ওম পরমাত্মনে নমঃ। ওম নমঃ শ্রী ভগবতে বাসুদেবায়।
শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা (সংশোধিত)
সূচনা : শ্রীমৎ ভগবৎ গীতা হচ্ছে, একটা দেহতত্ত্বের গানের বই। গীতা মহাভারতের একটাগুরুত্ত্বপূর্ন অংশ মাত্র। গীতাকে বুঝতে গেলে আমাদের দেহের সঙ্গে এই মহাভারতের প্রধান চরিত্রগুলোর সঙ্গে আমাদের কি সম্পর্ক সেটা বুঝতে হবে। তবেই আমরা গীতার যথার্থ মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারবো। গীতায় মোট ১৮টি অধ্যায় আছে আর সমস্ত অধ্যায়ের নাম দেওয়া হয়েছে "যোগ" । যোগ কথাটার অর্থ হচ্ছে মিলন। অর্থাৎ সমস্ত অধ্যায় অধ্যয়নের সাথে সাথে, সাধারণ মানুষ যাতে ঈশ্বরের সাথে মিলনের কথা অনুভব করতে পারেন তারই আলোচনা করা হয়েছে এখানে। অর্থাৎ যতক্ষন আমরা এই আলোচনায় থাকবো, ততক্ষন আমরা ঈশ্বরের সাথেই যুক্ত হয়ে থাকবো। আসলে গীতা শুধু অধ্যয়নের বিষয় নয় এটি চিন্তন মনন ও আচরণে ফুটিয়ে তুলতে পারলে, আমরা এক নতুন জীবন- শৈলীর সন্ধান পাবো।
আসলে আমি যখন খন্ড-বিখন্ড হয়ে যায়, তখন বহু আমিত্বের সৃষ্টি হয়। আর বহু আমিত্ত্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব ও অস্তিত্ত্বের লড়াই অবশ্যাম্ভাবী। আমাদের এই দেহ বহু অঙ্গের সমষ্টি মাত্র। কোনটা একটু কম গুরুত্ত্বপূর্ন কোনটা আবার বেশি গুরুত্ত্বপূর্ন। কিন্তু সবাইকে নিয়েই আমি।আমাদের প্রাণশক্তি, ঘ্রাণশক্তি, বাকশক্তি, শ্রবণশক্তি, স্পর্শশক্তি, এইসব শক্তির মিলিত সত্ত্বাই আমি। আবার এই দেহের বিনাশ ঘটলেও পাঁচটি জ্ঞানীন্দ্রিয় শক্তি ভ্রূণাকারে বেঁচে থাকে। এরাই পান্ডব। কিন্তু মারা যায় আমাদের কর্মশক্তি অর্থাৎ কুরু। তাই গীতা শুনতে গেলে আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের নিজেদের ভিতরে যে অশুভ শক্তি আছে, আর যে শুভ শক্তি আছে, এই দুই শক্তির লড়াইয়ের কাহিনী এটি। এ কোনো সাধারন যুদ্ধের কাহিনী নয়। রূপকের মাধ্যমে আমাদেরকে শোনানো হয়েছে। এবং স্বয়ং মহাযোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই কাহিনীর নায়ক। অর্থাৎ যিনি অবিনাশী অকর্তা তাঁর মুখনিঃসৃত বাণী বা শাশ্বত জ্ঞান এই গীতায় নিহিত আছে। এটি কোনো বিশেষ ধর্মের ব্যাপার নয়, এটি সত্যকে উদ্ঘাটন করা মাত্র।
এই কাহিনীর রূপক চরিত্রগুলোর দিকে আমরা একটু চোখ বুলিয়ে নেই, তাহলে গীতার মর্মার্থ বুঝতে আমাদের সুবিধে হবে। পঞ্চ পান্ডব, দ্রৌপদী ও কুন্তী সব সময় এক জায়গায় থাকেন । এর কারন কি ?
একজন মানুষের মৃত্যু প্রক্রিয়ার সঙ্গে দ্রৌপদী ও পঞ্চপাণ্ডবের মৃত্যু প্রক্রিয়ার সম্পর্ক কী । আর এঁদের জন্মের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কোথায় ? এসব আমাদের ভালো করে বুঝতে হবে, তবেই গীতাকে ধরতে পারবো।
একএক করে পঞ্চপান্ডব সিদ্ধান্ত নিলো তারা রাজ্যপাট দেখাশুনা করবে না। তারা অর্জুন ও সুভদ্রার পুত্র অভিমন্যুর ছেলে পরীক্ষিৎকে হস্তিনাপুরের রাজ্যভার দিলেন। এবং নিজেরা মহাপ্রস্থানের পথে পা বাড়ালেন। পাঁচ পান্ডব ও দ্রৌপদীর মধ্যে, দ্রৌপদীর মৃত্যু হয় সবার আগে।
এই পাঁচ পান্ডব বা দ্রৌপদী, এমনকি দ্রোণাচার্য্য, ভীষ্ম, এঁদের কারুরই জন্ম স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয় নি।
আমরা জানি দ্রৌপদী অগ্নি থেকে উদ্ভূত। অর্থাৎ আমাদের মৃত্যুকালে দেহের এই অগ্নিতেজ আমাদের সবার আগে ছেড়ে যায়। পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কন্যা দ্রৌপদী। এঁর আর এক নাম কৃষ্ণা। গায়ের রঙ কালো বা শ্যামলা। ইনি জন্মেছিলেন, যজ্ঞাগ্নি থেকে। অগ্নিতেজঃ সম্পন্ন আমাদের এই দেহ। মৃত্যুকালে তাই এই অগ্নি আমাদের দেহ ছেড়ে দেয় সবার আগে। পাঁচ পান্ডব ও দ্রৌপদীর মধ্যেও , দ্রৌপদীর মৃত্যু হয় সবার আগে। আমাদের দেহের অগ্নি হচ্ছেন এই মহাভারতের দ্রৌপদী।
আমরা জানি অগ্নি চলে যাবার পরে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ দেহ ছেড়ে চলে যায়। এরা হচ্ছেন নকুল-সহদেব। এঁরা অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের পুত্র। এই অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের মাতা হচ্ছে সংজ্ঞা। ইনি চন্দ্রভার্য্যা। কুমারদ্বয়ের নাম হচ্ছে, আশ্বিন ও রেবন্তঃ। এঁরা জমজপুত্র। এদের দেখতে একই রকম। থাকে একই সাথে। এরা চিকিৎসা বিদ্যায় পারদর্শী। এই কথাগুলোর মাধ্যমে বুঝতে পারবেন, আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস হচ্ছে এই নকুল ও সহদেব। এঁরাই আমাদের সংজ্ঞা দান করে থাকেন। আর এই শ্বাস-প্রশ্বাস আমাদের শরীরের সমস্ত রোগ নিরাময়ে সাহায্য করে থাকে।
অর্জুন : দেবরাজ ইন্দ্রের পুত্র হচ্ছে অর্জুন। ইন্দ্র হচ্ছেন দেবতাদের রাজা। অর্থাৎ সমস্ত শুভশক্তির রাজা। আমাদের মধ্যে যে রাজসিক শক্তি আছে, অর্জুন তার প্রতিভূ। এই রাজসিক শক্তির দ্বারাই আমরা কর্মে লিপ্ত হই। এবং এই শক্তি সুকর্ম দুস্কর্ম দুটোই করতে সক্ষম। তাই অর্জুন হচ্ছে আমাদের পুরুষকার-এর প্রতীক এক শুভশক্তি । ইচ্ছে করলে বা মনে করলে আমরা যুদ্ধ করতেও পারি, আবার নাও পারি। অপ্রতিরোধ্য শক্তি আছে আমাদের মধ্যে। যাকে আমরা শুভ বা অশুভ দুটো কাজেই কাজে ব্যবহার করতে পারি, আবার নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারি । কিন্তু নকুল-সহদেব অর্থাৎ আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস চলে গেলে এই পুরুষকার কোনো কাজে লাগতে পারে না। তাই অর্জুন মারা যান।
ভীম : ভীম হচ্ছে বায়ুপুত্ৰ। বায়ুর অসীম শক্তি। ভীম এই বায়ুর প্রতীক। আমাদের উর্জ্বা শক্তি। বায়ু আমাদের সমস্ত শরীরে পরিব্যাপ্ত। আমরা জানি, বায়ু দশ রকম বা বায়ুর দশটি গুন্ - প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান। এছাড়া আছে, নাগ, কূর্ম, কৃকর (অর্থাৎ কয়ার পাখি) দেবদত্ত্ব ও ধনঞ্জয় । এই মোট দশটি বায়ুর গুন্। প্রাণবায়ু আমাদের হৃদয়ে অবস্থিত। অপান আমাদের গুহ্যদেশে। নাভিদেশে আছে সমান, কন্ঠে উদানবায়ু, এবং সর্বশরীরে ছড়িয়ে আছে ব্যানবায়ু। এই পাঁচটি বায়ু প্রধান। নাগ, কূর্ম, কৃকর, দেবদত্ত্ব ও ধনঞ্জয় - এগুলো আমাদের নাড়ীতে অবস্থান করে। অর্থাৎ আমাদের শরীরে যে হাজার হাজার নাড়ী আছে, তার মধ্যে অবস্থান করে। তবে প্রধানত পাঁচটি নাড়ী অর্থাৎ ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, বজ্রাক্ষ্যা ও চিত্রাণি এই পাঁচটি নাড়ীতে অবস্থান করে। মৃত্যুকালে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলেও, এই বায়ুর ধারাবাহিকতা শেষ হতে সময় নেয়। তাই দেখবেন, ডাক্তাররা, অন্তত ৪ ঘন্টা সময় নেয়, দেহকে প্রাণহীন বলতে। ভীম আমাদের উর্জ্বা দেহ।
যুধিষ্ঠির : ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে একজন যুধিষ্ঠির আছেন। অর্থাৎ ধর্মবুদ্ধি আমাদের সবার আছে। এই ধর্মবুদ্ধি যদি আমাদের সক্রিয় থাকে তবে আমরা ভীম অর্থাৎ শারীরিক বল ও অর্জুন অর্থাৎ অর্থ-ধনুর্বিদ্যা দিয়ে এই ধর্মবুদ্ধিকে কাজে লাগাতে পারি। আর তা না হলে এই ধর্মবুদ্ধি নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে। আর ধর্ম্মবুদ্ধি আমাদের মৃত্যুর পরেও অর্থাৎ স্থুল দেহ ত্যাগের পরেও বেঁচে থাকে। তাই বলা হয়ে থাকে যুধিষ্ঠির সশরীরে স্বর্গে যান।
দুর্যোধন : আমাদের যেমন ধর্মবুদ্ধি আছে, তেমনি আছে আমাদের দুর্বুদ্ধি। এই দুর্বুদ্ধি আমাদের সদা সক্রিয়। এঁকে দমন করা সহজ নয়। সমস্ত শক্তি লাগে এই দুর্বুদ্ধিকে দমন করতে। তাই যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে সঙ্গেই জন্ম নেয় দুর্যোধনও । বলা হয়ে থাকে দুর্যোধন হচ্ছে কলির অংশে জাত । ইনি দুই বছরের উপরে মায়ের গর্ভে ছিলেন। আসলে ধর্ম না এলে অধর্মের আভির্ভাব হতে পারে না। তাই অধর্ম আসে দেরি করে, কিন্তু ধর্মযুদ্ধে অধর্ম-ই আগে চলে যায়।
কুন্তী : কুন্তীর আসল নাম পৃত্থি অর্থাৎ পৃথিবী। কুন্তীর পিতা সুরসেন ভাইয়ের নাম বসুদেব। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের পিতা। শ্রীকৃষ্ণের সম্পর্কে পিসিমা। তো পৃথিবীতেই আমাদের সবার জন্ম। আর আমরা যেখানেই যাই না কেন, পৃথিবী আমাদের সর্বদা আশ্রয় দান করে। পালনকর্ত্রী পৃথিবীকে ছেড়ে আমরা কখনো কোথাও যেতে পারি না। এই পৃথিবীই আমাদের অগ্নি, জল, বায়ুকে ধরে রেখেছে।
আমরা এক এক করে গভীরে যাবো। একটা কথা মনে রাখতে হবে, যা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন - ক্ষেত্র হচ্ছে এই শরীর আর ক্ষেত্রজ্ঞ হচ্ছে শরীরী।
এই কাহিনীর রূপক চরিত্রগুলোর দিকে আমরা একটু চোখ বুলিয়ে নেই, তাহলে গীতার মর্মার্থ বুঝতে আমাদের সুবিধে হবে। পঞ্চ পান্ডব, দ্রৌপদী ও কুন্তী সব সময় এক জায়গায় থাকেন । এর কারন কি ?
একজন মানুষের মৃত্যু প্রক্রিয়ার সঙ্গে দ্রৌপদী ও পঞ্চপাণ্ডবের মৃত্যু প্রক্রিয়ার সম্পর্ক কী । আর এঁদের জন্মের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কোথায় ? এসব আমাদের ভালো করে বুঝতে হবে, তবেই গীতাকে ধরতে পারবো।
একএক করে পঞ্চপান্ডব সিদ্ধান্ত নিলো তারা রাজ্যপাট দেখাশুনা করবে না। তারা অর্জুন ও সুভদ্রার পুত্র অভিমন্যুর ছেলে পরীক্ষিৎকে হস্তিনাপুরের রাজ্যভার দিলেন। এবং নিজেরা মহাপ্রস্থানের পথে পা বাড়ালেন। পাঁচ পান্ডব ও দ্রৌপদীর মধ্যে, দ্রৌপদীর মৃত্যু হয় সবার আগে।
এই পাঁচ পান্ডব বা দ্রৌপদী, এমনকি দ্রোণাচার্য্য, ভীষ্ম, এঁদের কারুরই জন্ম স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয় নি।
আমরা জানি দ্রৌপদী অগ্নি থেকে উদ্ভূত। অর্থাৎ আমাদের মৃত্যুকালে দেহের এই অগ্নিতেজ আমাদের সবার আগে ছেড়ে যায়। পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কন্যা দ্রৌপদী। এঁর আর এক নাম কৃষ্ণা। গায়ের রঙ কালো বা শ্যামলা। ইনি জন্মেছিলেন, যজ্ঞাগ্নি থেকে। অগ্নিতেজঃ সম্পন্ন আমাদের এই দেহ। মৃত্যুকালে তাই এই অগ্নি আমাদের দেহ ছেড়ে দেয় সবার আগে। পাঁচ পান্ডব ও দ্রৌপদীর মধ্যেও , দ্রৌপদীর মৃত্যু হয় সবার আগে। আমাদের দেহের অগ্নি হচ্ছেন এই মহাভারতের দ্রৌপদী।
আমরা জানি অগ্নি চলে যাবার পরে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ দেহ ছেড়ে চলে যায়। এরা হচ্ছেন নকুল-সহদেব। এঁরা অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের পুত্র। এই অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের মাতা হচ্ছে সংজ্ঞা। ইনি চন্দ্রভার্য্যা। কুমারদ্বয়ের নাম হচ্ছে, আশ্বিন ও রেবন্তঃ। এঁরা জমজপুত্র। এদের দেখতে একই রকম। থাকে একই সাথে। এরা চিকিৎসা বিদ্যায় পারদর্শী। এই কথাগুলোর মাধ্যমে বুঝতে পারবেন, আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস হচ্ছে এই নকুল ও সহদেব। এঁরাই আমাদের সংজ্ঞা দান করে থাকেন। আর এই শ্বাস-প্রশ্বাস আমাদের শরীরের সমস্ত রোগ নিরাময়ে সাহায্য করে থাকে।
অর্জুন : দেবরাজ ইন্দ্রের পুত্র হচ্ছে অর্জুন। ইন্দ্র হচ্ছেন দেবতাদের রাজা। অর্থাৎ সমস্ত শুভশক্তির রাজা। আমাদের মধ্যে যে রাজসিক শক্তি আছে, অর্জুন তার প্রতিভূ। এই রাজসিক শক্তির দ্বারাই আমরা কর্মে লিপ্ত হই। এবং এই শক্তি সুকর্ম দুস্কর্ম দুটোই করতে সক্ষম। তাই অর্জুন হচ্ছে আমাদের পুরুষকার-এর প্রতীক এক শুভশক্তি । ইচ্ছে করলে বা মনে করলে আমরা যুদ্ধ করতেও পারি, আবার নাও পারি। অপ্রতিরোধ্য শক্তি আছে আমাদের মধ্যে। যাকে আমরা শুভ বা অশুভ দুটো কাজেই কাজে ব্যবহার করতে পারি, আবার নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারি । কিন্তু নকুল-সহদেব অর্থাৎ আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস চলে গেলে এই পুরুষকার কোনো কাজে লাগতে পারে না। তাই অর্জুন মারা যান।
ভীম : ভীম হচ্ছে বায়ুপুত্ৰ। বায়ুর অসীম শক্তি। ভীম এই বায়ুর প্রতীক। আমাদের উর্জ্বা শক্তি। বায়ু আমাদের সমস্ত শরীরে পরিব্যাপ্ত। আমরা জানি, বায়ু দশ রকম বা বায়ুর দশটি গুন্ - প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান। এছাড়া আছে, নাগ, কূর্ম, কৃকর (অর্থাৎ কয়ার পাখি) দেবদত্ত্ব ও ধনঞ্জয় । এই মোট দশটি বায়ুর গুন্। প্রাণবায়ু আমাদের হৃদয়ে অবস্থিত। অপান আমাদের গুহ্যদেশে। নাভিদেশে আছে সমান, কন্ঠে উদানবায়ু, এবং সর্বশরীরে ছড়িয়ে আছে ব্যানবায়ু। এই পাঁচটি বায়ু প্রধান। নাগ, কূর্ম, কৃকর, দেবদত্ত্ব ও ধনঞ্জয় - এগুলো আমাদের নাড়ীতে অবস্থান করে। অর্থাৎ আমাদের শরীরে যে হাজার হাজার নাড়ী আছে, তার মধ্যে অবস্থান করে। তবে প্রধানত পাঁচটি নাড়ী অর্থাৎ ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, বজ্রাক্ষ্যা ও চিত্রাণি এই পাঁচটি নাড়ীতে অবস্থান করে। মৃত্যুকালে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলেও, এই বায়ুর ধারাবাহিকতা শেষ হতে সময় নেয়। তাই দেখবেন, ডাক্তাররা, অন্তত ৪ ঘন্টা সময় নেয়, দেহকে প্রাণহীন বলতে। ভীম আমাদের উর্জ্বা দেহ।
যুধিষ্ঠির : ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে একজন যুধিষ্ঠির আছেন। অর্থাৎ ধর্মবুদ্ধি আমাদের সবার আছে। এই ধর্মবুদ্ধি যদি আমাদের সক্রিয় থাকে তবে আমরা ভীম অর্থাৎ শারীরিক বল ও অর্জুন অর্থাৎ অর্থ-ধনুর্বিদ্যা দিয়ে এই ধর্মবুদ্ধিকে কাজে লাগাতে পারি। আর তা না হলে এই ধর্মবুদ্ধি নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে। আর ধর্ম্মবুদ্ধি আমাদের মৃত্যুর পরেও অর্থাৎ স্থুল দেহ ত্যাগের পরেও বেঁচে থাকে। তাই বলা হয়ে থাকে যুধিষ্ঠির সশরীরে স্বর্গে যান।
দুর্যোধন : আমাদের যেমন ধর্মবুদ্ধি আছে, তেমনি আছে আমাদের দুর্বুদ্ধি। এই দুর্বুদ্ধি আমাদের সদা সক্রিয়। এঁকে দমন করা সহজ নয়। সমস্ত শক্তি লাগে এই দুর্বুদ্ধিকে দমন করতে। তাই যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে সঙ্গেই জন্ম নেয় দুর্যোধনও । বলা হয়ে থাকে দুর্যোধন হচ্ছে কলির অংশে জাত । ইনি দুই বছরের উপরে মায়ের গর্ভে ছিলেন। আসলে ধর্ম না এলে অধর্মের আভির্ভাব হতে পারে না। তাই অধর্ম আসে দেরি করে, কিন্তু ধর্মযুদ্ধে অধর্ম-ই আগে চলে যায়।
কুন্তী : কুন্তীর আসল নাম পৃত্থি অর্থাৎ পৃথিবী। কুন্তীর পিতা সুরসেন ভাইয়ের নাম বসুদেব। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের পিতা। শ্রীকৃষ্ণের সম্পর্কে পিসিমা। তো পৃথিবীতেই আমাদের সবার জন্ম। আর আমরা যেখানেই যাই না কেন, পৃথিবী আমাদের সর্বদা আশ্রয় দান করে। পালনকর্ত্রী পৃথিবীকে ছেড়ে আমরা কখনো কোথাও যেতে পারি না। এই পৃথিবীই আমাদের অগ্নি, জল, বায়ুকে ধরে রেখেছে।
আমরা এক এক করে গভীরে যাবো। একটা কথা মনে রাখতে হবে, যা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন - ক্ষেত্র হচ্ছে এই শরীর আর ক্ষেত্রজ্ঞ হচ্ছে শরীরী।
মহাভারতের ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত ১৩-৪২ অধ্যায় পর্যন্ত গীতার আলোচনা।
ধৃতরাষ্ট্র বললেন - হে সঞ্জয়, ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধে উদ্যত আমার পুত্রগণ, ও পাণ্ডর পুত্রগণ কি করলো?
ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ।
মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈবঃ কিমকুর্বত সঞ্জয়। । (১/১)
ভগবৎ গীতার প্রথম বক্তা ধৃতরাষ্ট্র। শ্রোতা সঞ্জয়। ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ। পুত্র স্নেহে অন্ধ। এনার ন্যায়-অন্যায় টনটনে জ্ঞান আছে। কিনতু স্বার্থ বিঘ্ন্ হলে, অন্যায়কে সমর্থন করে বসেন। ইনি পরামর্শ দাতাদের কথা শোনেন, বোঝেন কিনতু সেই অনুযায়ী চলেন না। কারণ সত্য পথে চলার অক্ষমতা। আমরা যারা গীতার শ্রোতা বা পাঠক তারাও ভালো মন্দ সব বুঝি কিনতু করি না। আমাদের মতো জ্ঞানান্ধ যতদিন থাকবে তত দিন এই গীতার শ্রোতা বা পাঠক থাকবে।
আসলে আমাদের দুটি সত্ত্বা। একটা ভালো আমি, আর একটা খারাপ আমি। একটা ভিতরের আমি আর একটা বাইরের আমি। এই ধৃতরাষ্ট্র হচ্ছে আমাদের বাইরের আমি। অর্থাৎ এই দেহরূপ আমি।আর অর্জুন হচ্ছে আমাদের ভিতরের আমি। প্রথম প্রশ্নটা আমাদের এই বাইরের আমি করছে। করছে কাকে ? করছে সঞ্জয়কে। সঞ্জয় কে ? সঞ্জয় হচ্ছে ধৃতরাষ্ট্রের সারথি। অর্থাৎ আমাদের দেহধারী গুরু। আমাদের বাইরের আমি যখন বিপদে পড়ে, তখন সে গুরুর আশ্রয় নেয়। কিন্তু এই গুরুকেও সে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। সে মনে করে, এই দেহধারী গুরুর থেকে সে কম বোঝে না। এই গুরুকে সে শুদ্র অর্থাৎ অজ্ঞানী মনে করে। তার কারন আমিতো শিক্ষিত। আমিতো অঢেল ধনের অধিকারী। এই গুরু আমার অন্ন খেয়ে বেঁচে থাকে। শুদ্র কিন্তু সবাইকে আশ্রয় দেয়। মান অপমান তার কাছে সমান। গুরু তবু ভগবানের কথা শোনায়। আর আমরা জ্ঞানান্ধ এই সব কথা শুনি। কিন্তু বুঝি না। সঞ্জয় সম্পর্কে আর একটা ব্যাখ্যা হচ্ছে, সঞ্জয় হচ্ছে আমাদের স্মৃতি। আসলে যুদ্ধ তো দশ দিন হয়ে গেছে । এখন সেই ঘটনার স্মৃতি চারণ চলছে।
ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ।
মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈবঃ কিমকুর্বত সঞ্জয়। । (১/১)
ভগবৎ গীতার প্রথম বক্তা ধৃতরাষ্ট্র। শ্রোতা সঞ্জয়। ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ। পুত্র স্নেহে অন্ধ। এনার ন্যায়-অন্যায় টনটনে জ্ঞান আছে। কিনতু স্বার্থ বিঘ্ন্ হলে, অন্যায়কে সমর্থন করে বসেন। ইনি পরামর্শ দাতাদের কথা শোনেন, বোঝেন কিনতু সেই অনুযায়ী চলেন না। কারণ সত্য পথে চলার অক্ষমতা। আমরা যারা গীতার শ্রোতা বা পাঠক তারাও ভালো মন্দ সব বুঝি কিনতু করি না। আমাদের মতো জ্ঞানান্ধ যতদিন থাকবে তত দিন এই গীতার শ্রোতা বা পাঠক থাকবে।
আসলে আমাদের দুটি সত্ত্বা। একটা ভালো আমি, আর একটা খারাপ আমি। একটা ভিতরের আমি আর একটা বাইরের আমি। এই ধৃতরাষ্ট্র হচ্ছে আমাদের বাইরের আমি। অর্থাৎ এই দেহরূপ আমি।আর অর্জুন হচ্ছে আমাদের ভিতরের আমি। প্রথম প্রশ্নটা আমাদের এই বাইরের আমি করছে। করছে কাকে ? করছে সঞ্জয়কে। সঞ্জয় কে ? সঞ্জয় হচ্ছে ধৃতরাষ্ট্রের সারথি। অর্থাৎ আমাদের দেহধারী গুরু। আমাদের বাইরের আমি যখন বিপদে পড়ে, তখন সে গুরুর আশ্রয় নেয়। কিন্তু এই গুরুকেও সে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। সে মনে করে, এই দেহধারী গুরুর থেকে সে কম বোঝে না। এই গুরুকে সে শুদ্র অর্থাৎ অজ্ঞানী মনে করে। তার কারন আমিতো শিক্ষিত। আমিতো অঢেল ধনের অধিকারী। এই গুরু আমার অন্ন খেয়ে বেঁচে থাকে। শুদ্র কিন্তু সবাইকে আশ্রয় দেয়। মান অপমান তার কাছে সমান। গুরু তবু ভগবানের কথা শোনায়। আর আমরা জ্ঞানান্ধ এই সব কথা শুনি। কিন্তু বুঝি না। সঞ্জয় সম্পর্কে আর একটা ব্যাখ্যা হচ্ছে, সঞ্জয় হচ্ছে আমাদের স্মৃতি। আসলে যুদ্ধ তো দশ দিন হয়ে গেছে । এখন সেই ঘটনার স্মৃতি চারণ চলছে।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ দশ দিন হয়ে গেছে। সঞ্জয় এতদিন যুদ্ধক্ষেত্রে ছিল।এদিকে ধৃতরাষ্ট্র যুদ্ধের কোনো সংবাদ পাচ্ছে না। উদ্বিগ্ন চিত্তে অপেক্ষা করছেন। মন চাইছে কৌরবরা জিতুক। কিনতু তার জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক বলছে - পাণ্ডবরাই জিতবে। এই দ্বন্দ নিয়েই অপেক্ষমান ধৃতরাষ্ট্র খবর পেয়ে গেছেন - ভীষ্ম ভীষণ ভাবে আহত হয়েছেন। উদ্বিগ্নতা আরও বেড়েছে। তাই পুরো ঘটনা কি হয়েছে প্রথম থেকে জানতে চাইছেন। এতদিন ভেবে ছিলেন যুদ্ধ হবে না। কারণ কুরুক্ষেত্রের একটা স্থান মাহাত্য আছে। এটা ধর্মক্ষেত্র। এখানে গেলে মানুষের মনের পরিবর্তন হয়। তাই এমন হতে পারে, কুরুক্ষেত্রে গিয়ে তার ছেলেদের বা পাণ্ডবদের মনের পরিবর্তন হয়েছে। তার ছেলেরা - দুর্যোধন - দুঃশাসন হয়তো ৫-টা গ্রাম দেবার জন্য রাজি হয়ে গেল। অথবা এমনও হতে পারে ধর্মাত্মা পাণ্ডবরা ভাবলো - শুধু শুধু রাজ্য লাভের ইচ্ছায় ভাই-ভাইয়ে যুদ্ধ করা ঠিক হবে না। পাণ্ডবদের বহু গুরুজন তাদের বিপক্ষে। তাদের বধ করে রাজ্য লাভের আশা তারা ছেড়ে দিতে পারে। এই জন্য সঞ্জয় এসে যখন ভীষ্মের আহত হবার সংবাদ দিলো তখন তার দুরাশায় জল পড়লো। তাই বিস্তারিত জানতে চেয়ে সঞ্জয়কে প্রশ্ন করলো। প্রথম থেকে বলতো ব্যাপারটা কি হলো ? যেন রহস্যটা বুঝতে চাইছেন।
ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে - এই কুরুক্ষেত্রে একসময় দেবতারা যুদ্ধ করেছিলেন। এটা একটা তপভূমি। রাজা কুরু, এইখানেই একসময় তপস্যা করেছিলেন, এবং এখানেই যজ্ঞাদি কর্ম্ম করতেন। । যেহেতু যজ্ঞাদি কর্ম হচ্ছে বেদমতে ধর্মকর্ম, তাই এই স্থানকে বলা হয় ধর্মক্ষেত্র। এখন কথা হচ্ছে, রাজা ধৃতরাষ্ট্র যুদ্ধের স্থানটিকে ধর্মক্ষেত্র ও কুরুক্ষেত্র বললেন কেন ? আসলে ধৃতরাষ্ট্র কুরুবংশের রাজা। যদিও সন্দেহাতীত রাজা তিনি নন - পাণ্ডর প্রতিনিধি মাত্র। অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চাইছেন, আমাদেরই জায়গায় এই যুদ্ধ হচ্ছে। আর আমার পূর্বপুরুষ এই স্থানটিকে ধর্মক্ষেত্র বানিয়েছিলেন। অর্থাৎ আজ যা হচ্ছে, তাও ধর্মকর্মের অঙ্গ মাত্র।
আবার ধর্মক্ষেত্র বলা হচ্ছে এই জন্য যে ধর্মক্ষেত্র অর্থাৎ যজ্ঞক্ষেত্রে কি হয় ? আহুতি প্রদান করা হয়। আর এই আহুতি দ্রব্য হচ্ছে দেবভোগ্য। তাই এই যুদ্ধে যিনি বা যারা নিজেদের আহুতি প্রদান করবেন, তিনি দেবভোগ্য হবেন। অর্থাৎ স্বর্গলাভ করবেন।
এতো গেলো বাহ্যিক দিক। আসলে এই যুদ্ধক্ষেত্রটা হচ্ছে আমাদের দেহ। এই দেহর মধ্যে দিয়েই আমরা যেমন দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে পারি। অর্থাৎ গ্রাস-আচ্ছাদনের জন্য নিত্যনৈমিত্তিক কর্ম সম্পাদন করতে পারি, তেমনি পারি এই দেহ দিয়েই ধর্ম্ম কর্ম্ম করতে। এই দেহ যেমন আমাদের কুকর্মের জন্য কাজে লাগতে পারে। আবার দেহের সাহায্যেই আমরা আধ্যাত্মিক জগতের কাজকর্ম্ম করতে পারি। ভগবানের সেবা করতে পারি। অর্থাৎ এই দেহই আসলে আমাদের কুরুক্ষেত্র অর্থাৎ কর্ম্ম-স্থল। এই দেহ ভিন্ন আমরা কোনো কর্মই করতে পারবো না। আর এই দেহেই অবস্থান করতে আমাদের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন বৃত্তি সমূহ এবং অশুভ বৃত্তিগুলো।
সমবেত যুযুৎসবঃ - এই যুদ্ধের আগে বার বার সন্ধির চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং সন্ধি প্রস্তাব নিয়ে দুর্যোধনের দরবারে উপস্থিত হয়েছিলেন। আবার সঞ্জয়কে সন্ধির প্রস্তাব দিয়ে, পাণ্ডবদের কাছে পাঠিয়ে ছিলেন, ধৃতরাষ্ট্র । কিন্তু সবই ব্যর্থ হয়। দুর্যোধনের ছিল, রাজ্য হারাবার ভয়। আর পাণ্ডবদের ছিল, নারীর মর্য্যাদা রক্ষা ও রাজ্যের পুনঃউদ্ধার। তাই যুদ্ধে কেউই পরান্মুখ ছিলেন না।
মামকাঃ পান্ডবাশচৈব : আমার এবং পান্ডবের। ধৃতরাষ্ট্রকে পান্ডবরা জেষ্ঠপিতা হিসেবে সন্মোধন করতেন। ধৃতরাষ্ট্র তার সন্তানদের ও পাণ্ডর সন্তানদের উপর সম মনোভাব পোষন করতেন না। এই মোহ ও ভেদবুদ্ধিই মানুষকে দন্দ্বে লিপ্ত করে। আর বিনাশের পথে নিয়ে যায়। আর একটা কথা এই শব্দচয়ন দ্বারা বোঝানো হয়, পান্ডবাশচৈব, অর্থাৎ পান্ডবরাও। তার মানে পান্ডবরা তো ধার্মিক, দেখো তারাও যুদ্ধে উদ্দত। অর্থাৎ যা ভেবেছিলাম, তা নয়। অর্থাৎ ধার্মিকরা আবার যুদ্ধে যাবে কেন। তারাতো সব ছেড়ে বনে চলে যাবে, তা কিন্তু তারা করে নি। দেখো যুদ্ধ ক্ষেত্রে এসে পৌঁছেছে। তার মানে এরা অধার্মিক।
-------------------------
-------------------------পর্ব্ব - ২
এর পরের শ্লোক সঞ্জয়ের উক্তি।
সঞ্জয় বললেন - পান্ডব সৈন্যদের বুহ্যবদ্ধ অবস্থায় দেখে, রাজা দুর্যোধন আচার্য্যের (দ্রোণের) কাছে গিয়ে এই কথা বললেন।
দৃষ্ট্বা তু পাণ্ডবানীকং ব্যুঢ়ং দুর্য্যোধনস্তদা।
আচার্যম উপসঙ্গম্য রাজা বচনমব্রবীৎ। । (১/২)
সঞ্জয় অসম্ভব ভালো ছাত্র। একবার যা শোনে তা তার মুখস্ত হয়ে যায়। একবার যা দেখে তা তার স্মৃতিতে খোদাই হয়ে যায়। জ্ঞান যার সঞ্চয়ে থাকে, সেই সঞ্জয় । তথাপি নম্র, ও অসম্ভব প্রভু ভক্ত। প্রভুর মঙ্গল কামনা তার সর্বদা। তাই তো মাঝে মধ্যে প্রভুর ভালোর জন্যে সত্য বলে ফেলেন । তবে তার নিজের অবস্থান সম্পর্কে সে খুব সচেতন। নিজের অধিকারের বাইরে সে কখনও যান না। আসলে এই সঞ্জয়রাই আমাদের দেহধারী গুরু।
এই শ্রূতিধরেরাই (যারা স্মৃতি ধরে রাখতে পারতো) শুদ্র নামে পরিচিত। মুনি ঋষিরা, বা জ্ঞান-দ্রষ্টারা এদের দিয়ে নিজেদের উপলব্ধজাত জ্ঞান প্রচার করতেন । অর্থাৎ নিজেদের প্রচারের জন্য ওঁদের ব্যবহার করতেন। এই সঞ্জয়েরা এখনো আছেন । এরা বাবুর (ঈশ্বরের) কথা প্রচারে ব্যস্ত। বাবু (ঈশ্বর) ছাড়া কিছু জানেনা। কিনতু প্রখর স্মৃতিশক্তি, সত্যবাদী। সঞ্জয় এবার যুদ্ধের প্রারম্ভ থেকে বর্ণনা করতে লাগলেন। গীতার লেখক বা বক্তা রূপকের মাধ্যমে আমাদের আধ্যাত্বিক জ্ঞান দান করছেন। সত্যি সত্যি যুদ্ধ ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে কোনো তাত্বিক আলোচনার সুযোগ নেই। এখানে শুধু ধরো-মারো-কাটো। কোনো নীতি নেই আদর্শ নেই - শুধু যুদ্ধে জেতাই আদর্শ। অতএব এখানে বসে দেহতত্ত্বের কথা বলা বা শোনার অবকাশ নেই।
এই যুদ্ধক্ষেত্রটা আসলে আমাদের শরীর। আমাদের শরীরের মধ্যে ভালো মন্দের যে যুদ্ধটা চলছে সেটাই এই মহাভারতের যুদ্ধ । ক্ষেত্র হচ্ছে আমাদের শরীর, আর যুদ্ধ হচ্ছে তামসিক শক্তি ও রাজসিক শক্তির সঙ্গে । আর এই যুদ্ধে আমাদেরকে ধর্ম্মকথা শোনাচ্ছেন স্বয়ং ভগবান।
এই দেহই একদিকে কুরুক্ষেত্র আবার ধর্ম্মক্ষেত্ৰ। এই দেহর মধ্যে দিয়েই আমরা যেমন দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে পারি। অর্থাৎ গ্রাস-আচ্ছাদনের জন্য নিত্যনৈমিত্তিক কর্ম সম্পাদন করতে পারি, তেমনি পারি এই দেহ দিয়েই ধর্ম্ম কর্ম্ম করতে।এই দেহ ভিন্ন আধ্যাত্মিক সাধনা সম্ভব নয়। আবার দেহের সাহায্যেই আমরা যখন আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করতে চাই, তখন আমাদের মধ্যে একটা দন্দ্ব শুরু হয় অর্থাৎ এই দেহই আসলে আমাদের কুরুক্ষেত্র অর্থাৎ কর্ম্ম-স্থল, আবার ধর্মেই দেহই আমাদের ধর্ম্মস্থল বা ধর্ম্মক্ষেত্ৰ। এই দেহ ভিন্ন আমরা কোনো কর্মই করতে পারবো না। আর এই দেহেই অবস্থান করে আমাদের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন বৃত্তি সমূহ এবং অশুভ বৃত্তিগুলো। আমরা যখন আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করতে চাই, তখন এই শুভবৃত্তি আর অশুভবৃত্তিগুলোর মধ্যে একটা যুদ্ধ শুরু হয়। বাইরের আমি তখন দেহধারী গুরুর আশ্রয় নেয়। আর ভেতরের আমি বিবেকেগুরুর আশ্রয়ে থাকে। দুজনেরই অসংখ্য প্রশ্ন ও উদ্বেগ দানা বাধে। এইসব প্রশ্নের উত্তর আর উদ্বেগ থেকে উত্তরণের কালাতীত বাণী হচ্ছে গীতা।
এই দেহই একদিকে কুরুক্ষেত্র আবার ধর্ম্মক্ষেত্ৰ। এই দেহর মধ্যে দিয়েই আমরা যেমন দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে পারি। অর্থাৎ গ্রাস-আচ্ছাদনের জন্য নিত্যনৈমিত্তিক কর্ম সম্পাদন করতে পারি, তেমনি পারি এই দেহ দিয়েই ধর্ম্ম কর্ম্ম করতে।এই দেহ ভিন্ন আধ্যাত্মিক সাধনা সম্ভব নয়। আবার দেহের সাহায্যেই আমরা যখন আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করতে চাই, তখন আমাদের মধ্যে একটা দন্দ্ব শুরু হয় অর্থাৎ এই দেহই আসলে আমাদের কুরুক্ষেত্র অর্থাৎ কর্ম্ম-স্থল, আবার ধর্মেই দেহই আমাদের ধর্ম্মস্থল বা ধর্ম্মক্ষেত্ৰ। এই দেহ ভিন্ন আমরা কোনো কর্মই করতে পারবো না। আর এই দেহেই অবস্থান করে আমাদের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন বৃত্তি সমূহ এবং অশুভ বৃত্তিগুলো। আমরা যখন আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করতে চাই, তখন এই শুভবৃত্তি আর অশুভবৃত্তিগুলোর মধ্যে একটা যুদ্ধ শুরু হয়। বাইরের আমি তখন দেহধারী গুরুর আশ্রয় নেয়। আর ভেতরের আমি বিবেকেগুরুর আশ্রয়ে থাকে। দুজনেরই অসংখ্য প্রশ্ন ও উদ্বেগ দানা বাধে। এইসব প্রশ্নের উত্তর আর উদ্বেগ থেকে উত্তরণের কালাতীত বাণী হচ্ছে গীতা।
এবার আমরা সঞ্জয়ের মুখ দিয়ে নতুন দুটো চরিত্রের কথা শুনলাম। এক - রাজা দুর্যোধন, দুই আচার্য্য দ্রোণ। রাজা দুর্যোধন : দূর + যোধন = দুর্য্যোধন। দূর কথাটার অর্থ দুঃখজনক বা নিন্দিত হয়েছেন, যিনি যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন, আবার অন্য মানে হচ্ছে, যার সঙ্গে যুদ্ধে বহু ক্লেশ পেতে হয়। আসলে এই যুদ্ধের যিনি হোতা বা রাজা তিনি হচ্ছেন দুর্যোধন। হস্তিনাপুরের রাজা কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র তথাপি সঞ্জয় দুর্যোধনকেই রাজা বলে সম্মোধন করলেন। এতে ধৃতরাষ্ট্র খুশি হলেন, তা যদি না হতেন, তবে তিনি এর প্রতিবাদ করতেন। আসলে আমরা যা হতে পারিনি, আমার যে স্বপ্ন পূরণ হয় নি, আমার সন্তান তাই হয়েছে, এটা শুনে ধৃতরাষ্ট্র খুশিই হলেন। আবার এই শব্দের মাধ্যমে নাটের গুরুকে বা নষ্টের গোড়াকে চিহ্নিত করা হয়ে গেল। এই দুর্যোধনের জন্ম বৃত্তান্ত একবার শুনে নেই। ব্যাসদেবের কাছে, গান্ধারী ১০০ পুত্র ও এক কন্যার কামনা করলেন। গান্ধারী যথাকালে গর্ভবতী হলেন। কিন্তু দুবছর ধরে সন্তান হচ্ছে না দেখে, এবং ধৃতরাষ্ট্রের জন্ম সংবাদ শুনে, তিনি কাউকে কিছু না বলে গর্ভপাত ঘটালেন। বেরুলো একটা মাংসপিন্ড। ব্যাসদেব গান্ধারীকে একটু বকাবকি করলেন, তারপর এই মাংশপিন্ডকে ১০১টি মাটির পাত্রে ঘি ও জল সিঞ্চন করে ১০০টি পুত্র ও ১ কন্যার জন্ম দিলেন। দুর্য্যোধন জন্মেই গাধার মতো কর্কশ ধ্বনি করতে লাগলো। এর মধ্যে অবশ্য ধৃতরাষ্ট্রে এক বৈশ্যার গর্ভে একটি সন্তান উৎপাদন করলেন, যার নাম যুযুৎসু ।
দ্রোণাচার্য্য : আচার্য্য কথার মানে হচ্ছে শিক্ষক বা গুরু। আচার্য্য দ্রোণ ছিলেন সবার অস্ত্র শিক্ষক । অর্থাৎ কৌরব পক্ষীয় দুর্যোধন দুঃশাসন সহ একশত ভাইয়ের আবার পান্ডব পক্ষীয় পাঁচভাইয়েরই অস্ত্র শিক্ষক । যিনি ভরদ্বাজ মুনির পুত্র। অশ্বত্থামার পিতা। দ্রোণীর মধ্যে অর্থাৎ কলসির মধ্যে জন্ম বলে এনার নাম দ্রোণ। পিতা ভরদ্বাজ এক সময় কামতাড়িত হয়ে বীর্য স্খলন করে ফেলেছিলেন। আর তা গিয়ে পড়েছিল একটা কলসির মধ্যে। এবং সেখান থেকেই জন্ম হয় দ্রোণের। অর্থাৎ পিতার কামতাড়িত আকস্মিক সন্তান।
সবশেষে একটা কথা বলি, মাতা-পিতার কামতাড়িত সন্তান, আকস্মিক সন্তান, এরা কখনো ভালো মানুষ হতে পারে না। আর ভালো মাতা পিতা না পেলে মহাত্মাদের জন্মও হয় না।
---------------------------
---------------------------পর্ব্ব - ৩ এইবার দেখুন পাণ্ডব পক্ষের কে কে উপস্থিত হয়েছেন, যাদের কথা আমরা দুর্যোধনের মুখ দিয়ে শুনলাম।
হে আচার্য্যদেব, আপনার বুদ্ধিমান শিষ্য দ্রুপদ পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্বারা রচিত বুহ্যে অবস্থিত এই বিশাল সেনাদলকে দেখুন। (১/৩) এখানে বড় বড় বীর যোদ্ধা আছেন, মহাধনুর্ধারী বীরেরা আছেন, আছেন, ভীম-অর্জুনের মতো মহারথী,আছেন সাত্যকি, বিরাট, দ্রুপদ, ধৃষ্টকেতু, চেকিতান, কাশীরাজ, পুরুজিৎ, কুন্তিভোজ, শৈব্য, যুধামন্যু,উত্তমৌজাঃ, সুভদ্রার ছেলে ও দ্রৌপদীর ছেলেরা। (১/৪,৫,৬)
আসলে সবাই আমাদের শুভ সংস্কার বা চিত্তবৃত্তিতে ওঠা বুদ্বুদ, বিভিন্ন নামে এদের অভিহিত করা হয়েছে । হাজার হাজার সংস্কার আমাদের মধ্যে লুক্কায়িত আছে। এর মধ্যে যেমন ভালো সংস্কার তেমনি আছে খারাপ সংস্কার। আমরা যখন আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করতে চাই, ভগবানের সান্নিধ্যে যেতে চাই, তখন যেমন আমাদের শুভ সংস্কার আমাদের সাহায্য করে তেমনি আমাদের অশুভ সংস্কার, আমাদের তথাকথিত তুচ্ছ জ্ঞান আমাদের বাধা স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। তাই আমরা তখন দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যাই।
বিপক্ষে আছেন, দ্রোণাচার্য, পিতামহ ভীষ্ম, কর্ন, কৃপাচার্য্য, অশ্বত্থামা, বিকর্ণ, ভূরিশ্রবা। এর মধ্যে দুইজন গুরুত্ত্বপূর্ন, এক দ্রোণাচার্য যিনি আমাদের আত্মরক্ষার অর্থাৎ শরীর রক্ষার শিক্ষক। আর ভীষ্ম অর্থাৎ আমাদের ভ্রম।
দ্রোণাচার্য্য : আচার্য্য কথার মানে হচ্ছে শিক্ষক বা গুরু। আচার্য্য দ্রোণ ছিলেন সবার অস্ত্র শিক্ষক । অর্থাৎ কৌরব পক্ষীয় দুর্যোধন দুঃশাসন সহ একশত ভাইয়ের আবার পান্ডব পক্ষীয় পাঁচভাইয়েরই অস্ত্র শিক্ষক । যিনি ভরদ্বাজ মুনির পুত্র। অশ্বত্থামার পিতা। দ্রোণীর মধ্যে অর্থাৎ কলসির মধ্যে জন্ম বলে এনার নাম দ্রোণ। পিতা ভরদ্বাজ এক সময় কামতাড়িত হয়ে বীর্য স্খলন করে ফেলেছিলেন। আর তা গিয়ে পড়েছিল একটা কলসির মধ্যে। এবং সেখান থেকেই জন্ম হয় দ্রোণের। অর্থাৎ পিতার কামতাড়িত আকস্মিক সন্তান।
সবশেষে একটা কথা বলি, মাতা-পিতার কামতাড়িত সন্তান, আকস্মিক সন্তান, এরা কখনো ভালো মানুষ হতে পারে না। আর ভালো মাতা পিতা না পেলে মহাত্মাদের জন্মও হয় না।
---------------------------
---------------------------পর্ব্ব - ৩ এইবার দেখুন পাণ্ডব পক্ষের কে কে উপস্থিত হয়েছেন, যাদের কথা আমরা দুর্যোধনের মুখ দিয়ে শুনলাম।
হে আচার্য্যদেব, আপনার বুদ্ধিমান শিষ্য দ্রুপদ পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্বারা রচিত বুহ্যে অবস্থিত এই বিশাল সেনাদলকে দেখুন। (১/৩) এখানে বড় বড় বীর যোদ্ধা আছেন, মহাধনুর্ধারী বীরেরা আছেন, আছেন, ভীম-অর্জুনের মতো মহারথী,আছেন সাত্যকি, বিরাট, দ্রুপদ, ধৃষ্টকেতু, চেকিতান, কাশীরাজ, পুরুজিৎ, কুন্তিভোজ, শৈব্য, যুধামন্যু,উত্তমৌজাঃ, সুভদ্রার ছেলে ও দ্রৌপদীর ছেলেরা। (১/৪,৫,৬)
আসলে সবাই আমাদের শুভ সংস্কার বা চিত্তবৃত্তিতে ওঠা বুদ্বুদ, বিভিন্ন নামে এদের অভিহিত করা হয়েছে । হাজার হাজার সংস্কার আমাদের মধ্যে লুক্কায়িত আছে। এর মধ্যে যেমন ভালো সংস্কার তেমনি আছে খারাপ সংস্কার। আমরা যখন আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করতে চাই, ভগবানের সান্নিধ্যে যেতে চাই, তখন যেমন আমাদের শুভ সংস্কার আমাদের সাহায্য করে তেমনি আমাদের অশুভ সংস্কার, আমাদের তথাকথিত তুচ্ছ জ্ঞান আমাদের বাধা স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। তাই আমরা তখন দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যাই।
বিপক্ষে আছেন, দ্রোণাচার্য, পিতামহ ভীষ্ম, কর্ন, কৃপাচার্য্য, অশ্বত্থামা, বিকর্ণ, ভূরিশ্রবা। এর মধ্যে দুইজন গুরুত্ত্বপূর্ন, এক দ্রোণাচার্য যিনি আমাদের আত্মরক্ষার অর্থাৎ শরীর রক্ষার শিক্ষক। আর ভীষ্ম অর্থাৎ আমাদের ভ্রম।
কেউ কেউ বলেন এই যুদ্ধের আসল কারন দুর্যোধন । তার লোভ, অশালীন আচরণ, এই যুদ্ধকে ডেকে এনেছে। আমি বলি - এই যুদ্ধের আসল কারন এক পক্ষে ধৃতরাষ্ট্র অন্য পক্ষে শ্রীকৃষ্ণ। এক পক্ষে যুধিষ্ঠির অন্য পক্ষে ভীষ্ম। আর মূল কারন দ্রৌপদী। আমি এসব কথা বলছি মহাভারতকে অবলম্বন করেই। দ্রৌপদীর যদি অপমান না হতো, তবে তার স্বামীদের এত সহজে যুদ্ধে নাবানো যেত না। আর দ্রৌপদী-তো অপমানিত হয়েছিল নিজের দোষে। দ্রৌপদী-ই আগে অপমান করেছিল দুর্যোধনকে - সে কথা ভুলে গেলে চলবে ? মেরেছিলো ঢিল, খেয়েছিলো পাটকেল। আমি বলছি না অপমান করাটা ঠিক হয়েছে - নিশ্চয় এটা ঘোরতম অন্যায়। আর এই অন্যায় সংগঠিত হয়েছিল বলেই তো এতো বড় যুদ্ধ হলো।হ্যাঁ, আগে যে চারজনের নাম করেছি অর্থাৎ ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠির,ভীস্ম, সর্বোপরি শ্রীকৃষ্ণ যদি চাইতেন তবে যুদ্ধ নাও হতে পারতো। আর এও ঠিক,যুদ্ধ যদি না হতো তবে মহাভারত হলেও গীতা তো হতো না।
দুর্যোধন এগিয়ে গিয়ে দ্রোণাচার্যকে সৈন্য সমাবেশ দেখাতে লাগলেন । ভীষ্ম যখন বান বিদ্ধ হয়ে ভূমিতে লুটিয়ে পড়েছেন, দুর্যোধন তখন এই যুদ্ধের সেনাপতি করেছিলেন ব্রাহ্মণ অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যকে ।
দ্রোণাচার্য ব্রাহ্মণ। সেযুগের রীতি অনুযায়ী ব্রাহ্মণদের কাজ হলো জ্ঞান দান করা, যুদ্ধ করা নয়। আর প্রথমেই যাদের দেখালেন তারা সবাই বিপক্ষের অর্থাৎ পাণ্ডব পক্ষের। আশ্চর্য ব্যাপার হলো দ্রোণাচার্য শুধু বিপক্ষের শক্তি দেখছেন। কারন তারা সামনে আছে। নিজের শক্তি দেখতে পারছেন না। কারন ওরা সবাই আছে দুর্যোধনের পিছনে। আর দ্রোণাচার্যের পিছনে আছে বদরাগী দুর্যোধন। যে তার নিজের শক্তি সম্পর্কে সচেতন নয়, যার নিজ ধর্মও যুদ্ধ করা নয়। যার পিছনে একজন দুরাচারী দাঁড়িয়ে আছে। কি মনে হয়, এর দ্বারা যুদ্ধে জেতা সম্ভব ? প্রত্যেক মানুষকে জীবন যুদ্ধে জিততে গেলে নিজের শক্তিকে জানতে হবে - সামনে আসতে হবে।
আমরা এবার ভগবানের কথায় চলে যাবো। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এখানে অর্জুনের সারথি। অর্জুনের আদেশ অনুযায়ী রথের চালনা করা তার কাজ। অর্জুন যখন তাকে উভয় সেনার মধ্যে রথ লাগাতে বললেন - তখন শ্রীকৃষ্ণ তাই করলেন এবং বললেন - হে পার্থ !ভীষ্ম, দ্রোণ, প্রভৃতি কৌরব পক্ষীয় যোদ্ধাদের দেখো। -
এবমুক্তো হৃষিকেশো গুড়াকেশেন ভারত
সেনয়োরূভয়োর্মধ্যে স্থাপয়িত্বা রথোত্তমম্ ।
ভীষ্ম-দ্রোণ-প্রমূখতঃসর্ব্বেষাঞ্চ মহীক্ষিতাম্
উবাচ পার্থ পশ্যৈতান্ সমবেতান্ কুরূনীতি।
গীতায় ভগবানের প্রথম কথা। আমরা সঞ্জয়ের মাধ্যমে শুনলাম । যদিও তিনি এখনো ব্যাসদেবের ভাষায় ভগবান হন নি। এখানে উনি গুড়াকেশ। গুড়াকেশ কথার মানে হতে পারে কোঁকড়ানো চুলের যিনি অধিকারী। আবার অন্য মানে হতে পারে গুড়াকা অর্থাৎ নিদ্রা আর ঈশ মানে অধিপতি অর্থাৎ যিনি নিদ্রাকে জয় করেছেন। ব্যাসদেবের ভাষায় শ্রীকৃষ্ণ ভগবান হয়েছেন দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে। সারা মহাভারতে কোথাও শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান নামে উল্লেখ করা হয় নি এর আগে। আসলে এটা একটা ভালো বিজ্ঞাপন। ব্যাস দেবের মনেহয়ে ছিল - এতো ভালো ভালো কথা, কষ্ট করে লিখবো কিনতু কেউ শুনবে না, পড়বে না। আসলে বক্তব্য কেমন, সেটা বড়ো কথা নয়। বক্তা কে সেটাই বড় কথা। মিটিংয়ে লোক জড়ো করতে গেলে যেমন আগে থেকেই বক্তার নাম প্রচার করা হয়। এও তেমনি। ব্যাসদেব বললেন ভগবান উবাচ। অর্থাৎ এস হে সবাই - আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা ভগবান এসে গেছেন । তা না হলে গীতার যত শ্রোতা বা পাঠক বেদ-বেদান্ত-উপনিষদের এতো পাঠক বা শ্রোতা নেই কেন ? গীতায় তো নতুন কথা কিছু নেই। সবই বেদ বেদান্তে আছে। এবং সেগুলোও ব্যাসদেবের লেখা, বা সংগৃহীত । বা অন্যান্য মুনি ঋষিদের কথা। তথাপি বেদ-বেদান্তের এতো পাঠক নেই, এতো শ্রোতা নেই। আমি অষ্টাবক্র সংহিতা পড়ছিলাম। আধ্যাতিকতার সার কথা লেখা আছে এই সংহিতাতে। কিনতু কজন পড়ে এই বই ? তাই আমার মনে হয় ব্যাসদেব ঠিক বুঝে ছিলেন। তাই কথাগুলো শ্রীকৃষ্ণের মুখ দিয়ে না বলিয়ে ভগবানের মুখ দিয়ে বলালেন। সার্থক বিজ্ঞাপন।
সংযোজন : পাড়ার মদনকে দিয়ে রাজার পাঠ করাতে গেলে, তাকে তো রাজা সাজাতে হবে। মুখে রাজার মতো কথা বলবে আর তার পোশাক হবে সাধারণের মতো, তাতো হতে পারে না। আর মদন বলে ডাকলেও হবে না। তাই ব্যাসদেব যে কথা গুলো, অর্থাৎ সর্বশক্তিমান ঈশ্বর সন্মন্ধে কথা গুলো বলতে গেলে, শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান সাজাতেই হবে। নতুবা পাবলিক খাবে না। আর একটা কথা আমার মনে হয়, ঈশ্বর তো অব্যক্ত, তার বর্ণনা, তার কথা মানুষের ব্যবহৃত ভাষায় কি ভাবে হবে ? তাই তো তিনি ভগবানকে দিয়েই বলাচ্ছেন। ......
এবার আবার আমাদের গীতা প্রসঙ্গে আসি।
অর্জুন এবার যুদ্ধক্ষেত্রে চোখ বোলাতে লাগলো। যদিও অর্জুনের অজানা ছিল না কিছুই। কে কোন পক্ষে যুদ্ধ করতে আসবে বা এসেছে - সেটা সে ভালো ভাবেই জানতো। কিনতু সামনা-সামনি অর্থাৎ বিপক্ষে জ্ঞাতি, আত্মীয়-স্বজন, শ্রদ্ধাভাজন, সুহৃদবর্গকে দেখে তার মনে ভবিষ্যতের শুন্যতার চিত্র ফুটে উঠলো। সামনে যারা দাঁড়িয়ে আছে, তাদের সাথে প্রাগ মিলনের সুখস্মৃতি ভেসে উঠলো। ভবিষ্যৎ ভেবে সে শিউরে উঠলো। এরা কেউ থাকবে না ? তাহলে কাদের নিয়ে আমি বাঁচবো ? আর তা ছাড়া আমি যত বড়ো বীর-ই হই না কেনো, আমি নিজেই-তো মারা যেতে পারি। আর আমি নিজে মারা গেলে এই রাজ্য দিয়ে কি হবে আমার ? দরকার নাই ভাই এই সব মারামারি কাটাকাটিতে। এর চাইতে ভিক্ষা করে খাওয়া ভালো। কিনতু যুদ্ধের দামামাতো বেজে গেছে। এখন পালাই কোথায় ? একটা কথা ও ভালো করে জানতো যে - শ্রীকৃষ্ণই এই যুদ্ধের হোতা। শ্রীকৃষ্ণকে যদি বোঝানো যায় - এই যুদ্ধটা ঠিক হচ্ছে না, তাহলে এই মারামারি কাটাকাটি থেকে বাঁচা যাবে।
এখানে আর একটা কথা পরিষ্কার - যুদ্ধ করতে যে সাধারণ সৈন্য এসেছিলো - তা সে যে পক্ষেরই হোক - তাদের জন্য কিনতু অর্জুনের প্রাণ কেঁদে ওঠেনি। খারাপ লাগছিলো আত্মীয়-স্বজনদের দেখে - তাদের মৃত্যু সে কি করে সহ্য করবে? অতএব জনকল্যানের জন্য নয় - নিজের পরিবারের, নিজের জ্ঞাতিদের কথা ভেবেই, হয়তো তার নিজের কথা ভেবেই , তার এই বৈরাগ্য, আমি বলি শ্মশান বৈরাগ্য। তাই শ্রীকৃষ্ণকে বোঝাতে লাগলো। এই যুদ্ধতে কোনো লাভ হবে না। এই যুদ্ধের ভবিষ্যৎ অশুভ। কতকগুলো নিষ্পাপ মহিলা স্বামীহারা হবে। আমরা হয়তো রাজ্য পাবো। কিনতু ক্ষতি হবে অনেক বেশি। স্বজন বধে কোনো লাভ নেই। তা ছাড়া অন্যেরা খারাপ হলে, আমিও খারাপ হবো কেনো ? দুর্যোধন খারাপ হতে পারে - জ্যাঠামশায় ধৃতরাষ্ট্র খারাপ হতে পারে। তাই বলে আমরা খারাপ হতে যাবো কেন? স্বজন বধে তো পাপই হবে। আমরা কেন সেই পাপে লিপ্ত হবো ? এমনি নানা ভাবে কৃষ্ণকে এবং নিজেকে বোঝাতে লাগলো। আমরা নিশ্চই না বুঝে মহাপাপ করতে উদ্যত হয়েছি। এদিকে শ্রীকৃষ্ণ শুনছিলেন।কোনো কথার জবাব দিচ্ছিলেন না। শ্রীকৃষ্ণ কোনো কথার জবাব দিচ্ছেন না দেখে- "আমি যুদ্ধ করবো না" বলে.অর্জুন ধনুর্বান রেখে রথের উপরে বসে পড়লো।
এখানে আর একটা কথা পরিষ্কার - যুদ্ধ করতে যে সাধারণ সৈন্য এসেছিলো - তা সে যে পক্ষেরই হোক - তাদের জন্য কিনতু অর্জুনের প্রাণ কেঁদে ওঠেনি। খারাপ লাগছিলো আত্মীয়-স্বজনদের দেখে - তাদের মৃত্যু সে কি করে সহ্য করবে? অতএব জনকল্যানের জন্য নয় - নিজের পরিবারের, নিজের জ্ঞাতিদের কথা ভেবেই, হয়তো তার নিজের কথা ভেবেই , তার এই বৈরাগ্য, আমি বলি শ্মশান বৈরাগ্য। তাই শ্রীকৃষ্ণকে বোঝাতে লাগলো। এই যুদ্ধতে কোনো লাভ হবে না। এই যুদ্ধের ভবিষ্যৎ অশুভ। কতকগুলো নিষ্পাপ মহিলা স্বামীহারা হবে। আমরা হয়তো রাজ্য পাবো। কিনতু ক্ষতি হবে অনেক বেশি। স্বজন বধে কোনো লাভ নেই। তা ছাড়া অন্যেরা খারাপ হলে, আমিও খারাপ হবো কেনো ? দুর্যোধন খারাপ হতে পারে - জ্যাঠামশায় ধৃতরাষ্ট্র খারাপ হতে পারে। তাই বলে আমরা খারাপ হতে যাবো কেন? স্বজন বধে তো পাপই হবে। আমরা কেন সেই পাপে লিপ্ত হবো ? এমনি নানা ভাবে কৃষ্ণকে এবং নিজেকে বোঝাতে লাগলো। আমরা নিশ্চই না বুঝে মহাপাপ করতে উদ্যত হয়েছি। এদিকে শ্রীকৃষ্ণ শুনছিলেন।কোনো কথার জবাব দিচ্ছিলেন না। শ্রীকৃষ্ণ কোনো কথার জবাব দিচ্ছেন না দেখে- "আমি যুদ্ধ করবো না" বলে.অর্জুন ধনুর্বান রেখে রথের উপরে বসে পড়লো।
শ্রীকৃষ্ণ দেখলো - ব্যাটা মরেছে। আমার এতদিনের পরিকল্পনা মাঠে মারা যায়। ঘোড়াকে নিয়ে এলাম জল খাওয়াতে - ঘোড়া জল দেখে ভিমরি খাচ্ছে। শ্রীকৃষ্ণ একজন সুবক্তা-জ্ঞানী, এস্কিমোদের কাছে কি করে ফ্রিজ বিক্রি করতে হয়, তা তার ভালো ভাবেই জানা আছে। লাট খাওয়া ঘোড়াকে কি ভাবে শায়েস্তা করতে হয় - তা তার জানা আছে।
এইবার ভগবান শুরু করলো - এই সংকট সময়ে তোমার কোথা থেকে অনার্য জনোচিত, অখ্যাতিকর, এবং স্বর্গের বাধা স্বরূপ এই মোহ উপস্থিত হলো ?
কুতঃ-ত্বা কশ্মলম-ইদং বিষমে সমুপস্থিতম
অনার্য্য-জুষ্টম-অস্বর্গম-অকীর্তিকরং-অর্জুন।(২/২)
খেয়াল করুন -
প্রথমতঃ - অনার্যজনোচিত - অনার্য্যের মতো - অনার্য কাদের বলা হয় ? ভারতের মূল অধিবাসীদের অনার্য্য বলা হয়। এই নামটা দিয়েছে আর্যরা। আর্যরা গ্রীকের অধিবাসী। এরা ভারত-বাসীদের অনার্য বলতো অর্থাৎ অসভ্য,অসাধু, হীন, অধম। আমি জানিনা ব্যাসদেব কেন এই শব্দটা ভগবানের মুখে বসালেন।
দ্বিতীয়তঃ - আখ্যাতিকর- জীবনে খ্যাতি কে না চায় ? সুখ্যাতি-তো সবাই চায়। অর্জুনকে লোভ দেখাচ্ছেন খ্যাতির। অথবা ভয় দেখছেন বদনামের বা আখ্যাতির।
তৃতীয়তঃ - স্বর্গের বাধা স্বরূপ - আমি জানিনা স্বর্গ বলে কিছু আছে কি না। তবে এটা জানি স্বর্গ বলে এমন একটা জায়গার কল্পনা করা হয়েছে - যেখানে সুখ বই দুঃখ নেই। যেখানে অপ্সরাদের নিয়ে স্বর্গাবাসীরা আনন্দ করে। যেখানে কল্পবৃক্ষ আছে। তার কাছে যা চাওয়া হয় তাই পাওয়া যায়। মৃত্যুর পরে এই স্বর্গে আর যেতে পারবে না অর্জুন - যদি যুদ্ধ না করে।
মোক্ষম দাওয়াই।
ভগবান এবার অর্জুনকে সাহস জোগাচ্ছেন। ভগবান জানেন একবার যদি কেউ ভয় পেয়ে যায়, তবে তাকে দিয়ে আর কোনো দুঃসাহসিক কাজ করানো যাবে না। মানুষ সাহস করে পাহাড় থেকে লাফ দিতে পারে। নদী পেরিয়ে যেতে পারে। সাহসে ভর করে সামান্য বাঁশের সাঁকো উপর দিয়ে হেটে নদী পেরিয়ে যেতে পারে। কিনতু ভয় পেয়ে গেলে ও নির্ঘাত দুর্ঘটনা ঘটাবে। পড়ে হাত পা ভাঙবে। কিংবা ভয়ের চোটে হার্টফেল করবে। সাহস মানুষের এগিয়ে যাবার পরম অস্ত্র। পরম সহায়। তাই ভগবান বললেন :
ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ ন-এতৎ ত্বয়ি-উপপদ্যতে
ক্ষুদ্রং হৃদয়-দৌর্ব্বল্যং ত্যক্তা-উত্তিষ্ঠ পরন্তপ। (২/৩)হে পার্থ ! কাতর হয়ো না। এমন দুর্বলতা তোমার শোভা পায় না। তুমি তোমার তুচ্ছ হৃদয় দৌর্বল্য পরিহার করে সত্বর উত্থিত হও।
এক স্বামীজীর মুখে শুনেছিলাম : মানুষ যখন জন্ম গ্রহণ করে তখন সে কেঁদে উঠে। কেন জান ? জীবন তো একটা যুদ্ধ। এখানে আসার আগে ইহলোকের রঙ্গ তামাশা দেখে সে উৎসাহিত হয়, এখানে আসার জন্য। ভগবানের কাছে কামনা করে, কান্না কাটি করে, অভিমান করে। কিনতু সত্যি সত্যি যখন ভগবান তাকে এই মৃত্যু-পুরীতে পাঠায় তখন সে ভয় পেয়ে ভ্য়া করে কেঁদে ওঠে।ভগবান যখন তাকে জীবন-যুদ্ধ ক্ষেত্রে টেনে নিয়ে আসে, তখন সে আর আসতে চায় না। কিনতু ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। দশ মাস দশ দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। ক্ষেত্রে স্থিত হয়ে গেছে। মায়ের প্রসব বেদনার শঙ্খের ধনি-তো বেজে উঠেছে। আর ফিরে যাবার উপায় নেই। তখন ভগবান তাকে শান্তনা দেয়। সাহস যোগায়। জীবনে সু-কীর্তি রেখে যাবার কথা বলে। সাহসের সঙ্গে জীবন-যুদ্ধে নেবে যেতে বলে। এখন তুমি এটা না চাইলেও মেনে নিতে হবে। অতএব চরৈবতি - এগিয়ে চলো। এই কান্না শুনেই ভগবান এগিয়ে আসে। জীবনের সার কথা শোনায়। এটাই গীতা। এই গীতা তুমি আগেও শুনেছ। পরেও শুনবে। এটা তোমার জন্ম জন্মান্তরের গান। ভগবানের গান।
অর্জুন যখন বুঝতে পারলো যুদ্ধ না করে আর উপায় নেই। কলে পড়ে গেছে। একবার যুদ্ধের শঙ্খধ্বনি বেজে উঠলে, যুদ্ধ হবেই। তা সে তুমি চাও আর না চাও। চুপ থাকলে বিরোধী পক্ষ তোমাকে শেষ করে দেবে। তাই অর্জুন দ্বন্দ্বে পড়ে গেছে। এবং কাছাকাছি
যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া কেউ নেই, তাই তার কাছেই সে আশ্রয় চাইলো। নিঃশর্ত সমর্পন। বললো :
কার্পণ্যদোষোপহত-স্বভাবঃ
পৃচ্ছামি ত্বাং ধৰ্ম্মসংমূঢ়চেতাঃ।
যৎ-শ্রেয়ঃ স্যাৎ-তৎ-নিশ্চিতং ব্রূহি তম্মে
শিষ্য-তে-অহং শাধি মাং ত্বাং প্রপন্নম্। (২/৭)
অর্থাৎ হৃদয় দৌর্বল্যে আক্রান্ত আমি, ধৰ্ম-অধর্ম জ্ঞান হারা, বিমূঢ় চিত্ত আমি, তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি - আমার পক্ষে যা কল্যাণকর, তা তুমি নিশ্চয় করে বলো। আমি তোমার শিষ্য, তোমার স্মরণাগত , আমাকে উপদেশ দাও।
শ্রীকৃষ্ণের ধমক খেয়ে, অর্জুনের জ্ঞান হলো। বলা যায় চেতনা হলো। আসলে ও এখন না পারছে ছাড়তে, না পারছে ধরতে। তাই শ্রী কৃষ্ণের কাঁধে ভর করে পার হতে চাইলো। নিজের হৃদয় দৌর্বল্য স্বীকার করে, নিজেকে অজ্ঞান আখ্যা দিয়ে কৃষ্ণের ঘাড়ে বন্দুক রাখতে চাইলো। অর্থাৎ তুমিই বলো বাপু এই অবস্থায় আমি কি করবো ? অর্থাৎ যুদ্ধে যদি পাপ হয় তাহলে দায়ী তুমি। যদি হেরে যাই তাহলে দায়ী তুমি। আর যদি জিতি তবে তো কৃতিত্ব আমার। ব্যাটা বহুত চালাক। আবার বলছে - আমি তোমার শিষ্য, তোমার স্মরণাগত। অর্থাৎ গুরু হয়ে আমার সব দায়িত্ব তুমি নাও। যদি স্বর্গে যাই তো আমি যাবো। যদি নরক যন্ত্রনা ভোগ করি তবে তার দায়িত্ব তোমার। অর্জুনের মনে এমনটা যদি না হতো অর্থাৎ সে যদি সত্যি নিজেকে সমর্পন করতো তবে পরের কথাগুলো নিশ্চই বলতো না। শ্রীকৃষ্ণকে গুরু মেনে চুপ হয়ে যেত। এবং গুরুর নির্দেশ মেনে চলতো। কিনতু তা সে করেনি। বরং অর্জুন বলছে :
ন হি প্রপশ্যামি মমাপনুদ্যাদ্
যচ্ছোকম উচ্ছষনম্ ইন্দ্রিয়াণাম্।
অবাপ্য ভূমৌ অসপত্নম ঋদ্ধং
রাজ্যং সুরানাম অপি চ অধিপত্যম ।। (২/৮)
ন হি প্রপশ্যামি মমাপনুদ্যাদ্
যচ্ছোকম উচ্ছষনম্ ইন্দ্রিয়াণাম্।
অবাপ্য ভূমৌ অসপত্নম ঋদ্ধং
রাজ্যং সুরানাম অপি চ অধিপত্যম ।। (২/৮)
"পৃথিবীতে প্রতিদ্বন্দ্বীহীন সমৃদ্ধ রাজ্য, দেবতাদের উপর আধিপত্য লাভ করেও ইন্দ্রিয়গনের সন্তাপদায়ক শোক কিরূপে নিবারিত হবে - তা দেখতে পাচ্ছি না।"
সঞ্জয় অর্থাৎ যার মাধ্যমে আমরা শুনছি তিনি বলছেন : অর্জুন হৃষিকেশকে এই কথা বলে "আমি যুদ্ধ করবো না" বলে মৌন রইলেন।
শ্রীকৃষ্ণ ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। মনে মনে ভাবছে - ব্যাটা তুমি চলো ডালে ডালে, আমি চলি পাতায় পাতায়। তুমি যে স্কুলের মাস্টার, আমি সেই স্কুলের হেড-মাস্টার। তুমি একদিকে বলছো "আমি তোমার শিষ্য, তোমার স্মরণাগত" আবার বলছো "আমি যুদ্ধই করবো না" তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো।
তাই ভগবান বললেন :
"হে অর্জুন, যাদের জন্য শোক করবার প্রয়োজন নেই, তাদের জন্য তুমি শোক করছো, আবার পন্ডিতের ন্যায় কথা বলছো। পন্ডিতগণ জীবিত বা মৃত কারো জন্য শোক করেন না।"
খেয়াল করুন - অর্জুন কিনতু আদৌ শোক করছে না। শোক হয় কখন ? যখন মানুষ কোনো কিছু হারায়। অর্জুনের তো কিছু হারায় নি। তাহলে অর্জুনের শোক হবে কেন ? অর্জুন কেবল হারানোর আশঙ্কা ব্যক্ত করছে। যার কারণ এই যুদ্ধ। অর্থাৎ তার মধ্যে একটা দুশ্চিন্তা হচ্ছে। একটা ভয় কাজ করছে। যদি ভীষ্ম ইত্যাদি অভিভাবক ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজন, এই যুদ্ধে আমার হাতেই মারা যায় তবে কি হবে ? আমার হাতে যদি মারা নাও যায় অন্য্ কারুর হাতে মারা যায়, তবে কি হবে ? আমার দাদা, ভাই, ভাইপো, ছেলে ইত্যাদির যদি মারা যায়, তবে কি হবে ? কাদের নিয়ে আমি বাঁচবো ? আর সব থেকে আশঙ্কার কথা হচ্ছে, যদি আমি নিজেই মারা যাই তবে এই যুদ্ধের ফল দিয়ে আমার কি হবে ?
শ্রীকৃষ্ণ কিনতু অর্জুনের আশঙ্কার কথায় গেলেন না। কারন আশঙ্কার কোনো উত্তর নেই। যদি-কিনতুর কোনো জবাব হয় না। তাই সে পথে না গিয়ে - শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে গুলিয়ে দেবার জন্যই বললেন - শোক করছো কেন ? অর্থাৎ প্রশ্নটা ঘুরিয়ে দিলেন। যাতে জবাব দেওয়া যায় সহজে। অর্থাৎ সেই গরুর রচনা, আমি যা জানি তাই বলবো। তুমি যা জানতে চাইছো তা নয়।
একটা গল্প শুনেছিলাম। এক ডাক্তার শুধু জ্বরের ওষুধ জানতো। রুগী এলেই তাকে জিজ্ঞ্যেস করতো - কি হয়েছে ? জ্বর হয়েছে তো ? সে আমি ঠিক করে দেব। কোনো চিন্তা করতে হবে না। রুগী হয়তো বলতো : না ডাক্তারবাবু আমার মাথা ঘুরছে। ডাক্তারবাবু অমনি বলতো সে ঠিক আছে । আমি ঠিক করে দেব। আসলে তোমার রাত্তিরে রাত্তিরে জ্বর হয় - তুমি কেবল জানতি পারো না।
তা অর্জুন শোক করছে - কিনতু সে জানতে পারছে না। জেনে গেছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। এইবার উত্তর দেওয়া তার পক্ষে সহজ হবে।
এইবার কাসুন্দি বার করবে। যা সে গুলে রেখেছে। ব্যাসদেব বেদ বিভাজন করতে গিয়ে অনেক কিছু পেয়েছিলেন । সেই জ্ঞান সে স্বরচিত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখ দিয়ে শোনাবেন । আমরা অজ্ঞান তার সেই কথা শুনবো সঞ্জয়ের মুখ দিয়ে।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন : আত্মতত্ত্ব (সাংখ্যযোগ)
আমি আগে ছিলাম না তাহা নহে, আবার পরে থাকবো না তাহাও নহে। সকল জীবের যেমন বাল্য , যৌবন,ও বার্ধক্য থাকে সেইমতো মৃত্যুও একটা অবস্থা মাত্র। ইন্দ্রিয় সমূহের সঙ্গে বিষয় সংযোগে সুখ দুঃখ বোধ জন্মে। এজন্য এগুলোকে অনিত্য জেনে সহ্য করা শ্রেয়ঃ। জ্ঞানী ব্যাক্তি সুখ দুঃখকে সমান মনে করেন। যে ধীর ব্যাক্তিকে ইন্দ্রিয় সকল পীড়া দিতে অক্ষম, তিনিই মোক্ষ লাভ করেন। অনিত্য বস্তূ অস্তিত্বহীন , নিত্য বস্তূ অবিনাশী। যিনি বিশ্বব্যাপি বিরাজিত তিনিই অবিনাশী। সেই অব্যয়রূপী আত্মাকে বিনাশ করা যায় না। আত্মা নিত্য-বস্তূ, ভোগাদি রোহিত ও পরিনাম রোহিত। আত্মা অবিনশ্বর কিন্ত দেহ বিনাশশীল। আত্মাকে যিনি হত বা হন্তা ভাবেন তারা অজ্ঞান। আত্মা কাউকে বধ করেন না, আবার কারোর দ্বারা বধ হন না, আত্মা জন্ম মৃত্যু রোহিত। আত্মার বৃদ্ধিও নাই ক্ষয়ও নাই। আত্মা অজ নিত্য শ্বাশ্বত এবং চির পুরাতন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন :
আত্মা সর্বদা একই রূপে বিরাজমান। জন্ম, বৃদ্ধি, ক্ষয়শূন্য। আত্মার এই স্বরূপ যিনি জ্ঞাত আছেন, তিনি কাকেই বা বধ করেন আর কাকেই বা বধ করান। মনুষ্যগন যেরূপ জীর্ন পুরাতন বস্ত্র ত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে , সেই রকম আত্মাও জীর্ন পুরাতন দেহ ত্যাগ করে নবদেহ ধারণ করে। আত্মাকে অস্ত্র দ্বারা ছেদন করা যায় না, অগ্নি দগ্ধ করতে পারে না, জলে আদ্র করা যায় না, বায়ু শুষ্ক করতে পারেনা। আত্মা অবিচল। আত্মা নিত্য,স্থির, সর্বব্যাপী অচল অনাদি। আত্মা অব্যক্ত অচিন্ত্য অবিকারী। .......
নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দেহতি পাবকঃ।
ন চৈনং ক্লেদয়ন্তি আপঃ ( ক্লেদয়ন্ত্যাপো) ন শোষয়তি মারুতঃ। । (২/২৩)
(এই শরীরি কে ) না যায় শস্ত্র দ্বারা ছেদন করা, না যায় অগ্নি দ্বারা দহন করা। অপ বা জল দ্বারা এঁকে ভেজানো যায় না, বায়ু দ্বারা শুস্ক করা যায় না।
আমরা জানি জীবের পাঁচটি তত্ব। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। এর দ্বারাই শরীর গঠিত। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এখানে জীবদেহের কারন যে পাঁচটি তত্ব তার মধ্যে চারটি তত্ব সম্পর্কে বলছেন। যারা শরীরের ভালো মন্দ করতে পারে। ব্যোম তত্ব সম্পর্কে কিছু বলেন নি। তার কারন আকাশ তত্ত্বে কোনো বিকার উৎপন্ন হয় না।
শস্ত্র আসলে পৃথ্বী তত্ব থেকে উৎপন্ন। এই পৃথিবী আত্মা থেকে বহুত দূর। তাই বলছেন, পৃথিবী আত্মার কোনো বিকার সাধন করতে পারেন না। তেমনি, জল অপ তত্বের প্রকাশ। এই জল আত্মা থেকে বহুত দূর। এটিও আত্মার কোনো পরিবর্তন করতে পারে না।অগ্নি বা তেজঃ তত্বও আত্মা থেকে বহুত দূর। সেও আত্মাকে ছুঁতেও পারে না। তাই অগ্নি তার দাহিকা শক্তি দ্বারা আত্মার কোনো পরিবর্তন সাধন করতে পারে না। বায়ু আকাশের সবচেয়ে কাছাকাছি।কিন্তু আত্মা থেকে দূরে। তাই বায়ুও আত্মার কোনো পরিবর্তন করতে পারে না। আত্মার কাছে আছে আকাশ, আর যেহেতু আকাশের কোনো বিকার নেই, বিস্তার তার মহত্ত্ব, শব্দ তার গুন্। এই শব্দ কিন্তু আত্মাকে প্রভাবিত করে। সত্যদ্রষ্টা শ্রীকৃষ্ণ তাই আকাশ তত্বের কথা এখানে বললেন না। অন্যান্য চারটি তত্বের কথা বলে বোঝাতে চাইলেন, আত্মার অবিনশ্বরতা।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন :
এমনও যদি ভাবা হয় যে আত্মা নিত্য জন্মায় ও নিত্য মৃত্যু হয় তা হলেও কারুর মৃত্যুতে শোক করা উচিত নয়। কারণ মৃত্যু হলেও আবার জন্ম অবশ্যাম্ভাবী । অতএব শোক করা বৃথা মাত্র। জীবগন জন্মের পূর্বে কি ছিল আবার মৃত্যুর পরে কি হবে তা সে জানেনা। শুধুমাত্র মধ্যাবস্থার কথাই জানে। তাই শোক করা বৃথা। আত্মাকে কেউ জানতে পারেন না, শুধু তার আশ্চর্যত্ব সম্পর্কে শুনে থাকেন। অনির্বচনীয় স্বরূপ এই আত্মা সকলের দেহে সর্বদাই অবধ্য।তাই কারোর মৃত্যুর জন্য শোক করা উচিত নয়. শুধু স্বধর্মের কথা চিন্তা করো। সুখ দুঃখ , লাভ ক্ষতি , জয় পরাজয় সমান চিন্তা করে কর্ম করো।
এতক্ষন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আত্মতত্ম বোঝাচ্ছিলেন অর্জুনকে। এইখানে আমার কিছু প্রশ্ন। মানুষের শরীরে আত্মা কি একটা না একাধিক ? আত্মা কোথায় থাকে ? শরীরে না বাইরে ? আত্মার মৃত্যু নাই ? নির্দিষ্ট করে আত্মার অবস্থান কি বোঝা যায় ? আত্মা ছাড়া শরীর মৃত ? আত্মা কোথা থেকে আসে কোথায় যায় ? আত্মার কম্পোসিশন কি ? অর্থাৎ কি ধাতু দিয়ে তৈরি ? বিদ্বানদের কাছে নিশ্চয় এগুলো বোকা বোকা প্রশ্ন। তবুও, উত্তর নিশ্চই ভগবানের কাছে আছে।
আমার শরীরে অসংখ্য কোষ। প্রত্যেকেরই জন্ম মৃত্যু আছে। কেউ কয়েক ঘন্টা বাঁচে, কেউ কয়েক দিন বাঁচে, আবার কেউ কয়েক মাস বাঁচে, কেউ বা কয়েক বছর বাঁচে। আমার শরীর থেকে বাইরে বেরিয়েও কৃমি কিট বেঁচে থাকে। সবারই কি আত্মা আছে ? সবারই যদি আত্মা থাকে , তবেতো অসংখ আত্মার সমষ্টি আমার শরীরে অবস্থান করছে । আলাদা করে আমার আত্মা বলে কিছু থাকে কি ? এমনকি আমরা যখন মায়ের পেটে থাকি, তখন কি আলাদা করে আমার আত্মা বলে কিছু থাকে ?
আত্মা কোথায় থাকে ? কেউ বলে হৃদয়ে। কেউ বলে ভ্রূযুগলের মধ্যে। অদম্য শক্তি থাকে কুণ্ডলিনীতে। কুণ্ডলিনী শক্তি জাগ্রত হয়ে. সুষুম্নার মধ্যে দিয়ে সহস্রারে পৌঁছালে মানুষের ভগবত প্রাপ্তি হয়।
কেউ বলে আত্মা সর্বত্র। জল জমে থাকলে কিছু দিন পরে প্রাণের সৃষ্টি হয়। সেখানেও নিশ্চয় আত্মা ছিল তাহলে। আত্মা এক দেহ ত্যাগ করে আর দেহে প্রবেশ করে ? তাহলে দুই দেহের মধ্যবর্তী স্থানে আত্মা নেই ? তাই যদি হয় তবে আত্মার সর্বব্যাপকত্ত্ব কথাটা অসত্য ?
আত্মার জন্ম মৃত্যু নেই। অর্থাৎ আত্মার সংখ্যা বা পরিমান বাড়েও না আবার কমেও না। আবার যদি ধরে নেই আত্মা ভিন্ন প্রাণী নেই তাহলে পৃথিবীতে প্রাণের সংখ্যা বাড়ছে কি করে ?
_________________আমরা জবাব খুঁজবো _______
আমার কিছু পূর্ব সংস্কার আছে। পূর্ব সংস্কার অর্থাৎ পূর্বেই সংগ্রহ করা জ্ঞান। এই সংস্কার দ্বারাই আমার বিচার পর্ব চলে। যখনি আমি নতুন কিছু দেখি, নতুন কিছু শুনি, স্পর্শ করি - তখনই আমি তার বিচার শুরু করি। যা কিছু দেখি তাকে পূর্ব অভিজ্ঞতার নিরিখে নির্দিষ্টিকরণ করতে চাই। অর্থাৎ চেনা জিনিষ হলে তার কি নাম, তার কি গুন্, তার কি প্রকৃতি - এগুলো আমার মধ্যে জেগে ওঠে। এবং সে অনুযায়ী আমি নিজেকে সতর্ক করি, অথবা আস্বাদন করি। আবার নতুন জিনিস হলে নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করি। এ সবই আমার স্মৃতিতে ধরা থাকে। কতকগুলো স্মৃতি স্বল্প স্থায়ী। প্রিন্টারের কালি ভালো না হলে যেমন কিছুদিন পরে উড়ে যায়, এও তেমনি, কিছু দিন পরে উড়ে যায় । কতকগুলো স্মৃতি আবার দীর্ঘস্থায়ী। এই স্মৃতি ধরে রাখার জায়গা হলো মস্তিস্ক। এটি একটা ফাইল। এই ফাইলগুলো আবার রাখা থাকে আলমারিতে। এই আলমারিটিকে আমরা বলি মন। মাস্টার মহাশয় তাই আমাদের বলেন, মনে আছে তো ? এই আলমারিটা আবার রাখা থাকে রেকর্ড রুম-এ। এটাই জ্ঞান ভান্ডার। এই জ্ঞান ভান্ডার দেহে স্থিত নয়। এটি বিশ্বব্রহ্মান্ড। এই জ্ঞান ভান্ডার থেকেই সাধক, মুনি, ঋষি জ্ঞান সংগ্রহ করেন। এটাকে আমরা বলি অনুভূতি লব্ধ জ্ঞান।
মস্তিস্ক বায়োকেমিক্যাল পদার্থে তৈরী। মন আরো সুক্ষ। এটিও সূক্ষাতিসূক্ষ খাদ্যকণার নির্যাস। এখানে খাদ্য কনা মানে চোখ, মুখ, কান, নাক,ত্বক অর্থাৎ সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে যা কিছু আমরা সংগ্রহ করছি, সব কিছুর সুক্ষ সংস্করণ বা আমাদের গ্রন্থিতে তোলা আলোড়ন । আর বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সে একমেবম অদ্বিতীয় পুরুষ। তিনিই জ্ঞানের ভান্ডার।
এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে। শ্রীকৃষ্ণ ভগবানের প্রতীক হিসেবে আমাদের সামনে মহর্ষি ব্যাসদেবের ভাষায় জ্ঞান দান করছেন। এটি ব্যাস দেবের রচনা। শ্রীকৃষ্ণ যদি ভগবান হয়েও থাকেন, তবুও তার যথাযথ কথা এগুলো নয়। গীতা একটি দেহতত্ত্বের গানের বই।এটি একটি সমাজবিজ্ঞানের বই। এখানে মানুষ কি করে ভালো থাকতে পারে, কি করে মানুষ সুখ-দুঃখের ওপারে যেতে পারে। এখানে মানুষের কি কর্তব্য কী ? এখানে সুন্দর বাক্যবিন্যাসে দেহতত্ত্বের গান রচনা করা হয়েছে। আমাদের কিসে মঙ্গল হবে সে-সব বলা হয়েছে। ভগবানের যথাযথ কথা যদি হতো, তবে সেটা হতো রামকৃষ্ণের কথামৃতের মতো। যেমন বলছেন তেমন লিখছেন। এখানে ব্যাকরণের ভুল হতে পারে। আপাত-অসংলগ্ন হতে পারে। কিনতু যথা-যথ।
এইবার আসল কথায় আসি।
মানুষের শরীরে আত্মা কি একটা না একাধিক ? আত্মা কোথায় থাকে ? শরীরে না বাইরে ? আত্মার মৃত্যু নাই ? নির্দিষ্ট করে আত্মার অবস্থান কি বোঝা যায় ? আত্মা ছাড়া শরীর মৃত ? আত্মা কোথা থেকে আসে কোথায় যায় ?
মানুষের শরীরে আত্মা একটাও নয়, একাধিকও নয়। মানুষের শরীরে আদৌ আত্মা থাকেও না। আত্মা সর্বত্র। মানুষের শরীর-ই আত্মার মধ্যে আছে। শরীরের মধ্যে আত্মা নয়। প্রাণের সাহায্যে অর্থাৎ নিঃশাসের সাহায্যে আমরা এই আত্মাকে অর্থাৎ বৃহৎ শক্তিকে প্রতিনিয়ত সংগ্রহ করছি। তাই আমরা বেঁচে আছি। আত্মা শরীরের মধ্যে থাকে না। রাখা যায় না। তাই আত্মা প্রাণের মাধ্যমে আমাদের শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে, আবার অপান-এর মাধ্যমে বেরিয়ে আসে। একে ধরেও রাখা যায় না আবার না হলেও চলে না।
বায়ু যেমন সর্বত্র, আত্মা তেমনি সর্বত্র। আবার একটা জিনিস পরিষ্কার হওয়া দরকার বায়ুর মধ্যে আত্মা নয়। আত্মার মধ্যে বায়ু। যেখানে বায়ু নেই সেখানেও আত্মা বর্তমান। আমাদের শরীরে আত্মার গমন-নির্গমন এই বায়ুর মাধ্যমে হয়। আর এই প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে ফুসফুস। তাই ফুসফুস ও বায়ু গমন-নির্গমনের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে শরীরের মৃত্যু হয়।
অষ্টাবক্র বলছেন : আত্মা সাক্ষী, বিভু, পূর্ণ, এক, মুক্ত, চিদ্রুপ,অক্রিয়, অসঙ্গ, নিঃস্পৃহ ও শান্ত স্বরূপ। বিশ্বচরাচর ব্যাপ্ত এই অব্যয়।
জীব আত্মা আর পরমাত্মা বলে আলাদা কিছু নেই। পরম আত্মা যখন দেহ-স্থিত তখন আমরা তাকে বলি জীব-আত্মা। সমুদ্রের মধ্যে বুদ্বুদ। সমুদ্রের মধ্যে ঢেউ। এটাই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড। পরম-আত্মার মধ্যেই এই বিশ্বব্রহ্মান্ড খেলছে। জন্মাচ্ছে, আলোড়ন তুলছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি বলে কিছু নেই। তুমি বলে কিছু নেই। সবই তিনি। তুহি-তুহি-তুহি।
ভগবান কথা (25.04.2017)- কর্মযোগ
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন :
নিষ্কাম কর্মের বিনাশ নাই। এই কর্মে পাপ নাই। বিঘ্ন নাই। নিষ্কাম কর্মের অনুষ্ঠানে সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায়। মৃত্যু-ভয় থেকেও মুক্ত হওয়া যায়। নিষ্কাম কর্ম দ্বারা বুদ্ধি এক বিষয়ে স্থির হয়।মন যার এক বিষয়ে স্থির নয়,কামনার নিমিত্ত তার বুদ্ধি - মন নানা বিষয়ের দিকে ধাবিত হয়। জন্ম কর্ম নিমিত্য। জন্ম হলেই তার কর্ম আছে। আর কর্ম সর্বদা ফল-দায়ক। সকাম কর্মে ভোগ আপনার আপনার। ভোগযুক্ত মন কখনো ঈশ্বরে স্থির হয় না। সমস্ত কর্মফলের আশা পরিত্যাগ করে, আত্মতত্ত্ব জ্ঞানসম্পন্য হয়ে,সুখে-দুঃখে অবিচল থেকে, নিষ্কাম কর্ম করো। কিসে কি হবে, এই চিন্তা পরিহার করে আত্মাবান হও। বেদের কর্মকাণ্ডও ত্রিগুণাত্বক। বেদের কর্মকান্ডের অনুসরণ, তোমাকে কর্মফল ভোগ করাবে। বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু কর্ম প্রয়োজন, তুমি তাই করো।এর বেশী প্রয়োজন নাই। কর্মে তোমার অধিকার কিনতু কর্মফলে নয়। তাই কর্মফলের আশা ত্যাগ করো। কর্ম ত্যাগ করো না। ফলের আশা বা কামনা ত্যাগ করে যোগস্থ হয়ে কর্ম করো। সুফল কুফল সমান জ্ঞান করে, কর্ম করো। সর্বাবস্থায় মনকে সাম্য- অবস্থায় রাখাই যোগ। মনকে স্থির রাখাই যোগ। চিত্তকে বিক্ষিপ্ত হতে না দেওয়াই যোগ। নিষ্কাম কর্মই কাম্য ও উত্তম । সকাম কর্ম নিকৃষ্ট ও পরিত্যাজ্য। ফলাফলে সমান জ্ঞান জন্মালে, সেই জ্ঞানী ব্যক্তি এই জন্মেই পাপ-পুন্য উভয়কেই ছাড়িয়ে যায়। নিষ্কাম কর্মের কৌশল-ই যোগ। কর্মযোগ। কর্মযোগের এই কৌশল যে আয়ত্ব করেছে, সেই জন্ম-মৃত্যু-সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে মোক্ষ লাভ করেন।
কিন্তু সত্যি বলতে কি, কর্ম করলে, তার ফল তো হবেই। হ্যাঁ সেটা আমার প্রত্যাশিত মতো না হতে পারে। কিনতু ফল তো হবেই। পরিবেশের জন্য ফলের তারতম্য হতে পারে। কিনতু ফল হবে না, পরিবেশ থাকা সত্বেও তা হতে পারে না। আপনি বীজ লাগান, গাছ হবে। আপনি গাছ লাগান ফল হবে। সময়মতো লাগান। পরিবেশ করে দিন। গর্ত খুঁড়লে, জল না উঠুক,গর্ত তো হবেই।
শ্রীকৃষ্ণ বলছেন : কর্ম করার অধিকার তোমার কিনতু ফলের অধিকার তোমার নয়।
আমি বলি কর্ম যদি আমার, ফলও আমার। তবে হ্যাঁ এই কর্ম ফল ভোগ করার জন্য আমি অর্থাৎ আমার এই দেহ, থাকবে কিনা, সেটা আমার উপরে নয়। গাছে কবে ফল হবে, ততদিন আমি বাঁচবো কি না, তা আমি জানিনা। কিনতু অনুকূল পরিবেশ পেলে অবশ্যই ফল হবে। আর তা, আমার অবর্তমানে, এমন কি আমার বর্তমানেও আমি বা অন্য কেই ভোগ করবে। আমার কাছাকাছি, অর্থাৎ ফলের কাছাকাছি যারা থাকবে তারাই ভোগ করবে। এটা ভালো ফলের ক্ষেত্রেও হবে, খারাপ ফলের ক্ষেত্রেও হবে। মৌচাকে ঢিল মারলাম আমি, মৌমাছি কিনতু আমাদের সবাইকে কামড়াবে। পাপকর্ম আমার, পুন্যকর্ম আমার, অথচ ফলের ভাগিদার উপস্থিত সবাই। তেমনি ফলদানের সময় হলে ফল হবেই। তখন যারা, অর্থাৎ যে সব দেহধারী জীব থাকবেন তারই ভোগ করবেন। এমন নয় যে আমাকেই ভোগ করতে হবে।
কতকগুলো কর্মের ফল তাৎক্ষণিক হয়। কতকগুলো কর্মের ফল দেরিতে হয়। কতকগুলো কর্মের ফল ধীরে ধীরে অনেক দিন ধরে চলে। আবার কতকগুলো কর্মের ফল স্বল্প স্থায়ী হয়। এগুলো নির্ভর করে কর্মের প্রকারভেদের উপর। সাধনার ফল ধীরে ধীরে হয়। অগ্নি তাৎক্ষণিক ফল দেয়।
বাসনা রোহিত কর্ম : বাসনা রোহিত কর্ম হয় কি না আমার জানা নেই। বাসনা রোহিত কর্ম তারাই করতে পারে যারা অন্যের জন্য কর্ম করে। তাও বলা চলে এটিও বাসনা রোহিত নয়। কর্মের ফল অন্যে ভোগ করুক, এই ভাবনা থেকেই সে সব কর্ম। এই জগৎ-তো বাসনার ফল। এই সৃষ্টি তো বাসনার হাত ধরে এগোচ্ছে। বাসনা রোহিত মানে জগৎ স্থবির হয়ে যাওয়া। জন্ম তো বাসনার ফল। ঈশ্বর স্ব-স্বরূপে স্থিত থেকে আপন খেলায় মাততে চেয়ে ছিলেন। তাই তো তার বিভিন্ন রূপ। এই চাওয়াই তো বাসনা। মানুষ যে এতো সাধনা করে - ঈশ্বরকে পাবার জন্য, এও তো এক প্রকার বাসনা। সর্ব মঙ্গলের জন্য এই যে মহাভারতের যুদ্ধ - এও বাসনার ফল। বাসনা বিহীন কর্ম, শ্রীকৃষ্ণ নিজে কি করতো ? হ্যাঁ শ্রীকৃষ্ণ সবার মঙ্গল চেয়ে ছিলেন। সবার নয় - তার দৃষ্টিতে ভালোদের প্রতিষ্ঠা চেয়েছিলেন। এবং তাই তিনি করেছিলেন। আমাদের বলছেন বাসনা রোহিত হয়ে কর্ম করো। এ তো দ্বিচারিতা। অবশ্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে দ্বৈত ভাব সব কিছুতেই। সে আলোচনা থাক। আমাদের বিষয় বাসনাহীন কর্ম। বাসনা থেকেই সাধনা।
আসলে আমার মনে হয় আসক্তিহীন কর্মই কাম্য। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এটাই বলতে চেয়েছেন। আসক্তি নিয়ে কর্ম করলে সুখ-দুঃখের ভাগিদার হতে হয় সহজেই। তাই প্রত্যাশিত ফল পেলে আমার সুখী হই। প্রত্যাশিত ফল না পেলে দুঃখী হই। এই জায়গা থেকে শ্রীকৃষ্ণ বেরিয়ে আসতে বলছেন। তুমি যেমন দশটা-পাঁচটা অফিস করে বেরিয়ে যাও। মালিক তোমার গ্রাসাচ্ছাদনের দায়িত্ব নেন। ঠিক তেমনি আসক্তিহীন কর্ম করো। তবে তুমি সাম্যাবস্থায় থাকবে। না দুঃখের বিলাপ - না সুখের উচ্ছাস। এই সাম্যাবস্থাই শান্তির জায়গা। শ্রীকৃষ্ণ এই শান্তির সন্ধান দিলেন।
আসলে আমার মনে হয় আসক্তিহীন কর্মই কাম্য। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এটাই বলতে চেয়েছেন। আসক্তি নিয়ে কর্ম করলে সুখ-দুঃখের ভাগিদার হতে হয় সহজেই। তাই প্রত্যাশিত ফল পেলে আমার সুখী হই। প্রত্যাশিত ফল না পেলে দুঃখী হই। এই জায়গা থেকে শ্রীকৃষ্ণ বেরিয়ে আসতে বলছেন। তুমি যেমন দশটা-পাঁচটা অফিস করে বেরিয়ে যাও। মালিক তোমার গ্রাসাচ্ছাদনের দায়িত্ব নেন। ঠিক তেমনি আসক্তিহীন কর্ম করো। তবে তুমি সাম্যাবস্থায় থাকবে। না দুঃখের বিলাপ - না সুখের উচ্ছাস। এই সাম্যাবস্থাই শান্তির জায়গা। শ্রীকৃষ্ণ এই শান্তির সন্ধান দিলেন।
রামকৃষ্ণদেব বলতেন : পরের বাড়ির কাজ করো। পরের ছেলেকে দেখাশুনা করো। ধাঁই দেখেছো ? কেমন পরের ছেলেকে, আদর করে, স্নান করায়, গা মুছে দেয়, খাওয়ায়, ঘুম পাড়ায়, কাঁদলে চাঁদ দেখায়, গল্প বলে। কিন্তু মনে মনে জানে, ও আমার কেউ না। কাজ ছাড়িয়ে দিলে, আবার অন্য্ বাড়িতে গিয়ে ঠিক একই রকম করে। কাজ শেষ হয়ে গেলে বাড়িতে দৌড় লাগায়, নিজের ছেলের কাছে ফিরে যায়। নিজের বাবার-মায়ের কাছে ফিরে যায়। যেটা ওর আসল বাড়ী। তোমরাও সংসারে পাঁকাল মাছের মতো থাকো। পাঁক জড়াতে দিও না। এখানকার কাজ তো একদিন শেষ হবেই। তখন বাড়ি যেতে হবে। সঙ্গে তোমার মনিবের ছেলে যাবে না।
ভগবান কথা (26.04.2017) : (স্থীতপ্রজ্ঞ)
যখন তোমার বুদ্ধি মোহস্বরূপ পাপ হতে উত্তীর্ন হতে পারবে, তৎক্ষণাৎ তুমি শুনবার যোগ্য এবং যা শুনেছ সেই কর্মফল হেতু বৈরাগ্য লাভ করবে। বহু প্রকার বৈদিক ও লৌকিক কর্মযোগের কথায় তোমার মন চঞ্চল হয়েছে। যে সময় চঞ্চল মন নিশ্চলরূপে সমাধিতে স্থির হবে, তখনি তুমি যোগযুক্ত হবে।
যে সময় যোগী সর্বপ্রকার কামনা ত্যাগ করে আপনার মধ্যেই সন্তষ্ট থাকেন, তখনি তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ বলে জানবে। যিনি দুঃখে অবিচল, সুখে স্পৃহাশূন্য এবং আসক্তিহীন, নির্ভিক এবং ক্রোধশুন্য, তিনিই স্থীতপ্রজ্ঞ। শুভ ফলে যে ব্যক্তি আনন্দিত বা কোনো প্রকার বিকারগ্রস্থ হন না, তারই প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত বলে জানবে। ২/ ৫৭....
যে সময় যোগী সর্বপ্রকার কামনা ত্যাগ করে আপনার মধ্যেই সন্তষ্ট থাকেন, তখনি তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ বলে জানবে। যিনি দুঃখে অবিচল, সুখে স্পৃহাশূন্য এবং আসক্তিহীন, নির্ভিক এবং ক্রোধশুন্য, তিনিই স্থীতপ্রজ্ঞ। শুভ ফলে যে ব্যক্তি আনন্দিত বা কোনো প্রকার বিকারগ্রস্থ হন না, তারই প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত বলে জানবে। ২/ ৫৭....
কচ্ছপ যেমন আপন অঙ্গসমূহ সংকুচিত করে আপন দেহেই গুটিয়ে থাকে। সেইপ্রকার যিনি ইন্দ্রিয়গুলিকে ভোগ বস্তূ থেকে ফিরিয়ে আনে , তাঁরই প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অনেকে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বিষয়াদি ভোগ না করলেও তার ভোগ আকাঙ্খা থাকে। স্থিতপ্রজ্ঞের পরমাত্মা দর্শনেই ভোগাকাঙ্খা দূর হয়। মোক্ষ লাভের জন্য জ্ঞানী যাতনা করলেও, অনেক দূরন্ত ইন্দ্রিয়সমূহ তাদের মন ও চিত্তকে কু-পথে পরিচালিত করে। যোগীরা ইন্দ্রিয় সকলকে দমন করে মৎ-পরায়ণ হয়। যার ইন্দ্রিয়সকল এইরূপ বশীভূত তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ। বারংবার বিষয় চিন্তার ফলেই মানবের আসক্তি জন্মায়। আসক্তি হতে বাসনা - কামনা জন্মায়। কামনায় -বাসনায় বাধাপ্রাপ্ত হলে ক্রোধ জন্মায়। ক্রোধ থেকে মোহ এবং মোহ হতে স্মৃতিভ্রম হয়। স্মৃতিভ্রম হলে বুদ্ধিনাস এবং এতেই হয় অধঃপতন।
যার মন নিজের বশীভূত ও ইন্দ্রিয় সকল মনের বশীভূত - এমন ব্যক্তি বিষয় ভোগের মধ্যে থেকেও শান্তি লাভ করেন। যে ব্যক্তির মন স্থির ও প্রসন্ন ,তার সব রকম দুঃখ নাশ হয় ও বুদ্ধিও শীঘ্র স্থির হয়। মন স্থির ব্যতীত আত্মজ্ঞান লাভ সম্ভব নয়। আবার যার আত্মজ্ঞান নাই তার শান্তিও নাই। শান্তি ব্যতিরেকে সুখ কোথায় ?
বিষয় ভোগের জন্য ইন্দ্রিয়সকল সর্বদা অগ্রসর। এদের মধ্যে আবার মন যে কোনো একটির প্রতি অগ্রসর হয়। যেমন বাতাস সমুদ্রের বুকে ভাসমান তরনীকে ডুবিয়ে দেয়, তেমনি মন মানুষের প্রজ্ঞা হরন করে। যার ইন্দ্রিয়-সকল সব রকম বিষয়ভোগ হতে নিবৃত্ত, তারই প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জানবে। সাধারণের আত্মনিষ্ঠা যেখানে রাত্রির মতো, সংযমীপুরুষ সে রাত্রিতে জাগরুক। অন্য দিকে সাধারণ মানুষ বিষয়নিষ্ঠায় জাগ্রত, আত্মজ্ঞানী বিষয়বিমুখ হয়ে সুখে নিদ্রা যান। অসীম জলরাশি পূর্ণ সমুদ্রে যেরূপ নদ-নদীর জলরাশি এসে মিলিত হয়, কিন্ত পরিবর্তন হয় না। তেমনি জ্ঞানীব্যক্তিগণ ভোগের মধ্যে থেকেও শান্তি পান। কিন্ত বিষয়কামী কখনো শান্তি পান না। যে ব্যক্তি সব রকম কামনা ত্যাগ করে অহঙ্কারহীন হয়ে, স্পৃহা হীন হয়ে, মমতাহীন হয়ে সংসারে থাকেন, তিনিই প্রকৃতপক্ষে শান্তি লাভ করেন। ব্রহ্মনিষ্ঠায় অবস্থিতি একেই বলা হয়। ব্রহ্মনিষ্ঠা লাভ হলে, সংসার মোহে জীব আর আবদ্ধ হয় না। মৃত্যুকাল পর্যন্ত এই নিষ্ঠায় অবস্থিত থাকলে, জীবের ব্রহ্মনির্বান লাভ হয়ে থাকে।
ভগবান-উক্ত সাংখ্যযোগ এখানেই শেষ হলো। সাংখ্য যোগ আসলে কপিল মুনি কথা। ব্যাসদেব এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখে বসিয়েছেন, নিজের ভাষায় । গীতায় মূল কথা, বা অধ্যাত্বিকতার শেষ কথা এই আত্মতত্ব। অর্থাৎ আমার মূল লক্ষ কি ? কোথায় আমাকে যেতে হবে। কি উপলব্ধি করতে হবে। সেসব কথা ভগবান প্রথম বলে নিলেন। ব্যাসদেব প্রথমে বিষাদ যোগের কথা বললেন, অর্থাৎ মনের ব্যাকুলতার কথা। যা না জাগলে, অনুসন্ধান শুরু হয় না। তার পরে চূড়ান্ত লক্ষের কথা আগে বলে নিলেন। অর্থাৎ আগে জানার বা যাবার ইচ্ছে। তারপর টিকিট কাটা। অর্থাৎ টিকিট কাটতে গেলে তো বলতে হবে, কোথায় যাবো ? তা না হলে সেই টিকিট বিক্রেতা কোথাকার টিকিট দেবে ? তাই কোথায় যেতে হবে, তার বর্ণনা করলেন। এই আত্মতত্বের কথা আমরা পাই বেদ , উপনিষদের মধ্যে। ব্যাসদেব সেটাকেই পুনরাবৃত্তি করলেন। এর পরে বললেন সেখানে গেলে তোমার কেমন লাগবে, অথবা এই আত্মউপলব্ধি হলে তোমার অবস্থাটা কেমন হবে। অর্থাৎ স্থিতপ্রজ্ঞের বর্ণনা করলেন। এই স্থীতপ্রজ্ঞের বর্ণনা আমরা পাই আমরা অষ্টাবক্র সংহিতায়।
ভগবান কথা (03.05.2017) :(জ্ঞানযোগ ও কর্মযোগ এর তুলনা )
জ্ঞানীর জন্য জ্ঞানযোগ ভালো। কর্মীর জন্য কর্মযোগ ভালো। দুটোতেই নিষ্ঠা আবশ্যিক। প্রত্যেকের জন্মসূত্রে কর্মে অধিকার। কর্মহীন জীবন হয় না। আবার কর্মানুষ্ঠান ছাড়া জ্ঞান জন্মে না। আবার চিত্ত শুদ্ধি ছাড়া সন্যাস নিলেও তাতে মোক্ষ লাভ হয় না।
কর্ম ছাড়া কেউ এক মুহূর্ত থাকতে পারে না। সকলেই আপন গুন্ অনুসারে কর্ম করে থাকে। যে বোকা, কর্মেন্দ্রিয়গুলি সংযত করে মনে মনে বিষয় চিন্তা করে সে মিথ্যাচারী। যে মনের দ্বারা ইন্দ্রিয় সকল সংযত রেখে কৰ্মেন্দ্রিয়গুলির দ্বারা আসক্তিহীন ভাবে কর্ম করে - সেই ব্যক্তিই শ্রেষ্ঠ। সর্বদা কর্ম করো কর্ম ত্যাগ অপেক্ষা কর্ম করা উচিত। কর্ম না করলে এমনকি শরীর রক্ষাও হবে না। ..........৩/৮
কর্ম ছাড়া কেউ এক মুহূর্ত থাকতে পারে না। সকলেই আপন গুন্ অনুসারে কর্ম করে থাকে। যে বোকা, কর্মেন্দ্রিয়গুলি সংযত করে মনে মনে বিষয় চিন্তা করে সে মিথ্যাচারী। যে মনের দ্বারা ইন্দ্রিয় সকল সংযত রেখে কৰ্মেন্দ্রিয়গুলির দ্বারা আসক্তিহীন ভাবে কর্ম করে - সেই ব্যক্তিই শ্রেষ্ঠ। সর্বদা কর্ম করো কর্ম ত্যাগ অপেক্ষা কর্ম করা উচিত। কর্ম না করলে এমনকি শরীর রক্ষাও হবে না। ..........৩/৮
ভগবান কথা (07.05.2017) :( কর্মযোগ )
ঈশ্বর-প্রীতির জন্য কর্ম করো। ঈশ্বরপ্রীতিহীন কর্ম বন্ধনের কারণ। তুমি ঈশ্বরপ্রীতির জন্য আসক্তিহীন ভাবে কর্ম করো।সৃষ্টির আদিতে প্রজাপতি ব্রহ্মা, যজ্ঞসহকারে প্রজা সৃষ্টি করে বলেছিলেন এই যজ্ঞ অনুষ্ঠান করে তোমার উন্নতি ও ইষ্টলাভ হোক। যজ্ঞ হবি দ্বারা তোমরা দেবতাগণকে তৃপ্ত করো, দেবতারাও তোমাদের সুখী করুন। যজ্ঞে দেবতারা তোমাদের ইচ্ছা অনুসারে ফল বা ভোগ্য-বস্তূ দান করবেন। সেই সব দেবপ্রদত্ত বস্তূ দেবতাদের উদ্দেশ্যে দান না করে, যে ভোগ করে সে চোর। যজ্ঞ অবশিষ্ট খাদ্য-ভোজনকারী সর্বপাপে মুক্ত হয়। কিনতু নিজের জন্য যে আহার প্রস্তূত করে, সে পাপই আহার করে। বৃষ্টিতে অন্নের উৎপত্তি, অন্নে জীব, আবার যজ্ঞ হতেই মেঘ ও কর্ম হতেই যজ্ঞ সৃষ্টি হয়। ....৩/১৪
ভগবান কথা (৮/৫/২০১৭) (কর্মযোগ)
কর্ম হতে যজ্ঞ, কর্ম আবার বেদের (অনুশাসন ) থেকে। বেদ পরমেশ্বর থেকে সৃষ্ট। সেই সর্বব্যাপী ব্রহ্ম যজ্ঞে নিত্য বিরাজিত।ইন্দ্রিয়ে আসক্ত যে পাপাত্মা, এই সব (বেদ) প্রবর্তিত কর্মচক্রের অনুষ্ঠান না করে, তার জীবনই বৃথা। যার আত্মাতে প্রীতি আবার আত্মাতেই তৃপ্ত, আত্মাতেই তুষ্ট, সে রকম আত্মবান পুরুষের আর কোনো কর্তব্য থাকে না। এইসব আত্মারাম ব্যক্তির এই জগতে কর্মের দরকার হয় না। কর্ম ত্যাগ করলেও তার পাপ-পুন্য নাই। সর্ব্বভূতের মধ্যে কারুর আশ্রয়ে তার প্রয়োজন নেই। অতএব আসক্তিশূন্য হয়ে অবিরত কর্ম করো। অনাসক্ত ভাবে কর্ম করলে পুরুষ মুক্তি লাভ করে। জনকাদি মহাত্মাগণ কর্মযোগের দ্বারাই সিদ্ধিলাভ করেছেন। লোকসংগ্রহের প্রতি দৃষ্টি রেখেও তোমার কর্ম করা উচিত। কারণ, শ্রেষ্ট ব্যক্তিরা যেমন আচরণ করেন, অন্য্ লোকেরা তারই অনুকরণ করেন। তাঁরা যা প্রমান করে (যে আদর্শ উপস্থাপিত করে) জনসাধারণ তারই অনুকরণ করে থাকে। ৩/২১......
ভগবান কথা (১০/৫/২০১৭) (কর্মযোগ)
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন - ত্রিভুবনে আমার কিছু করার নেই, কিছু পাবারও নেই - তবু আমি কর্মে নিযুক্ত আছি। আমি যদি অলস হয়ে কর্ম না করতাম, তাহলে সকল মানুষই আমাকে অনুসরণ করে, অলস জীবনযাপন করতে চাইতো। আমি যদি কর্মে বিরত হই , তা হলে জনগণ কর্মহীন হয়ে উৎসন্নে যাবে। অর্থাৎ আমার-ই দোষে সকলে নষ্ট হয়ে যাবে।
এখান থেকেই শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে মানুষের উর্ধে উঠে নিজেকে আলাদা করছেন। নিজেকে ভগবান বলে আখ্যা দিতে চাইছেন। অর্জুন অর্থাৎ সাধারণ মানুষ থেকে নিজেকে উচ্চস্তরের অবতার বলে বোঝাতে চাইছেন। অবশ্য সীমা রেখে। অর্থাৎ নিজেকে প্রথমে, জ্ঞানী মহাপুরুষ বলে চিহ্নিত করছেন।
এখান থেকেই শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে মানুষের উর্ধে উঠে নিজেকে আলাদা করছেন। নিজেকে ভগবান বলে আখ্যা দিতে চাইছেন। অর্জুন অর্থাৎ সাধারণ মানুষ থেকে নিজেকে উচ্চস্তরের অবতার বলে বোঝাতে চাইছেন। অবশ্য সীমা রেখে। অর্থাৎ নিজেকে প্রথমে, জ্ঞানী মহাপুরুষ বলে চিহ্নিত করছেন।
এর পর ভগবান বলছেন :
অজ্ঞানীগন কর্মে আসক্ত হয়ে যেমন কর্ম করে, জ্ঞানীগণ অনাসক্ত হয়ে লোকশিক্ষার জন্য কর্ম করে। কর্মে আসক্ত জ্ঞানহীন মনুষ্য-মধ্যে বুদ্ধি ভেদ জন্মায়। কারণ বিদ্বান ও জ্ঞানীগণ সব কাজ নিজে করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ও অপরকে কর্মে নিযুক্ত করায়। কর্ম সম্পন্ন হয় প্রকৃতির গুনের দ্বারা। কিন্ত অহংকারের বশীভূত বিমূঢ় ব্যক্তি ভাবে - আমিই করছি - আমিই কর্তা। প্রকৃত গুন্ ও কর্মের তত্ব সম্পর্কে যিনি জ্ঞাত তিনি জানেন - গুনের আশ্রয়ে সকল গুন্ থাকে। অতএব 'আমি করি' এমনটি সে ভাবে না। প্রকৃতির গুনে মোহাবিষ্ট হয়ে যে মূঢ়গণ বিষয়াসক্ত হয়, সর্বজ্ঞ জ্ঞানীগণও তাদের বিচলিত করতে সমর্থ হয় না। অতএব তোমার সমস্ত কর্ম আমাতে অর্পণ করো। .....৩০
এইবার শ্রীকৃষ্ণ, ভগবান হিসেবেই নিজেকে স্থাপিত করলেন। তাই তো বলতে পারলেন : তোমার সমস্ত কর্ম আমাতে সমর্পন করো। সাধারণ ভাবে দেখলে মনে হয়, অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, সব ছেড়ে কৃষ্ণকে স্মরণ করতে, তার প্রতি নির্ভর করতে। আমি কিন্তু সেই ভাবে দেখি না। কৃষ্ণ মানে এখানে ঈশ্বর। অর্থাৎ তুমি সর্ব কর্ম ঈশ্বরের নির্দেশে করো। এবং ফলও তাকেই সমর্পন করো। আমরা আমাদের ইচ্ছেতে কাজ করি। ফল হয় ঈশ্বরের ইচ্ছা মতো। আমরা যদি ঈশ্বরের ইচ্ছা মতো কাজ করি ফল হবে আমাদের ইচ্ছা মতো। এটাই সুখের জায়গা।
ভগবান কথা (১১/৫/২০১৭) (কর্মযোগ)
যারা আমার মত্ শ্রদ্ধা সহকারে অনুকরণ করে,তারা কর্ম করেও কর্ম হতে মুক্ত থাকে। আমার মতের দোষ ধরে যারা আমার মত্ অনুসারে কর্ম না করে তারা মূঢ় ও জ্ঞান-ভ্রষ্ট বলে জানবে। জ্ঞানীগণও আপন প্রকৃতি অনুসারে কর্ম করে। কারণ সমস্ত প্রাণী নিজ নিজ স্বভাব অনুসারে চলে - কাজেই ইন্দ্রিয়-নিগ্রহে কি হবে ? স্বভাবই বলবান। সকল ইন্দ্রিয়েরই নিজ নিজ বিষয়ে আসক্তি ও বিদ্বেষ অবসম্ভাবী।এই দুটোর অর্থাৎ আসক্তির ও বিদ্বেষের বশীভূত হওয়া উচিত নয়। এরা জীবের পরম শত্রূ বলে জানবে। পরের ধৰ্ম সর্বাঙ্গ সুন্দর হলেও, বিকলাঙ্গ আপন ধর্মই শ্রেষ্ট। আপন ধর্মে মরণও মঙ্গলজনক। কিনতু পরের ধৰ্ম ভয়াবহ জানবে।
যারা আমার মত্ শ্রদ্ধা সহকারে অনুকরণ করে,তারা কর্ম করেও কর্ম হতে মুক্ত থাকে। আমার মতের দোষ ধরে যারা আমার মত্ অনুসারে কর্ম না করে তারা মূঢ় ও জ্ঞান-ভ্রষ্ট বলে জানবে। জ্ঞানীগণও আপন প্রকৃতি অনুসারে কর্ম করে। কারণ সমস্ত প্রাণী নিজ নিজ স্বভাব অনুসারে চলে - কাজেই ইন্দ্রিয়-নিগ্রহে কি হবে ? স্বভাবই বলবান। সকল ইন্দ্রিয়েরই নিজ নিজ বিষয়ে আসক্তি ও বিদ্বেষ অবসম্ভাবী।এই দুটোর অর্থাৎ আসক্তির ও বিদ্বেষের বশীভূত হওয়া উচিত নয়। এরা জীবের পরম শত্রূ বলে জানবে। পরের ধৰ্ম সর্বাঙ্গ সুন্দর হলেও, বিকলাঙ্গ আপন ধর্মই শ্রেষ্ট। আপন ধর্মে মরণও মঙ্গলজনক। কিনতু পরের ধৰ্ম ভয়াবহ জানবে।
এইখানে ভগবান পরের ধৰ্ম বলতে কি বোঝাচ্ছেন ? পরের ধৰ্ম বলতে হিন্দু, ইসলাম, খ্রিস্ট নিশ্চই নয়। পরের ধৰ্ম বলতে, আমার মনে হয় স্বভাব জাত ধৰ্ম। হাঁস জন্ম থেকে জলে সাঁতার কাটে। পাখি জন্ম থেকেই আকাশে ওড়ে। মানুষ দুই পায়ে হাটে। জীব জন্ত চার পায়ে হাটে। ঘোড়া নিশ্চই আকাশে উড়তে চাইবে না। উড়তে চাইলে পঙ্খিরাজ হতে হবে। তার আগে ওড়ার চেষ্টা মানে - হাত পা ভাঙা। তাই আমাদের বলছেন, তোমরা স্বভাব অনুযায়ী, বা ক্ষমতা অনুযায়ী কর্ম করো। তুমি লেখক হতে পারো, যদি তুমি ক্ষমতা অর্জন করো। ক্ষমতা অর্জন, কর্ম থেকেই হয়, জ্ঞান অর্জনও কর্ম থেকেই হয় । কতকগুলো ক্ষমতা জন্ম সিদ্ধ, আবার কতকগুলো ক্ষমতা কর্মসিদ্ধ। তুমি এদের সাম্যভাব রক্ষা করে চলো।
ভগবান আবার বলছেন :
মানুষ কেন বুঝেশুনেও পাপাচারে লিপ্ত হয় ? তার কারণ হলো, কাম এবং ক্রোধ। এই দুটোর সৃষ্টি রজো গুন্ থেকে। কাম বাঁধা পেলেই ক্রোধের উদ্রেক করে। এদের মতো শত্রূ এ জগতে আর কেউ নেই। ধোঁয়া যেমন আগুন-কে, ধূলি যেমন আয়নাকে, চর্ম যেমন গর্ভকে আবৃত করে রাখে - কামও তেমনি প্রকৃত জ্ঞানকে আবৃত করে রাখে। মানুষের পরম শত্রূ হচ্ছে কাম। কামকে তুষ্ট করা যায় না। এবং কামই জ্ঞান কে আবৃত করে রাখে। আবার কামের আশ্রয় হলো ইন্দ্রিয়সকল, মন ও বুদ্ধি। এই গুলির সাহায্যেই কাম সৎ জ্ঞানকে ঢেকে রেখে অসৎ কর্মে মানুষকে উদবুদ্ধ করে। তাই সবার আগে ইন্দ্রিয়কে বশে আনো, ইন্দ্রিয়কে দমন করো। শরীর অপেক্ষা ইন্দ্রিয় বলবান, ইন্দ্রিয় অপেক্ষা মন শ্রেষ্ট, মন অপেক্ষা বুদ্ধি শ্রেষ্ট আবার বুদ্ধি অপেক্ষা আত্মা শ্রেষ্ট। তাই আত্মাকে শ্রেষ্ট জেনে, আত্মার নির্দেশ জেনে - বুদ্ধির দ্বারা মনকে স্থির করো, মন দ্বারা ইন্দ্রিয়কে বশীভূত করো। ইন্দ্রিয় দ্বারা কামকে দমন করো ......৩/৪৩
শ্রীভগবান এবার জ্ঞানের মধ্যে যা সর্বশ্রেষ্ট জ্ঞান তার কথা বলছেন। যা শুনলে এবং বুঝলে পরম সিদ্ধি লাভ করা যায়। এই জ্ঞান লাভ করলে জ্ঞানী ভগবানের স্বারূপ্য লাভ করেন। জন্ম-মৃত্যু থেকে রেহাই পান। সুখ-দুঃখ -এর অতীত হয়ে যান। এই জ্ঞান কী ? প্রকৃতি ভগবানের গর্ভধানের স্থান। প্রকৃতিতেই ভগবান জগৎ বিস্তারের বীজ নিক্ষেপ করেন। এই গর্ভাধান থেকেই সর্বভূতের সৃষ্টি।
আমি এতক্ষন অর্জুনের প্রশ্নগুলোকে গুরুত্ত্ব না দিয়ে শুধু ভগবানের বাণীগুলোকে আশ্রয় করে ছিলাম। এবার অর্জুনের একটা প্রশ্ন আমাকে নাড়া দিয়েছে। যেটা আমি না উল্লেখ করে পারছি না।ভগবান বলছেন : আমি এই অবিনাশী যোগ সূর্যকে বলেছিলাম, সূর্য তার পুত্র মনুকে এবং মনু তার পুত্র ইক্ষ্বাকুকে (ইক্ষাকু) বলেছিলেন। এইরূপে পরম্পরাপ্রাপ্ত এই যোগ রাজর্ষিগন অবগত ছিলেন , কিনতু দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ায়, মনুষ্যলোকে এই যোগ লুপ্তপ্রায় হয়েছে। তুমি আমার ভক্ত, প্রিয় সখা, সেই জন্য এই পুরাতন যোগ আজ তোমাকে বললাম। কারণ এটি অতি গূঢ় রহস্য।
অর্জুন বলছেন (৪/৪): তোমার জন্ম এখন হয়েছে। আর সূর্যের জন্ম হয়েছে অনেক আগে। সুতরাং তুমিই যে সৃষ্টির আদিতে এই যোগ সন্মন্ধে সূর্যকে বলেছিলে - তা আমি কি করে বুঝবো ?
ভগবান বলছেন : হে পরন্তপ অর্জুন ! আমার এবং তোমার বহু জন্ম অতীত হয়েছে। আমি সে সব জানি কিনতু তুমি জান না।
এইখানে আমার কিছু প্রশ্ন আছে। এতক্ষন ভগবান যা বললেন, সবই তর্কাতীত। ভগবানের কথাই বটে।এইসব গূঢ় রহস্যের কথা পরম মঙ্গলময়। শুধু তাই নয়। এই সব কথা বহু যুগের পুরাতন। যা আজও নবীন। এবং ভবিষ্যতেও এইসব কথার গুরুত্ত্ব এতটুকু কমবে না। কিনতু প্রশ্ন হলো, ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে একথা কেন বলতে হলো যে - আমি এগুলো সূর্যকে বলেছিলাম। ....ইত্যাদি ইত্যাদি।..
এইখানে আমার কিছু প্রশ্ন আছে। এতক্ষন ভগবান যা বললেন, সবই তর্কাতীত। ভগবানের কথাই বটে।এইসব গূঢ় রহস্যের কথা পরম মঙ্গলময়। শুধু তাই নয়। এই সব কথা বহু যুগের পুরাতন। যা আজও নবীন। এবং ভবিষ্যতেও এইসব কথার গুরুত্ত্ব এতটুকু কমবে না। কিনতু প্রশ্ন হলো, ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে একথা কেন বলতে হলো যে - আমি এগুলো সূর্যকে বলেছিলাম। ....ইত্যাদি ইত্যাদি।..
আসলে, শ্রীকৃষ্ণকে, অর্জুন ভগবান বলে এখনো ভাবেনি। এখনো, সখা বা বন্ধুর কথায় অর্জুন কতটা গুরুত্ব দেবে, সে ব্যাপারে শ্রীকৃষ্ণের মনে সন্দেহ জন্মেছে। তাই তাকে এসব কথা বলতে হয়েছে। আসলে জ্ঞান তো বহু পুরাতন। এবং জ্ঞানের সংরক্ষক, বা ভান্ডার একমাত্র ভগবানই। আর তা ছাড়া শ্রীকৃষ্ণ নিজেও এখনো অর্জুনকে সমবয়সী সখাই ভাবে। তা না হলে এ কথাটা বলতো না যে - তুমি আমার ভক্ত ও প্রিয় সখা, সেজন্য আমি তোমাকে এতসব কথা বলছি। আসলে অর্জুনতো দূরের কথা শ্রীকৃষ্ণ নিজেই এখনো বুঝতেই পারছে না যে, অর্জুন এসব বুঝলো কি না। আর যদি বোঝেও, তাহলেও তার কথা শুনবে কি না। অর্থাৎ যুদ্ধ করবে কি না। যার জন্য তাকে এর আগে বার বার বলতে শুনেছি - আমার কথা শোনো - যুদ্ধ করো। শ্রীকৃষ্ণের মনে এই সন্দেহ থেকেই তিনি নিজেকে অর্জুন থেকে আলাদা করে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা করছেন। নিজেকে ঈশ্বর হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা করছেন। আবার ভেতরের দ্বন্দও এখনো যায় নি।
আবার সত্য হল, জ্ঞানতো বহু পুরাতন। আবার সূর্য্যও বহু পুরাতন। প্রাণ সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় সূর্যের ভূমিকা প্রধান। এমনকি এই পৃথিবী বা সূর্যালোকের সবইতো সূর্য্য থেকেই সৃষ্টি। আমরা এখন জ্ঞানের জন্য গুগল খুঁজছি, বইপত্র খুঁজছি। এগুলোতো আগে ছিল না। তবে জ্ঞান কোথা থেকে পেতাম ? বইয়ের আগে জ্ঞান শ্রূতি অর্থাৎ শুনে শুনে লাভ করতে হতো। অর্থাৎ জ্ঞান ছিল গুরুবিদ্যা, বা শ্রুতিবিদ্যা । তার আগে কি ছিলো ? উপলব্ধি। এই উপলব্ধি কি থেকে হতো ? ধ্যান থেকে। ধ্যানে আমরা কোথা থেকে জ্ঞান সংগ্রহ করতাম ? বিশ্বব্রহ্মান্ড থেকে। এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড, বা আমাদের সূর্যলোকের প্রধান হচ্ছেন সূর্যদেব । তিনিই প্রথমে কর্ম শুরু করেন। অর্থাৎ অবিরত পরিক্রমা, বিরামহীন আলোকবর্ষণ তাঁর ধৰ্ম। অতএব কর্মতত্ব তিনিই জ্ঞাত হয়েছিলেন প্রথমে। একেই বলে বিবস্বত। মনু হচ্ছেন প্রথম মানব আকাশতত্ব অর্থাৎ ওং । আর এই মনুর নাসিকা থেকে হাঁচিবার সময় এই ইক্ষাকুর জন্ম হয়। অর্থাৎ ইক্ষাকুর উৎপাদনের কারন হচ্ছে প্রাণবায়ু। অর্থাৎ সূর্যকে যদি মহারাজা বলা হয় , তবে মনু-ইক্ষাকুকে সূর্যবংশের রাজা বলা যেতে পারে। অর্থাৎ কর্মজ্ঞান প্রথম পেয়েছিলেন সূর্য। ভগবান বা পরম ঈশ্বর এই উপদেশ তাকে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ সূর্যের যিনি স্রষ্টা তিনিই জ্ঞানের ভান্ডার। এবং তিনিই জ্ঞানদানকারী। এখন দেহধারী শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে এর কি
সম্পর্ক ?
এ সম্পর্কে একটা গল্প বলি। এক জিজ্ঞাসু ভক্ত রামায়নের আসরে প্রশ্ন করে ফেললেন : সীতা হরনের পরে, রাম এত কান্না কাটি কেন করছিলো ? তিনি যদি ভগবানই হবেন, তবে তার এত বিলাপ কেন ? স্বয়ং ভগবানের যদি এই দশা হয়, আমাদের কি হবে ? এই প্রশ্নের একটা খুব সুন্দর উত্তর শুনেছিলাম। আর সেটা হচ্ছে - দেখো তোমরা সবাই জানো রাম জন্মের আগে রামায়ন লেখা হয়েছিল। তো রামায়ণে মহর্ষি বাল্মীকি এই বিলাপের কথা লিখে গিয়েছেন। এখন রাম যদি এই বিলাপ না করে তবে রামায়ন মিথ্যা হয়ে যাবে। অর্থাৎ ঠিক ঠিক নাটক-টা করা হল না। এখন নাটক করতে এসে মঞ্চে উঠে নাটকের কথা বা নাট্যকারের কথা না বলে যদি নিজের ইচ্ছে মতো সংলাপ বলি তবে চলবে ? তাই রামকে এই বিলাপের নাটক করতে হয়েছিল। এখন শ্রীকৃষ্ণ এখানে ভগবানের ভূমিকায় অভিনয় করছেন। তাকে তো নাট্যকারের সংলাপ অর্থাৎ ভগবানের কথা বলতেই হবে। তা না হলে ঠিক ঠিক ভগবান সাজা হলো না। দেহধারী শ্রীকৃষ্ণ এখানে ঈশ্বরের ভূমিকায় অভিনয় করছেন। আমাদের সেটা মনে রাখতে হবে।
অষ্টাবক্রর একটা পড়ছিলাম :
আবার সত্য হল, জ্ঞানতো বহু পুরাতন। আবার সূর্য্যও বহু পুরাতন। প্রাণ সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় সূর্যের ভূমিকা প্রধান। এমনকি এই পৃথিবী বা সূর্যালোকের সবইতো সূর্য্য থেকেই সৃষ্টি। আমরা এখন জ্ঞানের জন্য গুগল খুঁজছি, বইপত্র খুঁজছি। এগুলোতো আগে ছিল না। তবে জ্ঞান কোথা থেকে পেতাম ? বইয়ের আগে জ্ঞান শ্রূতি অর্থাৎ শুনে শুনে লাভ করতে হতো। অর্থাৎ জ্ঞান ছিল গুরুবিদ্যা, বা শ্রুতিবিদ্যা । তার আগে কি ছিলো ? উপলব্ধি। এই উপলব্ধি কি থেকে হতো ? ধ্যান থেকে। ধ্যানে আমরা কোথা থেকে জ্ঞান সংগ্রহ করতাম ? বিশ্বব্রহ্মান্ড থেকে। এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড, বা আমাদের সূর্যলোকের প্রধান হচ্ছেন সূর্যদেব । তিনিই প্রথমে কর্ম শুরু করেন। অর্থাৎ অবিরত পরিক্রমা, বিরামহীন আলোকবর্ষণ তাঁর ধৰ্ম। অতএব কর্মতত্ব তিনিই জ্ঞাত হয়েছিলেন প্রথমে। একেই বলে বিবস্বত। মনু হচ্ছেন প্রথম মানব আকাশতত্ব অর্থাৎ ওং । আর এই মনুর নাসিকা থেকে হাঁচিবার সময় এই ইক্ষাকুর জন্ম হয়। অর্থাৎ ইক্ষাকুর উৎপাদনের কারন হচ্ছে প্রাণবায়ু। অর্থাৎ সূর্যকে যদি মহারাজা বলা হয় , তবে মনু-ইক্ষাকুকে সূর্যবংশের রাজা বলা যেতে পারে। অর্থাৎ কর্মজ্ঞান প্রথম পেয়েছিলেন সূর্য। ভগবান বা পরম ঈশ্বর এই উপদেশ তাকে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ সূর্যের যিনি স্রষ্টা তিনিই জ্ঞানের ভান্ডার। এবং তিনিই জ্ঞানদানকারী। এখন দেহধারী শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে এর কি
সম্পর্ক ?
এ সম্পর্কে একটা গল্প বলি। এক জিজ্ঞাসু ভক্ত রামায়নের আসরে প্রশ্ন করে ফেললেন : সীতা হরনের পরে, রাম এত কান্না কাটি কেন করছিলো ? তিনি যদি ভগবানই হবেন, তবে তার এত বিলাপ কেন ? স্বয়ং ভগবানের যদি এই দশা হয়, আমাদের কি হবে ? এই প্রশ্নের একটা খুব সুন্দর উত্তর শুনেছিলাম। আর সেটা হচ্ছে - দেখো তোমরা সবাই জানো রাম জন্মের আগে রামায়ন লেখা হয়েছিল। তো রামায়ণে মহর্ষি বাল্মীকি এই বিলাপের কথা লিখে গিয়েছেন। এখন রাম যদি এই বিলাপ না করে তবে রামায়ন মিথ্যা হয়ে যাবে। অর্থাৎ ঠিক ঠিক নাটক-টা করা হল না। এখন নাটক করতে এসে মঞ্চে উঠে নাটকের কথা বা নাট্যকারের কথা না বলে যদি নিজের ইচ্ছে মতো সংলাপ বলি তবে চলবে ? তাই রামকে এই বিলাপের নাটক করতে হয়েছিল। এখন শ্রীকৃষ্ণ এখানে ভগবানের ভূমিকায় অভিনয় করছেন। তাকে তো নাট্যকারের সংলাপ অর্থাৎ ভগবানের কথা বলতেই হবে। তা না হলে ঠিক ঠিক ভগবান সাজা হলো না। দেহধারী শ্রীকৃষ্ণ এখানে ঈশ্বরের ভূমিকায় অভিনয় করছেন। আমাদের সেটা মনে রাখতে হবে।
অষ্টাবক্রর একটা পড়ছিলাম :
আত্মা সাক্ষী বিভুঃ পূর্ণ একো মুক্ত-চিৎ-অক্রিয়ঃ
অসঙ্গো নিঃস্পৃহ শান্তো ভ্রমাৎ সংসারবান-ইব।
আত্মা সাক্ষী,বিভু, পূর্ণ, এক, মুক্ত, চিৎ-অক্রিয় অসঙ্গ, নিস্পৃহ শান্ত স্বরূপ। ভুলবশতঃ আত্মাকে সংসারী জীবের ন্যায় মনে হয়।
আসলে দেহধারী শ্রীকৃষ্ণ এখনো মায়াতেই আবদ্ধ। তা না হলে অর্জুন তার সখা হয় কি
করে ? বিশেষ করে এই মুহূর্তে, শ্রীকৃষ্ণের উপরে ঈশ্বরের সমস্ত শক্তি, সমস্ত জ্ঞান প্রকাশ পাচ্ছে। তৎ সত্বেও শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে সন্দেহাতীত ভাবে ভগবান ভাবতে পারছেন না। চেষ্টা করছেন নিজেকে ভগবান বলে প্রতিষ্ঠিত করতে। তাই তো তিনি নিজেকে আলাদা করে বোঝাবার জন্য জাহির করে বলছেন :
করে ? বিশেষ করে এই মুহূর্তে, শ্রীকৃষ্ণের উপরে ঈশ্বরের সমস্ত শক্তি, সমস্ত জ্ঞান প্রকাশ পাচ্ছে। তৎ সত্বেও শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে সন্দেহাতীত ভাবে ভগবান ভাবতে পারছেন না। চেষ্টা করছেন নিজেকে ভগবান বলে প্রতিষ্ঠিত করতে। তাই তো তিনি নিজেকে আলাদা করে বোঝাবার জন্য জাহির করে বলছেন :
বহুনি মে ব্যাতীতানি জন্মানি তব চ-অর্জুন
তান্যহং বেদ সর্বাণি ন ত্বং বেত্থ পরন্তপ।
হে অর্জুন ! আমার এবং তোমার বহু জন্ম অতীত হয়েছে। আমি সে সব জানি, কিনতু তুমি জান না।অর্থাৎ তুমি আর আমি এক না। আমি তোমাকে বন্ধু ভাবি বলে ভেবো না, আমি আর তুমি এক। আমি তোমার থেকে অনেক কিছু বেশি জানি। তোমার থেকে আমার ক্ষমতাও বেশী। তাই যা বলছি তাই করো। যুদ্ধ করো। যা আমি চাইছি - তাই করো।
এইখানে কিছু প্রাসঙ্গিক কথা আলোচনা করি। আমি তখন ভালো থাকার জন্য, একটি আশ্রয় খুঁজবার জন্য ব্যাকুল। বাবা মারা যাবার পরে আমার মনে হয়েছিল, আমি আশ্রয়হীন হলাম। আমরা পারিবারিক সূত্রে যেহেতু কৃষ্ণ অনুগামী, তাই আমার সেই মনের ব্যাকুলতা নিয়ে এক কৃষ্ণ ভক্তকে সাহস করে জিজ্ঞেস করে ছিলাম। আমরা কি কৃষ্ণকে ভজনা করলে ভালো থাকবো। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জন্মেছিলেন বহু বছর আগে। আজও কি তার প্রভাব আছে ? তিনি কি আমাদের সত্যিই ভালো করতে পারেন বা ভালো রাখতে পারেন। যখন তিনি সশরীরে ছিলেন, তখন তার মা, বাবা, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবাই কি ভালো ছিলেন ? তাতো ছিলেন না। এমনকি কৃষ্ণ নিজেও কখনো ভালো ছিলেন কি ? সারাটা জীবন তার যুদ্ধ যুদ্ধ করে কেটে গেল। সেই ছোট্টো বেলা থেকে মৃত্যু-ভয় তার পিছন ছাড়ে নি। এমনকি শেষ বয়সে গান্ধারীর অভিশাপ তাকে কুড়োতে হয়েছিল। তার জীবদ্দশায় তার সন্তানসম আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যু তার পিছু ছাড়ে নি। তাহলে ? আমার আজও মনে পরে, ভগবান শ্রী কৃষ্ণের সেই পরম ভক্ত, আমাকে বিড়ম্বনায় ফেলে, নিজের নাক-কান মললেন, হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ বলে হুঙ্কার ছাড়তে লাগলেন। এবং এমন ভাবে দিক বিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে ছুটতে লাগলেন যে তার কাঁছা পর্যন্ত খুলে গেল। আমি নিজেকে যার পর নাই অপরাধী ভাবতে লাগলাম। হায় ভগবান আমি কার কাছে যাবো ?
সেই থেকে আর কাউকে প্রশ্ন করি না। প্রশ্ন করি ঈশ্বরকে। কিন্তু ঈশ্বরকেও তো চিনি না। প্রশ্ন করি নিজেকে। আর খুঁজি ঈশ্বরকে। কিন্তু যাকে দেখিনি কোনো দিন, তাকে কি খুঁজে পাওয়া যায় ? মাটির মূর্তির মধ্যে ঈশ্বর খুঁজি, নিজের অন্তরে ঈশ্বরকে খুঁজি। আর জিজ্ঞেস করি তুমিকি ঈশ্বর ? খুঁজতে খুঁজতে এক জায়গায় পেলাম ঈশ্বরকে। অন্তর থেকে উত্তর এলো। এই দেখো আমি। যাকে তুমি খুঁজছো। কে সেই ঈশ্বর ? বলি শুনুন :
"সৃষ্টির আদিতে সমস্ত অব্যক্ত ছিল, তখন তার কোনো বিশেষ্ত্ব ছিল না। এক বস্তুসার ছিল। এই অব্যক্ত এক বস্তুই কালক্রমে ব্যক্ত ও বহুরূপ ধারণ করে। এখনো সে অব্যক্ত, একবস্তু বর্তমান। একেই আধুনিক বিজ্ঞান বলছে ইথার, তরঙ্গ । মুনি ঋষিরা বলছেন অব্যকৃত বা অবিশেষ অব্স্থা। এই অধরার আধারেই সব।"
"দেখো সবারই একটা নির্ভরতা দরকার। যার মধ্যে সে থাকবে। যার আশ্রয়ে সে থাকবে। নির্ভরতা বিহীন কেউ নয়। এই নির্ভরতাকেই বলে আধার। আধার বিহীন কেউ নেই, থাকতেও পারে না। সবারই আধার দরকার। গর্ভাবস্থায় মায়ের গর্ভ শিশুর আধার। মানুষের আধার পৃথিবী। পৃথিবীর আধার তেজ। তেজের আধার বায়ু। বায়ুর আধার আকাশ। আকাশের আধার অব্যক্ত। এই আধারই আমাদের অবলম্বন । এই ভাবে করতে করতে এগিয়ে গেলে শেষ আধার যদি কিছু পাওয়া যায়, তবে সেটাই ঈশ্বর। আধারের মধ্যে আধার, আধারের বাইরে আধার। তাই আধারের সূক্ষতা ও সীমা নির্ধারণ করা যায় না। তাই রামকৃষ্ণ বলেছেন ঈশ্বরের শেষ করতে নেই। পৃথিবী থেকে বায়ু সূক্ষ্ম, বায়ু থেকে আকাশ সূক্ষ্ম। এইভাবে সূক্ষ্ম থেকে অতিসূক্ষ্ম, সূক্ষ্মতম, সূক্ষ্মতর । আবার দেখো যত সূক্ষ্ম তত কম গুনের অধিকারী। তুমি তো জানো -পৃথিবীর গুন্ - শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ। অর্থাৎ পাঁচটি গুন্। জলের গুন্ - শব্দ স্পর্শ, রূপ, রস। অর্থাৎ ৪টি গুন্। একটা কমে গেলো। বাতাসের গুন্ - শব্দ স্পর্শ, রূপ। আবার একটা কমে হলো তিন। তেজ বা আগুনের গুন্ দুটো - রূপ ও শব্দ। একদম শেষে, অর্থাৎ আমাদের উপলব্ধির শেষ আধার আকাশ। এই আকাশের গুন্ - শব্দ। অর্থাৎ মাত্র একটি গুন।
নির্গুণ আত্মার মধ্যে আছে আকাশ। এই নির্গুণ আত্মার কোনো আধার নেই। পন্ডিতরা বলে ব্যোম, আসলে শুন্য। আকাশের মধ্যে আছে বাতাস। বাতাসের মধ্যে আছে তেজ। তেজের মধ্যে আছে জল। জলের মধ্যে আছে পৃথিবী। পৃথিবীর মধ্যে আছে গাছপালা। এই গাছপালার মধ্যে আছে অন্ন। আর অন্নের মধ্যে আছে প্রাণী। অর্থাৎ প্রাণ বীজ আকারে অন্নের মধ্যে নিহিত।
একটু নিবিষ্ট চিত্ত হয়ে ভাব। তুমিতো জানো, এই পৃথিবীর ৭৫% ভাগ জল। ২৫% ভাগ স্থল। একটু চোখ বুজে কল্পনা করতো - বিশাল একটা পুকুর তার মধ্যে একটা মৃত্তিকা খণ্ড অর্থাৎ যে মাটির উপরে আমরা দাঁড়িয়ে আছি বা বাস করছি। এই পুকুরটা নিচে তেজ, আর তেজের নিচে বায়ু অর্থাৎ বায়ুর উপরে পুকুরটা ভাসছে। আর বায়ুর নিচে আকাশ। অর্থাৎ এক খণ্ড আকাশের মধ্যে বায়ু, আবার বায়ুর মধ্যে তেজ, তেজের মধ্যে জলাধার, আবার জলাধারের মধ্যে মাটির টুকরো। এই মাটির টুকরোর মধ্যে আছে গাছপালা। এই গাছপালার মধ্যে আছে অন্ন। আবার অন্নের মধ্যে প্রাণ। এই প্রান-ই সর্বজীবের আশ্রয়স্থল। প্রাণহীন জীবন নেই। এই তত্ত্বের মধ্যে ঢোকা বা বিশ্লেষণ করাই ঈশ্বরকে খোঁজা। অর্থাৎ নির্ভরতা খোঁজা নিজের উৎপত্তি খোঁজা। ঈশ্বর অর্থাৎ ঈশ + বর, ঈশ কথাটার মানে আধিপত্য করা আর বর কথাটার মানে বাঞ্ছিত সত্য বা ভালো কিছু। তাহলে কি দাঁড়ালো বাঞ্চিত সত্য বা ভালো সবকিছুর মধ্যে যিনি আধিপত্য করছেন তাকে আমরা ঈশ্বর বলি। প্রকৃত সত্যকে খোঁজাই ঈশ্বরকে খোঁজা।
ঈশ্বরকে খোঁজা মানে নিজের নির্ভরতাকে খোঁজা। আমি কার উপর দাঁড়িয়ে আছি। কে আমাকে নির্ভরতা দিয়েছে, তাঁকে খোঁজা। এই খোঁজার শেষ নেই। তাই আজও ঈশ্বর অধরা। আসলে আমি বলে কিছু নেই। সবই তিনি। চোখ নিজেকে দেখতে পায় না। ঈশ্বর স্ব-স্থিত।
ভগবান এর পরে বলছেন :
আদ্যাশক্তির প্রভাবে জন্ম জন্মান্তের জ্ঞান অর্জন করা যায়। অবিদ্যায় আচ্ছন্ন থাকলে এসব জানা বোঝা যায় না। একই শক্তি বারবার জন্ম-মৃত্যুর খেলায় রত। ভগবান সবার ঈশ্বর। যিনি জন্ম মৃত্যু রোহিত। আবার প্রকৃতিকে আশ্রয় করে নিজ মায়া প্রভাবে নিজেকেই সৃষ্টি করেন।
আদ্যাশক্তির প্রভাবে জন্ম জন্মান্তের জ্ঞান অর্জন করা যায়। অবিদ্যায় আচ্ছন্ন থাকলে এসব জানা বোঝা যায় না। একই শক্তি বারবার জন্ম-মৃত্যুর খেলায় রত। ভগবান সবার ঈশ্বর। যিনি জন্ম মৃত্যু রোহিত। আবার প্রকৃতিকে আশ্রয় করে নিজ মায়া প্রভাবে নিজেকেই সৃষ্টি করেন।
ভগবান বলছেন :
যদা যদা হি ধর্ম্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত
অভ্যূত্থানমধর্ম্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্। (৪/৭)
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্
ধৰ্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে। (৪/৮)
যখন যখন ধর্মের গ্লানি অর্থাৎ পতন হয় তখনই আমি নিজেকে সৃষ্টি করে থাকি। সাধুগণের ত্রাণ, পাপীগণের বিনাশ ও ধর্মকে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।
যদা যদা হি ধর্ম্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত
অভ্যূত্থানমধর্ম্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্। (৪/৭)
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্
ধৰ্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে। (৪/৮)
যখন যখন ধর্মের গ্লানি অর্থাৎ পতন হয় তখনই আমি নিজেকে সৃষ্টি করে থাকি। সাধুগণের ত্রাণ, পাপীগণের বিনাশ ও ধর্মকে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।
এই জায়গায় প্রশ্ন। এই প্রশ্ন শুধু নাস্তিকদের নয়, ঈশ্বর-বিশ্বাসীদের অর্থাৎ আস্তিকদের-ও বটে। ঈশ্বর আবার মানুষ হয়ে জন্মায় নাকি ?
জন্মাতে পারে কি না সেটা প্রশ্ন নয়। তিনি সর্বশক্তিমান তিনি সব কিছু করতে পারেন। কিনতু শুধু মানুষ কেন, মৎস, কুর্ম, বরাহ, প্রভৃতি হয়ে তিনি জন্মান কি না। প্রশ্নটা এখানেই। আমার মনে হয় এই যে অবতারতত্ত্ব, এটি জীবনের ক্রমোন্নতির উদাহরণ মাত্র । খেয়াল করুন, মৎস অর্থাৎ জলচর প্রাণী। প্রথম প্রাণী তো জলেই হয়। তার পরে কুর্ম অর্থাৎ উভচর প্রাণী। তার পর বরাহ অর্থাৎ কর্দমাক্ত জায়গায় বসবাসকারী প্রাণী। এগুলি প্রাণ সৃষ্টির পর্যায় মাত্র। এর পর নৃসিংহ অর্থাৎ মানুষ ও পশুর মিশ্রণ। এর পরে মানুষের রূপ পরিগ্রহ । .... রাম , পরশুরাম, কৃষ্ণ, চৈতন্য, হরিচাঁদ। .. ইত্যাদি ইত্যাদি
ঈশ্বর সবাইকে সৃষ্টি করেছেন। সবাই ঈশ্বরের মধ্যে বা সবার মধ্যে ঈশ্বর। তাহলে ঈশ্বর-মানুষ বলে কিছু হয় নাকি ? মানুষ ঈশ্বর অর্থাৎ ঈশ্বরসম হয় তার কর্ম গুনে। তুমি যখন কোনো অসহায় মানুষকে বিপদ থেকে উদ্ধার করো - তখন তুমি তার কাছে ঈশ্বরসম। এখানে ঈশ্বর মানে মঙ্গলময়। আবার কাউকে যদি তুমি বিপদে ঠেলে দাও - তবে তার কাছে তুমি অমঙ্গলকারী বা সর্বনাশা শয়তান। দুটোই শক্তির খেলা। একটা শুভ কাজের জন্য, অপরটি অশুভ কাজের জন্য।
ঈশ্বর মানুষ হিসেবে জন্ম গ্রহণ করতে পারেন কি না বা করেন কি না, সেটা আমার প্রশ্ন নয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে ঈশ্বর-এর মনুষ্যাবতার গ্রহণ করার জন্য, বা মানুষ্য রূপ গ্রহণ করার জন্য কোনো বিশেষ পরিস্থিতির দরকার হয় কি না। অর্থাৎ এই যে বলছেন, যখন যেখানে ধর্মের গ্লানি হয়, সেখানেই আমি নিজেকে সৃষ্টি করি। নিজেকেই তো বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড হিসেবে সৃষ্টি করেছেন তিনি। তিনি ছাড়া তো কিছু নয়। ভালো মন্দ সব-ই তার। ধর্মের গ্লানি অর্থাৎ ভালোর অপমান যখন হয় তখন তিনি আসেন। তাহলে, এই যুগে অর্থাৎ যাকে আমরা কলি যুগ বলি, এখনই তো সবচেয়ে বেশি তার প্রয়োজন। এখন তিনি কোথায় ? নাকি এখনো তিনি আছেন। হ্যাঁ তিনি আছেন, আমাদের সবার অন্তরে আছেন। আগেও তিনি ছিলেন, এখনো তিনি আছেন। ভিতরের অশুভকে দমন করার জন্য তিনি সর্বদা জাগ্রত আছেন। দুষ্টকে দমন করার জন্য তিনি আসেন। এই কথাটা লোকশিক্ষার জন্য প্রয়োজন। এতে দুষ্টেরা ভয় পাবে। কিন্তু সাধুদের পরিত্রানের জন্য তিনি আসেন, এই কথাটা আসলে তথাকথিত অসাধুদের জন্য, অর্থাৎ যারা নিজেদেরকে সাধু বলে পরিচয় দেন বা পরিচয় দিতে ভালো বাসেন, তাদের জন্য এটি একটি পরিহাস মাত্র। সত্যিকারের সাধুদের পরিত্রানের কোনো দরকার পড়ে না। সত্যিকারের সাধুরা সর্বকালে, সর্বত্র সুরক্ষিত। এরা পার্থিব সম্পদের অধিকারী নয়। এমনকি দেহকেও এরা অসত্য মনে করে। এঁরা অপার্থিব অর্থাৎ পারমার্থের অধিকারী, আর এই সম্পদ বাইরে থেকে নষ্ট করা যায় না, বাইরে থেকে রক্ষাও করা যায় না। তাই তথাকথিত সাধুরা যারা আসলে অসাধু, তারাই ভাবেন তাদের রক্ষার জন্য ভগবান আসবেন। এর থেকে হাস্যকর আর কি হতে পারে ? আমার জন্য সূর্য ওঠে, আমার জন্য চাঁদের উদয় হয়, আমার জন্য মৃদুমন্দ্র বাতাস বয়, আমার পা ধুয়ে দেবার জন্য সমুদ্র ঢেউ তোলে। এমনটি যারা ভাবে, তাদের মতো আহাম্মক আর কে আছে। আসলে সূর্য ওঠে তাই আমরা আলো পাই। আমরা বেঁচে থাকি। আমাকে বাঁচানোর জন্য সূর্য ওঠে না। সূর্য ওঠে তাই আমরা কিরণ পাই, বেঁচে থাকি। চাঁদ ওঠে তাই আমরা জ্যোৎস্না পাই। আমাদের জ্যোৎস্না দেবার জন্য চাঁদ ওঠে না। সমুদ্র আপন খেয়ালে দুলছে, ঢেউ উঠছে। আমি তাতে অবগাহন করি। আমাকে গন্ধ দেবার জন্য ফুল ফোটে না, ফুল ফোটে তাই আমরা গন্ধ পাই। ভগবান নরোত্তম হন, তাই আমরা তার সুফল পাই। কারুর জন্য ভগবান জন্মান না, তিনি তার আপন খেয়ালে ঘুরছেন। যেমন ইচ্ছে তেমন রূপ নিচ্ছেন। আমরা, নরাধমরা, ভাবি আমার জন্য আসেন।এর চেয়ে রসাত্মক কৌতুক আর কি হতে পারে ?
আর দুষ্টের দমন, দুষ্টকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে হয় না। এই সত্য কৃষ্ণর মতো মহাপুরুষ ভালো ভৱেই জানতেন। আর যদি দুষ্ট দমন তাকে মেরে ফেলে হতো, তাহলে কৃষ্ণের দুষ্ট দমনের পর আর দুষ্ট থাকতেই পারতো না। দুষ্টকে শোধরাতে হয়। আর এই শোধরানোর কাজ সাধুদের। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জানতেন, আত্মা মরে না। তাকে মারাও যায় না। দেহান্তরিত হয় মাত্র। অতএব দেহের নাশে কখনোই দুষ্টের নাশ হয় না। দুষ্টকে শোধরাতে হয় মাত্র। বিচার থেকেই দুষ্টামি আসে। সাধুদের কাজ সমাজের বিচারে সংশোধন আনা, মানুষের বিচারে সংশোধন করা । মানুষের বিচারে সত্য প্রতিষ্ঠা করা। এই কাজ যারা করেন তারাই প্রকৃত সাধু। সাধু কারুর সুরক্ষার ধার ধারে না।
আমার মনে হয় ভগবানের আসার জন্য কোনো বিশেষ পরিস্থিতির দরকার হতেই পারে না। ভগবান যে কোনো সময় আসতে পারেন। পরিস্থিতি তার অনুকূল হয়ে যায়। ভগবান পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করেন না। ভগবান পরিস্থিতির জন্য জন্মান না। তার ইচ্ছাই তাকে দেহ ধারণ করায়। আর পরিস্থিতি তার পেছনে দৌড়োয়। যার জন্য আমরা দেখি, ভগবান যখন আসেন, তখন সমাজ সত্যের পেছনে ধায়। ভগবান যখন আসেন তখন সমাজে পরিবর্তন আসে। সমাজ পরিবর্তন করার জন্য তিনি আসেন না। কিন্তু ভগবান এলে সমাজ পরিবর্তিত হয়ে যায়। ভগবান বুদ্ধ যখন এসে ছিলেন তখন সমাজ দুঃখের নিবৃত্তির জন্য ছুটেছিলো। শান্তির বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল। তিনি আপন খেয়ালে আসেন। আর তার পেছনে সমাজ দৌড়োয়। আমি নিজেকে সৃষ্টি করি, এ কথা ভগবানই বলতে পারেন। অথবা এ কথা বলা যায়, আমাদের বাসনাই আমাদের সৃষ্টি করে। আমাদের বাসনার পূরণের জন্য সেই মতো দেহ ধারণ করি। ভগবান ইচ্ছাপূরণের জন্য দেহ ধারণ করেন। নিজেকে আস্বাদন করার জন্য, রূপ পরিগ্রহ করেন। কাউকে রক্ষার জন্য, বা কাউকে মারার জন্য নয়। জন্ম মৃত্যু তো তারই খেলা। এর জন্য তাকে মানুষের দেহ ধারণ করতে হয় না। অলক্ষ্যেই সব নির্ধারণ করতে পারেন।
সমস্ত মহাপুরুষের জন্মের পিছনে একটা কাহিনী প্রচলিত থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে সব অলৌকিক। শ্রীকৃষ্ণের জন্মের পিছনেও তেমনি একটি কাহিনী আছে। কংসের নাশ করবার জন্য তিনি জন্ম গ্রহণ করে ছিলেন। জন্মের দিন যোগমায়া বলেছিলেন : তোমাকে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে। জন্মের আগে আকাশবাণী শুনেছিলো কংস : দেবকীর অষ্টম পুত্র তোমাকে হত্যা করবে। এগুলো সব কবি কল্পনা। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এই আকাশবাণীর জন্যই মা দেবকীকে, পিতা বসুদেবকে কারাবন্দী হয়ে অসহ্য যন্ত্রনা সহ্য করতে হয়েছিল। ভগবানের পিতা মাতা - সেতো মহা ভাগ্যবান। ভগবানকে জন্ম দিতে তাদের এতো কষ্ট হবে কেন ? জন্মের পরেই বা কষ্ট সইতে হবে কেন ? এসব, কাহিনীকে জমাবার আয়োজন নয় তো ? নাকি অন্য কোনো গুড় রহস্য আছে এর পেছনে ?
জন্মের রাতে দুর্যোগ। দুর্যোগের রাতেই-তো ভগবান আসেন। মানুষ আসে দুর্যোগ পোহাতে। কষ্ট দিতে ও নিতে। মাকে কত কষ্ট করতে হয়, সন্তানের জন্ম দেবার জন্য। আতুর ঘরের বাইরে, সবাই উদ্বিগ্ন চিত্তে অপেক্ষা করে। এতে আশ্চর্য্য হবার কিছু নেই।
ভগবানের জন্মের পরেই মৃত্যু ভয়। মানুষ জন্মের পরে মৃত্যুর ভয়ে সেঁধিয়ে থাকে। আর সারা জীবন মৃত্যুকে জয় করবার লড়াই চালিয়ে যায়। এতেও আমি আশ্চর্য্যর কিছু দেখি না।
ব্যাসদেবের শ্রীকৃষ্ণ আদৌ জন্মে ছিলেন কিনা সেটা আমার কাছে বড়ো ব্যাপার নয়। আমার কাছে বড়ো ব্যাপার, শ্রীকৃষ্ণের মতো মহাপুরুষের জন্ম হতে পারে কি না। আমি বলি, অবশ্যই পারে। ঐতিহাসিক শ্রীকৃষ্ণের চেয়ে, আমাদের মনের শ্রীকৃষ্ণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এমন রমণীয় পুরুষ, এমন ব্যক্তিত্ব পূর্ণ চরিত্র, এমন আকর্ষণীয় মানুষ, এমন সর্বজয়ী মহাপুরুষ, সর্বজ্ঞ, কালজয়ী একজন আমাদের ভগবান হতেই পারে।
ভগবান বলছেন -
আমার এইপ্রকার দিব্য জন্ম ও কর্ম সন্মন্ধে যিনি জ্ঞাত হন দেহত্যাগের পর তার আর জন্ম হয় না। তিনি আমাকেই লাভ করেন। এই সংসারে আসক্তি, ক্রোধ,ভয় ত্যাগ করে আমাতেই মন প্রাণ সমর্পন পূর্বক আমার স্মরণাগত হয়ে বহু মহাত্মা জ্ঞানে এবং তপস্যায় আমার ভাব অর্থাৎ মোক্ষ লাভ করেছেন। ৪/১০.......
আমার এইপ্রকার দিব্য জন্ম ও কর্ম সন্মন্ধে যিনি জ্ঞাত হন দেহত্যাগের পর তার আর জন্ম হয় না। তিনি আমাকেই লাভ করেন। এই সংসারে আসক্তি, ক্রোধ,ভয় ত্যাগ করে আমাতেই মন প্রাণ সমর্পন পূর্বক আমার স্মরণাগত হয়ে বহু মহাত্মা জ্ঞানে এবং তপস্যায় আমার ভাব অর্থাৎ মোক্ষ লাভ করেছেন। ৪/১০.......
আমাকে যে যেভাবে ভজনা করে, আমি সেইভাবেই তাদের কৃপা করি। মানবগন সব ভাবেই আমারি পথ অনুসরণ করে। কর্মফলকামীগন এ জগতে ফল লাভের আশায় দেবতাগনের উদ্দেশ্যে যাগযজ্ঞ করে থাকে।
গুন -ত্রয়-বিভাগ -যোগ
গুন্ ও কর্ম বিভাগ অনুযাযী আমি চারটি বর্ণের সৃষ্টি করেছি। কিনতু স্রষ্টা হলেও আমি আসক্তিহীন বলে আমাকে অকর্তা বলে জানবে। কোনো কর্মই আমাকে স্পর্শ করতে পারেনা। কর্মফলেও আমার স্পৃহা নেই। যিনি প্রকৃত সত্য জানেন তিনি কর্ম করলেও তিনি কর্মে আবদ্ধ হন না। ৪/১৪......
ভগবান কথা (১৮/৫/২০১৭)
আমি কোনো কর্ম করি না,এই সত্য জেনে মুক্তি লাভেচ্ছু ঋষিগণ কর্মে লিপ্ত হন। তুমিও "আমি কর্ম করি না " এই ভেবে প্রাচীন মহাত্মাদের মতো কর্ম করে যাও। এবার কর্ম কি আর অকর্মই বা কি - এটা জেনে রাখো। না হলে মোহগ্রস্থ হয়ে পড়বে । আবার এটা মেনে চললে তুমি অমঙ্গলজনক সংসারবন্ধন হতে মুক্ত হবে।
কর্ম - তিন প্রকার। কর্ম, বিকর্ম, ও অকর্ম। কর্ম কি, বিকর্ম কি, অকর্মই বা কী ? কর্ম হচ্ছে ঈশ্বরের সৃষ্টিকার্যে ও তার সৃষ্টির অভ্যুদয় বা বিকাশে সহযোগিতা করা। বিকর্ম অর্থাৎ শাস্ত্র নির্দিষ্ট কর্ম বা জনহিতকর কর্ম। অকর্ম হচ্ছে আলসেমী বা আলস্য। কর্মই গতি নির্ধারক। কর্ম সন্মন্ধে বিশেষ রূপে বুঝবার প্রয়োজন আছে। কৰ্মই সমস্ত সুখ দুঃখের কারন। যিনি কর্মে অকর্ম ও অকর্মে কর্ম দর্শন করেন, মনুষ্য মধ্যে তিনিই বুদ্ধিমান, তিনিই যোগী, তিনিই সর্ব কর্মের অনুষ্ঠান কর্তা। ৪/১৮.........
ভগবান কথা (১৯/৫/২০১৭)
সব কর্মেই যারা কামনাশূন্য, সব কর্ম যার জ্ঞানের অগ্নিতে দগ্ধ, জ্ঞানীগণ তাকেই পণ্ডিত বলেন। কর্ম ও কর্মফলে যার আসক্তি নাই, যিনি সব সময় নিত্যানন্দে পূর্ণ থাকেন, তিনি কর্মে লিপ্ত থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি কিছুই করেন না। কামনা শুন্য যার মন, আত্মাতেই যার স্থিতি,সংযত, গ্রহণ-লিপ্সা যার ত্যাগ হয়েছে - তিনি শুধুমাত্র দেহাদির ধৰ্ম হিসেবে কর্ম করেন। কর্ম ফলও তাকে স্পর্শ করতে পারে না। যিনি বিনা চেষ্টায় যা পান তাতেই সন্তুষ্ট ,যার কাছে সুখ দুঃখ সমান, যিনি সিদ্ধি বা অসিদ্ধি - কে সমান জ্ঞান করেন তিনি কর্ম করেও কর্ম ফলে আবদ্ধ হন না। ৪/২২.........
ভগবান কথা (২৫/৫/২০১৭) (গুন -ত্রয়-বিভাগ -যোগ)
ফলাকাঙ্ক্ষা-শুন্য হয়ে, হিংসা মুক্ত হয়ে, চিত্ত সর্বদা যার জ্ঞানাধিষ্ঠ, সর্ব কর্মই যার যজ্ঞ-সে মহাপুরুষের কর্মফল বলে কিছু নেই। যজ্ঞের সামগ্রী - অর্থাৎ ঘি, হোম, অগ্নি এমন কি যজ্ঞের পত্রাদি/পাত্রাদী পর্যন্ত সমস্তই ব্রহ্ম এই জ্ঞানে যিনি কার্য্য করেন সেই ব্যক্তিই ব্রহ্ম লাভ করেন। যোগীরা দৈব কৃপার জন্য যজ্ঞ করেন। আর জ্ঞানীরা ব্রহ্মরূপ অগ্নিতে সকল কর্ম আহুতি দেন। এক এক যোগী এক এক রকম ভাবে যজ্ঞ করেন। কেউ সংয্মরূপ অগ্নিতে ইন্দ্রিয় সকলকে আহুতি দেন। কেউ ইন্দ্রিয়-অগ্নিতে বিষয় সকল আহুতি দেন - অর্থাৎ আসক্তিহীন ভাবে বিষয় ভোগ করেন। আবার অনেকে জ্ঞানদীপ্ত আত্মসংযমরূপ অগ্নিতে সকল ইন্দ্রিয় কর্ম এবং প্ৰাণকর্ম-সকলকে আহুতি দেন। যোগীদের মধ্যে কেউ দ্রব্য-যজ্ঞ কেউ যোগ-যজ্ঞ পরায়ণ। আবার কেউ যোগ দ্বারা জ্ঞান-যজ্ঞ পরায়ণ। কেউ আবার অত্যন্ত কষ্টকর নিয়মে বেদাদি শাস্ত্রজ্ঞানরূপ যজ্ঞ করে থাকেন। কোনো যোগী অপান বায়ুতে
প্রাণ বায়ু আহুতি দেন। কেউ আবার প্রাণ বায়ুতে অপান বায়ু আহুতি দেন। কেউ আবার প্রাণ - অপান দুটোরই গতি রুদ্ধ করে প্রাণায়ামে আহুতি দেন। এই সমস্ত যজ্ঞকারী যজ্ঞ সম্পাদন করে নিষ্পাপ হয়ে যান। যজ্ঞের শেষে অমৃত ভোজন করে সনাতন ব্রহ্মকে লাভ করেন। যিনি যজ্ঞে লিপ্ত হন না তার ইহলোকই নাই - পরলোক তো দূর অস্ত। এই সব কর্ম-উদভূত তত্ব বুঝলে তবেই মুক্তি লাভ সম্ভব।
দ্রব্য দ্বারা যে যজ্ঞ সম্পাদিত হয় তার থেকে তার থেকে জ্ঞান-যজ্ঞ (অর্থাৎ যজ্ঞের প্রকৃত উদ্দেশ্যের মনন ) শ্রেষ্ট। কারন সমস্ত কর্মই জ্ঞান বিকাশ হলেই শেষ হয়। ....৪/৩৩....
ভগবানকথা (২৭/৫/২০১৭)
জ্ঞানীগণকে প্রণাম করো। সেবা করো। এবার নানা প্রকার প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করো - তিনি তোমার প্রশ্নের উত্তর দেবেন। এই ভাবে জ্ঞান লাভ করলে তোমার মোহ দূর হবে। তখন তুমি নিজ আত্মাকে এবং পরমাত্মাকে অভিন্ন দেখবে। জ্ঞানরূপ তরীর সাহায্যে সকল পাপ সমুদ্র পাড় হতে পারবে। জ্বলন্ত আগুন যেমন কাঠকে পুড়িয়ে ভষ্মে পরিণত করে তেমনি জ্ঞান সমস্ত কর্ম ভস্মিভূত করে। ফলে কর্মফল বলে আর কিছু থাকে না। জ্ঞানের মতো পবিত্র আর কিছু নাই। জ্ঞানযোগেই সিদ্ধযোগী অনন্তকাল পরমাত্মায় লীন হয়ে থাকেন। শ্রদ্ধাবান ব্যক্তিই জ্ঞান লাভ করেন এবং ইন্দ্রিয় সংযমের মাধ্যমে শান্তি লাভ করে থাকেন। জ্ঞানহীন,শদ্ধাহীন ও সন্দেহমনা ব্যক্তি বিনাশ প্রাপ্ত হয়। যে ব্যক্তি শাস্ত্রাদির কথায় অবিশ্বাস করে, গুরুর উপদেশে সন্দেহ করে, তার পরলোক তো দূরের কথা, ইহলোকের বৈষয়িক সুখও পায় না। যে ব্যক্তি যোগবলে সমুদয় কর্ম ভগবানে অর্পণ করেছেন, সেই আত্মজ্ঞানী ব্যক্তি কর্ম বন্ধন থেকে মুক্তি পায় । তাই তুমি জ্ঞানরূপ বিবেক অস্ত্র দ্বারা হৃদয় মধ্যে স্থিত অজ্ঞান, সন্দেহ ছেদন করে নিষ্কাম কর্মযোগ অবলম্বন করো।
চতুর্থ অধ্যায় সমাপ্ত
পঞ্চম অধ্যায় (কর্ম-সন্যাস যোগ )
কর্ম সন্যাস ও কর্মযোগ উভয়ই মোক্ষদায়ক। কিনতু দুটির মধ্যে কর্মসন্যাস থেকে কর্ম-যোগ শ্রেষ্ট। যে ব্যক্তি হিংসা ও আসক্তিহীন,সুখে-দুঃখে বিরুদ্ধ-ভাব পোষণ করে না - সেই ব্যক্তিই নিত্য সন্যাসী। অনায়াসেই সেই ব্যক্তি সংসার বন্ধন হতে মুক্তি লাভ করতে পারে। সন্যাস ও কর্মযোগ পৃথক নয়। এর একটিকে অনুসরণ করলেই উভয় ফল লাভ হয়। জ্ঞান-যোগী ও কর্ম-যোগী উভয়ের একই গতি। সন্যাস ও কর্মযোগকে যিনি এক দেখেন তিনিই প্রকৃত জ্ঞানী বলে জানবে। নিষ্কাম কর্মযোগের অনুষ্ঠান ব্যাতিত কর্মত্যাগ দুঃখের কারণ। কর্মযোগী কর্মযোগে সিদ্ধিলাভ ক'রে পরম ব্রহ্ম লাভ করেন। যোগযুক্ত ব্যক্তি বিশুদ্ধ আত্মা। আত্মজয়ী, জিতেন্দ্রিয় ও সর্বজীবে সমজ্ঞানী ব্যক্তি কর্মানুষ্ঠান করলেও কর্মে লিপ্ত হন না। ৫/৭......
২৯/৫/২০১৭ ভগবান কথা (কর্ম সন্যাস যোগ)
কর্মযোগীর তত্ত্বজ্ঞান হলে দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শন, ঘ্রান ভোজন,গমন, স্বপ্ন,স্বাস গ্রহণ,কথন , ত্যাগ, উন্মেষ এবং নিষেধাদি কার্য করেও তিনি ভাবেন, এসব ইন্দ্রিয় কর্ম, আমি কিছুই করি না।
পদ্মপাত্রে জল পড়লেও জল থাকে না। সব কর্মফল ব্রহ্মকে অর্পণ করলে, আসক্তিহীন ভাবে কর্ম করলে তিনি কোনো পাপে লিপ্ত হন না। যোগীগণ চিত্মসুদ্ধির জন্যই আসক্তিহীন হয়ে দেহ, মন , বুদ্ধি ইন্দ্রিয়সকলের সাহায্যে কর্ম করে থাকেন।
যিনি ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে কর্মের অনুষ্ঠান করেন তিনি কর্মফলে উদাসীন থাকার ফলে মোক্ষস্বরূপ শান্তি লাভ করেন। যিনি কামনার বশীভূত হয়ে নিজের জন্য ফল আশা করেন, তার সংসাররূপ বন্ধন দশা প্রাপ্ত হয়। ইন্দ্রিয় জয়ী ব্যক্তি মনের দ্বারা সকল কর্ম ত্যাগ করে নবদ্বার যুক্ত ( অর্থাৎ : দুটো কানের ছিদ্র, দুটো নাকের ছিদ্র, দুটো চোখের ছিদ্র,একটা মুখ, একটি মূত্র দ্বার, একটা মলদ্বার - এই নয়টি দ্বারকে নবদ্বার বলে) মনুষ্য দেহে পরম আনন্দে বাস করেন। প্রকৃত পক্ষে তিনি নিজেও কিছু করেন না অন্য কাউকে দিয়ে কিছু করান না। প্রভু জীবের কর্তৃত্বও সৃষ্টি করেন না। কর্মফলও সৃষ্টি করেন না। স্বভাববশেই মানুষ বা জীব প্রকৃতির প্রভাবে কর্মে প্রবৃত্ত হয়।
আত্মা সর্বব্যাপী। তিনি কারো পাপ বা পুন্য গ্রহণ করেন না। জীব অজ্ঞানে আচ্ছন্ন হয় বলেই মোহো গ্রস্থ হয়। জ্ঞানের প্রকাশের ফলে যার অজ্ঞানতা ধংস হয়েছে তাদের জ্ঞান, সূর্যের ন্যায় পরম বস্তূকে প্রকাশ করে থাকে। যাদের বুদ্ধি ব্রহ্ম-নিষ্ঠ,আত্মভাব পরব্রহ্মে স্থির, সেই সব ব্রহ্মনিষ্ঠ ব্যক্তিদের, জ্ঞানের দ্বারা সমস্ত পাপ নষ্ট হয়েছে জানবে। এদের আর পুনর্বার জন্ম হয় না। বিদ্যা ও বিনয় যার মধ্যে আছে তিনিই পণ্ডিত। এরা সর্ব ভূতে অর্থাৎ মনুষ্য পশু ব্রাহ্মণ চণ্ডাল সব কিছুতেই সমদর্শী থাকেন। সমজ্ঞানী ব্যক্তি সংসারে বাস করেও সৃষ্টিজয়ী। কারণ তিনি সর্বত্রই ব্রহ্ম দেখেন। সব কিছুতেই সমভাবাপন্ন - কোনো কিছুতেই দোষ দেখেন না। এই কারনে সমদর্শীগন সর্বদা ব্রহ্মতেই স্থিত আছেন।ব্রহ্মকে যে যোগী জেনেছে, সেই যোগীই ব্রহ্মে স্থিত আছেন । তিনি প্রিয় বস্তূ পেলেও আনন্দ লাভ করেন না আবার অপ্রিয় বস্তূ পেলেও দুঃখ পান না। যিনি বাহ্য ইন্দ্রিয় বিষয়ে আসক্তিহীন, তিনি আত্ম সম্পর্কীয় সুখে সুখহীন। এঁরা যোগের সাহায্যে ব্ৰহ্মে চিত্তকে যুক্ত করে পরমানন্দ লাভ করেন। মোটকথা - বিষয় সম্পর্কিত সকল সুখ-ই আসলে দুঃখের কারন। এই কারণে বিবেকবান ব্যক্তি বিষয় সুখে রত থাকেন না। কাম-ক্রোধকে যে মানুষ ইহলোকে আমৃত্যু সহ্য করতে পারবেন তিনিই প্রকৃত সমাহিত এবং সুখী। যার আত্মাতেই সুখ, আত্মাতেই আনন্দ, আত্মাতেই দৃষ্টি নিবদ্ধ -সেই যোগী পুরুষ ব্রহ্মে স্থিত হয়ে নির্বাণ লাভ করেন। যারা সন্দেহ রহিত,পাপশূন্য, সমাহিত চিত্ত ও সর্ব জীবের মঙ্গলে রত, সেই যোগীগণ ব্রহ্ম নির্বাণ লাভ করেন। কাম-ক্রোধ-শুন্য, সংযত চিত্ত,আত্মজ্ঞান সম্পন্ন যোগীগন জীবিত বা মৃত উভয় অবস্থাতেই ব্রহ্ম নির্বাণ লাভ করেন।
রূপ,রস, ইত্যাদি বাহ্যিক বিষয় থেকে মন সরিয়ে যিনি ভ্রূ-মধ্যে চক্ষুদ্বয়কে স্থাপন করে,প্রাণ,অপান,বায়ুকে উর্ধ্ব ও অধোগতি সমান করে, ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধিকে সংযত এবং ইচ্ছা, ভয়, ও ক্রোধকে দূর করতে পারেন,তিনি জীবিত অবস্থাতেই মুক্তি লাভ করেন। ভগবানই যজ্ঞ ও তপস্যার ফল ভোগ করেন। তিনিই ত্রিলোকের স্বামী , সকলের সুহৃদ। এই জ্ঞান যার আছে, তিনিই পরম শান্তি ভোগ করেন। ৫/২৯..........
ষষ্ঠ অধ্যায় : ধ্যান যোগ (৩০/৫/২০১৭)
কর্মফলের আশা ত্যাগ করে যিনি নিজের কর্তব্য সম্পাদন করেন, তিনিই সন্যাসী ও যোগী। কর্ম ত্যাগ করলেই যোগী হয়ে যায় না। পন্ডিতগণ যাকে সন্যাস বলেন সেটাই যোগ। কারন কর্মত্যাগ না করলে সন্যাস বা যোগ কোনটা হতে পারে না। যোগারূঢ় মুনির কর্মত্যাগ-ই শ্রেষ্ঠ সাধনা। ইন্দ্রিয়ভোগ-কর্মে আসক্তিশুন্য, সঙ্কল্পত্যাগী এইরূপ যোগীকেই যোগারূঢ় বলা হয়। বুদ্ধি ও বিবেকের সাহায্যে আত্মার উদ্ধার করবে। আত্মাকে অধঃপতিত করবে না। মন-ই আত্মার শত্রূ, আবার মন-ই আত্মার মিত্র। যিনি নিজের দ্বারা নিজে বশীভূত, তিনি আত্মার সুহৃদ। আর যিনি নিজের বশীভূত নন তিনি-ই আত্মার শত্রূ। যিনি আত্মাকে জয় করেছেন, যার ইন্দ্রিয় সংযত, চিত্ত প্রশান্ত - তার মধ্যে পরমাত্মার প্রকাশ। তিনি শীত-গ্রীষ্ম;সুখ-দুঃখ ;মান-অপমান সবেতেই স্থির বুদ্ধি হয়ে থাকেন। ৬/৭......
ভগবান কথা (৩১/০৫/২০১৭)
জ্ঞান বিজ্ঞানে যার মন তুষ্ট ; যিনি চিত্তজয়ী ; যিনি ইন্দ্রিয় জয়ী ;যার কাছে লোষ্ট্র অর্থাৎ মাটির ঢেলা বা ঢিল এবং কাঞ্চন বা সোনা যার কাছে সমান - সেই যোগীকে যোগরূঢ় বলা হয়। সুহৃদ, বনধু, উদাসীন,মধ্যস্থ, দ্বেষ্য, সাধু, পাপী - সবেতেই যিনি সম জ্ঞান করেন। তিনিই শ্রেষ্ট পুরুষ এবং প্রশংসার যোগ্য।
যোগ প্রক্রিয়া :
সবসময় যোগী নির্জনে থেকে, সংযত চিত্তে, ভোগ পরিত্যাগ করে, কাহারও কিছু গ্রহণ না করে - একাকী মনকে সমাহিত করবেন। পবিত্র স্থানে যোগী মৃগচর্ম,ব্যাঘ্র চর্ম অথবা কুশনির্মিত আসন পাতবেন। আসনের জায়গা যেন বেশি উঁচু না হয় আবার বেশি নিচু না হয়। সেই আসনে একাগ্র মনে শুদ্ধ চিত্ত্বে যোগ অভ্যাস করবেন। এইভাবে যোগী, দেহ মস্তক , গ্রীবা, সরল ও স্থির ভাবে রেখে, ইতস্তত মনোযোগ না দিয়ে বা না তাকিয়ে কেবল মাত্র ভ্রূমধ্যে দৃষ্টি স্থির রেখে যোগাভ্যাস করবেন। এইভাবে মনকে সমাহিত করে যোগী যোগাভ্যাস করলে, নির্বাণ রূপ পরম শান্তি লাভ করবেন।
যোগের সাবধানতা :
অধিক আহারকারী, একান্ত অনাহারী আবার অধিক নিদ্রাতুর, বা অধিক জাগরণশীল ব্যক্তির যোগ হয় না। যিনি আহারে- বিহারে, কর্মে-নিদ্রায় এবং জাগরনে সমতা রক্ষা করেন - তার যোগাভ্যাস দুঃখ নাশ করে। যার মন সংযত হয়ে আত্মাতেই স্থিত থাকে ও কামনাশূন্য থাকে তাকেই যোগী বলে অবহিত করা হয়।
যোগের ফল :
প্রদীপের শিখা যেমন বায়ুহীন স্থানে স্থির থাকে, সেই ভাবে মনকে স্থির রেখে বা সংযত করে যদি যোগী যোগযুক্ত হয়, তবে চিত্ত নিরুদ্ধ ও একেবারে স্থির হয়। সেই অবস্থায় পরব্রহ্মকে নিজের মধ্যে দর্শন করে যোগী নিজের মধ্যে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন। ইন্দ্রিয় সংযোগ ছাড়াই তখন সুখানুভব হয়। এই অবস্থায় যোগী আত্মার -স্বরূপ অনুভব করে এবং অবিচলিত থাকে। এই অবস্থায় সর্বপ্রকার লাভ-কেই তুচ্ছ মনে হয়। গুরুতর দুঃখতেও যোগী অবিচল থাকে। একেই যোগ বলে।
সুখ-দুঃখ ত্যাগের নামই যোগ। সংযতমনা ও সমস্ত কামনা ত্যাগ করেই যোগ সাধনা করতে হয়। বুদ্ধির সাহায্যে, ধৈর্য্য সহকারে, ক্রমে ক্রমে, মনকে আত্মগত করতে হয়। মনের সকল চিন্তা পরিত্যাগ করতে হয়। মনের স্বাভাব-ই অস্থিরতা, চঞ্চলতা। মন প্রতিনিয়ত বিষয়ের প্রতি ধাববান। সেইজন্য এই ধাববান-চঞ্চল মনকে অভ্যাসের দ্বারা ক্রমে ক্রমে আত্মাতে স্থির করতে হবে। সংযত মন যখন রজোগুন বর্জন করে শান্ত হয় তখনি ব্রহ্ম-ভাব প্রাপ্ত হয়। একেই সমাধি বলে। সমাধি সর্বত্তম সুখ। এই ভাবে রজঃ ও তমোগুণ বর্জিত হয়ে যোগযুক্ত হলেই ব্রহ্ম দর্শন হয়,পরম সুখ লাভ হয়। সমদর্শী যোগী আপনাকে সর্বজীবে সমান দেখেন। আপন আত্মাকে সর্বভূতে অবস্থিত দেখেন আবার সর্বভূতকে নিজ আত্মাতে অবস্থিত দেখেন। ৬/২৯........
ভগবান কথা (০১/০৬/২০১৭)
যিনি ঈশ্বরকে সর্বভূতে দর্শন করেন আবার ঈশ্বরের মধ্যে সর্বভূতকে দর্শন করেন - ঈশ্বর তার কাছে প্রত্যক্ষ, ঈশ্বরও তাকেই দেখেন। যিনি ঈশ্বরকে পৃথক জ্ঞানে ভজনা করেন তিনি সকল বিষয়ে থাকলেও ঈশ্বরে বিরাজিত থাকেন। সকল জীবের সুখ-দুঃখকে যে যোগী নিজের মতো চিন্তা করেন - তিনিই শ্রেষ্ট।
মন যে সর্বদা অস্থির -এতে সন্দেহ নাই, কিনতু অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা মনকে দমন করা যায়। মন কে নিজ বশে না আনতে পারলে, তার পক্ষে যোগ সম্ভব না। মন যার বশীভূত তিনি সঠিক উপায় অবলম্বনে চেষ্টা করলে যোগ লাভ করতে পারেন। .......৬/৩৬
ভগবান কথা (০২/০৬/২০১৭)
যোগভ্ৰষ্টা অর্থাৎ কেউ যদি যোগে প্রবৃত্ত হবার পরে কিছুদিন যোগ করার পরে, চঞ্চল চিত্ত বা শিথিলতার কারণে যোগ ছেড়ে দেন তাতে তার কোনো ক্ষতি হয় না। বরং যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি পুণ্যবানদিগের সাথে দীর্ঘকাল অবস্থান করে, পরে কোনো সদাচারী ধনবানের গৃহে, অথবা কোনো যোগীকুলে জন্ম গ্রহণ করেন। পূর্বজীবনের বুদ্ধিবৃত্তি নিয়ে পুনরায় মোক্ষ লাভের চেষ্টা করেন। ৬/৪৩....
ভগবান কথা (৪/৬/২০১৭)
যোগভ্ৰষ্ট যোগী নিজে চেষ্টা না করলেও পূর্ব জন্মের অভ্যাসের জন্য যোগে আকৃষ্ট হন। যোগ জিজ্ঞাসু সেই ব্যক্তি বেদবিহিত কর্মফলের অধিক ফল লাভ করেন। সেই যোগভ্ৰষ্ট যোগী অত্যন্ত যত্নের দ্বারা পাপ শুন্য হয়ে বহু জন্মের সঞ্চিত যোগ সাহায্যে সিদ্ধি লাভ করে পরমাগতি লাভ করেন। সেই যোগী, তপস্বী জ্ঞানী ও কর্মীদের থেকে শ্রেষ্ট। ভগবানে যার চিত্ত স্থির, ভগবানের সেবাই যার কর্ম - তিনিই শ্রেষ্ট যোগী। ৬/৪৭......
ভগবানে চিত্ত নিবিষ্ট ও ভগবানের স্মরণ নিয়ে কি ভাবে ভগবানকে জানতে পারবে সেটা শোনো। শাস্ত্রের তত্ত্বজ্ঞান - যা জ্ঞাত হলে আর কিছুই জানবার থাকে না। হাজারের মধ্যে এক ব্যক্তি আত্মজ্ঞান লাভার জন্য চেষ্টা করেন। আবার হাজার হাজার আত্মজ্ঞান সম্পন্ন
মানবের মধ্যে জন্মার্জিত সুকৃতির বশে হয়তো মাত্র একজন ব্যক্তি ভগবানের প্রকৃত স্বরূপ জানতে পারে।
ভূমি, জল, অনল, বায়ু, আকাশ, মন, বুদ্ধি ও অহংকার -ইহা ভগবানের ভিন্ন ভিন্ন আট প্রকার প্রকৃতি। ভগবানের এই আট প্রকার প্রকৃতি অপরা বা জড়। এগুলো জড় তাই নিকৃষ্ট। এছাড়া ভগবানের একটা পরা বা শ্রেষ্ট প্রকৃতি আছে। সেই পরা চেতনরূপ প্রকৃতিই জগৎকে ধারণ করে আছে। সকল প্রাণীই এই পরা ও অপরা প্রকৃতি হতে উদভুত । প্রকৃতি সহ সমস্ত জগতের সৃষ্টি ও প্রলয়ের কারণ স্বয়ং ভগবান।
ভগবান কথা (৭/৬/২০১৭)
ভগবান বলছেন : আমার অপেক্ষা শ্রেষ্ট কিছুই নাই। মালায় যেমন মনিসকল গাঁথা থাকে - তেমনি আমাতেই এই বিশ্ব জগৎ বিরাজিত আছে। জলের মধ্যে আমি রস স্বরূপ। আমি সূর্য ও সূর্যের প্রভাস্বরূপ। আমি সর্ববেদের প্রণব (ওম ) আকাশে শব্দ, মানবের মধ্যে আমি পুরুষকার। পৃথিবীর পবিত্র গন্ধরূপে,সূর্যের তেজরূপে, সর্বভূতে জীবনরূপে, তপস্বীদের তাপস্যারূপে আমিই বিরাজিত। সর্বভূতের আমি বীজ স্বরুপ, বুদ্ধিমানের বুদ্ধি, তেজষ্মীগণের আমিই তেজ। বলবান্গনের কামরাগ বর্জিত বল আমি। প্রাণীকুলের ধৰ্ম অবিরোধী শাস্ত্রসম্মত কার্য্য আমিই জানবে। সাস্ত্বিক, রাজসিক, ও তামসিক ইত্যাদি যে সমস্ত ভাব বর্তমান, আমা হতেই তাহার উৎপত্তি। কিনতু আমি এতে লিপ্ত নই। এসকল আমাতেই লিপ্ত।
ভগবান বলছেন : আমার অপেক্ষা শ্রেষ্ট কিছুই নাই। মালায় যেমন মনিসকল গাঁথা থাকে - তেমনি আমাতেই এই বিশ্ব জগৎ বিরাজিত আছে। জলের মধ্যে আমি রস স্বরূপ। আমি সূর্য ও সূর্যের প্রভাস্বরূপ। আমি সর্ববেদের প্রণব (ওম ) আকাশে শব্দ, মানবের মধ্যে আমি পুরুষকার। পৃথিবীর পবিত্র গন্ধরূপে,সূর্যের তেজরূপে, সর্বভূতে জীবনরূপে, তপস্বীদের তাপস্যারূপে আমিই বিরাজিত। সর্বভূতের আমি বীজ স্বরুপ, বুদ্ধিমানের বুদ্ধি, তেজষ্মীগণের আমিই তেজ। বলবান্গনের কামরাগ বর্জিত বল আমি। প্রাণীকুলের ধৰ্ম অবিরোধী শাস্ত্রসম্মত কার্য্য আমিই জানবে। সাস্ত্বিক, রাজসিক, ও তামসিক ইত্যাদি যে সমস্ত ভাব বর্তমান, আমা হতেই তাহার উৎপত্তি। কিনতু আমি এতে লিপ্ত নই। এসকল আমাতেই লিপ্ত।
এই ত্রিগুণাত্মক ভাবদ্বারা জগৎ মোহিত। সেই জন্যই ত্রিগুণাতীত চির অক্ষয় এবং আন্দস্বরূপ আমাকে বিশ্বজগত জানতে সক্ষম হয় না।
ত্রিগুণাত্মক আমার দৈবীমায়া, অতিক্রম করা খুবই কষ্টকর । কিনতু অনন্য শরণ হয়ে যারা আমাকেই ভজনা করে, তারাই শুধুমাত্র এই দুস্তর মায়া অতিক্রম করতে পারে। মায়ায় আচ্ছন্ন যাদের শাস্ত্র-উপদেশ-জাত জ্ঞান লোপ হয়েছে, তারা সবাই নরাধম-দুষ্কৃতকারী-মূঢ়। আমাকে তারা পায় না।
আর্ত,আত্মজ্ঞান-লাভেচ্ছু, অর্থকামী, ও জ্ঞানী এই চার প্রকার সুকৃতি পরায়ণ মানুষই আমার ভজনা করে। আবার এই চার প্রকার মানুষের মধ্যে আমা-পরায়ণ জ্ঞানীই শ্রেষ্ট। আমি জ্ঞানীর অত্যন্ত প্রিয় আবার জ্ঞানীও আমার অত্যন্ত প্রিয়। এই চার প্রকার পুণ্যবানই উদার। এদের মধ্যে জ্ঞানীই আমার আত্মার স্বরূপ। জ্ঞানীই সর্বশ্রেষ্ট পরাগতি স্বরূপ আমাকেই আশ্রয় করে। জ্ঞানী বহু জন্মের পর - শেষে বুঝতে পারে একমাত্র বাসুদেবই সব অর্থাৎ আমিই সব। সুতরাং এইরকম মহাপুরুষ জগতে দুর্লভ।
কামনার প্রভাবে যার জ্ঞান লুপ্ত, সেইসব লুপ্ত বিবেকীগন আপন আপন প্রকৃতির বশবর্তী হয়ে অন্যান্য দেবতার আরাধনা করে থাকেন। যে সমস্ত ভক্ত শ্রদ্ধা সহকারে যে যে দেবতার উপাসনা করে, আমি সেই সব দেবতাতেই তাঁর অচলা ভক্তি প্রদান করে থাকি। যে সব ভক্ত অচলা শ্রদ্ধাসহকারে যে যে দেবতার আরাধনা করে,সে সে দেবতা তাদের সকল বাসনা পূর্ণ করেন। কারন আমা কর্তৃক সেই সকল বিহিত হয়।
যাদের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ, সেই সকল ভক্তদের দেব-আরাধনা ক্ষনস্থায়ী হয়। কারন, বিভিন্ন দেবতার আরাধনাকারী দেব লোকে গমন করেন। আমার ভক্তগণ কিনতু আমাকেই লাভ করেন।
যাদের অল্পবুদ্ধি, তারা আমার অব্যয় পরমভাব জ্ঞাত না হয়ে, মায়াতীত আমাকে, ব্যক্ত অর্থাৎ নানারূপে জন্ম গহন করি, এইরূপ মনে করে।
আমি মহামায়ায় আচ্ছন্ন থাকায় সবার নিকট প্রকাশিত নয়। সেই জন্য মূঢ় ব্যক্তিগণ আমাকে জন্মরহিত ও অব্যয় বলে বুঝতে পারে না।
অতীতে, বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে যা কিছু ঘটেছে, ঘটছে ও ঘটবে তা সবই আমি জানি, কিনতু আমাকে কেউ জানেনা।
জন্মকাল হতেই মোহের দ্বারা বাসনা এবং দ্বেষ হতে সুখ-দুঃখ প্রভৃতি বিরুদ্ধ ভাবগুলি জন্ম লাভ করে। যে সকল পুণ্যবান ব্যক্তিগণের পাপ নষ্ট হয়েছে, তারা সুখ দুঃখের অতীত হয়ে একাগ্র চিত্তে আমার ভজনা করে। জ্বরা -মরণ হতে মুক্তি লাভ হেতু যারা যত্ন সহকারে আমাকে আশ্রয় করে, তারা সর্ব কর্ম করেন আবার ব্রহ্মকেও জ্ঞাত হন।আমাকেই যারা অধিভূত, অধিদৈব ও অধিযজ্ঞ স্বরূপ বলে জানেন, তাঁরা মৃত্যু কালে আমাকেই পরমব্রহ্ম চিন্তা করেন। ৭/৩০.....
ভগবান কথা : ৮/৬/২০১৭
ব্রহ্ম কে ? পরমাত্মাই ব্রহ্ম।
কর্ম কী ? স্বভাব, অধ্যাত্ম এবং যজ্ঞাদি অর্থাৎ যে সমস্ত ক্রিয়ার দ্বারা মানবের জন্ম ও বৃদ্ধি হয় - তাহাই কর্ম।
অধিযজ্ঞ কাকে বলে? দেহাদি নশ্বর পদার্থই অধিভূত, অক্ষর সবিতৃমণ্ডল মধ্যস্থ বিরাট পুরুষই আধিদৈব ও যজ্ঞাদির ফলদাতা রূপে আমিই অধিযজ্ঞ। ৮/৪.....
ভগবান কথা : ৯/৬/২০১৭
ভগবান বলছেন : অন্তকালে আমাকে স্মরণ করতে করতে যিনি দেহ ত্যাগ করেন, তিনি আমাকেই প্রাপ্ত হন। এতে কোনো সংশয় নেই। মৃত্যুকালে যে ব্যক্তি যে সকল বিষয় স্মরণ করতে করতে দেহ ত্যাগ করেন সেই ব্যক্তি সেই ভাবই প্রাপ্ত হন। সেজন্য সর্বদা আমাকে চিন্তা করো এবং স্বধর্ম অনুযায়ী কর্মে প্রবৃত্ত হও। মন,বুদ্ধি আমাকে অর্পণ করে কর্ম করলে আমাকেই প্রাপ্ত হবে। সর্বদা ঈশ্বর চিন্তা করলে, মন অপরদিকে যায় না। এইভাবে চিন্তার ফলে অভ্যাস যোগের সাহায্যে দিব্য পরম পুরুষকে লাভ করা যায়। সেই পরম পুরুষ সর্বজ্ঞ, অনাদি, সবার নিয়ন্তা,সুক্ষ হতে সূক্ষতর, ব্রহ্মান্ডের পালক, অচিন্ত্য, সূর্যসম জ্যোতির্ময় ও প্রকৃতির অতীত পরম পুরুষ। ভক্তিপূর্বক যিনি একাগ্র চিত্তে যোগের সাহায্যে ভ্রূদ্বয়ের মধ্যে প্রাণবায়ু স্থাপন করে মৃত্যু সময় তাঁর চিন্তা করেন, তিনি সেই জ্যোতির্ময় পরম পুরুষকে অবশ্যই লাভ করেন। বেদবিদ পণ্ডিতগন যাঁকে অক্ষর বলেন, বিষয় স্পৃহাহীন যোগীগণ যাকে লাভের হেতু ব্রহ্মাচার্য অনুষ্ঠান করেন, আমি সংক্ষেপে সেই ব্রহ্মের কথা বলছি।
ইন্দ্রিয় দ্বার সমূহ সংযত করে, মনকে হৃদয়ে স্থাপনপূর্বক ধৈর্য্য সহকারে যোগ দ্বারা প্রাণ-বায়ুকে ভ্রূদ্বয় মধ্যে স্থাপন করবে। অতঃপর "ওঁ " এই এক অক্ষর ব্রহ্ম শব্দটি মনে মনে উচ্চারণ করতে করতে যিনি দেহত্যাগ কেন, তিনি পরম গতি প্রাপ্ত করেন।
অনন্য চিত্তে আমায় স্মরণ সর্বদা স্মরণ করেন, সেই চিত্ত সমাহিত-যোগীর পক্ষে আমি অত্যন্ত সুলভ জানিও। মহাত্মাগণ আমাকে পেয়ে পরম সিদ্ধি লাভ করেন। সেই কারণ দুঃখময় অনিত্য সংসারে আর তাদের পুনর্জন্ম গ্রহণ করতে হয় না। ব্রহ্মলোক হতেও জীবকে ফিরে আসতে হয়। আমাকে পেলে তার আর পুনর্জন্ম নিতে হয় না।
এক সহস্র যুগে ব্রহ্মার একদিন ও রাত্রি। যিনি এটা জানেন, তিনিই দিন রাত্রি সন্মন্ধে প্রকৃত জ্ঞানী। ব্রহ্মার দিবা ভাগে জগৎ-সৃষ্টি হয়। আবার প্রলয়ে বিলীন হয়। এই ভাবে জীবগন ব্রহ্মার দিবা কালে জন্মলাভ করে আবার রাত্রিকালে বিলীন হয়।
সেই অব্যক্ত হতেও অব্যক্ত, চক্ষু,প্রভৃতি ইন্দ্রিয় অগোচর যে সনাতন ভাব, সর্বভূতে ধ্বংস প্রাপ্ত হলেও তা বিনাশপ্রাপ্ত হয় না। এটাই অব্যক্ত অক্ষর ও পরমাগতি যা প্রাপ্ত হলে আর সংসারে ফিরে আসতে হয় না। তাহাই আমার পরম ধাম।
যার মধ্যে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড নিহিত, যিনি জগৎ ব্যাপ্ত হয়ে বিরাজিত, সেই পরম পুরুষকে শুধুমাত্র দৃঢ় ভক্তি দ্বারাই লাভ করা যায়।
যে সময় যোগীদের মৃত্যু হলে আর আর আসতে হয় না এবং যে সময় মৃত্যুতে আসতে হয় - তা বলছি।
অগ্নির্জ্যোতি, দিন ও শুক্ল পক্ষ এবং উত্তরায়ণের ছয় মাস - এই সময় গমনকারী ব্ৰহ্মজ্ঞগণ ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হন।
ধুম, রাত্রীঃ,কৃষ্ণপক্ষ, আর দক্ষিণায়নের ছয় মাস ; এই সময়ে যোগী চন্দ্রমার জ্যোতি প্রাপ্ত হয় ও পুনরায় মৃত্যুর অধীন হন।
শুল্কপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষ ইহা জগতে নিত্য শাশ্বত। শুক্লপক্ষে মুক্তি আর কৃষ্ণপক্ষে পুনর্জন্ম। শুক্লপক্ষ মোক্ষ আর কৃষ্ণপক্ষ সংসার স্বরূপ।এই দুটি পথই জ্ঞাত হয়ে যোগীগণ মোহগ্রস্থ হন না। বেদে, যজ্ঞে, তপস্যায় এবং দানে পুন্য লাভ হয়। এই পরম তত্ব জেনে যোগীপুরুষ এ সব অতিক্রম করেন। ৮/২৮......
ভগবান কথা : ১০/৬/২০১৭
রাজ্ বিদ্যা রাজগুহ্য অতি পবিত্র, সর্বশ্রেষ্ট , অতি গোপনীয়, উত্তম এবং উত্তম প্রত্যক্ষ ফলপ্রদ ধর্মমত, সুখসাধ্য ও অবিনশ্বর। যা জানলে শুভ মোক্ষলাভ হয়।
অব্যক্ত আমি জগতে পরিব্যাপ্ত। সমস্ত প্রাণী আমাতে অবস্থিত বটে কিনতু আমি কিছুতেই স্থিত নোই। আমি সর্বভূতকে পরমাত্মারূপে ধারণ করে আছি। কিনতু না আমি ভূতে স্থিত, না ভূত আমাতে স্থিত। আকাশে যেমন মহান বেগবান বায়ু সর্বগামী , সেই রকম সর্বভূত আমাতেই স্থিত। প্রলয় সময়ে আমারই প্রকৃতিতে সর্ব-ভূত লীন হয়। আবার সৃষ্টিকালে পুনরায় আমিই সকল সৃষ্টি করি। আপন প্রকৃতিকে স্থির করে আমি নিজ মায়ার সাহায্যে এই ভুতগনকে বার বার সৃষ্টি করি। সর্ব বিষয়ে আমি উদাসীন-আসক্তিহীন, সেজন্য এ সকল কর্ম আমাকে বন্ধন করতে পারে না।
প্রকৃতি এই বিশ্ব চরাচর বার বার সৃষ্টি করে আমারই হেতু। এই কারণেই বিশ্বজগৎ বার বার সৃষ্টি হয়।
জ্ঞানহীন মূঢ়গন আমার এই পরম ভাব না বুঝে, আমার নরদেহধারী মূর্তিকে তুচ্ছ জ্ঞান করে। এই কারণে - তারা বেবেকশুন্য, অস্থির চিত্ত নিষ্ফলকর্মা ,জ্ঞানহীন,বিচারশুন্য হয়ে বুদ্ধিনাশকারিনী, আসুরী ও রাক্ষসী প্রকৃতিকে আশ্রয় করে। দৈবী প্রকৃতি আশ্রয়কারীগণ আমাকে সর্ব ভূতের আদি জেনে একান্তমনে আমারই ভজনা করে। সর্বদা আমার নাম কীর্তন করে। যত্ন ও ভক্তিপূর্বক আমাকে প্রণাম করে। নিত্যযোগে আমার উপাসনা করে। কেউ কেউ জ্ঞানযোগের দ্বারা আমার উপাসনা করে। কেউ আবার নিজেকে আমার সাথে অভেদ জ্ঞান করে ভজনা করে। কেউ আবার নিজেকে দাস ও আমাকে প্রভুরূপে চিন্তা করে আমাকে উপাসনা করে।৯/১৫.........
ভগবান কথা : ১১/৬/২০১৭
ভগবান বলছেন : আমিই ক্রতু, আমিই যজ্ঞ, আমিই স্বধা, আমিই ঔষধ,আমিই মন্ত্র,আমিই যজ্ঞের হবি,আমিই অগ্নি,আমিই হোমকর্ম। আমিই এই জগতের পিতা, মাতা,বিধাতা,পোষনকারী, পিতামহ।
আমিই জ্ঞেয় বস্তূ ,আমিই 'ওঁ' কার। আমিই ঋক, সাম,যজু, অথর্ব -সমস্ত বেদ। আমিই গতি, ভারত, প্রভু, সাক্ষী, জগৎ আশ্রয়, শরণ, সুহৃদ, উৎপত্তি স্থান, সংহারতা, প্রলয় ও আমিই অবিনাশী বীজ।
আদিত্য রূপে আমিই তাপ প্রদান করি। বৃষ্টি রূপে আমিই বর্ষণ করি। আমিই জলরাশি আকর্ষণ করি। আমিই জীবন। আমিই মৃত্যু। আমিই সৎ এবং অসৎ।
তিন বেদজ্ঞানী মহাত্মাগণ সোমরস পানে নিষ্ফল হয়ে স্বর্গ কামনা করে। তারা পুণ্যফলে স্বর্গপ্রাপ্ত হন। দিব্য স্বর্গসুখ ভোগ করেন। স্বর্গসুখ ভোগের পর আবার মর্ত্যলোকে ফিরে আসেন। এই ভাবে বেদ-উক্ত অনুবর্তনকারীগণ জন্ম-মৃত্যু লাভ করেন। অন্য্ দিকে যাঁরা একাগ্র মনে আমারই চিন্তা করেন, তাদের জীবিকা অর্জন ও রক্ষনা বেক্ষন আমিই করি। যারা শ্রদ্ধান্বিত হয়ে অন্যান্য দেবতার ভজনা করে তারাও অবিধিপূর্বক আমারই ভজনা করে। আমিই সমস্ত যজ্ঞের ভোক্তা ও প্রভু। আমাকে ভালো রূপে না জেনে মানুষ প্রকৃত পথ হতে বিচলিত হয়ে থাকেন।
দেবতার উপাসনায় দেব লোক প্রাপ্ত হয়। পিতৃগণের শ্রাদ্ধ দ্বারা পিতৃলোক প্রাপ্ত হয়। ভুতগনের অর্চনায় ভূতলোক প্রাপ্ত হয়। কিনতু আমার উপাসনার দ্বারা আমার উপাসকগন আমাকেই লাভ পরে থাকেন।
পত্র, পুষ্প, ফল, জল যে ব্যক্তি আমার উদ্দেশ্যে অর্পণ করে, আমি তার সেই ভক্তি-উপাচার যত্ন পূর্বক গ্রহণ করি। তুমি যা কারো, যা আহার করো, হোম করো,দান বা তপস্যা করো, তা সকলই আমাতে সমর্পন করো। তুমি এতে শুভাশুভ কর্মের বাঁধন হতে মুক্তি লাভ করবে। সান্যাসযোগযুক্ত আত্মা হয়ে আমাকেই লাভ করবে।
আমি সর্বভূতকে সমান দেখি, কারো প্রতি বিদ্বেষ নেই। আমার প্রিয় বা অপ্রিয় কেউ নেই। কিনতু ভক্তিযুক্ত হয়ে আমার ভজনা করে, আমি তাদের সঙ্গে থাকি ও তারাও আমার সঙ্গে থাকে। অতি দুরাচারী ব্যক্তিও যদি একান্ত ভাবে আমার ভজনা করে, লোকে সেই ব্যক্তিকে সাধু বলে মনে করে। খুব শীঘ্র সেই ব্যক্তি ধর্মাত্মা হয়ে, শাশ্বত শান্তি লাভ করে থাকে। ভক্ত কখনো বিনষ্ট হয় না। নিচ বংশে যার জন্ম, স্ত্রী-লোক বৈশ্য , শুদ্র - আমার স্মরণ নিলে পরমাগতি লাভ করে। ......৯/৩২.....
জাগতিক ভোগ সমূহ অনিত্য। এর পরিনাম দুঃখদায়ক। অতএব অনিত্য সুখে মোহগ্রস্থ না হয়ে আমাকে ভজনা করো। আমাতে মনোযোগ দাও। আমার ভক্ত হও। আমার উপাসনা করো। আমার উদ্দেশ্যে ভজনা করো। এই ভাবে আমা -পরায়ণ হয়ে আমাতে চিত্ত সমাহিত করে আমাকেই প্রাপ্ত হও। ৯/৩৪......
ভগবান কথা : ১২/৬/২০১৭
পরমতত্ব কথা শোনো। সমস্ত দেবতা বা মহর্ষিগন কেউই আমার তত্ব জ্ঞাত নয়। এর কারন আমি দেবতা মহর্ষিগনের আদিতে বিরাজিত। আমাকে যে ব্যক্তি জন্মরহিত অনাদি ও সর্বলোকের মহেশ্বর বলে জানেন, মর্তলোকে তিনিই সর্ব পাপ হতে মুক্ত হন।
জিবগনের বিভিন্ন ভাব আমা হতেই সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ বুদ্ধি,জ্ঞান,অব্যাকুলতা, ক্ষমা, দম, শম,সুখ, দুঃখ, জন্ম, মৃত্যু,ভয়,অভয়,অহিংসা, ক্ষমতা, তুষ্টি,তপ , দান, যশ, অযশ সবই আমা হতে সৃষ্টি।
ভৃগু প্রভৃতি সপ্ত মহর্ষি, তার পরে চারজন মনু আমার প্রভাবযুক্ত এবং আমার মানসসৃষ্ট। এই জীব জগৎ তাদেরই সন্তানরূপে বিদ্যমান। আমার এই যোগ ও বিভূতি যিনি সম্পূর্ণরূপে অবগত, তিনি অবিচলিত চিত্তে যোগ যুক্ত হন।
বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা আমিই। এই বিশ্বজগৎ আমাতেই প্রবর্তিত। জ্ঞানী ব্যক্তিগণ আমার ভাবযুক্ত হয়ে আমারই ভজনা করেন। আমার এই লীলা ও রূপ গুনে মুগ্ধ হয়ে, যারা আমাতেই মন প্রাণ সমর্পন করেছে, যারা আমার বিষয়ে আলোচনা করে, - তারা সদাই তৃপ্ত, আনন্দময় সদাশান্তি লাভ করে। করুনাবশে আমি এদের অন্তরে থেকে জ্ঞান আলোকে অন্ধকার নাশ করি।
আমার বিভূতি অনন্ত।
সর্বভূতে অবস্থিত আমি আত্মা।
আমিই আদি, মধ্যে ও অন্ত বলে জানবে।
দ্বাদশ আদিত্য মধ্যে আমি বিষ্ণু।
জ্যোতিস্ক মধ্যে আমি সুর্য্য।
মরুৎগনের মধ্যে আমি মরীচি।
নক্ষত্র সকলের মধ্যে আমি চন্দ্র।
বেদ সকলের মধ্যে আমি সাম বেদ।
দেবতাদের মধ্যে আমি ইন্দ্র।
ইন্দ্রিয়গনের মধ্যে আমি মন।
প্রাণীগণের মধ্যে আমি চেতনা স্বরূপ।
রুদ্রগনের মধ্যে আমি শঙ্কর।
যক্ষ ও রাক্ষস গনের মধ্যে আমি কুবের।
অষ্টবসুর মধ্যে আমি পাবক।
পর্বত সকলের মধ্যে আমি সুমেরু।
পুরহিতগণের মধ্যে আমি বৃহস্পতি।
সেনাপতিগণের মধ্যে আমি কার্তিকেয়।
জলাশয়ের মধ্যে আমি সাগর।
মহর্ষি গনের মধ্যে আমি ভৃগু।
অক্ষর মধ্যে আমি একাক্ষর ওঙ্কার।
যজ্ঞ মধ্যে আমি জপ্ যজ্ঞ।
স্থাবরগন মধ্যে আমি হিমালয়।
বৃক্ষ সকলের মধ্যে আমি অশ্বথ।
দেবর্ষিগণের মধ্যে আমি নারদ।
গন্ধর্ব গনের মধ্যে আমি চিত্ররথ।
সিদ্ধগন মধ্যে আমি কপিলমুনি।
অশ্বগন মধ্যে আমি, সমুদ্র মন্থনে উদভূত উচ্চৈঃশ্রবা।
হস্তি গনের মধ্যে আমি, সমুদ্র মন্থনে উদভূত ঐরাবত।
নরগনের মধ্যে আমি নরপতি। ১০/২৭.......
ভগবান কথা : ১২/০৬/২০১৭
ভগবান বলছেন :
অস্ত্র সকলের মধ্যে আমি বজ্র
ধেনু গনের মধ্যে আমি কাম ধেনু।
প্রজনন কার্যে আমি কন্দর্প।
সাপগনের মধ্যে আমি বাসুকি।
নাগগনের মধ্যে আমি অনন্ত।
জলচরের মধ্যে আমি বরুন।
পিতৃগণের মধ্যে আমি অর্য্যমা।
সংয়মকারীর মধ্যে আমি যম।
দৈত্য গনের মধ্যে আমি প্রহ্লাদ।
গ্রাসকারীগনের মধ্যে আমি কাল।
পশুগণের মধ্যে আমি সিংহ।
পাখী গনের মধ্যে আমি গরুড়।
বিজ্ঞানের মধ্যে আমি বায়ু।
শস্ত্রধারীগণের মধ্যে আমি রাম ।
জলজনতুগনের মধ্যে আমি মকর।
নদনদীর মধ্যে আমি জাহ্নবী।
আমি সৃষ্টির আদি, অন্ত মধ্য।
বিদ্যামধ্যে অধ্যাত্ব বিদ্যা।
তার্কিকগণের মধ্যে আমি তর্কবিদ্যা।
অক্ষর সকলের মধ্যে আমি অ-কার।
সমাস মধ্যে আমি দ্বন্দ্ব সমাস।
আমি অক্ষয়কাল স্বরূপ।
আমিই কর্মফলদাতা, বিধাতা।
সংহারকারীর মধ্যে আমি মৃত্যু।
ভবিষ্যৎ উৎপত্তির হেতু আমি।
নারী গনের মধ্যে আমি কীর্তি,শ্রী,স্মৃতি,মেধা,ধৃতি ও ক্ষমা।
সামবেদ মধ্যে আমি বৃহ্ৎসাম।
ছন্দগুলির মধ্যে আমি গায়ত্রী।
মাসগুলির মধ্যে আমি অগ্রহায়ণ (মার্গশীর্ষ).
ঋতুসকলের মধ্যে আমি বসন্ত।
ছলনাকারীর মধ্যে দ্যূতক্রীড়া।
তেজষ্মীগণের তেজ।
বিজয়ীদের মধ্যে জয়।
ব্যবসায়ীগনের ব্যবসা।
সাত্বিকগণের মধ্যে আমি সত্বগুন।
বৃষ্ণী বংশীয় অর্থাৎ যাদব বংশীয়দের মধ্যে বাসুদেব।
পাণ্ডবগণের মধ্যে আমি ধনঞ্জয়।
মুনিগণের মধ্যে ব্যাস
কবিগনের মধ্যে আমি উশনা (শুক্রাচার্য) .
দমন কারীদের মধ্যে আমি দণ্ড।
জিগীষু গনের মধ্যে আমি নীতি।
গোপনীয় বিষয়ে আমি মৌন।
জ্ঞানীগণের আমি তত্ত্বজ্ঞান।
এখানে আমার একটা প্রশ্ন : সব ভালো যদি আপনি, তবে খারাপটা কে ? সব শক্তিমান যদি আপনি, তবে দুর্বলরা কোথা থেকে এলো ? আমার মতো অজ্ঞানীরা কি সব বানের জলে ভেসে এসেছে ? সবই যদি আপনি তবে ভালোও আপনি, খারাপটাও আপনি। সবলও আপনি, দুর্বলও আপনি। মারেনও আপনি মরেনও আপনি। সর্বত্র সবকিছু আপনাতেই নিমগ্ন। আপনা থেকেই জন্ম, আপনাতেই খেলা, আপনাতেই লয়। এটাই সত্য, অন্যথা নয়।
অবশ্য পরবর্তী শ্লোকেই বলছেন :
সকল জীব সৃষ্টির বীজ স্বরূপ আমি। সেজন্য আমি ছাড়া পৃথক থাকতে পারে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এমন কিছু নেই। আমার দিব্য বিভূতি অনন্ত। এই বিশ্বে যা কিছু শ্রীযুক্ত, সে সমস্ত আমারই তেজের একটি অংশ মাত্র। আমি আমার মাত্র একাংশের সাহায্যে জগৎব্যাপ্ত রয়েছি। ১০/৪২.....
ভগবান কথা : ১২/৬/২০১৭
এতক্ষন ভগবানের উক্তি শুনছিলাম। ভগবান - ঈশ্বর, আত্মা সম্পর্কে অনেক কথা বলছিলেন। কিনতু শ্রীগীতার এই অংশ ভগবানের উক্তি নয়। তবুও এখানেই ভগবানের প্রকাশ। নিজেকে নিজে তো দেখা যায় না। চোখ নিজেকে দেখতে পায় না। এখানে ভগবান দেখা দিয়েছিলেন। দেখে ছিলেন শিষ্য শ্রী অর্জুন। তিনি কি দেখেছিলেন ? আসুন আমরা অর্জুনের চোখের সাহায্যে দেখে নেই।
অর্জুন বলছে :হে পদ্মপত্রায়ত লোচন ! তুমিই যে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি ও প্রলয়ের কর্তা। সে মাহাত্মের কথা শুনলাম। নিজের বিষয় সম্পর্কে তুমি যা বললে তা সত্য। তবুও হে পুরুষত্তম! তোমার ঐশ্বরিক রূপ আমি দর্শন করতে চাই।
তখন ভগবান বললেন : হে পার্থ ! নানাপ্রকার দিব্যাকৃতি, অলৌকিক, নানাবর্ন যুক্ত ও আকৃতি বিশিষ্ট শত সহস্র রূপ দর্শন করো। আমার দেহে দ্বাদশ আদিত্য, অষ্টবসু, একাদশ রুদ্র, ঊনপঞ্চাশৎ বায়ু, অশ্বিনী কুমারদ্বয় দেখ। আমার দেহ মধ্যে বিশ্বচরাচর দর্শন করো। যা কিছু আরো দেখতে চাও তাও দর্শন করো। আমার যোগেশ্বর রূপ দর্শন করো।
এইবার সঞ্জয়ের মুখ দিয়ে শুনি : মহাযোগেশ্বর শ্রীহরি এই বলে আপন ঐশ্বরিক রূপ পার্থকে দেখালেন।
বহু বদন ও চক্ষুবিশিষ্ট অনেক অদভুত-দর্শন, বহু দিব্যা অলংকার যুক্ত, দিব্য অস্ত্রধারী মূর্তি। দিব্য মালা বস্ত্রাদিতে সজ্জিত,দিব্য গন্ধে লিপ্ত , সর্ব-আশ্চর্যময়, জ্যোতিপূর্ণ,অনন্ত ও সর্বত্র মুখ যুক্ত। যদি মহাকাশে একত্রে সহস্র সূর্য হয়,তবে সে মহাত্মার দীপ্তির কিছু সমান হতে পারে।
অর্জুন নত মস্তকে প্রণাম করলো এবং বললো - হে দেব তোমার দেব দেহের মধ্যে সব দেবতা, বিভিন্ন প্রাণী,কমল আসন-স্থিত ব্রহ্মা, পুণ্যবান ঋষিগণ ও সর্পসকল দেখছি। আমি তোমার বহু উদর, বহু বদন, বহু চক্ষু বিশিষ্ট, সর্বব্যাপী দেখতে পেলাম। কিনতু আদি-অন্ত দেখলাম না।
অর্জুন নত মস্তকে প্রণাম করলো এবং বললো - হে দেব তোমার দেব দেহের মধ্যে সব দেবতা, বিভিন্ন প্রাণী,কমল আসন-স্থিত ব্রহ্মা, পুণ্যবান ঋষিগণ ও সর্পসকল দেখছি। আমি তোমার বহু উদর, বহু বদন, বহু চক্ষু বিশিষ্ট, সর্বব্যাপী দেখতে পেলাম। কিনতু আদি-অন্ত দেখলাম না।
অর্জুন আবার বলছেন - তুমিই কিরীটি, গঙ্গা, ও চক্রধারী। তোমার তেজরাশিতে সমস্ত দীপ্তিময়। সর্বত্রই তুমি তেজোদীপ্ত সূর্যসম, অত্যন্ত দুনিরীক্ষ, ও অপ্রমেয়। তুমি অক্ষর বেদবিদগণের জ্ঞেয় পরমব্রহ্ম। তুমি বিশ্বব্রমাণ্ডের আশ্রয়। অব্যক্ত, ও শাশ্বত ধর্মের রক্ষক সনাতন পুরুষ।
আবার বলছেন : তুমি অখণ্ড বীর্যবান আদি, মধ্যে ও অন্তহীন। অনন্ত বাহু সমন্বিত। চন্দ্র ও সূর্য তোমার নয়নদ্বয়। দীপ্ত হুতাশনের ন্যায় তোমার বদন মন্ডল। নিজ তেজে তুমি বিশ্ব চরাচর উত্তপ্ত করছো। তুমি স্বর্গ মর্ত ও মধ্যবর্তীস্থান - সর্বত্র ব্যাপিয়া বিরাজিত। ত্রিলোক তোমার এই বিশ্বরূপ দর্শন করে ভিত হচ্ছে। দেবতা সকল ভীত হয়ে তোমার স্তূতি করছে। মহর্ষিগন ও সিদ্ধ গন তোমার স্তব করছে। রুদ্র, আদিত্য,বসু গণ ,সাধ্যগণ, এবং বিশ্বের দেবতা গন, অশ্বিনী কুমার দ্বয়, মরুৎ গণ পিতৃগণ গন্ধর্ব,যক্ষ,অসুর, সকলে বিস্মিত হয়ে তোমাকে দেখছে। তুমি অসংখ্য বদন, নেত্র,বহু, উরু, পদ, উদর,ও দাঁতযুক্ত। ( এই সব দেখে অর্জুন ভয় পেয়ে গেছে - তার শান্তি নষ্ট হয়ে গেছে - ইত্যাদি ইত্যাদি আরো কি সব দেখলো ও বললো। আমরা এ সবের মধ্যে যাবো না। ভগবানের কথায় যাবো)
ভগবান বললেন : আমি লোক ধংশ কারী মহাকাল। সকল লোককে ক্ষয় করতে আমি প্রবৃত্ত। আমি প্রসন্ন হয়ে আত্মযোগ সাহায্যে, তোমাকে আমার বিশ্বব্যাপী অনাদি অনন্ত বিশ্বরূপ দেখালাম।
শুধুমাত্র অনন্যা ভক্তি থাকলেই আমাকে জানা যায়, বোঝা যায়। আমার জন্য যে ব্যক্তি কর্ম করেন, যিনি আমার শরণাপন্ন ও আসক্তিশুন্য,সর্বভূতে শত্রূ শুন্য, ইনিই আমাকে প্রাপ্ত হন। ১১/৫৫.........
ভগবান কথা : ১৪/০৬/২০১৭ (ভক্তিযোগ)
পরম শ্রদ্ধা সহকারে যাদের মন আমাতে নিবিষ্ট করে আমাকে উপাসনা করেন, তারাই শ্রেষ্ট যোগী।
যাঁরা সর্বদা সমবুদ্ধি যুক্ত, সর্ব ভূতে হিতে রত, সর্বত্র গমনকারী, অব্যক্ত, কূটস্থ, অচল, অচিন্তনীয়, ধ্রূব, ক্ষয়োদয় রোহিত, ব্রহ্মের উপাসনা করে তারাও আমাকে প্রাপ্ত হয়। অব্যক্ত বা নিরাকার নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসকদের মুক্তিলাভ কষ্টকর হয়। কারণ, দেহধারীর নির্গুণ ব্রহ্মলাভ খুবই কষ্টসাধ্য।
কিনতু যাঁরা আমাপরায়ণ হয়ে, সর্ব কর্ম আমাতেই সমর্পন করে, স্থির চিত্তে, আমাকেই চিন্তা করতে করতে আমার উপাসনা করে, সেই সকল সাধককে আমি মৃত্যুপূর্ণ সংসার সমুদ্র হতে অচিরেই রক্ষা করি। আমাতেই মন নিবিষ্ট কর। আমাতেই বুদ্ধিযুক্ত হও, তাহলে দেহান্তে আমাকেই প্রাপ্ত হবে। স্থির ভাবে আমাতে চিত্ত স্থির করতে যদি সমর্থ না হও, তা হলে অভ্যাসের সাহায্যে আমাকে পেতে চেষ্টা করো। যদি অভ্যাসেও সামর্থ না হও, তাহলে আমার কাজে চিত্ত স্থির করো। আমার প্রীতির জন্য কর্ম করলেও তুমি সিদ্ধি লাভ করবে। তাও যদি সম্ভব না হয়, তবে আমার শরণাপন্ন হয়ে, সংযত চিত্ত হয়ে, সমস্ত কর্মফল ত্যাগ করো। অভ্যাস থেকে জ্ঞান শ্রেষ্ট - জ্ঞান হতে ধ্যান শ্রেষ্ট - কর্মফল ত্যাগ ধ্যান হতেও শ্রেষ্ট। ত্যাগেই পরম শান্তি।
যে ব্যক্তি সর্বভূতে হিংসা শূন্য, মৈত্রী ভাব সম্পন্ন, সবাকার প্রতি করুণা, মমতা শূন্য, অহংকার শূন্য, সুখ-দুঃখ সমান জ্ঞান করেন, ক্ষমাশীল, সর্বদা তুষ্ট,দৃঢ় বিশ্বাসী, মন বুদ্ধি যার আমাতে অর্পিত - সেই যোগী আমার ভক্ত ও প্রিয়। যার দ্বারা উদ্বেগ প্রাপ্ত হয় না, নিজেও কারো ব্যবহারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন না, অপরের আনন্দ লাভে যিনি অসহিষ্ণু নহেন, ভয় ও উদ্বেগ শূন্য - সে-ই আমার প্রিয়। ১২/১৬.....
যে ব্যক্তির আনন্দের প্রকাশ নেই, চিত্ত ক্লেশ শূন্য, কামনা হীন, শুভ অশুভ ফল ত্যাগী সে ভক্তই আমার প্রিয়। যিনি শত্রূ-মিত্র, মান-অপমানে, শীত-গ্রীষ্মে, সুখে-দুঃখে অবিচলিত, সর্ব বিষয়ে আসক্তিহীন, নিন্দা প্রসংশায় সম জ্ঞানকারী, স্থির চিত্ত, নির্দিষ্ট বাসস্থান শুন্য, সেই ভক্তই আমার প্রিয়। যারা ভক্তি পূর্বক মৎপরায়ণ হয়ে, এই ধর্ম-অমৃত পান করেন, তারাই আমার অত্যন্ত প্রিয়।
১২/২০.........
আমি এই ভক্তি যোগটা একটু ভালো করে বোঝার চেষ্টা করবো :
এই ভক্তিযোগ অর্থাৎ দ্বাদশ অধ্যায়ে মাত্র কুড়িটা শ্লোক আছে।
এখানে প্রথমেই অর্জুন প্রশ্ন করছে :
এবং সততযুক্তা যে ভক্তাঃ ত্বাং পর্যা-উপাসতে
যে চ অপি অক্ষরম-অব্যক্তং তেষাং কে যোগবিত্তমা।
অর্থাৎ যে ভক্ত তোমাতে সততযুক্ত হয়ে তোমার (রূপের) উপাসনা করে আর যারা তোমার অব্যক্ত অক্ষর রূপের সাধনা করে, তাদের মধ্যে শ্রেষ্ট যোগবিদ কে ?
ভগবান তার উত্তরে বলছেন :
ময়ি-আবেশ্যমান যে মাং নীতিযুক্ত উপাসতে
শ্রদ্ধয়া পরয়া-উপেতা-অস্তে মে যুক্ততমা মতাঃ।
যারা আমাতে মন নিবিষ্ট করে, আমাতে নীতিযুক্ত হয়ে আমার উপাসনা করে, আমার মতে তারাই শ্রেষ্ট।
শুনলে মনে হয়, এতো অহংকারের কথা। এ কথা হয় বুদ্ধু বলতে পারেন নতুবা বুদ্ধ বলতে পারেন।ভগবান আগেই বলেছেন ঈশ্বর অব্যক্ত। এই অব্যক্ত ঈশ্বরের কথা পুরাতন ব্রহ্মবিদগণ, বেদবিদগণ বলে গেছেন। তো যারা অব্যক্ত পরম-ঈশ্বরের সাধনা করছে, তাদের থেকে তোমার এই মনুষ্যরূপী শ্রীকৃষ্ণের সাধনা করা, কি করে শ্রেষ্ট হয়। তাছাড়া এই শ্রীকৃষ্ণের জন্মের আগেও ঈশ্বর ছিলেন, এবং তার উপাসক-ও ছিলেন , তবে তারা সবাই নিকৃষ্ট সাধনা করে ছিল ? আর শ্রীকৃষ্ণের আমলেও তো শ্রীকৃষ্ণের পূজা হতো না। কেউ কেউ হয়তো তাকে ভগবানের অবতার বলে স্বীকার করতো। কিন্তু তখনও শ্রীকৃষ্ণকে ঘিরে সাধন পদ্ধতির উদ্ভব হয় নি। তাহলে শ্রীকৃষ্ণ এসব কি বলছেন ?
এইখানেই গীতার সংযোজন। এর আগে বেদ-নির্দিষ্ট পথে সাধন হতো। বেদে কর্মকাণ্ড অর্থাৎ জাগযজ্ঞ করবার পদ্ধতি ছিল। আর ছিল জ্ঞান কাণ্ড, অর্থাৎ নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা। চিত্ত-নিরোধের পদ্ধতি যা পতঞ্জলি প্রবর্তন করেছেন - আশ্রমীদের এই চিত্তনিরোধের পদ্ধতি বা অষ্টাঙ্গ যোগ করতে দেখা গেছে।
শ্রীকৃষ্ণ এসে জ্ঞানযোগের সঙ্গে যোগ করলেন নিষ্কাম কর্মযোগ।
অর্থাৎ বাসনাহীন বা আসক্তিহীন কর্ম। আর একটা নতুন পদ্ধতি তা হলো ভক্তিযোগ। আশ্রমীদের মধ্যে গুরুভক্তি আগেও ছিল, কিন্তু ভগবানে ভক্তি কথাটার প্রচলন ছিল না, নির্ভরতা ছিল। আর দেবতা বলতে ছিল প্রকৃতি। বিশেষ করে আর্যদের মধ্যে নিরাকার সাধনাই প্রচলিত ছিল। শ্রীকৃষ্ণ এসে এই ভক্তিযোগ চালু করলেন। এবং এটা ভারতবর্ষের আবিষ্কার। শ্রীকৃষ্ণের আবিষ্কার। ব্যাসদেবের আবিষ্কার। অন্য কোনো ধর্মে এই ভক্তিবাদ আজও আসেনি। এবং এই ভক্তিবাদের আকর্ষণেই লক্ষ লক্ষ্য বিদেশী হিন্দু-ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। আশ্চার্য্য ব্যাপার হচ্ছে এই ভক্তি আমাদের অন্তরে জন্ম থেকেই আছে। এটা জাগ্রত করার জন্য শুধু বলছেন শ্রীকৃষ্ণ। নতুন কিছু সংগ্রহ নয়।
এখন সাধন পদ্ধতি দুই প্রকার - দ্বৈতবাদ আর অদ্বৈতবাদ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই দ্বৈতবাদের আবিস্কারক। শ্রীকৃষ্ণ একদিকে বলছেন ঈশ্বর অব্যক্ত, আবার বলছেন : যারা আমাতে মন নিবিষ্ট করে,আমাতে নিত্যযুক্ত হয়ে ঐকান্তিক ভক্তি সহকারে আমার উপাসনা করে, তারাই শ্রেষ্ট। এখন কেন শ্রেষ্ট ? প্রশ্ন এখানেই। আর একটা প্রশ্ন শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে ভগবান বলছেন, এটা কি তার অহমিকা নয় ? নিজেকে জাহির করা নয় ? তিনি যদি ভগবান হন তবে তার কর্মেই আমরা তার ভগবানত্ব বুঝবো বা দর্শন করবো। নিজেকে কেন বলতে হবে আমি ভগবান, আমার পূজা করো। এর থেকে আমরা কি শিখবো ? আমরা কি নিজের ঢাক নিজে পেটাতে শিখবো না ?
এই প্রসঙ্গে আমি দুটো উদাহরণ দেই। এক : স্বামী প্রণবানন্দ মহারাজ, ভারত সেবাশ্রম এর প্রতিষ্ঠাতা। ইনি একটা সময়ে, তার শিষ্যদের কাছ থেকে আক্ষরিক অর্থে পূজা গ্রহণ করতেন। স্বামীজী আসনে বসতেন, ভক্তরা তাকে মালা পড়াতেন, ভোগ দিতেন, ফুল, বেলপাতা , ধুপ, প্রদীপ দিয়ে তার পূজা করতেন, আরতি করতেন। প্রণবানন্দজি নিজেকে শিব ভাবতেন। আর শিষ্যদের বলতেন পূজা করতে। এখন, তার সমবয়সী যে সব সন্যাসী, যারা তার মানবসেবা কর্মের সহযোগী ছিলেন, তাদের কাছে এটা অশোভন লাগতে লাগলো। তারা একদিন, একথা স্বামী প্রনাবনান্দকে বললেন। প্রণবানন্দ তাদের বলে ছিলেন : দেখো, মা বাবাকে যদি পূজা করা যায়, তবে আমার পূজায় দোষ কোথায় ? আমি যেটা বলতে চাইছি - মহাপুরুষরা নিজের পূজার প্রচলন নিজেরাই করেছেন। পূজা পাবার জন্য অনেক দেবতা, নানান ভাবে ভক্তদের বিড়ম্বনায় ফেলতো, এমন গল্পতো বহু আছে।
আর ঠাকুর রামকৃষ্ণ নিজেকে অবতার বলে প্রচারের ভাগিদার ছিলেন। ভৈরবী যজ্ঞেশ্বরী যখন তাকে অবতার বলে প্রচার করতে চেয়েছিলো, এবং পান্ডিত্সভা ডাকবার জন্য বলছিলেন। তখন ঠাকুর রামকৃষ্ণই মথুরবাবুকে এই পান্ডিত্সভা ডাকবার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা। তাহলে এও তো এক প্রকার নিজেকে ভগবানের অবতার বলে প্রচার করা , এবং সেটা নিজে থেকেই করা। আসলে ভগবানকে আমরা তো চিনি না। তাই ভগবানরাও নিজেকে ভগবান বলে প্রচার করেন । আবার ভন্ডরাও নিজেকে ভগবান বলে প্রচার করে। কালের গতিতে ভগবান বেঁচে থাকে, ভন্ডরা হারিয়ে যায়। শ্রীকৃষ্ণের আমলেও দ্বিতীয় বাসুদেব ছিল পৌন্ড্র। ইনি আসামের দিকে কোনো রাজ্যের রাজা ছিলেন, তার কাকার পুত্রের নাম ছিল বলরাম। তারও সুদর্শন চক্র ছিল। নিজেকে বাসুদেব বলে প্রচার করতেন। অতএব শ্রীকৃষ্ণ একা নিজেকে ভগবান বললেন, বা নিজের প্রচার নিজেই করেছেন এমন নয়। এইরকম প্রচার আকছার এখনো হচ্ছে। আগেও হয়েছে। যাই হোক এখন আমরা অদ্বৈত বাদ সম্পর্কে আলোচনা করবো।
যারা অদ্বৈতবাদের সাধনা করেন, তারা নিজেরা জানেন এটি একটি সময়সাপেক্ষ, এমনকি জন্ম জন্মান্তর লেগে যেতে পারে, এই উপলব্ধিবোধের চূড়ান্তে পৌঁছাতে। এছাড়া ব্রহ্মজ্ঞানী পুরুষ আর তথাকথিত পাগলের মধ্যে প্রায়শই কোনো পার্থক্য থাকে না। একজন চৈতন্যবান পুরুষ আর একজন চৈতন্যহীন। যার জন্য ঠাকুর রামকৃষ্ণের মতো ব্রহ্মজ্ঞানীকে তখনকার অনেক পণ্ডিত পাগল বলতো। যার যেমন জ্ঞানের বহর আর কি ? তবুতো রামকৃষ্ণ দ্বৈত - অদ্বৈত দুরকম সাধনা করেছিলেন।
অষ্টাবক্র তার সংহিতায় ব্রহ্মজ্ঞানী সম্পর্কে এক জায়গায় বলছেন :
অষ্টাবক্র তার সংহিতায় ব্রহ্মজ্ঞানী সম্পর্কে এক জায়গায় বলছেন :
নির্বাসন নিরালম্বঃ স্বচ্ছন্দো মুক্তবন্ধনঃ।
ক্ষিপ্তঃ সংস্কারবাতেন চেষ্টতে শুস্কপর্নবৎ।।
অর্থাৎ বাসনারাহীত, কর্তব্যবুদ্ধিবিহীন, রাগদ্বেষের অনধীন বন্ধনহেতু অজ্ঞানশূন্য জ্ঞানী প্রারবদ্ধকর্মরুপ বায়ুদ্বারা প্রেরিত হয়ে পবন-সঞ্চালিত শুস্কপত্রের ন্যায় কর্ম প্রচেষ্টা করে থাকেন।
তাহলে ভাবুন তো এই ব্রহ্মজ্ঞানী কেমন আছেন। ব্রহ্মবিদ তো জড়বৎ। না আছে দুঃখ না আছে আনন্দ। না আছে কর্তব্যকর্ম। না আছে দ্বেষ, না আছে রাগ, না আছে মমতা, না আছে স্নেহ। উনি কাঁদেন না, হাসেন না। অথবা ওনার হাঁসা-কাঁদার সাধারণ মানুষ কি বোঝে ? ওনার থাকা না থাকা সমান। উনি স্ব -স্বরূপে স্থিত।
তাহলে ব্রহ্মজ্ঞানী হতে সময় লাগে, আর তার পরে যা হয় তা আর কোনো কম্মে লাগে না। তাহলে অদ্বৈতপথে এই ব্রহ্মজ্ঞানী হয়ে কি লাভ ? যার দেহজ্ঞান থাকে না।
আর ভক্তিযোগের সাধনার ফল আলোচনার আগে আমরা সাকার সাধনা আর নিরাকার সাধনার পার্থক্যটা একবার আমরা বুঝে নেই।
ঈশ্বর নিরাকার, নির্গুণ, অব্যক্ত, অব্যয়, সর্বত্র। কয়েকজন লোক নির্বাক হয়ে আকাশ দেখছে। কেউ আকাশে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কেউ আকাশের নীল বর্ণ দেখছে। কেউ আকাশের ক্ষনে ক্ষনে পরিবর্তিত মেঘ দেখছে। কেউ সে মেঘের মধ্যে শিবের মূর্তি দেখছে, কেউ শিব লিঙ্গ দেখছে, কেউ ইস্ট মূর্তি দেখছে, কেউ হাতি দেখছে। আবার কেউ কিছুই দেখছে না, শুধুই মেঘ দেখছে, আর সে বিরক্ত হচ্ছে। যে মেঘ দেখছে, সে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছে। যে ইষ্টমূর্তি দেখছে সে আনন্দে আত্মহারা হচ্ছে। আপনি কি বিরক্ত হতে চান ? ধৈর্য্য হারাতে চান ? নাকি আনন্দ পেতে চান ? আনন্দ আকারেই দিতে পারে। নিরাকারে আনন্দ সুদুর্লভ।
ঈশ্বরকে কি দেখা যায় ? কিভাবে দেখা যায় ? ঈশ্বর কি আকার নেয় ?
ঈশ্বরকে অবশ্যই দেখা যায়। কিভাবে ঈশ্বরকে দেখা যায় না, সেটা আগে ভাবুন। তবেই ঈশ্বরকে দেখতে পারবেন। ঈশ্বরকে না দেখার কোনো উপায় নেই। বরং ঈশ্বরকে দেখতে না পারাটাই আশ্চর্য্য। ঈশ্বর অবশ্যই আকার নেন। আপনি যেমন তাকে দেখতে চান, তেমন ভাবেই তিনি আপনাকে দেখা দেবেন। আপনি দেখছেন কিনতু সনাক্ত করতে পারছেন না। তাই ভাবছেন আমি দেখতে পারছি না। আসলে ঈশ্বর আপনি, আপনার ভিতর, বাহির, সর্বত্র যা কিছু দেখছেন সবই ঈশ্বর। তবে আমি দেখছি না, এটা কত বড়ো ভুল, বুঝতে পারছেন ? ঈশ্বর-সমুদ্রের মধ্যে বুদ্-বুদ্ আমি। এখানেই জন্ম, এখানেই লয়। মানুষের শরীরের মধ্যে যেমন অসংখ্য কোষ, আমিও তেমনি ঈশ্বরের বিরাট শরীরের কোষ মাত্র। ঈশ্বরের শরীরেই জন্ম, ঈশ্বরের শরীরেই মৃত্যু। যতদিন বাঁচি, ঈশ্বর থেকেই খাদ্য সংগ্রহ করি, বা ঈশ্বরই খাদ্য যোগায়। এক সময় ঈশ্বরেই লয় প্রাপ্ত হই। আমি বা অহং বলে কিছু নেই। এগুলো মন-বুদ্ধির খেলা। মন বুদ্ধির ওপারে আমি বলে কিছু থাকে না।
নিরাকারই সাকার হয়। আবার সাকার থেকে নিরাকার। জলের তিন রকম অবস্থা। বায়বীয়, তরল, কঠিন।তাপমাত্রার তারতম্যে এই প্রকারভেদ। বায়বীয় জল সর্বত্র। তরল জল নদী, নালা, পুকুরে যেমন পাওয়া যায়, তেমনি পৃথিবীর মধ্যেও পাওয়া যায়। কঠিন জল আমরা বরফের আকারে দেখতে পাই। বায়বীয় জল আমাদের ভোগ্য বস্তু নয়। কঠিন জলের আইচক্রীম খাই, তরল জলে তৃষ্ণা মেটাই। বায়বীয় জলে আমাদের তৃষ্ণা মেটায় না। বাহ্যিক কোনো কাজ বায়বীয় জলে আমাদের হয় না। অর্থাৎ নিরাকারে আমরা আনন্দ পাই না। কোনো কাজে লাগে না। তৃষ্ণা পেলে, হা করে থাকলে বায়বীয় জল, আপনার তৃষ্ণা মেটাবে ? তাহলে বায়বীয় জল সত্য কিনতু আনন্দ দেয় না। তাই ঈশ্বর সাধনায় যদি আনন্দ পেতে চান তবে সাকারের সাধনা করুন।
নিরাকারের শক্তি সাকারের মধ্যেই প্রকাশ পায়। আকাশের একটা গুন্ - শব্দ, বাতাসের দুটো গুন্ - শব্দ, স্পর্শ। আগুনের তিনটি গুন্ শব্দ, স্পর্শ, রূপ। জলের চারটি গুন্ -শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস। মাটির পাঁচটা গুন্ - শব্দ, স্পর্শ, রূপ,রস, গন্ধ। তাহলে দেখতে পাচ্ছেন, নিরাকার থেকে সাকারের দিকে যত যাচ্ছে তত তার গুন্ বেড়ে যাচ্ছে। এবং আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো এই গুন্ গুলো থেকেই জ্ঞান সংগ্রহ করছে। কান দিয়ে আমরা শব্দ শুনছি। চোখ দিয়ে আমরা রূপ দেখছি। নাক দিয়ে আমরা গন্ধ শুঁকছি। মুখ দিয়ে আমরা রসের আস্বাদন করছি। ত্বক দিয়ে আমরা স্পর্শ করছি। এ সবই আমাদের সুখ ও দুঃখের আস্বাদন করাচ্ছে। এ থেকেই আমরা সুখ দুঃখের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছি আমাদের অজ্ঞাতসারে। দৈহিক সুখ দুঃখের কারন এই ইন্দ্রিয়গুলো। তাই মহাপুরুষগন বলছেন, ইন্দ্রিয়গুলোকে সংযমী করো, যদি সুখী হতে চাও। যাক অন্য্ কথায় চলে যাচ্ছি। আমাদের মূল আলোচনা ভক্তিবাদ, এবং সে প্রসঙ্গে সাকার, নিরাকার ঈশ্বর।
আপনি আগুন চান। আগুন পেতে গেলে আপনাকে একটা মাধ্যম করতে হবে। আগুন সবত্র আছে। কিনতু কাঠি/কাঠ চাই। আর চাই বারুদ। এই বারুদ দেন গুরুদেব। মাধ্যম ছাড়া আগুনের প্রকাশ হয় না। তেমনি ঈশ্বরের প্রকাশ যদি দেখতে চান তবে মাধ্যমকে আশ্রয় করুন। আর নিজেকে তৈরি করুন। অপেক্ষা করুন আকুলতা নিয়ে।
আজও নাকি শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি শোনা যায়, বৃন্দাবনে। আপনি কি বলবেন সত্যিই শোনা যায় ? আপনি বলবেন - পাগল ? আজও রাশলীলা দেখা যায়। আপনি কি বলবেন - পাগল ? আপনার এক্সপোজারে যদি ব্যাটারি বা ইলেকট্রিসিটি থাকে, অর্থাৎ আপনার মধ্যে যদি ভক্তি থাকে, অনুরাগের সুইচ দিয়ে দিন। ঠিক দেখতে পাবেন রাসলীলা , শুনতে পাবেন বাঁশি । আপনার আগে পিছনে সর্বত্র, গান ভেসে বেড়াচ্ছে। নাচের ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে। আপনি দেখতে পাচ্ছেন না। কিনতু আপনার যদি এক্সপোজার অর্থাৎ টিভি থাকে তাতে যদি ইলেকট্রিসিটি থাকে, সুইচটা অন করে দিন আপনি সব দেখতে পাবেন। এক্সপোজারের মধ্যে কিনতু কিছু নেই। ওটা ভেঙে ফেললেও ভিতরে ছবি পাবেন না. গান পাবেন না। গান আছে সর্বত্র,ছবি আছে সর্বত্র। আপনার এন্টেনা ঠিক করুন, নিজেকে যোগ্য করুন, ব্যাকুল হন, নিরন্তর তৎগতপ্রাণ হন , তবেই তাকে দেখতে পারবেন তার বাঁশি শুনতে পাবেন।
আপনি ফল খেতে চান ? ফলের স্বাদ আপনি কান্ডে পাবেন না। বীজ তো বিস্বাদ। ভক্তিবাদীরা ফল খায়। নিরাকারবাদীরা মাটির মধ্যে উৎস খোঁজে,মাটির মধ্যে স্বাদ খোঁজে। আপনি কোনটা চান ?
একটা ঘটনা বলি। শিরডির সাঁইবাবা - নাম শুনেছেন নিশ্চই। তো তাকে এক ভদ্রলোক দুপুরে খাবার জন্য নিমন্ত্রণ করেছেন। খাবারের সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ। ভদ্রলোক অপেক্ষা করছেন। এই বুঝি বাবা আসে। বাবা আর আসছেন না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। বাবা আর আসেন না। সন্ধ্যে হয়ে গেল। বাবা আর আসেন না। একটা কুকুর ঘুর ঘুর করছে। ভদ্রলোক খাবার রেখে উঠতে পারছেন না। কুকুরটাকে যতই তাড়ানো হচ্ছে, কুকুরটা একটু দূরে গিয়ে অপেক্ষা করছে। ভদ্রলোক, লোক পাঠালেন, বাবার কাছে। বাবা বললেন - আমিতো গেছিলাম রে। কিন্তু তোর মনিব তো লাঠি দিয়ে তারা করলো। লোকটি বললো - সে কি বাবা কখন গেছিলেন ? আমার বাবু তো সারাক্ষন আপনার অপেক্ষায় বসে আছেন। বাবা বললেন - তোর বাবুতো লাঠি নিয়ে বসে আছে। আমি যাই কি করে ? খাই-ই বা কি করে ?
ভগবানকে না চিনলে এই হয় দশা। ভগবান এসে বসে থাকে। আর আমি লাঠি নিয়ে বসে থাকি। ভগবান আসতে চায়, আমরা তাকে তাড়াতে চাই।
অতএব শ্রীকৃষ্ণ বলছেন : আমার মতে তারাই শ্রেষ্ট যারা ভক্তি সহকারে আমার উপাসনা করে। ভক্তিবাদেই আনন্দ, জ্ঞানী নিরস।
দুধের মধ্যে মাখন আছে, দই আছে। আপনি যদি ফেলে রাখেন , দুধ দই হয়ে যাবে। আর যদি ঝাঁকান তবে মাখন পেতে পারেন। তখন জলে ভাসতে পারবেন। না হলে জলে মিশে যাবেন। নিজেকে ঝাঁকান-ঝাঁকান, আরো জোরে, আরো জোরে নিজেকে ঝাঁকান, তবে আপনি নিজেকে মাখন করতে পারবেন। নতুবা একদিন জলে মিশে যাবেন। তাই ভগবান বলছেন ভক্তিবাদ-ই শ্রেষ্ট।
এবার একটু অন্য্ কথা বলি। ধ্যানে সাধকেরা তার ইষ্ট বা গুরুদেবের প্রতিচ্ছবি কল্পনা করে ধ্যান করেন। তখন গুরুদেবকে বা তার ইষ্টকে জ্যান্ত বলে মনে হয়। তখন সেই ইষ্টদেবতার সঙ্গে বা গুরুদেবের সঙ্গে কথা বলা যায়। এবং কথা বলেন সাধক। সেই প্রতিচ্ছবিও কথা বলে। আপনারা নিশ্চয় শুনেছেন আমাদের আজ্ঞা চক্র বা তৃতীয় নয়ন বলে একটা কথা আছে। এটি একটি শক্তিশালী বার্তা প্রেরণ কেন্ত্র। বিশ্বাস করতে হবে না, এই বার্তা প্রেরণ কেন্দ্রে নিজের মনকে স্থির করে আপনি যদি কাউকে আদেশ বা নির্দেশ দেন, তবে সে তা পালন করতে বাধ্য হবে। এটা আপনি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। এটি একটি অসাধারন গতিশীল শক্তি। কোনো ব্যক্তির ছবি, বা প্রতিমাকে মনের মধ্যে রেখে, তার ক্ষুদ্র প্রতিমাকে ধ্যানে নিয়ে আজ্ঞা চক্র থেকে যদি ভেজা মাটির মূর্তির উপরে, বা ছবির উপরে নিবিষ্ট করা যায় তবে সেই মাটির মূর্তি আর সাধারণ থাকে না। সেটা আপনার আজ্ঞা দ্বারা সঞ্চারিত চলমান শক্তিতে পরিণত হয়ে যায়। তখন আপনি যা স্নরন করবেন, সেটা গতিশীল হয়ে যাবে। মূর্তিপূজা এই প্রক্রিয়ার গভীর প্রয়োগ । আমরা মনে করি, ঈশ্বর তো বিরাট। আর এই সর্বত্র বিরাজমান বিরাটের কাছে পৌঁছেতে আমরা মূর্তির মাধ্যমে যেতে পারি। একটা কথা আছে, যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তাই আছে এই দেহভান্ডে অর্থাৎ মানব শরীরে। এবং শুধু তাই আছে না, সেই প্রপোরশনে অর্থাৎ সেই ভাগে আছে। অর্থাৎ জল ৭৫%, আকাশ ____, বায়ু _____ অগ্নি _____ মৃত্তিকা _____ । আপনার মস্তিস্ক আর পরমাত্মার মস্তিষ্কের সঙ্গে একটা সম্পর্ক আছে। এই দুই সন্মন্ধকে যুক্ত করার জন্য একটা সেতু চাই। এই সেতু নির্মিত হতে পারে মূর্তি দিয়ে। কেননা আপনি নিরাকার কিছুর সঙ্গে সোজা সুজি সম্পর্ক স্থাপিত করতে পারবেন না। আপনি আকারে বর্তমান। নিরাকার সম্পর্কে তো আপনার কিছু জানা নেই। তাই যে যাই বলুক না কেন পরমাত্মা নিরাকার, অপ্রকাশিত। সেটা শুধু কথার কথা হয়ে যাবে আপনার কাছে। আপনার অনুভবের মধ্যে কিন্তু আসবে না। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে যত অনুভব আছে, সেগুলোর সবই আকৃতির অনুভব। রূপের অনুভব। আমাদের কারুর মধ্যে নিরাকারের একটাও অনুভব নেই। কারুর কথা ভাবা মানে তার রূপের কথা। অবয়বের কথা। তার সূক্ষ্ম গুনের কথাতেও আমরা রূপ কল্পনা করি। আর যার সন্মন্ধে কোনো ধারণা নেই তার সম্পর্কে কোনো শব্দ আপনাকে তার স্মরণ করাতে পারবে না। তাই আপনি নিরাকারের কথা বলতে থাকবেন আর সাকারের মধ্যে বাস করবেন। যদি সত্যি সত্যি আপনি নিরাকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে চান তবে আপনাকে এমন একটি মূর্তি নির্মাণ করতে হবে যার একদিকে সাকার আর এক দিকে নিরাকার। এটা একটা অসম্ভব রহস্যময় মূর্তি হবে। একটু ভাবুন, আমরা যেখানে রয়েছি, সেখানে তার সীমা প্রকাশিত। আর অন্যদিকে পরমাত্মা যেখানে আছেন সেটা সীমাহীন অপ্রকাশিত। তাই মূর্তিকে দুটো কাজ করতে হবে আমরা যেখানে সেখানে সে প্রকাশিত হবে, আর পরমাত্মা যেখানে আছেন সেখানে নিরাকারের মধ্যে হারিয়ে যাবে। এই ধরনের কথা হয়তো কখনো শোনেননি।
একটা কথা শুনুন যে ব্যক্তি মূর্ত্তিপূজা করে, সে ওই মাটির মূর্তিকে পূজা করে না। সে ওই ছবিকে বা মূর্ত্তিকে পূজা করে না। সে পূজা করে ওই ছবির মধ্যে তার পিতাকে, মাতাকে, গুরুকে । দেবতাকে। ইষ্টকে। পরমাত্মাকে। মূর্তির কখনো পূজা হয় না। মূর্তির মধ্যে আমি যাকে দেখতে চাই তার পূজা করা হয়। আর যার কাছে মূর্তি দৃশ্যমান, সে কখনো পূজা শেখেনি, সে পূজা করে না। তার পূজা সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। পূজা আর মূর্তি দুটো আলাদা কথা। পূজা মূর্তির হয় না, পূজা হয় ভাবনার। যে পূজা করে, সে কখনো মূর্তি দেখতে পায় না। যে মূর্তি দেখতে পায়, সে কখনো পূজা করে না। পূজা মূর্তিকে মুছে ফেলার কৌশল। আমরা তো আকৃতি সম্পন্ন, সেই আকৃতিকে মুছে ফেলার কৌশলই পূজা।দেহাতীত হয়ে যাওয়াই পূজা। পূজায় দৃশ্যমান আকৃতি, আকৃতিবিহীন হয়ে যায়। তবেই পূজা সম্পন্ন হয়। প্রকাশিত অংশে পূজা আরম্ভ হয়, অপ্রকাশিতে পূজা সম্পন্ন হয়। পূজা সাধককে গ্রাস করে নেয়। যারা পূজা করেনি তারা ভাবে পাথর রেখে কি হবে ? আর যারা পূজা করেছে তাদের পাথর হারিয়ে যায়, সীমা হারিয়ে যায়, অসীমে প্রবেশ করে আর তখন পরমাত্মা প্রকট হয়ে যায়।
ভগবান শ্রীচৈতন্য যখন দুহাত তুলে কৃষ্ণনাম করে, মিরা যখন পূজার ছলে নাচ করে, মতুয়ারা যখন হরিবোল হরিবোল করে তখন তারা নিজেরা পূজার মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। এদের জন্য সেখানে কোনো মূর্তির অস্তিত্ব থাকে না। পূজা শুরু হলে মূর্তি বিলীন হয়ে যায়। মূর্তি তো প্রারম্ভ মাত্র। আমরা যারা পূজার কিছু বুঝি না, তারা মূর্তি দেখতে পাই। তাই আমার মনে হয় - সত্যিকারের পূজা যত কমতে থাকবে, মূর্তি তত বাড়তে থাকে, পূজা শুরু হলে মূর্তি অন্তর্হিত হবে।
মূর্তি তো পরমাত্মাকে দেখবার জানলা মাত্র। আমি দেহের মধ্যে থেকে পরমাত্মাকে দেখতে চাই। আমার তো দেহ আছে। অর্থাৎ আমি আকৃতি সম্পন্ন। তো জালনাও তো আকৃতি সম্পন্ন হবে , কিন্তু জানলা খুলে যখন আকাশের দিকে তাকাবো তখন নিরাকারের মধ্যে প্রবেশ করবো। এই দেহের মধ্যে জানলা আছে, সেটাকে খুলতে হবে। আকাশকে দেখতে হবে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে জানলা ছোট্ট। কিন্তু আকাশ তো বড়ো। কিন্তু ছোট্ট জানলা দিয়েইতো বড়ো আকাশকে দেখা যায়। এটা বোঝানো কঠিন কিন্তু সত্যি। যে জানলা কখনো খোলেনি, যুক্তি দিয়ে তাকে বোঝানো কঠিন হবে যে বৃহৎ আকাশকে, আয়তনে ছোট্ট জানলা দিয়েও দেখা যায়। মূর্তি পূজা এই জানলা খোলার প্রক্রিয়া। আপনি মন্দিরের কাছে যেতে পারেন। মূর্তির কাছে যেতে পারেন। কিন্তু পূজার কাছে যেতে পারেন না। কতকগুলো বিষয় আছে যার অভিব্যক্তি সম্ভব নয়। এগুলো অন্তরের ব্যাপার। আন্তরিক বস্তু প্রদর্শন সম্ভব নয়।
সাকার নিরাকার দুটি পৃথক নয়। একটি অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। যাকে আমরা সাকার বলি সেটা নিরাকারের অংশ। আবার যাকে আমরা নিরাকার বলি সেটিও সাকারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আমরা সাকারে আছি। আমার দেহ সাকার। আমরা সম্পর্ক গড়ি সাকারের সঙ্গে। এই সত্য তো অস্বীকার করলে চলবে না যে আমরা সাকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। আর আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি আমাদের সেখান থেকেই যাত্রা শুরু করতে হবে। যেখানে আমাদের যাওয়া উচিত, সেখান থেকে যাত্রা শুরু করা যায় না। যেখানে আছি সেখান থেকেই যাত্রা শুরু করতে হয়। যেখানে আমরা নেই সেখান থেকে যাত্রা শুরু করা যায় না। আমরা যা কিছু জেনেছি আকারের মধ্যেই জেনেছি। আমরা প্রেম করেছি - আকারে। আমরা রাগ করেছি আকারে। আমরা ঘৃণা করেছি আকারে। আসক্ত হয়েছি তাও আকারে। বন্ধুত্ব করেছি আকারে। শত্রূতা করেছি তাও আকারে। ঈশ্বরের নিরাকারত্ব যেমন সত্য। আমাদের আকারত্ব তেমনি সত্য। আমাদের মন যখন কিছু ধরে রাখে সেটা আকারেই ধরে রাখে।
তাই শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ বা কথা যখন আমরা স্মরণ করি, তার গুনের কথা যখন আমরা স্মরণ করি, তখন তার আকারের কথাই আমাদের চোখে ভাসে। আর এই জন্য নিরাকারের দিকে যদি যাত্রার জন্য আমাদের বেরোতে হয়, তবে আমাদের নিরাকারের জন্য আকার সৃষ্টি করতে হবে।এই আকারটা যদি শ্রীকৃষ্ণের হয়, বা অন্য্ কারুর হয় তবে আমাদের সাধনপথ সহজ হবে।
আমরা আবার ভগবান কথায় ফিরে যাবো।
ভগবান বলছেন : ১৫/০৬/২০১৭
ভগবান বলছেন : ১৫/০৬/২০১৭
এই সংসারের সৃষ্টিভূমি বা প্ররোহভূমি ব'লে এই শরীরকে ক্ষেত্র বলা হয়। যিনি এটা জানেন তিনি ক্ষেত্রজ্ঞ। সর্বক্ষেত্রেই ক্ষেত্রজ্ঞ রূপে আমাকেই জানবে। ক্ষেত্র - ক্ষেত্রজ্ঞ জ্ঞানী প্রকৃত পক্ষে আমার জ্ঞান।
এই শরীর বা ক্ষেত্র কি ? কি তার রূপ - বিকার কি -ক্ষেত্রে কি প্রকার -তার প্রভাব কেমন -স্বরূপ কি প্রকার ; শ্রবণ করো। ঋষিগণ বৈদিক মন্ত্রে - ছন্দে এই ক্ষেত্র - ক্ষেত্রজ্ঞ সম্পর্কে জ্ঞান নির্ধারণ করেছেন।
পঞ্চ মহাভূত - ক্ষিতি, অপ ,তেজ,মরুৎ , ব্যোম।
দশ ইন্দ্রিয় - অহংকার,বুদ্ধি (চক্ষু, জিহ্বা, কর্ন, চর্ম, নাসিকা, বাক,পাণি, পাদ , পায়ু , উপস্থ ) ইত্যাদি। এর মধ্যে পাঁচ ইন্দ্রিয়ের রূপ, রস, গন্ধ,স্পর্শ, শব্দ এই পাঁচটি বিষয় ও ইচ্ছা,দ্বেষ,সুখ, দুঃখ,শরীর, চেতনা এবং ধৈর্য্য এইগুলি ক্ষেত্র ও তার বিকার।
নিরভিমান, দম্ভ, অহিংসা, ক্ষমা, সহ্য, সারল্য, গুরুসেবা,দেহ-মনের শুচিতা,মনস্থির করা,সকল বিষয়ে বৈরাগ্য, অহংকার-শুন্যতা, জন্ম,মৃত্যু, জ্বরা, ব্যাধি , সুখ-দুঃখ, দ্বেষ প্রভৃতিতে আসক্তিহীন, স্ত্রী-পুত্র-গৃহে অনাসক্ত,ইষ্ট -অনিষ্টে সমজ্ঞানী, আমাতে একনিষ্ঠ ভক্তি, নির্জনে বাসকারী, আত্মতত্ব ও মোক্ষ বিষয়ে সদা উপলব্ধি, এই গুলো হলো জ্ঞান। এর বিপরীতে যা কিছু সবই অজ্ঞান।
জ্ঞেয় হচ্ছে পরমব্রহ্ম। ব্রহ্মকে জানলে পরম আনন্দ লাভ হয়। অনাদি পরব্রহ্ম সৎ বা অসৎ নহেন। ১৩/১৩.....
সর্বত্রই ব্রহ্মের হস্ত, পদ,মস্তক, মুখ ও কর্ন। তিনি বিশ্বব্রম্মান্ড ব্যাপী বিরাজিত। তিনি সর্ব ইন্দ্রিয়ের গুনের আভাস বা অধিকারী আবার সর্ব ইন্দ্রিয়-বিবর্জিত। তিনি কোনো কিছুতেই আসক্ত নয় আবার সর্ব গুনের আধার। নির্গুণ অথচ গুনের ভোক্তা। তিনি সর্ব ভূতের অন্তরে অবস্থিত। তিনি স্থাবর-জঙ্গম অর্থাৎ অচল আবার সচল রূপে বিরাজিত। তিনি সূক্ষ্ম হতে সূক্ষতর, তিনি দুরস্থ হয়েও নিকটে অবস্থিত। সর্বভূতে তিনি যুক্ত অথচ অবিছিন্ন, অচঞ্চল। তিনি সর্ব ভূতকে পালন পোষন করেন, প্রলয়কালে গ্রাস করেন। পুনরায় সৃষ্টিকালে বিভিন্নরূপে প্রকাশিত হন। তিনিই সকলের মূল। জ্যোতিষ্কগনের তিনিই জ্যোতি। তিনি তমোরূপ অন্ধকারের অতীত। তিনি জ্ঞান; তিনি জ্ঞেয় ; আবার তিনিই জ্ঞানগম্য। তিনি সর্ব ভূতের হৃদয়ে অবস্থিত। আমার ভক্তগণ বিশেষরূপে এসব জেনে আমার স্বরূপ অবগত হন বা আমাকে প্রাপ্ত হন।......১৩/১৯.....
ভগবান কথা : ১৭/০৬/২০১৭
প্রকৃতি ও পুরুষ অনাদি। গুন্ সকল প্রকৃতি হতে জাত। কার্য্য, কারন ( শরীর, ইন্দ্রিয় ) উভয়ের হেতু প্রকৃতি। সুখ-দুঃখের হেতু ভোগ। আবার ভোগের হেতু পুরুষ। পুরুষ প্রকৃতিতে অবস্থান করে সুখ দুঃখ অর্থাৎ প্রকৃতির গুন্ ভোগ করে। এই গুন্ সুমুহের সঙ্গেই পুরুষ সৎ অসৎ যোনিতে জন্ম গ্রহণ করে। সকল দেহেই পরম পুরুষ বিরাজিত। তিনি উপদেষ্টা বা সাক্ষী। তিনিই অনুমানতা অর্থাৎ অনুমতিদাতা। তিনিই ভর্তা , ভোক্তা,মহেশ্বর। তিনিই পরম আত্মা।
যিনি প্রকৃতি ও পুরুষের এই সকল গুনের কথা জানেন তিনি যে অবস্থায়ই থাকুন না কেন, দেহান্তে তাঁর পুনর্জন্ম হয় না।
কেই ধ্যান যোগের সাহায্যে,কেউ জ্ঞান যোগের সাহায্যে , কেউ বা কর্মযোগের সাহায্যে আত্মাকে দর্শন করেন। আবার কেউ এই সমস্ত ভাব না জেনে শুধু অপরের মুখে শুনে তার উপাসনা করেন। এবং এতেই তিনি মৃত্যুময় সংসার অতিক্রম করেন।
স্থাবর জঙ্গম, জগতে যা কিছু পদার্থের উৎপত্তি হয় ,সে সকলই ক্ষেত্রে-ক্ষত্রজ্ঞ সংযোগেই হয়। ১৩/২৭.......
ভগবান কথা : ১৮/০৬/২০১৭
যিনি সমভাবে, সর্বভূতে বিরাজিত ও বিনাশশীল পদার্থে অবিনাশী আত্মাকে দর্শন করেন, তিনিই সমদর্শী এবং পরমেশ্বরকে তিনিই যথার্থ রূপে জানেন। সর্বভূতে সমানভাবে যিনি ঈশ্বরকে সবত্র ব্যাপী বিরাজমান দেখে আত্মহিংসা মুক্ত, তিনিই মোক্ষ লাভ করেন। সমস্ত কার্যই করেন প্রকৃতি আত্মা অকর্তা ও নিষ্ক্রিয় এইরূপ যিনি দর্শন করেন এবং বুদ্ধির সাহায্যে বুঝতে পারেন - তিনিই সত্যদ্রষ্টা। ...১৩/৩০....
ভগবান কথা : ১৯/০৬/২০১৭
পৃথক পৃথক ভূত সকলকে যিনি আত্মাতে স্থিত জানেন, সৃষ্টি সময়ে পুনরায় ভুতগন আত্মা হতে পৃথক হন - এই তত্ব যিনি জ্ঞাত হন তিনিই ব্রহ্মত্ব লাভ করেন। অনাদি, নির্গুণ এবং অব্যয় বলে, এই দেহে অবস্থান করেও তিনি কিছুই করেন না। তাই তিনি নির্লিপ্ত। সর্বব্যাপী আকাশ যেমন সকল বস্তূতে ব্যাপ্ত হয়েও সূক্ষ্ম বলে সে কিছুতে লিপ্ত হয় না। তেমনি আত্মা সর্ব প্রকার দেহে থেকেও নির্লিপ্ত থাকেন। একমাত্র সূর্য যেমন বিশ্ব প্রকাশ করেন তেমনি ক্ষেত্রী অর্থাৎ আত্মা সমস্ত ক্ষেত্রকে প্রকাশ করেন। যারা ক্ষেত্র - ক্ষেত্রজ্ঞের পার্থক্য এবং ভূত ও প্রকৃতি হতে মুক্তিলাভের উপায় জ্ঞানদৃষ্টির দ্বারা উপলব্ধি করেছেন - তারাই পরমাগতি লাভ করেন। ১৩/৩৫....
ভগবান কথা : ২০/০৬/২০১৭
ভগবান বলছেন : সকল যোনিতে যে দেহ উৎপত্তি হয়, মহৎ ব্রহ্ম অর্থাৎ প্রকৃতি তাদের জননী, আর আমিই বীজপ্রদ পিতা।
সত্ব, রজঃ, তমঃ এই ত্রিগুন প্রকৃতি হতে জাত। এই ত্রিগুন নিত্য আত্মাকে আবদ্ধ করে রাখে। এই ত্রিগুণের মধ্যে সত্ত্বগুণ নির্মল। এই সত্ত্বগুণ প্রকাশক ও মলিনতা শুন্য। এই সত্ত্বগুণ-ই জীবকে সুখের আসক্তি ও জ্ঞানের আসক্তিতে সংসারে আবদ্ধ করে রাখে।
রজগুন আসক্তিময় ও পিপাসাময়। রজগুনে কামনা জন্মে ও জীবকে আসক্তি দ্বারা কর্ম বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে।
অজ্ঞানতা হতে তম গুনের সৃষ্টি। তমঃগুণ ভ্রান্তি কারক। এই গুন্ জীবকে প্রমাদ, আলস্য, নিদ্রা দ্বারা জীবকে আবদ্ধ করে।
সত্বগুন্ জীবকে সুখ দান করে। রজোগুণ কর্মে প্রবৃত্ত করে। তমগুণ জীবের জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করে ভ্রমে পতিত করে। কোনো কোনো সময় সত্ত্বগুণ - রজঃ ও তমোগুণকে অতিক্রম করে প্রবল হয়ে উঠে। ঠিক তেমনি কখনো রজঃগুন -সত্ব ও তম গুনকে অতিক্রম করে প্রবল হয়। আবার কোনো কোনো সময় তম গুণও
সত্ব ও রজ গুনকে অতিক্রম করে প্রবল হয়ে ওঠে।
যে সময় সর্বদ্বার অর্থাৎ ইন্দ্রিয় দ্বারা দেহে জ্ঞান প্রকাশ পায় - তখনি সত্বঃগুন বৃদ্ধি হয়েছে জানবে।
রজঃ গুণ বৃদ্ধিতে লোভ, কর্মে প্রবৃত্তি, অশান্তি ইত্যাদি লক্ষ্মণ প্রকাশ পায়।
তমঃগুণ বৃদ্ধিতে বিবেকহীনতা, কর্তব্যহীনতা, আলস্য,অসাবধানতা এবং ভ্রম ইত্যাদি লক্ষ্মণ প্রকাশ পায়।
সত্বঃগুন্ বৃদ্ধিকালে যদি জীবের দেহান্ত হয়, তবে তত্ত্বজ্ঞানী ব্যক্তিগণ যে নিস্কলুষ স্থান প্রাপ্ত হন সেই জীব সেই স্থান প্রাপ্ত হয়।
রজঃ গুন্ বৃদ্ধিকালে যদি জীবের মৃত্যু হয় তবে তার মানব যোনিতেই জন্ম হয়।
তমঃগুণ বৃদ্ধিকালে যদি কারো দেহান্ত হয় তবে সে পশু-পক্ষী যোনিতে জন্ম গ্রহণ করে। ১৪/১৫......
ভগবান কথা : ২১/০৬/২০১৭
সাত্বিক কর্মের ফল নিস্কলঙ্ক। রাজসিক কর্মের ফল দুঃখদায়ক। তামসিক কর্মের ফল অজ্ঞানতা। সত্ব গুণান্বিত কার্যে প্রকৃত জ্ঞান লাভ। রজোগুণান্বিত কর্মে লোভ। তমগুনান্বিত কর্মে মোহ ও অজ্ঞানতা জন্মায়। সত্ব গুন্ ঊর্ধ্বলোকে ; তমোগুণ জঘন্য কাজের জন্য অন্ধকারলোকে ; ও রজগুণ মধ্য অর্থাৎ মৃত্যু লোকে প্রেরন করে। যিনি সমস্ত কর্ম বিষয়ে গুনকেই কর্তা জানেন ও আত্মাকে গুণাতীত বলে জানেন, তিনি আমার ভাব প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। জীব জীবিত কাল হতেই গুন্ তিনটিকে অতিক্রম করে জন্ম, মৃত্যু,জরা প্রভৃতি দুঃখ হতে মুক্ত হয়ে অমৃতত্ব লাভ করেন।
সত্ব, রজঃ, তম গুনের প্রকাশ অর্থাৎ মোহ,প্রবৃত্তি ইত্যাদি কর্মকে যিনি আত্মার কার্য মনে করেন এবং এতে প্রবৃত্ত বা নিবৃত্ত হন না - তিনিই গুণাতীত। যিনি সাক্ষী মনে করে উদাসীনের ন্যায় অবস্থিতি করেন, সত্বাদি তিন গুনের প্রভাবে তিনি প্রভাবিত হন না। তিনিই গুণাতীত। যিনি সুখ দুঃখ, প্রিয়-অপ্রিয়, লোষ্ট্র অর্থাৎ মাটির ঢেলা বা কাঞ্চন অর্থাৎ সোনা সমান চক্ষে দেখেন সেই ধীর ব্যাক্তিই গুণাতীত। মান-অপমান, শত্রূ-মিত্র -তে যিনি সমজ্ঞান করেন ; যিনি সর্বকর্মে উদ্যম পরিত্যাগ করেছেন, তিনিই গুণাতীত। একান্ত ভক্তি সহকারে যিনি আমাকে সেবা করেন, তিনিই এই তিন গুনকে অতিক্রম করে ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হন। আমিই ব্রহ্মে প্রতিষ্ঠা স্বরূপ অমৃত ও অব্যয়। আমি শাশ্বত ধৰ্ম এবং ঐকান্তিক সুখের নিদান। ১৪/২৭.......
ভগবান কথা : ২২/০৬/২০১৭
যার মূলদেশ ঊর্ধে, শাখা নিচে, এইরূপ সংসার অশ্বথ-বৃক্ষ অব্যয়। কর্মকাণ্ড যুক্ত ছন্দযুক্ত চতুর্বেদ এর পাতা। যিনি এই সংসাররূপ অশ্বথ বৃক্ষকে অবগত হয়েছেন তিনিই বেদজ্ঞ।
এই সংসাররূপ বৃক্ষের শাখা সমূহ গুণত্রয় দ্বারা বর্ধিত ও বিষয়রূপ প্রবাল বিশিষ্ট, এর শাখা সমূহ উর্দ্ধে ও অধোদেশে বিস্তার করে আছে। এর মূল সকল অধোদিকে মনুষ্য লোকে প্রসারিত। এই মূল সকল ধৰ্মা-ধর্মরূপ কর্মের কারন।
জীবগন এই সংসার রূপ অশ্বথ-বৃক্ষের আকার উপলব্ধি করতে পারে না। এর আদি-অন্ত -মধ্যে ও স্থিতি দুর্বোধ্য। জ্ঞানীগণ অনাসক্তি রূপ অস্ত্রের সাহায্যে এর সুদৃঢ় মূল উচ্ছেদ করে ব্রহ্মকে জানতে পারেন। এদের আর ফিরে আসতে হয় না।
যা হতে চিরন্তনী সংসারগাতি বিস্তার হয়েছে সে আদি পুরুষের আশ্রয় করে সেই পদকে অন্বেষণ করতে হয়। যারা অভিমান ও মোহ ত্যাগ করেছে, যারা অনাসক্ত, আত্মজ্ঞানময়, কামনা হীন, সুখ দুঃখরূপ দ্বন্দ্ব বিমুক্ত তারা পরম পদ প্রাপ্ত হয়। আমার যে পরম ধাম - যা প্রাপ্ত হলে জীবের আর পুনর্বার জন্ম হয় না,সে ধামকে সূর্য্য চন্দ্র অগ্নি প্রকাশ করতে পারে না। আমার সনাতন অংশ জীব হয়ে প্রকৃতিতে অবস্থিত মন ও পাঁচ ইন্দ্রিয়কে সংসারে আকর্ষণ করে। বায়ু যেমন পুষ্পাদি হতে সুগন্ধ কনা নিয়ে যায়, তেমনি জীব যখন এক দেহ থেকে অন্য দেহে প্রবেশ করে তখন এই সকলকে সঙ্গে নিয়ে যায়। জীবাত্মা চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক এবং মনকে আশ্রয় করে বিষয় ভোগ করে। জীব-আত্মা কিভাবে সত্বাদিগুন(সত্ব, রজঃ, তম) যুক্ত হয়ে দেহে অবস্থিত করে, বিষয় ভোগ করে, আবার কিভাবে দেহ হতে উত্ক্রান্ত হয় তা অজ্ঞ ব্যাক্তিগন দেখতে পায় না। কিনতু জ্ঞাননেত্র বিশিষ্ট জ্ঞানীগণ তা দেখতে পারেন।সমাহিতচিত্ত যোগীগণ আপনাতে অবস্থিত এই আত্মাকে দর্শন করে থাকেন। কিনতু অজিতেন্দ্রীয় ও অবিবেকী যারা তারা শত চেষ্টাতেও তাকে দেখতে পান না। যে তেজ সূর্যে অবস্থিত থেকে জগৎ উদ্ভাসিত করে এবং যে তেজ চন্দ্র ও অগ্নিতে বিদ্যমান - তা আমারই জানবে। ১৫/১২....
আমি পৃথিবীতে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে আপন শক্তির সাহায্যে ভূত সকলকে ধারণ করে আছি। আমি রসময় সমরূপ ঔষধি সকল রসাত্বক করছি। বৈশ্বানর রূপে আমি সব জীবের দেহে আশ্রয় পূর্বক প্রাণ ও অপান চতুর্বিধ অন্ন (চর্ব্য-চুষ্য-লেহ্য-পেয় ) পরিপাক করি। সর্ব জীবের হৃদয় মাঝে আমি অধিষ্ঠিত। আমা হতেই জীব সকল স্মৃতি, জ্ঞান ও বিবেচনা শক্তি লাভ করে। আমি বেদের জ্ঞাতব্য বস্তূ, বেদান্ত কর্তা, ও একমাত্র বেদজ্ঞ। ত্রিলোকে ক্ষর অর্থাৎ বিনাশশীল ও অক্ষর অর্থাৎ অবিনাশী নামে দুটি পুরুষ বর্তমান। তার মধ্যে ক্ষর নামক পুরুষ সকল জীবে একীভূত আছেন। এবং অক্ষর পুরুষ কূটস্থ এবং নির্বিকার ভাবে আছেন। এই ক্ষর ও অক্ষর পুরুষ অপেক্ষা উত্তম পুরুষ হলেন পরম আত্মা। তিনি নির্বিকার হয়েও নিয়ন্তা রূপে তিন লোক ধারণ করে আছেন। ক্ষর -অক্ষর অর্থাৎ নশ্বর ও অবিনশ্বর পুরুষ অপেক্ষা আমি শ্রেষ্ট। সে জন্য বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড এবং বেদ সকলে আমাকে পুরুষোত্তম বলে থাকে। মোহো মুক্ত চিত্তে যিনি আমাকে পুরুষোত্তম বলে জ্ঞাত হন, সেই সর্বজ্ঞ পুরুষ আমারই ভজনা করেন। নিষ্পাপ পুরুষই এই গুহ্য কথা জানতে পারেন। .........১৫/২০....
ভগবান কথা : ২৩/০৬/২০১৭
ভয় শুন্যতা, চিত্ত শুদ্ধি,আত্মজ্ঞান নিষ্ঠা, কর্মযোগে তৎপরতা,দান, ইন্দ্রিয় সংযম, যজ্ঞ, শাস্ত্র অধ্যয়ন, তপস্যা, সরলতা, অহিংসা, সত্য, ক্রোধহীনতা,ত্যাগ, শান্তি, পরনিন্দা বর্জন,দয়া, লোভহীনতা, বিনয়, কুকর্মে লজ্জা, অ-চাপল্য, তেজস্বিতা, ক্ষমা, ধৃতি, শৌচ,অদ্রোহ,নিরভিমানিতা - এই সকল গুন্ গুলি জাতকের দৈব সম্পদ। ১৬/৩......
ভগবান কথা : ২৪/০৬/২০১৭
দম্ভ, দর্প ,অভিমান,ক্রোধ,নিষ্ঠূরতা ও অজ্ঞানতা এগুলি আসুরিক সম্পদ - জাত। দৈবী সম্পদ মোক্ষের হেতু। আসুরী সম্পদ বন্ধনের কারন। দুঃখ করো না তুমি দৈবীসম্পদ নিয়েই জন্ম গ্রহণ করেছো।
আসুরী প্রকৃতি সম্পন্ন ব্যক্তিগণ ধৰ্ম বিষয়ে প্রবৃত্তি কি - অধর্ম বিষয়ে নিবৃত্তি কি তা জানে না। তাদের মধ্যে শুচিতা, সদাচার, সত্য বলে কিছুই নাই। এই জগৎ অসত্য। ন্যায় - অন্যায় বলে কিছু নাই। ঈশ্বর বলে কিছু নাই।স্ত্রী - পুরুষের কামনাই সৃষ্টির কারণ। এইরূপ দৃষ্টি অবলম্বন করে বিকৃতি বুদ্ধি, নীচমন, উগ্রকর্মা, ও জগতের অহিতকার কার্যে প্রভাবিত করে। ..১৬/.৯....
এদের কামনা দুষ্পূরণীয়। দম্ভ, অভিমান ও গর্বের অধীন হয়ে মোহবশতঃ অসৎ কর্মে প্রবৃত্ত হয়। বিভিন্ন অশুচিতে অবস্থান করে।
কাম ভোগকে শ্রেষ্ট মনে করে এতেই মগ্ন থাকে। কামভোগকেই সার বস্তূ মনে করে। শত শত আশা-পাশে আবদ্ধ থাকে। কাম ক্রোধের বশবর্তী হয়ে অসৎ পথে অর্থ সঞ্চয়ে মন দেয়। আজ আমার এই লাভ হলো , ভবিষ্যতে আমার এই মনোরথ পূর্ণ হবে। এই ধন আমার আছে -ভবিষ্যতে এই লাভ হবে। এই শত্রূ বধ করেছি - অপর সব শত্রূ -কেও বধ করবো। আমি সকলের প্রভূ। আমি সকল ভোগ সুখের অধিকারী। আমিই সিদ্ধ বা কৃতকৃত্য। আমি বলবান। আমিই সুখী। আমি ধনবান, আমি কুলীন, আমার তুল্য আর কে আছে ? আমি যজ্ঞ করবো, আমি দান করবো। এই ভাবে নানা মোহবশে, কামভোগে, আসক্ত চিত্ত হয়ে নরকে পতিত হয়ে থাকে। এরা নিজেদের বড়ো জ্ঞান করে। আর্থিক মান বশে গর্বিত হয়ে, আসুরিক দম্ভ সহকারে অবিধিপূর্বক নাম ও যশ লোভে বিধিহীন যজ্ঞের অনুষ্ঠান করে।
অহংকার, শক্তি, দর্প , কাম ও ক্রোধকে আশ্রয় করে যারা নিজদেহে ও পরদেহে আমার প্রতি হিংসা করে ও আমার নিন্দা করে। আমা - বিদ্বেষী সেই ক্রূর প্রকৃতি নরাধম দিগকে বার বার আমি আসুরি যোনিতে নিক্ষেপ করে - সিংহ -ব্যাঘ্র -সর্প ইত্যাদি যোনিতে নিক্ষেপ করি। এই সকল মূঢ়গন আসুরি যোনিতে জন্ম গ্রহণ করে জন্ম - জন্মান্তরে আমাকে প্রাপ্ত না হয়ে আরো অধম গতি প্রাপ্ত হয়। কাম, ক্রোধ, লোভ, এই তিন নরকের দ্বার স্বরূপ, ইহা আত্মার বিনাশ করে। সে জন্য এই তিনটি সর্বদা পরিত্যাগ করবে। ....১৬/২১....
নরকের দ্বার স্বরূপ কাম, ক্রোধ, ও লোভ। যে এই তিনটি হতে মুক্ত,সেই মুক্ত পুরুষ যদি আপন শ্রেয় সাধন জন্য জাগ্-যজ্ঞ তাপস্যাদির অনুষ্ঠান করে, তবে সে পরমাগতি লাভ করেন। যে শাস্ত্র বিধি ত্যাগ করে যথেচ্ছ ভাবে কাজ করে, সে কখনো সিদ্ধি লাভ করতে পারে না। সে কখনো সুখ বা পরমাগতি লাভ করে না। সে জন্য কর্তব্য বিষয়ে শাস্ত্রের উপদেশই মানবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করবে। ১৬/২৪.......
ভগবান কথা : ২৬/০৬/২০১৭
ভগবান বলছেন, দেহীদিগের তিন প্রকার নিষ্ঠা স্বভাবজাত। সাত্বিক,রাজসিক, তামসিক। সত্বার তারতম্য অনুযায়ী, দেহিগনের শ্রদ্ধা হয়ে থাকে। সত্ত্বগুণের ব্যক্তিগণ দেবতার অর্চনা করেন। রাজসিক ব্যক্তিগণ যক্ষ-রাক্ষসগনের পূজা করেন। তমোগুণের ব্যক্তিগণ ভূত প্রেতাদির পূজা করেন। যারা অশাস্ত্রীয় কঠোর তপস্যা করে, দম্ভ ও অহংকার বশে আসক্তি পরায়ন হয়, শক্তিশালী হয়ে দেহস্থিত ভূতগণকে ক্লেশ দেয় ও শরীরস্থ আমাকেও কষ্ট দান করে, তারা অসুর প্রকৃতির জানবে।
সকলের আহার, দান, যজ্ঞ ও তপস্যাও বিভিন্ন। আয়ু, উদ্যম ,শক্তি, আরোগ্য, সুখ ও প্রীতি বর্দ্ধনকারী এবং সরস ও স্নিগ্ধ, যার ফল দেহ মধ্যে বহুকাল থাকে, যা খেলে আনন্দ হয় - তাই সাত্বিক আহার।
অধিক কটু, অতি অম্ল, অতি লবনাত্বক, অতি উষ্ণ,অতি রুক্ষ, অতি ঝাল, অতিরিক্ত বিদাহী এসব রাজসিক ব্যক্তির প্রিয়। এই খাদ্য দুঃখ, শোক ব্যাধির সৃষ্টি করে।
অনেক আগে প্রস্তূত খাদ্য, নিরস, বাসি দুর্গন্ধ যুক্ত, উচ্ছিষ্ট, অপবিত্র খাদ্য, তামসিক ব্যক্তির প্রিয়।
ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে এক মনে অবশ্য কর্তব্য জ্ঞানে শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী যে যজ্ঞ করা হয় -সেটাই সাত্বিক যজ্ঞ বলে জানবে। ফলাকাঙ্ক্ষা এবং আপন মহত্ব ও দম্ভ প্রকাশন করে যে যজ্ঞ করা হয় তাই রাজসিক।
অশাস্ত্রীয় রূপে, অন্নদান না করে, যথাবিধি দক্ষিণা না দিয়ে, শ্রদ্ধাহীন ভাবে যে যজ্ঞ করা হয় তাই তামসিক যজ্ঞ।
দেবতা, ব্রাহ্মণ গুরু ও জ্ঞানীগণের পূজা, সূচিত সরলতা, ব্রহ্মচর্য ও অহিংসা এই সকল শারীরিক তপস্যা। অনুদ্বেগকর বাক্য, সত্য অথচ প্রিয় বাক্য বেদ অধ্যায়নে যুক্ত থাকাকে বাচিক তপস্যা বলে। .......১৭/১৫....
মনের প্রসন্নতা, সৌম্য ভাব, মৌনতা, আত্মনিগ্রহ, এবং অন্তরশুদ্ধি, এই সকল মানসিক তপস্যা। ফলের কামনা ত্যাগ করে, একাগ্র মনে
পরম শ্রদ্ধা সহকারে এই তিন প্রকার অনুষ্ঠানকেই সাত্বিক তপস্যা বলে। লোকের প্রশংসা লাভ ও পূজা পাবার জন্য যে তপশ্চরণ করা হয় তাই রাজসিক তপস্যা। অবিবেকী ব্যক্তি দুষ্টবুদ্ধি বশে শরীর প্রভৃতির পীড়া জন্মিয়ে বা অপরের ক্ষতিকরার উদ্দেশে যে তপস্যা করা হয়, তাই তামসিক তপস্যা। দান করা কর্তব্য মনে করে, প্রত্যুপকারীকে দেশ -কাল -পাত্র বুঝে যে দান করা হয়, তাকে সাত্বিক দান বলে। প্রত্যুপকারের আশায়,ফল কামনায়,বা মনের ক্লেশে, যে দান করা হয় - তাকে রাজসিক দান বলা হয়।
ওঁ-তৎ-সৎ এই তিনটি ব্রহ্মের নাম। এর সাহায্যে ব্রহ্মা সৃষ্টির প্রথমে
যজ্ঞ কর্তা ব্রাহ্মণ ও যজ্ঞের হেতু বেদ সৃষ্টি করেছিলেন। এই কারণে "ওঁ" ওঙ্কার শব্দ উচ্চারণ পূর্বক সর্বদা শাস্ত্র-উক্ত যজ্ঞ-দান ও তপস্যা সম্পন্ন করা কর্তব্য। "তৎ" এই শব্দ উচ্চারণ করে মুক্তিকামীগন ফল কামনা ত্যাগ করে নানা প্রকার যজ্ঞ, তপস্যা দান প্রভৃতি ক্রিয়া সম্পাদন করেন। সমস্ত বস্তূর ব্রহ্ম ভাব নির্দেশে এবং সাধুত্বে "সৎ" শব্দ প্রযুক্ত হয়। কর্মেও "সৎ" শব্দ উচ্চারণ করা হয়। যজ্ঞ, তপস্যা, ও দানে যে নিষ্ঠা তাতেও "সৎ" শব্দ ব্যবহার করা হয়। ঈশ্বরের উদ্দেশে যে কার্য করা হয় তাকেও "সৎ" বলা হয়।
অশ্রদ্ধাপূর্বক যে যজ্ঞ, দান, তপস্যা ও অন্যান্য যা কিছু অনুষ্ঠিত হয় তা সকলই অসৎ বলে জানবে। এই সব অসৎ পথ-আশ্রয়ীর ইহ-লোকে, পরলোকে কোথাও কোনো শুভ ফল হয় না। ১৭/২৮....
ভগবান কথা: ০১/০৭/২০১৭
জ্ঞানীগণ কাম্য সকল ত্যাগকেই সন্যাস বলে জানেন। বিচক্ষণ ব্যাক্তিগন কর্মফল ত্যাগকেই সন্যাস বলে জানেন।
ত্যাগ তিন প্রকার। যজ্ঞ, দান, ও তপস্যা-র কর্মফল ত্যাগ করা উচিত। নিত্যকর্ম ত্যাগ করা উচিত। মোহ বশতঃ নিত্য কর্ম ত্যাগকে তামসিক ত্যাগ বলে। কস্টকর মনে করে, বা দেহক্লেশের ভয়ে যে কর্মা ত্যাগ করে তা রাজসিক ত্যাগ। এই ধরনের ত্যাগে কোনো ফল লাভ হয় না।
কর্তব্য জ্ঞানে যে নিত্য কর্ম করা হয় - সে কর্মের ফল ত্যাগ করাকেই সাত্বিক ত্যাগ বলা হয়। সত্বগুনযুক্ত, মেধাবী, সংশয়হীন ত্যাগী পুরুষ কস্টকর কর্মে বিরক্ত বা সুখকর কার্যে প্রীতি অনুভব করেন না। পৃথিবীতে দেহ-সকল কর্ম ত্যাগ করতে পারে না। তবে কর্মফল ত্যাগী ব্যক্তি প্রকৃত ত্যাগী বলে অবহিত হয়।
অত্যাগী বা সকাম ব্যাক্তিগন মির্ত্যুর পর - ইষ্ট, অনিষ্ট ও ইষ্ট-অনিষ্ট মিশ্রিত, এই ত্রিবিধ কর্ম-ফল প্রাপ্ত করেন।
সর্ব কার্য সিদ্ধির জন্য সাংখ্যে এবং বেদান্তে পাঁচটি কারন বর্ণনা করা হয়েছে। দেহ, অহংকার, ইন্দ্রিয়, প্রাণ-অপান ও দৈব - এই পাঁচটি কারন। দেহ বাক্য ও মনের দ্বারা মানুষ ধৰ্ম বা অধর্ম যা কিছুই করুক - এই পাঁচটি সকলের হেতু। সে জন্য এই পাঁচটিকে না জেনে যে মানুষ আপনাকে কর্তা মনে করে - সে দুর্মতি সত্য জানতে পারে না। আমি কর্তা - বলে যার অভিমান নেই, যার বুদ্ধি কর্মফলে আসক্ত হয় না তিনি সমস্ত লোক হত্যা করলেও, কিছুই হত্যা করেন না এবং তার ফলে তিনি আবদ্ধ হন না।
জ্ঞান, জ্ঞেয়, ও পরিজ্ঞাতা এই কর্ম -প্রবৃত্তির হেতু। করণ অর্থাৎ উপায়। কর্মা, ও কর্তা এই তিনটি ক্রিয়ার আশ্রয়। সাংখ্য দর্শনে জ্ঞান,কর্ম ও কর্তাকে গুনভেদে তিন প্রকার বলা হয়েছে। যে জ্ঞানের দ্বারা পরস্পর বিভক্ত ভাবে অবস্থিত সর্বভূতে এক নিত্য অদ্বয় বস্তুর দর্শন হয়, তাকে সাত্বিক জ্ঞান বলে জানবে। যে জ্ঞানের সাহায্যে ভিন্ন ভিন্ন ভূত সমূহে পৃথক পৃথক ভাবের অনুভব হয়, তা রাজসিক জ্ঞান। যে গুণের সাহায্যে যুক্তি প্রমান শূন্য প্রাণী স্থুল পদার্থে বিশ্ব জগতের তত্ব আরোপ করে তাতে আসক্ত হয়, সেই জ্ঞান তামসিক জ্ঞান।
যে ব্যক্তি অনাসক্ত ভাবে অনুরাগ বা বিদ্বেষ বর্জিত হয়ে অবশ্য করণীয়রূপে যে বিহিত কর্ম করেন, তাকে সাত্বিক কর্ম বলা হয়।
কামনার বশে অহংকার পূর্বক অতি কষ্টে যে কর্মের অনুষ্ঠান করা হয়, তাকেই রাজসিক কর্ম বলা হয়। অপরিণাম দর্শী হয়ে, বিত্ত ক্ষয় পূর্বক হিংসা ও সামর্থ বিচার না করে, মোহবশে যে কর্ম করা হয় তাকেই তামসিক কর্ম বলা হয়।
আসক্তিহীন,অহংকার শূন্য, ধৈর্য্যশীল এবং উৎসাহযুক্ত -সিদ্ধি-অসিদ্ধিতে নির্বিকার কর্তাকে সাত্বিক কর্তা বলে। অনুরাগ পরায়ণ , কর্মফলাকাঙ্খী, লোভী, হিংসুক,অশুচি আনন্দ ও শোকযুক্ত কর্তাকে রাজসিক কর্তা বলা হয়। একাগ্রহীন,অবিনয়ী প্রতারক,মূঢ়, ক্রূর, বিষাদ যুক্ত অলস ও দীর্ঘসূত্রী কর্তাকে তামসিক কর্তা জানবে।
যে বুদ্ধির সাহায্যে মানুষ প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি, কার্য্য ও অকার্য্য, ভয় ও অভয় বন্ধন ও মুক্তি সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান লাভ করে, তাকে সাত্বিক বুদ্ধি বলা হয়। যে বুদ্ধির দ্বারা ধৰ্ম অধর্ম, কর্তব্য অকর্তব্য যথাযথ জ্ঞান হওয়া যায় না, তাই রাজসিক বুদ্ধি। যে বুদ্ধি দ্বারা ধর্মকে অধর্ম জ্ঞান হয়, কর্তব্যকে অকর্তব্য এইরূপ মিথ্যা জ্ঞান দান করে, তা তামসিক বুদ্ধি।
যে ব্যভিচারিণী ধৃতির সাহায্যে মন-প্রাণ ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া সকলকে সংযত করা হয় তাকে সাত্বিক ধৃতি বলে। যে ধৃতির দ্বারা ধর্ম অর্থ-কাম প্রধান বলে স্থির হয় ও যাতে ফালাকাঙ্ক্ষা জন্মে,তাকে রাজসিক ধৃতি বলে। যে ধৃতির দ্বারা অবিবেকী ব্যক্তি নিদ্রা-ভয়-শোক-বিষাদ ও গর্ব কখনো ত্যাগ করে না, সেটাই তামসী ধৃতি।
যা প্রথমে বিষের মতো মনে হয় - অথচ পরিণামে অমৃতের মতো মনে হয় , আত্মবুদ্ধির প্রসন্নতা জনিত সে সুখকে সাত্বিক সুখ বলে।
ইন্দ্রিয়-সহ বিষয় সংযোগে যে সুখ প্রথমে অমৃতের মতো মনে হয় কিনতু পরিণামে বিষের ন্যায় মনে হয় তাকে রাজসিক সুখ বলে।
যে সুখ প্রথমে ও পরিণামে সর্বদাই মোহ জন্মায়, নিদ্রা, আলস্য ও প্রমাদ হতে সৃষ্ট সে সুখ তামস।
পৃথিবীতে বা স্বর্গলোকে দেবগনের মধ্যেও এমন কেহ নেই যিনি প্রকৃতিজাত এই তিনটি গুন্ থেকে মুক্ত। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্রের কর্ম-সকল তাদের স্বভাব গুন্ অনুসারে ভাগ করা হয়েছে।মানসিক শান্তি, ইন্দ্রিয় দমন, তপস্যা, শুচিতা, ক্ষমা, সরলতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান এই নয়টি ব্রাহ্মণের স্বভাবজাত কর্ম। পরাক্রম, তেজ, ধৈর্য্য, দক্ষতা,যুদ্ধে অপলায়ান, দান ও সকলকে আয়ত্বে রাখার ক্ষমতা - এগুলো ক্ষত্রিয়ের গুন্। কৃষিকার্য, গো ইত্যাদি পশু পালন,বাণিজ্য এগুলো বৈশ্যের স্বভাব জাত কর্ম। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের সেবা করাই, শুদ্রের স্বভাব জাত কর্ম। আপন আপন কর্মে নিষ্ঠাবান ব্যক্তি কর্মে ব্যাপৃত থাকলে সিদ্ধিলাভ করে।
যার ইচ্ছেয় মানুষ কর্মে প্রেরণা লাভ করে ও যিনি সর্বব্যাপ্ত আছেন , তাকে উপাসনা করলে সর্বসিদ্ধি হয়। নিয়মিত ভাবে পরধর্ম অনুষ্ঠান করার চেয়ে, নিজ ধৰ্ম অঙ্গহীন হলেও প্রসংশনীয়। করেন মানুষ স্বাভাভি জাত কর্ম করলে পাপ ভোগী হয় না। সহজাত কর্ম দোষযুক্ত হলেও, ত্যাগ করা অনুচিত। করেন অগ্নি যেমন ধুম - আবৃত থাকে, তেমনি কর্ম দোষাবৃত থাকে। যিনি সকল বিষয়ে নিরাসক্ত, জিতেন্দ্রিয়, যার কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই, তিনি সন্যাসের সাহায্যে নিষ্কাম কর্ম ত্যাগ করে, সকল কর্ম বন্ধন মুক্ত হন।
শুদ্ধবুদ্ধি যুক্ত হয়ে, সাত্বিক ধৈর্য্য সহকারে। স্থির চিত্তে, সাব্দাদি বিষয় সমূহ ত্যাগ করে, রাগ দ্বেষ ত্যাগ পূর্বক নির্জনে মিতভোজী হয়ে, বাকি, মন, প্রভৃতিকে সংযত করে ধ্যান ও বৈরাগ্য আশ্রয় করে, অহংকার, বল, দর্প , কাম, ক্রোধ ও পরিগ্রহ পরিত্যাগী, এই রূপ মমতা ও বিক্ষেপ শুণ্য ব্যক্তি ব্রহ্ম সাক্ষাৎকার লাভ করেন। ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত, নির্মলচিত্ত ব্যক্তির শোক বা আকাঙ্খা নেই। সকল ভূতে সামা ভাবাপন্ন হয়ে আমাতে পরমাভক্তি লাভ করেন। সেই পরমভক্তির জন্য আমাকে সর্ব্যাপী ও সচ্চিদানন্দ স্বরূপ, তা জানতে পারেন। এবং তা জেনে জ্ঞান বশে আমাতেই প্রবেশ করেন। আমার শরণাপন্ন হয়ে সর্বদা সব প্রকার কর্ম করে, আমার প্রসাদে সর্বদা শাশ্বত অব্যয় পদ লাভ করেন। ......১৮/৫৬....
ভগবান বলছেন - তুমি মনের সাহায্যে আমা পরায়ণ হয়ে, মনে মনে সকল কর্ম আমাতে সমর্পণ করে, বুদ্ধিযোগ আশ্রয়ে অমতেই স্থির করো। আমাতে চিত্ত স্থির হলে, আমার কৃপায়, সব রকম দুর্গম পথ পার হতে সক্ষম হবে। আর যদি অহংকার বশে, আমার কথা না শোনো, তবে তুমি বিনষ্ট হয়ে যাবে। যদি অহংকার বশে যুদ্ধ করবো না বলে স্থির সংকল্প হও, কিন্তু জন্মজাত পূর্ব সংস্কার, তোমাকে যুদ্ধে উৎসাহিত করবে। মোহবশে যে কাজ তুমি করতে ইচ্ছা করছো না, তাও স্বভাব জাত আপন কর্মের বশে তোমাকে করতে হবে। সর্বজীবের হৃদয়ে বিরাজিত ঈশ্বর মায়ায় মোহিত করে, যন্ত্রের ন্যায় কাজ করাছেন বা ঘোরাচ্ছেন। সর্বপ্রকারে তুমি তারই শরণাপন্ন হও। তার প্রসাদে তুমি পরম শান্তি ও শাশ্বত নিত্যধাম প্রাপ্ত হবে। আমি তোমাকে গুহ্য থেকে গুহ্যতর জ্ঞান সম্পর্কে উপদেশ দিলাম। আমার দেওয়া জ্ঞানের সম্যক বিবেচনা পূর্বক - যা ইচ্ছে তাই করো।
শ্রী ভগবান অর্জুনকে বলছেন : তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়। তাই তোমার মঙ্গলের জন্য আমি আবার সবচেয়ে গুহ্যতম কথা তোমাকে বলছি - শোনো।
তুমি আমাগত চিত্ত হও। আমাকে ভক্তি করো। আমার পূজা করো। আমাকে নমস্কার করো। তাতে আমার প্রসাদে আমাকেই প্রাপ্ত হবে। তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়। সে জন্য তোমার কাছে আমি সত্য অঙ্গীকার করছি যে, অবশ্যই তুমি আমাকে পাবে। তুমি সকল ধৰ্ম ত্যাগ করে একমাত্র আমারি শরণাপন্ন হও, আমি তোমার সকল পাপ মুক্ত করবো।
আমার এই সকল কথা স্বধর্মানুষ্ঠানহীন, অভক্ত, শুশ্রূষা রহিত ব্যক্তিকে বলবে না। যে ব্যক্তি অসূয়া পরবশ হয়ে আমার নিন্দা করে, তাকে বোলো না। আমার ভক্তবৃন্দের কাছে, এই পরম গুহ্য কথা যে বলবে তিনি আমাতে সর্বোত্তম ভক্তি রেখে পরাগতি লাভ করবেন।
মানুষের মধ্যে তার চেয়ে আমার প্রিয় আর কেউ নেই,ভবিষ্যতেও হবে না। যে ব্যক্তি আমাদের এই ধর্মালোচনা অধ্যয়ন করবেন, তিনি জ্ঞানরূপ যজ্ঞ দ্বারা আমার পূজা করবেন। এটাই আমার মত। যে ব্যক্তি শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে, ঘৃণা দ্বেষ শুন্য হয়ে ইহা শ্রবণ করেন, তিনিও পাপ হতে মুক্ত হয়ে পুণ্যাত্মা গনের প্রাপ্য শুভলোক প্রাপ্ত হন।
ভগবান বলছেন : হে পার্থ অর্থাৎ অর্জুন তুমি একান্ত মনে আমার সকল কথা শুনেছো তো ? হে ধনঞ্জয় ! (ধনকে যিনি জয় করেছেন ) তোমার অজ্ঞান জনিত মোহ দূরীভূত হয়েছে তো ?
ভগবান মুখনিঃসৃত বাক্য শ্রী গীতায় আর নেই। এর পরে -
অর্জুন বলছেন : হে অচ্যুত ! তোমার প্রসাদে আমার মোহো দূর হয়েছে। আমি আমার আত্ম স্মৃতি ফিরে পেয়ে স্থির সংকল্প হয়েছি। আমার আর কোনো সংশয় নেই। এখন থেকে আমি তোমার বচন বা নির্দেশ পালন করবো।
এই অব্দি বলে সঞ্জয়, যিনি দিব্য দৃষ্টি-বলে এই অদৃশ্যপূর্ব ঘটনাবলী দেখছিলেন এবং রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে আনুপূর্বক বর্ণনা করছিলেন - তিনি বললেন : হে মহারাজ ! মহাত্মা বাসুদেব ও অর্জুনের এই অদ্ভুত রোমহর্ষক কথোপকথন আমি শুনলাম। ব্যাসের প্রসাদে আমি স্বয়ং যোগেশ্বের শ্রীকৃষ্ণের শ্রীমুখে এই অতিগুহ্য যোগের কথা শুনেছি। হে রাজন ! শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের সেই অতি অদ্ভুত বিশ্বরূপ স্মরণ করে, আমার মহা বিস্ময় হচ্ছে। আমি বার বার রোমাঞ্চিত কলেবর হচ্ছি। যেখানে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ,যেখানে ধনুর্ধার পার্থ, সেখানে শ্রী, জয়, ঐশর্য্য, নীতি বিরাজিত।এই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
সবার শেষে আমরা দুটি বিষয় নিয়ে একটু আলোচনা করবো।
প্রথমত শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন :
তুমি আমাগত চিত্ত হও। আমাকে ভক্তি করো। আমার পূজা করো। আমাকে নমস্কার করো। তাতে আমার প্রসাদে আমাকেই প্রাপ্ত হবে। তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়। সে জন্য তোমার কাছে আমি সত্য অঙ্গীকার করছি যে, অবশ্যই তুমি আমাকে পাবে। তুমি সকল ধৰ্ম ত্যাগ করে একমাত্র আমারই শরণাপন্ন হও, আমি তোমার সকল পাপ মুক্ত করবো।
সর্ব ধর্ম্নান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।
অহং ত্বাং সর্ব্বাপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ। (১৮/৬৬)
আমার ভিতরে প্রশ্ন জাগে,. অৰ্জুন কি কৃষ্ণের প্রতি নিজেকে সমর্পন করেছিলো ? যদি করে থাকে তবে কি তার সব পাপের ভার শ্রীকৃষ্ণ নিয়ে ছিলেন ? অর্থাৎ অৰ্জুন কি পাপমুক্ত অবস্থায় মৃত্যুর পরে, স্বর্গে গিয়েছিলো ?
সর্ব ধর্ম্নান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।
অহং ত্বাং সর্ব্বাপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ। (১৮/৬৬)
আমার ভিতরে প্রশ্ন জাগে,. অৰ্জুন কি কৃষ্ণের প্রতি নিজেকে সমর্পন করেছিলো ? যদি করে থাকে তবে কি তার সব পাপের ভার শ্রীকৃষ্ণ নিয়ে ছিলেন ? অর্থাৎ অৰ্জুন কি পাপমুক্ত অবস্থায় মৃত্যুর পরে, স্বর্গে গিয়েছিলো ?
অর্জুন কি গীতার উপদেশ বুঝেছিলো ? তাতে কি তার উন্নতি হয়েছিল ? অর্জুন ছাড়া অন্যান্য যারা শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান বলে শ্রদ্ধা ভক্তি করতো, তাদের দশা কি হয়েছিল ?
এতদিন ধরে আমার ধারণা ছিলো - ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, সব ধর্মমত অর্থাৎ হিন্দু, খ্রিস্টান, মুসলিম, জৈন, শিখ ইত্যাদি সব মত ছেড়ে শ্রীকৃষ্ণের পায়ে সমর্পন করো। তবে তিনিই সব দায়িত্ব নেবেন। সমস্ত পাপ থেকে আমাদের মুক্তি দেবেন। এখন মনে হয় ব্যাপারটা আদৌ তা নয়। জগতে ধর্ম্ম একটাই। আর সেটা হচ্ছে প্রকৃতির ধর্ম্ম। আর এই ধর্ম্ম সর্বত্র এক। সূর্যের কাজ আলো বিকিরণ , মেঘের কাজ জল বিতরণ, সর্বত্র সব কালে এক। ঈশ্বরও এক। কথাটা লক্ষ করুন "মামেকং" . অর্থাৎ আমি এক। কেউ কেউ এটাকে ব্যাখ্যা করেছেন মামেকং মানে একমাত্র আমাকে। আমি মনে করি, আমার স্মরণে এস মানে সেই একের স্মরণে যাও যা আমি। অর্থাৎ "আমির" স্মরণে যাও । অর্থাৎ নিজেকে স্মরণ করো। তুমি কে তা বুঝতে চেষ্টা করো। "আমি" যদি শ্রীকৃষ্ণ হয়, বা অন্য কেউ হয়, তবে সেটা তুমি হয়ে যাবে। আমি থাকবে না। আমি-তুমি বলে আসলে কিছু নেই। সবই এক। সেই একের স্মরণে যাও। গভীর গুহ্যকথা রয়েছে এই শ্লোকটিতে। পন্ডিতেরা যেমন আমাদের বুঝিয়েছেন, আমরা তেমন বুঝেছি। সেই মতো দেহধারী শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে আমরা নাচানাচি করছি। আমরা সবাই বৈষ্ণব বা বিষ্ণুর ভক্ত হয়ে পাপমুক্ত হতে চাইছি। এটা নিজেকে ধোকা দেওয়া ছাড়া কিছু নয়। আসলে আমি তুমি বলে কিছু নেই। আমি তুমি বোধ লোপ না পেলে সেই একের সাথে মেলা যাবে না। একই বা বলবো কেন ? এক থাকলে তো দুই থাকে। দুই থাকলে এক থাকে। সেই তুলনারহিত তিনি অদ্বিতীয়। দ্বিতীয় নাস্তি। সবই তিনি। আসলে ভগবানের এই শ্লোকে শরণাগতির কথা বলা হয়েছে। সেই পরমপিতা পরম-ঈশ্বরের শরণাগতির কথা বলা হয়েছে। দেহধারী কৃষ্ণ আসলে এক নাট্যমঞ্চের অভিনেতা। তিনি ভগবানের অভিনয় করছেন। আমরা নাট্যমঞ্চের অভিনেতাকে যদি সত্যিকারের রাজা ভাবি তবে ব্যাপারটা খুব মজার হবে। অবশ্য ভারতবর্ষে এটাই চলছে। রাবনের চরিত্রে যিনি অভিনয় করছেন তিনি ব্রাত্য। আর রামের চরিত্রে যিনি অভিনয় করছেন তিনি নমস্য। বিচিত্র এই দেশ। খেয়াল করুন ভগবান বলছেন সর্ব ধর্ম্মান পরিত্যজ্য - অর্থাৎ সব ধর্ম্মকেই ত্যাগ করুন। ধর্ম্ম টর্ন্ম দিয়ে কিছু হবে না। সব কিছু ত্যাগ করে আমি ব্যাটাকে ধরো। যে তোমাকে দিয়ে পাপ করাচ্ছে। যিনি পাপ করাচ্ছেন তিনিই বিমোচন করতে পারেন। আমিকে ধরলেই অহং অর্থাৎ আমি পালাবে। সেদিন তুমি পাপ-পূন্যের উর্দ্ধে বৃহতে লয় হবে। অদ্ভুত এই শ্লোক। বিরল এই কথা। মহামুনি ব্যাসদেবকে নমস্কার।
এতদিন ধরে আমার ধারণা ছিলো - ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, সব ধর্মমত অর্থাৎ হিন্দু, খ্রিস্টান, মুসলিম, জৈন, শিখ ইত্যাদি সব মত ছেড়ে শ্রীকৃষ্ণের পায়ে সমর্পন করো। তবে তিনিই সব দায়িত্ব নেবেন। সমস্ত পাপ থেকে আমাদের মুক্তি দেবেন। এখন মনে হয় ব্যাপারটা আদৌ তা নয়। জগতে ধর্ম্ম একটাই। আর সেটা হচ্ছে প্রকৃতির ধর্ম্ম। আর এই ধর্ম্ম সর্বত্র এক। সূর্যের কাজ আলো বিকিরণ , মেঘের কাজ জল বিতরণ, সর্বত্র সব কালে এক। ঈশ্বরও এক। কথাটা লক্ষ করুন "মামেকং" . অর্থাৎ আমি এক। কেউ কেউ এটাকে ব্যাখ্যা করেছেন মামেকং মানে একমাত্র আমাকে। আমি মনে করি, আমার স্মরণে এস মানে সেই একের স্মরণে যাও যা আমি। অর্থাৎ "আমির" স্মরণে যাও । অর্থাৎ নিজেকে স্মরণ করো। তুমি কে তা বুঝতে চেষ্টা করো। "আমি" যদি শ্রীকৃষ্ণ হয়, বা অন্য কেউ হয়, তবে সেটা তুমি হয়ে যাবে। আমি থাকবে না। আমি-তুমি বলে আসলে কিছু নেই। সবই এক। সেই একের স্মরণে যাও। গভীর গুহ্যকথা রয়েছে এই শ্লোকটিতে। পন্ডিতেরা যেমন আমাদের বুঝিয়েছেন, আমরা তেমন বুঝেছি। সেই মতো দেহধারী শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে আমরা নাচানাচি করছি। আমরা সবাই বৈষ্ণব বা বিষ্ণুর ভক্ত হয়ে পাপমুক্ত হতে চাইছি। এটা নিজেকে ধোকা দেওয়া ছাড়া কিছু নয়। আসলে আমি তুমি বলে কিছু নেই। আমি তুমি বোধ লোপ না পেলে সেই একের সাথে মেলা যাবে না। একই বা বলবো কেন ? এক থাকলে তো দুই থাকে। দুই থাকলে এক থাকে। সেই তুলনারহিত তিনি অদ্বিতীয়। দ্বিতীয় নাস্তি। সবই তিনি। আসলে ভগবানের এই শ্লোকে শরণাগতির কথা বলা হয়েছে। সেই পরমপিতা পরম-ঈশ্বরের শরণাগতির কথা বলা হয়েছে। দেহধারী কৃষ্ণ আসলে এক নাট্যমঞ্চের অভিনেতা। তিনি ভগবানের অভিনয় করছেন। আমরা নাট্যমঞ্চের অভিনেতাকে যদি সত্যিকারের রাজা ভাবি তবে ব্যাপারটা খুব মজার হবে। অবশ্য ভারতবর্ষে এটাই চলছে। রাবনের চরিত্রে যিনি অভিনয় করছেন তিনি ব্রাত্য। আর রামের চরিত্রে যিনি অভিনয় করছেন তিনি নমস্য। বিচিত্র এই দেশ। খেয়াল করুন ভগবান বলছেন সর্ব ধর্ম্মান পরিত্যজ্য - অর্থাৎ সব ধর্ম্মকেই ত্যাগ করুন। ধর্ম্ম টর্ন্ম দিয়ে কিছু হবে না। সব কিছু ত্যাগ করে আমি ব্যাটাকে ধরো। যে তোমাকে দিয়ে পাপ করাচ্ছে। যিনি পাপ করাচ্ছেন তিনিই বিমোচন করতে পারেন। আমিকে ধরলেই অহং অর্থাৎ আমি পালাবে। সেদিন তুমি পাপ-পূন্যের উর্দ্ধে বৃহতে লয় হবে। অদ্ভুত এই শ্লোক। বিরল এই কথা। মহামুনি ব্যাসদেবকে নমস্কার।
আমাদের কর্মফল তো কৃষ্ণে সমর্পন করলাম। কৃষ্ণের কর্মফল কে নিয়েছিল ? এ সব প্রশ্নের জবাব খুজবো, আমরা মহাভারতের অন্য্ অংশে।
অর্জুন বলছেন : হে অচ্যুত ! তোমার প্রসাদে আমার মোহো দূর হয়েছে। আমি আমার আত্ম স্মৃতি ফিরে পেয়ে স্থির সংকল্প হয়েছি। আমার আর কোনো সংশয় নেই। এখন থেকে আমি তোমার বচন বা নির্দেশ পালন করবো।
গীতাকথা এখানেই শেষ হলো - জয় শ্রীকৃষ্ণ, জয় শ্রী - জয় শ্রী সঞ্জয় - জয় মহামুনি ব্যাসদেবের জয়।
এবার আমরা শ্রীকৃষ্ণ চরিত্র সন্মন্ধে বোঝার চেষ্টা করবো।
আসলে আমার অনেক প্রশ্ন।আমাদের বাড়িতে একবার ইসকন সদস্যদের দিয়ে ভাগবত পাঠের অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেখানে ভাগবত শেষে, শ্রোতাদের কাছে, পাঠক জানতে চেয়ে ছিলেন, তাদের কোনো প্রশ্ন আছে কি না। তো, আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, মানুষতো ভগবানের পুজো অর্চনা করে, ভালো থাকার জন্য। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সবথেকে কাছের পাণ্ডবরা কি ভালো ছিল ? যারা তাকে ভগবান বলে বিশ্বাস করতো তখনকার যুগে, তারাও কি ভালো ছিল ? ভগবতপ্রেমী সেই ইসকনের সদস্য তখন তার নিজের নাক কান মুচড়ে দিলেন। আর মুখে বলতে লাগলেন - হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ।........ বলে রাগে গর্ গর্ করতে করতে উঠে গেলেন। এর পরেও এই সব প্রশ্ন নিয়ে যার যার কাছে জিগ্যেস করেছি, তারা সবাই আমাকে এড়িয়ে চলতেন। তাই অন্যকে জিজ্ঞেস করা ছেড়ে দিয়েছি। এখন জিজ্ঞেস করি নিজেকে।
শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান বলা হয় কেন ? তাকে পূর্নাবতার বলা হয় কেন ? যোগেশ্বর বলা হয়
কেন ? তার মধ্যে এত দ্বৈত ভাব কেন ? একটু একটু করে বোঝার চেষ্টা করি।
কেন ? তার মধ্যে এত দ্বৈত ভাব কেন ? একটু একটু করে বোঝার চেষ্টা করি।
কৃষ্ণনাম : কৃষ্ণ কথাটার মানে কালো। তার গায়ের রঙ-ও ছিল কালো। কালো মানে অন্ধকার। অন্ধকার সব সময় রহস্যময়। অন্ধকারই শূন্য, অর্থাৎ তাতে আমরা কিছুই দেখতে পাই না। আর শূন্যই পূর্ণ।
কৃষ্ণ কথাটার মানে আকর্ষণ। অর্থাৎ মাধ্যাকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। অর্থাৎ যার টানে সব কিছু কাছে চলে আসে। এ যেন চুম্বক। পাঁচ হাজারেরও বেশি সময় ধরে আমাদেরকে টানছে।
শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভাব বা জন্ম :
এবার আমরা শ্রীকৃষ্ণের জন্ম বা আবির্ভাবটা একটু দেখে নেই। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম দুর্যোগপূর্ণ অন্ধকার রাতে। নিজের হাত নিজে দেখা যায় না। বাইরে ঝড় বৃষ্টির প্রচণ্ড প্রতাপ। এরই মধ্যে ভগবান এলেন। দুর্যোগের রাতেই-তো আমরা ভগবানকে ডাকি। আর তিনি তখনি হাজির হন। কি অদ্ভুত না ? আসলে জন্ম তো অন্ধকারেই হয়। আমার ভিতরে যা জন্ম নেয় তাতো সব গভীরে, অন্ধকারে। ধ্যান, সমাধি জন্ম নেয় অন্ধকারে। বীজ থেকে অঙ্কুর জন্ম নেয় অন্ধকারে। জন্মতো অন্ধকারেই হয়, মায়ের পেটে। বাবাওতো অন্ধকারেই বীজ রোপন করেন। অন্ধকারেই সব কিছুর জন্ম। আর দুর্যোগপূর্ণ অন্ধকারেই ভগবান আসেন। শ্রীকৃষ্ণও এসেছেন। আমরা সবাই অন্ধকারেই জন্মাই। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
ভগবান এলেন কারাগারে শৃঙ্খলাবদ্ধ মায়ের কাছে। ভগবানতো ভগবান বুদ্ধের মতো রাজার পরিবারে আসতে পারতেন। তা তিনি এলেন না। তিনি এলেন কারাগারে শৃঙ্খলাবদ্ধ মা-বাবার কাছে। এখানেই পার্থক্য। ভগবান বুদ্ধ দুঃখের মুক্তি চেয়ে ছিলেন। জন্ম মৃত্যুর চক্রের বন্ধন থেকে মুক্তির জন্য নয়। ভগবান বুদ্ধ ভগবানের কাছে কাউকে যেতে বলেন নি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু বন্ধন মুক্তির জন্য এসেছিলেন। কাছে টেনে নিয়ে ছিলেন। তা সে তার তথাকথিত শত্রুই হোক আর তথাকথিত মিত্রই হোক। কংশ মুক্তি পেয়েছিল। শিশুপাল মুক্তি পেয়েছিলো। আর তা ছাড়া, আমরা তো কারাগারেই জন্মাই, কারাগারেই মারা যাই।কেউ কেউ অবশ্য মুক্তি পায়। তবে কোটিতে কটি ? আর জন্ম মানেই তো একটি সাময়িক বন্ধন। দেহের মধ্যে আসাই তো বড়ো বাঁধন। দেহই তো একটা কারাগার। দেহ ত্যাগ মানে বন্ধন থেকে মুক্তি।
আর একটা জিনিস আমরা কৃষ্ণের জন্মের পরে দেখি । তা হলো মৃত্যু ভয়। তাকে মেরে ফেলার জন্য কংসের সাথীরা সক্রিয় ছিল। জন্মের পরে মৃত্যু ভয় কার নেই ? জন্ম মানেই মৃত্যু অবসম্ভাবী। মৃত্যুর জন্য শুধু জন্মটাই দরকার। আর কোনো গুনের দরকার নেই। ঘর বাড়ি, বিছানা চাদর, জামা কাপড় নোঙর করার জন্য প্রয়াস করার দরকার নেই। ওটা এমনি এমনি হয়। বেঁচে থাকার জন্য লড়াই দরকার, মরার জন্য কোনো লড়াই দরকার নেই, কোনো প্রয়াস নেই। অদ্ভুত ব্যাপার, না চাইলেও পাওয়া যায়। যাকে আমরা জীবন বলি, সেটা তো শোভা যাত্রা। স্মশান যাত্রা। আমরা স্মশানের দিকে এগিয়ে চলেছি। কেউ কেউ তো প্রতিক্ষণ মরছি। দেহে তো প্রতিনিয়ত মৃত্যু যাত্রা চলছে। প্রতিক্ষণেই আমাদের দেহকোষের, জন্ম মৃত্যু চলছে। মৃত্যুমিছিল চলছে, একেই আমরা জীবন বলছি।বেঁচে থাকা বলছি। আশ্চর্য।
ভগবান গীতাতে বলছেন : যখনই ধর্মের হানি হয় তখন আমি আসি। ধর্মের রক্ষার জন্য অধর্মের নাসের জন্য আমাকে আসতে হয়। এই ব্যাপারে ভগবান রজনীশের (ওশো) কিছু বক্তব্য আমাকে আকৃষ্ট করে। তিনি কি ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন শুনুন।
সাধুদের রক্ষা করার জন্য ভগবানের কি সত্যিই দরকার ? কার রক্ষা করার দরকার - যে অনিশ্চয়তায় ভোগে। যে বিপন্ন, তার সুরক্ষা দরকার। নিজের অনিশ্চয়তায় যে সুরক্ষিত সেইই সাধু। যিনি স্ব-স্বরূপে স্থিত, তিনিই সাধু। যিনি স্ব-অধীন তিনিই সাধু। বিপদেও যে শান্ত, সেইই সাধু। সাধুর অর্থই হলো, যার কাছে কোনো অনিশ্চয়তা নেই। অথবা যে অনিশ্চয়তাকেই মেনে নিয়েছেন। ইনি ভবিষ্যতের অনিশ্চিয়তায় ভুগেন না। ভবিষ্যতের জন্য কিছু সঞ্চয় করেন না। যার সঞ্চয় নেই, তার রক্ষার চিন্তাও নেই। যিনি দেহাতীত, তার দেহ রক্ষার কোনো তাগিদ নেই। তাকে বাঁচানোর জন্য কৃষ্ণের কি দরকার ? এই কথাটা আমার কাছে বিস্ময়ের। যার কাছে এখনো অনিশ্চিয়তা, সে তো সাধুই হয় নি। যেদিন সাধু আর সাধু থাকবে না, সেদিন তাকে বাঁচানোর জন্য কৃষ্ণের দরকার পড়বে। অতয়েব সাধুকে বাঁচানোর জন্য কৃষ্ণকে আসার দরকার নেই।
আর একটা কথা বলছেন দুষ্টের দমনের জন্য অর্থাৎ মারার জন্য কৃষ্ণের প্রয়োজন। তাই তিনি এসেছিলেন। ভগবান নিজে জানেন, কাউকে মারা যায় না। দেহান্তরিত হয় মাত্র। অতয়েব দুষ্টকে মেরে দুষ্টমিকে খতম করা যায় না। দুষ্টকে মারার কাজ যে কেউ করতে পারে। সারা বিশ্বে দুষ্টকে শাস্তি দেবার জন্য আইন আছে, শাস্তির ব্যবস্থা আছে। তাতে কৃষ্ণের আসার দরকার নেই। আসলে দরকার দুষ্টদের রূপান্তর করা। আর এই কাজ সাধুদেরই করা উচিত।
আসলে সাধুরা মনে করে, আমাদের বাঁচানোর জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এসেছিলেন। তার মানে কি আমরা ধরে নেবো, এখন আর সাধু নেই, বা শ্রীকৃষ্ণের আগে সাধু ছিল না তাই শ্রীকৃষ্ণ আসেন না। দুষ্টরা মনে করতে পারে, আমাদের মারার জন্য ভগবান আসবেন। তাদের এই বোঝাটা ঠিক হতে পারে। কিন্তু সাধুদের রক্ষার জন্য ভগবান আসবেন, এটা ঠিক নয়। মনে রাখা দরকার, যে সাধু মনে করে, তার সুরক্ষার দরকার, সে সাধুই নয়। আর কেউ তো মারাই যায় না, মারা যেতেই পারে না, পুনর্জন্মে সে আবার আসবে, আর দুষ্টমি করবে। তাই দুষ্টদের বিনাশের জন্য শ্রীকৃষ্ণ এসেছিলেন, একথাটাও ঠিক নয়।
আসলে তথাকথিত সাধুরা এই ভেবে তৃপ্তি পায় মাত্র। বাস্তিবক পক্ষে, অন্তর যদি পরিশুদ্ধ হয়ে থাকে, তবে দুষ্টকেও বন্ধু মনে হবে। আমরা লোকনাথবাবাকে জানি, তার আশ্রমে একটা হিংস্র সাপ এসে দুধ খেয়ে যেত। আমরা ভগবান শঙ্করকে দেখেছি, তার কাছে হিংস্র বাঘ এসে শুয়েছিল। দেওঘরে, এক সাধুর (নামটা ভুলে গেছি) আশ্রম আছে, তাকে নাকি দুটো বাঘ পাহারা দিতো। যে কষ্ট দেয়, তাকে শত্রূ মনে করা সাধুর কাজ নয়। সাধুর অর্থই হলো, কাউকে শত্রূ মনে না করা। তাকে কষ্ট দিলেও শত্রূ মনে হবে না। আসলে তথাকথিত সাধুরা বসে বসে এই সব ভাবে। আমি বলবো, যারা সাধুর বেশ ধরে আছে, তারা ভাবে, যে আমাদের রক্ষার জন্য ভগবান আসবেন। তারা জানেনা, এই শ্লোক দ্বারা তথাকথিত সাধুদের উপহাস করা হয়েছে। অথবা এটা কবি কল্পনা মাত্র। আর সত্যি সত্যি ভগবান যদি এটা বলে থাকেন, তবে জানবেন এর কোনো গভীর অর্থ আছে। যা আমি জানিনা।
আর একটা কথা বলছেন যুগে যুগে আমি আসি। যুগে যুগে আমি আসি - এমন কথা কে বলতে পারে ? যিনি স্বাধীন। এই প্রকৃতির জগতে কেউ স্বাধীন নয়। সবই প্রকৃতির অধীন। কারণের অধীন। এমনকি ভগবান, যখন প্রকৃতির আশ্রয় নেন, তখন তিনিও প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলেন, চলতে বাধ্য হন। তাহলে ভগবান কখন আসেন ? আর কেনোই বা আসেন ? আমরা সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজবো।
ভগবানের, অর্থাৎ কৃষ্ণের মতো ব্যক্তিত্বের জন্ম যে কোনো সময় হতে পারে। সব পরিস্থিতিই তার পক্ষে অনুকূল। এমন কোনো পরিস্থিতি নেই, যখন তিনি আসতে পারেন না। আবার, কোনো বিশেষ কাল বা পরিস্থিতি, কৃষ্ণের মতো মানুষের জন্মের অপেক্ষায় থাকে না। কোনো কারন ছাড়াই কৃষ্ণের মতো মহামানবের জন্ম হতে পারে। চেতন পুরুষের জন্য সর্ব কাল-ই সমান। অচেতন ব্যক্তির জন্মের জন্য কালের অপেক্ষা প্রয়োজন। চেতন পুরুষ সর্বকালে, সর্ব পরিস্থিতিতে আসতে পারেন। অচেতন পুরুষ পরিস্থিতির দাস। চেতন পুরুষ পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে করে নেন। সময় তাকে অনুসরণ করে, তিনি সময়কে অনুসরণ করেন না। তিনি সময়ের পিছনে থাকেন না। সময় তার পিছনে থাকে। এমন ভাবার কোনো কারন নেই যে খারাপ সময় না হলে তিনি আসবেন না। এই ধরনের ভাবনাটাই ভুল। খারাপ সময় মানে কি ? আমাদের পক্ষে, আমাদের মতো অ-সাধুদের পক্ষে, যারা নিজেদেরকে সাধু বলে ভাবতে চাই, এমন লোকের পক্ষে খারাপ, সেই সময় শ্রীকৃষ্ণের মতো ব্যক্তিত্বের আগমন হয়। ব্যাপারতা আদৌ তা নয়। আমাদের প্রয়োজনে আদৌ শ্রীকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেন না। আমরা মনে করি, আমাদের রক্ষার জন্য, আমাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ভগবান আসেন। তার জন্মকে আমরা অন্য ভাবে দেখি না, দেখতে চাই না। অর্থাৎ ভাবখানা এমন যেন, দেখ আমি কত গুরুত্বপূর্ণ, আমাকে রক্ষা করার জন্য ভগবান স্বয়ং এসেছেন।
যদি রাস্তার পাশে, গাছে ফল হয়, আমি ভাবি আমার জন্য হয়েছে।আমি তার আস্বাদন পেতে চাই। রাস্তার পাশের বাগানে যদি ফুল ফোটে, আমি ভাবি, আমার জন্য ফুটেছে। যদি গন্ধ ছড়ায়, আমি তা গ্রহণ করি, আর ভাবি, আহা কি সুন্দর গন্ধ। কিন্তু ফলের গাছ, বা তার ফল যে কোনো জায়গায় হতে পারে। আমার যাবার রাস্তায় নাও হতে পারে। ফুল আমার জন্য গন্ধ দেয় না। আমি ফুলের গন্ধ উপভোগ করি মাত্র। ফল আপন খেয়ালে ফলে, বীজকে সুরক্ষিত রাখার জন্য। আমরা ভাবি আমার খাবার জন্য হয়েছে। এটা আমার বিচার মাত্র, বলা যায়, আমার স্বার্থে, আমি বিচারকে প্রভাবিত করি।একটা পিঁপড়েও আমার জন্য জন্মায় না। এমনকি আমার সন্তানও আমার জন্য জন্মায় না। ফুল কারুর জন্য ফোটে না। নিজের জন্য ফোটে, অন্য কেউ তার গন্ধ পেতে পারে। তাতে তার কিছু এসে যায় না। কৃষ্ণের মতো মানুষও কারুর জন্য জন্মায় না। নিজের জন্য, নিজের আনন্দে জন্মায় , তাতে কারুর উপকার হতে পারে, কিন্তু তাতে তার কিছু এসে যায় না। এমন কোনো সময় আছে, এমন কোনো যুগ আছে, যখন কৃষ্ণ জন্মালে আমাদের উপকার হবে না? সব যুগেই কৃষ্ণকে দরকার। তারা সমস্ত যুগেই নিজের কাজে ব্যস্ত, আমরা ভাবি আমাদের জন্য এসেছেন, আমাদের জন্য করছেন। বিরাট শিশুরা আপন মনেই খেলে, আপন মনেই ভাঙে/গড়ে । আমরা কি ভাবে দেখছি, সেটা আমাদের ব্যাপার। দুঃখ ছিল না, এমন কোনো সময় নেই, দুঃখ থাকবে না এমন কোনো সময় হবে না। কৃষ্ণের মতো মানুষ সব যুগেই কাজে লাগবে। অসুর চিরকাল ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কৃষ্ণ এসেছিলো বলে সবাই শেষ হয়ে গেছে তা কিন্তু নয়। তারা আজও আছে। মহাভারতের যুদ্ধের পরেও ছিল। কৃষ্ণ বর্তমান থাকতেই ছিল। শকুনির ছেলে উলুখা অর্থাৎ গান্ধারীর ভাই, বা দুর্যোধনের মামাতো ভাইতো ভীমকে শান্তি প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে, যুদ্ধে আহ্বান করেছিল। আসলে সবই থাকে। আমরা আসলে সবকিছু, আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি। আমাদের কোনটা কাজে লাগবে আর কোনটা কাজে লাগবে না। আমাদের একটা সীমারেখা আছে। আমরা সব কিছুর মধ্যে আমাদের উপযোগিতার কথা ভাবি। আমার কোনটা কাজে লাগবে আর কোনটা কাজে লাগবে না। যেটা আমার কাছে কাজে লাগবে না, তার কোনো মূল্য আমাদের কাছে নেই। কিন্তু, ভগবানকে উপযোগিতার মধ্যে খুঁজতে গেলে, তাকে পাওয়া যাবে না। সূর্য উত্তাপ দেয় আপনার উপযোগিতার ভেবে নয়। এটা তার স্বভাব। মেঘ বৃষ্টি দান করে, আপনার কথা ভেবে নয়। এটা তার স্বভাব। বাতাস আপন মনে বয়ে চলে। আপনি তার কাছ থেকে কি নেবেন, আর কি নেবেন না এটা আপনার বিষয়। মেঘ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টির জল মাঠের চাষের কাজে লাগাবেন, না আপনার তৃষ্ণা মেটাবেন এটা আপনার ব্যাপার। এতে মেঘের কিছু এসে যায় না। তাই একথা ভাবা ঠিক নয়, কৃষ্ণ আমাদের কারুর জন্য জন্মে ছিলেন। তিনি না সাধুর না অসাধুর। তুমি তার কাছ থেকে কি পাচ্ছো, কি পাচ্ছো না সেটা তোমার ব্যাপার। মানুষ ভাবে, তার অহংকে কেন্দ্র করে। সে ভাবে, কৃষ্ণ জন্মায় আমাদের জন্য, ফুল ফোটে আমাদের জন্য, সূর্য কিরণ দেয় আমাদের জন্য। চাঁদের আলো আমাদের জন্য। মেঘের বৃষ্টি আমাদের জন্য। ব্যাপারটা উল্টো ওদের জন্য, অর্থাৎ সূর্যের জন্য, চাঁদের জন্য, মেঘের জন্য, নদীর জন্য, পাহাড়ের জন্য, সমুদ্রের জন্য আমরা বেঁচে আছি। ওঁরা আমাদের জন্য আসেও না, যায়ও না। তাই কৃষ্ণ সাধুদের জন্য এসেছিলো, এর থেকে হাস্যকর কথা আর কিছু হতে পারে না। ভগবানের রসিকতা। আসলে মহাপুরুষের জন্মের বহু পরে তার সম্পর্কে লেখা হয়। তার কথা লেখা হয়। অনেক প্রচিলিত কাহিনী, কবি তার নিজের ভাষাতে লেখে। ভগবানের মুখে সেই কথা গুলো বসায়, যা সে বিশ্বাস করে, যা সে ভগবানের কাছে পেতে চায়। তাই ভগবান কি বলেছিলো, এটা বড়ো কথা নয়, আমি ভগবানকে দিয়ে কি বলাতে চাই, ভগবানের কাছে কি শুনতে চাই, তাই ভগবানের মুখে বসাই। এতে অবশ্য ভগবানের কিছু আসে যায় না। ভগবান আপন খেয়ালে লীলা করেন। আমি যা দেখতে চাই, তাই দেখি, যা শুনতে চাই তাই শুনি। সূর্য উঠলে আপনি বাড়ী বসে আলো পাবেন, সেই আলো, সেই উত্তাপ আপনি কি ভাবে ব্যবহার করবেন, সেটা আপনার ব্যাপার।গরিবের ঘরেও যাবেন, বড়োলোকের ঘরেও যাবেন। আপনি নিজেকে আড়াল করবেন কিনা সেটা আপনার ব্যাপার। তবে এটাও বলি ওই আড়ালও তারই লীলা। ভগবান কোনো বিরোধিতা করবে না, আবার সংগতও করবে না। তার খেলা সে খেলবে। ভগবান কারুর জন্য আসেন না, কারুর জন্য আসা বন্ধও করেন না। পরিস্থিতি তাকে জন্মায় না। তিনিই পরিস্থিতির জন্ম দেন।
পরিস্থিতির কথা যখন এলো, একটা কথা বলি, আমরা পরিস্থিতির দাস। সামাজিক পরিস্থিতি, পরিবেশ, ব্যক্তির ব্যক্তিস্বত্বাকে বা ব্যক্তিত্বকে জন্ম দেয়।পরিবেশ মানুষকে খারাপ করে, পরিবেশ মানুষকে ভালো করে। পরিস্থিতি মানুষকে উন্নতিতে সাহায্য করে।এইসব কথা দুর্বলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কৃষ্ণের মতো ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়। কোনো পরিস্থিতিই কৃষ্ণকে জন্ম দিতে পারে না। কোনো পরিস্থিতিই কৃষ্ণের জন্মের জন্য আবশ্যক নয়। এমন কোনো পরিস্থিতিই নেই যা কৃষ্ণের মতো ব্যক্তির জন্ম দিতে পারে। কৃষ্ণ শুধু জন্মায়। আর পরিস্থিতি তার পিছন পিছন যায়।কৃষ্ণ যখন জন্মায় তখন সমাজ তার পিছন পিছন চলে। কৃষ্ণ সমাজের পিছে চলে না। এটাই ভগবান আর সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্য। মহাপুরুষ পথ দেখান, পথ তৈরি করেন। আমরা পথের দাস, ওঁরা পথের স্রষ্টা। আমরা পরিস্থিতির দোহাই দেই। ওঁরা পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে আনেন। আমরা পথ খুঁজি তাই কষ্ট পাই। আর ওঁরা যেখান দিয়ে যান সেটাই পথ হয়ে যায়। ওঁরা আনন্দে ঘুরতে বেরোন, আমরা উদ্দেশ্য নিয়ে ঘুরে বেড়াই। তাই না পাবার বেদনা আমাদের, ওনাদের ঘোরাতেই আনন্দ। তাই সদাই আনন্দে থাকেন। আমরা উদ্দেশ্যপূরণের ব্যর্থতা নিয়ে হতাশ, উনি বেড়ানোর আনন্দে মশগুল। ভগবানের জন্ম কার্যকারণের উর্ধে। ভগবান আমাকে পথ দেখিয়েছেন, মানে এই নয় যে উনি আমাকে পথ দেখাবার জন্য জন্মে ছিলেন, আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম, উনি দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি পথের সন্ধান চেয়ে ছিলাম, উনি বলে দিয়েছিলেন। উনি আমার জন্য পথে দাঁড়িয়েছিলেন তা নয়, উনি ছিলেন তাই বলে দিলেন।
চেতনা চিরকালই স্বাধীন। তাকে কেউ বাঁধতে পারে না। একটা গল্প শুনেছিলাম, এই গল্পটা দিয়ে শেষ করবো। : এক জ্যোতিষী খুব নাম করেছে। সে নাকি যা বলে তাই খেটে যায়। এক সন্দিহান যুবকের মনে দুষ্ট বুদ্ধি এলো। সে জ্যোতিষীকে মিথ্যা প্রমান করার জন্য শীতের রাতে, চাদরের মধ্যে একটা পায়রাকে লুকিয়ে নিয়ে, গ্রামবাসীদের নিয়ে চললো জ্যোতিষীকে মিথ্যা প্রমান করবার জন্য। জ্যোতিষী বাড়ির ভিতরে ছিল। ছেলেটি বাইরে থেকে জিজ্ঞেস করলো, আমি একটা পায়রা নিয়ে এসেছি। বলুনতো পায়রাটা মৃত না জীবিত। ছেলেটি ভেবেছিলো, জ্যোতিষী যদি বলে মৃত তাহলে, জীবিত পায়রা বের করে দেখাবো। আর যদি বলে জীবিত তাহলে, চাদরের মধ্যেই পায়রাটাকে মেরে দেখাবো, যে পায়রাটি মৃত। জ্যোতিষী কিন্তু মজার জবাব দিলো : বললো পায়রা তোমার হাতে,তার প্রাণ ও তোমার হাতে। তোমার যা ইচ্ছা তাই করো। তাই জীবন আমাদের হাতে। আমি কি ভাবে বাঁচবো সেটা আমাদেরই ঠিক করে নিতে হবে। কৃষ্ণের মতো মহামানবের জীবন তো পুরোপুরি তারই হাতে।বাসনা থেকেই জন্ম। আমাদের জন্ম ভোগের জন্য। ভগবানের জন্ম ভোগাতীত। তিনি কাউকে বাঁচাবার জন্য জন্মান না। হ্যাঁ কেউ যদি বেঁচে যায়, সেটা আলাদা কথা। ফুল ফোটে আপন খেয়ালে। হ্যাঁ আপনি সুগন্ধ পান সেটা আলাদা কথা। মেঘ আপন মনে ভেসে বেড়ায়।নদী আপন মনে বয়ে যায়। বাতাস আপন খেয়ালে চলে।সূর্য তার গতিপথে প্রতিনিয়ত চলছে। তার সকালও নেই, সন্ধ্যাও নেই। আমরা কেবল সকাল-সন্ধ্যা দেখি। আমরা কারনের জন্য বেঁচে আছি।আমরা ভালোবাসি, তারও কারন আছে। আমরা কারন খুঁজি, তাই কারন দেখি। প্রকৃতি অকারনেই সব দিচ্ছে। ভগবান অকারণেই আসছে, যাচ্ছে। আমরা আমাদের মতো কারন আরোপ করছি। যেদিন সব কারন ভুলে যাবো, সেদিনই ভগবান আসবেন।
পরিস্থিতির কথা যখন এলো, একটা কথা বলি, আমরা পরিস্থিতির দাস। সামাজিক পরিস্থিতি, পরিবেশ, ব্যক্তির ব্যক্তিস্বত্বাকে বা ব্যক্তিত্বকে জন্ম দেয়।পরিবেশ মানুষকে খারাপ করে, পরিবেশ মানুষকে ভালো করে। পরিস্থিতি মানুষকে উন্নতিতে সাহায্য করে।এইসব কথা দুর্বলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কৃষ্ণের মতো ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়। কোনো পরিস্থিতিই কৃষ্ণকে জন্ম দিতে পারে না। কোনো পরিস্থিতিই কৃষ্ণের জন্মের জন্য আবশ্যক নয়। এমন কোনো পরিস্থিতিই নেই যা কৃষ্ণের মতো ব্যক্তির জন্ম দিতে পারে। কৃষ্ণ শুধু জন্মায়। আর পরিস্থিতি তার পিছন পিছন যায়।কৃষ্ণ যখন জন্মায় তখন সমাজ তার পিছন পিছন চলে। কৃষ্ণ সমাজের পিছে চলে না। এটাই ভগবান আর সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্য। মহাপুরুষ পথ দেখান, পথ তৈরি করেন। আমরা পথের দাস, ওঁরা পথের স্রষ্টা। আমরা পরিস্থিতির দোহাই দেই। ওঁরা পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে আনেন। আমরা পথ খুঁজি তাই কষ্ট পাই। আর ওঁরা যেখান দিয়ে যান সেটাই পথ হয়ে যায়। ওঁরা আনন্দে ঘুরতে বেরোন, আমরা উদ্দেশ্য নিয়ে ঘুরে বেড়াই। তাই না পাবার বেদনা আমাদের, ওনাদের ঘোরাতেই আনন্দ। তাই সদাই আনন্দে থাকেন। আমরা উদ্দেশ্যপূরণের ব্যর্থতা নিয়ে হতাশ, উনি বেড়ানোর আনন্দে মশগুল। ভগবানের জন্ম কার্যকারণের উর্ধে। ভগবান আমাকে পথ দেখিয়েছেন, মানে এই নয় যে উনি আমাকে পথ দেখাবার জন্য জন্মে ছিলেন, আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম, উনি দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি পথের সন্ধান চেয়ে ছিলাম, উনি বলে দিয়েছিলেন। উনি আমার জন্য পথে দাঁড়িয়েছিলেন তা নয়, উনি ছিলেন তাই বলে দিলেন।
চেতনা চিরকালই স্বাধীন। তাকে কেউ বাঁধতে পারে না। একটা গল্প শুনেছিলাম, এই গল্পটা দিয়ে শেষ করবো। : এক জ্যোতিষী খুব নাম করেছে। সে নাকি যা বলে তাই খেটে যায়। এক সন্দিহান যুবকের মনে দুষ্ট বুদ্ধি এলো। সে জ্যোতিষীকে মিথ্যা প্রমান করার জন্য শীতের রাতে, চাদরের মধ্যে একটা পায়রাকে লুকিয়ে নিয়ে, গ্রামবাসীদের নিয়ে চললো জ্যোতিষীকে মিথ্যা প্রমান করবার জন্য। জ্যোতিষী বাড়ির ভিতরে ছিল। ছেলেটি বাইরে থেকে জিজ্ঞেস করলো, আমি একটা পায়রা নিয়ে এসেছি। বলুনতো পায়রাটা মৃত না জীবিত। ছেলেটি ভেবেছিলো, জ্যোতিষী যদি বলে মৃত তাহলে, জীবিত পায়রা বের করে দেখাবো। আর যদি বলে জীবিত তাহলে, চাদরের মধ্যেই পায়রাটাকে মেরে দেখাবো, যে পায়রাটি মৃত। জ্যোতিষী কিন্তু মজার জবাব দিলো : বললো পায়রা তোমার হাতে,তার প্রাণ ও তোমার হাতে। তোমার যা ইচ্ছা তাই করো। তাই জীবন আমাদের হাতে। আমি কি ভাবে বাঁচবো সেটা আমাদেরই ঠিক করে নিতে হবে। কৃষ্ণের মতো মহামানবের জীবন তো পুরোপুরি তারই হাতে।বাসনা থেকেই জন্ম। আমাদের জন্ম ভোগের জন্য। ভগবানের জন্ম ভোগাতীত। তিনি কাউকে বাঁচাবার জন্য জন্মান না। হ্যাঁ কেউ যদি বেঁচে যায়, সেটা আলাদা কথা। ফুল ফোটে আপন খেয়ালে। হ্যাঁ আপনি সুগন্ধ পান সেটা আলাদা কথা। মেঘ আপন মনে ভেসে বেড়ায়।নদী আপন মনে বয়ে যায়। বাতাস আপন খেয়ালে চলে।সূর্য তার গতিপথে প্রতিনিয়ত চলছে। তার সকালও নেই, সন্ধ্যাও নেই। আমরা কেবল সকাল-সন্ধ্যা দেখি। আমরা কারনের জন্য বেঁচে আছি।আমরা ভালোবাসি, তারও কারন আছে। আমরা কারন খুঁজি, তাই কারন দেখি। প্রকৃতি অকারনেই সব দিচ্ছে। ভগবান অকারণেই আসছে, যাচ্ছে। আমরা আমাদের মতো কারন আরোপ করছি। যেদিন সব কারন ভুলে যাবো, সেদিনই ভগবান আসবেন।
-------------------------------------------------------------------
মহাভারতের যুদ্ধ :
আমার অনেক বার মনে হয়েছে : যুদ্ধ তো অশান্তির উৎপাদক। যুদ্ধ না হলে ভালো হতো। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বর্তমান থাকতে, এই যুদ্ধ কেন হলো? আমরা শান্তি চাই, লড়াই চাই না। শান্তির জন্যইতো আমরা ভগবানের দ্বারস্থ হই। সেই ভগবানই যদি যুদ্ধ যুদ্ধ করেন, বা যুদ্ধ না থামাতে পারেন, তাহলে ভগবানের কাছে আমাদের প্রত্যাশা ধাক্কা খায়। যুদ্ধও হয়।
আসলে, পৃথিবীটা দ্বন্দে ভরা। পৃথিবীটা ভালো মন্দের সম্মিলিত
No comments:
Post a Comment