পুনঃপ্রকাশিত
ব্রহ্মবিদ্যার অধিকারী কে ?
অদ্বৈতবাদের একটি অসাধারণ গ্রন্থ এই "বিবেক চূড়ামনি" .মূল গ্রন্থ সংস্কৃত ভাষায় লিখিত। মানুষ ভালো মন্দ বোঝে। সত্য অসত্য বোঝে। আর কোনো প্রাণীর মধ্যে এই বিচার শক্তি নেই।সহজাত প্রবৃত্তির বশে কাজ করে সে । সে ভালো মন্দ বোঝে না। কেবলমাত্র নিজের স্বার্থটা বোঝে। কিন্তু মানুষের মধ্যে বিচারবোধ আছে। আর এই বিচার আমাদের বিবেকের কার্য্য। সেই বিবেকের চূড়া অর্থাৎ শিখর বা উচ্চস্থান অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ বিচার-এর কথা আলোচনা হয়েছে এই গ্রন্থতে। আর মনি কথাটার মানে মূল্যবান সামগ্রী। তাহলে বিবেক চূড়ামনি বলতে আমরা বুঝি আমাদের শ্রেষ্ট বিচার বুদ্ধি। যা একমাত্র মানুষেরই মধ্যেই দেখা দেয়। এবং এই বিচারবুদ্ধিই মানুষকে অন্য জীব থেকে স্বতন্ত্র করেছে। আমাদের হাতে আছে স্বামী বেদান্তানন্দ (বাংলা) ও স্বামী সনাতনদেব অনূদিত (হিন্দি) গ্রন্থের অনুবাদ, আরো আছে স্বামী লোকেশ্বরানন্দের প্রবচনের লিপি। সব শেষে আছে আমাদের বিচার বুদ্ধি যা দিয়ে আমরা মহাত্মা শঙ্করের অসামান্য গ্রন্থ যা পরম-আত্মাকে আস্বাদন করতে সাহায্যে করবে। আসুন আমরা সেই আত্মলোব্ধির একমাত্র ও চূড়ান্ত উপায় নিয়ে আলোচনায় বসি। বুঝবার চেষ্টা করি আচার্য শঙ্কর কি ভাবে আমাদের সেই চরম উপায় অবলম্বনের কথা বলছেন।
একটা কথা বলি, এই সব ব্রহ্মবিদ্যার বই সাধারনতঃ নিরস হয়। অধিকারীভেদে এর প্রকৃত স্বত্বা নিজের অন্তরে স্ব-স্ব রূপে জাগ্রত হয়। নিতান্ত বই পড়ে বা আমাদের কথা শুনে, আমাদের আত্মলব্দ্ধি জাগ্রত হবে, এমন ভাবার কোনো কারন নেই। তবে একটা স্পৃহা জাগ্রত হতে পারে। আর একটা কথা, সত্যি সত্যি আপনি যদি আমাদের এই কথা শুনবার জন্য আগ্রহী হয়ে থাকেন, অথবা আচার্য শঙ্করের বিবেক চূড়ামণি গ্রন্থটি সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে থাকেন, বা অষ্টাবক্র সংহিতার মতো গ্রন্থকে বার বার পড়বার মধ্যে আনন্দ পান, তবে আপনি অধ্যাত্মতিক জগতের পথে একটা ধাপ পেরিয়েছেন বলা যেতে পারে। আপনারা সবাই আমার নমস্য। সবাইকে প্রনাম জানাই। এইবার দেখি আচার্যদেব কি বলছেন। কিন্তু তার আগে ভগবান শঙ্করকে যিনি আমাদের এই পথের পথপ্রদর্শক, তাকে প্রণাম জানাই। ওং নমঃ শ্রী ভগবতে শঙ্করায়ঃ। এবার আমরা বিবেকচূড়ামনি গ্রন্থে প্রবেশ করি।
একটা কথা বলি, এই সব ব্রহ্মবিদ্যার বই সাধারনতঃ নিরস হয়। অধিকারীভেদে এর প্রকৃত স্বত্বা নিজের অন্তরে স্ব-স্ব রূপে জাগ্রত হয়। নিতান্ত বই পড়ে বা আমাদের কথা শুনে, আমাদের আত্মলব্দ্ধি জাগ্রত হবে, এমন ভাবার কোনো কারন নেই। তবে একটা স্পৃহা জাগ্রত হতে পারে। আর একটা কথা, সত্যি সত্যি আপনি যদি আমাদের এই কথা শুনবার জন্য আগ্রহী হয়ে থাকেন, অথবা আচার্য শঙ্করের বিবেক চূড়ামণি গ্রন্থটি সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে থাকেন, বা অষ্টাবক্র সংহিতার মতো গ্রন্থকে বার বার পড়বার মধ্যে আনন্দ পান, তবে আপনি অধ্যাত্মতিক জগতের পথে একটা ধাপ পেরিয়েছেন বলা যেতে পারে। আপনারা সবাই আমার নমস্য। সবাইকে প্রনাম জানাই। এইবার দেখি আচার্যদেব কি বলছেন। কিন্তু তার আগে ভগবান শঙ্করকে যিনি আমাদের এই পথের পথপ্রদর্শক, তাকে প্রণাম জানাই। ওং নমঃ শ্রী ভগবতে শঙ্করায়ঃ। এবার আমরা বিবেকচূড়ামনি গ্রন্থে প্রবেশ করি।
প্রথম শ্লোক :
১. সর্ববেদান্ত সিদ্ধান্তগোচরং তম অগোচরম ।
গোবিন্দং পরম-আনন্দং সদ্গুরুং প্ৰণতঃ অস্মি অহং। ।
সর্ব বেদান্ত সিদ্ধান্তগোচরং - অর্থাৎ সর্ব বেদান্ত শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত বা বিষয় যার গোচরে,
তম - অর্থাৎ সেই তুমি,
অগোচরং গোবিন্দম পরমান্দং - অর্থাৎ গোবিন্দ যিনি গোচরের অতীত সেই পরমান্দং
সদ্গুরুং অর্থাৎ সৎ গুরু,
প্ৰণতঃঅস্মি অহং - আমি প্ৰণত হচ্ছি।
সর্ব বেদান্ত সিদ্ধান্তগোচরং - অর্থাৎ সর্ব বেদান্ত শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত বা বিষয় যার গোচরে,
তম - অর্থাৎ সেই তুমি,
অগোচরং গোবিন্দম পরমান্দং - অর্থাৎ গোবিন্দ যিনি গোচরের অতীত সেই পরমান্দং
সদ্গুরুং অর্থাৎ সৎ গুরু,
প্ৰণতঃঅস্মি অহং - আমি প্ৰণত হচ্ছি।
সকল বেদান্ত সিদ্ধান্তের দ্বারা যাকে জানা যায়, সেই অগোচর গোবিন্দ পরম আনন্দস্বরূপ সদ্গুরুকে আমি প্রণাম করি।
গোবিন্দ - গো কথার একটা অর্থ বাণী। বেদান্ত-বাক্য দ্বারা যাকে জানা যায় , তিনিই গোবিন্দ। অর্থাৎ আচার্য্যদেব গ্রন্থের শুরুতে সেই সদ্গুরু জগৎগুরু পরমাত্মাকে প্রণাম জানাচ্ছেন।
আবার এখানে গোবিন্দ কথাটার মানে আমরা গোবিন্দপাদকে অর্থাৎ আচার্য্যদেবের দেহধারী গুরুদেবের নাম গোবিন্দপাদ, তাঁকে বুঝতে পারি। শোনা যায়, এই গোবিন্দপাদ, যিনি আচার্য্য শঙ্করের গুরু ছিলেন, তিনি নাকি আসলে মহর্ষি পতঞ্জলি। যিনি নাকি হাজার বছর পরেও সমাধিস্থ অবস্থায় নর্মদা নদীর তীরে এক গুহা মধ্যে সমাধিস্থ হয়ে ছিলেন। সেই গোবিন্দপাদকে অথবা মহর্ষি পতঞ্জলিকে অর্থাৎ শঙ্কর তাঁর দেহধারী গুরুদেবকে প্রণাম জানাচ্ছেন। বেশিরভাগ উপনিষদ শান্তিমন্ত্র দিয়ে শুরু হয়। এখানে আচার্য্যদেব প্রণাম মন্ত্র দিয়ে শুরু করছেন।
আমাদেরও উচিত দিনের শুভ আরম্ভে, বা যেকোনো শুভ কাজ শুরুর আগে সেই পরম গুরুদেবর প্রতি প্রনত হয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে, দিনের কাজ শুরু করা , বা শুভ কাজের সূচনা করা উচিত গুরুদেব বা পরম-আত্মাকে স্মরণের মাধ্যমে।
দ্বিতীয় শ্লোকে বলছেন :
২.জন্তুনাং নরজন্ম দুর্লভমতঃ পুংস্ত্বং ততো বিপ্রতা
তস্মাদবৈদিক ধর্ম মার্গপরতা বিদ্বত্ত্বমস্মাৎ পরম।
আত্মা অনাত্মা বিবেচনং স্বনুভবো ব্রহ্মাত্মনা সংস্থিতি -
র্মুক্তির্নো শত জন্ম কোটি সুকৃতৈঃ পুন্যৈঃ বিনা লভ্যতে। (২)
২. আচার্য্যদেব শুরুতে মুক্তিমার্গে যাবার জন্য কে অধিকারী তার কথা বলছেন।
সমস্ত জীবের মধ্যে মনুষ্যজন্মই দুর্লভ। আবার মানুষের মধ্যে পুরুষ দেহ দুর্লভ। পুরুষের মধ্যে আবার যিনি বিপ্রতা পেয়েছেন, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ ঘরে জন্ম গ্রহণ করেছেন, সেই মানুষ আরো দুর্লভ। ব্রাহ্মণ পুরুষের মধ্যে যিনি বৈদিক ধর্মমার্গে নিষ্ঠাযুক্ত সেইরকম মানুষ আরো দুর্লভ। এর থেকেও শ্রেষ্ট প্রাপ্তি হচ্ছে শাস্ত্রের তাৎপর্য জ্ঞান। আত্মা ও অনাত্মা বিষয়ের তাৎপর্য বিচার, দুর্লভ। স্বরূপের প্রতক্ষ্য অনুভূতি আরো দুর্লভ। সবশেষে ব্রহ্মের সঙ্গে অভেদভাবে স্থিতি লাভ করতে পারা দুর্লভতম। শতকোটি জন্মের সুকৃতি ও পুণ্যফল ব্যতীত এসব পাওয়া সম্ভব নয়। আর জন্ম জন্মান্তরের সুকীর্তি অর্জনের মাধ্যমে যতক্ষন এই সব দুর্লভ গুণগুলো প্রাপ্ত না হচ্ছি, ততক্ষন আমাদের পক্ষে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।
জন্তুনাং নরজন্ম দুর্লভমতঃ পুংস্ত্বং ততো বিপ্রতা (২- অংশ)
জন্তুনাং - জন্তু বলতে সাধারণত আমরা নিম্নতর প্রাণীকে বুঝি। যার জান আছে সেই জন্তু ,জন্তুনাং অর্থাৎ সমস্ত জীব গনের মধ্যে বা সমস্ত প্রাণীদের মধ্যে
নরজন্ম - মনুষ্য জন্ম বা মানুষের এই দেহ লাভ
দুর্লভম - দুর্লভ
অতঃ পুংস্ত্বং - এর থেকে পুরুষের দেহলাভ আরো দুর্লভ। (এখানে মহাত্মা শঙ্কর পুরুষের দেহলাভ দুর্লভ কেন বলছেন জানিনা। নারীদেহ লাভ কি দুর্ভাগ্যজনক ? মৈত্রেয়ী, গার্গী এঁরা কি কম ভাগ্যবান ? শোনা যায় শঙ্কর মা অন্নপূর্ণার কৃপা লাভ করেছিলেন। আমরা শুনেছি, আচার্য্য শঙ্কর তাঁর শাস্ত্রব্যাখ্যা দ্বারা সেকালের পণ্ডিতদের তর্কযুদ্ধে আহবান করতেন। এমনই একদিন তিনি মুন্ডন মিশ্রের দুয়ারে উপস্থিন হন, এবং তাঁকে তর্ক যুদ্ধে আহবান করেন। তো তর্ক যুদ্ধে তো মুন্ডন মিশ্র হেরে যান এবং আচার্য্য শংকর জিতে যান,, কিন্তু সেই তর্ক যুদ্ধে বিচারক ছিলেন, একজন নারী, যিনি সম্পর্কে মন্ডন মিশ্রেরই সহধর্ম্মিণী। এই বিদুষা নারী শঙ্করকে এমন প্রশ্নবানে বিদ্ধ করেছিলেন, যে এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে বিদ্বান ও যোগশ্রেষ্ঠ শঙ্করকে একমাস সূক্ষ্ম দেহে অবস্থান করতে হয়েছিল। তো নারীদেহ জ্ঞান সংগ্রহে অপারগ বা দুর্বল, এমন ভাবার কোনো কারন নেই। মা তো মেয়েরাই হয়। সব থেকে বড় কথা আচার্য্য শঙ্কর তার স্থুলদেহ, বা আমরা সবাই এই স্থুলদেহ মায়ের শরীর থেকেই পাই। সৃষ্টির সহযোগী পুরুষের থেকে মায়েরাই বেশী। আসলে কথাটা পুরুষ দেহ না বলে পুরুষাকার বলতেন, তাহলে বোধ হয় ভালো হতো। পুরুষাকার বলতে আমাদের ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে কর্মে রত হবার ক্ষমতা বোঝায়। তো জ্ঞান লাভ ক্ষমতা সম্পন্ন মনুষ্য দেহ পুরুষ বা নারী উভয়ই হতে পারে । পুরুষাকার প্রয়োগ করেই মানুষ জ্ঞান অর্জন করে। এর মধ্যে নারী পুরুষে কোনো ভেদ নেই। মাপ করবেন এই অনাধিকার চর্চা করবার জন্য।
আবার এখানে গোবিন্দ কথাটার মানে আমরা গোবিন্দপাদকে অর্থাৎ আচার্য্যদেবের দেহধারী গুরুদেবের নাম গোবিন্দপাদ, তাঁকে বুঝতে পারি। শোনা যায়, এই গোবিন্দপাদ, যিনি আচার্য্য শঙ্করের গুরু ছিলেন, তিনি নাকি আসলে মহর্ষি পতঞ্জলি। যিনি নাকি হাজার বছর পরেও সমাধিস্থ অবস্থায় নর্মদা নদীর তীরে এক গুহা মধ্যে সমাধিস্থ হয়ে ছিলেন। সেই গোবিন্দপাদকে অথবা মহর্ষি পতঞ্জলিকে অর্থাৎ শঙ্কর তাঁর দেহধারী গুরুদেবকে প্রণাম জানাচ্ছেন। বেশিরভাগ উপনিষদ শান্তিমন্ত্র দিয়ে শুরু হয়। এখানে আচার্য্যদেব প্রণাম মন্ত্র দিয়ে শুরু করছেন।
আমাদেরও উচিত দিনের শুভ আরম্ভে, বা যেকোনো শুভ কাজ শুরুর আগে সেই পরম গুরুদেবর প্রতি প্রনত হয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে, দিনের কাজ শুরু করা , বা শুভ কাজের সূচনা করা উচিত গুরুদেব বা পরম-আত্মাকে স্মরণের মাধ্যমে।
দ্বিতীয় শ্লোকে বলছেন :
২.জন্তুনাং নরজন্ম দুর্লভমতঃ পুংস্ত্বং ততো বিপ্রতা
তস্মাদবৈদিক ধর্ম মার্গপরতা বিদ্বত্ত্বমস্মাৎ পরম।
আত্মা অনাত্মা বিবেচনং স্বনুভবো ব্রহ্মাত্মনা সংস্থিতি -
র্মুক্তির্নো শত জন্ম কোটি সুকৃতৈঃ পুন্যৈঃ বিনা লভ্যতে। (২)
২. আচার্য্যদেব শুরুতে মুক্তিমার্গে যাবার জন্য কে অধিকারী তার কথা বলছেন।
সমস্ত জীবের মধ্যে মনুষ্যজন্মই দুর্লভ। আবার মানুষের মধ্যে পুরুষ দেহ দুর্লভ। পুরুষের মধ্যে আবার যিনি বিপ্রতা পেয়েছেন, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ ঘরে জন্ম গ্রহণ করেছেন, সেই মানুষ আরো দুর্লভ। ব্রাহ্মণ পুরুষের মধ্যে যিনি বৈদিক ধর্মমার্গে নিষ্ঠাযুক্ত সেইরকম মানুষ আরো দুর্লভ। এর থেকেও শ্রেষ্ট প্রাপ্তি হচ্ছে শাস্ত্রের তাৎপর্য জ্ঞান। আত্মা ও অনাত্মা বিষয়ের তাৎপর্য বিচার, দুর্লভ। স্বরূপের প্রতক্ষ্য অনুভূতি আরো দুর্লভ। সবশেষে ব্রহ্মের সঙ্গে অভেদভাবে স্থিতি লাভ করতে পারা দুর্লভতম। শতকোটি জন্মের সুকৃতি ও পুণ্যফল ব্যতীত এসব পাওয়া সম্ভব নয়। আর জন্ম জন্মান্তরের সুকীর্তি অর্জনের মাধ্যমে যতক্ষন এই সব দুর্লভ গুণগুলো প্রাপ্ত না হচ্ছি, ততক্ষন আমাদের পক্ষে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।
জন্তুনাং নরজন্ম দুর্লভমতঃ পুংস্ত্বং ততো বিপ্রতা (২- অংশ)
জন্তুনাং - জন্তু বলতে সাধারণত আমরা নিম্নতর প্রাণীকে বুঝি। যার জান আছে সেই জন্তু ,জন্তুনাং অর্থাৎ সমস্ত জীব গনের মধ্যে বা সমস্ত প্রাণীদের মধ্যে
নরজন্ম - মনুষ্য জন্ম বা মানুষের এই দেহ লাভ
দুর্লভম - দুর্লভ
অতঃ পুংস্ত্বং - এর থেকে পুরুষের দেহলাভ আরো দুর্লভ। (এখানে মহাত্মা শঙ্কর পুরুষের দেহলাভ দুর্লভ কেন বলছেন জানিনা। নারীদেহ লাভ কি দুর্ভাগ্যজনক ? মৈত্রেয়ী, গার্গী এঁরা কি কম ভাগ্যবান ? শোনা যায় শঙ্কর মা অন্নপূর্ণার কৃপা লাভ করেছিলেন। আমরা শুনেছি, আচার্য্য শঙ্কর তাঁর শাস্ত্রব্যাখ্যা দ্বারা সেকালের পণ্ডিতদের তর্কযুদ্ধে আহবান করতেন। এমনই একদিন তিনি মুন্ডন মিশ্রের দুয়ারে উপস্থিন হন, এবং তাঁকে তর্ক যুদ্ধে আহবান করেন। তো তর্ক যুদ্ধে তো মুন্ডন মিশ্র হেরে যান এবং আচার্য্য শংকর জিতে যান,, কিন্তু সেই তর্ক যুদ্ধে বিচারক ছিলেন, একজন নারী, যিনি সম্পর্কে মন্ডন মিশ্রেরই সহধর্ম্মিণী। এই বিদুষা নারী শঙ্করকে এমন প্রশ্নবানে বিদ্ধ করেছিলেন, যে এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে বিদ্বান ও যোগশ্রেষ্ঠ শঙ্করকে একমাস সূক্ষ্ম দেহে অবস্থান করতে হয়েছিল। তো নারীদেহ জ্ঞান সংগ্রহে অপারগ বা দুর্বল, এমন ভাবার কোনো কারন নেই। মা তো মেয়েরাই হয়। সব থেকে বড় কথা আচার্য্য শঙ্কর তার স্থুলদেহ, বা আমরা সবাই এই স্থুলদেহ মায়ের শরীর থেকেই পাই। সৃষ্টির সহযোগী পুরুষের থেকে মায়েরাই বেশী। আসলে কথাটা পুরুষ দেহ না বলে পুরুষাকার বলতেন, তাহলে বোধ হয় ভালো হতো। পুরুষাকার বলতে আমাদের ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে কর্মে রত হবার ক্ষমতা বোঝায়। তো জ্ঞান লাভ ক্ষমতা সম্পন্ন মনুষ্য দেহ পুরুষ বা নারী উভয়ই হতে পারে । পুরুষাকার প্রয়োগ করেই মানুষ জ্ঞান অর্জন করে। এর মধ্যে নারী পুরুষে কোনো ভেদ নেই। মাপ করবেন এই অনাধিকার চর্চা করবার জন্য।
তত বিপ্রতা - অর্থাৎ ব্রাহ্মণ শরীর লাভ আরো দুর্লভ। এটাও বিতর্কের বিষয়। বিপ্র বলতে উনি যদি জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ বুঝে থাকেন, তবে সেটা অসত্য বলে মনে হয় । তবে যাঁরা বিপ্র বা ব্রাহ্মণ ঘরে জন্ম গ্রহণ করেননি তারা সবাই অভাগা ? বিবেকানন্দ অভাগা ? শ্রীকৃষ্ণ অভাগা ? বুদ্ধদেব অভাগা।আসলে মহর্ষি শঙ্কর মনুবাদের সমর্থক ছিলেন। এবং জন্মসূত্রে যারা ব্রাহ্মণ তাদেরকে একটু বেশি গুরুত্ত্ব দিয়েছেন। আসলে বিপ্র কথাটার মানে যদি জ্ঞানী বলে ধরে নেওয়া যায় তবে ভালো হয়।
সমস্ত মানুষই অজ্ঞান অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে, অর্থাৎ শূদ্র হিসেবে জন্ম গ্রহণ করে। ধীরে ধীরে মানুষ জ্ঞান সঞ্চয় করতে থাকে। তখন তিনি বিপ্র হন । এই জ্ঞানের সাহায্যে যখন জীবিকা অর্জনের উপায় অবলম্বন করে, তখন সে বৈশ্য বা ক্ষত্রিয় । যখন মানুষ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে, তখন সে ব্রাহ্মণ। ব্রহ্মজ্ঞানীকে ব্রাহ্মণ বলা হয়, জন্মসূত্রে কেউ জ্ঞানী বা ব্রাহ্মণ হতে পারেন না। ব্রাহ্মণ হতে হয়, ব্রাহ্মণ হয়ে কেউ জন্মায় না।
আমরা জানি শঙ্করাচার্য শুদ্রদের এড়িয়ে চলতেন। ঘৃণা করতেন। যদিও শেষ জীবনে এসে তার সেই ভুল ভেঙে ছিল। এবং এক শুদ্রকে গুরু হিসেবে সম্মোধন করেছিলেন। মহর্ষি শঙ্কর যে ব্রাহ্মণ বা ব্রহ্মজ্ঞানী ছিলেন, সে ব্যাপারে আমাদের কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু যে ব্রাহ্মণ বংশে ( পিতা : শিবগুরু, মাতা - বিশিষ্টা ) তিনি জন্মে ছিলেন, সেটা একটু শুনুন। ইনি নামপুদ্রি বা নামপুরি বংশে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন । আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি নম্বুরী ব্রাহ্মণ বংশে জন্ম গ্রহণ করেন। এই নম্বুরী ব্রাহ্মণদের আচার ব্যবহার অন্যদের থেকে পৃথক। এঁদের জেষ্ঠপুত্রই কেবলমাত্র নম্বুরীকন্যা বিবাহ করেন, এবং পৈতৃক বিষয়ের অধিকারী হন। অন্য ছেলেরা নায়ার জাতির রমণীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের ছেলেরা নায়ার জাতিপ্রাপ্ত হয় । নায়ার জাতি না ব্রাহ্মণ না শুদ্র, ব্রাহ্মণ-শুদ্রের মিশ্রণ। এদের নায়ারদের একটা মেয়ে প্রয়োজন হলে বহুবিবাহ করতে পারেন। একই কন্যার নায়ার ও নম্বুরী স্বামী থাকতে কোনো বাধা নেই। আচার্য শঙ্কর এই নম্বুরী ব্রাহ্মণকুলের সন্তান।
এবার শুনুন বেদে ব্রাহ্মণ বলতে কাদের বোঝায়। ঋক্বেদ সংহিতার ১০-ম মন্ডলে ৯০ সূক্তে ১ ও ১১-১৪ নং ঋকে কি বলছেন শুনুন :
১০/৯০/ ১ - সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রক্ষঃ সহস্রপাৎ// স ভূমি বিশ্বতো বঽত্যতিষ্ঠৎ দশাঙ্গুলম )। অর্থাৎ পুরুষের সহস্র মস্তক, সহস্র চক্ষু ও সহস্র চরণ। তিনি পৃথিবীকে সর্বত্র ব্যাপ্ত করে দশ অঙ্গুলি পরিমান অতিরিক্ত হয়ে অবস্থিত থাকেন। আসলে প্রাচীন ঋষিরা বিশ্বব্রহ্মান্ডকে এক বিরাট পুরুষের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
১০/৯০/১১ - যৎ পুরুষং ব্যদধুঃ কতিধা ব্যকল্পয়ন // মুখং কিমস্য কৌ বাহু কা ঊরু পাদা উচ্চতে ।।
পুরুষকে খন্ড খন্ড করা হলো, কয় খন্ড করা হয়েছিলো ? মুখ কি হলো, বাহু, উরু, পা-ই বা কি হলো ? উত্তর দিচ্ছেন পরবর্তী শ্লোকে।
১০/৯০/১২ - ব্রাহ্মণো অস্য মুখম অসীদ্বাহূ রাজন্যঃ কৃতঃ // উরু তদস্য যদ্বৈশ্যঃ পদভ্যাং শুদ্রো অজয়ত। অর্থাৎ এর মুখ হলো ব্রাহ্মণ, দুই বাহু হলো রাজন্য ( খেয়ালকরুন ক্ষত্রিয় নয় রাজন্য ) যা উরু হলো বৈশ্য, দুই চরণ হলো শুদ্র।
১০/৯০/১৩ - চন্দ্রমা মনসো জাত্শচক্ষোঃ সূর্যো অজায়ত / মুখাদ ইন্দ্রশ্চ অগ্নিশ্চ (প্রাণাদ্বায়ুরজায়ত) প্রানাৎ বায়ুর জায়ত । অর্থাৎ মন থেকে চন্দ্র চোখ থেকে সূর্য, মুখ থেকে ইন্দ্র ও অগ্নি, প্রান হতে বায়ু।
১০/৯০/১৪ - নাভি হতে আকাশ, মস্তক হতে স্বর্গ, দুই চরণ হতে ভূমি, কর্ন থেকে দিক ও ভুবন সকল নির্মাণ হলো। ( নাভ্যা আসিৎ অন্তরিক্ষং শীর্ষ্ণ দৌ সমবর্তত / পদ্ভ্যাং ভূমির্দিশঃ শ্রোত্রাত্তথা লোকা অকল্পয়ন্। ।)
তাহলে আমরা বুঝতে পারছি :
বিশ্বপিতাকে বা বিরাট সেই পুরুষকে মানুষের রূপে কল্পনা করা হয়েছে। এবং তার পা-কে বলা হচ্ছে ভূমি অর্থাৎ পৃথিবী যা আমাদের আশ্রয়স্থল। নাভিকে বলা হচ্ছে আকাশ। কান কে বলা হচ্ছে দশ দিক বা সমস্ত ভুবন। মনকে বলা হচ্ছে চাঁদ। চোখকে বলা হচ্ছে সূর্য, মুখকে বলা হচ্ছে অগ্নি, আর প্রাণকে বলাহচ্ছে বায়ু। একটা কথা আছে যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তাই আছে এই ভান্ডে অর্থাৎ এই দেহভান্ডে।
ব্রাহ্মণ অর্থাৎ জ্ঞান যা আমাদের মাথার কাজ। বাহু আমাদের রক্ষাকারী, আমাদের শরীরকে রক্ষা করে আমাদের বাহু। মাথায় বা আমাদের শরীরকে কেউ আঘাত করতে এলে বাহু এগিয়ে যায় রক্ষার জন্য।তাই বহু আমাদের ক্ষত্রিয়। মাথার এক-একটি অংশ এক একটা কর্মের দ্যোতক। যেমন মুখ ও নাক হলো গ্রহণকারী, অর্থাৎ শরীরের মধ্যে কিছু দিতে গেলে অর্থাৎ বায়ু বা অন্ন যা থেকে শরীর বেঁচে থাকে তা এই মুখ বা নাক গ্রহণ করে। কিন্তু সে ধরে রাখে না। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বিতরণ কেন্দ্রে, বা প্রসেসিং সেন্টারে পাঠিয়ে দেয় . অর্থাৎ বুকে বা পেটে পাঠিয়ে দেয়। আমাদের পেট ও বুক হচ্ছে প্রসেসিং সেন্টার, এখানে সব কিছু পরিপাক হয়। অর্থাৎ নির্যাস বার করা হয়। এই পেট ও বুক আবার বিতরণ কেন্দ্রও বটে। তাই আমরা দেখি, পেট বা বুক নিজে কিছু ধরে রাখে না, পেট বা বুক আবার এই বাতাস ও খাদ্য থেকে উর্যাশক্তি বের করে এবং সমস্ত শরীরে যার যেটা প্রয়োজন তাকে তা পাঠিয়ে দেয়। এবং যা অপ্রোজনীয় তা মল মূত্র আকারে বের করে দেয়।
এই ব্রাহ্মণ অর্থাৎ মস্তিস্ক আমাদের সবার আছে। জন্ম সূত্রে খালি মাথা নিয়ে কেউ জন্মায় না। মাথা যেমন আমাদের ব্রাহ্মণ, পেট তেমনি আমাদের বৈশ্য, হাত আমাদের ক্ষত্রিয়, পা আমাদের শুদ্র। তাই কোনো মানুষকেই শুধু, শুদ্র, বা বৈশ্য, বা ক্ষত্রিয় বা ব্রাহ্মণ বলা যায় না। এই চারি বর্ণের মিশ্রণ আমাদের শরীর অর্থাৎ আমাদের মনুষ্যদেহ। তাই আমার কাছে মনে হয়, কেউ যদি নিজেকে ব্রাহ্মণ বলে দাবি করেন, তাঁকে ধরবিহীন কেতু বা শুধু মস্তিস্ক মনে হয়। পূর্ন মানুষ সেই, যিনি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র সবকিছুর মিশ্রণ।
ধরবিহীন মুন্ডু একটি অসম্পূর্ন মনুষ্যদেহের কল্পনা মাত্র। এর কোনো অস্তিত্ত্ব নেই। এ যেন সেই কেতু, কেবল মুন্ডু।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন : ময়া সৃষ্ট্যং গুন্ ও কর্ম বিভাগশঃ অর্থাৎ গুণ ও কর্ম অনুসারে আমি এই চতুর্বর্ণের সৃষ্টি করেছি। .আসলে আমরা আমাদের যে অঙ্গের ব্যবহার বেশি করি, আমাদের সেই অঙ্গ শক্তিশালী হয়। যারা মাথার ব্যবহার বেশি করেন, তাদের মাথা সক্রিয় হয়। তেমনি পরিশ্রমী মানুষের দেহ শক্তিশালী হয়।
যাইহোক আমরা এবার শ্লোকের পরবর্তী অংশে যাবো।
তস্মাদবৈদিক ধর্মমার্গপরতা বিদ্বত্ত্বমস্মাৎ পরম। (২ অংশ )
তস্মাদ - তা হলেও অর্থাৎ ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মালেও
বৈদিক ধর্ম মার্গপরতা - বেদ বিহিত ধর্মমার্গে নিষ্ঠা
বিদ্বত্ত্বমস্মাৎ পরম - বিদ্বত্ত্বম অর্থাৎ শাস্ত্রের তাৎপর্য জ্ঞান ; অস্মাৎ - অর্থাৎ এ হতে :
পরম - অর্থাৎ উৎকৃষ্ট
অর্থাৎ মহাত্মা শঙ্কর বলছেন ,প্রথমে মনুষ্য জন্ম, তারপরে পুরুষ (যা আমাদের দৃষ্টিতে পুরুষাকার) তার পরে বিপ্রতা অর্থাৎ ব্রাহ্মনঘরে জন্ম (যা আমার দৃষ্টিতে জ্ঞানী হওয়া ) তার পরে বেদবিহিত ধর্মমার্গে নিষ্ঠা। বেদবিহিত ধর্ম্মমার্গে নিষ্ঠা, অর্থাৎ বেদে যে ধর্মের মার্গ বা পথ দেওয়া হয়েছে, সেই দিকে নিষ্ঠা যার আছে। বেদ কথাটার মানে কিছু পুস্তক নয়। বেদ কথাটার মানে হচ্ছে জ্ঞান, ঈশ্বরিক জ্ঞান। অর্থাৎ এই জ্ঞানের পথে যাবার জন্য যার নিষ্ঠা আছে তিনি ভাগ্যবান। শুধু তাই নয় বিদ্বত্ত্বম অর্থাৎ শাস্ত্রের তাৎপর্য সম্পর্কে জ্ঞান থাকা আবশ্যক। এই রকম ব্যক্তিই আত্মজ্ঞান লাভের জন্য দুর্লভ কিন্তু উৎকৃষ্ট।
-------------------------
আত্মা অনাত্মা বিবেচনং স্বনুভবো ব্রহ্মাত্মনা সংস্থিতি
র্মুক্তির্নো শত জন্ম কোটি সুকৃতৈঃ পুন্যৈঃ বিনা লভ্যতে। (২ অংশ )
আত্মা অনাত্মা বিবেচনং - আত্মা অনাত্মা বিচারশীল
স্বনুভবো : স্ব-অনুভবঃঅর্থাৎ সম্যক অনুভব
ব্রহ্মাত্মনা সংস্থিতি - আত্মাই ব্রহ্ম এই বোধে স্থিতি
র্মুক্তির্নো : মুক্তি হবে না
শত জন্ম কোটি :শত সহস্র কোটি জন্মে
সুকৃতৈঃ পুন্যৈঃ : সুকৃতি ও পুন্য কর্ম
বিনা লভ্যতে : ছাড়া লাভ করা যাবে না।
তাহলে আমরা আচার্য্যের ২ নং শ্লোকের শেষ অংশের যথার্থ অর্থ দাঁড়ালো :-
২. মনুষ্যজন্ম দুর্লভ। মানুষের মধ্যে ব্রাহ্মণ শরীর লাভ অর্থাৎ জন্ম সূত্রে জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ এটি দুর্লভ। যদিও আমি বলি যার মধ্যে পুরুষকার শক্তির বিকাশ আছে, সেই মানুষ আরো দুর্লভ। পুরুষাকারের সাহায্যে যিনি জ্ঞান লাভ সমর্থ হয়েছেন, সেই মানুষের সংখ্যা আরো কম। জ্ঞানীগনের মধ্যে যিনি আত্মা-অনাত্মা বিচারশীল, সেই মানুষ আরো কম। এর মধ্যে যারা স্ব-স্বরূপে অনুভূতি লাভ করেছেন, সেই মানুষ অতি দুর্লভ। এই অনুভূতি লব্ধ মানুষের মধ্যে যিনি ব্রহ্মের সাথে অভেদজ্ঞানে স্থিতি লাভ করেছেন তিনি দুর্লভতম। শতকোটি জন্মের সুকৃতি থাকলে, এই মুক্তি লাভ সম্ভব।
জীবের মধ্যে মানুষই শ্রেষ্ট। মনুষ্য জন্ম মুক্তির দ্বার। তাই সবাই মানুষ হয়ে জন্মাতে চায়। তা সে দেবতা বলুন, আর গন্ধর্ব কিন্নর বলুন। কারন মনুষ্য জন্মেই মুক্তি সম্ভব। একমাত্র মনুষ্য জন্মেই কর্মফল সঞ্চিত হয়। অন্য কেউ এই কর্মফল সঞ্চয় করতে পারে না। আর সব ভোগযোনি। সেখানে শুধু কর্মফলের ভোগ আছে। পাপপুণ্যের লেখাজোকা শুধু এই মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। একটা পশু আর একটা পশুকে মারলে যেমন পাপ হয় না। দেবতা বা সুর অসুরকে মারলেও পাপ হয় না। আবার গরু ছাগল ঘাস পাতা খায় কোনো হিংসা করে না, তবুও তাদের কোনো পুন্য হবে না। পাপ্পুন্য কেবল মানুষেরই হয়।
তাই মানুষই ভালো মন্দ বোঝে, তাদেরই কেবল বিচার শক্তি আছে। পশুরা বা দেবতারা কেবল সহজাত বৃত্তি অনুযায়ী কর্ম করে, বা ভোগ বিলাসে ব্যস্ত থাকে।
তাই মহাত্মা শঙ্কর বলছেন, মানুষ হয়ে জন্মানো, নিজের জ্ঞান সঞ্চয়ের ক্ষমতাকে কাজে লাগানো, বিচার দ্বারা আত্মা-অনাত্মা ভেদ করে ব্রহ্মে সংস্থিতি লাভ আমাদের বহু জন্মের পুণ্যফল। অতয়েব এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে। তবে মহাত্মা শঙ্করাচার্য আরো দুটি নির্দেশ করেছেন, অধিকারী নির্ণয়ের ক্ষেত্রে, একদিকে আমাদের যেমন মনুষ্য জন্ম নিতে হবে, তেমনি, মুক্তিলাভের জন্য আমাদের গভীর আগ্রহ অর্থাৎ ব্যাকুলতা থাকা চাই, আবার শুধু মনুষ্য জন্ম ও ব্যাকুলতা থাকলেই হবে না, ব্রহ্মদর্শী মহাপুরুষের সংশ্রবে আসতে হবে। সেগুলো তিনি পরবর্তী শ্লোকে আলোচনা করেছেন। আমরা সেগুলো পরেরদিন শুনবো।
আত্মা অনাত্মা বিবেচনং স্বনুভবো ব্রহ্মাত্মনা সংস্থিতি
র্মুক্তির্নো শত জন্ম কোটি সুকৃতৈঃ পুন্যৈঃ বিনা লভ্যতে। (২ অংশ )
আত্মা অনাত্মা বিবেচনং - আত্মা অনাত্মা বিচারশীল
স্বনুভবো : স্ব-অনুভবঃঅর্থাৎ সম্যক অনুভব
ব্রহ্মাত্মনা সংস্থিতি - আত্মাই ব্রহ্ম এই বোধে স্থিতি
র্মুক্তির্নো : মুক্তি হবে না
শত জন্ম কোটি :শত সহস্র কোটি জন্মে
সুকৃতৈঃ পুন্যৈঃ : সুকৃতি ও পুন্য কর্ম
বিনা লভ্যতে : ছাড়া লাভ করা যাবে না।
তাহলে আমরা আচার্য্যের ২ নং শ্লোকের শেষ অংশের যথার্থ অর্থ দাঁড়ালো :-
২. মনুষ্যজন্ম দুর্লভ। মানুষের মধ্যে ব্রাহ্মণ শরীর লাভ অর্থাৎ জন্ম সূত্রে জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ এটি দুর্লভ। যদিও আমি বলি যার মধ্যে পুরুষকার শক্তির বিকাশ আছে, সেই মানুষ আরো দুর্লভ। পুরুষাকারের সাহায্যে যিনি জ্ঞান লাভ সমর্থ হয়েছেন, সেই মানুষের সংখ্যা আরো কম। জ্ঞানীগনের মধ্যে যিনি আত্মা-অনাত্মা বিচারশীল, সেই মানুষ আরো কম। এর মধ্যে যারা স্ব-স্বরূপে অনুভূতি লাভ করেছেন, সেই মানুষ অতি দুর্লভ। এই অনুভূতি লব্ধ মানুষের মধ্যে যিনি ব্রহ্মের সাথে অভেদজ্ঞানে স্থিতি লাভ করেছেন তিনি দুর্লভতম। শতকোটি জন্মের সুকৃতি থাকলে, এই মুক্তি লাভ সম্ভব।
জীবের মধ্যে মানুষই শ্রেষ্ট। মনুষ্য জন্ম মুক্তির দ্বার। তাই সবাই মানুষ হয়ে জন্মাতে চায়। তা সে দেবতা বলুন, আর গন্ধর্ব কিন্নর বলুন। কারন মনুষ্য জন্মেই মুক্তি সম্ভব। একমাত্র মনুষ্য জন্মেই কর্মফল সঞ্চিত হয়। অন্য কেউ এই কর্মফল সঞ্চয় করতে পারে না। আর সব ভোগযোনি। সেখানে শুধু কর্মফলের ভোগ আছে। পাপপুণ্যের লেখাজোকা শুধু এই মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। একটা পশু আর একটা পশুকে মারলে যেমন পাপ হয় না। দেবতা বা সুর অসুরকে মারলেও পাপ হয় না। আবার গরু ছাগল ঘাস পাতা খায় কোনো হিংসা করে না, তবুও তাদের কোনো পুন্য হবে না। পাপ্পুন্য কেবল মানুষেরই হয়।
তাই মানুষই ভালো মন্দ বোঝে, তাদেরই কেবল বিচার শক্তি আছে। পশুরা বা দেবতারা কেবল সহজাত বৃত্তি অনুযায়ী কর্ম করে, বা ভোগ বিলাসে ব্যস্ত থাকে।
তাই মহাত্মা শঙ্কর বলছেন, মানুষ হয়ে জন্মানো, নিজের জ্ঞান সঞ্চয়ের ক্ষমতাকে কাজে লাগানো, বিচার দ্বারা আত্মা-অনাত্মা ভেদ করে ব্রহ্মে সংস্থিতি লাভ আমাদের বহু জন্মের পুণ্যফল। অতয়েব এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে। তবে মহাত্মা শঙ্করাচার্য আরো দুটি নির্দেশ করেছেন, অধিকারী নির্ণয়ের ক্ষেত্রে, একদিকে আমাদের যেমন মনুষ্য জন্ম নিতে হবে, তেমনি, মুক্তিলাভের জন্য আমাদের গভীর আগ্রহ অর্থাৎ ব্যাকুলতা থাকা চাই, আবার শুধু মনুষ্য জন্ম ও ব্যাকুলতা থাকলেই হবে না, ব্রহ্মদর্শী মহাপুরুষের সংশ্রবে আসতে হবে। সেগুলো তিনি পরবর্তী শ্লোকে আলোচনা করেছেন। আমরা সেগুলো পরেরদিন শুনবো।
দুর্লভং ত্রয়ম-এবম-এব-এতৎ-দেবানুগ্রহ-অহেতুকম
মনুষ্যত্বং মুমুক্ষুত্বং মহাপুরুষ-সংশ্রয়ঃ (৩)
মনুষ্য জন্ম প্রাপ্তি, মুক্তিলাভের আগ্রহ, মহাপুরুষের সংশ্রয় এই তিনটিই দুর্লভতম। দেবানুগ্রহই এগুলো পাবার একমাত্র পথ।
আচার্য্য বলছেন, প্রথমে মনুষ্য জন্ম পেতে হবে, তারপরে এই মনুষ্য জন্ম থেকে অর্থাৎ সংসার বন্ধন থেকে মুক্তি পাবার ইচ্ছেকে জাগ্রত করতে হবে, এরপর মহাপুরুষের সংশ্রবে আসতে হবে। আবার বলছেন, এই তিনটেই নাকি একমাত্র দেবানুগ্রহে পাওয়া সম্ভব। আমরা যারা এই আচার্য্যের বাক্য পড়ছি, বা শুনছি, তারা সবাই আর কিছু না হোক, অবশ্যই মনুষ্য শরীরেরই অবস্থান করছি। এখন এই মনুষ্য শরীর কেন, কিভাবে পেয়েছি তা আমরা জানি না, তবে এটুকু বুঝি যে আমরা এই শরীর পিতা-মাতা থেকেই পেয়েছি। এখন পিতা-মাতা থেকে শরীর তো পেয়েছি, এই শরীর যা আসলে কর্ম্ম ক্ষেত্র, এই শরীরের কি কাজ, তা আমাদের জানা নেই। আমরা কেবল এই শরীরটাকে লালন পালন করে চলেছি। এই শরীরের যে মন আছে, তাকে আমরা খুশি করবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি। কিন্তু মহাত্মাগণ বলে থাকেন, আমি মানুষ বটে, কিন্তু মানুষ হিসেবে যে মহান পরিচয় আমরা পেয়েছি, তার সম্পর্কে আমরা বিশেষ কিছুই জানি না।
এই শরীরের দুটো দিক , একটা হচ্ছে, মানুষ হিসেবে আমরা কিছু ইন্দ্রিয়ের অধিকারী হয়েছি। আর এই ইন্দ্রিয়শক্তি বলে আমরা বাহ্য জগৎ সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। এমনকি বাহ্য জগতে যে বিষয় তা থেকে আমরা বিষয়সুখ অনুভব করবার শক্তি পেয়েছি। এখন কথা হচ্ছে, এই বিষয়সুখ বা বিষয়বোধ কার হচ্ছে ? এই বিষয়সুখ বা বিষয়বোধ হচ্ছে আমাদের মনের। মনই ইন্দ্রিয়সকলের সাহায্যে এই বিষয় থেকে সুখ-দুঃখ ভোগ করছে। আর আমরা এও জানি, যে মন হচ্ছে সূক্ষ্ম পদার্থ। অর্থাৎ যাকিছু আমরা শরীরের মাধ্যমে গ্রহণ করছি, এই খাদ্য সামগ্রীর সূক্ষ্মতম অংশ হচ্ছে মন। আবার এই মন। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে, মন পার্থিব পদার্থ অর্থাৎ জড় পদার্থ। আর আমরা এও জানি যে জড় পদার্থের কোনো বোধশক্তি নেই। কিন্তু আমাদের মন বোধশক্তি সম্পন্ন। তো এই বোধ শক্তি সে কোত্থেকে পায় ? মহাত্মাগণ বলছেন, এই বোধশক্তি সে পায় আত্মা যা আসলে চেতনশক্তির উৎস সেখান থেকেই মন এই বোধশক্তি পেয়ে থাকে। অর্থাৎ মনকে যিনি চেতনা যোগাচ্ছে তিনি হচ্ছেন, আত্মা বা উপনিষদের ভাষায় ব্রহ্ম। তো এই বোধশক্তি মানুষকে চেতনার স্তরে নিয়ে গেছে। কিন্তু এই আত্মার সঙ্গে মনের সংযোগ ঘটলো কি করে ? এই সংযুক্তি ঘটিয়েছে আমাদের প্রাণ বা শ্বাস প্রশ্বাস। তো শ্বাসপ্রশ্বাস জনিত কারনে মন যা আসলে জড় পদার্থের সূক্ষ্মতম অংশ মাত্র, তা চেতনা সম্পন্য হয়েছে প্রাণের সংস্পর্শে এসে।
ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলছেন, নিজের মান সমন্ধে যার হুঁশ আছে, চৈতন্য আছে, তিনিই মানুষ। এখন কথা হচ্ছে হুশ তো সমস্ত জীবকুলের মধ্যেই আমরা দেখতে পাই। কীটাণু কীট থেকে হাতিঘোড়া সবারই হুঁশ আছে। সবারই একটা ব্যক্তি সত্ত্বা আছে। আর এই ব্যক্তিসত্ত্বাকে সে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। তাই আমরা লক্ষ করেছি, যখনই জীবকুলের সামনে, কোনো বিপদ বা বিরূপ অবস্থার আবির্ভাব হয়, তখন সে সতর্ক হয়ে নিজে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য সচেষ্ট হয়। কচ্ছপ নিজেকে গুটিয়ে নেয়, পিঁপড়ে পালিয়ে বাঁচতে চায়। যার মধ্যে প্রাণের আনাগোনা আছে, তার মধ্যেই অর্থাৎ সমস্ত প্রাণীর মধ্যেই হুশ আছে। প্রাণের উদ্গমনে এই হুশ আর থাকে না। শরীর থেকে প্রাণশক্তি বেরিয়ে গেলে, আর হুশ থাকে না। অর্থাৎ প্রাণহীন মৃত জীব, নিজেকে বাঁচাবার জন্য চেষ্টা করে না। তো হুশ সবার আছে, আর এই কারণেই, সে বেঁচে থাকবার একটা অনুকূল পরিবেশের সন্ধান করে, এবং বিপদ থেকে সে নিজেকে রক্ষা করে থাকে।
কিন্তু মান বা মান্যতাবোধ কেবলমাত্র মানুষের মধ্যেই থাকে। সে শুধু বাঁচতে চায়, তা নয়, তার মধ্যে গর্ব্ব বা দাম্ভিকতা আছে। বিশেষ গর্ব্বযুক্ত মনকে বলা হয় মান। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে মান-অভিমান আছে। এই মানবোধ আর কোনো প্রাণীর মধ্যে বিশেষ ভাবে দেখা যায় না। হয়তো ব্যতিক্রমী জীব থাকতে পারে, কিন্তু জাতিগত ভাবে, কেবলমাত্র মনুষ্যজাতির মধ্যেই এই মান-এর অভিব্যাক্তি দেখা যায়। আর এই মান-বোধ থেকে মানুষের মধ্যে বিচারশক্তির উদ্ভব ঘটে থাকে। অর্থাৎ ভালো-মন্দ বিচার করতে শেখে। নিজের মধ্যে প্রশ্ন জাগে। অর্থাৎ সে জানতে চায়, সে কে ? কোথেকে এসেছে, কেনই বা এসেছে, এখানে তার কি কর্তব্য, এখান থেকে সে কোথায় যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই প্রশ্ন যার মধ্যে জাগে না, সে মনুষ্যেতর প্রাণী ছাড়া কিছু নয়। অন্যান্য জীবের সঙ্গে তার কোনো পার্থক্য রইলো না। সে স্থবির হয়ে গেলো। অর্থাৎ সে প্রকৃতির ক্রীড়নক হয়ে গেলো। প্রকৃতির নিয়মে সে বেঁচে থাকে, আবার প্রকৃতির নিয়মে তার মধ্যে পরিবর্তন লক্ষিত হয়, একসময় প্রকৃতির কারণেই তার দেহান্তর ঘটে।
তো যার মধ্যে কোনো প্রশ্ন জাগে না, মহাত্মাগণ বলে থাকেন,তার মনুষ্য শরীর ধারণই সার হলো। মনুষ্য জীবনের যে উদ্দেশ্য অর্থাৎ মনুষ্যত্ব লাভ আর হলো না। আচার্য্যদেব বলছেন, "মুমুক্ষুত্বং" অর্থাৎ পরবর্তী গন্তব্যের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা। সংসার বন্ধন থেকে মুক্তির ইচ্ছে।এই স্থুল শরীরের মৃত্যু তো একদিন হবেই, কিন্তু দুর্লভ এই মনুষ্য শরীর পেয়েও, যিনি এর সদ্ব্যবহার করলেন না, তার মতো দুর্ভাগা আর কে আছে। আচার্য্য শঙ্কর বলছে, এর জন্য দরকার "মহাপুরুষের সংশ্রয়" অথাৎ সাধুসঙ্গ করবার সুযোগ ও মানসিকতা। যিনি ভাগ্যক্রমে এই সাধুসঙ্গের সুযোগ পান, তার মন আস্তে আস্তে বিষয় থেকে বিরত হয়ে ঈশ্বরের দিকে ঝুকে পড়ে, অর্থাৎ অনন্ত যাত্রার জন্য তিনি প্রস্তুত হন । আসলে মনুষ্যজীবন হচ্ছে, আমাদের অনন্ত যাত্রাপথে কিছুক্ষনের জন্য, এই স্থুল শরীরে আশ্রয় নিয়ে যাত্রার রসদ সংগ্রহ করার কাল। আর এসময়টা আমরা যদি বাহ্যিক আড়ম্বরে বিমোহিত হয়ে সমস্ত নষ্ট করি, তবে বার বার আমাদের এই শরীর ধারণ করতে হবে। আর এই উৎকৃষ্ট শরীর অর্থাৎ মনুষ্য শরীর আবার কবে লাভ হবে কি-না , তাতো আমরা জানি না, তাই এই শরীরে অবস্থান কালেই আমাদের ভববন্ধন থেকে মুক্তির আগ্রহ জাগাতে হবে, মহাপুরুষের সঙ্গ করতে হবে, তবেই আমাদের মনুষ্য শরীর ধারনের উদ্দেশ্য সফল হবে। আচার্য্যদেব বলছেন, এই তিনটি অর্থাৎ মানুষই শরীর প্রাপ্তি, মুক্তির ইচ্ছে, ও মহাপুরুষের সংশ্রব এই তিনটি দেবানুগ্রহেই হয়ে থাকে।
----------------------
লব্ধ্বা কথঞ্চিন্-নরজন্ম দুর্লভং
তত্রাপি পুংস্ত্বং শ্রুতি পারদর্শনম।
যস্ত্বাত্মমুক্তৌ ন যতেত মূরধীঃ
স হ্যাত্মহা স্বং বিনিহন্তি-অসদগ্ৰহাৎ। (৪)
৪. পূর্ব জন্মকৃত পুন্য কর্মের ফলে মনুষ্য জন্ম লাভ হয়। সেই মনুষ্য দেহে পুরুষাকার থাকে, সেই পুরুষকার ব্যবহার করে, যে নিজের মুক্তি লাভের জন্য যত্ন করে না, তিনি নিজেকে ধংশ করছেন। তিনি তো আত্মঘাতী। অনিত্য বস্তু গ্রহণ করে, নিজেকে বিনাশের পথে নিয়ে চলছেন।
এই দুর্লভ নরজন্মে পুরুষকারের সাহায্যে মানুষ বিচারশীল হতে পারে, বেদান্ত বিচারে পারদর্শী হতে পারে। কিন্তু যিনি এই পুরুষকরকে বিষয় গ্রহণের কাজে লাগাচ্ছেন, তিনি আত্মঘাতী পুরুষ। কেননা, তিনি নিত্যকে ছেড়ে অনিত্যকে নিয়ে সময় ব্যাতিত করছেন। আর নিজেকেই নিজে বঞ্চিত করছেন। এই ব্যক্তি স্থুল বুদ্ধি সম্পন্ন মূঢ়। যদিও বেদান্ত বিচার বড়ো কথা নয়, বড়ো কথা হচ্ছে, নিজের মধ্যে নিজেকে জানার আগ্রহকে জাগিয়ে তোলা।
পুরুষ কথার অর্থ হচ্ছে, যিনি অন্যের অভাব পূরণ করেন। আবার পুর কথাটার অর্থ শরীর। তো এই শরীরে যিনি বাস করেন, বা শয়ান ক'রে যিনি এই শরীরকে রক্ষা করছেন, তিনিই পুরুষ। পুরুষার্থ :পুরুষ+অর্থ, পুরুষের যা প্রয়োজন তা হচ্ছে পুরুষার্থ। এই পুরুষার্থঃ হচ্ছে চারটি বর্গ - ধর্ম্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ। সর্ব্বদা আলস্য পরিত্যাগ পূর্ব্বক মন, শরীর, বাণী ও ধন দ্বারা উত্তম ব্যবহার সিদ্ধির জন্য অত্যন্ত উদ্যোগ করার নাম পুরুষার্থ। সৃষ্টির মূল চৈতন্যময় ঈশ্বর হচ্ছেন পুরুষ। তো সবার শরীরেই এই পুরুষ বাস করছেন। কিন্তু যিনি এই পুরুষের সন্ধান জানেন না, তিনি নির্বোধ। আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, "স হ্যাত্মহা স্বং বিনিহন্তি-অসদগ্ৰহাৎ।" - সে আত্মঘাতী সমান, যিনি সৎ বস্তু ছেড়ে অসৎ বস্তু গ্রহন করছেন, তিনি নিজেকেই বিনষ্ট করছেন। ইশ উপনিষদ বলছেন, যাদের আত্মজ্ঞান হয়নি, আত্মজ্ঞান আরজনে উদাসীন, তারা আত্মঘাতী। এরা দেহত্যাগের পর সূর্য্যহীন লোক, বা অসুরলোক প্রাপ্ত হন।
তো এই ঈশ্বররূপ পুরুষ আমাদের সবার শরীরে বাস করছেন। তিনি যেমন আছেন, নরদেহে, তেমনি আছেন নারী দেহে। তো তাঁর সাথে সংযুক্ত হয়ে, অর্থাৎ আত্মস্থ হয়ে মনুষ্য জীবন সার্থক করতে হবে।
------------------
ইতঃ কো স্বস্তি মূঢ়াত্মা যস্তু স্বার্থে প্রমাদ্যতি
দুর্লভং মানুষ্যং দেহং প্রাপ্য তত্রাপি পৌরুষম। (৫)
৫. দুর্লভ এই মনুষ্য জন্ম, দুর্লভ এই পুরুষকার, এসব পেয়েও যিনি নিজের যথার্থ স্বার্থ বুঝতে না পারেন। যিনি আলস্যের বশে নিজের মুক্তি সাধনে চেষ্টা না করেন, তার চেয়ে নির্বোধ আর কে আছে ?
বলছেন, তুমি মানুষ হয়ে জন্মেছ। তোমার সঙ্গে আছেন সেই পরমপুরুষ - যিনি সৃষ্টির মূল। তো তুমি এই পরমপুরুষের সন্ধান না করে বিষয়ের মোহে বিষয়ের পিছনে ছুটে বেড়াচ্ছ ? এ অতি নির্বোধের কাজ, তুমি কি নিজের ভালো নিজে বোঝোনা ? তুমি কি নিজের স্বার্থটাও বোঝো না ? এর চেয়ে মূঢ়তা আর কি হতে পারে ? বাস্তবিক, আমরা সবাই সেই মূঢ়ের দলে। লক্ষকোটি যোনী ভ্রমনের পরে মানুষ হয়ে জন্মে কোথায় আত্মজ্ঞান লেভার চেষ্টা করবো,, তা না করে এই তুচ্ছ বিষয়ের পিছনে ছুটে মনুষ্য জীবনটাকে ব্যর্থ করে তুলছি। ক্ষনিকের এই সংসার, প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল এই সংসার, আজ জৈব একটু সুখের মুখ দেখতে পাই, তো কাল থেকে শুরু হয় দুঃখ। আর এই সুখ-দুঃখের নৌকোয় ভাসতে ভাসতে আমরা কোথায় যাচ্ছি ? কখন যে ঝড় আসবে আর নৌকা ডুবে যাবে, আমরা নাকানি চোবানি খাবো, তার ঠিক নেই। তাই আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, সে সাময়িক সংসার সুখের আশায় ব্রহ্মানন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রেখেছে, সে তো নির্বোধ। ঠাকুর বলতেন, ব্রহ্মানন্দের সন্ধান পেলে, বিশায়ানন্দ আলুনি লাগে। শঙ্করাচার্য্যও বলছেন, আজ ব্রহ্ম তোমার নিকটে তোমার শরীরের মধ্যেই অবস্থান করছেন, যেখানে তোমার বাস, সেখানেই হৃদয়গুহায় লুকিয়ে আছেন সেই ব্রহ্ম, বাইরের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে একবারটি অন্ত্রের দিকে তাকাও, তবে তুমি পরমান্দের সন্ধান পাবে। এই সুযোগ আর কখনো হবে না। এই শরীর পাবার জন্য দেবতারাও উৎসুক থাকে, আর তুমি এই শরীর পেয়ে হেলায় সময় অতিবাহিত করছো। এই শরীর তোমার চিরস্থায়ী নয়, প্রতিক্ষনে এই শরীর বিনাশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এক্ষুনি শুরু করো, শরীর থাকতে থাকতে সেই পরমপুরুষকে ধরে মনুষ্য জীবন সার্থক করো। তোমার শুভবুদ্ধি জাগ্রত হোক।
বদন্তু শাস্ত্রাণি যজন্তু দেবান
কুর্বন্তু কর্মাণি ভজন্তু দেবতাঃ।
আত্মৈক বোধেন বিন্যাপি মুক্তি
র্ণ সিধ্যতি ব্রহ্মশতান্তরে -অপি। ( ৬)
৬. কেউ, যতই শাস্ত্রের ব্যাখ্যা করুক, শাস্ত্র বিচার করুক, দেবতাদের উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করুক, কিম্বা শাস্ত্র বিহিত বিবিধ কর্মের অনুষ্ঠান করুক, কিংবা ইষ্ট দেবতার উপাসনা করুক, ব্রহ্মজ্ঞান বিহীন এই সমস্ত সাধনার দ্বারা, তার শতব্রহ্মার আয়ুষ্কালের মধ্যেও অর্থাৎ অনন্ত কালেও তার মুক্তি লাভ হবে না।
উদ্দেশ্য মুক্তি, আর উপায় হচ্ছে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ। ব্রহ্মজ্ঞান অর্থাৎ ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করা । এমন অনেকে আছেন যারা শাস্ত্রাদি পাঠ করছেন, শাস্ত্র বাক্য নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করছেন। আচার্য্য বলছেন, এতে করে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হবে না। এখন কথা হচ্ছে তাহলে কি এতে কোনো উপকার নেই ? অবশ্যই আছে . শাস্ত্রপাঠ, শাস্ত্রবিষয় নিয়ে আলোচনা আমাদের ব্রহ্ম বিষয়ে একটা সাধারণ ধারণা এনে দিতে পারে। আর তা-ছাড়া, আমরা জানি যার বুদ্ধি তীক্ষ্ণ হয়নি, যার মন পবিত্র হয়নি, তার মধ্যে ব্রহ্মের জ্যোতি প্রতিফলিত হতে পারে না। এই যে শাস্ত্রপাঠ, এটি আসলে বুদ্ধির চর্চ্চা। এই বুদ্ধির চর্চ্চা অবশ্য়ই প্রয়োজন ও উপকারী, কিন্তু শাস্ত্রপাঠ শেষ কথা নয়, শাস্ত্র পাঠের সঙ্গে সঙ্গে শাস্ত্রের বিষয়ে মনন করতে হবে। তাহলে ব্রহ্মজ্ঞান লাভের পথের দিশা মিলে যেতে পারে। শুষ্ক পান্ডিত্যে কোনো লাভ নেই। পাতা-পাতা শাস্ত্র মুখস্থ করেও কোনো লাভ নেই। শাস্ত্র বাক্যকে মনের গভীরে বসিয়ে তাকে প্রতক্ষ্য করতে হবে। তবেই শাস্ত্র পাঠের সুফল মিলবে।
আচার্য্যদেব বলছেন, দেবতাদের উদ্দেশ্য যজ্ঞ করুক, আর শাস্ত্র বিহিত বিবিধ কর্ম্ম করুক, তাতে করে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হবে না। দেবতাদের উদ্দেশ্যে যজ্ঞ, অর্থাৎ শাস্ত্র বিহিত মন্ত্রাদি পাঠ করে, সমিধকাষ্ঠে আগুন জ্বেলে, ঘি-বেলপাতা পুড়িয়ে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হবে না। তাহলে কি এইসব বেদ-বিহিত কর্ম্মের কোনো ফল নেই ? না তা নয়, বেদবিহিত কর্ম্ম সুস্থ শরীরের জন্য, মনের মধ্যে যে জাগতিক কামনা-বাসনা আছে তার পূরণের জন্য, এমনকি শত্রু নিধনের জন্য অবশ্য়ই ফলপ্রদ, কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞান অর্থাৎ ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম হওয়া, এর দ্বারা সম্ভব নয়। দেবতারা হচ্ছেন ব্রহ্মের অনন্ত গুনের মধ্যে এক বা একাধিক গুনের অধিকারী। তো এই দেব-যজ্ঞ করলে, দেবতাগণ তাদের এই গুন্ অনুসারে, পার্থিব পদার্থের প্রাপ্তি ঘটিয়ে দিতে পারেন। আর এতে করে, যজমানের পার্থিব লাভ অবশ্য়ই হতে পারে। কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞান লাভের পথে কোনো দিশা দেখাতে পারে না। আসলে প্রকৃত যজ্ঞ হচ্ছে প্রাণে অপানের ও অপানে প্রাণের আহুতি প্রদান। এতে করে আমাদের মূলাধারস্থ শক্তি উদ্দীপ্ত হয়ে সুষুম্নার মধ্যস্থিত ব্রহ্মরন্ধ্র পথে উর্দ্ধগামী হয়ে সহস্রারে মিলিত হতে পারে। ব্রহ্মনুভূতির এই হচ্ছে প্রকৃত যজ্ঞ ।
আচার্য্যদেব বলছেন, ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম্যতা অনুভব না করতে পারলে, শত ব্রহ্মার আয়ুষ্কালের মধ্যেও মুক্তির কোনো সম্ভব নেই। এক ব্রহ্মার আয়ু হচ্ছে, ৪৩২,০০০,০০০ বছরে এক দিন। একজন ব্রহ্মা এমনিতর একশত বছর বেঁচে থাকেন। এর পর মহা প্রলয় শুরু হয়। তো আচার্য্য শঙ্কর বলতে চাইছেন, অনন্তকাল ধরে এই সব যজ্ঞক্রিয়া বা শুষ্ক শাস্ত্র পাঠে কোনো লাভ হবে না। মুক্তি পেতে চাইলে, ব্রাহ্মনুভূতি লাভ করতে হবে। আমরা ধীরে তাঁর কাছ থেকে শুনে নেবো, এই ব্রহ্মানুভূতি লাভের উপায়।
অমৃতত্বস্য নাশান্তি বিত্তনেত্যেব হি শ্রুতিঃ
ব্রবীতি কৰ্মণো মুক্তের হেতুত্বং স্ফুটং যতঃ (৭)
শ্রুতিতে বলা হয়েছে, বিত্তের দ্বারা, অমৃতত্ব লাভ হবে না, আবার কোনো কর্মের দ্বারাও মুক্তি লাভ হবে না। এটি স্পষ্ট করে জেনে রাখুন ।
এখানে একটা বলছেন, অমৃতত্ব - অমৃত এমন একটা পানীয়, যা পান করলে বা যা হতে মৃত্যুকে জয় করা যায়। অর্থাৎ মৃত্যহীন জীবন হচ্ছে অমৃতত্ব লাভ। আসলে অমৃতত্ব মানে অনন্তকাল স্থুল দেহে বেঁচে থাকা নয়। মৃত্যুর সঠিক অর্থটাকে বুঝতে পারা। জীবের যে মৃত্যু হয়, তা স্থুল দেহের নাশ মাত্র। কিন্তু আমি তো এই স্থুল দেহ নোই। আমি আত্মা। এই আত্মা অজর অমর - এই সত্যকে উপলব্ধি করাই অমৃতত্ব লাভ। একেই অন্য কথায় বলে মুক্তি। আমাদের দেহ কেবলমাত্র কামনা-বাসনা পূরণের জন্য একটা কর্ম্মক্ষেত্র মাত্র। এখানে অর্থাৎ এই দেহে স্থিত হয়ে, আমি নিজেকে দেহ ভেবে বসে আছি। যতক্ষন আমাদের মধ্যে থেকে এই দেহাভিমান না যাবে, ততক্ষন আমাদের মুক্তি নেই। আর দেহাভিমান তখনই চলে যেতে পারে, যখন আমাদের স্বরূপের উপলব্ধি হবে। আমি যখন নিজেকে জানতে পারবো, যখন আমার আত্মজ্ঞান হবে, তখন আমার মধ্যে এই বোধের জাগরণ হবে, যে আমি নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত আত্মা। তো আচার্য্যদেব বলছেন, বিত্তের দ্বারা অর্থাৎ ধন-সম্পত্তির দ্বারা এই অমৃতত্ব লাভের সম্ভাবনা নেই। আর বিষয় বা বিত্তের পিছনে ছুটছে মানুষ। আর এর কারন হচ্ছে, সে তার ইহকালের অভিজ্ঞতায় দেখেছে, যে বিষয়ের মধ্যে একটা সুখ আছে, বিষয়-প্রাপ্তিতে একটা আনন্দ আছে। এখন এই যে বিষয়সুখ, বা বিষয়ানন্দ এটি আসলে আনন্দের মোড়কে ঢাকা দুঃখের ভান্ডার। এই মোড়ক যখন সে খুলে ফেলে, তখন বেরিয়ে আসে নিরানন্দের দুর্গন্ধ। আর আমাদের দুঃখে দুঃখে জীবন কাটে। আমরা সুখের পিছনে ছুটে দুঃখকে ডেকে ঘরে নিয়ে আসি। আচার্য্যদেব বলছেন, বিষয় সংগ্রহের জন্য যে কর্ম্ম তুমি করছো, সেই কর্ম্ম তোমাকে মুক্তির পথ দেখাতে পারবে না। অমৃতত্ত্বের আস্বাদন করাতেও পারবে না। কিন্তু তাই বলে কি আমরা কর্ম্ম করবো না ? নিস্কর্মা, অলস হয়ে বসে থাকবো ? না তা নয়, আমাদের কর্ম্ম হবে নিরাসক্ত। অর্থাৎ বিষয়ের প্রত্যাশায় যেন কোনো কর্ম্ম না করি। কর্ম্ম হবে কর্তব্য বোধে। কর্ম্ম হবে ভূতের হিতের জন্য। সকাম কর্ম্ম কখনো সুখ দিতে পারে না। কর্ম্মে নিরাসক্ত ভাব থাকলে কর্ম্মফল সাধককে বিব্রত করতে পারে না। আমরা যে শ্বাস প্রশ্বাস ক্রিয়া করে থাকি, তার মধ্যে কোনো আসক্তির ভাব থাকে না। এমনকি যদিও এই শ্বাস প্রশ্বাস ক্রিয়াই আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখে, তথাপি এই শ্বাস প্রশ্বাস ক্রিয়া চলাকালীন, আমাদের মনের মধ্যে বেঁচে থাকবার প্রত্যাশা নিয়ে এসব ক্রিয়া সংগঠিত হয় না। আর এই নিরাসক্ত শ্বাস প্রশ্বাসক্রিয়াই পঞ্চভূতকে অর্থাৎ আমাদের শরীর গঠনের যে কারন তাকে লালন পালন করে থাকে - পুষ্টি বর্ধন করে থাকে, এবং এই পঞ্চভূতকে একসূত্রে বেঁধে রাখে। তাই নিরাসক্ত শ্বাস প্রশ্বাস ক্রিয়ারর মতো আমাদের জাগতিক সমস্ত কর্ম্মেও নিরাসক্তের ভাব আনতে হবে।
জাগতিক কর্ম্মের ফলে আমাদের বিষয় লাভ হয়ে থাকে। কিন্তু বিষয়-বৈভব মানুষকে কখনো শান্তির সন্ধান দিতে পারে না। বৃহদারণ্যক উপনিষদে এই বিষয়ে একটা সুন্দর উদাহরণএ আছে। আমাদের হিন্দু শাস্ত্রে, মনুষ্য জীবন-কালকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে ব্রহ্মচর্য্য, গার্হস্থ, বানপ্রস্থ, ও সন্ন্যাস। ঋষি যাজ্ঞবল্কের দুই স্ত্রী। কাত্যায়নী, ও মৈত্রেয়ী। তো ঋষি যাজ্ঞবল্ক ঠিক করলেন, অনেকদিন সংসার হয়েছে, এবার বানপ্রস্থ বা সন্ন্যাস গ্রহণের সময় হয়েছে। তো গৃহস্থ আশ্রম ছেড়ে যাবার আগে, দুই স্ত্রীর মধ্যে সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা করে দিতে চাইলেন। আর সেই উদ্দেশ্যে দুই স্ত্রীকে ডেকে কাছে বসালেন। সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা প্রসঙ্গ আসতেই, মৈত্রেয়ী স্বামী যাজ্ঞবল্কের কাছে জানতে চাইলেন, সম্পদের সাহায্যে কি আমি অমৃতত্ব লাভ করতে পারবো ? ঋষি যাজ্ঞবল্ক স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। পরে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে মৈত্রেয়ীকে উত্তর দিলেন, বিত্তের দ্বারা অমৃতত্বের কোনো আশা নেই। "অমৃতত্বস্য তু নাশাঽস্তি বিত্তেন ইতি" (বৃহদ - ২/৪/২৩)
তো সম্পদ লাভ করতে গেলে, অনেক পরিশ্রম করতে হয়, কর্ম্ম করতে হয়, এই কর্ম্মের দ্বারা বিষয় সম্পদ সংগ্রহ করা যেতে পারে, কিন্তু অমৃতত্ব লাভ হয় না।
-----------
অতো বিমুক্ত্যৈ প্রযতেত বিদ্বান
সংন্যাস্ত বাহ্যার্থ সুখস্পৃহঃ সন্।
সন্তং মহান্তং সমুপেত্য দেশিকং
তেনো-উপদিষ্টার্থ সমাহিতাত্মা। (৮)
৮. তাই বুদ্ধিমান ব্যক্তি, সমস্ত বাহ্য সুখ ভোগের আকাঙ্খ্যা পরিত্যাগ করে, সাধু মহাত্মাদের গুরুরূপে প্রাপ্ত হয়ে, তার উপদেশ অনুসারে, মনকে সাধনায় একাগ্র করবেন। এবং মুক্তি লাভের জন্য যত্নশীল হবেন।
৯. আত্মদর্শন নিষ্ঠা সহায়ে, যোগরূঢ় অবস্থা প্রাপ্ত হয়ে, সংসার সমুদ্রে মগ্ন আত্মাকে নিজের দ্বারা উদ্ধার করবেন। অর্থাৎ আত্মাকে জানতে গেলে, আত্মাকে উদ্ধার করতে গেলে, নিজেকেই সাধনায় লিপ্ত হতে হবে।
১০. বেদান্তের শ্রবণ, মনন, এবং ব্রহ্মজ্ঞানের সাধনায় তৎপর, উদ্বেগশূন্য, পণ্ডিত ব্যক্তিগণ, বা শাস্ত্রজ্ঞগন সমস্ত তথাকথিত সর্ব্বকর্ম ত্যাগ করে, ভব-বন্ধন থেকে মুক্তির জন্য, যত্নবান হবেন।
১১. নিষ্কাম কর্মের দ্বারা, চিত্ত শুদ্ধি হয়। কিন্তু এই নিষ্কাম কর্মের দ্বারা আত্মস্বরূপের উপলব্ধি হয় না। একমাত্র বিচারের দ্বারা বস্তুর স্বরূপের উপলব্ধি হয়। কোটি কোটি, কর্মের অনুষ্ঠানের দ্বারা কিছুমাত্র প্রয়োজন সিদ্ধ হয় না।
১২. ভ্রান্ত পুরুষের অজ্ঞানবশতঃ মহাসর্প ভয় জনিত কম্পাদি-দুঃখের নাশক রজ্জুর যথার্থ জ্ঞান যথাযথ বিচারের দ্বারা সিদ্ধ হতে পারে।
১৩. বিচারের দ্বারা হিতকরী গুরুর উক্তি হতে পদার্থের স্বরূপ জ্ঞান অনুভূত হয়। যা স্নান, দান, শত প্রাণায়ামের দ্বারা হয়। না
১৪. বিচারের যথার্থ জ্ঞান বিশেষভাবে অধিকারীকে অপেক্ষা করে। দেশ কালাদি উপায় সমূহ এতে ফল সিদ্ধি বিষয়ে সহায়ক হয়ে থাকে।
১৫. এই জন্য, জ্ঞানীশ্রেষ্ট দয়ালু গুরুকে প্রাপ্ত হয়ে জিজ্ঞাসুর আত্মবস্তুর বিচার করা উচিত।
১৬. মেধাবী বিদ্বান, প্রশ্ন-উত্তর বিজ্ঞানে চতুর বেদান্ত শাস্ত্রোক্ত, অধিকারী লক্ষ্মনযুক্ত ব্যক্তি আত্মবিদ্যা অনুশীলনে অধিকারী।
১৭. বিবেকীর বৈরাগ্যবানের শম-দম ইত্যাদি গুনযুক্তের মুমুক্ষু ব্যক্তিরই অবশ্য ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা বিষয়ে যোগ্যতা ব্রহ্মজ্ঞ গনের অভিমত।
১৮. এই আত্ম জিজ্ঞাসায় চারটি সাধন মনীষিগণ কর্তৃক কথিত হয়েছে। যে সকল থাকলে তবে আত্মনিষ্ঠা সিদ্ধ হয়। যার অভাবে সিদ্ধি হয় না।
১৯. প্রথমে, নিত্য-অনিত্য বস্তূ বিবেক গৃহীত হয়। তারপর ইহামূত্র -ফল ভোগ বিরাগ শমাদি ষট্ সম্পত্তি নিঃসন্দিগ্ধ রূপে গৃহীত হয়।
২০. ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা এই প্রকারেই নির্ধারণ সেই এই নিত্য-অনিত্য-বস্তূ বিবেক বলে গৃহীত হয়।
২১. নিজের দেহ থেকে ব্রহ্মার দেহ পর্যন্ত সমস্ত অনিত্য বস্তুর দোষ দেখা ও শোনার ফলে, মনে বিষয়ত্যাগের ইচ্ছে উৎপন্ন হয়, এই ইচ্ছেকেই বলে বৈরাগ্য।
২২. বারবার বিষয়ের দোষ দেখার ফলে, বিষয়ে বৈরাগ্য আসে, ফলে মন ব্রহ্মে স্থিত হয় - যা তার লক্ষ। একেই শম বলে।
২৩. জ্ঞান ও কর্ম ইন্দ্রিয়গুলোকে সমস্ত ভোগ্য বিষয় থেকে সরিয়ে নিয়ে ইন্দ্রিয়গুলোকে নিজ নিজ স্থানে নিশ্চল ভাবে রেখে দেওয়াকে দম বলা হয়। চিত্তবৃত্তিগুলোর বাহ্য বিষয়ের সঙ্গে একাত্মীকরন না হওয়াকে উপরতি বলে।
২৪. যতই দুঃখ আসুক না কেন, তার জন্য মনে চিন্তা-ভাবনা না করে, বা দুঃখের কথা অন্য কাউকে না বলে, এমনকি দুঃখেের প্রতিকারের জন্য কোনো রকম চেষ্টা না করে, সহ্য করে যাওয়াকে তিতিক্ষা বলে।
২৫. গুরুদেবের উপদেশ এবং শাস্ত্রের শিক্ষা যথার্থ সত্য বলে অন্তরে যখন দৃঢ়তা উৎপন্ন হয় তখন তাকে শ্রদ্ধা বলে।
২৬. সব সময়, সমস্ত ভাবে বুদ্ধিকে শুদ্ধভাবে ব্রহ্মে স্থিত করে রাখাকে সমাধান বলে। নিতান্ত কৌতূহল বশে শাস্ত্র আলোচনা করার ফলে, মনে যে তৃপ্তি লাভ হয় তাকে সমাধান বলে না।
২৭. আত্মস্বরূপের উপলব্ধি দ্বারা, সকল বন্ধন (অবিদ্যা থেকেউৎপন্ন সূক্ষ্ম অহংকার থেকে আরম্ভ করে স্থূল দেহ পর্যন্ত সমস্ত রকম বন্ধন থেকে মুক্তি লাভের ইচ্ছাকে মুমুক্ষুতা বলে।
২৮. মুক্তির ইচ্ছা কারও অল্প, কারও বা মধ্যম। কিন্তু এই মুক্তির ইচ্ছা অল্পই হোক বা মধ্যম হোক, এই সঙ্গে বৈরাগ্য, শম-দম সাধন সাহায্যে ও গুরুর কৃপায়, কালে কালে তীব্র রূপ ধারণ করে এবং আত্মসাক্ষাৎ-কার রূপ ফল প্রদান করে।
২৯. কিন্তু যে সাধকের বৈরাগ্য ও মুমুক্ষা পুরোমাত্রায় আছে সে সাধকের শম-দম সাধন সার্থক হয় মোক্ষের সহায়ক হয়।
৩০. যে সাধকের, বৈরাগ্য ও মুমুক্ষতা এই দুই সাধনে স্বল্পতা থাকে, তার পক্ষে শম-দম সাধনের চেষ্টা মরীচিকায় জলের মতো আভাস মাত্র।
৩১. মোক্ষের সাধনগুলোর মধ্যে ভক্তিই শ্রেষ্ট। নিজের স্বরূপ-চিন্তনকে ভক্তি বলে। আবার কেউ কেউ বলেন, আত্মা ও পরম-আত্মার তত্ত্ববিচারকে ভক্তি বলে।
৩২. এইরূপ সাধনসম্পন্ন মুক্তিকামী ব্যক্তি, আত্মার স্বরূপ জানতে জিজ্ঞাসু হয়ে ব্রহ্মজ্ঞ গুরুদের নিকট উপস্থিত হবেন। ব্রহ্মজ্ঞ গুরুর উপদেশে সংসার বন্ধন থেকে মুক্তি ঘটে।
গুরুর লক্ষ্মণ কি ? ব্রহ্মজ্ঞ গুরু বলতে আমরা কি বুঝি ?
৩৩. শ্রূতি শাস্ত্রে যিনি পারঙ্গম, অর্থাৎ বেদজ্ঞ , নিষ্পাপ, কামনাশূন্য, যে ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ বাহ্য় বিষয় সমূহ ত্যাগ করে, ব্রহ্মচিন্তায় মগ্ন শান্ত, জ্বলন্ত কাঠের ধোঁয়া শূন্য অগ্নির মতো তেজস্বী, অহেতুক দয়াশীল, সেই প্রণম্য সৎ-ব্যক্তি আধ্যাত্মিক জগতের বন্ধু ।
৩৪. এই রকম গুরুকে ভক্তি সহকারে, প্রণাম করে, সেবাদ্বারা সন্তুষ্ট করে, নম্রভাবে, নিজের জ্ঞাতব্য বিষয় নিবেদন করবেন।
৩৫. প্রনামকারীর হিতকারী দয়াসিন্ধু হে প্রভু,আপনার সরল করুনা, অমৃতধারা বর্ষণকারী স্নিগ্ধ কৃপা দ্বারা সংসারে পতিত আমাকে উদ্ধার করুন।
প্রথম দুদিনের আলোচনায় আমরা কি পেলাম একবার দেখে নেই।
১. গুরুপ্রণাম ও পরম-ঈশ্বরকে প্রণাম দিয়ে শুরু।
২.মনুষ্যজন্ম ; পুরুষকার ; জ্ঞান ; বিচার ; এবং একাত্মবোধ।
৩. ভিতরে একটা আধ্যাত্মিক ক্ষুধা তৈরি করা।
৪. গুরুর খোঁজ ও গুরুসেবা ;
৫. প্রশ্ন অর্থাৎ জানবার আগ্রহ।
১২. ভ্রান্ত পুরুষের অজ্ঞানবশতঃ মহাসর্প ভয় জনিত কম্পাদি-দুঃখের নাশক রজ্জুর যথার্থ জ্ঞান যথাযথ বিচারের দ্বারা সিদ্ধ হতে পারে।
১৩. বিচারের দ্বারা হিতকরী গুরুর উক্তি হতে পদার্থের স্বরূপ জ্ঞান অনুভূত হয়। যা স্নান, দান, শত প্রাণায়ামের দ্বারা হয়। না
১৪. বিচারের যথার্থ জ্ঞান বিশেষভাবে অধিকারীকে অপেক্ষা করে। দেশ কালাদি উপায় সমূহ এতে ফল সিদ্ধি বিষয়ে সহায়ক হয়ে থাকে।
১৫. এই জন্য, জ্ঞানীশ্রেষ্ট দয়ালু গুরুকে প্রাপ্ত হয়ে জিজ্ঞাসুর আত্মবস্তুর বিচার করা উচিত।
১৬. মেধাবী বিদ্বান, প্রশ্ন-উত্তর বিজ্ঞানে চতুর বেদান্ত শাস্ত্রোক্ত, অধিকারী লক্ষ্মনযুক্ত ব্যক্তি আত্মবিদ্যা অনুশীলনে অধিকারী।
১৭. বিবেকীর বৈরাগ্যবানের শম-দম ইত্যাদি গুনযুক্তের মুমুক্ষু ব্যক্তিরই অবশ্য ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা বিষয়ে যোগ্যতা ব্রহ্মজ্ঞ গনের অভিমত।
১৮. এই আত্ম জিজ্ঞাসায় চারটি সাধন মনীষিগণ কর্তৃক কথিত হয়েছে। যে সকল থাকলে তবে আত্মনিষ্ঠা সিদ্ধ হয়। যার অভাবে সিদ্ধি হয় না।
১৯. প্রথমে, নিত্য-অনিত্য বস্তূ বিবেক গৃহীত হয়। তারপর ইহামূত্র -ফল ভোগ বিরাগ শমাদি ষট্ সম্পত্তি নিঃসন্দিগ্ধ রূপে গৃহীত হয়।
২০. ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা এই প্রকারেই নির্ধারণ সেই এই নিত্য-অনিত্য-বস্তূ বিবেক বলে গৃহীত হয়।
২১. নিজের দেহ থেকে ব্রহ্মার দেহ পর্যন্ত সমস্ত অনিত্য বস্তুর দোষ দেখা ও শোনার ফলে, মনে বিষয়ত্যাগের ইচ্ছে উৎপন্ন হয়, এই ইচ্ছেকেই বলে বৈরাগ্য।
২২. বারবার বিষয়ের দোষ দেখার ফলে, বিষয়ে বৈরাগ্য আসে, ফলে মন ব্রহ্মে স্থিত হয় - যা তার লক্ষ। একেই শম বলে।
২৩. জ্ঞান ও কর্ম ইন্দ্রিয়গুলোকে সমস্ত ভোগ্য বিষয় থেকে সরিয়ে নিয়ে ইন্দ্রিয়গুলোকে নিজ নিজ স্থানে নিশ্চল ভাবে রেখে দেওয়াকে দম বলা হয়। চিত্তবৃত্তিগুলোর বাহ্য বিষয়ের সঙ্গে একাত্মীকরন না হওয়াকে উপরতি বলে।
২৪. যতই দুঃখ আসুক না কেন, তার জন্য মনে চিন্তা-ভাবনা না করে, বা দুঃখের কথা অন্য কাউকে না বলে, এমনকি দুঃখেের প্রতিকারের জন্য কোনো রকম চেষ্টা না করে, সহ্য করে যাওয়াকে তিতিক্ষা বলে।
২৫. গুরুদেবের উপদেশ এবং শাস্ত্রের শিক্ষা যথার্থ সত্য বলে অন্তরে যখন দৃঢ়তা উৎপন্ন হয় তখন তাকে শ্রদ্ধা বলে।
২৬. সব সময়, সমস্ত ভাবে বুদ্ধিকে শুদ্ধভাবে ব্রহ্মে স্থিত করে রাখাকে সমাধান বলে। নিতান্ত কৌতূহল বশে শাস্ত্র আলোচনা করার ফলে, মনে যে তৃপ্তি লাভ হয় তাকে সমাধান বলে না।
২৭. আত্মস্বরূপের উপলব্ধি দ্বারা, সকল বন্ধন (অবিদ্যা থেকেউৎপন্ন সূক্ষ্ম অহংকার থেকে আরম্ভ করে স্থূল দেহ পর্যন্ত সমস্ত রকম বন্ধন থেকে মুক্তি লাভের ইচ্ছাকে মুমুক্ষুতা বলে।
২৮. মুক্তির ইচ্ছা কারও অল্প, কারও বা মধ্যম। কিন্তু এই মুক্তির ইচ্ছা অল্পই হোক বা মধ্যম হোক, এই সঙ্গে বৈরাগ্য, শম-দম সাধন সাহায্যে ও গুরুর কৃপায়, কালে কালে তীব্র রূপ ধারণ করে এবং আত্মসাক্ষাৎ-কার রূপ ফল প্রদান করে।
২৯. কিন্তু যে সাধকের বৈরাগ্য ও মুমুক্ষা পুরোমাত্রায় আছে সে সাধকের শম-দম সাধন সার্থক হয় মোক্ষের সহায়ক হয়।
৩০. যে সাধকের, বৈরাগ্য ও মুমুক্ষতা এই দুই সাধনে স্বল্পতা থাকে, তার পক্ষে শম-দম সাধনের চেষ্টা মরীচিকায় জলের মতো আভাস মাত্র।
৩১. মোক্ষের সাধনগুলোর মধ্যে ভক্তিই শ্রেষ্ট। নিজের স্বরূপ-চিন্তনকে ভক্তি বলে। আবার কেউ কেউ বলেন, আত্মা ও পরম-আত্মার তত্ত্ববিচারকে ভক্তি বলে।
৩২. এইরূপ সাধনসম্পন্ন মুক্তিকামী ব্যক্তি, আত্মার স্বরূপ জানতে জিজ্ঞাসু হয়ে ব্রহ্মজ্ঞ গুরুদের নিকট উপস্থিত হবেন। ব্রহ্মজ্ঞ গুরুর উপদেশে সংসার বন্ধন থেকে মুক্তি ঘটে।
গুরুর লক্ষ্মণ কি ? ব্রহ্মজ্ঞ গুরু বলতে আমরা কি বুঝি ?
৩৩. শ্রূতি শাস্ত্রে যিনি পারঙ্গম, অর্থাৎ বেদজ্ঞ , নিষ্পাপ, কামনাশূন্য, যে ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ বাহ্য় বিষয় সমূহ ত্যাগ করে, ব্রহ্মচিন্তায় মগ্ন শান্ত, জ্বলন্ত কাঠের ধোঁয়া শূন্য অগ্নির মতো তেজস্বী, অহেতুক দয়াশীল, সেই প্রণম্য সৎ-ব্যক্তি আধ্যাত্মিক জগতের বন্ধু ।
৩৪. এই রকম গুরুকে ভক্তি সহকারে, প্রণাম করে, সেবাদ্বারা সন্তুষ্ট করে, নম্রভাবে, নিজের জ্ঞাতব্য বিষয় নিবেদন করবেন।
৩৫. প্রনামকারীর হিতকারী দয়াসিন্ধু হে প্রভু,আপনার সরল করুনা, অমৃতধারা বর্ষণকারী স্নিগ্ধ কৃপা দ্বারা সংসারে পতিত আমাকে উদ্ধার করুন।
প্রথম দুদিনের আলোচনায় আমরা কি পেলাম একবার দেখে নেই।
১. গুরুপ্রণাম ও পরম-ঈশ্বরকে প্রণাম দিয়ে শুরু।
২.মনুষ্যজন্ম ; পুরুষকার ; জ্ঞান ; বিচার ; এবং একাত্মবোধ।
৩. ভিতরে একটা আধ্যাত্মিক ক্ষুধা তৈরি করা।
৪. গুরুর খোঁজ ও গুরুসেবা ;
৫. প্রশ্ন অর্থাৎ জানবার আগ্রহ।
সংসার বন্ধন থেকে মুক্তি লাভের উপায় (১)- বিবেক চূড়ামণি - আচার্য্য শংকর।
সংসার বন্ধন আবার সংসারের বন্ধন বলে একটা কথা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। সংসারের এই বন্ধন নাকি মানুষকে দুঃখ-কষ্ট ভোগ করাচ্ছে। আমরা মাঝে মধ্যে জানতে ইচ্ছে করে, কি সেই অদৃশ্য বন্ধন যা মানুষকে এই সংসারে বেঁধে রেখেছে ? সংসার বন্ধন আর কিছুই হয়, সংসার বন্ধন হচ্ছে পঞ্চভূত বা পঞ্চ তন্মাত্রের আকর্ষণ।
দেখুন মানুষ তো ছাড় স্বয়ং ভগবান রামচন্দ্র নাকি সোনার হরিণের আকর্ষনে আকৃষ্ট হয়ে, সীতাকে হারিয়ে বনে বনে কেঁদে বেরিয়েছিলেন । আর অন্যদিকে শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির সুরে আকৃষ্ট হয়ে গোপীগন নাকি স্বামী-সংসার ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েছিলো । তো একজন রূপের মোহে গভীর জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে মরছেন, আর একদল সুরে মোহিত হয়ে দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে বুঁদ হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে খুঁজছেন ।
মহাত্মা শঙ্কর একটা সত্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, বলছেন, হরিণ বাঁশির ধ্বনিতে আকৃষ্ট হয়ে, অর্থাৎ শব্দে আকৃষ্ট হয়ে ব্যাধের ফাঁদে পড়ে প্রাণ হারায়। হাতি স্পর্শসুখের আশায় কুনকে হাতির আকর্ষনে প্রান হারায়। পোকা আগুনের রূপে মুগ্ধ হয়ে, আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ হারায়। মাছ মাংসের আস্বাদের লোভে বঁড়শী গিলে খেয়ে প্রাণ হারায়, ভ্রমর পদ্মের মধুর গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে পদ্মকে ছাড়তে চায় না। সন্ধ্যাকালে, পদ্ম যখন তার পাপড়িকে মুদ্রিত করে, তখন পাপড়ির মধ্যেই আটকা পড়ে, প্রাণ হারায় ভ্রমর । আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, দেখুন কেউ রূপের লোভে, কেউ গন্ধের আকর্ষনে, কেউ সুরের আকর্ষনে, কেউ রসের লোভে, কেউ স্পর্শ লাভের আশায় নিজের জীবনকে বিপন্ন করছে। আর সেখানে মানুষ এই পাঁচটা ইন্দ্রিয় বা পাঁচটি গুনের অর্থাৎ শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধের দাস। তা হলে মানুষের কি দুর্গতি হতে পারে, একবারটা ভাবুন।
কিন্তু কথা হচ্ছে, এখন থেকে আমরা বেরুবো কি করে ?
আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, রোগ থেকে আরোগ্যলাভের জন্য যেমন নিজেকে ঔষধাদি সেবন করতে হয়, তেমনি এই ভববন্ধন থেকে অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গুলো থেকে মুক্তি লাভের জন্য উপযুক্ত সাধন প্রক্রিয়া যেমন করতে হবে তেমনি সাধনার সাথে আমাদের বিচারশীল হতে হবে । তবেই আমরা মুক্তির পথ খুঁজে পাবো। (৬৬)
আত্মতত্ত্ব জানবার জন্য প্রথমে যেটা দরকার সেটা হচ্ছে একটা জিজ্ঞাসু মন, একটা বিচারশীল মন। যার মনে কখনো প্রশ্ন জাগেনি তার পক্ষে আত্মতত্ত্ব জানবার সন্ধান-ক্রিয়া শুরু হতে পারে না। আর এই সন্ধানী মন যখন শ্রীগুরুর কাছে উপস্থিত হয়, তখন গুরুর উপদেশে জিজ্ঞাসু মন মুক্তির পথে অগ্রসর হতে পারে। আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, অনিত্য বস্তুতে তীব্র বৈরাগ্য, হচ্ছে প্রধান, এর পরে শম. দম, তিতিক্ষা ও শ্রুতিবিহিত সকাম কর্ম্মত্যাগ এই হচ্ছে সংসার বন্ধন থেকে মুক্তি লাভের - সাধন চতুষ্টয়। (৬৯)
আচার্য্যদেব বলছেন, প্রথমে গুরুমুখে আত্মার স্বরূপ ও মহাবাক্য শ্রবণ, তারপর সেই শ্রুতি বাক্যের মনন, এর পরে দীর্ঘকাল ধরে ধারাবাহিক ভাবে আত্ম স্বরূপের ধ্যান। এরফলে বিচারশীল সাধক আত্মস্বরূপের উপলব্ধি করে জীবন সার্থক করতে পারেন। (৭০)
এখন কথা হচ্ছে, কোনটা আত্মা আর কোনটা আত্মা নয়, অর্থাৎ অনাত্মা কোনটি তা কিভাবে বুঝবো ?
আচার্য্য দেব, বলছেন, (৭৪) দেখো সাতটি ধাতুর তৈরী এই শরীর। এগুলো হচ্ছে, অস্থি, চর্ম্ম, চর্বি, মাংস, মজ্জা ও রক্ত। এই হচ্ছে সাতটি ধাতু। আবার দেখো মাথা, বুক, পিঠ, হাত, পা, উরু - এসব হচ্ছে শরীরের অঙ্গ বা উপাঙ্গ। পন্ডিতগণ একেই স্থুল শরীর বলে থাকেন।
এখন এই যে স্থুল দেহ, তা কি দিয়ে তৈরী হয়েছে ? এই স্থুল দেহ পঞ্চভূতের তৈরী। এই স্থুল শরীরের মধ্যে আছে, পঞ্চভূত অর্থাৎ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। মানুষের এই স্থুল শরীরেই নিজেকে ব্রাহ্মণ-শুদ্র, জ্ঞানী-আজ্ঞানী, ভালো মন্দ, ইত্যাদির জ্ঞান হচ্ছে। এখন কথা হচ্ছে, এই যে পঞ্চভূত, এর রসায়নটা কি ? এই পঞ্চভূতের মধ্যে কি আছে ? এই পঞ্চভূতের মধ্যে আছে পঞ্চ তন্মাত্র। অর্থাৎ পঞ্চভূতের গভীরে যদি প্রবেশ করা যায়, তবে আমরা এর মধ্যে সন্ধান পেতে পারি, পঞ্চ তন্মাত্রের । এই পঞ্চ তন্মাত্র ব্যাপারটা কি ? এই পঞ্চ তন্মাত্র হচ্ছে - শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ। এই পঞ্চ তন্মাত্র দিয়েই তৈরী হয়েছে পঞ্চভূত। এই পঞ্চভূত স্থুল। আর পঞ্চ তন্মাত্র হচ্ছে সূক্ষ্ম। একেই বলে পঞ্চভূতের সূক্ষ্মতম অংশ বা গুন্।
পঞ্চভূতের সূক্ষ্মতম অংশ অর্থাৎ তন্মাত্র পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে স্থুল পঞ্চভূতের সৃষ্টি হয়েছে। আবার পঞ্চভূতের যে সূক্ষ্মতম অংশ বা তার যে গুন্ অর্থাৎ শব্দ স্পর্শ রূপ রস গন্ধ - তাকে যিনি উপভোগ করছে, তিনি হচ্ছেন জীবাত্মা। অর্থাৎ জীবাত্মাই রূপ-রস-গন্ধ ইত্যাদির ভোক্তা। এই যে সূক্ষ্মতম ভূত - বা পঞ্চভূতের গুন্স-মূহ একে তন্মাত্র নামে ডাকা হয়। যেমন আকাশের তন্মাত্র বা গুন্ হচ্ছে শব্দ। বায়ুর তন্মাত্র বা গুন হচ্ছে স্পর্শ, অগ্নির তন্মাত্র বা গুন হচ্ছে রূপ, জলের তন্মাত্র বা গুন্ হচ্ছে রস, এবং ক্ষিতির তন্মাত্র বা গুন্ হচ্ছে গন্ধ। এই তন্মাত্র গুলো পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে স্থুলভূতের সৃষ্টি করে থাকে। এই যে পঞ্চ তন্মাত্রের মিশ্রণ প্রক্রিয়া তার একটা মাত্রা আছে।
যেমন ক্ষিতি হচ্ছে অর্দ্ধেক ক্ষিতি-তন্মাত্র অর্থাৎ গন্ধ, আর অন্য-তন্মাত্র গুলো থেকে ১/৮ অংশ করে নিয়ে ক্ষিতি।
ঠিক তেমনি অপ বা স্থুলজলে আছে, অর্দ্ধেক রস বাকি অর্ধেক হচ্ছে অন্য তন্মাত্রের ১/৮ ভাগ করে ।
তেজে বা অগ্নিতত্ত্বে আছে অর্ধেক রূপ বাকি অর্দ্ধেক অন্য তন্মাত্রের ১/৮ ভাগ করে।
মরুৎ বা বায়ুতত্ত্বে আছে অর্দ্ধেক স্পর্শ বাকি অর্দ্ধেক অন্য তন্মাত্রের ১/৮ ভাগ করে।
আকাশ তত্ত্বে আছে অর্দ্ধেক শব্দ বাকি অর্দ্ধেক অন্য তন্মাত্রের ১/৮ ভাগ করে।
এই তন্মাত্রের মিশ্রণ-মাত্রা বা পঞ্চীকরন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আরো একবার শুনে নেই।
কোনো সূক্ষ্ম-তত্ত্বের অর্ধেক অংশের সাথে অবশিষ্ট চারটি ভূতের প্রত্যেকটি থেকে ১/৮ অংশ মিলিত হলে, যে সূক্ষ্ম ভূতের অর্ধাংশ এতে গৃহীত হয়েছে তাকে সেই নামের স্থুলভূত বলা হয়। যেমন ধরুন সূক্ষ্ম ক্ষিতি ১/২. সূক্ষ্ম জল ১/৮, সূক্ষ্ম অগ্নি ১/৮, সূক্ষ্ম বায়ু ১/৮, সূক্ষ্ম আকাশ ১/৮ এই মিলে হলো স্থুল ক্ষিতি। এই যে মিশ্রণ প্রক্রিয়া একে বেদান্ত বলে থাকে পঞ্চীকরন।
তাহলে আমাদের এই স্থুল দেহটা হচ্ছে, একঅর্থে ভোগের মাধ্যম। আর এই ভোগ হচ্ছে শব্দ, স্পর্শ,রূপ, রস, গন্ধ। আর এর ভোক্তা হচ্ছেন জীবাত্মা। এই কথাটা আমাদের ভালো করে খেয়াল করতে হবে, যে ভোক্তা হচ্ছেন জীবাত্মা যা আসলে পরমাত্মার অংশবিশেষ বা প্রতিফল মাত্র । এই দেহের মধ্যে যে ইন্দ্রিয়সকল আছে, তার মাধ্যমে মন বিষয়কে সংগ্রহ করছে, আর জীবাত্মা এগুলোকে ভোগ করছেন । আর এই ভোগেচ্ছা থেকেই জীবাত্মা দেহ থেকে দেহান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন । এখন কথা হচ্ছে, একদেহ থেকে আর এক দেহে যাবার দরকারটা কি ? এখানে অর্থাৎ একদেহে থেকেই তো জীবাত্মা ভোগ সম্পাদন করতে পারতেন । দেখুন এই যে স্থুল দেহ, এটি প্রকৃতির নিয়মে বাঁধা। আর প্রকৃতি সবসময় অস্থির। প্রকৃতি পরিণতি বাচক। প্রকৃতি এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকতে পারে না। প্রকৃতি সবসময় পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। তো এই স্থুল শরীর যেহেতু প্রকৃতির দান, তাই প্রকৃতি তার স্বভাব বসেই দেহকে তার পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে চলেছে। আর একসময় এই দেহ আর জীবাত্মার বাসনা ভোগের সহায়ক হতে পরে না। একসময় চোখের দৃষ্টি কমে আসে, কানের শ্রবণ ক্ষমতা কমে আসে। চলন ক্ষমতা, বাকশক্তি কমে আসে, ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন জীবাত্মা আর এই দেহে স্থিত থাকতে চান না। কেননা তার উদ্দেশ্য হচ্ছে ভোগ সাধন। তো ভোগসাধন যে দেহে থেকে করা সম্ভব নয়, সেখানে থেকে তার উদ্দেশ্য সাধিত হয় না। কিন্তু জীবাত্মার বাসনার তো শেষ হয় না , তাই সে তার বাসনা পূরণের জন্য, দেহ থেকে দেহান্তরে ঘুরে বেড়ায়। তো এই দেহান্তর প্রক্রিয়াকে স্তব্ধ করতে গেলে, জীবাত্মার মধ্যে যে বাসনা আছে তাকে নিবৃত্ত করতে হবে।
মহাত্মা শঙ্কর বলছেন, মূঢ় ব্যক্তি আসক্তির বসে বিষয়ভোগে প্রমত্ত হয়ে স্ব-স্ব কর্ম্মফল দ্বারা পরিচালিত হয়ে কখনো বা পশু, কখনো কীটপতঙ্গ, কখনো মনুষ্য যোনিতে জন্ম গ্রহণ করে থাকে। কখনো সে স্বর্গসুখ ভোগ করে আবার কখনো বা নরক যন্ত্রনা ভোগ করে। এইভাবে জীব জন্ম-মৃত্যুরূপ সংসারদুঃখ ভোগ করে চলেছে।
এখন আমরা একটু পুরোনো কথা শুনে নেই। আমাদের এই দেহ শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ এই পাঁচটি ভোগ সম্পাদন করছে। আর জীবাত্মা এই পাঁচভোগের নিমিত্ত আসছে, যাচ্ছে।
এই বিষয়কে সহজে ত্যাগ করা যায় না এ কথা সত্য। কিন্তু এই বিষয়ভোগের আশা যিনি ত্যাগ করতে পারছেন, তিনিই মুক্তি বা মোক্ষলাভের অধিকারী হতে পারেন। এই ভোগাকাঙ্খ্যাই মানুষের মুক্তিলাভের বাধা। অনেকে ভাবেন, অল্প-বিস্তর ভোগ চলুক, আবার একটু আধটু বৈরাগ্য আসুক, একটু আধটু সাধনক্রিয়া করি তাহলে নিশ্চই ধীরে ধীরে আমাদের উন্নতি হবে। একদিন হয়তো মুক্তিপথের সন্ধান পাওয়া যাবে। দেখুন, মুক্তি পথের দিশারীর কাছে ভোগাকাঙ্খ্যা হচ্ছে সেই কুমির, যে আপনাকে সমুদ্রে টেনে নিয়ে যাবে, কিন্তু কখনো অন্য পাড়ে পৌঁছে দেবে না। কুমিরকে ধরে কখনো নদী পাড় হওয়া যায় না। কুমির ছেড়ে নৌকা ধরুন ভোগ ছেড়ে গুরু ধরুন। আচার্য্য শঙ্কর বলছেন (৭৭) রূপ-রস ইত্যাদি বিষয়সমূহই আমাদের রাগ-দ্বেষ ইত্যাদি উৎপত্তির কারন হয়ে থাকে। চক্ষু দ্বারা দৃষ্ট দৃশ্য, কর্ন দ্বারা শ্রুত শব্দ, নাসিকা দ্বারা গ্রাহ্য গন্ধ, জিহ্বাদ্বারা আস্বাদিত রস, ত্বক দ্বারা গৃহীত স্পর্শ - এই যে পাঁচ ইন্দ্রিয় দ্বারা বিষয় অনুভব একেই বলা হয় সংসার বন্ধন, একে ত্যাগ করতে পারলেই মুক্তি। আর এই অজ্ঞান আমরা যোগসাধনা ও বিচারের দ্বারা দূর করতে পারি। তবেই আমাদের সংসার থেকে মুক্তি পেতে পারি। ধীরে ধীরে আমরা সেই আলোচনা আচার্য্য শঙ্করের কাছ থেকে শুনবো।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
সংসার বন্ধন থেকে মুক্তিলাভের উপায় (২)- বিবেক চূড়ামণি - আচার্য্য শংকর।
আলোচনা একটু দীর্ঘ হবে, ধৈর্য্য ধরে শুনতে হবে। যারা আগের আলোচনাগুলো শোনেননি, তাদেরকে বলি আগের আলোচনা শুনলে, হয়তো বিষয়টি পরিষ্কার হতে পারে। নিচে লিঙ্ক দেওয়া হলো।
আমরা শুনছিলাম বিবেকচূড়ামনি গ্রন্থ থেকে। বিবেকচূড়ামনি গ্রন্থ আসলে ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের অধ্যয়নের বিষয়। এই বই শ্রীমদ্ভগবৎ গীতার মতো সার্ব্বজনীন গ্রন্থ নয়। আপনি সমস্ত লোকের বাড়িতে একটা করে শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা পেয়ে যেতে পারেন, কিন্তু বিবেকচূড়ামনি হাজারে একজনের কাছে পাবেন কিনা সন্দেহ। এর কারন হচ্ছে, এই গ্রন্থের বিষয় আস্বাদন করতে গেলে, আগে অধিকারী হতে হয়। আচার্য্য শঙ্কর বোধ হয়, এই কারণেই গ্রন্থের প্রথমেই বলেছেন, ব্রাহ্মণপুরুষ এই বিদ্যার অধিকারী। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ ব্যাতিত অন্য কেউ, এমনকি সমগ্র নারীজাতি (অর্থাৎ স্বল্পবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ, যাঁদের জীবনে শুধু সেবা আর স্নেহ করা কিছু নেই ) এই গ্রন্থ পাঠ করে বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে পারবেন না। কিন্তু কৌতূহল যাবে কোথায় ? তাই আমাদের মতো অজ্ঞান এই গ্রন্থের সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। জ্ঞানের আলো তো অজ্ঞানের ঘরেই প্রকৃত কদর পেতে পরে, জ্ঞানের আলো অজ্ঞানের ঘরেই শোভা বর্দ্ধিত করতে পারে।
যাইহোক, আমাদের আলোচ্য বিষয় ছিলো সংসার বন্ধন থেকে কিভাবে মুক্তি পাওয়া যাবে। আগের দিন শুনেছিলাম, সংসার সমুদ্র পার হতে গিয়ে আমরা যদি স্বল্প-বৈরাগ্যের উপরে নির্ভর করি, তা হবে, কুমীরের গলা ধরে সমুদ্র পার হবার মতো। কুমীর আপনাকে গলা কামড়ে ধরে গভীর জলে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু কখনও আপনাকে সমুদ্রের পারে নিয়ে যেতে পারবে না।
আচার্য্য শংকর বলছেন, বৈরাগ্যরূপ তরবারির আঘাতে বিষয়রূপ কুমীরকে বিনাশ করতে হবে। বিষয়ভোগের ইচ্ছেকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে। আসলে তারাই নির্বোধ যারা বিষয়ভোগে লিপ্ত থেকে দুঃখকে ডেকে আনছেন। দেখুন মৃত্যু আপনার ছায়ার মতো সঙ্গে সঙ্গেই আসছে। একমাত্র বিচারের সাহায্যেই অর্থাৎ শুদ্ধবুদ্ধির সাহায্যে বিচার করে মৃত্যুকে জয় করে জীবনমুক্তি প্রাপ্ত হওয়া যেতে পারে। প্রথমে আচার্য্যদেবের এই মহাবাক্যের উপরে আপনাকে দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে।
আমরা যখন ঋষি অষ্টাবক্রের কথা শুনছিলাম, তখন জেনেছি, মুক্তির লাভের আকাংখ্যা যদি থাকে, তবে বিষয়কে বিষের মতো পরিত্যাগ করতে হবে। আর কিছু সদগুণের অনুশীলনীর অভ্যাস করতে হবে। এই সদ্গুণগুলো হচ্ছে, সন্তোষ, দয়া, ক্ষমা, সরলতা, শম, ও দম। দেহাদিতে আমি-আমার বোধ ত্যাগ করতে হবে। "আমি-আমার" বোধ আসলে অজ্ঞান ছাড়া কিছু নয়। একটা জিনিস জানবেন, এইযে স্থুল দেহ, এটি প্রাণের অনুপস্থিতেই কুকুর শৃগালের ভোজনদ্রব্যে পরিণত হয়ে যাবে। আসলে যারা দেহাভিমানী, যারা শরীরের পালন-পোষণে বেশি গুরুত্ত্ব দেন, তারা আসলে কুমীরকে কাঠ ভেবে, সেই কুম্ভীর-কাষ্ঠ ধরে ভবনদী পার হতে চাইছেন।
যারা আমি-আমার জ্ঞান ক'রে, সবার তৃপ্তি সাধন ক'রে মুক্তি লাভের অলীক কল্পনা করছেন, তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন, আর বারবার জন্ম-মৃত্যুর সম্মুখীন হচ্ছেন। আর যিনি মোহকে ত্যাগ করতে পেরেছেন, দেহাদিতে আসক্তির সম্পূর্ণ নাশ করতে পেরেছেন, একমাত্র তিনিই মুক্তি লাভের অধিকারী হতে পারেন। মহাত্মা শঙ্কর বলছেন, নিজের দেহ ও স্ত্রী-পুত্র-গৃহাদিতে আসক্তি ও মোহ ত্যাগ করে সেই সর্ব্বব্যাপী পরমাত্মার স্বরূপের ধ্যান করুন।
এই সত্য উপলব্ধি করবার চেষ্টা করুন, একটু ভাবুন, এই যে স্থুল দেহ, এটি একটি রক্ত, মাংস, ত্বক, স্নায়ু, মেদ, মজ্জা, অস্থির সমন্বয় মাত্র। এর মধ্যে আছে মল-মূত্র - যা আসলে ঘৃনার বস্তু। আর এই ঘৃণিত বস্তুর উপরেই অজ্ঞানীর আকর্ষণ হয়ে থাকে। এই দেহাসক্তি ত্যাগ করে বৈরাগ্য উৎপাদনের চেষ্টা করুন।
আমরা আগেই শুনেছি, পঞ্চীকৃত স্থুল ভূত সমূহের সমবায়ে জীবের পূর্ব-পূর্ব-জন্মের কর্ম্ম অনুসারে এই ভোগ-দেহ উৎপন্ন হয়েছে। আর এই দেহাভিমান-ই জীবের জাগ্রত অবস্থা। জীব এই স্থুল শরীরকে আশ্রয় করেই বিষয়ভোগ করছে। আর এই কারণেই জাগ্রত অবস্থায় সে এই স্থুল দেহের প্রাধান্য দিয়ে থাকে।
আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, গৃহস্থ যেমন গৃহে বাস ক'রে গার্হস্থ ধর্ম্ম পালন করে, জীব তেমনি এই স্থুল শরীরকে আশ্রয় করে স্থুল ভোগ্য পদার্থ উপভোগ করে থাকে। আর এই স্থুল দেহের ধর্ম্মই হচ্ছে জন্ম-জরা-মৃত্যু। এই স্থুল দেহ, কখনও সুস্থ কখনো অসুস্থ, কখনও শৈশব, কখনো যৌবনের অবস্থা প্রাপ্ত হচ্ছে । এই দেহেই পালিত হয়, জরা-ব্যাধি-মৃত্যু। এই দেহেই আছে মান-অপমান বোধ । এই দেহকে আশ্রয় করেই জীব, সুখ-দুঃখ ভোগ করে থাকে।
এই স্থুল দেহ ছাড়াও আছে জীবের সূক্ষ্ম দেহ। আমাদের আছে ৫টি জ্ঞানেন্দ্রিয় - চক্ষু, কর্ন, নাসিকা জিহবা, ত্বক। এই জ্ঞানেন্দ্রিয়-সকল দ্বারা আমরা শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস গন্ধ ইত্যাদির জ্ঞান লাভ করে থাকি। তাই একে জ্ঞানেন্দ্রিয় বলা হয়। এছাড়া আছে ৫টি কর্ম্মেন্দ্রিয় - হাত, পা, মুখ, পায়ু (মলদ্বার), উপস্থ (জননেন্দ্রিয়) . এগুলো আমাদের বাহ্য ইন্দ্রিয়। এই বাহ্য ইন্দ্রিয় এছাড়াও আছে আমাদের অন্তরেন্দ্রিয়। এগুলো হচ্ছে মন, বুদ্ধি, অহংকার ও চিত্ত। অন্তঃকরণ যখন সংকল্প-বিকল্প করে, তখন তাকে বলা হয়, মন। কোনো বস্তুকে যার দ্বারা নিশ্চয় করা হয়, তাকে বলা হয় বুদ্ধি, আর দেহাদিতে যখন "আমি-আমার" বলে অভিমান প্রকাশ হয়, তখন তাকে বলে অহঙ্কার। সবশেষে নিজের সুখদায়ক বস্তুর যখন চিন্তা হয়, তখন তাকে বলে চিত্ত। তো অন্তরেন্দ্রিয় - চার, জ্ঞানেন্দ্রিয় - পাঁচ, আর কর্ম্মেন্দ্রিয় পাঁচ - এই মোট ১৪টি ইন্দ্রিয়।
আবার এই স্থুল দেহের অভ্যন্তরে আছে প্রাণবায়ু। এই প্রাণবায়ু বৃত্তিভেদে পাঁচ প্রকার - প্রাণ, অপান ব্যান, উদান, সমান। এই পঞ্চবায়ুর কর্ম্মক্ষেত্ৰ নির্দিষ্ট আছে, যেমন - প্রাণবায়ুর কর্ম্মস্থান হৃদয়ে, অপানবায়ুর কর্ম্মস্থল মলনালীতে, সমান বায়ুর কর্ম্ম স্থান নাভিতে, উদানবায়ুর কর্ম্ম স্থান কণ্ঠদেশে আর সবশেষে ব্যানবায়ুর কর্ম্মক্ষেত্ৰ সমস্ত দেহে।
তো এইযে পাঁচ কর্ম্মেন্দ্রিয়, পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পাঁচ বায়ু, এছাড়া পঞ্চমহাভূত, অন্তঃকরণের চারিভেদ,
( মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহঙ্কার), অবিদ্যা, কাম ও কর্ম্ম এই মোট আটটি (কর্ম্মেন্দ্রিয়, জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চবায়ু, পঞ্চমহাভূত, অন্তঃকরণ, অবিদ্যা, কাম, কর্ম্ম) সূক্ষ্ম অবস্থায় যে পুরীতে বাস করে তাকে বলা হয়, সূক্ষ্ম শরীর। এই সূক্ষ্ম শরীরকেই আবার লিঙ্গ শরীর বলা হয়ে থাকে। তার কারন, জীবের সমস্ত কর্ম্মসমূহ এই সূক্ষ্ম শরীরে লীন হয়ে থাকে, তাই একে লিঙ্গশরীর নাম দেওয়া হয়েছে। এই লিঙ্গ শরীর পঞ্চীকৃত নয়, (পঞ্চীকরন সম্পর্কে আমার আগেই শুনেছি) এই শরীর অ-পঞ্চীকৃত মহাভূতের সমবায়ে গঠিত হয়ে থাকে। এই সূক্ষ্ম শরীরই জীবের বাসনাযুক্ত , কর্ম্মফলের উৎপাদক, এবং স্ব-স্বরূপের জ্ঞানের অভাব বশত জীবের অনাদি উপাধি। (৯৭) আমাদের স্মৃতি, বাসনা এই লিঙ্গশরীরেই বর্তমান থাকে।
এই সূক্ষ্ম শরীরের ব্যাপারটা আমরা আরো একটু ভালোভাবে বুঝে নেবার চেষ্টা করবো। প্রথমত অ-পঞ্চীকৃত পঞ্চভূত হচ্ছে এই সূক্ষ্ম শরীরের উপাদান। পঞ্চীকরন নিয়ে আলোচনার সময় আমরা শুনেছি যে - কোনো সূক্ষ্ম-তত্ত্বের অর্ধেক অংশের সাথে অবশিষ্ট চারটি ভূতের প্রত্যেকটি থেকে ১/৮ অংশ মিলিত হলে, যে সূক্ষ্ম ভূতের অর্ধাংশ এতে গৃহীত হয়েছে তাকে সেই নামের স্থুলভূত বলা হয়। যেমন ধরুন সূক্ষ্ম ক্ষিতি ১/২. সূক্ষ্ম জল ১/৮, সূক্ষ্ম অগ্নি ১/৮, সূক্ষ্ম বায়ু ১/৮, সূক্ষ্ম আকাশ ১/৮ এই মিলে হলো স্থুল ক্ষিতি। এই যে মিশ্রণ প্রক্রিয়া একে বেদান্ত বলে থাকে পঞ্চীকরন। অর্থাৎ যেকোনো তত্ত্ব যতক্ষন নির্ভেজাল থাকে ততক্ষন তা পঞ্চভূতের পঞ্চীকরণের পূর্বাবস্থা।
এখন সূক্ষ্ম শরীরের উপাদান হচ্ছে, অপঞ্চীকৃত মহাভূত। এই সূক্ষ্ম শরীরের আছে, বাসনা, আছে কর্ম্মফলের অনুভব । অজ্ঞানের কারনে যতক্ষন সে তার নিজের স্বরূপকে জানতে না পারছে, ততক্ষন এই সূক্ষ্ম শরীর আত্মার আবরণ হিসেবে কাজ করে থাকে। মহাত্মা শঙ্কর বিবেক চূড়ামণি গ্রন্থের ৯৭ নং শ্লোকে বলছেন,
"ইদং শরীরং শৃণু সূক্ষ্ম সংজ্ঞিতং
লিংঙ্গ ত্বপঞ্চীকৃত ভুতসম্ভবম।"
অর্থাৎ আচার্য্য শঙ্কর বলছেন - শোনো, সূক্ষ্ম বলে বর্ণিত যে শরীর একে লিঙ্গ শরীর বলেও ডাকা হয়ে থাকে। এই শরীর অপঞ্চীকৃত ভূতগুলো থেকে উৎপন্ন।
সবাসনং কর্ম্মফলানুভাবকম
স্ব-অজ্ঞানতঃ-অনাদিঃ-উপাধিঃ-আত্মনঃ।
অর্থাৎ বাসনাযুক্ত কর্ম্মফলের অনুভাবক। স্বীয় স্বরূপ জ্ঞানের অভাববশতঃ আত্মার অনাদি উপাধি।
লিঙ্গ কথাটার মানে হচ্ছে স্মরণ করানো।আভিধানিক অর্থে লিন্গ্ অর্থাৎ গমন করা + অ = বিশেষ চিহ্ন। এই শরীর একদিকে লিঙ্গ আবার সূক্ষ্ম। সূক্ষ্ম এই কারনে যে স্মৃতি ও বাসনা কর্ম্ম এই শরীরের মধ্যেই সূক্ষ্মভাবে মিশে থাকে। যাইহোক, এই শরীর "অপঞ্চীকৃত ভূত-সম্ভবম" সূক্ষ্ম পঞ্চভূত অন্য চারটির সঙ্গে মিশে তৈরী হয় স্থুল ভূত। স্থুল ভূত দিয়েই আমাদের স্থুল শরীর। এই পঞ্চভূত যা অন্য কারুর সঙ্গে মিশে স্থুল ভূতে পরিণত হয়নি, তখন সূক্ষ্মভূতের যে অবস্থা তাকে বলা হচ্ছে অপঞ্চীকৃত অবস্থা। অর্থাৎ আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল, মৃত্তিকা সূক্ষ্ম অবস্থায় আলাদা আলাদা আছে। কেউ কারুর সঙ্গে মিশতে পারেনি, কেউ ভেঙেও যায়নি। এর মধ্যেই আছে বাসনা। পূর্বপূর্ব জীবনের অতৃপ্ত যতসব বাসনা এই সূক্ষ্ম তত্ত্ব বহন করছে। এমনকি ভালো-মন্দ কর্ম্মের যে সুখ বা দুঃখ স্বরূপ ফল সেসবের অনুভব এই সুক্ষ শরীরের মধ্যেই আছে। জীবের যখন মৃত্যু হয়, তখন স্থুল শরীর থেকে এই সূক্ষ্ম শরীর বেরিয়ে আসে। অর্থাৎ স্থুল শরীর থেকে সূক্ষ্ম আলাদা আলাদা হয়ে যায়। এই সূক্ষ্ম শরীরই তার সমস্ত কৃত কর্ম্মের বোঝা ও অপূর্ন বাসনা সঙ্গে করে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে এই বাসনা ও সঞ্চিত কর্ম্মের ফল তাকে আবার একটা স্থুল দেহ অবলম্বন করতে বাধ্য করে।
আচার্য্য শংকর বলছেন, স্ব-অজ্ঞানতঃ-অনাদিঃ-উপাধিঃ-আত্মনঃ। স্বরূপকে ভুলে যাওয়াই অজ্ঞান, নিজেকে না চিনতে পারাই অজ্ঞান। এই অজ্ঞানের জন্য সূক্ষ্ম শরীর আত্মার আবরণ বা উপাধি হয়ে রয়েছে অনাদিকাল থেকে। এই অজ্ঞানের আরোপের ফলে সচ্চিদানন্দ স্বরূপ সেই আমি বা আত্মাকে আমরা চিনতে পারি না। পরন্তু এই স্থুল বা সূক্ষ্ম শরীরকেই আমরা "আমি" ভাবছি। অবশ্য আমরা সবাই স্থুল শরীরকেই আমি ভাবি, কিন্তু যাঁরা যোগক্রিয়ার পথে অন্তত ক্ষানিকটা অগ্রসর হয়েছে, তাঁদের কাছেও এই সূক্ষ্ম শরীরকেই প্রথমে "আমি" বলে মনে হয়। আর এই হচ্ছে আমাদের অবিদ্যা বা অজ্ঞানের কারনে। আমাদের মধ্যে থেকে যতদিন না অজ্ঞানের দূরীকরণ করতে পারছি , ততদিন আত্মার উপরে এই আবরণকেই আমরা "আমি" বলে ভুল করে সুখ-দুঃখের অংশীদার হবো। একটা জিনিস জানবেন, এই যে অজ্ঞান এটিও অনাদি। কেননা আমাদের স্থুল দেহ তো জন্ম-মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এমনকি প্রতিদিন কালের গতির সঙ্গে সঙ্গে পাল্টাচ্ছে, সূক্ষ্ম শরীর নতুন স্থুল দেহে স্থানান্তরিত হচ্ছে বটে, কিন্তু স্বরূপের জ্ঞান হচ্ছে না। এইভাবেই আমাদের জন্মের পর মৃত্যু আবার জন্মের পর মৃত্যু অনাদিকাল থেকে চলে আসছে।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
যোগ সাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রী গীতা - কমিউনিটিতে পড়ুন
সংসার বন্ধন থেকে মুক্তিলাভের উপায় (৩)- বিবেক চূড়ামণি - আচার্য্য শংকর।
এর আগের দিন আমরা শুনেছিলাম, মানুষ তার দেহ-ইন্দ্রিয়সকলের সাহায্যে বিষয়ভোগ সম্পন্ন করছে। ইন্দ্রিয়গুলোকে দুই ভাগ করা হয়েছে বাহ্য ইন্দ্রিয় ও অন্তর-ইন্দ্রিয়। বাহ্য ইন্দ্রিয় দশটি অর্থাৎ পাঁচটি কর্ম্ম-ইন্দ্রিয়, আর পাঁচটি জ্ঞান ইন্দ্রিয় আর অন্তর ইন্দ্রিয় ৪টি।
এই চারটি অন্তর ইন্দ্রিয়গুলো হচ্ছে, মন বুদ্ধি চিত্ত অহঙ্কার। মনে আমাদের সংকল্প-বিকল্পের উদয় হচ্ছে, বুদ্ধি দিয়ে আমরা বিষয়কে বিচার করছি, অর্থাৎ নিশ্চিত করছি, চিত্তে আমাদের যখন সুখদায়ক বস্তুর চিন্তা হয়, আর অহঙ্কার আছে আমাদের দেহাদিতে আমি-আমার ভাব ।
আমরা আরো শুনেছিলাম, আমাদের যেমন স্থুল দেহ আছে, তেমনি আছে একটি সূক্ষ্ম দেহ। এই সূক্ষ্ম দেহ বা লিঙ্গ দেহে আমাদের সমস্ত স্মৃতি বাসনা কর্ম্মফল সঞ্চিত থাকে।
আচার্য্য শংকর বলছেন, (শ্লোক ৯৮-৯৯) আমরা যারা দেহাভিমানী, তারা দুটো অবস্থা বেশ উপভোগ করে থাকেন। এক হচ্ছে জাগ্রত অবস্থা আর একটা হচ্ছে স্বপ্নাবস্থা। জীব জাগ্রত অবস্থায় একরকম - আবার স্বপ্নবস্থায় আর একরকম। জাগ্রত অবস্থায় জীবের কাছে জগৎ প্রকাশিত হয়, আর স্বপ্নাবস্থায় জীব নিজেকে প্রকাশ করে থাকে । স্বপ্নে আমাদের অন্তঃকরণ নিজেই তার জাগ্রতকালীন অবস্থার নানাবিধ বাসনার সাহায্যে কর্তৃত্ত্ব ইত্যাদি ভাব অবলম্বন করে বিরাজ করে। জাগ্রত অবস্থা আমাদের স্থুল শরীরে হয়ে থাকে আর আমাদের যে স্বপ্নাবস্থা এই সূক্ষ্ম শরীরে হয়ে থাকে।
আসলে স্বপ্নাবস্থায় আমাদের স্থুল শরীর বিছানায় পড়ে থাকে, এমনকি ইন্দ্রিয়গুলোও ঠিক ঠিক কাজ করতে পারে না। অর্থাৎ বাইরের কোনো শব্দাদি আমরা শুনতে পাই না, বাইরের কোনো দৃশ্য আমরা দেখতে পাই না। অথচ স্বপ্নে একটা জগৎ থাকে। সেখানে শুনে পাই, দেখতে পাই, এমনকি কি এমন সব কাজ করি, যা বাস্তবে আমার পক্ষে করা হয়তো সম্ভব হতো না। এসব কি করে হয় ? আসলে আগে আমরা যে অন্তরিন্দ্রীয়ের কথা শুনেছি, সেই অন্তঃকরণ আসলে জড় বস্তু। কিন্তু এই জড়বস্তু স্বপ্নে নিজেকে প্রকাশ করছে। আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, স্বপ্নে স্বয়ং পরমাত্মাই সবকিছুকে ভাস্বর করে তুলছেন । অন্তঃকরণ আত্মার উপাধী রূপে বিরাজ করছে। আর এই চৈতন্যস্বরূপ পরমাত্মার এই চৈতন্যের আভায় অন্তঃকরণ চৈতন্যরূপে প্রকাশিত হচ্ছে। আবার আমাদের জাগ্রত অবস্থাতেও সেই একই পরমাত্মা সাক্ষীরূপে বিরাজ করেন। আসলে জাগ্রত অবস্থায় আমরা জগৎকে স্থুল রূপে অনুভব করে থাকি , আর স্বপ্নাবস্থায় আমরা স্থুল জগতের ছায়াকে অন্তঃকরণে অনুভব করে থাকি। তাই স্বপ্নে দেখা বস্তুর কোনো বাস্তব সত্ত্বা নেই আমাদের কাছে।
এখন কথা হচ্ছে, এই যে দেহ-ইন্দ্রিয় ইত্যাদি আবরণের মধ্যে চৈতন্যস্বরূপ আত্মা যিনি আছেন বলেই আমরা বাইরের জগতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করছি, কাজ-কর্ম্ম করছি, এমনকি চিন্তা ভাবনা করছি, এগুলো কি তাহলে সেই আত্মাই সরাসরি করছেন ? মহাত্মা শংকর বলছেন, " চৈতন্যস্বরূপ পুরুষ-এর সমস্ত ব্যাপার চলছে এই লিঙ্গ শরীরের সাহায্যে।" আবার বলছেন, তিনি আছেন বলে সব কিছু হচ্ছে সত্য, কিন্তু তিনি স্বয়ং নির্লিপ্ত।
চোখ কখনো দেখতে পায় , আবার কখনো দেখতে পায় না, কান কখনো শোনে আবার কখনো শুনতে পায় না। অর্থাৎ কোনো শরীর বধির, কোনো শরীর মুক। কিন্তু আত্মার না আছে বধিরতা, না অন্ধত্ব। এই যে শরীরের বা ইন্দ্রিয়ের ব্যাধি, এসব আসলে প্রাণের খেলা। যেখানে প্রাণের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়, সেখানে শরীরের ক্রিয়া বন্ধ থাকে। কিন্তু এসবের উর্দ্ধে আত্মা, তিনি সর্বদা সাক্ষী রূপে বিরাজ করছেন ।
আমাদের অন্তঃকরণ অর্থাৎ অন্তরেন্দ্রিয়গুলো উদ্ভাসিত হয় জ্যোতির্ময় আত্মার তেজে। আর বাহ্য ইন্দ্রিয়গুলো ক্রিয়াশীল হয় প্রাণের সাহায্যে। আমরা এর আগে শুনেছি, অন্তরেন্দ্রিয় চারটি - মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার। মন হচ্ছে সংকল্প-বিকল্পাত্মক, বৃদ্ধি হচ্ছে নিশ্চয়াত্মিকা, চিত্ত হচ্ছে আমাদের ভাবাবেগের ধারক ও বাহক সবশেষে অহঙ্কার হচ্ছে, আমাদের "আমি-আমার" বোধ। আমাদের বহিরেন্দ্রীয় যখন বিষয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে, আমরা সেটাকে কিভাবে গ্রহণ করবো, সেটা ঠিক করে দেয় আমাদের অন্তরিন্দ্রিয়। এই যে বিষয়ের সঙ্গে যোগাযোগ তা হচ্ছে, আমাদের চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, ত্বক ইত্যাদি দ্বারা। আবার আমাদের যে কর্ম্মেন্দ্রিয় তার ব্যবহারও হয়ে থাকে অন্তরেন্দ্রীয়ের নির্দেশে।
তো এই দশটি বাহ্য ইন্দ্রিয় এবং চারটি অন্তরেন্দ্রিয় এর পিছনে আছেন সেই চৈতন্য স্বরূপ আত্মা। এই চৈতন্যের প্রভা-তেই আমাদের সমস্ত কাজকর্ম্ম চলছে।
এখন কথা হচ্ছে, যাকে দিয়ে যা-কিছুই হোক না কেন, আমরা কিন্তু ভাবছি, আমি করছি, এমনকি সুখ-দুঃখ যা আসলে কর্ম্মফল তাও আমিই ভোগ করছি। আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, এই যে অহঙ্কার বা আমি-ভাব,এটি তিন গুনের সংযোগে এসে আমাদের জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি এই তিন অবস্থা প্রাপ্ত হয়ে থাকে।
"অহংকারঃ স বিজ্ঞেয়ঃ কর্তা ভোক্তা-অভিমানী-অয়ম।
সত্ত্বাদিগুন-যোগেন চ অবস্থাত্রয়ম-অশ্নুতে। (১০৪)
আমরা অহঙ্কার বলতে কি বুঝি ? অহংকার হচ্ছে, আমি কর্ত্তা, আমি ভোক্তা, আমি বুদ্ধি, আমি স্মৃতি ইত্যাদি ইত্যাদি । আর আমার কান, আমার নাক, আমার হাত, আমার পা, আমার মাথা ইত্যাদি ইত্যাদি। তো যেহেতু ইন্দ্রিসকলকে আমি আমার ভাবছি, তাই এই ইন্দ্রিয়সকল দ্বারা যা কিছু হচ্ছে, তা আমি আমার কর্ম্ম বলেই মনে করছি। ঠিক এই ভাবনা থেকেই আমাদের যে অহঙ্কার তা দেহ-ইন্দ্রিয় ইত্যাদির সঙ্গে একাকার হয়ে যাচ্ছে। তো বুদ্ধির উপরে যখন চিদাত্মার ছায়া পড়ে, এবং বুদ্ধিতে যাকিছু আরোপিত হয়, তখন আমরা তাকে আমি মনে করি। আর এই কারণেই শরীর-মন-বুদ্ধি জড় হলেও, তাকে চেতন বলে মনে হচ্ছে আমাদের ।
তো আমাদের এটা বুঝবার চেষ্টা করতে হবে, যে অহঙ্কার হচ্ছে, আমি কর্ত্তা, আমি ভোক্তা ইত্যাদি-রূপ অভিমান মাত্র। যদিও এর কোনো সত্যতা নেই। আর এই অহঙ্কারই তিনটি গুন্ সম্পন্ন হয়ে তিন অবস্থা প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ সত্ত্ব-রজঃ-তম এই তিন অবস্থা প্রাপ্ত হয়। এই তিন অবস্থা হচ্ছে জাগ্রত, স্বপ্ন, ও সুষুপ্তি। জাগ্রত অবস্থা হচ্ছে রজঃ গুনের প্রভাব, স্বপ্নাবস্থায় সত্ব প্রভাব, আর সুষুপ্তিতে থাকে তম গুনের প্রভাব।
আরো একটা জিনিস আমাদের বুঝবার চেষ্টা করতে হবে, তা হচ্ছে, বিষয়সকল যখন বুদ্ধি অনুকূল বলে স্থির করে, তখন সেই বিষয় থেকে তার সুখ আসে, আর অহংকার সুখী হয়। আর বিষয় যখন বুদ্ধির বিচারে প্রতিকূল হয়, তখন অহংকার দুঃখী হয়। তো সুখ-দুঃখ আসলে অহঙ্কারের ধর্ম্ম, আমার (আত্মার) নয়। (১০৫)
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
সংসার বন্ধন থেকে মুক্তিলাভের উপায় (৪)- বিবেক চূড়ামণি - আচার্য্য শংকর।
আগের দিন আমরা শুনেছিলাম, বিষয়সকলকে যখন বুদ্ধি অনুকূল বলে স্থির করে, তখন সেই বিষয় থেকে তার সুখ আসে, আর আমাদের অহঙ্কার সুখী হয়। আর সেই একই বিষয় যখন বুদ্ধির বিচারে প্রতিকূল হয়, তখন আমাদের অহঙ্কার দুঃখী হয়। তো সুখ-দুঃখ আসে আমাদের বুদ্ধির বিচার থেকে। আর বুদ্ধিকে কাজে লাগায় আমাদের অহঙ্কার। আর এই অহঙ্কারের মধ্যে সুখ-দুঃখের অনুভূতি হয়ে থাকে। এইজন্য আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, সুখ-দুঃখ অহঙ্কারের ধর্ম্ম, আমার (আত্মার) নয়। (১০৫)
আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, বিষয় কখনো নিজের গুনে প্রিয় বা অপ্রিয় হয় না। যাকিছু তৃপ্তি সাধন করে, সেইবস্তুই আমাদের কাছে প্রিয়। আমাদের অন্তরতম আত্মা হচ্ছেন, সৎ-চিৎ-আনন্দস্বরূপ। এই আত্মাই আসলে আমাদের সত্তা, আমাদের জ্ঞান, আমাদের আনন্দ। সব অনুভূতির পিছনে আছেন, দ্রষ্টা স্বরূপ এই আত্মা। (১০৬) এখন আত্মাকে বলা হচ্ছে আনন্দস্বরূপ। তাহলে কি দুঃখের অনুভূতির পিছনে আত্মা নেই ? তা নয়, সব অনুভূতির পিছনেই তিনি দ্রষ্টা রূপে আছেন, কিন্তু আত্মার স্বরূপ আনন্দ, নিরবিচ্ছিন্ন আনন্দ, তাই আত্মাকে দুঃখ কখনো স্পর্শ করতে পারে না।
এই আত্মা বিষয়শূন্য হয়েও সুসুপ্তিতে অর্থাৎ গাঢ় ঘুমে কিন্তু আনন্দ ভোগ করে থাকে । তো শুধু বিষয়ের মধ্যে আনন্দ এটা যদি সত্য হতো তবে আমরা সুসুপ্তির সময়ে বিষয়হীন অবস্থায় সুখের অনুভব থেকে বঞ্চিত হতাম। দেখুন সুসুপ্তিতে অর্থাৎ গভীর ঘুমে স্বপ্ন থাকে না। অর্থাৎ না থাকে জগৎ (যা জাগ্রত অবস্থায় ছিল) না থাকে জগতের ছায়া ( যা স্বপ্ন অবস্থায় ছিল) . সুসুপ্তির সময় আমাদের ইন্দ্রিয়সকল কাজ করছে না। এমনকি মনও ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু এই গভীর ঘুম থেকে আমরা যখন জেগে উঠি, তখন আমরা একটা অপার্থিব আনন্দ অনুভব করি। প্রশ্ন হচ্ছে কেন এমন হয় ? কারন এই সুসুপ্তির অবস্থায় আমরা কেবলমাত্র আত্মাতেই অবস্থান করি। তবে এই অবস্থায় আমরা অজ্ঞান হয়ে থাকি, তাই সেটা জানতে পারি না। তো আমরা প্রত্যেকেই সুসুপ্তির সময় আত্মাতে অবস্থান করে থাকি, কিন্তু অজ্ঞানের করনে আমরা সেটা জানতে পারি না।
এখন কথা হচ্ছে সুসুপ্তিতে যে আমরা আত্মাতেই অবস্থান করি তার প্রমান কি ? আচার্য্য শংকর বলছেন, প্রমান চার রকমের - শ্রুতি, প্রত্যক্ষ, ঐতিহ্য ও অনুমান। শ্রুতি অর্থাৎ যা বেদ-উপনিষদে লেখা আছে, বা ঋষিমুখে যা আমরা শুনেছি - তারা বলছেন, "আনন্দো ব্রহ্মেতি " (তৈত্তিরীয় -৩/৬/১) আনন্দই ব্রহ্ম। এই আনন্দ ব্রহ্ম থেকেই সমস্ত প্রাণীর জন্ম। উপনিষদ একটা অদ্ভুত বিজ্ঞানগ্রন্থ, উপনিষদের ঋষিগণ বারবার বলছেন, বা উপনিষদের মূল কথাই হচ্ছে, যুক্তি ও বুদ্ধির দ্বারা কোনো বিষয় যদি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে না হয়, তবে যেন আমরা কোনো সিদ্ধান্তকেই মেনে না নেই।
বৃহদারণ্যক উপনিষদ বলছে, (৪/৩/৩২) "অস্য এষঃ পরমঃ আনন্দঃ" - অস্য অর্থাৎ এই ব্রহ্ম, পরমঃ আনন্দ অর্থাৎ পরম আনন্দের অবস্থা। তো শ্রুতি বলছে আত্মা পরমানন্দ স্বরূপ। প্রতক্ষ্য অনুভূতিতেও আমরা দেখছি, সুষুপ্তি হচ্ছে আনন্দের অবস্থা। তো এই যে সুষুপ্তি এটি প্রত্যক্ষ প্রমান। তো সুসুপ্তিতে যা আমরা প্রত্যক্ষ করছি, তার সঙ্গে শ্রুতি বাক্যের মিল দেখা যাচ্ছে।
এর পরে হচ্ছে, ঐতিহ্য প্রমান : এই যে সুসুপ্তিতে থেকে আনন্দ হয়, বা সুসুপ্তিতে আমরা আত্মার অনুভব করি এই অভিজ্ঞতা শুধু মুনি-ঋষিদেরই হয় অন্য কারুর হয় না, ব্যাপারটা এমন নয়। সবার ক্ষেত্রেই এই নিয়মের ধারাবাহিক কার্যকারিতা দেখা যায়। তো একটা ঐতিহ্য। এটা অর্থাৎ এই অনুভূতি আজও আছে, পুরাকালেও ছিল, আবার ভবিষ্যতেও হবে।
এর পরে হচ্ছে অনুমান : আমরা দেখেছি, বা অনুভব করেছি, যে আত্মাই সবার কাছে নিজ-নিজ অত্যন্ত প্রিয়। আত্মার থেকে বেশী প্রিয় আমাদের কাছে আর কিছু নেই। এর থেকে অনুমান হয়, আত্মা আমাদের প্রিয় তার কারন আত্ম আনন্দস্বরূপ ।
আমরা আলোচনা শুনছি, সংসার থেকে মুক্তি লাভের উপায় সম্পর্কে। প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোকে না জানতে পারলে, আমরা এই পথের সন্ধান পাবো না। তাই এইসব কথা আমাদের বিচারের মধ্যে আনতে হবে। এর পরে আমরা মায়ার কথা শুনবো, যা আসলে আমাকে ও সংসারকে আঠার মতো জুড়ে রেখেছে।
আচার্য্য শঙ্কর এর পরে শ্লোক নং ১০৮ এ বলছেন, অব্যক্ত মায়া থেকে জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। মায়া হচ্ছে ব্রহ্মের অবিদ্যা জনিত শক্তি। এই মায়ার আদি-অন্ত নেই। এই মায়া সত্ত্ব, রজঃ, তম এই ত্রিগুন্ সমন্বিত জগতের কারন স্বরূপ। সৃষ্টিরূপ কার্য্য থেকে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি এর অনুমান করতে পারেন।
এখন কথা হচ্ছে, কোন কাজ থেকে বিচক্ষণ ব্যক্তি মায়ার অস্তিত্ত্ব অনুভব করতে পারেন ? উত্তর হচ্ছে বিশ্বসৃষ্টির কাজ। এখন কথা হচ্ছে, সৃষ্টি ? সৃষ্টি হচ্ছে যা অব্যক্ত ছিলো, তা ব্যক্ত হলো। এই হচ্ছে সৃষ্টি। সৃষ্টি মানে নতুন কিছু নয়। যা ছিল অব্যক্ত তা হলো ব্যক্ত - এই হচ্ছে সৃষ্টি। সৃষ্টির পূর্ব্বে ত্রিগুণের মধ্যে সাম্যাবস্থা ছিলো। ত্রিগুন অর্থাৎ সত্ত্বঃ-রজঃ-তমঃ। এই তিনের মধ্যে যতক্ষন সাম্য অবস্থা ততক্ষন জগৎ অব্যক্ত। আবার এই সাম্যের মধ্যে যখন বিক্ষেপ উপস্থিত হলো, তখন সৃষ্টি কার্য্য শুরু হলো। এই তিনটি গুন্ তখন নানান ভাবে বিভক্ত হয়ে নানান মিশ্রনের ফলে যা অব্যক্ত ছিল, তা ব্যক্ত হতে শুরু করলো । দেখুন, এই মায়া আর প্রকৃতি কিন্তু এক নয়। মায়া হচ্ছে ব্রহ্মের শক্তি - অব্যক্ত নামে পরমেশ শক্তি। প্রকৃতি হচ্ছে জড় - যা শুদ্ধ চৈতন্য থেকে আলাদা। কিন্তু মায়া আর ব্রহ্ম আলাদা নয়। যেমন অগ্নি ও তার দাহিকা শক্তি আলাদা নয়, তেমনি ব্রহ্ম ও মায়া আলাদা নয়। ব্রহ্ম যেমন বাক্যের অতীত, ইন্দ্রিয়ের অতীত, তেমনি মায়াও অপ্রকাশ্য। সত্ত্বঃ-রজঃ-তমঃ এই তিন গুনের সমন্বিত বলে মায়াকে বলা হয় ত্রিগুণাত্মিকা শক্তি।
দেখুন আমরা জানি বিবর্তনের মাধ্যমে এই জগৎ ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয়েছে। এই বিবর্তনবাদ সম্পর্কে এখন আরো কোনো সংশয় নেই। এই যে বিবর্তন এর পরিণামের কারন-স্বরূপা শক্তি হচ্ছে মায়া। এই মায়াকেই ঋষি-পুরুষগন বলছেন, অনাদি অবিদ্যা। এই মায়াই আমাদের অজ্ঞানের কারন। এই মায়ার কারণেই মানুষ তার ব্রহ্মস্মৃতি অর্থাৎ আত্মস্মৃতি হারিয়েছে। জীব তার নিজস্ব সত্তাকে ভুলে বসে আছে। আর দেহাদিতে আত্মবুদ্ধি করে জন্ম-মৃত্যুর ঘূর্ণিচক্রে হাবুডুবু খাচ্ছে।
মায়ার কাজই হচ্ছে সত্যকে ঢেকে রেখে অসত্যকে সত্যবৎ করে দর্শন করানো। মায়া যেন জাদুকরী-বিদ্যা যা অসত্যকে সত্য বলে দেখিয়ে দর্শককে মুগ্ধ করে। এই অবিদ্যা যে কবে থেকে এসেছে, আর কতকাল ধরে চলবে তা কেউ বলতে পারে না। যোগীপুরুষগন তীক্ষ্ণ বুদ্ধির সাহায্যে এই জগতের মধ্যে মায়ার অস্তিত্ত্ব অনুমান করেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, কোন কাজ থেকে মায়ার অস্তিত্ত্ব অনুভব করা সম্ভব ? বিশ্ব বা বিষয় সৃষ্টির কাজ। আমরা আগেই শুনেছি, যা আগে অব্যক্ত ছিল, তা মায়ার প্রভাবে ব্যক্ত হলো। আচার্য্য শঙ্কর মায়া সম্পর্কে বলছেন (১০৯ নং শ্লোকে), সৎ ন অপি , অসৎ ন অপি, উভয়াত্মিকা নো." - অদ্ভুত কথা, বলছেন, না অসৎ, না সৎ, আবার সৎ-অসৎ উভয় একসঙ্গে আছে তাও নয়। এখন কথা হচ্ছে, সৎ বলতে আমরা বুঝি যা চিরকাল আছে, আবার অসৎ বুঝি যা কোনো কালেই ছিল না। মায়াকে সৎ বলা যায় না, কারন ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের কাছে মায়া বলে কিছু থাকে না। আবার মায়াকে অসৎ বলা যাবে না,কারন মায়ার যে কাজ তা আমাদের সবার প্রতক্ষ্য অনুভূতির বিষয়। আবার এই দুই অর্থাৎ সৎ-অসৎ দুই নয়, কারন এই বিপরীত ধর্ম্মী অবস্থা কখনো একসঙ্গে থাকতে পরে না। মায়া ব্রহ্ম থেকে আলাদা নয়, আবার ব্রহ্মে সঙ্গে অভিন্নও নয়। তার ব্রহ্ম হচ্ছে নির্বিকার, অন্যদিকে মায়া বিকারশীল। মায়ার সমস্ত কাজেই বিকারের লক্ষণ স্পষ্ট।
আচার্য্য শংকর আবার বলছেন, মায়া অঙ্গযুক্ত আবার অঙ্গবিহীন নয়। আবার এই দুয়ের একত্র অবস্থাও নয়। " স-অঙ্গা-অপি-অনঙ্গা হি -উভয়াত্মিকা নো।" মায়া যদি স-অঙ্গ হতো তাহলে তাকে দেখা যেতো। কিন্তু মায়াকে তো দেখা যায় না। অতএব ধরে নিতে পারি তার কোনও অঙ্গপ্রতঙ্গ নেই। আবার তার যে অঙ্গ নেই তাই বা কি করে বলি, তার কারন হচ্ছে এই যে দৃশ্যমান জগৎ, এই স্থুল জগতের কারণস্বরূপ মায়া বিদ্যমান। তো মায়ার কারণেই এই বৈচিত্রপূর্ন জগৎ দৃশ্যমান হয়েছে। আবার যদি বলি মায়ার অঙ্গ থাকা বা না থাকা উভয়েই আছে, তাহলে বার সেই পুরোনো যুক্তি দিয়ে অর্থাৎ দুটো বিরোধীশক্তি কখনো একসঙ্গে থাকতে পারে না। তাই মায়া একটা অদ্ভুত জিনিস যা আমাদেরকে অভিভূত করে রেখেছে। এই জগৎ সংসার মায়ার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নাকানি চুবানি খাচ্ছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা এখান থেকে বেরুবো কি করে ? মায়ার প্রভাব থেকে হবার কথা শুনবো আমরা আচার্য্য শঙ্করের কাছ থেকে আগামীতে। আজ বিরতি দিলাম।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ , হরি ওম।
সংসার বন্ধন থেকে মুক্তিলাভের উপায় (৫)- বিবেক চূড়ামণি - আচার্য্য শংকর।
আগের দিন আমরা শুনেছিলাম, মায়ার তিনটে গুন্স ত্ত্বঃ, রজঃ, তমঃ। আর এই তিন গুন্ থেকেই সুখ-দুঃখ-মোহের সৃষ্টি হচ্ছে, যা আমাদের সংসারের বন্ধানের কারন। এই মায়ার কারনেই আমাদের মধ্যে অজ্ঞানের জন্ম হচ্ছে। এই অজ্ঞান আমাদের চিত্ত বিভ্রম সৃষ্টি করছে। আর এই চিত্ত বিভ্রমের ফলে আমাদের মধ্যে ভ্রমজ্ঞানের সৃষ্টি হচ্ছে। আর ভ্রমজ্ঞান আমাদের অনিত্য বস্তুকে নিত্য বলে মনে করাচ্ছে। দড়িকে সাপ বলে ভ্রমজ্ঞান হচ্ছে।
এখন কথা হচ্ছে দড়িকে যদি দড়ি বলেই জানতে পারি, তবে আমাদের সাপের ভয় চলে যাবে। তো দড়িকে দড়ি বলে জানতে গেলে, অর্থাৎ সত্যকে জানতে গেলে আমাদের জ্ঞানের আলো জ্বালতে হবে। এই জ্ঞানের আলোই হচ্ছে ব্রহ্মজ্যোতি বা ব্রহ্মজ্ঞান। এই ব্রহ্মজ্যোতি যখন উদ্ভাসিত হবে, তখন ভ্রমজ্ঞানে যে জগৎ উদ্ভাসিত হচ্ছিলো, তা তখন দূর হয়ে যাবে। আর অমরা সত্যে প্রতিষ্ঠিত হবো। অবিদ্যা বা মায়ার প্রভাবে, জগতের আশ্রয় সেই ব্রহ্মকে না দেখে আমরা জগৎকে দেখে থাকি । ব্রহ্মজ্যোতি প্রজ্বলিত হলে মায়া বা অবিদ্যা তখন আর আমাদের অসত্যকে দেখাতে পারবে না।
আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, "রজস্তমঃ সত্ত্বমিতি প্রসিদ্ধাঃ গুনাঃ-তদিয়াঃ প্রথিতৈঃ স্বকার্যৈঃ। সত্ত্ব-রজঃ-তমঃ মায়ার এই যে তিনটে গুন্ এরা নিজের নিজের কাজের দ্বারা প্রসিদ্ধ। এই তিনটে গুনের সাহায্য নিয়েই মায়া তার কাজ করছে। সত্ত্ব গুনে সুখ, রজঃগুনে দুঃখ আর তমোগুণে মোহ উৎপাদন করছে। আর এইসবের করনেই মানুষ দিনের পর দিন সংসারে জড়িয়ে থাকছে। তো ব্রহ্মজ্ঞান হলে এই সুখ-দুঃখ-মোহ থাকে না, অর্থাৎ মায়া ও তার গুণগুলো তখন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
এই আলোচনা থেকে আমরা দুটো জিনিস পেলাম, একটা হচ্ছে বহ্মজ্ঞান আর একটা হচ্ছে মায়া তার গুনগুলোর সাহায্যে আমাদের উপরে প্রভাব বিস্তার করছে।
প্রথমে দেখে নেই, মায়া তার গুন্ গুলোর দ্বারা আমাদের কিভাবে প্রভাবিত করছে। আমরা জানি গুন্ হচ্ছে তিনটি অর্থাৎ সত্ত্ব রজঃ ও তমঃ।
আচার্য্য শঙ্কর বিবেক চূড়ামণির ১১১ নং শ্লোকে বলছেন,
"বিক্ষেপশক্তি রজসঃ ক্রিয়াত্মিকা
যত প্রবৃত্তিঃ প্রসৃতা পুরাণী।" (১১১-অংশ)
"বিক্ষেপশক্তি রজসঃ ক্রিয়াত্মিকা" - রজোগুণের ক্রিয়া থেকেই বিক্ষেপশক্তির উদ্ভব হয়। মানুষের মন যখন বিক্ষিপ্ত হয়, তখন সে আর স্থির থাকতে পারে না। তখন তাকে কিছু না কিছু করতেই হয়। এই যে কাজ করবার ইচ্ছে, বা মনের বিক্ষেপ এটি রজোগুণ থেকে উৎপন্ন হয়ে থাকে। আচার্য্যদেব বলছেন
"যত প্রবৃত্তিঃ প্রসৃতা পুরাণী" - মানুষের যত প্রবৃত্তি তা সে ভালো হোক বা মন্দ, তা এই রজোগুণের বিক্ষেপের কারনেই হয়ে থাকে। আর এই প্রবৃত্তি বিষয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে অনাদিকাল ধরে।
এই একই শ্লোকের শেষাংশে বলছেন :
রাগ-আদয়ঃ-অস্যা প্রভবন্তি নিত্যং
দুঃখাদয়ো যে মনসা বিকারাঃ। (১১১- শেষাংশ)
বিষয়াশক্তি, সুখ-দুঃখ ইত্যাদি যা মনের বিকার তা চিরকাল এই বিক্ষেপ শক্তি থেকে উৎপন্ন হয়।
এখন কথা হচ্ছে, কাজ করবার উৎসাহ বা শক্তি আমাদের এই রজোগুণ থেকে উৎপন্ন হয়। তো একদিক থেকে দেখতে গেলে এতো ভালোই । অবশ্যই ভালো, কেননা এই কাজ করবার শক্তিই মানুষকে উন্নতির শিখড়ে নিয়ে যাচ্ছে। এতে অসুবিধা কোথায় ? আসলে রজোগুণ হচ্ছে রাগাত্মক অর্থাৎ এই রজোগুণ থেকেই আমাদের কামনা বাসনা ও বিষয়ের প্রতি আসক্তির জন্ম হচ্ছে। যা আমার কাছে আছে, তার প্রতি আসক্তিবশতঃ সেগুলোকে আমরা আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছি, আবার যেগুলো আমার কাছে নেই, তাকে আমরা পাবার জন্য ছটফট করছি, লড়াই শুরু করে দিচ্ছি। এমনকি অসম্ভবকে সম্ভব করবার জন্য যান-প্রাণ লড়িয়ে দিচ্ছি। আর এই ভাব থেকেই মানুষের মধ্যে জন্ম হচ্ছে রাগ, দ্বেষ, ঘৃণা, অভিমান, গর্ববোধ ইত্যাদি ইত্যাদি। তো এতে করে মানুষ অশান্ত হয়ে উঠছে, আর হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে যা নয় তাই করে ফেলছে। বিপদটা এখানেই।
আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, আমাদের যে কাম-ক্রোধ-লোভ-দম্ভ-অসূয়া (ঈর্ষা-হিংসা-দ্বেষ, পরগুনের অনাদর ইত্যাদি ) অহঙ্কার -ঈর্ষা-মাৎসর্য ইত্যাদি ভয়ানক দুঃখদায়ক বৃত্তি এগুলো যেমন রজোগুণ থেকে উৎপন্ন হয়ে থাকে, তেমনি জীবের সংসার বন্ধনের হেতু রূপে এই বৃত্তিগুলোই কাজ করে থাকে।
আবার, তমোগুণের প্রভাবে মানুষ বিভ্রান্ত হয়। অর্থাৎ যা নয় তাই দেখে। যা নয় তাই শোনে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই তমোগুণ হচ্ছে আবরণ শক্তি। আগে আমরা শুনেছি রজোগুণের প্রভাবে বিক্ষেপশক্তির উদয় হয়, এবার বলছেন তমোগুণের প্রভাবে আবরনের কথা। আবরণী শক্তি আমাদের কাছ থেকে সত্যকে আবৃত করে রাখে। আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, "এষা - আবৃতিঃ নাম তামোগুনস্য শক্তিঃ যয়া বস্তু অবভাসতে অন্যথা। " অর্থাৎ আবৃতি নামক তমোগুণের শক্তি বস্তুকে যা নয়, সেইভাবে প্রকাশ করে।
তো মায়ার দুটো গুনের কথা আমরা শুনলাম, একটা হচ্ছে রজোগুণ - যার শক্তি হচ্ছে বিক্ষেপ। আর একটা তমোগুণ যার শক্তি হচ্ছে আবৃতি বা আবরণ। এই ব্যাপরটা উপনিষদে একটা বহুর প্রচলিত উদাহরনের দ্বারা বুঝিয়েছেন।
অন্ধকার রাতে রাস্তা দিয়ে হাটছি। রাস্তায় একটা দড়ি পড়েছিল। অন্ধকার রাতে দড়িটাকে সাপ ভেবে আঁতকে উঠলাম। ভয়ে কাঠ। সামনে এগুতে ভয় পাচ্ছি। আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে সাপ সাপ বলে চিৎকার জুড়ে দিলাম। আমার চিৎকার শুনে কিছুক্ষনের মধ্যে পিছন থেকে কেউ একজন টর্চ নিয়ে এলো। দড়িটার উপরে আলো ফেলতেই বুঝতে পড়লাম, এটি সাপ নয়, দড়ি। আসলে দড়ি তো দড়ি-ই ছিল, কিন্তু অন্ধকার রাতে আমি ঠিকঠিক মতো দেখতে না পেয়ে, দড়িকে সাপ ভেবে ভয় পেয়েছিলাম, আর চিৎকার জুড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু যখন দড়ির উপরে আলো ফেলা হলো, তখন আমার অজ্ঞান দূর হলো, আর ভয়-ও দূর হয়ে গেলো।
মহাত্মা গণ বলছেন, এই যে ভয়, আতঙ্ক, চিৎকার, এটি রজোগুণের প্রভাবে হয়ে থাকে। এই যে আলোর জন্য চিৎকার, বা আলো আনা এটি রজোগুণের প্রভাবে কর্ম্ম প্রবণতার লক্ষণ। তো মায়া তার তমোগুণ দ্বারা প্রভাবিত করে আমাকে ভয় দেখিয়েছিলো, আর সেই একই মায়া রজোগুণের প্রভাব দেখিয়ে আলো আনার ব্যবস্থা করেছিল।
এই সংসারেও আমাদের ঠিক একই অবস্থা। আমরা ভুল করে কতই না ভয় পাচ্ছি। কতো কতো উদ্ভট চিন্তা আমাদের মাথার মধ্যে এসে জড়ো হচ্ছে, আর আমরা সারাটা জীবন আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে জড়োসড়ো হয়ে আছি। অনিত্য বস্তুর পিছনে ছুটছি, একটু আনন্দের জন্য। মনে মনে কত কি কামনা করি - তার ইয়াত্বা নেই। এই কামনার আগুনই মনের মধ্যে প্রতিনিয়ত প্রজ্বলিত হচ্ছে। অতৃপ্ত বাসনার আগুন নেভানোর জন্য কতকিছু করছি। কিন্তু আগুনে জল ছেটানোর পরিবর্তে আমরা ঘি ঢেলে চলেছি। আর এতে করে আগুন বাড়ছে বই কমছে না। আমরাও দেহ থেকে দেহান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছি অতৃপ্ত বাসনা পূরণের জন্য - কৃতকর্ম্মের ফল ভোগ করার জন্য আবার জন্মাতে হচ্ছে। এইভাবেই অনিত্য সংসারে জীবের যাতায়াত চলছে যতদিন না জ্ঞান হচ্ছে।
কিন্তু কথা হচ্ছে, এ-সবই তো আমরা জানি, কিন্তু এই অনিত্য সংসার থেকে মুক্তি পাবো কি করে ? আচার্য্য বলছেন, ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে হবে । আমরা ধীরে ধীরে সেইসব অমৃত কথাই শুনবো আচার্য্য শংকরের বিবেকচূড়ামনি গ্রন্থ থেকে। আজ বাক্যের বিরাম দিলাম।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।
সংসার বন্ধন থেকে মুক্তিলাভের উপায় (৬)- বিবেক চূড়ামণি - আচার্য্য শঙ্কর ।
আচার্য্য শঙ্কর আক্ষেপ করে বলছেন, মানুষ এতটাই দুর্ভাগ্যবান যে তমোগুণের আবরণী শক্তি এদের মধ্যে এতটাই প্রবল যে হাজার শাস্ত্র পাঠ করেও, শাস্ত্রবাক্য মুখস্ত করেও, এমনকি তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন হয়েও, গুরুর উপদেশ পেয়েও এঁরা আত্মতত্ত্ব নিঃসংশয় ভাবে জানতে, বুঝতে বা উপলব্ধি করতে পারেন না। দেহাদিতে ভ্রমজ্ঞান হেতু, অনিত্য বস্তুকেই সত্য ও সুখপ্রদ বলে মনে করেন আর এই সব বস্তুর ভালো-মন্দ অবলম্বন করেই কালাতিপাত করে থাকেন । তমোগুণের এই আবরণশক্তির প্রভাবে সে এতটাই আচ্ছন্ন থাকে, যে তার মধ্যে একদিকে যেমন থাকে বিপরীত চিন্তা, তেমনি থাকে বিচারশক্তির অভাব। আর এই সব অসংলগ্ন চিন্তা ভাবনা সে কিছুতেই পরিত্যাগ করতে পারে না। আর এই মায়ার আবরণী শক্তির দ্বারা যিনি প্রভাবিত, তার মধ্যে বিক্ষেপ শক্তিও আপনা থেকেই এসে পড়ে । আর এই বিক্ষেপ শক্তির ফলে সে সাপেকাটা রুগীর মতো ছটফট করতে থাকে। ব্রহ্ম বা আত্মা সম্পর্কে তার যেমন কোনো ধারণা নেই, তেমনি নেই এই আত্ম -বিষয় সম্পর্কে জানবার আগ্রহ।
দেখুন প্রত্যেকের মধ্যে যেমন এই তমোগুণ, রজোগুণ আছে, তেমনি আছে সত্ত্বগুণ। তমোগুণ সত্যকে আমাদের কাছ থেকে ঢেকে রাখে, রজোগুণ আমাদেরকে চঞ্চল করে রেখেছে। সত্ত্ব (সৎ + ত্ব) সৎ স্বরূপে স্থিতি বা বিদ্যমান থাকা। তমঃ অর্থাৎ নিজেকে আবৃত করে রাখা । রজঃ অর্থাৎ নিজেকে বিস্তৃত করা।
কবি গেয়েছেন :
"নিরাকার ব্রহ্ম তিন রূপেতে সাকার
সত্ত্বরজস্তমোগুন্ প্রকৃতি তাহার।
রজোগুণে বিধি তাহে লোভের উদয়
তমোগুণে শিবরূপ অহঙ্কারময়।
সত্ত্বগুনে নারায়ণ কেবল চিন্ময়।
তমোগুণে অধোগতি অজ্ঞানের পাকে,
মধ্যগতি রজোগুণে লোভে বান্ধা থাকে;
সত্ত্বগুনে তত্ত্বজ্ঞান করতলে মুক্তি।"
সত্ত্বগুনেই মুক্তি আবার সত্ত্বগুণ আমাদের সুখের উৎপাদন করে থাকে। আর এই সুখের আশায় মানুষ সংসার ছাড়তে চায় না। আচার্য্যদেব বলছেন, সত্ত্বগুণ জলের মতো স্বচ্ছ, কিন্তু এই সত্ত্বগুণ রজঃ আর তমঃ গুনের সঙ্গে মিলেমিশে জীবের সংসার যাত্রা নিশ্চিত করছে । সত্ত্বগুণের প্রভাবে আমরা যেমন আমাদের স্বরূপের জ্ঞান অৰ্জন করতে পারি। আবার এই সত্ত্বগুণও আমাদের বন্ধনের কারন।
সত্ত্বগুণ আমাদের সৎকর্ম্মে উৎসাহিত করে সুখের সন্ধান দেয়। তো সত্ত্ব গুনের কারনে আমাদের বুদ্ধি স্বচ্ছ হতে পারে, এই স্বচ্ছ বুদ্ধিতে আত্মার প্রতিফলন ঘটতে পারে। কিন্তু সত্ত্বগুণ আমাদেরকে দিয়ে সৎকর্ম্ম করিয়ে যে সুখ-ভোগের সন্ধান দেয় , তার কারণেই জীব সংসারের প্রতি লালায়িত হয়। আচার্য্য শংকর বলছেন, এই কারণেই আমাদের এই তিন গুনের পারে যেতে হবে। অর্থাৎ সত্ত্ব রজঃ তমঃ এই তিন গুনকে অতিক্রম করতে হবে।
আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, এবার তোমাকে পরমাত্মার স্বরূপের কথা বলবো, যাকে জানলে মানুষ বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে কৈবল্য লাভ করতে পারবে।
এখন কথা হচ্ছে কৈবল্য ব্যাপরটা কি ? কেবলের ভাব অর্থাৎ আত্মার কেবলত্ব। জ্ঞানীদিগের ক্রমশঃ নিখিল ব্রহ্মান্ড-জ্ঞানের পর পর-ব্রহ্মজ্ঞান হয়ে জ্ঞানানন্দময় পরম-আত্মাতে বিলীন হয়ে যাওয়ার নাম কৈবল্য। কৈবল্য হচ্ছে সংসার-মুক্তি, যাকে আমরা বলি মোক্ষ। এখন কথা হচ্ছে আত্মাতে বিলীন হওয়ার নাম কৈবল্য। এই আত্মা বা পরমাত্মা কি ?
আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, এই ব্রহ্মজ্ঞান বা পরমাত্মা সম্পর্কে জানতে গেলে, আমাদের ত্রিগুণের অতীতে যেতে হবে। এই ত্রিগুণের অতীতে যেতে গেলে, আমাদের ব্রহ্মজ্ঞ হতে হবে। এই ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের অবস্থা তা, অর্থাৎ ত্রিগুনের অতীত হলে, সাধকের কি অবস্থা হয়, তা একবার আমরা আচার্য্য শঙ্করের মুখে শুনে নেই। আচার্য্য শঙ্কর বলছেন:
বিশুদ্ধসত্ত্বস্য গুনাঃ প্রসাদঃ
স্বাত্মানুভূতিঃ পরমা প্রশান্তিঃ।
তৃপ্তি প্রহর্ষঃ পরমাত্মনিষ্ঠা
যয়া সদানন্দরসং সমৃচ্ছতি। (১১৯)
সত্ত্বগুণের আশ্রয়ে মানুষের ব্রহ্মজ্ঞান হয়। মন যখন নির্ম্মল হয়, আমি-আমার বোধ যখন চলে যায়, সর্বভূতে যখন সমদৃষ্টি হয় - চিত্ত তখন প্রসন্নতায় ভরে যায়। তখন আত্মতৃপ্তি অনুভব হয়, স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দে মন ভরপুর হয়ে যায়। পরমাত্মন চিন্তায় মন যখন মশগুল হয়, তখন জগৎ বোধের লোপ সাধন হয়। এই অনুভূতিতেই ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের অবস্থান।
দেখুন আত্মার তিনটে শরীর। এর আগে আমরা স্থুল ও সূক্ষ্ম শরীরের কথা শুনেছি, এখন কারন শরীরের কথা একটু শুনে নেই। স্থুল ও সূক্ষ্ম শরীরের যা কারন তাকে বলে কারন শরীর। যা শীর্ন হয়, তাকে বলা হয় শরীর। তিন গুনের সাম্যাবস্থায় আত্মার যে শরীর অব্যক্ত অবস্থায় থাকে তাকে বলে কারন শরীর। এই অব্যক্ত কারন শরীর একসময় সূক্ষ্ম ও স্থুল শরীর রূপে প্রকাশ হচ্ছে। জগৎ সৃষ্টির কারন যেমন ত্রিগুণাত্মিকা মায়া , ঠিক তেমনি কারন শরীর আমাদের এই স্থুল ও সূক্ষ্ম শরীরের কারন স্বরূপ।
তথাকথিত মৃত্যুতে যেমন আমাদের স্থুল শরীরের নাশ হয়, সংকল্প -কামনা-বাসনার বিলুপ্তিতে তেমনি সূক্ষ্ম শরীরের নাশ হয়, আবার ব্রহ্মজ্ঞান হলে আমাদের কারন শরীরের নাশ হয়। এই ব্যাপারটা আমরা আরো একটু গভীরে বুঝবার চেষ্টা করবো।
আমরা যখন জেগে থাকি, তখন আমাদের তিন গুনের প্রভাবে আমাদের শরীর ও ইন্দ্রিয়গুলো কাজ করে থাকে। এই শরীর ও ইন্দ্রিয়গুলোর সাহায্যেই আমরা বাইরের জগতের সঙ্গে লেনদেন করে থাকি। এর পরে যখন আমরা ঘুমিয়ে থাকি, অর্থাৎ স্বপ্নাবস্থায় থাকি, তখন আমাদের ইন্দ্রিয়সকলও ঘুমিয়ে বা নিষ্ক্রিয়প্রায় হয়ে পড়ে। এই স্বপ্নাবস্থায় আমাদের মন-বুদ্ধি-চিত্ত-অহঙ্কার এই চারটি বৃত্তি আমাদের বিচিত্র স্বপ্ন জগতের সৃষ্টি করে থাকে । আর এই জগৎ আমাদের দৃশ্যমান বহির্জগতেরই অনুরূপ আরো একটা ছায়া-জগৎ। এখানে আমিও ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াই, কত কি যে করি - তার ঠিক নেই। এর পরে আমরা যখন গভীর ঘুমে বা সুসুপ্তিতে চলে যাই, তখন আমাদের অন্তঃকরণবৃত্তি অর্থাৎ মন-বুদ্ধি-চিত্ত-অহঙ্কার এগুলো কিছুই থাকে না। অর্থাৎ তখন যা ছিল জাগতিক অবস্থায়, যা ছিল স্বপ্নাবস্থায় তার কিছুই থাকে না। আসলে তখন আমরা আত্মস্বরূপে পৌঁছে গেছি। কিন্তু অজ্ঞানরূপ যে কারন শরীর সেই আবরণটুকু তখনও রয়ে গেছে। আসলে এই যে সুষুপ্তি, তা কারন-শরীরের একটা বিশেষ অবস্থা মাত্র । কেউকেউ একে সমাধির সঙ্গে তুলনা করে থাকেন, কিন্তু সমাধি আর সুষুপ্তি এক নয়। কারন সমাধিতে আমাদের আত্মানুভূতি বোধ থাকে, কিন্তু সুসুপ্তিতে এই আত্মানুভূতি বোধ থাকে না। আমরা সুসুপ্তিতে থাকি অজ্ঞান। কিন্তু সমাধিতে অজ্ঞান থাকে না, থাকে শুধু আত্মানুভূতি বোধ।
এই সুষুপ্তি থেকেই কারনশরীরের অস্তিত্ত্ব বোঝা যায়।
আচার্য্য শঙ্কর সত্ত্ব রজঃ তমঃ এই তিন গুনের সমন্বয়ে এই অব্যক্ত শরীর তাকেই বলা হয় কারন শরীর। জাগ্রত অবস্থায় আমাদের স্থুল শরীর ক্রিয়াশীল, স্বপ্নাবস্থায় আমাদের সূক্ষ্ম শরীরে অবস্থান করি, আর সুসুপ্তির অবস্থায় আমরা কারন শরীরে অবস্থান করে থাকি।
এই সুসুপ্তির অবস্থায় আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো ঘুমিয়ে পড়েছে, এমনকি আমাদের বুদ্ধিও কাজ করছে না, বুদ্ধি তখন সংস্কার রূপে অজ্ঞানের মধ্যে প্রবেশ করে বীজাকারে অবস্থান করছে। এখন কথা হচ্ছে, আমার যখন স্বপ্নাবস্থায় থাকি তখনও তো আমরা অজ্ঞান হয়েই থাকি। আসলে তখন আমাদের বাহ্যিক জগতের জ্ঞান থাকে না বটে, কিন্তু সূক্ষ্ম জগতের জ্ঞান থাকে। আর সুসুপ্তির অবস্থায় আমাদের এই দুই জগতের জ্ঞানই লোপ পেয়ে থাকে। সুসুপ্তির সময় কিছু ঘটেছে কি না তা আমরা জেগে উঠে বলতে পারি না, তবে একটা প্রশান্তির ভাব থাকে। কিন্তু স্বপ্নাবস্থা থেকে জেগে উঠে আমাদের স্বপ্নের স্মৃতি হয়তো বলতে পড়ি। এই স্বপ্নাবস্থার স্মৃতি সবসময় মুছে যায় না। এমনকি স্বপ্নে যে অযাচিত অবাঞ্চিত ঘটনা দেখে আমাদের মধ্যে সুখ-দুঃখের-ভয়ের আশঙ্কার অনুভব হয়েছিল, আমরা জেগে উঠেও সেটা ভুলতে পারি না। কিন্তু সুসুপ্তিতে মানুষের ঘুম এতো গভীর হয়, যে সুষুপ্তি থেকে জেগে একমাত্র আনন্দ ছাড়া আর কিছুই মনে থাকে না। আসলে এই সুসুপ্তিতে আমরা কোনো না কোনো আনন্দের উৎসের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলাম। আর সেই আনন্দ হচ্ছেনা আত্মা, যা কারন শরীরে অবস্থান করে থাকে।
যাইহোক, আজ বাক্যের বিরাম দিলাম। আমাদের আলোচনা চলতে থাকবে। সবাই ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন, শান্তিতে থাকুন।
শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
সংসার বন্ধন থেকে মুক্তিলাভের উপায় (৭)- বিবেক চূড়ামণি - আচার্য্য শঙ্কর ।
আমরা শুনছিলাম, আচার্য্য শঙ্করের বিবেকচূড়ামটি গ্রন্থ থেকে। আচার্য্য শঙ্কর বিদ্বজনের কাছে নমস্য কিন্তু আমাদের মতো সাধারনের কাছে দুরূহ, দুর্বোধ্য ।
যাই হোক, আগের দিন শুনেছিলাম, আমরা সবাই সুসুপ্তিতে আত্মার সঙ্গে অবস্থান করি। যারজন্য গাঢ় ঘুম থেকে জেগে উঠে আমাদের মন শান্তি অনুভব করে। অর্থাৎ আত্মার সান্নিধ্য আমাদের যে আনন্দে রেখেছিলো তার আভাস ঘুম থেকে জেগে উঠেও চলতে থাকে। এখন কথা হচ্ছে এই আত্মা কি বা কে, যার সান্নিধ্যে এসে সুসুপ্তিতে আমরা শান্তি লাভ করেছিলাম ? এই প্রশ্নের উত্তর জানার আগে, আমরা একটু অন্য কথা শুনে নেই। আর এটি আমাদের আলোচনার সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
সত্য হচ্ছে, সংসারে বিষয়সুখ আছে, সংসারে সংকল্প পূরণের সুযোগ আছে, সংসারে বাসনার তৃপ্তি সাধনের উপায় আছে। আর এইসব কারণেই আমরা সংসারকে এতটাই ভালোবাসি যে এই সংসার ছেড়ে চলে যেতে হবে, শুনলেই আমরা আঁতকে উঠি। কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ মানুষ শুনলে খুশী হবেন, যে সংসার আপনাকে কখনোই ছাড়বে না। ঈশ্বরে আপনার বিশ্বাস ঠাকুর আর না থাকুক, ঈশ্বর যেমন আপনাকে ছেড়ে যাবে না, যেতে পারে না, তেমনি আপনি এই দেহ ছেড়ে গেলেও কামনা-বাসনার এই সংসার আপনাকে সহজে ছেড়ে যাবে না। আপনি এখন যে দেহে অবস্থান করছেন, সেই দেহের নাশ হলে যেমন আপনি আবার একটা নতুন দেহ পাবেন, তেমনি যাকিছু আপনি সংসারে সংগ্রহ করেছিলেন, তাও আপনার জন্যই গচ্ছিত থাকবে। ভালো মন্দ সবই আপনার জন্যই থাকবে। এর ভবিতব্য থেকে কেউ আপনাকে বঞ্চিত করতে পারবে না। আর পরবর্তী জীবনে অর্থাৎ নতুন শরীরে আপনাকে আবার সেই সংসারে গচ্ছিত ধনের কাছে এনে উপস্থিত করবে। এই সত্য যারা উপলব্ধি করেছেন, হয়তো তারাই বারবার এই সংসারে আসার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন। আর সাংসারিক ধন সংগ্রহে উদগ্রীব হয়ে থাকেন।
কিন্তু আচার্য্য শঙ্কর আমাদেরকে অন্য কথা বলছেন, তিনি বলতে চাইছেন, এই সংসারে যেমন আছে সুখ, তেমনি আছে দুঃখ, যেমন আছে বিষয় সুখ, তেমনি আছে বিষয় লাভের যন্ত্রনা। এই সংসারে যেমন সুস্থ যৌবন আছে, আছে তেমনি জরাগ্রস্থ বার্ধক্যের অবস্থা। এই সংসারে আছে ভালোবাসা আবার এই সংসার হিংসা দ্বেষ ঘৃণা দ্বারা পরিপূর্ন। এই সংসারে আছে ভালো- মানুষ, আছে দেব মানব আবার আছে পশুমানব আসুর মানব । এই সংসারে যেমন ফুলের গন্ধ আছে, তেমনি আছে বিষ্ঠার দুর্গন্ধ। একটা ছেড়ে আর একটাকে আপনি গ্রহণ করতে পারবেন না। মুদ্রার এপিঠ ও পিঠ। সুখ চাইলে আপনাকে দুঃখকেও নিতে হবে। আবার দুঃখের নিবৃত্তিতে আপনার কাছে সুখ এসে পাশে দাঁড়াবে। এর কোনো অন্যথা হবে না। সুখ-দুঃখ, এরা পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। তো এখানে যেমন নির্ভেজাল সুখ বলে কিছু নেই, তেমনি দুঃখও কারুর চিরকাল থাকে না। সুখ-দুঃখ চক্রাকারে জন্ম-মৃত্যুর মতো আবর্তিত হচ্ছে।
আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, এই যে দৃশ্যমান স্থুল জগৎ এমনকি সূক্ষ্ম অদৃশ্য জগৎ, এসব যার প্রতিবিম্ব স্বরূপ, তিনিই স্বয়ং আত্মা। এই আত্মাকে সূর্য প্রকাশ করে না, চন্দ্র তারকাও প্রকাশ করে না, বিদ্যুৎও এঁকে প্রকাশ করে না। ইনি স্বয়ং প্রকাশ। তাই এখানে অর্থাৎ ব্রহ্মাকাশে কোনো অন্ধকার নেই। ইনি কারুর অপেক্ষায় থাকেন না। ইনিই সমস্ত কিছুর দীপ্তির কারন। এনার দীপ্তিতেই সমস্ত বিশ্ব বিবিধ-রূপে প্রকাশ পাচ্ছে। কঠোপনিষদ বলছেন, "ত্বমেব ভান্তম অনুভাতি সর্বম" (২/২/১৫) তোমার জ্যোতিতেই সব কিছু জ্যোতির্ময়।
এখন কথা হচ্ছে সবাই আনন্দ খুঁজছে। বিষয়ের মধ্যে সে আনন্দের সন্ধান পাচ্ছে, তার কারন হচ্ছে, এই বিষয়কে সে বিচার দ্বারা অনুকূল মনে করছে। এই পার্থিব বস্তুতে যেমন আনন্দ আছ্ এবং দুঃখ আছে, তেমনি বাক্য ধ্বনির (প্রণব) ও আলোর (ব্রহ্মজ্যোতি) মধ্যেও একটা আনন্দ আছে। আমরা মধুর কথা শুনলে, গান শুনলে, আনন্দ পাই। আবার মধুর ধ্বনি অর্থাৎ বাজনা শুনলেও আনন্দ পাই। এই যে মধুর বাক্য, মধুর ধ্বনি এগুলো আমাদের আনন্দ দেয়। কিন্তু কঠোর বাক্য, বা বেসুরো ধ্বনি আমাদের বিরক্তির কারন হয়। এই বাক্যের মধ্যেই আছে জ্ঞান অর্থাৎ বেদ । এই জ্ঞানের কথা শুনলেও আমাদের এক ধরনের আনন্দ হয়। এই জ্ঞান পার্থিব, আবার অপার্থিব দুইই হতে পারে। এই যে অপার্থিব জ্ঞান - যা অনুভব করলে আমাদের আনন্দ হয় তাকেই বলে ব্রহ্মানন্দ। সমস্ত আনন্দের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে এই ব্রহ্মজ্ঞানানন্দ।
দেখুন এই ব্রহ্মের সঙ্গে জগতের একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। জগৎ রূপে ব্রহ্ম নিজেকে প্রকাশ করেছেন। সুতরাং সকল অস্তিত্ত্বের অন্তরতম সত্তা হচ্ছে এই ব্রহ্ম। এই শাশ্বত জ্ঞানের যিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তিনি শাশ্বত আনন্দের অধিকারী হতে পেরেছেন। জীবের বাসনা অসংখ্য এবং কোনো না কোন ভাবে জীবাত্মা তার বাসনা চরিতার্থ করে। কিন্তু সে যা চায়, তা লাভ করতে গেলে, জীবাত্মাকে পরমাত্মার উপরে নির্ভর করতে হয়। আসলে ব্রহ্ম রূপে পরমাত্মাই জীবাত্মার বাসনা পূরণ করে থাকেন। আর এই ব্রহ্ম সমস্ত ভূতের মধ্যে জ্যোতি রূপে অবস্থান করছেন।
এখন আমাদের যে তিনটে অবস্থা অর্থাৎ জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি এই তিন অবস্থার মধ্যে কে এমন আছেন, যিনি এই তিন অবস্থারই দ্রষ্টা হয়ে অবস্থান করছেন ? আপনি হয়তো বলবেন, কেন আমি আছি। হ্যাঁ ঠিক আমি আছি। তাহলে বলতেই হয়, এই আমি কিন্তু স্থুলশরীর বা -ইন্দ্রিয় নোই। কারন স্বপ্নাবস্থায় এই স্থুল দেহ-ইন্দ্রিয় কোনো কাজে আসে না। আবার আমি এই অন্তর-ইন্দ্রিয়সকল (মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহঙ্কার) নোই, আবার সূক্ষ্ম দেহও নোই । কারন মন-বুদ্ধি-চিত্ত-অহঙ্কার ও সূক্ষ্ম দেহ আমাদের সুসুপ্তির অবস্থায় থাকে না। তো এই তিন অবস্থার যিনি দ্রষ্টা তার নাম রাখুন ব্রহ্ম বা আত্মা, যাকে আপনি "আমি" বলছেন। এই আমিই সর্ব্বভূতের আত্মা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলছেন, "অয়মাত্মা" আমি আত্মা। বৃহদারণ্যক উপনিষদে (১/৪/৮) বলা হচ্ছে "অন্তরতরং যদয়াত্মা" - আত্মা সকলের অন্তরের বস্তু।
এখন কথা হচ্ছে, আত্মাকে আমরা কোথায় খুঁজে বেড়াবো ? দেহের ভিতরে না বাইরে ? আচার্য্য শঙ্কর এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, ১৩২ নং শ্লোকে। যা আমরা আগামীদিন শুনবো।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
সংসার বন্ধন থেকে মুক্তিলাভের উপায় (৮) - বিবেক চূড়ামণি - আচার্য্য শঙ্কর ।
আগের দিন আমরা একটা প্রশ্ন দিয়ে শেষ করেছিলাম, অর্থাৎ আত্মা, যিনি আমাদের আনন্দের উৎস, তাঁকে আমরা কোথায় খুঁজবো ? আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, এই দেহে, সত্ত্বগুনপ্রধান অন্তঃকরণে, বুদ্ধিরূপ গুহায় এবং কারন শরীরে জ্যোতিস্মান আত্মা স্বীয় কমনীয় তেজের দ্বারা এই বিশ্বকে প্রকাশ করে, উর্দ্ধে প্রকাশমান সূর্য্যের ন্যায় সাক্ষী রূপে বর্ত্তমান রয়েছেন।
"অত্রৈব সত্ত্ব-আত্মনি ধীগুহায়াম -অব্যকৃত আকাশ উশৎ প্রকাশঃ।
আকাশ উচ্চৈ রবিবৎ প্রকাশতে স্বতেজসা বিশ্বমিদং প্রকাশয়ন। (১৩২)
প্রথমতঃ এই দেহেই সেই আত্মার খোঁজ করতে হবে। দ্বিতীয়ত দেহের অন্তঃকরণের মধ্যে খুঁজতে হবে। আর এই অন্তঃকরণ যেন হয় সত্ত্বগুণ সম্পন্ন। অর্থাৎ আমাদের অন্তঃকরণ যখন সত্ত্বগুণে ভরপুর হবে, তখন এই সত্ত্বগুণ-প্রধান অন্তঃকরণে আত্মাকে খুঁজতে হবে। তৃতীয়তঃ "ধীগুহায়াম" অর্থাৎ বুদ্ধিরূপ গুহার মধ্যে তাকে খুঁজতে হবে। চতুর্থতঃ "অব্যাকৃতাকাশ: অর্থাৎ অব্যক্ত আকাশে খুঁজতে হবে । এই অব্যক্ত আকাশ হচ্ছে আমাদের কারণ শরীর। তো এই কারণ শরীরে বুদ্ধিরূপ গুহায় সেই আনন্দস্বরূপ আত্মা অবস্থান করছেন।
কঠোপনিষদে এই একই ধ্বনি শুনতে পাই। সেখানে যমরাজ বলছেন, "অঙ্গুষ্ঠমাত্র পুরুষো- অন্তরাত্মা সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্ট।" (শ্লোক /৩/১৭) অঙ্গুষ্ঠ প্রমান অন্তরাত্মা-পুরুষ সর্বদা সকলের হৃদয়ে বিদ্যমান।
এখন কথা হচ্ছে, এই আত্মাকে আমরা চিনি না, জানি না। তো যাঁকে চিনিনা, জানি না, তাঁকে দেখেও তো আমরা সনাক্ত করতে পারবো না। এইখানে আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, মনি যেমন তার জ্যোতিঃ স্বরূপ হয়ে অবস্থান করার ফলে, সন্ধানীর নজর এড়াতে পারে না। এই জ্যোতিই তাঁকে ধরা খাইয়ে দেয়, তেমনি আপনি চেনেন আর নাই চেনেন তাতে কিছু আসে যায় না। তিনিই আপনাকে আপনা থেকেই ধরা দেবেন। "উশৎ প্রকাশঃ আকাশঃ" সর্ব্বপ্রকার উজ্জ্বল অথচ স্নিগ্ধ তেজস্বরূপ সেই আত্মা । তো আপনার চিনতে অসুবিধা হবার কোনো কারন নেই। আসলে তিনিই আপনার কাছে ধরা দেবেন, আপনাকে ধরতে হবে না। তবে একটা কথা বলি, এই যে আপনার অন্তর-আকাশে বা কারন শরীরে আত্মার দর্শন, এটি কিন্তু আত্মার প্রতিফলন মাত্র। যেমন বাটির জলে সূর্যকে দেখা যায়, তেমনি অন্তরাকাশে আত্মার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। আরো একটা কথা হচ্ছে, এই আত্মাকে প্রথমে বিদ্যুৎ রেখার মতো ক্ষনিকের তরে দেখতে পাওয়া যায়। ধীরে ধীরে সাধনার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এই বিদ্যুৎরেখা প্রজ্বলিত দ্বীপ শিখার আকার নিয়ে থাকে। তখন সাধকের দেহবোধের লোপ সাধন হয়। জগৎবোধের সামান্যতম অস্তিত্ত্বও থাকে থাকে না। যদিও এমন অবস্থা কেবল মাত্র কৈবল্যকালে হয়ে থাকে।
তো স্থুল দেহ, অন্তঃকরণ, ও কারণদেহ বা অব্যক্ত আকাশে তিনি এমন ভাবে জ্বলজ্বল করছেন, যে তাঁকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে কোনো অসুবিধা হয় না। আকাশে সূর্য উঠলে, যেমন হাজার এক নক্ষত্রের মধ্যেও তাকে আমরা অনুভব করতে পারি, বা আকাশে চন্দ্র উঠলে তার স্নিগদ্ধতা আমাদেরকে স্পর্শ করে, তেমনি যখন অন্তর-আকাশে প্রবেশ করবেন, যখন আপনি আত্মস্থিত হতে পারবেন, তখন আত্মজ্যোতি স্বয়ং প্রকাশিত হবে।
কঠোপনিষদে (শ্লোক নং ২/৩/১৭) বলছেন, "স্বাৎ শরীরাৎধৈর্যেণ তং প্রবৃহেৎ" - ধৈর্যসহকারে স্বীয় শরীর থেকে তাঁকে অর্থাৎ আত্মাকে আলাদা করতে হয়। পরমাত্মা আমাদের সকলের অন্তরে লুকিয়ে আছেন। যোগ অভ্যাসের দ্বারা মনের মলিনতা দূর হলেই অন্তরে ব্রহ্মজ্যোতি আপনিই ঝলমল করে উঠবে। যোগ অভ্যাসের দ্বারা যোগীর শরীরের পরিবর্তন হলো কি হলো না সেটা বড়ো কথা নয়, অন্তরের পরিবর্তনই আসল কথা। আমরা এখন নিজেদেরকে পাঞ্চভৌতিক দেহকে নিয়ে জগতের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করছি । কিন্তু যোগক্রিয়ার ফলে যোগীর মধ্যে যখন পরিবর্তন হতে শুরু করে, তখন তিনি বুঝতে পারেন যে তিনি দেহ নন।
দেখুন সূর্য্য সমস্ত প্রাণের উৎস হলেও, প্রাণের সঙ্গে সূর্য্য লিপ্ত নন। ঠিক তেমনি আমাদের যে স্থুল দেহ, সূক্ষ্ম দেহ, কারন দেহ, এমনকি অন্তরাকাশ এসব তাঁরই আলোতে প্রকাশিত হলেও, এসবের সঙ্গে আত্মা কখনো লিপ্ত নন। আচার্য্য শঙ্কর এটা একটা উপমার সাহায্যে বুঝিয়েছেন, বলছেন, জ্বলন্ত লোহার তাল নানান আকৃতি গ্রহণ করে, কিন্তু আগুন ঐসব আকৃতির পরিবর্তনে সঙ্গে পরিবর্তিত হয় না। তেমনি মন বুদ্ধি চিত্ত অহঙ্কার দেহ ইন্দ্রিয় ইত্যাদিকে অনুবর্তন করার কোনো চেষ্টাই আত্মার নেই। আত্মা কখনও বিকারগ্রস্থ হন না। অর্থাৎ আত্মার কোনো পরিবর্তন নেই কিন্তু মন-বুদ্ধি চিত্ত অহঙ্কার দেহ ইন্দ্রিয়সকল ইত্যাদির মধ্যে যে পরিবর্তন হচ্ছে, তার জ্ঞাতা রূপে অবস্থান করছেন। তার মধ্যে কোনো বিকার নেই, তিনি অবিকারী,নিষ্ক্রিয় অথচ সবকিছুর জ্ঞাতারূপে আমাদের হৃদয় কেন্দ্রে অবস্থান করছেন।
এখন আত্মা হৃদয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন, আর হৃদয় আমাদের দেহের মধ্যেই অবস্থিত, তো এই দেহের নাশ হলে, আত্মার অবস্থান কোথায় হয় ? আচার্য শঙ্কর বলছেন,
"ন জায়তে নো ম্রিয়তে ন বর্ধতে
ন ক্ষিয়তে নো বিকরোতি নিত্যঃ। (১৩৪)
আত্মা চির বর্তমান, আত্মা জন্মান না, মরেন না, তাঁর বৃদ্ধি নেই, বিকার নেই, ক্ষয়ও নেই।
বিলীয়মানঽপি বপুষ্য-অমুষ্মিন
ন লীয়তে কুম্ভ ইব-অম্বরঃ স্বয়ম। (১৩৪)
এই দেহ নাশ প্রাপ্ত হলেও আত্মা স্বয়ং নাশ প্রাপ্ত হন না ঘটস্থ আকাশের মতো।
আমাদের দেহ অনিত্য। এই দেহের নাশ আছে, এই দেহের আছে ষড়বিকার অর্থাৎ এই দেহের জন্ম আছে, স্থিতি আছে, বৃদ্ধি আছে, পরিনাম আছে, ক্ষয় আছে আর সব শেষে দেহের নাশ আছে। এই যে ছয়টি বিকার আত্মার মধ্যে নেই। তিনি জন্মান না, মরেন না, বৃদ্ধি পান না, ক্ষয়প্রাপ্ত হন না, অর্থাৎ তার মধ্যে কোনো বিকার নেই। দেহ বিনষ্ট হলে, ঘটাকাশের মতোই যেমন ছিলেন, তেমনই থাকেন।
এই আত্মাকে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
এক জিজ্ঞাসু আচার্যকে জিজ্ঞেস করছেন, গুরুদেব আত্মা কোথা থেকে আসে, আর কোথায়ই বা চলে যায় ? আর কিভাবেই বা আমি তা বুঝবো ?
গুরুদেব বলছেন, দেখো, এসব বাক্য দিয়ে বোঝানো যায় না।
শিষ্য : তাহলে কি করে আমি বুঝবো ?
গুরুদেব বলছেন, দুটো কাঠের টুকরো নিয়ে এস।
তো শিষ্য দুটো কাঠের টুকরো নিয়ে এলো।
গুরুদেব বললেন, এবার কাঠে কাঠে ঘষতে থাকো, যতক্ষন না এ থেকে আগুনের জন্ম হয়। তো শিষ্য কাঠে কাঠে ঘষতে লাগলো। এবং একসময় এই ঘর্ষনের ফলে আগুনের উৎপত্তি হলো।
গুরুদেব বললেন, এবার দেখতে থাকো, যতক্ষন না আগুন নিভে যায়। একসময় আগুন নিভে গেলো।
গুরুদেব বললেন, এবার নিজের কাছে প্রশ্ন করো, আগুন কোথা থেকে এসেছিলো, আবার কোথায়ই বা চলে গেলো। আসলে আগুন এখানেই আছে। এখানেই ছিল, আবার এখানেই চলে গেলো। তেমনি আত্মা এখানেই ছিল, আছে, থাকবে। কিন্তু আগুন প্রজ্বলিত হবার আগে, এটি তোমার বোধের বিষয় ছিল না। আবার যখন আগুন নিভে গেছে, তখনও আগুন তোমার বোধের বিষয়ের বাইরে চলে গেছে।
ঠিক তেমনি আত্মা যখন দেহের মধ্যে স্থিত হয়, ততক্ষন তোমার মধ্যে দেহ-ইন্দ্রিয়সকল সক্রিয় হয়ে ওঠে আবার যখন আত্মা স্ব -স্থানে স্থিত হয়, তখন আত্মা তোমার বোধের বিষয় থাকে না।
তো তুমি তোমার দেহে যতক্ষন আত্মা স্থিত আছে, সেই কালে যদি তুমি যদি অপান-প্রাণের ঘর্ষনে তাকে প্রজ্বলিত করতে পারো, তবে তোমার মধ্যে একটা ব্রহ্মজ্যোতি প্রকাশ পাবে। এই ব্রহ্মজ্যোতিই স্বয়ং তুমি।
কঠোপনিষদ (শ্লোক নং ১/২/১৮) যমরাজ বলছেন,
ন জায়তে ম্রিয়তে বা বিপশ্চিৎ-অয়ম কুতশ্চিত ন বভূব কশ্চিৎ।
অজো নিত্য শাশ্বতঃ অয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে। (১//২/১৮)
আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই। আত্মার কোনো উৎপত্তি নেই, আবার আত্মা থেকেও কোনো বস্তুর উৎপন্ন হয় না। আত্মা জন্মরহিত, চিরন্তন, অপরিবর্তনীয় এবং সদা বিরাজমান। দেহের নাশ হয়, কিন্তু আত্মা অবিনাশী। এই আত্মার সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করাই জীবনের লক্ষ্য।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
সংসার বন্ধন থেকে মুক্তিলাভের উপায় (৯) - বিবেক চূড়ামণি - আচার্য্য শঙ্কর ।
আমরা আগের দিন শুনেছিলাম, আত্মা অবিনাশী। আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই। তো আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, তাতে আমার কি ? আমার তো জন্ম মৃত্যু আছে। আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, তুমি সংযতমনের এবং শুদ্ধ বুদ্ধির সাহায্যে নিজের দেহস্থিত আত্মাকে আমি স্বরূপে অনুভব করো। আর এই ভাবে জন্ম-মৃত্যুরূপ সংসার সাগর থেকে নিজেকে আলাদা করো।
" নিয়মিত মনসামুং ত্বং স্বম-আত্মানং-আত্মনি-অয়ম-অঽম-ইতি সাক্ষাদ বুদ্ধি প্রসাদাৎ।" (শ্লোক-১৩৬) - বুদ্ধির সাহায্যে প্রতাক্ষবৎ অনুভব করো, যে "এই শুদ্ধ আত্মাই আমি।" বিষয়গ্রহনে মনকে বিরত রেখে সেই শুদ্ধ মনের সাহায্যে অনুভব করো। তাহলে তুমি জন্ম-মৃত্যু সংকুল এই সংসার সাগর থেকে উত্তীর্ন হয়ে ব্রহ্মস্থিতি লাভ করতে পারবে।
কিছুদিন আগে, আমার কাছে একটা ছেলে এসেছিলো, তার পরিচয় জানতে। আসলে সে কারুর কাছ থেকে শুনেছে, যে তার এখন যে পিতা মাতা, এরা তার আসল অর্থাৎ জন্মদাতা মাতা-পিতা নয়। আর সেটা আমিও শুনেছি। কিন্তু ওর সত্যিকারের পিতা বা মাতা কে তা আমারও জানা নেই। আসলে হয়েছিল কি, এখন যারা ওর মাতা-পিতা তারা ছিলো নিঃসন্তান। অনেক ডাক্তার-বাদ্যি দেখিয়েও কোনো কাজ হয় নি। তো যে ডাক্তার ওর চিকিৎসা করেছিল শুনেছি সেই ডাক্তার কোনোভাবে এই পিতৃমাতৃ পরিচয়হীন সন্তানকে টাকার বিনিময়ে হস্তান্তর করেছিল। হতে পারে, কোনো কুমারীর মায়ের সন্তান। কুন্তী কর্ণকে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছিলো, মরমিয়া কবির নদীর কিনারে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিলো। শিরডির সাইবাবার জন্ম-পরিচয় পাওয়া যায় না। আমার পিতৃদেবের মৃত্যুর বছর দুই পরে, আমার এক ভাইয়ের ছেলে হয়। তো আমাদের মা বলতেন, তো বাবা নাড়ুর ছেলে হয়ে জন্মেছে। সত্যি মিথ্যে জানি না, কিন্তু যিনি ছিলেন, আমার পিতা, তিনি এখন আমার ভাইপো হয়েছেন, ভাবতে অবাক লাগে।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, অর্জ্জুন তোমার আমার বহু জন্ম অতীত হয়েছে, তুমি সেসব জানোনা, আমি জানি। তো শিশু একদিন পিতা হয়, কিন্তু পিতা কি আবার শিশু হয় ? আজ যিনি আমার মাতা-পিতা, স্ত্রী পুত্র এরা সবাই আগের জন্মে আমার কে ছিলো, কে বলতে পারে। তবে একটা কথা ধ্রুব সত্য আর তা হচ্ছে, আমার এই যে পরিচয়, তা কেবল ৭০/৮০/১০০ বছরের জন্য, তার আগে আমার কি পরিচয় ছিলো , আর ভবিষ্যতেই বা আমার কি পরিচয় হবে, তা কে বলতে পারে ? আর আমার কোনো শ্বাশত পরিচয় আছে কি না, আমরা সেই খোঁজেই আমরা আচার্য্য শঙ্করের আশ্রয় নিয়েছি। আচার্য্য শঙ্করের যিনি দেহধারী গুরুদেব, অর্থাৎ গোবিন্দপাদ, শোনা যায়, তিনি নাকি ছিলেন ঋষি পতঞ্জলি। যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়, আগের জন্মে নাকি বাবাজির শিষ্য ছিলেন। তাঁর সেই পূর্বজন্মের সাধানগুহায় ডেকে নিয়ে বাবাজি আবার তাকে দীক্ষা দিয়েছিলেন, আর পুব্বজন্মের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন।
তো কে আমি, কি আমার পরিচয় ?
আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, স্বরূপতঃ আমরা সবাই ব্রহ্ম। এটাই আমাদের শ্বাশত পরিচয়। এর বাইরে যাকিছু সবই আমাদের সাময়িক সময়ের পরিচয়। চাকরিটা থাকতে বড়বাবু, চাকরি চলে গেলে, আমি সেই আগের আমি। যার কোনো আলাদা পদ নেই। দেহ থাকতে আমি আমার এই দেহকেই আমি ভেবে বসে আছি। কিন্তু তো এই দেহ একদিন থাকবে না, তখন আমার কি পরিচয় হবে ? আর এই যে দেহ তা নিয়ত পরিবর্তনশীল, এককালে এই শিশুর আকারে ছিল, ধীরে ধীরে সে কৈশোরে পদার্পন করেছে, একসময় যৌবন লাভ করে, প্রৌঢ় হয়েছে, ধীরে ধীরে আজ বৃদ্ধে পরিণত হয়েছে। একসময় এই দেহের নাশ হবে, তখন আমার পরিচয় কি হবে ? নাকি সব শূন্যে মিলিয়ে যাবে। আমি বলে কিছুই থাকবে না। আমি সত্ত্বার সমাপ্তি হবে ?
আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, দেহাদিতে আমি-জ্ঞানই বন্ধনের কারন। আর এই যে দেহাদিতে আমি জ্ঞান এ আসলে অজ্ঞান ছাড়া কিছু নয়। এই অজ্ঞানের বশীভূত হয়েই দেহকে আমি জ্ঞান করে, বিবিধ ভোগ্য বিষয়ের দ্বারা দেহের পালন পোষন মাৰ্জন করে থাকি। গুটিপোকা যেমন পরিশ্রম করে নিজের শরীর থেকেই সুতো উৎপাদন করে সেই সুতো দ্বারা নিজের মরনফাঁদ রূপ গুটি প্রস্তুত করে থাকে, আমরাও তেমনি কামনা-বাসনা-রূপ কর্ম্মের দ্বারা আমাদের এই দেহ তৈরী করেছি। গুটিপোকা একসময় বাঁচার তাগিদে সেই গুটি কেটে তারই বহু পরিশ্রমে নির্মিত গুটিটিকে ত্যাগ করে, নিজেকে বাঁচায়। কেননা গুটির মধ্যে থাকলে সে গুটির মধ্যে মরে পরে থাকতো। সেই মৃত্যুর যন্ত্রনা থেকে বাঁচবার জন্য সে একদিন গুটিকে কেটে বাইরে বেরিয়ে শ্বাস নিয়ে বাঁচে। তেমনি মুক্তিকামী পুরুষকেও এই বহুযত্নে লালিত-পালিত দেহের মায়া ছেড়ে, আমি-আমার অভিমান ত্যাগ করে বেরিয়ে আসতে হবে। এই হচ্ছে সংসার থেকে মুক্তির উপায়।
আর এর জন্যই যতসব সাধন ক্রিয়া। এর জন্যই গুরুকরন।
কিন্তু এই যে দেহকে আমি ভাবা, যাকে মহাত্মাগন বলছেন, অজ্ঞান এই অজ্ঞান কোথা থেকে এলো ? আর কিভাবেই তা দূরীভূত হতে পারে ?
আমরা আগেই শুনেছি তমোগুণে যে আবরণ শক্তি তা আত্মাকে আবৃত করে রেখেছে। তাহলে কি আত্মাকে কেউ ঢেকে রাখতে পারে ? আসলে রাহু যেমন সূর্যকে গ্রাস করে, তেমনি তমোগুণ আত্মাকে আবৃত করে রাখে। পূর্ণ গ্রহণ কালে সূর্য অপ্রকাশিত থাকে। তেমনি তমোগুণের কারনে আত্মস্বরূপ আমাদের কাছে প্রকাশিত হতে পারছে না। আবার এই আচ্ছাদন কালে, রজোগুণের বিক্ষেপ শক্তি তাকে কাম ক্রোধ, লোভ মোহ ইত্যাদির বন্ধনে আবদ্ধ করে অশেষ দুঃখ-কষ্টের মধ্যে ফেলে নিদারুন কষ্ট প্রদান করে থাকে। আর ঠিক এই সময় হয় বুদ্ধিভ্রম। আর এই ভ্রমাত্মক বুদ্ধির ফলে বিষয় সমুদ্রে সে একবার ডুবছে, আর একবার ভেসে উঠছে। দেখুন সূর্য কিরনের আকর্ষণেই একদিন সমুদ্রের জল মেঘে পরিণত হয়েছিল। আবার এই স্বকৃত সেই মেঘ সেই সূর্যকেই ঢেকে ফেলে, মেঘ নিজেকে প্রকাশ করছে । ঠিক তেমনি আত্মা থেকে উৎপন্ন অহঙ্কার আত্মতত্ত্বকে ঢেকে নিজেকে প্রকাশ করতে থাকে। এই মেঘ যেমন চিরস্থায়ী নয়, কিছুক্ষনের মধ্যেই মেঘ কেটে যায়, তেমনি জীবের যে অজ্ঞান তা একসময় দূরীভূত হয়ে স্বরূপের উপলব্ধি এনে দিতে পারে।
তো তমোগুণের আবরণশক্তি আর রজোগুণের বিক্ষেপশক্তি এই দুই শক্তির প্রভাবেই জীব শরীরকে আত্মা ভেবে বারংবার জন্ম-মৃত্যর যন্ত্রনা ভোগ করছে। এখান থেকে বেরুতে গেলে, চিত্তশুদ্ধি, ব্রহ্ম চিন্তন, এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এই তিন শস্ত্রের আশ্রয় নিতে হবে।
দেখুন কারুর কথায় যদি আপনার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায়, তবে আপনার মধ্যে তাঁর কথা মতো কর্ম্মে প্রবৃত্ত হবার আগ্রহ জন্মাতে পারে। তেমনি বেদবাক্য অর্থাৎ শ্বাশত জ্ঞানের কথায় অর্থাৎ প্রাচীন মুনি-ঋষিদের কথায় যদি আপনার বিশ্বাস জন্মায় তবে আপনার মধ্যে যজ্ঞকর্ম্মে আগ্রহ আসতে পারে। এইবার যদি আপনি নিষ্ঠার সঙ্গে এই যজ্ঞকর্ম্মে প্রবৃত্ত হন, তবে যে ফল একসময় মুনিঋষিগন উপলব্ধি করেছিলেন, সেই একই উপলব্ধি আপনার মধ্যেও হতে পারে। আর এই যজ্ঞ হচ্ছে নিষ্কাম ভাবে স্বধর্ম্ম পালন।
শরীর পঞ্চ কোষের সমষ্টি (অনন্ময়, প্রাণময়, মনময় , বিজ্ঞানময়, আনন্দময়) .এই কোষগুলোর কোনোটিই আত্মা নয়। এটাকে প্রথমে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করুন। এইবার ধীরে ধীরে, এই পঞ্চকোষকে আত্মা থেকে আলাদা করতে হবে।
আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, মুঞ্জাঘাস থেকে তার ভিতরের শাঁস বার করবার জন্য যেমন তার উপরের আবরণ গুলোকে আলাদা করতে হয়, তেমনি বিচারের দ্বারা এই দৃশ্যমান দেহ থেকে সমস্ত অনাত্ম বস্তুকে আলাদা করতে হবে। এই একই প্রক্রিয়ার কথা বলা আছে কঠোপনিষদে। সেখানে বলা হচ্ছে "স্বাৎ শরীরাৎধৈর্যেণ প্রবৃহেৎ " অর্থাৎ স্বীয় শরীর থেকে ধৈর্য্যসহকারে সেই আত্মাকে স্বতন্ত্র করতে হবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, করতে তো হবে, কিন্তু কিভাবে করবো ?
আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, বিচারের সাহায্যে করতে হবে। শঙ্কর বলছেন, মাতাপিতার ভুক্ত অন্নাদির পরিনাম থেকে উৎপন্ন এই দেহ অনন্ময় কোষ বলে জানবে। এই অন্যের দ্বারা জীব জীবিত থাকে, আবার অন্ন না পেলে জীব মারা যায়। তো ত্বক চর্ম্ম মাংস রক্ত বিষ্ঠার সমষ্টি এই অনন্ময় শরীর কখনো নিত্যসুদ্ধ আত্মা হতে পারে না। আত্মা হচ্ছেন নিত্য শুদ্ধ মুক্ত। কিন্তু এই অনন্ময় দেহ জন্মের আগেও ছিল না, আবার মৃত্যুর পরেও থাকবে না। অর্থাৎ ৭০/৮০/১০০ বছরের জন্য এই দেহের প্রকাশ ঘটে, স্বল্পকাল প্রকাশমান থাকে, আবার যতদিন সে প্রকাশমান থাকে, ততদিনও সে একরূপও থাকে না। এর যে অঙ্গপ্রতঙ্গ তার যেমন বৃদ্ধি আছে, তেমনি ধীরে ধীরে এর হ্রাস ঘটে থাকে। শিশু থেকে যুবক, যুবক থেকে বৃদ্ধ হয় । কখনো সুস্থ কখনো অসুস্থ। আবার একদিন সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। তো এই দেহ জড়পদার্থ ছাড়া কিছু নয়। এর কোনো চৈতন্যশক্তি নেই, যা আমরা শরীরের মৃত্যু কালে প্রতক্ষ্য করে থাকি। তো যা জড়-স্বভাবের, যার উৎপত্তি আছে, যার বিনাশ আছে, যা বিকারগ্রস্থ তাকে আমরা আত্মা বলতে পারি না। কারন মাহাতাগন বলে থাকেন, আত্মা শ্বাশ্বত অবিকারী, চৈতন্যসত্ত্বা। তাই শরীরকে আমার আত্মা বলতে পারি না। কিন্তু আত্মা দেহাদির অঙ্গ না হলেও, এই দেহের পরিচালক হচ্ছে আত্মা।
দেখুন আপামর জনসাধারণ স্থুল দেহকেই আমি-আমার বলে মনে করে থাকে। এই মিথ্যা জ্ঞানকে ত্যাগ করা সহজ সাধ্য নয়। তবে এই মিথ্যা জ্ঞানকে যিনি ত্যাগ করতে পারেন, তিনিই বুদ্ধিমান, তিনিই প্রকৃত জ্ঞানী। অধিকাংশ মানুষ, মোহগ্রস্থ বলে আপনি কেন মোহগ্রস্থ হবেন ? বিচারশীল ব্যক্তি দেহ থেকে ভিন্ন অথচ দেহস্থিত শুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপকে অনুভব করে থাকেন। নিজেকে বলুন, রে নির্বোধ, এই রক্ত, মাংস, চামড়া, হাড্ডিগুড্ডি, শ্লেষ্মা মল মূত্র সম্বলিত এই শরীরে "আমি" জ্ঞান ছেড়ে দাও। সেই নির্বিশেষ ব্রহ্মে আত্মভাবনা করো, আর শান্তি অনুভব করো। (১৬১)
আচার্য্য শঙ্কর (১৬২) বলছেন, দেহাভিমান থাকতে মুক্তি নেই। অথচ আমরা এই দেহভিন্ন আমিকে আমাদের উপল্বদ্ধিতে আনতে পারি না আবার আনা সহজসাধ্যও নয়। আচার্য্য বলছেন, কোনো বিদ্বান ব্যক্তি, বেদান্ত দর্শনে ও নীতিশাস্ত্রে যত বড়ো পণ্ডিত হন না কেন, যতক্ষন না এই অনিত্য দেহ-ইন্দ্রিয়াদিতে যে অনিত্য বিষয়-ভ্রম উৎপন্ন হচ্ছে, যে "আমি-আমার" বোধ উৎপন্ন হচ্ছে, এই বোধের উর্দ্ধে উঠে আত্মজ্ঞান লাভ করতে না পারছেন, ততক্ষন মুক্তি লাভের কোনো সম্ভাবনা নেই।
এই আমি কে ধরবার একটা সাধন ক্রিয়া আছে, যাকে বলা হয় অহং-এর ধ্যান। এই অহং-এর ধ্যান সম্পর্কে আমরা পরের দিন শুনবো স্বামী সোমেশ্বরানন্দের কাছ থেকে ।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
সংসার বন্ধন থেকে মুক্তিলাভের উপায় (১০) - বিবেক চূড়ামণি - আচার্য্য শঙ্কর ।
আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, দেহজ্ঞান ছাড়ো। দেখো নিজের ছায়াকে আমরা কেউ "আমি" মনে করি না। আয়নায় প্রতিফলিত দেহের যে প্রতিচ্ছবি তাকেও আমরা কেউ "আমি" বলে মনে করি না। এমনকি স্বপ্নে বা কল্পনায় আমরা যে শরীর দেখি, তাকেও কেউ "আমি" বলে মনে করি না। ঠিক তেমনি এই যে জীবিত শরীর অর্থাৎ রক্ত মাংসের হাড্ডিগুড্ডি, মল-মূত্রের আশ্রয় এই যে শরীর তাকেও তুমি "আমি" বলে মনে করো না। কিন্তু বাস্তব হচ্ছে, আমরা সবাই এই দেহকেই আমি বলে মনে করি। এই দেহকে ঘিরেই আমাদের যতসব আমিত্ত্ব।
এখন কথা হচ্ছে, এই যে ছায়া, প্রতিবিম্ব, বা স্বপ্নে দেখা শরীর এটা যে আমাদের জীবিত শরীর থেকে আলাদা, সেটা আমরা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারি। এর জন্য আমাদের কোনো যুক্তি-তর্কের আবশ্যক হয় না। আলাদা করে কোনো জ্ঞান বুদ্ধির দরকার পড়ে না। একটা গুতো খেলেই আমরা বুঝতে পারি, যে আমি ব্যাথা পাচ্ছি। যতই পন্ডিতি করে আমরা বলি না কেন, যে আমি দেহ নোই, আমি আত্মা ইত্যাদি ইত্যাদি কিন্তু যখন আমরা অসুস্থ হই, তখন আমরা কাতরাতে থাকি। যতই আমরা বলি না কেন, যে আমরা সবাই আত্মা। আর এই আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, যখন আমাদের স্বজনের, প্রিয়জনের দেহপাত হয়, তখন আমরা শোকে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকি। যতই বলি না কেন, আজকে অর্থাৎ এই জনমে যাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তৈরী হয়েছে, এরা কেউ আমার আপনজন নয়, এরা কেউ আগের জন্মে আমার সঙ্গে হয়তো ছিলই না, বা ভবিষ্যৎ জীবনেও থাকবে না। তথাপি এই সম্পর্ককে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। এদের দুঃখ-কষ্টে আমিও দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে থাকি। এমনকি আমরা যখন মৃত্যুর সম্মুখীন হই, তখন আমাদের মধ্যে একটা আতঙ্ক, একটা ভয় আমাদেরকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। ঠাকুর রামকৃষ্ণের মতো অবতার পুরুষের মধ্যেও আমরা শারীরিক যন্ত্রনার অভিব্যক্তি দেখতে পেয়েছি।
তাই চট করে, আমাদের পক্ষে এই দেহকে "আমি" বলে যে জ্ঞান আমাদের হয়েছে, তার থেকে নিজেকে আলাদা করতে পারি না। অর্থাৎ আত্মাকে দেহ থেকে থেকে আলাদা করতে পারি না। যুক্তি বিচার করে হয়তো আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি, যে এই দেহ থেকে আত্মা ভিন্ন। কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে এর প্রতিফলন ঘটানো সহজসাধ্য নয়।
এখন কথা হচ্ছে সহজ সাধ্য নয়, এককথা যেমন সত্য, তেমনি দেহ ও আত্মা দুটো যে বিপরীতধৰ্ম্মী বস্তু একথাও সত্য। আর আমাদের যদি সত্যকে জানবার ইচ্ছে প্রবল হয়, আমরা যদি স্বরূপকে জানতে চাই, তবে যোগীপুরুষের এই সিদ্ধান্তকে আমাদের মেনে নিতে হবে। হ্যাঁ প্রথমে শুধু মেনে নিন, যে দেহ এত আত্মা আলাদা। ধীরে ধীরে এই সত্যকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে শিখুন। মনের মধ্যে এই কথাটাকে শিবলিঙ্গের মতো বসিয়ে এর ধ্যান করতে থাকুন। আমি শরীর নোই, আমি আত্মা। আমি শরীর নোই, আমি আত্মা। বার বার এই কথা স্মরণে আনতে থাকুন। এবং নিজেকে বলুন, আমি আমার স্বরূপ জানতে চাই, যা নিত্যবস্তু তাতেই আমি স্থিত হতে চাই। এই যে অনিত্য দেহ, এই অনিত্যদেহে "আমি" বুদ্ধি আমি অবশ্য়ই বৰ্জন করবো। আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, এই দৃঢ় সংকল্প করে, নিরন্তর চেষ্টা করতে করতে একদিন এই দেহে যে আমিত্ব-বুদ্ধি, তা দূর হতে পারে।
আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, (১৬৪) যেহেতু শরীরে আত্মবুদ্ধি - অশুদ্ধ। আর এই অশুদ্ধ বুদ্ধিই জন্ম-মৃত্যুর কারন, তাই মনের এই ভ্রান্ত দেহাত্মবুদ্ধি ত্যাগ হলেই আর কোনো জন্ম মরনের সম্ভাবনা থাকবে না। আচার্য্য শঙ্কর বলছেন বটে, আর আমরা তাঁর কথায় বিশ্বাসও করছি, কিন্তু মন থেকে এই দেহাত্ম বুদ্ধি তাড়িয়ে দেওয়া খুবই শক্ত। দেখুন আমাদের সব কিছুই এই শরীরকে ঘিরেই চলছে। এমনকি আমাদের অধ্যাত্ম সাধনা তাও এই দেহকে ঘিরেই শুরু করতে হয়। আমরা ঘুমুচ্ছি, চলছি, ফিরছি, কথা বলছি, এমনকি চিন্তা করছি, এসবই আমরা দেহকে ঘিরেই করে থাকি। তাই দেহটা আমি নোই, এই ধরনের চাপানো কথায় "আমি দেহ নোই" এমনটা আমাদের মনের মধ্যে কোনো কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে না। সেক্ষেত্রে উপায় হচ্ছে, প্রতিনিয়ত আমাকে এইচিন্তা করতে হবে, যে আমি নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্ত, আত্মা। এই আত্মাই আমার স্বরূপ। এই কথাটা আমাদের প্রতিটি কাজের মধ্যে স্মরণে আনতে হবে। প্রতি মুহূর্তে আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, যে আমি এই দেহে আছি বটে, কিন্তু আমি দেহ নোই। এই দেহ আমার আবাসস্থল। আমি দেহ নোই। এই দেহের মধ্যে যে মন-বুদ্ধি কাজ করছে, তা সেই চৈতন্যের প্রভাবে সম্পন্ন হচ্ছে। এই চৈতন্য না থাকলে, এই দেহ অকেজো হয়ে যাবে। এই ধরনের চিন্তা বারবার মনের মধ্যে ওঠাতে হবে। আর বারবার এই একই চিন্তা ওঠাতে থাকলে, দেখবেন, এই দেহের প্রতি আমাদের যে টান, মমত্ত্ববোধ তা ধীরে ধীরে শিথিল হতে শুরু করবে। আর এই প্রক্রিয়া যত দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকবে, তত মনের মধ্যে বিশ্বাস দৃঢ় হতে শুরু করবে। একটা সময় প্রাকৃতিক কারনে, যখন চোখে কম দেখবেন, কানে কম শুনবেন, দাঁত পড়ে যেতে থাকবে, মাথার চুল উঠে যাবে, গায়ের চামড়া ঢিলে হবে, তখন এর জন্য কোনো কষ্ট অনুভব হবে না। আর শরীরের জন্য কোনো মায়াবোধ থাকবে না। শরীরের এই যে স্বাভাবিক স্খলন, বা পরিণতি এর জন্য কোনো বিয়োগব্যাথা অনুভব হবে না। এমনকি একদিন যখন এই শরীরকে ছেড়ে যাবার সময় আসবে, অর্থাৎ যখন আমরা মৃত্যুর সম্মুখীন হবো, তখনও আমাদের এই শরীরটার প্রতি মায়া থাকবে না। তখন স্থুল শরীর ত্যাগ অনেক সহজ সাধ্য হবে। মৃত্যু তখন আর অবাঞ্চিত হবে না। মৃত্যুকে অবশ্যম্ভাবী মনে করে আত্মস্থিত থাকতে পারবো। যাইহোক, এতো তাড়াতাড়ি মৃত্যুর কথা নাই বা শুনলাম। এর আগে আমরা অনন্ময় কোষের কথা শুনেছি। এই অন্নময় কোষ অন্নের দ্বারা পুষ্টি লাভ করে থাকে।
প্রাণময় কোষ :
এবার আমরা প্রাণময় কোষের কথা একটু শুনে নেই। আমরা জানি প্রাণবায়ু আমাদের শরীরের সর্বত্র চলাচল করে আমাদের শরীরকে সচল করে রেখেছে। এমনকি আমরা ও লক্ষ করেছি, আমাদের শরীরের কোনো বিশেষ অঙ্গে যদি এই প্রাণের প্রবাহ না থাকে, তবে আমাদের সেই অঙ্গ অকেজো হয়ে যায়। আর এই কাজ অর্থাৎ সমস্ত শরীরের মধ্যে এই প্রাণবায়ুকে ছড়িয়ে দেবার কাজ করে থাকে আমাদের কর্ম্মেন্দ্রিয়। অর্থাৎ বাক, হস্ত , পাদ, পায়ু, উপস্থ। এই যে কর্ম্মেন্দ্রিয় এগুলো কাজ করে, আমাদের মস্তিষ্কের নির্দেশে। তো প্রাণময় কোষের দ্বারা আমদের সমস্ত অঙ্গপ্রতঙ্গ চেতনাযুক্ত হচ্ছে। আর এই প্রাণময় কোষ আছে বলেই, আমাদের অন্নময় কোষগুলো কাজ করতে পারে। তো এইদিক থেকে দেখতে গেল, আমাদের দেহ বা অন্নময় স্থুলদেহ চেতনা সম্পন্ন হচ্ছে তার কারন হচ্ছে এই প্রাণবায়ু। তাই আপাতত মনে হয়, প্রাণ-ই হচ্ছে চেতনার কারন, বা প্রাণ-ই আমাদের আত্মা-স্বরূপ ।
কিন্তু সত্য হচ্ছে, প্রাণময় কোষ আমাদের আত্মা নয়। প্রাণময় কোষ হচ্ছে অপাঞ্চিকৃত বায়ুর বিকার মাত্র। এই বায়ু আমাদের শরীরের একবার ভিতরে যাচ্ছে, আবার বাইরে বেরিয়ে আসছে। এর নিজের কোনো ভালোমন্দ বোধ নেই। এমনকি সুখ-দুঃখ বোধও নেই। এই বায়ু না পারে নিজেকে জানতে, না পারে অন্যকে জানতে (শ্লোক-১৬৬) । আমরা বায়ু জ্ঞাতসারে হোক বা অজ্ঞাতসারে হোক, ফুসফুসের সাহায্যে নাক দিতে টানছি, তাই সে প্রবেশ করছে, আবার বের করে দিচ্ছি, তাই সে বেরিয়ে যাচ্ছে। এর নিজের কোনো ইচ্ছেশক্তি নেই, বরং বলা যেতে পারে, সে আমার ইচ্ছেতেই আসছে যাচ্ছে। আমরা যখন প্রাণায়াম করি, তখন সে আমাদের বশে থাকে। কিন্তু আমরা শুনেছি, আত্মা জ্ঞানস্বরূপ, আত্মা স্বাধীন, আত্মা স্বতন্ত্র। অতয়েব প্রাণময় কোষ কখনো আত্মা হতে পারে না।
এর পরে আছে আমাদের মনোময় কোষ। এই মনোময় কোষ নিয়ে আলোচনা একটু দীর্ঘ হবে। তাই আজ আর এই আলোচনার মধ্যে ঢুকলাম না। শুধু এইটুকু বলি, আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, (শ্লোক ১৬৭) আমাদের যে পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় (চক্ষু কর্ণ নাসিকা জিহবা ত্বক) ও মন - এই হচ্ছে আমাদের মনোময় কোষের বা মনোময় দেহের উপাদান। আমরা জানি, খাদ্যের সূক্ষ্ম অংশ দিয়ে তৈরী হচ্ছে আমাদের মন। সাধন জগতে এই মনোময় কোষের ভূমিকা সবচেয়ে বেশী। অজ এইপর্যন্ত। .....চলবে
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
সংসার বন্ধন থেকে মুক্তিলাভের উপায় (১১) - মূলসূত্র : বিবেক চূড়ামণি - আচার্য্য শঙ্কর ।
আমরা শুনছিলাম মনোময় কোষের কথা। এই মনোময় কোষ অত্যন্ত বলবান। বলা হয়, মনটা যদি না থাকতো, তবে আমি-আমাকেই চিনতে পারতাম না। আমাদের যে অহংভাব আমি আমার ভাব তা এই মনোময় কোষকে অবলম্বন করেই হয়ে থাকে। বস্তুর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ভাব দেখছি, তা এই মনোময় কোষের কারণেই হচ্ছে । জগতের এই যে বৈচিত্র তার ধারণার স্থান হচ্ছে এই মনোময় কোষ। আর এই মনোময় কোষ অনন্ময় ও প্রাণময় কোষকে পরিবৃত করেই প্রকাশিত হচ্ছে। জ্ঞান-ইন্দ্রিয় ও মন একসঙ্গে মিলে হয়েছে, মনোময় কোষ। এর আগে আমরা শুনেছি, প্রাণময় কোষ পরের অধীন। অর্থাৎ এর কোনো নিজস্ব ইচ্ছেশক্তি নেই। আর তাই প্রাণায়ামের সাহায্যে এই প্রাণময় কোষকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। আসলে এই যে প্রাণময় কোষ এটি মনোময় কোষেরই অধীন। মন ও প্রাণের চঞ্চলতা পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত। প্রাণের চঞ্চলতায় মন চঞ্চল হয়, আবার মনের চঞ্চলতায় প্রাণ চঞ্চল হয়।
তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হচ্ছে, প্রাণের স্পর্শে ইন্দ্রিয়সকল সক্রিয় হয়। আর এই কারণেই ইন্দ্রিসকল সে তার নিজ নিজ কর্ম্ম সম্পাদন করতে সক্ষম হয়। কি মানুষ কি জীবজন্তু সবার ক্ষেত্রেই একই কথা প্রযোজ্য । প্রাণ আছে তাই প্রাণী। প্রাণ-ই সবাইকে জীবনীশক্তি দান করছে। যতদিন প্রাণ থাকে ততদিন আমরা জীবিত থাকি। তো অনন্ময় কোষের অন্তরতম আত্মা হচ্ছে এই প্রাণময় কোষ, আর এই প্রাণময় কোষের গভীরে আছে আমাদের মনোময় কোষ। এই মনোময় কোষই সমগ্র প্রাণসত্তাকে পূর্ণ করে রেখেছে। অন্নময় কোষ যেমন আমাদের দেহের একটা আকৃতি দিয়েছে, আবার এই প্রাণময় কোষ অবিকল এই স্থুল দেহের আকৃতির মতোই একটা বায়বীয় দেহ দিয়েছে । অর্থাৎ দেহের সর্বত্র এই বায়ুর বিস্তার আছে। এখন কথা হচ্ছে আমাদের অনন্ময় শরীরের একটা আকৃতি আছে, আমাদের প্রাণময় শরীরের একটা আকৃতি আছে, কিন্তু আমাদের মনোময় শরীরেরও কি কোনো আকৃতি আছে ? অর্থাৎ মনোময় কোষ বা মনোময় শরীর দেখতে কেমন ? তৈত্তিরীয় উপনিষদ বলছেন, এই মনোময় কোষের আকারও প্রাণময় কোষের মতো। আসলে এই অন্নময়, প্রাণময়, ও মনোময় এই তিনটে দেহই পার্থিব পদার্থে তৈরী। আর যেহেতু পার্থিব, তাই এদের প্রত্যেকের একটা আছে আকৃতিও আছে। (তৈত্তিরীয়-২/৩/১) আর তা দেখতে ঠিক মানুষের মতো। আর এই তিন দেহই একে অন্যের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে।
তো কর্ম্ম-ইন্দ্রিয়গুলো নিয়ে আমাদের স্থুল অন্নময় দেহ কাজ করছে । আবার আমাদের জ্ঞান-ইন্দ্রিয় গুলো নিয়ে সূক্ষ্ম মনোময় দেহ কাজ করছে। আর জ্ঞানেন্দ্রিয় অর্থাৎ কান দ্বারা শুনছে, চোখ দ্বারা দেখছে, জিহ্বা দ্বারা আস্বাদন করছে, ত্বক দ্বারা স্পর্শ করছে, নাক দ্বারা ঘ্রান গ্রহণ করছে। এই যে বিষয় গ্রহণ ক্রিয়া, যা আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে আমাদের জ্ঞান ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া তা আসলে কিন্তু হচ্ছে মনের কারনে। এই মনই মনে করছে, আমি দেখছি, শুনছি ইত্যাদি। কিন্তু এই যে মন, এর কোনো স্থিরতা নেই, সে কখনো ভাবছে এইরকম দেখলাম, আবার ভাবছে হয়তো অন্য রকম ছিল। তো একটা সন্দেহ সংকল্প বিকল্পের দোলায় মন সারাক্ষন দুলছে। জগতের মধ্যে এই যে বৈচিত্রের ধারণা এটা মনের মধ্যেই উৎপন্ন হচ্ছে। এখন কথা হচ্ছে, এই অন্নময়, প্রাণময়, মনোময়, এই তিন পার্থিব শরীরের সাহায্য নিয়েই আমাদের আত্মার খোঁজ করতে হবে।
আচার্য্যদেব বলছেন, মনের অতিরিক্ত কোনো অবিদ্যা নেই। এই অবিদ্যার কারণেই মন সংসার বন্ধনের হেতু হয়ে থাকে (শ্লোক:১৬৯) । অবিদ্যা অর্থাৎ মায়া। আচার্য্যদেব বলছেন, মায়া বা অবিদ্যার সবচেয়ে বেশি প্রভাব হচ্ছে আমাদের মনে। এই মনের কারণেই আমরা নিজেদেরকে বদ্ধ ভাবছি, আবার এই মনের কারণেই আমরা নিজেদেরকে মুক্ত ভাবছি। এই মনই অনিত্য বস্তুকে অর্থাৎ দেহাদিতে আমি আমার বলে আঁকড়ে ধরছে, আবার সেগুলোকে হারাবার ভয়ে দুশ্চিন্তা করছে মন এই অনিত্য বস্তুকেই রক্ষনাবেক্ষন করতে চাইছে, এইসবের মধ্যে সে নিজেকে কর্ত্তা ভেবে অশান্ত হয়ে অস্থির হয়ে নিজেকে বিক্ষুব্ধ করছে। আর এসবই হচ্ছে অজ্ঞানের কারনে। এই কারনে আচার্য্যদেব বলছেন, মনের নাশ হলে সব বন্ধনের নাশ হতে পারে।
কিন্তু কথা হচ্ছে মনের নাশ কিভাবে হবে ? আসলে মনের ক্রিয়া বন্ধ হলেই মন স্থির হতে পারে। এই মনের ক্রিয়া হচ্ছে সংকল্প-বিকল্প। মনের মধ্যে এই সংকল্প-বিকল্পের ফলেই মনের বিকাশ ঘটে থাকে। আর সংসার শুরু হয়। আবার এই সংকল্প-বিকল্পের পরিসমাপ্তিতে মনের নাশ হতে পারে। আসলে মনের নাশ তো হয় না, মন নিষ্ক্রিয় হয়। তাই আমরা দেখেছি,সাধনক্রিয়ার ফলে কিছুক্ষনের জন্য, বা কিছুদিনের জন্য, সংকল্প বিকল্প শূন্য হয়ে মনের শান্ত ভাব হয়, আবার যখন মনের মধ্যে সংকল্প বিকল্পের উৎপত্তি হয়, তখন আবার মনের প্রকাশ ঘটে। কিন্তু কথা হচ্ছে এই সংকল্প-বিকল্প ত্যাগ কিভাবে হতে পারে ? আচার্য্য দেব বলছেন, আমাদের দেহাত্মবুদ্ধি চলে গেলেই সেটা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু দেহাত্মবুদ্ধি চলে যাওয়া কি এতটাই সহজ ? আবার দেখুন, স্বপ্নাবস্থায় তো আমাদের স্থুল দেহাত্মবোধ থাকে না, কিন্তু তখনও আমাদের মন অশান্ত হয়। স্বপ্নাবস্থায় আমাদের দেহ নিষ্ক্রিয় থাকে তথাপি, আমরা দৌড়ে বেড়াচ্ছি, কত কি খাচ্ছি, কতকিছু করছি। তো দেহাত্মবোধ চলে গেলেও তো আমাদের মন অশান্ত থাকছে, সেখানে থেকে বেরুবো কি করে ? অর্থাৎ জেগে থেকে যেমন ভোগ্য বস্তুর পিছনে ছুটছি, তেমনি স্বপ্নাবস্থাতেও আমরা সেই একই রকম ভোগ্য বস্তুর পিছনে ছুটছি। তো দেহ নিস্ক্রিয় হয়ে গেলেও, মনই আমাদের দৌড় করাচ্ছে। আমরা আমাদের রাগ, দ্বেষ, ঘৃণা, ভয় ইত্যাদি থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছি না। আচার্য্যদেব বলছেন, এই অবস্থা থেকে বেরুতে গেলে আমাদের সুসুপ্তির অবস্থায় যেতে হবে, অর্থাৎ আমাদের গাঢ় ঘুমের মধ্যে নিজেকে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু গাঢ় ঘুমে কি আমরা ইচ্ছে করে যেতে পারি ?
তো এই গাঢ় ঘুমে কি হয়, অর্থাৎ সুসুপ্তিতে আমাদের কেমন অবস্থা হয়, সেটা আমরা একটু বুঝে নেই। দেখুন এই যে সংসার এসব মনের কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। আর সুসুপ্তির সময় মন যখন আত্মাতে লীন হয়ে যায়, তখনও আমদের কাছে সংসার বলে কিছু থাকে না। তো একটা জিনিস পরিষ্কার যে সংসার আমাদের মনের সৃষ্টি মাত্র। মন যখন সুসুপ্তিকালে আত্মাতে স্থিত হচ্ছে, তখন আমাদের কাছে সংসার বলে কিছুই থাকছে না। এই সুসুপ্তিকালীন যে আত্মা এঁকে বলা হয় প্রজ্ঞা। স্বপ্নে ছিলো আত্মার তৈজস অবস্থা । সুসুপ্তিতে এসে হলো প্রজ্ঞা। স্বপ্নে আমরা যেমন সূক্ষ্ম শরীরের মধ্যে অবস্থান করছিলাম, জাগ্রত অবস্থায় আমরা যেমন স্থুল শরীরে অবস্থান করছিলাম, তেমনি এই গাঢ় ঘুমে অর্থাৎ সুসুপ্তির অবস্থায় আমরা আমাদের কারন শরীরে অবস্থান করে থাকি । আর এই কারন শরীরে যে আত্মা বিরাজ করছেন, তিনি প্রজ্ঞা নামধেয়। এই কারন শরীর যেখানে প্রজ্ঞা অবস্থান করছেন, তা দ্বিবিধ বিজ্ঞানময় কোষ, ও আনন্দময় কোষ। এই দুয়ে মিলে আমাদের কারণ শরীর। এই কারণ শরীরে আছেন প্রজ্ঞারূপ পরমাত্মা।
প্রজ্ঞা কথাটার অর্থ হচ্ছে, প্র অর্থাৎ জ্ঞাত হওয়া বা জানা, অ অর্থাৎ যা ভাসিত হচ্ছে। তো আমার জ্ঞাননেত্রের সামনে যা ভাসছে, জ্ঞাননেত্রের সামনে সাক্ষাৎ প্রতক্ষ্যবৎ অথচ অপরোক্ষ তত্ত্বের উপলব্ধি। এটি কার দ্বারা সম্পন্ন হয়, তীক্ষ্ণ জ্ঞান-বুদ্ধির দ্বারা। অর্থাৎ সামনে উপস্থিত মূল জ্ঞাতব্য বিষয়কে আশেপাশের ডালপালা থেকে সরিয়ে দিয়ে উপলব্ধ যে জ্ঞান তাকে বলা হয় প্রজ্ঞা। অর্থাৎ যথার্থ জ্ঞান। ইংরেজিতে যাকে বলা যায় WISDON -ফলজ্ঞান। জগতের চরম উদ্দেশ্য বিষয়ে যথা সম্ভব তত্ত্ব নির্ধারণ করাই প্রজ্ঞার কার্য্য। তো প্রজ্ঞা বলতে আমরা সূক্ষ্ম জ্ঞানকে বুঝি। আর এই প্রজ্ঞাকে উপনিষদ বলছে কারন শরীরের আত্মা।
বিজ্ঞানময় কোষের মধ্যে বুদ্ধিরূপ আত্মা আছেন, আবার এই বিজ্ঞানময় কোষের অভ্যন্তরে আনন্দময় কোষ আছেন, যার মধ্যে আছে আনন্দরূপ আত্মা। আর এই দুয়ে মিলে (বিজ্ঞানময় ও আনন্দময়) কারণ শরীর। তো কারণ শরীরে যে প্রজ্ঞা রূপ আত্মা আছেন, তিনি বুদ্ধি ও আনন্দের স্বরূপ। তৈত্তিরীয় উপনিষদ (শ্লোক ২/৫/১) বলছে, এই বিজ্ঞানময় কোষ ও আনন্দময় কোষের আকৃতিও মনুষ্যদেহের অনুরূপ। উপনিষদের নির্দেশ হচ্ছে, বুদ্ধিকে অনুসরণ করলে আমাদের সব দুর্বল ও সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করা যায়। তখন আর আমাদের শরীরের দাসত্ব করতে হয় না। স্থুল থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে আমাদের সূক্ষ্ম স্তরের দিকে এগিয়ে যেতে পারি। এটাই সংসারমুক্তিকামী সাধকের উদ্দেশ্য হবে। শরীরকে নিয়ে আমাদের ব্যতিব্যস্ত হওয়া উচিত নয়। শরীরকে গুরুত্ত্ব দেওয়া মানে নির্বুদ্ধিতাকে গুরুত্ব দিয়ে পুষে রাখা।
বিজ্ঞানময় কোষ, আনন্দময় কোষ এই দুয়ে মিলে যে কারন শরীর তাকে আমরা যেন আত্মা বলে ভুল না করি। তবে এই অবস্থায় আমরা আত্মার খুব কাছাকাছি থাকি। অর্থাৎ সুসুপ্তির অবস্থায় আমরা আত্মার খুব কাছাকাছি অবস্থান করে থাকি। দেখুন আপনি যত পাহাড়ের উপরের দিকে উঠতে থাকবেন, তত শীতের সুশীতল বাতাস আপনাকে ঘিরে থাকবে। তেমনি আপনি যত সূক্ষ্ম শরীরের মধ্যে প্রবেশ করতে পারবেন, তত আপনি আত্মার সান্নিধ্য অনুভব করতে পারবেন। আমাদের সকল দুর্দশার কারন হচ্ছে, আমাদের অনাত্মবোধ। এই অনাত্মবোধ থেকে যত আমরা আত্মবোধে স্থির হতে পারবো, ততো আমরা শান্তি অনুভব করতে থাকবো। তো আমাদের সুসুপ্তির অবস্থায় যেতে হবে, কারণ শরীরের মধ্যে প্রবেশ করতে হবে. আর তা হতে পারে, আমাদের সূক্ষ্মবুদ্ধি ও জ্ঞানের দ্বারা। এই হচ্ছে সংসার মুক্তির পথ।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
সংসার বন্ধন থেকে মুক্তিলাভের উপায় (১২) -
সংসার বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে গেলে, আগে বুঝতে হবে, কে সংসার থেকে মুক্তি পেতে চায় ? আমি সংসার থেকে মুক্তি পেতে চাই। তো আমিটা কে বা আমিটা কি ? আর জগৎ সংসারটাই বা কি ? আর এই জগৎ-সংসারের সঙ্গে আমার সম্পর্কটাই কি ? এই তিনটে জিনিষ যখন আমাদের উপল্বদ্ধিতে আসবে, তখন আমাদের মুক্তি আমাদের ইচ্ছের অধীন হবে। অর্থাৎ আমাদের তখন ইচ্ছে চাইলে সংসার করবে, আর না চাইলে সংসার করবে না। আজ আমরা এই আমি-বোধকে ধরবার চেষ্টা করবো।
আমরা এর আগে শুনেছি, আমাদের তিনটে অবস্থা। জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি। এগুলো আসলে মনের তিনটে অবস্থা মাত্র। অর্থাৎ আমাদের চেতন মন, অবচেতন মন, ও অতিচেতন মন। দেখুন আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর কোনো স্বাধীন সত্তা নেই। এই তিন মন যখন কাজ করে তখন সে আত্মার বলে বলীয়ান হয়ে ওঠে। আত্মার এই তিন অবস্থায় তিনটে মনের সাহায্যে যেমন কাজ করে, তেমনি এই তিন অবস্থায় আমাদের আত্মাও তিনটি নামে অভিহিত হয়। অর্থাৎ প্রথমে বৈশ্বানর, তারপরে তৈজস, এবং শেষে প্রজ্ঞা। আসলে আত্মা তো একটাই কিন্তু অবস্থাভেদে এঁকে তিন নামে ডাকা হয়।
দেখুন আমরা যখন ক্লান্ত বোধ করি, তখন আমাদের ঘুম পায়। আবার এই ঘুমের মধ্যেই আমরা কখন যে একসময় গাঢ় ঘুমের মধ্যে চলে যাই, তা আমরা কেউ জানি না। ঘুমে কি হয় ? ঘুমে আমাদের স্থূল শরীর নিষ্ক্রিয় থাকে কিন্তু স্থুল শরীরের অনুরূপ একটা মানসিক দেহে যা আসলে সূক্ষ্ম দেহ, সেই দেহ স্বপ্নাবস্থায় আমাদের সক্রিয় হয়ে ওঠে। আর তেজস নামক আত্মার সাহায্যে জগতের অনুরূপ একটা ছায়া জগতে বিচরণ করে। এরপরে আমরা যখন গাঢ় ঘুমের মধ্যে চলে যাই, তখন আর কোনো জগতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক থাকে না। এইসময় আমরা প্রাজ্ঞ নামক আত্মার সঙ্গে আমরা অবস্থান করি। তো এই তিন অবস্থাকে কে পর্যবেক্ষন করছে ? এই তিন অবস্থাকে যিনি পর্যবেক্ষন করছেন, তিনি সেই অন্তরাত্মা বা আমি। এই অমিকে আমাদের ধরতে হবে। কিন্তু কিভাবে ? -------------------
এই আমিকে আমরা ধ্যানের সাহায্যে ধরতে পারি। আমরা জানি, ধ্যান ধারনা-ভেদে দুই রকম। সাধক প্রথম দিকে শাস্ত্রাদি পাঠ করে, বা কারুর কাছ থেকে শুনে, বা তার নিজস্ব সংস্কার অনুযায়ী নিজের মধ্যে বা ঈশ্বর সম্পর্কে একটা ধারণা করে নেয়। এই ধারণার ধ্যানকে বলা হয় প্রতীকের ধ্যান। আরো এক প্রকার ধ্যান আছে যাকে বলা হয় অহং-এর ধ্যান। আমাদের আলোচ্য হচ্ছে অহং-এর ধ্যান।
অহং-এর ধ্যানে নাম-রূপ-ভাব ইত্যাদির প্রতি গুরুত্ত্ব না দিয়ে দেখতে হয়, এসবের দ্রষ্টা কে ? দ্রষ্টা হচ্ছেন, অহং। এই অহং-এর ধ্যানে সাধক অন্তরের মূল অনুভূতির গোড়ায় পৌঁছতে চান। সুসুপ্তির অবস্থায় আমাদের কি হয়, এবং সুসুপ্তির ঘুম থেকে জেগে উঠে আমাদের কি অবস্থা হয়, সেটিকে ধরবার চেষ্টা করতে হয়। প্রথমে একটু মনে করবার চেষ্টা করুন, গাঢ় ঘুম থেকে জেগে উঠে আমাদের কি অবস্থা হয় ? এইসময় কয়েক সেকেন্ডের জন্য, আমরা আমাদের দেশ-কালের অবস্থা ভুলে থাকি। অর্থাৎ আমি এখন কোথায় আছি, এখন সকাল না বিকেল, তা আমাদের ধারণাতে আসে না। যদিও এই অবস্থা আমাদের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কেটে যায়। তখন আমরা আবার সংসারে ফিরে আসি। যারা অহং-এর ধ্যান করেন, তাঁরা এই সুসুপ্তির এই অবস্থাকে দীর্ঘায়িত করেন, এই অবস্থাকে ভালোভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে, আরো গভীরে চলে যেতে চান। এখন কথা হচ্ছে কি করে যান ? যদিও এই কথাগুলো, কখনও লিখে বা বলে বোঝানো সম্ভব যায় না, তথাপি এই কথাগুলোর মধ্যে তার একটা আভাস পেতে পারেন। যা আপনাকে হয়তো অহং-এর ধ্যানে অনুপ্রাণিত করবে।
যাইহোক, যাঁরা এই অধ্যাত্ম পথের পথিক, অর্থাৎ যাঁরা সাধন ভজন, ধ্যান-ধারণা ইত্যাদির মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন, তাঁরা জানেন, প্রথম দিকে মন বা মনের চিন্তা নিয়েই সাধন জগতে এগুতে হয়। এর পরে আমাদের ধীশক্তির সাহায্যে এগুতে হয়। এই ধীশক্তি যেন একটা আলো। আর এই আলোই আমাদের পথ দেখিয়ে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে, অথবা বলা যেতে পারে এই আলোই আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়।
এবার আমরা এই অহং-এর ধ্যানের ব্যবহারিক দিক সম্পর্কে শুনবো।
কিছুদিন একটু সহজপাচ্য খাবার খান। খাবার পরে ৫ মিনিট বজ্রাসন করুন। খাবার আধাঘন্টা আগে জল খান, ভরপেট না খেয়ে, পেট খালি রেখে খান। শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য একটু আধটু খালিহাতে ব্যায়াম, একটু প্রাণায়াম অর্থাৎ ভাস্ত্রিকা, কপালভাতি, অনুলোম বিলোম , ত্রিবন্ধ (অর্থাৎ জলন্ধর, উড্ডীয়ান, মূলবন্ধ) উজ্জায়ী অগ্নিসার, ভ্রামরী, উদ্গীথ ও ক্ষাণিক্ষণ প্রণবের ধ্যান করুন।
কিছু দিন অভ্যাসের ফলে আপনার শরীরের মধ্যে যেমন একটা স্বস্তির ভাব আসবে, আপনার শরীরের উৎস যে পঞ্চভূত, তার মধ্যে একটা সাম্যতা আসবে। অন্যদিকে আপনার মন ধীরে ধীরে নির্ম্মল হতে শুরু করবে। জানবেন, আমাদের খাদ্যের সূক্ষ্ম কনা থেকেই আমাদের মন তৈরী হচ্ছে, পুষ্টি লাভ করছে । আর এইসব ছোটোখাটো খালিহাতে ব্যায়াম, প্রাতঃভ্রমন ইত্যাদি আমাদের শরীর মনকে সুস্থ -সবল রাখতে সাহায্য করে।
যাইহোক, এবার সারাদিনের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট সময় (১৫-৩০ মিনিট) বেছে নিন, যখন আপনার অন্য সমস্ত কাজের বিরতি। এইসময় আপনাকে কেউ যেন বিরক্ত না করে। প্রতিদিন এই নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট স্থানে, স্থির হয়ে সুখাসনে বসে থাকার অভ্যাস তৈরী করুন। আর খেয়াল করতে থাকুন, মনের মধ্যে কি চিন্তার উদয় হচ্ছে। এইসব চিন্তাকে দমিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন না। এমনও ভাবতে যাবেন না যে আমি এখন ঈশ্বর সাধন করতে চাই, এখন এই সব বৈষয়িক চিন্তা করবো না। আপনি শুধু চিন্তাগুলোকে দেখতে থাকুন। কিছুদিন এইভাবে চলতে দিন। একটা দিন আসবে, যখন দেখবেন, আপনার মন স্থির হতে শুরু করেছে। অর্থাৎ যখনই আপনি আসনে বসবেন, আপনার মন স্থির হয়ে যাবে। হয়তো-বা চিন্তাশূন্য হয়ে পড়বে। এমনকি আপনি এও লক্ষ্য করবেন, যে আপনার শরীর আগে থেকে অনেক বেশি স্থির হতে শুরু করেছে। এখন আর শরীরের মধ্যে অস্থিরতা নেই।
এবার পরবর্তী ধাপে চলুন। মনটাকে ভ্রুদ্বয়ের মাঝখানে, অথবা হৃদয়ে স্থাপন করবার চেষ্টা করুন। অত্যধিক চঞ্চল মনের মানুষের পক্ষে হৃদয়ে মনকে স্থাপন করা সহজ হবে। যদি আপনার মন চঞ্চল না হয়, তবে ভ্রুদ্বয়ের মাঝখানে মনকে স্থাপন করবার চেষ্টা করুন। এখানে অর্থাৎ ভ্রুদ্বয়ের মাঝখানে মন সহজেই স্থির হতে পারে, তবে যারা অতিরিক্ত ভাবুক প্রকৃতির মানুষ, তাদের এই অবস্থায় কিছুক্ষনের মধ্যেই মাথা ধরতে পারে। তবে কিছুদিন অভ্যাসের ফলে এই মাথাধরা কেটে যাবে।
এই ভ্রূযুগলের মাঝখানেই আছে আমাদের আজ্ঞাচক্র। এটিকে খুঁজে বের করবার চেষ্টা সাধককেই করতে হবে। আর এটি আপনি টের পাবেন, যখন দেখবেন, আজ্ঞাচক্রে মৃদু কম্পন অনুভব হচ্ছে।
এবার আপনাকে আপনার অহংবোধকে ধরবার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এটা কিভাবে সম্ভব হতে পারে ? অহং আর কিছুই নয়, আপনার চেতনাশক্তি। এই চেতনা শক্তির প্রভাব আছে আমাদের সমস্ত শরীরে। অর্থাৎ চেতনাশক্তির কার্য্যক্ষেত্র আমাদের সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু এই চেতনা শক্তির একটা উৎস আছে। যেখান থেকে এই চেতনাশক্তি উৎসারিত হচ্ছে। এই উৎসকে বলা হয় চৈতন্য। সূর্য্যের আলো যেমন সর্বত্র ছড়িয়ে আছে, তেমনি এই আলোর একটা উৎস আছে আর সেই উৎস হচ্ছে সূর্য। ঠিক তেমনি আমাদের শরীরে যে চেতনা শক্তি বিরাজ করছে, তারও একটা উৎস আছে। এই উৎসকে আপনার খুঁজে বের করবার চেষ্টা করতে হবে।
প্রথম দিকে মনে হয়, এই শক্তির উৎস হচ্ছে আমাদের মস্তিস্ক। এবার মস্তিষ্কের কোন অংশ থেকে এই শক্তি উৎসারিত হচ্ছে তাকে নির্দিষ্ট করবার চেষ্টা করুন। এইসময় মাথার পিছনে দিকে ডান দিকে একটা চীন চীন ব্যাথা অনুভব হতে পারে। এমন হলে, কিছুদিন এই ধ্যান থেকে বিরত থাকুন, ব্যাথা চলে যাবে। কিছু দিন অপেক্ষা করুন, তবে এইসময় ভ্রূযুগলের মধ্যে বা হৃদয়ে ধ্যানের প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে হবে।
এবার আরো সতর্ক হন। মাথার ঠিক কোন অংশ থেকে এই চেতনশক্তি বেশি অনুভব হচ্ছে। মনে হবে মাথার ঠিক মাঝখানটায় এই চেতনার উৎস। আরো ভালোভাবে লক্ষ করলে বুঝতে পারবেন, ঠিক মাঝখানে নয়, মাঝখানের একটু সামনের দিকে এই চেতনার উৎস। এই উৎসকে সাধককে নিজেই খুঁজে বের করতে হবে।
চেতনার উৎসকে যদি না ধরতে পারেন, তবে মনের চিন্তাগুলোকে শুধু লক্ষ্য করতে থাকুন। চিন্তার উৎসকে ধরবার চেষ্টা করুন। ভ্রূযুগলের ধ্যান করবার সময় যেমন আজ্ঞাচক্রকে নিজেই খুঁজে বের করতে হয়, তেমনি হৃদয়ে ধ্যান করবার সময়েও প্রথমে এই অনাহত চক্রকে নিজেকেই খুঁজে বের করতে হয়।
এই হৃদয়কেন্দ্রে বা আজ্ঞাচক্রে যে চেতনা অনুভব হচ্ছে, সেটির উপরে সাধককে বেশি জোর দিতে হবে । কোথায় ধ্যান করছেন, অর্থাৎ অনাহত না আজ্ঞাচক্র সেটা বড়ো কথা নয়, আপনি ধ্যান করছেন চেতন কেন্দ্রে। এই চেতন কেন্দ্রে প্রথমে একটা আকাশ ফুটে উঠবে। এই আকাশ হতে পারে অন্ধকার আছন্ন অথবা জ্যোৎসার আলোর মতো। এটি নির্ভর করে আপনার মধ্যে কোন গুনের প্রভাব বেশি আছে তার উপরে। সত্ত্বগুণের দ্বারা প্রভাবিত পুরুষের মধ্যে এই জ্যোতির্ময় আলোক সম্পন্ন আকাশ সহজেই নজরে পরে। যদি তা নাও হয়, তাতে কিছুই এসে যায় না। এই আকাশের মধ্যে একসময় আলোর বিন্দু, এমনকি বিভিন্ন বর্ণের আলো, দৃষ্টিগোচর হবে। এখন কথা হচ্ছে এই জ্যোতিঃ বা আলোর দিকে বেশী নজর না দিয়ে আমাদের এর মধ্যে চেতনশক্তি আছে, তার দিকে নজর দিতে হবে। চেতন শক্তি থেকে এই আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে, সেদিকে নজর রাখতে হবে। এই চেতন শক্তিকে আমাদের ধরতে হবে। এই আলোর উৎসে যেতে হবে। এটিকে একবার আবিষ্কার করতে পারলে, মনকে শান্ত করা সহজ হয়ে যায়। অহং-এর ধ্যান মানেই এই জ্যোতির উৎসে যাওয়া। এবার এই উৎসে কিছুক্ষন অবস্থান করতে পারলেই, মোটামুটি ভাবে আপনি বুঝতে পারবেন, আপনি এই দেহ নয়, মন নয়, দেহ মন থেকে আলাদা একটা সত্তা।
এইসময়, বারবার নিজের মধ্যে প্রশ্ন ওঠাতে থাকুন, আমি কে ? এই প্রশ্নের সাথে সাথে নিজের মনকে একাত্বিভূত করতে থাকুন। এতে করে আপনার মধ্যে একটু একটু করে আমি বোধের জন্ম হতে শুরু করবে। ............. এই প্রক্রিয়ার অভ্যাস কিছুদিন করতে থাকুন। এর পরের প্রক্রিয়ার কথা আমরা পরবর্তীতে শুনবো। .... ততদিন অপেক্ষা করুন, আর প্রথম প্রক্রিয়া চালিয়ে যান।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
সংসার বন্ধন থেকে মুক্তিলাভের উপায় (১৩) মূলসূত্র : ধ্যান ও শান্তি - স্বামী সোমেশ্বরানন্দ
এই যে সাধন পদ্ধতি, এর কথা আছে বিভিন্ন উপনিষদে, আছে আচার্য্য শঙ্করের বিবেক চূড়ামণি গ্রন্থে। পাতঞ্জল যোগদর্শনেও এর উল্লেখ আছে। আগের দিন আমরা শুনেছিলাম, "আমি" এই দেহ নোই। যদিও আমরা সবাই এই দেহকে ঘিরেই আমি সত্তার প্রকাশ দেখতে পাই। তো পরিবর্তনশীল এই শরীরকে ঘিরেই আমাদের আমি সত্তা। যখন শিশু ছিলাম, তখন যেমন আমি ছিলাম, আবার আজ এই বৃদ্ধ শরীরেও সেই একই আমি আছি। আমার বুদ্ধির পরিবর্তন হয়েছে, জ্ঞানের পরিবর্তন হয়েছে, এমনকি আমার মনেরও পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু আমি আছি। সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, এই শরীরের জন্মের আগেও আমি ছিলাম, আবার এই শরীরের মৃত্যুর পরেও আমি থাকবো। সুতরাং একথা বলা যেতেই পারে, যে আমার যে মূল সত্তা তা এই শরীর অতিরিক্ত কিছু, যাকে আমাদের উপল্বদ্ধিতে আনতে হবে।
এখন এই শরীরকে আমরা জানি পাঁচকোষের সমষ্টি। তো এই "আমি" সত্তাকে জড়িয়ে আছে পাঁচটি সত্তা। আমরা যদি অন্ন-জল গ্রহণ না করি, তবে আমার স্থুল শরীর বিনষ্ট হবে। কিন্তু আমি থাকবো। তো স্থুল শরীর থেকে আমিকে আলাদা করতে হবে। এর পর আছে প্রাণময় শরীর। আমরা যদি বেশিক্ষন শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া না করতে পারি, তখন আমরা আমচান করতে থাকি। তো এই প্রাণময় কোষকেও আমি বলে মনে করি। তো দেহ ও প্রাণ আমি থেকে আলাদা নয়। এর পরে আছে, আমার মন। আমার যে ব্যক্তিত্ত্ব, বিশ্বাস অবিশ্বাস সবই এই মনের উপরে নির্ভর করে। আর এই কারণেই আমরা অনেক সময় "আমি" -কে আমরা মন থেকে আলাদা করতে পারি না।
যাইহোক, ধ্যানের সময় প্রথমে মনকে শান্ত করতে হয়, মনের চিন্তাকে শান্ত করতে হয়। এখন এই চিন্তাকে শান্ত করা সহজসাধ্য নয়। এইজন্য বলা হয়, মনের চিন্তাগুলোকে দেখতে থাকুন। একটু একাগ্র হলেই আপনি ধরতে পারবেন, যে মনের এই চিন্তাগুলোকে কে যেন দেখছে। এই দ্রষ্টাকে আমাদের ধরতে হবে। এবার সামনে কি দেখছেন - খেয়াল করুন, হয়তো অন্ধকার আকাশ দেখছেন, বা স্নিগ্ধ আলোয় ভরা একটা আকাশ দেখছেন। এই দৃশ্য আর দ্রষ্টাকে আলাদা করবার চেষ্টা করুন। কে দেখছে, আর কাকে দেখছে, এই দুইজনকে আলাদা করতে হবে। আলো বা অন্ধকারকে উপেক্ষা করে "আমি দেখছি" এই ভাবের মধ্যে ডুব দেবার চেষ্টা করুন। এবার "আমি" এবং "দেখছি" অর্থাৎ কর্ত্তা ও কর্ম্মকে আলাদা করবার চেষ্টা করুন। অর্থাৎ শুধু আমি বোধের উপরে জোর দিন।
মনের অন্যান্য বৃত্তি থেকে এই অহংবোধকে আলাদা করা প্রথম দিকে কঠিন মনে হলেও একটু চেষ্টা করলেই, কাজটি শীঘ্রই সহজ হয়ে যাবে। আসলে এখন আপনি যাকিছু দেখছেন, তা আপনার মনের চিন্তাপ্রসূত।
"তত্ত্বমসি" -মহামন্ত্রের ধ্যান। মূলসূত্র - বিবেকচূড়ামণি - আচার্য্য শঙ্কর
শ্রুতি বলছে, তুমিই সেই - "তত্ত্বমসি" . এই শ্রুতিবাক্যে দুটো পদ লক্ষিত হয়, তৎ ও ত্বম। জীব ও ব্রহ্ম সম্পূর্ণ এক, এই কথা বার বার মুনিকন্ঠে ঘোষিত হয়েছে। আক্ষরিক দিক থেকে এই কথা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। জোনাকি ও সূর্যের সঙ্গে তুলনা করা চলে না। রাজা ও ভৃত্যের সঙ্গে তুলনা করা চলে না। কূপের সঙ্গে সমুদ্রের অথবা পরমাণুর সঙ্গে মেরুপর্বতের ঐক্য যেমন আক্ষরিক অর্থে সম্ভব নয়, তেমনি ব্রহ্ম ও জীবের মধ্যে ঐক্য সেইভাবে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।
কুন্তীপুত্র কর্ন ছিলেন বিজাতীয় কর্ম্মফল জাত। মাতা কুন্তী তাকে পরিত্যাগ করেছিলেন। আর কর্ন হয়ে উঠেছিলেন সুতপুত্র। কবিরকে পরিত্যাগ করেছিলেন, তাদের ব্রাহ্মণ মাতা-পিতা। লালিত পালিত হয়েছিলেন, মুসলিম মাতা-পিতার কাছে। ক্ষত্রিয় পুত্র শ্রীকৃষ্ণ পালিত হয়েছিলেন, গোয়ালা নন্দের ঘরে। কিন্তু স্বভাব যাবে কোথায় ? সুতপুত্র কর্ন হয়ে উঠেছিলেন, মহাযোদ্ধা। কবির হয়ে উঠেছিলেন, মরমিয়া সাধক। শ্রীকৃষ্ণ হয়ে উঠেছিলেন একাধারে মহাযোদ্ধা, আর যোগের কারনে যোগেশ্বর। তো আপনি যা তা আপনাকে জানাতে হবে না, আপনি তাই হয়ে উঠবেন। শুধু আপনার মধ্যে যে পুরুষকার আছে, তার প্রয়োগ করুন।
উপনিষদ (ছান্দোগ্য) বলছে, যতক্ষন জীবের মধ্যে জীববোধ থাকে, ততক্ষন জীব জন্ম-মরন-ধর্ম্ম বিশিষ্ট জীবই থাকে। ব্রহ্মের সঙ্গে সে কখনো একাত্ম অনুভব করতে পারে না। কিন্তু সত্য হচ্ছে, জীব ও ব্রহ্মের মধ্যে যে ভেদ তা কল্পিত উপাধির কারনে হয়ে থাকে। এই উপাধি কিন্তু বাস্তব নয়। এখন কথা হচ্ছে কি সেই উপাধি যার জন্য জীব তার স্বরূপ ভুলে বসে আছে ? আসলে উপাধি একটা চাপানো জিনিস, এর কোনো বাস্তব সত্তা নেই। মায়া আছে বলে তিনি মহৎ হয়ে আছেন, অব্যক্ত হয়ে বীজাকারে আছেন, অনুলোম হয়ে আছেন। আবার তিনিই নিজেকে যখন বিস্তার করছেন, তখন বিলম্ব হচ্ছেন, জীবের মধ্যে প্রকাশিত হচ্ছেন।
মহৎ প্রভৃতির উৎপত্তির কারন হচ্ছে মায়া। আর এই মায়াই ঈশ্বরের উপাধি। আর জীবের উপাধি হচ্ছে মহত্যাদির যে পরিনাম অর্থাৎ পঞ্চকোষ। মায়া এবং মায়াদ্বারা নির্মিত পঞ্চকোষ এই হচ্ছে উপাধি। প্রথমটা ঈশ্বরের উপাধি, আর পরেরটা জীবের উপাধি। এই দুই উপাধি সরিয়ে ফেলতে পারলে, অর্থাৎ এই উপাধির মিথ্যাত্ব উপলব্ধি করতে পারলে, ঈশ্বর থাকে না, আবার জীব থাকে না। তখন অবশিষ্ট থাকে কেবল ব্রহ্ম।
আচার্য্য শংকর তার বিবেক চূড়ামণি গ্রন্থে এই ব্যাপারটা একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন। বলছেন, ধরো কোনো ব্যক্তির রাজ্য থাকলে, সে রাজা, ওই ব্যক্তি যখন শস্ত্র ধারণ করে যুদ্ধ করেন, তখন তিনি যোদ্ধা। কিন্তু ও ব্যক্তির রাজ্য বা শস্ত্র না থাকলে সে তখন তিনি রাজাও নন , আবার যোদ্ধাও নন । তিনি তখন একজন সাধারন মানুষ মাত্র। এই মায়া উপাধিযুক্ত ঈশ্বর সর্বজ্ঞ, শক্তিমান, ইত্যাদি রূপে প্রতীয়মান হয়, আর পঞ্চ কোষের আবরনে আবদ্ধ জীব, নিজেকে দিন-হীন, দুঃখী মনে করে। এবার ঈশ্বর ও জীবের এই উপাধি চলে গেলে, ঈশ্বর বা জীবের আর পৃথক অস্তিত্ত্ব অনুভব হয় না। তখন এক অদ্বিতীয় নির্বিশেষে ব্রহ্ম অবশিষ্ট থাকে। শ্রুতি বলছে, এই দ্বৈতভাবকে জ্ঞানের দ্বারা অপসারিত করতে পারলেই উপাধির যে মিথ্যাত্ব তা অনুভব করা সম্ভব।
দেখুন, দৃশ্যমান যাকিছু স্থুল বা সূক্ষ্ম সেসব আত্মা নয়। কিন্তু আমাদের ভ্রমজ্ঞানের কারনে যেমন অন্ধকারে রজ্জুর মধ্যে সর্পকে দর্শন করে থাকি, যেমন স্বপ্নে দেখা বস্তু সমূহ স্বপ্নকালে সত্য বলে মনে হয়, তেমনি আমাদের অজ্ঞান যতক্ষন না দূর হয়, ততক্ষন জীব ও ব্রহ্মের মধ্যে একত্ত্ব তা আমরা ধরতে পারবো না।
দেখুন আমরা জিনিস কিভাবে চিনি ? কোনো জিনিস খাঁটি না নকল তা আমরা বুঝি কি করে ? আমরা জিনিস চিনি তার লক্ষণ দেখে। এই লক্ষণ হচ্ছে জিনিসের বৃত্তি বিশেষ। এই লক্ষণ দুই রকম, একটা জহতী আর একটা অজহতী। এখন শব্দের মধ্যে বা ধ্বনির মধ্যেও লক্ষণ আছে। এই লক্ষণ হচ্ছে শব্দের বৃত্তি। এমন অনেক শব্দ আছে, যা আক্ষরিক অর্থে ধরলে, তার মানে স্পষ্ট হয় না। তখন আমরা শব্দের ভাবার্থকে ধরে প্রকৃত অর্থ নিরুপন করে থাকি।
আচার্য্য শঙ্কর দুটো উদাহরনের সাহায্যে ব্যাপারটা বুঝিয়েছেন, যেমন ১. "গঙ্গায়াম ঘোষঃ" - অর্থাৎ গঙ্গার তীরে ঘোষপল্লী। এখন গঙ্গায়াম বলতে আমরা গঙ্গানদীকে বুঝি। কিন্তু এখানে গঙ্গায়াম বলতে নদীর তীরকে বোঝানো হচ্ছে। অর্থাৎ গঙ্গার তীরে ঘোষপল্লী। এটা হচ্ছে জহতি লক্ষণ। জহৎ কথাটার অর্থ হচ্ছে, ত্যাগ করা, অর্থাৎ স্ব -অর্থ ত্যাগ করে অন্য অর্থ বা লক্ষন-যুক্ত অর্থ গ্রহণ করা। আবার অজহতি লক্ষণ যেমন - শ্বেতঃ ধাবতি। আক্ষরিক অর্থে সাদা দৌড়োচ্ছে। এখন সাদা একটা রঙ বিশেষ। এখন সাদা তো দৌড়োতে পারে না, হয় সাদা মেঘ দৌড়োচ্ছে, বা সাদা ঘোড়া দৌড়োচ্ছে, ব্যাপারটা এইভাবে বুঝতে হবে।
আসলে আমাদের সমস্ত শাস্ত্র এইরকম। একটা শব্দার্থ - আর একটা ভাবার্থ। শুধু শব্দার্থ দিয়ে শাস্ত্র বুঝতে গেলে আমরা মুশকিলে পরে যাবো, বিভ্রান্ত হবো। এইজন্য শাস্ত্র ব্যাখ্যা আমাদের আচার্য্যের কাছ থেকে শুনে নিতে হয়। বেদান্ত বলছে, জীব আর ব্রহ্ম এক - এটা সিদ্ধান্ত। কিন্তু আমরা জীব আর ব্রহ্মকে আলাদা করেই দেখি। আর এটা হয়ে থাকে আমাদের অজ্ঞানতার কারনে। আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, শ্রুতিবাক্যের এই লক্ষণের মধ্যে অর্থাৎ কিছু অংশ ত্যাগ, আবার কিছু অংশ যোগ করে যথার্থ অর্থ নিরুপন করতে হয়।
বহুদিন পরে, আপনার ছোটবেলার বন্ধুর সাথে হঠাৎ দেখা হলো। ছোটবেলা যে বুন্ধুকে আপনি চিনতেন অর্থাৎ তখন যে চেহারায় আপনি বন্ধুকে দেখেছিলেন, বন্ধুটি আজ আর সেই মতো নেই। তার চেহারায় অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে, এমনকি তার মনের মধ্যেও অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। দেশ ও কালের তারতম্যে, বন্ধুর মধ্যে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। তথাপি কোথায় যেন আপনার মনে হচ্ছে এই লোকটিই আপনার ছোটবেলার বন্ধু। তো একত্বকে বুঝতে গেলে, কিছূ বাদ দিতে হয়, আবার কিছু সংযোগ করতে হয়, তবেই যথার্থ সত্যকে ধরতে পারা যায়।
ঠিক তেমনি তত্ত্বমসি এই বাক্যের তৎ ও ত্বম - ব্রহ্ম ও জীব এই উভয়ের বিরোধী ধর্ম্মসমূহকে ত্যাগ করে এবং মাত্র চৈতন্য অংশকে গ্রহণ করে বিচারশীল হতে পারলে, অদ্বয়-বোধ-স্বরূপের উপলব্ধি হতে পারে। জীব ভ্রান্তি বশতঃ নিজেকে স্থুল বা ক্ষুদ্র বলে মনে করে, কিন্তু এই যে স্থুলত্ব বা ক্ষুদ্রত্ব তা ব্রহ্মে নেই। আত্মা স্বরূপতঃ শুদ্ধব্রহ্ম। দেহাদি প্রপঞ্চকে যে আমি ভাবছি, আর একেই সত্য বলে জেনেছি, এই ভ্রান্ত ধারণাকে ত্যাগ করতে হবে।
দেখুন, আকাশ সর্বত্র। আবার একই, আকাশের মধ্যে মেঘ, চন্দ্র সূর্য তারকা দেখলেও আকাশ যে সর্বত্র এক এই বিষয়ে আমাদের মনে কোনো সংশয় জাগে না। ঠিক তেমনি জানবেন, আত্মাও সর্ব্বদা আকাশের ন্যায় সর্ব্বব্যাপী ও একই ভাব সম্পন্ন - এব্যাপারে কোনো সংশয় রাখা উচিত নয়। তৎ -ত্বম-অসি - এই তৎ কে তা আমরা জানি না, তাঁর নাম জানি না, ধাম জানি না, কিন্তু তিনিই নাকি সর্বভূতে আছেন। আর তিনি আছেন বলেই আমি আছি। এই সত্যকে উপলব্ধি করতে হবে। শ্রুতি বলছে, সেই তিনিই সর্বত্র - তিনিই তুমি। তাঁকে তুমি ব্রহ্ম বলতে পারো, পরমাত্মা বলতে পারো , যা খুশি তাই বলতে পারো।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি বিরাট, আমি ক্ষুদ্র, তিনি সর্বত্র আমি দেহস্থিত, তিনি বড়ো আর আমি ছোট। তো আমরা কি করে এক হলাম ? শ্রুতি বলছে, এক কারন হচ্ছে, আমরা উভয়ই চৈতন্য। দেখুন কুয়োর জল, আর সমুদ্রের জল, ঘটাকাশ আর মহাকাশ-এর মধ্যে কোনো ফারাক নেই। জোনাকির আলো আর সূর্য্যের আলোর মধ্যে গুনগত কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য হচ্ছে ঘট্ একটা ছোট্ট পাত্র, তার ভিতরেও আকাশ, আবার বাইরেও আকাশ। এই তৎ হচ্ছে বাইরের আকাশ বা মহাকাশ। এইযে ঘট্ মাটি দিয়ে তৈরী ,বা তোমার এই যে দেহ তা পঞ্চকোষ দ্বারা নির্ম্মিত। এই পঞ্চকোষ বা মাটি তোমাদেরকে আলাদা করে রেখেছে । এই ঘট্ ভেঙে গেলে, বা পঞ্চকোষের দেহের নাশ হলে তোমরা (জীব ও ব্রহ্ম) আবার এক অভিন্ন হয়ে যাবে।
এখন কথা হচ্ছে, তাই যদি হয়, তবেতো মৃত্যুর পরে আবার আমরা এক হয়ে যাবো, তবে আর এতো কৃচ্ছ -সাধন কেন ? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির নিয়মেই আমরা আবার একীভূত হয়ে যাবো। এসব সাধন ক্রিয়ার দরকারটা কি ? দেখুন মৃত্যুতে আমাদের স্থুল দেহের নাশ হয়, সূক্ষ্ম বা কারন দেহের নাশ হয় না। আর কামনা বাসনার বশবর্তী হয়ে আবার আমরা বারবার স্থুল কর্ম্মদেহ ধারন করি। অর্থাৎ স্থুল থেকে সূক্ষ্ম বা কারনে, আবার সেখানে থেকে স্থুল দেহে প্রবেশ করি। একেই বলে জন্ম-মৃত্যুর চক্র। এই জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আমরা বারবার আবর্তিত হচ্ছি। এই জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে নিজেকে বের করে ব্রহ্মে প্রতিষ্ঠিত করাই সাধনক্রিয়ার উদ্দেশ্য।
আচার্য্য শংকর বলছেন, স্বপ্নকালে দৃষ্ট দেশ, কাল, বিষয় এবং এই সকলের জ্ঞাতা যেমন মিথ্যে তেমনি জাগ্রত কালে অনুভূত যে জগৎ বা জাগতিক বস্তুসকল, তা মিথ্যে। এই যে শরীর, ইন্দ্রিয়, প্রান, অহংকার সব মিথ্যে - এর থেকে ভিন্ন নিত্য, প্রশান্ত, নির্ম্মল অদ্বিতীয় যিনি তিনি পরমব্রহ্ম, তুমিই সেই। এখন কথা হচ্ছে, এইসব যদি সত্য হিসেবে ধরেও নেই, তা তো আমাদের অনুভূতি আসে না, সেই অনুভূতি আমাদের কিভাবে হবে ?
আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, ব্রহ্মের সঙ্গে জাতি-ধর্ম্ম-বর্ণের কোনো সম্পর্ক নেই। ব্রহ্মের কোনো জাত -কুল-গোত্র নেই। এই ব্রহ্মের কোনো রূপ-গুন্-দোষ নেই। দেশ-কাল-বিষয়ের উর্দ্ধে সেই ব্রহ্ম। তুমিই সেই ব্রহ্ম। তাঁকেই তুমি অন্তরে ধ্যান করো। (২৫৪)
সর্ব্ব-বেদান্ত সিদ্ধ, অবিদ্যার অতীত,বাক্যাদি যাঁকে প্রকাশ করতে পারে না, ইন্দ্রিয়ের যিনি অগোচর, তিনি শুভ বুদ্ধির বিষয়, তিনি নির্ম্মল চৈতন্য স্বরূপ, কার্য-কারন-রহিত এমন যে ব্রহ্মবস্তু আছেন, তুমি তাহাই, এই ভাবে অন্তরে ধ্যানমগ্ন হও। (২৫৫)
দেহ-ইন্দ্রিয়-প্রাণের যে ধর্ম্ম অর্থাৎ জরা-মৃত্যু-ক্ষুধা-পিপাসা-শোক-মোহ-রূপ যে ছয়টি তরঙ্গ তা ব্রহ্মকে ক্ষুব্ধ করতে পারে না। যোগীগণ যাঁকে হৃদয়ে ধ্যান করেন, যা কোনো ইন্দ্রিয়ের দ্বারা জানা যায় না, অশুদ্ধ বুদ্ধিতে যা প্রকাশ পায় না, যা নির্দোষ, সেই ব্রহ্ম স্বয়ং তুমি - এই কথা অন্তরে ধ্যান করো। (২৫৬)
জগৎ ভ্রান্তকল্পনা বৈ কিছু নয়। তুমি নিজেই নিজের আশ্রয়, সূক্ষ্ম ও স্থুল পদার্থ থেকে তুমি ভিন্ন। তুমি অবয়ব শূন্য, তুমি তুলনা রহিত। তুমি এই পরম-ব্রহ্মের ধ্যান করো (২৫৭)
ব্রহ্ম জন্ম, বৃদ্ধি, পরিণামপ্রাপ্তি, ক্ষয়, ব্যাধি, মৃত্যু প্রভৃতি সর্ব্ববিধ বিকার বর্জ্জিত। অপরিণামী এবং বিশ্বের সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের কারন স্বরূপ। তুমি সেই ব্রহ্ম, এঁকেই অন্তরে ধ্যান করো। (২৫৮)
যে ব্রহ্ম ভেদরহিত অপরিণামী, নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের ন্যায় শান্ত, নিত্য-মুক্ত ও বিভাগ বর্জ্জিত, তুমি তা-ই, এঁকেই তুমি অন্তরে ধ্যান করো। (২৫৯)
ব্রহ্ম সৎ-স্বরূপ, বিচিত্র সৃষ্টির কারন, অন্য কারনের নিরাস-কারক, তিনি স্বয়ম্ভূ কারণশূন্য, এবং কার্য্য কারন থেকে পৃথক। তুমি সেই ব্রহ্ম। একেঁই অন্তরে ধ্যান করো। (২৬০)
যে ব্রহ্ম সংশয়-বিপর্যয় প্রভৃতি বিকল্পশূন্য, অপরিছন্ন, হানিরহিত ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ থেকে ভিন্ন, সেই সর্বোত্তম অবিনাশী, নিত্যানন্দ স্বরূপ এবং অবিদ্যার লেশ রহিত, তুমি সেই ব্রহ্ম। এঁকেই তুমি ধ্যান করো। (২৬১)
স্বর্ণের বিকার রূপ অলঙ্কার, আর অলঙ্কারের মধ্যে স্বর্ণ বর্তমান থাকে। তেমনি ব্রহ্ম নিজে অবিকারী হয়েও নাম-রূপ-গুন্ ইত্যাদি বিকাররূপে প্রকাশ পান। তুমিই সেই ব্রহ্ম। অন্তরে এই ব্রহ্মকে ধ্যান করো। (২৬২)
যিনি , অদ্বিতীয় অব্যক্ত থেকেও উৎকৃষ্ট, সকল প্রাণীর অন্তরে যিনি অভিন্ন-চৈতন্য রূপে বিদ্যমান, আত্মস্বরূপ, সচ্চিদানন্দ অনন্ত অব্যয় ব্রহ্মস্বরূপ প্রকাশ পাচ্ছেন, তুমিই সেই ব্রহ্ম। অন্তরে সেই ব্রহ্মকে ধ্যান করো। (২৬৩)
আচার্য্য শঙ্কর তাঁর "বিবেকচূড়ামনি গ্রন্থে" বলছেন, জীব ও ব্রহ্মের যে একত্ব বর্ণিত হলো, তা নিজের অন্তঃকরণে যুক্তির দ্বারা শুভবুদ্ধি সহকারে অহর্নিশি ধ্যান করবে। এই ভাবে ধ্যানের দ্বারা সংশয়রহিত হয়ে ব্রহ্মসাক্ষাৎকার লাভ হবে।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
একই আত্মা সকলের মধ্যে বিরাজ করছেন - বুঝবো কি করে ? মূল সূত্র : বিবেক চূড়ামণি - আচার্য্য শঙ্কর
কতকগুলো জিনিস আছে, যা আমরা বিজ্ঞানমতে মেনে নিতে বাধ্য হই। কিন্তু সেইসব কথা আমাদের উপল্বদ্ধিতে আসে না। যেমন, বিজ্ঞান বলছে, আকাশের কোনো রঙ নেই। কিন্তু আমরা আকাশের দিকে তাকালে তাকে আমাদের নীল বর্ণের মনে হয়। আমরা জানি, পৃথিবী গোল অর্থাৎ পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশ হচ্ছে বাঁকা। কিন্তু আমাদের বোধে এসব আসে না। পৃথিবীকে আমাদের সমতল বলেই মনে হয়। আমরা জানি সূর্য এক জায়গায় স্থির। সূর্য কখনো উদয় হতে পারে না বা অস্ত যেতে পারে না। অর্থাৎ সূর্য্যের কোনো গতি নেই। কিন্তু আমাদের চোখ বা উপলব্ধি বলছে, সূর্য পুব থেকে পশ্চিমের দিকে এগিয়ে চলেছে। আমরা জানি চাঁদের কোনো নিজস্ব আলো নেই তথাপি এই চাঁদের আলোকেই বলি জ্যোৎস্না। স্বচ্ছ স্ফটিক যখন লাল রঙের কাছে থাকে, তখন স্পটিকের মধ্যে লাল রঙ দেখা যায়।স্বচ্ছ স্ফাটিক তখন আমাদের কাছে রক্তবর্ণের বলে দৃশ্যমান হয়।
ঠিক তেমনি প্রত্যেকের মধ্যে যে একই আত্মা আছেন, তাকে আমরা ঋষিবাক্যঃ অনুসারে মেনে নিতে বাধ্য হই। কিন্তু তাকে আমরা অনুভব করতে পারি না। অর্থাৎ এই স্থুল-জড় দেহকে আশ্রয় করে যে প্রত্যগাত্মার প্রকাশ তাকেও আমাদের জড় বলেই মনে হতে থাকে। এই যে ভ্রান্তি তা আমাদের কিভাবে দূর হবে ? কিভাবে আমরা সত্যকে উপলব্ধি করতে পারবো ? আর আমাদের মতো অজ্ঞান জীবের মুক্তি কিভাবেই বা হবে ?
আচার্য্য শংকর বলছেন, বুদ্ধি ও তার প্রকাশক কে ? তাকে একবার ধরবার চেষ্টা করুন। এবার এই প্রকাশকের যথার্থ স্বরূপকে জেনে, অর্থাৎ এঁকে বুদ্ধি থেকে আলাদা করুন। তাহলে যাঁকে পাওয়া যাবে, তার নাম রাখুন আত্মা। এবার এই আত্মাই "আমি" এইভাবে ভাবতে ভাবতে এঁকে সমস্ত বস্তু থেকে আলাদা করে অনুভব করতে থাকুন।
আচার্য্য শঙ্কর আবার বলছেন, এই কাজটা করতে গেলে আমাদের তিনটে কাজ করতে হবে। ১. লৌকিক ও সামাজিক শিষ্টাচার সম্পর্কে নিজেকে উৎসাহহীন করুন। অর্থাৎ লোকে কি বলছে, সেদিকে খেয়াল করবেন না। ২. দেহ ধারনের প্রয়োজনীয় অন্ন-বস্ত্র ব্যতিরেকে, অতিরিক্ত দেহ-সুখের চেষ্টারহিত হোন। ৩.শাস্ত্র অধ্যয়ন করে নিজেকে পণ্ডিত বানাতে যাবেন না। আবার শাস্ত্রকে উপেক্ষা করবেন না। কারন এই শাস্ত্র আপনাকে সঠিক পথ দেখাবে। নিজেকে শাস্ত্রভিমানী করে তুলবেন না। শাস্ত্রবাক্যকে যথার্থভাবে উপল্বদ্ধিতে আনুন। (২৭১)
তো আচার্য্য শংকর বলছেন, এই তিনটে জিনিস আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।
এক) লোকের কথায় কান দিতে যাবেন না. লোকে কে কি বললো, তাতে আপনার কোনো উপকার হবে না। লোকের খুশির দিকেও বিশেষ নজর দিতে যাবেন না। আমরা অনেক কাজ করি অথবা করি না কেবলমাত্র লোক লজ্জ্বার ভয়ে। আবার অনেক কাজ করি লোকের সন্তুষ্টির জন্য। সত্যকথা কথা বলতে কি আমরা নিজেকে দেখি অন্যের চোখ দিয়ে। অন্যরা কে কি বললো, তার উপরে আমার ব্যক্তিসত্ত্বা গড়ে ওঠে, এমনকি আমাদের তথাকথিত যে জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ হয়, অন্যের কথায় পুষ্ট হয়ে। কিন্তু আচার্য্যদেব বলছেন, তো লোকের কথায় কান দেবেন না।
দুই) দেহের সুখের কথা ভাববেন না। দেহ রক্ষার কথা অবশ্যই ভাবতে হবে, কিন্তু দেহেকে সুখী করবার চেষ্টা না করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
তিন) অতিরিক্ত শাস্ত্র গ্রন্থ পাঠ করে নিজেকে অভিমানী পণ্ডিত না বানিয়ে,শাস্ত্রের গূঢ়তত্ত্ব বুঝবার চেষ্টা করুন, শাস্ত্রের কথা অনুযায়ী চলবার চেষ্টা করতে হবে, নিজের ব্যবহারিক জীবনে শাস্ত্র বাক্যের প্রয়োগ করুন ।
আচার্য্য শঙ্কর আবার বলছেন, আপনার যত পুরোনো আদত যাকে শুদ্ধ ভাষায় যাকে বলে অধ্যাস (ভ্রম-জ্ঞান) তাকে দূর করবার জন্য যত্নশীল হন। আমি-আমার এই ভাব ত্যাগ করুন। মানুষকে খুশি করবার চেষ্টা করবেন না, মানুষের কাছে প্রিয় হবার চেষ্টাও করবেন না। শাস্ত্রে পান্ডিত্য ও পান্ডিত্যের প্রকাশ, এমনকি দেহের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির বা দৈহিক ভোগ সুখের চেষ্টাও করবেন না। তবে আত্মজ্ঞান জন্মাতে পারবেন না।
দেখুন, সংসার একটা কারাগৃহ, এখান থেকে মুক্তিলাভ করতে চাইলে বাসনত্রয়, অর্থাৎ লোকানুবর্তন, দেহানুবর্তন আর শাস্ত্রানুবর্তন - এই তিন বাসনাকেই বিষ্ঠার মতো পরিত্যাগ করতে হবে। যিনি এই তিন বাসনার বশীভূত নন, তিনিই জীবনমুক্তি লাভ করে থাকেন। দেখুন আপনি সেই চন্দন কাঠ যার ভিতরে সুগন্ধি ভরপুর। কেবল ঘর্ষনের দ্বারা সেই সুগন্ধের প্রকাশ হতে পারে। (২৭২-৭৩)
অনন্তকাল ধরে জীবের অন্তরে এই বাসনাত্রয় বাসা বেঁধে আছে, সেই বাসনারূপ ধূলো-ময়লা আমাদের শুদ্ধ আত্মাকে আবৃত করে রেখেছে। নিরন্তর আত্মবিচারের অভ্যাসের দ্বারা আত্মস্বরূপের অভিব্যক্তি হয়ে থাকে। আত্মস্বরূপের চিন্তনের ফলে, ধীরে ধীরে ভোগবাসনার বিলোপ ঘটবে, আর আত্মস্বরূপ পূর্ন রূপে প্রকাশ পাবে।
মন যেমন যেমন আত্মাতে স্থিত হতে থাকে, ঠিক সেই সেই পরিমানে মন বিষয়ভোগের বাসনা ত্যাগ করতে সমর্থ হয়। ধারাবাহিক ভাবে আত্মচিন্তনের ফলে বাসনার নিঃশেষ হয়ে আত্মস্বরূপের অনুভূতি প্রবল থেকে প্রবলতর হতে থাকে।
ধারাবাহিক ভাবে আত্মস্বরূপের চিন্তন করতে করতে সাধকের মন আত্মস্থিত হয়। তখন মনের মধ্যে আর সংকল্প-বিকল্পের উদয় হয় না। তখন দেহাদিতে অহংবোধের নিবৃত্তি হতে থাকে। এই চেষ্টাই সাধককে করতে হবে।
তম ও রজো গুনের নাশ করে সত্ত্বগুনে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। তো তমোগুণকে নাশ করতে গেলে প্রথমে রজঃ গুনের বৃদ্ধি করতে হবে, আবার রজঃগুনকে নাশ করতে গেলে, সত্ত্বগুণের বৃদ্ধি করতে হবে। আর সত্ত্বগুনকে আশ্রয় করতে পারলেই ধীরে ধীরে আমাদের অধ্যাস অর্থাৎ ভ্রমজ্ঞানের নাশ হতে থাকবে। (২৭৮)
তমোগুণের প্রভাবে জীব প্রমাদ-আলস্য-নিদ্রায় দিন কাটাতে চায়। তার দ্বারা কোনো শুভকর্ম্ম করা সম্ভব হয় না। এখানে থেকে বেরিয়ে এসে, রজোগুণের প্ৰভাৱ বৃদ্ধি করে আমাদের ক্রিয়াশীল হতে হবে। এই ক্রিয়া করতে করতে আমাদের মধ্যে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা জন্মাবে। এই জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার সাহায্যে আমাদের ভালো মন্দ, শুভ অশুভ বোধ তৈরী হবে। এবার সত্ত্ব গুনের বৃদ্ধি করতে হবে। অর্থাৎ তখন শুধু শুভ কর্ম্মে আমাদেরকে নিযুক্ত করতে হবে, শুভ চিন্তা, শুভ বাসনার উদ্রেগ করতে হবে । সত্ত্বগুনের বৃদ্ধিতে ধীরে ধীরে রজঃ গুনের কর্ম্মচাঞ্চল্য নষ্ট হতে থাকবে। সত্ত্ব গুনের দুটো দিক একটা হচ্ছে মনের মলিনতাকে দূর করবে, আর মনের শুদ্ধসত্ত্বকে জাগিয়ে তুলবে।
দেখুন আমাদের অতীত কর্ম্মফলের কারনে এই স্থুল মনুষ্য দেহ প্রাপ্ত হয়েছে। এবং জানবেন, দেহ যেমন রয়েছে, তেমনই থাকবে। যেমন এর পরিণতি তাকে আপনি রোধ রোধ করতে পারবেন না। এই দেহ শিশু থেকে যুবক, যুবক থেকে বৃদ্ধ, জরা ব্যাধি কবলিত হয়ে, একসময় এই স্থূল দেহের নাশ হবেই। এই ধারাবাহিকতা অপ্রতিরোধ্য। একে আপনি আটকাতে পারবেন না। জানবেন, প্রারব্ধ কর্ম্মফল জনিত এই দেহ, ভোগের নিমিত্ত তৈরী হয়েছে। আর এই ভোগ সম্পাদন করবার জন্য এই দেহ থাকবে। তো এই দেহকে রক্ষা করবার জন্য, এই দেহের বৃদ্ধির জন্য, আপনাকে আলাদা করে প্রয়াস করতে হবে না। দেহ-পোষনের অতিরিক্ত উৎসাহ ত্যাগ করুন। বরং এই দেহে স্থিত থাকাকালীন বারংবার চিন্তা দ্বারা আপনার পুরোনো খারাপ সংস্কারকে দূর করবার চেষ্টা করুন আর নতুন নতুন শুভ সংস্কারের জন্ম দিতে থাকুন । (২৭৯)
আচার্য্য শঙ্কর বলছেন "আমি জীব নোই, আমি এই দেহ নোই, আমি মন নোই, আমি আত্মা আমি পরমব্রহ্ম " এইভাবে বিচার অবলম্বন করে, সমস্ত অনাত্মবস্তুকে অস্বীকার করে অতীত সংস্কার হতে উৎপন্ন আত্মায় যে দেহ ধর্ম্মের অভিমান তা ত্যাগ করতে হবে। (২৮০)
শ্রুতিবাক্য, বিচার এবং অনুভব, এই তিন উপায়ে আত্মার সর্ব্ব স্বরূপতা, অর্থাৎ সমস্ত বস্তুতে আত্মা বিরাজ করছেন, তা সে স্বপ্নে হোক বা জাগ্রত অবস্থায় হোক, এই সত্য জেনে, কখনো নিজের আত্মায় অধ্যাসের লেশ মাত্র এলেই তার নিরসন করতে হবে ।
অধ্যাস অধি+অস (ক্ষেপন করা) = এক বস্তুতে অন্য বস্তুর আরোপ বা জ্ঞান। এই ব্যাপারটা আমরা একটু ভালোভাবে বুঝবার চেষ্টা করবো।
বাসনার প্রভাবে আমাদের মধ্যে নানান রকম সংস্কারের সৃষ্টি হয়েছে, এখনও হচ্ছে। আমি ভালো, আমি মন্দ, আমি জ্ঞানী, আমি অজ্ঞানী, এই ধরনের নানান অভিমানের সৃষ্টি হয়েছে, আমাদের মধ্যে । এগুলোকে বলে অধ্যাস। আচার্য্যদেব বলছেন, এগুলোকে দূর করতে হবে। কিন্তু কিভাবে এসব দূরীভূত হবে ?
আচার্য্য শঙ্কর বলছেন,
শ্রুত্যা যুক্ত্যা স্বানুভূত্যা জ্ঞাত্বা সার্বাত্ম্যমাত্মনঃ
ক্বচিদাভাসতঃ প্রাপ্ত-স্বাধ্যাস-অপনয়ং কুরু। (২৮১)
"শ্রুত্যা যুক্তা স্বানুভূত্যা" শ্রুত্যা অর্থাৎ শ্রুতির সাহায্যে, যুক্তা অর্থাৎ যুক্তি বা বিচার বুদ্ধির সাহায্যে, স্বানুভূত্যা অর্থাৎ নিজের অনুভূতির সাহায্যে। তো প্রথমে শাস্ত্র অধ্যয়ন করে বা গুরুদেবের কাছ থেকে শুনে বুঝবার চেষ্টা করতে হবে, এর পরে নিজের বোধ বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে দেখতে হবে। এর পরে আমি যা বুঝেছি, তাকে নিজের অনুভূতির সঙ্গে মেলাতে হবে। যদি নিজের অনুভূতির সঙ্গে নিজের শোনা ও যুক্তি দিয়ে বোঝা বিষয়ের সঙ্গে নিজের অনুভূতিকে মেলাতে পারি, তবেই বুঝতে হবে, আমি ঠিক জেনেছি। এখন কথা হচ্ছে, গুরুমুখে শোনা বা শাস্ত্র অধ্যয়ন, সবার ক্ষেত্রেই একই রকম হতে পরে, কিন্তু বুদ্ধি দিয়ে যে বিচার তা এক-একজনের ক্ষেত্রে এক-এক রকম হতে পারে। কেননা আপনার জ্ঞান বা বিচারবুদ্ধির সূক্ষ্মতা আমার চেয়ে বেশি বা কম হতে পারে। একজন পরিণত বয়সের মানুষের বুদ্ধি আর একজন অপরিণত শিশুর বুদ্ধি এক রকম নাও হতে পারে। তাহলে আমাদের বিচারের মধ্যে একটা পার্থক্য রয়েই গেলো। আবার শাস্ত্রভেদে বা গুরুভেদে আমাদের জ্ঞান অভিন্ন নাও হতে পরে। দেখুন, শ্রুতি যা আসলে ব্রহ্মসূত্র তা কখনো আলাদা হতে পারে না. এই শ্রুতি বাক্যের যে তা ব্যাখ্যা আলাদা হতে পরে, আর এই ব্যাখ্যাকে বলা হয় স্মৃতি । এক-একজন পণ্ডিত ব্যক্তি এক-একরকম বলতে পারেন। আসলে শ্রুতি হচ্ছে বারংবার পরীক্ষিত সত্য - যাকে অপৌরুষেয় বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ বিশেষ কোনো পুরুষের নয়। এই জ্ঞান স্বতঃসিদ্ধ - বহু যোগীপুরুষের ধ্যানে এই একই জ্ঞান উপলব্ধ হয়েছে। কেবলমাত্র একজন ব্যক্তিকে আশ্রয় করে এই জ্ঞানের উন্মেষ হয় নি। এই জ্ঞান যেন আপনা আপনি নিজেকে প্রকাশ করেছে। যে সত্য বারবার পরীক্ষিত হয়েছে তাই শ্রুতি।
তো এই শ্রুতির সাহায্যে যুক্তির সাহায্যে আর নিজের অনুভূতির সাহায্যে আমাকে জ্ঞান লাভ করতে হবে। এখন কথা হচ্ছে কি সেই জ্ঞান যা আমাদের লাভ করতে হবে ? আচার্য্য শংকর বলছেন, "সার্বাত্ম্য-আত্মনঃ" - একই আত্মা সর্বভূতে বিরাজ করছেন। চাঁদ তো একটাই, সূর্য তো একটাই, কিন্তু তার ছায়া অনেক জায়গায় রয়েছে। বাটির জলে, কূপের জলে, পুকুরের জলে, খালের জলে, নদীর জলে, সমুদ্রের জলের মধ্যে, তার ছায়া।তো ভ্রম বশত আমাদের মনে হবে, অনেক চাঁদ, অনেক সূর্য, কিন্তু সত্য হচ্ছে চাঁদ একটাই, সূর্য একটাই। ঠিক তেমনি একই আত্মা আমার মধ্যে, আবার সকলের মধ্যে। কিন্তু ভ্রমবশতঃ এঁকে আলাদা আলাদা মনে হচ্ছে।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ বলছে,
"একো দেব সর্বভূতেষু গূঢ়ঃ
সর্বব্যাপী সর্বভূতান্তরাত্মা " (৬/১১)
একই আত্মা সকলের মধ্যে বিরাজ করছেন। এক দেবঃ - ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। সর্বভূতেষু গূঢ়ঃ - সর্ব্বভূতের গুহায় লুকিয়ে আছেন। সর্বব্যাপী সর্বভূতান্তরাত্মা - যিনি সর্ব্বব্যাপী , আবার সর্ব ভূতের অন্তরতম সত্তা।
আকাশ সর্বত্র, আমাদের হৃদয়ের মধ্যেও আকাশ, ঘটের মধ্যেও আকাশ, আবার বাইরেও আকাশ। একই আকাশ। এই আকাশ দ্বিখণ্ডিত হতে জানে না। শুধু আমাদের অজ্ঞানের কারনে মনে হয়। আকাশ দুই রকম নয় । তেমনি আত্মা আমাদের সকলের মধ্যে। আমরা দেহটাকে আমি মনে করে অপরের দেহের সঙ্গে নিজেকে আলাদা করছি। কিন্তু আসলে আমরা সবাই এক।
এই এক জ্ঞানটাই আমাদের বোধে আনতে হবে। আত্মা এক এই হচ্ছে শ্রুতিবাক্যঃ। আর এই শ্রুতি বাক্যকে আমদের যুক্তি দিয়ে অনুভূতিতে আনতে হবে। অজ্ঞানের কারনে এটিকে আলাদা মনে হতে পারে। আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, যদি এমনটা হয়, তবে সেই অজ্ঞানকে তাড়াতাড়ি দূর করে দাও। "অপনয়ং কুরু" - অর্থাৎ দূর করে দাও।
কখনও যদি নিজেকে দেহ বলে মনে হয়, কখনো যদি নিজেকে পৃথক বলে মনে হয়, কখনো যদি নিজেকে জ্ঞানী, অজ্ঞানী, ধনী, দরিদ্র, পণ্ডিত বা মূর্খ বলে মনে হয়, জানবে এটি অধ্যাস বা ভ্রমজ্ঞান মাত্র। এই অধ্যাস আমাদের দূর করতে হবে। আসলে আমি নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত আত্মা। শ্রুতির এই মহাবাক্য যুক্তি আর অনুভূতি দিয়ে জানতে হবে। আত্মার কোনো উপাধি নেই। এই যে উপাধি, অর্থাৎ জ্ঞানী, অজ্ঞানী, দেহাতীত বা দেহস্থিত এগুলো সব অজ্ঞানের দ্বারা আরোপিত। এর কোনো সত্যতা নেই। আর এই অসত্য যা আরোপিত, তাকে দূর করতে পারলেই আমরা সর্বভূতে আত্মাকে উপলব্ধি করতে পারবো।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
অপূর্ব লেখা আজ এক মনের মত লেখা পেলাম | যা মনে দাগ কাটল আরো কিছু জানার ইচ্ছে রইল |
ReplyDeleteভাল লাগলো। পরের অংশের অপেক্ষায় রইলাম। 🙏
ReplyDeleteখুব সুন্দর উপস্থাপনা
ReplyDelete