একই মানুষ দুই দেহে কি ভাবে থাকতে পারে ?
আজ আমরা শুনবো , একটা অলৌকিক ঘটনা সম্পর্কে। বিজ্ঞান যার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি।
আমরা শুনেছি, এমনকি আমাদের অনেকের অভিজ্ঞতা বলে, বহু মহাপুরুষ তাঁর স্থূল দেহ নিয়ে যথেচ্ছ বিচরণ করতে পারেন। বহু সাধক তার গুরুদেবকে স্মরণমাত্র দর্শন পান। বিবেকানন্দ পেয়েছেন রামকৃষ্ণের দেখা। এমনকি ঠাকুরের মৃত্যুর পরেও ঠাকুরের জ্যোতির্ময় দেহ দেখতে পেয়েছেন। এমনকি ঠাকুরের কাছ থেকে নির্দেশও পেয়েছেন, বিবেকানন্দ । বাবা লোকনাথ, বিজয় গোস্বামীকে গভীর জঙ্গলে আগুনের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। শ্রীশ্রী রাম ঠাকুর এমনি ভাবে অনেক শিষ্যকে দেখা দিতেন। শুধু রামঠাকুর বা বাবা লোকনাথ নয়, অনেক মহাত্মা বা অনেক মহাপুরুষ আছেন এবং ছিলেন, যারা তাদের স্মরণপ্রার্থীকে দেখা দিয়ে থাকেন। তো রামঠাকুরের এক শিষ্য শ্রী শুভময় দত্ত একবার শ্রীশ্রী রামঠাকুরকে প্রশ্ন করেছিলেন,আচ্ছা মানুষ কি নিজ শরীর এবং পরিহিত বস্ত্রাদি সহ শূন্যে এক স্থান থেকে আর এক স্থানে চলে যেতে পারেন ? তো রামঠাকুর উত্তর দিয়েছিলেন, "হ্যাঁ যে যে স্থান দিয়ে বিদ্যুৎ যেতে পারে, মানুষ ঐ সব স্থান দিয়ে যেতে পারে, এবং একই সময় বহু স্থানে উপস্থিত থাকে পারে।" (শ্রী শ্রী ঠাকুর রামচন্দ্র দেব স্মরণে - পৃ ২৩)
এতো শুধু দেখা দেওয়া বা উপদেশ দেওয়া। এটা আমাদের কারুর কারুর মনে হতে পারে, যে এগুলো সবই আমাদের মনের ভ্রম। কিন্তু মানুষ তার নিজের দেহকে নিষ্ক্রিয় রেখে অন্য দেহে প্রবেশ করে, এবং নতুন দেহে সে জ্ঞান সংগ্রহ করছেন, এটা খুব কম শোনা যায়। এই রকম দুজন মহাপুরুষের কথা আজ আমরা শুনবো। এবং এগুলো সম্ভব কি না সেই সব কথাও শুনবো।
আচার্য্য শঙ্কর বিচার-যুদ্ধে মন্ডন আচার্যকে পরাজিত করলেন। পণ্ডিত মন্ডন পাছে প্রতিশ্রূতি অনুযায়ী সন্যাস নিয়ে না নিতে পারেন , তাই তার স্ত্রী সরস্বতীদেবী, আচার্য্য শঙ্করকে পরাজিত করবার মানসে, আজীবন ব্রহ্মাচারীকে কাম বিষয়ক প্রশ্ন করে বসলেন, এতে করে আচার্য্য শঙ্কর বাকরুদ্ধ হয়ে যান। তখন বাধ্য হয়ে তিনি এক মাস সময় চেয়ে নেন এই প্রশ্নের জবাব দেবার জন্য। এবং তৎক্ষণাৎ জঙ্গলে প্রবেশ করেন। এদিকে রাজা অম্রুক জঙ্গলে শিকারে এসে হঠাৎ মারা যান। আচার্য্য শঙ্কর তার বর্তমান দেহকে একটি গুহায় রেখে, তার শিষ্যকে দেহ রক্ষার ভার দিয়ে ওই রাজা অম্রুকের শরীরে প্রবেশ করেন শঙ্করাচার্য । রাজা বেঁচে ওঠেন আর শঙ্করের দেহ মৃতপ্রায় হয়ে গুহার মধ্যে পড়ে থাকে। ওই রাজ্ দেহে থেকে শঙ্কর কাম শাস্ত্র রচনা করেন। তারপর আবার রাজদেহ পরিত্যাগ করে, আচার্য্য শঙ্করের দেহে প্রবেশ করেন। এই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন তার শিষ্য পদ্মপাদ। এসব আমাদের কাছে বইপড়া গল্প।
এমনি আর একটা কাহিনী আমরা শুনেছি। মহাযোগী গোরক্ষনাথের কথা আপনারা সবাই শুনেছেন। এই গোরক্ষনাথের গুরু ছিলেন, শিবস্বরূপ মৎস্যেন্দ্রনাথ। গোরক্ষনাথের এক সময় মনে হলো, কায়াসিদ্ধি অর্থাৎ শরীরের উর্দ্ধে ওঠা, বা শরীরকে সূক্ষ্মতম-বৃহত্তম করা এই সাধনা আজও পূর্ণাঙ্গ হয় নি। তো গুরু মহারাজ কাছে থাকলে হয়তো সব কথা জানা যেত। তাই তিনি গুরুকে স্মরণ করলেন। কিন্তু গুরুর দেখা নেই। তো ভাবলেন, গুরু কোথায় আছে, সেটা নিজশক্তিবলে জানতে হবে। ধ্যানাবিষ্ট হয়ে তিনি আশ্চর্য্য হয়ে দেখলেন, গুরুদেব রয়েছেন কামরূপে। এবং সেখানে শত শত তরুণী দ্বারা তিনি বেষ্টিত। ভাবলেন, একি ? গুরুদেব ভোগসুখে ডুবে আছেন ? কামরূপ রমনীদের রাজ্য। ভাবলেন, হয়তো গুরুদেব প্রারব্ধ বসতঃ এই দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন। তো যোগীরাজ গোরক্ষনাথ গুরুদেবের উদ্ধারের নিমিত্ত সেখানে উপস্থিত হলেন। এবং অনেক চেষ্টায় সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে গুরুদেবের জ্যোতির্ময় দিব্য দেহ নিয়ে আসেন।এখন, গোদাবরী তীরে ভজন কুটিরে আসার পরে, গোরক্ষনাথ আশ্চর্য়্য় হয়ে দেখেন, গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথের স্থুল দেহ সেখানেই ধ্যানাবিষ্ট। আর তার সামনে কয়েকজন সেবক ভক্ত হাতজোড় করে বসে আছেন । এবং লক্ষ করলেন, এতক্ষন গুরুদেবের যে দিব্যদেহ তার সঙ্গে ছিল, সেই জ্যোতির্ময় দিব্যদেহ গুরুদেবের স্থুল দেহের মধ্যে মিশে গেলো। একি অদ্ভুত অলৌকিক কান্ড। সেবকরা বললো, গুরুদেব এখানেই এই গোদাবরী তীরেই অবস্থান করছেন। এক দিনের জন্যও কোথাও যাননি।
তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো ? মানুষ কি একই সঙ্গে দুটো দেহে অবস্থান করতে পারে ? আমরা এই প্রশ্নের জবাব খুঁজবো। আসলে এই দেহটা আমাদের সংকল্প পূরণের জন্য। এই কথাটা আমাদের ভালো ভাবে মনে রাখতে হবে।
প্রথমে বলি, প্রাণহীন ও চেতনাহীন এক জিনিস নয়। আমরা অনেক সময় সঙ্গাহীন হয়ে যাই, তার মানে এই নয় যে আমরা মারা গেছি। আমাদের যখন ক্লোরোফর্ম দিয়ে অচেতন করা হয়, তখন কি আমরা প্রাণহীন হই ? হই না। আসলে চেতনাহীন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু প্রাণহীন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। ডাক্তাররা আমাকে অচৈতন্য করে অপারেশন টেবিলে তোলে। আমার জ্ঞান থাকে না, কিন্তু আমি বেঁচে থাকি। এই অচেতনতা আমাদের খানিক্ষন পরে কেটে যায়। আর এই অচেতন অবস্থায় কি ঘটেছিলো, তা আমাদের মনে থাকে না, কারন আমার চেতনা ছিলো না। কিন্তু এটা সত্য যে আমি সেই সময় মারা যাই নি। আমি ছিলাম।
ধ্যানে আপনারা যারা আমিকে ধরার চেষ্টা করেছেন, তারা খেয়াল করেছেন যে এই প্রক্রিয়ায় একটা সময় আসে, যখন আমাদের মনে হয়, আমার আমি সত্ত্বা দেহের বাইরে ঘোরাফেরা করছে। আমি যেন মারা গেছি। কেউ কেউ এটাকে সমাধি ভেবে থাকেন, আসলে এটি একটি সঙ্গাহীন অবস্থা। যদিও সেটা খুব স্বল্প সময়ের জন্য। আবার যখন আমরা আমাদের পুরোনো স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলি, তখন আবার আমি দেহের মধ্যে প্রবেশ করি। আমার অহং যখন আমাদের দেহের বাইরে অবস্থান করে তখন আমাদের খুব ভয় করে। কিন্তু এটা যাদের অভ্যাস হয়ে গেছে, তারা এই সময়টাকে দীর্ঘায়িত করতে পারেন । অর্থাৎ দেহ থেকে অহংকে আলাদা করতে পারেন । এবং ইচ্ছেমতো ভিতর-বাহির করতে পারেন । বেশিক্ষন যারা এই অহংকে বাইরে রাখতে পারেন, তারাই সমাধি লাভ করতে পারেন। যদিও সমাধিতে অহংবোধও লোপ পায় ।
সার্কাসের খেলা দেখেছেন, কেমন একটা দড়ির উপর দিয়ে হাটছে। ব্যালান্সের খেলা। আপনি আমি পারবো না। ভীষণ মনোযোগের খেলা। মনটা এদিক ওদিক হয়ে গেলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু উপযুক্ত শিক্ষক পেলে, এবং যদি আমরা এটি বার বার অভ্যাস করি, তবে আমি আপনিও এই খেলা দেখাতে পারবো। কিন্তু একা একা এই চেষ্টা করতে গেলে , আমাদের জীবন সংশয় হতে পারে।
ঠিক তেমনি ধ্যানের সাহায্যে আমরা আমাদের অহংকে আমাদের শরীর থেকে আলাদা করতে পারি। এবং এই অহংকে যেমন আমরা বাইরে রাখতে পারি, বিশ্ব শক্তির সঙ্গে একাত্মীভূত করতেও পারি। এই সময় সাধক অনুভব করেন, যে জ্যোতির এক ক্ষুদ্র অংশ সে নিজে। এই সময় সাধকের অহংবোধ ছাড়া অন্য কোনো বোধ থাকে না। পরে অবশ্য অহংবোধও লোপ পায়। কিন্তু এই অহং বোধ লোপ পাবার আগের স্তরে, অহংকে আলাদা করে, আমাদের বাসনা বা সংকল্প পূরণের জন্য উপযুক্ত আধার বা শরীর খুঁজে নিতে পারি। সেটাই করেছিলেন, আচার্য শঙ্কর। নিজের জ্ঞান সংগ্রহের জন্য, কামের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভের জন্য, যুবক রাজা অম্রুকের শরীরে প্রবেশ করেছিলেন আচার্য্য শংকর । যে শরীর তখন ছিল অচেতন।
আর মৎস্যেন্দ্রনাথ করেছিলেন, শিষ্য গোরক্ষনাথকে কায়াসিদ্ধি লাভের শিক্ষা দেবার জন্য।
সব শেষে একটা কথা বলি, এইসব গুহ্যতত্ত্ব সর্ব্বসাধারণের জন্য নয়। গুরুবিনা এইসব সাধনা নিষিদ্ধ।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি ওম।
No comments:
Post a Comment