Monday, 23 December 2019

ধ্যানের ধারাভাষ্য

ধ্যানের গভীরে 

যদিও বাক্যের  মাধ্যমে ধ্যানের মধু পান করা যাবে  না। স্বয়ং পান করে  দেখতে হবে । যিনি কোনোদিন ধ্যানস্থ হতে পারেন নি, তাকে ধ্যানের গভীরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ধ্যান কখনো কাউকে দিয়ে করানো যায় না, ধ্যান শেখানো যায় না, ধ্যান শুধু হয়। যার সেই অভিজ্ঞতা হয় নি, তাকে আগ্রহী করে তোলা, বা কৌতুহলী করে তোলাই আমাদের এই বক্তব্যের  উদ্দেশ্য। 

প্রথম প্রথম আমরা যখন ধ্যান করতে বসি, তখন  নানানরকম চিন্তা আমাদের মাথার মধ্যে আসে। একটু লক্ষ করলেই দেখবেন, সেই চিন্তাগুলোর অধিকাংশ হচ্ছে, সাম্প্রতিক ঘটনার বিচ্ছিন্ন অংশ। অথবা তার পরিবর্ধিত সংস্করণ মাত্র । অর্থাৎ কল্পনার সাহায্যে চিন্তার মধ্যে আপনি ঘটনাকে এগিয়ে নিয়ে যান। ঘটনার সময়ে যে কথাগুলো আপনি বলতে পারেন নি, আপনার ভাবনার মধ্যে আপনি সেই সব কথাগুলো নিজের মুখে বসিয়ে দেবেন।
যদি একটু বেশিদিন ধরে আপনি ধ্যানের  অভ্যাস করেন, তবে দেখতে পাবেন, দু-চার মাস আগের ঘটনা ভেসে উঠছে, আপনার চিন্তার স্রোতে।
যদি আরো বেশিদিন ধরে যদি ধ্যানে নিযুক্ত থাকেন, তবে দেখবেন, কয়েক বছরের আগের ঘটনা ভেসে আসছে আপনার চিন্তার মধ্যে ।
যত  বেশিদিন ধ্যানের অভ্যাস করেন, বা আপনার ধ্যানের  গভীরতা যত  বাড়বে, তখন একসময় দেখবেন , আপনার ছোটবেলার ঘটনা চিন্তার স্রোতের  মধ্যে ভেসে উঠছে। অর্থাৎ ধ্যান যত  দীর্ঘায়িত হবে, তত আপনার  পুরোনো দিনের কথা মনের মধ্যে উঠতে থাকবে। অর্থাৎ আপনার অবচেতন মনে যে সব পুরোনো সংস্কার চাপা পড়েছিল, সেগুলো ধীরে ধীরে ভেসে উঠবে। আপনার ভিতরে যেসব স্মৃতি,  লেখা হয়ে রয়েছে, সেই স্মৃতির পাতা আপনা আপনি ওল্টাতে শুরু করবে। সংস্কারের বিভিন্ন স্তরের উন্মেষ ঘটতে শুরু করবে । এর মধ্যে আর একটা জিনিস লক্ষ করতে থাকবেন, অনেক জানা- অজানা জায়গা, চেনা-অচেনা  চিত্র, বা মূর্তি  আপনার মনের স্তরে ভেসে উঠবে, যেখানে আপনি হয়তো কখনো যান নি, অথবা গেলেও আপনার সে সব মনে নেই, সেইসব জানা-অজানা, চেনা-অচেনা  দৃশ্যপট, বা মূর্তি আপনার মধ্যে ভেসে উঠবে। অর্থাৎ আপনি জেগে থেকে যেন স্বপ্ন দেখছেন।
ধ্যানের  কাজ হচ্ছে, এই চিন্তাস্রোতকে ধরা। অর্থাৎ অবচেতন  মনের বৃত্তি-গুলোকে ধরা। আপনার অবচেতন মনের স্তরে যে স্মৃতিগুলো জমাট বেঁধে আছে, সেগুলোকে পর্যবেক্ষনের সাহায্যে সংস্কার করাই প্রাথমিক ভাবে ধ্যানের  উদ্দেশ্য ।    

যারা ধ্যানে অভ্যস্থ হয়ে গেছেন, তারা এইসব চিন্তা উঠবার সঙ্গে সঙ্গে চাপা দিয়ে দেন। অর্থাৎ যাদের মন শান্ত হয়ে গেছে, তার এইসব চিন্তা উঠবার সঙ্গে সঙ্গেই সতর্ক হয়ে যান, এবং চিন্তাগুলোকে চাপা দিয়ে দেন।  কিন্তু যাদের মন এখনো শান্ত হয়নি, তারা প্রথম দিকে এই চিন্তাগুলোকে ধরতে পারেন না। অর্থাৎ চিন্তার স্রোত যে বইছে তার মধ্যেই  নিবদ্ধ থাকেন। খানিকক্ষণ চিন্তাদৃশ্য দেখবার  পরে, হঠাৎ মনে হয়, তিনি অপ্রয়োজনীয় চিন্তার মধ্যে প্রবেশ করেছেন। অর্থাৎ ধ্যান হচ্ছে না। আর   তিনি  টের পান যে তিনি ইষ্ট  থেকে দূরে চলে গেছেন। অর্থাৎ ধারণার বিষয় থেকে তিনি অন্যত্র চলে গেছেন। ধারণার বিষয় অর্থাৎ গুরুদেব বা মূর্তি, বা বিশেষ চিহ্ন বা আলোর বিন্দু, আমারদের ইষ্টের বিষয় যাই হোক না কেন, সেখান থেকে দূরে সরে গেছি।

এইভাবে, ধ্যানকালীন সময়ে, যখন আমরা ধরতে পারি, যে আমরা ইষ্ট  থেকে আমরা  দূরে চলে গেছি, তখন আমাদের কাজ হচ্ছে, চিন্তার ধারাটিকে ধরবার চেষ্টা করা। চিন্তার উৎস খোঁজার চেষ্টা করা উচিত। বোঝার চেষ্টা করা উচিত,  চিন্তাটি কোথা থেকে আসছে। এইভাবে চিন্তাকে ধরেই চিন্তার উৎসে যাবার চেষ্টা করতে হয় । এইবার একটু  খেয়াল করুন, চিন্তার উৎসে যাবার আগেই দেখবেন , চিন্তা সরে সরে যাচ্ছে, একটার পর আর একটা চিন্তা উঠে আসছে। এবারে আমাদের কাজ হচ্ছে, চিন্তা গুলোকে পর পর সাজানো। এবং এই চিন্তাগুলোকে সাজালে লক্ষ্য করবেন, প্রত্যেকটি চিন্তার মধ্যে একটা বিষয়  আছে, যেটা অন্য চিন্তার মধ্যেও আছে। অর্থাৎ প্রত্যেক ভাবনার মধ্যে একটা সাধারণ ভাব আছে। এই সাধারণ ভাবটি, অর্থাৎ যা প্রত্যেক ভাবনার মধ্যে আছে, সেটাই  হচ্ছে আমাদের অবচেতন মনের বৃত্তি। এবং এই বৃত্তি সাধককে ইষ্ট থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। এইজন্য আমাদের উচিত ধ্যানের  সময় আমাদের মনের চিন্তা বা বৃত্তিগুলোকে  বিশ্লেষণ করা। আমাদের মনের এই বৃত্তিগুলোকে বিচার বিশ্লেষণ করা। এটা করতে থাকলে দুই-এক মাসের মধ্যেই আমরা আমাদের অবচেতন মনের বৃত্তি ও চেতন মনের বৃত্তিগুলিতে কি পার্থক্য তা বুঝতে পারবো।  এইবার আমাদের কাজ হচ্ছে, এই দুই বৃত্তির মধ্যে একটা সামঞ্জস্য বা সাযুজ্য আনা।

মনটাকে লক্ষ করুন, কখনোই সে নিজেকে নিয়ে আবার কখনো অন্যকে নিয়ে সে চিন্তা করছে। কখনো অতীত নিয়ে চিন্তা করছে, কখনো ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছে, কখনো বর্তমান নিয়ে চিন্তা করছে। কখনো স্মৃতি, কখনো কল্পনা। আর এইসব চিন্তাগুলোই, আপনাকে ইষ্টে স্থির হতে দিচ্ছে না।

মনের এই বৃত্তিগুলোকে আপনি যদি ধরতে পারেন, তবে দেখবেন , এগুলো আর কিছুই না, আমার ভিতরের রাগ, হিংসা, ঈর্ষা, কামনা, বাসনা, অহংকার। এগুলোকে দমিয়ে রাখলে, আপাতত এগুলো চলে যাবে সত্য, কিন্তু ক্ষাণিকক্ষন পরেই আবার উদয় হবে। তাই এগুলো সম্পর্কে আপনি নির্লিপ্ত থাকুন, দেখবেন, কিছুদিনের মধ্যেই  এগুলো লোপ পেয়ে গেছে।

যদি  মনকে বিশ্লেষণ করবার সময়, আমি-বোধকে ধরতে পারেন, তবে এই বৃত্তিগুলোকে লোপ করা সহজ হয়। এখন কথা হচ্ছে, আমি বোধ কি ? ধ্যানের সময় এই আমি বোধ স্থানান্তরিত হয়।  অর্থাৎ প্রথমদিকে মনে হয়, এই শরীরটা আমি।  তারপরে মনে হয়, এই মনটাই আমি। যারা শরীরবোধে আবদ্ধ আছেন, তারা ধ্যানে বেশিক্ষন থাকতে পারবেন না। কোথাও চুলকাবে, কোথাও টনটন করবে, মনে হবে পাদুটো অসার হয়ে গেছে। ইত্যাদি ইত্যাদি।... অর্থাৎ শারীরিক সুবিধা অসুবিধা আপনাকে পীড়া দেবে। যখন আপনি মনের স্তরে উঠে আসবেন, তখন এই শরীরবোধ কমে যাবে, বা একদমই থাকবে না। বিবেকানন্দ যখন ধ্যানে বসতেন, তার শরীরে মশা ছেঁকে ধরতো, কিন্তু স্বামীজীর সেদিকে খেয়াল থাকতো না। আপনারও থাকবে না, যদি আপনি শরীর  থেকে নিজেকে মনে উত্তরণ ঘটাতে পারেন।

আমাদের এর পরের  কাজ হচ্ছে,মনের দিকে খেয়াল করা। ভালো করে খেয়াল করুন, মনের চিন্তা গুলো সরে সরে যাচ্ছে। একটা চিন্তারূপ দৃশ্যপট আপনার সামনে ভেসে উঠছে, কেউ একজন যেন সেটা দেখছে।  অর্থাৎ আপনি এখন দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছেন, একটা হচ্ছে আপনার মনের চিন্তা-দৃশ্য আর একটা হচ্ছে এই দৃশ্যের দ্রষ্টা। অর্থাৎ আপনি দেখছেন আপনার চিন্তাগুলোকে। প্রথমে আপনি শারীরবোধে ছিলেন, তার পরে মনের স্তরে উঠে এসেছেন, এর পরে শরীর  ও মন থেকে আলাদা কেউ একজন অর্থাৎ দ্রষ্টা হয়ে গেছেন আপনি। এখন আপনি শরীর  নন, মন নন, মনের মধ্যে যে চিন্তা উঠছে তার দ্রষ্টা, আপনি ।

আমিবোধ রূপ দ্রষ্টাকে যখন আপনি  ধরতে পারবেন, অর্থাৎ এই বোধে যখন আপনি থাকবেন, তখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটবে, আর তা হচ্ছে, দৃশ্যপট থেকে দৃশ্যগুলো  অদৃশ্য হয়ে যাবে।  অর্থাৎ আপনার মনে যে চিন্তা গুলো উঠছিলো, সেগুলো আর উঠবে না, লোপ পেয়ে যাবে। তখন মনে হবে, আমি আমাকে জানছি।

এই আমি আসলে কিন্তু সত্যিকারের আমি নোই।  অর্থাৎ আমি যে আত্মা তা এটি নয়। আসলে এই সময় আমার মধ্যে একটা বৃত্তি জেগে ওঠে, যে আমি আমাকে জানছি। এই স্তর পেরিয়ে আমরা যখন আরো ধ্যানের গভীরে যাবো, তখন আমরা আমাদের চেতন স্তরকে ধরতে পারবো। আমাদের রিপুগুলোকে ধরতে পারবো।  রিপুগুলো থেকে নিষ্কৃতি পাবো। আমাদের যে ষড়রিপু অর্থাৎ কাম. ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য্য এর থেকে আমরা রেহাই পাবো। এই প্রক্রিয়াটা শেষ করতে পারলে আমরা পরবর্তী প্রক্রিয়ায় যাবার যোগ্য হতে পারবো। আর সেটা শুনবো আমরা পরবর্তী পর্যায়ে।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।
ধ্যানের গভীরে (২)
আজ আমরা ধ্যানের দ্বিতীয় পর্যায় শুনবো। আগেরদিন আমরা শুনেছিলাম, দ্রষ্টা আমিকে যদি ধরতে পারি, অর্থাৎ চিন্তাস্রোতকে বা চিন্তাদৃশ্যকে কে দেখছে সেটা আমরা যদি ধরতে পারি, এবং একে যদি আমরা আরো বিশ্লেষণ করতে পারি, তবে আমরা চেতন সত্ত্বাকে ধরতে পারবো। এখন কথা হচ্ছে, এই চেতন সত্ত্বা কি ? মন যে শক্তিতে কাজ করে, তাকেই বলে চেতন শক্তি। এই শক্তিই আসলে আমাদের অবুভব শক্তি, উপলব্ধি বোধ। আমরা জানি মনের প্রাথমিক ভাবে  তিনটি স্তর। চেতন, অবচেতন, অতিচেতন। আমরা যখন জেগে থাকি, অর্থাৎ আমাদের জাগ্রত অবস্থায়, যে মন কাজ করে, যে স্তরে মন কাজ করে, তাকে বলে চেতন স্তর।  আর স্বপ্নাবস্থায়, মন যে স্তরে কাজ করে, তাকে বলে অবচেতন স্তর।
এটা আমাদের বুঝবার সুবিধার জন্য বলা হলো। কিন্তু সত্য হচ্ছে, অবচেতন মন আমাদের জাগ্রত অবস্থাতেও কাজ করে, সেটা আমাদের খেয়ালে আসে না। চেতন মনের নির্দেশ ছাড়াও, আমাদের শরীর আমাদের অজ্ঞাতসারে অনেক কাজ করে, আমরা যে চোখের পাতা ফেলি, আমরা যে নিঃস্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছি বা ছাড়ছি, আমাদের যে হজম হচ্ছে, এগুলো সবই অবচেতন মনের কাজ। অতি চেতন মনের স্তরে আমাদের কাজ আমরা ধরতে পারি না। এটি বিশেষ পরিস্থিতিতে আমাদের মতো সাধারণের মানুষের জাগ্রত হয়। মহাত্মাদের মধ্যে এই অতিচেতন মন সক্রিয় থাকে সব সময়। যাই হোক আমরা আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে ধ্যান, আমরা ধ্যানের ক্রোমবিকাশ নিয়ে আলোচনা করছিলাম। ধ্যানের সময় মানুষের মন  প্রথমে চেতনকে অতিক্রম করে, অবচেতনে যায়, এবং তার পরে অতিচেতন স্তরে উঠে আসে। এই অতিচেতনে আমরা যখন যেতে পারবো, তখন আমরা বুঝতে পারবো, এটিই আমাদের মূল সত্ত্বা। আর চেতনস্তর ও অবচেতন স্তর আসলে আমাদের বৃত্তির সমষ্টি মাত্র। অর্থাৎ আমাদের অভিজ্ঞতার সমষ্টি মাত্র। এই আমি-বোধকে বিশ্লেষণ  করতে করতে আমরা বুঝতে পারবো,  আমাদের যেসব ইন্দ্রিয় আছে, অর্থাৎ চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক, - এগুলোর কোনো নিজস্ব বা স্বাধীন সত্ত্বা নেই। এই আমি-বোধের অবচেতন অংশের দ্বারা এই ইন্দ্রিয়গুলো পরিচালিত হচ্ছে।  এইজন্য আমাদের কাজ হচ্ছে, এই আমি-বোধকে ধরে রাখা। যারা এই আমিবোধকে ধরতে পারেন না, তারা প্রথম দিকে ইষ্টকে ধরে থাকুন। অর্থাৎ আপনি আপনার দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কাজে লিপ্ত আছেন, কিন্তু আপনার মন ইষ্টে নিবদ্ধ আছে। এই অবস্থাতে থাকতে পারলেও আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনের উন্নতি ত্বরান্বিত হয়। এই  ইষ্টকেও যারা কল্পনাতে আন্তে পারেন না, বা ধরতে পারেন না, তার কোনো মন্ত্রের সাহায্য নিতে পারেন। অর্থাৎ ঈশ্বরের গুনবাচক কোনো    শব্দ।
যাই হোক, আমরা আগে ধ্যান করতে গিয়ে দেখেছি, আমাদের মনে নানান স্মৃতি বা কল্পনা আমাদের মনকে শান্ত হতে দিচ্ছে না। এখন কথা হচ্ছে, আমাদের মনে তো অসংখ্য স্মৃতি আছে, ধ্যানের সময় বিশেষ বিশেষ স্মৃতি ভেসে উঠে কেন ? বা আমাদের কল্পনাগুলোই বা বিশেষ ধরনের হয় কেন ? এটাই আসলে আমাদের পূর্ব্ব সংস্কারের খেলা। আপনি যখন বাজারে যান, তখন বাজারের সব কিছু দেখেও দেখেন না, আপনার যেগুলো দরকার, আপনার যেগুলো পছন্দ সেগুলোর দিকে আপনার নজর যায়। বাচ্চারা বাচ্চাকে খোঁজে, পুরুষ পুরুষকে খোঁজে, মহিলা মহিলাদের খোঁজে। বিশেষ গুরুর শিষ্যরা তাদের গুরুভাইকে খোঁজে। আসলে আপনি যা, আপনি তাই খোঁজেন। আপনার রুচি-পছন্দ-ইচ্ছা এগুলো আমাদের পূর্ব সঞ্চিত সংস্কার দ্বারা পরিচালিত। আমাদের অবচেতন মনে এই সংস্কার রক্ষিত আছে। সেই সংস্কার আমাদেরকে নির্দিষ্ট পথে বা কর্ম্মে পরিচালিত করছে। এবং সেই অনুযায়ী ফল ভোগ করায়। ধ্যানের মাধ্যমে আমরা এই সংস্কারগুলোকে ধরতে চেষ্টা করি। এবং বিচার বিশ্লেষণ দ্বারা সংস্কারকে সংশোধন করতে চাই। এগুলো সবই ধ্যানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য। নিজেকে উর্দ্ধগতি করতে হবে। অশুভ সংস্কারকে শোধন করতে হবে।
ধ্যানের সময় লক্ষ করতে থাকুন আপনার স্মৃতিগুলোকে বা কল্পনাকে। আসলে আপনার জীবনে যে সব ঘটনা আপনার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল, ধ্যানে সেই ঘটনাগুলোই উঠতে থাকবে। এখন এই স্মৃতি দু-রকম হতে পারে, একটা হচ্ছে সুখের স্মৃতি, আর একটা হচ্ছে দুঃখের স্মৃতি। আপনি যে জীবনধারায় এখন অভ্যস্ত হয়েছেন, সেটা আপনার পূর্ব-পূর্ব কর্ম্ম বা অভিজ্ঞতা থেকে সঞ্জাত। এই জীবনযাত্রায় আপনি যে ছন্দে প্রবাহিত হচ্ছেন, সেটি রক্ষার একটা তাগিদ আপনার ভিতরে থাকবে। এইভাবেই আপনার ব্যক্তিত্ত্ব বা আপনার একটা ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে। ধ্যানের মধ্যেও আপনার ভাবমূর্তির একটা ছাপ দেখতে পারবেন। আর এই ভাবমূর্তির দিকে দৃষ্টিপাত করলে আপনি বুঝতে পারবেন, ভাবমূর্তিটি কিসে উপরে দাঁড়িয়ে। অর্থাৎ এই ভাবমূর্তিরূপ গৃহের পিলার কারা, এর ভীত
কিসের তৈরি ?  তখন আপনি বুঝতে পারবেন, এগুলো আর কিছুই নয়, এগুলোর কিছু আছে আপনার স্মৃতি, আর কিছু আছে আপনার কল্পনা।
আপনার ধ্যান যত  গভীর হবে, ধীরে ধীরে কল্পনাগুলো উবে যাবে। কিন্তু স্মৃতি সহজে যাবে না। তাই আমাদের কাজ হবে, এই স্মৃতির সাথে একাত্ম না হয়ে, নির্লিপ্ত ভাবে শুধুই দ্রষ্টা হয়ে যাওয়া। আপনি যেন পুরীর সমুদ্রে কিনারে দাঁড়িয়ে আছেন।  অসংখ্য ঢেউ উঠছে, আপনি শুধুই  দেখছেন। আপনি যেন দূরের কোনো পাহাড়, বা প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখছেন। শুধু দেখা, তাকিয়ে থাকা। আর মনটাকে অসীমের দিকে ধাবিত করা। আপনি অসীমের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন। আপনি সাগরের মধ্যে ডুবে আছেন। কিন্তু অসীম আপনাকে ধরতে পারছে না. সাগরের অফুরন্ত জল আপনাকে ধরতে পারছে না। কিন্তু আপনি অসীমের মধ্যেই আছেন, জলের মধ্যেই আছেন। আপনার মন তখন অসীমে ধাবিত হচ্ছে। তীব্র গতিতে আপনার মন ধাবিত হচ্ছে। সামনে যেন এক উজ্জ্বল আলো আপনাকে  টেনে নিচ্ছে। আপনি এখন শুধু গতি। মাঝে মধ্যে একটা আলোর বিন্দু দেখতে পাচ্ছেন, কখনো সেটি স্পষ্ট আবার কখনো সেটা হারিয়ে যাচ্ছে। আপনি সেই আলেয়ার পিছনে ছুটছেন, যা দেখা দিয়েই  হারিয়ে যাচ্ছে । কেবল উর্দ্ধগতি মন প্রান্ত থেকে দিগন্তের দিকে ছুটছে।
এই সময় ইষ্টমূর্তি আপনার মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই আসবে।  এর জন্য আর তখন আলাদা করে চিন্তা করতে হবে না। ইষ্টমূর্তি তখন আর নিতান্ত ছবি বা কল্পনা  থাকবে না।  এটি তখন জ্যান্ত বলে মনে হবে। মনে হবে, ইষ্টমূর্তি যেন কথা বলছেন। আপনার ধ্যান যত  গভীর হবে, তত  ইষ্টমূর্তির সঙ্গে আপনি ভাবের বিনিময় করতে পারবেন। ইষ্টমূর্তি আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। এই সময় ইষ্টের মধ্যে নানান রঙের খেলা দেখতে পাবেন। বিভিন্ন আকারের খেলা দেখতে পারবেন। এই যে রঙ এগুলো আর কিছুই নয়, আমাদের বিভিন্ন চক্রের রঙ। এবং মনের অবস্থা। এবং মনের মধ্যে একটা অহেতুক আনন্দ এনে দেয়।  কিন্তু এসবের মধ্যে নিজেকে নিবদ্ধ রাখবেন না। এগুলোর কার্যকারিতা, মনের বিভিন্ন বৃত্তি বা সংস্কারগুলোকে ধরবার চেষ্টা করুন। বিভিন্ন দর্শনে নিরাসক্ত থাকবার চেষ্টা করুন। এবং আপনি যদি এইসব দর্শনে  নিরাসক্ত থাকেন, তখন আপনার ধীশক্তি বৃদ্ধি  পাবে। অর্থাৎ বিষয়ের গভীরে জ্ঞান লাভের  ক্ষমতা অর্জন করতে পারবেন।  এইসময়,ইষ্টের সঙ্গে  নিজেকে একাত্ম করবার  চেষ্টা করুন। আর একাত্মতা যত  বাড়বে, তত আপনার মধ্যে ইষ্টের গুন্ আয়ত্ত্ব করার স্বাভাবিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
এতদিন আমরা চেতন স্তরে ঘোরাফেরা করতাম। এখন আমরা চেতন ও অবচেতন মনের অবস্থাকে ধরতে পারছি।  অর্থাৎ মনে যে দুটো স্তর আছে, এবং সেখানে কি খেলা চলছে, সেটা এই অবস্থায় এসে আমরা ধরতে পারি।  অর্থাৎ আমাদের সংস্কার কিভাবে আমাদের প্রভাবিত করে, সেটা তখন আমরা ধরতে পারবো।  এই সময় আমাদের মনের শক্তি এতটাই বেড়ে যেতে পারে, যে  আমাদের  গভীরতম স্তরে থাকা সংস্কারগুলোকেও আমরা তখন প্রত্যক্ষ করতে পারবো। এই প্রতক্ষ্য অভিজ্ঞতা, কখনো আমাদের কাছে আনন্দের হতে পারে, সুন্দর হতে পারে, বা দুঃখেরও  হতে পারে, এমনকি  ভীতিপ্রদ  হতে পারে। এখন আপনার ধ্যানের  গভীরতা অনেক বেড়ে গেছে, তাই এই ছবি বা দৃশ্যগুলো সহজে লুপ্ত হবে না। আপনার মন অশান্ত হলেও যাবে না। বারবার ফিরে ফিরে আসবে। এমনকি আপনি ধ্যান ছেড়ে দিলেও, আপনার মন থেকে এই দৃশ্যগুলো সহজে যাবে না। এই অবস্থাটা সাধকের কাছে সবচেয়ে মারাত্মক। কারন আপনি যা চাইছেন না, সেটাও আপনার মনের  মধ্যে ভেসে উঠছে। এই অবস্হায় আপনার মধ্যে একটা ভয় কাজ করতে পারে, মনের অস্থিরতা হতে পারে। এই অবস্থাকে মোকাবিলা করতে গেলে দরকার নিরাসক্তি।  অর্থাৎ এইগুলো সম্পর্কে আমাদের নিরাসক্ত থাকতে হবে। এইগুলোকে গুরুত্ত্ব দেওয়া চলবে না। আর একটা উপায় হচ্ছে, মোকাবিলা করা।  আপনার মধ্যে ভয়ের সৃষ্টিকারী মুখ বা দৃশ্যগুলোকে  অপলক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষপণ করুন, আর গভীর পর্যবেক্ষপণ, দৃশ্যগুলোর  অবলুপ্তি ঘটাবে। এই মুখগুলো আসলে আপনার অতি গভীরে লুক্কায়িত সংস্কার। আর একে জাগাতেও হবে, আবার এর লোপ করতেই হবে।  তাই এগুলোর প্রতি নির্লিপ্ত থাকা অথবা এর গভীরে অন্তর্দৃষ্টি নিক্ষেপ করা, এর মাধ্যমেই আমরা নিজেদেরকে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারবো। এই সময় গুরু সাহায্য হলে ভালো হয়।যার সঙ্গে ধ্যানের  অভিজ্ঞতা খোলালহুলি ভাবে আলোচনা করা যায়।   নতুবা, নিজেকে স্থির রাখা দুর্বলমনের মানুষের পক্ষে, খুবই কষ্টকর হয়। এমনকি এই অবস্থায়, ধ্যানের সাময়িক বিরতিরও  দরকার হতে পারে।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।

ধ্যানের গভীরে (৩)
ধ্যান মানে কর্ম্ম থেকে অব্যাহতি নয়। ধ্যান মানে সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে এমন নয়।  ধ্যান মানে এমন নয় যে গুহার মধ্যে অবস্থান করতে হবে। ধ্যান প্রথম দিকে নির্জনে করতে পারলে ভালো হয় ঠিকই, কিন্তু যথার্থ ধ্যানমগ্ন পুরুষ দৈনন্দিন কাজের মধ্যেও ধ্যানেই রত থাকেন। ধ্যান একটা মানসিক অবস্থা মাত্র। ধ্যানময় জীবন মানে, একটা জীবনশৈলী। একটা নির্দিষ্ট সময়ে ধ্যানে যে সংস্কারগুলো উঠে আসবে, সেগুলো বিশ্লেষণ ক্রিয়া সারাক্ষন ধরেই চলতে পারে। আর এতে করে, আমাদের সংশোধনযোগ্য সংস্কারগুলোকে তাড়াতাড়ি সংশোধন করতে পারবো। উন্নত ভবিষ্যৎ জীবন গড়ার পক্ষে এটাই উপায়। অর্থাৎ ধ্যান আমাদের ভবিষ্যৎ উন্নত জীবনের সহায়ক হতে পারে।   যে জীবনে আমরা বিশ্বশক্তির সঙ্গে একাত্ম হয়ে অবস্থান করতে পারি। ধ্যান আমাদের  ভিতরে তখন এক শান্ত ভাব জাগিয়ে তুলবে, যা আমাদের নিরুদ্বিগ্ন জীবনযাপনে সহায়তা করে।  যা আমাদের নির্ভয়ে থাকতে সাহায্য করবে । ধ্যানে  আমরা এমন এক প্রাচুর্য্যের মধ্যে অবস্থান করবো, তখন আমাদের আর অভাববোধ থাকবে   না। ধ্যানে নিবিষ্ট হওয়ার এটাই প্রাপ্তি।

কোনো রূপের ধ্যান, বা কোনো চক্রের ধ্যান করলে আমাদের মধ্যে ভালোবাসার শক্তি বৃদ্ধি পায়। কারুর  যদি গুরুমন্ত্র পাবার অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে, তবে তিনি  নিশ্চই জানেন, যে সহজ ও স্বাভাবিক বিশ্বাস অনুযায়ী মূর্তির ধ্যান  বা  মন্ত্রের জপ করতে বলে থাকেন গুরুদেবরা । কিন্তু কেন ? আর এর থেকে কি ভাবে ভালোবাসা জন্মাবে। আর  এই ভালোবাসার ভাবটিই বা কি হবে ?

ধরুন, আমি যদি তেতুল শব্দটি উচ্চারণ করি, বা ফুসকা শব্দটি উচ্চারণ করি, তবে সে শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার  সামনে একটা তেতুল  বা তেতুলের জল বা গোল গোল ফুসকা আমার  মধ্যে ভেসে উঠবে, এমনকি আমার  জিহ্বা রস নিঃস্বরণ করা শুরু করে দেবে। অর্থাৎ একটা শব্দ আমাকে  একটা রূপ সামনে এনে  দেবে, গুন্ চিন্তনে সাহায্য করবে ।  এমনকি আমার  জৈব শরীরে রস নিঃস্বরণ ক্রিয়া শুরু করে দেবে। ঠিক তেমনি সাধক  যখন  একটি মূর্তির কথা চিন্তা করছেন, বা একটা মন্ত্র যা আসলে ভগবানের রূপ  বা গুন্ বর্ণন, উচ্চারণ করছেন, তখন সাধকের  সামনে একটা রূপ বা একটা ভাবের সৃষ্টি করবে। অর্থাৎ কোনো রূপ বা মন্ত্র  যখন আমাদের ধ্যানের বিষয় হবে, তখন আমাদের মধ্যে একটা ভাবের উদয় হবে। সেই ভাবটি উঠবে চিন্তার আকারে। এবং ঈশ্বর সম্পর্কে সাধকের যে ধারণা, ঠিক সেই ভাবেই তার চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকবে। আর ঈশ্বর সম্পর্কে আমাদের সবার একটা ধারণা আছে, আর তা হচ্ছে  তিনি সর্ব্বশক্তিমান, তিনি দয়ালু, তিনি ক্ষমাশীল, তিনি প্রেমের উৎস। তো আমাদের চিন্তা তরঙ্গেও ঠিক এই ভাব উঠতে থাকবে। এখন কথা হচ্ছে, এই চিন্তা তরঙ্গ  উঠে যাবে কোথায় ? যাবে আমাদের স্মৃতিতে। অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, এই চিন্তা আমাদের সংস্কারে পরিণত হবে। অর্থাৎ স্মৃতিতে একটা চিরস্থায়ী ছাপ  রেখে যাবে। এই নতুন চিন্তার ঢেউ, প্রথম প্রথম আমাদের জপের সময় আমাদের মনের ভিতরে ঢুকতে গেলে, পুরোনো  সংস্কার দ্বারা  বাধা প্রাপ্ত হবে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও সাধক যদি জপ চালিয়ে যান,তবে সেই জপের মন্ত্রের ঢেউ ক্রমশ মনের গভীরে চলে যেতে থাকবে। আর আমাদের সদগুণের সংস্কার, তখন শক্তিশালী হতে থাকবে। আর এই শক্তিশালী সংস্কারগুলো অর্থাৎ নতুন জপমন্ত্র তখন আমাদের মনে গভীরে অনুরণিত হতে থাকে, আর একেই আমরা বলি স্বতঃস্ফূর্ত মানসিক জপ। অর্থাৎ জপ তখন আপনা-আপনি উচ্চারিত হতে থাকে। এর জন্য আলাদা করে প্রয়াসের প্রয়োজন পরে না। এই সময় আমাদের মন শান্ত হয়ে থাকে এবং আমাদের অনুভূতি শক্তি প্রবল থেকে প্রবলতর হতে থাকে। এইসময় আমাদের মনের মধ্যে কোনো কামনার ভাব জেগে উঠলে, মনকে শান্ত হতে বাধা দেয়। এইজন্য কামনা-রহিত হয়ে আমাদের ধ্যানে প্রবৃত্ত হওয়া উচিত। তা না হলে আমাদের মন শান্ত হতে পারবে না। তাই আমাদের নিরাসক্ত হয়ে মন্ত্রশক্তি দ্বারা উদ্ভূত ভাবকে ধরে রাখতে হবে। এবং এই ভাবের গভীরে যেতে হবে, তাহলে আমরা ধ্যানের উচ্চস্তরের আস্বাদ অনুভব করতে পারবো।

এইসময় থেকে অতিপ্রাকৃত অনেক ভাব আমরা পর্যবেক্ষন করতে পারবো। এই সময় ইষ্টমূর্তি বা প্রতীকের পরিবর্তন লক্ষিত হয়।  এমনকি নিজের শরীরের আকারের পরিবর্তন মনে হতে পারে। না আমাদের  শরীরে সত্যি সত্যি কোনো পরিবর্তন হবে তা নয়, কিন্তু আমাদের  মনে হবে আমার  শরীর যেন হালকা হয়ে গেছে, আমার  শরীর  যেন স্বাভাবিক থেকে অনেক বড়ো  হয়ে গেছে, আমার  চোখের সামনের অনেক  দৃশ্য অনেক স্পষ্ট হয়ে গেছে। অর্থাৎ সাধক, চেতন মনে যে স্তরে বাস করতেন, এখন যেন  মন অন্য এক চেতন স্তরে উঠে এসেছে। অর্থাৎ সাধক  এখন অবচেতন মনের স্তরকে ধরতে পেরেছেন। এখন সাধকের  মনের শক্তিও অনেক বেড়ে গেছে। এইসময় আমাদের ইন্দ্রিয়সকল বাদ  দিয়েই আমি যেন সব শুনতে পারছি, দেখতে পাচ্ছি, এমনকি  কথা বলছি, কিন্তু কোনো ইন্দ্রিয় অর্থাৎ চোখ, কান, মুখ কাজ করছে না। কিন্তু কিভাবে এটি কাজ করছে, সেটা তখন আমরা ধরতে পারি না। তাই এই দর্শন-শ্রবণ-কথন এর উপরে আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না । মন এই শক্তিকে নিজের ইচ্ছে মতো পরিচালিত করতে পারছে না। বরং মনটাকে এই স্বয়ংক্রিয় অবস্থার মধ্যে ভাসিয়ে দিতে হচ্ছে ।

ধ্যানের গভীরতা যত  বাড়তে থাকবে,সাধকের  মনের শক্তি এইভাবে বাড়তে থাকবে। এখন সাধক  মনের সমস্ত সংস্কারগুলোকে যেন দেখতে পাচ্ছেন। বহু পুরোনো, এমনকি সাধকের  মনের গভীরে যেসব কু-ভাবনা, বা খারাপ বাসনা লুক্কায়িত হয়ে আছে, সেগুলো তখন জেগে উঠতে থাকবে।এগুলো সম্পর্কে আমাদের নির্লিপ্ত থাকতে হবে। এই ভাব গুলোকে উপেক্ষা করতে হবে।  এইসময় সাধকের পক্ষে গুরুর সাহায্য দরকার হতে পারে। অর্থাৎ যার সঙ্গে সাধক  ধ্যানের গভীরে নিজের  পর্যবেক্ষন  শেযার করতে পারেন। অবশ্য এই পর্যবেক্ষন সব সাধকের একই আসবে তার কোনো মানে নেই।  যার যেমন সংস্কার, তার কাছে সেইমতো হয়ে দেখা দেবে। এর মধ্যেই সাধক  নিজেকে আসল রূপে দেখতে পারবেন।  মন কোথায়, কিভাবে আসক্ত হয়ে আছে, সেটা সাধক  ধরতে পারবেন। তখন সাধকের  কাজ হবে, মনের এই অন্তর্মুখী প্রবণতাগুলোকে ইচ্ছাশক্তি ও বুদ্ধির দ্বারা, বিশ্লেষণ করে, একটা নির্দিষ্ট উচ্চতর লক্ষ্যের  দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। উন্নত চিন্তাধারা,  সাধকের  মনে যত  প্রবাহিত হতে থাকবে, তত সাধকের  মনের খারাপ সংস্কারগুলো স্তিমিত হয়ে যাবে। এবার সাধক একটা নতুন আমি হয়ে উঠবেন। ধ্যান যত দীর্ঘায়ত হবে, যত গভীর হবে, একটা নতুন আমির জন্ম হবে। পুরোনো সংস্কারগুলোর জাগরণের সঙ্গে সঙ্গে  নতুন সংস্কারগুলো তাকে চাপা দেবার প্রয়াস করবে। এবং ধীরে ধীরে এটা একটা অভ্যাসে পরিণত হবে।  এই নতুন চেতনার সাহায্যে সাধক  তখন সত্যের সন্ধানে প্রবৃত্ত হবার উপযুক্ত হয়ে উঠবেন ।

সাধকের মনে ঈশ্বর সন্মন্ধে, একটা ধারণা আগে থেকেই তৈরি হয়ে থাকে। এটা  সমাজ, পরিবার, শিক্ষা, ইত্যাদির দ্বারা গড়ে ওঠে। এবং সেই অনুযায়ী সে একটা কাল্পনিক মূর্তি গড়ে তোলে। শান্তমনে এই ঈশ্বরের রূপ  জোরালো হতে থাকে। এমনকি মানস নেত্রে, এই রূপকেই আমরা দেখতে থাকি। কিন্তু সাধনার গভীরতা যত  বাড়তে থাকে, সাধকের হৃদয়ের মধ্যে যেন একটা দরজা খুলে যায়, তখন তিনি নিজের মধ্যে এক জ্যোতির্ময় সত্ত্বার আবিষ্কার করেন। এক ভাবময় সত্ত্বার আবিষ্কার করেন।

ধ্যান যত  গভীর  হয়,  তত তিনি উপলব্ধি করেন, এই জ্যোতিঃ আসলে চৈতন্যময় সত্ত্বার এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র  অংশমাত্র। এমনকি যে ইষ্টমূর্তি নিয়ে আমরা ধ্যানে রত হয়েছিলাম, সেটিও সেই পরম-চৈতন্য সত্ত্বার অংশমাত্র। এইসময় সাধক পরম-চৈতন্য সত্ত্বার সমুদ্রের মধ্যে নিজেকে অনুভব করেন। এবং মনে করেন, অহমকে ঘিরে চৈতন্য বিরাজ করছেন । অর্থাৎ অহম যেন একটি কেন্দ্র তাকে ঘিরে আছে অসীম চৈতন্য শক্তি।

ধ্যানের পরবর্তী স্তরে, এই অহমবোধ লোপ পেতে থাকে। তখন মনে হয়, অসীম চৈতন্য শক্তিই একমাত্র  সত্য। রাতের শেষে নক্ষত্রগুলো যেমন আকাশে মিলিয়ে যায়, রাতের শেষে চাঁদ যেমন আকাশে মিলিয়ে যায়, অহম বোধ যেন ঠিক তেমনি অসীম চৈতন্যশক্তির মধ্যে ম্লান হয়ে গেছে। এটাই অদ্বৈত উপলব্ধি। এটির ভাষা আমাদের জানা নেই। সবশেষে একটা কথা বলি, এই সাধন যাত্রাপথের উপলব্ধি এক-এক সাধকের ক্ষেত্রে এক এক রকম ঘটাই স্বাভাবিক। একজন সাধকের অনুভূতির সঙ্গে আর একজন সাধকের  অনুভূতির  মিল না থাকতেই পরে। এগুলো তীর্থযাত্রার পথের  দৃশ্যমাত্র । যে যেপথ দিয়ে অতিক্রম করেন, তিনি তেমন দেখে থাকেন। পথের  শোভা, আলাদা হতেই পারে। তবে সব পথ মিলবে তো তীর্থক্ষেত্রে, সেখানে সব এক।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।    

No comments:

Post a Comment