা একবার শুনে নেই। 

 ভোলানাথের কোষ্ঠিতে নাকি তার পরমায়ু লেখা  আছে মাত্র বাইশ বছর। ভোলানাথের মা তা জানতেন, তাই ভোলানাথ কিশোর বয়সে যখন সংসার ছেড়ে সন্ন্যাস নিতে চাইলেন, তার মা আর আপত্তি করলেন না। তো কিশোর ভোলানাথ তার ছোটবেলায় দেখা এক মহাপুরুষের খোঁজে চললেন ঢাকা। সঙ্গে তার আর এক বন্ধু, হরিপদ বন্দোপাধ্যায়।  সেখানে অনেক ঘোজাখুঁজির পরে,  ঢাকার উপকন্ঠে রমনা নামক জঙ্গল ঘেরা শক্তিসাধনার পীঠস্থানে সেই মহাপুরুষের সাক্ষাৎ পেলেন। তো একদিন গভীর রাতে রমনার জঙ্গলে যখন অন্ধকার নেমে এসেছে, তখন সাধু মহারাজ দুই কিশোরের হাত দুটোকে চেপে ধরে, বনপথ দিয়ে হাটতে শুরু করলেন। এর পরে, একসময় সাধুমহারাজ দুই কিশোরের চোখ কাপড় দিয়ে বেঁধে দিলেন। এবার দুই কিশোর, সাধু মহারাজের হাত ধরে, মোহাচ্ছন্নের মতো পথ চলতে লাগলো। পরদিন সকালে তাদের চোখের কাপড় খুলে দেওয়া হলো। এবং তারা আশ্চার্য্য হয়ে দেখলেন, পাহাড়ের উপরে এক মন্দিরে তারা দাঁড়িয়ে আছেন। স্থানীয় লোকজনদের কাছে জিজ্ঞেস করে জানলেন, এই জায়গায়র নাম বিন্ধাচল। তো ঢাকা থেকে এই বিন্ধাচল প্রদেশের দূরত্ত্ব ছয়শত মাইল। আর  যোগীপুরুষের সাহায্যে একরাতে, এই ছয়শত মাইল পথ অতিক্রম করতে পেরে, তারা যোগীপুরুষের অলৌকিক সামর্থের কথা অনুভব করতে পারলেন। এর পরে এই একই প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ যোগশক্তি বলে যোগী মহারাজ বালক দুইজনকে নিয়ে হিমালয় অতিক্রম করে তিব্বতের দুর্গম এক মালভূমিতে এনে উপস্থিত করলেন। এ এক অদ্ভুত সাধনরাজ্য। শক্তিধর বহু সাধক এখানে মিলিত হন, সাধনা করবার জন্য। এই স্থানটির নাম জ্ঞানগঞ্জ। এই  ভোলানাথ হচ্ছে, উত্তরকালের বিশুদ্ধানন্দ পরমহংস। আর ওই মহাপুরুষ হচ্ছেন স্বামী নিমানন্দ পরমহংস।

জ্ঞানগঞ্জে কিভাবে যাওয়া যায় ? 

আমরা আগে শুনেছি, ভোলানাথ গুরুদেবের হাত ধরে আকাশমার্গে সেখানে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ গুরুদেব যার হাত ধরেন, বা যিনি সৎগুরুর হাত ধরতে পারেন, সেই ভাগ্যবানই জ্ঞানগঞ্জের সন্ধান পান, সেখানে পৌঁছতে পারেন।  তো এই সৌভাগ্য আমাদের সবার হবে তা সম্ভব নয়। এইখানে মহাত্মা  যুৎসুং লামা  বলছেন, জ্ঞানগঞ্জে তুমি মুক্তির স্বাদ পাবে। নিজেকে আগে সূক্ষ্ম ধ্যান-জপে মগ্ন রাখো। নিজেকে গুটিয়ে আনো।  লোকালয় এড়িয়ে চলো। ঈশ্বর আর তোমার মাঝে কোনো বাধা আসতে  দিও না। পথনির্দেশ যথা-সময়ে তুমি পেয়ে যাবে। শুধু ঈশ্বর সেবাতে নিজেকে নিযুক্ত রাখো। অ-শেষের জন্য যাত্রা শুরু করো।  তিন অক্ষরি মন্ত্র জপ করো।  জ্ঞানগঞ্জে যাবার সিদ্ধান্ত যদি নাও, তবে সূর্য উদয় হবার আগেই স্নান সেরে নাও, পরিষ্কার বস্ত্র পরিধান করো।, ঠাকুর ঘরের সব দরজা-জানলা বন্ধ করে দাও, মেঝেতে আসন পেতে উত্তরমুখে পদ্মাসনে  বসো, এবার জপ শুরু করো।  জপের সংখ্যা গুনে রাখো।  প্রতিদিন ১০০১ বার এই তিন অক্ষর মন্ত্র জপ করবে।  জপ শেষ হবার আগে  কোনোভাবেই   আসন ছেড়ে উঠবে না। জপ শেষ হয়ে গেলে, তোমার গুরুদেবকে বা তোমার ইষ্টদেবকে যা জানাতে চাও, তা মনে মনে বলবে। একটা জিনিস জেনে রেখো, গুরুদেব যেখানেই থাকুন না কেন, তিনি তোমার মনের কথা জেনে যাবেন। এর পর গুরুদেবের কাছ থেকে অবশ্য়ই নির্দেশ আসবে, তোমার কাছে। আর তুমি সেটা আসনে বসেই জেনে যাবে।  তবে এই বীজ মন্ত্র কখনো প্রকাশ ও অপব্যবহার করবে না। 

জ্ঞানগঞ্জে  গেলে কি হয়  ?

জ্ঞানগঞ্জে এসে,  স্বামী নিমানন্দ পরমহংসের গুরুদেব স্বামী মহাতপার কাছে থেকে নবীন দুই সন্ন্যাসী দীক্ষা লাভ করে।  প্রায় বারো বৎসর তিনি এখানে থেকে যোগশিক্ষা আয়ত্ত্ব করেন। এর পরে আরো দুই  বছর তন্ত্রসাধনা ও যোগসাধনা চলতে থাকেন । এই যোগশিক্ষা দান  করেন, আচার্য্য ভৃগুরামস্বামী এবং শ্যামানন্দ স্বামী। এতে করে তাদের মধ্যে যোগবিভূতির প্রকাশ হয়। এবং গুরুর আদেশে গৃহাশ্রমে ফিরে আসেন।

 এই বিশুদ্ধানন্দ অনেক অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। এনাকে গন্ধবাবা নামেও ডাকা হতো।  কারন, ইনি, বিভিন্ন গন্ধ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম ছিলেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন রুগীকে একলহমায় ভালো করতে পারতেন, সাধারণ জিনিস থেকে তুলো একটি আতস  কাঁচের সাহায্যে   সোনাদানা, স্ফটিক, বা মূল্যবান পাথর তৈরী করতে পারতেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। বিশুদ্ধানন্দের কাছে, এই বিভূতি প্রদর্শন একটা খেলা। তিনি খেয়াল-খুশি মতো, পরমাণুর রূপান্তর ঘটিয়ে হীরা, প্রবাল সোনা, রুপো তৈরি করতে পারতেন। কিন্তু এইসব ক্রিয়া দেখানোর আগে, কুমারী ভোজনের নাম করে, উৎসাহী দর্শনার্থীর কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিতে ভুল করতেন না। ইনি কুমারী ভোজন করাতেন।  এ সন্মন্ধে তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতেন,  "বিভূতি দেখানো তো অপরাধ"! তাই এই অপরাধ থেকে রেহাই পাবার জন্য, কুমারী ভোজন করিয়ে থাকি। 

তো একবার হলো কি, বিশুদ্ধানন্দের আশ্রমে এলেন, মা আনন্দময়ী। আনন্দময়ীর সামনেই একটা ফুল থেকে স্ফটিক তৈরী করছেন বিশুদ্ধানন্দ ।  এতেকরে মা আনন্দময়ী খিলখিল করে হেসে উঠলেন। বললেন, বাবা তুমি যা করছো, মেয়ে কিন্তু সব বুঝতে পারছে। বাবা তুমি এসব কি দেখাও ? এর চেয়ে তোমার ভিতরে যে দুর্লভ বস্তু আছে, তা তুমি এদের কেন দিচ্ছ না ? বিশুদ্ধানন্দ কেমন যেন শান্ত হয়ে গেলেন, বললেন, "নেয় কে ?"  অর্থাৎ এইবস্তু নেবার লোক কোথায় ? 

স্বামীজীর এক প্রিয় শিষ্য ছিলেন, গোপীনাথ কবিরাজ।  তো মা আনন্দময়ী তাকে ডেকে বললেন, "বাবা তোমাদের খেলা দেখিয়ে ভুলিয়ে রেখেছেন। এঁর থেকে আসল বস্তু তোমরা আদায় করে নাও। আসলে শাস্ত্র মিথ্যা নয়, যোগ মিথ্যা নয়, কিন্তু যোগের ফল, বিভূতিতে শেষ হয়ে যায় না। বরং বিভূতি প্রদর্শন সাধককে সত্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। 

জ্ঞানগঞ্জে গেলে আমাদের মধ্যে বিভূতির প্রকাশ ঘটতে  পারে বা ঘটে, কিন্তু জ্ঞানগঞ্জে যাবার উদ্দেশ্য তা নয়। জ্ঞানগঞ্জ আসলে আমাদের শরীরেই অবস্থিত। যোগের সাহায্যে জ্ঞানের উন্মেষ সাধন হচ্ছে জ্ঞানগঞ্জ ভ্রমন।  যিনি যে ধরনের সাধনায় লিপ্ত, তার সেই বিষয়ে সর্বোচ্চ জ্ঞানের উন্মেষ হয়ে থাকে। একেই জ্ঞানগঞ্জ ভ্রমন বলা হয়ে থাকে।   

ই প্রসঙ্গে আমরা ঋষি পতঞ্জলির একটি উক্তি শুনবো।                 

 ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, (বিভূতিপাদ- ৪৪)  স্থুলস্বরূপ-সূক্ষ্ম-অন্বয়-অর্থবত্ত্ব সংযম-উদ্ভূত-জয়ঃ।

পৃথিবীর আদি  স্থুলতা, স্বরূপতা, সূক্ষ্মতা, অন্বয়িতা, ও অর্থবত্ত্বা এই পাঁচরূপ বিশিষ্ট স্থূল ভূতগুলিতে সংযম করলে যোগীর ভূতজয় হয়ে যায়। ভূত সমষ্টি দুই রকম। স্থুল ও সূক্ষ্ম। প্রত্যেকেই তাদের নিজস্ব ধর্ম্মের সীমানাতে নিজেরা প্রতিষ্ঠিত। ভূতের এই যে ধর্ম্ম একে  বলা হয় স্বরূপ। এগুলোর উপরে সংযম করলে, আমাদের বুদ্ধি সত্ত্বের আবরণ উন্মোচন হয়। প্রথম অবস্থায়, অর্থবত্ত্ব।  অর্থাৎ প্রথম অবস্থায়, এই ভূত গ্রহণের দ্বারা আমাদের ভোগায়তন শরীর  হয়, আর এই শরীর যখন বৈরাগ্যের দ্বারা অপবর্গ হয়, তখন সাধকের আকাঙ্খ্যা পূরণ হয়। পঞ্চভূতের স্থুল রূপ হচ্ছে, ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। আর এর সূক্ষ্ম রূপ হচ্ছে,শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ। আর এই পঞ্চভূতের স্বরূপ বা ধর্ম্ম হচ্ছে, ক্ষিতির- কঠিনতা, জলের আদ্রতা বা স্নেহত্ব, তেজের উষ্ণতা, বায়ুর চঞ্চলতা, আকাশের সর্বগতত্ত্বা এগুলোকে সুক্ষ অর্থে বলা হয়, তন্মাত্র। আবার এর   প্রকাশ, ক্রিয়া, ও স্থিতি হিসেবে সত্ত্ব, রজঃ ও তমো এই তিন গুন্ সম্পন্ন। এই পঞ্চভূতের সাধনা করলে, বা সংযম করলে, এই মহাভূতগুলো সাধকের বশীভূত হয়। একেই বলে বিভূতি। এই বিভূতি মানুষকে আকাশপথে গমনে সমর্থ করে থাকে বা অনেক অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী করতে পারে।  কিন্তু  আর এই বিভূতিকে অগ্রাহ্য করতে পারলে, তবেই সাধক শুদ্ধজ্ঞানের অধিকারী হতে পারেন। এই শুদ্ধ-জ্ঞানের রাজ্যই জ্ঞানগঞ্জ বা সাংগ্রীলা মঠ।     


ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

তথ্যসূত্রঃ  ত্রৈলঙ্গস্বামী সমগ্র   - অপূর্ব চট্টোপাধ্যায় ,


গল্প না সত্যি  ? 

জ্ঞানগঞ্জে মানস-ভ্রমন 

আজ যাঁর কথা আমরা শুনবো, তার নাম প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আছে। শুধু নাম নয়, তার লিখিত বক্তব্যের মধ্যেও কিছু কিছু কথা সর্বসাধারণের মধ্যে প্রকাশের ক্ষেত্রেও কড়া নিষেধাজ্ঞা দিয়ে গেছেন তিনি । শুধু এইটুকু বলা যেতে পারে, যিনি একজন সংসারী সাধক।   তাই আমরা তার লিখিত কথাগুলো নিষিদ্ধ অংশ বাদ  দিয়ে নির্বাচিত কিছু অংশ শুনবো। 

"ঘটনা সত্য নয়, কিন্তু দেখাটা সত্য। আপনি এই ঘটনাকে ভ্রমাত্মক জ্ঞান বলতে পারেন। কিন্তু ওই মুহূর্তের জন্য, সেই জ্ঞান জ্ঞাতার কাছে সত্য বলেই প্রতিভাত হয়েছিল। আলো-আঁধারি রাতে যখন  দড়িকে  সাপ  বলে মনে হয়. তখন দ্রষ্টার কাছে সেই সত্যকে অস্বীকার করবার উপায় থাকে না। এমনই একটা ঘটনার কথা আজ বলবো । 

"আসলে গত কয়েকদিন যাবৎ অলৌকিক জ্ঞানগঞ্জের কথা চিন্তা করছিলাম। সেখানে নাকি অনেক  উচ্চকোটির মহাত্মাগণ বাস করেন। বিভিন্ন রকমের জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিষয়ে শিক্ষার ব্যবস্থা আছে সেখানে। এইসব সাধকগণ নাকি কালজয়ী, বয়সের গাছ পাথর নেই, এঁরা নাকি আকাশচারী, ইত্যাদি ইত্যাদি।  এঁরা নাকি যোগ্য ছাত্রের খোঁজে লোকালয়ে ভ্রমন করে থাকেন। এখানে লামাদের অনেক তন্ত্র সাধনার মঠ আছে। এমনসব গল্পকথা আমি স্বয়ং গুরুদেবের মুখ থেকে শোনার সৌভাগ্য পেয়েছিলাম  ।আর সেখানে  পৌঁছোবার জন্য, তিন-অক্ষরি মন্ত্র নিয়ম করে জপের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেইমতো নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম।   

"ঠাকুর ঘরে গভীর রাতে ধ্যান করা আমার একটা আবশ্যিক কাজ। প্রথমে এটি গুরুদেবের নির্দেশ পালনের জন্যই শুরু করেছিলাম বটে, তবে এখন সেটা  নেশার মতো।  আর এই ধ্যানের  সময়, আমি সিদ্ধাসনে বসে থাকি ঘন্টার পর ঘন্টা।  গভীর রাতে ধ্যান একটু গভীর হলে, আমি বেশ বুঝতে পারি, আমার শরীরের চারিদিকে একটা আলোর আভা ঘিরে ফেলে। এই আলোর আভার রঙ নীলাভ ।  এটা ধ্যানের সময় আমি প্রতক্ষ্য করে থাকি। না এটি আমার কোনো বিশেষ ধ্যানের  ফলে হয় তা নয়, বিজ্ঞান বলছে, সমস্ত জীব-জন্তু-উদ্ভিদ এমনকি সমস্ত বস্তুকে ঘিরে রেখেছে একটা আউড়া অর্থাৎ একটা জ্যোতির্পূঞ্জ। তাই এটাকে কোনো অলৌকিক ভাবার কারন নেই। আসলে ধ্যান যখন গভীর হয়,  কেবল তখনই এই আলোক পুঞ্জ ঘনীভূত হবার ফলে, এটি আমাদের কাছে দৃশ্যমান হয়ে থাকে। এই অবস্থা নিশ্চয়ই বহু সাধকের হয়ে থাকতে পারে। 

"কিন্তু সেদিন এক অদ্ভুত দৃশ্যের সম্মুখীন হলাম। জীবনে একটা নতুন অভিজ্ঞতা। প্রথমে চোখে একটা আলোর ঝলকানি এলো। এবং আমি আলোর ঝলকানির আকস্মিকতায়, চোখ খুলে ফেললাম।  চেয়ে দেখলাম, দুটি আলোকপুঞ্জ আমাদের ঠাকুরঘরে প্রবেশ করেছে। আমি অবাক বিস্ময়ে সেই আলোর গোলাকে দেখতে লাগলাম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, সেই আলোর গোলা দুটি দুজন মানুষের আকৃতি ধারণ করলো।  না স্বাভাবিক নয়, সেই মূর্তি। গায়ের রং শ্বেতশুভ্র। মাথায় পাকা চুল। মুখে পাকা দাড়ি।  গায়ে এবং পরনে শ্বেত বর্ণের কাপড়। আমার তখন কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে গেলাম। আমার শরীর তখন স্থবির হয়ে গেছে। নিজেকে হালকা বোধ হতে লাগলো। নিজেকে শরীরের বাইরে অনুভব করতে লাগলাম। এরপর আমার বাহ্যিক জ্ঞান লোপ পেয়ে গেলো। আমি আছি আবার নেই। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। শরীরে নেই, কিন্তু আমি আছি। আমার শরীরকে আমি বাইরে থেকে দেখতে পাচ্ছি। শরীরের পিছনটা সাধারণত আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু এখন একটা সিদ্ধাসনে বসা শরীর আমি চতুর্দিক  থেকে স্পষ্ট   দেখতে পাচ্ছি। 

"এক মহাত্মা যেন আমাকে ইরাসৱায়, বললেন, এসো। কিন্তু একটা জিনিস আমি বুঝতে পারছিলাম না, যে আমি যাবো কি করে ? এছাড়া আমি কোথায় যাবো ? কেন যাবো, তা কিছুই জানতে ইচ্ছে বা শক্তি তখন আমার ছিল না।  শুধু এক গম্ভীর নির্দেশ, আমাকে চঞ্চল করে তুললো,  যে নির্দেশ অমান্য করে কার সাধ্যি।  আমার পক্ষেও  অমান্য করা সম্ভব নয়।  কিন্তু আমার শরীরতো চলৎশক্তিহীন। আমি যেতে চাইলেও আমার শরীর তো যেতে পারছে না।  এটা কি করে হয় ? আমার এই মনের কথা হয়তো, মাহাত্মন বুঝতে পারলেন, মাহাত্ম্য অন্য একজন মাহাত্ম্যকে দেখিয়ে বললেন, "তোমার শরীর রক্ষা করবার জন্য উনি থাকছেন, তুমি চলো। তাঁর কথা বলা শেষ হতে না হতেই সেই আলোক পুঞ্জসদৃশ্য মহাপুরুষ  উর্দ্ধমুখী হয়ে আকাশপথে বায়ুর মধ্যে দিয়ে দ্রুতবেগে রওনা হলেন, আমি কিছু বোঝার আগেই, লক্ষ করলাম, আমি যেন সেই ঘর্ণিঝড়ের মধ্যে লাটখাওয়া শুকনো ঘাস-পাতার মতো ছুটে  চললাম, সেই অসীম শক্তির পিছন পিছন। আমি যাচ্ছি তা নয়, আমাকে টানছে, একটা অসীম শক্তি  প্রবাহ। জোৎস্না-স্নাত আকাশের মধ্যে দিয়ে অসীম দিগন্তে দ্রুতগামী একটা আলোর গোলক আমাকে টেনে নিয়ে চলেছে। এর পরে একসময় সেই আলোর গোলক স্থির হয়ে  গেলো। আমিও দ্রুতগতিতে গিয়ে সেই আলোর তরঙ্গে মিলিয়ে গেলাম। নারদকে  মেঘের মধ্যদিয়ে ভ্রমন করতে দেখেছি সিনেমায়। স্বর্গে-মেঘের জগতে স্বর্গের নর্তকীদের নাচ দেখেছি, আলোকচিত্রে। আজ যেন আমি সেই আলোর জগতের মধ্যে প্রবেশ করলাম। মেঘের জগতে প্রবেশ করলাম। চারিদিকে একটা শুভ্র আলোর রশ্মি। চারিদিক নিঝুম।  কোনো জনপ্রাণীর দেখা নেই।  যতদূর নজরে আসছে, শুধু আলোর আভা। ধীরে ধীরে আমার সামনে এক-এক করে একটা স্বপ্নের জগৎ সৃষ্টি হতে লাগলো।  আমার নিচে যে মাটি বলে কিছু নেই, তা বুঝবার মতো ক্ষমতা  আমার  ছিল না।  নিজেকে হালকা একটা বায়বীয় পদার্থ মনে হচ্ছিলো। চারিদিকে হালকা কমলা ধোঁয়া ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কমলা রঙের এই ধোঁয়া গতিশীল। এই ধোঁয়ার মধ্যে থেকেই আমি দেখতে পেলাম একটা মন্দিরের চূড়া।  ধীরে ধীরে আলোর মেঘ কেটে যেতে বুঝলাম, এটি একটি আশ্রম। যার চারিদিকে সুন্দর সুন্দর লতাগুল্ম-ফুল, মঠকে ঘিরে রেখেছে ।  শুধু কমলা রং নয়, বিভিন্ন রঙের মেঘের খেলা  চলছে এখানে।

"এই স্থান যেন একটা স্বপ্নপুরী। স্নিগ্ধ আলোর মধ্যে যেন আনন্দের ধারা প্রবাহিত হচ্ছে। বিচিত্র সব রঙের খেলা। কেউ যেন বিভিন্ন রঙের আলোর আবির ছিটিয়ে রেখেছে। এই আলোর মেঘ আমার দৃষ্টিপথকে আটকাতে পারে নি। ধীরে ধীরে নজরে এলো, মন্দিরে পুজো দেবার জন্য, কিছু গন্ধর্ব নারী-পুরুষ হাতে পূজার ডালা নিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করছে। কেউ একজন যেন আমাকে বললো, জানো এই স্থান যেখানে তুমি অবস্থান করছো, তা একজন যোগীপুরুষের ইচ্ছাশক্তি প্রসূত। আর এটি ব্রহ্মান্ডের সবত্র বিরাজ করছে। শুধু যোগীমহারাজের ইচ্ছেশক্তি জাগ্রত হলে এটি দৃশ্যমান হয়ে থাকে। আমি তন্ময় হয়ে এই অপূর্ব দৃশ্যের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছিলাম, যে আমি কোনো দেহ নোই, তবু আমি বলে কোনো একটা সত্ত্বা আমাকে স্বতন্ত্র রেখেছে। এই সব অলৌকিক দৃশ্যের দ্রষ্টা হয়ে বিরাজ করছি। মন্দিরে চারিদিক  থেকে বিভিন্ন রঙের স্ফুলিঙ্গ প্রস্ফুটিত হচ্ছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। এ যেন বাজির খেলা। আলোর খেলা। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে এখানে কোনো ধ্বনি বা শব্দ নেই। হঠাৎ লক্ষ করলাম, অগ্নি-স্ফুলিঙ্গগুলো ধীরে ধীরে ঘনীভূত হলো।  আর তার মধ্যে একটা আকার প্রকটিত হতে লাগলো। আমি লক্ষ করলাম, এই আকার আর কারুর নয়, ঠাকুর ঘরে দেখা, সেই শ্বেতশুভ্র কমনীয় মূর্তি। 

"আমাকে ইঙ্গিতে  নির্দেশ দিলেন, তার কাছে যাবার জন্য। আমি নির্বাক অবস্থায়, সেই মহাপুরুষের পিছন পিছন চলতে লাগলাম।  আসলে আমি যাচ্ছি তা বলা যা না, বরং বলা যেতে পারে, আমাকে কোনো অদৃশ্য শক্তি, হতে পারে, মহাপুরুষের সেই আলোক স্বরূপ  শক্তি আমাকে টেনে নিয়ে চললো।

"স্বল্প পরেই, আমরা আরো একটা মঠে প্রবেশ করলাম।  এটিকে মঠ না বলে একটা মেঘে ঢাকা পাহাড় বলা যেতে পারে। এই মঠের মধ্যে অবস্থান করছে  সুড়ঙ্গ পথ। সেই সুড়ঙ্গপথ দিয়ে আমি একটা আলোর শক্তির টানে ভিতরে প্রবেশ করলাম। এখানে আসার পরে আমি যেন লক্ষ করলাম, আমার একটি মনুষ্যবৎ  অবয়ব বা শরীর আছে। এখানে অসংখ্য গুহার অবস্থান।  আর প্রত্যেকটি গুহাতে এক-একজন ধ্যানস্থ পুরুষ অবস্থান করছেন। কিন্তু  গুহার মুখ   কুয়াশার পর্দা দিয়ে ঢাকা, ভিতরে কি আছে বোঝা যায় না। 

"আমি যার টানে এখানে এসেছি, তিনি আমার সামনে  সামনে চলছেন। আমি তাকে অনুসরণ করছি। হঠাৎ মনের মধ্যে জিজ্ঞাসা উঠলো, এরা  কারা ? কেনই বা এখানে বসে আছেন। উত্তর ভিতর থেকেই জেগে উঠলো, এঁরা সবাই যোগীপুরুষ। 

"মহাপুরুষ যিনি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন, তিনি গম্ভীর অথচ মৃদু স্বরে বললেন। শরীর কর্ম্ম করবার জন্য ধারণ করতে হয়।  কার্য্য দ্বারা জ্ঞান সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু জ্ঞান সংগ্রহ হয়ে গেলে, শরীর ছেড়ে দিতে হয়। তখন জ্ঞানের মধ্যে বাস। জ্ঞান আনন্দের উৎস  স্বরূপ। জ্ঞানবৃক্ষে যখন আনন্দরূপ পুষ্পের জন্ম হয়,  তখন জ্ঞান ছেড়ে দিতে হয়। তখন আনন্দের মধ্যে বাস। একসময় আনন্দ মিলিয়ে যায়। থাকে শুধু ব্রহ্ম। যোগ এই জ্ঞানভূমির দর্শন।  যোগ এই জ্ঞানভূমি পর্যন্ত নিয়ে আসতে  পারে। তাই এঁরা  সবাই যোগে আবিষ্ট। জ্ঞানভূমি থেকে আনন্দে উত্তরণ ঘটাতে পারে একমাত্র ইচ্ছেশক্তি। এই ইচ্ছেশক্তিই বিশ্বশক্তি। সমস্ত জগতের কারন। 

"আমার মধ্যে প্রশ্ন জেগে উঠলো, এই কুয়াশার মতো আলোকপুঞ্জ যা আমি গুহার বাইরে দেখেছিলাম, তা আসলে কি ? মহাত্মা বললেন, এগুলো সব আত্মশরীর। যাকে  তুমি আলোর মেঘ ভেবেছো, এগুলো সবই যোগীর আলোকদেহ। তুমি এখানে ধ্যানে বসো, বলে একটা শুন্য গুহা দেখিয়ে দিলেন। আমি মহাপুরুষের নির্দেশ মেনে, গুহার  মধ্যে প্রবেশ করলাম।  একটা সুগন্ধ নাকে এলো। আমি ধ্যানে আবিষ্ট হয়ে, নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। কতক্ষন এই অবস্থায় ছিলাম জানিনা। কিন্তু যখন সম্বিৎ ফিরে এলো, তখন আমি ঠাকুর ঘরে ধ্যানাসনে অবস্থান করছি। ভোরে আলো  ফুটেছে।  ভাবতে লাগলাম, আমি কি স্বপ্ন  দেখছিলাম ? 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।               

 

   



















 

 

No comments:

Post a Comment