আত্মার কি কোনো ব্যক্তিসত্ত্বা আছে ?
প্রতিনিয়ত আমাদের এই দেহের পরিবর্তন হচ্ছে। প্রতিনিয়ত আমাদের মনের পরিবর্তন হচ্ছে। প্রতিনিয়ত আমাদের জ্ঞানের পরিবর্তন হচ্ছে। প্রতিনিয়ত আমাদের ব্যাক্তিত্ত্বের পরিবর্তন হচ্ছে। আমি কিন্তু একই আছি। তো এই যে আমি একই আছি, আমাদের মৃত্যুর পরেও কি এই আমি একই থাকি ? অর্থাৎ মৃত্যুর পরে, আমাদের আত্মশক্তি কি কারুর সঙ্গে অর্থাৎ পরম বিশ্বশক্তির সঙ্গে একাত্মীভূত হয়ে যায় ? এই যে আমি আমার নিজস্বতা আমাদের স্বতন্ত্রতা এটা কি আমাদের মৃত্যুর পরেও বজায় থাকে ? স্থুল দেহের পরিবর্তন, মনের পরিবর্তন, ব্যাক্তিত্ত্বের পরিবর্তন এগুলো আমরা ধরতে পারি কি করে ? আমাদের স্মৃতির সাহায্যে। অর্থাৎ স্মৃতি আমাদের বলে দেয়, আগের আমি আর এখনকার আমি, একই আমি। এই স্মৃতি যদি আমাদের না থাকে, তবে আগে কি ছিলাম তা আমরা মনে করতে পারবো না। আর সেই আমি আর এই আমি, একই ,এটাও আমাদের উপল্বদ্ধিতে আসবে না। তো মৃত্যুর পরে আমাদের স্থূল দেহ থাকবে না। তো স্মৃতি, যা আমাদের এই মস্তিষ্কে অবস্থান করছে, তা এই স্থূল দেহের নাশের সঙ্গে সঙ্গে বিনষ্ট হয়ে যাবে। তাহলে মৃত্যুর পরেও এই আমি আর ভবিষ্যতের আমি একই, এটা আমরা উপলব্ধি করবো কি করে ? আর কেই বা এটা উপলব্ধি করবে ? আর স্মৃতির ভাণ্ডারে আমাদের প্রতিনিয়ত অনেক নতুন জিনিসের সংযোজন ঘটছে, আবার পুরাতন স্মৃতি আমাদের হারিয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুর পরেও কি একই প্রক্রিয়া চলতে থাকে আমাদের স্মৃতি-ভান্ডে। বিজ্ঞান বলছে, স্মৃতি আমাদের নিম্নতর মস্তিষ্কের কাজ। স্থূল দেহের মৃত্যুর পরে, আমাদের এই স্থূল মস্তিস্ক থাকবে না। তবে তখন আমাদের স্মৃতি কোথায় সংরক্ষিত থাকবে ? চেতন মস্তিস্ক আমাদের স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলে। মৃত্যুর পরে, আমাদের এই মস্তিস্কই যদি না থাকে, তবে কে এই স্মৃতিচারণ করবে ? এই সব অনেক প্রশ্ন আমাদের সবার মনে উঁকি দেয়। আমরা এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো।
প্রথমে বিজ্ঞানের কথা দিয়ে শুরু করি। এই কিছুদিন আগেও আমরা শুনতাম, সব রোগের ঔষুধ আছে, মনের রোগের কোনো ঔষুধ নেই। এখন কিন্তু আর সেই কথা আমরা শুনি না। ডাক্তাররা বলছেন, মনের রোগেরও ঔষুধ আছে। আপনি মনোবিদের কাছে যান। তো কিছু ক্ষেত্রে ডাক্তারবাবুরা নার্ভের ঔষধ দিচ্ছেন। আবার কিছু ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং অর্থাৎ আপনার মনের কথা জেনে, মনের কষ্ট জেনে আপনার মনকে উপদেশের মাধ্যমে, আপনার মানসিক রোগ নিরাময় করছেন। তো বিজ্ঞান এখন শুধু আর স্থূল দেহের চিকিৎসার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তারা আমাদের মানস দেহের চিকিৎসা শুরু করে দিয়েছেন।
আমাদের মুনি ঋষিরা হাজার হাজার বছর আগে থেকেই, উপলব্ধি করেছিলেন, মানুষের দেহ পাঁচটি। এবং তার চিকিৎসাও পঞ্চবিধ। বিজ্ঞান এখন দুটো দেহের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। আর স্বামী রামদেবের দৌলতে আর একটা দেহের চিকিৎসা সম্প্রতি সার্বজনীন হয়েছে। সেটা হচ্ছে প্রাণময় দেহ। এবং সেটা এখন বিজ্ঞান জগতেও স্বীকৃত হয়েছে। এবং আমি বিশ্বাস করি, ঈশ্বরের কৃপায়, বিজ্ঞানও একদিন পাঁচটি দেহ সম্পর্কেই জ্ঞাত হবে। এবং তার চিকিৎসা পদ্ধতিও জানতে পারবে। শুধু দরকার যেটা তা হচ্ছে, অন্ধ-বদ্ধ ধারণা যেন আমাদের প্রগতিকে আটকে না দেয়।
যাই হোক যে কথা বলছিলাম, আমরা আমাদের স্মৃতির সাহায্যেই আমাদের পুরাতন আমি ও বর্তমানের আমির মধ্যে সাযুজ্য খুঁজে পাই। আর স্মৃতি থাকে আমাদের দেহের মধ্যে। তবে আমাদের দেহের নাশ হয়ে গেলে আমরা কি ভাবে পুরাতন আমি আর বর্তমানের আমির মধ্যে সাযুজ্য খুঁজে পাবো। এই ব্যাপারটা বুঝতে গেলে আমাদের সেই পুরাতন কথা আর একবার স্মরণ করতে হবে। আর তা হচ্ছে আমাদের দেহ একটি নয়, আমাদের দেহ পাঁচটি। আর প্রত্যেকটি দেহের মধ্যেই আমাদের আমিত্ত্বের বীজ লুক্কায়িত আছে। প্রত্যেক গাছ তার মৃত্যুর আগে তার বীজের মধ্যে তার ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে সুরক্ষিত করে রেখে যায়। বীজ দেখে বোঝা মুশকিল, তার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা। কিন্তু সত্য হচ্ছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ, ও সুরক্ষা পেলে সেই বীজ আবার বৃহৎ গাছের আকার নেবে। এবং আবার সে বীজে অসংখ্য সম্ভাবনা রেখে যাবে। ঠিক তেমনি আমরাও আমাদের সমস্ত শক্তিকে, সম্ভাবনাকে বীজ আকারে সঙ্গে নিয়ে যাই। আমরা কেউ মরি না, অর্থাৎ আমাদের কখনো নাশ হয় না। আমরা খোলস ছাড়াই মাত্র। আমাদের স্থূল ও প্রাণময় দেহের নাশের পরে, আমরা মনোময় দেহের মধ্যে অবস্থান করি। এবং এই দেহের মধ্যেও আমাদের সমস্ত শক্তি নিহিত থাকে। আমাদের মনোময় দেহের নাশ হয়ে গেলে, আমরা বিজ্ঞানময় দেহে অবস্থান করি। সেখানেও আমাদের সমস্ত শক্তি সংরক্ষিত থাকে। তবে হ্যাঁ, আমরা যখন প্রকৃতিকে আশ্রয় করি, আর এই প্রকৃতির জগতে বাস করি,তখন আমাদের প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলতে হয়। স্বয়ং ভগবানও যখন মানুষ হিসেবে জন্ম গ্রহণ করেন, তাকেও প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলতে হয়। আর যখন যেমন দেহে বা যার মধ্যে আমরা আশ্রয় গ্রহণ করি, সাময়িক ভাবে, সেটাকেই আমরা আমি বলে ভাবতে শিখি। আর এটাকেই বলে অজ্ঞান। অর্থাৎ আমি কে সেটা আমি ভুলে যাই। এখন আমি যে সংসারে আছি, যে মা-বাবার আশ্রয়ে আছি, যে আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে আছি, তাদেরকেই আমি, আমার ভাবি। এটাকে বলে আমাদের সম্মন্ধ বা মোহ। আর এটাই আমাদের বন্ধন। এই মোহ যখন আমরা কাটিয়ে উঠতে পারবো, তখন আমরা আমাকে জানতে পারবো।
আমাদের যখন তথাকথিত মৃত্যু হয়, তখন আমরা আমাদের একসঙ্গে দুটো দেহ ত্যাগ করি। অর্থাৎ আমরা আমাদের অনন্ময় দেহ, যা অন্ন দ্বারা পুষ্ট ছিল, সেটাকে ত্যাগ করি। এবং আমাদের প্রাণময় দেহ যা প্রাণবায়ু দ্বারা পুষ্ট ছিল, সেটাকে আমরা ত্যাগ করি। আর এর পরে, আমাদের মতো সাধারণ লোকেরা মনোময় দেহে অবস্থান করি। এই মনোময় দেহে যখন অবস্থান করি, তখন আমরা মনোময় জগতে বাস করি। এই মনোময় জগৎ আমাদের স্থূল জগতের মতোই একটা জগৎ। অর্থাৎ আমরা যখন স্বপ্ন দেখি, তখন যেমন আমরা এই স্থুল জগতের মতোই একটা জগতে বিচরণ করি। তেমনি মনোময় জগতও এই স্থূল জগতের মতো একটা জগৎ। স্থূল জগতে আমাদের কর্ম্মক্ষমতা থাকে কিন্তু মনোময় জগতে আমাদের কর্ম্ম ক্ষমতা থাকে না। অথচ সেখানেও মনের সাহায্যে আমাদের স্বাভাবিক বৃত্তি অনুসারে আমাদের মনে হয় যেন আমরা কর্ম্ম করছি। ঠিক স্বপ্নের মতো। স্বপ্নে আমাদের মনে হয়, অনেক কিছু করছি, কিন্তু সত্যি সত্যি কিছু করছি না। আর স্বপ্ন জগতে যেমন অনেক কিছু করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, যেমন আমি আকাশে উড়ছি, বা জলের মধ্যে ডুবে আছি, শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে খেলা করছি, ইত্যাদি ইত্যাদি তেমনি মনোময় জগতেও আমাদের অনেক কিছু করতে হয়। আর সেটা সেই ধরনের হয়, যা আমরা স্থূল জগতে থাকার সময় করতাম বা করার কথা ভাবতাম। অর্থাৎ স্থূল জগতে থাকার সময় যদি আমার পূজা অর্চনা করবার অভ্যাস করে থাকি, তবে মনোময় জগতেও একই রকম করতে থাকি। আবার এই মনোময় জগতে, আমাদের ইচ্ছে অনুযায়ী যে কারুর সাক্ষাৎ পেতে পারি। এগুলো তখন সত্যি মনে হয়। তখন স্থূল জগতের কোনো জ্ঞান আমাদের থাকে না, কিন্তু স্থূল জগতে যেমন আচরণ করতাম, সেখানেও ঠিক তেমনি আচরণ করতে থাকি। আর আমার সুখ দুঃখ অনুভবও হতে থাকে।
এই মনোময় শরীরে যেহেতু আমাদের সমস্ত শক্তি নিহিত থাকে, এমনকি ইন্দ্রিয় শক্তি এই দেহের মধ্যে নিহিত থাকে, তেমনি থাকে স্মৃতিশক্তি । তবে সুপ্ত। কিন্তু উন্নত মহাত্মারা দুটো জগতের স্মৃতি তখন অর্থাৎ স্থূল জগতের ও মনোময় জগতের স্মৃতি জাগ্রত করতে পারেন। এই মনোময় শরীরের খোলস পাল্টিয়ে মহাত্মারা জ্ঞানময় জগতে প্রবেশ করেন। অর্থাৎ তখন তারা বিজ্ঞানময় শরীর ধারণ করেন। এই বিজ্ঞানময় শরীর আর কিছু নয়, আমাদের জ্ঞান। আর এটি অপার্থিব। অনন্ময় শরীর স্থূল প্রাণময় শরীর সূক্ষ্ম মনোময় শরীর সূক্ষতম। কিন্তু এই তিন শরীরই পার্থিব, কিন্তু বিজ্ঞানময় শরীর অপার্থিব। কিন্তু বিজ্ঞানময় শরীর অপার্থিব হলেও পার্থিব শরীরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। অর্থাৎ আমরা এই স্থূল শরীরে থাকা কালিন জ্ঞান সংগ্রহ করতে পারি। এবং জ্ঞানময় শরীরকে পুষ্ট করতেও পারি।
এখন কথা হচ্ছে, স্মৃতি নিয়ে। স্মৃতি রক্ষিত থাকে বিজ্ঞান অনুযায়ী মস্তিষ্কে। আর মন সম্পর্কে বিজ্ঞান বলছে, মন হচ্ছে আমাদের স্নায়ুর ক্রিয়া। আর স্নায়ু ক্রিয়াশীল হয় জ্ঞানেন্দ্রিয়র সাহায্যে। তো ইন্দ্রিয় শক্তি, অর্থাৎ জ্ঞান ইন্দ্রিয়গুলোর শক্তি যদি আমাদের মনোময় দেহেও অবস্থান করে তবে আমাদের মনোময় দেহেও স্মৃতি সুরক্ষিত থাকতেই পারে।
বেশিরভাগ মানুষ এই মনোময় দেহে অনির্দিষ্ট কিছুকাল অবস্থানের পরে আবার স্থূল দেহে প্রবেশ করে। তো তখনও তার সঙ্গে তার সেই স্মৃতিশক্তিও থাকে। কিন্তু সুপ্ত থাকে। আর এই স্মৃতিশক্তি অব্যবহৃত থাকার জন্য অতলে তলিয়ে যায়। কিন্তু থাকে। অর্থাৎ আমাদের অবচেতন মনে এই স্মৃতি সুরক্ষিত আছে বা থাকে। আর একে জাগ্রত করবার আমরা কেউ চেষ্টা করি না। মহাজনরাও, স্মৃতি জাগ্রত করবার জন্য কাউকে উৎসাহিত করেন না। কারন, তাতে তার বর্তমান জীবন প্রভাবিত হতে পারে। সমাজে শৃঙ্খলার অভাব ঘটতে পারে। শুধু পারে না ঘটবে। তাই এটি গুপ্তপ্রক্রিয়া। জ্ঞানীরা এটা করে থাকেন, নিজেকে সমৃদ্ধ করবার জন্য। সমাজের কল্যাণের জন্য। আমাদের মতো সাধারণ লোকের এটি কারায়ত্ত্ব হলে, এই শক্তির অপব্যবহারের সম্ভাবনা। ধরুন আপনি জেনে গেলেন আগের জীবনে আপনাকে কেউ ঠকিয়েছিলো। তো আপনার মধ্যে তখন একটা বিদ্বেষ ভাবের উদয় হবে। এবং আপনি উত্তেজিত হয়ে, সমাজের এমনকি আপনার নিজের ক্ষতি করে বসবেন।
তাই জন্ম- জন্মান্তরের স্মৃতি আমাদের সবার মধ্যে আছে, এটা আমাদের অবচেতন মনের মধ্যেই আছে। এটা জাগ্রত কারো সম্ভব। কিন্তু না করাই ভালো। কিন্তু এটা সত্য, এই আমি আর সেই আমি একই। আমার কোনো পরিবর্তন নেই। আমি শাশ্বত। অমর। চিরকালীন। আমি এক অমৃত-যাত্রার যাত্রী মাত্র। মাঝে মধ্যে খোলস পাল্টাই মাত্র।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি ওম।
বেদান্তের মূল কথা হচ্ছে, আত্মা অমর। আমাদের প্রত্যেকের আত্মাই অমর। পঞ্চভূতের এই দেহের মৃত্যু হলেও আত্মার মৃত্যু নেই। এমনকি এই আত্মা শুন্যে বিলীন হয়েও যায় না। এবং এই আত্মার অনন্তযাত্রারও কোনো বিরাম ঘটে না। কারুর কারুর মতে অমরত্ত্ব নাকি লাভ করতে হয়, অর্থাৎ অমরত্ত্ব অর্জিত গুনের দ্বারা হতে পারে। এখন কোন্ কোন্ গুনের অধিকারী হলে বা কতটা গুনের অধিকারী হলে মানুষ অমর হতে পারে, তার কোনো মাপকাঠি নেই। আবার কেউ বলেন, অমরত্ত্ব বলে কিছু হয় না। কিন্তু বেদান্ত বলছে, অমরত্ত্ব বা নিত্যতা আত্মার স্বভাব। এর কোনো পরিবর্তন করা যায় না। আর তার জন্য কোনো বিশেষ গুন্ আয়ত্ত্ব করতে হবে, তারও কোনো মানে নেই। এই অমরত্ত্ব না কোনো আশীর্বাদ, না কোনো অর্জিত শক্তি। এটি আমাদের নিজস্ব স্বভাব মাত্র।
দেখুন, সৃষ্টি আছে, অথচ ধংশ নেই এমন কোনো বস্তুর কল্পনা অলীক। এমন কোনো বস্তুর কল্পনা করা যায় না, যার শুরু আছে অথচ শেষ নেই। এটা একেবারেই অসম্ভব। আসলে স্থান ও কাল যেমন সীমাহীন, অনন্ত তেমনি তেমনি আত্মাও অমর। এই দেহ সৃষ্টির পূর্বেও ছিল আমাদের দেহের বিনাশের পরেও থাকবে।
এখন কথা হচ্ছে, যদি আমাদের এই দেহের জন্মের আগে আমার অস্তিত্ত্ব থেকে থাকে তবে তা আমরা ভুলে যাই কি করে, বা আমরা মনে করতে পারি না কেন ? আসলে আত্মার অমরত্ত্ব প্রমানের জন্য স্মৃতি কোনো মানদন্ড হতে পারে না। বেদান্ত বলছে,যদি ধরেও নেই, স্মৃতি একটা মানদন্ড হতে পারে, তবে বলি, যারা রাজযোগ অভ্যাস করেছেন , বা ঋষি পতঞ্জলির যোগশাস্ত্র পড়েছেন, তারা জানেন :
"সংস্কারসাক্ষাৎকরনাৎ পূর্বজাতিজ্ঞানম্" অর্থাৎ সংস্কারকে বুঝতে পারলে, পূর্বজন্মের জ্ঞান হতে পারে। প্রাক অভিজ্ঞতার এই ছাপ আমাদের অবচেতন মনের গভীরে সংরক্ষিত আছে। এর কখনো বিনাশ নেই। আমাদের এই পূর্বসঞ্চিত জ্ঞান বা অভিজ্ঞতাকে চৈতন্যের মাধ্যমে জাগ্রত করতে পারি। এটাই বলে স্মৃতি। রাজযোগীরা তাদের এই অবচেতন মনের সুপ্ত সংস্কারের উপরে গভীর মনোযোগ স্থাপন করে, তার বিগত জীবন-পরম্পরার সমস্ত ঘটনাকে স্মরণে আনতে পারেন। আমাদের দেশে এমন অনেক মহাপুরুষের সন্ধান আমরা জানি, যারা তাদের নিজের অতীত জীবন সম্পর্কে জানেন। এমনকি শুধু নিজের অতীত জীবন নয়, অন্যের অতীত জীবন সম্পর্কেও জানতেন। আমরা মহা-যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের কথা শুনেছি, তিনি অর্জুনকে বলছেন - হে অর্জুন, তোমার, আমার বহুবার জন্ম হয়েছে, তুমি তা জান না, কিন্তু আমি সে সব জানি। অর্জুনকে নিয়ে কৃষ্ণ যখন মহাদেবের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন, তখন মহাদেব তাদের নর ও নারায়ণ বলে সম্মোধন করেছিলেন। অর্থাৎ শিবজি তাদের পূর্ব জন্মের নাম ধরে ডেকেছিলেন। এই সব কথা যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের মনে ছিল। কিন্তু অর্জুনের সে সব মনে ছিল না। তাই শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, তুমি তা জান না, কিন্তু আমি সেসব জানি।
আমরা ভগবান বুদ্ধকে তার পূর্ব-পূর্ব জীবনের কথা বলতে শুনেছি। শুধু তাদের নিজের পূর্ব জীবনের কথা নয়, তার কাছাকাছি যারা থাকতো দেবদত্ত ইত্যাদিদের পূর্ব জীবনের কথা বলতে শুনেছি। এমনকি এখনো অনেক মহাপুরুষ আছেন, যারা তাদের পূর্ব জীবনের কথা জানেন।
আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা আত্মা সম্পর্কে কিছুই জানি না। এমনকি আমাদের অবচেতন মনে কি সংস্কার আছে তাও জানি না। বা সেই সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই। এই অবচেতন মনকে বেদান্ত বলছে চিত্ত। আমাদের সমস্ত সংস্কারের ভান্ডার হচ্ছে এই চিত্ত। আমাদের চিত্তে এই সব সংস্কার সুপ্ত অবস্থায় থাকে। কিন্তু যখন আমাদের ইচ্ছা শক্তিকে জাগ্রত করি, এবং আমাদের চিত্তের উপরে গভীর মনোনিবেশ করি, তখন চিত্তের ভিতরে অবস্থিত স্মৃতির উপরে আমাদের জ্ঞানের আলোর বন্যা বইতে শুরু করে, আর আমাদের স্মৃতি স্পষ্ট হয়ে যায়। তখন আমরা আমাদের এই স্মৃতিকে আমাদের চেতন মনের স্তরে তুলে নিয়ে আসতে পারি।
দেখুন আমাদের সামনে বাতাসে অনেক ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে, বহু সুর, ধ্বনি ভেসে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আমরা তা দেখতে পাই না, শুনতে পাই না। কিন্তু যদি রিসেপ্টর অর্থাৎ গ্রাহক যন্ত্র ও প্রজেক্টর বা অভিক্ষেপন যন্ত্র যদি আমাদের সক্রিয় থাকে তবে এগুলো আমাদের চোখে বা কানে ধরা দিতে পারে। আবার দেখুন, ছবি যা কতকগুলো বিন্দুর সমষ্টি মাত্র, যখন একটা নির্দিষ্ট ঘনীভূত মাত্রায় থাকে, তবে তাকে আমরা দেখতে পাই , বেশি ঘনীভূত অবস্থায় বা ঘনত্ত্বের মাত্রা যদি কমে যায়, তবে আমরা সেই ছবি দেখতে পাই না।তাই আমাদের চোখে অদৃশ্য, বা কানে শোনা না গেলেও, এগুলোর অস্তিত্ত্ব যেমন আমরা অস্বীকার করতে পারি না, তেমনি পূর্ব জীবনের স্মৃতি আমাদের নেই তা আমরা বলতে পারি না। আসলে আমাদের শরীরের যখন পরিবর্তন হয়, অর্থাৎ এক শরীরের থেকে যখন আমরা আর এক শরীরে প্রবেশ করি, তখন আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা একটা মূর্ছা অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাত্রা করি। আমাদের মাথায় আঘাত লাগলে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের পূর্ব স্মৃতি হারিয়ে যায়। কিন্তু আবার নতুন করে আঘাত লেগে আকস্মিক ভাবে আবার সেই স্মৃতি ফিরে আসতে পারে। এমনি অনেক ঘটনার কথা আমরা সবাই শুনেছি। সেই রকম আমাদের অবচেতন মনের পর্দায়, আমাদের পূর্ব পূর্ব জীবনের সমস্ত ঘটনার স্মৃতি সুপ্ত বা অদৃশ্য অবস্থায় আছে। তার অস্তিত্ত্বে অস্বীকার করা মানে সত্যকে অস্বীকার করা।
আমরা কিছু মনে করতে পারি আর না পারি, আমাদের একটা সহজাত বৃত্তি আছে, যা আমার চরিত্র গঠনের উপাদান। আমার এটা ভালো লাগে, আবার এটা ভালো লাগে না। একে ভালো লাগে, তো ওকে ভালো লাগে না। পাহাড় ভালো লাগে, তো সমুদ্র ভালো লাগে না। কেন এমন হয়। আমাদের মধ্যে এত যে বৈচিত্র, এর কারন কি ? আসলে আমাদের পূর্ব জীবনের অভিজ্ঞতাই এই জীবনের অভিব্যক্তি। আমরা পূর্ব জীবনে যে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলাম, সেটা আমাদের চেতন মন ধরতে পারছে কি পারছে না, সেটা বড় কথা নয়। আমি রক্ত দেখলে ভয় পাই। ঝড়ের কথা শুনলে ভয় পাই। আবার আমি ধ্যানে আনন্দ পাই। এগুলো আমাদের সবই পূর্বসংস্কার থেকে হয়। অনেকে ছোটবেলা থেকে গান করতে ভালোবাসে, ছবি আঁকতে ভালোবাসে। এগুলো আমাদের সবই পূর্বসংস্কার থেকে হয়। কেউ কেউ বলে থাকেন, গায়কের ছেলে তাই গান গাইতে ভালো বাসে। আসল ব্যাপারটা কি জানেন, আমরা যারা এই জনমে গানকে ভালোবাসি, পূর্নতা অর্জনের জন্য, পরের জীবনে আমরা সেই লক্ষ পূরণের জন্য উপযুক্ত মা-বাবা খুঁজে নেই। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যারা এই জীবনে যোগসাধনা করতে করতে মারা যান, তার পরবর্তী জীবনে যোগসাধনার উপযুক্ত পরিবারে বা পরিবেশে জন্ম গ্রহণ করবেন। তাই আপনি যে ধরনের সাধনাই করুন না কেন, পরবর্তী জীবনে সেই সাধনার লক্ষে জন্ম ও দেহধারন করবেন। তাই মানুষ বা জীব ধীরে ধীরে উন্নততর দেহপ্রাপ্তি হয়। আর এই ভাবেই আত্মার উর্দ্ধগতি সম্ভব হচ্ছে।
আমাদের এই ব্যক্তি-আত্মার অবচেতন-মনের অন্তরালে লুকোনো থাকে আমাদের পূর্বাপর জীবনের অভিজ্ঞতা। আর সেখান থেকেই আমরা অনুপ্রেরণা পাই, লক্ষ বস্তুর দিকে ধাবিত হই। জীবন একটা পরম্পরা। মানুষের মধ্যে অনেক পাশবিক বৃত্তির লোক আছেন। আসলে এঁরা পূর্বের জীবনে অনুন্নত জীব ছিলেন। সুকৃতির বসে মনুষ্যদেহ পেয়েছেন, কিন্তু বৃত্তি পরিবর্তন হয় নি। আমার এক বন্ধুর ছেলে, বাজারে গেলেই মুরগির দোকানে দাঁড়িয়ে মুরগি কাটা দেখতো, আর আনন্দে লাফাতো। আবার এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা অন্যের কষ্ট এমনকি সিনেমা দেখে কেঁদে ফেলেন। এগুলো সবই পূর্ব জীবনের সংস্কার। অতীত জীবনগুলোর কর্ম্মফল আমাদের প্রারব্ধ আকারে ভোগ করতে হবে, আর এই জীবনের কর্ম্মফল যা ভোগ করা হলো না, তা পরবর্তী জীবনে ভোগ করতে হবে। তাই বলা হয়ে থাকে প্রারব্ধ খন্ডাতে পারে না কেউ। কিছুই নষ্ট হবে না।
কিন্তু কথা হচ্ছে এই স্মৃতি আমাদের এক দেহ থেকে আর এক দেহে, বা এক জীবন থেকে আর এক জীবনে স্থানান্তরিত হয় কি করে ? আসলে স্মৃতি আমাদের সম্পূর্ণরূপে দেহযন্ত্রের উপরে নির্ভর করে না। এটি ঘোরে জীবাত্মার সাথে সাথে। দেহযন্ত্রের নাশ আছে, কিন্তু এই আত্মার নাশ নেই। আমাদের স্থুল দেহের মৃত্যুকালে আমাদের সমস্ত শক্তি এমনকি ইন্দ্রিয়শক্তি সূক্ষ্ম আকারে পরমাত্মার সেই আত্মজ্যোতিখন্ড সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে থাকে। জীবাত্মার প্রচ্ছন্ন সেই শক্তি, পরবর্তী শরীরে অধিগত ক্ষমতাকে পুনর্বিকাশ করে মাত্র। প্রত্যেক ব্যক্তি-আত্মার সঙ্গে যে স্মৃতি সঞ্চিত থাকে তা পরবর্তী কালে বিশেষ পরিস্থিতিতে আমাদের চেতন স্তরে উঠে আসে, ফল দান করবার জন্য।আর এই শক্তি বা স্মৃতি বা অভিজ্ঞতা আমাদের ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। এই বিকাশ আমাদের স্তরের পরিবর্তন করে। তাই আমরা বিভিন্ন স্তরের মানুষ দেখতে পাই।
এখন কথা হচ্ছে স্মৃতি আমাদের অগোচর বা অদৃশ্য থাকে কেন ? আমাদের জ্ঞানীন্দ্রিয় চেতনার অধিকতর শক্তিশালী আলো আমাদের স্মৃতিকে নিষ্প্রভ করে রাখে, তাই আমরা একে জানতে বা বুঝতে পারি না । কিন্তু আমরা যদি বাইরের জগৎ থেকে আমাদের জ্ঞানীন্দ্রিয়গুলোকে অন্তর জগতের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে পারি, অর্থাৎ চোখের পর্দা যদি ভিতরের দিকে খুলতে পারি, ও আমাদের অন্তরের গভীরে যে চৈতন্যলোক আছে, সেখানে মানসিক রশ্মির প্রতিফলন ঘটাতে পারি তবে, আমরা আমাদের পূর্ব -পূর্ব জীবনকে জানতে ও স্মরণ করতে পারবো।
যারা এই অতীত জীবন সম্পর্কে জানতে চান, তারা আগে আত্মসংযমের অভ্যাস করুন। এতে ইন্দ্রিয়গুলো নিজের আয়ত্ত্বে আসবে। এবার মনকে নিবিষ্ট ও দৃঢ় করে, অন্তঃকরণের চৈতন্যলোকে স্থির করুন। তখন মনজ্যোতিঃ উদ্ভাসিত হবে। সেই আলোতে আপনি স্নাত হবেন, এবং স্বয়ংকে জানতে পারবেন। স্বয়ংকে জানতে পারলে, আপনার পূর্বাপর সব জানতে পারবেন। আর যারা এই সাধনায় সিদ্ধ হবেন, তারা অনির্বান চৈতন্যলোকের আনন্দ, উন্নত সার্থক জীবন, এবং জীবনের পরিপূর্ণতা পাবেন ।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি ওম।
No comments:
Post a Comment