অষ্টাবক্র গীতা অদ্বৈতবাদের একটি প্রাচীন গ্রন্থ। মহাভারতের রচনাকালেরও আগে বা রামায়ণের সময়েরও পূর্বে এই অষ্টাবক্রমুনির জীবনকাল প্রবাহিত হয়েছিল। এমনও হতে পারে, মহাভারতকার ব্যাসদেবের সমসাময়িক বা বয়োবৃদ্ধ ছিলেন, এই অষ্টাবক্র মুনি। মহর্ষি ব্যাসদেবের পুত্র শুকদেবের গুরু ছিলেন, ঋষি জনক। এই জনক নামের রাজা এক না একাধিক, তা বলা মুশকিল। কেননা শ্রীরাম-পত্নি সীতা ছিলেন রাজা জনকের কন্যা। এমনও হতে পারে, কোনো এক দেশের রাজার উপাধি ছিল, জনক অর্থাৎ পিতা। এই দেশের সমস্ত রাজাকেই বলা হতো জনক। তো কোনো এক জনক রাজার শিষ্য ছিলেন, ব্যাসপুত্র শুকদেব। আর রাজা জনকের গুরু ছিলেন, অষ্টাবক্র মুনি। অষ্টাবক্রের পিতা ছিলেন, ঋষি কহোড়। মাতা সুজাতা। মাতামহ ছিলেন, ঋষি উদ্দালক। আর মাতুল ছিলেন, শ্বেতকেতু।
যাইহোক, আমাদের উদ্দেশ্য স্রষ্টাকে জানা নয়, সৃষ্টিকে জানা । যদিও কথায় কথায় আমাদের তাদের কথা অবশ্যই আসবে, কিন্তু তা আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় নয়। তাই আমরা সরাসরি সৃষ্টির মধ্যে প্রবেশ করবো। অর্থাৎ অষ্টাবক্র গীতার মধ্যে প্রবেশ করবো।
অষ্টাবক্র গীতা আসলে, গুরুশিষ্যঃ সংবাদ। গুরু ঋষি অষ্টাবক্র, শিষ্য রাজা জনক। শিষ্য গুরুকে প্রশ্ন করছেন। হে গুরুদেব, আমার প্রভু, কিভাবে আমার তত্ত্বজ্ঞান লাভ হবে ? কিভাবেই বা আমার মুক্তি হবে ? কিভাবেই বা আমি বৈরাগ্য প্রাপ্ত হতে পারবো ?
সরাসরি প্রশ্ন দিয়ে, অষ্টাবক্র গীতার শুরু। এই প্রশ্ন একেবারে আমাদের আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভের প্রথম এবং শেষ প্রশ্ন। আমাদের সবার আকুল হৃদয়ের প্রশ্ন। আসলে সত্যিকারের জিজ্ঞাসুর মধ্যে প্রশ্ন জাগে। আর আমরা প্রশ্ন করি।
প্রথমং প্রকরণম - আত্মানুভব-উপদেশ বর্ণনং নামকং।
যাইহোক, রাজা জনক বলছেন,
কথম্ জ্ঞানম অবাপ্নোতি – জ্ঞান লাভের উপায় বলুন ।
কথম্ মুক্তির্ভবিষ্যতি – মুক্তি কি ভাবে হবে ?
বৈরাগ্যং চ কথম্ প্রাপ্তম – বৈরাগ্য-ই বা কি ভাবে প্রাপ্ত হয় ?
এতদ্ ব্রূহি মম প্রভো – আমার প্রভু, এই সমস্ত আমাকে বলুন ।
সরাসরি আধ্যাত্মিক প্রশ্ন দিয়ে অষ্টাবক্র সংহিতার শুরু। কোনো ভূমিকা নয়। সরাসরি প্রশ্ন : ১) হে প্রভু,জ্ঞান কি করে লাভ করা যায় দয়া করে বলুন। ২) মুক্তি কী ভাবে হবে ? ৩) বৈরাগ্য কি ভাবে পাওয়া যায় ?
ভগবৎ গীতা যাঁরা পড়েছেন, তারা দেখেছে, - অর্জুনই প্রথম ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জ্ঞান দেওয়া শুরু করেছিল। প্রথমে তো আদেশ - "হে অচ্যুত ! উভয় সেনার মধ্যে আমার রথ স্থাপন করো। " পরে কাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে তা দেখে, তার মধ্যে মায়া, মমতা, স্নেহ, শ্রদ্ধা, প্রভৃতি কমনীয় গুনের জাগরণ ঘটে। অহিংস সাত্বিক ভাব জেগে ওঠে। হিংসা ছেড়ে, যুদ্ধ ছেড়ে - বৈরাগী হতে চাইলো। আর এর স্বপক্ষে নানান যুক্তি খাড়া করে, কৃষ্ণকে বোঝাতে চেষ্টা করলো। অর্জুনের আদৌ আধ্যাত্মিক জ্ঞান পাবার ইচ্ছেই ছিল না। তার জিজ্ঞাসার কোনো আধ্যাত্মিক দিকও নেই। অর্জুন কেবলমাত্র নিজের সাময়িক অহিংস-নীতির পক্ষে শ্রীকৃষ্ণের সমর্থন চাইছিলো।
আর ক্ষেত্রটাও যুদ্ধ-ক্ষেত্র। এখানে কোনো আধ্যাত্মিক আলোচনা চলতেই পারে না।
অন্যদিকে কঠোপনিষদ যেখানে আমাদের আত্মা সম্পর্কে প্রামাণ্য তথ্য পাই, সেখানে দেখছি, গুরুদেব-এর কাছে, নচিকেতা নিজের ইচ্ছেতেও যায় নি। এমনকি সশরীরেও যমরাজের কাছে যেতে পারেনি। তার কোনো প্রশ্নও ছিলোনা। স্রেফ যমরাজ তিনটি বর দিতে চেয়েছিলো, তাই কি চাইবেন, কি চাইবেন ভেবে তিনটি বর প্রার্থনা করেছিল : ১) আমার পিতা যেন আমার সন্মন্ধে দুশ্চিন্তা না করেন - আমার প্রতি যেন তার রাগ না থাকে - আমি আবার মানুষ হিসেবে ফিরে গেলে যেন আমাকে সবাই চিনতে পারে। ২)স্বর্গ প্রাপ্তি - অর্থাৎ দুঃখহীন ভোগের রাজত্বে যাবার রাস্তা বলে দাও। ৩) তিন নম্বর প্রশ্নটি ছিল আত্মার অস্তিত্ব - অনস্তিত্ব্য সম্পর্কে জ্ঞান। আসলে এই প্রশ্নটার জন্যই কঠোপনিষদ মান্যতা পেয়েছে। প্রথম প্রশ্ন দুটোতো একেবারেই ফালতু প্রশ্ন। তৃতীয় প্রশ্নে অধ্যাত্বিকতার ছোঁয়া থাকলেও যমরাজ নানান বাহানায় তাকে জবাব দিতে চাইছিলো না। নচিকেতাকে সে উপযুক্ত মনেই করছিলো না। যাক সে সব কথা -
জনক রাজার প্রথম তিনটি প্রশ্নই আমাকে নাড়া দিয়েছে। আত্মকথা জানার জন্য - আকুল হৃদয়ের প্রশ্ন। যুদ্ধ থেকে রেহাই পাবার জন্য নয় - আবার বাপের উদ্ধারের জন্যও নয়। অর্থাৎ নচিকেতা কিন্তু বাপের উদ্ধারের জন্য, বাধ্য হয়ে যমরাজের কাছে গিয়েছিলো।
মহারাজা জনক তিনটে প্রশ্ন করছেন। প্রথম প্রশ্ন - কথম জ্ঞানম ? কি ভাবে জ্ঞান হবে। হে প্রভু,জ্ঞান কি করে লাভ করা যায়, দয়া করে বলুন। দ্বিতীয় প্রশ্ন : মুক্তি কী ভাবে হবে ? তৃতীয় প্রশ্ন : বৈরাগ্য কি ভাবে পাওয়া যায়। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করে, আর সত্যিকারের জিজ্ঞাসুর মনে প্রশ্ন জাগে। আমরা সাধারণ মানুষ, অন্যকে অযাচিত অনেক উপদেশ থাকি, পরামর্শ দিয়ে থাকি। এটা ঠিক নয়, ওটা ঠিক। এটা করা উচিত, ওটা করা উচিত নয়। ইত্যাদি ইত্যাদি। যেন আমরা সবজান্তা। আমরা অন্যের উপরে উপদেশের বোঝা চাপিয়ে দেই। কিন্তু নিজে যখন বিপদে পড়ি, তখন বিভ্রান্ত হয়ে যাই। আমরা প্রশ্ন করি, আমার সমর্থনে বক্তব্য শোনার জন্য। অন্যকে যাচাই করবার জন্য। এদের প্রশ্ন জ্ঞানের পিপাসা থেকে আসে না। আসে বেদনা থেকে, সমস্যা থেকে। আর এরা উত্তরের অপেক্ষায়ও না। উত্তর পেলেও সেই অনুযায়ী কাজ করে না। তাই এদেরকে এড়িয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। যাই হোক রাজার মনে প্রশ্ন জেগেছে। যা যথাযথ জ্ঞানের পিপাসা থেকে এসেছে।
রাজা জনক বলছেন, মুক্তি কিভাবে হবে ? অর্থাৎ রাজা জনক মুক্তির প্রত্যাশী। রাজা জনক ছিলেন, একজন স্বাধীন দেশের স্বাধীন রাজা। তো তাকে কে বেঁধে রেখেছে, যে তিনি মুক্তি চাইছেন ? আসলে আমরা যে বদ্ধজীব, আমাদের এই ধারণাই নেই। আমাদের মুক্তির ইচ্ছেও জাগে না। বন্ধন হচ্ছে, ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেকে জীব বা জীবাত্মা ভাবা। বন্ধন হচ্ছে দেহ শৃঙ্খলে আবদ্ধ হওয়া, কর্ম্মবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। তাহলে কি স্থুল দেহত্যাগ বা মৃত্যুই আমাদের মুক্তির পথ ? না মুক্তি হচ্ছ অজ্ঞানতা থেকে মুক্তি। আত্মজ্ঞানলাভই মুক্তি। এই আত্মজ্ঞান লাভের জন্য ব্যাকুলতা জেগেছে, রাজা জনকের মধ্যে।
যাইহোক, আমরা এইসব প্রশ্নের উত্তর শুনবো। কিন্তু উত্তর শোনার আগে দেখে নেবো, উত্তর শোনার পরে, রাজা জনকের কি অবস্থা হয়েছিল। আর রাজা জনকের উল্লাসবাক্য শোনার আগে, আমি ছোট্ট দুটো ঘটনার কথা বলি।
আমার তখন ৭/৮ বছর বয়স। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ি। আমাদের স্কুলের পাশে ছিল, কবিরাজ মহাশয়ের মুদির দোকান। এই দোকানের ঘর ঘেঁষে, রাস্তার পাশে ছিল, একটা বেলগাছ। একদিন দেখি, বেলগাছে মধুর চাঁক হয়েছে। তো কি খেয়াল হলো, মৌচাকে ঢিল ছুড়তে লাগলাম। পর-পর কয়েকটা ঢিল ছোড়ার পরে, হঠাৎ মৌচাক-টা আমার মাথায় ভেঙে পড়লো। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমি দৌড়োতে লাগলাম, আর মৌমাছিগুলোও আমার পিছনে ধাওয়া করলো। আমি বই-স্লেট ফেলে, প্রানপনে ছুটছি , আর মৌমাছিগুলো আমার পিছনে মেঘের মতো ছুটে চলেছে। শেষে বাবুদের পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। পুকুরে অনেকে স্নান করছিলো। কিছু মৌমাছি, তাদের দিকে তেড়ে গেলো, আমি ডুব সাঁতার দিয়ে পুকুরের অন্য পাড়ে চলে গেলাম। এতেও আমি রেহাই পাইনি, আমার সারা গা মৌমাছির কামড়ে ফুলে উঠেছিল। আমার জ্বর এসে গিয়েছিলো। আমি অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। বাড়িতে যাবার পরে, আমার ঠাকুরমা আমার সারা গায়ে মধু মেখে দিয়েছিলেন । আর আশ্চর্য্যের ব্যাপার হচ্ছে, মধু মাখার খানিক্ষন পর আমার শরীরের সব ব্যথা চলে গেল। এই কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, সেখানে অস্থিরতাসৃষ্টি হয়,সেখানেই আছে অস্থিরতা নিবৃত্তির দাওয়াই।
আর একদিনের কথা। আমাদের বাড়িতে কাঁকড়া খাবার প্রচলন ছিল। ছোট ছোট একরকম কাঁকড়া পাওয়া যেত। এগুলো থেকে শুধু ঘিলু বের করে, খাওয়া হতো। তো বাবা একদিন সকালে বাজার থেকে কেজি দশেক কাঁকড়া কিনে আমার মাথায় চাপিয়ে দিলেন। কি ভাবে কি হলো জানিনা , বস্তার মুখ খুলে গেলো। আর আমার সারা শরীর বেঁয়ে কাঁকড়াগুলো নাবতে লাগলো। আমি তো চিংড়ি মাছের মতো লাফাতে লাগলাম। সারা-গা কুট-কুট করতে লাগলো। শেষে জ্ঞানার বৌদি এসে আমাকে রক্ষা করেন। সারা রাস্তায় কাঁকড়া ছড়িয়ে গেলো। সেগুলো আর একত্র করতে পারিনি। কিন্তু কাঁকড়া আমার গা থেকে নেবে যেতেই, আমরা অস্থিরতা চলে গেলো। অর্থাৎ যারা আমাকে ঘিরে রেখেছে, তাদের তাড়িয়ে দিতে পারলেই, আমার অস্থিরতা কেটে যাবে।
এবার আমরা অষ্টাবক্র গীতার কথায় যাবো। আমরা শুনেছি রাজা জনকের প্রশ্নগুলো।
অষ্টাবক্র উবাচ
মুক্তিম ইচ্ছসি চেত্তাত বিষয়বান বিষবৎ ত্যজ
ক্ষমা-আর্জব-দয়া-তোষ-সত্যং পীযূষবদ ভজ (১/২)
– মুক্তির ইচ্ছা চিত্ততে জাগলে বিষয়কে বিষবৎ ত্যাগ করো। আর ক্ষমা-আর্জব-দয়া-তোষ-সত্য ইত্যাদি গুনগুলোকে অমৃতসুধা মনে করে ভজনা করো।
এবার আমরা প্রশ্নের উত্তর না শুনে, আমরা দেখবো, প্রশ্নের উত্তর শোনার পরে, রাজা জনকের অবস্থা কি হয়েছিল। অর্থাৎ দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে আমরা আলোচনা শুরু করবো। এই পর্বের নাম রাখা হয়েছে, শিষ্যক্তম আত্মা-অনুভবো-উল্লাসঃ। অর্থাৎ রাজা জনক গুরুদেবের আত্ম-অনুভবের উপদেশ শুনে যে উল্লাস প্রকাশ করেছিলেন, সেই কথাগুলো শুনবো। কেন আমি গুরুদেবের উত্তর যা বইয়ের প্রথম প্রকরণে আছে, সেই আলোচনা না করে, পরবর্তী প্রকরণ থেকে শুরু করছি।
দেখুন আমি যখন সাংবাদিকতায় এম.এ. পড়ি, এমনকি যখন "ল" পড়ি, তখন আমাদের ক্লাসে প্রফেসররা ইংরেজিতে লেকচার দিতেন। তো আমি গাঁয়ের স্কুল/কলেজে বাংলা মিডিয়ামে পড়া ছেলে। আমি এই বিদেশ ফেরত প্রফেসরদের ইংরেজি বিশেষ করে তাদের আধো-আধো উচ্চারণ ভালো বুঝতে পারতাম না। ফলত বিষয়ের গভীরে যাবার জন্য, আমাকে টেক্সট বই ভালো করে পড়তে হতো। কিন্তু আমি এম.এ পড়তে পড়তে যখন চাকরি পেয়ে গেলাম, তখন আমি আর ক্লাসে হাজির থাকতে পারতাম না। এই সময় আমি অফিস শেষে ক্লাসমেটদের বাড়িতে যেতাম ক্লাসনোট আনতে। তখন বিষয়ভিত্তিক আলোচনা হতো বন্ধুটির সাথে, আর এই আলোচনা হতো বাংলা ভাষায়। যা আমার মাতৃভাষা। যা আমি ভালোভাবে বুঝি। ফলত বিষয়ের গভীরে যেতে আমার সুবিধে হতো। তো প্রফেসরের মুখে যে কথা আমার মগজে ঢুকতে অসুবিধা হতো, সেই একই বিষয় যখন বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করতাম, তখন বিষয়টি আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যেত। আর ঠিক এই কারণেই, আমি প্রথমেই গুরুদেবের কথা না শুনে শিষ্যের অনুভবের কথা যদি ধরতে পারি, তবে গুরুদেবের কথা বুঝতে আমাদের সুবিধে হবে।
রাজা জনক আনন্দের সঙ্গে বলছেন, আহা ! আসলে রাজা জনক বিস্ময়ে উল্লাস প্রকাশ করছেন। বলছেন, তাইতো, এতদিন আমি সব ভুল বুঝে এসেছি। এখন আমার দৃষ্টি খুলে গেছে। আমি সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, বুঝতে পারছি। আসলে এই সত্যকে জানবার জন্য কোনো বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন নেই। শুধু গুরুমুখের বাক্যই যথেষ্ট। গুরুদেবের প্রতি, শ্রদ্ধা-বিশ্বাস এই অবিশ্বাস্য কাজটা করতে পারে। রাজা জনক বলছেন, গুরুদেবের কথা শোনার আগে পর্যন্ত আমি কি মোহের মধ্যেই না ছিলাম। কি বিড়াম্বনার মধ্যেই না ছিলাম। দেহ ও আত্মা সম্পর্কে আমার যে ভ্রান্ত ধারণা বা জ্ঞান ছিল, সেই মোহ আমার কেটে গেছে।আমি আমার সম্পর্কে যা কিছু ভাবতাম, সেই ভুল আমার কেটে গেছে। আমি সমস্ত রকম উপাধিহীন, অর্থাৎ আমি রাজা নোই, আমি দেহ নোই, আমি জ্ঞানী নোই, আমি অজ্ঞানী নোই, আমি স্ত্রী নোই পুরুষ নোই। আমি সর্ব বিকার রোহিত, স্ব-প্রকাশ চিদরূপ। অচেতন জগতের প্রকাশক আমি, ঠিক তেমনি এই স্থুল দেহের প্রকাশকও আমি। এই যে দৃশ্যমান যে জগৎ, এমনকি এই দেহ সবই আমাতেই প্রকাশিত। অর্থাৎ আমিই সেই চৈতন্য।
দ্বিতীয় প্রকরণে ২৫টি শ্লোক আছে। বিভিন্ন উপমার সাহায্যে এই অদ্বৈত তত্ত্বের উপল্বদ্ধির কথা প্রকাশ করেছেন, রাজা জনক। আমরা এর পরের দিন, সেই উপমার সাহায্যে তত্ত্বকথা বুঝবার চেষ্টা করবো, চেষ্টা করবো, রাজা জনকের চিন্তার সাথে নিজের চিন্তাকে মেলে ধরতে, মিলিয়ে নিতে। তবে একটা কথা মনে রাখতে হেবে, আমরা অষ্টাবক্রের কথা এখনো শুনিনি। অর্থাৎ যথার্থ গুরুবাক্য আমাদের এখনো কানে আসেনি। তাহলে রাজা জনকের উল্লাসের কারন জানতে পারবো। কিন্তু উল্লাসের ধ্বনি শুনে তে আমরা ধ্বনির উৎসে যেতে পারবো।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
অষ্টাবক্র গীতা - নতুন সংস্করণ (দ্বিতীয় ভাগ)
সমুদ্রের তরঙ্গকে সমুদ্র থেকে আলাদা করা যায় না। জলের বুদ্বুদকে জল থেকে আলাদা করা যায় না। তেমনি আত্মা থেকে উৎপন্ন এই যে বিশ্ব, এঁকে আত্মা থেকে আলাদা করা যায় না। কাপড় থেকে সুতোকে আলাদা করা যায় না। যদি সুতোকে আলাদা করো, তবে সুতোই থাকবে, কাপড় বলে কিছু থাকবে না। আখের রসে যে মধু বা মিষ্টি আছে, তাকে আলাদা করা যায় না। তাহলে আখ বলে কিছু থাকে না।
জগতের একটা রসায়ন আছে। আর তা হচ্ছে, কেউ কারুর থেকে আলাদা নয়। আমাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গকে আমাদের আলাদা মনে হয় বটে, কিন্তু কেউ কারুর থেকে আলাদা নয়। আমার পায়ের আঙুলে যদি ব্যথা পাই, তবে আমার সারা শরীরের এমনকি মনের কষ্ট হয়। আবার আমার চোখের যদি কষ্ট হয়, তখন আমাদের সারা শরীরে সেই কষ্ট প্রভাবিত হয়। আবার আমার যদি মনে কষ্ট হয়, তখন আমার শরীর ভালো থাকতে পারে না। আমার শরীরের যেকোনো অঙ্গ যদি রুগ্ন হয়, তখন পুরো শরীরটাই বিচলিত বোধ করে। ঠিক তেমনি, এই বিশ্বব্রহ্মান্ড একটা শরীর। মানুষ তার একটা ক্ষুদ্র অঙ্গ বা অংশ। সূর্য্যে যদি কোনো বিস্ফোরণ ঘটে তবে তার প্রভাব সমস্ত সৌরজগৎকে প্রভাবিত করবে। এমনকি প্রতিটি জীবের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি হবে। আমার হাতে যদি একটা অগ্নিখন্ড চেপে ধরা হয়, তবে শুধু আমার হাত ব্যথা পাবে না, আমার সমস্ত শরীরে সেই কষ্ট ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের অনেকের ধারণা হচ্ছে, আকাশ মানে শূন্য, অন্তরীক্ষ মানে শূন্য। ব্যাপারটা কিন্তু আদৌ তা নয়। অন্তরীক্ষ সম্পূর্ণ ভরাট হয়ে আছে। আর একটা কথা হচ্ছে, একটা মানুষের মূল সত্ত্বা আর একটা জীবের এমনকি উদ্ভিদের মূল সত্ত্বার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আপনা শুনে আশ্চর্য্য হবেন, অন্তরীক্ষে মানুষ পাঠাবার আগে, আলু পাঠানো হয়েছিল। এবং বিজ্ঞানীরা এটা উপলব্ধি করেছিলেন, একটা আলু মহাকাশে গিয়ে যদি তার মূল সত্ত্বার পরিবর্তন না করে, তবে মানুষ সেখানে ঠিক টিকে থেকে যেতে পারে। অর্থাৎ আলুটা ফিরে এলে যদি দেখা যায়, তার মধ্যে অংকুরিত হবার সম্ভাবনা আছে, তবে বুঝতে হবে, অন্তরীক্ষে মানুষ গেলেও, তার জীবনীশক্তি নষ্ট হবে না। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, সমস্ত কিছুর মধ্যে যে মূল সত্ত্বা তা এক। তা সে মানুষ বলুন, জীব বলুন, আর উদ্ভিদ বলুন, এমনকি জড়পদার্থ বলুন। সবারই উৎপত্তি স্থান হচ্ছে এক, আর তা হচ্ছে, দৃশ্যমান সূর্য। সূর্যই সমস্ত সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলে। মাটি ফুড়ে যে বীজ অংকুরে রূপান্তরিত হয়, তার মুলে আছে সূর্য। মানুষকেও ওই একই শক্তি বেঁচে, বেড়ে ওঠার শক্তি যোগায়। আর ঠিক এই কারণেই গায়ত্রী মন্ত্রে সূর্য্যরশ্মির উপাসনা করা হয়েছে। আবার আমাদের মধ্যে বৈপরীত্ত্বে ভরা। আমি আর আপনি এক নয়। কোনো মানুষই অন্য মানুষের মতো নয়। আমাদের কান যেমন দেখতে পায় না। চোখ তেমনি শুনতে পায় না । প্রত্যেকের গুন্ বা ক্ষমতা আলাদা আলাদা। এমনকি আমার বুড়ো আঙুলের মধ্যে যে ছোট্ট ছোট্ট রেখা আছে, তাও সবার থেকে আলাদা আলাদা।তেমনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রত্যেকের গতিপথ আলাদা আলাদা। প্রত্যেকের কাজ বা গুন্ আলাদা আলাদা।
কিন্তু সবই পূর্বনির্দিষ্ট। এই পূর্বনির্দিষ্ট যে গুন্ বা কাজ তাকে আপনি বদলাতে পারবেন না। পৃথিবীর গতিপথকে আপনি পাল্টাতেপারবেন না। সূর্য্যের গতিপথ আপনি পালটাতে পারবেন না। গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানেই থাকবে। ঠিক তেমনি মানুষের পেটে মানুষ হবে। পশুর পেটে পশু হবে, আমের আঁটিতে আমগাছ হবে। এটাকে আপনি বদলাতে পারবেন না। আর এগুলো সবই পূর্ব-নির্ধারিত। আমি যে আপনাদের সাথে কথা বলছি, এটাও পূর্বনির্ধারিত। আর আজ যাকে আমরা জন্মাতে দেখছি, তার জন্ম অনেক আগেই হয়ে গেছে। আজ আমি তার প্রকাশ দেখছি মাত্র। প্রকৃত অর্থে আজ আমি যাকে গন্তব্যে পৌঁছতে দেখছি, সেতো অনেক আগে হাটা শুরু করেছিল। আজ যে ফুলটাকে প্রস্ফুটিত হতে দেখছি, সেতো অনেক আগেই পরিণতিতে যাবার জন্য যাত্রা শুরু করেছিল।
তো তিনটে জিনিস আমাদের মনে রাখতে হবে, এক) আমরা সবাই মূলতঃ এক। দুই) কিন্তু আমরা সবাই বাহ্যত আলাদা। তিন) যা কিছু হচ্ছে, বা হবে সবই পূর্বকৃত কর্ম্মফল, এবং নির্দিষ্ট। আমরা তাকিয়ে আছি ভবিষ্যতের দিকে। তাই আমরা গাছ হতে দেখছি, ফুল ফুটতে দেখছি, ফল হতে দেখছি। আর আমরা একের পর এক ভবিষৎ দেখছি। সাধন জগতের যাত্রা হয় উল্টো দিকে। অর্থাৎ আমরা ফল দেখে ফুলের কথা ভাববো, ফুল দেখে গাছের কথা চিন্তা করবো, গাছ দেখে আমরা বীজের কথা চিন্তা করবো। অর্থাৎ আমরা সবাই কোথা থেকে এসেছি, এটা যদি ধরতে পারি, এখন আমি কোথায় আছি, সেটা যদি বুঝতে পারি, তবে আমরা ভবিষ্যতে কোথায় যাবো, সেটা যেমন বুঝতে পারবো, তেমনি বুঝতে পারবো আমাদের মূল সত্ত্বাকে ।
প্রথম শ্লোক :দ্বিতীয়ং প্রকরণম্
অহো নিরঞ্জনঃ শান্তো বোধঃ অহং প্রকৃতেঃ পরঃ
এতবন্তম অহং কালং মোহেন এব বিড়ম্বিতঃ।
কি আনন্দ ! আমি নিরঞ্জনঃ অর্থাৎ শুদ্ধ নির্মল আত্মা। আমি শান্ত অর্থাৎ সর্ব বিকার রোহিত, সর্ব বিকারেরের উর্ধে। প্রকৃতির উর্ধে, সেই স্বপ্রকাশ চিৎস্বরূপ।এতকাল আমি দেহ ও আত্মার অভেদরূপ মোহে কি বিড়ম্বনাই না ভোগ করছিলাম।
আমরা মিথ্যা অহং বোধে ডুবে আছি। দেহ ও আত্মার ভেদ বুঝি না। আমি এবং আমার দেহ এর মধ্যে পার্থক্য করতে পারি না। প্রতিদিন আমার দেহ পরিবর্তন হচ্ছে, তবু এই দেহকেই "আমি" বলে ভ্রমে আবদ্ধ আছি। এবং দুঃখ কষ্ট ভোগ করছি। আমরা যতক্ষন দেহাতীত না হতে পারছি, ততক্ষন আমার বিড়ম্বনা চলতেই থাকবে। গুরুপ্রদত্ত জ্ঞানই পারে এই দেহবোধের উর্দ্ধে প্রতিষ্ঠিত করতে।
আমরা সবাই ত্রিতাপ দুঃখ অনলে পুড়ে মরছি। এর মধ্যে একটি স্ব-কৃত কর্মফল, অন্যটি অন্য জীবদের দেওয়া দুঃখ, আর সব শেষে প্রকৃতির রোষানলে অসহায় অবস্থা। আর এর মধ্যে সব থেকে বেশি কষ্ট পাই, আমার স্ব-কৃত কর্মের দ্বারা। আমাকে এই ত্রিতাপ থেকে মুক্তি পেতে হবে। কিন্তু সত্যি কি এইসব দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব ? সম্ভব কিন্তু কি ভাবে, সেই কথাই মহামুনি অষ্টাবক্র গীতায় তার শ্লোকে শ্লোকে বলেছেন।
শ্লোক নং ২ :দ্বিতীয়ং প্রকরণম্
যথা প্রকাশয়ামি একঃ দেহমেনং তথা জগৎ
এত মম জগৎ সর্বমথবা না চ কিঞ্চন।
২/২ আমিই এই অচেতন জগতের প্রকাশক, আবার আমিই স্থুল দেহেরও প্রকাশক। অতএব দৃশ্যত এই দেহাদি সহ সর্ব জগৎ আমাতেই অধ্যস্ত। আমার দেহ বলে কিছু নেই, আমাতেই দেহ, আর জগৎ বলে কিছু নেই, আমাতেই জগৎ।
আসলে এটাই ঈশ্বরের সংজ্ঞা । জনক নিজেকেই ঈশ্বর ভাবছেন । আত্মজ্ঞান লাভের পরে এটাই সত্যিকারের উপলব্ধি। যদিও প্রথমে আমার মনে হত এই উপলব্ধি আসলে সূর্যকে আয়নার মধ্যে দর্শনের মতো । বাটির জলে চাঁদের দর্শন যেমন হয় আরকি । পরে বুঝেছি, যাঁকে আলাদা করাই যায় না, সেই বুদ্বুদ যা সমুদ্রেই জন্ম, সমুদ্রেই খেলে বেড়ায়, সমুদ্রেই লয় প্রাপ্ত হয় - তাঁকে সমুদ্র ছাড়া আর কি বলবো ? যাঁকে আলাদা করা যায় না। তাঁকে জোর করে কাল্পনিক ভাবে আলাদা করে কারুর সঙ্গে তুলনা করা - এটা হাস্যস্কর প্রয়াস মাত্র।
তাহলে কি আমি বলে কিছু নেই ? সবই তিনি। তার সব গুন্ ক্ষুদ্রাকারে আমার মধ্যে। আমার সব গুন্ বৃহৎ আকারে ঈশ্বরের মধ্যে ! অতএব আমিই ঈশ্বর। সমুদ্রের জল যখন সমুদ্রে থাকে, আর সমুদ্র থেকে জল নিয়ে যখন একটা কলসি ভরাট করা হয় তখন কলসিটা কি সমুদ্র হয়ে যায় ? ঈশ্বরের বিরাটত্ব/বিশালত্ব গুনতো কলসির জলে পাওয়া অসম্ভব। তাহলে "অহম তত্ত্বমসি" আমিই সেই - কথাটা কি ভুল ? না ভুল নয়। আকাশ যেমন বিশাল, তেমনি সর্বত্র-ব্যাপ্ত, আকাশের এইগুনের জন্য ঘটের আকাশও, আকাশের সমস্ত গুন্ নিয়েই অবস্থান করছে। এক মাত্র বিশালত্ত্ব গুন্ বাদে। অতএব আমি ঈশ্বর একথা যেমন সত্য, আবার আমি ঈশ্বর নোই এ কথাটাও সত্য নয়। আসলে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঈশ্বরের অংশ আমরা। ঈশ্বরের মধ্যেই অবস্থান করছি। কেবল এই উপল্বদ্ধির সাময়িক লোপ পাবার ফলেই আমাদের মধ্যে অহং-এর সৃষ্টি হয়েছে। আবার এই অহংয়ের বিলোপে আমরা স্বরূপে স্থিত হবো।
তৃতীয় শ্লোক :দ্বিতীয়ং প্রকরণম্
সশরীরম অহো বিশ্বং পরিত্যজ্য ময়াধুনা
কুতশ্চিৎ কৌশলাদেব পরমাত্মা বিলোক্যতে।
২/৩ কি আনন্দ ! এই যে শরীর, এই যে দৃশ্যমান জগৎ, এই সব ত্যাগ করে, এই সবের উর্ধে উঠে, গুরু প্রদত্ব চাতুরীর সাহায্যে, আমি পরমাত্মা এই অনুভবেই বিলোপ বা মগ্ন হয়েছি ।
গুরুপ্রদত্ত্ব জ্ঞানে গভীর আস্থাই একমাত্র এই উপলব্ধি দিতে পারে। এইজন্য গুরুর প্রতি গভীর আস্থা, শ্রদ্ধা না থাকলে স্ব-স্বরূপে স্থিত হওয়া যায় না। রাজা জনকের মতো গুরুসমর্পিত প্রাণই এই গভীর আত্মউপলব্দ্ধির অধিকারী। সনাতন ধর্মে তাই গুরুভক্তি, গুরুশ্রদ্ধার প্রতি এত গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়েছে।
আসলে রাজা জনক কি অবস্থায়, এই উপল্বদ্ধিতে পৌঁছনোর যোগ্য হতে পেরেছিলেন, সে গল্প পরের দিন করবো, তবে একটা কথা বলতে পারি, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, ভক্তি অর্থাৎ সম্পূর্ণ রূপে নিজেকে অর্থাৎআমার তন -মন-ধন গুরুর চরণে না রাখতে পারলে, এই উপল্বদ্ধিতে পৌঁছানো সম্ভব নয়। রাজা জনক এটা করতে পেরেছিলেন। আসলে অষ্টাবক্রমুনি নিমিত্ত মাত্র। রাজা জনক আত্মজ্ঞানের জন্য, নিজেকে এতটাই ব্যাকুল করতে পেরেছিলেন, বা ব্যাকুল হয়েছিলেন, যে সামান্য স্ফুলিঙ্গ তাকে বিরাট অগ্নিশিখাতে পরিণত করে দেয়। এই সময় ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথা মনে পরে, তিনি বলতেন, নদীতে জোর করে চেপে রাখলে, মানুষ যেমন শ্বাস নেবার জন্য, যেমন ব্যাকুল হয়ে ওঠে, সর্ব্বশক্তি নিয়োগ করে, উপরে উঠে আসতে চায়। সেই ব্যাকুলতা জাগা চাই। রাজা জনকের মধ্যে সেই ব্যাকুলতার জন্ম হয়েছিল। তাইতো, তিনি পাগলের মতো নিজেকে বার বার নমস্কার করছিলেন।
চতুর্থ শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্
যথা ন তোয়াতো ভিন্নাঃ তরঙ্গাঃ ফেন - বুদ্-বুদাঃ
আত্মনো ন তথা ভিন্নং বিশ্বম-আত্ম-বিনির্গতম।
২/৪ তরঙ্গ,ফেনা,বুদ্-বুদ্ যেমন জল থেকে ভিন্ন নয়, আত্মা হতে উৎপন্ন বিশ্বও তেমনি আত্মা হতে ভিন্ন নয়।
আমিতো সমুদ্রে উৎপন্ন বুদ্-বুদ্ মাত্র। এক অর্থে আমি তারই মধ্যে তারই সত্বা দিয়ে তৈরি, তারই অংশ মাত্র।
যতদিন, আমাদের ভ্রান্ত আত্মপরিচয় বোধ থাকবে, অর্থাৎ, আমি আমি ভাব থাকবে,ততদিন আমাদের দুঃখ বোধ থাকবে। আমি যখন, যার সাথে একাত্মবোধ করছি, আমি তখন তাই হয়ে যাচ্ছি। এই হয়ে যাওয়াই আমার দুঃখের কারন। আমি যদি মনে করি, আমি সব জানি, আমি বিদ্বান, আমি পণ্ডিত-বুদ্ধিমান, অর্থাৎ আমি যদি প্রকৃতি থেকে নিজেকে আলাদা ভাবি, তবে এই উপলব্ধি হাওয়া সম্ভব নয়। রাজা জনক এই প্রকৃতিবোধয়ে একাত্ম ছিলেন।
পঞ্চম শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্
তনতু মাত্রো ভবেদেব পট যদ্বদ্ বিচারিতঃ
আত্মা-তন্মাত্রমেমেদং তদ্বদ্ বিশ্বং বিচারিতম্।
২/৫ বিচার করলে দেখা যাবে,পট, তনতু অর্থাৎ সূতা ছাড়া কিছুই নয়।তেমনি বিচার করলে দেখা যাবে বিশ্বও আত্মা মাত্র।
আমরা কাপড় দেখেছি। একটু খেয়াল করলে দেখতে পারবেন, এই কাপড় সুতো নয়। সুতোগুলো যদি কাপড় হয়, তবে কাপড় বলে আলাদা কিছু না। ঠিক তেমনি, "আমি" যা তৈরী তা যদি আলাদা করি, তবে আমি বলে কিছু থাকে না। ধরুন, আমি এই দেহ, যা আমরা সাধারণত ভেবে থাকি, তো দেহ আমরা সবাই জনি পঞ্চভূতের দ্বারা তৈরি, অর্থাৎ ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ- ব্যোম দিয়ে তৈরি।আর এর সঙ্গে রয়েছে মন-চিত্ত স্মৃতি এগুলো দিয়ে আমার অহং। খেয়াল করুন, আমার অহং আমি নোই। তো আজ থেকে ১০০ বছর আগে আমার এই দেহ ছিল না. আবার ৫০ বছর পরে আমার এই দেহ থাকবে না। কিন্তু মৃত্যুর পরেও, অর্থাৎ স্থুল দেহ নাশের পরেও আমাদের অহং যা মন-বুদ্ধি-চিত্ত দিয়ে তৈরি সেটা কিন্তু থাকবে। আরও হাজার বছর
ষষ্ট শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্
যথা এব ইক্ষু রসে কল্পতা (কঌপ্তা) তেন ব্যাপ্তা এব শর্করা
তথা বিশ্বং ময়ি কল্পতং (কঌপ্তং) ময়া ব্যপ্তং নিরন্তরম্।
২/৬ আখের রসে কল্পিত চিনি যেমন মধুর রসের দ্বারা সর্বত ভাবে ব্যাপ্ত হয়ে থাকে, তেমনি আমাতে (আত্মায়) কল্পিত বিশ্বও আমার দ্বারা ভিতরে-বাহিরে সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে।
আমি ও এই দৃশ্যমান জগৎ এক এবং অভিন্ন। আমাদের মূল সত্ত্বা এক। এই বোধ আমাদের জাগ্রত করতে হবে। তবে, আমরা অষ্টাবক্র মুনির কথার তাৎপর্য বুঝতে পারবো। আসলে অষ্টাবক্র মুনি বা তার উপদেশ নিমিত্ত মাত্র। অগ্নি তো কাঠের মধ্যেই আছে। দরকার শুধু ঘর্ষণ। যে কাজটা করেছিলেন, অষ্টাবক্র মুনি।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
অষ্টাবক্র গীতা - নতুন সংস্করণ ( তৃতীয় ভাগ)
রাজা জনকের রাজসভায় - ঋষি যাজ্ঞবল্ক
অষ্টাবক্র গীতা আলোচনার প্রারম্ভে , আমরা অষ্টাবক্র গীতা বইটি সংগ্রহ করতে বলেছিলাম।অষ্টাবক্র গীতার মর্মার্থ উপলব্ধি করতে গেলে, প্রথমে এই বইটি অধ্যয়ন করা জরুরী। কিন্তু বইটি পড়ে, আমরা এই বইয়ের গূঢ়তত্ত্ব অনুধাবন করতে পারবো, এমনটা নাও হতে পারে। মহাত্মাগণ বলে থাকেন, এই বইয়ে আছে, আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ জ্ঞানের কথা। তাই আমাদের মতো সাধারণের পক্ষে এই জ্ঞানের ঘনত্ত্বে প্রবেশ সাধ্যাতীত। এই জ্ঞান সংগ্রহের জন্য, আমাদের সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর ধীশক্তি সম্পন্ন হতে হবে। যা আয়ত্ত্বে আনতে গেলে আমাদের জন্ম-জন্মান্তরের সাধনার প্রয়োজন। তবুও আমাদের এই আলোচনার উদ্দেশ্য অষ্টাবক্র গীতা সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি করা। যা আমাদের প্রাথমিক প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করতে পারে। এছাড়া, কিছু মানুষ তো নিশ্চই আছেন, যারা স্বপ্রতিভায় তাদের পূর্বার্জিত জ্ঞানকে জাগ্রত করতে পারেন। আমরা শুধু আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চাইছি। এই বইতে মাত্র দুটো চরিত্র। গুরু-শিষ্য। গুরু হচ্ছেন, অষ্টাবক্র মুনি আর শিষ্য হচ্ছেন রাজা জনক। একজন পরমাত্মা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভাবে অবহিত আর একজন পরমাত্মার প্রতিফলন বা জীবাত্মা সম্পর্কে অবহিত কিন্তু পরমাত্মা সম্পর্কে উৎসুক।
ঠিক এই কারনে, সাধনধন অষ্টাবক্র গীতা বুঝতে গেলে, আমাদের রাজা জনক ও অষ্টাবক্র সন্মন্ধে জানবার চেষ্টা করতে হবে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, এঁরা দুজনই ছিলেন ব্রহ্মজ্ঞানী। এঁরা সবাই জন্ম-জন্মান্তরের সাধক। একটা সময় ভারতবর্ষে খুব প্রসিদ্ধ তিনটি রাজ্য ছিলো। কুরু, পাঞ্চাল ও বিদেহ। মহাভারতে এই কুরু ও পাঞ্চাল রাজাদের কথা বেশি করে বলা আছে। বিশেষ করে, কুরু রাজাদের কথা। এই কুরুবংশে জন্মেছিলেন, পঞ্চপান্ডব। যাদের বলা হয়ে থাকে, কেউ ধর্ম্মপুত্র, কেউ সূর্যপুত্র, কেউ পবনপুত্র, কেউ আবার অশ্বিনীকুমারদের পুত্র। এই পাঞ্চাল রাজ্যে অগ্নি থেকে উদ্ভূত হয়েছিলেন, দ্রৌপদী। এই তিনটি রাজ্যেই অনেক বড় বড় ঋষিমুনি জন্মেছিলেন, যাঁরা বেদোক্ত মন্ত্রের দ্রষ্টা ছিলেন। এই বিদেহ রাজ্যের রাজা ছিলেন রাজা জনক। যেহেতু তিনি বিদহ রাজ্যের রাজা, তাই তাঁকে বৈদেহ বলা হতো। আমরা যখনকার কথা বলছি, তখন রাজা জনক ব্রহ্মবিদ হয়ে ওঠেন নি। তার সাথে অষ্টাবক্রমুনির সাক্ষাৎও হয় নি। তিনি তখন শুধুই রাজা। তবে তিনি দানধ্যানে, যাগ-যজ্ঞে তুলনারহিত হয়ে উঠেছিলেন। অনেক ব্রহ্মচারী তার কাছে, বিদ্যাশিক্ষা করতেও আসতেন। আবার অনেক ঋষি তাপস তার কাছে আসতেন, দান-সামগ্রী পাবার প্রত্যাশী হয়ে।
তো একবার এই রাজা জনক, একটা বিরাট যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। সমস্ত যজ্ঞেই ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের, শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তিদের বিভিন্ন সামগ্রী দান করা হতো। এই যজ্ঞেও দানের সামগ্রী ছিল প্রচুর। তাই এই যজ্ঞের নাম রাখা হয়েছিল, বহুদক্ষিন যজ্ঞ। অর্থাৎ যেখানে বহু দক্ষিনা দেওয়া হবে। আর প্রাচীন কালে একটা প্রথা ছিল, ব্রাহ্মণ পন্ডিতগণ রাজাদের কাছে গিয়ে, পান্ডিত্য প্রদর্শন করে দক্ষিনাপ্রার্থী হতেন। বহুদক্ষিন যজ্ঞে বহু পন্ডিতের সমাগম হলো। তো রাজা জনক দেখলেন, এই একটা সুযোগ, জ্ঞান সংগ্রহের। আসলে রাজা জনক জ্ঞান পিপাসু ছিলেন ধন পিপাসু নয় । তাই এত পন্ডিতদের সমারোহ দেখে, ভাবলেন, এই এক অপূর্ব সুযোগ, যাঁরা আজ এখানে উপস্থিত, সবাই বেদবিদ্যায় পারদর্শী, পবিত্র ব্রাহ্মণ। কিন্তু এর মধ্যে কে শ্রেষ্ট ব্রহ্মবিৎ, কে শ্রেষ্ঠ বিদ্যান এই সুযোগে আজ জেনে নিতে হবে। আর রাজা জনক জানতেন, ব্রাহ্মণ পন্ডিতেরা সবাই জাগতিক সম্পদের অভাবে ভোগেন। আর সেই সময় সম্পদ হিসেবে গোধনের খুব চাহিদা ছিল। তাই কৌশল করে হাজার খানেক গাভী, যাদের শিং সোনা দিয়ে মোড়া - , যজ্ঞ সভার নিকটেই গোষ্ঠঘরে হাজির করলেন । এবং ব্রাহ্মণ মন্ডলীর সামনে প্রণাম করে বললেন, হে মহর্ষিগন, এই এক হাজার ধেনু, খুবই সামান্য, আপনাদের মধ্যে যিনি শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মিষ্ঠ তাঁকে এই গোধন দিয়ে আমি কৃতার্থ হতে চাই। আপনাদের মধ্যে যিনি শ্রেষ্ঠ, তিনি দয়াকরে এই দান গ্রহণ করুন।
তখন সবাই এর ওর দিকে তাকাতে লাগলো। একি বিড়াম্বনা। এঁরা সবাই বেদবিদ্যায় পারদর্শী। কিন্তু কে শ্রেষ্ঠ এটা কে বলে দেবে ? আর নিজের থেকে নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলা, এটা তো দাম্ভিকতার পরিচয় হবে। তাই যজ্ঞভূমি শান্ত-স্তব্ধ হয়ে গেলো। একদিকে হাজার হাজার ব্রাহ্মণ, আর দিকে হাজার হাজার গোধন। সবাই এর ওঁর দিকে তাকাতে লাগলো। মনে মনে ভাবছেন, রাজামহাশয় একি বিড়াম্বনায় ফেললেন আমাদের। কিন্তু কেউ সাহস করে, কিছু বলতে পারলো না। হঠাৎ এর মধ্যে থেকে উঠে দাঁড়ালেন, এক জটাজুট মন্ডিত-শির দ্যুতিময় দেহধারী এক প্রৌঢ়। আর সবাইকে অবাক করে, তার ব্রহ্মচারী শিষ্যদের বললেন, গাভীগুলোকে আমার আশ্রমে নিয়ে যাও। এই প্রৌঢ় ঋষি যাজ্ঞবল্ক বলে পরিচিত। আর এতেকরে, সমস্ত ব্রাহ্মণ পন্ডিতগণ ক্রোধে জ্বলতে লাগলো। কিন্তু কেউ কোনো কথা বলতে পারলো না।
রাজা জনকের রাজ্ পুরোহিত ছিলেন, অশ্বল। তার ডাকনাম ছিল হোতা অশ্বল। সমস্ত রাজযজ্ঞের হোতা পুরোহিত ছিলেন, এই অশ্বল। স্বভাবতই তিনি নিজেকে সবচেয়ে, ভাগ্যবান ও পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ মনে করতেন। তো রাজা জনক কোনো কথা বলছেন না দেখে, অশ্বল ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন, বললেন, কিহে, তুমিই নাকি আমাদের মধ্যে ব্রহ্মিষ্ঠ ? যাজ্ঞবল্ক প্রশান্ত ভাবে উত্তর দিলেন, সমস্ত ব্রহ্মিষ্ঠের চরণে কোটি কোটি প্রণাম। আমার গাভীগুলোর প্রয়োজন ছিল মাত্র। রাজা জনক এই কথাটায় খুবই সন্তুষ্ট হলেন, আর মৃদু-মৃদু হাসতে লাগলেন, ভাবলেন, এই হচ্ছে যথাযথ সত্যনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ ও ব্রহ্মিষ্ঠ। ধীর স্থির শান্ত অথচ তেজস্বী। কিন্তু অন্য-ব্রাহ্মণ পন্ডিতগণ তো ছাড়বার পাত্র নয়। এতগুলো গোধন কেউ হাতছাড়া করতে চায় না। ফলতঃ শুরু হলো, ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা। শুরু হলো ব্রহ্ম-বিষয়ক প্রশ্ন-উত্তর, যা রাজা জনকের মূল উদ্দেশ্য ছিল। তো এই হচ্ছে, রাজা হয়েও, জাগতিক সমস্ত ভোগের সামগ্রী যার আয়ত্ত্বে ছিল, কিন্তু তিনি নিজের মধ্যে ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা জাগিয়ে রেখেছিলেন। এই কাহিনী বৃহদারণ্যক উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ে আছে। যারা এ সম্পর্কে জানতে উৎসুক, তারা এই উপনিষটি পড়ে দেখতে পারেন।
যাইহোক, প্রশ্ন-উত্তর পর্বের প্রথমে যাজ্ঞবল্ক গার্গীকে যা বলেছিলেন, তা হচ্ছে - প্রাণের প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে জল। জল যা সমস্ত প্রাণের উৎস তা বায়ুতে ওতপ্রোত ভাবে অবস্থান করছে, বায়ু অন্তরিক্ষলোকে ওতপ্রোত ভাবে অবস্থান করছে, তেমনি অন্তরীক্ষ আছে গন্ধর্বলোকে, গন্ধর্বলোক আছে, আদিত্যলোকে, আদিত্যলোক আছে চন্দ্রলোকে, চন্দ্রলোক আছে নক্ষত্রলোকে, নক্ষত্রলোক আছে দেবলোকে, দেবলোক আছে ইন্দ্রলোকে, ইন্দ্রলোক আছে প্রজাপতিলোকে, প্রজাপতিলোক আছে ব্রহ্ম লোকে।
যাজ্ঞবল্ক এইসময় অন্তর্যামী ব্রহ্ম সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, তা আজো সমানভাবে যুগোপযুগি। যিনি এই পৃথিবীতে থেকে পৃথিবীর অভ্যন্তরে বর্তমান, পৃথিবী যাকে জানে না, অথচ পৃথিবীই তার শরীর, যিনি পৃথিবীর অন্তরে বসে পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রিত করেন, তিনিই আত্মা তিনিই অন্তর্যামী। যিনি অন্ধকারে থেকে, অন্ধকারের অন্তরে বিরাজ করেন, অন্ধকার যাকে জানে না, অথচ অন্ধকারই তার শরীর, যিনি অন্ধকারে বসে অন্ধকারকে নিয়ন্ত্রিত করেন, তিনি এই আত্মা। আত্মাই অন্তর্যামী, তিনিই অমৃত। যিনি তেজে থেকে তেজের অন্তরে বিরাজ করেন, তেজ যাঁকে জানে না, অথচ তেজ যার শরীর, যিনি অন্তরে বসে তেজকে নিয়ন্ত্রিত করেন, তিনিই আত্মা, আত্মাই অন্তর্যামী, তিনিই অমৃত। অর্থাৎ সবার মধ্যে যিনি আছেন, সবাইকে যিনি নিয়ন্ত্রণ করছেন, অথচ কেউ তাকে জানতে পারছেন না, তিনিই সেই অন্তর্যামী আত্মা।
যাই হোক, আমাদের আজকের আলোচনা ব্রহ্মবিষয়ক নয়, আমাদের আলোচনা রাজা জনককে বোঝার চেষ্টা করা। রাজা জনক এসব কথা শুনেছিলেন অষ্টাবক্র মুনির শিষ্যত্ত্ব নেবার অনেক আগে । কিন্তু পরবর্তীতে নিজে ব্রহ্মজ্ঞ হয়েও, তিনি সংসার ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন নি। তখন নিজের আত্মাকে নিস্তরঙ্গ রেখে নিজের মধ্যে নিজে ডুবে থাকতেন। এসব কথা বলবার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমাদের মনকে রাজা জনকের জায়গায় নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে হবে, তবেই আমরা ঋষি অষ্টাবক্রের অমৃত উপদেশের যথাযথ অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারবো।
আর একটা কথা বলি, রাজা জনক সমস্ত চঞ্চলতার মধ্যেও নিজেকে স্থির রাখতে পারতেন । বহুদিন পরে, শুকদেব যখন পিতা ব্যাসদেবের নির্দেশে রাজা জনকের কাছে গিয়েছিলেন, তখন রাজসভায় চলছিল নৃত্যগীত। তো শুকদেব ভেবেছিলেন, পিতা আমাকে কার কাছে পাঠালেন ? যিনি এই নৃত্যগীতে মশগুল থাকেন, তিনি কি করে আমাকে ব্রহ্মবিদ্যা দান করবেন ? শুকদেব বহুক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করছিলেন, রাজা জানতে পেরে, তাকে ভিতরে ডেকে নেন। এবং একটা পাত্রে কানায় কানায় তেল ভ'রে বলেছিলেন, সভার চারিপাশ দিয়ে একটা চক্কর দিয়ে এস। শুকদেব তাই করেছিলেন, বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনি, নৃত্য-গীত কিছুই তাকে বিচলিত করতে পারে নি। রাজা জনকের মধ্যেও এই নিস্তব্ধতা ছিলো, সমস্ত কর্তব্য তিনি যথাযথ ভাবে পালন করতেন, আবার কর্ম্ম-উদ্ভূত চঞ্চলতা তাকে স্পর্শ করতে পারতো না। তো এই হচ্ছে রাজা জনক।
যাই হোক, আমরা বলছিলাম, অষ্টাবক্র মুনির প্রাথমিক উপদেশ শুনবার পরে, রাজা জনকের কি অবস্থা হয়েছিল। বা তিনি কি বলেছিলেন।
সপ্তম শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্
আত্ম-অজ্ঞান-জগৎ-ভাতি আত্ম-জ্ঞানাৎ-ন ভাসতে
রজ্জু-অজ্ঞানাৎ-ভাতি তজ্ জ্ঞানাদ্ ভাসতে ন হি।
২/৭ আত্ম বিষয়ক অজ্ঞানতা বশতই জগৎ প্রতিভাত বা দৃশ্যমান মনে হয়। রজ্জুর জ্ঞান হলে আর জগৎ দৃষ্টিগোচর হয় না।
অন্ধকারের মধ্যে, মনে হচ্ছে, রাস্তায় সাপ শুয়ে আছে। আলো জ্বালাবার পরে বুঝতে পারলাম, এটি সাপ নয়, একটুকরো দড়ি মাত্র। তো রজ্জুর জ্ঞান হলে অর্থাৎ অজ্ঞানতা কেটে গেলে, এই দৃশ্যমান জগৎ আর আমাতে কোনো ভেদ থাকে না। এই জ্ঞান অর্থাৎ আত্মউপলব্ধি অন্তঃস্থিত হলে এই প্রতিভাত জগৎ, স্বরূপ বা নিজের রূপ বলেই মনে হয়। যা একমাত্র সত্যি। যা চরম সত্যি। আমরা চোখের সামনে যা কিছু দেখছি, তা রঙ্গিন আলোর তরঙ্গ মাত্র। এমনকি আমাদের এই যে দেহ, এটি একটা রঙ্গিন আলোর তরঙ্গ। সরে সরে যাচ্ছে, কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না। এত দ্রুততার সঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে, যে আমরা পরিবর্তনতাকে ধরতে পারছি না, কিন্তু একটা অবয়ব আমাদের চোখের সামনে ভাসছে। এমনকি এই অবয়বের পরিবর্তন হচ্ছে, প্রতি মুহূর্তে আমাদের শরীরের অসংখ্য কোষ মৃত্যুবরণ করছে, আবার নতুন কোষের জন্ম হচ্ছে। প্রতি ৭ বছরে আমরা সম্পূর্ণ নতুন দেহ পাচ্ছি। এসব আমরা ধরতে পারি না। কিন্তু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমরা যদি শরীরের দিকে তাকাই তবে আমরা নিশ্চই বুঝতে পারি, আমি আর সেই আমি নেই। এমনকি আমাদের মনেরও প্রতিমুহূর্তে পরিবর্তন হচ্ছে, আমাদের স্মৃতির গর্ভে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হচ্ছে। মনের চিন্তাধারার পরিবর্তন হচ্ছে। তাই আমরা যাকে আমি বলি, তা একটা পরিবর্তনশীল সত্ত্বা, যা একসময় মূল ভূতে বিলীন হয়ে যাবে। কিন্তু সত্যিকারের আমির মধ্যে এগুলো প্রকাশিত হচ্ছে মাত্র। এই প্রকাশিত অবয়ব আমি নোই। আবার আমি এই রূপের মধ্যেই আছি।
অষ্টম শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্
প্রকাশো মে নিজং রূপং নাতিরিক্তো-অস্মি-অহং ততঃ
যদা প্রকাশতে বিশ্বং তাদাহং ভাস এব হি।
২/৮ নিজের মধ্যেই নিজের রূপের প্রকাশ। এর অতিরিক্ত আমি কিছু নই। আমি আমাতেই প্রকাশিত। যখন বিশ্ব দৃষ্টিগোচর হয় তখন তা আমার দ্বারাই প্রকাশিত হয়ে থাকে।
এই যে পরিবর্তন হচ্ছে, এক দৃষ্য আর এক দৃষ্য এর কেন্দ্রবিন্দুতে আছে আত্মা। এই আত্মাকে ঘিরেই প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। আত্মার পরিবর্তন হচ্ছে না। কিন্তু আত্মাকে ঘিরে যা কিছু সবই পরিবর্তন হচ্ছে। আমাদের কাজ হচ্ছে, নিজেকে এই কেন্দ্রবিন্দুতে স্থিত করা। আর কেন্দ্রবিন্দুতে যখন আমি স্থিত হতে পারবো, তখন আমি দেখতে পারবো, আমাকে ঘিরে কি সব খেলা চলছে। আসলে আমার মধ্যেই এইসব পরিবর্তনশীল সত্ত্বার জন্ম হচ্ছে, আবার মৃত্যু ঘটছে। আমি অপরিবর্তনশীল - অক্ষয়, অব্যয়, অবিনশ্বর। এই উপল্বদ্ধিতে আমরা যখন স্থিত হবো, তখন আমি শান্ত হবো।
নবম শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্
অহো বিকল্পিতং বিশ্ব অজ্ঞান ময়ি ভাসতে
রূপ্যং শুক্তৌ ফনি রজ্জৌ বারি সূর্যকরে যথা।
২/৯ অহো ! কাল্পনিক বিশ্ব অজ্ঞানতা বসত আমাতে প্রতিভাত হচ্ছে। ভুল বসত ঝিনুক (শুক্ত) যেমন রুপোর মতো লাগে, দড়ি যেমন সাপের মতো লাগে, সূর্য কিরণে যেমন জল প্রতিভাত হয়, আমিও তেমনি অজ্ঞানবলে কল্পিত এই বিশ্ব দেখছি।
রাজা জনক বিস্মিত হচ্ছেন। কাল্পনিক বিশ্ব এতদিন তার কাছে সত্য বলে মনে হচ্ছিলো। ভুল বশত সূর্য্যরশ্মির প্রভাবে ঝিনুকের মধ্যে মুক্তকে রুপো মনে হয়, অন্ধকারে, দড়িকে সাপ মনে হয়, সূর্য্যের রশ্মিকে অর্থাৎ মরীচিকাকে জল মনে হয়। এসবই ভ্রান্ত। এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটাতে হবে। তবেই আমরা আমাদের প্রকৃত সত্ত্বাকে জানতে পারবো। বুঝতে পারবো। এবং নিজের মধ্যে নিজেকে স্থিত করতে পারবো।
দশম শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্
মত্তো বিনির্গতং বিশ্বং মর্যেব লয়মেষ্যতি
মৃদি কুম্ভ জালে বীচিঃ কনকে কটকং যথা।
২/১০ আমা-হতে উৎপন্ন এই বিশ্ব আমাতেই লয় প্রাপ্ত হবে। যেমন কলসি মাটিতে লয় প্রাপ্ত হয়, যেমন জলের মধ্যে বুদ্বুদ বা ঢেউ জন্ম নেয়, আবার জলেই লয় প্রাপ্ত হয়, স্বর্ণ থেকে বিচ্ছুরিত বলয় যেমন স্বর্নতেই বিলোপ প্রাপ্ত হয় - তেমনি আমার থেকে উৎপন্ন এই মায়া-বিশ্ব আমাতেই লোপ পেয়ে যাবে।
আমার এই অজ্ঞানতা বশত যে দর্শন, এসবই আমার মন থেকে উৎপন্ন। সূর্য্যের আলোর রশ্মি যাকে আমি জল ভাবছি, সেতো আমারি মনের ভ্রম। দড়িকে সে সাপ ভাবছি, সেতো আমার মনের ভ্রম। আমার এই ভ্রম যখন কেটে যায়, তখন এই ভ্রমরূপ দর্শনীয় বস্তু কোথায় যায় ? আমার মনের মধ্যেই লোপ পায়। কলসি যা মাটি থেকে উৎপন্ন হয়েছিল, তা এক সময় মাটি হয়ে যায়। বুদ্বুদ যা থেকে অর্থাৎ জল থেকে উৎপন্ন হয়েছিল, তা আবার জলে মিশে যায়। সোনা থেকে বিচ্ছুরিত যে উজ্জ্বল আলো তা তো সোনা থেকেই উৎপন্ন হয়েছিল, আবার সোনাতেই বিলীন হয়ে যায়।
একাদশ শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্
অহো অহং নমো মহ্যং বিনাশো যস্য নাস্তি মে
ব্রহ্মাদি-স্তম্ব-পর্যন্তং জগৎ-নাশে-অপি তিষ্ঠতঃ।
২/১১ আহা ! কি আশ্চর্যরূপ আমি ! আমি আমাকেই নমস্কার করি -যার বিনাশ নাই। ব্রহ্মা ইত্যাদি অচঞ্চল-সহ সর্ব জগতের বিনাশ কালে অর্থাৎ জগতের বিবর্তন কালেও আমি থাকি, আমার বিনাশ নাই সুতারাং এই আমি অবিনশ্বর, আমাকে নমস্কার।
রাজা জনক এবার আমাদের দৃষ্টিতে আনন্দে উন্মাদ হয়ে গেছেন। বার বার নিজে নমস্কার করছেন। কেননা আমি তো অমর, আমার বিনাশ নেই। আমি অপরিবর্তনশীল। কেননা যা কিছু হচ্ছে, যা কিছু দেখছি, যা কিছু শুনছি, সবই অস্থায়ী। আমাতেই প্রতিভাত হচ্ছে, আবার আমাতেই লোপ পাচ্ছে। অতয়েব এই কল্পিত জগৎ সৃষ্টি কালে আমি ছিলাম, এই জগতের বিনাশ কালেও আমিই থাকবো। এই অবিনশ্বর আমি-স্বরূপ আত্মাকে আমি নমস্কার করি।
দ্বাদশ শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্
অহো অহং মহ্যংএকঃ অহং দেহবান অপি
ক্বচিন্ন গন্তা নাগন্তা বাপ্য বিশ্বং অবস্থিতঃ।
২/১২ আহা ! আমি দেহধারী হয়েও আমি এক -অদ্বিতীয়, কোথাও গমনাগমন নেই আমার। সর্ব বিশ্বে আমার অবস্থিতি।
আপাতত মনে হচ্ছে, আমি এই দেহ। কিন্তু সেটা তো সত্য নয়, আমি দেহধারী। আমি স্থির, কেননা আমিই তো সমগ্র বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু। আবার আমার অবস্থিতি সমগ্র বিশ্বে, কেননা সমগ্র বিশ্ব আমাতেই স্থিত।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
--------------------------------------------------------------------------------------------------
অষ্টাবক্র গীতা - নতুন সংস্করণ ( চতুর্থ ভাগ)
আমরা এর আগের দিন রাজা জনককে দেখেছি, কিভাবে তিনি নিজেকেই নমস্কার করছেন। একএকটা অনুভব তার মধ্যে জেগে উঠছে, অর্থাৎ একটি করে জ্ঞানের বুদ্বুদ তার অন্তরে ভেসে উঠছে আর তিনি নিজেকে নমস্কার করছেন। আমরা এই নমস্কারের শ্লোকগুলো আজ শুনবো। আর কি কারনে নমস্কার করছেন সেটাও শুনবো। আসলে কি জানেন, আমাদের এই শাস্ত্র কথা শাস্ত্রের উপদেশ শাস্ত্রের নীতিবাক্য শুনতে শুনতে আমাদের কান পচে গেছে। শুধু এটা করো, ওটা করো না। এইভাবে জীবনযাপন করো, ঐভাবে করো না। কেউ বলছেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়া করো। কেউ বলছেন, জপ-তপ করো। যদিও আমরা সেগুলো শুনেও শুনি না.. আর সব ধর্ম্মগুরুরা এই একই কথা বলে থাকেন । আমাকে ছোটবেলায়, ঠাকুরমা রামায়নের গল্প মহাভারতের গল্প শোনাতো। আমার ভালো লাগতো, আর এই ভালোলাগা আমাকে ঘুমুতে সাহায্য করতো। এমনকি আমার ঠাকুরমাকেও দেখেছি, গল্প বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আসলে গল্প তার মুখস্ত হয়ে গেছে, তাই চোখ বুজে গল্প বলে যেতেন। বইয়ের দরকার পড়তো না। তো শাস্ত্রকথা আমাদের ঘুমুতে সাহায্য করে থাকে। জেগে থাকতে সাহায্য করে বলে কখনো শুনিনি। কাউকে জাগিয়ে রাখবার জন্য শাস্ত্র কথা শোনানো হয় না, আর আমরা যখন জেগে থাকবার সময় হয়, তখন আমরা শাস্ত্রের গল্পগাথা নিয়ে বসিও না। আমরা কাজে নেবে পড়ি। তা সে জাগতিক কাজই বলুন, আর জপ ধ্যান বলুন। আমরা কিছু করতে লেগে যাই।
অষ্টাবক্র গীতা এই দিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অষ্টাবক্র গীতা মানুষকে জাগিয়ে তোলে। কিছু করতে বলে না,শুধু শুনতে বলে। জনক রাজা মহামুনি অষ্টাবক্র-এর কথা শুনে আধা পাগলা হয়ে গেছেন। তিনি লাফানো শুরু করেছেন। আর পাগলের মতো নিজেকে নমস্কার করছেন, যা আমরা স্বাভাবিক সাধারণ মানুষেরা একদম করি না। একটা কথা শুনুন, আমরা যেন ভুলেও না ভাবি যে আমরা জ্ঞানী হয়ে গেছি, আমরা যেন ভুলেও না ভাবি, যে আমাদের বয়স হয়ে গেছে। আমাদের আর কিছু হবার নয়। এই বয়সে না পারবো, যোগ-ধ্যান করতে, না পারবো পরিশ্রম করতে। আপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এটা শুরু করুন। এটা যে কোনো বয়সেই হতে পারে। আসলে আরম্ভ করাটাই বড়ো কথা। অষ্টাবক্র মুনি কিছু করতে বলেন না, শুধু শুনতে বলেন। শুধু বিশ্বাস করতে বলেন। আর বিশ্বাস করতে বলেন, এইজন্য যে বিশ্বাস করলে, আপনার স্মৃতি জাগ্রত হতে পারে। শুধু মনে করবার চেষ্টা করুন, আপনি কোথা থেকে এসেছেন। গঙ্গাসাগর মেলায়, বহু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা হারিয়ে যান। তারা তাদের ঠিকানা ঠিক-ঠিক মতো বলতে পারেন না। স্বেছাসেবকগন তাদের বারে বারে জিজ্ঞেস করেন, আপনি শুধু মনে করবার চেষ্টা করুন, আপনি কোথা থেকে এসেছেন, তাহলেই আমরা আপনাকে আপনার বাড়িতে - আপনার আত্মীয় স্বজনের কাছে পৌঁছে দেব। আসলে আপনি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছেন। এতদিন অন্ধকারেই হেঁটেছেন, তাই আপনি কোন পথে এসেছেন, সেটা আপনার স্মৃতিতে নেই। কোনো মানুষ কখনোই এতো দূরে যেতে পারেনা, যে সে আর ফিরে আসতে পারবে না। কোনো মানুষ যতই ভুলপথে যাক না কেন, সে কখনো ঠিক পথে আসতে পারবে না তা হতে পারে না। অষ্টাবক্র মুনি হাতে আলো নিয়ে এসেছেন। হাজার বছর যাবৎ যে পথ ছিল অন্ধকার, তা আজ আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে। অন্ধকারে হাটতে হাটতে আমারা মনে করতে ভুলেই গেছি যে আমার দুটো চোখ আছে। অষ্টাবক্র মুনি আমাদের দৃষ্টিশক্তি দেন নি, তিনি শুধু প্রদীপ জ্বেলে দিয়েছেন। তাই আমাদের কাজ হচ্ছে, শুধু মনোযোগ দিয়ে অষ্টাবক্র মুনির কথা গুলো শোনা। না কিছু করতে হবে না। কোথাও যেতে হবে না। শুধু মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। আর মনোযোগ দিয়ে যখন শুনবেন, তখন আপনার ঘুম ছুটে যাবে। আপনি তখন আত্মউপল্বদ্ধির আনন্দে মেতে উঠবেন। যখন নিজেকে দেখতে পারবেন, যখন নিজেকে জানতে পারবেন, তখন আপনার হাজার বছরের চিন্তা, হাজার বছরের ধারণা সব পাল্টে যাবে। আর সেটাই হয়েছে, এই রাজা জনকের। আমরা এখন রাজা জনকের উল্লাস ধ্বনি শুনবো। কিছু বুঝতে হবে না শুধু শুনতে হবে। আসলে রাজা জনকের মুখ দিয়ে এখন যেসব কথা উচ্চারিত হচ্ছে, সেগুলো আসলে গুরুদেবেরই কথা। রাজা জনকের মুখ দিয়ে যা সতস্ফূর্ত ভাবেই বেরিয়ে আসছে। আসুন শুনি তার কথাগুলো।
ত্রয়োদশ শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্
অহো অহং নমো মহ্যং দক্ষো ন স্থিত মৎসমঃ
অসংস্পৃশ্য শরীরেণ যেন বিশ্বং চিরং ধৃতম।
২/১৩ আহা ! আমি আমাকে নমস্কার করি। আমার মতো দক্ষ কেউ নেই। শরীরের সাথে কোনো সম্মন্ধ না থাকা সত্বেও বিশ্বকে আমি চিরকাল ধারণ করে আছি।
আসলে রাজা জনক যে কথাগুলো বলছেন, তা স্বয়ং গুরুদেবেরই কথা। রাজা জনকের মুখ দিয়ে উচ্চারিত হচ্ছে মাত্র। তার মধ্যে আত্মবোধ জেগেছে, তাই উল্লসিত হয়ে বলছেন," অহং নমো মহ্যং " । এই মহ্যম হচ্ছে আমি যার অপর নাম আত্মা। .
চতুর্দশ শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্
অহো অহং নমো মহ্যং যস্য মে নাস্তি কিঞ্চন
অথবা যস্য মে সর্বং যদ্-বাঙ-মনসঃ-গোচরং।
২/১৪ আহা ! আমি আমাকে নমস্কার করি। যার কোনোকিছুর সঙ্গেই সন্মন্ধ নেই, আবার সে-ই সব। যাকে বাক্য - মন দ্বারা গোচর করা যায় না। অতএব সেই সর্বসম্বন্ধি আবার সর্ব-অসম্বন্ধি - আমাকে আমি নমস্কার করি।
আমাদের মন সবসময় বিচার প্রবন। ব্যবসায়ী ব্যবসার শুরু থেকেই হিসেব শুরু করে দেয়। আর সারা জীবন ধরেই তার হিসেব চলতে থাকে। জীবনের শুরুতে যখন সে শিশু ছিল,তখন কিন্তু তার এই হিসেব ছিলো না। যেদিন থেকে তার উপার্জনের চিন্তা এসেছে, সেদিন থেকে সে হিসেবে শুরু করেছে। তো একসময় সে একজন হিসেব রক্ষক রেখে দিলো। এখন আর তাকে প্রতিদিনকার হিসেবে রাখতে হয় না। প্রত্যেকের জীবনে এমন একটা সময় আসে, যখন মহাজনের কাছে, সব হিসেবে চুকিয়ে দিতে হয়। তখন আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে যাই। আমাদের আর হিসেবের খাতা দরকার পরে না। এই মহাজন হচ্ছেন, গুরুদেব। গুরুদেব এসে সমস্ত হিসেবের দায়িত্ত্ব নিয়ে নেন।
পঞ্চদশ শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্
জ্ঞানং জ্ঞেয়ং তথা জ্ঞাতা ত্রিতয়ং নাস্তি বাস্তবম্
অজ্ঞানাদ্ ভাতি যত্রেদং সঃ-অহম-অস্মি নিরঞ্জনঃ।
২/১৫ জ্ঞান,জ্ঞেয়,জ্ঞাতা -এই তিনটি বাস্তবে নাই। অজ্ঞানপ্রভাবে এই ত্রিতয় প্রতিভাত হয়। আমিই সেই শুদ্ধ আত্মা, যে প্রপঞ্চরূপ সমস্ত কিছুর সঙ্গে সম্পর্কহীন।
ষোড়শ শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্
দ্বৈতমূলম অহো দুঃখং ন-অন্য-তস্য-অস্তি ভেষজম
দৃশ্যং-এতৎ-মৃষা সর্বং একঃ-অহং চিদ্রসঃ-অমলঃ।
২/১৬আহা ! ভ্রম বসতঃ দ্বৈত ভাবনাই দুঃখের মূল । আমি এক অদ্বিতীয়,মায়া ও তৎকার্যের অতীত ও চিন্মাত্র স্বরূপ। প্রতীয়মান সব কিছু, সব জড়- পদার্থ একান্তই মিথ্যা। এই তত্বজ্ঞানই ত্রিবিধ দুঃখ উপশমের ঔষধ।
সপ্তদশ শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্
বোধ-মাত্রঃ-অহম-অজ্ঞানাৎ-উপাধিঃ কল্পিতো ময়া
এবং বিমৃশতো নিত্যং নির্বিকল্পে স্থিতির্মম।
২/১৭ আমার অহং বোধ থেকেই আমার অজ্ঞান-উপাধিসমূহ কল্পিত হয়েছে। এটা বিস্মৃত হলেই আমি নির্বিকল্পে স্থিতি লাভ করবো।
অষ্টাদশ শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্
ন মে বন্ধো-অস্তি মোক্ষো বা ভ্রান্তিঃ শান্ত নিরাশ্রয়া
অহো ময়ি স্থিতং বিশ্বং বস্ত্ুতো ন ময়ি স্থিতম্।
২/১৮ না আছে আমার বন্ধন, না আছে আমার মুক্তি। আমাতেই বিশ্ব স্থিত আমি বিশ্বে স্থিত নোই। বিশ্ব আমাতে স্থিত হলেও কোনোকালে (কালত্রয়) উহা আমাতে আশ্রিত নহে। এইরূপ বিচারকারী আমি - আমার নির্মূলা জগৎ ভ্রান্তি শান্ত হয়ে গাছে।
ঊনবিংশতি তম শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্
সশরীরম ইদং বিশ্বং ন কিঞ্চিৎ ইতি নিশ্চিতম
শুদ্ধ-চিৎ-আত্মা চ তৎ কাশ্মিন কল্পনা অধুনা।
২/১৯ শরীর সহিত এই বিশ্ব কিছুই নহে (না অসৎ না সৎ) এটা নিশ্চিত।
আত্মা শুদ্ধ চৈতন্য স্বরূপ মাত্র। সুতরাং অজ্ঞান নিবৃত্তি হলে, আর জগৎ কল্পনা কিসের উপর হবে ?
বিংশতি তম শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্
শরীরং স্বর্গ-নরকৌ বন্ধ - মোক্ষৌ ভয়ং তথা
কল্পনামাত্রম এব এতৎ কিং মে কার্যং চিদাত্মনঃ।
২.২০ শরীর,স্বর্গ,নরক, বন্ধ, মোক্ষ এবং ভয় - এই সকলি কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। অতএব চিদাত্মার কি করণীয় ? অর্থাৎ চিদাত্মার কিছুই করণীয় নাই।
এক বিংশ তম শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্
অহো জনসমুহে-অপি না দ্বৈতং পশ্যতো মম
অরণ্যম-ইব সংবৃত্তং ক্ব রতিং করবানি-অহম্।
২/২১ আহা ! জনসমূহের মধ্যেও দ্বৈত আর দেখতে পারছি না। যেন নির্জন অরণ্যের ন্যায় পর্যবসিত হয়েছে। তাহলে আমি কিসের উপর প্রীতি স্থাপন করবো।
দ্বিবিংশ তম শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্
নাহং দেহো ন মে দেহো জীবো নাহমহং হি চিৎ
অয়মেব হয় মে বন্ধ আসীদ্ যা জীবিতে স্পৃহা।
২/২২ আমি শরীর নহি, শরীরও আমার নয়,(অন্তঃকরণবিশিষ্ট চিদাভাসরূপ ) জীবও আমি নহি। আমি কেবল বিশুদ্ধ চৈতন্য স্বরূপ। জীবন ধারনের স্পৃহাই আমার এতকালের বন্ধন ছিলো। (সচ্চিদানন্দস্বরূপ অনুভব-বলে সেই জীবন ধারনের ইচ্ছাও আর এখন আমার নেই। )
ত্রয়োবিংশতিতম শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্
অহো ভুবন-কল্লোলৈঃ-বিচিত্রৈঃ-দ্রাক্ সমুত্থিতম্
ময়ি-অনন্ত-মহা-অম্বাধৌ চিত্তবাতে সমুদ্যতে।
২/২৩ কি আশ্চর্য্য ! অপার মহা-সমুদ্ররূপ আমাতে চিত্তরূপ পাবন উৎপন্ন হয়ে জগৎ-পরাম্পরারূপ কতই না বিচিত্র তরঙ্গসমূহ প্রকটিত হয়েছে।
চতুর-বিংশতি তম শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্
ময়ি-অনন্ত-মহা-অম্ভোধৌ চিত্তবাতে প্রশাম্যতি
অভাগ্যাৎ-জীব-বণিজঃ জগৎপোতো বিনশ্বরঃ।
২/২৪ সর্ব ব্যাপক চিৎ সমুদ্র রূপ আমাতে সংকল্প বিকল্পাত্মক চিত্ত-পবন শান্ত হলে জীব রূপ বনিকের অভাগ্য অর্থাৎ প্রারব্ধ ক্ষয় বশতঃ দেহাদি বিশিষ্ট এই জগৎরূপ নৌকাও স্বতঃই বিনাশপ্রাপ্ত হয়।
পঞ্চ-বিংশতি তম শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্
ময়ি-অনন্ত-মহা-অম্ভোধৌ-আশ্চর্যং জীববিচয়ঃ
উদ্যন্তি ঘ্নন্তি খেলন্তি প্রবিশন্তি স্বভাবতঃ।
২/২৫. আহা ! কি আশ্চর্য্য ! নিষ্ক্রিয় নির্বিকার অপার মহাসমুদ্র-রূপ চৈতন্যস্বভাব আমাতে অবিদ্যা কামকর্মাদি প্রভাবে জীবরূপী তরঙ্গসমূহ যেন কখনো উদয় হচ্ছে শত্রূভাবে কখনও বা পরস্পর তাড়না করছে, কখনো বা মিত্রভাবে খেলা করছে এবং কখনো বা অবিদ্যা কামকর্মাদির ক্ষয়ে অধ্যস রোহিত হয়ে যেন আমাতেই পুনঃ প্রবেশ করছে অর্থাৎ বিলয় প্রাপ্ত হচ্ছে।
দ্বিতীয় প্রকরণের সমাপ্ত।
-------------------------------------------------------------------------
অষ্টাবক্র গীতা - নতুন সংস্করণ (পঞ্চম ভাগ)
সত্যিকারের নিজেকে বা "আমি"কে, এই বিষয়ে কার না জানতে ইচ্ছে করে ?
আমরা চোখের সামনে যা কিছু দেখি, সবই পরিবর্তনশীল। এই যে আমি অর্থাৎ আমার এই স্থূল দেহ, এও অবশ্যই fএকদিন থাকবে না। জগতে সত্যিই অপরিবর্তনশীল বলে কিছু আছে কি ? আমি বলে কেউ মৃত্যুর পরে থাকবে কি ? আমার এই স্থুল দেহ একদিন পঞ্চভূতে মিশে যাবে। তারপর কি আমি শেষ হয়ে গেলাম ? এই জিজ্ঞাসা থেকেই আমরা কতনা বই-এর পাতা উল্টাই । সংসারত্যাগী মানুষ দেখলে জানতে চাই । দুঃখের কথা -এই মানুষ দুর্লভ। কোথায় পাবো, কার কাছে পাবো , তাতো জানি না । বেশিরভাগ মানুষ একটা মান্যতা নিয়ে চলছে । কিন্তু উপলব্ধি আছে কী ? উপলব্ধিহীন জ্ঞানের কথায় মান্যতা পাই না । সত্য কোথায় ? যার কাছে সত্যতা/সত্য আছে সে কি মৌন ? আমি কে ? আমি এই সংসারে কেন এসেছি ? এই সংসার কে বানিয়েছে ? কেনো বানিয়েছে ? এখানে এসে আমার কর্তব্য কী ? আমার কেনো দুঃখ হয় এই সংসারে ? আমার কল্যাণ কিসে হবে ? এইসব প্রশ্ন জাগে আমাদের সবার মনে। হাজার হাজার বছর ধরে এই প্রশ্নই মানুষকে ঘরছাড়া করেছে। আর কতকাল মানুষ এই প্রশ্ন নিয়ে দেহত্যাগ করবে ?
অবশ্য এই সব প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন গ্রন্থ আছে, বিভিন্ন মত আছে। পাশ্চাত্য দেশে ভোগবাদে বিশ্বাস করে। প্রকৃতিকে মানুষের নাগালে আনার জন্য বিজ্ঞান চর্চা করে। বিবর্তনবাদ-ই সৃষ্টির মূলকথা বলে তারা মনে করে। আমাদের দেশেও অনেক মত প্রচলিত। কেউ অদ্বৈতবাদ-এ বিশ্বাস করে কেউ দ্বৈতবাদে বিশ্বাস রাখে। কেউ ভৌত-বাদে বিশ্বাস করে। এর মধ্যে কোনটা সত্য, কোনটা অর্ধ-সত্য, আর কোনটাই বা মিথ্যা। কে বলে দেবে ? বহু বই বাজারে পাওয়া যায়। কোনোটাকে বলে স্মৃত,(অনুভূতি লব্ধ জ্ঞান ) কোনটা স্মৃতি,(বেদ - বেদান্ত)। কোনটা বিনির্গত ,(পুরান, রামায়ণ , মহাভারত ) আবার কোনটা কৃৎ-গ্রন্থ(উপলব্ধিহীন মানুষের লেখা)। বাজারে মহারাজ-এর অভাব নেই, গুরুদেবদের সংখ্যা কম নয়। জিজ্ঞাসু মানুষের প্রশ্নের জবাব দেবার জন্য তারা সংগঠন খুলে বসে আছে। আশ্রম-এর নামে কেউ কেউ ব্যবসাও করছে। আমাদের মন তো অবিশ্বাসী, সন্দেহ প্রবন মন আমদের । বিশ্বাস নেই কিন্তু জানতে চায়। শ্রদ্ধা নেই বরং শ্রাদ্ধ করার দিকে ঝোক বেশি।
এমন সময় হাতে এলো স্বামী ধীরেশানন্দের অনুবাদ করা অষ্টাবক্র গীতা । উদ্বোধন কার্যালয় থেকে প্রকাশিত। গুরু শিষ্য সম্বাদ । রাজা জনকের প্রশ্ন আমাকে আকর্ষন করলো । সত্য কি ?
কথম্ জ্ঞানম অবাপ্নোতি – জ্ঞান লাভের উপায় বলুন ।
কথম্ মুক্তির্ভবিষ্যতি – মুক্তি কি ভাবে হবে ?
বৈরাগ্যং চ কথম্ প্রাপ্তম – বৈরাগ্য-ই বা কি ভাবে প্রাপ্ত হয় ?
এতদ্ ব্রূহি মম প্রভো – আমার প্রভু, এই সমস্ত আমাকে বলুন ।
সরাসরি আধ্যাত্মিক প্রশ্ন দিয়ে অষ্টাবক্র সংহিতার শুরু। কোনো ভূমিকা নয়। সরাসরি প্রশ্ন : ১) হে প্রভু,জ্ঞান কি করে লাভ করা যায় দয়া করে বলুন। ২) মুক্তি কী ভাবে হবে ? ৩) বৈরাগ্য কি ভাবে পাওয়া যায়।
জনক রাজার প্রথম তিনটি প্রশ্নই আমাদের সবার অন্তরের প্রশ্ন । আত্মকথা জানার জন্য - আকুল হৃদয়ের প্রশ্ন।
মূল বিষয়ে যাবার আগে, অষ্টাবক্র সংহিতা রচনার প্রেক্ষাপটটা একবার দেখে নি ।
বিদহ রাজ্যের রাজা, জনক দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে দিবানিদ্রা গিয়েছেন । স্বপ্ন দেখছেন – দ্বারপাল ত্রস্ত্র হয়ে এসে খবর দিলো মহারাজা শিঘ্র উঠুন । রাজ্য আক্রান্ত । যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে । মাহারাজা তরিঘড়ি করে উঠে , যুদ্ধ করতে ছুটলেন । স্বল্প প্রস্তুতি । ষুদ্ধে হেরে গেলেন । বিপক্ষ রাজা, বৃদ্ধ-জনক রাজাকে রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে বললেন । জনক রাজা মৃত্যু ভয়ে শঙ্কিত হয়ে রাজ্য ছেড়ে পালাতে লাগলেন । ছুটতে ছুটতে,ক্ষুধা-তৃষ্ণায় ক্লান্ত হয়ে পড়লেন । খাদ্যের সন্ধানে ক্লান্ত পদে এগোতে লাগলেন । কোথাও খাবার নাই, কোথাও জল নাই । সামনে একটা পুকুর দেখে দাঁড়ালেন । একটু জল পান করলেন । পুকুরের অপর প্রান্তে মন্দির নজরে এল । পায়ে পায়ে হেঁটে গেলেন মন্দিরে । দেখলেন, মন্দিরে প্রসাদ বিতরন হচ্ছে । দীর্ঘ লাইন । জঠড় জ্বালা নিবৃওির জন্য রাজা জনক সাধারনের মতো লাইনে দাড়ালেন। অদম্য ক্ষুধা নিয়ে যখন প্রসাদ পাত্রের কাছে এলেন, দেখলেন প্রসাদ শেষ ।
বিষাদে মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো । ক্ষুধার্থ রাজা জনক, কাতর কন্ঠে পুজারি ব্রাহ্মণকে, প্রসাদ অবশিষ্ট দেবার জন্য মিনতি জানালেন । পূজারীর ,যাচ্ঞাকারীকে দেখে দয়া হ্ল, একটু অপেক্ষা করতে বললেন। প্রসাদ-পাত্রে লেগে থাকা অংশ একত্রিত করে, পাতায় করে, রাজা জনককে দিলেন । ভূখা রাজার মন আনন্দিত হ’ল । যতই ক্ষুধা পাক, সাত্ত্বিক মনের মানুষ রাজা-জনক তো । ভাবলেন স্নান করে, তবে খাবেন । এই ভেবে রাজা স্নান করতে নাবলেন পুকুরে । প্রসাদ/খাবার রইল পুকুর পাড়ে । কোত্থেকে হঠাৎ এক কাক উড়ে এসে ছোঁ মারল প্রসাদের পাতায়। ছড়িয়ে গেলো ধুলিমধ্যে সমস্ত প্রসাদকনা । ক্ষুধার্থ রাজা জনক হা হা কার করে উঠলেন । হে ভগবান-হে ইশ্বর .........
হঠাৎ প্রহরীর ডাকে জেগে উঠলেন রাজা । “রাজা মশায় উঠুন – বেলা যে যায়”
ঘেমে নেয়ে একাকার রাজা । উঠেই দেখলেন – নাঃ সবই তো ঠিক আছে । তবে ? এতক্ষন যা দেখছিলাম সেটা ঠিক, না এখন যা দেখছি এটা ঠিক ? রাজা সত্য – না ভিখারী সত্য ? আমি কে ? আসলে মহারাজা জেগে উঠেছেন, সত্যিকারের জেগে উঠেছেন। আর যে জেগে উঠতে পারে, তার মধ্যেই জীবন জিজ্ঞাসা জেগে ওঠে। আর এই জেগে উঠেই তার মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, স্বপ্নের আমি আর জাগ্রত আমি, কোনটা সত্যি। অষ্টাবক্র মুনি বলছেন, দুটোই সত্যি। তুমিই সত্য। মহারাজ জনক ব্রহ্মজ্ঞানের উপযুক্ত অধিকারী ছিলেন। জ্ঞান সংগ্রহের সমস্ত যোগ্যতা তার ছিলো। অশ্বারোহণ কালে এক রেকাবে এক পা ন্যস্ত করে দ্বিতীয় পা অপর রেকাবে রাখার জন্য যে অতি অল্প সময়ের প্রয়োজন তার মধ্যেই গুরুর উপদেশে তিনি ব্রহ্ম সাক্ষাৎকার করেছিলেন। যেমন গুরু তার তেমন শিষ্য।
হাজার বছরের অন্ধকার, এক ঘষাতেই পরিষ্কার। দেশলাই আর কাঠি যদি শুকনো থাকে তবে এক ঘষাতেই আলো। বহু যুগের অন্ধকার এক মুহূর্তেই দূর হয়ে যায়।
রাজা জনক সংশয়ে পড়েছেন - রাজা সত্য - না ভিক্ষারী সত্য। যেসব ব্রাহ্মন কুলগুরু তার দরবারে নিত্য শাস্ত্রব্যখ্যান শোনাতেন তারা কোনো উত্তর দিতে পারছেন না। মহর্ষি অষ্টাবক্রের কাছে সংবাদ গেল। তিনি রাজদরবার -এ এসে বললেন - তুমিই সত্য আর সব মিথ্যা। কথাটা বিদেহ মহারাজের মনে ধরলো। তিনি মহর্ষির কাছে ব্রহ্ম উপদেশ প্রার্থনা করলেন। আচার্য বললেন - তুমি রাজা , সিংহাসনে বসে আছো। আমি আচার্য তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তোমার যদি ব্ৰহ্মজ্ঞান পাওয়ার বাসনা হয় তবে নিচে নেবে এস। আমি তোমার যোগ্যতা পরীক্ষা করবো। তারপর যদি উপযুক্ত মনে করি তবেই ব্রহ্ম-উপদেশ দান করবো। উপদেশ প্রদানের এটাই শাস্ত্রীয় বিধি।
মহারাজা জনক তাই করলেন। নেবে এলেন নিচে। মহর্ষি অষ্টাবক্র রাজাকে বললেন চলো বনে, চলো নির্জনে। রাজা সম্মত হয়ে অশ্বারোহনে বনে চললেন আচার্যকে সঙ্গে নিয়ে। গভীর জঙ্গলে এলে অষ্টাবক্র মুনি অশ্ব থামাতে বললেন। বললেন, নেবে এস সওয়ারী। জনক ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলেন। অষ্টাবক্র আবার বললেন, না এখানে নয়। আরো গভীর জঙ্গলে যেতে হবে। বলতেই রাজা আবার অশ্বের পিঠে উঠবার জন্য রেকাবিতে পা রাখলেন। যেই না দ্বিতীয় পা উঠাতে যাবেন, অষ্টাবক্র মুনি ধমক দিয়ে বলে উঠলেন - হে রাজন ! দ্বিতীয় পা উঠাবার আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। -
বিদেহ রাজ্ ! তুমি কি জানোনা, ব্রহ্মবিদ্যা লাভ করতে গেলে গুরুকরণ করতে হয়? আর তুমি যদি আমাকে গুরুপদে অভিষিক্ত করতে চাও, শাস্ত্র অনুসারে গুরুদক্ষিণা দেওয়াও তোমার কর্তব্য। মহারাজা জনক বললেন - হ্যাঁ গুরুদেব আমার তন-মন-ধন, সবই আমি আপনার চরণে সমর্পন করলাম। এখন আপনি আমাকে কৃপা করে ব্রহ্ম-উপদেশ দান করুন। এ কথা শুনে মুনি দূরে এক গুহায় প্রস্থান করলেন।
কিছুক্ষন পরে মুনি এসে জনক রাজা-কে ঘোড়সওয়ার-উন্মুখ অবস্থায় আগের মতোই স্থির দেখে জিজ্ঞেস করলেন - এমনতরো গতিহীন নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেন ? রাজা উত্তরে বললেন - গুরুদেব এই হাত, এই পা, এই শরীর , এই মন , সমস্ত ঈন্দ্রিয়াদি কিছুই তো আর এখন আমার নয়। এতদিন যা কিছু আমার ভাবতাম এমনকি বিদেহ-রাজের রাজ্য, সবই আপনাকে সঁপেছি। এখন আপনার আদেশ ছাড়া আমি আর কিছুমাত্র করতে সমর্থ নই। আচার্য অষ্টাবক্র মুনি, জনকের কথা শুনে খুশি হলেন এবং ব্রহ্মজ্ঞান দিতে উদ্যোগী হলেন। "অষ্টাবক্র গীতা" জনক রাজার প্রতি প্রদত্ত এই ব্রহ্ম-জ্ঞান।
মহাত্মাগণ বলে থাকেন, অষ্টাবক্র গীতা এমনি শক্তিশালী ব্রহ্মবিদ্যা যে মুহূর্তের মধ্যেই অর্থাৎ ঘোড়ার পিঠে উঠবার জন্য যে স্বল্প সময় দরকার পড়ে - সেই মুহূর্তকালের মধ্যেই মানুষ এই দুর্লভ ব্রহ্মবিদ্যা লাভ করে, তক্ষুনি মুক্তি লাভ করতে পারে।
মহর্ষি অষ্টাবক্র প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন । রাজা জনক আত্মজ্ঞান লাভের জন্য এতটাই ব্যাকুল ছিলেন যে এক নিঃশ্বাসে পরপর তিনটি প্রশ্ন করেছেন কিনতু উত্তর তো একটাই। তাই মহর্ষি অষ্টাবক্র বলছেন –
মুক্তিম ইচ্ছসি চেত্তাত বিষয়ান্ বিষবৎ ত্যজ (১/২)
– মুক্তির ইচ্ছা চিত্ততে জাগলে বিষয়কে বিষবৎ ত্যাগ করো।
হাজারো বছরের পুরাতন, কিন্তু চির নবীন এই কথা । কে এই মহর্ষী ?
উজ্জানক (উজ্জয়িনী-?) নামক স্থানে ভৃগুতুঙ্গ নামক মহাগিরি । বুকচিরে বয়ে চলেছে বিতস্তা নদী । নদীর তীরে বহু আশ্রম । মুনিদের তপভুমি । এখানেই এক সময় বাস করতেন মহর্ষি উদ্দালক । তাঁর পুত্র শ্বেতকেতু কন্যা সুজাতা, ও জামাতা কহোড় ,মহর্ষি উদ্দালকের আশ্রমেই বেদ আধ্যায়ন করতেন ।
কহোড়, মহর্ষি উদ্দালকের খুব প্রিয় ছিলেন । তার সেবায় ও নিষ্ঠায় সন্তুষ্ট হয়ে উদ্দালক সমস্ত শ্রুতিবিদ্যা (অর্থাৎ বেদবিদ্যা ) তাকে দান করে ছিলেন । এমনকি নিজ কন্যা সুজাতার সাথে তার বিবাহ দিয়ে ছিলেন । এ'কে বেদ বিদ্যার অধিকারী তায় মহর্ষি উদ্দালকের মত মহান ঋষির জামাতা হয়ে কহোড়ের অহঙ্কার বেড়ে গেলো । আশ্রমের আচার্য্যর পদে আসিন হয়ে গুরু হয়ে বসলেন । সুজাতাকে নিয়ে সুখে সংসারধর্ম পালন করতে লাগলেন । একসময় সুজাতা গর্ভ ধারন করলো । এই গর্ভস্থ সন্তান-ই মহর্ষি অষ্টাবক্র নামে বিখ্যাত । অষ্টাবক্রের আসল নাম কৌশকেয়। কিন্তু শারীরিক অঙ্গ বিকৃতির জন্য তিনি অষ্টাবক্র নামেই খ্যাত। তাই আমরাও তাকে অষ্টাবক্র বলে উল্লেখ করবো। আর কৌশিকেয়র অঙ্গহানির কাহিনী ও পরবর্তীতে আবার সুস্থসবল হয়ে ওঠার কাহিনী আমরা পরবর্তীতে শুনবো।
আজ আমরা সংহিতায় ফিরে যাব -
মুক্তিম ইচ্ছসি চেত্তাত বিষয়ান্ বিষবৎ ত্যজ(১/২) – মুক্তির ইচ্ছা চিত্ততে জাগলে বিষয়কে বিষবৎ ত্যাগ করো ।
যে চিত্তে মুক্তির ইচ্ছা জাগে সে বিষয়কে বিষবৎ ত্যাগ করে । এখন মুক্তি কি ? - দুঃখনিবৃত্তিই মুক্তি । দুঃখপ্রাগভাবে স্থিতিই মুক্তি । অহংনাশই মুক্তি । আত্মজ্ঞানলাভই মুক্তি ।
বিষয় কি ? - তন – মন - ধন - এই তিনটিই বিষয় । আচার্যদেব তো সোজা বলে দিলেন বিষয়-কে বিষবৎ ত্যাগ করো। ব্যাপারটা কি এতই সোজা ? ধন ছাড়া তো মানুষের এক মুহূর্ত বাঁচার উপায় নাই। সংসার ত্যাগ করে যারা সন্যাস নিচ্ছেন, তারাও তো ধনের মোহে পড়ে যাচ্ছেন। কেননা দেহ রক্ষার জন্য যেমন খাদ্যের প্রয়োজন, তেমনি প্রকৃতির রোষের হাত থেকে বাঁচতে গেলে বাসস্থানের প্রয়োজন। আর এই দেহই সাধন ভজনের একমাত্র আশ্রয়স্থল। দেবভূমি উত্তরাখণ্ডে বা হিমালয়ের কোলে গেলে দেখতে পারবেন, অসংখ্য আশ্রম। অল্পকিছু মানুষ অবশ্য একাকী নিরাশ্রয়ে ঈশ্বর চিন্তায় মগ্ন আছেন। কিন্তু বেশিরভাগ ঈশ্বর সন্ধানী আশ্রমে আশ্রয় নেন। আর এই আশ্রম গুলো চলে সাধারণত দানের উপরে নির্ভর করে।
আবার একবার শ্লোকটা পড়ি : মুক্তিম ইচ্ছসি চেত্তাত বিষয়ান্ বিষবৎ ত্যজ – মুক্তির ইচ্ছা চিত্ততে জাগলে বিষয়কে বিষবৎ ত্যাগ করো । এখানে একটা কথা লক্ষ্য করুন অষ্টাবক্র বিষয়কে ত্যাগের কথা বলছেন কি ? তাহলে-তো সোজা বলতেই পারতেন বিষয়কে ত্যাগ করো তা কিন্তু বলেননি। বলছেন বিষয়কে বিষবৎ ত্যাগ করো অর্থাৎ বিষয় যদি বিষবৎ হয় তবে তাকে অবশ্যই ত্যাগ করো। জীবনের জন্য বিষয় বিষ নয়। বিষয়ের জন্য জীবন বিষ। তাই বেচে থাকার প্রয়োজনে বিষয়-কে রাখো। কিন্তু বিষয় ভোগের জন্য বিষয়কে রেখো না। আর একটা আমার মনে হয়, বিষয় এবং বিষ কথাটা খুব কাছাকাছি - বিষ খেলে মানুষ মারা যায়। বিষয়ে খেলে কি হয় ? পলে পলে মরে। আমরা জানি মানুষ প্রতিনিয়ত মরছে। আমার শৈশবে মারা গেছে - আমার কৈশোর মারা গেছে - আমার যৌবন মারা গেছে - প্রৌঢ় মারা গেছে - এখন বেঁচে আছে বৃদ্ধ আমি । এর পর বৃদ্ধও মারা যাবে। এই বিষয় খেতে খেতে, বিষয় ভোগ করতে করতে জীবন শেষ হয়ে যাবে এটা তো ধ্রুব সত্য। তাহলে বিষয় ত্যাগ করলে কি জীবন বেঁচে থাকবে ? তাতো নয় বলেই মনে হয়। তাহলে সত্য কি ?
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, শ্রীমদ্ভগবৎ গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে ৭০ নম্বর শ্লোকে বলছেন, "কামা যং প্রবিশন্তি সর্বে স শান্তিমাপ্নোতি ন কামকামী" - তো শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, সংযমী মানবের মাঝে বিষয়সকল প্রবেশ করে বিলীন হয়ে যায়, কোনো রকম বিকার উৎপন্ন করতে পারে না। আর এই আর এই সংযমী মানুষই পরমশান্তি লাভ করেন। এখানে "কামা" শব্দটি দ্বারা কামনাকে বোঝানো হয় নি, যে বস্তুগুলো কামনা করা হয়, সেই ভোগ্য পদার্থগুলো অর্থাৎ বিষয়কে বোঝানো হয়েছে। তো বিষয় থাকবে, বিষয় ভোগও থাকবে, কিন্তু বিষয় সাধককে বিব্রত করতে পারবে না। বিষয় তার মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে। যেমন নদী সমুদ্রে গিয়ে বিলীন হয়ে যায়। যাদের মনে ভোগ্য পদার্থগুলোর কামনা থাকে, তারা সেগুলোকেই গুরুত্ত্ব দেয়, এবং তাদের দৃষ্টি সেদিকেই থাকে। আবার আশ্চর্য্যের কথা হচ্ছে, সাংসারিক ভোগ্যবস্তু যতই প্রাপ্তি হোক না কেন, তাদের তৃপ্তি হয় না। আসলে আমরা সবাই চৈতন্য স্বরূপ। আর এই চৈতন্য স্বরূপের কখনোই জড়বস্তুতে তৃপ্ত হতে পারে না। তাই অষ্টাবক্র মুনি বলছেন, বিষয়ান্ বিষবৎ ত্যজ।
বিষয় বলতে আমরা তিনটে জিনিসের কথা শুনেছি, তন-মন-ধন। এতক্ষন আমরা ধনের কথা শুনছিলাম। মনও একটা বিষয়। আমাদের এই মনের যতক্ষন না বিলুপ্তি ঘটছে, ততক্ষন আমরা স্ব-রূপে স্থিত হতে পারবো না। মনের বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে চিন্তা - ভাবনা। সাধক যখন জাগ্রত অবস্থায় থাকে তখন সে স্থুল দেহাত্ত্ববোধে স্থিত থাকে। এই শরীরটাকেই সে মনে করে আমি। মানুষ যখন স্বপ্নাবস্থাতে থাকে তখন সে মানসিক শরীরে বা মানসলোকে অর্থাৎ চিন্তার জগতে অবস্থান করে থাকে। এই দুটো অবস্থা থেকে যখন আরো উঁচু অবস্থাতে যায় তখন তার মনের ক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে যায়। যাকে আমারা সুসুপ্তির অবস্থা বলে থাকি। অর্থাৎ আমরা যারা আমিকে মন ভাবছি, সেখান থেকে আমাদের উত্তীর্ন হতে হবে। ঋষি পাতাঞ্জলি বলছেন, চিত্ত বৃত্তিকে নিরোধ করতে হবে।
আর সবশেষে আমাদের তন, অর্থাৎ আমি যে দেহ নোই, আমি দেহে অবস্থান করছি মাত্র, এই বোধ আমাদের জাগ্রত করতে হবে। নশ্বর এই দেহ। এই দেহ আমি চাই না চাই একদিন মৌল বস্তুতে অর্থাৎ ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ-ব্যোমে বিলীন হয়ে যাবে। এই চির সত্যকে আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে।
এগুলো আমরা বুঝি কিন্তু মায়া-মোহ রূপ মেঘ আমাদেরকে এমন ভাবে ঘিরে রেখেছে, যে আমরা সত্যকে দেখতে পারছি না। গুরুর উপদেশে ধীরে ধীরে আমাদের এই মেঘকেটে যাবে। তখন আমরা সত্যে উপনীত হবো। আজ এই পর্যন্ত।
এই চিরসত্যের কথা আমরা পরের দিন আবার শুনবো। আজ ব্রহ্মবাক্যের বিরাম দিলাম।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
----------------------------------------------------------------------------------------
অষ্টাবক্র গীতা - নতুন সংস্করণ (ষষ্ঠ ভাগ)
আগের দিন আমরা শুনেছিলাম, মুক্তির ইচ্ছে যদি চিত্তে জাগে তবে, বিষয়কে বিষবৎ ত্যাগ করো। বিষয় কি, তা আমরা শুনেছি। তন অর্থাৎ শরীর, মন অর্থাৎ চিন্তা ভাবনা, ও ধন অর্থাৎ আমাদের বিষয়সম্পত্তি। এখন বিষয়কে কিভাবে ত্যাগ করা যেতে পারে। ঠাকুর রামকৃষ্ণের জীবনের একটা ছোট্ট ঘটনার কথা বলি, ঠাকুর তামাক খেতেন। তো তাঁর ছিল, নারকেলের মালা ও কাঠ দিয়ে গড়া একটা গড়গড়া । তো ঠাকুরের একবার রুপোর গড়গড়ায় তামাক খাবার ইচ্ছে হলো। মথুরবাবু, রুপোর গড়গড়া এনে দিলেন। ঠাকুর রুপোর গড়গড়া মুখে দিয়ে বেশ আয়েস করে তামাক টানলেন, এরপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাক খেলেন, একবার ডানদিকে কাত হয়ে খেলেন, একবার বা দিকে কাত হয়ে তামাক খেলেন। শেষে বললেন, মন এই হলো রুপোর গড়গড়ায় তামাক খাওয়া।
আরও একবার ঠাকুরের পেঁয়াজ খাবার খুব ইচ্ছে হলো, তো একটা পেঁয়াজ নিয়ে মুখের মধ্যে রাখলেন, তারপর একবার ডান গালে, একবার বাম গালে পেঁয়াজটাকে মুখের মধ্যে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। একটু পরে পেঁয়াজটাকে ফেলে দিয়ে বললেন, মন, এরই নাম পেঁয়াজ খাওয়া। তো এই হচ্ছে, মহাপুরুষদের বিষয়ভোগ।
অষ্টাবক্র মুনি বলছেন, মুক্তির ইচ্ছে যদি চিত্তে জাগে, এই চিত্ত ব্যাপারটা কি ? চিত+ত। চিত কথাটার মানে জ্ঞান, বা চিন্তন করা আর "ত" কথাটার অর্থ জ্ঞাত হওয়া। অর্থাৎ যার দ্বারা জ্ঞান লাভ করা যায়। এই চিত্তেই আমাদের সংস্কার বাসা বাধে। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলতেন, তোমার চৈতন্য হোক। ঠাকুর বলতেন, মানুষ মান-হূঁস হোক। মান অর্থে সত্তা বা মূল্যবোধ আর হূঁস অর্থাৎ সচেতন হওয়া। অর্থাৎ নিজের সম্পর্কে সচেতন হওয়া। জীবন সম্পর্কে সচেতন হবার জন্য, জীবন জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজবার জন্য, একটা সময় মানুষের মধ্যে প্রশ্ন জেগে ওঠে। আর যেখানে এই জিজ্ঞাসার বুদ্বুদ ভেসে ওঠে সেটাই আমাদের চিত্ত।
স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন, এমন কোনো সময় ছিল না, বা এমন কোনো সময় আসবে না, যখন মানুষ তার নিজের স্বরূপ সম্পর্কে আকর্ষণ বোধ করবে না। কিছু নিষ্ঠাবান মানুষ, কিছু সাহসী মানুষ, কিছু ভাগ্যবান সাধক এই রহস্য উন্মোচন করেন। এইসব মহাপুরুষদের আমাদের অনুসরণ করা উচিত।
একটা ছোট্ট ছেলেকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তুমি কি বলতে পারো, কে তোমাকে তৈরি করেছেন ? তো ছেলেটি হেসে জবাব দিয়েছিলো, ভেবো না কেউ আমাকে তৈরি করেছে, আমিই আমাকে তৈরি করেছি। এই কথাগুলো, আমাদের কাছে শিশু সুলভ মনে হতে পারে, কিন্তু এই শিশুর মুখ দিয়েই চিরন্তন সত্য প্রকাশিত হয়েছিল। জীবের মৃত্যু মানে স্থূল দেহের অস্তিত্ত্ব লোপ, কিন্তু জীবাত্মার অস্তিত্ত্ব তখন সুক্ষ জগতে সূক্ষ্ম দেহে বর্তমান থাকে। প্রতিবার স্থূল দেহ ত্যাগের পরে, সুক্ষ শরীর প্রাকৃতিক কারণেই, সূক্ষ্ম জগতে বাস করতে পারে। এবং তার প্রকৃতি অনুসারে, নতুন দেহ প্রাপ্ত হয়। এইভাবে বার বার হাজার বার জন্ম-মৃত্যু চক্রের আবর্তন করতে করতে একসময় ক্ষীনভাবে তার মধ্যে আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসা জাগ্রত হয়। তখন মানুষের অন্তরাত্মা যেন অনন্ত নিদ্রা থেকে জেগে ওঠে। নিজের স্বরূপ উপল্বদ্ধির জন্য আকুল হয়ে ওঠে, সাধনায় ব্রতী হয়। এইসময়, জাগ্রত পুরুষ তাকে সাহায্য করেন, এবং ধীরে ধীরে, নিজ আধ্যাত্মিক স্বরূপ ও পরমাত্মার সঙ্গে তার অভেদ সম্পর্কের বিষয় উপলব্ধি করে। তখন তার সমস্ত কর্ম্ম বন্ধন খুলে যায়, জন্ম-মৃত্যুর আবর্তের নিবৃত্তি হয়। তো যার চিত্তে এই প্রশ্ন জেগেছে, মুক্তি কিভাবে হবে। জানবেন তিনি, লক্ষ লক্ষ যোনী ভ্রমনের পরে আজ এই অবস্থায় এসেছেন। রাজা জনকের মনে এই প্রশ্ন জেগেছিল, আর জাগ্রত পুরুষ অষ্টাবক্র মুনি এই প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। একটা কথা জানবেন, রাজা জনকের দেহাত্মবোধ লোপ পেয়ে গেছে, মন স্বরূপের চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেছে, জাগতিক ধনের প্রতি তিনি নিস্পৃহ হয়ে গেছেন। আর এই মানুষই অষ্টাবক্র মুনির মতো মহাপুরুষের সন্ধান পান।
আমরা আবার অষ্টাবক্র গীতায় ফিরে যাবো।
পরের লাইনে বলছেন :
ক্ষমা-আর্জব-দয়া-তোষ-সত্যং পীযূষবৎ ভজ –(১/২)
ক্ষমা,আর্জব (আবেদন), দয়া, সন্তোষ, ও সত্য ইত্যাদি গুণগুলি-কে ভজনা করো ।
বিষয়কে বিষবৎ ত্যাগ করতে বললেন এখন বলছেন কয়েকটা গুনের ভজনা বা সাধন করতে বলছেন। আসলে এই গুনের সাধনাই মানুষকে মহামানব করে তোলে। মানুষকে দেবতা করে তোলে এই গুনের সাধনা। তাই অষ্টাবক্র মুনি গুনের সাধনা করতে বললেন।
প্রথমটি হলো "ক্ষমা " : ক্ষমা অর্থাৎ সহ্য করা। শক্তি থাকতেও অপরাধীর অপরাধের মার্জনা করা। ক্ষমা গুনের অধিকারী ব্যক্তি সর্বদাই প্রসন্ন থাকেন।
চোর ধরতে গেলে নিজেকেও দৌড়াতে হবে। চোরকে তার অপরাধের জন্য দণ্ড দিতে গেলে নিজেকে আরো জোরে দৌড়তে হবে। জীব অপরাধ করে দুটি কারণে। এক: নিজের অভাব পূরণের জন্য। দুই: স্বভাবের তৃপ্তির জন্য। অভাব পূরণের জন্য যারা অপরাধ করে তারা ক্ষমার যোগ্য। এদের ক্ষমা করে দেওয়া উচিত। যারা অহংকারের তৃপ্তির জন্য অপরাধ করে তারা ক্ষমার অযোগ্য। অহংকারীর অহংকার নাসের জন্য, অপরাধ থেকে বিরত থাকার জন্য তাদের শিক্ষা দান করা উচিত। এটাই জ্ঞানী বা শক্তিশালী মহাপুরুষরা করে থাকেন। জ্ঞান মহাপুরুষের শক্তি- ক্ষমা তার গুন্। আমরা গুন্ থেকেই দ্রব্য চিনতে পারি। । আমরা গুন্ থেকেই সাধারণ পুরুষ ও মহাপুরুষের মধ্যে পার্থক্য নির্নয় করতে পারি। অতএব তুমি যদি সাধারণ পুরুষ থেকে উত্তম পুরুষ হতে চাও তবে যে সব গুনের সমৃদ্ধি দরকার তার মধ্যে একটা হলো ক্ষমা। তুমি ক্ষমা গুনের সাধনা করো।
ক্ষমা করতে শেখো। ধন্যবাদী হয়ে বাঁচো। যে তোমার জন্য এতটুকু করেছে তাকে ধন্যবাদ দাও। যে তোমার জন্য কিছুই করেনি তাকেও ভালোবাসো। যে তোমার ক্ষতি করেছে তাকে ক্ষমা করে দাও। যার জন্য তুমি অনেক করেছো, অথচ সে তোমাকে চিনতেপারছে না - তাকেও তুমি ক্ষমা করে দাও। তার জন্য ঈশ্বরের কাছে মঙ্গল প্রার্থনা করো।
দ্বিতীয়টি হলো আর্জব : আর্জব কথার অর্থ হলো আবেদন। জ্ঞানী সর্বদা বৃহতের কাছে আর্জি করেন। নিজের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে বৃহতের সঙ্গে একাত্বতা অনুভব করবার মানসে আবেদন করেন। নিজের ক্ষুদ্রত্ব স্বীকার করা। নিজের ক্ষুদ্রত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকা। এবং ক্ষুদ্রত্ব কাটিয়ে বৃহতের সঙ্গে মিলিয়ে যাওয়া। আকুল ভাবে আবেদন করো। তিনিই কাছে টেনে নেবেন। তার সমস্ত কিছু তোমাকে দেবার জন্য তিনি ব্যাকুল। শুধু তোমার আকুলতা বাড়াতে হবে। আকুল হয়ে প্রার্থনা করতে হবে।
তৃতীয়টি হলো দয়া : পার্থিব, অপার্থিব সবই তার। তারই দয়ায় আমরা সবাই বেঁচে আছি। এই আকাশ, বাতাস, পৃথিবী, সূর্য, চন্দ্র, পাহাড়, সমুদ্র, নদী, গাছপালা - সবাই আমাদের নিঃশর্ত ভাবে দয়া করছেন। তারই দয়ায় আমরা সবাই বেঁচে আছি। আমাদেরও উচিত পাত্রাপাত্র বিচার না করে সবাইকে দয়া করা।
চতুর্থ হলো তোষ - অর্থাৎ সন্তোষ। সন্তুষ্ট হয়ে বাঁচা। ধন্যবাদী হয়ে বাঁচো। ভগবানকে ধন্যবাদ দাও।
"ভগবান তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ। যা তুমি দিয়েছো তাতো অনেক। তোমার দেওয়ায় কিছু কমতি নেই।কমতি আমার সামলানোর শক্তি। ভগবান তোমাকে লাখ লাখ প্রণাম। তোমার দানেই আমার জীবন। তোমার দানেই আমার রক্ষা। তোমার দানেই আমার সমৃদ্ধি। তোমার দেওয়া দান তো আমার কাছে প্রসাদ। প্রসাদ কম হোক, বেশী হোক, প্রসাদ তো প্রসাদই। তোমাকে আমার সহস্র কোটি প্রণাম। তোমার দেওয়া জমি, তোমার দেওয়া অন্ন ,তোমার দেওয়া প্রাণবায়ু, তোমার দেওয়া এই শরীর - কোথাও তো তুমি কম দাওনি। কমতি হলো আমার প্রাণের আকুলতা - যা তোমাকে আমার দেওয়া উচিত। হে ঠাকুর, বাহ্যিক ধন কামাতে আমি মনের শান্তি নষ্ট করেছি। আমাকে ক্ষমা করো। কোলে তুলে নাও। "
ধন্যবাদী হয়ে যাও। যা কিছু পেয়েছো তাতেই সন্তুষ্ট থাকো।
পঞ্চমটি হচ্ছে সত্য : জীবনের সত্যকে জানো। জীব পরিবর্তনশীল। জীবন পরিবর্তনশীল। সত্য স্থির। জীবনের সত্যকে বোঝার চেষ্টা করো। অর্থাৎ নশ্বরতাই জীবন। এই সত্য উপলব্ধি করো। তুমি অবিনশ্বর। এই সত্যকে বোঝার চেষ্টা করো। আসলে নিজেকে জীবনের ওপারে নিয়ে যাও। যেখান থেকে তুমি এসেছো, সেই স্মৃতি জাগিয়া তোলো। স্বপ্ন ভেঙে যাক। জেগে ওঠো। সত্যকে উপলব্ধি করো। এই জীবন তো স্বপ্ন। এ তো সত্য নয়। আমরা রাতে স্বপ্ন দেখি। সকালে ভুলে যাই। বাস্তবে চলে আসি। স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। এই রাতের স্বপ্ন বড়জোর ছয় বা আট ঘন্টা পরেই আমরা বুঝতে পারি যে এতক্ষন স্বপ্নে ছিলাম। এই জীবনটাও একটা স্বপ্ন। কেবল পার্থক্য হচ্ছে এই স্বপ্ন ভাঙতে আমাদের আশি বা একশো বছর লাগে। আসলে আমরা যাকে মৃত্যু বলি সেটাই জেগে ওঠা। স্বপ্ন ভেঙে জেগে ওঠা। এই সত্যকে স্বীকার কারো - উপলব্ধি করো।
তো অষ্টাবক্র মুনি বলছেন ক্ষমা,আর্জব (আবেদন), দয়া, সন্তোষ, ও সত্য ইত্যাদি গুণগুলি-কে পীযুষবৎ ভজনা করো। পীযুষ কথাটার অর্থ হচ্ছে, পীয + উষ পীয অর্থাৎ তৃপ্ত হওয়া, আর উষ অর্থাৎ যার দ্বারা , তো পীযুষ অর্থ যার দ্বারা মানুষ তৃপ্তি পেতে পারে। অর্থাৎ অমৃত। তো এই অমৃতস্বরূপ গুনগুলোকে ভজনা করতে হবে।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি ওম।
অষ্টাবক্র গীতা - সপ্তম পর্ব্ব।
আচার্য্যদেব এর পর বলছেন –
ন পৃথ্বী - ন জলং – ন অগ্নিঃ – ন বায়ুঃ – ন দৌঃ বা ভবান্
এষাং সাক্ষিনম্ আত্মানং চিদ্রূপং(চিৎ -রূপম) বিদ্ধি মুক্তয়ে (১/৩)।
- হে শিষ্য, তুমি পৃথিবী (মাটি ) নয় - জল নয় - অগ্নি নয় - বায়ু নয় - আকাশ নয়। এ সকলের সাক্ষী আত্মাকে তুমি মুক্তি লাভার্থে চৈতন্য রূপে অবগত হও।
আমরা জানি, পঞ্চ ভূতের (ক্ষিতি ,অপ , তেজ , মরুৎ , ব্যোম ) তৈরি এই শরীর। আত্মার পঞ্চবিধ আবরণ - ১) অন্ন -বিকারজ স্থুল শরীর বা অন্ন-ময় কোষ, ২) পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সহিত পঞ্চ প্রাণ বা প্রাণময় কোষ ৩) মনের আশ্রিত ইন্দ্রিয়গনের সহিত মন বা মনোময় কোষ ৪) জ্ঞানের আশ্রিত ইন্দ্রিয়গণ ও জ্ঞান বা জ্ঞানময় কোষ ৫) অবিদ্যার আশ্রিত অহঙ্কারাদি বা আনন্দময় কোষ।
তুমি এই দেহ নও। তুমি চৈতন্য। দেহের কারণও তুমি নও। তুমি কোষ নও। কোষ তোমাকে আশ্রয় করেছে মাত্র।
আমরা জানি পিতৃ-মাতৃ প্রদত্ত পঞ্চভূতের এই শরীর। আমাদের মৃত্যুর পরে আমাদের দেহ পঞ্চভূতে মিশে যাবে। এটা বৈজ্ঞানিক সত্য। আর এই দেহের সঙ্গে আমি অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত। এই দেহ ভিন্ন আমি এটা আমাদের কল্পনার বাইরে। এইযে অষ্টাবক্র আমাদের জ্ঞান দান করছেন ইনিও একজন দেহধারী মহাপুরুষ। যাকে জ্ঞান দান করছেন তিনিও একজন দেহধারী মানুষ যার নাম রাজা জনক। মহামুনি অষ্টাবক্র বলছেন : ন পৃথ্বী - ন জলং – ন অগ্নিঃ – ন বায়ুঃ – ন দৌঃ বা ভবান্। আমি পৃথিবী বা মাটি নই - আমি জল নই - আমি অগ্নি নই - আমি বায়ু নই - আমি আকাশ নই। অর্থাৎ আমি শরীর নোই, আবার শরীরের যেসব কারন পঞ্চভূত, তাও আমি নোই, তা হলে আমি কে ? উনি বলছেন : এষাং সাক্ষিনম্ আত্মানং চিদ্রূপং (চিৎ -রূপম) বিদ্ধি মুক্তয়ে।
এষাং সাক্ষিনম অর্থাৎ এই আমি একজন সাক্ষি। সাক্ষি কথাটা একটু ভালো হলে বোঝার দরকার। সাক্ষি অর্থাৎ যে কিছুই করে না, শুধু ঘটনার পর্যবেক্ষণ করে মাত্র। ঘটনার জন্য তার কোনো ক্রিয়াশীলতা নেই। শুধু ঘটনার পর্যবেক্ষণ করে না, প্রয়োজনে বা সময়কালে ঘটনার যথাযথ চিত্রের পুরাবৃত্তি করতে সক্ষম। এটাই আমাদের স্মৃতি। এই স্মৃতি এতটাই প্রখর ও দীর্ঘস্থায়ী যে কালান্তরেও তার লোপ হয় না। এই স্মৃতি আমাদের দেহে সাময়িক ভাবে স্থিত থাকে। দেহে অবস্থিত কিছু স্মৃতি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুছে যায়। অর্থাৎ কিছু স্মৃতি স্বল্পস্থায়ী। আবার কিছু স্মৃতি দীর্ঘ স্থায়ী। কিন্তু দেহের বাইরের এই স্মৃতি রক্ষ্মণ চিরকালীন। কোনো স্মৃতি কখনোই মুছে যায় না। এই স্মৃতিই থাকে চৈতন্যে বা আত্মায়। মহর্ষি বলছেন - এষাং সাক্ষিনম্ আত্মানং চিদ্রূপং (চিৎ -রূপম) বিদ্ধি মুক্তয়ে। আত্মনং চিদ্রূপং অর্থাৎ আমার নাম আত্মা, আমি চৈতন্য স্বরূপ - আচার্য বলছেন মুক্তি লাভার্থে তুমি এইরূপ বোধ করো।
কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, বোধ করা কি এতই সোজা ? কষ্টকল্পনা করা যায় মাত্র, তার বেশি নয়। আমার স্বরূপ হচ্ছে চৈতন্য। চৈতন্য আবার স্বরূপ হয় নাকি? চৈতন্য হচ্ছে একটা উপলব্ধির নাম মাত্র। তার আবার স্বরূপ কি ? চৈতন্য যদি আমার স্বরূপ হয় তাহলে তার আবার মুক্তি কি ? চৈতন্যতো সর্বত্র-সর্বদা মুক্ত। তাহলে কি আমার ধারণার মুক্তি চাই? অর্থাৎ আমি যে ধারণা করে বসে আছি অর্থাৎ - আমি শশাঙ্ক শেখর, এই আমার দেহ, এই ধারণাটাই ভুল ? জন্ম জন্মান্তরের সংস্কার আমাকে স্মৃতি থেকে টেনে দেহতে নিয়ে এসেছে। এখান থেকে আবার ফিরতে হবে। তবেই মুক্তি। আমরা আসলে অভ্যাসের দাস। আমি চোখ বুজে খাবার খেতে পারি। খাবার আমাদের মুখের কাছেই নিয়ে যাই। আমি কখনোই কানের কাছে নিয়ে যাই। এটা আমাদের অভ্যাস। একটা ফুল পেলে আমরা নাকের কাছে নিয়ে যাই। গন্ধ পাবার জন্য। আর এই যে আমাদের অভ্যাস, এই অভ্যাসই আমাদের একটা বাঁধনে বেঁধে রেখেছে। এই অভ্যাসগুলোকে আমাদের বিশ্লেষণ করতে হবে।
একটা গল্প শুনেছিলাম বন্ধন ও মুক্তি প্রসঙ্গে। গল্পটা বলি -
এক রাখাল বালক প্রতিদিন গঙ্গার তীরে গোরু চড়াতে যায়। দড়ি বেধেঁ গরুগুলোকে নিয়ে যায়। গঙ্গার তীরে গিয়ে দড়ি খুলে গোরুগুলোকে ছেড়ে দেয় , চড়ে খাবার জন্য। আবার দিনের শেষে গোরুগুলোর গলায় দড়ি বেঁধে নিয়ে আসে। এক দিন হলো কি - রাখাল বালক দুপুরে যখন গাছতলায় ঘুমুচ্ছিলো তখন তার দড়িগুলো চুরি হয়ে যায়। এইবার, সন্ধ্যাবেলায় যখন গরুগুলোকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে, তখন আর গরুগুলো আসতে চায় না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে জাবর কাটছে। নট নড়নচরণ। রাখাল বালক যতই গরুর লেজ মুচড়ে দিচ্ছে, চল-চল বলছে গোরুগুলো কিন্তু ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। বিরক্ত হয়ে লাঠি দিয়ে দু-এক ঘা মেরেও দিলো। তথাপি গোরুগুলো মাঠ ছেড়ে যেতে চাচ্ছে না। অগত্যা রাখাল বালক হাল ছেড়ে দিয়ে বসে পড়েছে। এ দিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ভাবছে কি করা যায় ?
গঙ্গার তীরে এক সাধু মাটির-কুটির বেঁধে সাধন ভজন করত। রাখাল বালক অনেক আশা নিয়ে সাধুর কাছে গেল, যদি সাধুর কাছে দড়ি পাওয়া যায়। সাধুকে দড়ির কথা বলতেই , সাধু বললো - আমার কাছে দড়ি তো নেই কিন্তু তোমার সমস্যাটা কী। রাখাল বালক তখন তার দড়ি চুরি যাবার ঘটনা বললো এবং দড়ি ছাড়া গরুগুলোকে কি ভাবে মাঠ থেকে নিয়ে যাওয়া যায় - তা জিজ্ঞেস করলো। সব চেয়ে বড়ো সমস্যা হচ্ছে গরুগুলো মাঠ থেকে এক পা-ও যেতে চাইছে না।
সাধু জিজ্ঞাসা করলো - কেনো যেতে চাইছে না ?
রাখাল বললো - তাতো জানিনা। গরুগুলো বাঁধা নেই। সব গুলোই ছাড়া।
সাধু বললো - অন্যদিন কি ভাবে নিয়ে যাও ?
রাখাল বললো - অন্য দিন তো বাড়ি নিয়ে যাবার আগে দড়ি দিয়ে বেঁধে নেই। আজ তো দড়ি হারিয়ে গেছে, তাই বাঁধতে পারছি না। দড়ি ছাড়া গরু নিয়ে যাওয়া সমস্যা বটে। অন্যের জমির ফসল খেয়ে নেবে। কিন্তু তার চাইতে সমস্যা হচ্ছে , গরুগুলো নড়ছেই না।
সাধু বললো - এক কাজ করো। তুমি অন্য দিন যেভাবে দড়ি দিয়ে গরুগুলোকে বাঁধো, আজ মিথ্যে মিথ্যে দড়ি ছাড়াই গরুগুলোকে বাঁধো অর্থাৎ দড়ি দিয়ে বাঁধার অভিনয় করো। দেখবে গরুগুলো ঠিক হাটা দেবে। আর বাড়ি চলে যাবে।
রাখাল ভাবলো সাধু আমার সাথে মজা করছে। ও এদিক ওদিক দেখতে লাগলো। কোথাও যদি দড়ি পাওয়া যায়।
সাধু বললো - কিগো যাও , যা বলছি করো। দেখোনা তোমার কাজ হয় কি না।
রাখাল বললো - আপনি আমার সাথে মজা করছেন না তো ? সাধুবাবা হাসলো। রাখাল তখন অনন্য উপায় হয়ে বললো - ঠিক আছে বলছেন যখন করে দেখি।
এইবার রাখাল সন্দেহজনক মন নিয়ে মাঠে ফিরে এলো। এবং দড়ির কোনো ব্যবস্থা না করতে পেরে বাধ্য হয়ে সাধুর কথা মতো দড়ি দিয়ে গরু বাঁধার অভিনয় করতে লাগলো। আশ্চর্যের ব্যাপার অভিনয় শেষ হয়ে গেলে গরুগুলো বাড়ির পথে হাটা দিলো। রাখালের মন আনন্দে ভরে গেল। গরু নিয়ে সাধুর কুটিরের সামনে দিয়ে যাবার সময় সাধুকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গেলো।
সাধু রাখালকে বললো বাড়ি নিয়ে আবার গোয়াল ঘরে খুঁটিতে দড়ি বাঁধার অভিনয় করো। না হলে গরু বাইরে বেরিয়ে যাবে। রাখাল তাই করলো।
পরদিন সকালে আবার যখন গরুগুলোকে গঙ্গার তীরে মাঠে নেবার জন্য চেষ্টা করলো, গরুগুলো গোয়াল থেকে বেরোতে চাইলো না। বাঁধন খোলার অভিনয় তো করা হয় নি। রাখালের মনে সন্দেহ হলো গরুগুলোকে সাধুবাবা তুকতাক করেনি তো ? না হলে গরু কেনো গোয়াল থেকে বের হতে চাইছে না। ওদের তো বাঁধন নেই। তবে ? ও আবার সাধুবাবার কাছে দৌড়ে গেল। বললো সাধুবাবা গরুগুলো সব গোয়াল থেকে বের হতে চাইছে না। সব গরুই ছাড়া , অথচ গোয়াল থেকে বের হচ্ছে না। কি করবো ?
সাধুবাবা একটু হাসলো। বললো আবার দড়ি খোলার অভিনয় করো। দেখবে সবাই তোমার কথা শুনছে।রাখাল বাড়ি এসে তাই করলো। আশ্চর্যের ব্যাপার, সঙ্গে সঙ্গে সব গরু রাখালের কথামতো মাঠের উদ্দেশ্যে হাটা দিলো।
গল্পকথা - কিন্তু আমরা কি ওই গরুগুলোর মতো অভ্যাসের বাঁধনে আবদ্ধ ? আমি তাহলে শশাঙ্ক শেখর নোই ? এটা আমার বহু দিনের অভ্যাস মাত্র ? তাইতো, আমার বাবা-মা যদি আমাকে শশাঙ্ক শেখর না বলে শশিশেখর বলে ডাকতো তাহলে আমি শশিশেখর হতাম । আর আমার নামকরণের আগে আমি কি ছিলাম ? একটা মাংসপিণ্ড ছাড়া কিছুতো নয়। তার আগে কি ছিলাম ? মাতৃ গর্ভে এক্স - ওয়াই ক্রোমোজমের মিশ্রণ। পিতৃ-মাতৃ শক্তির মিশ্রিত সত্বা এই শরীর। এই শক্তি কোথায় ছিল ? খাদ্যকণা থেকেই এই শক্তি উৎপণ্য হয়েছে। খাদ্যকণা আবার পঞ্চভূতের সৃষ্টি। পঞ্চভূত এলো কোথা থেকে ? এখান থেকেই ধোঁয়াশার শুরু।
শব্দ(ওম) থেকেই পঞ্চভূতের সৃষ্টি। সৃষ্টির পর্যায়ক্রম - আকাশ -বায়ু -অগ্নি-জল-পৃথিবী। আকাশের একটি গুন্ - শব্দ; বায়ুতে দুটো গুন্ - শব্দ ও স্পর্শ ; অগ্নিতে তিনটি গুন্ - শব্দ স্পর্শ ও রূপ ; জলে চারটি গুন্ - শব্দ, স্পর্শ, রূপ ও রস :পৃথিবীর পাঁচটি গুন্ : শব্দ, স্পর্শ, রূপ রস ও গন্ধ। এক্ষেত্রে শব্দগুন সবার মধ্যে বর্তমান। এর পরে এলো ঔষধি -গাছপালা। ধীরে ধীরে জলজ প্রাণী-উভচরপ্রাণী - আকাশচারীপ্রাণী -মৃত্তিকাচারীপ্রাণী। তাহলে আমি কি শব্দ ? শব্দব্রহ্ম ? শব্দের আগে কিছু ছিল কি ? শব্দতো একটা গুন্। তাহলে এর ধারক বা কর্তা কে ? ইচ্ছা শক্তি ? ইচ্ছা শক্তিও তো একটা গুন্। বিশ্বশক্তির গুন্ ইচ্ছাশক্তি। কেউ বলেন মহাশুন্য, কেউ বলেন বিভূতি। মহাশুন্য, যাকে বিগব্যাং তত্ত্ব বলছে ব্ল্যাক হোল।
মহর্ষি অষ্টাবক্র চতুর্থ শ্লোকে বলছেন :
যদি দেহং পৃথক্ কৃত্য চিতি বিশ্রাম্য তিষ্ঠসি -
যদি দেহাদি পৃথক করে, চৈতন্যে বিশ্রাম করিতে পারো
অধুনৈব সুখী শান্তো বন্ধমুক্তো ভবিষ্যসি। (১/৪)
এখনই সুখী, শান্ত, বন্ধনমুক্ত হতে পারো
মহর্ষি অষ্টাবক্র কত কঠিন কথা কত সহজ ভাবে বলে দিলেন। শুধু মান্যতা। এক্ষুনি এই মুহূর্তেই মুক্তি। এই জীবদ্দশাতেই মুক্তি। শুধু দেহাতীত হয়ে , তোমার আসল সত্বা চৈতন্যে অবস্থান করো। এক কথায় মুক্তির পথ বলে দিলেন। তুমি কে তা বলে দিলেন। আত্মজ্ঞান দান করলেন। কোনো সাধনপথ নয় ,যোগক্রিয়া নয় , সোজা শিখরে নিয়ে গেলেন। সোজা কৈলাশ। পাহাড়ের দুর্গম পথের বর্ণনা নয়। পূর্ব , পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ - কোনো দিক নয়। সোজা স্বয়ং এর কাছে নিয়ে গেলেন। এখানেই অষ্টাবক্রের বিশেস্বতঃ। এখানেই অষ্টাবক্রর সাফল্য। সোজা বলে দিলেন দেহাতীত হয়ে চৈতন্যে বিশ্রাম লও। চৈতন্যই তোমার স্বরূপ।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম
অষ্টাবক্র গীতা নতুন সংস্করণ - অষ্টম ভাগ।
মহারাজ জনক ব্রহ্মজ্ঞানের উপযুক্ত অধিকারী ছিলেন। জ্ঞান সংগ্রহের সমস্ত যোগ্যতা তার ছিলো। অশ্বারোহণ কালে এক রেকাবে এক পা ন্যস্ত করে দ্বিতীয় পা অপর রেকাবে রাখার জন্য যে অতি অল্প সময়ের প্রয়োজন তার মধ্যেই গুরুর উপদেশে তিনি ব্রহ্ম সাক্ষাৎকার করেছিলেন। যেমন গুরু তার তেমন শিষ্য। হাজার বছরের অন্ধকার, এক ঘষাতেই পরিষ্কার। দেশলাই আর কাঠি যদি শুকনো থাকে তবে এক ঘষাতেই আলো। বহু যুগের অন্ধকার এক মুহূর্তেই দূর হয়ে যায়।
আচার্যদেব পরবর্তী শ্লোকে বলছেন :
ন ত্বং বিপ্রাদিকো বর্ণো ন আশ্রমী ন অক্ষগোচরঃ
অসঙ্গঃ অসি নিরাকারো বিশ্বসাক্ষী সুখী ভব। (১/৫)
- তুমি ব্রাহ্মণ বা অন্যকোনো বর্ন (ক্ষত্রিয় , বৈশ্য , শুদ্র )ভুক্ত নয় - আশ্রমী বা আশ্রমবাসী নও - চক্ষু দ্বারা গোচরযোগ্য নয় - নিরাকার - বিশ্বসাক্ষী - সুখী হও।
তুমি বিপ্র নও, অর্থাৎ তুমি জ্ঞানী নও। আশ্ৰমী অর্থাৎ ব্রহ্মচর্য আশ্রম, গার্হস্থ আশ্রম ইত্যাদি ভুক্ত তুমি নও। তুমি এসবের উর্দ্ধে। বর্ণাশ্রম বন্ধনে যে আবদ্ধ , আশ্রমের বিধি বন্ধনে যে আবদ্ধ সে তো তুমি নয়। এমনকি জ্ঞানের বিধি-নিষেধের মধ্যেও তুমি আবদ্ধ নও। তুমি চক্ষুর অগোচর। তূমি নিরাকার, অগোচর, অসঙ্গ ( কেউ তোমার সঙ্গী নয় , কারুর তুমি সঙ্গী নয়), সমস্ত চলমান এই বিশ্বের তুমি সাক্ষি। তুমি তো চির - সুখী।
আমি শুনেছি , ঠাকুর রামকৃষ্ণ, নরেনকে অষ্টাবক্র সংহিতা পড়তে দিয়ে ছিলেন। নরেন পড়তে চায় নি। রামকৃষ্ণ বলেছিলেন , তুই আমাকে পড়ে শোনা । রামকৃষ্ণ, নরেনকেই কেন অষ্টাবক্র সংহিতা পড়তে দিয়েছিলেন ? কেউ কেউ বলেন অষ্টাবক্র সংহিতা - আধ্যাত্বিক দিক থেকে যারা অগ্রসর ব্যক্তি - তারাই এই বই পড়তে পারে। কেননা এখানে অধ্যাত্বিকতার শেষ কথাটা বলা আছে। তাই সাধারণ সাধক এই বই পড়ে, মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারবে না। আমার মনে হয় - অষ্টাবক্র সংহিতা এমন একটা বই - যা পড়লে আর কিছু পড়তে হয় না। যা পড়লে আর কিছু করতে হয় না। রামকৃষ্ণ দেখেছিলেন নরেন-এর প্রতিভা। রামকৃষ্ণ দেখেছিলেন নরেনের মধ্যে বিবেকানন্দের সম্ভাবনার বীজ। নরেনের বিবাহের তোড়জোড় চলছিলো। সেখান থেকে নরেনকে ফিরিয়ে আনতে গেলে মোক্ষম ঔষধ ছিলো অষ্টাবক্র গীতা। ঔষধে কাজও হয়েছিলো। নরেন সন্ন্যাস নিয়েছিলেন। নরেন হয়েছিলেন বিবেকানন্দ।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বললেন :
"চাতুর্ব্বন্যং ময়া সৃষ্ট্ং গুনকর্ম্মবিভাগশঃ
তস্য কর্ত্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম।." (শ্রীমদ্ভগবদ্ গীতা- ৪/১৩)
গুন্ ও কর্ম অনুসারে আমি চারটি বর্ণের সৃষ্টি করেছি। ব্রহ্মচর্য্য, গার্হস্থ, বানপ্রস্থ, ও সন্ন্যাস। মানুষের জীবন এই চার ধারায় প্রবাহিত হয়। কিন্তু আমরা মানুষকে চার ভাগে ভাগ করেছি। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র। এবং এদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছি ভেদ বুদ্ধি, প্রয়োগ করেছি, উঁচু-নিচু ভাব। এখন আর গুন্ ও কর্ম্মের কথা কেউ বলে না। বলে শুধু জন্মের কথা, বলে শুধু বংশ মর্যদার কথা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন : তুমি দেহ নও, তুমি আত্মা। আমি যদি আত্মা হই তবে আত্মার আবার ভাগ কেমন করে হবে ? বিভূতির আবার ভাগ কী ? অব্যয়, অব্যক্ত, বিভূতি নির্গুণ - তার গুনের সীমা করা যায় না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ক্ষত্রিয় বংশে জন্ম গ্রহণ করে ছিলেন। তবে কি তিনি ক্ষত্রিয় হয়েই থাকবেন ? একই পিতার (ব্যাস) ঔরসে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন বিদুর, ধৃতরাষ্ট্র ও পান্ডু। দাসীপুত্র বিদুর বিদ্যান হয়েও ব্রাত্য কেন ? জন্মগত কারন শুধু নয়, বীরশ্রেষ্ঠ কর্ন সূর্যপুত্র কুন্তীর গর্ভজাত হয়েও, শুদ্রঘরে পালিত হয়েছিলেন বলে, তার যোগ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। সত্যকথা হচ্ছে, যুধিষ্ঠিরের বড়ভাই হচ্ছে, কর্ন। এসব কথা তার মা কুন্তীদেবী জানতো, লোকলজ্বার ভয়ে তিনি তা বলেন নি।অন্যদিকে শ্রীকৃষ্ণ দেখুন, ক্ষত্রিয় ঘরে জন্ম গ্রহণ করেও, নন্দ গোয়ালার ঘরে পালিত হয়ে ছিলেন। তিনিও কিন্তু গোয়ালার পুত্র বলে গালি খেয়েছিলেন। যদিও যারা গালি দিয়েছিলো, তাদের পরিনাম ভালো হয় নি। তবু গালি তো তাকে শুনতে হয়েছিল। আসলে শ্রীকৃষ্ণের জন্মের আগে থেকেই, সমাজে এই জন্ম-সূত্রে মৰ্য্যাদার বীজ, যা আসলে সামাজিক ব্যাধি, তা গ্রথিত ছিল। ভগবান এই বিধিকে সংশোধিত করেছিলেন। বলে ছিলেন, গুন্ ও কর্ম্মের কথা। গুনের বৃদ্ধি, এবং বুদ্ধির সাহায্যে শ্রেয় কর্ম্ম মানুষকে মহামানব করে গড়ে তোলেন।
দেখুন করোনা হওয়া কোনো অপরাধ নয়, শুদ্র বা গোয়ালার ঘরে জন্ম গ্রহণ করাটাও কোনো অপরাধ নয়। অপরাধ হচ্ছে, এঁদেরকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখা, অচ্ছুৎ করে দেওয়া, বা দূরে সরিয়ে দেবার মতো ভুল পথে পা দেওয়া। এটাই আমাদের সামাজিক ব্যাধি। এই ব্যাধি আমাদের সবাই মিলে দূর করতে হবে।বিশেষ করে, ব্রাহ্মণ বংশজাত পুরুষদের বেশী করে এগিয়ে আসতে হবে, তা না হলে, এমন একদিন আসবে, যখন কুলীন বলে যারা গর্ব করেন , তারাই সমাজচ্যুত হয়ে পড়বেন ।
এ বিষয়ে অবশ্য একটা যুক্তি গ্রাহ্য ব্যাখ্যা আছে বেদে । মানুষ জন্মায় শূদ্র হয়ে অর্থাৎ অজ্ঞানী হয়ে। শিক্ষান্তে হয় বিপ্র। কর্মজীবনে বৈশ্য বা ক্ষত্রিয়। অর্থাৎ চাষবাস বা ব্যবসা নিয়ে থাকলে বৈশ্য। যদি রক্ষক অর্থাৎ হিংস্র জীব জন্তু থেকে রক্ষা করা বা গোষ্ঠীদ্বন্দে নিজেদের গোষ্ঠীকে রক্ষা করা যাদের কাজ তারা ক্ষত্রিয়। এর পর আধ্যাতিক জগতে প্রবেশ, সাধনার শুরু। ব্রহ্মজ্ঞান হলে তবেই ব্রাহ্মণ। জন্মসূত্রে যারা বাহ্মন হতে চায় তারা অজ্ঞান, চিরকালই তারা আসলে শুদ্রই থাকে। এর পর সমস্ত আশ-পাশ অর্থাৎ সমস্ত বাসনা ও জাগতিক বন্ধন নাস হলে, তবেই সন্যাস।
আর একটা ব্যাখ্যা শুনেছিলাম, সেটাও বলি। মানুষের শরীরকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। মানুষের পদদ্বয় হচ্ছে শুদ্র। যার উপরে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। অর্থাৎ পৃথিবী। যা আমাদের আধার। পৃথিবী ছাড়া মানুষের দাঁড়াবার জায়গা থাকবে না। তেমনি সমাজের ভীত্ এই শুদ্র সমাজ। পৃথিবী যেমন আমাদের নিঃশর্তে আশ্রয় দান করছে , জ্ঞানী-অজ্ঞানী, বড়-ছোটো, আমির-গরিব সবাই যেমন পৃথিবীর আশ্রয়ে বেঁচে আছে, সারা মনুষ্য সমাজ তেমনি শুদ্রদের আশ্রয়ে বেঁচে আছে। শুদ্র বিহীন সমাজ নিরাশ্রয়। তেমনি ক্ষত্রিয় সমাজ আমাদের রক্ষা করছে। হাত দুটো ক্ষত্রিয়ের প্রতিক। বাইরের আক্রমন থেকে শরীরকে বাঁচাবার জন্য আমাদের হাত দুটো আগে এগিয়ে যায়। হাতদুটো আমাদের রক্ষক। এই হাত দিয়েই আমরা খাই, অর্থাৎ শরীরকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয় সামগ্রী শরীরের কাছে পৌঁছে দেয় এই হাত। ক্ষয় থেকে যে ত্রাণ করে সেই ক্ষত্রিয়। শরীরের মস্তিস্ক ব্রাহ্মণ। আমাদের পাঁচ জ্ঞান ইন্দ্রিয় এই মস্তকে অবস্থিত। চোখ, কান, নাক মুখ, জিব্বা আমাদের মাথাতেই থাকে। এর দ্বারাই আমরা জ্ঞান সংগ্রহ করি। মস্তিস্ক বিহীন মনুষ্য হয় না। আমরা কাউকে মেরে ফেলতে চাইলে শরীর থেকে মস্তিস্ককে আলাদা করতে চাই। অমনি হাত দুটো বাধা দেয়। অদ্ভুত ব্যাপার দেখেন অন্য্ অঙ্গ এগিয়ে আসে না। যদিও পাদুটো অর্থাৎ শুদ্ররাও অবস্থাভেদে এগিয়ে আসে। কিন্তু প্রথমেই আসে হাত। তাই মস্তিস্ক আমাদের শরীরের প্রধান অঙ্গ। তাকে রক্ষা করা না গেলে আমরা মৃত। বৈশ্য আমাদের পেট, বুক বা বিতরণ কেন্দ্র। যে সমাজে বিতরণ ব্যবস্থা ভালো নেই, সেই সমাজ একপেশে হয়ে যায়। প্রসেসিং সেন্টার হচ্ছে আমাদের বুক-পেট। এখানেই সমস্ত কিছু পরিপাক হচ্ছে। বিতরণ হচ্ছে। তাই আমাদের সমস্ত শরীর পুষ্টি লাভ করছে। ক্ষত্রিয় অর্থাৎ হাতদুটো কিছু পেলে ব্রাহ্মণের কাছে নিয়ে যায়। অর্থাৎ মুখের কাছে, বা নাকের কাছে বা চোখের কাছে বা কানের কাছে নিয়ে যায়। আবার ব্রাহ্মণ কিছু পেলে, সে ধরে রাখে না। খাবার পেলে মুখে বেশিক্ষন থাকে না, পেটে চালান করে দেয়। ব্রাহ্মণ তাই ত্যাগী। কিন্তু ব্রাহ্মণকেই আগে দিতে হয়। হাত সব কিছু গ্রহণ করে, আর ব্রাহ্মণকে দিয়ে দেয়। ব্রাহ্মণ বৈশ্য অর্থাৎ পেট বুকে পাঠিয়ে দেয়। বৈশ্য সমস্ত শরীরকে বিতরণ করে। এটাই শরীরের বর্ণ ব্যবস্থা। এটা আমরা জন্ম সূত্রেই পাই। কিন্তু এটাকে তথাকথিত পন্ডিতরা নিজেদের স্বার্থে অপ-ব্যাখ্যা করে নিজেদেরকে উচ্চ স্থান দেবার হাস্যস্কর চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাদের এর থেকে বেরোতে হবে।
যাই হোক এইসব কথা আমি কারুর বিশ্বাসে বা সংস্কারে আঘাত দেবার উদ্দেশ্যে বলছি না। আমার কাছে যেটা সত্য বলে মনে হয়েছে, সেই কথাগুলোই ব্যক্ত করেছি মাত্র। তবে আমি এ কথাও বিশ্বাস করি, মানুষ তার পূর্ব-পূর্ব জীবনের সংস্কার নিয়ে জন্মায় । এবং আমাদের সংকল্প পূরণের জন্য, আমরা আমাদের পিত-মাতা বেছে নেই। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যোগী সিদ্ধি লাভ করবার আগে যদি, দেহ ত্যাগ করেন, তবে তিনি উপযুক্ত পরিবেশে, উপযুক্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করে থাকেন। সেখানে সে তার সংকল্প পূরণের জন্য, সমস্ত সুযোগ সুবিধে পান। তাই আমরা দেখি, গায়কের ঘরে গায়কের জন্ম হয়। শিল্পীর ঘরে শিল্পীর জন্ম নেয় । কিন্তু ব্রাহ্মণের ঘরে জন্ম নিয়ে যদি আমরা ব্রাহ্মণের যা উদ্দেশ্য অর্থাৎ ব্রহ্মত্ত্ব লাভের চেষ্টা করা, সেটা না করে, সমস্ত জীবন শুধু বংশ-মৰ্য্যাদার কথা ভেবে নিয়ে, অহংকারের বশে অন্যকে ছোট-করে দেখি, তবে আমরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছি। আর এই অহমিকার মধ্যে কোনো কৃতিত্ত্বও নেই।
যাইহোক, মহর্ষি অষ্টাবক্র কিন্তু সমাজের প্রচলিত ধারণাকে নষ্ট করে বললেন তুমি স্বয়ং বিভু - তুমি না বিপ্র অর্থাৎ জ্ঞানী না আশ্রমবাসী সাধক। তুমি বনাশ্রমের উর্ধে। তুমি না কারোর সঙ্গী না কেউ তোমার সঙ্গী। তুমি আকারবিহীন , তুমি কেবল সাক্ষী। এ সব কথা শোনার পরে রাজা জনক নাচতে শুরু করেছিল, - আমি উম্মুক্ত। পৃথিবীর পৃষ্ঠে কিলবিল করা দেহ আমি নোই। আমি পূর্ণ। আমি সর্বত্র। আমি বিরাট। আমি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। আমি ছোট নোই। আমি বড়ো নোই।
তবে আমাদের মতো সাধারনের মানুষের কাছে এগুলো - বই পড়া বিদ্যা - আমাদের কাছে এগুলো, পরের পকেটের টাকা। পরের ঘরের ধন, এ দিয়ে কোনো কাজ আমাদের হয় না। বই পড়ে, বা কারুর কাছে থেকে শুনে প্রাথমিক জ্ঞান পাওয়া যায়। কিন্তু যতক্ষন অন্তর দিয়ে উপলব্ধি না করতে পারছি, অপরোক্ষ জ্ঞান যতক্ষন না হচ্ছে, ততক্ষন এই জ্ঞান শুষ্ক-মলিন ফুল মাত্র । অষ্টাবক্রের কাছ থেকে রাস্তার সন্ধান পেলে, এবার বেরিয়ে পড়ো, খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এস, রাস্তা ধরে এগিয়ে চলো। তবেই লক্ষে পৌঁছাবে।
অষ্টাবক্র মুনি সত্য বলছেন। তুমি তা বুঝলে কি বুঝলে কি না, তাতে তার কিছু আসে যায় না। তুমি অষ্টাবক্রর কথা বিশ্বাস করলে কি করলে না, তাতে তার কিছু আসে যায় না। শ্রীকৃষ্ণ সমাজ সংস্কারক ছিলেন, সমস্ত স্তরের মানুষের কথা ভেবে তাকে কথা বলতে হতো, তাই তার মুখে সব সময় সমন্নয়ের কথা শুনি। সবাইকে তিনি সুযোগ দিতেন, সংশোধিত হবার। তিনি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলেন। তুমি যা চাও, তুমি যা শুনতে চাও, তোমার মনের মধ্যে যা আছে, তিনি তাই বলেন। তাই তুমি মন্ত্ৰমুগ্ধ হয়ে শোনো। বিশ্বাস করো। বাহবা দেও।আসলে তুমি যেখানে আছো, তিনি সেখান থেকে শুরু করতে বলেন। তিনি সত্যকে নিজের কাছে রাখেন। তিনি কর্ম যোগের কথা বলেছেন, যা আমরা বুঝবো। যা আমাদের কাছে ব্যবহারিক সত্য। যখন কর্মযোগের কথা বলছেন, তখন সেটাকেই শ্রেষ্ট সাধন পথ বলছেন। আমরা খুশি হয়েছি। আবার তিনি জ্ঞান যোগের কথা বলছেন, যে জ্ঞানকে আমরা নিজেরাই শ্রেষ্ট বলে মনে করি। আমাদের সমাজ তো জ্ঞানীকেই শ্রেষ্ট বলে মনে করে। এবং আমরাও তাই শ্রীকৃষ্ণের মুখে যখন শুনি, তিনি যখন বলেন, জ্ঞান যোগ শ্রেষ্ট , তখন আমরা তার কথা সহজে মেনে নিতে পারি। শ্রীকৃষ্ণ আবার ভক্তি-যোগের কথা যখন বলছেন, এবং ভক্তিযোগকে শ্রীকৃষ্ণ যখন শ্রেষ্ট বলছেন, তখনও তা আমরা মেনে নিয়েছি। আসলে আমরা-তো ভক্তকে ভালোবাসি। তোষন আমাদের সমাজের অঙ্গভূষণ। কে না তোষন পছন্দ করে ? তাই আমরা শ্রীকৃষ্ণের কথা মেনে নেই, ভক্তই শ্রেষ্ট।
কিন্তু অষ্টাবক্র সত্য বলছেন, যা আমাদের মেনে নেওয়া কঠিন। যা আমাদের স্মৃতি থেকে মুছে গেছে, তা আমরা বিশ্বাস করবো কি করে ? তাই অষ্টাবক্রর কথা আমরা বুঝতে পারি না, মানতে পারি না । কিন্তু সত্যকে বুঝতে গেলে, সত্যকে জানতে গেলে, সত্যের মুখোমুখি হতে হবে, ঋষি অষ্টাবক্রর কথা আমাদের অনুধাবন করতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে। বারবার তার কথার অনুধ্যান করতে হবে, তবেই আমরা অষ্টাবক্রের উক্তির যথার্থতা আমাদের ধারণায় আসবে। রাজা জনকের জায়গায় আমাদেরকে নিয়ে যেতে হবে।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
অষ্টাবক্র গীতা - নবম ভাগ।
ঋষি অষ্টাবক্র বলছেন
:ন ত্বং বিপ্রাদিকো বর্ণো ন আশ্রমী ন অক্ষগোচরঃ
অসঙ্গঃ অসি নিরাকারো বিশ্বসাক্ষী সুখী ভব। (১/৫)
ন ত্বং বিপ্রাদিকো বর্ণো ন আশ্রমী ন অক্ষগোচরঃ
তুমি জ্ঞানী নও, তুমি কোনো বর্ণাশ্রমের মধ্যেও আবদ্ধও নও। এই সম্পর্কে আমরা আগের দিন শুনেছি। এর পরে বলছেন, তুমি অক্ষগোচর নও। অর্থাৎ চর্ম্মচক্ষুতে আমাকে দেখা যায় না। অর্থাৎ আমি আমাকে দেখতে পারি না, আবার আমাকে কেউ দেখতে পায় না।
আমরা চক্ষুর অগোচর। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলতেন, ঈশ্বর কেমন জানো, সচ্চিদানন্দ সমুদ্র - কুল কিনারা নেই, এই সমুদ্রের জল ভক্তি-হিমে বরফ হয়, আবার জ্ঞান সূর্য উঠলে, বরফ গোলে যায়, আসলে আমরা জানি, আলোর প্রতিফলনে বস্তু দৃশ্যমান হয় । তো যিনি সচ্চিদানন্দ তার উপরে আলো ফেলবে কে ? তাই ঠাকুর বলছেন, সাধকের ভক্তি-রূপ হিম ঈশ্বরকে আকার দিতে পারে, কিন্তু জ্ঞানরূপ আলো তাকে স্ব-রূপে প্রতিষ্ঠিত করে। অষ্টাবক্র গীতা আসলে জ্ঞানের প্রদীপ। তাই এখানে
এখনকার বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরা মা-বাবা থেকে বাইরে থাকে, তা সে পড়াশুনার জন্য হোক, বা চাকরিসূত্রে হোক। তাদের গতিবিধির উপরে আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কি খাচ্ছে, কেমন আছে, আমরা জানতে পারি না। তাদের শরীর খারাপ হলেও আমরা কিছু করতে পারি না। কেবল উৎকন্ঠায় কেটে যায় আমাদের দিনগুলো। আমরা আসলে সবাই অসহায়। ঘটনা ঘটে আমরা শুনতে থাকি, দেখতে থাকি। নীরব সাক্ষী হয়ে যাই। \
একটা ঘটনা বলি। আমার বাবা ডাক্তার ছিলেন। রুগীদের কাছে, রুগীর পরিবারের কাছে তিনি ছিলেন অভিভাবক সম। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু ছিল না। তিনি সবসময় রুগী-অন্ত প্রাণ ছিলেন। সকাল সন্ধে দিন রাত্রি বলে কিছু ছিল না। গভীর রাতেও, বাবাকে বার বার ছুটে যেতে দেখেছি, রুগী দেখতে। এমনকি নিজের অসুস্থতার মধ্যেও তাকে রুগীর সেবা করতে দেখেছি। এই বাবা একদিন সন্ধ্যের বেলা চেম্বারে রুগী দেখতে গেলেন না। বাড়িতে আমার ছোট ভাই "মনা" কয়েকদিন ধরে অসুস্থ। মনার বয়েস তখন ৭/৮ বছর হবে।কি হয়েছিল তা জানিনা। কিন্তু সেই রাতেই ভাই দেহ-ত্যাগ করলো। আমরা তখন গভীর ঘুমে ডুবে আছি । ভোর বেলা উঠে দেখি, বাবা ভাইয়ের নিস্প্রান দেহকে কোলে করে, বসে আছেন। বাবার চোখে জল। বাবা রাশভারী মানুষ ছিলেন, শত শত বিপদের সামনেও যিনি ছিলেন স্থির-অচঞ্চল। বাবাকে গলাছেড়ে হাসতে দেখিনি কখনো, কাঁদতেও দেখিনি কখনো । সেদিন তাকে প্রথম ও শেষবারের মতো কাঁদতে দেখেছিলাম। ডাক্তার হবার সুবাদে বাবাকে অনেক মৃত্যুর সাক্ষীও হতে হয়েছে। বাবা অনেক মৃত্যুর সাক্ষী কিন্তু বাবাকে দেখেছি, নির্ভিক-নিস্পৃহ থেকে কর্তব্য পালন করে যেতে। যিনি ডাক্তার, যিনি অন্যদের রোগের প্রশমন করেন, সেই ডাক্তার-বাবার ছেলে মারা গেলো, বাবার চোখের সামনে ঘটনাটা ঘটলো, বাবা দর্শকের মতো, চেয়ে চেয়ে দেখলেন। তার কিছু করবার ছিল না।
অসঙ্গঃ অসি নিরাকারো বিশ্বসাক্ষী সুখী ভব।
তুমি সঙ্গীহীন, তুমি নিরাকার, তুমি বিশ্বসাক্ষী - এই সত্য জেনে তুমি সুখী হও।
আচার্যদেব বলছেন, হে পুত্র তুমি নিঃসঙ্গ - তুমি আকারবিহীন - তুমি এই চলমান বিশ্বজগতের সাক্ষী মাত্র । নিঃসঙ্গতা, নিরাকরত্ত্ব এবং সাক্ষীভাব আমাদের স্বরূপ। আমাদের স্বভাবের মধ্যে নিহিত আছে এই সব গুন্।
নিঃসঙ্গতা : আমরা জানি এই জীবজগতে সঙ্গীবিহীন কেউ নেই। সঙ্গীবিহীন কেউ বাঁচতেও পারে না। আমরা এ'কে অন্যের উপরে নির্ভর করে বেঁচে থাকি। আবার এও ঠিক, আমাদের এক এক সময় বড্ড এক লাগে। আমরা কেউ নিঃসঙ্গ হতে চাই না। কিন্তু তবুও ভিড়ের মাঝেও যেন নিজেকে নিঃসঙ্গ লাগে।আর অষ্টাবক্র মুনি এক আশ্চার্য্য সত্য বলছেন, যে আমাদের স্বরূপ হচ্ছে নিঃসঙ্গতা। নানান কারনে মানুষের মধ্যে এই নিঃসঙ্গতা এক-এক সময় জেগে ওঠে। আমরা সংসারীরা শেষ পর্যন্ত হিসেবে মেলাতে পারি না। কোথায় যেন গন্ডগোল হয়ে যায়। এই নিঃসঙ্গতার আসল কারন হচ্ছে, আমাদের চাওয়া পাওয়ার মধ্যে অসংগতি। আমরা যা পাই তা চাই না। যা চাই তা পাই না। আর যা চাই তা ভুল করে চাই। এই যে চাওয়া পাওয়ার মধ্যে ব্যবধান, এটা আমাদের মধ্যে একটা অতৃপ্তি এনে দেয়। সমস্ত জীব জগতের মধ্যে এই নিঃসঙ্গতার প্রভাব ক্রিয়াশীল।
নিঃসঙ্গতা তিন রকম। সাংসারিক, আধ্যাত্মিক ও আবেগজনিত। এর মধ্যে আধ্যাত্মিক নিঃসঙ্গতা সদর্থক। আমরা সাধনার জন্য নিঃসঙ্গতাকে বেছে নেই। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলতেন, সাধন করবে, মনে, বনে, ও কোন। অর্থাৎ নিঃসঙ্গতা আমাদের ইষ্টের কাছে পৌঁছতে সাহায্য করে থাকে। আবেগপ্রবন নিঃসঙ্গতার রং-রূপ আবার আলাদা। এক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে একটা অভাববোধ স্বভাবের মধ্যে জড়িয়ে থাকে। এটা সদর্থক হতে পারে আবার নঞৰ্থক হতে পারে। বিজ্ঞানীর মধ্যে অভাববোধ, বা শিল্পীর মধ্যে অভাব বোধ তাকে শিল্প কার্য্য ও বিজ্ঞানীর ক্ষেত্রে অনুসন্ধানের কাজে সাহায্য করে থাকে। আবার প্রেমিকের কাছে এই অভাববোধ একটা অন্য মাত্রা এনে দেয়। অধরাকে ধরবার জন্য, মনের মানুষের কাছে যাবার বা তাকে পাবার জন্য একটা আকুলি-ব্যাকুলি ভাব তাকে নিঃসঙ্গ করে দেয়। সব আছে, কিন্তু কি যেন নেই। এই ভাবপ্রবণ নিঃসঙ্গতা মানুষকে অনেকসময় আত্মহননের পথে নিয়ে যায়। বুকের মধ্যে যেন রক্ত-ক্ষরণ হতে থাকে। সাংসারিক নিঃসঙ্গতা - আজ স্নেহ-ভালোবাসার মধ্যে বাণিজ্যের গন্ধ। বন্ধু বলুন বা বান্ধবী, স্বামী-স্ত্রী বলুন বা ছেলে-মেয়ে বলুন, সবাই যেন একটা হিসেবের খাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই একটা লাভ-ক্ষতির হিসেবে নিয়ে ব্যস্ত। হৃদয় বলে কিছু নেই, বিবেক বলে কিছু নেই। যার জন্য এতো করেছি, সে আজ আমাকে দেখতে পারে না। পারিবারিক জীবনে যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ছিল,, তা যেন শিথিল হয়ে গেছে। একসঙ্গে থেকেও সবাই যেন ছাড়া-ছাড়া। গতি আছে, অগ্রগতি নেই, আবর্তন আছে প্রবাহ নেই। আমাদের বাসস্থান এখন যেন কেবলমাত্র মাথা গোজার ঠাঁই। ইট-কাঠ-বালি-সিমেন্টের বাড়ি মাত্র। প্রাণ নেই। যন্ত্রের মতো হিসেবে মেলাতে ব্যস্ত সবাই । শুধু দাও-দাও, দেহি-দেহি রব সবত্র। রূপং দেহি, যশং দেহি, - বাড়ি দাও, গাড়ি দাও, কোটি-কোটি টাকা দাও। এই দাও দাও ভাব চিরকাল ছিল, এখনো আছে। আপনি যতই হিসেবে করে চলুন, আপনাকে একদিন অবশ্য়ই নিঃসঙ্গ হয়ে যেতে হবে। আসলে এটাই যে আমাদের স্বরূপ। নিঃসঙ্গতার থেকে বেরুবার জন্য আমরা অনেক উপায়ের অবলম্বন করতে পারি। কিন্তু সত্য হচ্ছে, আমাদের স্বরূপ হচ্ছে নিঃসঙ্গতা। আর নিজের মধ্যে আমরা যখন স্থিত হবো, তখন আমরা অবশ্য়ই নিঃসঙ্গতার সাথী হবো। আমাদের স্বরূপ তো আমরা ত্যাগ করতে পারবো। তাই আচার্য্যদেব বলছেন, তুমি আমার কথা শোনো, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করো, তুমি নিঃসঙ্গ - তুমি তোমার এই স্বরূপে যদি স্থিত হতে পারো, তবেই তুমি তোমার চিরসুখী ভাব অনুভব করতে পারবে।
ঋষি অষ্টাবক্র বলছেন, তুমি নিরাকার। চক্ষুর অগোচর। দেখুন আমি নিরাকার। এটা আমাদের কল্পনাও করা সম্ভব নয়। এই দেহে আমি স্থিত, আমি দেহ নোই, এটা আমাদের কাছে একটা দুঃস্বপ্নও বটে। কারন আমরা কেউ নিরাকার হতে চাই না। নিরাকার মানে তো মৃত্যু। এই স্থূল দেহের নাশ।তো আমিতো এই স্থুল দেহে থেকেই সমস্ত ক্রিয়া এমনকি চিন্তা ভাবনা করে থাকি। তো আমি নিরাকার আমার স্বরূপ নিরাকার একথা আমরা ভাবলেই শিউরে উঠি। কতো কতো সাধক যুগ-যুগান্তর ধরে, এই দেহের অমরত্ত্ব লাভের জন্য সাধনা করে চলছেন। এমনকি দেহের রোগ নিরাময়ের জন্য সাধনা করে চলেছেন। তো এটা যদি আমরা সঠিক ভাবে বুঝতে পারি, যে এই দেহ আসলে প্রকৃতির, প্রকৃতির নিয়মেই এর জন্ম-মৃত্যু ঘটে থাকে। এই দেহ আমার নয়, আর এই দেহের জন্য, সত্যিকারের আমার কিছুই করবার নেই। তাহলে আমরা নিশ্চিন্ত হতে পারতাম। কিন্তু তাতো আমরা পারি না। এই দেহ আমাদের সুখ দেয় , এই দেহ আমাদের কষ্ট দেয়। এই দেহই আমাদের সুখ-দুঃখের অনুভূতি দেয়। তো এই দেহভিন্ন আমি সেতো আমাদের অনুভবের বাইরে।
আমাদের এই দেহ আসলে একটা রঙ্গিন আলোর তরঙ্গ মাত্র। প্রতিনিয়ত এই তরঙ্গ সরে সরে যাচ্ছে। এটা আমাদের বোধগম্য নয়। এই তরঙ্গ আসলে এতটাই দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে, যে আমাদের চোখে এটা ধরা পড়ে না। আমাদের চোখে একটা অবয়ব নজরে পরে। তাই আমরা এটা স্থিতিশীল ভাবি। কিন্তু আমরা তো জানি, আমাদের দেহ অসংখ কোষের সমষ্টি মাত্র। এই কোষগুলোর আয়ু, কারুর কয়েক মুহূর্ত, করুন কয়েক ঘন্টা, কারুর কয়েকদিন, কারুর কয়েক মাস, কারুর কয়েক বছর মাত্র। আর এই কোষের অন্তিম আয়ু সবথেকে বেশি হলে, ৭ বছর । তো ৭ বছর পরে, আমরা সবাই একটা নতুন দেহ পাই। তাই ৭-১৪-২১-২৮ এই বয়সগুলো প্রত্যেক মানুষের গুরুত্ত্বপূর্ন সময়। ৭ বছরে আমরা শৈশব থেকে বাল্যে উপস্থিত হই। ১৪ বছরে আমরা কৈশোরে পদার্পন করি , ২১ বছরে আমরা পূরণ যুবক হয়ে যাই। আর ২৮ বছর বয়সে আমাদের বৃদ্ধির পূর্নতা প্রাপ্তি হয়। ২৮ বছরের পরে আমাদের আর শারীরিক বৃদ্ধি হয় না। এমনকি আমাদের মানসিক গঠনের পূর্নতা এসে যায় এই সময় । ২৮ বছরের যুবকের মধ্যে যে ব্যক্তিত্ত্বের জন্ম নেয়, তা আর সহজে পরিবর্তন হয় না। তো সত্যকে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে, যে আমাদের দেহ প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। তো পরিবর্তনশীল সত্ত্বা আমি নোই। টা যখন আমরা বুঝতে পারবো, তখন আমাদের মধ্যে একটা দেহাতীবোধ উৎপন্ন হবে।দেহের উর্দ্ধে কিছু একটা আমি সেটা বুঝতে পারবো। আমি যে দেহ অতিরিক্ত কিছু, সেটা তখন আমি উপলব্ধি করবো। আর এই উপল্বদ্ধিতে আমি যখন পৌঁছতে পারবো, তখন আমি তখন আমি স্বরূপে স্থিত হবো। আর স্বরূপ যেহেতু একটা আনন্দময় সত্ত্বা, তাই আমরা একটা অহেতুক আনন্দের মধ্যে ডুব দেব। একটা কথা বলি, আপনি যাকেই আপন ভাবেন, তার জন্যই আপনার সুখ-দুঃখ অনুভব করবেন। আপনি একটা বোতলকে যদি নিজের ভাবেন, তবে বোতলটা ভেঙে গেলে আপনার কষ্ট শুরু হবে। ঠিক তেমনি আপনি যাকে আপন ভাবছেন, যেমন মা-বা-ভা-বোন-স্ত্রী-পুত্র-পরিবার এমনকি আপনার গৃহে পালিত পশুকে যদি আপনি আপন ভাবেন, তখন আপনি তাদের সুখ দুঃখের সঙ্গে নিজেকে এক করে দেখতে শুরু করবেন। এবং আপনার সুখ দুঃখের অনুভূতি শুরু হবে। এবার আরো একটু গভীরে ভাবুন, আমরা সবাই সবচেয়ে বেশি ভালো বাসি, নিজেকে। আর নিজেকে বলতে আমরা ভাবি আমাদের এই দেহকে। তো এই নশ্বর দেহ, পরিবর্তনশীল দেহে সর্বদা পরিবর্তন হতেই থাকবে। এই দেহে রোগাদি বাসা বাঁধবে, দেহ শিশু থেকে বার্ধক্যে পৌঁছবেএবং একসময় এই দেহের নাশ বা মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। তো আমি যদি দেহকে আঁকড়ে থাকি, আমার সারা জীবন সুখ-দুঃখের মধ্যে দিয়েই যেতে হবে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, এই দেহ আমি নোই। এই দেহটা আমি আশ্রয় করেছি মাত্র। এই দেহ নাশ হয়ে গেলে, আমি আবার আমার কর্ম্ম অনুযায়ী দেহ লাভ করবো। তো দেহ থেকে দেহান্তরের যে ভ্রমন এই প্রক্রিয়া আমার চলতেই থাকবে। অষ্টাবক্র মুনি এই দীর্ঘকালীন যে প্রক্রিয়া অর্থাৎ দেহ থেকে দেহান্তরে আমার যে ভ্রমন, এখান থেকে এখনই আজই বেরিয়ে আসতে বলছেন। বলছেন, তুমি দেহ নও। তুমি আত্মা - তুমি সৎ-চিৎ-আনন্দ স্বরূপ। এই চিরসত্য জেনে তুমি চিরসুখী হও। তোমার কোনো আকার নেই, তোমার কোনো রূপ নেই, কোনো রূপের মধ্যে তুমি আবধ্য নও। তুমি নিরাকার।
এর পরে অষ্টাবক্র মুনি বলছেন, তুমি বিশ্বসাক্ষী। অর্থাৎ তোমার সামনে যা কিছু ঘটছে, তার তুমি নিয়ন্ত্রক নও, তুমি তার দর্শক মাত্র। তোমার কিছুই করবার নেই। তুমি দ্রষ্টা। ঘটনা প্রকৃতির নিয়মে, ঘটবে। তুমি তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছো, তাই তোমার কষ্ট হচ্ছে, তুমি আসলে নিষ্ক্রিয়। তোমার কিছুই করবার নেই। অন্তিমে সেই কথা আমাদের কাছে উপলব্ধ হয়। তার আগে আমরা সেটা বুঝতে পারি না।
ঘটনা ঘটে আমরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি। আমরা ভাবি আমাদের জন্য, ঘটনা ঘটছে। আমরা ভাবি আমরাই ঘটনা ঘটাচ্ছি। আমরা হাসি কাঁদি গাই, কিন্তু আমরা জানি না, এইসব ঘটনার নিয়ন্ত্রক আমরা নোই। আমরা শুধু নিদেরকে সম্পৃক্ত করে থাকি। আর সুখ দুঃখের ভাগিদার হয়ে যাই। ঋষি অষ্টাবক্র মুনি বলছেন, তুমি এই চলমান বিশ্বের সাক্ষী মাত্র। তুমি নিষ্ক্রিয়, নিস্পৃহ। এই সত্য যখন আমাদের উপলব্ধিতে আসবে, তখন আমরা আমার স্বরূপে স্থিত হবো আর, আমরা চিরসুখী হতে পারবো।
আজ এইপর্যন্ত বাক্যের বিরাম দিলাম।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
অষ্টাবক্র গীতা - দশম ভাগ। তুমি কোনো কর্ম্মের কর্তা নও।
অসম্ভব অনুভূতি সম্পন্ন এই মহামুনি অষ্টাবক্র জন্ম জন্মান্তের পণ্ডিত। জন্মের আগেই মাতৃগর্ভে তার জ্ঞানের প্রকাশ হয়েছিল। পিতা ও পিতামহ যখন বেদবিদ্যা ছাত্রদের শেখাতেন তা শুনে শুনে অষ্টাবক্র বেদবিদ্যা আয়ত্ব করে ফেলেছিলেন। ফলে পিতা কাহোড় যখন বেদমন্ত্র উচ্চারণে ত্রূটি করতেন তা অষ্টাবক্রের কাছে স্পষ্ট হয়ে যেত। মাতৃগর্ভে থাকাকালীন , একদিন পিতা যখন শিষ্যদের বেদ পাঠ করে শোনাচ্ছিলেন তখন মাতৃ-গর্ব্ভ হতে অষ্টাবক্র বলে উঠলেন : হে পিতঃ, আপনার কৃপায় আমি মাতৃ গর্ভে বসেই সমস্ত বেদ ও সমস্ত শাস্ত্রজ্ঞান লাভ করেছি। বেদমন্ত্র উচ্চারণে আপনার ত্রূটি হচ্ছে। প্রথমে কেউ বুঝতে পারেনি কে এই সাবধান বাণী উচ্চারণ করছে। কোথা থেকে ভেসে আসছে এই শাসনবাণী। যখনি কহোড় বেদমন্ত্র উচ্চারণে ত্রূটি করছিলেন তখনি অষ্টাবক্র ত্রূটি সংশোধন করে দিচ্ছিলেন। অহংকারী পণ্ডিত শাস্ত্রজ্ঞ কহোড় শিষ্যসম্মুখে এই বেদ উচ্চারণের ত্রূটি প্রদর্শন ভালোভাবে নিতে পারলেন না। যখন বুঝতে পারলেন সুজাতার গর্ভস্থ শিশুই এই অনাধিকার চর্চা করছে, তখন আর ধৈর্য্য রাখতে পারলেন না।......... বললেন :
"আমারই ভবিষ্যৎ সন্তান, যে এখনো পৃথিবীর আলো দেখেনি তার এতো বড় স্পৰ্ধা - আমাকে,পণ্ডিত কহোড়কে বেদমন্ত্র উচ্চারণের ত্রূটি শোনাতে চাইছে ? ও জানেনা আমি কত বড় পণ্ডিত, কতবড় শাস্ত্রজ্ঞ্। সর্বপরি আমি ওর পিতা. জন্মের আগেই আমাকে অপমান করার সাহস ও পায় কোত্থেকে ?"
রেগে গেলে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না. কহোড়মুনি রেগে গিয়ে অভিশাপ দিলো : " রে মূর্খ, তুই যতবার আমাকে মন্ত্র উচ্চারণের ত্রূটি শোধরাবার মতো দঃসাহস দেখিয়েছিস তোর অঙ্গ ততো জায়গায় খণ্ডিত হোক " ।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, প্রাচীন মুনি ঋষিগণ এতো জ্ঞানের অধিকারী হয়েও, তাঁরা তাদের ইন্দ্রিয়গুলোকে দমন করতে পারেন নি ? কথায় কথায় তারা রেগে যেতেন। মান অপমান জ্ঞান তাদের টনটনে ছিল। আবার এই রাগের বশে যে কাজ করতেন,অর্থাৎ কথায় কথায় যে অভিশাপ দিতেন, তার জন্য পরে তাঁরা অনুতাপও করতেন। এমনকি অভিশাপের প্রতিকারের কথা বলতেন। তো কথায় কথায় যারা রেগে যান, যারা মান-অপমানকে সমজ্ঞান করতে পারেন নি। অথচ তাদের জ্ঞান ও ক্ষমতা ছিল অসীম।
যাই হোক : কহোড়ের অভিশাপ ফলে গেল - যে হেতু আট বার সাবধান বাণী উচ্চারণ করে ছিলেন তাই - দেখা গেল অষ্ট -অঙ্গ বিকৃতি নিয়ে সুজাতার সন্তান হলো। এই অষ্ট - অঙ্গ বিকৃতির কারণেই তার নাম অষ্টাবক্র বলে খ্যাত হলো। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে মানুষের কি তাহলে ভ্রূণ অবস্থা থেকেই জীবের শিক্ষা শুরু হয়ে যায় ? শুনেছি - মা-বাবার মিলনক্ষন, উন্মত্ত অবস্থায় মিলন, মিলন ও গর্ভকালীন সময়ে মায়ের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা সন্তানের উপরে প্রভাব ফেলে। অষ্টাবক্রর ক্ষেত্রে এই প্রভাব কতটা সত্য ? আসলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চৈতন্য শক্তি আমাদের স্থূল শরীরে প্রবেশ করে ৪৪-৫০ দিনের মধ্যেই। কিছু ব্যতিক্রম আছে, যেখানে ৮৪-৯০ দিনের মধ্যে হয়। এই ৯০ দিনের মধ্যেই যদি শরীরে চৈতন্যশক্তি প্রবেশের উপযুক্ত না হয়, তবে সেই শরীর মায়ের গর্ভেই মৃত বলে ধরে নেওয়া হয়। অবশ্য এই সময় সে মায়ের প্রাণশক্তির মাধ্যমে চৈতন্য শক্তির প্রবাহ গ্রহণ করে থাকে। এর পরে যখন সে মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসে তখন তার নিজস্ব প্রাণশক্তির ক্রিয়া শুরু হয়। আর চৈতন্যই জ্ঞান। মাতৃগর্ভেই মানুষ চেতনা পেয়ে থাকে। তাই মায়ের ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে সে জ্ঞান সংগ্রহ করতে পারে। সেটাই আমরা দেখতে পারি ঋষি অষ্টাবক্রের ক্ষেত্রে।
তবে এই "আট " শব্দটির একটা মাহাত্ম আছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অষ্টমীতে জন্ম গ্রহণ করে ছিলেন। ভগবান বুদ্ধ, মায়ের অষ্টম পদক্ষেপে গর্ভ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। অর্থাৎ মা "মায়া" লুম্বিনীর জঙ্গলে গর্ভ যন্ত্রনায় ছটফট করছেন। না পারছেন, বসতে, না পারছেন শুতে, না পারছেন দাঁড়াতে। মা অসহ্য যন্ত্রনায় ছোটাছুটি শুরু করলেন, আর ঠিক অষ্টম পদক্ষেপে বেরিয়ে এলেন, ভগবান বুদ্ধ। আমাদের আটটি পাশ - লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, শঙ্কা, জিগীষা, জাতি, কুল, মান। এই অষ্টপাশে আমরা আবদ্ধ। এছাড়া আছে অষ্টবসু, অষ্টসিদ্ধি, অষ্টসাত্ত্বিক, অষ্টশক্তি ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই আটের একটা আলাদা গুরুত্ত্ব আছে।
ধর্ম্মাধর্ম্মৌ সুখং দুঃখং মানসানি ন তে বিভো
ন কর্তা অসি ন ভোক্তা অসি মুক্ত এব অসি সর্বদা। (১/৬)
- ধর্ম্ম-অধর্ম্ম, সুখ-দুঃখ মনের ধৰ্ম , বিভো-তে এসব নেই।
(তুমি ) কর্তা নও ,ভোক্তা নও , সর্বদা মুক্ত।
আমাদের সমস্ত ইন্দ্রীয়-কৃত-কর্ম্মের রাজা হচ্ছে মন। আমরা সুখ-দুঃখ অনুভব করি আমাদের ইন্দ্রিয় দ্বারা। অর্থাৎ চক্ষু, কর্ন , নাসিকা, জিব্বা, ত্বক - এগুলো দ্বারা আমরা সুখ বা দুঃখের অনুভূতি পাই। আর এই ইন্দ্রিয়াগুলোকে পরিচালনা করে মন। তাই সুখ দুঃখের অনুভব আমাদের মনের সঙ্গে সম্পর্কিত। এটা মনের খেলা মাত্র। মনটাকে যদি বোঝো, চঞ্চল মন যদি তোমার অধীন থাকে, তবে তুমি এই মন-এ প্ৰতিফলিত সুখ দুঃখ তোমাকে স্পর্শ করবে না।
আমি ভালো কাজ করে ধার্মিক হয়ে যাই। আর সুখী হই। আর খারাপ কাজ করে আমি অধার্মিক হয়ে যাই, দুঃখী হয়ে যাই। কারন আমার মনে এই ধারণা গেথে আছে যে অধার্মিক হাওয়া পাপ। ধার্মিক হওয়া পুন্য। তাই কেউ অধার্মিক হলে তাকে আমরা শাস্তি দিতে চাই, ধার্মিক হলে তাকে পুরস্কৃত করতে চাই। এগুলো আসলে ধর্মান্ধতা। ধর্ম্ম সম্পর্কে অজ্ঞানতা।
অষ্টাবক্র মুনি বলছেন :তুমি কর্তা নয় ভোক্তা নয় । তাহলে আমার আবার সুখ-দুঃখ কিসের ? তুমি সর্বদা মুক্ত। কর্তারাই ভোক্তা আবার ভোক্তারাই কর্তা হয়। কর্তা -ভোক্তা এই জ্ঞান তোমাকে সুখ-দুঃখের অনুভূতি এনে দেয়। এখান থেকে বেরিয়ে এস। তুমি সদাই মুক্ত। তোমার মুক্তি পাবার কী আছে। যার বাঁধন আছে তার মুক্তি আছে. যার বাঁধন-ই নেই তার আবার মুক্তি কি ? যে নিজেকে কর্তা ভাবে, অর্থাৎ আমি করছি এই ভাব যার মধ্যে জেগেছে, সেই কর্মের জালে ফেঁসে গেছে। আর সুখ দুঃখের কীর্তন বা বিলাপ করছে।পাওয়া-না-পাওয়ার দুঃখ কষ্ট ভোগ করছে। আসলে তুমি কর্তা নও এই কথাটা শুধু বোঝার দরকার, । যা কিছু করছ, তা তোমার কর্ম নয়, তুমি করছও না। এই শরীর দ্বারা কৃত, মন দ্বারা পরিচালিত কর্ম তো তোমার নয়। কর্মতো করছে প্রকৃতি। তুমি সাক্ষী মাত্র। তাহলে তুমি এর ভালো-মন্দ কোনোটারই ভাগিদার নয় । তুমি না কর্তা না ভোক্তা। তুমি তোমাতেই আছো। তোমার না বন্ধন না মুক্তি।
যে মুহূর্তে তুমি বুঝতে পারবে, যে ধর্ম অধর্ম বলে কিছু নেই, তুমি ধার্মিক হতেও পারো না, আবার অধার্মিক হতেও পারো না, এগুলো আমাদের মনের ভ্রম মাত্র সেদিন তুমি সুখী হয়ে যাবে। আমরা ভাবি, আমার যে জ্ঞান, আমর যে অজ্ঞান, আমার যে প্রতিপত্তি, আমার যে সন্মান, আমার যে অভাব, আমার যে দুঃখ আমার যে সুখ, সবই আমার স্বকৃত কর্ম্মের ফল। এই ধারণাটাই ভ্রান্ত। একটু গভীর ভাবে ভেবে দেখলে আমরা বুঝতে পারবো, এগুলো কর্ম্মফল সন্দেহ নেই, কিন্তু আমার ইচ্ছেতে হয় নি, আমি চেয়েছি তাই হয়েছে এমনটা নয়, আসলে তখন আমার যে মনের অবস্থা ছিল, তাতে আমি এসব না করে পারতাম না। আমাকে করতেই হতো। কেউ যেন আমাদে দিয়ে এসব করিয়ে নিয়েছে, আর আমরা সেই কৃতকর্মের ফল ভোগ করে যাচ্ছি। আর এটা যদি সত্য হয়, যে আমাকে দিয়ে কেউ একজন কিছু করিয়ে নিচ্ছে, তবে আমি কেন এর ফল ভোগ করতে যাবো ? যিনি আমাকে দিয়ে এইসব করিয়েছেন, ফল তো তারই হওয়া উচিত। যে মুহূর্তে আমি বুঝতে পারবো, আমার উপল্বদ্ধিতে আসবে, যে যাকিছু ঘটেছে, তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই, তবে সেইমুহূর্তেই আমি মুক্ত হয়ে যাবো। সুখ বা দুঃখ তা সে মানসিক হোক বা শারীরিক হোক, সবই অন্য কোথাও ঘটছে, আমার সঙ্গে নয়। তোমার শরীর যদি জড় হয়ে যায়, চৈতন্যহীন হয়ে যায়, তখন তোমার আর শারীরিক সুখ-দুঃখ বোধ থাকবে না। শরীরবোধ হারিয়েছে যে শরীর বা তার অঙ্গ, তার কোনো শারীরিক ব্যথা-যন্ত্রনা বা সুখানুভূতি থাকে না। ঠিক তেমনি মন যদি মুঢ় হয়ে যায়, মনের সুখ-দুঃখ বলে কিছু থাকবে না।
একো দ্রষ্টাসি সর্বস্য মুক্ত প্রায়ঃ অসি সর্বদা
অয়মেব হি তে বন্ধো দ্রষ্টারং পশ্যসীতরম্। (১/৭)
- তুমি সর্ব শরীরের একমাত্র ব্যাপক দ্রষ্টা, দেহাধ্যাস বসতঃ বন্ধ প্রতীয়মান হলেও তুমি আসলে মুক্ত। তথাপি আত্মাকে দেহাদি পরিচ্ছিন্নরূপেই তুমি জেনে থাকো, এটিই তোমার বন্ধন।
মহামুনি এবার, মানুষ নিজেকে কিভাবে বন্দী করে ফেলে, সেটাই বলছেন। আমরা আত্মাকে দেহ ভাবি। গুটিপোকা যেমন নিজ মুখ নিঃসৃত লালা থেকে নিজেকে আছন্ন করে ফেলে, তরল লালা আস্তে আস্তে কঠিন পদার্থের রূপ নেয় , জীব তেমনি বাসনা বা ইচ্ছা রূপ লালা দিয়ে নিজেকে আছন্ন করে ফেলে। এই বাসনাই আস্তে আস্তে রূপ পরিগ্রহ করে। এবং অজ্ঞানতাবশে দেহ -কেই আত্মা মনে করে. এবং দেহে অবস্থিত ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধ সুখ দুখঃ নিজের বলে ভাবতে শুরু করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গুটি পোকা যেমন বাসা কেটে বেরিয়ে পড়ে, আত্মাও তেমনি দেহ থেকে বেরিয়ে পড়ে। একেই আমরা মৃত্যু বলি। জন্মই বন্ধন - মৃত্যুই মুক্তি। দেহের মধ্যে থেকেও যিনি স্বয়ংকে কে জ্ঞাত হন বা জ্ঞাত থাকেন তিনিই দেহাতীত মুক্ত পুরুষ।
অহং কর্তা ইতি অহং মানো মহাকৃষ্ণ-অহি দংশিতঃ
নাহং কর্তেতি বিশ্বাস-অমৃতং পীত্বা সুখী ভব। (১/৮)
-আমি কর্তা এই অহঙ্কাররূপ মহান কৃষ্ণ সর্প কর্তৃক দংশিত হয়েছে।
আমি কর্তা নই এই বিশ্বাস রূপ অমৃত পান করে তুমি সুখী হও।
শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ বলতেন : "যতক্ষন অহংকার ততক্ষন অজ্ঞান। অহংকার থাকতে মুক্তি নাই। গরুগুলো হাম্মা হাম্মা করে, আর ছাগলগুলো ম্যা ম্যা করে। তাই ওদের এত যন্ত্রনা। কষায়ে কাটে চামড়া দিয়ে জুতো বানায় ঢোলের চামড়া তৈরি করে, যন্ত্রনার শেষ নাই। হিন্দিতে হাম মানে আমি আর ম্যায় মানেও আমি। আমি আমি করে বলে কত কর্ম ভোগ। শেষে ধুনুরীর তাঁত তৈরি করে। তখন ধুনীর হাতে তুঁহু তুঁহু বলে , অর্থাৎ তুমি তুমি। তুমি তুমি বলার পরে তবে নিস্তার। (শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত পৃ : ১৪) .
অষ্টাবক্র মুনি বলছেন, অসীমের মতোই বন্ধনহীন তুমি। মুক্ত হবার যে বাসনা এটাই মানুষের বন্ধন। সাপে কামড়ালে সারা শরীরে যেমন জ্বালা অনুভব হয়, তেমনি শরীরের কোষে কর্তৃত্ত্বভাব রূপ বিষ ছড়িয়ে পড়েছে, আমাদের অন্তরে অহংভাব, অষ্টপাশ মলিন করেছে আত্মাকে, তাই আমরা বন্ধন জ্বালায় কষ্ট পাচ্ছি। জীবন একটা স্রোতস্বীনি নদী, সুখ-দুঃখ রূপ ঢেউ তুলতে তুলতে এগিয়ে চলেছে।
কখনো তুমি সুখী, কখনো তুমি দুঃখী। চলমান এই জীবনে শুধু সুখ বা শুধু দুঃখ সম্ভব নয়। তুমি চাইলেও চিরস্থায়ী দুঃখ যেমন তুমি পেতে পারো না, তেমনি চিরস্থায়ী সুখও তুমি পেতে পারো না। জীবন-নদী আপন গতিতে বেয়ে চলবে, সুখ-দুঃখ-রূপ ঢেউ তার সঙ্গী, একে তুমি অস্বীকার করতে পারো না। এর থেকে বেরুতে গেলে অশান্ত জীবন নদীকে শান্ত করতে হবে। আর এটা করবার অষ্টাবক্র মুনি বলছেন, নাহং কর্তেতি - অহং কর্তা ন ইতি -বিশ্বামৃতং প্রীত্বা সুখী ভব - বিশ্বাস অমৃতং পীত্বা সুখী ভব। আমি কর্তা নোই, এই জ্ঞানরূপ অমৃত পান করে, অর্থাৎ অনুভব করে পরমানন্দ লাভ করো।
আসলে আমরা ভাবি, আমিই সব করছি। এবং এটাও মানি যে আমার কর্মের ফল আমিই ভোগ করবো। আসলে আমার ভাবনাটাই আমাকে কর্ম ফল ভোগ করায়। আমি কর্তা, অর্থাৎ আমি করছি, এই ভাবনা আমাদের কর্মফল ভোগ করায় । এই ভাবনাই আমাদের সর্পের ন্যায় দংশন করছে। এই ভাবনা থেকে আমি যদি সরে যেতে পারি, তবে আমরা কর্মফল থেকে মুক্তি পেতে পারি। এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে সব কিছুই আপন গতিতে বয়ে চলেছে। দেখো তোমার শরীর আপন গতিতে কেমন শিশু থেকে বালক, বালক থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন, যৌবন থেকে প্রৌঢ়, প্রৌঢ় থেকে বৃদ্ধ, বৃদ্ধ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আপন গতিতে এগিয়ে চলেছে। তুমি এর জন্য আলাদা কিছু করছো ? করছো না। কিন্তু হচ্ছে। এই হওয়াতে তোমার কোনো হাত নেই। কিন্তু হচ্ছে। তোমার শরীরই ভেতরে ভেতরে ক্রিয়াশীল থাকছে। তোমার শরীরে কোষ জন্মাচ্ছে, আবার মারা যাচ্ছে। এই ক্রিয়ায় তোমার ইচ্ছা অনিচ্ছা নেই। তবু হয়। ঠিক তেমনি জগতে সমস্ত কাজই, এক অমোঘ শক্তির নির্দেশে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে হয়তো আমার মন-বাসনা-ইন্দ্রিয় বা আমার শরীরের অঙ্গ প্রতঙ্গ নাড়া-চড়া করছে। তাই আমার মন ভাবছে, বা আমি ভাবছি আমিই এ সব করছি। আমার এই ভাবনাই আমাকে সুখ দুঃখের অনুভূতি যোগাচ্ছে। এটাই ভ্ৰম। আমাদের এই ভ্রম দূর করতে হবে। তবেই আমরা সুখী অর্থাৎ যা আছি তাই থাকবো।
আচার্যদেব অষ্টাবক্রমুনি বলছেন "তুমি কর্তা নও" এই বিশ্বাস-অমৃত পান করে সুখী হও।
একো বিশুদ্ধ বোধঃ অহম ইতি নিশ্চয় -বহ্নিনা
প্ৰজ্বাল্য অজ্ঞানগহং বীতশোকঃ সুখী ভব। (১/৯)
-আমি এক ও বিশুদ্ধ, গভীর অজ্ঞান অরণ্যে, এই বোধ - বহ্নির ন্যায় প্রজ্জলিত করো - শোক রোহিত হও - সুখী হও।
আমি এক ও বিশুদ্ধ। এর আগে আচার্যদেব বলেছিলেন - আমি অসঙ্গ। অর্থাৎ আমার কোনো সঙ্গী সাথী নেই। না আমি কারো সঙ্গী বা সাথী। আমাদের মিথ্যে সন্মন্ধ বোধ, অর্থাৎ আমার ছেলে, আমার মেয়ে, আমার বন্ধু, আমার আত্মীয় এই সন্মন্ধ-বোধ আমাকে কষ্ট দেয়। তাদের কথা আমাকে কষ্ট দেয়। তাদের আচরণ আমাকে কষ্ট দেয়। তাদের কান্না আমাকে কষ্ট দেয়। তারা আমার সন্মন্ধে কি ভাবলো তার জন্য আমি কষ্ট পাই। এই নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েই আমার কষ্ট বাড়ে। আমি যদি নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারি, বাইরের আরোপিত কষ্ট আমাকে প্রভাবিত করতে পারবে না। আমি স্থিতাবস্থায় থাকতে পারবো। যেমন আছি তেমন থাকতে পারবো। আমি বিশুদ্ধ। এই বিশ্বাস আমাকে আনন্দিত করবে। আমি বিশুদ্ধ এই সত্য আমাকে উপলব্ধি করতে হবে। তবেই আমি শোকাতিত হতে পারবো। আচার্যদেব রাজা জনককে এই উপদেশই দিলেন।
আমি এক-অদ্বিতীয়, এই বিশুদ্ধ জ্ঞানের আগুনে তোমার অজ্ঞানতার আবর্জনা ভস্মীভূত হয়ে যাক। তোমার সমস্ত দুঃখ বিনাশ প্রাপ্ত হোক। ভেবে দেখো, তোমার চারিপাশে বিনাশশীল জগতের প্রবাহ চলছে। আর এই পরিবর্তন তোমাকে সুখ-দুঃখের অনুভূতির চক্রে আবদ্ধ করে রেখেছে। তোমার চারিদিকে মানুষগুলো ভিতরে বাইরে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয়ে চলেছে। এমনকি তোমার যে শরীর, তোমার যে মন তাও প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয়ে চলেছে। কেন তুমি এইসব অস্থায়ী বস্তুর জন্য দুঃখ পাচ্ছো ? এগুলো সব প্রবাহমান জীবন নদীর বুদ্বুদ। ক্ষণকালের জন্য জন্মাচ্ছে আবার নদীর মধ্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আজ তোমার শরীর-স্বাস্থ্য সুস্থ-সবল আছে, কাল তা থাকবে না। আজ তোমার সাথে যাদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে কাল তা থাকবে না। আজ যে ছেলে-মেয়েকে তুমি তোমার তোমার ভাবছো, কাল সে অন্য মানুষ হয়ে যাবে। এটাই আমাদের সবার পরিণতি।এরা কেউ তোমার সাথে একদিন ছিল না, আবার একদিন আসবে, যেদিন তারা কেউ তোমার সঙ্গে থাকবে না। এই যে শরীর এ কখনো সুস্থ কখনো অসুস্থ। এই যে মন কখনো ভালো, কখনো খারাপ। সারা জীবন আমরা শরীরকে আরামে রাখতে চাই, আবার ভবিষ্যতের কথা ভেবে শরীরকে কষ্ট দেই। আমরা যে ভবিষ্যতের কথা ভেবে বর্তমানকে বিসর্জন দেই, সেই ভবিষ্যত কখনোই আসে না যে ভবিষ্যতের কল্পনা আমি করেছিলাম। প্রতিদিনই আমি ভবিষ্যতের আশায় বেঁচে থাকি।
সমস্ত জীবের একটা নিজস্ব জীবনধারণ প্রণালী আছে। প্রত্যেক মানুষও কিছু ধারণার বশবর্তী হয়ে একটা ব্যক্তিত্ত্ব গড়ে তোলে । আর এই ধারণা গুলো তৈরি হয়, আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও আমাদের পূর্বপুরুষের জ্ঞান থেকে। আমাদের জন্মের পর থেকে, আমাদের মা-বাবা বা অভিভাবক এমনকি সমাজ আমাদের কিছু নির্দেশ দিয়ে থাকে। সেইসব নির্দেশ এবং আমাদের জীবনের চলার পথে যে সব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়, সেই সব থেকে আমরা আমাদের মধ্যে একটা জীবনশৈলী তৈরি করে নেই। এটি ভৌগলিক ও জাতিগত কারনে ভিন্নতর হয়ে থাকে। কেউ মাছ-মাংস খেতে অভ্যস্ত হয় । তো কেউ নিরামিষ খেতে অভ্যস্ত হয়। আবার ব্যক্তি হিসেবেও আমাদের কিছু পছন্দ-অপছন্দ থাকে। এর বাইরে আমরা সহজে যেতে পারি না। কেউ কেউ কুকুরকে ভয় পায়, কেউ কুকুরকে খাবার দেয়। কেউ সাঁতার কাটতে পছন্দ করে, তো কেউ জল দেখলে ভয় পায়। এগুলো তার ব্যক্তিগত পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম নেয়।
আমরা সবাই একটা ধারণা নিয়ে আমরা চলি, এই ধারণা আমাদের মনের ভিতরে অচল পাথরের মতো গেঁথে বসে আছে। এমনকি আমাদের ক্ষমতা সম্পর্কেও আমরা একটা ধারণা করে নিয়েছি। আমি এটা পারবো, আর এটা পারবো না। এখান থেকে আমরা সহজে বাড় হতে পারি না। এই ধারণাগুলোই আমাদের সুখ দুঃখের কারন। এইসব ধারণা আমাদের যে মূল সত্তা, তাকে চাপা দিয়ে দিয়েছে। আমি ভুলে গেছি আমি কে। আমি অমুক নামধারী মানুষ, আমি মহিলা -পুরুষ, আমি যুবক-বৃদ্ধ, আমি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, আমি পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন, পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনকি আমি শিক্ষিত বা অশিক্ষিত,জ্ঞানী-অজ্ঞানী, আমি দক্ষ বা অদক্ষ, ইত্যাদি ভাবনা আমাদের মধ্যে শিকড় গেড়ে বসে আছে। আর এগুলোর একটা সামাজিক স্বীকৃতি ও অস্বীকৃতি আছে। এই স্বীকৃতি আমাকে স্বস্তি-সুখ দিচ্ছে, আর অস্বীকৃতি আমাকে অস্বস্তি-কষ্ট দিচ্ছে। এমনকি আমার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আমাকে ঠিকঠিক মূল্যায়ন করা হয় নি। আমার যা পাওয়া উচিত ছিল, সন্মান প্রতিপত্তি তা আমি পাইনি। আমরা ভাবি, আমার সমস্ত কাজের হিসেবে রাখুক আমার সমাজ, আর আমার কি হওয়া উচিত, আর কি করা উচিত নয়, তার সঠিক বিচার করুক আমার সমাজ।
এর মধ্যে আবার কিছু মানুষ আছেন, যারা সমাজের ধার ধারেন না, অন্যরা কি ভাবলো, না ভাবলো তাতে তাদের কিছু এসে যায় না। তারা তাদের মতো করে চলেন। শুধু নিজের পছন্দ-অপছন্দের দিকটা নিয়ে ভাবেন। একটা স্ব-রচিত স্বাধীনতা ভোগ করতে চায় । এদের মধ্যে একটা চঞ্চলতা লক্ষ করা যায়।
এই দু ধরনের মানুষই নিজেদের মূল সত্তাকে এড়িয়ে চলে। চলমান জগৎ বৈচিত্রে ভরা। আমরা এই বৈচিত্রের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। এই বিশ্ব, এই সমাজ, এই শরীর এই মন - এর বাইরেও যে একটা কিছু আছে, যা সতত স্থির তার স্পন্দন আমরা অনুভব করতে পারি না। আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ নিজের সম্পর্কে সচেতন নন। তারা শুধু অন্যরা কে কি করছে, অন্যরা কে কি বলছে, সেইমত নিজেকে গতি দিচ্ছে। তার নিজস্ব কোনো সচেতন গতি নেই। আমরা কোনো কাজই সচেতন ভাবে করি না। আমরা শুধু অভ্যাসের বসে কাজ করে যাই। আমরা অভ্যাসের দাসে পরিণত হয়ে গেছি। আমরা অন্যদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানি, নিজের সম্পর্কে কিছুই জানি না। অন্যদের সম্পর্কে জানা সহজ কারন সেই বস্তু আমার সামনে আছে, আমি তাকে ইন্দ্রিয় দিয়ে জানতে পারি। কিন্তু যিনি আমারই ভিতরে আছেন, তাকে আমরা জানি না, জানতে পারি না, কারন জানা সহজ নয়। কারন ইন্দ্রিয় দিয়ে তাকে জানা যায় না।
স্বাস্থ্য নিয়ে যে সজাগ, সে সারা জীবন স্বাস্থ্যের জন্য উদ্বিগ্ন থাকে, আর স্বাস্থ্য নিয়ে যে চিন্তা করে না, তার ডাক্তারের কথায় কথায় কাছে যেতে হয় না। এটা একটা অবাক করা কথা, কিন্তু এটাই সত্যি। এই মানুষগুলো মানসিক দিক থেকে অধিক শক্তিশালী। আর এই মানসিক শক্তি তাকে রোগপ্রতিরোধ শক্তি এনে দেয়, তাই সে অধিক ভালো থাকে। যারা বলে এই কাজটা হবেতো ? তাদের সেই কাজ সহজে হয় না। কারন তাদের মনে সন্দেহ। কিন্তু যারা বলে, এটা না হবার কিছু নেই, হবেই, তাদের সেই কাজ হবেই। সদর্থক চিন্তা মানুষকে সাফল্য এনে দেয়, আর নঞর্থক চিন্তা মানুষকে অসহায় করে তোলে। অষ্টাবক্র মুনি এই সদর্থক হতে বলছেন, বলছেন, তুমি সেই অসীমশক্তিশালী এক অদ্বিতীয় সত্তা। শুদ্ধ বোধে নিজেকে জানো, আর সুখী ভব। প্রজ্ঞাবান পুরুষের এই কথা আমাদের কাছে আশীর্বাদ স্বরূপ হয়ে উঠুক। আমরা সুখী হবোই -হবো।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
অষ্টাবক্র গীতা : নতুন সংস্করণ - একাদশ ভাগ।
জগৎ কল্পনা -মাত্র , মুক্তি আসলে আমারা-বদ্ধ এই ধারণা থেকে মুক্তি।
অষ্টাবক্র জ্ঞান-গীতা আমাদের সবার জীবনে কাজে আসবে, এমন কথা বলা আমাদের অহমিকা হবে। জ্ঞানের লন্ঠন অষ্টাবক্র জ্বেলে দিতে পারেন, কিন্তু সেই লণ্ঠনের সাহায্যে আমাদের জীবনে চলার পথে কোনো দিশা দেখতে পারবে কি না, সেটা নির্ভর করবে আমার অবস্থার উপরে।
এই প্রসঙ্গে একটা ছোট্ট গল্প বলি, কোনো একসময় এক খঞ্জ আর এক জন্মান্ধের বন্ধুত্ত্ব হয়েছিল। তো একদিন খঞ্জ জন্মান্ধকে নিমন্ত্রণ করলো, তার বাড়িতে খাবার জন্য। জন্মান্ধ খঞ্জের বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে গেলো। খাওয়াদাওয়ার পরে, গল্প গুজব করতে করতে গভীর রাত হয়ে গেলো। খঞ্জ বললো, বন্ধু অনেক রাত হয়ে গেছে। এবার তো তোমাকে বাড়ি ফিরতে হবে। কিন্তু এতো রাতে কোনো গাড়িঘোড়া তো পাওয়া যাবে না। তো এক কাজ করো, আমি তোমাকে একটা লন্ঠন জ্বেলে দিচ্ছি। এতে রাস্তায় তোমার সুবিধে হবে। খঞ্জের কথা শুনে জন্মান্ধ দুঃখ পেলো। বললো, বন্ধু আমি চোখে দেখতে পাই না বলে, অনেকে আমাকে পরিহাস করে থাকে। কিন্তু তুমি তো আমার বন্ধু তুমিওআমার দুর্দশা নিয়ে আমার সঙ্গে পরিহাস করছো ? লন্ঠন দিয়ে আমরা কি হবে ? আমি কি চোখে দেখতে পাই, যে লণ্ঠনের আলোতে আমি পথ দেখতে পাবো ? খঞ্জ ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। বললো, না বন্ধু আমি তোমার সঙ্গে মশকরা করছি না। অন্ধকার রাতে, তোমার হাতে লন্ঠন থাকলে, জীবজন্তু তোমার কাছে আসবে না। আর এছাড়া অন্য পথযাত্রী তোমার হাতে লণ্ঠন-আলো দেখলে, তোমার সঙ্গে তাদের ধাক্কা লাগার সম্ভাবনা থাকবে না। তুমি নিশ্চিন্তে রাস্তা চলতে পারবে। এবার জন্মান্ধ ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। বন্ধু ঠিকই বলেছে। তো জন্মান্ধ আনন্দের সঙ্গে লণ্ঠন হাতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো। কিন্তু নিয়তি যাবে কোথায়, কিছুদূর যেতেই তার সাথে এক পথিকের ধাক্কা লেগে গেলো। জন্মান্ধ চিৎকার করে উঠলো। অন্ধ নাকি ? চোখে দেখতে পাও না ? লণ্ঠনের আলোও কি তোমার চোখে পড়ে না ? অন্ধ কোথাকার। তো পথিকঅন্ধের হাতে লন্ঠন দেখেই মুহূর্তেই ব্যাপারটা বুঝে গেলো। বললো,কিছু মনে করো না, আসলে তুমি হয়তো জানো না যে তোমার লণ্ঠনের আলো জ্বলছে না। তোমার লণ্ঠন নিভে গেছে। তাই আমি তোমাকে দেখতে পারিনি। তুমি কিছু মনে করো না।
তো আমাদের হাতে অষ্টাবক্র গীতার জ্ঞানের লন্ঠন ঝুলিয়ে দিলেও কি আমরা আধ্যাত্মিক পথের দিশা দেখতে পাবো ? জানিনা, তবে একথা বলতে পারি, আমরা যারা অষ্টাবক্র গীতা শুনছি, তারা ভাগ্যবান - পুণ্যবান সন্দেহ নেই, কেননা এই জ্ঞানালোক দুর্লভ বস্তু।
যাইহোক, আমরা অষ্টাবক্র গীতায় প্রবেশ করবো।
যত্র বিশ্বম ইদং ভাতি কল্পিতং রজ্জু সর্পবৎ
আনন্দ পরমানন্দঃ স বোধস্ত্যং সুখং চর। (১/১০)
রজ্জুসর্পের ন্যায় কল্পিত এই বিশ্ব যে বোধস্বরূপে প্রতিভাত হয় ;
সেই স্বতঃ নিত্য অনন্ত আনন্দ স্বরূপ চিদাত্মা তুমিই ; এইরূপ জেনে সুখে বিচরণ করো।
অষ্টাবক্র বলছেন, এই যে বিশ্ব তোমার সামনে প্রতিভাত হচ্ছে, এটি তোমার কল্পিত সর্প, যা তুমি রজ্জুতে আরোপ করেছো। এই রজ্জুতে সর্প-জ্ঞান, অর্থাৎ ভ্রমাত্মক জ্ঞানে ফলেই আমরা এই বহির্বিশ্বকে দেখতে পাচ্ছি । একটা চলমান বহির্বিশ্ব আমাদের চোখের সামনে ভাসছে। এই দৃশ্যমান জগৎ সম্পর্কে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই। জগতের সমস্ত কিছু তা সে চলমান বলুন, বা স্থির বলুন, সবই আমাদের চোখের সামনে ঘটছে। ঋষি অষ্টাবক্র বলছেন, এই দৃশ্যমান জগৎ আমাদের কল্পনা। এর মধ্যে কোনো সত্যতা নেই। অষ্টাবক্রের এই কথা বা তার এই অনুভূতি আমাদের মতো সাধারনের পক্ষে বোধগম্য হওয়া শুধু কঠিন নয়, এমনকি অসম্ভব। কেননা দৃশ্যমান জগৎ আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। আমরা একে চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছি, ত্বক দিয়ে অনুভব করতে পারছি, পাখির কলতান, মেঘের গর্জন আমরা শুনতে পাচ্ছি। স্থির কঠিন পাহাড়, জলমগ্ন সমুদ্র যেমন আমরা দেখতে পাচ্ছি, তেমনি বহমান নদীও আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। তো যা দেখতে পাচ্ছি, যা শুনতে পাচ্ছি, তাকে আমরা কি করে ভাববো, যে এসব আমাদের কল্পনা। আর আমার ব্যক্তিগত কল্পনার চিত্র অন্যের কাছে, একইরকম ভাবে দৃশ্যমান বা শ্রুতিগোচর কি ভাবে হবে ? তো অষ্টাবক্রের এই কথা যে "বিশ্বম ইদং কল্পিতম" এই বিশ্ব আমাদের কল্পনা মাত্র - এই কথা আমাদের কাছে অষ্টাবক্র ঋষির ব্যক্তিগত কল্পনা বলে মনে হয়।
কিন্তু আপ্তবাক্যে আমাদের নির্ভরশীলতা রাখতে হবে, আমরা অনেক কিছুই জানি না। আমি কোথা থেকে এসেছি, তা আমরা জানি না, মৃত্যুর পরে কোথায় চলে যাবো তা আমরা জানি না। সমুদ্রের মধ্যে অসংখ্য জীবের বাস, মাটির নিচে অসংখ্য জীবের বাস।এদের কজনের খবর আমরা জানি ? আমাদের চোখের সামনে, অসংখ্য জীবাণু ঘুরে বেড়াচ্ছে, অসংখ্য চিত্র ভেসে বেড়াচ্ছে, এমনকি বাতাসের মধ্যে ধ্বনির তরঙ্গ ভেসে বেড়াচ্ছে, তাকে কি আমরা ধরতে পারি ? এমনকি আমার নিজের শরীরের ভিতরে কি কি আছে, তারা কিভাবে আমাকে বাঁচিয়ে রাখছে, কেনই বা আমাকে বাঁচিয়ে রাখে, তাকি আমরা জানি ? এদের সবার সঙ্গে আমার একটা গভীর সম্পর্কে আছে তাকি আমরা জানি ? জানি না তাই আমাদের ঋষিবাক্যের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে। এবং আপ্তবাক্যের উপরে নির্ভর করেই আমরা সত্যের অনুসন্ধান করতে পারবো। আপ্তবাক্য একটা লক্ষ স্থির করে দেয়। আর লক্ষ ধরে এগুতে এগুতে যখন আমরা সত্যে উপনীত হবো, যখন আমাদের অপরোক্ষ জ্ঞান হবে, তখন আমাদের উপল্বদ্ধিতে ঋষিবাক্যের সত্যতা অনুভব হবে। এবার আমরা ঋষি অষ্টাবক্রে কথার যথার্থতা বুঝবার চেষ্টা করবো।
আমাদের মন একটা ক্যামেরার ফিল্মের মতো। আমাদের চোখের সামনে যা কিছু ঘটছে, তার একটা প্রবাহমান চিত্র সে নিজের মতো করে এঁকে নিচ্ছে। নিজের মতো বললাম এইজন্য, যে একই ঘটনা এক-একজনের ক্ষেত্রে এক-এক রকম দাগ কাটে। দৃষ্টিভঙ্গিও আমাদের আলাদা আলাদা। আর এগুলোকে সে প্রতিনিয়ত সংরক্ষণ করছে। এই ক্রিয়া আমরা অজ্ঞাতসারেই করছি। নদী বয়ে চলেছে, আমি ভাটির টানে এগিয়ে চলেছি। নদীর প্রবাহ আমার শরীরটাকে টেনে নিয়ে চলেছে। ঠিক তেমনি, জগৎটাও এগিয়ে চলেছে, আমরা সবাই এই জগতের সঙ্গে এগিয়ে চলেছি। আমি শিশু থেকে বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে চলেছি। এর জন্য আমার কিছু করতে হচ্ছে না। তাই জগৎ গতিশীল, পরিবর্তনশীল, এটা আমার কাছে তাৎক্ষণিক ভাবে ধরা পড়ে না।
কিন্তু একটু খেয়াল করলেই আমরা বুঝতে পারি, আমার ছোটবেলার আমি আর এই বৃদ্ধ আমি এক নোই। এমনকি আমার চোখের সামনে যে গাছটা সেটাও প্রতিনিয়ত বিবর্তিত হচ্ছে। কোনো বস্তুর পরিবর্তনের গতি দ্রুত আবার কারুর পরিবর্তনের গতি শ্লথ। কিন্তু পরিবর্তনই নিয়ম। আর এই পরিবর্তনের চিত্র ধরা থাকছে আমার মনের ফিল্মে ।
এবার মনের ফিল্মটাকে একটু উল্টোদিকে ঘোরান। ৫০ বছর আগে চলে যান, বা একদিন আগে চলে যান, তখন আপনার সামনের জগৎটা কি ছিল, কেমন ছিল, একটু কল্পনা করুন। তখন সেই পুরোনো দিনের কথা আপনার মনে পরে যাবে, যা নিছকই একটা কল্পনা মাত্র। তো এই পুরোনো দিনের জগৎটা একসময় ছিল, আপনার কাছে বাস্তব, এখন সেটি আপনার কাছে কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। এইজন্য অষ্টাবক্র মুনি বলছেন, ইদং বিশ্ব কল্পিতং ভাতি। এই বিশ্ব কল্পনা বই কিছু নয়।
এই গুড় তত্ত্ব ঋষি অষ্টাবক্র একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছেন। বলছেন, কল্পিতং রজ্জু সর্পবৎ। একটা লোক রাতের অন্ধকারে পথে বেড়িয়েছেন। রাস্তায় একটা সাপকে শুয়ে থাকতে দেখে ভয়ে পিছিয়ে গেলেন। তার মধ্যে একটা আতঙ্ক তৈরী হলো, দূরে অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু সাপটি রাস্তা থেকে যাচ্ছে না। তাই রাস্তা পারও হতে পারছেন না। সারারাত তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন। ভোরের আলো ফুটতেই তার নজরে এলো, যাকে সে এতক্ষন সাপ ভেবেছিলো, যাকে দেখে সে ভীত-সন্ত্রস্ত ছিল, যার ভয়ে সে সামনে এগুতে পারছিলো না, সেটি আসলে একটা দড়ি। তার মানে দড়িকে সে এতক্ষন সাপ ভেবেছিলো। এটি তার মনের ভ্রম মাত্র। অষ্টাবক্র ঋষি বলছেন, যে জগতের ঘটনার সঙ্গে তুমি নিজেকে সম্পৃক্ত করে, দুঃখ কষ্ট অনুভব করছো, তা আসলে সত্য নয়, এটি তোমার মনের ভ্রম মাত্র। কোথায় তোমার বিশ্বসংসার ? কোথায় তোমার সমাজ ? কোথায় তোমার প্রাণের অস্তিত্ত্ব ? তুমি কার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছো ? কার কথায় তুমি কষ্ট পাচ্ছো ? কাকে তুমি আপন ভাবছো ? কার জন্য তুমি ব্যাকুল হয়ে আছো ? যাকিছু ভাবছো, যাকিছু শুনছো, যার জন্য তোমার অন্তরে ব্যাকুলতা জন্ম নিচ্ছে, তার সবই তোমার মনের উপর বহমান একটা জল-ছবি মাত্র। আসছে - আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। ভুলে যাও এসব কাল্পনিক ছবি। জাগো, সজাগ হও, তোমার সম্বিৎ ফিরে আসুক। তুমি স্বরূপে স্থিত হও। তোমার স্বরূপ আনন্দময় সত্তা, এই বোধে তুমি জাগ্রত হও, এবং সুখে বিচরণ করো।
এখন কথা হচ্ছে এই ভ্রম আমাদের কেন হয়। যা অজ্ঞানের অন্ধকারে আছে, তাকে আমরা জানতে পারি না। সে যা নয় তাকে তাই মনে হয়।অন্ধকারে দড়িকে যেমন সাপ মনে হয়, তেমনি সাপকেও দড়ি বলে মনে হতে পারে। বিবেকের অভাব হলে, সাপকে দড়ি বলে মনে হয়। এখন সাপকে দড়ি ভেবে যদি ধরতে যাই, তবে আমাদের বিপদ হতে পারে। অর্থাৎ মিথ্যা বস্তু গ্রহণ করাই আমাদের বন্ধন। মায়ার জন্য এসব হয়। আমাদের ভুল দেখানোই মায়ার কাজ। মায়া আমাদেরকে সত্যকে আবরণ দিয়ে ঢেকে রাখে, আর অসত্যকে সত্য বলে দেখায়। বিচার বুদ্ধির অভাব হলে আমরা এই ভুলে করে থাকি। দড়িকে সাপ ভাবি, বা সাপকে দড়ি ভাবি।
মুক্ত-অভিমানী মুক্তো হি বদ্ধো বব্ধ-অভিমানী অপি
কিংবদন্তি ইহ সত্যেয়ং যা মতিঃ সা গতির্ভবেৎ। (১/১১)
- আমি মুক্ত - এইরূপ যার ভাবনা সেই মুক্ত আর আমি বদ্ধ এইরূপ যার ভাবনা সেই বদ্ধ। যার যেমন মতি তার তেমন গতি - এই কিংবদন্তী সত্য।
এক জিজ্ঞাসু, মুক্তির উপায় জানতে এক সাধুবাবার কাছে উপস্থিত হলো। সাধুবাবা বললো, তুমি একবছর এই আশ্রমে সেবাকর্ম্ম করো, তারপরে তোমাকে মুক্তির উপায় বলে দেব। তো জিজ্ঞাসু একবছর যাবৎ আশ্রমের বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত থাকলো। একবছর পরে, সে সাধুবাবার কাছে মুক্তির উপায় জানতে চাইলো। সাধুবাবা তাকে আগামীকাল ভোরে স্নান করে আশ্রমে আসতে বললো। তো পরদিন অতি উৎসাহে-আনন্দের সঙ্গে জিজ্ঞাসু স্নানটান করে, শুদ্ধ-বস্ত্র পড়ে আশ্রমে প্রবেশ করলো। আশ্রমে ঢুকেই দেখে সাধুবাবা একটা গাছ জড়িয়ে ধরে চিৎকার করছে, মুক্ত করো, মুক্ত করো। তো জিজ্ঞাসু হতবাক হয়ে গেলো, দৌড়ে সাধুবাবার কাছে গেলো, হাতটাকে গাছ থেকে ছাড়াবার চেষ্টা করতে লাগলো, কিন্তু সাধুবাবা জোর করে গাছটাকে আঁকড়ে ধরতে লাগলো। জিজ্ঞাসু বললো, হাতটা ছাড়ুন, গাছটাকে ছেড়ে দিন, তবেই তো ছাড়া পাবেন। সাধুবাবা বললো, তাইতো, কি বোকা আমি !তো জিজ্ঞাসু যার জন্য, একবছর অপেক্ষা করেছিল, যে মুক্তির জন্য অপেক্ষা করেছিল, যে প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় ছিলো, এই মুহূর্তেই সেই প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেলো।
ঠাকুর রামকৃষ্ণ একদিন মাস্টারকে বললেন -"দেখো অষ্টাবক্রসংহিতায় অত্মজ্ঞানের কথা আছে. আত্মজ্ঞানীরা বলে, 'সোহহম ' অর্থাৎ 'আমিই সেই পরমাত্মা'. এসব বেদান্তবাদী সন্যাসীর মত,....... আমি মুক্ত এ অভিমান খুব ভালো। "আমি মুক্ত " এ কথা বলতে বলতে সে মুক্ত হয়ে যায়। আবার "আমি বদ্ধ"" আমি বদ্ধ "বলতে বলতে সে ব্যক্তি বদ্ধই হয়ে যায়। যে কেবল বলে আমি পাপী সে শালাই পড়ে যায়। বরং বলতে হয় আমি তাঁর নাম করছি , আমার আবার পাপ কি , বন্ধন কি ! (পৃ -৯৪ শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত )
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেলিন - "তুমি যাহা চিন্তা করিবে তুমি তাহাই হইয়া যাইবে, তুমি যদি নিজেকে তেজস্বী ভাব, তবে তেজস্বী হইবে , যদি তুমি নিজেকে দুর্বল ভাবো তবে দুর্বল হইয়া যাইবে "
ভাবনা, মান্যতা, একটা বড় ব্যাপার। মানুষ যা ভাবে সেই ভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করে। এবং এই ভাবেই মানুষের রূপান্তর ঘটে। শুনেছি ঠাকুর রামকৃষ্ণ একবার সুফী সাধনা করতে গিয়ে নিজেকে মেয়েমানুষ বলে ভাবতেন। গিরিশচন্দ্র ঠাকুরের স্ত্রী-পুরুষ উভয় ভাব দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন,মশাই, আপনি পুরুষ না প্রকৃতি ? ঠাকুর হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, জানি না। আমার এই উপলব্ধি নেই। কিন্তু অস্বীকার করি কি করে ?
এ ছাড়া সেই বিখ্যাত গল্পোতো সবার জানা। কথায় আছে দশচক্রে ভগবান ভূত। ব্রাহ্মণের পাওয়া ছাগল, দুষ্টূ ছেলেদের পাল্লায় পড়ে, কেমন কুকুর ভ্রম-হলো আর ব্রাম্মন বেটা কুকুর ভেবে ছাগল ফেলে পালালো। গল্পটা খুলেই বলি। এক বামুন ঠাকুর, গৃহস্থের বাড়িতে পুজো করে, গৃহস্থের মানত করা একটা ছাগল পেয়েছিলো। মানত অর্থাৎ ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে দান। তো আমাদের কাছে তো বামুন ঠাকুর, ঈশ্বরের প্রতিনিধি। তো ছাগলটাকে বেঁধে বামুন ঠাকুরকে দিয়ে দেওয়া হলো। তো ছাগল পেয়ে, বামুন ঠাকুর, বেজায় খুশি। ছাগলটাকে কাঁধে করে, সে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলো। এদিকে কিছু দুস্টু ছেলে বামুনের কাঁধে ছাগল দেখে, ছাগলটাকে বামুনের কাছ থেকে কিভাবে হাতড়ে নেবে, সেই ফন্দি আটতে লাগলো। ছেলেরা জানে, বামুন ঠাকুর, কুকুরকে অশুভ জীব মানে। তো ছেলেরদল চারটি ভাগে ভাগ হয়ে গেলো এবং কিছুদূর অন্তর রাস্তার মোড়ে মোড়ে, দাঁড়িয়ে গেলো। ঠাকুর মশায় আসতেই, তাকে জিজ্ঞেস করলো, কিগো ঠাকুর, কুকুরছানাটাকে কাঁধে নিয়েছো কেন ? পুষবে বুঝি ? ঠাকুর বললো, এটা কুকুর নয়, ছাগল। ছাগল চিনিস না বুঝি ? ছেলেটি বললো, চিনবো না কেন, এটা তো কুকুর। তুমি ভালোভাবে দেখো। তো বামুন ছাগলটাকে একবার পরোখ করে দেখলো। নাঃ ঠিকই আছে। এটা ছাগলই বটে। বামুন কথা না বাড়িয়ে ছাগলটাকে নিয়ে রওনা হলো। কিছুদূর যাবার পরে, দুস্টু ছেলেদের আর একজন দাঁড়িয়ে ছিল। ঠাকুর মশায় আসতেই, তাকে জিজ্ঞেস করলো, কিগো ঠাকুর, কুকুরছানাটাকে কাঁধে নিয়েছো কেন ? পুষবে বুঝি ? ঠাকুর বললো, এটা কুকুর নয়, ছাগল। ছাগল চিনিস না বুঝি ? ছেলেটি বললো, চিনবো না কেন, এটা তো কুকুর। তুমি ভালোভাবে দেখো। তো বামুন ছাগলটাকে কাঁধ থেকে নামালো, ভালো করে পরোখ করে দেখলো। নাঃ ঠিকই আছে। এটা ছাগলই বটে। বামুন কথা না বাড়িয়ে ছাগলটাকে নিয়ে রওনা হলো। কিছুদূর যাবার পরে, দুস্টু ছেলেদের আর একজন দাঁড়িয়ে ছিল। ঠাকুর মশায় আসতেই, তাকে জিজ্ঞেস করলো, কিগো ঠাকুর, কুকুরছানাটাকে কাঁধে নিয়েছো কেন ? পুষবে বুঝি ? ঠাকুর বললো, এটা কুকুর নয়, ছাগল। ছাগল চিনিস না বুঝি ? ছেলেটি বললো, চিনবো না কেন, এটা তো কুকুর। তুমি ভালোভাবে দেখো। তো বামুন ছাগলটাকে কাঁধ থেকে নামালো, একবার পরোখ করে দেখলো। নাঃ ঠিকই আছে। এটা ছাগলই বটে। বামুন কথা না বাড়িয়ে ছাগলটাকে নিয়ে রওনা হলো। এবার কিন্তু বামুনের মনে সন্দেহ হলো। আর বার বার ছাগলটাকে নামিয়ে দেখতে লাগলো। কিছুদূর যাবার পরে, দুস্টু ছেলেদের আর একজন দাঁড়িয়ে ছিল। ঠাকুর মশায় আসতেই, তাকে জিজ্ঞেস করলো, কিগো ঠাকুর, কুকুরছানাটাকে কাঁধে নিয়েছো কেন ? পুষবে বুঝি ? ঠাকুর বললো, এটা কুকুর নয়, ছাগল। ছাগল চিনিস না বুঝি ? ছেলেটি বললো, চিনবো না কেন, এটা তো কুকুর। তুমি ভালোভাবে দেখো। তো বামুন ছাগলটাকে কাঁধ থেকে আবার নামালো, একবার গায়ে হাত দিয়ে দেখলো, একবার কাছ থেকে দেখো, একবার দূর থেকে দেখলো, একবার লেজ উঁচু করে দেখলো। ভালোভাবে দেখার পরে, একটু যেন সন্দেহ হচ্ছে, ছাগল নাও হতে পারে। এতজন যখন বলছে। কিন্তু ভাবলো, গৃহস্থ ভালো মানুষ। তাকে নিশ্চই ঠকাবে না । নাঃ ঠিকই আছে। এটা ছাগলই বটে। বামুন কথা না বাড়িয়ে ছাগলটাকে নিয়ে রওনা হলো। কিছুদূর যাবার পরে, দুস্টু ছেলেদের আর একজন দাঁড়িয়ে ছিল। সেই ঠিক আগের কথাই বললো, এবার ঠাকুর আর সহ্য করতে পারলো না। কারন বামুনের কাঁধে কুকুর। ছিঃ ছিঃ - ইহকাল পরকাল সবই গেলো। বামুন ছাগলটাকে ছুড়ে ফেলে দিলো। আর দৌড় লাগলো, বাড়ির দিকে নিজেকে শুদ্ধি করনের জন্য।
অজ্ঞানের দুটো শক্তি, একটা হচ্ছে মোহ, আর একটি হচ্ছে বিক্ষেপ। মোহের বসে আমরা কুকুরকে ছাগল ভাবতে পারি। আবার আমাদের যখন দুস্টু ছেলেদের কথায় বিক্ষেপ জ্ঞান জন্মায়, তখন আমাদের ছাগলকে কুকুর বলে মনে হয়।
তো একটা কথা বার বার শুনতে শুনতে ভাবতে ভাবতে আমরা সেটাই সত্য বলে মনে করি। ঠিক তেমনি জন্ম-জন্মান্তরের দেহত্ত্ববোধ আমাদেরকে দেহটাকেই আমি মনে করে, দেহ-সংক্রান্ত সবকিছুকে আঁকড়ে ধরে আমরা মেতে আছি। আমাদের ম্যান-সন্মান, কর্ম্মন্নতি, সামাজিক প্রতিষ্ঠা - কিসের জন্য না আমরা চেষ্টা করছি। আমি-আমার করে আমরা সন্মন্ধের জালে জড়িয়ে পড়ছি। এই দেহাত্ত্ববোধ থেকেই আমাদের অশেষ যন্ত্রনা। আর এই দেহকে কত যত্ন করে খাইয়ে-দাইয়ে, পরিষ্কার পরিছন্ন করে সযত্নে লালন পালন করছি। কিন্তু আমরা সাবি জানি দেহ নিত্য নয়, একদিন এই দেহের নাশ অবশ্যাম্ভাবী। তথাপি একটা মোহের জালে নিজেকে দেহের মধ্যেই জড়িয়ে রেখেছি। ছোটবেলা থেকেই শুনছি আমি অমুক। এই আমার বাবা, এই আমার ভাই, এই আমার মা, এই আমার বাড়ি, এই আমার দাদা, এই আমার দিদি। এই আমার দেহ। এই দেহই আমি। আমাকে তো এটি শেখানো হয়েছে। এর বাইরে বা ভেতরে অন্য কিছু আছে, তাতো আমি জানিনা। জানার কিছু আছে তাইই তো জানিনা। - আমি আসলে কী বা কে ? আমার সারা জীবনের শিক্ষা আমাকে বহির্মুখী করেছে। আজ ভিতরের দিকে তাকিয়ে, অন্তর্মুখী হবার চেষ্টা করছি। তাও সেই মনের সাহায্যে। যেটা দেহেরই অঙ্গ। তাই দেহের যত্ন করতেই হবে, কেননা দেহই আত্মজ্ঞান লাভের সহায়। জানি না মনের দ্বারা এই আত্মজ্ঞান লাভ হবে কি না। শাস্ত্র বলছে : মনের র্উর্দ্ধে সেই আমি। তবে সে কোথায়? কীভাবে জানবো ? কেই বা জানবে ? কেই বা জ্ঞাতা ? কেই বা জ্ঞেয় ? অষ্টাবক্র ঋষি বলছেন,এগুলো সব তোমার কষ্ট কল্পনা। তুমিই জ্ঞাত তুমিই জ্ঞেয়। তুমি বন্ধনহীন মুক্ত পুরুষ। তোমার আবার দুঃখ কিসের ? তুমি চিরসুখী ভব।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
অষ্টাবক্র গীতা - নতুন সংস্করণ - দ্বাদশ ভাগ ।
আত্মা সাক্ষী বিভুঃ পূর্ণ একো মুক্তঃ চিৎ অক্রিয়ঃ
অসঙ্গো নিঃস্পৃহঃ শান্ত ভ্ৰমাৎ সংসারবান ইব. (১/ ১২)
ঋষি অষ্টাবক্র রাজা জনককে দেহ-বোধের উর্দ্ধে উঠবার জন্য উপদেশ দিচ্ছেন।
- আত্মা স্বভাবতই সাক্ষী, বিভু,পূর্ণ, মুক্ত চৈতন্য স্বরূপ , অক্রিয় , অসঙ্গ, নিস্পৃহ ও শান্তস্বরূপ। ভ্ৰম বশতঃ সংসারবান মনে হয়।
আমরা সবাই সংসারী। এই সংসারে থেকেই আমরা সমস্ত কর্ম্ম সম্পাদন করে থাকি। এই সংসারে থেকেই আমরা জ্ঞান সংগ্রহ করে থাকি। আবার এই সংসারেই আমরা সমস্ত সুখ দুঃখ ভোগ করে থাকি। অর্থাৎ এই দেহ-রূপের সঙ্গে যা কিছু সম্পর্কযুক্ত, তা সে বিষয়-বস্তু হতে পারে, আবার আমার আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব হতে পারে, এই সম্পর্কের জন্যই আমরা আমাদেরকে "আমি" ভাবি, আবার এই আমি এই সংসারের সঙ্গে ওতপ্রোত থেকে, সুখ দুঃখের অনুভূতি পাই। ঋষি অষ্টাবক্র বলছেন, তুমি যে সংসারী এই ধারণাটা মস্তবড় ভ্রম। তুমি আদৌ এই সংসারের কেউ নোই। ঋষি অষ্টাবক্র আগেই বলেছেন, তুমি এই দেহ নও, দেহের কারণও তুমি নয়, অর্থাৎ দেহের কারন যে পঞ্চভূত, সেই ক্ষিতি , অপ, তেজ, মরুৎ বা ব্যোম এগুলোও তুমি নয়, তুমি আত্মা।
আর এই আত্মার স্বরূপ-স্বভাব হচ্ছে, সাক্ষীর মতো। আত্মা কোনো রূপের মধ্যে আবধ্য নয়, আত্মা বিভু - অর্থাৎ সমস্ত কিছুর উৎস, বি+ভূ অর্থাৎ বিশিষ্টরূপে হওয়া। চৈতন্যবান। বিভূই সমস্ত কিছুর উৎস। সর্বব্যাপী, ব্যাপক।
আচার্য্য শংকর বলছেন, আমাদের সঙ্গে আছে তিনি জিনিস এক এই স্থূল দেহ দুই বুদ্ধি-মন ইত্যাদি- তিন বুদ্ধিতে প্রতিফলিত চৈতন্যস্বরূপ আত্মার ছায়া। এই তিনের উর্দ্ধে বুদ্ধির গভীরে নিহিত আছেন আত্মা, যিনি দ্রষ্টা ( বি:চূ-২২০) বা সাক্ষী ।
তুমি বিভু, অর্থাৎ লৌকিক-অলৌকিক সমস্ত গুনের অধিকারী, কিন্তু বিভু কখনো ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য নয়।
এই বোধে নিজেকে জাগ্রত করো। দেখো তুমিই সেই অনন্ত আত্মা। তোমার জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কার, তোমার অতীতের অভিজ্ঞতার ছায়া, তোমাকে আবৃত করে রেখেছে । এই আভরণ উন্মোচন করে জেগে ওঠো। তোমার প্রকৃত সত্ত্বাকে স্মরণ করো। সমস্ত কিছুর দ্রষ্টা তুমি। তুমি কর্তা নয়, তুমি সাক্ষী।
তোমার মধ্যে যে দ্বৈতভাব জন্ম নিয়েছে, সেখান থেকে তুমি বেরিয়ে এস।
তুমি পূর্ণ - অর্থাৎ তোমার কোনোকিছুতেই কমতি নেই । তোমার সব আছে। তোমার পাবার কিছু নেই। কিসের জন্য ছুটে বেড়াচ্ছ ? নিজের দিকে তাকাও , দেখো, তোমাতেই সব কিছুর অধিষ্ঠান। তোমার মধ্যেই সব আছে। তুমি শুধু নিজের অন্তরের দিকে দৃষ্টি ফেরাও। তবে বুঝতে পারবে, তোমার মধ্যে পূর্নতা বিরাজ করছে। \
তুমি মুক্ত - অর্থাৎ স্বাধীন । তোমার কোনো বারণ নেই। তুমি স্থির হতে পারো , গতিশীল হতে পারো । তুমি কেবলমাত্র নিজের অধীন। নিজের ইচ্ছেই সব। তোমার কাছে আরোপিত কোনো নিয়ম নেই। তুমিই চৈতন্য স্বরূপ- অর্থাৎ সর্ব জ্ঞানের ভান্ডার । এমন কোনো জ্ঞান নেই যা তোমার ভিতরে নেই।তুমি তোমাকে দেহ ভেবে, নিজেকে প্রকৃতির নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলেছো, তুমি পরিবারের মধ্যে, সমাজের মধ্যে, রাষ্ট্রের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছো, তাই তুমি নিয়মের অধীন মনে করছো নিজেকে। অভিজ্ঞতার ঢেউ তোমার মধ্যে সংস্কারের ছাপ ফেলছে, আর এই সংস্কার তোমাকে তোমার স্বরূপ থেকে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে দিয়েছে । জেগে ওঠো। চৈতন্য হোক তোমার। মুছে ফেলো সংস্কার, স্বরূপের স্মৃতি তোমার জেগে উঠুক।
তুমি অক্রিয় অর্থাৎ কোনো কাজই তোমার নয়। তুমি কোনো কাজের কর্তা নও । কোনো কর্তব্যও নেই তোমার । কাজ তো প্রকৃতির। প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে কর্তব্যরত আছে। তুমি ভাবছো, তুমি করছো ? এই ভাবনায় তোমাকে কর্তা বানিয়েছে। আর এই ভাবনাই তোমাকে কর্ম্মফল ভোগাচ্ছে।
তুমি অসঙ্গ - কোনো সঙ্গী সাথী নাই। কেউ তোমার সাথী নন। কারুর সাথী তুমি নয়। মিথ্যে সম্পর্কের জালে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছো। যাদেরকে তুমি আজ তোমার জীবনের সাথী ভাবছো, একটু ধীর হয়ে বিচার করে দেখো, এরা কেউ তোমার সাথে আসে নি আবার তোমার সাথে যাবেও না। তুমি যেমন একা এসেছিলে আবার একা চলে যাবে।
তুমি নিস্পৃহ অর্থাৎ স্পৃহাশুন্য হও । সমস্ত আসক্তি, সমস্ত বিরক্তি দূর হোক তোমার। তুমি অনাসক্ত হয়ে, নিজের স্বরূপকে উপলব্ধি করো।
তুমি শান্ত - অর্থাৎ তোমার মধ্যে কোনো চঞ্চলতা নেই , অবিচল। বিষয় বৈচিত্র তোমার মধ্যে চঞ্চলতার ঢেউ তুলছে। এই ঢেউ তোমার ভিতরে নেই। সমুদ্র যেমন কুলের কাছে, ঢেউয়ের তরঙ্গ তোলে, আর কূলে আছড়ে পড়ে, কিন্তু সমুদ্রের গভীরে সমুদ্র শান্ত। তুমিও আসলে ভিতরে ভিতরে শান্ত। তোমার সেই শান্তভাবে মধ্যে নিজেকে দাও।
তুমি পূর্ণ অর্থাৎ তোমার কোনো কিছুর অভাব নেই। যিনি স্বরূপেই পূর্ণ। ঋষি অষ্টাবক্র বলছেন, হে জনক, তুমি সাক্ষী মাত্র, যাকিছু তোমার সামনে ঘটছে, এই সব কর্ম্মের কর্তা তুমি নও, তোমার কিছুই করার নেই। তুমি বিভু, অর্থাৎ সেই এক এবং অদ্বিতীয় চিৎ শক্তির অংশ তুমি, তোমাতে সব কিছু পূর্ন অবস্থাতে আছে, তুমিই সেই অকৃত্তিম ভাব, তাই কোনো অভাব তোমার নেই, তুমি মুক্ত, বন্ধনহীন, সমস্ত দৃশ্যমান জগৎ, স্থূল জগৎ, সূক্ষ্ম জগৎ তোমাতেই স্থিত। তুমি ভিন্ন কিছু নেই, তাই তুমি অসঙ্গ। কর্ম্ম করছে প্রকৃতি তুমি নও, তোমার চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই, তাই তুমি নিস্পৃহ। তুমি স্থির-শান্ত কেননা সর্বত্রই তোমার অবস্থিতি, এই অবস্থায় নিজেকে সংসারী ভাবা অজ্ঞান ছাড়া কিছু নয়।
এখন কথা হচ্ছে, আমি আত্মা, আমাতেই জগৎ স্থিত। এই কথার অর্থ আমাদের কাছে, বোধগম্য নয়। সৃষ্টি থাকলে, স্রোষ্টা থাকবে। দৃশ্য থাকলে দ্রষ্টা থাকবে। জ্ঞান থাকলে জ্ঞানী থাকবে। জ্ঞাতা থাকলে জ্ঞেয় থাকবে। কার্য্য থাকলে, কারন থাকবে। অর্থাৎ সব কিছুর মধ্যে একটা দ্বৈত ভাব আমরা দেখতে পাই। কিন্তু অষ্টাবক্র ঋষি বলছেন, তুমিই সেই পরমাত্মা যার থেকে সবকিছু দৃশ্যমান হচ্ছে। তো এই দ্বৈত ধারণা থেকে আমরা বেরুবো কি করে ?
উপনিষদের একটা বিখ্যাত শ্লোক আমরা সবাই শুনেছি। তাতে বলছেন :
ওঁ পূর্নমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্নমেবাবশিষ্যতে
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।
আমাদের ঋষিদের কি গভীর অন্তর্দৃষ্টি ছিল। ওঁ, উহা পূর্ণ, ইহাও পূর্ণ। পূর্ণ হতে পূর্ণ উদগত হন। পূর্ণের পূর্ণত্ব গ্রহণ করলে পূর্ণই মাত্ৰ অবশিষ্ট থাকে। শূন্য থেকে শূন্য নিলে শূন্যই অবশিষ্ট থাকে।
একটা কারন থেকে আর একটা কারণের উৎপত্তি হয়, কিন্তু কারণের নিস্পত্তি হয় না। প্রদীপ শিখা থেকে আর একটা প্রদীপ শিখার জন্ম হয়, প্রদীপ যেমন ছিল তেমনি থাকে।একটা জীব থেকে আর একটা জীবের জন্ম হয়, কিন্তু জীবটি যেমন ছিল, তেমনই থাকে। একটা মানুষ থেকে, আর একটা মানুষের জন্ম হয়, কিন্তু মানুষটি যেমন ছিল, তেমনই থাকে। তেমনি আত্মা থেকে আত্মার জন্ম, আত্মা যেমন ছিল, তেমনই আছে। এ এক অদ্ভুত রহস্যঃ যা অষ্টাবক্র ঋষি জনকের মাধ্যমে আমাদের বলছেন।
ঋষি অষ্টাবক্র বলছেন : আত্মা এক অর্থাৎ ভেদরহিত অদ্বিতীয় ; মুক্ত অর্থাৎ মায়া বা তার কার্যের অতীত ; চিদরূপ অর্থাৎ চৈতন্য স্বরূপ, স্ব-প্রকাশিত অর্থাৎ নিজেকে নিজে প্রকাশ করছেন বা প্রকাশবান হচ্ছেন ; অক্রিয় অর্থাৎ সমস্ত ক্রিয়াহীন ; অসঙ্গ অর্থাৎ সর্বসন্মন্ধের উর্ধে ; নিঃস্পৃহ অর্থাৎ কোনো কিছুতেই স্পৃহা নেই ; শান্তস্বরূপ অর্থাৎ সমস্ত প্রবৃত্তির উর্ধে তিনি।
কূটস্থং বোধম অদ্বৈতম আত্মানং পরিভাবয়
আভাস অহং ভ্ৰমং মুক্তা ভাবং বাহ্যম অথান্তরম । (১/১৩)
-আমি অহঙ্কাররূপ এই ভ্রম, দেহাদি আমার, এই বাহ্যভাবনা এবং আমি সুখী দুঃখী এই বিমূঢ় ভাবনাসমূহ পরিত্যাগ করে অকর্তা অসঙ্গবোধস্বরূপ ব্যাপক অদ্বিতীয় আত্মাকে চিন্তা করো।
আমি আমি এই ভাবনা, এই বোধ ত্যাগ করে কূটস্থ অর্থাৎ পরমাত্মাকে চিন্তা করো। অহং-এ র অভ্যাস, এটা তো আমাদের ভ্রম। এই ভ্রম থেকে অন্তরে বাহিরে মুক্ত হও। তবেই তুমি সুখী হতে পারবে। সুখী হবার এটাই রাস্তা। এটাই একমাত্র পথ। জাগতিক বস্তুতে সুখ খোঁজা মানে দুঃখকে ডেকে আনা। জাগতিক বস্তুতে সুখ দুঃখ মিশ্রিত। দুঃখ বাদ দিয়ে সুখ আলাদা করা যায় না। সুখের সঙ্গে দুঃখ আবার দুঃখের সঙ্গে সুখ, লবন মিশ্রিত জলের মতো। আলাদা করা যায় না। কিন্তু ঈশ্বরে বা আত্মায় আনন্দই আনন্দ। অতএব অহং এর ভ্রম থেকে মুক্ত হও। এবং অন্তরের আনন্দ উপলব্ধি করো।
দেহ-অভিমান-পাশেন চিরং বদ্ধ -অসি পুত্রক
বোধঃ -অহং জ্ঞ্যান -খড়্গেন তন্নিঃকৃত্য সুখী ভব। (১/১৪)
দেহ -অভিমান পাশে চির আবদ্ধ হয়ে আছো আমার পুত্র। জ্ঞান খড়গ দ্বারা এই অহং-বোধ ছিন্ন করে তুমি সুখী হও।
-হে পুত্রসম শিষ্য ! সুদীর্ঘকাল যাবৎ তুমি দেহাত্ম-অভিমানে বদ্ধ হয়ে আছো, সুতরাং "আমি শুদ্ধচৈতন্যস্বভাব" এই ভাবনারূপ খড়গ দ্বারা দেহাত্ম-অভিমান নিঃশেষে ছিন্ন করে সুখী হও। সত্যের জ্ঞানই তোমাকে সুখী করতে পারে। আমি-আমার এই ভাবনা পরিত্যাগ করো। তবেই প্রকৃত সুখী হতে পারবে।
ভগবান বুদ্ধের এক শিষ্য ছিল। সকাল বেলা তাকে মাধুকরিতে যেতে হতো। তো এই মাধুকরিতে যেতে যেতে, এক বারবনিতার সাথে ভাব হলো। ভাব গভীর আসক্তিতে পরিণত হলো। এখন প্রতিদিন শিষ্য একই গ্রামে মাধুকরী করতে আসে, কেননা ওই বারবনিতাকে সে মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছে। প্রতিদিন তাকে একবার না দেখলে, তার মন বিষণ্ণ হয়ে ওঠে । কিন্তু গ্রামের লোক বিরক্ত হলো। এখন আর তাকে সবাই ভিক্ষা দেয় না। ফলত ভিক্ষা সংগ্রহের পরিমান কমতে লাগলো। ভগবান বুদ্ধের কাছে খবর গেলো। ভগবান বুদ্ধ শিষ্যকে ডেকে পাঠালেন। শিষ্য সব বললো। এবং এও বললো, ওই বারবনিতা-কে ছাড়া সে বাঁচতে পারবে না। ভগবান বললেন - সামান্য দেহকে তুমি ভালো বেসেছো ? এই দেহতো অস্থায়ী। হাড় মাংসের পিন্ড মাত্র। শিষ্য বললো - এসব কি বলছেন আপনি ? আমি ওকে ভালোবাসি। আমাকে ছেড়ে দিন। আমি ওকে বিয়ে করে সংসারী হবো। ভগবান বললেন ঠিক আছে, তুমি এই আশ্রম ছেড়ে তিন দিন কোথাও যাবে না। তিন দিন পরে তুমি যদি ওকে বিয়ে করতে চাও তবে আমি নিজে সব ব্যবস্থা করব। শিষ্য আনন্দে আত্মহারা। তিন দিন ধরে শয়নে স্বপনে বারবনিতাকে দেখতে লাগলো। তার রূপে মুগ্ধ হয়ে রইলো। তিন দিন পরে, শিষ্যকে নিয়ে ভগবান চললেন বারবনিতার কাছে। বারবনিতা দু দিন আগে মারা গেছে। ঘরের মধ্যে তার দেহে পচন ধরেছে। দুর্গন্ধের চোটে তার কাছে যাওয়া যাচ্ছে না। ভগবান বললেন এই তোমার রূপবতী ? যাকে তুমি ভালো বেসেছিলে ? শিষ্য দেখলেন অসাধারন রূপবতী কেমন কুৎসিত হয়ে গেছে। যার পাশে দাঁড়ালে সুগন্ধে প্রাণ মন নেচে উঠতো। তার কাছে এখন নাক চাপা দিয়েও দাঁড়ানো যাচ্ছে না। যাকে দেখে চোখ ফেরানো যেত না। তার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। শিষ্য সত্য বুঝতে পারলো। ভগবান বুদ্ধের পা জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো।
আমাদের দৈহিক রূপ, নিষ্ঠূর ভাবে ক্ষণস্থায়ী। যৌবনে যার দিকে তাকালে চোখ ফেরানো যেত না, বার্ধক্যে তাকে আর সহ্য হয় না। মৃতদেহতো অচ্ছুৎ হয়ে যায়। ছুঁলে স্নান করতে হয়। কি নিষ্ঠূর এই সত্য। তাই আচার্যদেব বলছেন দেহাভিমান ত্যাগ করো। এ-সবই অসত্য, ক্ষণস্থায়ী। তুমি না চাইলেও এগুলো তোমাকে ছেড়ে যাবে, তাই এগুলো তুমি নও, তোমার নয়, এই সত্য উপলব্ধি করো।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।
অষ্টাবক্র গীতা ( নতুন সংস্করণ) ত্রয়োদশ পর্ব।
নিঃসঙ্গো নিষ্ক্রিয় অসি ত্বং স্বপ্রকাশো নিরঞ্জনঃ
অয়মেব হি তে বন্ধঃ সমাধিম্ অনুতিষ্ঠসি। (১/১৫)
তুমি তো নিঃসঙ্গ, নিষ্ক্রিয়, স্ব-প্রকাশ নির্মল পরব্রহ্ম হয়েও তুমি যে সমাধিরূপ ক্রিয়া অনুষ্ঠান করছো, এটাই তোমার বন্ধন।
তুমি নিঃসঙ্গ অর্থাৎ সর্বসন্বন্ধ শুন্য, অর্থাৎ তুমি তোমার আত্মীয়-স্বজন, পিতা-মাতা ভাই বোন - এদের সঙ্গে যে তুমি সম্পর্কযুক্ত ভাবছো। এটি তোমার ভ্রান্ত ধারণা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, আজ যাদের সঙ্গে তুমি সম্পর্কযুক্ত, কে বলতে পারে, এরা আগের জন্মে তোমার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল কিনা। অথবা পরের জন্মে সম্পর্কযুক্ত থাকবে কিনা। অষ্টাবক্র বলছেন, তুমি নিষ্ক্রিয় অর্থাৎ সর্ব ক্রিয়া রোহিত, . ভগবান অর্জুনকে বলছেন, তুমি কি ভাবছো, আজ যুদ্ধক্ষেত্রে তোমার সামনে যারা যুদ্ধে উদ্দত তারা তোমার হাতে হত হবে, বা তুমি তাদের হাতে হাত হবে, তোমার এই ধর্ণা ভ্রান্ত। যা করবার তা আমি আগেই করে রেখেছি। তো যা আগেই করা হয়ে গেছে, যা অবশ্যম্ভাবী, তাতে মানুষের বা জীবের কি করবার আছে ? ঋষি অষ্টাবক্র বলছেন, তুমি স্বপ্রকাশ অর্থাৎ স্বয়ং প্রকাশ, নিজেই নিজের প্রকাশক। এবং নিরঞ্জন অর্থাৎ কালিমাবিহীন আত্মা। তো এর পরেও, তুমি যে পতঞ্জলি কথিত বৃত্তি-নিরোধাত্মক সমাধি ইত্যাদির অনুষ্ঠান করবার চেষ্টা করছো, এটাই তোমার বন্ধন। অর্থাৎ তুমি ঈশ্বর থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভেবে, নিজেকে আবার ঈশ্বরের সন্ধানই রত করছো, এই ভ্রান্ত লড়াই থেকে নিজেকে নিষ্ক্রিয় করো।
আমাদের একটা ধারণা হচ্ছে, এই সংসার বন্ধন থেকে আমাদের মুক্তির জন্য লড়াই করতে হবে। দান ধ্যান করতে হবে, সত্য কথা বলতে হবে, ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে,যোগক্রিয়া করতে হবে, যাগযজ্ঞ করতে হবে, সমাধি লাভ করতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। ঋষি অষ্টাবক্র বলছেন, এই যে এটা ক'রে, ওটা ক'রে তুমি মুক্তির জন্য চেষ্টা করছো, এই ভাবনাই তোমার বন্ধন।
ঋষি অষ্টাবক্র বলছেন, তুমি যে বন্ধন থেকে মুক্তির জন্য চেষ্টা করছো, অর্থাৎ ধ্যান-সমাধির জন্য সচেষ্ট হচ্ছো, এটাই তোমার বন্ধনের লক্ষ্মণ। নিজেকে যে বদ্ধ ভাবে সেই বদ্ধ। তাই সে মুক্তির জন্য লাফালাফি করে। আসলে নিজেকে নিজেই কল্পনায় বাঁধে, আবার মুক্তির জন্য সচেষ্ট হয়। হায় ভগবান, কত সাধক যে কত জন্ম, জন্মান্তর ধরে মুক্তির সাধনা করে যাচ্ছে তার ঠিক নেই। সবই ভাবনা। সবই কাল্পনিক। বন্ধনও কাল্পনিক, মুক্তিও কাল্পনিক। মিথ্যে ভাবনার অবসানেই সত্য আসবে। আমরা নিজেকে জানতে পারবো। কবে সেই দিন আসবে ? এক্ষুনি আসতে পারে, নতুবা কোনোদিনই নয়। অন্ধকার দূর করতে সময় নয়, শুধু নিজেকে ঝাঁকানো, সুইচ টেপার অপেক্ষা মাত্র। চারিদিকে আলো। আমি কেবল দরজা জানলা বন্ধ করে আছি। মিথ্যে অন্ধকার আমাকে ঘিরে রেখেছে। শুধু ভাবনার পর্দাটা ছিড়ে দাও। আলো - আলো। .... মুক্তি মুক্তি।........
সমস্ত শাস্ত্র মুক্তির কথা বলছে, এখন কথা হচ্ছে, মুক্তি বলতে আমরা কি বুঝি। একটা জাগতিক মুক্তি, আর একটা আধ্যাত্মিক মুক্তি। জাগতিক বা সামাজিক কিছু বন্ধনের মধ্যে আমরা আবদ্ধ। আমাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা চাই, আমরা ভয় থেকে মুক্তি চাই, শিক্ষার স্বাধীনতা চাই, আমরা ধর্মাচরণের স্বাধীনতা চাই, আমরা বাক স্বাধীনতা চাই, রাজনৈতিক স্বাধীনতা চাই ইত্যাদি ইত্যাদি । এই সব স্বাধীনতা আমরা রাষ্ট্রের কাছে, বা সমাজের কাছে দাবি করতে পারি।
আমার ছোটবেলায়, ভোররাতে উঠে হারিকেনের আলোয় পড়াশুনা করতে হতো। শীতের সকালে ওঠা একটা বিরক্তিকর ব্যাপার ছিল। ভোরের আলো ফুটলে, দাঁত-মুখ ধুয়ে, বাহ্য ইত্যাদি কর্ম্ম সেরে আবার পড়াশুনা করতে হতো। তো সকাল বেলা বাবা যখন চেম্বারে চলে যেতেন, তখন একটা মুক্তির আনন্দ পেতাম। বছর শেষে বাৎসরিক পরীক্ষা হয়ে গেলে, লেপমুড়ি দিয়ে মুক্তির আনন্দ উপভোগ করতাম। বিকেলবেলায়, স্কুল ছুটির পরে, একটা মুক্তির আনন্দ পেতাম। অভিভাবকের চোখ এড়িয়ে, বিলের জলে মাছ ধরতে গিয়ে একটা মুক্তির আনন্দ পেতাম। গাছের মগডালে উঠে পেয়ারা খেতে একটা মুক্তির আনন্দ পেতাম। বড়ো হয়ে অফিস ছুটির পরে একটা মুক্তির আনন্দ পেতাম। এখন আমি স্বাধীন, সকালবেলা ইচ্ছেমতো বিছানায়, বালিশ আঁকড়ে শুয়ে থাকতে পারি। সারাদিন ছুটি। অভিভাবক-হীন জীবন কিন্তু সেই মুক্তির আনন্দ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। মুক্তি কি দাসত্ত্বের বেড়াজাল ডিঙোনো ? ভয় থেকে মুক্তি ? কিসের ভয় আমার ? প্রচন্ড রাগী গম্ভীর পিতা দেহ রেখেছেন। যার ভয়ে ভোররাতে পড়তে বসতে বাধ্য হতাম। আজ সেই প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রিয়নাথ শিকদার নেই, যার ভয়ে আমার মতো অনেক শিশু প্যান্টে হিসু করে দিতো। আজ সেই অবসরপ্রাপ্ত মিলিটারি অফিসার - শিক্ষক নীহাররঞ্জন রায়চৌধুরী নেই, যার গুরু গম্ভীর আওয়াজ, আমাদেরকে ভীত করে তুলতো। আজ সেই সন্তোষ মাস্টারমহাশয় নেই, যার শ্লেষাত্মক বাক্যবাণ আমাদের মাথা নত করে দিতো। আজ অফিসের বসের তীক্ষ্ণ নজরের বাইরে চলে এসেছি। স্বাধীন জীবন। তবু কোথায় যেন একটা বন্ধন।
মহাত্মাগণ বলছেন, জীবাত্মা জন্ম-জন্মান্তরের প্রবৃত্তির দাস, সে তার আবেগ ও তার বিশ্বাসের দাস। এই যে জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কার যা আমাকে বদ্ধ করে রেখেছে, সেখান থেকে আমাদের মুক্তি কিভাবে হবে ? আমরা কেউ এই শরীর নোই, আমরা কেউ জ্ঞানী নোই, আমরা কেউ অজ্ঞানী নোই, আমরা কেউ মন নোই, আমরা কেউ বুদ্ধি নোই, এই বোধ যখন আসে, তখন আমাদের জীবসত্ত্বা চেতন কেন্দ্রে অবস্থান করে থাকে। আর এই চেতন কেন্দ্র হচ্ছে জীবাত্মার অবস্থান কেন্দ্র। জীবাত্মা তখন উন্মুখ হয়, পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হবার জন্য। এই যে আকাঙ্খা বা বলা যেতে পারে, স্বাভাবিক পরিণতির দিকে ধাবিত হওয়ার প্রক্রিয়া, এটাকে গতিশীল করবার নামই মুক্তি। এই মুক্তি স্বাভাবিক, শুধু উন্মোচিত হওয়া মাত্র। অর্থাৎ চেতনার উন্মেষ হওয়া মাত্র। অষ্টাবক্র ঋষি বলছেন, মুক্তির আকাঙ্খা থেকে মুক্তি পাওয়াই আসল মুক্তি। মুক্তির আশায় আমরা যে চেষ্টায় রত থাকছি, এটাই বন্ধনের মূল।
বহু যুগের অজ্ঞানের অন্ধকার, জীবাত্মাকে বিশ্বচৈতন্য থেকে তার অস্তিত্ত্বভাবের মধ্যে বিপর্যয় জ্ঞান এনে দিয়েছে। ঈশ্বর ব্যতীত পৃথক সত্তাবোধই বন্ধন। মুক্তি অর্থাৎ জীব-ভাবের সমাপ্তি। যতদিন না নিজ অনন্ত-স্বরূপের উপলব্ধি জীবের মধ্যে আসছে, ততদিন তার দুর্ভোগ, দুর্গতি, যন্ত্রনা। ততদিন তাকে জন্ম-মৃত্যুর চক্রের বন্ধনের মধ্যে দিয়েই যেতে হবে। আমাদের যতদিন শরীরবোধ না যাবে , মনের আসক্তি না যাবে , ততদিন আমাদের আত্ম-উপলব্ধি হওয়া সম্ভব নয়। এটি খুব কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়।
আমার এক বন্ধু ছিল, হিরু। ও জুতো সেলাইয়ের কাজ করতো। ওর মা, বাবা, আত্মীয় স্বজন বলে কেউ ছিল বলে জানি না। ওকে জুতো সেলাই করতে দিলে, কিছুদিন সে নিজেই সেটা ব্যবহার করতো। তারপর ফেরত দিতো। এতেই ও আনন্দ পেতো। শুনেছি, ও আরেকটা অদ্ভুত কাজ করতো, আর তা হচ্ছে, অন্যের হয়ে জেল খাটতো। তো আমি তাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, হিরু, লোকে জেলে যেতে ভয় পায়। আর তুমি অন্যের অপরাধে নিজেকে শাস্তি দেও কেন ? তো হিরু হেসে জবাব দিয়েছিলো, জেলে ভারী মজা। কোনো কাজ করবার জন্য, চিন্তা করতে হয় না। জেলাররা কাজ দেয়। খাওয়া, শোয়া ফ্রি। এছাড়া যার হয়ে জেল খাঁটি, তার কাছ থেকেও কিছু পাই। মস্ত বড়ো দালানের মধ্যে থাকি। নিশ্চিন্ত জীবন।
আসলে আমাদের বদ্ধজীবন। আমরা বদ্ধ জীবনে থাকতে থাকতে, এই বদ্ধ জীবনেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাই, আমাদের একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়, এই বদ্ধ জীবন। এই রকমই আত্মকেন্দ্রিক অশুদ্ধ জীবনে আমরা সন্তুষ্ট, মুক্তির কথা আমরা ভাবতেই পারি না। আমরা ভাবি, পাগলরাই এইসব মুকি-ফুক্তির কথা ভাবতে পারে। অথবা মহাত্মাগণ এইসব মুক্তির কথা ভাবতে পারে।
বেদান্ত দর্শন বলছে, যেখানে প্রকৃতি নেই, যেখানে পরিবর্তন নেই, যেখানে কোনো পরিনাম উৎপন্ন হয় না সেখানেই যথার্থ মুক্তি। এটি কোনো মুক্ত স্থান নয়, এটি দূরে নয়, কাছে নয়, এটি আমাদের ভিতরে। মুক্তি হচ্ছে বদ্ধ-বোধের অভাব। এটি আমাদের উচ্চতর চেতন অবস্থা মাত্র। জগতের সমস্ত ধর্ম্মই এই মুক্তির কথা বলে থাকে। কেউ বলছে, পাপ থেকে মুক্তি, কেউ বলছে বাসনা থেকে মুক্তি, কেউ বলে কর্ম্মফল থেকে মুক্তি। সাংখ্য দর্শন বলছে, ত্রিবিধ দুঃখ থেকে মুক্তি। অর্থাৎ অর্থাৎ শারীরিক অসুস্থতা, কামনা বাসনা লোভ লালসা থেকে মুক্তি, বন্য জীবজন্তু বা বা খারাপ মানুষ থেকে যে দুঃখের উৎপন্ন হয়, তার থেকে মুক্তি। এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মুক্তি। আর আমাদের মতো সাধারণ মানুষ চাই, শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রনা থেকে মুক্তি।
ঋষি অষ্টাবক্র এইখান থেকে আরো উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেলেন রাজা জনককে। বললেন, সমস্ত গুনের থেকে মুক্তি, বিশ্বশক্তির অর্থাৎ প্রকৃতির এলাকার বাইরে বেরিয়ে এসো। আসলে বাইরে তুমি আছোই, কিন্তু তোমার বহুদিনের অভ্যাস তোমাকে ভ্রান্তির মধ্যে আবদ্ধ করে রেখেছে। তোমার এই ভ্রান্তি যখন কেটে যাবে, যখন তুমি তোমাকে চিনতে পারবে, তখন তুমি বুঝতে পারবে, তোমার বন্ধন বলে কিছু নেই। তোমারই স্বরচিত ভাবনা তোমাকে বদ্ধ ভাবনায় আবদ্ধ করে রেখেছে। বলছেন, বহুযুগের ভ্রমরূপ নিদ্রায় তুমি আচ্ছন্ন। এই দীর্ঘ-নিদ্রা থেকে জেগে উঠলেই এই বন্ধন সম্পর্কে তোমার যে ভ্রান্ত ধারণা আছে তা তোমার কেটে যাবে।
এক রাজার ছেলেকে ছোটবেলায়, ডাকাতেরা নিয়ে গিয়েছিলো, তো ডাকাতদের সাথে সে নিজেকে এক বলে ভাবতো। একদিন রাজার সান্ত্রীরা তাকে চিনতে পেরে, রাজার কাছে নিয়ে গেলো, এবং তার সঠিক পরিচয় দিলো। রাজার ছেলে আর তখন ডাকাত-পুত্র রইলো না। সে এখন রাজপুত্র হয়ে গেলো। আসলে তুমি সেই রাজার ছেলে, বিশ্বপিতার সন্তান তুমি। বিশ্বপিতার রক্ত আর তোমার রক্ত এক। বিশ্বপিতার চেহারা আর তোমার চেহারা এক। বিশ্বপিতার সমস্ত গুন্-সম্পত্তির অধিকারী তুমি। তুমি আজ তোমাকে শরীর-মন-বুদ্ধি-স্মৃতি বলে ভাবছো। তুমি আনন্দ-স্বরূপ। তোমার মধ্যেই সমস্ত ভাব, এই জগৎ তোমাতেই স্থিত। তোমার আবার অভাব কিসের ? আত্ম মুক্তির জন্য কোনোরকম চেষ্টা করা, এমনকি চেষ্টা করবার ইচ্ছে করা নিতান্তই অমূলক। তুমি যথার্থই মুক্ত, নিজেকে বদ্ধ ভাবা, এবং বন্ধন থেকে মুক্তির চেষ্টা করা, আমাদের মস্তিস্ক বিকৃতির লক্ষণ।
আমাদের মধ্যে তিনটি শক্তি কাজ করছে। সত্ত্ব, রজঃ তমঃ। জ্ঞান-কর্ম্ম-আলস্য। আমরা সবাই বুঝি আলস্য ভালো নয়, কর্ম্ম আমাদের বন্ধনের কারন, আর জ্ঞান আমাদের সত্যের সন্ধান দেয়। একটা কথা মনে রাখতে হবে, জ্ঞানলাভ আমাদের উদ্দেশ্য নয়, আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্যকে জানা, নিজেকে জানা। এটা জ্ঞানের সাহায্যে হতে পারে, আবার ভ্রান্তজ্ঞান আমাদের অসত্যের কাছে টেনে নিতে পারে। সত্ত্বগুণ আমাদের লক্ষে নিয়ে যাবার রাস্তা হতে পারে, সিঁড়ি হতে পারে। কিন্তু রাস্তা কখনো লক্ষ হতে পারে না। তাই অষ্টাবক্র ঋষি বলছেন, তুমি না জ্ঞানী, না অজ্ঞানী। আসলে মায়া থেকে উদ্ভূত আমাদের অহং ভাব আমাদের জ্ঞানী অজ্ঞানী করেছে। এই গুণাবলীর উর্দ্ধে উঠতে হবে। তবেই স্বরূপকে জেনে, মুক্তাবস্থার স্বাদ গ্রহণ করতে পারবে।
বিচিত্র এই মানুষের প্রকৃতি। আর আমরা এই প্রকৃতি বা স্বাভাবিক স্বভাবের মাধ্যমে নিজেকে আবৃত্ত করে রেখেছি।অষ্টাবক্র মুনির আহ্বান নিজের প্রকৃতি থেকে বেরিয়ে এসো, স্বভাব থেকে এসো । স্বরূপে নিজেকে জানো - চরম সত্যের সম্মুখীন হও। তোমার জাগতিক স্বভাবের রূপান্তর হোক। তাহলেই তুমি উন্মুক্ত হতে পারবে। সবার মধ্যে দুটো ভাব বর্তমান, ভালো-মন্দ, জ্ঞান-অজ্ঞান, সুর-অসুর, - এই যে মিশ্রণ এটি তোমাকে আত্ম-উপলব্ধি বাধা স্বরূপ। ভালো-মন্দের উর্ধে নিয়ে যাও নিজেকে - আর মুক্তির আস্বাদ পেতে থাকো। নিজের আনন্দ-স্বরূপে উপলব্ধি করো নিজেকে। ঋষি অষ্টাবক্রের এই আহ্বান রাজা জনককে উদ্বুদ্ধ করেছিল, আমাদেরকেও উদ্বুদ্ধ করুক।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
অষ্টাবক্র গীতা - (নতুন সংস্করণ) চতুর্দশ পর্ব।
এক স্বামীজীর মুখে শুনছিলাম : যদি তোমারা ভাবের জগতে কেঁদে কেটে ভগবান লাভ করতে চাও তো ভাগবত পড়ো, ভাগবত শোনো। কেঁদে কেঁদে সুখ পাবে। ভগবানকেও পেয়ে যেতে পারো। আর যদি তর্ক করে ভগবানকে জানতে চাও বা পেতে চাও , তবে শ্রীমৎ ভগবৎ গীতা পড়ো। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের, কথায় কথায় তর্ক করার জায়গা পাবে। এই করে ভগবানের সান্নিধ্যে যেতে পারবে। আর যদি সত্য জানতে চাও তবে অষ্টাবক্র সংহিতা পড়ো।
তবে একটা কথা বলি - আত্ম উপলব্ধি সবসময় অস্ফুট। এমন ভাবার কোনো কারন নেই যে, মহান শিষ্য রাজা জনক, এই কথাগুলো চিৎকার করে, তার গুরুদেব মহামুনি অষ্টাবক্রকে বলেছেন। আসলে তাঁর ভেতরের উপলব্ধি লেখক ব্যক্ত করছেন। আমাদের শোনানোর জন্য। এইগুলি গুরু-শিষ্যের অব্যক্ত অনুভূতি মাত্র। লেখক আমাদের শোনাচ্ছেন সেই অন্তরের অনুভূতির কথা।
মহান ঋষিরা যে আদর্শকে আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য বলে বারবার বলেছেন তা হলো আত্মউপলব্ধি। আর এই আধ্যাত্মিক জাগরণ হয় দুটি কারণে প্রথমতঃ গুরুকৃপায়। আর দ্বিতীয়তঃ শিষ্যের ব্যাকুলতায় । কোনো আচার অনুষ্ঠান, পূজাপাঠ, গ্রন্থপাঠ, কোনো কিছুই এই উপলব্ধি করাতে পারে না। ভন্ড গুরুরা তো স্বর্গের পথ দেখায়। অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার বড়াই করে। কিন্তু প্রকৃত গুরু জীব-আত্মার সঙ্গে পরম-আত্মার যোগ করে দেয়। এবং শিষ্য উপলব্ধি করেন যে তাঁরা উভয়েই একই আত্মা।
আমরা আসলে আমাদের দিব্য সত্ত্বাকে ভুলে গেছি। আমাদের সংসার জীবনে বাসনার দাস হয়ে গেছি। তো কেউ একজন যখন আমাদের মনে করিয়ে দেয় - আমাদের প্রকৃত স্বরূপ কী। তিনিই গুরু। যিনি অন্ধকার থেকে আলোয় আসবার ব্যবস্থা করে দেন। যিনি আমাদের মোহযুক্ত ভ্রান্ত ধারণা থেকে মুক্ত করে আমাদের স্বরূপে স্থিত করেন। অর্থাৎ আমাদের মনে করিয়ে দেন যে আমি কে ! তিনিই সদগুরু।
একটা গল্প শুনেছিলাম, আপনারাও শুনে থাকবেন। : এক বাঘিনী প্রসবকালে, একটি বাচ্চা প্রসব করে মারা যায়। এক মেষপালক মেষ চড়াতে এসে বাঘের বাচ্চাকে দেখে মায়া হয়। এবং তাকে সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে যায়। তার তো অনেক ভেড়া অর্থাৎ মেষ ছিল। তাদের সঙ্গেই তাকেও অর্থাৎ বাঘের বাচ্চাকেও পালন করতে লাগলো। বাচ্চাটা অন্য ভেড়ার দুধ খেত। একটু বড়ো হলে তাকে মেষপালক ঘাস খেতে দিতো। বাঘের বাচ্চাটি , ভেড়াদের সাথে মিশে ভেড়ার মতো আচরণ করতে শিখলো। ভেড়ার মতো ডাকতে শিখলো। তাদের খাবার খেতে শিখলো এবং শেষে তাদেরই একজন হয়ে গেল।
বছর কয়েক পরে ওই মেষের পালে বাঘ পড়লো। ধরা পরে গেল বাঘের বাচ্চাটি। ভেড়ার পালের মধ্যে বাঘের বাচ্চা দেখে বাঘটি অবাক হয়ে গেলো। বাঘের বাচ্চাটি ভেড়ার মতোই ডাকতো। বাঘ দেখে সেও অন্যান্য ভেড়ার মতো পালাবার চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু পারলো না। ধরা পরে গেলো। ভীতসন্ত্রস্ত বাঘের বাচ্চা। ভেড়ার মতো আর্তনাদ করতে লাগলো। কিন্তু বাঘটি ওকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলো। আর বাঘের মতো ডাক শেখাতে লাগলো। পুকুরের কাছে টেনে নিয়ে ওর প্রতিবিম্ব দেখাতে লাগলো। মুখে একখন্ড মাংস পুড়ে দিলো। ধীরেধীরে বাঘের বাচ্চা তার স্বমহিমায় ফিরে এলো।
আমরাও মায়ার প্রভাবে নিজেদের স্বরূপ ভুলে গেছি। ভগবৎ কৃপায় পরম-আত্মা স্বয়ং গুরু বা আচার্যরূপে এসে আমাদের উপলব্ধি করতে শেখান যে আমরা দেহ নোই, মন নোই, আমরা সেই শাশ্বত আত্মা।
আমরা যখন অযাচিত কৃপা লাভ করি, বা আকুল হয়ে প্রার্থনা করি, তখন পরমাত্মা স্বয়ং গুরু রূপে বা আচার্য রূপে আমাদের জ্ঞানের আলো দিয়ে আমাদের স্বয়ং-এর উপলব্ধি করান। যিনি তীব্র ভাবে ব্যাকুল, যিনি সর্বস্য ত্যাগে প্রস্তুত, যার আত্মা নির্মল, সেখানে আচার্য্য বা আধ্যাত্মিক গুরু অধ্যাত্ম স্পন্দন সঞ্চারণ করেন। এই অনুভূতি এক বিরল অভিজ্ঞতা। যা আমরা মহাত্মা রাজা জনকের মুখ থেকে খানিকটা শুনেছি, আবার পরবর্তীতে শুনবো।
আমরা মিথ্যা অহং বোধে ডুবে আছি। দেহ ও আত্মার ভেদ বুঝি না। আমি এবং আমার দেহ এর মধ্যে পার্থক্য করতে পারি না। প্রতিদিন আমার দেহ পরিবর্তন হচ্ছে, তবু এই দেহকেই "আমি" বলে ভ্রমে আবদ্ধ আছি। এবং দুঃখ কষ্ট ভোগ করছি। আমরা যতক্ষন দেহাতীত না হতে পারছি, ততক্ষন আমার বিড়ম্বনা চলতেই থাকবে। গুরুপ্রদত্ত জ্ঞানই পারে এই দেহবোধের উর্দ্ধে প্রতিষ্ঠিত করতে।
আমরা সবাই ত্রিতাপ দুঃখ অনলে পুড়ে মরছি। এর মধ্যে একটি স্ব-কৃত কর্মফল, অন্যটি অন্য জীবদের দেওয়া দুঃখ, আর সব শেষে প্রকৃতির রোষানলে অসহায় অবস্থা। আর এর মধ্যে সব থেকে বেশি কষ্ট পাই, আমার স্ব-কৃত কর্মের দ্বারা। আমাকে এই ত্রিতাপ থেকে মুক্তি পেতে হবে। কিন্তু সত্যি কি এইসব দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব ? সম্ভব কিন্তু কি ভাবে, সেই কথাই মহামুনি অষ্টাবক্র তার শ্লোকে শ্লোকে বলেছেন।
আমরা সবাই ত্রিতাপ দুঃখ অনলে পুড়ে মরছি। এর মধ্যে একটি স্ব-কৃত কর্মফল, অন্যটি অন্য জীবদের দেওয়া দুঃখ, আর সব শেষে প্রকৃতির রোষানলে অসহায় অবস্থা। আর এর মধ্যে সব থেকে বেশি কষ্ট পাই, আমার স্ব-কৃত কর্মের দ্বারা। আমাকে এই ত্রিতাপ থেকে মুক্তি পেতে হবে। কিন্তু সত্যি কি এইসব দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব ? সম্ভব কিন্তু কি ভাবে, সেই কথাই মহামুনি অষ্টাবক্র তার শ্লোকে শ্লোকে বলেছেন।
ত্বয়া ব্যাপ্তমিদং বিশ্বং ত্বয়ি প্রোতং যথার্থতঃ
শুদ্ধ-বুদ্ধ-স্বরূপ অস্ত্বং মা গমঃ ক্ষুদ্রচিত্ততাম্। (১/১৬)
তুমিই এই বিশ্বে ব্যাপ্ত, তোমাতেই এই বিশ্ব পরিব্যাপ্ত। তুমি সর্বত্র ওতপ্রোত হয়ে রয়েছো। তুমিই শুদ্ধ , বুদ্ধ , এ সবই তোমার স্বরূপ। তুমি ক্ষুদ্র-চিত্ত বা দীন-চিত্ত হয়ে যেও না।
একই কথা বার বার শুনতে শুনতে যেমন আমাদের ভ্রম উৎপন্ন হয়েছিলো। এই ভ্রম উৎপাটনের রাস্তাও হচ্ছে স্ব-রূপের কথা বার বার স্মরণ করা। তবেই মুক্ত বোধ করা সম্ভব। কাটা দিয়ে কাটা তোলা। তাই মহামুনি অষ্টাবক্র বার বার একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে স্মরণ করাচ্ছেন।
আমি দেখেছি, আজ যারা সাধু-সন্ত হয়েছেন, বিশেষ করে হিন্দুদের মধ্যে, তারা সবাই ছোটবেলা থেকেই কোননা কোনো আদর্শ পুরুষকে অবলম্বন করে অধ্যাত্ম জীবন শুরু করেছিলেন। তা এই আধ্যাত্ম পুরুষ হতে পারে শাস্ত্রের দেব-দেবী বা ঐতিহাসিক মহাপুরুষ।এদের মধ্যে কেউ ভগবান বিষ্ণু, ভগবান শিব, শ্রীগনেশ, মা-কালী বা এমন তরো দেবতাদের প্রতি আকর্ষণ অনূভব করেন। ইষ্টে শ্রদ্ধা- অবনত হন। ইষ্টে স্থিত হন। এই ইষ্ট জাগতিক দিক থেকে বস্তু বা প্রাণী বা জীব বা মানষ-কল্পনাচিত্র মাত্র। কিন্তু এই ইষ্টে নিবিষ্ট হয়ে, স্থিত হন অন্তরে। অনুভব করেন ব্যাপ্তির। অনুভব করেন, সর্বত্র স্থিতির। অনুভবের করেন সংযোগের। এই সংযোগ অনুভূতিই ক্রমে ক্রমে পরম আত্মার সঙ্গে সংযোগ ঘটায়। আত্ম-তৃপ্তি লাভ করেন।
নিরপেক্ষো নির্বিকারো নিৰ্ভয়ঃ শীতলাশয়ঃ
আগাধবুদ্ধি অক্ষুব্ধো ভব চিন্মাত্রবাসনঃ। শ্লোক নং : ১/১৭
তুমি নিরপেক্ষ অর্থাৎ পক্ষ রহিত, নির্বিকার অর্থাৎ বিকার রহিত, নির্ভরঃ অর্থাৎ কারো উপর নির্ভরশীল নয়, অতিশয় শীতল অর্থাৎ সদা শান্ত সুখ স্বরূপ। তোমার অগাধ বুদ্ধি, অক্ষুব্ধো অর্থাৎ কারুর প্রতি তুমি ক্ষুব্ধ নও, সর্ব ক্ষোভ-শুন্য। তুমি চৈতন্যমূর্তি, চৈতন্যেই তোমার বাস বা চৈতন্যেই স্থিতি, তুমিই চৈতন্য।তুমি যে স্বয়ং চৈতন্য স্বরূপ, সেটার বিস্মৃতির অন্তরালে চলে গেছে, তাই নিজেকে পক্ষপাতদুষ্ট করে ফেলেছ। বিষয়ের প্রতি তোমার পক্ষপাত জন্মেছে। আবার তোমার স্বভাব বিকাররহিত, কিন্তু স্বরূপ জ্ঞান থেকে বিচ্ছিন্ন বোধে তুমি নির্বিকার থাকতে পারছো না। এই জ্ঞান যখন উদয় হবে, তখন তুমি শীতল অর্থাৎ শান্ত হবে। তোমার ভিতরেই অগাধ জ্ঞানের অবস্থান। তোমার ভিতরেই সমস্ত বেদ, উপনিষদ, বেদান্ত সমাহিত। তোমার ভিতর থেকেই এগুলোর প্রকাশ ঘটেছিলো। আজও তোমার ভিতরে এগুলো আছে, এগুলোর সাময়িক অভাব বোধে তুমি নিজেকে ক্ষুব্ধ করেছো। চৈতন্যেই তোমার বাস, চৈতন্যই তোমার স্বরূপ। এই বোধ জাগিয়ে তোলো।
সাকারমনৃতং বিদ্ধি নিরাকারং তু নিশ্চলম
এতত্-তত্ত্ব-উপদেশেন ন পুনর্ভবসম্ভবঃ।শ্লোক নং ১/১৮ :
সমস্ত সাকার বস্ত অনৃত্য, (অনিত্য) মিথ্যা। তুমি নিরাকারে নিশ্চল হয়ে থাকো। এই তত্ব উপদেশ প্রাপ্ত হয়ে তুমি সেই বস্তূতে বিশ্রান্তি লাভ করলেই, পূনর্ভব অসম্ভব হবে,অর্থাৎ পুনরায় ভব সংসারে আসতে হবে না, বা মোক্ষ লাভ করতে পারবে। সাকার বস্তুর কোনো স্থিতি নেই। প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল, এই সাকার বস্তুর স্বপ্নবৎ দৃষ্ট হচ্ছে। জ্ঞানের আলোতে স্বপ্ন ভেঙে গেলে তুমি সত্যে উপনীত হবে।
যথা-এব-আদর্শ-মধ্যস্থে রূপে-অন্তঃ পরিতঃ-তু সঃ
তথৈব অস্মিন্ শরীরে অন্তঃ পরিতঃ পরমেশ্বরঃ।শ্লোক নং ১/১৯ :
দর্পনে প্রতিবিম্বিত দেহাদির অন্তরে ও বাহিরে যেরূপ এক দর্পন পরিব্যাপ্ত হয়ে বিদ্যমান, আত্মাতে অধ্যস্থ এই স্থুল দেহাদির অন্তরে ও বাহিরেও তদ্রুপ এক চিদাত্মাই পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন।
আয়নার সামনে দাঁড়ালে, তুমি তোমাকে শরীরের অবয়ব আয়নার মধ্যে একই রকম দেখতে পাচ্ছ। ঠিক আমাদের চিত্তাকাশে চিদাত্মা প্রতিফলিত হচ্ছে।
একং সর্ব গতং ব্যোম বহিরন্তর্যথা ঘটে
নিত্যং নিরন্তরং ব্রহ্ম সর্বভূতগনে তথা।শ্লোক নং ১/২০ :
প্রলয় পর্যন্ত স্থায়ীরূপে নিত্য এক মহাকাশ যেরূপ ঘটের অন্তরে ও বাহিরে বিদ্যমান, অবিনাশী ব্রহ্মও তদ্রুপ সর্ব ভূতগনের অন্তরে ও বাহিরে সদা বর্তমান রয়েছেন।
আমার এক নিকটজন আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি যে এইসব কথা আত্মা সম্পর্কে বলে থাকেন,, পুনর্জন্ম সম্পর্কে বলে থাকেন, এমনকি ধ্যান সমাধি ইত্যাদি সম্পর্কে বলে থাকেন, সেগুলো কি সত্যি, না কেবলমাত্র প্রচারের উদ্দেশ্যে, বই-পড়া কথা, নাকি আপনার উপল্বদ্ধিতে এগুলোর কোনো অস্তিত্ত্ব আছে । আর সত্যি যদি আপনার মধ্যে এইসব উপলব্ধি হয়ে থাকে তা তো আপনার উত্তেজিত স্নায়ুর প্রভাবে হয়ে থাকে পারে। একজন মৃগীরুগীর মধ্যেও অনেক অভিজ্ঞতা হতে পারে। একজন পাগলের মধ্যে অনেক অনুভূতি হতে পারে, একজন সঙ্গাহীনের মধ্যেও অনেক অবাস্তব অনুভূতি হতে পারে। এর কোনো সত্যতা আছে কি ? নাকি পাগলের প্রলাপ মাত্র। আপনি মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন না তো ?
তো আমি তাকে বলেছিলাম, দেখো, এই জগতে আমরা সবাই পাগল। আমরা যাকে ভালো মানুষ ভাবি, পাগল তাকেই পাগল ভাবে, বোকা ভাবে, এটা কি জানো ? আর সত্যি হচ্ছে, আমরা সবাই পাগোল। কেউ জাগতিক বস্তুর জন্য পাগল, আবার কেউ ঈশ্বরের জন্য পাগল। কেউ জাগতিক বস্তুকে সত্য ও আনন্দের উৎস বলে মনে করে, আবার কেউ ঈশ্বরের অস্তিত্ত্বকেই সত্য বলে মনে করে, আর সেখানেই সে আনন্দের খোঁজ করে থাকে। মৃত্যুর পরে কি হবে, কোথায় যাবে, সেটা তুমি মৃত্যুর পরেই জানতে পারবে। চর্ম চক্ষুর দৃষ্টি সীমিত, কিন্তু অন্তরের দৃষ্টি সীমাহীন। স্থুল শরীরের কর্ম্মের সীমাবদ্ধতা আছে, মানসিক শরীরের কর্ম্মের সীমা নেই। যে যেখানে আছে, সে সেখান থেকেই দেখে। তোমার বিপরীতে যে আছে, সে যা দেখছে তা তুমি দেখতে পাচ্ছ না। এটা তোমার অবস্থানের জন্য হয়ে থাকে। আবার তোমার মন যা দেখতে চায়, তুমি তাই দেখো। আবার তুমি যা দেখো, তুমি তা তোমার অভিজ্ঞতার নিরিখে বিচার করে থাকো। তোমার অভিজ্ঞতা, তোমার জ্ঞান, তোমার চেতন শক্তি দৃশ্যগুলোকে বাস্তব করে তোলে। তো আমাদের দৃষ্টিশক্তির ফারাক। তুমি যা দেখছো, সেটি যেমন তোমার কাছে সত্য, আবার আমার সামনে যা ভাসছে, তা আমার কাছে সত্য। এই পার্থক্য ঘুচে যাবে, যখন তুমি আমার চোখ, আমার মন দিয়ে দেখতে পারবে।
সন্তান মাকে যে দৃষ্টি দিয়ে দেখে, স্বামী তার স্ত্রীকে সেই দৃষ্টি দিয়ে দেখে না। পিতা পুত্রকে যে দৃষ্টিতে দেখে, পাড়াপ্রতিবেশী সেই দৃষ্টিতে দেখতে পারে না। একই ঘটনা দুইজন উকিল দুই-দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করে থাকে। এর মধ্যে থেকে বিচারক সত্যকে অন্বেষণ করে বের করে থাকে। কে কি বলছে, সেটা বড়ো কথা নয়, তুমি কি ভাবে সেটাকে বিচার করছো, সেটাই বড়ো কথা। আমার কথায় তোমার বিশ্বাস করতেই হবে, তা নয়, কিন্তু অবিশ্বাস করে নাক উঁচু করে চলে যাওয়াও বুদ্ধিমানের কথা নয়। তুমি নিজের চোখে, নিজের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে সত্যকে উপলব্ধি করবার চেষ্টা করো। আমি যা বাহ্যিক ভাবে করি, আমি যা অন্তর দিয়ে চিন্তা করি, সেটা তুমিও করতে পারো। আর সেটা যদি তুমি করতে পারো, তবে আমার কথার যথার্থতা বুঝতে পারবে। অবাস্তব বলে কিছু নেই। দৃষ্টিকোণের ফারাক মাত্র । একজন পূজার্থী যেকারনে ফুল চয়ন করে, অর্থাৎ ঠাকুরের পায়ে দেবে বলে, বা মালা গেথে ঠাকুরের গলায় দেবে বলে, একজন মালি কিন্তু সেই কারনে ফুল চয়ন করে না, সে করে ফুল থেকে সে ভাত কাপড়ের পয়সা পাবে বলে । আবার একজন মরমিয়া সাধক, ফুলকে দেখে সৌন্দর্য্যের মধ্যে, সুগন্ধের মধ্যে, এবং ফুলের মধ্যে থেকে সে আনন্দ নিতে থাকে।
যাই হোক, অষ্টাবক্র সংহিতার প্রথম অধ্যায়,আত্মানুভবোপদেশ (আত্ম-অনুভব-উপদেশ) এখানেই শেষ।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।
অষ্টাবক্র গীতা (নতুন সংস্করণ) - চতুর্দশ পর্ব্ব।
কিনতু আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে যাবার আগে প্রথম অধ্যায় আবার একবার সংক্ষেপে আলোচনা করে নেবো।
অষ্টাবক্র গীতার প্রথম প্রকরণ-এর সংক্ষিপ্তসার একবার স্মরণ করি।
আমরা কিছুদিন যাবৎ অষ্টাবক্র ঋষি-উক্ত আত্মজ্ঞানের কথা শুনছিলাম। আসলে আমরা জন্মের পর থেকে যে সব কথা শুনে আসছি, সেই সব কথা আমাদের মনের মধ্যে গেথে গেছে। আর এইসব কথার সঙ্গে ঋষি অষ্টাবক্রের কথার কোনো মিল খুঁজে পাই না। আমাদের এই সংসারে সম্পর্কের কথা, আমাদের বাস্তবিক অভিজ্ঞতার কথা, আমাদের ব্যথা বেদনার কথা, আমরা কিছুতেই ভুলতে পারি না। আমাদের যে সম্পর্ক অর্থাৎ ইনি আমার বাবা, ইনি আমার মা, এরা আমার ভাই-বোন, এই আমার বাড়ি। এটা স্কুল, এটা কলেজ, এটা বিড়াল-কুকুর-গাছ-নদী-সমুদ্র-পাহাড়। এই যে চেহারার সঙ্গে নাম বা সম্পর্কের কথা আমাদের স্মৃতিতে গেথে গেছে। এখান থেকে আমরা কিছুতেই বেরুতে পারি না। বেরোনো মোটেই সহজ নয়।
আবার আমাদের যখন অক্ষর জ্ঞান করানো হয়, তখন অক্ষরের সঙ্গে বস্তুর মিল শেখানোর চেষ্টা হয়। অ - আম খ - খরগোশ, গ -গরু। ঘ-ঘোড়া ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ শব্দের সঙ্গেও একটা আকৃতি আমাদের স্মৃতিতে গেথে গেছে। তাই যখনই আমরা কোনো শব্দ শুনি, তখন আমাদের অন্তরে একটি আকৃতি বা গুন্ ভেসে ওঠে। এতেই আমরা অভ্যস্ত, আর একেই আমরা সত্য বলে ধরে নিয়েছি। আর এইসব কথা আমাদের মনের মধ্যে চিরকালের জন্য গেথে গেছে। তো যখন আমরা বই-উপন্যাস পড়ি, তখন আমাদের চোখের সামনে একটা গল্পের চরিত্র ভাসে, একটা ঘটনা ভাসে - আর এতে করে আমাদের কখনো দুঃখ হয়, কখনো হাসি পায়, কখনো আমাদের কান্না পায়। অর্থাৎ আমাদের অনুভূতির স্তরে একটা আলোড়ন তোলে। তা সে ভালো মন্দ যাই হোক না কেন। অনুভূতি আমাদের তখনই হতে পারে, যখন সেই গল্পের সঙ্গে, চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে ফেলি। আমাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে যখন সেগুলো একটা মিল খুঁজে পায়। তো অষ্টাবক্র গীতা এমন একটা বই, যেখানে আমাদের পূর্ব-পূর্ব অভিজ্ঞতার সঙ্গে আর এই জ্ঞানের সঙ্গে আমাদের কোনো মিল নেই। তাই এইসব কথা আমাদের বারবার শুনতে হবে, হৃদয় দিয়ে বিশ্বাস করতে হবে, তবেই আমরা এই গ্রন্থের রস আস্বাদন করতে পারবো। তাই আমরা প্রথম প্রকরণের মূল কথাগুলো, আরো একবার শুনে নেবো সংক্ষেপে ।
১.১ রাজর্ষি জনক তিনটি প্রশ্ন করেছিলেন : ১. কিভাবে জ্ঞান লাভ হবে ? ২. মুক্তি কি ভাবে হবে ?
৩. বৌরাগ্যই বা কি ভাবে লাভ হবে ?
৩. বৌরাগ্যই বা কি ভাবে লাভ হবে ?
আমরা এবার দেখে নেবো এই তিনটি প্রশ্নের উত্তরে মহর্ষি অষ্টাবক্র মুনি কি বললেন।
১/২. প্রথমে তিনি বললেন : তোমার যদি মুক্তির ইচ্ছে জাগে তবে বিষয়কে বিষবৎ ত্যাগ করো। ক্ষমা করতে শেখো। বৃহতের কাছে আবেদন করতে শেখো। দয়া করতে শেখো। সন্তুষ্ট থাকতে শেখো। অর্থাৎ দুই নম্বর প্রশ্নের উত্তর দিলেন।
১/৩.আর জ্ঞান লাভ বা বৈরাগ্য কি করে হবে ? প্রথমে বোঝো জ্ঞান লাভ কে করবে ? তুমি। বৈরাগ্য কে লাভ করবে ? তুমি। তো তুমি কে ? তোমার ধারণা হচ্ছে, তুমি এই দেহ, আর তোমার এই দেহ পঞ্চভূতের তৈরী। অর্থাৎ দেহের কারন হচ্ছে পঞ্চভূত। আর এই দেহই তুমি। তোমার এই যে ধারণা, সেটা ভুল। ঋষি অষ্টাবক্র বলছেন, তুমি দেহ নয়, দেহের যে কারন পঞ্চভূত তাও তুমি নও। তুমি চৈতন্য। এইভাবেই নিজেকে জানো।
১/৪. তুমি দেহ, এই ভাবনা বা বোধ থেকে নিজেকে আলাদা করো। যদি দেহ ভাবনা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারো তবেই তুমি সুখী ও বন্ধন মুক্ত হতে পারবে।
১/৫. তুমি মনুষ্যকৃত বর্ণবাদে বিশ্বাস করো না। তুমি আসলে নিরাকার। তুমি এদের, বা যাদের তুমি আপন ভাবছো, তুমি তাদের কেউ নও, তোমারও এরা কেউ নয় । এটা জেনে নিজে সুখী হও।
১/৬. ধৰ্ম, অধর্ম, সুখ-দুঃখ, এগুলো সব মনের ভাবনা। মন-তো দেহের অঙ্গ। দেহাতীত হয়ে গেলে, তোমার কর্তাবোধ চলে যাবে, ভোগ-দুর্ভোগ সব চলে যাবে। এসব অনিত্য পার্থিব বস্তূ। এইসব থেকে নিজেকে মুক্ত করো। আর সুখে থাকো।
১/৭. তুমি আসলে দ্রষ্টা। দ্রষ্টার কোনো বন্ধন নেই। তুমি আসলে আত্মাকে দেহ ভেবে নিয়েছো, তাই নিজেকে মুক্ত ভাবতে পারছো না।
১/৮. তোমার মধ্যে অহংকার রয়েছে। তুমি কিছুই করছো না, অর্থাৎ তুমি আসলে কোনো কর্ম্মের কর্তা নও , এই বোধ তোমার মধ্যে জাগুক, তাহলেই তুমি পরম-আনন্দ লাভ করতে পারবে।
১/৯. তুমি স্ব-প্রকাশ চিদ-আত্মা, এই দৃঢ় নিশ্চয় বোধ তোমার মধ্যে জেগে উঠুক, তাহলে তোমার শোক-ও হবে না, রাগ-ও হবে না।
১/১০. তোমার অজ্ঞানবশতঃ কল্পিত এই বিশ্ব তোমার বোধকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আসলে আনন্দস্বরূপ চিদাত্মা তুমি। এটা জান এবং সুখী হও।
১/১১. তোমার ভাবনায় পরিবর্তন আনো। "আমি বদ্ধ", এই ভাব ত্যাগ করো।অর্থাৎ বন্ধনমুক্ত হবার জন্য তুমি যে অহেতুক নানানরকম ভাবনা বা ক্রিয়া করছো, এটাই তোমাকে বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। তিমি আসলে মুক্ত। কিন্তু তোমার অজ্ঞান তোমাকে মুক্ত ভাবতে দিচ্ছে না। তুমি যেমন ভাববে তুমি তেমন-ই হয়ে যাবে। তোমার মুক্তির চেষ্টাই তোমার বন্ধনের লক্ষ্মণ।
১/১২. তুমি তো দেহ নয়, মন-বুদ্ধিও নয়, তুমি আত্মা। তুমি বিভু। আর আত্মা, বিভু, সাক্ষীর ন্যায় থাকেন। আত্মা এক এবং পূর্ণ, মুক্ত ও ক্রিয়াহীন। তুমি নিস্পৃহ, অসঙ্গ, শান্তস্বরূপ।
১/১৩. তোমার অহং-ভাবই ভ্রম। তুমি দেহ - এটা তোমার বাহ্য ভাবনা। তুমি সুখী বা দুঃখী এটা তোমার অন্তর্ভাবনা। এসব অবান্তর ভাবনা পরিত্যাগ করে নিজেকে এক-অদ্বিতীয় আত্মার কথা ভাব।
১/১৪. তুমি দেহাত্ম-অভিমানে বদ্ধ হয়ে আছো। তোমার বোধোদয় হোক। জ্ঞান-অস্ত্র দ্বারা অভিমান ছিন্ন করো। তবেই তুমি যে আসলে সুখী, এটা অনুভব করতে পারবে।
১/১৫. দেখো, তুমি যে সমাধির ইত্যাদির অনুষ্ঠান করছো - এটাতেই বোঝা যাচ্ছে তুমি তোমার ভুল ভাবনায়-বদ্ধ। তুমি তো সর্ব সম্মন্ধ শূন্য, তুমি সর্ব ক্রিয়া রোহিত। তুমি নিজে থেকেই প্রকাশিত পরমাত্মা।
১/১৬. তোমারই ব্যাপ্তি সারা বিশ্বে। তুমিই সর্বত্র ওতপ্রোত হয়ে আছো। তুমি শুদ্ধ, বুদ্ধ। তোমারি রূপ সর্বত্র। নিজেকে ক্ষুদ্র চিত্ত করো না।
১/১৭. তুমিতো নিরপেক্ষ, নির্বিকার, চিদ্ঘনস্বরূপ, শীতলচিত্ত। অর্থাৎ তুমি সুখের স্বরূপ। তুমি বাসনাহীন, চিন্ময়। তোমার কোনো ক্ষোভ নেই। তোমার বুদ্ধির কোনো সীমা পরিসীমাও নেই।
১/১৮. তুমি দেহ-ইত্যাদি সমস্ত সাকার বস্তু মিথ্যা বলে জানো। এবং সেই হেতু এসব ত্যাগ করো ও নিরাকারে স্থিত হও। আর এই উপদেশ প্রাপ্ত হয়ে, তুমি জন্ম মৃত্যু রোহিত হও। দেহ-ইত্যাদির জন্ম মৃত্যু আছে, কিন্তু তুমি জন্ম-মৃত্যুর উর্দ্ধে।
১/১৯. দর্পনে বা মাধ্যমে প্রতি-বিম্বিত শক্তি মাধ্যমের আকার নেয়। মাধ্যম এই পরম শক্তি নয়। মাধ্যমে শক্তি নিহিত আছে মাত্র। তেমনি তোমার শরীর একটা মাধ্যম, তাই তোমার শরীর-এর অন্তর বাহিরে আত্মাই প্রতিবিম্বিত ।
১/২০. ঘটের ভিতরে বাইরে যেমন আকাশ বিদ্যমান। ঠিক তেমনি নিত্য ব্রহ্ম সর্বদা সর্ব ভূতের ভিতরে- বাইরে সদা বর্তমান।
মূল কথা হচ্ছে, তুমি দেহ-মন-বুদ্ধি নও, এই সত্যকে উপলব্ধি করবার চেষ্টা করো। তুমি শুদ্ধ-চৈতন্য-স্বরূপ, এই জ্ঞান লাভ করে সুখী হও। দেহাভিমান ছিন্ন করে, সুখী ভব।
ঋষি অষ্টাবক্রের কাছে আমরা আশীর্বাদ প্রার্থনা করি, আমরা যেন তার অমৃতবাণী স্বরূপ উপদেশ আমরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারি।
মহর্ষি অষ্টাবক্র কৃত আত্ম-অনুভব উপদেশ এখানেই বিশ্রাম নিলেন।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
অষ্টাবক্র গীতা (নতুন সংস্করণ) - ষোলতম পর্ব্ব।
অষ্টাবক্র গীতা বা অষ্টাবক্র সংহিতা পড়তে পড়তে, শুনতে শুনতে, আমাদের মাঝে মাঝে মনে হয়, অষ্টাবক্র ঋষি কি ঈশ্বরকে অস্বীকার করছেন ? সব সময় বলছেন, তুমি ও আত্মার মধ্যে কোনো ভেদ নেই। তুমিই মূলভূত আত্মা। তোমাতেই জগৎ স্থিত। তাহলে কি ঈশ্বর বলে আলাদা কিছু নেই। নাকি আমি বলে আলাদা কিছু নেই। সবই সেই মূলভূত আত্মা। আমি বলে যদি কিছু না থাকে, তাহলে কে এই ঈশ্বরকে অনুভব করবে ? আর ঈশ্বর বলে যদি কিছু না থাকে, তবে কীসের এই গুরুকরন, কিসের জন্য এই সাধ্য সাধনা। কার প্রতি সমর্পন ? আমাদের আলাদা আলাদা অস্তিত্ত্ব দৃশ্যমান। কিন্তু ঈশ্বরের অস্তিত্ত্ব দৃশ্যমান নয়। তো যা দৃশ্যমান নয়, এমনকি আমাদের মতো সাধারণের মানুষের যা অনুভবের মধ্যেও আসে না, সেই অস্পষ্ট বিষয়ের মধ্যে প্রবেশ করবার জন্য, প্রাণপাত করা কি অনাবশ্যক নয় ? আমরা আমাদের এই স্বল্পায়ু জীবনের মূল্যবান সময় অহেতুক নষ্ট করছি নাতো ? আমাদের এই ভাবনার উত্তর পেতে গেলে, আমাদের সেই সব মুনি ঋষিদের কথায় আস্থা রাখতে হবে।
দেখুন জীবন অতিবাহিত হচ্ছে, আমরা কেউ চাই বা না চাই, আমরা ভালো কাজ করি, বা মন্দ কাজ করি, আমরা ভালো থাকি বা মন্দ থাকি, জীবন জীবনের মতো গতিশীল থাকবে, জীবন বয়ে চলবে। একদিন আমাদের প্রাণসত্ত্বা দেহহীন হয়ে পড়বে। এটা আমরা আমাদের পূর্ব-পূর্ব পুরুষদের পরিণতি দেখে নিশ্চিত হয়েছি। এক্ষেত্রে আমাদের কাজ হওয়া উচিত, এই মানব জীবন যেন ভালোভাবে অতিবাহিত করতে পারি। আর দ্বিতীয় কাজ হতে পারে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যাতে ভালো ভাবে থাকতে পারে, তার জন্য কিছু কাজ করে যাওয়া। আমরা মহামানব তাদেরই বলি, যারা এই দ্বিতীয় কাজটি করে থাকেন। অর্থাৎ কিছু ছাপ রেখে যাওয়া।
আর এক শ্রেণীর মানুষ আছেন, যাদেরকে দেখে আপাতত মনে হয়, তাঁরা নিজের মুক্তির জন্য ধ্যান সাধনা করছেন। এবং ঈশ্বরের মধ্যে নিজেকে বিলীন করে দেবার সাধ্যসাধনা করছেন। জগৎ সম্পর্কে তাঁরা নিস্পৃহ।
এখন কথা হচ্ছে, মহামানব হতে গেলে আমাদের পরের জন্য, কিছু করে যেতে হবে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, আমরা কি সত্যি কি কিছু করবার ক্ষমতা রাখি ? দা-কুড়ুল অনেক কিছু কাটতে পারে। কিন্তু দা-কুড়োল নিজে কিছু করতে পারে না, যদি না সে অন্যের ইন্ধন পায়। প্রথিবীর কোনো কিছুই আমরা সৃষ্টি করতে পারি না। এই বাতাস, এই আলো, এই মাটি, এই জল, এই সূর্য, এই চন্দ্র, এই নক্ষত্র, এই পৃথিবী, এই সব মূল বস্তুই ঈশ্বরের শক্তিতে চলছে। এমনকি এর গতিও আমরা পরিবর্তন করতে পারি না। একটা পিঁপড়ের গতিও আমরা পরিবর্তন করতে পারি না। জগৎ জগতের মতো চলবে, যা কিছু হবে, সবই তাঁর নির্দেশে হবে। আমার শরীরটা আমর মনটা, আমর স্বল্প বুদ্ধি হয়তো তাতে নাড়াচড়া করবে, কিন্তু তাতে আমার কোনো হাত নেই। তাই মহাত্মাগণ নিজেকে ঈশ্বরের মধ্যে লিন করে দিয়ে, ঈশ্বরের সাথে সাথে একাত্ম চলতে চান। ঈশ্বরের ইচ্ছেয়, ঈশ্বরকৃত কর্ম্মে নিজেকে সম্পৃক্ত করে থাকেন।আমি সত্তার সম্পূর্ণ বিলোপ চান। তাই যে ঈশ্বরের মধ্যে সাধারণ সাধক বিলীন হতে চান, তাই সে ঈশ্বরকে নিজের মধ্যে, বা নিজেকে ঈশ্বরের মধ্যে এক করে থাকেন। ঋষি অষ্টাবক্র মুনি রাজা জনককে এই কথাটি উপল্বদ্ধির উচ্চ স্তরে স্থাপন করতে চাইছেন।
এবার মহৎ শিষ্য বৈদেহী রাজা জনক স্বতঃস্ফূর্তভাবে, নিজের মানসিক অবস্থার কথা বর্ণনা করছেন। শ্রদ্ধাবনত মস্তকে গুরুসান্নিধ্যে গুরুবাক্য শ্রবনে, তাঁর এখন কি মনে হচ্ছে, সে সব অব্যক্ত অনুভূতি ব্যক্ত করছেন।
দ্বিতীয় প্রকরণ : সংক্ষিপ্তসার।
২/১ কি আনন্দ ! আমি নিরঞ্জনঃ অর্থাৎ শুদ্ধ নির্মল আত্মা। আমি শান্ত অর্থাৎ সর্ব বিকার রোহিত, সর্ব বিকারেরের উর্ধে। প্রকৃতির উর্ধে, সেই স্বপ্রকাশ চিৎস্বরূপ।এতকাল আমি দেহ ও আত্মার অভেদরূপ মোহে কি বিড়ম্বনাই না ভোগ করছিলাম।
২/২ আমিই এই অচেতন জগতের প্রকাশক, আবার আমিই স্থুল দেহেরও প্রকাশক। অতএব দৃশ্যত এই দেহাদি সহ সর্ব জগৎ আমাতেই অধ্যস্ত। আমার দেহ বলে কিছু নেই, আমাতেই দেহ, আর জগৎ বলে কিছু নেই, আমাতেই জগৎ।
২/৩ কি আনন্দ ! এই যে শরীর, এই যে দৃশ্যমান জগৎ, এই সব ত্যাগ করে, এই সবের উর্ধে উঠে, গুরু প্রদত্ব চাতুরীর সাহায্যে, আমি পরমাত্মা এই অনুভবেই বিলোপ বা মগ্ন হয়েছি ।
২/৪ তরঙ্গ,ফেনা,বুদ্-বুদ্ যেমন জল থেকে ভিন্ন নয়, আত্মা হতে উৎপন্ন বিশ্বও তেমনি আত্মা হতে ভিন্ন নয়।
২/৫ বিচার করলে দেখা যাবে,পট, তনতু অর্থাৎ সূতা ছাড়া কিছুই নয়।তেমনি বিচার করলে দেখা যাবে বিশ্বও আত্মা মাত্র।
২/৬ আখের রসে কল্পিত চিনি যেমন মধুর রসের দ্বারা সর্বত ভাবে ব্যাপ্ত হয়ে থাকে, তেমনি আমাতে (আত্মায়) কল্পিত বিশ্বও আমার দ্বারা ভিতরে-বাহিরে সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে।
২/৭ আত্ম বিষয়ক অজ্ঞানতা বশতই জগৎ প্রতিভাত বা দৃশ্যমান মনে হয়। রজ্জুর জ্ঞান হলে আর জগৎ দৃষ্টিগোচর হয় না।
২/৮ নিজের মধ্যেই নিজের রূপের প্রকাশ। এর অতিরিক্ত আমি কিছু নই। আমি আমাতেই প্রকাশিত। যখন বিশ্ব দৃষ্টিগোচর হয় তখন তা আমার দ্বারাই প্রকাশিত হয়ে থাকে।
২/৯ অহো ! কাল্পনিক বিশ্ব অজ্ঞানতা বসত আমাতে প্রতিভাত হচ্ছে। ভুল বসত ঝিনুক (শুক্ত) যেমন রুপোর মতো লাগে, দড়ি যেমন সাপের মতো লাগে, সূর্য কিরণে যেমন জল প্রতিভাত হয়, আমিও তেমনি অজ্ঞানবলে কল্পিত এই বিশ্ব দেখছি।
২/১০ আমা-হতে উৎপন্ন এই বিশ্ব আমাতেই লয় প্রাপ্ত হবে। যেমন কলসি মাটিতে লয় প্রাপ্ত হয়, যেমন জলের মধ্যে বুদ্বুদ বা ঢেউ জন্ম নেয়, আবার জলেই লয় প্রাপ্ত হয়, স্বর্ণ থেকে বিচ্ছুরিত বলয় যেমন স্বর্নতেই বিলোপ প্রাপ্ত হয় - তেমনি আমার থেকে উৎপন্ন এই মায়া-বিশ্ব আমাতেই লোপ পেয়ে যাবে।
২/১১ আহা ! কি আশ্চর্যরূপ আমি ! আমি আমাকেই নমস্কার করি -যার বিনাশ নাই। ব্রহ্মা ইত্যাদি অচঞ্চল-সহ সর্ব জগতের বিনাশ কালে অর্থাৎ জগতের বিবর্তন কালেও আমি থাকি, আমার বিনাশ নাই সুতারাং এই আমি অবিনশ্বর, আমাকে নমস্কার।
২/১২ আহা ! আমি দেহধারী হয়েও আমি এক -অদ্বিতীয়, কোথাও গমনাগমন নেই আমার। সর্ব বিশ্বে আমার অবস্থিতি।২/১৫ জ্ঞান,জ্ঞেয়,জ্ঞাতা -এই তিনটি বাস্তবে নাই। অজ্ঞানপ্রভাবে এই ত্রিতয় প্রতিভাত হয়। আমিই সেই শুদ্ধ আত্মা, যে প্রপঞ্চরূপ সমস্ত কিছুর সঙ্গে সম্পর্কহীন।
২/১৩ আহা ! আমি আমাকে নমস্কার করি। আমার মতো দক্ষ কেউ নেই। শরীরের সাথে কোনো সম্মন্ধ না থাকা সত্বেও বিশ্বকে আমি চিরকাল ধারণ করে আছি।
২/১৪ আহা ! আমি আমাকে নমস্কার করি। যার কোনোকিছুর সঙ্গেই সন্মন্ধ নেই, আবার সে-ই সব। যাকে বাক্য - মন দ্বারা গোচর করা যায় না। অতএব সেই সর্বসম্বন্ধি আবার সর্ব-অসম্বন্ধি - আমাকে আমি নমস্কার করি।
২/১৫ জ্ঞান,জ্ঞেয়,জ্ঞাতা -এই তিনটি বাস্তবে নাই। অজ্ঞানপ্রভাবে এই ত্রিতয় প্রতিভাত হয়। আমিই সেই শুদ্ধ আত্মা, যে প্রপঞ্চরূপ সমস্ত কিছুর সঙ্গে সম্পর্কহীন।
২/১৬আহা ! ভ্রম বসতঃ দ্বৈত ভাবনাই দুঃখের মূল । আমি এক অদ্বিতীয়,মায়া ও তৎকার্যের অতীত ও চিন্মাত্র স্বরূপ। প্রতীয়মান সব কিছু, সব জড়- পদার্থ একান্তই মিথ্যা। এই তত্বজ্ঞানই ত্রিবিধ দুঃখ উপশমের ঔষধ।
২/১৭ আমার অহং বোধ থেকেই আমার অজ্ঞান-উপাধিসমূহ কল্পিত হয়েছে। এটা বিস্মৃত হলেই আমি নির্বিকল্পে স্থিতি লাভ করবো।
২/১৮ না আছে আমার বন্ধন, না আছে আমার মুক্তি। আমাতেই বিশ্ব স্থিত আমি বিশ্বে স্থিত নোই। বিশ্ব আমাতে স্থিত হলেও কোনোকালে (কালত্রয়) উহা আমাতে আশ্রিত নহে। এইরূপ বিচারকারী আমি - আমার নির্মূলা জগৎ ভ্রান্তি শান্ত হয়ে গেছে।
২/১৯ শরীর সহিত এই বিশ্ব কিছুই নহে (না অসৎ না সৎ) এটা নিশ্চিত।
আত্মা শুদ্ধ চৈতন্য স্বরূপ মাত্র। সুতরাং অজ্ঞান নিবৃত্তি হলে, আর জগৎ কল্পনা কিসের উপর হবে ?
২.২০ শরীর,স্বর্গ,নরক, বন্ধ, মোক্ষ এবং ভয় - এই সকলি কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। অতএব চিদাত্মার কি করণীয় ? অর্থাৎ চিদাত্মার কিছুই করণীয় নাই।
২/২১ আহা ! জনসমূহের মধ্যেও দ্বৈত আর দেখতে পারছি না। যেন নির্জন অরণ্যের ন্যায় পর্যবসিত হয়েছে। তাহলে আমি কিসের উপর প্রীতি স্থাপন করবো।
২/২২ আমি শরীর নহি, শরীরও আমার নয়,(অন্তঃকরণবিশিষ্ট চিদাভাসরূপ ) জীবও আমি নহি। আমি কেবল বিশুদ্ধ চৈতন্য স্বরূপ। জীবন ধারনের স্পৃহাই আমার এতকালের বন্ধন ছিলো। (সচ্চিদানন্দস্বরূপ অনুভব-বলে সেই জীবন ধারনের ইচ্ছাও আর এখন আমার নেই। )
২/২৩ কি আশ্চর্য্য ! অপার মহা-সমুদ্ররূপ আমাতে চিত্তরূপ পাবন উৎপন্ন হয়ে জগৎ-পরাম্পরারূপ কতই না বিচিত্র তরঙ্গসমূহ প্রকটিত হয়েছে।
২/২৪ সর্ব ব্যাপক চিৎ সমুদ্র রূপ আমাতে সংকল্প বিকল্পাত্মক চিত্ত-পবন শান্ত হলে জীব রূপ বনিকের অভাগ্য অর্থাৎ প্রারব্ধ ক্ষয় বশতঃ দেহাদি বিশিষ্ট এই জগৎরূপ নৌকাও স্বতঃই বিনাশপ্রাপ্ত হয়।
২/২৫. আহা ! কি আশ্চর্য্য ! নিষ্ক্রিয় নির্বিকার অপার মহাসমুদ্র-রূপ চৈতন্যস্বভাব আমাতে অবিদ্যা কামকর্মাদি প্রভাবে জীবরূপী তরঙ্গসমূহ যেন কখনো উদয় হচ্ছে শত্রূভাবে কখনও বা পরস্পর তাড়না করছে, কখনো বা মিত্রভাবে খেলা করছে এবং কখনো বা অবিদ্যা কামকর্মাদির ক্ষয়ে অধ্যস রোহিত হয়ে যেন আমাতেই পুনঃ প্রবেশ করছে অর্থাৎ বিলয় প্রাপ্ত হচ্ছে।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
দ্বিতীয় প্রকরণের সমাপ্ত।
অষ্টাবক্র (নতুন-সংস্করণ) - সতেরতম পর্ব্ব।
এবার আমরা তৃতীয় প্রকরণের মধ্যে প্রবেশ করবো। তার আগে আমরা একটু প্রাসঙ্গিক অন্য্ কথা শুনে নেই। আমরা আবার অষ্টাবক্র মুনির জীবন কাহিনীর মধ্যে যাই। অষ্টাবক্র সংহিতার/গীতার শ্লোক ব্যাখ্যা করার কিছু নাই। আর আমার জ্ঞানই বা কতটুকু যে মহামুনির শ্লোক ব্যাখ্যা করবো। নিজেকে একটু হালকা করার জন্য, তার আশ্চর্য জীবন সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, সে- টুকু জেনে নেই।
অষ্টাবক্র তখন মাতা সুজাতার গর্ভে। একদিন সুজাতা কহোড়কে (অষ্টাবক্রর পিতা),ডেকে প্রসন্ন করে বললো - হে স্বামীন আমি এখন দশ মাসের গর্ভবতী। খুব তারাতাড়ি আমাদের সন্তান ভূমিষ্ট হবে। এতদিন তো পিতার আশ্রমে, পিতার আশ্রয়ে আমাদের চলেছে। এখন আমাদের নিজেদের সন্তান আসছে। হে মহর্ষে, এখন আমাদের নিজেদের আয়ের পথ দেখা উচিত। আপনি সমস্ত শাস্ত্রে পারঙ্গম। বেদবিদ্যা আপনার অধিগত। শুনেছি রাজা জনক জ্ঞানীদের খুব সমাদর করেন। আপনি যদি একবার রাজার কাছে আপনার অধিত জ্ঞানের প্রদর্শন করতে পারেন তবে তিনি নিশ্চয়ই আপনাকে অনেক অর্থসম্পদ দিয়ে সমাদর করবেন।
কহোড় মুনি স্ত্রী-বাক্যে যুক্তি দেখে, একদিন ধনের আশায়, শাস্ত্র-জ্ঞানের অহংকারকে সাথী করে রাজা জনকের কাছে রওনা হলেন।
রাজা জনকের রাজসভায় বন্দি নাম এক ব্রাহ্মণপণ্ডিত ছিলেন। ইনি বরুন দেবতার পুত্র। প্রতাপশালী এই ব্রাহ্মন পণ্ডিত, জনক রাজার দরবারে আগত ধন-প্রার্থী পন্ডিতদের শাস্ত্রজ্ঞানের পরীক্ষা নিতেন।
তখনকার দিনে প্রত্যেক রাজসভাতে এমন একজন পণ্ডিত ব্যক্তি থাকতেন, তার কাজ হতো ধন-প্রার্থী পন্ডিতদের শাস্ত্রজ্ঞান পরীক্ষা করা। এবং রাজার কাছে সুপারিশ করা। রাজা পন্ডিতের যোগ্যতা অনুসারে দান সামগ্রী প্রদান করতেন। রাজা জনকের এই সভা-পণ্ডিত ছিলেন "বন্দি" ।. তিনি শাস্ত্রজ্ঞানী পন্ডিতদের তর্কে আহ্বান করতেন এবং শর্ত দিতেন যদি তর্কে পরাজিত হন তবে জলসমাধি নিতে হবে। এই শর্তে আবদ্ধ হয়ে ধনের আশায় আসা বহু পণ্ডিত বন্দির কাছে পরাজিত হয়ে জলসমাধি প্রাপ্ত হন।অর্থাৎ স্বেচ্ছায় জলে ডুবে মরতে হতো। অষ্টাবক্রের পিতা কহোড়ো বন্দির কাছে পরাজিত হয়ে জলসমাধি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন। এই ভাবেই অষ্টাবক্র পিতৃহীন হলেন।
মাতা সুজাতা অনোন্য-উপায় হয়ে পিতার গলগ্রহ হয়ে রয়ে গেলেন পিতৃগৃহে। পিতামহ উদ্দালকের গৃহেই অষ্টাবক্র মাতৃগর্ভ থেকে পৃথিবীর মুখ দেখলেন। অষ্টাবক্রের জন্মের কিছুদিন আগেই মহর্ষি উদ্দালকের এক পুত্র জন্ম গ্রহণ করেন। তার নাম শ্বেতকেতু। অষ্টাবক্র ও শ্বেতকেতু কাছাকাছি বয়েসের হওয়ায়, দুজনেই একসাথে মহর্ষি উদ্দালকের আশ্রমে, উদ্দালকের স্নেহছায়ায় বড় হতে লাগলেন। শ্বেতকেতু যেহেতু উদ্দালককে পিতা বলে সম্মোধন করতেন, অষ্টাবক্রও উদ্দালককে পিতা বলেই সম্মোধন করতেন।
(এমনটা আমি নিজেও দেখেছি আমাদের এক সহকর্মী একান্নবর্তী পরিবারে থাকতেন - অরুন দাসগুপ্ত - আমার বস ছিলেন। ওনার মেয়ে ওনাকে কাকু আর মা-কে কানি (কাকী) বলে ডাকতো। ভাইপো - ভাইঝি-রা যেমন ডাকতো আরকি। )
একদিন অষ্টাবক্র, মহর্ষি উদ্দালকের ক্রোড়ে বসে দাদুর সাথে খেলছিল। হঠাৎ শ্বেতকেতু-র অভিমান হলো। বাবার কোল থেকে অষ্টাবক্রকে টেনে নাবাতে লাগলো - আর বলতে লাগলো নেবে আয় আমার বাবার কোল থেকে। সরলমতি অষ্টাবক্র উদ্দালকের কোল থেকে নাবতে চাইলো না। শ্বেতকেতু বলতে লাগলো - আমার বাবার কোলে কেন বসেছিল ? তুই তোর বাবার কোলে যা। উনি আমার বাবা। তোর বাবা কোথায় ? তার কাছে যা। উদ্দালকও অষ্টাবক্রকে কোল থেকে নাবিয়ে শ্বেতকেতুকে কোলে নিলো। অষ্টাবক্রর মনে খুব ব্যাথা হলো। তাহলে এতদিন যাকে সে পিতা ভেবে এসেছে সে তার পিতা নয় ? তবে কে তার পিতা ? মাতা সুজাতার কাছে অশ্রূ -পূর্ণ নয়নে কাতর ভাবে বললো - মা আমার পিতা কে ? আমি বাবার কোলে বসে ছিলাম। কিনতু শ্বেতকেতু যেতেই বাবা আমাকে কোল থেকে নাবিয়ে শ্বেতকেতুকে কোলে নিলো। আর বললো উনি আমার পিতা নন। তাহলে কে আমার পিতা ?
আদিম কালের প্রশ্ন। পিতা কে ? সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার মনেও প্রশ্ন জেগেছিলো - কে আমার জন্ম দাতা ? পিতার সন্ধানে পদ্মনালের মধ্যে প্রবেশ করেছিলেন। অষ্টাবক্রর মনেও প্রশ্ন জেগেছিলো - আমার পিতা কে ? এতদিন যাকে পিতা বলে সে জানতো সে তার পিতা নয়। তাহলে পিতা কে ? ছোট্ট ছেলে অষ্টাবক্র অবাক হয়ে গিয়েছিলো। উদাস হয়ে গিয়েছিলো। আনমনা হয়ে গিয়েছিলো। নিজের উৎস সন্ধানের আগ্রহ তাকে চঞ্চল করে তুললো। সন্তানের মনমরা অবস্থা দেখে মা চিন্তিত হলেন। জিজ্ঞাসা করলেন - কি হয়েছে তোমার ? বালক অষ্টাবক্র মাকে প্রশ্ন করলো - আমার পিতা কে ?
দেবাদিদেব মহাদেবকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল আপনার পিতা কে ? মহাদেব বললেন আমার পিতা ব্রহ্মা । ব্রহ্মার পিতা কে ? মহাদেব জবাব দিলেন - বিষ্ণু। বিষ্ণুর পিতা কে ? বিষ্ণুর পিতা আমি স্বয়ং। কে কার পিতা ? সবাই সবার পিতা। চক্রাকারে চলছে। এই জনমে আমি যার সন্তান - কয়েক জন্ম আগে আমি যে তার পিতা ছিলাম না তা কে বলতে পারে ?
সন্তানের প্রশ্ন শুনে সুজাতার স্বামীঃস্মৃতি ভেসে উঠলো। সেই মুখ, আনন্দের দিন গুলির কথা মনে হতে লাগলো। চোখে অশ্রূ পরিপূর্ণ হয়ে গেল। চোখ মুছে মা বললেন মহর্ষি উদ্দালকই তোমার পিতৃসম। উনিই তোমার পালক পিতা। অষ্টাবক্রর মনে আশঙ্কা হলো। কোথাও একটা লুকোছাপার ব্যাপার আছে। মা-কে জড়িয়ে ধরে অষ্টাবক্র কাঁদো কাঁদো স্বরে বলতে লাগলো -মা তুমি সত্য বলো -আমার পিতা কে ? কোথায় তিনি ? তখন সুজাতা আর লুকোতে পারলো না। বললো দেখো বাবা, তোমার জন্মের আগেই তোমার পিতা গত হয়েছেন। আমারই দোষে তিনি মারা গেছেন। তুমি ভূমিষ্ট হবার আগে আমি তোমার পিতাকে পাঠিয়ে ছিলাম জনক রাজার কাছে। শুনেছিলাম, জনক রাজা বেদজ্ঞ পন্ডিতদের ধন দৌলত দান করছেন। তোমার ভবিষ্যতের কথা ভেবে, তোমার বাবাকে আমি পাঠিয়েছিলাম জনক রাজার দরবারে। শুনেছি সেখানে বন্দি নাম এক মহাপন্ডিত তোমার বাবাকে তর্কে পরাজিত করেন - এবং তর্কের শর্ত অনুসারে জল-সমাধি গ্রহণ করেন - এই বলে সুজাতা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
অষ্টাবক্রের মন উথালপাতাল হতে লাগলো। কে এই বন্দি পণ্ডিত ? কিছুদিনের মধ্যেই মামা শ্বেতকেতুকে সঙ্গে নিয়ে অষ্টাবক্র চললো রাজ দরবারে। জনক রাজার পণ্ডিত সভায়। এর পরের ঘটনা আবার পরে হবে। আমরা এখন অষ্টাবক্র সংহিতার মধ্যে প্রবেশ করবো।
অষ্টাবক্র গীতা - (নতুন-সংস্করণ) - অষ্টাদশ পর্ব্ব।
তৃতীয় অধ্যায়/প্রকরণম্ (প্রত্যাক্ষেপদ্বার-উপদেশ নামকং )
ঋষি অষ্টাবক্র রাজা জনককে ব্রহ্ম-জ্ঞান প্রদানের পরমুহূর্তে, শিষ্যকে, তার জগৎব্যবহার নিরত কথাবার্তা শুনে, পরীক্ষার নিমিত্ত অথবা তার জ্ঞানের দৃঢ়তা প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য, জাগতিক ব্যবহারের প্রতি আক্ষেপ করে আত্মা অনুভবকে সমৃদ্ধ করবার জন্য, উপদেশ দান করছেন। আমরা অনেক সময় মুখে বড় বড় কথা বলি, কিনতু যখন কার্যক্ষেত্রে তার প্রয়োগের সময় আসে তখন ব্যর্থ হই। এতো মিথ্যা জ্ঞান। রাজা জনক ঋষি অষ্টাবক্রের কাছ থেকে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছেন, এবার তিনি তার ব্যবহারিক জগতে প্রবেশ করবেন। তো, তখন তার আচরণ কি ধরনের হওয়া উচিত সে সম্পর্কে এখন উপদেশ দিচ্ছেন।
প্রথম শ্লোক : তৃতীয় প্রকরণম্
অবিনাশিম্ আত্মানং একম্ বিজ্ঞায় তত্ত্বতঃ।
তব-আত্মজ্ঞস্য ধীরস্য কথং-অর্থ-অর্জনে রতিঃ।।
অবিনাশী আত্মাই এক, এই তত্বে যিনি যথার্থরূপে বিজ্ঞ, সেই আত্মজ্ঞের কখনোই অর্থ অর্জনে রতি থাকার কথা নয়।
আমরা সব সংসারী মানুষ, আর সংসারে থাকতে গেলে, অর্থকরী বিদ্যা, এবং অর্থ উপার্জনের জন্য,কর্ম্ম সম্পাদন করা, অবশ্য কর্তব্য। এমনকি নির্বোধ ব্যক্তিও এটা ভালোই বোঝে। রাজা জনকও একজন সংসারী মানুষ। তিনি একটি দেশের রাজা। প্রজা পালন, দেশরক্ষা তার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। আর এর জন্য, অর্থ সংগ্রহ করা, দেশের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা গড়ে তোলা, দেশের সমৃদ্ধি, ইত্যাদি ইত্যাদি নানান জিনিস তার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। ঋষি অষ্টাবক্রের আশঙ্কা হচ্ছে, ব্রহ্মবিদ্যা লাভের পরে, তার শিষ্য যেন, অর্থকরিকার্য্যে আবার লিপ্ত না হয়ে যান। তাই তাকে সতর্ক করছেন, তত্ত্বজ্ঞান লাভের পরে, সেই তত্ত্বজ্ঞান যদি, নিজের জীবনে প্রতিফলিত করতে না পারা যায়, তবে সেই জ্ঞান বৃথা। আর এই ধরনের জ্ঞানপ্রদানও ভস্মে ঘি ঢালা মাত্র। আমরা অনেকে, ধর্ম্মশাস্ত্র পাঠ করি, গুরুদেবের কাছ থেকে অনেক ভালো ভালো কথা শুনি, কিন্তু সেই নীতিশাস্ত্রের কথাগুলো, নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হই। ঋষি বলছেন, তুমি এই দেহ নও, তুমি আত্মা। আর আত্মা অবিনাশী।
ঋষি অষ্টাবক্র বলছেন, আত্মজ্ঞান-সম্পন্ন মানুষ অর্থাৎ যিনি যথার্থ রূপে বিজ্ঞ, তাঁর কখনোই অর্থ উপার্জনে রতি থাকা উচিত নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অর্থ বিনা তো মানুষের এক মুহূর্ত চলে না। মানুষের বেঁচে থাকবার জন্য খাবারের দরকার, আবাসস্থল তৈরী করবার জন্য অর্থ দরকার, এমনকি গুরুর কাছ থেকে শিক্ষা নিতে গেলেও, আমাদের অর্থের সাহায্য নিতে হয়। তো অর্থ এমন একটা মাধ্যম যার সাহায্যে জাগতিক সমস্ত কিছু, যা আমাদের জীবন ধারনের জন্য প্রয়োজন তা পাওয়া যায়। তো ঋষি অষ্টাবক্র বলছেন, সেই অর্থ উপার্জন থেকে বিজ্ঞব্যক্তি নিজেকে বিরত রাখবেন। আমাদের প্রশ্ন তবে তার চলবে কি করে ?
এই জায়গাটা আমাদের বিশেষ রূপে বুঝবার চেষ্টা করতে হবে। আসলে আমরা যা কিছু করি, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে কিছু উপাৰ্জন করা। তাই কি করছি, কি বলছি, সেটা বড়ো কথা নয়, এর ফলে আমাদের কিছু উপার্জন হচ্ছে কি না সেটাই বড়ো কথা। কোথায়, কি কাজ করছি, সেটা বড়ো কথা নয়, কত টাকা উপার্জন করছি, সেটাই আমাদের কাছে বড়ো কথা। কিন্তু সত্য হচ্ছে, উপার্জন দ্বারা মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না, মানুষ বেঁচে থাকতে পারে, তার উৎপাদন দ্বারা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ কত টাকা উপার্জন করেছিলেন, কত তার বিষয় সম্পত্তি ছিল, তা তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে নি। তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, তার চিন্তা, তার চিন্তাপ্রসূত লেখা। যা আমাদের জীবনের প্রতিমুহূর্তে পথ দেখায়। হাজার হাজার বছর আগে জন্ম গ্রহণ করেও আজ যাঁরা আমাদের মধ্যে বেঁচে আছেন, তা তার সৃজনশীল কর্ম্মের জন্য। কত বিষয়-সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন, সেই কারনে নয়। আসলে পৃথিবীতে আপনি এসেছেন, কিছু দেবার জন্য। নেবার জন্য নয়। বিষয়সম্পত্তি তো এই জগতেরই বস্তু, আপনি সেগুলোকে আপনার নিজের হেফাজতে আনবার জন্য উপার্জনের কথা ভাবছেন। কিন্তু এই বিষয়সম্পত্তি, আগে যেমন অন্য কারুর ছিল, কাল তেমনি অন্য কারুর হয়ে যাবে। এটাই সাধারণ নিয়ম।
দেখুন, উপার্জন আর উৎপাদন এক জিনিস নয়। উপার্জন হচ্ছে ব্যবসা, আর উৎপাদন হচ্ছে শিল্প। উপার্জন হচ্ছে কারুর কাছ থেকে কিছু নেওয়া। আর শিল্প হচ্ছে নিজের থেকে কিছু দেওয়া। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে যে শিল্প সত্ত্বা আছে, তাকে প্রকাশিত করা। আমরা প্রত্যেকটি মানুষ স্বতন্ত্র। আমরা প্রত্যেকেই পৃথিবীকে কিছু দেবার অধিকারী। এই দেয়াটাই শিল্প কর্ম্ম। বলা হয়ে থাকে, যিনি মিছিলের পিছনে দৌড়ান না, তার পিছনে মিছিল দৌড়ায়। যিনি টাকার পিছনে ছোটেন না, তার পিছনেই টাকা দৌড়োই। আপনি কাউকে সন্তুষ্ট করতে পারলে, সে আপনাকে সন্তুষ্ট করবার চেষ্টা করবে। আপনি প্রকৃতিকে সন্তুষ্ট করতে পারলে, প্রকৃতিও আপনাকে কিছু দেবে। অর্থাৎ যাকে নিয়ে আপনি ভাববেন, সে আপনাকে নিয়ে ভাববে। আপনি যদি ঈশ্বরকে নিয়ে ভাবেন, তবে জানবেন, ঈশ্বরও আপনাকে নিয়ে ভাবনবেন। অর্থাৎ আপনি যখন অন্যকে নিয়ে ভাববেন,তখন দেখবেন, আপনাকে ভালো রাখবার জন্য, অন্যরা ভাবছে।
অর্থ উপার্জন মানে ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা। জাগতিক বস্তুর প্রতি আসক্তি থেকেই এটা হয়ে থাকে। তাই তুমি সমস্ত জাগতিক সহায়তা থেকে নিজেকে সরিয়ে নাও । অনিত্য বস্তূর প্রতি আকর্ষণ আমাদের নিত্য বস্তূ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। আকাশবৃত্তি অবলম্বন করো। অর্থাৎ শরীরের সুখের জন্য,এমনকি শরীর রক্ষার জন্য তোমার যেন প্রবৃত্তি না জাগে। শরীর দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনি। এই বিশ্বাস দৃঢ় হোক তোমার মধ্যে। তোমার সমস্ত অনিত্যবস্তুর জন্য যখন আসক্তি বিলীন হয়ে যাবে, তবে সেটা তোমার জন্য মঙ্গলময়। জাগতিক বস্তুর উপরে নির্ভরতা শুধু ঈশ্বরের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। এই অভিজ্ঞতা খুব কষ্টদায়ক। কিন্তু আধ্যাত্মিক অনুভূতির এক সম্পূর্ণ তিতো ঔষধ।
এক স্বামীজী যিনি গঙ্গোত্রী থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে একটা গুহায় সাধন ভজনে দিনাতিপাত করেন, তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি যে এখানে থাকেন, এখানে কে আপনাকে খাবার, জামা কাপড় জুগিয়ে দেয় ? এখানে আপনি নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন না ? তো তিনি একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলেন, কে যে জোগাড় করে দেয়, তাঁকেই তো খুঁজছি। বললেন, আপনাদের মতো কেউ না কেউ, সময়মতো এসে যায়, সব কিছু দিয়ে যান। আমার কোনো কিছুর অভাব নেই। আর নিরাপত্তার কথা বলছেন, আমার কোনো কিছুতেই আপত্তি নেই, এই শরীর তৈরিতে কার হাত আছে জানিনা। মা-বাবার কথাও মনে পড়ে না। তো এই শরীর যদি কোনো বন্যজন্তুর ক্ষুধা মেটাতে পারে, আমার আপত্তি করবার কি আছে ? কি অদ্ভুত শরণাগতি। এই দক্ষিণী স্বামীজী আরো একটা কথা বলেছিলেন, যে গুরু সান্নিধ্যে থাকা, গুরু বাক্য শ্রদ্ধার সঙ্গে শ্রবণ, সাধককে দ্রুত গভীর অনুভূতি সম্পন্ন করে দেয়। যাকিছু বহু সাধনার সম্পদ, অনেক সময়, সেই অপ্রত্যক্ষ জ্ঞান এক মুহূর্তে পাওয়া যেতে পারে।
এই সমগ্র বিশ্ব এক অবিনাশী আত্মা মাত্র। এখানে আমি-তুমি বলে কোনো ভেদ নেই। এই সত্যকে জেনে বিষয়-সম্পদ আহরণ বা সঞ্চয় করবার মতো দুর্মতি যেন তোমার না হয়। তোমার দেশের জাগতিক সমৃদ্ধি মানে অন্য দেশকে শোষণ বা তোমার দেশের আয়তন বাড়া মানে অন্য দেশের সঙ্কোচন। তোমার মধ্যে যদি সত্যিকারের বিজ্ঞতা আসে, তবে তোমার মধ্যে থেকে ভেদ জ্ঞান দূর হয়ে যাবে। ঋষি অষ্টাবক্রের কৃপায়, ঋষি জনক, এই সত্য উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তিনি পরবর্তী জীবনে নির্লিপ্ত থেকে রাজকার্য্য পরিচালনা করেছিলেন। এমনকি সাধনবিদ্যা দান করেছিলেন। ব্যাসপুত্র শুকদেবকে ঋষি জনক ব্রহ্ম বিদ্যা দান করেছিলেন।
আসলে সব খেলার একটা নিয়ম আছে। যাঁরা আত্মজ্ঞানের শিক্ষা গ্রহণ করেছেন, তাঁদেরও একটা নিয়মের মধ্যে চলতে হয়। ঋষি অষ্টাবক্র এই নিয়মের কথাই বলছেন, আত্মজ্ঞ পুরুষ কখনো বিষয়মুখী হন না। অর্থ উপার্জন তার বৃত্তি হতে পারে না।
আজ এই পর্যন্ত, এর পরে আমরা দ্বিতীয় শ্লোক থেকে শুনবো।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
অষ্টাবক্র গীতা - (নতুন-সংস্করণ) - ঊনবিংশ পর্ব্ব।
দ্বিতীয় শ্লোক : তৃতীয় প্রকরণম্
আত্মা অজ্ঞানাৎ অহো প্রীতিঃ-বিষয়-ভ্রম গোচরে
শুক্তেঃ-অজ্ঞানতঃ লোভো যথা রজতবিক্রমে।
আহা ! আত্মা সম্পর্কে অজ্ঞানতার জন্যই প্রীতিকর বিষয়-ভ্রম গোচরে আসে। ঝিনুকের মধ্যে রুপোর অজ্ঞানই লোভ উৎপন্ন করে থাকে। ঝিনুক দেখে রূপো ভাবছি। অনিত্য বস্তুর মধ্যে সুখের সন্ধান করছি। অনিত্য বস্তুকে চিরন্তন ভাবছি। এই অজ্ঞানতাই আমাদের লোভের বৃদ্ধি করছে।
রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে একটা ছেলে সিগারেট ফুঁকছিলো। দূর থেকে বাবাকে সাইকেলে আসতে দেখে, সিগারেট নিভিয়ে ভালো ছেলে হয়ে গেলো। সাইকেল যাত্রী কাছে আসতেই সে বুঝলো, ইনি বাবা নন । কিন্তু দূর থেকে বাবাই মনে হয়েছিল, আর সঙ্গে সঙ্গে তার ভিতরে একটা অপরাধবোধ জেগে উঠেছিল, এবং ভবিষ্যৎ নিপীড়নের সম্ভাবনা থেকে তার মধ্যে ভয়ের আবহ তৈরী হয়েছিল। তাই সিগারেট নিভিয়ে সে ভালো ছেলে হবার ভান করেছিল। বাবা সত্য নয়, কিন্তু ভয়টা সত্য।
বারান্দায় বসে পেপার পড়ছিলাম। হঠাৎ মনে হলো, পিঠে হালকা কিছু একটা পড়লো। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। সামনেই শিউলি গাছ। শিউলি গাছে শুঁয়াপোকার জন্ম হয়। ভাবলাম, আমার পিঠে নির্ঘাত শুঁয়াপোকা পড়েছে। আমি চঞ্চল হয়ে উঠলাম। দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু শুঁয়াপোকার হুলের সম্ভাব্য যন্ত্রনা আমাকে উঠে দাঁড়াতে বাধ্য করলো। আলতো করে পিঠটাকে ঝাড়া দিতে লাগলাম। পিঠ থেকে কিছু একটা কিছু নিচে পড়লো। চেয়ে দেখলাম, শুঁয়াপোকা নয়, গাছের শুকনো পাতা। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
ঝিনুকের উপরে সূর্য্যের আলো পড়লে দূর থেকে তাকে রুপো বলে ভ্রম হয়। এটি একধরনের দৃষ্টিবিভ্রম। আর এই দৃষ্টিবিভ্রমে আকৃষ্ট হয়ে আমাদের মধ্যে একধরনের অনুভূতির জন্ম হয়। এই অনুভূতি, আমাদের ভয়, আনন্দ এমনকি বিস্ময় সৃষ্টি করতে পারে। আর এই অনুভূতি, অর্থাৎ ভয়, আনন্দ, বিস্ময় আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে।
আমাদের প্রত্যেকের জীবনে বেঁচে থাকবার প্রতি, একটা স্বভাবজাত আকর্ষণ আছে। তো আমাদের জীবননাশের যদি কোনো সম্ভাবনা দেখা দেয়, তবে আমরা আতঙ্কিত হই, ভয় পাই, এবং এই ভয় বা আতঙ্ক দূর করবার জন্য, আমরা দ্রুত ক্রিয়াশীল হয়ে উঠি।
ঠিক তেমনি, আমাদের মধ্যে জ্ঞান সংগ্রহের জন্য, বা আনন্দ উপভোগের জন্যও একটা স্বভাবসুলভ বৃত্তি রয়েছে। এই জ্ঞান ও আনন্দ লাভের জন্যও আমরা ক্রিয়াশীল হই। তাই আমরা সবাই তিনটি কারনে, ক্রিয়াশী হই। অস্তিত্ব রক্ষার জন্য, জ্ঞান লাভের জন্য, এবং আনন্দ লাভের জন্য আমরা স্বভাবসুলভ ভাবেই প্রয়াসী হয়ে উঠি। এই অস্তিত্ব জ্ঞান আনন্দ এগুলো আসলে আমাদের আত্মার স্বভাব, আমাদের প্রকৃত স্বরূপ, আমাদের সারবত্তা।
জগৎকে যখন আমরা বিশ্লেষণ করি, তখন আমরা দুটো জগতের সন্ধান পাই, একটা বহির্জগৎ, বা বিশ্বজগৎ আর একটি হচ্ছে অন্তর্জগৎ। বহির্জগতের ক্রিয়া আমাদের অন্তর্জগতের ক্রিয়াকে প্রভাবিত করে, আবার আমাদের অন্তর্জগতের ক্রিয়া আমাদের বহির্জগৎকে প্রভাবিত করে। এই দুই জগতের মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক আছে। বহির্জগতে সজীব ও নির্জীব পদার্থ আমাদের সামনে বিরাজ করছে। অর্থাৎ এগুলো রয়েছে একটা না একটা রূপের মধ্যে। আবার অন্তর্জগৎ রূপ বিহীন, অথবা বলা যায়, ভাবের জগতে সবরূপের দেখা মেলে, যার অস্তিত্ব বাইরে নাও থাকতে পারে। আমার স্থিতি কিন্তু এই দুটো জগতেই। বহির্জগতে যেমন আমি আমার অস্তিত্ব ও চেতনতা অনুভব করি, তেমনি আমি আমার অন্তর্জগতেও একটা চেতনা পেয়ে থাকি।
ভৌত বস্তু আমাদের প্রত্যেকের জীবনে কোনো না কোনো অভাব পূরণ করে থাকে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, ভৌত বস্তুর গুনাগুন বিচার না করেই, সেই পেলে আমরা সুখী হবো এই কথা ভেবে, তার পিছনে ছুটতে থাকি। আমাদের মধ্যে, সুখ ভোগের আকাঙ্খা সবসময় রয়েছে। আর ইন্দ্রিয়ভোগ্য বস্তু আমাদের মনকে আকর্ষণ করে, কারন আমরা ভাবি সেগুলো থেকে আমরা সুখ ভোগ করতে পারবো। এই জন্য লোভে পড়ি। আর অসংযত লোভ আমাদের বস্তুর সত্যাসত্য বিচার থেকে বিরত রাখে।
আসলে সুখ ওই বস্তুতে নয়, সুখ আমার মনে। তাই বস্তু সবসময় আমাদের মনকে আকর্ষণ করে। একটু যদি গভীরে প্রবেশ করি, তবে আমরা বুঝতে পারবো, আমরা বস্তুর প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারিনি। কেবলমাত্র তার রূপ ও নামের মধ্যেই নিজেকে আটকে রেখেছি। এই নাম ও রূপ বস্তুর সত্য-স্বরূপকে ঢেকে রেখেছে। এই নাম ও রূপের পিছনে আছে বস্তুর সৎ-স্বরূপ।, যা আমাদের অন্তর্জগতের ও বাহ্য জগতের ভিত্তি। একেই ঋষি অষ্টাবক্র মুনি বলছেন, আত্মা বা পরমাত্মা। যাকে উপনিষদ বলছে ব্রহ্ম।
আমাদের মধ্যে এই ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্মতার একটা সংযোগ রয়েছে। হয়তো এটা কারুর ক্ষেত্রে ক্ষীণধারার আকারে বইছে, কারুর ক্ষেত্রে বেগবান। ধারা একটা আছে, সংযোগ একটা আছে। এই অস্পষ্ট চেতনধারাকে স্পষ্টতর করাই আধ্যাত্মিক জ্ঞান।
তাই অষ্টাবক্র মুনি বলছেন, আত্মা সম্পর্কে অজ্ঞানতার জন্যই প্রীতিকর বিষয়-ভ্রম গোচরে আসে।
আত্মা অজ্ঞানাৎ অহো প্রীতিঃ-বিষয়-ভ্রম গোচরে।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
অষ্টাবক্র গীতা - (নতুন-সংস্করণ) - বিংশতি পর্ব্ব। তৃতীয় শ্লোক : তৃতীয় প্রকরণম্
বিশ্বং স্ফূর্তি যত্রেদং তরঙ্গা ইব সাগরে।
সঃ-অহম -অস্মি-ইতি বিজ্ঞায় কিং দীন ইব ধাবসি।।
সাগর থেকে যেমন তরঙ্গের স্ফূরণ হচ্ছে, তেমনি যার থেকে এই বিশ্বের প্রকাশ হচ্ছে সেই-ই আমি, আমিই সেই। এই কথা যদি জেনে থাকো, তবে দীনের মতো কিসের পিছনে ধাবিত হচ্ছো ? আমরা সব সময়ই আমি আমি করছি। আমরা মনে করি, আমাদের এই ক্ষুদ্র ব্যাক্তিত্বটির একটা স্বতন্ত্র সত্তা আছে। আসলে তা নয়। এটি সেই অনন্ত সত্তার একটি অংশ মাত্র।
স্বামী বিবেকানন্দ মহাসমাধি লাভ করেছেন। এর কিছুক্ষন পরে, স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ যার আগের নাম ছিল শশী, যিনি সেই মুহূর্তে মাদ্রাজে ছিলেন, ধ্যানে বসার পরেই শুনতে পেলেন, কেউ যেন তাকে ডেকে বলছেন, শশী, আমি শরীরটাকে থু-থু ফেলার মতো ত্যাগ করেছি। এই কন্ঠস্বর শশীর পরিচিত। এই কন্ঠস্বর গুরুভাই নরেন্দ্রের।
স্বামী ব্রহ্মানন্দ যার পূর্বাশ্রমের নাম রাখাল, দেহত্যাগের আগে, ভাবাবস্থায়, বলেছিলেন, আমার খেলা এবার সাঙ্গ হলো। দেখো দেখো গোপাল আমাকে আদর করছে। সে আমাকে তার সঙ্গে যেতে বলছে। আমি আসছি।
এই ঘটনার দ্বারা আমরা বুঝতে পারি, মৃত্যুর পরেও বা জন্ম গ্রহণের আগেও আমরা ছিলাম। আমাদের প্রত্যেকের অন্তরে যে জীবাত্মা আছে, যা আসলে পরমাত্মার অংশ মাত্র, সেই তিনি জন্ম ও মৃত্যুর অতীত। অজ্ঞানতা বশত জীবাত্মা ভোগ বাসনার দেহে একাত্ম বোধ করে থাকে। জীবনকাল শেষ হয়ে গেলে, স্থূল শরীরের মৃত্যু বা নাশ ঘটে থাকে। কিন্তু যতক্ষন না আমাদের সংকল্প-বাসনার নিস্পত্তি হয়, ততক্ষন বারবার নতুন দেহে ফিরে ফিরে আসে এই জীবাত্মা । আমাদের জ্ঞান উন্মেষের ঠিক পূর্বাবস্থাতে অথবা আমাদের জ্ঞান উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে এমনকি দেহান্তরের পরেও আমরা বুঝতে পারি, আমরা দেহত্যাগ করেছি। আমরা বিদেহ অবস্থায় আছি, বা সূক্ষ্ম দেহে আছি । এই চেতন-অবস্থা কেবলমাত্র জ্ঞানী পুরুষের হয়ে থাকে।
সমস্ত মানুষ মায় সমস্ত জীবকুল, একই ঈশ্বরের ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ। প্রকাশের তারতম্য আছে, কিন্তু ঈশ্বর-সত্তা সর্বত্র একই। ঋষি অষ্টাবক্র সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে এর তুলনা করছেন। সমুদ্র ও তার ঢেউ বা বুদ্বুদ একই সমুদ্রজাত। কেবল প্রকাশের ভিন্নতা, প্রকাশের তারতম্য মাত্র। রজঃ শক্তিতে এর প্রকাশ হয়ে থাকে।
আমাদের মধ্যে এমনকিছু আছে, যা নিত্য-মুক্ত-আনন্দময় । এই শরীর, এই মন প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তন হচ্ছে, শরীর মন যৌগিক পদার্থ। অন্ন দ্বারা পুষ্ট। এই যৌগিক পদার্থ কখনো পরিবর্তনশীলতার উর্দ্ধে যেতে পারে না। কিন্তু এই স্থুল আবরনের ভিতরে বাইরে আত্মা বিরাজমান। এই আত্মাই মানুষের প্রকৃত সত্তা।
ঋষি অষ্টাবক্র বলছেন, সমুদ্রের মধ্যে যেমন ঢেউয়ের জন্ম, তেমনি সমগ্র বিশ্বজগৎ আমারই মধ্যে অবস্থিত। এই স্বরূপের মধ্যে, বা স্বয়ং-এর মধ্যে জ্ঞানী যখন স্থিত হয়ে যাবেন, তখন তার মধ্যে স্বভাবজাত আনন্দের স্ফূরণ ঘটবে। তখন আনন্দের জন্য তাকে আর বাইরের জগতের উপরে, বা বাইরের বস্তুর উপরে নির্ভর করতে হবে না। আসলে আমাদের কামনা বাসনা উদয় হয় আমাদের আধাচেতন মনে, অর্থাৎ বাহ্যিক বিষয়ে যে মন চেতন, কিন্তু বিষয়ের গভীরে যে সূক্ষ্ম সত্তা আছে, সে সম্পর্কে যে মন অচেতন। এই আধা চেতন মনেই আমাদের কামনা-বাসনার উদয় হয়ে থাকে। আমরা যখন সঙ্গাহীন বা অচেতন হয়ে যাই, তখন আমাদের মধ্যে কোনো কামনা-বাসনা-সংকল্প থাকে না। আবার আমাদের মন যখন উচ্চস্তরে অবস্থান করে অর্থাৎ যখন আমরা অতিচেতন মনের স্তরে থাকি, তখনও আমাদের মধ্যে কামনা-বাসনার লেশ মাত্র থাকে না। তাই অষ্টাবক্র রাজা জনককে বলছেন, যখন তোমার কোনো অভাব-বোধ থাকবে, তখন তোমার মধ্যে কামনার উদ্ভব হবে। যখন তুমি অতিচেতন স্তরে অবস্থান করবে, তখন তোমার মধ্যে কোনো অভাববোধ থাকবে না। বিষয়-প্রাপ্তি জনিত কোনো আনন্দ অনুভূত হবে না। আবার বিষয় অপ্রাপ্তি জনিত কোনো দুঃখ থাকবে না। কেননা তোমার কোনো অভাব নেই। শুন্য কলসিতে কোনো শব্দ নেই। আবার ভরা কলসিতেও কোনো সব নেই। শব্দ হয়, ভরতে গিয়ে, অর্থাৎ ঋষি অষ্টাবক্র মুনি বলছেন, তুমিতো পূর্ন তোমার আবার অভাব কিসের ? তুমি সৎ-চিৎ-আনন্দময়, তোমার আনন্দের জন্য বাইরে তাকাবার কোনো প্রয়োজন নেই।
আসলে দৃষ্টিভঙ্গি। কেউ মনে করেন, আমার যা থাকবার সবই আছে। আবার কেউ মনে করেন, আমার কিছুই নেই। এই দুই ধরনের মানুষই আছেন জগতে। কোটি টাকার মালিক অভাববোধে টাকার পিছনে ছুটছেন। রাতের ঘুম নষ্ট হয়ে গেছে। আবার আশ্রয়হীন, ক্ষুধার্থ ভিখারি নিশ্চিন্তে রেলের প্লাটফর্মে গভীর ঘুমে আছন্ন। আপনার অভাববোধ আপনাকে স্থির থাকতে দেবে না , তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে। অন্যদিকে আপনার সন্তুষ্টি আপনাকে স্থির-শান্ত থাকতে, নিরুদ্বিগ্ন থাকতে সাহায্য করবে।
অষ্টাবক্র সংহিতা আমাদের অদ্বৈতবাদের অনুভূতি এনে দিতে পারে। এই অনুভূতির দুটো স্তর একটা আত্মানুভূতি, অপরটি ঈশ্বরানুভূতি। ঋষি অষ্টাবক্র এই দুটো অনুভূতিকে এক করে দেখেছেন। এই পথে অহং চেতনাকে অতিক্রম করা ও জীবাত্মার সন্ধান পাওয়া অবশ্য কর্তব্য। এই আত্মবিশ্লেষণ দ্বারা আত্মানুভূতি হতে পারে। আসলে আমরা আমাদের আত্মাকে বিস্মৃত হয়েছি, হারিয়ে ফেলেছি। ঋষি অষ্টাবক্র আমাদের এই স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়া আত্মাকে উচ্চতর অনুভূতির দ্বারা খুঁজে নিতে বলছেন। মানুষ যখন নিজের আত্মার অনুসন্ধান আরম্ভ করে, তখন তার সত্যিকারের অধ্যাত্মজগতের যাত্রা শুরু হয়। আর আত্মাকে যখন খুঁজে নিতে পারেন, তখন তিনি ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ হয়ে যান। তখন আমাদের শুদ্ধ বোধ জাগ্রত হয়। এই শুদ্ধ বোধে আমরা জ্ঞাত হই, যে আমরা কেউ এই দেহ নোই, আমরা কেউ মন নোই, আমরা কেউ আবেগ নোই, আমরা কেউ স্ত্রী-পুরুষ নোই, আমরা এমন একটা সত্তা যা অসীম পরমাত্মার অংশ। এই বোধ যখন আমাদের জেগে ওঠে, সেই অবস্থাকে বলে অতি চেতন অবস্থা আর নিজেকে এক আনন্দঘন মূর্তি বলে মনে হয়। তাই ঋষি অষ্টাবক্র মুনি বলছেন, সঃ-অহম -অস্মি-ইতি বিজ্ঞায় কিং দীন ইব ধাবসি। আমিই সে-ই, এই সত্য যার কাছে প্রকট হয়েছে, তার আবার দীনতা কিসের ?
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
অষ্টাবক্র গীতা - (নতুন-সংস্করণ) - একবিংশতি পর্ব্ব।
আমার মাঝে মধ্যে জানতে ইচ্ছে করে, অষ্টাবক্র সংহিতার মতো বুদ্ধির অগম্য শাস্ত্র আমরা কেন শুনি ? যার মধ্যে এতটুকু বুদ্ধির জাগরণ হয়েছে, তার কাছে অষ্টাবক্র সংহিতা দুর্বোধ্য। স্বামীজীর কাছে, এক ঈশ্বর জিজ্ঞাসু এসেছেন। তার জিজ্ঞাসা হচ্ছে, ঈশ্বরকে কি করলে জানা যাবে। তো স্বামীজী বলছেন, ঈশ্বর কোনো জানার বস্তু নয়। ঈশ্বর উপল্বদ্ধির বিষয়। আর ঈশ্বরকে উপলব্ধি করবার জন্য, কিছু করতে হয় না। তোমার যখন পেটব্যথা হয়, তোমার যখন বাহ্য-প্রস্রাব পায়, তোমার যখন ক্ষিধে পায়, ইত্যাদি বুঝবার জন্য, তোমাকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করতে হয় না। তোমার নিজের মধ্যেই একটা বোধ জাগ্রত হয়, যা থেকে তুমি এই বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে পারো। এটা তোমার স্বভাবের মধ্যেই আছে। আমরা গুরুদেবের কাছে যাই, কিছু ক্রিয়া শিখবার জন্য। আমাদের একটা ধারণা হচ্ছে, জাগতিক বস্তু পাবার জন্য, যেমন আমাদের অনেক কায়িক পরিশ্রম করতে হয়, তেমনি ঈশ্বরকে জানবার জন্যও আমাদের কিছু না কিছু করা উচিত। তা সে যাগ-যজ্ঞ, দান-ধ্যান-জপ যাই হোক না কেন, কিছু না করলে কিছু পাওয়া যায় না। এবং আমাদের সমস্ত ধর্ম্ম গ্রন্থ, আমাদেরকে কিছু না কিছু করবার জন্য নির্দেশ-উপদেশ দিয়ে গেছেন। আর সেই নির্দেশ অনুযায়ী ঈশ্বরকে পাবার জন্যও আমরা নানাবিধ কর্ম্মে লিপ্ত হয়ে থাকি। ঋষি অষ্টাবক্র মুনি এই দিকে থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তিনি বলছেন, তুমিই ঈশ্বর, তোমার ভিতরেই ঈশ্বর, ঈশ্বরকে খুঁজতে হয় না, শুধু নিজের দিকে তাকাও, অন্তর্মুখী হও। তাই অষ্টাবক্র সংহিতা আমাদের কাছে দুর্বোধ্য। আজ আমরা অষ্টাবক্র সংহিতা থেকে মাত্র দুটো শ্লোক বুঝবার চেষ্টা করবো। কিছু না করে সবকিছু পাওয়া যায়, এমন কথা তো কখনো কেউ বলেন না।
চতুর্থ শ্লোক : তৃতীয় প্রকরণম্
শ্রূত্বা-অপি শুদ্ধ-চৈতন্যম-আত্মনাং-অতি-সুন্দরম্
উপস্থে-অত্যন্ত সংসক্তো মালিন্যম-অধি-গচ্ছতি।
শুদ্ধ চৈতন্য স্বরূপ অতি সুন্দর আত্মার সম্পর্কে শোনা সত্বেও যা চোখের সামনে দেখছো বা শুনছো, তাতেই আসক্ত হয়ে কোনো আত্মজ্ঞ পুরুষ মলিনতা প্রাপ্ত হতে পারে না। আমরা শুনে থাকি, শুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ আত্মা অতি সুন্দর। এটি আমাদের শোনা কথা। কিন্তু আমরা বাইরের জগতে যা দেখছি, তাকেই সুন্দর ভাবছি। অর্থাৎ আমরা যা দেখছি আর যা শুনছি, এই দুয়ের মধ্যে ফারাক বিস্তর।
ঋষি অষ্টাবক্র বলছেন, তুমি যা দেখছো, তাতো সত্য নয়। তুমি যা ভাবছো সেটাও সত্য নয়। তুমি ভাবছো তুমি অশুদ্ধ, অথচ তুমি শুনেছ তুমি আত্মা। আত্মা শুদ্ধ চৈতন্য স্বরূপ। তো তুমি যদি আত্মা হও তবে তোমার মধ্যে অশুদ্ধতা আসবে কি করে ? এই সত্যটা বোঝার চেষ্টা করো। তুমি বলে আলাদা কিছু নেই। আমি বলেও আলাদা কিছু নেই। সবই তিনি। যাঁকে আমি ভাবছো সেও তিনি। আত্মজ্ঞ পুরুষ জগৎ-ঈশ্বর সব কিছুর মধ্যেই কেবল তাঁকেই দেখেন। বহু শাস্ত্রে আমরা পড়েছি, বহু মহাপুরুষের কাছে আমরা শুনেছি, "আমি শুদ্ধ চৈতন্য স্বরূপ" .তবু আমাদের মনের কোনে অবিশ্বাসের ছায়া। আমাদের মনের মধ্যে সন্দেহ। আমরা শুনেছি, আমাদের মধ্যেই আছেন, ঈশ্বর। তবু আমরা হাজার বছর ধরে খুঁজে চলেছি ঈশ্বরকে। আসলে আমার স্বরূপকে ভুলে, আমরা আমাদের উপাধিকে আমি বলে ভাবছি। হাত থেকে ছেড়ে দিয়ে হাতড়াচ্ছি। আর ভাবছি গেলো কোথায় ? "আমি" আমার স্বরূপকে ভুলে, স্বরূপের আশ্রয়স্থলকে আমি বলে ভাবছি। মালিককে ছেড়ে দিয়ে, আস্তানাকেই মালিক বলে ভাবছি। দেহীকে ছেড়ে দিয়ে দেহকে আমি বলে ভাবছি। আর এই আস্তানার দুর্দশা, দেহের মলিনতা আমাকে বিমর্ষ করছে। নিত্যকে ছেড়ে দিয়ে অনিত্যকে আশ্রয় করছি।
পঞ্চম শ্লোক : তৃতীয় প্রকরণম্
সর্বভূতেষু চ-আত্মানং সর্ব-ভূতানি চ-আত্মানি
মুনেঃ-জানতঃ আশ্চর্য্যং মমত্বম-অনুবর্ততে।
সর্বভূতে আত্মা, আত্মাই সর্বভূতে এই তত্ব জেনেও কোনো মুনির মধ্যে যদি মমত্ববোধ (অহং-বুদ্ধি ) দৃষ্টিগোচর হয় তবে তা বড়োই আশ্চর্যের।
ঋষি অষ্টাবক্র মুনি রাজা জনককে বলছেন, এর পরেও তোমার অহংবোধ কেন আসবে ? আলাদা করে বিশেষ বস্তুর প্রতি বা জীবের প্রতি তোমার মমত্ত্ব বোধ কেন জাগ্রত হবে ? সর্বভূতে-ই তিনি। হ্রী অষ্টাবক্র মুনি বলছেন, তুমি যাকে আমি ভাবছো, সেটা অহং। এই অহং ত্যাগ করো।
দেখুন, আমাদের শরীর ও মনের যে ক্রিয়া তা আসে আমাদের আমি বোধ থেকে। এই যে আমি বোধ এটা একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটের যেমন আছে, তেমনি আছে একটা বিশাল দেহি জীবের মধ্যে। এটা অনুন্নত শ্রেনীর জীবের মধ্যে যেমন আছে, উন্নত জীব মানুষের মধ্যেও তেমনি আছে । আর এই আমি বোধ থেকেই আমরা সুখের সন্ধান করি, এই আমি বোধ থেকেই আমরা দুঃখ এড়িয়ে চলতে চাই। এই আমি-বোধ আমাদের সংবেদনশীল করে থাকে। এই আমির অভাব-বোধ জাগে, এই আমির অস্তিত্ত্ব রক্ষার বোধ আছে , আমির মৃত্যুভয় আছে , আমির সুখানুভূতি আছে, আমির দুঃখ অনুভূতি আছে , এমনকি আমির মধ্যে আছে নিজেকে বহু করবার প্রবৃত্তি, আছে নিজেকে প্রকাশ করবার অভিপ্রায়। এই আমিবোধ আছে বলেই আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো ক্রিয়াশীল হয়। এই আমিই এই দেহের পরিচালক। এই আমি বোধ যখন আমাদের থাকবে না, তখন দেহ ক্রিয়াশীল থাকবে না। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো অকেজো হয়ে যাবে। আমাদের স্নায়ুতন্ত্র থেমে যাবে। আমাদের শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। আর সত্যি কথা বলতে কি এই আমি বোধ-ই আমাদের মস্তিস্ক, আমাদের স্নায়ু, এমনকি এই অস্থি-পেশির নির্মাতা। এই আমি-বোধকে ঋষি পতঞ্জলি বলছেন অস্মিতা। যখনই আমাদের মধ্যে এই অস্মিতার উদয় হয়, তখন আমাদের মধ্যে তুমি বোধ অর্থাৎ একটা বিপরীত প্রত্যয়ের জন্ম হয়। এবং এই আমি-তুমি বোধ আমাদের মধ্যে অহংকারের জন্ম দেয়। অর্থাৎ একটা পার্থক্য-বোধ বা বিরুদ্ধ-স্বভাবের জন্ম দেয়। কর্তা-বোধের জন্ম দেয়। এখান থেকেই আমাদের অজ্ঞানতার শুরু। অর্থাৎ আমি যদি চিৎ তো তুমি অচিৎ। আমি যদি সৎ হই তবে তুমি অসৎ। আমি যদি আলো হই তবে তুমি অন্ধকার। আর তখন আমাদের মধ্যে আমি-তুমি বোধ এমন ভাবে জড়িয়ে যায়, যে এটিকে আমরা আর আলাদা করতে পারি না। আমি যদি ধর্ম্ম হই তবে তুমি অধর্ম্ম। আমি যদি আত্মা হই তবে তুমি অনাত্মা। আর এই অনাত্মার প্রকাশ ঘটে আমাদের অন্তরের মধ্যে, আমাদের বৃত্তির মধ্যে আমাদের বুদ্ধির মধ্যে। সত্যিকারের আত্মা তখন সাক্ষী-মাত্র হয়ে যায়। আর জীবাত্মা বা আমি অনাত্মারূপে বুদ্ধিযুক্ত হয়ে যায়। আবার এই বুদ্ধির প্রভাব কেটে গেলে অর্থাৎ আমি যখন বুদ্ধি থেকে আলাদা হয়ে যায়, তখন আত্মস্বরূপের উপলব্ধি হয়। অর্থাৎ আত্মার সংযাগে যখন বুদ্ধি যোগ হয়, তখন সে জীবাত্মা, আবার বুদ্ধির বিয়োগ হলে, তখন অস্মিতার প্রকৃত স্বরূপে প্রকট হয়, যাকে বলা হয় আত্মা।
এখন কথা হচ্ছে, আমাদের যে সংবেদন তাকে সাজিয়ে রাখে আমাদের বুদ্ধি। সংবেদন যখন কার্যকরী রূপে নেয়, তখন তা জড়বস্তুর আকার নেয়। একটু গভীরে ভাবলে আমরা বুঝতে পারবো, বাইরের জগতের কোনো বস্তুরই প্রকৃত স্বরূপ আমরা জানতে পারি না। আমরা কেবল আমাদের মানসিক বৃত্তি অনুযায়ী বস্তুকে বিচার করি। আর সেই অনুযায়ী বস্তু আমাদের কাছে জ্ঞাত হয়। আমাদের মনের বৃত্তিই জগতের স্থুল বস্তুর কারন।
আমরা বই পড়ি। বই তো আর কিছু নয়, কিছু বাক্য। বাক্য কিছু শব্দের সমষ্টি। শব্দ কিছু অক্ষরের সমষ্টি মাত্র, যাকে অন্য অর্থে বলা হয়ে থাকে বর্ণমালা । এই বর্নমালা বা অক্ষর দুই প্রকার, স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণ। ব্যঞ্জন বর্ণের মধ্যে আছে আবার ৫টি বর্গ - ক,চ,ট,ত,প। উচ্চারণ ভেদে তালু, মুর্দ্ধা, দন্ত, ওষ্ঠ, ইত্যাদি নানান রকম ভেদ বর্নমালার। কিন্তু আমরা যখন বই পড়ি, এসব ভাবি না। আমরা এক ঘটনা বা কাহিনী, বা ভাবের মধ্যে প্রবেশ করি। আর এই ঘটনার বর্ননা আমাদের অন্তরে একটা চিত্রপটের আকার নেয়। আমরা সুখী হই বা দুঃখী হই ।
তো যা বলছিলাম, আমরা আমাদের মনের বৃত্তিগুলোকে জানতে পারি। আবার মন তার নিজের বৃত্তিগুলোকে জানতে পারে। একটু চিন্তা করলে আমরা বুঝতে পারবো, সমস্ত কার্য্যের কারন বলতে আমরা যা বুঝি তা বাইরে নয়, ভিতরে। মনের বৃত্তি যখন বাইরে প্রসারিত হয়, তখন তাকে আমরা কারন বলে থাকি। মনের বৃত্তির প্রকাশই স্থূল কারন।
আমরা এর আগে শুনেছি, আমরা বাইরে যা কিছু দেখছি, সবই আলোর স্পন্দন মাত্র। তা জীব-জগৎ বলুন, উদ্ভিদ জগৎ বলুন, বা নির্জীব পদার্থ বলুন। সবই বিভিন্ন মাত্রার আলোর স্পন্দন মাত্র। এখন এই স্পন্দন যখন আমাদের ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে স্নায়ুর সংস্পর্শে আসে, তখন আমাদের মস্তিষ্ক-কোষে একটা আলোড়ন তোলে। এই আলোড়নের ফলে আমাদের বিষয়ের অনুভূতি হয়। আবার এই বিষয়ের অনুভূতি শুধু দ্রষ্টা নয়, দৃশ্য-কম্পন ও দ্রষ্টার কম্পন, এই দুইয়ের সংমিশ্রনে অনুভূত হয়। অর্থাৎ আমাদের মনের সংবেদন হচ্ছে সেটাই,যা আমাদের মস্তিষ্কের ভিতরে উল্লাসিত হচ্ছে। আর েকে বলা হয় কারন। আর বাইরের বস্তুর মধ্যে যে স্পন্দন তাকে বলি কার্য্য। আমাদের ভিতরে যিনি জ্ঞাতা তাকে বলা হয় বিষয়ী। অর্থাৎ জ্ঞাতার স্পন্দন হচ্ছে বিষয়ী। বা বলা যেতে পারে, এটি আমাদের মনের বৃত্তি। আবার বাইরের যে বৃত্তিগুলোর সংস্পর্শে এসে সে জ্ঞাত হয়েছে, তাকে বলা হয়, বিষয় বা উপাদান। অর্থাৎ যে বৃত্তিগুলোকে আমরা জানি, তা হচ্ছে বিষয়, আবার আমাদের মনের বৃত্তিগুলো যখন বাইরে প্রসারিত হয়, তখন তা বাইরের বিষয়রূপে প্রতীয়মান হয়। অর্থাৎ আমাদের মনোবৃত্তিগুলোই বিষয় রূপে প্রতিভাত হয়।
\
জীবাত্মা হচ্ছে বুদ্ধি ও শুদ্ধ চৈতন্যের মিশ্রণ। কিন্তু আত্মা দেশ-কাল-নিমিত্তের উর্দ্ধে, এমনকি বুদ্ধির উর্দ্ধে। তাই জীবের পরিবর্তন হয়, জীবাত্মারও পরিবর্তন হয়, কিন্তু আত্মার কোনো পরিবর্তন হয় না। অর্থাৎ আত্মা যখন ব্যবহারিক রূপ নেয়, তখন তাকে বলে জীবাত্মা। আমাদের দেহ দেশ-কাল-নিমিত্তের উর্দ্ধে নয়। এই দেহ পঞ্চভূতের সমষ্টি। বস্তু থেকেই অনন্ময় কোষ আবার বিষয় থেকেই মনোময় কোষের উৎপত্তি হয়। মনোময় কোষ থেকেই আমাদের জ্ঞানীন্দ্রিয়, আবার জ্ঞানীন্দ্রিয় থেকে আমাদের বুদ্ধি পুষ্ট হয়। তাই দেহের যেমন পরিবর্তন হয়, তেমনি আমাদের বুদ্ধির, মনের, এমনকি জীবাত্মার পরিবর্তন হচ্ছে। আর এই জীবাত্মা হচ্ছেন ভোক্তা। তাই এগুলোর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জন্ম, বৃদ্ধি ও নাশ অবশ্যম্ভাবী।
এই অনিত্য দেহের মধ্যেই বাস করেন সেই নিত্য আত্মা। আর এই দেহ, মন, বুদ্ধির মধ্যে আত্মার প্রতিফলন জীবাত্মা রূপে বাস করেন। আত্মার স্বরূপ সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞান বা অবিদ্যা আমাদের মধ্যে অস্মিতার জন্ম দিয়েছে।
যাই হোক, অস্মিতা বা আমিবোধ সম্পর্কে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু এই আমি হচ্ছে, আমাদের বুদ্ধি ও চৈতন্যের মিশ্রসত্তা। এই আমি বোধ থেকেই জন্ম নেয়, বাসনা বা আমাদের ইচ্ছেশক্তি। বাসনার কোনো সীমা পরিসীমা নেই। তাই বাসনা কখনো পূর্নতা পায় না। আর অপূর্ণ বাসনা আমাদের মধ্যে জন্ম দেয় অভাববোধ যার পরিণতি হচ্ছে দুঃখ। অস্মিতার প্রতি আকর্ষণ আমাদেরকে করে তোলে, স্বার্থপর। আর অস্মিতার বিলোপ সাধনে আমাদের মধ্যে জেগে ওঠে ব্রহ্মচৈতন্যের উপলব্ধি। তখন নিজের সীমাবদ্ধতার বাঁধন কেটে যায়। নিজের মধ্যে জেগে ওঠে পূর্ণতার উপলব্ধি। তখন নিজেকে আত্মা স্বরূপে জেনে দৃষ্ট হয় ঋষি অষ্টাবক্রের অমৃতবাণী - "সর্বভূতেষু চ-আত্মানং সর্ব-ভূতানি চ-আত্মানি". সমস্ত ভূতে আত্মা, আত্মাই সর্বভূতে।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
-----------------------
অষ্টাবক্র গীতা - (নতুন-সংস্করণ) - দ্বি-বিংশতি পর্ব্ব।
ষষ্ঠ শ্লোক : তৃতীয় প্রকরণম্
আস্থিতঃ পরম-অদ্বৈতং মোক্ষার্থে-অপি ব্যবস্থিতঃ
আশ্চর্যং কাম-বশগো বিকলঃ কেলি-শিক্ষয়া।
কি আশ্চর্য ! পরম উৎকৃষ্ট অদ্বৈত-তত্বে যিনি স্থিত । এর প্রতি যে আস্থাবান, তিনি কাম-ক্রিয়া-বশীভূত হয়ে কি করে বিকলেন্দ্রিয় হবেন?
যিনি এক ঈশ্বরে স্থিত, যিনি এক-এ স্থিত তার দ্বৈত ভাব কেমন করে আসবে ? অর্থাৎ যিনি অদ্বৈত জ্ঞান লাভ করেছেন, এক ঈশ্বর ভিন্ন কিছু নেই, এই পরমসত্যে যিনি উপনীত হয়েছেন, সেই পরমপুরুষ ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান, ইন্দ্রিয়-লব্ধ সুখ, দুঃখ এ সবের উর্দ্ধে তিনি অবস্থান করছেন।
সপ্তম শ্লোক : তৃতীয় প্রকরণম্
উদভূতং জ্ঞান-দুর্মিত্রম-অবধার্য্য-অতি-দুর্বলঃ
আশ্চর্যং কামম্-আকাঙ্খেৎ কালম-অন্তং-অনুসৃতঃ।
উদভূত কাম অর্থাৎ বিষয় চিন্তা অতি দুঃখের কারন, কিনতু মিত্রের মতো আচরণ করে এবং দুর্বল করে দেয়। এ সব জেনেও, জ্ঞানীজন মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে কামাকাঙ্খা বা বিষয় ভোগের ইচ্ছা কি ক'রে করে ? এটা বড়োই আশ্চার্য্য ?
আমরা প্রতিদিন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলছি। আর একটু গভীর ভাবে ভাবলে আমরা বুঝতে পারবো মৃত্যু আমাদের শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে।সময়মতো আমাদের তিনি জীবন থেকে তুলে নেবেন। আর এই সময়মতো মানে প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী আমরা মৃত্যুর কোলে শুয়ে পড়বো। তৎ সত্বেও দেখুন আমরা কেমন মোহগ্রস্থ। প্রতিনিয়ত বিষয় চিন্তায় মগ্ন আছি। সব বুঝি। আবার বুঝি না।
ঋষি অষ্টাবক্র এবার ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের ইন্দ্রিয়ের উপযোগিতা ও কামবিষয় সম্পর্কে বলছেন। অষ্টাবক্র এখানে একটা অদ্ভুত কথা বলছেন। বলছেন, ইন্দ্রিয়সকল দ্বারা আমরা যেমন বিষয়সুখ অনুভব করে থাকি, ঠিক তেমনি আবার এই ইন্দ্রিয়দ্বারা আমরা জ্ঞান অর্জন করে থাকি। আমাদের শ্রবণ শক্তি আমাদের যেমন সংগীতসুখের ব্যবস্থা করেছে, আবার এই কানের দ্বারা আমরা গুরুবাক্যঃ শ্রবণ করে, জ্ঞান সংগ্রহ করতে পারি। তো ইন্দ্রিয়সকল শুধু আমাদের বিষয়ভোগের জন্য নয়, জ্ঞান সংগ্রহের জন্য ইন্দ্রিয়গুলোর আবশ্যিকতা অস্বীকার করতে পারি না। তো আমাদের মতো সাধারনের কাছে ইন্দ্রিয়গুলোর দ্বিবিধ উপযোগিতা। এক - বিষয় ভোগ, তা সে সুখের হতে পারে, আবার দুঃখের হতে পারে। আবার এই ইন্দ্রিয় আমাদের বই থেকে জ্ঞান সংগ্রহ করতে, গুরুবাক্যঃ থেকে, জ্ঞান সংগ্রহ করতে সাহায্য করতে পারে। আবার বিষয়ের জ্ঞান অর্থাৎ রসোগল্লার স্বাদ কেমন সেটা জানতে গেলেও আমাদের জিহ্বার সাহায্য নিতে হয়। শীত বা তাপ অনুভব করতে গেলে আমাদের ত্বকের সাহায্য গ্রহণ করতে হয়। তো সমস্ত ইন্দ্রিয় আমাদের শুধু বিষয় ভোগের জন্য নয়, জ্ঞান সংগ্রহ করবার জন্য বটে।
এত গেলো সাধারণ মানুষের কথা। অষ্টাবক্র বলছেন, ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান, ইন্দ্রিয়-লব্ধ সুখ, দুঃখ এ সবের উর্দ্ধে তিনি অবস্থান করছেন। এখন কথা হচ্ছে সে আবার কেমন ? আসলে বিষয়জ্ঞান একাগ্রতার সাহায্যে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে, কিন্তু সত্যিকারের ব্রহ্মজ্ঞান ইন্দ্রিয় দ্বারা লব্ধ নয়। ইন্দ্রিয়াতীত সেই ব্রহ্মজ্ঞান। এর জন্য প্রয়োজন আমাদের সজ্ঞাকে জাগ্রত করা। আর সজ্ঞা যখন জাগ্রত হয়, তখন আমাদের অদ্বৈত জ্ঞান হয়। অর্থাৎ সবকিছুর মধ্যেই তিনি একমাত্র ব্রহ্মদর্শন করে থাকেন। ইন্দ্রিয় দ্বারা জ্ঞান সংগ্রহকালে আমাদের মধ্যে দ্বৈত ভাব জেগে থাকে। অর্থাৎ দৃশ্য ও দ্রষ্টা। অর্থাৎ যা কিছু আমি দেখছি, সেসব আমার থেকে আলাদা। আর আমি এই যে দেখছি, অর্থাৎ দ্রষ্টা তখন দৃশ্যবস্তু থেকে আলাদা প্রতীয়মান হয়।
এখন এই দ্রষ্টা কে ? আর সজ্ঞা কি, ও কিভাবে এই সজ্ঞাকে জাগ্রত করা যায় ?
দ্রষ্টা হচ্ছে জীবসত্ত্বা। আর এই জীবসত্ত্বা হচ্ছে অহংতত্ত্ব। এই অহংতত্ত্বের মধ্যে আছে, মন-অহং-চেতনা, ও ব্রহ্মের প্রতিফলন বা প্রতিবিম্ব । এই তিনের সংমিশ্রনে জীবসত্তা গঠিত হয়েছে। এখন সাধারণভাবে আমরা জানি প্রতিফলন হয়, আয়নায়। তো ব্রহ্ম প্রতিফলিত হচ্ছে আমাদের অন্তরাত্মায় আর জীবসত্তায়। এখন কোনো কারনে যদি আয়নাটি অর্থাৎ জীবসত্তাটি ভেঙে যায়, তখন ব্রহ্ম যা মূল সত্তা শুধুই সেই ব্রহ্মই অবশিষ্ট থাকে। আয়নায় সূর্য্যের প্রতিফলন হচ্ছিলো, আয়নাটি ফেঙ্গে গেলো, তো সূর্য তখন সূর্য্যতেই অবস্থান করে। আয়নায় আমার দেহের অবয়ব প্রতিফলিত হচ্ছিলো, আয়না ভেঙে গেলে, আমি আমিই থাকি। তো আমাদের অন্তরে বা মনে যা অহং চেতনার কেদ্রীভূত বিন্দু, সেখানে যতক্ষন ব্রহ্মের প্রতিফলন হচ্ছিলো, ততক্ষন জীবসত্তার অস্তিত্ত্ব থাকে। প্রথমে ব্রহ্ম প্রতিফলিত হয়েছিল কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞানের ফলে, ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের অন্তঃকরণ বিলোপপ্রাপ্ত হওয়াতে, ব্রহ্মের সঙ্গে তিনি অভিন্ন হয়ে যান। আর ব্রহ্ম যেহেতু, সীমাহীন, মুক্ত, অসীম, নিরপেক্ষ, অসঙ্গ অর্থাৎ একমেব-অদ্বিতীয়ম - একভিন্ন দ্বিতীয় নাস্তি, তাই তখন ব্রহ্ম বৈ কিছুই অবশিষ্ট থাকে না ।
অবশ্য এই উচ্চভাব আমি যত সহজে ভাষায় প্রকাশ করলাম, এই অনুভূতির স্তরে পৌঁছানো, আমাদের কত জীবন লাগবে, তা আমরা জানি না। কিছু ঋষি অষ্টাবক্র বা রাজা জনক, এই স্তরেই কথা বলছেন, সেটা আমাদের মনে রাখতে হবে। আর এর মাধ্যমে আমরা একটা আভাস যদি দেখতে পাই, তবেই আমরা অসীমের পথে পা বাড়াতে পারবো। অষ্টাবক্র গীতা পাঠের এটাই উদ্দেশ্য।
এখন কথা হচ্ছে সজ্ঞা কি, এবং আমরা কিভাবে আমাদের সজ্ঞাশক্তিকে জাগ্রত করতে পারবো ? প্রথমে আমরা শুনে নেই সজ্ঞা কি ? দেখুন, আমরা যখন কোনো বস্তুর পর্যবেক্ষন করি, তখন আমাদের দুটো সত্তার দরকার পরে, এক দ্রষ্টা বা দর্শক ও দৃশ্য। এবং এইভাবেই আমরা জ্ঞান সংগ্রহ করে থাকি। কিন্তু সজ্ঞার সাহায্যে যখন আমরা প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করি, তখন দ্বৈত সত্তার প্রয়োজন পড়ে না। এই সজ্ঞা আসলে আমাদের বিশেষ-বোধশক্তি ছাড়া কিছু নয়। এই বিশেষ বোধশক্তি আমাদের ইদ্রিয়াতীত জ্ঞানের সন্ধান দিয়ে থাকে। আর এই সজ্ঞাশক্তি আমাদের সবার মধ্যেই সুপ্ত অবস্থায় আছে। আমাদের কাজ হচ্ছে, সেটিকে জাগিয়ে তোলা। এখন কথা হচ্ছে, কিভাবে জাগাতে হবে ?
প্রথমেই বলি, আমাদের ত্রিবিধ মানসিক শক্তি। সেগুলো হচ্ছে, আমাদের ইচ্ছেশক্তি, আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি ও আমাদের অনুভূতি। এগুলোর যত সুষ্ঠ ব্যবহার আমরা করবো, ততই আমরা আমাদের অন্তরস্থ এই সুপ্ত সজ্ঞা শক্তিকে জাগ্রত করে তুলতে পারবো। প্রথমে দরকার এই বৃত্তিগুলোর শুদ্ধিকরণ। এই যে শুদ্ধিকরণ বা পবিত্র-করুন এটি নিঃসন্দেহে একটা দুরূহ কাজ। এতে প্রচুর সময়ের দরকার পড়ে। আমরা যে পূর্ব-অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করেছি, সেগুলো আমাদের মধ্যে সংস্কার আকারে সুপ্ত হয়ে রয়েছে। এগুলোকে দূর করতে হবে। দেখুন, আপনার পেট যদি ভর্তি থাকে, তবে আপনাকে যত সুস্বাদু বা উপাদেয় খাবার বা পানীয় দেওয়া হোক না কেন, আপনি তা খেতে চাইবেন না। তো প্রথমে আপনার ক্ষুধা বা তৃষ্ণা জাগ্রত হওয়া দরকার। এর পর আপনার ইচ্ছেশক্তিকে জাগ্রত করতে হবে। অর্থাৎ আমি এই সংস্কারগুলোকে অন্তঃকরণ থেকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করতে চাই, এই ইচ্ছেকে জাগিয়ে তুলতে হবে। এরপর এটা ভাবতে হবে যে আমি নতুন অভিজ্ঞতা দ্বারা নিজেকে পরিপূর্ন করতে চাই। আমাদের অন্তঃকরণে যে তেজ সঞ্চিত রয়েছে, তাকে জাগ্রত করতে হবে। উচ্চখাতে প্রবাহিত করতে হবে, এই তেজঃশক্তিকে । একেই বলে উদ্গতি। অর্থাৎ উচ্চতর খাতে প্রবাহিত করবার প্রবল আকাংখ্যা বা ইচ্ছে। এখন ধরুন, আমাদের মধ্যে রাগ, ঘৃণা, ভয়, ইত্যাদি আছে। এগুলোকে দূর করতে হবে। এখন মুখে বললেই তো হবে না, এগুলোকে নিজের জীবনে সেগুলোকে মান্যতা দিতে হবে। আপনি যত সৎ-কর্ম্ম করবেন, আপনি যত সৎ চিন্তা করবেন, আপনি যত নিজেকে ধৈর্য্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ন করতে পারবেন। তত দেখবেন, আপনার মনের মধ্যে একটা অদৃশ্য শক্তি জাগ্রত হচ্ছে। আপনি আগে যখন কাউকে ক্ষমা করতে বাধ্য হতেন, সেটা ছিল আপনার দুর্বলতা, আপনার ভয়। কিন্তু যত আপনার মধ্যে মোকাবেলা করবার শক্তি জাগ্রত হবে, যখন আপনি নির্ভিক হয়ে, ঘটনাকে পর্যবেক্ষন করতে থাকবেন, তখন দেখবেন, আপনার ক্ষমাশক্তি অন্যকে প্রবাহিত করতে থাকবে। অন্যরা তখন, আপনাকে ভয় নয়, আপনাকে শ্রদ্ধা করতে আরম্ভ করবে। মনকে পবিত্র করে, সংকল্পে দৃঢ় থাকুন। আর এই ভাবে আপনার চিন্তা, আপনার কর্ম, ধীরে ধীরে আপনার মধ্যে একটা নতুন সংস্কারের জন্ম দেবে।
জপ-ধ্যানের মাধ্যমেও নিজেকে পরিবর্তন করা যায়। আমাদের ইচ্ছা-অনুভূতি ও চিন্তাই আমাদের পরিবর্তন করতে পারে। আর এই তিনের শুদ্ধিকরণ দ্বারাই আমাদের চিন্তাশক্তিকে কেন্দ্রীকরণ করতে পারি। অর্থাৎ সংকল্পে যদি আমরা দৃঢ় থাকতে পারি তবে আমরা আমাদের সজ্ঞাবৃত্তির সন্ধান পেয়ে যেতে পারি । আসলে শরীরের মধ্যে মনের যেমন কোনো নির্দিষ্ট স্থান নেই, তেমনি সজ্ঞাও আমাদের শরীরের কোনো অঙ্গ নয়। সজ্ঞা হচ্ছে জ্ঞান জ্যোতি, যাঁকে আত্মজ্যোতিও বলা যেতে পারে। এটি প্রথমে ক্ষণেক উদ্ভাসিত আবার ক্ষণেক নির্বাপিত অবস্থার মধ্যে দিয়ে একসময় উজ্জ্বল জ্ঞানালোক চ্ছটায় পরিণত হয়। টিউব-এর সুইচ দিলে প্রথম দিকে যেমন টিমটিম করে একসময় হাঠৎ জ্বলে উঠে, আলো স্থির হয়ে যায়, তেমনি জ্ঞানালোকের জ্যোতিসম্ভার প্রথম দিকে টিম টিম করলেও একসময় আমাদের মধ্যে স্থির আলোকে পরিণত হয়। তখন অন্তরের অন্তস্থল থেকেই মনে নয়, জীবাত্মা ভৌত শরীরের মাধ্যমে, ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে, মনের মাধ্যমে কাজ করে চলেছে। আর আত্মসত্তার প্রকাশ হলেই সমস্ত বস্তু বিভাসিত হয়, এক ব্রহ্মরূপে। এই অভিজ্ঞতা যখন আমরা লাভ করতে পারবো, সমস্ত বস্তুর-বিষয়ের কারণরূপ আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। আর আগে যাঁকে পৃথক-পৃথক আমরা আত্মা (আসলে জীবাত্মা) বলে জানতাম বা ভাবতাম, সেই ভ্রান্ত ধারণা বা জ্ঞান আমাদের তখন দূর হয়ে যাবে। আমরা বুঝতে পারবো, কেবলমাত্র এক শুদ্ধ-আত্মাই সমস্ত কিছুর পিছনে থেকে তাদেরকে আলোকিত করছেন, প্রাণবন্ত করে তুলছেন। তাই আমাদের আশু কর্তব্য হচ্ছে, আমাদের মধ্যে যে সজ্ঞাশক্তি আছে, তার মাধ্যমে প্রকাশমান আত্মার সন্ধান করা। আর ভবিষ্যতের কর্তব্য হচ্ছে, আমাদের ক্ষুদ্র সত্তাকে অনন্ত পরমাত্মায় বা পরব্রহ্মে লিন করে দেওয়া।
তাই ঋষি অষ্টাবক্র বলছেন, যিনি ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ বা যার ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছে, তিনি কাম-ক্রিয়া-বশীভূত হয়ে কি করে বিকলেন্দ্রিয় হবেন অর্থাৎ তিনি কখনোই ইন্দ্রিয়াসক্ত হবেন না। ইন্দ্রিয় দ্বারা জ্ঞান সঞ্চয়ও করবেন না, ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বিষয়সুখ-দুঃখও ভোগ করবেন না। ঋষি অষ্টাবক্র মুনি বিস্ময়ের সঙ্গে বলছেন, জ্ঞানীজন মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়েও কামাকাঙ্খা বা বিষয় ভোগের ইচ্ছা কি ক'রে করে ? এটা বড়োই আশ্চার্য্য ? অর্থাৎ এটা স্ব-বিরোধী, ইন্দ্রিয়াসক্ত ব্যক্তি কখনোই ব্রহ্মজ্ঞানী নয়, আর ব্রহ্মজ্ঞান কখনোই ইন্দ্রিয়লব্ধ নয়।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
-------------------
অষ্টাবক্র গীতা - (নতুন-সংস্করণ) - ত্রি-বিংশতি পর্ব্ব।
অষ্টম শ্লোক : তৃতীয় প্রকরণম্
ইহামূত্র বিরক্তস্য নিত্যানিত্য-বিবেকিনঃ
আশ্চর্যং মোক্ষ-কামস্য মোক্ষাৎ-এব বিভীষিকা।
ইহা অমুত্র অর্থাৎ ইহলোক ও পরলোকের, যাবতীয় ভোগ্য পদার্থ বিষয়ে যিনি বিরক্ত বা বৈরাগ্যবান , নিত্য অর্থাৎ আত্মা ও অনিত্য অর্থাৎ দেহাদি বিষয়ে সর্বদা বিচার-পরায়ণ এমন মোক্ষকামী জ্ঞানীরও দেহ ত্যাগের ভয়, ধনাদি বিয়োগের ভয় দৃষ্টিগোচর হয় - এ কি আশ্চর্য ? অর্থাৎ অষ্টাবক্র বলছেন, মুক্ত পুরুষ যেকোনো ধরনের ভোগ থেকে বিরত। তা সে ইহলোকের হোক, বা স্বর্গলোকের হোক। তিনি নিত্য ও অনিত্য সম্পর্কে সম্যক ভাবে অবহিত। তাই তাঁর মোক্ষ কামনা, না আছে, মোক্ষ না পাবার ভয়। অর্থাৎ তিনি বিচারশীল, এবং তিনি জানেন, তাঁর মোক্ষ পাবার কিছু নেই, তিনি মোক্ষেই স্থিত আছেন।
নবম শ্লোক : তৃতীয় প্রকরণম্
ধীরস্তূ ভোজ্য়মানোঃ অপি পীড্যমানঃ অপি সর্বদা
আত্মানং কেবলং পশ্যন্ ন তুষ্যতি ন কুপ্যতি।
পরেচ্ছাবসে বিষয়ভোগ করেও - পরনিন্দা দ্বারা পীড়িত হয়েও জ্ঞানী সদা সুখ-দুঃখ রোহিত থাকেন। আত্ম-অনুভব বলে কখনো সন্তোষ বা ক্রোধাদি দ্বারা কুপিত হন না।
দশম শ্লোক : তৃতীয় প্রকরণম্
চেষ্টমানং শরীরং স্বং পশ্যতি অন্য্ শরীর বৎ
সংস্তবে চাপি নিন্দায়াং কথং ক্ষুভ্যেৎ মহাশয়ঃ।
চেষ্টমান অর্থাৎ ব্যবহারিক এই নিজের শরীর ও অপরের শরীর যিনি একই দেখেন এবং আত্মাকে যিনি শরীর থেকে ভিন্ন রূপে দর্শন করেন এমন গাম্ভীরাত্মা তত্ববিদ মহাপুরুষ স্তূতি বা নিন্দাতে বিক্ষুব্দ বা চঞ্চলতা প্রাপ্ত হতে পারেন ? পারেন না।
একাদশ শ্লোক : তৃতীয় প্রকরণম্
মায়ামাত্রমিদং বিশ্বং প্শ্যন বিগত কৌতুকঃ
অপি সন্নিহিতো মৃত্যৌ কথং ত্রস্যতি ধীরধীঃ।
পরিদৃশ্যমান এই বিশ্ব জ্ঞানীর কাছে মায়ামাত্র। এর সম্পর্কে কোনো কৌতুহলই তার জাগে না। অতএব মৃত্যুর সম্মেখে দাঁড়ালেও স্থিতধী পুরুষের কিসের ত্রাস ? কোনো ত্রাস নেই।
দ্বাদশ শ্লোক : তৃতীয় প্রকরণম্
নিঃস্পৃহং মানসং যস্য নৈরাশ্যে অপি মাহাত্মনঃ
তস্য-আত্ম-জ্ঞান-তৃপ্তস্য তুলনা কেন জায়তে।
নিস্পৃহ অর্থাৎ স্পৃহা শুন্য যার মন সেই মহাত্মার আবার নৈরাশ্য কিসের ? তাঁর আত্মজ্ঞানেই সে তৃপ্ত। তার সঙ্গে কার তুলনা ? তিনি নৈরাশ্যের উর্দ্ধে, পরম-জ্ঞানী পুরুষ।
ত্রয়োদশ শ্লোক : তৃতীয় প্রকরণম্
স্বভাবাৎ-এব জানানো দৃশ্যমেতন্ন কিঞ্চন
ইদং গ্রাহ্যমিদং ত্যাজ্যং স কিং পশ্যতি ধীরধীঃ।
দৃশ্যমান জগতের স্বভাব (প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল ) যে কিছুমাত্র জানে তার কাছে ত্যাজ্য বা গ্রাহ্য বলে কিছু থাকতে পারে কি ? মুক্ত পুরুষের কাছে, না আছে ত্যাগের স্পৃহা, না আছে গ্রহণ করবার বাসনা। তিনি এসবের উর্দ্ধে।
চতুর্দশ শ্লোক : তৃতীয় প্রকরণম্
অন্তঃ-ত্যক্ত-কষায়শ্য নির্দ্বন্দ্বস্য নিরাশিষঃ
যদৃচ্ছয়া-আগতো ভোগো ন দুঃখায় ন তুষ্টয়ে।
মুক্ত পুরুষ, অন্তরে কষায় অর্থাৎ বিষয় বাসনা রোহিত, নির্দ্বন্দ অর্থাৎ দ্বন্দ্বের অতীত, নিরাশিষ অর্থাৎ আশা নিরাশার অতীত - তাই, এমন ব্যক্তি যেমন ইচ্ছা ভোগ করুক না কেন তাতে তার দুঃখও নাই আবার কোনো তুষ্টি বা তৃপ্তিও নেই।
এই শ্লোকগুলো থেকে আমরা কয়েকটা জিনিস মুক্ত পুরুষ সম্পর্কে শুনলাম। প্রথমত মুক্ত পুরুষের কি ইহলোকে, কি পরলোকে, যাবতীয় ভোগ্য পদার্থ বিষয়ে বৈরাগ্যবান।
আমাদের মতো সাধারণ মানুষ ইহলোকে বিষয়ভোগে সুখী হতে চাই। আবার মৃত্যুর পরে যাতে স্বর্গের সুখ ভোগ করতে পারি, তার জন্য যত্নবান হয়ে থাকি। অর্থাৎ শাস্ত্র-উক্ত পুণ্যকর্ম করে মৃত্যুর পরে পরলোকে গিয়ে যেন স্বর্গের বাসিন্দা হতে পারি এইমত কার্য্য করে থাকি। ঋষি অষ্টাবক্র মুনি বলছেন, মুক্ত পুরুষ ইহলোকের বা পরলোকের সমস্ত ভোগ্য পদার্থ বিষয়ে বিরক্ত। দ্বিতীয়তঃ মুক্ত পুরুষ সবসময় নিত্য-আত্মা ও অনিত্য-দেহাদি সম্পর্কে বিচারপরায়ণ। ফলত মুক্ত পুরুষ কখনোই বিচারহীন নন। তিনি সবকিছুর মধ্যে শ্রেয় ও প্রিয় বিচার করে থাকেন। শ্রেয়কে গ্রহণ করেন, আর প্রিয়কে পরিত্যাগ করে থাকেন। তৃতীয়তঃ যিনি মুক্তির পথের পথিক, না আছে ত্যাগের ব্যাপারে অনীহা, না আছে বিয়োগের ভয়।
ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলতেন, সাধা লোকের বেতালে পা পড়ে না। যার গলা সাধা আছে, তার গলায় সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা ক্রমানুসারে আপনা-আপনি এসে পড়ে। যারা টাইপ করতে পারেন, তাদের আঙ্গুলের অগ্রভাগ ঠিক অক্ষরে গিয়ে আঘাত করে। এর জন্য এমনকি বিশেষ মনোযোগের দরকার পড়ে না। কোনো মুক্ত পুরুষকে অশুভ প্রবণতা বিচলিত করতে পারে না। এমনকি সে প্রচলিত নিয়ম-নীতির ধারও ধারেন না। তিনি জাতি ধর্ম্ম এমনকি সামাজিক মর্যদার বা অমর্যাদার গন্ডি মানেন না।
ঠাকুর রামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ, এঁরা সবাই তামাক খেতেন। রামদাস কাঠিয়াবাবা তাঁর গুরু দেবদাসজী তো গাজা খেতেন। এঁরা সবাই তামাক খেতেন। অনেক মহাত্মা নারী বেষ্টিত হয়ে থাকতেন। এতে এঁদের বিকার উৎপন্ন হতো না। কিন্তু আমাদের হয়। এখানেই সাধু ও সাধারণের মধ্যে পার্থক্য। এটা আমাদের বুঝতে হবে।
শুধু তাই নয়, এদের জীবন ধারনের পদ্ধতিও, আমাদের বিচার বুদ্ধিতে বোঝা মুশকিল। এক জিজ্ঞাসু গুরুর খোঁজে বেরিয়েছেন। তো কেউ একজন বলেদিলো, অমুক জায়গায় এই নাম তোমার গুরু আছেন। তার কাছে যাও। তো জিজ্ঞাসু, খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে দেখে, লোকটি মাংস কেটে বিক্রি করছে। তো ভাবলো, এই নৃশংস, জীব হত্যাকারী, কি করে ব্রহ্মদর্শী হতে পারে ? তো কে যে কি নিয়ে বসে আছে, কে বলতে পারে ? আসলে ব্রহ্মদর্শীরাও সাধারণের মতোই আচরণ করেন, আবার অস্বাভাবিক আচরণও করেন। তাই কারুর বাইরের আচরণে দেখে আমরা সাধারণরা তাঁকে বা তার জ্ঞানের বা তার অনুভূতির বিচার করতে পারি না। তাই তুমি বাইরে কি করছো, সেটা বড়ো কথা নয়। তোমার ভিতরে কি অনুভূতি হচ্ছে, সেটাই বড়ো কথা। এবং আসলে তুমি তাই যা তোমার ভেতরে।
এই জন্য, মহাত্মারা কি করছেন, তা না করে, তিনি কি বলছেন, তার প্রকৃতমর্ম উদ্ধার করে, সেই মতো করতে হয়। স্বামী অর্গরানন্দ, যিনি গীতার যথার্থ মর্মার্থঃ লিখেছেন, তিনি ভোর রাতে তাঁর মাটির পুতুলদের অর্থাৎ তার শিষ্যদের ঘুম থেকে তুলে দিয়ে, নিজে আবার শুয়ে পড়তেন, আর শিষ্যদের ধ্যানে বসতে বলতেন। তাই গুরুদেবকে দেখতে হয় না, শুনতে হয় না, অনুভব করতে হয়। তবে সাধন জীবন সার্থক হয়।
তৃতীয় প্রকরণের সমাপ্ত।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
অষ্টাবক্র গীতা - (২৪) (নতুন-সংস্করণ) চতুর্বিংশতি পর্ব্ব।
আমার এক বন্ধু জিজ্ঞেস করছিলো, অষ্টাবক্র গীতা কি শেষ হয়ে গেলো ? যদি শেষ না হয়ে থাকে তবে অষ্টাবক্র গীতার পর্বগুলো আর আপলোড করছো না কেন ? আসলে অষ্টাবক্র গীতার পর্বে প্রবেশের অধিকার আমার নিজেরও আছে কি না, সেই সন্দেহের উর্দ্ধে আমি উঠতে পারিনি। এর আগে মাত্র তিনটি অধ্যায়/প্রকরণ আমরা শুনেছি। তাতে আমি কিছু বোঝাতে পেরেছি কিনা সেটা আমি নিজেই বুঝতে পারিনি।
আসলে অষ্টাবক্র সংহিতা সত্য কথাটা এতো সহজে অবলীলায় বলে চলেছেন। এটাতে বোঝার কিছু নেই। আমরা আসলে কোনো কিছু শুনলে, দেখলে আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা, আমাদের সঞ্চিত জ্ঞান দিয়ে বিচার করে নেই, বুঝতে চাই। এ ক্ষেত্রে বোঝার কিছু নেই। শুধু মেনে নেওয়া। আগে কি দেখেছো, আগে কি শুনেছ সব ভুলে যাও । এই দেখো তাজমহল। বাবার মুখে শোনা বর্ণনা দিয়ে কল্পনার রঙে আঁকা তাজমহল নয়। তুমি কি ভেবেছো তা নয়। যা সত্যি তাই দেখো।
অনির্দিষ্ট যাত্রা নয়। আকাশ ছুঁয়ে দেখবার জন্য চলেছি,পৃথিবীর পূর্বে একবার, পশ্চিমে একবার। যেখানেই যাই আকাশ দূরে চলে যায়। অষ্টাবক্র কোনো কল্পনার জাহাজে চাপান নি। ঈশ্বর, পুরুষ না স্ত্রী, মা না বাবা, খ্রিস্টের মতো না কৃষ্ণের মতো শিবের মতো না বিষ্ণুর মতো। সব কিছুর ঊর্ধে এই ঈশ্বর স্বয়ং তুমি । রামকৃষ্ণের মতো "আয় দেখবি আয়।" রামকৃষ্ণের বেলায় মুশকিল হচ্ছে ওনার তিরোধানের পর আর কেউ বলতে পারে না "আয় দেখবি আয়।"
আমরা আবার একবার অষ্টাবক্রের জীবন কথা শুনে নেই। অষ্টাবক্রের তখন বারো বছর বয়স। মায়ের মুখে পিতা কহোড়ে অন্তর্দ্ধান রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য মামা শ্বেতকেতুকে নিয়ে জনক রাজার দরবারে চললেন। এই কাহিনী মহাভারতের বনপর্বে আছে । রাজার প্রাসাদের কাছে কাছে আসতেই রাজার সাথে অষ্টাবক্রের সাক্ষাৎ ঘটলো। রাজা জনক বোধ হয় প্রাতঃভ্রমনে বেরিয়ে ছিলেন।
অষ্টাবক্র বললেন - হে রাজন ! পথে যতক্ষন না ব্রাহ্মনের সাথে দেখা না হয় ততক্ষন অগ্রে অন্ধ তার পরে বধির - স্ত্রী - ভারবাহী - এবং সর্ব শেষে রাজা ক্রমান্নয়ে পথ চলবে। কিনতু যদি ব্রাহ্মণ থাকে তবে ব্রাহ্মণ সর্বাগ্রে থাকবে। এটাই পথ চলার নিয়ম।
বাপ্ কা বেটা। যেমন বাপ্ তার তেমন বেটা। অগ্নি পরিমানে ছোট হলেও তার দাহিকা শক্তি হ্রাস পায় না।শোনা যায়, অষ্টাবক্রর পিতা কহোড় একবার এমনি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন - রাস্তায় দেখা এক চণ্ডালের সঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গে অহংকারী পণ্ডিত মহর্ষি কহোড়, চণ্ডালকে রাস্তা ছেড়ে চলে যেতে বলেছিলেন। চণ্ডাল তো আর বিনয়ী ছিল না। সে বললো - কিসের পণ্ডিত হে তুমি ? জন্ম সূত্রে কেউ ব্রাহ্মণ হয় না, পণ্ডিত ও হয় না। এতো অহংকার কিসের তোমার ? দু পাতা পুঁথি পড়ে আর ঋষি উদ্দালকের জামাই হয়ে তোমার খুব বার বেড়েছে। ব্যাটা শ্বশুর-পোষ্য। যদি তোর এতো জ্ঞানের অহংকার তবে হোক লড়াই। তবে শোন্ লড়াইয়ে যে হারবে তাকে দু পায়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। যদি শর্তে রাজি হোস তবে প্রশ্ন কর। নতুবা রাস্তা দিয়ে সরে দাড়া আমি চলে যাই, তবে তুই যাবি। পণ্ডিত কহোড় ভাবলো - ব্যাটা মূর্খ, অস্পৃশ্য , অচ্ছুৎ - এত বড়ো কথা। ঠিক আছে। তুই প্রশ্ন কর। আমি তার জবাব দিচ্ছি। চণ্ডাল বললো দিক কয়টি ? কোন দিকে কার অবস্থান ? কহোড় বললো এই কথা ? শোন্ দিক চারটি - পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ। পূবেও সূর্য পশ্চিমেও সূর্য উত্তরে হিমালয় দক্ষিণে সমুদ্র। এবার আমি প্রশ্ন করি !
চণ্ডাল বলে উঠলো রে মূর্খ - এতদিন তুই তোর শ্বশুর-এর অন্ন ধংশ করেছিস। এই তোর জ্ঞানের বহর। তারপর চণ্ডাল বলতে লাগলেন-শোন,দিক দশটি - পূর্ব,পশ্চিম,উত্তর,দক্ষিণ,ঈশান,অগ্নি,নৈঋত,বায়ু,
ঊর্ধ, অধ।
ঊর্ধ, অধ।
পূর্বদিকে ইন্দ্র দেবতা। পশ্চিমে বরুন। উত্তরে কুবের। দক্ষিণে যম দেবতা। ঈশান অর্থাৎ উত্তর-পূব কোন পঞ্চমুন্ডি শিবের অবস্থান। অগ্নি অর্থাৎ দক্ষিণ-পূব কোন অগ্নি দেবতার অবস্থান। নৈঋত বা দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে অপদেবতা বা শয়তানে অবস্থান। বায়ু কোনে অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিম কোন ভগবান বিষ্ণুর অবস্থান। ঊর্ধে ব্রহ্মাণী, অধে বৈষ্ণবী। আরো শোন্ -ঊর্ধলোকে সাতটি স্তর বা লোক আছে। ভূঃ, ভুবঃ,স্বঃ,মহঃ, জনঃ, তপঃ, সত্যম। অধোদিকেও এমনি সাতটি স্তর আছে। এর নাম হলো তল, অতল,সুতল,তলাতল,মহাতল, রসাতল,পাতাল। বুঝেছেন ঘরজামাইবাবু ?
কহোড় অপমানে লাল হয়ে গেলো। এবং চণ্ডালের ধৃষ্টতা ও জ্ঞান দেখে ভীত হলো। কিংকর্তব্য-বিমুখ হয়ে ছুট লাগালো।
রাজা জনক-তো চণ্ডাল নয়।
তিনি অষ্টাবক্রের কথাটা শুনলেন। তাকিয়ে দেখলেন একজন পঙ্গু কিশোর তাকে ধরে-ধরে আর এক কিশোর পথ চলছে। বিনয়ী রাজা জনক কোনো বাত -বিতন্ডার মধ্যে গেলেন না। শুধু বললেন - যাও - আমি তোমাকে পথ প্রদান করলাম।
রাজা তো রাস্তা ছেড়ে দিলেন কিনতু দ্বারপাল তো রাজা নয়। সে তো আর রাস্তা ছাড়ছে না। রাজ্সভায় যেতে গেলে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। অষ্টাবক্র বলছে আমরা বিদ্বানদিগের যজ্ঞ সভায় যাবো।
বিদ্বানদিগের সভায় যেতে গেলে প্রথমত বিদ্বান হতে হবে। অন্তত চেহারায় তো কম সে কম বিদ্বান হতে হবে। একে দুবলা-পাতলা বারো বছরের শিশু। তায় আবার পঙ্গু। চেহারা দেখে তো মনে হয় পণ্ডিত তো দূরের কথা - পণ্ডিত হওয়া মতো বয়সই হয় নি। পঙ্গু হওয়াতে আরো তাচ্ছিল্যের চেহারা হয়েছে।
দ্বারপাল বলছে - হে ব্রাহ্মণ আমরা বন্দির আজ্ঞাকারী। এখানে বৃদ্ধ ও বিদগ্ধ পন্ডিতদেরই প্রবেশ করার অনুমতি আছে। বাচ্চাদের খেলবার জায়গা এটা নয়।
অষ্টাবক্র বলছে - হে দ্বারপাল এখানে যদি জ্ঞানবান বৃদ্ধদের প্রবেশের অধিকার থাকে তো আমারও প্রবেশের অধিকার আছে। কেননা আমিও জ্ঞানী-বেদজ্ঞ-জিতেন্দ্রিয়। অতএব আমাকে বালক জেনে অবজ্ঞা করো না।
দ্বারপাল বলছে : দেখো বাপু আমি এত কিছু বুঝি না। আমরা বন্দির আজ্ঞাধারী। বন্দি বলে দিয়েছে কেবলমাত্র পন্ডিতদেরই এখানে প্রবেশ করার অনুমতি দিতে। তুমি তো পণ্ডিত নও। তুমি বাপু বৃথা কেনো নিজেকে জাহির করছো? বিদ্বান অতি দুর্লভ। বিদ্যা অর্জন করতে করতে মানুষ বৃদ্ধ হয়। এবং বৃদ্ধদের মধ্যে কেউ কেউ জ্ঞানী হয়। তুমি বাপু বালক। এত অল্প বয়সে জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। কেবল অকাল-পক্কের মতো কথা বলছো।
তখন অষ্টাবক্র বললেন - হে দৌবারিক ! কেবল পলিত কেশ হলেই বৃদ্ধ হয় না। বালক হয়েও যে প্রজ্ঞাবান হয় তাকেই স্থবির বলা হয়। কি বয়স, কি পলিত, কি ঐশ্বর্য্য, কি বনধু , এ সব কিছুই কাউকে জ্ঞানবৃদ্ধ করতে পারে না। কেবলমাত্র সাঙ্গবেদসম্পন্ন্ ব্যক্তিই মহান। তুমি সময় নষ্ট না করে আমাকে তোমার আজ্ঞাকারী বন্দির কাছে নিয়ে চলো। নতুবা রাজা জনকের কাছে নিয়ে চলো। আমি বন্দিকে দেখবার মানসে এখানে এসেছি। তুমি অবশ্যই দেখবে আজ আমি পণ্ডিতদের সাথে শাস্ত্র বিচারে ও বাদে বন্দিকে নিশ্চয় পরাজিত করবো। তারপর দেখো জনক সহো সমস্ত পণ্ডিতগণ, আমার উৎকর্ষের প্রশংসা করবে। তুমি শুধু আমাকে বিদ্বানসভায় নিয়ে চলো।
দ্বারপাল দেখলো এ ছোকরা ছাড়বার পাত্র নয়। বললো ঠিক আছে আমি তোমাকে কৌশলে বিদ্বানদিগের যজ্ঞসভায় নিয়ে যাচ্ছি। তুমি শুধু আমাকে অনুসরণ করো। যা বলছি তাই করো।
এর পর দ্বারপাল অষ্টাবক্রকে কোথায় নিয়ে গেল বা সেখানে কি হলো সে কথা বলার আগে আমরা অষ্টাবক্র সংহিতার পরবর্তী শ্লোক আর একটু দেখে নেই।
চতুর্থ প্রকরণ :
- শিষ্য -প্রোক্ত -অনুভব-উল্লাস-ষট্কনাম
এই চতুর্থ প্রকরণে মাত্র ছয়টি শ্লোক। এখানে আত্মজ্ঞ ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হচ্ছে।
এই চতুর্থ প্রকরণে মাত্র ছয়টি শ্লোক। এখানে আত্মজ্ঞ ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হচ্ছে।
প্রথম শ্লোক : চতুর্থ প্রকরণম্
হন্ত-আত্নজ্ঞস্যঃ ধীরস্য খেলতো ভোগলিলয়া
ন হি সংসার-ৰাহিকৈঃ-মূঢ়ৈ সাহা সমানতা।
আ মরণ ! আত্মজ্ঞ ব্যক্তি, ধী সম্পন্য ব্যক্তি যতই ভোগ লীলায় রত থাকুন, তিনি কখনোই সংসার-আসক্ত মূঢ় ব্যক্তির সঙ্গে তুলনীয় হতে পারেন না ।
এই শ্লোকটির মধ্যে আমরা সংখ্যযোগের মিল দেখতে পাই, আবার গীতার পঞ্চম অধ্যায় - সন্যাস যোগের মধ্যে দেখতে পাই এই একই সুর ।
গীতায় ৫/১৩ শ্লোকে বলা হচ্ছে,
সর্বকর্ম্মানী মনসা সংন্যস্যান্তে সুখং বশী
নবদ্বারে পুরে দেহি নৈব কুর্ব্বন ন কারয়ন্। (৫/১৩ -গীতা)
সমস্ত কর্ম্মই মনে মনে পরিহার করে, এই নবদ্বার রূপে দেহে অবস্থান করেন।
না কর্তৃত্বং ন কর্ম্মানি লোকস্য সৃজতি প্রভুঃ।
ন কর্ম্মফল সংয়োগং স্বভাবস্তু প্রবর্ত্ততে। (৫/১৪-গীতা)
তিনি কোনো কর্তৃত্ত্ব করেন না, তিনি কোনো কর্ম্ম করেন না, আবার কর্ম্মফলও সৃষ্টি করেন না। যা কিছু হচ্ছে, তা প্রকৃতির স্বভাবে হচ্ছে।
দ্বিতীয় শ্লোক : চতুর্থ প্রকরণম্
যৎপদং প্রেপ্সবো দিনাঃ শত্রু-আদ্যাঃ সর্ব-দেবতা
হো তত্র স্থিত যোগী ন হর্ষম -উপগচ্ছতি। (৪/২)
যে পদ পাবার জন্য দেবগনকেও শত্রূ মনে করা হয়, আবার না পেলে নিজেকে দীনহীন মনে হয় - সেই পদ-অবস্থায় স্থিত থেকেও যোগী কখনও হর্ষান্নিত হন না।
তৃতীয় শ্লোক : চতুর্থ প্রকরণম্
তজ্জ্ঞস্য (তৎ-জ্ঞস্য) পুন্য-পাপাভ্যাং স্পর্শ হ্যন্তর্ন (অন্তঃ ন) জায়তে
ন হ্য়াকাশস্য(হি-আকাশস্য) ধুমেন দৃশ্যমানা-অপি সঙ্গতিঃ।
সেই অজ্ঞ পুরুষের অন্তরে পাপ পুন্য স্পর্শ করতে পারে না, যেমন দৃশ্যমান ধোঁয়ার সঙ্গে আকাশের কোনো সম্পর্ক নেই।
চতুর্থ শ্লোক : চতুর্থ প্রকরণম্
আত্মৈব-ইদং জগৎ-সর্বং জ্ঞাতং যেন মাহাত্মনা
যদৃচ্ছয়া বর্তমানং তং নিষেদ্ধ ুং ক্ষমেত কঃ।
সর্ব জগৎকে আত্মা রূপে জেনেছেন যে মহাত্মা, তিনি যেমন ইচ্ছা বর্তমান থাকুন - তার আবার কিসের নিষেধ ? তিনি ক্ষমারও উর্ধে।
পঞ্চম শ্লোক : চতুর্থ প্রকরণম্
আব্রহ্ম-স্তম্ব-পর্যন্তে ভূতগ্রামে চতুর্বিধে
আব্রহ্ম-স্তম্ব-পর্যন্তে ভূতগ্রামে চতুর্বিধে
বিজ্ঞস্য-এব হি সামর্থম-ইচ্ছা-অনিচ্ছা-বিবর্জনে।
ইচ্ছা - অনিচ্ছা পরিত্যাগে অশক্ত ব্রহ্মা পর্য্ন্ত সমস্ত প্রাণিকুল (জলচর-স্থলচর-উভচর-আকাশচর)- এর মধ্যে একমাত্র বিদ্বান বা বিজ্ঞই এই ইচ্ছা-অনিচ্ছা নিবর্তনের সামর্থ রাখে।
ষষ্ঠ শ্লোক : চতুর্থ প্রকরণম্
আত্মানম-অদ্বয়ং কশ্চিৎ-জানাতি জগদীশ্বরম্
যৎ-বেত্তি তৎ স কুরুতে ন ভয়ং তস্য কুত্র-চিৎ।
আত্মা অদ্বিতীয়। এই জগদীশ্বরকে কশ্চিৎ জানা যায়। যিনি জেনেছেন, তিনি যা কিছু কর্তব্য বলে মনে করেন তাই করেন, তাতে না আছে কোনো ভয় না প্রারব্ধ।
চতুর্থ প্রকরণম সমাপ্ত
১৯৫৬ সালের ৩১-সে জুলাই, সন্ধ্যেবেলা। বাবাসাহেব, বারান্দায় বসে, অপসহায়ক শ্রী রক্তু সাহেবকে, ডিকটেশন দিচ্ছেলেন। হঠাৎ বাবা সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। রক্তুসাহেব তাকে বিছানায় শুইয়ে সেবাযত্ন করতে লাগলেন। এইসময় রক্তু সাহেবের মনের মধ্যে ,এক আশঙ্কা জেগে উঠলো। তাহলে কি বাবাসাহেব শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন ? আজকাল বাবাসাহেবের মধ্যে যেন একটা বিষণ্নতার ছায়া পড়েছে। তাঁকে আর আগের মতো উদ্দমী হতে দেখা যায় না। মাঝে মধ্যে একাএকা কাঁদেন, তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু কেন ? আর নিজেকে চেপে না রাখতে পেরে, বাবাসাহেবকে প্রশ্ন করলেন, স্যার, আজকাল আপনাকে এতো বিষন্ন ও হতোদ্যম দেখায় কেন ?
এইসময় বাবাসাহেব, ছিলেন, বাকরুদ্ধ। তার শরীর মন আজকাল বিপর্যস্থ। কোথাও যেন একটা না পাওয়ার বেদনা। আবেগরুদ্ধ কন্ঠে বাবাসাহেব হাতটা কপালে তুললেন। যেন সেই ঈশ্বরকে প্রণাম করলেন। তারপর বললেন, আমার দুশ্চিন্তা হলো, আমি আমরা সাধনা পূরণ করতে পারিনি। আমি দেখতে চেয়েছিলাম, আমার জীবদ্দশাতে আমার লোকজন এদেশের শাসক হয়ে বসেছে। তারা অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে ও একই মাপকাঠিতে রাজনৈতিক ক্ষমতা ভাগ করে নিয়েছে। যতটুকু আমি করতে পেরেছি, তার সবটাই অল্প কয়েকজন শিক্ষিত দলিত ভোগ করছে। আর ের নিজেদের সঙ্গেই প্রতারণা করছে। নিজেদের পদদলিত নির্যাতিত নিরক্ষর ভাইবোনদের প্রতিও এদের কোনো সহানুভূতি নেই। এসব আমার কল্পনার বাইরে ছিল। ের কেবল ব্যক্তিগত লাভের জন্য, বেঁচে আছে। একজনও সমাজের জন্য কাজ করতে প্রস্তুত নয়। ের নিজেদের ধংসের পথ ধরেই এগিয়ে চলেছে। এখন আমার দৃষ্টি গ্রামের বিরাট নিরক্ষর আমজনতার দিকেই ফেরাবো ভাবছি। আজও আমার গ্রামের ভাইবোন চরম দুর্ভোগের মধ্যে বাস করছে। তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক কোনো পরিবর্তন আসেনি। অথচ আমার পরমায়ু কমে আসছে।
আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, যে দেশের মানুষ এতটা জাতবিদ্বেষী, এবং পূর্বসংস্কার দ্বারা আবদ্ধ সে দেশে জন্মানোটাই একটা পাপ। দেশের মানুষ একমাত্র রাষ্ট্রশক্তির (প্রধানমন্ত্রীর) কথা ছাড়া অন্য কিছু শুনতে বা মানতে চায় না। দেশটা যে কোথায় তলিয়ে যাচ্ছে, তা বলার নয়। সে যাই হোক, আমার চারিদিক থেকে আমার উপরে ভর্ৎসনা বর্ষিত হচ্ছে, তথাপি আমি আমার মৃত্যু পর্যন্ত আমার লোকেদের জন্যই যথাসাধ্য করে যাবো।
বলতে বলতে তার গালবেয়ে অশ্রুধারা নেমে এলো। বাবাসাহেব, এবার এদিক ওদিক তাকিয়ে সোজা হয়ে বসলেন। আবার আস্তে আস্তে বললেন "রক্তু ভেঙে পড়ো না। এই শরীর তো একদিন ভেঙে পড়বে, এই জীবন একদিন নিঃশেষিত হবে। তথাপি জেনো, জীবন একটা লড়াই। লড়াই করেই বাঁচতে হয়। লড়াই থেকে কখনো যেন পিছিয়ে এসো না। জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাও।
আজ যে ক্যারাভ্যান দেখতে পাচ্ছো, সেটাকে-তো বহুকষ্টে এখানে টেনে নিয়ে এসেছি। বা বলা যায় , আনতে পেরেছি। এই ক্যারাভ্যান আরো এগিয়ে চলুক। রাস্তায় তো বাধা থাকবেই, রাস্তায় তো গভীর খাদ থাকবেই, জীবনে তো সমস্যা থাকবেই। আমি জানিনা, আমার লোকেরা এই ক্যারাভ্যান সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে কি না। যদি নাও পারে, তথাপি যেন এই ক্যারাভ্যানকে এখানেই এই অবস্থাতেই রেখে দেয়। একে যেন কেউ পিছনে হটিয়ে না দেয়, এতটুকু যেন আমার লোকেরা আমার জন্য করে। আমার লোকজনের প্রতি এই আমার শেষ বার্তা। আবার বিশ্বাস, আমার লোকেরা আমার এই কথার মান্যতা দেবে। হে রক্তু, যাও সবাইকে ডেকে আমার এই শেষ বাণী তাদের কাছে পৌঁছে দাও। সবাইকে ডেকে আমার শেষ ইচ্ছেটা বলে দাও।
এই কথা বলতে বলতে বাবাসাহেব, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। তার চোখ অশ্রুভরাট ঝাপসা হয়ে গেলো। বাবাসাহেব ধীরে ধীরে বিছানায় শরীরটাকে এলিয়ে দিলেন।
এর মাত্র চারমাস, ৬ দিন পরে, ৬-ই ডিসেম্বর ১৯৫৬ বাবাসাহেবের পার্থিব দেহ নির্ব্বান লাভ করে। আমরা সবাই যেন তাঁর শেষ বাণীর কথা স্মরণ রেখে, যার পক্ষে যতটুকু সম্ভব, সেই মতো আমাদের লোকের জন্য একটু সময় দেই, আমরা যেন আমাদের লোকের জন্য একটু শ্রম দান করি, আমরা যেন আমাদের লোকের জন্য, একটু আর্থিক সাহায্য করি, আমরা যেন আমাদের লোকের জন্য একটু শিক্ষার প্রদীপ জ্বেলে দেই, আমরা যেন আমাদের লোকের জন্য সামাজিক ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম করি। .এই আমার্ প্রার্থনা। .
No comments:
Post a Comment