Tuesday, 27 May 2025


মরণ ঘুমের রহস্যঃ - নিদ্রা বা ঘুমের রহস্যঃ : ঘুমের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক কী ?  

মুক্তানন্দ বলছিলেন, ঘুমের রহস্য যদি তোমার কাছে পরিষ্কার হয়, তবে এই নিত্য-অনিত্য, সৎ-অসৎ, আত্মা-অনাত্মা এমনকি জন্ম-মৃত্যুর রহস্যঃ তোমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। এমনকি  ওঙ্কারের বা প্রণবের রহস্যঃ তোমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু জন্মের পর থেকেই, ঘুম তো আমাদের এমনি এমনি আসে, ঘুম ছাড়া আমরা কেউ বাঁচতে পারি না, এই ঘুমের মধ্যে আমরা প্রতিনিয়ত যাতায়াত করছি, কতবার যে ঘুম আসছে, আর চলে যাচ্ছে, এ যেন শ্বাস প্রশ্বাসের মতো, আসছে আবার চলে যাচ্ছে। এর মধ্যে কি এমন রহস্যঃ আছে, যাতে আমরা এমনকি জন্ম-মৃত্যুর রহস্যঃ বুঝতে পারবো ? 

মুক্তানন্দ বলছেন,  স্বাসের সঙ্গে যেমন তোমার জীবন জড়িয়ে আছে, অর্থাৎ তোমার এই  বেঁচে থাকা বা মৃত্যু বরণ করা জড়িয়ে আছে, তেমনি ঘুমের সঙ্গে তোমার আত্মা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। ঘুমের মধ্যে তুমি যদি সজাগ থাকতে পারো, অর্থাৎ সচেতন থাকতে পারো, তাহলেই সব রহস্যের উন্মোচন হতে পারে। কিন্তু কথা হচ্ছে, ঘুমের মধ্যে আবার কেউ সজাগ   থাকতে পারে নাকি ? ঘুমে আমরা জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। কিন্তু কথা হচ্ছে যাই কোথায় ? মুক্তানন্দ বলছেন, এই ঘুমের মধ্যে আমরা সবাই একটা অন্য জগতে চলে চাই, এমনকি ঘুমের মধ্যে আমরা  সবাই আত্মার সঙ্গে মিলিত হয়ে যাই। মুক্তানন্দ বলছেন, গাঢ়  ঘুমে আমরা প্রতিদিন একবার করে আত্মার সঙ্গে মিলিত হয়ে যাই।  কিন্তু জেগে উঠে আমাদের সেই স্মৃতি থাকে না। তাই আত্মা সম্পর্কে আমাদের কোনো জ্ঞান থাকে না। তো ঘুমের মধ্যে যদি তুমি সচেতন থাকতে পারতে, তবে তোমার মধ্যে এই আত্মার  জ্ঞান হতে পারতো। অর্থাৎ তুমি আত্মজ্ঞান লাভ করতে পারতে । 

আজ আমরা এই ঘুম সম্পর্কে, এবং ঘুমের মধ্যে সজাগ থাকার প্রক্রিয়া  সম্পর্কে শুনবো। 

প্রথমত ঘুম ব্যাপারটা কি ? ২. ঘুম কেন আসে ? ৩. ঘুমের মধ্যে আমরা কোথায় কি অবস্থায় থাকি।  ৪. ঘুম থেকে আবার আমরা আবার জেগে উঠি কেন ? 

ঘুম ব্যাপারটা কি ? 

বিজ্ঞান বলছে, আমাদের চোখের ভিতর থেকে একটা নার্ভ মস্তিষ্কে গিয়েছে, সেখানে হাইপো-থ্যালামাসে গিয়ে মিশেছে। মস্তিষ্কের এই হাইপো-থ্যালামাসে আছে ঘুমের চাবিকাঠি। একেই বলে আমাদের স্লিপ সেন্টার। এই হাইপো-থ্যালামাসে আছে সুপ্রাকায়াসমেটিক নিউক্লিয়াস যাকে   সংক্ষেপে বলা হয় SCN. তো আমাদের ঘুমের নিয়ন্ত্রক হচ্ছে এই SCN - দিনের বেলায় রেটিনা, আর রাতের বেলা পিনিয়াল গ্লান্ড থেকে নির্গত রস বা মেলাটনিন হরমোন আমাদের ঘুমকে ডেকে  আনে।  সবার ঘুমের মধ্যে পিটুইটারি গ্রন্থি একধরনের হরমোনের নিঃসরণ করে, যা আমাদের শরীরের ক্ষতিগ্রস্থ কলার মেরামতি করে। তো ঘুমের মধ্যে আমরা আমাদের ক্ষতিগ্রস্থ কোষগুলোর মেরামতি ক্রিয়া করে থাকি। 

আবার এই ঘুম আমাদের দুটি ধরন দেখা যায়,  যাকে  বিজ্ঞান বলছে, REM এবং NREM . REM বা  RAPID EYE MOVEMENT আর NREM অর্থাৎ NON RAPID EYE MOVEMENT. বলা হচ্ছে, ঘুমের মধ্যে নাকি আমাদের চক্ষু কখনো  স্থির থাকে, আবার কখনো চক্ষু নাড়াচাড়া করে।  

শরীর যখন ক্লান্ত  হয়ে যায়, বা আমাদের যখন ঘুমোতে যাবার ইচ্ছে হয় ষে একসময় আমাদের মস্তিষ্কের পিছন দিকে যে পনস আছে, তাকে নির্দেশ দিয়ে প্রথমে শরীরের কাজ কর্ম্মকে স্থগিত করে দেয়।  এবার ঘুম শুরুর প্রথম  অবস্থায় এই NREM বা স্থির চক্ষুর ঘুম শুরু হয়। অর্থাৎ আমরা চোখ বুজকে ঘুমুতে যাবার চেষ্টা করি। প্রথমে অর্থাৎ  ১ থেকে দেড় ঘন্টার এই অবস্থা থাকে, এর পরে REM ঘুম অর্থাৎ  চক্ষু নাড়াচাড়া শুরু করে, একে  অস্থির চক্ষুর ঘুম বলে।  কিছুক্ষন অর্থাৎ ১৫-২০ মিনিট নাকি চক্ষু দ্রুত নাড়াচাড়া করতে থাকে। তখন  এই অবস্থাকে বলে REM  ঘুম বলে।  এইভাবে  একবার REM ঘুম একবার NREM ঘুম চলতে থাকে।  চার পাঁচ ঘন্টা ধরে  এই চক্র  চলতে থাকে।  

এই যে NREM বা স্থির  চক্ষুর ঘুম এর শেষের দিকে আমাদের গভীর ঘুম হয়। অস্থির চক্ষুর ঘুমে বা REM ঘুমে  আমরা স্বপ্ন দেখে  থাকি। স্বপ্নাবস্থায় আমাদের হার্টবিট, পালসবিট বাড়ে, এই সময় মস্তিষ্কের মধ্যে ওয়েব বা তরঙ্গের মাত্রা বাড়ে। অন্যদিকে গাঢ়  ঘুমে, আমাদের হার্টবিট, পালসবিট কমে, শ্বাস প্রশ্বাসের হার কমে, এমনকি দেহের তাপমাত্রা কমে। 

এবার আমরা অধ্যাত্ম জগতের মহাত্মাদের কথা শুনবো।  তাঁরা ঘুম সম্পর্কে কি বলেন। এঁরা  বলছেন, ঘুম আর তোমার মৃত্যুর মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। আমাদের যে ঘুম তা কেবল মাত্র ৭/৮ ঘন্টা ব্যাপী হয়ে থাকে।  এর পরে আমরা আবার জেগে উঠি। আর যাকে  আমরা মৃত্যু বলি, সেও এক প্রকার ঘুম, যে ঘুম থেকে ফিরে আসতে আমাদের দশ/বিশ/ত্রিশ বা হাজার  বছর লেগে যায়। অর্থাৎ মৃত্যুতে আমরা দীর্ঘদিন ঘুমের মধ্যেই  কাটাই। কথায় বলে মরন ঘুম অর্থাৎ যে ঘুমে কেউ আর  জেগে ওঠে না। পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন, মৃত্যু কালীন অবস্থাতেও, জীবের কিছুক্ষনের জন্য ঘুম ঘুম ভাব আসে। অর্থাৎ একটা অজ্ঞান ভাব তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।  

আমাদের শাস্ত্র বলছেন, ঘুম তো নয়, এ এক বিশেষ অবস্থা মাত্র। জেগে থেকে আমরা যেমন স্থূল জগৎকে ভোগ করি, তেমনি ঘুমের সময় আমরা সূক্ষ্ম ও কারন জগতের বাসিন্দা  হয়ে যাই । ধ্যানে বসলে আমাদের ঘুম পায়।  আসলে ধ্যান আর ঘুমের মধ্যে পার্থক্য সামান্যই। গভীর ঘুমে আমরাদের জ্ঞান থাকে না, আর সমাধির ঘুমে আমরা অজ্ঞান থেকে বেরিয়ে যাই। মুক্তানন্দ বলছেন, মৃত্যু আসলে এক ধরনের সমাধি বিশেষ, যে সমাধি সহজে ভাঙে না। 

আমরা যখন মাণ্ডুক্য উপনিষদের  কথা শুনেছিলাম, সেখানে শুনেছি, জীবরূপী ব্রহ্মার চার অবস্থা -  জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি ও তুরীয়।  
















Sunday, 11 May 2025

সাংখ্য যোগদর্শন। দুঃখ যাবে কিসে ? Samkhya Yogadarshan

সাংখ্য যোগদর্শন। দুঃখ যাবে কিসে ?  Samkhya  Yogadarshan 

১) মানুষ যখন ত্রিতাপ জ্বালায় দগ্ধ হতে শুরু করে, অর্থাৎ মানুষ যখন, দুঃখত্রয়ের (আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক, আধিদৈবিক) সম্মুখীন হয়, তখন সে এই দুঃখত্রয় থেকে পরিত্রানের রাস্তা খোঁজে। মানুষের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, কেন এমন হয় ? আর কিভাবেই বা এই দুঃখ-দুর্দশা দূরীভূত হবে ? বলা যেতে পরে, কেন আমরা তো এই দুঃখ দূর করবার জন্য, নানান রকম ঔষধাদির ব্যবস্থা করেছি। ঘরবাড়ি বানিয়েছি। নদী-নালাকে বাঁধ দিয়েছি। নদীর  উপরে সেতু বানিয়েছি, পশুকুলকে খাঁচায় পুরেছি। জঙ্গল কেটে বস্তি গড়েছি, পাহাড় কেটে রাস্তা করেছি।  আমরা এখন নিরাপদ, আমরা এখন নিশ্চিন্ত।  কিন্তু সত্যিই কি আমরা নিশ্চিন্ত হতে পেরেছি ? এখনও মেঘের ডাকে আমরা শিউরে উঠি, মাথার উপরে বাজ পড়ে,  অজানা মৃত্যু  ভয় আমাদেরকে তাড়া করে  নিয়ে বেড়ায়। ডানলোপিলোর গদিতেও আমাদের ঘুম আসে না। আসলে যাকিছুই করা হোক না কেন, এযেন বালির বাঁধ, সবই সাময়িক। তাই যদি হয়, তবে কিভাবে আমরা এই ত্রিতাপ জ্বালা থেকে নিষ্কৃতি পাবো ? 

২)  এই দুঃখ দূর করবার উপায় হিসেবে, শাস্ত্র আমাদের অনেক উপদেশ দিয়ে থাকে। অনেক আচার-আচরণের নির্দেশ দিয়ে থাকে। কখনো কখনো এগুলো ফলপ্রসূ হয় বটে, তবে তাও সাময়িক। এই দুঃখ দূর করবার উপায় হচ্ছে অভেদ জ্ঞানদের উন্মোচন। জগৎ কখনও  ব্যক্ত, কখনো অব্যক্ত।  ব্যক্ত ও অব্যক্তের মধ্যে যে ভেদ রেখা আছে, তাকে দূর করবার জন্য দরকার প্রতক্ষ্য অভেদজ্ঞান। এই প্রতক্ষ্য অভেদজ্ঞানই পারে আমাদের সমস্ত দুঃখ-দুর্দশাকে  দূর করে দিতে। যতদিন আমাদের মধ্যে বৈষম্যজ্ঞান বর্তমান থাকবে, ততদিন, আমাদের দুঃখের নিবৃত্তি হবে না। 

৩) সাংখ্য দর্শন বলছে, সৃষ্টিতত্ত্বের গোড়ায় মূল কারন রূপে অবস্থান করছে পুরুষ ও প্রকৃতি। এই আদি পুরুষ ও আদি প্রকৃতি অব্যক্ত, সর্বব্যাপী, অনন্ত, কালাতীত। এখান  থেকেই এসেছে মহৎতত্ত্ব অর্থাৎ বুদ্ধি যা সৃষ্টির প্রথম প্রকাশ স্বরূপ। এই মহত্তত্ত্ব থেকে অহঙ্কার। এই অহঙ্কার  ত্রিবিধ সাত্ত্বিক, রাজসিক, এবং তামসিক। এই সাত্ত্বিক অহংকার থেকে এসেছে মানস।  এই মানস  থেকে কর্ম্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয়। অন্যদিকে তামসিক অহঙ্কার  থেকে এসেছে পাঁচটি তন্মাত্র, পাঁচ তন্মাত্র  থেকে পাঁচ মহাভূত। তো কেউ একজন পুরুষ এই সৃষ্টির করেন স্বরূপ, এমন ধারণা সাংখ্য দর্শন অনুমোদন করে না। 

তো সমষ্টি  মন থেকে মানস, পাঁচটি  জ্ঞানেন্দ্রিয়, পাঁচটি কর্ম্মেন্দ্রিয় এবং পাঁচটি মহাভূত - এই ষোলোটা তত্ত্বের উৎপত্তি। মহাচৈতন্য থেকে মহৎ, অহঙ্কার ,এবং পাঁচটি তন্মাত্র এই ৭জন।  তো একটা বিকৃতি তত্ত্ব, আর একটা প্রকৃতিতত্ত্ব। এই হচ্ছে সৃষ্টির  মূল কারন। 

দুঃখ যাবে কিসে ? 

খোকন বাবু কিছুদিন যাবৎ দুশ্চিন্তাগ্রস্থ। কিছুদিন আগে তার ৩৫-৩৬ বছরের যুবক ছেলে, ৫/৬ বছরের নাতিকে বৌমাকে রেখে  হঠাৎ  হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। তার নিজের স্ত্রীর নানান রকম রোগে,  বলতে গেলে শয্যাশায়ী। দু-দু বার কিসব কারনে অস্ত্রপচার  হয়েছে। সংসারের কোনো কাজ করতে পারেন  না। ডাক্তারবাবু বলছেন, আবার অপেরেশন করতে হবে।  কিন্তু হার্টের ডাক্তারের অনুমতি ছাড়া এই অপেরেশন করা  যাবে না। হার্টের ডাক্তার লিখিত অনুমতি দিতে রাজি নয়।  আবার অপেরেশন না করলে নাকি, তার স্ত্রী আর বেশিদিন  দিন ইহজগতে থাকবেন না। ডাক্তার বাবু গম্ভীর স্বরে নিদান হেঁকেছেন। খোকন  বাবু যিনি একটু বেশী কথা বলতে ভালো বাসেন,  তিনি এখন মুখ কালো করে থাকেন। 

জিজ্ঞেস করতেই  খোকনবাবু বললেন, জানেন, কাল রাতে স্ত্রীর মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়েছে। এর আগে মলদ্বার দিয়েও রক্ত ঝরেছে। কি যে করি কিছুই বুঝতে পারছি না। কোনো ডাক্তারবাবু বলছেন, এই ট্যাবলেটটা খাওয়ালে এমনি ভাবে রক্ত ঝরবে। আবার কেউ বলছেন, এই ট্যাবলেট টা  না খাওয়ালে চলবে না। আমি বুঝে উঠতে পারছি  না,  কি করবো ? বলে ফ্যাল ফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। 

এমনিতে ওনার টাকা পয়সার টানাটানিও আছে।  বাড়ি  থেকে স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পাঁচশো / হাজার টাকা বেরিয়ে যায়।  এছাড়া ডাক্তার বাবুকে নাকি ৬০০ টাকা ফিস্ দিতে হয়।  অথচ কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছি না। 

আমরা খুব খারাপ লাগলো, ওনার এই অবস্থার কথা  শুনে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, আমি তো ডাক্তার নোই। আমি কিছু করতেও পারি না। 

বললাম, দেখুন, আমরা কে কয়দিন বাঁচবো, তা আমরা কেউ জানি না।  তবে এটা জানি, যে একদিন না একদিন আমরা অবশ্যই মারা যাবো।  আর  এছাড়া, আপনাদের দুজনের বয়স ৭০ এর কাছাকাছি। যে কয়দিন বাঁচবেন, আনন্দে বাঁচুন।  কিন্তু আনন্দে বাঁচবেন কি করে ? ধীরে ধীরে ডাক্তারের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করুন। এক্ষুনি  না হলেও, ধীরে ধীরে ঔষধের প্রতি আকর্ষণ ত্যাগ করুন। 

আপনি হয়তো জানেন না, মানুষের মধ্যে ঔষধ ততক্ষন সুফল বা ক্রিয়া করতে পারে, যতক্ষন রুগীর মধ্যে ঔষদের প্রতি বিশ্বাস থাকে।  যেদিন বিশ্বাস হারিয়ে যায়, সন্দেহ তৈরী হয়, এমনকি যেদিন বস্তুর প্রতি অনাসক্তি আসে, তখন আর এই ঔষধ তার শরীরে রাসায়নিক ক্রিয়া করতে অক্ষম হয়ে যায়।  প্রত্যেকের জীবনে একটা দিন আসে, যখন শরীরে ঔষদের ক্রিয়া বন্ধ  হয়ে যায়। তখন  ঘুমের ঔষধ খাওয়ালেও আর রুগীর ঘুম আসে না। আর ঠিক এই কারণেই, একদিন ডাক্তার বাবু বলে দেন, আপনি রুগীকে বাড়ি নিয়ে যান। ভালো মন্দ খেতে দিন। একটু সেবাযত্ন করুন।  এই রুগীর  চিকিৎসা এখন আমাদের হাতে নেই।  

আমি তাকে দুটো দাওয়াই দিয়েছিলাম। 

১. সকালে ঘুম থেকে বিছানা ছাড়ার আগে, এবং রাতে ঘুমুতে যাবার আগে,  ঈশ্বরের কাছে আপনার কষ্টের  কথা জানিয়ে, প্রতিকারের জন্য প্রার্থনা করুন। 

২. একটা কাঁচা সুপুরি জোগাড় করুন। স্ত্রীকে বলুন এটিকে লাল সুতো দিয়ে ভালো করে মুড়ে দিতে। একটা ডিমের আকৃতি বানিয়ে নিন। এর পরে প্রতিদিন তিনবেলা, অর্থাৎ সকালে, দুপুরে, এবং সন্ধ্যাতে ধুপ ধুনো প্রদীপ দিয়ে, আরতি  করুন।  এবার  এই সুপারির (গনেশ সুপারির) কাছে বসে, মনে মনে প্রার্থনা করুন। এই যে প্রক্রিয়া এসব আমার মনগড়া নয়, এটি একটি জ্যোতিষ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। 

এই কথা গুলো আমি প্রায় ছয়  মাস আগে বলেছিলাম। তিনি এগুলো করতেন কি না, সেই খোঁজও আমি কখনও  নেই নি। কেননা বারবার বললে, পাচ্ছে ভদ্রলোক বিরক্ত হন। হঠাৎ গতকাল ভদ্রলোক , বললেন আমার স্ত্রী কিছুদিন যাবৎ  ভালো আছেন, প্রেসারের ঔষধ ছাড়া আর কিছু খান না। শুনে  আমার খুব ভালো লাগলো। 

আসলে কি জানেন, আমরা সবাই শরীরে রোগকে টেনে আনি, রোগকে প্রশ্রয় দেই। আমাদের মন নানান রকম আশঙ্কায় ভুগছে। আর এই আশঙ্কা থেকে আমরা দুশ্চিন্তার শিকার হয়েছি। এই দুশ্চিন্তা আমাদের শরীরে নানান রকম হরমোনের জন্ম দিচ্ছে, বা হরমোনের নিঃসরণে বাধা সৃষ্টি করছে।  শরীরের সাম্যভাব  নষ্ট হচ্ছে। আমরা শারীরিক দিক থেকে রোগগ্রস্থ হয়ে পড়ছি। 

আমরা যখন অসহায় হয়ে পড়ি, আমরা যখন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ হয়ে যাই, তখন বিশ্বশক্তির কাছে ঐকান্তিক প্রার্থনা একটা অলৌকিক শক্তির জন্ম দেয়। আমরা একটা আশ্রয় খুঁজে পাই, যা আমাদের শরীরের মধ্যে সাম্যভাবের সৃষ্টি করে। আমরা একটা শান্তি অনুভব করি। মানসিক স্থিরতা, শারীরিক অসুস্থকে সরিয়ে তোলে। কাঁচা সুপারিতে সুতো জড়িয়ে সুপারি গনেশ বানানো, মানে হচ্ছে নিজের মধ্যে ভালো থাকবার একটা অদম্য উৎসাহ সৃষ্টি  করা।  এর কোনো বস্তুগত মূল্য নেই।  কিন্তু মনের দিক থেকে এর অসীম গুরুত্ত্ব। সুপারি গনেশ নিমিত্ত মাত্র , মনের মধ্যে বেঁচে থাকবার, শারীরিক দিক থেকে সুস্থ থাকবার, অদম্য ইচ্ছাশক্তি মানুষকে ভালো থাকবার রসদ যোগাতে  সক্ষম। 

যেখানেই থাকুন, যে অবস্থাতেই থাকুন, সেই বিশ্বশক্তির কাছে আকুল হয়ে প্রার্থনা করতে পারলে , অনেক সমস্যা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়।  মন একটা নির্ভরতা খুঁজে পায়। আসলে আমরা কেউ আশ্রয়হীন হয়ে বাঁচতে পারি  না। মায়ের কোল  যেমন শিশুকে নিশ্চিন্ত রাখে, তেমনি আন্তরিক  প্রার্থনা মানুষকে নিশ্চিন্ত থাকতে অলৌকিক ভাবে শক্তি জোগাতে পারে। 

তাই অনুরোধ করবো, রাতে ঘুমুতে যাবার আগে, আর সকালবেলা বিছানা ছাড়ার আগে, এক মিনিট বিশ্বশক্তির কাছে প্রার্থনা করুন। করেই দেখুন না, কিছু ফল হয় কি না ?

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি  ওম।   

সবকিছু ছেড়ে দেবেন কখন ? অনাসক্তি আসবে কি করে ?

বাড়িতে একটা পুরানো, ফ্রিজ পড়েছিলো। ছেলে নতুন ফ্রিজ কিনে নিয়ে এসেছে।  গৃহকর্ত্তি ফ্রিজটিকে বেঁচে দিতে চাইলেন। গৃহকর্ত্তা কিছুতেই সেটি বেচতে দেবেন না। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে তুমুল ঝগড়া। অশান্তি।  মনে মনে ভাবছিলাম, এই আসক্তি, বস্তুর প্রতি এই যে আসক্তি, যা অশান্তির করেন, তার  নিষ্পত্তি হবে কবে ? 

জীবন মানেই কৰ্ম্মময় অবস্থা।  কর্ম্মহীন জীবন বলে কিছু হয় না। এই কর্ম্মই জীবনে সাফল্য এনে দেয়। আর এই কারণেই জীবনে সাফল্য পেতে গেলে, জীবনের উদ্দেশ্য ও উপায়গুলোর প্রতি অর্থাৎ আমাদের বিষয়কর্ম্মে  মনোযোগী হওয়া উচিত। অর্থাৎ জীবনের উদেশ্য পূরণের জন্য, আমাদের কিছু উপায়ের অবলম্বন করতে হয়। আর এই উপায়ের প্রতি যে যত  বেশি মনোযোগ দিতে পারে, তার জীবনে সাফল্য বেশি মাত্রায় দেখা যায়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই মনোযোগ দিতে গিয়ে আমরা ওই বিষয়ের প্রতি অর্থাৎ উপায়ের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। তখন আমাদের কাছে বিষয়গুলো  এতো বেশী আকর্ষণীয় হয়, যে তাকে আমরা আর ঝেড়ে ফেলতে পারি না। মধুর ভান্ডে মধু  খেতে গিয়ে আমরা মধুর মধ্যেই নিজেকে   আটকে ফেলি ।  আর সেখানেই  আমাদের দমবন্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটে। অর্থৎ  আমরা মধুর মধ্যে যে মৃত্যু ওঁৎপেতে রয়েছে, তা আমরা বুঝতে পারি না। 

জীবনে যখন ব্যর্থতা  আসে, তখন আমরা ব্যর্থতার কারনগুলোর  দিকে যদি আমরা ধ্যান দেই , তাহলে আমরা দেখবো, এই ব্যর্থতার মধ্যে আছে, উপায়গুলোর প্রতি আমাদের অতিরিক্ত মনোযোগ। জীবনে সাফল্য পেতে গেলে, আমাদের উপায়গুলোর দিকে মনোযোগ দিতেই  হবে, উপায় যদি সঠিক হয়, তবেই  আমাদের সাফল্য অবশ্যই  আসবে।  কিন্তু  জীবনের উদ্দেশ্য আর উপায়কে আমরা গুলিয়ে ফেলি। এইজন্যই আমাদের হতাশা আসে। 

দেখুন, জীবনের সাফল্যের পিছনে, যেমন একটা কারন আছে, তেমনি অসাফল্যের পিছনেও একটা কারন থাকে। আমাদের জীবনে দুঃখের সবচেয়ে বড়ো  কারন হচ্ছে, আমরা যখন কোনো কাজ একবার শুরু করি, তাতেই আমরা সর্ব্বশক্তি নিয়োগ করি, হয়তো সেখান থেকে সাফল্য আসে, বা আসে না, কিন্তু সেই কাজকে আমরা কখনোই পরিত্যাগ করতে পারি না। বুদ্ধিমান মানুষ এও  জানে, বা উপলব্ধি করে, যে এই কাজ চালিয়ে যাওয়াটা পীড়াদায়ক, কিন্তু তথাপি  সে সেই কর্ম্ম ছাড়তে পারে না। একটা নেশার মতো হয়ে যায়। সে এটাও বুঝতে পারে , যে এখান  থেকে তার দুর্দশা আসছে, তথাপি সে এখান  থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। 

মধুমক্ষি-রূপ এই আমি সংসাররূপ মধুভান্ডে মধু খেতে এসেছিলাম। কিন্তু এখানে এসে  সেই সংসাররূপ মধুভান্ডে  আমি নিজেকে এতটাই জড়িয়ে ফেলেছি, যে এখন হাজার এক দুর্দশার কারন এই সংসারের মধ্যে দেখেও, আমি আর সেই সংসার রূপ মধুভান্ড থেকে বেরুতে পারছি না।  মধুর মধ্যেই যেন আটকে দমবন্ধ হয়ে আসছে। 

আমরা যখন এসেছিলাম, তখন নিজের ইচ্ছেয় এসেছিলাম, না  ঈশ্বরের   ইচ্ছেয় এসেছিলাম তা আমরা জানি না। কিন্তু এখন আমি না আমার ইচ্ছেয় চলতে পারছি, না ভগবানের ইচ্ছেয় চলতে পারছি । আমরা  এখন অপরের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছি। এমনকি আমরা অপরের মনকে চালিত করবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার।  আমরা এইভাবেই  সুখের আস্বাদ পেতে চাইছি, কিন্তু ধীরে ধীরে এই চক্রে পড়ে, আমার প্রাণশক্তি শেষ হয়ে  যাচ্ছে । 

আমরা চাই প্রকৃতির কাছ থেকে সব কিছু পেতে, আমরা জল চাই, বাতাস চাই, আলো  চাই , আশ্রয় চাই, কিন্তু পরিণামে আমরা নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলি, প্রকৃতিই  আমাদের থেকে সব কিছু শুষে নিচ্ছে। আমাদের প্রকৃতি প্রদত্ত শরীর ভেঙে পড়ছে। জরা ব্যাধি, আমাদেরকে আক্রমন করছে। আমরা ছেলে-মেয়ে-স্ত্রীর কাছ থেকে পেতে চাই, কিন্তু পরিণামে এরাই আমার কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিচ্ছে। আসলে আমরা এদের কাছে আবদ্ধ  হয়ে পড়েছি। যদি আমরা আবদ্ধ  না হতাম, তবে আমাদের জীবন হয়ে উঠতে পারতো আনন্দ-উজ্জ্বল। 

আমাদের সমস্ত দুঃখের কারন হচ্ছে, আমরা অন্যের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছি, আমরা জীবনে সাফল্যের জন্য যে উপায়গুলোকে খুজেছিলাম, অর্থাৎ ধন, দৌলত, গাড়ি, বাড়ি, স্ত্রী, পুত্র, এখন সেই  সফলতাই  আমাদের অসফলতার কারন হয়েছে। যাদের কাছে আমি সুখের জন্য গিয়েছিলাম, এখন সেখানে জড়িয়ে জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছে। শ্বাস ওষ্ঠাগত  হয়ে উঠেছে। 

এইজন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, কর্ম্ম করো, কিন্তু আসক্ত হয়ো না। তুমি নিয়ত কর্ম্ম করবে, কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, তোমাকে যেন কর্ম্ম আবদ্ধ করে না ফেলে। প্রতিটি  বিষয়কে গ্রহণ করবার শক্তি যেমন তোমাকে অৰ্জন করতে হবে, তেমনি সেই বিষয়কে বৰ্জন  করবার  শক্তি যেন আমরা হারিয়ে না ফেলি। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সংসার বেঁধেছিলাম সুখ পাবো বলে, এখন সেই সংসার যেন আমাকে না বেঁধে ফেলতে পারে, সেই দিকে নজর দিতে হবে। প্রত্যেকটি বিষয় থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেবার বিদ্যাও  শিখতে হবে। বস্তু তা সে যতই প্রিয় হোক, তাকে ত্যাগ করতে হবে।  আর এই ত্যাগ করতে যেন বেদনা না আসে, এই শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। 

জীবাণু তো সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে, ভাইরাস না আছে কোথায় ? কিন্তু নিজের মধ্যে যদি প্রতিরোধ শক্তি থাকে তবে সেই  ভাইরাস তোমাকে আক্রমন করতে পারবে না। জীবনে সবচেয়ে দুঃখের কারন হচ্ছে, নিজেকে দাস করে ফেলা। নিজেকে দুর্ব্বল করে ফেলা। এই দুর্ব্বলতা জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু। দুর্ব্বলকে সবাই আঘাত করে, দুর্বলতাই  মৃত্যু ডেকে  আনে ।  জীবন থেকে সমস্ত দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে দাও। নিজের মধ্যে থেকে দাসত্বের বৃত্তি, দাসত্বের মনোভাবকে দূর করে দাও।  শক্তিকে আশ্রয় করো।  শক্তিই জীবন, শক্তিই সুখ, সত্যকে আশ্রয় করো, সত্যই জীবন। 

দুঃখে যাদের জীবন চলছে, তাদের দিকে একবার খেয়াল করলেই দেখতে পারবেন, তাদের এই দুঃখের কারন হচ্ছে, আসক্তি।  কর্ম্মের প্রতি আসক্তি, সাফল্যের প্রতি আসক্তি, আত্মীয় স্বজনের প্রতি আসক্তি, বন্ধু বান্ধবের  প্রতি আসক্তি, স্ত্রী-পুত্র পরিবারের প্রতি আসক্তি। 

প্রকৃত আনন্দ পেতে গেলে, আমাদের অনাসক্ত হতে হবে। একটা বয়সে, সংসারের কাজ ছেড়ে দিতে হবে, ঈশ্বরের কাজ করতে হবে। ধরা-ছাড়াতে যারা স্বচ্ছন্দ তাদের জীবন হয়, সহজ সরল। আমাদের সবার জীবনে একটা সময় আসে, যখন চাকরি থেকে অবসর নিতে হয়, তেমনি প্রত্যেকের জীবনে একটা সময় বেছে  নিতে হয়, যখন সে সংসার থেকে অবসর নেবে। তথাকথিত কর্ম্ম থেকে অবসর নেবে। একটা জিনিস জানবেন, অনাশক্তিই জীবনে আনন্দ এনে দিতে পারে। যার মধ্যে ইচ্ছেশক্তি অনাসক্ত এনে দিতে পারে, তার মধ্যে আনন্দের অভাব  হয় না। 

আর এই ক্ষমতা আমার, আপনার সবার মধ্যেই আছে।  জীব-জন্তু সাধারণত পেট ভরে গেলে, আর খাবারের সন্ধানে বেরোয় না।  মানুষই একমাত্র, যার পেটের  ক্ষিদে মিটে  গেলেও, তার মনের খিদে মেটে  না। আবার এই মানুষেরই ক্ষমতা আছে, ক্ষুধা-তৃষ্ণা সহ্য করবার। জীব জন্তু কখনও  ক্ষুধা তৃস্না সহ্য করতে পারে না, মানুষ পারে । 

এখন কথা হচ্ছে, তাহলে কি আমরা সবাই কাজ-কর্ম্ম ছেড়ে দিয়ে সংসার ছেড়ে সন্যাসী হয়ে যাবো ? কিছু লোক অবশ্য  আমাদের মধ্যে  আছেন, তাঁরা কোনো কিছুতেই আকৃষ্ট হন না। যাদেরকে আমরা তথাকথিত সন্ন্যাসী বলি।  এদের কঠিন হৃদয়, এরা এমনকি ভালোবাসতেও চায় না। এদের মন কঠিন।  কিন্তু পাথরের মতো মন নিয়ে আপনি হয়তো দুঃখে এড়িয়ে যেতে পারেন, কিন্তু জানবেন, তখন আনন্দও আপনার কাছ থেকে দূরে চলে যাবে। এই অবস্থা কাম্য নয়। এই জড়বৎ অবস্থায়, দুঃখবোধ না থাকতে পারে, কিন্তু সত্যিকারের আনন্দবোধ থেকেও তিনি  বঞ্চিত থাকে। বরং আমরা চাই, একটা প্রেমময় জীবন।  যেখানে সহানুভূতি থাকবে, ভালোবাসা থাকবে, কিন্তু ভালোবাসার বস্তুর প্রতি আসক্তি থাকবে না। এ এক অদ্ভুত রহস্য যা আমাদের শিখতে হবে। 

দেখুন, ভিখারি কখনো সুখী হতে পারে না। আবার ব্যবসায়ীও কখনো সন্তুষ্ট হতে পারে না। যারা জীবনকে ভিক্ষারিবৎ করেছেন, অথবা জীবনকে নিয়ে কেবল ব্যবসা করছেন, তারা ঘৃণার পাত্র, তারা জীবনে কখনো সুখী হতে পারেন না।  এই ভিক্ষারী লাখ-টাকা পেলেও, ভিক্ষাই করবে। মন্দিরে মসজিদে গীর্জায়, এই ভিক্ষারিদের দর্শন পাওয়া যায়। এদের মধ্যে কেউ মানুষের কাছে ভিক্ষা চাইছে, আবার কেউ ঈশ্বরের কাছে ভিক্ষে চাইছে। 

আবার যারা জীবন-ব্যবসায়ী তারা  প্রেম নিয়ে ব্যবসা করে, ধর্ম্ম নিয়ে ব্যবসা করে, ব্যবসায়িক বৃত্তিই তার জীবনকে টেনে নিয়ে চলেছে, একটা অজ্ঞান অন্ধকারের দিকে।  

এখন কথা হচ্ছে, আমরা এই বস্তু বা বিষয় বা সংসারের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ি কিভাবে ? আসলে আমরা যাকিছু দেই, তার একটা প্রতিদান আশা করি। আর এর ফল হয় উল্টো, আমরা ভালোবাসা দিয়ে দুঃখ পাই।  কিন্তু সত্য হচ্ছে,  এই দুঃখ বাইরে দিক থেকে  আসে না, আমার্  ভালোবাসার প্রত্যাশা, অপূর্ন হলেই, আমার ভিতর থেকে  থেকেই দুঃখ উঠে আসে। দুঃখের বাহক হচ্ছে বাসনা। বাসনাই দুঃখ বহন করে নিয়ে আসে। 

তাই মহাত্মাগণ  বলছেন, "কিছু কামনা করো না. প্রতিদানে কিছু চেয়ো না। যা তোমার দেবার আছে তা তুমি দাও। যা তোমার প্রয়োজন আছে তা তুমি নাও। সূর্য সমুদ্র থেকে জল শুষে  নিচ্ছে, আবার বৃষ্টি  রূপে ফিরিয়ে দিচ্ছে। একটা জিনিস জানবে, যা তুমি নিচ্ছ, তা তোমাকে ফিরিয়ে দিতে হবে, আবার যা তুমি দিচ্ছ, তা তোমার কাছে হাজার গুন্ বেশি হয়ে ফিরে আসবে। তাই তুমি যদি কাউকে ঘৃণা দাও, তবে, তোমার কাছে ঘৃনাই ফিরে ফিরে আসবে, আবার তুমি যদি ভালোবাসা দাও, তবে প্রেম হয়ে তা ফিরে আসবে। একটা জিনিস যেন, তুমি সংসারে এসেছো সঞ্চয় করতে নয়, ভিক্ষা চাইতে নয়।  তুমি যা কিছু এখান থেকে নেবে, তা এখানেই ফিরিয়ে দিতে হবে। যাবার সময় শূন্য হাতেই ফিরে যেতে হবে। আমাদের ত্যাগে সাহস আসে না, ভাবি যদি ভবিষ্যতে যদি কম পরে যায়। কিন্তু সত্য হচ্ছে, তুমি যখন এসেছিলে তখন তোমার কাছে কিছুই ছিল না, আবার যখন তুমি এখান থেকে চলে যাবে, তখন শূন্য হাতেই  যেতে হবে।  এখানকার জিনিস এখানেই পরে থাকবে।  তাহলে কার জন্য সঞ্চয় করছো ? হাসপাতালের ডাক্তারদের জন্য ? ভুলে যাও , যখন যাবার সময় হবে, তখন ডাক্তার কেন, ডাক্তারের বাপও তোমাকে  বাঁচাতে পারবে না। তবে কেন ডাক্তারের কথা ভাবছো ? সবই ভগবানের, তুমি কেবল আদান-প্রদানের মাধ্যম মাত্র। তোমার দ্বারা এই আদানপ্রদান ক্রিয়া করছেন, স্বয়ং ঈশ্বর। তুমি গতিশীল নদী মাত্র।  তোমার গন্তব্য সমুদ্র। তোমার ঘাটে  যদি কেউ স্নান করে, তাতে তোমার জল কমবে না। তোমার কাছ থেকে জল নিয়ে কেউ যদি পান করে, তবে তোমার জল কমবে না, তোমার কাছ থেকে জল নিয়ে কেউ যদি অন্ন উৎপাদন করে, তাতেও তোমার জল কমবে না। কারন এই জল উৎস থেকে  প্রতিনিয়ত ঝরছে, তুমি সেই জলের তোরে ভেসে চলেছো। তুমি জল, নও, তুমি নদী নয়, তুমি শুধুই প্রবাহ। সামনের দিকে বেয়ে চলাই  তোমার কাজ। অনাসক্ত হয়ে এগিয়ে চলো । নিজেকে অনুভব করবার চেষ্টা করো। তুমি যে শক্তি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছো, তাকে অনুভব করবার চেষ্টা করো। 

প্রতিদিন প্রভাতে অনাসক্ত থাকবার জন্য সংকল্প করো। কারুর ক্রীতদাস হয়ে থেকো না।  নিজেই নিজের প্রভু বোনে যায়। নিজের উপরে নিজেই কর্তৃত্ত্ব করো। আমরা বলি, সবাই আমাকে কষ্ট  দিচ্ছে। মিথ্যে - মিথ্যে- মিথ্যে   আমরা বলি জগৎ মন্দ -  মিথ্যে মিথ্যে মিথ্যে - কেউ ভালো না, বার কেউ খারাপ না। শিবরাম নির্জন  পাহাড়ের  কোলে দাঁড়িয়ে, একসময় হতাশ হচ্ছে চিৎকার করে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলো, প্রভু তুমি কি নেই ? কঠিন পাথরে আঘাত খেয়ে সে ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এসেছিলো নেই - নেই- নেই। প্রভু তুমি কি আছো - প্রতিধ্বনি জবাব দিয়েছিলো,  আছে আছে আছে। 

মেরুদন্ড সোজা করে দাড়াও, কারুর উপরে দোষারোপ করো না। নিজেকেও নয়।  কাউর মধ্যে দোষ  খুঁজতে যেও না। তুমি যখন দোষের কথা চিন্তা করবে, তখন শুধু দোষই  দেখবে। যখন আনন্দ খুঁজবে, তখন শুধুই আনন্দই দেখবে । সব ছেড়ে দাও, আবার কিছুই ছেড়ো না। ধরি মাছ, না ছুঁই পানি। সেই যে গোসাঁই কবি গেয়েছেন, আমার যেমন বেণী তেমনি রবে, চুল ভেজাবো না। শুধু বিষয়-আসক্ত থেকে নিজেকে অনাসক্ত করো। কিছুই ছাড়বে না, আবার কিছুই ধরবে না। কর্ম্ম থেকে নিষ্কৃতি নয়, আসক্তি থেকে নিষ্কৃতি পেতে হবে। আর এটা করতে হবে এক্ষুনি, এখন থেকেই। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম। 



  






সত্যধর্ম্ম : মন -গ্রন্থিচক্র - বীজমন্ত্র


সত্যধর্ম্ম : মন -গ্রন্থিচক্র - বীজমন্ত্র 
শশাঙ্ক  শেখর শান্তিধাম 




ওঁ সহ নাববতু।  সহ নৌ ভুনক্তু । সহ বীর্যং করবাবহৈ।
তেজস্বি নাবধীতমস্তু  মা  বিদ্বিষাবহৈ।।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ।।

হে  পরম আত্মা  পরম ঈশ্বর,  আমাদের উভয়কে  সমভাবে রক্ষা করুন।   সমভাবে  বিদ্যাফল  দান করুন।   আমরা যেন সমভাবে বিদ্যাফল লাভের জন্য সামর্থ অর্জন করতে পারি। আমাদের লব্ধ বিদ্যা সফল হোক।  আমরা যেন পরস্পর বিদ্বেষ না করি।  - হে পরম আত্মা-পরম ঈশ্বর আমাদের ত্রিবিধ শান্তি অর্থাৎ শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্বিক শান্তি হোক।

আমরা আগের দিন পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও পঞ্চভূত নিয়ে আলোচনা করছিলাম। এবং বুঝেছিলাম এই ইন্দ্রিয়গুলি সরাসরি সুখ-দুঃখের অনুভূতির কারন। এখন এই ইন্দ্রিয়গুলি কার নির্দেশে চলে ?

ইন্দ্রিয়গুলো মস্তিষ্কের নির্দেশে চলে। কিন্তু মস্তিস্ক মনের নির্দেশে চলে। তাই আমরা এই মন ও মস্তিস্ক নিয়ে আলোচনা করবো। আমরা মনের গভীরে ঢুকবো। কিন্তু তার আগে, আমাদের আধ্যাত্বিক হতে হবে। আর  আধ্যাত্বিক জীবনের প্রবেশ দ্বার হচ্ছে গুরুকরন। গুরুমন্ত্র গ্রহণ। গুরুমন্ত্র মানে বীজ মন্ত্র।  আগে এই বীজ মন্ত্র  সম্পর্কে কিছু কথা আলোচনা করবো, তার পরে মস্তিস্ক ও মন নিয়ে আলোচনা করবো।  

বীজ মন্ত্র আর কিছু নয়  ঈশ্বরের গুনকীর্তন, বা  ঈশ্বরের বর্ণনা মাত্র। অথবা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা। এটি খুব কম শব্দে উচ্চারিত হয়। বা একক শব্দে উচ্চারিত হয়। বার বার এই মন্ত্র  উচ্চারণের ফলে শরীরে একটা মৃদু কম্পন অনুভূত হয়। মন্ত্রে তন্ময় হলে চিত্ত ঈশ্বরে নিবদ্ধ হয়। জপ্ করলে  বা বারবার একই মন্ত্র বা বিষয় বারবার উচ্চারিত হলে মন সেই বিষয়ে স্থির হয়। বাহ্যিক সুখ-দুঃখ থেকে, শরীরকে সাম্য অবস্থায় রাখা যায়।

গুরুদেব  বলছেন : উপাসনা বা গুনকীর্তন যেমন সাধারণ ভাষায় করা যেতে  পারে, তেমনি বৈজিক ভাষায় করা যেতে পারে। সাধারণ ভাষা অর্থাৎ বাংলা, সংস্কৃত, ইত্যাদি।  আর সব থেকে আদি ভাষা হচ্ছে বৈজিক  ভাষা। ভাষা সৃষ্টির ক্রোম এই রকম - বৈজিক -বৈদিক-সংস্কৃত-প্রাকৃত-বাংলা ইত্যাদি।

গুরুদেব বলছেন বৈজিক ভাষাই  মূল ভাষা। বৈজিক থেকে বৈদিক। আর বৈদিক থেকে সংস্কৃত, গ্রিক, ল্যাটিন,আরবি, হিব্রু  প্রভৃতি উৎপন্ন হয়েছে। সংস্কৃত থেকে প্রাকৃত তারপর বাংলার উৎপত্তি হয়েছে। অতএব  ভাষার মূল বা বীজভূত ভাষা হচ্ছে "বৈজিক"। এই ভাষাতেই জীব, জন্তু, পশু, পাখি কথা বলে। অতএব যদি  বৈজিক ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান থাকে তবে তুমি সবার কথা বুঝতে পারবে, তা সে দেবতার কথাই হোক আর পশু পাখির কথাই  হোক, আর মানুষের কথাই  হোক। বৈজিক ভাষায় উৎকৃষ্ট জ্ঞান থাকলে নিখিল ব্রহ্মান্ডের ভাষা বোঝা যেতে পারে।

বৈজিক  ভাষা হচ্ছে ভাব প্রকাশের সব চেয়ে সংক্ষিপ্ত ভাষা এবং প্রথম ভাষা, সৃষ্টির আদি ভাষা ।  বীজ থেকে  বৈজিক, অর্থাৎ ভাষার মূলভূত বীজ। কেউ কেউ এটাকে বৈচিক ভাষায় বলে অর্থাৎ কথ্য ভাষায় বীজকে বলে বিচি।  এই বিচি থেকেই বৈচিক।  যাই হোক বৈজিক ভাষা  শুধু সংক্ষিপ্ত  শব্দ নয়, বৈজিক ভাষার উচ্চারনে একটা মহৎ গাম্ভীর্য ভাব উৎপন্ন হবে।   গুরুদেব মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্ত, একটা উদাহরণ দিয়ে এটা বুঝিয়েছেন। যেমন ধরো আমাদের বলতে হবে  :

"হে জগদীশ্বর ! তোমার করুনার অন্ত  নেই, তুমি আমাদেরকে  যাবতীয় বিপদ হতে রক্ষা  .করছো এবং তোমার তুল্য মহৎ কেউ নেই. অর্থাৎ তুমি সর্ব জগতের মধ্যে মহিষ্ঠ, তোমাকে প্রণাম করি। "

এই একই কথা সংস্কৃতে বললে অল্প সময়ের মধ্যে বলা যাবে এবং তা হবে :

"অনন্ত-করুনং ব্রহ্ম রক্ষকং ত্বাং নমাম্যহম্"

গুরুদেব বলছেন ভাষার শক্তি দেখ   ; একই কথা সংস্কৃতে উচ্চারণ করলে যে মহান গাম্ভীর্যতা প্রকাশ পায়  তা বাংলায় হয় না।  আবার একই ভাব বা কথা যদি বৈজিক ভাষায় উচ্চারণ করা হয় তা হয়ে যাবে  এই রকম।

"ওঁং ক্রীং নমঃ"

 তাহলে দেখছো বৈজিক ভাষা, বা  বীজ মন্ত্রের ভাষা কতটা সংক্ষিপ্ত ও গাম্ভীর্যপূর্ণ।

বৈজিক ভাষার আরো কিছু মন্ত্র অর্থ সহ বলছি :

হৌং  :  হ্ = শিব, ঔ=সদাশিব, ং=দুঃখহরণ ; সর্বদা মঙ্গলকারী শিব আমার দুঃখ হরণ  করুন।

দূঁ : দ্ = দুর্গা , ঊ = রক্ষা, ঁ = কর : হে জগৎ জননী দুর্গে ! আমাকে রক্ষা করো।

ক্রীঁ : ক্ = কালী , র্= ব্রহ্ম, ঈ = মহামায়া, ঁ = দুঃখ হরণ  : মহামায়া ব্রহ্মস্বরূপ জগৎ জননী কালী আমার দুঃখ হরণ  করুন।
গং :  গ = গনেশ , ং = দুঃখ হরণ।  গনেশ দুঃখ হরণ করুন।

ক্লীং : ক = কামদেব বা কৃষ্ণ  ল =  ইন্দ্র বা ঐশ্বর্য্যশালী , ঈ = তুষ্টি , ং = দুঃখ হরণ  : হে  ঐশ্বর্য্যশালী কামদেব বা কৃষ্ণ আমার তুষ্টি বিধান করুন, দুঃখ হরণ করুন।

এই রকম আরো বীজ মন্ত্র আছে : যেমন

হ্রীঁ - মহাদেবের শক্তি মহামায়া জগৎ জননী দুঃখ হরণ  করুন
শ্রীঁ - পরমেশ্বরী মহালক্ষ্মী আমাদের ধন ও পরম সন্তোষ প্রদান করুন এবং আমার দুঃখ হরণ  করুন।
ঐং - সরস্বতী দুঃখ হরণ  করুন।
হূঁ - মহাদেব যার ভৈরব, সেই পরমেশ্বরী আমার দুঃখ হরণ  করুন ।
স্ত্রীঁ - জগৎ জননী মহামায়া মোক্ষদা দুর্গোত্তারিণী তাঁরা আমার দুঃখ হরণ  করুন।

দ্রব্যের যেমন গুন্ বা শক্তি আছে, শব্দেরও তেমনি শক্তি আছে। ভালো সুর শুনলে আমাদের মন মোহিত হয়। আবার বাজির শব্দে বা বজ্রের শব্দে আমাদের মন চমকে ওঠে।
শব্দ দুই রকম : ধ্বনি ও বর্ণ। ধ্বনি অর্থবহ নয়। যেমন বিভিন্ন বাদ্যের বাজনা।বাঁশির সুর, বজ্রের ধ্বনি। মেঘের ডাক। ইত্যাদি।
বর্ণ কিন্তু অর্থবহ। মানুষ এই বর্ণের সাহায্যেই কথা বলে।  তাই অর্থবহ। বর্ণ দুই প্রকার ব্যঞ্জন  বর্ণ ও স্বরবর্ণ। আমাদের মুনি ঋষিরা ধ্বনি ও শব্দ, উভয়ের মাহাত্য দিয়েছেন। বেদে  ধ্বনির মাহাত্য।  এইজন্য বেদের সূক্ত বা শ্লোকের উচ্চারণের প্রতি বিশেষ গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়েছে।  এই জন্য এঁকে শ্রূতি   বিদ্যা বলা হয়েছে। অর্থাৎ এটি একমাত্র গুরুমুখে শুনেই শেখা বা আয়ত্ত্ব করা যায়।

ধ্বনির সাথে সাথে বর্ণগুলিকে অর্থাৎ অ, আ - ক, খ ইত্যাদি বর্নকে পর্যালোচনা করে, মুনি ঋষিরা  দেবতা-বিশেষের জন্য বিশেষ বীজ মন্ত্র নির্দ্ধারণ করে গেছেন।

তোমরা  শুনে থাকবে,  ওম নমঃ শিবায়ঃ - একটা বীজ মন্ত্র।  ওম নমঃ বাসুদেবায়, এ ছাড়া গায়ত্রী মন্ত্র, মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র এগুলো মানুষ জপ্ করে। এগুলোর উচ্চারণ যে যার মতো করে। ফলতঃ সঠিক উচ্চারণের ফল অপ্রকাশিত থাকে। আর একটা কথা খেয়াল রাখবে, বীজ মন্ত্র  সব সময় প্রণব পূত হবে। অর্থাৎ প্রণব ছাড়া  বীজমন্ত্র হয় না। 

বীজমন্ত্রের  সঠিক অর্থ যেমন জানা দরকার, তেমনি ভাবে এর সঠিক  উচ্চারণ করা আবশ্যক। যেহেতু উচ্চারণ কখনো  বই পড়ে শেখা যায় না, তাই গুরুর কাছ থেকে এটা  শিখে নিতে হয়। তাই দেখবে, গুরুদেব  বীজমন্ত্র সবসময়  কানের কাছে মুখ নিয়ে উচ্চারণ করেন । এর সঠিক উচ্চারণ গুরুই শিখিয়ে দেন। তাই বীজ মন্ত্র গুরুপ্রদত্ত। আর একটা কথা তোমরা  যারা গুরুমন্ত্র জপ্ করো  তারা খেয়াল করবে, তুমি  হয়তো জপের মন্ত্র উচ্চারণ করে যাচ্ছো, কিন্তু তোমার  মন  জপের মধ্যে নেই, অর্থাৎ জপ্-কে  যে মনন করা উচিত, তা হচ্ছে না। আবার হয়তো মনকে জপের মধ্যে নিয়ে এলে।  যতক্ষন তোমার  মন স্থির না হচ্ছে ততক্ষন এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এটাই প্রত্যাহার।  জপমন্ত্র   হচ্ছে তোমার  ধারণার বিষয়। মন বিষয় থেকে বেরিয়ে যাওয়া মানে  তোমার  দুর্বল ইচ্ছাশক্তির পরিচয়। এইখানে গুরু সহায়ক  হয়। প্রকৃত গুরুর কাছ থেকে যদি তুমি  মন্ত্র  পাও , তা সে তোমার  জানা মন্ত্রই হোক, গুরু তোমার  অবচেতন মনে মন্ত্রের মালা গেঁথে  দেবেন। তোমার  শরীরে মশা  পড়লে যেমন হাত আপনা থেকে এগিয়ে যায়, তোমার  অজ্ঞাতসারেই এটা হয় ।  তেমনি তোমার  জপ্ বন্ধ  হয়ে গেলে বা মন থেকে জপের মালা সড়ে গেলে, গুরুর ইচ্ছেতেই আবার জপ্ শুরু হয়ে যাবে।  মন্ত্র আর মন এক হয়ে যাবে।  এর জন্য কোনো প্রয়াস করতে হয় না। এইখানেই গুরুকরণের সার্থকতা। মন্ত্র  তো আমরা সবাই বই পড়ে শিখে নিতে পারি।  কিন্তু গুরুপ্রদত্ত মন্ত্র, গুরুকৃপায় সর্বক্ষণ স্পন্দিত হতে থাকে। আসলে গুরুদেবের আজ্ঞাচক্র সক্রিয়। আর সক্রিয় আজ্ঞাচক্র যখন কাউকে কোনো নির্দেশ দেয় তা সে মানতে বাধ্য। তাই সৎ গুরুর দেওয়া বীজমন্ত্র সব সময় শিষ্যের  মধ্যে স্পন্দিত হতে থাকে। কোনো প্রয়াশ ছাড়াই।  তাই গুরুমন্ত্র প্রকৃত  গুরুর কাছ থেকেই গ্রহণ করা উচিত। অন্যথা নিজের ইচ্ছা শক্তি জাগ্রত করতে হয়।  যা সবাই পারে না।

গুরুদেব  বলছেন : বৈজিক ভাষা উচ্চারনে ভাব বিনিময় যেরূপ সম্পূর্ণ হয়, অন্য কোনো ভাষায় তদ্রুপ হয় না। বৈজিক ভাষাই পূর্ণ ভাষা। বৈজিক ভাষা নিখিল ভাষার মাতা-পিতা। বৈজিক ভাষাই সার্বভৌম, ও সর্বজীবের ভাষা। একারনে, উন্নত মহাত্মারা এই অতি মহীয়সী ভাষায় যে সকল বীজ প্রদান করেন, তার উচ্চারণেই  অভিপ্রেত সিদ্ধি সম্পূর্ণ রূপে হয়ে থাকে। বীজ বিশেষের উচ্চারণে ভক্তি, একাগ্রতা বৃদ্ধিও হয়ে থাকে।

এখন এই বীজমন্ত্র উচ্চারণে আমাদের কি ভাবে উপকার হয়, সেই সম্পর্কে আলোচনা করবো।

গুরুদেব বলছেন :

মেরুদণ্ডের দুইদিকে ইড়া ও পিঙ্গলা নামে দুইটি নাড়ী আছে। এই ইড়ার দক্ষিণে ও পিঙ্গলার বামে অর্থাৎ ইড়া-পিঙ্গলার মাঝখানে সুষুম্না নাড়ী অবস্থান করছে। সুষুম্নার মধ্যে আবার বজ্রাখ্যা নাড়ী ও তার মধ্যে চিত্রিণী নাড়ী অবস্থান করছে। এর মধ্যে সাতটি স্থানে গ্রন্থি আছে।

 কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে  এসব জানলে কি আমরা  ভালো থাকতে পারবো ?

দেখো, ভালো যদি থাকতে চাও তো না জানাই ভালো। সহজ সরল মানুষ বড়ো ভালো থাকে।
কিন্তু আমরা  মোটেই সহজ সরল নই । সহজ সরল মানুষের মধ্যে কোনো প্রশ্ন জাগে না। তারা শুধু মেনে নেয়। তাই তারা ভালো থাকে। কোনো প্রশ্ন করে না। আমাদের  মধ্যে প্রশ্ন অনেক। আমরা  সমুদ্রের কিনারে দাঁড়িয়ে আছি । সমুদ্রের ঢেউ আমাদেরকে   অস্থির করেছে। 

মন ও মস্তিস্ক আমাদের দেহেরই অঙ্গ। মস্তিস্ক অসংখ্য স্নায়ুর বা গ্রন্থির  সমষ্টি। একটা খুলির  মধ্যে সুরক্ষিত প্রায় ১০০০০ মিলিয়ন অর্থাৎ ১০০০ কোটি নিউরোন নিয়ে গঠিত স্নায়ুতন্ত্রের স্ফীতকায় অংশটিকে বলে মস্তিস্ক। আমাদের মস্তিষ্কের ওজন প্রায় ১২০০ থেকে ১৪০০ গ্রাম।

আর মন হচ্ছে বিভিন্ন  গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত অন্তর্মুখী রসের সূক্ষ্যাংশ দ্বারা গঠিত।

আমরা আগেই জেনেছি, দেহ পঞ্চভূতের তৈরি। মন নিয়ে আলোচনার প্রারম্ভে আমাদের দেহতত্বটা একবার বুঝে নিতে হবে। কথায় বলে যা আছে ব্রম্ভান্ডে তাই আছে আমাদের দেহভান্ডে। দৃশ্যমান ব্রহ্মান্ড যেমন পঞ্চভূতের তৈরী, দেহও তেমনি পঞ্চভূতের তৈরি।

হঠযোগীরা বলছেন : "শরীরমাদ্যং খলু  ধর্মসাধনম্" . শরীরই সমস্ত সাধনার ভিত্তিভূমি। এই শরীর সুস্থ না থাকলে তোমার  দ্বারা কোনো সাধনাই  হবে না। তা সে সূক্ষ্ম জগতের সাধনা বলো  আর স্থুল জগতের সাধনাই  বলো । দেহটাই যন্ত্র।  আর দেহকে ধারণ করে আছেন আত্মা-রূপী যন্ত্রী। এই দেহই বলো, আর দেহে স্থিত মন, বুদ্ধি, অহংকার এগুলো আত্মার বিভূতি বা শক্তি। এই শক্তির খেলাই  চলছে নিরন্তর দেহ যন্ত্রের মধ্যে। দেহযন্ত্র ভালো বা শুদ্ধ থাকলে - এটা  হবে দেবভূমি।  আর দেহযন্ত্র যদি ত্রূটি যুক্ত হয় তবে তা  হবে অসুরভূমি। এখন তোমার দেহকে দেবভূমি বানাবে না অসুরভূমি বানাবে তা তোমার উপরে। দেখো তোমার যদি ঠিকমতো হজম না হয়, অর্থাৎ তোমার দেহের যকৃতের ক্রিয়া যদি ঠিক না থাকে তবে তোমার মেজাজ খিটখিটে হবে।  তোমার সেক্স-গ্লান্ড-(Sex gland)  বা পিতৃগ্রন্থি যদি ঠিক না থাকে তবে তুমি স্বার্থপর এবং কামুক হয়ে যাবে। তোমার থাইমাস (thymus ) বা মঙ্গলগ্রন্থি যদি ঠিক না থাকে তবে তুমি চোর-ডাকাত-বদমায়েশ হবে। শিবসতী গ্রন্থি  (Pituitary ) যদি ঠিক না থাকে তবে মানুষ ছোট মনের  মানুষ হয়। এরা কেবল পরের দোষ  দেখে বেড়ায়। এমনকি এরা ঘুষখোরও  হয়।

আসলে কোনো মানুষই খারাপ হয়ে জন্মায় না। সবার অন্তরে ভাগবত সত্ত্বা বিরাজ করছে। কিন্তু খাদ্যদোষে হোক আর প্রাকৃতিক কারণে হোক আমাদের শরীরে, রোগ বাসা বাঁধে। অর্থাৎ বিভিন্ন গ্রন্থির কাজ ঠিক ঠিক মতো হয় না। কোনো কোনো গ্রন্থি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। গ্রন্থির ক্রিয়া দোষযুক্ত হলে আমাদের মধ্যে কুচিন্তা ও কু-কাজ করবার প্রবৃত্তি জেগে ওঠে। তাই আমরা মানুষে মানুষে পার্থক্য দেখতে পাই। খেয়াল করবে, মাংসাশী প্রাণী প্রায়শঃ হিংস্র হয়। তৃণভোজী প্রাণী নিরীহ হয়। দেহ শুদ্ধ হলে মন শুদ্ধ হবে। মন যার শুদ্ধ সে সর্বদা আত্মাস্বরূপে অবস্থান করে।  আনন্দে থাকে। পরহিতে নিযুক্ত থাকে।

হঠযোগীরা বলছেন আমাদের শরীরের ইড়া-পিঙ্গলার উপরে আধিপত্য বিস্তার করতে পারলে চিরদিন যেমন ব্যাধিমুক্ত থাকা যায় তেমনি মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি। আত্মার আনন্দময় স্বরূপ, অনন্ত  স্বরূপ, আমরা আস্বাদন করতে পারি। এখন কথা হচ্ছে, এর সঙ্গে গুরুমন্ত্রের কি সম্পর্ক ?

মন্ত্র  হচ্ছে তরঙ্গ উৎপাদনের কারন। আমরা যখন শব্দ বলি বা ধ্বনির সৃষ্টি করি তা সে যে ভাবেই হোক, তা একটা বিশেষ তরঙ্গ সৃষ্টি করে। তরঙ্গই রূপ নেয়। যার জন্য বলা হয় সৃষ্টির আদি হচ্ছে প্রণব। প্রণব কথাটার মানে হচ্ছে নব নব রূপ পরিগ্রহ। আদি ধ্বনি ওঁম থেকেই সমস্ত সৃষ্টি। সাধনার একটু গভীরে করলে, আমরা বুঝতে পারবো : প্রণব আসলে অনাহত নাদ । প্রণবের কোনো অর্থ  নেই। সাধারনতঃ সমস্ত ধ্বনি সৃষ্টি হয় - হয় সংঘর্ষে নয়  আঘাতে। প্রণবের কোনো কারন নেই, কোনো আঘাতে বা সংঘর্ষে  এর সৃষ্টি হয় নাই। প্রণব সৃষ্টির আগে সমস্ত-ই ছিল এক। আঘাতে বা সংঘর্ষে দুই-এর প্রয়োজন। তাই প্রণবকে অনাহত নাদ বলা হয় । কাঁসর ঘন্টা, শঙ্খের  ধ্বনি ইত্যাদি প্রণব পুত।  তাই এই ধ্বনি শুভ, মঙ্গলময় ও সৃষ্টির আদি। এখন এই বিশেষ ধ্বনি যে তরঙ্গের সৃষ্টি করে তা আমাদের শরীরের বিভিন্ন চক্রে  আঘাত করে, এবং সেখানে স্পন্দন তোলে, তাকে চঞ্চল করে তোলে, এবং ক্রিয়াশীল করে তোলে। বিশেষ বিশেষ ধ্বনি আমাদের বিশেষ বিশেষ জায়গায় বা গ্রন্থিতে আলোড়ন তোলার  সক্রিয় ভূমিকা নেয়। আর ওই গ্রন্থি যখন ক্রিয়াশীল হয়ে যায়, তখনি আজব ব্যাপার সংগঠিত হয়। মানুষের চিন্তা ধারার পরিবর্তন হয়। বিচারাধারার পরিবর্তন হয়। কর্মধারার পরিবর্তন হয়। মানুষ পাশবিক প্রবৃত্তি ত্যাগ করে, দেবমানব হয়ে যায়। এইখানেই মন্ত্রের কারিকুরি। প্রতিনিয়ত যখন বীজমন্ত্র জপ্ করছো তখন তোমার  সমস্ত চক্র (১১৪) ক্রিয়াশীল হতে পারে। ১১৪টি চক্রের মধ্যে ১০৮টি চক্র ক্রিয়াশীল করা যায়। এই জন্য জপের মালায় ১০৮টি পুঁথি থাকে।  বাকি ছয়টি ক্রিয়াশীল হয় না। কিন্তু মাত্র ৭টি চক্র বা ১১টি স্পর্শকাতর জায়গায় আমরা যারা সাধারণ মানুষ, একটু চেষ্টা করলেই সেগুলিকে ক্রিয়াশীল করতে পারি। সেজন্য এই জায়গাগুলো সম্পর্কে আমাদের একটা ধারণা থাকা দরকার। প্রথমে এটি কল্পনা করে নিতে হয়। সাধনার সঙ্গে সঙ্গে এই সব জায়গায় মৃদু কম্পন অনুভূত হয়। তখন এর সঠিক অবস্থান জানা যায়। 

এই এগারোটি জায়গা হচ্ছে :

মূলাধার,(মেরুদণ্ডের শেষে গুহ্যদ্বারে) 
স্বাধিষ্ঠান, (লিঙ্গমূলে) 
মনিপুর,(নাভির ঠিক পিছনে ) 
অনাহত, (হৃদয়ের পিছনে ) 
বিশুদ্ধি, (কন্ঠার ঠিক পিছনে) 
আজ্ঞা, (মেরুদণ্ডে নয় - এটি ভ্রূযুগলের পিছনে নিম্ন মস্তিষ্কে) 
সহস্রার, (মস্তিষ্কের তালুতে) 
বিন্দু, (সহস্রারের ঠিক উপরে )
এ ছাড়া তিনটি স্পর্শকাতর জায়গা সম্পর্কে আমাদের ধারণা রাখা উচিত।  সেগুলো হল : 
ভ্রূযুগল মধ্যে,
নাসিকাগ্র ; 
এবং 
চিদাকাশ অর্থাৎ চোখ বুজলে যেখানে আমরা অন্ধকার দেখি । এগুলোর মধ্যে প্রথম ৭টির জন্য বিশেষ মন্ত্র  আছে। যেমন
মূলাধারের জন্য লং, ल्न्ग 
স্বাধিষ্ঠানের জন্য ৰং (ওয়াং), व्ङ्ग् 
মনিপুরের জন্য রং, र्ङ्ग् 
অনাহতের জন্য যং (ইয়ং), य्ङ्ग्  
বিশুদ্ধির জন্য হং, ह्ङ्ग्  
আজ্ঞাচক্রের জন্য ওঁং ॐ এবং 
সহস্রারের জন্য সোহং सोह्ङ्ग् । 

এই মন্ত্র  বা ধ্বনির  সাহায্যে এই চক্র বা গ্রন্থিগুলিকে ক্রিয়াশীল করা যায়।
গুরুদেব  বলছেন :
এই বীজগুলি বস্তুতঃ বাংলা অক্ষরে বা সংস্কৃত অক্ষরে লিখিত নহে। এগুলি বৈজিক ভাষার বর্ণমালা অনুসারে লিখিত। শুধু তাই নয়, এই ৭টি দলে বা গ্রন্থিতে যে আকার আছে অর্থাৎ যে আকৃতিতে ওই গ্রন্থি সকল আমাদের শরীরে অবস্থান করছে তা বৈজিক বর্নমালার আকার অনুসারেই হয়েছে। আর একটা গুহ্য কথা বলছেন গুরুদেব তা  হচ্ছে, নাড়ী সংযোগ উৎপন্ন  স্থল বা চক্র ৬৮ টির অধিক হলেও এর মধ্যে ৫০টি প্রধান।  আর তাই আমাদের বর্নমালার সংখ্যাও পঞ্চাশ। (অ আ ই ঈ উ ঊ ঋ এ ঐ ও ঔ - ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ ট ঠ ড ঢ ণ ত থ দ ধ ন প ফ ব ভ ম য র ল শ ষ স হ ড় ঢ় য় ৎ ং ঃ ঁ ক্ষ )  এখানে অবশ্য গুরুদেব বলছেন  "ক্ষ" যুক্তাক্ষর হলেও একে মূল বর্ণের মধ্যে বর্ণনা করা হয়েছে। 

কিন্তু কথা হচ্ছে এগুলো  ক্রিয়াশীল করলে কি হয় ?

আমরা জানি সমগ্র ব্রহ্মান্ড সাতটি  লোক বা স্তরে  বিভক্ত। এগুলো হচ্ছে : ভূ-লোক, ভুব-লোক, স্বঃ-লোক, মহঃ-লোক, জনঃ-লোক, তপঃ-লোক, এবং সত্যম বা  সত্য-লোক। আবার আমাদের শরীরের মধ্যেও সপ্ত ধাতু আছে যেমন : শুক্র, শোনিত, মজ্জা, মেদ, মাংস, অস্তি , ত্বক। এই দেহের এক একটা স্থান এক একটা লোকের কর্ম-কেন্দ্র। এই কর্মকেন্দ্রের নামই চক্র বা গ্রন্থি। এই গ্রন্থিগুলো বা এক একটা গ্রন্থি এক এক তত্ত্বের কর্মকেন্ত্র। তত্ত্ব অর্থাৎ পঞ্চতত্ত্ব - ক্ষিতি, অপ, তেজ. মরুৎ , ব্যোম। দেহের প্রধান প্রধান গ্রন্থি গুলির অন্তর্মুখী রস  নিঃসরণের ক্ষমতা আছে। এই অন্তর্মুখী রসই রক্তের সঙ্গে মিশে দেহের গঠন ও পালনপোষন করে। এমনকি মানসিক জীবন  বা মন গঠন করে। যার দেহে যে গ্রন্থির আধিপত্য বেশি বা যার দেহে যে গ্রন্থি অধিক ক্রিয়াশীল, তাকে সেই গ্রন্থিপ্রধান মানুষ বলা হয়।

যদিও সমস্ত গ্রন্থিই আলাদা আলাদা ভাবে সারা শরীরে ক্রিয়াশীল। তথাপি এক এক গ্রন্থির এক একটি প্রধান কার্যকেন্দ্র  আছে। এগুলো এই রকম :

কণ্ঠদেশ থেকে ললাটের মধ্যবর্তী অংশ   আকাশ তত্ত্বের কাজ করে। অর্থাৎ ব্যোম গ্রন্থি বলা যেতে পারে। এখানেই  ইন্দ্রগ্রন্থি ( THYROID) উপেন্দ্রগ্রন্থি (Para-Thyroid ), তালুগ্রন্থি (Tonsil ),  লালা গ্রন্থি (Salivary Glands ) ইত্যাদির কর্মক্ষেত্র   । এখান থেকেই যে অন্তর্মুখী রস  নিঃসৃত হয় আমাদেরকে সুস্থ থাকতে  সাহায্য করে।  এই গ্রন্থিগুলি  সুস্থ-সবল থাকলে - আমাদের স্নেহ, প্রীতি, ভালোবাসা, উচ্চ চিন্তা বা গভীর চিন্তা করার ক্ষমতা থাকে। আর গ্রন্থিগুলি  অতি সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলে আমাদের বিষাদ, উচ্চ চিন্তার ক্ষমতা হ্রাস, হতদ্যম, আলস্য, কর্মবিমুখতা প্রভৃতি দেখা দেয়। ব্যোম তত্ত্বে সত্ত্বগুণের আধিপত্য। 

এখানে একটা কথা বলা প্রয়জন :: এই অন্তর্মুখী রস, অর্থাৎ প্রত্যেক চক্র বা গ্রন্থি  থেকে নিঃসৃত অন্তর্মুখী রসের সুক্ষ অংশ থেকে মন গঠিত হয়। এই কথাটা আর একবার একটু খেয়াল করো - গ্রন্থি বা  চক্র থেকে  নির্গত অন্তর্মুখী রস আমাদের মনের গঠন করে।

এর পরে আসছে বক্ষ প্রদেশ।  এটি বায়ুতত্বের প্রধান কর্মকেন্দ্র। এখানে দুটো ফুসফুস, হৃদযন্ত্র, মঙ্গলগ্রন্থি (thymus ) এবং প্রাণকোষ নির্মাণকারী গ্রন্থি এবং অনেকগুলো উপগ্রন্থি এই বায়ু গ্রন্থির অন্তর্গত। বায়ুই দেহের প্রধান রক্ষক ও পরিচালক।

এই বায়ু গ্রন্থি ও তার তার অন্তর্গত গ্রন্থিগুলি সুস্থ-সবল থাকলে একদিকে যেমন দেহ সুস্থ থাকে তেমনি এই গ্রন্থিই মানুষকে ধীর-স্থির, শুদ্ধ-শান্ত, শ্রদ্ধাশীল, ও মহাকর্মী করে । বায়ু ঠিকমতো কাজ না করলে মানুষ অস্থিরমতি, অকৃতজ্ঞ, কৃতঘ্ন হয়।

এর পরে আসছে মধ্যপ্রদেশ অর্থাৎ পেট। এটি অগ্নিগ্রন্থির  অন্তর্গত। এখানে কি আছে এক বার দেখে নেই। প্লীহা,(Spleen ) যকৃৎ(liver ) অগ্ন্যাশয় (Pancreas ) শুক্রগ্রন্থি (Adrenal Gland )  প্রভৃতি গ্রন্থি অগ্নিগ্রন্থির প্রধান কর্মক্ষেত্র। অগ্নিগ্রন্থিই শরীরে তাপ প্রদান করে। প্রাণকে সঞ্জীবিত রাখে। এই অগ্নিগ্রন্থি থেকে যে রস  নিঃসৃত হয় তা Nitric Acid , Hydrochloric Acid, Sulphuric Acid প্রভৃতি দাহিকাশক্তি সম্পন্ন উপাদানের সমাহার। এই অগ্নিরসই পাচকরস, পিত্তরস, অম্লরস। এই অগ্নিরস অন্নকে দগ্ধ করে, রসরক্তে পরিণত করে। দেহের মাংস মেদ অস্থি প্রভৃতি গঠনে সহায়তা করে।

এই অগ্নিপ্রধান লোকেরাই হয় মহাতেজস্বী, উদ্দমী। নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা থাকে এঁদের। আর এই গ্রন্থি যদি ঠিক ঠিক মতো কাজ না করে তবে তারা হয় কামুক, ঝগড়ুটে, দাম্ভিক, অহংকারী, উগ্র, অস্থির, অসহিষ্ণু।

এর পরে আসছে নিম্নাঙ্গ। অর্থাৎ মূত্রগ্রন্থি,(kidney ), প্রজাপতি গ্রন্থি বা পিতৃগ্রন্থি (Testis ) কন্দর্প-গ্রন্থি (Prostate gland ), মদনগ্রন্থি (cowpers Gland ), মাতৃ গ্রন্থি (Ovary ) রতি গ্রন্থি,(Bartholins gland)  মিথুন  গ্রন্থি (Skenes gland ) . এগুলো সবই  বরুন গ্রন্থির অন্তর্গত। এই বরুণগ্রন্থির নিঃসৃত অন্তর্মুখী রসে সন্তান বীজ বা শুক্রকীট উৎপন্ন হয় ও সৃষ্টিধারাকে অব্যাহত রাখে। এই শুক্র হতেই দেহের সমস্ত উপাদান অর্থাৎ স্নায়ু, তন্তু  কোষ, মাংস, মজ্জা, অস্থি সমস্তই গড়ে ওঠে। বরুণগ্রন্থি হতে নিঃসৃত রসকে বলা হয় সোমরস।

বরুন-গ্রন্থি  প্রধান লোকেরা খুব সহৃদয় হয়। এদের মিষ্টি ব্যবহার, মিষ্টি কথা মানুষকে আকর্ষণ করে। এরা বৈষয়িক প্রতিষ্ঠা পায়। বরুণগ্রন্থি  ঠিক ঠিক মতো কাজ না করলে মানুষ স্বার্থপর, পরশ্রীকাতর, ক্রোধী ও কামুক হয়।

পৃথ্বি গ্রন্থি অস্থি ও মাংস উপাদানের কারন ক্ষেত্র। পৃথ্বি গ্রন্থির শক্তি ও তার প্রকাশ সুপ্ত।

পৃথ্বি গ্রন্থিপ্রধান লোকেরা স্থুলদেহী হয়।  স্বভাব হয় উদার,ও সহিষ্ণু। এরা  সাধারণত ঝামেলা এড়িয়ে চলে। এই গ্রন্থির অসামাঞ্জস্যে মানুষ হয় ভোগী স্বার্থপর।

আধুনিক বিজ্ঞান  বলছে  : স্নায়ুতন্ত্র বা nurvas system আমাদের বাহির জগৎ ও অন্তর্জগতের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে।   এই স্নায়ুতন্ত্র গঠিত হয় স্নায়ু তন্তু অর্থাৎ সুতো বা fibre-এর   মতো একপ্রকার পদার্থ দিয়ে। তন্তু গুলো বিভিন্ন আকারের হয়। সরু, মাঝারি, পাতলা। কর্ম অনুসারে এরা  তিন ধরনের হয়।  প্রথম গ্রাহক বা receptor, দুই প্রেরক বা বাহক conductor (Neurone ) এবং তিন কারক বা effector . এই তিন রকম কাজের সাহায্যে স্নায়ুতন্ত্র আমাদের অন্তর্জগৎ ও বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে।

আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি  অর্থাৎ চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিব্বা, ত্বক, এই  পাঁচটি ইন্দ্রিয় এবং দেহের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত গ্রাহক কোষগুলি বাইরের জগতের উদ্দীপনা বা ভৌত বা রাসায়নিক পরিবর্তন গ্রহণ করে। এইবার গৃহীত উদ্দীপনা সংবেদ স্নায়ু বা বাহক স্নায়ুর মাধ্যমে স্নায়ুকেন্ত্র অর্থাৎ মস্তিস্ক বা সুষুম্নাকাণ্ডে পাঠিয়ে দেয়।

এইবার মস্তিস্ক বা সুষুম্নাকাণ্ড অর্থাৎ স্নায়ু কেন্দ্র এই উদ্দীপনার বিশ্লেষণ করে এবং ক্রিয়া স্থান বা কারকে অর্থাৎ effective organ- এ বাহকের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়। 

এইবার স্নায়ু কেন্দ্র থেকে গৃহীত আদেশ অনুসারে ক্রিয়াস্থান বা কারকে কার্য সম্পাদিত হয়।

অতএব আমাদের কাছে একটা জিনিস পরিষ্কার : মস্তিস্ক হচ্ছে স্নায়ু কেন্দ্র।  এবং এখানেই সুষুম্না অর্থাৎ স্নায়ুতন্ত্রের প্রধান কর্মক্ষেত্র , এবং  এখান থেকেই বাহক তন্তুর সাহায্যে  সমস্ত নির্দেশ পাঠাচ্ছে এবং সেই মত আমরা কাজ করছি বা আমাদের কার্য সম্পাদিত হচ্ছে।

আধুনিক বিজ্ঞান বলছে,  সুষুম্নাকাণ্ডের উভয়পার্শ্বে বিভিন্ন স্থান থেকে একাধিক স্নায়ু নির্গত হয়ে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। এগুলো সবই জোড়া জোড়া। সাধারনতঃ এর মধ্যে একটি গ্রাহক অন্যটি বাহক হিসেবে কাজ করে। এই রকম ৩১ জোড়া স্নায়ু সুষুম্না থেকে নির্গত হয়েছে। 
এই যে ৩১ জোড়া স্নায়ু এর মধ্যে আট জোড়া স্নায়ু  গ্রীবা (survical ) থেকে অর্থাৎ কন্ঠের পিছনে অবস্থিত সুষুম্না নারি  থেকে নির্গত হয়েছে।  যাকে মুনি ঋষিরা বলছেন বিশুদ্ধ চক্র। 
বারো জোড়া স্নায়ু  বক্ষ (Thoractic) থেকে অর্থাৎ বুকের পিছনের সুষুম্না নারি থেকে বের হয়েছে।  যাকে ঋষিরা বলছেন অনাহত চক্র। 
পাঁচ জোড়া স্নায়ু কটিদেশ (Lumber)  বা নাভির বিপরীতে সুষুম্না নারি থেকে নির্গত হয়েছে।
যাকে সাধকরা বলছেন মনিপুর চক্র। 
আরো পাঁচজোড়া স্নায়ু নির্গত হয়েছে শ্রোণীদেশ (Sacral ) বা লিঙ্গমূল থেকে। যাকে  সাধকরা বলছেন স্বাধিষ্ঠান চক্র। 
আর একজোড়া স্নায়ু নির্গত হয়েছে পুচ্ছদেশ (Coceygeal) যাকে  ঋষিরা বলেছেন মূলাধার। 

ভাবতে অবাক লাগে, হাজার হাজার বছরের পুরাতন ঋষিবিদ্যা কতটা বৈজ্ঞনিক সত্য ছিল।  আগে এগুলো নাকি কেউ পাশ্চাত্য প্রদেশে  জ্ঞাত ছিল  না।         

অহং গ্রন্থি বা অহং তত্ত্বের স্থান ললাট বা আমাদের কপাল।  এই অহং গ্রন্থি আমাদের সমস্ত গ্রন্থির অর্থাৎ পঞ্চগ্রন্থির (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম)  কর্তৃত্ব করে। আমাদের দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, চিন্তাশক্তি, বিচারশক্তি, স্মৃতিশক্তি, সমস্ত কিছুই অর্থাৎ পঞ্চইন্দ্রিয়শক্তির  (চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিব্বা, ত্বক) কর্ম পরিচালনা হয় এই অহং গ্রন্থি থেকে। এদের দোষ, ত্রূটি, দুর্বলতা সবই  যথাসাধ্য সংশোধন করে এই অহংগ্রন্থি।

এই অহংগ্রন্থি প্রধান লোকের ভিতর থেকেই বেরিয়ে আসে উচ্চ প্রতিভা, সাধু-মহাত্মা।  এই অহংগ্রন্থি ক্রিয়াশীল না থাকলে দেখা দেয় হৃদয়হীনতা, নিচটা, দুস্টু বুদ্ধি।

মহৎগ্রন্থি আমাদের ললাটের উপরে। অর্থাৎ অহংগ্রন্থির কিঞ্চিৎ উপরে অবস্থিত। এরই মধ্যে আছে সোমগ্রন্থি, দেবক্ষগ্রন্থি (Pineal Gland ), রুদ্র গ্রন্থি, সহস্রার গ্রন্থি  প্রভৃতি। এই মহৎ গ্রন্থির অন্তর্মুখী রসের নাম সোমধারা। এই সোমধারাই মাথা থেকে নেমে  দেহের সমস্ত গ্রন্থিকে, সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রকে সুস্থ-সবল ও প্রাণবন্ত রাখতে সাহায্য করে।

এই মহৎ গ্রন্থি প্রধান লোকই মহাপুরুষ, অবতার রূপে পূজিত হন। পৃথিবীতে এঁরাই নরোত্তম। ভগবৎ প্রাপ্তির অপার্থিব অনাবিল আনন্দ এঁরাই আস্বাদন করেন।

মহৎগ্রন্থির ঠিক উপরে আছে ব্রহ্মরন্ধ্র, যা আমাদের দেহাকাশ ও দিব্যাকাশকে  যুক্ত রেখেছে। এই ব্রহ্ম বা সহস্রার প্রদেশেই চেতনার অনন্ত পারাবার, এই প্রদেশই  গুণাতীত ভূমি। একেই কেউ বলে কৈলাস, কেউ বলে পরমশিব ও পরমাশক্তির অধিষ্ঠান ভূমি।

গ্রন্থিকথা এবার শেষ করবো। এই গ্রন্থিস্রাব বা গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত লালা আমাদের জীবন, আমাদের ব্যক্তিত্ব, আমাদের মন, আমাদের স্বভাব নিয়ন্ত্রন করছে । জানিনা সম্পূর্ণরূপে এর নিয়ন্ত্রণ করা যায় কি না। তবে এটা  ঠিক এই  ব্রহ্মান্ড বায়ু, অগ্নি, ও বরুন  দ্বারা লালিত হচ্ছেন, তেমনি এঁরা  কুপিত হলে, সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাদের দেহে অবস্থিত এই বায়ু অর্থাৎ প্রাণক্রিয়া, অগ্নি অর্থাৎ দেহের তাপ  রক্ষাকারী   ও জল অর্থাৎ রস রক্ত ইত্যাদির দ্বারা  এই  দেহের পালন হচ্ছে, দেহের পুষ্টি সাধন হচ্ছে। এই তিন দেবতার প্রকোপেই দেহ অসুস্থ হয়, আমাদের মৃত্যু ঘটে।

প্রসঙ্গত বলি : ভূত তো পাঁচটি। তবে তিনটি ভূতের কথা হচ্ছে  কেন  ? আসলে  অতিসূক্ষ্ম আকাশভূতের ক্রিয়া আমাদের ইন্দ্রিয় গোচর হয় না। আবার পৃথিবীতে বা মাটিতে জড়ত্বের ভাব বেশি। তাই শক্তির প্রকাশ নেই। অর্থাৎ শক্তির প্রকাশ আছে বায়ু, অগ্নি ও জলে। তাই   বায়ু  আকাশের মতো অতিসূক্ষ্ম না হলেও সূক্ষ্ম।  বায়ুকে আমরা চোখে দেখিনা বটে কিন্তু বায়ুর স্পর্শ আমরা অনুভব করতে পারি। তেজ বা অগ্নি বায়ুর মতো সূক্ষ্ম নয় আবার জল বা মাটির মতো স্থুলও নয়। আকাশের বিদ্যুৎ, আলো, জ্যোতি ইত্যাদি অগ্নির রূপ আমাদের চোখে পড়ে । সুতরাং অগ্নি স্থুল  ও সূক্ষ্মের মাঝামাঝি। জল আবার পৃথিবীর মতো বা মাটির মতো স্থুল  না হলেও অর্ধস্থুল।  আবার মাঝে মাঝে বরফের আকার নিয়ে স্থুলে পরিণত হয়।  অর্থাৎ শক্তির প্রকাশ আছে বায়ু, অগ্নি ও জলে। তাই আমাদের দেহে ত্রিশক্তির আধিপত্য। আকাশ ও মৃত্তিকা ম্রিয়মান হয়ে আছে আমাদের শরীরে। 

এসো,  আমরা এই তিন দেবতাকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য জপে প্রবৃত্ত হই। ধ্বনির সাধনায় লিপ্ত হই।  এই বায়ু, অগ্নি, জল - দেবতার সৃষ্টির কারন  সেই প্রণবের সাহায্য নেই। এবার আবার জপের কথায় আসি।

জপে যাবার আগে একবার মনটাকে  বুঝে নেই। আমরা অনেকেই জানি মন ত্রিস্তরীয় : চেতন - অবচেতন - অতিচেতন। হঠযোগীরা বলেন : দেহ শুদ্ধ হলেই মন শুদ্ধ হবে। এবং একমাত্র শুদ্ধ মনই আত্মউপলব্ধি করতে পারে। তো যার দ্বারা আত্মউপলব্ধি হবে তাকে একটু বুঝে নেই।

এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি :  এটি কোনো এক কবিগানের আসরে আমি শুনেছিলাম। ছেলে বলছে আমি কাঁঠাল খাবো। বাবা বাজার থেকে কাঁঠাল কিনে এনেছে। বাবা ছেলেকে কাঁঠালের পরিচয় দিচ্ছে। এই যে উপরের কাঁটা কাঁটা আস্তরণ দেখছিস  এঁকে বলে ছোবড়া। আস্তরণ ছাড়ালে কোয়া, কোয়ার ভিতরে আঁটি, আর এইযে কোয়ার বাইরে যে দেখছিস এটাকে বলা হয় ভুচরো।  আর ভেতরে মুগুরের মতো দেখছিস এটাকে বলে মোথা। তো ছেলে বলছে তবে  বাবা কাঁঠাল কোথায়  ?

তো মনকে খুঁজলে, দেহের মধ্যে কোথাও পাওয়া যাবে না। তবু আমাদের মনকে জানতে হবে।

যারা বিজ্ঞানের ছাত্র তারা জানে -  মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের কাজ কে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। একটা হচ্ছে সুষুম্না কান্ডীয় (Spinal Cord  Level ) , দ্বিতীয়টা হচ্ছে নিম্নতর মস্তিস্ক স্তর (Lower Brain Level) উচ্চতর মস্তিস্ক স্তর  (Upper Brain Level )

এই উচ্চতর মস্তিস্ক আমাদের মাথার সবচেয়ে বা আমাদের দেহের সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ন অংশ। আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার সংগ্রহশালা হিসাবে কাজ করে। অতীতের অভিজ্ঞতার অধিকাংশ স্মৃতিই এখানে সঞ্চিত থাকে। এছাড়া আমাদের শরীরের যে প্রতিক্রিয়া হয় অর্থাৎ যাকে  আমরা চেতন মনের কাজ বলি, তার খবর এখানে সঞ্চিত থাকে। এবং নিজের ইচ্ছায় সে খাবরাখবরকে কাজে লাগিয়ে দেহের চেষ্টীয় প্রতিক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ করে।

নিম্নতর মস্তিস্ক দ্বারা দেহের অধিকাংশ অবচেতন কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। রক্তচাপ,শ্বাসক্রিয়া, ক্রোধ, উত্তেজনা, যৌনক্রিয়াকলাপ, যন্ত্রনা, আত্মতুষ্টি, এগুলো সবই নিম্নতর মস্তিষ্কের কাজ।  অতএব আমরা যাকে অবচেতন মনের কাজ বলি তা এই নিম্নতর মস্তিস্ক করে থাকে।

দেহের ইন্দ্রিয়সকল দ্বারা গৃহীত সমস্ত সংবাদ বা উদ্দীপনা সুষুম্নাকাণ্ডে প্রেরণ করা হয়।  এবং সুষুম্নাকাণ্ড এই সংবাদের ভিত্তিতে সুষুম্না কাণ্ডের উদ্ভাবনী প্রতিক্রিয়ার উদ্ভব হয়। এটা স্বয়ংক্রিয় এবং সংজ্ঞাবহ সংকেত সুষুম্নাকাণ্ডে যাবার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায়। এটাই অতিচেতন মনের কাজ বলতে আমরা যা বুঝি তাই।

মন কোনো আলাদা বস্তূ  বা স্নায়ু নয়। বিভিন্ন স্নায়ুর ক্রিয়াকে আমরা মনের ক্রিয়া বলি। মন বলে কিছু নেই সবই স্নায়ুর খেলা।  আমাদের এই স্নায়ুর কেন্দ্রে যেতে হবে।  স্নায়ু যেখান থেকে  শুরু হয়েছে সেটা মস্তিস্ক। আর স্নায়ুর অবতরণ ক্ষেত্রে হচ্ছে সুষুম্না কাণ্ড। তাই সুষুম্না নাড়িকেই আমাদের আশ্রয় করতে হবে যদি আমরা আত্মউপলব্দ্ধি করতে চাই। এই স্নায়ুকেন্দ্রে প্রতিফলিত হবে আমাদের অধরা ঈশ্বর।আমাদের চেতন স্বরূপ।

যদি ভালো থাকতে চাও তবে সব ছেড়ে গুরুমন্ত্র জপ্ করতে থাকো।

আপনাদের বলি  যদি গুরুপ্রদত্ত মন্ত্র না পেয়ে থাকেন তবে পরম-পিতার  যে কোনো নামের আগে/পরে  ওঁং জুড়ে জপতে থাকুন । আপনি  মহাসুখী থাকবেন । ভালো থাকবেন। আর আপনার যা কিছু দরকার, সব জগদীশ্বরের কাছে চান। মানুষ তো ভিখারী।  ভিখারীর কাছে কিছু চাইতে যাবেন না। পরম পিতা পরম-ঈশ্বরের কাছে চান। ঈশ্বরের অসীম ক্ষমতা, অসীম সম্পদ। অনন্ত অনন্ত অনন্ত করুনাময় ঈশ্বর আপনার সহায়। আপনি তার কাছে বসুন। তার কাছেই প্রার্থনা করুন। আপনি সর্বসুখী হবেন।, কি পার্থিব, কি অপার্থিব সব সম্পদের অধিকারী একমাত্র ঈশ্বর। আপনি তাঁকেই ধরে থাকুন। 

ওম শান্তি ওম শান্তি ওম শান্তিঃ।