Sunday, 11 May 2025

সাংখ্য যোগদর্শন। দুঃখ যাবে কিসে ? Samkhya Yogadarshan

সাংখ্য যোগদর্শন। দুঃখ যাবে কিসে ?  Samkhya  Yogadarshan 

১) মানুষ যখন ত্রিতাপ জ্বালায় দগ্ধ হতে শুরু করে, অর্থাৎ মানুষ যখন, দুঃখত্রয়ের (আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক, আধিদৈবিক) সম্মুখীন হয়, তখন সে এই দুঃখত্রয় থেকে পরিত্রানের রাস্তা খোঁজে। মানুষের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, কেন এমন হয় ? আর কিভাবেই বা এই দুঃখ-দুর্দশা দূরীভূত হবে ? বলা যেতে পরে, কেন আমরা তো এই দুঃখ দূর করবার জন্য, নানান রকম ঔষধাদির ব্যবস্থা করেছি। ঘরবাড়ি বানিয়েছি। নদী-নালাকে বাঁধ দিয়েছি। নদীর  উপরে সেতু বানিয়েছি, পশুকুলকে খাঁচায় পুরেছি। জঙ্গল কেটে বস্তি গড়েছি, পাহাড় কেটে রাস্তা করেছি।  আমরা এখন নিরাপদ, আমরা এখন নিশ্চিন্ত।  কিন্তু সত্যিই কি আমরা নিশ্চিন্ত হতে পেরেছি ? এখনও মেঘের ডাকে আমরা শিউরে উঠি, মাথার উপরে বাজ পড়ে,  অজানা মৃত্যু  ভয় আমাদেরকে তাড়া করে  নিয়ে বেড়ায়। ডানলোপিলোর গদিতেও আমাদের ঘুম আসে না। আসলে যাকিছুই করা হোক না কেন, এযেন বালির বাঁধ, সবই সাময়িক। তাই যদি হয়, তবে কিভাবে আমরা এই ত্রিতাপ জ্বালা থেকে নিষ্কৃতি পাবো ? 

২)  এই দুঃখ দূর করবার উপায় হিসেবে, শাস্ত্র আমাদের অনেক উপদেশ দিয়ে থাকে। অনেক আচার-আচরণের নির্দেশ দিয়ে থাকে। কখনো কখনো এগুলো ফলপ্রসূ হয় বটে, তবে তাও সাময়িক। এই দুঃখ দূর করবার উপায় হচ্ছে অভেদ জ্ঞানদের উন্মোচন। জগৎ কখনও  ব্যক্ত, কখনো অব্যক্ত।  ব্যক্ত ও অব্যক্তের মধ্যে যে ভেদ রেখা আছে, তাকে দূর করবার জন্য দরকার প্রতক্ষ্য অভেদজ্ঞান। এই প্রতক্ষ্য অভেদজ্ঞানই পারে আমাদের সমস্ত দুঃখ-দুর্দশাকে  দূর করে দিতে। যতদিন আমাদের মধ্যে বৈষম্যজ্ঞান বর্তমান থাকবে, ততদিন, আমাদের দুঃখের নিবৃত্তি হবে না। 

৩) সাংখ্য দর্শন বলছে, সৃষ্টিতত্ত্বের গোড়ায় মূল কারন রূপে অবস্থান করছে পুরুষ ও প্রকৃতি। এই আদি পুরুষ ও আদি প্রকৃতি অব্যক্ত, সর্বব্যাপী, অনন্ত, কালাতীত। এখান  থেকেই এসেছে মহৎতত্ত্ব অর্থাৎ বুদ্ধি যা সৃষ্টির প্রথম প্রকাশ স্বরূপ। এই মহত্তত্ত্ব থেকে অহঙ্কার। এই অহঙ্কার  ত্রিবিধ সাত্ত্বিক, রাজসিক, এবং তামসিক। এই সাত্ত্বিক অহংকার থেকে এসেছে মানস।  এই মানস  থেকে কর্ম্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয়। অন্যদিকে তামসিক অহঙ্কার  থেকে এসেছে পাঁচটি তন্মাত্র, পাঁচ তন্মাত্র  থেকে পাঁচ মহাভূত। তো কেউ একজন পুরুষ এই সৃষ্টির করেন স্বরূপ, এমন ধারণা সাংখ্য দর্শন অনুমোদন করে না। 

তো সমষ্টি  মন থেকে মানস, পাঁচটি  জ্ঞানেন্দ্রিয়, পাঁচটি কর্ম্মেন্দ্রিয় এবং পাঁচটি মহাভূত - এই ষোলোটা তত্ত্বের উৎপত্তি। মহাচৈতন্য থেকে মহৎ, অহঙ্কার ,এবং পাঁচটি তন্মাত্র এই ৭জন।  তো একটা বিকৃতি তত্ত্ব, আর একটা প্রকৃতিতত্ত্ব। এই হচ্ছে সৃষ্টির  মূল কারন। 

দুঃখ যাবে কিসে ? 

খোকন বাবু কিছুদিন যাবৎ দুশ্চিন্তাগ্রস্থ। কিছুদিন আগে তার ৩৫-৩৬ বছরের যুবক ছেলে, ৫/৬ বছরের নাতিকে বৌমাকে রেখে  হঠাৎ  হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। তার নিজের স্ত্রীর নানান রকম রোগে,  বলতে গেলে শয্যাশায়ী। দু-দু বার কিসব কারনে অস্ত্রপচার  হয়েছে। সংসারের কোনো কাজ করতে পারেন  না। ডাক্তারবাবু বলছেন, আবার অপেরেশন করতে হবে।  কিন্তু হার্টের ডাক্তারের অনুমতি ছাড়া এই অপেরেশন করা  যাবে না। হার্টের ডাক্তার লিখিত অনুমতি দিতে রাজি নয়।  আবার অপেরেশন না করলে নাকি, তার স্ত্রী আর বেশিদিন  দিন ইহজগতে থাকবেন না। ডাক্তার বাবু গম্ভীর স্বরে নিদান হেঁকেছেন। খোকন  বাবু যিনি একটু বেশী কথা বলতে ভালো বাসেন,  তিনি এখন মুখ কালো করে থাকেন। 

জিজ্ঞেস করতেই  খোকনবাবু বললেন, জানেন, কাল রাতে স্ত্রীর মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়েছে। এর আগে মলদ্বার দিয়েও রক্ত ঝরেছে। কি যে করি কিছুই বুঝতে পারছি না। কোনো ডাক্তারবাবু বলছেন, এই ট্যাবলেটটা খাওয়ালে এমনি ভাবে রক্ত ঝরবে। আবার কেউ বলছেন, এই ট্যাবলেট টা  না খাওয়ালে চলবে না। আমি বুঝে উঠতে পারছি  না,  কি করবো ? বলে ফ্যাল ফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। 

এমনিতে ওনার টাকা পয়সার টানাটানিও আছে।  বাড়ি  থেকে স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পাঁচশো / হাজার টাকা বেরিয়ে যায়।  এছাড়া ডাক্তার বাবুকে নাকি ৬০০ টাকা ফিস্ দিতে হয়।  অথচ কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছি না। 

আমরা খুব খারাপ লাগলো, ওনার এই অবস্থার কথা  শুনে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, আমি তো ডাক্তার নোই। আমি কিছু করতেও পারি না। 

বললাম, দেখুন, আমরা কে কয়দিন বাঁচবো, তা আমরা কেউ জানি না।  তবে এটা জানি, যে একদিন না একদিন আমরা অবশ্যই মারা যাবো।  আর  এছাড়া, আপনাদের দুজনের বয়স ৭০ এর কাছাকাছি। যে কয়দিন বাঁচবেন, আনন্দে বাঁচুন।  কিন্তু আনন্দে বাঁচবেন কি করে ? ধীরে ধীরে ডাক্তারের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করুন। এক্ষুনি  না হলেও, ধীরে ধীরে ঔষধের প্রতি আকর্ষণ ত্যাগ করুন। 

আপনি হয়তো জানেন না, মানুষের মধ্যে ঔষধ ততক্ষন সুফল বা ক্রিয়া করতে পারে, যতক্ষন রুগীর মধ্যে ঔষদের প্রতি বিশ্বাস থাকে।  যেদিন বিশ্বাস হারিয়ে যায়, সন্দেহ তৈরী হয়, এমনকি যেদিন বস্তুর প্রতি অনাসক্তি আসে, তখন আর এই ঔষধ তার শরীরে রাসায়নিক ক্রিয়া করতে অক্ষম হয়ে যায়।  প্রত্যেকের জীবনে একটা দিন আসে, যখন শরীরে ঔষদের ক্রিয়া বন্ধ  হয়ে যায়। তখন  ঘুমের ঔষধ খাওয়ালেও আর রুগীর ঘুম আসে না। আর ঠিক এই কারণেই, একদিন ডাক্তার বাবু বলে দেন, আপনি রুগীকে বাড়ি নিয়ে যান। ভালো মন্দ খেতে দিন। একটু সেবাযত্ন করুন।  এই রুগীর  চিকিৎসা এখন আমাদের হাতে নেই।  

আমি তাকে দুটো দাওয়াই দিয়েছিলাম। 

১. সকালে ঘুম থেকে বিছানা ছাড়ার আগে, এবং রাতে ঘুমুতে যাবার আগে,  ঈশ্বরের কাছে আপনার কষ্টের  কথা জানিয়ে, প্রতিকারের জন্য প্রার্থনা করুন। 

২. একটা কাঁচা সুপুরি জোগাড় করুন। স্ত্রীকে বলুন এটিকে লাল সুতো দিয়ে ভালো করে মুড়ে দিতে। একটা ডিমের আকৃতি বানিয়ে নিন। এর পরে প্রতিদিন তিনবেলা, অর্থাৎ সকালে, দুপুরে, এবং সন্ধ্যাতে ধুপ ধুনো প্রদীপ দিয়ে, আরতি  করুন।  এবার  এই সুপারির (গনেশ সুপারির) কাছে বসে, মনে মনে প্রার্থনা করুন। এই যে প্রক্রিয়া এসব আমার মনগড়া নয়, এটি একটি জ্যোতিষ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। 

এই কথা গুলো আমি প্রায় ছয়  মাস আগে বলেছিলাম। তিনি এগুলো করতেন কি না, সেই খোঁজও আমি কখনও  নেই নি। কেননা বারবার বললে, পাচ্ছে ভদ্রলোক বিরক্ত হন। হঠাৎ গতকাল ভদ্রলোক , বললেন আমার স্ত্রী কিছুদিন যাবৎ  ভালো আছেন, প্রেসারের ঔষধ ছাড়া আর কিছু খান না। শুনে  আমার খুব ভালো লাগলো। 

আসলে কি জানেন, আমরা সবাই শরীরে রোগকে টেনে আনি, রোগকে প্রশ্রয় দেই। আমাদের মন নানান রকম আশঙ্কায় ভুগছে। আর এই আশঙ্কা থেকে আমরা দুশ্চিন্তার শিকার হয়েছি। এই দুশ্চিন্তা আমাদের শরীরে নানান রকম হরমোনের জন্ম দিচ্ছে, বা হরমোনের নিঃসরণে বাধা সৃষ্টি করছে।  শরীরের সাম্যভাব  নষ্ট হচ্ছে। আমরা শারীরিক দিক থেকে রোগগ্রস্থ হয়ে পড়ছি। 

আমরা যখন অসহায় হয়ে পড়ি, আমরা যখন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ হয়ে যাই, তখন বিশ্বশক্তির কাছে ঐকান্তিক প্রার্থনা একটা অলৌকিক শক্তির জন্ম দেয়। আমরা একটা আশ্রয় খুঁজে পাই, যা আমাদের শরীরের মধ্যে সাম্যভাবের সৃষ্টি করে। আমরা একটা শান্তি অনুভব করি। মানসিক স্থিরতা, শারীরিক অসুস্থকে সরিয়ে তোলে। কাঁচা সুপারিতে সুতো জড়িয়ে সুপারি গনেশ বানানো, মানে হচ্ছে নিজের মধ্যে ভালো থাকবার একটা অদম্য উৎসাহ সৃষ্টি  করা।  এর কোনো বস্তুগত মূল্য নেই।  কিন্তু মনের দিক থেকে এর অসীম গুরুত্ত্ব। সুপারি গনেশ নিমিত্ত মাত্র , মনের মধ্যে বেঁচে থাকবার, শারীরিক দিক থেকে সুস্থ থাকবার, অদম্য ইচ্ছাশক্তি মানুষকে ভালো থাকবার রসদ যোগাতে  সক্ষম। 

যেখানেই থাকুন, যে অবস্থাতেই থাকুন, সেই বিশ্বশক্তির কাছে আকুল হয়ে প্রার্থনা করতে পারলে , অনেক সমস্যা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়।  মন একটা নির্ভরতা খুঁজে পায়। আসলে আমরা কেউ আশ্রয়হীন হয়ে বাঁচতে পারি  না। মায়ের কোল  যেমন শিশুকে নিশ্চিন্ত রাখে, তেমনি আন্তরিক  প্রার্থনা মানুষকে নিশ্চিন্ত থাকতে অলৌকিক ভাবে শক্তি জোগাতে পারে। 

তাই অনুরোধ করবো, রাতে ঘুমুতে যাবার আগে, আর সকালবেলা বিছানা ছাড়ার আগে, এক মিনিট বিশ্বশক্তির কাছে প্রার্থনা করুন। করেই দেখুন না, কিছু ফল হয় কি না ?

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি  ওম।   

সবকিছু ছেড়ে দেবেন কখন ? অনাসক্তি আসবে কি করে ?

বাড়িতে একটা পুরানো, ফ্রিজ পড়েছিলো। ছেলে নতুন ফ্রিজ কিনে নিয়ে এসেছে।  গৃহকর্ত্তি ফ্রিজটিকে বেঁচে দিতে চাইলেন। গৃহকর্ত্তা কিছুতেই সেটি বেচতে দেবেন না। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে তুমুল ঝগড়া। অশান্তি।  মনে মনে ভাবছিলাম, এই আসক্তি, বস্তুর প্রতি এই যে আসক্তি, যা অশান্তির করেন, তার  নিষ্পত্তি হবে কবে ? 

জীবন মানেই কৰ্ম্মময় অবস্থা।  কর্ম্মহীন জীবন বলে কিছু হয় না। এই কর্ম্মই জীবনে সাফল্য এনে দেয়। আর এই কারণেই জীবনে সাফল্য পেতে গেলে, জীবনের উদ্দেশ্য ও উপায়গুলোর প্রতি অর্থাৎ আমাদের বিষয়কর্ম্মে  মনোযোগী হওয়া উচিত। অর্থাৎ জীবনের উদেশ্য পূরণের জন্য, আমাদের কিছু উপায়ের অবলম্বন করতে হয়। আর এই উপায়ের প্রতি যে যত  বেশি মনোযোগ দিতে পারে, তার জীবনে সাফল্য বেশি মাত্রায় দেখা যায়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই মনোযোগ দিতে গিয়ে আমরা ওই বিষয়ের প্রতি অর্থাৎ উপায়ের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। তখন আমাদের কাছে বিষয়গুলো  এতো বেশী আকর্ষণীয় হয়, যে তাকে আমরা আর ঝেড়ে ফেলতে পারি না। মধুর ভান্ডে মধু  খেতে গিয়ে আমরা মধুর মধ্যেই নিজেকে   আটকে ফেলি ।  আর সেখানেই  আমাদের দমবন্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটে। অর্থৎ  আমরা মধুর মধ্যে যে মৃত্যু ওঁৎপেতে রয়েছে, তা আমরা বুঝতে পারি না। 

জীবনে যখন ব্যর্থতা  আসে, তখন আমরা ব্যর্থতার কারনগুলোর  দিকে যদি আমরা ধ্যান দেই , তাহলে আমরা দেখবো, এই ব্যর্থতার মধ্যে আছে, উপায়গুলোর প্রতি আমাদের অতিরিক্ত মনোযোগ। জীবনে সাফল্য পেতে গেলে, আমাদের উপায়গুলোর দিকে মনোযোগ দিতেই  হবে, উপায় যদি সঠিক হয়, তবেই  আমাদের সাফল্য অবশ্যই  আসবে।  কিন্তু  জীবনের উদ্দেশ্য আর উপায়কে আমরা গুলিয়ে ফেলি। এইজন্যই আমাদের হতাশা আসে। 

দেখুন, জীবনের সাফল্যের পিছনে, যেমন একটা কারন আছে, তেমনি অসাফল্যের পিছনেও একটা কারন থাকে। আমাদের জীবনে দুঃখের সবচেয়ে বড়ো  কারন হচ্ছে, আমরা যখন কোনো কাজ একবার শুরু করি, তাতেই আমরা সর্ব্বশক্তি নিয়োগ করি, হয়তো সেখান থেকে সাফল্য আসে, বা আসে না, কিন্তু সেই কাজকে আমরা কখনোই পরিত্যাগ করতে পারি না। বুদ্ধিমান মানুষ এও  জানে, বা উপলব্ধি করে, যে এই কাজ চালিয়ে যাওয়াটা পীড়াদায়ক, কিন্তু তথাপি  সে সেই কর্ম্ম ছাড়তে পারে না। একটা নেশার মতো হয়ে যায়। সে এটাও বুঝতে পারে , যে এখান  থেকে তার দুর্দশা আসছে, তথাপি সে এখান  থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। 

মধুমক্ষি-রূপ এই আমি সংসাররূপ মধুভান্ডে মধু খেতে এসেছিলাম। কিন্তু এখানে এসে  সেই সংসাররূপ মধুভান্ডে  আমি নিজেকে এতটাই জড়িয়ে ফেলেছি, যে এখন হাজার এক দুর্দশার কারন এই সংসারের মধ্যে দেখেও, আমি আর সেই সংসার রূপ মধুভান্ড থেকে বেরুতে পারছি না।  মধুর মধ্যেই যেন আটকে দমবন্ধ হয়ে আসছে। 

আমরা যখন এসেছিলাম, তখন নিজের ইচ্ছেয় এসেছিলাম, না  ঈশ্বরের   ইচ্ছেয় এসেছিলাম তা আমরা জানি না। কিন্তু এখন আমি না আমার ইচ্ছেয় চলতে পারছি, না ভগবানের ইচ্ছেয় চলতে পারছি । আমরা  এখন অপরের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছি। এমনকি আমরা অপরের মনকে চালিত করবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার।  আমরা এইভাবেই  সুখের আস্বাদ পেতে চাইছি, কিন্তু ধীরে ধীরে এই চক্রে পড়ে, আমার প্রাণশক্তি শেষ হয়ে  যাচ্ছে । 

আমরা চাই প্রকৃতির কাছ থেকে সব কিছু পেতে, আমরা জল চাই, বাতাস চাই, আলো  চাই , আশ্রয় চাই, কিন্তু পরিণামে আমরা নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলি, প্রকৃতিই  আমাদের থেকে সব কিছু শুষে নিচ্ছে। আমাদের প্রকৃতি প্রদত্ত শরীর ভেঙে পড়ছে। জরা ব্যাধি, আমাদেরকে আক্রমন করছে। আমরা ছেলে-মেয়ে-স্ত্রীর কাছ থেকে পেতে চাই, কিন্তু পরিণামে এরাই আমার কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিচ্ছে। আসলে আমরা এদের কাছে আবদ্ধ  হয়ে পড়েছি। যদি আমরা আবদ্ধ  না হতাম, তবে আমাদের জীবন হয়ে উঠতে পারতো আনন্দ-উজ্জ্বল। 

আমাদের সমস্ত দুঃখের কারন হচ্ছে, আমরা অন্যের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছি, আমরা জীবনে সাফল্যের জন্য যে উপায়গুলোকে খুজেছিলাম, অর্থাৎ ধন, দৌলত, গাড়ি, বাড়ি, স্ত্রী, পুত্র, এখন সেই  সফলতাই  আমাদের অসফলতার কারন হয়েছে। যাদের কাছে আমি সুখের জন্য গিয়েছিলাম, এখন সেখানে জড়িয়ে জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছে। শ্বাস ওষ্ঠাগত  হয়ে উঠেছে। 

এইজন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, কর্ম্ম করো, কিন্তু আসক্ত হয়ো না। তুমি নিয়ত কর্ম্ম করবে, কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, তোমাকে যেন কর্ম্ম আবদ্ধ করে না ফেলে। প্রতিটি  বিষয়কে গ্রহণ করবার শক্তি যেমন তোমাকে অৰ্জন করতে হবে, তেমনি সেই বিষয়কে বৰ্জন  করবার  শক্তি যেন আমরা হারিয়ে না ফেলি। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সংসার বেঁধেছিলাম সুখ পাবো বলে, এখন সেই সংসার যেন আমাকে না বেঁধে ফেলতে পারে, সেই দিকে নজর দিতে হবে। প্রত্যেকটি বিষয় থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেবার বিদ্যাও  শিখতে হবে। বস্তু তা সে যতই প্রিয় হোক, তাকে ত্যাগ করতে হবে।  আর এই ত্যাগ করতে যেন বেদনা না আসে, এই শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। 

জীবাণু তো সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে, ভাইরাস না আছে কোথায় ? কিন্তু নিজের মধ্যে যদি প্রতিরোধ শক্তি থাকে তবে সেই  ভাইরাস তোমাকে আক্রমন করতে পারবে না। জীবনে সবচেয়ে দুঃখের কারন হচ্ছে, নিজেকে দাস করে ফেলা। নিজেকে দুর্ব্বল করে ফেলা। এই দুর্ব্বলতা জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু। দুর্ব্বলকে সবাই আঘাত করে, দুর্বলতাই  মৃত্যু ডেকে  আনে ।  জীবন থেকে সমস্ত দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে দাও। নিজের মধ্যে থেকে দাসত্বের বৃত্তি, দাসত্বের মনোভাবকে দূর করে দাও।  শক্তিকে আশ্রয় করো।  শক্তিই জীবন, শক্তিই সুখ, সত্যকে আশ্রয় করো, সত্যই জীবন। 

দুঃখে যাদের জীবন চলছে, তাদের দিকে একবার খেয়াল করলেই দেখতে পারবেন, তাদের এই দুঃখের কারন হচ্ছে, আসক্তি।  কর্ম্মের প্রতি আসক্তি, সাফল্যের প্রতি আসক্তি, আত্মীয় স্বজনের প্রতি আসক্তি, বন্ধু বান্ধবের  প্রতি আসক্তি, স্ত্রী-পুত্র পরিবারের প্রতি আসক্তি। 

প্রকৃত আনন্দ পেতে গেলে, আমাদের অনাসক্ত হতে হবে। একটা বয়সে, সংসারের কাজ ছেড়ে দিতে হবে, ঈশ্বরের কাজ করতে হবে। ধরা-ছাড়াতে যারা স্বচ্ছন্দ তাদের জীবন হয়, সহজ সরল। আমাদের সবার জীবনে একটা সময় আসে, যখন চাকরি থেকে অবসর নিতে হয়, তেমনি প্রত্যেকের জীবনে একটা সময় বেছে  নিতে হয়, যখন সে সংসার থেকে অবসর নেবে। তথাকথিত কর্ম্ম থেকে অবসর নেবে। একটা জিনিস জানবেন, অনাশক্তিই জীবনে আনন্দ এনে দিতে পারে। যার মধ্যে ইচ্ছেশক্তি অনাসক্ত এনে দিতে পারে, তার মধ্যে আনন্দের অভাব  হয় না। 

আর এই ক্ষমতা আমার, আপনার সবার মধ্যেই আছে।  জীব-জন্তু সাধারণত পেট ভরে গেলে, আর খাবারের সন্ধানে বেরোয় না।  মানুষই একমাত্র, যার পেটের  ক্ষিদে মিটে  গেলেও, তার মনের খিদে মেটে  না। আবার এই মানুষেরই ক্ষমতা আছে, ক্ষুধা-তৃষ্ণা সহ্য করবার। জীব জন্তু কখনও  ক্ষুধা তৃস্না সহ্য করতে পারে না, মানুষ পারে । 

এখন কথা হচ্ছে, তাহলে কি আমরা সবাই কাজ-কর্ম্ম ছেড়ে দিয়ে সংসার ছেড়ে সন্যাসী হয়ে যাবো ? কিছু লোক অবশ্য  আমাদের মধ্যে  আছেন, তাঁরা কোনো কিছুতেই আকৃষ্ট হন না। যাদেরকে আমরা তথাকথিত সন্ন্যাসী বলি।  এদের কঠিন হৃদয়, এরা এমনকি ভালোবাসতেও চায় না। এদের মন কঠিন।  কিন্তু পাথরের মতো মন নিয়ে আপনি হয়তো দুঃখে এড়িয়ে যেতে পারেন, কিন্তু জানবেন, তখন আনন্দও আপনার কাছ থেকে দূরে চলে যাবে। এই অবস্থা কাম্য নয়। এই জড়বৎ অবস্থায়, দুঃখবোধ না থাকতে পারে, কিন্তু সত্যিকারের আনন্দবোধ থেকেও তিনি  বঞ্চিত থাকে। বরং আমরা চাই, একটা প্রেমময় জীবন।  যেখানে সহানুভূতি থাকবে, ভালোবাসা থাকবে, কিন্তু ভালোবাসার বস্তুর প্রতি আসক্তি থাকবে না। এ এক অদ্ভুত রহস্য যা আমাদের শিখতে হবে। 

দেখুন, ভিখারি কখনো সুখী হতে পারে না। আবার ব্যবসায়ীও কখনো সন্তুষ্ট হতে পারে না। যারা জীবনকে ভিক্ষারিবৎ করেছেন, অথবা জীবনকে নিয়ে কেবল ব্যবসা করছেন, তারা ঘৃণার পাত্র, তারা জীবনে কখনো সুখী হতে পারেন না।  এই ভিক্ষারী লাখ-টাকা পেলেও, ভিক্ষাই করবে। মন্দিরে মসজিদে গীর্জায়, এই ভিক্ষারিদের দর্শন পাওয়া যায়। এদের মধ্যে কেউ মানুষের কাছে ভিক্ষা চাইছে, আবার কেউ ঈশ্বরের কাছে ভিক্ষে চাইছে। 

আবার যারা জীবন-ব্যবসায়ী তারা  প্রেম নিয়ে ব্যবসা করে, ধর্ম্ম নিয়ে ব্যবসা করে, ব্যবসায়িক বৃত্তিই তার জীবনকে টেনে নিয়ে চলেছে, একটা অজ্ঞান অন্ধকারের দিকে।  

এখন কথা হচ্ছে, আমরা এই বস্তু বা বিষয় বা সংসারের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ি কিভাবে ? আসলে আমরা যাকিছু দেই, তার একটা প্রতিদান আশা করি। আর এর ফল হয় উল্টো, আমরা ভালোবাসা দিয়ে দুঃখ পাই।  কিন্তু সত্য হচ্ছে,  এই দুঃখ বাইরে দিক থেকে  আসে না, আমার্  ভালোবাসার প্রত্যাশা, অপূর্ন হলেই, আমার ভিতর থেকে  থেকেই দুঃখ উঠে আসে। দুঃখের বাহক হচ্ছে বাসনা। বাসনাই দুঃখ বহন করে নিয়ে আসে। 

তাই মহাত্মাগণ  বলছেন, "কিছু কামনা করো না. প্রতিদানে কিছু চেয়ো না। যা তোমার দেবার আছে তা তুমি দাও। যা তোমার প্রয়োজন আছে তা তুমি নাও। সূর্য সমুদ্র থেকে জল শুষে  নিচ্ছে, আবার বৃষ্টি  রূপে ফিরিয়ে দিচ্ছে। একটা জিনিস জানবে, যা তুমি নিচ্ছ, তা তোমাকে ফিরিয়ে দিতে হবে, আবার যা তুমি দিচ্ছ, তা তোমার কাছে হাজার গুন্ বেশি হয়ে ফিরে আসবে। তাই তুমি যদি কাউকে ঘৃণা দাও, তবে, তোমার কাছে ঘৃনাই ফিরে ফিরে আসবে, আবার তুমি যদি ভালোবাসা দাও, তবে প্রেম হয়ে তা ফিরে আসবে। একটা জিনিস যেন, তুমি সংসারে এসেছো সঞ্চয় করতে নয়, ভিক্ষা চাইতে নয়।  তুমি যা কিছু এখান থেকে নেবে, তা এখানেই ফিরিয়ে দিতে হবে। যাবার সময় শূন্য হাতেই ফিরে যেতে হবে। আমাদের ত্যাগে সাহস আসে না, ভাবি যদি ভবিষ্যতে যদি কম পরে যায়। কিন্তু সত্য হচ্ছে, তুমি যখন এসেছিলে তখন তোমার কাছে কিছুই ছিল না, আবার যখন তুমি এখান থেকে চলে যাবে, তখন শূন্য হাতেই  যেতে হবে।  এখানকার জিনিস এখানেই পরে থাকবে।  তাহলে কার জন্য সঞ্চয় করছো ? হাসপাতালের ডাক্তারদের জন্য ? ভুলে যাও , যখন যাবার সময় হবে, তখন ডাক্তার কেন, ডাক্তারের বাপও তোমাকে  বাঁচাতে পারবে না। তবে কেন ডাক্তারের কথা ভাবছো ? সবই ভগবানের, তুমি কেবল আদান-প্রদানের মাধ্যম মাত্র। তোমার দ্বারা এই আদানপ্রদান ক্রিয়া করছেন, স্বয়ং ঈশ্বর। তুমি গতিশীল নদী মাত্র।  তোমার গন্তব্য সমুদ্র। তোমার ঘাটে  যদি কেউ স্নান করে, তাতে তোমার জল কমবে না। তোমার কাছ থেকে জল নিয়ে কেউ যদি পান করে, তবে তোমার জল কমবে না, তোমার কাছ থেকে জল নিয়ে কেউ যদি অন্ন উৎপাদন করে, তাতেও তোমার জল কমবে না। কারন এই জল উৎস থেকে  প্রতিনিয়ত ঝরছে, তুমি সেই জলের তোরে ভেসে চলেছো। তুমি জল, নও, তুমি নদী নয়, তুমি শুধুই প্রবাহ। সামনের দিকে বেয়ে চলাই  তোমার কাজ। অনাসক্ত হয়ে এগিয়ে চলো । নিজেকে অনুভব করবার চেষ্টা করো। তুমি যে শক্তি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছো, তাকে অনুভব করবার চেষ্টা করো। 

প্রতিদিন প্রভাতে অনাসক্ত থাকবার জন্য সংকল্প করো। কারুর ক্রীতদাস হয়ে থেকো না।  নিজেই নিজের প্রভু বোনে যায়। নিজের উপরে নিজেই কর্তৃত্ত্ব করো। আমরা বলি, সবাই আমাকে কষ্ট  দিচ্ছে। মিথ্যে - মিথ্যে- মিথ্যে   আমরা বলি জগৎ মন্দ -  মিথ্যে মিথ্যে মিথ্যে - কেউ ভালো না, বার কেউ খারাপ না। শিবরাম নির্জন  পাহাড়ের  কোলে দাঁড়িয়ে, একসময় হতাশ হচ্ছে চিৎকার করে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলো, প্রভু তুমি কি নেই ? কঠিন পাথরে আঘাত খেয়ে সে ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এসেছিলো নেই - নেই- নেই। প্রভু তুমি কি আছো - প্রতিধ্বনি জবাব দিয়েছিলো,  আছে আছে আছে। 

মেরুদন্ড সোজা করে দাড়াও, কারুর উপরে দোষারোপ করো না। নিজেকেও নয়।  কাউর মধ্যে দোষ  খুঁজতে যেও না। তুমি যখন দোষের কথা চিন্তা করবে, তখন শুধু দোষই  দেখবে। যখন আনন্দ খুঁজবে, তখন শুধুই আনন্দই দেখবে । সব ছেড়ে দাও, আবার কিছুই ছেড়ো না। ধরি মাছ, না ছুঁই পানি। সেই যে গোসাঁই কবি গেয়েছেন, আমার যেমন বেণী তেমনি রবে, চুল ভেজাবো না। শুধু বিষয়-আসক্ত থেকে নিজেকে অনাসক্ত করো। কিছুই ছাড়বে না, আবার কিছুই ধরবে না। কর্ম্ম থেকে নিষ্কৃতি নয়, আসক্তি থেকে নিষ্কৃতি পেতে হবে। আর এটা করতে হবে এক্ষুনি, এখন থেকেই। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম। 



  






No comments:

Post a Comment