আত্মার সন্ধানে - জ্যোতি ব্রাহ্মণ (চতুর্থ অধ্যায় তৃতীয় পর্ব) অনুসরণে
আত্মজ্যোতি দর্শন।
আপনাদের যাদের একটু আধটু ধ্যানাদি করবার অভ্যাস আছে, তারা লক্ষ করেছেন, ধ্যানের সময়ে আমরা চিদাকাশে একটা জ্যোতির আভাস দেখতে পাই। স্বামী বিবেকানন্দ চোখ বুজলেই বা ঘুমুতে গেলেও এই জ্যোতির দর্শন পেতেন। এই জ্যোতির প্রকৃত স্বরূপ কি ? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজবো আমরা বৃহদারণ্যক উপনিষৎ থেকে। আমরা উপনিষদের গল্পে শুনেছি, দেবতাগণ যখন বিজয়উল্লাসে মেতে ছিলেন, যখন নিজেদেরকে সর্বশক্তিমান মনে করে, অহমিকায় মত্ত হয়েছিলেন, তখন তারা এক জ্যোতির দর্শন করেছিলেন। এই স্বয়ংজ্যোতি তাদেরকে শক্তি পরীক্ষায় পরাস্থ করে, অন্তর্দ্ধান করেছিলেন। কে এই জ্যোতির্ময় সত্ত্বা ?
পুরাকালে বৈদেহ জনক নামক এক রাজা ছিলেন। তিনি ব্রহ্মজ্ঞান পিপাসু ছিলেন। তার আমলে ঋষি যাজ্ঞবল্ক নামে এক মহামুনি ছিলেন। তিনি ব্রহ্মজ্ঞানী ছিলেন। তো ঋষি যাজ্ঞবল্ক বৈদেহ জনককে ব্রহ্মজিজ্ঞাসু দেখে, তাকে বলেছিলেন, তুমি ব্রহ্ম সম্মন্ধীয় যাকিছু প্রশ্ন করবে, আমি তার জবাব দেবো। তুমি নির্দ্বিধায় তোমার মনের সমস্ত প্রশ্ন আমাকে করতে পারবে।
তো একদিন রাজা জনকের দরবারে, যাজ্ঞবল্কের উপস্থিতি দেখে, তাকে সমাদর করে, যথাবিহিত সম্মানিত করে, তাকে প্রশ্ন করলেন। হে মহামুনি, কোনো শক্তি আমাদের ক্রিয়াদির সহায়ক হয় ? আমরা কোন শক্তিবলে সমস্ত কার্যাদি করতে পারি। কোন জ্যোতি পুরুষের সমস্ত কার্য্যের সহায়ক হয় ?
যাজ্ঞবল্ক রাজাকে যথাযথ সন্মান প্রদর্শন করে বললেন, হে সম্রাট এই শক্তি হচ্ছে আদিত্যজ্যোতি। মানুষের সমস্ত ক্রিয়াশক্তি এই আদিত্যজ্যোতির সাহায্যে প্রাপ্ত হয়ে থাকে। মানুষ এই সূর্যালোকের সাহায্যেই গমনাগমন শক্তি প্রাপ্ত হয়ে থাকে। সমস্ত কার্য করবার শক্তি এই সূর্যালোকের সাহায্যেই সে প্রাপ্ত হয়ে থাকে। তাই প্রত্যেক মানুষ সূর্য-উদয়ের মুহূর্ত থেকে কর্ম্মে উদ্দীপ্ত হয়। আবার সূর্য-অস্ত গেলে, সে স্তিমিত হয়ে থাকে। ন্যুইস্টেজ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
জনক : কিন্তু কিছু মানুষ এমনকি কিছু জীবজন্তু রাতেও সক্রিয় থাকে, তখন কে তাকে সাহায্য করে থাকে ?
যাজ্ঞবল্ক : সূর্য অস্তাচলে গেলে, চন্দ্র এই কাজ করে থাকে। কারন, সূর্য্যের জ্যোতি চন্দ্রের উপরে প্রতিফলিত হয়ে সে তখন সূর্য্যের মহিমা প্রাপ্ত হয়। আর এই চন্দ্রালোকের সাহায্যে জীব বা মনুষ্য বিভিন্ন ক্রিয়াদি সম্পন্ন করে থাকে।
জনক : কিন্তু অমাবস্যা রাতে চন্দ্র থাকে না। তখন কিভাবে কার সাহায্যে মানুষ কার্য করতে সক্ষম হয় ?
যাজ্ঞবল্ক : সূর্য অস্তমিত হলে, চন্দ্রিমা অস্তমিত হলে, অগ্নিই এর জ্যোতি হয়। তখন অগ্নিপ্রভার সাহায্যে মানুষ সমস্ত কর্ম্ম করে থাকে।
জনক : সূর্য ও চন্দ্র অস্তমিত হলে, এমনকি অগ্নি নির্বাপিত হলে, কোন জ্যোতি মানুষের সহায়ক হয় ?
যাজ্ঞবল্ক : শব্দই তখন জ্যোতি স্বরূপ হয়। মানুষ তখন শব্দের সাহায্যে বসে, চলে, কর্ম্ম করে, আবার ফিরে আসে। এইজন্য মানুষ যখন নিজের হাত পর্যন্ত ভালোকরে দেখতে পায় না, তখন যেখানে শব্দ হয়, সেখানে সে উপস্থিত হতে পারে।
জনক : শব্দও যদি নিরুদ্ধ হয়, তখন কোন জ্যোতি মানুষের সহায়ক হয় ?
যাজ্ঞবল্ক : তখন আত্মাই এর জ্যোতি হিসেবে কাজ করে থাকে। আত্মজ্যোতি-সহায়ে মানুষ তখন বসে, চলে, কর্ম্ম করে, আবার ফিরে আসে।
মন্তব্য : এই পর্যন্ত যা আলোচনা হলো, তাকে আমরা বুঝতে পারলাম, সমস্ত লোকব্যবহার আলোক সাপেক্ষ। সুতরাং আমরা অনুমান করতে পারি, যে যেখান আমাদের দেহাদি কর্ম্ম আছে, সেখানে আলোকের সহযোগিতা দরকার, এমনকি যেখানে মনের কার্য্য আছে, সেখানেও আলোক অবশ্যই আছে। কিন্তু আমরা জানি, মানুষ কর্ম্ম সম্পাদন করে থাকে তার দেহ-ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে। কিন্তু ঋষি যাজ্ঞবল্ক বলছেন, এই দেহ-ইন্দ্রিয় যা কিছু করে থাকে, তার জন্য আলোকশক্তির প্রয়োজন। আর একটা গভীর তত্ত্ব হচ্ছে, দেহ-ইন্দ্রিয় আমাদের জাগ্রত অবস্থায় কার্য সম্পাদন করে থাকে। কিন্তু প্রত্যেক মানুষের বা জীবের এই জাগ্রত অবস্থা বাদেও আমাদের এমন ব্যবহার স্থল বা অবস্থা আছে, যেখানে আপাতত কোনো আলোক নেই। যেমন স্বপ্নাবস্থা, বা সুসুপ্তির অবস্থা। সেখানে কি আদৌ কোনো আলো আছে ?
ঋষি যাজ্ঞবল্ক প্রথমে আমাদের জাগরণ-কালীন ক্রিয়া সম্পাদনের জন্য দেহ-ইন্দ্রিয় ছাড়াও যে একটা আলোক যা আমাদের ক্রিয়া সম্পাদন করে থাকে তার কথা বললেন, অর্থাৎ দিন, রাত্রি, ও অগ্নির কথা বললেন, এবং শেষে শব্দ-রূপ আলোর কথা বললেন, তাহলে কি আমরা ধরে নেবো, যে স্বপ্নাবস্থায় আমরা যে কার্য্য করে থাকি, সেখানেও তেমনি কোনো আলোর সাহায্য আমরা পেয়ে থাকি ? জাগরনে আমরা বাহ্যজ্যোতির সাহায্য পেতে পারি, কিন্তু স্বপ্নে বা সুসুপ্তিতে এই বাহ্যজ্যোতির সাহায্য পাওয়া সম্ভব নয়। অথচ এই স্বপ্নাবস্থাতেও আমরা বিভিন্ন ক্রিয়া সম্পাদন করে থাকি। আবার সুসুপ্তিতে আমাদের সুখের নিদ্রা হয়ে থাকে। সুতরাং এই অবস্থাতেও নিশ্চই কোনো জ্যোতি সাহায্য করে থাকে বা সাক্ষী হিসেবে থাকে। তিনি কে ? আমরা ধ্যান করবার সময়ও বিভিন্ন দৃশ্য দেখে থাকি। এখানেও কি কোনো জ্যোতি বর্তমান থাকে ?
ঋষি যাজ্ঞবল্ক বলছেন, এই জ্যোতিই অন্তর-জ্যোতি। এই জ্যোতি আমাদের দেহ, ইন্দ্রিয় এমনকি অন্তঃকরণ থেকেও ভিন্ন অথচ আরোপিত দীপ্তি অর্থাৎ অবভাসক। ঋষি যাজ্ঞবল্ক বলছেন, আত্মাই এই অন্তর-জ্যোতি। এই অন্তর-জ্যোতি দেহ, ইন্দ্রিয় ও আমাদের অন্তঃকরণ হতে ভিন্ন। এই জ্যোতি স্বয়ং কারুর দ্বারা অবভাসিত হন না। আমাদের সমস্ত বাহ্য কর্ম্ম বস্তুত এই অন্তর-জ্যোতির দ্বারাই সম্পাদিত হয়ে থাকে। আমাদের কাছে সাধনার প্রথম দিকে এই গূঢ় তত্ত্ব একটা ধারণা মাত্র। কিন্তু তত্ত্বজ্ঞ পুরুষের কাছে, জ্ঞানের বিষয়। এই জ্ঞানের অন্নেষন ক্রিয়াই সাধনা।
এখন রাজা জনক প্রশ্ন করছেন, আত্মা কোনটি ?
ঋষি যাজ্ঞবল্ক বলছেন, যিনি আমাদের বুদ্ধিতে উপস্থিত তিনি আত্মা ! ইন্দ্রিয়ে যিনি উপস্থিত তিনি আত্মা !
রাজা জনক প্রশ্ন করছেন, বুদ্ধির অভ্যন্তরস্থ জ্যোতিঃপুরুষই আত্মা! সূর্য সমজাতীয় বস্তুকে প্রকাশ করেন, আবার ইন্দ্রিয় সমজাতীয় ইন্দ্রিয়গুলোকে উদ্ভাসিত করেন। আবার সকল ইন্দ্রিয় জ্ঞান আহরণ করছে, কিন্তু এর মধ্যে সত্যিকারের আত্মা কোনটি ?
যাজ্ঞবল্ক বলছেন, বুদ্ধিতে আরোপিত আত্মা বুদ্ধিস্বরূপ মনে হয়। কিন্তু সত্য হচ্ছে, বুদ্ধি, প্রাণ, মন, ও ইন্দ্রিয়গুলোকে যিনি চেতনপ্রায় করে তোলেন তিনিই আত্মা।
শিষ্য :হে গুরুদেব মানুষ মৃত্যুর পরে কোন লোক প্রাপ্ত হয় ?
গুরুদেব : প্রত্যেকটি মানুষ মৃত্যুর পরে ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হয়।
শিষ্য : ব্রহ্মলোকে তো ব্রহ্মা থাকেন। তো আমরা কিভাবে সেখানে স্থান পাবো। শুনেছি, মহাভাগ্যবান, এই ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হয়ে থাকেন।
গুরুদেব : তুমিও ব্রহ্ম। আর তুমি ব্রহ্মলোকেই বিরাজ করছো। কিন্তু তা তুমি জান না। অজ্ঞান বশত, অবিদ্যা বশত নিজেকে মর্তলোকের বাসিন্দা ভাবছো। আসলে মর্তলোকে হচ্ছে সেই লোক, যেখানে এলেই মৃত্যুবরণ করতে হয়। প্রতিনিয়ত যেখানে মৃত্যু হচ্ছে সেটাই মৃত্যু লোক। এখানে সবকিছু পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনশীল ক্রিয়ার সাহায্যে যখন কোনো বস্তু আমাদের দৃষ্টিগোচর থাকে না, তখন তাকে আমরা মৃত্যু বলে থাকি। দেখো এ সবই জ্যোতির খেলা। তুমি নিজেও জ্যোতির্বিন্দু বই বেশি কিছু নও।
শিষ্য : সে কিরকম ?
গুরুদেব : এই জগৎ ততক্ষনই আমাদের কাছে দৃশ্যমান, যতক্ষন জ্যোতি আছে। জ্যোতিই সমস্ত কিছুকে চলমান করে রাখে। সৌর জগতে সূর্যই এই জ্যোতির উৎস। সূর্য যখন অস্তাচলে চলে যায়, তখন চন্দ্রজ্যোতি জগৎকে দৃশ্যমান করে থাকে। অমাবস্যা রাতে অগ্নি জগৎকে দৃশ্যমান করে থাকে। আবার দেখো, যখন সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি নির্বাবিত হয়, তখন শব্দ জ্যোতি এই জগৎকে দৃশ্যমান করে রাখে। আবার শব্দজ্যোতি যখন বিলোপ প্রাপ্ত হয়, তখন আত্মাই জ্যোতি রূপে প্রতিভাত হয়। আর এই আত্মজ্যোতি প্রভাবে জগৎ দৃশ্যমান থাকে। অর্থাৎ সবই আলোক সাপেক্ষে বর্তমান থাকে।
শিষ্য : আত্মা কি ?
গুরুদেব : তোমার বুদ্ধিতে যা উপস্থিত তাই আত্মা। তোমার বুদ্ধিতে কি উপস্থিত ? জ্ঞান। আর এই জ্ঞান তুমি তোমার পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে পেয়ে থাকো। আর এই জ্ঞান যখন তোমার লোপ পেয়ে যায়, তখন আর তুমি তোমার "আমি"-কে বুঝতে জানতে বা উপল্বদ্ধিতে আনতে পারো না। আসলে বুদ্ধিতে উপস্থিত থাকে আত্মজ্যোতি। এই জ্যোতিই আত্মা, জ্যোতিই ব্রহ্ম। বুদ্ধি আত্মা নয়, কিন্তু আত্মা তোমার মধ্যে বুদ্ধি স্বরূপ। কাঁচের ডুমের মধ্যে আলো যেমন তার চারিপাশের বস্তুকে জ্যোতির্ময় করে, আত্মজ্যোতিও তেমনি বুদ্ধি, মন, প্রাণ, ইন্দ্রিয়গুলোকে সচেতনপ্রায় করে তোলে। আসলে এঁরা নিজ-নিজ গুনে চেতন নয়, জ্যোতি এদের চৈতন্যপ্রায় করে তোলে। রঙ্গিন কাঁচ আর তার রঙ্গিন আলো যেমন পৃথক করা যায় না, তেমনি বুদ্ধির সাথে আত্মজ্যোতিকে অভিন্ন বলেই মনে হয়। বুদ্ধিতে প্রতিফলিত আত্মা বুদ্ধিকে অবলম্বন করে দেহের ইন্দ্রীয় সকলের মধ্যে প্রতিফলিত হন। আর সেইজন্য ইন্দ্রিয়গুলোকেও ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। আত্মার কোনো ক্রিয়া নেই। কিন্তু বুদ্ধি ক্রিয়ার জনক। এইভাবে বুদ্ধির সাথে আত্মার সহযোগে ব্রহ্মার স্বপ্ন, জাগরণ, সুষুপ্তি হয়।
জাগরনে যিনি বুদ্ধিকে উদ্ভাসিত করেন, স্বপ্নে জাগ্রত অবস্থার অতীত হয়েও, তিনিই স্বপ্নাবস্থায় বুদ্ধিকে উদ্ভাসিত করে থাকেন। এই জ্যোতি বা আত্মা জন্মগ্রহণকালে অর্থাৎ শরীর ধারণ কালে, দেহের ইন্দ্রিগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত হন আবার মরণকালে ইন্দ্রিয়সকল ত্যাগ করে থাকেন। আমাদের জাগরনে এই বুদ্ধিযুক্ত আত্মা দেহকে গ্রহণ করে থাকেন আবার স্বপ্নে দেহকে ত্যাগ করেন। আবার মরণকালে ও জন্মগ্রহণকালে এই একইভাবে আগমন ও নির্গমন হয়ে থাকে।
জাগরনে আমরা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বিষয় সংযোগ করে থাকি। অর্থাৎ কান দিয়ে শুনি, চোখ দিয়ে দেখি, ত্বক দিয়ে স্পর্শ করি, মুখ বা জিহ্বা দিয়ে কথা বলি, বা আস্বাদ গ্রহণ করে থাকি। কিন্তু এই একই কাজ অর্থাৎ আস্বাদন, শ্রবণ, দর্শন ইত্যাদি করে থাকি স্বপ্নাবস্থায়, কিন্তু সেখানে আমাদের কোনো ইন্দ্রিয় ক্রিয়াশীল থাকে না। এমনকি দেহের সবকিছু নিষ্ক্রিয় থাকে। তো কান নেই অথচ শুনছি, চোখ নেই তথাপি দেখছি, এমনকি আমরা স্বপ্নে সুখ-দুঃখ অনুভব করছি। তো এই সব হচ্ছে কিভাবে ? হচ্ছে আত্মার উপস্থিতির জন্য।
আসলে গমনশীল আত্মার দুটো স্থান। এক হচ্ছে ইহলোক, আর একটি হচ্ছে পরলোক। কিন্তু স্বপ্ন নামক যে তৃতীয় স্থান এটি একটি সংযোগ স্থান। এই সংযোগস্থলে থেকেও আত্মা ইহলোক ও পরলোক দুটোই দেখে থাকেন। স্বপ্নাবস্থাতে আত্মা তার ভূত ভবিষ্যৎ দেখতে পান। অর্থাৎ তার সঞ্চিত জ্ঞান-কর্ম্ম-সাধনফল যা তিনি আশ্রয় করেছেন, অর্থাৎ পাপফল ও পুণ্যফল এই দুইপ্রকার ফলই দর্শন করে থাকেন। আত্মা যখন স্বপ্নের জগতে বিরাজ করেন, তখন তিনি সর্বপালক এই দেহ-ইন্দ্রিয়ের সংঘাতের একাংশ গ্রহণ ক'রে, নিজেই এই দেহকে বিনাশ ক'রে একটা স্বপ্নদেহ নির্মাণ ক'রে স্বীয় জ্যোতি দ্বারা প্রকাশিত স্বয়ং প্রকাশ রূপে অবস্থান করে থাকেন, এবং স্বপ্ন দর্শন করেন।
আসলে আমরা যাকে জাগ্রত অবস্থা বলে থাকি, সেটিও একপ্রকার স্বপ্নাবস্থা। আমরা যে স্বপ্নের কথা বলে থাকি, তা আমাদের ছয় বা আট ঘন্টার পরেই আমরা অনুভব করতে পারি। কিন্তু আমরা জেক জাগ্রত বলছি, তাও একপ্রকার স্বপ্ন বই কিছু নয়, যেখান থেকে বেরিয়ে আসতে গেলে আমাদের জীবিতকালে অর্থাৎ আশি থেকে একশত বৎসর লাগে। এই অবস্থায়, আমাদের সংস্কার অনুযায়ী স্বপ্ন দর্শন হয়। কিন্তু আমরা যাকে স্বপ্নদর্শন বলে থাকি, সেখানে যে দর্শন বা সুখ-দুঃখের অনুভূতি হয়, তা শুধু ইহজন্মে সংস্কার - একথা বলা যায় না। এখানে স্বপ্নদর্শন আমাদের পূর্বজন্মের সংস্কারসকল অনুভবের কারন বলা যেতে পারে। এ থেকে আমরা পরলোকের অস্তিত্ত্ব সম্পর্কে একটা প্রমান পেতে পারি। স্বপ্নে আমরা পূর্বপূর্ব জীবনের ধর্ম্ম-অধর্ম্ম কর্মফলজনিত সুখ দুঃখীর অনুভব করে থাকি। আবার অদৃষ্টবশে কিংবা দেবানুগ্রহে আমরা ভাবি-জন্মের আভাস পেতে পারি।
জাগ্রত অবস্থায়, অদৃষ্টের ভোগ ক্ষয় থেকে দেহ ও ইন্দ্রিয় সকলের যে বিশ্রাম, তাকেই আমরা মৃত্যু বা স্থুল দেহের নাশ বলে থাকি। আবার এই অদৃষ্ট বসেই আমাদের স্বপ্ন-দেহ নির্মিত হয়, এবং স্বপ্নদেহে আমরা স্বপ্ন দর্শন করে থাকি। এই বিনাশ ও নির্মাণ আসলে আত্মকৃত। স্বপ্নে আমাদের মন বাহ্য বিষয় থেকে বিরত থাকে। কিন্তু বাহ্য বিষয় যখন আমাদের বাসনার আকার নেয়, তখন আত্মা এই বাসনাময় অন্তঃকরণবৃত্তি রূপে প্রকাশিত থাকেন। আত্মা যখন বাসনাময় অন্তঃকরণবৃত্তি রূপে প্রকাশিত থাকেন, এই থাকাকে উপনিষদ বলছে মূলে "স্বেন ভাসা" । এই স্বপ্ন অবস্থায় সাক্ষীভূত আত্মজ্যোতি আমাদের বৃত্তিসকলকে প্রকাশ করে থাকেন। একেই বলা হয় "স্বেন-জ্যোতিষা"।
আমাদের যে স্বপ্নের অনুভব হয়, সেখানে না আছে কোনো সূর্য্যের আলোক, না আছে কোনো ইন্দ্রিয়সকল। এখানে আছে আত্মার জ্যোতি। আত্মার আলোক। আত্মা আসলে কাউকেই সৃষ্টি করেন না, কর্ম্মফলই সৃষ্টির কারন। তথাপি বলা হয়ে থাকে, আত্মাই কর্ম্মফলের হেতু। জাগরনেও তিনি কর্তা নন, তিনি কিছুই করেন না, কিন্তু তাঁর জ্যোতির দ্বারা আভাসিত হয়ে আমাদের দেহ-ইন্দ্রিয়সকল কর্ম্মে ব্যাপৃত হয় বলে তাঁহাতে কর্তৃত্ব আরোপিত হয়। কথায় বলে জ্যোতির্ময় এবং নিঃসঙ্গ পূর্ণাত্মা স্বপ্নাবেশে স্থূল শরীরকে নিশ্চেষ্ট রেখে অথচ স্বয়ং অসুপ্ত থেকে ও ইন্দ্রিয়সকলের জ্যোতিস্মান মাত্রা সকলকে নিয়ে স্বপ্নাবস্থায় বাসনাময় বিষয়গুলোকে প্রকাশ করে থাকেন। এরপর তিনিই আবার জাগ্রত অবস্থায় ফিরে আসেন।
জ্যোতিময়-একাকি-সঞ্চারী এবং অমর এই পূর্ণাত্মা নিকৃষ্ট বাসস্থানকে প্রাণের দ্বারা রক্ষা করে স্বয়ং এই ভিতরে-বাহিরে বিচরণ করেন। সেই অমর পুরুষ বিভিন্ন বিষয়-বাসনার অনুগমন করে থাকেন। আমরা জানি আমাদের স্বপ্নাবস্থায় আত্মা দেহেই থাকেন। তৎ সত্ত্বেও দেহের মধ্যে অবস্থিত যে আকাশ, এই আকাশ যেমন দেহের সঙ্গে সম্মন্ধযুক্ত নয়, এই আকাশ দেহের ভিতরে এবং বাইরে অবস্থান করছে, ঠিক তেমনি দেহ-সম্মন্ধ শূন্য আত্মা দেহের ভিতরে বাইরে অবস্থান করছে। কর্ম্মফল বশতঃ যে সব কামনা-উদ্ভূত বৃত্তি হয়, সেই বৃত্তি বাসনার আকারে পরিণত হলে তিনি সেই বিষয় অনুভব করে থাকেন।
এই আত্মজ্যোতি স্বপ্নে অনেক বাসনাকার বস্তু নির্মাণ করেন। সেইমতো তিনি উচ্চ-নিচ যোনী প্রাপ্ত হন, যেন স্ত্রী হাস্যরসে মজে যান, আবার তিনিই ভয়ানক বস্তুসকল দর্শন করে থাকেন। জীব স্বপ্নের মধ্যে এই ক্রিয়া দর্শন করে থাকেন, কিন্তু ক্রিয়াসম্ভোগকারীকে দেখতে পান না।
আমরা কেউ ঘুমুলে হঠাৎ করে ডাকতে নেই। কারন হচ্ছে, এইসময় আমরা ইন্দ্রিয়াতীত হয়ে বিচরণ করে থাকি। তো হঠাৎ সেখান থেকে টেনে-হিচড়ে নিয়ে আসলে, এমনটা হতে পারে, যে তিনি তখন কোনো না কোনো ইন্দ্রিয়কে প্রাপ্ত না হয়েই ফিরে আসতে পারেন। এই অবস্থায় আমরা কোনো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারি। কেউ আবার বলেন, জাগ্রত অবস্থা হচ্ছে আত্মার স্বপ্ন, কারন জাগ্রত অবস্থাতে তিনি যা কিছু দেখেন, স্বপ্নেও তিনি তাই দেখেন। যদিও এই ধারণা ঠিক নয়, আমাদের স্বপ্নে পুরুষ স্বয়ংজ্যোতি হন। তাই ধ্যানে চোখ বুজলে আমরা আত্মজ্যোতিকে দেখতে পাই, জাগ্রত অবস্থায় তাকে হারিয়ে ফেলি। (বৃহদারণ্যক উপনিষৎ - ৪/৩/১ থেকে ৪/৩/১৪)
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
,
No comments:
Post a Comment