Thursday, 26 September 2019

ভগবান যখন মানুষকে মারে


ঈশ্বর সম্পর্কে কতকগুলো মৌলিক প্রশ্ন ও তার জবাব।

ভগবান যখন মানুষকে মারে, তখন, মানুষ তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। কিন্তু মানুষ যখন মানুষকে মারে, তখন ভগবান মানুষকে বাঁচাতে পারে না। কেন এমন হয় ? এই প্রসঙ্গে আপনাদের সবার জানা  একটা গল্প বলি। ভগবান বুদ্ধ তখন শ্রাবন্তি নগরে বর্ষা যাপন করছেন। কিসা গৌতমী নামে এক পুত্র-শোকাতুরা মা কাঁদতে কাঁদতে তার পায়ে পড়লো। সে শুনেছে, বুদ্ধ স্বয়ং ভগবান। মানুষের জ্বরা-ব্যাধি-মৃত্যুর দুঃখ মোচন করবার জন্য, তিনি অবতীর্ন হয়েছেন। বুদ্ধের পাদুটো চেপে ধরে, আর্তি জানাতে লাগলো, তার মৃত একমাত্র সন্তানকে বাঁচানোর জন্য। হাজার হাজার লোক তার পেছনে ছুটছে। নিশ্চয় তিনি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। মায়ের কান্না থামছে না দেখে, বুদ্ধ তাকে হাত ধরে তুললেন। বললেন, মা আমি তোমার সন্তানকে বাঁচাতে পারি।  কিন্তু তার আগে একটা কাজ করতে হবে। যে বাড়িতে কেউ কখনো মারা যায়নি, শোকের ছায়া পড়েনি, সেই বাড়ি থেকে একমুঠ সর্যে এনে দিতে হবে। নয়নের জল মুছে, শোকাতুর নারী ছুটলো, বাড়ি বাড়ি একমুঠো সর্ষের জন্য। কিন্তু হায়, এমন কোনো বাড়ি সে খুঁজে পেল না, যে বাড়িতে কেউ কখনো মারা যায় নি।  শোকের ছায়া পড়ে  নি। আসলে বিশ্বসংসারে সবারই একই দশা।  মৃত্যু শোক মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। ভগবান এসে সেই শোকে শান্তি বাড়ি ছেটান মাত্র। নিয়তিকে রোধ করতে পারেন না। মরা মানুষ কখনো বেঁচে উঠতে পারে না। 
মানুষ তো ছাড়,  দেবাদি দেব মহাদেব হিন্দুদের মতে সংহারকর্তা।  অর্থাৎ সমস্ত সংহারের দায়িত্ত্ব নাকি তার। তো তার স্ত্রী, স্বয়ং মহামায়ার অংশ দেবী সতী, স্বামীর অপমান সহ্য না করতে পেরে, দেহ ত্যাগ করলেন। স্বয়ং মহাদেব, সতীর মৃতদেহ নিয়ে সারাবিশ্বে উন্মাদ হয়ে ঘুরে বেড়ালেন। কিন্তু তাকে বাঁচাতে পারলেন না।
মহাত্মা ভীষ্ম মৃত্যুর আগে খেদের সঙ্গে বলেছিলেন,  স্বয়ং ভগবান যাদের নিত্যসঙ্গী, সেই পাণ্ডবদের দুঃখের শেষ নেই। ভগবানের লীলা বোঝা বড় দায়। 
আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, কি সেই শক্তি যা স্বয়ং মহাদেবকে কষ্ট  দেয়।  কি সেই শক্তি যা ভগবানের সাথী, পান্ডবদের কষ্ট দেয় ? এমনকি স্বয়ং বিষ্ণুর অবতার অর্থাৎ সৃষ্টির পালনকর্তা শ্রীকৃষ্ণকে জন্ম থেকে শুরু করে, মৃত্যু পর্যন্ত কষ্ট দেয় ?
প্রশ্ন জাগে, ভালো থাকার জন্য,ঈশ্বরকে খোজা কি নিরর্থক ? এই কথাটা, যারা ঈশ্বরকে বিশ্বাস  করেন , তাদের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য তেমনি যারা ঈশ্বরকে বিশ্বাস করেন  না তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যারা বিশ্বাস  করেন , যে ঈশ্বর বলে কিছু নেই, তারা কেন ঈশ্বরকে খুঁজতে যাবেন  ? আর যারা ঈশ্বরকে বিশ্বাস করেন  তারা এর মধ্যে জেনে গেছে যে ঈশ্বর অব্যক্ত। তাহলে তাকে যত  খোঁজ না কেন, তার সন্ধান কেউ পাবে না।ঈশ্বর অকর্তা, টি নিজে থেকে কিছু করতেই পারেন না।  এর পরে, আমরা ভাবতাম,ঈশ্বর সর্ব্বশক্তিমান।  তিনি সব কিছু করতে পারেন। তো  ঈশ্বর যদি সর্ব্বশক্তিমান না হন, তবে সেই মঙ্গলময় ঈশ্বরকে খোজ করে আমাদের কি লাভ ?  

এসব কথা বুঝতে গেলে আমাদের ঈশ্বরকে বুঝতে হবে। তার ক্রিয়াপদ্ধতি সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে। হিন্দুরা  বিশ্বাস করে যে ঈশ্বর এক,  কিন্তু তিনি তিন মূর্তিতে কর্ম করেন।  আর তা হচ্ছে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব। অর্থাৎ  একজন সৃজন করেন, একজন পালন করেন, একজন ধ্বংস করেন। 
এই যে বিচিত্র জগৎ আমাদের চোখের সামনে বা চোখের অন্তরালে বর্তমান, তার নিশ্চয় একজন নির্মাতা আছেন। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে ঈশ্বরের অস্তিত্ত্ব স্বীকার করতে হয়। কিন্তু তিনি যে ঈশ্বর তার কোনো প্রমান নেই। আর  আমি যাকে দেখি নাই, সে আছে বা নেই দুটোই হতে পারে। যদি আমরা তর্কের খাতিরে ধরে নেই, যে ঈশ্বর আছেন, তাহলে প্রশ্ন জাগে ঈশ্বরের প্রকৃতি কি প্রকার ? ঈশ্বর বিশ্বাসীরা বলেন, ঈশ্বরের ইচ্ছাতে জগতের সৃষ্টি হয়েছে।  কেউ কেউ বলে থাকেন,   এসব কথা কাল্পনিক, এর কোনো প্রমান নেই। আর এর সত্যতা জানবার উপায় ও আমাদের জানা নেই। তাহলে এটা ধরে নিতে পারি, ঈশ্বর যদি থেকেও থাকেন, তিনি অজ্ঞেয়। ঈশ্বরবাদীরা ঈশ্বরের তিনটি গুনের কথা বলে থাকেন, সৎ-চিৎ-আনন্দম। কেউ বলেন, শক্তি-জ্ঞান-দয়া। কেউ বলেন, সত্ত্ব-রজঃ-তমঃ। কেউ বলেন,ঈশ্বরের গুন্ অনন্ত।  কেউ বলেন, ঈশ্বর সর্ব্বশক্তিমান, ঈশ্বর সর্বজ্ঞ, তিনি দয়াময়। কেউ বলেন, ঈশ্বর অকর্তা, তিনি কিছু করেন না। তার শক্তি হচ্ছে প্রকৃতি আর এই  প্রকৃতিই  সমস্ত কিছু করেন। তো যিনি ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে সব কিছু করতে পারেন, তার আবার এত কায়দা কলমের কি দরকার। তার প্রকৃতিরই বা কি দরকার ? যিনি ইচ্ছে করলেই সব করতে পারেন, তার আবার কারুর সাহায্যের   দরকার পড়ে নাকি ? 
দেখুন, নির্মাতা আর সৃষ্টিকর্তা এক নয়। রাজমিস্ত্রি বাড়ি তৈরি করতে পারেন। রাজমিস্ত্রি বাড়ি সৃষ্টি করতে পারেন না। তো সৃষ্টিকর্তার কারুর সাহায্যের প্রয়োজন নেই, কিন্তু নির্মাতার বস্তুর সাহায্যের এবং  কৌশলের বা প্রযুক্তি বিদ্যার  প্রয়োজন। মানুষের দেহে দেখুন, কত কলা-কৌশল,  এবং তা নির্মাণে কত শক্তি ব্যয় হয়েছে, তাকে রক্ষার জন্য কত শক্তি ব্যয় করতে হচ্ছে। এর পরেও দেখুন, শরীর বেশিদিন থাকে না। এত কায়দা করে, শক্তি ক্ষয় কোরে, যে মনুষ্য দেহ ঈশ্বর বানিয়েছেন, কিছু দিন পরেই তা বিনষ্ট হয়ে যায়। তার মানে আমরা ধরে নিতে পারি, আমাদের নির্মাণকর্তা  সর্ব্বশক্তিমান নয়।  তা যদি হতো তিনি এমন মানুষ তৈরি করতে পারতেন, যা চিরস্থায়ী। তা তিনি পারেন না। তাহলে এটা বলা যেতে পারে, তিনি সর্ব্বশক্তিমান নয়।  তার কোনো একটা বিরুদ্ধ শক্তি আছে। আমি পাহাড় উল্টে ফেলতে পারি না। কারন মাধ্যাকর্ষন শক্তি আমাকে বাধা দেয়।  আমি আকাশে উড়তে পারি না, কারন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আমাদে টেনে আনে। অতএব, প্রকৃতিকে   নির্মাণকারী বলা যেতে পারে।  কিন্তু স্রষ্টা  বলা যেতে পারে না। 

বলা হয়ে থাকে, ঈশ্বর সর্বজ্ঞ। ঈশ্বর যদি সর্বজ্ঞ হতেন তবে তার নির্মাণের ত্রূটি  তিনি ধরতে পারতেন।একটা আসুরিক শক্তি আছে, যাকে  তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। যাকে বলা হয়ে থাকে অদৃষ্ট, অর্থাৎ যা দেখা যায় না। অর্থাৎ ঈশ্বরও তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। শিবকে বলা হয়ে থাকে সংহার কর্তা। সেই  শিবের স্ত্রী সতী দেহত্যাগ করলে, স্বয়ং মহাদেবও তাকে বাঁচাতে পারেন নি।  তাই কেউ কেউ বলেন এই অদৃস্ট শক্তিই জগতের অনিষ্টের কারন। তাকে রোধ স্বয়ংঈশ্বর ও করতে পারেন না। জীবের অশেষ কষ্ট, সব সময় সে অবিরত দুঃখ কষ্ট  ভোগ করছে। আসলে জীবের কাজ হচ্ছে, সারাজীবন ধরে, কেবল দুঃখ মোচনের চেষ্টা  করা। একটা জিনিস ভাবুনতো, ঈশ্বর তো মঙ্গলময়। তবে তারই সৃষ্ট জগতে এত অমঙ্গল কেন ? তা হলে ধরে নিতে হয়, হয় ঈশ্বর মঙ্গলময় নয়। নতুবা জীব ভালো থাকুন, তা তিনি চান না। 
এর উত্তরে কেউ কেউ বলে থাকেন, ঈশ্বর দয়াময় মানে এই নয় যে তিনি সব সময় মানুষকে সুখে রাখবেন, তিনি আসলে মানুষকে ধর্মপথে চালিত করতে চান। তাই দুঃখের মধ্যে দিয়ে মানুষকে তিনি শোধন করে নেন। তবে এই উত্তরে বলি, সুখ-দুঃখ কিন্তু ধার্মিক ও অধার্মিক সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ধার্মিক ব্যক্তি সুখে আছেন , আর অধার্মিক ব্যক্তি দুঃখে আছেন, এমন তো নয়।  ধার্মিক ব্যক্তির যেমন দুঃখ আছে, আবার অধার্মিক ব্যক্তির সুখ আছে।  এসব আমরা চোখের  সামনে দেখতে পাচ্ছি। যদি ধর্মের শাসনে সংসার চলতো, তবে অধার্মিক সব সময় দুঃখী থাকতো, আর ধার্মিক সবসময় সুখে থাকতো।  তা তো নয়। এর উত্তরে, আবার তারা বলেন, দুস্কৃতিকারী পরলোকে গিয়ে দুঃখ ভোগ করে। আর সুকৃতিকারী পরলোকে  গিয়ে পরম-আনন্দে থাকেন। দেখুন, মানুষ শুধু নিজের কর্মদোষে কষ্ট  পায়  তা নয়,  পরিবার-সমাজ-জাতি-দেশ-প্রকৃতি - এদের জন্যও মানুষ দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে। তাহলে মানুষ নিজে ,  ধার্মিক হলেই ভালো থাকে, তা কিন্তু নয়। এইজন্য, একথা বলা যেতে পারে, ধর্ম-অধর্ম যাই বলুন না কেন, দুটো শক্তি এই সৃষ্টির পিছনে কাজ করছে। শুভ-অশুভ, সুর-অসুর, দেবতা-দানব। তার মানে একটা শক্তি মঙ্গলময়, আর একটা শক্তি অমঙ্গলের। আর দুইয়ে মিলে সৃষ্টি চলছে। 
এইজন্য, পন্ডিতগণ বলছেন, এই জগতের যেমন নির্মাণ  কর্তা আছেন, তেমনি আছেন পালনকর্তা, আবার সংহার কর্তাও   আছেন। এই তিন শক্তি জগৎ পরিচালনা করছেন। তাই জগতে জন্ম-জীবন-মৃত্যু একসাথে ক্রিয়া করছে। এইখানে খেয়াল করুন ব্যাপারটা। ঈশ্বর নিরাকার। কিন্তু যখন তিনি ক্রিয়া শুরু করেন, তখন তিনি রূপ পরিগ্রহ করেন, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের রূপ আছে, বা যদি ধরেও নেই, যে এগুলো কাল্পনিক রূপ। তাহলেও সত্য হচ্ছে দেহ ভিন্ন কর্ম সম্পাদন করা যায় না। ঈশ্বর যখন কাজ করতে চান, তখন তিনি মায়ার আশ্রয় নেন। রূপের আশ্রয় নেন। যাকে আমরা বলি জীব। আর ঈশ্বর যখন প্রকৃতির আশ্রয় নেন, তখন তিনি প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য থাকেন। এই প্রকৃতির নিয়ম তারই সৃষ্ট। তারই সৃষ্ট নিয়মে তিনি আবদ্ধ হয়ে যান। নিরাকার ঈশ্বর কখনো মানুষকে সাহায্য করতে পারেন না। যখনই তিনি জীবকে সাহায্যের কথা মনে ভাবেন, তখন তাকে রূপ পরিগ্রহ করতে হয়। রামপ্রসাদকে সাহায্য করবার জন্য তিনি তার মেয়ের রূপ নেন। বা মেয়ের মধ্যে আসেন। মানুষ যখন ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে কিছু পাবার জন্য, তখন ভগবান মানুষের রূপ ধরেই তাকে সাহায্য করেন। সুরদাসের বাড়িতে যখন অন্নের অভাব, তখন দুটো বাচ্চা এসে খাবার দিয়ে গিয়েছিলেন। মানুষের মধ্যে দিয়ে, ভগবান মানুষকে ভালোবাসেন, কষ্ট  দেন, সাহায্য করেন। মানুষ যখন মানুষকে মারে, আমরা ভাবি, মানুষ মানুষকে মারছে। আসলে ঈশ্বর ঈশ্বরকে মারছে। তিনিই ভোক্তা, তিনিই ভোগ । তিনিই দ্রষ্টা, তিনিই দৃশ্য।  
বিজ্ঞান বলছে, ভৌতিক বস্তুর সমাহারে জীবের নির্মাণ। সৃষ্টি আসলে কালের উর্দ্ধে। সৃষ্টি বলে কিছু হয় না। যা কিছু হয়, তা হলো নির্মাণ। কলসি কুম্ভকার তৈরি করে, জল-মাটি-আগুন-বায়ু-আকাশ, অর্থাৎ যা দিয়ে কলসি তৈরি হয়েছে, তা কুম্ভকার নির্মাণ করে নি। এগুলো আগে থেকেই ছিল। ছিলোনা শুধু সমাহার।  কুম্ভকার এই কাজটা করছেন মাত্র। কেউ কিছু সৃষ্টি  করতে পারে না। সমাহার করতে পারে মাত্র। একত্রীকরণ করতে পারে মাত্র।  তাই নির্মাতার ইচ্ছে অনুযায়ী রূপ পরিগ্রহ করে। সৃষ্টি বলে কিছু হয় না। আর সৃষ্টি বলে যদি কিছু না হয়, তবে স্রষ্টা বলেও কিছু হতে পারে না। ঈশ্বর আমাদের কল্পনা বিলাস মাত্র।  
সেইদিক থেকে  বলা যেতে পারে, জগৎ একটা নিয়মের ফল মাত্র। জন্ম জাগতিক নিয়মের ফলে হচ্ছে, রক্ষা জাগতিক নিয়মের ফলে হচ্ছে, আবার ধংশও সেই জাগতিক নিয়মের ফলে সংগঠিত হচ্ছে। এখন এই নিয়মের স্রষ্টা, নিয়মের রক্ষা, নিয়মের পালনের নিয়ন্তা যিনি তাকেই আমরা ঈশ্বর বলতে পারি। বা স্রষ্টা বলতে পারি।  জগতের স্রষ্টা  নয়, নিয়মের স্রষ্টা । 
যে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় সংযোজন হয়, সেই একই রাসায়নিক বিক্রিয়াতেই রক্ষা হয়, আবার একই রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলেই বিলুপ্তি হয়। যে অম্লজানের সংযোগে  জীবের দেহ গঠিত হয়েছিল, পরিপুষ্ট হয়েছিল, শেষদিনে সেই অম্লজানের সংয়োগেই তা বিনষ্ট হয়ে যাবে। অতয়েব পালনকর্তা-রক্ষাকর্তা আর সংহারকর্তা একই। 
এখন কথা হচ্ছে, সৃজন-পালন একই কর্তার কাজ এটা মেনে নিলেও সংহারকর্তা একই, অর্থাৎ মঙ্গল ও অমঙ্গলের কর্তা  একই এটা মেনে নেওয়া সহজ নয়। আর স্রষ্টা যদি তার সৃষ্টিকে রক্ষা করতে না পারেন, তবে তাকে সৃষ্টি করতে যাবেন কেন ? আর একটা জিনিস দেখুন, জীবের দ্বারা জীবের সৃষ্টি হচ্ছে। জীব ভিন্ন জীবের সৃষ্টি  হচ্ছে না। আকাশ থেকে কেউ নেবে আসে না। আবার অসংখ্য সম্ভাবনাময় বীজ অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যায়। তাহলে কি ধরে নিতে পারি, সৃষ্টিকর্তার থেকে সংহার কর্তার শক্তি বেশী ? অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা যখন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বীজের প্রেরণ করলেন, সম্ভাবনাময় সেই বীজ অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে ফেললেন, সংহার কর্তা। জীবের সাহায্য ছাড়াই সংহারকর্তা সবাইকে সংহার করতে পারেন, কিন্তু সৃষ্টিকর্তা জীবের সাহায্য ছাড়া জীব সৃষ্টি করতে পারেন না। তাহলে কি সংহার কর্তা অধিক শক্তিশালী ? আমরা শ্রীকৃষ্ণকে  ঈশ্বর বলে মানি, বা ঈশ্বরের অবতার  হিসেবে মানি, এই ভগবানের অবতারদেরকেও  আমরা দেখেছি, অশুভ শক্তির দ্বারা পদে পদে অপদস্থ হতে। কখনো কখনো পরাজিত  হতে, অন্ততঃ পৌরাণিক কাহিনীতে এমনটাই লেখা। ভীষ্ম যার জন্য, বলেছিলেন, স্বয়ং ভগবান যাদের সহায়, তারা প্রতি পদে অপদস্থ হচ্ছে, অশেষ কষ্ট পাচ্ছে। এর পেছনে কোনো যুক্তি না পেয়ে, বলেছিলেন - ভগবানের লীলা বোঝা দায়। 
মানুষ যখন মানুষকে মারে, বা জীব যখন আর একটা জীবকে মারে, তখন তার শরীরটাকে মারে, শরীরের অঙ্গগুলোকে ক্ষতবিক্ষত করে। ভগবান তো শরীর তৈরি করেন নি। শরীর আমাদের প্রকৃতির দান। আর প্রকৃতিপ্রদত্ত সমাহার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে, মানুষই পারে জোড়া লাগাতে, অর্থাৎ প্রকৃতিই পারে জোড়া লাগাতে। তাই আমাদের শরীরের মধ্যেই আছে, নিরাময়ের শক্তি ।  ঈশ্বর এসবের উর্দ্ধে। ঈশ্বর স্রষ্টা, আর প্রকৃতি নির্মাতা। প্রকৃতি নিয়মে আবদ্ধ। ঈশ্বর নিয়মের উর্দ্ধে। 
আসলে সংহার বা শেষ বলে কিছু হয় না। সংহার উন্নতির সোপান। সতী আবার জন্ম নেয় পার্বতী হয়ে।আসলে এটি একটি যাত্রা।   কষ্ট মানুষকে সঠিক পথ দেখায়।কামার লোহাকে গরম করে, দমাদম হাতুরি  দিয়ে পেটায়। নিজের ইচ্ছে মতো জিনিষ তৈরী করবার জন্য।  পছন্দ না হলে আবার তাকে জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে ঢোকায়।   ভগবানের ইচ্ছে জগতের উন্নতি, জীবের উন্নতি । ঈশ্বরের সংহার শক্তি তাই শক্তিশালী। সংহার অশুভ নয়, সংহার শোধন প্রক্রিয়া মাত্র । সব শেষে একটা কাহিনী দিয়ে শেষ করবো। গুরুনানক একবার পরিব্রাজন করতে করতে এক গরিবের ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন। সেই বাড়ির কর্তা  ছিলেন, রাজকর্মচারী। রাজার বাড়িতে কাজ করতেন। রাজার   অনেক হাতি, ঘোড়া, গরু ছিল।  সেই হাতিশালে হাতিদের পরিচর্য্যা  করতেন। তো সেই সময় একটা হাতি প্রাণত্যাগ করলো। লোকটি আতঙ্কিত হলো, কান্নাকাটি জুড়লো,এবার তার চাকরি যাবে। হাতি মারা গেছে। নানক-এর কাছে সংবাদ গেলো। নানক বললেন, কোথায় সেই হাতি, তার কাছে আমাকে নিয়ে চলো। হাতির কাছে গিয়ে, নানক হাতির কানে কানে কি বললেন, হাতিটি অমনি সোজা হয়ে বসলো। রাজার কাছে, এই সম্বাদ পৌছালো। রাজা নানককে দেখতে এলেন। রাজা নানককে বললেন, আপনি মরা হাতিকে জ্যান্ত করতে পারেন ? নানক  মুচকি হাসলো। রাজা বললেন, আপনি আবার হাতিটিকে মারুন তো দেখি। তখন নানক আবার হাতিটিকে কানে কানে কি বললেন, আর হাতিটি মরে  গেল। রাজা বললেন, এবার বাঁচান তো দেখি। নানক বললেন, ভগবান  যখন জীবকে মারেন , তখন তাকে বাঁচানো যায়। কিন্তু জীব যখন জীবকে মারে তখন তাকে বাঁচানো  যায় না। 
মানুষ যখন নিজেকে মারতে চায়, তখন তাকে বাঁচায় কার সাধ্যি।       

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ - হরি ওম।  



   

বঙ্কিমের বাঁকা কথা :

আমাদের বঙ্কিম হরিদাস বাবাজিকে ভালোও বসে আবার তাকে বিরক্ত করতে ছাড়ে  না। মাঝে মাঝে বাবাজিকে অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন করে বিব্রত করে তোলে। তো বঙ্কিম নবমী পূজার দিন বাবাজিকে খুঁজে পাচ্ছে না। বাবাজি হয়তো হরিনাম করে ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছে। নামের বিনিময়ে চাল জোগাড় করে বেড়াচ্ছে। বদান্যতা আর কি। অমূল্য হরিনাম শুধু দুটো চালের বিনিময়ে বিতরণ করে দিচ্ছেন।শেষমেশ বাবাজিকে এক পূজাবাড়িতে প্রসাদ নিতে দেখতে পেলো। দেখে বঙ্কিমের বাঁকামন জাগ্রত হয়ে উঠলো।

বঙ্কিম - বৈষ্ণব বাবাজি দেখছি শক্তিদেবীর প্রসাদ ভক্ষণ করছেন ? বা বা প্রভুর ক্ষুধার সময় ধর্মের উদারতা বৃদ্ধি পায়  দেখছি।

বাবাজি : কেন একথা বলছো বঙ্কিম ?

বঙ্কিম : না বলছিলাম, শক্তির প্রসাদে বৈষ্ণবের সেবা ?
- তাতে দোষ কি ?

বঙ্কিম - কৃষ্ণের উপাসক, প্রসাদ খাবে শক্তি পুজোর  ?
- শক্তিটা কে, শক্তিটা কি জানো তুমি ?
বঙ্কিম - জানবো  না কেন।  দেবতার স্ত্রীকে বলে শক্তি।  দেবতার শক্তি। নারায়ণের শক্তি লক্ষ্মী, শিবের শক্তি দূর্গা, ব্রহ্মার শক্তি ব্রহ্মাণী।
-  দূর হয় পাপিষ্ঠ। তো মুখ দেখে প্রসাদ খেলে প্রসাদ পন্ড হয়ে যাবে। দেবতা কি তোর মতো বৈষ্ণবী নিয়ে ঘরকন্না করে নাকি ? দূর হ।

বঙ্কিম - তবে শক্তি কি ?
- এই ঘটির জলটা তোল তো  দেখি। - বঙ্কিম  ঘটির জল তুললো। - এই জলের জালাটা তোলতো দেখি।
বঙ্কিম - তাও কি পারা  যায় ?
-ঘটি তোলার শক্তি আছে,  তোলার শক্তি নেই।

No comments:

Post a Comment