জীবন রহস্যঃ - ১৯ - মহান আত্মার মরদেহ ত্যাগ।
জীবনের অধিকার - দেহত্যাগ - একটি মৌলিক প্রশ্ন
মহাত্মাগণ বলে থাকেন, নিজে বাঁচো, অপরকে বাঁচাও। কিন্তু আমরা চারিদিকে একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাই, আমরা নিজেরা বাঁচবার অজুহাতে অন্যদেরকে মারছি। এমনকি নিজেকে নিজেই মারছি।
জীবন তুমি কার ? এই জীবনের উপরে কার অধিকার ? জীবনের উপরে কি জীবের অধিকার ? মনুষ্য জীবনের উপরে কি মানুষের কোনো অধিকার আছে ? জীবন কার ইচ্ছেয় চলে ? বলা হয়ে থাকে, বাসনা পূরণের উদ্দেশ্যে, সংকল্প পূরণের জন্য আমরা নানাবিধ দেহ ধারণ করে থাকি। তো সেই দিকথেকে দেখতে গেলে, মনে হয়, জীবাত্মা তার নিজের ইচ্ছেতেই দেহ ধারণ করে থাকে। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, ঈশ্বরের ইচ্ছেতেই এই জগতের সৃষ্টি। জগৎময় ঈশ্বর। জীবাত্মা বলে আলাদা কিছু নেই।
কিন্তু আমরা দেখেছি, একটা জীব অন্যজীবের উপরে নির্ভর করে বেঁচে, বেড়ে ওঠে। জীব কখনো নিঃসঙ্গ ভাবে বাঁচতে পারে না। তার খাবারের জন্য, তার বাস-স্থানের জন্য, তার নিরাপত্তার জন্য, সে যেমন প্রকৃতির উপরে নির্ভর করে, তেমনি, সমাজ-রাষ্ট্রের উপরে নির্ভর করে। জীব সমাজবদ্ধ হয়ে বাঁচতে চায়। এই সমাজের উপরেই তার বাঁচা বাড়া নির্ভর করে। সমাজ আবার রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে চলে। রাষ্ট্র আবার আইন-কানুনের উপরে নির্ভর করে চলে। রাষ্ট্রের এই আইন কানুন আবার এমনই দ্বৈতে ভরা যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেমন সামাজিক জীবকে বাঁচিয়ে রাখে, আবার সেই সামাজিক জীবকে মৃত্যুমুখে ফেলে দিতে পারে। সার্বভৌম রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনা করে, জনগণ দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি । অর্থাৎ যাকে সে নির্বাচন করে, সেই তাকে সুরক্ষা দেয়, আবার তাকেই সে নির্যাতন করে, এমনকি মেরে ফেলতেও পারে। তো প্রশ্ন জাগে যে জীবন তোমার নয়, তা তুমি সমাজকে দিলে কি করে ? যে জীবন তোমার নয়, তাকে তুমি রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিলে কি করে ? এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে ? আরো একটা ব্যাপার হচ্ছে, আপন জীবন রক্ষার উদ্দেশ্যে সে তার ব্যক্তি জীবন বিপন্ন করে তোলে। আগুনের হাত থেকে বাঁচতে তিনতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে । বাঘের হাত থেকে বাঁচতে সে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কুমিরের হাত থেকে বাঁচতে সে সিংহের গুহায় আশ্রয় নেয়। সিংহের মুখের কাছে চলে যায়।
সমাজ অদৃশ্যভাবে পরস্পরের মধ্যে একটা চুক্তি করে রেখেছে , একে অপরকে বাঁচাবে বলে । তাই সে নিজের জীবন বিপন্ন করে, অন্যের জীবন বাঁচাতে ছুটে যায়। আবার জীবের স্বাভাবিক স্বভাব হচ্ছে সে অপরের জীবনের বিনিময়ে নিজের জীবন বাঁচাতে চায়। এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্যের মেলবন্ধন। কেউ কারোর নয়, আবার সবাই সবার। রাষ্ট্র যখন কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, তখন সে বলে, তোমার মৃত্যু রাষ্ট্রের পক্ষে মঙ্গলকর - তাই তুমি মরবে। আর সমাজের সবাই বলে ঠিক-ঠিক-ঠিক। এযাবৎ তুমি যে নিরাপত্তা পেয়েছিলে, তা তোমাকে রাষ্ট্র দিয়েছিলো। আর আজ যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে তাও রাষ্ট্রের দান।
খুনির ফাঁসিদন্ড আসলে জীবনরক্ষার দোহাই। আইন প্রণয়নের সময় রাষ্ট্র-প্রতিনিধিগণ কেউ কি ভাবেন, যে চুরি করলে জেলে যেতে হবে, খুন করলে খুন হতে হবে ? রাষ্ট্রের অধিকারে হস্তক্ষেপ করলে রাষ্ট্রদ্রোহী হতে হবে ? আসলে জীবনকে যখন খুন করে রাষ্ট্র, তখন সে জীবন রক্ষার প্রতিশ্রুতি পালন করে। মানুষ যখন আগুনের ভয়ে তিন তলা থেকে ঝাঁপ দেয়, তখনও সে জীবন রক্ষার দায়িত্ত্ব পালন করে। আবার যখন সে সিংহের গুহায় প্রবেশ করে, তখনও সে জীবন রক্ষার দায়িত্ত্ব পালন করে থাকে।
বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক রুশো বলেছিলেন, অপরাধের শাস্তি বিধান অবশ্য কর্তব্য, অন্যথা অপরাধ-প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে। তাই অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া, বা ক্ষমা করবার অধিকার তারই হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত, যিনি কোনোকালে অপরাধ করেননি, যার ক্ষমারও কোনো প্রয়োজন হয় নি।
অন্যদিকে মহাত্মাগন বলছেন, মৃত্যুই মুক্তির পথ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন, আমি সবাইকে মেরেই রেখেছি, তুমি নিমিত্ত্ব মাত্র। দেহের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর কারন লুক্কায়িত থাকে দেহের মধ্যেই। আমরা কেউ মারতেও পারি না, মরতেও পারি না।
তো কেউ বাঘের পেটে যায়, কেউ কুমিরের পেটে যায়, কেউ রাষ্ট্রের রোষে যায়, কেউ বয়সের ভারে যায়, কেউ রোগের প্রকোপে যায় । যায় সবাই। কিন্তু যোগীগণ বলছেন, যেতে তোমাকে হবেই, কিভাবে যাবে, কোথায় যাবে সেটাই বড়ো কথা। যোগবলে দেহত্যাগ করতে হবে তবেই মহামুক্তি। নতুবা ফিরে ফিরে আসতে হবে।
যোগীগণ যোগবলে দেহ ত্যাগ করতে পারেন, ইচ্ছামৃত্যু বরণ করতে পড়েন। সত্যিই কি সম্ভব ? এটা কিভাবে সম্ভব ? স্বামীজী বলেছিলেন, আমাদের পুরানশাস্ত্রে যোগবলে দেহত্যাগকে মহামুক্তির পথ হিসেবে বর্ননা করা হয়েছে। আত্মহত্যা আর যোগবলে দেহত্যাগ এক কথা নয় কিন্তু । আত্মহত্যা প্রকৃতি বিরুদ্ধে কাজ, আর যোগীর দেহত্যাগ প্রকৃতির সঙ্গে মিলন। স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী বলেছিলেন, যোগীর ইচ্ছামৃত্যু। যোগবলে দেহত্যাগ সহজ ব্যাপার নয়। এসব গুহ্য বিদ্যা। উদ্ধব এই বিদ্যা বিদুরকে শিখিয়েছিলেন। বিদুর এই বিদ্যা গান্ধারী, ধৃতরাষ্ট্র ও কুন্তীদেবীকে শিখিয়েছিলেন। এছাড়া মহামতি ভীষ্ম এই বিদ্যা অর্জন করেছিলেন। অনেক মহাপুরুষ দেহত্যাগের এই পন্থা অবলম্বন করে থাকেন। যাই হোক, আসলে এই বিদ্যা আয়ত্ত্ব তারাই করতে পারেন, যারা যোগের সাহায্যে সংযম/সমাধি/কৈবল্য লাভ করতে পারেন। আমাদের শরীরে নটি দ্বার আছে। এগুলো হলো, দুটো কানে , দুটো চোখে , দুটো নাকে,মুখে এক, গুহ্যে এক, লিঙ্গতে এক। এই নয়টি দ্বার বন্ধ করতে হবে। অর্থাৎ হাতের বুড়ো আঙ্গুল দুটো দ্বারা কান, তর্জনী দ্বারা চোখ, মাধ্যমে দ্বারা নাক, অনামিকা ও কনিষ্ঠ দ্বারা মুখ বন্ধ করতে হবে। এর পর, গোড়ালি দ্বারা গুহ্যস্থানে চাপ দিতে হবে। এর পর, কুন্ডলিনী জাগরণের ক্রিয়া অনুসারে, শ্বাসের সাধন করতে হবে। এতে করে, পঞ্চপ্রাণ, পাঁচ কর্মেন্দ্রিয় ও মনের সাথে জীবশক্তিকে কুন্ডলিনীর সাহায্যে মূলাধার পদ্ম থেকে ক্রমে ক্রমে সুষুম্নার মধ্যে দিয়ে স্বাধিষ্ঠান,মনিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ভেদ করে আজ্ঞা চক্রে নিরুদ্ধ করতে হবে। এইসময়, নাকের আঙ্গুল সরিয়ে বাইরের বায়ু আকর্ষণ করে, গুহ্যদেশ সংকোচন করে যোনিমুদ্রা অবলম্বন করতে হবে। ফলে প্রাণবায়ু তৎক্ষণাৎ ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে, পরব্রহ্মে মিলিত হবে। একেই জীবাত্মার মহামুক্তি বলা হয়ে থাকে।
কাঠে কাঠে ঘর্ষনে তাপের বা আগুনের উদ্ভব হতে পারে। আবার আগুন লাগলে দুটো জিনিস হতে পারে, একটা হচ্ছে ধোঁয়া আর একটা হচ্ছে আলো। বায়ু-সাধন প্রণালীর মাধ্যমে অর্থাৎ কুম্ভক ইত্যাদির সাহায্যে আমরা আমাদের শরীরে মধ্যে বায়ুকে ঘর্ষনের দ্বারা উত্তাপ বা আলো সৃষ্টি করে থাকি। এই ধুম্রহীন জ্যোতিই জ্ঞান।একেই জ্ঞানের আলো বলা হয়ে থাকে। আবার শরীরের এই জ্যোতিই শক্তি যা কুণ্ডলিনী থেকে যাত্রা শুরু করে সুষুম্না বর্তে আজ্ঞাচক্রে এসে মিলিত হয়। এই শক্তিই প্রাকৃতিক শক্তিকে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ করবার ক্ষমতা রাখে। বিজ্ঞানের ছাত্রগণ জানেন, পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে যদি নিষ্ক্রিয় করা হয়, তবে পৃথিবী আবার সূর্য্যের সঙ্গে মিলিত হয়ে যাবে। এই ঘটনা বাহ্যিক জগতে ঘটেনি, বা ঘটে না। কিন্তু এই ঘটনা আমাদের অন্তর্জগতে ঘটতে পারে, ঘটছে। তাই প্রতিনিয়ত জীবের প্রকাশ ও অবলুপ্তি ঘটছে। এখানে প্রাণবায়ু কুণ্ডলিনীশক্তির সাহায্যে অর্চ্চিপথ প্রাপ্ত হয়। অর্চ্চি কথাটার অর্থ হচ্ছে দীপ্তি বা সূর্যকিরণ আলোর তরঙ্গ। কুণ্ডলিনীর দুটি স্পন্দন বা আলোর তরঙ্গ এঁকেবেঁকে অর্থাৎ দুলতে দুলতে চলতে থাকে। একটা ইড়া একটা পিঙ্গলা পথ। এর ফলে পিতৃযানপথ সৃষ্টি হয়। পিতৃযানপথ হচ্ছে, সৃষ্টিশক্তি, পিতৃগণের যান বা গমনপথ যা চন্দ্রলোক পর্যন্ত বিস্তৃত। উদ্বোধিতা শক্তি স্পন্দনমুক্ত হলে জ্যোতির্পথে সূর্যালোক প্রাপ্ত হয়, অর্থাৎ সহস্রারে গমন করে । এই প্রক্রিয়ার সাহায্যে সাধকের জ্ঞাননেত্র প্রস্ফুটিত হয়। এর পর ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে, বিন্দুতে এই শক্তি মিলিত হয়। একেই বলে ব্রহ্মসাযুজ্য লাভ বা ব্রহ্মলোক প্রাপ্তি। সহস্রারের উপরে অবস্থা করছে, বিন্দু। বিন্দুই এমন স্থান যেখানে জীব ও জগতের মিলনঘটিয়ে থাকে। আবার বিন্দুই চন্দ্রলোক সূর্যলোক উভয়ের মিলন স্থান। এইসব অনুভূতিলব্ধ জ্ঞান গুরুসান্নিধ্যে সহজলভ্য। নতুবা আমাদের মতো সাধারনের কাছে, কল্পনার বিষয় মাত্র। আর একটা কথা বলি, উপযুক্ত গুরু ছাড়া, এই বিদ্যা অনুধাবন করা সম্ভব নয়।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
অধিকারী কে ? মুক্তির অধিকারী কে ?
আধুনিক উদারপন্থী বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ, মানুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদের স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়। কারন সমস্ত মানব-আত্মাই এক অভিন্ন। আর সমস্ত মানব-আত্মার উদ্দেশ্য এক, একই নির্দিষ্ট আদর্শ ও একই লক্ষ। আর এই লক্ষ হচ্ছে অনন্তের সঙ্গে একাত্মতা। এই অনন্তের সঙ্গে মিলিত হবার রাস্তা ভিন্ন ভিন্ন। যেকোনো রাস্তাতেই সবাই সমান অধিকারী।
কিন্তু বাস্তব অন্য কথা বলে, আমরা দেখেছি, সবাই সমান বুদ্ধির অধিকারী নয়। নির্বোধের সংখ্যাও কম নয়। আর এর কারন নিহিত আছে, তার নিজের মধ্যেই। এই সংসারে সকাম ও নিষ্কাম দুই শ্রেণীর মানুষই আছেন। একেকজনের প্রবৃত্তি এক-এক রকম । একদিকে যেমন সবার সবকিছুতে রুচি, বা আগ্রহ সমান নয়। তেমনি সুযোগের মধ্যেও তারতম্য আছে। সুযোগের অভাব আছে। এমনকি সময়ের তারতম্য আছে। একই সময়ে পিতা -পুত্র সমান জ্ঞানের অধিকারী নাও হতে পারে এবং না হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই একটা নির্দিষ্ট সময়ে যারা মনুষ্যদেহ ধারণ করে আছেন, তার মধ্যে বয়সের তারতম্য আছে, বুদ্ধির তারতম্য আছে, জ্ঞানের তারতম্য আছে। সর্বোপরি, সবাই এক জন্মের দেহধারী, এমন ভাবার কোনো কারন নেই। আমি আগের জন্মে কোন ধরনের দেহে অবস্থান করেছিলাম, সেখানে আমার সুযোগ কতটা ছিল, বা সেই সুযোগের কতটা সদ্ব্যবহার করেছিলাম, তার উপরে নির্ভর করে মানুষে মানুষে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। আমি ছোটবেলা থেকে মাছ-মাংস খেতে ভালোবাসি না । এটি আমার ছোটবেলার পরিবেশের দান হতে পারে, আবার আমার পূর্ব-পূর্ব জীবনের অভ্যাসের বশে দেখা দিতে পারে। জন্ম থেকেই কেউ গান-বাজনা বা ধ্যানের প্রতি আগ্রহশীল হতে পারে, আবার কেউ বন্দুক নিয়ে ঘোরাফেরা করতে ভালোবাসতে পারে। কেউ জল দেখলে ভয় পায়, কুকুর দেখলে ভয় পায়, আবার কেউ জলে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাতে ভালোবাসে, কুকুরকে আদর ক'রে খেতে দিতে ভালোবাসে। এসবই তার পূর্বজীবনের সঞ্চিত অভ্যাসের বহিঃপ্রকাশ। এতে করে কেউ ছোট বা বড়ো এমন ভাবার কোনো কারন নেই। কারন সঞ্চিত সংস্কার মানুষকে নির্দিষ্ট পথে ধাবিত করে থাকে। কিন্তু ভগবান প্রত্যেক মানুষের মধ্যে একটা শক্তি দিয়েছেন , যার ব্যবহার করে সে তার জীবনকে উন্নত করে পারে। তো এই অসীম শক্তির ব্যবহার কে কিভাবে করছেন , তার উপরে নির্ভর করেই তার জীবনের উদ্দেশ্য সফল হয়ে থাকে। মানুষ যখন তার পুরুষাকারের সদ্ব্যবহার করতে সক্ষম হয়, তখন মানুষের জীবনে পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তনই মানুষে মানুষে পার্থক্য সূচিত করে থাকে। এই পরিবর্তনের তারতম্য অনুসারে মানুষে মানুষে প্রভেদ দেখা যায়।আর এই তারতম্যের জন্যই ব্রহ্মসাযুজ্য লাভ করতে কারুর এক জন্ম লাগবে, কারুর একাধিক জন্ম অপেক্ষা করতে হবে। তবে হ্যাঁ ঈশ্বর সবাইকেই একদিন না একদিন কাছে টেনে নেবেন অবশ্য়ই।
আচার্য্যদেব শঙ্কর বিবেকচূড়ামনি গ্রন্থের (শ্লোক-২)শুরুতে মুক্তিমার্গে যাবার জন্য কে অধিকারী তার কথা বলছেন।
তস্মাদবৈদিক ধর্ম মার্গপরতা বিদ্বত্ত্বমস্মাৎ পরম।
আত্মা অনাত্মা বিবেচনং স্বনুভবো ব্রহ্মাত্মনা সংস্থিতি -
র্মুক্তির্নো শত জন্ম কোটি সুকৃতৈঃ পুন্যৈঃ বিনা লভ্যতে।
সমস্ত জীবের মধ্যে মনুষ্যজন্মই দুর্লভ। আবার মানুষের মধ্যে পুরুষ দেহ দুর্লভ। পুরুষের মধ্যে আবার যিনি বিপ্রতা পেয়েছেন, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ ঘরে জন্ম গ্রহণ করেছেন, সেই মানুষ আরো দুর্লভ। ব্রাহ্মণ পুরুষের মধ্যে যিনি বৈদিক ধর্মমার্গে নিষ্ঠাযুক্ত সেইরকম মানুষ আরো দুর্লভ। এর থেকেও শ্রেষ্ট প্রাপ্তি হচ্ছে শাস্ত্রের তাৎপর্য জ্ঞান। আত্মা ও অনাত্মা বিষয়ের তাৎপর্য বিচার, দুর্লভ। স্বরূপের প্রতক্ষ্য অনুভূতি আরো দুর্লভ। সবশেষে ব্রহ্মের সঙ্গে অভেদভাবে স্থিতি লাভ করতে পারা দুর্লভতম। শতকোটি জন্মের সুকৃতি ও পুণ্যফল ব্যতীত এসব পাওয়া সম্ভব নয়। আর জন্ম জন্মান্তরের সুকীর্তি অর্জনের মাধ্যমে যতক্ষন এই সব দুর্লভ গুণগুলো প্রাপ্ত না হচ্ছি, ততক্ষন আমাদের পক্ষে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হয়।
তাই মানুষই ভালো মন্দ বোঝে, তাদেরই কেবল বিচার শক্তি আছে। পশুরা বা দেবতারা কেবল সহজাত বৃত্তি অনুযায়ী কর্ম করে, বা ভোগ বিলাসে ব্যস্ত থাকে।
তাই মহাত্মা শঙ্কর বলছেন, মানুষ হয়ে জন্মানো, নিজের জ্ঞান সঞ্চয়ের ক্ষমতাকে কাজে লাগানো, বিচার দ্বারা আত্মা-অনাত্মা ভেদ করে ব্রহ্মে সংস্থিতি লাভ আমাদের বহু জন্মের পুণ্যফল। অতএব এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে। তবে মহাত্মা শঙ্করাচার্য আরো দুটি নির্দেশ করেছেন, অধিকারী নির্ণয়ের ক্ষেত্রে, একদিকে আমাদের যেমন মনুষ্য জন্ম নিতে হবে, তেমনি, মুক্তিলাভের জন্য আমাদের গভীর আগ্রহ অর্থাৎ ব্যাকুলতা থাকা চাই, আবার শধু মনুষ্য জন্ম ও ব্যাকুলতা থাকলেই হবে না, ব্রহ্মদর্শী মহাপুরুষের সংশ্রবে আসতে হবে। অর্থাৎ উপযুক্ত গুরুর সংশ্রবে আসতে হবে।
জন্তুনাং নরজন্ম দুর্লভমতঃ পুংস্ত্বং ততো বিপ্রতা
জন্তুনাং - জন্তু বলতে সাধারণত আমরা নিম্নতর প্রাণীকে বুঝি। যার জান আছে সেই জন্তু ,জন্তুনাং অর্থাৎ সমস্ত জীব গনের মধ্যে বা সমস্ত প্রাণীদের মধ্যে
নরজন্ম - মনুষ্য জন্ম বা মানুষের এই দেহ লাভ
দুর্লভম - দুর্লভ
অতঃ পুংস্ত্বং - এর থেকে পুরুষের দেহলাভ আরো দুর্লভ।
সমস্ত মানুষই অজ্ঞান অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে, অর্থাৎ শূদ্র হিসেবে জন্ম গ্রহণ করে। ধীরে ধীরে মানুষ জ্ঞান সঞ্চয় করতে থাকে। তখন তিনি বিপ্র হন । এই জ্ঞানের সাহায্যে যখন জীবিকা অর্জনের উপায় অবলম্বন করে, তখন সে বৈশ্য বা ক্ষত্রিয় । যখন মানুষ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে, তখন সে ব্রাহ্মণ। ব্রহ্মজ্ঞানীকে ব্রাহ্মণ বলা হয়, জন্মসূত্রে কেউ জ্ঞানী বা ব্রাহ্মণ হতে পারেন না। ব্রাহ্মণ হতে হয়, ব্রাহ্মণ হয়ে কেউ জন্মায় না।
এবার দেখেনেবো বেদে ব্রাহ্মণ বলতে কাদের বোঝায়। ঋক্বেদ সংহিতার ১০-ম মন্ডলে ৯০ সূক্তে ১ ও ১১-১৪ নং ঋকে কি বলছেন শুনুন :
১০/৯০/ ১ - সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রক্ষঃ সহস্রপাৎ// স ভূমি বিশ্বতো বঽত্যতিষ্ঠৎ দশাঙ্গুলম )। অর্থাৎ পুরুষের সহস্র মস্তক, সহস্র চক্ষু ও সহস্র চরণ। তিনি পৃথিবীকে সর্বত্র ব্যাপ্ত করে দশ অঙ্গুলি পরিমান অতিরিক্ত হয়ে অবস্থিত থাকেন। আসলে প্রাচীন ঋষিরা বিশ্বব্রহ্মান্ডকে এক বিরাট পুরুষের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
১০/৯০/১১ - যৎ পুরুষং ব্যদধুঃ কতিধা ব্যকল্পয়ন // মুখং কিমস্য কৌ বাহু কা ঊরু পাদা উচ্চতে ।।
পুরুষকে খন্ড খন্ড করা হলো, কয় খন্ড করা হয়েছিলো ? মুখ কি হলো, বাহু, উরু, পা-ই বা কি হলো ? উত্তর দিচ্ছেন পরবর্তী শ্লোকে।
১০/৯০/১২ - ব্রাহ্মণো অস্য মুখম অসীদ্বাহূ রাজন্যঃ কৃতঃ // উরু তদস্য যদ্বৈশ্যঃ পদভ্যাং শুদ্রো অজয়ত। অর্থাৎ এর মুখ হলো ব্রাহ্মণ, দুই বাহু হলো রাজন্য ( খেয়ালকরুন ক্ষত্রিয় নয় রাজন্য ) যা উরু হলো বৈশ্য, দুই চরণ হলো শুদ্র।
১০/৯০/১৩ - চন্দ্রমা মনসো জাত্শচক্ষোঃ সূর্যো অজায়ত / মুখাদ ইন্দ্রশ্চ অগ্নিশ্চ (প্রাণাদ্বায়ুরজায়ত) প্রানাৎ বায়ুর জায়ত । অর্থাৎ মন থেকে চন্দ্র চোখ থেকে সূর্য, মুখ থেকে ইন্দ্র ও অগ্নি, প্রান হতে বায়ু।
১০/৯০/১৪ - নাভি হতে আকাশ, মস্তক হতে স্বর্গ, দুই চরন হতে ভূমি, কর্ন থেকে দিক ও ভুবন সকল নির্মাণ হলো। ( নাভ্যা আসিৎ অন্তরিক্ষং শীর্ষ্ণ দৌ সমবর্তত / পদ্ভ্যাং ভূমির্দিশঃ শ্রোত্রাত্তথা লোকা অকল্পয়ন্। ।)
তাহলে আমরা বুঝতে পারছি :
বিশ্বপিতাকে বা বিরাট সেই পুরুষকে মানুষের রূপে কল্পনা করা হয়েছে। এবং তার পা-কে বলা হচ্ছে ভূমি অর্থাৎ পৃথিবী যা আমাদের আশ্রয়স্থল। নাভিকে বলা হচ্ছে আকাশ। কান কে বলা হচ্ছে দশ দিক বা সমস্ত ভুবন। মনকে বলা হচ্ছে চাঁদ। চোখকে বলা হচ্ছে সূর্য, মুখকে বলা হচ্ছে অগ্নি, আর প্রাণকে বলাহচ্ছে বায়ু। একটা কথা আছে যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তাই আছে এই ভান্ডে অর্থাৎ এই দেহভান্ডে।
ব্রাহ্মণ অর্থাৎ জ্ঞান যা আমাদের মাথার কাজ। বাহু আমাদের রক্ষাকারী, আমাদের শরীরকে রক্ষা করে আমাদের বাহু। মাথায় বা আমাদের শরীরকে কেউ আঘাত করতে এলে বাহু এগিয়ে যায় রক্ষার জন্য।তাই বহু আমাদের ক্ষত্রিয়। মাথার এক-একটি অংশ এক একটা কর্মের দ্যোতক। যেমন মুখ ও নাক হলো গ্রহণকারী, অর্থাৎ শরীরের মধ্যে কিছু দিতে গেলে অর্থাৎ বায়ু বা অন্ন যা থেকে শরীর বেঁচে থাকে তা এই মুখ বা নাক গ্রহণ করে। কিন্তু সে ধরে রাখে না। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বিতরণ কেন্দ্রে, বা প্রসেসিং সেন্টারে পাঠিয়ে দেয় . অর্থাৎ বুকে বা পেটে পাঠিয়ে দেয়। আমাদের পেট ও বুক হচ্ছে প্রসেসিং সেন্টার, এখানে সব কিছু পরিপাক হয়। অর্থাৎ নির্যাস বার করা হয়। এই আবার বিতরণ কেন্দ্রও বটে। তাই আমরা দেখি, পেট বা বুক নিজে কিছু ধরে রাখে না, সে এই বাতাস ও খাদ্য থেকে উর্যাশক্তি বের করে এবং সমস্ত শরীরে যার যেটা প্রয়োজন তাকে তা পাঠিয়ে দেয়। এবং যা অপ্রোজনীয় তা মল মূত্র আকারে বের করে দেয়।
এই ব্রাহ্মণ অর্থাৎ মস্তিস্ক আমাদের সবার আছে। জন্ম সূত্রে খালি মাথা নিয়ে কেউ জন্মায় না। মাথা যেমন আমাদের ব্রাহ্মণ, পেট-বুক তেমনি আমাদের বৈশ্য, হাত আমাদের ক্ষত্রিয়, পা আমাদের শুদ্র। তাই কোনো মানুষকেই শুধু, শুদ্র, বা বৈশ্য, বা ক্ষত্রিয় বা ব্রাহ্মণ বলা যায় না। এই চারি বর্ণের মিশ্রণ আমাদের শরীর অর্থাৎ আমাদের মনুষ্যদেহ। তাই আমার কাছে মনে হয়, কেউ যদি নিজেকে ব্রাহ্মণ বলে দাবি করেন, তাঁকে ধরবিহীন কেতু বা শুধু মস্তিস্ক মনে হয়। পূর্ন মানুষ সেই, যিনি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র সবকিছুর মিশ্রণ।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন : ময়া সৃষ্ট্যং গুন্ ও কর্ম বিভাগশঃ অর্থাৎ গুণ ও কর্ম অনুসারে আমি এই চতুর্বর্ণের সৃষ্টি করেছি। .আসলে আমরা আমাদের যে অঙ্গের ব্যবহার বেশি করি, আমাদের সেই অঙ্গ শক্তিশালী হয়। যারা মাথার ব্যবহার বেশি করে, তাদের মাথা সক্রিয় হয়। তেমনি পরিশ্রমী মানুষের দেহ শক্তিশালী হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কখনোই জন্ম সূত্রে কেউ ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় এমন কথা বলতে চান নি। আর তাই যদি হয়, তবে ভগবান জন্মসূত্রে ক্ষত্রিয়, যার পালকপিতা শুদ্র।শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে ব্রাহ্মণেতর বলবেন, এমনটি ভাবা যায় না। শ্রীমদ্ভগবৎ গীতার এই শ্লোক প্রক্ষিপ্ত কিনা কে বলতে পারে ?
যাইহোক আমরা এবার শ্লোকের পরবর্তী অংশে যাবো।
তস্মাদবৈদিক ধর্মমার্গপরতা বিদ্বত্ত্বমস্মাৎ পরম।
তস্মাদ - তা হলেও অর্থাৎ ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মালেও
বৈদিক ধর্ম মার্গপরতা - বেদ বিহিত ধর্মমার্গে নিষ্ঠা
বিদ্বত্ত্বমস্মাৎ পরম - বিদ্বত্ত্বম অর্থাৎ শাস্ত্রের তাৎপর্য জ্ঞান ; অস্মাৎ - অর্থাৎ এ হতে :
পরম - অর্থাৎ উৎকৃষ্ট
অর্থাৎ মহাত্মা শঙ্কর বলছেন ,প্রথমে মনুষ্য জন্ম, তারপরে পুরুষ (যা আমার দৃষ্টিতে পুরুষাকার) তার পরে বিপ্রতা অর্থাৎ ব্রাহ্মনঘরে জন্ম (যা আমার দৃষ্টিতে জ্ঞানী হওয়া )তার পরে বেদবিহিত ধর্মমার্গে নিষ্ঠা। বেদবিহিত ধর্ম্মমার্গে নিষ্ঠা, অর্থাৎ বেদে যে ধর্মের মার্গ বা পথ দেওয়া হয়েছে, সেই দিকে নিষ্ঠা যার আছে। বেদ কথাটার মানে কিছু পুস্তক নয়। বেদ কথাটার মানে হচ্ছে জ্ঞান, ঈশ্বরিক জ্ঞান। অর্থাৎ এই জ্ঞানের পথে যাবার জন্য যার নিষ্ঠা আছে তিনি ভাগ্যবান। শুধু তাই নয় বিদ্বত্ত্বম অর্থাৎ শাস্ত্রের তাৎপর্য সম্পর্কে জ্ঞান থাকা আবশ্যক। এই রকম ব্যক্তিই আত্মজ্ঞান লাভের জন্য দুর্লভ কিন্তু উৎকৃষ্ট।
আত্মা অনাত্মা বিবেচনং স্বনুভবো ব্রহ্মাত্মনা সংস্থিতি
র্মুক্তির্নো শত জন্ম কোটি সুকৃতৈঃ পুন্যৈঃ বিনা লভ্যতে।
আত্মা অনাত্মা বিবেচনং - আত্মা অনাত্মা বিচারশীল
স্বনুভবো : স্ব-অনুভবঃঅর্থাৎ সম্যক অনুভব
ব্রহ্মাত্মনা সংস্থিতি - আত্মাই ব্রহ্ম এই বোধে স্থিতি
র্মুক্তির্নো : মুক্তি হবে না
শত জন্ম কোটি :শত সহস্র কোটি জন্মে
সুকৃতৈঃ পুন্যৈঃ : সুকৃতি ও পুন্য কর্ম
বিনা লভ্যতে : ছাড়া লাভ করা যাবে না।
তাহলে আমরা আচার্য্যের ২ নং শ্লোকের যথার্থ অর্থ দাঁড়ালো :-
২.
ওম নমঃ শঙ্করায়ঃ। ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ
No comments:
Post a Comment