Wednesday, 16 January 2019

শ্রাদ্ধ ও তর্পন বিধি

শ্রাদ্ধ ও তর্পন বিধি

শ্রাদ্ধ ও তর্পন বিধি 

ওং হৌং জুং সঃ  ওং ভূঃ ভুবঃ স্বঃ
ওং ত্রয়ম্বকং যযামহে  সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধনম্
উর্বারূকমিব বন্ধ্নান মৃত্যু্র্মুক্ষীয় মা মৃতাৎ
ওং স্বঃ ভুবঃ ভূঃ  ওং সঃ জুং  হৌং ওং

গুরুদেব মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন : "পরলোকগত পিতৃলোকদিগের উদ্ধারের নিমিত্ত শ্রদ্ধাপূর্বক যে কর্ম সম্পাদিত হয়, তাহাকে শ্রাদ্ধ কহে। " 
কত কঠিন কাজ চিন্তা করুন। পরলোকগত অর্থাৎ যারা এই লোকে বা  ভূর্লোকে  নেই। অন্য্ কোনো লোকে গেছেন। আমরা জানি, সাতটা লোক আছে।  জানি না, বলা যেতে পারে, শাস্ত্রে পড়েছি। এগুলো  হলো  -  ১.ভূ ; ২. ভুব ;৩. স্বঃ ৪. মহঃ ৫. জনঃ ৬. তপঃ ৭. সত্যম। আবার কেউ কেউ সংক্ষেপে এই লোককে তিন ভাগে ভাগ করেছেন, আমাদের বোঝার সুবিধের জন্য, সেই তিনটি হলো : ভূলোক, দ্যুলোক, অন্তরীক্ষ লোক।  প্রথম সাতটি লোকের ভৌগলিক সীমা  নেই।  এইগুলো সর্বত্র অন্তর্হিত।  কিন্তু পরের  তিনটি অর্থাৎ ভূলোক, দ্যুলোক ও অন্তরীক্ষ লোকের ভৌগলিক সীমা  আছে।  ভূ  অর্থাৎ পৃথিবী লোক, দৌ বা আকাশ -লোক আর এই আকাশের বাইরে যেটা সেটা অন্তরীক্ষ লোক । সেটা আমাদের মনের লোক-ও হতে পারে। অর্থাৎ ভূলোক, বা দৃষ্টিগোচর লোক থেকে যারা চলে গেছেন, কোথায় গেছেন, আমরা জানি না,  যে কোনো লোকেই যেতে পারেন, তাদের মঙ্গলের জন্য, তাদের উদ্ধারের জন্য শ্রদ্ধা সহকারে যে কাজ সম্পাদন করা হয় তাকেই শ্রাদ্ধ বলে। অর্থাৎ কঠিন থেকে কঠিনতম কাজ। আর এটা করতে হবে শ্রদ্ধা সহকারে। অর্থাৎ শ্রাদ্ধকর্মে মূল উপাদান হচ্ছে শ্রদ্ধা। শ্রাদ্ধ কথাটার আর একটা মানে হচ্ছে নিস্পত্তি। বাস্তবকে মেনে নেওয়া, সম্পর্ককে বিচ্ছিন্ন করা, নির্ভরশীলতাকে কাটিয়ে ওঠা - এটাই শ্রাদ্ধ কর্মের উদ্দেশ্যে।

গুরুদেব আর এক জায়গায় কবিতায়  বলছেন : 

না থাকিলে ধন / বনেতে গমন / করিয়া রোদন করো। 
তাহে শ্রাদ্ধ ফল,/ হ'বে নিরমল / হইবে তাহা শুভকর। 

অর্থাৎ বাহ্যিক উপাদান সংগ্রহের ক্ষমতা যদি না থাকে তবে তবে নিরালায় বসে রোদন করো, তাকে স্মরণ করো, তার জন্য দুফোটা চোখের জল ফেলো, তাতেই শুভ-কাজ সম্পন্ন হবে। 
এইখানে গুরুদেব অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র। 

আমার বাবার কাজের সময়, পুরোহিত ব্রাহ্মণ, যিনি আমাদের খুবই আপনজন, বাবার উদ্ধারের জন্য একটি ফর্দ ধরিয়ে বলেছিলেন, এগুলো লাগবে।  ১৩৮ রকম, জিনিসের লিস্ট। তাতে,সোনা দানা থেকে  খাট , বিছানা থেকে শুরু করে তিল তুলসী অবধি ছিল। গুরুদেব বলছেন কিছুই লাগবে না শুধু শ্রদ্ধা, একটু আকুতি, একটু চোখের জল।  প্রাণ ভরে প্রার্থনা করো। কয়েকজন সৎলোকের উপস্থিতিতে, উপবিষ্ট হয়ে প্রার্থনা করো। 

গঙ্গা সাগর মেলায় গিয়ে ছিলাম, দেখলাম একদল গ্রাম্য পুরোহিত, গরু বাছুর নিয়ে বসে আছে।  খদ্দের খুঁজছে।  বৈতারিনী পার করে দেবে বলে। বেটা তোরে কে পার করে তার ঠিক নেই , তুই অন্যকে বৈতারিনী পার করতে বসে আছিস।

আসলে জীবন-মরন, আত্মার গমন-নির্গমন, আত্মার প্রবেশ-বাহির, এমনকি আত্মার অস্তিত্ব- অনস্তিত্ব এসব বিষয় এতটাই দুর্বোদ্ধ যে, এগুলো নিয়ে ব্রাহ্মণ পন্ডিতগণ অনেক গল্প ফেঁদেছেন। আর গল্পের গরু গাছে চড়ে। আর গল্প শুনতেও আমাদের ভালো লাগে। অসম্ভব কিছু  সম্ভব হচ্ছে - এমন গল্প গাঁথা আমাদেরকে আকর্ষণ করে। তাই এর মাধ্যমে চতুর ব্রাহ্মণরা কিছু জাগতিক ফায়দা ওঠায়। আমরা অসম্ভব ভবিষ্যতের আশায় বর্তমানকে বিসর্জন দেই। আমাদেরকে  বোকা বানায়।  আমরাও বোকা হতে ভালো বাসি। নিজেকে নিপীড়নে আমরা একটা আত্মতৃপ্তি পাই। 

এইবার আমরা  জন্ম-মৃত্যু, বা আসা যাওয়ার খেলাটা একটু দেখে নেই। আমাদের দেহ পঞ্চভূতের সংমিশ্রণ। পুরুষ-প্রকৃতির খেলাতেই এই সংমিশ্রণ ঘটে।  প্রথমে মাংসপিন্ড, পরে ধীরে ধীরে জন্মদাতার-জন্মদাত্রীর আকার গ্রহণ।  এটি তখন দেহ মাত্র। এই দেহে ৪৪ থেকে ৪৮ দিনের মধ্যেই প্রাণের গমন নির্গমন গুরু হয়। তবে সেটা মায়ের প্রাণের অংশ মাত্র। সব থেকে বেশি হলে ৮৪ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হওয়া চাই।  এই সময় থেকেই আমরা মায়ের দেহের মধ্যে সন্তানের নাড়াচাড়া টের পাই। যদি না হয় জানবেন কিছু গোলমাল আছে।  অর্থাৎ যে দেহটি তৈরি হচ্ছে সে মায়ের প্রাণের গতি গ্রহণ করছে পারছে না। এমনটি হলে জানবেন কিছু গড়বার আছে।  হরিবোল - হরিবোল হয়ে গছে। এই মায়ের প্রাণের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় যখন সে মায়ের দেহ থেকে আলাদা হয়ে যায়। তখন তার নিজস্ব প্রাণক্রিয়া, প্রাণের গমন-নির্গমন শুরু হয়। এবং সেটা যদি তাৎক্ষণিক ভাবে শুরু না হয় তখন সন্তানকে এই প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে ধাঁই। সে তখন ফুসফুস - তাকে উল্টে-পাল্টে ক্রিয়াশীল করে তোলে। বাচ্চা কেঁদে ওঠে। শুরু হলো জীবনের খেলা। 

এইবার চলে যাবো মৃত্যু প্রক্রিয়ায়। জীবন হচ্ছে শ্বাসের খেলা। এই শ্বাসের মাধ্যমেই আমাদের সমস্ত প্রক্রিয়া চলে। পঞ্চভূতের মধ্যে (ক্ষিতি, অপ,তেজ, মরুৎ, ব্যোম ) মরুৎ অর্থাৎ বায়ু সবথেকে শক্তিশালী ও সংযোগকারী। উপনিষদে একে ব্রহ্ম বলে আখ্যা  দেওয়া হয়েছে। প্রাণ শরীরের কোনে কোনে পরিব্যাপ্ত হয়। শরীরের কৰ্মইন্দ্রিয় (বাক,পানি,পাদ, পায়ু,উপস্থ ) জ্ঞান ইন্দ্রিয় (কর্ন, চর্ম, চক্ষু, জিহবা, ও নাসিকা) অর্থাৎ কান,ত্বক,চোখ,জিভ,নাক,মুখ,হাত,পা,মলদ্বার, ও লিঙ্গ। এর মধ্যে আমরা স্বাস প্রক্রিয়ার জন্য দুটো ইন্দ্রিয় কাজ করে, এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে নাক।  যদি কোনো কারণে নাক বন্ধ  হয়ে যায় মুখ দিয়ে আমরা এই স্বাস প্রক্রিয়া চালাই । একমাত্র স্বাস প্রক্রিয়ার জন্য দুটো অঙ্গ বা দুটো ইন্দ্রিয় ব্যবহার করতে পারি।  শরীরের অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলো বিশ্রাম নিলেও, নিদ্রা গেলেও এই প্রাণশক্তির ক্রিয়া চলতে থাকে।  কখনই বিশ্রাম নিতে পারে না। দিন-রাত অনবড়ত  কাজ করতে থাকে। যতক্ষন এই প্রাণশক্তি প্রবাহমান থাকে ততক্ষনই আমাদের আয়ু থাকে। প্রাণ যতক্ষন কর্মক্ষম থাকে ততক্ষনই আমাদের জীবিত বলা হয়।  এই প্রাণশক্তির কাজ শেষ হয়ে গেলে, সঙ্গে সঙ্গে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। এই প্রাণের শক্তিতেই দৃষ্টি-শক্তি, এই প্রাণের শক্তিতেই শ্রবণ শক্তি, এই প্রাণের শক্তিতেই ঘ্রান শক্তি, বাক শক্তি, জ্ঞানশক্তি, পাচন  শক্তি। প্রাণের ক্রিয়া শুরুতে জীবন শুরু হয় - আবার প্রাণের ক্রিয়া শেষে জীবনের শেষ হয়।ত্রিলোকে যা কিছু বর্তমান সবই প্রাণের অন্তর্গত। 

এবার আমরা যাবো আর একটু গভীরে। প্রাণ তো দেহটা কে বাঁচিয়ে রাখে। সবার মধ্যেই প্রাণ।  তাহলে "অমি"  কে ? এই দেহ যখন অকেজো হয়ে যায়, তখন তাকে আমরা পুড়িয়ে ফেলি, কবর দেই।  এর সঙ্গেই "আমি"  শেষ হয়ে গেলাম ? "আমি" যদি শেষ হয়ে গেলাম, তবে আর এই শ্রাদ্ধ-শান্তির দরকারটা কি ? "আমি" বলে কিছু আছে কি ? তাহলে কি, জগৎ সত্য, আমি মিথ্যা। 

এখান থেকেই ধোঁয়াশার শুরু। এই জায়গাটা উপল্বদ্ধির জায়গা। এই জায়গাটা বুদ্ধি দিয়ে, জ্ঞান দিয়ে, বেশিদূর এগোনো যায় না।  মৃত্যুর পরে কেউ ফিরে আসেনা। এসে কেউ পরপারের কথা, পরপারের বর্ণনা দিতে পারে না।  এখানেই চতুর পন্ডিতরা গল্প ফাঁদে। স্বর্গ, নরকের গল্প ফাঁদে। যে যত রসালো গল্প বলতে পারে তাকে আমরা ততো বড় সাধক ভাবি। আসলে কল্পনা শক্তি, আমাদের ভাবের জগতে নিয়ে যায়। আমরাও আমাদের একটা কাল্পনিক ভাবের জগৎ তৈরি করি। কিন্তু বাস্তব  অন্য কথা বলে। সব ভাষায় বলা যায় না। কাউকে সেখানে নিয়ে যাওয়া যায় না। 

এবার একটু উপনিষদের গল্পে যাই। 

উপনিষদের মধ্যে আমি দুটো জায়গায়, মৃত্যুর রাজার গল্প পাই। অর্থাৎ যমরাজের গল্প পাই। তার প্রথমটি হলো কঠোপনিষদ। এই গল্প আপনারা নিশ্চই শুনে থাকবেন। যমরাজ বা ধর্মরাজ হিন্দু মতে  মৃত্যুর রাজা।  তিনিই নাকি আমাদের সবাইকে মৃত্যুরপুরীতে নিয়ে যান।  আর আমাদের কর্ম অনুযায়ী সাজা অথবা বিলাসের ব্যবস্থা করেন। গল্পটা সংক্ষেপে বলি :

পুরাকালে বাজ-শ্রবস নামে এক রাজা ছিলেন। তার পিতা বাজ-শ্রবা অজস্র  ধন-দান করে যশস্বী হয়ে ছিলেন। বাজ-শ্রবস ভাবলেন, তিনি তার পিতার থেকেও আরো বারো কীর্তি  করে যাবেন।  এবং মহা পুন্য অর্জন করবেন। এমনটি কামনা করে, তিনি এক আশ্চর্য যজ্ঞ আরম্ভ করলেন। যজ্ঞের  নাম বিশ্বজিৎ।  এই বিশ্বজিৎ যজ্ঞে ঋষিকে তার যথা সর্বস্য দান করতে হবে। বিস্তারিত বলবো না।  এখন যজ্ঞের দান শুরু হয়েছে। সে যুগে গোদান সর্বশ্রেষ্ট দান বলে পরিগণিত হতো। চারিদিকে আনন্দের উৎসব হচ্ছে। সবাই উল্লাস কোলাহলে ব্যস্ত। কিন্তু বাজ-শ্রবসের পুত্র নচিকেতা বিমর্ষ। নচিকেতার বয়স ৮/৯ বছর ।  ভাবছে,পিতা কত ফল কামনা এই যজ্ঞ করছে। আর শেষে কিনা এই হাড্ডিসার গাভীগুলোকে দান করছে ? যাদের তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে।  যাদের গর্ভধারণের ক্ষমতা হারিয়েছে।  দুধ দেবার ক্ষমতা হারিয়েছে। এই গরুগুলো নিয়ে ব্রাহ্মণদের কি কাজে লাগবে। বিশ্বজিৎ যজ্ঞ মানে তো সর্বশ্রেষ্ট দানের প্রতিশ্রূতি। এই সব শীর্ণকায় গাভী দানে কি বাবা পূণ্যলাভ করতে পারবে ?তা যদি না হয় তবে তো বাবার যজ্ঞের উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। পিতার মঙ্গলের জন্য উদ্বিগ্ন নচিকেতা ধীর পায়ে বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। বাজ-শ্রবস তখন ঋষিদেরকে নিয়ে ব্যস্ত। দান-কর্মে লিপ্ত। নচিকেতা গিয়ে, বাবার মঙ্গল কামনায়, বাবাকে বললো - "বাবা সবই তো দিলেন, আমাকে কাকে দিলেন? আমিতো আপনার উত্তম ধন, আমাকে কাকে দিলেন ? বাজ-শ্রবস কোনো উত্তর দিচ্ছে না দেখে, পুনরায় একই কথা বললেন।  বাবা আমাকে কাকে দিলেন। বাবা বিরক্ত হলেন। কিন্তু কোনো উত্তর দিলেন না। এদিকে বাবা কোনো উত্তর দিচ্ছে না দেখে, নচিকেতা আবার বললেন, আমাকে কাকে দিলেন ? বাবা এবার চরম বিরক্ত হয়ে, রাগের মাথায় বলে দিলেন - "ব্যাটা তোমাকে যমের কাছে দিলাম"। নচিকেতা এবার চুপ হলো। ভাবলো ভালোই হলো।  বাবার এতে উপকার-ই  হলো।

নচিকেতা এবার যমের কাছে চললো। যমের বাড়িতো চেনেনা। চললো স্মশানে। যমের বাড়ী। যমের কাছে তো কেউ যায় না। সবার কাছে যম যায়। ফলে, যমের বাড়িতে যমকে পেলো না নচিকেতা। বসে থাকলো দুয়ারে। এদিকে ধর্মরাজ যম স্ব-ধৰ্ম রক্ষায় ব্যস্ত। বাড়ি এসে দেখে, ৮/৯ বাছারের একটা ফুটফুটে বালক বসে আছে। ধর্মরাজ ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো। সবার কাছে যম যায়। এ দেখি নিজে থেকে এসে বসে আছে। একি অনাসৃষ্টি। তাহলে নিশ্চই তার কর্তব্যে কোনো ভূল হয়ে গেছে। আসলে যমেরও ভয় আছে। ব্ৰহ্মের শাসনে, সূর্য যেমন আলো  দেয়, মেঘ যেমন বৃষ্টি দেয়, চন্দ্র যেমন জ্যোৎস্না দেয়, যম তেমনি তার কর্তব্য পালন করে। সূর্য যেমন আলো দেবোনা বলে বসে থাকতে পারে না। যমও তেমনি আর মানুষ মারবো না বলে বসে থাকতে পারে না। তাই যমরাজ ভয় পেয়ে গেল। পাচ্ছে এই ত্রূটি পাঁচজন জেনে যায়, তাই চুপি চুপি সে নাচিকেতাকে খুশি করে, বাড়ি ফেরাতে চাইলো। এবং বললো - কি চাও তুমি বলো, আর মানে মানে কেটে পরো। কেউ যেন জানতে না পারে। তা হলেই বিপদ। সুযোগ বুঝে, নচিকেতা তিনটি বর চেয়েছিলো। 
১.  মৃত্যুলোক হতে ফিরে গেলে সবাই যেন আমাকে চিনতে পারে। এবং প্রসন্ন হন। 
২.  শুনেছি, স্বর্গে কোনো ভয় নেই, জ্বরা নেই, ব্যাধি  নেই, যা চাওয়া যায় সবই সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যায়।  এমনকি যমও সেখানে যেতে পারে না। তো আমি সেখানে কি করে যাবো তার পথ বলে দাও। 
৩. শুনেছি মরলে পর, কেউ বলে আত্মা থাকে, কেউ বলে আত্মা বলে কিছু নেই। আমাকে এই সম্পর্কে খুলে বলো। আমি আত্ম-বিদ্যা লাভ করতে চাই। 

এইবার আমি একটা প্রাসঙ্গিক ঘটনা বলি। ঘটনাটা পেপারে বেরিয়েছিল। এক ভদ্রলোক ট্রেনে করে যাচ্ছিলো।  ট্রেনটি এক্সিডেন্ট করে। বাড়িতে খবর আসে। ভদ্রলোকের বড়ছেলেকে নিয়ে যাওয়া হয়, হসপিটালে। সেখানে মর্গে একটি পচাগলা দেহ দেখিয়ে বলা হয়, দেখো ইনি তোমার বাবা কি না। ছেলে দেহ দেখে কিছু বুঝতে পারে নি।  কিন্তু তার জামা প্যান্ট এমনকি ঘড়িটা দেখে জানায়, হ্যাঁ ইনিই আমার পিতা। শোকাচ্ছন্ন সন্তান বাড়িতে এসে, সমস্ত পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করে। এদিকে ভদ্রলোক কিন্তু  একসিডেন্টে মারা যায়  নি। ট্রেন থেকে ছিট্কে পাশের খালে পরে গিয়েছিলো। বেহুশ হয়ে ছিল। হুশ ফেরার পরে কোনো রকমে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে পরবর্তী স্টেশনে যায়।  এবং বিনা টিকিটে ফেরার পথে টিকিট চেকারের   হাতে ধরা পরে । সাত দিন জেল খেটে, হাটতে হাটতে, ক্লান্ত, ক্ষুধার্থ অবস্থায় সন্ধ্যেবেলা  বাড়ি ফেরে। এদিকে বাবাকে দেখে, ছেলেরা -মেয়েরা হাউমাউ জুড়ে দেয়। ভূত ভূত বলে পালাতে থাকে। সে যতই, ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছে, ছেলেমেয়েরা ততই তার থেকে দূরে পালাতে থাকে। এমনকি তার স্ত্রী, তাকে এক পলক দেখে দরজায় খিল তুলে দেয়। ভদ্রলোক সেই ক্লান্ত শরীরে, সারারাত শীতের মধ্যে বাইরে পরে থাকে।  এবং সেই রাতেই মারা যায়। হরিবোল - হরিবোল।  আসলে আমরা মারা যাওয়াটা সহ্য করতে পারি। কিন্তু ফিরে আসাটা সহ্য করতে পারি না।  তার কারন আমরা জানি, এটা হয় না। হতে পারে না। ভগবানের কৃপা চাই। কিন্তু কৃপা পেলে, সন্দেহ করি, দূরে সরে  যাই।

নচিকেতা এই সত্যতা জানতেন। তাই ধর্মরাজের  কাছে  তার প্রথম প্রার্থনা ছিল, আমি বেঁচে ফিরে গেলে যেন সবাই চিনতে পারে। 


দ্বিতীয় প্রশ্ন স্বর্গলাভ। এটি লাভের জন্য, তিনি কর্ম পদ্ধতির কথা বললেন - যজ্ঞকর্ম বলা হয়। অর্থাৎ যথাযথ কর্মেই স্বর্গ লাভ হয়। এই স্বর্গ বাইরে নয়।  নিজের ভিতরে। কর্তব্য কর্ম সম্পাদনেই এই স্বর্গলাভ সম্ভব। 


তৃতীয় প্রশ্নই গুরুত্ত্বপূর্ণ। আত্মতত্ব। এই আত্মতত্ব লাভ-ই  জীবনের উদ্দেশ্য। আত্মজ্ঞান লাভ-ই  জীবনের লক্ষ্য। আত্ম অর্থাৎ নিজেকে জানা। আমি কে ? যমরাজ বলছেন ইনি 

"ওম " . যিনি বাক্যের অতীত, শব্দের অতীত, স্পর্শের অতীত,রূপের অতীত, ইনিই অনাদি-অনন্ত-বিভু। ইনিই আত্মা। জ্ঞানে এনাকে পাওয়া যায় না। অজ্ঞানেও পাওয়া যায় না। কর্মেও পাওয়া যায় না, নিস্কর্মেও পাওয়া যায় না। আকুতি দ্বারা নিজেকে দগ্দ্ধ করো।  তার করুনা, তার অনুগ্রহই একমাত্র আত্ম দর্শনের পথ। সর্ব বাসনার অতীতে চলে যাও, শরীর-বোধের উপরে ওঠো। শরীরতো রথ,আত্মাই রথী, বৃদ্ধি সারথি, মন রশ্মি, ইন্দ্রিয়গণ অশ্ব। রথীকে জানো, উপলব্ধি করো। 

আমরা শ্রাদ্ধ নিয়ে আলোচনা করছিলাম। শ্রাদ্ধের তিনটি পাঠ : এক : স্বাধ্যায় , পিন্ডদান, তর্পণ। 

স্বাধ্যায় : অর্থাৎ দেব দেবতার পূজা অর্চনা করা। 

 পিন্ড দান  - এক্ষেত্রে অন্ন, তিল, তুলসী,ধান ইত্যাদি এক সঙ্গে মেখে প্রদান করা হয়। 


এইগুলো কে খায়  জানিনা। দেখি যা, পশু পাখিতে খায়। গুরুদেব বলছেন, আমি খাই না খাই আমাকে কেউ যদি কিছু কেউ দান করে, তবে আমি তৃপ্ত হই। তেমনি পিতৃলোকের পক্ষেও জানবে। তাঁরা তোমাকে শ্রাদ্ধ বা তর্পন করতে দেখলে তৃপ্ত হন, পরম আনন্দ লাভ করেন। 

তর্পন - পূর্ব পুরুষের উদ্দেশে, জল দান করাকে তর্পণ  বলে।


এই তর্পণ  করার সময় প্রথমে দেব তর্পণ  করতে হয়। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র, প্রজাপতি, যক্ষ, গন্ধর্ব, সুর, অসুর, জলচর জীব, মৃত্তিকাচারী, আকাশচারী  সবার উদ্দেশে জল দান করা ও তৃপ্তি দেওয়া। 


এর পারে মনুষ্য তর্পণ : সনক, সনন্দ,  সনাতন প্রভৃতি আদি পুরুষের উদ্দেশ্যে জল দন।


তারপরে ঋষি  তর্পণ : মরিচ, অত্রি,অঙ্গিরা,পুলস্ত ভৃগু,নারদ, বশিষ্ট, প্রভৃতি ঋষিদের উদ্দেশ্যে জল দান। 


এর পরে ভীষ্ম তর্পণ 


তার পরে পিতৃ-মাতৃ তর্পণ - অর্থাৎ পিতা, পিতামহ, মাতা, মাতামহ, প্রপিতামহ, প্রপিতামহী। প্রপিতামহ, প্রমাতামহী ইত্যাদিদের স্মরণ করে জল অঞ্জলি পূর্বক প্রদান করা।  এবং তৃপ্তি দান করা।



এখন আমার কাছে যা যুক্তি গ্রাহ্য তার দুটো কথা বলি।  


শরীরে আমাদের মুখ্য প্রাণ পাঁচটি। অর্থাৎ যা দিয়ে আমাদের শরীর  তৈরি হয়েছে। এগুলো হচ্ছে :

প্রাণ -এটি বায়ু। হৃদয়ের আশেপাশের অংশ - নাভি থেকে একটু উপরে - যাকে আমরা অনাহত চক্র বলি।   
অপান - এটি পৃথিবী।এটির অবস্থান মূলাধারে ও চোখের পাতায় -  
উদান -এটি আকাশ।  হৃদয়, কন্ঠ,তলপেট,ভ্রূকুটির মধ্যে, মস্তিস্ক ভাগে  - 
সমান - এটি অগ্নি। নাভি এবং আশেপাশের অংশে, শ্বাসনালীর কিনারায়- 
ধ্যান -জল  তত্ব এটি।  অস্থি, মাংস, চামড়া,রক্ত,চুল ইত্যাদি - 

মানুষের যখন স্বাভাবিক মৃত্যু হয় তার ২০-২৫ মিনিটের মধ্যে এই অগ্নি বায়ু বেরিয়ে যায়। আর শরীর ঠান্ডা হতে শুরু  করে। ৩-৪ ঘন্টার মধ্যে  সমস্ত  তত্বই  বেরিয়ে  যাবার প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়।  জলতত্ব বেরোতে ১১-১৪ দিন লাগে। এখন দেহের মৃত্যুর পরে, তার অহং, তার সংস্কার অর্থাৎ  তার সঞ্চিত জ্ঞান-বুদ্ধি -অভিজ্ঞতা-উপলব্ধি তাকে নতুন অবস্থার সামনে অসহায় করে দেয়। পুরোনো অভিজ্ঞতার সাথে সে মেলাতে পারে না - মৃত্যুকালীন অবস্থা। কারন এর আগে তো এমন হয় নি। তাই কিং কর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পরে। এবং দেহকে অনবরত নির্দেশ দিতে থাকে। অকেজো দেহ তার কোনো কথা শোনে না। অর্থাৎ তার নির্দেশ অনুযায়ী সারা দেয় না। তাই দেহকে ঘিরে সে ঘুরতে থাকে। এবং কষ্ট পেতে থাকে। তাই মৃত্যুর পরে অবিলম্বে দেহের সমস্ত ছিদ্র বন্ধ বিশেষ করে নাক মুখ, চোখ বন্ধ  করে দেওয়া উচিত এবং  যত তাড়াতাড়ি  সম্ভব দেহ পুড়িয়ে  দেওয়া উচিত। অগ্নিতে ভস্ম হয়ে গেলে সমস্ত তত্ব তার নিজের জায়গায় তাড়াতাড়ি ফিরে যায়।   তা হলে সংস্কারের বা অহং-এর  দেহের প্রতি মায়া বা আসক্তি কেটে যায়। এবং অহং ব্রহ্মান্ডের সাথে এক আত্মা হয়ে যায়।আর তা যদি না করা হয় তবে এই অহং আত্মীয় স্বজনের কান্না কাটি দেখে কষ্ট পায়, নিজেকে অসহায় দেখে চঞ্চল হয়ে ওঠে। দেহ বিনষ্ট  হয়ে গেলে, অহং ব্রহ্মান্ডের সাথে বিলীন হয়ে যায়।   এর পরে জাগতিক জগতের সঙ্গে তার আর কোনো সম্পর্ক থাকে না।


তাই শ্রাদ্ধ শান্তি আসলে আমরা যারা বেঁচে থাকি, তাদের শান্তি প্রক্রিয়া। এতে পারলোকবাসীর কোনো সম্পর্ক নেই। বাস্তবকে মেনে নেওয়া, সম্পর্ককে বিচ্ছিন্ন করা, নির্ভরশীলতাকে কাটিয়ে ওঠা - এটাই শ্রাদ্ধ কর্মের উদ্দেশ্যে। তাই গুরুদেব বলছেন - প্রতি তিথিতে, পারলে প্রতি  অমাবশ্যায়, উপাসনার আয়োজন করা কর্তব্য। নিজের শান্তির জন্য, নিজের বিচার বুদ্ধি সৎ পথে পরিচালনা করার জন্য।  


ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ 


শ্রাদ্ধ কর্মে উপাসনা বা প্রার্থনা করার উপকারিতা :


সত্যধর্মের  ভাই-বোনদের মৃত্যুর পড়ে, শ্রাদ্ধ-কর্মাদির সঙ্গে আমরা উপাসনা বা প্রার্থনা করতে দেখি। এর দ্বারা কি উপকার হয় ? যদি হয় কার উপকার হয়?

একটা কথা মনে রাখা দরকার আমাদের এই পার্থিব জগতে বা দৃশ্যমান জগৎ যেমন নিয়মে বাঁধা অর্থাৎ প্রত্যেক কাজের একটা কারন আছে, তেমনি পরলোকেও একটা নিয়ম শৃঙ্খলা আছে। নিতান্ত খেয়ালের উপরে কোনো কিছু হয় না। জগতের সমস্ত ঘটনাই নিয়মের অধীন। এবং মনে রাখবেন, ঈশ্বর আমাদের মঙ্গলের জন্যই সমস্ত ঘটনা ঘটাচ্ছেন। আমাদের উচিত অদৃশ্য শাসন-কর্তাকে সাহায্য করা। আমরা অজ্ঞতা বশতঃ অনেক সময় বিপরীত কাজ করে থাকি। এইসব ভুল পদক্ষেপ যেমন আমাদের নিজেদের পক্ষে ক্ষতিকারক, তেমনি আমাদের নিকটজনের জন্যও ক্ষতিকারক।

আমাদের সবারই অভিজ্ঞতা বলে, কেউ মারা গেলে আমরা শোক করি, কান্নাকাটি করি। কিন্তু এটা আমাদের করা উচিত নয়।  এতে আমাদের যিনি মারা গেছেন, তাঁর অর্থাৎ দেহ-মুক্ত জীবাত্মার ক্ষতি করি। এতে করে, সেই জীবাত্মার  কামলোকে অবস্থানের মেয়াদ বেড়ে যায়। তাই আমাদের শোক ত্যাগ করে, আমাদের ভাবা উচিত, কি ভাবে  আমাদের সেই স্নেহের পাত্র বা শ্রদ্ধার পাত্র যিনি দেহ থেকে মুক্ত হয়ে গেছেন, তিনি পরলোকে কিভাবে  সুখে শান্তিতে থাকতে পারেন।  এবং সেই উদ্দেশ্যেই আমাদের উচিত তার আত্মার শান্তির জন্য  পরমেশ্বর-এর কাছে প্রার্থনা করা  বা উপাসনা করা , এমনকি তার উদ্দেশে যদি আমরা ধ্যান করি, তাহলেও  পরলোকগত আত্মার শান্তি হয়।

"উপাসনা" সর্বদাই মঙ্গলময় বাসনা বা মঙ্গলমায়ের কাছে আবেদন  ছাড়া আর কিছু নয়। এর মধ্যে স্বার্থের লেশ মাত্র থাকা উচিত নয়। কিছু প্রত্যাশা করা  উচিত নয়। নিঃস্বার্থ শুভইচ্ছা প্রদান, গভীর ভাবে তার শুভ  চিন্তায় মগ্ন থাকলে তার উপকার হয়। এবং এই শুভকর্ম  করলে, তা কখনোই নিষ্ফল হয় না।

আমরা জানি, চিন্তার একটা আকার আছে, চিন্তা মাত্রেই বস্তূ, তা সে সুচিন্তাই হোক বা কুচিন্তাই  হোক। আমাদের স্বার্থহীন কল্যাণ  চিন্তা  অব্যর্থ ভাবে সেই অদৃশ্য সেই বিদেহী আত্মার কাছে বা বস্তূর কাছে, আমাদের চিন্তার প্রবাহ বা স্রোত   অবশ্য়ই পৌঁছাবে  । এবং তার কল্যাণ হবে। আমরা শুধু শ্রাদ্ধ শান্তি করে, নিয়ম রক্ষা করতে পারি। নিজেরা তৃপ্ত হতে পারি। কিন্তু তাতে তার কোনো মঙ্গল হয় না। বরং আমরা যদি পরম-ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, হে প্রভু তোমার এই পুত্রকে  " চির শান্তি দাও তারে, রেখো তারে আনন্দ পাথারে" - এই চিন্তা করে, দৈনিক কয়েকবার স্থির চিত্তে পরম-ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে পারি, তবে পরলোকগত আত্মার কল্যাণ  সাধিত হয়। আমাদের যে সব নিকট আত্মীয়, পরলোকে বাস করছে, তারা সবাই তখন এসে নবাগতকে অভ্যর্থনা করে। নতুন জগতের সব কিছু তাকে বোঝায়, এবং সাহায্য করে। তা না করে যদি আমরা শোকাচ্ছন্ন হয়ে থাকি, কান্নাকাটি করি, তবে মৃত ব্যক্তির আত্মা একটা দোটানায় পরে যায়, এবং অকুল পাথারে দুলতে থাকে। এবং এর ফলে, যে মৃত্যু তাকে এক আনন্দময় উজ্বল জীবনের সন্ধান দিতে পারতো, তাঁকে সে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করতে পারে না। ফলে আমাদের কান্নাকাটি, শোক, এগুলো মৃত আত্মার উন্নতির অন্তরায় হয়ে যায়। এবং নতুন জীবনে অভ্যস্ত হতে তার দেরি হয়। মৃত আত্মার প্রকৃত মঙ্গল সাধন করতে হলে তন্ময় চিত্তে প্রতিদিন, মৃত আত্মার জন্য প্রার্থনা করা কর্তব্য। একটা সুন্দর প্রার্থনার কথা আমি অনেক দিন আগে এক ব্রাহ্মণ পন্ডিতের কাছে শুনেছিলাম, জানিনা কার লেখা, সেটা বলি :

ঈশো দিশতু কল্যানং সর্ব্ব অশুভ নিবর্তকম।
নির্মল আনন্দ সন্দোহং শাশ্বতং তে প্রযচ্ছতু। ।

হে ঈশ্বর, সমস্ত অশুভকে দূর করে,  কল্যাণ  করুন। শাশ্বত নির্মল আনন্দ যথেষ্ট পরিমানে প্রদান করুন।

শান্তি নির্বাণ-পরমা ব্রহ্ম সংস্থা সদা অস্তু তে।
ভূয়াৎ চিরন্তনী তৃপ্তিঃ প্রীতির ঐকান্তিকী পরা। ।

পরম-নির্বাণ শান্তি স্বরূপ ব্রহ্মে স্থিতি যেন বিধেয় হয়।  তৃপ্তি ও প্রীতি যেন চিরস্থায়ী হয় ও ঐকান্তিক হয় ।

সৎ কৃপাবারি বর্ষৈস্তে ত্রিতাপানল সঞ্চয়াঃ।
চিরায় প্রশমং যান্তু-মাঙ্গল্যম ঈদম অর্থয়ে। ।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি  ওঁং

ত্রিতাপ জ্বালা নিবারণের জন্য তোমার সৎ কৃপাবারি সদাই বর্ষাতে  থাকুক। অমঙ্গল প্রশমিত হোক চিরতরে। এই আমাদের প্রার্থনা। 

আমাদের মধ্যে কারুর কারুর ধারণা, উপাসনাতে, বা প্রার্থনাতে, পরলোকগত আত্মার কি  আসে যায়  ? বরং বলা যেতে পারে, যারা এই উপাসনা, বা প্রার্থনা করে, তাদের এতে লাভ হয়। মনের শান্তি আসে। মৃত ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠা আমাদের পক্ষে আরো বেশি জরুরী।  কিন্তু তারা যেটা জানে না, সেটা হচ্ছে, জীবের মৃত্যু কিংবা জীবিত থাকা প্রকৃত পক্ষে অর্থহীন বাক্য। জীব যখন, আনন্দলোক থেকে বেরিয়ে আসে, তার পর থেকে সে ঘুরতে থাকে, কখনো স্থুল শরীর  ধারণ করে, যাকে  আমরা জীবিত বলি,  আবার কখনো সূক্ষ্ম শরীর ধারণ করে, তখন তাকে আমরা মৃত বলি। আসলে আমরা যেমন, তেমনই  আছি।  যখন আমরা মনুষ্য শরীরের মধ্যে প্রবেশ করি তখন মানুষ  হয়ে যাই।  আসলে আমি যার মধ্যে যখন প্রবেশ করি, তখন আমাকে তাই মনে হয়। আমি মানুষের মধ্যে প্রবেশ করলে আমি মানুষ হই , আবার যদি কোনো জীব অর্থাৎ গরু গাধা, বাঘ, হাতি যার মধ্যেই প্রবেশ করি, তখন আমি তাই হয়ে যাই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, আমাদের বাসনার তৃপ্তি সাধনের সমাপ্তিতে,  আবার সেখান থেকে বেরিয়ে নিজ ধামে ফিরে আসি।  এটাই মোক্ষ।  এটাই মুক্তি। আসলে আমি যা তাইই  থাকি। আমি যার মধ্যে প্রবেশ করি, সেটার লয় মানে আমার লয়  নয়।  এই সত্য আমাদের বুঝতে হবে।

তথাকথিত মৃত্যু আর কিছুই নয়, শরীরের পরিবর্তন, অর্থাৎ স্থূল থেকে সূক্ষ্ম শরীরে গমন। জীবিত মানুষের ক্ষেত্রে যেমন ভালো কথা, ভালোবাসার কথা আমাদের আনন্দ দেয়, ঠিক তেমনি বিদেহীর পক্ষে, তার সম্পর্কে প্রেমাত্মিকা চিন্তা, তার কাছে  উপাদেয়, বা উপভোগ্য। আমাদের শুভ চিন্তা যত  ঐকান্তিক হবে যত  গভীর হবে, ততই অধিক ফলবতী হবে।  আর একই জিনিস যদি সমবেত ভাবে করা যায়, অর্থাৎ উপাসনা যদি সমবেত ভাবে করা যায়, তবে সেটা আরো বেশি ফলপ্রসূ, আরো বেশি আনন্দ দায়ক হবে। আর বিদেহীর  আত্মউন্নতির পথে সহায়ক হবে। আত্মীয়স্বজন যদি একসঙ্গে, একই সময়ে একত্রে মিলিত হয়ে প্রতিদিন শুভচিন্তা প্রেরণ করে তার চেয়ে ভালো কিছু আর হয় না। যদি সবাই একই সময় এক জায়গায় মিলিত হতে নাও  পারেন, তথাপি, একটা নির্দিষ্ট সময়ে এই শুভ চিন্তার অনুষ্ঠান করতে পারেন, তবে সেটাও খুব ফলপ্রসূ হবে। সুতরং আমাদের চিন্তাশক্তির এই শুভ দিকটি যদি আমরা সম্মিলিত ভাবে কাজে লাগাতে পারি, তবে শুধু পারলৌকিক আত্মাদেরই শান্তি হবে তাই নয়, আমাদেরও সর্বাঙ্গীন শান্তি লাভ হবে।

শোক আসলে স্বর্থের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।  আমরা মনে করি,  যে এত স্নেহ, মমতা, প্রেম, ভালোবাসা, সবই  জীবনের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায়। আমি তো জানিনা যে আমার শেষ নেই। নতুন ভাবে আমি পরলোকে বিকশিত হই।  পরলোকে তো জন্ম মৃত্যু নেই সেখানে আমরা আবির্ভূত হই, আবার সময় শেষ হয়ে গেলে আমরা সেখান থেকে প্রস্থান করি। অর্থাৎ হয় উচ্চতর স্তরে অথবা আবার মৃত্যুপুরীতে চলে আসি। কারুর সঙ্গেই আমার বিচ্ছেদ হয় না। পরলোকে বসে আমরা সব দেখতে শুনতে পাই শুধু আদান প্রদান পার্থিব ভাবে করতে পারি না। কিন্তু ভাবনা-চিন্তা আমাদের মিলনের সেতু হতে পারে। পুত্র যখন দূর দেশে চাকরি করতে যায়, তখন আমরা কান্নাকাটি করি, এগুলো ঠিক নয়। এতে দুরদেশবাসী আমার আত্মীয়ের বা পুত্রের  মানসিক যন্ত্রনা হয়।এতে তারা  সেখানকার স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারে না। আমরা সেটা বুঝতে পারি না। তেমনি পরলোকবাসীর জন্য আমরা যদি শোক করি, তাতে তাদের কষ্ট  হয়। এবং তাদের স্বাভাবিক উন্নতিতে বাধা হয়। কামনার লোকে তাদের বাসের সময় দীর্ঘায়িত হয়। সেটা আমাদের একদম অনুচিত। আমাদের নিকটজন বাড়ির বাইরে গেলে এক অশুভ আশঙ্কা আমাদের ঘিরে থাকে, এই বুঝি তার কোন খারাপ কিছু হলো। আসলে স্নেহ ভালোবাসা, আমাদের অনিষ্টের আশঙ্কা বাড়িয়ে তোলে। তাই শোক করা, বা অনিষ্টের আশঙ্কা থেকে আমাদের চিন্তাকে দূরে রাখতে হবে। শুভ চিন্তা-ভাবনা নিয়ে উপাসনা করুন, শুধুই উপাসনা করুন। আমাদের শুভভাবনার এক অলৌকিক ক্ষমতা আছে, সেটা প্রতক্ষ্য করুন।

            
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ

  


         




      



                           

                
















No comments:

Post a Comment