Monday, 2 December 2019

অধ্যাত্ম জগতে চোখের ভূমিকা

অধ্যাত্ম জগতে চোখের ভূমিকা 
Order Number: 405-9596855-4290702

কিছুদিন আগে আমি এক অসুস্থ  নিকট আত্মীয়কে দেখতে গিয়েছিলাম। শুনলাম তিনি এখন চোখে ঝাপসা দেখেন। আমাকে দেখিয়ে তার ছেলে বললো, কে এসেছে, চিনতে  পারছো ? তো ভদ্রলোক,  ঘাড়  নেড়ে জানিয়ে দিলেন, চিনতে পারছেন না। অর্থাৎ তিনি কানে শুনতে পারছেন, চোখেও ঝাপসা দেখতে পারছেন, কিন্তু চিনতে পারছেন না। অর্থাৎ তার স্মৃতি ও চোখের পাতা ঝাপসা হয়ে এসেছে। কিছুদিন বাদে ভদ্রলোক, স্থূল দেহ ত্যাগ করেন। ভাবছিলাম, মৃত্যুর সাথে চোখের সম্পর্ক কোথায় ?

হিমালয়ের পাহাড়ের গুহায় বহু ধ্যানস্থ মহাত্মা আছেন। তারা সবাই, চোখ বুজে, মেরুদন্ড সোজা করে বসে আছেন। চোখের সঙ্গে  কি ধ্যানের  কি কোনো সম্পর্ক আছে।
   
আমাদের চক্ষুদুটো  একটা বিষ্ময়কর বস্তূ।  আমাদের শরীরের যে অঙ্গগুলো স্বয়ংসম্পূর্ন তার মধ্যে চোখদুটো প্রধান। তাই চোখকে আমরা অন্যের শরীরে প্রতিস্থাপন করতে পারি।  এর ক্রিয়া কখনো বন্ধ করা যায় না। আমরা দেখতে চাই বা না চাই আমাদের চোখ কিন্তু দেখবেই। আমরা চোখের পাতা বন্ধ করতে পারি, কিন্তু চোখের ক্রিয়া অর্থাৎ দেখা বন্ধ করতে পারি না। এমনকি আমরা চোখের গতি বন্ধ করতে পারি না। আমাদের চোখ সবসময় ঘুরছে।  আমরা চোখ বন্ধ করলেও আমরা কিছু না কিছু দেখতে পাই। চোখ যেমন বাইরের জগৎ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান প্রদান করে, ঠিক তেমনি এই চোখের সাহায্যে আমরা আমাদের অন্তর্জগতের সাথেও সম্পর্ক স্থাপন করতে পারি। তাই চোখ আমাদের অন্তর্জগতের অনুসন্ধানের কাজে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে।
 চোখ সবসময় গতিশীল। আমাদের মন যেমন চঞ্চল।  আমাদের চোখ দুটোও চঞ্চল। চোখ আমাদের মনের আয়না। আমরা চোখ দেখে বুঝতে পারি, মানুষটি সুখে আছে, না দুঃখে আছে, রেগে আছে না শান্ত আছে। কারুর মনকে আমরা দেখতে পারি না।  কিন্তু মন যেহেতু চোখে প্রতিফলিত হচ্ছে, তাই মনকে ভালো করে বুঝতে গেলে, আমাদের তাদের  চোখের দিকে দৃষ্টিপাত করতে পারি। এমনকি আমাদের চৈতন্য শক্তির সঙ্গে আমাদের চোখের একটা যোগাযোগ আছে, যা আমাদের অন্য কোনো অঙ্গের সঙ্গে নেই। তাই চোখ যতক্ষন আমাদের ক্রীয়াশীল থাকে ততক্ষন আমাদের চৈতন্য থাকে।তাই আমাদের মৃত্যুর আগে, চোখে ঝাপসা দেখতে থাকি। মৃত্যুতে আমাদের চক্ষু স্থির হয়ে যায়।  কেউ সজ্ঞা  হারিয়ে ফেললে, আমরা চোখে জলের ছিটে দেই, সংজ্ঞা  ফিরিয়ে আনবার জন্য। তাই চোখ আমাদের একটা গুরুত্ত্বপূর্ন অঙ্গ। আর চোখকে আমরা আধ্যাত্মিক অনুশীলনের জন্য  ব্যবহার করতে পারি। চোখের দৃষ্টিকে আমাদের বাইরের থেকে ভিতরের দিকে ফেরাতে হবে।

আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশের জন্য, আমাদের চোখের ক্রিয়াকে স্থির করতে হবে। চোখের ক্রিয়াকে বন্ধ করা আর চোখের পাতাকে বন্ধ করা কিন্তু এক জিনিস নয়।  এই পার্থক্যটা আমাদের ভালো ভাবে বুঝতে হবে। যেকোনো মুহূর্তেই আমাদের চোখের পাতা বন্ধ করতে পারি। আমরা ঘুমের সময় চোখ বন্ধ রাখি। কিন্তু চোখের যে অন্তরযাত্রা তা তাতে বন্ধ হয় না। চোখের এই যাত্রা যা একবার বাইরে আর একবার ভিতরে এই যাত্রাকে আমাদের বন্ধ করতে হবে।  কিন্তু চোখ সজাগ থাকবে। অর্থাৎ দেখছে, কিন্তু দেখবে না। আর চোখের দেখা বন্ধ অর্থাৎ বাইরের দৃশ্য দেখা বা ভিতরের দৃশ্য দেখা যখন বন্ধ হয়ে যাবে তখন,  আমাদের চিন্তাগুলোও ধীরে ধীরে চলে যাবে। চোখের সমস্ত গতিকে রুদ্ধ করে দিন। অনুভব করুন যেন আপনি একটা পাথরে পরিণত হয়ে গেছেন। চোখ দুটোকেও পাথরের মতো স্থির করুন। কিছুই করতে হবে না।  শুধু স্থির অবস্থাকে উপলব্ধি করুন।
--------------
ভূতের দুটো রূপ,  স্থুল ও সূক্ষ্ম। স্থুল  বলতে বোঝায়, ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। আর সূক্ষ্ম বলতে বোঝায়, রূপ, রস,গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ।    এই ভূত গ্রহণের জন্যই আমাদের সুখ-দুঃখ অনুভূত হয়।  শরীর  ভোগায়তন। ভূতে থাকা সত্ত্বেও বৈরাগ্যের দ্বারা আমরা ভোগ থেকে নিবৃত্তি পেতে পারি। এই অবস্থায়ই  যোগীর আকাঙ্খিত অবস্থা। অর্থাৎ জলেও নামবো, স্নানও  করবো, কিন্তু গা ভেজাবো না। পদ্মপাতা জলে থাকে,  কিন্তু জলের গুনকে সে গ্রহণ করে না অর্থাৎ জল পদ্মপাতাকে ভেজাতে পারে না।  ভূত থেকে নিজেকে আলাদা করতে পারলে, স্ব-রূপে স্থিতি হয়।

SASANKA SEKHAR PEACE FOUNDATION - বক্তব্য শুনে অনেকের মধ্যে একটা সত্য অনুভূত হয়েছে যে এই শশাঙ্ক শেখর ব্রহ্মজ্ঞানী ব্যক্তি নন। দেখুন SASANKA SEKHAR PEACE FOUNDATION কোনো ব্যক্তি নন। এটি একটি সংস্থা, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে, অধ্যাত্ম জগতে প্রবেশের দ্বার উন্মোচন করা। চিরকালীন সত্যকে উপলব্ধি করা। এর মধ্যে এমন কোনো ব্যক্তি নেই, যিনি দাবি করতে পারেন, বা করেন, যে তার ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছে। ভারতের মুনি-ঋষিরা যে সত্যকে উপলব্ধি করেছিলেন, তার কিছু কথা সাধারণের ভাষায় ব্যক্ত করাই উদ্দেশ্য । এই সব কথা SASANKA SEKHAR PEACE FOUNDATION -এর পৈতৃক সম্পত্তি নয়, নিজস্ব বানানো নয়। এটি একটি যাত্রা যাতে আপনি অবশ্য়ই সামিল হতে পারেন, আবার নাও পারেন । এটি তথাকথিত কোনো ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ত্ব করে না, তার গুনগানও করে না।   অধ্যাত্ম শান্তির খোঁজে, একটা পদক্ষেপ মাত্র। সবাই স্বস্তিতে থাকুন, শান্তিতে থাকুন, সবার মঙ্গল হোক, এই আমাদের কামনা।

সমাধি কাকে বলে : আত্মহারা হওয়ার নামই সমাধি। ধ্যান করতে করতে মানুষের যখন কেবল মাত্র ধ্যেয় বস্তুর সত্ত্বার উপলব্ধি থাকে, আত্মসত্ত্বাকে যখন সে ভুলে যায়, ধ্যেয় বিষয় ছাড়া অন্য কিছু জ্ঞান গোচর  হয় না, সেই অবস্থাকে বলে সমাধি।
গল্পটা সবার জানা, তবু আর একবার শুনি। শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি শুরু হয়ে গেছে। আজ শ্রীরাধিকার অভিসারে যাবার সময় হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি শুনে শ্রীরাধিকার মন আরো উতলা হয়ে উঠলো। কিন্তু প্রিয়তমার কাছে, যাবার আগে একটু সাজসজ্জ্বা করে যেতে হয়। প্রসাধন সামগ্রী নিয়ে বসলো। পায়ে কাজল পড়লো , চোখে আলতা লাগলো , গলার মালা মাথায় পরে নিলো,  হাতের আঙুলে  দুল পড়লো, কানে আংটি ঝুলিয়ে দিলো । শাড়ি অগোছালো।  সখীরা তার এই অদ্ভুত সাজ দেখে, হেসে খুন। বললো, দেখবি যায় কি সেজেছিস।  বলে, একটা আয়নার সামনে নিয়ে গেলো। বললো, তাকিয়ে দেখ, কি সেজেছিস। সখীরা  ভেবেছিলো, শ্রীরাধিকা নিশ্চয় তার ভুল ধরতে পারবে, আর লজ্জ্বা  পাবে। কিন্তু শ্রীরাধিকা আয়নায় নিজের অবয়ব  দেখতে পেলো না দর্পনে।  দেখলো শুধু গোবিন্দ। দর্পনে ভেসে  উঠছে শুধু শ্রীকৃষ্ণের  মুখ, প্রিয়তমের মুখ । যেখানে নিজের মরন সাধন হয়, বরণ হয় প্রিয়তমের, একেই বলে সমাধি। ধ্যানে ধ্যানকর্তা বলে কিছু থাকে না, অর্থাৎ ধ্যাতা থাকে না থাকে শুধু ধ্য়েয়। নিজেকে ভুলে তিনিতে  তন্ময় হয়ে যাওয়াই ধ্যান।  আর ধ্যানের  পরিনাম  সমাধি। 


এই কথাগুলো বার বার শুনতে ইচ্ছে করে, তাই পুনরাবৃত্তি করি। মহর্ষি পতঞ্জলি তার যোগদর্শনে বলছেন : "যোগঃ চিত্তবৃত্তি নিরোধঃ" - একটা ছোট্ট শ্লোকে যোগের সার কথা বলে দিলেন। কিন্তু রসিক ভক্ত এই একই কথা কি ভাবে ব্যক্ত করছেন দেখুন।

একা কুম্ভ কাঁখে করি, যমুনাতে জল ভরি,
জলের ভিতরে শ্যামরায়।
ফুলের চূড়াটি মাথে, মোহন মুরলি হাতে,
পুনঃ কানু জলেতে লুকায়।
অনেক প্রবন্ধ করি, ধরিবারে যায় হরি,
ধীরে ধীরে কর বাঢ়াইনু।
কর বাঢ়াইয়া যাই, আর না দেখিতে পাই,
আকুল হইয়া জলেতে ডুবিনু।
ঢেউ মোর হলো কাল, না পাইনু নন্দলাল,
উঠিলাম যমুনার তীরে।
না হেরি বঁধুর মুখ, হইল বিষম দুখ,
কাঁদিতে কাঁদিতে এলাম ঘরে।

শ্রীরাধিকা একাকিনী কাঁখে কলসি নিয়ে যমুনাতে জল ভরতে গিয়েছেন।  "একা কুম্ভ কাঁখে করি, যমুনাতে জল ভরি"। আমাদের সবার  এই একই দশা। আমরাও জীবন ঘট ভরে নেবার জন্য, মন-যমুনার তীরে চুপি চুপি জল ভরতে যাই। আর সেই মন যমুনার জলেই আছেন, আমাদের প্রাণ-পুরুষ, শ্যামরায়। অপূর্ব মনোমোহিনী মূর্তি, যার মাথায় শোভা পাচ্ছে ফুলের চূড়া,  হাতে সেই মোহন মুরলি, যার মধুর ধ্বনিতে  আমরা পাগল হয়ে যাই। ঘর সংসার ছেড়ে বিবাগী হয়ে যাই। মন-যমুনার জলে, তাকে দেখামাত্র শ্রীরাধিকা পাগল হয়ে যায়। তাঁকে পাবার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে।  তাকে দেখি, দেখি আবার দেখি না। আসলে আমাদের মন যমুনার জলে তো বাসনার ঢেউ উঠছে সর্বদা। অনেক আশা নিয়ে, শ্রীরাধিকা জলের মধ্যে, অঙ্গুলি সঞ্চালন করে, শ্রীহরিকে ধরবার জন্য। আর যত সে কর সঞ্চালন করে, হাত যত  নাড়াচাড়া করে, যমুনার জলে তত ঢেউ ওঠে, শ্রীহরি তত জলের  গভীরে লুকিয়ে পরেন , অস্পষ্ট হয়ে যান । আমরা তাঁকে পাবার জন্য যত  আড়ম্বর করি, ততই তিনি লুকিয়ে যান। অর্থাৎ ফল হয় উল্টো, আমরা তাকে পাবার জন্য আড়ম্বর করে পুজো-অর্চনা করি, আর তাতে তিনি আমাদের থেকে আরো দূরে সরে যান। আমরা তা বুঝি না। কোনো উপায় না পেয়ে, শ্রীরাধিকা "আকুল হইয়া জলেতে ডুবিনু"। অর্থাৎ জলে ঝাঁপ দিলেন।ভাবলেন, জলের তলায় তিনি লুকিয়ে আছেন।  আর এতে জল আরো অস্থির হয়ে উঠলো, শ্রীহরি জলের মধ্যে কোথায় হারিয়ে গেলেন । শ্রীহরির পূজায় যত আড়ম্বর বাড়বে, শ্রীহরি তত আমাদের থেকে দূরে সরে যাবেন । পদকার বলছেন, "ঢেউ মোর হলো কাল, না পাইনু নন্দলাল,উঠিলাম যমুনার তীরে"। মনের অস্থিরতা, চিত্তের বিক্ষিপ্ততা, আমাদের যত  বাড়বে তত আমরা শ্রীহরি থেকে দূরে সরে থাকবো। শেষে শ্রীরাধিকা বলছেন,  না হেরি বঁধুর মুখ, হইল বিষম দুখ, কাঁদিতে কাঁদিতে এলাম ঘরে। শূন্য কুম্ভটি নয়ন জলে পূর্ন করে, শ্রীরাধিকা ঘরে ফিরে এলেন। আমাদের এই শ্রীরাধিকার মতো অবস্থা, অস্থির মনে তাঁকে দেখতে চাই, কিন্তু আমাদের চিত্ত যতক্ষন শান্ত না হবে, ততক্ষন শ্রীহরি আমাদের মনে আসন পাততে পারেন না। তাই আগে মন-তরঙ্গ  শান্ত করতে হবে। তবেই আমরা ঈশ্বরের দেখা পাবো। তাই মহর্ষি পতঞ্জলি বলছেন, চিত্তবৃত্তিকে নিরোধ করতে হবে, যদি যোগ অর্থাৎ ঈশ্বরের সাথে মিলিত হতে চান।

ভূতেদের সভা বসেছে, চৈতন্য সে সভার সভাধিপতি। ভূতেরা সারাক্ষন সভামধ্যে  গোলমাল করে।  চৈতন্য খেয়াল করে। একসময় চৈতন্য সভা ভেঙে দিয়ে, বাড়িমুখী হয়। 






    











  

No comments:

Post a Comment