Sunday, 11 May 2025

সত্যধর্ম্ম : মন -গ্রন্থিচক্র - বীজমন্ত্র


সত্যধর্ম্ম : মন -গ্রন্থিচক্র - বীজমন্ত্র 
শশাঙ্ক  শেখর শান্তিধাম 




ওঁ সহ নাববতু।  সহ নৌ ভুনক্তু । সহ বীর্যং করবাবহৈ।
তেজস্বি নাবধীতমস্তু  মা  বিদ্বিষাবহৈ।।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ।।

হে  পরম আত্মা  পরম ঈশ্বর,  আমাদের উভয়কে  সমভাবে রক্ষা করুন।   সমভাবে  বিদ্যাফল  দান করুন।   আমরা যেন সমভাবে বিদ্যাফল লাভের জন্য সামর্থ অর্জন করতে পারি। আমাদের লব্ধ বিদ্যা সফল হোক।  আমরা যেন পরস্পর বিদ্বেষ না করি।  - হে পরম আত্মা-পরম ঈশ্বর আমাদের ত্রিবিধ শান্তি অর্থাৎ শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্বিক শান্তি হোক।

আমরা আগের দিন পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও পঞ্চভূত নিয়ে আলোচনা করছিলাম। এবং বুঝেছিলাম এই ইন্দ্রিয়গুলি সরাসরি সুখ-দুঃখের অনুভূতির কারন। এখন এই ইন্দ্রিয়গুলি কার নির্দেশে চলে ?

ইন্দ্রিয়গুলো মস্তিষ্কের নির্দেশে চলে। কিন্তু মস্তিস্ক মনের নির্দেশে চলে। তাই আমরা এই মন ও মস্তিস্ক নিয়ে আলোচনা করবো। আমরা মনের গভীরে ঢুকবো। কিন্তু তার আগে, আমাদের আধ্যাত্বিক হতে হবে। আর  আধ্যাত্বিক জীবনের প্রবেশ দ্বার হচ্ছে গুরুকরন। গুরুমন্ত্র গ্রহণ। গুরুমন্ত্র মানে বীজ মন্ত্র।  আগে এই বীজ মন্ত্র  সম্পর্কে কিছু কথা আলোচনা করবো, তার পরে মস্তিস্ক ও মন নিয়ে আলোচনা করবো।  

বীজ মন্ত্র আর কিছু নয়  ঈশ্বরের গুনকীর্তন, বা  ঈশ্বরের বর্ণনা মাত্র। অথবা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা। এটি খুব কম শব্দে উচ্চারিত হয়। বা একক শব্দে উচ্চারিত হয়। বার বার এই মন্ত্র  উচ্চারণের ফলে শরীরে একটা মৃদু কম্পন অনুভূত হয়। মন্ত্রে তন্ময় হলে চিত্ত ঈশ্বরে নিবদ্ধ হয়। জপ্ করলে  বা বারবার একই মন্ত্র বা বিষয় বারবার উচ্চারিত হলে মন সেই বিষয়ে স্থির হয়। বাহ্যিক সুখ-দুঃখ থেকে, শরীরকে সাম্য অবস্থায় রাখা যায়।

গুরুদেব  বলছেন : উপাসনা বা গুনকীর্তন যেমন সাধারণ ভাষায় করা যেতে  পারে, তেমনি বৈজিক ভাষায় করা যেতে পারে। সাধারণ ভাষা অর্থাৎ বাংলা, সংস্কৃত, ইত্যাদি।  আর সব থেকে আদি ভাষা হচ্ছে বৈজিক  ভাষা। ভাষা সৃষ্টির ক্রোম এই রকম - বৈজিক -বৈদিক-সংস্কৃত-প্রাকৃত-বাংলা ইত্যাদি।

গুরুদেব বলছেন বৈজিক ভাষাই  মূল ভাষা। বৈজিক থেকে বৈদিক। আর বৈদিক থেকে সংস্কৃত, গ্রিক, ল্যাটিন,আরবি, হিব্রু  প্রভৃতি উৎপন্ন হয়েছে। সংস্কৃত থেকে প্রাকৃত তারপর বাংলার উৎপত্তি হয়েছে। অতএব  ভাষার মূল বা বীজভূত ভাষা হচ্ছে "বৈজিক"। এই ভাষাতেই জীব, জন্তু, পশু, পাখি কথা বলে। অতএব যদি  বৈজিক ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান থাকে তবে তুমি সবার কথা বুঝতে পারবে, তা সে দেবতার কথাই হোক আর পশু পাখির কথাই  হোক, আর মানুষের কথাই  হোক। বৈজিক ভাষায় উৎকৃষ্ট জ্ঞান থাকলে নিখিল ব্রহ্মান্ডের ভাষা বোঝা যেতে পারে।

বৈজিক  ভাষা হচ্ছে ভাব প্রকাশের সব চেয়ে সংক্ষিপ্ত ভাষা এবং প্রথম ভাষা, সৃষ্টির আদি ভাষা ।  বীজ থেকে  বৈজিক, অর্থাৎ ভাষার মূলভূত বীজ। কেউ কেউ এটাকে বৈচিক ভাষায় বলে অর্থাৎ কথ্য ভাষায় বীজকে বলে বিচি।  এই বিচি থেকেই বৈচিক।  যাই হোক বৈজিক ভাষা  শুধু সংক্ষিপ্ত  শব্দ নয়, বৈজিক ভাষার উচ্চারনে একটা মহৎ গাম্ভীর্য ভাব উৎপন্ন হবে।   গুরুদেব মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্ত, একটা উদাহরণ দিয়ে এটা বুঝিয়েছেন। যেমন ধরো আমাদের বলতে হবে  :

"হে জগদীশ্বর ! তোমার করুনার অন্ত  নেই, তুমি আমাদেরকে  যাবতীয় বিপদ হতে রক্ষা  .করছো এবং তোমার তুল্য মহৎ কেউ নেই. অর্থাৎ তুমি সর্ব জগতের মধ্যে মহিষ্ঠ, তোমাকে প্রণাম করি। "

এই একই কথা সংস্কৃতে বললে অল্প সময়ের মধ্যে বলা যাবে এবং তা হবে :

"অনন্ত-করুনং ব্রহ্ম রক্ষকং ত্বাং নমাম্যহম্"

গুরুদেব বলছেন ভাষার শক্তি দেখ   ; একই কথা সংস্কৃতে উচ্চারণ করলে যে মহান গাম্ভীর্যতা প্রকাশ পায়  তা বাংলায় হয় না।  আবার একই ভাব বা কথা যদি বৈজিক ভাষায় উচ্চারণ করা হয় তা হয়ে যাবে  এই রকম।

"ওঁং ক্রীং নমঃ"

 তাহলে দেখছো বৈজিক ভাষা, বা  বীজ মন্ত্রের ভাষা কতটা সংক্ষিপ্ত ও গাম্ভীর্যপূর্ণ।

বৈজিক ভাষার আরো কিছু মন্ত্র অর্থ সহ বলছি :

হৌং  :  হ্ = শিব, ঔ=সদাশিব, ং=দুঃখহরণ ; সর্বদা মঙ্গলকারী শিব আমার দুঃখ হরণ  করুন।

দূঁ : দ্ = দুর্গা , ঊ = রক্ষা, ঁ = কর : হে জগৎ জননী দুর্গে ! আমাকে রক্ষা করো।

ক্রীঁ : ক্ = কালী , র্= ব্রহ্ম, ঈ = মহামায়া, ঁ = দুঃখ হরণ  : মহামায়া ব্রহ্মস্বরূপ জগৎ জননী কালী আমার দুঃখ হরণ  করুন।
গং :  গ = গনেশ , ং = দুঃখ হরণ।  গনেশ দুঃখ হরণ করুন।

ক্লীং : ক = কামদেব বা কৃষ্ণ  ল =  ইন্দ্র বা ঐশ্বর্য্যশালী , ঈ = তুষ্টি , ং = দুঃখ হরণ  : হে  ঐশ্বর্য্যশালী কামদেব বা কৃষ্ণ আমার তুষ্টি বিধান করুন, দুঃখ হরণ করুন।

এই রকম আরো বীজ মন্ত্র আছে : যেমন

হ্রীঁ - মহাদেবের শক্তি মহামায়া জগৎ জননী দুঃখ হরণ  করুন
শ্রীঁ - পরমেশ্বরী মহালক্ষ্মী আমাদের ধন ও পরম সন্তোষ প্রদান করুন এবং আমার দুঃখ হরণ  করুন।
ঐং - সরস্বতী দুঃখ হরণ  করুন।
হূঁ - মহাদেব যার ভৈরব, সেই পরমেশ্বরী আমার দুঃখ হরণ  করুন ।
স্ত্রীঁ - জগৎ জননী মহামায়া মোক্ষদা দুর্গোত্তারিণী তাঁরা আমার দুঃখ হরণ  করুন।

দ্রব্যের যেমন গুন্ বা শক্তি আছে, শব্দেরও তেমনি শক্তি আছে। ভালো সুর শুনলে আমাদের মন মোহিত হয়। আবার বাজির শব্দে বা বজ্রের শব্দে আমাদের মন চমকে ওঠে।
শব্দ দুই রকম : ধ্বনি ও বর্ণ। ধ্বনি অর্থবহ নয়। যেমন বিভিন্ন বাদ্যের বাজনা।বাঁশির সুর, বজ্রের ধ্বনি। মেঘের ডাক। ইত্যাদি।
বর্ণ কিন্তু অর্থবহ। মানুষ এই বর্ণের সাহায্যেই কথা বলে।  তাই অর্থবহ। বর্ণ দুই প্রকার ব্যঞ্জন  বর্ণ ও স্বরবর্ণ। আমাদের মুনি ঋষিরা ধ্বনি ও শব্দ, উভয়ের মাহাত্য দিয়েছেন। বেদে  ধ্বনির মাহাত্য।  এইজন্য বেদের সূক্ত বা শ্লোকের উচ্চারণের প্রতি বিশেষ গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়েছে।  এই জন্য এঁকে শ্রূতি   বিদ্যা বলা হয়েছে। অর্থাৎ এটি একমাত্র গুরুমুখে শুনেই শেখা বা আয়ত্ত্ব করা যায়।

ধ্বনির সাথে সাথে বর্ণগুলিকে অর্থাৎ অ, আ - ক, খ ইত্যাদি বর্নকে পর্যালোচনা করে, মুনি ঋষিরা  দেবতা-বিশেষের জন্য বিশেষ বীজ মন্ত্র নির্দ্ধারণ করে গেছেন।

তোমরা  শুনে থাকবে,  ওম নমঃ শিবায়ঃ - একটা বীজ মন্ত্র।  ওম নমঃ বাসুদেবায়, এ ছাড়া গায়ত্রী মন্ত্র, মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র এগুলো মানুষ জপ্ করে। এগুলোর উচ্চারণ যে যার মতো করে। ফলতঃ সঠিক উচ্চারণের ফল অপ্রকাশিত থাকে। আর একটা কথা খেয়াল রাখবে, বীজ মন্ত্র  সব সময় প্রণব পূত হবে। অর্থাৎ প্রণব ছাড়া  বীজমন্ত্র হয় না। 

বীজমন্ত্রের  সঠিক অর্থ যেমন জানা দরকার, তেমনি ভাবে এর সঠিক  উচ্চারণ করা আবশ্যক। যেহেতু উচ্চারণ কখনো  বই পড়ে শেখা যায় না, তাই গুরুর কাছ থেকে এটা  শিখে নিতে হয়। তাই দেখবে, গুরুদেব  বীজমন্ত্র সবসময়  কানের কাছে মুখ নিয়ে উচ্চারণ করেন । এর সঠিক উচ্চারণ গুরুই শিখিয়ে দেন। তাই বীজ মন্ত্র গুরুপ্রদত্ত। আর একটা কথা তোমরা  যারা গুরুমন্ত্র জপ্ করো  তারা খেয়াল করবে, তুমি  হয়তো জপের মন্ত্র উচ্চারণ করে যাচ্ছো, কিন্তু তোমার  মন  জপের মধ্যে নেই, অর্থাৎ জপ্-কে  যে মনন করা উচিত, তা হচ্ছে না। আবার হয়তো মনকে জপের মধ্যে নিয়ে এলে।  যতক্ষন তোমার  মন স্থির না হচ্ছে ততক্ষন এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এটাই প্রত্যাহার।  জপমন্ত্র   হচ্ছে তোমার  ধারণার বিষয়। মন বিষয় থেকে বেরিয়ে যাওয়া মানে  তোমার  দুর্বল ইচ্ছাশক্তির পরিচয়। এইখানে গুরু সহায়ক  হয়। প্রকৃত গুরুর কাছ থেকে যদি তুমি  মন্ত্র  পাও , তা সে তোমার  জানা মন্ত্রই হোক, গুরু তোমার  অবচেতন মনে মন্ত্রের মালা গেঁথে  দেবেন। তোমার  শরীরে মশা  পড়লে যেমন হাত আপনা থেকে এগিয়ে যায়, তোমার  অজ্ঞাতসারেই এটা হয় ।  তেমনি তোমার  জপ্ বন্ধ  হয়ে গেলে বা মন থেকে জপের মালা সড়ে গেলে, গুরুর ইচ্ছেতেই আবার জপ্ শুরু হয়ে যাবে।  মন্ত্র আর মন এক হয়ে যাবে।  এর জন্য কোনো প্রয়াস করতে হয় না। এইখানেই গুরুকরণের সার্থকতা। মন্ত্র  তো আমরা সবাই বই পড়ে শিখে নিতে পারি।  কিন্তু গুরুপ্রদত্ত মন্ত্র, গুরুকৃপায় সর্বক্ষণ স্পন্দিত হতে থাকে। আসলে গুরুদেবের আজ্ঞাচক্র সক্রিয়। আর সক্রিয় আজ্ঞাচক্র যখন কাউকে কোনো নির্দেশ দেয় তা সে মানতে বাধ্য। তাই সৎ গুরুর দেওয়া বীজমন্ত্র সব সময় শিষ্যের  মধ্যে স্পন্দিত হতে থাকে। কোনো প্রয়াশ ছাড়াই।  তাই গুরুমন্ত্র প্রকৃত  গুরুর কাছ থেকেই গ্রহণ করা উচিত। অন্যথা নিজের ইচ্ছা শক্তি জাগ্রত করতে হয়।  যা সবাই পারে না।

গুরুদেব  বলছেন : বৈজিক ভাষা উচ্চারনে ভাব বিনিময় যেরূপ সম্পূর্ণ হয়, অন্য কোনো ভাষায় তদ্রুপ হয় না। বৈজিক ভাষাই পূর্ণ ভাষা। বৈজিক ভাষা নিখিল ভাষার মাতা-পিতা। বৈজিক ভাষাই সার্বভৌম, ও সর্বজীবের ভাষা। একারনে, উন্নত মহাত্মারা এই অতি মহীয়সী ভাষায় যে সকল বীজ প্রদান করেন, তার উচ্চারণেই  অভিপ্রেত সিদ্ধি সম্পূর্ণ রূপে হয়ে থাকে। বীজ বিশেষের উচ্চারণে ভক্তি, একাগ্রতা বৃদ্ধিও হয়ে থাকে।

এখন এই বীজমন্ত্র উচ্চারণে আমাদের কি ভাবে উপকার হয়, সেই সম্পর্কে আলোচনা করবো।

গুরুদেব বলছেন :

মেরুদণ্ডের দুইদিকে ইড়া ও পিঙ্গলা নামে দুইটি নাড়ী আছে। এই ইড়ার দক্ষিণে ও পিঙ্গলার বামে অর্থাৎ ইড়া-পিঙ্গলার মাঝখানে সুষুম্না নাড়ী অবস্থান করছে। সুষুম্নার মধ্যে আবার বজ্রাখ্যা নাড়ী ও তার মধ্যে চিত্রিণী নাড়ী অবস্থান করছে। এর মধ্যে সাতটি স্থানে গ্রন্থি আছে।

 কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে  এসব জানলে কি আমরা  ভালো থাকতে পারবো ?

দেখো, ভালো যদি থাকতে চাও তো না জানাই ভালো। সহজ সরল মানুষ বড়ো ভালো থাকে।
কিন্তু আমরা  মোটেই সহজ সরল নই । সহজ সরল মানুষের মধ্যে কোনো প্রশ্ন জাগে না। তারা শুধু মেনে নেয়। তাই তারা ভালো থাকে। কোনো প্রশ্ন করে না। আমাদের  মধ্যে প্রশ্ন অনেক। আমরা  সমুদ্রের কিনারে দাঁড়িয়ে আছি । সমুদ্রের ঢেউ আমাদেরকে   অস্থির করেছে। 

মন ও মস্তিস্ক আমাদের দেহেরই অঙ্গ। মস্তিস্ক অসংখ্য স্নায়ুর বা গ্রন্থির  সমষ্টি। একটা খুলির  মধ্যে সুরক্ষিত প্রায় ১০০০০ মিলিয়ন অর্থাৎ ১০০০ কোটি নিউরোন নিয়ে গঠিত স্নায়ুতন্ত্রের স্ফীতকায় অংশটিকে বলে মস্তিস্ক। আমাদের মস্তিষ্কের ওজন প্রায় ১২০০ থেকে ১৪০০ গ্রাম।

আর মন হচ্ছে বিভিন্ন  গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত অন্তর্মুখী রসের সূক্ষ্যাংশ দ্বারা গঠিত।

আমরা আগেই জেনেছি, দেহ পঞ্চভূতের তৈরি। মন নিয়ে আলোচনার প্রারম্ভে আমাদের দেহতত্বটা একবার বুঝে নিতে হবে। কথায় বলে যা আছে ব্রম্ভান্ডে তাই আছে আমাদের দেহভান্ডে। দৃশ্যমান ব্রহ্মান্ড যেমন পঞ্চভূতের তৈরী, দেহও তেমনি পঞ্চভূতের তৈরি।

হঠযোগীরা বলছেন : "শরীরমাদ্যং খলু  ধর্মসাধনম্" . শরীরই সমস্ত সাধনার ভিত্তিভূমি। এই শরীর সুস্থ না থাকলে তোমার  দ্বারা কোনো সাধনাই  হবে না। তা সে সূক্ষ্ম জগতের সাধনা বলো  আর স্থুল জগতের সাধনাই  বলো । দেহটাই যন্ত্র।  আর দেহকে ধারণ করে আছেন আত্মা-রূপী যন্ত্রী। এই দেহই বলো, আর দেহে স্থিত মন, বুদ্ধি, অহংকার এগুলো আত্মার বিভূতি বা শক্তি। এই শক্তির খেলাই  চলছে নিরন্তর দেহ যন্ত্রের মধ্যে। দেহযন্ত্র ভালো বা শুদ্ধ থাকলে - এটা  হবে দেবভূমি।  আর দেহযন্ত্র যদি ত্রূটি যুক্ত হয় তবে তা  হবে অসুরভূমি। এখন তোমার দেহকে দেবভূমি বানাবে না অসুরভূমি বানাবে তা তোমার উপরে। দেখো তোমার যদি ঠিকমতো হজম না হয়, অর্থাৎ তোমার দেহের যকৃতের ক্রিয়া যদি ঠিক না থাকে তবে তোমার মেজাজ খিটখিটে হবে।  তোমার সেক্স-গ্লান্ড-(Sex gland)  বা পিতৃগ্রন্থি যদি ঠিক না থাকে তবে তুমি স্বার্থপর এবং কামুক হয়ে যাবে। তোমার থাইমাস (thymus ) বা মঙ্গলগ্রন্থি যদি ঠিক না থাকে তবে তুমি চোর-ডাকাত-বদমায়েশ হবে। শিবসতী গ্রন্থি  (Pituitary ) যদি ঠিক না থাকে তবে মানুষ ছোট মনের  মানুষ হয়। এরা কেবল পরের দোষ  দেখে বেড়ায়। এমনকি এরা ঘুষখোরও  হয়।

আসলে কোনো মানুষই খারাপ হয়ে জন্মায় না। সবার অন্তরে ভাগবত সত্ত্বা বিরাজ করছে। কিন্তু খাদ্যদোষে হোক আর প্রাকৃতিক কারণে হোক আমাদের শরীরে, রোগ বাসা বাঁধে। অর্থাৎ বিভিন্ন গ্রন্থির কাজ ঠিক ঠিক মতো হয় না। কোনো কোনো গ্রন্থি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। গ্রন্থির ক্রিয়া দোষযুক্ত হলে আমাদের মধ্যে কুচিন্তা ও কু-কাজ করবার প্রবৃত্তি জেগে ওঠে। তাই আমরা মানুষে মানুষে পার্থক্য দেখতে পাই। খেয়াল করবে, মাংসাশী প্রাণী প্রায়শঃ হিংস্র হয়। তৃণভোজী প্রাণী নিরীহ হয়। দেহ শুদ্ধ হলে মন শুদ্ধ হবে। মন যার শুদ্ধ সে সর্বদা আত্মাস্বরূপে অবস্থান করে।  আনন্দে থাকে। পরহিতে নিযুক্ত থাকে।

হঠযোগীরা বলছেন আমাদের শরীরের ইড়া-পিঙ্গলার উপরে আধিপত্য বিস্তার করতে পারলে চিরদিন যেমন ব্যাধিমুক্ত থাকা যায় তেমনি মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি। আত্মার আনন্দময় স্বরূপ, অনন্ত  স্বরূপ, আমরা আস্বাদন করতে পারি। এখন কথা হচ্ছে, এর সঙ্গে গুরুমন্ত্রের কি সম্পর্ক ?

মন্ত্র  হচ্ছে তরঙ্গ উৎপাদনের কারন। আমরা যখন শব্দ বলি বা ধ্বনির সৃষ্টি করি তা সে যে ভাবেই হোক, তা একটা বিশেষ তরঙ্গ সৃষ্টি করে। তরঙ্গই রূপ নেয়। যার জন্য বলা হয় সৃষ্টির আদি হচ্ছে প্রণব। প্রণব কথাটার মানে হচ্ছে নব নব রূপ পরিগ্রহ। আদি ধ্বনি ওঁম থেকেই সমস্ত সৃষ্টি। সাধনার একটু গভীরে করলে, আমরা বুঝতে পারবো : প্রণব আসলে অনাহত নাদ । প্রণবের কোনো অর্থ  নেই। সাধারনতঃ সমস্ত ধ্বনি সৃষ্টি হয় - হয় সংঘর্ষে নয়  আঘাতে। প্রণবের কোনো কারন নেই, কোনো আঘাতে বা সংঘর্ষে  এর সৃষ্টি হয় নাই। প্রণব সৃষ্টির আগে সমস্ত-ই ছিল এক। আঘাতে বা সংঘর্ষে দুই-এর প্রয়োজন। তাই প্রণবকে অনাহত নাদ বলা হয় । কাঁসর ঘন্টা, শঙ্খের  ধ্বনি ইত্যাদি প্রণব পুত।  তাই এই ধ্বনি শুভ, মঙ্গলময় ও সৃষ্টির আদি। এখন এই বিশেষ ধ্বনি যে তরঙ্গের সৃষ্টি করে তা আমাদের শরীরের বিভিন্ন চক্রে  আঘাত করে, এবং সেখানে স্পন্দন তোলে, তাকে চঞ্চল করে তোলে, এবং ক্রিয়াশীল করে তোলে। বিশেষ বিশেষ ধ্বনি আমাদের বিশেষ বিশেষ জায়গায় বা গ্রন্থিতে আলোড়ন তোলার  সক্রিয় ভূমিকা নেয়। আর ওই গ্রন্থি যখন ক্রিয়াশীল হয়ে যায়, তখনি আজব ব্যাপার সংগঠিত হয়। মানুষের চিন্তা ধারার পরিবর্তন হয়। বিচারাধারার পরিবর্তন হয়। কর্মধারার পরিবর্তন হয়। মানুষ পাশবিক প্রবৃত্তি ত্যাগ করে, দেবমানব হয়ে যায়। এইখানেই মন্ত্রের কারিকুরি। প্রতিনিয়ত যখন বীজমন্ত্র জপ্ করছো তখন তোমার  সমস্ত চক্র (১১৪) ক্রিয়াশীল হতে পারে। ১১৪টি চক্রের মধ্যে ১০৮টি চক্র ক্রিয়াশীল করা যায়। এই জন্য জপের মালায় ১০৮টি পুঁথি থাকে।  বাকি ছয়টি ক্রিয়াশীল হয় না। কিন্তু মাত্র ৭টি চক্র বা ১১টি স্পর্শকাতর জায়গায় আমরা যারা সাধারণ মানুষ, একটু চেষ্টা করলেই সেগুলিকে ক্রিয়াশীল করতে পারি। সেজন্য এই জায়গাগুলো সম্পর্কে আমাদের একটা ধারণা থাকা দরকার। প্রথমে এটি কল্পনা করে নিতে হয়। সাধনার সঙ্গে সঙ্গে এই সব জায়গায় মৃদু কম্পন অনুভূত হয়। তখন এর সঠিক অবস্থান জানা যায়। 

এই এগারোটি জায়গা হচ্ছে :

মূলাধার,(মেরুদণ্ডের শেষে গুহ্যদ্বারে) 
স্বাধিষ্ঠান, (লিঙ্গমূলে) 
মনিপুর,(নাভির ঠিক পিছনে ) 
অনাহত, (হৃদয়ের পিছনে ) 
বিশুদ্ধি, (কন্ঠার ঠিক পিছনে) 
আজ্ঞা, (মেরুদণ্ডে নয় - এটি ভ্রূযুগলের পিছনে নিম্ন মস্তিষ্কে) 
সহস্রার, (মস্তিষ্কের তালুতে) 
বিন্দু, (সহস্রারের ঠিক উপরে )
এ ছাড়া তিনটি স্পর্শকাতর জায়গা সম্পর্কে আমাদের ধারণা রাখা উচিত।  সেগুলো হল : 
ভ্রূযুগল মধ্যে,
নাসিকাগ্র ; 
এবং 
চিদাকাশ অর্থাৎ চোখ বুজলে যেখানে আমরা অন্ধকার দেখি । এগুলোর মধ্যে প্রথম ৭টির জন্য বিশেষ মন্ত্র  আছে। যেমন
মূলাধারের জন্য লং, ल्न्ग 
স্বাধিষ্ঠানের জন্য ৰং (ওয়াং), व्ङ्ग् 
মনিপুরের জন্য রং, र्ङ्ग् 
অনাহতের জন্য যং (ইয়ং), य्ङ्ग्  
বিশুদ্ধির জন্য হং, ह्ङ्ग्  
আজ্ঞাচক্রের জন্য ওঁং ॐ এবং 
সহস্রারের জন্য সোহং सोह्ङ्ग् । 

এই মন্ত্র  বা ধ্বনির  সাহায্যে এই চক্র বা গ্রন্থিগুলিকে ক্রিয়াশীল করা যায়।
গুরুদেব  বলছেন :
এই বীজগুলি বস্তুতঃ বাংলা অক্ষরে বা সংস্কৃত অক্ষরে লিখিত নহে। এগুলি বৈজিক ভাষার বর্ণমালা অনুসারে লিখিত। শুধু তাই নয়, এই ৭টি দলে বা গ্রন্থিতে যে আকার আছে অর্থাৎ যে আকৃতিতে ওই গ্রন্থি সকল আমাদের শরীরে অবস্থান করছে তা বৈজিক বর্নমালার আকার অনুসারেই হয়েছে। আর একটা গুহ্য কথা বলছেন গুরুদেব তা  হচ্ছে, নাড়ী সংযোগ উৎপন্ন  স্থল বা চক্র ৬৮ টির অধিক হলেও এর মধ্যে ৫০টি প্রধান।  আর তাই আমাদের বর্নমালার সংখ্যাও পঞ্চাশ। (অ আ ই ঈ উ ঊ ঋ এ ঐ ও ঔ - ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ ট ঠ ড ঢ ণ ত থ দ ধ ন প ফ ব ভ ম য র ল শ ষ স হ ড় ঢ় য় ৎ ং ঃ ঁ ক্ষ )  এখানে অবশ্য গুরুদেব বলছেন  "ক্ষ" যুক্তাক্ষর হলেও একে মূল বর্ণের মধ্যে বর্ণনা করা হয়েছে। 

কিন্তু কথা হচ্ছে এগুলো  ক্রিয়াশীল করলে কি হয় ?

আমরা জানি সমগ্র ব্রহ্মান্ড সাতটি  লোক বা স্তরে  বিভক্ত। এগুলো হচ্ছে : ভূ-লোক, ভুব-লোক, স্বঃ-লোক, মহঃ-লোক, জনঃ-লোক, তপঃ-লোক, এবং সত্যম বা  সত্য-লোক। আবার আমাদের শরীরের মধ্যেও সপ্ত ধাতু আছে যেমন : শুক্র, শোনিত, মজ্জা, মেদ, মাংস, অস্তি , ত্বক। এই দেহের এক একটা স্থান এক একটা লোকের কর্ম-কেন্দ্র। এই কর্মকেন্দ্রের নামই চক্র বা গ্রন্থি। এই গ্রন্থিগুলো বা এক একটা গ্রন্থি এক এক তত্ত্বের কর্মকেন্ত্র। তত্ত্ব অর্থাৎ পঞ্চতত্ত্ব - ক্ষিতি, অপ, তেজ. মরুৎ , ব্যোম। দেহের প্রধান প্রধান গ্রন্থি গুলির অন্তর্মুখী রস  নিঃসরণের ক্ষমতা আছে। এই অন্তর্মুখী রসই রক্তের সঙ্গে মিশে দেহের গঠন ও পালনপোষন করে। এমনকি মানসিক জীবন  বা মন গঠন করে। যার দেহে যে গ্রন্থির আধিপত্য বেশি বা যার দেহে যে গ্রন্থি অধিক ক্রিয়াশীল, তাকে সেই গ্রন্থিপ্রধান মানুষ বলা হয়।

যদিও সমস্ত গ্রন্থিই আলাদা আলাদা ভাবে সারা শরীরে ক্রিয়াশীল। তথাপি এক এক গ্রন্থির এক একটি প্রধান কার্যকেন্দ্র  আছে। এগুলো এই রকম :

কণ্ঠদেশ থেকে ললাটের মধ্যবর্তী অংশ   আকাশ তত্ত্বের কাজ করে। অর্থাৎ ব্যোম গ্রন্থি বলা যেতে পারে। এখানেই  ইন্দ্রগ্রন্থি ( THYROID) উপেন্দ্রগ্রন্থি (Para-Thyroid ), তালুগ্রন্থি (Tonsil ),  লালা গ্রন্থি (Salivary Glands ) ইত্যাদির কর্মক্ষেত্র   । এখান থেকেই যে অন্তর্মুখী রস  নিঃসৃত হয় আমাদেরকে সুস্থ থাকতে  সাহায্য করে।  এই গ্রন্থিগুলি  সুস্থ-সবল থাকলে - আমাদের স্নেহ, প্রীতি, ভালোবাসা, উচ্চ চিন্তা বা গভীর চিন্তা করার ক্ষমতা থাকে। আর গ্রন্থিগুলি  অতি সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলে আমাদের বিষাদ, উচ্চ চিন্তার ক্ষমতা হ্রাস, হতদ্যম, আলস্য, কর্মবিমুখতা প্রভৃতি দেখা দেয়। ব্যোম তত্ত্বে সত্ত্বগুণের আধিপত্য। 

এখানে একটা কথা বলা প্রয়জন :: এই অন্তর্মুখী রস, অর্থাৎ প্রত্যেক চক্র বা গ্রন্থি  থেকে নিঃসৃত অন্তর্মুখী রসের সুক্ষ অংশ থেকে মন গঠিত হয়। এই কথাটা আর একবার একটু খেয়াল করো - গ্রন্থি বা  চক্র থেকে  নির্গত অন্তর্মুখী রস আমাদের মনের গঠন করে।

এর পরে আসছে বক্ষ প্রদেশ।  এটি বায়ুতত্বের প্রধান কর্মকেন্দ্র। এখানে দুটো ফুসফুস, হৃদযন্ত্র, মঙ্গলগ্রন্থি (thymus ) এবং প্রাণকোষ নির্মাণকারী গ্রন্থি এবং অনেকগুলো উপগ্রন্থি এই বায়ু গ্রন্থির অন্তর্গত। বায়ুই দেহের প্রধান রক্ষক ও পরিচালক।

এই বায়ু গ্রন্থি ও তার তার অন্তর্গত গ্রন্থিগুলি সুস্থ-সবল থাকলে একদিকে যেমন দেহ সুস্থ থাকে তেমনি এই গ্রন্থিই মানুষকে ধীর-স্থির, শুদ্ধ-শান্ত, শ্রদ্ধাশীল, ও মহাকর্মী করে । বায়ু ঠিকমতো কাজ না করলে মানুষ অস্থিরমতি, অকৃতজ্ঞ, কৃতঘ্ন হয়।

এর পরে আসছে মধ্যপ্রদেশ অর্থাৎ পেট। এটি অগ্নিগ্রন্থির  অন্তর্গত। এখানে কি আছে এক বার দেখে নেই। প্লীহা,(Spleen ) যকৃৎ(liver ) অগ্ন্যাশয় (Pancreas ) শুক্রগ্রন্থি (Adrenal Gland )  প্রভৃতি গ্রন্থি অগ্নিগ্রন্থির প্রধান কর্মক্ষেত্র। অগ্নিগ্রন্থিই শরীরে তাপ প্রদান করে। প্রাণকে সঞ্জীবিত রাখে। এই অগ্নিগ্রন্থি থেকে যে রস  নিঃসৃত হয় তা Nitric Acid , Hydrochloric Acid, Sulphuric Acid প্রভৃতি দাহিকাশক্তি সম্পন্ন উপাদানের সমাহার। এই অগ্নিরসই পাচকরস, পিত্তরস, অম্লরস। এই অগ্নিরস অন্নকে দগ্ধ করে, রসরক্তে পরিণত করে। দেহের মাংস মেদ অস্থি প্রভৃতি গঠনে সহায়তা করে।

এই অগ্নিপ্রধান লোকেরাই হয় মহাতেজস্বী, উদ্দমী। নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা থাকে এঁদের। আর এই গ্রন্থি যদি ঠিক ঠিক মতো কাজ না করে তবে তারা হয় কামুক, ঝগড়ুটে, দাম্ভিক, অহংকারী, উগ্র, অস্থির, অসহিষ্ণু।

এর পরে আসছে নিম্নাঙ্গ। অর্থাৎ মূত্রগ্রন্থি,(kidney ), প্রজাপতি গ্রন্থি বা পিতৃগ্রন্থি (Testis ) কন্দর্প-গ্রন্থি (Prostate gland ), মদনগ্রন্থি (cowpers Gland ), মাতৃ গ্রন্থি (Ovary ) রতি গ্রন্থি,(Bartholins gland)  মিথুন  গ্রন্থি (Skenes gland ) . এগুলো সবই  বরুন গ্রন্থির অন্তর্গত। এই বরুণগ্রন্থির নিঃসৃত অন্তর্মুখী রসে সন্তান বীজ বা শুক্রকীট উৎপন্ন হয় ও সৃষ্টিধারাকে অব্যাহত রাখে। এই শুক্র হতেই দেহের সমস্ত উপাদান অর্থাৎ স্নায়ু, তন্তু  কোষ, মাংস, মজ্জা, অস্থি সমস্তই গড়ে ওঠে। বরুণগ্রন্থি হতে নিঃসৃত রসকে বলা হয় সোমরস।

বরুন-গ্রন্থি  প্রধান লোকেরা খুব সহৃদয় হয়। এদের মিষ্টি ব্যবহার, মিষ্টি কথা মানুষকে আকর্ষণ করে। এরা বৈষয়িক প্রতিষ্ঠা পায়। বরুণগ্রন্থি  ঠিক ঠিক মতো কাজ না করলে মানুষ স্বার্থপর, পরশ্রীকাতর, ক্রোধী ও কামুক হয়।

পৃথ্বি গ্রন্থি অস্থি ও মাংস উপাদানের কারন ক্ষেত্র। পৃথ্বি গ্রন্থির শক্তি ও তার প্রকাশ সুপ্ত।

পৃথ্বি গ্রন্থিপ্রধান লোকেরা স্থুলদেহী হয়।  স্বভাব হয় উদার,ও সহিষ্ণু। এরা  সাধারণত ঝামেলা এড়িয়ে চলে। এই গ্রন্থির অসামাঞ্জস্যে মানুষ হয় ভোগী স্বার্থপর।

আধুনিক বিজ্ঞান  বলছে  : স্নায়ুতন্ত্র বা nurvas system আমাদের বাহির জগৎ ও অন্তর্জগতের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে।   এই স্নায়ুতন্ত্র গঠিত হয় স্নায়ু তন্তু অর্থাৎ সুতো বা fibre-এর   মতো একপ্রকার পদার্থ দিয়ে। তন্তু গুলো বিভিন্ন আকারের হয়। সরু, মাঝারি, পাতলা। কর্ম অনুসারে এরা  তিন ধরনের হয়।  প্রথম গ্রাহক বা receptor, দুই প্রেরক বা বাহক conductor (Neurone ) এবং তিন কারক বা effector . এই তিন রকম কাজের সাহায্যে স্নায়ুতন্ত্র আমাদের অন্তর্জগৎ ও বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে।

আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি  অর্থাৎ চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিব্বা, ত্বক, এই  পাঁচটি ইন্দ্রিয় এবং দেহের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত গ্রাহক কোষগুলি বাইরের জগতের উদ্দীপনা বা ভৌত বা রাসায়নিক পরিবর্তন গ্রহণ করে। এইবার গৃহীত উদ্দীপনা সংবেদ স্নায়ু বা বাহক স্নায়ুর মাধ্যমে স্নায়ুকেন্ত্র অর্থাৎ মস্তিস্ক বা সুষুম্নাকাণ্ডে পাঠিয়ে দেয়।

এইবার মস্তিস্ক বা সুষুম্নাকাণ্ড অর্থাৎ স্নায়ু কেন্দ্র এই উদ্দীপনার বিশ্লেষণ করে এবং ক্রিয়া স্থান বা কারকে অর্থাৎ effective organ- এ বাহকের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়। 

এইবার স্নায়ু কেন্দ্র থেকে গৃহীত আদেশ অনুসারে ক্রিয়াস্থান বা কারকে কার্য সম্পাদিত হয়।

অতএব আমাদের কাছে একটা জিনিস পরিষ্কার : মস্তিস্ক হচ্ছে স্নায়ু কেন্দ্র।  এবং এখানেই সুষুম্না অর্থাৎ স্নায়ুতন্ত্রের প্রধান কর্মক্ষেত্র , এবং  এখান থেকেই বাহক তন্তুর সাহায্যে  সমস্ত নির্দেশ পাঠাচ্ছে এবং সেই মত আমরা কাজ করছি বা আমাদের কার্য সম্পাদিত হচ্ছে।

আধুনিক বিজ্ঞান বলছে,  সুষুম্নাকাণ্ডের উভয়পার্শ্বে বিভিন্ন স্থান থেকে একাধিক স্নায়ু নির্গত হয়ে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। এগুলো সবই জোড়া জোড়া। সাধারনতঃ এর মধ্যে একটি গ্রাহক অন্যটি বাহক হিসেবে কাজ করে। এই রকম ৩১ জোড়া স্নায়ু সুষুম্না থেকে নির্গত হয়েছে। 
এই যে ৩১ জোড়া স্নায়ু এর মধ্যে আট জোড়া স্নায়ু  গ্রীবা (survical ) থেকে অর্থাৎ কন্ঠের পিছনে অবস্থিত সুষুম্না নারি  থেকে নির্গত হয়েছে।  যাকে মুনি ঋষিরা বলছেন বিশুদ্ধ চক্র। 
বারো জোড়া স্নায়ু  বক্ষ (Thoractic) থেকে অর্থাৎ বুকের পিছনের সুষুম্না নারি থেকে বের হয়েছে।  যাকে ঋষিরা বলছেন অনাহত চক্র। 
পাঁচ জোড়া স্নায়ু কটিদেশ (Lumber)  বা নাভির বিপরীতে সুষুম্না নারি থেকে নির্গত হয়েছে।
যাকে সাধকরা বলছেন মনিপুর চক্র। 
আরো পাঁচজোড়া স্নায়ু নির্গত হয়েছে শ্রোণীদেশ (Sacral ) বা লিঙ্গমূল থেকে। যাকে  সাধকরা বলছেন স্বাধিষ্ঠান চক্র। 
আর একজোড়া স্নায়ু নির্গত হয়েছে পুচ্ছদেশ (Coceygeal) যাকে  ঋষিরা বলেছেন মূলাধার। 

ভাবতে অবাক লাগে, হাজার হাজার বছরের পুরাতন ঋষিবিদ্যা কতটা বৈজ্ঞনিক সত্য ছিল।  আগে এগুলো নাকি কেউ পাশ্চাত্য প্রদেশে  জ্ঞাত ছিল  না।         

অহং গ্রন্থি বা অহং তত্ত্বের স্থান ললাট বা আমাদের কপাল।  এই অহং গ্রন্থি আমাদের সমস্ত গ্রন্থির অর্থাৎ পঞ্চগ্রন্থির (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম)  কর্তৃত্ব করে। আমাদের দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, চিন্তাশক্তি, বিচারশক্তি, স্মৃতিশক্তি, সমস্ত কিছুই অর্থাৎ পঞ্চইন্দ্রিয়শক্তির  (চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিব্বা, ত্বক) কর্ম পরিচালনা হয় এই অহং গ্রন্থি থেকে। এদের দোষ, ত্রূটি, দুর্বলতা সবই  যথাসাধ্য সংশোধন করে এই অহংগ্রন্থি।

এই অহংগ্রন্থি প্রধান লোকের ভিতর থেকেই বেরিয়ে আসে উচ্চ প্রতিভা, সাধু-মহাত্মা।  এই অহংগ্রন্থি ক্রিয়াশীল না থাকলে দেখা দেয় হৃদয়হীনতা, নিচটা, দুস্টু বুদ্ধি।

মহৎগ্রন্থি আমাদের ললাটের উপরে। অর্থাৎ অহংগ্রন্থির কিঞ্চিৎ উপরে অবস্থিত। এরই মধ্যে আছে সোমগ্রন্থি, দেবক্ষগ্রন্থি (Pineal Gland ), রুদ্র গ্রন্থি, সহস্রার গ্রন্থি  প্রভৃতি। এই মহৎ গ্রন্থির অন্তর্মুখী রসের নাম সোমধারা। এই সোমধারাই মাথা থেকে নেমে  দেহের সমস্ত গ্রন্থিকে, সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রকে সুস্থ-সবল ও প্রাণবন্ত রাখতে সাহায্য করে।

এই মহৎ গ্রন্থি প্রধান লোকই মহাপুরুষ, অবতার রূপে পূজিত হন। পৃথিবীতে এঁরাই নরোত্তম। ভগবৎ প্রাপ্তির অপার্থিব অনাবিল আনন্দ এঁরাই আস্বাদন করেন।

মহৎগ্রন্থির ঠিক উপরে আছে ব্রহ্মরন্ধ্র, যা আমাদের দেহাকাশ ও দিব্যাকাশকে  যুক্ত রেখেছে। এই ব্রহ্ম বা সহস্রার প্রদেশেই চেতনার অনন্ত পারাবার, এই প্রদেশই  গুণাতীত ভূমি। একেই কেউ বলে কৈলাস, কেউ বলে পরমশিব ও পরমাশক্তির অধিষ্ঠান ভূমি।

গ্রন্থিকথা এবার শেষ করবো। এই গ্রন্থিস্রাব বা গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত লালা আমাদের জীবন, আমাদের ব্যক্তিত্ব, আমাদের মন, আমাদের স্বভাব নিয়ন্ত্রন করছে । জানিনা সম্পূর্ণরূপে এর নিয়ন্ত্রণ করা যায় কি না। তবে এটা  ঠিক এই  ব্রহ্মান্ড বায়ু, অগ্নি, ও বরুন  দ্বারা লালিত হচ্ছেন, তেমনি এঁরা  কুপিত হলে, সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাদের দেহে অবস্থিত এই বায়ু অর্থাৎ প্রাণক্রিয়া, অগ্নি অর্থাৎ দেহের তাপ  রক্ষাকারী   ও জল অর্থাৎ রস রক্ত ইত্যাদির দ্বারা  এই  দেহের পালন হচ্ছে, দেহের পুষ্টি সাধন হচ্ছে। এই তিন দেবতার প্রকোপেই দেহ অসুস্থ হয়, আমাদের মৃত্যু ঘটে।

প্রসঙ্গত বলি : ভূত তো পাঁচটি। তবে তিনটি ভূতের কথা হচ্ছে  কেন  ? আসলে  অতিসূক্ষ্ম আকাশভূতের ক্রিয়া আমাদের ইন্দ্রিয় গোচর হয় না। আবার পৃথিবীতে বা মাটিতে জড়ত্বের ভাব বেশি। তাই শক্তির প্রকাশ নেই। অর্থাৎ শক্তির প্রকাশ আছে বায়ু, অগ্নি ও জলে। তাই   বায়ু  আকাশের মতো অতিসূক্ষ্ম না হলেও সূক্ষ্ম।  বায়ুকে আমরা চোখে দেখিনা বটে কিন্তু বায়ুর স্পর্শ আমরা অনুভব করতে পারি। তেজ বা অগ্নি বায়ুর মতো সূক্ষ্ম নয় আবার জল বা মাটির মতো স্থুলও নয়। আকাশের বিদ্যুৎ, আলো, জ্যোতি ইত্যাদি অগ্নির রূপ আমাদের চোখে পড়ে । সুতরাং অগ্নি স্থুল  ও সূক্ষ্মের মাঝামাঝি। জল আবার পৃথিবীর মতো বা মাটির মতো স্থুল  না হলেও অর্ধস্থুল।  আবার মাঝে মাঝে বরফের আকার নিয়ে স্থুলে পরিণত হয়।  অর্থাৎ শক্তির প্রকাশ আছে বায়ু, অগ্নি ও জলে। তাই আমাদের দেহে ত্রিশক্তির আধিপত্য। আকাশ ও মৃত্তিকা ম্রিয়মান হয়ে আছে আমাদের শরীরে। 

এসো,  আমরা এই তিন দেবতাকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য জপে প্রবৃত্ত হই। ধ্বনির সাধনায় লিপ্ত হই।  এই বায়ু, অগ্নি, জল - দেবতার সৃষ্টির কারন  সেই প্রণবের সাহায্য নেই। এবার আবার জপের কথায় আসি।

জপে যাবার আগে একবার মনটাকে  বুঝে নেই। আমরা অনেকেই জানি মন ত্রিস্তরীয় : চেতন - অবচেতন - অতিচেতন। হঠযোগীরা বলেন : দেহ শুদ্ধ হলেই মন শুদ্ধ হবে। এবং একমাত্র শুদ্ধ মনই আত্মউপলব্ধি করতে পারে। তো যার দ্বারা আত্মউপলব্ধি হবে তাকে একটু বুঝে নেই।

এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি :  এটি কোনো এক কবিগানের আসরে আমি শুনেছিলাম। ছেলে বলছে আমি কাঁঠাল খাবো। বাবা বাজার থেকে কাঁঠাল কিনে এনেছে। বাবা ছেলেকে কাঁঠালের পরিচয় দিচ্ছে। এই যে উপরের কাঁটা কাঁটা আস্তরণ দেখছিস  এঁকে বলে ছোবড়া। আস্তরণ ছাড়ালে কোয়া, কোয়ার ভিতরে আঁটি, আর এইযে কোয়ার বাইরে যে দেখছিস এটাকে বলা হয় ভুচরো।  আর ভেতরে মুগুরের মতো দেখছিস এটাকে বলে মোথা। তো ছেলে বলছে তবে  বাবা কাঁঠাল কোথায়  ?

তো মনকে খুঁজলে, দেহের মধ্যে কোথাও পাওয়া যাবে না। তবু আমাদের মনকে জানতে হবে।

যারা বিজ্ঞানের ছাত্র তারা জানে -  মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের কাজ কে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। একটা হচ্ছে সুষুম্না কান্ডীয় (Spinal Cord  Level ) , দ্বিতীয়টা হচ্ছে নিম্নতর মস্তিস্ক স্তর (Lower Brain Level) উচ্চতর মস্তিস্ক স্তর  (Upper Brain Level )

এই উচ্চতর মস্তিস্ক আমাদের মাথার সবচেয়ে বা আমাদের দেহের সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ন অংশ। আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার সংগ্রহশালা হিসাবে কাজ করে। অতীতের অভিজ্ঞতার অধিকাংশ স্মৃতিই এখানে সঞ্চিত থাকে। এছাড়া আমাদের শরীরের যে প্রতিক্রিয়া হয় অর্থাৎ যাকে  আমরা চেতন মনের কাজ বলি, তার খবর এখানে সঞ্চিত থাকে। এবং নিজের ইচ্ছায় সে খাবরাখবরকে কাজে লাগিয়ে দেহের চেষ্টীয় প্রতিক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ করে।

নিম্নতর মস্তিস্ক দ্বারা দেহের অধিকাংশ অবচেতন কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। রক্তচাপ,শ্বাসক্রিয়া, ক্রোধ, উত্তেজনা, যৌনক্রিয়াকলাপ, যন্ত্রনা, আত্মতুষ্টি, এগুলো সবই নিম্নতর মস্তিষ্কের কাজ।  অতএব আমরা যাকে অবচেতন মনের কাজ বলি তা এই নিম্নতর মস্তিস্ক করে থাকে।

দেহের ইন্দ্রিয়সকল দ্বারা গৃহীত সমস্ত সংবাদ বা উদ্দীপনা সুষুম্নাকাণ্ডে প্রেরণ করা হয়।  এবং সুষুম্নাকাণ্ড এই সংবাদের ভিত্তিতে সুষুম্না কাণ্ডের উদ্ভাবনী প্রতিক্রিয়ার উদ্ভব হয়। এটা স্বয়ংক্রিয় এবং সংজ্ঞাবহ সংকেত সুষুম্নাকাণ্ডে যাবার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায়। এটাই অতিচেতন মনের কাজ বলতে আমরা যা বুঝি তাই।

মন কোনো আলাদা বস্তূ  বা স্নায়ু নয়। বিভিন্ন স্নায়ুর ক্রিয়াকে আমরা মনের ক্রিয়া বলি। মন বলে কিছু নেই সবই স্নায়ুর খেলা।  আমাদের এই স্নায়ুর কেন্দ্রে যেতে হবে।  স্নায়ু যেখান থেকে  শুরু হয়েছে সেটা মস্তিস্ক। আর স্নায়ুর অবতরণ ক্ষেত্রে হচ্ছে সুষুম্না কাণ্ড। তাই সুষুম্না নাড়িকেই আমাদের আশ্রয় করতে হবে যদি আমরা আত্মউপলব্দ্ধি করতে চাই। এই স্নায়ুকেন্দ্রে প্রতিফলিত হবে আমাদের অধরা ঈশ্বর।আমাদের চেতন স্বরূপ।

যদি ভালো থাকতে চাও তবে সব ছেড়ে গুরুমন্ত্র জপ্ করতে থাকো।

আপনাদের বলি  যদি গুরুপ্রদত্ত মন্ত্র না পেয়ে থাকেন তবে পরম-পিতার  যে কোনো নামের আগে/পরে  ওঁং জুড়ে জপতে থাকুন । আপনি  মহাসুখী থাকবেন । ভালো থাকবেন। আর আপনার যা কিছু দরকার, সব জগদীশ্বরের কাছে চান। মানুষ তো ভিখারী।  ভিখারীর কাছে কিছু চাইতে যাবেন না। পরম পিতা পরম-ঈশ্বরের কাছে চান। ঈশ্বরের অসীম ক্ষমতা, অসীম সম্পদ। অনন্ত অনন্ত অনন্ত করুনাময় ঈশ্বর আপনার সহায়। আপনি তার কাছে বসুন। তার কাছেই প্রার্থনা করুন। আপনি সর্বসুখী হবেন।, কি পার্থিব, কি অপার্থিব সব সম্পদের অধিকারী একমাত্র ঈশ্বর। আপনি তাঁকেই ধরে থাকুন। 

ওম শান্তি ওম শান্তি ওম শান্তিঃ।         


                





















No comments:

Post a Comment