Thursday, 23 May 2019

ধ্যানরহস্যঃ - নিগূঢ়ানন্দ - খুঁজে ফিরি কুণ্ডলিনী থেকে নির্বাচিত কিছু অংশ


ধ্যানরহস্যঃ  - নিগূঢ়ানন্দ - খুঁজে ফিরি কুণ্ডলিনী  থেকে নির্বাচিত কিছু অংশ

আমার জীবনে লাহিড়ীবাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ একটা স্মরণীয় ঘটনা, সন্দেহ নেই। না ইনি সেই যোগীশ্রেষ্ট বাবাজির শিষ্য  শ্যামাচরণ লাহিড়ী   নন। ইনি শ্যামাচরণ লাহিড়ীর নাতি সরোজ কুমার লাহিড়ী। হাওড়া রামরাজতলা বাকসারা  গ্রামে তিনি থাকেন । লাহিড়ী বাবার সঙ্গে আমার দ্বিতীয় সাক্ষাতের দিনের রাতেই অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হলো আমার। আমাকে অনেকে অনেকদিন ধ্যান করতে বলেছিলেন।  কিন্তু ধ্যানে আমার কখনো প্রবৃত্তি হয় নি। সেদিন রাতে খাওয়া দাওয়ার পরে বিছানায় বসে মনে হলো একটু ধ্যান করে দেখিই না। চোখ বুজতেই দেখি আশ্চর্য্য জিনিষ ! বহু দূর থেকে গাঢ় নীলবর্ণের জ্যোতি বিন্দুরূপে ফুটে উঠে বড় হয়ে ছুটে আসছে আমার দিকে। সেই বিন্দু আলোর বৃত্ত রচনা করছে। তার মধ্যে যে অন্ধকার, সেই অন্ধকার থেকে আবার একটা বিন্দু ফুটে উঠে বড় হয়ে ছুটে আসছে আমার দিকে। সেই বিন্দু আলোর বৃত্ত রচনা করছে। তার মধ্যে যে অন্ধকার, সেই অন্ধকার থেকে আবার একটি বিন্দু ফুটে উঠে,আরও বৃহত্তর আলোর বৃত্ত রচনা করছে।  তার মধ্যে অন্ধকার থেকে আবার নতুন বিন্দু বেরুচ্ছে।  অদ্ভুত! এমনতো কখনো ভাবিনি। চিন্তা করিনি। এটা কি ? অপরিসীম একটা জিজ্ঞাসা  ফুটে উঠলো মনের মধ্যে।

কোথা থেকে কি হলো বুঝতে পারলাম না। কিছুদিন ধরেই শরীর ভালো করার জন্য যোগব্যায়াম করছিলাম। মায় শীর্ষাসন পর্যন্ত। ব্যায়াম গুলো যথেষ্ট কঠিন।  কিন্তু আমি ব্যায়ামগুলো অভ্যাস করতে গিয়ে দেখলাম, আমাকে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হচ্ছে না। আমার শরীর যে এত কোমল তা আমি জানতাম না। চক্রাকারে বেঁকে যেতেও আমার মোটেও বেগ পেতে হয় না। অকারণে আসন দুটো করছিলাম, সিদ্ধাসন ও ভদ্রাসন।  দুটো আসনই ব্রহ্মচর্যের জন্য। সিদ্ধাসন সম্পর্কে লেখা আছে, এ আসন করলে,জপ্, প্রাণায়াম, ধ্যান-ধারাণাদি অভ্যাস করলে, সহজে ও অল্প সময়ের মধ্যে সিদ্ধি লাভ করা যায়। ভদ্রাসন করলে ব্রহ্মচর্য রক্ষা পায়।  সিদ্ধাসন করে নিশ্বাস উর্দ্ধদিকে  টানলে কুণ্ডলিনীও জেগে উঠেন বলে অনেকের ধারণা। আমি অবশ্য ধ্যান জপ্, তপ্ ইত্যাদি কোনো উদ্দেশ্য মনে রেখে এ সব করিনি। অকারণেই করা।

ভাবলাম তাহলে, যোগব্যায়ামের ফলেই এই আলো দর্শন হলো না তো ? কিন্তু এই আলো দর্শন যেন একটা নেশা। রাতের পর রাত  জেগে এই আলো  দর্শনের চেষ্টা করতে লাগলাম।

কয়েকদিন পরে লক্ষ করলাম, আসনে বসে ভ্রূ মধ্যে বিন্দুরূপ আলো  কল্পনা করলেই, শরীরটা যেন কিসে দোলায়।  সে দোলানির মধ্যে একটা আনন্দও আছে। বেশ চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা। যেন একটা খেলা। ভাবলাম এই রহস্যের মানে জানতে হবে।  আবার লাহিড়ী বাবার (সরোজ কুমার লাহিড়ী) কাছে যাবো বলে ঠিক করলাম।

লাহিড়ী বাবা বললেন,  অনেক মহাপুরুষ আপনার সঙ্গে দেখা করবেন।  তারা আপনাকে চোখে চোখে রেখেছেন। আপনার দ্বারা লোক শিক্ষার কাজ হবে বলে।

লাহিড়ীবাবার কাছ থেকে ফিরে এলাম। একটা নতুন প্রেরণা যেন।  ধ্যানে যেন একটা নেশা চেপে গেল। কখন সেই নির্দিষ্ট সময় আসবে, সে সময়ের জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম। বাসে চলতে চলতে দাঁড়িয়ে থাকি বা বসে থাকি, মনে হয় চোখ বুজি।  চোখ বুজে একটু অপেক্ষা করলেই, সেই আলো  দেখতে পাই।  কখনো যদি সেই আলো আসতে  একটু দেরি হয়, ভয়ানক  যন্ত্রনা হয়। জেদ  চেপে যায়। যতক্ষন না সেই আলো  দেখবো বিশ্রাম নেই। সেই আলো  এসে  বেশিক্ষন থাকতো না।  আবার তাকে টেনে আনবার ইচ্ছা হতো। এই ভাবে অনেক রাত অবধি জেগে থাকতে লাগলাম। এর মধ্যে হঠাৎ একটা নতুন অভিজ্ঞতা হলো। মনে হতে লাগলো, পদ্মাসনে বসলে শরীরটা দুলতে থাকে।  শরীরটা খুব হালকা বোধ হয়। রাত জাগলে শরীর  খারাপ হয় জানি।  আগে রাত  জেগে পড়াশুনা করতে গিয়ে শরীর খারাপ হয়েছিলো। কিন্তু এখন রাত জাগলেও শরীরে কোনো অস্বস্তি বোধ করলাম না।

এর মধ্যে একদিন, তন্ত্রসাধক জ্যোতিষী ননীগোপাল চট্টোপাধ্যায়ের যাকে সবাই "বেণুদা"  বলে ডাকে, তার কাছে দুলালবাবুকে নিয়ে গেলাম। বেণুদা যাকে  সবাই  জ্যোতিষী বলে জানে,  বেণুদা আমার হাত দেখে বললেন, আপনার জ্যোতি দর্শন হচ্ছে ? বললাম হ্যাঁ একটা আলো  দেখি। বললেন, সাধনার প্রথম  স্টেজ। ধ্যান চালিয়ে যান।

আমি বললাম, এই জ্যোতি দর্শনের ফল কি ? বেণুদা বললেন, আপনি এখন পারিবারিক ও আর্থিক দিক থেকে প্রচন্ড বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। এই জ্যোতি দর্শন আপনাকে রক্ষা করছে। সবই তাঁরা মায়ের ইচ্ছা।

বেনুদার কাছ থেকে ফিরে আসার পর যথারীতি ধ্যান করতে লাগলাম। হঠাৎ মনে হল শুধু রাতে নয়, ভোরেও ধ্যান করলে ক্ষতি কি ? শুনেছি ব্রাহ্ম মুহূর্তে ধ্যান করা বিধেয়। তখন দেবতাদের বিচরণের সময়। কিন্তু আমি সে সময় বেছে  নিলাম না।  মনে হলো, ভোর বেলা উঠে হাত মুখ ধুয়ে, প্রাতঃকৃত্য সেরে একবারে বসবো। সে কথা ভাবতে গিয়েই আর এক নতুন অভিজ্ঞতা।

প্রাক্তন বা পূর্বজন্ম সম্পর্কে আগে আমার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। এখন মনে হয় পূর্বজন্ম বা প্রাক্তন বলে একটা কিছু থাকলেও থাকতে পারে। একটা অদৃশ্য শক্তিও আছেন যিনি আমাদের চালান, নির্দেশ দেন। তিনিই বোধহয় প্রকৃত গুরু।  প্রতিপদে সেই শক্তিরই পরিচয় পেতে লাগলাম।

একদিন সকালবেলা উঠেই মনে হল জল খেয়ে নি। পর পর কয়েক মগ জল খেয়ে ফেললাম, একেবারে আকন্ঠ। তারপর দাঁত  মেজে মুখ ধুতে গেলাম। জিভ কচলাতে গিয়ে দেখি, পেটের ভিতর থেকে হড়হড় করে জল বেরিয়ে পড়ছে। অম্ল পিত্ত যা ছিল বেরিয়ে গেলো।  ফলে পায়খানাও পরিষ্কার হলো। শরীরটা হালকা বোধ হতে লাগলো। বেশ কিছুদিন থেকে আমি কোষ্ঠকাঠিন্য ও অম্লতে ভুগছিলাম, যার ফলে পেটে  বায়ু হচ্ছিলো। শরীর  ভার ভার লাগতো।  একদিনেই শরীরটা হালকা বোধ হলো। মনে হলো মন্দ নয়তো। এইভাবে অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক একটা রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে, তা আমি ভাবতেও পারিনি কখনো। বহু চিকিৎসা করেও যে রোগ থেকে আমি মুক্ত হতে পারিনি, তা যেন একদিনেই সেরে গেলো।

যাই হোক : সেদিন সকালে ধ্যানে বসতেই নতুন জিনিস দেখতে পেলাম। আলোর বিন্দু খুব তাড়াতাড়ি এলো।  তারপরই ছড়িয়ে পড়লো। আগে যেমন বৃত্ত রচনা করতো তেমন নয়। যেন চোখের সামনের  স্পেস আলোর রশ্মিতে ছেয়ে গেলো। শুধু তাই নয়, যেন, ক্রমশঃ স্টেজের পর স্টেজ অতি দ্রুত উঠে যেতে লাগলাম। কখনো  কখনো ভয় পেতে লাগলাম। বন্ধ চোখেই, মন যখন নিচের দিকে তাকায়, তখন আলোর এক ভাব।  সামনে তাকালে এক ভাব, আবার উর্দ্ধে তাকালে আর এক ভাব। নতুন অভিজ্ঞতায় কেমন আশ্চর্য্য বোধ করলাম। এর অর্থ কি ? ভাববার চেষ্টা করলাম। এমনি এক দিনে হঠাৎ আমার এক আত্মীয় আমাকে দুটি ইংরেজি পত্রিকা এনে দিলেন।  লেখক দ্বারকনাথ ভট্টাচার্য্য়।  পুস্তিকা দুটির নাম "SIMPLE KRIYA  YOG" এবং "SOME TALKS ON KRIYA YOG " . পড়ে আশ্চার্য্য হয়ে দেখলাম, সাধক যখন সাধনা করেন, তখন এমনই ভাবে তিনি অগ্রসর হন। তারও এমনি অভিজ্ঞতা হয়। মনে মনে উৎফুল্ল বোধ করলাম। রাত্রি বেলায়ও  দেখতে লাগলাম, বিন্দু তত আসছে না , আসছে শুধু আলো। নানা বর্ণের নানা তরঙ্গের আলো। সেই আলোর স্তরগুলো আমি পার হতে লাগলাম, একটা পাখির মতো। যেন একটা শকুন, পাক খেয়ে খেয়ে আকাশের অনেক উর্দ্ধে উঠছি। আকাশের বহু স্তর ভেদ  করছি আর অপূর্ব আনন্দ পাচ্ছি। ক্রমশঃ যেন আলোর দীপ্তি বাড়ছে। আলোর বিভিন্ন স্তরে, বিভিন্ন রকম ভাবনা হচ্ছে। মনে পড়ছে, রবীন্দ্র সঙ্গীত - "আনন্দধারা বহিছে ভুবনে". আলো ফুটবার প্রথম পর্যায়ে আরো একটা গানের কালী মনে পড়ছে "এই জ্যোতি সমুদ্র মাঝে, যে শতদল পদ্মরাজে, তারই মধু পান করেছি, ধন্য আমি তাই। "

আরো একটা জিনিস লক্ষ্য করছি।  ধ্যানের সময় শরীর হালকা হয়ে থাকে। হাতদুটো তুলবার চেষ্টা করতেই মনে হচ্ছে পাখির দানার মতো হাওয়ার উপরে ভাসছে। জলের মধ্যে দেহটাকে ছেড়ে দিলে যেমন জলের চাপ যেমন দেহটাকে ঠেলে উপরে তোলার চেষ্টা করে, ঠিক যেন তেমন ভাব।  এছাড়া আরো একটা জিনিস লক্ষ্য করেও অবাক হতে লাগলাম। কখনো সূক্ষ্ম অন্ধকারের একটা স্তরকে পাতলা কাঁচের মতো মনে হচ্ছে। তার মধ্যে জীবন্ত কতকগুলো মানুষের মুখ ভেসে উঠছে। কারা, কাদের এ মুখ কে জানে। জীবনে এহেন মুখ আগে কখনো দেখিনি। কয়েক দিন আশ্চর্য্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, আমার নিজেকেই আমি দেখছি। সামনে থেকে নয়, পিছন থেকে ও পাশ থেকে।

দুইবেলা নিয়মিত ধ্যান করছি। অভিজ্ঞতার সংগ্রহশালায় নতুন সংযোজিত হলো "ওঁ"  শব্দ।  এক রাত্রে ধ্যান করছি, স্তরে স্তরে মহাকাশে রঙের খেলা চলছে, ক্রমশ যেন উর্দ্ধে উঠছি।  হঠাৎ মনে হলো "ওঁ" শব্দ উচ্চারণ করি।  কেন মনে হলো জানিনা। ঘটনা প্রবাহ যে ভাবে চলছে, তাতে আমার "সচেতন আমি" নিতান্তই দিশেহারা।  অবচেতনের চরিত্রটাও মাঝে মধ্যে ধরতে পারি। এই স্তর ছাড়িয়ে আছে আর এক স্তর, মনের অচেতন স্তর। আসলে সেখানেই মানুষের মধ্যে যে সত্যিকারের মানুষ "মানুষ রতন" সেই কাজ করে। তার কাজের ধারা বোঝা সচেতন মনের সাধ্যের অতীত।  বুঝতে পারছি সেখান থেকেই কিছু ঘটছে। তার কাছেই ধীরে ধীরে যেন আত্মসমর্পন করছি। সুতরাং মনে যে হঠাৎ কেন মাঝে মাঝে অদ্ভুত একটা ইচ্ছা জাগে আমার বাইরের আমি তা বুঝতে পারে না।  সেই ভেতরের "আমি" র নির্দেশেই এখন এগিয়ে চলেছি। সুতারং যেই মনে হল, "ওঁ" শব্দ উচ্চারণ করি, তক্ষুনি ধরনের একটা বিশেষ স্তরে,আলোর একটা বিশেষ স্তরে যখন বিচরণ করছি, সেই "ওঁ" শব্দ উচ্চারণ করলাম। সঙ্গে সঙ্গে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।  শুনলাম, মহাকাশ সেই ওঙ্কার ধ্বনিতে গমগম করছে। সেই ধ্বনি শুনে প্রচন্ড আনন্দ বোধ হতে লাগলো। বার বার ওঁ শব্দ উচ্চারণ করতে লাগলাম।  শব্দটা এমন যেন কোনো গুহায় বসে তা উচ্চারণ করছি।পারে দেখেছি, মনের মধ্যে শব্দটা সামান্য উচ্চারিত হলেই ধরনের বিশেষ এক স্তরে মহাকাশ অ-উ-ম, অ-উ-ম শব্দে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।

এর মধ্যে লাহিড়ীবাবা একদিন এলেন আমার বাড়িতে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এসব হচ্ছে কেন বলুন তো ? লাহিড়ীবাবা বললেন, আপনার যে পূর্ব্ব জন্মের সাধনা ছিল, তা ফুটে উঠছে। বহু মহাপুরুষ আপনাকে তাদের দৃষ্টিতে রেখেছেন। সময়মত তারা এসে আপনার সাথে দেখা করবেন। বহুদিন আপনার গুরু লাগবে না।  আপনার ভেতরের বীজ তার নিজের চরিত্র অনুযায়ী প্রস্ফুটিত হতে থাকবে।

আমার ভিতরে এমন জিনিস আছে, যা সম্পর্কে আমি কিছুই জানিনা, এই ভাবনাটাই আমার কাছে বিভ্রান্তিকর। বিভ্রান্ত না হোয়ে  উপায়ই বা কি ?

একদিন পদ্মাসনে বসে ধ্যান করছি। হঠাৎ মনে হল উপরে উঠে যাচ্ছি, উপরে উঠছি। আসনে যেন আমার শরীর  আর লেগে নেই। আমার শরীরটা যেন একটা রাবারের টিউব। ভেতরের বায়ু তাতে আশ্চর্য রকম খেলা করছে। ভেতরটা বায়ুপূর্ণ হয়ে যাওয়াতেই আমি ভাসছি।লাহিড়ীবাবাকে একথা বলতে  তিনি বললেন, এটা হঠযোগ। ভাবলাম, আমিতো কখনো অভ্যাস হঠযোগ  করিনি। লাহিড়ীবাবা বললেন,গভীর মনোযোগ হলে হঠযোগ আপনিই হয়।

জানিনা এসব বিদ্যায় আমি রপ্ত নোই। কিন্তু কোথা থেকে যে কি হচ্ছে, সেটাই আশ্চার্য্য ব্যাপার। কিন্তু এসব ব্যাপারে যেমন অদ্ভুত অভিজ্ঞতা তেমনি আমার সাংসারিক জীবনে দারিদ্র্য ও ঝঞ্ঝাট বাড়ছে। ধর্ম সন্মন্ধে আমার কৌতহল আছে। একটা জেদ  আছে।  দেখতে হবে এর মধ্যে কি আছে ?সাধু সন্ন্যাসীরা আসলে কি ? সাধুসন্ত সম্পর্কে আমার ধারণা  সমাজের পরজীবী শ্রেণী। কিন্তু তথাকথিত দেবদেবী, ঈশ্বর, ব্রহ্মন এসব আসলে আসলে কি সঠিক না ধাপ্পা সেটা জানার জন্য চেষ্টা করে যাই। পুরোহিতদের সম্পর্কে আমার ধারণা এরা (imposter ) অর্থাৎ ভন্ড বা প্রতারক।  কোনো জিনিস সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবার আগে তাকে ভালোভাবে না জেনে তার সম্পর্কে মন্তব্য কার উচিত নয়। এজন্য আমার একটা জেদ  চেপে গেছে। সুতরাং ধ্যান করতেই লাগলাম।

অনেক সময় মনে হচ্ছে, আমি কি আসলে ধ্যান করছি, নাকি পাজলেড ব্রেনের  একটা কারসাজি। লাহিড়ীবাবা বলছিলেন এটা ধ্যানের স্তরগুলি আমি যেভাবে দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছি, তাকে বিপ্লব বলা যেতে পারে। সাধনার জন্য মানুষকে বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ে-পর্বতে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়াতে হয়। আর আমি ঘরে বসেই এই বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। কিন্তু আমার মন( kant )কান্ট্-এর নয়, অর্থাৎ আমি বলতে চাইনা যে GOD WITHOUT CERTAIN TRUTH . বরং আমার মন HUME - হুম এর সঙ্গে একমত। আর তা হচ্ছে TRUTH WITHOUT GOD আমি সত্যদ্রষ্টা, সত্যকে জানতে চাই। সত্য যদি ঈশ্বরবিহীন হয়, তাহলেও আমি সেটাকেই জানতে চাই। বই পড়ে নয়। নিজের মধ্যে জানতে চাই।  সাধকরা যা বলেছেন, তার সত্যতা কতদূর।  উপনিষৎ বলছে "আত্মানং বিদ্ধি" .নিজেকে জানার জন্য মনের মধ্যে ডুব দিতে বলা হয়েছে। আমি সেই মনের মধ্যেই ডুব দেবার চেষ্টা করছি। বাউলরা বলেন, দেহের মধ্যে বিশ্বব্রহ্মান্ড। চোখবুজে ভেতরে তাকালে কিন্তু সে কথাটা অবিশ্বাস্য মনে হয় না।

এখন দেখছি চোখবুজলেই চেতনা যেন মহাবেগে উর্দ্ধে লাফিয়ে ওঠে।  স্তরের পর স্তর ভেদ করে দ্রুত ছুটে চলে যে, অনেক সময় ভয় করে মোর যাবো না তো ?   রঙ নানা স্তর পাল্টাতে থাকে। এত স্তর মনে হয় অসংখ্য। তন্ত্রে আছে দেহের মধ্যে ষটচক্র ভেদ করতে হয়। এক এক স্তর ভেদ করলে এক এক রকম অভিজ্ঞতা। আমার মনে হয় এই একএকটা স্তরেই রয়েছে অসংখ্য পর্যায়। তাই এই বিচিত্র রঙের খেলা দেখা যায়। এক একটা স্তর পার হয়ে আর এক স্তরে যাবার মুখে এক ধরনের অন্ধকারের স্তর আসে বলে মনে হয়। অন্ধকার স্তরের মধ্যে দিয়ে চলতে ভয় লাগে সব থেকে বেশি। কিন্তু সেই স্তর পার হয়ে যখন আবার নতুন আলোর জগতে যাওয়া যায়, তখন মনে সাহস ফিরে আসে। কোনো আলো তীব্র, যেন আনন্দের ঝর্ণাধারা নিয়ে সমস্ত দেহ মনকে নাচায়। কোনো এল মৃদু। কোনো এল মধুর চন্দ্রালোকের মতো। কখনো দেখা যায়, দুধকাটা চানায় ভরা আকাশের মতো। তার ফাঁকে নীল আকাশ উঁকি দে।  সেই আকাশে একটা মধুর স্নিগ্ধ সূক্ষ্ম আলোর বন্যা বইতে থাকে। মনের মধ্যে অকারণে অভূতপূর্ব একটা আনন্দের সঞ্চার হয়। কখনো সুগন্ধি ধূপের গন্ধ পাই। কখনো যজ্ঞের ধোয়ার গন্ধ অর্থাৎ ঘিপোড়া গন্ধ পাই। কখনো অত্যন্ত শীতল হাওয়া লাগে গায়। কখনো শুনি অ-উ-ম। কখনো মনে হয় মহাকাশে করা যেন কথা বলছে। এক এক সময় মনে হয়, আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সত্যিই এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করে চলেছি আমি। আমার মতো এমন দিশেহারা ভাবে লোকে বোধহয় কম পড়েছে।  অনেক সময় আমার কান্না পায়।  আমি কি পাগল হয়ে গেলাম ?

ধ্যান আমাকে ছাড়লো না।  নির্দিষ্ট সময় এলে মোহগ্রস্থের মতো ধ্যানে বসে যেতাম। বিচিত্র অভিজ্ঞতা বিচিত্রতর হচ্ছে। হঠাৎ একদিন ধ্যানের মধ্যে চোখের পাতা একটু জোর করে চেপে ধরতেই,  মনে হল কোটি কোটি সূর্য্য জ্বলে উঠেছে। চোখ অন্ধ হয়ে যাবে বলে মনে হলো। তারপর কয়েকবার সেই কোটি কোটি সূর্য্যের আলো বিস্ফোরিত হবার পর টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেলো। একটি গোল আলো সূর্য্যের মতো দূর থেকে কপালের দিকে এগুতে লাগলো।  পাতলা নীল জ্যোৎস্নায় ভরা একটা আকাশ সেই ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিতে লাগলো।  আকাশের বিশেষ একটি স্তরে এসে আমার মনে হতে লাগলো, আমি ভাসছি। অমিতাভ বুদ্ধের মতো পদ্মাসনে বসে আমি ভাসছি : আমিই অমিতাভ বুদ্ধ।

ধ্যানের জগতে যে আলোর বিচিত্র খেলা, তা কখনো স্থির নয়। কিন্তু যতই উর্দ্ধগতি ততই তা কম দ্রুততর।  দ্রুততর কম হলে  মনে মধ্যে একটা স্বস্তির ভাব জাগে।  মহাকাশে পদ্মাসনে বসে আমি একটা বেলুনের মত ভাসছি বলে মনে হয়। সে বোধটা আসার সঙ্গে সঙ্গে অভূতপূর্ব আনন্দের ভাবও বোধ করি।  সবটাই মনের একটা ভ্রান্তি কিনা কে জানে ?

আশ্চার্য্য দৃশ্য আমার সামনে ভাসছে।  বেশির ভাগই দেখি নানা চেহারার যোগাসনে উপবিষ্ট ধ্যানরত ঋষিদের।  শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস ও শ্রীশ্রীসারদা মাকেও দেখি। সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়, ওঁরা তো মোক্ষলাভ করেছেন। আকাশের কোনো স্তরেই তাদের থাকা সম্ভব নয়। হয়তো আমার মনের ভিতরে রেখে দেওয়া ছবিই ভেসে ওঠে।  কিন্তু আর সব যোগী ? তাছাড়া বরফ-আচ্ছন্ন হিমালয়ের বহু গিরিশৃঙ্গের ছবি  দেখি। দেখি বিচিত্র সব অস্পষ্ট  শহর।  সাহেব জাতীয় কিছু লোক। কোনো কোনো দিন মনে হয়, মহাশুন্য  নয়, একটা সূক্ষ্ম তরল জলের সমুদ্র।  পুরীর সমুদ্রের ঢেউয়ের মত ঢেউ উঠছে।  ঢেউয়ের মাথায় মাথায় কখনো আমি উঠছি  এবং নামছি। দোল খাওয়া ছেলেদের মতো তখন দারুন ভালো লাগে।

এতো সব দর্শনে আমি অর্থনৈতিক অভাব কিন্তু গেলো না। সাংসারিক ঝঞ্ঝাট থেকেও আমি কিন্তু নিস্তার  পাইনি। আমার নানা সমস্যা, দুঃখ দরিদ্রের যন্ত্রনা যেন ক্রমশঃ বেশি করে এগিয়ে আসছে।তাহলে কি সেই কথাটাই সত্যি - যে করে আমার আশ, তার করি সর্বনাশ। ।    



































































   

No comments:

Post a Comment