আজ থেকে, ৫৫০ বছর আগে হরিনাম সংকীর্তন অর্থাৎ "হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে" এই নাম-রূপ-মন্ত্র প্রচার করেছিলেন চৈতন্য মহাপ্রভু। বেদ মন্ত্রে অধিকারী ভেদ ছিল অর্থাৎ বেদ মন্ত্র উচ্চারনে সাধারণের অধিকার ছিল না। চৈতন্য মহাপ্রভু, পতিত উদ্ধারে, ভেদহীন এই মহামন্ত্রে সবাইকে উজ্জীবিত করেছিলেন।
এই মন্ত্রে চারবার "কৃষ্ণ", চারবার "রাম", আটবার "হরে" আছে । অর্থাৎ ষোলোটি শব্দ আছে। আর এই ষোলোটি শব্দের মধ্যে আছে বত্রিশটি অক্ষর বা বর্ণ বা অন্য অর্থে রঙ । আমরা এই মহামন্ত্রে স্থূল থেকে সূক্ষ্ম তাৎপর্য্য বুঝবার চেষ্টা করবো। এই শব্দগুলোর অভিধানগত অর্থই বা কী ?
প্রথমে জেনে নেই, এই বর্ণ বলতে আমরা কি বুঝি ?
বর্ণ বলতে যেমন আমরা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য শূদ্র বুঝি, তেমনি বর্ণ বলতে আমরা বুঝি যার দ্বারা স্তব করা হয়। অর্থাৎ মনের ভাব প্রকাশ করা হয়। যা আমাদের কন্ঠ, তালু, মুর্দ্ধা ইত্যাদি থেকে নির্গত হয়। আমাদের বোধশক্তি যখন কন্ঠে সংকেত দেয়, তখন আমরা তাকে অক্ষর বলি। আমাদের উদানবায়ু যখন কন্ঠনালী হতে নিঃসৃত হয়ে শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের গ্রাহ্য শব্দের উৎপাদন করে, তখন তাকে আমরা বলি ধ্বনি। এই ধ্বনির স্ফুট অবস্থার নাম বর্ণ। এই বর্ণের সাংকেতিক চিহ্ন আমাদের দর্শন ইন্দ্রিয়ের বিষয়। একে বলা হয় লিপি। একই বর্ণের বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন লিপির প্রচলন দেখা যায়।
বর্ণের আর একটা অর্থ হচ্ছে রং। সাদা, কালো, লাল, ইত্যাদি। আমরা জানি সূর্য্যের সাতটি রং বা বর্ণ । লোহিত বা লাল, কপিল অর্থাৎ কমলা, পীত অর্থাৎ হলুদ, হরিৎ অর্থাৎ সবুজ, নীল, মহানীল অর্থাৎ গাঢ় নীল, এবং ধুম্র বা ধোঁয়াটে। এছাড়া বিভিন্ন শাস্ত্রে আরো কিছু রঙ-এর কথা বলা আছে, যেমন, শ্বেত বা সাদা, কৃষ্ণ বা কালো, অরুন অর্থাৎ স্বর্ণাভ, পান্ডুর বা হলদেটে, ধূসর অর্থাৎ ছাইরং, শুক্লাভ বা গাঢ় সবুজ, গাঢ় লাল, এছাড়া বিভিন্ন রঙের অল্প বা অধিক মিশ্রনের জন্য অসংখ্য বর্ণের উৎপত্তি হতে পারে। তাই মিশ্র বর্ণ আসলে অসংখ্য। কিন্তু মূল বর্ণ মাত্র সাতটি যা সূর্য থেকে এসে থাকে ।
আমরা এই বর্ণের সাহায্যে কথা বলি, বা মনের ভাব প্রকাশ করে থাকি। আমরা যখন কথা বলি, তখন বাতাসের মধ্যে একটা তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। এবং তরঙ্গগুলো আমাদের কানের পর্দায় কম্পন তোলে। তাই আমরা শুনতে পাই। এই যে তরঙ্গ এগুলো আসলে বিভিন্ন বর্ণের বা নানান রঙের তরঙ্গ।
পরা- বিদ্যাবিদগন বলে থাকেন, দেবতাগণ যখন কথা বলেন, বা ভাব বিনিময় করেন, তখন এই রঙের তরঙ্গ দেখতে পাওয়া যায়। সূক্ষ্ম জগতের জীবাত্মাগণ আমাদেরকে বা স্থুলদেহকে ঘনীভূত বিভিন্ন রঙের তরঙ্গ সদৃশ্য দেখতে পান। আমরা যখন কথা বলি, তখন এই বর্ণ আমাদের শ্রুতিগোচর হয় বটে, কিন্তু রঙতরঙ্গ আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না।
এই মহামন্ত্রে আছে ষোলোটি শব্দ। বৈষ্ণবগন এসম্পর্কে বলে থাকেন - হরে আটবার - চন্দ্রাবলী, প্রেমময়ী শ্রীরাধা, সুভাষিণী, সিংহাসন, সুদর্শন ,শেষদেব, সাবিত্রী, ও রেবতী। কৃষ্ণ চারবার : . পরমব্রহ্ম শ্রীগোবিন্দ,, বাসুদেব, জগন্নাথ, ও কৃষ্ণ-বলভদ্র। রাম চারবার : শ্রীরাধিকা, শ্রীলক্ষ্মী, শ্রীসরস্বতী, ও শ্রীমতি সুভদ্রা।
এখন আমরা শুনবো, "হরে" কথাটার তাৎপর্য্য কী ?
হ+র+এ = হরে।
হ - ছোটবেলায় দেখেছি, গরু, মহিষ কে অর্থাৎ যে আমার ভাষা বোঝে না, তাকে দাঁড় করবার জন্য, "হ" "হ" করতে, আর এই হ-হ করলে, গরু মহিষ দাঁড়িয়ে যেত। হ হচ্ছে ব্যঞ্জনবর্ণ মালার একটা বর্ণ। কেউ কেউ অবশ্য একে ব্যঞ্জন বর্ণ বলে মনে করেন না। কারন হচ্ছে, যে বর্ণ অন্যের সাহায্য নিয়ে উচ্চারণ করে, তাকে ব্যঞ্জন বর্ণ বলে। কিন্তু হ উচ্চারণ করবার জন্য, কারুর সাহায্য নেবার দরকার পড়ে না। এটি আসলে অ উচ্চারণ করতে গেলে শ্বাসবায়ু যখন প্রায় নিঃশেষিত হয়, তখন অবশিষ্ট বায়ু গলা থেকে জোরে বের করলেই হ উচ্চারণ হয়। এইজন্য হ-কে অ-এর মহাপ্রাণ উচ্চারণ বলা হয়ে থাকে। হ বর্ণের দ্বারা শিব, বিষ্ণু,চন্দ্র, স্বর্গ, মঙ্গল, রক্ত, শূন্য বা আকাশ, ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
র- এটি ব্যঞ্জন বর্ণ। উচ্চারণ স্থান হচ্ছে মূর্দ্ধা। র যখন অন্য বর্ণের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন র ফলা, যেমন বজ্র, ভদ্র, আবার মস্তকে বসলে রেফ, যেমন পূর্ন, স্বর্গ, বর্ণ, কর্ম ইত্যাদি। "র" বর্ণের অর্থ হচ্ছে বিরত হওয়া।
এ- এটি স্বরবর্ণ। এর উচ্চারণ হচ্ছে কন্ঠ ও তালু। এটিকে সন্ধ্যক্ষর বলে। কারন এ আসলে অ + ই = এ। এ কথাটার অর্থ হচ্ছে ইহা। অর্থাৎ নিকটস্থিত বা সন্মন্ধযুক্ত বিষয়।
তাহলে হরে - কথাটা কথাটার অর্থ হচ্ছে, হে পরমাত্মা। অর্থাৎ কারনের কারন। যিনি ভৌতিক অভৌতিক সবকিছুর উদ্গাতা। হরে কথাটা যখন আমরা উচ্চারণ করি, তখন আমাদের শ্বাসবায়ু জোরে বের করে দিতে হয়, কন্ঠ, তালু ও মুর্দ্ধা স্পর্শ করে বায়ুকে দ্রুত নিঃশেষিত করতে হয়। ফলত আমাদের যে বিশুদ্ধ চক্র থেকে শুরু করে, মা সরস্বতীর স্থান হয়ে বহির্বিশ্বে গমন করে। তো বিশুদ্ধ চক্র ক্রিয়াশীল করতে "হরে" কথার গুরুত্ত্ব অপরিসীম । পুনঃ পুনঃ হর বা হরে উচ্চারনে আমাদের বিশুদ্ধ চক্র ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে।
হ-কার হিঙ্গুল বর্ণের প্রতীক। হিঙ্গুল অর্থাৎ পারদবহুল ঘোর লোহিত(রক্ত)বর্ন খনিজ পদার্থ বিশেষ। পারদ যেমন বিষ বিশেষ আবার পারদ ঔষধ বিশেষ। "রে" বলতে রক্তবর্ণ গোপালকে বোঝায়। পাপক্ষয়ে বা বিষক্ষয়ে "হরে" মহাঔষধি হিসেবে কাজ করতে পারে।
শ্রী শ্রী চৈতন্যদেব যে নামকীর্তনের প্রচলন করেছিলেন, তাতে হরে কথাটা আটবার আছে। বৈষ্ণব পন্ডিতগণ এই হরে বলতে বোঝাচ্ছেন - ১) চন্দ্রাবলী, ২) প্রেমময়ী শ্রীরাধা, ৩)সুভাষিণী, ৪) সিংহাসন, ৫) সুদর্শন ,৬) শেষদেব, ৭)সাবিত্রী, ও ৮) রেবতী। এঁরা সবাই কৃষ্ণসখী বা রাধাসখী। অর্থাৎ যে সম্মিলিত প্রেমশক্তি স্বয়ং ভগবানকে বা নির্গুণ ব্রহ্মকে টেনে নিয়ে আসতে পারে।
হ-কার হিঙ্গুল বর্ণের প্রতীক। হিঙ্গুল অর্থাৎ পারদবহুল ঘোর লোহিতবর্ন খনিজ পদার্থ বিশেষ। পারদ যেমন বিষ বিশেষ আবার পারদ ঔষধ বিশেষ। "রে" বলতে রক্তবর্ণ গোপালকে বোঝায়। পাপক্ষয়ে বা বিষক্ষয়ে "হরে" মহাঔষধি হিসেবে কাজ করতে পারে।
কৃষ্ণ বলতে কি বা কাকে বোঝায় ? আমরা জানি শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন, বিষ্ণুর অবতার। বসুদেব ও দেবকীর পুত্র। বৈষ্ণব মতে কৃষ্ণ চারবার অর্থাৎ : . পরমব্রহ্ম শ্রীগোবিন্দ, বাসুদেব, জগন্নাথ, ও কৃষ্ণ-বলভদ্র।
কৃষ্ণ - কৃষ্+ন। কৃষ্ কথাটার অর্থ আকর্ষণ করা। ন অর্থাৎ আত্মা। যিনি আত্মাকে আকর্ষণ করেন।আবার কেউ কেউ কৃষ্ণকে সন্ধি বিচ্ছেদ করেছেন এইভাবে। কৃৎস্ন + ন। যিনি জীববৃন্দের আত্মা স্বরূপ। কৃৎস্ন (কৃত+স+ন) কৃত অর্থাৎ করা যিনি কর্ম্ম জগতে প্রবেশ করেছেন, যে আত্মা কর্ম্মের উদ্দেশ্যে শরীরের মধ্যে স্থিত হয়েছেন বা শরীর ধারণ করেছেন। অর্থাৎ জীবাত্মা।
আবার ক + ঋ + ন = কৃষ্ণ। ক - হচ্ছে ব্রহ্ম, ঋ হচ্ছে অনন্ত শিব। ন হচ্ছে নিবৃত্তি বাচক। তো যিনি ব্রহ্মরূপে সৃষ্টি করেন, যিনি অনন্ত, যিনি শিব রূপে সংহার করে থাকেন। তিনিই কৃষ্ণ। যিনি বিষ্ণুর অবতার। বৈষ্ণবদের আরাধ্য বা ইষ্টদেবতা । যদুপতি।
কৃ - কাজল বর্ণের প্রতীক। গতি শক্তি, রতি, প্রেম এ থেকেই এসে থাকে। ষ্ণ -কার লোহিত বর্ণের প্রতীক। লোহিত বর্ণ আবার নরকের প্রতীক। তো লোহিতবর্ন স্বরূপ নরক থেকে যে নাম জীবকূলকে উদ্ধার করে থাকে, তাঁকে বলা হয় কৃষ্ণ। বারবার কৃষ্ণ ধ্বনি উচ্চারনে আমাদের হৃদয়কেন্দ্র, অর্থাৎ অনাহত চক্র ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে।
রাম : আমরা জানি দশরথ পুত্র রাম। যাঁকে বিষ্ণুর অবতার বলা হয়ে থাকে। আবার রাম শব্দে বলা হয়ে থাকে, রময়তি যে স রাম। অর্থাৎ যিনি ঈশ্বরের সাথে রমন করছেন। রাম চারবার অর্থাৎ : শ্রীরাধিকা, শ্রীলক্ষ্মী, শ্রীসরস্বতী, ও শ্রীমতি সুভদ্রা।
রাম = র+আ+ম। র - এটি ব্যঞ্জন বর্ণ। উচ্চারণ হচ্ছে মূর্দ্ধা। র ধ্বনিকে বলা হয়ে থাকে একাক্ষর কোষ। অবিরামতা বোঝাতে র-এর ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন বকর-বকর, ঘ্যানর ঘ্যানর ইত্যাদি। অবস্থিতিকর বা অপেক্ষাকর অবস্থা বোঝাতে র-এর ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
আ - এ-এর উচ্চারণ স্থান হচ্ছে, কন্ঠ। জিহ্বা মুখের নিচের দিকে রেখে মুখ খুলে উচ্চারণ করতে হয়। আ শব্দের প্রথমে ব্যবহার হলে "আ" থাকে মাঝে ব্যবহার হলে "া" আকৃতি নেয়, আবার শেষে ব্যবহার হলে "য়া" রূপে দেখা যায়। আ কথাটার অর্থ স্মরণ যেমন আ ! কি আরাম। অর্থাৎ আরামের স্মরণ।
অর্থাৎ "রা" (র+আ) কথাটি দিয়ে বারবার স্মরণ বোঝাচ্ছে।
ম - এটি অনুনাসিক ওষ্ঠ বর্ণ। অর্থাৎ বর্ণের উচ্ছারণকালে যখন ওষ্ঠ ভেদ করবার শক্তি না থাকে তখন ধ্বনি নাক দিয়ে বের হয়। তাই রুগ্ণ ব্যক্তি নাকি স্বরে কথা বলে থাকে। র-এর মতো ম একাক্ষর কোষ। এর অর্থ মধুসূদন শিব, চন্দ্র, ব্রহ্মা, যম, সময়, বিষ, মধুসূদন, কোমল। ম অর্থে ভবিষ্ৎকাল বোঝায়। ম অর্থে মন্থন করা, মা অর্থে মৃত্যু। অনুনাসিক বর্ণের উচ্চারনে জীবের সমস্ত দুঃখ নাশ হয়ে থাকে।
তো সার্বিক অর্থ দাঁড়ালো, (র+আ+ম) র-বারবার, আ - স্মরণ ম - ব্রহ্মা - তো বারবার প্রজাপতি ব্রহ্মার স্মরণ। রা অর্থাৎ চন্দ্রজ্যোতি ম অর্থাৎ নিস্কলঙ্ক। তো নিস্কলঙ্ক চন্দ্রজ্যোতি-সম ঈশ্বরের স্মরণ। রাম কথাটির দ্বারা এক স্নিগ্ধ জ্যোতিঃ রঙের প্রকাশ ঘটে। পুনঃ পুনঃ রাম ধ্বনি উচ্চারনে আমাদের চিদাকাশে জ্যোতিদর্শন হয়ে থাকে।
তো হরের্ণাম সংকীর্তন কতকগুলো বর্ণ-সমষ্টির অর্থাৎ এক অদ্ভুত রঙের তরঙ্গ সৃষ্টি করে থাকে। আর তা হলো, স্নিগ্ধ নির্মল জ্যোতি, কাজলবর্ন, এবং লোহিত বর্ণের স্তর বিশিষ্ট। যা আমাদের চিদাকাশে ভেসে ওঠে।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
দুর্গতিনাশিনী দুর্গা মন্ত্রের অর্থ ও প্রয়োগ : প্রার্থনা মন্ত্র হচ্ছে - ওঁ দুর্গে দুর্গে রক্ষণি স্বাহা, ওঁ হ্রীং দূর্গায়ৈ নমঃ।
দুর্গামন্ত্রের যথার্থ অর্থ
১৪/১৫ বছরের একটি মেধাবী ছেলে অঙ্ক করতে করতে হঠাৎ একদিন পাগল হয়ে গেলো। পিতা নিজে ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও, তাকে ভালো করবার জন্য, অসহায়ের মতো, যে যা বলছেন, তাই করছেন। পরিচিত সমস্ত ডাক্তারদের কাছে ছুটলেন। কিন্তু কোনো কিছুতে কিছু হচ্ছিলো না। দিন দিন তার পাগলামির মাত্রা বাড়তে লাগলো। বাড়ির কুল পুরহিত একটা মাদুলীর ব্যবস্থা দিলেন। আর পিতা-মাতাকে বললেন, দূর্গা নাম জপ করতে। কিসে কি হলো বলা মুশকিল, ছেলেটি বছর -খানেক বাদে ধীরে ধীরে ভালো হয়ে গেলো। ছেলেটি মেধাবী। এখন সে সম্পূর্ণ সুস্থ। এইসব মাদুলিত-ফাদুলিতে তার কোনো আস্থা নেই। বিজ্ঞানে যার বিশ্বাস, নিজে মাদুলিতে হাতে ঘুরে বেড়াবে, এটা তার একদমই ভালো লাগে না। একদিন সে মাদুলীর ভিতরে কি আছে, সেটা দেখবার জন্য, মাদুলিটাকে হাত থেকে খুলে নিলো। কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য, মাদুলিটাকে ভেঙে দেখলো কি আছে, এর ভিতরে । দেখলো একটা ভূর্জপত্রে লাল রঙে ওং হ্রীংঁ দুর্গায়ৈ নমঃ - ওং হ্রীংঁ দুর্গায়ৈ নমঃ - কথাটি বার-বার ১০৮ বার লেখা আছে। আর সেই ভূর্জ গাছের পাতাটি মুড়ে মাদুলীর মধ্যে রেখে মোম দিয়ে মুখটা ঢেকে দেওয়া হয়েছে।
কী আছে এই দূর্গা মন্ত্রে ? এতে আদৌ কোনো উপকার হয়কি ? নাকি আমাদের মানসিক ভ্রম ? মন্ত্র জপ করলে, ধ্বনির তরঙ্গে আমাদের মধ্যে আলোড়ন তুলতে পারে, কিন্তু এই তাবিজ কবজে আদৌ কোনো উপকার হতে পারে কি ?
প্রথমে দেখে নেই এই মন্ত্রের অর্থ কি ?
ওং - আদি ধ্বনি। প্রত্যেক মন্ত্রের এটি বাঁধন। ওং ত্রিকালেশ্বর - ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব-এর মিলিত শক্তি।
"হ" অর্থে শিব, "র্" অর্থাৎ প্রকৃতি, "ঈ" অর্থাৎ মহামায়া, ঁ অর্থাৎ দুঃখরণ। সামগ্রিক ভাবে "হ্রিংঁ" এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, হে মহাদেবের শক্তি মহামায়া জগৎজননী আমাদের দুঃখ হরণ করুন।
দুর্গায়ৈ অর্থাৎ দুর্গাকে, - দুর কথাটার অর্থ দুঃখ গম অর্থাৎ গমন করা, অ, দুর্গ এর সঙ্গে যোগ করা হয়েছে স্ত্রীলিঙ্গ সূচক আ, = দুর্গা। যাকে দুঃখে জানা যায়। কিংবা যিনি দুর্গ অর্থাৎ সঙ্কট থেকে ত্রাণ করেন। তন্ত্র মতে দ্ হচ্ছে দৈত্য নাশ সূচক, উ বিঘ্ননাশ সূচক, র রোগ-বিঘ্ন বাচক , গ - পাপ বিঘ্ন বাচক, আ হচ্ছে শত্রূনাশ বাচক। বলা হয়েছে, দুর্গ নামক অসুর বিশেষ, আ অর্থাৎ বধ-কর্ত্রী। অর্থাৎ যিনি দুর্গ নামক অসুর বিনাশ করেছিলেন। ইনিই পরমাপ্রকৃতি। বিশ্বের আদি কারন। শিব-পত্নী।
বলা হয়ে থাকে, সত্যযুগে রাজা সুরথ এবং সমাধি বৈশ্য, এর পুজো ধরাধামে প্রচার করেন। এবং তিন বছর ধরে আরাধনা করেছিলেন। ত্রেতা যুগে রাবন - বসন্তকালে এই পুজো করতেন। যাকে বাসন্তী পুজো বলা হয়ে থাকে। আবার এই ত্রেতা যুগেই রামচন্দ্র অশ্বিন মাসে অর্থাৎ শরৎ কালে এই পুজো করেছিলেন। আবার দ্বাপর যুগে গোপ-কুমারীরা শ্রীকৃষ্ণকে পতি হিসেবে পাবার কামনায়, অগ্রহায়ন মাসে অর্থাৎ হেমন্ত কালে এই পুজো করেছিলেন। কলিযুগে এই তিন ঋতুতেই মা-দুর্গার পুজো হয়ে থাকে।
বলা হয়ে থাকে আমাদের বর্নমালার প্রত্যেকটি বর্ণ এক-একটা ভাবের প্রতীক। দেবতাগণ যখন কথা বলেন, তখন নাকি এই বর্ণের ছটা দৃশ্যমান হয়। এমনকি আমরা যখন কথা বলি, তখনও বিভিন্ন বর্ণের ছটা ছাড়িয়ে পড়ে, যা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। প্রত্যেকটি বর্ণের একটা আকর্ষণী-বিকর্ষণী ক্ষমতা আছে। আর "দ" বর্ণটি ব্যতিক্রমী। "দ" মধ্যমনি হিসেবে কাজ করে থাকে। অর্থাৎ আকর্ষণ-বিকর্ষণ এর মধ্যে একটা ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে।
মানুষ যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে, বা কোনো বিপদে পড়ে, তখন তার মনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। তার শ্বাসের গতিও বেড়ে যায়। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাঝে যে অন্তর সেটা বেশ কমে যায়। এই অবস্থায় "দ" অক্ষরটি বারবার উচ্চারণ করলে তার মনের ভারসাম্য ফিরে আসে। আর এই মনের ভারসাম্যের গতি ফেরানোর কাজ ত্বরান্বিত করবার জন্য "উ" যোগ করা হয়। স্বরবর্ণ আকর্ষনাত্মক। "গ" হচ্ছে গাম্ভীর্যের প্রতীক, "র" তেজের প্রতীক = দুর্গ। এর সঙ্গে আ অর্থাৎ স্ত্রীলিঙ্গবোধাত্মক আকার যোগ করলে হয়, দুর্গা। এই মন্ত্র উচ্চারনে, স্মরণে-মননে মানুষের মধ্যে নিষ্ঠা ও তেজের সঙ্গে লড়াই করবার শক্তি জন্মায়। মানুষের মধ্যে উদ্দোম ফিরে আসে।
আসলে দুর্গাশক্তির বীজমন্ত্র হচ্ছে "দূঁ" .দ বর্ণে দুর্গা, ঊ অর্থে রক্ষা আর ঁ অর্থে করো। অর্থাৎ হে জগৎজননী দুর্গে ! আমাকে রক্ষা করো।
মা দুর্গার ধ্যান মন্ত্র হচ্ছে - ওঁ দুর্গে দুর্গে রক্ষণি স্বাহা, ওঁ হ্রীং দূর্গায়ৈ নমঃ।
No comments:
Post a Comment