আমরা যে নাম সংকীর্তন করি, বা বিভিন্ন নাম জপ্ করি, এর উৎস কোথায় ? আমরা কেউ কৃষ্ণ নাম করি, কেউ রাম নাম করি, কেউ শিবের নাম জপ্ করি। কেন করি ? সত্যিই কি এই নাম জপের কোনো গুরুত্ত্ব আছে ? কেউ বলেন, এই নামের মধ্যে ধ্বনির মাহাত্ম আছে । কেউ বলেন, মন্ত্রের অর্থ না বুঝে জপ্ করলে কিছু হয় না। কেউ বলেন, নির্দিষ্ট সংখ্যক জপ্ করলে তবে জপ্ সার্থক হয়। কালী কালী জপলেই কি মা-কালীকে পাওয়া যায় ? বা রাম -কৃষ্ণ-শিব বলে বার বার ডাকাডাকি করলেই সেই দেবতা বা দেবীকে পাওয়া যায় ? আজ আমরা সেই রহস্যঃ বোঝার চেষ্টা করবো।
আমরা সবাই জানি, আমাদের দেহের তিনটি ভাগ। স্থুল -সুক্ষ - কারন। সাধু-মহাত্মারা এটা অনুভূতিলব্ধ জ্ঞানের সাহায্যে উপলব্ধি করেছেন। তাঁরা স্থুল -সুক্ষ -কারন ভেদে দেহের অন্তর-পথকে তিনটি নামে উল্লেখ করেছেন। পিন্ডদেশ, অন্ডদেশ, এবং ব্রহ্মদেশ। আমাদের তিনটি জিনিস প্রধান - দেহ-মন-আত্মা। এছাড়া আছেন, পরমাত্মা। এখন পরমাত্মাকে অনুভব করতে গেলে, এই আত্মাকে দিয়েই অনুভব করা যায়। বিজ্ঞানীরা যেমন কোনো জিনিষকে বিশ্লেষণ করতে গেলে, বস্তূর স্থুলতা থেকে ধীরে ধীরে, সুক্ষ তত্বের দিকে এগিয়ে যান , তেমনি সাধু-মহাত্মারাও স্থুল থেকে সূক্ষ্ম দিকে এগিয়ে যান, সাধনার সাহায্যে।
সাধু-মহাত্মারা, মূলাধার ইত্যাদি ছয়টি চক্র সমন্বিত দেবাদিলোককে বলছেন, পিণ্ডদেশ। প্রলয়ে এগুলোর লয় হয়। এর উপরে আছে অন্ডদেশ। এখানেও ছয়টি স্তর আছে। সেগুলো কাল বা সময় দ্বারা রচিত। প্রলয়কালে এগুলোরও লয় হয়। পিন্ড ও অণ্ডদেশের অতীত হচ্ছে ব্রহ্মান্ড। এই ব্রহ্মান্ডদেশ মহাকাল দ্বারা রচিত। এখানেও কিঞ্চিৎ মায়া বর্তমান। এখানেও ছটা স্তর আছে। সাধারণ প্রলয়ে এর লয় হয় না। কিন্তু মহাপ্রলয়ে এর লয় হয়।
এই ব্রহ্মান্ড ভূমির অতীত হচ্ছে পরমভূমি, যাকে চৈতন্যভূমি বলা হয়। এখানে মায়ার লেশমাত্র নেই। সাধু-মহাত্মাদের মতে, প্রলয়কালে, এমনকি মহাপ্রলয়কালেও, এই পরমবস্তু ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। সাধু-মহাত্মাদের এখানেই গন্তব্য, এখান থেকেই আমরা আসি, এখানেই রক্ষিত আছে সমস্ত সৃষ্টির বীজ। এখানেই জীবের সত্যিকারের মুক্তি।
পিন্ডদেশ : মূলাধার-স্বাধিষ্ঠান-মনিপুর-অনাহত-বিশুদ্ধ-আজ্ঞা ১. মূলাধার চক্র - এর অধিপতি হচ্ছেন শ্রী গনেশ। চতুর্দল পদ্ম ২. স্বাধিষ্ঠান চক্র - এর অধিপতি ব্রহ্মা। ষটদল পদ্ম। ৩. মনিপুর চক্র - এর অধিপতি বিষ্ণু - অষ্টদল পদ্ম।
৪. অনাহত চক্র - দ্বাদশদল পদ্ম - অধিষ্ঠাত্রী দেবী, কালী-দূর্গা ইত্যাদি শক্তি। ৫. বিশুদ্ধচক্র - ষোলো দল পদ্ম - এখানকার অধিপতি হচ্ছেন শিব। ৬. এর উপরের ভূমি আজ্ঞাচক্র - দ্বিদলপদ্ম - এর অধিপতি ব্রহ্ম।
এখানে একটা জিনিস খেয়াল করুন, মূলাধারে শ্রীগণেশ। স্বাধিষ্ঠানে ব্রহ্মা, মনিপুরে বিষ্ণু, অনাহতে শক্তির দেবী - কালী-দূর্গা ইত্যাদি, বিশুদ্ধে শিব, এবং আজ্ঞাচক্রে ব্রহ্ম । অর্থাৎ এই শিবভূমির নিচে সমস্ত দেবতাদের অবস্থান বলে শিবকে বলা হয়েছে দেবাদিদেব মহাদেব। মহাদেবের উপরে অর্থাৎ বিশুদ্ধচক্রের উপরে আজ্ঞাচক্র যেটা ব্রহ্ম-ভূমির অন্তর্গত।
পিণ্ডদেশের এই ছটা ভূমি অণ্ডদেশের অনুকরণে মায়া রচনা করেছে। যাতে সাধক প্রকৃত তত্ত্বের সন্ধান না পায়।
অন্ডদেশ : এবার অণ্ডদেশ সম্পর্কে শুনুন। আসলে অন্ডদেশের অনুকরণেই তৈরী হয়েছে পিন্ডদেশ। অর্থাৎ আমরা আগে যেটা আলোচনা করলাম। এখানে আছে :
১. চতুর্দল কমল : - মন-বুদ্ধি-চিত্ত-অহংকার প্রভৃতির কেন্দ্রবিন্দু।
২. ষটদল কমল : - আমাদের থার্ড আই বা তৃতীয় নেত্রের ঠিক নিচে। এই শক্তিপ্রবাহ থেকেই আমাদের জন্ম, বেঁচেথাকা, বৃদ্ধি, ক্ষয়, ভবিষ্যৎ, এবং মৃত্যুর কাজ পরিচালিত হয়।
৩. অষ্টদল কমল : - আমাদের তৃতীয় নেত্রের মধ্যে অবস্থিত। পঞ্চতত্ব (ক্ষিতি, অপি, তেজ, মরুৎ , ব্যোম ) এবং ত্রিগুণের (সত্ত্বঃ, রজঃ, তমঃ) উৎপত্তি স্থান এটি।
৪. দ্বাদশদল পদ্ম : - এটি সহস্রদল কমলের অন্তর্গত।
৫. ষোলদল পদ্ম - শ্বেত শূন্য - এর প্রতিবিম্ব পিণ্ডদেশের বিশুদ্ধ চক্রে শেতাম্বর শিবস্থানে পড়েছে।
৬. দ্বিদল পদ্ম - এটি ত্রিকুটির নিম্নভাগে।
এখানে কালের খেলা। উচ্চতর কেন্দ্রের ঠিক অবিকল চিত্র ফুটে উঠেছে নিম্ন কেন্দ্রে। এইজন্য সাধকরা এখানে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। এখানে অর্থাৎ পিন্ডদেশে এসেই, সাধক মনে করেন, উচ্চকেন্দ্রে অর্থাৎ অন্ডদেশে এসে গেছেন।
ব্রহ্মান্ডদেশ : ব্রহ্মান্ডদেশ আজ্ঞাচক্র থেকে সহস্রার চক্রের মধ্যে। এই সহস্রার -ভূমির অধিপতি হচ্ছেন, পরমপুরুষ-নিরঞ্জন পুরুষ। এখান থেকে দশটি ধুন বা নাদ প্রকট হয়েছে। আসল বিষ্ণুভূমি, শিবভূমি, এবং ব্রহ্মভূমি এখানে। অর্থাৎ সহস্রদল পদ্মে এই তিন ভূমি অবস্থান করছে। এর উপরিভাগে আছে পরব্রহ্ম। পিন্ডদেশ ও অণ্ডদেশ হচ্ছে ব্রহ্মান্ড দেশের নকল, যা তৈরি করে রেখেছেন কাল এবং মায়া । কাল ও মায়া মিলে তৈরি করেছেন অন্ডদেশ, আর মায়া তৈরি করেছেন পিন্ডদেশ।
সে যাই হোক, পিণ্ডদেশ ও অণ্ডদেশের আসল কেন্দ্র হচ্ছে ব্রহ্মান্ডভূমি। আর এই ব্রহ্মান্ডভূমি থেকে দশটি ধুন বা নাদ অর্থাৎ শব্দ তরঙ্গ বিভিন্ন দেশে এবং বিভিন্ন ভাবে প্রবাহিত হচ্ছে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, পরব্রহ্ম থেকেই সমস্ত নাদের উৎপত্তি। কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় এসে, এই শব্দ তরঙ্গ বিভিন্ন ভাবে শ্রুত হচ্ছে, অর্থাৎ শব্দ তরঙ্গ পর্যায়ক্রমে পরিবর্তন হচ্ছে, পরিবর্তন হচ্ছে তার শক্তিমত্তার । যেমন একই নদী বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধ্বনি উৎপাদন করে থাকে। উৎসে একরকম, পাহাড়ের গায়ে এক রকম, সমতল ভূমিতে একরকম, আবার সমুদ্রের নিকটে আরএক রকম। তাই একই ধ্বনি যখন প্রবাহিত হয়, কালক্রমে তার শক্তি ও পর্যায়ের পরিবর্তন হচ্ছে । আর এই ব্রহ্মান্ডদেশের সর্বোচ্চ ধাম থেকে যে ধ্বনি প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে, তা পিন্ডদেশের মূলাধার পর্য্যন্ত প্রবাহিত হচ্ছে। এবং বিভিন্ন স্তরে এসে তার শক্তি ও তরঙ্গের মাত্রার পরিবর্তন হচ্ছে।
ব্রহ্মভূমিতে এটা হচ্ছে রাং বা ক্লিং ( কৃষ্ণের বাঁশির সুর )
দ্বিদলপদ্মে হচ্ছে প্রণব বা ওঙ্কার ( অনাহত নাদ )
ত্রিকূটি মন্ডলে অর্থাৎ ত্রিনয়ন স্থানে বেদের চারি মহাবাক্য রূপে চারিধারার প্রকাশ পাচ্ছে অর্থাৎ জ্ঞানের প্রকাশ ।
বিশুদ্ধ চক্র - অর্থাৎ শিবভূমিতে এসে বম্ বম্ ববম্ রূপে প্রকাশ পাচ্ছে।
অনাহত চক্রে - এই ধ্বনি হয়ে যাচ্ছে ক্রিং।
মূলাধারে - গং গং রূপ পাচ্ছে।
আর এই কারণেই আমরা দেখি শ্রীকৃষ্ণের বীজ মন্ত্র হচ্ছে ক্লীং। রামের বীজ মন্ত্র হচ্ছে রাং। ব্রহ্মের বীজ মন্ত্র হচ্ছে ওং বা ওঁ। মাকালীর বীজ মন্ত্র হচ্ছে ক্রীং। শ্রীগণেশের বীজ মন্ত্র হচ্ছে, গং।
প্রসঙ্গত একটা কথা বলি, এই যে চক্রগুলোর কথা বলা হয়েছে, যা আমাদের শরীরের মেরুদণ্ডের বিভিন্ন অংশে অবস্থিত। এগুলো আর কিছুই নয়, গ্রন্থিচক্র, অর্থাৎ এই সব জায়গায়, বিভিন্ন গ্রন্থির বিভাগ স্থল। গ্রন্থিগুলো নেবে এসেছে উচ্চ মস্তিস্ক থেকে, এখানে গ্রাহক ও প্রেরক গ্রন্থির বিভাগ স্থল। এবং এই স্থলগুলোর আকার খানিকটা ওই বীজ অক্ষরের মত। অর্থাৎ দেবনাগরী ভাষায় যদি ওই মন্ত্রগুলো লেখা যায়, তা আমাদের গ্রন্থিচক্রের আকারের মতোই হবে। আমাদের ঋষিদের এ এক অদ্ভুত পর্যবেক্ষন। শরীরবিদ্যার বইতেও আজকাল এইসব গ্রন্থিচক্রের কথা লেখা আছে।
তাই আমাদের কোনো দেবতাকে পেতে হলে সেই দেবভূমি হতে আগত তরঙ্গের সাথে নিজেকে যুক্ত করতে হবে। ধ্বনিটা আসল। অর্থাৎ আমি যদি, মা কালীকে বা শক্তিদেবীকে অনুভব করতে চাই, তবে অনাহত চক্রে যে ক্রীং ধ্বনিত হচ্ছে, তার সঙ্গে আমাকে একাত্ম করতে হবে। শুধু মুখে বা মনে মনে মন্ত্র উচ্চারণ করলে হবে না। এই ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে হবে। অর্থাৎ আপনি যদি মাকালীকে পেতে চান তবে অনাহত চক্রে যে ধ্বনি ক্রীং ক্রীং ধ্বনি অনবরত ঝংকৃত হচ্ছে তার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে হবে। এই ধ্বনির তরঙ্গ প্রবাহ আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে মা কালির কাছে। ঠাকুর রামকৃষ্ণ এই ক্রীং ক্রীং ধ্বনির সঙ্গে বা অনাহত চক্রের ধ্বনির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন বলে, তিনি মাকালীর দর্শন পেয়েছিলেন। ঠিক তেমনি ব্রহ্মান্ডভূমির মন্ত্র হচ্ছে বা ধ্বনি হচ্ছে ক্লীং। যিনি ব্রহ্মান্ডভূমির সঙ্গে বা কৃষ্ণের সঙ্গে যুক্ত হতে চান তাকে এই ব্রহ্মান্ড ভূমির ধ্বনির সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। আবার বিশুদ্ধ চক্রের যে ধ্বনি বম বম, তার সাথে যুক্ত হতে পারলে আপনি শিবময় হয়ে যাবেন।
এখন কথা হচ্ছে, আমাদের লক্ষ্য কী হওয়া উচিত ? এইসব দেবদেবীর সাক্ষাৎ করাই কি জীবনের উদ্দেশ্য ? মহাত্মাগণ বলে থাকেন, দেব দেবীর সাক্ষাৎ তীর্থপথের দৃশ্য মাত্র। দেবদেবী হচ্ছেন, বিভিন্ন গুনের আধার মাত্র। দেবদেবী হচ্ছেন ঐশ্বর্যের অধিকারী। দেবদেবী হচ্ছেন, স্বর্গবাসী। অর্থাৎ এই অবস্থায় বা স্বর্গবাসে পরম আনন্দ লাভ করা যায়। কিন্তু এই দেবদেবী গন অর্থাৎ যাঁরা স্বর্গবাসী, তারাও তাদের সঞ্চিত পুন্য-কর্ম্মফল ভোগের শেষে আবার এই মৃত্যুপুরীতেই ফিরে ফিরে আসেন, কর্ম্মফল সঞ্চয়ের জন্য। স্বর্গে কখনো কর্ম্মফল সঞ্চিত হয় না। আসলে আমাদের লক্ষ হওয়া উচিত এই জন্ম মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি। দেবদেবীর সান্নিধ্য বা দেবদেবীর কৃপা নয়।
আমাদের পিন্ডদেশ থেকে অণ্ডদেশে উত্তরণ করতে হবে নিজেকে এবং তার পরে অণ্ডদেশ থেকে ব্রহ্মান্ডদেশ-এ যেতে হবে। দেবভূমির তুলনায়, পরব্রহ্ম ভূমি অধিকতর চৈতন্যময়। এবং এটাই প্রকৃত অক্ষয় ধাম বা আনন্দ ধাম। এই নির্মল চৈতন্যদেশই আমাদের ইষ্ট , আমাদের মালিক, আমাদের উপাস্য। জীবের এটাই পরম পুরুষার্থ। এখান থেকে যে পবিত্র ধ্বনি উদ্গীত হচ্ছে তার সঙ্গে একাত্ম হতে হবে। এটাই সত্যিকারের নাম বা নামের উদ্দেশ্য, নাম্ জপের উদ্দেশ্য।
ওম শান্তি, শান্তি, শান্তিঃ। হরি ওম।
No comments:
Post a Comment