আত্মতত্ত্ব - আমি কে ?
(মহামুনি ব্যাসদেব এর গীতা, মুনিবর অষ্টাবক্র-এর সংহিতা ও মহাত্মা গুরুনাথ-এর তত্ত্বজ্ঞান থেকে )
জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মজ্ঞান লাভ। আত্মতত্ব অর্থাৎ নিজের সম্পর্কেজীবাত্মা সম্পর্কে জানা। আমি কে - এই কথাটা সর্ব ধর্মের গবেষণার বিষয়। আত্মাকে জানার জন্য ব্যাকুলতা সর্বকালের। হাজার হাজার বছর আগেও এই আগ্রহ ছিল। এখনো সেই আকুলতায় ভাটা পড়ে নি। আমিও আত্মার খোঁজে, অর্থাৎ নিজের খোঁজে, মাঝে মধ্যে বইয়ের পাতা ওল্টাই। আজ আমরা সেই বইয়ের পাতা থেকেই আত্মার খোঁজ করবো। আত্মতত্ত্বের কথা উঠলেই যে বইটির কথা সব চেয়ে বেশি মনে পড়ে তা হলো শ্রীমদ্ভগবত গীতা। সর্ব ধর্মের সার এই পবিত্র গীতা। ভগবান কথিত মহামুনি ব্যাসদেব রচিত গীতার মান্যতা সব থেকে বেশি। তাই আমরা শ্রীমদ্ভগবৎ গীতার মধ্যেই প্রথমে প্রবেশ করবো।
মহামুনি ব্যাসদেব লিখিত শ্রীমদ্ভগবৎ গীতায়, যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ "সাংখ্যযোগ" অর্থাৎ দ্বিতীয় অধ্যায়ে আত্মতত্ত্ব সম্পর্কে বলছেন। সেখানে তিনি অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিৎ নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বত অয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে। (২/২০)
আত্মা কখনো জন্ম গ্রহণ করেন না, মৃত্যুবরণও করেন না। না ইনি কখনো জন্মগ্রহণ করেছেন, না ভবিষ্যতে জন্ম গ্রহণ করবেন। ইনি অজ অর্থাৎ জন্ম রোহিত, নিত্য বস্তূ অর্থাৎ চিরকালের , শ্বাশ্বত অর্থাৎ অবিনাশী এবং চির পুরাতন বা পরিনাম রোহিত । শরীরের বিনাশ হলেও, তাঁর অর্থাৎ অবিনাশী আত্মার বিনাশ হয় না।
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়নবানি গৃহ্ণাতি নরঃ-অপরাণি।
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্যন্যানি সংযাতি নবাণি দেহী। (২/২২)
মনুষ্যগন যেরূপ জীর্ন পুরাতন বস্ত্র ত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে , সেই রকম আত্মাও জীর্ন পুরাতন দেহ ত্যাগ করে নবদেহ ধারণ করে।
এটি একটি বিখ্যাত উক্তি যা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে অমর করে রেখেছে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় আত্মা কি এক দেহ থেকে আর এক দেহে বিচরণশীল একটা সত্ত্বা মাত্র ? দেহ ভিন্ন আত্মা থাকতে পারেন না ?
নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ
ন চৈনং ক্লেদয়ন্তি আপঃ ন শোষয়তি মারুতঃ। (২/২৩)
আত্মাকে অস্ত্র দ্বারা ছেদন করা যায় না, অগ্নি দগ্ধ্ করতে পারে না, জলে আদ্র করা যায় না, বায়ু শুষ্ক করতে পারেনা। অর্থাৎ আত্মা অমর, অপরিবর্তনশীল, অবধ্য।
ভগবান এর পরে বলছেন :
অব্যক্ত অয়ম অচিন্ত অয়ম অবিকার্য্যঃ অয়ম উচ্চ্যতে
তস্মাদ এবং বিদ্বিত্বৈনং ন অনুশোচিতং অর্হসি। (২/২৫)
আত্মা অব্যক্ত, অচিন্ত ও অবিকারী বলে কথিত। এই কথা বলে অর্জুনকে বলছেন : আত্মাকে এই ভাবে বিদিত হয়ে অনুশোচনা ত্যাগ করো।
এখানে একটা বিশেষ ব্যাপার লক্ষ্য করুন, আত্মা কে বা কি, সে সম্পর্কে কিছু বলছেন না। বলছেন আত্মার গুন্ সম্পর্কে বা স্বভাব সম্পর্কে। অর্থাৎ আত্মাকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আত্মার গুন্ বা আত্মা কি নয়, সেটাই বলা যায়। আত্মা কি সেটা বলা যায় না।
এইজন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ (২/২৯)এক জায়গায় বলছেন :
আশ্চর্যবৎ পশ্যতি কশ্চিদেনম আশ্চর্য্যবৎ বদতি তথৈব চান্যঃ।
আশ্চর্য়্য়বৎ চ এনম অন্য শৃনোতি শ্রূত্বা অপি এনংবেদ ন চৈব কশ্চিৎ।
এইজন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ (২/২৯)এক জায়গায় বলছেন :
আশ্চর্যবৎ পশ্যতি কশ্চিদেনম আশ্চর্য্যবৎ বদতি তথৈব চান্যঃ।
আশ্চর্য়্য়বৎ চ এনম অন্য শৃনোতি শ্রূত্বা অপি এনংবেদ ন চৈব কশ্চিৎ।
কেউ এঁকে অর্থাৎ আত্মাকে আশ্চার্য্যবৎ দেখেন, আবার কেউ এঁকে আশ্চার্য্যবৎ বর্ণনা করেন। আবার কেউ একে আশ্চার্য্যবৎ শোনেন, কিন্তু শোনার পরেও তাকে জ্ঞাত হতে পারেন না।
আত্মা সম্পর্কে একটা ধোঁয়াশা রয়েই গেলো। এটিকে তাই অনেকে বলেন গুহ্য তত্ত্ব। বলা যায় না।
আত্মা সম্পর্কে একটা ধোঁয়াশা রয়েই গেলো। এটিকে তাই অনেকে বলেন গুহ্য তত্ত্ব। বলা যায় না।
এবার আমরা মুনিবর অষ্টাবক্র তার সংহিতায় কি বলছেন, সেটা দেখবো : মহামুনি অষ্টাবক্র বিদেহী রাজা জনককে বলছেন :
ন পৃথ্বী - ন জলং – ন অগ্নিঃ – ন বায়ুঃ – ন দৌঃ বা ভবান্
এষাং সাক্ষিনম্ আত্মানং চিদ্রূপং(চিৎ -রূপম) বিদ্ধি মুক্তয়ে ।
হে শিষ্য, তুমি পৃথিবী (মাটি ) নয় - জল নয় - অগ্নি নয় - বায়ু নয় - আকাশ নয়। এ সকলের সাক্ষী আত্মাকে তুমি মুক্তি লাভার্থ চৈতন্য রূপে অবগত হও।
অষ্টাবক্র মুনি এখানে আত্মাকে চৈতন্যরূপে অবগত হওয়ার কথা বলছেন। অর্থাৎ চৈতন্য স্বরূপ।
অষ্টাবক্র মুনি এখানে আত্মাকে চৈতন্যরূপে অবগত হওয়ার কথা বলছেন। অর্থাৎ চৈতন্য স্বরূপ।
আচার্য্যদেব এর পর বলছেন – শ্লোক নং (১২) :
আত্মা সাক্ষী বিভুঃ পূর্ণ একো মুক্তঃ চিৎ অক্রিয়ঃ
অসঙ্গো নিঃস্পৃহঃ শান্ত ভ্ৰমাৎ সংসারবান ইব.
- আত্মা স্বভাবতই সাক্ষী, বিভু,পূর্ণ, মুক্ত চৈতন্য স্বরূপ , অক্রিয় , অসঙ্গ, নিস্পৃহ ও শান্তস্বরূপ। ভ্ৰম বশতঃ সংসারবান মনে হয়।
এখানে অষ্টাবক্র মুনি প্রথমে নঞৰ্থক অর্থাৎ আত্মা কি নয়, সেটা বলার পরে বলছেন তিনি সাক্ষী। অর্থাৎ দ্রষ্টা, বিভু, পূর্ণ, একা, মুক্ত। চিৎ অর্থাৎ চৈতন্যস্বরূপ, অক্রিয় অর্থাৎ ক্রিয়াহীন, অসঙ্গ, শান্ত, নিঃস্পৃহ ইত্যাদি ইত্যাদি। এখানে অষ্টাবক্র সদর্থক ভাবে এগিয়ে গেছেন। তিনি যে বিভু সেটা স্পষ্ট করেছেন। তিনি যে চৈতন্য স্বরূপ সেটা ব্যক্ত করেছেন।
এখানে অষ্টাবক্র মুনি প্রথমে নঞৰ্থক অর্থাৎ আত্মা কি নয়, সেটা বলার পরে বলছেন তিনি সাক্ষী। অর্থাৎ দ্রষ্টা, বিভু, পূর্ণ, একা, মুক্ত। চিৎ অর্থাৎ চৈতন্যস্বরূপ, অক্রিয় অর্থাৎ ক্রিয়াহীন, অসঙ্গ, শান্ত, নিঃস্পৃহ ইত্যাদি ইত্যাদি। এখানে অষ্টাবক্র সদর্থক ভাবে এগিয়ে গেছেন। তিনি যে বিভু সেটা স্পষ্ট করেছেন। তিনি যে চৈতন্য স্বরূপ সেটা ব্যক্ত করেছেন।
এবার আমরা মহাত্মা গুরুনাথের বই তত্ত্বজ্ঞান থেকে আত্মা সম্পর্কে জানবো।
মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্ত তার তত্ত্বজ্ঞান উপাসনা গ্রন্থে বলছেন। জ্ঞানের আশ্রয়-দ্রব্য হচ্ছে "আত্মা"। অর্থাৎ জ্ঞানকে যিনি আশ্রয় করে আছেন তিনিই আত্মা।পার্থক্যটা লক্ষ্য করুন, মহামুনি ব্যাসদেব বা অষ্টাবক্র মুনি আত্মার গুন্, স্বভাব সম্পর্কে বলছেন, আত্মা কি নয় সে সম্পর্কে বলছেন। আর মহাত্মা গুরুনাথ প্রথম কথাতেই আত্মার স্বরূপ বলে দিলেন। অর্থাৎ আত্মা হচ্ছে জ্ঞানের আশ্রয় দ্রব্য। এবার বলছেন, আত্মা দুই প্রকার : পরমাত্মা বা ঈশ্বর ও জীবাত্মা। ক্ষিতি ও অঙ্কুরাদির কর্তৃত্ব যিনি করেন, তিনিই ঈশ্বররূপে অনুমেয়। আর জীবাত্মা হচ্ছে মানস-প্রত্যক্ষ-সিদ্ধ। কথাটা আবার বলি : ক্ষিতি ও অঙ্কুরাদির কর্তৃত্ব যিনি করেন, তিনিই ঈশ্বররূপে অনুমেয়। আর জীবাত্মা হচ্ছে মানস-প্রত্যক্ষ-সিদ্ধ।
ক্ষিতি অর্থাৎ পৃথিবী . তিনি কিন্তু পৃথিবী কথাটা ব্যবহার করেন নি। বলছেন ক্ষিতি অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যত মৃত্তিকা বা মৃত্তিকা দ্বারা নির্মিত বস্তু আছে অর্থাৎ জড়বস্তু আছে তার যে কর্তৃত্ত্ব করেন, এবং অঙ্কুরাদি অর্থাৎ প্রাণ সৃষ্টির প্রক্রিয়ার উপরে যিনি কর্তৃত্ত্ব করেন, তিনিই ঈশ্বর। অর্থাৎ বিশ্ব শক্তি নিয়ন্ত্রক-ই হচ্ছেন ঈশ্বর বা পরমাত্মা।
একদম শেষে সংস্কৃত তত্ত্বজ্ঞান থেকে শুনবো :
মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্ত তার তত্ত্বজ্ঞান উপাসনা গ্রন্থে বলছেন। জ্ঞানের আশ্রয়-দ্রব্য হচ্ছে "আত্মা"। অর্থাৎ জ্ঞানকে যিনি আশ্রয় করে আছেন তিনিই আত্মা।পার্থক্যটা লক্ষ্য করুন, মহামুনি ব্যাসদেব বা অষ্টাবক্র মুনি আত্মার গুন্, স্বভাব সম্পর্কে বলছেন, আত্মা কি নয় সে সম্পর্কে বলছেন। আর মহাত্মা গুরুনাথ প্রথম কথাতেই আত্মার স্বরূপ বলে দিলেন। অর্থাৎ আত্মা হচ্ছে জ্ঞানের আশ্রয় দ্রব্য। এবার বলছেন, আত্মা দুই প্রকার : পরমাত্মা বা ঈশ্বর ও জীবাত্মা। ক্ষিতি ও অঙ্কুরাদির কর্তৃত্ব যিনি করেন, তিনিই ঈশ্বররূপে অনুমেয়। আর জীবাত্মা হচ্ছে মানস-প্রত্যক্ষ-সিদ্ধ। কথাটা আবার বলি : ক্ষিতি ও অঙ্কুরাদির কর্তৃত্ব যিনি করেন, তিনিই ঈশ্বররূপে অনুমেয়। আর জীবাত্মা হচ্ছে মানস-প্রত্যক্ষ-সিদ্ধ।
ক্ষিতি অর্থাৎ পৃথিবী . তিনি কিন্তু পৃথিবী কথাটা ব্যবহার করেন নি। বলছেন ক্ষিতি অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যত মৃত্তিকা বা মৃত্তিকা দ্বারা নির্মিত বস্তু আছে অর্থাৎ জড়বস্তু আছে তার যে কর্তৃত্ত্ব করেন, এবং অঙ্কুরাদি অর্থাৎ প্রাণ সৃষ্টির প্রক্রিয়ার উপরে যিনি কর্তৃত্ত্ব করেন, তিনিই ঈশ্বর। অর্থাৎ বিশ্ব শক্তি নিয়ন্ত্রক-ই হচ্ছেন ঈশ্বর বা পরমাত্মা।
একদম শেষে সংস্কৃত তত্ত্বজ্ঞান থেকে শুনবো :
"নায়মাত্মা শরীরমিন্দ্রিয়ং বা। আত্মা শরীর বা ইন্দ্রিয় নয়।
আহতে শরীরে, বিষয়ে ইন্দ্রিয়-প্রবিষ্টে চ অন্যমনস স্তদুভয়াননুভাবাৎ। শরীর আঘাত প্রাপ্ত হলে, বা বিষয়ে ইন্দ্রিয় প্রবিষ্ট হলেও, যদি অন্যমনস্ক থাকা যায়, তবে এই উভয়ের অনুভব হয় না।
প্রাঞ্চ ঊচুঃ, চাতুর্দ্দশসু ( নব্যাস্তূ সপ্তসু ) বর্ষেষু গতেষু পরিবর্তণীয়ানি শারীরস্য মস্তিস্কস্য চ উপাদানানি, নতু স্মৃত্যাদয়ো ভাবাঃ। প্রাচীনদিগের মতে ১৪ বছর, আধুনিক মতে ৭ বছরের মধ্যে শরীরের ও মস্তিষ্কের সমস্ত উপাদানের পরিবর্তন হয়। কিন্তু স্মৃতি প্রভৃতি ভাব পরিবর্তিত হয় না।
অতএব স্মৃত্যাদয়ো যত্র বিদ্যন্তে স আত্মা, ন শরীরং ন মস্তিস্কঞ্চ। অতয়েব স্মৃতি ইত্যাদি ভাব যাতে বিদ্যমান আছে বা ধরা থাকে সে-ই আত্মা, এটি না শরীর না মস্তিস্ক।
পরং স চৈতন্যবান্। কিন্তু ইহা চৈতন্য বিশিষ্ট।
শরীরমিন্দ্রিয়ানিচ করণানি, আত্মা তু কর্ত্তা। শরীর বা ইন্দ্রিয়গণ হচ্ছে করন, আর আত্মা হচ্ছে কর্তা।
অতএব শরীরেন্দ্রিয় মস্তিস্কাতিরিক্ত শ্চৈতন্যবান এবং আত্মা। এতএব শরীর, ইন্দ্রিয়, মস্তিস্ক থেকে অতিরিক্ত কিছু, যা চৈতন্যবান এবং তিনিই আত্মা।
এর পরে মহাত্মা গুরুনাথ একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছেন সেটা হচ্ছে আত্মা ও জীবন সম্পর্কে। আমাদের মধ্যে একটা ধারণা আছে যে আত্মা আমাদের শরীরকে বাঁচিয়ে রাখে। আত্মা বা চেতন শক্তি চলে গেলে আমাদের শরীরের মৃত্যু হয়। ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। জীবনী শক্তি ও চেতনা শক্তি দুটো আলাদা জিনিস।
শুনুন মহাত্মা গুরুনাথ কি বলছেন :
জীবনী-শক্তিঃ প্রাণ-সংজ্ঞয়া অভিধীয়তে, সা চ আত্মনঃ পৃথক্। জীবনী শক্তি যা প্রাণ নামে খ্যাত, সেটা আত্মা থেকে পৃথক।
আত্মনো ধর্ম্ম-শ্চৈতন্যং তওু প্রাণ-ধর্ম্মো ন। আত্মার ধৰ্ম চৈতন্য যা প্রাণের ধৰ্ম নয়।
তথাত্বে সতি শ্বাসাদীনি প্রাণ কার্য্যাণি চৈতন্যাভাবে ন ভবিতুং শক্ন্ু বন্তি। তাই যদি হতো তবে শ্বাস প্রভৃতি প্রাণ-কার্য্য-সমূহ চৈতন্য অভাবে হতে পারতো না।
অতএব দেহেন্দ্রিয়-মস্তিস্কপ্রাণাতিরিক্ত আত্মা।" অতয়েব দেহ, ইন্দ্রিয়, প্রাণ ইত্যাদি থেকে অতিরিক্ত কিছু আত্মা।
আমাদের সব কিছুর পরিবর্তন হয়, কিন্তু স্মৃতির পরিবর্তন হয় না। স্মৃতি বা ভাব পরিবর্তিত হয় না। অতএব মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন, এই স্মৃতির ভাব যাতে বিদ্যমান আছে তিনিই আত্মা। ।
খেয়াল করুন, মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন : এই শরীরে অবস্থিত ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যিনি জ্ঞাত হন তিনিই আত্মা। কে জ্ঞাত হয় ? ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যে জ্ঞান আমরা সংগ্রহ করি, তা আসলে কে বোঝে বা জ্ঞাত হন ? আমাদের সাধারণ ভাবে মনে হয় মন এই জ্ঞাতা। আমরা যখন যা কিছু দেখছি, শুনছি, বা আস্বাদন করছি, সেটি প্রথমে যায় আমাদের মস্তিষ্কে। মস্তিস্ক পাঠিয়ে দেয় চেতনমনে, চেতনমন পাঠিয়ে দেয়, বুদ্ধির কাছে। বুদ্ধি তার পূর্ব সংস্কার অনুযায়ী ইন্দ্রিয়লবদ্ধ বিষয়ের সঙ্গে জ্ঞানকে মেশায়। বা জ্ঞান প্রদান করে। এইবার বিচার করে। এবং মনকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়। এই সমগ্র ব্যাপার থেকে যে জ্ঞান হয় সেটা আমাদের স্মৃতিতে চলে যায়। এই স্মৃতিকে যিনি ধরে রেখেছেন তিনিই চেতনা বা আত্মা, চৈতন্য শক্তি। ইনি অকর্তা। কিছুই করেন না। দ্রষ্টা মাত্র। সাক্ষী মাত্র। সাক্ষী যেমন শুধু দেখেন না - স্মৃতিতে ধরে রাখেন , এবং প্রয়োজনে প্রকাশ করতে পারেন। আত্মা তাই সাক্ষী, বিভু, চৈতন্য, নিরাকার, নির্বিকার।
মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন ৭ বা ১৪ বছরের মধ্যে আমাদের শরীরের বা মস্তিষ্কের সমস্ত উপাদান পরিবর্তিত হয়ে যায়। আসলে আমাদের শরীর অসংখ্যা কোষের সমষ্টি। এই কোষ প্রতিনিয়ত জন্মাচ্ছে, প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি প্রাপ্ত হচ্ছে আবার মারা যাচ্ছে। এই মৃত কোষগুলোই বিভিন্ন ভাবে আমাদের শরীর থেকে মল-মূত্রের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। আমাদের অল্প বয়সে এই কোষ বৃদ্ধি, কোষ অবলুপ্তের থেকে বেশি হয়। তাই আমাদের শরীর বৃদ্ধি পায়। একটা বয়সের পরে আমাদের এই কোষের প্রজনন ক্ষমতা কমে যায় ফলত আমাদের শরীরের বৃদ্ধি হয় না। আমরা বৃদ্ধ হবার পথে এগিয়ে যাই। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজ আমার শরীরে বা মস্তিষ্কে যে উপাদান আছে, একটা সময়ের পরে তা আর একেবারেই থাকবে না। শরীর তখন সম্পূর্ণ নতুন উপাদানের মিশ্রণ হবে। একটা নয় বছরের শিশুর শরীরে আজ যা আছে - ষোলো বছর বয়সে, তার পুরোনো শরীরের কিছুই আর থাকবে না। এমনকি মনও এক থাকবে না। কিন্তু স্মৃতি থেকে যাবে। আমি, আমার শরীর-মন কিন্তু আর আগের মতো নেই। এটা আমরা সবাই বুঝি। এমনকি আমাদের শরীরের একটা অঙ্গহানি হয়ে গেলেও আমরা কিন্তু আমরা ভাবি আমিতো আছি । কিন্তু এই আমি আর সেই আমি এক নই অর্থাৎ সেই শরীর নেই,সেই মন, আমার আর এখন নেই। তবু স্মৃতি আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখে। তাই আমরা ভাবি। সেই শিশু বিনয় আর এই প্রৌঢ় বিনয় একই। এই স্মৃতি যিনি ধরে রাখেন তিনিই আত্মা বা জীবাত্মা।
ব্যক্তিগত স্মৃতি যিনি ধরে রাখেন তিনি জীবাত্মা। আর যিনি সমগ্র জগতের স্মৃতি যিনি ধরে রাখেন তিনিই পরমাত্মা বা পরমপিতা পরমেশ্বর। ।
এরপরে গুরুদেব আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছেন, সেটা হচ্ছে, আমরা যাকে প্রাণ শক্তি বা জীবনী শক্তি বলি. অর্থাৎ যার দ্বারা মানুষ বেঁচে থাকে, সেই প্রাণ কিন্তু আত্মা থেকে আলাদা। আত্মার ধৰ্ম হচ্ছে চৈতন্য। আর প্রাণের ধৰ্ম হচ্ছে জীবনীশক্তি । চৈতন্য না থাকলেও মানুষের প্রাণের কাজ চলতে পারে। তাই তো দেখি চেতনাবিহীন মানুষেরও স্বাসপ্রস্বাস চলতে থাকে।
শরীরে এমন একটা কিছু আছে যার সুখ, দুঃখ, প্রযত্ন, ইচ্ছা ও দ্বেষ জ্ঞান আছে, কিন্তু অনুভব নেই। ইনিই আত্মা। ইনি না শরীর, না মন. না মস্তিস্ক। এগুলোর অর্থাৎ শরীর, মন, মস্তিষ্কের পরিবর্তন আছে। কিন্তু স্মৃতির পরিবর্তন নেই। এই স্মৃতি যাতে থাকে তাকেই বলে আত্মা ।
মহাত্মা গুরুদেব বলছেন, আত্মার কর্মক্ষেত্র হচ্ছে অন্তঃকরণ অর্থাৎ মন, বুদ্ধি, অহংকার ও চিত্ত । আত্মার আছে ইচ্ছা। অন্তঃকরণের আছে প্রবৃত্তি। সংশয়, নিশ্চয়, অহংকার, স্মরণ। মন কোনো কিছু দেখলেই সংশয় সৃষ্টি করে, বুদ্ধি এই সংশয় দূর করে, অহংকার গর্ব্ব করে, আর চিত্ত স্বরণ করে।
জীবাত্মার সমস্ত কর্মই ত্রিবিধ : কর্ম, ভোগ, জ্ঞান। এই কারণে জীব, একাধারে কর্তা, আবার ভোক্তা, ও জ্ঞাতা বলে কথিত হয়। আত্মা চৈতন্যাত্মক, শরীরাদি জড়াত্মক।
তাহলে মহাত্মা গুরুনাথের কথায় আমাদের কাছে দুটো জিনিস পরিষ্কার হলো। একটা হচ্ছে জীবনীশক্তি বা প্রাণশক্তি। যা আমাদের শরীরকে বাঁচিয়ে রাখে। আর একটা হচ্ছে চেতন শক্তি যা স্মৃতির ধারক, ইনিই আত্মা।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
-----------------------------------------------------------------------
বিখ্যাত শাস্ত্র গ্রন্থে যা পাইনি তাই পেলাম গুরুদেব মহাত্মা গুরুনাথের গ্রন্থে। আপনারা যারা মহাত্মা গুরুনাথের বই পড়ার সৌভাগ্য পান নি, বা পেলেও পড়েন নি, তাদের অনুরোধ করবো, শুধু হাজার বছরের পুরোনো হলেই ভালো হয়, বিশ্বাসযোগ্য হয়, তা নয়। বরং নতুনের মধ্যে আরো ভালো জিনিস পেতে পারেন। জাগতিক বিজ্ঞান যেমন উন্নতি করছে, আধুনিক আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানও সত্যের গভীরে ঢুকছে। খোলা মন নিয়ে এগিয়ে আসুন। সত্যকে উপলব্ধি করুন।
জয় গুরুদেব ; জয় গুরুদেব ; জয় গুরুদেব ; জয় গুরুদেব।
নমঃ গুরুদেব ;নমঃ গুরুদেব ;নমঃ গুরুদেব ;নমঃ গুরুদেব।
জয় গুরুনাথ ;জয় গুরুনাথ ; জয় গুরুনাথ ; জয় গুরুনাথ।
নমঃ গুরুনাথ ;নমঃ গুরুনাথ ; নমঃ গুরুনাথ ;নমঃ গুরুনাথ।
জয় জয় সদগুরুর জয় ; জয় জয় জগৎ-গুরুর জয়। জয় জয় গুরুনাথের জয়। জয় জয় পরমপিতা পরমেশ্বরের জয়। হরি ওঁং।
বিখ্যাত শাস্ত্র গ্রন্থে যা পাইনি তাই পেলাম গুরুদেব মহাত্মা গুরুনাথের গ্রন্থে। আপনারা যারা মহাত্মা গুরুনাথের বই পড়ার সৌভাগ্য পান নি, বা পেলেও পড়েন নি, তাদের অনুরোধ করবো, শুধু হাজার বছরের পুরোনো হলেই ভালো হয়, বিশ্বাসযোগ্য হয়, তা নয়। বরং নতুনের মধ্যে আরো ভালো জিনিস পেতে পারেন। জাগতিক বিজ্ঞান যেমন উন্নতি করছে, আধুনিক আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানও সত্যের গভীরে ঢুকছে। খোলা মন নিয়ে এগিয়ে আসুন। সত্যকে উপলব্ধি করুন।
জয় গুরুদেব ; জয় গুরুদেব ; জয় গুরুদেব ; জয় গুরুদেব।
নমঃ গুরুদেব ;নমঃ গুরুদেব ;নমঃ গুরুদেব ;নমঃ গুরুদেব।
জয় গুরুনাথ ;জয় গুরুনাথ ; জয় গুরুনাথ ; জয় গুরুনাথ।
নমঃ গুরুনাথ ;নমঃ গুরুনাথ ; নমঃ গুরুনাথ ;নমঃ গুরুনাথ।
জয় জয় সদগুরুর জয় ; জয় জয় জগৎ-গুরুর জয়। জয় জয় গুরুনাথের জয়। জয় জয় পরমপিতা পরমেশ্বরের জয়। হরি ওঁং।
------------------
ব্রহ্মানুভূতি লাভের উপায় :
মাঝে মাঝে মনে হয়, যার সম্পর্কে নিজের কোনো প্রতক্ষ্য অনুভূতি নেই, সে সম্পর্কে আলোচনা বা আলোচনায় অংশগ্রহণ করা আদৌ কোনো ফল প্রসব করে কি ? আসলে প্রতক্ষ্য অনুভূতি পেতে গেলে একটা প্রস্তুতি দরকার। যাঁকে প্রতক্ষ্য জানতে চাই, তাঁর সম্পর্কে যারা জানেন, তাদের কাছ থেকে আগের থেকে কিছু জেনে নিলে, প্রতক্ষ্য দর্শন যদি ভাগ্যক্রমে সত্যি সত্যি কখনো হয় , তখন নিজের অনুভূতিটাকে জ্ঞানীর প্রতক্ষ্য অনুভূতির সঙ্গে মেলাতে সক্ষম হবো। আর যদি প্রাথমিক কোনো জ্ঞান না থাকে, তবে সত্যিকারের অনুভব ও স্নায়বিক দুর্বলতার মধ্যে পার্থক্য ধরতে পারবো না। এই আশা নিয়ে বা এই উদ্দেশ্য নিয়ে, মহাত্মাদের কথা শুনতে চাই, মহাত্মাদের কথার মধ্যে নিজের বিচারশক্তিকে কাজে লাগিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চাই।
আমরা প্রতিনিয়ত রূপান্তরিত হচ্ছি। আর রূপান্তরের মধ্যে দিয়েই, আমরা ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছি। এই রূপান্তর যেমন আমাদের দেহে হচ্ছে, আমাদের বাহ্যিক জগতে হচ্ছে, তেমনি হচ্ছে, আমাদের মনের মধ্যে আমাদের বুদ্ধির মধ্যে। আর এই মন-বুদ্ধির রূপান্তর আমাদের বিশুদ্ধ জ্ঞানের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। আর আমরা যখন বিশুদ্ধ জ্ঞানের মধ্যে প্রবেশ করছি, তখন আমাদের মধ্যে একটা দিব্যভাব এনে দিচ্ছে।
যমরাজ নচিকেতাকে বলেছিলেন, ইন্দ্রিয়-সংযম, মন শান্ত,এবং চিন্তা যখন আলোড়নবিহীন হয়, তখন জীবাত্মা সমদর্শী হয়। অর্থাৎ তখন নিজেকে নিজে উপলব্ধি করতে পারে। আর নিজেকে উপলব্ধি করাই পরম-ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা।
যদা পঞ্চাব তিষ্ঠন্তে জ্ঞানানি মনসা সহ।
বুদ্ধিশ্চ ন বিচেষ্টতি তামাহুঃ পরমাং গতিম। (কঠ - ২/৩/১০)
পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় যখন মনের মধ্যে লীন হয়ে নিশ্চল ভাবে, অবস্থান করে, তখন বুদ্ধিও তার কর্ম্ম থেকে অবসর নিয়ে, স্থির হয়। এই অবস্থাকেই সাধনার সর্বোচ্চ অবস্থা বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ এই সময় আমাদের জ্ঞান ইন্দ্রিয় অর্থাৎ চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক অর্থাৎ রূপ, রস, গন্ধ,শব্দ, স্পর্শ গ্রহণকারী যে শ্রবণ শক্তি, বাক শক্তি, ইত্যাদি তাদের স্ব স্ব বিষয় থেকে নিবৃত থেকে, মনের সাথে আত্মাতেই অবস্থান করে থাকে। তখন সঙ্কল্পরহিত অন্তঃকরণ, আত্মাতে অবস্থান করে। এই সময় আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী বিচার-শক্তি, কোনো কর্তৃত্ত্ব করে না। এই অবস্থাকেই আচার্য্য শংকরের ভাষায় পরাগতি বলা হয়ে থাকে। আর এই অবস্থা আয়ত্ত্ব করতে হলে আমাদের যোগ অভ্যাস করতে হবে। যোগ মানে যোগাসন, বা যোগ-ব্যায়াম নয়। যোগ হচ্ছে অষ্টাঙ্গযোগ যা আমরা ঋষি পতঞ্জলির যোগদর্শনের মধ্যে পেয়েছি।
এখন কথা হচ্ছে, কঠোপনিষদে আমরা পড়েছি, ব্রহ্মকে বাক্য মন চক্ষু দ্বারা জানা যায় না। "নৈব বাচা ন মনসা প্রাপ্তুং শক্যো ন চক্ষুষা" (২/৩/১২) .তাহলে কি ব্রহ্ম-উপলব্ধি পেতে গেলে, আমাদের এই স্থুল দেহ, এমনকি আমাদের এই জ্ঞানেন্দ্রিয় কোনো কাজেই লাগবে না ? স্থুল বস্তুকে আমরা ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করতে পারি। আবার একথাও ঠিক যে এই স্থুল বিশ্ব যা আমাদের ইন্দ্রিয়গোচর হচ্ছে, তাও কিন্তু ব্রহ্মেরই প্রকাশ। এই কথাও ঋষিবাক্য। তাহলে একঅর্থে আমরা প্রতিনিয়ত ব্রহ্মকেই উপলব্ধি করছি। এবং তা এই দেহ-ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধ হচ্ছে। কিন্তু পরাব্রহ্ম অর্থাৎ বিশ্বের অতীত যে ব্রহ্ম, এই বিশ্বের যিনি মূলীভূত কারন, তাকে উপলব্ধি করতে গেলে, আমাদের ইন্দ্রিয়াতীত হয়ে উঠতে হবে। অর্থাৎ সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর স্পন্দনের মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে। এবং এই বিশ্ব যে আলোর স্পন্দন বৈ কিছু নয়, এই উপলব্ধি আনতে হবে। এবং এই আলোর উৎস সেই পরব্রহ্ম। এই ব্রহ্মের অবস্থান, নিত্যলোকে। এই নিত্যলোক, দ্বন্দ্বাতীত, নিরপেক্ষ, সাম্য।
আমাদের চিন্তার স্রোত, এই মায়াতীত তুরীয় অবস্থার মধ্যে প্রবেশের যোগ্য নয়। এক-একসময় আমাদের মনে হয়, আমরা চিন্তার রাজ্যে উন্নতি করতে পারলে, হয়তো আত্মাকে উপলব্ধি করতে পারবো। কিন্তু সত্য হচ্ছে, আমাদের মন কখনো সেই অবিনাশী আত্মার জগতে প্রবেশ করতে পারে না। আসলে আমাদের মনের সর্বোচ্চ অবস্থাতে পৌঁছলেও আমাদের দিব্য সত্ত্বাকে উপলব্ধি করতে পারবো না। এইখানে কঠোপনিষদ এক ভালো কথা বলেছে, সেটি হচ্ছে, শুধু এইটুকু জেনে রাখো, বা বিশ্বাস করো যে, ব্রহ্ম আছেন। এতেই আমাদের অনেক প্রাপ্তি হতে পারে।
"নৈব বাচা ন মনসা প্রাপ্তুং শক্যো ন চক্ষুষা। অস্তিতি ব্রুবতোঽন্যত্র কথং তৎ-উপলভ্যতে।। (২/৩/১২)
ব্রহ্মকে বাক্যের দ্বারা বর্ণনা না করা গেলেও, চোখের দ্বারা প্রতক্ষ্য না করা গেলেও, "স অস্তি" তিনি আছেন এই কথা যিনি বলতে থাকেন, তার মধ্যেই একসময় এই উপলব্ধি জেগে উঠতে পারে। একটা জিনিষ আমাদের দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করতে হবে, যে তিনি আছেন বলেই, বিশ্বের অস্তিত্ত্ব সম্ভব হয়েছে। এমনকি নিবিশেষ ব্রহ্মভাবেও তাকে উপলব্ধি করা সম্ভব। শুধু নেই নেই ভাবলে, তোমার কাছে, শূন্যতাই ফুটে উঠবে। হিন্দু সংসারে একটা কথা আমরা ছোট বেলা থেকে শুনে আসছি, নেই বলতে নেই। বাড়িতে কোনো কিছু না থাকলে, বলা হয়, অমুক জিনিসটি বাড়ন্ত। নেই একথা মুখে বললে, সেই সংসারে, নেতিবাচক প্রভাব পরে। আর সেই সংসারের অভাব কোনো দিন যায় না। তাই ব্রহ্মকে যদি পেতে চান, তবে ব্রহ্ম আছেন, এই ভাব নিজের মধ্যে জাগিয়ে তুলুন। অতএব, ব্রহ্ম উপল্বদ্ধির প্রথম সোপান হলো, "ব্রহ্ম আছেন" এই ইতিবাচক চেতনার উদ্বোধন।
এখন কথা হচ্ছে, কিভাবে এই চেতনার উদ্রেগ করা সম্ভব ? দেখুন আমরা নিজেকে কিভাবে জানি ? নিজের অস্তিত্ত্বকে আমরা কিভাবে, বুঝতে পারি ? আসলে অন্যের অস্তিত্ত্বকে আমরা যখন স্পর্শ করতে পারি, তখন আমাদের কাছে নিজের অস্তিত্ত্ব জানান দেয়। আমি-আমার তুমি-তোমার এই সম্পর্ককে ধরে আমাদের চৈতন্য যখন বিস্তার লাভ করে, তখন আমরা আমাদের অস্তিত্ত্ব সম্পর্কে সচেতন হই। অর্থাৎ নিজেকে জানার মধ্যে দিয়েই আমরা ব্রহ্ম উপল্বদ্ধির দিকে এক কদম এগিয়ে যেতে পারি।
অর্থাৎ প্রথমে ব্রহ্ম আছেন, এই বিশ্বাস দৃঢ় করতে হবে। এর পর আমি আছি, এই চেতনাকে ধরতে হবে। এবার খেয়াল করবার চেষ্টা করুন, আপনি কোথায় আছেন ? আপনি চেয়ারে বসে আছেন, আপনি বাড়িতে বসে আছেন, আপনি ভারতবর্ষে আছেন, আপনি পৃথিবীতে আছেন, আপনি সৌরলোকে আছেন। আপনি ব্রহ্মাণ্ডে আছেন। তো আপনি কোথায় আছেন, এই ধারণাকে প্রসারিত করবার চেষ্টা করুন। গন্ডিতে নিজেকে সীমাবদ্ধ করে ফেলবেন না। এরপর আপনি দেহে আছেন, আপনি মনে আছেন, আপনি আত্মায় আছেন, আপনি ব্রহ্মে আছেন। ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে আনুন। অর্থাৎ নিজের অন্তর্নিহিত সত্ত্বাকে উপলব্ধি করবার চেষ্টা করুন। তো প্রথমে নিজেকে প্রসারিত করেছিলেন। এবার আপনি নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে সূক্ষ্ম অস্তিত্ত্বের মধ্যে নিজেকে উপলব্ধি করছেন।
দেখুন নিজের অস্তিত্ত্ব বলতে আমরা কি বুঝি ? আমাদের অস্তিত্ত্ব কি শুধু দেহকে ঘিরে ? নিদ্রাকালে আমাদের দৈহিক চেতনা থাকে না। কিন্তু নিদ্রাকালে আমরা এই জড়দেহকে ক্রিয়াহীন রেখেও আমি কিন্তু বিচরণশীল বা ক্রিয়াশীল থাকতে পারি। স্বপ্নকালীন এই যে অস্তিত্ত্ববোধ এটি কিন্তু দেহ-সৃষ্ট নয়। তথাপি এই জড়দেহের মধ্যেই এই স্বপ্নের প্রভাব পড়ে । সত্যি কথা বলতে কি, আত্মার অস্তিত্ত্বের জন্যই আমাদের এই দেহের অস্তিত্ত্ব সম্ভব হয়েছে। চৈতন্যময় সত্ত্বা তার নিজ উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য প্রাণবন্ত এই গতিশীল দেহটি নির্মাণ করেছে। আমাদের চিন্তাধারা যত স্বচ্ছ হবে, তত আমরা বুঝতে পারবো, বিশ্বের সমস্ত বস্তুর অস্তিত্ত্বই সম্ভব হয়েছে আত্মার জন্য। এবং সমস্ত বস্তুর মধ্যেই এই এক চৈতন্য সত্ত্বা বিধৃত হয়েছে, এবং আত্মাই আত্মার অস্তিত্ত্বকে জ্ঞাত করাচ্ছে।
দেখুন দেহের মধ্যে বা আমার মধ্যে সূর্য্যের কোনো অস্তিত্ত্ব থাকতো না যদি না কিনা আমি চৈতন্যবান হতাম। দেখুন বধিরের কাছে, শব্দের কোনো অস্তিত্ত্ব নেই। অন্ধের কাছে, গোলাপের রঙের কোনো অস্তিত্ত্ব নেই। কিন্তু তাই-ব'লে শব্দ বা আলোর কি কোনো অস্তিত্ত্ব নেই ? আছে, কিন্তু সেগুলো আমাদের কাছে অজ্ঞাত। তাই অন্ধ বা বধিরের কাছে এগুলো অর্থাৎ শব্দ, রঙ ইত্যাদি অস্তিত্ত্বহীন।
ঈশ্বরকেও আমাদের এইভাবে বুঝতে হবে। ঈশ্বরের অস্তিত্ত্ব আছে কি নেই সেটি আমরা তখনই ধরতে পারবো, যখন সেই সম্পর্কে আমার জ্ঞান হবে। এখন কথা হচ্ছে, বাহ্যিক বস্তু আমরা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে মনের সাহায্যে জ্ঞাত হতে পারি। কিন্তু উপনিষদ বলছে, ব্রহ্ম ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কিছু নয়। অথচ আমরা আমাদের সমস্ত বিষয়জ্ঞান লাভ করে থাকি, এই ইন্দ্রিয় ও মনের সাহায্যে। এই জায়গাটা আমাদের ধরতে হবে। কিন্তু কিভাবে ?
উপনিষ বলছে, ঈশ্বর উপলব্ধি করতে হলে প্রথমে আমাদের দেহ মনের একটা সাম্যাবস্থা দরকার। বলছেন, দেহ থেকে মনকে প্রত্যাহার করে নিলে, ইন্দ্রিয়গনের চঞ্চলতা দূর হয়ে যাবে। দেহ তখন শান্ত হবে। মনকে যখন আপনি বাসনাহীন করতে পারবেন, তখন মনের আবেগ, উচ্ছাস, উত্তেজনা ইত্যাদি আমাদের বশীভূত হবে। তখন দেহ-মন থাকবে না তা কিন্তু নয়। তবে বিশাল দৈত্য যখন ছোট্টো একটা কলসির মধ্যে প্রবেশ করে তেমনি। অর্থাৎ আমাদের প্রাণশক্তিকে একত্রীভূত করা। অর্থাৎ আমরা প্রথমে দেহকে শান্ত করেছি, তারপর আমাদের মনকে শান্ত করেছি, সবশেষে আমাদের প্রাণশক্তিকে একত্রীভূত করেছি।
আর ঠিক এই সময় এক আশ্চার্য্য প্রদীপ জ্বলে ওঠে। চৈতন্যস্বরূপ যে আত্মা তিনি তখন স্বমহিমায় প্রকাশিত হন। এই সময় অন্তর্জগতে বহির্জগতের কোনো কিছুই আর প্রবেশ করতে পারে না। বাইরের কোলাহল, বাইরের দৃশ্যপট কিছুই আর অন্তর্মুখী আত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না। অথচ অন্তরের জ্যোতি তখন বাইরে ফুটে বেরোয়। এই অবস্থার নামই সমাধি। সমাধিমগ্ন অবস্থায়, সাধক বা মানবাত্মা ব্রহ্মানুভূতি আস্বাদন করতে থাকেন। ধন্য সেই সাধক যিনি এই সমাধির অবস্থা প্রাপ্ত হন। এই কাজ আমি যত সহজে সংক্ষেপে বলে গেলাম, এটিকে কার্যকরী করতে গেলে ব্যাপারটি তখন আর সহজ থাকবে না। হবে কঠিন থেকে কঠিনতর। তবে একটা কথা বলতে পারি, কঠিন হলেও অসাধ্য নয়। আর এই বিশ্বাস অর্জন করতে গেলে, যে স্বল্প সংখ্যক মহাপুরুষ সাধনার দুর্গম পথ অতিক্রম করে ব্রহ্মানুভূতি লাভ করেছেন, তাদের জীবন-বাণীকে অনুসরণ করতে হবে। আর সেই উদ্দেশ্যেই আমরা এই আলোচনা শুনছি, এবং শুনবো।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
৩০-০৫-২০২১
আমি কে ?
নিজেকে যখনই এই প্রশ্ন করি, আমি কে ? তখন, আমার মধ্যে একটা ভয়ের উদ্রেগ হয়। সত্যি সত্যি যদি কারুর মধ্যে এই ধরনের উদ্ভট প্রশ্ন জাগে, যে আমি কে, তবে তার মধ্যেও হয়তো, একটা ভীতির ভাব জেগে উঠতে পারে। আসলে প্রশ্নটা স্বাভাবিক, কিন্তু প্রশ্নের উত্তর জানতে গেলে, দেখেছি, আমি থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। কেননা, এতদিন নিজেকে যে আমি ভেবেছি, এখন নতুন করে আমিকে দেখতে গেলে, আমির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। আর এই নিজের অহং থেকে বেরিয়ে আসতে গেলে, একটা মৃত্যু পরবর্তী অবস্থার সৃষ্টি হয়। আমার একটা নিজস্ব পরিচিতি আছে। অন্ততঃ আমি সেইরকম মনে করে থাকি। আর যখন সেই আমিকে জানতে চাই তখন, আমাকে আমি থেকে বেরিয়ে এসে তাঁকে দেখতে হয়। এ বড়ো ভয়ঙ্কর অদ্ভুত অভিজ্ঞতা । আমি তখন দৃশ্য, আবার আমিই দ্রষ্টা। যখনই আমিকে জানতে চাই, তখন আমার অহং যেন ভস্মিভূত হয়ে যায়। কেননা তখন আমার পরিচয় মারা যায়। আর যতক্ষন পরিচিত আমার মৃত্যু না হচ্ছে, ততক্ষন আমার জন্ম হতে পারে না। একে পুনর্জন্ম, সত্যিকারের পুনর্জন্ম বলা যেতে পারে। এ যেন একটুকরো বীজ যা মাটির মধ্যে লুকিয়ে পড়ছে। বীজকে যখন মাটির মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, বীজ তখন গভীর অন্ধকারে ভীত হয়ে পড়ে । বীজ কিভাবে বিশ্বাস করতে পারে, সে আসলে একটি বিরাট বৃক্ষ হতে চলেছে। বীজ যখন মৃত্তিকার অন্ধকারে গ্রথিত হয়, তখন তার কোনো সাক্ষী থাকে না। অন্য কোনো বীজকে সে তখন দেখতে পায় না। এই সময় অহং প্রচন্ড বাধা সৃষ্টি করে। সে তখন বিশ্বাস করছে চায় না, যে সে আরো বড়ো কিছু। অহং নাশের কালে সে ভীত হয়ে ওঠে, শেষ নিঃশ্বাসকে সে ধরে রাখতে চায়। অহং বেঁচে থাকবার জন্য, বিদ্রোহ করে ওঠে। আর আমার মনে হয়, আমি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছি। এই মৃত্যু আসলে অহং-এর মৃত্যু। আর অহং নাশ হলেই, আমি, আত্মা হয়ে যাই। বিন্দু থেকে সিন্ধু হয়ে যাই। ক্ষুদ্র থেকে বিরাট হয়ে যাই। বীজ থেকে বৃক্ষ হয়ে যাই। ডিম্ থেকে পাখি হয়ে অনন্ত আকাশে উড়তে থাকি।
-------------------
No comments:
Post a Comment