মৃত্যু রহস্যঃ (1)
মৃতদেহে কি পুনরায় প্রাণের সঞ্চার ঘটানো সম্ভব ?
অকালমৃত্যু রোধ করা কি সম্ভব ? একটা জিনিস আমরা সবাই মেনে নিয়েছি যে জন্ম হলে তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। এটা রোধ করবার সাধ্য কারুর নেই। তা সে আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্র বলুন বা আমাদের দর্শন শাস্ত্র বলুন - সবাই মেনে নিয়েছেন, যে মৃত্যুকে রোধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু এমনকিছু অলৌকিক কাহিনীর কথা আমরা শুনে থাকি, যেখানে সাধু মহাত্মাদের কৃপায়, মরা মানুষ জ্যান্ত হয়ে উঠতে পরে। শুধু সেযুগে নয়, এই যুগেও, এসব কথা শুনতে পাওয়া যায়। আমাদের অনুসন্ধানের বিষয়, এইসব কলাকৌশল, ও তার প্রয়োগ পদ্ধতি, যাতে মরার আগে যেন কেউ না মারা যায়। অর্থাৎ অকালে যেন কেউ মারা না যায়। আমরা পরবর্তী কয়েকদিন এই প্রসঙ্গে অর্থাৎ অকালমৃত্যু কিভাবে রোধ করা যায় - সেই সম্পর্কে দর্শনশাস্ত্র ও চিকিৎসাশাস্ত্রের মধ্যে অনুসন্ধান মূলক আলোচনা শুনবো।
এই প্রসঙ্গে একটা মহাভারতের গল্প দিয়ে শুরু করি। ধীরে ধীরে আমরা বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করবো। আসলে মহাভারতের গল্প আমার কাছে নিতান্ত গল্প নয়, এখানে আছে জীবন জিজ্ঞাসার উত্তর। এই মহাভারতে আছে গীতা, যা আমাদেরকে জীবনশৈলী শেখায়। ব্যাসদেব বলেছে, মহাভারত হচ্ছে বেদের অর্থাৎ জ্ঞানের নির্যাস, যা আমাদের গল্পের আকারে শোনানো হয়েছে । যাইহোক, মহাভারতের শান্তিপর্বে এই গল্পের কথা বলা হয়েছে। মহামতি ভীষ্ম যখন শরশয্যায়, যুধিষ্ঠির জিজ্ঞেস করছেন, হে পিতামহ, আপনি কি কখনো মানুষকে প্রাণত্যাগের পরে, পূনরুজ্জীবিত হতে দেখেছেন, বা শুনেছেন। ভীষ্ম বলছেন, হ্যাঁ মানুষ যদি অকালে কালের কবলে পরে, তবে তাকে বাঁচানো সম্ভব হতে পারে। একসময় এক ব্রাহ্মণের সুকুমারমতি কুমার গ্রহের ফেরে প্রাণত্যাগ করে। তো ব্রাহ্মণ-পিতা শোকে কান্নাকাটি করতে করতে তার আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে ছেলের মৃতদেহ সৎকারকরবার জন্য, শ্মশানের দিকে যাত্রা করে। সেখানে গিয়ে ছেলেটিকে কোলে নিয়ে তার পিতা-মাতা কান্নাকাটি করতে থাকে। কিছুতেই তাকে মাটিতে কবর দিতে চায় না। এইসময় একটা শকুন তাদের কাছে আসে, আর বলতে থাকে দেখো মানুষ, সবাই একদিন না একদিন মৃত্যুমুখে পতিত হবে, তোমারা অহেতুক শোক করছো। মৃত্যু সমস্ত জীবের নিশ্চিত পরিণতি। এই বালক মৃত। একে তোমরা এক্ষুনি শ্মশানে রেখে দিয়ে, বাড়ি ফিরে যাও। দেখো এই শ্মশানে হাজার হাজার মানুষ তাদের আত্মীয়স্বজনদের মৃতদেহ ত্যাগ করে গেছে। সমস্ত জগৎ এই মৃত্যুশোকে পরিপূর্ন। যারা মৃতদেহ ত্যাগ না করে, তারা তাদের নিজেদের মৃত্যুকেই ডেকে আনে। মৃত্যুশোক মানুষের আয়ুক্ষয় করে থাকে। অতয়েব আমার কথা শোনো, মৃত বালকের দেহ ত্যাগ করে তোমারা শীঘ্র বাড়ির দিকে যাত্রা করো। দেখো শ্মশানে শেয়াল শকুনের বাস। কঙ্কালের স্তুপ। এখানে বেশিক্ষন থাকা তোমাদের উচিত নয়। মর্ত্যলোকে মৃত্যুই সত্য। এখানে সবাইকেই একদিন না একদিন মৃত্যুর মুখে পতিত হতে হবে। আর কালের নিয়মে একবার কেউ মারা গেলে, তাকে আর কখনোই পুনরায় জীবিত করা সম্ভব নয়। ইহলোকে সমস্ত জীবকুল নিয়তি ও কর্ম্মফলের দ্বারা বাঁধা। দেখো সূর্য অস্ত যাচ্ছে, সন্ধ্যা নেমে আসছে। এক্ষুনি তোমাদের মৃত পুত্রের মায়া ত্যাগ করে, বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত। এই কথা শুনে, স্মশানযাত্রীগন পুত্রের নিস্প্রান দেহকে শ্মশানে রেখে তার বাড়ির দিকে যেতে উদ্দত হলো।
এইসময় কালো রঙের একটা শিয়াল গর্তথেকে বেরিয়ে এলো। বেরিয়েই কথা বলতে শুরু করলো, বললো, আরে তোমরা তো ভীষণ নির্দয়, নিষ্ঠুর, দেখো এখনো দিনের আলো আছে, আর তোমরা ভীত হয়ে এই অল্প-বয়সী বালকের দেহ পরিত্যাগ করে, বাড়িতে চলে যাচ্ছো ? দেখো মুহূর্তের প্রভাব অতি চমৎকার। কখন কি হয়, কেউ বলতে পারে না। এক মুহূর্তের মধ্যেই এই বালকের দেহে প্রাণের সঞ্চার হওয়া আমি আশ্চর্য্যের মনে করি না। খানিক্ষন আগেও যার মুখের মধুর বাক্যে তোমরা পুলকিত হতে, যাকে কোলে নিয়ে, তুমি অশেষ আনন্দ লাভ করতে, যাকে তুমি চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিতে, সেই সুকুমার বালককে, এত তাড়াতাড়ি পরিত্যাগ করে এই নির্জন শ্মশানে, এই শেয়াল-শকুনের কাছে রেখে, নিজেরা নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে যাচ্ছ ? দেখো সন্নাসীগণ সন্তান লাভ করতে পারে না। তথাপি তারা বালকের সমাদর করে থাকে। পশুপাখিগন তাদের সন্তানদের কাছ থেকে বৃদ্ধ বয়সে প্রতিপালনের প্রতিশ্রুতি পায় না। তথাপি এরা সবাই সন্তানদের লালন পালন করে থাকে। কিন্তু আজ তোমাদের আচরণ থেকে বুঝতে পারলাম, মানুষ কত নিষ্ঠুর। মানুষের শরীরে স্নেহ-মমতা নেই। তোমাদের শোক-কান্নাকাটি দেখে মনে হচ্ছে - এগুলো সবই কৃত্তিম। যে তোমার কুলরক্ষক তাকে তুমি শ্মশানে রেখে চলে যাচ্ছ ? দেখো ইষ্ট বস্তু কখনোই পরিত্যাগ করতে নেই। দেখো, মানুষের বিপদে যদি মানুষ কাছে থাকে, মানুষের অসময়ে যদি মানুষের কাছে আত্মীয়স্বজন কাছে থাকে, তবে তাকে বহিঃশত্রু আক্রমন করতে পারে না। দেখো প্রাণ সকলের প্রিয়। সকলেই স্নেহের বশীভূত। সাধুসন্তগণ পশুপাখিদের স্নেহ প্রদর্শন করে থাকে। এখন তোমাদের গলার মালা স্বরূপ এই বালক - একে তোমরা পরিত্যাগ করে চলে যাচ্ছ ? তোমাদের উচিত, শোক পরিত্যাগ করে, কুলরক্ষক এই পুত্রকে নিরীক্ষণ করা, ও সর্ব শক্তিমান ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা, যাতে কালের প্রভাব থেকে সে মুক্ত হতে পারে। এই কথা শুনে ব্রাহ্মণগণ বালকের মৃতদেহ রক্ষার্থে আবার মৃত সন্তানের কাছে ফিরে এলো।
ব্রাহ্মণদের ফিরে আসতে দেখে, শকুন আবার বলতে শুরু করলো। হে মনুষ্যগন, তোমরা অতিশয় নির্বোধ। এই নীচাশয় নৃশংস অল্পবুদ্ধি শৃগালের কথায় আবার ফিরে এলে ? আর কিজন্যই বা আত্মার অস্তিত্ত্বে অবিশ্বাসী হয়ে, এই পঞ্চভূত-পরিশূন্য নিস্প্রান বস্তুর উপরে আকৃষ্ট হয়ে, শোকাভিভূত হচ্ছো ? যে তপঃপ্রভাবে, তোমরা পাপ থেকে বিমুক্ত হতে পারবে, সেই তপঃ অনুষ্ঠানে তোমাদের যত্নবান হওয়া উচিত। তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করলে, কিছুই দুর্লভ হয় না। অতয়েব শোক ত্যাগ করো। দেখ, সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য নিয়েই দেহের জন্ম হয়ে থাকে। তোমাদের দুর্ভাগ্যের প্রভাবেই এই বালক তোমাদের শোকসাগরে নিমজ্জিত করে দেহ ত্যাগ করেছে। তোমার সন্তান-সন্ততি বলো, জাগতিক সম্পত্তি বলো সবই তপবল দ্বারাই লভ্য। পূর্বজন্মে যেমন তপস্যা করেছো, এই জন্মে সেই অনুযায়ী সুখ-দুঃখ ভোগ করতে হবে। জীব আগে সুখ-দুঃখ সংগ্রহ করে, তারপরে জন্ম গ্রহণ করে থাকে। কেউ কারুর কর্ম্মফল ভোগ করতে পারে না। সকলেই স্ব-স্ব সুকৃত ও দুষ্কৃত অনুসারে ফল ভোগ করে থাকে। অতয়েব তোমরা অধর্ম্ম থেকে বিরত হয়ে, নিজ নিজ ধর্ম্ম পালন করো। অতয়েব, স্নেহ-মমতা-শোক-দুঃখ ত্যাগ করে, বালকের দেহ শ্মশানে নিক্ষেপ করে, এখান থেকে চলে যাও । কর্ত্তাকেই শুভ-অশুভ ফল ভোগ করতে হয়। তার বন্ধু-বান্ধব-আত্মীয়-স্বজন এদের এখানে কিছু করবার নেই। অতয়েব শীঘ্র শ্মশান পরিত্যাগ করাই বিধেয়। কি বিদ্বান, কি মূর্খ, কি ধনবান, কি নির্ধন সবাই নিজ নিজ শুভ-অশুভ কাজের ফল ভোগান্তে কালের কবলে নিপতিত হয়। এর জন্য শোক করা বৃথা। কাল সকলের নিয়ন্তা। কাল কখনো পক্ষপাতিত্ত্ব করতে পারে না। কি বালক, কি যুবক, এমনকি কি গর্ভস্থ সবাইকে কাল আক্রমন করে থাকে। জগতের এটাই গতি। এর অন্যথা সম্ভব নয়। এই কথা শুনে ব্রাহ্মণগণ আবার নিজনিজ গৃহের দিকে পা বাড়ালেন।
কালো শৃগাল এই সব কথা শুনছিলো। শৃগাল বললো, আমি বেশ বুঝতে পারছি, শকুনের কথায় তোমাদের স্নেহের লোপ পাচ্ছে। আমি জানি এই বালকের মৃত্যুতে বৎসবিহীন গাভীর মতো অবস্থা তোমাদের। তোমাদের কান্না কাটি দেখে, আমারও ভিতরে শোকের আবহ তৈরী হয়েছে। আমারও চোখে জল আসছে। দেখো, সব ব্যাপারে নিজের সাধ্য মতো চেষ্টা করা উচিত। শুধু শোক-দুঃখ-পরিতাপ কোনো কাজের কথা নয়। দেখো চেষ্টা করলে দৈবফল লাভ করা যায়। শুধু পরিতাপ করে কখনো সুখ অর্জন করা যায় না। দৈবফলে যেমন অসম্ভব সম্ভব হতে পারে, তেমনি পুরুষকারের প্রভাবেই দৈবফল লাভ করা যেতে পারে। যত্ন সহকারে চেষ্টা করা অভীষ্ট লাভের উপায়। অতয়েব তোমরা বালককে জীবিত করবার জন্য, আপ্রাণ চেষ্টা করো। চেষ্টা ব্যতিরেকে হতাশ হয়ে, নির্দয় হয়ে বালককে পরিত্যাগ করো না। দেখো, পিতার শরীর থেকে উৎপন্ন এই পুত্র। এই পুত্র তোমার বংশরক্ষা করবে। পিতার অর্দ্ধ অংশ হচ্ছে পুত্র। সেই পুত্রকে শ্মশানে রেখে তোমরা কোথায় গমন করছো ? কিছুক্ষন অপেক্ষা করো। সূর্য অস্তাচলে গেলে, এমনকি সন্ধ্যা হয়ে গেলেও হয় একেবারে পুত্রের সাথে বাড়িতে যাবে, নতুবা পুত্রের সাথে এইখানেই থেকে যাবে।
এবার আবার শকুন, কথা বলা শুরু করলো। বললো, হে মানবগন, আমি হাজার বছর হলো জন্ম গ্রহণ করেছি। কিন্তু কখনো, কাউকে কালের কবলে নিপতিত হবার পরে, পুনরায় জীবিত হতে দেখি নাই। কেউ গর্ভ অবস্থায়ই মারা যায়। কেউ জন্মের পরেই মারা যায়, কেউ শৈশবে মারা যায়। কেউ যৌবনে মারা যায়। দেখো, মানুষ বলো, পশু-পাখি বলো, সবার ভাগ্য অনিত্য। কি স্থাবর, কি অস্থাবর জীব জঙ্গম সবাই পরমায়ুর অধীন। অনেকেই প্রিয় পুত্র-প্রিয়জনদের শ্মশানে পরিত্যাগ করে গৃহে গমন করে থাকে। আবার দেখো, একসময় নিজেই শ্মশানে পরিত্যক্ত হয়। মানুষ মাত্রেই ভালো-মন্দ সমস্ত কিছু পরিত্যাগ করে একসময় পরলোক গমন করে থাকে। এর কোনো অন্যথা নেই। অতয়েব প্রাণহীন এই দেহ, তা সে হোক না প্রিয়তম পুত্রের, জীবনহীন দেহ প্রাণহীন কাঠের মতো। এই দেহের প্রতি স্নেহ করা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আর এই ভবিতব্যের নিস্পত্তির জন্য, কখনোই কোনো পরিশ্রম করে লাভ নেই। তোমরা যে এর জন্য শোক করছো, তা এই মৃত পুত্র শুনতেও পারছে না, দেখতেও পাচ্ছে না, তাহলে কেন তোমরা এর জন্য অকারণ শোক করছো। মৃতদেহ সত্ত্বর পরিত্যাজ্য - এই অমোঘ বাক্য তোমাদের স্মরণ রাখা উচিত। মৃত গাছে জল দিয়ে কোনো লাভ নেই, মৃত শরীরে কঠোর বচন বা মূল্যবান উপদেশ, কোনো কাজে লাগে না। এমনকি মৃত শরীরে কখনোই প্রাণের সঞ্চরণ ক্ষেত্র হতে পারে। অতয়েব, হে মানবগন তোমরা এই মৃতদেহ পরিত্যাগ করে শীঘ্র এই স্থান ত্যাগ করো। এই কথা শুনে আবার ব্রাহ্মণগণ গৃহাভিমুখে গমন-উদ্দত হলো।
আবার শৃগাল দ্রুতপায়ে সেখানে এসে মৃত বালকের দিকে চেয়ে থাকলো। বললো, হে মানবগন তোমরা অহেতুক এই শকুনে কথায় বিচলিত হচ্ছো। এই বালক পিতৃলোকের পিন্ডদাতা। একে ত্যাগ করলে, একসময় তোমাদের মনে পরিতাপ হবে, ভবিষ্যতের পরিতাপ থেকে তোমরা রেহাই পাবে না। আমি শুনেছি, রামচন্দ্র তপস্যারত শূদ্র হৃষীকে বিনাশ করলে, সেই ধর্ম্ম প্রভাবে,এক ব্রাহ্মণ বালক পুনরায় জীবিত হয়েছিল। ধর্ম্মিকশ্রেষ্ঠ রাজর্ষি শ্বেত তার মৃত পুত্রকে পুনর্জীবিত করেছিল। অতয়েব, মৃত ব্যক্তির পুনর্জীবন নিতান্ত অসম্ভব নয়। তোমরা এখানে কান্নাকাটি করলে, হয়তো কোনো সিদ্ধপুরুষ বা মুনি অথবা কোনো দেবতা তোমাদের প্রতি দয়া প্রকাশ করতে পারেন। এই কথা শুনে ব্রাহ্মণগণ পুনরায় পুত্রকে কোলে নিয়ে নিরন্তর রোদন করতে লাগলেন।
আবার শকুনের আবির্ভাব হলো। মানুষের কান্নাকাটির শব্দ শুনে, শকুন বিরক্ত হয়ে বলতে লাগলো, তোমরা আবার বালকের শরীরে চোখের জল ফেলছো ? এই শিশু ভবিতব্যের শাসন-নিয়মে চিরনিদ্রা প্রাপ্ত হয়েছে। কি তপস্বী, কি জ্ঞানী, কি অজ্ঞানী, কি ধনী কি নির্ধনী সবাই একসময় কালের কবলে শমনভবনে গমন করতে হয়। পৃথিবী নামক এই মৃত্যুপুরীতে কোটি কোটি বালক-বৃদ্ধ তাদের দেহ পরিত্যাগ করেছে। তোমরা এই চিরসত্যকে অস্বীকার করে, মৃত এই বালককে জীবিত কোরবার জন্য উদগ্রীব হয়েছো ? মৃত ব্যক্তির জন্য শোক করা বৃথা। মানুষ মারা গেলে আর তাকে কখনোই জীবিত করা যায় না। একটা কথা শুনে রাখো, মানুষ তো ছাড় - শতশত শৃগাল একত্র হয়ে শতশত বৎসর চেষ্টা করলেও, কখনোই মৃতদেহে প্রাণের সঞ্চার করতে পারে না। কিন্তু আমি জানি, যদি ভগবান রুদ্রদেব, কার্ত্তিকেয়, ব্রহ্মা বা বিষ্ণু স্বয়ং এসে যদি বড় দান করেন, তাহলে এই শিশু পুনর্জীবিত হতে পারে। তোমাদের কান্নাকাটি, তোমাদের শোক, তোমাদের চিৎকার চেঁচামেচি কোনো জীবন লাভের উপায় হতে পারে না। আমি এই শকুন, আর ওই শৃগাল, বা তোমরা মানবগন, - সকলেই স্ব -স্ব পাপ-পুন্যভার বহন করবার নিমিত্য অবস্থান করছি। বিজ্ঞব্যাক্তিগন এই কথা স্মরণ রেখে অন্যের অবান্তর কথায় কান দেন না। তোমরা যত্নসহকারে , ধর্ম্মের অনুষ্ঠান, সত্যবাক্যের অনুশীলন, শাস্ত্রের আলোচনা, ন্যায়পথ অবলম্বন করে জীবন ধারণ করো। সমস্ত প্রাণীদের প্রতি সরল ও দয়া প্রকাশের চেষ্টা করো। জীবিত থেকে পিতা-মাতা ও অন্যান্যদের পালন পোষন তত্ত্বাবধান না করলে অধর্ম্মে লিপ্ত হতে হয়। এই বালকের এমন কোনো অঙ্গভঙ্গি দেখা যাচ্ছে না. যাতে সে জীবিত হতে পারে। সুতরাং এই বালকের জীবিতলাভের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। অতয়েব, তোমরা এই অহেতুক শোক পরিত্যাগ করে, মায়া মমতা পরিত্যাগ করে, নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করো। এই কথা শুনে ব্রাহ্মণগণ বাড়ি ফিরবার জন্য উদ্যোগী হলো।
শৃগাল আবার কথা বলা শুরু করলো : বললো, এই মর্তলোক অতি ভয়ানক স্থান। এখানে জীবের জীবিতকালে অতি অল্প। প্রতিটি মানুষ জীবনে প্রিয়জনের বিয়োগব্যথায় কাতর হয়ে থাকে। এই জগতে সমস্ত কাজই অলীক, সব কাজই অপ্রিয়। কিসে কি হয়, কে বলতে পারে ? অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, মানুষ জীবিত থাকতে কতনা স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা প্রদর্শন করে থাকে। আর সেই প্রিয়জনের মৃত্যু হলে, পরক্ষনেই তাকে পরিত্যাগ করে থাকে। আর এই শকুনের কথা শুনে, মানুষ নিজ নিজ কর্তব্য সম্পর্কে জ্ঞান শূন্য হয়ে যায়। একটা জিনিস শুনে রাখো, জীবনে সুখের অবসানে দুঃখ এসে থাকে আবার দুঃখের অবসানে সুখ এসে থাকে। আর এই সুখ দুঃখ কালের অধীন। কালের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সুখ -দুঃখের অবসান হয়ে থাকে। ইহকালে কেউ চিরকাল সুখ বা চিরকাল দুঃখ ভোগ করতে পারে না। তবে সময়ে কর্তব্য অবহেলা করা উচিত নয়। আমর বালকের সুমুখশ্রী দেখে মনে হচ্ছে, তার শরীরের লাবণ্য দেখে মনে হচ্ছে, এই পুত্র অবশ্যই জীবিত। অতয়েব একে তোমাদের পরিত্যাগ করা উচিত নয়। শ্মশানবাসী শৃগালের এই মনোহর কথা শুনে, ব্রাহ্মণগণ আবার বালকের কাছে অবস্থান করতে লাগলো।
শকুন আবার বলছে, শোনো হে মানবগন, এই শ্মশান অতি ভয়ঙ্কর। রাত হলেই শ্মশানের ভয়ঙ্কর রূপ প্রকট হয়ে ওঠে। এখানে রাতে পেঁচা, যক্ষ, রাক্ষস নিরন্তর বাস করে থাকে। অতয়েব, রাত হতে না হতেই, এই স্থান পরিত্যাগ করা অবশ্য কর্তব্য। বরং বাড়িতে গিয়ে, এই বালকের প্রেতকার্য্যের অনুষ্ঠান করো। এর পরে এখানে মাংসাশী প্রাণীদের আসা শুরু হবে। এর পরে একটু রাত হলেই মাংসাশী প্রাণী তোমাদের আক্রমন করতে পারে। অরণ্য থেকেও ভয়ানক এই স্থান। এখানে থাকলে, নানান রকম ভয়ঙ্কর ধ্বনি তোমাদের ভীত করে তুলবে। অতয়েব অজ্ঞানী শেয়ালের কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে, তোমাদের অবশ্যই এই স্থান পরিত্যাগ করা কর্তব্য। এতে তোমাদের সবার সমূহ বিপদ হতে পারে ।
শৃগাল বললো, হে মানবগন যতক্ষন না সূর্যদেব অস্তাচলে যাচ্ছেন, ততক্ষন এখানে বসে অশ্রুরুদ্ধ বদনে নির্ভিক চিত্তে বসে বালককে রক্ষা করো, তাকে নিরীক্ষণ করো। শকুনের নিষ্ঠুর বাক্যে বিশ্বাস করলে, আর এই সুন্দর মুখ দর্শন করতে পারবে না।
ব্রাহ্মণগণ একবার শকুনের কথা আবার শিয়ালের কথায়, কিংকর্তব্য-বিমূঢ় হয়ে গেলো। শ্মশানে অবস্থান করবার পক্ষে যুক্তি আবার বিপক্ষে যুক্তিজাল তাদেরকে আবদ্ধ করে ফেললো। কি করবে তা তারা বুঝতে পারছিলো না। শেষে ক্রন্দনরত অবস্থায় শ্মশানে অবস্থান করাই স্থির করলেন।
এই ঘটনা পর্যবেক্ষন করছিলেন, পার্বতী-বল্লভে স্বয়ং মহাদেব। মাতা পার্বতীর অনুরোধে, এই ব্রাহ্মণদের দুঃখ দর্শনে ভূতপাবন ভবানীপতি সেই শ্মশানে এসে উপস্থিত হলেন। এবং করুনার স্বরে বললেন, আমি মহাদেব, আমি তোমাদের বড় দিতে এসেছি। তোমরা তোমাদের অভিলাষিত বড় প্রার্থনা করো। তখন সমস্ত উপস্থিত ব্রাহ্মণসকল মহাদেবকে প্রণাম করলেন। বললেন, আমরা সবাই এই বালকের প্রাণনাশের কারনে আমরা মৃতপ্রায় হয়েছি। অতয়েব, এই বালককে জীবন দান করে আমাদের শান্তিপ্রদায়ক হউন। এই কথা শুনে ভূতনাথ জলাঞ্জলি গ্রহণপূর্বক "শতায়ু হও" বলে বালককে পুনরায় জীবিত করলেন।
এই ভাবে, সেই ব্রাহ্মণগণ স্বয়ং ভূতনাথের প্রসাদে মৃতবালকের পুনর্জীবন লাভ করে পুলকিতচিত্তে দেবাদিদেবকে অভিবাদন পূর্বক পরম সুখে অবস্থান লাগলেন।
এই কাহিনী বলে, মহামতি ভীষ্ম বলছেন, আলস্যবিহীন অধ্যবসায় ও ভগবান শঙ্করের অনুগ্রহে অবিলম্বে ফললাভ হয়ে থাকে। দৈব ও বুদ্ধি সহযোগে পুরুষকার মিলিত ভাবে অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পারে।
গল্পকথা। কিন্তু এই গল্পের মধ্যে যে সত্য নিহিত আছে, তা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।
আমি আমার একটা ছোট্টবেলার গল্প বলি। আমাদের বাড়ির কাছে, দুটো বিল ছিল, একটা ছোট আর একটা বড়ো। এই বড়ো বিলে চৈত্র বৈশাখ মাসে বহু বাচ্চারা শিংমাছ-কাঁকড়া ধরতে যেত। এই সময় মাছ কিছু ছোট গর্তের মধ্যে ঢুকে থাকতো। সেখান দিয়ে লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সেগুলোকে বার করা হতো। কখনো কখনো হাত ঢুকিয়ে বের করে আনতো। তো আমিও মাঝে মধ্যে নিতাইয়ের সাথে এই কাজের সাথী হতাম। তো একদিন হয়েছে কি, বিলের পারের মাঠের মধ্যে গিয়ে দেখি সঞ্জীবন আমাদের আর এক বন্ধু, মাঠের মধ্যে অচৈতন্য অবস্থায় শুয়ে আছে। আমরা ভাবলাম হয়তো সাপের কামড়ে মারা গেছে। তো নিতাই চিৎকার করে তার বাবাকে ডাকতে লাগলো। ওর বাবা নানান রকম তুকতাক জানতো। তো দেখলাম, সঞ্জীবনকে নিতাইয়ের বাবা চিৎ করে শোয়ালো। ওর শরীরের উপরে শুয়ে পড়লো। নিতাইকে বললো, বিল থেকে জল এনে চোখ-মুখে ছিটিয়ে দিতে। নিতাইয়ের বাবা সঞ্জীবনের মুখের সঙ্গে মুখ লাগিয়ে জোরে ফুঁ দিতে লাগলো। কয়েকবার ফুঁ দিতেই দেখলাম, সঞ্জীবন হাঁচি দিতে লাগলো। আর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে বসলো। পরে বোঝা গেলো, ও ভেবেছিলো, ওকে সাপে কামড়েছে। তাই ভয়ে সে মূর্ছা গেছে। হয়তো এই অবস্থায় থাকলে, সে মারাও যেতে পারতো।
মানুষ কেন, কোনো জীবই চিরস্থায়ী নয়। এমনকি কোনো বস্তুও চিরস্থায়ী নয়। প্রতিটি দেহের একটা সময়সীমা আছে। যা তাকে তার পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে যাবে। আর এই সময়সীমা প্রকৃতির নিয়মে আবদ্ধ। কিন্তু অকালমৃত্যু কেন হবে ? এখান থেকে আমরা বের হতে পারি কি না, সেটাই আমাদের গন্তব্য। পরের দিন আমরা আবার এই আলোচনায় যাবো। আজ এই পর্যন্ত।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
মৃত্যু রহস্যঃ - ২ প্রাণহীন দেহে প্রাণের সঞ্চার - একটা অনুসন্ধান কোনো সিদ্ধান্ত নয়।
আগেরদিন আমরা মহাভারতের শান্তিপর্ব থেকে একটা গল্প শুনেছিলাম। সেখানে আমরা একটা কথা আমরা শুনেছিলাম, মানুষ যদি অকালে কালের কবলে পরে, তবে তাকে কিভাবে বাঁচানো যায়। মহাত্মা ভীষ্ম বলছেন, ধৈর্য্য সহকারে বুদ্ধিদীপ্ত পুরুষকার ও দৈবের অনুগ্রহে অকাল মৃত্যু থেকে মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হতে পরে। অসম্ভব সম্ভব হতে পারে, যদি আমরা আলস্য বিহীন অধ্যবসায়ে লিপ্ত হতে পারি। আর লক্ষে সর্বশক্তি নিয়গ করে কর্ম্মে লিপ্ত হতে আমাদের দৈব অনুগ্রহ লাভ হতে পারে। আরো একটা জিনিস আমরা শুনেছিলাম, মানুষের অকালমৃত্যুর কারন, পিতা-মাতার অবিমৃষ্যতা। যাই হোক, আজ আমরা শুনবো, হরিবংশ থেকে আরো একটি কাহিনী।
হরিবংশে বর্ণিত ঘটনার সাক্ষী ছিলেন, স্বয়ং অর্জুন। আমরা তার মুখ থেকেই ঘটনাটি শুনবো।
অর্জুন তখন দ্বারকায় গিয়েছিলেন । সেখানে ধর্ম্মাত্মা শ্রীকৃষ্ণ শাস্ত্র অনুসারে একাহব্রতে দীক্ষিত হয়েছিলেন। দীক্ষা হয়ে যাবার পরে, বসে গল্পগুজব হচ্ছে, এমনসময় এক ব্রাহ্মণ এসে কান্নাকাটি জুড়ে দিলো। প্রশ্ন করে জানা গেলো, ব্রাহ্মণের, পর-পর তিনটি সন্তান সুতিকাগৃহেই পঞ্চত্ব প্রাপ্তি হয়েছে। এবার আবার তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা হয়েছেন । আগত সন্তান যেন আর মারা না যায়, সেই আর্তি নিয়ে তিনি দ্বারকায় এসেছেন। এখন শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, আমি সবে যজ্ঞে দীক্ষিত হয়েছি। এখন আমার পক্ষে যজ্ঞের কাজ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ব্রাহ্মণকে রক্ষা করাও কর্তব্য। তো অর্জুন বলছেন, কেশব আপনি চিন্তা করবেন না আপনি যদি বলেন, তবে আমি ব্রাহ্মণকে রক্ষা করতে পারি। কৃষ্ণ স্মিত হেসে বললেন, ঠিক আছে, যাও তবে যেতে তো ক্ষতি নেই।
ঘটনার বিস্তারে যাবো না,অর্জুন সেখানে গিয়ে সমস্যার সমাধান করতে পারলো না, ব্রাহ্মণের চতুর্থ সন্তান সুতিকাগৃহেই প্রাণত্যাগ করলো। তো ব্রাহ্মণ অর্জুনকে তাচ্ছিল্য করলে যা তাই নয় তাই বলে তিরস্কার করতে লাগলো। যদি গোবিন্দ আসতো, তবে হয়তো এযাত্রা রক্ষা হতো। ইত্যাদি ইত্যাদি। তো অর্জুন ফিরে এলো শ্রীকৃষ্ণের কাছে, আর তার ব্যর্থতার কাহিনী বর্ণনা করলো। শ্রীকৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ তার রথ প্রস্তুত করে, অর্জুনকেই সাথে নিয়ে রওনা হলেন, সমস্যার প্রতিকারের উদ্দেশ্যে। রথ বন-জঙ্গল পার হয়ে, নদী-সমুদ্র পার হয়ে, পাহাড় পর্বত পার হয়ে বিবর-অভ্যন্তরে প্রবেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। বিবর কথাটা খেয়াল করুন - বিবর কথার অর্থ হচ্ছে গহ্বর - বি মানে আভরণ অর্থাৎ আবরনে ঢাকা যে অঞ্চল। আসলে অন্ধকারের আবরণ উন্মেষ করে সূর্যলোকে প্রবেশ। একেই বলে বিবর অভ্যন্তরে প্রবেশ। প্রথমে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে অর্থাৎ যেখানে স্পর্শ ইন্দ্রিয় ভিন্ন অন্য ইন্দ্রিয় কাজ করে না, সেখানে প্রবেশ করলেন। এর পর সেই তমসা কাটিয়ে স্নিগ্দ্ধ আকাশ পথে প্রবেশ করলেন। সেখান থেকে তেজরাশির মধ্যে প্রবেশ করলেন। এখানে অর্জুনকে অপেক্ষায় থাকতে বলে, শ্রীকৃষ্ণ ওই তেজঃপুঞ্জের মধ্যে প্রবেশ করলেন। তেজঃপুঞ্জের মধ্যে নিজেকে লিন করে দিলেন। এর পর অর্জুন কিছু দেখতে পেলেন না। কিছুক্ষন পরে দেখলেন, শ্রীকৃষ্ণ চারটি ব্রাহ্মণ কুমারকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলেন।
অর্জুন পরবর্তীতে শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করছেন, তুমি কিভাবে এই অন্ধকার দূর করে তেজের মধ্যে বিলীন হয়ে গেলে ? শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, এই যে তেজরাশি তুমি দেখেছো, তা আসলে আমারই ব্রহ্মহ্ময় তেজ। ওই তেজ আমাদের স্থূল-সূক্ষ্ম স্বরূপ প্রকৃতি মাত্র। যোগীগণ ওই তেজঃময় প্রকৃতিমধ্যে বিলীন হতে পারলে, মুক্তি লাভ করতে পারেন । আমিই ওই প্রদীপ্ত তেজোরাশি। আসলে আমরা সবাই ওই প্রদীপ্ত তেজরাশী মাত্র। কিন্তু সাধারণ মানুষ নিজেকে নানান বৈভব দিয়ে নিজেকে ঢেকে রেখেছে। তাই সে তার স্বরূপ সম্পর্কে বিস্মৃত হয়েছে। যাত্রা পথে যে বন-সমুদ্র-পাহাড়-আকাশ-তেজ অর্থাৎ এই বাহ্যিক প্রকৃতি থেকে প্রকৃতির সূক্ষ্মতম রূপের মধ্যে প্রবেশ। কার্য্য থেকে কারনে প্রবেশ।
শ্রীকৃষ্ণ এই যে অবস্থার কথা বর্ননা করলেন, এটি আসলে আমাদের ধ্যানময় অবস্থা মাত্র। কিন্তু কথা হচ্ছে, শ্রীকৃষ্ণ এই অনুভূতির মধ্যে ধ্যানের মাধ্যমে প্রবেশ করলেও, কিভাবে অর্জুন এই অবস্থাগুলো প্রতক্ষ্য করেছিল? এই সম্পর্কে আমরা কখনো পরবর্তীতে আলোচনা করবো। শুধু একটা উদাহরণ দিতে পারি, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের পদস্পর্শে নরেনের ব্রহ্মানুভূতির কথা নিশ্চয়ই আপনা শুনেছেন। কিন্তু অন্য আর একটা প্রশ্ন হচ্ছে, শ্রীকৃষ্ণ এই মৃত কুমারদের কিভাবে কোথা থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে এলেন ? এটা বুঝতে গেলে আমাদের জগতের অনিত্যতা, ও সময়-স্থানের বিজ্ঞান, ও শব্দ বিজ্ঞান সম্পর্কে জানতে হবে। এটি কোনো অলৌকিক ব্যাপার নয়। সবই সম্ভব দৈবের প্রভাবে। আর এই দৈবশক্তি আমাদের সবার মধ্যেই সুপ্ত অবস্থায় আছে। আমরা এই শক্তির উন্মেষ ঘটাতে পারি না। কিন্তু যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ সেটি পারেন। আসলে সব কথা সাধারনের বোধগম্য নয়। কিন্তু সত্য হচ্ছে, আমরা সবাই এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে পারি, সেই সম্ভাবনা আমাদের সবার মধ্যেই লুক্কায়িত আছে। এ সম্পর্কে জানতে হবে। এবং নিরন্তর তপস্যা, স্বাধ্যায়ঃ ও ঈশ্বর-প্রণিধান করতে হবে। আর একেই বলে ক্রিয়াযোগ। তো ক্রিয়াযোগে যাঁরা সিদ্ধ কাছে অসম্ভব বলে কিছু নেই, তাদের পক্ষে মৃত দেহে প্রাণের সঞ্চার করা সম্ভব।
এবার অন্য একটা গল্প বলি, এই গল্পটি আপনারা শ্রীশ্রী পরমহংস যোগানন্দ বীরোচিত "Autobiography of a Yogi" বইতে পাবেন। যোগানন্দের গুরু ছিলেন শ্রী যুক্তেশ্বর গিরিজি মহারাজ। এই গিরিজীর গুরু ছিলেন, লাহিড়ী মহাশয় অর্থাৎ শ্রী শ্যামাচরণ লাহিড়ী। তো যুক্তেশ্বর গিরিজী বলছেন, রাম যিনি গিরিজীর গুরুভাই, একবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এশিয়াটিক কলেরায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। লাহিড়ী মহাশয় কখনো অসুস্থতার সময় ডাক্তার ডাকা বারন করতেন না। তো দুজন ডাক্তারকে ডাকা হলো। কিন্তু গিরিজী গুরুদেব লাহিড়ী মহাশয়ের কাছে বন্ধুর অসুস্থার কারনে, খুব কান্নাকাটি করতে লাগলেন।
তো লাহিড়ী মহাশয় বললেন, " আরে ডক্তারেরা তো রামকে দেখছে, তবে আর ভাবনা কী। সে ভালো হয়ে যাবে।" কিন্তু রামের বাড়িতে এসে দেখলেন, ডাক্তার চলে গেছেন। একজন আবার লিখে গেছেন, "আমাদের যতদূর করবার সবই করেছি, কিন্তু এর আর কোনো আশা নাই" ।একে গুরুদেবের আশ্বাস বাক্যে অগাধ বিশ্বাস, অন্যদিকে রামের মুখখানা দেখে মনে হলো, সত্যিই মরন এগিয়ে আসছে। এবার সব শেষ। একবার গুরুদেবের কথায় বিশ্বাস আবার পরক্ষনেই ভীতিমূলক সন্দেহ - এই দোদুল্যমান অবস্থায় রাম চিৎকার করে বলে উঠলো, যুক্তেশ্বর, গুরুদেবের কাছে দৌড়ে যা, বল গিয়ে যে আমি চললুম। আমার শেষ কাজের আগে যেন তিনি আমার দেহকে আশীর্বাদ করেন।" এই কথা বলে রাম মরনের কোলে ঢোলে পড়লো। অন্য একজন শিষ্য সেখানে এলে, তাকে কাছে থাকতে বলে, যুক্তেশ্বরজী আবার গুরুজীর কাছে ছুটলাম। গুরুদেবের দেখা হতেই বললেন, "রাম কেমন আছে গো ?" গিরিজি বললেন, ঘন্টাকতক বাদেই দেখবেন, তাকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গুরুদেব লাহিড়ী মহাশয় বললেন, তোমরা শান্ত হয়ে ধ্যানে বসো, বলে নিজেও সমাধিতে মগ্ন হলেন। ভোরের দিকে লাহিড়ী মহাশয় আশ্বাস দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, এঃ অরে কালকে কেন বললে না, যে ওষুধ-টসুধ গোছের একটা প্রতক্ষ্য কিছুর সাহায্য চাই ? তারপর রেড়িরতেলের প্রদীপ দেখিয়ে বললেন, একটা ছোট্ট শিশিতে ওই প্রদীপটা থেকে ক্ষানিকটা তেল ঢেলে নিয়ে রামের মুখে সাত ফোটা ঢেলে দাও দেখি ?"
খানিকটা তেল নিয়ে যুক্তেশ্বরজী রামের বাড়িতে গিয়ে দেখেন, রামের দেহ মৃত্যুকঠিন হিমশীতল। তার এই বীভৎস অবস্থার দিকে না তাকিয়ে, ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে ঠোঁট দুটো ফাক করে, বাঁ হাতে তার দাঁতলাগা মুখের উপর ফোটা-ফোটা তেল ঢালতে লাগলেন । সাতফোটা তেল তার ঠোঁট স্পর্শ করতেই রামের দেহ ভীষণ ভাবে থরথর করে কেঁপে উঠলো। ধরফর করে উঠে রাম আশ্চার্য্য হয়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। আর স্পষ্ট ভাবে বললো, লাহিড়ী মহাশয়কে দেখলুম, এক অতি উজ্জ্বল জ্যোতির্মন্ডলের মাঝখানে, যেন সূর্য্যের মতো জ্বলছেন। তিনি আমায় আদেশ করলেন, ওঠ ওঠ, ঘুম ছেড়ে উঠে পর আর যুক্তেশ্বরকে সঙ্গে করে নিয়ে আমার কাছে দেখা করতে এস। বলেই তেড়েফুড়ে উঠে জামাকাপড় পরে, গিরিজির সঙ্গে লাহিড়ী মহাশয়ের সঙ্গে দেখা করতে ছুটলো ।
লাহিড়ী মহাশয় মিটিমিটি হেসে বললেন, যুক্তেশ্বরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এবার থেকে তুমি রেড়ির তেলের শিশি সঙ্গে রাখতে ভুলবে না নিশ্চই ? মনে রেখো, অক্ষর, অন্বয় পরমাত্মাই যেকোনো লোককে আরাম করে তুলতে পড়েন, ডাক্তার থাকুক আর না থাকুক। তেলের দাওয়াই দেওয়ার কোনো মানে হয় না - কেবল এইটুকু ছাড়া যে প্রত্যক্ষ একটা কিছু চাই - প্রতীক আর কি।
এখানে একটা জিনিস করুন, লাহিড়ী মহাশয় প্রথমে ধ্যানে বসলেন, সমাধিস্থ হলেন, রামের নিকট স্বপ্নে দেখা দিলেন, নির্দেশ দিলেন, এবং রামকে জাগ্রত করলেন। আমরা সবাই মৃত্যুর পরে, একটা অন্য জগতে বিচরণ করে থাকি। সেখানে বিশ্বশক্তির নির্দেশ পেলে, অতি অল্প ক্ষেত্রে হলেও, দেহত্যাগী আত্মা আবার মৃতবৎ শরীরে ফিরে আসতে বাধ্য হয় । বিশ্বশক্তির অমোঘ নির্দেশ পালন ভিন্ন অন্য উপায় নেই। এই ধরনের ঘটনা, শুধু আমাদের ধর্ম্মশাস্ত্রে বর্ণিত আছে তাই নয়, এই অভিজ্ঞতা বিশ্বের বহু ডাক্তারদের জীবনেও হয়েছে। আমরা জন্ম নেবার সময় যেমন কিভাবে আসি, তা জানি না, কারন তখন আমরা সাধারণ মানুষগণ তমসাচ্ছন্ন বা তন্দ্রাবস্থাতে থাকি। আবার যখন দেহান্তর প্রাপ্ত হই তখনও তমসাচ্ছন্ন অবস্থাতেই থাকি। অর্থাৎ স্থূল দেহ থেকে সূক্ষ্ম দেহে, সূক্ষ্মদেহ থেকে অতি অতিসূক্ষ্ম দেহে স্থানান্তরনের সময় আমরা জ্ঞান হারাই । তাই পূর্বস্মৃতি আমাদের কিছুই থাকে না।
যাইহোক, এগুলো আমাদের কাছে অকল্পনীয়, অলীক গল্পকথা মাত্র । কিন্তু এমনটা তো হতে পারে, মহাযোগী লাহিড়ী মহাশয়, বা যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে এমনকিছু ক্ষমতা নিশ্চই ছিল, যা আমাদের জ্ঞানের বাইরে। কিন্তু তাই বলে এগুলোকে অসত্য বলে উড়িয়ে না দিয়ে এর মধ্যে অনুসন্ধান করলে হয়তো মানুষের কল্যানে কোনো নতুন তথ্য পেতে পারি।
যাই হোক। আজ এই পর্যন্ত।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
এবার আমরা শুনে নেবো, এই আশ্চার্য্যজনক ঘটনার যিনি নায়ক, সে শ্রীকৃষ্ণ কে ছিলেন।
মৃত্যু রহস্যঃ - ৩ - প্রাণহীন দেহে প্রাণের সঞ্চার।
দেওয়াল ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে। বুঝলাম ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছে। তো নতুন ব্যাটারি কিনে এনে লাগালাম । ঘড়ি চলা শুরু হলো, কিন্তু পেন্ডুলামটা দুলছে না। একটু নাড়িয়ে দিতেই পেন্ডুলাম দুলতে শুরু করলো, আর চলতেই থাকলো । সন্তান ভূমিষ্ট হয়েছে, কিন্তু শিশুর প্রাণক্রিয়া শুরু হচ্ছে না। ধাঁই বা নার্চ শিশুর শরীরকে নেড়েচেড়ে উল্টে পাল্টে দিতেই কোন এক অজ্ঞাত কারনে শিশুর শ্বাসক্রিয়া শুরু হলো। একই সঙ্গে শুরু হলো জীবনের প্রাণক্রিয়া। আর সারা জীবন ধরেই এই ক্রিয়া চলতেই থাকলো।
আমাদের মৃত্যু সম্পর্কে বা বলা যেতে পারে, জীবন সম্পর্কে আমাদের কত ভুল ধারণা আছে, তা এই খবরটা শুনে বোঝা যেতে পারে। আমেরিকার মতো দেশে, যাকে আমরা পৃথিবীর সমস্ত দিক থেকে একটা উন্নত দেশ হিসেবে মনে করি, সেখানে বেশ কিছু বড় বড় কোম্পানি CRYONICS অর্থাৎ উন্নত ধরনের মর্গ বা হিমঘর তৈরী ক'রে, সেখানে মৃত মানুষের শবদেহ রক্ষিত করা হচ্ছে, শুধু এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে শীঘ্রই মরা মানুষকে বাঁচিয়ে তোলার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হবে, এবং আর এই কৌশল আবিষ্কার হলেই, তার এই মৃতদেহ আবার বাঁচিয়ে তোলা হবে। অর্থাৎ আবার তিনি পৃথিবীকে উপভোগ করতে পারবেন। আর এই মৃতদেহগুলোকে ৫০ থেকে ১০০ বছর পর্যন্ত অবিকৃত অবস্থায় হিমঘরে বাঁচিয়ে রাখা যাবে। জীবনের প্রতি মানুষের যে মোহ, বা বেঁচে থাকবার উগ্র ইচ্ছে, একে আশ্রয় করে, মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমেরিকান অসৎ কোম্পানিগুলো ব্যবসায় নেমেছে। ভাবলে অবাক হতে হয়। এরা কি জানেনা, মরা মানুষ কখনোই বেঁচে উঠতে পারে না। এরা কি জানে না, বৃদ্ধ কখনো শিশু বা যুবক হতে পারে না। বাংলা একটা সিনেমায় দেখেছিলাম, যুবক হবার জন্য, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাগন কিভাবে এঁদো পুকুরে ডুব দিচ্ছে, আর যৌবন ফিরে পাচ্ছে । মানুষের এই কল্পনা কি বাস্তবে পরিণত হতে পারে ? যযাতি কথা আমরা মহাভারতে পড়েছি। যিনি বৃদ্ধ বয়স থেকে যুবক বয়সে ফিরে এসে জীবনকে উপভোগ করেছিলেন। সত্যিই কি এটা সম্ভব ? যদি সম্ভব হয়, তবে কিভাবে সম্ভব ? আর যদি সম্ভব না হয়, তবে কেন সম্ভব নয় ? এই সম্পর্কে আজ আমরা শুনবো। মৃত্যুকে ভালোভাবে বুঝতে গেলে আমাদের প্রথমে জন্মকে বুঝতে হবে।
দেখুন পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছু হয় না। জীবন প্রবাহ কোনো সরলরেখা নয় যে চলতেই থাকবে। জীবন প্রবাহ একটি বৃত্ত, যা ঘুরেঘুরে একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে মিলিত হয়। বার বার মিলিত হয়। আমরা জানি সন্তান জন্মের জন্য, পিতার শুক্রশক্তি ও মাতার রজঃ শক্তির মিলনে তৈরী হয় ভ্রূণ। এই ভ্রূণ ধীরে ধীরে মাতা-পিতার অবয়ব গ্রহণ করে থাকে। এতদিন আমরা জানতাম এই দুই শক্তি একই শরীরে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানীগন বলছেন, কোনো কোনো মানুষের শরীরে অর্থাৎ যাকে রাপান্তরকামী বা নপুংশক বলে থাকি তাদের শরীরে এই দুই শক্তিই বর্তমান। এখন সমকামিতার দ্বারা যদি এই দুই শক্তিকে জাগ্রত করা যায়, তবে সেই নপুংশক মায়ের শরীরে পুরুষের শুক্র প্রবেশ না করিয়ে সন্তান উৎপাদন সম্ভব। এছাড়া টেস্ট টিউব বেবির কথা এখনতো পরীক্ষিত সত্য।
জীবন অসীম সম্ভাবনাময়, এখানে যা কিছু ঘটতে পারে। এখানে মানুষের একটা নির্দিষ্ট আয়ু আছে। আবার দেখুন, শিব-কৃষ্ণ-কালী সবাই ক্রিয়াশীল বলে আমাদের ধারণা। হোক না তারা দেবতা কিন্তু তার আমাদের সহায় হতে পারে বলে আমাদের মনে করি। অর্থাৎ তারা কি সবাই বেঁচে আছে ? বা তাদের পক্ষে কি কোন কার্য্য সম্পাদন করা সম্ভব ? কেউ কেউ বলে থাকেন, আপেক্ষিকতা, কালের গতিকে রুদ্ধ করা, সময়ের কাছে নিজেকে বেঁধে রাখা, আলোর গতিকে বুঝলে, আমরা আমাদেরকে অমর করতে পারি।
আসলে আমরা সবাই বেঁচে থাকতে চাই, তা সে আমাদের জীবনেে যতই দুঃখ-কষ্ট থাকুক না কেন। আর এই কারণেই আমরা হাজার হাজার বছর যাবৎ সাধনা করতেও প্রস্তুত। যেকোনো মূল্য ধরে দিতে পারি - এজন্য। কিন্তু সত্য হচ্ছে, মৃত্যু যেমন অবশ্যম্ভাবী, তেমনি মৃত্যু আমাদের আবশ্যিক। মৃত্যু আমাদের যেমন নতুন শরীর দান করে থাকে, তেমনি জীবনের ধারাবাহিকতা আমাদের জীবনকে সংস্কার করে থাকে এই মৃত্যু ।
আমরা জানি, আমাদের এই শরীর অসংখ্য কোষের সমষ্টি। প্রতিদিন আমাদের শরীরের এক থেকে দেড় ভাগ কোষ মারা যায়। আর তার জায়গায় নতুন কোষের জন্ম হয়। এর মধ্যে কোনো কোষ স্বল্প সময় বাঁচে, কিছু কোষ কিছুদিন বাঁচে, কিছু কোষ কয়েক-মাস বা কয়েক বছর বাঁচে। ৭ বছরের বেশী আমাদের আমাদের শরীরে কোনো কোষই বেঁচে থাকতে পারে না। শৈশবে আমাদের শরীরের কোষের জন্মহার, কোষের মৃত্যু-হারের তুলনায় বেশী থাকে। আমাদের যখন ২৮ বছর বয়স হয়, তখন এই মাত্রা সমান সমান হয়ে যায়। ৫৬ বছর পর থেকে কোষের মৃত্যুহার জন্ম হারের তুলনায় বেশি হতে শুরু করে থাকে। এতে করে আমাদের শরীর দিন দিন ক্ষীণ হতে থাকে। এই হিসেবে ধরলে আমাদের গড় আয়ু হওয়া উচিত, ২৮*৩ = ৮৪ বছর। কিন্তু মানুষ এর আগেই মারা যেতে পারে আবার ৮৪ বছর পরেও বেঁচে থাকতে পারে, সেটি নির্ভর করে তার জীবনশৈলীর উপরে। আকস্মিক দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, ইত্যাদি অস্বাভাবিক কারনে মৃত্যু এই নিয়মের মধ্যে পরে না। প্রত্যেক মানুষের বৃদ্ধি যেমন নির্ভর করছে, তার শরীরের কোষ বৃদ্ধির উপরে, তেমনি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নির্ভর করে, ভ্রূণ তৈরির উপরে। আমাদের শরীরের এই কোষ এক থেকে দেড় ভাগ মারা যায় প্রতিদিন, আবার মোট জনসংখ্যার এক থেকে দেড় ভাগ মারা যায়, প্রতিদিন। কিন্তু মৃত্যুর হার জন্মের তুলনায় কম। তাই পৃথিবীতে জনসংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কিন্তু পৃথিবীর আয়তন বা ওজনের কোনো হেরফের হচ্ছে বলে শোনা যায় না।
আসলে কেউ আসছে, কেউ যাচ্ছে, অর্থাৎ পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় জন্ম-মৃত্যু চলছে, জীব ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে, নিকৃষ্টতর জীব-জন্তু ধীরে ধীরে পৃথিবী থেকে লোপ পাচ্ছে। এককালে যেমন ডাইনোসর পৃথিবীর উপরে দাপিয়ে বেরিয়েছে, আজ মানুষ পৃথিবীর দখল নিয়েছে, ভবিষ্যতে এই পৃথিবী অন্য্ কোনো উন্নততর জীবের দখলে চলে যাবে। এই ব্যাপারটা আমাদের নজরে আসে না।
জীব কেন জন্মায় এর বায়োলজিক্যাল ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হলেও, জীব সৃষ্টির কারন বিজ্ঞান এখনো দিতে পারে নি। বলা হয়ে থাকে পৃকৃতির মধ্যে বিবর্তনের যে স্বাভাবিক ধর্ম্ম, সেই ধর্ম্ম অনুযায়ী এই জীবনের সৃষ্ট করেছে। অন্যদিকে মৃত্যুর বায়োলজিক্যাল ব্যাখ্যা দিতে পারলেও, কেনই বা আমাদের মৃত্যু হয়, কেনই বা জন্মের সময় নারী-পুরুষের একটা সমতা রক্ষা হয়, তার ব্যাখ্যা বিজ্ঞান এখনো দিতে পারে নি। আমাদের দর্শনশাস্ত্র এর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছে - অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা নিজেকে নিজের লীলাসংগী করবার জন্য, দ্বিধাবিভক্ত করে থাকেন নিজেকে । আমরা দেখেছি, অনু পরমাণু একটা নির্দিষ্ট আকারের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হলে, আপনা থেকেই দ্বিধা বিভক্ত হয়ে যায়। এর কারন এখনো পাওয়া যায় নি।
বাইরের থেকে দেখলে জীবদেহকে একটা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতোই মনে হয়। জীব প্রকৃতি থেকে তার খাদ্য সংগ্রহ করছে, নিজেকে পরিপুষ্ট করছে, অপ্রয়োজনীয় পদার্থ শরীর থেকে বের করে দিচ্ছে, বংশ বিস্তার করছে, এমনকি নিজের শরীরের ক্ষয়-ক্ষতি নিজেই মেরামত করে নিচ্ছে । এগুলো সে কেন করছে, তা কিন্তু বিজ্ঞান বলতে পারে না। আবার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য, নিজেই নিজের শরীরের মধ্যে সহনশক্তি বা নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে উন্নত করে নিচ্ছে। এই যে স্বাভাবিক ক্রিয়া, এটি সে নিজেকে টিকিয়ে রাখবার জন্য করে থাকে, কিন্তু কোথেকে এই শক্তি সে সংগ্রহ করে থাকে সেই ব্যাখ্যা দেওয়া মুশকিল। আসলে পদার্থ ও শক্তির মিশ্রণ এই জীব সত্ত্বা। আর এই শক্তির আহরণ করে থাকে জীবকুল থেকেই। এ ছাড়াও চেতনশক্তি জীবের আরো একটি লক্ষণ। আর এই চেতন-শক্তিকে বলা হয়ে প্রতিফলিত শক্তি মাত্র।যেমন আমরা জানি,চাঁদের আলো, সূর্য্যের কিরণ মাত্র। সূর্য্যের মূল শক্তির উৎস এখনো, বিজ্ঞান বের করতে পারে নি। সূর্য হিলিয়াম গ্যাসের সাহায্যে উজ্জীবিত থাকে, কিন্তু এই অফুরন্ত হিলিয়াম গ্যাস কে যোগাচ্ছে, বা কোথা থেকে আসছে, সেই ব্যাখ্যা এখনো পাওয়া যায় নি।
উন্নততর জীবের মননশীলতা আছে, যা ব্যাকটেরিয়া বা অনুন্নত জীবের নেই। জীবের ক্ষুদ্র একক কোষ হচ্ছে জীবকোষ। এই কোষের মধ্যে আছে, প্রোটোপ্লাজম। প্রোটোপ্লাজম-এর মধ্যে আছে প্লাস্টিড, মাইটো-কনড্রিয়া । এই কোষ সর্বদা সঞ্চরণশীল। কিন্তু জীব যখন প্রাণহীন হয়, তখন এই সব কোষ চলনশক্তি রোহিত হয়ে যায়। কিন্তু এর রঙের পরিবর্তন হতে থাকে। ধীরে ধীরে তামাটে রঙ ধারণ করে থাকে। এ এক অদ্ভুত খেলা। মৃত শরীরে নতুন কোষের জন্ম হতে পারে না, অথচ ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হতে থাকে।
কোষগুলো তৈরী হয় কতকগুলো মৌলিক পদার্থের সংমিশ্রনে - যেমন কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, ফসফরাস, গন্ধক, পটাশিয়াম, নাইট্রোজেন, ক্যালসিয়াম ম্যাগনেশিয়াম, লোহা, এছাড়াও থাকে বোরন-মলিবডেনাম, তামা, দস্তা, ম্যাঙ্গানিজ ইত্যাদি। এই সব মৌলিক বস্তুর মিশ্রনে একটা নতুন গুনের উৎপন্ন হয়, জেক বলে জীবনীশক্তি। কোষের কেন্দ্রে আছে নিউক্লিয়াস। এই নিউক্লিয়াস হচ্ছে কোষের নিয়ন্ত্রক শক্তি বা বলা যেতে পারে মস্তিস্ক। এই অসংখ্য কোষের সম্মিলিত শক্তি নির্ধারণ করে থাকে পরবর্তী জীবের আকার বা বৈশিষ্ঠ। এদের স্মৃতি ধারণ করবার ক্ষমতা আছে। মানুষের স্মৃতির বৈজ্ঞানিক বিশ্লষন করতে গিয়ে পাওয়া গেছে গেছে DNA (deoxy-ribo-nucleic acid) এবং RNA.ribo-nucleic acid.
DNA - (deoxy-ribo-nucleic acid) - তৈরী হয়, রাইবোস শর্করা, পিউরিন, পাইরিমিডিন ও ফসফেট দিয়ে। এই ডিএনএ আমাদের স্মৃতি ধারণ করে থাকে, এমনকি পূর্বজীবনের স্মৃতি ধারণ করে থাকে। অর্থাৎ জীবের পূর্ব-জীবন সম্পর্কে ধারণা করতে হলে আমাদের এই ডিএনএ পরীক্ষা করতে হয়।
ডিএনএ-অনু বিশেষ এনজাইমের সাহায্যে তৈরী হয় RNA .আরএনএ অনু জীবের নির্দেশ বহন করে থাকে। আমার এই DNA অর্ধেক পাই পিতার দেহ থেকে বাকি অর্ধেক পাই মাতার দেহ থেকে। আমরা সবাই এই জীন বাহিত বলে, আমরা মাতা-পিতার মতো সমস্ত গুন্-স্মৃতি ইত্যাদির বাহক হয়ে থাকি । মানুষের মৃত্যুর পরেও তার সন্তানদের দেহে এই জিনের দেখা মেলে। দেহ থেকে দেহান্তরে এই জীন হাজার হাজার বছর ধরে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। তাই বলা হয়ে থাকে জীবের মৃত্যু হয়, ব্যক্তির মৃত্যু হয়, কিন্তু তার জন্মগত কোনো গুণাবলীর বা স্বভাবের পরিবর্তন হয় না। এ এক আশ্চর্য্য কৌশল।আমরা যেমন আমাদের ছেলে-মেয়ের মধ্যে দিয়ে আমাদের অপূর্ন আশা পূরণ করতে চাই, তেমনি আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদের মধ্যেই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখি।
তো এই কোষের জন্ম-মৃত্যুর মধ্যে যত সময়ের পার্থক্য ঘটতে থাকে, তত জীবের বেড়ে ওঠা ও মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবার ঘটনা নিরন্তর ঘটতে থাকে। জীবন সৃষ্টির প্রক্রিয়া যেমন জটিল জীবের মৃত্যু প্রক্রিয়া তেমনি আরো জটিল। জীবের উন্নতি বিধানের জন্য, মৃত্যুর প্রয়োজন। জীবনের বেঁচে থাকবার জন্য অন্য জীবের মৃত্যু আবশ্যিক। আমরা ভাবি মৃত্যু মানে জীবের ধংশ। ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়, মৃত্যু জীবনকে উন্নত করবার একটা প্রক্রিয়া বিশেষ। মৃত্যু একটা আশ্চার্য্য কারিগরি বিদ্যা যা কোনো অদৃশ্য শক্তি পরিচালনা করে থাকেন। আমাদের মৃত্যু আসে নানান রোগের কাঁধে চেপে। এই রোগ প্রতিহত করবার জন্যও আমাদের শরীরে এন্টিবডি আছে, যাকে আমরা বলে থাকি প্রত্যক্রমন শক্তি বা ইমিউনিটি। জীবন এক অদ্ভুত রহস্যঃ। এই নিয়ে আমরা পরবর্তীতে আবার আলোচনা করবো। আজ এই পর্যন্ত।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
-----------
এয়ারপোর্ট ১ নং থেকে হলদিরাম। হলদিরাম থেকে বাঁ-দিকে চার্নক হাসপাতাল ছুঁয়ে সোজা চিনারপার্ক হয়ে এক্কেবারে নারকেলবাগান (রবীন্দ্র তীর্থ)। সেখান থেকে ডানদিকে (অর্থাৎ সল্টলেকের দিকে) নারকেলবাগানের পরবর্তী বাস-স্টপেজ প্রাইড হোটেল বা বিকেক তীর্থ। এবার আবার ডানদিকে প্রাইড হোটেলের পাশ দিয়ে রাস্তা। প্রাইড হোটেলের নিচে দেখবেন, স্টেট ব্যাঙ্ক, বন্ধন ব্যাংক। এর পরে একটা রাস্তা বাঁ-দিকে গেছে। সেটি ছেড়ে দিন। পরের বাঁ-দিকের রাস্তার নং ৯৯। এই রাস্তায় ঢুকুন চারটি বাড়ি বাদ দিয়ে পঞ্চম বাড়ি। বাড়ির নং BA - ৬৮, (বাড়ির সামনে লেখা আছে) রাস্তার নং. ৯৯, সেক্টর (এরিয়া) -এক, কলকাতা - ১৫৬. প্রাইড হোটেল থেকে ১-২ মিনিট হাটা রাস্তা।
আমার ( বিনয় রায় )-ফোন নং . ৯৮৩০৫৪২১৮৫।
--
--
----------------------
মৃত্যু রহস্যঃ - ৪ প্রাণহীন দেহে প্রাণের সঞ্চার।
যেকোনো ঘটনা ঘটলে, সম্পৃক্ত অসংখ্য সম্ভাব্য ঘটনার জন্ম হতে পারে । এর মধ্যে কোনটা বাস্তবায়িত হবে আর কোনটা বাস্তবায়িত হবে না। আর এটা নির্ভর করছে পরিস্থিতি পরিবেশের উপরে। ধরুন আপনি তীর্থ করতে বেরুলেন। হ্যাঁ আপনি সবকিছু ঠিকঠাক করেই বেরুলেন । কোথা থেকে কোথায় যাবেন, সেখানে কয়দিন থাকবেন। ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ঘটনা বহু সম্ভাবনার জন্ম দেয়। তীর্থ করে আপনি ভালোভাবে নির্দিষ্ট দিনে বাড়ি ফিরে আসতে পারেন। বা আগে-পরে বাড়ি ফিরতে পারেন । আবার দেখা গেলো, আপনি সেখানে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এমনকি আপনি মারাও যেতে পারেন। হয়তো, সেখানে আপনার সাথে কোনো ঋষি মহাপুরুষের সাক্ষাৎ হতে পারে। আপনার মনের একটা পরিবর্তন হতে পারে। আপনি একটা নতুন জীবন পেতে পারেন। ইত্যাদি ইত্যাদি। তো তীর্থ করতে গিয়ে কি হতে পারে, তা আপনি জানেন না, আবার বলা যেতে পারে, আপনি কিন্তু একটা বা একাধিক নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়েই আপনি তীর্থের পথে পা বাড়িয়েছেন । ঠিক তেমনি, আমরা যখন জন্ম গ্রহণ করি, তখন কিঁছু সংকল্প /বাসনা নিয়ে আমরা জন্ম গ্রহণ করে থাকি, বা দেহ ধারণ করে থাকি। কিন্তু আমার জন্ম-নেবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা আরো বহু সম্ভাবনার জন্ম দিয়ে থাকি। অর্থাৎ যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেই, যে জন্ম গ্রহণ করা আমাদের ইচ্ছাধীন, তথাপি একথা সত্য, যে জন্ম গ্রহণ করবার পরে, আমাদের জীবনে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। যা আসলে সম্ভাবনা মাত্র। আপনি জীবনে তথাকথিত প্রতিষ্ঠা পেতে পারেন, আবার নাও পেতে পারেন । আপনি দীর্ঘজিবি হতে পারেন, আবার নাও হতে পারেন। তো কি-কি হতে পারে তা আমাদের অজানা থাকলেও, অনেক কিছুই হতে পারে, সেটি সত্য। আবার এই সম্ভাবনাগুলো যেমন আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে হতে পারে আবার আমাদের আয়াত্ত্বাধীন হতে পারে , এইসবই ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা মাত্র । এই কথাগুলো বুঝতে আমাদের কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়। ঠিক তেমনি আমরা যখন দেহান্তরের জন্য, দেহ থেকে বেরিয়ে পড়ি, অর্থাৎ আমাদের যখন মৃত্যু হয়, তখন অসংখ্য সম্ভাব্য ঘটনার জন্ম হতে পারে। সেগুলো আমরা পরবর্তীতে আলোচনা করবো।
যাক হোক, এই জায়গা থেকে আমরা একটা শিক্ষা নিতে পারি, বা একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে সামনেও আমার অসীম সম্ভাবনা আছে । এবার, এই অসীম সম্ভাবনাগুলো সম্পর্কে আমাদের যদি একটা ধারণা থাকে, একটা জ্ঞান থাকে, তবে আমরা আগে থেকে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি। যেমন যেখানে আপনি তীর্থ করতে যাচ্ছেন, সেখানে আপনি কোথায় থাকবেন, তার জন্য আগে থেকেই হোটেল বুকিং করতে রাখতে পারেন। কতদিন থাকবেন, তার জন্য কত টাকা লাগতে পারে, তার ব্যবস্থা আগে থেকে করে নিতে পারেন।সেখানকার জলবায়ু সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে, একটা ছাতা বা শীতবস্ত্রের ব্যবস্থা রাখতে পারেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এতে করে আপনার যাত্রাকালীন সম্ভাব্য অসুবিধাগুলো, যা ঘটতেও পারে, আবার নাও ঘটতে পারে, সেগুলো দূর হতে পারে। এছাড়া অনেক ভ্রমন সংস্থা আছে, তাদের সাথে যদি আপনি তীর্থযাত্রায় বেড়োন, তবে, তারা আপনার অনেক ঝামেলা সামলানোর দায়িত্ব নিয়ে নেবে। এরা যেহেতু বারবার সেখানে গিয়েছে, তো সেখানকার সম্পর্কে তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে। কোথায় ডাক্তার পাওয়া যেতে পারে। কোথায় বাজারঘাট আছে। কোথায় কি পাওয়া যায়। এমনকি কোথায় ভালো-জাগ্রত মন্দির আছে, সে সম্পর্কেও তাদের কাছে, একটা পূর্ব ধারণা আছে। তো ভ্রমন সংস্থা, আপনাকে সাময়িক হলেও একটা নিরাপদ যাত্রার প্রতিশ্রুতি দিতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনি অজানা জায়গায় গিয়েও নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন। পূর্ব পরিকল্পনা মতো ভ্রমন শেষ করে নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে আসতে পারেন।
আমাদের এই জীবনপথে যাত্রা, যা আমাদের দেহ ধারনের মুহূর্ত থেকে শুরু হয়েছে, সেখানেও বহু সম্ভাবনার বিষয় আছে। জীবন হচ্ছে, অসীম সম্ভাবনার ক্ষেত্র। এখানে যেমন মিলন আর বিচ্ছেদের খেলা, কেউ আসে কেউ যায়। আবার জীবন আমাদের আত্মিক উন্নতির অনেক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। আসা-যাওয়া নিয়মে বাঁধা, তেমনি আমাদের আত্মিক উন্নতিও নিয়মে বাঁধা । কিন্তু সেই নিয়ম আমাদের জানা নেই। কেনই বা আসি, কেনই বা যাই। কখন আসি আর কখন আমাদের চলে যেতে হয়। এ সম্পর্কে আমাদের কোনো পরিষ্কার ধারণা নেই। আবার ও ঠিক কিছু কিছু নিয়ম আমাদের জানা আছে। কবে মারা যাবো তা আমরা জানি না। কিন্তু এটা জানি আমাদের একদিন মরতেই হবে, এবং সেটা ৮০ থেকে ১০০ বছরের বেশি না হবার সম্ভাবনা। আমরা জানি, শরীর থাকলে রোগভোগ থাকবে, কিন্তু এটা জানি না কবে কিভাবে কোন রোগের প্রকোপে আমাদের পড়তে হবে। শেষ জীবন আমার কেমন হবে, তা আমরা জানি না । এসবই আমাদের কাছে ধোঁয়া ধোঁয়া একটা অস্পষ্ট ধারণা মাত্র। নির্দিষ্ট করে আমাদের পক্ষে কিছুই বলা সম্ভব নয়।
আমরা সবাই জানি, জীবন হচ্ছে শ্বাসের খেলা বা প্রাণশক্তির খেলা। প্রাণশক্তি যখন স্পন্দিত হয়, তখন সে গতি লাভ করে থাকে। এই প্রাণশক্তিকে উপনিষদ বলছে ব্রহ্ম। প্রাণশক্তির এই গতিশীল স্পন্দন বহির্জগতে তাপ, আলো, মহাকর্ষ, তড়িৎ, এমনকি জল-মৃত্তিকা সৃষ্টির কারন। এদের মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে, উৎপন্ন হয় পঞ্চভূত। পঞ্চভূতের মিশ্রনের তারতম্য অনুযায়ী জন্ম হয় বিভিন্ন আকারের বস্তু যা ধীরে ধীরে রূপান্তর হতে হতে তৈরি হয় প্রাণীদেহ। এরা সবাই সেই প্রাণশক্তির নিয়মের অধীনে কাজ করে থাকে। এমনকি আমাদের অন্তর্জগতে যে ক্রিয়া চলছে, তা সবই এই প্রাণশক্তির ক্রিয়া, যার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে চৈতন্য শক্তি ।
অর্থাৎ বিশ্বের উৎপত্তি হচ্ছে প্রাণশক্তি থেকে। যাকে উপনিষদ বলছে ব্রহ্ম। কেউ বলছেন পরমাত্মা। কেউ কেউ অবশ্য এই প্রাণশক্তির উপরে পরব্রহ্মের কথা বলেছেন। আমরা সেই আলোচনায় যাবো না। যাইহোক, এই প্রাণশক্তি থেকে প্রথমে উৎপন্ন হয়, আকাশ। আকাশের মধ্যে উৎপন্ন হলো ঈথার । ঈথার সম্পর্কে বিশেষ কিছু এখনো জানা নেই, তবে অনুমান করা হয়, ঈথার মহাশূন্য পরিব্যাপ্ত অতিসুক্ষ পদার্থ বিশেষ। অর্থাৎ আকাশের যেমন সীমা পরিসীমা নেই, তেমনি এই ঈথারের কোনো সীমা পরিসীমা নেই। এমনকি পরিমাপ করা সম্ভব নয়। বলা হয়ে থাকে, ঈথার আকাশকে পূরণ করে রাখে। অর্থাৎ আকাশকে ধরে রেখেছে, এক চিরন্তন-বিশ্বশক্তি (পরব্রহ্ম)। আর আকাশ ধরে রেখেছে ঈথারকে অর্থাৎ সূক্ষাতিসূক্ষ পদার্থ বিশেষকে। প্রাণশক্তি বা বিশ্বশক্তি বা ব্রহ্ম যখন এই পরমাণুর মধ্যে স্পন্দন সৃষ্টি করছেন, তখন পরমাণুগুলো একে অপরকে আকৃষ্ট করছে, এবং গঠিত হচ্ছে অনু। আবার অণুগুলোর মধ্যে আকর্ষণ বিকর্ষনের ফলে তৈরী হয়েছে পঞ্চভূত। ক্ষিতি,অপ,তেজ,মরুৎ ব্যোম। সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে, শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ নামক গুনগুলোর।
আমাদের মনে হতে পারে, এই ক্রিয়া প্রাকৃতিকভাবেই সংগঠিত হচ্ছে, কিন্তু সত্য হচ্ছে একটা বৃহৎশক্তি একে পরিচালনা করছে। এই বৃহৎ শক্তিই হচ্ছে প্রাণ শক্তি, বা ব্রহ্ম, আর উপরে আছেন, পরব্রহ্ম । দেখুন জড় বস্তুর মধ্যে উত্তাপ, বিদ্যুৎ, আকর্ষণ-বিকর্ষণ, এমনি নানান শক্তি অবশ্যই আছে। কিন্তু এর মুলে আছে, প্রাণশক্তি। আমরা উপনিষদে দেখেছি, সমস্ত ইন্দ্রিয়ের রাজা হচ্ছে প্রাণ। এমনকি মনেরও রাজা হচ্ছে প্রাণশক্তি। আমাদের দেহের যে স্বয়ংক্রিয় তন্ত্র অর্থাৎ হজম করা, স্বাস-প্রশ্বাস, অপ্রোজনীয় খাদ্যাবশেষ বের করে দেওয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি যা কিছু স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা আছে, সেই সব ক্রিয়া পরিচালনা করে থাকে প্রাণশক্তি। প্রাণশক্তি না চাইলে আমাদের দেহরূপ জড়বস্তু কোনো ক্রিয়াই করতে সক্ষম হয় না। আমাদের দেহে যখন প্রাণশক্তি ক্রিয়াশীল না থাকে তখন আমাদের এই জীবদেহ মৃতদেহ বা নিষ্প্রাণবস্তু বই কিছু নয়। কিন্তু আবার এটাও সত্য যে সমস্ত ভৌতিক বা অভৌতিক সমস্ত বস্তুর মধ্যেই এই শক্তি অবশ্য়ই সদা বিদ্যমান।
আগেই বলেছি, উপনিষদ এই প্রাণশক্তিকে বলছে ব্রহ্ম । আবার এই ব্রহ্মের মধ্যেই প্রাণশক্তি ও চৈতন্য শক্তি অভিন্ন। প্রাণহীন চৈতন্য যেমন হয় না, তেমনি প্রাণের মধ্যেই চৈতন্য ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। আবার বুদ্ধির প্রকাশ দেখলেই বুঝতে হবে সেখানে প্রাণ বিদ্যমান। জগতে প্রাণহীন বলে কোনো বস্তু হয় না। সমস্ত বিশ্বই প্রাণময়। এমনকি আমাদের মৃতদেহের মধ্যেও প্রাণের উপস্থিতি আছে। অনু-পরমাণুর মধ্যেও প্রানের অস্তিত্ত্ব আছে। প্রাণ আমাদেরকে গতিশীল করে রেখেছে। এখন কথা হচ্ছে মৃত দেহের মধ্যে যদি প্রাণ থাকে তবে, আমাদের এই মৃতদেহকে প্রাণহীন বলা হয় কেন ? আর আমরা গতিশীল থাকতে পারি না কেন ? আসলে অজৈব বস্তুতে প্রাণের প্রকাশ রুদ্ধ হয়ে থাকে। প্রাণের স্পন্দন সেখানে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই তাকে আমার মৃত বা জড় বস্তু বলে থাকি। এর পরের দিন আমরা আলোচনা শুনবো, প্রাণ কিভাবে ও কখন আমাদের মধ্যে প্রবেশ করে গতিশীল হয়, আবার কোথায় কিভাবে প্রাণের প্রকাশ রুদ্ধ হয়ে যায়। আবার পুনরায় কোথায় কিভাবে ধীরে ধীরে আমরা প্রাণের প্রকাশকে গতিশীল হতে দেখতে পারি। আসলে জীবন মৃত্যু একটা অসীম সম্ভাবনা - এখানে যাকিছু হতে পারে।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
মৃত্যু রহস্যঃ : ৫ : অমর মৃত্যুকথা ।
এক স্বামীজী একসময় আমাকে একটা বিষ্ময়কর কথা বলেছিলেন। বলছেন, মানুষ এমনকি সমস্ত জীবজন্তু লড়াই করে বেঁচে থাকবার জন্য। আর সন্যাসী-সাধকগণ লড়াই করেন মৃত্যুর জন্য। জীবজগৎ মৃত্যুকে ভয় পায়, আর যোগী-সান্যাসীগণ সেই মৃত্যুর দেবতার সঙ্গে আলিঙ্গন করবার জন্য আকুলিত হয়। তুমি যদি যোগীদের যোগক্রিয়া সম্পর্কে অনুসন্ধান করো তাহলে দেখতে পাবে, তাঁরা প্রাণশক্তিকে রুদ্ধ করবার চেষ্টা করছে। আর এটা সবাই জানে, প্রাণশক্তিকে রুদ্ধ করা মানে মৃত্যুকে ডেকে আনা। তো যোগক্রিয়া হচ্ছে, মৃত্যুকে ডেকে আনার একটা প্রক্রিয়া মাত্র। আসলে সমাধির অর্থই হচ্ছে, প্রাণশক্তির গতিকে ধীর করা। আর কৈবল্য হচ্ছে, প্রাণশক্তির গতিকে রুদ্ধ করা। তাই কৈবল্য অবস্থায়, মানুষ শরীর ছেড়ে দেয়। অর্থাৎ আত্মা বা চৈতন্য-শক্তি শরীর ছেড়ে অনন্তে আশ্রয় নেয়।
আজ আমরা কিছু যোগীপুরুষের মৃত্যুকালীন অবস্থা সম্পর্কে শুনবো। আসলে মৃত্যু মানে তো ধংশ নয়, মৃত্যু মানে, পরিবর্তন মাত্র। স্বামী বিবেকানন্দ যেদিন দেহত্যাগ করেন, সেই ৪-জুলাই, ১৯০২ শুক্রবার (বাংলা ২০ আষাঢ় ১৩০৯ সাল ) স্বামীজী দুপুর ১১ তা নাগাদ, স্বামী শুদ্ধানন্দ শুক্ল-যজুর্বেদ থেকে একটা মন্ত্র ও তার অর্থ পাঠ শুনেছিলেন :
মন্ত্রটি হচ্ছে : সুষুম্নঃ সূর্য্যরশ্মি-চন্দ্রমা গন্ধর্বস্তস্য নক্ষত্রান্যপ্সরসো ভেকুরয়ো নাম।
স ন ইদং ব্রহ্মক্ষত্ৰং পাতু তস্মৈ স্বাহা বাট্ তাভ্যঃ স্বাহা।
হরফ প্রকাশণী গ্রন্থে এর অর্থ লেখা আছে, "যজ্ঞের দ্বারা সুখপ্রদ, সূর্য্যের কিরণতুল্য চন্দ্রমা রূপ গন্ধর্ব ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় আমাদের রক্ষা করুন। স্বাহা ও বষট্ মন্ত্রে তাকে আহুতি দিচ্ছি। তার কান্তি বিকিরণকারী নক্ষত্র নামে অপ্সরা আছে, তাকে স্বাহা মন্ত্রে আহুতি দিচ্ছি।"
জানিনা এই অর্থ তিনি শুনেছিলেন কি না, তবে, যাই তিনি শুনেছিলেন, সেই অর্থ শুনে স্বামীজী বলেছিলেন, এই ব্যাখ্যা আমার মনে লাগছে না। ভাষ্যকার সুষুম্না পথের যে ব্যাখ্যাই সেকালে করুন না কেন, পরবর্তীকালে তন্ত্রাদিতে দেহ-অভ্যন্তরস্থ সুষুম্না নাড়ী বলে যা উক্ত হয়েছে, তারই বীজ এই বৈদিক মন্ত্রে নিহিত রয়েছে।"
এই মন্ত্রে, আসলে যজ্ঞ বলতে বোঝায়, যোগক্রিয়া। এই যোগক্রিয়া দ্বারা আমাদের শরীরে সূর্য্যের কিরণ তুল্য তেজ সংগঠিত হয়, চন্দ্রমা অর্থাৎ চাঁদের যে জ্যোৎস্না সেই স্নিগ্ধতা ভরপুর হয়ে ওঠে শরীর। বিশ্বশক্তি আমাদের সবার শরীরে সুষুম্না নাড়িকে আশ্রয় করে থাকে। সকলের মস্তিষ্কের মধ্যস্থলের ঠিক উপরিভাগে, বিন্দু বা রবি কল্পিত হয়, হৃদয় অন্তরীক্ষ রূপে কল্পিত হয়, স্বর্গলোক আমাদের মস্তক, ভূলোক আমাদের পা। শরীরস্থিত জলে অবস্থান করে থাকে আমাদের প্রাণবায়ু বা আয়ু। যা শরীর ছাড়ার পরে সূক্ষাতি-সূক্ষ্ম অবস্থায়,বায়ুকে আশ্রয় করে থাকে। এই আহুতি আসলে যোগক্রিয়া। যোগ বলতে আমরা বুঝি বায়ুর ক্রিয়া - বায়ুকে শরীরের মধ্যে ইচ্ছেমতো পরিচালনা করা। বায়ুকে বিভিন্ন নাড়ীর মধ্যে সঞ্চালন করা। আর এর ফলেই উজ্জীবিত হয়, বা প্রকাশ পায় বায়ুর বিভিন্ন গুন্।
আসলে আমরা আলোচনা করছিলাম মৃত্যু নিয়ে। দেহ থেকে প্রাণ বেরিয়ে যাওয়া মানে মৃত্যু, অথবা শরীরের মধ্যে প্রাণের প্রবেশর অর্থ জন্ম। এই প্রসঙ্গে, দুই একজন মহাত্মার মৃত্যুকালীন অবস্থা দেখে নেবো। স্বামী বিবেকানন্দের দেহত্যাগের প্রক্রিয়া সম্পর্কে শুনে নেবো। তার আগে একটা কথা বলি, আপনারা শুনে থাকবেন, ঠাকুর রামকৃষ্ণ মৃত্যুর আগে পঞ্জিকা পড়ে শোনাতে বলতেন। স্বামীজীও মৃত্যুর আগে পঞ্জিকা নাড়াচড়া করতেন। আসলে শুভক্ষণ-এর অপেক্ষা করতেন আমরা মহাত্মা ভীষ্মকেও দেখেছি, শরশয্যায় অসীম শারীরিক যন্ত্রনা সহ্য করেও তিনি উত্তরায়ণের অপেক্ষায় নিজের শরীরে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অর্থাৎ একটা বিশেষ ক্ষনে তাঁরা দেহ ছেড়ে অনন্তে যাত্রা করতে চান।
যাই হোক, স্বামীজীর দেহান্তর প্রক্রিয়া কিভাবে সংগঠিত হয়েছিল, সেটা আমরা একবার শুনে নেবো। সন্ধ্যা ৭টা বাজে। বেলুড় মঠে তখন সন্ধ্যারতির ঘন্টা বেজেছে। স্বামীজী নিজের ঘরে গঙ্গারদিকে মুখ করে বসলেন অর্থাৎ পূর্ব দিকে মুখ করে বসলেন। ব্রজেন্দ্র নামে এক অল্প-বয়সী সন্যাসী যে তার মৃত্যুকালীন একমাত্র সাক্ষী ছিল, তাকে বাইরে বসে ধ্যান করতে আদেশ দিলেন । নিজে জপের মালা হাতে নিয়ে ধ্যানে বসলেন ঘরের মধ্যে । একঘন্টা পরে, অর্থাৎ ৮টা নাগাদ স্বামীজী ব্রজেন্দ্রকে ডেকে বাতাস করতে বললেন। স্বামীজীর ভীষণ গরম বোধ হতে লাগলো। দরজা-জানলা খুলে দিতে বলে শুয়ে পড়লেন। হাতে জপের মালা। ব্রজেন্দ্রকে পা টিপে দিতে বললেন। এইভাবে প্রায় একঘন্টা কেটে গেলে, স্বামীজী ডান দিকে কাত হয়ে শুলেন। স্বামীজীর মুখ দিয়ে বাচ্চার কান্নার মতো অস্পষ্ট ধ্বনি বেরিয়ে এলো। রাত ন'টার কাছাকাছি, তার ডানহাত কেঁপে-কেঁপে উঠতে লাগলো। সঙ্গে গভীর নিশ্বাস ছাড়লেন। মাথা বালিশ থেকে গড়িয়ে গেলো। দুই এক-মিনিট পরে, তিনি আরো একবার গভীর নিঃশ্বাস ফেললেন। তারপর সব স্থির হয়ে গেলো। এখন রাত্রি ৯টা বেজে দশ মিনিট। ডাক্তাররা কেউ বললেন, সন্যাস রোগে মারা গেছেন, কেউ বললেন, মাথার শিরা ছিড়ে গেছে, আবার কেউ বললেন হৃৎক্রিয়া বন্ধ হওয়াই মৃত্যুর কারন। ভক্তগন বুঝলেন, স্বামীজী যোগ-অবলম্বনে, সমাধিমার্গে দেহত্যাগ করেছেন।
আমরা জানি, মহামতি ভীষ্ম শরশয্যায় থাকাকালীন দেহ ত্যাগ করেছিলেন। এই অবস্থাতেই, তিনি তার প্রিয়জনদের সাথে বিভিন্ন প্রসঙ্গে উপদেশের কথা শুনিয়েছিলেন। মৃত্যুর ঠিক আগে, ভীষ্ম প্রথমে মৌনতা অবলম্বন করলেন। মূলাধারে চিত্তকে সন্নিবেশিত করে যোগ অবলম্বন করলেন। এর পর তিনি অন্তর-কুম্ভক করলেন। বায়ুকে নিরুদ্ধ করার ফলে প্রাণবায়ু নিরুদ্ধ হলো। এরপর বায়ু উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হলো। এবার যে যে অঙ্গ পরিত্যাগ করে বায়ু ক্রমশ উর্দ্ধে উঠতে হতে লাগলো, তাঁর সেই সেই অঙ্গ শরশুন্য অর্থাৎ অগ্নিরোহিত হলো ও বর্নরহিত (ব্রনরহিত) অর্থাৎ চৈতন্যহীন হতে আরম্ভ হলো। সামনে ছিলেন, ব্যাসদেব, অন্যান্য মহর্ষিগন, পান্ডবগন ও স্বয়ং বাসুদেব। কিছুক্ষনের মধ্যেই ভীষ্মের গাত্র থেকে সমস্ত শর-ব্রণো উপনীত হলো, এবং প্রাণবায়ু ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে উল্কার ন্যায় আকাশপথে উত্থিত হলো। ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে আকাশে উত্থিত তেজোরাশি সবার সামনে বিলীন হয়ে গেলো। - মহাভারত - অনুশাসন পর্ব্ব।
যাইহোক, এর আগে আমরা একটা মন্ত্রের কথা শুনেছি । পরে দুইজন মহাত্মার মৃত্যু কালীন অবস্থার কথা শুনলাম। আসলে মৃত্যু হচ্ছে প্রাণবায়ু রুদ্ধ হওয়া। এটা স্বেচ্ছাকৃত হতে পারে, আবার অনিচ্ছাকৃত হতে পারে। আমাদের মতো মানুষ হয়তো অনিচ্ছাকৃত ভাবেই প্রাণবায়ু ত্যাগ করে থাকে। কিন্তু যোগীমহাত্মাগণ ইচ্ছাকৃত ভাবেই প্রাণবায়ু ত্যাগ করে থাকেন। স্বামীজী মৃত্যুর ৫ বছর আগে থেকেই মৃত্যুর কথা বলতেন। শুধু মহাত্মাগণ নন, আমরা সবাই মৃত্যুর আগে, নিজের মনে একটা সারা পেতে থাকি। কেউ সেটা বুঝি কেউ সেটাকে উপেক্ষা করে থাকি।
প্রশ্ন (৩/৭) উপনিষদ বলছে, যদি কোনো মানুষ পুণ্যকর্ম করে থাকে, তবে মৃত্যুকালে উদ্যান বায়ু তাকে সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে দিয়ে পুন্য লোকে নিয়ে যায়। অর্থাৎ মৃত্যুকালীন সময়ে উদান বায়ুর একটা বিশেষ ভূমিকা আছে। (৩/১০) মৃত্যুকালে, জীবাত্মা প্রাণে প্রবেশ করে। সঙ্গে থাকে মন এবং সেই সময়কার মনের চিন্তা ও বাসনা। প্রাণ তখন অগ্নি অর্থাৎ উদান বায়ুর সঙ্গে যুক্ত হয়। কেননা উদানই তাকে দেহের বাইরে নিয়ে যায়।
যাইহোক এতো গেলো মহাত্মাদের স্বাভাবিক মৃত্যুর কথা। কিন্তু মৃত্যুর পরে, আবার দেহে প্রাণের স্পন্দন যে পুনরায় হতে পারে, সেই সম্পর্কে আমরা আরো দুটো গল্প শুনবো, আচার্য্য শংকরের জীবনী (আচার্য শংকর- স্বামী অপূর্বানন্দ পৃ-১০০ এবং পৃ - ৮৪) থেকে। আচার্য শংকর তখন মুকাম্বিকা তীর্থে, অম্বিকাদেবীর মন্দির অভিমুখে চলেছেন। যেতে যেতে রাস্তার মধ্যে, শংকর দেখতে পেলেন, এক দ্বিজদম্পতি মৃতপুত্র কোলে নিয়ে কান্নাকাটি করছেন। তাদের এই ক্রন্দনধ্বনি আচার্যের প্রাণস্পর্শ করলো। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে গেলেন। আর দম্পতি তার মৃত সন্তানকে শঙ্করের চরণতলে রেখে মৃতপুত্রের প্রাণভিক্ষা করতে লাগলেন। শঙ্কর চুপচাপ দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে, ভগবতীর স্তব করতে লাগলেন। কিছুক্ষন পরে, সহসা শিশুদেহে প্রাণের স্পন্দন ফিরে এলো। সবাই আশ্চর্য্য হয়ে শংকরের পদধূলি নিতে লাগলো।
জানিনা এসব গল্প কাহিনী কি না। তবে একটা কথা বলা যেতে পারে, যোগীপুরুষ যোগক্রিয়ার সাহায্যে অনেক বিভূতির অধিকারী হতে পারেন। যা আমরা পতঞ্জলির বিভূতিযোগে দেখতে পাই। তাই লৌকিক দৃষ্টিতে যা অলৌকিক তা যোগীর ইচ্ছাশক্তিতে বাস্তব হতে পারে। আসলে বিশ্বশক্তির ইচ্ছে আর যোগীগণের ইচ্ছের মধ্যে তখন আর ফারাক থাকে না।
এবার একটু অন্য স্বাদের গল্প শুনবো, যেখানে প্রাণ বেরিয়ে যাবার পরে পুনরায় সেই দেহে ফিরে এসেছে, যেখানে অন্য কোনো মহাপুরুষের কৃপা ছিল না। আচার্য শংকরের কাছে, ধর্ম্ম প্রচারের একটা উপায় ছিল, ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের তর্কযুদ্ধে পরাজিত করা। আর তাঁকে এবং তার শিষ্যদের নিজের সম্প্রদায়ভূত করা। তো পণ্ডিত মণ্ডন মিশ্রকে পরাজিত করে, তর্কের শর্ত অনুযায়ী তাকে দীক্ষিত করা কালীন, এক অভূতপূর্ব সমস্যার মধ্যে পড়লেন শংকর। মণ্ডন মিশ্রের স্ত্রী উভয়ভারতী বাধা দিলেন। বললেন,"আত্মনোঽর্ধং পত্নী" - আমি তার পত্নী, আমাকে জয় করে তবে, আমার স্বামীকে শিষ্য করুন। এইধরনের অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য শংকর প্রস্তুত ছিলেন না। আর নারীর সঙ্গে শাস্ত্রীয় বাতবিতণ্ডায় তিনি নিজেকে জড়াতে চাইলেন না। আসলে নারীকে তিনি তার উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী বলে ভাবতেই পারতেন না। তো উমাভারতী ছাড়বার পাত্র নয় - বললেন, ঋষি যাজ্ঞবল্ক গার্গীর সঙ্গে শাস্ত্রীয় বিচারে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। রাজা জনক সুলভার সঙ্গে বিচারে লিপ্ত হয়েছিলেন, তো আপনি কেন আমার সঙ্গে শাস্ত্রীয় বিচারে অনিচ্ছা প্রকাশ করছেন ? তাই যদি হয়, তবে আমার স্বামী যার অর্ধাঙ্গিনী আমি স্বয়ং, তাকে আপনার শিষ্যত্ব গ্রহণের অনুমতি আমি দিচ্ছি না। তো উভয়ভারতী - ছিলেন বিদুষী মহিলা, যার জন্য তাকে বলা হতো সরস্বতীদেবী। তো শংকর বাধ্য হয়ে নিমরাজি হলেন। কিন্তু সরস্বতীদেবী কয়েকটা সূক্ষ্মতর প্রশ্নের ভিতরে প্রবেশ করেই বুঝলেন, শঙ্কর সমস্ত শাস্ত্রে পারঙ্গম। কৌশলে, তার দুর্বল জায়গায় ঘা দিলেন, জিজ্ঞেস করে বসলেন, কামশাস্ত্র বিষয়ক প্রশ্ন। এখন সন্যাসী মানুষ শংকর, তিনি কামশাস্ত্রকে সন্যাস-রীতি অনুযায়ী বরাবর পরিত্যাগ করে এসেছেন। শঙ্কর উত্তরবিমুখ হয়ে, মৌনতা অবলম্বন করলেন। অবশেষে বললেন, আমি এই বিষয়ে মুখ খুললে, সন্ন্যাসের আদর্শ কলুষিত হবে। আমি এই প্রশ্নের জবাব দেব, গ্রন্থের সাহায্যে। দেহান্তরে প্রবেশ করে, আমি এই গ্রন্থ রচনা করবো।
যাইহোক, এর পরে, বনপথে ভ্রমন করতে করতে, একস্থানে গুহার মধ্যে নিজের স্থুল দেহকে রেখে, শিষ্যদেরকে ওই দেহ রক্ষার দায়িত্ত্ব দিয়ে, যোগ অবলম্বন করলেন। আর যোগবলে লিঙ্গ-শরীর ধারণ করলেন, এবং আকস্মিক ভাবে মৃত, রাজা অম্রুকের মৃতদেহে ,সূক্ষ্মদেহে, প্রবেশ করলেন, । রাজগৃহে, রাজদেহে, শঙ্কর কামকলার বিদ্যা আয়ত্ত্ব করলেন। অধ্যয়ন করলেন, কন্দর্প শাস্ত্র। রচনা করলেন, কামকলার উপরে প্রামানিক গ্রন্থ। যদিও এইধরনের কোনো গ্রন্থের সন্ধান আমার জানা নেই।
ঠিক একই ধরনের কাহিনী পাই আমরা মৎস্যেন্দ্রনাথের জীবনে। আমরা যোগী গোরক্ষনাথের কথা শুনেছি। তার জীবনীকার বলছেন, গোরক্ষনাথের গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ তার দেহকে রক্ষা করবার ভার গোরক্ষনাথকে দিয়ে, মৎস্যেন্দ্রনাথ আসামের এক রাজার দেহে প্রবেশ করেছিলেন।
এছাড়া, মহাভারতের শান্তিপর্বে, দেখা যায়, সুলভা নামে এক সন্ন্যাসিনী রাজর্ষি জনক-দেহে প্রবেশ করেছিলেন। আবার অনুশাসন পর্বে আমরা দেখতে পাই, দেবশর্মার শিষ্য বিপুল, গুরুর নির্দেশ অনুসারে তার গুরুপত্নী রুচির দেহে প্রবেশ করেছিলেন।
যাইহোক, এই ঘটনা সত্য না নিতান্তই গল্প, তাও আমার জানা নেই। তবে এই ধরনের ঘটনার কথা অসম্ভব বলে আমি মনে করি না। অলৌকিক বলে উড়িয়ে দিলে, সত্য জানা যাবে না। ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, "বজ্রোলি" যোগবলে পরকায়ে প্রবেশ সম্ভব। অর্থাৎ আত্মাকে প্রাণবায়ুর সঙ্গে অন্য শরীরে প্রবেশ করানো যেতে পারে, আবার একই শরীরে প্রবেশ করানোও যেতে পারে। অন্তত কাহিনী গুলো সেই রকমই আভাস দিচ্ছে।
যাই হোক, আমাদের আলোচ্য বিষয় প্রাণের গমন - নির্গমন। রুদ্ধ প্রাণের গতিকে কিভাবে গতিশীল করা যায়। তো প্রশ্ন উঠতে পারে, সেই আলোচনায় আমরা এতো ভূমিকা করছি কেন ? আসলে, এই বিষয়ের গভীরে যেতে গেলে, প্রথমে একটা বিশ্বাসের বাতাবরণ চাই। এই বিশ্বাস না থাকলে, আমাদের অনুসন্ধানের প্রতি আগ্রহ আসা সম্ভব নয়। বিশ্বাস থেকেই বিজ্ঞানের শুরু হতে পারে। অবিশ্বাস মানুষকে কখনো অনুসন্ধানের জন্য অনুপ্রেরণা দিতে পারে না। আর অনুসন্ধানই সত্যকে উদ্ঘাটন করতে পারে। এই সম্পর্কে আমরা আবার পরের দিন শুনবো। আজ বাক্যের বিরাম দিলাম।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
অমর মৃত্যু কথা- ষষ্ঠ পর্ব। (THE SECRET OF DEATH) - ৬
আসলে শরীরে মধ্যে যে জীবকোষ আছে, তাদের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে আমাদের ফুসফুস। ।
No comments:
Post a Comment